কেন ৫-৮

০৫.

ফাইনম্যানকে কিন্তু ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া গেল না। ম্যাককিলভি দীর্ঘদিন লেগে ছিল তার পিছনে, ছায়ার মতো। কোনো নূতন সূত্র আবিষ্কার করতে পারেনি। অবশেষে কর্নেল প্যাশ নিজেই একদিন এসে হাজির হল প্রফেসর ফাইনম্যানের ডেরায়। সমাদর করে ফাইনম্যান তাকে বসালোলা নিজের বৈঠকখানায়। আবহাওয়া থেকে শুরু করে সিনেমা, বেল সব কিছু আলোচনা করল খোশমেজাজে, কফি খাওয়ালো। শেষমেশ লস অ্যালামসের প্রসঙ্গ তুলতে বাধ্য হল প্যাশ। ফাইনম্যান তৎক্ষণাৎ বললে, আপনার আইডেন্টিটি কার্ডটা দেখাবেন দয়া করে?

কর্নেল প্যাশ তৈরি হয়েই গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ তার সনক্তিকরণ কাগজপত্র দেখালো অধ্যাপককে–সে সিকিউরিটির লোক, লস অ্যালামস সম্বন্ধে আলোচনা করার অধিকার তার আছে এটা প্রমাণ করল। বললে, এবার আপনাকে আমি কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই; কিছু মনে করবেন না–

করলেই বা ঠেকাচ্ছে কে? স্বচ্ছন্দে প্রশ্ন করে যান।

–পিটার নামে আপনার কোনো পুত্রসন্তান ছিল, বা আছে?

 আজ্ঞে না। আমার আদৌ কোনো পুত্রসন্তান হয়নি। ছিল না, বা নেই।

–মিসেস ওবমোতা নামে একটি গভর্সেকে আপনার পুত্রের জন্য কখনও নিয়োগ করেছিলেন একগাল হাসল ফাইনম্যান। বললে, আপনার প্রশ্নটাই অবৈধ। হয়ে পড়ছে নাকি, অফিসার? আমার পুত্রই নেই, তার জন্য গভর্নের্স?

-আই মিন, ওই নামে কাউকে আপনি চেনেন?

–না, চিনি না।

–অথচ লস অ্যালামসে থাকতে একটি চিঠিতে আপনি পিটার এবং মিসেস ওবমোতার উল্লেখ করেছিলেন?

-না।

–না? আমার কিন্তু একজন সাক্ষী আছে।

আনন্দের কথা। সাক্ষীকে কাঠগড়ায় যখন তুলবেন তখন তাকে আমি ক্রস্-এগজামিন করব। জিজ্ঞাসা করব পিটার বানান কী? ওই বানানে সে আমার লেখা কোনো চিঠিতে

–একজ্যাক্টলি। ওই বানানে লেখেননি। উল্টো করে লিখেছিলেন–

-কর্নেল! আপনি গোয়েন্দা আমি বিজ্ঞানী–কিন্তু আমরা আলোচনা করছি ইংরেজি ভাষা নিয়ে। কোনো ভাষাবিদকে ডাকলে হয় না? আর-ই-টি-ই-পি বানানে পিটার উচ্চারণ শাস্ত্রসম্মত কিনা

এবারও বাধা দিয়ে প্যাশ বলে, দেখুন প্রফেসর, আপনি ক্রমাগত ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। এটা আদৌ কোনো রসিকতার কথা নয়। আপনি কি নিজেই আমাদের সিকিউরিটি অফিসারকে বলেননি অক্ষরগুলো উল্টোপাল্টা করে লিখেছেন?

-বলেছিলাম। না হলে সে আমার চিঠি পাস্ করছিল না।

–অথচ অক্ষরগুলো মোটেই উল্টোপাল্টা করে সাজানো নয়, স্রেফ উল্টো করে সাজানো–কেমন?

-তাই নাকি?

–এবং পিটার একজন রাশিয়ান এজেন্ট।

–বলেন কী!

–অথচ আপনি ম্যাককিলভিকে বলেছিলেন, পিটার আপনার ছেলের নাম, মিসেস ওবমোতা আপনার গভর্নেসের নাম?

-বলেছিলাম।

–কেন?

–ওই তো বললাম-না হলে সে আমার চিঠি পাস্ করত না।

–তাহলে আসলে আপনি আপনার স্ত্রীকে কী কথা জানিয়ে ছিলেন? ফাইনম্যান সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, লুক হিয়ার অফিসার, আমার স্ত্রীকে আমি চিঠিতে কী লিখেছি তা জানাতে আমি বাধ্য নই। আমি বলব না।

–আমার কাছে অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু কোনো এনকোয়ারি কমিশনের কাছে—

ফাইনম্যান হেসে বলে, আপনি ভুল করছেন অফিসার। ওভাবে হবে না। এনকোয়্যারি কমিশন পর্যন্ত যেতেই পারবেন না আপনারা। ওই চিঠিখানির অস্তিত্বই প্রমাণ করতে পারবেন না। তাছাড়া আমার অ্যাডভোকেট আপনাদের তো ছেড়ে কথা বলবে না। আমি তো অমন চিঠির কথা মনেই করতে পারব না। আপনাদেরই বরং জবাবদিহি করতে হবে, কেন অমন চিঠি আপনারা পাস’ করলেন–আদৌ যদি চিঠির অস্তিত্বটা মেনে নেওয়া হয়।

কর্নেল প্যাশ এবার তার আক্রমণ-পদ্ধতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হল। সত্য। কথা–ওই চিঠিখানার অস্তিত্ব প্রমাণ করা শক্ত। সেটা স্বীকার করা মানে, প্রমাণ করা লস অ্যালামসে সিকিউরিটিম্যান অপদার্থ ছিল। প্যাশ এবার প্রশ্ন করে, এ কথা কি সত্য যে, আপনি কম্বিনেশান-চাবির সাহায্যে কারচুপি করে লস অ্যালামসের ‘আয়রন-সেফ’ একদিন খুলে ফেলেছিলেন?

ফাইনম্যান বলে, তা কেমন করে সম্ভব? সেখানে তো সর্বক্ষণ প্রহরা থাকত।

–আমি নিশ্চিন্তভাবে খবর পেয়েছি–প্রহরী মিনিট পনেরোর জন্য অনুপস্থিত ছিল, আর তখন আপনি সেফটি খোলেন।

ফাইনম্যান অট্টহাস্য করে ওঠে। বলে, কী বকছেন মশাই পাগলের মতো? আপনি কি এই আষাঢ়ে গল্পও এনকোয়্যারি-কমিশনকে শোনাতে চান নাকি?

–আপনি সোজাসুজি আমার প্রশ্নের জবাব দিন। এ অভিযোগ আপনি অস্বীকার করছেন? ‘হ্যাঁ’ না ‘না’?

ফাইনম্যান গম্ভীর হয়ে বললে, এককথায় ওর জবাব হয় না। আমাকে কতকগুলি প্রতিপ্রশ্ন করতে দিতে হবে–

-বলুন?

–ওই আয়রন-সেফ-এ মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের গোপনতম তথ্য রাখা হত–এ কথা সত্য?

-ইয়েস।

–তাই ওই সেফটি বসানোর আগে তার নিরাপত্তা বিষয়ে এফ. বি. আই.-কে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছিল–আপনারা লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন সেটা কেউ খুলতে পারবে না।’হ্যাঁ’ না ‘না’?

কর্নেল প্যাশ ইতস্তত করে বলে : ইয়েস।

অথচ এখন আপনি বলছেন, পনেরো মিনিটের মধ্যে একজন ফুস-মন্তরে সেটা খুলে ফেলল। কেমন? তার অনুসিদ্ধান্ত কী? আপনারা অপদার্থ না গল্পটা আষাঢ়ে?

কর্নেল প্যাশ চটে উঠে বললে, জেরা কে করছে? আপনি না আমি?

–আপনার অনুমত্যনুসারে আপাতত আমি।

-না। আমি প্রশ্ন করব, আপনি জবাব দেবেন। বলুন–কোর্টে দাঁড়িয়ে হলপ নিয়ে আপনি এ অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেন?

আগে কোর্টে তুলুন মশাই। আদালতের কথা আদালতে হবে। আপাতত এটা আমার ড্রইংরুম।

কর্নেল প্যাশ উঠে দাঁড়ায়। দ্বারের দিকে পা বাড়ায়।

–জাস্ট এ মিনিট কর্নেল-পিছন থেকে ফাইনম্যান ডাকে।

–ইয়েস?

–আপনার সেই মাথামোটা বন্ধু ম্যাককিলভিকে বলবেন–আমার চিঠিখানা পুড়িয়ে ফেলে সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেনি। একটু তদন্ত করলে সে জানতে পারত চিঠিখানা আমার ব্যক্তিগত টাইপরাইটারে টাইপ করা–

–কোন্ চিঠিখানা?

–আপনি জানেন না। সে জানে। যেখানায় তাকে আমি চারটে জরুরি খবর জানিয়েছিলাম। রাখলে, সেখানাই আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় এভিডেন্স হতে পারত। তাকে জিজ্ঞাসা করবেন। সব কথা এবার সে স্বীকার করবে।

***

রবার্ট জে. ওপেনহাইমারও আমাদের কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন। আমরা ভুললেও এফ. বি. আই. তাকে ভোলেনি। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা হাত বদলেছে। কর্নেল প্যাশ তার নথিপত্র বুঝিয়ে দিয়েছেন তার উত্তরসূরী এডগার হুভারকে। এফ. বি. আই. ওপেনহাইমারের ব্যাপারে সর্বক্ষণের জন্য একটি স্পেশাল গোয়েন্দা লাগালেন। নবনিযুক্ত এই গোয়েন্দাটি ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে ওপিকে।

যুদ্ধজয়ের অব্যবহিত পরেই ওপেনহাইমার লস অ্যালামাসের ডিরেকটারের আসন থেকে পদত্যাগ করলেন। অনেকেই বিস্মিত হল এ সিদ্ধান্তে। ওপি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের বললেন–অতঃপর বৈজ্ঞানিক গবেষণাই তার জীবনের ব্রত। মারণাস্ত্র নয়, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনে নিযুক্ত হতে চান তিনি। প্রকৃত বিজ্ঞানভিক্ষুর মতো কথা।

ইতিমধ্যে কিন্তু আমূল পরিবর্তন হয়েছে তার জীবনদর্শনে। খ্যাতির মোহ পেয়ে বসেছে তাঁকে। একের পর একটি সম্মান পেয়ে যাচ্ছেন তিনি। কাগজে কাগজে ফলাও করে বার হচ্ছে তার নাম। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান যুদ্ধান্তে তাকে সে বছরই দিলেন- ‘মেডেল অফ মেরিট’। ন্যাশনাল বেবি ইনস্টিটুট তাকে সে বছর ‘ফাদার অফ দ্য ইয়ার’ বলে ঘোষণা করল। ‘পপুলার মেকানিস্ট’ নামে একটি পত্রিকা এক বিশেষ সংখ্যায় তাকে খেতাব দিল ‘বিংশশতকের প্রথমার্ধের শ্রেষ্ঠ মনীষী’। আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, গান্ধীজী, রোমাঁ রোঁলা, ফ্রয়েড, বার্নাড শ-কে পিছনে ফেলে ওপি ‘সবিনয়ে’ গ্রহণ করলেন এ খেতাব। অনেক কাগজেই তাকে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘অ্যাটম-বোমার জনক’ হিসাবে। সহস্রাধিক বৈজ্ঞানিকের প্রাপ্য সম্মানটাও নির্বিচারে গ্রহণ করলেন ওপি। তিনি তার প্রাইজ, খেতাব, এবং মানপত্রগুলি রোজই নাড়াচাড়া করেন। সস্ত্রীক ইউরোপ ভ্রমণে গেলেন। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কুড়িয়ে আনলেন ‘অনারারি ডক্টরেট’। সংবাদপত্রে তাঁর নামে যেখানে যা কিছু ছাপা হয় তা সাজিয়ে রাখেন ফাইলে। এ কাজের জন্য শেষ পর্যন্ত একটি সেক্রেটারি পর্যন্ত নিযুক্ত করলেন ওপি।

লোভ থেকে মোহ–তা থেকে অহঙ্কার। আমূল বদলে গেলেন ওপেনহাইমার। দিবারাত্র বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানোই হল তার কাজ। আজ এখানে দ্বারোঘাটন, কাল সেখানে সভাপতিত্ব, পরশু ওখানে প্রধান-অতিথি। ক্লাস নেওয়াও হয়ে ওঠে না সবসময়ে। 1943 থেকে 53–এ দশ বছরের মধ্যে তিনি মাত্র পাঁচটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখার সময় করে উঠতে পেরেছিলেন এবং বিশেষজ্ঞদের মতে সেগুলিও নেহাৎ মামুলি। অথচ বক্তৃতাপ্রসঙ্গে আইনস্টাইনের মতো লোককেও তিনি কড়া সমালোচনা করতে কসুর করেননি। ওঁর একজন দীর্ঘদিনের বন্ধু এই সময়ে লিখেছেন, “যেদিন ওপি জেনারেল মার্শালকে শুধু ‘জর্জি’ বলে উল্লেখ করল সেদিনই বুঝলাম আমরা ভিন্ন পথের পথিক হয়ে গিয়েছি। মনে হয় আকস্মিক খ্যাতিতে ওর মাথা ঘুরে গিয়েছিল।…সে নিজেকে মনে করত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অবতার। যেন দুনিয়াটাকে ঠিক পথে চালিত করার দায়িত্ব শুধু ওর স্কন্ধের ওপর আরোপিত!”

ওপি নিজেকে যাই ভাবুক না কেন গোয়েন্দা হুভার তাকে বিশ্বাসঘাতক ছাড়া আর কিছু ভাবত না। নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবুনের বিশেষ সংবাদদাতা লিখেছেন, 1953 সালের নভেম্বর-তক ওপেনহাইমার-সংক্রান্ত নথিপত্র এত জমেছিল যে, ফাইলগুলি একের পর এক সাজানো হলে তা সাড়ে চার ফুট উঁচু হয়ে যেত। অর্থাৎ মানুষটার বিরুদ্ধে প্রমাণ প্রায় মানুষ-প্রমাণ! হুভার ওই মাসেই সেই। পর্বতাকৃতি নথিপত্র ঘেঁটে একটা সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট তৈরি করল। ম্যানহাটান প্রকল্পের বিভিন্ন নথিপত্র থেকে ওপি যেমন সঙ্গোপনে একটি মাত্র বোমা তৈরি করতে বসেছিলেন, ঠিক সেই ভঙ্গিতেই হুভার তৈরি করল আর একটি পরমাণু বোমা। ওপেনহাইমার তার বিন্দুবিসর্গও জানেন না। যুদ্ধকালে হিরোশিমার জিয়ানো কইমাছগুলোও বোধকরি এত নিশ্চিন্ত ছিল না। ইন্ডিয়ানাপোলিস জাহাজে যেমন অতি সঙ্গোপনে পাচার করা হয়েছিল প্রথম বোমাটা–ঠিক তেমনি করেই হুভার তার রিপোর্টখানা সন্তর্পণে পাঠিয়ে দিলেন সর্বোচ্চ দপ্তরে; এমনকি একটি কপি খাস আইসেনহাওয়ারের কাছে। না জেনারেল আইসেনহাওয়ার নয়, প্রেসিডেন্ট আইক-এর দপ্তরে। এতদিনে ট্রুম্যানের চেয়ারে এসে বসেছেন আইক।

তাতে কাজ হল।

রিপোর্টে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সাজিয়েছেন হুভার। যুক্তিনির্ভর তথ্য :

প্রথমত, ওপেনহাইমার দীর্ঘদিন ধরে কম্যুনিস্টদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের অনেক রুদ্ধদ্বার কক্ষের মিটিং-এ উপস্থিত ছিলেন। অনেক কম্যুনিস্ট ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল তাঁর। ওপির স্ত্রী, ভাই ও ভ্রাতৃবধূ কম্যুনিস্ট। ওপেনহাইমার ছদ্মনামে ওদের মুখপত্রে প্রবন্ধ লিখেছেন, পার্টি ফান্ডে চাঁদা দিয়েছেন। তার অকাট্য প্রমাণ আছে।

দ্বিতীয়ত, 1943-এর সেই বারোই জুন ওপি যে মেয়েটির সঙ্গে রাত কাটান সেই মিস ট্যাটলক একজন নামকরা কম্যুনিস্ট এজেন্ট। ওই সাক্ষাৎকারের পর মেয়েটি আত্মহত্যা করে। কারণটা অজ্ঞাত।

তৃতীয়ত, ওপেনহাইমার সজ্ঞানে মিথ্যাভাষণ করেছেন-হাকন শেভেলিয়ার আদৌ গুপ্তচরবৃত্তি নেননি। দীর্ঘদিন ওই শেভেলিয়ারের পেছনে এফ. বি. আই. গুপ্তচর নিযুক্ত করে নিঃসন্দেহে বুঝেছে তিনি জীবনে কখনও রাশিয়ান গুপ্তচরদের সংস্পর্শে আসেননি। ওপেনহাইমার তার মিথ্যাভাষণে একজন নিরীহ পণ্ডিতের সর্বনাশ করেছেন।

প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার সচরাচর এসব ব্যাপারে নাক গলাতেন না। অধীনস্থ কর্মচারীদের যথাকৰ্তব্য করতে দিতেন। এক্ষেত্রে কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটল। তিনি তৎক্ষণাৎ কয়েকজন অতি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীকে হোয়াইট হাউসে ডেকে পাঠালেন। সংক্ষিপ্ত অধিবেশন। মিলিটারিম্যান আইসেনহাওয়ার তার কোনো কর্মচারিকে ‘দিস রিকোয়ার্স এ্যাকশান’ বলেছিলেন কিনা জানি না–কিন্তু ব্যবস্থা হল অবিলম্বে।

ওপেনহাইমার তখন প্রিন্সটাউনে। আসন্ন বড়দিনের উৎসবে ব্যস্ত। হঠাৎ একটা জরুরি টেলিগ্রাম এল ওয়াশিংটন থেকে–অ্যাটমিক-এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান তাকে অবিলম্বে দেখা করতে বলেছেন। একুশে ডিসেম্বর সব কাজ ফেলে ওপি ছুটে এলেন ওয়াশিংটনে। দেখা করলেন চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তখনই তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল চার্জশিট। দীর্ঘ অভিযোগের তালিকা। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত।

বজ্রাহত হয়ে গেলেন ‘বিংশশতাব্দীর প্রথমার্ধের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা।

যোজনবিস্তৃত সর্ষে ফুলের ক্ষেত নয়; তিনি দেখলেন–’প্রকাণ্ড একটা ধোঁয়ার বলয় পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে যাচ্ছে–একটা আগুনের বলয়, তার কিনারাগুলো সিদুরে লাল…অনাবিষ্কৃত একটা নগ্নসত্য উদঘাটিত হল চোখের সামনে…ঘনিয়ে এল মহামৃত্যু।

অস্বাভাবিক একটা নীরবতা। পুরো দেড় মিনিট ওপেনহাইমার কথা বলেননি।

 শুরু হল ওপেহাইমারের ঐতিহাসিক বিচার। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে।

সেটা কিন্তু 1954-র এপ্রিল মাসে। বস্তুত বিশ্বাসঘাতক ‘ডেক্সটার’ ধরা পড়ার চার বছর পরে। আমাদের মূল কাহিনির এক্তিয়ারের বাইরে।

আজ্ঞে না। ওপেনহাইমার ‘ডেক্সটার’ নন।

.

০৬.

ক্লাউস ফুকস্ আর সস্ত্রীক প্রফেসর কার্ল গ্রীশ্মাবকাশ কাটাতে এলেন পারিতে।

হঠাৎই এ সিদ্ধান্ত। প্রস্তাবটা প্রথমে তুলেছিলেন প্রফেসর কার্ল অন্যভাবে। কী একটা প্রয়োজনে তাকে দিন তিন-চারের জন্য পারিতে যেতে হবে। কারণটা কী তা উনি খুলে বলেননি। তখন রোনাটা হঠাৎ বলে বসে, তাহলে আমরাও কেন যাই না সঙ্গে? ক্লাউস-এর নতুন গাড়িটার একটা পরখ হয়ে যাবে। কী বল ক্লাউস?

ক্লাউস তার পুরনো গাড়িটা বেচে সম্প্রতি একটা ভালো সিডানবডি গাড়ি কিনেছে। সেটা নিয়ে পারি ভ্রমণে যেতে তার আদৌ আপত্তি নেই, আগ্রহ আছে। সেসব কথা নয়, ও ভাবছিল হঠাৎ রোনাটার এ মত পরিবর্তনের কারণটা কী? ইতিপূর্বে সে তো একদিন অন্তিম ফতোয়া জারী করে বসে আছে ক্লাউস তাদের বাড়িতে একেবারে না এলেই ভালো হয়।

মোটকথা ব্যবস্থা হল। সব কিছু আয়োজন করলেন প্রফেসর কার্ল। পারিতে হোটেলের ঘর বুক করলেন তিনিই। তারপর একদিন ওঁরা রওনা হয়ে পড়লেন। গাড়ি নিয়ে। লন্ডন থেকে পারি।

ওঁরা এসে উঠলেন পিগেল অঞ্চলে হোটেল ইন্টারন্যাশনালে। প্রকাণ্ড হোটেল। ব্যবস্থাপনা ভালো। প্রফেসর আগেভাগেই দু-খানি ঘর ‘বুক’ করেছেন। সাততলায়। রুম নম্বর 728 এবং 729। দুটোই দ্বৈতশয্যার। ক্লাউস-এর পক্ষে এতবড় কামরার প্রয়োজন ছিল না কিন্তু পাশাপাশি থাকা যাবে এই মনে করে প্রফেসর ওই ব্যবস্থা করেছিলেন। 729-এ উঠলেন সস্ত্রীক কার্ল এবং 728-এ একা ফুকস।

পারিতে পৌঁছেই কিন্তু অতি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন প্রফেসর কার্ল। দিনপঞ্জিকায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট তার ঠাসা। বেড়ানোর সময় নেই আদৌ। রোনাটা অভিযোগ করলে বলেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম–আমি বেড়াতে আসছি না, কাজে আসছি। তা তোমার অসুবিধা কী আছে? ঘোর না যত খুশি। ক্লাউস তো আছে সঙ্গ দিতে।

অগত্যা ক্লাউসকেই ঘুরতে হচ্ছে। লুভর মিউজিয়াম, আর্ক-দ্য-ত্রিয়ম্ফ, ঈফেল-টাওয়ার, নতরদাম গির্জা। ভালোই লাগছিল ফুকসের। দুজনের মধ্যে কোনো চুক্তি হয়নি, কিন্তু সেই প্রসঙ্গটা কেউই আর উত্থাপন করেনি। বন্ধুত্বের সম্পর্কেই আনন্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যায় নৌকাযোগে সেইন-এ বেড়াচ্ছে। রাস্তার ধারে খোলা রেস্তোরাঁয় আহারাদি সেরে হোটেলে ফিরছে রাত করে।

পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায় ক্লাউস-এর। তার যৌবনের দিনগুলোর কথা। সেই যখন সে ছিল রোনাটার বাবার আশ্রয়ে। তখনও এমনিভাবে ওরা দুজন বেড়াতে যেত। ও ছাড়া আর কারও সঙ্গে ডেটিং’করত না। রোনাটা। তাহলেও মেয়েটা ছিল অত্যন্ত সাবধানী, রক্ষণশীল। বেশি দূর অগ্রসর হতে দেয়নি কখনও তাকে। একসঙ্গে সিনেমা দেখেছে, থিয়েটার দেখেছে, নেচেছে, গল্প করেছে। ব্যস, তারপর অগ্রসর হতে চাইলেই সরে গেছে রোনাটা। অথচ ক্লাউস-এর বেশ মনে আছে, রোনাটা সে-যুগে তাকে ঘিরে ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচত। জীববিজ্ঞানের নিরিখে তুলনাটা হয়তো ঠিক হল না, কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটা ওইরকমই হত। সে-আমলে রোনাটার প্রসাধন, সাজসজ্জা, অঙ্গভঙ্গি, বাকচাতুর্য সবকিছুই ছিল ওই তরুণ ছাত্রটির মনোহরণের উদ্দেশ্যে।

একদিনের ঘটনা ওর বিশেষ করে মনে পড়ে। সেই একটি দিনই ও উদ্দাম হয়ে উঠেছিল। তখনও রোনাটার বাবা বেঁচে। সে রাত্রে লন্ডনে বিখ্যাত ওল্ড ভিক’ গ্রুপের রোমিও-জুলিয়েট হচ্ছে। ক্লাউস দুখানা টিকিট কেটে এনেছিল। রোনাটা একমাত্র তার সঙ্গে তখন ‘ডেটিং’ করছে–ওর বাবা জানেন সে কথা। অনুষ্ঠান দেখে যখন ফিরে এল তখন শহরতলীতে নিশুতি রাত। বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছে। দ্বিতল বাড়ি। একতলায় ক্লাউস-এর শোওয়ার ঘর–ভাইবোনদের নিয়ে রোনাটা থাকত দ্বিতলে। সদর দরজার ডুপ্লিকেট চাবি থাকত ওদের কাছে। আহারাদি সেরে এসেছিল ওরা। ওকে শুভরাত্রি জানিয়ে রোনাটা যখন দ্বিতলে উঠে যাচ্ছে তখন হঠাৎ গ্লাভস-সমেত হাতটা চেপে ধরেছিল ফুকস্। রোনাটা প্রথমটা বুঝতে পারেনি। বলেছিল, কী?

ফুকস-এর রক্তে তখন তুফান জেগেছে। কোনো কথা বলেনি সে। জোর করে ওকে টেনে নিয়েছিল নিজের বুকে। প্রথমটা বিস্ময়, তারপরেই শিউরে উঠেছিল রোনাটা। দু-হাতে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল–বাধা দিয়েছিল। ফুকস্ সে বাধা মানেনি। জোর করে চেপে ধরেছিল ওর পায়রার মতো নরম বুক নিজের পেশীবহুল কবাট বক্ষে। কী যেন বলতে চেয়েছিল রোনাটা–পারেনি। ফুকসের উন্মুক্ত ওষ্ঠাধরে সে প্রতিবাদের ভাষাটা হারিয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। আজও ভোলেনি সে কথা। কখন অজান্তে রোনাটার প্রতিবাদ-উদ্যত বাহুজোড়া ওকে সবলে আলিঙ্গন করে ধরেছিল। সেই ওকে প্রথম চুম্বন করে। এবং সেই শেষ। এর চেয়ে আর একটি পদও তাকে অগ্রসর হতে দেয়নি মেয়েটি।

পরে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। ক্লাউস বলেছিল–ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই নয়, তাহলে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে কেন? রোনাটা দু-হাতে মুখ ঢেকে বলত–প্লিজ, ক্লাউস, ও-প্রসঙ্গ তুললে আমি তোমার সামনে আর আসব না। আশ্চর্য লাজুক মেয়েটা। না, লাজুক নয়–রক্ষণশীল। ও কিন্তু মধ্যযুগের মেয়ে নয়, চার্চের ‘নান’ নয়, কলেজে-পড়া আধুনিকা। তার সহপাঠিনীরা ‘ডেটিং’ করতে গিয়ে সপ্তপদীর কয় পা অগ্রসর হত, সে কথা নিশ্চয় জানা ছিল তার। কিন্তু ধর্মের এক ভূত চেপে বসেছিল রোনাটার ঘাড়ে। কুমারী মেয়ের কৌমার্য সম্বন্ধে সে ছিল অস্বাভাবিক রকমের সচেতন–আর সে কৌমার্য ওর ঠোঁটে, বুকে, সর্বাঙ্গে। আশ্চর্য মেয়ে!

তবু তার একটা অর্থ হয়। প্রাকবিবাহযুগে কুমারী মেয়ের সহজাত সংস্কার। কিন্তু এর অর্থ কী? আজ কেন সেই পরিণতবয়স্কা মেয়েটি হঠাৎ বলে বসল : বিবাহের সংজ্ঞা ইন্দ্রিয়জ ব্যভিচারের একটা পাসপোর্ট নয়?

***

প্রফেসর কার্ল গোটা-তিনেক ক্যামেরা এনেছেন–কিন্তু ফটো তোলার মত সময় অথবা মেজাজ নেই তার। অগত্যা রোনাটা আর ক্লাউস আনাড়ি হাতে তার সদ্ব্যবহার করে। এখানে-ওখানে ফটো তুলে বেড়ায়। সেদিন ওরা গেল শহরের বাইরে ভার্সাইপ্রাসাদ দেখতে। লুই পরিবারে বিলাস-ব্যসনের স্মৃতি-বিজড়িত ভার্সাই প্রাসাদ। অনেক ফটো নিল। তারপর প্রাসাদের পিছন দিকের সুন্দর বাগানটিতে গিয়ে বসল ওরা। টুরিস্ট অনেক এসেছে, বাগানটাও অতি প্রকাণ্ড। দূরতম প্রান্তে একটা কারনেশান-বেড এর ধারে ওরা যেখানে গিয়ে খাবারের বাস্কেট খুলল, সেখানটা প্রায় নির্জন। ফুকস্ তার ফ্লাস্ক বার করে দু-পাত্র ব্র্যান্ডি ঢালল। রোনাটা বললে, আজ আমরা এই যে বাগানটায় নির্জনে বসে লাঞ্চ খাচ্ছি, এখানেই একদিন হয়েছিল ‘টেনিস কোর্ট বিদ্রোহ’ তা জান?

–টেনিস-কোর্ট বিদ্রোহটা কী?

-তুমি কি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ছাড়া আর কিছু পড়নি? ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস?

-না। অত সময় আমার নেই।

–তবে ও প্রসঙ্গ থাক। গোটা ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস শোনাবার মতো মেজাজ আমার নেই।

–তবে থাক।

দুজনে কিছুক্ষণ নীরবে পানাহার করতে থাকে। তারপর ফুকস্ বলে, আচ্ছা সত্যি করে বলত রোনাটা–তুমি কী চাও? আমি ইস্ট-জার্মানিতে চাকরি নিয়ে চলে গেলে তুমি খুশি হও, না বকে নিয়ে এসে এখানেই যদি রাখি?

রোনাটা মিষ্টি হাসে। বলে, কী মনে হয়?

–কী জানি, ঠিক বুঝতে পারি না। এক-এক সময় মনে হয় আমি তোমার চোখের আড়ালে চলে গেলেই শান্তি পাবে তুমি।

–নিজের গুরুত্বটা বড় বেশি করে দেখছ না?

–তুমিই তো বললে সেদিন।

-সে তো রাগের মাথায়।

–তবে মনের কথাটা কী?

–এতদিনেও যদি না বুঝে থাক, তবে বুঝে আর কাজ নেই।

-কিন্তু স্পষ্ট করে না বললে কেমন করে আমি সিদ্ধান্ত নেব। ও চাকরি নেব কি না?

ম্লান হাসল রোনাটা। বললে, আমার ইচ্ছার সঙ্গে তোমার সিদ্ধান্ত নেবার কী সম্পর্ক? আমাকে খুশি করতেই কি সারাজীবন ধরে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি?

-না, তা নিইনি। তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম একদিন…

–সে কথা কিন্তু আমি ‘মিন’ করিনি। ও কথা বরং থাক।

–তবে কী কথা আলোচনা করব? আজকের আবহাওয়া?

–না। অন্য কিছু।

–তবে তোমার কথা বল।

 –কী আমার কথা?

 –তুমি আবার ‘মা’ হচ্ছ না কেন?

–আবার ‘মা’। মানে?

–অ্যালিসের কোনো ছোটো ভাই অথবা বোন?

 ম্লান হাসল রোনাটা। যক্ষ্মারোগীর রক্তশূন্য পাণ্ডুর হাসি। ব্র্যান্ডিটা গলায় ঢেলে দিয়ে বললে, ফর য়োর ইনফরমেশন জুলি, অ্যালিস আমার মেয়ে নয়।

দ্বিতীয় পানপাত্রটা তুলেছিল ক্লাউস। ধীরে ধীরে এবার তার হাতটা নেমে আসে। অবাক হয়ে বলে, মানে? অ্যালিস তোমার মেয়ে নয়?

–না। অ্যালিস প্রফেসর কার্ল-এর প্রথম পক্ষের কন্যা।

ক্লাউস-এর মনে পড়ে গেল অ্যালিসের চেহারা। অ্যালিস ছিল ব্রুনেট– মাথাভরা কালো চুল। অথচ রোনাটা ব্লন্ডি। তাই মেয়ে মায়ের মতো দেখতে হয়নি আদৌ। অস্ফুটে বললে, আশ্চর্য। এত বড় খবরটা এতদিন আমাকে বলনি তো?

-শুধু তাই নয় জুলি। অ্যালিস প্রফেসর অটো কার্লের মেয়েও নয়।

তার মানে?

–অ্যালিসের মাকে তিনি বিবাহ করেন ওই কন্যা সমেত।

 হঠাৎ ক্লাউস ওর গ্লাভস-পরা হাতটা চেপে ধরে–যেভাবে একদিন তার হাত চেপে ধরেছিল প্রথম যৌবনে, সিঁড়ির মুখে। বলে, ডাক্তার দেখিয়েছিলে? অসুস্থ কে? তুমি, না প্রফেসর?

–অসুস্থ হতে হবে তার মানে কী?

রোনাটা তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বলে, পাগলামি কোরো না। এখানে আরও লোক আছে।

ক্লাউস তার হাতটা ছেড়ে দেয়। রোনাটা ঘড়ি দেখে বলে–সময় হয়ে গেছে। চল, ওঠা যাক। বাসটা ছেড়ে দেবে না হলে।

ওরা টুরিস্ট বাসে গিয়েছিল ভার্সাই। প্রফেসর কার্ল ওর গাড়িটা ব্যবহার করছেন।

***

পরের দিন ক্লাউস একাই বেরিয়েছিল তার গাড়িটা নিয়ে। শহরতলির এক বিশেষ অঞ্চলে। হিটলারের অত্যাচারে দেশত্যাগ করার আগে সে কিছুদিন পারিতে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। ওকে যারা আশ্রয় দিয়েছিল তাদের কিছু তত্ত্ব-তালাশ নেবার উদ্দেশ্যে। দেখা পেল না কারও। যুদ্ধের ডামাডোলে ও-অঞ্চলের বাসিন্দারা তো ছাড়, গোটা ভূগোলটাই পালটে গেছে। সব অচেনা মানুষ। হোটেলে ফিরে এসে রিপেসশান কাউন্টারে নিজের ঘরের চাবিটা নিতে যাবে হঠাৎ নিজের নামটা শুনে চমকে উঠল। ওর সামনেই কাউন্টারের দিকে মুখ করে, এবং ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কাউন্টারের রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে তিনি বললেন, দেখুন তো ডক্টর ক্লাউস ফুকস-এর নামে কোনো চিঠি আছে? রুম নম্বর 728?

মেয়েটি কাউন্টারের পিছনে পায়রার খোপের মতো একটা বাক্স থেকে বার করে আনল একটা মোটা খাম। তখনই হস্তান্তরিত করল না কিন্তু। বলল, আপনার। চাবিটা প্লিজ?

–ও সার্টেনলি! বৃদ্ধ তাঁর পকেট থেকে হোটেলের চাবিটা বার করে টেবিলে রাখলেন।

মেয়েটি বললে, মাপ করবেন, এটা 729 নম্বর।

 বৃদ্ধ যেন চমকে ওঠেন। তারপর হো-হো করে হেঠে ওঠেন। বলেন, আমারই ভুল। প্রফেসর কার্ল-এর ঘরের চাবিটা ভুল করে নিয়ে নিয়ে এসেছি। ওই 728 আর 729 আমি একসঙ্গে বুক করেছি।

মেয়েটি জবাব দেয় না। একটা রেজিস্টার খুলে কী যেন দেখে। তারপর সে নিশ্চিন্ত হয়ে হাসে। ফরাসি ভাষায় বলে, আপনারা, মানে ইংরেজ অধ্যাপকরা, সবাই একরকম। যান, আপনার বন্ধুর চাবিটা তাকে ফেরত দিয়ে আসুন।

বৃদ্ধ অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে খাম আর চাবিটা তুলে নিয়ে সরে পড়লেন। ক্লাউস এতক্ষণে চিনতে পারল তাঁকে। নিঃসন্দেহে তিনি প্রফেসর অটো কার্ল-যদি না তার যমজভাই হন। তফাত শুধু এই প্রফেসর কার্ল এর দাড়ি-গোঁফ পরিষ্কার করে চাছা, এই বৃদ্ধের দিব্যি কঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

বৃদ্ধের অলক্ষ্যে সে তাকে অনুসরণ করে সদর দরজা পর্যন্ত এল। বৃদ্ধ হন্তদন্ত হয়ে বার হয়ে গেলেন। হোটেলের পোর্টিকোর তলাতেই অপেক্ষা করছিল একটা কালো রঙের মার্সেডিজ। তার ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। মুহূর্তমধ্যে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ঘটনাটা নিরতিশয় অদ্ভুত। কে ওই বৃদ্ধ? কেন তিনি ক্লাউস ফুকস্-এর নামে মিথ্যা পরিচয় দিলেন মেয়েটির কাছে? গাড়িটাই বা কার? অন্যমনস্কের মতো সে ফিরে এল কাউন্টারে। মেয়েটিকে বললে, নাম্বার 728 প্লিজ?

যান্ত্রিক অভ্যাসে হুক থেকে নামিয়ে মেয়েটি বাড়িয়ে ধরে চাবিটা।

-দেখুন তো 729 নম্বর চাবিটা এখানে আছে কিনা?

হঠাৎ কী মনে পড়ে যায় মেয়েটির। বলে, ও হো! আপনাদের চাবি দুটো উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে। আপনার বন্ধু আপনার চাবিটা নিয়ে চলে গেলেন। এইমাত্র…

–ঠিক আছে। একটা ঘরে ঢুকতে পারলেই হল।

নিজের ঘরে ফিরে এসে ক্লাউস আদ্যোপান্ত ব্যাপারটা তলিয়ে দেখে। কী হতে পারে? প্রফেসর কার্ল দুটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন; 729 নিজের নামে, 728টা ফুকস-এর নামে। অথচ কাউন্টারে তিনি আত্মপরিচয় দিলেন ডক্টর ফুকস্ বলে। তার ওপর ছদ্মবেশ। প্রফেসর কার্ল একদিন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁর পিছনে গুপ্ত আততায়ী লেগে থাকায় তিনি বিস্মিত নন। কেন? তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে কার কী লাভ? আচ্ছা, রোনাটা কি সব কিছু জানে? সব কথা। রোনাটাকে খুলে বললে কেমন হয়? কিন্তু সে যদি বিশ্বাস না করে? যদি ভাবে, তার স্বামীর বিরুদ্ধে কতকগুলো মিথ্যে অভিযোগ আনছে সে। প্রমাণ করবে কেমন করে?

হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। ক্লাউস সেটা তুলে নিয়ে বললে, হ্যালো?

-তুমি ঘরে ফিরে এসেছ? কতক্ষণ?

–রোনাটা কথা বলছে পাশের ঘর থেকে।

 –এইমাত্র। প্রফেসর আছেন?

–না। ও তো সেই সকালেই বেরিয়ে গেছে। এস না এ ঘরে? চল, এখনই কোথাও বের হই! চুপচাপ এমন ঘরে বসে থাকার জন্য পারিতে এসেছি নাকি?

-তুমি তৈরি হয়ে নাও তাহলে।

 –এ ঘরে এসে দেখ আমি তৈরি কি না।

নিজের ঘরে তালা দিয়ে ও চলে আসে এ-ঘরে। রোনাটা তৈরি হয়েই বসেছিল। নিখুঁত সেজেছে সে।

-বাস রে! এত সাজের ঘটা?

–বাঃ। ভুলে গেছ? আজ সন্ধ্যার পর ফলি বার্জার-এ যাওয়ার কথা আছে না।

–ও হ্যাঁ, তাই তো! না, না, আমি ভুলিনি। কিন্তু তার তো অনেক দেরি। তুমি বোসো দেখি ওখানে। তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলতে চাই

-বল।-রোনাটা তার স্কার্ট সামলে আলতো করে বসে সামনের চেয়ারটায়।

ভুল বুঝো না আমাকে। আমি একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না..আই মিন, প্রফেসর কালের বিষয়ে। আচ্ছা, তুমি কি সম্প্রতি তাঁর ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ?

রোনাটা স্পষ্টই সতর্ক হয়। গম্ভীর হয়ে বলে, বলছি। কী একটা দুশ্চিন্তায় উনি একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। আমাকে কিছু বলতে চান না, কিন্তু বেশ বুঝতে পারি, সেই চিন্তাটা ওঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে। রাত্রে ঘুমোন না। সারারাত পায়চারি করেন–

-তুমি কি মনে কর প্রফেসরের কোনো শত্রু আছে? কেউ তাকে ব্ল্যাকমেল করছে?

–আমার তো তা মনে হয়নি এতদিন। অমন দেবতুল্য মানুষের শত্রু থাকবে কেন?

ফুকস্ কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে। তারপর মনস্থির করে বলে, আমি যদি বলি প্রফেসর কার্লকে হত্যা করবার উদ্দেশ্যে একজন আততায়ী সর্বদা ওঁর পেছনে ঘুরছে–বিশ্বাস করতে পার?

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রোনাটা। তারপর নীরবে মাথা নেড়ে জানায়না।

ক্লাউস আর দ্বিধা করে না। ওদের সেই দুর্ঘটনার আনুপূর্বিক একটা বনা দেয়। উপসংহারে বলে, প্রফেসর কার্ল আমাকে বারণ করেছিলেন একথা কাউকে জানাতে। আমি কাউকেই বলিনি, অথচ কেমন করে জানি আর্নল্ড সেটা জেনে ফেলেছে। তোমাকেও এতদিন বলিনি। আজ আর একটা ঘটনা ঘটায় মনে হল তোমার জানা উচিত। তাই বললাম। বিশ্বাস করতে পারলে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোনাটা বললে, তুমি মিছিমিছি আমাকে মিথ্যা কথাই বা বলবে কেন? তাছাড়া আজ বুঝতে পারছি, আর্নল্ড কেন সেদিন আমাকে অত জেরা করছিল।

–কবে? কী জাতীয় জেরা?

-কতকগুলো ফটো দেখিয়ে জানতে চাইল, তাদের আমি চিনি কিনা। লস অ্যালামসে তাদের আমি কখনও দেখেছি কিনা। আমি সবচেয়ে অবাক হলাম যখন আর্নল্ড বললে, আপনাকে যে এসব প্রশ্ন করেছি তা কাউকে বলবেন না। আপনার। স্বামীকেও নয়।

–কেন, তা জানতে চাওনি তুমি?

–চেয়েছিলাম। আর্নল্ড বলেছিল, এটা কার্লের ভালোর জন্যই। কিন্তু তুমি তখন কী বললে? আজ আর একটা ঘটনা কী ঘটতে দেখেছ বলছিলে—

ফুকস্ সরাসরি সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করে, তুমি ডক্টর অ্যালেন নান মে-র নাম শুনেছ?

–শুনেছি। একটা ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক। কাগজে দেখেছি তার জেল হয়েছে। ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল যদিও।

হাসল ফুকস্ ওর উত্তেজনা দেখে। বললে, তুমি ডেক্সটার’-এর নাম শুনেছ?

–কে ডেক্সটার? অনেক ডেক্সটারকেই আমি চিনি। ওটা একটা সাধারণ নাম। কার কথা বলছ তুমি?

ফুকস্ সংক্ষেপে লস অ্যালামসের তথাকথিত প্রতারক ডেক্সটার-এর কথা বলে। ইতিপূর্বে আর্নল্ড এবং তারও আগে লস অ্যালামসে ম্যাককিলভি তাকে যেটুকু বলেছিল সেটুকুও জানায়। শুনতে শুনতে কেমন যেন বিচলিত হয়ে ওঠে রোনাটা। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, এনাফ। এনাফ অফ ইট। তুমি আজ কী দেখেছ বলো?

ফুকস্ অতঃপর মাত্র আধঘণ্টা আগে যা দেখেছে তার একটা আনুপূর্বিক বর্ণনা দেয়।

রোনাটা বলে, তুমি নিশ্চয় ভুল দেখেছ, ভুল শুনেছ। এ কখনও সত্য হতে পারে। প্রফেসর কার্ল একজন দেবচরিত্রের মানুষ। তুমি তাকে..না, না, ছি, ছি!

ফুকস্ নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বলে, তাই হবে–হয়তো ভুলই দেখেছি। ভুলই শুনেছি।

–নিশ্চয়ই। উনি তো সেই সকালে বেরিয়ে গেছেন। তাছাড়া দাড়ি-গোঁফ এঁটে…তোমার মাথা খারাপ!

ফুকস্ উঠে দাঁড়ায়। বলে, কই বের হবে বলেছিলে যে?

-না। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে। বস তুমি। আচ্ছা, ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলতো জুলি, তুমি নিজে এটা বিশ্বাস করতে পারছ? আমার স্বামী এতবড় বিশ্বাসঘাতক?

ফুকস্ একটুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবে। তারপর প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করে বলে, ঈশ্বরের নামে শপথ আমি নিই না রোনাটা। আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না। আমি নাস্তিক।

এবার স্তম্ভিত হবার পালা রোনাটার। অনেকক্ষণ নির্নিমেষ নয়নে সে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। তারপর অদ্ভুত স্বরে বললে, এ সব কী বলছ জুলি! তুমি নাস্তিক?

-হ্যাঁ তাই।

 –আজ বিশ বছর মেলামেশার পর তুমি আমাকে একথা বিশ্বাস করতে বলো?

–বলি। এতদিন তোমাকে সাহস করে জানাইনি।

–আজই বা তাহলে জানালে কেন?

-আমার মনে হচ্ছে, তোমার-আমার শেষ বোঝাঁপড়ার দিন এসে গেছে। তোমার-আমার শেষ সিদ্ধান্তের আগে সবকিছু তোমার জেনে নেওয়া দরকার।

–শেষ সিদ্ধান্তটা কীসের?

–প্রফেসর কার্লকে যদি ডিভোর্স করতে বাধ্য হও তারপর…

 রোনাটা একখানা হাত বাড়িয়ে দেয়। থামতে বলছে ওকে। ফুকস্ কিন্তু থামে না। বলে, থামবার উপায় নেই রোনাটা। এই হচ্ছে বাস্তব অবস্থা। আমি ও ঘরে চলে যাচ্ছি। যদি মনটা স্থির হয়, বের হবার ইচ্ছে হয়, আমাকে ফোন কোরো বরং…

***

নিজের ঘরে ফিরে এসে কাবার্ড থেকে বের করে হুইস্কির বোতলটা। মনটা আজ অনেক হালকা বোধ হচ্ছে। এতদিনে সে মন খুলে সত্যি কথাটা বলে ফেলেছে। সে নাস্তিক। এটাই ছিল রোনাটার সঙ্গে তার মিলনের পথে অন্যতম প্রধান বাধা। রোনাটা ধর্মভীরু, তার বাপের মতো। ক্লাউস মনে করে ঈশ্বর একটা ভাওতা। কতকগুলো ফন্দিবাজ লোকের একটা ফাঁকিবাজি। সাহস করে এতদিন রোনাটাকে কথাটা বলতে পারেনি। আজ মনের ভার নেমে গেছে। হঠাৎ ওর মাথায় একটা ফন্দি জাগে। প্রফেসর কার্লকে একটু বাজিয়ে দেখতে দোষ কী? ছদ্মবেশি লোকটা আসলে কে, সে কথা তাহলেই সহজে বোঝা যাবে। চট করে টেবিল থেকে একটা সাদা কাগজ তুলে নেয়। বাঁ-হাতে কলমটা ধরে ক্যাপিট্যাল অক্ষরে বড় বড় করে লেখে, “ছদ্মবেশ এবং ছদ্মনাম সত্ত্বেও তোমাকে কিন্তু চিনতে পেরেছি।”

কাগজটা ভাজ করে একটা খামে বন্ধ করে। উপরে লেখে ‘ডক্টর ক্লাউস ফুকস, রুম নং 728’। তারপর ঘরে চাবি দিয়ে নেবে যায় নীচে। রিসেপশান-কাউন্টারে এসে দেখে মেয়েটি চলে গেছে। তার বদলে অন্য একটি ছেলে বসে আছে। তার হাতে খামটা দেয়। যন্ত্রচালিতের মতো ছেলেটি পিছনের নম্বরি খোপে চিঠিখানা রেখে দেয়।

ফুকস্ আবার ফিরে আসে ওর ঘরে। বোতলটা টেনে নেয়। রেডিওটা খোলে। উৎকট জ্যাজ বাজছে কোথাও। বন্ধ করে দেয়। পাত্রটা হাতে উঠে গিয়ে দাঁড়ায় জানলার পাশে। নীচে প্রবহমান পারির সন্ধ্যা। গাড়ির ক্যারাভান আর নিওন আলোর ঝলকানি। বারে, পাবে, স্ট্রিপটিজ নাচের আসরে নিচের তলায় পারি এতক্ষণে জমজমাট। আর ও একা ঘরে বসে মদ্যপান করছে। পাশের ঘরেও নিশ্চয় বসে আছে কাঠ হয়ে অধ্যাপকের শুচিবায়ুগ্রস্ত ধর্মপত্নী-স্বামীর সঙ্গে যার বাইশ বছর বয়সের ফারাক। ‘দুত্তোর’ বলে উঠে পড়ে ক্লাউস। ঢকঢক করে পাত্রের বাকি মদটুকু ঢেলে দেয় গলায়। হাতের উল্টোপিঠে মুখটা মুছে নেয়। তারপর ঘর বন্ধ করে চলে যায় আবার পাশের ঘরে।

কিন্তু দ্বারের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। ঘরের ভেতর বচসা হচ্ছে। দাম্পত্যকলহ নিশ্চয়, অর্থাৎ অধ্যাপক-মশাই ফিরে এসেছেন এতক্ষণে। কী। কথা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না–কিন্তু দুজনেই উত্তেজিত। পায়ে পায়ে আবার ফিরে আসে নিজের ঘরে।

আবার হুইস্কির বোতলটা টেনে নেয়।

***

ঘণ্টাতিনেক কেটে গেছে তারপর। বোতলটা কখন জানি শেষ হয়ে গেছে। তখনও ওর তৃষ্ণা মেটেনি। হুইস্কিতে এ তৃষ্ণা মিটবে না বোধহয়। নৈশাহার হয়নি। ফলি বার্জার-এ নৈশাহারের জন্য টেবিল বুক করা ছিল। যায়নি। এখন কিন্তু খেতে যাবার মতো শারীরিক অবস্থাও আর নেই। রীতিমতো পা টলছে। জামা কাপড় ছেড়ে নৈশসজ্জা পরে নেয়। তারপর নীল বাতিটা জ্বেলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে না কিছুতেই।

অনেক পরে মনে হল কে যেন দ্বারে সন্তর্পণে টোকা দিচ্ছে। ফুকস্ বিরক্ত বোধ করে। দ্বারের বাইরে সে বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে ‘বিরক্ত করবেন না’–তবু কে এল জ্বালাতে? টলতে টলতে এসে দরজা খুলে দিয়েই চমকে ওঠে একেবারে।

করিডোরে স্তিমিত আলোয় দাঁড়িয়ে আছে বোনাটা।

সন্ধ্যার সেই সাজসজ্জা নেই তার অঙ্গে। পরেছে একটা নাইটি। অদ্ভুত বিচিত্র বর্ণের সেই ঢিলে-ঢালা পোশাকটা। ধূসর রঙের সঙ্গে এসে মিশেছে কিছুটা সিঁদুরে লাল, কিছুটা বা হলুদ, কমলা অথবা নীল। এমন বর্ণসম্ভার সে কোথায় যেন দেখেছে! রামধনু রঙে? প্রজাপতির পাখায়? সূর্যাস্তের বর্ণসম্ভারে? ঠিক মনে পড়ছে না। হুইস্কির একটা তরল পর্দা ওর স্মৃতিপথে যবনিকার সৃষ্টি করেছে!

-তুমি!

নিঃশব্দে রোনাটা ঢুকে পড়ে ওর ঘরে। দরজাটা ঠেলে দেয়। ইয়েল-লক। তৎক্ষণাৎ তালাবন্ধ হয়ে গেল নিশ্চয়। ঘরটা ছিল আলো-আঁধারী। নীলাভ আলোর একটা মোহময় আবরণে ঢাকা। রোনাটা হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দেয়। হঠাৎ আলোর বন্যায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল ক্লাউস-এর। ওর মনে হল রোনাটা নাইটির নীচে অধোবাস পরেনি। ওর অন্তরের যুগ্মকামনা উত্তুঙ্গ হয়ে উঠেছে। রোনাটা কিন্তু তার বেশবাস বিষয়ে সচেতন নয়। এসে বসল সে চেয়ারটা টেনে নিয়ে। একখানা কাগজ বাড়িয়ে ধরে বললে, পড়ে দেখ।

-কী ওখানা?-কাগজটা হাত বাড়িয়ে নেয়।

–একটু আগে হোটেলের একজন বয় দিয়ে গেল।

 প্রফেসর অটো কার্ল-এর সংক্ষিপ্ত পত্র। স্ত্রীকে লেখা। সম্বোধনবিহীন। লিখেছেন, বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে তিনি কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন। রোনাটা যেন ক্লাউসের সঙ্গে পরে সুবিধামতো ফিরে আসে। ব্যস। আর কিছু নয়।

-কী হতে পারে বল তো?

ফুকস্ প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে, ওঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি তোমার?

হয়েছিল। ঘণ্টাখানেক আগে এসে খামকা আমার সঙ্গে ঝগড়া করে গেছেন। বললেন, আমি নাকি ওঁকে চিঠি লিখে ভয় দেখাচ্ছি।

–কী চিঠি?

–কী জানি। কিছুই খুলে বললেন না।

–কী করবে এখন?

–তাই তো পরামর্শ করতে এলাম তোমার সঙ্গে।

 –আমার সঙ্গে? আমার পরামর্শ তুমি শুনবে?

–কেন শুনব না?

 –আমি যে নাস্তিক। আমি যে বিশ্বাসঘাতক।

-প্লিজ, অমন করে বোলো না। তোমাকে আমি কোনোদিনই বিশ্বাসঘাতক বলিনি।

–কিন্তু আমিও তো বিশ্বঘাতক হয়ে উঠতে পারি?

–না, পার না।

–পারি না? প্রফেসর কার্ল বিশ্বাস করে তার সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে এভাবে ফেলে পালাতে পারেন, তুমি এমন নাইটি পরে এতরাত্রে অসঙ্কোচে ব্যাচিলারের ঘরে আসতে পার, আর আমিই শুধু বর্বর হয়ে উঠতে পারি না?

-না পার না, জুলি। কারণ তুমি জান তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। আমি খ্রিস্টান, আমি বিবাহিতা। আমি ব্যভিচারিণী হতে পারি না।

ক্লাউস নিরুদ্ধ আক্রোশে বিছানার ওপর একটা ঘুষি মারে।

রোনাটা হেসে বলে, পুয়োর চাইল্ড।

–থাক। রসিকতা কোরো না।–আবার উঠে যায় কাবারে কাছে। আর একটা বোতল পেড়ে আনে।

রোনাটা বলে, আর খেও না। তোমার পা টলছে।

-তুমি পাষাণ।

–আর তুমি নাস্তিক। কিন্তু নাস্তিকদেরও একটা জিনিস থাকে জুলি–’কোড অফ এথিক্স’।

–কিন্তু আমি তো মানুষ?

–তাই তো সেদিন বলছিলাম-তুমি বিয়ে করো। সংসার করো।

–আর তুমি? তোমার কী হবে?

–আমার আবার কী হবে?

–তুমি এমন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছ কেন? নিজের চিকিৎসা করাচ্ছ না কেন?

ম্লান হাসল রোনাটা। ফুকস দু-পাত্র তরল পানীয় ঢালল। তারপর বললে, কই, জবাব দিলে না?

–কী জবাব দেবো? এ রোগের চিকিৎসা নেই, আমি জানি।

–কী রোগ?

–এখন আর তো তোমাকে জানানো যাবে না।

–কেন?

–নাস্তিককে তা বলা যায় না।

 পানীয়টা কণ্ঠনালীতে ঢেলে দিয়ে আবার এক পাত্র ঢালে। বলে, বলতে তোমাকে হবে না। আমি জানি, কী তোমার রোগ। কী তার চিকিৎসা।

কৌতুক উপচে পড়ল রোনাটার গলায়। বললে, তাই নাকি? শুনি একটু।

–তোমার ‘মা’ হওয়া দরকার। তুমি একজন গাইনোকলজিস্টকে দিয়ে নিজেকে দেখাও।

রোনাটা জবাব দেয় না। এতক্ষণে পানপাত্রটা তুলে নেয় হাতে। এক সিপ মুখে দিয়ে বলে, তার প্রয়োজন নেই। আমার কোনো আঙ্গিক ত্রুটি নেই।

তবে কি প্রফেসর?

 এবারও ইতস্তত করে রোনাটা জবাব দিতে। তার হাতটা কাঁপছে। সেই সঙ্গে কাঁপছে তার হাতে তরল পানীয়টা। অনেকটা খেয়ে ফেলে একসঙ্গে। মুখটা মুছে নিয়ে বলে, এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা কি তোমার উচিত হচ্ছে?

ফুকস্ খাটের প্রান্তে এগিয়ে আসে। রোনাটার কাঁধে একখানা হাত রাখে। বলে, হচ্ছে রোনাটা। আমার সে অধিকার আছে। তবে কি প্রফেসরই দায়ী?

-প্লিজ। আমাকে জিজ্ঞাসা কোরোনা, আমি বলতে পারব না।

 দু-হাতে মুখ ঢাকে রোনাটা। ফুকস্ দু-হাতে ওর অনাবৃত বাহুমূল শক্ত মুঠিতে ধরে একটা ঝাঁকানি দেয়, বলে–বলতে তোমাকে হবেই রোনাটা। প্রফেসর কি পিতা হবার উপযুক্ত নন?

তবু মুখ থেকে হাত সরায় না রোনাটা। তার সোনালি চুলে ভরা মাথাটায় একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে, আমি জানি না। বিশ্বাস করো, আমি জানি না।

-তবে কোনো ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যাওনি কেন?

হঠাৎ হাত সরে গেল রোনাটার। অশ্রুআর্দ্র দুটি চোখের দৃষ্টি মেলে ধরে বলে,

–বিশ্বাস করবে জুলি? অ্যালিসের মা এটাকে মেনে নিতে পারেনি। সে…অন্যত্র সান্ত্বনা খুঁজত।

-তার মানে? সব কথা আমাকে বল দেখি?

কিন্তু সব কথা খুলে বলা যায়? ওর কাছেও? হঠাৎ একেবারে ভেঙে পড়ে রোনাটা। উপুড় হয়ে পড়ে ওর বালিসের ওপর। ফুকস্ ওর প্ল্যাটিনাম-বুন্ড চুলের। ওপর ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয়। সে স্পর্শে একবার শিউরে উঠে রোনাটা। তার পিঠটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। তারপর ওইভাবে মুখ লুকিয়েই বলে, বিবাহের আগেই প্রফেসর আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার সন্তানের মা হতে হবে না আমাকে!

হঠাৎ জোর করে ওকে টেনে তোলে! দু-হাতে ওর বাহুমূল শক্ত করে ধরে মুখোমুখি বসিয়ে দেয়। বলে, প্রতিশ্রুতি! কীসের জন্য প্রতিশ্রুতি! তুমি চেয়েছিলে? কেন?

–তাও কি বলে দিতে হবে তোমাকে?

চোখ দুটো জ্বলে ওঠে মাতালটার। বলে, তুমি কি পাগল? আমার জন্যে!!

হঠাৎ ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে রোনাটা। থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে ওর ঠোঁট দুটো। অস্ফুটে বলে ফেলে, উড য়ু বিলিভ মি, জুলি, অ্যাট দিস এজ, আফটার এইট ইয়ার্স অব ম্যারেড লাইফ..আই অ্যাম,…ইয়েট, ইয়েট–এ ভার্জিন।

–”ফোর…থ্রি..টু…ওয়ান…নাউ!

“প্ৰকাণ্ড একটা ধোঁয়ার বলয় পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ওপর আর একটা আগুনের বলয়–তার কিনারাগুলো সিঁদুরে লাল। ওপরে ওপরে, আরও ওপরে উঠে গেল। অনাবিষ্কৃত একটা নগ্নসত্য আবির্ভূত হল ওর চোখের সামনে। পারমাণবিক বন্ধনমুক্ত মহামৃত্যু নেমে এল এবার পৃথিবীর বুকের ওপর।

“তারপর অস্বাভাবিক একটা নিস্তব্ধতা। পুরো দেড় মিনিট কেউ কোনো কথা বলেনি।”

.

০৭.

পরদিন অনেক বেলায় ফুকস-এর যখন ঘুম ভাঙল তখনও ওর মাথাটা ভার। কাল রাত্রের কথা আবছা মনে পড়ছে। কী যেন ঘটেছিল? কে যেন এসেছিল ওর ঘরে? একে একে সব কথা মনে পড়ে যায়। কখন পাশের ঘরে উঠে চলে গিয়েছিল রোনাটা? মনে পড়ছে না। মুখ হাত ধুয়ে নিল প্রথমেই। তারপর জামাকাপড় বদলে ফোন করল পাশের ঘরে। ফোন বেজেই গেলো। ধরল না কেউ। কী ব্যাপার? নিশ্চয় রোনাটা ঘুমাচ্ছে এখনও। তা তো হতেই পারে, ত্রিশ বছরের জীবনে এমন একটা রাত তার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম।

আরও ঘন্টাখানেক পরে আবার ফোন করল। এবারও নিরুত্তর।

খোঁজখবর নিতে গিয়ে যা জানা গেল তা প্রায় অবিশ্বাস্য। মিসেস রোনাটা কার্ল ভোরবেলা উঠে হোটেল থেকে চেক-আউট করে বেরিয়ে গিয়েছেন। ঠিকানা রেখে যাননি।

একটা দিন অপেক্ষা করল। যদি অন্য কোনো হোটেল থেকে রোনাটা ফোন করে। তারপর হারওয়েলে ফিরে গেল সে দ্বিতীয় দিন।

সেখানে তার জন্য প্রতীক্ষা করছিল সবাই।

অদ্ভুত খবর। দুদিন আগে মিসেস অটো কার্ল ফিরে এসেছিলেন। পাড়ার লোক শুনেছে–স্বামী-স্ত্রীতে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল রাত্রে। সকালবেলা জানা গেছে। অধ্যাপকজায়া আত্মহত্যা করেছেন। ফুকস্ যখন ফিরে এল তখনও মৃতদেহের সকার হয়নি।

ক্লাউস ফুকস-এর মানসিক অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। রুদ্ধদ্বারকক্ষে একা বসে রইল সে সারাটা দিন। প্রফেসর কার্ল-এর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারল না। কতটা জানেন তিনি? কতটা বলে ফেলেছে রোনাটা? এমনটা যে হবে, তা কে ভেবেছিল? সে বসে বসে সে-রাত্রের কথাটা ভাবেনাঃ। সে ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোনাটাকে বাধ্য করেনি। অত বড় জানোয়ার সে নয়। মনে পড়ে যায় অনেক অনেকদিন আগেকার সেই কথা। সেদিনও ওর চুম্বন-উদ্যত আনত মুখটা। ঠেলে দিতে চেয়েছিল প্রথমে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। ঠিক সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি কি আবার হয়নি এবার? তাহলে এমন কাণ্ডটা কেন করল রোনাটা? তবে কি হেতুটা ক্লাউস নিজে নয়–প্রফেসর কার্ল? রোনাটা কি বুঝতে পেরেছে, প্রফেসর কার্ল এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক? দেশের প্রতি, মুক্ত পৃথিবীর প্রতি জঘন্যতম অপরাধ করেছে যে-মানুষটা তার সহধর্মিণী হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না রোনাটা।

হঠাৎ ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোনটা।

মদের পাত্রটা নামিয়ে রেখে ক্লান্ত ফুকস্ টেলিফোনটা তুলে নেয়। সিকিউরিটি অফিসার জেমস্ আর্নল্ড একবার দেখা করতে চান। অবিলম্বে। ফুকস্ রীতিমতো বিরক্তি প্রকাশ করে বললে, মাপ করবেন, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত। আজ আমি কোনো কথা বলতে পারব না।

–আপনিই বরং মাপ করবেন আমাকে। আপনার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছি। ডক্টর, কিন্তু আমি নিরুপায়। ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি। আমি একবার আসছি।

পুলিসের লোক। ’না’ বললে শোনে না। ওরা মানুষের সুখ-দুঃখ-অনুভূতির ধার ধারে না।

একটু পরেই এসে উপস্থিত হল জেমস্ আর্নল্ড। বললে, আমি জানি মিসেস কার্ল ছিলেন আপনার বাল্যবান্ধবী। তার এমন পরিণামে আপনি যে কতটা মর্মাহত তা অনুমান করতে পারি। কিন্তু ইতিমধ্যে এমন কতকগুলি ব্যাপার ঘটেছে যাতে আপনাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হচ্ছি।

ফুকস্ পানীয়টুকু গলাধঃকরণ করে বললে, বলুন। আমি প্রস্তুত।

-পারিতে অথবা পথে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে দেখেছেন আপনি?

অম্লানবদনে ফুকস্ বললে, না, তেমন কিছু তো আমার নজরে পড়েনি।

 মিসেস কার্ল কেন আত্মহত্যা করলেন কিছু অনুমান করতে পারেন?

–না।

-ফর য়োর ইনফরমেশন ডক্টর, ঘটনার পূর্বদিন রাত্রে কলহের সময় ওঁরা বার বার যে শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন, রুদ্ধদ্বার কক্ষের বাইরে তা মনে হয়েছে-ট্রেইটার, বিশ্বাসঘাতক।

 ফুকস্ নির্লিপ্তের মতো বললে, দাম্পত্য-কলহে ও শব্দটা এমন কিছু অপ্রত্যাশিত নয়। যে কোনো পক্ষ যখন মনে করে অপরপক্ষ তার প্রেমের মর্যাদা দিচ্ছে না তখন ওই শব্দটা ব্যবহার করে।

আর্নল্ড ঘরোয়া হতে চায়। হেসে বলে, আপনি ব্যাচিলার হয়েও তো অনেক খবর রাখেন।

ফুকস্ কিন্তু হাসে না। নীরবে আর এক পাত্র মদ ঢালতে থাকে।

-কিন্তু ব্যাপারটার ওখানেই শেষ হয়নি ক্লাউস ফুকস। পরদিন ওঁদের মেডসার্ভেন্ট ডরোথি যখন প্রশ্ন করে গৃহকর্ত্রী এমনভাবে আত্মহত্যা করলেন কেন, তখন অসতর্ক মুহূর্তে প্রফেসর বলেছিলেন-রোনাটা বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে ঘর করতে চায় না বলে।

ফুকস্ চমকে ওঠে। বলে, বলেন কী। তারপর? প্রফেসর এ কথার কী জবাবদিহি করছেন?

করছেন না। তিনি কোনো জবানবন্দি দেননি এবং দেবেন না বলেছেন।

–আই সি।

আর্নল্ড এতক্ষণে বোতল থেকে নিজের পাত্রে মদ ঢালে। আরও ঘনিয়ে বসতে চায় সে। প্রশ্ন করে, আপনি অমনভাবে চমকে উঠলেন কেন ডক্টর?

–চমকে উঠলাম? কই না তো? চমকে উঠব কেন?

–আমার মনে হল যেন আপনি বলতে চাইছেন মিসেস কার্ল শুধু দাম্পত্য জীবনের বিশ্বাসঘাতকতার প্রসঙ্গে কথা বলেননি।

ফুকস্ জবাব দেয় না। সে আরও সতর্ক হয়ে ওঠে।

–আর একটা কথা। পারির হোটেলে কি আপনি এমন একজন বৃদ্ধকে দেখেছিলেন, যাঁকে দেখতে অবিকল প্রফেসর কার্লের মতো, অথচ তার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে?

অম্লানবদনে ফুকস বললে, কই না তো।

–রোনাটা মারা যাবার পর প্রফেসরের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?

হয়েছে। মামুলি সান্ত্বনার কথা ছাড়া আর কিছুই আলোচনা হয়নি।

 হঠাৎ কেন উনি পারি থেকে হারওয়েলে ফিরে এলেন তা জানাননি?

-না। প্রশ্নটা করবার অবকাশ পাইনি। উনি আর একটু মানসিক স্থৈর্য ফিরে পেলে জিজ্ঞাসা করব।

করবেন। তিনি কী বলেন জানাবেন আমাকে।

 –জানাব।

***

ওকে প্রশ্ন করতে হয়নি। প্রফেসর নিজেই বলেছিলেন। রোনাটাকে সমাধিস্থ করার পরে একদিন প্রফেসর কার্ল এসে দেখা করলেন ফুকসের সঙ্গে। বললেন, তুমিই এবার হারওয়েলে নাম্বার ওয়ান হলে। স্যার জন কক্ৰক্ট অবসর নিচ্ছেন শুনেছ নিশ্চয়, আর আমিও পদত্যাগ করছি।

–পদত্যাগ করছেন? আপনি। কেন?

 –আমি চিরদিনের জন্য হারওয়েল ছেড়ে চলে যাচ্ছি, ক্লাউস।

 –কেন স্যার?

–তোমাকে তো আগেই বলেছি জুলি–প্রত্যেক ক্রিশ্চিয়ানের জীবনে এমন একটা ‘ক্রস্’ থাকে যার ভার তাকে নিজেকেই বইতে হয়।

–আমাকে সব কথা খুলে বলবেন?

-বলতেই তো এসেছি। তবে সব কথা নয়। কারণ সবটা আমার নিজের কথা নয়–

-তবে কার? রোনাটার?

-না, আমার যমজ-ভাইয়ের। রোনাটার সব কথা তোমাকে খুলে বলতে আমার আপত্তি নেই। সে কথা শোনার অধিকার তোমার আছে। কী জানতে চাও বলো?

ফুকস্ কোন ইতস্তত করল না। সরাসরি চরম প্রশ্নটা একেবারে প্রথমেই পেশ করে বসে, রোনাটা আপনার সন্তানের জননী হয়নি কেন? অসুস্থ ছিল কে? আপনি না রোনাটা?

বৃদ্ধ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বিদ্ধ করেন প্রশ্নকারীকে। প্রতিপ্রশ্ন করেন, রোনাটা বলেনি তোমাকে?

–না। সে শুধু বলেছিল–বিবাহের আগেই আপনি নাকি কথা দিয়েছিলেন, আপনার সন্তানের জননী হতে হবে না তাকে।

-হ্যাঁ, ঠিক কথা। ওইরকম একটা প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছিলাম।

 –কিন্তু কেন? কেন?

-কারণ কোনো সন্তানের পিতা হবার মতো শারীরিক ক্ষমতা আমার নেই। অ্যালিসের মাকে বিবাহ করে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম আমি।

ফুকস্ অসহিষ্ণুর মতো মাথা ঝাঁকিয়ে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, তবে সব জেনেশুনে কেন ওই বাইশ বছরের মেয়েটির এতবড় সর্বনাশ আপনি করলেন? এজন্য পরলোকে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে না?

ম্লান হাসলেন কার্ল। বললেন, পরলোক। তুমি মানো?

-না, মানি না, আমি মানি না, কিন্তু আপনি তো মানেন। এজন্য নিজেকে দায়ী। মনে করেন না?

শান্ত সমাহিত কণ্ঠে অধ্যাপক বললেন, না। এজন্য আমি দায়ী করি তোমাকে।

–আমাকে?

–হ্যাঁ, তোমাকে। এবার তুমি জবাবদিহি কর কেন ওই বাইশ বছরের মেয়েটার এতবড় সর্বনাশ করলে তুমি? কেন তাকে বিবাহ করনি? কেন তাকে বাধ্য করলে আমার সঙ্গে এমন অস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে?

ক্লাউস দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। জবাব জোগালো না তার মুখে।

বৃদ্ধ তখন একে একে বলতে থাকেন তার অভিজ্ঞতার কথা। অসঙ্কোচে। যেন চার্চে এসে ‘কনফেস্’ করছেন। যেন ক্লাউস ওখানে উপস্থিত নেই। তিনি তাঁর বিচারকের সামনে সব কিছু মনের ভার উজাড় করে দিচ্ছেন :

যৌবনের ঊষাযুগে একটি কলেজে-পড়া প্রাণচঞ্চল মেয়ে ভালোবেসেছিল একটি যুবককে। একই বাড়িতে থাকে ওরা, একই বয়সী প্রায়। ওদের মন জানাজানি হল। তারপর ছেলেটি হঠাৎ একদিন বাঁধন ছিঁড়ে সরে পড়তে চাইল। মেয়েটি প্রাণপণ বলে তাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল–নির্লজ্জের মতো বলেছিল, আমায় বিবাহ করো। ছেলেটি শোনেনি। প্রত্যাখ্যান করার একটা মনগড়া কৈফিয়ও দেখায়নি। পাথরের দেয়ালে মাথা খুঁড়ে ফিরে এসেছিল মেয়েটি। তারপর অনেক। পুরুষ এসেছে তার জীবনে, কিন্তু সে তার প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারেনি। বাবা মারা গেলেন–ভাইবোনেরা প্রতিষ্ঠিত হল জীবনে, বিয়ে করল। ও স্থির করল–আজীবন বিবাহ করবে না। সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে। নান’ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই সংকল্পটাও তার হারিয়ে গেল, যখন অ্যালিসের মা ছয়মাসের শিশুকন্যাটিকে রেখে মারা গেলেন। পিতৃবন্ধু আত্মভোলা অধ্যাপক অটো কার্লকে দেখে মায়া হল মেয়েটির। মা-হারা মেয়েটিকে সে বুকে তুলে নিল। সে নিজেই হতে চাইল অ্যালিসের মা। প্রফেসর কালই বরং আপত্তি করেছিলেন। বয়সের পার্থক্যের জন্য নয়, যৌনজীবনে তিনি যে অশক্ত তা বুঝতে পেরেছিলেন অ্যালিসের মাকে বিবাহ করে। সত্যাশ্রয়ী প্রফেসর নির্দ্বিধায় সব কথা খুলে বলেছিলেন রোনাটাকে। পরিবর্তে রোনাটাও খুলে বলেছিল তার জীবনের গোপনতম লজ্জার কথাটা। সে প্রত্যাখ্যাতা। বলেছিল, প্রফেসর, সন্ন্যাসিনী হতে চেয়েছিলাম আমি, তা এও তো একরকম সন্ন্যাসিনীর জীবন। অন্তত–দুজনেই নিঃসঙ্গতার হাত থেকে তো মুক্তি পাব। আপনার বিধবা মেয়ে থাকলেও তো তাকে বাড়িতে থাকতে দিতেন।

বৃদ্ধ চুপ করলেন। ফুকস্ তখনও বসে আছে স্থাণুর মতো। কিন্তু রেহাই দিলেন না তাকে অধ্যাপক কার্ল। বললেন, সত্যি করে বল তো জুলি, কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলে তাকে?

ফুকস উঠে দাঁড়ায়। নীরবে পায়চারি করে কয়েকবার। তারপর বলে, প্রফেসর। প্রত্যেকের জীবনেই এমন একটা ‘ক’ থাকে যার ভার তাকে একাই বইতে হয়–

চীৎকার করে ওঠেন বৃদ্ধ : না। ওকথা বলার অধিকার তোমার নেই। ওটা ক্রিশ্চিয়ানের কথা। তুমি খ্রিস্টান নও। তুমি নাস্তিক। ক্রস’ বইবার অধিকার তোমার নেই।

-আমি নাস্তিক। কে বলেছে আপনাকে?

 প্রফেসর কার্ল নীরবে একটি ভোলা চিঠি বার করে ওর হাতে দিলেন। রোনাটার পত্র। শেষ পত্র। লিখে গেছে তার স্বামীকে। সম্বোধন করেছে, ‘মাই ডিয়ার ওল্ড ড্যাডি’ বলে। অকপটে সে স্বীকার করেছে তার পারির শেষ রজনীর অভিজ্ঞতা। সবিস্তারে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। লিখেছে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি এ দুর্ঘটনা ঘটত তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতাম। তাহলে মিসেস অটো কার্লের পরিচয় বহন করেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তা তো হয়নি। আই ওয়াজণ্ট রেপড। আই কোয়াপরেটেড। অ্যান্ড আই এঞ্জয়েড দ্য অর্গাজম। দ্যাটস্ হোয়াই আই হ্যাভ সিনড।

বুকের ভিতর মুচড়ে উঠল ফুকস-এর। রোনাটা আত্মহত্যা করেনি–ক্লাউস তাকে হত্যা করেছে! মাথাটা সে আর তুলতে পারে না।

–ইউ নিডন্ট ব্লাশ, মাই বয়। আমি অস্বাভাবিক কিন্তু তোমরা দুজনে যা করেছ তাই তো স্বাভাবিক। টেক ইট ইজি।

তাই কি নেওয়া যায়? দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে ফুকস।

প্রফেসর অন্যমনস্কের মতো বলেন, রোনাটাকে আমি ভালোবাসতাম। প্রয়োজনে প্রটেস্টান্ট হয়েও তার মুখ চেয়েই তাকে ডিভোর্স করবার সংকল্প করেছিলাম। কথাটা তাকে বলা হয়নি। তোমাদের মন জানাজানির একটা সুযোগ করে দেবার জন্যই এভাবে একা পালিয়ে এসেছিলাম পারি থেকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না–

ফুকস্ এবার মুখ থেকে হাতটা সরায়। আর্তকণ্ঠে বলে, প্লিজ প্রফেসর। আমি একটু একা থাকতে চাই।

তৎক্ষণাৎ উঠে পড়েন অধ্যাপক। পকেট থেকে একটি দেশলাই বার করে জ্বালেন। এক মিনিটের ভিতরেই রোনাটার শেষ পত্রখানি অঙ্গারে পরিণত হল।

***

এর পরের অধ্যায়টা করুণ।

ক্লাউস ফুকস-এর পরিবারে একাধিক লোক যে পাগল হয়ে গিয়েছিল, এতদিন পরে সে কথা মনে পড়ল তার। ওও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? কারা যেন ওর চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। তারা কথা বলে। কী বলে তাও বুঝতে পারে না। ও তাদের সঙ্গে তর্ক করে। বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না। কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলে না। আর্নল্ড মাঝে মাঝে আসে। বিরক্ত করে। একদিন এসে বললে, আমি নিশ্চিন্তভাবে জানি, প্রফেসর কার্ল আপনাকে রোনাটার শেষ পত্রখানা। দেখিয়েছিলেন। অস্বীকার করতে পারেন?

চীৎকার করে ওঠে ফুকস, হা, দেখিয়েছিলেন। কী হয়েছে তাতে?

–হয়নি কিছু। কী ছিল সেই চিঠিতে? বিশ্বাসঘাতক কে? কীসের? কেন?

–বলব না। প্রফেসর কার্ল ইংল্যান্ড ছেড়ে যাবার পাসপোর্ট পেলেন না। সব কথা খুলে না বলা পর্যন্ত তাকে নজরবন্দি করে রাখা হল সমুদ্র-মেখলা গ্রেট ব্রিটেনের মুক্ত কারাগারে। ছায়ার মতো গুপ্তচর ঘুরছে তার পিছনে দিবারাত্র। আর একটি প্রমাণ, একটি ইঙ্গিত পেলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। ডেক্সটাররূপে তাঁকে শনাক্ত করা যাবে। তার আর দেরি নেই। ইলেকট্রিক-চেয়ার আর প্রফেসর কার্ল-এর মধ্যে বৈদ্যুতিক তারের সামান্য একটু ফাঁক। তবু উনি অনমিত। কোনো জবানবন্দি দেবেন না, কোনো স্বীকৃতি জানাবেন না। না, ডেক্সটার কে তা উনি জানেন না। অ্যাটমিক-এনার্জির গুপ্তচরদলের কোনো সংবাদই তিনি রাখেন না। তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হল অবশ্য। এখন ব্যাঙ্কের জমানো অর্থই বাকি জীবনের পাথেয়। এ অবস্থায় কে তাকে নতুন চাকরি দেবে?

ফুকস্ আবার অনুভব করে তার চতুর্দিকে অদৃশ্য চক্ষুর মিছিল এসে জুটেছে। দিবারাত্রি কারা যেন তাকে পাহারা দিচ্ছে। দিক। সে ক্ষেপ করে না। সে কোনো কথা স্বীকার করবে না। কারও কাছে নয়। কিন্তু রোনাটা? তার কাছে যে একটা কৈফিয়ৎ আজও দেওয়া হয়নি।

স্লিপিং পিল আর মদের মাত্রা বাড়ল। তবু ঘুম আসে না। জীবনের উদ্দেশ্যটাই বুঝি হারিয়ে গেছে। কী হবে বেঁচে থেকে? এভাবে বেঁচে থেকে? ঈশ্বরে তার। বিশ্বাস নেই। রোনাটার ছিল, ওর বাবার ছিল। তারা সুখী। রোনাটা বলেছিল যিসাস একদিন ওকে মেষশাবকের মতো বুকে টেনে নেবেন। যত সব বুজরুকি। যিসাস কে? দু-হাজার বছর আগেকার একটা বদ্ধ পাগল। পাগলামির ফলও পেয়েছে। ঝুলতে হয়েছে ক্র থেকে। তার চেয়ে অনেক কাজের লোক প্রমিথিউস, জিয়ুসের কজা থেকে সে আগুনটাকে চুরি করে এনেছিল। অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি। ধরা পড়েছিল সেই। ঈগলে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল তার নাড়িভুড়ি। দূর! এসব কী আবোলতাবল ভাবছে সে পাগলের মতো? পাগলের মতো। সে কি তবে পাগল হতে বসেছে?

***

-আমি নিশ্চিতভাবে জানি, প্রফেসর কার্ল আপনাকে রোনাটার শেষ পত্রখানা দেখিয়েছেন। কী ছিল তাতে? বিশ্বাসঘাতক কে? কীসের? কেন?

-বলব না! বলব না! বলব না! এবং বেশ করব বলব না।

***

কেন বলবে? সে যে নিদারুণ লজ্জার কথা। তার, রোনাটার আর প্রফেসর কার্ল-এর। কী নির্লজ্জ অশ্লীলভাষায় খোলাখুলি লিখেছিল রোনাটা ওই চিঠিখানা। যেন বটতলার উপন্যাস লিখেছে। বের হলেই হু হু করে বিক্রি। কিন্তু রোনাটাকে যে সেই কৈফিয়তটা দেওয়া হয়নি। কেন সে তার প্রথম প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। রোনাটা কি একবার সামনে এসে দাঁড়াতে পারে না? মন উজাড় করে ওকে সব কথা বলে ফেলার একটা সুযোগ দিতে পারে না? আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে–বাস্তবে পরলোক আছে। আত্মা অবিনশ্বর। হয়তো রোনাটা শুনতে পাবে তার কথা।

–আমি নিশ্চিন্তভাবে জানি, আপনি প্রফেসর কার্ল-এর গুপ্তরহস্যটা জেনে ফেলেছেন।

–হ্যাঁ ফেলেছি।

তবে স্বীকার করুন–তিনিই ডেক্সটার।

–আঃ। কী বিড়ম্বনা। তা কেন হবে? হতে পারে তার যমজ ভাই রাশিয়ান গুপ্তচর। তাই তার পিছনে গুপ্ত-আততায়ী ঘুরছে। তার মানে এ নয় যে, তিনিই সেই ডেক্সটার।

-তবে কে? তুমি জান। বল খুলে সব কথা।

–হ্যাঁ জানি। কিন্তু আমি বলব না।

–জান? তুমি জান–ডেক্সটার কে?

–বলছি তো, জানি। তবে বলব না আমি, এবং বেশ করব বলব না।

–বলবে। বলতে তোমাকে হবেই। আমাদের না বলো রোনাটাকে বলে দাও। বি এ ট্রু ক্রিশ্চিয়ান। নিজের ক্র নিজেকেই বইতে হবে যে তোমাকে।

***

মধ্যরাত্রে একদিন উন্মাদের মতো এসে হাজির হল ফুকস জেমস আর্নল্ডের অ্যাপার্টমেন্টে। দ্বার খুলে ওকে দেখতে পেয়ে বিন্দুমাত্র বিস্মিত হল না আর্নল্ড। বললে, আসুন, আপনার জন্যই জেগে বসেছিলাম। আমি জানতাম, আপনি আসবেন।

–আপনি জানতেন? জানতেন, আমি আজ রাত্রে আসব?

–আজ রাত্রেই আসবেন তা জানতাম না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে আসবেন তা জানতাম। এতদিনে মনস্থির করেছেন? বলবেন সব কথা খুলে?

-বলব। এখনই—

বলুন তবে।-কাগজ কলম টেনে নেয় আর্নল্ড।

–না, আপনাকে বলব না। বলব রোনাটাকে।

–রোনাটাকে!?–বিহ্বল হয়ে পড়ে আর্নল্ড।

–হ্যাঁ। একটা টেপ-রেকর্ডার বসিয়ে দিন ওই টেবিলটায়। অনেকগুলো বিল রেখে যান। আর হ্যাঁ–এক বোতল হুইস্কি। ফর হেভেনস্ সেক, আমাকে কোনোভাবে ডিসটার্ব করবেন না। বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ঘণ্টা দু-তিন পরে ফিরে এসে টেপটা বাজিয়ে শুনবেন।

–অ্যাজ য়ু প্লিজ, স্যার।

আর্নল্ড তৎক্ষণাৎ যন্ত্রটা বসিয়ে দেয় ওর সামনে। হুইস্কির বোতল আর গ্লাসটা রাখে হাতের কাছে। মানবচরিত্র সে ভালোরকমই বোঝে। আন্দাজ করে, এখন এই অর্ধোন্মাদ অবস্থায় ফুকস্ যদি স্বেচ্ছায় সব কথা স্বীকার করে তবেই রহস্যটা পরিষ্কার হবে। রাত পোহালে হয়তো তার মতটাও পালটে যাবে। তখন আর কিছুতেই নাগাল পাওয়া যাবে না তার।

নির্জন ঘরে তার প্রথম-প্রেমের মুখোমুখি বসল ডক্টর ক্লাউস ফুকস্। মাইকটাকে চুম্বন করল। তারপর ফিসফিস করে ডাকল, রোনাটা। রোনাটা।

.

০৮.

আমাদের বংশে কিছু পাগল আছে, জানলে রোনাটা? আমার বাবা হচ্ছেন এক নম্বর পাগল। তাকে তো তুমি ভালো রকমই চেন। তার ধারণা তিনি হচ্ছেন অ্যাটলাস-জগদ্দল এক পৃথিবীর ভার বহন করতেই তিনি এসেছেন এ দুনিয়ায়। জিয়ুস বুঝি হুকুম দিয়েছে–ওটা ঘাড়ে করে চুপচাপ বসে থাক। ব্যস। বাবা ডাইনে। তাকান না, বাঁয়ে তাকান না–জগদ্দল পৃথিবী ঘাড়ে করে বসে আছেন সারাটা জীবন। আর এক পাগল ছিল প্রমিথিয়ুস। তাকে তুমি চেন না। তার কথা থাক। এছাড়া আমার ছোটো বোন এবং মা-ও পাগল হয়েছিল। আমি কিন্তু তা-বলে পাগল নই। এ আমার আদৌ পাগলামি নয়। ধীর স্থির মস্তিষ্কে সব কথা তোমাকে জানাতে এসেছি। আমি এটুকু বুঝি–তুমি একা নয়, ওরাও এটা জানবে। তা জানুক। আজ গোটা পৃথিবীটাকে ডেকে এ কথা শোনাতে চাই–আমার কথা, তোমার কথা। ভেবে দেখলাম এ ছাড়া পথ নেই। তোমার ‘ড্যাডি’-কে না হলে ওরা মুক্তি দেবে না। এখনই তো প্রায় অন্তরীণ হয়ে আছেন, দুদিন পরে ওঁকে জেলে পুরবে। ওদের যে ধারণা হয়েছে–তিনিই সেই বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক ডেক্সটার। কথাটা সত্য নয়। বিশ্বাস করো রোনাটা–কথাটা সত্য নয়। ওরা ভুল বোঝে বুঝক–কিন্তু তুমি কেমন করে বিশ্বাস করলে–তোমার ড্যাডি এতবড় পাপকাজটা করবেন?

-কী বললে? তা হলে কে সেই ডেক্সটার? আমি চিনি কি না? হ্যাঁ, আমি চিনি। না–রিচার্ড ফাইনম্যান নন, রবার্ট ওপেনহাইমার নন, প্রফেসর অটো কার্লও নন। ডেক্সটার হচ্ছে সেই হতভাগ্য যার বাহুবন্ধনে তুমি ধরা দিয়েছিলে : ডক্টর এমিল জুলিয়াস ক্লাউস ফুকস্।

-প্লিজ রোনাটা। ও-ভাবে ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিও না। আমার কথাটা শেষ পর্যন্ত শোনো। একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করি, কেমন?

***

-তুমি জান, আমার জন্ম ফ্রাঙ্কফুর্ট-এর কাছাকাছি একটা গ্রাম-রাসেলশীম-এ 1912তে। না, পঁচিশে ডিসেম্বর নয়, তার চারদিন পরে। প্রচণ্ড শীতের রাত্রে। আমরা দুই ভাই, দুই বোন। দাদা গেহার্ড, দিদি ক্রিস্টি, আমি, আর আমার ছোটো বোন লিজা। বাবা ছিলেন পাদরি–প্যাস্টর এমিল ফুকস। খ্রিস্টান ধর্মযাজক হয়েছিলেন অনেক পরে–উনিশ শ পঁচিশে; আমার বয়স তখন বছর তেরো। তার আগে তিনি ছিলেন একটি কারখানার মেশিনম্যান। লেদ আর ওয়েল্ডিং-এর দক্ষ কারিগর। সে-যুগের কথা তুমি জান না। তুমি যখন তাকে দেখেছ তখন তিনি কোয়েকার্স সম্প্রদায়ভুক্ত। বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী–সোসাইটি অব ফ্রেন্ড এর একজন কর্ণধার। আমি তাকে মিস্ত্রী হিসাবেও দেখেছি।

একদিনের কথা মনে পড়ছে। তখন আমার বয়স কত হবে? এই ধর ছয়-সাত। আমরা থাকতাম ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছাকাছি একটা কারখানার বাড়িতে। দু কামরার একটা ছোট্ট বাড়িতে। সৎ ও দক্ষ কর্মী হিসাবে কারখানায় বাবার খুব সুনাম ছিল। সবাই তাকে খুব শ্রদ্ধা করত। এই সময় আমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোকের কুকুরের বাচ্চা হল। ভারি সুন্দর বাচ্চাগুলো। লোমে ভর্তি। আমি আর লিজা রোজ ওই কুকুরছানাগুলোকে দেখতে যেতাম। ভদ্রলোকের নামটা আজ আর মনে নেই, তবে তার চেহারাটা মনে আছে। আমাদের পাড়ার মনিহারি দোকানের মালিক, মধ্যবয়সী, মোটা, একমাথা টাক। রোজ আমাদের ভাইবোনকে কুকুরের লোভে আসতে দেখে উনি একদিন নিজে থেকেই বললেন, কী খোকা? একটা কুকুরছানা নেবে?

আমি তো লাফিয়ে উঠি? বলি, দেবেন?

–দেব। তবে বিনা-পয়সায় নয়। দাম দিতে হবে। এক মার্ক।

এক মার্ক কতটা তখনও বুঝি না। তবে বামা-মা দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসেন। একটা মার্ক কি আর দেবেন না? আমি নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে আসি। মাকে বলি, মা একটা মার্ক দেবে? ওই দোকানদার ভদ্রলোক তাহলে আমাকে একটা কুকুরছানা দেবেন বলেছেন।

মা জানতেন, কুকুরছানাটা আমার প্রাণ। তৎক্ষণাৎ এক ডয়েশমার্ক আমার হাতে দিলেন। আবার নাচতে নাচতে আমি ভদ্রলোকের কাছে ফিরে গেলাম। উনি বোধহয় আশা করেননি আমি বাড়ি থেকে একটা ডয়েশমার্ক নিয়ে আসতে পারব। আসলে কুকুরছানাটা হস্তান্তরের কোনো বাসনাই ছিল না তার। শুধু শুধু বাচ্চা পেয়ে আমাকে নাচাচ্ছিলেন। এখন কায়দা করে বললেন, এরকম মার্ক-এ তো হবে না খোকা। দেখছ না, আমার কুকুরের লেজ নেই। ডয়েশমার্কেও ‘টেইল’ থাকলে চলবে না। এমন মার্ক আনতে হবে যার দু-দিকেই হেড অর্থাৎ দুদিকেই কাইজারের মুখ ছাপা।

আমি অভিমান করে বলি, সে কথা আগে বললেই হত।

আবার ফিরে এলাম বাড়িতে। মাকে বলি, এ মার্কে হবে না মা, কুকুরের যে লেজ নেই। দু-মুখে রাজার ছাপওয়ালা মার্ক একটা দাও।

মা তো আমার মতো পাগল নন। বললেন, অমন মার্ক হয় না বাছা। ও-লোকটা তোমাকে কুকুরছানা দেবে না, তাই এমন অদ্ভুত দাবি করছে।

আমি কিছুতেই শুনব না। ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি। শেষমেশ মা আর মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে এক ঘা মেরেই বসেন আমাকে। অভিমানে আমি সারাদিন জলস্পর্শ করি না। মা অনেক সাধ্যসাধনা করলেন, টাকশালে কীভাবে মুদ্রা ছাপা হয় বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমিও অবুঝ। সারাটা দিন প্রায়োপবেশনেই গেল।

সন্ধ্যার পর বাবা ফিরলেন। প্যাস্টর ফুকস্ নন, লেদম্যান ফুক। মায়ের বিরুদ্ধে আমার এবং আমার বিরুদ্ধে মায়ের অভিযোগ মন দিয়ে শুনলেন। তারপর মাকেই ধমক দিলেন, তা তুমিও তো আচ্ছা বাপু। শুনছ কুকুরটার লেজ নেই। বাক্স খুঁজে দু-দিকে রাজার মুখওয়ালা একটা মার্ক ওকে দিলেই পারতে।

মা রাগ করে বললেন, তুমিও ওকে খেপিয়ে তুলছ! এমনিতে পাগল ছেলেটা সারাদিন খায়নি–

বাবা বাধা দিয়ে বললেন, তুমি থাম দেখি।

তারপর আমাকে বললেন, ঠিক আছে খোকা। কাল তোমাকে আমি অফিস থেকে অমন একটা মার্ক এনে দেব। চল, এবার আমরা খেয়ে নিই।

আমি সোৎসাহে বলি, তোমার অফিসে অমন দুমুখো মার্ক আছে?

–কত।

মা বাবাকে ধমক দেন, কেন নাচাচ্ছ ওকে? কাল আবার এই কাণ্ড হবে।

বাবা বললেন, সে তোমাকে ভাবতে হবে না। যাও, আমাদের দুজনের খাবার নিয়ে এস।

পরদিন সারাটা দিনমান আমি বাবার ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকি। সন্ধ্যার পর তিনি ফিরতেই আমি লাফিয়ে উঠি, আমার সেই দু-মুখো মার্ক?

বাবা অন্যমনস্কের মতো পকেট থেকে একটা মার্ক নিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কুড়িয়ে নিয়ে আমি একেবারে লাফিয়ে উঠি। দুদিকেই ‘হেড’, ‘টেইল’ নেই।

তখনই ছুটে বেরিয়ে গেলাম এবং মিনিট পনেরো পর কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলাম বাড়িতে।

দেখি, ইতিমধ্যে মা বাবার জন্য খাবার বেড়ে দিয়েছেন। বাবা কিন্তু খেতে বসেননি। আলমারি থেকে তাঁর দোনলা বন্দুকটা নিয়ে পরিষ্কার করছেন। আমি ফিরতেই বললেন–কী হল জুলি? কাঁদছিস কেন? কুকুরছানা কই?

আমি চোখ মুছতে মুছতে বলি, দিল না। বললে, এটা অচল মার্ক।

বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বন্দুকটাও তুলে নিলেন হাতে। বললেন, আয় দেখি আমার সঙ্গে।

মা পিছন থেকে ডাকেন, কোথায় যাচ্ছ? খেয়ে যাও। ও লোকটা কুকুরছানা দেবে না, বুঝতে পারছ না?

-খাবারটা তুলে রাখ। ফিরে এসে খাব।

আমার বয়স, আগেই বলেছি, তখন ছিল মাত্র ছয় কি সাত। তবু দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পাই আজও। বাবা ছিলেন অত্যন্ত শান্ত নম্র স্বভাবের মানুষ। কোনোদিন তাকে রাগতে দেখিনি। অথচ সেদিন তাকে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম। বাবার সেই রুদ্রমূর্তির সামনে দোকানদার ভদ্রলোক একেবারে কেঁচো। বাবা বললেন, আপনি মানুষ না জানোয়ার মশাই? আমার ছেলেকে কেন। এভাবে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়েছেন? জবাব দিন?

লোকটা আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু এটা যে অচল মার্ক স্যার।

–আমিও তো তাই বলছি। এমন মার্ক হয় না জেনেও তা কেন দাবি করেছিলেন আপনি? আপনি কী চান? জার্মানির সব শিশু বড় হয়ে আপনার মতো জোচ্চোর থোক?

-আমার মতো জোচ্চোর?

–জুয়াচুরি নয়। প্রথমত, অসঙ্গত দাবি, দ্বিতীয়ত, ও তা পূরণ করার পরেও আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রাখেননি। আপনি কুকুরছানাটি একে না দিলে আমি আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো। ‘পাবলিক’ নুইসেন্স হিসাবে মাজায় দড়ি পরাবো আপনার!

ভদ্রলোক হাত দুটি জোর করে বলেন, স্যার, নিয়ে যান আপনার কুকুরছানা। ওই অচল মার্কে আর আমার প্রয়োজন নেই। আমিই বরং উল্টে আপনাকে পাঁচ মার্ক দিচ্ছি–শুধু বলে যান, অমন একটা দু-মুখো মার্ক কোথা থেকে পয়দা করলেন আপনি?

কুকুরছানা নিয়ে আমরা ফিরে এলাম।

তুমি হয়তো ভাবছো এ-সব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক কাহিনি কেন শোনাচ্ছি তোমাকে। অসংলগ্ন-গল্প নয়, রোনাটা–এ কাহিনিটাও প্রাসঙ্গিক। আমি যা করেছি তা কেন করেছি বুঝতে হলে তোমাকে জানতে হবে কী ভাবে আমি গড়ে উঠেছি।

সেদিন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি কী পরিশ্রম করে দক্ষ কারিগরটি দুটি মার্ককে মাঝামাঝি মেসিনে চিরে আবার জোড়া দিয়েছিলেন। কেন? তার উদ্দেশ্য ছিল–তার সন্তান যেন জুয়াচুরি না শেখে। ছয় বছরের ছেলের কথার খেলাপ হতে দেবেন না বলে এতটা পরিশ্রম করেছেন। এইভাবেই তিনি আমার চরিত্রটা গঠন করতে চেয়েছিলেন।

***

আমার বয়স যখন তেরো, তখন বাবা কোয়েকার হলেন। বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী। চার্চের অনুষ্ঠানভিত্তিক ধর্মের ভড়ং নয়, তিনি যিসাস্-এর ওই একটি বাণীকেই মূলমন্ত্র করলেন–’ল্যভ দাই নেবার। বিশ্বপ্রেম। মানবপ্রেম মন্ত্র হল তার-ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে। আমাদের বাড়ির আর সবাই রাতারাতি ধার্মিক হয়ে উঠল–কেউ আন্তরিক, কেউ বাবাকে খুশি করতে। একমাত্র ব্যতিক্রম তেরো বছরের একটি কিশোর-প্রহ্লাদকুলে দৈত্য-এই জুলিয়াস ক্লাউস ফুকস্। মনে মনে আমি নিরীশ্বরবাদী ছিলাম। মনে করতাম ধর্ম একটা ভড়ং। বিজ্ঞানচর্চা শুরু করেছি তখন। যার প্রমাণ নেই তা মানি না। বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ দাও ঈশ্বর আছেন, তবেই মানবো, নচেৎ নয়। অবশ্য আমার এ মনোভাব কাউকে কখনও বলিনি। বাবা সেটা টের পেলেন আরও দু বছর পরে, আমার ষোড়শ জন্মদিনে।

জন্মদিনে বাবা আমাকে উপহার দিলেন যিসাস-এর একটা ছবি। ফ্রেমে বাঁধানো। আমার পড়বার টেবিলে সেটা রেখে দিলেন আর নিজে হাতে লিখে দিলেন সুইস বিদ্রোহী-কবি উইলিয়াম টেল এর একটি চার-লাইনের কবিতা :

চিরউন্নত বিদ্রোহী শির লোটাবে না কারও পায়ে।
তোমারেই শুধু করিব প্রণাম, অন্তরতম প্রভু!
 জীবনের শেষ শোণিতবিন্দু দিয়ে যাব দেশ-ভাইয়ে
রহিবে বিবেক। সে শুধু আমার। বিকাবো না তারে কভু।

বললেন, জুলি, এটাই আমার জীবনের ব্রত। এই ব্রতে তুমিও দীক্ষা নিও।

আমি জবাব দিইনি।

পরদিন বাবা ঘুম ভেঙে উঠে দেখলেন যিসাসের ছবিখানি তার টেবিলের ওপর রাখা। কারণটা জানতে আমার ঘরে উঠে এলেন–দেখলেন ওই কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা আমি মুছে দিয়েছি।

বাবা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন এর হেতু কী।

আমি কবিতার শেষ পংক্তিটা আবৃত্তি করলাম মাত্র।

বাবা কিন্তু রাগ করেননি। দীর্ঘসময় আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন–কিন্তু আমার মত পরিবর্তন করতে পারেননি। বিজ্ঞান যা জানতে পারেনি আমি তা কিছুতেই মানতে পারলাম না।

আমি নিরীশ্বরবাদী হওয়ায় বাবা নিশ্চয় দুঃখিত হয়েছেন, আহত হয়েছেন–কিন্তু জোর-জবরদস্তি করেননি। মেনে নিয়েছেন আমার যুক্তি। তিনি বলতেন, সময় হলেই প্রভু যিশু মেষশাবকের মতো তোমাকে কোলে টেনে নেবেন।

***

লাইপজিগ কলেজে ভর্তি হলাম। ওই সময়েই কার্ল মার্কস্ পড়তে শুরু করি। দাস কাপিটাল এবং এঙ্গেলস-এর ভাষ্য। এতদিনে পথের সন্ধান পেলাম। হাতে পেলাম আমার বাইবেল। আমি কম্যুনিস্ট হলাম। মনে-প্রাণে। কলেজে পার্টি-পলিটিক্সে যোগ দিয়েছি। সক্রিয় অংশ নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হেরে গেলাম আমরা। ন্যাশনাল সোসালিস্টরা ক্ষমতা দখল করল। অর্থাৎ হিটলারের নাৎসি পার্টি। 1933এ একদিন কিয়েল থেকে ট্রেনে করে বার্লিন যাচ্ছি হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলাম ওরা রাইখস্ট্যাগে আগুন দিয়েছে। কম্যুনিস্ট ছাত্রদের ধরে ধরে হত্যা করছে। তৎক্ষণাৎ কোটের হাতা থেকে আমি পার্টি-ব্যাজটা খুলে ফেললাম। কলেজে আর গেলাম না। শুরু হল আমার আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন। প্রথমে মাসদুয়েক জার্মানিতেই ছিলাম। পালিয়ে পালিয়ে। শুনলাম, আমাদের বাড়িতে নাৎসি ছাত্ররা চড়াও হয়েছিল। হামলা করেছে বাবার ওপর। কলেজের হস্টেলেও আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। ধরা পড়লে ওরা নিশ্চয় আমাকে হত্যা করত। কিন্তু ওরা আমাকে ধরতে পারেনি। সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলাম ফ্রান্সে। পারিতে ছিলাম প্রথমে, তারপর উদ্বাস্তু হিসাবে চলে গেলাম ইংল্যান্ডে।

এর পরের অধ্যায়টা তুমি জান। আশ্রয় পেলাম একটি কোয়েকার্স পরিবারে। ওই পরিবারের একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেললাম। মেয়েটিও আমাকে তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু আমি যে তার আগেই আমার জীবনের ব্রত স্থির করে ফেলেছি। বাবা ছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী, আমি বিশ্ব-সাম্যবাদের। আমার জীবনের লক্ষ্য হল হিটলারকে তাড়িয়ে আমরা, কম্যুনিস্টরা, বার্লিন দখল করব। আমার সে স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে, রোনাটা। 1945এর তিরিশে এপ্রিল সেই রাইখস্ট্যাগের ওপর কাস্তে-হাতুড়ি-আঁকা লাল পতাকাটা আমরা উড়িয়েছি।

কিন্তু এ কী জার্মানি ফেরত পেলাম আমরা? বার্লিনের মাঝামাঝি উঠল পাঁচিল। এপারেও জার্মানি ওপারেও জার্মানি–অথচ দুদিকের মানুষ আজ স্বদেশবাসী নয়। তাদের মাঝখানে আজ দুস্তর ব্যবধান।

মন্ত্রগুপ্তি জিনিসটা আছে আমার রক্তে। আমি যে সাম্যবাদের পূজারী তা ঘুণাক্ষরে জানতে পারেনি কেউ, আমি ইংল্যান্ড আসার পর। এখানে আমি ছিলাম ভালো ছেলে। ছাত্রানাম্ অধ্যয়নং তপঃ। দিনে আঠারো ঘন্টা বিজ্ঞান-চর্চা করেছি। সে তুমি দেখেছ। কিন্তু তুমিও জানতে পারনি আমি রাত জেগে রাজনীতির বই পড়তাম। মার্ক-এঙ্গেল-লেনিনের বাণী আমার কণ্ঠস্থ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও ছিল অনেক কম্যুনিস্ট। তাদের সঙ্গে আমি কিন্তু কোনো যোগাযোগ রাখিনি। কারণ আমি লুকিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। স্কটল্যান্ডইয়ার্ড তাই সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার সময় আমার বিরুদ্ধে কিছুই খুঁজে পায়নি। ছিল একটি মাত্র রিপোর্ট। হিটলারের গেস্টাপো-বাহিনি আমাকে ফেরত পাঠাতে বলেছিল প্রাকযুদ্ধ-যুগে। বলেছিল, আমি নাকি কম্যুনিস্ট। স্কটল্যান্ডইয়ার্ড সে রিপোর্টের ওপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করেনি কারণ নাৎসিরা তাদের বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই মিথ্যা কথা বলতো।

উদ্বাস্তু জীবনের প্রথমেই স্থির করেছিলাম, একলা চলার পথে চলব। তাই চলেছি সারাজীবন। এমন কি যে মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলাম তাকেও মন খুলে বলতে পারিনি আমার গোপন কথা। আমার জীবন উৎসর্গীকৃত। যে কোনোদিন আমি ধরা পড়ে যেতে পারি। তৎক্ষণাৎ অবধারিত মৃত্যু। তাই মেয়েটিকে গ্রহণ করতে পারিনি। তাছাড়া আরও একটি বাধা ছিল। সেটাও অনতিক্রম্য। আমরা ছিলাম বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। মেয়েটি পরম ঈশ্বরবিশ্বাসী, আমি চরম নাস্তিক। মেয়েটির কাছে ধর্মই ছিল জীবনের নিউক্লিয়াস; আমার জীবনে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সই ছিল ধর্ম। তথাকথিত ধর্ম আমার কাছে আফিঙের নেশা। কেমন করে মেলাবো বলো এমন বিপরীত মেরুর বাসিন্দাদের?

অথচ কী আশ্চর্য দেখ! কী অদ্ভুত ঘটনাচক্র। সেই মেয়েটির জীবন জড়িয়ে গেল আমার সঙ্গে নিবিড়ভাবে। আমার জন্যই জীবন দিল সে। আমিও আজ জীবন দিতে বসেছি তার জন্য।

বিশ্বাস কর রোনাটা-তোমার ড্যাডি, প্রফেসর কার্ল, এর সাতে-পাঁচে নেই। তার যমজভাই আজ রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসতে চান। কেন চান, তা জানি না। তিনিও প্রফেসর কাপিৎজার সহকর্মী। নিঃসন্দেহে তার কাছ থেকেই প্রফেসর কার্ল কাপিজার শেষ সংবাদটা পেয়েছিলেন, আমার কাছে স্বীকার করেননি। প্রফেসর কার্ল-এর ধারণা এবং আর্নল্ডের দৃঢ় বিশ্বাস–সেদিন তাকেই গুলি করে মারতে চেয়েছিল সেই আততায়ী। হয়তো তাকে হ্যান্স বলে ভুল করেছিল হত্যাকারী। আবার তা নাও হতে পারে। হয়তো আমাকেই মারতে চেয়েছিল সে।

1942এ আমি প্রথম রাশিয়ান গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। নিজে থেকে। কেমন করে জান? আমি সোজা চলে গিয়েছিলাম লন্ডনের রাশিয়ান এম্বাসিতে। ছদ্মবেশে। তখন আমি ব্রিটিশ অ্যাটমিক রিসার্চে নিযুক্ত। ওরা আমার কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এমন গুপ্তচর ওরা কখনও দেখেনি–যে স্বেচ্ছায় খবর দিতে আসে। বিনিময়ে যে অর্থ দাবি করে না। ওরা বললে, এর পর যেন কোনো কারণেই ওদের এম্বাসিতে না আসি। যোগাযোগ রক্ষা করত একটি ছেলে। তার আসল নামটা জানি না। ছদ্মনাম ছিল আলেকজান্ডার*। [* আসল নামটা ক্লাউস ফুকস কোনদিনই জানতে পারেননি। তার নাম ছিল দাভিনোভিচ ক্রেমার। রাশিয়ান। যুদ্ধান্তে সে রাশিয়ায় ফিরে যায়।] নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে সে হাজির হত। আমি তার হাতে তুলে দিতাম আমার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল। শুধু আমার নিজে হাতে করা এক্সপেরিমেন্টের কথাই তখন জানাতাম আমি। কারণ আমার বিবেক বলত, ওই গবেষণার ফলাফল আমার নিজস্ব সম্পত্তি। আমার মস্তিষ্ক থেকে যা বার হচ্ছে তার মালিকানা আমার নিজের। ছেলেটি আরও তথ্য জানতে চাইত। আমি জানতাম না। বলতাম, অপরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফলে আমার মালিকানা নেই। জানলেও তা আমি জানাব না:

 ‘রহিবে বিবেক। সে শুধু আমার। বিকাবো না তারে কভু।‘

 এর পরেই একটা আঘাত পেলাম। রাশিয়ান ছোকরার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলাম। আঘাতটা কী জান? স্তালিন হিটলারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন। অনাক্রমণাত্মক চুক্তি। আমি মরমে মরে গেলাম। স্তালিনকে কোনো দিন মহান নেতা বলে মনে হয়নি আমার। আমি বরং ছিলাম ট্রটস্কির ভক্ত। কিন্তু স্তালিন যখন রাশিয়ার একনায়ক হয়ে পড়লেন তখন বাধ্য হয়ে তাকে মেনে নিলাম। বিশ্বসাম্যের খাতিরে। হিটলারের সঙ্গে যেদিন স্তালিন চুক্তিবদ্ধ হলেন সেইদিনই ওই গুপ্তচরবৃত্তিতে ক্ষান্ত দিলাম। ওই বিবেকের নির্দেশেই।

কিন্তু ওখানে তো শেষ নয়। কালের রথচক্র আবার এক পাক ঘুরল। হিটলার আক্রমণ করে বসল সাম্যবাদের রাজ্য। যে পথ দিয়ে নেপোলিয়ন মৃত্যুর মুখে এগিয়েছিল ঠিক সেই পথ ধরেই এগিয়ে চলল হিটলারের ব্রিসক্রিগ বাহিনী। মস্কো তাদের লক্ষ্য। কম্যুনিজম-এর নাভিশ্বাস উঠেছে তখন। আমার বিবেক আবার পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি স্বেচ্ছায় আবার যোগাযোগ করলাম রাশিয়ান গুপ্তচরদের সঙ্গে। সাম্যবাদের এতবড় সর্বনাশ দেখে আমি আগের চেয়েও এক পা এগিয়ে গেলাম। যেসব আবিষ্কার আমার নয় তাও জানাতে শুরু করলাম ওদের।

এর পরের পর্যায় মার্কিন মুলুকে। স্যার জন কক্ৰট, চ্যাডউইক, প্রফেসর কার্ল প্রভৃতির সঙ্গে আমারও যাওয়ার কথা উঠল। আবার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হল। আবার তদন্ত হল। কিছুই পাওয়া গেল না–একমাত্র সেই নাৎসিদের ‘মিথ্যা’ দোষারোপখানা ছাড়া। ভাগ্যে ওদের মিথ্যাবাদী বলে বদনাম ছিল। চলে গেলাম আমেরিকায়। প্রথমে শিকাগো, পরে লস অ্যালামসে। এ ছাড়াও দু-একটি কেন্দ্রে যেতে হয়েছে আমাকে। লস অ্যালামসে এসে তোমার সাক্ষাৎ পেলাম। তুমি তো অবাক আমাকে দেখে। তার চেয়েও আমি অবাক মিসেস। কার্লকে দেখে। তখনও আমি জানতাম না প্রফেসর অটো কার্ল তোমার ‘ড্যাডি’, অ্যালিসের তুমি আন্টিও নও আসলে।

***

এর পরের ইতিহাস তোমার জানা। যেটুকু জান না তা এই :

আমার দুই বোন ছিল মনে আছে? ছোটো বোন লিজা আত্মহত্যা করে। সে ছিল আর্টিস্ট। ভারি সুন্দর ছবি আঁকত সে-ওয়াটার কালার, অয়েল এবং প্যাস্টেলে। বিয়ে করেছিল একজন রাশিয়ানকে–প্রাণচঞ্চল ফুর্তিবাজ কিটোস্কিকে। হঠাৎ নাৎসিদের হাতে সে ধরা পড়ে। লিজার সহায়তায় বন্দী শিবির। থেকে শেষ পর্যন্ত কিটোস্কি পলিয়ে যায়। সীমান্ত পার হয়ে চলে যায়–চেকোস্লোভাকিয়ায়। এবার নাৎসিরা অত্যাচার শুরু করল লিজার ওপর। লিজা তখন সদ্য-জননী। ওর কোলে তার প্রথম সন্তান রবার্ট–অর্থাৎ বব। মাত্র একমাসের শিশু। তার শরীর খুব দুর্বল। উপায়ান্তরবিহীন হয়ে সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে সে বাবার ওখানে পালিয়ে আসতে চাইল।

এই সময় আর একজন কমরেড এসে লিজাকে জানিয়ে গেল প্রাগে কিটোস্কি ধরা পড়েছে। তাকে নাকি নাৎসিরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। প্রথমে চোখ উপড়ে নিয়েছিল, তারপর এক-একটি করে তার সব দাঁত তুলে ফেলে–শেষে গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বেলে দেয়। লিজা পাগল হয়ে গেল শুনে। আমাদের বংশে সেই প্রথম পাগল হল। আমি তার আগে দেশ ছেড়েছি। দাদাও নিরুদ্দেশ। দিদি বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেছে। বাবা জেল থেকে সদ্য ছাড়া পেয়েছেন। অগত্যা বাবাকেই যেতে হল–পাগল মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। উন্মাদ মেয়েকে হাত ধরে নিয়ে আসছিলেন বাবা। কী একটা স্টেশনে সে হঠাৎ বাবার হাত ছাড়িয়ে একটা চলন্ত এঞ্জিনের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবার কোলে ছিল বব–এক মাসের শিশু। বাবা কিছু করতে পারলেন না। তার চোখের সামনেই লিজার দেহটা মাংসপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেল।

তুমি হয়তো বলবে : ঈশ্বর করুণাময়।

 বাবাও তাই বলতেন।

সবচেয়ে বড় কথা, লিজাকে ভুল খবর দেওয়া হয়েছিল। কিটোস্কি আদৌ ধরা পড়েনি। সে আজও বহাল তবিয়তে জীবিত। রাশিয়ায়। বিয়ে-থা করেছে, ঘর-সংসার করছে। শুনে এবারও বাবা বললেন : ঈশ্বর করুণাময়।

মা কিন্তু তা বললেন না। উল্টে এবার তিনি পাগল হয়ে গেলেন। তবে ঈশ্বর করুণাময় বলেই বোধকরি তাকে বেশিদিন কষ্ট পেতে হয়নি। এবার তিনিও আত্মহত্যা করে বসলেন। ল্যাটা চুকে গেলো।

দাদা নিরুদ্দেশ, আমি পলাতক, ক্রিস্টি আমেরিকায়–তা হোক। গোটা পৃথিবীর বোঝা যখন বইতে পারছেন তখন আর এ শাকের আঁটিটাকে কি আর কাঁধে নিতে পারবেন না? বৃদ্ধ অ্যাটলাস মানুষ করতে থাকেন মা-বাবা-হারা বকে। আমার কৌতূহল হয় জানতে ব-এর পড়ার টেবিলের ওপরও কি বাবা বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী উইলিয়াম টেস্-এর সেই চার-লাইনের কবিতাটি উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলেন। বও কি মুছে দিয়েছিল দ্বিতীয় লাইনটা?

***

কী কথা যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, লস অ্যালামসের কথা। সেখানে মাস ছয়েক কাজ করার পর কদিনের ছুটি নিয়ে আমি চলে গেলাম ম্যাসাচুসেটসে। সেখানে কেমব্রিজে থাকত ক্রিস্টি আর তার স্বামী হেইম্যান। ক্রিস্টিকে আমি আগেই খবর দিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে ওরা আমায় নিতে এসেছিল। এক মার্কিন বন্ধুর গাড়ি নিয়ে। আলাপ হল মার্কিন ভদ্রলোকটির সঙ্গে। বেশ আমুদে লোক। নাম হ্যারি গোল্ড। দিনসাতেক ছিলাম ক্রিস্টিদের বাড়িতে। ওর মধ্যেই একদিন সুযোগ করে হ্যারি নিরিবিলিতে আমাকে বললে, ডক্টর ফুকস্, দীর্ঘদিন তোমার সঙ্গে নিরিবিলিতে দুটো কথা বলব বলে সুযোগ খুঁজছি।

আমি অবাক হয়ে বলি, বল কী হে! তোমার সঙ্গে আলাপই তো হয়েছে আজ পাঁচদিন।

হ্যারি গোল্ড ঝুঁকে আসে আমার কাছে। প্রায় কানে কানে বলে, আই কাম ফ্রম জুলিয়াস।

–আমি জুলিয়াসের কাছ থেকে আসছি।

আমার রক্তের মধ্যে একটা শিহরন খেলে গেল। এটাই ছিল আমাদের সঙ্কেত। ওই কোড-ম্যাসেজ নিয়েই দীর্ঘদিন পূর্বে আলেকজান্ডার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু সাবধানের মার নেই। হ্যারি গোল্ড আমেরিকান। সে এফ. বি. আই, নিযুক্ত কাউন্টার-এসপায়ওনেজের এজেন্ট হতে পারে। আমি ন্যাকা সেজে বলি, তার মানে?

তার মানে আমার গাড়িতে ওঠো।

 নির্জনে এসে সে অকাট্য প্রমাণ দাখিল করল। সে দীর্ঘদিন ধরে আমার পেছন পেছন ঘুরছে। রাশিয়ান গুপ্তচর সংস্থা কে. জি. বি.-র নির্দেশে। আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। ওরা আমাকে ভোলেনি। ইতিমধ্যে আমি ম্যানহাটান প্রজেক্টের অন্যতম মূল খুঁটি হয়েছি। পারমাণবিক বোমার আকার ও আয়তন আমিই কষে বার করেছি। সেটাও বোধহয় কে. জি. বি. জানে; কিন্তু লস অ্যালামসের সতর্ক প্রহরার ভেতর কিছুতেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। পারছিল না। শুধু আমার জন্যই হ্যারি গোল্ড ক্রিস্টিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে অপেক্ষা করে বসে আছে-কবে আমি ওদের ওখানে আসব।

এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। স্থির হল, চার মাস পরে সান্তা ফে-তে কাস্টিলো ব্রিজের কাছে আমি গোপন তথ্যটি হস্তান্তরিত করব। হ্যারি নিজে আসবে না। আসবে তার এজেন্ট। তারিখটা স্থির হল 6 অগাস্ট 1945, সময়-সন্ধ্যা ছয়টা দশ। কোড মেসেজ ওই একই : আই কাম ফ্রম জুলিয়াস।

তবু সাবধান হলাম আমি। আমরা দুজনে বসে কথা বলছিলাম একটি নির্জন পাব-হাউসের একান্তে। মদের বিলটা আমি দু-টুকরো করে এক টুকরো পকেটে রাখলাম। হ্যারিকে বললাম-তোমার এজেন্ট যেন এই বাকি আধখানা কাগজ আমাকে দেখায়। তাহলে নিশ্চিত বুঝতে পারব সে তোমার কাছ থেকেই আসছে। যে রিপোর্টখানা আমি তাকে দেব তার দাম বিলিয়ন ডলার। আমি একেবারে নিশ্চিন্ত হতে চাই।

–কত বড় হবে তোমার রিপোর্ট?

–অত্যন্ত ছোটো। একটি মাইক্রোফিম। থাকবে একটি পলমল সিগারেটের প্যাকেটে। মন দিয়ে শোন : তোমার এজেন্ট যেন অতি অবশ্যই একটা পলমলের ভর্তি সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার রাখে তার ডান পকেটে। আমি আমার প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে বলব–দেশলাই আছে? সে আমার হাত থেকে প্যাকেটটা নেবে, নিজের পকেটে ঢোকাবে এবং পরমুহূর্তেই তার প্যাকেট আর লাইটার বার করবে। আমরা দুজনে দুটি সিগারেট ধরাব আর তারপর পরিবর্তিত প্যাকেটটা নিয়ে আমি ফিরে আসব।

চমৎকার পরিকল্পনা। সর্বসমক্ষেই ইচ্ছে করলে লেনদেনটা তাহলে হতে পারবে।

–তাই হওয়া ভালো। যত গোপন করতে যাবে ততই ধরা পড়ার ভয়।

 –ঠিক কথা। কিন্তু আর একটা কথা। বিনিময়ে আমরা তোমাকে কী দেব?

–বিনিময়ে? না কিছু দিতে হবে না।

–তা কি হয়? জুলিয়াস সেটাও জানতে চেয়েছে।

জুলিয়াসকে বল–তারা আমাকে খুঁজে বার করেনি, আমি তাদের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। গরজটা তাদের নয়, আমার! ঘুষ আমি চাই না। নেব না।

-ঠিক আছে। জুলিয়াসকে বলব।

 চার মাস পরে নির্দিষ্ট স্থানে জিনিসটা পৌঁছে দিলাম আমি। কী অদ্ভুত ঘটনাচক্র দেখো। ওই 6 অগাস্টেই প্রথম অ্যাটম বোমা ফাটানো হল। মদ কিনবার অছিলায় আমি চলে এলাম লস অ্যালামস থেকে সান্তা ফে-তে। মদের আসরে যারা উপস্থিত ছিল, তাদের ‘অ্যালেবাই’ নাকি পাকা, এ. বি. আই.-য়ের ধারণা। মূর্খগুলো ভেবে দেখেনি, ওই মদ কিনতে যে সান্তা ফেতে গিয়েছিল তার ঘণ্টাদুয়েকের মতো অনুপস্থিতিকালের কোনো সাক্ষী নেই।

***

তুমি বিশ্বাসঘাতককে ঘৃণা করো। তাই না রোনাটা? আগে আমার কথা সবটা শোনো। তারপর জানিও আমাকে ঘৃণা কর কি না।

আমি সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় এ-কাজ করেছি। অর্থের লোভে নয়, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়। তবে কেন? কেন?

আমেরিকা আজ বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের একচেটিয়া মালিক। মনোপলি বিজনেস! গর্বে তার মাটিতে পা পড়ে না। ধরাকে সে সরা জ্ঞান করছে। কিন্তু কে তার হাতে তুলে দিল এই সম্পদ? কারা? তাদের কয়জন আমেরিকান?

যে ছয়জন প্রাকযুদ্ধ-যুগে ওই সম্ভাবনাময় প্রথম পাঁচটি দুরূহ সোপান অতিক্রান্ত করেছিলেন তাদের একজনও মার্কিন নন–রাদারফোর্ড, চ্যাডউইক, কুরি-দম্পতি, ফের্মি আর অটো হান! ইংল্যান্ড; জার্মানি; ফ্রান্স; ইতালি; আবার জার্মানি! আমেরিকা কই? তারপর দেখ–ওই পাঁচজনের প্রাথমিক নির্দেশ সম্বল করে যে বৈজ্ঞানিক দল হাতে-কলমে পরমাণু বোমাকে বাস্তবায়িত করলেন তারাও অতলান্তিকের এ পারের মানুষ। নীলস বোহর, হান্স বেথে, জেমস্ ফ্রাঙ্ক, এনরিকো ফের্মি, উরে, ৎজিলাৰ্ড, টেইলার, উইগনার, ফন নয়ম্যান, ক্রিস্টিয়াকৌস্কি, রোবিনভি, ওয়াইস্কফ, চ্যাডউইক, ক্লাউস ফুস্ক ই? মার্কিন নাম কই? লরেন্স, কম্পটন ইত্যাদি মুষ্টিমেয় কজন সাচ্চা বিজ্ঞানী ছাড়া আছেন একমাত্র ‘অ্যাটম-বোমার জনক’ ওই ওপেনহাইমার। তার অবদানের কথা সৌজন্যবোধে আর নাই বললাম।

তাহলে? এ অস্ত্রের ওপর আমেরিকার একচ্ছত্র মালিকানা হল কোন যুক্তিতে? যুক্তি একটাই–ক্যাপিটালিস্টের যুক্তি! আমেরিকা টাকা ঢেলেছে। ক্যাপিটাল জুগিয়েছে। ওইসব বিদেশি বৈজ্ঞানিকরা কারখানা-মজদুর বৈ তো নয়? যুক্তিটা তো এই? আমি এই যুক্তি মানতে পারিনি। তুমি পারছো?

দ্বিতীয়ত। বিশ্বাসঘাতক কে, বা কারা? আমাদের বলা হয়েছিল জার্মান জুজুর ভয়েই এই বোমা বানানো হচ্ছে। আসলে আমাদের প্রতিযোগী ছিল চারজন জার্মান বৈজ্ঞানিক-অটো হান, ওয়াইৎসেকার, ফন লে আর হেইজেনবের্গ। আমরা য়ুরোপখণ্ডের বিদেশি বিজ্ঞানীরা–কর্তৃপক্ষের মুখের কথায় বিশ্বাস করে প্রাণপাত খেটেছি পুরো ছটি বছর। কারখানা থেকে লভ্যাংশ যখন ঘোষিত হল তখন মিলমালিক মজদুরদের মুখে লাথি মেরে গোটা লভ্যাংশটাই পকেটজাত করলেন। অ্যাটম বোমা ফেলা হবে কি হবে না সে বিষয়ে আমাদের আর কথা বলার কোন। অধিকার রইল না। ৎজিলাৰ্ড দোরে দোরে মাথা খুঁড়ে মরেন বৃথাই, ফ্রাঙ্ক-রিপোর্ট এর স্থান হল ছেঁড়া-কাগজের ঝুড়িতে, প্রফেসর নীলস বোহরের মতো বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিককে চার্চিল মুখের ওপর বললে–লোকটা কী বকছে? রাজনীতি না পদার্থবিদ্যার কথা? স্বয়ং আইনস্টাইনের দ্বিতীয় চিঠিটা–যা তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে লিখেছিলেন অ্যাটম বোমা না ফেলার জন্য তাকে ট্রুম্যান কোনো মূল্যই দেননি!!

তৃতীয়ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জাপান যদি এশিয়াবাসী না হত, পীতবর্ণের পৃথক জাতি না হত, তাহলে ট্রুম্যানগ্রোভ-ওপি এভাবে পৈশাচিক উল্লাসে উন্মত্ত হত না। আমার বাবা বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী–আমি বিশ্বসাম্যবাদের। আমি ওদের ক্ষমা করতে পারি না।

চতুর্থত। ক্লাউস ফুকস্ যে অপরাধে বিশ্বাসঘাতক, সে অপরাধে গোজেঙ্কো কেন বিশ্বাসঘাতক নয়, তা আমাকে বোঝাতে পার? সেও কি গোপন তথ্য শত্রুপক্ষকে ফাঁস করে দেয়নি? অথচ তার তো বিচার হল না? কেন? সে ক্যাপিটালিজম-এর দালাল বলে? এই বোধহয় ওদের আইনের নির্দেশ! হিটলার পরাজিত না হলে–ওই ন্যুরেমবার্গে হয়তো বিচার হত গ্রোভস্ আর ট্রুম্যানের! আইকম্যানের সঙ্গে ওদের তফাত কোথায়?

সবচেয়ে দুঃখ কী জান, রোনাটা? এত করেও কিছু হল না। আমার সাধের। জার্মানি আজ দু টুকরো! বার্লিনের মাঝখান দিয়ে উঠেছে কাঁটাতারের বেড়া। যে স্তালিনের রাশিয়ার জন্য কাণ্ডটা করলাম সেও আজ হিটলার হতে বসেছে। পূর্ব জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়ায় দেখেছি তার স্বরূপ! কাপিৎজা আজ সাইবেরিয়ায় বন্দী!

“এ আমরা কী করলাম! কমরেড! এ তুমি কী করলে!”

***

ওরা বলে–বিংশ শতাব্দীর ‘জুডাস’। বিশ্বাস কর রোনাটা–

আমি জুডাস নই, আমি প্রমিথিউস! প্রমিথিউস কে জান? অ্যাটলাসের ভাই। অ্যাটলাস জগদ্দল বোঝা বইছে নির্বিকারে–কিন্তু প্রমিথিউস হচ্ছে আদিম বিদ্রোহী। স্বর্গাধিপতি ‘জিউস’-এর গোপন গুহা থেকে সে চুরি করে এনেছিল অগ্নিশিখা। যে আগুন আলো দেয়, যে আগুন উত্তাপ দেয়। মানুষের কল্যাণে, পৃথিবীকে প্রথম আলোকিত করেছিল সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধরা পড়ে যায়। জিউস তাকে পর্বতশৃঙ্গের সঙ্গে শৃঙ্খলিত করে–ঈগল পাখি দিয়ে তার যকৃৎ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ায়। আমাকে ওরা অবশ্য ধরতে পারেনি, আমি নিজেই ধরা দিলাম। স্বেচ্ছায়।

লিজা পাগল হয়ে গিয়েছিল। মাও পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বাস করো রোনাটা, আমি কিন্তু পাগল হইনি। জানি, এ স্বীকারোক্তির পরিণাম কী? প্রমিথিউসের শেষ পরিণাম! না! কৃতকার্যের জন্য আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। যা করেছি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় করেছি-সুযোগ পেলে আবার এ কাজ করবো! স্বীকার করছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে-অনুশোচনায় নয়!

***

আমার সামনে এখন খোলা আছে দুটি মাত্র পথ। পটাসিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুল রয়েছে আমার পকেটে। এই রাখলাম টেবিলের ওপর। যারা বিচারের প্রহসন করে আমার যকৃৎ ঈগল দিয়ে খাওয়াবার আদেশ দেবে তারা শুনে রাখুক–অনায়াসে এই মুহূর্তে তাদের হাত এড়িয়ে যেতে পারি আমি। কেন যাচ্ছি না জান? তার দুটি কারণ :

আমি পদার্থবিজ্ঞানী, কেমিস্ট নই। তাই কে. সি. এন.-এর চেয়ে কিলো ভোল্টকে আমি বেশি চিনি। ক্যাপসুলের চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ার। সেটাও আসল কথা নয়–আসল কথা এবার চুপি চুপি বলি : শুধু তোমাকেই বলছি!

ইতিমধ্যে আমার অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়েছে, জানলে? ডায়ালেকটিকাল মেটেরিয়ালিজম-এ এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। সেটা যে কী, তা এদের বলতে যাওয়া বৃথা। এরা বুঝবে না! তোমার কাছে তো যাচ্ছিই–তোমাকে বলব, বুঝবে তুমি। আর একজন বুঝবেন–তিনি আমার বাবা। সে জন্যই ক্যাপসুলটা আমি মুখে পুরতে পারছি না। আমি নিজের ক্ৰস্ নিজের কাঁধে বইতে চাই যে!

মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা পেয়ে আমি একটি অনুরোধ জানাব। আমার বাবাকে শুধু একবার দেখতে চাই : তাকে একটা অনুরোধ করে যাব : আমার সমাধির ওপর কবি উইলিয়াম টেস্-এর ওই চারটি লাইন কবিতা যেন তিনি উত্তীর্ণ করিয়ে দেন। হ্যাঁ, চারটি লাইনই। প্রথম দুটি সমেত :

চিরউন্নত বিদ্রোহী শির লোটাবে না কারও পায়ে
তোমারেই শুধু করিব প্রণাম, অন্তরতম প্রভু!
জীবনের শেষ শোণিতবিন্দু দিয়ে যাব দেশ-ভাইয়ে
রহিবে বিবেক! সে শুধু আমার! বিকাবো না তারে কভু!

তোমার কাছে যাওয়ার সময় হয়ে এল। লর্ড যিসাস্! এবার তুমি মেষশিশুর মতো আমাকে তোমার বুকে তুলে নাও।

আমেন!

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *