৮. শাহুজির প্রাসাদ

শাহুজির প্রাসাদেই থাকার ব্যবস্থা হলো ওদের। পরের কয়েকদিন যাবত একের পর এক অস্ত্রধারী সৈন্যদল পাহাড়ের ওই বিপদসংকুল রাস্তাটা ধরে উঠে আসতে লাগলো। সেই থেকে পুরো মহল এক মুহূর্তের জন্যেও আর নীরব নেই। আস্তাবলে, হাতীর দল থেকে থেকে শুড় তুলে ডেকে উঠছে। ঘোড়াগুলো মাটিতে খুর ঠুকে শব্দ করছে।

টম পুরোটা সময় জাবর কেটে পার করে দিলো। ওদের খাতির যত্ন কম করছেন না শাহুজি। সুন্দরি পরিচারিকাদেরকে দিয়ে প্রচুর খাবার আর পানীয় পাঠিয়েছেন। কিন্তু মহলের মূল ভবন ছেড়ে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। টম জানালার ধারে বসে বসে সৈন্য সামন্তের আসা যাওয়া দেখলো, তারপর বিরক্তি ধরে গেলে দাবা খেললো বসে বসে। ফ্রান্সিস মোটামুটি খেলতে পারে। টম সেই ছোট থেকেই দাবা খেলে বড় হয়েছে। তাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো আনার সাথে।

“ইশ যদি বাস্তব জীবনেও একটা দুর্গ দখল করা এতোটা সহজ হতো,” টমের একটা নৌকা খেয়ে দিয়ে বললো অ্যানা। খুঁটিগুলো সব হাতীর দাঁতের বানানো। টম আগে কখনো এরকম খুঁটি দিয়ে দাবা খেলেনি। সবগুলো খুঁটিই হয় হাতী, নাহয় কোনো দেবতা, নাহয় সাধারণ কোনো সৈনিকের মতো করে বানানো। মানে খুঁটিগুলোর পদমর্যাদাও একদম নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

টম মন্ত্রী দিয়ে আক্রমণ করে জবাব দিলো। পরের কয়েক চালেই ও অ্যানার দুটো বড়ে, একটা হাতী আর একটা নৌকা খেয়ে রাজাকে কোণঠাসা করে ফেললো।

“আপনি ঠিক একজন ইংরেজের মতো খেলেন,” অ্যানা বললো। কণ্ঠে মুগ্ধতা। বাকি সব টুপিওয়ালার মতোই আপনি আক্রমণ করতে ভালোবাসেন, ফলাফল নিয়ে অতো ভাবেন না। আর ভারতীয়রা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে ভালোবাসে।”

অ্যানা ওর ঘোড়াটা তুলে একটা চুমু খেলো, তারপর সেটা দিয়ে টমের মন্ত্রীকে খেয়ে দিলো।

 “অপেক্ষা খুবই বিরক্তিকর,” টম বললো অ্যানাকে। ওর হাতী বোর্ডের অন্য প্রান্ত থেকে এসে রাজার কোণাকুণি একটা ঘরে স্থির হলো। রাজা চাইলে ওটাকে খেতে পারবে না, কারণ ঘরটাকে পাহারা দিচ্ছে ওর ঘোড়া। ফলে রাজার আর নড়ার জায়গা রইলো না।

“চেকমেট,” হেসে অ্যানাকে বললো টম।

*

শিকারের দিন সকাল বেলা শাহুজির একজন চাকর এসে ওদেরকে ডেকে নিয়ে গেলো। তারপর পালকিতে করে পাহাড় থেকে নিচে নামিয়ে আরো কয়েক মাইল দূরে শাহুজির শিকার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসলো রাজার ডুলিরা। বাড়িটা হচ্ছে একটা নির্মল দিঘির পাশে বানানো কয়েক তলার একটা প্যাগোডা। ওটার সামনে দেয়ালে ঘেরা একটা বাগানও আছে।

টম আর ফ্রান্সিস দুজনেরই শিকারে হাতেখড়ি হাই উইল্ড এস্টেটের বাগানবাড়িতে। সেই পুরনো স্মৃতি ফিরে এলো ওদেরঃ ঢাকের আওয়াজ, শিঙার শব্দ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো উত্তেজনা। তবে এতো বড় পরিসরে কখনো শিকারের সুযোগ হয়নি আগে। কয়েকশো ঢাক দেখা গেলো। বাদ্যকরেরা বাঁশি সহ আরো নানা প্রকার তারের বাদ্য বাজাচ্ছে। পরিচারিকারা সবাইকে লবঙ্গ মেশানো আরক পরিবেশন করছে, এছাড়াও আছে থালা ভর্তি খেজুর আর কাঠবাদাম। হাতীগুলো শান্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে, মাহুতের দেওয়া বিশাল পাতার আটি থেকে একমনে চিবিয়ে যাচ্ছে। ওগুলোর পিঠে সুন্দর নকশাকাটা অনেকগুলো বক্স দেখা গেলো। অ্যানা বললো ওগুলোর নাম নাকি হাওড়াহ।

“ওগুলোতে করে বাঘ মারতে যাবো আমরা, অ্যানা জানালো।

 ফ্রান্সিস বিশাল জানোয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। “পড়ে যাবো নাতো?”

“সরাসরি বাঘের মুখে পড়ার চাইতে অন্তত নিরাপদ,” আশ্বস্ত করলো অ্যানা।

প্রথমে ঢাকীর দলে ঢুকে গেলো জঙ্গলের ভিতরে। হাতে লাঠি আর কুড়াল। বাকিরা অপেক্ষা করতে করতে সকালটা ওখানেই কাটিয়ে দিলো। বাদ্যকরেরা বাজানো বন্ধ করে দিলো একসময়; হাসি ঠাট্টা স্তিমিত হয়ে নীরব কথপকথনে রূপ নিলো। সবচে জোরে শব্দ হতে লাগলো শুধু হাতীগুলোর পাতা চাবানোর। সকল শিকারিরা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

“আমাদের কি হাতীর পিঠে চড়ে বাঘের পিছনে ধাওয়া করা উচিত না?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো।

অ্যানা ওর প্রশ্নটা রাজাকে অনুবাদ করে শোনালো।

“জঙ্গলে ঢুকে খুঁজলেই বাঘ পাওয়া যায় না,” রাজা ব্যাখ্যা করলেন। “ওদেরকে আগে ওদের আস্তানা থেকে বের করে আনতে হবে। আমার লোকেরা বনের কয়েকটা জায়গায় মহিষ বেধে রেখেছে। বাঘ ওগুলোকে খেতে আসলেই, ওরা আমাদেরকে খবর দেবে। তখন আমরা সেখানে যাবো।”

 শাহুজিকে সেদিন সকালে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেলো। মহলে থাকতে যেকরকম সবসময় চিন্তিত থাকেন এখানে সেরকম নেই মোটেও। অবশ্য একটা ভাবগাম্ভীর্যের মুখোশ পরে আছেন, কিন্তু তবুও শিকারের আনন্দ আর উত্তেজনা লুকাতে পারছেন না। যে লোকটা জীবনের অর্ধেক সময় বন্দী হিসেবে কাটিয়েছে, তার কাছে এই বিশাল জঙ্গলের মাঝে একটা জন্তুকে ধাওয়া করা যে কেমন আনন্দের হতে পারে, তা টম অনুধাবন করতে পারলো।

একজন সংবাদ বাহক প্যাগোডার সামনের খোলা জায়গাটায় দৌড়ে এলো। তার সারা গা ঘামে ভেজা, জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। খবরটা কোনোমতে দিয়েই হাটু মুড়ে বসে পড়লো সে।

 শাহুজি তার অতিথিদের দিকে ফিরলেন। উত্তেজনায় চেহারা জ্বলজ্বল করছে তার। এরমধ্যেই চাকরেরা হাতীগুলোতে অস্ত্রপাতি তুলতে শুরু করে দিয়েছে।

 “একটা বাঘ মহিষ খেতে এসেছে,” একজন আর একজনকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো সবাই।

টম জীবনে অগণিত হাতী মেরেছে, কিন্তু এই প্রথম একটার পিঠে চড়তে যাচ্ছে। আফ্রিকার যেসব হাতি দেখে অভ্যস্ত ও, এটা সেগুলোর চাইতে ছোট, কিন্তু তবুও দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। হাতীগুলোর দুই চোখের মাঝে লাল রঙের বিশাল একটা বৃত্ত আঁকা হয়েছে। তাতে চেহারায় একটা জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব চলে এসেছে। অভ্যাসবশত টম ওটার দাঁত দুটো মাপতে শুরু করলো আর ভাবতে লাগলো কেপ টাউনে কতোটা নিয়ে ফিরতে পারবে।

মাহুত হাতীটার পেটে চাপড় দিতেই ওটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। টম জানোয়ারটার বাড়িয়ে দেওয়া পিছনের পায়ে ভর দিয়ে ওটার নিতম্বের উপর উঠে এলো, তারপর হাওড়ায় গিয়ে বসলো। একটা ছোট ছেলে এক জোড়া জবরদস্ত বন্দুক নিয়ে উঠে এলো। বন্দুকের গায়ে রুপার খোল পরানো। চোখ কুচকে নলের ভিতর দিয়ে তাকালো টম। বন্দুকটার গতি আর দক্ষতা যে অনেক বেশি, তা দেখেই বোঝা গেলো।

মাহুত দড়াবাজিকরের মতো লাফ দিয়ে হাতীর মাথার দিক দিয়ে উঠে এলো। তারপর ওটার ঘাড়ের ওপর বসে পা দুটো গুঁজে দিলো জানোয়ারটার কানের পেছনে। লোকটা স্পষ্ট কিন্তু নিচু গলায় কিছু একটা বলতেই উঠে দাঁড়ালো হাতীটা। টম পিছনে তাকিয়ে দেখলো অ্যানা আর ফ্রান্সিসও যার যার হাতীতে চড়ে বসেছে। সবার আগে আছেন রাজা। ওনার হাওড়াটার কাঠে দুর্দান্ত সুন্দর নকশা কাটা আর সোনার সুতা দিয়ে বোনা একটা কাপড় দিয়ে মোড়া।

টম কিছুক্ষণের মাঝেই হাতীটার হেলেদুলে চলার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে জঙ্গলের গভীরে এগিয়ে চললো ওটা। জন্তুটার সামর্থের কথা ভাবতেই মনে মনে অবাক হলো টম। যদি হাওড়াটা গাছের কোনো ডালে বাধার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে হাতীটা শুড় বাড়িয়ে সেই ডালটা টেনে ভেঙে দিতে লাগলো। মাঝে মাঝে সরু রাস্তায় পুরো গাছটাকেই ঠেলে ফেলে দিলো। রাস্তায় পানি বা কাদা থাকলে মাথা নামিয়ে শুড় দিয়ে দেখে নিতে লাগলো কোথায় পাড়া দিলে পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

কয়েক মাইল পর একটা শৈলশিরার কাছে এসে উপস্থিত হলো ওরা। ওখানে রাস্তা থেকে নেমে একটা নালা দিয়ে আগাতে লাগলো এরপর। নালাটা আসলে একটা শুকিয়ে যাওয়া নদীগর্ভ। ওখান দিয়ে প্রায় কয়েক মাইল গেলো ওরা। নদী গর্ভের কাদা আর বালিতে নানা প্রজাতির জন্তু জানোয়ারের পদচিহ্ন চিহ্নিত করতে পারলো টম। গাছের ডালে বানর কিচিকিচ করতে লাগলো। নদীর ধার দিয়ে গলা বড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো বন মোরগ। এক ঝাঁক ময়ুর উড়ে গেলো ওদের মাথার ঠিক উপর দিয়ে। সূর্যের আলোয় ওগুলোর নীল রঙের গলা ঝিলিক দিতে লাগলো। দৃশ্যটা দেখে টম হঠাৎ একটা বেদনা অনুভব করলো। নেপচুন তরবারিটার কথা মনে পড়ে গিয়েছে ওর।

নদীর এক জায়গায় একটা ক্ষীণ ধারা এসে মিশেছে, রাজা সেখানে সবাইকে থামতে আদেশ করলেন। হাতীগুলো হাঁটু মুড়ে বসতেই শিকারিরা সব নেমে পড়লো। টম ওর পা সোজা করতে করতে আশপাশটা দেখতে লাগলো। নিচের মাটিতে ওদের শিকারের কোনো চিহ্ন দেখা যায় কিনা সেটা খুঁজছে।

শাহুজির চোখ এড়ালো না ব্যাপারটা। এর আগে কখনো বাঘ শিকার করেছেন?” অ্যানার মাধ্যমে জিজ্ঞেস করলেন উনি।

“সিংহ শিকার করেছি।”

শাহুজি মাথা ঝাঁকালেন। “আমি সিংহ দেখেছি। মুঘল সম্রাট তার মনোরঞ্জনের জন্যে দিল্লির দরবারে কয়েকটা এনে রেখেছিলেন। কিন্তু বাঘ বেশি ভয়ংকর। আকারেও বড়, শক্তিশালী, হিংস্র। সিংহ দলবেধে শিকার করে, কিন্তু বাঘ করে একা একা। তাই ওকে বেশি শক্তিশালী আর ধূর্ত হতে হয়। আমি একটা বাঘকে একটা মহিষ মেরে মুখে করে টেনে নিয়ে যেতে দেখেছি। যেনো একটা বিড়াল ইঁদুর মেরে নিয়ে যাচ্ছে।”

শাহুজি টমের চেহারার অবিশ্বাসী দৃষ্টিটা খেয়াল করলেন। “একবার দিল্লিতে, সম্রাট বাঘ আর সিংহের লড়াইয়ের আয়োজন করেছিলেন। মহল জুড়ে তখন শুধু এই লড়াই নিয়ে আলাপ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামন্তরা জড়ো হতে থাকেন এই অভূতপূর্ব লড়াই দেখার জন্যে। জানোয়ার দুটোকে যখন খাঁচার ভিতর ছেড়ে দেওয়া হয়, দর্শকেরা সবাই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।”

“কে জিতেছিলো?” জানতে চাইলো ফ্রান্সিস।

“এক থাবায় সিংহটাকে মেরে ফেলেছিলো বাঘটা। সিংহের ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গিয়েছিলো। সেখান থেকে রক্তক্ষরণেই পরে মারা পড়ে সিংহটা।” আবারও টম শাহুজির ভূতুড়ে হাসিটা দেখতে পেলো। সর্বোচ্চ এইটুক আবেগই উনি প্রকাশ করেন। “সম্রাট প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। এতোগুলো আমির আর জাগিরদার-তারা সবাই খুব হতাশ হন।”

কথা বলার ফাঁকেই রাজার চাকরেরা ওনার হাওড়াটা হাতীর পিঠ থেকে খুলে, ধরাধরি করে একটা লম্বা গাছে দিকে নিয়ে গেলো। তারপর ওটায় রশি বেঁধে প্রায় দশ ফুট উপরে একটা বেরিয়ে থাকা গাছের ডালে বেঁধে দিলো। পাশে একটা বাঁধলো একটা মই।

“এটা হচ্ছে মাচা,” শাহুজি বললেন। “এখানেই অপেক্ষা করবো আমরা।”

মই বেয়ে উঠে গেলো ওরা। চাকরেরা দুটো হাওড়া পাশাপাশি বেঁধে দিয়েছে। একটা টম আর শাহুজির জন্যে, আর একটা অ্যানা আর ফ্রান্সিসের জন্যে। বন্দুকবাহীসহ বাকি চাকরেরা পিছনের ডালগুলোতে আশ্রয় নিলো। সবাই চোখ বড়বড় করে আশে পাশের জঙ্গলে নজর বুলাচ্ছে।

“বাঘেরা পানি ধরে চলতে পছন্দ করে,” বলতে বলতে শাহুজি অপর পাড়ে যেখানে ধারাটা নদীতে এসে মিশেছে সেটা দেখালেন। “ঢাকীর দল যদি ঠিকমতো তাড়িয়ে আনতে পারে তাহলে এখান দিয়েই আসবে বাঘটা।”

টম বুঝতে পারলো শিকার কেন যুদ্ধযাত্রার জন্যে এতো ভালো প্রস্তুতির কজ করে। জঙ্গলের ভিতর এখন প্রায় আটশো নোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সবাই এক অদেখা শিকারকে খুঁজছে, তাই ওদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষাটা সবচে জরুরি। কারণ একটা সারিও যদি একটু এগিয়ে বা পিছিয়ে যায়, তাহলে মাঝে যে ফাঁকটা সৃষ্টি হবে, সেটা দিয়েই বাঘ বেরিয়ে যেতে পারবে। যদি বাঘ দিক পরিবর্তন করে, তাহলে পুরো সারিটাকেই ঘুরে যেতে হবে। এর ফলে সবার মাঝে যে বোঝাঁপড়ার সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন দলপতির মাঝে একইভাবে আদেশ গ্রহণ ও হস্তান্তরের মাধ্যমে পুরো দলটাকে দিয়ে সেটা পালন করানোর যে অনুশীলন হচ্ছে-সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে অমূল্য কাজে দেবে।

 মাহুতেরা হাতীগুলোকে বনের দিকে নিয়ে গেলো। “ওরাও ঢাকীদের সাথে যোগ দেবে,” শাহুজি বললেন। “হাতীগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া আছে। ওরা গাছের ডাল ভেঙে, শুড় দিয়ে খুঁড়িতে বাড়ি দেবে। শব্দে বাঘ ভয় পেয়ে যাবে।”

বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ওরা। জঙ্গল জুড়ে নানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কানের পাশে নানান পোকা ডাকতে ডাকতে ওদের গা বেয়ে উঠতে লাগলো। যতোটা সম্ভব স্থির থাকার চেষ্টা করলো টম একটা নীলগাই নদীর ধারে ঘুরে বেড়ালো কিছুক্ষণ। টম ওটার দিকে বন্দুক তাক করলো কিন্তু গুলি অপচয় করলো না।

“আংরিয়ার সাথে আমার শত্রুতা অনেক পুরনো,” হঠাৎ বলে উঠলেন শাহুজি। “আপনি সেটা জানেন নাকি?”

টম মাথা নাড়লো।

“আংরিয়া জলদস্যু হওয়ার আগে আমার নৌবাহিনির ক্যাপ্টেন ছিলো। মুঘলরা আমাদেরকে ডাঙায় শায়েস্তা করছিলো বারাবার, সমুদ্রই তাই তখন ছিলো আমাদের আশ্রয়স্থল। যোগাযোগ আর রসদপত্রের জন্যে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলাম এই পথের উপর। কিন্তু যখন আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো, আংরিয়া তখনই আমাদের সাথে বেঈমানি করে বসলো। ও বিদ্রোহ করে ওর নিয়ন্ত্রণে থাকা জাহাজ আর নলাকজন নিয়ে ভেগে যায়। তারপর টিরাকোলায় আমাদের সৈন্যদের পরাস্ত করে ওটর দখল করে নেয়। এরপর থেকেই ও উপকূল জুড়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে চলেছে। আমাদের দুর্গগুলো অবরোধ করতে থাকে, জাহজগুলো লুট করতে থাকে। এদিকে মুঘলেরাও আমাদের হাত থেকে সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নিতে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করছিলো তখন। আমি ওকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। সমুদ্রে ওর নিজস্ব অরাজক সাম্রাজ্য সৃষ্টির লোভের কারণে আমাদের পুরো সাম্রাজ্য হারানোর উপক্রম হয়েছিলো।”

শাহুজি আঙুল দিয়ে তার বন্দুকের বাটের উপর টোকা দিতে লাগলেন।

 “তারপরেও ওকে ক্ষমা করে দিতাম। সাম্রাজ্যের খাতিরে আমাদের ঝামেলাটা ছেড়ে দিতে রাজি ছিলাম আমি। শান্তি প্রস্তাব দিয়ে প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিলাম। ও কি করেছিলো জানেন?”

এমনকি স্মৃতিটা মনে পড়তেও তার চেহারা রাগে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

“ও আমার লোকদের ফেরত পাঠায়। তবে তার আগে তাদের চোখ উপড়ে নেয় আর লোহা পুড়িয়ে কপালে ওর প্রতীক এঁকে দেয়। কপালের চামড়া পুড়ে খুলির হাড় বেরিয়ে পড়েছিলো লোকগুলোর। এমনকি মস্তিষ্কে পর্যন্ত সমস্যা হয়ে যায়। ওরা এখন আবার ছোট বাচ্চার মতো হয়ে গিয়েছে। কথা বলতে পারে না, কাপড়েই পেশাব পায়খানা করে দেয়।”

সারাহ আর অ্যাগনেস যে এই রকম মানসিকতার একজনের কাছে বন্দী এই চিন্তাটা টম জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিলো।

“আংরিয়াকে হাতীর পায়ের নিচে পিষে মারতে পারলে সবচে খুশি হতাম আমি,” শাহুজি বলতে লাগলেন। “দিল্লিতে মুঘল সম্রাট এভাবে মাঝে মাঝে ওনার শত্রুদের মৃত্যুদণ্ড দিতেন। আমি আপনাকে সত্যিটা বলছি। আমাকে রাজমুকুট পরিহিত অবস্থায় শ’খানেক পরিষদ নিয়ে বসে থাকতে দেখে যদি ভাবেন যে আমি মহান মানুষ, তাহলে ভুল করছেন।”

 বলে শাহুজি নিজের বুকে থাবা দিলেন। “হ্যাঁ, আমি মহান। আমি পবিত্র পৈতা ধারণ করেছি, আমি হচ্ছি ছত্রপতি, মারাঠাদের সম্রাট। তবুও…” ওনার চেহারায় শোকের ছায়া নামলো। “আমার মহলের বাইরে আমার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। গৃহযুদ্ধে প্রতিটা লোকের আসল চেহারা খুলে যাচ্ছে। আমি যদি টিরাকোলা আক্রমণ করে ব্যর্থ হই, তাহলে সেটা আমার সামর্থ্যের প্রমাণের উপর কুঠারাঘাত করবে।”

“গাই কোর্টনীও একই কথা বলে,” ফ্রান্সিস বললো। “উনি মনে মনেই নিজেকে শক্তিশালী ভেবে মজা পান। সেটা প্রমাণ করার ঝুঁকি নিতে চান না।”

ফ্রান্সিস ঝোঁকের বশে বলে ফেলেছে কথাটা। কিন্তু শাহুজি কিছু মনে করলেন না। “যখন বড় হবে, তখন বুঝবে যে অনেক সময় ক্ষমতা জাহির করাটা, আসলে ক্ষমতা থাকার চাইতে জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।”

 “কিন্তু ক্ষমতা থাকার পরেও যদি ব্যবহার না করেন, তাহলে সেটা আসলে কোনো ক্ষমতাই না,” টম বললো।

শাহুজি উত্তর দিলেন না। একটা নতুন শব্দ জঙ্গলের এতোক্ষণের হট্টগোলকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। একটানা ছন্দময় দ্রিম দ্রিম শব্দ। যেনো এক হাজার কামার একসাথে তাদের হাতুড়ি দিয়ে লোহার ওপর পেটাচ্ছে। টম একবার ভাবলো এটা আবার কোনো অচেনা প্রজাতির পাখি কিনা। তারপর শাহুজির প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারলো এ হচ্ছে ঢাকের আওয়াজ। বাঘকে ভয় দেখিয়ে মাচার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। টমের কাছে ওটা শুধুই সাধারণ একটা আওয়াজ। কিন্তু খেয়াল করলো শাহুজি কান পেতে শব্দটা শুনছেন। শব্দটা কতোটা আগালো তার নিখুঁত হিসাব রাখছেন।

ওদের বাম পাশে হাত তালি আর হৈচৈয়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। গাছের মাথায় বসা লোকগুলো করছে কাজটা। বাঘটা যাতে রাস্তা ছেড়ে দিক না বদলায় সেজন্যে এই ব্যবস্থা। শাহুজি একটা বন্দুক তুলে নিলেন। টম, ফ্রান্সিস আর অ্যানাও একই কাজ করলো। টম টের পেলো ওর রক্তে শিকারের উত্তেজনা পাক দিয়ে উঠছে।

জঙ্গল জুড়ে ভয়ংকর একটা গর্জন ছড়িয়ে পড়লো। গাছে মাথার লোকগুলোর আওয়াজ বাড়লো আরো। তাতে করে বাঘ চাইলেও নদীপথ ছেড়ে অন্য কোনোদিকে যেতে পারলো না। স্বর্ণালি সূর্য কিরণের মতো বাঘটা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। টম জানোয়ারটা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হলো যে হাতের বন্দুকটার কথাও খেয়াল থাকলো না। জন্তুটা বিশাল, কিন্তু সেই বিশাল শরীরের তুলনায় এতো দ্রুত চলছে যে ওটার সঠিক মাপ সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব না। তবে আফ্রিকায় দেখা যে কোনো সিংহের চাইতে যে বড় তা ও নিশ্চিত।

বাঘটা লাফ দিয়ে নদীবক্ষে নেমে এলো। হাতীর উপর থেকে নেমে ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেটা থেকে মাত্র বিশ কদম মতো দূরে। সামনে মানুষের গন্ধ পেয়ে দাঁত খিঁচিয়ে গরগর করে উঠলো জানোয়ারটা। তারপর ঘুরে গেলো। ওটার ঘাড়ের সাদা চুলগুলো খাড়া হয়ে আছে। গর্জন করতেই ঝিকিয়ে উঠলো ওটার তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো।

 এতো কাছ থেকেও গুলি লাগানোটা খুব কষ্টকর ছিলো, কিন্তু রাজা গুলি করে বসলেন। টম গুলিটা লাগতে দেখলো, জন্তুটার শোল্ডার ব্লেডের অনেক পিছনে। ভারী গুলিটার আঘাতে জানোয়ারটা গড়িয়ে পড়লো মাটিতে, কিন্তু একই মুহূর্তে ডিগবাজি দিয়ে আবার ওটা চারপায়ে খাড়া হয়ে গেলো। তারপর যেনো কিছুই হয়নি এমনভাবে চলে যেতে লাগলো। টম আর ফ্রান্সিস একযোগে গুলি করলো। কিন্তু বাঘ খুব দ্রুত ছোটা শুরু করেছে, তাই ওদের বুলেট কয়েক ফুট পেছনে মাটিতে লেগে ধুলো আর শুকনো পাতা ছেটানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। বাঘটা বনের ধারে পৌঁছে উধাও হয়ে গেলো।

শাহুজি গাছ থেকে লাফিয়ে নামলেন। পড়ে ব্যথা পাবেন কিনা সে খেয়াল নেই। তারপর বাঘটা যেখানে গুলি খেয়ে ডিগবাজি দিয়েছিলো সেখানে ছুটে গিয়ে মাটিতে রক্তের দাগ খোঁজা শুরু করলেন।

 “বাঘটা আহত হয়েছে,” ঘোষণা দিলেন রাজা। “কিন্তু মরেনি। আর আহত বাঘ সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর।”

“এখন কি করবো আমরা?” জানতে চাইলো টম।

 “একে তো আহত, তার উপর ধাওয়া খেয়ে বাঘটা খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকার কথা। কাছেই একটা জলা আছে। আমার মনে হয় ওটা ওখানেই যাবে।”

 অ্যানা অনুবাদ শেষ করার আগেই মাহুতগুলো হাতী নিয়ে হাজির হয়ে গেলো। এখন আবার হাওড়া বাধার সময় নেই। পিঠের উপর শুধু কম্বল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা হাতীর পিঠে চড়ে, ওটার পেট পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা একটা রশি ধরে নিজেদেরকে পতনের হাত থেকে বাঁচালো। জানোয়ারটা লম্বা পা ফেলে আবার ঢুকে গেলো জঙ্গলের ভিতরে।

কিছুক্ষণ পরেই ওরা বনের ভিতরের সরু রাস্তাটা পেরিয়ে চওড়া একটা ঘাসবনের ভিতরে এসে ঢুকলো। ওখানে ঘাস এতো বড় যে হাতীর পেটে ঘষা লাগতে লাগলো। টমের মনে হতে লাগলো ও যেনো একটা জাহজের উপর আছে। বরফে ভরা সাগরের ভিতর দিয়ে চলছে ওরা। নিজের বন্দুকটা চেপে ধরে সামনে মাটিতে কোনো রক্তের দাগ বা বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায় কিনা সেই চেষ্টা করতে লাগলো ও। জানে যে বাঘটাকে দেখা যাবে না, লুকিয়ে থাকবে সে। এই লম্বা ঘাসের আড়ালে ওটার গায়ের ভোরাগুলো নিখুঁতভাবে মিশে যাবে।

একজন শিকারি হাতীগুলোর আগে আগে দৌড়ে যাচ্ছিলো। আচমকা সে চিৎকার দিয়ে সামনের মাটিতে কিছু একটা দেখাতে লাগলো। কিন্তু গতি কমালো না একটুও।

“বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে,” অ্যানা জানালো।

মাহুতেরা লাঠি মেরে হাতীগুলোর গতি বাড়িয়ে দিলো। একটু পরেই ঘাস শেষ হয়ে গিয়ে খালি মাটির এলাকা শুরু হলো। অসংখ্য খুর আর থাবার ছাপ দেখা গেলো ওখানে। হাতীর পিঠের উপর বসে থেকেও টম এর মাঝে বাঘের ছাপগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলো। ওটার সদ্য রেখে যাওয়া ছাপগুলোয় নিচ থেকে পানি উঠে জমা হচ্ছে। আর জানোয়ারটার রক্তক্ষরণও হচ্ছে। উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় চুনির মতো জ্বলজ্বল করছে রক্তের ফোঁটাগুলো।

 “বাঘটা পুরুষ। যুবক। চোদ্দ বছর মতো বয়স। সামনের বাম পায়ের বুড়ো আঙুলটা নেই,” গড়গড় করে বলে গেলেন শাহুজি। অ্যানা অনুবাদ করে শোনালো।

টম রাজার দিকে চেয়ে মাথা ঝোকালো। হাতীর পিঠে চড়ে থেকেও মাত্র কয়েক ঝলক দেখায় এতো কিছু বলে ফেলতে পারাটা রাজার শিকারের অনবদ্য দক্ষতার কথাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

 একটা কাদাময় গর্তের কিনারে গিয়ে ছাপগুলো শেষ হলো। ওটার অর্ধেক পানিতে ভরা। এক জোড়া বাজ, পাতা ঝরা একটা গাছের মগডাল থেকে লক্ষ্য করছে ওদের দিকে। কিন্তু বাঘটা কোথাও নেই।

 যেকোনো সময় আক্রমণের আশংকায় টমের দেহের প্রতিটা স্নায়ু টানাটান হয়ে থাকলো। এটাই হচ্ছে শিকারের অভিভুতকারি শিহরণ। যেদিন ওর বাবা প্রথম ওর হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছিলেন, সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত এক ফোঁটা নেশা কমেনি।

বাঘটা কাছে পিঠেই আছে। হাতীগুলো ওটার ঘ্রাণ পাচ্ছে।

দুশ্চিন্তাগ্রস্তের মতো গা ঝাড়ি দিতে লাগলো হাতীগুলো। গুড় দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। এভাবে নড়লে চড়লে শিকারিদের পক্ষে ঠিকমতো নিশানা করে লাগানো সম্ভব হবে না। শাহুজি পিছলে নেমে এলেন হাতীর পিঠ থেকে। টম আর ফ্রান্সিস ওনাকে অনুসরণ করলো।

 শাহুজি ওনার শিকারের লোকদের সাথে পরামর্শ করলেন। “সামনে আরো একটা জলা আছে। আর একটু উত্তরে,” অ্যানা অনুবাদ করে শোনালো। “ওটা দিয়ে গেলে একটা গিরিখাত হয়ে অন্যপাশের উপত্যকায় পৌঁছা যাবে। বাঘটা আমাদের হাত থেকে বাঁচতে সেদিক দিয়ে যেতে পারে।”

ওরা কথা বলতে বলতেই ওদের কাছাকাছি পৌঁছে গেলো ঢাকীর দল। কয়েক মিনিট পরেই দেখা গেলো কয়েকশো অর্ধনগ্ন লোক ঢাক আর লাঠি হাতে ফাঁকা জায়গাটায় উপস্থিত।

রাজার হাতীটা পিপাসার্ত হয়ে ছিলো। কোনো সংকেত না দিয়েই ওটা দিঘিটার কিনারে গিয়ে পানিতে শুড় ডুবিয়ে খেতে শুরু করলো। মাহুত চিৎকার করে ওটার রশি ধরে টান দিলো; আরো একজন চাকর এগিয়ে এলো ওকে সাহায্য করতে। কিন্তু তবুও ওটাকে নড়ানো গেলো না। শব্দ পেয়ে, কি হয়েছে দেখার জন্যে হাতীটার দিকে ফিরলো সবাই।

শিকারিদেরকে শিকারে পরিণত করতে ঠিক সেই মুহূর্তটাকেই বেছে নিলো বাঘটা। কয়েকটা ছোট গাছের চারার পেছনে লুকিয়ে ছিলো ওটা এতোক্ষণ। চারাগুলো মানুষের হাঁটুর চাইতে বড় হবে না, খুবই পাতলা। এর পিছনে এতো বড় একটা জানোয়ার লুকিয়ে ছিলো-বিশ্বাসই হতে চাইলো না টমের। এমনকি আফ্রিকার সিংহের মাঝেও ও এরকম গতি দেখেনি। সাদা লম্বা গোফগুলো খাড়া খাড়া হয়ে আছে, প্রচণ্ড আক্রোশে মুখব্যাদান করে আক্রমণ করে বসলো বাঘটা। লেজটা একটা বাঁকা তরবারির মতো পিঠের উপর সোজা হয়ে আছে। থাবাগুলো একেকটা স্যুপের বাটির সমান। সেগুলো পুরোটা সামনে ছড়িয়ে মাটি দাবিয়ে ছুটে এলো সামনে। একটা মাহুতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘটা। এক থাবায় লোকটার মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে গেলো। হতভাগ্য লোকটা পিছন দিকে দুই ভাজ হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে।

কিন্তু বাঘটা লাশের দিকে কোনো নজরই দিলো না। পরের লাফে ওটা একজন পলায়নরত লোকের উপর গিয়ে পড়লো। এক কামড়ে তার মাথাটা ছিঁড়ে ফেললো বাঘটা; আরো একজন শিকার হলো ওর, আরো একজন। মুহূর্তে নরক গুলজার হয়ে গেলো জায়গাটায়। মানুষজন সব চিৎকার করে ছুটে পালাতে লাগলো, হাতীগুলোও ভয় পেয়ে আর্ত রব ছাড়তে ছাড়তে এদিকে সেদিকে দৌড় দিয়ে পায়ের নিচে পিষে মারলো কয়েকজনকে।

 টম একপাশে দৌড়ে গেলো। বাঘের দিকে নিশানা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু লোকজন আতংকিত হয়ে উল্টোপাল্টা ছোটাছুটি করতে থাকায় তাক করতে পারলো না, বরং কয়েকজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে মরার জোগাড় হলো। টম দেখলো ফ্রান্সিস ওর বন্দুক তুলে উন্মত্ত জানোয়ারটার দিকে গুলি করলো। কিন্তু গুলি করার আগ মুহূর্তে একজন ঢাকী ওর সামনে চলে আসায় গুলিটা গিয়ে লাগলো লোকটার বুকে। মাটিতে পড়ার আগেই মারা গেলো সে। হাত থেকে ছুটে পড়ে গেলো তার ঢাকটা।

শাহুজি এতো কিছুর মাঝেও নিজের জায়গা ছেড়ে নড়েননি। নিজের বন্দুকটা উপরে তুলে ধরে বাঘটাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্যে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন; “এদিকে আয় শয়তান! তোকে আমি তোর শয়তান প্রভুগুলোর কাছে ফেরত পাঠাবো। আয় এদিকে।”

বাঘটা মনে হলো তার ডাক শুনতে পেয়েছে। কারণ এরপরেই ওটা সোজা তার দিকে দৌড় দিলো। প্রচণ্ড একটা হুঙ্কার ছাড়লো বাঘটা, যেনো শাহুজির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। দাঁতগুলো ওটার থাবায় মরা মানুষগুলোর রক্তে লাল হয়ে আছে। সেগুলো বের করে রেখেই ছুটে এলো জানোয়ারটা। শাহুজি সামনে ঝুঁকে বন্দুকের বাটটা নিজের কাঁধে ঠেকালেন। ট্রিগারে আঙুল স্থির। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন।

ঠিক তখনি টম দেখতে পেলো যে শাহুজি হাতীটা খেয়াল করেননি। এটা হচ্ছে সেই হাতীটা যেটা দিঘিতে পানি খেতে গিয়েছিলো। এখন বাঘের গন্ধ আর গর্জনে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে। অন্ধের মতো সোজা রাজার দিকে ছুটছে।

 টম চিৎকার করে ডাকলো রাজাকে। কিন্তু রাজার সমস্ত মনোযোগ তখন তার সামনে আগুয়ান হিংস্র শার্দুলটার দিকে। হাতীটাও শুড় দিয়ে ক্রমাগত বাঘটার গন্ধ পাচ্ছে, আর কানে ওটার গর্জন বাজতে থাকায়, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে পাত্তা দিলো না। ওটার সামনের উদ্যত পা-টা সোজা শাহুজির পিঠে গিয়ে লাগলো। শাহুজি বাতাসে উড়ে প্রায় পনেরো ফুট দূরে গিয়ে পড়লেন। গুলিভরা বন্দুকটাও ছিটকে গেলো হাত থেকে। ওটা উড়ে গিয়ে পড়লো অ্যানার পায়ের কাছে। ও দ্রুত সেটা তুলে নিলো হাতে।

 হাতীটা লম্বা ঘাসের জায়গাটার দিকে ছুটে চলে গেলো। বাঘটা যখন দেখলো যে সামনে আর রাজা নেই, তখন ওটা দৌড় থামিয়ে নতুন কোনো শিকারের সন্ধানে মাথাটা ডানে বামে ঘুরাতে লাগলো।

 ফ্রান্সিসের দিকে নজর গেলো বাঘটার। গর্জন ছেড়ে ওর দিকে ধাওয়া দিলো এবার। ফ্রান্সিস ওর অস্ত্রটা তাক করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। ওর চোখের উদ্ৰান্ত দৃষ্টি আর ফ্যাকাশে চেহারা দেখেই টম বুঝলো যে ফ্রান্সিসের মাথা কাজ করছে না। সম্ভবত এর আগে কখনো এতো ভারী বন্দুক চালায়নি ফ্রান্সিস। আর জীবনে কখনো এরকম আক্রমণোদ্যত কোনো শিকারি প্রাণীর সামনে তো পড়েই নি।

 টম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে গুলি করে বাঘটাকে লাগানো সম্ভব না; তার উপর অ্যানা ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ফ্রান্সিসের জীবন বিপদাপন্ন, তাই শেষ সম্ভাবনাটুকুও কাজে লাগাতে হবে। ও নিজের বন্দুকটা তুলেই গুলি করলো। কিন্তু সাথে সাথে টের পেলো কিছু একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। বন্দুকের নল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, কিন্তু ওটার বাট ওর গায়ে কোনো ধাক্কা দিলো না। হয় ওর সাথের শিকারি গুলি ভরতে ভুলে গিয়েছে, অথবা হাতীর পিঠ থেকে নামার সময় ঝুঁকিতে গুলিটা পড়ে গিয়েছে।

ঘটনা যেটাই হোক, বাঘটা এখনো আগের গতিতেই ফ্রান্সিসের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। একদম শেষ মুহূর্তে মনে হলো ফ্রান্সিস ওর সাহস ফিরে পেয়েছে। ও নিজের বন্দুকটা উপরে তুলেই গুলি করলো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ও তাকিয়ে ছিলো বাঘটার দিকে, বন্দুকের নিশানা যে ঠিক কোনদিকে পড়েছে সে খেয়াল ছিলো না। গুলিটা বাঘের তিন-চার ফুট বাম দিয়ে ছুটে আরো ছয়ফুট পিছনে মাটিতে গিয়ে গাঁথলো।

ফ্রান্সিস আর উপায়ন্তর না দেখে বন্দুকটা ফেলে ঘুরে দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু বাঘটা ততোক্ষণে ওর দিকে ঝাঁপ দিয়েছে। মুখটা হাঁ করে খোলা, সামনের দুই থাবা ওর দিকে প্রসারিত। ফ্রান্সিস অসহায়ের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে চিৎকার করে বললো, “না! না!”

আর একটা গুলির শব্দ কাঁপিয়ে দিলো চারপাশ। বাঘটাকে দেখে মনে হলো বাতাসে থাকতেই একটা ঝাঁকি খেলো যেন। কিন্তু ওটার ভরবেগ ওটাকে ঠিকই ফ্রান্সিসের উপর নিয়ে ফেললো। ধাক্কায় মাটিতে আছড়ে পড়লো ফ্রান্সিস। আর জটাও পড়লো ওর উপর।

টম প্রায় সাথে সাথেই ওদের কাছে পৌঁছে গেলো। বাঘের মাথাটা টেনে ধরলো ওতারপর কিভাবে ঐ তাগড়া দেহটা ফ্রান্সিসের উপর থেকে টেনে সরালো ও নিজেও জানে না।

“তুমি ঠিক আছো?” চিৎকার করে জানতে চাইলো টম।

“মনে তো হচ্ছে,” ফ্রান্সিস হামাগুড়ি দিয়ে বাঘের তলা থেকে বেরিয়ে এলো। “আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। ধন্যবাদ চাচা।”

“আমি না! আমার বন্দুকেতো গুলি-ই ছিলো না…” বলে টম আশেপাশে তাকালো। আর তখনি প্রথমবারের মতো অ্যানাকে চোখে পড়লো। ওদের ওখান থেকে দশ ফুট মতো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ও। তখনও রাজার লম্বা বন্দুকটার বাট ওর কাঁধে ঠেকানো। নীলচে একরাশ ধোয়া বন্দুকের নল থেকে উড়ে যাচ্ছে।

“অ্যানা দুয়ার্তে!” টম ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁপতে থাকা হাত থেকে বন্দুকটা নামিয়ে নিলো। “তুমি গুলি করেছিলে?” অ্যানা মাথা ঝাঁকালো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। “একজন পুরুষ মানুষও এটার জন্যে সারা জীবন গর্ব করবে।” টম বললো।

টম আবার ফিরে এসে বাঘের মাথাটা দুই হাত দিয়ে মুচড়ে উল্টো করে ধরলো। অ্যানার গুলিটা সোজা জন্তুটার কপালে লেগেছে। ঘিলু ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছে ওটা।

“আর একজন মহিলার এরকম গুলির জন্যে দ্বিগুণ গর্ব করা উচিত।”

“আমার এটা ছাড়া আর উপায় ছিলো না; ফ্রান্সিস ছাড়া আমার আর কেউ নেই,” কান্না সামলাতে সামলাতে বললো অ্যানা।

*

চিত্তিত্তিঙ্কারায় রানির মহলে প্রবেশ করতেই টমের গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। এখানে যারা যারা মারা পড়েছে তাদের কথা মনে পড়লো ওর। ক্যাপ্টেন হিকস, লরেন্স ফয় সহ আরো অনেকে। তারপরেই ওর মনে হলো ঘটনাগুলো আসলে স্বপ্ন ছিলো কিনা। দেয়ালের বুলেটের ছিদ্রগুলো বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। পাথরের গায়ে লেগে থাকা রক্তের দাগও আর নেই। ভেঙে পড়া ব্যালকনিটা ঠিকঠাক করা হয়েছে। এখানে যে যুদ্ধ হয়েছিলো তার একমাত্র প্রমাণ হলো দেয়ালে করা নতুন প্রাস্টার। সেদিনের হত্যাকাণ্ডের কথা মনে আসতেই প্রচণ্ড রাগ হলো ওর।

দরবার ঘরটাও অনেকগুলো তিক্ত স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো। গতবার যখন এসেছিলো, তখন এখানে নেপচুন তরবারিটা নিয়ে টুঙ্গারের সাথে লড়াই করতে গিয়ে প্রায় মরতে বসেছিলো। আর এবার রানি নিজে ওকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেলেন। যেনো ওদের মাঝে কিছুই হয়নি। শাহুজির মতো ইনিও যা কিছু রাজ্যশাসনের জন্যে ঝামেলাপূর্ণ তা ভুলে যেতে সিদ্ধহস্ত। আসলে সব শাসকেরই এই গুণটা থাকে। টম ভেবে পেলো না ও কি এজন্যে রানিকে করুণা করবে নাকি ঈর্ষা করবে।

তবে এসব বাজে চিন্তায় বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করলো না ও।

“সাতারার রাজা, ছত্রপতি শাহুজির পক্ষ থেকে এসেছি আমি। আমার জাহাজ থেকে যে কামানগুলো উদ্ধার করেছিলেন সেগুলো ফেরত নেওয়ার জন্যে পাঠিয়েছেন উনি। ব্রিঞ্জোয়ানের কাছেই ওনার পাঠানো জাহাজ অপেক্ষা করছে। আপনি ওগুলো দিয়ে দিলেই ওটায় করে নিয়ে যাওয়া হবে।” এই জাহাজে করেই টম সাতারার কাছের সৈকত থেকে এখানে এসেছে। ফ্রান্সিস আর অ্যানা থেকে গিয়েছে শাহুজির মহলে। শাহুজি টিরাকোলা দুর্গ অবরোধের জন্যে নিজের সৈন্যদল প্রস্তুত করছেন।

টমের রাগ দেখে রানি হাসলেন। হাসলে তাকে এতো সুন্দর দেখায় যে এক মুহূর্তের জন্যে টম সব ভুলে থমকে গিয়েছিলো।

“কামানগুলো আমি উদ্ধার করেছি, তাই ওগুলো আমার,” রানি ব্যাখ্যা করলেন। “এই উপকূলে যত জাহাজডুবি হয়, সেগুলোর মালামালসহ সব আমার।” বলে উনি এক হাত তুলে টমকে কিছু বলা থেকে নিবৃত করলেন। “ক্যাপ্টেন কোর্টনী, আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। বরং আমি কেন যেনো আপনার প্রতি একটা অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ করি। তাই যদি আমার সামর্থ্য থাকতো তাহলে আমি কোনো ধরনের বাহানা ছাড়াই সবগুলো কামান আপনাকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে ওগুলো আর আমার কাছে নেই। আমার সৈন্যরা যখন ব্রিঞ্জোয়ানের অবরোধ ছেড়ে পালিয়ে আসে, তখন তারা কামানগুলোও ওখানে ফেলে আসে। পর টুপিওয়ালারা ওগুলো নিয়ে নেয়। আমি শুনেছি ওগুলোকে ওরা ওদের দুর্গের দেয়ালে লাগিয়েছে।”

টম মনে মনে অভিশাপ দিলো ভাগ্যকে। এমনটা হবে সেটা ধরেই রেখেছিলো, কিন্তু তবুও রানির কাছে আগে এসেছে যদি ওর ধারণা ভুল হয়, সেই আশায়। আর গাই যদি বোম্বে থেকে ওর পালানোর খবর এখানে পাঠিয়ে থাকে, তাহলে কামানগুলো আনতে ব্রিঞ্জোয়ানে গেলে যে সমাদর পাবে না তা বলাই বাহুল্য।

“এতো কষ্ট করে আমার কাছে আসার পরেও আপনার সময় নষ্ট হলো দেখে খারাপ লাগছে,” রানি বললেন। “কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি আসলে আপনার সাথে আবার দেখা হওয়ায় মন থেকে খুশি হয়েছি। আর কোনোভাবে কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?” বলে রানি নিজের সিংহাসনে ঝুঁকে এলেন। এতে তার স্তনযুগলও আরো বেশি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো।

 “আর একটা ব্যাপার।” ওর প্রতি রানির এই পরিবর্তিত মানসিকতা টমকে একটু অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। তাই ও ঠিক করলো এটার পুরো সুবিধা আদায় করবে। আপনার সেনাপতি টুঙ্গার আমার একটা তরবারি কেড়ে নিয়েছিলো। ওটা আমার পরিবারের ঐতিহ্য। তরবারিটার সাথে আমার অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে। স্বর্ণের গিলটি করা ছিলো তরবারিটায়। হাতলে ছিলো একটা বিশাল নীলকান্তমণি।”

“আমি চিনি ওটাকে।” মাথা ঝাঁকালেন রানি। সত্যিই দুর্দান্ত ছিলো তরবারিটা। টুঙ্গার ওটা সবাইকে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াতো। অবরোধের সময়েও ওর সাথেই ছিলো ওটা।”

“হ্যাঁ,” টম বললো। “টুঙ্গার মারা যাওয়ার পরে তার লাশটা আমি ব্রিঞ্জোয়ানের কাছেই খুঁজে পাই। কিন্তু অস্ত্রটা ওর কাছে ছিলো না।”

“আপনাদের কেউ হয়তো নিয়ে নিয়েছে।”

“আমিই সবার আগে ওর লাশটার কাছে পৌঁছেছিলাম। যদি কেউ নিয়ে থাকে তো আপনার সৈন্যদের কেউই নিয়েছে।”

রানি হাত নেড়ে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলেন। টম তার হাতটা খেয়াল করলো; ওগুলো দারুণ সুন্দর, ঠিক তার চেহারার মতোই। “আমার কোনো প্রজা আমার কাছে থেকে এরকম কিছু লুকিয়ে রাখার সাহস করবে না। একজন কৃষক এরকম একটা অস্ত্র দিয়ে করবেই বা কি? আর আমার চোখ এড়িয়ে এতো দামি একটা জিনিস বিক্রি-ইবা করবে কার কাছে? আর যদি ওটা পাওয়া না যায়, তার মানে ওটা হয় সাগরের ভেসে গিয়েছে, নয়তো কেউ লুট করেছে।”

টমের উত্তরটা মনঃপুত হলো না। যদিও ও জানে যে রানি ঠিকই বলছেন। আর একটা প্রশ্ন আছে ওর।

“আপনার দলে একজন লোক ছিলো-লোকটা শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলতে পারতো, আর একটা অদ্ভুত তরবারি ছিলো তার। অনেকটা চাবুকের মতো। তার কি হয়েছে?”

“ওর নাম ছিলো আৰসালম। শেষদিন যুদ্ধের পর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ওর। আমরা ওর লাশও খুঁজে পাইনি। হয়তো দুর্গের ফটকের কাছে যে বিস্ফোরণ হয়েছিলো সেটায় চাপা পড়েছে।”

 রানির কথাগুলো টমকে কেনো যেনো খুব কষ্ট দিলো। অবশ্যই একজন ডাকাতের মৃত্যুতে ওর কিছুই আসে যায় না। কিন্তু তবুও কেন যেনো মন মানতে চাইলো না। আবসালম নামের লোকটার সাথে ওর কিছু দেনা পাওনা ছিলো-ক্যাপ্টেন হিকসের মৃত্যুর বদলা নেওয়া তো আছেই। কিন্তু সেই সাথেও কিছু আছে।

টম যাওয়ার জন্যে ঘুরলো।

“দাঁড়ান,” আদেশ না অনুরোধের সুর রানির গলায়। টম থেমে দাঁড়ালো। “অনেক টুপিওয়ালাই ভারতে এসে সৈনিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন।”

“আমি সাতারার রাজার হয়ে কাজ করি,” টম জবাব দিলো।

“উনি যতো টাকাই দিক আমি তার তিনগুণ দেবো। আমার রাজ্যের একজন উচ্চ ক্ষমতাসীন হতে পারবেন আপনি। আপনার আর জীবনে কিছুই লাগবে না।”

রানির গাল হালকা লাল হয়ে গিয়েছে। তার অলংকারে ভরা হাতটা ওনার গলা আর স্তনযুগলের মাঝের উপত্যকায় স্থির হয়ে আছে।

“আমার সাথে থাকুন, টমাস কোর্টনী।” রানির গলা খাদে নেমে এসেছে। “আমার আপনাকে দরকার।”

 কামনা আর অপরাধবোধ দুদিক থেকে টেনে ধরলো টমকে। মনে হলো ওর চেতনার ভিত্তিমূল ধরে ঝাঁকি দিয়েছে কেউ। রানি খুব বেশি সুন্দর, কিন্তু একই সাথে খুব বেশি শয়তানি তার মনের ভিতর।

টম নিজের টুপির প্রান্ত ধরে মার্জিতভাবে কুর্নিশ করলো। “দুঃখিত, মহামান্য। আমাকে যে এখন আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে যেতে হবে।”

*

ব্রিঞ্জোয়ানের কুঠিতে আবার এসে রানির মহলের চাইতেও বেশি অবাক হলো টম। ফটকের প্রহরী ওর দিকে এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো যেনো ও কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা।

“মিস্টার উইল্ড?” কথা জড়িয়ে গেলো প্রহরীর।

টম ওকে চিনতে পারলো। অবরোধের পরেও বেঁচে যাওয়া সিপাহীদের একজন। ও লোকটার নাম মনে করার চেষ্টা করলো। “আকাল?”

টম ওকে চিনতে পারায় প্রহরীর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “স্বাগতম সাহেব।”

“নতুন গভর্নর এসে গিয়েছেন?”

“তিন সপ্তাহ আগে এসেছেন।” দাঁত বের করে বললো আকাল। যেনো এটা খুব হাসির কিছু। “তবে আমার মনে হয় না উনি আপনাকে দেখে খুশি। হবেন।”

“তাহলে এখনি আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও।”

দুৰ্গটা পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। এখনো পুরো শেষ হয়নি। বেশ কয়েকজন অর্ধনগ্ন শ্রমিককে দেখা গেলো পাথর, ইট-সুরকি আনা নেওয়া করছে। এখনো ফটকটা পুরো নির্মাণ শেষ হয়নি। তবে টম যে গভর্নরের বাড়িটা ভেঙে ফেলেছিলো, সেটা আবার নির্মাণ শেষ। এবার খড় পাতার বদলে ইট আর টাইলস দিয়ে ছাদ বানানো হয়েছে দেখে খুশি হলো ও। শেষমেশ শিক্ষা হয়েছে তাহলে।

গভর্নরের অফিসের দরজায় কোনো প্রহরী দেখা গেলো না। “বাইরেই থাকো,” টম আকালকে বললো। “তুমি যে আমাকে ঢুকতে দিয়েছো এটা ওর না জানাই ভালো।”

দরজায় নক না করেই ভিতরে ঢুকে পড়লো টম। গভর্নরের ডেস্কে কাগজপত্র জমে পাহাড় হয়ে আছে। তবে সেগুলো নিশ্চয়ই জরুরি কিছু না। কারণ গভর্নরকে দেখা গেলো পাশেই একটা ছোট বিছানায় শুয়ে আছেন। আধো ঘুমে রত উনি, বুকের কাছে একটা ওয়াইন ভরা গ্লাস ধরা। কিছু চলকে পড়ে ওনার সাদা জামার উপর লম্বা একটা দাগ সৃষ্টি করেছে, দেখে মনে হচ্ছে কেটে গিয়েছে।

টম দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। গভর্নর চমকে উঠে ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন। আরো ওয়াইন চলকে পড়লো ঝাঁকিতে। টমের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন উনি।

“মিস্টার উইল্ড, চি চি করে বললেন গভর্নর।

টম চেহারা কালো করে মাথা ঝাঁকালো। ও যে অবাক হয়েছে সেটা প্রকাশ। করলো না। “মিস্টার কাইফেন।”

“কি-আহ-কেন…?” কাইফেন টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো।

“আমার কামানগুলো নিতে এসেছি,” সরাসরি বলে দিলো টম। “যে নাইন পাউন্ডারগুলো রানি জাহাজ থেকে উদ্ধার করেছিলো। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যেগুলো কোম্পানি তুলে এনেছে।”

কাইফেন হতবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো।

“আপনি কি এখন বলবেন নাকি যে ওগুলো আপনার সম্পত্তি?” জিজ্ঞেস করলো টম। “কোম্পানির জন্যে এতো কিছু করলাম। এখন আপনি অন্তত আমাকে আমার জিনিস ভালয় ভালয় নিয়ে যেতে দিন।”

কাইফেন অবশেষে বাকশক্তি ফিরে পেলো। “হাবলাদার, “ চিৎকার করলো

দরজা খুলে গেলো। টম ঘুরে তাকিয়ে আর একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেলো। সেই গোফওয়ালা সার্জেন্ট। অবরোধের সময় একসাথে লড়াই করেছিলো ওরা। হাবিলদারের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে কোমর থেকে পিস্তল বের করে টমের দিকে তাক করে ধরলো।

“এই লোকটা একজন খুনী, একটা চোর, জালিয়াত! লন্ডন আর বোম্বে দুই জায়গাতেই তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে, কো কো করে বললো কাইফেন। “এখনি বন্দী করো একে।”

হাবিলদার টমের দিকে চেয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে গোঁফে তা দিতে লাগলো। তারপর পিছনে ফিরে ওর লোকেদের কিছু একটা আদেশ দিলো। ঘরের বাইরের ত্রস্ত পদশব্দ শুনতে পেলো টম।

টমের মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছে। ওর নিজের পিস্তল আছে, জুতোর ভাজে একটা ছুরিও আছে। কিন্তু হাবিলদারের উদ্যত পিস্তলের চাইতে দ্রুত ও পিস্তল বের করতে পারবে না।

“মিসেস হিকস আর আমার স্ত্রীকে আংরিয়ার হাত থেকে উদ্ধার করতে আমার ঐ কামানগুলো লাগবে,” টম কাইফেনকে বললো। “আর ওরা ঐ শয়তানের হাতে ধরা পড়েছিলো আপনার জন্যেই। আপনি যখন পালাচ্ছিলেন, তখন আমি এখানে বসে আপনার এই দামী কুঠি জীবন দিয়ে আগলে রেখেছিলাম।”

 দুজন সিপাহী করিডোর দিয়ে ভিতর প্রবেশ করলো। দুজনের হাতেই হাতকড়া। টমের কিছুই করার নেই। ও নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। “এভাবেই কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে?”

কাইফেন জবাব দিলো না। টমের কথা শেষ না হতেই হাবিলদার ওর পিস্তলের নিশানা টমের দিক থেকে কাইফেনের দিকে সরিয়ে নিলো। একই সময়ে সিপাহী দুজন টমকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে কাইফেনের হাত জোর করে টেনে ধরে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। হাতকড়ার অন্য প্রান্তটা আটকালো চেয়ারের হাতলের সাথে।

 “এটা কিন্তু বিদ্রোহের শামিল,” চেঁচিয়ে উঠলো কাইফেন। “গভর্নর কোর্টনী যখন সব শুনবেন

“তাতে আমার প্রতি গাই-এর ধারণা এক কণাও পরিবর্তন হবে না, উল্লসিত কণ্ঠে বললো টম। ও কাইফেনের কোটের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে কাইফেনের মুখে গুঁজে দিলো, যাতে আর ঘ্যানঘ্যান না করতে পারে। তারপর হাবিলদারকে জড়িয়ে ধরলো।

“ধন্যবাদ, বন্ধু,” টম বললো। “যদিও এটা করা ঠিক হলো না। ওরা আপনাকে বিদ্রোহের দায়ে ফাঁসি দিতে পারে।”

হাবিলদার দাঁত বের করে হাসলো। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। “আংরিয়া আসলেই মিসেস হিকসকে আটক করে রেখেছে?”

“হ্যাঁ, আর আমার স্ত্রী সারাহকেও। টিরাকোলার দুর্গে বন্দী ওরা।”

 “কামানগুলো ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে জাহাজ এনেছেন?”

 “সৈকতে অপেক্ষা করছে।”

“জাহাজে আর একজন লোকের জায়গা হবে তো? আমি যেতে ইচ্ছুক।”

টম হাবিলদারের হাত চেপে ধরলো। “ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।” তারপর টম কাইফেনের দিকে তাকালো। চেয়ারে বসে গোঁ গোঁ করছে আর বাঁধন খোলার জন্যে. অযথা টানাটানি করছে। আমি আমার কামানগুলো নিয়ে যাচ্ছি। আর সেই সাথে ভাবছি কোম্পানীকে কিছু পাউডার আর গোলাবারুদের ভার থেকেও মুক্ত করে দেবো।”

 কাইফেন আক্রোশে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে মুখের রুমাল ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু টম আবার ওটাকে ভিতরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে কাইফেনের কোমর থেকে বেল্ট খুলে ওর মুখে লাগিয়ে দিলো।

 “কাজ শেষে ছেড়ে দেবো আপনাকে। হাবিলদার সাহেব আমাকে সাহায্য করছেন, তবে আপনার যদি মনে হয় যে আমি কামানগুলো একা সরাতে পারতাম না, তাহলে সাবধান করে দিচ্ছি। যদি আমাকে সাহায্য করেছে সন্দেহে কোনো সিপাহীর গায়ে একটা আঙুলও তোলা হয়, আমি কিন্তু সে খবর পাবো। আর আমি তার শোধ তুলবোই। রানি মিস্টার ফয়কে কি করেছিলো মনে আছে তো? আমি আপনার যে অবস্থা করবো, তার তুলনায় সবাই বলবে ওটা কিছুই না। বোঝা গিয়েছে?”

কাইফেন মোচড়ামুচড়ি বন্ধ করে অসহায় চোখে মাথা ঝাঁকালো।

“মিসেস ফয়কে আপনার শুভেচ্ছা পৌঁছে দেবো,” টম আশ্বস্ত করলো ওকে।

*

কামানের মুখ থেকে আগুন বেরিয়ে এলো। টেলিস্কোপ দিয়ে টম দেখতে পেলো গোলাটা দুর্গের ফটকের বামে গিয়ে আঘাত করলো। জায়গাটা আগের গোলার আঘাতে খানিকটা ভেঙেই ছিলো, এখন আরো খানিকটা পাথর টুকরো হয়ে গড়িয়ে পড়লো। গোলন্দাজের নির্ভুল নিশানার প্রশংসা করতেই হয়। পিছনেই টম শুনতে পেলো মেরিডিউ মারাঠা গোলন্দাজদের চিৎকার করে। উৎসাহ দিচ্ছে। “ওয়ার্ম এন্ড স্পঞ্জ। পাউডার।” ওর প্রশিক্ষণে এর মধ্যেই ওদের গোলা ভরার সময় দশ থেকে পাঁচ মিনিটে নেমে এসেছে। দস্যুদের দুর্গের ভিতর ঢুকতে পারলে কি কি গুপ্তধন পাওয়া যাবে সেসব গল্প সৈন্যদেরকে শুনিয়েছে মেরিডিউ। তাতেই ওদের উৎসাহ বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ।

ব্রিঞ্জোয়ান থেকে উদ্ধার করে আনা কামানগুলো নিয়ে শাহুজির সৈন্যদল এখানে এসে হাজির হয়েছে আজ পাঁচ সপ্তাহ। পাঁচ সপ্তাহ ধরেই ওই পুরু দেয়ালগুলো ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছে ওরা। এতো বেশি লোকজন এই দুৰ্গটাকে অজেয় বলেছে যে আর একটু হলে টমও কথাটা বিশ্বাস করে বসতো। কিন্তু এখন ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে ওটার দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করার পর মনে হচ্ছে আশা ছাড়া ঠিক হবে না।

এটা সত্যি যে সমুদ্রপথে যে কোনো আক্রমণই বৃথা যাবে। খাড়া গিরিখাতটার গোড়ায় কোথাও এক চিলতে জায়গা নেই যেখানে একটা ঘাট বানিয়ে জাহাজ ভেড়ানো যাবে। আর আংরিয়া যেখানে ওর জাহাজের বহর ভিড়িয়ে রাখে তার চারপাশে কাটা গাছে ফেলে রেখেছে। ওখানে যাওয়া সম্ভব না। এছাড়া প্রবাল প্রাচীরে এখানকার পানি ভরা। জোয়ারের সময় দেখা যায় না। ফলে পানি নেমে গেলেই, দুর্গে বোমা বর্ষণ করতে আসা জাহাজগুলো ভয়ানক বিপদে পড়ে যায়।

ডাঙার দিক দিয়েও এটা আক্রমণ করা দুরূহ। দুর্গের ফটকের সামনের শৈল অন্তরীপটা খুব বেশি সরু। ফলে ওদিক দিয়ে আসতে গেলে ফটকে বসানো হালকা কামানগুলোর মুখোমুখি না হয়ে আসার উপায় নেই। দুর্গের দেয়াল ঘেঁষে ঘন কাটা ঝোঁপ জন্মে আছে। ওগুলো শুধু যে আক্রমণকারীদের আহত করে তা-ই না, ওগুলোর কণ্টকময় ডালগুলো কামানের গোলার আঘাত অনেকটা চুষে নেয়। ফটক থেকে চার ফুট লম্বা লোহার কাটা বেরিয়ে আছে বাইরে। ফলে হাত দিয়ে গুতো মেরেও ফটক খোলা সম্ভব হবে না।

কিন্তু এর বাইরে প্রতিরক্ষাকে সুসংহত করার আর কোনো চেষ্টা করা হয়নি। দুর্গ থেকে আধা মাইলটাক দূরে একটা ছোট পাহাড় আছে। ওখান থেকে চাইলেই দুর্গে গোলা ছোঁড়া যায়। পাহারার জন্যে আংরিয়া ওখানে একটা ছোট মিনার বসিয়েছিলো। তবে সেটা বসানোর উদ্দেশ্য ছিলো সমুদ্রে জাহাজ আছে কিনা তা দেখা। শাহুজির গোলন্দাজেরা এক বোমায় খুঁড়িয়ে দিয়েছে সেটাকে। তারপর পাহাড়ের চূড়ার দখল নিয়ে, মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, তাতে মাচা বানিয়ে কেস্ট্রেল-এর নাইন পাউন্ডারগুলো বসিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে দিন রাত সর্বক্ষণ বোমা মেরেই চলেছে। আর ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওদের প্রতিবন্ধকতা গুঁড়িয়ে পড়ছে।

টম প্রার্থনা করলো এটুকুই যেনো যথেষ্ট হয়।

*

শৈল অন্তরীপের গোড়ার জেটিটায় জেলেরা তাদের সারা দিনের শিকার নৌকা থেকে নামাচ্ছে। অবরোধের কারণে ওরা মাছের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ভালোই। কারণ দেয়ালের দুই পাশেই আগ্রহী ক্রেতা কম নেই। একটা নতুন ফসলের মাঠে পাখিরা যেভাবে ভীড় করে নৌকাগুলোও প্রতি সকালে সেভাবে এসে জড়ো হয়। কামানের গোলার আওয়াজ এখান থেকে শুনলে দূরে কোথাও বজ্রপাতের আওয়াজের মতো মনে হয়।

 শব্দটা এখন কানে এতোটা সয়ে গিয়েছে যে নৌকা থেকে মাছগুলো নামানো তদারকি করার সময় ক্রিস্টোফারের ওগুলো আর খেয়ালই হলো না। একটা ঢেউ এসে পাথরে আছড়ে পড়তেই ওর মুখে এসে পানির ছিটা লাগলো। সমুদ্রে দেখা গেলো একটা সওদাগরি জাহাজের পাল ধীরে সুস্থে উপকূল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ওটার নির্ভীক চলে যাওয়া দেখে এক অক্ষম আক্রোশে ছেয়ে গেলো ক্রিস্টোফারের মন। মারাঠাদের সমুদ্রের দিক থেকে দুৰ্গটা আক্রমণ করার সামর্থ নেই। কিন্তু তবুও আংরিয়া জাহাজগুলোকে বের করতে দেবে না। ওর নাকি দুৰ্গটা রক্ষা করতে সকল লোক আর কামানের দরকার হবে। তাই জাহাজের বহর এখনো গাছের গুঁড়ির বেষ্টনীর এপাশেই নোঙর করে আছে। আর স্থানীয় সওদাগরেরা কোনো ভয় ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছে।

 ক্রিস্টোফার টিরাকোলাতে এসেছে শুধুমাত্র ধনী হওয়ার আশায়। আর এখন যেহেতু জাহাজ নিয়ে বের হওয়া যাচ্ছে না, আর কোনো লুটপাট বা ডাকাতির সুযোগও নেই, তাই বর্তমান জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া অকর্মণ্যতা আর টাকা পয়সার কমতি ওর মাথা গরম করে দিচ্ছে।

ওখানে যে শুধু ওর একারই এরকম লাগছে, তা কিন্তু না। বেশ কয়েকজন দস্যুই অসন্তোষ প্রকাশ করা শুরু করেছে, প্রথমে ফিসফিস করে হলেও ইদানীং আংরিয়ার সামনেই বলে উঠছে কেউ কেউ। ওরা জানে যে মারাঠাদের পক্ষে দুৰ্গটা দখল করা সম্ভব না। এটা অজেয়, দুর্ভেদ্য। এর একটা কারণ হচ্ছে, সমুদ্রপথে ওরা অফুরন্ত রসদপত্র জোগাড় করতে পারবে। ফলে অনাহার বা অন্য কোনো ভয় ওদের নেই। কিন্তু তাহলে কেন ওরা খামাখা বসে না থেকে নিজেদের রুজির সন্ধানে বের হবে না?

ক্রিস্টোফার এ ব্যাপারে কিছু একটা করবে বলে ঠিক করলো।

বেশিরভাগ জেলেরই মাছ দেওয়া শেষ। আবার নিজেদের জালের কাছে। ফিরে যাচ্ছে। এখন যে মাছগুলো ধরা পড়বে সেগুলো ওরা সন্ধ্যায় মারাঠাদের কাছে বিক্রি করবে। ওদের কাছে যুদ্ধ বেঁধে বরং ভালোই হয়েছে। আয় ইনকাম বেড়েছে। মাছ ভরা পিপাগুলো একটা কপিকলে করে দুর্গের দেয়ালের পাশ দিয়ে উপরে তুলে নেওয়া হচ্ছে।

অন্যান্য দস্যুরা আবার দুর্গের ভিতরে নিজেদের জায়গায় ফিরে গেলেও, ক্রিস্টোফার দাঁড়িয়ে থেকে মাঝির সাথে কথা বলতে লাগলো।

সবাই চলে গেলে ক্রিস্টোফার এক জেলেকে একপাশে টেনে নিলো। ও জানে এই জেলেটাকে ভরসা করা যায়। কারণ গত এক সপ্তাহ ধরে লোকটা মাছের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার পরেও, ক্রিস্টোফার তেমন কিছুই বলছে না। কারণ লাভের ভাগ ও নিজেও পাচ্ছে। এখন ক্রিস্টোফার ওকে পাহাড়ের গোড়ায় এমন এক জায়গায় নিয়ে গেলো যেখানে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দে ওদের কথোপকথন শোনা যাবে না।

“আজ মারাঠাদের ওখানে যাবেন?”

জেলে মাথা ঝাঁকালো।

“তাহলে আমার পক্ষ থেকে ওদেরকে একটা খবর পৌঁছে দিতে হবে।”

ক্রিস্টোফার ওর কথাটা বললো, তারপর জেলের কাছ থেকে দুইবার শুনলো। কাগজে লিখে দেওয়ার দুর্বুদ্ধি করলো না।

 “যদি ধরা খান, আমি কিছুই স্বীকার করবো না। আর যদি আমার সাথে বেঈমানি করেন, তাহলে আপনার পুরো পরিবারকে খুঁজে বের করে আপনি মাছের পেট যেভাবে ফাড়েন সেভাবেই ফেঁড়ে ফেলবো। বোঝা গিয়েছে?”

জেলে কাঁপতে শুরু করলো। ক্রিস্টোফার হেসে ওর কাধ চাপড়ে দিলো।

“যদি সব ঠিকঠাকমতো হয়, তাহলে দুজনেই লাভ ভাগ করে নেবো। আপনাকে আর জীবনেও মাছ ধরে খেতে হবে না।”

*

সেই রাতে শাহুজি টমকে নিজের তাঁবুতে ডেকে নিলেন। তাঁবুটা দুর্দান্তভাবে বানানো হয়েছে। একজন রাজার জন্যে উপযুক্ত। তাঁবুর ভিতরে আবার ভারী রেশমের পর্দা ফেলে কয়েকটা ঘরে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলোর ভিতরে মেহগনি কাঠের দামি সব আসবাব। কোনায় কোনায় সুগন্ধী ধূপ জ্বলছে, ফলে বাইরের দুর্গন্ধ ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না। ভিতরে ঢোকার পর এটা যে যুদ্ধক্ষেত্র সেটাই বোঝার কোনো উপায় থাকলো না। শুধু কামানের গোলার শব্দই মনে করিয়ে দিচ্ছে সেটা। প্রতিবার গোলা ছোঁড়া হতেই তাবুটা কেঁপে ওঠে। তাবুর ভিতরের স্বর্ণের থালা আর গ্লাসগুলোও কাঁপতে থাকে সেই সাথে।

“অগ্রগতি কেমন আমাদের?” রাজা জিজ্ঞেস করলেন।

“দেয়ালের ফাটল বাড়ছে,” টম জবাব দিলো! “কাজটা অনেক আস্তে আস্তে হচ্ছে-দেয়ালগুলো একেকটা পনেরো ফুট পুরু। তবে একটু একটু করে হলেও ভেঙে পড়বে যে কোনো সময়।”

“বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে,” শাহুজি বললেন। “ব্রিঞ্জোয়ান থেকে যে গোলা বারুদ এনেছিলেন তাতে আর বেশিদিন চলবে না। আমার সৈন্যবাহিনি ওদের বাড়ি ছেড়েছে অনেকদিন। গত সপ্তাহেও যারা লড়াই করতে মুখিয়ে ছিলো আজ তারা বাড়ির জন্যে বেজার হয়ে আছে।”

“দস্যুদের গুপ্তধনের চেহারা দেখলেই ওদের সব অভিযোগ চলে যাবে।”

“যদি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাহলে।”

টমের চোখ সরু হয়ে গেলো। অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ও এই ভয়টাই করে আসছিলো : শাহুজি একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন বা টমের উপর আর ভরসা করতে পারবেন না।

“আপনি কি অবরোধ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন, মহামান্য?”

শাহুজি এক বাটি খেজুর টেনে নিলেন। তারপর একটা খেজুর মুখে পুরে রূপার একটা বাটিতে আঙুলের মাথাটা ধুয়ে নিলেন!!

“আমি শুনেছি আপনার দেশে নাকি লড়াই শুরু হলে মরার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে,” শাহুজি বললেন।

 টমের ব্লেনহেইম-এর যুদ্ধের কথা মনে পড়লো। কয়েক বছর আগেই যুদ্ধটা হয়েছিলো ফ্রান্স, ব্রিটেন আর রোমান সাম্রাজ্যের মাঝে। কেপ টাউনে বসে ও যা শুনেছে তা হচ্ছে ফ্রেঞ্চদের নাকি প্রায় তিরিশ হাজার সৈন্য মারা গিয়েছে, যা কিনা ওদের পুরো সৈন্যবাহিনির অর্ধেকেরও বেশি। টম মাথা ঝাঁকালো।

“ভারতে আমাদেরকে সেই তুলনায় সভ্য বলতে পারেন,” শাহুজি বললেন। “বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন আরকি। আমাদের মহামুণি কৌটিল্য বলেছিল যে বল প্রদর্শনের চাইতে ষড়যন্ত্র করে যুদ্ধে জেতা সহজ। সামনে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করার কি দরকার যদি কেউ তোমার জন্যে পিছনের দরজা দেয়?”

টম বুঝতে পারলো শাহুজি কি বোঝাতে চাচ্ছেন। “আপনার কি মমে পড়ে যে টিরাকোলায় সেরকম কেউ আছে?”

শাহুজি মাথা ঝাঁকালেন। আমাকে একজন একটা খবর পাঠিয়েছে।

কোর্টনীরা কখনোই এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে কিছু লাভ করতে আসে না। তবে টম ওনার কথাটার মর্মার্থ ধরতে পারলো। যদি দুর্গটা মুখোমুখি ছাড়াই দখল করে নেওয়া যায়, তাহলে খুব বেশি হতাহত হবে না আর। অ্যাগনেস আর সারাহকে অক্ষত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা-ও বাড়বে।

“কে খবর পাঠিয়েছে।”

“এক জেলে নিয়ে এসেছে খবরটা। সে বলেছে যে খবর দিয়েছে আংরিয়ার খুব কাছের লোক। সে নাকি টাকার সন্ধানে আংরিয়ার কাছে ভিড়েছিল, কিন্তু এখন নাকি বুঝতে পেরেছে যে আংরিয়ার সাথে বেই করেও টাকা কামাতে পারবে ও।”

“এরকম একটা লোককে কি বিশ্বাস করা ঠিক?”

“আমরা ওর বিশ্বাস কিনে নেবো,” শাহুজি একটা ছোট রেশমের ডাল টেনে নিয়ে হাতের তালুর উপর ঢাললেন। এক মুঠো কাটা হীরা তার হাতের চামড়ার উপর ঝিলিক মেরে উঠলো।

“কিভাবে কথা হবে লোকটার সাথে?”

“লোকটার পক্ষে কারো চোখে না পড়ে ডাঙা দিয়ে আমাদের কাছে আসা সম্ভব না। কিন্তু পাহাড়ের গোড়ায় নাকি পানিতে নামার জন্যে একটা পথ আছে। ওদিক দিয়ে আংরিয়া রসদপত্র আনা নেওয়া করে। কাল রাতে সেই লোকটাকে উপকূল ধরে একটা সৈকতে নিয়ে আসবে। আপনি গিয়ে তার সাথে কথা বলবেন।”

“যদি পুরোটাই একটা ফাঁদ হয়?”

শাহুজি হাতের মুঠো গোল করে আবার হীরা গুলো থলেটার ভিতর রেখে দিলেন। “সেরকম কিছু হলে, কি করতে হবে সেটা আপনি নিশ্চয়ই করতে পারবেন।”

*

পরের রাতটা ছিলো বেশ শান্ত আর পরিষ্কার। ক্ষয়ে যাওয়া একটা চাঁদ ঝুলে আছে আকাশে। বালি আর ঢেউয়ের ফেনার উপর তারার আলো পড়ে চিকচিক করছে। সৈকত ছেয়ে থাকা পাম গাছগুলোর একাটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টম। সাগর থেকে কেউ তাই ওর দিকে নিশানা করতে পারবে না। ছোট উপসাগরটার দুই পাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতশ্রেণির দিকে তাকালো ও একবার। ফ্রান্সিস আর মেরিডিউ আছে ওখানে। হাতে ফ্লিন্টলক বন্দুক। ম্যাচলকের আলো অন্ধকারে দেখা যেতে পারে।

 “আপনার কি মনে হয় যে ও আসবে?” মোহিত নামের সেই হাবিলদার বললো। টমের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সে। ও নিজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উর্দি ফেলে দিয়ে এখন ধুতি পরে আছে। হাতে একটা জৈত্রি (লাঠির মাথায় কাটা যুক্ত বল বেঁধে তৈরি করা অস্ত্র)। শাহুজির অস্ত্রভাণ্ডারের ভিতর থেকে খুঁজে বের করেছে।

সাগরের ভিতর থেকে কিছু একটা চি চি করে ডেকে উঠলো। এতো আস্তে যে ঢেউয়ের শব্দের আড়ালে প্রায় শোনাই যায় না। কিন্তু টমের সমস্ত ইন্দ্রিয় টানটান হয়ে আছে। ও অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। একটু পরেই সাগরের বুকে একটা আবছা কাঠামো চোখে পড়লো। ওটা একটা ছোট নৌকা। ভারতীয়রা এগুলোকে মাসসুলা বলে। এতো হালকা আর ছোট যে একটা ঢেউ-ই ওটাকে ঠেলে সৈকতে নিয়ে আসার জন্যে যথেষ্ট।

দুজন লোক লাফ দিয়ে নেমে ওটাকে টেনে বালিতে এনে রাখলো। একজন নৌকার পাশেই বসে থাকলো; আর একজন বুক ফুলিয়ে সোজা গাছের সারির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। একজন ভারতীয় হিসেবে অনেক লম্বা লোকটা। প্রায় টমের সমান বলা যায়। তারার আলোয় টম বুঝলো লোকটার মুখ ভরা দাড়ি গোফ। মাথায় পাগড়ি আর কোমরে একটা তরবারি ঝুলছে।

টমের একে আগে কখনো দেখার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু তবুও, এই অন্ধকারেও ওর লোকটার কিছু একটা চেনা চেনা মনে হতে লাগলো। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেলো ওর। জঙ্গলের ভিতর সেই জলার ধারে বাঘ খোঁজার সময়েও এমন লেগেছিলো। ও লোকটার চেহারা দেখার চেষ্টা করলো, কিন্তু তা অন্ধকারে ঢেকে আছে।

“কি নাম আপনার?” কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইলো মোহিত।

“রুদ্র।”

“ওকে জিজ্ঞেস করেন কিভাবে ও ফটকটা খুলবে,” টম মোহিতকে বললো।

ক্রিস্টোফার টমের গলা শুনে এতোটাই বিস্মিত হয়েছে যে ও আর একটু হলেই ইংরেজিতে জবাব দিয়ে বসেছিলো। ও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে হাবিলদারের অনুবাদ শোনার ভান করলো। ওর মনের ভিতর ঝড় চলছে। গাছের আড়ালে থাকার কারণে লোকটার চেহারা ছবি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু তবুও ওর মনে হচ্ছে যে ও লোকটাকে চেনে। ইনি কি বোম্বের কেউ নাকি?

 ওরা ক্রিস্টোফারের উত্তরের অপেক্ষা করছিলো। “আমি সদর দরজা খুলতে পারবো না। ওগুলোয় পাহারা খুব কড়া। আর আপনারা আগানো শুরু করলে সবাই দেখতে পাবে।”

“তাহলে?” টম অধৈর্য গলায় বললো। “আমাদেরকে এখানে টেনে আনার মানে কি?”

আবারও ক্রিস্টোফার জোর করে হাবিলদারের অনুবাদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। অবশ্য এতে করে সামনের ইংরেজ লোকটাকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেলো ও। লোকটা লম্বা, চওড়া কাঁধ, দাড়ি আর চুল দুটোই কালো। আত্মবিশ্বাসী হুকুম করে অভ্যস্ত। ঠিক ওর নিজের মতোই সব বৈশিষ্ট্য।

তারপর আচমকাই ও ধরে ফেললো লোকটা কে। টম উইল্ড, যে তাকে ব্রিথ্রোয়ানে পরাজিত করেছে; এনাকে সর্বশেষ দেখেছিলো দুর্গের ভেঙে পড়া

ফটকের উপরে। যার তরবারি এখন ওর কোমরে ঝুলছে। ইনি এখানে কিভাবে এলেন?

উইল্ড-ও একইভাবে ক্রিস্টোফারকে মন দিয়ে দেখছে। উনি কি ওকে চিনে ফেলেছেন? নাকি এটা সেই পুরনো চেনে চেনা ভাব?

 “আংরিয়া তার জাহাজগুলো দুর্গের উত্তরে একটা উপসাগরে নোঙ্গর করে রাখে, ওগুলোর চারপাশে গাছের গুঁড়ির বেড়া দিয়ে ঘেরা,” ক্রিস্টোফার বললো। জোর করে কণ্ঠ শান্ত রাখছে, সেই সাথে মাথা-ও নিচু করে থাকলো যাতে ওর চেহারা ছায়ার ভিতর থাকে।

“আমরা সেটা জানি।”

“তিন রাত পরেই অমাবস্যা। আমি গাছের গুঁড়ির বরগাগুলো কেটে দেবো। ভাটার টানে জাহাজগুলো ভেসে যাবে। আপনারা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে গিয়ে জাহাজগুলো পুড়িয়ে দিতে বা যেটা ইচ্ছে করতে পারবেন। জাহাজ ছাড়া সে রসদপত্র জোগাড় করতে পারবে না। ভালো হয় যদি আপনার আপনাদের নিজস্ব গ্রাব আর গালিভাতগুলো নিয়ে আসতে পারেন। তাহলে ওগুলোর কামান দিয়ে ডাঙার দিক থেকে যারা আসবে তাদের সামলাতে পারবেন। আংরিয়ার শহীদ হওয়ার বিন্দুমাত্র খায়েশ নেই। যদি ও বুঝতে পারে যে জেতার সম্ভাবনা নেই তাহলে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করবে। ভারতীয়রা এটাই পছন্দ করে।”

অনেকগুলো কথা বলেছে ক্রিস্টোফার। হাবিলদার সেগুলো অনুবাদ শেষ করতেই টম নিজের বেল্ট থেকে একটা ছোট থলে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলো।

“রাজা শাহুজি এটা দিয়েছেন।” বলে ও থলেটা হাতের উপর ঢেলে দিলো। তারার আলোতেও কাটা হীরাগুলো ঝিকমিক করে উঠলো। ক্রিস্টোফার জুলজুল করে তাকিয়ে রইলো ওগুলোর দিকে।

 “যা যা বললে সেটা যদি করেন, তাহলে শাহুজি আপনার দিকটা খেয়াল রাখবেন,” টম বললো। “আপনি

 কথা শেষ না করেই থমকে গেলো টম, কারণ ক্রিস্টোফার হীরাগুলো ভালোমতো দেখতে যেই সামনে ঝুঁকেছে তখনই চাঁদের আলো গিয়ে পড়েছে ওর তরবারির হাতলের উপর। হাতলে বসানো মসৃণ পাথরটা থেকে আলো ঠিকরে পড়লো বালিতে, তার নিচেই খাপের ভিতর থেকে দেখা গেলো তরবারিটার সোনার বাঁধানো অংশটা-টম সারাজীবন ধরে এই নকশাটা চেনে। এটা হচ্ছে নেপচুন তরবারি। রাতের কারণে ওটার নীলা পাথরটা এখন নীলচে দেখাচ্ছে, কিন্তু ওটার আকৃতি ও ঠিকই ধরতে পারছে। আর সারাহের দেহের বাকের মতোই ও তরবারিটার ফলার বাকও চেনে; হাতলের ফোলা অংশ, খাপে ভরে রাখার পরেও ওটার বেরিয়ে থাকা তীক্ষ্ণ ডগা-এটা ওরই নীল তরবারি।

ও পারলে তখনি ওটা কেড়ে নিতো। “এই তরবারি আপনি কোথায় পেয়েছেন?” প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো টম।

ক্রিস্টোফার সোজা হয়ে ওর ডান হাতটা হাতলে রাখলো। “লড়াই করে জিতেছি।”

কথাটা বলার আগেই টম বুঝে গেলো কেন একে চেনা চেনা লাগছিলো। সব জট খুলে গেলো ওর। এই লোকটাকেই ও রানির মহলে দেখেছিলো। এ ই ওর কামানগুলোকে উদ্ধার করেছিলো, ক্যাপ্টেন হিকসকে মেরেছিলো। আর কিভাবে কিভাবে আবার এই টিরাকোলার দুর্গে এসে হাজির… আর ওর কাছে এখন নেপচুন তরবারি।

টম তরবারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ব্রিঞ্জোয়ান থেকে ফিরে আসার পর, ও প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলো। জানতে যে তরবারিটা হারানোর দুঃখ ভুলতে ওর অনেকদিন লাগবে। কিন্তু ওটা আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এটা মনকে বুঝিয়ে ফেলেছিলো। তবে আবার ওটাকে দেখা যাচ্ছে। হাতের নাগালেই।

টম জানে যে ওর চুপ থাকা উচিত, কিন্তু পারলো না।

“ওটা আমার তরবারি,” হিস হিস করে বলে উঠলো ও। “ওটার মালিক ছিলো আমার বাবা, তার আগে আমার দাদা, তার আগে তার বাবা।”

ক্রিস্টোফার টমের দিকে তাকিয়ে রইলো। “আপনার বাবার?” ইংরেজিতেই বলে ফেললো ও। কিন্তু দুজনেই এমন হতবাক যে কেউই খেয়াল করলো না ব্যাপারটা। এতো বড় ধাক্কা খেয়েছে ক্রিস্টোফার যে কথাটা হজম করতে পারছে না।

ক্রিস্টোফার নিজেকে সামলে নিলো। “তরবারিটা আমার,” যতোটা সম্ভব বিনয়ের সাথে বললো ও। “গোলকোন্দা খনির সমস্ত হীরার বিনিময়েও এটা হাতছাড়া করবো না আমি।”

টমের মনে ঝড় বইতে লাগলো। ওর সাথে হাবিলদার আছে। দুজন মিলে একে কাবু করতে পারবে। আর তাছাড়া ফ্রান্সিস আর মেরিডিউ-ও উপর থেকে রাইফেল তাক করে রেখেছে এদিকে। একবার ডাক দিলেই ডাকাতটা মারা পড়বে। তরবারিটা আবার দখলে চলে আসবে ওর।

ও আদেশটা দেওয়ার জন্যে মুখ খুললো। কিন্তু ভিতরে থেকে কেউ যেনো ওকে সাবধান করলো যে কাজটা ঠিক হবে না। ও হয়তো তরবারিটা পাবে, কিন্তু যা হারাবে তা সারাজীবন কেঁদেও আর ফিরে পাবে না। কিন্তু তরবারিটা ওর চোখের সামনে, ওটার নীলাটার ধারগুলোয় তারার আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, যেনো ওকে চোখ টিপছে। ও এটাকে হারিয়ে ফেলেছিলো, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আবার এটাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে। ও কি ধরনের মানুষ যে এরকম একটা সুযোগ হেলায় ছেড়ে দেবে? এটা ওর উত্তরাধিকার-আর তাছাড়া সমস্ত কোর্টনী পরিবারের ইজ্জত আর সম্মান জড়িয়ে আছে এর সাথে।

ক্রিস্টোফার বুঝলো যে কিছু একটা সমস্যা আছে। ও এক পা পিছিয়ে গেলো; হাত তরবারির হাতলের উপর। অবশ্য দক্ষ বন্দুকবাজের হাত থেকে এতে ও রক্ষা পাবে না। টম লম্বা একটা দম নিলো যাতে চিৎকার করে পাহাড়ের উপরে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে আদেশটা দিতে পারে।

কিন্তু ও আদেশটা দিতে পারলো না। টমের বাস্তব বুদ্ধি ওকে সেটা করতে দিলো না। ও যদি একে মেরে ফেলে, তাহলে জাহাজের বেড়া কেউ খুলবে না-দুর্গটাও জয় করা সম্ভব হবে না। আর তাহলে সম্ভবত টম জীবনেও আর সারাহ বা অ্যাগনেসকে দেখতে পাবে না।

ওর সবচে ভালোবাসার রমণীকেই যদি ও নিরাপদে উদ্ধার করতে না পারে, তাহলে কোর্টনীদের ইজ্জত সম্মান তখন কোথায় যাবে?

টম মুখটা বন্ধ করে ফেললো। হঠাৎ মনে হলো ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। ওর। লজ্জা লাগছে খুব, একই সাথে স্বস্তিও পাচ্ছে এই ভেবে যে গুলি করার আদেশ দেয়নি।

“আংরিয়ার দুজন বন্দী আছে,” টম বললো। “ইংরেজ মহিলা। ওদের কথা জানেন কিছু? ওরা কেমন আছে?”

 তরবারির হাতলে ক্রিস্টোফারের মুঠো ঢিল হলো। ও জানে না টম কেনো থেমে গেলো, তবে বিপদ যে আসছে সেটা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলো।

 “হ্যাঁ,” নিচু স্বরে বললো ও। “হ্যাঁ, মহিলা দুজন এখনো ভালো আছেন। তবে একজনের…”

ও প্রায় বলেই দিয়েছিলো যে পেটে বাচ্চা। কিন্তু বললো না। গত পাঁচ মিনিটে বেশ কয়েকবার ওর ভাগ্য বদল হয়েছে। সবকিছু বুঝে উঠতে ওর কিছু সময় দরকার। আগেই সব বলে দেওয়া ঠিক হবে না। পরে কাজে লাগতে পারে।

 “স্বাস্থ্য একটু খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনো সমস্যা নেই, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো ক্রিস্টোফার।

“খেয়াল রাখবেন ওদের যেনো কোনো কিছু না হয়,” টম বললো। ভিতরে ভিতরে ও ভাবছে, কে তুমি? এই লোকটা এমন নিখুঁত ইংরেজি বলে, কিন্তু ডাকাত আর দস্যুদের সাথে সবসময় চলাফেরা। আর এখন ওর তরবারি দখল করে বসে আছে। কোন ভাগ্যে ঘুরে ফিরে বারবার ওদের দেখা হয়ে যাচ্ছে?

অপরদিকে ক্রিস্টোফারের আর অজানা নেই যে ও কার সাথে কথা বলছে। তরবারিটা ছিলো আমার বাবার… লোকটাই বলেছে কথাটা। যদি সত্যি বলে থাকে, তাহলে ইনি অবশ্যই গাই-এর ভাই। অবশ্য লোকটার গলার জোর দেখে মনে হয়নি যে সে মিথ্যে বলছে। উইলিয়াম চাচা মারা গিয়েছেন। আর ক্রিস্টোফার ওদের পরিবারের ঠিকুজি থেকে জানে যে ডোরিয়ান চাচার চুল লাল। তার মানে এতোক্ষণ ও ওর চাচা টম কোর্টনীর সাথে কথা বলেছে।

ক্রিস্টোফার সাথে সাথে আতংকিত হয়ে পড়লো এই ভেবে যে টম ওকে চিনে ফেলবে। ব্যাপারটা অসম্ভব যদিও-টমের সাথে ওর জীবনেও দেখা হয়নি। এমনকি ওর কথাও সম্ভবত উনি জানেন না। কিন্তু আবার মনে হলো ও-ও জীবনেও ভাবেনি যে ও এরকম একটা পরিবেশে কখনো ওর মৃত চাচার সাথে দেখা হয়ে যাবে।

ওকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে ভাগতে হবে। কোনো কথা না বলেই ও ঘুরে ক্রস্ত পায়ে নৌকার দিকে যাওয়া শুরু করলো। এতোটাই আচমকা যে টম ওটাকে ফাঁদ মনে করে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েই ফেলেছিলো প্রায়।

কিছু একটা উড়ে এলো বাতাসে। সহজাত প্রবৃত্তিবশে ক্রিস্টোফার এক হাত দিয়েই লুফে নিলো জিনিসটা-সেই হীরা ভরা থলে। হাতটা মুঠো করতেই ও থলের পাতলা কাপড়ের ভিতর দিয়ে হীরাগুলোর আকৃতি অনুভব করতে পারলো।

“আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম,” বিস্মিত গলায় বলে উঠলো ক্রিস্টোফার।

 “কিন্তু বেড়ার গাছগুলো কাটতে ভুলো না যেন,” টম সতর্ক করে দিলো।

নৌকাটা পানিতে ঠেলে নামাতেই ক্রিস্টোফারের গোড়ালিতে ঢেউ আছড়ে পড়লো। ঠাণ্ডা বাতাস ওর ভাবনা চিন্তাকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করলো অনেকটাই। যেনো একটা স্বপ্নের ঘোর থেকে টেনে তুললো ওকে।

“সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। বেড়া খোলা-ই পাবেন।”

*

ক্রিস্টোফার টলতে টলতে নেমে এলো নৌকা থেকে। আসার আগে মাঝিকে একটা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে এলো মুখ বন্ধ রাখার জন্যে। তারপর পাথর কেটে বানানো সিঁড়িটা বেয়ে উঠে গেলো। ঢেউ থেকে ছিটকে আসা পানিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে সিঁড়িটা; ভাবনায় ডুবে থাকায় প্রায় আছাড় খেয়েই বসেছিলো।

ও জোর করে ভাবনাগুলোকে সরিয়ে দিলো। এখনো বিপদমুক্ত না ও। সিঁড়ির মাথার ঘোট দরজাটায় টোকা দিয়ে নিজের নাম বললো ও।

দরজার ছোট জানালাটায় একটা চেহারা দেখা গেলো। “মালটা কেমন?”

 ক্রিস্টোফার ভুলেই গিয়েছিলো যে কোন মিথ্যেটা বলে দুর্গ ছেড়ে বেরিয়েছিলো। জোর করে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বললো, “একেবারে খাসা। তুমিও গিয়ে দেখতে পারো।”

 ভারী হুড়কো টেনে খোলার শব্দ পাওয়া গেলো। দরজা খুলতেই ও প্রহরীকেও একটা স্বর্ণমুদ্রা দিলো। দেওয়ার সময় নিজের কোমরে বাঁধা হীরার থলেটার কথা মনে পড়লো। “আংরিয়া যেনো কিছুই না জানে,” সাবধান করে দিলো ও। “ও যদি জানতে পারে যে আমি দুর্গের বাইরে গিয়েছিলাম, তাহলে মেরেই ফেলবে।”

“মেয়েটা নিশ্চয়ই সেই জিনিস। নইলে নিজের গর্দানের ঝুঁকি নিতেন না,” প্রহরী বললো। আরো বিস্তারিত শুনতে চাচ্ছে।

“মধুর চেয়েও মিষ্টি, গোলাপের চাইতেও কোমল!” ক্রিস্টোফার সায় দিলো।

ও দুর্গের একদম চূড়ার মাথায় নিজের ঘরে চলে এলো। লিডিয়া বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছিলো ওর।

ক্রিস্টোফার ওর হাতকড়া খুলে দিলো। এটা এখন একটা নিয়মিত কার্যে পরিণত হয়েছে : দিনের বেলায় লিডিয়া কয়েদখানায় থাকে, কিন্তু প্রতি রাতে কারারক্ষী ওকে ক্রিস্টোফারের ঘরে দিয়ে যায়। ক্রিস্টোফার কারণটা জানে না, কিন্তু কেন যেন ও যতোটা স্বীকার করে, তার চাইতে বেশি লিডিয়ার সঙ্গ পছন্দ করে। এতোগুলো মাস আর বছর ছদ্মবেশে জালিয়াতি করে চলার পর এততদিনে ও একটু ইংরেজি বলার আর শোনার ফুরসত পেয়েছে। কিন্তু এটা তার চাইতেও বেশি কিছু। লিডিয়ার ভিতরে কিছু একটা আছে যা ক্রিস্টোফারকে টানে। লিডিয়া যেনো একটা আগুনের ফুলকি, যা ওর ভিতরের শুকনো কাগজগুলোতে অগ্নি সংযোগ করেছে।

আর লিডিয়ার মতো করে আর কেউ আদর করতে পারে না। কোনো কিছুতেই বাধা নেই ওর। এমনকি তামান্নাও এতোটা উদ্দাম ছিলো না।

 লিডিয়া ক্রিস্টোফারের পিঠ জড়িয়ে ধরলো। তারপর সামন ঝুঁকে ওর হাত ক্রিস্টোফারের দুই পায়ের ফাঁকে উরুতে ঘষতে লাগলো।

ক্রিস্টোফার সাড়া দিলো না।

লিডিয়া কোনো সতী সাধ্বী কেউ না। এর মাঝেই ওর দুটো স্বামী ছিলো, আর গোটা দশেক প্রেমিক ছিলো, কিন্তু ক্রিস্টোফারের মতো করে আর কাউকে ও এতোটা বিলিয়ে দেয়নি। যদিও শুরুতে ওর পুরো ছলাকলাটাই ছিলো নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে ক্রিস্টোফার ওকে সত্যিকার ভাবেই আকর্ষণ করে। ও সারাদিন বসে বসে অপেক্ষা করে কখন কারারক্ষী এসে ওকে ক্রিস্টোফারের ঘরে নিয়ে যাবে।

“কিছু হয়েছে নাকি?”

দুশ্চিন্তার মাঝে ক্রিস্টোফার খেয়ালও করলো না যে লিডিয়া কিছু বলেছে। ও নিজেকে লিডিয়ার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নেপচুন তরবারিটা তুলে নিলো। তারপর ওটার ফলায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো।

“আমার উপর রাগ করেছেন?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো লিডিয়া। যতোই ক্রিস্টোফারের প্রতি আকৃষ্ট হোক না কেন, ও জানে যে ক্রিস্টোফার অসন্তুষ্ট হলে ওর কপালে শনি আছে। ওর জীবন নির্ভর করছে এর উপর।

 ক্রিস্টোফার ওর দিকে তাকালো। “আজ সন্ধ্যায় এমন একটা কথা জেনেছি, যেটা আসলে হজম করতে পারছি না।”

লিডিয়া ওর লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে ক্রিস্টোফারের হাতে মালিশ করতে লাগলো। “কি কথা, সোনা?”

“তুমি বুঝবে না।”

লিডিয়া ক্রিস্টোফারের ঘাড়ের মাংসপেশিতে হাত বুলালো, ওগুলো ঠিক নোঙরের কাছির মতো পাকানো। আরো জোরে চাপ দিলো ও, যতোটা পারে ভিতরে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করছে আঙুল। ক্রিস্টোফার আরামে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো।

 “একবার বলেই দেখুন না,” লিডিয়া আবদারের সুরে বললো। “আপনি নিজের ভিতর এতো কিছু চেপে রাখেন! আমাকে বলে কেন কিছুটা হালকা হন না?”

ক্রিস্টোফারের আসলে বলার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু লিডিয়ার আঙুলের চাপে মনে হলো যেনো কিছু একটা খুলে গেলো, অনেকটা বোতলের মুখ খুলে যাওয়ার মতো। “টম কোর্টনী এখানে হাজির হয়েছেন,” ফস করে বলে ফেললো ও।

লিডিয়ার আঙুল থেমে গেলো। “টম কোর্টনী?”

“গাইয়ের ভাই। আজ সন্ধ্যাতেই তার সাথে দেখা হলো। উনি এখানেই আছেন। ঐ অবরোধকারীদের দলে।”

“নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?”

“উনি তরবারিটা চিনে ফেলেছেন। এটা নাকি তার বাবার ছিলো। আর এখন ওনার।” একবার শুরু হতেই বাঁধ ভাঙা নদীর মতো করে কথা বের হতেই থাকলো ক্রিস্টোফারের মুখ দিয়ে। “তুমি না বলেছিলে তোমার সাথে যারা আছে তাদের একজন হচ্ছেন সারাহ কোর্টনী। উনি হচ্ছেন টমের স্ত্রী-উনি এসেছেন ওনাকে উদ্ধার করতে।”

লিডিয়ার মস্তিষ্কে ঝড় চলছে। তথ্যগুলো হজম করার চেষ্টা করছে, সেই সাথে ওগুলোর গুরুত্ব নিরূপণের চেষ্টা করছে।

“গভর্নর ওনাকে পাঠিয়েছেন নাকি?” সাবধানতার সাথে জিজ্ঞেস করলো লিডিয়া। “গাই কি অ্যাগনেস আর সারাহকে মুক্ত করতে এই সৈন্যদল পাঠিয়েছেন?”

ক্রিস্টোফার হাসলো। “সেটা কোনোদিন সম্ভব না। গাই আমার চাইতেও টমকে বেশি ঘৃণা করে। যদি জানতে পারে যে টম এখানে, তাহলে উনি নিজে এসে টমের গলা কেটে আংরিয়াকে উপহার দেবে।”

“কোর্টনীদের সম্পর্কে দেখি আপনি অনেক কিছু জানেন,” খোঁচা মেরে বললো লিডিয়া। “আপনি কি আমাকে না জানিয়েই সারাহের সাথে শুয়েছেন নাকি?”

ক্রিস্টোফারের চেহারা আবার কালো হয়ে গেলো। লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ও। এমনভাবে ওর আপাদমস্তক দেখতে লাগলো যে লিডিয়া ওর জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেলো। এই মেজাজে ক্রিস্টোফার যে কোনো কিছু করে বসতে পারে।

“আমাকে বলুন, সোনা,” অনুনয় করলো ও। “আমি তো আপনারই দলে।”

ক্রিস্টোফার আর নিজের ভিতর কথাগুলো ধরে রাখতে পারলো না। “সারাহ কোর্টনী আমার চাচী। আমি হচ্ছি ক্রিস্টোফার কোর্টনী, গাই-এর ছেলে। দুই বছর আগে আমি গাই-এর সাথে ঝামেলা করে বোম্বে থেকে পালিয়ে চলে আসি।”

আচমকা সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো লিডিয়ার কাছে। “আপনি নিশ্চয়ই গাইকে খুব ঘৃণা করেন?”

“আমার সমগ্র সত্তা দিয়ে।”

কথোপকথন দ্রুত আগাচ্ছিলো। আর এতোগুলো সম্ভাবনার মাঝ দিয়ে লিডিয়া ঠিক করতে পারছিলো না কোনটা ধরে নাড়লে ওর সবচে সুবিধা। ওর আপাতত সব গোপন রাখলেই ভালো হবে মনে হয়। কিন্তু ও যদি এখন না বলে, আর ক্রিস্টোফার পরে সব জানতে পারে, তাহলে সম্ভবত কোনোদিনও ওকে ক্ষমা করবে না।

 লিডিয়া ওর দিকে ঝুঁকে এলো। এরপর ও যা বলতে চাচ্ছে সেটা ও চাইলেও আর আটকে রাখতে পারলো না।

 “গাই আপনাকে ঘৃণা করার একটা কারণ আছে, যা আপনি জানেন না। গাই আপনার বাবা নন।”

ক্রিস্টোফার এতটাই অবাক হলো যে হেসে ফেললো। পর মুহূর্তেই ওর চেহারা শক্ত হয়ে গেলো। যেনো লিডিয়াকে ধরে মার দেবে। “এসব কি আবোল তাবোল বলছো?” ওর গলা চড়ে গেলো। “তুমি কি ভেবেছো যে। তোমাকে আমার বিছানায় শুতে দেই মানে এসব উল্টাপাল্টা বলে আমাকে অপমান করতে পারবে? আমি চাইলে এখুনি তোমাকে আবার কয়েদখানায় ফেরত পাঠাতে পারি-বা আংরিয়ার কাছে মজা করতে পাঠাতে পারি।”

 “সারাহ কোর্টনী বলেছে আমাকে, কোনোমতে বললো লিডিয়া। “তার বোন, মানে আপনার মা ক্যারোলিন নাকি টমের সাথে শুয়েছিলেন। যখন ওনারা সবাই একসাথে জাহাজে করে ইংল্যান্ডে যাচ্ছিলেন তখন। গাই তাকে স্পর্শ করার আগেই উনি গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন।” লিডিয়া খেয়াল করলো টম ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তার পেটে ছিলেন আপনি।”

 “অসম্ভব।” কিন্তু ও যতোই কথাটাকে অস্বীকার করতে চাক না কেন, ওটা ওর মাথায় ঘুরতে লাগলো। কথাটার সত্যতা ওর ভেতরে অনুরণিত হতে লাগলো। কিছুতেই সরাতে পারলো না। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। ঠিক যেমন একজন নাবিক তার চার্টে দেখনো পথ ধরে নিরাপদে জাহাজ বন্দরে ভেড়াতে পারে, ক্রিস্টোফারও তেমনি ওর সারা জীবনের নতুন একটা গতিপথ দেখতে পেলো। গাইয়ের মেজাজ, নিজের স্ত্রীর প্রতি তার তীব্র অসন্তোষ, নিজের সন্তানের প্রতি তার অসম্ভব আক্রোশ। যেভাবে ছোট থেকে কোম্পানির লোকজন এটা সেটা বলাবলি করতো, আর গাই ঘরে ঢুকলেই চুপ হয়ে যেতো। সত্য কথা হচ্ছে, ওর বাবার চুল লাল আর চামড়াও ফর্সা, আর ক্রিস্টোফারের চুল আর গায়ের রঙ দুটোই গাঢ়। তুমি ভেবছিলে এসব তোমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। নিজেকে তিরস্কার করলো ও। সৈকতে দেখা লোকটার দর্পন প্রতিবিম্ব ও। টম কোর্টনীর ছেলে ও।

 ওর সারা জীবনটা বদলে গেলো মুহূর্তেই। জানালার চৌকাঠে হাত রেখে বাইরের রাতের আকাশের দিকে চেয়ে রইলো ও। লিডিয়া পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

“টম আপনার বাবা,” আবার বললো লিডিয়া। “আর উনি এখানেই আছেন, অপেক্ষা করছেন।” বলে ও জানালা দিয়ে দূরে অবরোধকারীদের জ্বালা আগুনগুলোর দিকে ইশারা করলো। “এখন আর আপনার উচিত হবে না। ওনাকে তার স্ত্রী আর তার আপন ছেলের সহবত থেকে বঞ্চিত করা। চলেন আমরা ওনার কাছে যাই। আজ রাতেই। আমি জানি আপনি প্রহরীদের একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। দেখবেন, উনি আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবেন। আপনাকে নিজের সন্তান হিসেবেই মেনে নেবেন।”

 লিডিয়া চুপ করে গেলো। ক্রিস্টোফার জানালার উপরে নেপচুন তরবারিটা তুললো। ফলাটা দিগন্তের দিকে তাক করা।

“এটা জন্মগত ভাবেই আমার সম্পত্তি,” বিড়বিড় করে বললো ক্রিস্টোফার। “টম কোর্টনী এটা তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে, আর আমিও এটা তার কাছ থেকেই পেতাম। যদি না সে আমাকে ফেলে পালাতে।”

“এখনতো আবার উনি. আপনাকে খুঁজে পেয়েছেন, লিডিয়া বললো।

 ক্রিস্টোফার ঘোর লাগা চোখে তাকালো লিডিয়ার দিকে।

“না, নরম স্বরে বললো ক্রিস্টোফার। তারপর একটু ভেবে যেনো ব্যাপারটার নিশ্চয়তা খুঁজে পেয়ে আবার বললো, “না।”

লিডিয়া এর আগে কখনো ক্রিস্টোফারের চোখে এমন উন্মাদ দৃষ্টি দেখেনি। ও পিছনে দিকে সরে গেলো। বুঝলাম না।”

ক্রিস্টোফার তরবারিটা খাপে ভরে রাখলো। “টম কোর্টনী কেমন মানুষ?” শীতল গলায় বললো ও। “আমার মা-কে ভোগ করলো, তারপর মায়ের পেটে যখন আমি আসলাম, তখন তাকে একটা ময়লা কাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আমার বাবা-গাই-যে আমাকে ঘৃণা করে, সেটা কোনো অবাক করার বিষয় না। আমি তাকে সন্তুষ্ট করার কত চেষ্টা করেছি, তার আদর পাওয়ার জন্যে কতো কষ্টই করেছি, কিন্তু তবুও উনি আমাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারেননি, কারণ আমি তার সন্তান নই।”

“আপনার পক্ষে তো জানা সম্ভব ছিলো না।”

“আমি ওনাকে কতোটা যে অপছন্দ করি!” প্রতিটা শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করতে লাগলো ক্রিস্টোফার। “আমি বুঝি না। উনি আমার মায়ের সম্মান রক্ষা করেছেন। চাইলে ওনাকে ছেড়ে দিতে পারতেন। এরপরে আবার আমাকেও ভালবাসাটা আসলে তার জন্যে বেশি বেশি হয়ে যেতো। আমি ছিলাম তার ভাইয়ের অপরাধের প্রমাণ, কিন্তু তবুও উনি আমাকে তার ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। উনি ওনার সর্বোচ্চটা করেছেন, উনি আমাকে তার সন্তান হিসেবে পালন করেছেন, কিন্তু বিনিময়ে আমি তাকে ঘৃণা বাদে আর কিছুই দেইনি। আর তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে, তাহলে হয়তো জীবনেও আমার সত্যিটা জানা হতো না।”

 ক্রিস্টোফার শক্ত হাতে লিডিয়ার মুখটা ধরে রইলো। লিডিয়া নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেললো না। ক্রিস্টোফারের চোখের দিকে চাইলো, কিন্তু ক্রিস্টোফার কি ওকে চুমু খেতে চায় নাকি ঘাড়টা মটকে দেওয়ার জন্যে এভাবে ধরেছে সেটা ও জানে না।

 “আমি দুঃখিত, কোনোমতে বললো লিডিয়া।

 ক্রিস্টোফার ওর কপালে চুমু খেলো। “তুমি ভুল কিছু করোনি। তোমাকে ধন্যবাদ। এখন আমার সামনে বিশাল একটা সুযোগ এসে হাজির হয়েছে।”

লিডিয়া আশান্বিত হয়ে উঠলো, “কিসের? বাবার সাথে পুনর্মিলনের?”

 “প্রতিশোধ নেওয়ার।”

*

কোনো শব্দ না করেই নৌকাগুলো ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলো। ফ্রান্সিস দাঁড় আটকানোর জায়গাটাতে সবাইকে ভালোমতো তেল দিয়ে রাখতে বলেছিলো। আর দাঁড়েও বলেছিলো ন্যাকড়া বেঁধে নিতে, যাতে শব্দ সর্বনিম্ন হয়। মারাঠারা পাহাড়ী মানুষ, নৌকা চালিয়ে অভ্যস্ত না। দুর্গ থেকে দেখা যায় না এমন জায়গায় নিয়ে, টম আর ফ্রান্সিস ওদেরকে সারাদিন অনুশীলন করিয়েছে। কেস্ট্রেল-এর নাবিকেরা ছিলো ওদের প্রশিক্ষক। কিন্তু যতোই হোক, এই রাতের বেলা, খোলা পানিতে ওরা ঠিকই গণ্ডগোল করে ফেললো।

একজন মাল্লা ঠিকমতো দাঁড় ফেলতে পারলো না। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে হাত থেকে পিছলে গেলো দাঁড়টা। ঠাস করে সোজা গিয়ে পড়লো নৌকার ভিতর জড়ো করে রাখে অস্ত্রগুলোর উপর। দাঁড়ের বাড়ি খেয়ে তরবারিগুলো ঝনঝন করে উঠতেই মাল্লাটা গালি দিয় উঠলো।

“আস্তে,” হিসিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস।

লোকটা দাঁড়টা আবার তুলে নিতে নৌকার খোলের দিকে ঝুঁকে গেলো। বাকিরা সবাই দাঁড় তুলে বসে রইলো, নিঃশ্বাস নেওয়ারও সাহস করছে না। সবাই কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে যে ওরা ধরা পড়ে গিয়েছে কিনা।

কিন্তু পাখির কিচিরমিচির, পোকামাকড়ের কিচকিচ, তীরে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ আর ওদের দাঁড় থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার শব্দ বাদে আর কিছুই শোনা গেলো না। মেরিডিউ ফ্রান্সিসের পাশে বসে নিচু স্বরে আদেশ দিতেই আবার সবাই বাওয়া শুরু করলো।

 “যখন গোলাগুলি শুরু হবে, তখন এরা ঠাণ্ডা থাকতে পারলেই হয়, ফিসফিসিয়ে বললো মেরিডিউ। “যদি বেড়াটা কাটা না থাকে তো আমাদেরকে খুব দ্রুত পালাতে হবে।”

“ওটা কাটা থাকবে,” ফ্রান্সিস জোর দিয়ে বললো। যেনো নিজেকেই আশ্বস্ত করলো ও। নৌকার ডানপাশে দুৰ্গটার অবয়ব দেখা গেলো। তারাভরা আকাশের বিপরীতে কালো দেখাচ্ছে। একটা মিনারে আলো জ্বলছে। নিশ্চয়ই একজন প্রহরী ওদিক দিয়ে নজর রাখছে। সে কি চুপিচুপি ওদের জাহজাগুলোর দিকে যেতে থাকা এই ছোট্ট নৌকাটা খেয়াল করতে পারবে? গালিভাত নামের চারটা ডিঙি নৌকা। প্রতিটায় পঞ্চাশজন করে অস্ত্রধারী লোক।

টম চাচা এখন থাকলে ভালো হতো, মনে মনে ভাবলো ফ্রান্সিস। দুজনের এতো কষ্টের পর, ওর চাচার সান্নিধ্যেই নিজেকে নিরাপদ মনে হয়। ও ভেবেছিলো টম-ই বোধহয় এই আক্রমণে নেতৃত্ব দেবে-টম চেয়েছিলোও-কিন্তু শাহুজি বাধ সাধেন। “আপনিই আমাদেরকে এই বিশাল কামানগুলোকে এনে দিয়েছেন আর সেগুলো থেকে টুপিওয়ালাদের মতো গোলা ছোঁড়াও শিখিয়েছেন। যদি আপনি অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেন বা যদি পাহারাদারদের হাতে ধরা পড়েন বা অন্য কিছু হয় আপনার, তাহলে আমার সৈন্যদলের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে যাবে।”

“আমার স্ত্রী আছে ওখানে,” টম প্রতিবাদ করেছিলো। কিন্তু ও আর কোনো যুক্তি দেওয়ার আগেই ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। ও জানে ওর কি করতে হবে।

“আমি যাবো সৈন্য নিয়ে।”

এখন নৌকায় বসে সেজন্যে ওর আফসোস হচ্ছে না-তবে ভয় পাচ্ছে ঠিকই। সামনেই কাঠ আর রশির ঘষা খাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো। ওরা ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। ও অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলো। বেড়াটা খুঁজছে, আশা করছে যে ওটা ওখানে থাকবে না।

“অন্তত ওরা আমদের জন্যে ওঁত পেতে নেই,” বিড়বিড় করে বললো ফ্রান্সিস। কোনো নৌকাতেই কোনো আলো নেই। আর তীরেও কেউ আগুন জ্বেলে পাহারা দিচ্ছে না। সম্ভবত আংরিয়া ওর সব লোককে দুর্গের ভিতরে থাকার আদেশ দিয়েছে।

ও পায়ের কাছে বস্তাটায় হাত দিলো। এটার ভিতর মাটির বানানো ছোট ছোট ঘটে তেল ভরে নিয়ে আসা হয়েছে। ঢাকনার ভিতর দিয়ে একটা সলতে ভরা। ওরা, দেখে ফেলার ভয়ে নৌকায় আগুন বহন করতে পারেনি, কিন্তু প্রতিটা নৌকাতেই আগুন জ্বালানোর মতো যথেষ্ট সরঞ্জাম আছে। ওরা আংরিয়ার জাহাজগুলোর কাছে পৌঁছালেই সলতেয় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে দেবে।

শৈল অন্তরীপটা পেরিয়ে উপসাগরে প্রবেশ করলো ওরা। দুপাশেই এখন ডাঙা। কালো দেখাচ্ছে সবদিকে। বেড়াটার কাছাকাছি চলে এসেছে। বা টের না পেয়েই ওটাকে ছাড়িয়ে এসেছে কিনা কে জানে। সম্ভবত লোকটা তার কথা রেখেছে।

 ফ্রান্সিস ওর বসার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো, নৌকার দুলুনির তালে তালে দুলছে। দৃষ্টি সামনের দিকে নিবদ্ধ। সামনে কি কিছু দেখা যাচ্ছে? নাকি ওটা পানির ভিতর চর জাতীয় কিছু?

ধ্যাপ করে নৌকার সামনের অংশ শক্ত কিছু একটায় বাড়ি খেলো। ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে গিয়ে আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো ফ্রান্সিস। লোকজন সতর্ক হয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো; কয়েকজন দাঁড় ফেলে অস্ত্র তুলে নিয়েছে।

“বেড়াতে লাগলো নাকি?” সতর্ক কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস।

 মেরিডিউ অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে জিনিসটা কি সেটা বোঝার চেষ্টা করলো। “এটা একটা নৌকা,” ও জবাব দিলো। “আমরা বন্দরের ভিতরে।”

ফ্রান্সিস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বেঈমান লোকটার লোভের উপর সন্দেহ না থাকলেও, লোকটার উপর ভরসা করতে পারেনি। আর এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ও নিশ্চিত ছিলো না যে বেড়াটা কাটা কিনা।

“আমরা কি বোমাগুলোয় আগুন লাগানো শুরু করবো?” মেরিডিউ জিজ্ঞেস করলো।

“আর একটু ভিতরে যাওয়ার পরে,” ফ্রান্সিস বললো। “প্রথম জাহাজটায় আগুন দেওয়ার পরেই কিন্তু আমাদেরকে পালানোর তোড়জোড় শুরু করতে হবে।”

ও পিছনে ফিরে দেখে বাকি নৌকাগুলোও চলে এসেছে। ভেজা দাড়ের পানি স্নানভাবে চিকচিক করছে। “সবার শেষের নৌকাকে বলো এখানেই অপেক্ষা করতে যাতে পালানোর সময় সমস্যা না হয়। বাকিরা আমাদের পিছু পিছু আসো।”

নৌকাগুলো ঘাট বরাবর এগিয়ে গেলো। মেরিডিউ নৌকার সামনে লগি হাতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। সামনে কিছু পড়লে সরিয়ে দেবে ওটা দিয়ে। আংরিয়ার বহরের কাছে পৌঁছে যাওয়ায়, ফ্রান্সিস জাহাজগুলোকে আরও স্পষ্ট দেখতে পেলো। অনেকগুলোই ছোট, ওদের গালিভাতের চাইতে বড় না, কিন্তু কয়েকটা আছে বিশাল গ্রাব, নাক ভোতা জাহাজ ওগুলো। মাস্তুল নৌকার লোকগুলোকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গিয়েছে। ফ্রান্সিস অনুমান করলো যে ওগুলোতে নিশ্চয়ই যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ আছে, নইলে এগুলোও দুর্গের রসদপাতি আনার কাজে ব্যবহার করতো আংরিয়া। এগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই ও অনেক দূরে চলে যেতে চায়।

ওরা বেয়ে চললো। সামনে আর কোনো গ্রাব নেই, তার মানে ওরা নিশ্চয়ই জেটির পিছনে কম পানিতে চলে এসেছে। এখানেই নদীর মুখটা। ফ্রান্সিস সবাইকে থামতে আদেশ দিলো।

 “অনেকদূর চলে এসেছি,” ঘোষণা দিলো ফ্রান্সিস। “বোমাগুলোতে আগুন লাগাও।”

 ওর কেমন যেনো লাগতে লাগলো। এটাই হচ্ছে সবচে বিপজ্জনক সময়, উপসাগরের অনেক ভিতরে চলে এসেছে ওরা। কিছু হলে, মাঝখানে আরো দুটো নৌকা পেরিয়ে তারপর নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে পারবে। এখন আবার ওদেরকে আগুন জ্বালাতে হবে, কেউ নজর রেখে থাকলে নিজেদের উপস্থিতি ফাস হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণের মাঝেই।

কিন্তু এই কাজটা করতেই এসেছে ওরা। ফ্রান্সিস আগুন জ্বালার বক্সটা থেকে ছোট একটু আগুনের মশলা বের করলো। মেরিডিউ বস্তাটা নৌকার খোলে উপুড় করে সবগুলো বোমা বের করে এক সারি করে রাখলো। ফ্রান্সিস চকমকি পাথরটা ঘষা দিলো ইস্পাতের উপর।

প্রথম ফুলকিটা আগুনের মশলায় স্পর্শ করার আগেই একটা গুলির আওয়াজ রাতের নীরবতাকে খান খান করে দিলো। ঝট করে মাথা তুললো ফ্রান্সিস। সাথে সাথে দেখতে পেলো উপসাগরে ঢোকার মুখে কোথাও কামানের মুখ থেকে আগুন বেরিয়ে এলো।

 “আমাদের লোকজন নাকি?” প্রশ্ন করলো ফ্রান্সিস। কিন্তু আর একটা শব্দ শুনেই বুঝলো এটা ওদের কাজ না। যে নৌকাটাকে পাহারায় রেখে এসেছে সেটা ছিলো উপসাগরের মাঝখানে। গোলার আওয়াজ আসছে কাছের ডাঙা থেকে।

“নৌকা ঘোরাও,” চিৎকার করে আদেশ দিলো ও। “আমরা ধরা পড়ে গিয়েছি।”

অস্ত্র ফেলে দিয়ে দাঁড় তুলে নিলো সবাই। অন্ধকারে একজন আর একজনের সাথে ঠোকাঠুকি লেগে গেলো। কয়েকজন আবার বসলো উল্টো হয়ে, ফলে দাঁড়ে দাঁড়ে বাড়ি খেতে লাগলো; কোনো দিকে না এগিয়ে এক জায়গায় পাক খাওয়া শুরু করলো নৌকাটা।

 “সবাই একসাথে,” ফ্রান্সিস চেঁচালো। সামনে ও শুধু একগাদা কালো অবয়বকে দাঁড় হাতে ঠেলাঠেলি করতে দেখতে পাচ্ছে। কোনদিকে যে যাচ্ছে। সেটা যেমন বুঝতে পারছে না, কোনদিকে যাওয়ার আদেশ দেবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না।

তারপর আচমকা সবকিছু আলোকিত হয়ে গেলো। উপসাগরের সবকিছু। দুইপাড় জুড়ে বিশাল বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠলো। ওগুলোর আগুন এতো উজ্জ্বল ভাবে আর এত উপরে উঠতে লাগলো যে ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চোখে ঠিকমতো দেখতে পেলো না। নোঙর করে রাখা জাহাজগুলোতেও আরো অনেকগুলো আলো জ্বলে উঠলো। অনেকগুলো পায়ের দৌড়ে আসার শব্দ শোনা গেলো ডেক-এর উপর। এততক্ষণ লুকিয়ে ছিলো এরা।

রাত যেনো দিনে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। নিজের দৃষ্টি ঠিক হতেই ফ্রান্সিস চেয়ে দেখলো নৌকার সবাই আতংকে জায়গায় জমে গিয়েছে। যেনো বজ্রাহত হয়ে আছে সবাই। আলোর পরিমাণ বাড়তেই লাগলো। আরো অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হচ্ছে। পাহাড়ের চূড়ায় সংকেত দেওয়া হতে লাগলো। দুর্গের ভিতর থেকেও আলো আসতে লাগলো। নৌকা থেকে জাহাজের খোপ দিয়ে কামান বের করার অশুভ ধ্বনি ভেসে এলো ফ্রান্সিসের কানে।

“ফাঁদে পড়েছি আমরা!” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

*

ঘুম আসছে না টমের। ফ্রান্সিস এখন এই অন্ধকারে সাগরে। নিজের জীবন বিপন্ন করে সারাহ আর অ্যাগনেসকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। টম সহজে দুশ্চিন্তা করে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটুও স্থির হতে পারছে না। নিজের তাবুতে শুয়ে আছে ও, ভেবেছিলো একটু ঘুমাতে পারলে সময়টা তাড়াতাড়ি যাবে। কিন্তু দেখা গেলো শোয়া মাত্র দুনিয়ার যতো খারাপ চিন্তাগুলো ভীড় করতে লাগলো মাথায়। যদি বেড়াটা ভোলা না থাকে? যদি দস্যুরা ওদেরকে ধোকা দেয়? বা যদি আংরিয়া ধরে ফেলে ঐ ডাকাতটার কাছে থেকে চাপ দিয়ে সব কথা বের করে ফেলে? যদি-?

 থাকতে না পেরে শেষমেশ ও তাবু থেকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের উপরের মিনারটার উপর উঠে গেলো। এতো উঁচু থেকে পাহাড়ের শেষ প্রান্ত, আর তার নিচের উপসাগর দুটোই দেখা যায়। ওখানেই আংরিয়ার জাহাজগুলো নোঙর করে রাখা, ফ্রান্সিসেরও এতোক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা সেখানে। টম নিশ্চিত যে ও সবার আগে আগে যাচ্ছে।

নিজের ভাতিজাকে নিয়ে গর্ব করে টম। গত কয়েক মাসে ওরা দুজন দুজনের চোখের আড়াল হয়নি বললেই চলে। এখন ছেলেটা কাছে না থাকায় টম বুঝতে পারছে ওর অনুপস্থিতি কতোটা মর্মপীড়াদায়ী। টম ফ্রান্সিসের উপর ভরসা করেই চলে এখন। ফ্রান্সিসের তারুণ্য, ওর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, ওর শান্তশিষ্ট মার্জিত চলাফেরা। এরকম কাউকে নিয়ে যে কেউই গর্ব বোধ করবে।

 হঠাৎ একটা অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো ওর মন। আবারও ওর মনে সেই বহু বছর আগের টেমস নদীর ভয়ংকর স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেলো। মুখ ঢাকা মানুষটার হাতে পিস্তলটা দেখা; একটা জ্যাভেলিনের মতো করে নেপচুন তরবারিটা ছুঁড়ে দেওয়া, সেটা লোকটার হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিতে দেখা। আবোলি মৃত লোকটার মুখের আবরণ সরাতেই সেখানে বিলির মুখ আবিষ্কৃত হওয়া।

আমি ফ্রান্সিসের বাবাকে খুন করেছি। এটাই ওর আদি পাপ। প্রতিবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেই এই অমার্জনীয় অপরাধটা ওকে তাড়া করে।

কিন্তু ও ফ্রান্সিসকে যতোটা ভালোবাসে, বিলি কখনোই ততোটা বাসতো না, ভাবলো টম। ফ্রান্সিসের ভালো দিকগুলো দেখলে বিলি সহ্য করতে পারতো না। দরকার হলে পিটিয়ে ওর ভিতর থেকে ভালোটা বের করে ওকে একজন শয়তানে পরিণত করতো। ফ্রান্সিস তখন পরিণত হতো এক ভাঙাচোরা, বিকৃত মানসিকতার মানুষে। বা আরো খারাপ, হয়তো হুবহু বিলির মতো হতো। এক শয়তান, যে কিনা শুধু ক্ষমতার লোভে মত্ত, যে কিনা অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজের আখের গোছাতে ছাড়ে না।

আমি বিলিকে খুন করেছি। কিন্তু আমি ফ্রান্সিসকেও বাঁচিয়েছি। এই অনুভূতিটা একটা চাবির মতো টমের মনটা পাল্টে দিলো। প্রায় বিশ বছর ধরে বন্ধ থাকা একটা তালা খুলে গেলো যেনো। ও এতোদিন বুঝতেও পারেনি যে এতো শক্ত করে এই বাঁধনটা ওর বুকে চেপে বসে ছিলো, আজ এখন সেটা খুলে যাওয়ায় বুঝতে পারছে। একটা নতুন চেতনা যেনো জাগ্রত হচ্ছে ওর ভিতরে। ওর আত্মাকে পরিপূর্ণ করে দিচ্ছে। রাতের তাজা আর পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাস বুক ভরে টেনে নিলো ও। এতো সব সুগন্ধে ভিতরটা ভরে গেলো যেগুলো ও এতোদিনে এই প্রথম খেয়াল করলো।

বিলিকে খুব করার অপরাধবোধ কখনোই যাবে না ওর। কিন্তু অবশেষে ও সেটা থেকে মুক্তিরও একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে।

নিচের অন্ধকারে একটা আগুন ঝলসে উঠলো। টম মিনারের ধারটা চেপে ধরলো। ৰিলিসহ যাবতীয় চিন্তা মুহূর্তে উবে গিয়েছে। ফ্রান্সিস নিশ্চিত বেড়াটা পার হয়ে উপসাগরের ভিতরে ঢুকে ওর বোমাগুলো ছোঁড়া শুরু করেছে। টম ফ্রান্সিসের ছোট নৌকাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। এটাই হচ্ছে পরিকল্পনার সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ। ফ্রান্সিসরা যদি এখন দ্রুত পালিয়ে আসতে না পারে, তাহলে সোজা আংরিয়ার কামানের মুখে পড়ে যাবে।

কিন্তু আগুনের শিখা কোনো জ্বলন্ত জাহাজ থেকে আসছে না। ওগুলো আসছে ডাঙা থেকে। একটা বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে যাচ্ছে সোজা আকাশের দিকে। ওটার পাশেই আরো একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠলো। তারপর আর একটা, আরো একটা, কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো উপসাগরটা যেনো একটা চুলায় পরিণত হলো। জাহাজের ডেক এ লোকজন জড়ো হতে লাগলো। এদেরকে দেখে মনে হলো না যে ওরা অবাক হয়েছে, কেউই ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে এসে হাজির হয়নি। সবাই-ই আগে থেকেই সচেতন ছিলো কি ঘটতে যাচ্ছে, উঠে এসেই কামানের দিকে ছুট দিলো সবাই।

টমের কেমন অসুস্থ লেগে উঠলো। ওখানে আর দেরি করলো না ও। মই বেয়ে একরকম পিছলে নেমে এলো নিচে। ঘষায় হাত ছিলে গেলো, কিন্তু পরোয়া করলো না। দৌড়ে গেলো শাহুজির তাবুর দিকে।

“ওরা আমাদের জন্যে ফাঁদ পেতে বসে ছিলো,” হড়বড় করে বললো টম। আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না ওর। কারণ সাথে সাথে কামানের বিস্ফোরণের শব্দ তাঁবুর দেয়াল কাঁপিয়ে দিলো। এরপর একের পর একে চলতেই থাকলো। এক মুহূর্তের জন্যেও থামছে না গোলাবর্ষণ। ফ্রান্সিস এই গোলাগুলির ভিতর ছোট্ট একটা নৌকায় করে ভাসছে সেই চিন্তাটা মাথায়ও আনতে চাচ্ছে না টম।

 শাহুজি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। উনি উঠে দ্রুত একটা চাদর গায়ে দিলেন। নিচের উপসাগর থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ চলতেই থাকলো।

“আমার সাথে পাঁচশো লোক দিন,” অস্থির কণ্ঠে বললো টম। “আমি উপসাগরে গিয়ে ওদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবো-বা অন্তত ওদের গোলার জবাব দিতে পারবো।”

শাহুজি মাথা নাড়লেন। “আমি জানি আপনার ভাতিজা ওখানে আছে। কিন্তু উপসাগরের দুই পাশেই খাড়া পাহাড়। এই অন্ধকারে ওদিক দিয়ে নামতেই পারবেন না। আর ওরা সবাই কামানের আড়ালে থাকবে। ওরা যেহেতু জানতো যে নৌকাগুলো যাবে, তার মানে ওরা এটাও ধরে রেখেছে যে আমরা ওদেরকে উদ্ধার করতে যাবো। ওদের গোলন্দাজেরা সাথে সাথে দেয়ালের পিছনে কামানে বসে যাবে, আর আপনাদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।”

টম জানে যে শাহুজি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ফ্রান্সিসের কিছু হয়ে যাওয়ার ভয় ওকে এসব যুক্তি মানতে সায় দিচ্ছে না। “আমি একাই যাবো তাহলে।”

“আপনাকে আমি আটকাবো না। কিন্তু খামাখা শহীদ হয়ে গেলে আপনার ভাতিজা বাঁচবে না-বা দুর্গের ভিতরে আপনার স্ত্রীও উদ্ধার হবে না।”

 টম থমকে গেলো। রাজার এই নিষ্ঠুর ধীর স্থির কথাবার্তা ওর সহ্য হচ্ছে না। শাহুজির মতো এক অর্বাচীনের কাছ থেকে ওর এরকম জটিল পরিস্থিতিতে কি করা উচিত সেই শিক্ষা নিতে হবে না।

 “আপনি বলেছিলেন এই আক্রমণটা ব্যর্থ হলে আপনাকে অবরোধ ছেড়ে দিতে হতে পারে,” টম বললো।

“আমি আপনাকে আগেও বলেছি, আমরা হচ্ছি গোয়ালঘরের ইঁদুর। আমরা আমাদের শত্রুকে তিলে তিলে মারি। আর যখন বিড়াল আসে, তখন আমরা দৌড়ে আমাদের গর্তে গিয়ে লুকাই। এভাবেই টিকে আছি আমরা।”

 কামানের গোলার আওয়াজ বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। টম টের পাচ্ছে তাঁবুর খুঁটিগুলোর কম্পন থামছেই না। ওর হাতে সময় নেই।

 “আংরিয়া কিন্তু জানতো যে আমরা ঘাটের দিক দিয়ে আক্রমণ করবো,” আচমকা বলে উঠলো টম।

“সেরকমই মনে হচ্ছে।”

“তার মানে ও দুর্গ থেকে ওদিকে লোকজন পাঠিয়ে দিয়েছে কামান চালানোর জন্যে।” টমের মাথার ভিতর একটা পরিকল্পনা বাসা বাঁধছে। একটা জুয়া, কিন্তু ওর মাথায় আর কিছু আসছে না। ফ্রান্সিস, সারাহ আর অ্যাগনেস-ওদের সবার জীবন এখন হুমকির মুখে।

শাহুজি টমের অভিব্যক্তিটা খেয়াল করলেন। “কি করতে চাচ্ছেন আপনি?”

“আংরিয়া যেটার কথা স্বপ্নেও ভাববে না।”

*

উপসাগরটার পাশের আগুন এতো উঁচুতে উঠে গেলো যেনো মেঘ ছুঁয়ে ফেলবে। পানির উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়তে লাগলো; কামানের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলো চারপাশে।

ফ্রান্সিসদের নৌকার অবস্থাটা হচ্ছে বস্তায় ভরা বিড়ালের বাচ্চার মতো। পালাতে হলে ওদেরকে আংরিয়ার বিশাল জাহাজ বহরের কামানের সামনে দিয়ে যেতে হবে। একেকটা গ্রাব বিশাল লম্বা। গালিভাতের লোকজন নিজেদের নৌকার মুখ ঘোরানোর জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা হতে লাগলো খুবই ধীরে ধীরে। ওদের চারপাশে কামানের গোলা শব্দ তুলে উড়ে যাচ্ছে। একটা এসে ওদের একজনের মাথা উড়িয়ে নিয়ে গেলো। দেখে মনে হলো যেনো গাছ থেকে নারিকেল পড়লো। আর একটা সোজা এসে পড়লো পিছনের নৌকাটায়। সাথে সাথে দুইভাগ হয়ে গেলো নৌকাটা, আরোহীরা সবাই পানিতে ছিটকে পড়লো। কামানের গর্জনের সাথে এবার যুক্ত হলো আর্তচিৎকার। মারাঠারা সাঁতার পারে না।

ফ্রান্সিস হালটা ধরে মোচড় দিলো। গালিভাতের নাক ঘুরে গেলো দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজগুলোর দিকে।

 “আরে করছেনটা কি?” চেঁচিয়ে উঠলো মেরিডিউ। “মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?”

“জাহাজের দিকে গেলেই ভালো হবে,” ফ্রান্সিস বললো। “আমাদের দিকে আর গোলা ছুঁড়তে পারবে না তাহলে।”

 লোকজন সজোরে দাঁড় বাইতে লাগলো। সবার মুখ নৌকার পিছনের দিকে থাকায় ওরা দেখছে না যে ফ্রান্সিস ওদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে কামানের গর্জন আরো জোরালো হওয়ায় ওর উদ্দেশ্য ঠিকই ধরতে পারলো। কামানের মুখ থেকে বের হওয়া আগুনের হলকা এসে লাগতে লাগলো ওদের পিঠে। লোহার বল চারপাশের বাতাসকে চিরে দিচ্ছে থেকে থেকে। গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে মাথার উপর। ভয়ংকর লাগছে শুনতে, তবে এখন ওরা ওগুলোর নাগাল থেকে নিরাপদ। ওর জাহজাগুলোর এতো কাছে চলে এসেছে যে কামানের মুখ এতো বেশি বাঁকানো সম্ভব না।

কামানের গুরুগম্ভীর গর্জন থেমে এখন শুরু হলো মাস্কেটের খট খট। গ্রাবের লোকজন রশি বেয়ে মাস্তুল বেয়ে উঠতে শুরু করলো, যাতে ওখান থেকে নিচে গুলি ছুঁড়তে পারে। নৌকার চারপাশে মুহূর্তের মাঝে সীসার ভারী বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। আশে পাশের পানি টসবগ করে ফুটতে আরম্ভ হলো গুলির চোটে।

অনেকগুলো গুলিই লাগলো জায়গা মতো। একটা ভোলা নৌকার ভিতর ঠাসাঠাসি করে এতোগুলো লোক বসে আছে, ফলে লুকানোর কোনো জায়গা পেলো না ওরা। কিছুক্ষণ পরেই নৌকার খোল রক্তের পুকুরে পরিণত হলো। নৌকার দুই ধার ছিদ্র হয়ে চালুনির মতো দেখতে হয়ে গেলো, দাঁড়গুলো ভেঙে অর্ধেক নৌকার কিনারে ঝুলতে লাগলো, বাকি অংশ পানিতে ভেসে গেলো দূরে।

“কাছের গ্রাবটার দিকে গুলি করতে থাকো,” চেঁচিয়ে বললো ফ্রান্সিস। তবে আহতদের চিৎকার ছাপিয়ে অল্প কয়েকজনই ওর ডাক শুনতে পেলো। ওরা যদি জাহাজের বন্দুকবাজগুলোকে থামাতে না পারে, তাহলে এই ছোট নৌকাটায় কিছুক্ষণের মাঝে দস্যুরা ইচ্ছে মতো নিশানা করে মারতে পারবে ওদেরকে।

ফ্রান্সিস সামনে তাকালো। মাল্লারা সবাই দাঁড়ের উপর উবু হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে রক্ত ভরে আছে সবার। কিন্তু তখনও ওরা চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেনি। এই প্রচণ্ড আক্রমণের মাঝেও ওদের সাহসের প্রমাণ পেলো ফ্রান্সিস। তবে আর বেশিক্ষণ এই মনোবল ধরে রাখতে পারবে না। দস্যুদের সাথে লড়াই করতে হলে ওদের অন্য কিছু লাগবে।

জীবনে প্রথমবারের মতো ফ্রান্সিস নেতৃত্বের আসল বোঝা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারলো। ওকেই সবাইকে পথ দেখেতে হবে, আর সেটা করতে গিয়ে যদি মরেও যেতে হয় তবুও কিছু করার নেই।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়ালো, মাথা নিচু করে রেখেছে যাতে কামানের গোলা না লাগে। তারপরেও মাত্র এক ইঞ্চি উপর দিয়ে চুল পুড়িয়ে উড়ে গেলো একটা গোলা। দাঁড়ানোর সাথে সাথে ওর পায়ের ধাক্কা লেগে শক্ত কিছু একটা গড়িয়ে পড়ে গেলো-ওদের বানানো বোমাগুলোর একটা। দস্যুদের আচমকা আত্মপ্রকাশের কারণে ভুলেই গিয়েছিলো ওগুলোর কথা।

ফ্রান্সিস দুই হাতে দুটো তুলে নিলো। “আগুন জ্বালাও দেখি।”

মেরিডিউ সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলো। সাবধানে নিশানা করে ফ্রান্সিস দুটকেই ছুঁড়ে দিলো জাহজের ভিতর। এরকম গোলাগুলির মুখে যেখানে ওর নৌকা ভরে আছে মরা লাশ আর আহত লোকে, সেখানে ওর পক্ষে মাথা তোলাই ছিলো দায়-কিন্তু ওদের সবার জীবন মরণ নির্ভর করছিলো এটার উপর।

ওর নিশানা ভুল হলো না। বোমা দুটো জাহাজের কিনারে গিয়ে লাগলো, ঠিক কামানের খোপের নিচে। তারপর বিশাল দুটো অগ্নিশিখা তৈরি করে বিস্ফোরিত হলো। ওদিকে যে দস্যুরা ছিলো সাথে সাথে তাদের গায় আগুন ধরে গেলো। কয়েকজন ডেক-এ শুয়ে পড়ে গায়ের আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

গালিভাতটা গিয়ে গ্রাবটার গায়ে বাড়ি খেলো।

“আমার সাথে সাথে,” চিৎকার করে বললো ফ্রান্সিস। একপাশে একটা রশি ঝুলছিলো। ও সেটা আঁকড়ে ধরে একটা দোল দিয়ে জাহাজের পাশের কাঠের পাটাতনে উঠে এলো। কি হবে সেটা ভাবার সময় এখন হাতে নেই। বোমার তেলে খুব দ্রুত আগুন ধরে কিন্তু তাতে জাহাজে আগুন ধরেনি। দস্যুরা এর মধ্যেই আবার জড়ো হতে শুরু করেছে।

জাহাজের পাশের জালটা বেয়ে উঠে লাফ দিয়ে জাহাজের ডেকে নেমে এলো ফ্রান্সিস, তরবারি বের করে ফেলেছে। একজন দস্যু দৌড়ে এলো ওর দিকে। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে ছিলো ওর। আন্দাজেই ফ্রান্সিস দস্যুটার গলা বরাবর তরবারি চালালো, একবারের বেশি আর তরবারি তুলতে হলো না ওকে।

নির্মমভাবে লড়ে গেলো ফ্রান্সিস। ওর নিজের জন্যে, ওর লোকজনের জন্যে, সারাহ আর অ্যাগনেসের জন্যে-আর আবারও অ্যানাকে একনজর দেখার আশায়। একটা কামানের উপর লাফিয়ে উঠলো ও। জুতোর ভিতর দিয়ে ওটার গায়ের উত্তাপ টের পাচ্ছে। প্রথমে গোলন্দাজের চেহারা বরাবর লাথি হাকালো ফ্রান্সিস, তারপর লোকটা পিছিয়ে যেতেই সোজা পেটে চালিয়ে দিলো তরবারি।

একটা চিৎকার দিয়ে দস্যুটা ডেক-এ পড়ে গেলো। ফ্রান্সিস সামনে তাকালো। ওর দলের অনেকেই উঠে এসেছে জাহাজে। কয়েকজন মাস্তুল বেয়ে উঠে গিয়ে বন্দুকবাজগুলোকে পেড়ে ফেলার কাজ শুরু করে দিয়েছে। ওরা ওদেরকে টেনে নিচে ফেলে দিলো। ডেক-এর উপর পড়ে, ভর্তা হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হলো ওদের।

গ্রাবে যত লোক ধরে ততো লোক নেই। নিজের জাহাজের সংখ্যার উপর নির্ভর করে আংরিয়া ওর লোকদের অল্প অল্প করে সবগুলো জাহাজে ছড়িয়ে দিয়েছে। শুধু কামান দাগতে পারবে এরকম কয়জনই আছে একেকটা জাহাজে। ওরা ভাবেওনি যে ফ্রান্সিসের লোকেরা জাহাজে চড়তে পারবে। ফ্রান্সিসের লোকেরা লাগামহীন আক্রোশ নিয়ে লড়াই করতে লাগলো। ছোট নৌকাটায় যে যন্ত্রণা ওরা পেয়েছে তা সুদে আসলে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেলো সবগুলো দস্যু মৃত, নয়তো পানিতে ঝাঁপিয়ে পালিয়েছে।

“রশি কেটে দাও,” আদেশ দিলো ফ্রান্সিস। আজ অমাবস্যা, ভাটার টান খুব বেশি। যদি দস্যুদের কামানের গোলার হাত থেকে বাঁচা যায়, তাহলে স্রোতের টানেই ওরা এলাকাটা পেরিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করা যায়।

হঠাৎ ফ্রান্সিসের খেয়াল হলো এদের মাঝে ও-ই সবচে অভিজ্ঞ নাবিক। তার মানে ওদের সম্ভাবনা আরো কমে এলো। তবে মেরিডিউ ওর সাথে আছে, ও জানে কখন কি করতে হবে। মেরিডিউ-ই মারাঠাদেরকে নোঙ্গরের কাছিটা। দেখিয়ে কোথায় কাটতে হবে বলে দিলো। কয়েকজন ওই কাজে লেগে পড়তেই ফ্রান্সিসের চোখে পড়লো ক্যানভাসগুলো। ও কয়েকজনকে ওটার রশি ধরে টানার কাজে লাগিয়ে দিলো। প্রধান পালটা খুলে যেতেই মেরিডিউ দ্রুত দৌড়ে গিয়ে ওটার সাথে বাধা রশিগুলো টানটান করে দিলো। একেবেকে, থেমে থেমে জাহাজটা সামনের দিকে আগাতে লাগলো।

মেরিডিউ রশিগুলো ছেড়ে দিয়ে প্রায় বিড়ালের, দক্ষতায় লাফিয়ে নামলো। “নিচে নেমে গেলে ভালো হবে মনে হয়। সামনের গ্রাবের সারির দিকে দেখিয়ে বললো ও। “খোলা সমুদ্রে যেতে হলে আমাদেরকে আগে ওগুলো পার হতে হবে।”

 অগ্নিকুণ্ডগুলোর তেজ কমে এসেছে। ফলে ডাঙায় থাকা দস্যুরা ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে জাহাজে আসলে কি হচ্ছে। নিজেদের লোকের গায়ে লাগিয়ে ফেলার ভয়ে গুলি করা বন্ধ রেখেছিলো ওরা। কিন্তু জাহাজ নড়ে উঠতেই বুঝলো যে ওটা মারাঠাদের দখলে চলে গিয়েছে, তাই আবার গুলি করতে শুরু করলো।

ফ্রান্সিস নিচে নামার হ্যাচের দিকে তাকালো। “আমি লুকাবো না,” দৃঢ় গলায় বললো ও। ও গ্রাবটার সামনের দিকে তাকালো। ওখানে চারকোণা একটা দুর্গ মতন বানানো। পিছন দিকে খোলা। ভিতরে দুটো নাইন পাউন্ডারের লম্বা নল উঁকি দিচ্ছে।

“চেষ্টা করে দেখি অবস্থার উন্নতি করা যায় কিনা।”

কামান চালাতে জানে এরকম ডজন খানেক লোক বাছাই করলো ফ্রান্সিস। তারপর ওদেরকে কামানগুলোর কাছে পাঠিয়ে দিলো। দস্যুগুলো পর্যাপ্ত পাউডার আর গোলা ফেলে রেখে গিয়েছে। টম যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবে করে দ্রুত ওরা কামানে গোলা ভরে সামনের জাহাজটার দিকে তাক করে ফেললো।

 “যতোটা সম্ভব নিচু করে তাক করো,” নির্দেশ দিলো ফ্রান্সিস। “আমরা ওটার সামনে আর পিছন দুই দিকে ফুটো করে দেবো।”

কামান গর্জে উঠতেই জাহাজটা দুলে উঠলো। সন্তুষ্ট চিত্তে ফ্রান্সিস দেখলো গোলা দুটো সোজা গিয়ে জাহাজের পিছন দিকের খোল গুঁড়িয়ে দিয়ে ডেক-এর দিকে চলে গেলো। টম আর আবোলির কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার কারণে ও জানে যে গোলাটা সামনে যাকেই পাবে তাকেই ভর্তা বানিয়ে দিয়ে উড়ে যাবে।

“রি-লোড,” আদেশ দিলো ও। মারাঠারা কেউ ইংরেজি জানে না। কিন্তু আদেশটা ঠিকই ধরতে পারলো। ওরা দ্রুত হাতে নলটা পরিষ্কার করে ফেললো, তারপর ঠিকঠাক নিয়ম মেনে গোলা ভরে, আবার জায়গামতো গোলা ছুঁড়ে আবার পরবর্তী গোলা ভরার কাজ শুরু করে দিলো। দস্যুরা এর আগে কখনোই তাদের প্রতিপক্ষের কাছে থেকে এভোটা প্রতি আক্রমণের শিকার হয়নি। আর এতো দ্রুত পরে আরও একটা একটা আক্রমণ আসবে সেটা তো ছিলো ওদের কল্পনারও বাইরে। ওরা এখন এতো কাছে চলে এসছে যে ফ্রান্সিস জাহাজটার নিচের ডেক থেকে আর্তনাদও শুনতে পেলো।

মেরিডিউ হাল ধরেছে জাহাজটার। ও দিক পরিবর্তন করলো যাতে ওরা সামনের জাহাজটার পাশ কেটে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু জাহজটার পাশ ঘেঁষে খোলা পানিতে বেরিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, ও জাহাজটার পিছনে যাওয়া শুরু করলো। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানালো। এতে করে কামানের মুখ থেকে আংরিয়ার জাহাজটাই ওদেরকে আড়াল করে রাখবে।

কিন্তু তবুও এদিক দিয়ে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন, পরের বার কাছে আসতেই দেখা গেলো ওরা এতো কাছ দিয়ে যাচ্ছে যে দুটোর একটা আর একটার সাথে বাড়ি খেলো। যদি দস্যুগুলো এদিকের কামান প্রস্তুত করে রাখতো, তাহলে একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ফ্রান্সিস জাহাজটা গুড়ো গুছো করে দিতে পারতো। কিন্তু ফ্রান্সিসের একটু আগের আক্রমণের কারণে ওদের সবার কামানের মুখ এখন খোলা সাগরের তাক করা। ও দেখতে পেলো দস্যুরা দ্রুত কামানের মুখ এদিকে ঘোরানোর জন্যে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে।

“দেখা যাক এই শক্ত দাওয়াই ওরা কেমন হজম করতে পারে,” বললো ফ্রান্সিস। আর একটা বোমা তুলে নিলো ও দ্রুত হাতে জ্বেলে দুটো জাহাজের মধ্যবর্তী ছোট ফাঁকটা পার করে ছুঁড়ে দিলো জাহাজে। একগাদা দড়িদড়ার উপর পড়ে বিস্ফোরিত হলো বোমাটা। মাঝে দস্যুরা কামানে দাগার কথা ভুলে আগুন নেভাতে ছোটাছুটি শুরু দিলো। কারণ, ওরা সারা ডেক জুড়ে পাউডার আর গোলা ছড়িয়ে রেখেছে, একবার আগুন ওগুলোর একটা পিপার কাছে পৌঁছালেই কম্ম সাবার হয়ে যাবে। একজন এক বালতি পানি এনে আগুনের উপর ঢেলে দিলো সাথে সাথে বিশাল একটা অগ্নিশিখা ওকে গ্রাস করলো।

ডাঙা থেকে ভেসে এলো বাতাস। শুরুতে দুর্বল থাকলেও এই সরু পথ দিয়ে পার হওয়ার সময় চাপে পড়ে বেশ শক্তিশালী হয়ে গেলো সেটা। বানানোই হয়েছে অল্প বাতাসেও প্রচুর বেগ লাভের জন্যে। আর এই বাতাসে একেবারে উড়াল দিলো। ওরা সর্বশেষ বড় জাহাজটার পাশে চলে এলো। এটা পার হয়ে যেতে পারলেই খোলা সাগরে গিয়ে হাজির হওয়ার মাঝে আর ডাঙায় কয়েকটা কামান দেখা গেলো, কিন্তু সেগুলো নিয়ে আর দুশ্চিত ফ্রান্সিসের। দুর্গের কামানগুলো এতো বাঁকানো সম্ভব হবে না, আর গোলন্দাজেরা ওদের দিকে নিশানাই করতে পারলো না। একটা গোলাও ওদের কাছে এলো না।

ফ্রান্সিস পিছনে তাকিয়ে ঘাটটা ঠিকমতো দেখতে লাগলো। ওরটা কেটে বেরিয়ে এসেছে, আর দস্যুদেরকেও বেঈমানির উপযুক্ত শিক্ষা দিতে এসেছে। একটা জাহাজ গুঁড়িয়ে দিয়েছে, আর একটা দিয়েছে পুড়িয়ে। এখন আংরিয়ার গালিভাতগুলোর মাঝে ভাসছে, ফলে আরো ডজন কয়েক নৌকায় আগুন ধরে গিয়েছে।

কিন্তু এখনো দস্যুদের প্রায় অর্ধেক জাহাজ অক্ষত। আর প্রায় সব লোক নিয়ে ওরা এখানে এসেছিলো, এখন ফিরে যাচ্ছে গোটা তিরিশ। চড়া মূল্য দিতে হয়েছে ওদের। ফ্রান্সিসের মনে হতে লাগলো যে পুরো দায়টাই ওর।

যে নৌকাটাকে পাহারা দিতে রেখে গিয়েছিলো সেটাকে কোথাও দেখা গেলো না। ও আবার ভালো করে সামনে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো। মনে পড়লো, আক্রমণ যখন শুরু হয় তখন এখানেই প্রথম গোলা ছোঁড়া হয়েছিলো।

 নৌকাটাকে দেখতে পেলো না ও। কিন্তু সেটা খুঁজতে গিয়েই সামনে কালো সমুদ্রের মাঝে আরো কালো একটা রেখা ধরা পড়লো ওর চোখে। এক মুহূর্তের জন্যে ও জোর করে মনকে বোঝাতে চাইলো যে ওটা আসলে সামান্য একটা ছায়া, বা ঢেউয়ের কোনো খেলা। কিন্তু সেটা মিথ্যা। নিজের চোখে দেখা জিনিসটাকে অস্বীকার করতে পারলো না ও শেকলে বাঁধা মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি পুরো উপসাগরের মুখটাকে আটকে রেখেছে।

“ওরা বেড়াটা বন্ধ করে দিয়েছে,” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

মেরিডিউ হাল টেন ধরতেই পুরো জাহাজ কেঁপে উঠলো।

“সোজা যেতে থাকো,” উন্মাদের মতো বলে উঠলো ফ্রান্সিস।

 “তাহলে সোজা বেড়ায় গিয়ে বাড়ি খাবো,” মেরিডিউ মনে করিয়ে দিলো।

 “ওটাকে ভেঙে বেরিয়ে যাবো।”

“জাহাজের মাথা ভেঙে যাবে। ডুবে যাবে জাহাজ।” উপসাগর যেখানে খোলা সাগরে মিশেছে, আসার সময় ওখানের পানির ঘূর্ণি দেখেই বুঝেছিলো যে নিচে কিরকম মারাত্মক চোরা স্রোত বইছে। “সোজা চলে যাবো সমুদ্রের তলায়।”

 মেরিডিউ-এর কথার সত্যতা ধরতে পেরে ফ্রান্সিসের শেষ আশাটাও উবে গেলো। ভেবেছিলো এ যাত্রায় ওরা বোধহয় বেচেই গেলো; কিন্তু ফাঁদটা আসলে ওদের চারপাশ থেকেই আটকে রেখেছে। এখন ওদের একমাত্র উপায় হচ্ছে জাহাজটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা বা ওখানে বসে বসে অপেক্ষা করা কখন দস্যুরা এসে ওদেরকে গোলা ছুঁড়ে পানিতে নিয়ে ফেলবে।

ডাঙার কামানগুলো থেকে একটা গোলা জাহাজের নাকে এসে লাগলো। অবশেষে আংরিয়ার গোলন্দাজেরা নিশানা খুঁজে পেয়েছে। পিছনেই বেশ কয়েকটা গালিভাত ঝাঁক বেঁধে এগিয়ে আসতে লাগলো জাহাজের দিকে। ঠিক যেভাবে হাঙরের দল আহত তিমির দিকে এগিয়ে যায়।

ফ্রান্সিসের অ্যানার কথা মনে এলো। অ্যাগনেস আর সারাহের কথা ভাবলো। তবে সবচে বেশি মনে এলো টমের কথা। ও কিভাবে কোর্টনীদের ব্যর্থ করে দিলো সেটার কথা।

“কি করবো আমরা?”

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *