৬. অবরোধের মুখোমুখি

টম এর আগে কখনোই কোনো অবরোধের মুখোমুখি হয়নি-মানে ভিতর থেকে না। সমুদ্রের কোনো লড়াইয়ে বা ওঁত পেতে থেকে আক্রমণ করা লাগলে, ও ভালোই পারতো; কিন্তু এক্ষেত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু অপেক্ষা করতে করতে ওর সমস্ত সহ্য শক্তি শেষ হয়ে যেতে লাগলো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো। সারাহ থাকলে হয়তো ওকে শান্ত করতে পারতো। কিন্তু ও এখন অনেক দূরে, আর এই ভাবনাটা ওকে আরো রাগিয়ে দিচ্ছে।

এ কেমন পুরুষ আমি? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো ও। কমপক্ষে এক হাজার শক্তিশালী লোকের একটা সৈন্যদল ঘিরে রেখেছে ওকে, প্রতিটা দিনের প্রতিটা মুহূর্তে ও জানে যে এরা ওকে খুন করার জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো ভয় বা রাগ কাজ করছে না; ওর চরম মাত্রায় একঘেয়ে লাগছে।

প্রতিদিন ওরা কামান থেকে কয়েকটা এলোমেলো গোলা ছোড়ে, টম-রাও জবাবে ছোড়ে কয়েকটা। কিন্তু কোনোটাতেই খুব বেশি কিছু হয় না। রানির লোকেরা অবশ্য এরকম বিলম্বে কোনো সমস্যা বোধ করছিলো না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই দেখা গেলো টম ঐ পক্ষের আক্রমণের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এই অচলাবস্থা ভাঙার জন্যে ও যে কোনো কিছুতেই রাজি।

তবে ও শুধু অলস বসে থাকলো না। নিজের লোকেদের মাঝেও একই রকম অবসন্নতা লক্ষ্য করে ও দ্রুত ব্যবস্থা নিলো। কারণ, জানে এখনি কিছু না করলে ঝামেলা হবে পরে। ও বৃষ্টির পানি ধরার জন্যে চৌবাচ্চা খুড়তে লাগিয়ে দিলো সবাইকে, ফয়-এর ভেঙে ফেলা বাড়ি থেকে আনা তক্তা আর পাটের দড়ি দিয়ে ওটার পাশে বেঁধে দিলো। সাগরের দিক থেকে আক্রমণ আসার কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে, ও সাগরের দিকে তাক করিয়ে রাখে একটা কামান এনে উঠোনে বসিয়ে সবাইকে অনুশীলন করাতে লাগলো। ধীরে ধীরে সবাই কামানের নল পরিষ্কার করে আবার গোলা ভরে মাত্র দুই মিনিটেই গোলা ছুঁড়তে পারদর্শি হয়ে উঠলো। সেইদিন রাতে, যে দলগুলো বানিয়ে দিয়েছিলো তাদের মধ্যকার একাত্বতা দেখে টম খুশি হলো খুব। এরা একসাথে খায়, একসাথে পাহারাদারি করে, ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টা এসব তো আছেই। কামানের গোলা ছোঁড়ায় টম ওদেরকে একে অন্যের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু দেখা গেলো যে দলটাই ভালো করুক না কেনো, ওরা একজনের সাফল্যে অন্যজন উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।

আমার হাতে যদি শুধু এরকম একশো লোক থাকতো, তাহলেই আমি রানির শিবির আক্রমণ করে সব কয়টাকে মহল পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে আসতাম, মনে মনে ভাবলো টম। ‘

প্রথম সপ্তাহগুলোতে ওদের সবচেয়ে বড় ঝামেলা ছিলো হচ্ছে আবহাওয়া। দিনের পর দিন সমুদ্র থেকে ঝড় ধেয়ে আসতো। আর এই ভোলা দুর্গে সেগুলো আটকানোর কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। লোকজন সবাই দেয়ালের আড়ালে গাদাগাদি করে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঠকঠক করে কাঁপতো। রানির লোকজন যদি এই অবস্থায় আক্রমণ করতো, তাহলে দুর্গ দখল করতে ওদের একটা গুলিও খরচ করতে হতো না। কয়েকদিন পর ঝড় চলে গেলেও, অব্যাহতভাবে বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। টমের ধারণার চাইতেও বেশিদিন বৃষ্টিপাত চলতেই থাকলো। অবশেষ যখন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঁকি দিলো, তখন টম দীর্ঘদিন কারা ভোগের পর মুক্তি পাওয়া মানুষের মতো সাগ্রহে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।

কিন্তু ওরা হাফ ছাড়ার সময় পেলো না। জামাকাপড় আর পাউডার শুকোতে না শুকোতেই ওরা টের পেলো যে বৃষ্টির চাইতে সূর্য ওদের বড় শত্রু। দিনের মধ্যভাগে দুৰ্গটা একটা গনগনে উনুন হয়ে থাকতো। সবাই একফোঁটা ছায়ার খোঁজে উত্তপ্ত পাথরের গায়ে ঠেসে থাকতেও দ্বিধা করতো না। যে চৌবাচ্চাগুলোতে কয়েকদিন আগেও পানি উপচে পড়ছিলো, এখন সেগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।

শুকনো মৌসুম অবরোধকারীদেরকেও তাতিয়ে দিলো। কাছের গোডাউনটা জ্বালিয়ে দিলো ওরা। তারপর ইটগুলো দিয়ে নিজেদের কামানের জন্যে অবলম্বন বানালো। টম ওদেরকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ওরা ওদের কামানগুলো এনেছিলো রাতের বেলো, আর সকালের মধ্যেই কামানগুলো বসিয়ে এমন গোলাবর্ষণ আরম্ভ করলো যে টম-রা মাথা তোলারও সুযোগ পেলো না।

“ওরা আমাদেরকে আক্রমণ করতে চায়,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। অবরোধ শুরু হয়েছে ছয় সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। সবগুলো মাস্কেটে গুলি ভরে প্রস্তুত করে রাখো।”

গোলন্দাজ বাহিনির পিছু পিছু রানির সৈন্যদলও আগাতে শুরু করেছে। নরম বালিতে একটা পরিখা খুড়ছে ওরা। টম দরজায় করা ছিদ্র দিয়ে ওদেরকে দেখতে লাগলো। ওদের সর্দারের প্রতি বিশেষ নজর ওর। কোনো সন্দেহ নেই লোকটা টুঙ্গার, টেলিস্কোপে ওর চেহারাটা এতো কাছে চলে এলো যে টমের মনে হলো হাত দিয়ে ওর মাথার কাটা দাগটা স্পর্শ করতে পারবে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ও লোকদের নির্দেশ দিচ্ছে। ব্যালকনি থেকে পড়েও মরেনি সে। তবে আহত হয়েছে ভালোই। আর এখনো কোমরে নেপচুন তরবারিটা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাশে দাঁড়ানো লম্বা লোকটার সাথে পরামর্শ করছে সে। এই লোকটা তার অদ্ভুত ইস্পাতের চাবুকটা দিয়ে হিকসকে খুন করেছে। একদম নিখুঁত উচ্চারণে ইংরেজি বলে। একজন ইংরেজ কিভাবে রানির দলে জুটলো সেটা ভেবে পেলো না টম। সম্ভবত বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

গুলি করার জন্যে টমের হাত নিশপিশ করছিলো। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাস্কেটগুলো খুব বেশি ভালো মানের না। একদম খুব হিসেব নিকেশ করে মারতে না পারলে সেটা শুধু পাউডারের অপচয়ই হবে।

টুঙ্গারের পিছনে দেখা গেলো সৈন্যদল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

“ওরা পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করবে,” টম ঘোষণা দিলো। ও নিজের লোকদের জরিপ করলো একবার। ওরাও উঠোনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদে ঝলসে লাল হয়ে আছে চেহারা, ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শুকিয়ে আমসি। এদেরকে মোটেও যোদ্ধার মতো লাগছে না। আর সংখ্যায়ও এরা কতো কম।

“সবাই মাথা নিচু করে রাখবে। গুলি যেনো না লাগে।” টম ভেবেছিলো যে বলবে, “নিজদের জীবন বৃথা যেতে দিও না,” কিন্তু ভেবে দেখলো এটা আসলে একটা ফালতু কথা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই বাতিল কুঠির জন্যে জীবন দেওয়ার কোনো মানে নেই। ওরা লড়াই করছে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্যে।

“আমরা সবাই নিজেদের রক্ষার জন্যে লড়বো, আর সবাই মিলে এই দুর্যোগ পাড়ি দেবোই।”

টম সবাইকে জায়গামতো দাঁড় করিয়ে দিলো। নিজে দাঁড়ালো পূর্ব দিকের দেয়ালে, শক্রদলের মুখোমুখি; হাবিলদার আর আলফ উইলসন দাঁড়ালো উত্তর আর দক্ষিণে।

“তুমি উঠোনে থেকে দরজার কামানটা চালাও,” ফ্রান্সিসকে বললো ও। শুনে হতাশ হলো ফ্রান্সিস।

“চাচা, আপনি যদি আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে থাকেন…”

“আমি আমাদের সবাইকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি। তোমার দলটা হচ্ছে আমাদের শেষ ভরসা।” খেদোক্তি করলো টম। কণ্ঠে দুশ্চিন্তা আর প্রশংসা দুটোই আছে। এই বয়সে ও নিজেও কি এরকম ছিলো না? “তুমিও যুদ্ধ করার সুযোগ পাবে, নিশ্চিত থাকতে পারো।”

শত্রুর কামানগুলো চুপচাপ হয়ে আছে। তবে সৈন্যরা সবাই আড়ালে চলে গিয়েছে। টম ছিদ্র দিয়ে খেয়াল করলো, রানির লোকেরা ওদের কামানের নিচে চলে এসেছে। এতো কাছে যে ওরা চাইলেও কামানের নল এতো বেশি বাঁকা করতে পারবে না। নিজেদেরকে নিরাপদ ভেবে ওরা সামনে বাড়লো। বালির চড়াটার উপর দিয়ে দৌড়ে আসছে।

 “তাড়াতাড়ি কামানের কাছে গিয়ে গোলা ছুঁড়তে থাকো,” ফ্রান্সিসকে বললো

আক্রমণকারীরা দরজায় বসানো কামানের ছিদ্রগুলো খেয়াল করেনি প্রথমে। যখন ওগুলোর ঢাকনা তুলে দুটো নাইন পাউন্ডারের লম্বা নল বেরিয়ে এলোতখন বুঝতে পারলো।

“ফায়ার, চেঁচিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস।

এরকম পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলো টম অ্যানা পুরনো চালের বস্তা সেলাই করে ছোট ছোট ব্যাগ বানিয়ে দিয়েছিলো। আর ছেলেরা সেগুলোতে মাস্কেটের গুলি ভরে টোপলা বানিয়ে রেখেছিলো। কামান থেকে ছোঁড়ার কারণে ব্যাগগুলো ছিঁড়ে একসাথে গুলিগুলো ছুটে গেলো। সৈকতের সামনের সারির লোকগুলো পড়ে গেলো সাথে সাথে। দ্বিতীয় সারির লোকেরা টের পেলেও পিছনের লোকের চাপের কারণে সরতে না পেরে লাশের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। ফলে আক্রমণের বেগ কমে গেলো অনেকটাই।

“রি-লোড,” ফ্রান্সিস আদেশ দিলো। তবে বলার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এতোদিনের যন্ত্রণা আর অপেক্ষার অবসান হয়েছে আজ। এতোদিনের প্রশিক্ষণ, হাতে ফোস্কা ফেলে তপ্ত কামানের গোলা দেগে অনুশীলন-সবকিছু প্রমাণের আজই সুযোগ। ওয়ার্ম এন্ড স্পঞ্জ, র‍্যাম দ্য কান্ট্রিজ। হোম! ওয়েডিং। শট। প্রিক দ্য কারররট্রিজ অ্যান্ড প্রাইম দ্য হোল। নিশানা করার দরকার হচ্ছে না কারণ লক্ষ্যবস্তু আকারে বিশাল আর ওদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে।

“ফায়ার।”

দ্বিতীয়বার আগের চাইতেও বেশি ক্ষতি হলো। সৈন্যরা সবাই ছড়িয়ে পড়েছিলো। ফলে মাস্কেটের একটা গুলিও অপচয় হলো না। ছুটোছুটির মাঝে কয়েকজন সৈন্য গুলির আওতা থেকে সরে যেতে পাশের পানিতে নেমে পড়লো। তবে তাতেও কাজ হলো না। ওদের রক্তে পানির রঙ লাল হয়ে গেলো। কয়েকজন মরলো ওদের উপর পড়া লাশের চাপে পানিতে ডুবে।

কিন্তু তবুও ওদের আসা থামলো না। দেয়ালের উপর থেকে টম দেখতে পেলো টুঙ্গার ঘোড়ার উপর বসে আছে। চেহারা সেই লম্বা শিরস্ত্রাণে ঢাকা। নেপচুন তরবারিটা দুর্গের দিকে নিশানা করে সৈন্যদেরকে আক্রমণ করতে উৎসাহ দিচ্ছে ও। একজন সৈন্য আতংকিত হয়ে পালাতে গেলো। টুঙ্গার ঘোড়ার পিঠে বসেই নিচু হয়ে এক কোপে লোকটার কাঁধ থেকে নিতম্ব পর্যন্ত ফেড়ে ফেললো। তারপর ঘোড়া দিয়ে মাড়ালো। খুবই স্বাভাবিক যে সৈন্যরা ওর মুখোমুখি হওয়ার চাইতে দুর্গের কামানের সামনে বুক পেতে দিতেই বেশি আগ্রহী।

টম গুলি করবে ভাবলো কিন্তু ধোয়ার কারণে টুঙ্গারের চেহারা ঢাকা পড়ে গেলো। এদিকে ঝামেলা বাধলো আর একটা। এতে প্রশিক্ষণের পরেও ফ্রান্সিসের লোকজন দ্রুত গোলা ভরাটা আয়ত্বে আনতে পারেনি। রানির লোকজন প্রায় দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। আর যতোই কাছে আসছে, ততোই কামানের গোলা ছোঁড়ার ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। সৈন্যরা দরজার দিকে আর না আগালেও, দেয়ালের দুই দিকে পানির স্রোতের মতো করে ছড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে অনেকেই বাঁশের বানানো লম্বা মই নিয়ে এসেছে।

“কামানের সাথেই থাকো,” ফ্রান্সিসকে ডাকলো ও। যদিও এতো বড় কামানটা দেওয়ালের গায়ে সেঁটে থাকা সৈন্যদের কিছু করতে পারবে না, কিন্তু তারপরেও ওটার কারণে অন্যেরা এদিকে আসতে কিছুটা হলেও ভাববে।

আক্রমণকারী সৈন্যদল দুর্গের তিনদিকের দেয়ালের পাশে জড়ো হলো। কামানের নল রাখার ফাঁকা জায়গাটায় একটা বাশের মই দেখে গেলো। টম এগিয়ে গিয়ে, না দেখেই নিচের দিকে গুলি ছুঁড়ে মইটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। মইটা আছড়ে পড়তেই আর্তনাদ শোনা গেলো। তার পরপরেই টম আর ওর লোকেরা দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিচে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করলো।

টম গুলি ছোড়া মাস্কেটটা একজন ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে, নতুন একটা তুলে নিলো। কিন্তু গুলি করতে দাঁড়াতেই, একযোগে অনেকগুলো গুলি ছুটে এলো ওর দিকে। দেয়ালের পাথরে গর্ত খুড়ে ওর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো গুলিগুলো। সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললো ও।

“এতো সহজে হাল ছাড়বে না এরা, বিড়বিড় করে বললো টম। যেনো ওর কথা প্রমাণ করতেই, আরো একটা মই দেখা গেলো আর এক পাশে। এবার অবশ্য টম আক্রমণকারীদের উঠতে দিলো। একটা খালি মাথা দেখা গেলো; দুটো কালো হাত দেয়ালের কিনার আঁকড়ে ধরলো। কিন্তু লোকটা নিজেকে টেনে তোলার আগেই, ওর গলা ধরে মই থেকে টেনে তুলে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলো টম। নিচ থেকে ছুটে আসা মাস্কেটের গুলি লোকটার শরীরে লাগতেই সে ছটফট করে উঠলো, তবু টম ছাড়লো না। এই ফাঁকে টমের লোকজন মাথা তুলে নিচের সবার দিকে গুলি করা শুরু করলো।

 টম ছিন্নভিন্ন লাশটাকে ফেলে দিলো নিচে। আরো একটা সৈন্য মই বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু একটা ছেলে একটা বল্লম হাতে ছুটে এসে তার হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। টম মইটা ধাক্কা দিলো কিন্তু নাড়াতে পারলো না। নিচের লোকেরা মইটাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।

দুর্গের ছাদের দেয়ালের এপাশে, অস্ত্রপাতি আর গোলাবারুদের পাশেই এক ডজন ওয়াইনের বোতল দেখা গেলো। ওগুলো খালি করে ভিতরে পাউডার, তারকাটা আর ভাঙা ধাতুর টুকরো ভরা। আর একটা ন্যাকড়া স্পিরিটে ভিজিয়ে মুখে মধ্য ঠেসে ভরে রাখা হয়েছে।

টম ওর খালি পিস্তলটা একটা বোতলের পাশে ধরে ট্রিগার টিপলো। চকমকি পাথরের ঘষায় ফুলকি সৃষ্টি হয়ে ন্যাকড়াটার উপর পড়তেই আগুন ধরে গেলো। দেয়ালের পাশ দিয়ে বোতলটা ঢিল মারলো ও। মইয়ের গোড়ায় পড়ে বিস্ফোরিত হলো সেটা। যারা মইয়ের গোড়ায় ধরে ছিলো তাদের সবার শরীর মোরব্বা হয়ে গেলো। কারো কারো চোখ, কান, আঙুল উড়ে গেলো। মইটাও পড়ে গেলো সাথে সাথে।

আক্রমণকারীরা দেয়াল থেকে সরে গেলো। ফলে টমের লোকদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো এবার। ওরা বিরতিহীন ভাবে গুলি ছুঁড়ে গেলো। সৈন্যদের দিকে। ফলে আরো খানিকটা পিছিয়ে কামানের গোলার আওতায় চলে এলো তারা।

টম চারপাশে তাকালো। দুর্গের উপরে ভেসে থাকা ধোয়ার মেঘের ভিতর দিয়ে ও দক্ষিণ দিকের দেয়াল হাবিলদারের দলটাকে দেখতে পেলো। ওরাও ভালোই প্রতিরোধ করছে। কিন্তু উত্তর দেয়ালে দেখা গেলো আলফ উইলসন মরিয়া হয়ে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করছে।

মাথা নিচু করে টম দৌড়ে গেলো সেদিকে। আলফকে কিছু বলতে হলো না, টম পৌঁছাতেই বিপদটা দেখতে পেলো। দুর্গ থেকে গজ বিশেক দূরেই একটা পাথরের কুঁড়েঘর আছে। আর ওটার জানালা থেকে অবিরাম মাস্কেটের গুলি এসে দুর্গের দেয়ালকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।

“ওদেরকে ওখান থেকে বের করতে হবে,” টম চিৎকার করে বললো। “ওরা যদি ঐ বাড়িটার দখল রাখতে পারে, তাহলে ওঁত পেতে থাকার জন্যে দারুণ একটা জায়গা পেয়ে যাবে।” ভারতীয় মাস্কেটগুলোর মান ও পাল্লা ভালো হওয়ায়, অবরোধকারীরা ওখান থেকে সহজেই দেয়ালের এদিকে গুলি চালাতে পারছে। এদিক দিয়ে মই তুলতে তাই ওদের কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।

এই আশংকাই করছিলো টম। ওর লোকেরা সংখ্যায় এতো কম যে, কোথাও বেশি সৈন্য লাগলে অন্য কাউকে যে ডাকবে সেই উপায় নাই।

ও চিৎকার করে উঠোনে দাঁড়ানো ফ্রান্সিসের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ফ্রান্সিস তাকাতেই চার আঙুল তুলে দেখালো। মানে চারজন লোকসহ ফ্রান্সিসকে এদিকে আসতে ইংগিত করছে। তাতেও অবশ্য একটা কামান চালানোর জন্যে যথেষ্ট লোক দরজার কাছে থাকবে। আশা করছে এতেই আক্রমণকারীরা দরজার দিকে আগাতে দুইবার ভাববে।

 ফ্রান্সিস আর ওর লোকেরা দুর্গের উপর উঠে এসে টমের পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো। দেয়ালের গায়ে মাস্কেটের গুলি লেগে সাই সাই করে ছিটকে যাচ্ছে একেক দিকে। টম ব্যাখ্যা করলো যে কি কি লাগবে।

“কিন্তু নামবো কিভাবে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

 “দড়ি বেয়ে।”

 “আবার উঠবো কিভাবে তাহলে?”

“সেটা ওঠার সময় কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেবো আমি।”

 “আমি মানে? আমরা না?”

“না,” টম বললো। “তুমি দেয়ালের উপর থেকে গুলি ছুঁড়ে আমাকে নামার সুযোগ করে দেবে।”

ফ্রান্সিসের চেহারা কালো হয়ে গেলো। প্রতিবাদে কিছু একটা বলতে গেলো ও। “সময় নেই এখন। যদি আমার কিছু হয়, সবাই তোমার দিকে চেয়ে থাকবে।” এক মুহূর্তের জন্যে টমের আর একটা দুর্গে আর একটা। অবরোধের কথা মনে পড়ে গেলো। এই সমুদ্রেরই অপর পাড়ে। সেবার একটা বিস্ফোরণের আঘাতে টমের বাবার পা উড়ে যায়, তখন টম দায়িত্ব নিয়েছিলো আক্রমণের।

 ও ঈশ্বর, আমার ভাগ্যটা যেনো সেরকম না হয়, প্রার্থনা করলো টম।

ওরা দড়ি এনে দেয়ালের গায়ের আঙটাগুলোয় বেঁধে দিলো। টম ওর বুকের বেল্টে দুটো পিস্তল আটকে নিলো, আরও দুটো নিলো কোমরের বেল্টে। কাঁধে ঝোলালো একটা মাস্কেট। আর একটা বস্তায় ভরে নিলো আধা ডজন ওয়াইনের বোতলের বোমা।

“তোমার লোকদের ডাকো,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। “এখনি।”

সবাই একসাথে গুলি করলো। এতো জোরে শব্দ হলো যে কানে তালা লেগে গেলো টমের। ঝলসানিতে চোখেও দেখলো না এক মুহূর্ত। গুলির চাইতে যে ধোয়াটা বের হলো সেটা বেশি কাজে দিলো ওর। দেয়ালের এপাশটা ঘোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় খোলা দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে থাকার গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকুতে নিরাপদেই থাকলো ওরা। তারপর দড়ি ধরে দিলো লাফ।

টম যাদেরকে বেছে নিয়েছে তারা সবাই কেস্ট্রেল-এর নাবিক। এরা ঘুমন্ত অবস্থায় একটা জাহাজ জ্বালিয়ে দিতে পারে। এতে দ্রুত ওরা দড়ি বেয়ে নেমে এলো যে আক্রমণকারীরা টেরও পেলো না। টম বালিতে নামেই দেরি না করে একটা গড়ান দিয়ে পায়ের উপর উঠে এলো। মাথার উপর ঠা ঠা শব্দ গর্জে উঠলো মাস্কেট। ফ্রান্সিসের লোকেরা আবারও গুলি করেছে, আক্রমণকারীরা যাতে মাখা তুলতে না পারে।

টম তরবারি বের করে ঘরটার দিকে দৌড় দিলো। আলফ উইলসন আছে ওর পাশে। হাতে একটা কুড়াল। একজন সিপাহীর পরশু-র বাট কেটে ছোট করে নিজেই বানিয়েছে এটা। আচমকা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে রানির সৈন্যদল পিছু হটলো।

তবে কুড়েটার ভিতরের আততায়ীরাও জবাব দিতে লাগলো সমানে। এই দাঙ্গার মাঝেও টম খেয়াল করলো ওটার জানালা থেকে ধোয়া বেরুচ্ছে। গুলি নিজেদের লোকের গায়ে লাগবে কিনা সেই পরোয়া করছে না। টমের সামনে এক লম্বা ভারতীয় সৈনিক পড়ে গেলো। মাস্কেটের গুলিতে তার মাথার পিছন দিকটা উড়ে গিয়েছে। তবে সব গুলিই কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না, টমের সাথের একজনের বাহুতে গুলি লাগলো; আর একজন চোখের মাঝে গুলি খেয়ে উল্টে পড়লো।

ওদের সামনে সৈকতটা একটা সরু নালায় গিয়ে মিশেছে। দুর্গ আর নালার মাঝ দিয়ে গিয়েছে সেটা। বাতাস বালি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওদিক দিয়ে। টম নালায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর লোকদেরকেও একই কাজ করতে ইশারা দিলো। ওরা যদি মাটির কাছাকাছি থাকতে পারে, তাহলে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাই ওদের জন্যে আড়াল হয়ে দাঁড়াবে। মাস্কেটের গুলি রানির সৈন্যদের গায়েই লাগবে। আর তাছাড়া ফ্রান্সিসের লোকগুলোও একটু পর পর গুলি করছে, ফলে শত্রুরাও মাথা বের করার সুযোগ পাচ্ছে না।

টম বস্তা থেকে তিনটা ওয়াইনের বোতল বের করলো। একজন নাবিকের দিকে ইশারা করলো ও। লোকটার বাড়ি কর্নিশ, নাম পেনরোজ। “এই তিনটা ফাটার সাথে সাথে তুমি আমার পিছু পিছু আসবে। আর আলফ তুমি গুলি করতে থাকো।” টম আলফকে নিজের দুটো পিস্তল ধরিয়ে দিলো। “প্রস্তুত?”

টম একসাথেই বোতলগুলোর ন্যাকড়ায় আগুন ধরালো। লকলকে শিখায় জ্যান্ত হয়ে উঠলো যেনো ওগুলো। যতোটা সম্ভব মাথা নিচু রেখেই দুটো বোতল বাড়িটার দিকে ছুঁড়ে দিলো। একটা বেশিদূর গেলো না, বালিতেই পড়ে নিভে গেলো। দ্বিতীয়টা বাড়িটার দেয়ালে লেগে চূর্ণ হয়ে গেলো। টম গালাগাল : করতে লাগলো। আর উপায় নেই; ঝুঁকিটা ওকে নিতেই হবে।

আলফ খেয়াল করলো টম কি করতে চাচ্ছে। সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে ও নিজের মাস্কেট উঁচু করে গুলি করলো। ঠিক সেই মুহূর্তে টম নালাটা থেকে মাথা উঁচু করে সবচে কাছের জানালাটার দিকে ঝুঁকে সজোরে বোতলটা ছুঁড়ে দিলো।

 বোতলটা খোলা জানালা দিয়ে উড়ে গেলো। ছুঁড়ে মেরেই নালায় মাথা ডুবিয়ে ফেলার কারণে টম দেখতে পেলো না ব্যাপারটা। কিন্তু চাপা বিস্ফোরণের আওয়াজে টের পেলো যে ওর নিশানা ব্যর্থ হয়নি। একদম নিখুঁত লক্ষ্যভেদ যাকে বলে। মেঝেতে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বিস্ফোরিত হলো বোতলটা। ওটার ভিতরের প্রাণঘাতী জিনিসগুলো ছড়িয়ে পড়লো ছোট্ট ঘরটায়।

 ভারী কিছু একটা আঘাত করলো টমের কাঁধে। প্রথমে ও ভেবেছিলো যে বোধহয় গুলি লেগেছে। তবে সেটা আসলে আলফ উইলসন। মাথা নিচু করতে ও টমের চাইতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পরিমাণ সময় বেশি নিয়ে ফেলেছে। তাতেই সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেলো। টমের উপর ঢলে পড়লো ও। কলার বোনের ঠিক উপরের একটা ক্ষত দিয়ে গলগল করে বের হচ্ছে রক্ত।

ওকে ধরার মতো সময় নেই টমের হাতে। রানির লোকজন এর মধ্যেই আবার জড়ো হতে শুরু করেছে। ও আলফের জামার হাতাটা কেটে, বুলেটের ক্ষতটার ভিতর ঢুকিয়ে দিলো যাতে অন্তত রক্তপাত বন্ধ হয়। আপাতত এর বেশি সম্ভব না। ওরা এখানে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না। যদি একবার এখানে আটকে যায়, তাহলে মৃত্যু সুনিশ্চিত।

টম মাথা তুলে সামনের দিকে দৌড় দিলো। পেনরোজও দৌড়ালো পিছনে। আর কেস্ট্রেল-এর বাকিরা আলফের সাথে দাঁড়িয়ে গুলি করতে লাগলো। আবারও ধোয়া ওদেরকে শত্রুদের দৃষ্টির আড়াল করে দিলো। টম সৈকত জুড়ে একেবেকে দৌড়াচ্ছে। আর সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই তরবারির কোপে ধরাশায়ী করছে। ধোয়ার ভিতরেও সামনের ডান থেকে গুলির আওয়াজ অবুসরণ করে আগাচ্ছে ও। ওর বোতলের বিস্ফোরণে ঘরের ভিতরের সবাই তখনও মারা পড়েনি।

 ঘরটার পাশে ধোয়ার আবরণ এতই পুরু যে টম আর একটু হলেই সোজা গিয়ে ওটার গায়ে বাড়ি খেতো। ঘরটার পাশ ঘুরে এসে দেখে একটা ওক কাঠের খোলা দরজা। আধা ডজনের মতো রানির সৈন্য ওটার ভিতরে। টম ওদের দুজনকে পিস্তল দিয়ে গুলি করলো। ততীয় একজন মাস্কেট হাতে দৌড়ে এলো। টম একপাশে সরে গিয়ে লোকটার সাথে ধ্বস্তাধস্তি করে হাত থেকে অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে মুগুরের মতো করে লোকটার মাথায় বাড়ি দিলো। লোকটা পড়ে যেতেই, টম মাস্কেটের মাথা ঘুরিয়ে পরের লোকটার গলা বরবর সজোরে ব্যাট চালানোর মতো করে মারলো। ঘাড় ভেঙে পড়ে গেলো সে।

পেনরোজ বাকি দুজনকে সামলালো। টম দরজায় লাথি মেরে ভিতরে ঢুকে গেলো, হাতে উদ্দত তরবারি। এখানেই ওর বোতল বোমাটা কাজ সেরেছে। তিনজন লোক মেঝেতে মরে পড়ে আছে। রক্তে রঙিন হয়ে আছে ঘরের দেয়াল। আর একটা দরজা দেখা গেলো, ওটা দিয়ে ভিতরের আর একটা বড় ঘরে যাওয়া যায়। ওটার ভিতর থেকে গুলি করার, তারপর আবার গুলি ভরার আওয়াজ আসছে।

যদি একটা বোতল নিয়ে আসতো, তাহলে সেটা দিয়েই সব ঠাণ্ডা করে দেওয়া যেতো। কিন্তু ওর সাথে একটা তরবারি আর একটু আগে কেড়ে নেওয়া মাস্কেটটা বাদে আর কিছুই নেই। দুর্গ থেকে গুলির পরিমাণ কমে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের লোজন হয় গুলি খেয়েছে, নয়তো গোলাবারুদের ঘাটতি হয়েছে। যদি আক্রমণকারীরা নিজেদেরকে এখানে নিরাপদে রেখে আবার জড়ো হতে। পারে, তাহলে আর কয়েক মিনিটেই দুর্গের পতন হবে।

 ঘরের ভিতর এতো লোক গাদাগাদি করে আছে সেটা টম চিন্তাও করেনি। কয়েকজন গুলি করছে, বাকিরা গুলি ভরে দিচ্ছে। কয়েকজন পাউডার আর গুলি এনে দিচ্ছে। প্রায় অসম্ভব একটা কাজ, কিন্তু আর উপায় নেই। ও পেনরোজের দিকে মাথা ঝাঁকালো।

ওরা দুজন ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়লো, এতো দ্রুত এগিয়ে গেলো যে কেউ মাস্কেট তাক করার সময়টাও পেলো না। টম হাতের তরবারিটা দিয়ে সাই সাই করে কোপাতে লাগলো, আর পেনরোজের চালাচ্ছে আলফ উইলসনের কুড়ালটা। এই ছোট জায়গায় এটাই ভয়ানক হয়ে দেখা দিলো। একটু পর দেখা গেলো ওগুলোও ব্যবহার করার দরকার পড়ছে না। ঘরের ভিতর ধ্বস্তাধস্তি করার মতো জায়গা ছাড়া আর জায়গা নেই।

এই যুদ্ধে ওদের জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে পড়লো টম। পেনরোজ পেটে ছুরি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো। সৈন্যদের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে গেলো মুহূর্তেই। টম ওকে ধরতে গেলো কিন্তু সামনেই আগাতে পারলো না।

টম আর এক পা পেছাতেই পিঠ ঠেকে গেলো পাথরের দেয়ালে। ফাঁদে আটকা পশুর মতো অবস্থা ওর এখন। রানির সৈন্যরা একটা অর্ধবৃত্ত করে ঘিরে দাঁড়ালো ওকে। ওদের সর্দার হচ্ছে কালো পাগড়ি পরা বিশাল বপুর একটা লোক। সে সামনে বাড়লো। তারপর নিজের কমলা কোমরবন্ধ থেকে একটা লম্বা নলের পিস্তল বের করে টমের চেহারা বরাবর তাক করলো।

গুলির আওয়াজ পেতেই টম বাঁকা হয়ে গেলো, তবে চোখ খোলাই ছিলো ওর। পিস্তলের ঘোড়া জায়গা ছেড়ে নড়েনি, কিন্তু দেখা গেলো ক্যাপ্টেনের চেহারাটা একটা রক্তের মুখোশে ঢেকে গিয়েছে।

ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে দরজায়, দুই হাতে দুটো পিস্তল। দুই পাশে দুর্গের দুটো লোক বেয়োনেট বসানো মাস্কেট উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হতভম্ব সৈন্যগুলো কিছু করার আগেই ফ্রান্সিসের লোকেরা আক্রমণ করে বসলো। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে টম ওদেরকে যেভাবে ছুরি চালনা শিখিয়েছে সেটা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করে দেখালো ওরা। সৈন্যরা এতো বেশি হতবাক হয়ে গিয়েছিলো যে বলতে গেলে কোনো প্রতিরোধই করলো না। জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা ভবন ছেড়ে পালাতে লাগলো, তাড়াহুড়ায় অস্ত্র নিতেও মনে থাকলো না।

 “আমি তোমাকে আসতে নিষেধ করেছিলাম,” টম বললো ফ্রান্সিসকে। “তবে এসেছে বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এখন ঝটপট কাজ শেষ করতে হবে। আমরা এখনো নিরাপদ না।”

 রানির লোকেরা ঘরটাকে লম্বা সময় ধরে ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করেছে। পিছনেই টম আর ফ্রান্সিস পাউডারের পিপার একটা ভাণ্ডার খুঁজে পেলো।

 “এখানে যা আছে তা তো মাস্কেটের জন্যে অনেক বেশি,” টম বললো। “ওরা নিশ্চয়ই এখানে কামানও নিয়ে আসার চিন্তা করছিলো। এখন ওদের অস্ত্রকে ওদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবো।”

ওরা পিপাগুলোকে ঘরের মাঝখানে জড়ো করে একটা ন্যাকড়া খুঁজে দিলো ভিতরে। দুর্গের পূর্ব প্রান্তে তখনও গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু একদিকে, মানে উত্তর দিকে রানির লোকেরা যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়েছে। টম পাউডারে আগুন ধরাতেই সবাই বাইরের দিকে দৌড়ে গেলো। ছোট নালাটায় নেমে এসে টম বালিতে ছাপ দেখে বুঝতে পারলো একটু আগে ওরা কোথায় লুকিয়ে ছিলো। আলফ উইলসন যেখানে পড়েছিলো সেখানে রক্তে ভরে আছে।

 এখন আর ওখানে কেউ নেই। “আলফকে কোথাও সরিয়েছে নাকি?” ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করলো টম। “এখানেই রেখে গিয়েছিলাম ওকে।”

 ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো। “আমরা যখন এসেছি তখন কেউ ছিলো না এখানে।”

ঠিক সেই মুহূর্তে কুড়েটা বিস্ফোরিত হলো। বৃষ্টির মতো চূর্ণ পাথর ঝরতে লাগলো সৈকতের উপর। এমনকি দুর্গের দেয়ালের গায়েও লেগে খন খন শব্দ হতে লাগলো। ধোয়া কাটতেই টম দেখলো ঘরটা একেবারে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে।

“শালারা এখানে অন্তত আর কখনো কামান আনতে পারবে না,” সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললো টম।

বিস্ফোরণের পর লড়াইয়ের সর্বশেষ ইচ্ছেটুকুও উবে গেলো আক্রমণকারীদের। দুর্গের পাশ দিয়ে সবাই সেই সরু চড়াটা দিয়ে নিজেদের শিবিরের দিকে দৌড়ে যেতে লাগলো। দরজার কামান থেকে কয়েকটা গোলা তাদের পলায়নের গতিকে বাড়িয়ে দিলো কয়েক গুণ। দুর্গের লোকদের এখনো যুদ্ধ করার খায়েশ মেটেনি।

টম হাতের মাস্কেটটার উপর ভর দিলো। সারা গায়ে ব্যথা করছে ওর। এখন আর ও যুবক নেই। ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো ও। চুল উস্কখুস্কু হয়ে আছে, মুখ ধুলো আর ধোয়ায় ভরা, গায়ের জামা ছিঁড়ে একাকার, ঘামে ভিজে সপসপ করছে। টম যেনো নিজের ছেলের কৃতিত্বে গর্ব বোধ করতে লাগলো।

“তোমার আমাকে উদ্ধার করতে আসা উচিত হয়নি,” নিচু স্বরে বললো ও।

 “আপনাকে বাঁচাতে আসিনি আমি,” ফ্রান্সিস বললো। “আমি ভেবেছিলাম আপনি মারা গিয়েছেন। আমি এসেছিলাম আপনার কাজটা শেষ করতে।”

টম ফ্রান্সিসের কাঁধের উপর হাত রাখলো। তারপর দুজন মিলে লাশের মিছিল পেরিয়ে দরজার দিকে যেতে লাগলো।

“তুমি খুবই ভালো দেখিয়েছো,” টম বললো। “কিন্তু একটা মাত্র লড়াই জিতেছি আমরা। সন্দেহ নেই খুব দ্রুতই আবার চেষ্টা করবে ওরা। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এখন আলফ উইলসন গেলো কোথায়?”

কিন্তু দুর্গের কেউই তাকে দেখেনি। “ও খুব আহত ছিলো,” টম কাতর স্বরে বললো। “কেউ নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে এসেছে।”

“আমার কাছে কেউ আনেনি ওকে,” অ্যানা জানালো। ওর পায়ে একটা নোংরা এপ্রন চাপানো। হাত রক্তে লাল হয়ে আছে। ওর নিজের না, যেসব আহতের সেবা করেছে, তাদের। “দুর্গে আনলে তো আমার কাছেই আনতো।”

“তাহলে কোথায়?”

একটা অসুস্থ চিন্তা মাথায় আসতেই টমের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। ও দেয়ালের কাছে দৌড়ে গিয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে সামনে তাকালো। সামনের লাশের স্তূপের ভিতর প্রয় বন্ধুর লাশ খুঁজছে। মাছি ভন ভন করছে লাশগুলোর উপর।

“দেখেন,” ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে উঠলো। “ওরা সাদা পতাকা উড়িয়েছে।”

চারজন অশ্বারোহী রক্তস্নাত বালি পেরিয়ে দুর্গের দিকে এগিয়ে এলো। একজন একটা বল্লম উঁচিয়ে রেখেছে। ওটার ডগায় একটা সাদা কাপড় বাধা। ওদের পাশেই আছে টুঙ্গার। ওদের পিছনে দুজন অশ্বারোহী একজন বন্দীকে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে টেনে নিয়ে আসছে। বন্দীর হাত বাঁধা, সেই দড়ির অপর প্রান্ত ঘোড়ার জিনের সাথে আটকানো। বন্দী সম্ভবত ঘোড়ার সাথে তাল মিলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছে।

দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো দলটা। বন্দী হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসলো।

“ওটাতো আলফ উইলসন,” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

“চুপ,” হিসিয়ে উঠলো টম। নিচে টুঙ্গার শুনতে পেয়েছে ফ্রান্সিসের কথা। ও শয়তানি হাসি দিলো একটা।

“এ তোর বন্ধু?” টুঙ্গার জিজ্ঞেস করলো।

“আমার দলের একজন।” টম যতোটা সম্ভব নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছে। আশা করছে আলফ বুঝবে কেন ও এরকম নির্মম আচরণ করছে। তবে টুঙ্গার এতে বোকা বলো না।

“আমি একটা প্রস্তাব দিতে এসেছি। আত্মসমর্পণ কর। আমি সব বন্দীকে ছেড়ে দেবো।”

 “তারপর? আত্মসমর্পণ করে আমরা কোথায় যাবো?”

“পাশের গ্রামে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। ওখান থেকে ট্রাভাঙ্কোর বা কোচিনের ইংরেজ কুঠিতে চলে যেতে পারবি।”

“রানির মহলে যাওয়ার পর মিস্টার ফয়কে যেভাবে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলি, সেরকম তাই না?”

টুঙ্গার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো অনুতপ্ত কণ্ঠে কথা বলার। “রানি এই যুদ্ধের জন্যে খুবই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এখন উনি শুধু চান শান্তি।”

টম খুব ভালোমতোই জানে কোন ধরনের শান্তি রানি চান। তরবারির মাধ্যমে যে শান্তি আসে সেটা। ও না চাইতেও বারবার টমের চোখ আলফের দিকে চলে গেলো। আলফ মাথা তুলে মাথাটা দুর্বোধ্যভাবে নাড়তে লাগলো। আহত, প্রহৃত এবং বন্দী কিন্তু তবুও ওর চেহারা এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতায় দোদীপ্যমান। আলফ-ও টুঙ্গারের কথার আড়ালের চাতুরিতা জানে। নিজের জন্যে ও কখনোই সবার সর্বনাশের কারণ হতে চায় না।

টম এতো জোরে ওর তরবারির বাট চেপে ধরলো যে চামড়ায় দাগ বসে গেলো। শুধুমাত্র বহু বছর ধরে ওর বাবার কাছ থেকে শেখা অন্যকে সম্মান করার অভ্যাসের কারণে ও এখন এই শান্তি আলোচনা ভঙ্গ করে টুঙ্গারের দিকে গুলি ছুঁড়তে পারলো না।

 “আমরা আত্মসমর্পণ করবো না,” টম ঘোষণা দিলো। “আর তুই যদি ওর একটা চুলও ছিড়িস, তাহলে আমি নিজে তোদের শিবিরে এসে তোকে এমন শিক্ষা দেবো যা বাপের জন্মেও কল্পনা করিসনি।”

টুঙ্গার তিক্ত একটা হাসি হাসলো। “আমি কি কল্পনা করতে পারি সে সম্পর্কে তোর কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আমার প্রস্তাব না মানলে শীঘ্রই সেটা দেখার সুযোগ পাবি।”

“ভাগ,” চিৎকার করে উঠলো টম। “আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে দিস না।

টুঙ্গার দাঁত বের করে হাসলো। “কসম; আমি ওকে ছোব-ও না।”

তারপর ও ঘুরে চলে গেলো। আলফ উইলসন শেষবারের মতো দুঃখিত চোখে টমের দিকে তাকালো। সৈন্যরা আবার টানতে টানতে নিয়ে গেলো ওকে।

 টম উঠোনে নেমে এলো। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলো ফ্রান্সিস বলে উঠছে, “ওরা আলফকে করছেটা কি?”

টম আবার দৌড়ে উঠে এলো দেয়ালের ধারে। শত্রু শিবিরের পিছনেই দেখা গেলো সৈন্যরা আলফের গায়ের কাপড় খুলে ফেলে ওকে একটা পাম গাছের সাথে বাধছে। বাধা শেষ হলে একজন সৈন্য একটা মাটির পাত্রে করে কিছু একটা নিয়ে এলো। তারপর সেই তরলটা আলফের গায়ে মেখে দিলো। সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠলো ওর শরীর।

 “এ কেমন শয়তানি?” টম অবাক হলো।

“ও ফিরে আসছে,” ফ্রান্সিস বললো। টুঙ্গার আবার ওর ঘোড়ায় চড়ে সৈকত ধরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। বল্লমের মাথায় সাদা কাপড় বাধা। তবে এবার একা এলো ও।

 “কি করেছিস তুই?” প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠলো টম। “তুই কসম কাটলি যে তুই ওকে ধরবি না।”

“ধরিওনি। আমিতো শুধু প্রকৃতির হাতে ওকে ছেড়ে দিয়েছি।” ও ঘোড়াটা ঘুরিয়ে বল্লমের মাথাটা দিয়ে আলফ যে গাছে বাধা সেটার দিকে ইংগিত করলো “নারিকেল গাছে থেকে মিষ্টি একটা রস বের হয়। তাড়ি বলি আমরা। এখানকার লোকজনের তো ওটা পেলে হুশ থাকে না। আবার লাল পিপড়া, ভীমরুল এরাও খুব পছন্দ করে জিনিসটা। সকাল বেলা যখন এই রস বের হয়, তখন এসব পোকা হাজারে হাজারে এসে জড় হয় গাছের গায়ে। সূর্য মাথার উপর ওঠার পর ওরা বিদায় নেয়। পিঁপড়ারা গাছ ছেড়ে গাছের নরম শেকড়ে গিয়ে বাসা বাঁধে।” বলে হাসলো ও। “তবে হ্যাঁ, যদি যাওয়ার পথে আরো রসালো কিছু পায়, যেমন-একজন মানুষের নরম তুলতুলে মাংস, তাহলে ওরা তার শরীরেই বাসা বাধবে। আর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ওদের কামড় ভীমরুলের কামড়ের চাইতে কোনো অংশে কম না। আর আমি ওর শরীরে মধু লেপে দিয়েছি। সেটার লোভে ভীমরুলও আসবে।

“একটা মাস্কেট নিয়ে এসো, টম ফিসফিসিয়ে বললো ফ্রান্সিসকে। “তাড়াতাড়ি।”

“একজন মানুষের এভাবে মরতে তিন দিন পর্যন্ত লাগে,” টুঙ্গার বললো। দুর্গের বেশিরভাগ লোকই দেয়ালের পাশে এগিয়ে এসেছে শোনার জন্যে। কিন্তু টুঙ্গার এমন ভাব করলো যেনো ওদেরকে দেখেনি। ও আরো গলা চড়ালো।

“তোর লোকদের কথাটা বলে দিস। যে সবার আগে দরজা খুলে দেবে আমি তাকে জমি আর স্বর্ণ দিয়ে ভরিয়ে দেবো। আর বাকিরা সবাই মরবে-কিন্তু এমনভাবে মরবে যে সবাই ভাববে, এর চাইতে আগে মরে গেলেই ভালো ছিলো।”

 “তোর এই দশা করবো আমি, আর তুই হাজারবার বেশি চাইবি,” টম ফ্রান্সিসের আনা মাস্কেটটা তাক করলো। টম ওর উদ্দেশ্য ধরতে পেরে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে, বালি ছিটিয়ে ফিরে গেলো নিজের শিবিরে। টমের গুলি ওর পেছনের পানিতে ঢেউ তুললো।

টম আবার গুলি ছুঁড়ে আলফ উইলসনের দিকে তাক করলো। আলফ এক চুল নড়ছে না। হয় খুব কষে বাঁধা হয়েছে, নয়তো নিজের দুর্ভাগ্য সম্পর্কে এখনো টের পায়নি। তবে টুঙ্গারের অত্যাচারের কৌশলে কোনো ফাঁক নেই। ভারতীয় মাস্কেটের গুলিও এতোদূর পাড়ি দিয়ে আলফের গায়ে লাগতো না।

 তাও প্রচণ্ড রাগে টম ট্রিগার টিপলো। আবারও গুলিটা গিয়ে পড়লো সাগরের পানিতে। ঢেউয়ের ফেনার মাঝে ওটা নতুন কোনো আলোড়নই তুলতে পারলো না।

 “এখন কি করবো?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো। ওর চেহারা বালির মতো সাদা হয়ে গিয়েছে।

“কিছুই করার নেই,” জবাব দিলো টম।

*

আলফ উইলসন মারা গেলো তিনদিন পর। দুঃস্বপ্নের চাইতেও ভয়ংকর তিনটা দিন-কাটতেই যেনো চাইছিলো না। কেউ কিছু বললো না, দুর্গের কারো সাহস হলো না টমের চোখের দিকে তাকাতে। প্রতিদিন সন্ধ্যায়, যখন বাতাস উল্টো দিকে বইতো, তখন ওদের কানে আলফের আর্ত চিৎকার ভেসে আসতো, টম বেশ কয়েকবার ভেবেছে রাতের বেলা চুপিচুপি গিয়ে আলফকে মুক্ত করে দিয়ে আসবে। কিন্তু টুঙ্গার ওখানে দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছে, আর রাতের বেলায় বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে রাখতো যাতে চারপাশের সবকিছুই ভালোমতো দেখা যায়। এমনকি আলফ মারা যাওয়ার পরেও ওকে ওভাবেই ফেলে রাখলো। একসময় ওর চেহারা বিকৃত হয়ে আর চেনা গেলো না।

 পরের আক্রমণের জন্যে টম অপেক্ষা করে রইলো। যুদ্ধের জন্যে মনটা আঁকুপাঁকু করছে ওর। কারণ শুধু তা হলেই ও টুঙ্গারের উপর আলফকে হত্যা করার প্রতিশোধ নিতে পারবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর এলো না। সেই আগের মতোই শুধু কামানের গোলা বিনিময় করেই কেটে যেতে লাগলো দিন। শুধু কামানের আওয়াজেই টের পাওয়া যেতো যে দুই পক্ষই এখনো আছে।

“ওরা আমাদেরকে না খাইয়ে মারার চেষ্টা করছে,” টম মন্তব্য করলো। ও আজ থেকে সকালের খাবার বন্ধ করে দিয়েছে। আর এখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি আছে মাত্র আর আধা পিপা। এর মধ্যেই লোকজনের অসন্তুষ্ট ঘ্যানঘ্যান শুনতে পেয়েছে। কয়েকদিন পরেই সবাই মরিয়া হয়ে যাবে।

“ওরা মনোবল হারিয়ে ফেলছে,” হাবিলদার বললো। “আমাদের দেশে কেউ জীবন দিয়ে অবরোধ রক্ষা করে না। কেউ তার মালিকের প্রতি এতোটা বিশ্বস্ত না যে তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে। দুর্গের পতন সবসময় বিশ্বাসঘাতকতার জন্যেই হয়।”

 ফ্রান্সিস কথাটা শুনে অবাক হলো। “মানুষজন এখানে এতোটাই দুর্বলচিত্ত? কোনো ইংরেজ কখনো এধরনের অসম্মানের কাজ করবে না।”

“উঁহু,” টম বললো। ভাতিজার আদর্শবাদিতা দেখে অবাক হয়েছে। “কাপুরুষতা বা স্বার্থবাদিতা থেকে কোনো জাতি-ই মুক্ত নয়। ইংল্যান্ডের পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে দেখো, আমাদের কতোগুলো দুর্গ বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণার জন্য বেদখল হয়েছে, গুণে শেষ হবে না।”

“আমার ধারণা রানি ঝামেলায় আছে,” অ্যানা বললো। “বর্ষা শেষ হওয়ার আগেই তার এই যুদ্ধ জিততে হবে। কয়েকদিন পরেই আবার ব্যবসার মৌসুম শুরু হবে। সেসময়েও যদি আমাদের সাথে যুদ্ধ চলতে থাকে তাহলে ওনার সওদাগরেরা তাদের কাপড় বা মশলা বিক্রি করার সুযোগ পাবে না। ওরা ওদের ক্ষতির জন্যে রানিকে দোষারোপ করবে, আর রানিও খুব বেশি খাজনা আদায় করতে পারবে না। পুরো রাজ্যেই সংকট সৃষ্টি হবে। রানি খুব ভালোমতোই সেটা জানে।”

 টম ওর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালো। এই কঠিন সময়েও মেয়েটা ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবসার কথা ভাবতে পারছে। ও ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। ছেলেটা সারাক্ষণ অ্যানার পিছনে ঘুরঘুর করে, যখন ওর কাজ থাকে না তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে অ্যানার সাথে গল্প করে। অল্প হলেও, নিজের ভাগের ভাত বাঁচিয়ে অ্যানাকে দেয়। এরকম অবস্থাতেও ফ্রান্সিসের এতো প্রেমের নমুনা দেখে টম অভিভূত বলা যায়।

 “বর্ষা শেষ হতে আর দেরি নেই।” টম এর মধ্যেই বাতাসে সেটার পরিবর্তন ধরতে পেরেছে। বাতাসের দিক বদলালেই ঠাণ্ডার একটা আমেজ পাওয়া যায় বাতাসে। কে জানে হয়তো রানি তার কর্মপন্থা বদলাতেও পারে।”

*

সোয়া মাইল দূরেই ক্রিস্টোফার বসে আছে টুঙ্গারের তাঁবুতে। তাঁবুর খোলা পর্দার ভিতর দিয়ে ও দেখতে পাচ্ছে যে নাইন-পাউন্ডের কামানগুলো সার বেঁধে ওগুলোর মাচার উপর নিস্কর্মা পড়ে আছে। দৃশ্যটা দেখে ভিতরে ভিতরে রাগ হলো ওর। এতোদিনে দুৰ্গটাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারতো ওগুলো। সাথে ওটার অধিবাসীরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। কিন্তু রানির পাউডার খুবই ফালতু, আর পাথরের গোলার বদলে ওকে ব্যবহার করতে হয় পাথর। সেগুলো শক্ত দেয়ালে লেগে ক্ষতি করার বদলে নিজেরাই চুরচুর হয়ে যায়।

“তোমার কর্মকাণ্ডে রানী খুবই অসন্তুষ্ট,” পুলা বললো। আজ সন্ধ্যায় কোনো খবর না দিয়েই এসে উপস্থিত হয়েছে সে। সাথে রানির পঞ্চাশজন দেহরক্ষী। ক্রিস্টোফারের চরদের দেওয়া তথ্যমতে পুলা নাকি এখন দিন-রাত রানির দরবারে পড়ে থাকে। সম্ভবত সেজন্যেই বসন্তে নতুন কুঁড়ি গজানোর মতো করেই আবার ওর দশ আঙুলে নতুন নতুন স্বর্ণের আংটি চকচক করছে।

যখন সুযোগ পেয়েছিলাম তখন তোর আঙুলগুলো কেটে ফেললেই ভালো হতো, মনে মনে ভাবলো ক্রিস্টোফার। সাথে তোর জিহ্বাও। একটা কাষ্ঠ হাসি হাসলো ও। তারপর অতিথিকে আর এক বাটি তাড়ি ঢেলে দিলো।

“দুর্গতে আরো কয়েক সপ্তাহ আগেই দখল হয়ে যেতো, ঝামেলতো বাধিয়েছে ঐ জাহাজডুবি হওয়া টুপিওয়ালাগুলো,” প্রতিবাদ করলো টুঙ্গার। “ওদের সর্দার যেনো একটা প্রেতাত্না, আস্ত শয়তান লোকটা।”

পুলা তাবুর একটা খুঁটিতে আটকানো নেপচুন তরবারিটার দিকে ইংগিত করলো। কুপির আলোয় ওটার বিশাল নীলাটার একদম গভীর থেকে আভা ছড়াচ্ছে। “যদি তুমি ওর তরবারিটা না নিতে, তাহলে মনে হয় সে আমাদের কথা-ই শুনতো। তার বদলে এখন আমাদেরকেই বাঁশ দিচ্ছে।”

“আপনি আসলে এখানে এসেছেন কেনো?” বেজার কণ্ঠে জানতে চাইলো টুঙ্গার। একটা গুবরে পোকা উড়ে এসে পুলার সামনে রাখা খেজুরের থালার উপর বসলো। শুঁড় নাড়তে নাড়তে ফলগুলোর উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো ওটা।

 “বর্ষা প্রায় শেষ। কয়েকদিন পরেই সমুদ্র শান্ত হয়ে যাবে, আর টুপিওয়ালাদের জাহাজও কিন্তু আসতে থাকবে। যদি আমাদের তাঁতী আর কৃষকেরা তাদের মালামাল বিক্রি করার জন্যে কোনো খরিদ্দার না পায়, তাহলে কিন্তু সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।”

“মানে ওরা রানির খাজনা দেবে না,” চাপা স্বরে বললো টুঙ্গার।

“আর এই সৈন্যবাহিনি চালানোর টাকা আসে কোত্থেকে?” পুলা বললো। বলে ও কাশি দিলো একটা। তাড়ির মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে এলো শ্বাস থেকে। “আমি আগেই এই যুদ্ধ বাধাতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু তোমরা রানিকে তাল দিয়েছে। যেহেতু তোমাদের কথাই থেকেছে শেষ পর্যন্ত, তার মানে এখন ব্যাপারটা যাতে ভালোয় ভালোয় শেষ হয় সেটা দেখতে হবে। যদি ব্যর্থ হও, তাহলে চিত্তিত্তিঙ্কারার মহলে আবার তোমাদেরকে স্বাগতম জানানো হবে সেরকম ভেবো না। এই অযথা যুদ্ধে রানির পুরো এক বছরের খাজনা নষ্ট হয়েছে।”

“আপনারও ভালোই পয়সা খসেছে বোঝা যাচ্ছে,” ক্রিস্টোফার বললো।

“রানি হচ্ছেন নদীর মতো, দেদারসে পয়সা বিলাতে তার কোনো সমস্যা হয় না,” বললো পুলা। “তুমি বুঝবে না।” তারপর টুঙ্গারের দিকে তাকালো। “দস্যু আর ডাকাতদের সাথে যুদ্ধ বাধালে এরকমই হয়।”

গুবরে পোকাটা তখনও খেজুরের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। আচমকা টুঙ্গার ওটাকে মারার জন্যে প্রচণ্ড জোরে থাবা দিলো। থালাটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে সব খেজুর মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু গুবরেটা ভো ভো করতে করতে অক্ষত অবস্থায় কুপিটার দিকে এগিয়ে গেলো।

টুঙ্গার থালাটার একটা ভাঙা টুকরো তুলে নিয়ে হাত দিয়ে মুচড়ে গুড়োগুড়ো করে ফেললো। “আমরা এই যুদ্ধ জিতবোই,” শপথ করলো ও। “এখান থেকে চিত্তিঙ্কিারার রাস্তার দুধারে বল্লমের আগায় টুপিওয়ালাদের কাটা মুণ্ড ঝুলিয়ে দেবো। আর যখন, মহলে পৌঁছাবো, তখন তোর মাথাটা সদর দরজার পাশে ঝুলাবো। যারা রানির কান ভাঙায় তাদের জন্য শিক্ষা স্বরূপ।”

ক্রিস্টোফার কিছু বললো না। ও খুব ভালো মতোই জানে যে টুঙ্গার আর পুলার মাঝের এই দ্বন্দ্বই ওকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। যদি যুদ্ধে পরাজয় হয়, তাহলে টুঙ্গারের গর্দান তো যাবেই, সাথে ওরটাও যাবে।

পুলা উঠে দাঁড়ালো। “আমার মনে হয় না আর কিছু আলোচনার বাকি আছে। শুভ রাত্রি।”

তাবুর পর্দাটা তুললো পুলা। বাইরের জ্বলন্ত আগুনের আচমকা উজ্জ্বলতায় আকৃষ্ট হয়ে গুবরে পোকাটা সাই করে উড়ে গেলো সেদিকে। তারপর সোজা আগুনের ভিতর গিয়ে পড়ে, পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।

 পুলা হাসলো। “দেখেছো? শত্রুদেরকে ধ্বংস করার কিন্তু অনেক উপায় আছে।”

*

পুলা চলে যাওয়ার পরে, ক্রিস্টোফার আগুনের পাশে বসে বসে ভাবতে লাগলো। ও জানে সবচে ভালো হয় জঙ্গলে পালিয়ে গেলে। কিন্তু তাহলে ওর জন্যে সব শেষ হয়ে যাবে। টুঙ্গার লোক পাঠাবে ওকে ধরে আনার জন্যে। তবে ক্রিস্টোফার ওদের হাত থেকে পালাতে পারবে।

 কিন্তু তরবারিটার চিন্তা ও ছাড়তে পারছে না। তরবারিটা ওটার নীল পাথরের চোখ দিয়ে যেনো ওর দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ। ওর উত্তরাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। গত কয়েক মাসে কতোবার যে ও টুঙ্গারকে খুন করে তরবারিটা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু টুঙ্গারের শত্রু অনেক, তাই সর্বক্ষণ পাহারা রাখে চারপাশে। এই কয়েক মাসে ক্রিস্টোফার ওকে একটা বারের জন্যেও একা পায়নি বা তরবারিটাকেও টুঙ্গার কখনো চোখের আড়াল করেনি।

আগুনের উল্টোপাশে হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। কয়েকজন শশব্যস্ত হয়ে কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছে, একটু পরেই তিনজন প্রহরী এক লোককে ধরে নিয়ে এলো ওর কাছে। লোকটার বালি রঙের চুল না দেখলে সে যে বিদেশি সেটা বোঝা যেতো না। ক্রমাগত সূর্যের তাপে পুড়ে ওর গায়ের রঙ স্থানীয়দের মতো গাঢ় হয়ে গিয়েছে। লোকটার গাল ভাঙা, পা দুটো দেখে মনে হচ্ছে দিয়াশলাইয়ের কাঠি। শতছিন্ন জামাটার ভিতর দিয়ে হাড় জিরজিরে বুকটা দেখা যাচ্ছে।

এই লোকগুলো কিভাবে আমাদেরকে দিনের পর দিন আটকে রাখছে? ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো ক্রিস্টোফার। ও ইংরেজদের সর্দার লোকটার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেলো। এই লোকটা সমুদ্রে ডুবে মরতে মরতে বেচে ফিরে এসে ওদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে এখন। যদি দুর্গ দখল হয়, তাহলে লোকটা মরার আগেই তার কাছে থেকে অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব জেনে নিতে

“এই ব্যাটা আমাদের এখানে ঢোকার চেষ্টা করছিলো,” প্রহরীদের প্রধান বললো। “এ নাকি আপনার সাথে কথা বলতে চায়।”

“আমার সাথে?” অবাক হলো ক্রিস্টোফার।

 “ও নাকি শুনেছে যে আপনি টুপিওয়ালাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন।”

 ক্রিস্টোফার বন্দীর আপাদমস্তক জরিপ করলো। লোকটা চর নয়তো? একবার ভাবলো আগে একটু মারধোর করে সেটা বের করার চেষ্টা করবে কিনা।

পরে ভাবলো যে লাগলে পরেও তা করা যাবে।

“কি বলবি বল, ইংরেজিতে বললো ও। নইলে শেষ যাকে ধরেছিলাম তার মতো অবস্থা করে ছাড়বো।”

বন্দী হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। করুন কণ্ঠে কথা বলছে। “ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক, হুজুর। আমাকে না বললেও চলবে। আমি দেখেছি আপনি কি করেছিলেন। আমি চাইনা আমারো ওরকম হোক। আমি এখানে স্বেচ্ছায় এসেছি। আপনার জন্যে একটা প্রস্তাব নিয়ে।”

“কি প্রস্তাব?”

“আমার নাম হুজুর ইব্দুলী। আমি মিস্টার ফয়-এর হিসাবপত্র দেখতাম। আমি শুনেছি হুজুর, যে আপনাদেরকে দুৰ্গটা খুলে দেবে তাকে নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে। আর সাথে অনেক পুরস্কারও দেওয়া হবে।”

“হ্যাঁ,”

“আমি কাজটা করতে পারবো হুজুর। আমি আপনাদের জন্যে দুর্গের দরজা খুলে দেবো।”

 লোকটা জুলজুল চোখে ক্রিস্টোফারের দিকে তাকিয়ে রইলো। ক্রিস্টোফার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। একবার ভাবলো এটা কোনো ফাঁদ নয়তো। আবারও মনে হলো যে ব্যাটাকে কিছুটা কড়কে দিয়ে সত্যটা বের করবে কিনা। কিন্তু কথা হচ্ছে দুর্গে এখন লোকজন খুবই কম। তাই দুর্গপ্রধান। নিশ্চয়ই এর মাঝে ফাঁদ পাতার জন্যে তার একটা লোকের জীবনের ঝুঁকি নেবে না। কারণ ওরা জানে যে ধরা পড়লে কি পরিণতি অপেক্ষা করছে।

“কখন পারবি?”

“কাল রাতে হুজুর। কাল আমাবস্যা, ওরা আপনাদেরকে আসতে দেখবে না।” তারপর হাত জোড় করে বললো, “পুরষ্কার তো পাবো, তাই না হুজুর?”

“তোর পাওনা তুই ঠিকমতোই পাবি,” জোর করে হাসি চেপে লোকটাকে আশ্বস্ত করলো ক্রিস্টোফার।

কৃতজ্ঞচিত্তে মাথা ঝাঁকালো ইক্বলী। “আমি তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরে যাই, হুজুর। আজ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব আমার, পরের জন আসার সময় যদি আমাকে পাওয়া না যায় তাহলে ক্যাপ্টেন আমার খবর করে দেবে। শালা একটা হারামজাদা। প্রতিদিন আমাদের অনুশীলন করারতে করাতে অবস্থা কাহিল করিয়ে দেয়। ভাবুন হুজুর, আমি একজন হিসাব রক্ষক, আর আমাকে দিয়ে এইসব করায়,” অপমানিত হওয়ার স্বরে বললো ইল্কলী।

ক্রিস্টোফার লোকটার প্যানপ্যানানি মন দিয়ে শুনছিলো না। কিন্তু ওদের ক্যাপ্টেনের কথায় মনোযোগ আকর্ষিত হলো ওর।

“তোদের ক্যাপ্টেনের নাম কি?” জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

“টম উইল্ড। মৌসুমের শুরুতে জাহাজডুবি হয়ে এখানে এসে উঠেছে। কেন হুজুর? চেনেন ওনাকে?”

“না কিন্তু কেমন যেনো খুব… পরিচিত মনে হয়।”

ক্রিস্টোফার ওর আশার চাইতেও বেশি জিনিস জেনে ফেলেছে। সোজা হয়ে বসে বললো, “যদি কাল দরজা খোলা পাই, তাহলে তোর ওজনের সমান স্বর্ণ পাবি।” বলে ও লোকটার চোখের দিকে তাকালো। যা দেখতে পেলো তাতে খুব খুশি হলো ওঃ লোভ, ক্ষুধা আর ভয়। “আর যদি না পাই, তাহলে স্বর্ণ গলিয়ে তোর গলা দিয়ে ভরে দেবো। সাবধান করে দিলাম।”

*

ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ। কেন তা ও জানে না। দুর্গের এক কোনায় উষ্ণ বালিতে শুয়ে ঝিমাচ্ছিলো ও। আপনাআপনি ওর হাত পাশে শুইয়ে রাখে মাস্কেটে চলে গেলো। নতুন চাঁদ উঠবে, আকাশ তাই আলকাতরার মতো কালো হয়ে আছে। অনেক আগেই ওদের মোম আর বাতি জ্বালানোর মতো তেল শেষ হয়ে গিয়েছে।

 একটা হালকা পদক্ষেপ এগিয়ে এলো ওর দিকে। উঠে বসলো ও।

“ফ্রান্সিস?” অন্ধকারের ভিতর অ্যানার গলা শোনা গেলো। রাতের মতোই। শীতল আর নরম। ফ্রান্সিসের পাশে বসে ও নিজের পোশক টানটান করতে লাগলো। ফ্রান্সিস ওকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছে। ওর শরীর থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে।

“আমি ঘুমাতে পারছি না,” অ্যানা বললো। “দুঃস্বপ্ন দেখলাম একটা। আমি একটা বিশাল দুর্গের ভিতরে দৌড়াচ্ছি আর তোমাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। লোকজন ধাওয়া করছে আমাকে, একটুর জন্য ধরতে পারছে না। আর আমি জানি যে যদি আমি তোমাকে খুঁজে না পাই তাহলে ওরা তোমাকে খুন করে ফেলবে।”

কিছু না ভেবেই ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো অ্যানাকে। তারপর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

“স্বপ্নতো স্বপ্নই।”

 অ্যানাকে নিজেকে সামলালো। “আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।”

“এইতো আর কয়েকদিন। সূর্যাস্তের ঠিক আগেই সমুদ্রে একটা পাল দেখেছি আমি। সাগরে জাহাজ চলা শুরু হয়েছে আবার। সারাহ আর অ্যাগনেস যদি মাদ্রাজে একটা খবর পাঠাতে পারে, তাহলেই হবে। ওখানকার গভর্নর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাহায্য পাঠাবে।”

“একটা জাহাজ যদি এসে আমাদেরকে অনেক দূরে কোথাও নিয়ে যেতো?”

অ্যানা অন্ধকার তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর সোজা হলো। ফ্রান্সিস কিছুটা লজ্জা পেয়ে ওর হাত সরিয়ে নিলো। কিন্তু অ্যানা সোজা হয়েছে ওর মুখ ফ্রান্সিসের মুখের সমান উপরে তোলার জন্যে। অ্যানা সামনে ঝুঁকলো, অন্ধকারে ফ্রান্সিসের মুখটা খুঁজছে।

অ্যানার ঠোঁটগুলো শুকনো কাগজের মতো হয়ে আছে। অ্যানা ওর ঠোঁট ফাঁক করে জিহ্বা দিয়ে ফ্রান্সিসের পুরো চেহারা ছুঁয়ে দিলো। ফ্রান্সিস ওকে জড়িয়ে ধরলো আবার। অ্যানার নরম স্তনের ছোঁয়া অনুভব করতে পারলো নিজের শরীরে। অ্যানার চুলের ভিতর আঙুল চালালো ও, তারপর

আচমকা ফ্রান্সিস নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মন খারাপ করে অ্যানা উঠে দাঁড়ালো। “আমি ভেবেছিলাম-”

 ফ্রান্সিস ওকে মুখ দিয়ে হিসস শব্দ করে চুপ করিয়ে দিলো। “গন্ধ পাচ্ছো?”

 অ্যানা নাক কুঁচকে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করলো। কেমন যেনো… সালফারের মতো গন্ধ।”

 “বন্দুকের সলতের গন্ধ,” ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়ালো। মন থেকে সমস্ত প্রেমের চিন্তা উধাও। “আমরা এসব বন্দুক ব্যবহার করি না। আমরা ব্যবহার করি ফ্লিন্টলক বন্দুক (চকমকি পাথর ব্যবহার করে গুলি ছোঁড়া হয় যে বন্দুকে)। শুধু ভারতীয়রাই ম্যাচলক বন্দুক ব্যবহার করে (সলতেয় আগুন ধরিয়ে গুলি ছোঁড়া হয় যে বন্দুকে)।”

মুহূর্তেই অ্যানাও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ফেললো। “পাহারায় কে আছে?”

“ইল্কলী।”

ফ্রান্সিস দেয়াল ধরে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি খুঁজে বের করলো। “চাচাকে ডেকে তোলো,” অ্যানাকে বললো ও। “হয়তো কিছুই না, কিন্তু…”

 এতোদিনে দুৰ্গটা ফ্রান্সিসের এতো পরিচিত হয়ে গিয়েছে যে এই অন্ধকারেও দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে কোনো সমস্যা হলো না ওর। সিঁড়ির শেষ মাথায় নেমেই জায়গায় জমে গেলো।

রাতটা ওর ধারণা মতো অতোটা অন্ধকার না। পশ্চিম দিকের আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে তারা জ্বলজ্বল করতে দেখা যাচ্ছে; আর পূর্ব দিগন্তে একটা হালকা লালচে আভা ভোর হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু এসব দেখে ও থমকে যায়নি। ওর নিচেই, দুর্গের চারপাশের সৈকতে একগুচ্ছ কমলা বিন্দু আভা ছড়াতে ছড়াত এগিয়ে আসছে। ঠিক কামারশালায় যেভাবে আগুনের ফুলকি ছড়ায়। ও জানে ওগুলো কি। ওদের শত্রুদের ম্যাচলক বন্দুকের সলতের ধিকিধিকি আলো।

ও আবার উল্টোদিকে উঠতে যেতেই টমের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে ফেলেছিলো প্রায়। “ওরা চলে এসেছে, হাফাতে হাফাতে বললো ফ্রান্সিস। “অনেক সৈন্য। একশোর বেশি। দরজার ঠিক বাইরেই চলে এসেছে।”

“ওদেরকে কেউ দেখেনি? ইল্কলী কোথায়?”

 “জানি না। ওকে দেখিনি।”

শব্দ করে দরজা খুলে গেলো। টম আর ফ্রান্সিস ঘুরে গেলো সেদিকে। দ্রুত ভোর হচ্ছে, ক্রান্তীয় অঞ্চলে এরকমটাই হয়। হালকা আলোয় সদর দরজাটা এখন দেখা যাচ্ছে। কিছু একটা নড়ে উঠলো ওখানে।

ইল্কলী ওদেরকে আসতে শোনেনি। অবরোধের শুরুতে, টম ফয়-এর ভেঙে ফেলা বাড়িটা থেকে লোহার বর্গা এনে লাগিয়ে দরজাটাকে অনেক মজবুত করে বানিয়েছে। এখন তাই এই ভারী দরজাটা খুলতে ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসেও ওর ঘাম ছুটে যাচ্ছে। ও কাজটা করার জন্যে খুব বেশি সময় পায়নি, আবার এদিকে রানির লোকজন আগে আগেই নিজেদের বন্দুকের সলতেয় আগুন লাগিয়ে ফেলেছে। প্রচণ্ড ব্যস্ততায় দরজা খোলার চেষ্টা করছে ও, কারণ শত্ৰুদলের সর্দার যদি এসে দেখে এখনো দরজা বন্ধ তাহলে যে ওর কি অবস্থা করবে সেটা ভাবতেও চাচ্ছে না। তিনমাস এই দুর্গে থেকে, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কান্তর হয়ে ইল্কলী সব আশা হারিয়ে ফেলেছে। দুর্গের পতন হতোই। আজ হোক আর কাল হোক। ও শুধু চায় নিজেকে বাঁচাতে।

সর্বশেষ হুড়কোটাও খুলে গেলো। ইল্কলীর ঘামে ভেজা হাত থেকে ছুটে গেলো দণ্ডটা। দড়াম করে নিচে গিয়ে পড়লো সেটা। কে কে শব্দটা শুনেছে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সুযোগ পেলো না ইল্কলী। দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে আছে শত্ৰুদলের সেনাপতি। দরজা খোলামাত্র আক্রমণ করে বসলো সে।

ইল্কলী দণ্ডটা তুলে বালিতে ছুঁড়ে দিলো। তারপর দরজায় কাঁধ ঠেকিয়ে সজোরে ঠেলতে শুরু করলো। বৃষ্টিতে ভিজে মরিচা পড়েছে কজায়, আর যেহেতু ব্যবহার করা হয়, না ময়লা জমে একেবারে ভয়ানক শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে দরজাটা। ইল্কলী আরো জোরে ঠেলা দিলো, নিজের শক্তির বহর দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলো খুব।

কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে বাই করে ঘুরে গেলো ও। টম আর ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। দুজনের হাতেই উদ্যত তরবারি। পিছনেই দেখতে পেলো বাকি সবাই জেগে উঠছে, ফিসফিস করে টমের আদেশ একজন আর একজনকে শুনিয়ে চুপচাপ নিজেদের অস্ত্র নিয়ে জায়গামতো চলে যাচ্ছে।

“একি করছিস তুই?” বেদনাহত কণ্ঠে বলে উঠলো টম।

ইল্কলী উত্তর দিতে গেলো কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। তোতলানো আরম্ভ হলো ওর। “আমি শুধু-”।

ততোক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গিয়েছে। ওর মরিয়া প্রচেষ্টায় দরজাটা ফুটখানে ফাঁকা হয়েছিলো, কিন্তু শত্রুদল এইটুকের অপেক্ষাতেই ছিলো। ফাঁকটা দিয়ে টম দেখতে পেলো একঝাক জ্বলন্ত ফুলকি জোনাকি পোকার মতো করে বালির মধ্য থেকে উড়াল দিলো যেনো। ও দরজার দিকে দৌড় দিলো।

“ওরা আসছে,” হাবিলদার চেঁচিয়ে উঠলো। ও ততোক্ষণে দুর্গের উপরে উঠে গিয়েছে।

টম ধাক্কা দিয়ে ইন্ধলীকে সরিয়ে আবার দরজাটা বন্ধ করার জন্য ধাক্কাতে শুরু করলো। যথেষ্ট আলো এখন চারপাশে। আক্রমণকারীরা ওকে দেখে ফেললো। একটা মাস্কেট ছোঁড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। টমের মাথার সামান্য উপর দিয়ে শিষ কেটে উড়ে গেলো একটা গুলি।

ফ্রান্সিস টমকে টেনে সরিয়ে নিলো। সাথে সাথে আর একটা গুলি এসে লাগলো দরজায়। দরজার লোহার চলটা উঠে ছুটে গেলো পাশ দিয়ে। এক মুহূর্ত আগে ঠিক টমের চোখ ছিলো সেখানে।

টম দরজার কামান দুটোর দিকে তাকালো। ওগুলোতে গোলা ভরে রাখা কিন্তু টাচ হোলে কোনো পাউডার নেই। টম দেয়ালে ঝোলানো একটা পাউডারের কৌটা টেনে নামিয়ে ঢেলে দিলো পুরোটা, তাড়াহুড়ায় ছড়িয়ে ফেললো খানিকটা। ফ্রান্সিস একটা দেয়াশলাই নিয়ে এলো।

আক্রমণকারীরা এর মধ্যেই দরজাটা খোলার জন্যে ধাক্কানো শুরু করেছে। টম প্রথম কামানটায় আগুনটা ছুয়িয়েই লাফ দিয়ে সরে গেলো ওখান থেকে। সাথে সাথে গর্জে উঠলো সেটা। বিস্ফোরণে দরজাটা ওটার কজা থেকে খুলে গেলো, সাথে উড়িয়ে দিলো যারা দরজা ধাক্কাচ্ছিলো তাদেরকে। দ্বিতীয় দলটা এগিয়ে এলো খোলা দরজা দিয়ে, কিন্তু টম ততোক্ষণে দ্বিতীয় কামানটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। আগের লাশগুলোর উপর জমা হলো এদের লাশ।

কিন্তু পিছনে আরো অনেক সৈন্য-আর কামানে আবার গোলা ভরার সময় আর নেই। যে তক্তাগুলো দিয়ে দরজাটাকে ভারী করা হয়েছিলো, টমের লোকজন সেগুলো তুলে নিয়ে দরজার সামনে তূপ করে দিলো। দরজার সামনে পড়ে থাকা লাশ, কামান আর দরজার ভাঙা অংশ, সব মিলিয়ে মোটামুটি একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো। ওরা ওটার পিছনে হামাগুড়ি দিয়ে বসে লুকালো।

সবাই আচমকা ঘুম থেকে উঠলেও, গত কয়েক মাসে টম যেভাবে কড়াকড়িভাবে নিয়ম শৃঙ্খলা অনুশীলন করিয়েছে তা কাজে দিলো আজ। লোকেরা ঠিকঠাক জানে কাকে কি করতে হবে। আর টমের কামানের বিস্ফোরণ ওদেরকে সেসব করার জন্যে পর্যাপ্ত সময় এনে দিলো। অর্ধেক লোক প্রতিবন্ধকতার পিছনে লুকিয়ে গুলি করতে থাকলো। বাকিরা মাস্কেটে গুলি ভরে দিতে লাগলো। ওদের পিছনে দুটো কম বয়সী ছেলে বালির ভিতর একটা গর্ত খুড়ছে। টম দেখিয়ে দিয়েছে জায়গাটা।

কিন্তু ওদের অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণের পরেও শত্রুরা আসতেই থাকলো। দরজার সামনে জমে থাকা তাদের সঙ্গীদের লাশের উপর দিয়েই এগিয়ে আসছে ওরা। একটু পর এতো কাছে চলে এলো যে প্রতিবন্ধকতার এপারের লোকজন গুলি ভরার সময় পেলো না। ওরা দ্রুত বেয়নেট লাগিয়ে নিলো। একেবারে হাতাহাতি লড়াই শুরু হলো কিছুক্ষণ পর। দুই দলই রক্তে ভিজে আছে।

ছেলে দুটো টমের কথামতো গর্ত খুঁড়ে ওটার ভিতর একটা জিনিস ভরে আবার উপরে বালি ছড়িয়ে দিলো। তারপর দুটো মুগুর তুলে নিয়ে ওরাও লড়াই করতে এগিয়ে গেলো। টম ওদেরকে ইশারায় সরে যেতে বললো। ও খুব ভালোমতোই বুঝছে যে লড়াই কোন দিকে যাচ্ছে। এখন যেহেতু দুই দলই মুখোমুখি, তাই শত্রু সেনাপতির কাছে বেশি সৈন্য থাকায়, সে সুবিধা আদায় করতে পারবে সহজেই। টম ওর লোকদের পেছাতে দিচ্ছিলো না, ঠিক একটা ফুটোয় গজাল ঢোকানোর মতোই ওদেরকে সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো। ওরা যতোই ভালো লড়াই করুক না কেনো, শত্ৰুদলের অব্যাহত চাপ খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কিছুক্ষণের মাঝেই হাফসে যাবে ওরা।

“সুরক্ষা কেল্লায় চলে যাও সবাই,” আদেশ দিলো টম।

অবরোধের শুরু থেকেই টমের আশংকা ছিলো যে এরকম কিছু একটা হবে। সেজন্যেই ও একটা সুরক্ষা কেল্লা বানিয়ে রেখেছে আগেই। ওদের সর্বশেষ আশ্রয় বলা যায় এটাকে। ফটক থেকে সবচে দূরে, দুর্গের উত্তর পশ্চিম দিকটায় প্রচুর অস্ত্র আর গোলাবারুদ জমা করে রেখেছে টম। ও কোনো দিবাস্বপ্ন দেখেনি। জানতো যে খুব বেশিদিন টিকবে না ওরা। আর দেয়ালের কাছে থাকলে ওরা শত্রুর মাস্কেটের গুলির সহজ শিকারে পরিণত হবে। শত্রুরা দেয়াল দখল করতে পারলেই ওরা শেষ। ও শুধু চাচ্ছে ওরা ওদের আক্রমণকারীদের এমন একটা শিক্ষা দেবে যাতে ওরা লড়াই করার নাম ভুলে যায়।

“যাও সবাই,” চিৎকার করে উঠলো ও। “তাড়াতাড়ি।”

এই যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেও ওর কণ্ঠ শোনা যেতে লাগলো বেশ জোরেই। প্রতিবন্ধকের পিছনের লোকজন লাফ দিয়ে পিছু হটে এতো জোরে ছুট দিলো যে ওদের সাথে যারা হাতাহাতি করছিলো তারা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলো। সামনের সারিতে যারা এতোক্ষণ প্রাণপণ লড়াই করছিলো তারা পিছনের সৈন্যদের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মারা পড়লো।

টম গেলো সবার শেষে। তবে যাওয়ার আগে একটু থেমে ছেলে দুটো যে গর্তটা খুঁড়েছিলো সেটা থেকে বেরিয়ে থাকা সলতেয় গুলি করলো। তারপর দিলো দৌড়।

টমের পিছনে উঠোনে হুড়মুড় করে ঢুকতে লাগলো সৈন্যরা। ওরা হয়তো টমকে ধরতে পারতো, কিন্তু অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হলো। গাদাগাদি করে দৌড়ানোর সময় বা নিজেদের মাস্কেট সোজা করতে গিয়ে ওরা একজন আর একজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে লাগলো। ফলে জ্বলতে থাকা সলতেটা নজরে এলো না কারো।

টম সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আগুনটাও বালির নিচে পোরা পাউডারের কৌটায় পৌঁছে গেলো। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে ছড়িয়ে পড়লো আগুন। সেই সাথে বালি আর রক্ত ছিটকে পড়লো চারপাশে। যেনো কোনো দৈত্যাকার হাত মাটি ফুড়ে উঠে এসেছে। এতো শক্তিশালী বিস্ফোরণ হলো যে মৃত সৈন্যগুলোর হাড়-গোড় পর্যন্ত গুলির মতো ছুটে গিয়ে আশেপাশের সৈন্যদের গায়ে বিধলো। আক্রমণকারীদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো।

বিস্ফোরণের শব্দ পুরো উঠোনকে প্রকম্পিত করে তুললো। আর্তনাদের ভিতরেও টম নতুন একটা শব্দ শুনতে পেলো, প্রতিধ্বনিগুলো ঘনীভূত হয়ে মূল বিস্ফোরণটার চাইতেও জোরে পুরো দুৰ্গটাকে কাঁপিয়ে দিলো। বাড়তে বাড়তে একেবারে বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হতে লাগলো, তারপর ধীরে ধীরে দুর্গের দেওয়ালের প্রকল্পমান পাথরে প্রশমিত হয়ে গেলো।

টম সিঁড়ির মাথায় উঠে নিচের উঠোনে তাকালো। ধোয়া আর ধুলোয় ভরে আছে বাতাস। তবে এর মাঝেও কি হয়েছে স্পষ্ট দেখতে পেলো। ফটকের চিহ্নও নেই আর। গত তিনমাস ধরেই শত্ৰুদলের গোলাগুলির সব ধকল গিয়েছে এটার উপর দিয়ে। আর আজ ওটার ঠিক পাশেই বিস্ফোরণ হওয়ার আর সহ্য করতে পারেনি। ভেঙে পড়ে জীবিত বা মৃত সবাইকে চাপা দিয়ে দিয়েছে।

তারপরেই ও ফ্রান্সিস আর অ্যানার খোঁজে চারপাশে তাকালো। দুজনেই ওখানে আছে। অ্যানা একজন লোকের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তার ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে দিচ্ছে। ফ্রান্সিস ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ও চিৎকার করে কিছু একটা বলছিলো, কিন্তু টমের কান তখনও বিস্ফোরণের শব্দের কারণে তালা লেগে থাকায় কিছুই বুঝতে পারছিলো না।

বাতাসের ধুলোবালি ঝরে পড়তে লাগলো উঠোনে। হতাশ হয়ে টম দেখলো ওর ফাটকাটা পুরোপুরি কাজে লাগেনি। বিস্ফোরণের পরেও শত্রু সৈন্যরা নিবৃত হয়নি। ফটকের সামনে জমা লাশ পেরিয়ে ওরা ছুটে এসে ওদের সুরক্ষা কেল্লায় আক্রমণ করতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যাবে যে ওরা দুর্গের দখল নিয়ে ফেলেছে।

 টম পিস্তল তুলতে গিয়ে দেখে যে ওটা নেই। গণ্ডগোলের মাঝে কখন যে পড়ে গিয়েছে টের পায়নি। ও তরবারি তুলে নিলো। সব শেষ, মানসিক ভাবে প্রস্তুতি এই নিয়ে নিলো। কিন্তু তবুও ও হাল ছাড়বে না। ও আত্মসমর্পণ করবে না, এততদিন ও খুব আশা করে ছিলো যে আবার সারাহকে দেখতে পাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে আর সময় পাওয়া গেলো না।

ফ্রান্সিস তখনও ওকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু টম তবুও কিছু শুনছে না দেখে ও টমের কাধ ধরে সমুদ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে দিলো। বিচিত্র কোনো কারণে ফ্রান্সিস পাগলের মতো হাসছে।

 টমও দেখতে পেলো এবার। আর এই যুদ্ধের আতংকের মাঝেও ওর চেহারায় এক অপার্থিব আনন্দ ফুটে উঠলো। ঘাটে একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। পালগুলো মাস্তুলের গায়ে মেঘের মতো উড়ছে। এক গাদা কামানের মুখও দেখা যাচ্ছে পাশ থেকে। আর জাহাজের পিছনের দিকে উড়ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাল আর সাদা ডোরাকাটা পতাকা। ওটা থেকে একটা নৌকা ঢেউ পেরিয়ে বালিতে এসে ঠেকলো। তাতে লাল উর্দি পরা নৌবাহিনির সৈন্য।

জাহাজের একটা কামান গর্জে উঠলো। টম দেখলো গোলাটা পানি পেরিয়ে সোজা উড়ে এসে রানির সৈন্যদলের মাঝখানে একটা বিশাল রক্তে ভরা গর্তের সৃষ্টি করলো। এক বালির ঝর্নায় রূপান্তরিত হলো যেনো সৈকতটা। আর একটা কামান গর্জে উঠলো, আরও একটা। একের পর এক গোলাবর্ষণে রানির সৈন্যরা বিন্দুমাত্র অবকাশ পেলো না। মুহূর্তেই ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। সোজা নিজেদের শিবিরের দিকে দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে পালালো। নিজেদের অস্ত্র, কামান বা রসদপত্র নেওয়ার কোনো চেষ্টাই করলো না। এমনকি অফিসারেরাও পালাতে শুরু করলো, সৈন্যদেরকে ফেরানোর কোনো চেষ্টাই করলো না তারা।

একমাত্র যে লোকটা পালালো না সে হচ্ছে টুঙ্গার, ঘোড়ার পিঠে বসে চিৎকার করে ওর সৈন্যদের না পালিয়ে যুদ্ধ করতে আদেশ দিতে লাগলো। কথায় কাজ না হওয়ায় নেপচুন তরবারিটা ব্যবহার করতে লাগলো। নিজেই নিজের লোকদের কোপানো শুরু করলো। কিন্তু পলায়নরত সৈন্যরা ওকে কোনো পাত্তা দিলো না এবার। সব আদেশ নির্দেশ অবমাননা করে জঙ্গলে গিয়ে লুকালো। একজন ওকে টেনে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু টুঙ্গার এক কোপে লোকটার চেহারা দুই ভাগ করে দিলো।

আবার জাহাজের কামান গর্জে উঠলো। গোলাটা টুঙ্গারের ঘোড়ার এতো কাছে পড়লো যে আর একটু হলেই ঘোড়ার মুণ্ডু উড়ে যেতো। জানোয়ারটা সামনে পা তুলে উঁচু হয়ে গেলো, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে আতংকে, শুধুমাত্র টুঙ্গারে ঘোড়া সামলানোর অতিমানবীয় দক্ষতার কারণেই ও পিঠ থেকে ছিটকে বালিতে পড়লো না।

শেষে ক্রুদ্ধ একটা গর্জন ছেড়ে টুঙ্গারও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে উল্টোদিকে ছুটে চলে গেলো। টম দেখতে পেলো যাওয়ার পথে সামনে যে পড়লো তাকেই ও নেপচুন তরবারিটা দিয়ে কোপাতে কোপাতে এগিয়ে গেলো।

 টম বুঝলো যে এটাই ওর শেষ সুযোগ। টুঙ্গার যদি একবার জঙ্গলে ঢুকে যায় তাহলে আর কখনো ও এই তরবারির দেখা পাবে না। আর আলফ উইলসন আর বাকি যাদের টুঙ্গার খুন করেছে তার বদলাও নিতে পারবে না। টম সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে, উঠোন পেরিয়ে ফটকের সামনে জমা পাথরের পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলো। বিস্ফোরণের তাপে তখনও পাথরগুলো গরম হয়ে আছে।

চোখের উপর হাত দিয়ে টম যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজতে লাগলো। কোথায় টুঙ্গার?

*

ক্রিস্টোফার টলতে টলতে দুর্গ থেকে সরে যেতে লাগলো। ধুলোবালিতে মুখের ভিতরটা ভরা; বিস্ফোরণের শব্দের কারণে এখনো ওর কানে তালা লেগে আছে। মাথায় হাত দিলো ও, খালি চামড়া আর রুক্তের স্পর্শ পেলো সেখানে। বিস্ফোরণে মাথার চুল পুড়ে গিয়েছে।

ফটকের একেবারে সামনেই ছিলো ও। টুঙ্গার এক প্রকার জোর করেই ওকে আক্রমণের নেতৃত্বে পাঠিয়েছিলো আজ। সন্দেহ নেই ও ইল্কলীর কথাটা বিশ্বাস করেনি। তাই ভেবেছিলো এতে করে যদি কোনো ঝামেলা হয় তাহলে মাঝখান থেকে ক্রিস্টোফার অক্কা পেয়ে ওকে বাঁচিয়ে দেবে। এবং নিখুঁতভাবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও হতে চলেছিলো। দরজা খুলতেই ক্রিস্টোফার টম উইল্ডকে অন্যপাশে দেখতে পায়। ও ভেবেছিলো আগে আগে আক্রমণ করে রানির লোকের হাতে পড়ে জবাই হওয়ার আগেই টম উইল্ডকে ও বন্দী করবে। ঠিক সেই সময়েই ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে সতর্ক করে দেয় আর ও পিছনেই থেকে যায়। ওর মা বলতো যে শয়তান তার সাঙ্গপাঙ্গদের রক্ষা করে সবসময়। ক্রিস্টোফার জানতো যে এটা হচ্ছে ভাগ্য। তরবারিটায় ওর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে একটা সুযোগ। ও আগালো না, একটু পরেই ওর লোকদের বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছাতু হয়ে যেতে দেখলো, যারা বেঁচে ছিলো তারা দরজার নিচে চাপা পড়ে মরল, আর টম উইল্ডও ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলো। বিস্ফোরণের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো ক্রিস্টোফার, কিন্তু পড়া অবস্থাতেই টের পেলো যুদ্ধের ভাগ্য উল্টে গিয়েছে। ওর লোকেরা প্রাণপণ পালাচ্ছে, তারপরই যখন কামানের গোলা একজন লোকের মুণ্ড উড়িয়ে দিলো, তখনই জাহাজটা নজরে এলো ওর। আর ওর লোকদের এরকম করার কারণটাও ধরতে পারলো।

এতে মোটেও হতাশ হলো না ও। এই সৈন্যদলের সাথে ওর কোনো সুসম্পর্ক নেই। আর এই মুহূর্তটার জন্যে ও বহুদিন যাবত অপেক্ষা করে আছে। সাথে সাথে ও টুঙ্গারের খোঁজ করতে লাগলো। একটু দূরেই টুঙ্গারকে দেখা গেলো ঘোড়ার উপর বসে আছে। চিৎকার করে লোকজনকে পালাতে নিষেধ করছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।

এই যুদ্ধের গন্ডগোলের মাঝেও ক্রিস্টোফার মেরুদণ্ডে একটা শিহরণ অনুভব করতে পারলো। টুঙ্গার আজ শেষ। যদি ইংরেজদের হাতে না-ও মরে, রানির হাতে মরবে নিশ্চিত। এখন শুধু তরবারিটা দখল করতে হবে।

টুঙ্গারের দিকে দৌড় দিলো ও। আশেপাশে আহত লোকজন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলো। ওদেরকে ধাক্কা মেরে আগাতে লাগলো ক্রিস্টোফার। সামনেই দেখা গেলো একজন সৈন্য টুঙ্গারের ঘোড়াটা ধরে টানছে, কিন্তু নেপচুনের এক কোপে শিক্ষা হয়ে গেলো তার। সেদিকে দেখতে থাকায় মাটিতে পড়ে থাকা বন্দুকটার দিকে খেয়াল হলো না ক্রিস্টোফারের। ওটায় পা বেধে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ও। পিছন থেকে দুজন সৈন্য ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। কিন্তু মাথা তুলতেই ও দেখতে পেলো একটা কামানের গোলা ঠিক ওর সামনেই দুজনকে পিষে দিলো বালিতে। ও যদি আছাড় না খেতো… আবারও ও শয়তানকে ধন্যবাদ দিলো ওকে রক্ষা করার জন্যে।

কিন্তু এতোক্ষণে টুঙ্গারও বুঝে গেলো যে আর লাভ নেই। ও পালানোর জন্যে ঘুরে সোনালি তরবারিটা দিয়ে কাস্তে চালানোর মতো করে কোপাতে কোপাতে লোকজনের মাঝ দিয়ে পথ করে আগাতে লাগলো। কিন্তু ওদের শিবির আর দুর্গের মাঝের সরু বালির চড়াটায় এতো মানুষ জমে আছে যে এতো কিছুর পরেও রাস্তা করতে পারলো না। ওর ঘোড়াটাও এতো মানুষ আর সমুদ্রে জাহাজের ভেপুর আওয়াজে ভয় পেয়ে জায়গায় জমে গেলো।

 ক্রিস্টোফার ভীড় ডিঙিয়ে আগাতে লাগলো ওর লক্ষ্যের দিকে। কোমর থেকে উরুমিটা খুলে নিলো, এরকম পরিস্থিতি আসতে পারে ভেবে সারাক্ষণ ওটা পরে থাকে ও। কিন্তু লোকজনের অব্যাহত চাপের কারণে ওটার প্যাঁচ খোলার জন্যে যথেষ্ট জায়গা পেলো না। একটু ফাঁকা হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। ভীড় কিছুটা পাতলা হলে লোকজনের মাথার উপর দিয়েই ছুঁড়ে দিলো ওটা।

ইস্পাতের ফলাটা প্যাঁচ খুলে সোজা টুঙ্গারের কবজি পেঁচিয়ে ধরলো। ক্রিস্টোফার শক্ত করে ধরে সর্বশক্তিতে টান দিলো ফলাটা। টুঙ্গারের হাতটা কেটে পড়ে গেলো মাটিতে। কাটা হাতেই নেপচুন তরবারিটা ধরা, আর ওটা থেকে তীর বেগে বের হতে লাগলো রক্ত। টুঙ্গার আর্তমাদ করে উঠলো। রক্তপ্রবাহ থামাতে ও ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলো। কিন্তু ওর ঘোড়াটা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলো। যেইমাত্র টের পেলো যে লাগাম আলগা হয়ে গিয়েছে, সাথে সাথে নিজের পিছনের পা দুটো তুলে ঝাড়া দিলো। টুঙ্গার উড়ে গিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়লো বালিতে। ঘোড়াটা দিলো ছুট, যাওয়ার পথে যে পড়লো সামনে তাকে মাড়িয়ে ছুটে গেলো জঙ্গলের দিকে।

ওদের পাশের ভীড় পাতলা হয়ে আসছে। বেশিরভাগ সৈন্যই বনের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, নয়তো পৌঁছাতে গিয়ে মারা পড়েছে। ক্রিস্টোফার দেখতে পেলো যে ইন্ডিয়াম্যানটা থেকে একটা নৌকা ডাঙ্গার দিকে আসছে। লাল উর্দি পরা মেরিন সৈন্য দিয়ে ভরা। ওরা ওকে এখানে ধরতে পারলে,..

নেপচুন তরবারিটা বালির উপর শুয়ে গুপ্তধনের মতো চকচক করছে। ক্রিস্টোফার ওটার দিকে হাত বাড়ালো। এতো ধ্বংসস্তূপের মাঝেও ওর মনে হতে লাগলো ও জয়লাভ করেছে। এতোদিন যতো অবর্ণনীয় কষ্ট সয়েছে, যেসব ভয়ানক জিনিস ও করেছে বা দেখেছে, সেগুলো সবই এই তরবারিটা পাওয়ার জন্যে সওয়া যায়। তরবারিটা ওর, মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরেই পড়ে আছে ওটা।

 কিন্তু আগাতেই একটা হাত ওর গোড়ালি, আঁকড়ে ধরলো। আচমকা টানে ক্রিস্টোফার ভারসাম্য হারিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লো। ও তরবারিটার দিকে ঝাঁপ দিলো কিন্তু হাতটা প্রচণ্ড শক্তিতে ওকে আটকে দিয়ে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলো।

ক্রিস্টোফার শরীরটা বাকিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে হাতটা টুঙ্গারের। কাটা হাতটা বালিতে চেপে রেখেছে যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়, আর বাম হাত দিয়ে ক্রিস্টোফারকে ধরে রেখেছে। একটা মাথার খুলি খচিত ছুরি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে ও, এতো জোরে যে ফলায় লেগে ঠোঁটের দুই কশ কেটে গিয়েছে।

 “বেঈমান,” ফলাটা চেপেই হিসিয়ে উঠলো টুঙ্গার। “তুই আমাকে হারিয়েছিস ঠিক আছে, কিন্তু আমার আগেই আমি তোকে শিবের (ধ্বংসের দেবতা) কাছে পৌঁছে দেবো।”

প্রচণ্ড ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে ও ওর কাটা ডান হাতের উপরেই ভর করে নিজেকে টেনে তুললো। একই মুহূর্তে ও ক্রিস্টোফারের পা-টা ছেড়ে দিয়ে মুখ থেকে ছুরিটা নিয়ে এক টানে ক্রিস্টোফারের পায়ে ঢুকিয়ে দিলো।

আরও একবার কালারিতে শেখা কৌশল বাঁচিয়ে দিলো ক্রিস্টোফারকে। টুঙ্গার ছেড়ে দেওয়া মাত্র ক্রিস্টোফার সমস্ত শক্তি জড়ো করে লাফ দিয়ে পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে গেলো। টুঙ্গার ছুরি চালাতে চালাতে ও ততোক্ষণে নিজের পায়ে খাড়া হয়ে গিয়েছে। ফলে চামড়ায় আচড় কেটে বেরিয়ে গেলো ছুরির ফলা, রক্ত বের হতে লাগলেও নিচের মাংসপেশির ক্ষতি হলো না।

এবার আর কোনো উপায় রইলো না টুঙ্গারের। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো এশবার, কিন্তু ক্রিস্টোফার ওকে ঘুষি মেরে শুইয়ে দিলো। তারপর ওর হাত থেক ছুরিটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললো। ক্রিস্টোফার টুঙ্গারের পিঠের উপর বসে পিছন থেকে গলা চেপে ধরলো হাত দিয়ে। টুঙ্গার হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্রিস্টফারে চোখে খোঁচা মারার চেষ্টা করলো কিন্তু ওর হাত সে পর্যন্ত পৌঁছালো না। ক্রিস্টোফার ওর হাত কামড়ে ধরলো। হাড় ভাঙার মট আওয়াজ পাওয়ার পর হাতটা ছাড়লো। টুঙ্গার চিৎকার করার জন্যে মুখ খুললো কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হলো না। কারণ ক্রিস্টোফার টুঙ্গারের গলার প্যাঁচ একটুও ঢিল করেনি। টুঙ্গারের শ্বাসনালীর উপর আরও জোর বাড়ালো ক্রিস্টোফার।

টুঙ্গারের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। চেহারা রক্ত জমে লাল হয়ে গিয়েছে, এতোটা লাল যে ক্রিস্টোফারের মনে হলো যে বোধহয় ওর চেহারার ক্ষতটা বরাবর ফেটে মগজ বেরিয়ে আসবে। কালো কুচকুচে দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভ বের হয়ে গেলো ওর। বাতাসের জন্যে হাসফাস করছে।

মট করে ভেঙে গেলো টুঙ্গারের শ্বাসনালী। চোখ বেরিয়ে এলো কোটর ছেড়ে। জিভ বের করা অবস্থাতেই মাথা হেলে পড়লো এক পাশে। ক্রিস্টোফার তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আরো একটা মোচড় দিলো দেহটায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তরবারিটা নিয়ে জঙ্গলের নিরাপদ আশ্রয়ে দৌড় দিলো। পায়ের ক্ষতে মন দেওয়ার সময় এখন আর নেই।

মেরিনের লোকজন ডাঙায় উঠে এসেছে। ওরা ক্রিস্টোফারের দিকে চেঁচালো কিন্তু ও কান দিলো না বা ফিরেও তাকালো না; তবে আশেপাশের সৈকতে ছিটকে ওঠা বালি দেখে বুঝতে পারলো যে ওরা ওর দিকে গুলি করছে। এবার ও ফিরে তাকালো। ব্যাপারটা বুঝলো না ও, মেরিনগুলো কেন যেনো ওকে ধাওয়া করছে না। ওদের পিছনেই দুর্গের ফটকের ধ্বংসস্তূপের উপরে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বলে না দিলেও ও জানে নোকটা হচ্ছে টম উইল্ড।

সে ক্রিস্টোফারকে পরাজিত করেছে। কিন্তু তরবারিটা এখন ক্রিস্টোফারের হাতে। আর তাতে ও এক নতুন উদ্যম ফিরে পেলো। এক ছুটে বনের ধারে পৌঁছে জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে গেলো।

*

বনের সামান্য ভিতরেই ক্রিস্টোফার টুঙ্গারের ঘোড়াটা খুঁজে পেলো। পলায়নরত সৈন্যরা ওর দিকে নজর দেয়নি। বনের ভিতর একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাস চাবাচ্ছে। সারা গা রক্ত আর ধুলোবালিতে ভরা।

ক্রিস্টোফার ওর লাগামটা ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলো। আশ্বস্ত হয়ে ওকে নিজের পিঠে উঠতে দিলো ঘোড়াটা। ও.জানে যে শীঘ্রই ধাওয়া করা হবে ওকে। সর্বশক্তি দিয়ে ঘোড়া ছোটালো তাই। সমুদ্র থেকে আসা পানির নালাগুলো পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথে পেরিয়ে এসে যখন নিশ্চিত হলো যে ও সম্পূর্ণ একা, তখনই থামলো।

 ঘোড়াটা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। পেটের দুপাশ ঘামে ভিজে গিয়েছে। তবে এতো গরম যে অল্প সময়েই ঘাম বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। ও ঘোড়াটাকে একটু বিশ্রাম দিতে জিন থেকে নেমে, লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলো। মাথার ভিতর চিন্তার ঝড় চলছে ওর।

রানির কাছে আর ফিরে যেতে পারবে না ক্রিস্টোফার। ওর সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় আর দুর্গটা আবার ইংরেজরা দখল নিয়ে নেওয়ায় তার কূটকৌশল পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন তাকে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে। আর কোম্পানিও নিশ্চয়ই এখন খুব বেশি নরম মেজাজে থাকবে না। ওরা হয়তো বলবে ক্রিস্টোফারকে ওদের হাতে তুলে দিতে যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে পারে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বোষেতে ফিরে গিয়ে, ওর বাবার সামনে মাথা নুইয়ে প্রাণভিক্ষা চাওার ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ওর সারা শরীর রাগে রি রি করে উঠলো।

হাঁটতে হাঁটতে একটা চৌরাস্তায় এসে পৌঁছালো ও। গাছপালার ফাঁকে কয়েকটা ছোট ছোট কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। গ্রামবাসী ওর ঘোড়ার আওয়াজ পেয়েই লুকিয়ে পড়েছে। ওরা জানে যে যখন কোনো ক্ষমতাধর তোক গ্রামে আসে তখন ভালো কিছু ঘটে না। ক্রিস্টোফার কুঁড়েগুলোয় ঢুকে খাবার দাবার যা পেলো নিয়ে নিলো। কয়েক থালা ভাত, আর সামান্য শুঁটকি মাছে। টাকা পয়সা খুঁজতে গেলো না। এদের জীবন বনের জানোয়ারদের চাইতে খুব বেশি সুবিধার না। নিজের উপর অন্য কারো দৃষ্টি টের পেলোলা ও, ঝোঁপ ঝাড়ের ভিতর থেকে নজর রেখে চলেছে ওরা। কিন্তু ও পাত্তা দিলো না। কারণ নেপচুন তরবারিটাই ওদেরকে নিরাপদ দুরত্বে রাখতে যথেষ্ট।

 ক্রিস্টোফার খাপ থেকে তরবারিটা বের করলো। ওটা ধরলেই অন্যরকম একটা শিহরণ খেলে যাচ্ছে শরীরে। ও ওটা হাতে ধরে নাড়তে চাড়তে লাগলো যাতে ওটার স্বর্নালি ফলাটা গাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় চকচক করে ওঠে। হাতলের নীলাটা দেখে মনে হচ্ছে একটা চোখ যেনো ওর আত্মার দিকে তাকিয়ে আছে। ও সব হারিয়েছে-কিন্তু এই তরবারিটা পাওয়ার পর থেকে  নিজেকে অজেয় মনে হচ্ছে ওর।

কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো ও, কি করবে ভাবছে সেটা। ত সাথে হওয়া শেষ কথোপকথনের একটা অংশ মনে এলো ওর।

মুক্ত হলে আমরা কোথায় যাবো? আমরা যদি একসাথে থাকতে তাহলে এমন কোথাও যেতে হবে যেখানে আমাদের অতীত কেউ জানে না

 টিরাকোলা, তামান্না জবাব দিয়েছিলো। ওখানে আইন কানুনের নেই। ওখানে গেলে আমি আর তুমি সত্যিই মুক্ত বিহঙ্গের মতো পারবো।

একদিন না একদিন নিশ্চয়ই যাবো, ক্রিস্টোফার জবাব দিয়েছিলো

ক্রিস্টোফার আবার ঘোড়ার পিঠে চড়ে, সোজা উত্তরে রওনা দিলো

*

টম রক্তে ভেজা বালির ভিতর টুঙ্গারের দেহটা খুঁজে পেলো। ওর ডান হাত কাটা, কিন্তু মারাত্মক কোনো ক্ষত দেখা গেলো না শরীরে। খুব সাবধানে আগাতে লাগলো টম। বলা যায় না, এখনো বেঁচে থাকতে পারে।

টুঙ্গারের মুখের ভিতর থেকে একটা মাছি বেরিয়ে এলো, বেরিয়ে থাকা জিভটাও চোখে পড়লো তখন। টম বুঝলো ওর আর ভয় পাবার কিছু নেই। কয়েক কদম আগেই ও কাটা হাতটা খুঁজে পেলো। জায়গাটা ঘোড়ার খুরের ছাপ-এ ভরা। কিন্তু তরবারিটার কোনো চিহ্ন ও দেখতে পেলো না।

 রানির সৈন্যদলের সবাইই ততক্ষণে সৈকত পেরিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছে। একজনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হলো; একজন লম্বা টাকমাথা লোক। দেখে চেনে চেনা লাগলো ওর। কিন্তু এতো দূর থেকে পাম গাছগুলোর আলো ছায়ার কারণে তার হাতে কোনো তরবারি আছে কিনা বুঝতে পারলো না টম।

হতাশায় ছেয়ে গেলো ওর মন-তবে কিছুক্ষণের জন্যে। নিশ্চয়ই কোনো সৈন্যই পালানোর সময় নিয়ে গিয়েছে তরবারিটা। টম তাই আশা ছাড়লো না। এরকম একটা জিনিস লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কথা ছড়াবেই, আর টম অবশ্যই কান খোলা রাখবে সেটা শোনার জন্যে। যদি রানি তরবারিটা ফেরত দিতে না চায়, তাহলে তার মহল মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।

“অস্ত্র নামিয়ে নাও!”

টম ঘুরে দেখলো দুই ডজন মাস্কেট সোজা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ডাঙায় উঠে এসেছে মেরিনেরা। সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে এক সারি করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, পা-এর মোজা ঢেউয়ে লেগে ভিজে গিয়েছে।

 টম সাবধানে হাত তুললো। “আরে, আমিতো আপনাদের লোক।”

টমের গলা শুকিয়ে ফ্যাসফেসে হয়ে গিয়েছে-তবে লোকগুলো ধরতে পারলো ওর কথা। ওদের সার্জেন্ট অস্ত্র নামাতে আদেশ দিলো।

 “মাফ করবেন, এবার আর একজন বলে উঠলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেনের নীল পোশাক পরা একজন লোক সৈন্যদের সারি থেকে সামনে এগিয়ে এলো। আপনাদের দুর্দশার খবর যখন মাদ্রাজে পৌঁছালো তখন আমরা ভেবেছিলাম যে জীবিত অবস্থায় কোনো ইংরেজকে বোধহয় আর পাবো না।” বলেই থেমে গেলো লোকটা। “ও ঈশ্বর! আপনি কি…?”

টম সূর্য থেকে বাঁচতে চোখের উপর হাত চাপা দিলো। এতো ঝড় ঝাঁপটা গিয়েছে ওর উপর দিয়ে যে ক্যাপ্টেনের মুখটা চিনতে সময় লাগলো কিছুটা। পোড় খাওয়া চেহারা, ঝকঝকে নীল চোখ, সোনালি আর ধূসরে মেশালো চুল।

“ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ড?”

“আবার দেখা হলো। আর এতোদিনে আমি আমার ঋণ শোধ করতে পারলাম বলে মনে হচ্ছে।” ইঞ্চবার্ড আগ্রহের সাথে তাকিয়ে রইলো টমের দিকে। “কোন পোড়া কপালে এখানে এসে জুটেছেন?”

“লম্বা কাহিনি।”

“আপনি কতোটা কষ্ট করেছেন সেটা কল্পনাও করতে পারছি না।” ইঞ্চবার্ড দুর্গের দিকে ইংগিত করলো। “এতো এতো প্রতিকূলতার পরেও এতো দিন ধরে অবরোধ প্রতিহত করে থাকা। লেডেনহল স্ট্রিটে আপনার নামে জয়ধ্বনি করা হবে নিশ্চিত।”

“ওদের কৃতজ্ঞতার কোনো দরকার নেই আমার। আমি শুধু আমাকে আর আমার পরিবারকে রক্ষা করতে সব করেছি। যদি কোম্পানির এতো অর্থলিপ্স না থাকতো তাহলে রানির সাথে এই যুদ্ধ কোনোদিনও বাধতো না।”

 “যাই হোক,” খোঁচা মেরে বললো ইঞ্চবার্ড, “লন্ডনের সওদাগরেরা নায়কদের খুবই পছন্দ করে। বিশেষ করে যারা তাদের সম্মান আর ব্যবসার মুনাফার সুরক্ষা করে।”

 “আমার কাছে শেষ কথা হচ্ছে আমার স্ত্রী আর অ্যাগনেস-মিসেস হিকস। ওরা ভালো আছে তো? আসার সময় কেমন দেখে এসেছেন?”

ইঞ্চবার্ডের চেহারা কালো হয়ে গেলো। “আপনার কথা বুঝলাম না।”

 “আপনারা মাদ্রাজ থেকে এসেছেন না?”

 ইঞ্চবার্ড মাথা ঝাঁকালো।

“তাহলে ওদেরকে দেখেননি? নাহলে আমাদের এখানের অবস্থা সম্পর্কে জানলেন কার কাছ থেকে?”

“মাদ্রাজে এখান থেকে কেউ যায়নি। তামিল কিছু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খবর পেয়েছি আমরা। ওরা সড়কপথে মাদ্রাজ গিয়েছে।”

 “কিন্তু সারাহ আর অ্যাগনেসতো কয়েক মাস আগে রওনা দিয়েছে, আর্তনাদ করে উঠলো টম। “বহু আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা ওদের।”

“হতে পারে আমরা রওনা দেওয়ার পরে ওরা পৌঁছেছে।” ইঞ্চবার্ড টমের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থা দেখে নিজের স্বর নরম করলো। “এই বর্ষায় সমুদ্রের অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিলো না। সম্ভবত ওরা কাছাকাছি কোনো বন্দরে নোঙ্গর করে আবহাওয়া ভালো হওয়ার অপেক্ষা করছিলো।”

কিন্তু টম যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। এসবই ফাঁকা বুলি, কোনো সত্যিকার আশা নেই। চরম হতাশ হয়ে গেলো ও, একটু হলেই কেঁদে দিতো। সারাহকেই যদি আর না পাবে তো এতো কষ্ট করে অবরোধ সহ্য করে কি লাভ হলো? সারাহের নানান ভয়াল পরিণতি মাথায় আসতে লাগলো ওর। প্রত্যেকটা আগেরটার চাইতে ভয়ংকর।

এই অমানিশার মাঝের একটু হলেও আশার প্রদীপ আছে। সারাহের যদি আসলেই কিছু হতো তাহলে ও সেটা টের পেতো। সারাহ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।

 “আমাকে ওদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে,” টম ইঞ্চবার্ডের দিকে তাকাতেই তার চেহারায় সহমর্মিতা দেখতে পেলো। “আপনি কোম্পানির কৃতজ্ঞতার কথা বললেন। যদি কথাটা আসলেই সত্যি হয় তো আমাদেরকে মাদ্রাজ পৌঁছে দিন।”

*

টম, ফ্রান্সিস আর অ্যানা ব্রিঞ্জোয়ান ছাড়ার তিন সপ্তাহ পর গিয়ে মাদ্রাজ বন্দরে পৌঁছালো। জায়গাটা দেখে, বইতে দেখা মধ্যযুগের শহরগুলোর ছবির কথা মনে পড়লো টমের। মরিচা রঙের পাথরের বাড়িতে ছেয়ে আছে শহরটা। সুরক্ষার জন্যে অসংখ্য অর্ধচন্দ্রাকার কেল্লা আর সারি সারি কামান বসানো সমুদ্রের ধার জুড়ে। তার পিছনে অনেকগুলো সুদৃশ্য ভবন, তবে উত্তর দক্ষিণে ধীরে ধীর ভবনের উচ্চতা ক্রমান্বয়ে কমে গিয়েছে। ওদিকে সব ভাঙাচোরা বাড়ির বস্তি। কোম্পানির সাথে ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করা সওদাগরেরা থাকে সেদিকে।

জাহাজের নোঙর নামানো হলো না, তার আগেই এক ঝাঁক ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা ছুটে এলো ডাঙা থেকে। ওগুলোতে আছে নারিকেল, রাম, ফল আর মাছ। কয়েকজন মহিলা প্রায় নগ্ন অবস্থায় নাবিকদের সাথে এসে ঢলাঢলি করতে লাগলো। টম জানে ওদের কাছেও বেচার মতো জিনিস আছে।

“ওরা আপনার নাম দিয়েছে অরম্বারস,” ইঞ্চবার্ড বললো। “মানে হচ্ছে শহরে নতুন আগন্তুক। আপনার কাছ থেকে ভালো পয়সা খসানোর চেষ্টা করবে ওরা।”

“তাহলে খুবই হতাশ হবে ওরা, কারণ আমার কাছে একটা পয়সাও নেই,” টম বললো। “আপনি মালপত্র ডাঙায় পাঠাবেন কখন?”

“কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো আমরা,” ইঞ্চবার্ড বললো। “আগে জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে লোকজনের জন্যে কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু গভর্নর চায় যে আমি অবিলম্বে টাকার প্যাকেটটা পাঠিয়ে দেই। আপনি যদি কষ্ট করে কাজটা করতেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকতাম।”

টম ওর কথা বুঝতে পেরে কৃতজ্ঞ বোধ করলো। ফ্রান্সিস আর অ্যানার সাথে একটা ছোট নৌকায় চড়ে বসলো ও। নৌকার তক্তাগুলো পেরেক দিয়ে না লাগিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফলে ওদের ওজনে বারবার জায়গা থেকে নড়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে পানি ঢুকতে লাগলো।

“ডাঙা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে তো?” ফ্রান্সিস বললো। “নৌকাটা তো সাগরে ডুবিয়ে মারার জন্যে বানানো হয়েছে দেখি।”

“মাঝিরা জানে যে ওরা কি করছে,” টম বললো। আমাদের নৌকার মতো না এগুলো। এগুলো স্রোতের সাথে সাথে বেকে যেতে পারে। তুমি হয়তো ভিজে যাবে, কিন্তু কোনোদিনও নৌকা উল্টে মরবে না।”

আসলেই তাই। নৌকাটা ওদেরকে ভিজিয়ে দিলো, কিন্তু নিরাপদেই জেটির কাছে বন্দরের দরজায় পৌঁছে দিলো। জাহাজের কাগজপত্র দেখাতেই ওদেরকে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হলো। দরজার পার হতেই সরাসরি বাজারে গিয়ে পড়লো ওরা। বালুতে ভরা রাস্তাগুলোর দুই পাশ ছোট ছোট দোকানে ভরে আছে। দোকানদার পাশেই দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জিনিসপত্রের দাম বলে বলে খরিদ্দার ডাকছে। একপাশের দেয়ালে পরবর্তী জাহাজ কখন আসবে সেই কাগজ সাটানো। অ্যানাকে দেখতে পেয়ে কয়েকজন দোকানদার এগিয়ে এসে অভিবাদন জানালো। অ্যানার প্রতি ওদের মমতা দেখে খুশি হলো টম। ফ্রান্সিস ভ্রু কুঁচকে পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো।

অ্যানা দোকানদারদের মাতৃভাষায় গড় গড় করে কথা বলতে লাগলো। বলতে বলতে ওর চেহারা কালো হয়ে গেলো। “এদের কাছে সারাহ বা অ্যাগনেসের কোনো খবর নেই। তবে ওরা নাকি দেখেছে যে একটা জাহাজ ব্রিঞ্জোয়ানের একজন লোককে গত সপ্তাহে উদ্ধার করে এনেছে। একজন ইংরেজ নাকি। এখন দুর্গে আছে।”

 “ওখানেই যাবো তাহলে,” টম বললো। “তুমি আর ফ্রান্সিস ঘাটে আরো একটু খোঁজ খবর করে দেখো কিছু জানা যায় কি না।”

চারপাশে দেয়াল ঘেরা শহরটার মাঝখানে যে দুৰ্গটা সেটা দেখে মনে হলো ব্রিঞ্জোয়ানের দুর্গটারই একটা বড়সড় প্রতিরূপ। যদিও আকারে দ্বিগুণ, আর ওটার মাঝে একটা তিনতলা সুরম্য অট্টালিকা দেখা যাচ্ছে। ওটার বাঁকানো খিলানটার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় টমের মনে পুরনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন ও ভেবেছিলো যে সব শেষ, সেই ভয়ানক সময়টার সব কিছু আবার প্রতিধ্বনিত হলো ওর মনে।

ইঞ্চবার্ডের বদৌলতে ও একটা ওয়েটিং রুমে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো। তাকার প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলো একজন চাকরকে। সেটা নিয়ে লোকটা চলে যেতেই ও বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।

সময় বয়ে যেতে লাগলো। ঘরের গ্রান্ডফাদার ঘড়িটা ঢং ঢং করে ঘণ্টার ধ্বনি দিয়ে জানিয়ে দিলো এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। টম প্রচণ্ড রেগে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবছে সেটা খুলে ফেলবে কিনা। চেয়ারের হাতল চেপে ধরে উঠে যাওয়া থেকে বিরত রাখলো নিজেকে।

ঠিক যখন ওর মনে হলো যে আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা সম্ভব না, তখনই দরজাটা খুলে গেলো। ওকে ইশারায় ডাক দিলো দারোয়ান। প্রচুর বাতাসওয়ালা একটা ঘরে এসে ঢুকলো ও। ঘরে অনেকগুলো জানালা। দেয়াল জুড়ে আগের আমলের অস্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো। সব দেয়ালে গেঁথে রাখা হয়েছে। মাস্কেটের একটা ছড়া, একগাদা তরবারি, আড়াআড়ি করে রাখা বল্লম। দেখে টমের হাই উইল্ডের লাইব্রেরির কথা মনে পড়ে গেলো। বহু বছর ওখানে যাওয়া হয় না ওর।

একজন লোক হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। “উইলিয়াম ফ্রেজার,” নিজের পরিচয় দিলো লোকটা। “ফোর্ট সেন্ট জর্জের গভর্নর আমি। আপনি নিশ্চয়ই টমাস উইল্ড?”

মাথা ঝাঁকালো, টম। ফ্রেজার জোরে ওর হাতে চাপ দিলো। “তাহলে আমি আর আমার কোম্পানি দুটোই আপনার কাছে ঋণী। ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ডের রিপোর্ট পড়েই বুঝেছি যে আপনার অকুতোভয় পদক্ষেপের কারণেই দুৰ্গটা হাতছাড়া হয়নি আমাদের। নইলে ওটার সাথে দুর্গের লোকজনেরও করুণ পরিণতি হতো। তারচে বড় কথা কোম্পানির সম্মান ধুলোয় মিশে যেতো। ব্যবসার কথা বাদই দিলাম, একবার যদি ঐ কালাগুলোর মাথায় ঢোকে যে ওরাও চাইলে আমাদেরকে মারতে পারে তাহলেতো এদেশে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।”

টম কোনো কথা বললো না। ব্যাপারটা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। ও কখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রক্ষক হতে চায়নি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সেটাই হয়েছে। আর বিপদও এখনো কাটেনি। কয়েক মাসের অবর্ণনীয় কষ্টের পর এরকম আরামদায়ক পরিবেশ এরকম উষ্ণ অভিবাদন পেলে বেখেয়াল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেউ যদি ওকে চিনে ফেলে আর গাই একবার খবর পেয়ে যায়…

 “আমি দুঃখিত, আপনাদের বেশি লোককে বাঁচাতে পারিনি,” নিচু কণ্ঠে বললো টম। “মিস্টার ফয় আসলে বাঁচানোর মতো কাউকে রেখে যাননি।”

“ওনার অপরিণামদর্শি আচরণের মূল্য উনি দিয়েছেন।”

‘শুধু উনি একাই দেননি। আরও অনেকেই। আর তাদের এক্ষেত্রে কিছুই করার ছিলো না।” টম টের পেলো গত কয়েক মাসের সব রাগ ভিতরে ফেনিয়ে উঠছে। ওর ইচ্ছে করেছে এই ভারী পর্দা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে, দেয়ালের সব ছবি টেনে আছড়ে ফেলে ফ্রেজারের টেবিলের সব কাগজ পত্রও ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে।

জোর করে নিজের রাগ সামলালো ও।

“অবরোধ শুরু হওয়ার আগে আপনাদের এক মুনশি কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে একটা নৌকায় করে পালিয়ে আসে। ফয়-এর স্ত্রী, ক্যাপ্টেন হিকসের স্ত্রী আর আমার স্ত্রী ছিলো ওর সাথে। ওরা মাদ্রাজ আসবে বলে রওনা দিয়েছিলো।”

ফ্রেজারের চেহারা গম্ভীর হয়ে গেলো। “গত সপ্তাহেও যদি আসতেন তাহলে আপনাকে কোনো ভরসা দিতে পারতাম না। কারণ সেরকম কিছুই শুনিনি আমি। তবে এখন কিছু জানি আমি। তবে সেটা যে সুসংবাদ তা বলতে পারবো না।”

টমের বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো। সামলাতে ফ্রেজারের ডেস্কের একটা কোনা চেপে ধরলো ও। হাতের মুঠি সাদা হয়ে গিয়েছে। “খবরটা কি?”

“বসুন,” ফ্রেজার একটা চেয়ারের দিকে ইংগিত করলো। “খবরটা যে এনেছে তার মুখ থেকেই শুনুন নাহয়। সে এখানেই আছে।”

ফ্রেজার একটা বেল চাপলো। টম একটা পিছন দিক উঁচু চেয়ারে বসলো। পিছনে দরজা খোলার আওয়াজ পেলো ও। মাপা পদক্ষেপে এগিয়ে এলো কেউ।

“মিস্টার কাইফেন,” দারোয়ান ঘোষণা দিলো। বলে সে দরজা বন্ধ করে দিলো আবার।

ঘরের অর্ধেকটা ঢুকে টমকে চোখে পড়লো কাইফেনের। জায়গায় জমে গেলো সে। ভীত চোখে ও একবার সামনে আর একবার বের হওয়ার দরজার দিকে তাকাতে লাগলো।

 ‘মিস্টার উইল্ড,” শুকনো গলায় বললো ও। অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পালানো সম্ভব না বুঝতে পেরে সামনে এগিয়ে এলো। “ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, আপনি বেঁচে আছেন। আমি আসলেই ভাবতে পারিনি যে আবার দেখা হবে আমাদের।”

শেষবার যখন ওদের দেখা হয়েছিলো তখন ওরা রানির মহল থেকে জান হাতে নিয়ে পালাচ্ছিলো। মাঝের মাসগুলো ওদের কারো-ই ভালো যায়নি। কিন্তু কাইফেনের দিন যে ভয়ানক গিয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। নাকের উপর ফোস্কা পড়ে আছে। সূর্যের তাপের ঝলসে চামড়ার রঙই বদলে গিয়েছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে কোটর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে যে কোনো সময়। হাতের আঙুল ক্রমাগত কাঁপছে।

টমের মনে অনেক প্রশ্ন ভীড় করে আছে। কিন্তু ও করলো মাত্র একটা প্রশ্ন। “আমার স্ত্রী কোথায়?”

কাইফেন শিউরে উঠলো। একটা চেয়ারের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়ে এমনভাবে মুখ করে বসলো যেনো টম ওর চোখের দিকে তাকাতে না পারে।

“আমি যা বলবো তা আপনার পছন্দ হবে না স্যার।”

*

নৌকাটা শান্ত সমুদ্রে আগাচ্ছেই না বলা চলে। আটজন পুরুষ আর তিনজন মহিলা ওটার মাল বোঝাই খোলর ভিতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। পুরুষদের কাবো-ই কোমরের উপরে কাপড় নেই; মহিলাদের কাপড়ের অবস্থাও তথৈবচ। চারটা দাঁড় স্বচ্ছ পানিতে কোনো আলোড়ন তুলতে পারছে না, শুধু পানিতে একবার নামছে আর উঠছে। একটু পরেই ক্ষান্ত দেবে ওরা, কারণ বহু আগেই বুঝে গিয়েছে যে এই ভ্যাপসা গরমের মাঝে নৌকা বাওয়ার চেষ্টা করে কোনো। লাভ নেই।

মেঘহীন আকাশ থেকে খরতাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। এবারের বর্ষাটা বেশ দুর্বল ছিলো। ঝড় ঝাপ্টা যা হয়েছে সব একেবারে সবসময় যখন হয়, ঠিক সেই সময়ে। কিন্তু এরপরে যে ভারী বর্ষণ হয় সেটা এবার হয়নি। ফলে কৃষকদের মাথায় হাত। ওরা মাটি খুঁড়েও পানির সন্ধান পাচ্ছে না। খরায় এবারের ফসল ভালো হবে না। আগামী মৌসুম ওদের কিভাবে চলবে জানে না কেউ। আর নৌকার ওরা জানে না যে আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত টিকতে পারবে কিনা।

দশ বছর বয়স থেকে অ্যাগনেস ভারতে থাকে। ইয়র্কশায়ারের ছোট ছোট পাহাড় আর মৃদু বৃষ্টিপাতের স্মৃতি ঝাপসা আকারে মনে আছে কিছুটা, অনেক সময় মনে হয় ওগুলো বুঝি স্বপ্ন। ও প্রায় বিশ বছর এখানে টিকে আছে। বিশটা ভয়ংকর বর্ষা; বিশটা গা ঝলসানো গ্রীষ্ম। মাঝে মাঝে মনে হতো যে হাড় পর্যন্ত পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। পাঁচটা বাচ্চা হয়েছিলো অ্যাগনেসের, কোনোটাই তিন বছরের বেশি বাঁচেনি। দুঃখ কষ্ট কাকে বলে ভালোই জানা আছে ওর।

কিন্তু এখন যে যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে সেটা আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। একটা তিরিশ ফুট লম্বা নৌকায়, আরো দশজন লোকের সাথে ঠাসাঠাসি করে তিন সপ্তাহ ধরে বসে আছে। নৌকাটা এতো বেশি জিনিসপত্রে ঠাসা যে কিনার পানি ছুঁই ছুঁই করছে। উপরে কোনো আচ্ছাদন নেই, কোনো গোপনীয়তা নেই। প্রথম ঝড়টা পার হওয়ার পর, লেই নামের কেস্ট্রেল-এর সারেং-টা পালের ক্যানভাস ছিঁড়ে নৌকার পিছন দিকে, উপরে আর সামনা সামনি পর্দার মতো লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে শুধু দাঁড় বেয়েই চলতে হচ্ছে ওদের। সারাহের যত্ন করতে না হলে অ্যাগনেসও দাঁড় বায়। সেই পরিশ্রমে ওর হাত কড়া পড়ে কুঁচকুচে কালো হয়ে গিয়েছে।

 “আমারও বাইতে সাহায্য করা উচিত,” এক সকালে বললো সারাহ। ওর জ্বর গিয়ে উঠে বসতে পারছে একটু। তবে তখনও খুবই দুর্বল।

 “মাথা খারাপ?” অ্যাগনেস বললো। “তোমার যে অবস্থা তাতে দাঁড় তুলতেই পারবে না।”

 “কিন্তু তাতে লোকগুলো আমাকে অকর্মা মনে করবে না। সবাই-ইতো একটু পরে পর করছে।”

“সবাই না,” অ্যাগনেস বললো। তারপর অগ্নি দৃষ্টিতে লিডিয়া ফয়-এর দিকে তাকালো। লিডিয়া নৌকার সামনের দিকে সিন্দুকগুলোর সাথে বসে আছে। কাইফেন বসে আছে ওর পাশে। খবরদারি করার চেষ্টা করছে। নৌকায় সবাই-ই ঠাসাঠাসি করে আছে, কিন্তু এর মাঝেও ওদের ঢলাঢলি সবার কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে। মাথার উপর একটা ছাতি ধরা ওর। লিডিয়া ওটা আর কাউকে দেয় না।

 “লোকজন সবাই জানে যে তুমি ওদেরকে কতোটা স্নেহ করো,” অ্যাগনেস সারাহকে বললো। “শুধু তোমাকে নিরাপদ কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্যে এতো কষ্ট করছে ওরা।”

সারাহ দুর্বলভাবে হাসলো। “তাহলেতো আমার

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই কাশতে শুরু করলো সারাহ। কাশির দমকে বমি পেয়ে গেলো ওর। নৌকার কিনারের মাথা নিতে নিতেই সকালে খাওয়া সামান্য ভাত আর শুঁটকি মাছের পুরোটাই বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে।

অ্যাগনেস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারাহের বমি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে ধরে রাখলো। প্রতি সকালেই এরকম হচ্ছে।

 “উনি যদি খেয়ে পেটে রাখতেই না পারে, তাহলে ওনার পিছনে খাবার নষ্ট না করলেই ভালো হবে,” কর্কশ কণ্ঠে বললো লিডিয়া ফয়। “এমনিতেই আমাদের না খেয়েই থাকতে হচ্ছে।”

“বাকি সবার মতো সারাহও ওর ভাগ পাবে,” জোর দিয়ে বললো অ্যাগনেস। নৌকার সব লোকের মাঝে একমাত্র লিডিয়াই কোনো কষ্ট করছে না বলা চলে। কম খাবারের ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ওর গায়ের রঙ এখনো আগের মতোই, স্তনও পোশাকের উপর দিয়ে আগের মতো ফুলে বেরিয়ে আছে। অ্যাগনেসের ধারণা কাইফেন সম্ভবত সবার অলক্ষ্যে ওকে অতিরিক্ত খাবার দিচ্ছে-বা আরো বেশি। কয়েকদিন রাতের বেলা ও নৌকার সামনের দিকে থেকে অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পেয়েছে।

“আমি বোঝা বাড়াতে চাই না,” বলতে বলতে সারাহ শুয়ে পড়লো। ওর পেটটা এখনো মোচড়াচ্ছে। অ্যাগনেস এমনভাবে সরে বসলো যাতে ওর ছায়া সারাহের উপর পড়ে। তারপর এক কাপ পানি বোনের ঠোঁটে ধরলো। কাপটা চীনামটির তৈরি, গায়ে উইলো পাতার নকশা আঁকা। এই পরিস্থিতিতে এই সুন্দর জিনিসটা একেবারেই বেমানান। অ্যাগনেস যখন দেখলো যে মিসেস ফয় তার পুরো ডিনার সেটা নৌকার তুলেছে তখন আক্ষরিক অর্থেই ওর মুখ হা হয়ে গিয়েছিলো।

“সাবধানে,” লিডিয়া বললো। “আবার বৃষ্টি না হলে কিন্তু পানির টানাটানি পড়ে যাবে।”

 এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতির আর একটা নির্মম দিক হলো এটা। যখন বৃষ্টি আসে তখন এতো বেশি আসে যে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। সবাই তখন দাঁড় বাওয়া ছেড়ে পানি সেঁচতে শুরু করে। কিন্তু ওদের কাছে পানি ধরে রাখার মতো কিছু না থাকায়, বৃষ্টি থেমে সূর্য উঠলেই দেখা যায় তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে মরে।

 অ্যাগনেস সামনের উপকূলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে সৈকত দেখা যাচ্ছে। ঝড়ের পর থেকে ওরা ডুবে যাওয়ার ভয়ে সবসময় ডাঙ্গার কাছে কাছে থাকে।

“আমাদের ডাঙায় যাওয়া উচিত একবার,” অ্যাগনেস বললো। “খাবার পানি পাওয়া যেতে পারে-বা গ্রামও থাকতে পারে। ওখান থেকে কিছু খাবারও আনা যাবে।”

“খাবার?” লিডিয়া কটাক্ষ নিক্ষেপ করলো ওর উপর। “ওরা আমদেরকে কেন সাহায্য করবে? আমারতো মনে হয় আমাদের গলা কেটে মালপত্র সব লুট করে নিয়ে যাবে।”

“আমাদের কাছে যথেষ্ট স্বর্ণ আছে। কিনে নিলেই হবে।”

“গরমে মাথা গুলিয়ে গিয়েছে আপনার। আমি এই গেয়োগুলোকে আমার একটা ফানামও (তৎকালীন মাদ্রাজের মুদ্রা) দেবো না।”

“এগুলো কোম্পানির স্বর্ণ,” অ্যাগনেস মনে করিয়ে দিলো।

“এগুলো আমার স্বামীর,” লিডিয়া জোর দিয়ে বললো।

“আর যদি মরেই যান তাহলে এগুলো কোনো কাজেই আসবে না।” অ্যাগনেস ভারতে যততদিন ছিলো ততোদিন কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী হতে শিখেছে। গাই-এর তিরস্কার আর ওর বোন ক্যারোলিনের খোঁচা দুটোই সহ্য করে গিয়েছে বিনা প্রতিবাদে। বয়স বাড়া সাথে সাথে ক্যারোলিন আরো বেশি মোটা, আর অসুখী যেমন হয়েছে, তেমনি ওর খোঁচার ধারও বেড়েছে বহুগুণ। শুধু নিজের স্বামীর কথা ভেবে অ্যাগনেস একটা শব্দও উচ্চারণ করনি কোনোদিন।

কিন্তু এখন টের পেলো ওর সহ্যশক্তি আর আগের মতো নেই। কারণটা হতে পারে ওর স্বামী বিয়োগ বা সূর্যের উত্তাপ অথবা এই চরম পরিস্থিতি। ও আর কিছুর পরোয়া করে না। ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে গেলো ও, আর সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলো না।

“আমার বোনের একটু ভালোমতো বিশ্রাম দরকার,” গরম কণ্ঠে বললো ও। “বাকিদেরও একটু বিশ্রাম আর ভালো খাওয়া প্রয়োজন। ওই সিন্দুকের উপর বসে বসে তা দেবেন আর আমাদের যা দরকার সেটা করতে দেবেন না, সেটা আমি হতে দেবো না।”

যারা দাঁড় বাইছিলো তারা দাঁড় তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। লিডিয়া নৌকার কিনার ছাড়িয়ে আর এক দিকে তাকিয়ে রইলো। “আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন মিসেস হিকস।”

অ্যাগনেস লেই-এর দিকে ফিরলো। ও হাল ধরে নৌকার একদম পিছনে বসে আছে। “কষ্ট করে নৌকা বাম দিকে ঘোরান। আমরা ডাঙায় নামবো।”

“ঐ গেয়োগুলোর হাতে লুট হয়ে দাসিগিরি করতে?” লিডিয়া কাইফেনকে ধরে ঝাঁকি দিলো। কাইফেন এততক্ষণ তর্কে না জড়াতে আর এক দিকে তাকিয়ে ছিলো। “মিস্টার কাইফেন! আপনি এখানকার দায়িত্বে আছেন।”

কাইফেন একবার অ্যাগনেস আর একবার লিডিয়ার দিকে তাকাতে লাগলো। “মিসে ফয় ঠিক বলেছেন,” শেষে কোনোমতে বললো ও। “যেদিকে যাচ্ছেন সেদিকেই যান। ডাঙায় যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।”

“মাফ করবেন ম্যাডাম, কিন্তু কোম্পানির নীল কোট পরলেই আপনি ক্যাপ্টেন হয়ে যাবেন না,” লেই বললো। তারপর ও হাল ঘুরিয়ে ফেলতেই বাকিরা আবার দাঁড় বাইতে শুরু করলো।

লিডিয়া রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো। আমার কথা না শুনলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। মাদ্রাজ পৌঁছেই আমি গভর্নরের কাছে নালিশ করবো। আর উনি তোদের সব কটাকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন।”

লেই-ও গরম চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। “আগে মাদ্রাজ পৌঁছাই, তারপর দেখা যাবে।”

“মিস্টার কাইফেন,” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আবার চেঁচিয়ে উঠলো লিডিয়া। “আপনি এই বেয়াদবি চুপচাপ সহ্য করবেন?”

 ‘কখনোই না,” ঠাণ্ডা গলায় বললো অ্যাগনেস। “আপনি যেভাবে ওনার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন, তাতে আপনার পোষা কুত্তা বাদে আর কিছু মনে হয় না আমার ওনাকে।”

অ্যাগনেসের নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। ওর মুখ থেকে এই কথাগুলো বেরিয়েছে। লিডিয়ার চেহারা রাগে সাদা হয়ে গেলো। অ্যাগনেস কাইফেনের দিকে চাইলো। কাইফেন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

গালাগাল করতে করতে লিডিয়া ওর জামার নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট পিস্তল বের করে আনলো। পিস্তলটার বাট হাতীর দাঁতের বানানো। অ্যাগনেসের দিকে তাক করলো সেটা।

“মিস্টার লেই, আবার আগের দিকে চালান,” আদেশ দিলো লিডিয়া। পিস্তল ধরা হাতটা এক চুল কাঁপছে না ওর।

কেউ নড়লো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অ্যাগনেসের দিকে তাকালো লেই। মাল্লাগুলোও ওদের দিকে চেয়ে রইলো। ঢেউ এসে নৌকার খোলে বাড়ি খাওয়ার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই আশেপাশে।

“জাহাজ!”

সারাহের কণ্ঠ নীরবতা ছিন্ন করলো। সবার অলক্ষ্যে ও উঠে বসেছে কখন যেনো। আর এখন সমুদ্রের দিকে দেখাচ্ছে। মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে আছে। ওর গলা এতোটাই ফ্যাসফেসে হয়ে আছে যে শব্দ বের হলো না বললেই চলে, কিন্তু নৌকার আশেপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে থাকায় শুনতে পেলো সবাই।

 মুহূর্তে ঝগড়া ভুলে, সারাহ যেদিকে দেখিয়েছে সেদিকে তাকালো সবাই। দিগন্তে সাদা পালওয়ালা একটা জাহাজ ওদের চোখের সামনে এগিয়ে আসছে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বেঁচে গেলাম আমরা,” কাইফেন প্রায় কেঁদে দিলো। ওর পাশেই লিডিয়া সরু চোখে জাহাজটাকে দেখতে লাগলো।

“জাহাজটা কি ইংল্যান্ডের?”

 “দেখে মনে হচ্ছে গ্রাব,” লেই বললো।

গ্রাব হচ্ছে ভারতীয় রীতিতে বানানো এক ধরনের জাহাজ। শব্দটা আরবি। অর্থ কাক। পাখির মতোই এগুলো সামান্য বাতাসেই উড়ে চলতে পারে। আর মাত্র দুটো পাল থাকায় ওগুলো সমুদ্রপথের এক দুর্দান্ত বাহনে পরিণত হয়েছে। তবে সবচে আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলোর লেজের দিকটা কেটে ফেলে সেখানে একটা কামান বসানো হয়। ফলে কেউ যদি ধাওয়া করে তাহলে সেদিকে দিয়ে খুব সহজেই গোলা ছুঁড়ে বাধা দেওয়া যায়।

“এরা কি কান্ট্রি ট্রেডার নাকি?” অ্যাগনেস জিজ্ঞেস করলো। ভারতীয় মহসাগরের উপকূলের মধ্যে যারা ব্যবসা করে তাদেরকে কোম্পানি নাম দিয়েছে কান্ট্রি ট্রেডার।

“বছরের এই সময়ে সমুদ্রে বেরিয়ে নিজেদের মালামাল খোয়ানোর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস খুব বেশি কারো নেই,” সন্দিহান সুরে বললো লেই।

ওদের উল্লাস থিতিয়ে পড়লো। এখন বরং জাহাজটা যতোই এগিয়ে আসতে লাগলো ততোই বাড়তে লাগলো ওদের দুশ্চিন্তা। সন্দেহের দোলাচালে দুলছে সবার মন। একবার মনে হচ্ছে উদ্ধার হবে ওরা, আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতির চাইতেও বাজে অবস্থায় পতিত হতে যাচ্ছে।

“পতাকা তুলছে ওরা।”

 একটা লাল পতাকা ওটার মাস্তুল বেয়ে উঠে গেলো। সাথে সাথে বাতাস এসে ছড়িয়ে দিলো সেটাকে। সবাই স্পষ্ট দেখতে পেলো টকটকে লাল জমিনে একটা সাপের প্রতিকৃতি।

অ্যাগনেস এর আগে পতাকাটা কখনো দেখেনি। তবে পতাকাটার ভয়ংকর কুখ্যাতি জানা আছে ওর। ব্রিঞ্জোয়ানের কোম্পানির খাবার ঘরে প্রায় রাতেই এদের কথা বলবলি হতে শুনেছে ও। এটা হচ্ছে মালাবার উপকূলের ত্রাস-জলদস্যু আংরিয়া-র পতাকা। এই এলাকার এমন কোনো সওদাগর নেই, যার জাহাজের কোনো না কোনো লোক আংরিয়ার হাতে খুন বা বন্দী হয়ে অবর্ণনীয় অত্যাচারের স্বীকার হয়নি।

“ডাঙার দিকে যাও,” আর্তনাদের মতো শোনালো কাইফেনের গলা। “পালাতে না পারলে খবর আছে।”

মাল্লারা সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড় বাইতে শুরু করলো। ওরা সংখ্যায় মাত্র কয়েকজন, আর খুবই দুর্বল হয়ে আছে। গ্রাবটা তাই ওদের পিছু ছাড়লো না, শান্ত সাগরে মসৃণভাবে ধেয়ে এলো।

“খোদ শয়তান ওদের জাহাজ চালতে সাহায্য করে,” হাফাতে হাফাতে বললো একজন।

“চুপ,” লেই আদেশ দিলো। “কথা বলে দম নষ্ট কোরো না।”

“তীরের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলে ওরা আর আমাদেরকে ধরতে পারবে না আশা করি, কারণ তাহলে ওদের খোল চড়ায় আটকে যাবে,” আশান্বিত কণ্ঠে বললো কাইফেন।

 অ্যাগনেস মাথা ঝাঁকালো। “আমি ব্রিঞ্জোয়ানের ঘাটে এরকম জাহাজ ভীড়তে দেখেছি। এগুলো কম পানিতে চলাচলের উপযোগী করে বানানো হয়।”

গ্রাবটার সামনের দিক থেকে আলোর ঝলকানি দেখা গেলো। এক সেকেন্ড পরেই কামানের বুমমম শব্দ কাঁপিয়ে দিলো চারদিক। গোলাটা উড়ে এসে ওদের নৌকা থেকে তিরিশ গজ মতো দূরে পানিতে আলোড়ন তুলে ডুবে গেলো।

“অসভ্যের দল ঠিকমতো কামানও দাগতে পারে না,” লিডিয়া ফয় বললো। এখনো ও আইভরির হাতলের পিস্তলটা ধরে আছে।

“এটা ছিলো সতর্কীকরণ,” লেই বললো। “পরেরটা কাছেই পড়বে।”

যেনো ওর কথা শুনেই গ্রাব থেকে আবার ছোঁড়া হলো গোলা। এবার গোলাটা এতো কাছে পড়লো যে ওদের গায়ে পানির ছিটে এসে লাগলো।

“আমাদের ভার বেশি,” লেই উদ্বিগ্ন সুরে বললো। “একটা লাগলেই ডুবে যাবে নৌকা। আপনি কি সাঁতরাতে পারেন মিসেস হিকস?”

“অল্পসল্প। কিন্তু সারাহকে ডাঙায় নেবো কিভাবে?”

ওরা ধেয়ে আসা জাহাজটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতো কাছে চলে এসেছে যে অ্যাগনেস ওটার কামানের নলের উপরে সূর্যের ঝলকানি দেখতে পেলো। সেই সাথে সামনের দিকে জড়ো হওয়া লোকজনও নজরে এলো ওর। ওরা ওদের অস্ত্রপাতি বাতাসে নাড়তে নাড়তে মুখ দিয়ে রক্ত হিম করা রণ-হুঁঙ্কার ছাড়ছে।

“কি করবো আমরা?”

*

গভর্নরের ঘরের চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে কাইফেন নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে আছে। জানালা দিয়ে সূর্যাস্তের আলো এসে পড়ছে ওর চেহারায়। একবারে লাল টকটকে লাগছে ওকে।

“স্বাভাবিকভাবেই আমি দস্যুদের ঠেকানোর জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমরা অনাহরে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম, আর তাছাড়া সমুদ্রে অনেকদিন ধরে আছি। দস্যুরা তাই সহজেই হারিয়ে দিলো আমাদের। ওর মহিলাদেরকে বন্দী করে আমাকে একটা ছোট নৌকায় করে ভাসিয়ে দেয়। আমাকে ছেড়ে দেয়ার কারণ হলো আমাকে দিয়ে একটা খবর মাদ্রাজে পাঠাতে চায়। তা হচ্ছে বন্দিদের জন্যে মুক্তিপণ দিতে হবে। আর তারপরেই ভাসতে ভাসতে, কোনোমতে যমের দুয়ার থেকে ফিরে এখানে এসে পৌঁছেছি আমি।”

ওর গল্প শুনতে শুনতে টম নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে সারা ঘরে পায়চারি শুরু করেছিলো। কথা শেষ হতে থামলো ও। তারপর জানালার গোবরাটে ভর দিয়ে বাইরের সূর্যাস্ত দেখতে লাগলো। শহরের পশ্চিমের একটা ছোট উপহ্রদের পানিতে ডুব দিচ্ছে সূর্যটা।

“কতো?” জিজ্ঞেস করলো টম।

কাইফেন অস্বস্তিভরে নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো। “মাফ করবেন?”

“ওরা কতো টাকা মুক্তিপণ চাইছে?”

“এইতো…” কাইফেনের মুখ ডাঙায় ভোলা মাছের মতো খাবি খেতে লাগলো। “পাঁচ হাজার রুপি।”

“কিভাবে দিতে হবে টাকা? মহিলাদের কোথায় আটকে রেখেছে ওরা?”

কাইফেন এতো জোরে নিজের আঙুল মোচড়াতে লাগলো যে টমের মনে হলো ওগুলো ভেঙে যাবে যে কোনো সময়। “আমার মনে নেই। আসলে পরিস্থিতি… সবকিছুই এতোটা ভয়ংকর ছিলো যে, আপনি তো বুঝতেই পারছেন। আমি কোনো মতে জান নিয়ে পালিয়েছি।”

 “আংরিয়ার ঘটি হচ্ছে বোম্বের দক্ষিণের টিরাকোলার দুর্গ,” গভর্নর বললো। “নিশ্চিত ওদেরকে ওখানেই নিয়ে যাওয়া হয়ছে।”

টম ওর কথায় পাত্তা দিলো না। ও জানালা থেকে ঘুরে কাইফেনের দিকে আগালো। চেয়ারের ভিতর কুঁকড়ে গেলো কাইফেন। ওর সামনে টমকে এখন দানবের মতো লাগছে।

“মিথ্যে কথা।”

বলে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই টম কাইফেনের কোটের কলার চেপে ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এক লাথিতে ফেলে দিলো মেঝেতে। তারপর আরো এক লাথিতে দেয়ালের গায়ে আছড়ে ফেললো। ফ্রেজার ওকে থামাতে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু টমের আক্রোশ দেখে থমকে গেলো।

“সত্যি কথা বল,” ওকে টেনে তুলে জানতে চাইলো টম।

কাইফেন নিজের জামার ভিতর এতো বেশি সেধিয়ে গিয়েছে যে ওর চেহারা আর দেখাই যাচ্ছে না। ও বিড়বিড় করে কি কি বলতে বলতে হাত পা ছুঁড়তে লাগলো। “ছেড়ে দিন আমাকে।” চি চি করে বললো ও।

টম ছেড়ে দিলো ওকে। ধপ করে মেঝেতে আছাড় খেয়ে ব্যথায় কাতরে উঠলো কাইফেন।

“তুই একটা কাপুরুষ, একটা নরাধম তুই,” টম বললো ওকে। “তুই যদি শুধু নিজের চামড়া বাঁচানোর ধান্দা না করে আমার কথা শুনতি, তাহলে ঐ নৌকায় করে আমরা সবাই আজ পালিয়ে বাঁচতে পারতাম। এতোগুলো ভালো মানুষ আজ না মরে বেঁচে থাকতো। আর আমার বৌও থাকতো আমার সাথে।”

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেলো টম; কথা বলতে বলতে আবার লাথি শুরু করলো ও। ডাক ছেড়ে কাঁদতে আরম্ভ করলো কাইফেন।

 “মিস্টার উইল্ড,” ফ্রেজার ডাকলো। হতভম্ব হয়ে গিয়েছে ও। “আমি কিন্তু প্রহরীদের ডাকবো।”

টম পিছিয়ে এলো। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে ওর। চোখে ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। কারণ, কাইফেনের দিকে চোখ গেলে আবারো ওর ওকে পিটাতে ইচ্ছে করবে।

“দস্যুরা তোকে ছেড়ে দিয়েছে, না? তোকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, তাই না?” বলতে বলতে টম ঘুষি তুললো। কাইফেন কো কো করতে করতে ঘরের এক কোনায় সরে গেলো।

“মিস্টার উইল্ড,” ফ্রেজার ডাকলো ওকে।

“তুই যখন ঘরে বসে খেলনা দিয়ে খেলতি, তখন থেকে আমি সমুদ্রে দস্যুদের সাথে লড়াই করে আসছি। ওদের কাছে প্রতিটা বন্দীই হচ্ছে ব্যবসার পণ্য। একটা স্বর্ণের বস্তা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওরা কাউকেই ছাড়বে না। তাই আবারও বলছি, ভালোয় ভালোয় বল কি হয়েছিলো?”

 কাইফেন উঠে বসলো। নাক বেয়ে রক্ত পড়ছে। ফ্রেজারের দিকে কাতর নয়নে তাকালো ও।

“আপনি ওনাকে আমার সাথে এরকম করতে দেবেন? আপনার সৈন্যদের ডাকুন-একে আটক করুন। পাগল হয়ে গিয়েছেন ইনি।”

“ওনার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

কাইফেন টম আর গভর্নরের দিকে তাকাতে লাগলো। ওর পক্ষে কেউ নেই দেখতে পেয়ে চেহারা অন্ধকার হয়ে গেলো ওর।

“আমি দস্যুদের সাথে লড়াই করিনি,” ফিসফিস করে বললো ও।

“আর ওরা তোকে ধরেওনি, তাই না?” জেরা করলো টম।

“আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়েছিলাম, কাইফেন কাতর কণ্ঠে বললো। “আমরা ডাঙার খুব কাছেই ছিলাম তখন। আমি সাতরাতে পারতাম। দস্যুরা তখন লুট করতে এতোই ব্যস্ত ছিলো যে আমার দিকে খেয়াল করেনি।”

“আপনি মহিলাদেরকে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন?” গভর্নর জিজ্ঞেস করলো।

 “হ্যাঁ,” মাথা নিচু করে বললো কাইফেন। “একশো দস্যুর বিপক্ষা আমি কি-ইবা করতে পারতাম? আমি ভেবেছিলাম কারো কাছে সাহায্য পাবো হয়তো। সবাইকে সতর্ক করে দেবো।”

“তুই এরকম কিছুই ভাবিসনি,” টম বললো। রাগ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে ওর। “তুই শুধু নিজেকে বাঁচানোর চিন্তা করছিলি।”

কাইফেন প্রতিবাদ করলো না। আমি একটা গ্রাম খুঁজে পাই। ওরা আমাকে আশ্রয় দেয়। দস্যুরা চলে যাওয়ার পরে জেলেরা আমাকে উপকূলে নিয়ে আসে। তারপর একের পর এক গ্রাম হেঁটে পাড়ি দিয়ে অবশেষে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি।” তারপর ভালো মানুষের মতো বললো, “বিশ্বাস করুন, এরপর থেকে এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন আমি বেচারা মহিলাদের মুক্তির জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিনি। আমি যদি আমার অবস্থানের সাথে ওদেরটা বদল করতে পারতাম, তাহলে খুশি মনেই তা করতাম।”

 টমের অগ্নিদৃষ্টি দেখে থেমে গেলো কাইফেন। টম মেঝেতে শুয়ে থাকা নাকি কান্না করতে থাকা লোকটার দিকে তাকালো। ওর মনে পড়লো অনেক আগে কোম্পানির এক চাকর ওদের পরিবারের সাথে বেইমানি করে দস্যুদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো। ওর বাবা হাল লোকটার সাথে কি করেছিলেন সেটাও মনে পড়লো ওর। উনি চাকরটার কাছ থেকে আগে স্বীকারোক্তি আদায় করেছিলেন, তারপর উলঙ্গ করে জানালা দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ফ্রেজার অনুমতি দিলেও টমের আর কাইফেনকে কষ্ট দেওয়ার মতো মানসিকতা নেই। কাইফেন আগাগোড়া একজন পুরুষ। যে দায়ে ওকে দোষী করা হচ্ছে, সেই দায়িত্ব ও নিজে থেকে নেয়নি। ওর উপরের ঠোঁটে রক্ত আর শ্লেষ্ম জমে আছে। যেনো বড় ছেলেদের হাতে ধোলাই হওয়া ছোট একটা বাচ্চা।

“আমার সামনে থেকে ভাগ,” হিসিয়ে উঠলো টম।

কাইফেন হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে গেলো। আবারও টমের আঘাতের ভয়ে সারা শরীর শক্ত হয়ে আছে। ও দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই টম ফ্রেজারের দিকে ফিরলো।

“সারাহ আর অ্যাগনেসকে ফিরিয়ে আনবো কিভাবে?”

ফ্রেজার অস্বস্তি নিয়ে তাকালো ওর দিকে। “যদি আংরিয়া ওদেরকে ধরে থাকে তাহলে নিশ্চিত যে ওদের মুক্তিপণের দাবি বোম্বেতে পাঠিয়েছে।”

“এখন কি হবে তাহলে?”

“গভর্নর কোর্টনী দস্যুদের সাথে কোনো প্রকার সমঝোতায় বিশ্বাসী না। ওনার মতে এতে ওদেরকে আরো উসকে দেওয়া হয়।”

“তো? উনি কি দুর্গ আক্রমণ করবেন?”

ফ্রেজার কি বলবে ভেবে পেলো না। “আংরিয়া হলো পুরো মালাবার উপকূলের সেরা দস্যু। আর গাই কোর্টনীর হাতে অতো সামরিক শক্তি নেই।”

“তার মানে উনি ওদেরকে ওখানেই পচে মরতে দেবেন? এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন অ্যাগনেস হিকস, গাই কোর্টনীর শ্যালিকা।”

“আমিতো আসলে ওনার ব্যাপার জানি না,” ফ্রেজার টমের চেহারার যন্ত্রণা খেয়লা করলো। “তবে আমি আপনাকে একটা জাহাজে করে বোম্বেতে পৌঁছার ব্যবস্থা করতে পারি। আপনি নিজে গভর্নর কোর্টনীর সাথে আলাপ করবেন নাহয়। যদি উনি আপনাকে মুক্তিপণের টাকাটা না-ও দেন, তাহলে ওখানে বা সুরাটে অনেক সওদাগর পাবেন যারা আপনাকে টাকাটা ধার দেবে।”

“কিসের বিনিময়ে?” হতাশ কণ্ঠে বললো টম। “আমার কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই। আর আপাতত যে হবে সেই সম্ভাবনাও নেই। আমি নিজের জীবন বাজি রেখে কোম্পানির মূল্যবান সম্পত্তি রক্ষা করেছি। আমার পুরষ্কার কি এটাই? আমার স্ত্রী এখন একটা দস্যুর কয়েদখানায় পচে মরবে?”।

ফ্রেজার দুই দিকে হাত ছড়িয়ে বললো, “আমি কিছু করতে পারলে খুশিই হতাম। আপনিতো জানেন-ই যে এই দস্যুগুলোর বিবেক বলে কিছু নেই। এদের কাছে ব্যবসাই মুখ্য, আর বন্দীরা হচ্ছে ওদের ব্যবসার পণ্য। আংরিয়া যে মুক্তিপন চাচ্ছে সেটা জোগাড় করুন, তাহলে ও আপনার সাথে কোনো ঝামেলা করবে না।”

“আর যদি না পারি?”

“তাহলে ও ক্ষতি মেনে নেবে, আর যারা ওর টাকা শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাদের জন্যে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করবে।”

*

মাদ্রাজে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হলো ওদেরকে। প্রতিদিন অ্যানা, টম আর ফ্রান্সিসকে নিয়ে বাজারে গিয়ে অ্যানার পরিচিত ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলতো। সবাই ওদের কথা শুনে দুঃখপ্রকাশ করলো, কিন্তু কারো কাছেই ধার দেওয়ার মতো টাকা ছিলো না।

 “আসলে কিছুই করার নেই,” অ্যানা বললো। “ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কারোই বেচা বিক্রি হবে না।”

অবশেষে ওরা রওনা দিলো। কেপ করমোরিন থেকে শুরু করে মালাবার উপকূল পর্যন্ত বাতাসের অনুকূলে এগিয়ে চললো জাহাজ। সকাল বেলা ডাঙা থেকে ধেয়ে আসতো বাতাস, ফলে সমুদ্রের গভীরে ঢুকে যেতো ওরা। বিকেলের দিকে সমুদ্রের বাতাস জোরালো হয়ে এলে ওরা আবার কূলের কাছাকাছি চলে আসতো।

 ওরা ব্রিঞ্জোয়ান পার হয়ে আসলো। দিগন্তে একটা ফোঁটার মতো দেখা যাচ্ছিলো ওটাকে। সমুদ্রের মাঝ থেকে ওটার ধ্বংসলীলার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। টম ওটাকে দেখতে পেয়ে খুশিই হলো। আরো উত্তরে আগাতেই আনা আঙুল দিয়ে কিডস আইল্যান্ড দেখালো। ওখানে নাকি দস্যু সম্রাট বিলি দ্য কিড একবার জাহাজ ভিড়িয়েছিলো।

 “ওখানে কোনো গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে যাননিতো আবার?” ফ্রান্সিস বললো। “আমাদের খুব কাজে লাগতো এখন।”

পাম গাছের সারি ভরা সৈকত শেষ হয়ে, একটা রুক্ষ, পাথুরে সৈকত শুরু হলো। দিগন্তে ঘন জঙ্গলে ভরা শৈল অন্তরীপ দেখা যেতে লাগলো একের পর এক। ওগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ঘোট ঘোট উপসাগর আর নদীর মোহনা। অনেকগুলোতে দেখা গেলো পাথরের দুর্গ দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোর পাদদেশে মাঝে মাঝে নির্জন ঘাটে একটা দুটো নৌকাও চোখে পড়লো।

“দেশটায় সবসময় যুদ্ধ লেগেই থাকে,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “তিরিশ বছর আগে মারাঠারা মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেদের আলাদা সাম্রাজ্য দাবি করে বসে। কিন্তু এখন ওরা নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ করছে। বুড়ো রানি তার নিজের সৎ ছেলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এই ফাঁকে আংরিয়া নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। দুই পক্ষকেই সমান তাল দিয়ে যাচ্ছে।”

জাহাজটা মূল ভূখণ্ড পেরিয়ে আসতেই নতুন আর একটা শৈল অন্তরীপ চোখে পড়লো। ওটার গোড়ায় সাদা ফেনায় ভরা ঢেউ এসে বাড়ি খাচ্ছে। উপরে কালো পাথরের তৈরি একটা দুর্গ ছোট পাহাড়টার পুরো চূড়াটা দখল করে আছে।

 “ঐতো,” অ্যানা দেখালো। “ওটাই টিরাকোলা। আংরিয়ার আস্তানা।”

টম একটা টেলিস্কোপ দিয়ে দুর্গটার জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো, যদি কোনো একটায় সারাহের মুখ দেখা যায় সেই আশায়। ওর বুকটা হু হু করে উঠলো। এতো কাছে এসেও এতো দূরে থাকার যন্ত্রণা সহ্য হতে চাইলো না। এই ভয়াল দর্শন দেয়ালের ওপারেই সারাহ আর অ্যাগনেস আছে। কি অবস্থায় আছে। তা ঈশ্বরই জানেন শুধু। নিশ্চয়ই ওরা অপেক্ষা করে আছে যে টম কবে এসে ওদেরকে উদ্ধার করবে। একবার মনে হলো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সাঁতরে পাড়ে গিয়ে পাহাড়ের ধারটা বেয়ে দুর্গে গিয়ে ওঠে।

“এটাতো একেবারে দুর্ভেদ্য মনে হচ্ছে,” নিচু কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস।

জাহাজের মাস্টার ওদের পাশে এসে দাঁড়ালো। “দেয়ালগুলো আঠারো ফুট পুরু। এখন পর্যন্ত একমাত্র এবং সর্বশেষ গভর্নর স্যার নিকোলাস ওয়েইট আংরিয়ার বিরুদ্ধে কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। উনি একঝাক বোমারু জাহাজ নিয়ে একটা বহর গঠন করে এখানে নিয়ে আসেন। দেয়ালগুলো অনেক উঁচুতে হওয়ায় জাহাজ থেকে গোলা ছোঁড়া সম্ভব ছিলো না। উনি কামানের নলের ভিতর মর্টার ভরে দেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। পাথরে লেগে ওগুলো ডিমের মতো ফেটে যায়, তাতে পাউডার ঝরে পড়ে ফিউজও নষ্ট হয়ে যায়।”

টম দুর্গ আর ওটার চারিপাশটা ভালো করে দেখে নিলো। প্রতি কোনায় উঁচু মিনার। দেয়ালের নিচের দিকটা শুধু পাথর কেটে বানানো। উপরের গাথুনিও এতো মজবুত যে ইউরোপের কোথাও এরকম দেখেছে কিনা মনে করতে পারলো না। খুব বেশি কামান অবশ্য দেখা গেলো না, তবে তাতে খুব বেশি কিছু আসে যায় না। দুৰ্গটার অবস্থানই ওটাকে অনাক্রম্য করে তুলেছে।

শৈল অন্তরীপটা পেরিয়ে উপকূলটা একটা গভীর উপসাগরে গিয়ে পড়লো। একটা নদী এসে মিশেছে ওখানে। টম গুণে দেখলো ওখানে প্রায় বারোটা জাহাজ নোঙ্গর করা। এর ভিতর কয়েকটা বড় আকারের গ্রাব দেখা গেলো, একেকটা প্রায় যুদ্ধ জাহাজের সমান লম্বা। তিনটা মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি একত্র করে বেঁধে উপসাগরের প্রবেশপথটা আটকে রাখা হয়েছে।

“আরো কয়েকটা পাল তোল,” মাস্টার আদেশ দিলো। দস্যুদের জাহাজের এতোটা কাছে চলে আসায় উদ্বিগ্ন বোধ করছে সে। কিন্তু গাছের গুঁড়িগুলো জায়গাতেই থাকলো আর ওদেরকে কোনো জাহাজ ধাওয়া করলো না। তার মানে আজ আংরিয়ার হাতে অন্য জরুরি কাজ আছে।

দূরে সরে যেতে যেতে টম দুর্গটার দিকে তাকিয়ে রইলো। “আমি আবার ফিরে আসবো,” প্রতিজ্ঞা করলো ও। বাতাস ওর কথাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো সুদূরে।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *