৫. ওয়ার্ম অ্যান্ড স্পঞ্জ

“ওয়ার্ম অ্যান্ড স্পঞ্জ!”

 ক্রিস্টোফার মহলের উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রানির সৈন্যদের কামান দাগানো অনুশীলন করাচ্ছে। এখন আর ওকে সেই হতভাগ্য বন্দীর সাথে মেলানো যাবে না-যে কিনা একমাস আগেও কয়েদখানায় পচে মরার জোগাড় হয়েছিলো। পরিপাটি করে দাড়ি আঁচড়ানো, মাথার চুল পাগড়িতে ঢাকা। পরিষ্কার পোশাক পরনে এখন। তার উপর একটা কোট পরা।

 তামান্নাকে হারানোর ক্ষত এখনো ওর মনে দগদগে ঘা হয়ে আছে, কিন্তু ক্রিস্টোফার কালারিতে থাকতেই নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। তবে এটা ও কোনোদিনও ভুলবে না, ঠিক সময়ে প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। ওর কোমরের কমলা কোমরবন্ধ থেকে একটা বাকানো ছুরি আর ধারালো তরবারি ঝুলছে। রানির সেনাবাহিনিতে ও কতোদূর এসেছে এটা দিয়ে তা বোঝা যাচ্ছে। তবে এক মুহূর্তের জন্যেও নিজেকে নিরাপদ মনে করে না ও। খুব দ্রুতই ধরে ফেলেছে যে দরবারের লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত : একদল হচ্ছে পুলা-র দলে। এরা ইংরেজদের সাথে ব্যবসা করে লাভ করতে চায়। আর এক দলের সর্দার হচ্ছে টুঙ্গার। ও চায় লড়াই করতে। ক্রিস্টোফার বেঁচে আছে শুধু রানির বদৌলতে। রানি ঘুরে ফিরে একদলকে দিয়ে অন্য দলকে খেলিয়ে নেয়, ফলে দুই দলই সামলে থাকে। ক্রিস্টোফার না চাইতেও এই খেলার একটা ঘুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ও ভালোমতোই জানে যে। যখন সময় আসবে তখন সবার আগে ওকেই বলির পাঠা বানানো হবে। আর এই প্রাসাদে শুধুমাত্র ক্রিস্টোফার একাই প্রতিশোধের নেশায় দিন গুনছে না।

 ক্রিস্টোফারের জীবন মরণ এখন নির্ভর করছে রানি ওকে যে দায়িত্ব দেয় সেটা হুবহু পালনের মধ্যে। বোম্বের গভর্নর হিসেবে ওর বাবাও আনুষ্ঠানিকভাবে বোম্বে আর্মির সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। প্রতি রবিবার দুপুরে উনি সমস্ত সৈন্যকে কুঁচকাওয়াজ করাতেন। নানা পদের মহড়া দেওয়াতেন। সত্যিকার সেনা কর্মকর্তারা রোদে ঘামতে ঘামতে তাকে গালাগাল দিতে দিতে আদেশ পালন করতো। ক্রিস্টোফারকেও জোর করে ধরে নিয়ে যেতেন। পরনে থাকতে পুরু একটা সানডে স্যুট, যেটা কিনা ইংল্যান্ডের শীতে ঘরের ভিতর পরা যায় কিন্তু এই ভারতীয় গরমে মোটেও না। কিন্তু এখন ব্যাপারটার জন্যে মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছে ও।

“গোলা ভরো।”

কামানের ক্রু-রা জায়গা মতো দাঁড়িয়ে গেলো। কিন্তু এতো আস্তে যে ওর মনে চাইলে চাবকে সবকটার পাছের চামড়া তুলে দিতে। কিন্তু সেটা পছন্দ করবেন না-অন্তত এখনি না। ক্রিস্টোফারকে তাই গালাগালি চিৎকার করেই মনের ঝাল মেটাতে হচ্ছে। এরা ক্রমাগত প্রতিটা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে, বারুদ ঠাসার কাঠিটা ভুল ভাবে ঠেসে দিয়ে পাউডারের বস্তা খুলে ছড়িয়ে ফেলছে বা গোলাটাই হাত থেকে ফেলে দিচ্ছে।

“ও ঈশ্বর! যদি একজন ইংরেজ এভাবে কামান দাগার চেষ্টা করে তাহলে মুঘল সম্রাটেরাই বরং এখন লন্ডনে গিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকতো। আমি তখন তোদের চাকরের কাজ করতাম আর সকাল বিকাল পাছায় খেতাম।”

বিস্ফোরণের শব্দে ওর আওয়াজ চাপা পড়ে গেলো। কামানের গোলা বিস্ফোরিত হয়েছে। কামানের আশেপাশের লোকেরা সাথে সাথে ছিন্নভিন্ন হয়ে মাংসের স্তূপে পরিণত হলো। আহতদের চিৎকারে কান পাতা দায়। যে সুবলদারটা কার্তুজ ঠাসার কাঠিটা ধরে ছিলো সে শখানেক ফুট দূরে গিয়ে পড়েছে। পেট চেপে ধরে পড়ে আছে সে। হাতের কাঠিটা ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে, এখন খোলা পেট দিয়ে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছে সব।

 “শালা নরকের কীট,” ক্রিস্টোফার মৃতপ্রায় লোকটার উপরেই ঝাড়লো। “তুই নিশ্চয়ই ঠিকমতো কামানটা মুছিসনি।” এই ভেজা স্পর্শের কাজ হচ্ছে একবার গোলা ছোঁড়ার পর যদি ভিতরে কোনো ফুলকি থেকে যায় তাহলে সেটাকে নিভিয়ে ফেলা। এতে করে নতুন করে বারুদ ঠেসে দিলেও আর বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে না।

কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই টুঙ্গার ওর একদল সৈন্য কোথাও থেকে আসছিলো। ও ঘোড়া থেক নেমে ভাঙা কামানটা দেখে তারপর লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে এলো।

“তোর কাজ রানির সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাদেরকে ধ্বংস করা না।

 ক্রিস্টোফার চুপচাপ খোঁচাটা হজম করলো। কামান, চিৎকাররত লোকজন, রানির অসন্তুস্তি-সব বেমালুম ভুলে গিয়ে এক দৃষ্টিতে টুঙ্গার কোমরে বাঁধা তরবারিটার দিকে তাকিয়ে আছে ও। এক অনিন্দ্য তরবারি, হাতলে একটা বড়সড় নীলা পাথর বসানো।

 তরবারিটাকে চেনে ও, বোম্বেতে ওর বাবার অফিসে স্যার ফ্রান্সিসকে ছবিতে বহুবার দেখেছে। ছোট থাকতে ও ছবিটার দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতো। এমনকি হয়তো কোনো জরুরি কাজ পড়ে আছে, তবু দেখা যেতো ও ঘুরে ফিরে এসে ছবিটা দেখছে। দেখতো আর কল্পনা করত এই অনিন্দ্য সুন্দর অস্ত্রটা ওর কোমরে ঝুলছে বা ডান হাতে আঁকড়ে আছে। এভাবে বসে বসে দিবাস্বপ্ন দেখার জন্যে ও গাই-এর হাতে অসংখ্য পিটুনি খেয়েছে। কিন্তু তাতেও দমে যায়নি ক্রিস্টোফার। ওর বাবাকে ক্রুরা বিরক্ত করতেই থাকে। তারপর একদিন ওর বাবা ওকে নেপচুন তরবারিটার কাহিনি খুলে বলে। স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক, চার্লস কোর্টনী–ওর দাদা বা পরদাদাদের নামগুলো শুনলেই ওর ভিতর কেমন একটা সম্ভ্রম ভাব জেগে উঠতে ওর ভিতর।

“তরবারিটা এখন কোথায়?” প্রবল আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে জানতে চেয়েছিলো ক্রিস্টোফার।

 “তোমার টম চাচা ওটা হাই উইল্ড থেকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। উইলিয়ামকে খুন করার কয়েকদিন আগে,” গাই বলেছিলো ওকে। ক্রিস্টোফার তখন ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলো। গাই টম সম্পর্কে একটা কথাও বলত না। আর ভুলেও যদি কখনো তার নাম উচ্চারিত হতো, তাহলে ক্ষেপে যেতো। “যখন ও আফ্রিকায় মারা যায় তখন ওটা ওর সাথেই ছিলো সম্ভবত। এখন হয়তো কোনো দস্যু বা ডাকাতের হাতে পড়েছে।”

ক্রিস্টোফার কল্পনাও করতে পারছে না যে কিভাবে এটা মালাবার উপকূলে এসে পৌঁছেছে; আর কিভাবেই বা টুঙ্গারের মতো শয়তানের হাতে পড়েছে।

টুঙ্গারও ক্রিস্টোফারের হতবাক অবস্থাটা খেয়াল করলো। ও তরবারিটা খাপ থেকে বের করে ডানে বামে বাতাসে কয়েকটা কোপ দিলো। ক্রিস্টোফারের মুখের ঠিক সামনে থেকে বাতাস কেটে সাই করে সরে গেলো চকচকে ফলাটা।

 “কয়েকদিন আগে টুপিওয়ালাদের একটা জাহাজ ডুবি হয়েছে উপকূলে। ওখানকার বেঁচে যাওয়া একজনের কাছ থেকে নিয়েছি এটা।” ক্রিস্টোফার পিঠের পিছনে হাত নিয়ে মুঠি পাকিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে রাখলো। ওর প্রচণ্ডত্ম ইচ্ছে করছিলো তরবারিটী কেড়ে নিয়ে সোজা টুঙ্গারের গলায় ঢুকিয়ে দিতে। তরবারিটা ওর সম্পত্তি। ও হচ্ছে বেঁচে থাকা ভাইদের মধ্যে সবচে বড় জনের বড় ছেলে, কোর্টনীদের উত্তরাধিকারি। এটা এমনিতেই ওর হবে : নইলে ভাগ্যের ফেরে ওর কাছেই বা কেন এটা চলে আসবে। ইতোমধ্যেই ও মনে মনে হিসেব করা শুরু করেছে কিভাবে ও তরবারিটা হস্তগত করতে পারবে। টুঙ্গারকে একা পাওয়াটা শক্ত। কারণ ও লোকজন নিয়ে একটা কুকুরের পালের মতো ঘোরে সবসময়। যেখানে যায় সাথে এরা থাকে। কিন্তু একটা না একটা উপায় বের করতেই হবে।

 “টুপিওয়ালাদের কি করেছো? সবাইকে খুন করে রেখে এসেছেন?” যতোটা পারলো আগ্রহ গোপন করে জানতে চাইলো ক্রিস্টোফার।

“একটা শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। মহামান্য রানি এখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত না।” তারপর টুঙ্গার আহত সৈন্যদের দিকে ইংগিত করে বললো, “আর এভাবে চলতে থাকলে কোনোদিন হবেনও না। তাড়াতাড়ি পরিষ্কার কর সব। নইলে তোকে দিয়েই সব চাটিয়ে পরিষ্কার করাবো।”

*

টুঙ্গার যাওয়া মাত্র ক্রিস্টোফার আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া আনিয়ে সৈকতের দিকে ছুটলো। গ্রামের মাতবর ওকে দেখে ভয় খেয়ে গেলো। অবশ্য স্বীকার করলো যে টুপিওয়ালারা এসেছিলো এখানে। তবে এখন তারা ব্রিঞ্জোয়ানের দুর্গের দিকে চলে গিয়েছে। মাতবর চাচ্ছিলো না যে এইসব বাইরের অপবিত্র লোক তার গ্রামে থাকুক। ওরা যা কিছু ছুঁয়ে দেখেছে তার সবকিছু খুব ভালো মতো ধুয়ে গোবর দিয়ে ঘষে পবিত্র করে নেওয়া হয়েছে।

ক্রিস্টোফার ওখান থেকে চলে এলো। ও জানে যে ওর মহলে ফিরে যাওয়া উচিত, তবে আগে সৈকতটা দেখতে গেলো। ঝড় থেমে গিয়েছে ততোক্ষণে, ডুবে যাওয়া জাহাজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। ওটা মাস্তুলের ভাঙা অংশটা ঢেউয়ের তালে ডুবছে আর ভাসছে। আর সাগরও এতো পরিষ্কার ছিলো যে ওটার কালো রঙের খোলটাও পানির ভিতর দিয়ে বোঝা যাচ্ছিলো। ইন্ডিয়াম্যান না জাহাজটা। ও বোম্বেতে ইন্ডিয়াম্যান এতো এতো দেখেছে যে দেখা মাত্র এধরনের জাহাজ চিনতে পারে। কোনো আরব দস্যুদের জাহাজও না-এটা একটা ইউরোপিয়ান জাহাজ। কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন জাহাজ ছিলো সম্ভবত, আরো ভালো করে বললে একজন ইন্টারলোপারের জাহাজ।

ওর মনে অনেকগুলো সম্ভাবনা এসে ভীড় করলো। যদি এটা ইংল্যান্ড থেকে এসে থাকে তাহলে নিশ্চিত কেপ টাউনে থেমেছিলো। সম্ভবত তরবারিটা তখনই জাহাজের কেউ কিনেছে। হয়তো এরা আফ্রিকার উপকূলের সব গোত্রে মালপত্র কেনাবেচা করে কেপটাউন থেকে এই দুর্ভাগ্যের যাত্রা শুরু করেছিলো। তরবারিটার দাম কত ছিলো? নাকি বাজি ধরে জিতেছে? কে জানে কাউকে খুন করে ছিনিয়ে নিয়েছে কিনা।

এসব কোনো ব্যাপার না। উত্তরাধিকার সূত্রেই নেপচুন তরবারিটা ওর। আর সমুদ্রই ওটা ওর কাছে এনে দিয়েছে। এখন ওর কাজ হচ্ছে টুঙ্গারকে শেষ করে তরবারিটা কেড়ে নেওয়া। আর কালারিতে প্রশিক্ষণ নেওয়া একজন লোকের কাছে সেটা পানিভাতের মতোই।

এরপরেও ও জাহাজটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঝড় ওটাকে পাড়ের কাছেই এনে ফেলেছে। এতো কাছে যে ওর মনে হলো ও হেঁটেই ওটার কাছে চলে যেতে পারবে। ওটার উপর ঢেউ এসে পড়ছে, আর ওটার ভাঙ্গা তক্তাগুলো দোলনার মতো দুলছে।

চোখের উপর হাত চাপা দিয়ে দেখতে লাগলো ক্রিস্টোফার। ঢেউ সরে যেতেই জাহাজের পাশ দিয়ে একটা লম্বা সরু জিনিস বের হয়ে থাকতে দেখা গেলো।

ওটা কি একটা কামান নাকি! নিজের সৌভাগ্যে নিজেই অবাক হয়ে গেলো ও জাহাজটায় কামান ছিলো। তার মানে নিশ্চয়ই আরো কামান আছে। সম্ভবত এখনো জাহাজে আটকে আছে, নইলে পড়ে আছে আশেপাশেই। একটা লম্বা দড়ি আর টানতে পারে এমন কিছু জানোয়ার পেলেই তুলে আনা যাবে।

ও ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো সবকিছু। কামানগুলো উদ্ধারের সমস্যা আর সম্ভাবনাগুলো যাচাই করে দেখছে। সবশেষে কাঁঠাল গাছে বাঁধা ওর ঘোড়াটার কাছে এগিয়ে লাফ দিয়ে উঠে মহলের দিকে ছুটলো।

অনুমতি ছাড়া মহলের বাইরে আসায় টুঙ্গার নিশ্চিত ওকে শাস্তি দিতে চাইবে, কিন্তু ক্রিস্টোফার কি পেয়েছে সেটা জানা মাত্রই পরিস্থিতি ঘুরে যাবে নিশ্চিত। ওর বিশ্বস্ততা নিয়ে তখন আর কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না।

*

তিন দিন পর, ক্রিস্টোফার আবারও একই সৈকতে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকতের যেদিক দিয়ে কামানের নলটা টেনে নেওয়া হয়েছে সেদিকে বালিতে গভীর গর্ত হয়ে গিয়েছে। ভালোই কাজ হয়েছে আজ, রানি খুব খুশি হবেন। কিন্তু কেন যেনো ওর মনটা খচখচ করছে।

আবারও দূর দিয়ে ভেসে যাওয়া নৌকাটার দিকে তাকালো ও। আজ প্রায় সারাদিনই ওটাকে দেখা গিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে চলেছে। কাছে আসার কোনো চেষ্টাই করছে না। সম্ভবত জেলে নৌকা। কিন্তু তবুও কেনো যেনো কেমন কেমন লাগছে ওর। কেন যেনো মনে হচ্ছে কেউ ওর উপর নজর রাখছে। ঝড়ের আগে যেরকম বাতাসে স্থির বিদ্যুতের আভাস পাওয়া যায়, সেরকম লাগছে ওর কাছে।

খামাখা ভাবছি আমি, নিজেকে বললো ও। কামানগুলো রানির কাছে নিয়ে যাওয়ার পর রানি নিশ্চয়ই ওকে পুরষ্কার দিতে চাইবেন। এমনকি ওকে টুঙ্গার এর উপরেও পদোন্নতি দিয়ে দিতে পারেন।

*

ধ্বংসাবশেষের কাছ থেকে ঘুরে চলে আসার পরদিন থেকে আবার ঝড় শুরু হলো। পুরো এক সপ্তাহ থাকলো এবার। টম আর বাকিরা অ্যাগনেসের বাংলোতেই থাকলো। বসে বসে ভাবনা চিন্তা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই ওদের। সারাহের জ্বর কমেছে খানিকটা; যদিও এখনো অনেক দুর্বল, আর যথেষ্ট পীড়াপাড়ি করে খাবার খাওয়াতে হয়। ব্রিঞ্জোয়ানে কোনো ডাক্তার নেই, তাই অ্যানা আর অ্যাগনেসই যতোটা পারে ওর যত্ন নিচ্ছে।

টম বেশিরভাগ সময়েই জানালার ধারে বসে বসে বৃষ্টি দেখে কাটিয়ে দিলো। বসে বসে হয় সারাহের কথা ভাবে, নয়তো নেপচুন তরবারিটার কথা ভাবে।

তবে এখন লরেন্স ফয়-এর ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বাঁচতে পারছে ও। গভর্নর এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত রানির দরবারে দেখা করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। নিজের ইশতেহার আর বক্তৃতাটা বার বার ঘষে মেজে ঠিকঠাক করছে। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে দিনের পর দিন ওকে দেরি করতে হলো।

“আমার স্বামী রানির সামনে একটা ভেজা কাকের মতো তো আর গিয়ে দাঁড়াতে পারে না, তাই না?” ফয়-এর স্ত্রী ঘোষণা দিলো। সে একবার বেড়াতে এসেছিলো এই বাড়িতে। ভাব দেখাচ্ছিলো যে সারাহকে দেখতে এসেছে, কিন্তু টমের ধারণা আসলে এসেছিলো ওরা এখন কি করবে না করবে সেসব খোঁজ করতে। “মহিলা কিন্তু নিজের স্বামীর ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর,” অ্যাগনেস আগেই বলে রেখেছিলো টমকে। “আর ওনার ধারণা তুমি ওনার ক্ষতির কারণ হতে পারো।”

টম মহিলাকে আশ্বস্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করলো। ওরা যে যতো দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে যেতে উদগ্রীব সেটা জানালো। মহিলা যাতে ওর সম্পর্কে খুব বেশি প্রশ্ন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখলো। কিন্তু তবুও দেখা গেলো ওর উত্তরে মহিলা সম্ভষ্ট হচ্ছে না। বেশ কয়েকবার টম খেয়াল করলো মহিলা তার পাখির মতো চোখগুলো দিয়ে ওকে খেয়াল করছে আর নাক সিটকে এমন ভাব করছে যেনো সে টমের কাজে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। মহিলা এক আজব চিড়িয়াঃ স্বামীর চাইতে বিশ বছরের ছোট, মাত্র সতেরো বছর বয়স। কিন্তু চলাফেরা এমন যা তার চাইতে তিনগুণ বেশি বয়সী মহিলার মাঝেও দেখা যায় না।

“মেয়েটা এর মধ্যেই একবার বিধাব হয়েছে, চুপিচুপি বলেছে অ্যাগনেস। “ভারতে এসেছিলো ওর বাবার সাথে। কিন্তু জাহাজ থেকে নামতে না নামতেই তেল্লিচেরির প্রধান গোমস্তার সাথে বাগদান হয়ে যায়। ব্যাটা ছিলো ইয়া ভুড়িওয়ালা এক বুড়ো। নাম কুপার। আস্ত খাটাস একটা লোক। যখন প্রথম বোম্বে আসে তখন ডিনারের টেবিলের নিচ দিয়ে মহিলাদের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতো। আর মেয়েটার বয়স তখন পনেরও হয়নি। কুপার এক বছরের মাঝে মারা পড়ে। তার সব সম্পত্তির মালিক হয় মেয়েটা। সেটা যৌতুক দিয়েই মিস্টার ফয়কে বিয়ে করেছে সে।”

 এখন টম অ্যাগনেসের বসার ঘরে বসে আছে আর চেষ্টা করছে সবার সাথে তাল মেলাতে। ওর অবশ্য বেশি কিছু বলারও নেই। মিসেস ফয়-এর মাথায় হাজার হাজার বুদ্ধি। সে গড়গড় করে সব বলে গেলো; নিজের ব্যক্তিত্ব বা অন্য কোনো গুণ দিয়ে না, বরং বলা যায় জবরদস্তি করেই সে সবার উপর প্রভাব বিস্তারের আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো। মেয়েটা খুব বেশি সুন্দর না। নাক চোখা, চোখা ড্যাবড্যাবে, মুখের কাটাও বেশি বড় গায়ে মাংস নেই কিন্তু স্তনের আকার বড় হওয়ায় গায়ের পোশাকটা ঠিকমতো আঁটেনি। কিন্তু তবুও এক অফুরন্ত শক্তির বলে সে ঘরের সমস্ত মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নিলো। টম দেখলো ফ্রান্সিস হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অ্যানা চুপিসারে কনুই দিয়ে গুতো দেওয়ার পড়ে চোখ নামিয়ে নিলো।

 “একবার আমার স্বামী এই হামবড়া কালা রানিটার সাথে সব ঠিকঠাক করে ফেলতে পারলেই আমি নিশ্চিত, গভর্নর কোর্টনী ওকে ভালো পুরস্কার দেবেন। আরো ভালো কোথাও পাঠাবেন,” একটা কাগজের পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললো মিসেস ফয়। “মাদ্রাজ বা ফোর্ট উইলিয়ামেও পাঠাতে পারেন।”

“কিন্তু মহলেই তো যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না,” ফয় বললো।

মিসেস ফয়ের চোখ ছোট ছোট হয়ে গেলো। “আশা করি কাল আবহাওয়ার উন্নতি হবে।”

*

সেটাই হলো। পরের সকালে উত্তাপ ছড়াতে ছড়াতে উদয় হলো সূর্য। যদিও মেঘ আছে আকাশে। উত্তাপে আরো বড় হচ্ছে আকারে, পুরো দুনিয়াই মনে হতে লাগলো জলীয় বাষ্পে উত্তপ্ত হয়ে আছে। বিছানা থেকে মাথা তুলতে না তুলতেই টমের সারা শরীর পাতলা ঘামের আস্তরণে ঢেকে গেলো। প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে গায়ে কোট চাপালো ও। কোটটা ক্যাপ্টেন হিকসের, অ্যাগনেস ওকে দিয়েছে। ফয় আদেশ জারি করেছে যেনো প্রতিটা লোককে একদম পরিপাটি দেখায়।

দুর্গের বাইরের বালুকাময় জায়গাটায় গিয়ে জড়ো হলো ওরা। ফয় প্রত্যেক সমর্থ পুরুষকে সাথে নিয়ে এসেছে। যাতে রানি ওকে দেখে সমীহ করে। এক কোম্পানি সৈন্যও আছে সাথে। আয়নার মতো চকচক করছে ওদের বুট। কোম্পানির মুনশি আর ব্যাপারীরা পরেছে নীল পোশাক; আরও আছে একগাদা বেয়ারা আর চাকর। চাকরদের হাতে রানির জন্যে উপহার সামগ্রী। বাকিরা সবাই এসেছে শুধুমাত্র ফয়ের ক্ষমতা দেখানোর অংশ হিসেবে।

 যারা সাথে গেলো না তারা পাশেই দাঁড়িয়ে বিদায় দিলো ওদের কয়েকজন বৃদ্ধ লোক আর ছোট বাচ্চা, কেস্ট্রেল-এর নাবিকেরা আর মহিলারা।

*

ফয় দাঁড়িয়ে আছে সারির একদম সবার সামনে। একটা মেরুন রঙের কোট, লম্বা কোকড়ানো পরচুলা, উটপাখির পালক বসানো টুপি আর সোনার আঙটা বসানো জুতো পরে একবারে ফুলবাবু সেজে আছে। মনে হচ্ছে কূটনীতিতে না পারলেও, ওর পোশাকই রানির উপর ভালোই প্রভাব ফেলবে। চেহারা গরমে একেবারে টকটকে লাল হয়ে আছে। কোটের কাঁধের দিকটা ঘামে প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে গিয়েছে এরমধ্যেই। রানির মহল ওখান থেকে ছয় মাইল। টম ভাবতে লাগলো ফয় ততোক্ষণ টিকবে কিনা।

“ওনাকে খুবই ভালো লাগছে, তাই না?” অ্যানাকে বললো টম। ও ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।

 “একেবারে ময়ূর পক্ষী, মুচকি হেসে বললো অ্যানা। “সাথে ঘিলুও সেই পরিমাণ। রানির কথা এ বুঝবে কিনা সেটাই সন্দেহ আমার।”

“তুমি কিন্তু দোভাষীর কাজ করতে পারো।” বলে টম এগিয়ে গিয়ে ফয়কে কথাটা বললো। শুনে ফয় হতভম্ব হয়ে গেলো।

“আপনার মাথা খারাপ? এসব কোনো হালকা বিষয় না-পুরো কোম্পানির ব্যবসা নির্ভর করছে এর উপর। একজন মহিলার মাধ্যমে সেটা চালানো সম্ভব না।” মহিলা শব্দটায় ফয় বিশেষ জোর দিলো। “আমার সম্মানহানি হবে তাতে।”

 “আমার মনে হয় না রানি এই কথার সাথে একমত হবে,” টমের কানে কানে বললো ফ্রান্সিস।

টম দেখলো অ্যানা আরো একবার যাওয়ার জন্যে জেদ করতে যাচ্ছে। ও ওকে হটিয়ে দিলো।

“তুমি এখানেই থাকো। সারাহকে দেখাশোনা করতে হবে। আমাদের যদি কিছু হয় তাহলে ওর যত্ন নেওয়ার জন্যে তোমাকে থাকতে হবে।”

অ্যানার রাগ মুহূর্তে উদ্বেগে রূপান্তরিত হলো। “আপনাদের বিপদ হতে পারে?”

 “রানির কর্মচারীরা কেমন আচরণ করে তা তো দেখেছোই।”

“তাহলে আপনার যাওয়ার দরকার নেই,” মিনতি করলো অ্যানা। “ফ্রান্সিসও থাক। মিস্টার ফয়-এর ব্যাপার স্যাপারে আপনারা না গেলেও হবে।”

“না, যাওয়া লাগবে। বদমাইশ টুঙ্গারের কাছ থেকে তরবারিটা ফেরত আনতে হবে। এটাই সবচে ভালো সুযোগ। আর ফ্রান্সিস চাইলে থেকে যেতে পারে। কিন্তু ওর যা বয়স তাতে বিপদের কথায় ও আরো নেচে উঠবে যাওয়ার জন্যে। আমি তাই পারলেও ওকে বারণ করবো না। তবে আলফ উইলসন আর বাকিরা আছে তোমাদেরকে রক্ষা করার জন্যে।”

 ওরা ফয়-এর পিছু পিছু রওনা দিলো। টম হাটছে ক্যাপ্টেন হিকসের পাশে। উনিই সৈন্যদলের দায়িত্বে আছেন। টম খেয়াল করলো ফয় এমনকি একজন প্রহরীও রেখে যায়নি দুর্গে। একটা অমঙ্গলের চিন্তা ওর মনে খেলে গেলো। ওর কি আসলেই সারাহ, অ্যানা আর অ্যাগনেসকে এভাবে অরক্ষিত রেখে চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে?

নেপচুন তরবারি, নিজেকে মনে করিয়ে দিলো।

মানুষের সারিটা আস্তে আস্তে সামনে আগাতে লাগলো। কমপক্ষে একশো লোক যাচ্ছে একসাথে। বৃষ্টির কারণে সব রাস্তাঘাট একেকটা ছোটোখাটো জলায় পরিণত হয়েছে। একটু পরেই দেখা গেলো কাদার প্রলেপ পড়ে যায় এর সোনার আঙটার জুতো আর চেনা যাচ্ছে না। আর সিপাহিদের উর্দির প্রায় কোমর পর্যন্ত কাদার ছিটেয় ভরে গিয়েছে। এক ঘণ্টা পরে দেখা গেলো ওরা মাত্র এক মাইল পার হয়েছে।

 টম স্থানীয় কুলিদের মাথার বস্তা আর ব্যাগগুলোর দিখে খেয়াল করলো। “ফয় কার বুদ্ধিতে রানির জন্যে এতো দিলখোলা আচরণ করছে? ওনার স্বভাবতো এরকম না।”

হিকস হেসে দিলো। “ফয় দরকার ছাড়া নিজের এক ফোঁটা প্রস্রাবও খরচ করবে না। ওগুলো হচ্ছে পাউডার আর গুলির বস্তা।”

“সৈন্যরা নিজেরা নিজেদেরটা নেয় না?”

“মিস্টার ফয় আমাদের স্থানীয় সৈন্যদেরকে বিশ্বাস করেন না। ওনার দুশ্চিন্তা যে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে না আবার লেগে যায়। রাস্তার একটা নুড়ি পাথরে লাথি দিলো হিকস। “শালা খালি গায়ের চামড়ার রঙ দেখে, বিশ্বস্ততা দেখে না।”

 টমের মনের দুশ্চিন্তা আরো বাড়লো। নিজের পিস্তলের ঘোড়া ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলো ও হিকসের কাছ থেকে ধার নিয়েছে এটা। একটা ছুরি আর একটা কাজ চালানোর মতো সেনাবাহিনির কোমরবন্ধনীও দিয়েছে। ওটা পরার পর থেকে নেপচুন তরবারিটার জন্যে আরো বেশি চুলকনি উঠে গিয়েছে ওর।

ওরা কষ্টে সৃষ্টে এগিয়ে চললো। পুরো দেশটা মনে হচ্ছে পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। টমের মনে হলো নূহের নৌকার অধিবাসীরা নৌকা থেকে নেমে আসার পর, তাদের কাছে সম্ভবত পুরো দুনিয়াটা এরকম লেগেছিলো। গাছপালা ঘাড় ভেঙে পড়ে আছে, রাস্তা ভরে গর্ত। আর গাছের ফাঁক দিয়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসা পানি এদিকে সেদিকে নালা সৃষ্টি করে ধাঁধার মতো ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই অনন্ত পানির মধ্যে চলতে চলতেও ওদের সবচে বড় কষ্টের নাম হচ্ছে তৃষ্ণা। কাদা ভাঙতে ভাঙতে ওদের উলের কোট আর টুপির ওজন আস্তে আস্তে বেড়েই চলেছে বলে মনে হতে লাগলো। এতো গরম যে মনে হচ্ছে ওরা কোন যুদ্ধক্ষেত্রে কামান ছুড়ছে। টমের মনে হচ্ছে যেনো ওর শরীরের সমস্ত তরল পদার্থ নিংড়ে ওর কাপড়ের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে।

 “সামনের বাকটা পার হলেই একটা কুয়ো আছে,” হিকস বললো। “ওখানে পানি খেয়ে নেওয়া যাবে।”

টম মনোযোগ সরাতে রাস্তার দু’ধারের দৃশ্য দেখায় মন দিলো। ও আফ্রিকার বনভূমিতে প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ আলাদা। এতো এতো অদ্ভুত সব গাছ আর ফুল ফুটে আছে চারপাশে যেগুলো ও জীবনেও দেখেনি। চোখা মাথার পাইন গাছ, এক পা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আতা, পেয়ারা, পেপে গাছ; জামপাতার মতো দেখতে পাতাওয়ালা একটা ঝোঁপ গাছ, উজ্জ্বল বেগুনি ফুল ফুটে আছে তাতে।

“এতো দেখি স্বর্গের বাগান,” ফ্রান্সিস বিস্মিত কণ্ঠে বললো।

“দুই সপ্তাহ আগেও ছিলো খরায় পোড়া, হিকস বললো। “নদীগুলো ছিলো নালার মতো সরু, গাছগুলো সব অর্ধেক মরে ছিলো। বৃষ্টি হওয়ার পর এক রাতের মাঝেই পুরো পাল্টে গিয়েছে।”

কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে এলো ওরা। জাহাজডুবির পর যেরকম গ্রামে গিয়েছিলো, এগুলোও সেরকমই। তাল পাতায় ছাওয়া ঘর সব, বাঁশের মাচায় মাছ ধরার জাল শুকোচ্ছে। নদী থেক ছোট ছোট নালা বেরিয়ে এখানে সেখানে পুকুর তৈরি করেছে, সেগুলোতে বাদামী রঙের শাঁসালো জিনিস দিয়ে ভরা। হিকস জানালো যে এগুলোতা নারিকেলের ছোবড়া জাগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে ছোবড়া কয়েক মাস পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়, তারপর নরম হলে সেগুলো দিয়ে সুতা বানানো হয়। সেটা দিয়েই পরবর্তীতে তৈরি হয় জাহাজের কাছি। কয়েক জায়গায় টম দেখলো মহিলারা ছোট লাঠি দিয়ে ছোবড়াগুলো পিটাচ্ছে।

 বড় হোক আর বাচ্চা হোক, ওদেরকে দেখামাত্র সবাই কাজ ফেলে রেখে ছুটে এসে জুলজুল করে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু টমের কেনো যেনো মনে হলো এদের এই অবার দৃষ্টির পেছনে শুধু কৌতূহল না, আরো কিছু আছে। গ্রাম ছাড়িয়ে বহুদূর চলে আসার পরেও ও ঝোঁপঝাড়ে নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো, কয়েকবার দেখলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কালো রঙের কিছু অবয়ব ওদের আগে আগে দৌড়ে যাচ্ছে। ও জীবনে যথেষ্ট বিপদ মোকাবেলা করেছে, নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উপর তাই ওর যথেষ্ট আস্থা। নিজেকে এখন ফাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়া পশুর মতো মনে হচ্ছে ওর।

ওরা একটা চৌরাস্তা পেরিয়ে এসে দেখে একটা খাড়ির উপর কাঠ দিয়ে একটা সাঁকো বানানো। পাশেই বানর দেবতা হনুমানের একটা মন্দির। মন্দিরের চারপাশে হলুদ রঙের জংলী ফুল ফুটে আছে। তার পাশেই একটা কুয়ো।

 ফয় সবাইকে থামতে বলে দৌড়ে গেলো কুয়োর দিকে। কিন্তু ভেতরে তাকিয়েই আর্তনাদ করে উঠলো।

“শুকিয়ে গিয়েছে।”

টম ওর কাছে এগিয়ে নিচে তাকালো। পাথর আর নুড়ি ফেলে রাখা হয়েছে ভেতরে। কিন্তু ওটা এতোই গভীর যে এই ভয়ানক বৃষ্টিপাতের পরেও পানি উপরে ওঠেনি।

“ব্যাপার না,” খিটিমিট করে বললো ফয়। গরমে ওর চেহারার লাল রঙ সরে এখন সাদাটে হওয়া শুরু করেছে। আমরা মহলে পৌঁছালেই রানি আমাদেরকে আপ্যায়ন করবেন।”

টম ওর কাছে এসে অন্য কেউ যাতে শুনতে না পায় এমনভাবে বললো, “আমার কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। কেউ ইচ্ছে করে কুয়োটা বন্ধ করে রেখেছে। ওরা ভালোমতোই জানে গরমের আমাদের অবস্থা কেমন হয়। ওরা চায় আমরা যাতে মহলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ি। আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।”

 “ফিরে যাবো?” প্রায় চিৎকার করে উঠলো ফয়। “পাগল নাকি? আমাদের সাথে প্রায় একশো শোক আছে। রানি আর ওর অশিক্ষিত লোকগুলো আমাদের কি-ইবা এমন করতে পারবে? বিপদের আঁচ পেলেই পালিয়ে যাওয়া একজন ইন্টারলেপারের স্বভাব হতে পারে, কিন্তু কোম্পানির কাজ করে যেসব লোক তাদের সাহস অন্যরকম।”

ফয়কে কুয়োর ভেতর ফেলে দিলে ঠিক কি কি হতে পারে সেটা নিয়ে টম এক মুহূর্ত ভাবলো। শেষে কি ভেবে বাদ দিলো চিন্তাটা। ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় ওকে বলছে ফিরে যেতে। কিন্তু তরবারিটা যেনো সাইরেনের (পৌরাণিক দানব, যারা গান গেয়ে নাবিকদের পথভ্রষ্ট করতো) মতো করে ওকে সামনের দিকে ডাকছে।

রাস্তাটা এরপর একটা লাল পাহাড়ে উঠে গিয়েছে। পশ্চিম ঘাটের প্রথম পাহাড় এটা। ওটার ঢাল ধান ক্ষেত আর নারিকেল গাছ দিয়ে ভরা। সামনেই গাছে ভরা পর্বতগাত্রের মাঝে একটা উপত্যকা মতো জায়গায় মহলটা সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

দুর্গ ছেড়ে আসার পর এটাই প্রথম পাথরের বাড়ি চোখে পড়লো টমের। মানে অন্তত এটার কিছুটা অংশ হলেও পাথরের। পুরো প্রাসাদটা আসলে গত এক যুগ ধরে এলোমেলো ভাবে বানানো অনেকগুলো ভবনের সমাহার। সুন্দর একটা বাগানের মাঝে আগাছার মতো। যখন যে-ই এই মহলে থেকেছে তার ইচ্ছে মতো যেদিকে খুশি নতুন নতুন চত্বর বা ভবন বানানো হয়েছে। বাইরে একটা লম্বা কাঠের দেয়াল। রানি আর তার প্রজাদেরকে আলাদা করেছে ওটা।

 ফয় লোকের সারিটাকে নিয়ে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এক ডজন প্রহরী কুঁচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। পরনে মোটা কাপড়ের উর্দি। তার উপরে লম্বা সাদা কোটি, আর কোমরে কমলা কোমরবন্ধ। সবার পরনে রুপালি শিরস্ত্রাণ। সেগুলো নাক ছাড়িয়ে চেহারার এতো নিচে নেমে এসেছে যে সৈনিকদের আর চেনা যাচ্ছে না। হাতের বন্দুকগুলো খাড়া করে দুই ফাইলে এগিয়ে এলো ওরা। একজন লোক দুই ফাইলের মাঝে এগিয়ে আসছে।

তাকে দেখে শক্ত হয়ে গেলো টম। হাত আপনাআপনি চলে গেলো কোমরের পিস্তলে। লোকটা টুঙ্গার। নিজের সৈনিকের পোশাক ছেড়ে আজ পরেছে রেশমি কাপড়ের জোব্বা। পাড়ে নকশা করা। শিরস্ত্রাণের জায়গায় পরেছে পাগড়ি। কিন্তু তাতেও ওর ফাটা চেহারার শয়তানি একটুও কমেনি।

হিকস টমের হাতের উপর হাত রাখলো। “এখন না,” ফিসফিস করে বললো ও।

টুঙ্গার ওদেরকে মালায়ালাম ভাষায় স্বাগত জানালো। অতিরিক্ত বিনয়ে গলে হাসছে হে হে করে। তাতে ওর কালচে দাঁতই দেখা হলো শুধু। একজন কমবয়সী ভারতীয় ছেলে সামনে এগিয়ে এসে দোভাষীর কাজ করতে লাগলো।

“উনি বলছেন রানির শরীর খারাপ। গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন। আপনারা অপেক্ষা করুন।”

“শুনুন,” কপালের গাম মুছতে মুছতে কড়া গলায় বললো ফয়। “আমরা অনেক দূর থেকে নানা জিনিসপত্র উপহার নিয়ে এসেছি আপনাদের ঐ উঁইফোড় রানির জন্যে। আমরা এভাবে বাইরে অপেক্ষা করতে পারবো না।”

তোষামদের ভঙ্গিতে টুঙ্গারের হাসি আরো চওড়া হলো। তারপর বললো কিছু একটা।

“অপেক্ষা করুন, দোভাষী বললো।

 “রাখ তোর অপেক্ষা। আমি-”

টুঙ্গার ঘুরে অলস পায়ে ফিরে যেতে লাগলো। ফয় পিছু পিছু যেতে গেলে কিন্তু রানির প্রহরীরা সামনে এগিয়ে এসে ওর পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হলো সদর দরজা।

“আমরা তাহলে এখন কি করবো?” জানতে চাইলো ফয়।

 “অপেক্ষা করুন,” আবার বললো দোভাষী।

*

ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতে লাগলো। এই তীব্র গরমের মধ্যেও সবাইকে সাবধান অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখলো ফয়। যখন হিকস পরামর্শ দিলো সবাইকে বিশ্রাম নিতে দেওয়ার জন্যে, ফয় প্রচণ্ড রেগেমেগে ওকে তাড়িয়ে দিলো। “রানির সামনে আমাকে অপদস্থ করতে চান? আমি নিশ্চিত যে কোনো মুহূর্তে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হবে।”

কিন্তু দরজা বন্ধই থাকলো।

টমের মনে হলো ওর গালের ভিতর ওটা জিহ্বা না, ইটের টুকরো। যাত্রাটা বেশি দূর হবে না মনে করে ওরা সাথে করে খাবার পানি কিছুই আনননি। বিকেল গড়িয়ে গেলে ক্ষুধায় সবার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হলো। কুলিদের মধ্যে এগারো বারো বছরের এক হ্যাংলা ছেলে ছিলো, অজ্ঞান হয়ে পড়েই গেলো সে। ওর বন্ধুরা ওকে তুলতে গেলো কিন্তু ফয় আদেশ দিলো ও যেখানে আছে সেখানেই যেনো পড়ে থাকে।

নেপচুন তরবারির ব্যাপারটা না থাকলে টম বহু আগেই ফ্রান্সিসকে সাথে নিয়ে কুঠিতে ফিরে যেতো। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়ার মতো দিনের আলো অবশিষ্ট আছে কিনা এ ব্যাপারে ও সন্দিহান।

“রানির সাথে দেখা হওয়ার পর আমার তরবারিটার খোঁজ করতে ভুলবেন না,” ফয়কে মনে করিয়ে দিলো টম।

 ফয় অবজ্ঞা মিশ্রিত একটা হাসি দিলো। কিন্তু ওর গলা এতোটা শুকিয়ে আছে যে শুনে মনে হলো, ভেতর ব্যাঙ ঢুকেছে। “আমরা এসেছি কূটনৈতিক কাজে। আপনার ঐ তুচ্ছ খেলনার জন্যে পুরো প্রদেশে ব্যবসার সম্ভাবনার ঝুঁকি নিতে পারবো না।”

টম কিছু বলার আগেই দরজা খুলে গেলো। আবারও হাজির হলো টুঙ্গার। আবারও বেরিয়ে এলো ওর কালো দাঁতের সারি।

“রানি আপনাদের সাথে দেখে করতে সম্মত হয়েছেন।”

“দেখেছেন,” ফয় বললো। “বলেছিলাম না যে সব ঠিকই হবে।”

টুঙ্গারের সৈন্যরা পথে দেখিয়ে ওদেরকে ভিতরে নিয়ে গেলো। দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রথমে পড়লো একটা চত্বর। সেটা পেরিয়ে আর একটা নিচু খিলানে ঢাকা পথে আগালো ওরা। টম ইতস্তত করতে লাগলো। সবকিছুই কেমন গোলমেলে ঠেকছে। কিন্তু ফ্রান্সিস আর হিকস এর মধ্যেই ঢুকে পড়েছে। আর পিছনের সিপাহীর দলও ঠেলা দিচ্ছে আগাতে। আর উপায় না দেখে সামনেই বাড়লো ও।

চত্বরটা পেরিয়ে আসতেই পিছনে সদর দরজার কাছে একটা সংঘর্ষের আওয়াজ পেলো টম। দেখা গেলো যে সব কয়জন চাকরকে না ঢুকিয়েই সদর দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মাথা উঁচিয়ে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করলো টম। কিন্তু লোকজনের চাপে খিলানের ভিতরে ঢুকে পড়লো।

 সামনে আর একটা চতুর। অনেকগুলো বাঁকানো তোরণ দেখা গেলো সেখানে। বেশিরভাগ তোরণই নারিকেলের ছোবড়ার পাটি দিয়ে ঢাকা, ফলে ওগুলোর ভিতরে কি আছে তা দেখার উপয়া নেই। লম্বা লম্বা বর্শা হাতে প্রহরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। সামনের উঁচু দেয়ালগুলোর গায়ে গাছপালা আর পশুপাখির নকশা কাটা। জানালা ঢেকে রাখা জালিগুলোর পেছনে নাড়াচাড়া দেখা গেলো। কিন্তু টম সেগুলোকে ঠিকমতো দেখার সুযোগ পেলো না।

ঠিক ওর উল্টোদিকে, দ্বিতীয় তলা থেকে একটা ব্যালকনি চতুরের উপর বেরিয়ে এসেছে। মহলের দরজায় আরো ছয়জন প্রহরী দাঁড়ানো। এদের শিরস্ত্রাণ সোনা দিয়ে বাধাই করা, হাতে পিতলের বন্দুক। কাছে যেতেই ওরা দরজাটা খুলে ধরলো।

 চত্বরে সব লোক আটছিলো না। যেসব কুলিরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলো, ওরা ফয়-এর পাশে ওদের পিঠের মালপত্র নামিয়ে রাখতে হিমশিম খেয়ে গেলো। টম ভীড়ের ভিতরে টুঙ্গারকে খুঁজলো, কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না।

ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো। দোভাষীটা ফিরে এলো আবার।

“টুঙ্গার বলেছেন যখন রানি আসবে, তখন যেনো আপনার লোকেরা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে সম্ভাষণ জানায়।”

“অবশ্যই,” বলে ও ছেলেটাকে বিদায় জানালো ফয়। “ব্যাটা কি মনে করে যে আমি আদব কায়দা কিছুই জানি না? এসব কালাগুলো একটু শব্দ টক শুনলেই গলে যায়।”

টম গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর ভিতর দিয়ে কসরত করে এগিয়ে চত্বরটার এক পাশে চলে এলো। তোরণগুলোকে ঢকে রাখা পাটিগুলো দেখে ওর মনটা খচখচ করছে। তোরণের খুটির গায়ে হেলান দিয়ে পাটিটার কোনা ধরে সামান্য সরিয়ে ভিতর উঁকি দিলো ও। ভিতরের আবছায়ার ভিতর অনেক লোকজন আর সৈন্য দেখা গেলো। ধীরে ধীরে জ্বলে এমন একটা বাতি জ্বালা ভেতরে। আর লোকগুলোর মাঝে বড়সড় কিছু একটা তেরপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।

একটা শক্ত হাত ওর কাধ চেপে ওখান থেকে সরিয়ে দিলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখে একজন প্রহরী চোখ গরম করে তাকিয়ে মাথা নাড়ছে ওর দিকে। সে ব্যালকনির দিকে দেখালো, দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে সেদিকে। তারপর নিজের ঠোঁটের উপর একটা আঙুল রেখে চুপ করে থাকার ইশারা করলো।

টম ঝাড়ি মেরে প্রহরীর হাত ছুটিয়ে দিলো। ওকে ফয়কে সাবধান করতে হবে যে রানির লোকজন নিশ্চিত কোনো কুমতলব আটছে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে রানি নিজে ব্যালকনিতে এসে উপস্থিত হলেন। পরনে মূল্যবান সব পাথর খচিত পাটের তৈরি মিহি কাপড়। চল্লিশজন সিপাহী তাকে স্বসস্ত্র সালাম জানাতে মাস্কেটগুলো আকাশের দিকে তুলে ধরলো।

 “থামো,” মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো টম। কিন্তু কথাটা ফয়-এর কানে যাওয়ার আগেই সিপাহীদের ফাঁকা গুলির বুম বুম আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেলো।

প্রত্যুত্তরে রানি ব্যালকনি থেকে মুচকি হেসে, অলস ভঙ্গিতে হাতটা উপরে তুলে আবার ছেড়ে দিলেন। টম বুঝতে পারলো এটা কোনো একটা সংকেত। চত্বরের চারপাশের তোরণগুলোর সামনের পাটিগুলো পড়ে গেলো। আর ভিতরে দেখা গেলো কালো রঙের সব কামান নল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে।

 টম দেয়ালের দিকে ঝাঁপ দিলো, সাথে সাথে সবগুলো কামান গর্জে উঠলো একত্রে। মনে হলো একসাথে অনেকগুলো বজ্রপাত হলো। ধোয়ায় ভরে গেলো চারপাশ। মাস্কেটের গুলি, ভাঙ্গা ধাতুর টুকরা, মরচে পড়া পেরেকের একটা ঝড় ছুটে এলো গাদাগাদি করে চতুরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে। মহলের দেয়ালগুলো কেপে উঠলো বিস্ফোরণের ধাক্কায়।

এক মুহূর্তে চত্বরটা একটা কসাইখানায় পরিণত হলো। শুধু যারা পেছনে ছিলো তারা বেঁচে গেলো, কারণ সামনের লোকগুলোর শরীর ওদের জন্যে ঢালের কাজ করেছে। যারা সরাসরি সামনে পড়েছে তাদেরকে আর মানুষ বলে চেনা যাচ্ছে না। আহতদের আর্তনাদ আর সাথে বাকিদের চিৎকার চেঁচামেচিতে নরক গুলজার হয়ে গেলো জায়গাটায়। সৈন্যদের মাস্কেট সব রানিকে অভিবাদন জানাতে গিয়ে খালি হয়ে গিয়েছে। ওরা কি করবে বুঝে না পেয়ে যারা জীবিত আছে তাদেরকে একসাথে জড়ো করতে লাগলো। কিন্তু তখনি চতুরের চারিধারের ব্যালকনিগুলো থেকে লুকানো আততায়ীরা গুলি ছুঁড়তে লাগলো। উদ্ৰান্ত সেপাহীরা টপাটপ পড়ে যেতে লাগলো তাতে। বল্লমধারী পাহারাদারেরা আক্রমণ চালালো এবার। কামানের লোকেরাও তাদের তরবারি তুলে নিয়ে যোগ দিলো ওদের সাথে।

এই তুমুল হট্টগোলের মাঝেই কোথাও আছে ফ্রান্সিস। টম ওকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে ও নিশ্চিত রানির ব্যালকনির নিচে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। যে লোকগুলো তাদের মাঝে ও আছে। আততায়ীর গুলি ওখানে পৌঁছাবে না। টম, হিকস আর ওর মোচওয়াল হাবিলদারকে দেখতে পেলো। বেঁচে থাকা সিপাহীরা ওদের চারপাশ ঘিরে একটা চক্র তৈরি করেছে। মরিয়া হয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করছে সবাই। কিন্তু রানিকে স্যালুট দিতে গিয়ে ওরা অস্ত্র খালি করে ফেলেছে। আর ওদের অতিরিক্ত পুলি আর পাউডার রয়ে গিয়েছে দরজার বাইরে-যেসব কুলিকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাদের কাছে। কয়েকজন অবশ্য বেয়নেট জুড়ে নিতে পেরেছে; আর বাকিরা তাদের বন্দুকটা মুগুরের মতো ব্যবহার করছে।

টম নিজের তরবারি বের করলো। যুদ্ধ শুরুর উত্তেজনায় টম যে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে সেটা কেউ খেয়াল করেনি। বর্ম আর দীর্ঘ শিরস্ত্রাণের কারণে রানির সৈন্যদের গলা আর পিঠ সুরক্ষিত থাকছে। কিন্তু ওদের পা পুরো অরক্ষিত। টম একজনের হ্যামস্ট্রিং পেশি দুই ভাগ করে দিলো। লোকটা পড়ে যেতেই টম তার শিরস্ত্রাণটা খুলে নিয়ে নিজের মাথায় গলিয়ে নিলো। তারপর তার পরে থাকা বল্লমটা তুলে নিয়ে ক্ষ্যাপা শুয়োরের মতো পাশের আর একজনকে আক্রমণ করলো।

 লোকটা চেঁচিয়ে উঠতেই, সবার দৃষ্টি ঘুরে গেলো টমের দিকে। একজন দৌড়ে এলো ওর দিকে, হাতে খোলা তরবারি। টম প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই লোকটা পিঠে গুলি খেয়ে হাঁটু মুড়ে পড়ে গেলো। পিঠের ক্ষত থেকে ফোয়ারার মতো রক্ত বের হচ্ছে। উল্টোপাশের একটা ব্যালকনিতে, ধোয়ার আড়ালে একজন আততায়ীকে দেখতে পেলো টম। গুলিটা আসলে ওকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছিলো।

সেই মুহূর্তেই ফ্রান্সিসকে চোখে পড়লো ওর। ব্যালকনির নিচে যারা প্রতিরোধ গড়েছে তাদের মধ্যে সামনের সারিতেই আছে। টম ওর দিকে এগিয়ে গেলো। যেতে যেতে সামনে যাকেই পেলো তাকে বল্লমের আঘাতে শুইয়ে দিতে লাগলো। একজন কুড়াল হাতে আক্রমণ করলো ওকে, মাথা নিচু করে এড়ালো আঘাতটা। তারপর বল্লমের খোঁচায় তার ভুড়ি ফাঁসিয়ে দিলো। ব্যালকনির নিচে পৌঁছে গেলো টম। রানির একজন প্রহরী চক্রটা ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলো প্রায়। হিকস এগিয়ে এসে হাতের পিস্তলটা খালি করলো তার চেহারা বরাবর।

“এখানে থাকা যাবে না,” চেঁচিয়ে বললো টম। আক্ষরিক অর্থেই দেয়ালে পিঠ ঠেকা এখন ওদের। লড়াই করার মতো বন্দুক, বা জনবল কোনটাই নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই যারা বেঁচে আছে তারাও কচুকাটা হবে। এখন উপায় একটাই যেভাবেই হোক এখান থেকে বেরিয়ে কোম্পানির কুঠিতে পালিয়ে যাওয়া।

 “আপনাকে যে পিস্তলগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো আছে?” হিকস জানতে চাইলো।

টম মাথা ঝাঁকালো। ও একটা বের করে কক করলো। হিকস হাতেরটায় গুলি ভরলো আবার।

“আমার সাথে সাথে… এখন।”

সবাই একসাথে গুলি ছুড়লো ওরা, ওদেরকে ঘিরে থাকা সৈন্যগুলোর মাঝে একটু জায়গা ফাঁকা হলো তাতে। আক্রমণকারীরা পিছু হটলো। টম ওর তরবারি বাগিয়ে আক্রমণ করলো। হিকস ওর ডানে, আর ফ্রান্সিস বামে।

 “একসাথে থাকবেন!,” চিৎকার করে বললো ও। একবার ব্যালকনি নিচ থেকে বের হতেই ওরা আবার আততায়ীর গুলির আওতায় চলে এলো। প্রমাণ স্বরূপ সাথে সাথেই মাস্কেটের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো আর সেটা টমের মাথা থেকে কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে গিয়ে পাশের দেওয়ালের খানিকটা প্লাস্টার উড়িয়ে দিলো। একটা টুকরো ছুটে এসে গালে বিধলো ওর। টম পিস্তল ধরা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রক্তটা মুছে, ঐ অবস্থাতেই তাক করে গুলি ছুড়লো। যে লোকটা ওর দিকে গুলি ছুঁড়েছিলো তার একেবারে কপালে গিয়ে লাগলো গুলিটা। ব্যালকনির রেলিং থেকে গড়ান দিয়ে নিচে ধপাস করে এসে পড়লো সে। টম লাশটা থেকে বন্দুকটা আর কোমর থেকে গোলার বেল্টটা টান দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে, দুটোই ফ্রান্সিসের দিকে ছুঁড়ে দিলো।

“আততায়ীগুলো যেনো মাথা বের করতে না পারে।”

 ফ্রান্সিস হাঁটু মুড়ে বসে গুলি ভরে গুলি ছুড়লো। ব্যালকনিতে একজন পেট চেপে ধরে টলতে টলতে পিছিয়ে গেলো। বাকিরাও ভিতরে ঢুকে গেলো সাথে সাথে। ওদের প্রতিরোধে ভয় পাচ্ছে।

“তাড়াতাড়ি,” চেঁচালো টম। যুদ্ধে ভাটা পড়ায় সামনে একটা ফাঁকা জায়গা বেরিয়ে পড়েছে। এখন আর অতো চিন্তা ভাবনা করার সময় নেই, টম সেদিকে দৌড় দিলো। প্রথমবার কামানের গোলায় যারা মারা পড়েছিলো তাদের লাশগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছে। পাথরের চতুরটা রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে, টম একবার পা পিছলে পড়তে পড়তে পড়লো না। আবার ব্যালকনি থেক গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো। ওর পাশের দুজন লোক পড়ে গেলো। একজন সৈন্য এখান থেকে বের হওয়ার জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে লম্বা একটা বল্লম। হাবিলদার তার বেয়নেট পরানো মাস্কেটটা একটা জ্যভেলিনের মতো করে ধরে ছুঁড়ে দিলো। সৈন্যটার গলা ফাঁক হয়ে গেলো তাতে। ওদের পায়ের সামনে পড়ে গেলো সে।

টম হামাগুড়ি দিয়ে নিচু একটা দেয়াল পার হয়ে খিলানে ঘেরা জায়গাটায় এসে পৌঁছালো। কামানগুলো এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমবার গোলা ছোঁড়ার পর এখন আর ওগুলোর কাছে কেউ নেই। ওগুলোর পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার সময় নলের উপরের জোড়া তরবারির ছাপগুলো নজরে এলো টমের। যে ঢালাইখানায় ওগুলো বানানো হয়েছিলো সেটার প্রতীক। ও চিনলো ছাপটা, যা আশংকা করেছিলো তাই। এটা কেস্ট্রেল-এর একটা কামান। উদ্ধার করে, পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন ওগুলো টম আর ওর বন্ধুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। সব দেখে ও রাগে কাঁপতে লাগলো।

কিন্তু এখন এসব নিয়ে কিছু করার সময় নেই। রানির প্রহরীরা আবার জড়ো হচ্ছে। ওর সামনে একটা দরজা খুলে গেলো, কিন্তু সেটা যে কোথায় গিয়েছে সেই চিন্তা ভাবনা না করেই টম ঢুকে গেলো সেদিক দিয়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে করিডোর ধরে কয়েকটা খোলা ঘরের পাশ কাটিয়ে এলো ও। তারপরেই গাছপালা আর কৃত্রিম ঝর্ণায় ভরা একটা বাগানে এসে উপস্থিত হলো। বাগানটার উপরে অনেকগুলো বন্ধ জানালা। এক কোনায় সিঁড়ি দেখা গেলো। ওটা দিয়ে প্রাসাদের উপরের তলায় যাওয়া যাবে।

পিছু পিছু আসা লোকগুলোর সংখ্যা গুনে নিলো টম। ফ্রান্সিস আছে, সাথে একটা যুবক সওদাগর। ফয়-এর সহকারীদের একজনকে দেখা গেলো। যুবক ছেলেটা বাচ্চাদের মতো চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেছে। জামায় অন্য কারো রক্ত মাখা। টম হিকসকে ফেলে এসেছে কোথাও। তবে হাবিলদার আর ছয়জন সেপাই এসেছে। এর মধ্যে চারজনের হাতে মাস্কেট আছে।

 পিছনে ত্বরিত পদক্ষেপ শোনা গেলো। টম ওর তরবারিটা উঁচু করে ধরলো। হিকস ছুটে এলো করিডোর ধরে। পিছনে খঞ্জর হাতে ধাওয়া করছে এক সৈন্য। হিকস ঘুরে গিয়ে সোজা সৈন্যটার বুক বরাবর গুলি করলো। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলো সৈন্যটা। আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করার আগেই ফ্রান্সিস বুদ্ধি করে সামনে এগিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিলো তাকে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আপনি ঠিক আছেন,” টম বললো। “আপনাকে আস্ত অবস্থায় ঘরে ফিরিয়ে নিতে না পারলে আমার শ্যালিকা জীবনেও আমাকে ক্ষমা করতো না।”

“আমার শ্যালিকাও কিন্তু আমাকে ছাড়বে না,” পিস্তলে গুলি ভরতে ভরতে বললো হিকস। “শালা গাধার বাচ্চা, ফয়।”

“কোথায় সে?”

“শেষ দেখছি ও ঐ কুত্তী রানিটার সাথে হে হে করে হাত মেলাচ্ছে।”

“সম্ভবত মারা পড়েছে এতোক্ষণে।” কিন্তু কেউই ফিরে গিয়ে ওকে উদ্ধারে আগ্রহ দেখালো না।

ফ্রান্সিস দ্রুত বাগানটা এক পাক ঘুরে এসেছে। ও গোমড়া মুখে হিকসের কাছে ছুটে এলো।

 “বের হওয়ার কোনো দরজা নেই। আমরা আটকা পড়েছি এখানে।”

যেনো ওর কথা প্রমাণ করতেই করিডোরের মাথায় চিৎকার শোনা গেলো।

“এখান থেকে পালাতে হবে,” বললো হিকস। “আমার পিছু পিছু আসো।”

হিকস সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো। এরকম গুরুতর পরিস্থিতিতেও বিন্দুমাত্র আতংকিত হচ্ছে না। এমন ঠাণ্ডা মাথা দেখে টম আলাদা একটা সম্মান বোধ করলো ওর প্রতি। অ্যাগনেস নিজের জন্যে ঠিক মানুষটাই বেছে নিয়েছে।

ওরা সিঁড়ির শেষ বাকটা ঘুরতেই একটা বারান্দায় উঠে এলো। খোলা দরজা দিয়ে টম দেখতে পেলো সবগুলো ঘরই দামি আসবাবপত্রে ভরা। ওরা দৌড়ে চললো। কোনোদিকে যাচ্ছে ঠিক নেই। এখন গতিই আসল ব্যাপার, থেমে ভাবনা চিন্তার সময় নেই। পিছনের ধাওয়াকারী দলটা ওদেরকে না ধরতে পারলেই হবে।

আর একটা ঘরে ঢুকতেই নিচের লড়াইয়ের শব্দ আবার শোনা যেতে লাগলো। টম গালাগাল করে উঠলো। এতো কষ্টের পরে আবার সেই বটতলাতেই ফিরে এসেছে চত্বরের উপরের বারান্দায়। কাঠের কপাটের ফাঁক দিয়ে ধোয়া ঢুকছে ঘরে। নিচে তাকিয়ে টম গণহত্যার ভয়াবহতাটা একসাথে দেখতে পেলো। পুরো জায়গাটা জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। কয়েক জায়গায় স্তূপ হয়ে আছে; দেয়ালে আর পাথরের উপর রক্ত জমে পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে। ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সব জায়গায়।

আর এই তাণ্ডবের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেদিন সৈকতে দেখা সেই লোকটা। কেস্ট্রেল-এর জিনিসপত্র উদ্ধার করছিলো যে। টম যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে সেদিক থেকে লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তবুও টম শুধু ওর দৈহিক গঠন দেখেই এক নিমিষেই চিনে ফেলেছে। এতে লাশের মাঝেও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, আর সৈন্যদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। তখনও যারা বেঁচে আছে তাদেরকে যমের দুয়ারে পাঠাচ্ছে এরা। এই লোকটাই টমের কামান চুরি করে টমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে।

 টম পিস্তল তুললো। কিন্তু জানালার ঝাজরির ছিদ্রগুলো এতো ছোট যে এর ভিতর দিয়ে গুলি করা সম্ভব না। তারপর সম্ভবত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাড়নাতেই, লোকটা এদিকে ঘুরে টমের দিকে তাকিয়ে রইলো। যদিও টম ওর কাছে পর্দার আড়ালের একটা অবয়ব হিসেবে ধরা দিচ্ছে শুধু। আবারও টমের মনে হলো যেনো ও নিজের প্রেতাত্মার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটা একজন প্রহরীকে কিছু একটা নির্দেশ দিলো। প্রহরী ওর হাতে একটা বন্দুক ধরিয়ে দিলো। তারপর হ্যাঁমার টেন টমের দিকে তাক করলো সে।

সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললো টম। সামনের পর্দাটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। টম সদ্য সৃষ্ট ছিদ্রটা দিয়ে নিজের পিস্তলের নলটা ঢুকিয়ে লোকটাকে খুঁজতে লাগলো।

কিন্তু সে উধাও হয়ে গিয়েছে।

“তাড়াতাড়ি,” ডাকলো হিকস। টম ঘুরে ওর পিছু নিতে গেলো-কিন্তু সাথে সাথে হিকস মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় একটুর জন্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়া থেকে বেঁচে গেলো।

“সৈন্য,” সাবধান করলো হিকস। অর্ধ ডজন সোনার কাজ করা শিরস্ত্রাণ পরা প্রহরী এগিয়ে আসছে এদিকে। আর ওদের মাঝখানে আছে টুঙ্গার। এখন ওর মাথায় কিছু নেই, ফলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কাটা দাগটা। নেপচুন তরবারিটা ওর হাতে; হাতলের নীলাটা আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে। টম, হিকসের দেওয়া ছুরিটা হাতে তুলে নিলো।

সৈন্যরা হাঁটু মুড়ে বসে ওদের দিকে মাস্কেট তাক করলো। ওদের লম্বা নলের মাস্কেটগুলো চালানো বেশ কষ্টকর। এতো ভারী যে নলের মাথায় তেপায়া লাগিয়ে নিতে হয়েছে। কোনো বদ্ধ জায়গায়, লড়াইয়ের উপযুক্ত না এগুলো। টম আর বাকিরা বারান্দার দেয়ালের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। গুলিগুলো ওদের কোনো ক্ষতি না করেই ছুটে গেলো পাশ দিয়ে। কিন্তু আবার গুলি ভরার আগেই টম আর বাকিরা আক্রমণ করলো।

মাস্কেট ফেলে তরবারির দিকে হাত বাড়ালো সৈন্যরা, কিন্তু তার আগেই সিপাহীরা ওদের কাছে পৌঁছে গেল। বিন্দুমাত্র দয়া দেখালো না কেউ। ওরা ওদেরকে বেয়নেটে বিদ্ধ করলো, নয়তো বন্দুকের বাট দিয়ে পিটিয়ে ছাতু বানালো। টুঙ্গারের টমের মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই। উল্টো ঘুরে পালিয়ে গেলো ও। বাকি সৈন্যরাও গেল সাথে।

 “এই মরণ ফাঁদ থেকে বের হওয়ার এটাই সুযোগ!” চেঁচিয়ে বললো হিকস। একটা খোলা জানালার দিকে ইংগিত করছে ও। ইট বসানো ছাদে নামা যায় ওটা দিয়ে। এদিক দিয়ে বের হওয়া যাবে।”

কিন্তু টম জানে যে ও নেপচুন তরবারিটা ছাড়া এখান থেকে যেতে পারবে না। ওটার টান সাইরেনের সঙ্গীতের মতো আবার ওর মাথার ভিতর বাজতে লাগলো।

“আপনারা আগান। আমি আসছি।”

হিকসের প্রতিবাদের জন্যে অপেক্ষা না করে টম টুঙ্গারের পিছে ধাওয়া করলো। প্রথম মোড়টা ঘুরতেই এক আতংকিত কাজের মেয়েকে প্রায় খুন। করেই ফেলেছিলো। মেয়েটা ভয় পেয়ে দৌড়ে আসছিলো এদিকে। টম, মেয়েটাকে একদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো। একটা ছোট করিডোর আর কয়েকটা খোলা পিতলের দরজা পেরিয়ে এলো ও।

 টম থেমে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। বিশাল একটা ঘরে চলে এসেছে, এতো বড় ঘর ও এর আগে কখনো দেখেনি। দামি পর্দা ঝুলছে জানালায়, এক প্রান্তে একটা বেদির উপর স্বর্ণখচিত মেহগনি কাঠের একটা সিংহাসন দেখা যাচ্ছে; ওটার দুই দিকে দুটো ব্যালকনির দরজা। ওখানে লুকিয়েই আততায়ীরা গণহত্যা চালিয়েছে। সিংহাসনের সামনে একটা বাঘের ছাল বিধানো; মাথাটা সোজা করে রাখা, যেনো নীরব গর্জনে ফেটে পড়ছে।

 টম একটা ব্যালকনি পরীক্ষা করে দেখলো, কিন্তু সেটা খালি। অন্য দরজাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তখনি পিছনে কাঠের মেঝেটা ক্যাচকোচ করে উঠলো। সাই করে ঘুরে গেল টম। ঘুরেই দেখে টুঙ্গার সিংহাসনের পেছন থেকে নেপচুন তরবারিটা হাতে ছুটে আসছে ওর দিকে। টমও ওর ছুরিটা বাগিয়ে সময় মতো সরে গেল। একটুর জন্য তরবারির আঘাত লাগলো না গায়ে। প্রতি আক্রমণ করতে গেল টম, কিন্তু আগে কখনো এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার না করায়, ঠিকমতো আক্রমণ করতে পারলো না। ফলে টুঙ্গার আবার পিছিয়ে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।

টম, টুঙ্গারের হাতের তরবারিটা দিয়ে জীবনে অসংখ্য লড়াই করেছে। কিন্তু আজ ও তরবারির বিপরীত পার্শ্বে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওটা হাতে থাকায় সারাজীবন কতোটা সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু এখন ঐ নিষ্ঠুর ফলাটা ওর দিকেই তাক করা। ওটার চকচকে অশুভ ফলাটার সামনে টমের সাহস টলে গেলো। খানিকটা।

 টুঙ্গার দ্রুত হাতে টমের দিকে কয়েকটা কোপ বসালো। টম মরতে মরতে বেঁচে গেলো বলা যায়। টুঙ্গারের চাপে আবার ব্যালকনির দরজার কাছে পিছিয়ে গেলো ও। হারানো সাহস আবার ফিরে এলো ওর। খুব সাবধানে খেয়াল করতে লাগলো টুঙ্গারের নাড়াচাড়া।

ও তরবারির ডগার চাইতে ধার দিয়ে মারতে পছন্দ করে। টম জানে যে এই জ্ঞানটা কাজে লাগবে ওর।

টম এক পাশে সরে গেলো, চেষ্টা করছে টুঙ্গারকে ওর বাম হাতের দিকে নিয়ে আসতে। টুঙ্গার সেটা ধরতে পেরে ওকে আবার পিছনের দিকে ঠেলে দিলো। টুঙ্গার চেষ্টা করছে টমকে ব্যালকনির রেলিং-এর কাছে ঠেলে দিতে, যাতে ও নিচে দাঁড়ানো কারো সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। টম চরকি কেটে ঘুরে গিয়ে আবার ঘরের মাঝে চলে এলো। তাতে অল্পই সুবিধা হলো ওর। টমের মনে হচ্ছে সীসা নির্মিত কোনো তরবারি দিয়ে লড়াই করছে। প্রতিটা আঘাত টলে যাচ্ছে, নয়তো নির্দিষ্ট সময়ের চাইতে সামান্য হলেও পরে হচ্ছে। হয়তো সেকেন্ডের ভগ্নাংশ, কিন্তু মোট যোগ করলে বেড়ে যাচ্ছিলো অনেক।

টম বাম দিকে আক্রমণের ভাব করলো, তাতে করে খুব ছোট একটু ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হলো। কিন্তু টুঙ্গারও সেটা ধরে ফেললো সাথে সাথে। এই পরিস্থিতিতে তরবারির ডগা দিয়ে খোঁচা মারাটাই স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু প্রবৃত্তি বশত ও কোপ মারতে গেলো। ঠিক টম যেরকমটা ভেবেছিলো, সেই মতো টুঙ্গার হাত উঁচু করলো কোপ দেবে বলে। কিন্তু তরবারিটা নেমে আসার আগেই টম ঝাঁপ দিলো সামনে। ওর সমস্ত ওজন এক করে ধাক্কাটা দিলো ও, যাতে টুঙ্গারের বর্মটা ভেদ করতে পারে।

 টুঙ্গার মুচড়ে সরে গেলো। টমের ছুরি ওর বর্মে আঘাত করে আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে পিছলে তো গেলোই, সেই সাথে টমের হাত থেকে ফসকে আর একদিকে ছুটে গেলো। মরিয়া হয়ে টম টুঙ্গারের কবজি চেপে ধরে মেঝেতে পেড়ে ফেললো। তারপর দুজনেই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। টম ওর বুট পরা দুটো পা-ই টুঙ্গারের বুকের উপর তুলে দিয়ে ওকে চেপে ধরে রেখে ওর ছুরিটার জন্যে হাতড়াতে লাগলো, কিন্তু ওটা তখনও কয়েক ফুট দূরে পড়ে আছে। ও হাত বাড়িয়ে ছুরিটার হাতল নাগালে পেতেই টান দিলো। কিন্তু বেশি তাড়াহুড়া করে ফেলায় ছুরিটার ফলা গেলো বাঘটার খিঁচিয়ে থাকা দাঁতের ফাঁকে আটকে। টম আবার টান দিলো কিন্তু ছুটলো না।

টমের অবস্থা দেখে টুঙ্গার আবার উঠে দাঁড়িয়ে নেপচুন তরবারিটা উঁচিয়ে ধরলো। আবারও ও ডগার বদলে ফলা ব্যবহার করছে। মালায়ালাম ভাষায় কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিলো ও। অর্থ না বুঝলেও ভাবার্থ ঠিকই বুঝলো টম।

সমস্ত শক্তি দিয়ে তরবারিটা সোজা নামিয়ে আনলো টুঙ্গার। টম ওর বুট পরা পা চালালো। সেটা গিয়ে লাগলো টুঙ্গারের হাঁটুর মালাই চাকিতে। ওর গালিগালাজ আচমকা আর্তনাদের আড়ালে চাপা পড়ে গেলো। হিস করে বাতাস কেটে টমের মাথার পাশ দিয়ে সরে গেলো তরবারিটা। কিন্তু যতো ব্যথাই পাক না কেন, টুঙ্গার তরবারির হাতলটা ছাড়েনি। ও টলতে টলতে আবারও উঠে দাঁড়ালো। ব্যথা পাওয়া পা-টা খোঁড়াচ্ছে। টম-ও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ছুটে গেলো।

আরো একবার টুঙ্গারকে চেপে ধরলো ও। তবে এবার পেছন থেক বগলের নিচ দিয়ে। যাতে করে টুঙ্গার তরবারির ফলাটা এদিকে ঘোরাতে না পারে। টম ওকে ঠেলে চত্বরের উপরের ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে এলো। ভাঙা মালাই চাকের কারণে টুঙ্গার বাধা দিতে পারলো না। টম ওকে কাঠের রেলিং-এর গায়ে নিয়ে ঠেসে ধরলো। চেষ্টা করছে ওকে নেপচুন তরবারিটা ফেলে দিতে বাধ্য করতে।

কিন্তু এরকম দুজন বলশালী লোকের ধ্বস্তাধস্তির অভিঘাত নেওয়ার মতো সামর্থ্য কাঠের রেলিংটার ছিলো না। হয়তো যুদ্ধের সময়ের গোলাগুলিতে ওটা দুর্বল হয়ে গিয়ে হোক বা টমের ধাক্কার জোরে হোক, রেলিংটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো। টুঙ্গার ভাঙা জায়গাটা দিয়ে নিচে পড়ে গেলো। এক মুহূর্ত মনে হলো ও দুই হাত দুদিকে প্রসারিত করে কিনারে ঝুলে আছে বোধহয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই ঝপ করে নিচে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো।

 জড়তার কারণে টমও প্রায় পড়েই গিয়েছিলো, কিন্তু একটা শক্ত হাত ওর ঘাড়ে কাপড় ধরে টান দিয়ে ওকে কিনার থেক সরিয়ে নিয়ে এলো।

 টম ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিলো, তারপর পিছনে ফিরলো। হিকস দাঁড়িয়ে আছে পিছনে, কাঁধে একটা মাস্কেট। কিন্তু টম ওকে কিছু না বলে রেলিং-এর ভাঙা জায়গাটা দিয়ে নিচে উঁকি দিলো।

একগাদা লাশের উপর পড়ে আছে টুঙ্গার। ডান হাতটা একটা ভাঙা ডানার মতো একদিকে বেঁকে আছে। কিন্তু তখনও হাতের মুঠিতে নেপচুন তরবারিটা ধরা। পতনের ফলে তরবারিটার কোনো ক্ষতি হয়নি, অক্ষতই আছে।

টম হিসেবি চোখে উচ্চতাটা মেপে দেখলো, তারপর সোজা হয়ে লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। কিন্তু হিকস ওকে ধরে ফেললো আবার। “বোকামি কোরো না, টম! তোমার হাত পা সৰ ছাতু হয়ে যাবে। ঘাড়টাও মটকাতে পারে। একটা তরবারিই তো, হলি গ্রেইল তো আর না।” ওরা আরো কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করলো।

কিন্তু এতোক্ষণ যারা এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা লাশগুলো থেকে জিনিসপত্র লুট করছিলো তারা টুঙ্গারের কাছে ছুটে এলো। কয়েকজন উপরে তাকিয়ে ব্যালকনিতে ওদের দুজনকে দেখতে পেয়ে চিৎকার জুড়ে দিলো। একই সাথে পিস্তল বের করে তাক করলো ওদের দিকে।

তা দেখে টম জোর খাটানো বন্ধ করে দিতেই হিকস ওকে টেনে আবার দরবার কক্ষে টেনে নিয়ে এলো।

 “আমি আপনাকে ফিরে আসতে নিষেধ করেছিলাম,” রাগ ঝাড়লো টম।

“এসেই যখন গিয়েছি, কি আর করা,” শুষ্ক কণ্ঠে হিকস বললো। “তবে এখন মনে হয় আমাদের বাড়ির দিকে পালানোর চেষ্টা করাই ভালো। রানি আর তার সৈন্যদল আমাদেরকে ধাওয়া করার আগেই।” টম বুঝতে পারল ও আসলে ওর নিজেদের লোকেরই জীবনবিপন্ন করে দিচ্ছিলো। এবার আর হিকসের কথা অমান্য করলো না ও।

আবার হিকস টমকে নিয়ে শিক বসানো জানালাওয়ালা একটা ঘরে এলো। একটা শিক খুলে ফেলা হয়েছে। ওটার পরেই একটা বাইরের ভবনের ইটের ছাদ দেখা যাচ্ছে। হিকস টমকে সেদিকে দিয়ে ঠেলে দিলো আগে, তারপর নিজেও লাফ দিলো সেদিক দিয়ে। ছাদের কিনারা ধরে দৌড়ে ওরা শেষ মাথায় চলে এলো। ওখান থেকে মহলের দেয়ালটা পার হলেই ভোলা প্রান্তর। ফ্রান্সিস আর বাকিরা ওখানে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে।

 লাফ দেওয়াটা ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। টম একদম নিচু হয়ে তারপর সব শক্তি এক করে দিলো লাফ। কাদায় ভরা একটা নরম জায়গায় গিয়ে পড়লো ও। তারপর হিকসকে ইশারা করলো লাফ দেওয়ার জন্যে। হিকস নিজের মাস্কেটটা টমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো।

কিন্তু আচমকা বাতাস ফুড়ে যেনো একটা ইস্পাতের সাপ উড়ে এসে হিকসের গোলা পেঁচিয়ে ধরলো। হিকস দুই হাতে ধরে ওটা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। আরো জোরে ওর গলায় এটে বসলো ওটা; থাকতে না পেরে পিছনে উল্টে বসে পড়লো। চেহারা ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। চিৎকার করার জন্যে মুখ খুললো কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। ইস্পাতের বেড়িটা ধরে কেউ টান দিলো। টানে চিত হয়ে পড়ে যেতে গেলো হিকস। সাথে সাথেই দেখা গেলো গলা জুড়ে একটা একটা লাল রেখা আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে।

 অসহায় চোখে টম দেখলো একটা অবয়ব এসে উপস্থিত হয়েছে হিকসের পেছনে। সৈকতে দেখা সেই লোকটাই! এই লোকটাই একটু আগে ওর দিকে গুলি ছুঁড়েছে। আর আবারও টমের সেই আজব অনুভূতিটা হতে লাগলো। যেনো এক অমোঘ নিয়তি আজ পূরণ হচ্ছে।

টমের দিকে তাকিয়েই লোকটা তার ডান হাতটা নাড়লো। ক্যাপ্টেন হিকসের গলার ইস্পাতের বেড়িটা আরো কিছুটা এঁটে বসলো। তারপর চামড়া, মাংস, শিরা-ধমনী ভেদ করে অবশেষে তার মেরুদণ্ডের হাড় আর সুষুম্না কাণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেলো ওটা।

 ধড় থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে গেলো হিকসের মাথা। মাথাটা কাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতেই কাটা জায়গাটা থেকে তীর বেগে ঝর্নার মতো রক্ত বের হতে লাগলো। নিষ্প্রাণ দেহটা সামনের দিকে ঝুঁকে ছাদের কোনার আর একদিকে গিয়ে পড়লো। টম আর দেখতে পেলো না সেটাকে। খুনীটা আবারও কবজি মোচড় দিতেই ধাতব সাপটা কুণ্ডলী পাকিয়ে তার ডান হাতের ভিতর ঢুকে গেলো।

 টম ওর বন্দুক তুকে তাক করে গুলি করলো, কিন্তু নিশান ভুল হয়ে গেলো। খুনী ওর দিকে চেয়ে হো হো করে হাসতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে টম ওর বৈশিষ্ট্যগুলো ধরতে পারলো। ওর হাসির মধ্যে মিশ্রিত ঘৃণার সুরটাও চিনে ফেললো ও। এই লোকটা হচ্ছে ওর ভাই গাই কোর্টনীর একটা প্রতিচ্ছবি। মানে বিশ বছর আগে ওদের যখন শেষ দেখা হয়, গাই তখন এরকমই ছিলো।

কবজির আর একটা মোচড়ে খুনীটা আবার ওর হাতের রুপালি ইস্পাতের সাপটা টমের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ওটা বাতাসে শিষ বাজিয়ে কুণ্ডলী খুলে ছুটে এলো টমের দিকে। কিন্তু পুরোটা খোলার পরও টমের কাছে পৌঁছালো না। মুখের এক ফুট দূরে এসে থেমে গেলো। শিউরে উঠে খানকটা পিছিয়ে গেলো টম।

 আবার যখন মুখ তুলে তাকালো, দেখতে পেলো খুনীটা নেই। তবে টম জানে যে ও কোনদিকে একে ভুলতে পারবে না।

মহলের দরজারে দিক থেকে সম্মিলিত চিৎকার ভেসে এলো। একদল কমলা কোমরবন্ধ পরা সৈন্য ধেয়ে এলো ওদের দিকে। তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হত্ৰ দৌড় দিলো টম। কানে খুনীর হাসিটা বাজছে।

মহলের দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস আর বাকি সিপাহীরা টমকে তাড়া দিতে লাগলো। কাছে পৌঁছাতেই টমকে টেনে তুললো ওরা। সাথে সাথেই কয়েকটা মাস্কেটের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো। একটু আগে যেখানে টম ছিলো সেই বরাবর দেয়ালের প্লাস্টার আর ইট ভেঙে ছড়িয়ে গেলো চারপাশে।

ওরা সবাই দেয়ালের উপর কিন্তু নিরাপদ জায়গা থেক এখনো অনেক দূরে।

জোর করে হিকসের চেহারাটা মাথা থেকে সরিয়ে টম দ্রুত ওরা কয়জন সেটা গুনে নিলো। ফ্রান্সিস, হাবিলদার, পাঁচজন সিপাহী আর সেই যুবক ব্যাপারি। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে নিজের জামার বোতাম ধরে টানাটানি করছে। ওদের কাছে আছে মাত্র চারটা মাস্কেট।

“গুলি আর পাউডার কেমন আছে?”

“কয়েকটা মাত্র। আর এক কৌটা পাউডার।” ব্রিটিশ সেনাবাহিনির মতো, ভারতীয় দলগুলো এখনো গোল কান্ট্রিজ ব্যবহার শুরু করেনি। ওগুলোতে একটা কাগজের মোড়কের ভিতর গুলি আর সঠিক পরিমাণ পাউডার একসাথে ভরা থাকে।

দেয়ালের শেষ প্রান্ত থেকে রানির সেনাবাহিনির এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া গেলো। সদর দরজা খোলা রু হয়েছে। টম ব্যাপারি ছেলেটার কাধ ধরে দাঁড়। করালো।

“আমার দিকে তাকাও,” টম ঝাঁকি দিলো ওকে। “তাকাও আমার দিকে। নাম কি তোমার?”

“কা… কাইফেন, স্যার,” তোতলাতে তোতলাতে বললো ও।

 “দৌড়াতে পারবে?”

কাইফেন মাথা ঝাঁকালো।

“তাহলে যতো জোরে পারো দৌড়ে কুঠিতে ফিরে যাও। ওদেরকে বলবে…” কি বলবে ভেবে পেলো না টম। ওরা আসার সময় যে কয়জনকে রেখে এসেছিলো তাদের কথা মনে পড়লো ওর; কয়েকজন মাত্র পুরুষ, মহিলা আর বাচ্চারা। কিভাবে ও এদেরকে নিয়ে দুর্গ রক্ষা করবে?

 কিন্তু আর কি-ইবা করার আছে? ওদের একটা মাত্র ছোট নৌকা আছে, আর এই ঝড়ের মৌসুমে এই প্রমত্তা সাগরে ওটার উপর ভরসা করা হবে বড়সড় বোকামি। অন্যদিকে দুর্গের দেয়ালটা যথেষ্ট পুরু আর শক্ত। কেস্ট্রেল এর কামানগুলো উদ্ধার করতে পারলেও রানির সৈন্যদের কাছে খুব বেশি গোলাবারুদ নেই। তার মানে ওরা অবরোধ করে খুব বেশি সময় আটকে রাখতে পারবে না। সেই সাথে ভাগ্য যদি সহায়তা করে আর ঠিকঠাক কৌশল খাটানো যায়, তাহলে পাশার দান উল্টেও যেতে পারে। মাদ্রাজ থেকে সৈন্যদল এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব বলেই মনে হয়।

কাইফেন তখনও আদেশের অপেক্ষায় বসে। টম ওর আদেশের গুরুত্ব বুঝতে পারলো। ওর সিদ্ধান্তের উপরেই অনেকগুলো মানুষের জীবন নির্ভর করছে।

 “ওদেরকে অবরোধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে বলবে। আমরা রানির সৈন্যদেরকে যতোক্ষণ পারি আটকে রাখছি।”

কাইফেন এমনভাবে দৌড় দিলো যেনো ওর পায়ে আগুন ধরে গিয়েছে। বাকিরা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকালো। টম ওদেরকে তিন জোড়ায় ভাগ করে দিয়েছে। প্রতি জোড়ায় একটা করে বন্দুক। আর একটা বন্দুক রাখলো নিজের কাছে।

“একজন একজন করে গুলি করবে,” আদেশ দিলো ও। “এক দল গুলি করার পর পরের দল গুলি করবে। তৃতীয় দল গুলি করতে করতে অন্য দল গুলি ভরে ফেলবে আবার। আর চেষ্টা করবে অফিসারগুলোকে তাক করতে। ওদের বিশৃঙ্খলা আর প্রশিক্ষণের অভাবই আমাদের একমাত্র ভরসা।”

*

এখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার চাইতে ফিরে গিয়ে কি করবে, সেই চিন্তাতেই টম আতংকে অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। ওর নিজের জন্যে না। সারাহ আর অ্যাগনেসের জন্যে। ওরা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে ওদের ভাগ্যে কি ঘটবে সেটা ভেবে। ওরা দৌড়াতেই থাকলো, দৌড়াতেই থাকলো। মাঝে মাঝে থেমে গুলি করলো বা বন্দুকে গুলি ভরলো। কখনোই খুব বেশি জোরে দৌড়াতে পারছিলো না, নিজেদের ক্রমেই শেষ হয়ে আসতে থাকা গোলা বারুদ সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। আর পিছনে রানির সৈন্যদল কুকুরের মতো তাড়া করলো ওদের।

 টম গুলি করে আবার দৌড় দিলো। আবার গুলি ভরার জন্যে পকেটে হাত দিলো কিন্তু ওটা শূন্য। ফ্রান্সিসকে দেখতে পেলো পাশে, একটা গাছের পাশে গুড়ি মেরে বসে আছে আর ওর সঙ্গী গুলি ভরছে বন্দুকে।

“তোমাদের কাছে আর গুলি আছে?”

“দুটো,” ফ্রান্সিস কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো। “মিস করবেন না কথা দিলে একটা দিতে পারি।”

“তোমার ঋণ কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না!” টমও হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

তখনও দুই কি তিন মাইলের বেশি ওরা পার হতে পারেনি। দিনের আলো আর বেশি বাকি নেই, আর সামনের রাস্তায় যে পরিমাণ কাদা, তাতে মনে হয় না ওরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। রানির ঘোড়া আছে। যদি অশ্বারোহী সৈন্যরা বের হয়, তাহলে রাত নামার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে।

 “কাইফেনের জন্যে আরো কিছু সময় বের করতে হবে।”

একটা বিস্ফোরণে কেঁপে গেলো আশপাশ। এতো জোরে যে ধাক্কায় সামনের গাছের পাতায় জমে থাকা পানি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়লো ওদের গায়ে। টম ফিরে তাকালো, আশংকা করছে যে রানির সৈন্যরা হয়তো ওদের সেই বড় বন্দুকগুলো নিয়ে বের হয়েছে। কিন্তু ও কাউকে ধেয়ে আসতে দেখলো না। সাথে সাথে আবারও কানে তালা লাগানো শব্দ হলো আর একটা।

“বজ্রপাত!” টম আর ফ্রান্সিস দুজনেই খুশি হয়ে গেলো।

একটা বড়সড় বৃষ্টির ফোঁটা এসে টমের হাতের উল্টো পিঠে পড়লো। তারপর আর একটা, আরও একটা। একটু পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো। এতো জোরে বৃষ্টি পড়তে লাগলো যে এতো ঘন জঙ্গল ভেদ করেও নিচের মানুষজন ভিজে যেতে লাগলো। বৃষ্টির বেগের চোটে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো ওদের। সামনে কয়েক হাতের বেশি কিছুই যাচ্ছে না।

 “ওরা এর মধ্যে আর আগাতে পারবে না, আমরাও অবশ্য কিছু করতে পারবো না,” টম খুশি হয়ে গেলো। “তবে ওদের গান পাউডার ভিজে হালুয়া হয়ে যাবে, আর এর মধ্যে পাথর ঘষেও আগুন জ্বালানো সম্ভব না।” ও হাতের অদরকারী বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে সবাইকে জড়ো করলো। তারপর আবার পালানো শুরু করলো। বারবার কাদায় আছাড় খেয়ে পিছলে গেলো। কিন্তু থামলো না কোথাও। দুর্গে পৌঁছাতে হবে যে করেই হোক।

 তবে রানির লোকজনও পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেয়নি। টম যতোবারই থেমে পিছনের তাকালো, ততোবারই দেখলো বৃষ্টির মাঝেও কিছু আবছায়া এগিয়ে আসছে।

সকাল বেলা হনুমানের মন্দিরের পাশের যে সাঁকোটা পার হয়েছিলো সেটার কাছে এসে পৌঁছালো টমের দল। যাওয়ার সময় যতোটা দেখেছিল তার চাইতে এখন পানি আরো পাঁচ ফুট বেশি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চকলেট রঙের পানি সঁকোর বাশের নিচটা ছুঁই ছুঁই করছে প্রায়।

পিছনে ধাওয়াকারীরা এতো দ্রুত এগিয়ে আসছিলো যে টম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ওর দলটাকে সাঁকোর উপর তুলে দিচ্ছিলো প্রায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে ওর খেয়াল হলো কি সুবর্ণ সুযোগ ওর সামনে। ও ঘুরে নিজের বাঁকা ছোরাটা বের করলো।

সৈন্যগুলো একদম সাঁকোর গোড়ায় পৌঁছে দেখতে পেলো যে অন্য পাড়ে টম ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা থেমে গেলো, ভাবছে এটা কোনো ফাঁদ কিনা, কিন্তু ওদের প্রতিপক্ষের সংখ্যাটা নজরে আসতেই হাসি ফুটে উঠলো মুখে। ওরাও অস্ত্র বের করে সামনে বাড়লো।

সৈন্যগুলো সাঁকোর অর্ধেক আসার আগে টম এক চুলও নড়লো না। তারপর আচমকা নিজের ছুরিটা বের করে সাঁকোর গোড়ার নারিকেলের ছোবড়ার কাছি বরাবর পোচ দিলো। তিন পোচেই হয়ে গেলো কাজ। বন্দুকের গুলির মতো শব্দ করে কাছি আলগা হয়ে সাঁকোটা একদিকে কাত হয়ে গেলো। সাথে সাথে বুপ অরে নিচের পানিতে পড়ে গেলো পাঁচ ছয়জন ধাওয়াকারী, সাথে সাথেই স্রোত টেনে নিয়ে গেলো তাদেরকে। বাকিরা মরিয়া হয়ে সাঁকোর পাশের সঁড়ি চেপে ধরলো। কিন্তু ওদের পা ঠিকই পানিতে ডুবে গিয়েছে। টম বাকি যে দড়িটা ছিলো সেদিকে মনোযোগ দিলো এবার। ঝটপট কয়েকটা পোচ বসাতেই আলগা হয়ে গেলো সেটা-ও। যে কয়জন সাঁকো ধরে ঝুলে ছিলো তারাও পড়ে গেলো পানিতে। গায়ের বর্মের ওজনের কারণে ডুবে যেতে সময় লাগলো না মোটেও।

বাকি যেসব সৈন্য তখনও সাঁকোর কাছে এসে পৌঁছেনি তারা দূর থেকেই। তাদের সঙ্গীদের সলিল সমাধির ব্যাপারটা দেখতে পেলো। পানির ধারে এসে তারা আতংক আর বিভ্রান্তিতে পিছিয়ে গেলো কিছুটা।

ঠিক সেই মুহূর্তে কালো ঘোড়ায় চলে এক অশ্বারোহী পিছনের বন থেকে বেরিয়ে এলো। পানির ধারে এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো সে, তারপর পিঠ থেকে না নেমেই অপর পাড়ে দাঁড়ানো টম আর ওর সঙ্গীদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখাচোখি হতেই টমের চেহারা গম্ভীর হয়ে গেলো। এই সেই কামান চোর লোকটা। একটু আগে, এ-ই ইস্পাতের সাপ দিয়ে হিকসের মুণ্ডচ্ছেদ করেছে।

একদৃষ্টিতে ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো, আর নদীটাও এতো বেশি চওড়া না যে দুরত্বের কারণে ওদের প্রতিহিংসা কমে যাবে। অশ্বারোহী চোখ নামিয়ে পানির দিকে তাকালো। হিসেব করছে যে লাফ দেওয়ার একটা চেষ্টা করবে কি-না। তারপর ঘোড়া নিয়ে একদম পানির কিনারে এগিয়ে এলো।

 “পালিয়ে কোথায় আর কতোদূর যাবি?” বললো লোকটা। “আমি তোকে ধরবোই।”

 অবাক বিস্ময়ে টম খেয়াল করলো লোকটা ইংরেজিতে কথা বলছে। একটুও আটকাচ্ছে না, বা উচ্চারণে কোনো টানও নেই। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া আর বেড়ে ওঠা এক লোকের আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ।

“কে তুই?” পানির গর্জনের ভিতর দিয়েই প্রশ্ন করলো টম।

অশ্বারোহী কোনো জবাব দিলো না। ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে ও আবার জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।

*

ঝড়ের কারণে রাত নেমে এলো দ্রুত। এই অন্ধকার আর বৃষ্টির মাঝে খেই হারিয়ে ফেললো ওরা। একাধিকবার দেখা গেলো ওরা খাড়ির ভিতরে নেমে পড়ছে। কিন্তু টম বিরতি দেওয়ার সাহস করলো না। কারণ, ও খুব ভালোমতোই জানে যে অশ্বারোহী লোকটা ওদেরকে ধাওয়া করা থেকে বিরতি নেবে না।

একটু পরেই ওরা পুরোপুরি পথ হারিয়ে ফেললো। কিন্তু তবুও টম কাউকে থামতে দিলো না বরং জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে দৌড় করিয়ে নিয়ে চললো। মাঝে একবার দম নেওয়ার জন্যে থামতেই ফ্রান্সিস এগিয়ে গেলো টমের দিকে।

“আমাদের থামা উচিত। এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে ঘুরে ফিরে আবার রানির জেলখানায় গিয়ে হাজির হয়েছি।”

টম জানে যে ফ্রান্সিসের কথা ঠিক। কিন্তু এতো সহজে হাল ছেড়ে দিতে রাজি না ও।

“আর কয়েক মিনিট। এর পরেই-” বলে ও থেমে গেলো। বৃষ্টি আর বাতাস দুটোই কমেছে কিছুটা। ফলে এর ফাঁকে নতুন আর একটা শব্দ শোনা যেতে লাগলো। “শোনো।”

ওরা দুজনেই শুনতে পেলো সৈকতে ঢেউ আছড়ে পড়ার নরম ছন্দময় শব্দ। “সমুদ্র,” একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো দুজন।

হাতের ছুরি দিয়ে জঙ্গলের মাঝের পথ পরিষ্কার করতে করতে টম সমুদ্রের শব্দ অনুসরণ করে আগাতে লাগলো। আচমকা জঙ্গল শেষ হয়ে সামনেই দেখা গেলো বালিতে ভরা একটা সৈকত।

“কোনদিকে যাবো?” টম ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু জবাব দেওয়ার আগে টমই ওদের সামনেই জ্বলতে থাকা দুর্গের বাতিটা দেখতে পেলো। তার মানে কাইফেন সময়মতো বার্তাটা পৌঁছে দিতে পেরেছে, আর সবাই ওদের অপেক্ষাই করছে।

টম আর ফ্রান্সিস দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো। কাঁচকোচ শব্দ তুলে দরজাটা খুলে যেতেই দেখা গেলো সামনে দুজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লণ্ঠন, ওদের দিকে মাস্কেট তাক করা।

 “মেয়েরা সব কোথায়?” মাস্কেটের নল একদিকে সরিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো টম। “আমার বৌ কোথায়?”

*

উইলিয়াম কাইফেন ঝোঁপ জঙ্গল মাড়িয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলো। আছাড় খেলো, উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটলো। জীবনে কখনো এতো ভয় পায়নি ও।

জীবনে যে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। কাইফেন। জীবনে প্রথম যখন কোম্পানির মুনশির নীল পোশাকটা পরেছিলো, তখন ওর কল্পনায় ছিলো এক গৌরবময় ভবিষ্যতের হাতছানি। স্বপ্ন ছিলো এদেশে এসে কনসোল জেনারেল হয়ে হাতীর পিঠে চড়ে দিল্লির রাজদরবারে যাবে, এমন সব দামী দামী মূল্যবান পাথর বা গয়না উপহার পাবে যেগুলোর একটার দাম-ই হবে ওর বাবার এক বছরের রোজগারের সমান। লিংকনশায়ারের এক গির্জার সহকারী যাজক ছিলো ওর বাবা। কিন্তু এখানে এসে নিজেকে আবিস্কার করলো এই পাণ্ডববর্জিত কুঠিতে। এমন একজন গভর্নরের অধীনে ওকে কাজ করতে হয় যে কিনা ওকে এখানকার স্থানীয় চাকরদের চাইতে বেশি পাত্তা দেয় না।

 ঝড়ের গতি বেড়েই চললো। মটমট করে ডাল ভাঙছে নাহয় গাছ থেকে ফল পড়ছে, আর কাইফেনের কানে সেগুলো মনে হচ্ছে মাস্কেটের গুলির আওয়াজ। ব্রিঞ্জোয়ানে পৌঁছে সৈকতে দুর্গের বিশাল বপুটা দেখার পরেও ও জানতো যে এখনো দুর্দশার কিছুই শেষ হয়নি।

ও দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সমস্ত লোক, মানে যারা ওদের সাথে যায়নি, তারা সবাই বেরিয়ে এলো ওর সাথে কথা বলার জন্যে। “টম আর ফ্রান্সিস কোথায়? মিস্টার ফয়? ক্যাপ্টেন হিকস?”

“মিস্টার ফয় আর ক্যাপ্টেন হিকস মারা গিয়েছেন। সবাইকেই মেরে ফেলা হয়েছে। শুধুমাত্র আমিই পালিয়ে আসতে পেরেছি।”

 শোনামাত্র অ্যাগনেসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। অ্যানা তাড়াতাড়ি এগিয়ে ধরলো ওকে। নইলে পড়েই যেতো।

এর চাইতে মিসেস ফয় বরং তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ আরো সংযমের সাথে গ্রহণ করলো। কাঁদলো না বা মূর্ছা গেলো না; এমনকি এক ফোঁটা চোখের জলও বের হলো না।

“তাহলে আমাদের এখুনি পালানোর ব্যবস্থা করা উচিত,” সাথে সাথে বললো সে।

 কাইফেন একদিকে কাত হয়ে বসে ওর গায়ের ব্যথা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো, “মিস্টার উইল্ড বলেছেন দুর্গকে অবরোধের জন্যে প্রস্তুত করতে।”

“তার মানে টম বেঁচে আছে?” অ্যানা জানতে চাইলো। “ফ্রান্সিস?

 “আমি যখন রওনা দেই তখন পর্যন্ত দুজনেই বেঁচে ছিলো।”

“কিন্তু এতোক্ষণে মারা গিয়েছে নিশ্চিত, নির্বিকার গলায় বললো মিসেস ফয়। “দেরি করা যাবে না। একটা মিনিট দেরি করার মানে ওই অসভ্যগুলোর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। আমাদের মতো চারজন ভদ্রমহিলাকে পেলে ওরা যে কি করবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে?”

কাইফেনও বুঝলো যে কি হতে পারে আসলে। কিন্তু ও ইতস্তত করতে লাগলো। কিন্তু মিস্টার উইল্ড বলেছেন

 মিসেস ফয়-এর চেহারা পাল্টে গেলো। যেনো এততক্ষণে সে পুরো ঘটনাটা অনুধাবন করতে পেরেছে। তারপর হঠাৎ হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে হাত দিয়ে কাইফেনের কোমর জড়িয়ে ধরে ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো।

“আমার স্বামী আর নেই,” বিলাপ করে উঠলো সে। “মিস্টার কাইফেন, এখন আপনিই পারেন আমাদেরকে বাঁচাতে।”

কাইফেন চোখ নামিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখা মহিলাটার দিকে তাকালো। তারপরেই ও যে সোজা তার বুকের ভাজটার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মিসেস ফয় ফোঁপাচ্ছেন আর তার স্তন ফুলে ফুলে উঠছে।

জীবনে প্রথমবারের মতো কাইফেনের কাছে এরকম সুন্দর কোনো মহিলা তার জীবন বাঁচানোর সবিনয় প্রার্থনা করছে। এর আগে কেউ কখনো তার কাছে কিছুই চায়নি। নিজের ভিতরে একটা দায়িত্ববোধ অনুভব করলো। ও। মিসেস ফয়কে ওর বাঁচাতে হবে। আর সেজন্যে দরকার হলে সেই প্রাচীন আমলের নাইটদের মতো সর্বস্ব বিলিয়ে দেবে। আর এখন সে বিধবা-একজন অসম্ভব ধনী বিধবা-আর এই শোকের দিন পাড়ি দিতে তার একজন পুরুষের শক্ত হাত লাগবে। আর একসময়, তার কৃতজ্ঞতা… নাহ কাইফেন আর ভাবতে পারলো না।

 কাইফেন মিসেস ফয়-এর কাঁধে হাত রাখলো। নিজের সাহসে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। “চিন্তা করবেন না,” শক্ত গলায় বললো ও। “এখন থেকে আমিই আপনাকে রক্ষা করবো।”

 “আমাদেরকে পালাতে হবে,” মিসেস ফয় বললো। “নৌকাটা প্রস্তুত করুন।”

“মিস্টার উইল্ড বলেছেন-”

“মিস্টার উইল্ড এখানকার হুকুমদাতা না। আপনি।” মিসেস ফয় ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, চোখে অনুনয়। কাইফেন হঠাৎ পাওয়া এই ক্ষমতার উত্তেজনায় শিহরিত হয়ে উঠলো। মিসেস ফয় আবার বললো, “আমরা আপনার উপরেই ভরসা করে আছি।”

কাইফেন জড়ো হওয়া লোকগুলোর দিকে ফিরে নিজের গলা পরিষ্কার করে নিলো। “নৌকাটা প্রস্তুত করো। দরকারি রসদ, পাউডার আর গুলি নিয়ে নাও। এক ঘন্টার মাঝে রওনা দেবো আমরা।”

 বৃদ্ধ লোকগুলো আর বাচ্চারা ওর আদেশ পালনে ছুটলো। কিন্তু আর এক কোণে আলফ উইলসন আর তার লোকেরা বুকে হাত ভাঁজ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো। কাইফেন ওদের দিকে অস্থির ভঙ্গিতে তাকাতে লাগলো। কেস্ট্রেল-এর মেট-এর চাউনিটা ভালো লাগছে না ওর। এখানে যদি ওর কর্তৃত্বকে নাকচ করার মতো কেউ থেকে থাকে তাহলে সেটা এই লোকই।

“তাড়াতাড়ি যান,” ধমকের সুরে বললো ও। “একবার ধরতে পারলে কিন্তু রানির লোকেরা শূলে চড়াবে।”

 ওর কোথায় পাত্তা না দিয়ে আলফ অ্যাগনেস আর অ্যানার দিকে এগিয়ে গেলো। “আমাকে কি করতে বলেন? টম আর ফ্রান্সিসের কি বাঁচার কোনো সম্ভাবনা আছে?”

ক্রমাগত কান্নার কারণে অ্যাগনেস আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। অ্যানা কথা বললো। নিজের কণ্ঠের আত্মবিশ্বাসে ও নিজেই চমকে গেলো। “আপনার অর্ধেক লোক নিয়ে কেউ বেঁচে আছে কিনা খুঁজতে যান। কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেবেন না। যদি রাস্তায় রানির সৈন্যদের দেখা পান তো সোজা পালিয়ে আসবেন। আর বাকি লোকেরা নাহয় নৌকাটা প্রস্তুত করতে সাহায্য করুক। টম আর ফ্রান্সিস বেঁচে থাক বা মারা যাক, আমার ধারণা, খুব শীঘ্রই নৌকাটা আমাদের কাজে লাগবে।”

অ্যানা অ্যাগনেসকে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলো। ও ভেবে পাচ্ছিলো না সারাহকে কিভাবে খবরটা দেবে। এখনো অসুস্থ্য হয়ে বিছানায় পড়ে আছে সে। ফ্রান্সিস আর টুম কি আসলেই মারা গিয়েছে? এতো প্রাণ প্রাচুর্য্যে ভরা দুটো মানুষ আর নেই, বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

এদিকে দুর্গে লিডিয়া ফয় তখনও কাইফেনের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে ওকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। লিডিয়া একটা চোখ সামান্য খুলে দেখালো লোকজন সবাই যার যার কাজে বিদায় নিয়েছে।

“গোডাউন থেকে কিছু মালপত্র নিয়ে নিতে ভুলবেন না যেনো।”

 কাইফেন হতভম্ব হয়ে গেলো। “এই পরিস্থিতিতেও আপনার মাথায় ব্যবসার কথা ঘুরছে?”।

“আমার প্রাণ প্রিয় স্বামী এই ব্যবসার জন্যে প্রাণ দিয়েছেন। তার কাছে এটাই ছিলো সবকিছু। ঐ খুনীগুলোর হাতে তার মালপত্র গুলো ছেড়ে দেওয়া মানে তার স্মৃতিকেই অসম্মান করা।”

মিসেস ফয় উঠে দাঁড়িয়ে চেহারা থেকে অশ্রু মুছে ফেললো। কাইফেনের চাইতেও তিন ইঞ্চি বেশি লম্বা সে। গভীর নীল চোখ জোড়া দিয়ে সে এমনভাবে কাইফেনের দিকে চেয়ে রইলো যে ওর মাথা চক্কর দিতে লাগলো।

 “আমরা যদি পালানোর পরেও ঠিকমতো বাঁচতে চাই, তাহলে অবশ্যই নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানোর পর আমাদের ভরণপোষণের জন্যে কিছু জিনিস থাকা উচিত। আমি বুড়ো বয়সে ভিক্ষা করতে চাই না।”

“সেরকম কিছু হবে না, ম্যাডাম। আমি নিজে আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।”

মিসেস ফয় কাইফেনের হাত ধরলো। “ওহ মিস্টার কাইফেন, আপনি কতো ভালো। কিন্তু আমাদের হাতে কিন্তু নষ্ট করার মতো একদম সময় নেই।”

কাইফেন চারজন শক্তিশালী লোককে মিসেস ফয়-এর সাথে ভাড়ার ঘরে যেতে বললো। কোন প্রতিবাদ ছাড়াই সবাই ওরা আদেশ পালন করতে ছুটতেই ব্যাপারটায় খুব সন্তুষ্ট হলো কাইফেন। আদেশ পালন করেই অভ্যস্ত ও, দিয়ে না। আজকের আগ পর্যন্ত ও ছিলো এখানকার সবচে ছোট মুনশি, কোম্পানির ক্ষমতার মইয়ের সর্বনিম্ন ধাপে অবস্থান ওর। বাকিরা ওকে মাড়িয়ে উপরে উঠে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে আজ একেবারে ক্ষমতাবান হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর এই অনুভূতিটা দারুণ সুখানুভূতি দিচ্ছে ওকে।

কিছুক্ষণের মাঝেই নৌকাটা সুতি কাপড়ের গাটরি, ইংল্যান্ড থেকে আসা হাতের কাজ করা কিছু মালামাল, ওয়াইন আর ব্রান্ডির ঝুড়িতে ভরে গেলো। মিসেস ফয় কড়া নজরে সব মালপত্র ভোলা তদারক করলো। সব মালপত্র যাতে একদম ঠিকভাবে রাখা হয়, সেদিকে সতর্ক নজর রাখলো সে। কাজ শেষে সন্তুষ্ট হয়ে আবার কাইফেনকে খুঁজে বের করলো।

“আমার সাথে আসুন,” বললো সে। “আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো।”

 কাইফেন সাগ্রহে গভর্নরের বাড়িতে প্রবেশ করলো। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও, নানান চটকদার সম্ভাবনার কথা মাথায় আসতে লাগলো ওর। কিন্তু মিসেস ফয় ওকে সরাসরি তার সদ্য প্রয়াত স্বামীর অফিসে নিয়ে গেলো।

 কাইফেন দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগলো। মিস্টার ফয় হয়তো মারা গিয়েছেন, কিন্তু বহুদিনের চর্চিত অভ্যাস মারা যায়নি। মিসেস ফয়-এর অবশ্য এধরনের কোনো সংকোচ নেই। সে লম্বা পা ফেলে ডেস্কের দিকে এগিয়ে গিয়ে একগাদা চামড়ায় বাধানো হিসাবের খাতা জড়ো করে কাইফেনের হাতে ধরিয়ে দিলো।

“এগুলোর আবার কি দরকার?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো কাইফেন।

“নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, যা যা ক্ষয়-ক্ষতি হলো তাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদেরকেই দায়ী করবে। আমাদের কাছেও তাই ওদের দাবীর বিপক্ষের প্রমাণ থাকা দরকার।”

কাইফেন এই মহিলার মানসিক ক্ষমতায় অবাক হয়ে গেলো। এরকম অসহ্য পরিস্থিতিতেও পরিষ্কার চিন্তা করে চলেছে।

“তবে আরো একটা ব্যাপার আছে।”

মিসেস ফয় এক কোনার কাঠের তৈরি একটা দেরাজ খুললো। ভারী দরজাটা খুলতেই কাইফেন বুঝলো ওটা আসলে একটা দেরাজ না। দরজার পেছনেই দেয়ালের মাঝে একটা না, চার চারটা সিন্দুক। সবগুলো লোহার তৈরি। বিশাল আকৃতির তালা ঝোলানো সেগুলোতে।

 মিসেস ফয়-এর প্রতি কাইফেনের মুগ্ধতা আরো খানিকটা বাড়লো।

“এগুলো নিতে তো লোক লাগবে,” কাইফেন বললো।

“সাবধানে আনবেন। প্রতিটা সিন্দুকে স্বর্ণে এক হাজার পাউন্ড করে আছে।”

 কাইফেন ভেবে পেলো না এই দুর্যোগ কি ওর জন্যে শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদে পরিণত হতে যাচ্ছে নাকি।

“আমাদেরকে তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়তে হবে,” মিসেস ফয় বললো। “তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে যেতে না পারলে আটকা পড়ে যাবো।”

কাইফেন ততোক্ষণে টমের নির্দেশ ভুলে গিয়েছে। সত্যি কথা হচ্ছে, ওর ধারণা টম মারা পড়েছে নাহয় রানির লোকদের হাতে বন্দি হয়েছে। কিন্তু তবুও ও থমকে গেলো।

“নৌকা এমনিতেই কানায় কানায় ভরে আছে; আর আমরা যদি সবাই ওটায় উঠি তাহলে নিশ্চিত ডুবে যাবে।”

“সেটাই,” মিসেস ফয় বললো। “কে কে নৌকায় যাবে সেটা ঠিক করে ফেলুন। বাকিরা এখানে থেকে আমরা ত্রাণ নিয়ে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত, যতোটা সম্ভব দুর্গ রক্ষা করার চেষ্টা করবে।”

স্বর্ণ ভরা সিন্দুকগুলো গালিভাত-এ তোলার পরে নৌকাটা পানিতে এতো বেশি ডেবে গেলো যে কাইফেনের মনে হলো ওটায় আর একজনের পক্ষেও ওঠা সম্ভব হবে না। সব লোকজন পানির ধারে জড়ো হয়েছে। সবাই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। আলফ উইলসন আর তার লোকেরা এখনো ফেরেনি।

অ্যানা নৌকাটার দিকে তাকিয়ে আছে। “এসব কি বলছেন? আপনারা যা পারেন নিয়ে ভেগে গিয়ে আমাদেরকে এখানে রেখে যাবেন? টম আর ফ্রান্সিস কিন্তু এখনো বেঁচে থাকতে পারে।”

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি,” কাইফেন বললো। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের চেষ্টা করছে। কোমরে গোজা পিস্তলের ওজন ওকে বেশ সাহস দিচ্ছে। তবে বৃষ্টির কারণে সম্ভবত ওটা আর ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। “মহিলা আর বাচ্চাদেরকে আমরা নৌকায় করে পাঠিয়ে দেবো। বাকিরা এখানে থেকে লড়াই করবে, আর কেউ যদি পালিয়ে আসতে পাড়ে তার জন্যে অপেক্ষা করবে।”

“খুবই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত,” মিসেস ফয় বললো।

“আলফ উইলসন আর ওর লোকেদের ফিরে আসা পর্যন্ত অন্তত অপেক্ষা করুন। টম আর ফ্রান্সিস সম্পর্কে যদি কিছু জানা যায়, অনুনয় করলো অ্যানা।

 কাইফেন মিসেস ফয় এর সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো।

“এতোক্ষণেও যেহেতু ওরা আসেনি, তার মানে নিশ্চিত মারা পড়েছে, মন্তব্য করলো মিসেস ফয়। আমাদেরও সেই অবস্থাই হবে যদি এখুনি না পালাই। মিস্টার কাইফেন কিন্তু আপনাকে যথেষ্ট সমাদর করেছেন, মিস দুয়ার্তে। আপনি এই কুঠির কেউ না; এবং আপনার উদ্দেশ্যও সম্ভবত ছিলো আমাদের ব্যবসার ক্ষতি করা। তবুও মিস্টার কাইফেন আপনাকে পালানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ধন্যবাদের বদলে তার কপালে শুধু দোষারোপ-ই জুটছে।”

অ্যাগনেস সামনে এগিয়ে এলো। “আমি যাবো। কিন্তু সারাহ খুব দুর্বল। ওকে নিয়ে আসার জন্যে লোক দরকার আমার।”

অ্যানা অ্যাগনেসের জামার হাতা টেনে ধরলো। “দাঁড়ান। এদের সাথে আপনি যাবেন মানে?”

“মিস্টার হিকস মারা গিয়েছেন, তিক্ত কণ্ঠে বললো অ্যাগনেস। এখানে থাকার আর কোনো কারণ নেই?”

“টম আর ফ্রন্সিস তত আছে।”

অ্যাগনেস ভোঁতা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “টম আমার স্বামী না, সম্ভবত ও-ও মারা গিয়েছে। এখন আমার বলতে থাকলো শুধু আমার বোন সারাহ।”

অ্যানা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তখন খেয়াল হলো মিসেস ফয় অ্যাগনেসের পিছনে দাঁড়িয়ে কান পেতে ওদের কথা শুনছে। অ্যানার মনে হলো টমের আসল পরিচয়টা এখনো জানানো ঠিক হবে না। এতো বেশি নাটকীয়তার পর ও আসলে কল্পনাও করতে পারছে না যে ভাগ্য ওদেরকে এরপরে কোথায় নিয়ে যাবে।

অ্যাগনেস নৌকায় চড়ে বসলো। তিনজন লোক সারাহকে ধরে এনে নৌকার সামনের দিকে কাপড়ের গাঁটরিগুলোর গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। একটা অতিরিক্ত পাল ওর গায়ের উপর দিয়ে দেওয়া হলো। বাকিদের মধ্য কাইফেন দুটো ছেলে আর আটজন পুরুষকে বাছাই করলো। ও যেহেতু নৌকা বাওয়ার জন্যে লোক খুঁজছে, তাই দেখা গেলো কেস্ট্রেল-এর থেকে যাওয়া নাবিকদেরকেই নির্বাচন করেছে। এদের মাঝে সবচে প্রবীণ লোকটা হচ্ছে একজন সারেং, নাম হেল। ও চোখে প্রশ্ন নিয়ে অ্যানার দিকে তাকালো।

“আমাদের ক্যাপটেন মিস্টার উইলসন আসার আগ পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করা উচিত,” প্রতিবাদ করলো সে।

 “আপনার শক্তপোক্ত লোকগুলোকে রেখে যান এখানে,” অ্যানা বললো। “যদি ঈশ্বরের কৃপায় ফ্রান্সিস আর টম ফিরে আসে, তাহলে ওদের কাজে আসবে। তবে টম এসে যদি শোনে যে সারাহ এভাবে সম্পূর্ণ অচেনা লোকজনের সাথে চলে গিয়েছে, তাহলে পছন্দ করবে না।” বলে ও নিচু গলায় বললো, “আমি মিসেস ফয় আর মিস্টার কাইফেনকে বিশ্বাস করি না। অন্তত যদি আপনি আর কেস্ট্রেল-এর কেউ নৌকায় থাকেন, তাহলে ওদেরকে রক্ষা করতে পারবেন।”

“মিসেস কোর্টনীকে এখানেই রেখে দিলে ভালো হয় না?”

“উনি সুস্থ্য হয়ে উঠছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সেটা আসলে-”

ওর কথা থেমে গেলো। কারণ লিডিয়া ফয় এর তাড়ায় নৌকার লোকজন এর মধ্যেই পাল তুলে দিয়েছে।

“যান, সাবধানে থাকবেন। আর সারাহের দিকে খেয়াল রাখবেন।”

হেল মাথা ঝাঁকালো। “উনি আমাদের মালকিনের মতে, মিস।” এরা। সবাই দীর্ঘদিন ধরে কোর্টনীদের হয়ে কাজ করছে। অনেকেতো টমের প্রথম সমুদ্রযাত্রা মানে সেই শেরপা জাহজেও ছিলো। নিজের মায়ের চাইতে সারাহকে ভালো চেনে। যখন ওদের ক্ষতস্থানে মলম লাগানোর প্রয়োজন হতো, যখন ডাঙায় থাকা ওদের বৌবাচ্চার কোনো সমস্যা হতো বা টাকা পয়সার দরকার হয়েছে-সারাহ সবসময় পাশে থেকেছে। ওরা সারাহকে ভালোবাসে, এমনকি জীবন দিতেও পিছপা হবে না। এইতো মাত্র কয়েক সপ্তাহ হয়েছে অ্যানা কোর্টনীদের সাথে কাটিয়েছে, তাতেই ওর নিজেরও এরকম মনে হচ্ছে।

“তুমি আসবে না?” অ্যাগনেস জানতে চাইলো।

 অ্যানা মাথা নাড়লো। “ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করবো।”

“থাকুক ও,” মিসেস ফয় বললো। “বোকা মেয়েটা যদি নিজের ভালো না বোঝে তো আমাদের কিছুই করার নেই।”

নৌকাটা ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে এগিয়ে গেলো। তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নানান দুশ্চিন্তা পাক খেয়ে উঠতে লাগলো অ্যানার ভিতরে। আবার যাতে সবাইকে নিরাপদে দেখতে পায় সেজন্যে প্রার্থনা করতে লাগলো মনে মনে।

জঙ্গলের ধারে নাড়াচাড়ার আভাস পাওয়া গেলো। রানির লোকজন কি চলে এসেছে নাকি?

আলফ উইলসন আর লোকেরা বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। কাদা মেখে ভূত হয়ে আছে সবাই; ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে। প্রথম দর্শনে অ্যানা ওদেরকে চিনতেই পারলো না।

“টম বা ফ্রান্সিসের কোনো চিহ্নই নেই,” বললো উইলসন। “যতোর সাহসে কুলিয়েছে গিয়েছিলাম আমরা।”

“অনেক করেছেন।”

 “তার মানে কিন্তু এই না যে ওরা বেঁচে নেই।”

 “জানি। ধন্যবাদ।”

আলফ উইলসন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে শিষ দিয়ে উঠলো। পরিস্থিতি ধরতে পেরেছে ও।

“আমরা তাহলে থেকে যাবো বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, না?”

আলফের হাসিমুখে মেনে নেওয়াটা আজকের এই ভয়াল দিনটায় কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিলো অ্যানার মনে। আবারও ওর কোর্টনীদের প্রতি মুগ্ধতা বাড়লো, এতোগুলো বিশ্বস্ত লোক সবসময় ওদের সাথে থাকে।

“আমার মনে হয় আমাদেরকে এখানে বহুক্ষণই থাকতে হবে।”

“তাহলে মেহমানদারির জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে ফেললে ভালো হবে।”

*

হট্টগোলের শব্দ শুনে অ্যানা আর আলফ দৌড়ে এলো কি হয়েছে শুনতে। অ্যানা গভর্নরের বাড়িতে শুয়ে ছিল; আলফ-ও একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলো। উঠে দেখে নজর রাখতে রেখছিলো যাদেরকে তারা কেউ জায়গায় নেই। ক্ষেপে বোম হয়ে দরজার কাছে এসে দেখে টম আর ফ্রান্সিস। টম ততোক্ষণে বুড়ো দুজনের কাছ থেকে সব শুনে নিয়েছে।

 “এটা যদি সেই শেরপা হতো তাহলে আমি এদের চামড়া তুলে নিতাম,” রাগে গরগর করতে করতে বললো আলফ।

 “বাদ দাও,” টম বললো। ভিতরে ঢুকে, অবস্থা দেখে প্রথমে ও নিজেও ক্ষেপে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন সবিস্তারে দেখলো সব, তখন বুঝলো যে এদেরকে আসলে বকাবকি করে লাভ নেই। জ্যেষ্ঠরা এদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। দায়িত্বে অবহেলাটা এমনিতেই এসেছে তাই। এখন যদি ও চায় ওদেরকে নিয়ে ঐ ভয়ানক শত্রুদের বিরুদ্ধে এই দুর্গ রক্ষা করবে, তাহলে অবশ্যই এদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ পরিমাণ আত্মবিশ্বাস আগে ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

টম প্রায় টানা এক দিন আর রাত ঘুমায়নি; মহলের ভিতর আর জঙ্গলেও মরণপণ লড়াই করেছে, আর এসে কিনা দেখে যে সারাহ নেই। ও যদি একটা নৌকাও পেতো-একটা ছোট ডিঙ্গিও যদি হতো তাহলে তখনই বেরিয়ে পড়তো। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। একটু বিশ্রাম, গরম খাবারের জন্যে জন্যে শরীর টানছে, কিন্তু মনটা পড়ে আছে সারাহের কাছে।

 টম জোর করে ভাবনাগুলো সরিয়ে দুর্গের উঠোনে সবাইকে জড়ো করলো। গুটিকয়েক উপস্থিতি দেখে নিজের হতাশা লুকাতে পারলো না ও। একুশ জন কোম্পানির লোক, যার মধ্য দুই-তৃতীয়াংশই পঞ্চাশোর্ধ। আর বাকিরা চৌদ্দর নিচে। এদের সাথে আছে রানির মহল থেকে পালিয়ে আসা ঐ হাবিলদার আর তার চার সিপাহী। আলফ উইলসন আর তার চারজন লোক, ফ্রান্সিস-তার মানে টম সহ মোট বত্রিশ জন পুরুষ।

“অস্ত্রপাতি কেমন আছে?”

“গুলি আর পাউডার নিয়ে চিন্তা নেই,” আলফ বললো। ও এর মধ্যেই খুঁজে দেখে এসেছে। কোম্পানি এদেরকে প্রচুর পাঠিয়েছে। কারণ অনেক সময় মাসের পর মাস রসদ পাঠানো সম্ভব হয় না।”

“মাস্কেট?”

 “বেশি নেই, তবে আমাদের দরকারের চাইতে বেশি। তরবারি আর বল্লমও আছে অনেকগুলো। ক্যাপ্টেন হিকস তার অস্ত্রপাতি ভালোই গুছিয়ে রেখেছেন। ওনার আত্মা শান্তি পাক। আর হ্যাঁ, কামানও আছে অনেকগুলো।”

ইশ, যদি শুধু ওগুলো চালানোর মতো লোকবল থাকতো, টম ভাবলো। তবে নিজের দুশ্চিন্তা অন্যদের সামনে প্রকাশ করলো না। কারণ এমনিতেই ওর সাথে যারা আছে তাদের অবস্থা সঙ্গিন, আরও খারাপ করতে চায় না। ভাগ্যের ফেরে আজ ওকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি রক্ষার জন্যে লড়তে হচ্ছে।

সবাই টমের দিকে তাকিয়ে আছে। টম বুঝলো ওরা ওর বক্তব্য শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওদের ওর বক্তব্য শোনাটা দরকার।

যে লোকগুলো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে আর কি বলা যায়? কি বললে এরা সান্ত্বনা পাবে?

টম একটা পাথরে উঠে দাঁড়ালো।

“আমি জানি আপনারা এখানে লড়াই করার জন্যে আসেননি,” ও বলা শুরু করলো। কিন্তু শত্রুরা ধেয়ে আসছে, তাই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেয়ালগুলো সুরক্ষিত, অস্ত্রপাতি বা গোলাবারুদের কোনো ঘাটতি নেই। সবচে বড় কথা আমরা এখনো বেঁচে আছি। সবাই মিলে যুদ্ধ করবো আমরা, আর আমরাই আমাদেরকে বাঁচাবো। ঐ রানিকে এমন শিক্ষা দেবো যে আজীবন আমাদের সাথে লাগতে আসার জন্যে আফসোস করবে। বিনা উস্কানিতে কাপুরুষের মতো সে আমাদেরকে আক্রমণ করেছিলো। তার এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত বদলা আমরা নিয়েই ছাড়বো।”

উপস্থিত সবাই হর্ষ ধ্বনি করে উঠলো। এরকম পরিস্থিতিতে এইটুকুই বেশি। অন্তত লড়াই করার আগেই ওরা পরাজয় মেনে নেয়নি।

*

টম সবাইকে কয়েকটা দলে ভাগ করলো। সব দলেই বুড়ো, বাচ্চা, নাবিক আর সিপাহীদেরকে রাখলো। এক দলের নেতৃত্বে থাকলো আলফ উইলসন, আর একটার দায়িত্বে ফ্রান্সিস, তৃতীয় দলটার দায়িত্বে থাকলে সুবলদারটা।

টমের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিলো পানি নিয়ে। যেখানে যতো পিপা, জগ, মগ বা বালতি পাও সব নিয়ে এসো। তারপর নদী থেকে সেগুলোয় পানি ভরে আনো,” ফ্রান্সিসকে নির্দেশ দিলো ও। “অস্ত্রপাতির চাইতে খাবার আর পানির অভাবেই বেশিরভাগ অবরোধ ভেস্তে গিয়েছে।” আর একটা দলে গেলো ভাড়ার ঘর থেকে চাল আর লবণ দেওয়া মাছের বস্তাগুলো আনতে।

টম বাকিদেরকে পাঠালো নিরাপত্তা জোরদার করার কাজে। ওরা সদর দরজার নিচের দিকে কামানের নল ঢোকানো যাবে এমন বড় করে কেটে নিলো। লোকগুলোর মধ্যে একজন ছিলো কাঠমিস্ত্রি। সে কাটা খোপটায় এমনভাবে ঢাকনা লাগিয়ে দিলো যে বাইরে থেকে বোঝার উপায় রইলো না আর। সব শেষে কামানগুলোর উপর তেরপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো যাতে করে বৃষ্টির পানি না লাগে।

 কাজ শেষ হলে টম গভর্নরের বাড়িসহ, ভিতরের যতো বাড়িতে তালপাতার ছাউনি ছিলো সেগুলো খুলে ফেলার আদেশ দিলো। শুকনো অবস্থায় ওগুলোতে যে কোনো সময় আগুন ধরে যেতে পারে।

টম দেয়ালের উপর উঠে দুৰ্গটা পরীক্ষা করে, কোনদিক দিয়ে কামান দাগলে বা আক্রমণ করলে ভালো হবে সেগুলো দেখে নিলো। ঘরের ছাউনি খুলে নেওয়ার পরে দুর্গের মাঝের জায়গাটা একটা ফাঁকা খোল-এর মতো হয়ে গেলো। বাতাসে ভেসে এসে বালি জমতে লাগলো সেখানে। যেনো সৈকত আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এই জায়গাটার দখল বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

বহুবারের মতো আবারও টম কোম্পানিকে তাদের অসাবধানতার জন্যে গালাগাল শুরু করলো-এই সবই ওদের অযথা ঔদ্ধত্যের বহিঃপ্রকাশ। যেনো এই উপমহাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করার মাধ্যমে এখানকার সব কিছুর উপরেও কর্তৃত্ববান হয়ে গিয়েছে। গোডাউনগুলো দুর্গের একদমই কাছে। ফলে অবরোধকারীরা চাইলেই ওখানে কামানের ঘাঁটি বানাতে পারবে। আরো খারাপ হচ্ছে, উত্তর দিকের দেয়ালের আড়ালে একটা কুঁড়ে আছে, একজন আততায়ী খুব সহজেই ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে। লোক পাঠিয়ে ওটাকে ভেঙে ফেলতে হবে।

জঙ্গলের ধারে নাড়াচাড়া চোখে এলো ওর। রানির অশ্বারোহী বাহিনির এক ডজন সদস্যু ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। পুরো সৈকতটা জুড়ে পানি ছিটাতে ছিটাতে এগিয়ে এলো ওরা। দুর্গের সামনে থেকে দুইশো গজ মতো সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন একটা কাসার টেলিস্কোপ বের করে দুৰ্গটা পর্যবেক্ষণ করলো।

“একটা মাস্কেট আনো দেখি,” টম ডাক দিলো। ছেলেটা ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে এনে দিলো অস্ত্রটা। গুলি ভরা আছে দেখে সন্তুষ্ট হলো টম। সবচেয়ে কাছের অশ্বারোহীর দিকে তাক করে গুলি করলো ও।

টম জানতো যে ওরা নাগালের বাইরে। গুলিটা লোকগুলোর কয়েক কদম সামনে সৈকতের বালি খুবলে নিলো। ঘোড়াগুলো ভয়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। একটাতো সামনের দুই পা এতো বেশি তুলে দিলো যে আরোহী একটু হলে পড়েই যেতো। বাকিরাও পিছিয়ে গেলো।

টম মাস্কেটটা নামিয়ে নিলো। ওদের গায়ে গুলি লাগবে সেটা আশা করেনি। শুধু ওদেরকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলো যে লড়াই না করে ওরা ক্ষান্ত দেবে না। যে ছেলেটা মাস্কেটটা এনেছিলো ওকে আবার সেটা ছুঁড়ে দিলো টম।

“গুলি ভরে রেখো। তাড়াতাড়িই আবার ওটা লাগবে আমাদের।”

দুজন অশ্বারোহী ফিরে গেলে আবার। সন্দেহ নেই পিছনে যে সৈন্যদল আসছে ওদেরকে সতর্ক করতে গিয়েছে। বাকিরা অলস ভঙ্গিতে সৈকতে চক্কর দিতে লাগলো। তবে ভুলেও মাস্কেটের আয়ত্বের মধ্যে আসলো না।

“লোকজন সব ভিতরে এসেছে?”

 “পানি আনতে যারা গিয়েছিলো তারা বাদে।”

“ফ্রান্সিস।” টম দৌড়ে গেলো নদীর ধারের দেয়ালটার কাছে। ফ্রান্সিস আর ওর সাথের লোকেরা নদী থেকে ফিরছে কেবল। কাঁধের পিপার ওজনের কারণে কুঁজো হয়ে আছে। গোডাউনের আড়ালে থাকার কারণে ওরা রানির সৈন্যদেরকে দেখতে পায়নি।

*

নদীর ধারে ফ্রান্সিস শক্ত মুখ করে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় ও এতো বেশি নিষ্ঠুরতা দেখেছে যা ওর কল্পনারও বাইরে; আর ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা বাদই দেওয়া হলো। কিন্তু ও বুঝতে পারছিলো যে সাথের লোকগুলো ওকে খেয়াল করছে। ওর নেতৃত্বের উপর ভরসা করছে। ও জানে যে খুব বেশি কিছু ও করেনি, তবে এদের ভরসার প্রতিদান দিতে চায় খুব ভালোভাবেই। নিজেও বাকিদের সাথে হাঁটু পানিতে নেমে, ঝড়ে উড়ে আসা কাঠ আর গাছের পাতা সরিয়ে, এই স্রোতের মাঝেও পিপাগুলো শক্ত করে ধরে রাখতে সাহায্য করতে লাগলো। এটা সেটা বলে সবাইকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিটা ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করলো। সবার নাম শিখে নিলো ও। খেয়াল করলো যে নাম ধরে ডাকলেই ওদের চোখমুখ কেমন উজ্জ্বল হয় উঠছে।

ওরা এরমধ্যেই একবার পিপাগুলো দুর্গের ভিতরে রেখে এসেছে। এখন এসেছে আরো এক সেট নিয়ে। হঠাৎ একজন লোক পানির দিকে কিছু একটা দেখালো। একটা গাছের গুঁড়ি ওদের দিকে ভেসে আসছে।

“ওটা কি?”

ফ্রান্সিস আতংকিত চোখে চেয়ে রইলো। ওটা কোনো গুঁড়ি না, একটা ভেলা। তিনটা লম্বা তক্তা সমান্তরাল রেখে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তক্তাগুলো কোনো রশি দিয়ে বাঁধা হয়নি। ওগুলোকে জোড়া দেওয়া হয়েছে একটা উলঙ্গ মানব শরীর দিয়ে। দেহটা অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ করার মতো গজাল দিয়ে তক্তাগুলোর সাথে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।

 “এটাতো মিস্টার ফয়,” একজন আর্তনাদ করে উঠলো। লোকটা এখানকার হিসাবরক্ষক। নাম ইল্কলী।

এটা মিস্টার ফয় না বলে, এটা একসময় মিস্টার ফয় ছিলো বলা ভালো, মনে মনে ভাবলো ফ্রান্সিস। ফয়ের শরীরে নৃশংস অত্যাচারের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মুখ হাঁ করে আছে; দেখে মনে হচ্ছে একটা গর্ত যেনো। ঘাতকেরা ওর জিহ্বা কেটে বুকের সাথে গজাল দিয়ে গেঁথে দিয়েছ।

 “ওনার কথা বলার ভঙ্গিটা ওরা পছন্দ করতো না,” ইল্কলী বললো।

ভেলাটা ভেসে চলে গেলো–সর্বোচ্চ এক হাত দূর দিয়ে। কিন্তু কেউই সেটা ধরার চেষ্টা করলো না। স্রোত ওটাকে ভাসিয়ে নিয়ে একটা বাঁক ঘুরে মোহনার কাছে একটা বালুর চড়ায় গিয়ে ঠেকালো।

“আমাদের ওনাকে কবর দেওয়া উচিত,” একজন সিপাহী বললো।

 ফান্সিস জোর করে দৃশ্যটা মন থেকে সরিয়ে দিলো। নিজেকে সামলাতে হবে ওর। “বাদ দিন,” নির্বিকারভাবে বললো ও। “যদি সময় পাই তো পরে দেবো নাহয়। আপাতত যারা জ্যান্ত আছে তাদেরকে নিয়ে ভাবতে হবে।”

 কেউ ও রকথার প্রতিবাদ করলো না। সবাই ভালো করেই জানে যে এই দুরবস্থার জন্যে শুধু মাত্র ফয়-ই দায়ী। তার জন্যেই ওদের জীবন এখন সুতার উপর ঝুলে আছে।

“সবগুলো পিপা ভরেছে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো। লোকেরা সম্মতি জানাতেই ওরা দুর্গের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্যে রওনা দিলো।

 দুটো কাঠের দণ্ডের উপর পিপা বসিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। দুইজনে একটা করে নেওয়ার পরেও নিতে কষ্ট হচ্ছে। পা ভার হয়ে আসতে লাগলো, কাঁধ ব্যথা করতে লাগলো। তবে ওরা থামলো না। বাচ্চা ছেলে দুটো একটা ছোট পিপা নিয়ে আসছে। তবে ওরা আনছে বালির উপর গড়িয়ে গড়িয়ে! দেখে ফ্রান্সিসের গ্রামে বাচ্চাদেরকে চাকা বানিয়ে লাঠি দিয়ে ঠেলে নেওয়া খেলার কথা মনে পড়লো।

আচমকা মাস্কেটের গুলির আওয়াজ আশেপাশের গুমোট নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিলো। একজনের হাত থেকে দণ্ডের মাথা ছুটে গেলো। ঝাঁকিতে পিপার ছিপি খুলে পানি পড়তে লাগলো। ফ্রান্সিস একবার দুর্গের দিকে তাকালো, তারপর জঙ্গলের ধারে, কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না।

 “তাড়াতাড়ি,” তাড়া দিলো ও। ও দ্রুত করতে চাচ্ছিলো, কিন্তু পিপার ওজন এতো বেশি যে সম্ভব হচ্ছিলো না। আর বালিতে ওদের পা ডেবে যাচ্ছিলো, ঘামে ভিজে যাওয়ার কারণে হাতগুলোও পিচ্ছিল হয়ে আছে।

ফ্রান্সিস পায়ের নিচে মাটিতে কাপুনি অনুভব করতে পারলো। মাথা তুলে দেখে দুর্গের দরজা খুলে যাচ্ছে। কেউ একজন দরজার ঠিক ওপরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। টম নাকি?

ঠিক সেই মুহূর্তে গোডাউনের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো ছয়জন অশ্বারোহী। ফ্রান্সিস আর সাথের লোকগুলোকে দেখতে পেয়েই ওরা ছুরি বের করে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো।

 কাঁধ থেকে পিপা ফেলে পালাতে উদ্যত হলো সবাই। ওদের মহামূল্যবান পানি যে তাতে বালিতে মিশে যেতে লাগলো সেদিকে খেয়াল নেই।

 “একসাথে থাকো সবাই,” ফ্রান্সিস চিৎকার করে ডাকলো সবাইকে। ও জানে যে একবার সবাই ছড়িয়ে পড়লে ওদেরকে পশুর মতো ধাওয়া করে মারা হবে। “আমার পাশে।”

দুটো বিশাল পিপা পাশাপাশি পড়ে আছে। ফ্রান্সিস সবাইকে ওটার পিছনে জড় করলো। ওদের কাছে মাস্কেট আছে পাঁচটা, কিন্তু মাত্র দুটোয় গুলি ভরা।

“ওগুলো আমাকে দাও,” বলে ও প্রায় ছিনিয়ে নিলো অস্ত্র দুটো। একটা নিজে নিয়ে আর একটা পাশের সিপাহীকে দিলো। অন্যগুলোতে গুলি ভরার সময় নেই এখন। “বেয়োনেট লাগিয়ে নাও,” আদেশ দিল ও।

অশ্বারোহীরা বিপজ্জনক গতিতে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ফ্রান্সিস সবার সামনের ঘোড়াটার বুক বরাবর নিশানা করে গুলি করলো। ওটা এতো কাছে এসে পড়েছে যে ফ্রান্সিস ওটার নাকের ফুটো পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলো। নিরীহ প্রাণীটার জন্যে খানিকটা খারাপ লাগলো ওর। কিন্তু তাতে ওর নিশানা নড়লো না। গুলিটা হৃৎপিণ্ড বরাবর গলা দিয়ে ঢুকে গেলো। আশাপাশে বালির মেঘ উড়িয়ে সামনের পা দুটো বাকিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ওটা। ওটার আরোহী চেঁচিয়ে উঠলো, কারণ ঘোড়ার নিচে একটা পা চাপা পড়ে ওর টিবিয়া আর ফিবুলা হাড় দুটো একসাথে ভেঙে গিয়েছে। পিছনের অশ্বারোহীরা দিক বদলে সরে গেলো। কিন্তু একজন ঠিক এটার পিছনেই ছিলো। সে সরতে পারলো না। তার পরিণতিও এর মতোই হলো।

বাকি চারজন অশ্বারোহী লাগাম টেনে থেমে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মুখ আবার ফ্রান্সিস আর ওর সিপাহীদের দিকে ফেরালো। ঠিক সেই মুহূর্তে ফ্রান্সিসের পাশের সিপাহীটা ঠিকমতো তাক না করেই দ্বিতীয় মাস্কেটটা থেকে গুলি ছুড়লো। গুলিটা সোজা একজন অশ্বারোহীর নাকের উপর গিয়ে লাগলো। সৈন্যটা দুদিকে হাত ছড়িয়ে উল্টো হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে পড়ে গেলো। তবে পা তখনও জিনের ফিতেয় আটকে আছে। ঘোড়াটা ভয় পেয়ে সৈকত ধরে দিলো ছুট। আর সৈন্যটার মাথা সৈকত জুড়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরে ধুপধাপ বাড়ি খেতে লাগলো।

ফ্রান্সিস মাস্কেটের নলের সামনের দিকটায় বেয়নেট বসিয়ে প্যাঁচ মেরে আটকে দিলো। তিনজনকে কাবু করা গিয়েছে, কিন্তু এখনো তিনজন বহাল তবিয়তেই আছে। ওদের মধ্যে একজনকে দেখা গেলো পিস্তলে গুলি ভরছে।

তবে কি ভেবে সে গুলি করার বদলে আবার পিস্তলটা কোমরে খুঁজে সঙ্গীদেরকে কিছু একটা বললো। তারপর তিনজনই একসাথে ঘোড়া ছুটিয়ে, নদী পার হয়ে জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে গেলো।

ওরা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেলে, তার পরে ফ্রান্সিস ঘুরে তাকালো। দুর্গের দরজা তখনও খোলা, আর মাস্কেট হাতে প্রায় এক ডজন লোক দৌড়ে আসছে ওদের দিকে। টম আছে সবার সামনে। ওরা যখন দেখলো যে ফ্রান্সিস আর বাকিরা নিরাপদ তখন আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। টম এতোক্ষণ ফ্রান্সিস আর বাকিদের গায়ে লাগার ভয়ে বাকিদেরকে গুলি করার অনুমতি দিতে পারছিলো না। বাকিদের নিশানায় বিশ্বাস করে না ও।

টম ফ্রান্সিসের কাছে দৌড়ে গিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যেন ও টমের নিজের সন্তান। “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তুমি ঠিক আছে।”

লড়াইয়ের উত্তেজনা কমে আসতেই ফ্রান্সিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। টম টের পেলো ফ্রান্সিসের হাত কাঁপছে। ও ওকে শক্ত করে ধরে রইলো।

“দারুণ দেখিয়েছে, বাকি লোকগুলো যাতে শুনতে না পায় এমনভাবে বললো টম। “কতো অভিজ্ঞ লোকও এই অবস্থায় পড়লে, দিশেহারা হয়ে, উল্টোপাল্টা করে শেষে মারা পড়তো।”

 ফ্রান্সিস পড়ে থাকা পিপাগুলো দেখালো। “অর্ধেকের বেশি পানি পড়ে গিয়েছে।”

“তাতে কিছুই হয়নি। চাইলেই আবার ভরে নেওয়া যাবে। কিন্তু তোমাকে হারালে পেতাম কই?”

 “থ্রি চিয়ার্স ফর ইংল্যান্ড, ফ্রান্সিস বললো। “থ্রি চিয়ার্স ফর রেড, হোয়াইট অ্যান্ড ব্লম। হিপ হিপ-”।

কিন্তু উল্লাস ধ্বনিটা ওদের মুখেই আটকে রইলো। কারণ নদীর অপর পাড়ে আবার অশ্বারোহীরা আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু একটু আগে যেখানে ছিলো তিনজন, এখন সেখানে এসেছে প্রায় একশো জন। দুলকি চালে লম্বা একটা সারি করে জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।

“দুর্গে যাও সবাই,” চেঁচিয়ে উঠলো টম। “এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।

 পিপাগুলোকে ফেলে রেখেই ওরা দরজার দিকে দৌড় দিলো। রানির অশ্বারোহী দল নদী পার হয়ে চলে এলো এপারে। তবে দুর্গের কামানের আওতায় আসার অনেক আগেই ঘোড়ার লাগাম টেনে থামিয়ে দিলো। যদি ওরা জানতো যে ভিতরে আসলেই কতো জন আছে, তাহলে হয়তো ঝুঁকিটা নিতো। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা কিছুই জানে না।

টম দরজার কাছে পৌঁছে এক এক করে সবাইকে ভিতরে ঢুকিয়ে সবার শেষে নিজে ভিতরে ঢুকলো। ফ্রান্সিস ওর পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে তাড়া দিতে লাগলো। সবাই ভেতরে ঢোকার পর কোটনীরাও ঢুকে গেলো ভিতরে। আলফ উইলসন দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে হুড়কো টেনে দিলো।

শত্রুর সেনাদল একটা বেষ্টনী রচনা করে ছড়িয়ে পড়লো। দুর্গের চারপাশে বেরিয়ে যাওয়ার সবগুলো পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। কয়েকজন সৈন্য গোডাউন আর গোলাঘরে ঢুকে নানা মূল্যবান মালামাল হাতে বেরিয়ে এলো। দুর্গের ভিতরের সবাই নিষ্ফল আক্রোশে চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু।

দিন শেষে পদাতিক বাহিনি এসে উপস্থিত হলো। সাথে একদল ষড়। প্রত্যেকে কেস্ট্রেল থেকে উদ্ধার করা একটা করে কামান টেনে নিয়ে আসছে। আরো কয়েকটা কামান আছে। কিন্তু ওগুলো খুবই পল্কা। লোহার চাকার উপর বাঁশের নল বসানো।

“ওগুলো আমাদের চাইতে ওদের গোলন্দাজদেরই সমস্যা করবে বেশি, টম মন্তব্য করলো। রানির লোকেরা সবাই জায়গামতো বসাচ্ছে কামানগুলো। ওর নিজের কামান, আর নেপচুন তরবারিটা শত্রুর হাতে পড়ায় মনে মনে ভাগ্যকে শাপ শাপান্ত করলো কিছুক্ষণ। “ওদের হাতে যদি শুধু আমাদের কামানগুলো না থাকতো, তাহলে পরের বর্ষা পর্যন্ত অবরোধে থাকলেও সমস্যা হতো না।”

“ওদের কাছে কিন্তু আপনার পাউডার নেই,” পাশ থেকে অ্যানা বললো।

“ওদের নিজেদেরই আছে।”

 “ভারতীয় গানপাউডার আসলে ইংরেজদেরটার মতো অতো ভালো না। আপনার কামানের পাল্লা অনেক বেশি হবে।”

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ম্যাডাম। এরকম টানটান পরিস্থিতিতে আসলে তোমার মতো মেয়েমানুষই দরকার।” বলে টম হাবিলদারকে ডাকলো।

“মিস দুয়ার্তের বিশ্বাস যে ওদের কামানের চাইতে আমাদের কামানের গোলা বেশি দূর যাবে। আমাদের লোকদেরকে সেটা একটু দেখে নিতে বলেন।”

হাবিলদার স্যালুট দিয়ে ওর লোকদের ভাকলো। ওদের কর্মচাঞ্চল্য দেখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটলো টমের মুখে। এদের কাজে দক্ষতার অভাব থাকলেও আগ্রহের ঘাটতি নেই। পাক্কা দশ মিনিট লাগলো ওদের একটা কামানে গোলা ভরতে; সেন্টারাস বা কেস্ট্রেল-এর লোজন হলে দুই মিনিটেই একটা গোলা ছুঁড়তে পারতো।

সবাই পিছিয়ে দাঁড়াতেই হাবিলদার ওর হাতের আগুনটা টাচ হোলে স্পর্শ করালো। মুহূর্ত পরেই কামান গর্জে উঠলো আর আর ধাক্কায় নিচের কাঠের কাঠামোসহ ঝাঁকি দিয়ে উঠলো কামানটা। ধোঁয়ার ভিতরেই টম দেখলো যে গোলাটা শত্রুদের কামানের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে সৈকতের বালি টপকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একদল পদাতিক বাহিনির মাঝে গিয়ে পড়লো। ওরা কামানের গোলন্দাজদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিলো। সৈন্যগুলো গোলার আঘাতে পুতুলের মতো উড়ে গেলো একেক দিকে, কয়েকজনের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো দেহ থেকে। একটা বালিয়াড়ির ভিতর অর্ধেক ঢুকে গিয়ে অবশেষে গোলাটা থামলো। পানির স্পর্শ পেয়ে হিসহিসিয়ে বাষ্প উঠতে লাগলো ওটা থেকে।

একটু পরেই সন্তুষ্ট চিত্তে টম দেখতে পেলো রানির সৈন্যদল কামানগুলোকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আবার তাদের বলদের দল নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *