৪. ফ্রান্সিস কেস্ট্রেল

ফ্রান্সিস কেস্ট্রেল-এর ভাঙা দিকটা দিয়ে নিজেকে টেনে তুললো। তারপর কাত হয়ে থাকা ডেক ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। মনে মনে প্রার্থনা করছে যেনো কোনো কামান দড়ি ছিঁড়ে ছুটে না আসে। হ্যাচের কাছে পৌঁছে মাথা গলিয়ে দিলো ভিতরে। নিচে নামার সিঁড়িটা ভেঙ্গে গিয়েছে। খোলের ভিতর আস্তে আস্তে পানিতে ভরে যাচ্ছে। ওর বুকটা ধড়াস করে উঠলো। কেউ কি এর মধ্যে বেঁচে আছে? ওর মনে হচ্ছে না।

শুধু কালো রঙের পানি দেখা যাচ্ছে।

 অ্যানা?” চিৎকার করে ডাকলো ও।

কোনো উত্তর এলো না।

খোলের আরো খানিকটা ভেঙ্গে পড়তেই জাহাজটা আরো একটু কাত হয়ে গেলো। ওর হাতে একদম সময় নেই। ও কিনারটা আঁকড়ে ধরে নিচের পানিতে নেমে এলো। নিচের দিকটা পানিতে পুরোপুরি ভরে গেলেও উপরের দিকে ঠিকই বাতাস আছে। ও জাহাজের এটা সেটা ধরে ধরে পানির উপর নাক উঁচিয়ে সামনে আগাতে লাগলো।

জাহাজটা উল্টে গেলেই এর ভিতর আটকে যাবো, ভাবলো ফ্রান্সিস। জোর করে নিজেকে আতংকিত হওয়া থেকে বিরত রাখলো ও ভারসাম্য রাখতে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই কি যেন একটা ঠেকলো

লাশ। ঠাণ্ডা আর ভেজা, তবে ও নিশ্চিত যে ওটা একটা মানুষের শরীর। এই অন্ধকারে ওর পক্ষে বলা সম্ভব না যে এটা অ্যানা কিনা। ও শরীরটাকে নিজের দিকে টেনে এনে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করলো মাথাটা। তারপর ঘাড়ে হাত রাখতেই মৃদু পালস টের পেলো।

জাহাজটা আবারও কাত হলো কিছুটা, পানিও ঢুকলো আরো। ফলে ফাঁকা জায়গা আর থাকলো না। পানিতে ডুবে যাওয়ার আগে ফ্রান্সিস আর মাত্র একবার শ্বাস নিতে পারলো।

 হ্যাচের কাছে যাও, নিজেকে বললো ও। পানি ওকে ঠেলে ছাদের সাথে ঠেসে ধরছে। অজ্ঞান শরীরটা হাত দিয়ে চেপে ধরে ও ডুব দিলো। নোনা জলের ভিতরে চোখ খোলা রাখতে খবর হয়ে যাচ্ছে। আবার ভোলা না রেখেও উপায় নেই। হ্যাচের খোলা জায়গাটা দিয়ে সূর্যের কিরণ দেখেতে পাওয়া মাত্র মরিয়া হয়ে পানিতে পা চালালো ও। ভাঙা কাঠের টুকরো এসে আঘাত করলো ওকে। একটুর জন্যে ছাদে আটকানো একটা লোহার হুক চোখে বিধলো না। তবে শেষমেশ ঠিকই হ্যাচ-এর কাছে পৌঁছাতে পারলো। এবার সাগরই বরং সাহায্য করলো ওকে। ফুলে ওঠা পানিই ওকে হ্যাচ দিয়ে বের করে ভাঙা সিঁড়ির উপর দিয়ে ডেক-এ টেনে তুললো।

এতোক্ষণে ও দেখতে পেলো কাকে উদ্ধার করেছে। অ্যানাকেই-অবশ্য এখন এখান থেকে যেতে না পারলে এতো কষ্টের কোন মানেই থাকবে না। ওদের হাতে কয়েক সেকেন্ড সময় আছে মাত্র। জাহাজ ডুবে যাচ্ছে।

“জাহাজ ছেড়ে যেতে হবে,” ফ্রান্সিস চিৎকার করলো। চারপাশের পানি জাহাজের ভাঙা টুকরো টাকরা দিয়ে ভরে গিয়েছে। এর ভিতর দিয়ে সাঁতরাতে গেলে ওগুলোর আঘাতে ভর্তা হয়ে যেতে হবে। তবে মাস্তুলটা সবকিছুর উপর দিয়ে একটা সাঁকোর মতো শুয়ে আছে। ওটার অমসৃণ গা ওটাকে সরতে দিচ্ছে না।

ওর কোলে অ্যানা নড়ে উঠলো। চোখ খুলে তাকালো সাথেসাথেই।

“কি-?”

“সময় নেই।” ফ্রান্সিস ওর পিঠে চাপড় দিলো। একগাদা নোনা পানি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। “নড়তে পারবে তুমি?”

অ্যানা মাথা ঝাঁকালো। “মনে হয়।”

“তাহলে চলো, জাহাজ থেকে নামতে হবে।” ফ্রান্সিস অ্যানার হাত ধরে মাস্তুলটার কাছে নিয়ে গেলো। কাছে গিয়ে ওকে বলতে হলো না, একাই ওটা ধরে হামাগুড়ি দিয়ে পানির উপর দিয়ে আগাতে লাগলো। ফ্রান্সিসও আগালো পিছু পিছু।

এ যেনো এক বুনো ঘোড়ার পিঠে চড়া। এখনো পোষ মানেনি, গায়ে স্যাডলও পরানো নেই-এরকম কোনো ঘোড়া। মাস্তুলটা ক্রমাগত নড়ছে। মোচড়াচ্ছে, ঢেউয়ের আঘাতে দুলছে। ফ্রান্সিস চার হাত পা দিয়ে গুঁড়িটা আঁকড়ে ধরে ইঞ্চি ইঞ্চি করে আগাচ্ছে। মাঝে মাঝে উপরে উঠে আসছে, বাকি সময়টা গাছে ঝোলা বানরের মতো হাত পা দিয়ে ধরে ঝুলে থাকছে। ঠিক নিচেই গর্জন করছে ঢেউ।

সামনেই দেখতে পেলো জাহাজ থেকে আশেপাশে নজর রাখতে ক্রোজ নেস্ট নামের গোল গামলার মতো যে জায়গাটা ব্যবহার করা হয়, সেটা তখনও মাস্তুলের সাথে আটকে আছে। হামাগুড়ি দিয়ে ওটায় গিয়ে নামলো ফ্রান্সিস। অ্যানা আগেই নেমে একটা পাশ আঁকড়ে ধরে বসে আছে। ফ্রান্সিস-ও অ্যানার পাশে হেলান দিয়ে বসলো। অবশেষে একটা আশ্রয় মিললো, যদিও ঝড় থেকে এখানে ওদের নিরাপত্তা খুবই কম।

 ওখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। জাহাজটা এখনো ঝড়ের ধাক্কায় ঘুরছে; যে কোনো সময় মাস্তুলটা গড়ান খেয়ে ওদেরকে শুঙ্কু পানির নিচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওরা ধ্বংসাবশেষের অংশটুকু পেরিয়ে এসেছে, কিন্তু এখনো একটা ঢেউই ওদের কম্ম কাবার করে দিতে পারে। ফ্রান্সিস ঝড়ের মাঝেই চেষ্টা করলো নৌকাটাকে দেখার, আশা করছে টম আর বাকিরা নিরাপদেই আছে। কিন্তু ওদের কোন নিশানা পেলো না ও।

“সাঁতরাতে পারবে তুমি?” ফ্রান্সিস চিৎকার করে বললো অ্যানাকে।

অ্যানা মাথা নাড়লো। ফ্রান্সিস আর দেরি করলো না। অ্যানাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কয়েকশো গজ দূরেই ডাঙা দেখতে পাচ্ছে। তবে ও সোজা ওটার দিকে সাঁতরালো না। তার বদলে সমস্ত : শক্তি ব্যয় করলো শুধু ভেসে থাকার পিছনে। ও অ্যানার কোমরের নিচে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে যাতে ওর মাথাটা পানির উপরে থাকে। অর্থাৎ স্রোতের কাছেই নিজেদের সঁপে দিয়েছে। স্রোতই ভাঙা জাহাজটা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে। একসময় ধ্বংসস্তূপের শেষ অংশটাও পেরিয়ে এলো ওরা। এরপরেই শুরু করলো সাঁতার।

 এতো কষ্টের পর আসলে ফ্রান্সিস স্রোতের ধাক্কা আর অনুভবই করছিলো না। ওগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারও চেষ্টা করলো না। স্রোতের টানে পানির নিচে ডুবে গেলো একবার, তারপর আবার লাথি মেরে মেরে উপরে উঠে এলো। আচমকা ও পায়ের নিচে শক্ত কিছু একটা অনুভব করতে পারলো। যে ঢেউগুলো ওদের এই ক্ষতির জন্যে দায়ী, সেই ঢেউই অবশেষে কৃপা করলো : ওদেরকে তুলে নিয়ে সৈকতের বালিতে আছড়ে ফেললো।

শরীরের শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে অ্যানাকে টেনে পানি থেকে দূরে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেলো ফ্রান্সিস। যাতে স্রোতের টানে আবার ভেসে না যায়। সামনেই একসারি পাম গাছ দেখা গেলো। ওগুলোর নিচে গেলে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা যায়, কিন্তু ফ্রান্সিস ফাঁকা জায়গাতেই থাকবে ঠিক করলো। বাতাসের চোটে গাছগুলো উলুখাগড়ার মতো বেঁকে যাচ্ছে, গাছের পাতা আর ফল প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে একেক দিকে। গাছ থেকে পড়া নারিকেল কামানের গোলার মতোই মারাত্মক।

ফ্রান্সিসের সারা শরীর ব্যথা করছে। সাঁতার কেটে পা-গুলো এতোটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে যে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটাও আর নেই। ঝড়ো বাতাস এসে বিঁধছে ওর গায়ে। ইচ্ছে করছে বালি খুঁড়ে তার ভিতর শুয়ে থেকে ঝড় থামার অপেক্ষা করে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। টম এখনো সমুদ্রে, সাথে আছে সারাহ আর বাকি সব লোকজন।

ফ্রান্সিস অ্যানাকে শুইয়ে রেখে বাকিদের খুঁজতে বের হলো। অ্যানার জ্ঞান নেই প্রায়। কিছু জায়গা ফ্রান্সিস হামাগুড়ি দিলো, কোথাও দৌড়ে দৌড়ে সৈকত ধরে এগিয়ে চললো। উষ্ণ বৃষ্টির পানি পড়তে লাগলো ওর চেহারায়। বাতাসের ধাক্কায় বালি উড়ে এসে লাগতে লাগলো সারা গায়ে। কিন্তু তবুও থামার কথা চিন্তাও করলো না। টমের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সারা সৈকত খুঁজতে লাগলো। একসময় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতে লাগলো ওর। শেষে কাউকেই না পেয়ে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই সর্বনাশা দুর্যোগের ভিতরে ওই ছোট্ট নৌকাটা টেকার সম্ভাবনা খুবই কম।

আর একটু এগিয়ে, সৈকতের পাশেই ফ্রান্সিস দেখলো বালির উপর একগাদা কাঠ পড়ে আছে। দৌড়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো ও। ওটা একটা ডিঙ্গি নৌকা, দুমড়ে মুচড়ে উল্টে পড়ে আছে। তবে এখনো আস্তই আছে। ওটার পাশের কালো অবয়বগুলো আসলে মানুষ। নৌকা থেকে যে যেখানে পড়েছে সেখানেই শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস দৌড়ে সবার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলো। এক সময় সারাহকে খুঁজে পেলো, সবার শেষে পেলো টমকে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আপনাদেরকে খুঁজে পেয়েছি।”

 “আর অ্যানা?” সমুদ্রের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে বললো টম।

ফ্রান্সিস যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে দেখালো। “ও নিরাপদেই আছে।”

“আমরা এখন কোথায়?” খড়খড়ে কণ্ঠে বলে উঠলো সারাহ। লবণাক্ত পানি ঢুকে ওর গলা ছুলে গিয়েছে। পাশের বালিতে হাত ডুবিয়ে দিলো ও। টম নেপচুন তরবারির ঝিলিক দেখতে পেলো। এতো কিছুর পরেও সারাহ কিভাবে যেনো ঠিকই ওটাকে ধরে রেখেছে।

টম কাঁধ ঝাঁকালো। “বেচে আছি-এখন এটাই একমাত্র ব্যাপার।” জোর করে ও জাহাজডুবির ফলে যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে সেসব ভাবা থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। সেসব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে।

সারাহ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ধপ করে চার হাত-পায়ে বসে পড়ে বালির উপর বমি করে দিলো।

“এখানেই অপেক্ষা করো,” বললো টম।

টম আর ফ্রান্সিস অ্যানাকে আনতে গেলো। ওখানে পৌঁছে দেখে অ্যানার জ্ঞান ফিরেছে পুরোপুরি। কিন্তু নিজেই হেঁটে যাবে বলে জোর করে উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে আবার ফ্রান্সিসের গায়ে ঢলে পড়লো।

“আমি ভেবেছিলাম আমি মরেই গিয়েছি।”

 “আমি সেটা হতে দিতাম না।”

টম বুঝলো ঝড়টা ফ্রান্সিসকে বদলে দিয়েছে। ওর মনের জোর এখন অন্য এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। ফ্রান্সিস অ্যানাকে আবার উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো, আর টম অ্যানার চোখের দৃষ্টি খেয়াল করলো। সেই দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতার চাইতেও আরো বেশি কিছু আছে। এখন আর অ্যানা ফ্রান্সিসকে একটা বাচ্চা ছেলে মনে করছে না, বরং পুরুষ হিসেবে দেখছে। হঠাৎ টমের নিজেকে কাবাবমে হাড্ডি মনে হতে লাগলো।

“আমাদের এখন যাওয়া উচিত।”

বেলা বাড়তেই পড়ে গেলো বাতাস, বৃষ্টির জোরও কমে গুঁড়ি গুঁড়ি পড়তে লাগলো। কিন্তু স্রোতের চেহারা পাল্টালো না; সৈকতে তাণ্ডব চালাতেই লাগলো। প্রতিবার আছড়ে পড়ার সময় শব্দ শুনে মনে হতে লাগলো যেনো বজ্রপাত হচ্ছে। নৌকাটা গায়েব হয়ে গিয়েছে। স্রোতে টেনে নিয়ে আছাড় মেরে গুড়ো গুড়ো করে ফেলেছে হয়তো। টমের প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগতে লাগলো, কিন্তু তবুও ও পুরো সৈকত চষে ফেলে কেস্ট্রেল-এর যে কয়জন তীরে আসতে পেরেছিলো তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করলো। আলফ উইলসনকে এদের মধ্যে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ও। তারপর সবাইকে নিয়ে যতোদূর সম্ভব সৈকতের উপরে উঠে গিয়ে, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে বসে রইলো।

সাগরে তখনও কেস্ট্রেল-এর খোলটা দেখা যাচ্ছে। স্রোত ভেঙ্গে পড়ছে। ওটার উপর। মাঝে মাঝে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, আবার ভাসছে। একবার সেদিকে তাকিয়েই টম বুঝলো যে ওটার পক্ষে আর কোনোদিন সমুদ্রে নামা সম্ভব হবে না। ওটার পিছন দিক ভেঙ্গে গিয়েছে, ফলে খোলটা একেবার হা হয়ে খুলে আছে। মুল মাস্তুলের শুধু গোড়াটুকু আছে। বাকি দুটো ভেসে গিয়েছে কোথায় কে জানে? জাহাজের অর্ধেক তক্তা ভেসে ভেসে সৈকতে চলে এসেছে। ওটার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা জিনিসপত্রের উপর সামুদ্রিক পাখি এসে বসছে। যেনো কোনো শকুন একটা লাশকে ঠুকরে খাওয়ার অপেক্ষায় আছে।

দৃশ্যটা সহ্য হলো না টমের। তারপরেই মনে পড়লো মারা যাওয়া লোকগুলোর কথা, লজ্জিত বোধ করতে লাগলো ও। লোকগুলোর জীবনের বিনিময়ে এই জাহাজ, মালপত্র সব আরো দুইবার হলেও দিয়ে দিতে রাজি টম।

“আমরা এখন কি করবো?” ফ্রান্সিস বললো।

“উপায় একটা বের হবেই,” সারাহ বললো। চেহারায় রঙ ফিরেছে ওর। নড়েচড়ে বেড়াতে পারছে এখন। তাই নাবিকদের ক্ষতের পরিচর্যা করছে যতোটা সম্ভব। যার যার গায়ের কাপড় ছিঁড়েই তাদের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে। ভেসে আসা কাঠ দিয়ে চটা বানাচ্ছে।

 “বসে বসে নাকি কান্না কাঁদলে কখনো কিছু ঠিক হয়ে যায় না,” বলতে বলতে টম উঠে দাঁড়ালা। তারপর সৈকত ধরে আরো খানিকটা উঠে এসে পাম গাছের গায়ের কাটা দাগগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো ও। দা দিয়ে নারিকেল কাটার দাগ ওগুলো।

“কেউ এই গাছগুলো লাগিয়েছে। কাছেই কোনো গ্রাম আছে নিশ্চয়ই।”

কিছুদূর আরো আগাতেই ওরা একটা ছোট্ট খাড়ি দেখতে পেলো যেটা ভিতরের দিকে চলে গিয়েছে। ওটার পাড় দিয়ে একটা পায়ে চলা পথে দেখা গলো। কাদার ভিতরে অনেকগুলো পায়ের ছাপ সেখানে।

“আমি আর ফ্রান্সিস গিয়ে দেখে আসছি,” নেপচুন তরবারিটা কোমরে বেঁধে বললো টম। “সারাহ আর অ্যানা, আলফ আর বাকিদের সাথে থাকো।”

 “না,” জোর গলায় বললো সারাহ। “আজ একটুর জন্যে আমরা বেঁচে গিয়েছি। আমি আর তোমার কাছ ছাড়া হবো না।”

টম জানে যে তর্ক করে লাভ নেই। আলফকে বাকিদের দায়িত্বে রেখে ওরা চারজন রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চললো। একটা নারিকেল আর কাঁঠাল গাছের বনের ভিতর দিয়ে গিয়েছে রাস্তাটা। লাল মাটির উপর উজ্জ্বল সবুজ। বৃষ্টির কারণে বনের ভিতর থেকে অদ্ভুত সব ঘ্রাণ বেরুচ্ছে। বাতাস তাই সোদা মাটি আর কচি কান্ডের ঘ্রাণে ভারি হয়ে আছে।

কিছুদূর আগানোর পরেই ফ্রান্সিস চিৎকার দিয়ে উঠলো। সেদিকে তাকিয়ে সামনেই একটা কাঁটা ঝোঁপের বেড়া দেওয়া বাড়ি দেখতে পেলো বাকিরা। বাড়িটা ছোট, মাটির তৈরি। সামনে এক চিলতে উঠোন। ওটার পরেই খাড়ির ধারে আরো অনেকগুলো বাড়ি দেখা গেলো। প্রতিটা বাড়িই নির্দিষ্ট দুরত্বে বানানো। সব মিলে গ্রামটা আধা মাইলটাক চওড়া। খাড়িতে একজন মহিলা কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে কাপড় ধুচ্ছে। মহিলা বেশ কৃশকায়, আর কোমরে বাঁধা ছোট্ট একটা পাতলা কাপড় বাদে গায়ে আর কোন কাপড় নেই। এই শুলির মতো জোরালো বৃষ্টিতেও কোনো বিকার নেই তার।

“এদের কি কোনো লজ্জা শরম নেই নাকি?” ফ্রান্সিস অবাক হলো।

“আমরা লন্ডনের সমাজ থেকে এখন বহু দূরে,” টম মনে করিয়ে দিলো।

“এদের ধর্মে নগ্নতায় লজ্জার কিছু নেই,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “আর এই আবহাওয়ায় কাপড় আসলে খুব একটা গায়ে রাখাও যায় না।”

 মহিলা ওদের গোলার আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। তারপর চিৎকার দিয়ে হাতের কাপড়চোপড় এক করে ডাঙ্গার দিকে দিলো দৌড়।

“দাঁড়ান,” টম ডাকলো। মহিলা কাছের একটা কুঁড়েতে ঢুকে গেলো, চেঁচানো থামছেই না। টম কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুঁড়ের ভিতর থেকে এক লোক শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। এর পরনেও মহিলাটার মতোই পোশাক। হট্টগোল শুনতে পেয়ে অন্য কুঁড়েগুলো থেকেও লোকজন বেরিয়ে এলো। একটু পরেই সারা গ্রাম এসে জড়ো হলো ওদের পাশে। বিচিত্র ভাষায় ওদেরকে দেখিয়ে কি সব বলতে লাগলো।

চুল-দাড়ি সাদা হয়ে যাওয়া এক কুজো বুড়ো এগিয়ে এলো সামনে। সম্ভবত ইনি-ই হচ্ছেন গ্রামের মাতবর। অ্যানা প্রথমে পর্তুগিজ ভাষায় তার সাথে কথা বললো। তারপর ভারতীয় একটা ভাষায়। কিন্তু মাতবরের মুখের ভঙ্গি বদলালো না। টেনে টেনে কথা বলতে লাগলো সে।

“তুমি এদের কথা বুঝতে পারছো?” অ্যানাকে জিজ্ঞেস করলো টম।

“মালায়ালম ভাষার একটা কথ্য রূপে কথা বলছে এরা, অ্যানা জানালো। “অনেকটা তামিলের মতোই। তাই ইনি কি বলছেন বুঝতে পারছি।”

 “বলো যে আমাদের খাবার লাগবে। আর কাছের বন্দরটা কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করো।”

 অ্যানা কথা বলতে লাগলো। আলাপ শেষ হওয়ার পর মাতবর কিছু একটা আদেশ দিলেন। একটা তালপাতার সেপাই ছেলে বনের ভিতর দৌড়ে গেলো। কয়েকজন মহিলা গেলো খাবার আনতে। আর একজন মহিলা শুকিয়ে আসা কাদার মতো দেখতে কিছু একটা হাতে নিয়ে পাশের একটা কুঁড়েতে ঢুকে গেলো। প্রথমে সে জিনিসটা ফেটে যাওয়া মাটির মেঝেতে লেপে দিলো, তারপর সারা দেওয়ালে একই কাজ করতে লাগলো।

“কি করছেন উনি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“বাড়িটা পরিষ্কার করছে।”

“কাদা দিয়ে?”

অ্যানা মুখ টিপে হাসলো। “ওটা কাদা না, গোবর।”

“গোবর?” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস। খুবই অবাক হয়েছে। ময়লা জিনিস দিয়ে ওরা ঘর পরিষ্কার করে?”

“গরু এদের কাছে খুব পবিত্র,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “ওটার বর্জ্যও তাই ঘরকে শূচি করে।”

মহিলাটা বেরিয়ে এলে মাতবর ওদেরকে ভিতরে যেতে ইঙ্গিত করলো।

“উনি আমাদেরকে ভিতরে যেতে বলছেন।”

টম ঢুকে গেলো। দরজাটা অনেক নিচু। আর ভিতর কোনো জানালা-ও নেই। শুধু দেয়ালের ফাটা থেকে চুঁইয়ে কিছু আলো আসছে। বেশি ফাটা জায়গায় আবার গোবর দিয়ে পট্টি মারা। তবে মেঝেটা শুকনো, বৃষ্টি ঢুকছে না ভিতরে। মাঝখানে একটা পাথরের চক্রের ভিতরে ছোট্ট একটা আগুন জ্বলছে।

তবুও জায়গাটা মানুষের থাকার জায়গার বদলে জন্তু জানোয়ারের থাকার জায়গা বলে মনে হতে লাগলো। টমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, এই অজানা দেশে, অচেনা মানুষের মাঝে এরকম বদ্ধ ঘরে প্রবেশ করতে ওকে নিষেধ করতে লাগলো।

“আমার বাইরেই ভালো লাগছে।”

অ্যানা গ্রামবাসীকে সেটা বললো। হয় ওরা ব্যাপারটা বুঝলো না অথবা ব্যাপারটা ওদের কাছে আদবের বিশাল একটা বরখেলাফ। ওরা কোর্টনীদের চারপাশে জড়ো হয়ে জোর করে দরজার দিকে ঠেলে দিতে লাগলো। অনেকেই আবার টমের কোমরে বাধা নেপচুন তরবারিটা ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। ওটার কারিগরি নৈপুণ্য আর বাটে বানো নীলকান্তমণিটার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নানান কথা বলাবলি করছে সবাই।

মেঝেতেই বসলো ওরা সবাই, আর গ্রামবাসীরা দরজায় অপেক্ষা করতে লাগলো। বৃষ্টিতে ভিজছে, কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না। উলঙ্গ বাচ্চারা তাদের বাবা মায়ের পায়ের ফাঁক দিয়ে ওদেরকে দেখার জন্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মহিলারা ওদের জন্যে এক বাটি ভাত আর আঙ্গুরের বিশাল একটা পাতায় করে ডাল নিয়ে এলো। টম গোগ্রাসে গিলতে লাগলো সেসব। পেট পুরে খেয়েও খিদে মিটলো না ওর। কিন্তু সবার হাড্ডিসার শরীর দেখে বুঝতে পারলো, ওদের যা কিছু ছিলো তার সবই সম্ভবত মেহমানদারিতে শেষ করে ফেলেছে।

খাওয়া শেষ করে টম দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু লোকজন একটুও নড়লো না।

“ওরা বলছে আমাদেরকে নাকি এখানেই থাকতে হবে,” আনা জানালো।

“কেন?”

“আমি যতোদূর বুঝতে পারছি, ওরা সম্ভবত ওদের স্থানীয় সর্দারকে খবর দিতে গিয়েছে,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “উনি আসলে হয়তো আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন।”

টম নিজের জাগায় ফিরে গিয়ে হতাশ হয়ে মাটিতে বসে মেঝেতে আঙুল দিয়ে ড্রাম বাজাতে লাগলো। “আমরা কোথায় আছি সেটা কি বলেছে ওরা?”

“না। আমাদের জাহাজের নিশানা যা ছিলো তাতে আমরা কোনদিকে আসছিলাম সেটা বলতে পারেন না?”

টম কাঁধ ঝাঁকালো। ঝড়টা এতো জোরে আমাদেরকে টেনে এনেছে যে পঞ্চাশ মাইলের ভিতরে কোথায় কি আছে তা বুঝতে পারছি না। জায়গাটা সিলন হতে পারে…”

“এটা সিলন না,” অ্যানা বললো। “ওদের ভাষা আলাদা।”

 “তার মানে ভারত। মালাবার উপকূল সম্ভবত।”

অ্যানা মাথা ঝাঁকালো। “সেটাই মনে হয়-তাহলে আমাদের জন্যে ভালোই হবে। উপকূল জুড়ে ব্রিটিশ আর পর্তুগিদের কুঠি আছে। আমরাও একটা খুঁজে বের করতে পারবো।”

“ওরা আমাদেরকে সাহায্য করবে?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো।’

“আমাদের জাহাজ গভীর পানিতে ডোবেনি,” সারাহ বললো। “ঝড় কমলে হয়তো ওটার মালপত্রগুলো উদ্ধার করা যাবে। দরকার হলে তা দিয়েই ওদের সাহায্য কিনে নেওয়া যাবে। মানে যদি ওরা আমাদেরকে এমনিতে সাহায্য করতে না চায় আরকি।”

“তবে আমার মনে হচ্ছে বেশিরভাগ মালই নষ্ট হয়ে যাবে,” টম বললো। “আইভরিগুলো হয়তো উদ্ধার করা যাবে। আর ডোরিয়ান আর আবোলির কাছে তো সেন্টারাস আছেই। ওদের সাথেও ভালো ব্যবসা করার মতো যথেষ্ট মালামাল আছে। আমরা যদি জায়গামতো না পৌঁছাই, ওরা কেপ টাউনে ফিরে যাবে। আর আমরা যদি ফিরে যাওয়ার মতো কোনো জাহাজ পেয়ে যাই, তাহলে এবারের মতো অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে যাবো আশা করি।”

ওরা অপেক্ষা করতেই লাগলো। মাথার উপর ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা নড়লো না।

 “ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে,” ফ্রান্সিস মন্তব্য করলো।

 “ওদের সর্দারের জন্যে,” অ্যানা বললো। ও বসেছে ফ্রান্সিসের পাশে। উষ্ণতার জন্যে ওর গায়ের সাথে গা লাগিয়ে আছে। “এই লোকগুলো এদের। সর্দারকে সাংঘাতিক ভয় পায়। অনুমতি ছাড়া এক পা-ও নড়বে না।”

“আশা করি এদের সর্দারের কাছে আমার মাপের এক সেট শুকনো কাপড় পাবো,” সারাহ বললো। এতোক্ষণ ধরে ভেজার পরে এই লবণ মাখা জামাটা পরে থাকতে থাকতে ওর গায়ে চুলকানি শুরু হয়েছে। কিন্তু ওগুলো পাল্টে পরার মতো কিছুই নেই সাথে।

 “সাথে আমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে একটা জাহাজ,” বললো ফ্রান্সিস।

 “সাথে একটা খাসীর ঠ্যাং,” ঘুম জড়ানো গলায় বললো টম। মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে ও। আগুনের তাপে উষ্ণ হতে শুরু করেছে। গত দুই দিন এক ফোঁটা ঘুমায়নি। ওর চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো।

ঘুমিয়ো না, নিজেকে বললো টম। এখনো নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাওনি।

ঘুম তাড়ানোর আশায় নিজের গালে চিমটি কাটলো ও। কিন্তু কিছুই অনুভব করতে পারলো না। আর ওর পক্ষে জেগে থাকা সম্ভব না। নিজের মনের এক অতল কালো গর্তের ভিতর ডুবে যেতে লাগলো ও।

*

টমের ঘুম ভাঙলো কারো হাতের ঝাঁকুনিতে। সারাহকে স্বপ্নে দেখছিলো ও। তাই প্রথমে মনে হলো সারাহই বুঝি ঝাঁকাচ্ছে ওকে।

ঝট করে চোখ খুললো টম। ওরা আর এখন কুঁড়ের ভিতর একা না। কয়েকজন গ্রামবাসী ভিতরে ঢুকে ওকে ধরে টানছে। টেনে তারা সোজা দাঁড় করিয়ে দিলো ওকে। সারাহ আর বাকিদের খোঁজে চারপাশে তাকালো ও, কিন্তু কাউকেই দেখা গেলো না। সহসা ও পুরো সজাগ হয়ে গেলো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর হাত ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দিলো। তারপর দরজার চৌকাঠ দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো বাইরে।

 সারাহ, অ্যানা আর ফ্রান্সিসকে ঘিরে গ্রামবাসীরা বিশাল একটা চক্র করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সামনেই সাতজন অদ্ভুতদর্শন লোক ঘোড়ার পিঠে বসা। প্রত্যেকের চেহারাই কঠোর, মুখে কাটাকুটির দাগ; গায়ে বর্ম, আর মাথার পাগড়িটা ইস্পাতের শিরস্ত্রাণের উপরে পেচানো। প্রত্যেকেই ভারি অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত। কোমরে পিস্তল আর ছোট আকারের তরবারিও দেখা গেলো। চারজনের হাতে বর্শা, বাকি তিনজন তরবারি হাতে।

টম, সারাহ আর অ্যানার সামনে গিয়ে ওদেরকে আড়াল করে দাঁড়ালো। “কারা এরা?” জানতে চাইলো ও।

সর্দার মতো লোকটা ঘোড়ায় লাথি মেরে সামনে এগিয়ে ওদের চারপাশে চক্কর দিতে দিতে অগ্নিদৃষ্টিতে ওদেরকে দেখতে লাগলো। লোকটার মাথার পাগড়িতে একটা হলুদ রঙের পাখির পালক গোজা, আর ওর বুকের বর্মটার চারপাশ স্বর্ণ দিয়ে বাঁধানো। একটা সরু ক্ষতচিহ্ন তার কপাল বেয়ে চোখের মাঝ দিয়ে নাকে এসে থেমেছে। তাতে চেহারায় একটা আলাদা শয়তানি ভাব প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। যেনো ওর মাথাটা কেউ দুই ভাগ করে দিয়েছিলো, তারপর আবার কোনোমতে জোড়ে লাগিয়ে দিয়েছে।

লোকটা চিৎকার করে গ্রামের মাতবরকে কিছু একটা বললো। মাতবর আমতা আমতা জবাব দিল প্রশ্নের। কথা বলার সময় দুই হাত ক্ষমার ভঙ্গিতে জড়ো করে মাথা নিচু করে রেখেছে।

 “এই ব্যাটার নাম হচ্ছে টুঙ্গার,” অ্যানা অনুবাদ করে শোনালো। “ও এখানকার স্থানীয় প্রশাসক, চিত্তাত্তিঙ্কারা-র রানির একজন সুবলদার।”

টুঙ্গার জুলজুলে চোখে নেপচুন তরবারিটার নীলার দিকে তাকিয়ে রইলো। টমও হাতলে হাত রেখে চেয়ে রইলো ওর দিকে।

“ওকে বল যে আমাদের জাহাজ ভেঙ্গে পড়েছে, আর আমরা শুধু একটু খাবার চাই আর নিরাপদে কাছাকাছি ইউরোপিয়ান কোনো উপনিবেশে যেতে চাই, আর কিছু না।”

 অ্যানা বললো, কিন্তু বোঝা গেলো টুঙ্গারের ওর কথার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। এমনকি ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ও বেয়াদবের মতো রূঢ় ভাষায় অ্যানাকে থামিয়ে দিলো।

“কি বলে ও?” টম জিজ্ঞেস করলো।

“বলছে এদেশে যে-ই আসুক না কেন, তাকে নাকি রানিকে কিছু একটা উপঢৌকন দিতে হবে।”

“ওকে বল যে আমাদের সব কিছুই জাহাজডুবিতে ভেসে গিয়েছে।”

অ্যানা কথাটা বলতেই টুঙ্গার টমের দিকে টিটকারির ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর সামনে ঝুঁকে ঘোড়ার চাবুকটা দিয়ে ওর নেপচুন তরবারিটা দেখালো।

 “না,” টম মাথা নাড়লো। “এটা কোনোদিনও না। এটা আমার পারিবারিক ঐতিহ্য। যাই হোক। আমাদের জাহাজে আইভরি ছিলো কিছু। সাগর শান্ত হলে আমরা ওগুলো উদ্ধার করে এনে রানিকে উপহার দেবো।”

টুঙ্গার লম্বা চাবুকটার প্যাঁচ খুলে, জ্যান্ত সাপের মতো সামনে ছুঁড়ে মারলো। ওটার আগা গিয়ে টমের কবজি পেঁচিয়ে ধরে, ওর হাতটাকে আঁকি দিয়ে তরবারির হাতল থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর পায়ের গুতোয় টুঙ্গার ওর ঘোড়াটাকে পিছিয়ে নিতে গলো যতক্ষণ না চাবুকটা টানটান হয়ে যায়। দুজন লোক ঘোড়া থেকে নেমে এসে তরবারিটা নিতে গেলো। টম ওদের দিকে লাথি ছুঁড়ে মোচড় দিয়ে সরে গেলো একদিকে। আরো দুজন লোক নেমে এসে টমকে ঘিরে ধরলো। ওদের বর্মগুলো টমের বুক বরাবর তাক করা। রেগেমেগে টম বাম হাত দিয়ে তরবারিটা খাপ থেকে বের করে এনে ওকে ঘিরে থাকা লোকগুলোকে ভয় দেখাতে লাগলো।

কিন্তু সারাহ চিৎকার করে উঠলো, “ওদেরকে দিয়ে দাও ওটা, টম! ঈশ্বরের দোহাই, এই তরবারির জন্যে মরতে হবে না তোমাকে। ওরা ছয়জন আর তুমি একা। কুচি কুচি করে কেটে ফেলবে ওরা তোমাকে।”

টমও জানে ব্যাপারটা। ও তরবারিটা নামিয়ে টুঙ্গারের দিকে ছুঁড়ে দিলো। তরবারিটার ডগার দিকটা মাটিতে গেঁথে ঠরঠর করে কাঁপতে লাগলো। কবজির একটা মাত্র মোচড়ে টুঙ্গার টমের হাত থেকে ওর চাবুকটা ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে বাড়ার জন্যে ঘোড়ার পেটে গুতো দিলো।

সামনে এগিয়ে ও ঘোড়ার পিঠ থেকেই ঝুঁকে তরবারিটার হাতল ধরে টান দিয়ে ছুটিয়ে নিলো। তারপর সেটাকে সোজা টমের চেহারা বরাবর তাক করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। টম অনড় দাঁড়িয়ে রইলো। সারাহ চিৎকার দিয়ে ওর দিকে দৌড় দিলো যাতে টমকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করতে পারে। কিন্তু অ্যানা আর ফ্রান্সিস ওকে টেনে ধরে রাখলো।

একেবারে শেষ মুহূর্তে টুঙ্গার তরবারিটা সরিয়ে নিয়ে হাতলের নীলাটা দিয়ে টমের কপালের মাঝখানে আঘাত করে ওকে ছাড়িয়ে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলো। টম কপালের জায়গাটা চেপে ধরে বসে পড়লো মাটিতে। ওখান থেকে রক্ত বেরিয়ে ওর মুখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে লাগলো।

টুঙ্গার ওর ঘোড়াকে আবার ফিরিয়ে এনে টমের সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখে শয়তানি হাসি, টমকে এভাবে ভড়কে দিতে পেরে নিজের উল্লাস লুকানোর কোনো চেষ্টাই করছে না।

“এই শুয়োরের বাচ্চাটা বলছে কি?” অঝোর ধারায় কাঁদছে সারাহ।

“ও বলছে ওর মালকিন, মহামহিম রানি, এই উপহার পেয়ে খুবই খুশি হবেন। আর উনি এমনকি আমাদেরকে কিছু খাবার ভিক্ষাও দিতে পারেন, তারপর যেখান থেকে এসেছি সেখানেই পাঠিয়ে দেবেন।”

টুঙ্গারের মজা নেওয়া শেষ। সে দাঁড়ানো লোকগুলোকে ধমক দিয়ে কিছু একটা বলতেই সবাই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে পড়লো। চলে যাওয়ার আগে ও অ্যানার দিকে চেয়ে কিছু একটা বললো, তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে ঝড়ের বেগে প্রস্থান করলো। একটু পরেই খাড়িটা ধরে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেলো সবাই।

সারাহ টমের পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো, “বেশি ব্যথা পেয়েছো?”

 টম ওর কপাল থেকে রক্ত মুছলো। কাটাটা খুব বেশি গভীর না, তবে বিশাল একটা কালশিটে পড়ে যাবে। “এরচে খারাপ অবস্থা বহুবার হয়েছে।”

কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো ওর। “যাওয়ার সময় কি বলে গেলো শয়তানটা?”

“উপকূল ধরে কয়েক মাইল গেলে নাকি একটা টুপিওয়ালাদের থাকার জায়গা আছে। গ্রামের মাতবরকে বললে একজন লোক সাথে দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবে।”

“টুপিওয়ালা?” টম মাথা ঝাঁকিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো।

“ইউরোপিয়ানদের ওরা এই নামে ডাকে। এরা পাগড়ি পরে, আমরা পরি টুপি।”

“হুম, ঠিকই আছে,” টম বললো।

অ্যানা ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশে যাওয়ার জন্যে গ্রামের মাতবরের সাথে ওদের সাথে একজনকে দেওয়ার ব্যাপারে আলাপ করলো। টম লোকটাকে পুরস্কার হিসেবে ওর তরবারিটার বেল্টটা দেবে বলে কথা দিলো। ওটার আর কোনো দরকার নেই। কিন্তু লোকটা খুশি হয়ে গেলো ওটা পেয়ে।

গ্রাম ছাড়িয়ে আগে আলফ উইলসন আর কেস্ট্রেল-এর বেঁচে যাওয়া বাকি লোকদের খুঁজতে গেলো ওরা।

তারপর ওদের গাইড উপকূলের বন ধরে উত্তর দিকে যাওয়া শুরু করলো। রাস্তাটা সম্ভবত ব্যবহার হয় না অনেক দিন। কখনো বন ছাড়িয়ে খোলা সৈকত দিয়ে আগালো ওরা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নদী বা সাগরের জমে থাকা পানি হেঁটে পার হতে হলো।

দলের প্রত্যেকেই ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে, গায়ে একদমই শক্তি নেই। পথিমধ্যে কয়েকটা পচা আম পাওয়া গেলো, যারা পেড়েছিলো, তারাই সম্ভবত ফেলে গিয়েছে।

অবশেষে বড়সড় একটা নদীর কিনারে এসে পৌঁছালো ওরা। নদীটা সাগরে গিয়ে মিশেছে। নদীর অপর পাড়ে একটা পাথরের দুর্গ দেখা যাচ্ছে। ওটার চুড়ায় ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা উড়ছে লাল আর সাদা ডোরা কাটা আর এক কোনায় ইউনিয়ন জ্যাক (ব্রিটেনের পতাকা)।

দুর্গের সামনে ভারী ব্রেকার (ঢেউ ভেঙে দেওয়ার জন্যে বসানো বাধ) বসানো। ঢেউ আছড়ে পড়ে ফেনায়িত হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে চারদিকে। পানির সীমার উপরে, বালির ভিতর কয়কেটা চোখা মাথার নৌকা তুলে রাখা হয়েছে। দুর্গের পিছনে ছয়টা গোডাউন আর গোলাঘর, ওখানে কোম্পানির মালামাল রাখা হয়। পাম গাছের পাতা দিয়ে ছাওয়া কয়েকটা কুটির দেখা গেলো ওগুলোর পাশে।

“এই পতাকাটা দেখে যে কোনোদিন এতো খুশি হবো, তা স্বপ্নেও ভাবিনি,” টম স্বগোক্তি করলো।

ওদের গাইড শিষ বাজাতেই কয়েকজন স্থানীয় মাঝি নৌকা নিয়ে এগিয়ে এলো। ওদেরকে পার করে দিতে প্রস্তুত। নদীর অপর পাড়ে পৌঁছাতেই দেখলো দুর্গ থেকে কয়েকজনের একটা দল ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাল পোশাক পরা প্রায় ডজনখানেক সৈন্য দেখতে পেলো টম। নীল পোশাক পরা কর্মচারীরাও আছে সাথে। তিন চারজন মহিলাকেও দেখা গেলো তাদের ছোট ছোট ছাতার নিচ থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মনে হলো অবশেষে ওরা আবার সভ্য কোনো জায়গায় পৌঁছেছে। এবার ওদের কষ্টের অবসান হবে।

দর্শকদের ভেতর থেকে লাল রঙের আঁটসাঁট পোশাক পরা দশাসই এক লোক এগিয়ে এলো। এই ভ্যাপসা গরমের মাঝেও সে একটা পরচুলা পরে আছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে মুখের পাউডার ধুয়ে মুখ আর কাপড়ে সাদা রঙের সর্পিল রেখা একে দিয়েছে।

“আপনারা কারা? কি চান এখানে?” ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো সে।

“আমার আসল নাম বলো না,” ফিসফিসিয়ে বললো টম সবাইকে। “এখানে গাই-এর লোক থাকতে পারে। গাই যদি টের পায় যা আমরা ওদের সদর দরজায় এসে হাজির হয়েছি তাহলে কি দশা হবে মনে রেখো।”

“টম উইল্ড,” মোটা লোকটাকে বললো টম। “আমার ভাতিজা ফ্রান্সিস, আমার স্ত্রী সারাহ। আমাদের সফরসঙ্গী অ্যানা দুয়ার্তে।”

টম জানে ওদেরকে কতোটা উস্কুখুস্কু আর নোংরা দেখাচ্ছে। সে কারণেই সম্ভবত লোকটা ওদের দিকে চরম বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

“লরেন্স ফয়,” লোকটা জানালো। “আমি ব্রিঞ্জোয়ানের ব্রিটিশ কুঠির গভর্নর।”

“ঝড়ে আমাদের জাহাজ ডুবে গিয়েছে,” টম ব্যাখ্যা করলো।

“জাহাজ?” ফয় সন্দেহের দৃষ্টিতে টমকে দেখতে লাগলো। “কোন জাহাজ?”

“কেস্ট্রেল। কেপ টাউন থেকে গুড হোপ হয়ে মাদ্রাজে যাচ্ছিলাম আমরা।”

“এই নামের কোম্পানির কোনো জাহাজের কথা তো শুনিনি,” ফয় বললো। “ইন্টারলোপার নাতো আপনারা?”

টম প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেলো। “এই মুহূর্তে স্যার, আমরা কয়েকজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নাবিক বাদে আর কিছুই নই।”

ফয় নাক সিটকালো। “হায় ঈশ্বর, আপনার গা থেকে আসছে।”

 “কাপড় বদলাতে পারলে আমরাও বেঁচে যাই,” টম বললো।

ফয় নিজের ঠোঁট চেপে ভাবলো কিছু একটা। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছে-যেনো বায়ু ত্যাগ করতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। টম মনে মনে হাসলো। ও জানে ফয় আপ্রাণ ভেবে বের করার চেষ্টা করছে যে, এই অনাহূত নোকগুলোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার ভদ্র কোনো উপায় আছে কি না।

“ঠিক আছে ভিতরে এসে আগে খুলে বলুন সব,” কর্কশ কণ্ঠে বললো ফয়।

ওদেরকে দুর্গের ভিতরে নিয়ে গেলো ফয়। এক নজর দেখেই টম বুঝলো এখানে নিয়ম শৃঙ্খলা ঠিকভাবে মানা হয় না। দরজায় কোনো পাহারাদার নেই, শুধু দুর্গের ছাদে একজনকে দেখা গেলো, সে-ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটা কার্ণিশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে গভর্নরের থাকার জায়গাটা কাঠ দিয়ে বানানো, উপরে তালপাতার ছাউনি। গরমের মৌসুমে এই জিনিস বন ফায়ারের মতো জ্বলবে।

 “এখানকার লোকজনের সাথে নিশ্চয়ই খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আপনার?” টম জিজ্ঞেস করলো।

ফয় হাত নেড়ে একটা মাছি তাড়ালো। “ওরা মাঝে মাঝে একটু আধটু ঝামেলা করে, কিন্তু উপযুক্ত জবাব পেয়ে ওদের টনক নড়েছে।”

টমের ঐ ঘোড়সওয়ারটার কথা মনে পড়লো, যে ওর তরবারিটা কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সে সম্পর্কে কিছু বললো না। বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো মেঝে বালিতে ভরে আছে, বাতাসের বেগ তখনো কমেনি। একজন অর্ধ উলঙ্গ ছোট ভারতীয় বাচ্চা বসে বসে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছে। তাতে বাতাসের স্রোতের দিক বদল হচ্ছে শুধু, গরম এক বিন্দুও কমছে না।

 ফয় ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো। এক বাটি খেজুর তার সামনের ডেস্কে রাখা। ও একসাথে তিনটা মুখে পুরে দিলো, কিন্তু অতিথিদেরকে নেওয়ার জন্যে বললো না। এমনকি বসতেও বললো না। ক্ষুধায় টমের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।

“আচ্ছা,” মুখভর্তি ফল নিয়ে বললো ফয়। “আপনাদের জাহাজডুবি হয়েছে বলছেন। কি ছিলো আপনাদের জাহাজে?”

প্রশ্নটা শুনে টম অবাক হয়ে গেলো। “সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, স্যার।”

“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।” সরু চোখে টমের দিকে তাকিয়ে বললো ফয়। টম টের পেলো এই ভালোমানুষি পোশাকটার নিচে আসলে ফয় একটা কুৎসিত আর কূট বুদ্ধির মানুষ।

“আইভরি, কাপড়, কিছু হাতে বোনা জিনিস।”

 “ইউরোপিয়ান মালপত্র।”

 “আমরা কেপ টাউন থেকে কিনেছি সব।”

“সেটা তো আপনাদের কথা। আপনাদের কাছে লগ বই আছে? বা কোনো ইশতেহার? রশিদ? মানে আপনাদের কথার প্রমাণের পক্ষে কিছু আছে?”

রাগ সামলাতে কষ্ট হলো টমের। “আমাদের সব কাগজপত্র জাহাজের সাথেই ডুবে গিয়েছে।”

“তাই নাকি?” বলে ফয় মুখ থেকে খেজুরের বিচি ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। “কোম্পানি ইন্টারলোপারদের কি করে জানেন তো? আমি চাইলে আপনাদেরকে গ্রেপ্তার করে ডাণ্ডা বেড়ি পরিয়ে আবার ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠাতে পারি। বোম্বেতে পাঠিয়ে গভর্নর কোর্টনীর হাতে তুলে দিতে পারি। বোম্বেতে কিন্তু ইংরেজ আইন সবসময় চলে না। ওখানে গভর্নরের আদেশই আইন।”

 ফয় চুপ করে কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “তবে আমরা যদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারি তাহলে ভিন্ন কথা।”

 শালা ঘুষ চায়! টম বুঝলো। কিছুটা শান্ত হলো ও। এধরনের পরিস্থিতিতে বহুবার পড়েছে ও, তাই ব্যাপারটা ভালোই বুঝতে পারছে।

“কিন্তু জাহাজডুবির পর আমরা এখন নিঃস্ব,” খুবই হতাশার একটা ভঙ্গি করলো টম।

ফয় ওর আঙুল তুললো। “খুবই দুঃখজনক।”

“যাইহোক,” টম বলে চললো। “আমাদের সাথে আইভরির একটা চালান ছিলো। যদি ঝড়ে আমাদের জাহাজের তলা ফেটে না যায় তাহলে ওটা জাহাজের ভিতরেই থাকবে। আর জাহাজ কম পানিতেই ডুবেছে। আমাদেরকে যদি একটা নৌকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে ওখান থেকে যা উদ্ধার হবে তার চার ভাগের এক ভাগ আপনাকে দিতে আমার আপত্তি নেই।”

“এটা আবার কি ধরনের প্রস্তাব?” ফয় এমনভাবে মুখ বিকৃত করলো যাতে টম বুঝতে পারে যে ও আসলে কতোটা আহত হয়েছে। “আমিতো চাইলে নিজেই সব উদ্ধার করে আমার বলে দাবি করতে পারি।”

“কিন্তু সেজন্যে আপনাকে লন্ডনের নৌ আদালতে যেতে হবে,” টম বললো। ডাওজার-এর ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ডের সাথে ওর কথোপকথন মনে পড়লো টমের। “লন্ডনে আমার প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধব আছে। একবার যদি ওখানে কেস ওঠে তাহলে আপনার সব বাণিজ্যের চালান খতিয়ে দেখা হতে পারে। তখন কিন্তু আপনার সারা বছরের সব মুনাফাই হারাবেন।”

ফয় গরগর শব্দ করে উঠলো, ঠিক যেনো একটা অসন্তুষ্ট কুকুর। “আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন স্যার?”

“আরে না, না! কি যে বলেন। আমি আপনাকে বোঝাতে চাচ্ছি যে আমরা চাইলেই এমন একটা সমঝোতায় আসতে পারি যেটায় দুজনেরই লাভ হয়।”

ফয় ভ্রু কুঁচকে ডেস্কে রাখা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আবার একটা খেজুর মুখে পুরে শব্দ করে চাবাতে লাগলো।

“অর্ধেক,” ফয় বললো।

“আচ্ছা,” টম রাজি হলো। “তবে আমাদের বাড়ি ফেরার উপায় হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার এখানেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”

 “আপনারা সৈন্যদের ব্যারাকে থাকতে পারবেন, আর কোম্পানির ক্যান্টিনে খাবেন। আমি সব খরচ পরে কেটে নেবো।” তারপর অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললো, “এখন আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার হাতে যথেষ্ট কাজ আছে।”

টম ভাবলো এ আবার ওদের সম্পর্কে গাইকে লিখে জানাবে না-তো? ও দরজার সামনে থেমে দাঁড়ালো। “আপনি বোম্বের গভর্নর কোর্টনীর কথা বললেন। আপনারা কি পরিচিত?”

ফয়ের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। শুধু পরিচিত? খুবই ঘনিষ্ট আমরা। গাই কোর্টনী আমার গুরুর মতো-না, আমার বন্ধু। ওনার জন্যেই আজ আমি এই অবস্থানে এসেছি। অবশ্য আমিও ওনাকে সুরাটের সওদাগরদেরকে ঠাণ্ডা করতে ছোটখাটো কিছু সাহায্য করেছিলাম।”

টম মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো যে ও ফয়কে নিজের আসল পরিচয় বলেনি। “উনি ভালো আছেন?”

“আছেন ভালো মন্দ মিলিয়ে। এই বাজে আবহাওয়ায় ইদানিং আর ঘর ছেড়ে তেমন একটা বের হন না।”

“আর ওনার পরিবার? ওনারতো একটা ছেলে ছিলো, তাই না?”

টমের পাশ সারাহ নাক সিটকালো। ও কনুই দিয়ে টমের পাজরে তো দিলো কিন্তু ফয় তখন গাই-এর সাথে নিজের ঘনিষ্টতা প্রমাণে ব্যস্ত, তাই খেয়াল করলো না ব্যাপারটা।

 “আহ! ওনার ছেলেটা আসলে একটা কুলাঙ্গার। বড়সড় কুলাঙ্গার,” আবার বললো ও। “বাবার আদেশ অমান্য করে পালিয়ে গিয়েছে বাড়ি ছেড়ে। এরপর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। গাই বলেন যে এটা ওর মায়ের প্রভাবে হয়েছে।”

টম আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিলো, কিন্তু ফয় দেরিতে হলেও টমের কণ্ঠে আগ্রহের ব্যাপারটা খেয়াল করে ফেললো। ওর চোখে কেমন একটা ঈর্ষা দেখতে পেলো টম।

“আপনারা পরিচিত নাকি?”

“বহু দিন আগের কথা,” টম বললো। “উনি এই ফ্যাক্টরির খোঁজ খবর রাখেন নাকি?”

“নাহ! উনি এখন পর্যন্ত একবারও তার পদধূলি দেননি এখানে।” ব্যাপারটা নিয়ে যায় যে আসলেই দুঃখিত তা স্পষ্টতই বোঝা গেলো। “তবে তার ভায়রা এখানে আছেন। এই দুর্গেই এখন আছেন উনি।”

একটা ঠাণ্ডা স্রোত টমের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো। ওকে কি চিনে ফেলেছে? ‘গাইয়ের ভায়রা’ মানে? টম আর গাই দুই বোনকে বিয়ে করেছে, কিন্তু ওরা তো আপন ভাই।

“বুঝলাম না,” যতোটা সম্ভব নির্মোহ গলায় বললো টম। ঘরের ভিতর একটা অস্ত্রের খোঁজে তাকালো ও। ব্যবহার করতে পারে এরকম যে কোন কিছু। দরজার প্রহরীর কাছ থেকে মাস্কেটটা কেড়ে নেবে কিনা ভাবলো। গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো সৈন্যদলের এখানে পৌঁছাতে কতোক্ষণ লাগতে পারে?

ফয় নিজের কপালের ঘাম মুছলো। ওর কথা শুনে টমের কি অবস্থা হচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। “ক্যাপটেন হিকস আর তার স্ত্রী জানুয়ারী থেকে ব্রিঞ্জোয়ানে আছেন। গাই-ই এক প্রকার জোর করে ওদেরকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

টম থেমে গেলো। কি বলছেন এসব? বলতে চাইলো ও। কিন্তু কিছু বলার আগেই সারাহ কথা বলে উঠলো।

“ও আচ্ছা,” খুশি হওয়ার ভঙ্গিতে বললো ও। “ক্যাপ্টেন হিকস অ্যাগনেস বিয়াত্তিকে বিয়ে করেছেন। গাইয়ের স্ত্রী ক্যারোলিনের বোন। আহা অ্যাগনেস। ইয়র্কে থাকার সময় আমরা খুবই কাছের বান্ধবী ছিলাম।”

টম ডেস্কের উপর ঝুঁকে এলো। “আপনি বলতে চাচ্ছেন অ্যাগনেস বিয়াত্তি আছে এখানে?”

 “উনি এখন অ্যাগনেস হিকস। আজ সকালেই তো দেখলাম। ওনার স্বামী আমাদের সৈন্যদলের প্রধান।” ফয়-এর চোখে এখন আর টমের প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই। কারণ এরা ওর ধারণার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে ও ঠিক নিশ্চিত না যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই ব্যাপারটাই ওকে উদ্বিগ্ন। করে তুললো। ওর পেশাগত উন্নতির পুরোটাই হয়েছে গাই কোর্টোনীর লেজুড়বৃত্তি করে। আর গাই অসম্ভষ্ট হলে তোটা রেগে যায়, সেটা ওর ভালোই জানা আছে। আবার যদিও যতোটা ভাব দেখাচ্ছে আসলে গাই-এর সাথে ও ততোটা ঘনিষ্ট, কিন্তু তবুও ও জানে যে গাই নিইজের পরিবারের লোকদেরকে খুব বেশি গোণে না। খুব কৌশলে সব সামলাতে হবে ওকে।

আগে এই অতিথিদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাক। ও চওড়া একটা হাসি দিলো। “আপনারা থাকার জায়গা চেয়াছিলেন। আমি নিশ্চিত ক্যাপ্টেন হিকস আর তার স্ত্রী আপনাদেরকে খুশি মনেই স্বাগত জানাবেন। আমি এখুনি আপনাদেরকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।”

*

যাওয়ার পথে টম স্বাভাবিক কৌতূহলবশতই চারপাশ দেখতে লাগলো। দুর্গের দেয়াল খুবই শক্ত, পাথরের তৈরি, ফাঁকে ফাঁকে তিনকোণা গম্বুজ। ওখান থেকে গুলি করা সহজ। তবে পুরো দুৰ্গটাই বালির উপরে বানানো।

“দুর্গে খাওয়ার পানির ব্যবস্থা কি?” জিজ্ঞেস করলো টম।

“নদী থেকে পানি আনা হয়,” ফয় জবাব দিলো। আবারও দরদর করে ঘামতে আরম্ভ করেছে সে। হাত দিয়ে নদীর ঘাট পর্যন্ত একটা পথ দেখালো। প্রায় চারশ গজ মতো দূরে।

“কেউ অবরোধ করলে তো পানির অভাবেই মরে যাবেন,” মন্তব্য করলো ফ্রান্সিস।

“ওহ! সেরকম কিছু হবে না। এই কালাগুলোর লড়াই করারই হিম্মত নেই। একটা গুলিই যথেষ্ট, সোটার শব্দেই ওরা জঙ্গলে গিয়ে পালাবে।”

 সারাহ হাচি দিলো একটা। ওরা গোডাউনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। আর কালো মরিচের গন্ধে ওর নাকে সুড়সুড়ি লাগছে। গোলাঘরের দরজাগুলো বন্ধ, কারণ এখন উপসাগরে কোনো জাহাজ নেই।

“বর্ষাকাল শুরু হয়ে গিয়েছে, এখন আর এদিক দিয়ে কোনো জাহাজ যাবে না। শরতের আগ পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্য পুরো বন্ধ।” দুঃখিত গলায় বললো ফয়।

“মরিচ কি আপনার মূল ব্যবসা নাকি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

ফয় মাথা ঝাঁকালো। “আগের মতো এখন আর দাম পাওয়া যায় না। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলোতে করে নির্দিষ্ট পরিমাণ মশলা সবসময় পাঠাতেই হয়। স্থানীয়দের সাথে চুক্তির কারণে এখানকার যতো মরিচ চাষ হয়। সবকিছুর একচেটিয়া খরিদ্দার আমরা, তাই কেনা আর বেচা দুটো ব্যবসা-ই আমাদের। যদি ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকে তাহলে সামান্য কিছু লাভ শেষ পর্যন্ত থাকে।”

 টম বুঝতে পারলো ‘ঠিক ব্যবস্থাপনা’ বলতে ফয় আসলে কি বুঝিয়েছে। ও যতোদূর শুনেছে, কোম্পানির এসব ছোট ছোট দূরবর্তী কুঠিকে সেখানকার গভর্নরেরা নিজেদের ব্যক্তিগত জায়গীর মনে করে। এরা স্থানীয়দেরকে যেমন ঠকায়, তেমন এদের উপরওয়ালাদের সাথেও দুই নম্বরি করে। ফয় যেটুকু লাভই করুক না কেন, তার খুব সামান্যই লেডেনহল স্ট্রিটে পৌঁছায়।

“এখানকার চাষীরা এতে খুশি?” অ্যানা জানতে চাইলো।

“খুশি?” ফয় যেনো আঁতকে উঠলো কথাটা শুনে। “আমার দেওয়া দামে যদি ওরা খুশি থাকে তাহলে সেটাকে আমি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নেবো।”

“ব্যবসা ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে হলে উভয় পক্ষকেই লাভবান হতে হয়।”

“আবার বলছি, এরা হচ্ছে অশিক্ষিত বর্বর একেকটা। এক মাস আগে কয়েকজন স্থানীয় চাষী আমার কাছে মাল বেচতে অস্বীকৃতি জানায়। আমি ওদের গলায় একটা তরবারি ধরে সোজা মাল আনতে পাঠিয়ে দেই। ওদের কিছু করার নেই। ওদের রানির আদেশ এমনই।”

টম থমকে দাঁড়ালো। “চিত্তাত্তিঙ্কারা-র রানি?”

আবারও ফয় সন্দিহান চোখে ওর দিকে তাকালো। “ওনার সাথেও আপনার খাতির আছে নাকি?”

“ডাঙায় ওঠার পর ওনার কিছু লোকের সাথে দেখা হয়েছিলো। আমার কাছ থেকে একটা দামি জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছে ওরা।”

“দামি? কি রকম?” ফয়ের চেহারা আগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে গেলো। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ওরা ভারতীয় কায়দায় বানানো একটা একতলা কিন্তু চওড়া বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এধরনের বাড়িকে বলে বাংলো। “চলে এসেছি।”

ফয় দরজায় টোকা দিলো। পিছনে সারাহ আর টম উদ্বিগ্ন দৃষ্টি বিনিময় করলো। সারাহ ওর বোনকে সর্বশেষ দেখেছে সেই ষোল বছর আগে। এখনো কি ও আগের মতো আছে?

একটা ভারতীয় কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। ফয়কে দেখে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখালো সে।

“তোমার মালকিনকে বলো যে কয়েকজন মেহমান এসেছেন।”

 কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই একজন মহিলাকে দেখা গেলো দরজায়। এসে দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দলটাকে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো সে। ভাল মতো দেখার জন্যে কয়েকবার চোখ পিটপিট করতে হলো তাকে।

“সারাহ?” দম আটকে বললো মহিলাটা। “আমি কি স্বপ্নে দেখছি নাকি?”

আনন্দের অতিশয্যে কাঁপতে শুরু করলো সে। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ভেবে টম দ্রুত গিয়ে তাকে ধরলো।

 “অ্যাগনেস, কান্না চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করে কোনোমতো বললো সারাহ। “আমিতো ভেবেছিলাম তোমার পুরনো বন্ধু সারাহ উইল্ডকে চিনতেই পারবে না।”

ফয় সরু চোখে ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করছে।

 “আপনার এক বোনের নামও না সারাহ ছিলো, মিসেস হিকস?”

“বেচারি, কয়েক বছর আগে সে মারা গিয়েছে।” অ্যাগনেস বুদ্ধি করে বললো। ও সারাহের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলো। “ভিতরে আসো। তোমার সাথের ওদেরকেও আসতে বলল।” টম, ফ্রান্সিস আর অ্যানার দিকে ইঙ্গিত করলো ও। “ইশ! কতদিন পর। অনেক গল্প হবে আজ। আপনিও থাকবেন নাকি, মি. ফয়?”

“দুঃখিত, আমার কিছু জরুরি কাজ আছে।” টুপির কোনা ধরে বললো ফয়। “আজকের মতো আসি। গুড ডে।”

ফয় যাওয়ার পর দরজা বন্ধ হতেই অ্যাগনেস এক প্রকার ঝাঁপিয়েই পড়লো সারাহের উপর। এতো জোরে জড়িয়ে ধরলো যে সারাহের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো।

“সারাহ,” নিচু স্বরে কাঁদতে লাগলো অ্যাগনেস। “আসলেই তুমি? আমি ভেবেছিলাম তুমি আফ্রিকাতে মারা গিয়েছে।”

“মরতে মরতে বেঁচেছি-তাও কয়েকবার।” অ্যাগনেসের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো সারাহ। তারপর ওর চেহারা থেকে কান্নায় ভিজে যাওয়া চুলগুলো সরিয়ে দিলো। “কিন্তু এইতো দেখা হলো।”

“তুমি এখনো বেঁচে আছে সেটা আমাকে জানাওনি কেন?”

“তুমি কোথায় আছ সেটা তো জানা ছিলো না। আর চিঠি দিলেও সেটা যে গাই-এর হাতে পড়বে না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলাম না।”

তারপর একটু সরে টমের দিকে মাথা দিয়ে ইঙ্গিত করলো।

“টম কোর্টনীকে মনে আছে?”

অ্যাগনেস আসলে অধিক আনন্দে পাথর হয়ে গিয়েছে। টমের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো ও। তারপর নরম স্বরে বললো, “তার মানে ক্যারোলিনের কথা-ই সত্যি। তুমি আর সারাহ জাঞ্জিবার থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে।”

টম কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো। “শেরপা-তে করে আমরা প্লইমাউথ থেকে চলে আসি।” সারাহ আর অ্যাগনেস তখন অনেক ছোট। এমনকি তখন টম ওদের দুজনকে আলাদা করে চিনতো-ও না। ও তখন ওদের বড় বোন ক্যারোলিনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু সে শেষমেশ গাইকে বিয়ে করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দুই বোনের চেহারায় যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। সারাহের তুলনায় অ্যাগনেসের চুল বেশি কালো, আর গায়ের রঙ বেশি ফর্সা। চেহারার টানটানে ভাব দেখেই বোঝা যায় ভালোই যত্ন নেয় ও নিজের। একসময় যে দুরন্ত কিশোরি ছিলো, তা আর এখন নেই। অবশ্য ওরা কেউই আর আগের মতো নেই।

 সবাই অ্যাগনেসের বসার ঘরে বসলো। পনের বছর আগে সারাহ আর টম গাই-এর কাছ থেকে জাঞ্জিবার ছেড়ে পালানোর পর থেকে যা যা হয়েছে সব খুলে বললো সারাহ। আফ্রিকায় ওদের অভিযান, কেপ টাউনে বিয়ে করার কথা থেকে শুরু করে ফ্রান্সিসের সাথে দেখা হওয়া আর এখানে এসে জাহজডুবি, সবকিছুই সংক্ষেপে জানালো অ্যাগনেসকে।

অ্যাগনেস মোহাবিষ্টের মতো চুপচাপ শুনে গেলো সব। পুরোটা সময় ও সারাহের হাত ধরে রাখলো, এমন ভাব যেনো ছেড়ে দিলে সারাহ আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে।

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি আমার সামনে বসে আছো,” ফ্যাসফেসে গলায় বললো ও। “আর উইলিয়াম কোর্টনীর ছেলে ফ্রান্সিস এতো বড় হয়ে গিয়েছে। পুরোটাই অলৌকিক লাগছে আমার কাছে।”

“ভাগ্যের নির্মম খেলায় আমরা আবার একসাথে হলাম,” টম স্বীকার করলো। “তবে এখন আগে ভাবতে হবে এই ঝামেলা থেকে পালাবো কিভাবে। আপনার স্বামীকে কি বিশ্বাস করা যায়?”

অ্যাগনেস মাথা ঝাঁকালো। “ক্যাপ্টেন হিকসের সাথে গাই কোর্টনীর কোনো খাতির নেই। বোম্বেতে গাই যতোভাবে পারে আমাদেরকে অপমান করেছে। আমার মনে হয় সে আমাদেরকে দেখতেই পারে না। গাই নিজে শয়তানি করে আমার স্বামীকে এই জঘন্য জায়গায় পাঠিয়েছে।”

“আর মিস্টার ফয়?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞে করলো।

“মিস্টার ফয় আছে শুধু নিজের ধান্দায়। গভর্নর হিসেবে উনি এখানকার সৈন্যদলের প্রধান, আর সেটা আমার স্বামীকে বারবার মনে করিয়ে দিতে ছাড়েন না। ওনার বৌ-টাও ওরকম। তবে আমি আর আমার স্বামী খেয়াল রাখবো যাতে ওরা আমাদের আসল সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই না জানে।”

“তাহলে ঠিক আছে, সারাহ বললো। “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।”

বলেই ও জ্ঞান হারিয়ে ধপ করে অ্যাগনেসের কোলের উপর পড়ে গেলো।

“হায় হায়,” আর্তনাদ করে উঠলো অ্যাগনেস। “করেছি কি? আপনারা সবাই না খেয়ে, ভেজা কাপড়েই বসে আছেন। আর আমি কিনা বকবক করেই যাচ্ছি। আপনাদের এখন খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করা দরকার।”

টম আর ফ্রান্সিস ধরাধরি করে সারাহকে ভিতরে নিয়ে গেলো। ওর গা গরম হয়ে আছে, জ্বর আসছে সম্ভবত। ওকে এতো কষ্ট দেওয়ার জন্যে টম মনে মনে নিজেকে গালাগাল করতে লাগলো। বিছানায় শুইয়ে একটা কম্বল দিয়ে সারাহের শরীরটা ঢেকে দিলো ও। অ্যাগনেস ডাল আর লেবুর তৈরি একটা স্যুপ নিয়ে এলো। তারপর সারাহের পাশে বসে যত্ন করে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগলো।

সদর দরজা খুলে গেলো। সামনের ঘর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ অ্যাগনেসের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভিতরে এসে ঢুকলো। কয়েক মুহূর্ত পর এঘরের দরজায় দেখা গেলো তাকে। একজন লম্বা, একহারা লোক। বালু রঙের চুল একেবারে খুলির সাথে লাগিয়ে কাটা। চামড়া রোদে পুড়ে লাল হয়ে আছে। বোম্বে রেজিমেন্টের লাল, সবুজে মেশানো পোশাক পরনে ওনার।

“ফয় বললো বাসায় নাকি মেহমান এসেছে।” আগন্তুকদের দিকে নজর বুলাতে বুলাতে সে হাত বাড়িয়ে দিলো। “এলিয়াহ হিকস, অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।”

“টম…” টম ইতস্তত করলো। “টম কোর্টনী।”

“কোর্টনী?” হিকসের স্বর বিস্ময় আর সন্দেহে ভারী হয়ে গেলো। সে অ্যাগনেসের দিকে ফিরলো। “তুমি এদেরকে…”

 “এরা সবাই ঘরের লোক, সারাহের ফ্যাকাশে, উষ্ণ গাল মালিশ করতে করতে অ্যাগনেস বললো। “এ হচ্ছে আমার বোন সারাহ। বিশ বছর পরে ওকে দেখলাম আমি। আমাদের ভাতিজা ফ্রান্সিস কোর্টনী। উইলিয়ামের ছেলে।”

হিকস কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। টম আর ফ্রান্সিসের সাথে করমর্দন করে অ্যানার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালো ও। তারপর অ্যাগনেস সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিলো। “ওর বিশ্রাম দরকার। এখানে এতে হৈ চৈ করলে হবে না। যাও সবাই!”

 মহিলাদেরকে ওখানে রেখে আবার বসার ঘরে ফিরে এলো বাকিরা। হিকস ছেলেদের জন্যে বোয়া জামা আর পায়জামা এনে দিলো। ফ্রান্সিসের ঠিকমতোই হলো, তবে টম জামার বোতাম লাগাতে গলদঘর্ম হয়ে গেলো।  ওয়াইন দিয়ে ওদেরকে আপ্যায়ন করলো হিকস। সামান্য পরেই টেবিলে মাছ আর ভাত সাজিয়ে ওদেরকে ডাক দিলো কাজের মেয়েটা।

 “এই জঘন্য গরম,” হিকস অভিযোগের সুরে বললো। “ঈশ্বর জানে কিভাবে এখনো টিকে আছি।”

খাওয়া শেষে আবার ওয়াইন খেতে খেতে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলো ওরা। হিকস কম কথার মানুষ, আর এখন এই সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিদেরকে ও কি বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিলো না।

 টম ও গ্লাসটা দুর্গের দিকে তাক করে বললো, “জায়গাটায় নিরাপত্তা দেখলাম তেমন ভালো না।”

 হিকস মুখ বেজার করে বললো, “এসব ফয়ের কারবার। লোকটা এতো বেশি হিংসুটে যে আমি যা-ই বলি না কেন, তার কাছে মনে হয় যে তাকে ছোট করার জন্য বলছি। তাই আমার পরামর্শের উল্টোটা করে সবসময়। আমি আমার লোকদের নিয়ে মহড়া করতে পারি না, বা এলাকাটা একটু টহলও দিতে পারি না। সে কোন না কোনো ছুতো তুলে আমার কাজে বাগড়া দেবেই।”

টম খুশি হলো যে এখানকার এই দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যে অ্যাগনেসের স্বামী কোনোভাবেই দায়ী না। সত্যি কথা বলতে লোকটার সোজা সাপ্টা হাবভাব আর সরাসরি সত্যিটা বলার মানসিকতা টমের খুবই পছন্দ হলো। এমন একজনকে ওদের পক্ষে পেয়ে ভালোই হয়েছে।

আর এ হচ্ছে আমার ভায়রা ভাই, মনে মনে ভাবলো টম। এতোদিন পর পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা দুই বোন আবার ভাগ্যের ফেরে কিভাবে একত্রিত হলো সেটা ভেবে টম অবাক হলো।

“স্থানীয় লোকজন কেমন?”

“খুব বেশি পছন্দ করে না আমাদেরকে। ফয় তাদেরকে ক্রমাগত খুঁচিয়েই চলে। তার শুধু নিজের লাভের চিন্তা। তাই এসব করতে গিয়ে ও যে আসলে কি ক্ষতিটা করছে সেটা চোখে পড়ে না। লোকজন না খেয়ে মরলেও ফয় নিজের মর্জির বাইরে এক দানা মরিচও কেনে না। এখানকার ব্যবসায়ীদেরকে বাধ্য করে ওর বলা দামে সব বিক্রি করতে। যদি তারা রাজি না হয় তাহলে কি করে তা আর না-ই বলি।”

“ওরা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু করে না?”

“ফয়ের বিশ্বাস রানি এসব সামাল দেবেন।”

টমের চেহারা বাঙলা পাঁচের মতো হয়ে গেলো। “এই নিয়ে তৃতীয়বার এই রানির কথা শুনলাম। কে ইনি?”

“স্থানীয় রানি। বয়স খুবই কম। কিন্তু আমি যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে মানসিকতার দিকে থেকে সে আসলে একটা সাপের চাইতে কম না। তার দরবারে দুটো পক্ষ। একদল আমাদের সাথে ব্যবসা করতে রাজি, আর একদল আমাদেরকে তাড়িয়ে দিতে চায়। সে এদের দুই দলকেই সামলে রাখে। তবে উপায়টা খুব বেশি সুন্দর না।” :

 “কিন্তু আমিতো দেখলাম রানির লোকজন ইংরেজদের সাথে খুব বেশি ভালো আচরণ করে না।”

টম, হিকসকে গ্রামের ঘটনাটা খুলে বললো। হিকস মাথা ঝাঁকালো।

“টুঙ্গারকে চিনি। রানির সেনাপতিদের একজন। ও ইংরেজদের পছন্দ করে না। কারণ আমরা আসার আগে ওর চাচা-ই মরিচের ব্যবসা সব নিয়ন্ত্রণ করতো।”

“ও আমার মূল্যবান একটা জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছে। একটা তরবারি। আমার পরিবারের কাছে কয়েক প্রজন্ম ধরে আছে ওটা। ওটাকে উদ্ধার করতে হবে।”

খাওয়াদাওয়া আর শুকনো কাপড় পাওয়ার পর টমের মন আপনাআপনি আবার নীলাখচিত তরবারিটার দিকে চলে যাচ্ছে। ওটা শুধু একটা অস্ত্র না, ওর কাছে ওটা কোটনী পরিবারের গৌরব আর ইজ্জতের প্রতিনিধি। এখনতো হাই উইন্ডও হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। আছে শুধু তরবারিটাই। টম ওখানে বসেই একটা প্রতিজ্ঞা করলো : তরবারিটা উদ্ধার না করে ও এই জায়গা ছেড়ে নড়বে না।

 “ফয়ের ইচ্ছা আগামী তিনদিনের মধ্যে রানির দরবারে দেখা করতে যাবে, হিকস বললো। “শুনে টুঙ্গার আবারও ঝামেলা করছে। তাই ফয় ওর একটা বিহিত করতে চাচ্ছে। আপনিও এই ফাঁকে রানির সাথে ওটা ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আলাপ করতে পারেন। তবে রানি উপহার নিতেই পছন্দ করেন, মনে হয় না ফেরত দিতে সম্মত হবেন। সে-ও মিস্টার ফয়-এর মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

“তাহলেতো ভালোই ঝামেলা হবে মনে হচ্ছে,” চিন্তিত মুখে শেষমেশ বললো টম।

*

সেরাতে টম মরার মতো ঘুমালো। ঘুম থেকে উঠে দেখে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। সারাহের অবস্থাও আগের চাইতে ভালো। তবে সকালে অ্যাগনেস যখন ওকে খাওয়াতে গেলো তখন কয়েক চামচের বেশি খেতে পারলো না।

একজন কাজের লোক একটা চিরকুট এনে টমকে দিলো। ফয় পাঠিয়েছে। টম ভেবে পেলো না কি এমন খবর যে ফয় নিজে ওর অফিস থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে এই বাসায় এসে দিতে পারলো না।

আশা করি আপনি আমাদের মধ্যকার চুক্তিটা ভুলে যাননি, চিরকুটে লেখা।

“তার মানে সে এখনি আমাকে জাহাজডুবির ওখানে গিয়ে দেখতে বলছে যে কিছু পাওয়া যায় কিনা,” টম বুঝতে পারলো। “বুঝতে পারছি যে আমরা যদি খরচাপাতি পরিশোধ করতে না পারি তাহলে তার জন্যে বাড়তি ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবো।”

“আমি যাবো নাহয় আপনাদের সাথে,” হিকস বললো।

“তাহলেতো ভালোই হয়,” কৃতজ্ঞচিত্তে বললো টম। “তবে এখানে আপনার কাজের যেনো আবার গাফিলতি না হয়।”

হিকস মুখ দিয়ে অবজ্ঞাসূচক একটা শব্দ করলো। আমি সারাদিনে যা করি, তার চাইতে নারিকেল কুড়ানো ভালো। মিস্টার ফয় সারাদিনে আমার চেহারা না দেখতে পেলে বরং খুশিই হবেন।”

টম কেস্ট্রেল-এর লোকদের মধ্যে আটজনকে পেলো যারা এখনো অক্ষত দেহে আছে। হিকস ওর লোকদের মধ্য থেকে চারজন সেপাইকে নিলো ওদের সাথে। নেতৃত্বে থাকলো মোহিত নামের এক হাবিলদার। লোকটার মোচটা বেশ দর্শনীয়। হাবিলদার হচ্ছে বোম্বের সেনাবাহিনির সার্জেন্টের সমতুল্য। দুজনের মধ্যেকার আন্তরিকতা দেখেই টম বুঝলল হিকস এর উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে।

একটা ভাড়া করা স্থানীয় নৌকায় রওনা দিলো ওরা। এগুলোকে গালিভাত বলে ডাকা হয়। জাহাজের ডিঙির সমানই বড়, তবে পাল খাটানো যায়। টম চিন্তিত মুখে আকাশের দিকে খেয়াল করতে লাগলো। তবে ঝড়টা শেষ পর্যন্ত কেটেই গিয়েছে। বাতাসের টানে মসৃণভাবে ভেসে চললো গালিভাত। ওটার তিনকোণা পালটা একদম পুরোটা ফুলে ফেঁপে আছে।

“ডোরিয়ান থাকলে ভালো হতো,” আক্ষেপ করে টম বললো। “ও ঠিকই ভাঙা জাহাজ থেকেও অনেক কিছু বের করে ফেলতো।”

“ভাগ্য ভালো হলে, কয়েকদিন পরেই উনি গনের সৈকতে বসে আবোলির সাথে কফি খেতে খেতে কেমন কামাই করলেন সেসব হিসাব করবেন,” ফ্রান্সিস বললো।

ব্রিঞ্জোয়ানে ওরা এসেছিলো হাটা পথে, টম সেসময় সৈকতের কিছুই দেখতে পায়নি। দিগন্ত বরাবর কয়েক ঘণ্টা নৌকা চালালো ওরা। আকাশ পুরোপুরি মেঘমুক্ত না, যেকোনো সময় আবার প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে যেতে পারে।

ওরা একটা ছোট বেরিয়ে থাকা চড়া পেরিয়ে একটা লম্বা কিন্তু অগভীর অংশে এসে পৌঁছালো। টমের মনে হলো কেঁদেই দেবে। কেস্ট্রেলকে দেখা যাচ্ছে সামনে। একটা বিশাল ধ্বংসস্তূপ। বাতাস আর ঢেউ ওটাকে তীরের কাছাকাছি ঠেলে এনেছে। পানি এখানে এতো কম যে ওটার ভাঙা ডেক পানির উপরে উঠে আছে।

তবে জাহাজটা খালি না। তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে ওটার উপর। সৈকতে দাঁড়ানো আরো একদল লোককে চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। সৈকতের লোকগুলো একপাল ষাঁড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের গায়ে একটা শেকল বেঁধে অপর প্রান্ত বাধা হয়েছে ষাঁড়গুলোর সাথে। টম দেখলো লোকগুলো সপাং করে ষাড়ের গায়ে বাড়ি দিলো আর জম্ভগুলো ঝাঁকি মেরে সামনে বাড়লো। ওদের গায়ে বাঁধা শেকলগুলোর সমুদ্রের পানি থেকে বেরিয়ে এলো। পানি ঝরছে ওগুলো থেকে। বঁড়গুলো সৈকত ধরে উঠতে উঠতে গাছের সারির ওপাশে হারিয়ে গেলো। ওখানে কিছু পাম গাছ কেটে জায়গা করা হয়েছে।

“ওরা কি পুরো জাহাজটাকেই ডাঙায় টেনে তুলবে নাকি?” ফ্রান্সিস অবাক হলো।

হিকস হাতের টেলিস্কোপটা দিয়ে সৈকতের দিকে নজর রাখছে। ও সেটা টমের হাতে ধরিয়ে দিলো। ওটা দিয়ে টম পানির নিচে একটা কালো হাঙরের আকৃতির জিনিস দেখতে পেলো।

 ষাঁড়গুলো ওটাকে ঢেউয়ের নিচ থেকে টেনে তুলতেই দেখা গেলো ওদের জাহাজের নয় পাউন্ডের কামানগুলোর একটা। ওটা পানির উপরে উঠে আসতেই লোকজন দৌড়ে গিয়ে ওটাকে থেকে একটা কাঠের খাঁচার মধ্যে তুলে দিলো যাতে আর গড়িয়ে না যেতে পারে।

“এরা করছেটা কি?”

“ইউরোপিয়ান কামান এখানকার লোকের কাছে সাত রাজার ধনের মতো,” হিকস বললো। “ওদের রানি এগুলোর জন্যে এগুলোর ওজনের সমান স্বর্ণ দিতে রাজি। কিন্তু তোমার ভাই গাই পর্যন্ত অস্ত্র বেচা-কেনা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করেছে। লাভ যতোই হোক, এগুলো যে একসময় কোম্পানির জাহাজ বা কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না তার নিশ্চয়তা কি?”

টম আবার সৈকতটা পর্যবেক্ষণ করলো। কামানটা গাছের সারির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর ষাঁড়গুলোকে আবারও নিয়ে আসা হলো পানির কাছে। দুজন লোক শেকলের মাথা হাতে নিয়ে ভাঙা জাহাজটার দিকে এগিয়ে গেলো। বোঝাই যাচ্ছে ওরা সবগুলো কামানই উদ্ধার করতে চায়।

টেলিস্কোপ দিয়ে টম ওদের সর্দারকে দেখতে পেলো। লম্বা, চওড়া কাধ, অন্য সবার চাইতে তার মাথা উঁচিয়ে আছে। লোকটার উর্ধাঙ্গে কোনো কাপড় নেই। কোমরে পিস্তল গোজা, আর বুকে কোনাকুণিভাবে ঝুলছে কার্তুজের বেল্ট। দুটো তরবারিও দেখা গেলো। ছোট ছোট সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে কাজ করাচ্ছে সে। তবে লোকগুলোর যেভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে কাজে ছুটছে সেটা দেখে অবাক হলো টম। এরা যে খুব ভালমতো প্রশিক্ষিত তা-ই না, এরা লোকটাকে প্রচণ্ড ভয়ও পায়।

“একেবারে জবরদস্ত এক লোক দেখি,” টম বিড়বিড় করে বললো। লোকটাকে দেখে মনে কু ডাক ডাকছে ওর। “এ আবার কে?

 হিকস টেলিস্কোপটা নিলো আবার। “একে আগে কখনো দেখিনি। সম্ভবত রানির নতুন লোক।”

“অথবা ডাকাতও হতে পারে।”

“রানির এলাকা থেকে জাহাজডুবির মাল লুট করতে হলে বুকের পাটা থাকতে হবে। আর কামান সরানো আর লোকজনের টাকার ব্যাগ মেরে দেওয়া এক জিনিস না। এতো গুলো লোক নিয়ে আসা, এতোগুলো ষাড় জোগাড় করা… আর নিয়ে যাওয়ার ঝামেলার কথা বাদই দিলাম। রানির অনুমতি ছাড়া এতোসব সম্ভব না।”

“তাহলেতো দেখা যাচ্ছে রানির সাথে দেখা করতে গেলে আমার তরবারির সাথে সাথে আরো অনেক কিছুই ফেরত চাইতে হবে।”

 হিকসের ভ্রু কুঁচকে গেলো। “আমার এসব পছন্দ হচ্ছে না। ওই মহিলা নিশ্চিত কোনো শয়তানি ফন্দি আঁটছে। আমি নিশ্চিত।”

সৈকতের লোকেরা গালিভাতটাকে দেখতে পেলো। চিৎকার করে হাত ছুঁড়তে লাগলো তারা। তবে ওদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে নাকি সরে যেতে হুশিয়ার করছে সেটা বোঝা গেলো না। টম আবার টেলিস্কোপে চোখ দিলো।

 “সোজা যেতে থাকো,” হাল ধরে রাখা আলফ উইলসনকে বললো টম। “ওরা সংখ্যায় অনেক, আর আমরা যে ওদেরকে এসব করতে দেখে ফেলেছি। সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না।” ওর মনে হয় না যে সৈকতের লোকগুলোর কাছে কোনো স্পাই গ্লাস থাকবে। ভাগ্য ভালো হলে ওরা বুঝবেই না যে নৌকার লোকগুলো বিদেশি।

 হিকস ওর চিন্তা ধরতে পারলো। “যদি বোঝাতে চান যে আমরা নিরীহ যাত্রী, তাহলে টেলিস্কোপটা নামিয়ে রাখলেই ভালো হবে। এখানকার জেলেরা এরকম কিছু ব্যবহার করে না।”

তবুও টম আরো একবার সর্দার লোকটাকে না দেখে পারলো না। কিন্তু ও টেলিস্কোপটা চোখে দিতেই লোকটাও সোজা ওর দিকে তাকালো। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়, কিন্তু টমের মনে হলো এতো দূর থেকেও সে টের পেয়ে গিয়েছে। লেন্সের ভিতর দিয়ে লোকটার চোখ দেখতে পেলো টম। ও নিশ্চিত যে একে জীবনেও কখনো দেখেনি, কিন্তু তবুও চেহারাটা নজরে আসতেই মেরুদণ্ড। বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেলো। অব্যাখ্যেয় কোন কারণে ওর মনে হলো একে বহুদিন ধরে চেনে, মনে হলো যেনো আয়নায় নিজের চেহারাটাই দেখতে পেলো।

ও টেলিস্কোপটা নামিয়ে আবার চামড়ার ব্যাগে রেখে দিলো। শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে, হয় ভুল দেখেছে নইলে ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ কেপ টাউনে দেখা সেই সবুজ দ্যুতির কথা মনে পড়লো ওর। একটা আত্মা আবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসবে।

টেলিস্কোপ ছাড়া সৈকতের লোকটাকে এখন পিঁপড়ার মতো ছোট লাগছে। কিন্তু তবুও টম ওর উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। ওরা জায়গাটা চক্কর দিয়ে আবার উল্টোদিকে ফিরে যেতে যেতে যখন জায়গাটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো, তখনই টম চোখ নামালো।

আবারও ব্রিঞ্জোয়ানে ফিরতে লাগলো ওরা। হিকসের সতর্কবার্তাটা কানে বাজছে টমের। ওই মহিলা নিশ্চিত কোনো শয়তানি ফন্দি আঁটছে।

*

পেটের উপর ভর দিয়ে ক্রিস্টোফার খাড়া পাহাড়টার ধার দিয়ে নিজেকে টেনে তুললো। ওখান থেকে একটা পচা গাছের উপর দিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো নিচের বহরটা। সবার সামনে আছে একটা পর্দায় ঘেরা পালকি, আটজন ডুলি বইছে সেটা। পিছনে আছে বিশজন সশস্ত্র লোক।

তামান্না উঠে এলো ওর পাশে। “বলেছিলাম না যে অপেক্ষা করলে ভালো

এই একই বহরটাকে তিনদিন আগে এই রাস্তা দিয়েই উল্টোদিকে যেতে দেখেছে ওরা। ক্রিস্টোফার চেয়েছিলো তখনই আক্রমণ করতে, কিন্তু তামান্না বলেছিলো ধৈর্য ধরতে। “এরা ব্রিঞ্জোয়ানের ইংরেজ কুঠিতে কাপড় নিয়ে যাচ্ছে। যখন ফিরে আসবে তখন এদের কাছে থাকবে বিক্রি করে পাওয়া স্বর্ণ।”

এখন সেটার সত্যতা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে ক্রিস্টোফার। তিন দিন আগের বহরে প্রায় একশো স্থানীয় কুলি ছিলো পালকিটার পিছনে। সবার মাথায় ছিলো নিখুঁতভাবে বোনা সৃতি কাপড়ের গাঁটরি। এখন আর ওরা নেই। তার বদলে আছে একটা মাত্র খচ্চর। ওটার পিঠের বস্তাটার যে অনেক ওজন তা জটার চলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে। এতোগুলো পাহারাদারের ভীড়ে ওটা যে নির্ভয়ে চলছে। তাতেই ক্রিস্টোফার বেশ অবাক হলো। সব দেখে একটু পিছনে সরে এলো ও।

 মনের ভিতর কেমন যেনো একটা আশংকা দোলা দিয়ে গেলো ওর, কেনো এমনটা হলো ভেবে পেলো না। ব্যাপারটা যে ওর বিবেকের দংশন না সেটা ও নিশ্চিত। ছয় মাস হয় ও তামান্নার ডাকাত দলে যোগ দিয়েছে, আর এর মাঝে কতোবার যে এই কাজ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। একাকী পথচারীদেরকে ছিনতাই করে খুন করেছে, কড়া পাহারায় থাকা ক্যারাভানও লুট করেছে। অব্যাহত সফলতার কারণে ওদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। লাভ ক্ষতি দুটোই হয়েছে তাতে। লাভ হচ্ছে ওদের দলে এখন এক ডজন লোক। আর ঝামেলা হচ্ছে ওদেরকে আরো উত্তরে চিত্তাত্তিস্কারাতে পালিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ আগের জায়গার রাজা ওদেরকে ধরার জন্যে মরণ পণ করেছিলেন।

“এখনই আক্রমণ করবো?”

তামান্না একটা শয়তানি হাসি হাসলো। “বেচারা খচ্চরটার পিঠটাই ভেঙে যাবে যদি আমরা ওর পিঠের বোঝাটা কমিয়ে না দেই। ভয় পাচ্ছো নাকি?”

“আরে নাহ।”

“তাহলে ওরা পালানোর আগেই ফাঁদটা পেতে ফেলা যাক।”

জায়গাটা আক্রমণের জন্যে একেবারে উপযুক্ত। রাস্তাটা এখানে মোড় নিয়ে একটা সরু গলিতে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে। কাদা কাদা অবস্থা। উপরের চড়াটা ভাঙা পাথরের টুকরো দিয়ে ভরা, ফলে লুকিয়ে থাকার জন্যে প্রচুর জায়গা পাওয়া যায়। প্রহরীরাও জানে ব্যাপারটা। ক্রিস্টোফার দেখলো প্রহরীরা সবাই নিজেদের তরবারি খাপমুক্ত করে হাতে তুলে নিলো। এদের সর্দার হচ্ছে লাল পাগড়ি পরা বিশালকায় একটা লোক। সে কিছু একটা আদেশ দিলো। ওদের চারজনের হাতে বন্দুক আছে, তারা সবাই বন্দুকের ঘোড়ায় আগুন জ্বেলে প্রস্তুত করে নিলো, যাতে দরকার হওয়া মাত্র গুলি ছুঁড়তে পারে। খাড়া ধারটায় কড়া নজর রেখে আগাতে লাগলো ওরা, সামান্য নাড়াচাড়াও চোখ এড়াচেই না। তবে ক্রিস্টোফারও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ওস্তাদ। দম বন্ধ করে পড়ে রইলো ও।

ক্যারাভানটা বাঁক ঘুরতেই একটা আতংকিত চিৎকার শোনা গেলো আর দলটা থেমে পড়লো। একটা গাছ ভেঙে পড়ে পুরো রাস্তা আটকে দিয়েছে। প্রহরীরা খচ্চরটাকে ঘিরে একটা চক্র করে দাঁড়িয়ে গেলো, চেহারা পাথরগুলোর দিকে। ক্রিস্টোফার দেখলো সর্দার লোকটা গাছের গোড়াটা পরীক্ষা করে দেখছে। নিজের কাজ ভালোই জানে সে। যদি খুঁড়িটায় কুড়ালের আঘাতের চিহ্ন থাকে তাহলে ঠিকই বুঝে যাবে যে ইচ্ছা করে গাছটা ফেলা হয়েছে।

কুড়ালের কোনো দাগ নেই। ক্রিস্টোফারের লোকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটি খুঁড়ে এমন অবস্থা করে রাখে যাতে গাছগুলো নিজের ভারেই ঢলে পড়ে। তাতে করে মনে হয় যে ব্যাপয়ারটা আপনাআপনিই ঘটেছে।

সর্দারও ধোকা খেয়ে গেলো ব্যাপারটায়। বন্দুকধারী লোকগুলো পাহারায় থাকলো আর বাকিরা অস্ত্র নামিয়ে রেখে গাছটা ঠেলে সরানোর কাজে লেগে গেলো। ঝটপট কাজ করতে লাগলো তারা। মুলত জানের ভয়েই যতো দ্রুত সম্ভব এলাকাটা পার হতে চায়। সেই সাথে সর্দারের গালাগাল তো আছেই। কয়েক মিনিটের ভিতরে ওরা ভারি গাছটাকে ঠেলে সরিয়ে ফেললো। কোনো আক্রমণ এলো না দেখে ওদের দুশ্চিন্তাও কমলো কিছুটা। ক্রিস্টোফার ওদের ঠোঁটে হাসি দেখতে পেলো, হাসির শব্দও কানে এলো ওর। এতে ভয় পেয়ে যাওয়ায় এখন সবাই কেমন লজ্জা পাচ্ছে। পালকির পর্দার ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এলো। ইশারায় রওনা দেওয়ার জন্যে আদেশ করছে।

প্রথম তীরটা সরাসরি সর্দারের গলা এফোড় ওফোড় করে দিলো। পরেরটা লাগলো খচ্চরের গায়ে। তামান্নার লোকেদের বন্দুক আছে, কিন্তু ওরা সবসময় প্রথম আক্রমণটা করে তীর দিয়ে। এতে করে শিকার দিশেহারা হয়ে। যায়। কারণ তীর ছুড়লে কোনো ধোয়া বা অন্য কিছু দেখা যায় না যা দিয়ে কেউ অনুমান করবে যে আক্রমণ ঠিক কোথা থেকে আসছে।

সর্দার না থাকায় দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। এলোপাথাড়ি গুলি করতে লাগলো ওরা। খামাখা বন্দুকের গুলিও খরচ হলো আবার গুলির ধোঁয়ায় নিজেরাই কিছু দেখতে পেলো না আর। বন্দুকে আবার গুলি ভরতে পারার আগেই তামান্না আর ওর লোকেরা ঢাল বেয়ে নেমে এসে আক্রমণ করলো। ক্রিস্টোফার উরুমিটা অবমুক্ত করে যোগ দিলো ওদের সাথে। ধোয়ার ভিতর দিয়েও দেখতে পেলো একজন প্রহরী মরিয়া হয়ে বন্দুকে গুলি ভরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। উরুমিটা সোজা উড়ে গিয়ে ওর বুকটা চিরে দিলো। দক্ষ হাতে ক্রিস্টোফার আবার ওটাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে হাতল ঘুরিয়ে আর একটা প্রহরীর দিকে ছুঁড়ে দিলো। তার হাঁটু কেটে বেরিয়ে এলো ওটা। আর্তনাদ করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো লোকটা।

কিছুদিন আগেও ক্রিস্টোফারও ছিলো এরকমই একজন প্রহরী। ধোয়ার ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলো ও, কিন্তু তামান্নার লোকেরা আগেই সব সেরে রেখেছে। উরুমিটা আর ব্যবহার করতে হলো না ওকে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেলো আটজন ডুলি বাদে আর কেউই জ্যান্ত নেই। শরীরের উর্ধাংশে কিছুই নেই লোকগুলোর আক্রমণের প্রচণ্ডতা আর দ্রুততায় ওরা আর জায়গা ছেড়ে নড়ার সময় পায়নি।

হাতে অস্ত্র থাকলে এরাও কঠিন প্রতিপক্ষ হতে পারতো। তবে ক্রিস্টোফার ভারত সম্পর্কে একটা জিনিস জানে, এখানে জাত ব্যাপারটা খুব কড়াভাবে মানা হয়। একজন ডুলি কখনো লড়াই করবে না, আবার একজন যোদ্ধা কখনো গরুর দুধ দুইবে না। একজন লোকের জন্মই তার নিয়তি ঠিক করে দেয় এখানে।

তাই ওরা যখন পালকি ফেলে ছুট দিলো তখন ক্রিস্টোফার বিশেষ অবাক হলো না। এমনটাই আশা করেছিলো এদের কাছ থেকে। ওদেরকে যেতে দিয়ে পালকিটার দিকে আগালো ও।

পর্দা সরে গেলো। একজন বেটে, মোটাসোটা লোক মাথা বের করলো ভিতর থেকে। পরনে সবুজ রঙের রেশমি কাপড়। বাইরের দৃশ্য চোখে পড়তেই চেহারার প্রচণ্ড রাগের অনুভূতি পাল্টে নির্জলা আতংক ভর করলো সেখানে। ক্রিস্টোফার ঠিক সামনেই তার দিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।

লোকটা হাতের আংটিগুলো খুলে ক্রিস্টোফারের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিতে শুরু করলো। মোটা আঙুল থেকে আংটি খোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখে খুব মজা পেলো ক্রিস্টোফার।

 “এর চাইতে আঙুলগুলো কেটে দিলে তাড়াতাড়ি খুলবে,” সাহায্য করার ভঙ্গিতে বললো ক্রিস্টোফার।

লোকটা বিলাপ করতে করতে আরো জোরে চেষ্টা করতে লাগলো। কার্নেলিয়ান আর চুনি বসানো একটা আংটি এতো বেশি এঁটে ছিলো যে খোলার সময় চামড়া সমেত উঠে এলো। রক্ত উপচে পড়তে লাগলো ক্ষত থেকে।

ক্রিস্টোফার তরবারির ডগাটা লোকটার গলায় ঠেকালো। যেনো নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেলো লোকটা।

“এতো কষ্ট করতে হবে না। তোকে মারার পর আমি নিজেই খুলে নেবো।”

ভয় পেয়ে আবার নিজের পালকির ভিতরে সেধিয়ে গেলো লোকটা। টান দিয়ে পর্দাগুলো ছিঁড়ে ফেললো ক্রিস্টোফার। ভিতরে দেখা গেলো অনেকগুলো নকশা করা বালিশ। ওগুলো থেকে সুগন্ধ ভেসে আসছে। ক্রিস্টোফারের পছন্দ হলো বালিশগুলো। এগুলোতে রক্ত যাতে না লাগে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

“দয়া করুন,” লোকটা অনুনয় করলো। “আপনি কি জানেন, আমি কে?”

“না,” ক্রিস্টোফার বললো।

ওর চোখ লোকটার টাকা পয়সার হিসাব কষতে ব্যস্ত থাকায়, সওদাগরের চোখের ধূর্ত দৃষ্টিটা খেয়াল হলো না।

“আমার নাম মহেন্দ্র পুলা। আমার ভাইয়েরা সব বড় বড় ব্যবসায়ী। আমাকে ছেড়ে দিলে ওনারা অনেক টাকা দেবেন।”

 “আমরা কাউকে অপহরণ করি না,” শান্ত স্বরে ব্যাখা করলো ক্রিস্টোফার।

 “আমার ভাইয়েরা এখান থেকে কাছেই থাকে। সব কিছুর ব্যবস্থা করতে কয়েকটা দিন লাগবে মাত্র।” লোকটা হাঁটু মুড়ে বসে অনুনয় করতে লাগলো। “সামনেই বর্ষাকাল আসছে, তখন রাস্তাঘাটে আর পালকি চলবে না। বর্ষার আগে তাই বড়সড় একটা দাও মারতে পারলে আপনাদেরই লাভ।”

“ঐ খচ্চরে যে স্বর্ণ আছে তা দিয়েই হেসে খেলে চলে যাবে অনেকদিন।”

সওদাগরের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। “ওটার জন্যে আপনারা আমার লোকগুলোকে মেরেছেন? ওই খচ্চরের পিঠের জিনিসের জন্যে?”

“তাছাড়া কি?” ক্রিস্টোফার কোপ দেওয়ার জন্যে তরবারি তুললো। লোকটার চেহারার আতংক তারিয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে। বালিশ জাহান্নামে যাক। ওগুলো কোনো অশিক্ষিত চাষীর কাছে বেঁচে দেবে। রক্তের দাগ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা থাকার কথা না। তরবারি নামিয়ে কোপ দিলো ও।

“থামো।”

তামান্নার গলা শুনে সওদাগরের ঘাড়ের এক ইঞ্চি আগে ক্রিস্টোফারের তরবারি থেমে গেলো। এই একটা মাত্র কণ্ঠই ক্রিস্টোফারকে থামাতে পারে। ঘুরে দেখে তামান্না একটা মোটা সোটা বস্তা নিয়ে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। সওদাগর ততোক্ষণে আকূল হয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।

“কি হয়েছে?”

কোনো কথা না বলে তামান্না লোকটাকে টেন দাঁড় করিয়ে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বললো, “স্বর্ণ সব কোথায়?”

“খচরে নেই?” জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

বাম হাত দিয়ে তামান্না উপুড় করে দিলো বস্তাটা। চেরির বানানো ব্রান্ডির ছোট একটা বোতল মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে গেলো। তারপরেই কাগজে মোড়া আরো কিছু জিনিস ধুপধাপ পড়তে লাগলো মাটিতে। ক্রিস্টোফার তরবারির ডগা দিয়ে একটা মোড়ক ছিঁড়ে ফেলতেই ভেতর থেকে কিছু ধাতব খণ্ড বেরিয়ে এলো। একটা তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই বেকে গেলো সেটা।’

“সীসা?”

সওদাগর একটা আক্রমণ আশা করে হাত দিয়ে মুখ আড়াল করলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে জিজ্ঞেস করলো, “স্বর্ণ কোথায়?”

“স্বর্ণ নেই।”

“তাহলে তিনদিন আগে ব্রিঞ্জোয়ানে যে কাপড়গুলো নিয়ে গেলি সেগুলোর কি হয়েছে?” তামান্না জানতে চাইলো।

 “ওখানকার ইংরেজ লোকটা একটা পাক্কা চোর। আমার জিনিস নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু টাকা দেয়নি। তার বদলে আপাতত এই সীসা দিয়েছে। গরমের সময় আসলে বাকি টাকা স্বর্ণে পরিশোধ করবে বলেছে।”

“মিথ্যা কথা,” ঠাণ্ডা স্বরে বললো তামান্না। “এর কাপড়চোপড় সব খুলে পরীক্ষা করে দেখো, আর যদি কাপড়ের নিচে কিছু না পাও তাহলে চামড়া খুলে দেখো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে স্বর্ণ।”

“না,” আর্তনাদ করে উঠলো লোকটা। “আমি মরে গেলে আপনাদের কোনোই লাভ হবে না। জ্যান্ত থাকলে কিন্তু লাভ করতে পারবেন।”

“এ চাচ্ছে আমরা যেনো ওকে না মেরে ওর ভাইদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করি,” ক্রিস্টোফার বললো।

“আমরা কাউকে অপহরণ করি না,” সোজাসুজি বলে দিলো তামান্না। “আর ধরা না পড়ে মুক্তিপণ আদায় করবোই বা কিভাবে? তোর পরিবারের লোকজন আমাদের সাথে দরদরি করতে চাইবে। আর প্রতিবার খবর দেওয়া নেওয়ার সময়ে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।”

“কোন দরাদরি করতে হবে না,” সওদাগর ওয়াদা করলো। “কতে চান বলুন শুধু। আমি আমার ভাইদের কাছে খবর পাঠাবো যাতে বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা দিয়ে দেয়। আপনারা যেখানে চান সেখানেই ওরা টাকাটা রেখে আসবে।”

 “যদি তোকে জ্যান্ত ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে ওরা কেনোই বা টাকা দেবে?”

 “কারণ তাহলে আমাকে ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর থাকবে না।” সওদাগরের চেহারার রঙ ফিরে আসছে আবার। সে হাতের শেষ আংটিটা খুলে তামান্নার সামনে তুলে ধররলো। “আমি এক সামান্য ব্যবসায়ী। চলুন এমন কিছু করি যাতে দুজনেই লাভবান হতে পারি।”

*

“আমি একে বিশ্বাস করি না, তামান্না বললো। একটা পাথরের আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে বসে নিচু স্বরে কথা বলছে ওরা। গভীর রাত এখন। আকাশে চাঁদ আছে, কিন্তু চাঁদনী নেই। ফলে অন্ধকার আরো জাঁকিয়ে বসেছে। ব্যাপারটা অবশ্য কাকতালীয় কিছু না। আজকের সব কিছু অনেকবার আলোচনা আর তর্কাতর্কির পর ঠিক করা হয়েছে। স্থান, সময়, দিক নির্দেশনা-সব। প্রায় ডজনখানেক পরিকল্পনা নাকচ করে শেষে এটা নির্ধারণ করেছে ওরা। ক্রিস্টোফার বেশ কয়েকবার ভেবেছে তামান্না বোধহয় বন্দিকে খুন করে সব তর্ক অবসান করে দেবে। এখনো অবশ্য সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় নি।

রাতের বাতাসে একটা অস্পষ্ট পেঁচার ডাক ভেসে এলো। কিন্তু ডাকটা হুবহু পেঁচার মতো না। ক্রিস্টোফার শক্ত হয়ে গেলো।

“সংকেত দিচ্ছে।”

পাহাড়ের উপর একটা পাথুরে গুহা নির্ধারণ করেছে ওরা। রাস্তা বা গ্রাম থেকে বহু দূরে। রাস্তা ভরে পাহারাদার রেখেছে, যাতে ওরা কোনো চালাকি করার চেষ্টা করলে সাথে সাথে ধরা পড়ে যায়। এখনই প্রমাণ হবে পুলা কি আসলেই কথা দিয়ে কথা রাখে কিনা।

 “টাকা পেলেও আমাদের কিন্তু ওকে মেরেই ফেলা উচিত, তামান্না অস্থির হয়ে উঠছে। “ও আমাদের চেহারা আর নাম দুটোই জানে। ও বাড়ি ফিরেই রানির কাছে অভিযোগ করবে, আর রানিও আমাদের ধরার জন্যে সৈন্য পাঠিয়ে দেবে।”

 “এ একটা বলদ,” ক্রিস্টোফার বললো। “জান নিয়ে যে পালাতে পারছে সে জন্যেই ওর ঈশ্বরদের ধন্যবাদ দেবে। আর এতেই সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। তাছাড়া, মুক্তিপণ নেওয়ার পরেও যদি খুন করি তাহলে কথাটা জানাজানি হয়ে যাবে। পরের বার কাউকে অপহরণ করলে আর কেউ টাকা দেবে না।”

তামান্না কাঁধ ঝাঁকালো, “আমাদের যথেষ্ট স্বর্ণ আছে।”

“যথেষ্ট স্বর্ণ বলে দুনিয়াতে কোনো কিছু নেই।”

পাথুরে মেঝেতে পদশব্দ পেতেই ওরা চুপ করে গেলো। দুজন কুলি এসে দাঁড়ালো গুহাটার মুখে। পিঠে বিশাল ওজনের দুটো সিন্দুক। চাপে ওদের পিঠ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ওরা সিন্দুক দুটো নামিয়ে রেখে হাত ডলতে ডলতে অন্ধকারে ইতিউতি তাকাতে লাগলো।

“মালিক পুলাকে নিতে এসেছি আমরা,” একজন বললো।

ক্রিস্টোফার টের পেলো তামান্না পিস্তল তুলে নিচ্ছে। ক্রিস্টোফার ওকে বাধা দিলো। “আগে শুনে নেই কি বলে?”

 “আমরা বলেছিলাম মাত্র একজন পাঠাতে,” জিজ্ঞেস করলো তামান্না। ওর কথা পাথরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। ফলে কোথা থেকে কথা বলছে। সেটা বোঝা গেলো না। কুলিগুলো এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। এই অন্ধকারেও ওদের আতংকিত চেহারা দেখতে পেলো ক্রিস্টোফার।

 “সিন্দুকটা একজনের পক্ষে টেনে আনা সম্ভব না,” একজন কুলি উচ্চস্বরে মিনতি করলো।

“তাহলে তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।”

 “মালিকের কি হবে?”

“টাকা গোণা শেষ হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এখন ভাগ।” তামান্না পিস্তল তুলে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লো। প্রতিধ্বনির কারণে মনে হলো যেনো পুরো এক কোম্পানি বন্দুকধারী সৈনিক একযোগে গুলি ছুঁড়েছে।

কুলিগুলো যাওয়ার পরেও ক্রিস্টোফার আর তামান্না নড়লো না। গুহার মাঝখানে একটা প্যাগান বেদীর মতো বসে আছে সিন্দুকটা। হাতের তালু চুলকাতে লাগলো ক্রিস্টোফার। সিন্দুকটা খুলতে আর তর সইছে না। কিন্তু প্রহরী এসে সব ঠিক আছে সেই সংকেত দেওয়ার আগ পর্যন্ত ওঠার উপায় নেই।

 “ওরা একারাই এসেছিলো,” নিশ্চিত করলো লোকটা। “এমনভাবে পালিয়েছে যেনো বাঘে তাড়া করছে।”

ক্রিস্টোফার সিন্দুকটার দিকে এগিয়ে গেলো। ভারি মেহগনী কাঠ দিয়ে বানানো ওটা। গায়ে চমৎকার নকশা। জিনিসটা সম্ভবত মশলা অথবা ওষুধ রাখার কাজে ব্যবহার হতো। কারণ ভিতর থেকে মৌরির সুঘ্রাণ ভেসে আসছে।

টান দিয়ে ঢাকনাটা খুললো ও। এই মরা চাঁদের আলোতেও ঝিকমিকিয়ে উঠলো ভিতরটা।

 এক হাতা মুদ্রা তুলে নিলো ক্রিস্টোফার। ধাতুগুলো আঙুলের ফাঁক দিয়ে নাড়াচাড়া করতেই অন্যরকম একটা অনুভূতি হতে লাগলো ওর। তামান্না সেগুলো ওর হাত থেকে ফেলে আবার ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলো।

“পরে। আগে এখান থেকে ভাগতে হবে। ওই কুলিগুলো লোকজন নিয়ে ফিরে আসতে পারে আবার।”

“আর পুলা?”

তামান্নার চোখের জ্বলজ্বলে ভাব দেখেই ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো ওর মনের ভিতর কি চলছে। ও নিজের আঙুলে একটা ছুরির ধার পরীক্ষা করলো।

ক্রিস্টোফার সিন্দুকটায় লাথি মেরে বললো, “একবার ডাকাতি করে যতো টাকা পাওয়া যায় তার চাইতে বহু গুণ এর ভিতর আছে।”

“ওর জিভটা কেটে দেওয়া যায় যাতে আর আমাদের কথা কাউকে বলতে না পারে, তামান্না জবাব দিলো।

“ও কিন্তু লিখতে পারবে,” ক্রিস্টোফার ধরিয়ে দিলো।

“তাহলেতো হাতটাও কেটে ফেলতে হবে।”

“ওর পরিবার কিন্তু ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নেবে না,” ক্রিস্টোফার বোঝানোর চেষ্টা করলো। এরকম জরুরি অবস্থায় তামান্না কি ওর সাথে মজা করছে নাকি আসলেই এসব বলছে তা ও ধরতে পারছে না।

কোনো জবাব না দিয়ে তামান্না ওর লোকদের শিষ দিয়ে পুলাকে আনতে বললো। ওরা ঠেলতে ঠেলতে পুলাকে গুহার ভিতরে নিয়ে এলো। পুলার চোখ বাধা, হাতও পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর এই ভ্যাপসা গরম রাতেও ও ঠকঠক করে কাঁপছে সে।

ক্রিস্টোফার তামান্নার মুখোভঙ্গি পড়ার চেষ্টা করছে। তবে অনেক চেষ্টা করেও ওর উদ্দেশ্যটা ধরতে পারছে না।

“আচ্ছা টাকাই যদি আসল না হয়, তাহলে আমরা এসব করছি কেনো?” ক্রিস্টোফার শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো।

 তামান্না ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে ছুরিটা ওর বেল্টের খাপে ঢুকিয়ে রেখে দিলো। চুপিসারে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ক্রিস্টোফার। পুলার জন্যে ওর বিন্দুমাত্র দরদ নেই। লাভের সম্ভাবনা থাকলে ও নিজেই খুশি মনে পুলার উপর যতো ইচ্ছা অত্যাচার করতো। কিন্তু এখন ওকে অক্ষত ছেড়ে দেওয়াই লাভ বেশি।

“তুই এখানেই থাক,” তামান্না পুলাকে বললো। “আর মনে মনে ভগবানকে ডাক যাতে সাপ আর হায়েনার আগেই তোকে অন্য কেউ যেনো খুঁজে পায়।”

“দয়া করে বাঁধন খুলে দিয়ে একটা তরবারি রেখে যান,” অনুনয় করলো পুলা।

 “ভালোমতো টানাটানি করলে বাধন এমনিই খুলে যাবে,” তামান্না বললো। “আর তোর বাড়ির লোকেরাও খুঁজতে খুঁজতে চলে আসবে।”

কথাটা বলে যাওয়ার জন্যে ঘুরলো তামান্না।

“আগে টাকাটা গুনে নিলে ভালো হতো না?” ক্রিস্টোফার বললো। “যদি ওরা কম দেয়?”

 “তাহলে ওরা দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, সেখানে গিয়ে ওদের খুন করে আসবো। ওদের বৌ বাচ্চা সবগুলোকে মারবো। এমনকি ভাই, বোন, চাকরবাকর সব। আর সবার শেষে মারবো একে।” বলে পুলার গায়ে একটা লাথি হাকালো। “বুঝতে পেরেছিস?”

“হ্যাঁ,” গোঙাতে গোঙাতে বললো পুলা। “ওরা একটা পয়সাও কম দেবে না। ভগবানের কসম।”

“এখানে দেরি করা মানেই ধরা পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া-আর সাথেও কাউকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ও থাকলে আমাদের ঝামেলা বাড়বে। আর তুমি যেহেতু একে বাঁচিয়ে রাখতে এতো বেশি আগ্রহী…” বলে ও কাঠের সিন্দুকটার দিকে ইঙ্গিত করলো। “তুমিই তাহলে নাও ওটা।”

ক্রিস্টোফার সিন্দুকটা তুলতে গিয়ে বুঝতে পারলো যে কুলিগুলো এটার ওজন সম্পর্কে বাড়িয়ে বলেনি কিছু। ও অনেক শক্তিশালী, তবুও ওটাকে কাঁধ পর্যন্ত তুলতে পারলো না। ব্যথায় কাতরে উঠতেই দুজন লোক দৌড়ে এলো সাহায্য করতে। দুজনে দুপাশের দুটো হাতল ধরলো কিন্তু জায়গাটা সমতল না হওয়ায় হোঁচট খেয়ে গেলো পড়ে। তামান্না এগিয়ে গিয়ে ওদেরকে বকতে লাগলো।

পাহাড় থেকে নেমে এসে নিচের ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেলো ওরা। এখানে চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। শুধু বন্য প্রাণী আর ডাকাতেরা ঘরে এদিক দিয়ে। ক্রিস্টোফারের হাতের ব্যথা বাড়তেই লাগলো। পুলার প্রতি প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা জন্ম নিলো ওর। শেষে মনে মনে কিভাবে পুলাকে মারা যায় সেসব কল্পনা করে ব্যথাটা ভুলে থাকার চেষ্টা করতে লাগলো।

অবশেষে একটা ফাঁকামতো জায়গায় এসে তামান্না থামার আদেশ দিলো। ক্রিস্টোফার যেইমাত্র সিন্দুকটা খুলে স্বর্ণমুদ্রাগুলো গোনা শুরু করলো তখনি যাদুমন্ত্রের মতো ওর হাতের ব্যথা দূর হয়ে গেলো। প্রায় আধা ঘণ্টা লাগলো গুণে শেষ করতে। শেষ করার পর দেখা গেলো সবার মুখেই চওড়া হাসি। পুরোটাই আছে এখানে। এমনকি তামান্নাও কঠিন ভাব ছেড়ে ক্রিস্টোফারের পাশে এসে বসে ওর পায়ের উপর হাত রেখে উরুতে চিমটি দিতে লাগলো।

“বেশিক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যাবে না কিন্তু,” সাবধান করলো তামান্না। “একটা। শহরে পালিয়ে যেতে হবে, বড় কোনো শহরে। যেখানে আমাদেরকে কেউ খেয়াল করবে না বা চিনবেও না। ওখানে রসদপত্র কিনে বর্ষাটা কাটিয়ে দেবো। তারপর একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে বের করে অপেক্ষা করতে থাকবো। আবার যখন লোকজন রাস্তাটা ব্যবহার শুরু করবে তখন কাজে নেমে পড়বো।”

 বর্ষাকালের দীর্ঘ বৃষ্টিময় বিকেলগুলোর কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো ক্রিস্টোফারের। ও আর তামান্না কিভাবে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারবে সেটা জানা আছে ওর। ভাবনাটা মাথায় আসতেই পায়জামার ভিতরে একটা শিহরণ অনুভব করলো যেনো। তামান্নার হাতটা টেনে নিয়ে নিচের দিকে ঠেলে দিলো ও। তামান্নাও হেসে দুষ্টুমিভরা চোখে চাইলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ক্রিস্টোফারের হাত ধরে টেনে জঙ্গলের আরও ভিতরে একটা ঘাসে ছাওয়া জায়গায় নিয়ে এলো। পা দিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে ঘাস মাড়িয়ে দিলো যাতে সাপ খোপ থাকলে সরে যায়।

মুহূর্ত পরেই এই জগত ছেড়ে অন্য আর এক অলৌকিক জগতে হারিয়ে গেলো যেনো ওরা। যে জগতে কামনা আর সুখ বাদে আর কিছু নেই।

*

ওরা জেগে উঠে একজন আর একজনের বাহুডোরে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কি জন্যে ঘুম ভেঙেছে বুঝতে পারছে না ক্রিস্টোফার। আশেপাশে টু শব্দটাও নেই, কেমন একটা অশুভ নীরবতায় ছেয়ে আছে চারপাশ। ভয়ানক আতংক ছড়িয়ে বুকের ওপর চেপে বসছে সেটা।

“কি হয়েছে?” তামান্না বলতে গিয়েও থেমে গেলো, কারণ দুজনেই কুকুরের ডাক শুনতে পেয়েছে। ওরা দ্রুত উঠে পড়ে ত্রস্ত হাতে কাপড় খুঁজতে লাগলো।

 ক্রিস্টোফার তামান্নার হাত ধরলো। “ওরা শিকারে বেরিয়েছে, আর আমরা হচ্ছি শিকার।”

“স্বর্ণটা নিয়ে আসি চলো।”

“এখন ওসব নেওয়া যাবে না। ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারবো না। এক মাইল যাওয়ার আগেই কুকুর ধরে ফেলবে। তাড়াতাড়ি!” ওরা যেখানে ওদের সঙ্গীসাথী আর স্বর্ণে ভরা সিন্দুকটা রেখেছিলো সেখানে দৌড়ে গেলো।

লোকজন এলোমেলো ভাবে জায়গাটায় ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বেশিরভাগই আরকের বোতল খুলে বসেছে। ক্রিস্টোফার গালাগাল করতে করতে সবচে কাছের লোকটার গায়ে লাথি ছুড়লো।

“ওঠ, শালা মাতালের দল।”

“ছাড়ো ওদের, যা আসছে তা ওদের প্রাপ্য, তামান্না আদেশ দিলো ক্রিস্টোফারকে। “পকেটে যতোটা সম্ভব স্বর্ণ নিয়ে নাও, তারপরেই আমরা পালাবো।”

সিন্দুকটা তখনও মাঝে রাখা। ওরা দৌড়ে গেলো ওটার দিকে। ক্রিস্টোফার ঢাকনা খুলে যতোগুলো পারলো স্বর্ণের প্যাগোড়া নিজের পকেটে ভরে নিলো।

“হয়েছে!” তামান্না দড়াম করে ঢাকনাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর কান পেতে আশেপাশে শোনার চেষ্টা করলো। কুকুরের ডাক আরো জোরে শোনা গেলো, আর ক্রিস্টোফারের মনে হলো ওগুলোর পায়ের ধাক্কায় জমি থরথর করে কাঁপছে।

 “ঘোড়া!” অবাক হলো ক্রিস্টোফার। “তার মানে ওরা আসলেই আমাদের পিছু নিয়েছে।” এতোগুলো মাস ধরে ওরা এসব রাস্তায় চরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঁচ কি ছয়জনের বেশি ঘোড়সওয়ার চোখে পড়েনি। যার একটা ঘোড়া পালার সামর্থ্য আছে, তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। ক্রিস্টোফার আবার মাথা কাত করে শোনার চেষ্টা করলো। শুনে মনে হলো পুরো একটা অশ্বারোহী দল ওদেরকে ধরতে বেরিয়েছে।

তামান্নার হাত ধরে জঙ্গলের ভিতরের দিকে দৌড় দিলো ও। মাটি আগাছায় ভরে, আর ওগুলোর অনেকগুলোই কাঁটাওয়ালা। আধা মাইল যাওয়ার আগেই দুজনের হাত পা ছড়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। পিছনে ঘোড়ার হ্রেষা ডাক আরো কাছিয়ে আসছে। মাতাল লোকগুলো আর স্বর্ণ ভরা সিন্দুকটা খুঁজে পাওয়া মাত্র ওদের ধাওয়াকারীদের উল্লাস ধ্বনিও কানে আসলো।

ক্রিস্টোফার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আশা করলো যাতে গাছের ফাঁক দিয়ে ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণটা চোখে পড়ে। কারণ রাতের অন্ধকারে ও কোনদিকে যে দৌড়াচ্ছে তার কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। ওরা শুধু পিছনের ঘোড়ার শব্দের আগে আগে দৌড়ে চললো। সূর্য পুরোপুরি ওঠার আগ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও থামলো না।

আচমকা ওদের সামনে জঙ্গল শেষ হয়ে গেলো। ঝোঁপ জঙ্গল মাড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিলো ওরা। তাই ব্যাপারটা প্রথমে খেয়াল করতে পারলো না। একেবারে শেষ মুহূর্তে ক্রিস্টোফারের চোখে পড়লো যে সামনে কিছুই নেই। ও তামান্নাকে টান দিয়ে একটা হাত দিয়ে কাঁধের পিছন দিকে জড়িয়ে ধরলো। একটুর জন্যে বেঁচে গেলো ওরা। নইলে দুজনেই একসাথে খাড়া খামায় পা হড়কে সোজা কয়েকশো ফুট নিচে এক শুকনো পাথুরে নদীবক্ষে গিয়ে পড়তো।

বর্ষাকালে নদীটা প্রমত্তা হয়ে ওঠে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন সেটা চোখা পাথরের ভরা একটা খাদ বাদে আর কিছু না।

কিছুক্ষণ ওটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তামান্না। তারপর মাথা ঘুরিয়ে পিছনের শব্দ শোনার চেষ্টা করলো। কুকুরগুলো খুবই কাছাকাছি চলে এসেছে। ওদের ঘ্রাণ কাছিয়ে আসায় উত্তেজনায় গরগর করছে।

“আমি এদের হাতে ধরা দেবো না।” তামান্না মন ঠিক করে ফেললো। তারপর ক্রিস্টোফারের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “আমি লাফ দিচ্ছি।”

“না, আমি তা করতে দেবো না।” ক্রিস্টোফার আরো জোরে তামান্নার কবজি চেপে ধরলো। পিছনে ঘোড়া আর কুকুরের আগমন ও নিজেও টের পাচ্ছে। সেই সাথে এখন যোগ হয়েছে মানুষের পদশব্দ।

“তাড়াতাড়ি মরবো এতে। ওরা যদি ধরতে পারে, তাহলে এতো অত্যাচার করবে যা সহ্য করার চেয়ে মরাই ভালো।”

“আই লাভ ইউ, ক্রিস্টোফার ওর মুখের সামনে বললো। “আর আমরা যতোক্ষণ বেঁচে আছি, ততোক্ষণ কোনো না কোনো উপায় বের হবেই।”

তামান্না হাত মুচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। আমি একবার তোমার কথা শুনে এখন পস্তাচ্ছি। আর না। জীবন থাকতে আমি ওদের হাতে ধরা দেবো না।”

তামান্না মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে প্রায় ছাড়িয়েই নিয়েছিলো, কিন্তু ক্রিস্টোফার আচমকা ওর উপর নিজের সমস্ত ভর চাপিয়ে দিয়ে জোর করে মাটিতে শুইয়ে দিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রথম কুকুরটা ওদের পিছনের আগাছার জঙ্গল থেকে লাফ দিয়ে সামনে বাড়লো। কুকুরগুলোর পরে উর্দিপরা লোকজন ছুটে এলো পিছনে। হাতে মুগুর। ওরা দৌড়াতে গিয়ে সোজা মাটিতে পড়ে থাকা ক্রিস্টোফার আর তামান্নার উপর হোঁচট খেলো। তখনও ধ্বস্তাধস্তি করে যাচ্ছে ওরা। সৈন্যরা হাতের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে অর্ধ অচেতন করে ফেললো ওদেরকে। তারপর ঝটপট হাতে হাতকড়া পরিয়ে গলায় শেকল বাঁধা। বেড়ি পরিয়ে দিলো। শেকলের অপর প্রান্ত দুটো ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা। ঘোড়া দিয়ে টেনে ওদেরকে আবার সেই ফাঁকা জায়গাটায় নিয়ে ব্রাসা হলো। যেখানে ওরা সিন্দুকটা আর মাতাল সঙ্গীদের ছেড়ে গিয়েছিলো।

সেখানে পৌঁছার পর ক্রিস্টোফার ওদের বন্দিকারীদের দেখতে পেলো। এরা সবাই নির্ভীক সৈনিক আর খুব ভালো ঘোড়সওয়ার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবার পরনে একই রকম ভারী কাপড়ের উর্দি, ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ, আর কোমরে কমলা রঙের একটা কাপড় বাধা। দেখেই বোঝা যায় এদের আত্মবিশ্বাস পাহাড় সমান। ক্রিস্টোফার ঠিক করলো যে ও মোটেও আগ্রাসী মনোভাব দেখাবে না, বা ও যে দক্ষ যোদ্ধা সেটাও প্রকাশ করবে না, বরং বিনয়ী আর ভদ্র ভাব দেখাবে। সেজন্যেই চোখ নিচু করে ওরা যা যা বললো তা শুনতে লাগলো।

 ওদের সাবেক বন্দী, পুলা দাঁড়িয়ে আছে একেবারে মাঝখানে। এইতো খানিকক্ষণ আগেও যে ও নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে তোতলাচ্ছিলো বারবার তা বোঝার কোনো উপায় এখন নেই। নতুন কাপড় পরেছে সে। চুল দাড়ি আচড়ে সোজা হয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিস্টোফার আর তামান্নাকে দেখতে পেয়ে সন্তুষ্টির হাসি হাসলো সে।

“বাতাস এখন উল্টোদিকে মনে হচ্ছে, কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো ও।

“এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে খুঁজে পেলেন আমাদের?” কণ্ঠে যতোটা সম্ভব ভয় ঢেলে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

“স্বর্ণের গন্ধ পাই আমি।” পুলা কাঠের সিন্দুকটায় লাথি মেরে বললো। তারপর ঢাকনা খুলে নাক টেনে লম্বা একটা দম নিলো। “এটা থেকে যে মৌরির ঘ্রাণ আসছে সেটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিস? তোদের ধারণা আমার বাড়ির লোকজন মুক্তিপণের টাকা খামাখা এরকম একটা ভারি সিন্দুকে ভরে পাঠিয়েছে শুধু তোদেরকে একটু কষ্ট দেওয়ার জন্যে? প্রতিবার যখনই এটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখেছিস, তখনি সেখানে একটা করে চিহ্ন থেকে গিয়েছে। আরো ভালো করে বললে গন্ধ থেকে গিয়েছে। টুঙ্গার আর ওর কুকুরগুলোর সেই গন্ধ শুঁকে পিছু নিতে তাই কোনো কষ্টই হয়নি।”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ইঙ্গিতে দেখালো পুলা। চলনে বলনে সব দিক থেকে পুলা-র উল্টো সে। পুলা হচ্ছে বেঁটে, মোটা আর চেহারা গোল আলুর মতো। টুঙ্গার লম্বা, দেখতে ভয়ঙ্কর। চেহারার মাঝ বরাবর একটা কাটা দাগ। এতো জোরে আঘাত পাওয়ার পরেও লোকটা বেঁচে আছে কিভাবে ভেবে পেলো না ক্রিস্টোফার। পাগড়িতে একটা হলুদ রঙের পাখির পালক আটকানো। লোকটাকে দেখেই বোঝা যায় হুকুম করার জন্যেই জন্ম হয়েছে তার।

“আর আপনি তাহলে আসলে কে?” ক্রিস্টোফার জিজ্ঞে করলো।

“আমি কোনো সওদাগর না,” পুলা জবাব দিলো। আমি মহামান্য চিত্তাত্তিস্কারার রানি-র একজন উপদেষ্টা। উনি তার প্রজাদের দুঃখ কষ্ট একদম পছন্দ করেন না। তাকে যারা অসন্তুষ্ট করে উনি তাদের কেমন শিক্ষা দেন তা তোরা একটু পরেই দেখতে পাবি।”

টুঙ্গারের লোকজন সাথে আনা একটা গাড়িতে সিন্দুকটা তুলে নিলো। তামান্নার দলের সবাইকেই ঘোড়ার পিছনে শেকল দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। দলটা আগে বাড়লো।

ক্রিস্টোফার ঠিক জানে না যে কতোদূর হাঁটতে হলো ওদের। টুঙ্গার যখন থামার আদেশ দিলো তখন ওর পা এতো বেশি ব্যথা করে উঠলো যে মনে হলো আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না। বন্দীরা সবাই ধপ ধপ করে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়লো। মাছি এসে বসতে লাগলো ক্রিস্টোফারের উপর; পিঁপড়া আর নানা পোকামাকড় ওর ছড়ে যাওয়া পায়ের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু হাত বাঁধা থাকায় ওগুলোকে তাড়িয়েও দিতে পারলো না।

কয়েকজন প্রহরী বনের ভিতরে চলে গেলো। এই ব্যথার ভিতরেও ক্রিস্টোফার কাঠ কাটার ছন্দময় কুড়ালের শব্দ শুনতে পেলো। সম্ভবত ওরা রান্না করার জন্যে লাকড়ি কাটছে। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ও।

 “আমাদেরকে কি করবেন?” পুলাকে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার। ওর মাথায় একটা বুদ্ধির উদয় হয়েছে। “রানির কাছে নিয়ে যাবেন?”

পুলা অবজ্ঞাসূচক একটা শব্দ করলো। “তোর মতো একটা অসভ্য ইতরের জন্যে আমি মহামান্য রানির সময় নষ্ট করাবো না।”

“আমদেরকে ওনার কাছে নিয়ে যান, ক্রিস্টোফার অনুনয় করল। “আমার যে দক্ষতা তা ওনার ভালোই কাজে লাগবে।”

“হ্যাঁ, তোর জন্যে ওনার একটা কাজ আছে,” পুলা গোমড়া মুখে ওকে আশ্বস্ত করল। “তবে সেজন্যে ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কিছুই করা লাগবে না।”

প্রহরীরা বনের ভিতর থেকে একটা গাছ টেনে নিয়ে আসলো। একজন মানুষের বাহুর সমান মোটা। ওরা বাকল চেঁছে ফেলে এক প্রান্ত কেটে একটা সূচালো গজালের মতো বানিয়ে ফেললো। বাকিরা হাতের শাবল দিয়ে রাস্তার ধারেই একটা গর্ত খুঁড়তে লাগলো। বন্দী ডাকাতেরা চেয়ে রইলো সেদিকে। গলায় বেড়ি পরে থাকার পরেও তারা আতংকে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো ওরা। বুঝতে পেরেছে যে ওদেরকে দিয়ে এরা কি করতে যাচ্ছে।

পুলা ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর হাতটা অর্ধেক তুলে সবার দিকে একে একে তাক করতে লাগলো, যেনো সে কসাইয়ের দোকানের কোনো খরিদ্দার, ঠিক বাছাই করতে পারছে না কোনটা থেকে মাংস নেবে। ক্রিস্টোফারের উপর ওর দৃষ্টি এসে স্থির হলো।

“তুই সবার শেষে,” ওকে বললো পুলা। “তোর সামনে একে একে তোর সব সঙ্গী সাথী মরবে এখন।”

ক্রিস্টোফারের পাশে বসে থাকা একজনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো ও। কৃশকায় একজন লোক, নাম বিজয়। বিজয়ের দায়িত্ব ছিলো পুলার দিকে নজর রাখা। আর দায়িত্ব পালনের সময় ও মোটেও খুব বেশি ভালো আচরণ করেনি। টুঙ্গারের লোকেরা ঘোড়া থেকে শেকলটা খুলে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে এসে দাঁড় করালো ওকে। ধ্বস্তাধস্তি শুরু করলো বিজয়। কিন্তু সৈন্যেরা ওকে উপুড় করে মাটির সাথে চেপে ধরলো। টুঙ্গার এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো ওর পাশে।

টুঙ্গারের হাতে এক টুকরো খাসীর চর্বি দেখা গেলো। এটা দিয়ে রাইফেলের কার্তুজে তেল দেয় ও। চর্বিটা ও চোখা খুটিটার গায়ে লেপে দিলো। ওর লোকেরা উল্লাস করে নোংরা ইংগিত করতে লাগলো।

বিজয় মোচড়ামুচড়ি করতে করতে এতো জোরে চিৎকার করতে লাগলো যে প্রহরীরা ওর মুখের ভিতরে একটা ন্যাকড়া ঢুকিয়ে দিলো।

যে প্রহরীগুলো বিজয়ের পা ধরে রেখেছিলো, তারা ও দুটোকে দুদিকে টেনে ধরলো। আরও দুজন লোক এসে সূচালো দণ্ডটা এনে ওর নিতম্বের মাঝে চেপে ধরলো। ক্রিস্টোফারের সহ্য হলো না দৃশ্যটা। চোখ বন্ধ করে ফেললো। তবে হাত বাঁধা থাকায় কান চাপা দিতে পারলো না। বিজয় ওর মুখের ন্যাকড়াটা ঠেলে ফেলে দিয়েছে। শুলটা ওর পায়ুপথ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতেই প্রচণ্ড আর্তনাদে জঙ্গল দুই ভাগ হয়ে গেলো যেনো। এরা এদের কাজ কর্ম ভালোই পারে। বিজয়ের চিৎকার থেকেই ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো যে এরা এমনভাবে শূলটা ঢুকিয়েছে যাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গে খোঁচা না লাগে। তাহলে খুব তাড়াতাড়ি মরে যাবে বন্দী।

 ক্রিস্টোফার চোখ খুললো। বিজয় পড়ে আছে মাটিতে, চিৎকার চলছেই। চিৎকার দ্বিগুণ হয়ে গেলো যখন প্রহরীরা শূলটা সোজা উপরের দিকে তুলে ধরলো। বিজয় দণ্ডটা বরাবর নিচে নেমে এলো, আর চোখা মাথাটা ওর শরীরের আরো গভীরে ঢুকে গেলো। কিন্তু প্রহরীরা দণ্ডটার মাঝ বরাবর একটা আড়কাঠ লাগিয়ে দিয়েছে যাতে খুব বেশি ভিতরে না ঢোকে। বিজয় তড়পাতে তড়পাতে একসময় নিস্তেজ হয়ে শিকে ঢোকানো মুরগির মতো ঝুলে রইলো। ওর পায়ু দিয়ে রক্ত বেরিয়ে নিচেই একটা ছোটোখাটো পুকুর হয়ে গিয়েছে। মাছির দল তাতে মহানন্দে সাঁতার কাটছে।

প্রহরীরা শূলটার গোড়া একটু আগে খোঁড়া গর্তে ঢুকিয়ে আবার মাটি আর পাথর দিয়ে ভরে দিলো, যাতে ওটা খাড়া হয়ে থাকে। তারপর পিছনে সরে এসে নিজেদের কাজ উপভোগ করতে লাগলো। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। বিজয় কতক্ষণ টিকবে তা নিয়েও নিজেদের মধ্যে বাজি ধরতে শুনলো ক্রিস্টোফার। বেশিরভাগই বললো দুই কি তিন দিন। বিজয় এখন আর চিৎকার করছে না, ফোঁপাচ্ছে আর বাতাসের জন্যে হাঁসফাস করছে। কারণ দণ্ডটার খোঁচায় ওর ফুসফুস ছ্যাদা হয়ে গিয়েছে।

পুলা সামনে এগিয়ে এসে চেহারায় একজন ধর্ষকামীর আনন্দ নিয়ে ক্রিস্টোফারের দিকে চেয়ে রইলো।

“এখান থেকে চিত্তাত্তিঙ্কারা প্রায় বিশ মাইল। প্রতি দুই মাইল পর পর তোর একজন লোকের এই হাল করবো আমি। তারপর যখন রানির মহলে পৌঁছাবো, তখন তোকে আর তোর ঐ মাগীটাকে সদর দরজার দুই পাশে গেঁথে রাখবো। তাহলেই সবার শিক্ষা হবে যে যারা রানির কর্মচারীদের গায়ে আঙুল তোলে বা তার ব্যবসায় বাধা দেয়, তাদের কি অবস্থা হয়।”

*

পরের দুই দিন ধরে পুলা তার হুমকি অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। একে একে সবগুলো ডাকাতকেই ধরে নিয়ে রাস্তার ধারে শূলে চড়িয়ে দেওয়া হলো। অবশেষে যখন ওরা পাহাড়ের নিচের মহলে পৌঁছালো তখন শুধু ক্রিস্টোফার আর তামান্নাই বাকি আছে।

 ক্রিস্টোফার ভেবেছিলো বারবার একই দৃশ্য দেখতে দেখতে হয়তো ওর আর এ বাপারে কোনো অনুভূতি থাকবে না। কিন্তু দেখা গেলো এতে করে। আতংক আরো কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। যতোবার ও কারো পিছন দিক। দিয়ে গজাল ঢুকে যাওয়া দেখলো, ততোবার ওর নিজের পায়ুর পেশিও সঙ্কুচিত হতে লাগলো। শত চেষ্টা করেও এই ভয়ানক দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলো না। টানা কয়েকদিন দানা পানি না পেয়ে ও উল্টাপাল্টা দেখা আরম্ভ করলো। স্বপ্নে দেখতে লাগলো যে ও ওর বাবার পড়ার ঘরে উপস্থিত, পায়জামা গোড়ালি পর্যন্ত নামানো, একটা চেয়ারের উপর বাঁকা হয়ে অপেক্ষা করছে কখন চাবুকের বাড়ি পড়বে। আর ওর মা চুপচাপ ঘরের এ কোণে বসে ওকে শক্ত হতে বলছে। একবার স্বপ্নে দেখলো ও তামান্নাকে আদর করছে। আবেশে তামান্না হাত ক্রিস্টোফারের পিঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তামান্না যখন ওর হাত সামনে আনলো, ক্রিস্টোফার দেখলো সেই হাত দিয়ে ওর পিঠ থেকে এক তাল মাংস খুবলে নিয়ে এসেছে।

 দ্বিতীয় দিন বিকেলের শেষে ওরা মহলের সদর দরজায় গিয়ে পৌঁছালো। ওদের ঠিক উপরে আকাশে পাখিরা চক্কর দিচ্ছে। যেন ওরা আগেই টের পেয়েছে যে একটু পরেই ওদের ভোজের জন্যে পচা মাংস পাওয়া যাবে। মহলের ভিতরের লোকেরাও বেরিয়ে এলো কাহিনি দেখার জন্যে।

টুঙ্গারের লোকেরা জঙ্গলে থাকতেই গাছ কেটে, এক প্রান্ত চোখা বানিয়ে প্রস্তুত করে রেখেছে। ক্রিস্টোফার আর তামান্নাকে উলঙ্গ করে রাস্তার মাঝে বসিয়ে দিলো সৈন্যরা। দুজনের মাঝে দূরত্ব কয়েক ফুট। পুলা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে সমাগত লোকজনের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে লাগলো। ওর উচ্চ কিন্তু আত্মম্ভরি গলায় ক্রিস্টোফার আর তামান্নার সকল অপরাধের গা শিউরানো বর্ণনা দিলো প্রথমে। দর্শকেরা সবাই আঁতকে উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের ঘামে ভেজা চোখ দিয়েও ওদের চেহারা পড়তে পারলো ক্রিস্টোফার। ভয় পেলেও ওরা সবাই মজা দেখতে আগ্রহী।

পুলা তার বক্তব্য শেষ করলো রানির অকুণ্ঠ প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে। ক্রিস্টোফার ইতিউতি তাকাতে লাগলো। রানি ওর শাস্তি দেখতে এসছেন কিনা দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে কোথাও দেখা গেলো না। পুলা টুঙ্গারের দিকে ইংগিত করতেই ও ওর একজন লোককে কিছু একটা আদেশ দিলো।

ওরা শূল দুটো নিয়ে এলো! উঁচিয়ে ধরে রেখেছে যাতে দর্শকেরা ওটার তীক্ষ্ণতা ভালোমতো দেখতে পায়। ওগুলো কিভাবে ওদের শরীরে ঢুকে যাবে সেটা ভেবে অনেকেই শিহরিত হলো। শূল দুটো দেখেই ক্রিস্টোফারের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়লো। উল্টোপাল্টা বকতে আরম্ভ করলো ও। ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিচু গলায় বিড়বিড় করতে লাগলো। “আমাকে মাফ করে দাও। আমি ভালো হয়ে যাবো। দরকার হলে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে রানির পায়ে চুমু খাবো। আমি ওনার দাস হয়ে থাকবো। সারাজীবন ওনার সেবা করবো। ও ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও।”

দর্শকেরা মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। ওকে নকল করে ভেংচি কাটতে লাগলো অনেকে। আতংকের চোটে না বুঝেই ক্রিস্টোফার ইংরেজিতে বকবক আরম্ভ করেছে। এমনকি তামান্নাও ওকে আগে কখনো ইংরেজিতে কথা বলতে শোনেনি।

“চোপ,” নিজের ভাষায় বললো তামান্না। “মরবি তো মাথা উঁচু করে মর।”

 পুলা বিরক্ত হয়ে, ভ্রু কুঁচকে লোকদেরকে দ্রুত কাজ শেষ করতে বললো। শুলটা প্রস্তুত করে ফেললো সৈন্যরা। ডগা থেকে খাসীর চর্বি ঝরে পড়ছে।

কিন্তু টুঙ্গারের মাথায় তখন অন্য চিন্তা খেলছে। ও পুলাকে ডেকে নিয়ে ক্রিস্টোফারকে দেখিয়ে রেগেমেগে কিছু একটা বলা শুরু করলো। মাথা ঠিকমতো কাজ না করায় ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো না যে ওরা কি বলছে। তবে বোঝা গেলো যে ব্যাপারটা জরুরি। সম্ভবত ওদেরকে অত্যাচার করার নতুন কোনো পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করছে।

তবে নতুন কোনো আদেশ নিষেধ আসার আগেই ওর নিতম্বের ভিতর দিয়ে ঢুকে গেলো শূল। টানা দুই দিন ধরে দেখতে থাকা ভয়ানক দৃশ্যগুলোর কারণে শূলটা শরীর স্পর্শ করা মাত্র চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। উপুড় হয়ে ধুলোর মধ্যে শুয়ে ও তামান্নার চোখের দিকে তাকালো। ও একদম সোজা হয়ে আছে। একটু শব্দ করছে না।

“ভালোবাসি তোমাকে,” ঠোঁট নেড়ে বললো তামান্না।

ওর মনের জোর দেখে লজ্জা লাগলো ক্রিস্টোফারের। ও-ও ঠোঁট কামড়ে পড়ে রইলো যতোক্ষণ না রক্ত বের হয়। শূলটা. প্রবেশের ব্যথা গিলে নেওয়ার চেষ্টা করলো পুরোটা। প্রহরীরা ওর সাথে শয়তানী করছিলো আরো বেশি। সামান্য একটু ঢুকিয়ে আবার বের করে নিচ্ছিলো। প্রতিটা কাতর ধ্বনিতে মজা পাচ্ছিলো ওরা। মারা পড়তে কতোক্ষণ লাগবে সেটাই ভাবছিলো ক্রিস্টোফার।

আবার ওটাকে বের করে নেওয়া হলো। একেবারে পুরোটা। ক্রিস্টোফার নিজেকে শক্ত করে নিলো। ওরা নিশ্চিত এবার এক ধাক্কায় পুরোটা একবারে সেঁধিয়ে দেবে। ওকে চিরে একেবার শরীরের ভিতরটা পর্যন্ত চলে যাবে শূল।

কিন্তু আর খোঁচা দিলো না কেউ। টুঙ্গার ওর লোকদেরকে চিৎকার করে কিছু একটা বললো। আর পুলা টুঙ্গারের সাথে রাগারাগি করতে লাগলো। ক্রিস্টোফার তার এক বর্ণও বুঝলো না। দর্শকেরা দুয়ো ধ্বনি দিতে শুরু করলো। তবে টুঙ্গার একবার চোখ গরম করে তাকাতেই পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এলো ভীড়ের মাঝে। আস্তে আস্তে ভীড় পাতলা হয়ে এলো।

প্রহরীরা ক্রিস্টোফার আর তামান্নাকে টেনে দাঁড় করিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভিতরে নিয়ে গেলো।

*

মহলের ভিতরের কয়েদখানায় প্রবেশের পর ওদের দুজনকে দুই জায়গায় নিয়ে গেলো প্রহরীরা। ক্রিস্টোফারকে একটা খুপরির ভিতর ঢুকিয়ে বেঁধে রাখা হলো। তবে তামান্নাকে কি করা হলো তা ও জানে না। কয়েদখানার পাথরের দেয়ালের সাথে শেকল দিয়ে ওকে বেঁধে রেখে চলে গেলো সবাই।

ওখানে থাকতে থাকতে সময়ের হিসাব ভুলে গেলো ক্রিস্টোফার। এই নিঃসীম অন্ধকারে একাকী থাকতে থাকতে ওর মনে হতে বোধহয় কবরে শুয়ে আছে। শুধু গায়ের ব্যথাটা মনে করিয়ে দিতো যে ও বেঁচে আছে। ওর কবজি আর ঘাড় শেকলে ঘষা খেয়ে ছুলে গিয়েছে, সেখানে ব্যথা করে। পায়ুপথে রক্ত আর পায়খানা শক্ত হয়ে জমে আছে। ভয়ানক ক্ষুধায় থেকে থেকে মোচড় দিয়ে উঠছে পেট। মেঝের একটা গর্ত থেকে পানি প্রবাহের শব্দ শোনা যায়। কয়েদখানার নিচ দিয়ে একটা নদী চলে গিয়েছে সম্ভবত। এদিকে পিপাসায় ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। তাই ব্যথার চাইতে ওর জন্যে এটাই সবচে বড় অত্যাচার। শুধু মনে হয় পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ ভরে ঠাণ্ডা পানি খাবে।

অবশেষে প্রহরীরা এলো। তবে কেউই ওকে সামান্যতম দয়াও দেখালো না। বাধন খুলে টানতে টানতে নিয়ে গেলো মহলের ভিতর দিয়ে। তখনও উলঙ্গ ও। মহলের ভিতরের দুই ধার সুদৃশ্য ভাস্কর্য দিয়ে ভরা, দেয়াল জুড়ে বিশাল বিশাল কাঠের জানালা। কোনদিকে যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার কিছুই টের পেলো না ক্রিস্টোফার। অনেকবার দিক বদলের পর একটা ভারি পিতলের দরজার সামনে এসে উপস্থিত হলো ওরা। ওখানকার দরজার পাহারাদার ক্রিস্টোফারকে দেখে নাক সিটকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো। কিন্তু ওকে ধরে আনা প্রহরীরা ধমক দিলো তাকে।

“রানির আদেশ।”

দরজা খুলে গেলো। ভিতরের ঘরটা বোম্বের দুর্গের বিশাল পার্টি রুমটার চাইতেও বড়। সুদৃশ্য পর্দা আর দামী চিত্রকর্ম ঝুলছে দেয়ালে। প্রহরীরা ঘরের শেষ মাথার বাঘের ছালের তৈরি কার্পেটের উপর নিয়ে দাঁড় করালো ওকে। পুলা আর টুঙ্গার ওখানে একটা সুন্দর নকশা কাটা মেহগনী কাঠের সিংহাসনের সামনে মাথা নত করে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। আর সিংহাসনে বসে আছে একজন কম বয়সী সুন্দরি মহিলা। চোখ নিচু করে রাখায় ক্রিস্টোফার অবশ্য ভালো করে তার চেহারাটা দেখতে পেলো না। প্রহরীরা ওকে ধাক্কা দিয়ে হাঁটু ভেঙে বসিয়ে দিলো। তবে মেয়েটার অপার্থিব সৌন্দর্য, তার পরনের আড়ম্বর পোশাক আর মাথার মুকুটটা দেখে ক্রিস্টোফারের বুঝতে বাকি রইলো না যে ইনিই হচ্ছেন চিত্তাত্তিঙ্কারার রানি।

পুলা আর টুঙ্গার কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছিলো। রাগে লাল হয়ে আছে। পুলার চেহারা। আর টুঙ্গারের কাটা দাগটা মনে হলো দপদপ করছে। ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে রাগ সামলাতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে তাদের।

“ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই,” পুলা বললো। “আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই ওদের উপর নির্ভরশীল।”

“আমরা না, আপনি ওদের উপর নির্ভরশীল,” টুঙ্গার জবাব দিলো।

“রানিকে ওদের একচেটিয়া ব্যবসার পক্ষে রাখার জন্যে ইংরেজরা আপনাকে কতে দেয়?”

“আমি শুধু চাই আমাদের কাপড়গুলোর জন্যে একটা লাভজনক বাজার। ইংরেজরা ছাড়া সেগুলো আর কেউ কিনবে না।”

“টুপিওয়ালা আরো আছে। ওরা আমাদেরকে এর চাইতে বেশি টাকা দেবে।”

 ক্রিস্টোফারের আগমনে কোনো ভাবান্তরই হলো না ওদের। ও জবুথবু হয়ে মেঝেতে বসে বসে কেনো ওকে কয়েদখানা থেকে এখানে আনা হলো সেটা ভাবতে লাগলো।

সিংহাসনে বসা মহিলাটা তার হাত তুললেন। হাতের সোনার বালাগুলো শব্দ করে উঠলো তাতে। সাথে সাথে লোক দুজন চুপ করে গিয়ে একান্ত বাধ্যগতের মতো মাথা নিচু করে রইলো।

 “ব্রিঞ্জোয়ানের ইংরেজগুলো একেকটা পাতি শেয়াল। ওরা আমাদের লোকজনকে চুষে খাচ্ছে,” ঘোষণা দিলেন মহিলা। “এতোবার সাবধান করার পরেও ওরা আমাদেরকে কাঁচকলা দেখিয়েই চলেছে।”

 টুঙ্গার খোঁচা মারা হাসি হাসলো একটা। পুলা মাথা নিচু করে রানির কথাই মেনে নিলো। “জ্বী, মহামান্য।”

“যাই হোক। আমরা প্রতিহিংসাপরায়ণ নই। আর কোনো উপায় না থাকলে শুধুমাত্র তখনই যুদ্ধ হবে।” রানি বললেন।

এখন পুলা-ও সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো।

 “তুই কি টুপিওয়ালা নাকি?” রানি জিজ্ঞেস করলেন।

মেঝেতে মাথা নামিয়ে বসে থাকায় ক্রিস্টোফার বুঝতে পারেনি যে ওকেই করা হয়েছে প্রশ্নটা। টুঙ্গার ওর পাজরে একটা লাথি কষিয়ে ওর সম্বিত ফেরালো। “মহামান্য রানি তোকে কি জিজ্ঞেস করেছে শুনতে পাসনি?”

ক্রিস্টোফার শশব্যস্ত হয়ে হাঁটুর উপর ভর করে বসে রানির দিকে তাকালো। ঠিক একজন হিন্দু দেবীর সৌন্দর্য নিয়ে তার সিংহাসনে বসে আছেন রানি। সারা বাহুতে স্বর্ণ আর আইভরির বালা; কাপড় সেলানো হয়েছে সোনার সুতা দিয়ে। তাতে মুক্তা বসানো। মাথায় একটা রাজমুকুট, ওটা থেকে একটা টকটকে লাল চুনি নেমে এসে ঠিক তার দুই চোখের মাঝখানে ঝুলছে। কালারিতে পড়াশোনার সুবাদে ক্রিস্টোফার জানে যে ওটা দিয়ে আসলে ষষ্ঠ চক্রকে বোঝানো হয়। জিনিসটা হচ্ছে নিগঢ় জ্ঞানের আধার। আলমন্ডের মতো দেখতে চোখ দুটো ওর দিকেই তাক করা, সে চোখের ভাষা পড়ার সাধ্য কারো নেই।

“জ্বী,” মাথা ঝাঁকালো ক্রিস্টোফার। “আমি টুপিওয়ালা।”

“তাহলে এর মানে কি?”

রানি চোখ দিয়ে এক চাকরকে ইশারা করলেন। লোকটার হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ। রানির প্রতিটা নাড়াচাড়া সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করতে করতে সে সামনে এসে হাতের ব্যাগটা উপুড় করে দিলো। উরুমিটা বেরিয়ে এসে থ্যাপ করে পড়লোমেঝের উপর। ক্রিস্টোফার ওটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক যেরকম করে একটা বিড়াল পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে হিসেব কষছে ওটা কতো দূরে, আর ওর ঐ পর্যন্ত পৌঁছাতে কতো সময় লাগতে পারে।

টুঙ্গার পা দিয়ে উরুমিটা চেপে ধরে নিজের তরবারির হাতলে হাত রাখলো। যা বোঝার বুঝে নিলো ক্রিস্টোফার।

 “আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি,” ক্রিস্টোফার ব্যাখ্যা করলো। “একজন আসান আমাকে তার কালারিতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওখানেই আমি কালারিপায়াত্ত শিখেছি।”

“মিথ্যে বলছে ও,” পুলা বললো।

“একজন ইংরেজকে ডেকে আনুন। আমার কথা শুনলেই উনি বুঝবেন যে আমি কোন দেশের মানুষ,” ক্রিস্টোফার অনুরোধ করলো। কারণটা জানে না, তবে এটা বুঝতে পারছে ওর জীবন মরণ এখন ওর জাতীয়তার উপর নির্ভর করছে।

“আমার সৈন্যদের উরুমি চালানো শেখাতে পারবি?”

টুঙ্গার প্রতিবাদ করতে গেলো কিন্তু রানি ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। ক্রিস্টোফারের উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছেন উনি।

 “পারবো,” ঘোষণা দিলো ক্রিস্টোফার। কিন্তু রানি আরও কিছু শুনতে চাচ্ছিলেন। “আমি ওদেরকে রণকৌশল-ও শেখাতে পারবো, যেভাবে টুপিওয়ালারা যুদ্ধ করে। ওদেরকে আরো দ্রুত কামানের গোলা ছোঁড়া-ও শেখাতে পারবো। আমি ওদেরকে এমন এক সৈন্যদলে রূপান্তরিত করতে পারবো যা এদেশের কেউ কখনো দেখেনি।”

 “এসবের কোনো দরকার নেই,” পুলা আপত্তি করলো। “ব্যবসা-ই হচ্ছে ক্ষমতার মূলমন্ত্র। যারা-ই যুদ্ধ করে, তারা না খেয়ে মরে।”

 রানি ওর দিকে এমনভাবে তাকালেন যে সেই দৃষ্টিতে একটা হাতীও কুপোকাত হয়ে যেতো। “ঐ টুপিওয়ালাদের জন্যে আমার অনেক লোক আহত হয়েছে, রানি বললেন। “ওদেরও জানা দরকার যে আমরাও মাথা উঁচু করতে চলতে জানি। ওদের জাহাজ আর কামানের ভয় করি না। ওরা যদি আমার সামনে মাথা নত না করে, তাহলে এমন শিক্ষা দেবো যে সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না।”

 টুঙ্গার ওর গালে হাত বুলালো। মুখের ক্ষতটায় মালিশ করছে। “মহামান্য রানিই ভালো বোঝেন।”

“তবে তার আগে আমাকে এই জানোয়ারটার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।” রানি এমনভাবে কথা বললো যেনো ক্রিস্টোফার এখানে নেই। সবাই যখন ওর দিকে একযোগে তাকালো তখন ও কথাটার অর্থ ধরতে পারলো।

ও কুর্নিশ করে বললো, “আমি শুধু আপনার আনুগত্য করবো।”

রানি সিংহাসনে বসেই সামনে ঝুঁকে এলেন। “তুই আমার প্রজাদের লুট করেছিস, নিরীহ লোকজনকে খুন করেছিস, আমার উপদেষ্টাকে হেনস্থা করেছিস। তোর মতো লোকদেরকে আমরা কি শাস্তি দেই সেটা কি জানা আছে?

 ক্রিস্টোফারের রাস্তার দুই ধারে শূলে চড়ানো লোকগুলোর কথা মনে এলো। এর মধ্যে প্রথমজন, মানে বিজয়ের এতোক্ষণে মারা যাওয়ার কথা। ও ভয়ার্ত মুখে মাথা ঝাঁকালো।

“তোর কি মনে হয় যে তোকে মাফ করে দেওয়া উচিত?”

“আমি মহানুভবের করুণা ভিক্ষা চাচ্ছি। সর্বস্ব দিয়ে আপনার সেবা করার সুযোগ দিয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের একটা সুযোগ দিন।”

রানি ভাবতে লাগলেন। “তোর এক ডাকাত সহযোগী এখনো বেঁচে আছে,” বললেন উনি।

রানি আর কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন, সেই দৃষ্টি দেখেই ক্রিস্টোফার বুঝে গেলো উনি কি বোঝাচ্ছেন। এটাই ওর ছড়ান্ত পরীক্ষা-ওর আনুগত্য প্রমাণ করে, জীবন বাঁচিয়ে মুক্তি পাওয়ার এটাই সর্বশেষ উপায়। একজন সত্যিকার ক্ষমতাবানের মতো রানি ঠিকই টের পেয়েছেন দুনিয়াতে ওর কাছে মূল্যবান আর কি আছে। উনি চান ক্রিস্টোফার তামান্নাকে খুন করুক।

ক্রিস্টোফার কি তামান্নাকে জঙ্গলের ওই ঢালটা থেকে লাফ দিতে দেয়নি এভাবে মরার জন্যে? ও পারবে না। চোখের কোনা দিয়ে আরো একবার উরুমিটার দিকে তাকালো ও। একবার যদি জিনিসটা হাতে পান্তু তাহলে এদের সবাইকে খুন করতে পারবে; তারপর প্রহরীদেরকেও মেরে কয়েদখানায় গিয়ে তামান্নাকে মুক্ত করে পালিয়ে যাবে। এখানে নিশ্চয়ই আস্তাবল আছে। ঘোড়ায় চড়ে দরকার হলে চীন চলে যাবে। নতুন পরিচয়ে, নতুন করে শুরু করবে জীবন।

 কিন্তু সকল কল্পনা এক আছাড়ে বাস্তবতায় নেমে এলো। ঘরে বিশজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। ও উরুমিটা ছোঁয়ার আগেই মারা পড়বে। অথবা আরো খারাপ কিছু হতে পারে, হয়তো ওকে না মেরে আবার কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়া হবে। শূলে বিদ্ধ হওয়ার তীব্র যন্ত্রণা মনে পড়লো ওর। কয়েদখানার নিঃসীম অন্ধকারের কথা মনে পড়লো। বুঝলো যে আর কোনো উপায় নেই।

“আমি ওকে খুন করবো,” রাজি হলো ক্রিস্টোফার। “আমাকে উরুমিটা দিন, ওকে মেরে ওর কাটা মুণ্ডু আপনার সামনে পেশ করবো।”

রানির মুখোভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হলো না। কিন্তু তার চোখের আড়ালে যেনো এক প্রেতাত্মার হাসি দেখা গেলো ক্রিস্টোফার।

 “আমি চাই তুই শুধু ঐ ডাকাত মহিলাকে খুন কর। মহলের সবাইকে না।”

 রানি তুড়ি বাজাতেই একজন চাকর এগিয়ে এসে রানির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে একটা আইভরির নকশা কাটা কাঠের বক্স সামনে তুলে ধরলো। রানি ঢাকনিটা তুলতেই দেখা গেলো ভিতরে রেশমি কাপড়ের উপর একটা ছোট ছুরি শুয়ে আছে। হাতলটা একটা স্বর্ণের আংটির মতো, ভাঁজ করা ফলাটা পালিশ করা ইস্পাতের তৈরি, সর্বোচ্চ দুই ইঞ্চি লম্বা। রানি ওটা বক্স থেকে বের করে, একটা বাচ্চার প্রিয় খেলনার মতো করে আদর করতে লাগলেন।

“এটার নাম বাঘের-নখ, ক্রিস্টোফারকে বললেন রানি। “আমার মনে হয় না কালারিতে এরকম কিছু ছিলো।”

 ক্রিস্টোফার মাথা নাড়লো। “এটা খুবই সুন্দর,” ফিসফিসিয়ে বললো ও। ছুরিটার ফলায় উপরের জানালা থেকে আলোক রশ্মি এসে পড়তেই ওটার খোদাইগুলো থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। ক্রিস্টোফার বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো।

রানি তার ডান হাতের তর্জনীতে আংটিটা পরে নিলেন। ফলাটা ভাঁজ হয়ে তার হাতের তালুতে লুকিয়ে থাকলো। হাত মুঠ করতেই আর ওটা দেখা গেলো না।

“এটা নে। দেখা যাক তোর হাতে এটা মাপমতো হয় নাকি।”

ক্রিস্টোফার ওটাকে আঙুলে পরে হাত মুঠি করে স্বর্ণের নখরটাকে ঢেকে রাখলো। হাতটা খুলতেই ওটার ভাজ আপনা আপনিই খুলে ছুটে গেলো সামনে। ও হাতটা একবার ডানে আর একবার বামে চালালো, আর ছুরিটা হিসহিসিয়ে বাতাস কেটে দিলো।

 “মেয়েটাকে নিয়ে আসুন,” নিরাসক্ত গলায় বললো ক্রিস্টোফার। রানি মাথা ঝাঁকাতেই টুঙ্গার এক প্রহরীকে আদেশ দিলো।

 চুপচাপ দরবারে বসে রইলো ওরা। টু শব্দটিও করলো না কেউ। এমনকি রানিও না।

অবশেষে নিচের ঘর থেকে উপরে আসার সিঁড়িতে পদশব্দ পাওয়া গেলো। একটু পরেই রানির চারজন প্রহরী আবার দরবারে প্রবেশ করলো।

ওদের মাঝখানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে তামান্না। এটা যে তামান্না তা চেনাই যাচ্ছে না। চামড়া ফেটে রক্ত বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ওর পায়ের পাতায় চাবুক মারা হয়েছে। গায়ে একটা সূতাও নেই। কবজি শরীরের সামনের একসাথে বাঁধা। সারা পিঠে জুড়ে চাবুকের দাগ লাল হয়ে ফুটে আছে। চুল আলুথালু হয়ে কোমর পর্যন্ত ঝুলছে, ঘাম আর রক্তে ভিজে সপসপে। চোখ টকটকে লাল, কোটরের গভীরে ঢুকে গিয়েছে। চোখের পাতে ফুলে আছে, খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে ওর। ঘুষি মেরে ওর প্রায় সবগুলো দাঁতই ফেলে দেওয়া হয়েছে, চোয়ালটাও ভেঙে গিয়েছে, ফলে ওর রক্তাক্ত, ফুলে ঢোল ঠোঁট দুটো বন্ধ করতে পারছে না।

ও অনিশ্চিত ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। ফুলে ওঠা পায়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে কষ্ট হচ্ছে। ওর চোখ ক্রিস্টোফারের উপর দিয়ে ঘুরে গেলো কিন্তু তাতে পরিচিতির কোনো আভাস পাওয়া গেলো না। ভাঙা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় শিষের মতো শব্দ হচ্ছে।

 “তামান্না!” প্রায় কেঁদে উঠলো ক্রিস্টোফার। তামান্না উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। পরিচিত কণ্ঠটা কোত্থেকে আসছে ধরতে পারছে না।

“ওরা আমাদেরকে ছেড়ে দিচ্ছে!” তামান্নাকে বললো ক্রিস্টোফার। তামান্না নীরবে কাঁদতে শুরু করতেই ওর চেহারা আরো বিকৃত হয়ে গেলো। ওর বুক ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। সারা শরীর কাঁপছে।

“ছে…ড়ে… দেবে,” ওর ঠোঁট নড়লো কিন্তু শব্দটা শোনা গেলো না। ক্রিস্টোফার ওর দিকে এগিয়ে গেলো। প্রহরীদের ইশারা করলো ওকে ছেড়ে দিতে। ওরা পিছিয়ে গেলো।

 “হ্যাঁ, এখান থেকে আমরা আরো সুন্দর, আরো অনেক ভালো একটা জায়গায় যাবো। আমরা পাখির মতো যেখানে খুশি উড়ে যাবো।”

“পাখি…” আবার বললো তামান্না। ক্রিস্টোফারকে চিনতে পেরে ফোঁপাতে শুরু করেছে। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে টলতে টলতে ওর দিকে আগাতে লাগলো। ক্রিস্টোফারও এগিয়ে গেলো। ডান হাতে বাঘের নখর খুলে রেখেছে।

“আর কোনো বাধা থাকবে না,” নরম সুরে বললো ক্রিস্টোফার। ও তামান্নার হাতের বাঁধন কেটে দিতেই ও ক্রিস্টোফারের উপর ঢলে পড়লো। ওর ফোলা ঠোঁটে চুমু খেলো ক্রিস্টোফার। তামান্না মরিয়া হয়ে ক্রিস্টোফারকে জড়িয়ে ধরতেই ও বাঘের নখটার ডগাটা তামান্নার ডান কানের নিচ বরাবর ঢুকিয়ে দিলো। তারপর এক পোচে ক্যারটিড ধমনী সহ সবগুলো প্রধান রক্তবাহিকা দিলো কেটে। গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্ত। দুজনেই ভিজে গেলো তাতে। তামান্না খুব দুর্বলভাবে বাধা দিতে চাইলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার ওকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে ওর কানে বিড়বিড় করে নরম সুরে কথা বলতে লাগলো। আস্তে আস্তে প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেলো তামান্নার।

রানি নিজের সিংহাসনে সামনের দিকে ঝুঁকে আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখছেন। তামান্নার মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে যথেষ্ট আমোদ পেয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। দরবারের কেউ এক চুল নড়লো না বা কোনো কথা বললো না।

আচমকা তামান্না ওর কাটা শ্বাসনালী দিয়ে ঘড়ঘড় করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে স্থির হয়ে গেলো। ক্রিস্টোফারের কোলে আরাম করে ঘুমাচ্ছে যেনো। একটু পরেই ওর মাথা কাত হয়ে ক্রিস্টোফারের কাঁধে ঢলে পড়লো। পা শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। ক্রিস্টোফার আলতো করে লাশটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো।

 “সাবাস!” হাতে তালি দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠলেন রানি। ক্রিস্টোফার হতবাক হয়ে দেখলো রানি কাঁদছেন। “জীবনে এরচে সুন্দর আর মর্মস্পর্শী কিছু দেখিনি আমি।”

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *