৩. জোসেফ ত্রিভান্ড্রাম বন্দর

এক সপ্তাহ পর জোসেফ ত্রিভান্ড্রাম বন্দরে নোঙ্গর করলো। কু-রা সবাই তো মহা খুশি। বোম্বে ছাড়ার পর আর ওদের ডাঙ্গায় পা দেওয়া হয়নি। পুরো সময়টা ফুর্তিতে কাটাবে বলে ঠিক করলো সবাই। ক্রফোর্ড একটা টুল আর টেবিল নিয়ে ডেক-এ গিয়ে বসলো। নাবিকরা ওর চারপাশে জড় হলো যার যার পাওনা নিতে।

খাতায় নিজের নাম সই করে, হাতে কয়েকটা পয়সা নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে যেতে লাগলো সবাই। ক্রিস্টোফার ছিলো সবার শেষে। ক্রফোর্ডের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। ক্রফোর্ড সরু চোখে তাকালো ওর দিকে।

“কি চাই?”

 “আমার বেতন।”

“অবশ্যই,” বলে ক্রফোর্ড মহা আয়োজন করে টাকা গুণতে বসলো। শেষে কয়েকটা মুদ্রা বের করে সেগুলো টেবিলের উপর দিয়ে ঠেলে দিলো সামনে। কিন্তু ক্রিস্টোফার ওগুলো তুলে নিতেই ক্রফোর্ড ওর কবজি ধরে ধরে ফেললো। তারপর মোচড় দিয়ে মুদ্রাগুলো ওর হাত থেকে আবার ফেলে দিলো টেবিলের উপর।

“আবার এসব কি করছিস?”

ব্যথায় ক্রিস্টোফারের চোখ ফেটে পানি চলে এলো। মনে হলো কবজিটা বোধহয় ভেঙেই গিয়েছে।

“আমার বেতন নিচ্ছি।”

“আবার আমার কাছ থেকে চুরি করছিস?”

 “প্রতি সপ্তাহে চার রুপি দেওয়ার কথা ছিলো আপনার।”

“তুই আমার নবীশ হিসেবে জাহাজে উঠেছিস। তার মানে তোর সব বেতন আমার কাছে আসবে।” বলে ক্রফোর্ড ক্রিস্টোফারের হাত ছেড়ে দিলো। আচমকা বন্ধন মুক্ত হওয়ায় ক্রিস্টোফার পিছনে উল্টে ডেক-এর উপর পড়ে গেলো। এতোগুলো লোক চেয়ে চেয়ে দেখলো, কেউ ধরতে পর্যন্ত আগালো না। ক্রফোর্ড পয়সাগুলো নিয়ে আবার ওর বক্সে ভরে রাখলো। তারপর ঠাস করে মুখটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে বাঁধা ছুরিটা নাড়তে লাগলো।

“সব পরিষ্কার?”

ক্রিস্টোফার ওখানেই পড়ে রইলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ। প্রতিশোধের নেশা পেয়ে বসেছে ওকে। শুধু ইচ্ছা করছে ছুরিটা ক্রফোর্ডের পেটে গেঁথে দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে ওর মৃত্যুটা দেখতে। ও টের পেলো সবগুলো ক্রু ওকে দেখছে, ওর দুরবস্থা উপভোগ করছে। এদেরকেও ও চরম ঘৃণা করে।

ক্রিস্টোফার নিজেকে টেনে তুলে সোজা ক্রফোর্ডের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলো। কবজির ব্যথাটাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ওকে দাঁড়াতে দেখে অবাক হয়ে গেলো ক্রফোর্ড।

 “সব পরিষ্কার,” কাটা কাটা ভাবে বললো ক্রিস্টোফার। আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না ওর।

ক্রফোর্ড আরো একবার ওকে ক্ষেপিয়ে তুলতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেলো। মাত্র কয়েক সপ্তাহেই ক্রিস্টোফার এখন আর বোম্বেতে দেখা সেই নাদুসনুদুস বাচ্চাটা নেই। কাঁধ চওড়া হয়ে গিয়েছে, শরীরও পেশিবহুল হয়েছে আরো বেশি। এখন আর আগের মতো বিনীতও নেই। তবে এতো কিছুর মধ্যে ওর চেহারার পরিবর্তনটা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে। কঠোর আর শক্ত হয়ে গিয়েছে চেহারা। কালো চোখের মণিতে কেমন অস্থিরতা, অথচ দৃষ্টি অনেক গভীর। ক্রফোর্ড মুখে স্বীকার করবে না, কিন্তু চোখ জোড়া দেখে ও নিজেও ভয় পায়।

ক্রফোর্ড ঘুরে আদেশ দিলো, “নৌকা নামাও। আমরা ডাঙ্গায় যাবো। তুই বাদে।” ক্রিস্টোফারের দিকে ঘেউ ঘেউ করে বললো ও। “তুই জাহাজে বসে নোঙ্গরের দিকে খেয়াল রাখবি। যদি আমার জাহাজের কিছু হয়, তাহলে তোকে মাস্তুলে পেরেক দিয়ে গেঁথে কাক দিয়ে খাওয়াবো। বুঝেছিস?”

ক্রিস্টোফার দেখলো শুধু দানেশে ওর দিকে সহানুভুতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বাকিরা ফিরেও তাকালো না। ক্রিস্টোফার বসে বসে দেখলো সবাই নৌকা বেয়ে ডাঙ্গার দিকে চলে গেলো। দানেশ-ও গেলো। একদল মহিলা তীরে দাঁড়িয়ে আছে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে। নামতে না নামতেই সবাইকে প্রায় টেনে হেঁচড়ে কাছের বেশ্যালয়ে নিয়ে গেলো মেয়েগুলো। রাত পোহানোর আগেই এদের সব ইনকাম হাওয়া হয়ে যাবে। তবে তাতে ক্রিস্টোফারের কোনো সান্ত্বনা নেই।

ও জাহাজের ছাউনির ছায়ায় বসে ছুরি দিয়ে একটা কাঠে আঁকিবুকি আকলো কিছুক্ষণ। পুরো জাহাজে ও একা, এই একাকীত্বটাই ওর কাছে ভালো লাগতে লাগলো। সারাজীবন বলতে গেলে ও একা-ই বড় হয়েছে। কুঠির অন্য ছেলেদের সাথে মেশা ওর বারণ ছিলো। কারণ ওর বাবার চোখে বাকিরা ছিলো ওদের চাইতে নিম্ন শ্রেণির। যে গুটি কয়েকের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়েছিলো তারা সব মারা পড়েছে নাহয় ইংল্যান্ড ফিরে গিয়েছে। ওর মা, বাবার ভয়ে কখনো নিজের ঘর ছেড়ে বের হন না। তাই ও সবসময় একা-ই বড় হয়েছে।

ও বুঝতে পারছে যে ওর পক্ষে এভাবে ভাগ্য গড়া সম্ভব হবে না। যদি ও ক্রফোর্ডের অত্যাচার সহ্য করে বেঁচে-ও যায়, তবুও ওকে একটা সস্তা কাপড়ের জামা বানানোর টাকা জমাতেও কয়েক বছর লেগে যাবে। রুথকে তো আর এতো দিন অপেক্ষা করিয়ে রাখা সম্ভব না।

ওর বাবার কাছ থেকে ক্রিস্টোফার আর একটা জিনিস শিখেছে। গভর্নরের অফিসে চুপচাপ সবার অলক্ষ্যে বসে থেকে থেকে ও অনেক মানুষকে অফিসে আসা যাওয়া করতে দেখেছে। নীরব ঘরটায় দূর থেকেও কথোপকথন শোনা যেতো। মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হলে লোজন ওর বাবাকে এমন কুৎসিত। ভাষায় গালি দিতে যা ও কল্পনাও করতে পারে না। এরপরেও ওর বাবা তাদেরকে মাথা উঁচু করেই ওদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দিতো। ওরা মনে মনে ভাবতো যে খুব জেতা জিতেছে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর ও তাদেরকেই দেখেছে হতদরিদ্র অবস্থায় ইংল্যান্ডের জাহাজে চড়ে বসতে। সব হারিয়ে পথের ফকির হয়ে গিয়েছে তারা। একজনকে তো গ্রেপ্তার করে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, কারণ তাকে একজন সেপাহী ছোঁকড়ার সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ধরা পড়েছিলো সে।

কখনো ভুলবে না, কখনো ক্ষমা করবে না। আর এমন সময় বদলা নেবে যখন সেটা তোমার শত্রুকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। ক্রিস্টোফারের মনে হলো ও যেনো নতুন কোনো সত্য আবিস্কার করে ফেলেছে।

ও ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো। সূর্যমামা ডুবে গিয়ে অন্ধকার ভরে গেলো চারপাশ। ক্রিস্টোফার হ্যাচ গলে নিচের ডেক-এ নেমে এলো। রান্নাঘরে গিয়ে বাবুর্চির রেখে যাওয়া একটা পাত্র থেকে খানিকটা স্ট্য নিয়ে উদরপূর্তি করলো। তারপর খোঁজাখুঁজি করে লুকানো জায়গা থেকে বের করে আনলো এক বোতল আরক। জিনিসটা আসলে ধেনো মদ। ছিপি খুলেই bক ঢক করে কয়েক ঢোক পেটে চালানরে দিলো। জ্বলন্ত তরলটা পেটে পড়তেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেলো ওর। এক অদ্ভুত সাহস অনুভব করতে লাগলো নিজের ভিতর।

 “আর এক শয়তানের দাস হয়ে থাকবো বলে আমি আমার বাবাকে ছেড়ে আসিনি,” নিজেকেই শোনালো ও। আর একটা হ্যাচ গলে একেবারে নিচের ডেক-এ চলে এলো ক্রিস্টোফার। জোসেফ-এর বেশিরভাগ মালপত্রই একেকটা বিশাল গাট্টি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কাপড়ের গাট্টি বা চাউলের বস্তাগুলো বেশি বড়, ওগুলো দিয়ে ওর উদ্দেশ্য সাধন হবে না। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে রেশমি কাপড়ের একটা ছোট বোঁচকা খুঁজে পেলো। এতেই চলবে।

পানির কাছাকাছি থাকায় ক্রিস্টোফার জাহাজের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলো। জাহাজের প্রতিটা ক্যাচকোচ শব্দ মাস্তুল বেয়ে নিচে নেমে আসছে। খোলের গায়ে শব্দ করে কিছু একটা বাড়ি খেলো, সম্ভবত ঢেউ। বা পানিতে ভেসে আসা কোনো কাঠের টুকরো। কিন্তু তাতেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলো ও। হাতের তালু ঘেমে পিছলে গেলো বোঁচকা। মদটা গলার কাছে উঠে এসে তেতো অনুভুতির সৃষ্টি করলো।

 একটা বস্তা থেকে সুপারি নিয়ে পকেটে ভরলো ক্রিস্টোফার, তারপর সিল্কের বোঁচকাটা কাঁধে ফেলে আবার উঠে এলো উপরে। ডিঙ্গি নৌকাগুলো এখনো তীরে, কিন্তু ঠিকই একটা ছোট নৌকা রয়ে গিয়েছে যা ও নিজেই বাইতে পারবে। ও নিজের ছুরিটা বের করে নৌকা বাধা দড়িগুলো কাটতে লাগলো।

 “যাচ্ছিস কোথায়?” গর্জে উঠলো ক্রফোর্ড। জাহাজের পিছনে জ্বালানো মশালের আবছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ডেক-এ বিশাল লম্বা ছায়া পড়েছে ওর। “আবার তুই চুরি করছিস। একবার মার খেয়ে শিক্ষা হয়নি?”

ক্রফোর্ড কখন জাহাজে এসেছে সেটা ক্রিস্টোফার টের পায়নি। হয় ও ক্রিস্টোফারকে বিশ্বাস করে না, নয়তো কোনো সাক্ষী ছাড়া ওকে শেষ করে দিতে এসেছে। কিন্তু ক্রিস্টোফার কারণটা কখনো জানতে পারেনি। ক্রফোর্ড সামনে এগিয়ে এসে এতো জোরে ক্রিস্টোফারের চেহারায় ঘুষি দিলো যে ও উড়ে পিছনের দড়াদড়ির উপর গিয়ে পড়লো।

“আমাকে মেরে ফেলতে হলে এর চাইতে জোরে মারতে হবে, ক্রিস্টোফার বললো। ওর কণ্ঠে এক ভয়ানক হিংস্রতা খেলা করছে। একটা বুড়ি মহিলার মতো আঘাত করেন আপনি।”

একটা হুংকার ছেড়ে ক্রফোর্ড পেয়ে গেলো সামনের দিকে। ক্রিস্টোফার উঠে দাঁড়িয়েছে। আত্মরক্ষার্থে নিজের হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে ধরলো ও, এক হাতে যে ছুরি ধরা সেটা খেয়াল নেই। অন্ধকারে ষাড়ের মতো ধেয়ে আসা ক্রফোর্ড-ও খেয়াল করলো না ব্যাপারটা।

 সহজাত প্রবৃত্তির বশেই ক্রিস্টোফার ক্রফোর্ডের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। বিশাল লোকটা ওকে আঁকড়ে ধরতে যেতেই ও-ও সজোরে ধাক্কা দিলো সামনের দিকে।

ক্রিস্টোফার কিছু বোঝার আগেই হাতের ছুরিটা ক্রফোর্ডের ভূড়ি ফাঁসিয়ে দিলো। গরম রক্ত বেরিয়ে এলো সেদিক দিয়ে। ক্রফোর্ড চিৎকার দিয়ে উঠে মোচড়া মুচড়ি করে ছুরিটা শরীর থেকে বের করার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু টানাটানিতে ওর জখম আরো বড় হওয়া ছাড়া আর কিছু হলো না। ওর নাড়িভুড়ি বেরিয়ে ক্রিস্টোফারের হাতের উপর এসে পড়লো।

ক্রিস্টোফার লাফিয়ে সরে গেলো দূরে। ছুরিটা টান দিয়ে বের করে ফেলেছে। ক্রফোর্ড নিজের পেট চেপে ধরে চেষ্টা করলো সবকিছু আবার ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার। ব্যথায় একটা আহত ষাড়ের মতো গোঁ গোঁ করছে ও।

 ক্রফোর্ডের চিৎকার নিশ্চয়ই পানি পেরিয়ে ডাঙ্গায়ও পৌঁছাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যাবে ডাঙ্গা থেকে কেউ না কেউ শব্দটা শুনে কি হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখতে চলে আসবে। আর ক্রিস্টোফারকে এভাবে উদ্দত ছুরি হাতে দেখলেই যা বোঝার বুঝে নেবে সবাই। ওকে এর শেষ করতে হবে।

এছাড়া ওর আর কোনো উপায় নেই। ক্রিস্টোফার শক্ত হাতে ছুরিটা ধরলো আবার, তারপর ওপরে তুলে সোজা ক্রফোর্ডের হৃৎপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিলো।

ক্রফোর্ডের চিৎকার চেঁচামেচি সর থেমে গেলো সাথে সাথেই। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পায়ের কাছে পড়ে থাকা লাশটার দিকে চেয়ে রইলো ক্রিস্টোফার। হাত থেকে ছুরিটা পড়ে গেলো ওর। সারা শরীর কাঁপছে।

 ‘তুমি একটা খুনী-গাই এর মতো ঠাণ্ডা স্বরের কেউ এসে ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেলো কথাটা।

লাশটা থেকে নিজের দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলো না ও। একটু আগেও যে একজন জলজ্যান্ত মানুষ ছিলো, সে এখন কাটা মাংসের স্তূপ ছাড়া কিছু না।

‘তুমিই করেছো সব’-কণ্ঠটা আবার বললো।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর অপরাধবোধ কমে এলো খানিকটা। আস্তে আস্তে শরীরে উষ্ণতাও ফিরে এলো। কাঁপাকাপি গেলো থেমে। যে লোকটা ওকে পিটিয়েছিলো, ঠেঙিয়েছিল, অত্যাচার করেছিলো, ধোঁকা দিয়েছিলো-সে এখন মৃত। ও আর কখনো ক্রিস্টোফারের গায়ে হাত তুলতে পারবে না।

 “আমিই কাজটা করেছি, নিজেকে নিজে বললল ও। ভাবনাটা মাথায় খেলতেই পুরো শরীর শিউরে উঠলো ওর। ঠাণ্ডার দিনে গোসল করতে গেলে যেরকম হয় সেরকম। “এতোদিন ধরে কাপুরুষের মতো কেননা বেঁচে আছি। আমি? নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে তো কিছুই জানতাম না।”

নিজের রক্তাক্ত হাত দুটো ক্রফোর্ডের পায়জামায় মুছে নিলো ক্রিস্টোফার, তারপর লাশটা হাতড়ে ক্রফোর্ডের টাকার থলেটা খুঁজে বের করলো। ভিতরে পয়সার ঝনঝনানি শোনা গেলো-ওর টাকা এগুলো সব। ও থলেটা নিয়ে নিজের পায়জামার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।

আর একটা জিনিস খেয়াল হলো ওর। একটা চাবি-ক্রফোর্ডের গলায় একটা রশি দিয়ে ঝোলানো। পিরিট রাখার সিন্দুকটার চাবির চাইতে অনেক ছোটো। তবে এই চাবিটাও ও সকালে দেখেছিলো। এটা হচ্ছে টাকার সিন্দুকের চাবি। ক্রফোর্ডের বুকের ছিদ্র থেকে রক্ত বেরিয়ে লাল হয়ে আছে। ক্রিস্টোফার টান মেরে চাবিটা ছুটিয়ে নিয়ে দ্রুত ক্যাপ্টেনের কেবিনের দিকে ছুটে গেলো। ক্রফোর্ডের খাটের নিচে টাকার সিন্দুকটা লুকানো থাকে। সবাই বেতন তুলে নেওয়ার পরেও ওর সিন্দুকটা বের করে আনতে ঘাম ছুটে গেলো। ভালো লক্ষণ।

নিচে ভাড়ার ঘরে গিয়ে এক বোতল কপির তেল খুঁজে পেলো ক্রিস্টোফার। জাহাজের খোলের ভিতর থাকা কাপড়ের গাড়িগুলোর উপর ঢেলে দিলো তেলটা, তারপর একটা ছোট পিপা থেকে গান পাউডার বের করে খোলের উপর ছড়িয়ে দিলো। এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতা আর শক্তির অনুভূতি কাজ করছে ওর ভিতরে। দ্রুত হাতে কাজ করতে লাগলো ও। ওর কাছে এই কাজটা একটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে। এতে করে ক্রফোর্ডের লাশও পুড়ে যাবে আর জাহাজের কোনো ত্রু-ও ওকে খোঁজার কথা চিন্তা করবে না। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে ও কাজটা শুরু করেছিলো ভিতরে থাকা প্রচণ্ড আক্রোশ থেকে, এতো কথা ভেবে না।

সিঁড়ির অর্ধেক উঠে এসে, ও ঘুরে হাতের কুপিটা অন্ধকারে ছুঁড়ে দিলো। কাঁচ ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে, আর তেলে ভেজা কাপড়ে আগুন ধরে গেলো মুহূর্তেই। লকলকে শিখায় ভরে গেলো খোল।

ক্রিস্টোফার তাকিয়ে থাকলো সেদিকে, নিজের কাজে নিজেই সম্মোহিত হয়ে গিয়েছে যেনো। আমিই করেছি সব, আবার ভাবলো ও। সামনের ধ্বংসলীলা ওর রক্তে আফিমের নেশার মতোই প্রবাহিত হতে লাগলো।

নিচ থেকে আসা গরম বাতাস এসে লাগলো ওর মুখে। বুঝলো যে আর থাকা যাবে না। সিঁড়ি বেয়ে উঠে ক্রফোর্ডের লাশের কাছে গিয়ে রেগে আবারও একটা লাথি দিলো ক্রিস্টোফার। ডিঙ্গিটা নামানোর সময় আর নেই, তবে গাছের গুঁড়ির যে ডোঙ্গাটায় করে ক্রফোর্ড এসেছে সেটা জাহাজের সাথে বাধা ই আছে। একটা রশিতে বেঁধে প্রথমে সিন্দুকটা নামিয়ে দিলো ডোঙায়, তারপর নিজেও নেমে এসে দাঁড়টা তুলে নিলো। দেরি না করে সমস্ত শক্তি দিয়ে বাওয়া শুরু করলো ও, পিছনের জাহাজটা ততোক্ষণে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।

একটু পরেই বালিতে এসে ঠেকলো ওর নৌকাটা। সিন্দুকটা কাঁধে তুলে নিয়ে ঝপাশ করে পানিতে নেমে পড়লো ক্রিস্টোফার। তারপর সোজা দিলো দৌড়। একটানে তীরের গাছগুলোর আড়ালে পৌঁছে তারপর পিছনে ফিরে তাকালো। জোসেফ দেখতে তখন বন ফায়ারের গানপাউডার ট্রিজন ডে-র মতো লাগছে। শহরের লোকজন অন্যপাশের পানির ধারে ছুটে আসছে কি হয়েছে দেখতে। প্রায় সবাই-ই অর্ধ উলঙ্গ। হাঁ করে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। জাহাজের কয়েকজনকেও দেখা গেলো, সাথের মেয়েগুলো তখনও সেটে আছে সাথে। ও ভেবে পেলো না ওরা কিভাবে বাড়ি যাবে? আর একটা জাহাজ খুঁজে পেতে কতো দিন লাগবে আর?

গাছের ফাঁকে মুক্ত বাতাস পাওয়ার আগ পর্যন্ত ও ভিতর হাঁটতেই থাকলো। বন্দরে যাওয়ার সাহস ওর নেই। অন্তত যতোক্ষণ জোসেফ-এর লোজন ওখানে থাকবে ততোক্ষণতো না-ই। তবে ও আসার পথে তীর দিয়ে অনেকগুলো শহর আর গ্রাম দেখেছে যেখানে আশ্রয় নিতে পারবে। সে উদ্দেশ্যেই দিক বদলে উত্তরে ঘুরতে যাবে কিন্তু দেখতে পেলো বনের ফাঁক দিয়ে আলো ছুটে আসছে। ও সিন্দুকটা টেনে সরিয়ে দিয়ে এক ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

অবয়বটা আরো কাছে এগিয়ে এলো, লাউয়ের খোল দিয়ে বানানো একটা বাতি ধরে আছে সাথে। ক্রিস্টোফারের লুকানো জায়গাটার একদম সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা। ধুলোমাখা পথে ওর পায়ের ছাপ আর সিন্দুক টেনে নেওয়ার দাগ দেখেই বুঝেছে কোথায় লুকিয়েছে।

“ক্রিস?” ডাকলো অবয়বটা।

 ওটা হচ্ছে দানেশ। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্রিস্টোফার লুকানো জায়গাটা থেকে মাথা তুলোলো। দানেশ আতংকে পিছিয়ে গেলো, চিনতে পারেনি ওকে। দানেশের কাছে মনে হচ্ছিলো ওর সামনে রক্ত আর ধুলোয় ভরা একটা অর্ধ উলঙ্গ দানব দাঁড়িয়ে আছে।

“ক্রিস?” ও তাকিয়েই রইলো। “আমি তোমাকে ডাঙ্গায় উঠতে দেখেছি।” তারপর রক্ত আর ওর চোখের উভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে বললো, “করেছছা কি তুমি?”

“আমি ওকে খুন করেছি,” বহু কষ্টে বললো ক্রিস্টোফার। মনে মনে বলার চেয়ে মুখে বলা অনেক কষ্ট। কিন্তু দানেশের চোখে তাকাতেই ওর প্রতি ‘দানেশের আলাদা একটা সম্ভম দেখতে পেলো।

“আর জাহাজ?”

“নেই। জ্বালিয়ে দিয়েছি আমি ওটাকে।”

দানেশের মুখ কালো হয়ে গেলো। “জাহাজটা দিয়েই পেট চালাতাম আমরা।”

“পেট চালানো? ক্রফোর্ড আমাকে কিছুই দেয়নি, মনে নেই?” ও ঝোঁপের পিছনে ফিরে গিয়ে আবার সিন্দুকটা তুলে নিয়ে এলো। “এটা দেখেছো? আমরা এখন নিজেরাই মালপত্র কিনতে পারবো। একটা জাহাজ ভাড়া করবো। আর দড়ি ধরেও ঝুলতে হবে না, বা ওর দড়ির বাড়িও খেতে হবে না। আমরাই এখন হবো সর্দার। আর কয়েকটা অভিযান ভালোয় ভালোয় করতে পারলেই আরো বড় একটা জাহাজ কিনে ফেলতে পারবো। তারপর আর একটা।” ও এর মধ্যেই কল্পনায় একটা বিশাল সওদাগরি জাহাজে করে বোম্বে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে শুরু করেছে। ওর জাহাজের কামানের খোপগুলো সোনার পাতে মোড়ানো থাকবে। তীরে রুথ দাঁড়িয়ে থাকবে ওর অপেক্ষায়, ডাঙায় নামতেই দুই হাত বাড়িয়ে দৌড়ে আসবে ওর দিকে। আর ওর বাবা যখন জানবেন খবরটা, তখন পরাজয়ের রাগে দুঃখে ক্ষোভে লাল হয়ে যাবেন।

দানেশের অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো। “চাবি? ওটা এনেছো তো?”

ক্রিস্টোফার কবজিতে বাঁধা চাবিটা বের করে তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিলো। ঝট করে খুলে গেলো তালা, ঢাকনা সরতেই দেখা গেলো ভিতএ সোনা আর রূপা চকচক করছে।

 “এ দিয়ে তো…” দানেশ এক মুঠো মুদ্রা বের করে হাতে নাড়তে লাগলো। “পুরো রাজার হালে থাকা সম্ভব।”

“সাবধান,” ক্রিস্টোফার হাসলো। “আমাদের কিন্তু সব টাকা একবারে খরচ করা যাবে না। যদি ঠিকমতো খাটাতে পারি তাহলে এর চাইতে দশ গুণ বেশি কামাতে পারবো।”

 ঘুষিটা কোন দিক থেকে এলো সেটা টেরও পেলো না ক্রিস্টোফার। এতে জোরে ওর চোয়ালে লাগলো যে ও পিছন দিকে উলটে পড়ে গেলো। দানেশের গায়ে মাংস কম, কিন্তু ও সেই দশ বছর বয়স থেকে জাহাজে কাজ করছে। রশির মতো পাকানো ওর শরীর-আর ক্রিস্টোফার এতোক্ষণের ধকলে অবসন্ন। হয়ে আছে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার একটা শিকড়ে বেঁধে পড়ে গেলো ও। আবারও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে যেতেই আর একটা ঘুষিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

 দানেশ ক্রিস্টোফারের কোমরের দড়ি দিয়ে বানানো বেল্টটা খুলে নিয়ে সিন্দুকের হাতলে ভরে একটা কাজ চালানোর মতো ফাস বানিয়ে ফেললো। আর বেল্টটা খুলে নেওয়ায় ও ক্রিস্টোফারের ছুরি আর ক্রফোর্ডের টাকার থলে দুটোই পেয়ে গেলো। ওগুলোও ও নিয়ে নিলো সাথে।

ক্রিস্টোফারের ততোক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে। থুথু দিয়ে মুখ থেকে খানিকটা রক্ত ফেলে, এক হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো ও। কিন্তু দানেশের মারমুখি ভঙ্গি দেখে আর বেশি ওঠার সাহস করলো না।

“আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার বন্ধ,” করুণ কণ্ঠে বললো ক্রিস্টোফার।

দানেশ এমনভাবে তাকালো যেনো ক্রিস্টোফার বাচ্চাদের মতো কোনো কথা বলেছে, “এতো বেকুব তুমি। স্বর্ণের কাছে কোনো বন্ধু নেই।”

দানেশ সিন্দুকটা কাঁধে তুলে নিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলো। ক্রিস্টোফার পিছু নেওয়ার চেষ্টা করলো না। ওখানেই শুয়ে শুয়ে দানেশের হাতের আলোটা ফিকে হয়ে যেতে দেখলো। তারপরেও না উঠে অন্ধকারেই শুয়ে রইলো ও।

*

“আপনি কি আমাকে মারতে চান?”

ক্রিস্টোফার চোখ খুললো। রাস্তার অপর পাশে একটা অপরিচিত লোককে দেখতে পেলো ও। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে ওর দিকে। লোকটার শরীর একহারা কিন্তু শক্তপোক্ত, মুখের দাড়ির রঙ ধূসর হয়ে এসেছে।

“আপনি কি আমাকে মারতে চান?” আবার বললো লোকটা। পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলছে সে, যদিও চেহারা আর পোশাকআশাক দুটোই ভারতীয়।

 ক্রিস্টোফার হাত দিয়ে ওর কপাল ডললো। চোয়াল ফুলে আছে, সামান্য নাড়াচাড়াতেই সারা শরীরে ব্যথা করে উঠলো একযোগে।

“আমাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে?” গরগর করে বললো ও।

“এই এলাকায় ডাকাতের অভাব নেই। কেউ কেউ এভাবে ভান করে শুয়ে থাকে, যেনো কেউ তাকে ছিনতাই করেছে। যখন নিরীহ কেউ তাকে সাহায্য করার জন্যে থামে তখন তাকে আক্রমণ করে।”

“আমি উঠেও বসতে পারছি না।”

লোকটা তবুও নড়লো না। “কোত্থেকে এসেছেন আপনি?”

“আমার জাহাজে আগুন লেগেছিলো। আমি সাঁতরে ডাঙায় উঠেছি।”

লোকটা চিন্তিত মুখে মাথা ঝাঁকালো। তারপর ক্রিস্টোফারের গায়ের শুকিয়ে আসা রক্ত আর চেহারার নীলচে দাগগুলো দেখলো কিছুক্ষণ।

“আমি আপনাকে ত্রিভান্ড্রামে আপনার জাহাজের বাকি লোকগুলোর কাছে নিয়ে যেতে পারি। ওরা নিশ্চয়ই আপনার জন্যে দুশ্চিন্তা করছে।”

ক্রিস্টোফার মাথা নেড়ে, ওর বাম দিকে, মানে ত্ৰিভাল্লামের উল্টোদিকে ইঙ্গিত করলো। “আমি যাচ্ছি ওইদিকে।”

“আহ, লোকটার ঠোঁটে একটা শুকনো হাসি দেখা গেলো। আমিও।”

 “আমাকে আপনার সাথে নেবেন?”

লোকটা উত্তর না দিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। সেকেন্ড তিনেক ভেবেই, এতো দ্রুত ক্রিস্টোফারের দিকে ধেয়ে এলো যে, ও ঠাহরও করতে পেলো না কখন লোকটা এসে ওর মাথায় তার লাঠিটা তাক করে ধরেছে। এতোদর আসতে বড়জোর মাত্র দুইবার পা ফেলতে হয়েছে তাকে। ক্রিস্টোফার প্রতিরক্ষার্থে হাত তুলে ধরলো, যদিও তাতে খুব বেশি লাভ হতো না। লাঠিটার ডগা ওর চোখ থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে এসে থামলো। বৃদ্ধ লোকটা ঠিক ওর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু নাগালের বাইরে। এতে দ্রুত এতো কিছু করার পরেও তার শ্বাসের গতি সামান্যও বাড়েনি।

“যদি আপনার কথা মিথ্যে হয়-যদি আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেন-তাহলে আপনাকে খুন করবো আমি,” সাবধান করলো লোকটা।

ক্রিস্টোফার তার দিকে তাকিয়ে রইলো, “কে আপনি?”

“এমন একজন যে নিজেকে রক্ষা করতে জানে।” বলে লোকটা লাঠির ডগা দিয়ে ক্রিস্টোফারের মুখের কালশিটে দাগটা স্পর্শ করলো। “কিন্তু আপনাকে দেখে সেরকম কেউ মনে হচ্ছে না।”

ক্রিস্টোফার কোমরে হাত দিলো, “আমার সাথে এমনকি একটা ছুরি-ও নেই।”

“মানুষকে মেরে ফেলার অনেক রাস্তা আছে, সেগুলো খুব শক্ত-ও না। এদেশে এমন ডাকাতও আছে যারা পরনের ধুতি পেচিয়েও মানুষ মারতে পারে।”

লোকটার কণ্ঠের নিশ্চয়তা শুনে ক্রিস্টোফারের আচমকা মনে হলো যে সে একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলো বলছে।

“আপনি কি ডাকাত?”

“এখন কি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছেন?” সহাস্যে বললো লোকটা। তারপর লাঠির মাথাটা এমন ভাবে ধরলো যাতে ক্রিস্টোফার ওটা ধরে নিজেকে টেনে তুলতে পারে।

“নাম কি আপনার?” জিজ্ঞেস করলো লোকটা।

ক্রিস্টোফার নিজের আসল নাম বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কারণ ক্রিস্টোফার কোর্টনী একটা জাহাজ ডাকাতি করেছে, একজন লোককে খুন করেছে। ক্রিস্টোফার কোর্টনী একজন ফেরারি। আর সবচে বাজে ব্যাপার হচ্ছে ক্রিস্টোফার কোর্টনী, গাই কোর্টনীর ছেলে।

 বোম্বেতে থাকাতে রবিবার সকালে গির্জায় যাওয়ার কথা মনে পড়লো ওর। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে, মাছির অত্যাচার সয়ে ওকে বসে বসে পাদ্রির বকবক শুনতে হতো। সেখানে শোনা বাইবেলের গল্পগুলোর মধ্যে একটা মনে পড়লো ওর। রাজা ডেভিডের ছেলের গল্প-যে কিনা তার বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়।

“আমার নাম আবসালম,” ক্রিস্টোফার বললো।

বৃদ্ধ লোকটা সরু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো, যেনো ওর ভিতরের মিথ্যে আর অপরাধগুলো সব দেখে নিতে পারছে।

গাধা, ক্রিস্টোফার নিজেকে বুঝালো। এগুলো শুধু আমার চোখ; দেহের একটা অংশ, ঠিক আমার পা বা কনুই এর মতোই।

“আমি রঞ্জন।” সামনের দিকে তাকিয়ে বললো লোকটা। “আমি আপনাকে পাশের গ্রামে নিয়ে যাবো।” কথাটা শুনে ক্রিস্টোফারের মনে হলো কাঁধ থেকে একটা বিশাল বোঝা নেমে গেলো যেনো।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। সূর্য উঠে গিয়েছে ততোক্ষণে। রাস্তায় লোকের চলাচলও বেড়েছে। রাস্তার দুই ধারে পাম গাছগুলোয় রসের হাঁড়ি ঝুলানো, দেখে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো মাকড়সা যেন শুড় দিয়ে রস চুষে খাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটা একটা শব্দও বললো না। কিন্তু ক্রিস্টোফার বকবক করেই চললো। বারবার ও ক্রফোর্ডের অত্যাচারের বর্ণনা দিতে লাগলো। কিভাবে ও ক্রফোর্ডের পেট ফেড়ে দিয়েছে সেটা বলতে গিয়ে কণ্ঠে গর্ব ফুটে উঠলে ওর। ইচ্ছা করছিলো আবার জাহাজে ফিরে গিয়ে আবার যদি কাজটা করতে পারতো তাহলে আরো ভালো লাগতো।

গ্রামটা একদমই নিরিবিলি। পাম গাছের পাতায় ছাওয়া মাটির ঘর দেখা গেলো কয়েকটা। তার ফাঁক দিয়ে চিমসানো কয়েকটা গবাদি পশু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তীরে জেলেরা নিজেদের জাল গোটাচ্ছে, ওটা দিয়ে ধরা মাছগুলো পড়ে আছে বালির উপর।

“তা কি করবেন এখানে?” রঞ্জন জানতে চাইলেন।

ক্রিস্টোফার মাথা নাড়লো। এসব ভেবে দেখেনি। চাইলে জেলে হতে পারে, তবে এখানকার সবচে বড় নৌকাটাও সম্ভবত জোসেফ-এর ডিঙ্গি নৌকার সমান হবে। কিন্তু আবারও সমুদ্রে যাওয়ার চিন্তাটা ওকে আতংকিত করে তুললো।

“আপনার কাছে খাবার আছে? টাকা? পরিচিত কেউ আছে?” রঞ্জন-ই জিজ্ঞেস করলেন আবার।

“নাহ,” জবাব দিলো ক্রিস্টোফার।

“তাহলে বরং আমার সাথে চলেন।”

ওরা চলতেই থাকলো, মাইলের পর মাইল। আরো অনেকগুলো জেলে গ্রাম, প্যাগোডা আর লম্বা, বালুকাময় সৈকত পেরিয়ে সুর্যাস্তের আগে আগে ওদের গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছালো। মোটামুটি বড় একটা শহর এটা। সাগরের তীর থেকে একটু ভিতরে যদিও, তবে আসার পথের গ্রামগুলোর তুলনায় অনেক বড়। বড় বড় বাজার, মন্দির সবই আছে এখানে।

রঞ্জন ক্রিস্টোফারকে শহরের শেষ মাথার একটা বিশাল বাড়িতে নিয়ে এলেন। বাইরে থেকে দেখে ক্রিস্টোফার ভেবেছিলো এটা একটা মন্দির। রঞ্জন লোকটার হাবভাব এতে সাধু সাধু যে ওনার পক্ষে একজন সন্নাসী হওয়া অবাক হওয়ার মতো কিছু না।

শুধু ধুতি পরা এক বাচ্চা ছেলে দরজা খুলে দিলো। ক্রিস্টোফার ভিতরে ঢুকতেই ছেলেটা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ভিতরে দেখা গেলো একদল অর্ধনগ্ন ছেলে মারামারি করছে। কয়েকজন এক কোনায় কাঠ দিয়ে বানানো লম্বা একটা লাঠি দিয়ে নানান কসরত করছে, অনেকটা বৃদ্ধের হাতের লাঠির মতোই। আর এক জায়গায় চাঁদের মতো বাকা তরবারি দিয়ে যুদ্ধ চলছে। একটু পর পর ঝনঝন আওয়াজ আসছে সেদিক থেকে। কয়েকজনকে দেখা গেলো খালি হাতে মারামারি করতে। এমন মোহনীয় ভঙ্গিতে ওরা নাড়াচাড়া করছে যে বোঝাই যাচ্ছে ওদের লাথি বা ঘুষি সবই সহজাত ভাবেই হচ্ছে, জোর করে কিছু করা লাগছে না।

“এ কোন জায়গা?” অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো ক্রিস্টোফার।

“এটা হচ্ছে কালারি-যোদ্ধাদের স্কুল বলতে পারেন। আমরা এখানে কালারিপায়াত্ত শেখাই। এটা হচ্ছে যুযুৎসু-র অতি প্রাচীন একটা রূপ। কারো কারো মতে সবচেয়ে প্রাচীন।”

“আপনি এসব পারেন?”

 “আমি হচ্ছি আসান, মানে এদের গুরু।”

ভাবনার চেয়েও দ্রুত এদের নাড়াচাড়া, হাতাহতি, ঘাম আর রক্তের গন্ধ সব ক্রিস্টোফারকে অবাক করে দিলো। ও সারাজীবনে যতো মার খেয়েছে সেসব মনে পড়লো ওর। ওর বাবার হাতে, ক্রফোর্ডের হাতে, এমনকি দানেশের হাতে। ও মুখ বুজে সব সহ্য করেছে কারণ ওর নিজেকে রক্ষা করার সামর্থ্য ছিলো না।

এখানকার সব লোকই নিজেকে রক্ষা করতে জানে।

 “আমাকে শেখাবেন?”

“এখানকার সবাই সেই বাচ্চাকাল থেকে এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে,” রঞ্জন সাবধান করলেন ওকে।

“আমি শিখতে পারবো।”

 রঞ্জন ওর চোখের দিকে তাকালেন। আবারও ক্রিস্টোফারের মনে হলো। ঊনি এমন সব জিনিস দেখে নিচ্ছেন যা কিনা ক্রিস্টোফার নিজেও জানে না।

“হ্যাঁ,” উনি বুঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। “আমার মনে হয় আপনি পারবেন।”

*

জাহাজের জীবনটা কষ্টের ছিলো সন্দেহ নেই, তবে কালারি-র জীবন আরো কঠিন। জাহাজে মার খাওয়ার ঘটনা ঘটতো হঠাৎ-সটাৎ, আর এখানে মারামারিটাই দিনের একমাত্র কাজ। ক্রিস্টোফার গায়ের কালশিটে দাগগুলো গোনা বন্ধ করে দিলো একসময়। কতোবার বুকের পাঁজরের হাড় ভাঙলো বা মার খেয়ে চোখ ফুলে ঢোল হলো সেই হিসাবও থাকলো না। ভাঙা পাঁজরের কারণে নিঃশ্বাস নিতে পারতো না মাঝে মাঝে। কিন্তু সেসব নিয়ে কখনো ঘ্যান ঘ্যান তো দূরে থাক একদিনের জন্যেও প্রশিক্ষণও বাদ দেয়নি ও।

দ্রুতই ওর শরীরে আমূল পরিবর্তন চলে এলো। জাহাজে থাকতেই যেসব পেশি গঠন শুরু হয়েছিলও সেগুলো আরো বেশি শক্তপোক্ত হলো, একেবারে পাথরের মতো। আরো বেশি সরু হলো কোমর। একেবারে সোজা হয়ে হাঁটতে শিখলো, আগের চাইতে লম্বা লাগতে লাগলো তাই। মোটকথা বোম্বে থেকে পালিয়ে আসা সেই নাদুসনুদুস ছেলেটা বা কথায় কথায় মার খাওয়া ভীতু নাবিকটা আর রইলো না ও। ওর সতীর্থ সবাই স্থানীয় ভারতীয়। তাই বাকি সবার চাইতেই ও লম্বা। অনেকেই এজন্যে আসানের কাছে অভিযোগ করলো যে ক্রিস্টোফার এতে অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রঞ্জন ওদেরকে এই বলে বিদায় করলো যে, “ভগবানই তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিক করে দেন।”

ক্রিস্টোফার খুব দ্রুত শিখে নিতে লাগলো সব। অষ্ট ধাপ আর অষ্ট ভঙ্গি শিখলো। একশো আটটা মামরা শিখলো; মামরা মানে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মধ্যে আছে বৈকালকারা অংশ, যেগুলো মানুষকে অসাড় করে দিতে পারে, আছে বিন্দু অংশ, যেখানে একটা মাত্র আঘাতই মেরে ফেলতে পারে যে কাউকে। চিৎকার করে মন্ত্র পড়ে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে বের করে আনা শিখলো। কারো চেহারা আর দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখেই তার পরবর্তী আক্রমণটা কোনদিক থেকে আসবে সেটা শিখলো। লাঠি আর তরবারি দুটো দিয়েই যুদ্ধ করা শিখে ফেললো। বাকা চাঁদের মতো দেখতে থোট্টি চালনাও শিখে নিলো একসময়।

এছাড়াও, প্রতিটা দিন শেষে কিভাবে নিজেকে সুস্থ্য করে তুলতে হয় সেটাও শিখলো। কিভাবে সারা শরীরে তেল মর্দন করতে হয়, কোন কোন জায়গায় কিভাবে মালিশ করলে সবচেয়ে দ্রুত ব্যথা সেরে যায়, সেগুলোও জেনে নিলো। ফলে পরের দিন আবার যুদ্ধে নামতে আর সমস্যা হতো না ওর।

বাড়িটার উঠোনের মাঝখানে দড়ি দিয়ে ঘেরা একটা মঞ্চ বানানো আছে। সপ্তাহে একদিন সব ছাত্ররা ওটার চারপাশে জড়ো হয় আর সেরা ছাত্ররা মঞ্চের উপর উঠে লড়াই করে। ওদের নাড়াচাড়া এতে মসৃণ আর দ্রুত যে শুরুতে ক্রিস্টোফার মাঝে মাঝে বুঝতো-ও না যে কোনদিক কোনদিক দিয়ে আঘাতটা হচ্ছে। তবে পরে যখন ও নিজেও ওগুলো শিখলো তখন একটু একটু ধরতে পারতো। এরপর থেকে যখন ও লড়াইগুলো দেখতো তখন ওর নিজের শরীরও আপনাআপনি সেগুলোর তালে বেকে যেতো, মনে মনে ও নিজেকে মঞ্চের উপরে কল্পনা করতো, আর লড়াই শেষে আরো মরিয়া হয়ে সেই কসরতগুলো অনুশীলন করতো।

অন্য ছাত্ররা ক্রিস্টোফারকে পাত্তা দিতে না বেশি। কিন্তু রঞ্জন ওকে সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। একদিন উনি ক্রিস্টোফারকে একজন কাঠ মিস্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলেন। জায়গাটা তেল আর বার্নিশের গন্ধে ভরা। অনেকগুলো অর্ধেক বানানো গণেশের মূর্তি রাখা তাকের উপর।

ক্রিস্টোফার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলো। মনে মনে অপেক্ষা করছে কখন আসান ওকে এখানে নিয়ে আসার কারণটা বলবেন। মিস্ত্রী তার হাতের বাটালি দিয়ে কাঠের গায়ে আঘাত করছে, প্রতি আঘাতে একটু একটু করে কাঠের চলটা উঠে আসছে।

 ওর দিকে না তাকিয়েই মিস্ত্রীটা কিছু একটা বললো। কিন্তু ভাষাটা এখানকার স্থানীয় হওয়ায় ক্রিস্টোফার বিন্দু বিসর্গ-ও বুঝলো না।

“কি বললেন উনি?”

“বললো যে এই মূর্তিটা আগে থেকেই কাঠের ভিতরে আছে। ওর কাজ হচ্ছে শুধু বাইরের অতিরিক্ত অংশটা বাদ দিয়ে ভিতরে যা আছে বের করে আনা। বাটালির প্রতিটা আঘাতে আসলে জিনিসটা আরো বেশি নিজেতে পরিণত হচ্ছে।” বলে রঞ্জন ক্রিস্টোফারের দিকে তাকালেন। “তোমার কি মনে হয় কাঠের অনুভূতি আছে?”

“না।“

“হিন্দু পুরানি অনুযায়ী প্রতিটা জীবিত জিনিসের চেতনা আছে। এমনকি গাছেরাও অনেক কিছু অনুভব করতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে কি তোমার মনে হয় যে কাঠ এই নিজের শরীরে খোদাই করাটা উপভোগ করে?”

মিস্ত্রী আবার হাতুড়ি চালালো, বাটালির ধারালো মাথা কামড় বসালো কাঠের গায়ে।

 “প্রচণ্ড ব্যথা পাওয়ার কথা।”

“প্রতিটা আঘাত কিন্তু ও যে জিনিস সেটাতেই পরিণত করছে ওকে। রাস্ত টিা অনেক কঠিন, আবসালম-কিন্তু গন্তব্য…” বলে উনি একটা গণেশের মূর্তির গায়ে চাপড় মারলেন। মূর্তির মাথাটা হাতীর। এতোটাই নিখুঁত যে ক্রিস্টোফারের মনে হলো যে কোনো মুহূর্তে ওটা শুড় নেড়ে উঠে দাঁড়াবে।

“গন্তব্যই আমাদের আসল পরিচয়টা বের করে আনে।”

*

যখন অনুশীলন করে না, তখন ক্রিস্টোফার কাজ করে নিজের থাকা খাওয়ার ব্যয় মেটায়। শুরুর দিকে গাছ কেটে লাকড়ি সংগ্রহ করতে বা সবজির বাগানে কাজ করতো। যখন এক জিনিস খেতে খেতে সবাই বিরক্ত হয়ে যেতো তখন রঞ্জন ওকে বাজারে পণ্য বিনিময় করতে পাঠাতেন। লড়াই করার সময়টা বাদে এই সময়টা ক্রিস্টোফারের খুব ভালো লাগতো। বহু কষ্টে ও স্থানীয় ভাষা আয়ত্ত করেছে। তবে বেশ তাড়াতাড়িই পেরেছে শিখতে। বার বার আসা যাওয়া করতে করতে সওদাগরেরো চিনে ফেললো ওকে। তবে ক্রিস্টোফার দোকানে আসলে মোটেও খুশি হতো না তারা। কারণ ও দামাদামিতে খুবই পটু, একেবারে একটা পয়সা পর্যন্ত ছাড় দিতে রাজি হয় না।

একদিন বাজারের ভিতর এক ভারতীয় ওর সাথে কথা বলতে এগিয়ে এলো। হাত ভরা সোনার আংটি তার সাথের চাকরেরা বাতাস করে পাশের মাছি তাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রিস্টোফার লোকটাকে এড়িয়ে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু লোকটার চেহারায় চোখ পড়তেই থমকে গেলো ও। একজন চাকর এগিয়ে এলো ওর দিকে। লোকটার পরনে চটকদার পোশাক, মাথার পাগড়িতে একটা পান্না বসানো পিন লাগানো। গায়ের কাপড়ে সোনার সুতোর কাজ করা-এক ধনী লোকের দেওয়ানের যেমনটা হওয়া উচিত, ঠিক তেমন। লোকটার পুরু ঠোঁট, পানের লাল রসে আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে আছে।

“ইনি হচ্ছেন আমার মালিক পরশুরাম,” ঘোষণা দিলো দেওয়ান লোকটা। ক্রিস্টোফারের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে সে, উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা এমনটাই করে। পরদেশীদের স্পর্শে নাকি ওদের জাত যায়। “উনি এই শহরের সবচেয়ে ধনী সওদাগর।”

পরশুরাম ক্রিস্টোফারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “তোমার কথা শুনেছি আমি। তুমি নাকি কালারির এক ভীষণ যোদ্ধা!”

ক্রিস্টোফার মাথা নোয়ালো।

“সবাই বলে তুমি নাকি দামাদামিতে সওদাগরদের একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়ো?”

“আমার বাবা শিখিয়েছেন যে, দামাদামিতে শেষ বলে কিছু নেই।”

“সেটাই-তবে সবাই কিন্তু সেটা পারেনা। তোমার মতো একজন হলে আমার খুব সুবিধা হয়।”

“আমাদের মালিকের কিছু জিনিস নিয়ুর শহরে নিতে হবে,” দেওয়ান। বললো আবার। “রাস্তাঘাট ভালো না আর ওটা যখন এসে পৌঁছাবে তখন সবচেয়ে সেরা দামেই বিক্রি করতে ইচ্ছুক উনি। সেজন্যে তুমিই সবচে উপযুক্ত লোক।”

“জিনিসটা কি?”

“লবণ।”

“বিনিময়ে, পরাম বললেন। “লাভের পাঁচ ভাগ দেবো আমি তোমাকে।”

“বিশ ভাগ, ক্রিস্টোফার বললো।

 ক্রিস্টোফারের দাবি শুনে দেওয়ান হতভম্ব হয়ে গেলো, তবে পরশুরাম হেসে দিলেন। “আসলেই তোমার গুণ আছে। ঠিক আছে দশ ভাগে রাজি হয়ে যাও।” কিন্তু ক্রিস্টোফারের চেহারায় না বোধক অভিব্যক্তি দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি যোগ করলেন, “যদি এবার সব ভালোয় ভালোয় করতে পারো, তাহলে সামনে আরো কাজ দেবো তোমাকে। আমি অনেক জিনিসের ব্যবসা করি। লবণের চাইতেও আরো অনেক বেশি দামি জিনিসের ব্যবসা আমার আছে।”

 “আমাকে আমার মালিকের অনুমতি নিতে হবে,” বলে ক্রিস্টোফার বিদায় নিলো।

রঞ্জনকে বলতেই উনি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

“আমি তোমার মালিক নই, বা তুমিও আমার গোলাম নও। তুমি যতোক্ষণ আমার সাথে থাকবে আমি ততোক্ষণ তোমাকে শিক্ষা দেবো। তুমি যদি অন্য কিছু পছন্দ করো তো যেতে পারো।”

“আমি কি প্রস্তুত?”

রঞ্জন নিজের হাতের তালুর দিকে তাকালেন, “লড়াইয়ের প্রথম নীতিটা কি?”

“কখনো ইচ্ছা করে লড়াই করবে না, তখনই যুদ্ধ করবে যখন সেটা এড়ানো সম্ভব না হয়।”

“এটা মনে রাখলে তোমার খুব বেশি ঝামেলা হবে না।”

যাত্রায় কোনো ঝামেলা হলো না। সেজন্যে নিয়ুরের যে বাড়িতে যাওয়ার কথা সেখানে পৌঁছে ক্রিস্টোফার হতাশ-ই হলো বলা চলে। ও চরম মাত্রায় দর কষাকষি শুরু করলো, এক পর্যায়ে ও চাকরদের আদেশ দিলো খচ্চরগুলোয় মালপত্র তুলে ফিরে যাওয়ার জন্যে। সদর দরজা দিয়ে অর্ধেকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর ওকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো।

পরের দিন বাড়ি ফিরে ও পরশুরামের বাড়িতে উপস্থিত হলো। সব কামাই বুঝিয়ে দিলো তাকে।

“কতো পেয়েছো লবণ থেকে?”

“বিশ রুপি” ক্রিস্টোফার জবাব দিলো।

দেওয়ান সন্দেহজনক ভঙ্গিতে মুদ্রাগুলো গুনলো। প্রতিটা পয়সা কামড়ে দেখে নিলো যে ঠিক আছে কিনা। তারপর ছোট্ট একটা নিক্তিতে মেপে দেখলো।

“ঠিক আছে,” কেমন বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো লোকটা।

 পরশুরাম ক্রিস্টোফারের দিকে চেয়ে হাসলো। “আমার দেওয়ান, জয়ন্তন তোমাকে বিশ্বাস করে না। সেজন্যে লবণের প্রথম বস্তাটার ভিতর নিয়ুরের সওদাগরের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম আমি। তাতে লিখে দিয়েছিলাম যে, লবণ কতো দামে বিক্রি হলো সেটা জানিয়ে যেনো তার সবচেয়ে দ্রুতগামী লোকটাকে পাঠিয়ে দেয়।”

ক্রিস্টোফারের চেহারা লাল হয়ে গেলো। “আপনি আমাকে টাকা পয়সার ব্যাপারে বিশ্বাস করেন না?”

“এখন করি।” বলে উনি দুটো পয়সা নিয়ে ক্রিস্টোফারকে দিলেন। “আপাতত এটা তোমার ভাগ। তবে শিগগিরিই আবার খবর পাঠাবো। আমি যাদেরকে বিশ্বাস করি তাদের জন্যে কাজের অভাব হয় না।”

পরের কয়েক মাস ক্রিস্টোফার দারুণ কাজ দেখালো। ভিন্ন ভিন্ন শহর, ভিন্ন ভিন্ন মালামাল। কখনো ক্রিস্টোফার একা গেলো, কখনো সাথে থাকলো কেউ। কয়েকবার অবশ্য মাস্তানের খপ্পরে পড়েছিলো, কিন্তু ক্রিস্টোফারের তরবারি দেখেই ভেগেছে সব। প্রতিবারই ক্রিস্টোফার তাই হতাশ-ই হয়েছে। ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ফুটছে ও, একেবার ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আছে বলা যায়। উত্তেজনা কমাতে মঞ্চের লড়াইতে এতো ভয়ংকরভাবে লড়াই করতে যে একদিন একজনকে প্রায় অন্ধ-ই করে ফেলেছিলো।

“তোমাকে দুই নম্বরে কোন নীতিটা শিখিয়েছি?” রঞ্জন জিজ্ঞেস করলেন।

 “ছানিগা,” গোমড়া মুখে বললো ক্রিস্টোফার।

 “আর ছানিগা কি জিনিস?”

“ধৈর্য।”

*

একদিন পরশুরামের দেওয়ান জয়ন্তন কালারি-তে এসে উপস্থিত। “মালিক তোমাকে খবর দিয়েছেন।”

পরশুরামের বাড়িতে পৌঁছালে উনি ক্রিস্টোফারকে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। ওটার কাঠের জালির ঢাকনার ভিতর দিয়ে নরম আলোয় অনেকগুলো চুনি ঝিকমিকিয়ে উঠলো।

 “মাদুরা-তে এক তামিল সওদাগরের কাছে নিয়ে যেতে হবে এগুলো। শহরটা পাহাড়ের ওপাশে। যেতেও সময় লাগবে অনেক। আর পাহাড়ের রাস্তাটা ডাকাত দিয়ে ভরা।”

ক্রিস্টোফারের কানে কথাগুলো গেলো বলে মনে হলো না। ও একদৃষ্টিতে চুনিগুলো দেখছে। বেশ্যাখানার দরজায় দাঁড়ানো এক বেশ্যার মতোই ওগুলো যেনো ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপছে। একটা শয়তানি চিন্তার উদয় হলো ওর মনেঃ চাইলে এই দুজনকে খুন করে এগুলো নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। তাহলেই ওর রুথকে বিয়ে করার মতো যথেষ্ট রুপি হয়ে যাবে। ক্রিস্টোফারের সারা শরীরে শিহরণ বইতে লাগলো। নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে ওর।

তিন নম্বর নীতিটা কি? রঞ্জনের কণ্ঠ ভেসে এলো ওর কানে।

আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, নিজের ভিতরের সত্ত্বা জবাব দিলো।

ও জোর করে নিজের চিন্তা আড়াল করলো।

“জয়ন্তন তোমার সাথে যাবে,” পরশুরাম বললেন। মৃত্যুর কতো কাছে থেকে মাত্র ফিরে এসেছেন সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই। শুধু তোমরা দুজন। আমি এক গাড়ি ভর্তি লোক পাঠাতে পারতাম-কিন্তু তাতে করে সবাই ই ব্যাপারটা খেয়াল করবে। আর সেই গন্ধে এখান থেক দিল্লি পর্যন্ত সব শয়তানের দলে এসে হাজির হবে। তাই বিশ জনের পক্ষে সম্ভব না হলেও দুই জনে আশা করা যায় যে ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারবে।”

ক্রিস্টোফার মাথা ঝোঁকালো, “আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো।”

পরের দিনই বের হয়ে গেলো ওরা। সমুদ্র পিছনে রেখে আরো ভিতরের দিকে গন্তব্য ওদের। রাস্তাটা একটা উপবনের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে। বৃষ্টির কারণে কাদা জমে আছে এখানে সেখানে। গাড়ি-ঘোড়া নেই বললেই চলে। রাস্তার দু’ধারে তেঁতুল গাছের সারি। সেখান থেকে ভেসে আসছে নানা পাখির ডাক। তবে সেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে তাঁত যন্ত্রের খটখট শব্দে। রাস্তার ধারে বসে তাঁতিরা কাপড় বুনছে।

ক্রিস্টোফার ওর জীবনের প্রায় পুরোটাই ভারতে কাটিয়েছে, কিন্তু এই প্রথম ও সমুদ্র থেকে এতো ভিতরে আসলো। এমনকি পরশুরামের হয়ে কাজ করতে যেসব জায়গায় গিয়েছে সেগুলোও ছিলো সব সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা। বেলা বাড়তেই জনমানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এলো। একটু পরেই তাঁতের খট খট শব্দ মিলিয়ে গিয়ে, অজানা সব পাখির ডাক ভেসে আসতে লাগলো কানে।

প্রথম রাত ওরা রাস্তার ধারের একটা মন্দিরে কাটালো। পরের দিনে দেখা গেলো রাস্তা সোজা ঘাট বরাবর উঠে গিয়েছে। ঘাট হচ্ছে বিশাল এক পর্বতের সারি। ভারতের পশ্চিম উপকূলে ওগুলো ঠিক এক সারি দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে এলো। আশেপাশের জঙ্গলও ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে। ওরা বিশাল বিশাল কাঠের গাছ আর বাঁশ দিয়ে ভরা এক বনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চললো। আগে কখনো এখানে মানুষের পা পড়েছে কিনা কেউ জানে না। প্রকাণ্ড সব লতা গুলা আর অর্কিড-ও দেখা গেলো। প্রচুর আগাছা মাটিতে, তুলা গাছের লাল রঙের ফুল পড়ে আছে সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে, দেখে মনে হচ্ছে রক্তের ফোঁটা।

ওরা অবশ্য রাস্তায় একা ছিলো না। কয়েকজন কুলিও ছিলো সাথে। বিশাল ভারি বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছে মাথায়। ওগুলোতে আছে নারিকেলের ছোবড়ার পার্টি, ফলের ঝুড়ি। প্রতিবারই ওরা কাছাকাছি আসতেই জয়ন্তন ক্রিস্টোফারের হাত চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, “খুব সাবধান।”

তবে ওরা জয়ন্তনের উচ্চ জাত চিনতে পারার সাথে সাথে সাথে মাটিতে উপুড় হয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। যতোক্ষণ না ক্রিস্টোফার আর জয়ন্তন চোখের আড়ালে গেলো ততোক্ষণ ওরা ওভাবেই রইলো।

“অন্তত এই মেয়েটা নিশ্চয়ই ডাকাত না,” ক্রিস্টোফার তরুণী বয়সী এক মেয়েকে দেখিয়ে বললো। মেয়েটার সাথে একটা গাধা। আম ভর্তি বস্তা গাধাটার পিঠে। মেয়েটার পরনে একটা সুন্দর শাড়ি। হাতে আর বাহুতে তামার বালা।

যেনো ক্রিস্টোফারের কথা শুনতে পেয়েই মেয়েটা ওর দিকে ফিরে তাকালো। অন্যদের মতো ও মাথা ঝোকালো না বা ওদের উচ্চ জাত টের পেয়ে সরেও গেলো না। বরং ও-ও বড় বড় চোখ করে ক্রিস্টোফারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, অনেকটা লাজুক একটা হাসি। সেই হাসিতে যেনো ক্রিস্টোফারের সমস্ত কল্পনা লুকিয়ে আছে। ওর সারা শরীরে কামনা ছড়িয়ে পড়লো।

“বেহায়া মাগী, গাল দিয়ে উঠলো জয়ন্তন। “শালীকে বেয়াদবির জন্যে ধরে চাবকানো উচিত।”

কোনো তাড়াহুড়া ছাড়াই মেয়েটা তার গাধাকে রাস্তার মাথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো আর ওদেরকে চলে যেতে দিলো। ক্রিস্টোফার আর একবার তার চোখে চোখে তাকাতে চেষ্টা করলো কিন্তু মেয়েটা গাধার পিঠের বোঝার বাঁধন টেনেটুনে দেখছিলো, তাই আর চোখ তুলে তাকালো না।

 জয়ন্তন আর ক্রিস্টোফার রাস্তার পাশের একটা ছোট মঠ পেরিয়ে এলো। একটা গণেশের মূর্তি দেখে গেলো সেখানে। গলেয় ফুলের মালার স্তূপ।

জয়ন্তন ক্রিস্টোফারের কোমরের তরবারিটার দিকে তাকালো। “জিনিসটা সময়মতো ব্যবহার করতে পারবে তো? এই মঠের এখানেই কিন্তু ডাকাতেরা একজনকে খুন করেছিলো।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা খনখনে চিৎকার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিলো। এক মুহূর্ত পড়েই ত্রাহি রব ছাড়তে ছাড়তে এক পাল খচ্চর রাস্তার উল্টোপাশ দিয়ে তীর বেগে ছুটে এলো। ক্রিস্টোফার তরবারি বের করে মাত্র যেদিক দিয়ে এসেছে সেদিকে দৌড় দিলো।

“আরে থামো থামো,” চিৎকার করে ডাকলো জয়ন্তন। “তোমার কাজ আমাকে বাঁচানো।”

ক্রিস্টোফার ওর কথায় কান না দিয়ে দৌড়াতেই থাকলো। পায়ের ধাক্কায় ধুলো উড়ছে চারপাশে। রাস্তার বাঁকে পৌঁছাতেই ও সেই মেয়েটাকে দেখতে পেলো। মাটিতে চিত হয়ে শোয়া। কাপড় কোমর পর্যন্ত তোলা, কাচুলি ছিঁড়ে সদ্য প্রস্ফুটিত স্তন বেরিয়ে আছে। একটা দশাশই কালো চামড়ার লোক মেয়েটার দুই পায়ের ফাঁকে বসে তাকে মাটির সাথে চেপে ধরে রেখেছে।

কালারিতে শেখা রণহুংকার ছেড়ে ক্রিস্টোফার লোকটাকে আক্রমণ করলো। কিন্তু শয়তানটা কামনায় একবারে দিশা হারিয়ে ফেলেনি। সে ক্রিস্টোফারকে আসতে দেখেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর ক্রিস্টোফারের হাতের তরবারির দিকে এক নজর যেতেই জান হাতে নিয়ে দিলো দৌড়।

ক্রিস্টোফার যথেষ্ট জোরে দৌড়াতে পারে, কিন্তু লোকটা আরো বেশি দ্রুত। খানিকটা দৌড়ানোর পরে ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো সোজাসুজি দৌড়ে ও কখনো লোকটাকে ধরতে পারবে না। ও থেমে দাঁড়িয়ে তরবারিটা মাটিতে ফেলে দিলো। দুই হাত মুক্ত হওয়ার পর ক্রিস্টোফার ওর ধুতি গুটিয়ে নিলো।

কোমরে একটা উরুমি পেচিয়ে পরেছে ক্রিস্টোফার। সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়বে না সেটা। উরুমি হচ্ছে দুই প্রান্তেই ধারালো, ফুট দশেক লম্বা একটা পাতলা ইস্পাতের পাত। চাবুকের কশ এর মতোই নমনীয়।

কালারিতে এটার ব্যবহারই সর্বশেষ শিখেছিলে ও। আর এটায় দক্ষতা অর্জন করাই ছিলো সবচেয়ে কঠিন। ঠিকমতো ব্যবহার করতে না পারলে ব্যবহারকারীরই গলা কাটা পড়ার সম্ভাবনা আছে।

 উরুমি-র হাতীর দাঁতের হাতলটা ওর হাতের মুঠোয় ঠিকঠাক বসে গেলো। কবজির মোচড়ে ও ফলাটা ছুড়ে দিলো সামনে। দেখে মনে হতে লাগলো জিনিসটা জ্যান্ত বুঝি। বাতাসে একেবেকে সোজা হল ওটা। ধর্ষক লোকটা ছিলো

উরুমি-র একেবারে ডগায়। ওটার বাকা ডগাটা লোকটার গোড়ালিতে সাপের মতো ছোবল দিয়ে ফাসের মতো আটকে ফেললো। তারপর পর্যায়ক্রমে ওটা গোড়ালির চামড়া, মাংস, রগ ভেদ করে শেষমেশ হাড়ও ভেঙ্গে দিলো। ব্যথায় প্রচণ্ড জোরে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলো লোকটা।

ক্রিস্টোফার লোকটার কাছে এগিয়ে গেলো। কোন তাড়াহুড়া নেই! আস্তে টান দিয়ে উরুমির ফলাটা গুটিয়ে নিলো ও। পথের ধুলোয় একটা গোখরার চলার পথের মতো দাগ করে ওর হাতের মুঠোয় কুণ্ডলী পাকিয়ে গেলো ওটা।

ক্রিস্টোফার লোকটার গায়ের উপর দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। “বন্ধু, তোমার সময় যে শেষ সেটা আশা করি বুঝতে পারছো? দুনিয়াকে বিদায় বলে দাও।” ও কথা বলছিলো ইংরেজিতে। ফলে লোকটা কিছুই বুঝলো না। তবে বলার ভঙ্গি আর ধরনেই যা বোঝার বুঝে নিলো। লোকটা গোঙাতে গোঙাতে প্রাণ ভিক্ষা চাইলো কিন্তু ক্রিস্টোফার হাসতে হাসতেই আবার ওর কবজি মোচড় দিলো। উরুমি-টা কুণ্ডলী খুলে ছুটে গিয়ে লোকটার গলায় স্পর্শ করলো এবার। দেখে মনে ওখানে আর একটা মুখের সৃষ্টি হয়েছে। ফুসফুসের সব বাতাস বেরিয়ে যেতে লাগলো সেদিক দিয়ে। এক মুহূর্ত পরেই ক্যারোটিড ধমনী দিয়ে সবেগে ছুটে বের হলো রক্ত, হৃৎপিণ্ডের ছন্দের তালে সেখানে রক্তের পরিমাণ কমতে বাড়তে লাগলো। ক্রিস্টোফারের পায়েও লাগলো রক্ত, তবে ও সরে যাওয়ার কোনো চেষ্টা করলো না। আস্তে আস্তে রক্তের বেগ কমতে কমতে একসময় পুরোপুরি থেমে গেলো। তারপর ও উবু হয়ে লাশটার পরনের কাপড়ের ভিতর হাত চালালো। ধুতির নিচে চামড়ার একটা থলে বাধলো হাতে। বেল্টে বাঁধা। ও থলেটার বাঁধন খুলে ভিতরের সবকিছু অন্য হাতে ঢেলে দিলো। বেশিরভাগ মুদ্রাই ছিলো তামার, তবে যথেষ্ট রুপা-ও আছে দেখে মুখে হাসি ফুটলো ওর।

যে মেয়েটাকে ধর্ষকটা আক্রমণ করেছিলো সে ক্রিস্টোফারের দিকে এগিয়ে এসে ওর হাতের দিকে ঝুঁকে দেখলো যে ও কি পেয়েছে। তখনও মেয়েটা নিজের কাপড় চোপড় ঠিকঠাক করছে। ক্রিস্টোফার মেয়েটার দিকে তাকালো। এতো কাছ থেকে ওকে দুর্দান্ত সুন্দর লাগছে। চুল খুবই ঘন, বেণী করে বাধা। নিয়মিত তেল দিয়ে আচড়ানোর কারণে চকচক করছে। ওর ছেঁড়া ব্লাউজের ভিতর তখনও একটা স্তন বেরিয়ে আছে। মেয়েটাও ক্রিস্টোফারের দৃষ্টি খেয়াল করে ইচ্ছে করেই সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে সেটাকে ভিতরে ঠেলে দিলো।

“ধন্যবাদ সাহেব। ভগবান আপনার ভালো করুক। এই পশুটার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার উপর।” মেয়েটার কণ্ঠ খুবই নরম আর মিষ্টি। বলতে বলতে সে ক্রিস্টোফারের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিলো। ক্রিস্টোফারের মনে হলো নিজেকে আর সামলাতে পারবে না।

কিন্তু মেয়েটাকে দেখে মনে হলো সে এসবের কিছুই টের পাচ্ছে না।

“আপনার সাথের লোকটা কই?” জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা।

“ও সুইট খ্রাইস্ট!” ক্রিস্টোফারের সম্বিত ফিরলো। জয়ন্তনের কথা ভুলেই গিয়েছিলো ও। বিদ্যুতবেগে দৌড়ে আবার রাস্তার বাকে ফিরে এলো। জয়ন্তন-ও এদিকেই আসছিলো। সামান্যের জন্যে দুজন মুখোমুখি বাড়ি খেলো না।

“কত বড় সাহস তুমি আমাকে রেখে চলে যাও?” প্রচণ্ড রেগে আছে ও। “মালিক খবটা জানতে পারলে-”

“ওই মেয়েটা একটা ডাকাতের হাতে পড়েছিলো,” ঠাণ্ডা গলায় বললো ক্রিস্টোফার। “আমার কি করা উচিত ছিলো?”

 “যদি এটা একটা ফাঁদ হতো? যদি ডাকাতের সাঙাতের ওঁত পেতে থাকতো, আর তুমি ওদিকে ধাওয়া করা মাত্র আমাকে আক্রমণ করতে? একটা ছোট জাতের বেহায়া মাগীর জন্যে নিজের দায়িত্ব ভুলে যেও না।”

ক্রিস্টোফার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে সামলালো। মৃত লোকটার গরম রক্ত তখনও ওর পায়ে লেগে আছে, আর খুন করার নেশা তখনও ওর ভেতর জ্বলছে। ওর সাথে এভাবে কথা বলার জন্যে উরুমি দিয়ে চাইলেই ও জয়ন্তনের জিহ্বাটা কেটে দিতে পারতো।

তা না করে ও আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলো। মেয়েটা পড়ে যাওয়া আমগুলো কুড়িয়ে আবার গাধার পিঠের বস্তায় তুলে রাখছে। ক্রিস্টোফারকে একটা সাধলো ও।

“নিন না,” বললো মেয়েটা। “এর বেশি কিছু দেওয়ার মতো নেই আমার।”

 ক্রিস্টোফার মেয়েটাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দিয়ে ছুরি দিয়ে আমটা কেটে খেতে শুরু করলো। দারুণ সুস্বাদু আম।

“খুব মিষ্টি,” ক্রিস্টোফার বললো। “ঠিক তোমার মতোই।”

মেয়েটা লজ্জা পেয়ে হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। “আমার নাম তামান্না, মেয়েটা বললো।

“ক্রিস…” বলতে গিয়ে থেমে গেলো ক্রিস্টোফার। “আবসালম।” মেয়েটার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একটু হলে আসল নামটাই বলে ফেলেছিলো। ও জয়ন্তনের দিকে তাকালো। কিন্তু দেওয়ানজী খেয়াল করেছে বলে মনে হলো না।

মেয়েটা সামনের ফাঁকা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো। “আমার সাথে একটু যাবেন, আবসালম? আমার ভয় করছে।”

“না,” বললো জয়ন্তন।

 “হ্যাঁ,” বললো ক্রিস্টোফার।

“না,” আবার বললো জয়ন্তন। ওর কণ্ঠে অধৈর্য। “তোমাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্যে আর আমার কথা শোনার জন্যে।”

ক্রিস্টোফার দুই পা ফাঁক করে, বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ালো। “আপনি নিজে যেতে চান তো যেতে পারেন। তবে আমি এই ভদ্রমহিলার সাথেই যাবো।”

“যখন মালিকের কানে খবরটা যাবে…” রাগের চোটে জয়ন্তনের কথা জড়িয়ে গেলো। বুকের যেখানে চুনি ভরা থলেটা রাখা সেখানে ধরে দেখলো।

 তামান্না ওদের মাঝে এসে দাঁড়ালো। আমার জন্যে আপনাদের মধ্য ঝামেলা করবেন না।”

 “উনি আমার বন্ধু-ও না, আমার মালিকও না, ক্রিস্টোফার গাধার লাগামটা ধরে হাঁটা শুরু করে দিলো। “তাছাড়া যেখানে বলা হয়েছে সেখানেই যাচ্ছি আমি।”

 “ওনার কি হবে?” রক্তে ভরা লাশটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো মেয়েটা। এর মধ্যেই মাছি ভনভন করতে শুরু করেছে সেখানে।

ক্রিস্টোফার কাঁধ ঝাঁকালো “ওখানেই থাক। অন্যদের জন্যে হুশিয়ারি হয়ে থাকবে।”

*

বাকি দিনটা ওরা হেঁটেই কাটালো। জয়ন্তন চুপচাপ সামনে, ক্রিস্টোফার আর তামান্না পিছনে। জয়ন্তন তামান্নার দিকে তাকালোই না বলা চলে। কারণ ও হচ্ছে নীচু জাত, তাই ওর কাছে বস্তুতঃ মেয়েটার অস্তিত্ব নেই। এদিকে ক্রিস্টোফার তামান্নার উপর থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না। কারণ, যা দেখেছে সেটা কিছুতেই মন থেকে সরছে না। ছিন্ন ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা প্রস্ফুটিত স্তন আর ধর্ষক লোকটা যখন কোমর পর্যন্ত ওর শাড়ি তুলে ফেলেছিলো তখন ও দুইপায়ের সংযোগস্থলটাও দেখতে পেয়েছিলো।

 রুথ এর কথা ভাবো, নিজেকে বললো ক্রিস্টোফার। যখন স্বামী স্ত্রী হিসেবে একসাথে থাকবে তখন ব্যাপারটা কতোটা মিষ্টি হবে সেটা চিন্তা করো।

কিন্তু তামান্নাকে পাশে রেখে রুথ এর কথা ভাবাটা বেশ শক্তই বটে। রুখের কথা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো ওর। কিন্তু তামান্নার হাসি আর কথায় সেসব উড়ে গেলো সহসাই। মেয়েটা বয়সে ওর চাইতে খুব বেশি বড় না, কিন্তু একেবারে চপল আর ইচড়ে পাকা। সেই সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ আর উদার মনের অধিকারি। সম্ভবত এই শ্যামল প্রকৃতির কোলে বড় হয়েছে বলেই এমন স্বভাব। তামান্নার বাবা একজন কৃষক। সমুদ্রতীরের কাছে এক গ্রামে বাড়ি ওদের। ওর বাবা নাকি এক পথচারীর কাছে শুনেছেন যে হায়দ্রাবাদের নিজামের সাথে যুদ্ধ চলার কারণে পাহাড়ের ওপাশে খাবার ঘাটতি চলছে। তাই তামান্না ওখানে আম নিয়ে চলছে, ভালো দাম পাওয়ার আশায়।

“তুমি একাই বেরিয়ে পড়েছো?” ক্রিস্টোফার অবাক হলো।

 “আমার ভাইদেরকে মাঠে কাজ করতে হবে।”

 “তোমার স্বামী?”

বলতে বলতে আবার ক্রিস্টোফার মেয়েটার দিকে তাকালো। সেটা দেখে তামান্নার চেহারা লাল হয়ে গেলো। লাজুক একটা হাসি হাসলো ও।

“আমার বিয়ে হয়নি। আমার বাবার যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আর সত্যি কথা হচ্ছে মাঠের কাজে আমাকেও লাগে।”

 ক্রিস্টোফার ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “তোমার মতো সুন্দরিকে কেউ এখনো বিয়ে করেনি সেটা আমার বিশ্বাস হয় না।”

তামান্না দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। “আমাকেত বাবার আদেশ মানতেই হবে।”

সন্ধ্যা নাগাদ ওরা এক মন্দিরে এসে উপস্থিত হলো। আশেপাশে আর কিছুই নেই। পাহাড়ের চূড়া ওখান থেকে কাছেই। ছোট ঘরটার চারপাশে এক চিলতে দেয়াল। উঠোন জুড়ে আগাছা আর কাটা ঝোঁপ। পোড়া ছাই দেখে বোঝা গেলো এর আগেও অনেকেই এখানে আশ্রয় নিয়েছে।

জয়ন্তন প্যাগোড়ার ভিতরে কম্বল পেতে নিলো। ক্রিস্টোফার দরজার কাছের ঝোঁপ জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানেই নিজের বিছানা পাতলো।

“আমি বাইরেই ঘুমাবো,” তামান্নাকে বললো ক্রিস্টোফার। “ভিতরে পোকামাকড়ের বাসা। গায়ের উপর হাঁটবে।”

কারো দৃষ্টি আকর্ষণের ভয়ে ওরা কোনো আগুন জ্বাললো না। ভাত আর ডাল দিয়ে রাতের খাবার সারলো সবাই। তারপর খেলো তামান্নার আম। ক্রিস্টোফার জোর করে দাম দিয়ে দিলো। “নইলে পাহাড় পার হতে হতে তোমার আর আম একটাও থাকবে না। শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হবে।”

ঘুমাতে অনেক সময় লেগে গেলো ক্রিস্টোফারের। ঘাসের উপর শুয়ে ও রাতের নিস্তব্ধতা শুনতে লাগলো। দেয়ালের ওপাশে জঙ্গলে পশু পাখিরা উচ্চস্বরে চিৎকার করে চলেছে। এই পর্বতে বাঘ আছে নিশ্চিত, আর কি আছে তা ঈশ্বরই জানেন। জঙ্গলে হাজার হাজার জায়গা আছে যেখান থেকে ওদের দিকে নজর রাখা সম্ভব। কে জানে, কেউ হয়তো সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে।

কিছু একটা শব্দ করে উঠলো। জঙ্গলে না, দেয়ালের ভিতরেই। ও তরবারির দিকে হাত বাড়ালো। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে, তবে সেটা ভয়ের জন্যে না। আবার লড়াইয়ের সম্ভাবনায় ওর শরীর জেগে উঠেছে।

“আবসালম?”

কোমর সমান উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে এলো তামান্না। কাটাঝোঁপ এড়াতে শাড়ি দুই হাতে উঁচিয়ে রেখেছে। এসে ক্রিস্টোফারের পাশে বসলো ও। এতো কাছে যে ওদের কাধ স্পর্শ করলো।

“আমার ঘুম আসছে না। চোখ বুজলেই…” শিউরে উঠলো তামান্না। “আপনি ভাবতেও পারবেন না।”

“এখন আর কোনো চিন্তা নেই, ক্রিস্টোফার আশ্বাস দিলো ওকে।

তামান্না ওর গায়ে হেলান দিয়ে কাঁধে মাথা গুঁজে দিলো। ক্রিস্টোফার বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলো। মেয়েটাকে চুমু খাওয়ার জন্যে ওর সারা শরীর একযোগে চিৎকার শুরু করেছে যেনো।

ও দাঁতে দাঁত চাপলো। রুথ, নিজেকে বললো ও। রুথের জন্যে নিজেকে শক্ত করো।

“আপনি যেভাবে ঐ শয়তানটাকে সামলালেন! আমি জীবনেও কাউকে এরকম করতে দেখিনি। আপনার ওই অস্ত্রটা মারাত্মক কিন্তু এতো ভালো করে কোত্থেকে শিখলেন?”

“কালারিতে শিখেছি।”

তামান্না নিজের ভর বদল করতে সামান্য বাকা হলো, ভারসাম্য রাখতে ও ক্রিস্টোফারের হাঁটুতে ভর দিলো।

“ওখানে অনেকদিন আছেন, তাই না?”

 “বেশি দিন না। আমার বাড়ি এখানে না। বোম্বেতে।”

তামান্নাকে বেশ কৌতূহলী দেখালো। “আপনি কি তাহলে এদেশী না?”

“না,” প্রশ্নটা ক্রিস্টোফারকে অবাক করেনি মোটেও। ওর কালো চুল আর কালো চোখের কারণে ওকে স্থানীয় বলেই মনে হয়। আর কালারিতে ঘণ্টার পর ঘন্টা রোদে অনুশীলন করার পর ওর চামড়া-ও পুড়ে গাঢ় বাদামী হয়ে গিয়েছে। ফলে এখন আর চেনার উপায় নেই। শুধু আকৃতির দিক থেকে অন্যদের চাইতে আলাদা ও।

“আমার বাবা ইংরেজ, তবে আমি সারা জীবনই এদেশেই থেকেছি।”

তামান্নার হাত ক্রিস্টোফারের হাঁটু থেকে উরুতে নেমে এলো। তারপর দুই পায়ের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা সেখানে ঝুলে রইলো।

“ইংল্যান্ডে কি খুব গরম?”

 “না। বাবাতো বলেন খুব ঠাণ্ডা আর সারাদিন নাকি বৃষ্টি হয়।”

“বর্ষাকালে এখানে যেমন হয়?”

 “সম্ভবত।”

তামান্নার হাত আবার নড়ে উঠলো। এবার সেটা দুই পায়ের সংযোগস্থলে আলতোভাবে গিয়ে স্থির হলো। ওর হাত পাতলা কাপড়টা ভেদ করে বিদ্যুতের মতো উত্তেজনা ছড়াতে লাগলো। ওকে থামাও, ক্রিস্টোফারের মন আদেশ দিলো। কিন্তু ওর শরীর শুনলো না-তামান্নার স্পর্শ পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব।

“কাজটা ঠিক হচ্ছে না, কোনোমতে বললো ক্রিস্টোফার। “মানে… আমার আর একজন আছে।”

“বুঝেছি,” তামান্না বললো কিন্তু হাত সরালো না। “আপনি বিবাহিত।”

“না”

“তাহলে সমস্যা কি?” তামান্নার হাতের নাড়াচাড়া আরো দ্রুত হলো। এতো দ্রুত মালিশ করতে লাগলো যে ক্রিস্টোফারের মনে হলো কামনার আবেশে ও উড়ে যাবে।

“কখনো কোন মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছেন?”

 “না,” স্বীকার করলো ক্রিস্টোফার।

তামান্না নিজের কাচুলি খুলে বক্ষ উন্মুক্ত করে ফেললো। তারপর ক্রিস্টোফারের একটা হাত নিয়ে আঙুলগুলো ফাঁক করে একটা স্তনের উপর রাখলো। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে স্তনের বোটা শক্ত আর উদ্ধত হয়ে আছে। ক্রিস্টোফার বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ওখানে চাপ দিতেই ও অস্ফুট শব্দ করে উঠলো।

“আস্তে,” ফিসফিস করে বললো তামান্না। ওর লম্বা ঘন চুল ক্রিস্টোফারের বুকে লাগতে লাগলো; চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো একজন আর একজনকে। তামান্না ক্রিস্টোফারকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে পিষতে লাগলো ওর সাথে।

রুথ, ক্রিস্টোফারের মনের গহীন একটা কোণ থেক আর্তনাদ ভেসে এলো। কিন্তু ও পাত্তা দিলো না। কামনা ওকে বশ করে ফেলেছে। মনে হচ্ছে শরীরের ভিতর একটা আগুন বইছে। এই আগুন চাপিয়ে রাখা আর ওর পক্ষে সম্ভব না।

*

ক্রিস্টোফারের ঘুম ভাঙলো দেরিতে। কালারিতে যখন থাকে তখন সবসময়ই ও সূর্য ওঠার আগেই উঠে নিজের যা কাজকর্ম সব সেরে নেয়। কারণ সূর্য উঠতে না উঠতেই অনুশীলন শুরু হয়ে যায়। শেষ কবে সূর্যোদয়ের পর ঘুম ভেঙ্গেছে মনে নেই ওর।

আরামটা ও উপভোগ করলো কিছুক্ষণ। কাল রাতের সবকিছু মনে আসছে, এতে স্পষ্টভাবে যে আবারও ওর কামনা জাগ্রত হতে শুরু করলো। আসলেই কি কাল রাতের সব সত্যি ছিলো? নাকি সব স্বপ্ন? না। তামান্নার শরীরের ঘ্রাণ এখনো নিজের শরীরে লাগে আছে ওর। নারিকেল, সুগন্ধি আর ঘামের গন্ধ।

চেহারায় চওড়া একটা হাসি খেলে গেলো ওর। শরীর এখনো ম্যাজ ম্যাজ করছে, তাই চামড়ার উপর সূর্যের নরম উত্তাপটা আরো বেশি ভালো লাগছে। ও একটা হাত বাড়িয়ে দিলো, কিন্তু তামান্না পাশে নেই। সম্ভবত ও চায়নি জয়ন্তন যেনো ওদেরকে একসাথে দেখে ফেলে। ক্রিস্টোফার উঠে বসে চারপাশে তাকালো।

 তামান্নার কম্বলটা দেখা যাচ্ছে। মাড়ানো ঘাসের উপর পড়ে আছে। গাধাটাও একই জায়গায় বাঁধা। আগাছা চিবুচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা কোথাও নেই।

একটা কাক এসে মন্দিরের গম্বুজের উপর বসলো। বেলা হয়ে গেলেও, জয়ন্তন কেন এখনো ওকে জাগিয়ে দেয়নি ভেবে অবাক হলো ক্রিস্টোফার। সাধারণত, ওর কোনো ত্রুটি ধরতে পারলে বিমলানন্দ লাভ করে জয়ন্তন।

নিতান্ত অনিচ্ছায় ও জয়ন্তনকে খুঁজতে গেলো। মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখলো কাকটা দরজার ভিতরে, মাটিতে পড়ে থাকা কিছু একটায় ঠোকরাচ্ছে। কিন্তু ক্রিস্টোফারের অবস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে জিনিসটা কি। কাকের পাশে একদল মাছি ভনভন করছে। সিঁড়ির মাথায় উঠে আসতেই ওকে দেখে কয়েকটা ইঁদুর দৌড়ে পালালো। জয়ন্তনকে দেওয়া ওর সাবধানবাণী মনে পড়লো। এসব পুরনো দালান হচ্ছে পোকা মাকড়ের আখড়া।

বাইরের উজ্জ্বল সূর্যালোকের কারণে অন্ধকারে চোখ সয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগলো ক্রিস্টোফারের। তারপর আরো কিছুটা সময় লাগলো মাটিতে পড়ে থাকা জিনিসটা কি সেটা বুঝতে।

জয়ন্তন চিত হয়ে শুয়ে আছে, তবে সে ঘুমাচ্ছে না। গলা থেকে বুকের মাঝ বরাবর নিখুঁতভাবে কাটা। এতো বড় হা হয়ে আছে জায়গাটা যে নিচের মেরুদণ্ড পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। চুনি ভরা ব্যাগটা নেই। চারপাশ ঘিরে শুকিয়ে আসা রক্তের ছোটখাটো একটা পুকুর দেখা যাচ্ছে। মাছিতে ভরে আছে সেটা। রক্তের কিনারায় পাথরের উপর ছোট একটা পায়ের ছাপ। গত রাতে এই পা টাই ওকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো।

রাগে উন্মাদ হয়ে বাইরে দৌড়ে এলো ক্রিস্টোফার। দুত হাতে তরবারিটা তুলে নিলো ও। তারপর উরুমি-টা বেঁধে ছুটে গেলো রাস্তায়।

ভোরের কুয়াশায় রাস্তার ধুলো মরে গিয়েছে। আর এতো সকালে এখানে আর কারোই আসার সম্ভাবনা নেই। তাই তামান্নার খালি পায়ের ছাপগুলো স্পষ্টভাবেই দেখতে পেলো ও। সেগুলো অনুসরণ করে পাহাড়ে উঠে এলো ক্রিস্টোফার। প্রতিটা পদক্ষেপে রাগ আরো বাড়ছে ওর। কোমরে ঝুলানো উরুমি-টা হিস হিস করছে। আর ও মনে অনে ভাবছে তামান্নাকে ধরার পর এটা দিয়ে ওকে কি করবে।

 রাস্তা ধরে কিছুদুর যাওয়ার পরেই পায়ের ছাপ দিক পরিবর্তন করে একটা ছাগল চরার রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়েছে। একটা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে মিশেছে সেটা। রাস্তাটা পাথরের। তামান্নার হালকা পা তাই এখানে কোনো ছাপ ফেলেনি। ও কি এদিক দিয়েই গিয়েছে? নাকি ওর পিছু নেওয়া থামানোর জন্যে ধোঁকাবাজি করেছে।

তামান্না শুরু থেকেই ক্রিস্টোফারকে ধোঁকা দিয়ে এসেছে। আমের বাগান, গরীব বাবা যে কিনা ওর যৌতুক দিতে পারে না-সব মিথ্যা। ধর্ষণটাও নাটক। জয়ন্তনের কথা-ই ঠিক 1. কিন্তু অতিরিক্ত রাগের কারণে ক্রিস্টোফার অনুতাপ বোধ করলো না। ওই ধর্ষক লোকটাও নিশ্চয়ই তামান্নারই সাথের কেউ। ক্রিস্টোফার কাছে আসামাত্র পালিয়ে যাবে, পরে রাত নামলে তামান্নার কাছে ফিরে আসবে-এই ছিলো ওদের পরিকল্পনা। তবে ওদের পরিকল্পনার এই অংশটুকু মাঠে মারা গিয়েছে।

কিন্তু সুযোগ থাকার পরেও তামান্না কেন ওকে খুন করেনি সেটা ভেবে অবাক হচ্ছে ও। আবেগ? ওর সাথে থাকার সময় তামান্নার কেমন লাগতো সেটা মনে পড়লো ওর। ওর স্পর্শের অনুভূতি মনে আসতেই রাগে হাত মুঠো করে ফেললো ও। একবার ধরতে পারলে জীবনের শিক্ষা দিয়ে দেবে।

ক্রিস্টোফার রাস্তা ধরে আরো কিছুটা গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো, কিন্তু আর কোনো পায়ের ছাপ পাওয়া গেলো না। তার মানে ছাগল চলার রাস্তা ধরেই গিয়েছে মেয়েটা। ও-ও সেদিকেই এগিয়ে পর্বতের খাড়া গা বেয়ে উঠতে শুরু করলো। ও মাটিতে ছাপ বের করায় খুব বেশি দক্ষ না, তবে এক জায়গায় সামান্য নরম মাটিতে ও আবার একটা পায়ের ছাপ খুঁজে পেলো। এখনো তাজা। উরুমির প্যাঁচ খুলতে খুলতে আরো জোরে ছুটলো ও।

পথটা পর্বতের চারপাশ ঘুরে তারপর উপরে উঠেছে। খানিকটা উঠতেই আচমকা একটা গিরিখাত দেখা গেলো সামনে। আর ওখানেই তামান্না  দাঁড়িয়ে। একাকী। একটা পাথরের চাই-এর উপর নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। ও নিশ্চয়ই ক্রিস্টোফারের আসার শব্দ শুনেছে কিন্তু পালানোর কোনো চেষ্টাই করেনি দেখা যাচ্ছে। এখন আর শাড়ি পরা নেই। শুধু কাচুলি আর হরিণের চামড়ার পায়জামা পরনে। ওটা ক্রিস্টোফার আগে দেখেনি।

“আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছো?” তামান্না অবাক হয়েছে বোঝা গেলো।

রাগের চোটে ক্রিস্টোফারের ইচ্ছে করছিলো তখনি দৌড়ে গিয়ে ওর টুটি চেপে ধরে। কিন্তু তামান্নার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিলো, যে জন্য ও সামনে আগালোে না। যেনো ওর ভিতর লুকানো একটা শক্তি আছে-আর সেজন্যেই ওর চেহারায় এক অদ্ভুত আত্মতুষ্টি ফুটে আছে। এই ব্যাপারটাই ক্রিস্টোফারের রাগকে কমিয়ে সচেতন করে তুললো।

“চুনিগুলো কোথায়?” জানতে চাইলো ক্রিস্টোফার।

“নিরাপদ কোনো জায়গায়। তোমার বন্ধু জয়ন্তন কিন্তু খুবই বিশ্বস্ত। আমাকে আসতে দেখে ও চেষ্টা করেছিলো পাথরগুলো গিলে ফেলতে, যাতে ওর মালিকের সম্পদ রক্ষা পায়। শেষে তাই ওর বুক কেটে সেগুলো বের করতে হয়েছে।”

“এজন্যে তোকে পস্তাতে হবে।”

“তুমিও একই কাজ করতে। ওর দিকে তুমি কিভাবে তাকাও সেটা আমি কালই দেখেছি। তোমার মনের ভিতর কি আছে জানি আমি।”

ক্রিস্টোফার ওর কথার প্রতিবাদ করলো না। কিন্তু এখনতো আমি তোকে বাগে পেয়েছি।”

 “তাই নাকি?” জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করলো তামান্না। পাথরের আড়াল থেকে পাঁচজন লোক বেরিয়ে এলো। চেহারা রুক্ষ, মুখে না কামানো দাড়ি, পরনে ছেঁড়া পোশাক। সবার হাতে ধরলো ছোরা।

“আমার তো মনে হচ্ছে তোমাকে বাগে পেয়ে গিয়েছি।”

“আমাকে আটকাতে হলে এই কয়জন দিয়ে হবে না।” বলতে বলতে ক্রিস্টোফার তামান্নার পাশে দাঁড়ানো লোকগুলোর চেহারা দেখে নিলো। কে সবচে দ্রুত বা কে সবার আগে আক্রমণ করতে পারে সেই চিন্তা করছে। কাকে খুন করতে সবচেয়ে কষ্ট হবে? কিন্তু সেরকম কিছুই ঠাহর করতে পারলো না।

 “যে কাছে আসবে, তারই কল্লা ফেলে দেবো,” সাবধান করলো ক্রিস্টোফার। তামান্না দশ গজ মতো দূরে দাঁড়িয়ে। উরুমির আওতার সামান্য বাইরে। ও সামনে এগিয়ে আক্রমণের লক্ষ্যে শরীরকে প্রস্তুত করে ফেললো।

তামান্না শরীরের পিছনে হাত দিয়ে কোমর থেকে একটা লম্বা পিতলের নলের পিস্তল বের করে আনলো। তারপর আলতো করে সেটা ক্রিস্টোফারের দিকে তাক করে হ্যাঁমার টেনে ধরলো।

ক্রিস্টোফার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলো। ওর মুখের অক্ষম ক্রোধ দেখতে পেয়ে হেসে দিলো তামান্না। “কালারির সেরা যোদ্ধার পক্ষেও বুলেটের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব না।”

“তাহলে আমাকে এখানে টেনে আনার মানে কি? জয়ন্তনের মতো আমাকে ঘুমের মধ্যে মেরে রেখে আসলেই তো হতো।”

“কারণ আমি তোমাকে খুন করতে চাইনি।” ক্রিস্টোফার আরো এক চুল আগালো। কিন্তু আর একটুও সামনে বাড়ার চেষ্টা করলে সেটা করতে বাধ্য হবো।”

“কেনো?”

“বাকি জীবন কি এই আনা নেওয়ার কাজই করে যেতে চাও? ওই ভোটকা ব্যাটার সেবা করে যেতে চাও যাকে তুমি এক ঘুষিতে পরপারে পাঠিয়ে দিতে পারবে? শুধু টাকা আছে বলে ওরা তোমার উপর ছড়ি ঘুরিয়া যাবে? তুমি কিভাবে ঊরুমি চালাতে পারো সেটা আমি দেখেছি। তোমার মতো একজন যোদ্ধা মালাবার উপকূলের ত্রাস হতে পারবে।”

“তাতে কি হবো আমি? দস্যু?”

“মুক্ত হবে।”

তামান্না বন্দুকের নলটা নামালো। ওর বাহু অনেক সরু, কিন্তু একবারের জন্যেও সেটা কাপলো না।

“কোন পক্ষে যোগ দিতে চাও ভেবে দেখো?”

*

“আমরা ঠিক কাজটাই করছি, তাই না?” টম জোরে জোরে চিন্তা করছে।

ও আর ডোরিয়ান পানসি নৌকাটার পিছন দিকে বসে আছে। এক হাতে হালটা ধরে আছে টম। টেবিল উপসাগরের বন্দরে ভীড়ে থাকা সওদাগরি জাহাজগুলোর ফাঁক দিয়ে পানসিটা এগিয়ে যাচ্ছে। সারাহ, ইয়াসমিনি আর অ্যানা বসেছে মুখোমুখি। ওদের পিছনে আলফ উইলসন আর তার সহযোগীরা নিখুঁত ঐকতানে দাঁড় বাইছে। আলফের বাবার বাড়ি ছিলো ব্রিস্টলে। তবে ওর গায়ের গাঢ় রঙটা পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন উচ্চ বংশের মঙ্গোলিয়ান মহিলা। আলফ নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে পেরে কতোটা আনন্দিত সেটা টম বুঝতে পারছে।

 “যদি আমরা সব ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারতাম যে কি হতে যাচ্ছে তাহলে বলতাম যে অবশ্যই ভুল পথে যাচ্ছি আমরা,” হেসে বললো ডোরিয়ান। “অনিশ্চয়তাই তো রোমাঞ্চের কারণ।”

 সারাহ টমের দিকে ভ্রুকুটি করলো। “তোমাকেতো এরকম অস্থির দেখিনা কখনো।”

“আমি আসলে জোরে জোরে চিন্তা করছিলাম।” সত্যি কথা হচ্ছে ফ্রান্সিস ওকে খুন করার অভিপ্রায়ে উদয় হওয়ার সেই রুদ্ধশ্বাস রাতটার পর থেকে ও অনিশ্চয়তায় থাকার আর কোনো সুযোগ পায়নি। কারণ এরপর থেকেই শুরু হয় অনবরত কাজ : একটা জাহাজ কিনে সেটাকে সুসজ্জিত করা, ওটায় এমন সব মাল ভর্তি করা যেগুলো ভারতে বিক্রি করলে প্রাচুর দাম পাওয়া যাবে, তারপর জাহাজকে চালানোর জন্য লোকবল জোগাড় করা। টম এসবের প্রতিটা খুঁটিনাটি নিজে নজরদারি করেছে। প্রতিদিন সূর্যের আগে ঘুম ভাঙতে ওর, বাসায় ফিরতে গভীর রাতে। ফিরেই লণ্ঠনের আলোয় সারাদিনের ব্যয়ের হিসেব কষতে বসে যেতো।

“অনেকের স্বামী-ই সমুদ্রে গিয়ে আর ফিরে আসে না। এরকম কিন্তু অনেক নজির আছে,” সারাহ বললো। “জাহাজে থাকার সময় তাই ওকে সবসময় চোখে চোখে রাখি।”

টম ওর হাত ধরলো। “যখন আমরা সমুদ্রে থাকবো, তখন আমার চোখ থাকবে শুধু তোমার দিকে।”

“তোমার চোখ থাকবে দিগন্তে, আবহাওয়ায়, পাল খাটানোয় আর তোমার লোকেদের দেখাশোনায়,” মুখ বাঁকিয়ে বললো সারাহ। “তবে আমার কাছ থেকে বেশি দূরে তো আর যেতে পারবে না।”

“ভারত যেতে অনেক সময় লাগবে রে পাগল,” জ্বলজ্বলে চোখে বললো টম।

 একটা অতিরিক্ত বোঝাই ইন্ডিয়াম্যানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো পানসিটা। দুপুরের কড়া রোদে ওটা সোনার পাত বসানো কামানের খোপগুলো ঝকমক করছে। তা দেখে টমের শেরপা জাহাজটার কথা মনে পড়লো। ওটায় করেই ও প্রথম আফ্রিকায় এসেছিলো। ওর বাবা হাল-এর সাথে এসেছিলো ও। সোনা দিয়ে এরকম গিলটি করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কতো টাকা খরচ হতে পারে ভাবলো টম। তবে ওদের মোট লাভের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ এই বিলাসিতা দ্বারা প্রকাশ পায়।

“ওরে আল্লাহ্! এতে তো অনেক টাকা লাগার কথা!” ইয়াসমিনি বললো।

টম জানে ও ইন্ডিয়াম্যানটা সম্পর্কে কথা বলছে না। ও বলছে গত কয়েক সপ্তাহে ওদের খরচ করা টাকা সম্পর্কে। জাহাজটার দামই অনেক, কেপ টাউনে এরকম জাহাজ মাত্র কয়েকটাই আছে। শুরুতে ওটার মালিক দাম কমাতেই চাইছিলো না। কেনার আশা তাই এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছিলো টম। ব্যাংক অফ হীরেনগ্রাচট-এ রাখা সব টাকা খরচের পরেও দেখা গেলো আরো টাকা দরকার ওদের। গত দশ বছর ধরে ইউরোপ জুড়ে স্প্যানিশ আগ্রাসন চলছে। সেই যুদ্ধের কারণে বন্দুক, পাউডার, গুলি, কার্তুজসহ আরো প্রায় শখানেক দরকারি জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছে।

“তবে টাকা দিয়ে কি পেয়েছি দেখো।” বলে টম পানসির মুখ সোজা করলো। ইন্ডিয়াম্যানের লেজের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো পানসিটা। সামনেই ওদের নতুন জাহাজটা দাঁড়িয়ে। ডাচ নকশায় বানানো একটা তিন মাস্তুলের জাহাজ। এগুলোকে বলা হয় স্কুনিয়ার্স, অর্থ ‘অত্যন্ত সুন্দর। ইংরেজিতে শব্দটা হচ্ছে ‘স্কুনার্স। এই নামটা যথাযথ। জাহাজটা বিশাল ইন্ডিয়াম্যানগুলোর চাইতে লম্বা কিন্তু সরু, সারা গায়ে মার্জত নকশা কাটা। ওটার সামনে লাগানো সমুদ্র পরীর ভাস্কর্য থেকে শুরু করে পিছন দিকের থাকার জায়গা পর্যন্ত সবই মনোহর। জাহাজটা কেপ টাউনে আসামাত্র টমের মনে ধরে যায়। ও জাহাজটার নাম দিয়েছে কেস্ট্রেল-একটা পাখির নাম। ডেভনে থাকার সময় টম প্রায়ই এই পাখি শিকারে যেভো। নামের সার্থকতা রাখতেই যেনো জাহজাটা সামান্য বাতাসেও প্রায় উড়ে চলতে পারে।

বন্দরের জাহাজের সারির পিছনে ওটাকে নোঙ্গর করে রাখা। পাশেই ভাসছে কোর্টনীদের আদি আর অকৃত্রিম সেবক সেন্টারাস। জায়গাটা দুর্গের কামানের গোলার আওতার বাইরে। এই আগাম সতর্কতাটা টম শিখেছে ওর বাবার কাছ থেকে।

টম পানসিটা কেট্রেল-এর পাশে এনে দাঁড় করালো। তারপর একজন একজন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে। আবোলি আগেই এসে উঠেছে, শেষ সময়ের প্রস্তুতি তদারকি করছে। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর হাতের খাতায় লিখে রাখছে।

সিঁড়ির মাথায় টমের মাথাটা দেখা যেতেই ও দৌড়ে গেলো সেদিকে।

“আসেন চাচা। সবকিছু রেডি। বাতাসও আছে প্রচুর। আবোলি বললো আপনার আদেশ পেলেই নোঙ্গর তুলে ফেলা যাবে।”

ছেলেটার আগ্রহ দেখে হাসলো টম। কেস্ট্রেল কেনা শেষ হওয়া মাত্র টম ফ্রান্সিসকে জাহাজে থাকতে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। যাতে লোকজন জ্যাকব দ্য সি আর অন্যান্য লোকগুলোর নিখোঁজ হওয়ার সাথে ফ্রান্সিসের আগমনকে মেলাতে না পারে। আবোলি ওকে সব ভালো খবরই দিলো। ফ্রান্সিস খুবই আগ্রহী ছাত্র। খুব দ্রুত সব শিখে নেয়, আর কাজকর্মেও পটু। যদিও আফ্রিকা আসার আগে কোনোদিনও কোনো জাহাজে পা দেয়নি ও। তবে সব দেখেশুনে টম ওর মধ্যে এক দুর্দান্ত নাবিকের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।

“ব্যবসার ক্ষেত্রে ওর মাথা ব্ল্যাক বিলির মতোই,” একরাতে আবোলি বলেছিলো টমকে। “কিন্তু মনটা একদম ওর মায়ের মতো।”

 টম হঠাৎ খেয়াল করলো ফ্রান্সিস আর ওর দিকে তাকিয়ে নেই, ওর কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। জাহাজ বা এটার কোনোকিছুই যেনো আর ওর মাথায় নেই। চেহারা বিমলানন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। অ্যানা উঠে এসেছে জাহাজে।

এই দুজনের দিকে নজর রাখতে হবে, মনে মনে বললো টম। আবোলি শুধু ফ্রান্সিসের শেখার দক্ষতা সম্পর্কেই টমকে বলেনি। ও আরো জানিয়েছে, “ছেলেটা প্রেমে পড়েছে, ক্লিবি। যখনই অ্যানা জাহাজে আসে ও সব কাজ ভুলে ওকে নিয়েই পড়ে থাকে।”

“আরে বাচ্চা একটা ছেলে।” টম অবাক হয়ে বলেছে। “আর অ্যানা বড় একটা মেয়ে।” তবে ভালো করে ভেবে বুঝলো দুজনের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না। “অ্যানারও কি একইরকম অবস্থা নাকি?”

“অ্যানা এখনো ফ্রান্সিসকে ঐ নজরে দেখে না,” আবোলি বলেছে। “কিন্তু আমাদের যাত্রাটা অনেক লম্বা হবে। আর সে জন্যেই সম্ভবত ফ্রান্সিস বেশি বেশি আশা করছে।”

টম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফ্রান্সিস বা অ্যানা দুজনের কেউই আর ছোট নেই। দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে ওরা। কিন্তু ও ফ্রান্সিসের জন্যে একটা দায়িতুবোধ অনুভব করে, নিজের আপন সন্তান থাকলেও এমনটাই অনুভব করতো। আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ও খুব ভাল মতোই জানে যে জাহাজের মতো এইরকম বদ্ধ পরিবেশে যে ভালোবাসার সম্পর্কগুলো হয়, সেগুলোর পরিণতি সাধারণত শেষমেশ ভালো হয় না।

সারাহ ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। “ফ্রান্সিস, মিষ্টি করে ডাকলো ও। “তুমি কি কষ্ট করে মিস দুয়ার্তের ব্যাগপত্র তার বার্থে দিয়ে আসতে পারবে?”

“তুমি ওকে এসবের মাঝে ঠেলে দিচ্ছো কেনো?” ওরা নিচে নেমে যেতেই নালিশের সুরে বললো টম।

“আমি ঠেলে দেই বা না দেই তাতে কিছুই যায় আসে না,” সারাহ জবাব দিলো। “যা হওয়ার তা হবেই। আর কেউ না হোক, অন্তত তোমার সেটা জানা থাকার কথা।”

ডোরিয়ান এগিয়ে এলো ওদের দিকে। “দারুণ কিন্তু জাহাজটা,” প্রশংসা করলো ও। “ঠিক আছে, আপাতত বিদায় তাহলে দেখা হবে শীঘ্রই।”

 “আচ্ছা।”

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে করা পরিকল্পনা মোতাবেক, টম আর সারাহ, ফ্রান্সিস আর অ্যানাকে নিয়ে কেস্ট্রেল-এ করে মাদ্রাজ যাবে। ডোরিয়ান, ইয়াসমিনি আর আবোলি সেন্টারাস-কে নিয়ে আফ্রিকার উপকূল ধরে আরবের গুম্বন আর মোকা বন্দরে যাবে। সেখান থেকে ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে একশো মাইল দূরে লাকুইডিভা নামের এক দ্বীপপুঞ্জে আবার একসাথে মিলবে ওরা। তারপর একসাথে বাড়ি ফিরবে।

টম ওর ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি করলো। “সাবধানে থেকো!”

“তুমিও নিরাপদে ফিরে এসো।”

“তাতে আসতেই হবে,” টম বললো। “সব টাকা ঢেলেছি এটার পিছনে।”

 ছোট ভাইয়ের গমন পথের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা বেদনা অনুভব করলো টম। প্রায় দশটা বছর টম জানতো যে ও মারা গিয়েছে। তাই এখন সামান্য সময়ের জন্যেও যদি আলাদা হতে হয় তো ওর ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। এটাই যদি আমাদের শেষ দেখা হয়?

“ডোরিয়ান চাচা চলে গিয়েছেন?”

ফ্রান্সিস উঠে এসেছে উপরে। ও আর অ্যানা কতক্ষণ নিচে ছিলো ভেবে অবাক হলো টম।

“বিদায় দেওয়ার জন্যে একেবারে ঠিক সময়ে চলে এসেছো তুমি।”

আবোলি, ইয়াসমিনি আর ডোরিয়ানকে নিয়ে নৌকাটা আবার দূরে সরে গেলো। ওরা হাত নাড়লো নৌকা থেকে। নৌকাটা দৃষ্টির আড়াল হতেই নোঙ্গর তোলার আদেশ দিলো টম। কু-রা কপিকল ঘোরানো শুরু করলো। নোঙ্গর উঠে আসা শুরু হতেই পায়ের নিচে সেই সুপরিচিত দুলুনিটা অনুভব করতে পারলো টম।

সাগরের অবাধ স্বাধীনতা টমের খুব পছন্দ। তবে এবার কাঁধে ঋণের বোঝার কারণে কিছুটা চিন্তিত ও। সারা জীবনে কখনো কারো কাছে থেকে ঋণ নেয়নি ও। তাই সারাক্ষণ ব্যাপারটা খচখচ করছে মনের ভিতর। এবারের যাত্রাটা তাই দ্রুত শেষ করার জন্যে মুখিয়ে আছে টম। দ্রুত সব শেষ করে লাভের টাকা দিয়ে দেনা শোধ করতে পারলে তবেই শান্তি। তারপরেই মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারবে ও।

*

সমুদ্র ওদের অনুকূলেই থাকলো। যদিও এখন মৌসুমের শেষ সময়, তবুও টম মনে করতে পারলো না কবে এতো ঝামেলাহীন যাত্রা করেছে ওরা। ক্রমাগত বাজে আবহাওয়া থাকার কারণে কেপ অফ গুড হোপ-এর নাম বদলে এখন সবাই কেপ অফ স্টর্মস ডাকা শুরু করেছে। কিন্তু ওখানেও ঝড়ের কোনো চিহ্ন দেখা গেলো না। কেস্ট্রেল-ও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করলো। বাতাসের আগে আগে ছুটলো ওটা, যেনো খোলের তলে পানি না, পাতলা বাতাস। প্রতিদিনই টম এমন নতুন কিছু না কিছু আবিস্কার করতে লাগলো যা ওকে ওর নতুন জাহাজটা সম্পর্কে অবাক করেই চললো।

টম, ফ্রান্সিসের সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে লাগলো। ও যা যা পারে সবই ছেলেটাকে শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক ওর বাবাও যেভাবে প্রথম যাত্রায় ওকে সব শিখিয়েছিলো। ও ফ্রান্সিসকে জাহাজ চালনা শেখালোঃ কিভাবে সূর্যের অবস্থান দেখে অক্ষাংশ বের করতে হয়, কিভাবে লগ লাইন দিয়ে জাহাজের গতি মাপতে হয়। কপাস দিয়ে কিভাবে দিক ঠিক রাখতে হয়, কিভাবে হাল-এর পাশে বসানো ট্রাভার্স বোর্ডের সাহায্যে জাহাজ কতদূর অগ্রসর হলো সেটা বের করতে হয়-সবই শেখালো।

“অনেক চেষ্টার পরেও দ্রাঘিমাংশ বের করার কোনো পদ্ধতি এখনো কেউ বের করতে পারেনি,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। “জাহাজের অবস্থান কতোটা পূর্ব বা পশ্চিমে তা সূর্য দেখে জানা যায়, কিন্তু উত্তর বা দক্ষিণে কতদূর আসলাম সেটা জানা সম্ভব না। সেটার জন্যে আমাদেরকে জাহাজের গতি আর স্রোত দেখে অনুমান করতে হবে।”

 বিকেলে, অবসরে ওরা তরবারি দিয়ে অনুশীলন করতো। ফ্রান্সিস ওর সৎ বাবার কাছে থেকে ভালোই শিখেছে, সেই সাথে ওর নিজের বাবার কাছ থেকে পাওয়া স্বাভাবিক ক্ষিপ্রতা তো আছেই। আর এখন টমের তত্ত্বাবধানে ও সত্যিকার অর্থেই এক ভয়ানক যোদ্ধায় রূপান্তরিত হলো।

মাঝে মাঝে ভারি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়েও অনুশীলন চলতো। কেস্ট্রেল-এ দশটা নয় পাউন্ডের কামান আছে। প্রতিদিন টম ওর সব লোকদেরকে সেগুলোর ব্যবহার প্রশিক্ষণ দিতে। কারণ, কোনো ঝামেলা ছাড়া ভারত পৌঁছাবে এটা ওরা কল্পনাতেও ভাবে না। আর সেজন্যে টম কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন নাবিক একেবারে ইংরেজ সৈন্যদলের সদস্যের মতো দ্রুত গোলা ছুঁড়তে পারে ততোক্ষণ টম অনুশীলন করিয়েই যেতো। সময়টা হচ্ছে সর্বোচ্চ দুই মিনিট। ফ্রান্সিসও বাকি সবার সাথে অনুশীলন করে। গেলো। অচিরেই ও বাকিদের মতো কামানের নল মুছে, তাতে গোলা ভরে, তাক করে ছোঁড়া শিখে গেলো।

“যদি সেরকম জরুরি পরিস্থিতি হয়-ই, তাহলে সেসময় যেনো প্রতি জোড়া হাতই আমাদের কাজে লাগে,” এক সন্ধ্যায় কথাটা বললো টম। “আমি আমার শেষ পয়সাটা পর্যন্ত এই যাত্রার পিছনে খরচ করেছি। কোনো ফালতু দস্যু এসে আরামে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তা আমি হতে দেবো না।”

 “আপনি নিশ্চিত যে দস্যুরা আমাদেরকে আক্রমণ করবে?” ফ্রান্সিসের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে টম হাসি গোপন করলো। ছেলেটা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণের জন্যে আগ্রহে ফেটে পড়ছে।

ব্যাপারটা ভালোই, টম নিজেকে বললো। তুমি নিজেও এরকম ছিলে। ওর মনে আছে, ওকে জাহাজে নেওয়ার জন্যে ও ওর বাবার প্রধান নিয়োগ কর্মকর্তা বিগ ড্যানিয়েল ফিশারের শুধু পা ধরা বাদ রেখেছিলো। এরপর ওর বাবা যখন অনুমতি দিলো, সেদিনটা ছিলো ওর জীবনের অন্যতম আনন্দের দিন।

“শুধু তো দস্যুদের কথা বললাম,” সাবধান করলো টম। “গাই যদি একবার আমাদের এই ইন্টারলোপিং অভিযানের কথা জানতে পারে, তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমগ্র বহর আমাদের পিছনে লেলিয়ে দেবে।”

রোদের চোটে ফ্রান্সিসের চোখ ছোট ছোট হয়ে আছে। “গাই চাচা আপনাকে এতো বেশি অপছন্দ করে কেননা? কেপ টাউনে আমাকে কথাটা বলেননি।”

“সে এক লম্বা কাহিনি।” এড়িয়ে যেতে চাইলো টম। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজের খুব কম কৃতকর্মের জন্যেই ও লজ্জা বোধ করে, আর ওর ভাই সম্পর্কে বলাটা সেগুলোর মধ্যে একটা। “তখন আমারদের বয়স এই তোমার মতোই…”।

একটা পালে বাতাস লেগে ফুলে উঠতেই হ্যাচকা টানে ওটায় বাঁধা একটা রশি গেলো খুলে। তারপর ওটার মাথা ডেক-এ ছোটাছুটি করতে লাগলো। জাহাজের গতিও পরিবর্তিত হয়ে গেলে সাথে সাথে।

“আগে এটা সামলিয়ে আসি,” ফ্রান্সিসের কাঁধ চাপড় দিয়ে বললো টম। “আর একদিন বলবো। প্রমিস, বলবো।”

ফ্রান্সিস অবশ্য আর জিজ্ঞেস করেনি। একটা কারণ হচ্ছে, টম যে এ ব্যাপারে আলাপে অনাগ্রহী সেটা টের পেয়েছে ও। আর আসল কারণটা হচ্ছে ওর মাথায় সারাক্ষণ শুধু অ্যানার চিন্তা ঘোরে। মেয়েদের সাথে মেলামেশার খুব বেশি সুযোগ ওর হয়নি। যতোদিনে বয়স বেড়ে উপযুক্ত হয়েছে বলা যায়, তততদিনে দারিদ্র ঝাঁকিয়ে বসেছে ওদের পরিবারে। হাই উইল্ডের বিশালতু দেখে কয়েকটা মেয়ে অবশ্য কিছু আগ্রহ দেখিয়েছিলো, কিন্তু সেটাও একদিনের বেশি টেকেনি। কারণ বাড়ির ভিতরের খালি দেয়াল আর ফাঁকা ঘর দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলো তারা।

কিন্তু অ্যানার সাথে ওর ওরকম কিছুই হচ্ছে না। অ্যানা ওকে ওর চরম দুরবস্থায় পাওয়ার পরেও দূরে ঠেলে দেয়নি। ওর সাথে একদম সহজভাবে, নরম সুরে কথা বলে অ্যানা। তবে এটায় একটা সমস্যাও আছে। ফ্রান্সিস ধরতে পারে না কথার আড়ালে ওর জন্যে অ্যানার আসল মনোভাবটা কি। ওর সারাক্ষণ অ্যানার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে হয়। ফলে যদি কখনো অ্যানা ওকে একটু এড়িয়ে যায় বা একটু বেখেয়াল হয়, তাহলে ওর সারাটা দিন খারাপ কাটে। যতোবার অ্যানা ডেক-এ উঠে আসে, ফ্রান্সিস কোনো কাজেই মন বসাতে পারে না। ট্রাভার্স বোর্ড নিয়ে খাবি খায় তখন, বা সূর্যের কৌণিক অবস্থান বের করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে।

“তুমি দেখি আমাদেরকে গ্রিনল্যান্ডের অক্ষাংশে অবস্থান দেখিয়েছো,” টম একদিন ওকে ডেকে বকুনি দিলো। সেদিনের হিসাবে বিশাল একটা গড়মিল করে ফেলেছিলো ফ্রান্সিস।

“ভুল হয়ে গিয়েছে, চাচা।”

“অ্যাডমিরাল স্যার ক্লাউডেসলি শোভেল-এর কথা শুনেছো? দুই বছর আগে, উনি নিজের অবস্থান বের করতে ভুল করে ফেলেন আর ওনার পুরো বহর নিয়ে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের দিকে চলে যান। ওখানকার পানির নিচের পাহাড়ে বেধে ওনার চারটা জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যায় দুই হাজার মানুষ। উনি নিজেও ছিলেন তার ভেতর। তাতে করে অবশ্য আত্মহত্যা করার ঝামেলা থেকে বেঁচে যান উনি।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আচ্ছা, বুঝেছি।”

টম ওর স্বর নরম করলো। “তোমাকে বুঝতে হবে, ফ্রান্সিস। জাহাজে মাত্র তিনজন লোক আছে যারা সূর্যের অবস্থান নিখুঁতভাবে বের করতে পারে। এখন যদি আমার বা আলফ উইলসনের কিছু একটা হয়-ধরো কোনো ঝড়, বা দস্যুর আক্রমণ, বা জাহাজ কিছুর সাথে ধাক্কা খায়-তাহলে একমাত্র তুমিই আছো যে কিনা জাহজটাকে নিরাপদে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।”

“আমি আসলে সেভাবে ভেবে দেখিনি।”

“আমি এই জাহাজের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারি না। কেপ টাউনের জাহাজঘাটার কেরানি vOC-র হয়ে কাজ করে। আমার কাছে থেকে সে ইচ্ছে করে বেশি টাকা নিয়েছে। আমার নিজের সব টাকা তো বটেই, তার সাথেও বাড়তি অনেক টাকা এই অভিযানের সাথে জড়ানো। যদি জাহজটা ডোবে তাহলে আমিও ডুবে যাবো।”

*

“ওর উপর ওর সৎ বাবার প্রভাব নিয়ে ভয় হয় আমার,” নিজেদের কেবিনে শুয়ে এক রাতে সারাহকে বললো টম। জাহাজে প্রতি কেবিনে একজনের শোয়ার মতো করে খাট ছিলো, কিন্তু টম কাঠ মিস্ত্রিকে বলে ওর ঘরের খাটটা দুজন শোয়ার মতো করে বানিয়েছে। পাশাপাশি শুয়ে আছে ওরা। ভ্যাপসা আবহাওয়ার কারণে দুজনেরই পরনে কোনো কাপড় নেই। ওনার মতো একজন জুয়াড়ির নিশ্চয়ই নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। যদি ফ্রান্সিসও সেসব শিখে নেয়?”

“তাহলে সেসব অভ্যাস ছাড়িয়ে দেওয়া হবে,” সারাহ পাশ ফিরে শুলো। টম এর বুকে মাথা রেখে ওর হৃৎস্পন্দন শুনছে।

“আর তার উপর ওর শরীরে বিলির রক্ত বইছে,” টম আবার বললো।

“আমার বাবা আজীবন শুধু লাত্রে ধান্দা করেছেন, আর আমার মায়ের ধ্যান জ্ঞান ছিলো শুধু খাওয়া। আর আমি কি তাদের মতো অতপ্ত দানব হয়েছি?”।

টম মাথার উপরের নিচু ছাদটার দিকে চেয়ে রইলো। উপর থেকে পাহারাদারের মাপা পদধ্বনি ভেসে আসছে।

“একজন মানুষের মানুষ হওয়ার পিছনে কি থাকে?” জোরে জোরে চিন্তা করতে লাগলো টম। “এটা কি বংশগত? নাকি পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেয় সবাই?”

সারাহ কনুইতে ভর দিয়ে হাতের উপর মাথা রাখলো। ওর বয়স সবে তিরিশ পেরিয়েছে। কিন্তু এখনো কিশোরী মেয়েদের মতোই চপল। ওর সোনালি আভার চামড়া একেবারে মসৃণ, স্তন নিখুঁত আর উন্নত আর চোখ ঠিক ডেভনের আকাশের মতোই পরিষ্কার আর নীল।

 ‘ফ্রান্সিস বংশগতভাবে যে গুণাবলিই পাক বা কারো কাছ থেকে যা কিছুই শিখুক-ও কিন্তু সেই সবার চাইতে আলাদা একটা মানুষ হবে। তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো। ও সঠিক পথে না হাঁটলে সেটা তোমার দায় না।”

 সারাহের লম্বা কেশরাজি টমের বুকের উপর ছড়িয়ে আছে, ওর কেমন সুড়সুড়ি লাগছে তাতে। সারাহ আঙুল দিয়ে টমের পেশির বাইরের দিকটায় বুলাতে লাগলো। ধীরে ধীরে নিজের কাজ করছে ও। টম টের পেলো ওর ভাবনা অন্যদিকে সরে যাচ্ছে।

 সারাহ টমের ঠোঁটে চুমু খেলো। ওর চোখ চকচক করছে। তবে আমি কিন্তু মায়ের প্রভাব থেকে পুরো মুক্ত নই। কিছু কিছু ব্যাপারে আমার লোভ খুব বেশি! যেমন তোমার আদর।”

*

কেপ কোমোরিন পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ওদের ভাগ্য সুপ্রসন্নই থাকলো। এটা হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ব দক্ষিণ প্রান্ত। জায়গাটা একবার পার হতে পারলেই ওদের আর মৌসুমি বায়ুর ভয় থাকবে না। ইদানীং ঝড়ের জন্যে পশ্চিম উপকূলে জাহাজ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“একবার অন্তরীপটা পার হতে পারলেই আর চিন্তা নেই। সিলন ঘুরে মাদ্রাজ পর্যন্ত একেবারে মাখনের মতো রাস্তা,” টম বললো। সামনের টেবিলে একটা চার্ট বিছানো। সেটার দিকে তাকিয়ে যেনো জোর করেই নিজেকে আশ্বস্ত করলো টম। ওরা ঠিক ঋতু বদলের সময়টাতে এখানে এসে পৌঁছেছে, তার উপর আজ সারা বিকেল বাতাস স্থির হয়ে আছে। এখনো নিরাপদ না ওরা।

“সিলনে নীলার খনি আছে,” অ্যানা বললো। “ওগুলো হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দামী পাথর। রানি সেবার মন জয় করার জন্যে রাজা সলোমন নাকি তাকে এই পাথরা উপহার দিয়েছিলেন।”

টেবিলের উল্টো পাশে বসা ফ্রান্সিসের মুখভঙ্গি দেখছে টম। ও কি ভাবছে সেটা পড়ার চেষ্টা করছে। সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ও অ্যানার দিকে তাকালো, কথাটা কি অ্যানা ইচ্ছেকৃতভাবে ফ্রান্সিসের মাথায় ঢোকানোর জন্যে বললো কিনা সেটা ভাবছে।

“আমরা কি সিলনে একবার নামতে পারি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“ফেরার পথে দেখা যাবে,” টম বললো। “এই মুহূর্তে আমাদের এক দলা পনির কেনারও সামর্থ্য নেই।” পরের কথাটা ও ঠাট্টার ছলে বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু কেনো যেনো সেটা বেশ রুঢ় শোনালো।

 “দামী পাথরের ব্যবসা কিন্তু অনেক লাভের,” অ্যানা বললো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে টম কোনো ছলনা দেখতে পেলো না। শুধু এক ব্যবসায়ীর বেশি লাভ করার অভিপ্রায়। “কয়েক বছর আগে মাদ্রাজের গভর্নর স্যার থমাস পিট বিশাল বড় একটা হীরা কিনেছিলেন। ওটার ওজন ছিলো প্রায় সোয়া এক পাউন্ড, চারশো দশ ক্যারেট ছিলো পাথরটা।”

শুনে এবার টমও আগ্রহী হয়ে উঠলো। মৃদু স্বরে শিষ দিয়ে উঠলো ও।

“এক ভারতীয় শ্রমিক গোলকান্দার খনিগুলোর একটা থেকে চুরি করে এনেছিলো হীরাটা। লোকটার পায়ে বিশাল একটা দগদগে ঘা ছিলো। তার ভিতরে লুকিয়ে খনি থেকে বের করে এনেছিলো হীরাটা। খনির পাহারাদারেরা কিছুই টের পায়নি। পিট ওটার জন্যে বিশ হাজার পাউন্ড দিয়েছিলেন। পাথরটা কেটে পালিশ করার পর ওটার দাম লক্ষ পাউন্ড ছাড়াবে।”

“গোলকান্দা কি মাদ্রাজের কাছে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“দুইশো মাইল ভিতরে। তবে সব ভালো ভালো পাথরই মাদ্রাজে আসে।”

“তাহলে দোয়া করো যেনো আমরা এতো বেশি লাভ করতে পারি যা দিয়ে কয়েকটা পাথর কেপ টাউনে কিনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়,” টম বললো। “আমি বাজি-”

 টম কথা থামিয়ে চুপ করে গেলো হঠাৎ। কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকছে ওর কাছে। যেনো জাহাজের কাঠের ভিতর দিয়ে ওর কাছে খবর পৌঁছে গিয়েছে। ও উঠে দাঁড়ালো, সাথে সাথেই শব্দ হলো দরজায়।

 “দুঃখিত স্যার,” মেট বললো। “বাতাস পড়ে গিয়েছে। আবহাওয়ার মতি গতিও ভালো ঠেকছে না। মাস্টার বললেন একটা ঝড় নাকি আসছে।”

 টম প্রায় দৌড়ে ডেক-এ উঠে এলো। ওরা নিচে গিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। এইটুকুতেই সমুদ্র ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। বিশাল বিশাল ঢেউ ফুলে উঠছে চারপাশে; দড়িগুলোতে বাধা পেয়ে বাতাস যেনো আর্তচিৎকার করে বেড়াচ্ছে। এক অশুভ, নীলচে-লাল আলোয় ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রের উপরিভাগ। দিগন্তে সূর্যের আলো মেঘের ফাঁক দিয়ে মাথা গলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু পারছে না।

“সব পাল নামাও এখনি, শুধু মাঝেরটা রাখো,” টম আদেশ দিলো। “ওটাকেও অর্ধেক তুলে রাখো। উপর থেকে গজ খানেক থাকবে শুধু। সমুদ্রের নোঙ্গরগুলো প্রস্তুত করে রাখো তাড়াতাড়ি।”

লোকজন ঝটপট কাজে লেগে গেলো। দড়ি ধরে টেনে পাল গুটিয়ে ফেলছে। টম ফ্রান্সিসকে ডাকলো।

 “কুয়োর গভীরতা কতোটুকু মেপে আসো।” কুয়োটা আসলে জাহাজের ঠিক মাঝের একটা গর্ত। জাহাজের পেটে যতো পানি ঢোকে তা ওখানে জমা হয়। সাগর যতোই ঠাণ্ডা হোক, বা জাহাজটা যতোই ভালো করে বানানো হোক কেন, খোলে পানি ঢুকবেই। আর ঝড়ের কারণে জাহাজের তক্তাগুলোর উপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। ঢেউ এসে খোলে বাড়ি দিয়ে তক্তাগুলো নাড়িয়ে দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই ফুটো হবে অনেকগুলো। যদি পানি ঠিকমতো সেচ দিয়ে বের করা না যায় তাহলে পানির কারণে জাহাজের ওজন আরো বেড়ে যাবে, তখন ওটা ঠিকমতো চালানোও যাবে না, ফলে জাহাজ ঢেউয়ের প্রতি আরো বেশি নাজুক হয়ে যাবে। আর জাহাজ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।

ফ্রান্সিস পানি মাপার কাঠিটা হাতে ফিরে এলো। “ছয় ইঞ্চি।”

“খারাপ না।” তবে টম কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না। “পালগুলো গোটানো হলেই সবাইকে পানি সেচতে পাঠিয়ে দেবে। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর লোক বদল করবে।”

“আচ্ছা।” বলে ফ্রান্সিস দৌড়ে গেলো আদেশ পালন করতে। টম ঘুরে দেখলো অ্যানা আর সারাহ শাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“ঝামেলা কি খুব বেশি?” সারাহ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো। বাতাসের তোড়ে ওর মাথার চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে।

“আমাদের সামনে আরো একশো মাইল খোলা সাগর,” টম বললো। “কেস্ট্রেল অনেক ভালো একটা জাহাজ। তাই ভাগ্যের সহায়তা পেলে আশা করছি ঝড়ের আগেই জায়গাটা পেরিয়ে যেতে পারবো।”

 “আর এখন?” সারাহ বললো। “আমি আর মিস দুয়ার্তে কি করতে পারি?”

“নিচে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকো। আর প্রার্থনা করো যেনো ঝড় চলে যায় দ্রুত।”

*

বাতাসের বেগ বাড়তেই লাগলো। সাগর ফুলে ফুলে উঠছে। ঢেউগুলো একেকটা এতো বড় যে ওটার উপর দিয়ে ওপাশে আর দেখার উপায় রইলো না। কেস্ট্রেল একবার ঢেউয়ের মাথায় উঠছে আবার ঝপাস করে আছড়ে পড়ছে। পানির তোড়ে ডেক-এর উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে টমের। রাত নামলো একসময়, তবে দিনের বেলাতেই এতো বেশি অন্ধকার ছিলো যে তফাতটা খুব বেশি বোঝা গেলো না। কেউ ঘুমাতে পারলো না। টম ডেক-এ পায়চারি করতে লাগলো, হালীকে এই বৈরি সাগরেরো ঠিকভাবে হাল ধরে রাখতে সাহায্য করলো। জাহাজের ছেঁড়া দড়াদড়ি আর মাস্তুলের দিকে কড়া নজর রাখলো। এতো দ্রুত ঝড়টা এগিয়ে এলো যে অর্ধেক ভোলা পালটা নামানোরও সময় পেলো না টম। শেষ পর্যন্ত ওর জাহাজের কোনো অংশ আস্ত থাকবে কিনা সেটা নিয়েই চিন্তায় পড়ে গেলো

 ওর আশংকাই সত্যি হলো। মাঝরাতের একটু পরে, জাহাজটা প্রচণ্ড জোরে কেঁপে উঠলো। এতো জোরে শব্দ হলো যে ঝড়ের মাঝেও স্পষ্ট শোনা গেলো। আলফ উইলসন দৌড়ে এলো অন্ধকার থেকে।

“সামনের পরীটা ভেঙ্গে পড়েছে।”

 “এখুনি ওটাকে কেটে ফেলো, এখুনি।” আদেশ দিলো টম।

পরীটার ভাঙা অংশটুকু ডেক-এ টেনে আনতেই টম টের পেলো যে ওর জাহাজ উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করেছে। যদি জাহাজটা বাতাসের আড়াআড়ি চলে আসে, তাহলে বাতাস ধাক্কা দিয়ে জাহাজটা একটা পিপার মতো করে উল্টে ফেলবে। হালী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আবার আগের দিকে ঘোরাতে। কিন্তু জড়তার কারণে পারছে না। সাগর আজ এতো শক্তিশালী যে, যে কোন সময় পুরো হালটাই ভেঙ্গে যেতে পারে।

 টম নিজে সব কাজে নেতৃত্ব দিতে লাগলো। জাহাজের উপর যে ঢেউগুলো। এসে পড়ছে সেগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে। ওগুলোকে আটকানো অসম্ভবই বটে, কোমরে রশি বেঁধে না রাখলে জাহাজ থেকে পড়েই যেতো। চেহারায় ঢেউয়ের বাড়ি খেলো, চোখে ছোবল খেলো। বলা যায় অন্ধই হয়ে গেলো ও, হাতের কুড়ালটা দিয়ে যে জাহাজের কিনারে বাঁধা দড়াদড়ি কেটে দেবে সেই উপায়ও রইলো না। আরো একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো।

জাহাজের সবচে বড় মাস্তুলের সাথে বাধা দড়িটার দিকে কুড়াল চালালো। টম। প্রবল বাতাসে ওটা টানটান হয়েই ছিলো। ওটা কাটা না হলে পুরো মাস্তুলটাকেই ভেঙ্গে ফেলতো।

ওর কুড়ালের কোপে কেটে গেলো দড়িটা। আচমকা প্রচণ্ড টান মুক্ত হওয়ায় ওটার মুক্ত প্রান্ত বাতাস কেটে একদিকে ছুটে গেলো। টম তীরবেগে ওটার পথ থেকে সরে গেলো। এক ইঞ্চির জন্যে সেটা ওর চোখে এড়িয়ে পিছনের লোকটার চেহারায় গিয়ে লাগলো। চিৎকার করে উঠে পড়ে গেলো লোকটা। সাথে সাথে একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো তাকে। তারপর একটানে জাহাজের কিনারে টেনে নিয়ে গেলো।

 লোকটার কোমরে একটা দড়ি বাঁধা, কিন্ত জাহজ থেকে পড়ে গেলে সেটা কোনো কাজেই আসবে না। কেউ তাকে জাহাজের খোলের গায়ে পিষে মারবে। টম দৌড় দিলো। ভয়ানক পিচ্ছিল হয়ে আছে তক্তাগুলো। ও ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার কোমর আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে আসলো, ঠিক সেই মুহূর্তে আর একটা ঢেউ ভেঙ্গে পড়লো ওদের উপর।

দড়াম করে একটা শব্দ হয়ে পুরো ডেক কেঁপে উঠলো। এক মুহূর্তের জন্যে টমের মনে হলো একটা মাস্তুল বুঝি ভেঙ্গে পড়েছে। ও উপরে তাকালো, ভেবেছে দেখবে যে ওটা ভেঙ্গে ওর উপরেই পড়ছে। কিন্তু দেখা গেলো মাস্তুল ঠিকই আছে, একটা ছেঁড়া পাল ওটা থেকে পতপত করে উড়ছে।

“কিছুতে বাড়ি খেয়েছি নাকি আমরা?” এই অঞ্চলে পানির কোনো নিচে লুকানো পাহাড় বা প্রবাল প্রাচীর নেই। তবে ঝড়ের তোড়ে ওরা যে কোথায় এসেছে সে সম্পর্কে টমের কোনো ধারণাই নেই।

“পরীটা স্যার, আলফ চেঁচিয়ে জবাব দিলো। “কেটে ফেলার পর ডেক এ আছড়ে পড়েছে।”

টম জাহাজের পিছন দিকে সরে আসতেই দেখে ফ্রান্সিস উপরে ওঠার হ্যাচটা দিয়ে উঠে আসছে। টলতে টলতে ও এগিয়ে এলো টমের দিকে। ওর হাত ফোস্কায় ভরে গিয়েছে।

 “পানি বাড়ছে।” ঝড়ের ভিতরে কথাগুলো টমের কানে পৌঁছাতে ওকে ফুসফুসের সবটুকু বাতাস খরচ করতে হলো। “এতো বেশি উঠছে যে আমরা সেঁচে সারতে পারছি না।”

“চেষ্টা করে যাও। তুমিই আমার শেষ ভরসা।”

*

রাতটা মনে হচ্ছিলো শেষই হবে না। ঝড়ের বেগ এক ফোঁটাও কমলো না। কখন যে ভোর হয়ে সকাল হয়েছে কেউ টেরই পায়নি। যখন বৃষ্টি চোখে পডলো তখন টম ব্যাপারটা ধরতে পারলো। ও নিজের লবণে ভরা চোখটা ডলে জাহাজের দিকে নজর দিলো। শুধু পরীটা না, জাহাজের সামনের আর মূল মাস্তুলটাও ভেঙ্গে পড়েছে, ওগুলোয় বাঁধা দড়িগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। পালগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে ফিতার মতো ঝুলছে। বাকি মাস্তুলটাও পুরোপুরি ফাঁকা। তবে তাতেও জাহাজটার গতি খুব একটা কমেনি। সেই সাথে বাতাসের বেগও মনে হচ্ছে আরো বেড়েছে।

 “আরো খারাপ হতে পারতো অবস্থা,” নিজেকে সান্ত্বনা দিলো টম। জাহাজটা এখনো ভাসছে, আর ওর সব লোকজনই এখনো অক্ষত। ওদের কাছে এখনো যথেষ্ট ক্যানভাস কাপড় আর অতিরিক্ত মাস্তুল আছে যা দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করে মাদ্রাজ পর্যন্ত চলে যাওয়া যাবে। কুয়োর ভিতরের পানি বেড়েই চলেছে, তবে এখন দিন হওয়ায় খোলের গায়ের ছিদ্রগুলো মেরামত করা সম্ভব হবে। ফ্রান্সিস সারা রাত খোলের ভিতরেই ছিলো। নিজেও পালাক্রমে পানি সেঁচেছে আবার অক্লান্তভাবে অন্যদেরকেও উৎসাহ দিয়েছে। টমের বুক ভরে গিয়েছে ওকে দেখে।

আরো খানিকটা আলো বাড়লো। মাঝে মাঝে জাহাজটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে দুলে উঠছে, ঝাপসাভাবে হলেও তখন দিগন্তে শান্ত পানি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত কেটে যাচ্ছে ঝড়টা।

 “ওটা কি?” হালী বলে উঠলো।

 টম সেদিকে তাকালো। “কি?”

কিন্তু জাহাজটা তখন ঢেউয়ের মাথা থেকে নেমে যাওয়ায় কিছুই দেখা গেলো না। আবার জাহাজটা আর একটা ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসতেই টম দিগন্তে সাদাটে কিছু একটা দেখা গেলো।

“ডুবো পাহাড়,” চিৎকার দিয়ে উঠলো একজন নাবিক। “সামনেই ডুবো পাহাড়।”

 টম একটা পাই গ্লাস নিয়ে চোখে লাগালো। “অসম্ভব। আমরা পাড় থেকে কমপক্ষে পঞ্চাশ মাইল দূরে থাকার কথা।”

আবারও কেস্ট্রেল ঢেউয়ের মাঝে নেমে যেতেই সামনের দৃশ্যটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। এক মুহূর্ত পরেই আর একটা ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসলো জাহাজটা। আর এবার স্পষ্ট দেখা গেলো সবকিছু।

“ডাঙা।” ডাঙাটা এতোক্ষণ অদৃশ্য হয়ে ছিলো। কালো আকাশের কারণে আবছায়ায় কারো চোখে পড়েনি। কিন্তু ডুবো পাহাড়ের সারি স্পষ্ট বোঝ যাচ্ছে। দিগন্তে একসারি ধারালো দাঁতের মতো কিড়মিড় করছে ওগুলো।

হতে পারে ওটা আসলে একটা অজানা প্রবাল প্রাচীর বা কোনো উপকূলের শেষ মাথা, যেটা ওখানে থাকার কথা না। এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই টমের। আর এই মুহূর্তে এটা নিয়ে ভাবারও বিন্দুমাত্র সময় নেই।

কেবিনের দরজা খুলে সারাহ এসে হাজির হলো। হাতে বিস্কুট আর একটা লবণ মাখানো মাংসের টুকরো। জাহাজের দুলুনির সাথে তাল রেখে এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো ও।

“সারা রাত কিছু খাওনি। কিছু খেতে হবে এখন।” তারপর টমের মুখের ভঙ্গি দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”

“সামনেই ডাঙা,” টম বললো। “কিভাবে এখানে আসলো জানিনা। স্রোতের ধাক্কায় মনে হয় ধারণার চাইতেও দূরে চলে এসেছি।” তারপর টের পেলো কথা বলে ওর মহামূল্যবান সময়ের অপচয় করছে। “যেটাই হোক, এখন সামনেই ডাঙা, আর দ্রুত কিছু করতে না পারলে সোজা ওটায় গিয়ে ধাক্কা খাবো।”

সারাহ টমের চেহারা দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলো। এতো বছর একসাথে সমুদ্রে কাটিয়ে এতো এতো ভয়াল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরেও ও খুব কমই টমকে এতোটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখেছে।

টম ডেক-এর মাঝখানে দৌড়ে গেলো। “জাহাজকে ঘুরিয়ে ফেলতে হবে।”

আলফ উইলসন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “এই আবহাওয়ায়? জাহাজের সবগুলো মাস্তুল ভেঙ্গে যাবে তো-আরো খারাপ কিছু হতে পারে।”

“সেটা না করলে সোজা ডাঙ্গায় গিয়ে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবো।”

সেটা সবাই বুঝতে পেরেছে। দড়াদড়ির যেটুকু অবশিষ্ট ছিলো তাই নিয়েই দৌড়ে গেলো নাবিকেরা। একটা পাল খাটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বাতাসের কারণে কাজটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। ক্যানভাসটা বার বার ফুলে উঠে হাত থেকে ছুটে যেতে লাগলো। শত চেষ্টা করেও ধরে রাখা গেলো না। মূল মাস্তুলের অবশিষ্টাংশ ভেঙে সাগরে গিয়ে পড়লো।

“এরপরে দেখা যাবে নাবিকদের কেউ পানিতে গিয়ে পড়েছে,” আলফ বললো।

“যদি পাল খাটানোনা যায় তাহলে আমরা সবাই ডুবে মরবো।”

পাল ছাড়া এই বাতাসের বিরুদ্ধে লড়ে ওরা কিছুতেই ডাঙা থেকে দূরে যেতে পারবে না। এমনকি পাল খাটানোর পরেও পুরো নিশ্চয়তা নেই। এই ফুঁসে ওঠা প্রমত্তা সাগর আর প্রবল বাতাসের বিরুদ্ধে গিয়ে জাহাজটা উল্টো দিকে চালাতে হবে ওদের। আর হাতে আছে খুবই কম সময়।

“উপকূল কাছিয়ে আসছে,” আলফ বললো। ঝড়ের কারণে কিছুই। ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, তাই টম বুঝতে পারছে না যে ওরা আসলে ঠিক কতোদূরে আছে। এখান থেকে স্পষ্ট সৈকতের সাদা বালু আর বাতাসের তোড়ে সারসের গলার মতো বেকে যাওয়া পাম গাছগুলো দেখা যাচ্ছে।

ঈশ্বর, মাঝে যেনো কোনো পাথর বা প্রবাল না থাকে, মনে মনে প্রার্থনা করলো টম। ও ঢেউয়ের দিকে তাকালো, ওদিক থেকে আবার বিপদ আরো বাড়ে কিনা নজর রাখছে।

একজন নাবিক ধপ করে ডেক এর উপর পড়ে গেলো। টম ভাবলো লোকটার হাত-পা কিছু ভেঙ্গে টেঙ্গে গেলো কিনা। তবে লোকটা পিঠ ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়ালো। পড়ার পর ডেক-এ পিছলে যাওয়ার কারণে জ্বলছে সেখানে।

“পাল খাটানো হয়েছে স্যার।”

টম উপরে তাকিয়ে দেখে অবশেষে ক্যানভাসের টুকরোটা বশ মেনেছে। যদিও বাকা হয়ে ঝুলছে ওটা। ঠিকমতো বাঁধতে না পারায় ফাঁকা জায়গা দিয়ে বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে এতেও চলবে।

“ঘুরিয়ে ফেলো জাহাজ।”

 “সোজা দিকে জায়গা নেই অতো,” আলফ মনে করিয়ে দিলো।

“ক্লাব হলিং করে ঘোরাবো জাহাজকে,” টম ঠিক করলো। ক্লাব হলিং হচ্ছে শেষ ভরসা। এই কৌশলে জাহাজের সামনের দিকটাকে জবরদস্তির মাধ্যমে বাতাসের বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এখন ওদের আর কোনো উপায় নেই। নাবিকেরা নোঙ্গরের গায়ে এক কাছি দড়ি বেঁধে জাহাজের সামনের দিকে বেঁধে দিলো।

“আপনি কি নিশ্চিত?” মেট বললো। “নোঙ্গরটা গেলে কিন্তু আমরা পুরোপুরি সাগরের দয়ায় পড়ে যাবো।”

 “আমাদেরকে ডাঙা থেকে দূরে সরে যেতে হবে,” টম চেঁচিয়ে জবাব দিলো। “নোঙ্গর ছুঁড়ে মারো।”

নোঙ্গর পানিতে গিয়ে পড়লো। একই সাথে সর্বশক্তি দিয়ে হাল টেনে ধরা হলো। খুবই আস্তে, একটু একটু করে ঘুরে যেতে লাগলো জাহাজের মুখ। ঢেউয়ের সাথে সমান্তরালে চলে আসায় জাহাজ কাত হয়ে গেলো একদিকে। প্রচণ্ড জোরে কাঁপছে।

 “দড়ি কেটে দাও।” কুড়াল হাতের লোকগুলো নোঙ্গরের সামনের দিকের দড়ি কেটে দিলো। জাহাজটা ঝাঁকি দিয়ে ভারমুক্ত হলো। এবার জাহাজের পিছনের দিকের দড়িতে টান পড়লো। আর জাহাজটা ঘুরতে লাগলো।

তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না ব্যাপারটা। ঢেউ আর বাতাস একসাথে দুটো প্রতিপক্ষের কারণে, জাহাজটা পর্যাপ্ত গতি পাচ্ছিলো না। আবার ওটা বাতাসের দিকে ঘুরে যেতে লাগলো।

আরো দুজন লোক হালীর সাথে যোগ দিলো। সবাই মিলে টেনে ধরলো। হাল। জাহাজের নাকটা সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আচমকা ওরা সবাই হুড়মুড় করে ডেক-এর উপড় আছড়ে পড়লো। আর হালের চাকাটা বনবন করে ঘুরতেই লাগলো। ওটার সাথে আর কোনো কিছুর সংযোগ নেই।

“হালটা গেলো,” চেঁচিয়ে উঠলো হালী।

“সাথে পাল-ও,” বললো আলফ। পালটা একেবারে মাঝ বরাবর ফেসে গিয়েছে। জামার সামনের দিকের মতো লাগছে এখন ওটাকে।

কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কেস্ট্রেল আবার পিছনে সরে গেলো। ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগলো ওটার খোলের উপর। আস্তে আস্তে আবার সমুদ্রের সমান্তরালে চলে আসছে ওটা। টম জাহাজের বামপাশে তাকাতেই দেখলো বিশাল একটা ঢেউ ওদের মাথার উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে।

“সাবধান!”

ঢেউটা একদম সোজা কেস্ট্রেল-এর পাশে এসে আঘাত করলো। জাহাজটা উল্টে যেতে যেতে গেলো না। দুনিয়াটাই উল্টে গেলো যেনো। জাহাজের পাটাতন একেবার সমুদ্রতলের সাথে লম্ব হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। মাস্তুলগুলো এতোটাই ঝুঁকে গিয়েছিলো যে ঢেউ স্পর্শ করলো ওগুলো। যারা কিছু আঁকড়ে ধরার সময় পায়নি, তারা অকস্মাৎ খেয়াল করলো পায়ের নিচে কিছু নেই। সোজা সমুদ্রে গিয়ে পড়লো তারা। কয়েকজন দড়িদড়া আকড়ে ধরেছিলো; বাকিরা ভেসে গেলো। টম দেখলো একটা লোকের মাথা সোজা নোঙ্গরের কপিকলের একটা কাঠে গিয়ে বাড়ি খেলো। সাথে সাথে ডুবে গেলো লোকটা, আর ভাসলো না।

 ডানদিকের একটা কামানের বাধন আলগা হয়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে উল্টো দিকের কিনারাটা গুঁড়িয়ে পানিতে ডুবে গেলো। বাকি কামানগুলোও টান টান হয়ে থাকলো।

 “মাস্তুলগুলো গোড়া থেকে কেটে ফেলো,” চিৎকার করে ডাকলো টম। একটু পরেই জাহাজটা আবার সোজা হবে, আর তখন মাস্তুলগুলো এটাকে একটা পেন্ডুলামের মতো উল্টোদিকে বাঁকিয়ে ফেলবে। আর এভাবে হতে থাকলে জাহাজটা দুলতে দুলতে উল্টেই যাবে।

কয়েকজনের হাতে তখনও কুড়াল ধরা ছিলো। ফেনায় ভরা ডেক-এ পিছলে পড়তে পড়তে ওরা দৌড়ে গেলো বড় মাস্তুলটার দিকে। বেশি কষ্ট করতে হলো না। সামান্য কেটে দিতেই অভিকর্ষ আর সাগরই বাকি কাজটা সারলো। দড়াদড়ি আর ক্যানভাস সহ ওটা ঝপাস করে গিয়ে পড়লো সাগরে। লোকজন লাফ দিয়ে ওটার রাস্তা থেকে সরে গেলো।

আবার সোজা হতে শুরু করলো কেস্ট্রেল। ডেক পুরো নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে উল্টোদিকে বেঁকে যেতে লাগলো। আরো, আরো… এতো বেশি যে পাশ দিয়ে পানি উঠে এলো।

ভাঙা মাস্তুলটাই বাঁচিয়ে দিলো ওদেরকে। পানিতে ঝুলে থাকায় ওটার ভর জাহাজটাকে সোজা রেখে উল্টে যাওয়া থেকে বিরত রাখলো। অল্পের জন্যে রক্ষা পেলো ওরা।

সব শেষ, টম ভাবলো। জাহাজের ডানপাশ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে; সেদিক দিয়ে কলকল করে পানি ঢুকছে। কিছুক্ষণের মাঝেই জাহাজ ডুবে যাবে। সব দেখে কাউকে যে কিছু করতে আদেশ দেবে সেই মনোবল ওর থাকলো না।

ফ্রান্সিস ওর হাত ধরে ফেললো। টম ওকে ডেক-এ উঠে আসতে দেখেনি। “জাহাজের খোল পানিতে ভরে গিয়েছে; পাম্পগুলোও আর কাজ করছে না।”

কথাগুলো টমের শেষ আশাটাকেও মরীচিৎকার মতো মিলিয়ে দিলো। “জাহাজ ছেড়ে নেমে যাও,” আদেশ দিলো ও। “নৌকা নামাও।”

নৌকা নামানোর কথা কারো মাথায় ছিলো না। নৌকায় নামার সিঁড়িগুলো ভেসে গিয়েছে। টম নৌকার দড়িগুলো কেটে দিতেই ওগুলো বাঁকা হয়ে থাকা ডেক থেকে পিছলে পানিতে গিয়ে পড়লো। ঢেউ ওটাকে ভাসিয়ে নেওয়ার আগেই লোকজন যতো দ্রুত সম্ভব হুড়োহুড়ি করে নৌকায় চড়ে বসলো।

সারাহ কেবিন থেকে উপরে উঠে এলো। ওর হাতে কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে। ঝড়ের অমানিশার মাঝেও উজ্জ্বলতা কমছে না জিনিসটার। ওটা হচ্ছে। সেই নেপচুন তরবারি, গিলটি করা খাপে ভরা। টম যে কতোটা খুশি হলো বলতে পারবে না। সারাহ জানে এই ভাঙা জাহাজ থেকে একটা জিনিস যদি টম বাঁচাতে চায় তাহলে সেটা হচ্ছে এই তরবারিটা।

“নৌকায় ওঠো।” বলে টম পিছল ডেকটায় সারাহের হাত ধরে নিয়ে চললো যাতে ও পড়ে না যায়। আর একটা ঢেউ এসে নৌকাটাকে সরিয়ে নিয়ে গেলো। সারাহ লাফ দিলো। নৌকায় পড়া মাত্র ওর ধাক্কায় নৌকাটা উল্টেই গিয়েছিলো প্রায়। তবে ও তরবারিটা ছাড়লো না।

“এবার তুমি,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। ওকেও ও এই ধ্বংসস্তূপের ভিতরে হাত ধরে নিয়ে চললো।

“লাফ দাও।”

 ফ্রান্সিস না দিয়ে বললো। “অ্যানা কোথায়?”

 টম চারপাশ তাকালো। ডেক ফাঁকা।

“ও সম্ভবত নৌকায় উঠে পড়েছে।” দেরি করার সময় নেই। টম ফ্রান্সিসকে ধাক্কা দিয়ে নৌকায় ফেলে দিয়ে নিজেও লাফ দিলো। একেবারে ফ্রান্সিসের উপর এসে পড়লো ও। দুজনে জড়াজড়ি করে গড়িয়ে গেলো আর নৌকাটাও দুলে উঠলো প্রচণ্ডভাবে।

ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। “অ্যানা কোথায়?” আবার বললো ও।

 টম আশেপাশের মুখগুলো জরিপ করলো। অ্যানা নৌকায় নেই।

 “ও তো আমার সাথেই কেবিনের দিকে গিয়েছিলো,” সারাহ বললো।

ফ্রান্সিসের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। “আর উপরে আসেনি?”

 “আমাকে বলেছিলো তোমাকে খুঁজতে যাবে।”

জাহাজটা কেঁপে উঠলো। একটা আহত জন্তুর মতো গোঙ্গাচ্ছে ওটা। কাটা মাস্তুলটা বিচ্ছিন্ন হয়ে সাগরে পড়ে গেলো। এতো কাছে যে আর একটু হলে নৌকার উপরেই পড়তো। টম ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রেখে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, “এখন আর কিছুই করার নেই।”

“না”

আচমকা একটা ঢেউ এসে নৌকাটাকে এতো উপরে তুলে দিলো যে ওটা জাহাজের খোলের গায়ে বাড়ি খাওয়ার উপক্রম হলো। টম কিছু করার আগেই লাফ দিলো ফ্রান্সিস। চিৎকার দিয়ে উঠে আতংকিত চোখে টম দেখলো যে ফ্রান্সিস উন্মত্ত সাগর পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে জাহাজের দিকে। ওর বাড়িয়ে রাখা দুই হাত পাখির ডানার মতো বাতাসে ঝাঁপটাচ্ছে। একটা ঢেউ এসে জাহাজের উপর আছড়ে পড়তেই ও ডুবে গেলো পানির নিচে। টমও ঝাঁপ দিতে গেলে কিন্তু ঐ ঢেউটাই নৌকাটাকে এক ধাক্কায় জাহাজ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিলো।

তবে ফ্রান্সিস তখনও টিকে আছে। ফেনা সরে যেতেই টম দেখলো ফ্রান্সিস জাহাজের একটা রশি আঁকড়ে ভেসে আছে, আর জাহাজ থেকে বেরিয়ে আসা পানির বিপরীতে নিজেকে টেনে সামনে আগানোর চেষ্টা করছে।

“আমাদেরকে ওকে উদ্ধার করতে হবে,” আলফের উদ্দেশ্যে চেঁচালো টম।

 কিন্তু বলামাত্র আরো একটা ঢেউ এসে নৌকাটাকে আরো দূরে নিয়ে গেলো। অর্ধেক দাঁড় পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। আর বাকি অর্ধেক ভাঙা। যদি এখন ওরা সাগরের সাথে লড়াই করতে যায় তাহলে নৌকা উল্টে সবাই ডুবে যাবে।

ফ্রান্সিসের এখন নিজেকেই যা করার করতে হবে।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *