২. কোর্টনীদের বোর্ডিং হাউস

কোর্টনীদের বোর্ডিং হাউসটা শহরের একদম শেষ মাথায়, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাগানের দেয়ালের ঠিক নিচে। ওদের মালয় হাউসকীপার মিসেস লাই সবসময় ঝেড়ে পুছে তকতকে করে রাখে জায়গাটা। ওনার রান্না সাধারণ কিন্তু স্বাদ দারুণ। তার বড় একটা কারণ সম্ভবত টমের পরামর্শ মতো উনি ইংলিশ খাবার ভারতীয় মশলা দিয়ে রান্না করেন তাই।

 বোতল থেকে এক গ্লাস ওয়াইন ছেলে নিলো টম। ডোরিয়ান আগের মতোই ফলের রস খেলো শুধু।

“আপনি ওয়াইন খান না?” অ্যানা খেয়াল করলো ব্যাপারটা।

 “আমি মুসলিম।”

“ইংল্যান্ডে কি অনেক মুসলমান আছে নাকি?”

“উমম… সেটা আসলে এক লম্বা কাহিনি।”

 “তবে অনেক ভালো একটা কাহিনি কিন্তু, টম বললো।

 “তাহলেতো সেটা শুনতেই হয়,” অ্যানা বললো।

অ্যানার আগ্রহ দেখে ডারিয়ান নিজের জীবন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে যতটা সম্ভব বললো ওকে। কিভাবে ও মাত্র এগারো বছর বয়সে আরব দস্যুদের হাতে বন্দী হয়, তারপর কিভাবে ওমানের এক প্রিন্স ওর লাল চুলের জন্যে ওকে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান, কারণ নবী মুহম্মদেরও (স.) নাকি চুল লাল ছিলো। ক্রীতদাস হলেও প্রিন্সের বাড়িতে ও একজন পালিত পুত্রের মতোই বড় হয়। একজন মুসলিম সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে করতে বড় হয়ে শেষমেশ এই বিশ্বাসটাকেই গ্রহণ করে ও।

অ্যানা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ডোরিয়ানের সব কাহিনি শুনলো। ডোরিয়ানের বলা শেষ হলে পরে শান্ত স্বরে বললো, “আপনাদের সবার মাথার জন্যেই দেখি দাম ধরা আছে!”

“তুমি কিভাবে জানো?” টম জানতে চাইলো। সম্বোধন বদলে গিয়েছে ততোক্ষণে।

 “মাদ্রাজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ভালোই জানাশোনা আছে আমার। ওদের কাছ থেকে জেনেছি যে বোম্বের গভর্নরের নাম গাই কোর্টনী। আর একটু খোঁজ খবর করতেই জানতে পারি যে আপনারা আত্মীয়।”

টম আর ডোরিয়ান অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলো।

“গাই আমাদের ভাই,” টম স্বীকার করলো। “তবে ও জানে যে ডোরিয়ান ওমানে মারা গিয়েছে আর আমি আফ্রিকার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছি।”

“ওনাকে জানাননি যে আপনারা বেঁচে আছেন?”

“খবরটা পেলে গাই মোটেও খুশি হতো না। সত্যি কথা হচ্ছে আমরা মারা যাওয়াতেই বরং ও বেশি খুশি।”

অ্যানা নিজের গ্লাসে চুমুক দিলো। যেনো কথাটা খুবই স্বাভাবিক। “থাক, আপনাদের মাঝে কি হয়েছিলো সেটা জানতে চাই না।” অনুচ্চ স্বরে বললো ও।

“মেয়ে সংক্রান্ত ব্যাপার, ডোরিয়ান সরাসরি বলে দিলো।

“আর মেয়েটা হচ্ছে আমার বোন, প্রথমবারের মতো কথা বললো সারাহ। “ডোরিয়ান যেবার দস্যুদের হাতে ধরা পড়ে, সেই জাহাজে আমরাও ছিলাম। আমি তখনও ছোট কিন্তু আমার বড় বোন ক্যারোলিন ছিলো পূর্ণ যুবতী। বোকা মেয়ে; ও আসলে নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে বেড়াতে পছন্দ করতো। বলা যায় একেবার স্বেচ্ছায় ও টমের সাথে শোয়।”

“পাউডার ম্যাগাজিন রাখার জায়গাটায়, তাই না?” শয়তানি হাসি হেসে বললো ডোরিয়ান। “জাহাজে শুধুমাত্র ওখানেই একটু নিরিবিলি ছিলো।”

“ভুলটা আসলে ছিলো আমার,” টম বললো। অ্যানার সামনে এরকম একটা ঘটনা ফাস হয়ে যাওয়ায় বিব্রত। “আমার আসলে বোঝা উচিত ছিলো যে গাই ওকে ভালোবাসে।”

“গাই মোটেও ক্যারোলিনকে ভালোবাসতো না,” সারাহ বললো। “গাই ওকে শুধু নিজের কর্তৃত্বে রাখতে চাইতো। ঠিক যেভাবে মানুষ নিজের গাড়ি ঘোড়া বা এক ব্যাগ স্বর্ণকে অধিকারে রাখে। বিয়ে করার পর থেকেই গাই আর ক্যারোলিনকে কোন দাম দিতো না। তুমি ভুলে গিয়েছে যে ওদের বিয়ের পর আমি অনেকদিন ওদের বাসায় থেকেছি। গাই ওর সাথে কেমন ব্যবহার করে সেটা আমার নিজের চোখে দেখা।” বলতে বলতে চোখ বন্ধ করে ফেললো সারাহ। “ও মোটেও ক্যারোলিনকে ভালোবাসতো না, খোদা সাক্ষী।”

 “আর উনিতো ক্যারোলিনকে বিয়ে করেই ফেলেছেন, তবুও আপনার সাথে ঝামেলা মেটেনি?” অ্যানা টমকে জিজ্ঞেস করলো।

“আসলে আরো কিছু ব্যাপার ছিলো। মানে…” টম আর বলতে পারলো না। কিছু কিছু ব্যাপার আসলে অ্যানার সাথে আলাপ করা সম্ভব না।

কি করেছি আমি? নিজেকে জিজ্ঞেস করলো টম। এক ভাইকে খুন করেছি, আর একজনও আমার মরণ চায়। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দুটো ভুল, আর সেগুলো শোধরানোরও আর কোনো উপায় নেই।

আবার ওর আগের রাতে দেখে সবুজ ঝলকটার কথা মনে হলো। খোদা আমাকে জ্ঞান দাও।

অ্যানা বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। “প্রতিটা পরিবারেই কিছু গোপনীয় ব্যাপার থাকে।”

“তবে তুমি কিন্তু খুবই সাহসী,” অ্যানাকে বললো সারাহ। প্রসঙ্গ পাল্টে পরিবেশ হালকা করতে চাচ্ছে। এই দুজন দাগী আসামীর সাথে বসে খাবার খাচ্ছো!”

“আপনারা আমার জীবন বাঁচিয়েছেন, আপনারা সবাই!” টেবিলের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো অ্যানা। “আপনাদের কিন্তু কোনো দরকার ছিলো না। আপনারা চাইলেই আমাদেরকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারতেন। একশো জনে নিরানব্বই জন লোকই সেই কাজটাই করতো।”

“কারণ একশো জনের মধ্যে নিরানব্বই জনেরই সারাহ বা ইয়াসমিনির মতো কেউ নেই যারা তাদেরকে বলে দেবে যে কোন কাজটা অবশ্যই করতে হবে,” হেসে বললো ডোরিয়ান। “আমরা কিন্তু যেতে চাইনি!”

আলাপ চলতে থাকলো। রাতের খাবারের পরে সবাই বসার ঘরে গিয়ে বসলো। সারাহ সবাইকে উইলিয়াম বাবেল-এর বুক অফ লেডিজ এন্টারটেইনমেন্ট-এর একটা অংশ হার্প-এ বাজিয়ে শোনালো। টম সেই ইংল্যান্ড থেকে এটা অর্ডার দিয়ে আনিয়েছে।

“আমার আগের হাপটা টম নদীতে ফেলে দিয়েছে, বাজানোর ফাঁকে অ্যানাকে জানালো সারাহ।

“পুরো কথাটা তো বলল না। আমাদের জাহাজ যে একটা চরে আটকা পড়েছিলো সেটা তো বললে না! একদল আরব যে আমাদেরকে খুন করার জন্যে পিছু নিয়েছিলো সেটা মনে নেই? মরতে মরতে বেঁচেছিলাম সেবার, ডোরিয়ান বললো। মেঝেতে একটা কুশন পেতে বসে আছে ও।

“আমি নিশ্চিত মিস দুয়ার্তে ঠিকই বুঝেছেন যে পরিস্থিতি এরকম কিছু একটাই ছিলো,” ইয়াসমিনি বললো।

সারাহ আরো কিছুক্ষণ বাজিয়ে একটা ঝঙ্কার তুলে বাজানো থামালো। হাত তালি দিয়ে উঠলো বাকিরা। সারাহ গিয়ে টমের পাশে বসলো।

“মিস দুয়ার্তে,” টম বলা শুরু করলো। “কাল যখন দেখে হয়েছিলো তখন বলেছিলে যে আমাদের জন্যে নাকি কি একটা প্রস্তাব আছে?”

অ্যানা হাত দিয়ে ডলে নিজের কাপড় সোজা করলো। এই ঘরের বাকিদের চাইতে ও কমপক্ষে বারো বছরের ছোট। কিন্তু ওর শান্ত শিষ্ট ভাব দেখে সেটা মনে হয় না।

“ভারত সম্পর্কে কি জানেন?” টমকে জিজ্ঞেস করলো অ্যানা।

টম হাতের ওয়াইনের গ্লাসটা নাড়লো কিছুক্ষণ। তলানির দিকে তাকিয়ে আছে। “বেশি কিছু না। নাবিকদের কাছে যা শুনেছি তাই। বুড়ো সম্রাট মারা যাওয়ার পর থেকে নাকি দেশটার অবস্থা বেশি সুবিধার না।”

“বৃদ্ধ আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর থেকে দেশটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে আছে,” অ্যানা-ও সায় দিলো কথাটায়। তার তিন পুত্র উত্তরাধিকার নিয়ে লড়াই করেই যাচ্ছে। আর যখনই ওরা যুদ্ধ শুরু করে, তখন দেখা যায় অন্যান্য জমিদার বা নবাবেরাও প্রতিবেশীকে আক্রমণ করে বসে। পশ্চিম দিকে মারাঠারা নিজেদের পাহাড়ের দুর্গ থেকে প্রায় তিরিশ বছর ধরে মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। মালাবার উপকূলে দস্যু আংরিয়া নিজের একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। টিরাকোলার দুর্ভেদ্য এক দুর্গ থেকে ও রাজ্য চালনা করে। দক্ষিণের সব নবাবেরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বলা যায় মুঘল সাম্রাজ্য একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।”

“ব্যবসার জন্যে খারাপ,” ডোরিয়ান মন্তব্য করলো।

 টম কিছু বললো না তবে অ্যানা ইতস্তত করতে লাগলো। যেনো এরপরে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

 “প্রস্তাবটা দেওয়ার আগে মনে হয় আমার আসলে নিজের আর আমার পরিবার সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া উচিত। আমার বাবা ছিলেন এক পর্তুগীজ ব্যবসায়ী। উনি ভারতে গোয়াতেই বসত গাড়েন। আমার মা ছিলেন ভারতীয়। স্থানীয় মানসবদারের মেয়ে। দুই পরিবারের কেউই বিয়েটা মেনে নেননি, তাই তারা মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ দুর্গে পালিয়ে যান। ওটা ছিলো ব্রিটিশদের অধীনে। কপর্দকহীন অবস্থায় শুরু করলেও কঠোর পরিশ্রমের জোরে ধীরে ধীরে তারা কাপড়ের ব্যবসায় প্রচুর উন্নতি করেন। মাদ্রাজের তাঁতিদের কাছে থেকে সুতি কাপড় কিনতেন তারা, তারপর সেগুলো ইউরোপে রপ্তানি করতেন। প্রথম প্রথম অবশ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে-ই বিক্রি করতেন, কিন্তু কোম্পানি বরাবরই প্রচণ্ড লোভী; ওরা আমাদেরকে দামে কম দিতো। বাবা তাই বিকল্প রাস্তা খুঁজে বের করেন। উনি এক ড্যানিশ জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের মালগুলো বয়ে নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করেন।

 “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্ট গাই কোর্টনীর কানে পৌঁছে যায় ব্যাপারটা। যেসব ব্যবসায়ীরা কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তাদেরকে ওরা কি বলে জানেন? ইন্টারলোপার।” থুতু ছিটানোর মতো করে কথাটা বললো অ্যানা। “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন মনে করে যে এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আসলে ওদের সাজানো বাগানে ঢুকে পড়া সাপ বাদে আর কিছু না। তাই প্রেসিডেন্ট জলদস্যুদের জানিয়ে দেন যে আমাদের জাহাজ কোথা থেকে ছাড়বে। কেপ কর্মোরিনের কাছে ওরা আমাদেরকে আক্রমণ করে বসে। একটা লোকও বেঁচে ফিরতে পারেনি।

“আমার বাবা তার সব পুঁজি ঐ অভিযানটায় খাঁটিয়েছিলেন। এতো বড় ঝুঁকি জানার পরেও। যদি ব্যাপারটা কোনো দুর্ঘটনা হতো তাহলে বাবা এই ধাক্কা সামলাতে পারতেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কোর্টনী শুধু ঐটুকু করেই ক্ষান্ত দেননি। উনি আমাদেরকে ওনার বাড়িতে ডেকে নিয়ে মুখের সামনে ঘোষণা দিয়ে জানান যে উনি কি কি করেছেন। এটা নাকি আমাদের আর বাকিদের প্রতি একটা সতর্কবার্তা। আমাদের কিছুই করার ছিলো না, ন্যায় বিচার পাবো সেই আশাও ছিলো না। প্রেসিডেন্টই ওখানে আইন।

 “বাবা এর কয়েক মাস পরেই মারা যান। প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েছিলেন উনি।” বলতে বলতে কেঁপে গেলো অ্যানার কণ্ঠ। সারাহ ওর কাধ চেপে ধরলো। “এরপর থেকে আমিই ব্যবসা দেখাশোনা করি। সেজন্যেই ডাওজারে উঠেছিলাম। ক্যাপ্টেন আমার মালগুলো বহনের জন্যে অনেক বেশি ভাড়া হেকেছিলেন। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম যে একটা ইন্ডিয়াম্যান-এ চাপলে যাত্রাটা নিরাপদ হবে।”

“এই দস্যুদেরকেও কি তোমার কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো নাকি?”

“না, ওটা ছিলো দুর্ভাগ্য।”

অ্যানা নিজের হাতের আঙুলগুলো একটা আর একটার ভিতরে ভরলো। “আমার কথা হচ্ছে, আমিও আপনাদের মতোই ব্যবসায়ী। আমি আমার মালগুলো সবচে কম খরচে বাজারে আনতে চাই, যাতে সবচেয়ে ভালো দামে বেচতে পারি। মাদ্রাজ থেকে কেপ টাউনে নিরাপদে মাল আনতে গেলে ব্রিটিশদের চাঁদা দেওয়া লাগে, ডাচদের চাঁদা দেওয়া লাগে, দস্যুদের চাঁদা দেওয়া লাগে, মুঘল সম্রাটদের চাঁদা দেওয়া লাগে। এরপরও জাহাজটা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাবে সেই নিশ্চয়তা নেই। কামান দাগার জন্যে আমাকেই লোক রাখতে হয়, আবার সুরক্ষা তহবিলেও চাঁদা দিতে হয়… এতো খরচের পরে আর সেটা আর সম্ভব হয় না।”

“তুমি চাও আমি তোমার মাল বহন করি?”

“এটা শুধু আমার জন্যে না। ভারত মহাসাগর দস্যুতে গিজগিজ করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলো, মানে শুধু ইংলিশ আর ডাচদের জাহাজের ক্ষমতা আছে ওদেরকে আটকানোর। কিন্তু এর জন্যে কোম্পানিগুলো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা টাকা নেয়। তবে কথা হচ্ছে, লন্ডনে, আমস্টারডামে বা অস্টেন্ডে বা এরকম আরো ডজনখানেক শহরে আরো অনেক সওদাগর, দালাল আর ব্যবসায়ী আছে যারা আরো সহজ শর্তে এসব ব্যবসায়ে অর্থ লগ্নি করতে রাজি, শুধু যদি তারা এই জাহাজের নিরাপত্তার ব্যপারে নিশ্চয়তা পেতো তাহলেই হয়।

“ইংল্যান্ড থেকে ভারত পর্যন্ত সরাসরি মাল পরিবহনের ব্যবসাটায় আসলে একচেটিয়া রাজত্ব চলছে। ভারতীয় মহাসাগরের বন্দরগুলোয় ব্যবসা পুরোপুরি উন্মুক্ত। যাত্রাটাকে যদি তাই দুই ভাগে ভাগ করা যায়, মানে মালগুলোকে যদি কেপ টাউনে একবার খালাস করা যায়, তাহলে আর এই একচেটিয়া কারবারটা থাকে না। এভাবেই আমি ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ডকে আমার মাল নিতে রাজি করিয়েছিলাম। আপনি যদি ভারত সাগরের এই ঝুঁকিটা নিতে রাজি হন, তাহলে ইউরোপের ব্যবসায়ীরা আপনাকে ভালো পরিমাণ টাকা দেবে। আবার ভারতের ব্যবসায়ীরাও আপনার কাছে ভালো জিনিস বিক্রি করবে, কারণ আপনি কোম্পানির চাইতে বেশি টাকা দেবেন। কিন্তু এরপরেও লাভ ভালোই থাকবে।”

“VOC, মানে দ্য ডাচ ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানি কেপ টাউনের সমস্ত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।”

“আর ওদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজদের ব্যবসাকে দুর্বল করে এরকম যে কোনো উদ্যোগকে ওরা স্বাগতম জানাবে।”

“আমাদেরকে কিন্তু দস্যুদের মোকাবেলা করতে হবে,” টম বললো।

“আপনারা দস্যুদের সাথে কিভাবে লড়েন সেটা আমি দেখেছি। আর শুধু ভারত কেন?” অ্যানা ডোরিয়ানের দিকে ফিরলো। “আপনার পালক বাবা না ওমানের খলিফা বললেন? লামু, মাস্কাট, মোকা বা গন এর মতো আরব বন্দরেও নিশ্চয়ই এরকম অনেক লোক আছে যারা আপনাকে বিশ্বাস করে। আপনি ওদের ভাষাতেই কথা বলেন, ওদের ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করেন।”

“আগের খলিফা ছিলেন আমার পালব বাবা। বর্তমান খলিফা আমার পালক ভাই। তবে সে আমাকে ঠিক ততোটা ঘৃণা করে, যতোটা ঘৃণা গাই টমকে করে। নিজের লাল দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো ডোরিয়ান। “তবে… পরিচিত অনেকেই আছে এখনো।”

“যদি শুধু ঠিকঠাক একবার কাজটা করা যায়, তাহলে পুরো সাগর বাণিজ্যের মালিক হয়ে যাবেন আপনারা।”

প্রস্তাবটা নিয়ে সবাই ভাবনা চিন্তা করত লাগলো।

“আমরা ভেবে দেখবো,” টম বললো। “আমি কাল তোমাকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানবো।”

*

ডোরিয়ান অ্যানাকে ওর থাকার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলো। বোর্ডিং হাউজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদেরকে চলে যেতে দেখলো টম। খাওয়া শেষে ও একেবারে গলা পর্যন্ত পান করেছে, তবে মাথা এখনো পরিষ্কার। ভালোভাবে চিন্তা করার জন্যে শুধু এখন একটু খোলা হাওয়া দরকার।

“আমি একটু বাগানে হাঁটতে যাচ্ছি,” সারাহকে বললো টম।

 “তরবারি নিয়ে যাও। নইলে সিংহ ধরে খাবে?”

“লাগবে না,” জবাব দিলো টম। “আমি দাঁত দিয়েই সিংহ মারতে পারি, জানো না?”

 বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো টম। ভাবনায় মগ্ন থাকায় রাস্তার উল্টো দিকের কটেজটার ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অবয়বটাকে খেয়াল করলো না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে শুরু করলো ও। আপনমনে স্প্যানিশ লেডি’ গানটার শিষ বাজাচ্ছে। অল্প পরেই voC-র কাছের গেটটায় পৌঁছে গেলো। গেটটা নানান কারুকার্যে সজ্জিত। বাগানের বাকি তিনদিকে কোনো দেয়াল নেই। তবে বন্য প্রাণীর আনাগোনা থেকে বাঁচতে পরিখা কাটা। ওদিক দিয়েই ডেভিল’স পিক-এর একটা ঢাল এসে মিলেছে। সারাহের সিংহের ব্যাপারে সতর্কবার্তাটা আসলে পুরোপুরি কৌতুক না।

 VOC বাগানটা বানিয়েছে কেপ টাউনের স্থানীয়দের বিনোদনের জন্যে। প্রথম যখন ওরা এখানে ঘাটি গাড়ে তখন বাগানটার পিছনে প্রচুর খরচ করেছে, কিন্তু এখন আর এটার বিশেষ যত্ন নেয় না। টম যত ভিতরে যেতে লাগলো ততোই দেখলো বাগানের বেহাল দশা বেড়েই চলেছে। বিশাল বিশাল মাচাগুলো আগাছা দিয়ে ভরা। ওগুলোর জন্যে চাঁদের আলোও বাগানে প্রবেশ করতে পারে না। কয়েকটা মাচা ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে। পুকুরগুলো ময়লা জমে জমে ডোবায় পরিণত হয়েছে। এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কয়েকটা মাত্র ফুলের গাছ টিকে আছে।

টম অবশ্য এসব কিছু খেয়াল করলো না। অ্যানার প্রস্তাবটা নিয়ে ওর মনের মধ্যে ঝড় চলছে। বিশ বছর আগে হলে ও এতো ভাবতো না, ঘরে বসেই রাজি হয়ে যেতো। কিন্তু এখন বয়স বেড়েছে, এখন ও জানে যে কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে কিছুক্ষণ থেমে নিলে ভালো হয়।

আবার মনে হচ্ছে কেননা প্রস্তাবটা নেবে না? কোর্টনীরা সবসময়েই এরকম অস্থির একটা পরিবার; ওদের স্বভাব-ই হচ্ছে নতুন নতুন দেশ, নতুন নতুন অভিযানে নেমে পড়া। আমরা বহুদিন ধরে একই জায়গায় লাঙ্গল ঠেলে চলেছি। মনে মনে ভাবলো টম। এই সুযোগটাই তো আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। এখন কেনো নেবো না?

সামনেই রাতের আধারে ও হায়েনার হাসি শুনতে পেলো। কলোনির ভাগাড়ে মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছে বোধহয়।

 গাই এর জন্যে, ওর মনের সতর্ক অংশটা উত্তরটা দিলো। কারণ যদি তুমি এটা করো, তুমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লেজে পাড়া দেবে, আর একসময় না একসময় গাই এর কানে ব্যাপারটা পৌঁছাবেই। শেষ যে দুবার তোমাদের দেখা হয়েছিলো, দুবারই ও তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো। তার মানে আর একবার যদি দেখা হয়, তাহলে দুজনের একজন অবশ্যই মারা পড়বে।

পিছনের রাস্তায় নুড়ি মাড়ানোর শব্দ হলো। টম ঘুরে গেলো সেদিকে। ওর পিছনে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। মাচার ছায়ার কারণে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না, তবে তার ফাঁক দিয়ে যে আলো আসছে তা দিয়ে হাতের খোলা তরবারিটা দেখতে কোনো কষ্ট হলো না। টম নিরস্ত্র।

“আপনি কি টম কোর্টনী,” ইংরেজ টানে জিজ্ঞেস করলো একজন।

“হ্যাঁ, আমিই সে।” লোকটা কথা বলতে শুরু করায় কিছুটা স্বস্তি পেলো টম। তারপর এক পা সামনে বাড়লো কিন্তু লোকটা তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর।

*

কেপ টাউন বন্দরে দ্য প্রফেট যেদিন এসে ভিড়লো, তার পরের দিনই ফ্রান্সিস কোর্টনী একটা ডিঙ্গি নৌকায় করে ডাঙ্গায় চলে এলো। এর আগেই ও জাহাজের কিনারে দাঁড়িয়ে উপসাগরকে বেষ্টন করে রাখা পর্বত চূড়া, সমুদ্রের ঢেউ, আর এই বিশাল মহাদেশটার একদম পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘরগুলো ভালো মতো দেখে নিয়েছে। ছোট বেলায় ওর অভ্যাস ছিলো লাইব্রেরিতে থাকা বিভিন্ন ম্যাপ বের করে বিভিন্ন এলাকার অদ্ভুত সব নাম খুঁজে খুঁজে বের করা। স্কুলের খাতায় ও প্রায়ই নিজের কল্পনা থেকে সব মানচিত্র আঁকতো আর সেসব জায়গা আবিষ্কারের অভিযানে বেরিয়ে পড়তো। আর এতোদিন পর অবশেষে বাস্তবেই ও সেই কাজে বের হয়ে পড়েছে।

প্রথমে বন্দরের মাস্টারের অফিসে গিয়ে ওর আগমন রেজিস্টার করে নিলো।

“নাম? “ কলম থেকে কালি ঝরাতে ঝরাতে জিজ্ঞেস করলো কেরানি।

ফ্রান্সিস কোটের পকেট থেকে একগাদা ভুয়া কাগজপত্র বের করলো। চিল্ডস ওকে এগুলো দিয়েছেন। “আমার নাম ফ্রাংক লেইটন।”

ওখান থেকে বেরিয়ে ও সৈকত ধরে হেঁটে দুর্গে গিয়ে পৌঁছালো। শহর থেকে মাস্কেটের গুলি ছুড়লে যতোদূর যাবে, দুৰ্গটা ততোদূর অবস্থিত। এই বন্দর আর এর আশেপাশের এলাকাটা নিয়ন্ত্রিত হয় এখান থেকে। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ এটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছে যে ওর দাদার দাদা এই গরমে এখানে কাজ করছে। হাই উইন্ডে বড় হওয়ায় ফ্রান্সিসের চারপাশেই ওর পূর্বপুরুষদের নানান স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। ওদের গির্জার সমাধিকক্ষে অনেকের আবক্ষ মূর্তি আছে। তাদের পাওয়া নানা পদক বা ভূষণগুলোও কাঁচের বক্সে রাখা ছিলো, দেয়াল জুড়ে ছিলো পোর্ট্রেট। একে একে সেসব পোর্ট্রেট গায়েব হয়ে যায়। ওর মনে আছে প্রথমবার যখন ও ওদের লম্বা গ্যালারিতে একটা জায়গায় ফাঁকা দেখেছিলো তখন কেমন লেগেছিলো। স্যার ওয়াল্টারের দেনা শোধ করতে প্রতিবার যখন একটা করে ছবি বিক্রি হয়ে যেতো তখনকার কষ্ট ফ্রান্সিস বলে বোঝাতে পারবে না।

কিন্তু আজ ও এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। এখানে দাঁড়ানো অবস্থায় ওর দাদার দাদার একটা ছবি ফ্রান্সিস দেখেছিলো। ওনার চেহারা ছিলো কঠোর, ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা কেশরের মতো কালো চুল। ওর মায়ের কাছে। শুনেছে ওর দাদা হাল-এরও নাকি ওরকম চুল ছিলো। ও মনে মনে কল্পনা করলো ওনারা বেঁচে থাকলে আজ কেমন হতেন। ক্যানভাসের রঙ তুলির না, রক্ত মাংসের জ্যান্ত মানুষ হিসেবে তারা কেমন হতেন।

ওর কেমন অদ্ভুত লাগতে লাগলো। যেনো চারপাশে নিজের পুরুষদের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে। গ্যালারির সবগুলো ছবি যেনো জ্যান্ত হয়ে, ছবির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে ওর পাশে এসে জড়ো হয়েছে। আর কোর্টনী নামটার সব ওজন আর তাদের প্রত্যাশার পুরো চাপটা ওর কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে।

ও যদি টম চাচাকে খুন করে, তাহলে কি ও ঐ খুনীটার চাইতে আলাদা কিছু হতে পারবে?

“আমার বাবার খুনের বদলা এটা,” নিজেকে প্রবোধ দিলো ফ্রান্সিস। স্যার নিকোলাসের প্রতিশ্রুতিমতো পাঁচ হাজার পাউন্ডের পুরস্কারের কথাটা মাথা থেকে জোর করে সরিয়ে দিলো। সামান্য টাকা পয়সার জন্যে এরকম একটা ঘৃণ্য কাজ করতে বাধছে ওর।

 ফ্রান্সিস টের পেলো দুর্গের দরজায় দাঁড়ানো প্রহরী ওর দিকে আগ্রহ নিয়ে খেয়াল করছে। ও ঘুরে দ্রুত পানির কাছে চলে এলো আবার। তারপর একটা সরাইতে ঢুকে পানীয়ের অর্ডার দিলো। এই সাত সকালে পুরো সরাই খালি, কিন্তু ওর কিছু পান করা দরকার।

বিয়ারটার রঙ টকটকে লাল। পানি ছাড়া, একদম কড়া। ফ্রান্সিস এক চুমুক দিতেই মনে পড়লো প্রায় দিনই সকালে ও ঘুম ভেঙ্গে নিচে এসেই দেখতো ওর সৎ বাবা অর্ধেক বোতল শেষ করে ফেলেছেন।

একজন মহিলা এসে ওর পাশের টুলে বসলো। মহিলার ঠোঁট লাল, মুখে পুরু পাউডার দিয়ে চেহারার বলিরেখাগুলো ঢেকে রেখেছে।

“ফুর্তি টুর্তি কিছু করার চিন্তা করছো নাকি?” নিজের ব্লাউজের ফিতে নিয়ে খেলতে খেলতে বললো মেয়েটা। “যা চাও তা-ই পাবে আমার কাছে।”

মেয়েটা কি প্রস্তাব করছে সেটা বুঝতে পেরে ফ্রান্সিস লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত কথা-ই বলতে পারলো না। ওর পুরো জীবনটাই কেটেছে হাই উইন্ডে। বাইরে গিয়েছে খুব কম, ফলে এরকম কোনো মহিলার সাথে কখনোই দেখা হয়নি আগে। এমনি অন্যান্য ছেলেদের কাছে এদের ব্যাপারে ফিসফিসানি শুনেছে, এর বেশি কিছু না।

“আমি টমাস কোর্টনীকে খুঁজছি,” কোনোমতে বললো ও। মেয়েটার দৃষ্টিতেই ফুটে উঠলো যে ও টমকে চেনে। তা দেখে ফ্রান্সিস আবার বললো, “আপনি চেনেন ওনাকে?”

ফ্রান্সিস টেবিলে একটা রূপার মুদ্রা রাখলো। মেয়েটা সাথে সাথে তুলে নিলো সেটা। তারপর নিজের কাপড়ে একবার মুছে কাচুলির ভিতর থেকে ছোট একটা ব্যাগ বের করে তার ভিতর রেখে দিলো।

ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো, “তারপর?”

“একটা ড্রিঙ্ক কিনে দেবে না?” ছলনাময়ী কণ্ঠে বললো মেয়েটা। “একজন ভদ্রলোক সবসময়েই একজন ভদ্রমহিলাকে ড্রিঙ্ক কিনে দেয়।”

 ফ্রান্সিস আবার লজ্জায় লাল হয়ে বারমেইডকে ডাকলো। লোকটা চুপচাপই আর এক গ্লাস বিয়ার নিয়ে এলো কিন্তু গ্লাসটা রাখার সময় ফ্রান্সিসের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকালো।

“প্রথমবার নাকি?” নিজের বিয়ারে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো বেশ্যাটা। “তোমার মতো একজন তাগড়া জোয়ান? বিশ্বাস হয় না।”

“আমি টমাস কোর্টনীকে খুঁজছি,” ফ্রান্সিস আবার বললো।

“আমি তোমার জন্যে যা করতে পারবো, সে কিন্তু সেসব পারবে না।” বলে মহিলাটা টেবিলের নিচে পা দিয়ে ফ্রান্সিসের পা ঘষতে শুরু করলো। ফ্রান্সিস ত্রস্ত ভঙ্গিতে সেটা সরিয়ে নিলো।

ফ্রান্সিসের অস্বস্তি দেখে খুব আমোদ পেলো মহিলা। “ব্যাগে এরকম আর রুপার মুদ্রা আছে নাকি? ওরকম আর একটা দিলে শুধু বলবো না, তোমাকে একেবারে দেখিয়ে দেবো টম কে?”।

ফ্রান্সিস বুঝলো যে একে আগেভাগেই টাকা দেওয়াটা বোকামি হয়েছে। ও আর একটা মুদ্রা বের করলো কিন্তু সেটাকে এগিয়ে না দিয়ে নিজের আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রাখলো।

“এটা আপনি পাবেন, কিন্তু আগে আমাকে নিয়ে যেতে হবে।”

মহিলাকে হতাশ দেখালো। “বেশ দ্রুত সব শিখে নাও দেখছি। সাথে আর একটা মুদ্রা দিলে আমি এমন জিনিস শিখিয়ে দিতে পারি যা জীবনেও ভুলবে না।”

“আমাকে ওনার কাছে নিয়ে যান,” ফ্রান্সিস প্রসঙ্গ পাল্টালো।

“যেতে হবে না, আমি এখান থেকেই ওনাকে দেখতে পাচ্ছি।”

বলে মহিলা সরাইয়ের জানালা দিয়ে ইশারা করলো। জানালাটা বাতির কালি আর সমুদ্রের লবণে ভরে আছে। পেছনে বন্দরের সম্মুখভাগটা আর ওটার কাঠের জেটিটা দেখা যাচ্ছে। প্রফেটের নৌকাগুলো ওটার পাশেই বাধা, একদল কৃষ্ণাঙ্গ কুলি ওগুলো থেকে মাল নামাচ্ছে। এই হট্টগোলের মাঝে তিনজন লোককে দেখা গেলো দাঁড়িয়ে আলাপ করছে আর একগাদা মাল পরীক্ষা করে দেখছে। ফ্রান্সিস দুজনকে চিনতে পারলো, একজন প্রফেটের ক্যাপ্টেন আর একজন জাহাজঘাটার কেরানী। তৃতীয় লোকটা সবচেয়ে লম্বা, কমপক্ষে ছয় ফুটের উপরে লম্বা, কাঁধ ওনার পাশের কুলিগুলোর মতোই চওড়া। ঘন কালো চুল নাবিকদের মতো বেণী করে রেখেছেন। হাসিমুখেই কথা বলছিলো লোকটা, কিন্তু ভাবেই বোঝা যাচ্ছিলো যে এই লোক কারো কাছে মাথা নোয়ায় না।

“লম্বা লোকটাই হচ্ছে টম কোর্টনী,” মেয়েটা বললো। কণ্ঠে প্রশংসার ছোঁয়া।

ফ্রান্সিসের মনে হতে লাগলো যেনো ওর রক্ত জমে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে টম কোর্টনী ওর জন্যে ছিলো রূপকথার এক দৈত্যের মতো, যে কিনা বার বার ওর দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দিতো। আর এখন সে ওর থেকে মাত্র কয়েক গজ সামনে দাঁড়িয়ে আছে, অন্য লোকদের সাথে হাসাহাসি করছে। ওর জন্য কি করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই।

বেশ্যা মহিলাটা ফ্রান্সিসের চেহারার অভিব্যক্তি পড়তে পারলো।

“তুমি ওনাকে ঘৃণা করো,” মজা পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বললো মহিলা।

 “তুমি ওনাকে খুন করতে চাও, তাই না?” আবার বললো সে। ফ্রান্সিস প্রতিবাদের চেষ্টা করতেই বললো, “তর্ক করে লাভ নেই। তোমার চোখে যে দৃষ্টি দেখলাম সেটা আমি আগেও অনেকবার দেখেছি। অবশ্য বেশিরভাগ সময়েই লোকগুলো ছিলো পাড় মাতাল।”

 ফ্রান্সিস টমের উপর থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলো না। “যদি চাই তো কি সমস্যা?”

“টম কোর্টনী কিন্তু কোনো ফালতু মাতাল নাবিক না। এখানকার সবচেয়ে বিপজ্জনক লোক সে। তার সম্পর্কে নানান গল্প শোনা যায়,..” বলতে বলতে মাথা নাড়লো মহিলা।

ফ্রান্সিসের সৎ বাবা ওর জন্যে খুব বেশি কিছু করেননি কিন্তু ফ্রান্সিস যেনো তরবারি দিয়ে আর খালি হাতে লড়াইটা ভালোমতো শেখে, সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছিলেন। একাধিকবার স্যার ওয়াল্টারের দেনার কারণে ফ্রান্সিসকে ভোর বেলায় ওনার পক্ষে ডুয়েলে নামতে হয়েছে। তাই ফ্রান্সিস ভালোভাবেই জানে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করতে হয়। স্যার ওয়াল্টার ছিলেন একেবারে জাঁদরেল প্রশিক্ষক। ফ্রান্সিসের মুঠি দিয়ে রক্ত বের হওয়ার আগ পর্যন্ত উনি ওকে এক বিন্দু ছাড় দিতেন না। অনেক সময় এমন হতো যে ব্যথায় ও তরবারিটাও মুঠি করে ধরতে পারতো না।

একদিন এটাই তোমার জীবন বাঁচাবে, উনি প্রায়ই বলতেন কথাটা।

 “আমি নিজেকে রক্ষা করতে জানি,” ফ্রান্সিস মহিলাটাকে আশ্বস্ত করলো।

“সেতো তুমি পারবেই সোনা,” কটাক্ষ হেনে বললো মহিলা। “কিন্তু এই ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কি? তোমার তো তরবারিও নেই। কেপ টাউনে তুমিই টম কোর্টনীর একমাত্র শত্রু না। আমি এরকম অনেককেই চিনি যারা তোমাকে খুশি মনেই সাহায্য করবে।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফ্রান্সিস জানালা থেকে রিয়ে মেয়েটার দিকে আবার তাকালো। “কি বলতে চাচ্ছেন?”

“আর একটা ড্রিঙ্ক কিনে দাও, তাহলে বলছি।”

*

অন্ধকার নেমে আসতেই ফ্রান্সিস পাহাড় বেয়ে উঠে এলো। কোমরে গোজা তরবারিটা উরুতে বাড়ি খাচ্ছে। হাতটা ধরে ওটাকে সোজা রাখতে হচ্ছে। তরবারিটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে স্বস্তি পাচ্ছে ফ্রান্সিস। টম কোর্টনীকে কিভাবে খুন করবে সেটাও ঠিক করে রেখেছে; মাস্কেট বা পিস্তলের গুলিতে অজ্ঞাত ভাবে ও খুন করবে না। একেবারে হৃৎপিণ্ডে তরবারি গেঁথে কাজটা সারবে ও। ঠিক যেভাবে টম উইলিয়ামকে মেরেছে।

 ফ্রান্সিস নার্ভাস ভঙ্গিতে ওর চারপাশের লোকজনের দিকে তাকালো একবার। অন্ধকারের পটভূমিতে অশরীরী কালো একেকটা অবয়বের মতো লাগছে সবাইকে। অবশ্য চাঁদের আলোয় চামড়া চকচক করে উঠছে। সবার হাতে লম্বা, সোজা ফলার ছুরি। হাতলে আঙুল ভরে ঘোরাচ্ছে।

ফ্রান্সিসের পিছনে আসছে জ্যাকব দ্য ড্রিস। লম্বা পা ফেলে ও পাহাড় বেয়ে উঠছে আর রাস্তার দুধারের ঝোঁপ জঙ্গল তরবারির আঘাতে কেটে দিচ্ছে। ছুরিগুলোর ফলা খুবই ভারি, অনেকটা তরবারির মতো। এগুলো বানানো হয়েছিলো বার্বাডোজের আখের ক্ষেতে ব্যবহারের জন্যে। কোনো এক ব্যবসায়ী হয়তো সেগুলো কেপ টাউনে নিয়ে এসেছে। জ্যাকব এখন সেটার নতুন একটা ব্যবহার খুঁজে পেয়েছে।

পিছন থেকে জ্যাকব-ও ফ্রান্সিসকে জরিপ করলো। একদম নবীশ এই ইংরেজ ছেলেটাকে নিয়ে বেশ কৌতূহল অনুভব করছে ও। যখন বেশ্যা মহিলাটা ওদের পরিচয় করিয়ে দেয় তখন ও ভেবেছিলো যে এটা হয়তো একটা ফাঁদ। ছেলেটা একেবারে তালপাতার সেপাই, সদ্য গজানো দাড়ি এখনো পুরো গাল জুড়ে ছড়ায়নি। দেখা মনে হয় কড়া কোনো পানীয় পেটে পড়লেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। তবে জ্যাকব ছেলেটাকে তরবারির ব্যবস্থা করে দেওয়ার আগে পরখ করে দেখেছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ছেলেটা খুবই ভালো একজন অসিযোদ্ধা। দ্রুত নাড়াচাড়া করতে পারে, সবসময় সতর্ক, আর মাত্র কয়েকটা প্যাঁচ কষেই জ্যাকবের মতো দক্ষ লোককেও অবাক করে দিয়েছে। আর টম কোর্টনীর কথা উঠলেই ছেলেটার চোখে যে আগুন দেখা যায়, সেটা ভুয়া হতে পারে না।

 জ্যাকব নিজেও এই অনুভূতিটার সাথে পরিচিত। দুই বছর আগে ও। মোজাম্বিক থেকে জাহাজে করে একদল দাস নিয়ে আসছিলো। আসার পথে ওর জাহাজ চরে আটকে পড়ে। টম কোর্টনী ওদেরকে উদ্ধার করে, কিন্তু বিনিময়ে ও জোর করে সব বন্দীকে মুক্ত করে দেয়। জ্যাকবের সব টাকা জলে যায়। বিশেষ করে একটা সুন্দরি দাসীকে ওর খুব মনে ধরেছিলো। নিজের জন্যেই রাখতে চেয়েছিলো মেয়েটাকে। কিন্তু ওই কুত্তী সারাহ কোর্টনী মেয়েটাকে নিজের কাছে নিয়ে পড়াশোনা আর আচার ব্যবহার শিখিয়ে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেয়, যাতে সে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে।

মেয়েটার কথা মনে হতেই জ্যাকবের শরীরে উত্তেজনার ঢেউ খেলে গেলো। মেয়েটাকে যখন ধরে আনা হয়ে তখন সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছিলো। উদ্ধত স্তন, মাথার চুল ওদের গোষ্ঠীর ঐতিহ্য অনুযায়ী বিশেষভাবে কাটা–জ্যাকবের কল্পনার সবটা ছিলো যেনো সে। ও মেয়েটাকে পেলে কি করতো সেকথা বহুবার ভেবেছে। আর টম কোর্টনী সরে গেলে সারাহ কোর্টনীর কি করবে সেটাও ভেবে রেখেছে অসংখ্যবার।

ওরা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলো। ওখানে মাত্র কয়েকটা ঘর, কিন্তু একটা পুরো খালি। মালিক গিয়েছে আমস্টারডামে। কয়েক মাসের ভিতরে আর ফিরবে না। জ্যাকব আর ওর লোকেরা বাগানের দেয়ালের ছায়ায় লুকিয়ে রইলো, উল্টো পাশের বোর্ডিং হাউজের দিকে লক্ষ্য রাখছে। একটু পরেই হার্পের সুরের মূর্ঘনায় ভরে গেলো চারপাশ। বাড়ির ভিতর উজ্জ্বল আলোর বাতি জ্বলছে। জানালা দিয়ে জ্যাকব দেখলো টম, ওর ভাই আর ওদের স্ত্রীরা বসার ঘরে বসে আছে। ভাইয়ের মাথায় একটা পাগড়ি, কাফিরদের (আফ্রিকান উপজাতি) মতো। জ্যাকব ভাবতে লাগলো ও যখন মুন্ডুটা আলাদা করে ফেলবে তখন কি পাগড়িটা জায়গা মতো থাকবে?

ও ফ্রান্সিসের কাঁধে টোকা দিলো। ছেলেটা এতো জোরে লাফ দিয়ে উঠলো যে মনে হলো ভয়ের চোটে কাপড় ভিজিয়ে ফেলবে। ব্যাপারটা মোটেও ভালো না, ভাবলো জ্যাকব।

“এখন আক্রমণ করবো?”

ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো। জ্যাকব ভেবে পেলো না ছেলেটা এখন আবার মত বদলাচ্ছে নাকি। সেরকম কিছু হলে ছুরির এক কোপে ছেলেটাকে শুইয়ে দেবে। জ্যাকব এরকম অনেক জায়গা চেনে যেখানে লাশ ফেলে দিলে কেউ দেখার আগেই শিয়াল কুকুর শকুন এসে খেয়ে সাবাড় করে ফেলবে।

 তবে অপেক্ষা করায় কোনো সমস্যা নেই। কিছুক্ষণ পরেই দরজা খুলে গেলো আর ডোরিয়ান কোর্টনী বেরিয়ে এলো। সাথে এক মহিলা, যাকে জ্যাকব চেনে না। চেহারা দেখে মনে হয় মেয়েটা সংকর জাতের। এখন আপাতত সারাহের সাথে সব কিছু মেটানো যাক, পরে একেও খুঁজে নেওয়া যাবে।

জ্যাকবের নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না। যদিও ও স্বীকার করবে না, কিন্তু এতোগুলো লোক নিয়েও একসাথে দুই কোর্টনী ভাইয়ের সাথে লড়াই করতে ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। কিন্তু এখন একজন একজন করেই লড়া যাবে।

ডোরিয়ান আর মেয়েটা দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো ও। তারপর ফ্রান্সিসের হাত টেনে ধরলো।

“এখন,” হিসিয়ে উঠলো ও।

কিন্তু নড়ার আগেই পুরো রাস্তাটা আলোয় ভরে গেলো। টম বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। জ্যাকব দ্রুত মাথা নিচু করে ফেললো, কিন্তু টম নিজের চিন্তায় এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে খেয়াল করলো না ব্যাপারটা। জ্যাকব আর একবার ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে দেখলো যে টম কোম্পানির বাগানের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সাথে কোনো অস্ত্র নেই।

জ্যাকব খুশিতে শব্দ করে উঠে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। তুই কে জানি না ভাই, মনে মনে ভাবলো ও। কিন্তু একেবারে শয়তানের ভাগ্য নিয়ে এসেছিস।

“এটাই উনি না?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, চোখের মণি বড় বড় হয়ে গিয়েছে। জ্যাকব ভেবে পেলো না এর কি আসলেই টমের সাথে লড়ার সাহস আছে কিনা। যাক ব্যাপার না। তরবারি যার হাতেই থাক, টম কোর্টনী আজ রাতে মারা পড়বেই।

ওরা নিরাপদ দূরত্ব রেখে টমকে অনুসরণ করে চললো। ভাগ্য আবারও ওদের সহায়তা করলো। দেখা গেলো টম বাগানের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে ওদের মারামারির শব্দও কেউ শুনবে না এখন। টম হাঁটছিলো খুব দ্রুত কিন্তু একবারও পিছনে ফিরে তাকালো না।

 কাছেই কোথাও হায়েনারা হেসে উঠলো। ফ্রান্সিস তরবারিটা বের করে হাতে নিলো। মরার আগ মুহূর্তে টমের চেহারাটা কেমন হবে সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করছে। ফ্রান্সিস আজ বহুদিন ধরে দৃশ্যটা চিন্তা করে যাচ্ছে, কিন্তু এখন যখন সময় উপস্থিত, তখন ও রাগের চাইতে বরং ভয় বেশি পাচ্ছে। এর আগে কখনো ও কোনো মানুষ খুন করেনি। তরবারিটার ওজন খুব বেশি মনে হতে লাগলো ওর, পা গুলো মনে হলো নরম মোমের তৈরি।

পারতেই হবে ফ্রান্সিস, নিজেকে বললো ও। বাবার জন্যে হলেও পারতে হবে।

 সাথে পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার, স্যার নিকোলাসের কণ্ঠ শুনতে পেলো যেনো মাথার ভিতর।

জ্যাকব ওর ইতস্তত ভাবটা বুঝতে পেরে সামনে এগিয়ে গেলো, আখ কাটা ছুরিটা প্রস্তুত। ফ্রান্সিস ওকে ইশারায় পিছনে যেতে বললো। “ওকে আমি মারবো,” ফিসফিসিয়ে বললো ও।

জ্যাকব কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিছিয়ে গেলো। ছেলেটা ওকে টাকা দিচ্ছে যেহেতু, ওকেই সুযোগটা নিতে দেওয়া যাক। শেষমেশ না পারলে জ্যাকব তো আছেই।

ফ্রান্সিস ওর হাতটা সরিয়ে নিলো। ইংল্যান্ড থেকে আসার পথে সমুদ্রে বসে বসে, ও হাজারবার এই দৃশ্যটা কল্পনা করেছে। তবে ঠিক যেরকম ভেবেছিলো ব্যাপারটা সেরকম হচ্ছে না। ভেবেছিলো ও টমের নাম ধরে ডাকতেই টম অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাবে। তারপর ফ্রান্সিস নিজের পরিচয় আর টমকে কেনো মারতে চায় সেটা জানাতেই সেই অবাক দৃষ্টি আতংকে রূপ নেবে। টম শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারবে যে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এরপর হাঁটু ভেঙ্গে বসে নিজের জীবন ভিক্ষা চাবে, কিন্তু ফ্রান্সিস কোনো ক্ষমা করবে না।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যতো তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা শেষ হবে ততোই ভালো। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে; আর নিতে পারছে না।

কোনো ব্যাপার না, নিজেকে বললো ফ্রান্সিস। কাজটা করাটাই আসল, কিভাবে সেটা মুখ্য না। ও টমের কাঁধ বরাবর তরবারিটা তাক করলো। ঠিক ওর সৎ বাবা যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবে। এভাবে ধরলে তরবারিটা বুকের হাড়গুলোর ফাঁক দিয়ে ঢুকবে। ও এক পা সামনে আগালো।

কিন্তু এতো জোরে পা পড়লো যে নিচের পাথরগুলো কড়মড় করে উঠলো। টম ঘুরে গেলো সাথে সাথে। যে লোকটা ওর বাবাকে খুন করেছিলো, জীবনে প্রথমবারের মতো তার মুখোমুখি হলো ফ্রান্সিস।

 “আপনি কি টম কোর্টনী?” জিজ্ঞেস করলো ফ্রান্সিস। কণ্ঠ যাতে না কাপে আপ্রাণ সে চেষ্টা করছে।

টমকে দেখে মনে হলো অবাক হয়েছে। “হ্যাঁ, আমিই সে।”

ফ্রান্সিস ঝাঁপিয়ে পড়লো সামনে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূতে সরে গেলো টম। তরবারির ডগায় লেগে ওর জামার সামনের দিকটা ছিঁড়ে গেলো। চামড়ায় ঠাণ্ডা ধাতব স্পর্শ পেলো, কিন্তু সামান্য আচড়ের বেশি লাগলো না। এদিকে আঘাত জায়গামতো না লাগায় ফ্রান্সিস তাল সামলাতে না পেরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। টম চাইলেই ওর হাত থেকে থাবা দিয়ে তরবারিটা ফেলে দিতে পারতো, কিন্তু আর একটা অবয়বকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো ওর দিকে। লোকটা হাতের ভারি ছুরিটা ঠিক টমের মাথা বরাবর ধরে রেখেছে। টম পিছনে সরে গেলো। মাচার ফাঁক দিয়ে ওখানে চাঁদের আলো এসে পড়ছে।

সেই আলোয় দেখা গেলো, ওখানে মোট পাঁচজন আছে। এর মধ্যে জ্যাকব দ্য ভিসকে চেনে টম। বাকি তিনজনেরও চেহারা পরিচিত, এর আগেও জ্যাকবের সাথে দেখেছে। পঞ্চম যে ছোঁড়াটাকে ওকে তরবারি হাতে আক্রমণ করেছিলো তাকে ও জীবনেও আগে দেখেনি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ওর সবকিছু কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছে।

কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই মোটেও। ছেলেটা আবার ওর দিকে এগিয়ে এলো। দীর্ঘদিন ধরে প্রশিক্ষিত মাপা আঘাত করলো সে, টমের হাত প্রায় কেটেই গিয়েছিলো। বাকি মাস্তানগুলো ওকে ঘিরে ফেলেছে ততোক্ষণে। পালানোর পথ বন্ধ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো সামনে।

বোঝা যাচ্ছে ছেলেটাই এদের সর্দার আজ। আক্রমণে ওর দক্ষতা আর ক্ষিপ্রতা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আসলে মারাত্মক বিপজ্জনক সে।

“তুই কে রে?” জানতে চাইলো টম। “তোকে তো চিনি বলে মনে হচ্ছে না।”

 কিন্তু উত্তরে ছেলেটা তরবারি বাগিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লো। টম লাফিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে, হামলাকারীর চোখে বিজোয়ল্লাস দেখতে পেলো ও। সেই মুহূতে আক্ষরিক অর্থেই টমের পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। একটা ময়লায় বুজে যাওয়া পুকুরে হুড়মুড়য়ে পড়ে গেল ও। ছেলেটা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ওর নিরস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

জ্যাকব ওর একটা লোকের দিকে তাকালো। “ছেলেটার সাথে থাক এখানে। ও যেনো কাজটা শেষ করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখবি?” টমের মরণ দেখতে ওর খুবই ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু ডোরিয়ান আসার আগেই ওকে টমের বাসায় যেতে হবে। ওর বৌয়ের গলায় একটা ছুরি ধরে থাকলে ডোরিয়ান কিছুই করতে পারবে না। ও ওর বৌকে কি করে সেটা দেখতে বাধ্য : করবে, তারপর সারাহের দিকে নজর দেবে।

জ্যাকব টমের দিকে ঝুঁকে বিশ্রী ভঙ্গিতে বললো, “তোর সুন্দরি বৌকে একটা দেখা দিয়ে আসি। ছেলেটা তোর সাথে হিসাব মেলাক।”

 টম কোর্টনীর দিকে আবার একটা উল্লসিত দৃষ্টি দিয়ে ও বোর্ডিং হাউজের দিকে চললো। সাথের দুজন গেলো ওর সাথে। আর একজন থেকে গেলো ফ্রান্সিসকে সাহায্য করার জন্যে।

মাজা পুকুরটার ভিতর ভয়ানক আঠালো কাদা। টম নিজের পা মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। জীবনে ও এতো বেশি লোকের জীবন সংহার করেছে যে এটা জানাই ছিলো একদিন সৌভাগ্যের দেবতা ওকে ছেড়ে যাবে। ওর বাবাও অনেক কম বয়সে মারা গিয়েছেন, ওর দাদা-ও। কিন্তু ও এখনো বুঝতে পারছে না যে ওর এই নিষ্ঠুর শত্রুটা কে।

 আর জীবন থাকতে টম জ্যাকব দ্য ভিসকে সারাহের দিকে একটা আঙুলও তুলতে দেবে না। ও কাদার ভিতর হাত ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। ঠিক তখনি ওর হাতে শক্ত ধারালো কিছু একটা বাঁধলো। টম আঙুল দিয়ে টেনে জিনিসটা কাদা থেকে বের করে আনলো-একটা তিন ইঞ্চি পুরু পাইপ। এটায় করে পুকুরে পানি দেওয়া হতো একসময়।

এদিকে ফ্রান্সিস পুকুরের কাদায় ভরা পাড় বেয়ে একজন নাচিয়ের মতো ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে নেমে এলো। তরবারি টমের তালু বরাবর তাক করে রেখেছে। টম হাঁটুতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাতের পাইপটা দিয়ে আঘাতটা আটকালো। ধাতুতে ধাতুতে আঘাত করে ঝংকার উঠলো তাতে। মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে রক্ষা পেলো টমের চেহারা।

ধাক্কা দিয়ে টম ফ্রান্সিসের ভারসাম্য নাড়িয়ে দিলো। ফ্রান্সিসও পা পিছলে পড়ে গেলো কাদার ভিতর। টম নিজেকে কাদা থেকে মুক্ত করে পাইপটা উঁচিয়ে ওর আক্রমণ করতে গেলো। কিন্তু তার আগেই রয়ে যাওয়া লোকটা আখ কাটার ছুরি নিয়ে তেড়ে এলো ওর দিকে। টম সেদিকে ঘুরে মাথা নামিয়ে আঘাতটা এড়ালো। তারপর লোকটার ছুরি ধরা হাতের কবজি ধরে ফেলে লোকটার জড়তাকে ব্যবহার করে ভারসাম্য নাড়িয়ে দিলো। একই সাথে হাতটা টেনে পিঠের পিছনে নিয়ে এলো। প্রায় সাথেসাথেই লোকটার কাঁধের জোড়াটা মট করে আলাদা হয়ে গেলো। লোকটা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো। টম ওর ডান হাতে ধরে থাকা লোহার পাইপটা লোকটার মাথা বরাবর সজোরে নামিয়ে আনতেই সে মুখ থুবড়ে কাদায় পড়ে গেলো।

টম আখ কাটার ছুরিটা কাদা থেকে তুলে নিয়ে ফ্রান্সিসের দিকে ফিরলো। কিন্তু ফ্রান্সিস ততোক্ষণে কাদায় গড়াগড়ি করে ভূত হয়ে গিয়েছে, আর পড়ার সময় হাত থেকে তরবারিটাও গিয়েছে ছুটে। নিরস্ত্র অবস্থায় টমের মুখোমুখি হওয়ার চাইতে পালানোই ভালো মনে করলো ও। তাই ঘুরে টলতে টলতে পুকুরের পাড় বেয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। ভয় আর লজ্জায় ফোপাচ্ছে ও। টম লোহার পাইপটা ওর দিকে ছুঁড়ে মারলো। ওটা থ্যাপ করে ফ্রান্সিসের পিঠের মাঝ বরাবর গিয়ে লাগলো। ফ্রান্সিস ব্যথায় কাতরে উঠলো কিন্তু থামলো না। সামান্য পরেই অন্ধকারে উধাও হয়ে গেলো, টম আর ওকে ধরতে গেলো না। আগে সারাহকে বাঁচাতে হবে।

জ্যাকব দ্য ভ্রিসের হুমকিটা কানে বাজতেই ও দৌড়াতে শুরু করলো। তোমার সুন্দরি বৌকে একটা দেখা দিয়ে আসি।

*

টম বাগানের দরজা দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে মিসেস লাই এর বোর্ডিং হাউজের দিকে ছুটলো। বাড়িটার খোলা দরজার সামনে জ্যাকবের দুই সাঙাত পাহারা দিচ্ছে। ওরা টমকে আসতে দেখলেও অন্ধকারে চিনতে পারলো না। আর ওর হাতে আখ কাটা ছুরিটা থাকায় ওরা ভেবেছে টম বুঝি বাগানে থেকে যাওয়া ওদের দলের লোকটা।

“ধীরে সুস্থে, হেনড্রিক,” একজন স্বাগত জানালো ওকে। “জ্যাকব, কোর্টনী মাগী দুটোর সাথে কেবল মজা শুরু করেছে।”

 বাড়ির ভিতর থেকে একটা তীক্ষ্ণ মেয়ে কণ্ঠের চিৎকার শোনা গেলো। প্রহরী দুজন হেসে সেদিকে ঘুরলো ঘটনা দেখার জন্যে। একজন মরার আগে জানলোও না কি তাকে আঘাত করলো। দ্বিতীয় জন আঘাত আর লাশটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে ঘুরতে গেলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। টমের আখ কাটার ছুরিটা ওর ঘাড়ের পাশ দিয়ে নেমে গেলো। ওর মেরুদণ্ড দুই ভাগ হয়ে গেলো তাতে। মাথাটা তখনও ঘাড়ের সাথে লেগে ছিলো। সেটা সামনের দিকে ভাঁজ হয়ে বুকের উপর ঝুলে পড়লো।

 টম লাফিয়ে লাশ দুটো পেরিয়ে দরজা ধরে ছুটলো। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা ঘোড়ার বেগে লাফাচ্ছে। আচমকা পিস্তলের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো। টম না থেমেই হুড়মুড় করে বসার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। রুমের উল্টো দিকে টমের দিকে মুখ করে সারাহ দাঁড়িয়ে আছে। বন্দুকের ধোয়ার পাতলা একটা আবরণে ঢেকে রেখেছে ওকে। তার পিছনে মিসেস লাই সারাহের জামা ধরে ভয়ে ফোপাচ্ছেন।

 ডান হাতে সারাহ ওর ছোট ফ্লিন্ট-লক ডেরিঞ্জারটা ধরে আছে, হাত সামনে বাড়ানো। সামনে মেঝেতে উপুড় হয়ে চার হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে জ্যাকব দ্য ভিস। খুলির পিছনে যেদিক দিয়ে বুলেট বেরিয়েছে সেই স্থানটা হা হয়ে আছে। মিসেস লাই-এর দামি কার্পেট ভরে গিয়েছে হলদেটে ঘিলুতে।

 সারাহ আর টম সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পরিমাণ সময় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সারাহ হাতের খালি পিস্তলটা ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো টমের বুকে।

 “টম কোর্টনী!” কেঁদে উঠলো সারাহ। ওর কণ্ঠে অর্ধেক ছিলো ফোপানি, বাকি অর্ধেক বাধ ভাঙা আনন্দ। “তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে আমাকে ভালবাসবে, সম্মান করবে আর রক্ষা করবে। কিন্তু দরকারের সময়েই কোথায় ছিলে তুমি?”

“ও, আমার সোনা, আমার লক্ষী সোনা।” ও হাতের ছুরিটা ফেলে সারাহকে জড়িয়ে ধরলো। “আর কক্ষনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না। কক্ষনো না! কক্ষনো না!” দেখা গেলো দুজনেই একসাথে কথা বলছে।

 সামনে দরজায় আবার হল্লা শোনা গেলো। একটু পরেই ডোরিয়ান ঢুকলো ভিতরে। সাথে একটা কাদা মাখা ভুতকে ধরে এনেছে।

“সারাহ! টম!” ডোরিয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। “আল্লাহর শুকরিয়া যে তোমরা ঠিক আছে। আমি ফেরার পথে পিস্তলের আওয়াজ শুনলাম, তারপরেই এই জানোয়ারটাকে দেখি পাহাড় ধরে নেমে যাচ্ছে।” বলে ও ওর বন্দীর পায়ের পেছনে একটা লাথি মারলো। ছেলেটা হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো মেঝেতে। “দেখেই বুঝেছি যে এর কোনো কুমতলব আছে, তাই ধরে এনেছি।”

টম দেখলো এ হচ্ছে ওকে আক্রমণকারী সেই কম বয়সী ছেলেটা।

“হ্যাঁ, এ ওদের দলেরই। সম্ভবত দলের সর্দার।” গম্ভীর কণ্ঠে বললো টম। সারাহের কাঁধে এক হাত জড়িয়ে রেখে ও মেঝেতে বসে থাকা ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ালো।

“কে তুই?” ঠাণ্ডা স্বরে জানতে চাইলো টম। “তোর সাঙ্গপাঙ্গগুলোকে যেভাবে মেরেছি তোকেও কেন সেভাবে মারবো না, বল দেখি?”

ছেলেটা ওর দিকে তাকালো। তারপর প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের আতংক সামলে উল্টো চোখ রাঙ্গিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “হ্যাঁ, টমাস কোর্টনী। দুই হচ্ছিস এক জন্ম খুনী। তুই আমার বাবাকে মেরেছিস-তার ছেলের সাথেও তো একই কাজই করবি।”

টম ওর প্রতি আনা অভিযোগ আর বলার হিংস্রতায় চমকে গেলো। ফলে ওর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিটাও আর থাকলো না। কয়েক সেকেন্ড কেমন যেনো ওর মাথা কাজ করলো না ঠিকমতো।

“ঠিক আছে, তা কাকে খুন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমাকে?” জানতে চাইলো ও।

“আমার বাবা উইলিয়াম কোর্টনী। তোর সৎ ভাই।”

“উইলিয়াম…” টমের মুখের কথা আটকে গেলো। “তার মানে বিলি? ব্ল্যাক বিলি তোমার বাবা?”

“জ্বী হ্যাঁ, উইলিয়ামই আমার বাবা।”

“তার মানে তুমি হচ্ছে ফ্রান্সিস; ফ্রান্সিস কোর্টনী।”

আবারও টমের সেদিন মারমেইডস উইঙ্ক-এ দেখা সবুজ দ্যুতির কথা মনে পড়লো। একটা আত্মা আবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসবে।

ও সামনে ঝুঁকে ফ্রান্সিসের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো। “বোঝাই যাচ্ছে যে তোমার আর আমার অনেক কথা বলা বাকি।” ওর স্বর শান্ত কিন্তু অনুতাপে ভরা। “তোমাকে অন্তত সবকিছু ব্যাখ্যা করে বলা উচিত।”

*

ফ্রান্সিস ঘুম ভেঙে দেখলো একটা পালকের বিছানায় শুয়ে আছে। প্রায় একমাস যাবত জাহাজের একটা সরু খাটে শোয়ার পর শয্যাটা ছিলো একেবারে স্বর্গশয্যার মতো। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ও বোধহয় হাই উইন্ডে ফিরে গিয়েছে আবার। চাকরেরা একটু পরেই ওর জন্যে সকালের নাস্তা নিয়ে আসবে।

পাশ ফিরে শুতে গেলো ফ্রান্সিস। তীব্র একটা ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তেই সব মনে পড়ে গেলো ওর। ও হাই উইন্ডে নেই। আছে কেপ টাউনে। ওর সারা শরীরে আঘাত।

চোখ খুলে তাকালো ও। কফির মতো গায়ের রঙের এক মহিলা ওর পাশে এসে বসলো। মাথার উপর একটা শাল জড়ানো। তার পেছনে মুখে দাগওয়ালা এক বিশাল কৃষ্ণাঙ্গ লোক দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

“আমি কোথায়?”

“টম আর ডোরিয়ান কোর্টনীর বাসায়, কালো লোকটা বললো।

ফ্রান্সিস লাফ দিয়ে উঠে বসলো। একটু বেশিই জোরে হয়ে যাওয়ায় সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো আবার। ও বিছানা ছেড়ে নামার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যথার চোটে পারলো না।

“আমাকে এখানে পেলে টম কোর্টনী মেরেই ফেলবে,” কোনোমতে বললো ও।

“টম কোর্টনী তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। তোমার ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে একজন ভদ্রলোক হিসেবে তোমার সেবা করতে কে বলে দিয়েছে বলে তোমার মনে হয়?”

“এটা খাও,” মহিলাটা বললো! বিশ্রী গন্ধযুক্ত একপাত্র তরল ওর ঠোঁটের সামনে ধরলো সে। ফ্রান্সিস একটু চেখে ওয়াক করে পাত্রটা একদিকে ঠেকে দিলো। চেহারায় দাগওয়ালা কালো লোকটা এগিয়ে আসলো বিছানার দিকে। তারপর ফ্রান্সিসের নাক টিপে ধরলো যাতে ও মুখ খুলতে বাধ্য হয়।

“মিস ইয়াসমিনি তোমাকে খেতে বলেছে, চুপচাপ খেয়ে নাও!” মহিলাটা আবার ওর ঠোঁটের ফাঁকে পাত্রটা ধরলো। ফ্রান্সিস আর ঝামেলা না করে চুপচাপ খেয়ে নিলো। সাথে সাথে কাজ হলো ওষুধে। অবিশ্বাস্যভাবে ওর ব্যথা গায়েব হয়ে গেলো। তবে মাথাটাও ঝিম ঝিম করে উঠলো। বিছানাটাও এতে নরম। না চাইতেও চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর।

ইয়াসমিনি ওর ক্ষতগুলো পরিষ্কার করে দিলো; ওগুলো অবশ্য খুব বেশি গভীর না। বন্য গুল্ম কেটে তৈরি করা একটা মলম ওখানে লাগিয়ে দিলো। এসব গুলা ও নিজেই সংগ্রহ করেছে। আল্লাহর রহমতে ক্ষত নিখুঁত ভাবেই সেরে যায়।

“আমি ভাবছি ও কি আসলেই টম আর ডোরিয়ানের ভাতিজা?” ইয়াসমিনি বললো।

“যদি না হয়, তা হলে একটা মাত্র মিথ্যা বলার জন্যে ও অনেক দূর চলে এসেছে,” মাথা নেড়ে বললো আবোলি। “জন্মের পর থেকে আমি উইলিয়াম কোর্টনীকে চিনি। এই ছেলেটা একেবারে ওর মতোই। আর এই ব্যাপারটাও আছে।”

ও তাকের উপর রাখা একটা পদক দেখালো। চুনির চোখওয়ালা একটা সোনালি সিংহ। ওটার পায়ের নিচে পৃথিবী, আর উপরে হীরার তারা খচিত আকাশ। “এটা ছিলো ক্লিবি-র বাবার। ছেলেটার জামার নিচে পেয়েছি। এতেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় যে ও আসলে কে।

 “কিন্তু সবাই জানে যে টম উইলিয়ামকে খুন করেছে। আর এজন্যেই ও আর কখনো ইংল্যান্ড ফিরতে পারবে না। উইলিয়ামের সাথে যা হয়েছে সেজন্যে টম এখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। ছেলের সাথে নিশ্চয়ই ও একই ভুল করবে না,” আবোলি বললো।

দরজায় টোকা শোনা গেলো। টম উঁকি দিলো সেখান দিয়ে। “রোগীর অবস্থা কি?”

“ওকে মারতে ব্যর্থ হয়েছেন আপনি,” খোঁচা মেরে বললো ইয়াসমিনি। “আবার যদি মারধোর না করেন তাহলে এ যাত্রা বেঁচে যাবে।”

টম বিছানার কাছে গিয়ে ঘুমন্ত ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বাবার মতোই ঘন কালো চুল হয়েছে ফ্রান্সিসের, কিন্তু বাকি সব বৈশিষ্ট্য নরম সরম। অনেকটা মেয়েদের মতোই সুন্দর। মোটেও ওর বাবার মতো না। টম আশা করলো ওর স্বভাবও যেনো এরকম উল্টো হয়।

টম হিসেব করতে বসলো শেষ কবে ও হাই উইল্ডের সিঁড়িতে ছোট্ট ফ্রান্সিসকে খেলতে দেখেছিলো। ছেলেটার বয়স এখন কমপক্ষে সতেরো। টম ও বাড়ি ছেড়েছিলো ঠিক এই বয়সে। বা বলা যায় ওকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। আর কখনোই ও হাই উইল্ড বা ইংল্যান্ড ফিরতে পারেনি। একজন ফেরারি আসামী-যার হাতে লেগে আছে তার ভাইয়ের রক্ত। সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটাকে এখনো ভুলতে পারে না টম। টেমস নদীর ঘাটের অন্ধকার গলিতে ও লোকটাকে মেরেছিলো শুধু নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে। অথচ টুপি সরিয়ে দেখা গেলো লোকটা ওর নিজের ভাই।

অর্ডার অফ দ্য সেন্ট জর্জের পদকটা তুলে নিলো টম। ও নিজেও নৌবাহিনির খেতাব প্রাপ্ত নাইট, তবে কখনোই পদকটা পরে না। উইলিয়াম অবশ্য সবসময়েই পরে থাকতো।

“ও উঠলে আমাকে ডাক দিও,” আবোলিকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো টম।

আমি ওর বাবাকে বাঁচাতে পারিনি। ছেলেকে দিয়ে সেই ঋণ আমি শোধ করতে পারি।

*

ফ্রান্সিস আবার জেগে উঠে দেখতে পেলো মহিলাটা ঘরে নেই। তবে কালো লোকটা তখনও দরজা পাহারা দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে এক চুলও নড়েনি জায়গা থেকে; ফ্রান্সিস একবার ভাবলো যে লোকটা কাঠের তৈরি নাতো?

ও সাবধানে উঠে বসলো। নাড়াচাড়া আস্তে করলে ব্যথা কম লাগে। বিছানা থেকে পা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর। কিন্তু ভারসাম্য রাখতে দেয়াল ধরে রাখা লাগলো। তবে আবোলি ওকে কিছু করলো না।

“ইয়াসমিনির ওষুধে কাজ করছে তাহলে,” মন্তব্য করলো ও।

ফ্রান্সিস আবোলির দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ। তারপর দেয়ালের জানালাটার দিকে তাকালো। এদিক দিয়ে কি বের হওয়া যাবে? ওর পরনে শুধু একটা নাইট শার্ট। এই পোশাক কেপ টাউনের রাস্তায় ওকে দেখতে একটা উন্মাদের মতো লাগবে। ওকে কি তখন গ্রেপ্তার করা হবে?

আবোলি ঘরের অন্যদিকে ইঙ্গিত করলো। সেখানে চেয়ারের উপর একটা জামা আর একটা পায়জামা ভাজ করে রাখা আছে।

 “পালাতে চাইলে কাপড় পরে নেওয়াই ভালো।”

“আমাকে থামাবেন না?”

আবোলি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। “তুমি এখানে নিরাপদ। কিন্তু যদি তুমি পালাতেই চাও…”

ওকে কথা শেষ করতে দিলো না ফ্রান্সিস, “নিরাপদ?” ব্যঙ্গ ঝরলো ওর কণ্ঠ থেকে। “টম কোর্টনী আমার বাবাকে খুন করেছে।” ও চেয়েছিলো কথাটা বলে আবোলিকে চমকে দেবে, কিন্তু আবোলি শুধু মাথা ঝাঁকালো একটু। “আপনি সেটা বিশ্বাস করেন না?”

“তোমার বাবাকে আমি জন্মের দিন থেকে চিনি,” মাপা স্বরে বললো আবোলি। “আমি মন থেকে বলতে পারি সে কতটা খারাপ লোক ছিলো। উইলিয়াম মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে টম হাই উইন্ডে গিয়েছিলো ওদের ভাইয়ের ব্যাপারে সাহায্য চাইতে, আর উইলিয়াম সাহায্যের বদলে টমের উপর চড়াও হয়। ও টমকে মেরেই ফেলতো সেদিন, কিন্তু টম তরবারি চালোনায় ওর চাইতে দক্ষ ছিলো। তাই শেষে দেখা গেলো টম-ই উইলিয়ামের গলায় তরবারি ধরে আছে। কিন্তু টম শেষ আঘাতটা করতে পারেনি। ওর হাত ওর কথা শোনেনি। এর এক সপ্তাহ পরে লন্ডনে উইলিয়াম টেমস নদীর ঘাটে কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই টমকে আক্রমণ করে বসে; সাথে লোকবল ছিলো। কিন্তু সাথের লোকগুলো যখন পারলো না, তখন ও পিস্তল বের করে টমকে গুলি করতে যায়। আমি সেখানে ছিলাম। টম সেসময় তোমার বাবার বুকে তরবারি না বসালে নিশ্চিত তখনই মারা পড়তো।”

 আবোলি বলে চললো, ছেলেটার উপর ওর, কথার কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা সেদিকে খেয়াল নেই। এমনকি যদি এই ঘটনার আগে তোমার বাবা তার চেহারা দেখাতো-যদি টম জানতো যে লোকটা আসলে কে-তাহলে টম আঘাতটা করতে পারতো না।”

 “আপনি এসব কেনো বলছেন আমাকে?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো। “আমাকে আমার বাবার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে?”

“কথাগুলো সত্যি তাই,” আবোলি বললো। “তুমি এটা মেনে নিতে পারো, নাও নিতে পারো; সেটা তোমার ব্যাপার। তবে যদি তুমি একটা মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকো তাহলে সেটা একসময় তোমাকে ধ্বংস করে দেবে।” তারপর সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, “কাপড় পরে নাও।”

 আবোলি বেরিয়ে যাওয়ার পর ফ্রান্সিস দীর্ঘ সময় খাটের পাশে বসে রইলো। ওর ভিতরে যে উন্মত্ততা ছিলো সেটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে; ও যে আসলে এখন কে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। চেয়ারের উপরের কাপড়গুলোর দিকে তাকালো ফ্রান্সিস, ওগুলো পরতে পারবে কিনা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত না। আবোলির কথাগুলো ওর মাথার ভিতর বন বন করে ঘুরছে। একসময় ওর মনে হলো যে মাথাটা দুই ভাগ হয়ে যাবে।

গত রাতের সব কথা ওর মনে নেই, তবে একটা জিনিস স্পষ্ট মনে আছে। টম চাইলেই ওকে মেরে ফেলতে পারতো, কিন্তু সেরকম কিছুই করেনি।

আর এই একটা কারণেই ফ্রান্সিসের সকল বিশ্বাস ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। ওর মনে পড়লো যে ওর মা কি বলেছিলেন। টম ঠাণ্ডা মাথায় নিজের ভাইকে খুন করার লোক না। কথাটা বিশ্বাস হয়নি ওর। আর এখন যখন ও টম কোর্টনীর কবলে পড়েও বেঁচে গিয়েছে, তখন মনে হচ্ছে যে মায়ের কথাটা সত্যি হলেও হতে পারে।

ওখানে বসে বসে ও নিজেকে এক নতুন দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। বেশ্যা আর মাস্তানদের সাথে আঁতাত করছে, নিজের পরিবারের একজন সদস্যুকে খুন করার চেষ্টা করছে-এ কেমন মানুষে পরিণত হয়েছে ও? আর বিনিময়ে টম কোর্টনী ওকে দিয়েছে দয়া আর করুনা।

যদি তুমি একটা মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকো তাহলে সেটা একসময় তোমাকে ধ্বংস করে দেবে।

কিন্তু ওর কি মিথ্যটাকে ত্যাগ করার মতো সৎ সাহস আছে?

*

ফ্রান্সিস নিচে নেমে এসে দেখে টম বসার ঘরের চেয়ারে বসে অর্ডার অফ দ্য সেন্ট জর্জের পদকটা হাতে নিয়ে দেখছে। ফ্রান্সিসের পরনে ডোরিয়ানের পায়জামা আর গায়ে টমের জামা। দেখে মনে হচ্ছে মাস্তুল থেকে পাল ঝুলছে বুঝি। ও সিঁড়ির মাঝপথে থেমে গেলো; টম ভেবেছিলো ওকে দেখেই হয়তো ফ্রান্সিস দৌড়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ফ্রান্সিস জানে যে এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। ও ভয়টাকে গিলে নামতে শুরু করলো আবার।

সিঁড়ির গোড়ায় নেমে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

টম-ই নীরবতা ভাঙলল। “মাঝে মাঝে তরবারি হাতে কারো সাথে দেখা হলেই ভালো হয়, দুঃখিত কণ্ঠে বললো ও। “তাহলে কি বলতে হবে সেটা ভাবতে হয় না।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকালো। তারপর আচমকা ওর ভিতর থেকে কথা ফুটে বেরুতে লাগলো। “আমার যত্ন নেওয়ার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। আমি… আপনি চাইলেই আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারতেন। বা চাইলে আরো খারাপ কিছু করতে পারতেন।”

“আমরা এভাবে শান্তভাবে কথা বলতে পারছি তাতেই আমি খুশি,” টম বললো। ও এমনভাবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো যে কোনো মুহূর্তে ও গায়েব হয়ে যাবে। “তুমি কি আসলেই বিলির ছেলে?”

ফ্রান্সিস কাটা কাটা ভাবে বললো, “হ্যাঁ, আমি।”

“তাহলে তুমি ঐ ভ্রিস এর মতো গুণ্ডাদের সাথে মিশলে কিভাবে?”

“একটা সরাইতে দেখা হয়েছিলো। একটা… মেয়েমানুষ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো।” ফ্রান্সিসকে দেখে বোঝা গেলো যে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। “আপনাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললেই ভালো হবে।”

টম ডোরিয়ান আর আবোলিকেও গল্প শোনার জন্যে ডেকে আনলো। টম অবাক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আবোলির চেহারার কাটা দাগ, আর ডোরিয়ানের মাথার পাগড়ি আর আরব পোশাক-দুটোই অবাক করেছে ওকে। আর ডোরিয়ান আসলে কে সেটা জানার পর ওর মুখ আক্ষরিক অর্থেই হাঁ হয়ে গেলো।

“আমাকে যা যা বলা হয়েছে সব দেখি মিথ্যে। আমি জানতাম যে আপনি আর বেঁচে নেই।”

“সে এক লম্বা কাহিনি,” ডোরিয়ান বললো। “বলবো পরে একসময়। কিন্তু তার আগে তুমি এখানে কিভাবে এলে আর আমাদেরকে খুঁজে পেলে সেই কাহিনি শোনাও দেখি।”

ছিন্নভিন্ন কুশনগুলোতে বসেই ফ্রান্সিস ওদেরকে সব খুলে বললো। শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে গেলো টম। স্যার ওয়াল্টারের কর্মকাণ্ড শুনে ও জোরে জোরেই গালাগাল করে উঠলো।

 “বেচারা এলিস। যেদিন আমি বিলিকে খুন করলাম, সেদিন থেকেই আসলে দুর্দশার শুরু।”

 “ও উইলিয়ামের সাথেও সুখী হতে পারতো না,” আবোলি বললো। “ও ওর সাথে কেমন ব্যবহার করতো তা তো দেখেছিলেই। যেভাবে ওকে মারধোর করতো, তাতে মনে হয় উইলিয়াম এলিস আর ফ্রান্সিস দুজনকেই মেরে ফেলতে।” টম ওকে ইশারায় থামতে বললো। কিন্তু আবোলি প্রতিবাদ করে বললো, “না, ছেলেটার নিজের বাবা সম্পর্কে সব সত্যি জানার অধিকার আছে।”

 “আমি জানি, ফ্রান্সিস বললো। আমি আসার আগে মা আমাকে বাবা। সম্পর্কে সব সত্যিটা বলেছিলেন। বাবা কেমন মানুষ ছিলেন সেটাও বলেছেন। উনি বলেছেন আপনি যা করেছেন নিজেকে রক্ষা করতে করেছেন।” তারপর বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, “আমি তার কথা বিশ্বাস করিনি।”

“আচ্ছা,” সেদিনের ভয়াবহ রাতটার কথা মনে পড়লো টমের। “তবে ওটা পুরোটাই বিলির দোষ ছিলো না। লর্ড চিল্ডস বলে না দিলে ওর জানার কথা ছিলো না যে আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে।”

ফ্রান্সিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “স্যার নিকোলাস চিল্ডস? তার মানে আমার সাথে দুই নম্বরি করা হয়েছে? আমাকেতো উনিই পাঠিয়েছেন। আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে সেই খবর উনিই দিয়েছেন আমাকে। আপনাকে মারতে পারলে পাঁচ হাজার পাউন্ডও দেবেন বলে কথা দিয়েছেন।”

 “পাঁচ হাজার পাউন্ড এর লোভ দেখালে তো আমিও কাজটা করতাম, মজা করে বললো ডোরিয়ান। কিন্তু টম মজার মেজাজে নেই।

“টাকা তুমি জীবনেও পেতে না। চিল্ডস একটা মাকড়সা। পৃথিবীর সমস্ত কোনায় কোনায় জাল বুনে রেখেছে সে। লেডেনহল স্ট্রিটে নিজের ডেরায় বসে বসে ও কুমতলব আটে আর এক পয়সার লাভেরও কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তাকে জালে আটকে শেষ করে দেয়। আমি তাকে প্রায় বিশ হাজার পাউন্ড লাভ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু সামান্য একটা এক মাস্তুলের জাহাজের বখরা দিতে অস্বীকার করায় উনি আমাকে খুন করার চক্রান্ত করেন। আস্ত একটা শয়তান লোকটা।”

“এখন আমি বুঝতে পারছি।”

“তোমার চাইতে অনেক বুদ্ধিমান লোক ওনার শয়তানির ফাঁদে পড়ে সব হারিয়েছেন। আমার ধারণা এমনকি তোমার বাবা বিলিও তার শিকার। ও বুঝতে পারেনি যে আসলে ও চিল্ডসের কুমন্ত্রণার এক সামান্য ঘুটি মাত্র! বিলি আমাকে খুন করতে চাইতো সেটা ঠিক, কিন্তু চিল্ডসই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। কোনো সন্দেহ নেই যদি সেদিন বিলি সফল হতো তাহলে ওর এই অপরাধটা চিল্ডস ওর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতো।”

 ফ্রান্সিসের ভ্রু কুঁচকে গেলো। “তাহলে এখন আমি কি করবো? লর্ড চিল্ডস গাই চাচা আর বোম্বেতে কোম্পানির অফিসে দেওয়ার জন্যে একটা চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু-” টমের মুখভঙ্গি বদলে যেতে দেখে ও থেমে গেলো। “কি হয়েছে?”

“গাই তো আর এক চীজ।”

“কিন্তু ফ্রান্সিস একজন কোর্টনী। আর আমাদের পরিবারের সম্পূর্ণ ইতিহাস জানার অধিকার ওর আছে,” নরম স্বরে বললো ডোরিয়ান। “এসব গোপন কথা আর অর্ধ সত্যগুলোই আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। এসব কারণেই লর্ড চিল্ডসের মতো শয়তানগুলো আমাদেরকেই আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ফায়দা উঠাচ্ছে।”

টম জবাব দেওয়ার আগেই দরজায় করাঘাতের আওয়াজ পাওয়া গেলো। অ্যানা দুয়ার্তে ঢুকলো ভিতরে।

“বিরক্ত করলাম নাকি? আজ সকালে আমার প্রস্তাবটার ব্যাপারে আর একবার আলোচনা করার কথা ছিলো না?” তারপর ফ্রান্সিসের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ইনি কে?”

ওর চেহারায় কৌতূহলের ভাব স্পষ্ট। এমনভাবে ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে রইলো যেনো এই ঘরে ও-ই একমাত্র পুরুষ মানুষ। আনমনেই নিজের জামার গলার কাছটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিলো অ্যানা।

টম ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো। “এ হচ্ছে আমার ভাতিজা, ফ্রান্সিস। ইংল্যান্ড থেকে এসেছে। গতরাতেই। আমরা অবশ্য জানতাম না। ফ্রান্সিস, এ হচ্ছে অ্যানা দুয়ার্তে। উনি আমাদের ব্যবসায়িক পার্টনার। অবশ্য এখনো সবকিছু চূড়ান্ত হয়নি।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকালো। যেনো একটা ঘোরের মাঝে আছে-যেন ওর দেখা সবচে স্পষ্ট স্বপ্নটা দেখছে এখন। অ্যানার সবকিছুই যেন একেবার সূক্ষ্মভাবে ওর চোখে ধরা পড়ছে। ওর কানের পেছন দিয়ে এক গোছা চুল বেরিয়ে আছে; ওর ঠোঁটের বাক; ওর চোখে আটকে থাকা অ্যানার বাদামী চোখের গভীরতা-সব।

কিছুক্ষণ কেউ কিছু বললো না। সবাই আশা করছিলো যে ফ্রান্সিস কিছু বলবে, কিন্তু ও কিছু বলার সাহস পেলো না।

 “ফ্রান্সিস কাল রাতে মাথায় আঘাত পেয়েছে। সম্ভবত এখনো পুরোপুরি ব্যথা যায়নি,” টম বললো।

 অ্যানার চোখ দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেলো। “ইশ! বেশি ব্যথা পেয়েছে? কি হয়েছিলো?”

“ও আমাদেরকে খুন করে ফেলার চেষ্টা করছিলো, তাই টম মাথায় বাড়ি মেরে ঠাণ্ডা করেছে, ডোরিয়ান বললো।

অ্যানা দুই ভাইয়ের দিকে খেয়াল করলো আবার। এবার ওদের চেহারা আর হাতের কাটাছেঁড়াগুলো নজরে এলো ওর। আসার সময় বাতাসে পোড়া গানপাউডারের গন্ধ পেয়েছিলো। আর কার্পেটে ছিটিয়ে থাকা রক্তের দাগও দেখেছে। মিসেস লাই পুরোপুরি পরিষ্কার করতে পারেননি দাগটা।

“এখন নিশ্চয়ই ওনার সে ইচ্ছা চলে গিয়েছে?”

ডোরিয়ান ফ্রান্সিসকে আড়চোখে একবার দেখলো। “সেরকম-ই আশা করি। কারণ ও এতোদিন যা জানতো, ভুল জানতো।”

ফ্রান্সিস সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। এখনো পায়ে পুরোপুরি বল আসেনি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। “আমাকে আসলে ভুল পথে চালানো হয়েছিলো।”

হঠাৎ ও বুঝলো কথাটা আসলে ঠিক হলো না। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, বিশেষ করে অ্যানা। নিজের দোষ নিজের কাঁধে নিতে শিখতে হবে ওকে।

“আমি অন্য লোকের মিথ্যে কথাগুলো বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু যাদের কথা শোনা উচিত ছিলো তাদেরকে পাত্তা দেইনি। আমি আপনাদের যে বিপদে ফেলেছিলাম সেজন্যে ক্ষমা চাচ্ছি, এসবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমাকে যা করতে বলবেন তা আমি খুশি মনেই করবো। আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।”

টম ওর কাঁধে হাত রাখলো। “ঠিক আছে। এখন শোনো, কাল রাতে মিস দুয়ার্তে আমাদেরকে তার ব্যবসার অংশিদার হওয়ার একটা প্রস্তাব এনেছিলেন। তুমিও ইংল্যান্ড ছেড়েছো ভাগ্য গড়তে; আমরা তোমাকে সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবো বলে মনে হয়।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে সবার সাথে খাবার ঘরের দিকে আগালো। ব্যথা শরীরেও দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে সাহায্য করলো অ্যানাকে।

 অ্যানা আসার কারণে যে কথোপকথনটা থেমে গিয়েছিলো সেটার কথা ও বেমালুম ভুলে গিয়েছে। অনেক পরে ওর খেয়াল হলো, আচ্ছা গাই চাচার কথা বলায় টম চাচা ওরকম আচরণ করলো কেনো?

*

প্রখর রোদের কারণে সমুদ্রের উপরিভাগ এতোটা মসৃণ আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। যে মনে হচ্ছে পাথর কুঁদে পুরো জিনিসটা বানানো। এমনকি ছোট ছোট ঢেউগুলো যখন তীর এসে পড়ছিলো তারাও কোনো আলোড়ন না তুলে একেবার নিখুঁতভাবে ছড়িয়ে পড়ছিলো। সৈকতেই দুটো ইন্ডিয়াম্যান অলস ভাবে নোঙ্গর ফেলে ভেসে আছে।

 মোহনায় কয়েকটা ছোট ছোট চর মাথা তুলে আছে। প্রতিটা পাহাড়ের চুড়ায় একটা করে পাথরের তৈরি দুর্গ। একগাদা বট গাছের ভিতর থেকে বিশাল একটা প্যাগোডার সুউচ্চ মিনার আর গম্বুজ মাথা তুলে আছে। ওখান থেকে একটা মাস্কটের গুলির দূরত্বের চাইতেও কম চওড়া একটা খাড়ি পার হলেই বিশিষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশ।

দুর্গ থেকে দুপুরের সংকেতদায়ী কামানের বুম শব্দ কানে এলো ক্রিস্টোফার কোর্টনীর। মুখ থেকে ঘাম মুছলো ও। নিজের সেরা জামা আর প্যান্টটা পরে আছে আজ। বোম্বের যত সওদাগর আছে তারা সবাই-ই আজ সকাল সকাল ব্যবসাপাতি গুটিয়ে, ঘরের ভিতরের তুলনামূলক ঠাণ্ডা পরিবেশ ফিরে গিয়েছে। এই মুহূর্তে ও বাদে জাহাজে আর কেউ নেই।

 Two monsoons are the age of a man,’ বোম্বের পুরনো প্রবাদ এটা। মাত্র দুই বছরেই ক্রিস্টোফার সেই কোটা পূরণ করে ফেলেছে। সৈকতের পাশের লবণের ঘেরগুলো থেকে ভেসে আসা কটু গন্ধের সাথে শুকাতে দেওয়া পচা মাছের দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। ফলে কেউ না দেখাও বলে দিতে পারবে যে ওরা তীরের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। পচা মাছগুলো স্থানীয় লোকেরা নারিকেল গাছের গোড়ায় সার হিসেবে দেয়। তীরেও কাউকেই দেখা গেলো না। সবাই ঘরের ভিতর বসে বসে মুনাফা গুনছে আর দিন গুনছে কবে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে জান বাঁচাবে।

ক্রিস্টোফার প্রায় পনেরোটা বর্ষা পার করে ফেলেছে এখানে-মানে ওর প্রায় পুরো জীবনটাই, মাঝে শুধু তিন বছর ছিলো জাঞ্জিবারে। ভারতের গরম পরিবেশে এসে দেখা যায় অনেকেই নিস্তেজ হয়ে এমনকি মারাও পড়ে, সেখানে ক্রিস্টোফারের চেহারা আরো খোলতাই হয়েছে। লম্বা একহারা গড়ন, শক্ত চোয়াল, গাঢ় বাদামী চোখ। ওর বাবার কোনো বৈশিষ্ট্যই পায়নি বলা চলে। সবাই কথাটা বলে তবে অবশ্যই ওর বাবার আবডালে।

এই গরমের মাঝেও ও কাঁপছে। এক কাহিল হয়ে যাওয়া প্রহরী ওকে ফটক দিয়ে ঢুকতে দিলো। উঠোন পেরিয়ে ও গভর্নরের বাসভবনে চলে এলো। দ্বীপটা যখন পর্তুগিজদের অধীনে ছিলো সেই সময়কার একটা ধ্বংসাবশেষ এই কুঠিটা। একটা মনোরম তিন-তলা বাড়ি, এখনো সদর দরজায় পর্তুগিজ প্রতীক খোদাই করা আছে। দুর্গের দেয়াল ছাড়িয়ে ওটার মাথা দেখা যায়। মূলত ইংরেজরা দখল নেওয়ার পর ওরা বাড়িটাকে ঘিরে দুৰ্গটা নির্মাণ করে।

যদিও এটা নিজের বাড়ি, তবুও ভিতরে ঢুকতে যেতেই দুশ্চিন্তায় ক্রিস্টোফারের শ্বাস ভারি হয়ে এলো। সিঁড়ির বেয়ে উঠে গভর্নরের অফিসের ভারি কাঠের দরজায় আস্তে টোকা দিলো ও।

“এসো,” পরিচিত কণ্ঠটা গর্জে উঠলো।

গাই কোর্টনী নিজের ডেস্কের পিছনে বসে আছে। উল্টোদিকে তিনটা বিশাল বিশাল জানালা। এগুলো দিয়ে সে সহজেই ঘাটের প্রতিটা জাহাজের উপর নজর রাখতে পারে। ডেস্কের উপর কাগজপত্র পরিপাটি করে সাজানো-চিঠিপত্র, আইনের বই, বিভিন্ন ঘোষণাপত্র, টাকার রসিদ। এসব দিয়েই চালিত হয় কোম্পানির ব্যবসা। লোকে বলে কোম্পানির ব্যবসা নাকি জাহাজের গায়ে লাগা বাতাসের চাইতেও দ্রুত চলে। দেয়ালের বাম দিকে গাই-এর বাবা হাল এর একটা তৈলচিত্র ঝোলানো। ওনার হাতে একটা দুর্দান্ত সুন্দর তরবারি। সোনালি হাতলে একটা বিশাল নীলকান্ত মণি খোদাই করা তাতে। ছবিটা আঁকা-ও হয়েছে এতো দারুণভাবে যে ছবির ভিতর থেকেই পাথরটা দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

একজন কৃষ্ণাঙ্গ চাকর গাই-এর পাশে দাঁড়িয়ে ময়ূরের পেখম দিয়ে বানানো পাখা দিয়ে বাতাস করছে। গাই ক্রিস্টোফারের দিকে ফিরেও তাকালো না।

“কি হয়েছে?” সপাং করে জানতে চাইলো গাই।

ক্রিস্টোফার ওর হ্যাঁটের কোনাটা একটু তুলে লম্বা একটা দম নিলো। “আমি বিয়ে করতে চাই, বাবা।”

গাই হতভম্ব হয়ে গেলো। “বিয়ে?” ও এমনভাবে শব্দটা আবার বললো যেনো ওটা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। “এই ভূত মাথায় চাপলো কি করে?”

“আমার বয়স হয়েছে।”

“সেটা কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। তা তোমার মোটা বুদ্ধিতে কোন মেয়েটাকে মনে ধরেছে শুনি?”

“রুথ রেড্ডি।”

 “কে?”

 “কর্পোরাল রেড্ডির মেয়ে। দুর্গের সৈন্যদলে আছেন উনি।”

“ঐ ফালতু মেয়েটা? ও তো একটা মাগী ছাড়া কিছু না!” গাই-এর অভিব্যক্তি বদলে গেলো। মাথাটা পিছনে হেলিয়ে হাসতে লাগলো সে। “আমিতো ভেবেছিলাম তুমি আসলেই বিয়ে করতে চাও। তোমাদেরকে প্রায়ই একসাথে দেখা যায় সেই খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম হয়তো তোমার বয়সী বাকি ছেলেপুলেরা যেমন করে সেরকম তুমিও বোধহয় সুযোগ পেলে আস্তাবলের পিছনে নিয়ে ওর সাথে একটু ঢলাঢলি করো। আমি বোধহয় তোমার সম্পর্কে একটু বেশিই ভেবে বসেছিলাম।

“আমি ওকে ভালোবাসি।”

গাই অর্ধনিমীলিত চোখে তার ছেলেকে জরিপ করলো। ছেলেটা সবসময়েই ওর বাবার মতোই গোঁয়ার। কিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, কিন্তু একবার নিলে আর ফেরানো যায় না। একজন ডাকসাইটে ব্যবসায়ী হওয়ার সমস্ত লক্ষণ ওর মাঝে আছে। দুর্দান্ত মেধাবী, গাই অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলতেও পিছপা হয়নি, উদ্দেশ্য ছিলো শুধু ওর ভিতরে যতো অপছন্দনীয় গুণাবলি আছে সেগুলো যাতে দূরীভূত হয়। যাতে ভবিষ্যতের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ও শতভাগ প্রস্তুত থাকতে পারে। কিন্তু এখনো ছেলেটা কিছুই শিখলো না।

সম্ভবত জবরদস্তি করার চাইতে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজ আদায় করা সহজ। গাই তাই স্বর নরম করে বললো।

“তোমার বয়সে কেমন লাগে সেটা আমি জানি। আমি যখন তোমার মতো কমবয়সী এক বেকুব ছিলাম তখন এক মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এতোটাই বেশি যে আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম তার জন্যে। কিন্তু পরে আবিস্কার করলাম যে মেয়েটা আসলে একটা বাজারের মাগী। সামান্য কয়েক রুপি পেলেও সে যে কারো সাথে শুয়ে পড়ে।”

এতো বছর পরেও স্মৃতিটা মনে আসতেই গাই রাগে গরম হয়ে গেলো। জোর করে নিজেকে শান্ত করলো ও। তবে একবার তার বৌ হওয়ার পর ও বহুবার এর বদলা সুদে আসলে আদায় করেছে।

“আপনার ভুল আমার ভাবার বিষয় না বাবা।”

“কিন্তু তোমারগুলো আমার চিন্তার বিষয়। তুমি এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারবে না। শুধু তোমার বাবা হিসেবে না। বোম্বে প্রদেশের গভর্নর হিসেবে আমি এই বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা দিলাম। জানো নিশ্চয়ই আমার অনুমোদন ছাড়া এখানে কোনো বিয়েই বৈধ হয় না।”

“নিজের ছেলের সাথে এমন করবেন আপনি?”

“যখন সে উল্টা পাল্টা কাজ করে? অবশ্যই, গাই চেয়ারে হেলান দিলো। “তোমার বিয়ে করার শখ? আমি ব্যবস্থা করবো। তোমার বয়স হয়েছে, তোমার বিয়ে করার ইচ্ছা হতেই পারে। আমার আগেই এ ব্যাপারটা দেখা উচিত ছিলো। তাহলে আজকের এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। আমি তোমার জন্যে উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে বের করবো। স্যার নিকোলাস চিল্ডসের একজন ভাতিজি আছে। অথবা আর্ল অফ গোডলফিনের নাতনীকেও দেখা যায়। এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যার সাথে বিয়ে হলে তোমার ভবিষ্যতের পথটাও মসৃণ হয়।”

সাথে আমারও, মনে মনে ভাবলো গাই। অবশ্য না বললেও বোঝা কষ্ট না। ছেলে যদি বাবার কাজে না লাগে তো সেই ছেলের দরকার কি? এর মধ্যেই গাই মনে মনে হিসেব করা শুরু করেছে যে জায়গা মতো বিয়ে হলে ও কোম্পানির আরো কতোগুলো শেয়ার বাগাতে পারবে। হয়তো কোর্ট অফ ডিরেক্টরসেও একটা জায়গা পাওয়া যাবে, এমনকি রাজদূত হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু হবে না।’

 ক্রিস্টোফার কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতো সাধ্য সাধনার পরেও ছেলেটা সারাজীবন রামগড়রের ছানা-ই থেকে গেলো, মনে মনে ভাবলো গাই। অকৃতজ্ঞ, গাই ওর জন্যে কতোটা স্বার্থ ত্যাগ করেছে সেটা কোনোদিন বুঝলো না।

“আমি লন্ডন থেকে খবর পেয়েছি যে স্যার নিকোলাস চিল্ডস এর শারীরিক অবস্থা ভালো না,” গাই বলতে লাগলো। “একদিন হয়তো লেডেনহাল স্ট্রিটের ঐ অফিসটায় তুমিই বসবে।”

 এতো ভালো একটা খবরেও ছেলেটার চেহারায় কোনো আনন্দের ছাপ পড়লো না। গাই-এর মনে হলো ক্রিস্টোফার সম্ভবত এখনো কর্পোরালের মেয়েটার সাথে শোয়নি। ও সম্ভবত আদর্শ বিয়ে নামের কোনো উদ্ভট চিন্তা থেকে নিজেকে এসব থেকে বিরত রাখছে। গাই-ও যখন এই বয়সী ছিলো, ও ও একটা বিশুদ্ধ আর পবিত্র ভালোবাসায় বিশ্বাস করতো। কিন্তু ওর ভাই টমের কল্যানে সেই বিভ্রম কেটে যায়।

“আমি জানি যে তোমার চাহিদা আছে, সেসবকে অবহেলা করে আমি অপরাধ করেছি,” বলতে বলতে ও ডেস্কের একটা ড্রয়ার থেকে একটা প্যাগোডা খচিত স্বর্ণমুদ্রা বের করে ক্রিস্টোফারের দিকে ছুঁড়ে দিলো। “তোমার ভবিষ্যৎ বৌয়ের কাছে থেকে যৌতুক হিসেবে এর চাইতে অনেক বেশি আদায় করা হবে। আপাতত এটা নিয়ে কাস্টম হাউজের ওখানে যে বেশ্যাপাড়াটা আছে ওখানে যাও। ওটাই সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অফিসারেরা ওখানেই যায়। ওখান থেকেই একটা মেয়েকে নিয়ে একটু ফুর্তি করে এসো।” মিটিমিটি হাসলো গাই। “খোদার দোহাই ওখানেও কারো প্রেমে পড়ে যেও না।”

ক্রিস্টোফার এমনভাবে মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে রইলো যেনো আগে কখনো দেখেনি। ও মুদ্রাটা তুলে ধরলো যাতে ওটার স্বর্ণালি আভা ওর মুখের উপর পড়ে।

“আপনি এতো কিছু করবেন? আমার জন্যে?”

পিতা হিসেবে গাই-এর খানিকটা গর্ব বোধ হলো। “আজীবনই আমি তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করেছি।”

মুদ্রাটা ক্রিস্টোফারের আঙুলের ফাঁক গলে ডেস্কের উপর পড়ে বনবন করে ঘুরতে লাগলো।

“আপনি একটা শয়তান। একটা নিষ্ঠুর, স্বার্থপর দানব। আপনার বুকের হৃৎপিণ্ডের জায়গায় ফাঁকা একটা বক্স বাদে কিছুই নেই। আপনি নিজের স্বার্থ চরিতার্থের জন্যে আপন সন্তানের সুখকেও বিসর্জন দিতে পিছপা হন না। আমি আপনার খেলার ঘুটি হবো না।”

গাই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ালো। এতোটাই রেগে গিয়েছে যে ধাক্কা দিয়ে ডেস্কটাকে সামনে ঠেলে দিলো।

“এতো বড় সাহস তুই আমার কথার উপর কথা বলিস?”

ক্রিস্টোফার তাতে ঘাবড়ালো না। আমি এখন আর ছোট ছেলে নেই যে আপনি যখন ইচ্ছে ধরে পেটাবেন। আমার যেমন ইচ্ছা আমি সেভাবে নিজের জীবন সাজাবো। আপনার পছন্দ মতো না। আমার যেখানে ইচ্ছা আমি যাবো, যাকে ইচ্ছা বিয়ে করবো।”

 গাই-এর গলার শিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যেতে লাগলো। “খবরদার, ক্রিস্টোফার! এই সমুদ্রের দুই কূলে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গিয়ে তুই আমার হাত থেকে নিস্তার পাবি।”

“আপনাকে আমি ভয় পাই না।”

“পাওয়া উচিত,” ভয়ানক স্বরে বললো গাই। “তোকে আমি শেষ করে দিতে পারি।”

ক্রিস্টোফার তার দিকে তাকিয়ে রইলো। “কি বলছেন বুঝে বলছেন তো? কোন পদের মানুষ নিজের ছেলেকে এই কথা বলতে পারে? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে আপনি আমার বাবা না।”

কথাটা গাই-এর এমন এক জায়গায় আঘাত করলো যেটা সম্পর্কে ক্রিস্টোফারের কোনো ধারণাই নেই। প্রচণ্ড রাগে মাথা খারাপ করে গাই একটা রূপার কাগজ কাটা ছুরি হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ক্রিস্টোফারের দিকে। ছুরিটা ক্রিস্টোফারের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দরজায় বিধে কাঁপতে লাগলো।

ক্রিস্টোফার এক চুল নড়লো না। এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়েই রইলো। ওরও রাগে সারা শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সামলে রেখেছে। গাই এর আগে খেয়াল করেনি যে তার ছেলে কতোটা লম্বা হয়ে গিয়েছে।

“বিদায়, বাবা। আমাদের আর দেখা না হওয়াই ভালো হবে।”

“দাঁড়াও,” গাই ডাক দিলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার আর ওর ডাক শোনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই।

*

সুর্য কিরণ একেবারে বজ্রপাতের মতো ক্রিস্টোফারের চোখে আঘাত করলো। মাত্র যা করে এসেছে তার ভয়াবহতা মনে হতেই ওর মাথা ঘুরে যাচ্ছে। একরকম টলতে টলতেই রাস্তাটা পার হয়ে এলো। সমুদ্রতীরের সাথে দেখা করলো রুথ। জায়গাটা মরচে পড়া নোঙ্গর আর ছিঁড়ে যাওয়া দড়াদড়িতে ভরা। শেষ দেখা হওয়ার পর এক ঘণ্টাও পার হয়নি, তবুও রুথ দুই হাত বাড়িয়ে এমনভাবে ক্রিস্টোফারকে জড়িয়ে ধরলো যেনো কতোকাল ওদের দেখা হয় না।

নয়মাস আগে রুথ ওর বাবার সাথে এখানে এসেছে। ওরা যে ইন্ডিয়াম্যানে করে এসেছিলো সেটা ক্রিস্টোফারের চোখের সামনেই বন্দরে এসে নোঙ্গর করে। দুর্গের দেয়ালের পাশে বসে ও জাহাজের যাত্রীবাহী ডিঙ্গিটায় রুথকে এক ঝলক দেখতে পায়। মাত্র ষোল বছর বয়স, শঙ্খের মতো গায়ের রঙ, লাল টকটকে চুল, কোনো মেয়েতে এই দুই রঙের সম্মিলন এর আগে দেখেনি ও। নৌকাটা দুর্গের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রুথ চোখ তুলে তাকায়, চোখে ওর নতুন ঠিকানা সম্পর্কে সন্দিহান কৌতূহল। তখনই ক্রিস্টোফারের নজরে পড়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে ও নিজের উরুতে এমন, এক কাঁপুনি টের পায় যা আগে কখনোই পায়নি। কামনার আবেশে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো ওর।

বোম্বেতে এক ইংরেজ মেয়ের আগমন অনেকটা মরুভূমিতে গোলাপ ফোঁটার মতো। আর সেই ফুলের সুবাস নিতে পুরুষ মানুষের অভাব নেই এখানে। কিন্তু গাই কোর্টনীর ছেলে রুথের ব্যাপারে আগ্রহী জেনে সবাই হাত গুটিয়ে নেয়।

তারপরেও সবকিছু হতে সময় লাগে অনেক। ক্রিস্টোফার মেয়েদের সাথে কথাই বলতে পারতো না। কারণ দাসী বাদে আর কোনো মেয়ের সাথে কখনো কথা হয়নি ওর। কতো রাত ও জেগে কাটিয়েছে রুথ এর ঠোঁটের স্বাদ কেমন হবে সেটা চিন্তা করে করে। নিজের কাপুরুষতায় নিজেকে হাজারবার গালাগাল করে কাটিয়েছে আরো কতো রাত।

 রুথ নিজেও ছিলো অনেক ধৈর্যশীলা। ও বুঝতে ক্রিস্টোফারের আসলে কেমন লাগে, কিন্তু ওর বাবা মা সেটা বুঝতে না। ও ক্রিস্টোফারের ভিতরের ভালোবাসাটা ধরতে পেরেছিলো, সেটাকেই ও মমতা আর যত্নের দিয়ে বের করে এনেছে। গভর্নরের বাড়িতে একটা সমাবেশ হয়েছিলও একবার। সেখানে সৈন্যদের পরিবারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়, কারণ এখানে মহিলার সংখ্যা ছিলো একদমই কম। সেখানে রুথ ক্রিস্টোফারকে নাচের আমন্ত্রণ জানায়। প্রথম যখন ক্রিস্টোফার রুথকে স্পর্শ করে, ওর সারা শরীর কেপে ওঠে। সারা রাত নেচেছিলো ওরা সেদিন। কিন্তু তাতে ওর প্যান্টের সামনের দিকটা ফুলে আটসাট হয়ে গিয়েছিলো, মনে মনে ভাবছিলো যে সবাই নিশ্চয়ই ওকে দেখে। হাসছে। কিন্তু রুথ হাসলো না। ও ক্রিস্টোফারকে নাচে সাহায্য করতে লাগলো, আর নাচের ফাঁকে যখনই ওরা মুখোমুখি নাচতো তখন ও একটু সামনে এগিয়ে যেতো যাতে ক্রিস্টোফার পরনের পাতলা কাপড়টার উপর দিয়েই ওর শরীরের প্রতিটা বাক টের পায়।

 এরপর ওরা দুজন প্রায় প্রতিদিন দেখা করতো। গোলঘরের পিছনে, বা ব্যাক বে-র সৈকতে, নারকেল বাগানের আড়ালে ওরা সময় কাটাতে। হাতে হাত রেখে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে ওরা। রুথ ক্রিস্টোফারকে ইংল্যান্ডের গল্প বলতো। ওখানে ক্রিস্টোফারের বাড়ি হলেও কখনো সেটা দেখার ভাগ্য হয়নি। রুথ এমন অনেক কিছু দেখেছে যা ক্রিস্টোফার শুধু বইয়ের পাতাতেইও পড়েছে বা ওর বাবার অধীনস্তদের আলাপচারিতায় শুনেছে। রুথ ক্রিস্টোফারের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখে কথা বলতো। দেখা যেতো রুথ বকবক করেই চলেছে আর ক্রিস্টোফার ওর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই আছে।

প্রথমবার চুমু খাওয়ার পর ক্রিস্টোফারের মনে হয়েছিলও যে জীবন এর চাইতে মধুর হতে পারেনা। পরে রুথ ক্রিস্টফারকে ওর কাচুলি খুলে বুকে হাত দিতে দিয়েছে। ও নিজেও ক্রিস্টোফারের পায়জামায় হাত ঢুকিয়ে ওর পুরুষাঙ্গ নাড়াচাড়া করেছে। কিন্তু এর বেশি কিছু ক্রিস্টোফারকে করতে দেয়নি। “বিয়ের আগে এসব পারবো না,” জোর দিয়ে বলেছে রুথ। আর ক্রিস্টোফার ওর দুই স্তনের মাঝে মুখ ডুবিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে, “তোমাকেই আমি বিয়ে করব।”

এখন রুথ ক্রিস্টোফারের উভ্রান্ত চেহারা দেখে দুই হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো। “কি বললেন বাবা? বলো সোনা? খারাপ লাগছে? বাবা অনুমতি দিয়েছেন?”

 “না।” ক্রিস্টোফার ধপাস করে ডাঙ্গায় তুলে রাখা একটা ভাঙাচোরা নৌকার খোলের উপর বসে পড়লো। ধাক্কায় একগাদা মাছি ভনভনিয়ে উড়ে গেলো।

রুথের নিষ্পাপ নীল চোখে অশ্রু জমলো। “কি করবো আমরা এখন? আমিতো তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। এরচে মরে যাওয়াই ভালো হবে।”

ক্রিস্টোফার চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই চোখ ধাঁধানো আলোয় ঠিকমতো চিন্তা ভাবনা করা যাচ্ছে না। ও কপাল ডলতে ডলতে বাবার সাথে হওয়া কথোপকথনটা আরো একবার ভাবতে বসলো। রুথের জন্যে ওর ভালোবাসাটা এতো খাঁটি, এতো পবিত্র! ওর বাবা কিভাবে সেটাকে অস্বীকার করেন? কতো বড় সাহস তার? ওর এতো বেশি হতাশ লাগতে লাগলো যে একবার চিন্তা করলো একটা নোঙ্গর পায়ে বেঁধে সাগরে ঝাঁপ দেবে কিনা। সব শেষ করে দেবে। দমবন্ধ লাগছে ওর। বাবাকে বোঝানো কখনোই সম্ভব না।

কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না।

“বোষে ছেড়ে চলে যাবো,” আচমকা বললো ও।

“আমিও যাবো তোমার সাথে!”।

 ক্রিস্টোফার মাথা নাড়লো। “আমার বাবা আমাকে এটা কানাকড়িও দেবে না। আমাকে নিজের পরিশ্রমে নিজের ভাগ্য গড়তে হবে। আর সেখানে মহিলাদেরকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানেই থাকো, তোমার পরিবারের সাথে, আর আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করো।”

“পারবো না।”

“পারতেই হবে। আমি জানি কতোটা কষ্ট হবে তোমার, কিন্তু আমাদের জন্যে তোমাকে পারতেই হবে।” ক্রিস্টোফার উঠে দাঁড়িয়ে রুথকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। কামনার আগুনে জ্বলে যাচ্ছে ও, কিন্তু তারচে বড় কথা ওর বাবাকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। “তুমি এখানেই থাকো, তাহলে বাবা ভাববেন যে উনি-ই জিতেছেন। কিন্তু যখন আমি ফিরে আসবো, তখন আমার জয় সম্পূর্ণ হবে-সেই সাথে আমাদের দুঃখেরও শেষ হয়ে যাবে।”

রুথ ক্রিস্টোফারের ঠোঁটে চুমু খেলো। “কথা দাও ক্রিস্টোফার, কথা দাও যে তুমি আমাকে সুখী করবে।”

“প্রতিজ্ঞা করলাম সোনা। যদি তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করো, আমি এতো বেশি টাকা কামাবো যে আমার বাবাও আমাদেরকে ছুতে পারবে না।”

 “আমি অপেক্ষা করবো। ঈশ্বরের কসম। তুমি বিশ বছর পরেও যদি ফিরে আসো, তবুও আমি অপেক্ষা করবো। প্রতিদিন এখানে বসে তোমার ফেরার অপেক্ষা করবো।”

“ওডিসাস আর পেনেলোপির মতো,” হাত নেড়ে বললো ক্রিস্টোফার।

 রুথের ভ্রু কুঁচকে গেলো। “কাদের মতো?”

“কাদের মতো সেটা ব্যাপার না।” বলতে বলতে ও গায়ের কোটটা খুলে ফেললো। ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে গিয়েছে সেটা। আর এখন যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, রওনা দিতে আর তর সইছে না ক্রিস্টোফারের। চোখের উপর হাত দিয়ে ও বন্দরের দিকে তাকালো। ইস্ট ইন্ডিয়াম্যানটা তখনও বাধা অবস্থায় দুলছে। তবে একটা ছোট সওদাগরী জাহাজের ডেক এ নড়াচড়া দেখা গেলো। জাহাজটা সমুদ্রে নামানোর জন্যে প্রস্তুত করছে ওটার ক্রু-রা।

“জোয়ার আসলেই জাহাজটা ছেড়ে যাবে। ওটায় চড়ে কোথায় যাওয়া যায় দেখি।” আবার রুথকে চুমু খেলো ক্রিস্টোফার। ওর শক্ত বাহুর স্পর্শে রুথের শরীরেও শিহরণ বয়ে গেলো।

“আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো কিন্তু।”

“কথা দিচ্ছি করবো।”

*

সাথে নেওয়ার মতো ক্রিস্টোফারের কিছুই নেই। ওর সব সম্পত্তি রয়ে গিয়েছে গভর্নরের বাড়িতে, ওর ঘরে। আর ওখানে ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না। ক্রিস্টোফার ঘাটে গিয়ে একটা ডিঙ্গি নৌকাকে ডেকে বললো ওকে সওদাগরি জাহাজটায় নিয়ে যেতে। জাহাজটার নাম জোসেফ। আলাদা একটা আড়কাঠে খোদাই করে লেখা। ও জাহাজে উঠে পড়লো। বেশিরভাগ ক্রু ই ভারতীয়, সবার গায়ের রঙ গাঢ়, গায়ে কাপড় নেই বললেই চলে। মালপত্র বোঝাই চলেছে। ডেক-এর একমাত্র শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে দেখে মনে হলো সে-ই মাস্টার। লম্বা একটা লোক, চুল একেবারে খুলির সাথে ছেটে রাখা। পেশল বাহুতে একটা মৎস্যকুমারীর ট্যাটু। মালপত্র ওঠানামা তদারকিতে বিরতি দিয়ে ক্রিস্টোফারের দিকে এগিয়ে এলো।

“কি চাই?” গর্জে উঠলো লোকটা।

 “আপনার জাহাজে কাজ করতে চাই।”

মাস্টার ওর আপাদমস্তক পরখ করলো। দেখে মুখ বিকৃত করে বললো, “আমি চিনি তোমাকে। তুমি গভর্নরের ছেলে, ক্রিস্টোফার কোর্টনী

ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালো।

“শালা একটা খবিশ?”

লোকটা এটো কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো যে ওর মুখের থুতু এসে ক্রিস্টোফারের মুখে লাগলো। ক্রিস্টোফার নড়লো না।

“তো?” মাস্টার বললো। “আমি তোমার বাবাকে গালাগাল করে যাবো আর তুমি কিছুই বলবে না? কেমন ছেলে তুমি?”

 “আমার বাবাকে পরোয়া করলে তো আর আমি এখানে আসতাম না।”

মাস্টার চটাশ করে ওর গালে একটা চড় কষালো। “যথেষ্ট বেয়াদবি হয়েছে। জাহাজে থাকতে হলে বড়দের সম্মান করতে হবে, নইলে ভাগো।”

সাথে সাথে অবশ্য ক্রিস্টোফার প্রত্যুত্তরে মারতে পারে ভেবে নিজের মুখের সামনে হাত তুলে আড়াল করলো। ক্রিস্টোফার বহু কষ্টে আঘাত করা থেকে বিরত থেকে নিজেকে শান্ত রাখলো। ওর বাবার কাছে থেকে যদি একটা জিনিস শিখে থাকে সেটা হচ্ছে মার খেয়ে কিভাবে হজম করতে হয়।

মাস্টার ডেক-এ থুতু ফেললো। ক্রিস্টোফারের পায়ের বুড়ো আঙুলের ঠিক পাশে পড়লো সেটা।

“এর আগে জাহাজে কাজ করেছিস?” সম্বোধন বদলে গেলো মাস্টারের।

“না, স্যার।”

“কখনো সমুদ্রে গিয়েছিস?”

 “না, স্যার।”

“তাহলে কোন দুঃখে আমি তোমাকে আমার. জাহাজে নেবো? এটা তো। তোমার বাবার সোনায় মোড়া ইন্ডিয়াম্যান না যে কয়েকশো কামলা থাকবে জাহাজ চালানোর জন্যে। এখানে থাকতে হলে খেটে খেতে হবে, নইলে ঈশ্বরের কসম আমি এতো জোরে তাকে পানিতে ছুঁড়ে মারবো যে পড়ার শব্দটা পর্যন্ত কেউ টের পাবে না।”

 “আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পারি স্যার।”

“কঠোর পরিশ্রমের ক সম্পর্কেও তোর ধারণা নেই।” বলে মাস্টার ক্রিস্টোফারের হাতটা টান দিয়ে নিয়ে তালু উল্টে ধরলো। “এই দুধ-সাদা চামড়ার দিকে তাকা। জীবনে এই হাত দিয়ে এক গাছি রশিও পাকাস নাই।” তারপর ঘুরে বললো। “জাহাজ থেকে নেমে যা, নইলে ছুঁড়ে ফেলে দেবো।”

“দাঁড়ান,” ক্রিস্টোফার ডাকলো। তারপর ও ডেক-এর এক কোণে পড়ে থাকা কাপড়ের একটা গাট্টি তুলে নিলো। “কি এটা? কালবেলে? রেশমের সাথে কার্মানিয়া উল দিয়ে বোনা, তাই না? আর এটা হচ্ছে জুরিস, সবচে বেশি দিন টেকে এই সুতি কাপড়। এটা হচ্ছে

 “আমার জাহাজ ছেড়ে ভাগ,” মাস্টার ক্রিস্টোফারের জামার গলার কাছে মুঠো করে ধরে শূন্যে তুলে ডেক-এর অন্য পাশে নিয়ে গেলো। তারপর জাহাজের কিনার দিয়ে ঠেলে দিলো নিচে।

 ‘আট রুপি, হাফাতে হাফাতে বললো ক্রিস্টোফার। “প্রতি গজ আট রুপি। কালবেলের জন্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আট রুপি দেবে আর জুরিস এর জন্যে ছয় রুপি।”

ও জাহাজের পাশ ধরে ঝুলে রইলো। মাস্টার ওর কাছে মুখ নামিয়ে আনলো। পিছনে নীল আকাশের প্রচ্ছদে তার পোড় খাওয়া মুখটা দেখতে অদ্ভুত লাগছে।

“তুই এসব কিভাবে জানিস?”

“বাবার হয়ে অনেক কাজ করেছি আমি। লেজার বইতে জিনিসপত্রের দাম লিখতাম। কোম্পানি কোন বন্দরে কোন মালের জন্যে কতো দাম দেয়, তার সবই আমার জানা।” বিশাল হাতটা ওর গলা চেপে ধরে টেনে আবার তুললো। দম বন্ধ হয়ে এলো ক্রিস্টোফারের। “এসব তথ্য কিন্তু আপনি কাজে লাগাতে পারবেন।”

মাস্টার ক্রিস্টোফারকে ছেড়ে দিলো। ডেক-এ আছাড় খেয়ে পড়লো ও। পড়েই পিঠ চেপে ধরলো।

ভারি বুটের লাথি পড়লো বুক বরাবর।

 “উঠে দাঁড়া।”

পিঠের ব্যথা আর বমি বমি ভাব দুটোকেই অগ্রাহ্য করে ক্রিস্টোফার উঠে দাঁড়ালো। মাস্টার ওকে ক্ষুধার্ত হাঙরের দৃষ্টিতে জরিপ করলো কিছুক্ষণ।

“আমি তোকে আমার নবীশ হিসেবে নেবো। মাসে চার রুপি করে পাবি। থাকা খাওয়া এর বাইরে।” ক্রিস্টোফারের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে হেসে দিলো লোকটা। “তোর কি মনে হয়? তোর দাম আরো বেশি? শালা নরম চামড়ার দামড়া ছোঁড়া? তাহলে আর একটা জাহাজ খুঁজে নে, যা।”

ক্রিস্টোফার হাত মুঠি করে ফেললো। কাজটা যে সহজ হবে না তা তো। আগেই জানা ছিলো, নিজেকে বললো ও। নিজের ভাগ্য গড়ার আগে ব্যবসাটা সম্পর্কে জানতে হবে।

“আমি রাজি।”

মাস্টারকে দেখে মনে হলো হতাশ হয়েছে। ক্রিস্টোফার বুঝলো লোকটা ওকে আবার আঘাত করার মওকা খুঁজছিলো। তবে ও খুব বেশি ভয় পেলো না। গাই-এর কাছে বড় হওয়ায় এসব ওর কাছে এখন পানি ভাত হয়ে গিয়েছে।

মাস্টার রেজিস্টার খাতা আনলে ক্রিস্টোফার সেখানে সই করলো। বাকি সব ভারতীয় ক্রুদের কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং-এর মতো লেখার মাঝে ওর ঝকঝকে হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছিলো ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরের মাঝে শান্ত দ্বীপমালা।

 গরমের কারণে লেখা শেষ না হতেই কালি শুকিয়ে গেলো। মাস্টার ঠাস করে বইটা বন্ধ করে বললো, “এখন থেকে তোর মালিক আমি। যদি কখনো দেখেছি কাজে ফাঁকিবাজি করছিস, তাহলে যে কি করবো সেটা খোদা মালুম। আমার জাহাজে যতোক্ষণ আছিস ততোক্ষণ তোর বাবার নামের-ও কোনো মূল্য নেই। তোর চামড়া সাদা আর হাতের লেখা ভালো বলে ভাবিস না যে পার পেয়ে যাবি। উল্টাপাল্টা কিছু করলে ওই কালাগুলোর মতোই ঠেঙানি খাবি। বোঝা গিয়েছে?”

 “জ্বী স্যার।”

মাস্টার ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ক্রিস্টোফার বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে নিলো। কাধও আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে নেমে গেলো নিচে। ভঙ্গিটা ও ওর বাবার হাতে মার খাওয়ার সময় আয়ত্ত্ব করেছে। মাস্টার ঘোত ঘোত করলো কিন্তু আর কিছু বললো না।

“এখন কাজে যা।”

মাত্র দশ মিনিটের মাঝে ক্রিস্টোফার বুঝে ফেললো কোন পাকে এসে পড়েছে ও। গায়ের দামি উলের পোশাকটা খুলে কোমরে বেঁধে বাকি খালাসিদের সাথে হাত লাগিয়ে কপিকল দিয়ে নোঙ্গর তোলা শুরু করলো। ওর নগ্ন পিঠে আগুন ছড়াতে লাগলো সূর্য। কপিকলের দড়ির টানে হাতে কড়া পড়ে গেলো। তবুও ও মাথা তুলে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করলো। ডাঙ্গায় তাকাতেই দেখলো পানির ধারে একটা জটলা, কোম্পানির ইউনিফর্ম পরা একদল লোক জোসেফ-এর দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। ওটা কি ওর বাবা? হয়তো উনি নিজের মন বদলে ফেলেছেন।

আচমকা পিঠে প্রচণ্ড একটা গুতো খেয়ে সম্বিত ফিরলো ওর। ঝাঁকি দিয়ে উঠে ফিরে দেখে কপিকলের দণ্ডটা ঝুলতে ঝুলতে ওর পিঠে এসে বাড়ি খেয়েছে। ও আবার ওটা ধরে নিজের কাজ করা শুরু করলো। আড়চোখে দেখলো মাস্টার জাহাজের পাশ থেকে ওর দিকে নজর রাখছে আর হাতে ছোট এক টুকরো মোটা দড়ি দোলাচ্ছে। উদ্দেশ্য ওটা দিয়ে ওকে মারবে।

“মন কোথায় যায় রে মুরগির বাচ্চা? আর একবার ভুল করবি তো কি করি দেখিস।”

“ওর কথায় ক্ষেপে যেওনা যেনো,” পিছন থেকে ফিসফিস করে বললো কেউ। লোকটা বলছে পর্তুগিজ ভাষায়। মালাবার উপকূলে এটাই হচ্ছে লিংগুয়া ফ্রাংকা (সবাই ব্যবহার করে এমন সাধারণ ভাষা)। ক্রিস্টোফার গলা লম্বা করে পিছনে হেললো। তখনও কপিকল টেনে চলেছে। একটা একহারা ছেলে নজরে এলো। গায়ের রঙ কালো কিন্তু চোখ জোড়া বেশ উজ্জ্বল। ওর পরের দণ্ডটাই ঠেলছে সে। ক্রিস্টোফারের চাইতে ওর বয়স কম, কিন্তু হাতে কড়া পড়ে শক্ত হয়ে আছে, এই বয়সেই গায়ে কিলবিল করছে পেশি।

“ক্যাপ্টেন ক্রফোর্ড একটা আস্ত শয়তান, আবার ফিসফিসিয়ে বললো ও। কপিকলের ক্যাচকোচের কারণে শোনাই যায়না বলা যায়। কিন্তু ওনাকে এড়ানোর উপায়ও আছে। তুমি যতোই ওনার সাথে শক্তি দেখাবে, উনি ততোই তোমাকে ভাঙার চেষ্টা করবে।”

অবশেষে উঠে এলো নোঙ্গরটা। দ্রুত ওটাকে শক্ত করে জায়গামতো বেঁধে ফেলা হলো। পালগুলো তুলে দিতেই কিছুক্ষণের মাঝে সাগর ছুঁয়ে আসা বিকেলের মৃদুমন্দ বাতাসে ফুলে উঠলো ওগুলো। আদেশমতো ক্রিস্টোফার পালের দড়িগুলো টেনে ধরে রাখলো। সেটা করতে গিয়ে কয়েকবার ক্রফোর্ডের দড়ির বাড়িও পড়লো পিঠে। কিন্তু একটা বারও পিছু ফিরে দেখলো না।

সেই রাতে ও জাহাজের পিছন দিকে ডেক-এর উপর বিছানা পাতলো। পিঠের নিচে শক্ত কাঠের তক্তা। তার উপর ব্যথায় সারা শরীর কাতরাচ্ছে। দাতে চেপে সেগুলো সহ্য করে তারার দিকে চেয়ে রইলো। আজ সকালেও ও গভর্নরের বাড়ির পালকের বিছানায় ঘুম থেকে উঠেছে। চাকরেরা বলার আগে ওর প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট হয়েছে। আর এখন শোয়ার জন্যে ওর এমনকি একটা কম্বল পর্যন্ত নেই।

একটা কালো অবয়ব এসে ওর পাশে বসলো। অন্ধকার সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠলো লোকটার। কপিকল টানার সময় যার সাথে কথা হয়েছিলো সেই ছেলেটা।

“আমার নাম দানেশ,” নিজের পরিচয় দিলো ছেলেটা।

“ক্রিস্টোফার।”

“তোমার বাবা আসলেই বোম্বের গভর্নর?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি ওনাকে খুন ঘেন্না করো, তাই না?”

ক্রিস্টোফারের গাই-এর চোখের দৃষ্টিটা মনে পড়লো।

 “হ্যাঁ, করি।”

 দানেশ ওকে একটা কম্বল ধরিয়ে দিলো। “আর এই অভিযান শেষ হতে হতে তুমি ক্রফোর্ডোকে আরো বেশি ঘৃণা করবে।”

*

পরের তিন সপ্তাহ ছিলো ক্রিস্টোফারের জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর সময়। দ্বিতীয় দিন ক্রফোর্ড ওকে মাস্তুলের মাথায় উঠে পাল খাটাতে আদেশ দেয়। মাস্তুলে অর্ধেক ওঠার পর ক্রিস্টোফার নিচে তাকিয়ে দেখে যে আর কেউ ওর সাথে উঠছে না। সবাই ডেক-এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে বাজি ধরছে।

 সেই মুহূর্তে দমকা বাতাসে একদিকে হেলে পড়লো জাহাজটা। খুবই সামান্য, কিন্তু ক্রিস্টোফারের মনে হলো যেনো হারিকেন বয়ে গেলো। ও উল্টোদিকে হেলে পড়ে একদিকে কাত হয়ে গেলো। ঢেউগুলো দেখে মনে হলো ওর দিকে ছুটে আসছে। ডেক-এর লোকগুলো কেউ শিষ দিয়ে উঠলো, কেউবা হেসে উঠলো হো হো করে। ক্রফোর্ড চিৎকার করে কিছু একটা বললো, কিন্তু ক্রিস্টোফারের হৃৎপিণ্ড এতো জোরে ধুকপুক করছিলো যে সেসব ও কিছুই শুনতে পেলো না। ওর হাত ফসকে যেতে শুরু করলো।

 জাহাজটা আবার সোজা হলো। ক্রিস্টোফারের ভয়টাও কাটলো কিছুটা। বুঝতে পারলো যে, ও যদি সাগরের দিকে তাকায় তাহলে আর এখানে থাকতে পারবে না, পড়ে যাবে। জোর করে ও উপরের দিকে দৃষ্টি ফেরালো-মাস্তুলের একদম মাথায়। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে উপরে উঠতে লাগলো। এক হাত প্রথমে তোলে তারপর অন্য হাতটা দিয়ে নিজেকে টেনে তোলে। প্রতিটা ধাপ পার হতে গিয়ে অবর্ণনীয় আতংক বয়ে গেলো ওর ভিতর দিয়ে। শেষে একটা রশির নাগাল পেতেই এমনভাবে আঁকড়ে ধরলো-যেভাবে বাচ্চা তার মায়ের আঙুল আঁকড়ে ধরে।

 কিভাবে মাস্তুলের মাথায় পৌঁছালো তা জানে না ও। তবে এটাই সবার উঁচু না, প্রধান মাস্তুল আরো উঁচু। ক্রিস্টোফারের মনে হচ্ছিলো ও বুঝি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করে ফেলেছে।

কিন্তু নিচ থেকে কেউ উল্লাস প্রকাশ করলো না। অবাক হয়ে ক্রিস্টোফার। বুঝতে পারলো ও এতো কষ্ট করে যা করলো তাতে কেউই তেমন খুশি হয়নি। বরং সবাই চেয়েছিলো যাতে ও পড়ে যায়। এটাই ওর জীবনের পরিণতি এখন-অন্যের বিনোদনের খোরাক হওয়া।

তবে ওদের আশা শেষ হয়নি এখনো, কারণ ক্রিস্টোফারের অগ্নিপরীক্ষা আরও বাকি। উপরে ওঠা হয়েছে, এখন ওকে আড়কাঠের কিনারায় যেতে হবে। ওর পায়ের নিচে তখন সরু একগাছি দড়ি বাদে আর কিছুই থাকবে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরো কয়েকজন নাবিক ওর সাথে যোগ দিলো। ওরা সবাই আড়কাঠ ধরে বানরের দক্ষতায় চলাফেরা করতে লাগলো। জাহাজের দুলুনিতে সামান্য কিছুও হলো না। কয়েকজন ইচ্ছা করে ক্রিস্টোফারকে ঠেলা দিলো, ওর হাতের উপর পাড়া দিলো বা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাঁধে ধাক্কা দিলো।

ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায়।

পাল বাধার দড়িটার গিটু খুলতে গিয়ে আঙুল বারবার পিছলে যেতে লাগলো ক্রিস্টোফারের। পায়ের নিচে দড়িটাও নড়েচড়ে গেলো বারবার। ওটা এতো চিকন যে ক্রিস্টোফারের মনে হতে লাগলো বাতাসের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। এরপর শুরু হলো নতুন এক আতংক, নিচে নামা। এক পা, এক পা করে নামিয়ে স্পর্শ করে করে পা বাধানোর জায়গাটা খুঁজে খুঁজে নামলো ও। কারণ নিচে তাকানোর সাহস হচ্ছিলো না।

নেমে এসে মাস্তুলটা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ক্রিস্টোফার। কারণ পায়ে মনে হচ্ছিলো একটুও বল নেই। বহু কষ্টে বমি আটকালো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব খুশি লাগছিলো নিজের উপর। ও কাজটা পেরেছে। ডেক এর উল্টো পাশ থেকে দানেশ ঠোঁট নেড়ে বলললো, “সাবাস।”

পিঠের উপর কাটা দড়ির ঘা পড়তে সম্বিত ফিরলো ওর। ব্যথায় মুখ বিকৃত করে ঘুরে দেখে ক্রফোর্ড ওর দিকে ঝুঁকে আছে।

 “আমিতো তোকে নামতে বলিনি।”

ক্রিস্টোফার জবাব দিয়েই ফেলেছিলো প্রায় সামলে নিলো শেষ মুহূর্তে। আপনাআপনি মাথা নিচু করে ক্রফোর্ডের রাগ কমার অপেক্ষা করতে লাগলো।

“তুই উপর থেকে লক্ষ্য রাখবি। এসব এলাকায় জলদস্যু আছে। ওদের কেউ যদি আমাদের জাহাজের এক মাইলের ভিতর আসতে পারে তো জ্যান্ত তোর চামড়া ছাড়িয়ে নেবো।”

ক্রিস্টোফার এমনভাবে বাঁকা হয়ে গেলো যেনো ওর গায়ে আবার আঘাত করা হয়েছে। প্রধান মাস্তুলের মাথায় তাকালো ও, অসম্ভব উঁচু। আবার কি ওখানে উঠতে পারবে?

 ক্রিস্টোফারের দৃষ্টি খেয়াল করে শয়তানি হাসি খেলে গেলো ক্রফোর্ডের ঠোঁটে।

“এখানে দাঁড়িয়ে কিছুই দেখা যাবে না। তুই উঠে ক্রসট্রেসে দাঁড়িয়ে থাকবি।”

ক্রসট্রেস হচ্ছে প্রধান মাস্তুলেরও উপরে একসাথে জোড়া লাগানো দুটো সরু আড়াআড়ি কাঠ। খুবই ছোট। ক্রিস্টোফার নিচ থেকে ওটাকে দেখতেই পাচ্ছে না। এমনকি সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো।

ও নড়লো না। ক্রফোর্ড জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে হাতের দড়িটা প্যাচাতে লাগলো। তারপর আবার সোজা করে ওটার জোর পরীক্ষা করলো।

“কথা কানে যাচ্ছে না?”

ক্রিস্টোফার বহু কষ্টে চোখে উপচে ওঠা অশ্রু সামলালো। ক্রফোর্ডোকে ও জিততে দেবে না কিছুতেই।

“যাচ্ছি স্যার।”

“তাহলে আবার বলার আগেই তোর ফর্সা পাছাটা মাস্তুলের উপরে তুলে ফেল। আর আমি বলার আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবি।”

ক্রিস্টোফার আর কিছু না বলে উঠতে শুরু করলো।

*

জীবনে ক্রিস্টোফার অনেককেই ঘৃণা করে, কিন্তু বর্তমান জীবনটাকে ও অন্য সব কিছুর চাইতে বেশি ঘৃণা করে। এমনকি ওর বাবার চাইতেও। তবে গাই এর কথা ওর আর মনে পড়ে না বললেই চলে। জাহাজ সামলানোর অবিরত কাজ-এটা সেটা করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলা–সবসময় সবার শেষে নিজের দায়িত্ব শেষ করতে পারাওর এখন অলস চিন্তা করার বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই। যখন কাজের ফাঁকে একটু সময় পায়, তখনি ও থাকার জায়গায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে আর ব্যথার জায়গাগুলোতে তেল মালিশ করে। ওর শরীরে এখন সেই প্যাগোডা খচিত মুদ্রার সমান একেকটা ফোস্কা।

জাহাজের বাকি লোকজন ওকে এড়িয়ে চলে। গায়ের রঙ সাদা হওয়ায় ও যেনো ভিন গ্রহের কোনো প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয় সবার কাছে। আর নাবিক হিসেবে সবাই ওকে করুণার চোখে দেখে। শুধু দানেশ ওর প্রতি সদয়। তবে ও-ও সবসময় সতর্ক থাকে যাতে ক্রিস্টোফারের সাথে ওর মেশাটা কেউ দেখে না ফেলে। জীবনে এতোটা একা কখনো লাগেনি আগে। এ কারণেই কয়েকদিন পরেই দেখা গেলো ও মাস্তুলের মাথায় ওঠার আদেশ পাওয়ার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় করা শুরু করেছে। তবে এখনো ওখান থেকে নিচে তাকানোর সাহস অর্জন করতে পারেনি। উপরে পালের মাঝে বসে থাকার সময়, ওর নিজেকে মেঘের মাঝে বসে থাকা কোনো দেবতার মতো মনে হয়। মরণশীল মানুষ আর তাদের ঘৃণ্য আচরণ থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। ওখানে বসে বসে ও রুথের সাথে নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে। কোথায় ওরা থাকবে, রুথকে কি কি উপহার কিনে দেবে-এইসব। কিন্তু যখনই ওর বাবা বা। ক্রফোর্ডে অথবা ওর সাথে শত্রুতা করেছে এমন সবার উপর প্রতিশোধের কথাটা মাথায় আসে তখন দেখা যায় সেসব স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে।

এক বিকেলে নজর রাখা শেষে ও নিচে গেলো পানি আনতে। নিচে খোলের ভিতর যেতে ভালো লাগে ওর। কাপড়ের গাটরি আর নতুন প্যাকেট করা কাপড় থেকে যে ঘ্রাণটা ভেসে আসে তা ওকে কোম্পানির গুদামগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। ছোটবেলায় ওটাই ছিলো ওর খেলার জায়গা।

“ক্রিস,” অন্ধকার থেকে হিসিয়ে ডাকলো দানেশ। “এটা দেখো।”

ওর হাতের তালুতে কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে। একটা পিতলের চাবি।

“কিসের চাবি?”

“সিন্দুকের,” দানেশ ফিসফিস করে বললো। “ক্রফোর্ড যখন দড়িগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলো তখন ওর কেবিন থেকে চুরি করেছি।”

গুদাম ঘরের সিন্দুকের ভিতর স্পিরিট রাখা। ওগুলো আসলে ক্রুদের ব্যবহারের জন্যে। কিন্তু গুজব শোনা যাচ্ছে যে ক্রফোর্ড সেটা নাকি বিক্রি করে দেওয়ার পায়তারা করছে।

ক্রিস্টোফার কাঁধের উপর দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে ইতিউতি তাকালো। “ধরা পড়ে গেলে?”

“কয়েক বোতল গায়েব হলে ও টের পাবে না। আমরা পরের বন্দরে ওগুলো বেঁচে দেবো। তাড়াতাড়ি।”

 দানেশ চাবিটা তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিলো। খোলা দরজা দিয়ে পিরিটের তীব্র ঝাঝালো গন্ধ নাকে এলো ওর।

“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দাও। ধরা খেলে ক্রফোর্ড কিন্তু জ্যান্ত ছাল তুলে ফেলবে।”

 দানেশ ওকে চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লো। ক্রিস্টোফার ওখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ওর মন বলছে দানেশকে এভাবেই ফেলে পালিয়ে যেতে। যদি ধরা পড়ে তাহলে সব অস্বীকার করলেই হবে যে ও এসবের মধ্যে নেই। কিন্তু দানেশই হচ্ছে একমাত্র লোক যাকে ও বন্ধুর কাছাকাছি একজন হিসেবে ধরতে পারে। ও যদি না থাকে তাহলে জাহাজে ক্রিস্টোফারের আর কেউই থাকবে না।

উপরের ডেক-এ পদশব্দ শোনা গেলো। জাহাজের দুলুনির কারণে উপরের হ্যাচওয়ে দিয়ে যে আলোটা আসে তাতে ছায়াগুলো একেক সময় একের রকম আকার ধারণ করছে, তাই বোঝা গেলো না যে লোকটা কে।

“তাড়াতাড়ি,” ক্রিস্টোফার বললো। “কেউ আসছে।”

দানেশ বেরিয়ে এলো। বগলে চার বোতল ব্রান্ডি ধরে রেখেছে। সেগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখলো ও।

 “এখানকার সব তো হাতীও খেয়ে শেষ করতে পারবে না,” ফিসফিসিয়ে বললো ও। “আর কয়েকটা আনতে পারলেই আমাদের দুজনের হয়ে যাবে।”

“না,” হিসিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। “এখন চলো। আমরা

ভারী কিছুর চাপে ঝাঁকিয়ে উঠলো কাঠের সিঁড়িটা। এক জোড়া জুতা দেখা গেলো সেখানে, তার উপরে দেখা গেলো সাদা মোজা পরা এক জোড়া গোদা পা। এরপর এক জোড়া চোঙ্গা প্যান্ট। তারপর একটা থলথলে দেহ নেমে এলো, গায়ের জামার বোতামগুলো টানটান হয়ে ছিঁড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে।

দানেশ দ্রুত নোঙ্গরের দড়ির পিছনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওটার বিশাল কুণ্ডলীর ভিতর একজন মানুষ অনায়াসে লুকিয়ে পড়তে পারবে। ক্রিস্টোফার

এক চুলও নড়লো না। যেনো পাথর হয়ে গিয়েছে। ক্রফোর্ড মাথা নিচু করে হ্যাচওয়েটা পার হয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে এলো। সব দেখে শুনে শান্তভাবে সিন্দুকের খোলা দরজাটা লাগালো, তারপর ক্রিস্টোফারের পায়ের কাছে নামিয়ে রাখা বোতল দুটো আর চাবিটা তুলে নিলো।

 “যখন খেয়াল করলাম যে চাবিটা পাওয়া যাচ্ছে না তখনই ভেবেছিলাম যে এখানে কাউকে পাওয়া যাবে।”

ক্রিস্টোফার কিছুই বললো না।

“তুই এটা পেলি কিভাবে? আর কে আছে তোর সাথে?”

ক্রিস্টোফার সোজা ক্রফোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো। দৃষ্টি কোনোদিকে সরাচ্ছে না; যাতে করে ক্রফোর্ড ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দানেশের অবস্থান টের না পেয়ে যায়। কিন্তু ক্রফোর্ড এটাকে ঔদ্ধত্য হিসেবে নিলো।

 “তোর বাপ বোম্বের গভর্নর বলে কি ভাবিস যে তুই এখানকার সবার চাইতে সেরা? তুই কি ভাবিস সেই ক্ষমতাবলে তুই আমার জিনিস চুরি করতে পারবি?”

ক্রফোর্ডের চেহারা ক্রোধে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। যেনো ঘন কালো মেঘ জমেছে আকাশে। ক্রিস্টোফার এই দৃষ্টি চেনে। ও ইষ্টনাম জপ করা শুরু করলো।

“সারেং,” চিৎকার করে ডাকলো ক্রফোর্ড। “মি. কোর্টনীকে ডেক-এ নিয়ে আয়। আর সবাইকে খবর দে। সবার সামনে শাস্তি দেবো আমি ওকে।”

কয়েকটা কঠোর হাত ওকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে গেলো। উঠেই দেখে বাকি সবাই প্রধান মাস্তুলের পিছনে বসানো একটা কামানের চারপাশে জড়ো হয়ে গিয়েছে। ক্রফোর্ড নিজের ঘরে গিয়ে খানিকটা রশি নিয়ে এলো। ও হাতে করে যে রশি নিয়ে ঘোরে এটা তার চাইতে সরু আর নমনীয়। কিছুক্ষণ আঙুলের ফাঁকে রশিটা নাড়াচাড়া করে সামনের দিকে দুটো গিট দিয়ে নিলা।

 “বন্দীকে প্রস্তুত কর,” আদেশ দিলো ক্রফোর্ড।

ওরা ক্রিস্টোফারকে ব্যারেলের উপর শুইয়ে দিলো। সারাদিন রোদের তাপে গনগনে হয়ে থাকা লোহার কড়াগুলো সাথে সাথে ওর নগ্ন বুকে ছ্যাকা দিলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার জানে যন্ত্রণা সবে শুরু। সারেং ওর হাত চেপে ধরে আছে, আর অন্য একজন নাবিক ধরে আছে ওর পা। ঠিক একটা ময়লা কাপড়ের মতো ও ব্যারেলটার উপর লম্বা হয়ে আছে।

পিছনেই জামার হাতা গুটিয়ে নিজেও প্রস্তুত হলো ক্রফোর্ড। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে রশিটার প্যাঁচ খুলে ফেলে, প্রথমে ডেক এর উপর কয়েকবার বাড়ি দিয়ে দড়িটাকে আরো নমনীয় করে নিলো। তারপর পা শক্ত করে হাত পিছনে নিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে ক্রিস্টোফারের পিঠের উপর নামিয়ে আনলো সেটা। শব্দ শুনে মনে হলো মাস্কেটের গুলি লেগেছে পিঠে। ব্যথার পরিমাণ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ক্রিস্টোফার দাঁতের ফাঁকে একটা পাটের দড়ি কামড়ে ধরে রইলো। কাঁদবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। প্রথম আঘাতের পর নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়টুকুও না দিয়ে আবার ক্রফোর্ড ওর দড়ির চাবুক হাকালো। এবার শোল্ডার ব্লেডের মাঝ বরাবর। এরপর তৃতীয়টা। তারপর

ক্রফোর্ড খেই হারিয়ে ফেললো। ঢেউয়ের মতো ব্যথা আসতে লাগলো। একের পর এক-এতো দ্রুত যে সবগুলো মিলে কিছুক্ষণ পর ক্রিস্টোফার অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়লো। অত্যাচারের চূড়ান্ত করলো ক্রফোর্ড। বর্বরতম আচরণ বলে যাকে, যেনো ওর ইচ্ছা ক্রিস্টোফারের শরীরের সকল হাড় গুড়ো করে ফেলবে।

তবে ক্রিস্টোফার এতো যন্ত্রণার মাঝেও প্রতিটা বাড়ি গুণে রাখলো। এভাবেই ও ওর বাবার মার খাওয়ার সময় মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখতো। এই মারটাও হজম করে ফেলতে পারলো তাই। যতোগুলো মার খায় সেই সংখ্যা থেকে যেনো ওর শরীরে শক্তি উতসরিত হয়। একটা কল্পিত লেজারে ও মারগুলো টুকে রাখে। একদিন সুদ সমেত আদায় করবে। যতদিন এভাবে মারের সংখ্যা গুণতে পারবে ততোদিন ও সব অত্যাচারই সহ্য করতে পারবে।

আস্তে আস্তে মারের জোর কমে এলো। ক্রফোর্ড আগের আক্রোশেই হাত চালিয়ে গেলো, কিন্তু ক্লান্ত হয়ে গেলো একটু পরেই। ও দড়িটা ফেলে দিলো। ওটার পাক খুলে গিয়েছে, এখন সেখানে ক্রিস্টোফারের রক্ত আর চামড়া লেগে আছে। লোকজন সবাই নিজেদের কাজে ফিরে যেতেই যারা ক্রিস্টোফারকে ধরে রেখেছিলো তারাও ছেড়ে দিলো। ওদের শরীরও রক্তে ভরে আছে। ক্রিস্টোফার ব্যারেল থেকে গড়িয়ে নেমে ডেক এর উপর স্তূপ হয়ে পড়ে রইলো। এতো ব্যথা সারা শরীরে যে চোখের পাতা বন্ধ করতেও কষ্ট হলো ওর।

কেউ একজন ওর ঠোঁটে এক মগ রাম এনে ধরলো। তৃষ্ণার্তের মতো তা খেয়ে নিলো ও। লোকটা দানেশ। রাম খেয়ে ব্যথা না গেলেও কমলো কিছুটা।

দানেশ ক্রিস্টোফারের পিঠ ধুয়ে দিলো। ক্রফোর্ড ক্রিস্টোফারকে পরিষ্কার পানি দিতে নিষেধ করেছে, দানেশ তাই জাহাজের পাশ দিয়ে বালতি ডুবিয়ে পানি নিয়ে এসেছে। নোনা পানির ছোঁয়ায় চাবুকের বাড়ির চাইতেও বেশি ব্যথা করে উঠলো। সহসাই একটা কালো পর্দা নেমে আসতে লাগলো ওর চোখের সামনে। ও নাড়াচাড়া করতে চাইলো কিন্তু ওর হাত পা কথা শুনলো না।

“উনপঞ্চাশ,” যেনো এক ঘোরের মাঝে বললো ক্রিস্টোফার।

“মানে?”

“ঊনপঞ্চাশটা বাড়ি।” হেসে বললো ক্রিস্টোফার। ঠোঁট নাড়তে গিয়েও অপরিমেয় ব্যথা হচ্ছে ওর। “পঞ্চাশটাও মারতে পারলো না। কাপুরুষ।” বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গেলো ও।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *