মৃত্যুঘড়ি

ভলিউম ৩৫ – মৃত্যুঘড়ি – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৬

০১.

ইয়ার্ডের গেট দিয়ে বেরোতে যাবে এই সময় কিশোরের সামনে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। লম্বা, বেশ ভালো স্বাস্থ্য। রিমলেস চশমার ভেতর দিয়ে তাকালেন ওর দিকে।

বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। তাই ঘুরতে বেরোচ্ছিল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে ওদের বন্ধু টমাস মার্টিন। পাহাড়ের দিকটীয় ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে।

তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা? হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক। আমি অ্যালেক্স ককার। ব্যাংকে কাজ করি। মিস্টার ভিকটর সাইমন তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। কথা বলার সময় হবে?

হবে, আসুন।

অ্যালেক্স ককরিডেনাল কিশোর। বে? ছ ককারকে এনে ওঅর্কশপে বসাল কিশোর। in কোন রকম ভূমিকার মধ্যে গেলেন না তিনি। বললেন, একটা বিশেষ কাজে এসেছি। মিস্টার সাইমনের কাছে গিয়েছিলাম। তার সময় নেই। বললেন, তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

বলুন কি করতে পারি?

পোশাক দেখে তো মনে হচ্ছে ঘুরতে যাচ্ছি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ককার বললেন, এক কাজ করতে পারো, ম্যানিলা রোডের দিকে চলে যাও। বন্দর পেরিয়ে গিয়ে মোড় নিলেই ম্যানিলা রিভার। নদীর কিনার ধরে বনের মধ্যে ঢুকে যেয়ো।

কেন? কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল কিলোর।

রিভেরা হাউসটা পেয়ে যাবে। অনেক পুরানো বাড়ি। নাম শুনেছ?

শুনেছি, মাথা ঝাঁকাল রবিন। পাথরে তৈরি। টালির ছাত। মেইন রোড থেকে অনেকখানি ভেতরে। বহুদিন ধরে ওখানে কেউ বাস করে না।

কার কাছে শুনলে?

বাবার কাছে। আমার বাবা সাংবাদিক।

 ও। ঘুরতে গেলে ওদিকটায় একবার ঘুরে এসো।

কেন? আবার প্রশ্ন করল কিশোর।

একটা রহস্য দিতে পারব। আগে দেখে এসে। তারপর কথা। এখন যাই। পরে আসব আবার।

ওদেরকে একটা ধাঁধার মধ্যে রেখে বেরিয়ে গেলেন ককার। গেটের বাইরে গাড়ি রেখেছেন। তাতে চেপে চলে গেলেন।

গোয়েন্দারাও রওনা হলো আবার। বন্দর পার হয়ে এসে কিছুদূর এগোতে ম্যানিলা রিভারের ওপরের ব্রিজটা চোখে পড়ল। মোড় নিয়ে দ্রুত এগোল সেদিকে। নদীর ধার ধরে এগোতে এগোতে আইভি লতায় ছাওয়া পাথরের দেয়াল চোখে পড়ল। ঘন হয়ে জন্মানো ছোট ছোট গাছপালা প্রায় আড়াল করে রেখেছে দেয়ালটা। ফাঁক দিয়ে একআধটু চোখে পড়ে ছাতের টালি।

ওটাই রিভেরা হাউস, রবিন বলল।

যদ্দুর জানি, বাড়ির মালিক বুড়ো রিভেরা মারা যাওয়ার পর আর কেউ বাস করতে আসেনি, টম বলল। বুড়ো নাকি আজব লোক ছিল।

থমকে দাঁড়াল মুসা। আজব মানে? মরেটরে ভূত হয়নি তো আবার!

আরে দূর! হাত নেড়ে মুসার কথাকে উড়িয়ে দিল কিশোর। চলো, ঢুকে দেখি কি আছে? কেন আসতে বললেন ককার, জানতে হবে।

 মিনমিন করে আরেকবার আপত্তি জানাল মুসা। কিন্তু তিনজনের চাপে আপত্তি টিকল না তার।

মেইন গেটটা খোলা। অবাক লাগল ওদের। আরও অবাক হলো, যখন ড্রাইভওয়েতে গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পেল।

সামনের বিশাল ধূসর অট্টালিকাটার দিকে তাকিয়ে সাবধানে ড্রাইভওয়ে ধরে এগোল চারজনে। দুই ধারে ঘন হয়ে জন্মেছে গাছ আর ঝোপঝাড়। নীরবতার মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল ভারি গলায় ডাক, অ্যাই, দাঁড়াও!

পুলিশের পোশাক পরা এক লোক বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। মাথার হেলমেট বলে দিল মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছে, মোটর সাইকেল পেট্রলম্যান। চেনে ওকে ছেলেরা। রকি বীচ থানার অফিসার, মরিস ডুবয়।

কি ব্যাপার, ডুবয়, আপনি এখানে? জানতে চাইল রবিন।

চোর তাড়া করে এসেছি। বন্দরে ইদানীং বড় বেশি চোরের উৎপতি হচ্ছে। ম্যানিলা রোড ধরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি কালো রঙের বিরাট একটা লিমুজিন গাড়ি ছুটে আসছে। গতি না কমিয়ে এত জোরে মোড় ঘুরল, সন্দেহ হলো আমার। পিছু নিলাম।

ধরতে পারেননি?

না, পালাল।

ওদের সঙ্গে এগোল অফিসার ডুবয়। বাড়ির সদর দরজার সামনে মোটর সাইকেলটা রাখা। তাতে চেপে স্টার্ট দিল। বিকট গর্জন করে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি ভেবে এখানে?

ঘুরতে, জবাব দিল কিশোর।

কেস? হাসল অফিসার।

হতে পারে। এখনও জানি না। ফিরে গেলে বোঝা যাবে। বাড়িটী সম্পর্কে কিছু জানেন নাকি?

ক্লাচ চেপে গিয়ার দিল ডুবয়। তেমন কিছু না। অনেক দিন থেকে খালি পড়ে আছে, ব্যস, এটুকুই। গেটটা খোলা পেয়ে অবাকই লাগল। মনে হলো এ বাড়িতেই ঢুকে পড়ল কালো গাড়িটা। তবে কোথাও দেখতে পেলাম না। চোখের ভুল ছিল বোধহয়। চলি।

যান। গেট আমরা বন্ধ করে দিয়ে যাব।

ক্লাচ ছাড়তেই লাফ দিয়ে আগে বাড়ল মোটর বাইক। বেরিয়ে গেল ডুবয়। ধীরে ধীরে কমে গেল ইঞ্জিনের শব্দ। স্তব্ধ নীরবতা যেন গ্রাস করল ছেলেদের।

.

০২.

পরিত্যক্ত বাড়ির ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে টম বলল, বাড়িটার কিন্তু কোন বদনাম শুনিনি কখনও! আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল সে। কক্ষনো কেউ বলেনি এখানে ভূতের উপদ্রব আছে!

মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি কিশোর বলল, এসো, ঘুরে দেখি। ককারের কথায় মনে হলো অদ্ভুত কিছু ঘটছে এখানে। রবিন, তুমি আর টম দরজা-জানালাগুলো দেখো; বন্ধ, নাকি খোলা। আমি আর মুসা চারপাশটা দেখব।

 আলাদা হয়ে গেল ওরা। বিশাল বাড়িটার পেছনে চলে এল কিশোর আর মুসা।

নিচের দিকে চোখ পড়তে আচমকা থেমে গেল কিশোর। মুসা, দেখো!

কি? ঘন হয়ে জন্মানো ঘাসের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না মুসা।

লম্বা ঘাসের ডগা সরিয়ে মাটি দেখাল কিশোর। এইবার দেখেছ? পায়ের ছাপ। কাল রাতে এসেছিল এখানে কেউ। হেঁটেছিল। দেখছ না, ঘাসের ডগা ভাঙা? শিশির পড়ে মাটি ভিজে নরম হয়ে গিয়েছিল তখন।

খাইছে, কিশোর, তোমার ওগুলো চোখ না, এক্স-রে মেশিন!

মুসার কথার জবাব না দিয়ে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগোতে শুরু করল কিশোর। চত্বর পেরিয়ে চলে এল ঘন গাছের জটলার দিকে। নদীর দিকে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। পায়ের ছাপ সেদিকেই গেছে।

মাছ ধরতে এসেছিল বোধহয় কেউ, অনুমান করল মুসা।

কি জানি! কথাটা ঠিক মেনে নিতে পারল না কিশোর।

ঘুরতে ঘুরতে এসে একখানে মিলিত হলো আবার চারজনে।

কিছু পেলে? রবিনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। সামনের দরজার তালায় আঁচড়ের দাগ। দেখলাম। অন্ধকারে কেউ খোলার চেষ্টা করেছিল মনে হয়।

পায়ের ছাপের কথা জানাল কিশোর। মাথা নেড়ে বলল, তেমন কিছু পেলাম না। এতে বোধহয় সন্তুষ্ট করা যাবে না মিস্টার ককারকে।

আর কি দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি? টমের প্রশ্ন।

বুড়ো রিভিয়েরার ভূত, হেসে বলল টম।

দূর, ওসব অলক্ষুণে কথা বোলো না তো! হাত নেড়ে বলল মুসা। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। খিদেয় পা কাঁপছে।

হেসে ফেলল সবাই।

পাথরের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করল রবিন, এতবড় বাড়ি, এত পুরানো, খালি পড়ে আছে ভাবতে পারছি না। এই মুহূর্তে ভেতর থেকে কেউ গোপনে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে জানলেও অবাক হব না।

হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। পায়ের ছাপ আর তালায় আঁচড়ের দাগকে উড়িয়ে দিতে পারছি না। নিশ্চয় কোন মানে আছে এ সবের। ককারকে বলব। দেখি, কি বলেন।

মাথার ওপরের শূন্য, কালো জানালাটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি দেখা দিল মুসার চোখে। দেখো, এ সব শুনতে একটুও ভাল লাগছে না আমার। আমি গেলাম!

গেটের দিকে হাঁটা দিল সে। হেসে তার পিছু নিল টম আর রবিন। কিশোরও চলল, তবে সে চিন্তিত। হাসিতে যোগ দিতে পারছে না। নিশ্চিত হয়ে গেছে, কোন রহস্য আছে বাড়িটীর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন ককারের সঙ্গে কথা বলতে চায়। বাড়ি ফিরেই যোগাযোগ করতে হবে।

বাইরে এসে গেটটা লাগিয়ে দিল সে। চাবি নেই, তালা দিতে পারল না।

 ম্যানিলা রোডে ফিরে এল ওরা। ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ।

ওরকম একটা পোড়ো বাড়ির প্রতি আগ্রহী হলেন কেন ককারের মত একজন ব্যাংকার? রবিনের মাথা থেকেও ভাবনাটা যাচ্ছে না।

বাবারে, ওসব কথা বাদ দাও না এখন! বাধা দিল মুসা। খাওয়ার জন্যে বসার জায়গা দেখো।

খোঁচা দিল টম, খাওয়ার পর ঘুমের জায়গা লাগবে না?

দেখো, ইয়ার্কি মেরো না। খাওয়া ছাড়া কেউ বাঁচতে পেরেছে? ঘুম ছাড়া কারও শরীরের ক্ষয় পূরণ হয়েছে?

তা হয়নি। তবে তোমার পূরণটা আজকাল একটু বেশিই হচ্ছে। বয়েসের তুলনায় দৈত্য।

জবাব দিল না মুসা। চারপাশে তাকিয়ে জায়গা খুঁজতে শুরু করেছে তার চোখ। রিভেরা এস্টেট পেছনে ফেলে এসেছে। ডানে উঠে গেছে ঘন বনে ছাওয়া পাহাড়ের ঢাল। বায়ে গমের খেত, শস্য কাটার পর খড়গুলো এখন রোদে শুকিয়ে বাদামী হয়ে গেছে। খেতের প্রান্তে বিশাল এক ওক গাছ ডালপালা ছড়িয়ে ছায়া ফেলেছে, লোভ দেখাচ্ছে যেন ওদের।

জায়গা পাওয়া গেছে, হতি তুলে দেখলি মুসা। প্রথমে খাওয়া, তারপর ঘুম।

মাথা নাড়ল টম, ওখানে হবে না।

কেন? ভুরু কোঁচকাল মুসা।

 পানি নেই।

তাই তো! সুতরাং পানির জন্যে আরও আধঘণ্টা হাঁটতে হলো ওদের। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নাটা চোখে পড়ল মুসার। সবুজ তৃণভূমির মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে টলটলে পানির নহর।

আহ, দারুণ!

দারুণ তো বুঝলাম, রবিন বলল, বসবে কোথায়? ছায়ার তো চিহ্নও নেই এখানে।

 দুর! খালি বাগড়া দেয়! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিন্তু ছায়া না থাকলে যে বসা যাবে না, মনে মনে এ কথাটা সে-ও স্বীকার করল।

আবার হাঁটতে হলো। দুই ধারে চেপে আসতে শুরু করল বন। ছোট একটা খাড়ির ধার দিয়ে গেছে পথ। ওপর থেকে গর্তে ঝরে পড়ছে ঝর্না।

খুশি হলো মুসা। বসার এত চমৎকার জায়গা আর পাওয়া যাবে না। গাছের ছায়া আছে, রোদ আছে, পানিও আছে। আর কি চাই!

বসে পড়ল ওরা। ব্যাগ খুলে ডিম আর মুরগীর মাংসের পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচ বের করল মুসা। আর আছে আপেলের জেলি, চকোলেট কেক এবং ফ্লাস্ক ভর্তি বরফ মেশানো দুধ।

খাওয়ার জন্যে মুসাই তাগাদা দিয়েছে বেশি। কিন্তু খেতে বসে আবিষ্কার করল অন্য তিনজন, ওদেরও খিদে পেয়েছে ভীষণ। দেখতে দেখতে সাবাড় করে ফেলল সমস্ত খাবার। ঝর্না থেকে পানি খেয়ে এসে গাছের ছায়ায় যার যে ভাবে ইচ্ছে শুয়ে পড়ল।

চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে কিশোর। গাছের ডালে শিস দিচ্ছে একটা। নাম না জানা পাখি। আরেকটা ছোট আকারের সবুজ পাখি ডাল থেকে মাঝে মাঝেই শূন্যে ঝাঁপ দিয়ে পোকা শিকার করছে। ফড়িং উড়ছে নানা রঙের।

আহ্, এই তো জীবন! আবেশে চোখ মুদে এল তার।

.

০৩.

ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল ওদের।

রকি বীচে ফিরে মুসা আর টম চলে গেল বেসবল প্র্যাকটিস করতে। রবিন আর কিশোর ইয়ার্ডে ফিরে এল।

মেরিচাচী জানালেন, মিস্টার ককার এসে বসে আছেন অনেকক্ষণ।

রবিন আর কিশোর বসার ঘরে ঢুকে দেখল অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন তিনি। সাড়া পেয়ে ফিরে তাকালেন। এবারও কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করলেন, কি দেখে এলে?

কিশোর বলল, গিয়ে দেখি গেট খোলা। চোর তাড়া করে ভেতরে ঢুকেছে একজন পুলিশ অফিসার। সে বেরিয়ে যাওয়ার পর পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছি…

পায়ের ছাপ! বাধা দিলেন ককার, কখন এসেছিল লোকটা?

রাতে কোন সময়, শিশির পড়ার পর।

কিন্তু গেট! কাল রাতে বেরোনোর সময় নিজের হাতে তালা লাগিয়েছি। আমি!

যেন বিদ্যুতের শক খেয়ে ঝট করে সোজা হয়ে বসল দুই গোয়েন্দা।

আপনি লাগিয়েছেন? প্রশ্ন করল অবাক রবিন।

 হ্যাঁ। কারণ বাড়িটার মালিক এখন আমি।

আপনি! আরও অবাক হলো রবিন।

হা। কাল অন্ধকার হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম আমি। তোমাদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে, আরও কেউ ছিল ওখানে। কিংবা আমি আসার পর ঢুকেছিল। আমার ওপর হামলা চালানোর জন্যেও হতে পারে।

মিস্টার কুকার, হাত তুলল কিশোর, আশা করি আমাদের ওপর। আপনার বিশ্বাস জন্মেছে?

ভুরু কোচকালেন ককার। অবিশ্বাস করেছি কি করে বুঝলে?

এটুকু না বুঝলে আর এতদিন গোয়েন্দাগিরি করতে পারতাম না, এত কেসের সমাধান করতে পারতাম না। আপনি আসলে ভিকটর সাইমনের কথা বিশ্বাস করে আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। সেজন্যে সকালে সব কথা না বলে শুধু বাড়িটা দেখে আসার কথা বলেছেন। বুঝতে চেয়েছেন, আমাদের দিয়ে আপনার কাজ হবে কিনা। পরীক্ষা তো করলেন, কি মনে হলো, হবে?

মাথা ঝাঁকালেন ককার, হবে।

তাহলে আর অন্ধকারে না রেখে সব খুলে বলুন।

সোফায় নড়েচড়ে আরাম করে বসলেন ককার। বললেন, খামখেয়ালী লোক ছিলেন ফ্রান্সিস রিভেরা, হয়তো জানেনা। রকি বীচ লাইব্রেরিকে দান করে গেছেন তার এস্টেট। লাইব্রেরির কাছ থেকে কিছুদিন আগে বাড়িটা কিনেছি আমি। কিছু মেরামত-টেরামত করিয়ে নিয়ে পরে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করার আশায়। কেনার পর বাড়িটা ভাল করে দেখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম।

সামনে গলা বাড়িয়ে দিল রবিন, কি?

তিনতলায় একটা গুপ্তঘর। বিল্ডিঙটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় তৈরি। হয়েছে ওটা। রীতিমত একটা ব্যাংকের ভল্ট যেন। অগ্নিনিরোধক, কোন, জানালা নেই। গোপন ভেন্টিলেটরের সাহায্যে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। একমাত্র দরজার পাল্লাটা তৈরি হয়েছে খুব ভারি করে ইস্পাত দিয়ে। বন্ধ করার জন্যে টাইম লক লাগানো আছে।

ওরকম একটা ঘর কি কাজে লাগত রিভেরার?

খামখেয়ালী, বললামই তো, মাথায় ছিট, মৃদু হাসলেন ব্যাংকার। ব্যাংককে বিশ্বাস করে না, এ রকম বহু লোক আছে, তিনিও তাদের একজন। দামী জিনিসপত্র ওই গুপ্তঘরে রাখতেন। নিজেকে লুকিয়ে রাখার জায়গা হিসেবেও ব্যবহার করতেন ঘরটাকে। দামী জিনিস লুকানো আছে কিনা। দেখার জন্যে অনেক খোঁজাখুজি করেছি আমি ওখানে, পাইনি। রিভেরার এক বিশ্বস্ত চাকর সমস্ত জিনিস তুলে দিয়েছে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের হাতে।

তা দিক, আমার মাথাব্যথা নেই। আমি কেবল বাড়িটা কিনেছি। তা-ও বসবাসের জন্যে নয়, ব্যবসা করার জন্যে। তবে গুপ্তঘরটা খুব পছন্দ হয়েছে। আমার। রিভেরার মতই ওখানে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে লুকিয়ে ফেলি। নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে কাজ করার এত চমৎকার জায়গা আর হয় না। নিজের ব্যক্তিগত অফিস বানিয়েছি ঘরটাকে।

জটিল হিসেব-নিকেশের কাজ করতে হলে এখন ওখানে গিয়ে ঢুকি আমি। ছোট একটা টেবিল, একটা কম্পিউটার আর কিছু ফাইলপত্র রেখে দিয়েছি। ঘর থেকে বেরোনোর সময় টাইম লক সেট করে দিই। তারপর আর কেউই, এমনকি আমিও নির্দিষ্ট সময়ের আগে আর ঢুকতে পারি না। ঠিক যতটায় সময় সেট করা থাকে কাঁটায় কাঁটায় ততটীয় খোলে তালাটা, তার আগে কিছুতেই নয়।

জানি, এতক্ষণে কথা বলল কিশোর, টাইম লকের এটাই বিশেষত্ব। নির্দিষ্ট সময়ে তালা খুলে যাওয়ার আগে কেউ ঢুকতে পারে না।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন ব্যাংকার। কিন্তু আমি যদি বলি আমার অনুপস্থিতিতে কেউ ওঘরে ঢুকেছিল, একবার নয়, একাধিকবার, তাহলে?

তালাটা নষ্ট না তো? রবিনের প্রশ্ন।

মোটেও না। একদম ঠিক। ভালমত পরীক্ষা করে দেখেছি আমি।

তারমানে আপনি চাইছেন, কিশোর বলল, ঘরটার তদন্ত করি আমরা? কি করে কে ঢুকল, বের করি?

মাথা ঝাঁকালেন ককার। হ্যাঁ। যখন-তখন ওবাড়ির যে কোন ঘরে ঢোকার জন্যে তোমাদের ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে দেব… বলবেন কি বলবেন না, দ্বিধা করতে করতে বলেই ফেললেন, আরেকটা ব্যাপার, কতখানি গুরুত্ব দেব বুঝতে পারছি না…আমার প্রাণ নাশের হুমকিও দিতে আরম্ভ করেছে!

কোথায়? কখন? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

গম্ভীর মুখে মানিব্যাগ থেকে ভাজ করে রাখা দুই টুকরো কাগজ বের করলেন ককার। একটা দিলেন রবিনকে, আরেকটা কিশোরকে।

রবিন আগে খুলল। পেন্সিলে লেখা রয়েছে:

চিরকালের জন্যে এই বাড়ি ছাড়ো,
নইলে কপালে মরণ আছে।

অন্য কাগজটা পড়ল কিশোর:

ঘড়ি যখন টিক টিক করবে,
তখন আসবে মরণ!

মুখ তুলে তাকাল সে, কি বলতে চায়?

সেটা জানার জন্যেই ভাল গোয়েন্দা দরকার আমার, ককার বললেন। কাগজগুলো কোথায় পেয়েছি আন্দাজ করতে পারো?

গুপ্তঘরে, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কিশোর।

অবাক হয়ে গেলেন ককার, কি করে বুঝলে?

স্রেফ অনুমান। ওখানে পেয়েছেন বলেই এতটা উদ্বিগ্ন হয়েছেন। তা ছাড়া বললেনই তো, আপনার অবর্তমানে লোক ঢুকেছে ওঘরে।

কখন পেয়েছেন এগুলো? জানতে চাইল রবিন।

তোমার হাতেরটা চারদিন আগে। আর অন্যটা কাল রাত আটটায়। সেজন্যেই এসেছিলাম আজ সকালে, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ব্যাংকারের চেহারা। বললে কাল রাতে বাড়িতে ঢুকেছিল কেউ, তারমানে আমাকে খুন করতে এসেছিল!

ভ্রূকুটি করল কিশোর। হু, যে লিখেছে সে সব জানে–আপনি কখন থাকেন না থাকেন। প্রতিশোধ নিতে চায় এমন কোন শত্রু আছে আপনার?

যদ্দুর জানি, নেই। শত্রু তৈরি হয় এমন কোন কাজ করি না আমি।

আগের প্রসঙ্গে এল রবিন, মিস্টার ককরি, ঘরে ঢোকার অন্য কোন পথ নেই তো? দেয়ালগুলো ভালমত দেখেছেন?

দেখেছি। কিছুই নেই। আমার জিনিসপত্র আর একটা ফায়ারপ্লেস বাদে ঘরে অন্য কোন জিনিসও নেই। চিমনির মুখে শিক লাগানো। তা ছাড়া চিমনির নলটী এত সরু, মানুষ ঢুকতে পারবে না।

কাগজ তো ফেলতে পারে?

মাথা নাড়লেন ককরি। তা পারে। তাহলে পাওয়া যেত চিমনির তলায়। কিন্তু পেয়েছি ঘরের মাঝখানে, কার্পেটের ওপর।

আপনি ছাড়া ঘরটার কথা আর কে জানে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। তালাটা খুলতে জানে আর কেউ?

ঘরটার কথাই কাউকে বলিনি। সুতরাং তালার কথা জানার প্রশ্নই ওঠে না। রিভেরার চাকরও নেই যে সে বলে দেবে।

হু। আমরা আপনাকে সাহায্য করব। একটা কাজ করলে কি অসুবিধে হবে–আমরা আপনাকে ঢুকতে না বলা পর্যন্ত ওবাড়ি থেকে দূরে থাকতে পারবেন?

পারব। ঠিক আছে, আজ উঠি। চাবি তৈরি হয়ে গেলে তোমাদের জানাব।

ককার বেরিয়ে যাওয়ার পর ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল দুই গোয়েন্দা।

রবিন বলল, আজব কাণ্ড! টাইম লক লাগানো থাকলে দরজা খোলা অসম্ভব। ঢুকল কোন পথে? নিশ্চয় অন্য কোন পথ আছে।

আজ রাতেই দেখতে যাব রিভেরা হাউসে। তুমি বাড়িতে ফোন করে দাও। বলো ফিরতে দেরি হবে।

.

০৪.

অন্ধকার নামলে বেরিয়ে পড়ল দুজনে। রবিনের ফোক্স ওয়াগেন গাড়িটা নিল। মুসাদের বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। সে যেতে পারল না। পার্টিতে ওদের যেতে বলেছিল সে, কেন যাওয়া হবে না খুলে বলেছে কিশোর। আর কিছু বলেনি মুসা। চাপাচাপি করেনি। জানে, কিশোরের কাছে কেসের তদন্ত, সবার আগে, সেটা বাদ দিয়ে দাওয়তি খেতে যাবে না।

রিভেরা হাউস থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি রাখল রবিন। বাকি পথ হেঁটে যাবে ওরা। ভেতরে কেউ থেকে থাকলে ইঞ্জিনের শব্দে যাতে সতর্ক হতে না পারে।

হেঁটে এগোল ওরা।

বিশাল গেটটা খোলা। আকাশে মেঘ করেছে। ঢাকা পড়েছে চাঁদ। বাতাস গরম, আঠা আঠা।

থমকে দাঁড়াল কিশোর। সকাল বেলা আমি লাগিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কেউ ঢুকেছে। হয়তো আছে এখনও।

ড্রাইভওয়ের দিকে নজর রাখতে পারে। অন্য কোনখান দিয়ে ঢেকি উচিত।

দেয়ালের ধার ধরে ঘুরে একটা ঘন জংলা জায়গায় চলে এল ওরা।

শক্ত একটা লতা ধরে টান দিয়ে কতটা শক্ত দেখতে দেখতে রবিন বলল, টপকানো কঠিন হবে না। বেয়ে উঠে যাওয়া যাবে।

নিরাশ করল তাকে কিশোর। দেয়ালের ওপর ভাঙা কাচ বসানো। সকালে দেখেছি। সহজে ঢোকার ব্যবস্থা রাখেননি ফ্রান্সিস রিভেরা।

তাহলে?

খুজতে হবে।

দেয়ালের ধার ঘেঁষে বড় গাছ তেমন নেই। খুঁজে খুঁজে অবশেষে পাওয়া গেল একটা। তার একটা ডাল দেয়ালের ওপর দিয়ে চলে গেছে অন্যপাশে, বাড়ির ভেতরে।

গাছে উঠে ডাল বেয়ে কাচ এড়িয়ে অন্যপাশে চলে আসতে পারল দুজনে। ডাল ধরে ঝুলে পড়ল। মাটি বেশি নিচে না। হাত ছেড়ে দিতে নিরাপদেই নামল মাটিতে।

বিদ্যুৎ চমকাল। গুড়গুড় শব্দ হলো আকাশে। গুঁড়ি মেরে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় চলে এল ওরা।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বিকট শব্দে বাজ পড়ল। গাছের পাতায় প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে বয়ে গেল এক ঝলক ঝোড়ো হাওয়া। ঝড় আসতে দেরি নেই।

খপ করে রবিনের হাত চেপে ধরল কিশোর। শুনছ! দৌড়ানোর শব্দ!

কান খাড়া করে রইল দুজনে। বাতাস, বজ্রপাত, গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মাঝেও পায়ের শব্দ কানে আসতে লাগল ওদের। ডালে পা পড়ে মট করে ভাঙল, জুতোতে ঠোকা লেগে গড়িয়ে সরে গেল একটা পাথর, শুনতে পেল ওরা।

বিদ্যুতের আলোয় লম্বা একজন মানুষকে বারান্দার দিকে ছুটে যেতে দেখা গেল। বারান্দায় উঠে সামান্য নুয়ে দরজার তালায় চাবি ঢোকাল। খোলার জন্যে।

ককরি! ফিসফিস করে বলল রবিন।

তুমি শিওর! তাকে তো আসতে মানা করেছিলাম।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা।

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে। আছে দুই গোয়েন্দা, আলো জ্বলার অপেক্ষায়।

কিন্তু জ্বলল না।

ককার হলে আলো জলছেন না কেন? অধৈর্য স্বরে বিড়বিড় করল রবিন। কারও দেখে ফেলার ভয়ে? বাড়িটা যদি তারই হয়, ভয় কিসের?

হয়তো ককার নয়।

তাঁর মতই তে লাগল। একই রকম শরীর-স্বাস্থ্য। গাড়ির শব্দ কিন্তু শুনলাম না। তারমানে আমরা আসার আগেই ঢুকেছেন।

গুপ্তঘরে চলে গেছেন হয়তো!

কিংবা তার কিছু হয়েছে। হুমকি দিয়ে নোট লিখেছে যে লোক, সে হয়তো ঘাপটি মেরে ছিল ভেতরে, তারই অপেক্ষায়।

চলো, দেখি।

দরজার দিকে দৌড় দিল দুজনে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। দাঁড়াও! লোকটা ককার না-ও হতে পারে। অন্য কেউ হতে পারে। ঢোকার সময় লোকটাকে মোটেও অস্থির মনে হয়নি। অথচ ককরি যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, খুব নার্ভাস মনে হয়েছে তাকে। দাঁড়াও, দেখি আর কিছুক্ষণ।

ঝোপের ধারে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল দুজনে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুতের আলোয় লাগছে রূপালী চাদরের মত।

রবিন বলল, আবার পায়ের শব্দ শুনলাম মনে হলো!

কান পেতে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা বড় ঘরের জানালায় আলো জ্বলতে দেখল ওরা।

এসো, দেখব, উঠে দাঁড়াল কিশোর।

মাথা নিচু করে একছুটে সামনের খোলা জায়গাটুকু পেরোল ওরা। মাথায় আর পিঠে আঘাত হানছে বড় বড় ফোঁটা। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে।

জানালার কাছে পৌঁছে গেল দুজনে। এখানে গীয়ে বৃষ্টি লাগে না। ঘর থেকে কেউ দেখতেও পাবে না ওদের। আরেকটা ছোট জানালার কাছে সরে এল।

জানালাটা অনেক ওপরে। দুই হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে পেটের ওপর রেখে মইয়ের ধাপ তৈরি করল কিশোর। তাতে পা রেখে উঠে দাঁড়াল রবিন। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল।

কি দেখছ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

একটা লিভিং রুম। কাপড়ে মোড়া আসবাব, প্যানেল করা দেয়াল, ঝাড়বাতি। মানুষ নেই।

তাহলে আলো জ্বালল কে?

সুইচ হয়তো অন করাই ছিল। কারেন্ট চলে গিয়েছিল। আবীর এসেছে। আপনাআপনি জ্বলেছে আলোটা।

আর কি আছে?

ভারি দরজা। এককোণে অনেক বড় একটা ঘড়ি, গ্র্যাণ্ডফাদার কুক। সামনের দিকে পুরোটা কাঁচে ঢাকা। পিতলের বিরাট পেণ্ডুলাম। এখান থেকেও টিক টিক শুনতে পাচ্ছি।

টিক টিক? রবিনের ভারে আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। কিশোর। খালি বাড়িতে ঘড়ি চলছে!

রবিনেরও মনে পড়ে গেল নোটটার কথা:

ঘড়ি যখন টিক টিক করবে,
তখন আসবে মরণ!

তুমি নামো, আমি দেখি, কিশোর বলল।

 লাফ দিয়ে নামল রবিন।

একই ভাবে তার হাতে ভর দিয়ে উঠে গেল কিশোর।

কে চালাল ঘড়িটা? দেখতে দেখতে বলল সে। নিজের হাতঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিল। একেবারে সঠিক সময়।

দপ করে ঘরের আলো নিভে গেল। আবার ঢেকে গেল অন্ধকারে। ঠিক একই সময়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল তীব্র আলো। বজ্রপাতের বিকট শব্দ হলো।

পরক্ষণে শোনা গেল রক্ত-হিম-করা তীক্ষ্ণ চিৎকার।

.

০৫.

চিৎকার থামতেই কাঠের বারান্দায় শোনা গেল পদশব্দ। পলকের জন্যে দেখা গেল একটা ছায়ামূর্তিকে। লাফ দিয়ে বাগানে নেমে লাফাতে লাফাতে চলে গেল ড্রাইভওয়ের দিকে।

ধরো! ধরো! বলে চিৎকার দিয়েই পিছু নিল কিশোর।

সে ড্রাইভওয়েতে ওঠার আগেই গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল মূর্তিটা। তার জুতোর শব্দ কানে আসছে।

কিশোরকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে রবিন। লোকটাকে দেখতে পেল আবার। গতি বাড়াল সে।

ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সামনের লোকটা। ছুটতে পারছে না আর তেমন। ধরে ফেলল রবিন।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল।

ভীত-সন্ত্রস্ত, পরিচিত মুখটা দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না ওদের।

এ কি! ডুডলি হ্যারিস! মস্ত ধনী। দামী ছবি আর শিল্পকর্ম সংগ্রহের বাতিক আছে। পগিলাটে স্বভাবের জন্যে রকি বীচে অনেকেই চেনে তাকে। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে ভাল খাতির। এই লোক এখানে কি করছে?

রবিন আর কিশোরকে চিনতে পারলেন তিনিও। স্বস্তিতে ঢিল করে দিলেন শরীর। তোমরা!

আপনি এখানে কি করছেন, মিস্টার হ্যারিস? জিজ্ঞেস করল রবিন।

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হ্যারিস বললেন, কিশোর, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো, প্লীজ! থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি। পরিশ্রম, উত্তেজনা এবং এই বৃষ্টিতে ভেজা সইতে পারছেন না আর বুড়ো শরীরে। উফ, কি সাংঘাতিক…কি জঘন্য চিৎকার…।

ধরে ধরে তাকে নিয়ে চলল কিশোর আর রবিন।

গাড়িটা কোথায়, দেখিয়ে দিলেন হ্যারিস। ম্যানিলা রিভার রোডের ধারে একটা বড় ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন। পুরানো মডেলের বিরাট গাড়ি। কাঁপা হাতে দরজা খোলার চেষ্টা করলেন।

বাধা দিল কিশোর, মিস্টার হ্যারিস, কি হয়েছে না বলেই চলে যাবেন? বললে হয়তো কিছু করতে পারতাম।

অসাধু কোন কিছুতে জড়িত নন হ্যারিস, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে।

কিন্তু প্রলাপের মত বকেই চললেন তিনি, কি সাংঘাতিক…বাপরে বাপ…আসা একেবারেই উচিত হয়নি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভুল করেছি…আসলে পান্নাগুলো চুরি হয়ে গেল তো…

কিশোরের দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল রবিন, নিশ্চয় তার পান্নার জিনিসগুলোর কিছু হয়েছে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বলার মত অবস্থাই নেই তাঁর।

গাড়ি চালাতে পারবেন কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।

চিৎকার কে করেছে সেটাও কিন্তু জানা হয়নি, মনে করিয়ে দিল রবিন। মিস্টার ককার এখনও বাড়ির ভেতরে।

আমি যাচ্ছি দেখতে। এক কাজ করো, তুমি গাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে যাও। দেখছ না কি রকম কাঁপছেন। সেবা দরকার। চাচী আছে, চিন্তা নেই। আমি বাড়ির ভেতরটা দেখে তোমার গাড়িটা নিয়ে চলে আসব।

প্রায় চ্যাংদোলা করে হ্যারিসকে গাড়িতে তুলে দিল দুজনে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল রবিন। ততক্ষণে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ির সদর দরজার দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করেছে কিশোর।

ঘরগুলো সব অন্ধকার। সামনের দিকের একটা জানালায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। কিছু দেখা যায় না। সদর দরজার পিতলের ঘণ্টাটা। বাজাল। কেউ সাড়া দিল না।

দরজায় থাবা দিয়ে ককৗরের নাম ধরে ডাকল।

 জবাব নেই।

 নব ঘুরিয়ে খুলতে গিয়ে দেখল, ঘোরে না। তালা লাগানো।

দ্রুত হেঁটে ঘুরে বাড়ির পেছন দিকে চলে এল সে। পেছনের দরজা বন্ধ, সেলারের দরজা বন্ধ। কোনখান দিয়ে ঢোকার উপায় নেই। চিৎকার করে বার বার ককারের নাম ধরে ডেকেও সাড়া পেল না। বাড়িটা তেমনি অন্ধকার, নীরব হয়ে আছে।

 কাজ হবে না। ঢুকতে পারবে না যে, বুঝতে পারল কিশোর। কি আর করা। নিরাশ হয়ে গাড়ির দিকে ফিরে চলল সে।

রবিন ওদিকে গাড়ির স্পীড তুলতে ভয় পাচ্ছে। হ্যারিস ধনী হলে হবে কি, ভীষণ কিপটে, গাড়িটাই তার প্রমাণ। পুরানো গাড়ি। গতি বাড়াতে গেলেই প্রতিবাদ শুরু করে ইঞ্জিন। বাধ্য হয়ে গতি কম রাখতে হলো তাকে।

অবশেষে ইয়ার্ডে পৌঁছল সে। নিচতলার ঘরগুলোতে আলো জ্বলছে। তারমানে জেগে আছেন মেরিচাচা, এবং নিচেই আছেন।

গাড়ির শব্দে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন চাচী। বিধ্বস্ত হ্যারিসকে নিয়ে রবিনকে নামতে দেখে আঁতকে উঠলেন, মাই গড! তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন সাহায্য করার জন্যে।

রাশেদ পাশা ওপরের বেডরুমে চলে গেছেন। তাঁকে ডাকার প্রয়োজন হলো না। রবিন আর মেরিচাচীই ধরে ধরে হ্যারিসকে রান্নাঘরে নিয়ে এল। চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হলো।

বড় তোয়ালে আর রাশেদ পাশার শার্ট-পাজামা এনে দিলেন রবিনের হাতে চাচী। বললেন, তুমি গা মুছে দাও। আমি কফি বানাচ্ছি।

চুলায় কেটলির পানি ফুটতে আরম্ভ করলে রবিনের দিকে ফিরে তাকালেন তিনি, কিশোর কোথায়? দুজনে তো দেখলাম একসঙ্গে বেরোলে।

যেন তার কথার জবাব দিতেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ভেতরে এসে দাঁড়াল কিশোর। টপটপ করে পানি পড়ছে ভেজা শার্ট থেকে।

চলে এসেছ! কিশোরকে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি রবিন।

হ্যাঁ। ঢুকতে পারলাম না। অনেক ডাকাডাকি করলাম, জবাবও দিল না কেউ। অহেতুক থেকে আর কি করব।

ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়েছ নিশ্চয়। আমি অবশ্য জোরে চালাতে পারছিলাম না, আড়চোখে হ্যারিসের দিকে তাকাল রবিন। শুকনো পোশাক পরে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন তিনি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত একবার রবিন, একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন মেরিচাচী। হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ল, ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম। মিস্টার ককৗর এসে বসে আছেন তোদের জন্যে।

হাঁ হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা। ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। হ্যারিসের দায়িত্ব চাচীর ওপর দিয়ে বসার ঘরে এসে ঢুকল ওরা।

.

০৬.

মিস্টার ককার, রবিন জিজ্ঞেস করল, আপনি ভাল আছেন!

আছি। কেন, না থাকার কোন কারণ ঘটেছে? প্রশ্ন করলেন ব্যাংকার।

আসলে জানতে চাইছিলাম, এত তাড়াতাড়ি এলেন কি করে এখানে, কিশোর বলল।

কি বলছ বুঝতে পারছি না! তাড়াহুড়া করতে যাব কেন? তাড়াহুড়া করা আমার স্বভাব নয়। যা করি ধীরেসুস্থেই করি। এমনকি জরুরী অবস্থায়ও তাড়াহুড়া করি না।

আপনাকে কিন্তু রিভেরা হাউস থেকে বেরোতে দেখিনি। পথেও আপনার গাড়ি আমাদের গাড়িকে ওভারটেক করতে দেখিনি। এলেন কি করে?

রিভেরা হাউস! ভুরু কোঁচকালেন ককার। ওখানে যাব কেন? গত দেড়টি ঘণ্টা ধরে তোমাদের অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছি। মিসেস পাশা বলতে পারলেন না তোমরা কোথায় গেছ। ওদের ভেজা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার, এত ভিজলে কি করে?

আপনার কেসের তদন্ত করতে গিয়ে, ককারের রুক্ষ ব্যবহার রাগিয়ে দিল রবিনকে। সেটা প্রকাশ করল না। রিভেরা হাউসে ঢুকেছিলাম। অন্ধকারে অবিকল আপনার মত দেখতে একজনকে ঢুকতে দেখলাম। একটু পর একটা আলো জ্বলে উঠে কিছুক্ষণ থেকে নিভে গেল। পরক্ষণেই কে যেন চিৎকার করে উঠল। আমরা ভাবলাম আপনাকে খুন করে ফেলা হচ্ছে। একজন লোক ছুটে বেরোল। তাকে তাড়া করলাম। ধরে নিয়ে এসেছি এখানে।

হাঁ হয়ে গেছেন ব্যাংকার। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার রাগ বেমালুম উবে গেল। নরম হয়ে বললেন, আমি যাইনি তো। তোমরা না বললে ওবাড়ি থেকে দূরে থাকতে। তাই তো রয়েছি।

আপনি তাহলে এলেন কোত্থেকে?

সোজা ব্যাংক থেকে। বেশি কাজ থাকলে অফিস আওয়ারের পরেও কাজ করি আমি।

এইবার গোয়েন্দাদের অবাক হওয়ার পালা। পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা।

এই সময় হ্যারিসকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মেরিচাচী। অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছেন ভদ্রলোক।

ককারকে দেখেই চটে উঠলেন হ্যারিস। তুমি! বলেই লাফ দিয়ে এগিয়ে গেলেন বিস্মিত ব্যাংকারের গলা টিপে ধরতে। চোর কোথাকার! আমার পান্নাগুলো কি করেছ! জলদি ফেরত দাও!

তাকে আটকে ফেলল কিশোর আর রবিন।

আবার রেগে গেলেন ককার। ভারি গলায় বললেন, আপনি যে-ই হোন, শান্ত হোন। কথাবার্তা সাবধানে বলবেন। মানহানীর কেস করে দিলে বিপদে পড়বেন কিন্তু।

এত সুন্দর জিনিসগুলো চুরি হয়ে গেল আমার! পান্না কেটে তৈরি করা এত সুন্দর সুন্দর পুতুল! রবিন আর কিশোরের দিকে তাকিয়ে ককিয়ে উঠলেন হ্যারিস। ফেরত দিতে বলো ওকে।

 আপনার পুতুল আমি নিতে যাব কেন? গর্জে উঠলেন ককার। আর একবার এ কথা উচ্চারণ করলে পুলিশকে ফোন করব আমি!

আহ্, কি পাগলামি শুরু করলেন আপনি, হ্যারিস! কঠিন হয়ে উঠল মেরিচাচীর দৃষ্টি। শান্ত হয়ে বসুন। কি হয়েছে, খুলে বলুন সব।

চেয়ারে বসলেন হ্যারিস। ককারকে দেখিয়ে বললেন, এর মত দেখতে একজন লোক এসে হাজির বাড়িতে। পান্নার তৈরি আমার দুর্লভ সংগ্রহগুলো দেখতে চাইল। বলল, তার কাছেও কিছু জিনিস আছে। আমারগুলো দেখলে নাকি বলতে পারবে ওগুলো আমি কিনতে আগ্রহী হব কিনা। বের করে আনলাম। আমি তখন বাড়িতে একা…

ম্যাগি কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন চাচী। ম্যাগি হলো হ্যারিসের বোন। মেরিচাচীর বান্ধবী।

বেড়াতে গেছে, জানালেন হ্যারিস। লোকটা আমার জিনিসগুলো দেখার পর জানতে চাইল আর আছে কিনা। গিয়ে আলমারি খুলে সবচেয়ে দামী জিনিসটা বের করলাম, পান্নার তৈরি একটা দাবার বোর্ড, অনেক টাকা দাম। ওটা নিয়ে ফিরে এসে দেখি লোকটাও নেই, আমার পুতুলগুলোও গায়েব!

ছুটে বেরোলাম। দেখি, একটা বড় গাড়িতে উঠছে সে। আমার গাড়িটা ড্রাইভওয়েতেই ছিল। তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে তার পিছু নিলাম। কিন্তু তার গাড়ির সঙ্গে তাল রাখতে পারলাম না। ম্যানিলা রিভার রোডে গাড়িটা ঢুকতে দেখলাম। তারপর দেখলাম একটা বাড়ির বিরাট গেট দিয়ে ঢুকে যেতে। ঝোপের আড়ালে গাড়ি রেখে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে আমিও ঢুকলাম সেই বাড়িতে। গাড়িটী দেখলাম না, তবে একটু পর লোকটাকে দেখলাম ঘরে ঢুকতে। তার পেছন পেছন আমিও ঢুকে পড়লাম ভেতরে।

সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন, কিশোর বলল, বুঝতে পারেননি!

বুঝব না কেন? আসলে এতটা রেগে গিয়েছিলাম চোরের ওপর, হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। তা ছাড়া জিনিসগুলো ফেরত নেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। যাই হোক, একটা হলঘরে ঢুকলাম। সামনের একটা ঘরে আলো জ্বলছিল। চুপিসারে এগোলাম সেদিকে। হঠাৎ আলো নিভে গেল। ঠিক আমার পেছনে হলো চিৎকারটা!

সে-কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন হ্যারিস। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আর দাঁড়ানোর সাহস হলো না, ঝেড়ে দৌড় মারলাম। কোন দিকে যাচ্ছি তা-ও খেয়াল ছিল না। পেছনে পায়ের শব্দ শুনে মনে করলাম খুনীটা আমারই পিছু নিয়েছে। আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। ধরা পড়ার পর দেখলাম, খুনীটা নয়, তোমরা।

ব্যাংকারের দিকে তাকাল কিশোর। মিস্টার ককার, মনে হচ্ছে, আপনার মত একই চেহারার আরও একজন আছে, যে মিস্টার হ্যারিসের পান্নাগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে। লোকটার চেহারা ভালমত দেখেছেন?

না, স্পষ্ট দেখতে পারিনি। মাথায় বড় হ্যাট পরেছিল। এখন বুঝতে পারছি, ইচ্ছে করে মুখের ওপর হ্যাট টেনে দিয়ে ছায়া ফেলে রেখেছিল। আমার দিকে তাকায়নি ঠিক মত। চেহারা দেখতে দিচ্ছিল না।

এর অর্থ, মিস্টার ককারের শরীরের সঙ্গে তার মিল দেখে চালাকি করে নিজেকে ককার বলে চালিয়ে দিতে চাইছে। রিভেরা হাউসে লোকে ঢুকতে দেখলে মনে করবে মিস্টার ককারই ঢুকছেন। সন্দেহ করে কিছু জিজ্ঞেস করতে আসবে না।

শুনতে একটুও ভাল লাগছে না আমার! মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। ককার, বিপদে ফেলে দেবে দেখছি আমাকে! আজ হ্যারিস আমাকে দেখে চোর ভেবেছেন, আরেকদিন আরেকজনে ভুল করবে না, একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

পুলিশকে জানাচ্ছি, টেলিফোন করতে উঠল কিশোর।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ককার। বাধা দিলেন, না না, আমার কেসের ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাই!

আপনার রহস্যের কথা কিছু বলব না। কেবল মিস্টার হ্যারিসের বাড়িতে চুরির কথাটা জানাব।

কয়েক মিনিট পর রিসিভার রেখে ফিরে এসে জানাল কিশোর, পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারকেই পেয়েছে। তিনি বলেছেন রিভেরা হাউসে লোক পাঠাবেন তদন্ত করতে। প্রয়োজনে রাতে পাহারার ব্যবস্থাও করবেন।

কিশোরকে হ্যারিসের কাছ থেকে দূরে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ককার বললেন, তদন্ত করে কি উন্নতি হয়েছে জানতে এসেছিলাম। কাল বিকেল পাঁচটায় রিভেরা হাউসে দেখা কোরো। গুপ্তঘরের দরজার টাইম লক তখন তোমাদের সামনে সেট করে দেব।

যাব।

কথা শেষ করে ব্যাংকার বেরিয়ে যেতেই হ্যারিস বললেন বাড়ি যাবেন। এখনও দুর্বল। একা যেতে পারবেন না বলে সন্দেহ হলো মেরিচাচীর। কিশোর আর রবিনকে বললেন বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে।

আপত্তি তো নেইই ওদের, বরং যেতে উৎসাহী, দেখে আসতে পারবে। কোনখান থেকে কি ভাবে পান্নাগুলো নিয়ে গেছে চোর।

হ্যারিসের গাড়িটা চালাল রবিন। পাহাড়ের কোলে পাথরের তৈরি হ্যারিসের বাড়িটা চেনে সে।

কিশোরও চেনে। রবিনের ফোক্স ওয়াগেন নিয়ে সে আসছে পেছন পেছন। হ্যারিসকে পৌঁছে দিয়ে ফেরত যেতে হবে ওদেরকে, গাড়িটা লাগবে তখন।

গেট দিয়ে ড্রাইভওয়েতে ঢুকতে চোখে পড়ল রবিনের, সদর দরজা হাঁ হয়ে খুলে আছে। আলো জ্বলছে ভেতরে।

আরি! চমকে উঠলেন হ্যারিস। খোলা রেখেই চলে গিয়েছিলাম! তাড়াহুড়োয় দরজা আটকে যেতেও মনে ছিল না!

রবিন গাড়ি থামাতেই দরজা খুলে নেমে পড়লেন তিনি। টলোমলো পায়ে যতটা সম্ভব দ্রুত এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।

গাড়ি রেখে কিশোর আর রবিনও তার পিছু নিল।

লাইব্রেরিতে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন হ্যারিস। চিৎকার করে উঠলেন, হায় হায়, আমার দাবার বোর্ডটাও নেই! বুক চেপে ধরলেন তিনি। টেবিলেই ছিল! গেছে ওটাও!

.

০৭.

 ধরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল রবিন। গেলাসে করে পানি এনে দিল। কিশোর গেল ডাক্তারকে ফোন করতে।

ডাক্তার আসতে আসতে তদন্তটা সেরে ফেলতে চাইল সে। হ্যারিসের কাছে রবিনকে বসিয়ে রেখে যে ঘরে আলমারিটা আছে সে-ঘরে এসে ঢুকল। দেখা শেষ করে ফিরে আসতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগল না।

চোখ বুজে আছেন হ্যারিস। খুললেন না। কিশোরের সাড়া পেয়ে বললেন, পান্নার বাকি জিনিসগুলো আলমারিতে আছে।

রবিনের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, কিছুই নেই আলমারিতে। সাফ করে নিয়ে গেছে। রবিনকে সরিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল, চুপ থাকো। ডাক্তার আসার আগে হ্যারিসকে বলার দরকার নেই।

আবার ফোন করতে গেল কিশোর। এবার থানায়। ইয়ান ফ্লেচারকেই পাওয়া গেল।

আমার মনে হয় দ্বিতীয় চুরিটাও প্রথমটার ওপর ভিত্তি করেই হয়েছে, কিশোর বলল। সাজানো ঘটনা। প্ল্যান করে চুরি করতে এসেছিল চোর। মিথ্যে কথা বলে ভজিয়ে-ভাজিয়ে মিস্টার হ্যারিসকে দিয়ে আলমারির তালা খোলায়। প্রথমে কয়েকটা পুতুল নিয়ে আসেন তিনি। সেগুলো দেখার পর তাকে দাবার বোর্ডটা আনতে পাঠায় চোর। তিনি সেটা আনতে গেলে পুতুলগুলো নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। সে জানত, মিস্টার হ্যারিস পিছু নেবেন। চালাকি করে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় রিভেরা হাউসে। মিস্টার হ্যারিসের বাড়ি তখন পুরোপুরি খালি। সেই সুযোগে চোরের কোন সহযোগী এসে দাবার। বোর্ড আর আলমারিতে রাখা অন্যান্য জিনিস নিয়ে কেটে পড়ে।

চীফ বললেন, আমার বিশ্বাস, যারা বন্দরে উৎপাত করছে, এটাও সেই চোরদেরই কাজ। কদিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছে ওরা। জেটিতে ভেড়ানো জাহাজ, বন্দরের গুদাম, যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, চুরি করছে। কোনমতেই ধরা যাচ্ছে না ব্যাটাদের। একটা কালো গাড়িতে করে চলাফেরা করত ওরা। পুলিশ জেনে ফেলেছে বুঝে সেটীও আর ব্যবহার করছে না।

মাল সরাচ্ছে কোথায়?

বুঝতে পারছি না। কড়া নজর রেখেছি আমরা। চোরাই মাল বাজারে এলেই খপ করে ধরব। কিন্তু আসছে না। তারমানে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে ফেলছে ওরা। পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে বের করবে।

জরুরী কিছু জানতে পারলে চীফকে জানাবে, কথা দিয়ে রিসিভার রেখে দিল কিশোর।

ডাক্তার এলেন। হ্যারিসকে দেখেটেখে বললেন, চিন্তার কিছু নেই। কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবেন। বেশি উত্তেজনায় এমন হয়েছে। তোমাদের আর থাকার দরকার নেই। বাড়ি যেতে পারো।

ওষুধ দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন।

আলমারিও যে ফাঁকা করে দিয়ে গেছে চোর, এ কথা আর হ্যারিসকে বলল না কিশোর। শুনলে আবার কি করে বসেন ঠিক নেই। ওষুধ দেয়া হয়েছে। ঘুমাক। সকালে উঠে নিজেই যা দেখার দেখবেন।

রবিনকে নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। বাড়ি ফিরে চলল।

অনেক রাত হয়েছে। ইয়ার্ডে ওদের বাড়িতেই রবিনকে থেকে যেতে বলল কিশোর। রবিনও রাজি হয়ে গেল। বাড়িতে ফোন করে দিলেই হবে, মা আর চিন্তা করবেন না।

পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়ল দুই গোয়েন্দা। প্রথমে যাবে। থানায়। আগের রাতে রিভেরা হাউসে পুলিশ কিছু পেল কিনা জানার জন্যে।

অফিসেই পাওয়া গেল ফ্লেচারকে। জানালেন, রিভেরা হাউসে নতুন কিছু পাওয়া যায়নি। তবে বন্দরে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। একটা স্পীড বোটের মালিক জানিয়েছে, তার বোটটা চুরি করে কেউ ব্যবহার করেছে। ঘাটে রেখে যাবার সময় ওটার পেট্রল ট্যাংক ভরা ছিল, ফিরে এসে দেখে প্রায় খালি। বোটের ইঞ্জিনও গরম। অথচ বহুক্ষণ ওটা চালায়নি সে। তারমানে কেউ চালিয়েছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটা হলো, হিরন নামে আরেকটা মোটর বোট চুরি করে নিয়ে। পালাচ্ছিল দুজন লোক। একজন বেটে, আরেকজন লম্বা। কোস্ট গার্ডের নজরে পড়ে যায় সেটা। তাড়া করে। ম্যানিলা রিভারের মুখের কাছে গিয়ে ডুবো পাথরে ঘষা লেগে ডুবে যায় বোটটা। সাঁতরে তীরে উঠে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে দুই চোর। আর ওদেরকে ধরা যায়নি।

আর তৃতীয় ঘটনাটা হলো, সী কিং নামে একটা জাহাজে ক্যাপ্টেনের কেবিনে চোর ঢুকেছিল। জাহাজটার মালিক স্টার লাইট শিপ কোম্পানি।

কি নিয়েছে? জানতে চাইল কিশোর।

মৃদু হাসলেন চীফ। শুনলে চমকে যাবে। একটা পান্না বসানো দামী হার। স্ত্রীর জন্যে কিনে রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন টমার।

সত্যিই চমকাল দুই গোয়েন্দা। খবরটা হজম করতে সময় লাগল ওদের। তারপর কিশোর বলল, মিলে যাচ্ছে। ডুডলি হ্যারিসের বাড়ি থেকেও পান্নার তৈরি জিনিসই চুরি গেছে।

মাথা ঝাঁকালেন চীফ, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুই দুইটা চুরি। পান্নার ওপরই লোভ ওদের। একই দলের কাজ বলেই মনে হয়।

ক্যাপ্টেন টমার এখন কোথায়? তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে?

লস অ্যাঞ্জেলেসে গেছেন। কোম্পানির হেড অফিসে, কথা বলতে। কাল নাগাদ ফিরে আসবেন।

একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন। বন্দরের চোরদের সঙ্গে মিস্টার হ্যারিসের বাড়িতে চুরির মিল, আবার মিস্টার হ্যারিসের সঙ্গে রিভের হাউসের যোগাযোগ। সব যেন একই সুতোয় বাঁধা।

আবার মাথা ঝাঁকালেন চীফ, সে-রকমই মনে হচ্ছে।

কিশোর বলল, বোট ব্যবহার করে শুনে মনে হচ্ছে, জলপথে পালায় চোরেরা। রিভেরা হাউসের পেছন দিয়েই বইছে ম্যানিলা নদী। বন্দর থেকে চোরাই মাল নিয়ে বোটে করে সোজা চলে যায় রিভেরা এস্টেটে। সেখানে কোনখান থেকে গাড়িতে পাচার করে দেয় মাল।

ঠিক! উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। সেজন্যেই হদিস করতে পারছে না পুলিশ!

চীফের দিকে তাকাল কিশোর, আজ বিকেল পাঁচটায় রিভেরা হাউসে যাব আমি আর রবিন। জরুরী কিছু পেলে আপনাকে জানাব।

.

০৮.

সাড়ে চারটায় রওনা হলো দুজনে। বাড়িতে কাজ থাকায় সেদিনও ওদের সঙ্গে যেতে পারল না মুসা।

এস্টেটে পৌঁছে রাস্তার ধারে একটা ঝোপের পাশে গাড়ি রাখল রবিন। আগের রাতে ডুডলি হ্যারিসও এখানেই রেখেছিল।

ভারি কাঠের গেটটার কাছে এসে শিস দিয়ে উঠল কিশোর। কাল রাতে খোলা দেখে গিয়েছিলাম..

এখন খোলা, এই তো? রবিন বলল, কাল রাতে তুমি চুরির কথা বলার। পর পুলিশ এসেছিল হয়তো, ওরাই লাগিয়ে রেখে গেছে।

কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর।

সাবধানে ভেতরে ঢুকল দুজনে।

বাড়ির পেছনের পায়ের ছাপগুলো আরেকবার দেখব, কিশোর বলল। এই গেটের ব্যাপারটা ভাল্লাগছে না আমার। খোলা রেখে গেলে দেখি লাগানো, লাগানো দেখলে থাকে বন্ধ। নিশ্চয় কারও যাতায়াত আছে।

প্রথমবার যেখানে পায়ের ছাপগুলো দেখেছিল, সেখানে চলে এল সে। মাটির দিকে তাকাল।

দেখো, নতুন ছাপ। অনেকগুলো। এই কটা দেখো, বেশি দেবেছে। তারমানে লোকটার ওজন বেশি।

এগুলো কালকেরগুলো না বলছ? রবিনের প্রশ্ন।

রাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। আগের ছাপ থাকার কথা নয়। বৃষ্টির পরে পড়েছে এগুলো।

ছাপ অনুসরণ করে নদীর ধারে চলে এল ওরা। এখানে নদীটা বেশ চওড়া।

মিনিটখানেক পর ড্রাইভওয়েতে একটা গাড়ি ঢোকার শব্দ শোনা গেল।

মনে হয় ককার এসেছেন, রবিন বলল। অন্য কেউও হতে পারে। লুকিয়ে পড়া দরকার।

ঘন গাছপালার আড়ালে আড়ালে এগোল ওরা। কিছুদূর এগোনোর পর বাড়ির বারান্দাটা চোখে পড়ল।

লম্বা, হালকা রঙের স্যুট পরা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। অধৈর্য ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। কয়েকবার তাকালেন ওরা যেদিকে রয়েছে সেদিকে, কিন্তু গাছের আড়ালে থাকায় ওদের দেখতে পেলেন না।

ককারই তো? রবিনের কণ্ঠে সন্দেহ, নাকি তার নকল?

ওদের দিকে পিঠ দিয়ে উল্টো দিকে ঘুরলেন ভদ্রলোক। নিঃশব্দে এক ছুটে তার কাছে চলে এল ওরা। আস্তে কাঁধে হাত ছোঁয়াল রবিন।

কে! ভীষণ চমকে গিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।

সরি! আপনি আসলেই মিস্টার ককার কিনা, সন্দেহ ছিল আমাদের…

খুব চমকে দিয়েছ, গম্ভীর হয়ে আছেন ব্যাংকার। তোমাদের গাড়ি দেখলাম না, ভাবলাম আসোনি বুঝি। এসো। একটা মিনিট নষ্ট করা যাবে না। কাটায় কাটায় পাঁচটায় সেট করা আছে টাইম লক। এখনই যেতে হবে। নইলে আর ঢুকতে পারব না।

চাবি দিয়ে সামনের দরজার তালা খুললেন ককার। লিভিং রুমে ঢুকে চট করে একবার তাকালেন গণ্ডিফাদার কুকটার দিকে। তারপর গোয়েন্দাদের নিয়ে চললেন ওপরতলায়।

বড় একটা ঘরে ঢুকে ফ্রেমে বাঁধা একটা ফটোগ্রাফ সরাতে একটা ছোট ছিদ্র দেখা গেল। তাতে আঙুল ঢুকিয়ে বোধহয় চাপই দিলেন। খুব ছোট গোল একটা দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে পড়ল টাইম লকের ডায়াল।

ডায়ালগুলোকে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘোরালেন তিনি।

তাকিয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। দেয়ালের যে জায়গাটায় এতক্ষণ। কাগজের জোড়া আছে ভেবেছিল, সেখানে একটা চির দেখা দিল। বড় হতে লাগল ফাটলটা। অবশেষে খুলে গেল দরজা।

গুপ্তঘরে ঢোকার পথ।

 গোয়েন্দাদের নিয়ে একটা ছোট, জানালাশূন্য ঘরে ঢুকলেন ককার।

ঘরের মাঝখানে পড়ে থাকা সাদা কাগজটা সবার আগে রবিনের চোখে পড়ল। এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল ওটা।

তাতে লেখা:

ঘড়ি যখন টিক টিক করবে,
তখন আসবে মরণ!
এবং এটাই শেষ হুশিয়ারি!

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল তিনজনে। তারপর হাত বাড়াল। কিশোর, দেখি?

প্রথম যে দুটো মেসেজ পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর মত একই হাতের লেখা।

 কিছু মনে না করলে এটা আমরা রেখে দিচ্ছি, মিস্টার ককার, বলল সে। সূত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে।

থমথম করছে ব্যাংকারের মুখ। মাথা ঝাঁকালেন। রাখো।… ওদের হুমকিকে আমি ভয় করি না। ভাবছি এতটা ঘৃণা আমাকে কে করে যে খুনই করতে চায়!

রবিন বলল, জিনিস খোয়া গেছে নাকি দেখেন তো?

টেবিলে রাখা কাগজপত্র আর ফাইলিং কেবিনেটটা দ্রুত একবার দেখে নিলেন ককার। না, সব ঠিক আছে। আগের বারের মতই। ঘরের মেঝেতে রহস্যময় একটা নোট। কোন জিনিস খোয়া যায়নি। কিছুতে হাতও দেয়নি।

বর্গাকার ঘরটাতে চোখ বোলাল কিশোর। দরজা ছাড়াও ঢেকিার আরও পথ আছে, সেটা বের করতে হবে। মিস্টার ককার, দরজাটা লাগিয়ে দিন। খুজব।

 সুইচ টিপে মাথার ওপরের একটা আলো জ্বাললেন ককরি। তারপর। ইস্পাতের ভারি দরজাটা লাগিয়ে দিলেন।

কাজে লেগে গেল দুই গোয়েন্দা।

ফায়ারপ্লেসে মাথা ঢুকিয়ে চিমনির ভেতর দিয়ে ওপরে তাকাল কিশোর।

ককার ঠিকই বলেছেন, ওপরের খোলা মুখটীয় শিক লাগানো। কেউ ওপথে ঢুকতে হলে শিকগুলো খুলে ফেলে দিতে হবে আগে। তা ছাড়া খুললেও এত সরু চিমনি দিয়ে কোন বাচ্চা ছেলেও ঢুকতে পারবে না। না, এ পথে করিও ঢোকা একেবারেই অসম্ভব।

কাজে লাগতে পারে ভেবে ছোট একটা হাতুড়ি নিয়ে এসেছে রবিন। সেটা দিয়ে দেয়াল ঠুকে দেখতে লাগল ফাপা আওয়াজ বেরোয় কিনা।

 কার্পেট উল্টে দেখতে শুরু করল কিশোর। নিচের মেঝেতে ট্র্যাপিডোর কিংবা আলগা তক্তা কোন কিছুই নেই, যেটা সরিয়ে ঢোকা যায়। চিমনি আর দরজাটা বাদে কোথাও এমন ফাঁক-ফোকর নেই, যেখান দিয়ে মানুষ তো দূরের কথা, একটা ইঁদুর ঢুকতে পারে।

বুঝতে পারছি না! রীতিমত অবাক হয়েছে কিশোর। কেউ তো একজন নিশ্চয় ঢুকেছে। নইলে নোট রেখে গেল কি ভাবে?

সাধে কি আর ডাকতে গেছি তোমাদের! ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে পড়লেন ককার।

আরেকটা সম্ভাবনা আছে অবশ্য, হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। পকেট থেকে ফিতে বের করে ঘরটা মাপতে শুরু করল। তারপর বলল, মিস্টার ককরি, দরজা খুলুন।

দরজার চৌকাঠের দুই পাশে দুই পা দিয়ে দাঁড়াল সে। দেয়াল কতটা পুরু, মাপল।

এ ঘরে আর কাজ নেই। বেরিয়ে এল সবাই। দরজা লাগিয়ে, টাইম লক সেট করে, দেয়ালের ছিদ্রের ওপর আবার ছবিটা ঝুলিয়ে দিলেন ককার।

ততক্ষণে সীটিং রুমের দেয়াল মাপতে আরম্ভ করেছে কিশোর। তারপর হলঘরে ঢুকে সেটার দেয়ালও মাপল।

ব্যাপারটা কি? কি করছ? জানতে চাইলেন ব্যাংকার।

দেখলাম গুপ্তঘরের দেয়ালে কোন কারসাজি আছে কিনা। এ সব পুরানো আমলের বাড়িতে অনেক সময় ফলস ওয়াল তৈরি করা হয়, আনমনে বলল কিশোর। কিন্তু এটার দেয়াল ফলস বলে মনে হয় না। মাপ ঠিক, কোন গণ্ডগোল নেই।

তাজ্জব ব্যাপার! রবিন বলল। হুমকিটীকে সিরিয়াসলি নেবেন, মিস্টার ককার। সাবধানে থাকবেন।

চওড়া সিঁড়িটা বেয়ে নিচে নেমে এল তিনজনে।

নীরব বাড়িটাতে একটাই মাত্র শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন। বিরাট ঘড়িটার শব্দ:

টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!

বিড়বিড় করল রবিন, ঘড়ি যখন টিক টিক করবে, তখন আসবে মরণ!

লিভিং রুমের দিকে এগোল সে। গ্র্যাণ্ড ফাদার কুকটার সামনে দাঁড়াল। একতালে দুলছে পেণ্ডুলাম। শব্দ করছে টিক-টক, টিক-টক।

কপাল ভাঁজ করে ফেললেন ককার, একবারও দম দিইনি আমি ঘড়িতে! চলে কি করে?

নিশ্চয় দেয় কেউ, রবিন বলল। কাল রাতেও দেখে গেছি চলছে। যে লোক নোট রেখে যায়, হতে পারে সে-ই চাবিও দিয়ে যায়। সে বলছে, ঘড়ি টিক টিক করলে মরণ আসবে, হয়তো এই ঘড়িটার কথাই বলেছে।

ঘড়ির নিচে পেণ্ডুলাম রয়েছে যে খুপড়িটায়, তার কাচের দরজাটার দিকে তাকাল সে। ভেতরে অন্য কিছু নেই। ওপরের দরজাটী সাবধানে খুলে। ভেতরটা দেখল।

এখানেও কিছু নেই।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। গভীর চিন্তায় মগ্ন। কি যেন মনে করার চেষ্টা করছে। বলল, মিস্টার ককার, আমাদের ডুপ্লিকেট চাবির খবর

হায় হায়, তাই তো! এত কাজের চাপ, চাবির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক আছে, কাল সকালে আগে চাবিওয়ালার কাছে যাব, তারপর অন্য কাজ।

.

০৯.

ইয়ার্ডে ফিরে মুসার পুরানো জেলপি গাড়িটাকে চতুরে দাঁড়ানো দেখল ওরা। মুসা বসে আছে ওঅর্কশপে। ওদের অপেক্ষায়।

তদন্তের কতখানি অগ্রগতি হয়েছে, কিছুই জানে না সে। শুনতে চাইল।

সব তাকে খুলে বলতে লাগল রবিন আর কিশোর। বদ্ধ ঘরে নোট পাওয়া গেছে শুনে গম্ভীর হয়ে গেল মুসা। মাথা দুলিয়ে বলল, বুঝলাম!

কি বুঝলে? ভুরু কোঁচকাল রবিন।

 কে ওখানে নোট ফেলে এসেছে।

কে? রবিন অবাক।

 ভূতে। বদ্ধ ঘরে ঢুকতেও কোন অসুবিধে হয় না ওদের।

তোমার মাথা! ভূত না ছাই! মানুষই ঢুকেছে। কি ভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না!

সেটা বুঝতে হলে বাড়িটার ওপর নজর রাখতে হবে আমাদের। ভাবছি, আজ রাতেই আবার যাব। কেউ ঢোকে কিনা দেখব। ঢুকলে তাকে ধরার চেষ্টা করব। মুসা, বাড়িতে তোমার কাজ শেষ হয়েছে?

পুরোপুরি হয়নি। তবে আজ রাতে না করলেও চলবে।

তাহলে যেতে পারবে আমাদের সঙ্গে?

পারব।

ভূত আছে তো পোড়োবাড়িতে, হেসে বলল রবিন, ভয় লাগবে না? যদি চেপে ধরে?

দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে যাব, হাত নেড়ে মুসা বলল, তাহলেই আর কাছে ভিড়তে পারবে না ভূত।

রাত নামার অপেক্ষা করল ওরা। তারপর তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনলে পালিয়ে যেতে পারে চোরেরা, তাই গাড়ি নিল না। হেঁটে চলল। টর্চ আছে সঙ্গে, জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ল না। চমৎকার চাঁদের আলো।

শহর ছেড়ে এসে নদীর পাড়ের পথ ধরল। এ পথে যানবাহন খুব কম। দুএকটা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। রিভেরা এস্টেটের দিকে কোন গাড়ি যেতে দেখলেই পথের পাশের পপি কিংবা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে ওরা। বলা যায় না, গাড়িটা চোরেরও হতে পারে। চিনে ফেলতে পারে ওদের।

রিভেরা হাউসের গেটে এসে ফিরে তাকাল মুসা। কেউ পিছু নিয়েছে। কিনা দেখল। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয় রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। নির্জন। গেটের পাশে গাছের জটলা আর দেয়ালে লম্বা লম্বা আইভি লতা রহস্যময় ছায়া সৃষ্টি করেছে। নিজের অজান্তেই গায়ে কাটা দিল তার।

গেট বন্ধ। ডিঙাতে অসুবিধে হলো না। ভেতরে ঢুকে বাড়িটার কাছাকাছি। এসে ঝোপে লুকিয়ে বসল। এখান থেকে সামনে-পেছনে দুদিকের দরজার ওপরই নজর রাখা যায়। চাঁদের আলোয় চকচক করছে বাড়ির প্লেট পাথরের টালি।

বসে আছে তো আছেই ওরা। কেউ আর আসে না। উসখুস শুরু করল মুসা। উঠে চলে যাওয়ার কথা বলতে যাবে কিশোরকে এই সময় তার গায়ে। কনুইয়ের তো মেরে ফিসফিস করে রবিন বলল, ওই দেখো!

জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সাদা শার্ট পরা খাটেীমত এক লোক। বাড়িটার দিকে এগোল। হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় পথ ওর চেনা।

ধরতে হবে, কিশোর বলল। এসো।

নিঃশব্দে এগোল ওরা। আরেকটু হলেই পেছন থেকে গিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু গোলমাল করে ফেলল মুসা। শুকনো ডালে পা। দিয়ে বসল। মট করে ভাঙল ওটা।

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। তিন গোয়েন্দাকে দেখে একটা মুহূর্ত দেরি করল না। নদীর দিকে দৌড় দিল।

পিছু নিল তিন গোয়েন্দা।

সাংঘাতিক দৌড়াতে পারে লোকটা। বনের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের পলকে।

ওর কাছে পিস্তল থাকতে পারে এই ভয়ে টর্চ জ্বালতে সাহস করল না গোয়েন্দারা। চাঁদের আলো থাকা সত্ত্বেও বনের মধ্যেটা অন্ধকার। দেখা গেল না লোকটাকে।

খানিক পর একটা মোটর বোটের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। নীরব রাতে অনেক বেশি করে কানে বাজল শব্দটী। নদীর দিকে ছুটল ওরা।

দেরি করে ফেলেছে। নদীর পাড়ে এসে দেখল, চলতে আরম্ভ করেছে। ছোট একটা স্পীড বোট। হুইল ধরে বসেছে লোকটা।

হতাশ চৌখে বোটটার দিকে তাকিয়ে রইল গোয়েন্দারা। নিজের ভুলের জন্যে ধরতে পারল না বলে আফসোস করতে লাগল মুসা। নদীর মোহনার দিকে যাচ্ছে বোট। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল বাকের আড়ালে।

কিশোর বলল, কাল রাতে দুজন লোককে তাড়া করেছিল পুলিশ। বেট ডুবে যাওয়ার পর পালিয়েছিল ওরা। একজন লম্বা, আরেকজন বেটে। মনে হয় সেই বেঁটে লোকটাই এই লোক।

রিভেরা হাউসে কি করতে এসেছিল? রবিনের প্রশ্ন।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আসলে বোকামি করে ফেলেছি। ধরার চেষ্টা না করে তার পিছু নেয়া উচিত ছিল। কোথায় যায়, কি করে, দেখতাম। অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেয়ে যেতাম তাহলে।

আবার বাড়ির কাছে ফিরে এল ওরা। আর এখানে থাকার কোন মানে নেই। সন্দেহজনক যাকে আশা করেছিল কিশোর, সে এসে চলে গেছে। এ রাতে আর কেউ আসবে বলে মনে হয় না।

অহেতুক বসে না থেকে দুই সহকারীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে চলল কিশোর।

.

১০.

পরদিন সকালে নাস্তার পর স্টার-লাইট শিপ কোম্পানির অফিসে রওনা হলো কিশোর আর রবিন। মুসাকে ফোন করেছিল কিশোর। আসতে পারবে না বলে দিয়েছে মুসা। কাজে ব্যস্ত। মা তাকে আটকে ফেলেছেন।

অফিসটা খুঁজে বের করল সহজেই। রিসিপশন ডেস্কে বসা সেক্রেটারি বলল, ক্যাপ্টেন টমার? হ্যাঁ, আছেন। কিন্তু ব্যস্ত। দেখা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।

বলুনগে পান্নার হারের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি অমিরা, কিশোর বলল। অবশ্যই দেখা করবেন তিনি।

অবাক হয়ে তার মুখের দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল সেক্রেটারি। তবে আর কিছু বলল না। উঠে চলে গেল ভেতরের দিকের একটা অফিসে। গেল আর এল। অফিসের দরজা দেখিয়ে ওদেরকে যেতে বলল।

ক্যাপ্টেনের ইউনিফর্ম পরা লাল-চুল, লম্বা একজন মানুষ বসে আছেন সেগুন কাঠের ভারি ডেস্কের ওপাশে। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, হারটা সম্পর্কে কি জানো?

এখনও কিছু জানি না, স্যার, বিনীত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। আশা করছি, চুরির ব্যাপারে আমাদের কিছু বলবেন আপনি।

কেন বলব? তোমরা কে তা-ই তো জানি না।

 তাড়াতাড়ি পকেট থেকে কার্ড বের করে দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর।

তাতে মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হলো না ক্যাপ্টেনের। ওদের গুরুত্ব বাড়ল না তাঁর কাছে। সেটা বুঝে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিল কিশোর। ওদেরকে দেয়া রকি বীচের পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের প্রশংসা পত্র।

নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সেটা দেখলেন ক্যাপ্টেন। হাত বাড়ালেন ফোনের দিকে। চীফকে ফোন করলেন।

ওপাশের কথা শুনতে শুনতে আস্তে আস্তে ভাবের পরিবর্তন হলো তাঁর। রিসিভার নামিয়ে রেখে এই প্রথম হাসলেন। ক্যাপ্টেন ফ্লেচার অনেক প্রশংসা করলেন তোমাদের।

কিশোর বলল, তাই।

ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। বলল, কি জানতে চাও। আমার সময় কম।

হারটা সম্পর্কে বলুন।

বলার তেমন কিছু নেই। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা দোকান থেকে কিনেছিলাম, বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ভাগ্যিস বীমা করিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল দোকানদার। চুরি হয়েছে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বীমা কোম্পানি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে নিয়োগ করেছে হারটা খুঁজে বের করার জন্যে। কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি, তোমরা কি চুরির তদন্ত করছ নাকি?

হ্যাঁ। আমাদের এক পরিচিত ভদ্রলোকের অনেকগুলো দামী জিনিস কাল রাতে চুরি গেছে, সব পান্নার তৈরি। ধারণা করছি সেগুলোর চোর আর আপনার হার চৌর একই লোক। চোরটাকে দেখেছেন?

নাহ, দেখলে কি আর পালাতে দিই। রাতের ওই সময়টায় খুব বেশি ব্যস্ত ছিলাম। জাহাজ থেকে দামী মাল খালাস করা হচ্ছিল। আমি ছিলাম সেখানে। কাজ করার জন্যে কয়েকজন নতুন শ্রমিককে নেয়া হয়েছিল। শ্রমিকের ছদ্মবেশে চৌরটাও উঠে থাকতে পারে জাহাজে।

তা পারে। তাদের নাম-ঠিকানা লেখার ব্যবস্থা আছে আপনার জাহাজের রেজিস্টারে? খোঁজ নেয়া যাবে?

না। বেশি প্রয়োজন হলে বাইরের শ্রমিক ভাড়া করি আমরা। কাজ শেষ হলে পাওনা চুকিয়ে বিদেয় করে দিই। নাম-ঠিকানা লিখে রাখার প্রয়োজন পড়ে না।

নতুন কোন তথ্য দিতে পারলেন না ক্যাপ্টেন। সাহায্য হলো না গোয়েন্দাদের। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

রকি বীচে ফিরে শিল্পকর্ম আর গহনার দোকানগুলোতে খোঁজ নিতে লাগল কিশোর, কেউ পান্নার কোন জিনিস বিক্রি করতে এনেছিল কিনা। দুই মাসের মধ্যে আনেনি কেউ, জানাল দোকানদারেরা। তবে ওদের একজন পরিচিত দোকানদার বলল, চোরাই মাল হলে ওদের কাছে আনার আগে অন্য একজনের কাছে যাবে চোর। তার নাম হব ডিকসন। এটা গোপন তথ্য। বলার আগে অবশ্যই ওদের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিল দোকানি, এ খবর যাতে কারও কাছে ফাস না করে ওরা।

শহরের একধারে হব ডিকসনের অ্যানটিক শপ। ইট বের হওয়া পুরানো বিল্ডিংটার সামনে গাড়ি রাখল রবিন। বাড়িটার নিচতলা রাস্তার সমতল থেকে অনেক নিচে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়।

নেমে এসে দোকানের সামনে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা। উইণ্ডোতে নানা রকম অদ্ভুত জিনিস রাখা। কোনটা দামী, কোনটা সাধারণ। বোঝানো হয়েছে, সব ধরনের অ্যানটিকই পাওয়া যায় এখানে।

 ওরা ঢুকতে কাঠের কাউন্টারের ওপাশ থেকে মুখ তুলল একজন ছোটখাটো মানুষ। ধূসর-চুল, চোখে স্টীল-রিমড চশমা। হাসিমুখে স্বাগত জানাল, হাল্লো, বয়েজ, কি করতে পারি তোমাদের জন্যে?

আপনি মিস্টার হব ডিকসন?

 মাথা ঝাঁকাল লোকটা। হ্যাঁ। অ্যানটিক চাই? কি জিনিস?

কিছু কিনতে আসিনি, মিস্টার ডিকসন, ভূমিকা না করে সরাসরি কাজের কথায় এল কিশোর। জানতে এলাম, কেউ কি পান্নার তৈরি কোন জিনিস বিক্রি করতে এনেছিল?

হাসি মুছে গেল লোকটার। সেই সঙ্গে বিস্ময়ও ফুটল চেহারায়। চমকে গেছে। ঢোক গিলে সামলে নিল। জিজ্ঞেস করল, কে তোমরা?

কার্ড বের করে দেখাল কিশোর। পরিচয় দিল।

বলবে কি বলবে না, দ্বিধা করতে লাগল হব। শেষে কি মনে করে বলেই ফেলল, দামী একটা দাবার বোর্ড আর একটা হার বিক্রি করতে এসেছিল একজন।

সামনে গলা বাড়িয়ে দিল রবিন, কিনেছেন?

না, পাগল ভেবেছ আমাকে! এত দাম চাইল, কিনে বেচব কততে? লাভ করব কি? লোকটা বলল, তার নাকি টাকার খুব ঠেকা। নইলে শখের জিনিস বেচত না।

লোকটা দেখতে কেমন, মিস্টার ডিকসন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ভেবে বলল হব, লম্বা, মধ্যবয়েসী, চোখে রিমলেস গ্লাস। হালকা রঙের স্যুট পরেছিল, মাথায় ঐ হ্যাট।

রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, মিস্টার ককারের মত মনে হচ্ছে না!

ও, চেনো তাকে? হব বলল। ভালই হলো। পকেটে হাত ঢোকাল সে।

ছোট চেন লাগানো একটা চাবির রিঙ বের করে কাউন্টারে রাখল সে। তাতে তিনটে চাবি। ফেলে গিয়েছিল। ফেরত দিতে পারবে?

প্রায় ছোঁ মেরে রিঙটা তুলে নিয়ে পকেটে ফেলল কিশোর। পারব।

দোকানিকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। গাড়িতে এসে উঠল।

জিনিস বেচতে ককরি আসেননি, রবিন বলল, নিশ্চয় তার মত দেখতে সেই লোকটা। পান্নার বোর্ড আর হার যখন নিয়ে এসেছে, আমাদের সন্দেহই ঠিক, চুরিটা একই লোকের কাজ।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিল সে।

পকেট থেকে রিঙটা বের করল কিশোর। চাবি তিনটা দেখতে দেখতে বলল, দুটো চাবি ইগনিশনের। কিসের ইগনিশন, বলো তো? গাড়ি, নাকি বোটের?

মনে তো হচ্ছে স্পীড বোটের।

একটা গাড়ির। অন্যটা স্পীড বোটের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এটা মাস্টার কী-র মত লাগছে। যে কোন বোটের ইগনিশনে ঢোকানো যাবে। সূতরাং কোন নির্দিষ্ট বোটের খবর নিয়ে লাভ নেই। তবে গাড়িটার খোঁজ করা যেতে পারে। তার জন্যে ক্যাপ্টেন ফ্লেচারের সাহায্য দরকার।

এখনই যাব?

না, পরে। আগে বাড়ি যাও।

১১.

 ইয়ার্ডে ঢুকতেই দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন, রোভারের সঙ্গে দেখা। বলল, এইমাত্র বেরিয়ে গেল লোকটা।

কোন লোক? ভুরু কোঁচকলি কিশোর।

তোমাকেই খুঁজতে এসেছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তোমাকে না পেয়ে নানা রকম উদ্ভট প্রশ্ন শুরু করল আমাকে। তোমাদের ব্যাপারে। যেন তোমরা একেকজন বড় বড় ক্রিমিনাল। দিয়েছি হাঁকিয়ে।

তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওঅর্কশপে ঢুকল দুজনে। একটা টুলের ওপর বসে পড়ে রবিন বলল, কে লোকটা বুঝতে পারছ কিছু?

মনে হয় পারছি, জবাব দিল কিশোর। বীমা কোম্পানির গোয়েন্দা। ক্যাপ্টেন টমার যার কথা বললেন। দাঁড়াও, রোভারকে ডাকি। কি কি বলেছে, জিজ্ঞেস করি।

দরজায় মুখ বের করে রোভারকে ডাকল কিশোর। সে ভেতরে এলে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কি বলল, সব খুলে বলুন তো?

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল রোভার। পুরানো একটা গদি ঝাড়ছিলাম। এই সময় এল সে। বয়েস বেশি না, সাতশি-আটাশ হবে। নাম বলল মিলার প্যাটোলি।

হু। তারপর?

বলল, আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আইডেনটিটি বের করে দেখাল।

দেখতে কেমন?

লম্বাও না খাটও না। সুন্দর একটা স্যুট পরেছে। ধূসর ফেল্ট হ্যাট। দাঁতের ব্রাশের মত খাড়া খাড়া গোঁফ।

নকল গোঁফ না তো? রবিনের প্রশ্ন।

কি করে বলব?

তাই তো, কি করে বলবে! হাত দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে তো আর আসল নকল বোঝা যায় না।

আর কিছু জানার নেই। রোভারকে যেতে বলল কিশোর। পকেট থেকে চাবির রিঙটা বের করে টেবিলে রাখল। সেটার দিকে তাকিয়ে রইল চিন্তিত ভঙ্গিতে।

 রবিন বলল, একটা চাবি মোটর বোটের ইগনিশনের। আরেকটা কোন গাড়ির। তৃতীয়টা সাধারণ দরজার তালার।

হু, আনমনে বলল কিশোর, তিনটেই যদি খুঁজে বের করা যেত, ভাল হত।

দুপুরের খাওয়ার আগে বেরেলি না ওরা।

খাওয়া শেষে বেরোল। চলে এল থানায়। চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে অফিসে পাওয়া গেল। চাবিগুলোর কথা বলল তাঁকে কিশোর।

পুলিশের ফাইলে সব রকম গাড়ি আর মোটর বোটের ইগনিশনের চাবির ফটোগ্রাফ আছে। একজন অফিসারকে ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। চীফ।

দশ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল অফিসার। উত্তেজিত। বলল, স্যার, গাড়িটা একটা বড় মেটিওর স্পেশাল! মনে হয় যে কালো গাড়িটাকে খুঁজছি আমরা, সেটাই।

কিশোর বলল, এই গাড়ি এ শহরে অত বেশি নেই। এখন বের করতে হবে, কটা গাড়ি আছে, তার মধ্যে কোনটা কালো, এবং মালিক কে।

সেটা জানা কঠিন হবে না, ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন চীফ। স্টেট মোটর ভেহিকল ব্যুরোকে জিজ্ঞেস করলেই হবে।

 রিসিভার কানে ঠেকিয়ে রেখেই প্যাড আর কলম টেনে নিলেন তিনি। ওপাশের কথা শুনে শুনে এক, দুই করে সিরিয়াল নম্বর দিয়ে লিখতে শুরু করলেন।

কয়েক মিনিট পর রিসিভার নামিয়ে রেখে প্যাড থেকে পাতাটা ছিঁড়ে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও। মোটর ভেহিকল অফিস। থেকে আটটা মেটিওর স্পেশালের রেজিস্ট্রেশন নেয়া হয়েছে। নাম-ঠিকানা লিখে দিলাম।

আগ্রহের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে কাগজটী টেনে নিল কিশোর। প্রথম নামটা পড়ল: জেরিল কাস্টার। হাসি ফুটল মুখে। উঠে দাঁড়িয়ে রবিনকে বলল, এসো, যাই।

সাহায্যের জন্যে চীফকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল দুজনে।

প্রথমে কোথায় যাবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

এক নম্বরটা থেকেই শুরু করব, কোন ঠিকানায় যেতে হবে বলল কিশোর। এক এক করে সন্দেহ কাটাব, আর সন্দেহভাজনদের নাম ছাঁটাই করব।

রকি বীচের রেসিডেনশিয়াল এরিয়ায় অনেক বড় একটা বাড়িতে থাকেন জেরিল কাস্টার। গেটের ভেতরে ঢুকে ড্রাইভওয়ে ধরে কিছুদূর এগোনোর পর গাড়ি রাখল রবিন। দুজনে নেমে হেঁটে চলল।

হঠাৎ কিশোরের হাত খামচে ধরল রবিন। কিশোর, দেখো!

গ্যারেজের দিকে তাকাল কিশোরও। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। চকচকে নতুন মেটিওর স্পেশাল গাড়িটা।

বাগানে রকিং চেয়ারে বসে আছেন হাসিখুশি এক বৃদ্ধ।

এগিয়ে গেল গোয়েন্দারা।

গুড আফটারনুন, বয়েজ, হেসে বললেন বৃদ্ধ, খুব গরম পড়েছে, না!

হ্যাঁ, বিনয়ের অবতার সেজে গেল কিশোর। আপনি কি মিস্টার কাস্টার, স্যার?

নিশ্চয়, কাস্টারের শরীর খুবই হালকা-পাতলা, কিন্তু তাঁর হালকা নীল চোখের তারা উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। গত উনআশি বছর ধরেই জেরিল কাস্টার হয়ে বেঁচে আছি আমি। এর জন্যে দুঃখ নেই। তরুণ বয়েসে অবশ্য অন্য কিছু হতে ইচ্ছে করত, বিখ্যাত কোন চরিত্র…

জেরিল। সদর দরজার ওপাশ থেকে ডাক শোনা গেল। কার সঙ্গে কথা বলছ? বেরিয়ে এলেন ছোটখাট একজন মহিলা। মাথার সব চুল সাদা। দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি কথা বলছ?

বিনীত গলায় জবাব দিল কিশোর, আপনাদের গাড়িটার কথা জানতে এসেছি।

ভাল করেছ, কাস্টার বললেন। তবে ওটাতে চড়তে চেয়ো না, আমাকে চালাতে বোলো না। বাপরে বাপ! তারচেয়ে একপাল পাগলা ঘোড়াকে গাড়িতে জুতে চালানো অনেক সহজ!

গর্বিত ভঙ্গিতে মিসেস কাস্টার বললেন, আমি কিন্তু চালাতে পারি।

 গাড়িটা কেমন লাগে আপনার? জানতে চাইল রবিন।

দারুণ! দুর্দান্ত! যেমন আরাম তেমনি গতি। স্পীডওলা গাড়ি ভাল লাগে আমার।

বৃদ্ধ এই দম্পতির সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে কিশোরের। অনেক চালান মনে হয়?

না, তেমন আর সুযোগ পাই কোথায়। বাজার করতে যাই, আর গির্জায় যাই। বাড়ি ছেড়ে বেশি দূর যেতে আর ইচ্ছে করে না আজকাল।

যেটুকু যাই, তাই যথেষ্ট, কাস্টার বললেন। ওর সঙ্গে গাড়িতে উঠলে সারাক্ষণ একটা দোয়াই করি, ঈশ্বর, অ্যাক্সিডেন্ট তো হবেই জানি-দয়া করে পঙ্গু বানিয়ে ভুগিয়ো না আমাকে, মেরে ফেলো!

রবিন আর কিশোর, দুজনেই হাসতে লাগল। বুঝল, এই গাড়িটার খোঁজে আসেনি ওরা।

কিশোর বলল, আপনাদের সময় নষ্ট করলাম। ইদানীং মেটিওর স্পেশীলের প্রতি আগ্রহ জেগেছে আমাদের। তাই জানতে এসেছিলাম, কেমন

ফিরে এসে গাড়িতে উঠল দুই গোয়েন্দা।

রবিন বসল ড্রাইভিং সীটে।

তালিকাটার দিকে তাকাল কিশোর, একজন বাদ। বাকি রইল সাত। একসঙ্গে না গিয়ে ভাগাভাগি হয়ে খোঁজা উচিত আমাদের, তাহলে তাড়াতাড়ি হবে।

কি করবে?

বাড়ি চলো। চাচার ভাঙা গাড়িটা নেব। তুমি একদিকে যাবে, আমি একদিকে।

.

১২.

সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ইয়ার্ডে ফিরল দুজনে। সবগুলো গাড়িই দেখে এসেছে। তবে কোনটার মালিকই দেখতে ককারের মত নয়।

একটাই জবাব হতে পারে এর, কিশোর বলল। গাড়িটা এই এলাকার নয়। অন্য কোনখান থেকে আনা হয়েছে। চোরাই নম্বর প্লেট ব্যবহার করে থাকলেও অবাক হব না।

কিন্তু গাড়িটা আছে কোথায় এখন?

জবাব মিলল না। সে রাতে জবাব না জেনেই ঘুমাতে যেতে হলো ওদের।

পরদিন সকালে কিশোর নাস্তা সেরে ওঅর্কশপে এসে ঢুকেছে কেবল, এই সময় এল মুসা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে টুলে বসতে বসতে বলল, পালিয়েছি, বুঝলে, আর পারব না। কাজ অনেক করেছি।

গোয়েন্দাগিরি করবে তো? নাকি সেটাও বন্ধ?।

উপযুক্ত খাবার পেলে করতে আপত্তি নেই, হেসে জবাব দিল মুসা।

এই সময় রবিন এল।

কেসটার অনেক কিছুই এখনও মুসার অজানা। তাকে জানানো হলো।

খাইছে! মুসা বলল। এ তো সাংঘাতিক জটিল! কোন সূত্রই নেই! কি করে কি করবে?

মেটিওর স্পেশালটা খুঁজতে হবে। আর কোন পথ নেই, কিশোর বলল।

তো, এখন কি খুঁজতে বেরোবে?

এখন মিস্টার ককারের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

 ককারের ব্যাংকে তাঁর অফিসে দেখা করল তিন গোয়েন্দা।

ওদের সন্দেহের কথা শুনে খেপে গেলেন ব্যাংকার, কি, আমার বাড়িটাকে চোরাই মাল পাচারের স্টেশন বানিয়েছে! ধরতে পারলে ঘাড় মটকাব! হুমকি দিয়েছে কেন বুঝলাম। ভয় দেখিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে, যাতে নিরাপদে শয়তানি চালিয়ে যেতে পারে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তবে কি করে নোটগুলো গুপ্তঘরে ফেলে এসেছে, সেই রহস্যটা জানা হয়নি এখনও।

তা বটে। আর কি কি জেনেছ তোমরা?

 জাহাজের কেবিন থেকে ক্যাপ্টেন টমারের পান্নার হার চুরির ঘটনা বলে কিশোর বলল, মনে হচ্ছে ডুডলি হ্যারিসের হারও চুরি করেছে একই চেরি।

ছেলেদের অবাক করে দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন ককার, আমার তা মনে হয় না! হ্যাঁলুসিনেশনে ভুগছে হ্যারিস। কোন জিনিস চুরি যায়নি তার। একটা বানানো গল্প বলে দিয়েছে।

কথা বললে সময় নষ্ট। ব্যাংকারের সময় আর নষ্ট করল না গোয়েন্দারা। নতুন কিছু ঘটলে, কিংবা তথ্য পেলে তাঁকে জানাবে বলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল। শেষ মুহূর্তে ডুপ্লিকেট চাবিটার কথা জিজ্ঞেস করল কিশোর। লজ্জিত হয়ে ব্যাংকার বললেন, আবার ভুলে গেছেন। খুব তাড়াতাড়িই বানিয়ে দেবেন, বলে দিলেন।

বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল ছেলেরা। রকি বীচে ফিরে চলল।

 হ্যারিসের ব্যাপারে ককারের মন্তব্যটা নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগল।

কিশোর, কি মনে হয় তোমার? প্রশ্ন করল মুসা, সত্যি কি জিনিস চুরি গেছে হ্যারিসের?

গেছে। ককার এখনও রেগে আছেন তাঁর ওপর, তাই মানতে চাইছেন না। এগুলো তাঁর রাগের কথা। তবে হ্যারিসের সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে অসুবিধে নেই আমাদের।

হঠাৎ করে লক্ষ করল কিশোর, মুসার আগ্রহ অন্য দিকে সরে গেছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

কি ব্যাপার? জানতে চাইল কিশোর।

জবাব না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা, রবিন, অত জোরে চালিয়ো না! ঠিক জায়গায় থামাতে পারবে না তো?

কোথায় থামাব?

ওই যে মিল্ক বারটার কাছে। সানডি খুব ভাল বানায় ওর–প্রচুর মাখন, চেরি আর বাদাম মেশায়। নামটাও দিয়েছে দারুণ, বিগল ইগলু। রাখো রাখো, গাড়ি রাখো। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। আগেই বলে রাখি, পয়সাটা তোমাদের কারও দিতে হবে। তাড়াহুড়া করে বাড়ি থেকে পালিয়েছি, টাকা নিতে ভুলে গেছি।

হেসে ফেলল কিশোর। বলল, গাড়ি রাখো, রবিন, এই পেটুককে নিয়ে আর পারা গেল না।

সাদা ছোট বাড়িটার সামনে গাড়ি রাখল রবিন।

শীঘ্রি ভেতরের একটা টেবিল ঘিরে বসল ওরা।

ওয়েইট্রেস এসে দাঁড়ালে অর্ডার দিল মুসা, চারটে বড় সাইজের বিগলু। ইগলু।

কিন্তু লোক তো তোমরা তিনজন?

তাতে তোমার কি? চারটে বলেছি, চারটে, ব্যস। দিতে অসুবিধে আছে?

না না, অসুবিধে কি? চলে গেল ওয়েইট্রেস।

লাঞ্চ আওয়ার এখন। ভিড়। প্রায় সব টেবিলেই লোক আছে। গুঞ্জন চলছে। মাথার ওপরের একাধিক অদৃশ্য স্পীকারে মৃদু শব্দে বাজছে রক এ মিউজিক। সব কিছু ছাপিয়ে হঠাৎ পেছন থেকে একটা কথা কানে এল কিশোরের, ..ঘড়ির সাহায্যে সারা হবে কাজটা!

.

১৩.

 ঘড়ির কথা শুনেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। কে বলছে দেখার জন্যে ঘুরতে গেল। খাবারের ট্রে নিয়ে তার একেবারে কাছে চলে এসেছিল ওয়েইট্রেস, হাতের ধাক্কায় উল্টে পড়ল ট্রে-টা। ঝনঝন করে ভাঙিল কাচের বড় বড় পেয়ালগুলো। মেঝেতে ছড়িয়ে গেল মুসার অত সাধের বিগলু ইগলু।

একটা মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল গুঞ্জন। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। হাত থেকে খাবারের প্লেট পড়ে ভাঙাটা নতুন কিছু না।

দুজন লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। হাঁটার সময় কথা বলছিল ওরা, কিশোরের কানে এসেছে। ওদের দেখিয়ে চিৎকার করে উঠল সে, মুসা, ওদের ধরতে হবে! জলদি এসো!

আবার স্তব্ধ হলো গুঞ্জন। এইবার বিস্মিত হলো শ্রোতারা। তবে তাদের তোয়াক্কা করল না কিশোর। দৌড় দিল লোক দুজনের পেছনে।

চিৎকার শুনে লোকগুলোও ফিরে তাকিয়েছে। একটা মুহূর্ত দেখল তিন গোয়েন্দাকে। তারপর ওরাও ছুটতে শুরু করল।

গোয়েন্দারা বাইরে বেরিয়ে দেখল, একটা কালো গাড়িতে উঠে পড়ছে ওরা।

ছেড়ে দিল গাড়িটা। রকি বীচের দিকে চলে গেল।

লম্বা লোকটাকে দেখলে! ছুটতে ছুটতে বলল কিশোর। শরীর একেবারেই ককারের মত!

রবিনের ফোক্স ওয়াগেন নিয়ে এসেছে ওরা। ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা। অন্য দুজন উঠে দরজা বন্ধ করতে না করতেই গাড়ি ছেড়ে দিল সে। পিছু নিল কালো গাড়িটার।

পাকা রাস্তায় টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে রবারের অনেকখানি ছাল চামড়া রেখে যখন মোড় ঘেরাল সে, অনেক দূরে চলে গেছে তখন সামনের গাড়িটা। এক্সিলারেটর যতটা যায়, চেপে ধরল মুসা।

প্রচণ্ড শব্দ করতে লাগল পুরানো ইঞ্জিন। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ার হুমকি দিচ্ছে যেন। কেয়ারই করল না মুসা।

মেটিওর স্পেশাল হলে ধরতে পারবে না, কিশোর বলল। পত্তিাই পাবে না।

দেখা যাক, মুসা বলল।

উঁচু হতে লাগল হাইওয়ে। সামনে হঠাৎ করে নেমে গেছে। তারপরে মোড়। কালো গাড়িটা একবার চোখে পড়ছে, একবার অদৃশ্য। হাল ছাড়ল না। মুসা। আঠার মত লেগে রইল পেছনে।

রকি বীচের কাছাকাছি পৌঁছল ওরা।

সামনের দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, ম্যানিলা রোডের দিকে যাচ্ছে। মনে হয়?

তার ধারণাই ঠিক। সেই পথই ধরল সামনের কালো গাড়িটা।

মোড় আর বনজঙ্গল এদিকটীয় বেশি। চোখের আড়ালে চলে গেল গাড়িটা।

রিভেরা এস্টেট চোখে পড়ল। গেট দেখা গেল। কিন্তু গাড়িটাকে আর দেখা গেল না। উধাও হয়ে গেছে।

গেট বন্ধ। ভেতরেও নেই গাড়িটা।

থেমো না, কিশোর বলল। এগিয়ে যাও।

 কিন্তু পুরো রাস্তাটা পার হয়ে এসেও আর দেখল না গাড়িটাকে।

 গেল! হতাশ ভঙ্গিতে সীটে হেলান দিল কিশোর।

তোমার এত কষ্ট কাজে লাগল না, মুসাকে বলল রবিন।

গাড়ি থামিয়ে দিল মুসা। ফিরে তাকিয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, কি করব?

ডুডলি হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

ওই রোডেই তার বাড়ি, জানা আছে মুসার। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার চালাল।

সাগরের দিকে মুখ করা পাহাড়ের ঢালে তৈরি পাথরের বাড়িটা চোখে পড়ল। বিশাল দুটো টাওয়ার, পাথরের দেয়াল আর আদিম চেহারা পুরানো আমলের দুর্গের রূপ দিয়েছে বাড়িটাকে। নিজের সীমানা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়েছেন হ্যারিস। গেটে তালা নেই।

ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকাল মুসা।

ঘণ্টা শুনে বেরিয়ে এলেন হ্যারিস। গম্ভীর হয়ে ছিলেন। তিন গোয়েন্দাকে দেখে উজ্জ্বল হলো চেহারা। ডেকে নিয়ে গেলেন লিভিং রুমে।

বেশি ভূমিকা না করে বললেন, দেখো, আমি তোমাদের সাহায্য চাই। আমার জিনিসগুলো খুঁজে বের করে দাও, আমি তোমাদের পুরস্কৃত করব।

তারমানে চুরির কেসটা আমাদের নিতে বলছেন আপনি? রবিন বলল।

অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছ তোমরা, পুলিশও হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল যেগুলো নিয়ে। আমার পান্নাগুলো যদি কেউ বের করে আনতে পারে, তোমরাই পারবে।

কিশোরের দিকে চোখ পড়তে থেমে গেলেন তিনি।

তাঁর দিকে নজর নেই কিশোরের। উঠে দাঁড়াচ্ছে। নজর বাগানের দিকের একটা জানালায়।

জিজ্ঞেস করল মুসা, কি? কিছু দেখেছ নাকি?

ফিসফিস করে জবাব দিল কিশোর, আড়ি পেতে আছে কেউ, আমাদের কথা শুনছে!

পেছনের দরজার দিকে ছুটল সে। ওদিক দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে বাগানে চলে যাবে। পেছন থেকে ধরার চেষ্টা করবে লোকটাকে।

.

১৪.

তাকে দেখে ফেলল লোকটা। কিংবা কিছু টের পেয়ে গেল। পাতাবাহারের বেড়া পার হয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটল পেছনের সীমানার দিকে। গায়ে। বাদামী রঙের স্পোর্টস জ্যাকেট। ছুটতে গিয়ে ঝাঁকি লেগে কোণগুলো লাফাচ্ছে। বানরের দক্ষতায় কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে চলে গেল ওপাশের রাস্তায়। ফিরে তাকাল একবার। দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখ।

মুসা আর রবিনও ততক্ষণে বেরিয়ে চলে এসেছে।

তিনজনেই ছুটল বেড়ার দিকে।

বেড়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল ওরা। ফাঁক দিয়ে রাস্তার এ পাশ ওপাশ দেখল কিশোর। অবাক হয়ে গেল। নেই লোকটা। গেল কোথায় এত তাড়াতাড়ি?

নীল জ্যাকেট পরা আরেকজন লোক রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে নতুন তৈরি হওয়া দুটো বড় বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

ডাকল তাকে কিশোর, এই যে, শুনছেন?…একজন লোককে দেখেছেন। এদিকে, বড় বড় দাড়ি!

ওই তো, ওই বাড়িগুলোর মাঝখানে ঢুকে গেল, জবাব দিল লোকটা। তাড়া করেছিলে নাকি? চোর?

জবাব দিল না কিশোর। গেট কাছেই। সেদিকে ছুটল। গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে দৌড় দিল বাড়িগুলোর দিকে। কিন্তু বাদামী জ্যাকেট-ওয়ালা লোকটাকে দেখতে পেল না আর।

বাড়িগুলোর ওপাশের রাস্তায় খুঁজতে গেল কিশোর। আশপাশে লুকানোর সম্ভাব্য যত জায়গা দেখল, সব খুঁজে দেখতে লাগল মুসা আর রবিন।

পেল না লোকটাকে। গায়েব হয়ে গেছে।

একসঙ্গে ডুডলির বাড়িতে ফিরে চলল তিনজনে।

 রাস্তায় এসে নীল জ্যাকেট পরা লোকটাকেও দেখতে পেল না।

এই লোকটা সত্যি বলেছে তো আমাদের? মুসার প্রশ্ন।

পেছনের বাগানে ওদের জন্য অপেক্ষা করছেন হ্যারিস।

কাছে এসে মাথা নেড়ে কিশোর জানাল, পেলাম না ওকে। তবে আপনার কেস আমরা নিলাম। পান্নাগুলো খুঁজে বের করে দেব।

পরদিন সকাল দশটায় থানায় চলল কিশোর আর রবিন। মুসা আসেনি। পালাতে পারেনি আজ। মা আটকে দিয়েছেন। চীফের সঙ্গে কথা বলে জানতে চায় কিশোর, বন্দরের চুরি রহস্যের সুরাহা হলো কিনা, কিংবা নতুন তথ্য পাওয়া গেল কিনা।

কড়া রোদ উঠেছে। গরম পড়ছে খুব। দোকানের ডিসপ্লে উইণ্ডোগুলোতে যেগুলোতে রোদ এসে পড়ে হয় সেগুলোতে শাটার টেনে দেয়া, নয়তো মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

কিশোর, দেখো! ঐ হ্যাট পরা লম্বা একজন লোকের দিকে আঙুল তুলল রবিন। ওদের দিকে পেছন করে রাস্তার ধারের একটা দোকানের উইণ্ডোর দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। অ্যালেক্স ককার, না সেই লোকটা? ককার হলে এ সময়ে ব্যাংক ফেলে এখানে কি করছেন?

চলো, জিজ্ঞেস করি।

রাস্তা পার হয়ে এল ওরা।

পেছন থেকে মৃদু গলায় ডাকল কিশোর, মিস্টার ককার!

ঘুরে তাকাল লোকটা।

এক পা পিছিয়ে এল কিশোর। লোকটা ককার নয়।

কি চাই? কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটা।

হ্যারিসের পান্নাগুলো আপনিই সরিয়েছেন, তাই না? ফস করে বলে বসল রবিন। বলেই বুঝল, এ ভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হয়নি।

কিসের পান্না? কি বলছ! তোমাদের আমি চিনি না। কথাবার্তা সাবধানে বলবে বলে দিলাম। নইলে পুলিশ ডাকব।

ধাক্কা দিয়ে ছেলেদের সরিয়ে, কয়েকজন ফেরিওয়ালাকে ঠেলে প্রায় ছুটে গিয়ে মোড়ের কাছে দাঁড়ানো একটা কালো গাড়িতে উঠে পড়ল লোকটা। চোখের পলকে মিশে গেল যানবাহনের ভিড়ে।

ওকে যেতে দিলাম কেন? নিজের ওপরই খেপে গেল রবিন।

আর কোন উপায় ছিল না বলে, কিশোর বলল। চোর চোর বলে চিৎকার করেও লাভ হত না, ও-ই যে চুরি করেছে কোন প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। যাই হোক, গাড়িটার নম্বর দেখেছি। ফ্লেচারকে বলব।

মেটিওর নয়। যদ্দুর মনে হয়, গতকাল এই গাড়িটাকেই ফলো করেছিলাম। মুসা থাকলে বলতে পারত।

যেদিকে যাচ্ছিল, আবার রওনা হলো ওরা।

.

হু, তাহলে চোরটাকে দেখে এসেছ, সব শুনে মাথা দুলিয়ে বললেন চীফ। নাম্বারটা বলো।

কিশোর বলল, লিখে নিলেন চীফ। অফিসারকে ডাকলেন।

খোঁজ পাওয়া গেল গাড়িটার। রকি বীচেরই রেজিস্ট্রেশন, জনৈক ডেভিড কুপারের নামে। ফোন করে পাওয়া গেল সেই লোককে। থানা থেকে করা হয়েছে শুনে বলল, তার গাড়িটা চুরি গেছে। পুলিশকে খবর দেয়ার কথা ভাবছিল সে।

দয়া করে একবার আসতে পারেন থানায়, মিস্টার কুপার? অনুরোধ করলেন চীফ। সামনাসামনি সব শুনতে পারলে ভাল হয়। আপনার গাড়িটা খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করতে পারি। নাকি আমরাই আসব?

না না, দরকার নেই, আমিই আসছি, কুপার বলল।

.

১৫.

আধঘণ্টা পর একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অফিসে ঢুকল সম্ভান্ত পোশাক পরা, মাঝবয়েসী, হালকা-পাতলা এক লোক। তাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল অফিসার। নিজের পরিচয় দিল লোকটা, ডেভিড কুপার।

কিশোর আর রবিনের চেনা শত্রু হয়ে যেতে পারে ভেবে ফাইল র‍্যাকের আড়ালে ওদের লুকিয়ে পড়তে বললেন চীফ। ওখান থেকে উঁকি মেরে দেখতেও পারবে ওরা, কথাও শুনতে পাবে।

পরিচয় আর হাত মেলানোর পর বললেন চীফ, হ্যাঁ, গাড়িটার কথা বলুন, মিস্টার কুপার। কোথায় রাখতেন?

অবশ্যই গ্যারেজে।

কিশোর দেখল, চীফের দিকে মুখ করে থাকলেও চোখজোড়া অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে লোকটার।

গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে গেল? চোরটীর সাহস আছে বলতে হবে।

গ্যারেজ থেকে চুরি যায়নি। বাড়ির সামনে রাস্তার মোড়ে রেখেছিলাম, ওখান থেকে নিয়ে গেছে।

কবে? কাল রাতে?

অ্যাঁ!…হ্যাঁ, কাল রাতে।

হু, লোকটার চোখের দিকে তাকালেন চীফ, কাল রাতে? নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন?

চোখ সরিয়ে নিল কুপার। অ্যাঁ!..হ্যাঁ, তা তো বটেই..দুশ্চিন্তাই তো হবার কথা, তাই না? সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর যখন জানতে পারলাম গাড়িটা নেই, তখন থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।

সকালে কটায় ওঠেন ঘুম থেকে?

সাতটা।

ওই সময় দেখলেন গাড়িটা চুরি গেছে? আপনাকে ফোন করেছি সাড়ে দশটায়। তারমানে চুরি গেছে জানার পরেও সাড়ে তিন ঘণ্টা পার করে দিয়েছেন, পুলিশকে খবর দেননি, আবার বলছেন খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।

আ-আমি… তখন বুঝতেই পারিনি গাড়িটা চুরি গেছে! চোখ মিটমিট করতে লাগল কুপার। কথা খুঁজে পাচ্ছে না যেন। হঠাৎ করেই রেগে উঠল, এমন জেরা শুরু করেছেন যেন আমি একটা ক্রিমিনাল!

কিছু মনে করবেন না, মিস্টার কুপার, আপনার আচরণই এ ভাবে কথা বলতে বাধ্য করছে আমাকে।

কি দেখলেন আমার আচরণের মধ্যে? খেঁকিয়ে উঠল কুপার।

আস্তে কথা বলুন। কি আচরণ করছেন, সেটা আপনিও বুঝতে পারছেন। যাকগে, গাড়ি চুরির রিপোর্ট করতে এসেছিলেন, করা হয়েছে। আপনি এখন যেতে পারেন। গাড়ির খোঁজ পেলে আপনাকে জানানো হবে।

কুপার চলে যাওয়ার পর বেরিয়ে এল কিশোর আর রবিন।

এত নার্ভাস কেন লোকটা? চীফের দিকে তাকাল রবিন। কথা বলতেই কেমন করছিল।

মিথ্যে কথা বলতে গেলে আর কি করবে, চীফ বললেন। ওর ওপর নজর রাখতে হবে। যেই পা ফসকাবে, অমনি কাঁক করে ধরব।

.

ইয়ার্ডে ফিরে দেখল ওরা টেলিফোনে কথা বলছেন মেরিচাচী। ওদের দেখেই বললেন, মুসা, ওরা এসে গেছে। কথা বলতে পারো। তবে আগেই বলে দিচ্ছি, আজ বিকেলে কোথাও আর বেরোতে পারবে না কিশোর। আমাদের বাড়ির ঘাস এত বড় হয়ে গেছে, গরু চরানো যাবে। তোমার আংকেল গেছে বোরিস আর রোভারকে নিয়ে মাল কিনতে। সুতরাং কিশোরকে বেরোতে দেয়া যাবে না।

কিশোরের হাসি হাসি মুখটা কালো হয়ে গেছে হঠাৎ। কেন, বুঝতে পারলেন চাচী। ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নে, কথা বল। তবে বেরোনোর চিন্তা করবি না বলে দিলাম আগেই।

 সারাটা বিকেল আর বেরোনো হলো না। সন্ধ্যার আলোও যখন নিভে এল, তখন কাজ শেষ করে, হাতমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে নিল কিশোর। রাস্তার আলোগুলো জ্বলেছে। গেটের দিকে এগোতে যাবে সে, ঘ্যাঁচ করে এসে থামল একটা পুরানো গাড়ি। জানালা দিয়ে মুখ বের করল মুসা আর রবিন। এই সময়ই আসতে বলেছে ওদেরকে কিশোর।

কোথায় যাব? কিশোর গাড়িতে উঠলে জানতে চাইল মুসা।

রিঙের তিন নম্বর চাবিটার ওপর গবেষণা চালাব আজ, কিশোর বলল। আমার বিশ্বাস, এটা রিভেরা হাউসের কোন দরজার তালার।

রিভেরা হাউস থেকে বেশ খানিকটা দূরে ম্যানিলা রোডের ধারে গাড়ি রাখল মুসা। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। বাকি পথটা হেঁটে এল। ওরা। এগোল দেয়ালের ধার ঘেঁষে। গেট খোলা। নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

তারাখচিত আকাশের পটভূমিতে আবছা অন্ধকার একটা ভূতুড়ে ছায়ার মত মাথা তুলে আছে বাড়িটা। চাঁদ ওঠেনি এখনও। পা টিপে টিপে গিয়ে। বারান্দায় উঠল কিশোর।

তালায় চাবি ঢুকিয়ে কয়েকবার মোচড় দিয়েও খুলতে পারল না। ফিরে তাকিয়ে বন্ধুদের জানাল, লাগছে না। পেছনে চলো।

কিন্তু পেছনের দরজায়ও লাগল না চাবিটা।

 সেলারের ঢাকনার না তো? রবিন বলল।

সেদিকেই চলল ওরা।

তালায় চাবি ঢোকাল কিশোর। মোচড় দিতেই ঘুরে গেল। খুলে গেল তালা। লেগেছে! উত্তেজিত হয়ে বলল সে।

ভারি ঢাকনাটা খুলল ওরা। সিঁড়ি নেমে গেছে মাটির নিচের ঘরে। সেই সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নেমে চলল ওরা নিচের অন্ধকারে।

টর্চ আছে সঙ্গে, কিন্তু জালতে সাহস করল না। এই অন্ধকারে জ্বাললে ওপরের ফোকর দিয়ে আলো বেরোবে, অনেক দূর থেকেও দেখা যাবে সেটা। আশেপাশে কেউ থাকলে দেখে ফেলবে।

স্যাঁতসেঁতে ঘর, ভাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে। ভ্যাম্পায়ারের কথা মনে পড়ে গেল মুসার। গায়ে কাঁটা দিল তার। অদ্ভুত এক অনুভূতি মনে হচ্ছে, আড়াল থেকে কেউ নজর রাখছে তার ওপর। অন্য দুজনের সঙ্গে গা ঘেষাঘেষি করে। এল সে। হঠাৎ এক চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে একপাশে সরে গেল। পরক্ষণেই ধূড়ম-ধাডুম করে পতনের শব্দ।

কোমরে ঝোলানো টর্চের সুইচ টিপে দিল কিশোর।

আলোক রশ্মি ঘুরে গিয়ে পড়ল মুসার মুখে। কতগুলো কাঠের বাক্সের মধ্যে প্রায় ডুবে রয়েছে সে। চোলে জাতক। ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল, কি-কি যেন। একটা নরম…চলে গেল আমার পায়ের ওপর দিয়ে। বাদুড়ের নখের মত

ওই যে তোমার বাড়ি, টর্চের আলো নেড়ে এককোণে দেখাল রবিন।

অনেক বড় একটা ইঁদুরকে কুঁজো হয়ে থাকতে দেখা গেল। মুসার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে।

গায়ে আলো পড়তে শুটিগুটি একপাশে সরে গেল ওটা।

মুসাকে উঠতে সাহায্য করল রবিন অব কিশোর।

এখনও গা কাঁপছে মুসার। কিশোরের পিছু পিছু চুপচাপ এগোল আরেকটা সিঁড়ির দিকে।

শব্দটা তার কানেই আগে ঢুকল। দাঁড়িয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওপরতলায় কেউ আছে!

কথা শোনা গেল। মেঝেতে বসানো কাঠের ঢাকনা তোলার শব্দ হলো।

চোর হলে কেয়ার করি না, ঢোক গিলল মুসা, কিন্তু অন্য কিছু হলে…

 তাকে কথা শেষ করতে দিল না রবিন। চলো, দেখি।

 সিঁড়ির মাথার দরজাটায় তালা দেয়া।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, আমরা ঢুকতে না পারলেও ওদেরকে বের করে আনতে পারি। চেঁচাও। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করো। বেরোতে বাধ্য হবে ব্যাটীরা।

চেঁচাতে শুরু করল তিনজনে। সেই সঙ্গে থাবা আর কিল মারতে লাগল দরজায়। মিনিটখানেক পরেই দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে কথা শোনা গেল, অ্যাই, কে, বলো তো! নিশ্চয় পুলিশ! পালাও! জলদি পালাও!

ভারি পায়ের শব্দ ছুটে গেল ঘরের অন্য প্রান্তে।

চিৎকার করতে করতে গোয়েন্দারাও নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। বাইরে বেরোনোর সিঁড়িটা বেয়ে আবার উঠতে লাগল। বেরিয়ে এল সেলারের মুখে।

ওরাও বেরোল, এমন সময় জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল দুটো ছায়ামূর্তি। নদীর দিকে দৌড় দিল।

ধরো ব্যাটাদের! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

ভূতের ভয়ের নামমাত্রও নেই আর মুসার মধ্যে। ছুটল লোকগুলোর পেছনে। তবে বনের ভেতরের পথ তার অচেনা, লোকগুলোর চেনা। ফলে গাছপালার আড়ালে ছোটার সময় ওরা সুবিধে বেশি পেল। পিছিয়ে পড়তে লাগল সে।

রবিনকে নিয়ে কিশোর ছুটল সোজা নদীর দিকে। বোটটেটি থাকলে সেটা আটকানোর ইচ্ছে। বন থেকে বেরিয়ে এসে দেখল পানির ধারে বাধা রয়েছে একটা মোটর বোট।

এখনও বেরোয়নি ওরা, কিশোর বলল। নেমে গিয়ে…

তার কথা শেষ হলো না। পেছন থেকে থাবা পড়ল হাতে। টর্চটী উড়ে গিয়ে পড়ল মাটিতে, নিভে গেল। বাল্ক ভেঙে গেছে বোধহয়। বাধা দেয়ার সুযোগ পেল না ওরা। কানের কাছে চেপে ধরা হলো পিস্তল। হাত-পা বেঁধে। মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া হলো। তারপর বয়ে নিয়ে গিয়ে তোলা হলো বোটে।

ঘোঁৎ-ঘোৎ করে উঠল কে যেন। গর্জে উঠল ইঞ্জিন।

 চলতে শুরু করল বোট।

মুখ ঘুরিয়ে কিশোর আর রবিন দেখল, ডানে কালো তীরের সঙ্গে ওদের দূরত্ব বাড়ছে। বুঝতে পারল উজানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওদের। দুজন লোক রয়েছে কাছাকাছি। এরাই ওদের ধরেছে। একজন লম্বা। অন্যজন বেটে, গাট্টাগোট্টা। হাল ধরেছে সে।

এদের নিয়ে গিয়ে কি করব? সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল লম্বা লোকটা।

দেব পানিতে ফেলে।

.

১৬.

হাত-পা বেঁধে বোটের তলায় ফেলে রাখা হয়েছে দুজনকে। অন্ধকার নদী ধরে যেন যুগ যুগ ধরে ছুটছে ওরা। রক্ত চলাচল ব্যাহত হওয়ায় অবশ হয়ে গেছে হাতের আঙুল। বোটের মাঝামাঝি অংশে একটা সীটে বসে ওদের পাহারা দিচ্ছে লম্বা লোকটা। তর্ক করছে বেটে সঙ্গীর সঙ্গে।

পানিতে ফেললে কি ঘটবে আন্দাজ করতে পারো? লম্বু বলল। কিডন্যাপ করাটাই বিরাট অপরাধ, ভিক, তারপর খুন…

থামো, ভীতু কোথাকার! খেঁকিয়ে উঠল বাটুল। ব্রুনো, তোমার যে কবুতরের কলজে, জানতাম না। এখানেই কোথাও ডোবাব ওদের। দেখি, নোঙরটা বের করো। ওটাতে বেঁধে ছেড়ে দেব।

শীতল শিহরণ বয়ে গেল রবিনের শিরদাঁড়া বেয়ে। লোকগুলো যে এতখানি সিরিয়াস, ভাবতে পারেনি এতক্ষণ। ভেবেছে কথার কথা বলছে। এখন দেখছে সত্যি সত্যি। তার মাথাটা রয়েছে বোটের একপাশ আর সীটের মাঝখানে। মুখ থেকে কাপড়টা ফেলার জন্যে বোটের গায়ে ঘষতে শুরু করল

দেখো, আমি এ সবের মধ্যে নেই! ব্রুনো বলল।

তাহলে বসে থাকো, ভিক বলল। আমিই যা করার করব।

 ইঞ্জিন নিউট্রাল করে বোট থামিয়ে দিয়ে উঠে এল বাঁটুল।

ইতিমধ্যে কাপড় খুলে ফেলেছে রবিন। আরেকটা ভারি ইঞ্জিনের শব্দ। কানে আসছে তার। এমনিতেও মরবে ওমনিতেও, পিস্তলের ভয় আর করল না। মরিয়া হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল, বাঁচাও! বাঁচাও!

লাফ দিয়ে তাকে থামাতে এগোল ব্রুনো।

জ্বলে উঠল সার্চলাইট। ছুটে আসতে লাগল একটা লঞ্চ। সাইরেন বেজে উঠল। বোটের ওপর এসে পড়ল তীব্র আলো।

রবিনকে ধরা বাদ দিয়ে লাফিয়ে গিয়ে আবার হালের কাছে বসে পড়ল। ভিক। ছুটতে শুরু করল বোট।

এ সব করে বাঁচতে পারবে না, চিৎকার করে বলল রবিন। ভয় পাচ্ছে, ওদেরকে পানিতে ফেলে দিয়ে না পেছনের লঞ্চটীকে ঠেকানোর চেষ্টা করে। ডাকাতগুলো। ওদের ফেলতে দেখলে নিশ্চয় থেমে যাবে লঞ্চ, খোঁজাখুজি। করবে। এই সুযোগে পালাবে দুই ডাকাত। তবু হাল ছাড়ল না সে। বলল, নদীটা নিশ্চয় চেনেন না। একটু পর পরই পুলিশের ঘাঁটি আছে। ধরা আপনাদের পড়তেই হবে।

জবাবে গতি আরও বাড়িয়ে দিল ভিক। স্পটলাইটের আলো থেকে বাঁচার জন্যে শাই করে একবার এদিকে হাল ঘোরাচ্ছে, একবার ওদিক। বার বার মোড় নিতে গিয়ে ভীষণ দুলতে আরম্ভ করেছে বোট।

আরে করছ কি! আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল লম্বু বুকে ডুবিয়ে মারবে

ওর তো এই অভ্যাস আছেই, মোহনার কাছে আরেকটা বোটকে ডুবানোর কথা মনে পড়তে বলল রবিন। ভয় দেখানোর চেষ্টা করল, এই নদীর কোন কিছুই চেনেন না। নিচে যে কি মারাত্মক সব ডুবো পাথর আছে, জানেন না। তার ওপর অন্ধকার। সেবার তো তীরের কাছে ডুবেছিল বলে সাঁতরে উঠে জান বাঁচিয়েছেন। এবার রয়েছেন গভীর নদীতে। ডুবলে আর বাঁচতে পারবেন না।

তার সূরে সুর মিলিয়ে ব্রুনো বলল, ও ঠিকই বলেছে, ভিক, থামো তুমি! মরার চেয়ে পুলিশের হাতে পড়া ভাল!

ঠা-ঠা-ঠা-ঠা করে গুলির শব্দ হলো। গর্জে উঠেছে মেশিনগান।

আর চালানোর সাহস করল না ভিক। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। তীব্র উজ্জ্বল সাদা আলোর বন্যা যেন ভাসিয়ে দিল বোটটাকে। পুলিশের লঞ্চের ভারি খোল এসে ঘষা খেল বোটের গায়ে।

লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নামল একটা ভারি শরীর।

মুসা! আনন্দে চিৎকার করে উঠল রবিন।-তুমি এখানে!

ভালই আছ তোমরা আনন্দে গলা কেঁপে উঠল মুসার। দ্রুতহাতে বাঁধন খুলতে শুরু করল।

দুই চোরের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল পুলিশ। লঞ্চে টেনে তুলল। মোটর বোটটাকে বেঁধে নেয়া হলো লঞ্চের সঙ্গে।

রকি বীচে ফিরে চলল লঞ্চ।

হেলান দিয়ে বসে কিশোর বলল, একটা কাজের কাজ করেছ, মুসা। এমন সময় মত পুলিশ নিয়ে হাজির হলে কি করে?

তোমাদের তুলে নিয়ে বোটটাকে চলে যেতে দেখলাম। পাগলের মত ছুটলাম গাড়ির দিকে। চলে গেলাম কাছের পুলিশ ফাঁড়িতে। ওদেরকে জানাতেই ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করল একটা টহল লঞ্চের সঙ্গে। ছুটে চলে গেলাম আবার নদীর ধারে। লঞ্চটা আমাকে তুলে নিল। উজানের দিকে যেতে বললাম ওদের। রবিনের চিৎকারটা কাজে লেগেছে। তাড়াতাড়ি পাওয়া গেছে তোমাদের।

ও চিৎকার না করলে আর পেতে কিনা সন্দেহ আছে, কব্জি ডলতে ডলতে বলল কিশোর। আমাদের ডুবিয়ে দিতে চাইছিল বাটুল শয়তানটা।

রিভেরা হাউসের কাছে এসে তিন গোয়েন্দাকে নামিয়ে দেয়ার সময় লঞ্চের ক্যাপ্টেন বললেন, হেডকোয়ার্টারে দেখা কোরো। কিডন্যাপার দুটোকে ওখানেই নিয়ে যাচ্ছি।

মুসার গাড়িতে করে রকি বীচ থানায় চলল ওরা। শহরে ঢুকে সে বলল, খিদে পেয়েছে। প্রস্তাবটা মন্দ না, কিশোর আর রবিনেরও মনে ধরল। একটা ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে হট ডগ আর গরম দুধ খেয়ে নিল।

থানায় এসে দেখল, ব্রুনো আর ভিককেও নিয়ে আসা হয়েছে। আরও দুজন অফিসারকে নিয়ে ওদের জেরা করছেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার। কোন কথাই স্বীকার করতে চাইছে না দুই চোর।

বন্দরে চুরি-ডাকাতির কথা কিছু জানি না আমরা। ফুঁসে উঠল ভিক। কোন প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে? প্রমাণ ছাড়া চোর বলতে পারেন না আমাদের।

কিডন্যাপার তো বলতে পারি, চীফ বললেন। তাতেই চলবে।

অনিশ্চিত দৃষ্টি ফুটেছে ব্রুনোর চোখে। চুপ করে রইল।

 কিশোর বলল, স্যার, আমার মনে হয় রিভেরা হাউসে গেলেই জোরাল প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমরা যাব নাকি দেখতে?

এক মুহূর্ত ভাবলেন চীফ। উজ্জ্বল হলো চোখ। ভাল বুদ্ধি। একজন। অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, মরিস, একটা পেট্রল কার নিয়ে তুমিও যাও সঙ্গে।

.

১৭.

সে-রাতে দ্বিতীয়বারের মত রিভেরা হাউসে চলল তিন গোয়েন্দা। এবারও রাস্তার ধারেই গাড়ি রাখল। মরিসকে নিয়ে এল সেই জানালাটার কাছে, যেটা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছিল দুই চোর।

ওই জানালা পথেই ভেতরে ঢুকে গেল ওরা।

শীঘ্রি আলো জ্বলে উঠল পুরানো বাড়িটার ঘরে ঘরে। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে খুঁজতে শুরু করল পুলিশ।

ডাইনিং রুমের কোণের একটা আলমারির দরজা টান দিয়ে খুলল মুসা। ভেতরে অনেকগুলো মলাটের বাক্স। হাত নেড়ে ডাকল মরিসকে, দেখে যান, এদিকে আসুন!

ছুটে এল মরিস, রবিন আর কিশোর। একটা বাক্স বের করে এনে মেঝেতে রেখে খুলল। পানি নিরোধক কাগজে মোড়া দামী একটা পরি। ফুলদানি রয়েছে ভেতরে। কোন দেশে তৈরি, সেটাও খোদাই করে লেখা। রয়েছে নিচে। জিনিসটা বিদেশী।

চোরাই মাল কোন সন্দেহ নেই, মরিস বলল। আগের বারও দেখে গেছি এই আলমারি। তখন এগুলো ছিল না।

অন্য বাক্সগুলোও খুলে দেখা হলো। নানা রকমের জিনিসে বোঝাই। চীনা মাটির তৈরি ঘর সাজানোর জিনিস, দামী গহনা, হীরা বসানো সোনার আঙটি আর হার, আরও নানা জিনিস।

ভ্রুকুটি করল রবিন। ডুডলি হ্যারিসের জিনিসগুলো কই? আর ক্যাপ্টেন টমারের পান্নার হার?

আবার শুরু হলো খোঁজা। একতলা-দোতলা-তিনতলার ঘর, চিলেকোঠা, সেলার; কোন জায়গাই বাদ দিল না। কিন্তু পাওয়া গেল না ওগুলো।

অবশেষে মরিস বলল, যা পাওয়া গেছে চোর দুটোকে ফাঁসানোর জন্যে যথেষ্ট। ওরাই রেখে গেছে এ সব।

তা ঠিক, কিশোর বলল। তবে মনটা খুঁতখুঁত করছে তার। পান্নার জিনিসগুলো পাওয়া গেল না কেন? কোথায় আছে ওগুলো?

বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।

মরিসকে বলল কিশোর, আপনি যান। আমার টর্চটা পড়ে গেছে নদীর ধারে। ওটা নিয়ে আসি।

ঠিক আছে, যাও, বলে আরেকটা টর্চ কিশোরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পেট্রল কারের দিকে চলে গেল মরিস।

দুই সহকারীকে নিয়ে কিশোর রওনা হলো নদীর পাড়ে। টর্চটা খুঁজে পেল সহজেই। বাল্ক ভাঙেনি। ঝাঁকুনিতে নিভে গিয়েছিল। সুইচ টিপে হাতের তালুতে দুচারটা বাড়ি দিতেই জ্বলে উঠল।

ড্রাইভওয়েতে ফিরে এল আবার ওরা।

মুসা বলল, আবার সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে আমার। ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন নজর রাখছে আমাদের ওপর।

হেসে বলল রবিন, উত্তেজনা কেটে গেছে তো, অনুভূতি ফিরে আসবেই। তোমার ভয়ের অনুভূতি মানে তো ভূতের ভয়।

জবাব না দিয়ে গাড়ির দিকে এগোল মুসা।

তিনজনেই চড়ে বসল। পকেটে হাত দিয়ে চাবি খুঁজছে মুসা, এই সময় কানে এল ইঞ্জিনের শব্দ। আরেকটা গাড়ি আসছে। আলো নিভিয়ে আসছে। ঝোপের আড়ালে থাকায় মুসার গাড়িটাকে দেখতে পেল না। সোজা এগিয়ে। গেল রিভেরা হাউসের গেটের দিকে। গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল ড্রাইভার, গেটের পাল্লা খুলে দিয়ে ফিরে এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

যাবে নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

মুসাকে বলল কিশোর, যাও।

হেডলাইট জ্বেলে দিল মুসা। খোলা গেটের দিকে এগোল সে-ও। ঢুকে পড়ল ভেতরে। গাড়িটা দেখতে পেল না।

ড্রাইভওয়েটা ঘুরে গিয়ে বাড়ির পেছনে যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে এনে গাড়ি রাখল মুসা।

নেমে পড়ল ওরাও। সামনে ঘন ঝোপঝাড়। চারাগাছকে নির্ভর করে ঘন হয়ে উঠে গেছে আঙুর লতা। বাড়ির অনেকখানিই দেখা যায় না এর জন্যে।

টর্চের আলোয় মাটি পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর। অবাক হয়ে দেখল, চাকার দগি সোজা চলে গেছে বিল্ডিঙের দিকে।

লতানো ঝোপের দিকে এগোল রবিন। লতাপাতা ধরে টেনে ফাঁক করে বাড়িটা দেখার চেষ্টা করল। অবাক হয়ে দেখল একটা রাস্তা চলে গেছে গাছের জটলার ভেতর দিয়ে।

খাইছে! গুপ্তপথ! কাঁধের কাছে বলে উঠল মুসা।

রহস্যময় গুপ্তপথটা ধরে এগিয়ে চলল ওরা। মাথার ওপরে পাতার চাঁদোয়া। ফাঁক-ফোকর দিয়ে আকাশ চোখে পড়ে এক-আধটু। তবে অন্ধকারই বেশি। অনেকটা গাছের সুড়ঙ্গের মতই মনে হচ্ছে। কোন রকম সাড়াশব্দ না পেয়ে টর্চ জ্বালার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

মরিসের দেয়া টর্চটা হাতে নিয়েছে রবিন।

ধসে পড়া একটা গোলাঘর ফুটে উঠল টর্চের আলোয়। মাটিতে চাকার দাগ। এগিয়ে গেছে ঘরটার দিকে।

ঘরে ঢুকে পড়ল ওরা। সামনের অর্ধেকটা একেবারে খালি। সামনের দিকে চালার আড়া বেঁকে গেছে, বেশি চাপ পড়লে ভেঙে যাবে। পেছনের অর্ধেক খড়ে বোঝাই। সামনের দিকটায় ওপর থেকে ঝুলে আছে খড়গুলো, যেন উপচে পড়তে চাইছে।

কবেকার খড়! মুসা বলল। মনে তো হয় রিভেরাই রেখে গিয়েছিল এগুলো।

তাহলে এই খড় সরানোর কাটাটা নতুন কেন? কাঠের হাতল লাগানো লোহার তিনটে বড় কাটাওয়ালা যন্ত্রটা দেখাল রবিন। খড়ের গাদার কাছে মাটিতে পড়ে আছে।

এবং গাড়িটাই বা কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।

সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা নড়ে উঠল সে। এগিয়ে গেল খড়গুলোর দিকে। কাঁটাটা তুলে নিয়ে খোঁচা দিল খড়ে। কাঠে লাগার শব্দ হলো। কাটা ফেলে খড় ফাঁক করে দেখল। ভেতরে প্লাইউডের বোর্ড একটা হাতল লাগানো আছে।

হাতল ধরে টানতেই দরজার পাল্লার মত করে সরে এল প্লাইউড।

খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা।

রবিনও হাঁ হয়ে গেছে।

খড়ের গাদার নিচে গোপন গ্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে যেন আরাম করে ঘুমিয়ে আছে লেটেস্ট মডেলের একটা কালো রঙের মেটিওর স্পেশাল গাড়ি।

গাড়িটার দুই পাশেই জায়গা আছে। একদিক দিয়ে ঢুকে গেল কিশোর। বনেটে হাত রেখে বলল, ইঞ্জিন এখনও গরম। একটু আগে ঢোকানো হয়েছে।

রবিন আর মুসাও এগিয়ে এল। একমত হলো কিশোরের সঙ্গে।

 শব্দ শুনতে পেল মুসা। ফিসফিস করে বলল, শুনছ? গোঙানি!

আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে শুরু করল কিশোর। গ্যারেজের মেঝেতে কেউ নেই। গাড়ির পেছনের সীটের নিচে আলো পড়তেই চমকে উঠল।

মেঝেতে পড়ে আছে একজন মানুষ। হাত-পা বাঁধা। মুখে কাপড় গোঁজা।

ঢোঁক গিলল মুসা।

কে-কেউ ওকে বেঁধে ফেলে গেছে!

আলো ধরে রাখল কিশোর আর রবিন। দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে লোকটার বাঁধন কেটে দিল মুসা।

ধীরে ধীরে উঠে বসল লোকটা। কব্জি আর গোড়ালি ডলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল আবার।

.

১৮.

তার সঙ্গে কথা শুরু করল রবিন, আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হয়?

কোথায় দেখেছে মনে পড়ল। হ্যারিসের বাড়িতে আড়ি পেতে থাকা লোকটাকে যখন তাড়া করেছিল কিশোর, তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল যে নীল জ্যাকেট পরী লোকটা, এ সেই। উদ্ধার পেয়েছে এর জন্যে কৃতজ্ঞ হবে, তা না, জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকাল সে। কপালের ঘাম মোছার জন্যে পকেট থেকে রুমাল টেনে বের করতে গেল। টান লেগে কি যেন একটা পড়ল পকেট থেকে।

দেখে ফেলল রবিন। নিচু হয়ে তুলে নিল। একটা নকল দাড়ি।

বুঝে ফেলল কিশোর। বলল, তার মানে আপনিই আড়ি পেতে শুনছিলেন হ্যারিসের বাড়িতে। এখন বলে ফেলুন তো, ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন কেন? খেলাটা কি আপনার?

জবাব দিল না লোকটা। আরেক দিকে মুখ ফেরাল।

 মুসা বলল, না বললে আবার বেঁধে এই গাড়িতে ফেলে যাব আপনাকে। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমাদের তিনজনের সঙ্গে পারবেন না।

অগত্যা হার স্বীকার করে নিল লোকটা। বলল, হ্যাঁ, আড়ি পেতে আমি শুনেছি। তবে তাতে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। এই জ্যাকেটটাও মাত্র একবার কাজ দিয়েছে। গায়ের জ্যাকেটটা খুলে উল্টে দেখাল সে। ভেতরের দিকটা বাদামী। তারমানে দুই দিকেই পরা যায়। এক পিঠের রঙ নীল, আরেক পিঠ বাদামী। তোমরা যখন আমাকে তাড়া করলে, এক ফাঁকে দাড়ি খুলে নিলাম। জ্যাকেটটা খুলে উল্টে নিয়ে পরে ফেললাম।

এবং আমাদের ধোকা দিলেন, রবিন বলল। ঠিক আছে, বলে যান।

 আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। এতদিন এ কাজে গর্ব বোধ করতাম। তবে এবার ঘেন্না ধরে গেছে। আর না। এই পেশা ছেড়ে দেব ঠিক করেছি।

দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। প্রাইভেট ডিটেকটিভ? নিশ্চয় বীমা কোম্পানির। আপনার নাম মিলার প্যাটোলি?

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আমার আসল নাম প্যাট ব্রিংহ্যাম। ক্যাপ্টেন টমারের চুরি যাওয়া হার খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। আমি শুনলাম, তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে তোমরা। তাই আড়ি পেতে শুনতে গিয়েছিলাম, তোমরা কতটা জানো। সেখানে শুনলাম, বুড়ো হ্যারিসও পান্নার জিনিস হারিয়েছে। আমি জানি কে নিয়েছে। বিশালদেহী ওই লোকটা, চশমা পরে যে–উইক শিপরিজ-সে নিয়েছে। এটা আমি বের করে ফেলেছি।

উইক শিপরিজ? রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। নামটা এই প্রথম শুনল ওরা। ভাবছে, ওই লোকই অ্যালেক্স ককারের নকল নয় তো?

হ্যাঁ, জবাব দিল প্যাট, উইক শিপরিজ। সারা শহরে তার পেছনে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। শেষে তার গাড়িতে উঠে পেছনে লুকিয়ে থেকেছি। ভেবেছি, টমারের হারটার কাছে আমাকে নিয়ে যাবে সে। কিন্তু সর্বনাশ করে দিল। হতচ্ছাড়া হাঁচি! নাক এত সুড়সুড় করতে লাগল কিছুতেই হাঁচি না দিয়ে পারলাম না। তারপর আর কি। মাথায় বাড়ি মেরে আমাকে বেহুশ করে ফেলল উইক। হুঁশ ফিরলে দেখি অন্ধকারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গাড়ির মেঝেতে পড়ে আছি। উফ, কি যে কষ্ট! গোয়েন্দাগিরি মানুষে করে নাকি!

মানুষেই করে, মুচকি হেসে বলল কিশোর, সবাই সহ্য করতে পারে না, এই আর কি। যাকগে। ভাল তথ্য দিলেন। সবাই মিলে এখন উইককে খুঁজতে যাব। আপনি যাবেন?।

একটু আগের প্রতিজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে গেল প্যাট। উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। নিশ্চয় যাব!

ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।

রিভেরা হাউসের জানালাটা এখনও ভোলা। সেটা দিয়ে ঢুকে পড়ল। চারজনেই। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও উইককে পাওয়া গেল না। কোথাও।

ঘরে নেই, হাল ছেড়ে দিয়ে বলল কিশোর। বাইরে জঙ্গলের মধ্যে থেকে থাকলে ওকে আজ রাতে পাওয়ার আশা ছাড়তে হবে। পুলিশকে জানানো দরকার।

মুসার গাড়িতে করে শহরে ফিরে এল ওরা।

আমাকে আমার মোটেলে নামিয়ে দাও, অনুরোধ করল প্যাট। আজ রাতে আর কুটোটিও সরাতে পারব না। গোয়েন্দাগিরি অনেক হয়েছে।

ওকে নামিয়ে দিয়ে থানায় চলে এল তিন গোয়েন্দা। অফিসেই আছেন ফ্লেচার। কয়েকজন পুলিশ অফিসার আছে ঘরে। ব্রুনো আর ভিককে জেরা করা বোধহয় শেষ হয়েছে। ওরাও বসে আছে। আগের তেজ আর নেই ভিকের। বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে মাথা। পুলিশের একজন ক্লার্ক কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে ওদের জবানবন্দি নিতে তৈরি।

তিন গোয়েন্দাকে ঢুকতে দেখে হেসে বলল অফিসার মরিস, আমি চোরাই মাল নিয়ে আসার পরও বহুত উঁটি দেখিয়েছে। স্বীকার করতে চায়নি। একটু আগে সব বলতে রাজি হয়েছে। বাটুলটার নাম ভিক বারগার। আর লম্বুটা ব্রুনো বেকিং।

চেয়ার টেনে বসল ছেলেরা।

ব্রুনো বলল, হ্যাঁ, মোটর বোটটা আমরা চুরি করে এনেছি। বন্দরে অনেকের বোট বাঁধা আছে। রাতে কোন একটা চুরি করে নিয়ে কাজে বেরোতাম। মাস্টার কী ছিল আমাদের কাছে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে অসুবিধে হত না। কাজ শেষ হলে নিয়ে গিয়ে আবার বোট রেখে দিতাম আগের জায়গায়। জাহাজের গায়ে বোট ঠেকিয়ে উঠে জাহাজ থেকেও জিনিস চুরি করেছি আমরা।

কি জিনিস? প্রশ্ন করলেন চীফ।

অনেক কিছু।

পান্নার তৈরি জিনিসও নিশ্চয়? জিজ্ঞেস করল কিশোর। চোখ গরম করে ওর দিকে তাকাল ভিক। তুমি জিজ্ঞেস করার কে! ধমক দিয়ে বললেন ফ্লেচার, জবাব দাও ওর কথার! চোখের আগুন নিভল না ভিকের। আরেক দিকে মুখ ফেরাল। ব্রুনো জবাব দিল, হ্যাঁ। তোমাদের দলপতি কে? রবিন জানতে চাইল।

দলপতি নেই, ব্রুনো জবাব দেয়ার আগেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল ভিক, আমরা দুজনই–আমি আর ব্রুনো।

ব্রুনোর মত একজন মাথামোটা ভীতু লোককে নিয়ে তুমি লক্ষ লক্ষ ডলারের জিনিস চুরি করে গাপ করে দিয়েছ, এ কথা বিশ্বাস করতে বলো আমাদের? ব্যাঙ্গের হাসি হাসল রবিন, হাসালে। তোমাদের বস উইক শিপরিজের কথা আমরা জেনে গেছি।

এমন চমকে গেল দুই চোর, যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে।

 তু-তুমি কি করে জানলে… বলতে গিয়ে বাধা পেল ব্রুনো।

ধমকে উঠল ভিক, চুপ, গাধা কোথাকার! থামো!

চেয়ারে এলিয়ে পড়ল ব্রুনো।

কিশোর বলল, আর অস্বীকার করে লাভ নেই। উইক আর পান্নার জিনিসগুলো কোথায়, বলে ফেলো এখন।

নিজেরাই গিয়ে বের করে নাও না! দাঁতে দাঁত ঘষল ভিক।

তেজ দেখাবে না বলে দিলাম! কঠিন গলায় ধমক দিলেন চীফ। ভাল চাও তো, যা জিজ্ঞেস করে, জবাব দাও।

ভিকের দিকে তাকাল ব্রুনো, সবই তো বলে দিলাম। আর গোপন রেখে লাভ কি? ছেলেদের দিকে ফিরল সে। কি জানতে চাও?

রবিন জিজ্ঞেস করল, মিস্টার হ্যারিসের জিনিসগুলো কে চুরি করেছে?

টমারের হারটা আমরা নিয়েছি। হ্যারিসেরগুলো করেছে উইক আর কুপার। প্রথমে হ্যারিসের বাড়িতে গিয়ে কৌশলে তাকে দিয়ে পান্নার কিছু জিনিস বের করায় উইক। তারপর হ্যারিসকে দাবার বোর্ড আনতে পাঠিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে বেরিয়ে যায়। বাড়ি খালি ফেলে তার পিছু নেয় হ্যারিস। ওই সময় বাড়িতে ঢুকে বাকি জিনিসগুলো নিয়ে আসার কথা ছিল কুপারের। কিন্তু সময়ের হেরফের করে গোলমাল করে দিয়েছিল সে। বাধ্য হয়ে তখন উইককে আবার যেতে হয়। তোমরা তখন হ্যারিসকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেছ। আমাদের সঙ্গে বন্দরে দেখা করার কথা ছিল কুপারের। সেটাও সে করেনি। একটা বোট নিয়ে রিভেরা হাউসে তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্যে তৈরি হয়ে বসেছিলাম আমি আর ভিক।

 মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওই বাড়িতে উইকের সঙ্গে দেখা হলো তোমাদের। সে নিয়ে গেছে পান্নার জিনিসগুলো, আর তোমরা অন্যান্য চোরাই মাল।

হ্যাঁ

লোকের বোট চুরি করে কাজ সারার ফন্দিটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল? জিজ্ঞেস করলেন চীফ।

উইক। গাড়ির ওপর চোখ পড়ে গিয়েছিল পুলিশের গাড়ি আর নিরাপদ ছিল না। তাই বোট চুরি করতে শুরু করলাম, যাতে মালিকরাও কিছু বুঝতে না পারে। তবু সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ল। পুলিশ তো আছেই, এই ছেলেগুলোর উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম, তিন গোয়েন্দাকে দেখাল সে। আজ রাতে সেলারে গিয়ে দরজা বন্ধ দেখে, ঘরে ঢুকতে না পেরে চেঁচাতে শুরু করল। আমরা তো ভাবলাম পুলিশ এসে ঘিরে ফেলেছে। জানালা টপকেই পালালাম।

প্রথম হাসল মুসা। হাসিটা সংক্রামিত হলো রবিন আর কিশোরের মাঝে। মুচকি হাসলেন ফ্লেচার। মরিসও হেসে ফেলল।

মুখটাকে বিষণ্ণ করে রাখল ব্রুনো।

ভিকের চেহারা থমথমে।

হাসতে হাসতে ছেলেদের দিকে ফিরলেন চীফ। জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, এইবার বলো, উইকের কথা জানলে কি করে?

বলল রবিন। গোপন গ্যারেজ আর বন্দি ডিটেকটিভের কথা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল চীফের।

 চাবির রিঙটা বের করে দিল কিশোর, এটা পাওয়াতে অনেক সুবিধে হয়েছে আমাদের।

হু, মাথা দোলালেন চীফ। মনে হচ্ছে, শেষ হয়ে এসেছে কেসটা। অফিসারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন তিনি, সকাল হলেই দলবল নিয়ে চলে যাবে রিভেরা হাউসে। তন্ন তন্ন করে খুজবে বাড়িটা। উইক আর কুপারকে সহ পান্নার জিনিসগুলো বের করার চেষ্টা করবে। গোলাঘর থেকে মেটিওর গাড়িটা বের করে নিয়ে আসবে।

ব্রুনো আর ভিকের ধরা পড়ার খবর নিশ্চয় পেয়ে যাবে ওরা, মরিস। বলল। যদি তল্পি গুটিয়ে পালানোর চেষ্টা করে?

শহর থেকে বেরোনো সমস্ত পথ ওদের জন্যে বন্ধ করে দিতে হবে। সব জায়গায় নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে রাস্তাগুলো আর বন্দর। কড়া পাহারা বসিয়ে দাওগে ওসব জায়গায়। কিছুতেই যাতে বেরোতে না পারে। রিভেরা হাউসের চারপাশেও পাহারার ব্যবস্থা করবে।

কিশোর বলল, কিন্তু পুলিশ দেখলে তো সতর্ক হয়ে যাবে উইক। বাড়িতে ঢুকবে না।

জানি। সেজন্যেই এমন করে লুকিয়ে থেকে পাহারা দিতে হবে, যাতে উইক দেখতে না পায়। সে মনে করে, কেউ নেই, আগের মতই নির্জন। যেই ঢুকবে, অমনি ধরে ফেলা হবে।

নির্দেশ মত কাজ করার জন্যে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। অফিসারেরা।

তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন চীফ, আবার পুলিশকে বিরাট সাহায্য করলে তোমরা। অনেক ধন্যবাদ। যাও, বাড়ি যাও। বিকেলে ফোন করে আমাকে। খবর জেনে নিয়ো।

.

১৯.

 রাত অনেক হয়েছে। ঘুমন্ত শহরের পথ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে মুসা। পেছনের সীটে বসা কিশোর বলল রবিনকে, বুঝতে পারছি না কি ঘটবে! উইক আর কুপার এখনও মুক্ত। পান্নাগুলোও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 একমত হয়ে রবিন বলল, মিস্টার ককারকে হুমকি দিয়ে লেখা নোট রহস্যেরও কিনারা হলো না। সেদিন রাতে অমন ভয়াবহ চিৎকারই বা দিয়েছিল কে?

হু! আনমনে নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটল কিশোর। কেসটা শেষ হয়নি এখনও। অনেক কিছু বাকি?

আগে গিয়ে ভালমত ঘুমিয়ে নাও, সকালে ভাবনা-চিন্তা কোরো, হাই তুলল মুসা। ব্রেক কষল। বাড়ি এসেছে। নামো।

পরদিন সকালে ডিরেক্টরি ঘেটে ককারের বাড়ির ফোন নম্বর বের করে ফোন করল কিশোর। রিভেরা হাউসে নয়, তাঁর আসল বাড়িতে, যেখানে বাস করেন। আগের রাতে রিভেরা হাউসে যে চোর ধরা পড়েছে, জানানোর জন্যে। ফোন ধরল না কেউ।

তখন ব্যাংকে ফোন করল কিশোর।

সরি, স্যার, ব্যাংক থেকে জবাব দিল একজন, মিস্টার ককার এখনও আসেননি। তিনি কোথায়, তা-ও বলতে পারব না। বলে যাননি।

কিছুক্ষণ পর রবিন এল। তাকে খবরটা জানাল কিশোর। সারাটা সকাল ওঅর্কশপে বসে রইল দুজনে। খানিক পর পরই ককারের বাড়িতে ফোন করল কিশোর। একবারও ফোন তুলল না কেউ।

দুপুরে খাওয়ার পর আর বসে থাকতে পারল না কিশোর। রবিনকে নিয়ে থানীয় রওনা হলো।

অফিসে আছেন চীফ। চোখের কোণে কালি। চোখ লাল। সারারাত ঘুমাননি। সকাল থেকেও নিশ্চয় বিছানায় পিঠ লাগানোর সুযোগ মেলেনি। জানালেন, পাশের শহরের এক মোটেল থেকে কুপারকে ধরে আনা হয়েছে।

রিভেরা হাউসের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখা হয়েছে, বললেন তিনি। মেটিওরটা নিয়ে এসেছে মরিস। কিন্তু উইক কিংবা পান্নাগুলোর কোন খোঁজ, মেলেনি। রিভেরা হাউসে নেই। নিশ্চয় অন্য কোনখানে লুকিয়েছে।

থানা থেকে বেরিয়ে একটা পাবলিক টেলিফোন বুঁদ থেকে আবার। ককারের বাড়িতে ফোন করল কিশোর। সেই একই অবস্থা। জবাব নেই। আবার ব্যাংকে ফোন করল সে। ব্যাংকেরও একই জবাব, আসেননি। কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

বুদ থেকে বেরিয়ে এসে রবিনকে বলল সে, ব্যাপারটা ভাল মনে হচ্ছে না আমার। তাঁর বাড়িতে যাওয়া দরকার।

শহরের একধারে ককারের বাড়িতে এসে ঢুকল দুই গোয়েন্দা। সদরদরজার ঘণ্টা বাজিয়ে, অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও সাড়া না পেয়ে সন্দেহ চরমে উঠল। শেষে আবিষ্কার করল, দরজায় তালা দেয়া।

পুলিশকে জানানো দরকার, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। শিওর, খারাপ কিছু হয়েছে ককারের।

আধঘণ্টা পর থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে এসে আবার ককারের বাড়িতে ঢুকল ওরা।

তালা ভেঙে ঘরে ঢুকল পুলিশ। সুন্দর করে সাজানো রয়েছে ঘরগুলো। সবই ঠিক আছে, কেবল ককার নেই।

আপাতত আর কিছু করার নেই। নতুন কিছু জানতে পারলে জানাবে, কিশোরকে কথা দিয়ে দলবল নিয়ে চলে গেল আফিসার মরিস।

নিজেদের গাড়িতে চড়ল দুই গোয়েন্দা।

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, আমার ধারণা, রিভেরা হাউসে গিয়েছিলেন ককার। বিপদে পড়েছেন। ওখানেই চলো।

বিকেলের মাঝামাঝি। কিন্তু সেই তুলনায় আলো কম। পশ্চিম আকাশে। মেঘ জমছে। চলতে চলতে হঠাৎই কোন রকম জানান না দিয়ে কেশে উঠে বন্ধ হয়ে গেল ফোক্স ওয়াগেনের ইঞ্জিন।

অনেক চেষ্টা করেও গোলমালটা ধরতে পারল না রবিন। কোন মতেই স্টার্ট করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে গাড়িটাকে ঠেলে রাস্তার পাশে নামাল দুজনে। তেতো গলায় কিশোর বলল, আর কোন উপায় নেই, হেঁটেই যেতে হবে।

অনেক সময় খেয়ে নিয়েছে গাড়িটা। বিকেল শেষ। গোধূলিও শেষ হয়ে গেল দ্রুত। ঘণ্টাখানেক একনাগাড়ে হাঁটার পর ম্যানিলা রোডের মোড়ে এসে পৌঁছল ওরা। রিভেরা হাউসে যখন ঢুকল, অন্ধকার হয়ে গেছে। ঢুকতে বাধা দিল না ওদের কেউ, কোন পুলিশম্যানকে দেখা গেল না আশেপাশে।

সোজা সেলারে ঢোকার মুখের দিকে এগোল কিশোর। ভাগ্যিস, চাবিটা ছিল সঙ্গে।

আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল। ঢাকনার তালায় চাবি ঢোকাল সে। সেলারে নেমে অন্য সিঁড়িটী বেয়ে রবিনকে নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। ভেবেছিল দরজায় তালা লাগানো দেখতে পাবে। ভেঙে কিংবা অন্য কোন ভাবে খুলতে হবে। কিন্তু অবাক হলো। দরজাটা ভোলা।

ভালই হলো। পরিশ্রম বাঁচল। ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।

অন্ধকারে পা টিপে টিপে লিভিং রুমের দিকে এগোল। কিছুদূর যেতে না যেতেই কিশোরকে চেপে ধরল অসাধারণ শক্তিমান দুটো হাত। ফেলে দিল মেঝেতে। আরেকটী দেহ পড়ার শব্দ কানে এল তার। নিশ্চয় রবিনকেও ফেলেছে।

দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। তবু বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। টিকতে পারল না। মাথায় কঠিন কিছুর বাড়ি খেয়ে আধাবেহুশ হয়ে গেল কিশোর। টেনে এনে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে হাতল আর পায়ার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে ফেলা হলো। রুক্ষ হাতে মুখে ঠেসে দেয়া হলো কাপড়। একপাশে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল, রবিনকেও কাবু করে ফেলা হচ্ছে।

তারপর নীরবতা। কানে আসতে লাগল এ্যাণ্ডফাদার কুকটার একটানা। একঘেয়ে শব্দ:

টিক-টক। টিক-টক! টিক-টক!

মাথার মধ্যে এখনও কেমন করছে তার, ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। এরই মধ্যে ভাবল, রবিন কি এ ঘরেই আছে? না অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাকে?

.

২০.

 কানে এল পা টেনে টেনে হাঁটার আওয়াজ। ভারি নিঃশ্বাস ফেলছে কেউ। জ্বলে উঠল একটা মান আলো। পুরো দৃশ্যটা দেখতে পেল কিশোর।

লিভিং রুমে রয়েছে সে। জানালার ভারি পর্দাগুলো টেনে দেয়া হয়েছে। এককোণে টিক টিক করে চলছে গ্র্যাণ্ডফাদার কুক। রবিনকেও তারই মত বেধে বসিয়ে রাখা হয়েছে পুরানো আমলের একটা পিঠ উঁচু চেয়ারে।

ওদের সামনে দাঁড়ানো লম্বা, বিশালদেহী একজন লোক। চোখে চশমা। ককারের মতই দেখতে অনেকটা, তবে ককার নয় সে। নিজের পরিচয় দিল উইক শিপরিজ বলে।

তাহলে এই লোকই সেই লোক, বন্দর-চোরদের দলপতি! ভাবল রবিন। মাথায় বাড়ি মেরে আমাদের কাবু করে চেয়ারে এনে বেঁধেছে। শয়তান কোথাকার!

একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাতে লাগল উইক। বাঁকা হাসি হেসে বলল, অবাক হয়েছ, না? অন্যের কাজে নাক গলানোর শাস্তি এবার পাবে তোমরা।

রাগ চেপে চুপ করে রইল রবিন।

আজকের সন্ধ্যায় তোমাদের জন্যে অনেকগুলো চমকের ব্যবস্থা করেছি। আমি। তোমাদের বন্ধু অ্যাক্সে ককারও সে-সব উপভোগ করবে। গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করে চোখ টিপল সে। তোমরা ভেবেছিলে, দুনিয়ায় একমাত্র তোমরাই চালাক। বোকা আর কাকে বলে। তোমরা কি জানো, যতবার এখানে এসেছ তোমরা, পুলিশ এসেছে, তোমাদের ওপর চোখ রাখা হয়েছে?

যদিও ভয় যে পেয়েছে এটা বুঝতে দিল না কিশোর কিংবা রবিন, বুঝতে পারল সাংঘাতিক চালাক এক খেপা অপরাধীর পাল্লায় পড়েছে এবার। ভেবে অবাক হলো, তাদের ওপর নজর রাখার কাজটা কে করেছে?

ঘড়ির দিক থেকে একটা চি-চি স্বর শোনা গেল। ঘুরে তাকলি উইক, গোরো, বেরিয়ে আসুন। মেহমান এসেছে।

তাজ্জব হয়ে দেখল দুই গোয়েন্দা ঘড়িটী তার পেছনের দেয়ালের খানিকটা অংশ নিয়ে পাশে সরতে আরম্ভ করেছে।

দরজা! চাপা গলায় নিজেকেই যেন বলল কিশোর, ঘড়ি দিয়ে আড়াল করা ছিল! নিশ্চয় দরজা খোলার গোপন সুইচ আছে!

বেরিয়ে এল সাদা-চুল এক বৃদ্ধ। নিখুঁত করে দাড়ি কামানো, নীল চোখ। এগিয়ে এসে ছেলেদের সামনে দাঁড়াল। অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল, মিস্টার শিপরিজ, মেহমান হলে ওদের বেঁধে রাখা হয়েছে কেন? আপনি তো বলতেন বিরক্ত করার জন্যে এখানে ঢোকে ওরা। ক্ষতির ভয়েই তো কড়া নজর রাখতাম  

অবাক লাগল কিশোরের। রবিনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে-ও অবাক হয়েছে। উইকের দলে কাজ করে এই লোক? ঠিক মানায় না।

সময় হলেই সব বুঝবে, গোরো, উইক বলল। গোয়েন্দাদের অবাক হয়ে বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল। ওহ, পরিচয় করানো হয়নি। ওর নাম গোরো কিনডার। একজন আবিষ্কারক। খুব বুদ্ধিমান।

আস্তে মাথা ঝাঁকাল গোরো। উইক, আপনি বলেছেন এরা আপনার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিতে চায়। কিন্তু আমার কাছে তো নিরীহ ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় না…

আপনার মনে হওয়া নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই! কর্কশ গলায় বলল উইক। কাজটা শেষ হয়েছে?

হয়েছে হয়েছে, তাড়াতাড়ি বলল গোরো, শেষ হয়ে গেছে। অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।

কে উত্তেজিত হচ্ছে! খেঁকিয়ে উঠল উইক। যান, নিয়ে আসুন।

 তাড়াহুড়ো করে গুপ্তপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল গোরো।

ছেলেদের দিকে ফিরল উইক। খুব চমকে গেছ, না? এ বাড়িতে একটা নয়, দুটো গোপন ঘর আছে, সেটা নিশ্চয় জানা ছিল না তোমাদের। তোমরা যখন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজাখুজি করে গেলে, তখন আমি চুপ করে বসেছিলাম ওই ঘড়ির পেছনের ঘরে। আজ সকালে যখন পুলিশ এল, তখনও ছিলাম।

নিজের মাথা ভাঙতে ইচ্ছে করল কিশোরের। ঘড়িটা দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল, যতবার ওটার দিকে চোখ পড়েছে, ততবারই মনে হয়েছে কোন একটা রহস্য আছে ওটীর। তারপরেও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল না কেন!

রবিন ভাবছে অন্য কথা, উইকই কি ককারকে হুমকি দিয়ে নোট রেখে এসেছিল? এ কাজে তাকে সাহায্য করেছে গোরো? কিন্তু বুড়ো মানুষটীকে দেখে মনে হয় না সে কারও ক্ষতি করতে পারে।

ফিরে এল গোরো। হাতে একটা ভারি জিনিস। কালো বাক্সের মত দেখতে, এদিক ওদিক থেকে কয়েকটা অ্যান্টেনার মত বেরিয়ে আছে।

গুড! দুই হাত ডলতে ডলতে বলল উইক। কালো বাক্সটা দেখিয়ে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞেস করল, এটা কি চিনতে পারছ?

টাইম বম্ব! বিড়বিড় করল কিশোর।

বাহ, বুদ্ধিমান ছেলে। বুঝে ফেলেছ, খিকখিক করে হাসল উইক। বোমা তৈরিতে একজন বিশেষজ্ঞ গোরো। বুড়োর দিকে তাকাল সে। যে ভাবে করতে বলেছি, করেছেন তো?

নিশ্চয়। আমার ভুল হয় না। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে…

আপনার পদ্ধতির কথা কে জানতে চায়! কর্কশ গলায় নিতান্ত অভদ্রের মত বাধা দিল উইক। মাল ঠিকঠাক মত ভরেছেন কিনা, সেটা বলুন। এ বাড়িটাকে নেই করে দিতে পারবে তো?

 ধড়াস করে এক লাফ মারল কিশোরের হৃৎপিণ্ড। ওদের সহ উড়িয়ে দেয়ার কথা ভাবছে না তো খেপা লোকটা। গোরোর দিকে তাকিয়ে দেখল, তার চেহারাও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো। বোমাটার গায়ে চেপে বসা আঙুলগুলো সাদা হয়ে গেছে।

কি বলছেন আপনি, মিস্টার শিপরিজ? কাঁপা গলায় বলল সে। আপনি আমাকে বলেছেন কনস্ট্রাকশনের কাজে বোমাটা ব্যবহার করবেন। এখন বলছেন…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…

 পারবেন। খুব শীঘ্রি। বোমাটা ওই টেবিলে রাখুন। আর কিছু করতে হবে না আপনার। যা করার আমিই করব।

কিন্তু নির্দেশ মানল না আর গোরো। পিছিয়ে গেল এক পী। না না, মিস্টার শিপরিজ! আমি বুঝতে পারছি অন্য কোন মতলব আছে অপিনার, খারাপ মতলব। মিথ্যে কথা বলেছেন আপনি আমাকে। ছেলেগুলোর কথা মিথ্যে বলেছেন। ওরা আপনার মেহমান নয়, বন্দি। আসলে প্রতিটি কথাই মিথ্যে বলেছেন আমার সঙ্গে। আমার নতুন আবিষ্কার বাজারজাত করে আমাকে সাহায্য করার কোন ইচ্ছেই আপনার কোনদিন ছিল না। মিথ্যে আশা দিয়েছিলেন আমাকে।

লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে টান মেরে গোরোর হাত থেকে বোমাটা কেড়ে নিল উইক। প্রচণ্ড এক থাবা মেরে মেঝেতে ফেলে দিল বেচারা বুড়ো মানুষটাকে। পড়ে রইল গোরো। ওঠার সামর্থ্যও হলো না।

২১.

 বোমাটা টেবিলে রেখে দড়ি বের করল উইক। গোরোর হাত-পা বাঁধল শক্ত করে। বলল, হ্যাঁ, গোরো, ঠিকই বলেছ, ছেলেগুলো আমার বন্দি। এখন তুমিও হলে। আসলে বন্দি তুমি সব সময়ই ছিলে, কিন্তু গবেষণায় এতটাই ডুবে ছিলে, বুঝতে পারোনি সেটা।

সোজা হলো উইক। চোখ জ্বলছে। নিমেষে কেমন বদলে গেছে। ভাবভঙ্গি। কঠিন গলায় বলল, বোমা বানাতে কতখানি সফল হলে, নিজের আবিষ্কারের ফল এখন নিজেই পরখ করতে পারবে। তুমি ভাগ্যবান, তাই না? এতবড় সুযোগ কটী মানুষে পায়?

ভাঙা গলায় গোরো বলল, মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার, উইক, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছ! এ সব করে বাঁচতে পারবে না তুমি

 তাই নাকি? দেখা যাবে। তবে তার আগে তোমার মুখটা বন্ধ করা দরকার।

এক টুকরো কাপড় এনে গোরোর মুখে ঠেসে ভরে দিল উইক। এইবার আমার আসল কাজ চলবে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সহকারীগুলো ধরা পড়ে সর্বনাশ করে দিল। থাকলে এখন সাহায্য হত।

আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল বন্দিরী, পকেট থেকে কয়েক টুকরো তার বের করল উইক। কালো বাক্সটার ওপর ঝুঁকে বসে কাজ শুরু করল। দ্রুত নড়াচড়া করছে তার আঙুল, তরগুলোকে যুক্ত করে দিচ্ছে। বাক্সের অ্যান্টেনার সঙ্গে। তারপর বাক্সটা নিয়ে গিয়ে রাখল ঘড়িটার কাছে। তারের অন্য মাথা যুক্ত করল ঘড়ির সঙ্গে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, দেখলে গোরো, কেবল তুমিই নও, এ সব কাজ আমিও করতে পারি।

কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াল উইক। নাটকীয় ভঙ্গিতে বিশাল ঘড়িটা দেখাল বন্দিদের। সময়টা দেখে রাখো। তিনটায় সেট করে দিয়েছি। ঘন্টার কাটী যখন তিনের ঘরে পৌঁছবে, ফেটে যাবে বোম।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। একটা বেজে গেছে। মনে। পড়ল সেই কথা: ঘড়ির সাহায্যে সারা হবে কাজটা…

যেন ওদের মনের কথা পড়তে পেরেই উইক বলল, সেদিন রেস্টুরেন্টে কি কথা শুনেছিলে মনে আছে? ঘড়ির সাহায্যে সারা হবে কাজটী। এখন। বুঝলে তো কি সারা হবে? সন্তুষ্টির হাসি হাসল সে। তবে সেদিন তোমাদের ওড়ানোর কথা বলিনি, কেবল বাড়িটা ধসিয়ে দেয়ার আলোচনা করছিলাম। কল্পনাই করিনি, সময় মত তোমরাও এসে হাজির হবে, কাজ সহজ করে দেবে আমার। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। আজকের পর আর কোনদিন আমার কাজে নাক গলাতে আসতে পারবে না তোমরা। ওই বিরক্তিকর ককারটাও না।

মাথা ঠাণ্ডা রাখো, ভয় পেলে সর্বনাশ হবে!–নিজেকে বোঝাল কিশোর। হাত-পায়ের বাঁধন খোলার জন্যে টানাটানি শুরু করেছিল। ককারের কথা বলতেই কান খাড়া করল।

ককার! কোথায় আছেন ব্যাংকার! তাঁকেও এ বাড়িরই কোনখানে। আটকে রাখেনি তো উন্মাদটী!

রবিনও বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। এটে বসল আরও দড়ি।

দেখে হাসল উইক, করো, চেষ্টা করা ভাল। তবে লাভ হবে না। অত। কাঁচা কাজ করি না আমি। নিজে নিজে যদি খুলতে পারো, বেরিয়ে যাও, বাধা দেব না।

কিশোরও বুঝল, খুলতে পারবে না। অহেতুক আর সেই চেষ্টা করল না।

ওদের ব্যর্থ হতে দেখে মজা পাচ্ছে যেন উইক। বলল, কি করে এই গুপ্তঘরটা আবিষ্কার করলাম, জানার কৌতূহল হচ্ছে নিশ্চয়? সে-জন্যে গোরোকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।

কি করে চোরাই মাল লুকানোর জন্যে একটা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে রিভেরা হাউসটার ওপর চোখ পড়ে উইকের, খুলে বলল। মাল রাখতে এসেই একদিন দেখা হয়ে গেল গোরোর সঙ্গে।

গোরো বলল, সে নাকি ফ্রান্সিস রিভেরার খালাত ভাই। ছোটবেলা থেকেই এ বাড়ির সবখানে খেলা করেছে, গুপ্তঘরগুলো সব চেনে। ঘড়ি-ঘরে ঢোকার একটা চাবিও আছে তার কাছে। আবিষ্কারের নেশা আছে তার। রিভেরা মারা যাওয়ার পর তার মনে হলো, তাই তো, গুপ্তঘরটায় গিয়ে গবেষণা করলে তো মন্দ হয় না। বিরক্ত করতে আসবে না লোকে। মন দিয়ে কাজ করা যাবে। সেজন্যেই এসেছিল। দেখা হয়ে গেল আমার সঙ্গে।

আমি ভাবলাম, তাকে কাজে লাগানো দরকার। ঘরটা খুলে দিতে সে আমাকে সাহায্য করবে। সেই ঘরে মাল রাখলে নিজের অজান্তে সেগুলো পাহারাও দেবে। তাকে লোভ দেখলাম, আমি একটা ল্যাবরেটরি বানিয়ে দিতে পারি। নতুন ধরনের যে কোন আবিষ্কার করতে পারলে সেটা বাজারজাত করতে সাহায্য করতে পারি। আমার টোপ গিলে নিল সে।

তারপর থেকে নিশ্চিন্তে ওখানে চোরাই মাল রাখতে লাগলাম। গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকত গোরো। আমি কি এনে রাখলাম না রাখলাম তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। চোখ তুলেও দেখত না। ভালই চলছিল। বাদ সাধল একদিন ককার। বাড়িটা কিনে নিল। বিপদে পড়ে গেলাম। তাকে না তাড়ালেই নয়। হুমকি দয়ে নোট লিখে রেখে এলাম তার গুপ্তঘরে। সেগুলো পেয়েই সে তোমাদের ডেকে আনল।

দম নেয়ার জন্যে থামল উইক। শয়তানি হাসি ফুটল চোখের তারায়। নিশ্চয় ভাবছ, কি করে ওই বদ্ধ ঘরে নোট রেখে এলাম? সে কথা বলছি না। তোমাদের। এই একটা কৌতূহল নিয়ে মরতে হবে তোমাদের, কোনদিনই জানতে পারবে না।

হ্যারিস এসেছিল যে রাতে, সে-রাতে একটা ভয়ানক চিৎকার শুনেছ তোমরা। আমিই করেছি চিকরিটী। ভয় দেখিয়ে বুড়োটাকে তাড়ানোর জন্যে। যে ভাবে ছোঁক ছোঁক করছিল, ওকে তাড়ানোর আর কোন উপায় ছিল না।

ঘড়ির দিকে তাকাল উইক। দুটো বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। আপন মনেই বলল, নাহ, আর দেরি করা যায় না। এবার যেতে হয়। সময় থাকতেই দূরে সরে যাওয়া উচিত।

ঘড়ির পেছনের গুপ্তঘরটায় গিয়ে ঢুকল সে। বাক্স ফেলার শব্দ কানে আসতে লাগল গোয়েন্দাদের। কয়েক মিনিট পর ক্যানভাসের একটা বড় ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এল উইক।

বাইরে ঝিলিক দিয়ে উঠল তীব্র আলো। মূহর্ত পরে বজ্রপাতের বিকট শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বাড়িটা। তারপর নামল বৃষ্টি। মুষলধারে।

ঝড় আসছে, উইক বলল। এবার বিদায় নিতে হয় তোমাদের কাছে। এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল সে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা। পান্নাগুলো কোথায় আছে ভাবছ তো? কাঁধের ব্যাগটাতে চাপড় দিল সে। এটার মধ্যে। আলোটা জ্বেলে রেখে যাচ্ছি যাতে ঘড়ির কাঁটা দেখতে পাও। চলি। গুডবাই।

বেরিয়ে গেল সে। সামনের দরজা খুলে বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল।

বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব।

তারমধ্যেও কানে আসছে বিশাল ঘড়িটী চলার জোরাল শব্দ:

 টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!

.

২২.

 সময় কাটছে। কাটছে না বলে বলা যায় উড়ে চলেছে। এমনই হয়। সময় দ্রুত কাটার জন্যে যখন অপেক্ষা করে মানুষ, তখন মনে হয় কাটছেই না। বড় ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। আর এখন যখন ওরা চাইছে না কাটুক, তখন যেন ছুটছে ঘড়ির কাটা।

কি করে যে পৌনে তিনটে বেজে গেল, টেরই পেল না।

জানোয়ার! দাঁতে দাঁত চাপল কিশোর। এ ভাবে আমাদেরকে ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্যে ফেলে গেল!

হাতে-পায়ে কেটে বসছে দড়ি। মরিয়া হয়ে টানাটানি শুরু করল ঢিল করার জন্যে। সেই একই অবস্থা। লাভ হলো না। সামনের দিকে ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করল নিজেকে, যাতে চেয়ার নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে। যাতে বোমাটার কাছাকাছি যেতে পারে।

এতেও কাজ হলো না।

রবিন শরীর মোড়ামড়ি করে হাতটাকে নিয়ে যেতে চাইছে তার পকেটের পেন্সিল কাটার ছোট ছুরিটার কাছে। সেটা আরও অসম্ভব মনে হলো। পকেটের ধারেকাছেও যাচ্ছে না আঙুল।

চুপ করে একই ভাবে পড়ে আছে গোরা। মেনে নিয়েছে যেন এই ভয়াবহ পরিণতি। এই অবস্থার জন্যে মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করছে। কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা।

আতঙ্কিত চোখে দেখল ছেলেরা, তিনটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!

চেয়ারে হেলান দিল ওরা। ধসে পড়ল যেন শরীরটা। হাতলের ওপর ঢিল হয়ে গেল আঙুলগুলো। আর কোন আশা নেই!

প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। কাঁপিয়ে দিল বাড়িটাকে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দ। সামনের বড় জানালাটায় দৃষ্টি যেন আটকে গেছে রবিনের। একটা নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে যেন।

দূর, আতঙ্কে মাথা গরম হয়ে গেছে!–ভাবল সে।

কিন্তু চোখ সরাতে পারল না। তারপর যা দেখল, বিশ্বাস করতে পারল না নিজের চোখকে। কাচের ওপাশে একটা মুখ। অতি পরিচিত। মুসার!

হাঁ করে তাকিয়ে আছে রবিন।

 ঝনঝন করে জানালার কাচ ভাঙল। পাল্লা খুলে ঘরে ঢুকল মুসা।

ঘড়ি দেখল কিশোর। আর মাত্র দুই মিনিট। বলল, জলদি করো মুসা! চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করল, কিন্তু জোর নেই গলায়। বোমা লাগানো আছে! দুই মিনিট পরেই ফাটবে! রবিনের পকেটে ছুরি আছে! আগে আমার দড়ি কাটো!

দৌড়ে এল মুসা। কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে সময় যেন স্থির হয়ে গেল। ঘোরের মধ্যে যেন মূসাকে দড়ি কাটতে দেখল কিশোর। মুক্ত হওয়ার পর আর একটা সেকেণ্ড দেরি করল না। লাফ দিয়ে উঠে প্রায় ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়ল ঘড়িটার কাছে। হ্যাঁচকা টানে ঘড়ির সঙ্গে যুক্ত বোমার তারগুলো ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন করে দিল। এতক্ষণ পর রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে পায়ে। বিচিত্র একট যন্ত্রণা। শরীরের ভার রাখতে পারল না আর পা দুটো। ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে।

ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে সে।

ঢঙঙ! ঢঙঙ! টঙঙ!

তিনবার বাজল ঘণ্টা। কিছুই ঘটল না। স্বস্তিতে চোখ মুদল কিশোর।

 দড়ি কেটে অন্য দুজনকেও মুক্ত করে ফেলল মুসা।

গোটা দুই গোঙানি দিয়ে উঠে বসল গোরো। কাঁপা খসখসে গলায় বলল, আহ, বাঁচালে! ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছ নাকি তুমি!

 চেয়ারে বসে থেকেই রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিল রবিন। তবে মুখে গোঁজা কাপড়টা টেনে খুলে ফেলল। কোটি কোটি ধন্যবাদ দিলেও ওর ঋণ শোধ করতে পারব না আমরা! যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছে!

দুই হাত তুলে নাড়তে লাগল মুসা, আরি বাবারে, থামো না! প্রশংসার। ঠেলায় তো পাগল হয়ে যাব! হয়েছিলটা কি?

আমাদের কথা বলার অবস্থা নেই এখন। তুমি কি করে এলে, আগে সেই কথা বলো।

সন্ধ্যায় স্যালভিজ ইয়ার্ডে গিয়ে শুনলাম, দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে গেছ। অপেক্ষা করতে লাগলাম। যতই রাত হতে লাগল, তোমরা ফিরলে না, মেরি আন্টির সঙ্গে সঙ্গে আমারও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। মাঝরাতেও যখন দেখা নেই তোমাদের, আর থাকতে পারলেন না আন্টি। পুলিশকে ফোন করলেন। ওরাও কিছু বলতে পারল না। ইয়ান ফ্লেচার অফিসে নেই। যে অফিসার ধরল, সে কথা দিল খুজতে বেরোবে। তবে কখন বেরোতে পারবে, বলতে পারল না। অস্থির হয়ে পড়লাম। হঠাৎ করেই মনে হলো রিভেরা হাউসের কথা। তাই তো, ওখানে গিয়ে কোন বিপদে পড়েনি তো!

এটা ভাবার জন্যে আরেকবার তোমাকে ধন্যবাদ, মুসা, কিশোর বলল। এই কালো জিনিসটা দেখছ? একটা সাংঘাতিক বোমা। তুমি আসতে যদি আর কয়েক মিনিট দেরি করতে, এতক্ষণে এই বাড়িটার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতাম। ই খাইছে! ভয়ে ভয়ে বাক্সটার দিকে তাকাতে লাগল মুসা, বলো কি! এই শয়তানিটা কে করল? ফাটার ভয় নেই তো আর?

না, নেই, মাথা নেড়ে বলল গোরো। দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। বোমাটা নেয়ার জন্যে এগোল।

আপনি ঠিক আছেন তো, মিস্টার কিনডার? সাংঘাতিক জোরে মেরেছে। আপনাকে উইক শয়তানটা!

আমি ঠিকই আছি। তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমরা না থাকলে আজ আমাকে মরতে হত। আমাকে ভেতরে রেখে বোমা ফিট করে চলে যেত। সব আমার দোষ। ওর কথা বিশ্বাস করে এত ভয়ঙ্কর একটা জিনিস বানীতে গেলাম কেন?

আপনি তো আর খারাপের জন্যে বানাননি, ভালর জন্যে বানিয়েছেন। উইক যে আপনার সঙ্গে বেঈমানি করবে, ওদের শয়তানির সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করে দেয়ার জন্যে বাড়ি উড়িয়ে দিতে চাইবে, সেটা জানতেন না। অতএব দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। তা ছাড়া আমাদের কোন ক্ষতিও হয়নি। বহাল তবিয়তে আছি সবাই।

এইবার বলে ফেলো তো সব, তাগাদা দিল মুসা। আর টেনশনে থাকতে রাজি নই।

সে-সব পরে শুনলেও হবে। বিপদ এখনও শেষ হয়নি। লুকিয়ে পড়তে হবে আমাদের। নিশ্চয় দূরে কোথাও অপেক্ষা করবে উইক, দেখবে বাড়িটী ধ্বংস হলো কিনা। বোমা ফাটার শব্দ না পেলে কি হলো দেখার জন্যে আবার ফিরে আসতে পারে।

মাথা ঝাঁকাল রবিন, তাই তো! এ কথা তো ভাবিনি! ওর কাছে পিস্তল থাকতে পারে। এবার এলে আর বাঁচতে দেবে না আমাদের।

উদ্বিগ্ন হলো মুসা, কোথায় লুকাব?

গুপ্তঘরটার দিকে হাত তুলল কিশোর।

ঘড়ির পেছনের ফোকরটা এতক্ষণ নজরে পড়েনি মুসার। দেখে হাঁ হয়ে গেল। খাইছে! ওটা আবার কি?

এসো। গেলেই দেখবে।

ছেলেদেরকে টর্চ জ্বালতে বলে সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল গোরো। সবাইকে নিয়ে গুপ্তঘরটার দিকে এগোল। সবার শেষে ঢুকল রবিন। কি করে ফোকরের দরজা বন্ধ করতে হবে, বলে দিল গোরো। বন্ধ করল রবিন। সামান্য ফাঁক রেখে দিল, বাইরের ঘরে কি ঘটছে দেখার জন্যে।

.

২৩.

ঘরটা দেখল ছেলেরা। বেশ বড়। মোটা পাইপ দিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মনে হলো, অন্য গুপ্তঘরটাও রয়েছে এটার ঠিক ওপরে। টর্চের আলোয় দেখা গেল কিছু আসবাব, কাজের বেঞ্চ, কিছু যন্ত্রপাতি, একটা হট প্লেট আর একটা খুদে রেফ্রিজারেটর।

বাহ, সুবিধা তো ভালই আছে, রবিন বলল।

 এটা আমার ল্যাবরেটরি, গোরো বলল। খারাপ বলা যাবে না।

দরজার কাছে ঘাপটি মেরে রইল ওরা। ইয়ার্ড থেকে বেরোনোর পর যা যা ঘটেছে, মুসাকে বলার সুযোগ পেল রবিন আর কিশোর।

তিনজনে মিলে ভাবতে লাগল, ককার কোথায় আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাড়িটা খুঁজে দেখার জন্যে বেরোতে সাহস পেল না। বসে আছে উইকের অপেক্ষায়।

থেমে এসেছে বিদ্যুৎ চমকানো। বজ্রপতি আরও আগেই বন্ধ হয়েছে। অন্ধকার নিঃশব্দতার মধ্যে এখন বেশি করে কানে বাজছে:

টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!

কিন্তু শব্দটা এখন কিশোরদের কাছে ভীতিকর নয়।

হঠাৎ স্নায়ু টানটান হয়ে গেল ওদের। সামনের দরজা খোলার শব্দ শুনেছে। লিভিং রুমে ঢুকল পদশব্দ। আলো জুলল।

দরজার ফাঁকে চোখ রাখল রবিন। মোলায়েম গলায় বলল, উইক!

অন্যেরাও গাঁ ঘেষাঘেষি করে এল ফাঁকে চোখ রাখার জন্যে। থমকে দাঁড়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে। ছেঁড়া তারগুলো দেখল। যে চেয়ারে বন্দিরা বাঁধা ছিল, ওগুলো দেখল শূন্য। কাটা দড়ি পড়ে আছে মেঝেতে।

ধরতে বেরোব নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

মাথা নাড়ল কিশোর, এখন না।

উন্মাদ হয়ে গেল যেন উইক। রাগে লাল হয়ে গেল মুখ। হ্যাঁচকা টানে একটা চেয়ার তুলে মেঝেতে বাড়ি মেরে ভাঙল। চিৎকার করে বলতে লাগল, পালিয়েছে! কি ভাবে…

টান দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করল। ছাতের দিকে তুলে ট্রিগার টিপতে শুরু করল। ম্যাগাজিনের গুলি শেষ না করে থামল না।

খালি করে ফেলেছে! ফিসফিস করে বলল রবিন। ভাল!

পিস্তলটা মেঝেতে আছড়ে ফেলে চারপাশে তাকাতে লাগল উইক। দুচোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আচমকী হেসে উঠল অট্টহাসি। হুমকি দিয়ে নোট রেখে আসার কথা প্রমাণ করতে পারবে না ওরা, যদি আমি আবিষ্কারটা ধ্বংস করে দিইগোরোর মহামূল্যবান আবিষ্কার…– ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।

না না! দম আটকে যাবে যেন গারোর। ওকে এ কাজ করতে দেয়া যাবে না! আটকাতে হবে!

চলুন! সোজা হয়ে দাঁড়াল কিশোর।

গুপ্তঘর থেকে বেরিয়ে এল চারজনে। দৌড়ে ঢুকল সামনের হলঘরে।

অন্ধকার সিঁড়িতে শোনা গেল উইকের গর্জন, বিচ্ছুর দল! সর্বনাশ করে দিয়েছে সব! আমি ওদের ছাড়ব না!

সিঁড়িতে পা রাখল গোরো। নিঃশব্দে উঠতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা। আবিষ্কার বাঁচানোর জন্যে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে বুড়ো মানুষটা, ছেলেদেরও পেছনে ফেলে দ্রুত উঠে যাচ্ছে।

মিস্টার কিনডার, সাবধান! ডেকে বলল রবিন।

ছাতে ওঠার আগেই শয়তানটাকে থামাতে হবে!

 সিঁড়ির মাথায় এসে দম নেয়ার জন্যে থামল সে।

পাশে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

ওপরে তাকাল কিশোর। আরও সিঁড়ি আছে। চিলেকোঠায় উঠে গেছে। ওপরের দিকে করে টর্চ জ্বালল। আলোক রশ্মিতে ধরা পড়ল উইক। শিপরিজের মুখ, মুখ বিকৃত করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

উইক, আর শয়তানির চেষ্টা করে লাভ নেই, কিশোর বলল, আপনার চেয়ে সংখ্যায় আমরা অনেক বেশি। গায়ে যত জোরই থাক, চারজনের সঙ্গে পারবেন না। নেমে আসুন। জলদি!

নড়ল না উইক। চোখের খেপা দৃষ্টি আরও খেপা হচ্ছে।

 নামুন বলছি! ধমক দিয়ে বলল রবিন। আপনার জারিজুরি খতম!

নড়ে উঠল উইক। ওপর থেকে ঝাঁপ দিল ওদের লক্ষ্য করে। ভারি শরীর নিয়ে ভয়াবহ গতিতে এসে পড়ল ওদের ওপর। সবাইকে ফেলে দিল। ওরা যখন সিঁড়িতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, রেলিং ধরে উঠে দাঁড়াল সে। লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যেতে শুরু করল।

ধরো ওকে, মুসা, চিৎকার করে উঠল কিশোর, ওকে পালাতে দেয়া যাবে না। আমিও আসছি! রবিন, তুমি যাও মিস্টার কিনডরের সঙ্গে। ওপরে চলে যাচ্ছে। ছাতে উঠতে দিয়ো না তাকে। এই শরীর নিয়ে উঠতে গেলে মারা পড়বে!

 কিশোরের কথা শেষ হওয়ার অনেক আগেই উঠে পড়েছে মুসা। উইকের পিছু নিয়েছে।

রবিন উঠে গেল চিলেকোঠায়। গোরোকে দেখতে পেল না। ঝোড়ো বাতাসে ঝাঁপটা দিয়ে খুলে ফেলল সামনের একটা জানালার পাল্লা। ওটার কাছে ছুটে এসে বাইরে উঁকি দিল সে।

এখনও মুষলধারে পড়ছে বৃষ্টি। ঠাণ্ডা, প্রবল ঝোড়ো বাতাস বইছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এখনও, তবে অনেক দূরে সরে গেছে।

গেল কোথায় গোরো!–ভাবল রবিন। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পিচ্ছিল ছাতে ওঠার চেষ্টা করলে পিছলে পড়ে মরবে।

জানালাটা দিয়ে ঢালু ছাতের একাংশ চোখে পড়ে। অন্ধকারের মধ্যেও আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে চিমনিটা।

গোরো! অস্ফুট স্বরে বলে উঠল রবিন।

এক হাতে চিমনি পেচিয়ে ধরেছে ভিজে চুপচুপে বুড়ো মানুষটা। ইটের তৈরি চিমনির গোড়ায় পা রেখে, কনকনে ঝোড়ো বাতাস আর তুমুল বৃষ্টির পরোয়া না করে, আরেক হাত বাড়িয়ে খুঁজছে কি যেন।

পড়ে মরবে! বাঁচাতে হলে এখুনি যেতে হবে আমাকে।ভাবল রবিন।

দেরি করল না সে। জানালা গলে নেমে পড়ল স্লেটপাথরে তৈরি পিচ্ছিল টালির ছাতে। তার পাহাড়ে চড়ার সমস্ত অভিজ্ঞতা আর প্র্যাকটিস এক করে ভারসাম্য বজায় রেখে খুব সাবধানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চলল চিমনিটার দিকে।

চিৎকার করে ডাকল, মিস্টার কিনডার, নড়বেন না, আমি আসছি!

ফিরে তাকাল বৃদ্ধ। বলল, ঠিক আছে। ওটা পেয়ে গেছি আমি। নড়ার আর দরকার নেই আমার।

গোরোর পাশে চলে এল রবিন। শান্ত হয়ে আমাকে ধরে থাকুন। আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাব আমরা। সমস্ত ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। নিজে কিছু করার চেষ্টা করবেন না।

চিমনি ছেড়ে দিয়ে ওরা ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড এক ঝলক ঝেড়ো বাতাস এসে ঝাঁপটা মারল। টলিয়ে দিল গোরোকে। সামলাতে পারল না সে। কাত হয়ে পড়ে যেতে শুরু করল। সেই সঙ্গে রবিনকেও কাত করে দিল।

ঠেকাতে পারল না রবিন। পড়ে গেলে দুজনে। গড়াতে শুরু করল ছাতের ঢালে। দ্রুত সরে যেতে লাগল কিনারের দিকে।

.

২৪.

 বাইরে চলে গেল উইক।

মুসা আর কিশোরও বেরিয়ে এল।

টর্চ জ্বেলে এদিক ওদিক দেখতে লাগল কিশোর। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে। গেছে লোকটা।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা, দিল মনে হয় গোল খাইয়ে আমাদের!

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, সে-রকমই তো মনে হচ্ছে। ও যে ওরকম করে। ঝাঁপ দিয়ে পড়বে, কল্পনাই করিনি!

তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই টর্চের আলোয় ঝোপঝাড় আর গাছপালার মধ্যে উইককে খুঁজতে লাগল ওরা। কিন্তু তার ছায়াও দেখা গেল না আর।

হঠাৎ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হলো। ছুটে ড্রাইভওয়েতে ঢুকল ওটা। আচমকা ব্রেক কষে থামানোর চেষ্টা করায় কর্কশ আর্তনাদ তুলল টীয়ার। হেডলাইটের আলো পড়েছে বাড়িটর সামনের অংশে।

 পুলিশ! চিৎকার করে বলল মুসা।

টপাটপ লাফিয়ে নামল ছয়জন পুলিশ অফিসার। ছুটে এল ওদের দিকে।

সবার আগে রয়েছেন পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচার। যাক, পাওয়া গেল। কিশোর, তোমার চাচী তো অস্থির হয়ে পড়েছেন…

মুসার কাছে শুনেছি। পরে সব বলব। আগে উইককে খুঁজে বের করা দরকার।

উইকের কি হয়েছে, অল্প কথায় চীফকে জানাল কিশোর। বলল, আমার ধারণী বেরোতে পারেনি, এ বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে। সারাক্ষণ টর্চ জ্বেলে রেখেছি আমরা। আড়াল থেকে বেরোলে আমাদের চোখে পড়তই। এখন আপনারা এসে গেছেন। আর বেরোনোর সাহস পাবে না। ওকে বের করে আনতে হবে।

চিৎকার করে সহকারীদের নির্দেশ দিলেন চীফ, বাড়ির চারপাশে খোঁজো। খেয়াল রেখো, কোনমতেই যেন পেছন দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। বাড়িতে যত আলো আছে, সব জ্বেলে দাও।

ককারও সম্ভবত এ বাড়িতেই আছেন, কিশোর বলল। তাকেও খুঁজতে হবে।

চীফ বললেন, তার জন্যে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি অফিস থেকে বেরোনোর ঠিক আগে ফোন করেছেন। সারাদিন শহরের বাইরে ছিলেন। তোমাদের বাড়িতেই করেছিলেন। তোমার চাচীর কাছে তোমাদের নিখোঁজ হবার খবর পেয়েছেন। যে কোন মুহূর্তে এখানে চলে আসতে পারেন।

আলোয় আলোকিত হয়ে গেল বাড়িটী।

খাইছে! হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা। ওপর দিকে হাত তুলে দেখাল।

দেখে বরফের মত জমে গেল যেন কিশোর।

 টালির ছাতের কিনার ধরে ঝুলছে দুটো ছায়া।

রবিন আর গেরো!

একহাতে গোরোকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে রবিন। আরেক হাতে টালির কিনার খামচে ধরে ঝুলে আছে।

পাশে তাকাল কিশোর। মুসা নেই। চিৎকার করেই সরে গেছে। ঢুকে যাচ্ছে আবার বাড়ির ভেতর।

তার পেছনে ছুটল কিশোর। প্রার্থনা করল, খোদা, আমরা না যাওয়া পর্যন্ত আটকে রাখো ওদের! পড়তে দিয়ো না!

চিলেকোঠার জানালার কাছে পৌঁছে গেল ওরা।

মুসা বলল, আমি নেমে যাচ্ছি। তুমিও এসো। আমার গোড়ালি চেপে ধরে রাখবে।

কিশোর বলল, না, আমি জোরে পারব না। ভার রাখতে পারব না। এতজনের। আমি ওদের তোলার চেষ্টা করব, তুমি ধরে রেখো।

আপত্তি করল না মুসা।

ভেজা, পিচ্ছিল ছাতে নেমে গেল ওরা। কমে এসেছে বৃষ্টি। কিন্তু নতুন আপদ দেখা দিয়েছে। কুয়াশা জমতে আরম্ভ করেছে। বুড়ো আঙুল বাঁকা করে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

এখনও ঝুলে আছে রবিন। দেয়ালের গায়ে ছাতের একপাশে টালি যেখানে গাঁথা হয়েছে, তার কাছাকাছি রয়েছে। নিশ্চয় টালির খাজে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে সে, নইলে একটা সেকেণ্ডও ঝুলে থাকা সম্ভব হত না।

টর্চ জ্বেলে দেখল কিশোর, টালিতে নয়, কিনার দিয়ে চলে যাওয়া ছাতের পানি নিষ্কাশনের পাইপ আঁকড়ে ধরে ঝুলছে রবিন। গোরোও এখন পুরোপুরি রবিনের ওপর ভর দিয়ে নেই, তার একটা হাতও পাইপ চেপে ধরেছে। তাতে অনেকটা ভার কমেছে রবিনের ওপর থেকে।

একপাশের দেয়ালের যে শিরাটা বেরিয়ে আছে, সাইকেলের সীটে বসার মত করে তাতে বসল মুসী। দুই পা আর গোড়ালি দিয়ে দুদিক থেকে চেপে ধরুল দেয়ালটা। কিশোরকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বলল।

মাথা নিচে পা ওপর দিকে করে ঢালু ছাতে শুয়ে পড়ল কিশোর। শক্ত করে তার গোড়ালি চেপে ধরল মুসা।

সামনে হাত লম্বা করে দিল কিশোর। কিন্তু অল্পের জন্যে রবিনের হাতের নাগাল পেল না। বলল, মুসা, পারছি না!

খুব সাবধানে শিরাটার ওপর ঘষটে ঘষটে আরও কয়েক ইঞ্চি নামল মুসা। হাত এগিয়ে গেল কিশোরের। তার আঙুলগুলো রবিনের হাত ছুঁতে পারল। রবিনের কব্জি চেপে ধরল। বলল, রবিন, ছেড়ে দাও! তোমার আঙুলগুলো দিয়ে আমার কব্জি পেঁচিয়ে ধরো!

ধরল রবিন। আরেক হাতে গোরোকে ঠেলতে লাগল ওপর দিকে, ছাতে তুলে দেয়ার জন্যে।

 অন্য হাত দিয়ে গোরোর হাত চেপে ধরল কিশোর। টানতে লাগল ওপর দিকে।

সাংঘাতিক কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক একটা কাজ। তবে সফল হলো সে। আস্তে আস্তে ওপর দিকে উঠে আসছে গোরো।

দুর্বল হয়ে পড়েছে রবিন। কিশোরের হাতে তার ভার পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে গোরোকে আরও জোরে ঠেলতে লাগল।

অবশেষে ছাতে উঠে এল গোরো। উপুড় হয়ে তাকে চুপ করে শুয়ে পড়তে বলল কিশোর। পড়ে থাকুক। রবিনকে তুলে আনার পর তার ব্যবস্থা করবে।

সবচেয়ে বেশি ভার বহন করতে হচ্ছে মুসাকে। কিন্তু একচুল ঢিল করল না আঙুলের চাপ। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রইল সে।

রবিনও উঠে এল ওপরে। কিশোরের হাতে চাপ অনেকখানি কমল।

তুমি গোরোর পা ধরো, কিশোর বলল। আমি তাকে ধরে রাখছি।

খুব ধীরে তাড়াহুড়ো না করে একটা মানব-শেকল তৈরি করল ওরা। মুসা। ধরে রেখেছে কিশোরের পা। কিশোর ধরল গৌরোর দুই হাত। রবিন ধরল গোরোর দুই পাঁ। পিচ্ছিল ছাতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পরের তিনজন। টেনে টেনে তাদেরকে সরিয়ে আনতে শুরু করল মুসা।

অবশেষে ছাতের কিনার থেকে সরে এল সবাই।

কিশোর আর রবিনও শিরা আঁকড়ে ধরে হাঁপাতে লাগল।

এই ভয়াবহ টানাটানিতে একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে গোরো। তাকে ধরে রাখল মুসা।

হাঁপাতে হাঁপাতে রবিন বলল, ভালই সার্কাস দেখলাম আমরা, কি বলো! আর কোন কাজ না পেলে দড়াবাজিকর হয়েও ভাত জোগাড় করতে পারব।

.

২৫.

বাতাস অনেক কমে গেছে, তাই রক্ষা। গোরোকে নিয়ে ছাতের ওপর দিয়ে চিলেকোঠার জানালার দিকে এগোতে অতটা অসুবিধে হলো না ছেলেদের। নিচে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। উইককে খুঁজতে ব্যস্ত পুলিশ। গোয়েন্দাদের খোঁজ এখনও পড়েনি নিশ্চয়।

জানালা টপকে ভেতরে ঢুকল প্রথমে রবিন আর কিশোর। নিচে থেকে গোরোকে ওপর দিকে ঠেলে দিল মুসা। তাকে টেনে তুলে অনিল দুজনে। মুসা ঢুকল সবার শেষে।

ভয়ানক পরিশ্রম গেছে। চিলেকোঠার মেঝেতেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

দুর্বল ভঙ্গিতে ছেলেদের দিকে তাকাল গারো, তোমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। নিজের প্রাণের বিন্দুমাত্র মায়া করলে না! সত্যি বলছি, এত বয়েস হলো, এ রকম ছেলে আমি দেখিনি! তোমরা একেকটা হীরের টুকরো!

 কিশোর ও মুসাকে বলল রবিন, আর আমার নেই তোমাদের দুজনকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা! ছাতের কিনার ধরে ঝুলে পড়ার পর একবারও ভাবিনি আজ বেঁচে ফিরে আসতে পারব।

মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর, খাওয়া নিয়ে আর তোমাকে ঠাট্টা করব না, মুসা। যত মন চায় খেয়ো। তোমার ওই গণ্ডারের শক্তিই কেবল আজ দুটো প্রাণিকে রক্ষা করল! ধন্যবাদ।

দরাজ হাসি হাসল মুসা, শুকনো ধন্যবাদে কাজ হবে না। আজ রাতেই শিক কাবাব খাওয়াতে হবে। বিশ-পঁচিশ, যতটা খেতে চাই। পয়সার মায়া করতে পারবে না।

করব না। চলো, উইককে পাওয়া গেল কিনা দেখি।

নামতে শুরু করল ওরা। সবার পেছনে আসতে আসতে চিৎকার করে উঠল গোরো, আমার আবিষ্কার! ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা!

গোরোকে যেতে দিলে আবার কোন বিপদ বাধাবে। তাই কেউ বাধা দেয়ার আগেই আবার ছুটে চিলেকোঠায় উঠে গেল রবিন। জানালা গলে ছাতে নেমে পড়ল। চিমনির দিকে রওনা হলো। চিমনির কাছে এসে একহাতে চিমনি ধরে আরেক হাত ফোকরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতড়াতে শুরু করল।

কি যেন হাতে লাগল। বের করে আনল সেটা। তারের একটা বাণ্ডিলের মত জিনিস। একমাথায় একটা অদ্ভুত যন্ত্র লাগানো। সেটা পকেটে ভরে চলে এল আবার জানালার কাছে।

তাকে ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করল মুসা। ছাতে ঘোরার নেশায় পেল, নাকি আজ তোমাকে? ঘটনাটা কি?

পকেট থেকে জিনিসটা বের করল রবিন। মিস্টার কিনডার…

সে কথা শেষ করার আগেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল গোরে। ধকল সহ্য করতে পারেনি আর তার বুড়ো শরীর।

ধরাধরি করে তাকে নিচের লিভিং রুমে নিয়ে এসে একটা লম্বা সোফায় শুইয়ে দেয়া হলো।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন ফ্লেচার। সঙ্গে আরেকজন লোক। মাথায় স্ট্র হ্যাট।

মিস্টার ককার! বলে উঠল রবিন।

দ্রুত এগিয়ে এলেন ব্যাংকার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক, তোমরা ভালই আছ। তোমাদের কিছু হলে নিজেকে…

বাধা দিল কিলোর, আমরা ঠিকই আছি। তবে মিস্টার কিনডারের সাহায্য লাগবে। বেহুশ হয়ে গেছে।

একজন অফিসারকে গাড়ি থেকে ফার্স্ট এইড বক্স আনতে পাঠালেন চীফ।

ছাতের ওপর ওদের ভয়াবহ অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলল ছেলেরা।

পকেট চাপড়ে রবিন বলল, মিস্টার কিনডারের আবিষ্কার এখন আমার পকেটে।

চীফ জানালেন, উইককে পেলাম না। রোডব্লকের আদেশ দিয়ে দিয়েছি। আমি। শহর থেকে বেরোতে যাতে না পারে। সাংঘাতিক পিচ্ছিল চোরটা! একেবারে পাকাল মাছ!

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে থমকে গেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, গোলাঘরটায় খুঁজেছেন?

কোন গোলাঘর?

যেটাতে গাড়ি লুকিয়েছিল?

মাথা নাড়লেন চীফ। না। মরিস আসেনি, আমরা ওটা চিনিও না, মনেও পড়েনি।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর, রবিন, মুসা, এসো আমার সঙ্গে! বলেই চীফ বাধা দেয়ার আগে রওনা হয়ে গেল দরজার দিকে।

 বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ঘন হতে আরম্ভ করেছে কুয়াশার চাদর। ভোঁতা করে দিয়েছে জানালার হলদে আলোগুলোকে। ঘন ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা।

গোলাঘরে গিয়ে ঢুকেছে ভাবছ নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

 হ্যাঁ।

পেছনে ফিরে তাকাল মুসা। কুয়াশার জন্যে আলোগুলোকে কেমন বিচিত্র লাগছে। টর্চ জ্বালতে গেল।

বাধা দিল কিশোর, জেলো না। উইক দেখলে হুশিয়ার হয়ে যাবে। কিছুই যাতে টের না পায়। চমকে দিতে হবে ওকে।

গাছে তৈরি সুড়ঙ্গমুখের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। লতাপাতার ঢাকন। ফাঁক করল রবিন। ভেতরে পা রাখল তিনজনে। টানটান হয়ে আছে স্নায়ু। আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত।

রাত শেষ হয়ে এসেছে। পুবের আকাশে হালকা আলো। সুড়ঙ্গে সেটা প্রবেশ করছে না। এখানে ঘন কালো অন্ধকার। শঙ্কিত হলে কি এই অন্ধকারে বসে থাকলে নিশ্চয় চোখে সয়ে গেছে উইকের। ওরা নাম আগেই না ওদেরকে দেখে ফেলে।

ঝুঁকি নিয়েও তাই টর্চ জ্বালার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

অন্ধকারের কালো চাদর ছুঁড়ে দিল তীব্র আলোক রশ্মি। সেই আলোয় পথ দেখে দ্রুত এগোল ওরা।

গোলাঘরে ঢুকল। খড়ের গাদা আগের মতই আছে। তবে সামনের দিকের কিছু খড় মাটিতে পড়ে আছে। বেরিয়ে আছে গোপন গ্যারেজের প্রাই উডের দরজা। ভেতরে উঁকি দিল সে।

দেয়ালের কাছে খুট করে একটা শব্দ হতেই পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল তিনজনে। মুসার হাতের টর্চের আলো গিয়ে সোজা পড়ল উইকের মুখে। ভিজে, কুঁকড়ে আছে তার কাপড়-চোপড়। চোখে ব্রুনো দৃষ্টি। খড় সরানোর যন্ত্রটা তুলে নিয়েছে। মারাত্মক কাটাগুলো যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে।

এইবার তোমাদের শেষ করব আমি! বিষাক্ত গোক্ষোরের মত হিসহিস করে উঠল উইক। লাফ দিয়ে এগিয়ে এল ওদের গেঁথে ফেলার জন্যে।

.

২৬.

 খবরদার! গর্জন শোনা গেল পেছনে। নড়লে খুলি ফুটো করে দেব। হাত থেকে ওটা ফেলো, উইক!

থমকে গেল উইক। ফিরে তাকাল। দেখল, উদ্যত পিস্তল হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার। পেছনে আরও দুজন পুলিশ অফিসার। তাদের হাতেও পিস্তল।

একটা মুহূর্ত দ্বিধা করল উইক। তারপর হাত থেকে ছেড়ে দিল যন্ত্রটা। খটাং করে মেঝেতে পড়ল ওটা।

আবার লিভিং-রুমে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।

উইককে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কারও দিকে তাকাচ্ছে। না সে। খানিক আগের ঝোড়ো আকাশের অবস্থা হয়েছে তার চেহারার।

 প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে। তার ওপর ভেজা কাপড়-চোপড়। থরথর করে কাঁপছে তিন গোয়েন্দা। শুকনো চাদরের ব্যবস্থা করা হলো ওদের জন্যে।

শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে গোরো। তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গোয়েন্দাদের দিকে ফিরলেন ককার, বললেন, আমি একে চিনতে পেরেছি। কয়েক বছর আগে একটা চমৎকার আবিষ্কার করেছিল। তার সেই ইলেকট্রনিক যন্ত্রটা বাজারজাত করার জন্যে টাকা ধার চাইতে এসেছিল আমার কাছে। না দিয়ে তখন ভুল করেছি। যন্ত্রটা লোকের উপকারে লাগত। টাকা না পাওয়াতেই উইক শিপরিজের মত বাজে লোকের খপ্পরে পড়ল। আরেকটু হলেই অজি সর্বনাশ করে ফেলেছিল তার বোমা!

শুনেছেন তাহলে, তিক্ত কণ্ঠে বলল রবিন।

মাথা ঝাঁকালেন ককার। ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালেন উইকের দিকে। আবার ছেলেদের দিকে ফিরলেন। তবে এবার আর ভুল করব না আমি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব কিনডারকে। যত ইচ্ছে গবেষণা করুক, আমার বাড়িটা ব্যবহার করুক, কিচ্ছু বলব না।

এ কথা শুনে খুশি হলো তিন গোয়েন্দা।

রবিন বলল, আজ আপনাকে না পেয়ে আমরা ভেবেছিলাম খারাপ কিছু ঘটেছে। সেজন্যেই এখানে এসেছিলাম দেখার জন্যে। কি হয়েছিল বলুন তো?

 ব্যাংকার জানালেন, খুব সকালে একটা জরুরী কাজে শহরের বাইরে। চলে গিয়েছিলেন। অফিসকে জানিয়ে যেতে পারেননি। বললেন, মাঝরাতে ফিরেছি। বাড়িতে ফিরে জানলাম, আমাকে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পুলিশ এসেছিল খুঁজতে। ইয়ার্ডে কিশোরের চাচী আর থানায় চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম তখন।

হাতকড়া পরা উইকের দিকে তাকালেন তিনি। তোমরা আমার বাড়িতে ঢুকলে কি করে? চাবি পেলে কোথায়?

খকখক করে হাসল উইক। ওটা আর এমন কি ব্যাপার। তালাওয়ালা এনে চাবি বানিয়ে নিয়েছি।

এই জন্যেই তলার গায়ে আঁচড়ের দাগ দেখা গেছে, ভাবল কিশোর।

আমার গুপ্তঘরে ঢুকে নোট রেখে এলে কি ভাবে? জিজ্ঞেস করলেন ককার।

সেটি বলছি না, কিশোরদের দেখিয়ে বলল উইক। এরা জিজ্ঞেস করেছিল, এদেরকেও বলিনি। মাথায় বুদ্ধি কম না ওদের, পারলে বের করে নিক।

চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করল কিশোর। হাত বাড়াল, রবিন, কিনডারের যন্ত্রটা দেখি দাও তো?

পকেট থেকে অদ্ভুত যন্ত্রটা বের করে দিল রবিন।

কৌতূহলী হয়ে ওটার দিকে তাকাল সবাই।

হাতে নিয়ে ভাল করে দেখতে লাগল কিশোর। তিন ইঞ্চি লম্বা ছোট একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে তাতে দুটো ওয়াটারপ্রুফ ব্যাটারি বসানো হয়েছে। তার নিচে রয়েছে চাকা। এক প্রান্তে ছোট ছোট একজোড়া খাজকাটা চোয়ালের মত জিনিস।

আমার অনুমান ভুল না হলে, কিশোর বলল, চাকাগুলো কয়েকবার ঘোরার পর হাঁ করে খুলে যায় চোয়াল দুটো। ঠিক কতবার ঘুরবে, সেটা সেট করে দেয়া আছে। চোয়াল খুললে চাকাগুলো থেমে যায়। আপনাআপনি আবার যখন চোয়াল দুটো বন্ধ হয়, চাকাঁ চালু হয়ে যায়। তবে তখন উল্টো দিকে ঘোরে।

দারুণ খেলনা তো! ককার বললেন।

হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস, আপনার গুপ্তঘরে নোট রেখে আসার কাজে এই যন্ত্রটাই ব্যবহার করা হত।

কি!

উইক বাদে সবাই কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোরের দিকে।

চোয়ালগুলো দেখুন, কিশোর বলল, খাজ কাটা আছে। এতে কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিলে চেপে ধরে রাখবে। তারের সাহায্যে যন্ত্রটা চিমনি দিয়ে নিচে নামিয়ে দিলে চাকায় ভর করে চলে যাবে ঘরের মাঝখানে। সেখানে চোয়াল খুলে কাগজ ফেলে দিয়ে ফিরে আসবে চিমনির কাছে। তার টেনে তখন আবার এটা তুলে নিলেই হলো। ছাতে উঠে উইক করেছে এই কাজ।

বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল ককারের চোখ। এ জন্যেই, মাথা দুলিয়ে। বললেন তিনি, এই জন্যেই আমরা বুঝতে পারিনি টাইম লক লাগানো ঘরে চোর ঢোকে কি করে! এ রকম একটা খেলনী যে তৈরি করে ফেলবে কেউ, কে ভাবতে পেরেছিল!

উইকের দিকে ফিরল কিশোর। আপনি গোরোকে বুঝিয়েছেন, এই খেলনাটা বাজারজাত করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন। তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন ওটা। তারপর গিয়ে ওই কুকাজ করেছেন। আশা করি, আর দোষ এড়াতে পারবেন না। গুপ্তঘরে নোট যে আপনিই রেখেছেন, পুলিশ প্রমাণ করতে পারবে এখন, কি বলেন?

চুপ করে রইল উইক। চোখের দৃষ্টিতে কিশোরকে ভস্ম করার চেষ্টা করতে লাগল।

 এখানকার কাজ আপাতত শেষ। উইককে থানায় নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন ফ্লেচার।

 হাত তুলল কিশোর, এক মিনিট, পান্নার জিনিসগুলো কোথায়, আগে জিজ্ঞেস করে নিই। কোথায় লুকিয়েছেন ওগুলো, উইক?

এবারেও জবাব দিল না উইক। ঘৃণায় একবার থুথু ফেলে আরেক দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

 বার বার জিজ্ঞেস করেও জবাব পাওয়া গেল না ওর কাছ থেকে। শেষে রাগ করে অফিসারদের আদেশ দিলেন চীফ, নিয়ে যাও থানায়, তারপর দেখা যাবে।

তারমানে জিনিসগুলো বের করার জন্যে আবার খুঁজতে আসতে হবে, বলল একজন অফিসার। এখনই কাজটা সেরে ফেলব নাকি, চীফ?

সেরে ফেললে মন্দ হয় না, আবার আসার ঝামেলা থেকে বাঁচা যাবে। এই, একজন গিয়ে বোমাটা চেক করো তত, ফাটার সম্ভাবনা আছে কিনা দেখো।

ঘরের মধ্যে চেক করতে গেলে ফেটে গিয়ে যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায় এ জন্যে ঝুঁকি নিল না পুলিশ। কালো বাক্সের মত জিনিসটা বের করে নিয়ে বাড়ির কাছ থেকে দূরে খানিকটা খোলা জায়গায় চলে গেল দুজন অফিসার।

এত ভীষণ ক্লান্ত তিন গোয়েন্দা। তবু ঠিক করল, পীন্নীগুলো না খুঁজে যাবে না। বোমা বের করল যে দুজন অফিসার তাদের সঙ্গে বেরিয়ে এল।

কোনখান থেকে শুরু করব? জানতে চাইল মুসা।

চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল কিশোর। সূর্য উঠছে। কুয়াশা কাটতে আরম্ভ করেছে সোনালি রোদ। প্রাসাদ থেকে পাঁচশো গজ দূরে ঝোপে ঢাকা একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল তার। আঙুল তুলে দেখাল।

বাড়িটাতে বোমা ফিট করে দূরে বসে যদি দেখতে চাই ফাটল কিনা, এর চেয়ে ভাল জায়গা আর নেই এ বাড়িতে। সূতরাং ওখান থেকেই শুরু করব।

বৃষ্টি আর কুয়াশায় ভেজা ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে গেল ওরা। ঝোপগুলোর ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল ক্যানভাসের ব্যগিটী আছে কিনা। কিন্তু হতাশ হতে হলো! নেই।

আশপাশে ওরকম জায়গা আর আছে কিনা দেখল। তা-ও নেই।

পুরানো একটা ম্যাপল গাছের দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। গোড়ার সামান্য ওপর থেকেই বেশ কয়েকটা ডাল ছড়িয়ে গেছে। কিশোরকে বলল, সহজেই ওঠা যাবে। ওতে চড়ে দেখব নাকি ভাল জায়গা আছে কিনা?

দেখো।

 গাছটায় চড়া কঠিন কিছু না। নিচের একটা মোটা ডালে চড়ে তাকাল। স্পষ্ট দেখা যায় প্রাসাদটী। আরও ভাল করে দেখার জন্যে মাথার ওপরের একটা ডালে হাত দিতে গিয়েই ধড়াস করে এক লাফ মারল হৃৎপিণ্ড। পাতার আড়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ব্যাগটী।

পেয়েছি! পেয়েছি। চিৎকার করে উঠল সে।

দৌড়ে এল মূসা আর কিশোর।

ভারি ব্যাগটা নামাতে রবিনকে সাহায্য করল মুসা।

ব্যাগটা নিয়ে লিভিংরুমে ফিরে এল ওরা। হেসে বলল কিশোর, এগুলো না পেলে হ্যারিসকে খুশি করতে পারতাম না। আর মক্কেলকে খুশি করতে না পারলে মন খুঁতখুঁত করতে থাকে আমাদের।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি, হেসে বললেন চীফ।

উইককে নিয়ে চলে গেল অফিসারেরা। সঙ্গে নিয়ে গেল বোমাটা আর ব্যাগে ভরা পন্নিার জিনিসগুলো। পরে যার যার জিনিস ফিরিয়ে দিতে পারবে।

তিন গোয়েন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্যে রয়ে গেলেন চীফ। ককার আর গোরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, পরে দেখা করবে কথা দিয়ে ওরাও বাড়ি যেতে তৈরি হলো।

মুসা বলল, একটা জরুরী কথা কিন্তু ভুলে গেছ।

কি? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।

শিক কাবাব। পঁচিশটা খাওয়ানোর কথা ছিল।

পঁচিশটা শিক কাবাব। কৌতূহল হলো ব্যাংকারের। ঘটনা কি জানতে চাইলেন।

জানানো হলো তাকে।

 শুনে হাসতে শুরু করলেন তিনি। ফ্লেচার আর গোরোও হাসল।

ককার বললেন, কুছ পরোয় নেই, আমি খাওয়াব তোমাকে শিক কাবাব। যত খেতে পারো। পঞ্চাশটা খেলেও আপত্তি নেই। এখন বাড়ি যাও। বিশ্রাম নাও। বিকেলে চলে এসো এখানে। তোমাদের সঙ্গে আমার আরও কথা আছে। বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগে। তোমাদের নিয়ে একসঙ্গে বেরোব। যে রেস্টুরেন্ট দেখাবে মুসা, তাতেই ঢুকব। ঠিক আছে?

ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসল মুসা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, স্যার।

ধন্যবাদগুলো তো আসলে তোমাদের পাওনা। চীফের দিকে তাকালেন ককার। আপনি আসবেন, চীফ? চলুন না, একসঙ্গে ডিনার খাই আজ?

হাসলেন চীফ। কথা দিতে পারছি না, ভাই। গত দুই রাত আপনাদের এই কেসের জন্যে দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। ভাবছি, আজ প্রাণ ভরে ঘুমাব। কিশোর, এসো, ওঠো। তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর আমার ছুটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *