নকশা

ভলিউম ৩৫ – নকশা – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৫

০১.

সন্ধ্যাবেলা ইয়ার্ডের ওঅকশপে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। ক্যামেরা নিয়ে। আলোচনা হচ্ছে, ইনফ্রারেড-ক্যামেরা। ওরকম একটা ক্যামেরা এই জন্মদিনে উপহার পেয়েছে মুসা। সামনের টেবিলে পড়ে আছে। কাজে লাগাতে পারছে না বলে তার খুব দুঃখ।

এই সময় ফোন বাজল। অলস ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর। হালো?

পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড?

হ্যাঁ।

কে, কিশোর? আমি ভিকটর সাইমন।

মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল কিশোর। নিশ্চয় কোন কেস। ও, আপনি, স্যার? কি খবর?

ভাল। তোমাদের খবর কি? ব্যস্ত?

 নাহ। কাজকর্ম কিছু নেই। বসে বসে ঝিমুচ্ছি।

ভালই হলো। ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ নামে এক ভদ্রলোক আমার সামনে। বসে আছেন। ব্যবসায়ী। কারখানার মালিক। একটা বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছেন। কিন্তু আমার এখন মোটেও সময় নেই। তোমাদের কাছে পাঠাচ্ছি। দেখো, কোন সাহায্য করতে পারো কিনা?

বিপদটা কি, স্যার?

 মিস্টার স্মিথকে পাঠাচ্ছি। তার কাছেই শুনো।

এখনই পাঠাবেন?

হ্যাঁ, এখনই।

আচ্ছা, পাঠান। আমরা তিনজনেই আছি।

দ্বিধা করে বললেন সাইমন, আরেকটা কথা, চোখ-কান একটু খোলা রেখো। ক্লিঙ্গলস্মিথের সন্দেহ, তার পেছনে লোক লেগে আছে। ইয়ার্ডেও গিয়ে হাজির হতে পারে ওরা। সাবধান থাকবে।

থাকব।

 কোন দরকার হলে আমাকে ফোন কোরো। বাড়িতেই আছি।

আচ্ছা।

রাখলাম?

আচ্ছা।

কিশোরকে ধন্যবাদ দিয়ে লাইন কেটে দিলেন সাইমন।

উৎসুক হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা আর রবিন। সে রিসিভার রাখতেই মুসা জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? কোন কেস?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আর আফসোস করা লাগবে না। তোমার ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ এসে গেছে। বাইরে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকোগে। এখন থেকে যে ভেতরে ঢুকবে তারই ছবি তুলে নেবে। গোপনে। কিছু যেন টের না পায়। আমি গেট খুলে রাখছি।

 অবাক হয়ে কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। কিছুই বুঝলাম না!

বুঝতে আমিও পারছি না। মিস্টার সাইমন বললেন চোখ-কান খোলা রাখতে। তা-ই রাখব। ইনফ্রারেড-ক্যামেরার চেয়ে কড়া নজর আর কোন চোখের নেই। লেন্সের সামনে পড়লে আর ফসকবে না। সুতরাং ওই চোখই ব্যবহার করতে বলছি।

আর কোন প্রশ্ন না করে টেবিলে রাখা ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল মুসা। কাজে লাগানোর জন্যে অস্থির হয়ে ছিল, সেই সুযোগ পেয়ে গেছে আজ।

জঞ্জালের আড়ালে লুকিয়ে বসল মুসা।

ইয়ার্ডের বেশির ভাগ আলোই নেভানো। বোরিস আর রোভারকে নিয়ে রাশেদ পাশা গেছেন পুরনো মালপত্র দেখতে। দোতলার ঘরে মেরিচাচী একা।

রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে। এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কয়েক মিনিট পর একটা মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ শুনল মুসা। শক্তিশালী ইঞ্জিন। ইয়ার্ডের গেটের কাছে একবার থমকাল মনে হলো, তারপর চলে গেল।

 বসেই আছে মুসা, গেটের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ দেখতে পেল লোকটাকে। কেমন অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল। এগিয়ে আসতে লাগল। কিছুদূর এসে থমকে দাঁড়াল। তাকাল এদিক ওদিক। এমন ভঙ্গি করল, যেন ভুল করে ঢুকে পড়েছে। ঘুরে আবার এগিয়ে গেল গেটের দিকে। বেরিয়ে গেল।

ততক্ষণে ছবি তুলে ফেলেছে মুসা।

খানিক পর একটা গাড়ি এসে থামল গেটের সামনে। হর্ন বাজাল। ওঅর্কশপ থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর আর রবিন। গাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আরোহীর সঙ্গে কথা বলে সরে দাঁড়াল।-ভেতরে ঢুকল গাড়িটা। ইয়ার্ডের চত্বরে থামল।

গাড়ি থেকে নামলেন যিনি, তাঁর মাথা জুড়ে টাক, দীঘল শরীর, পরনে ধূসর রঙের পুরানো ছাঁটের স্যুট। হাত বাড়িয়ে দিলেন কিশোরের দিকে।

 ছবি তুলে ফেলল মুসা। শুনতে পেল, ভদ্রলোক বলছেন, আমি ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ।

কিশোর পশিা, নিজের পরিচয় দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান। ও রবিন। আমাদের আরেক বন্ধু মুসা আমান, একটা জরুরী কাজে বাইরে গেছে। চলে আসবে।

রবিনের সঙ্গেও হাত মেলালেন স্মিথ। তাঁকে নিয়ে ঘরের দিকে এগোল কিশোর আর রবিন। বারান্দায় উঠল। ঢুকে গেল ভেতরে। বসার ঘরে ঢুকেছে।

ক্যামেরা হাতে বসেই রইল মুসা।

বসার ঘরে ঢুকে স্মিথকে বসতে বলল কিশোর। নিজেও বসল। জিজ্ঞেস করল, চা-টা কিছু দেব?

না না, দরকার নেই, হাত নেড়ে বললেন ভদ্রলোক, মিস্টার সাইমনের বাড়ি থেকে কফি খেয়ে এসেছি। সাংঘাতিক প্রশংসা করলেন তোমাদের। তোমরা নাকি অনেক বড় গোয়েন্দা।

জবাবে শুধু হাসল কিশোর।

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন স্মিথ। বললেন, হ্যাঁ, যা বলতে এসেছি সেটাই বলি। আমার এক ভাগ্নেকে খুঁজে বের করে দেয়ার অনুরোধ করব তোমাদের। তার নাম মাটি লফার, সে-ও আমারই মত কারখানার মালিক। অল্প বয়েসেই লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। মাস তিনেক আগে নিখোঁজ হয়েছে।

চুপ করে রইল কিশোর। অপেক্ষা করছে।

প্লেন নিয়ে বেরিয়েছিল, আবার বললেন স্মিথ। সঙ্গে ছিল তার এক বন্ধু, লুক ব্রাউন। অ্যারিজোনার মরুভূমিতে নেমে কলোরাডো নদীর কাছাকাছি হারিয়ে যায় ওরা। তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। বেমালুম গায়েব।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, প্লেনটার কি হয়েছে?

ওটা পাওয়া গেছে। মরুভূমিতে ল্যাণ্ড করেছে। পাহাড়ের খাড়া একটা দেয়ালের কাছে। এর ষোলো মাইল উত্তরে ব্লাইদি নামে একটা শহর আছে।

প্লেনটার কোন ক্ষতি হয়নি? জানতে চাইল কৌতূহলী রবিন।

নাহ, কিছুই হয়নি। ট্যাংকে তেল কমে গিয়েছিল। তবে তার জন্যে মরুভূমিতে ল্যাণ্ড করার কোন প্রয়োজন ছিল না। ইচ্ছে করলে ব্লাইদির কাছে রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে ফিরে যেতে পারত। ইঞ্জিনেরও কোন ক্ষতি হয়নি। এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে আমাকে। যেন ইচ্ছে করেই নেমেছে লফার, হারিয়ে যাওয়ার জন্যে।

তারমানে মারা যায়নি? অনুমান করল রবিন। হেঁটে চলে গেছে কোথাও কোথায়?

জানি না। সামান্যতম সূত্রও পাওয়া যায়নি।

পুলিশ জানে? ভালমত খোঁজা হয়েছে?

তন্নতন্ন করে। দুই-দুইজন মানুষ, মরে গেছে না বেঁচে আছে, তারও কোন নমুনা নেই। পুলিশ তো খুঁজেছেই, এয়ার ফোর্সও রেসকিউ টিম পাঠিয়েছে, কোন লাভ হয়নি। গত হপ্তায় আমিও গিয়ে শেষ চেষ্টা করে এসেছি। কিচ্ছু পাইনি।

চুপ করে বসে আছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। কি যেন। একটা কথা মনে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সোজা হয়ে বসল। কলোরাডো। নদীর কাছে নেমেছে বলছেন?

ভুরু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকালেন স্মিথ। হ্যাঁ। কেন?

ওড়ার সময় নিচে কি দেখেছেন, বলি?

বলো।

দেখেছেন কতগুলো দানবকে। একশো ফুট লম্বা একেকটা।

দানব! অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন।

ঠিকই বলেছে ও, ওপরে-নিচে মাথা দোলালেন স্মিথ। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি করে জানলে তুমি?

ব্লাইদি নামটা চেনা চেনা লাগল। ভাবতে মনে পড়ে গেল, গত বছর মরুর ওই দানবগুলো সম্পর্কে পড়েছিলাম। মরুভূমির বুকে আঁকা অনেক বড় বড় ছবি। রেখাচিত্র। কয়েকশো বছর আগে নাকি ইনডিয়ানরা একেছিল ওগুলো। রাইদির কাছে কলোরাডো নদীর পাশে আঁকা ছবিগুলো সবচেয়ে বড়।

এতবড় ছবি আঁকল কি দিয়ে ওরা? রবিনের প্রশ্ন।

লাঙলের ফাল জাতীয় কোন যন্ত্র দিয়ে। ওপরের পাতলা বালি আর মাটির আস্তর কেটে গভীর দাগ করেছে নিচের পাথরের মত শক্ত হলদে রঙের মাটিতে। ফুটে উঠেছে দাগগুলো। ছবি হয়ে গেছে।

অবাক কাণ্ড! মরুভূমিতে একশো ফুট লম্বা ছবি আঁকতে গেল কেন ইনডিয়ানরা? মাটি থেকে দেখে যে পরে উপভোগ করবে, তারও উপায় নেই। কিছুই বোঝা যাবে না। অদ্ভুত কিছু রেখাই মনে হবে শুধু!

 অনেক দিনের রহস্য ওটা, স্মিথ বললেন। বিরাট রহস্য। অনেক চেষ্টা করেও এর বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

কিশোর বলল, আপনার কি ধারণা ওই দানবগুলোকে দেখেই কৌতূহল হয়েছিল লফার আর ব্রাউনের? আরও কাছে থেকে দেখার জন্যে নিচে নেমেছিল?

মাথা নাড়লেন স্মিথ। না, মনে হয় না। এতবড় ছবি মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখে কিছু বোঝা যাবে না, এটুকু বোঝার বুদ্ধি ওদের আছে। সুতরাং নামার অন্য কোন কারণ ছিল। তবে কারণটার সঙ্গে এই ছবির কোন সম্পর্ক থাকাটী অস্বাভাবিক নয়।

আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছি! কিশোর বলল।

সেই সম্পর্কটা কি? রবিনের প্রশ্ন।

সেটা জানলে তো অনেক প্রশ্নেরই জবাব জানা হয়ে যেত।

একটা মুহূর্ত নীরবে কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন স্মিথ। তারপর বললেন, তোমাদের ব্যাপারে মিস্টার সাইমনের অনেক উঁচু ধারণা। সেটা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি এখন। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। কি ঠিক করলে, কাজটা নেবে তোমরা? খরচাপাতির জন্যে ভেব না…

মাথা নাড়ল কিশোর। না, ভাবছি না। কাজটা করব আমরা।

ভাল করে ভেবে দেখো। তদন্ত করতে হলে ওই মরুভূমিতে যেতে হবে। তোমাদের…

প্রয়োজন হলে যাবে। অ্যারিজোনা তো হাতের কাছে। বরফের দেশ আইসল্যাণ্ডে গিয়েও রহস্যের তদন্ত করে এসেছি আমরা।

এই প্রথম হাসলেন স্মিথ। ঠিক আছে, করো তদন্ত। কিন্তু তোমাদের আরেক বন্ধু তো এখনও এল না। দেখা হলো না।

কিশোর বলল, ঠিকানা দিয়ে যান, হবে। আজ রাতটা ভেবে নিই, কাল দেখা করব আবার। কি ভাবে কি করব, জানাব তখন আপনাকে।

ঠিক আছে। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলেন স্মিথ। আমি তাহলে এখন যাই।

উঠে দাঁড়ালেন স্মিথ। তাঁকে এগিয়ে দিতে চলল কিশোর আর রবিন।

.

স্মিথকে নিয়ে কিশোররা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করল মুসা। কাউকে ঢুকতে দেখল না। ভাবল, আর বসে থেকে লাভ নেই। আর কেউ ঢুকবে না। তার চেয়ে বরং যে দুটো ছবি তুলেছে সেগুলো ডেভেলপ করে ফেলা ভাল। দেখাতে পারবে কিশোরকে। যে লোকটা ঢুকে আবার বেরিয়ে গেছে, তার আচরণ সন্দেহজনক। তার পরিচয় বের করা। দরকার।

জঞ্জালের নিচে মোবাইল হোমের ভেতর, তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে আছে ল্যাবরেটরি। দুটো ছবি ডেভেলপ করে, প্রিন্ট করল মুসা। চমৎকার উঠেছে, খুবই স্পষ্ট। প্রথম ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে লোকটা তাকিয়ে আছে কিশোরদের বাড়িটার দিকে। দ্বিতীয় ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল মুসার, অস্ফুট শব্দ করে উঠল। ছবি দুটো নিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এল হেডকোয়ার্টার থেকে।

ওঅর্কশপটা অন্ধকার। যতদূর মনে পড়ে আলো জ্বেলেই ভেতরে ঢুকেছিল সে। কে নেভাল? কিশোররা কি বেরিয়ে এসেছে? না, তাহলে হেডকোয়ার্টারেই ঢুকত, কিংবা তাকে ডাকত।

মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকল তার। তবে ছবির উত্তেজনায় তেমন মাথা ঘামাল না ব্যাপারটা নিয়ে। ওঅর্কশপের দরজায় বেরিয়ে এল।

খসখস শব্দ হলো পেছনে। ফিরে তাকাতে গেল সে। মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। চোখের সামনে জ্বলে উঠল হাজার কয়েক রঙবেরঙের তারী।

ঢলে পড়ে গেল মুসা।

.

০২.

ওঅর্কশপে আলো নেই দেখে কিশোর আর রবিনও অবাক হয়েছে। ভাবল, কোন কারণে নিভিয়ে দিয়েছে মুসা। স্মিথ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর গেট লাগিয়ে দিল কিশোর। রবিনকে নিয়ে এগোল ওঅর্কশপের দিকে।

মাটিতে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা মুসার গায়ে হোঁচট খেল কিশোর। চিৎকার করে উঠল, মুসা, কি হয়েছে তোমার?– মুসার ভারি দেহটা ধরাধরি করে বসার ঘরে নিয়ে এল সে আর রবিন। লম্বা সোফায় শুইয়ে দিল।

ইয়ার্ডের বেচাকেনার হিসেব নিয়ে বসেছিলেন মেরিচাচী, চেঁচামেচি শুনে। নেমে এলেন। বেহুশ মুসাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে?

কিশোর বলল, কেউ বাড়ি মেরে বেহুশ করে ফেলে রেখে গেছে!

মরবি! এ ভাবেই মরবি তোর একদিন! বলে ছুট দিলেন চাচী। ভেজা তোয়ালে আর স্পিরিট অভ অ্যামোনিয়া নিয়ে এলেন। ততক্ষণে মুসার শার্টের বোতাম, কোমরের বেল্ট খুলে কাপড়-চোপড় ঢিল করে দিয়েছে কিশোর আর রবিন।

তুলোয় স্পিরিট অভ অ্যামোনিয়া ভিজিয়ে মুসার নাকের কাছে ধরলেন। মেরিচাচী। ভেজা তোয়ালে দিয়ে হাত-পায়ের তালু মুছে দিতে লাগল রবিন।

ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে ঢুকতে গুঙিয়ে উঠল মুসা।

 কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল কিশোর, মুসা, ওঠো! তাকাও! এই মুসা, শুনতে পাচ্ছ? তোমার চকলেট-কেক শেষ হয়ে গেল তো!

চোখ মেলল মুস, চকলেট-কেকের কথা বললে শুনলাম?

হাসি ফুটল মেরিচাচীর ঠোঁটে। হ্যাঁ, ওঠো। আস্তটাই রেখে দিয়েছি তোমার জন্যে।

কি ঘটেছিল, জানার জন্যে প্রশ্নের তুবড়ি ছোটাল কিশোর আর রবিন।

কে যে বাড়ি মারল, কিছুই বলতে পারব না, দুর্বল কণ্ঠে জানাল মুসা। অন্ধকারে দেখতে পাইনি।

তার জন্যে গরম দুধ আনতে চলে গেলেন মেরিচাচী।

কিন্তু বাড়িটা মারল কে? কেন মারল? রবিনের প্রশ্ন।

আন্দাজ করতে পারছি, মুসা বলল। একটা সাংঘাতিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। ছবি!

ছবি! দুই ভুরু কুঁচকে কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের।

উঠে বসল মুসা। মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ। দুটো ছবি তুলেছি। প্রথম ছবিটা যার তাকে চিনি না। মনে হলো ভুল করে ঢুকে পড়েছে। বুঝতে পেরে বেরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ছবিটা মিস্টার স্মিথের। তাকে দেখে অবাক হতাম না, হয়েছি তাঁর পেছনে আরেকজনকে দেখে। জঞ্জালের ওপাশে ঘাপটি মেরে ছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চেহারা। ছবি দেখেই বোঝা যায় লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে। এই লোকটাকেও চিনি না।

ছবিগুলো কোথায়! অধীর হয়ে জানতে চাইল কিশোর।

বেহুশ হওয়ার আগে পর্যন্ত তো হাতেই ছিল। হয়তো পড়ে গেছে। ওঅর্কশপের দরজায় খুঁজলে পাওয়া যাবে।

কিন্তু পাওয়া গেল না ছবিগুলো।

ওঅর্কশপের দরজায় একটুকরো কাগজ টেপ দিয়ে সটা। তাতে লেখা:

তিন গোয়েন্দা, সাবধান লেখার

নিচে আঁকা একটা রেখাচিত্র। ছবিতে একটা লোক, তার বুকের দিকে তীর তাক করা।

আঁকিয়ে হিসেবে সুবিধের না, রবিন বলল। কিশোর, কি বোঝাতে চেয়েছে?

বোঝাতে চেয়েছে, আমরা যেন সরে থাকি। নাহলে হৃৎপিণ্ড বরাবর তীর মারবে। তুড়ি বাজাল কিশোর, অর্থাৎ, খতম করে দেবে!

নেগেটিভগুলোর জন্যে ল্যাবরেটরিতে ঢুকল ওরা। ছবি ডেভেলপ করার জায়গাটায় জিনিসপত্র উলট-পালট হয়ে আছে। কেউ যে খুঁজে গেছে, বোঝা যায়।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে; ছবি, নিগেটিভ, কিছুই না পেয়ে খালিহাতে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। জানাল কি ঘটেছে।

সব শুনে কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল মুসা, কেবল নিজেকেই বড় গোয়েন্দা ভাব, তাই না? হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল নেগেটিভগুলো মূল্যবান, কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার।

অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল কিশোর, কোথায় রেখেছ?

উঠে দাঁড়াল মুসা। ঘুরে উঠল মাথা। আবার বসে পড়ল সে। খানিকক্ষণ পর একটু সুস্থ হয়ে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে চলল ল্যাবরেটরিতে।

একটা উঁচু টুলের নিচে হাত ঢুকিয়ে নেগেটিভ দুটো বের করে আনল। টেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল ওখানে।

 ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ওগুলো নিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেল রবিন। ছবি প্রিন্ট করতে দেরি হলো না। বেরিয়ে এল ভেজা ছবি হাতে। টেবিলে রাখল।

ছবির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। প্রথম যে লোকটার ছবি তোলা, হয়েছে, তার ছিপছিপে শরীর, মাথায় ধূসর চুল। আর স্মিথের পেছনে যে লোকটার ছবি উঠেছে, তার কালো চুল, পেশীবহুল দেহ।

তখুনি ফোন করে সাইমনকে সব কথা জানাল কিশোর। তার পরামর্শ চাইল।

পরদিন সকালে ছবিগুলো নিয়ে রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে চলল তিন গোয়েন্দা। অফিসেই পাওয়া গেল পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে। প্রথম ছবিটার ওপর টোকা দিয়ে গভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, চিনি এঁকে। নাম মরিস ডুবয়। রকি বীচ সেভিংস ব্যাংকের ট্রাস্টি। ভদ্রলোক, তবে বড় বেশি খামখেয়ালি। পথ চলতে চলতে প্রায়ই নিজের বাড়ি ভেবে ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। অনেকে রিপোর্ট করেছে পুলিশের কাছে। দ্বিতীয় ছবিটীয় টোকা দিয়ে বললেন, এর ব্যাপারে ফাইল না দেখে কিছু বলতে পারছি না।

কিন্তু অপরাধীদের রেকর্ড ফাইলে পাওয়া গেল না লোকটার নাম।

ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা। স্মিথের অফিসে। তার সঙ্গে দেখা করতে চলল।

 মুসার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর, মুসা, ইনি ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ। মার্টি লফারের মামা।

মুসার মাথায় বাড়ি মেরে ছবি নিয়ে যাওয়ার কাহিনী শুনে উদ্বেগ্ন ফুটল ওয়াল্টের চেহারায়। বললেন, থাকগে, তোমাদের আর এর মধ্যে গিয়ে কাজ নেই। পুলিশকেই বলি বরং। দেখুক আরেকবার চেষ্টা করে।

কিশোর বলল, কিন্তু এটা এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে, মিস্টার স্মিথ। মুসাকে বাড়ি মারার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ব না। আপনি আমাদের কাছে আসায় লোকটা এত খেপে গেল কেন? নিশ্চয় লফারের ব্যাপারে কিছু জানে। এই লোককে খুঁজে বের করতে হবে এখন আমাদের। মনে হচ্ছে, কিডন্যাপ করা হয়েছে আপনার ভাগ্নেকে।

ছবিটা ভাল করে দেখলেন স্মিথ। চেনা চেনা লাগল। হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে, এই লোককে তো কাল দেখেছি। আমি বাড়ি থেকে বেরোনোর পর মোটর সাইকেলে করে পিছু নিয়েছিল। মিস্টার সাইমনের বাড়ি পর্যন্ত পিছে পিছে গিয়েছিল। তাকে জানিয়েছি এ কথা।

মুসার মনে পড়ল, আগের সন্ধ্যায় ক্যামেরা নিয়ে যখন লুকিয়ে বসেছিল, তখন গেটের কাছে মুহূর্তের জন্যে থেমেছিল একটা মোটর সাইকেল। সে কথা জানাল সবাইকে।

কিশোরের অনুমান করতে কষ্ট হলো না, সাইমনের বাড়িতে নিশ্চয় জানালার নিচে আড়ি পেতে থেকে কথা শুনেছে মোটর সাইকেল আরোহী, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের নাম শুনেছে, বুঝতে পেরেছে এরপর এখানেই আসবেন স্মিথ। তিনি কি করেন, দেখার জন্যে তাই আগেই এসে লুকিয়ে থেকেছে জঞ্জালের আড়ালে। ইনফ্রারেড-ক্যামেরা হাতে মুসাকে ওঅর্কশপে ঢুকতে দেখে আন্দাজ করে ফেলেছে, কি কাজ করেছে মুসা। নিজের ছবি উঠেছে কিনা বুঝতে না পারলেও কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি লোকটা। তর্কে তক্কে ছিল, সুযোগ বুঝে কেড়ে নিয়েছে ছবিগুলো। জানালায় আড়ি পেতে স্মিথের সঙ্গে কিশোরদের কি কথা হয়েছে, সেটাও নিশ্চয় শুনেছে। নাহলে ওঅর্কশপের দরজায় হুমকি দিয়ে নোট রেখে যেত না। তারমানে তদন্ত করতে গেলে এই লোকের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।

 জরুরী আলোচনার পর স্মিথের অফিস থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। ইয়ার্ডে ফিরল। মরুভূমিতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে হবে।

সানগ্লাস নিতে হবে, রবিন বলল, আর চওড়া কানাওয়ালা হ্যাট। মরুভূমিতে ভয়াবহ গরম। পানির ক্যান্টিনও লাগবে। আমাদের বার্থ সার্টিফিকেটের কপিও সঙ্গে নেয়া ভাল। বাই চান্স যদি মেকসিকোতে যাওয়া লাগে।

গরম কাপড়-চোপড়ও নিতে হবে, কিশোর বলল। দিনে গরম হলে হবে কি, রাতে কনকনে ঠাণ্ডা।

আজব প্রকৃতি! মুসা বলল। এই মিয়ারা, মরুভূমিতে শুনেছি ভূতের খুব দাপট, ঠিক নাকি?

আরে দূর! হাত নাড়ল কিশোর। ওসব বানানো গপ্পেী।

তবে যে বইতে লেখে…

ও কি আর সত্যি কথা লেখে নাকি? ফ্যান্টাসি গল্প।

 ভরসা কতটা পেল মুসা, তার মুখ দেখে বোঝা গেল না।

তবে পরদিন সকালে মিস্টার সাইমনের বিমানটা দেখা মাত্র উজ্জ্বল হয়ে গেল তার মুখ। প্লেন চালাতে ভাল লাগে তার। এই প্লেনটা আগেও চালিয়েছে। সে, এবার অনেক বেশি সময় চালাতে পারবে, কারণ ওদের সঙ্গে যাচ্ছে না। সাইমনের পাইলট ল্যারি কংকলিন। প্লেনটা তিন গোয়েন্দার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়েছেন সাইমন।

মালপত্র নিয়ে প্লেনে চড়ল ওরা। আকাশে উঠল নীল রঙের সুন্দর বিমানটা। প্রথম যাবে স্যান বারনাডিনোতে।

সুন্দর সকাল। নিচে সান্তা মনিকার পাহাড়ের মাথায় ঝলমলে রোদ। প্রশান্ত মহাসাগরকে লাগছে নীল চাদরের মত। গালে হাত দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ শোভা প্রাণভরে উপভোগ করতে লাগল কিশোর। মনের সুখে গান ধরল রবিন।

সাগর পেছনে ফেলে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্লেন চালাল মুসা।

স্যান বারনাডিনোতে পৌঁছে ল্যাণ্ড করার আগে বিমান বন্দরের ওপরের আকাশে বার দুই চক্কর মারল। টাওয়ারের অনুমতি নিয়ে নামতে শুরু করল। রানওয়েতে মাটি ছুঁয়েছে বিমানের চাকা, এই সময় রানওয়ের শেষ মাথায় একটা কাব বিমান চোখে পড়ল তার। তীব্র গতিতে ছুটে আসছে।

আঁতকে উঠল মুসা। খাইছে! অ্যাক্সিডেন্ট করবে তো!

ভীষণ বেকায়দা। ডানে-বাঁয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করলে বিধ্বস্ত হবে বিমান। ব্রেক করলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ওপরে তুলতে গেলে ধাক্কা লাগবে অন্য বিমানটার সঙ্গে। কি করা? গতি না কমিয়ে সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিল সে। আস্তে আস্তে ব্রেক করবে। আর কোন উপায় নেই।

 ব্যাপারটা কিশোর আর রবিনের চোখেও পড়েছে। হাঁ করে তাকিয়ে। আছে। ভয়ে হৃৎপিণ্ডটাও স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন। মুসার ক্ষিপ্রতা আর উপস্থিত বুদ্ধিই কেবল এখন বাঁচাতে পারে ওদের।

ধাক্কা লাগে লাগে, শেষ মুহূর্তে নাক উঁচু করে আকাশে উড়ল কবি। ব্রেক কষল মুসা। ওদের মাথার ওপর দিয়ে বিমানের প্রায় পিঠ ছুঁয়ে গেল অন্য বিমানটার চাকা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই।

বাচলাম! গলা কাঁপছে মুসার। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে।

প্লেন থামতে এগিয়ে এল একজন পাইলট। মুসা নামার সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল। দারুণ সামলেছ হে। খুব ভাল পাইলট তুমি। দোষ ওই গাধাটার। অফিসে গিয়ে একটা কমপ্লেন করে রাখো। বলা যায় না, তোমার দোষ দেখিয়ে রিপোর্ট করে বসতে পারে ও। আগেই তৈরি থাকো।

কিন্তু কবিটার রেজিস্ট্রেশন নম্বর লক্ষ করেনি কেউ। ওড়ার আগে টাওয়ারের অনুমতিও নেয়নি পাইলট।

 সেদিন আর মরুভূমিতে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না গোয়েন্দাদের। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে উঠল।

পরদিন সকালে এল আবার। বিমান বন্দরের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কাটা নিয়ে সেই পাইলট ফিরে আসেনি।

মরুভূমির উদ্দেশে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা।

এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়া কলোরাডো নদীর রূপালী পানি চোখে পড়তে কিশোর বলল, মুসা, নিচে নামাও। ভালমত নজর রাখতে হবে। তার কোলের ওপর ক্যালিফোর্নিয়া, মরুভূমি আর অ্যারিজোনার তরাই অঞ্চলের একটা ম্যাপ বিছানো।

ওই দেখো! ডানে হাত তুলে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। একটা দানব!

দেখা গেল একশো ফুট খাড়া উঠে যাওয়া একটা পাহাড়ের দেয়ালের কিনারে আঁকা হয়েছে বিশাল ছবিটা। দেয়ালের কাছে প্লেন নিয়ে গেল মুসা। চক্কর দিতে লাগল একজায়গায়। বলল, আরেকটা পা কি হলো দানবের? ভূতে খেয়ে ফেলল নাকি?

ক্ষয় হয়ে গেছে কোন কারণে, বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। ওটার পাশে দেখো আরেকটা ছোট মূর্তি। আশপাশের ওই রেখাগুলো কি?

বড় ছবিটার পাশে ওটার অর্ধেক বড় আরেকটী ছবি। রেখাগুলো তার বড় ভাইয়ের চেয়ে অনেক গভীর করে কাটা হয়েছে। তাই মুছেও যায়নি, ফুটেও উঠেছে অনেক স্পষ্ট হয়ে।

মাঝের ডিজাইনটা ক্রসের মত লাগছে, রবিন বলল।

একে বলে মালটিজ ক্রস, রেফারেন্স বইতে এ ধরনের রেখাচিত্রের ছবি দেখেছে কিশোর। পুরানো ইউরোপিয়ান ডিজাইন। নাইটস অভ মালটা নামে। একটা ক্রসেডর গ্রুপের স্মারকচিহ্ন এটা।

কিন্তু ইনডিয়ানরা নাকি এঁকেছে এই ছবি? প্রশ্ন করল মুসা।

সেটাও একটা ধারণা মাত্র, জবাব দিল রবিন। ইতিমধ্যে এই নকশী নিয়ে বেশ কিছু অধ্যায় পড়ে ফেলেছে সে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এই চিহ্ন প্রমাণ করে প্রাচীন স্প্যানিশ ভ্রমণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল ইনডিয়ানদের। আসলে, কেউই ঠিক করে বলতে পারে না কারা একেছিল এই ডিজাইন, কেন এঁকেছিল। এরিক ফন দানিকেন নামে একজন সুইস পুরাতাত্ত্বিকের বিশ্বাস, মহাকাশ থেকে নেমে আসা ভিনগ্রহবাসীর এঁকেছে এই ছবি। কিংবা তাদের নির্দেশে ইনডিয়ানরা এঁকেছে। স্পেশশিপ নিয়ে নামার সময় এই চিহ্ন দেখে বুঝতে পারত প্রাচীন সেই ভিনগ্রহবাসীরা, কোথায় নামতে হবে। যেহেতু আকাশ থেকে আগুনের রথে চেপে নামত ওরা, ইনডিয়ানরা ভাবত দেবতা।

তারমানে ভূতের কথাটা একেবারে মিথ্যে বলিনি! কেঁপে উঠল মুসার গলা। আমার তো ধারণা ভূতে গাপ করে দিয়েছে লফার আর তার বন্ধুকে!

তোমার মাথা! অধৈর্য স্বরে বলল কিশেয়। যত্তসব অবাস্তব ধারণা!

নদীর এ পাড়ে আর কোন ছবি দেখা গেল না। অন্য পাড়ে প্লেন নিয়ে এল। মুসা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখে পড়ল আরেকটা দানব। আরও এগোতে বোঝা গেল, একটা দানবীয় কুকুরের ছবি আঁকা হয়েছে।

এখানেই প্লেন নামিয়েছিল লফার, কিশোর বলল।

আশ্চর্য! দেখতে দেখতে বলল রবিন। এত নিখুঁত, দানিকেনের কথাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে! মাটিতে দাঁড়িয়ে এই জিনিসের আকৃতি বুঝল কি করে শিল্পী? একমাত্র আকাশ থেকে দেখেই বোঝা সম্ভব!

খানিকটা এগিয়ে আরেকটা মানুষাকৃতির দানব আর ঘোড়ার ছবি দেখা গেল।

অনেকক্ষণ দেখেটেখে কিশোর বল, এবার ফিরে যাওয়া যায়।

ম্যাপে দেখা গেল, কাছাকাছি বিমান বন্দর রয়েছে রিভারসাইড কাউন্টিতে। সেখানে নেমে গাড়িতে করে ব্লাইদিতে যেতে হবে।

বিমান বন্দরের ওপরে এসে রেডিওতে নামার অনুমতি চাইল মুসা। অনুমতি পাওয়া গেল। নিখুঁত ভাবে ল্যাণ্ড করল সে। ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে গেল হ্যাঁঙ্গারের দিকে। আগের দিনের মত কোন অঘটন ঘটল না।

প্লেন থেকে নেমে এসে একটা কেবিনে ঢুকল গোয়েন্দারা। চেয়ারে বসে হতি-পা ছড়িয়ে আরাম করছে, এই সময় এগিয়ে এল রুক্ষ চেহারার ছিপছিপে এক লোক। নিজেকে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন এজেন্সির লোক বলে পরিচয় দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মধ্যে পাইলট কে? কে প্লেনটা চালাচ্ছিলে?

অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। মুসা জবাব দিল, আমি। কেন?

 লাইসেন্স দেখি?

বের করে দিল মুসা।

লাইসেন্সটা খুঁটিয়ে দেখল লোকটা। কোন খুঁত পেল বলে মনে হলো না। মাথা দুলিয়ে বলল, হু, তোমাকেই খুঁজছি। আচমকা কর্কশ হয়ে গেল কণ্ঠস্বর, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে!

.

০৩.

ব্যাপার কি বলুন তো? জানতে চাইল রবিন।

জবাব দিল না বোকটী! মাথা নেড়ে মুসাকে তার সঙ্গে যেতে ইশারা করল। মুসা উঠছে না দেখে তার হাত চেপে ধরে টান দিল।

তাকে প্রায় টেনে নিয়ে চলল, লোকটা। রবিনকে মালপত্রের পাহারায় বসিয়ে রেখে পিছে পিছে চলল কিশোর।

কেবিন থেকে দূরে ছোট একটা বিল্ডিঙের একটা অফিস ঘরে মুসাকে নিয়ে এল লোকটা। কিশোরও ঢুকল সঙ্গে। ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন। গোলগাল চেহারার এক ভদ্রলোক। একটা টাইপরাইটার নিয়ে যেন কুস্তি করছেন। রোলারের এ মাথার নব ধরে একবার টানছেন, ওমাথার নব ধরে একবার। নড়াতেও পারছেন না, সরাতেও পারছেন না।

হেসে এগিয়ে গেল কিশোর। বলল, মনে হয় এ জিনিস আর ব্যবহার করেননি? দিন, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

একটা লিভার টিপল সে। ফ্রী হয়ে গেল রোলার। সরাতে আর অসুবিধে হলো না।

বাহ, এত সহজ? ভারি গলায় বললেন ভদ্রলোক। থ্যাংক ইউ। মুসার দিকে তাকিয়ে ছিপছিপে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ও কে?

স্যার, সেই প্লেনটার পাইলট। স্যান বারনাডিনোতে অ্যাক্সিডেন্ট করছিল। আরেকটু হলেই।

ইশারায় মুসা আর কিশোরকে বসতে বললেন চেয়ারে বসা ভদ্রলোক। মুসার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সুরে বললেন, তোমার লাইসেন্স ক্যানসেল হয়ে যাবে। সরি, কিছু করার নেই। আকাশের নিরাপত্তার দিকে কড়া নজর রাখতে হয় আমাদের।

ভুরু কুঁচকে গেল মুসার। কিন্তু আমি তো কিছু করিনি..

কিশোর বলল, মনে হয় ভুল ইনফরমেশন পেয়েছেন আপনারা। দোষ ওর নয়, দোষ অন্য বিমানটার। স্যান বারনাডিনো থেকে নিশ্চয় ফোনে। যোগাযোগ হয় আপনাদের? লং ডিসট্যান্স কলে ভুল শোনা যেতেই পারে। দয়া করে আরেকবার যোগাযোগ করুন। টেলিটাইপ করে মেসেজ পাঠাতে অসুবিধে আছে?

না, নেই, মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। এখুনি করছি। আমি হারল্ড ডিক্সন, এই এয়ারপোর্টের ম্যানেজার। ছিপছিপে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিল, যাও তো, মেসেজ পাঠাও।

মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল বিল।

এখানে কেন এসেছে ওরা, জানাল কিশোর।

মার্টি লফারের নিখোঁজ সংবাদ ডিক্সনও জানেন। বললেন, জানি। মাস তিনেক আগে মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছে, কোন চিহ্নই পাওয়া যায়নি। তোমরা কোন খোঁজ পেয়েছ?

না, মাথা নাড়ল কিশোর। এবং আমরা তার খোঁজ করি এটাও কেউ একজন চায় না। জঞ্জালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় লোকটার কথা। বলল সে। এমনও হতে পারে, লং ডিসট্যান্স কলের জন্যে গণ্ডগোল হয়নি, ফোনে আপনাদের দেয়াই হয়েছে ভুল খবর, যাতে লাইসেন্স কেড়ে নিয়ে আটকে দেন আমাদের। তদন্ত চালাতে না পারি।

খবর আসতে কতক্ষণ লাগবে, স্যার? অধৈর্য হয়ে পড়ল মুসা। পেট যে জ্বলে গেল খিদেয়! লাইসেন্স ক্যানসেলের সঙ্গে কি খাওয়াও ক্যানসেল করে দেয়া হবে নাকি?

হেসে ফেললেন ম্যানেজার। ভাল কথা মনে করেছ। আমারও খিদে পেয়েছে। একটু বসো, খবরটা শুনেই যাই। আমিও বেরোব। ইচ্ছে করলে আমার গাড়িতে একটা লিফট নিতে পারো। শহরে পৌঁছে দেব।

রবিনকে ডেকে আনতে গেল কিশোর।

মালপত্রের বোঝা নিয়ে ওরাও ঢুকল অফিসে, বিলও মেসেজ নিয়ে ফিরে এল। চেহারার কঠোর ভাবটা চলে গেছে তার। বলল, মুসার দোষ নয়, স্যার। ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে আমাদের। এ রকম একটা শয়তানি কে করল বুঝতে পারছি না!

কে আর করবে! বিড়বিড় করল মুসা। যে আমার মাথায় বাড়ি মেরেছে…

পায়ে লাথি দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিল কিশোর। বিলকে সব কথা শোনাতে চায় না। কার মনে কি আছে কে জানে!

অবশেষে ছাড়া পেল মুসা। অফিস থেকে বেরোল ওরা। আটটা বাজে। আকাশের রঙ উজ্জ্বল নীল। মরুভূমির ওপরে শুকনো পর্বতের ঢালে বড় বড় ছায় নামছে। খানাখন্দগুলো অন্ধকার হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, কালচে-নীল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে পর্বতের গায়ে কালি ঢেলে দিয়েছে যেন কেউ।

কি একখান আকাশ! মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে বলল রবিন। পর্বতটাকে এত বড় লাগছে কেন বলো তো?

বাতাস খুব পরিষ্কার বলে, জবাব দিল কিশোর।

মাখন রঙা একটা চকচকে কনভারটিবল গাড়ির কাছে ওদেরকে নিয়ে এলেন ডিক্সন। উঠতে বললেন।

সামনে বসল রবিন আর কিশোর। পেছনে ওদের মালপত্রের গাদার পাশে মুসা। শহরে রওনা হলেন ডিক্সন।

জানালা দিয়ে ঢুকছে উষ্ণ, অস্বাভাবিক কোমল বাতাস। গালে, মুখে লাগছে। তজ্জিব করে দিল গোয়েন্দাদের। সূর্যাস্তের সময়ও বাতাস বড় বেশি শুকননী, বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই। শিশিরের কোন লক্ষণই নেই বাতাসে।

আমি তো জানতাম মরুভূমিতে রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়ে, ডিক্সনের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন।

গরমকালে পড়ে না এখানে, জবাব দিলেন ম্যানেজার। বেডরোল ছাড়াই বাইরে ঘুমাতে পারবে, শীত লাগবে না। মরুভূমিতে ঘুমানোর কথা ভাবছ নাকি?

পরে, কিশোর বলল। আজ রাতে শহরেই থাকব। ভাল জায়গা আছে না?

আছে।

নতুন একটা মোটেলের ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকালেন ডিক্সন। ঘোড়ার খুরের আকৃতিতে তৈরি বিল্ডিং। সাদা রঙ করা। সুইমিং পুলে গাঢ় নীল পানি। তীরে কয়েকজন লোক। ডাইভ দিয়ে পড়লেই পানি ছিটকে উঠছে।

পানি দেখে গা শিরশির করে উঠল মুসার, তখুনি ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করল। চমৎকার একটা রেস্টুরেন্টও চোখে পড়ল তার।

নিচতলায় ঘর নিল ওরা। ব্যাগ-সুটকেসগুলো ওখানে রেখে দশ মিনিটের মধ্যে এসে ঝাঁপ দিল পুলের পানিতে। গোসল সেরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে গলা পর্যন্ত গিলল।

পরদিন সকালে কিশোর বলল খবরের কাগজের অফিসে যাবে। ব্লাইদির একমাত্র কাগজ Daily Enterprise-এর অফিসে হানা দিল ওরা, লফারের নিখোঁজ হওয়ার খবরটা পড়ার জন্যে।

সাইমন বলেন: গোয়েন্দাদের বন্ধু খবরের কাগজ আর পুলিশ, প্রচুর উপকার পাওয়া যায় তাদের কাছে। প্রথমে খবরের কাগজের অফিসে এল তিন গোয়েন্দা।

পুরানো কাগজে লফার আর ব্রাউনের নিরুদ্দেশের খবর ছাপা হয়েছে, কিন্তু তাতে নতুন কিছু পেল না কিশোর, কেবল রিপ্লির কাছে বিশাল এক দানবের কাছে ওদের প্লেন ল্যাণ্ড করার খবরটা ছাড়া।

পুলিশের কাছে যাবে? জানতে চাইল রবিন।

যাব।

রাইদি পুলিশের কাছেও ভিকটর সাইমন নামটা অপরিচিত নয়, তার সুখ্যাতি তাদের কানেও পৌঁছেছে। তার ওপর তিন গোয়েন্দার কাছে রয়েছে। ইয়ান ফ্লেচারের দেয়া সার্টিফিকেট। সুতরাং রাইদির পুলিশ চীফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অসুবিধে হলো না।

তিনিও নতুন কোন তথ্য দিতে পারলেন না। বললেন, তোমরা যতটা জানো, আমিও ততটুকুই জানি। নতুন কিছু বলতে পারছি না।

হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। রাইদির প্রধান রাস্তা হবসনওয়ে ধরে এগোল।

কিশোর, এক কাজ করা যাক, হঠাৎ বলে উঠল রবিন, মুসা হবে মার্টি লফার, তুমি আর আমি লুক ব্রাউন!

খাইছে! পাগল হয়ে গেলে নাকি? অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল মুসা। মরুর ভূতে আসর করেনি তো

তার কথা এড়িয়ে গিয়ে উত্তেজিত স্বরে রবিন বলল, তুমি প্লেন চালাবে। আমি আর কিশোর হব যাত্রী…

তাই তো করছি। এতে আর নতুন কথা কি?

এবারও মুসার কথায় গুরুত্ব দিল না রবিন। লফাররা যে পথ ধরে উড়ে গেছে, আমরাও সেই পথ ধরে যাব। শেষবার রিভারসাইড কাউন্টি থেকে উড়েছিল ওরা। ডিক্সনের কাছে ওদের ফ্লাইট চার্ট পাওয়া যাবে। আকাশ থেকে একই জিনিস দেখব, একই জায়গায় ল্যাও করব। হয়তো কিছু বোঝা যাবে।

তা যাবে! বিড়বিড় করল মুসা। বুঝব, কি করে গায়েব হয় মানুষ। কারণ আমরাও তো হব!

কিশোর বলল, রবিন কিন্তু মন্দ বলেনি। গায়েব যদি হইই, তাহলে তো আরও ভাল। রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। বুঝে যাব কি ভাবে গায়েব হয়েছে। লফাররা।

তার জন্যে অত কষ্ট করার দরকার কি? আমাকে জিজ্ঞেস করো, বলে দিচ্ছি। ভিনগ্রহ থেকে স্পেসশিপ এসে তুলে নিয়ে গেছে ওদের। আমি বাবা পৃথিবীতেই ভাল আছি, অন্য কোন গ্রহে যেতে রাজি না। আল্লাহই জানে ওরা ওখানে কি খায় না খায়!

মোটেলে ফিরে তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আবার তিন গোয়েন্দা। ট্যাক্সি নিয়ে চলল রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে।

কড়া রোদ বাড়িটার সাদা দেয়ালে পড়ে ঠিকরে আসছে, চোখে লাগে। দাঁড়িয়ে থাকা বিমানগুলোর ডানা চকচক করছে। চওড়া কানওয়ালা হ্যাট পরেছে কিশোর আর রবিন। মুসা মাথায় দিয়েছে খড়ের তৈরি একটা মেকসিকান সমরেরো হ্যাট।

বাপরে বাপ, কি গরম! বলল সে। একশো আট ডিগ্রি। এয়ারপোর্টের থার্মোমিটারে দেখলাম।

ও তো কিছুই না, রবিন বলল। গরমের দিনে দুপুরবেলা নাকি বালি তেতে একশো পঁয়ষট্টি ডিগ্রি হয়ে যায়। এর মধ্যে হাঁটা লাগলে বুঝবে। ঠেলা।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। খাইছে! বলো কি! তাহলে বেরোলাম কেন? মোটেলের পুলই তো আরামের ছিল।

আরাম করতে তো আসিনি আমরা, মনে করিয়ে দিল কিশোর। এসেছি মাটি লফারের খোঁজে। মনে রেখো, খরচটা বহন করছেন তার মামা।

প্লেনের দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মুসা। ভেতরে বদ্ধ বাতাস আগুনের মত গরম হয়ে আছে। সেটা বেরিয়ে যাওয়ার সময় দিল।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতে অফিসে গেল কিশোর।

কয়েক মিনিট পর আকাশে উড়ল নীল বিমানটা। এয়ারপোর্টের ওপর একবার চক্কর দিয়ে উত্তরে মরুভূমির দিকে নাক ঘোরাল মুসা।

মুগ্ধ হয়ে নিচের দৃশ্য দেখতে লাগল ওরা। আকাশের ছায়া পড়েছে। কলোরাডো নদীতে, আকাশের মতই নীল। তীরে অপূর্ব সুন্দর হলদে পাতাওয়ালা টামারিস্ক গাছের সারি। এক তীরে শস্য খেত, অন্য তীরে শুকনো টিলা-টক্কর, মালভূমি আর পাহাড়।

মরুভূমি শুনে আমি ভেবেছিলাম শুধু বালি আর পাথরের পাহাড় দেখতে পবি, রবিন বলল। কিন্তু এ কি দেখছি! এত সুন্দর!

বালিই ছিল এককালে, কিশোর বলল। ওই খালগুলো দেখছ না? নদী থেকে পানি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে ওগুলো দিয়ে। মাটি ভিজিয়ে ফসল ফলিয়েছে।

এক জায়গায় বড় একটা নিঃসঙ্গ দানব আঁকা আছে, আগের দিনই দেখে গেছে। সেটার কাছে এসে ভাল করে দেখার জন্যে নিচুতে বিমান নামিয়ে। আনল মুসা।

একটা টিলা আছে। প্রায় একশো ফুট উঁচু। একধারে খুবই খাড়া, আরেক ধীর ঢালু। ঢালু ধারটার কাছে সমতল জায়গায় বিমান নামানো সম্ভব। ল্যাণ্ড করল মুসা।

বিমান বন্দর থেকে আনা ফ্লাইট চার্ট দেখে রবিন বলল, এখানেই ল্যাণ্ড করেছিল লফাররা। তারপর কি করেছে?

 হয়তো গিয়ে ওই টিলাটার ওপর উঠেছে, কিশোর অনুমান করল, চারপাশটা দেখার জন্যে।

বিমান থেকে নেমে এসে টিলাটায় উঠল ওরা। ওপরটা সমতল, অনেকটা মালভূমির মত। রুক্ষ, কঠিন মাটি চারপাশে, তাতে বিছিয়ে আছে নুড়ি পাথর। এখানে ওখানে দু-চারটা ছোট ছোট শুকনো ঝোপ। বিরান প্রকৃতি।

দেখো, একটা রাস্তা, মুসা বলল, রাস্তাটা কি অদ্ভুত! মনে হয় কেউ যেন ঝড় দিয়ে নুড়ি সরিয়ে তৈরি করেছে।

রাস্তা না ওটা, রবিন বলল। একটা দানবের পা।

চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। বলল, ভাবছি, এই টিলা মানুষের তৈরি নয়তো? প্রাচীন ইনডিয়ানরাই কি বানিয়েছিল চূড়ার ওপর ছবি আঁকার জন্যে?

হতে পারে, সমর্থন করল রবিন। আর দানবের অবস্থানটারও হয়তো কোন মানে আছে।

টিলাটার ওপর ঘুরে বেড়াতে লাগল ওরা। যত দিক থেকে সম্ভব দেখছে।

আচমকা দাঁড়িয়ে গিয়ে রবিন বলল, লফার যদি এখানে উঠে থাকে, কি পড়েছিল তার চোখে?

রবিনের পাশে দাঁড়িয়ে মুসাও দেখতে লাগল।

দানবের বাঁ হাতটীর ওপর দাঁড়িয়ে মরুভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। কিশোর। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ওই দেখো কি চকচক করছে।

ধাতব কিছু? রবিনের প্রশ্ন।

চলো না গিয়েই দেখি।

ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল কিশোর, পেছনে তার দুই সহকারী। ঢালের গোড়ায় পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল সে। পরক্ষণে লাফ দিয়ে পিছিয়ে। এল। চিৎকার করে বলল, খবরদার!

.

০৪.

মাথা তুলল প্রায় দুই ফুট লম্বা একটা গিরগিটি। ভীষণ রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে কিশোরের দিকে। সাপের জিভের মত চেরা লাল একটা জিভ ভয়ানক ভঙ্গিতে বার বার বেরোচ্ছে মুখের ভেতর থেকে।

আরেকবার লাফ দিয়ে আরও পিছিয়ে এল কিশোর। মূসা আর রবিন দাঁড়িয়ে গেছে। তাকিয়ে আছে গিরগিটিটার দিকে। চামড়ার রঙ কালচে বেগুনী। তাতে হলুদ রঙের গোল গোল ছাপ। সারা শরীরে অসংখ্য আঁচিলের মত জিনিস কুৎসিত করে তুলেছে প্রাণীটাকে।

খাইছে! ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার চোখ। কি এটা? কুমিরের বাচ্চার ব্যারাম হয়েছে?

হিলা মনস্টার, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। জোরে দৌড়াতে পারে না বটে, তবে দাঁতের নাগালে পেলে সর্বনাশ করে দেবে। সাংঘাতিক বিষাক্ত।

থেমে গেল গিরগিটিটা। ঠাণ্ডা, কুৎসিত চোখ মেলে দেখছে গোয়েন্দাদেরকে।

আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে, হেসে বলল রবিন।

সার্থক হয়েছে তার চেষ্টা, মুসা বলল। ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেছে। আমার। এমন ভূতুড়ে জানোয়ার জনমেও দেখিনি। দাঁড়িয়ে থাকব কতক্ষণ। নড়লেই তো মনে হচ্ছে নড়ে উঠবে!

উঠুক। না দেখে গায়ে পা দিয়ে ফেললে বিপদ, কামড়ে দিতে পারে, কিশোর বলল। দেখে যখন ফেলেছি, আর কিছু করতে পারবে না। দৌড়ে পারবে না আমাদের সঙ্গে। তবে সাবধান যে করে দিয়েছে, এ জন্যে একটা ধন্যবাদ ওর পাওনা। ওর জাতভাইরা আরও অনেক আছে এই অঞ্চলে। বালি আর ঝোপের মধ্যে চুপ করে পড়ে থাকলে চোখে পড়বে না। ভুল করে পা দিয়ে ফেললেই মরব। সুতরাং, সাবধান!

কয়েক মিনিট একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ফোঁস ফোঁস করল হিলা মনস্টার। বিপদের আশঙ্কা নেই দেখে ঘুরল। অলস ভঙ্গিতে হেলেদুলে আস্তে আস্তে গিয়ে ঢুকে পড়ল একটা ঝোপে।

আবার পা বাড়াল তিন গোয়েন্দী। এগিয়ে চলল চকচকে জিনিসটার দিকে। হাঁটছেই, হাঁটছেই, কিন্তু জিনিসটার কাছে পৌঁছতে পারার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না। আশ্চর্য!

পায়ে মোকাসিন পরেছে ওরা। তলা ফুড়ে যেন উঠে আসছে তপ্ত বালির ভয়ানক উত্তাপ।

রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে মুসা বলল, বাপরে বাপ, হিলা মনস্টারের বাচ্চা এই বালিতে হাঁটে কি করে! পায়ে কিসের চামড়া লাগানো!

কিসের আর, ওরই চামড়া, কিশোর বলল। গরম বালিতে চলার উপযোগী করেই বানিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি।

কিন্তু ওই চকচকে জিনিসটা কাছে আসে না কেন? ভূতুড়ে কাণ্ড মনে হচ্ছে!

ভূতটা আসলে বাতাস। বেশি হালকা বলে এখানে অনেক দূরের জিনিসও কাছে মনে হয়।

অবশেষে পৌঁছল ওরা ওটার কাছে। গোল একটা জিনিস রোদে পড়ে চমকাচ্ছে।

তুলে নিল রবিন। বড় একটা পাথর, তাতে ছোট ছোট অন্য পাথর গাঁথা। কোনটী গাঢ় লাল, কোনটা বাদামী, কিছু আছে সবুজ। নাড়াচাড়ায় গায়ে রোদ পড়লেই ঝিক করে উঠছে পাথরগুলো।

কিশোরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে, কি এটা, বলো তো? কোন ধরনের স্ফটিকের সমষ্টি?

সম্ভবত জ্যাসপার।

 মুসা জানতে চাইল, দামী জিনিস? হীরার মত?

হীরার মত অত দাম না হলেও, দামী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আশেপাশে খুঁজল ওরা। ওরকম পাথর আর একটাও পাওয়া গেল না।

অবাক কাণ্ড! রবিন বলল। এটী এখানে এল কোত্থেকে?

মাটির দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে নিজেকেই প্রশ্ন করল, এর সঙ্গে লফারের নিখোঁজের কোন সম্পর্ক নেই তো?

বুঝতে পারল না মুসা। মানে?

এখানে জন্মালে এ রকম পাথর আশেপাশে আরও থাকার কথা। নেই কেন?

হয়তো ছিল, রবিন বলল। আকাশ থেকে চোখে পড়েছে লফার আর ব্রাউনের। এগুলোর জন্যেই নেমেছিল ওরা। তুলে নিয়েছিল।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছি আমি। সবই নিয়ে গেছে, কিন্তু এই একটা কোনভাবে রয়ে গেছে এখানে। হয়তো কাড়াকাড়ির সময় পড়ে গেছে। সেজন্যেই লফার আর ব্রাউন নিখোঁজ।

অস্বস্তি ফুটল মুসার চোখে। কিশোরের কথা এতক্ষণে বুঝেছে। আচ্ছা, বুঝলাম! ওদেরকে খুন করে পাথরগুলো ডাকাতেরা কেড়ে নিয়ে গেছে সন্দেহ করছ! মরুভূমিতে লাশ গুম করে ফেলেছে।

করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই, রবিন বলল। দামী পাথরের জন্যে মানুষ খুন হওয়াটা নতুন কিছু নয়।

উফ, কি রোদরে বাবা! সিদ্ধ হয়ে গেলাম! মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল কিশোর। এখানে আর দেখার কিছু নেই। চলো, প্লেনে গিয়ে বসি।

প্লেনের দিকে হাঁটতে লাগল ওরা। মনে হচ্ছে কাছে, অথচ যতই হাঁটে, পথ আর ফুরায় না।

ভারী পাথরটা নিয়ে হাঁটতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে গেল রবিন। তা দেখে মুসা বলল, দেখি, দাও আমার কাছে।

পাথরটা মুসার হাতে তুলে দিয়ে বাঁচল রবিন।

কিছুদূর এগিয়ে মুসারও হাঁপ ধরে গেল। বলল, খাইছে! এটী পাথর না লোহারে বাবা! দশ টন ওজন হবে!

তার কথা শেষ হতে না হতেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ওই দেখো, হিলা মনস্টার!

কই, কোথায়! এতটাই চমকে গেল মুসা, হাত থেকে ছুটে উড়ে গিয়ে পড়ল পাথরটা। লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ল সে।

তবে অত চমকানোর কিছু ছিল না। বেশ দূরে রয়েছে গিরগিটিটা। ওদের দিকে তাকাল না। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ঢুকল একটা ঝোপের মধ্যে।

কিন্তু পাথরটা আর দেখতে পেল না ওরা। গেল কোথায়?

ওটাতে পড়ল না তো? একটা গর্ত দেখিয়ে বলল রবিন।

গর্ত না বলে সরু একটা ফাটল বলা উচিত। বেশ গভীর। দেখা গেল, তার মধ্যেই পড়েছে পাথরটা। তুলতে কষ্টই হলো। সাবধান থাকতে হলো হিলা মনস্টারের ব্যাপারে। গর্তে থাকলে কামড়ে দিতে পারে। আর কামড়ালে মরতে হবে।

মুসা কিছুক্ষণ বহন করার পর পাথরটার ভার নিল কিশোর। ভাগাভাগি করে বয়ে এনে প্লেনে তোলা হলো ওটাকে।

রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছল ওরা, বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে।

পেটের মধ্যে নাড়িভূড়িও নেই আর আমার, ঘোষণা করল মুসা। এখন গিয়ে সুইমিং পুলে কয়েকটা ডুব, তারপর পেট ভরে গরুর শিককাবাব

ম্যানেজার হারল্ড ডিক্সনকে এগিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল সে।

কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, তারপর? কেমন কাটল? কি দেখে এলে?

হিলা মনস্টার, জবাব দিল মুসা।

হাসলেন ডিক্সন। ও আর এমন কি। কিছুদিন একটা মনস্টার পুষেছিলাম আমি। বাসন থেকে দুধ খেত ওটা। বেড়ালের মত এসে আমার কোলে উঠত।

বলেন কি! ঢোক গিলল মুসা। ওই কুৎসিত প্রাণীটাকে ধরতে খারাপ লাগত না আপনার?

না, লাগত না। ওটাকে শিস দিতে শিখিয়েছিলাম। বেশিদিন আটকে রাখিনি। ছেড়ে দিয়েছি মরুভূমিতে।

পাথরটা দেখাল তাঁকে রবিন। এটা পেয়েছি।

ডিক্সন বললেন। মরুভূমিতে গেলে এ সব পাথর অনেকেই পায়। আমরা। একে বলি চাইনিজ জেইড।

দামী?

আছে। মোটামুটি।

আপনার কি মনে হয়, এই পাথরের জন্যে ডাকাতেরা মানুষ খুন করবে? আকাশ থেকে এ সব দেখেই হয়তো নেমেছিল লফার আর ব্রাউন। তারপর ওগুলোর জন্যে খুন হয়েছে। হতে পারে না?

 চাইনিজ জেইডের জন্যে মানুষ খুন হয়েছে এই এলাকায়, শুনিনি কখনও।

তাহলে হয়তো পাথর দেখে কৌতূহলী হয়ে নেমেছিল ওরী, মরুভূমিতে পথ হারিয়েছে। কিংবা জখম হয়ে পর্বতের মধ্যে আটকা পড়েছে।

শ্রাগ করলেন ডিক্সন। জখম হলে একজন হবে, দু-জন হওয়াটা অস্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে আরেকজন প্লেন চালিয়ে নিয়ে আসতে পারত। আর পর্বতে গেলে টিলার কাছে প্লেন ফেলে যাবে কেন? মরুভূমিতে হাঁটীর চেয়ে। প্লেন নিয়ে যাওয়াই সহজ।

তা-ও বটে। চুপ হয়ে গেল রবিন।

কিশোর জানতে চাইল, লফারের প্লেনটা এখন কোথায়? জানেন?

আমাদের এখানেই, জবাব দিলেন ডিক্সন।

 একটু দেখা যাবে?

হেসে বললেন ডিক্সন, সূত্র খুঁজতে চাও তো? ওদিককার হ্যাঁঙ্গারে আছে। পকেট থেকে চাবি বের করে দিলেন। নাও। দেখা হয়ে গেলে ফেরত দিয়ে যেয়ো।

ম্যানেজারকে ধন্যবাদ দিল কিশোর। পাথরটা আবার প্লেনের ভেতরে রেখে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। দুই সহকারীকে নিয়ে রওনা হলো হাঙ্গীরের দিকে।

লাল আর সাদা রঙের একটা সুন্দর বিমান লফারের। চার সীট। কেবিনের একদিকের দরজা হাঁ হয়ে খুলে আছে।

ব্যাপারটা অবাক করল রবিনকে। দরজা লাগায়নি কেন?

 তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কেউ।

ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলে খুঁজতে লাগল কিশোর। মুসা গেল মালপত্র রাখার জায়গায়। গ্লীভ কম্পার্টমেন্টে হাত দিল রবিন। হলদে রঙের একটুকরো কাগজ পেল। পেন্সিলে লেখা নোটটার দিকে একনজর তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল। সে, অ্যাই, দেখে যাও!

কাগজটাতে কবিতার মত করে লেখা:

তিন গোয়েন্দা সাবধান;

গোলাপের রঙ লাল,
ভায়োলেটের রঙ নীল,
লফারকে কবর দিয়েছি আমরা।
সময়মত না যদি সরো
সেথায় যাবে তোমরাও!

.

০৫.

শিস দিয়ে উঠল মুসা, কোন ব্যাটার কাজ!

হবে কোন বদমাশ! জবাব দিল রবিন।

রসিক বদমাশ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এই নোটের কথা ডিক্সনকে বলার দরকার নেই। তবে দরজা খোলা পাওয়া গেছে, এটা জানাতে হবে তাকে। দরজা যে খুলেছে, নোটটা সে-ই রেখে গেছে।

কিন্তু কখন রাখল? নিশ্চয় রাতের বেলা এক ফাঁকে ঢুকে রেখে গেছে। জানত, কোন না কোন সময় বিমানটাতে তল্লাশি চালাতে আমরা আসবই।

তার মানে আমাদের গতিবিধির ওপর পুরো নজর আছে ওর। কাগজটা যত্ন করে পকেটে রেখে দিল কিশোর। মিস্টার সাইমনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। চলে রেখে দিল কিশোর পর পুরো নজর আছে

ডিক্সনকে চাবি ফিরিয়ে দিল কিশোর। বিমানটাতে লোক ঢুকেছিল। জানাল। তারপর মোটেলে ফিরে ফোন করল রকি বীচে সাইমনের বাড়িতে।

ফোন ধরল কিম। জানাল, মিস্টার সাইমন বাড়িতে নেই। জরুরী কাজে বাইরে গেছেন। কোথায় গেছেন, তা-ও বলতে পারল না। তিন গোয়েন্দার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গেছেন।

মেসেজটা কিমকে পড়তে অনুরোধ করল কিশোর।

কিম পড়ল, রাইদি থেকে চলে এসো। লস অ্যাঞ্জেলেসে এসে তদন্ত করো। হোটেলে থাকবে, বাড়ি ফেরার দরকার নেই। লফারের অফিস আর তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজখবর নাও। আশা করছি, শীঘ্রি তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। ভিকটর সাইমন।

পরদিন সকালে মালপত্র গোছগাছ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল তিন। গোয়েন্দা।

মোটেলের ম্যানেজার বলল, এত তাড়াতাড়িই চলে যাচ্ছ?

হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। জায়গাটা ভাল লাগল না। দেখার তেমন কিছু নেই।

সব ঠিকঠাক মত নিয়েছ? ফেলে যাওনি তো কিছু? গেলে দয়া করে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। এই যে রইল, ঠিকানা।

ঠিক আছে।

প্লেনে করে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসতে বেশি সময় লাগল না। বিমানটা এয়ারপোর্টে রেখে ট্যাক্সি করে এসে শহরের একটা পুরানো হোটেলে উঠল ওরা।

জানালা খুলে বাইরে মুখ বের করে দিল মুসা। বলল, ফায়ার-এসকেপ আছে। আগের দিনে যেমন বানাত লোকে।

থাকবেই, রবিন বলল। বাড়িটা বানানো হয়েছে অনেক দিন আগে।

গোসল সেরে খেয়ে নিল ওরা। মুসা জিজ্ঞেস করল, এবার কি করব? কিশোর, মিস্টার ক্রিস্টোফারের দেয়া সেই পাসগুলো তো কোনদিন কাজে লাগল না। এবার লাগালে কেমন হয়?

এক সময় তিনটে পাস দিয়েছিলেন, তিন গোয়েন্দাকে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার। ওগুলো দেখিয়ে যখন তখন হলিউড কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেসের যে কোন স্টুডিওতে শূটিং দেখতে ঢুকতে পারবে ওরা। এবার বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে কিশোরের মনে হয়েছিল, লফারের ব্যবসা যখন লস অ্যাঞ্জেলেসে, এদিকে তদন্তের জন্যে আসতেও হতে পারে। পাসগুলো ব্যবহারের সুযোগ মিলতে পারে তখন।

মন্দ হয় না, কিশোর বলল। কিন্তু যাব কখন? আমি তো ভাবছি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার কথা। লফারের খোঁজ নিতে।

তিনজন একসাথে গিয়ে কি করব? তুমি আর রবিন যাও। আমি বরং স্টুডিওতে চলে যাই।

হেসে বলল রবিন, খুব মনে হয় শূটিং দেখতে ইচ্ছে করছে?

হোটেল থেকে বেরিয়ে মুসা গেল শূটিং দেখতে। রবিন আর কিশোর চলল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।

কিন্তু নতুন কিছু জানতে পারল না। একজন পুলিশ সার্জেন্ট কথা বলল ওদের সঙ্গে। বলল, লফারের ব্যাপারটা সত্যি অবাক করে দিয়েছে আমাদের। কোনই হদিস নেই। লুক ব্রাউনের ব্যাপারেও কিছু জানি না। ব্লাইদি পুলিশও তেমন কিছু বলতে পারেনি।

আপনার কি মনে হয় মিসেস লফার আমাদের সঙ্গে দেখা করবে?

করবে। তার স্বামীর ব্যাপারে কেউ আগ্রহ দেখালে খুশি হয় সে। বেচারী: লফারের অফিসে তার সেক্রেটারির সঙ্গেও কথা বলতে পারো ইচ্ছে করলে।

সার্জেন্টের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে গোয়েন্দাদের সাবধান করে দিয়ে বলল সে, বিপদের আশঙ্কা দেখলেই আমাকে জানাবে। কোন রকম ঝুঁকি নিতে যেয়ো না। তার জন্যে পুলিশই আছে।

সার্জেন্টকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল কিশোররা। হোটেলে ফিরে এল। মুসা ফেরেনি।

রবিন বলল, অহেতুক ঘরে বসে না থেকে বরং চলো মুসা কি করছে দেখে আসি।

কিশোরের আপত্তি নেই।

কোন স্টুডিওতে যাবে মুসা বলেই গেছে। খুঁজে বের করতে মোটেও বেগ পেতে হলো না। পাস দেখিয়ে ভেতরে ঢুকল কিশোর আর রবিন। সেদিন একটা জায়গাতেই কেবল শুটিং চলছে। মেকসিকোর পটভূমিতে ওয়েস্টার্ন ছবির শুটিং। লোকজনের ভিড়ে মুসাকে কোথাও দেখতে পেল না ওরা।

সেটের মাঝখানে অনেক লোক জটলা করছে। সবাই বেশ লম্বা, মাথায়। চওড়া কানাওয়ালা মেকসিকৗন হ্যাট। কারও পরনে রঙচটা নীল জিনসের। প্যান্ট, গায়ে ডেনিম জ্যাকেট; কারও এমব্রয়ডারি করা পোশাক। কোমরে রূপার বাকলেসওয়ালা চকচকে চামড়ার বেল্ট, পায়ে চামড়ার বুটজুতো। মেয়েদের পরনে উজ্জ্বল রঙের পোশাক। একটা দৃশ্যের শূটিঙের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে সবাই।

এককোণে দু-জন লোককে কথা বলতে দেখল রবিন। একটু পর সরে এল একজন। চিনতে পারল রবিন। আরি, ওই তো মুসা! মাথায় সমব্রেরো হ্যাট।

হাত নেড়ে ডাকল তাকে রবিন। নিজেও এগিয়ে গেল।

বন্ধুদের দেখে মুসও এগিয়ে এল। বাহ, তোমরাও এসে গেছ দেখছি।

লোকটা কে, মুসা? জানতে চাইল কিশোর। কোণের দিকে তাকিয়ে আর দেখতে পেল না-ওকে। অভিনেতাদের ভিড়ে মিশে গেছে।

এমন কেউ না, একজন এক্সট্রা, মুসা বলল। ডাকাত দলের একটা দৃশ্যে অভিনয় করতে এসেছিল। আমার মাথায় সমব্রেরো হ্যাট দেখে বলল চেষ্টা করলে আমিও এক্সট্রীর কাজ পেতে পারি। করেছি। পাইনি। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। পরিচালক বললেন, হয়ে গেছে, আর লোক লাগবে না।

তাহলে আর বসে আছ কেন? চলো, যাই।

হ্যাঁ, চলো। ব্যাংকেও যেতে হবে, বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই।

 ব্যাংকে? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।

যে লোকটা এক্সট্রা সেজেছে সে একটা চেক দিয়েছে। কাজ ফেলে বেরোতে পারবে না। তাই আমাকে অনুরোধ করল, একটা চেক দেবে; সেটা নিয়ে আমি যেন তাকে নগদ টাকা দিই। সে বেরোতে বেরোতে ব্যাংক বন্ধ। হয়ে যাবে। কিন্তু টাকাটা তার আজই দরকার। পকেটে যা ছিল দিয়ে দিলাম। সে আমাকে চেক সই করে দিল।

বোকামি করোনি তো? রবিন বলল। আজকাল কত রকম অসুবিধে হচ্ছে। প্রায়ই চেক জাল হয়।

 কি করব, এমন করে ধরল। তবে এটা হবে না, সরকারি চেক। দেখো, ইউনাইটেড স্টেটস গভর্নমেন্ট ছাপ দেয়া।

বেরোল ওরা। একটা ব্যাংক দেখে দুজনকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে চলে গেল মুসা। কয়েক মিনিট পর ব্যাংকের একজন দারোয়ান বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নাম কিশোর আর রবিন?।

হ্যাঁ, কেন? জবাব দিল কিশোর।

ভেতরে আসতে হবে। বিপদে পড়েছে তোমাদের বন্ধু। তোমাদের নাম বলল।

ক্যাশিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। ওদের দেখেই উত্তেজিত স্বরে বলল, আমাকে চেক নিতে দেখেছ না তোমরা! ক্যাশিয়ার সাহেব বিশ্বাস করছে না, তাকে বলো!

রবিন বলল, তখনই সন্দেহ হয়েছিল আমার, বোকামি করেছ!

কার কাছ থেকে কি ভাবে চেকটা নিয়েছে ক্যাশিয়ারকে বুঝিয়ে বলল সে আর কিশোর।

বিশ্বাস করল ক্যাশিয়ার। দারোয়ানকে বলল মুসাকে ছেড়ে দিতে।

কিশোর জানতে চাইল, চেকটাতে কি গোলমাল?

জাল, আরকি। ইদানীং বেশ কিছু জাল চেক পেয়েছি আমরা। সে জন্যেই সাবধান থাকতে হচ্ছে। যাই হোক, ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের কাছে এটা পাঠিয়ে দেব।

কিন্তু আমার টাকার কি হবে? ককিয়ে উঠল মুসা। পকেট তো খালি করে দিয়ে দিয়েছি।

কি আর করবে, কপাল খারাপ তোমার। বোকামির ফল, সহানুভূতির সুরে বলল ক্যাশিয়ার। তোমাদের কথা বিশ্বাস করে যে ছেড়ে দিলাম, বরং সেইটা ভাব। পুলিশের কাছে তুলে দেয়াটাই স্বাভাবিক ছিল না?

কিশোর বলল মুসাকে, জলদি চলে! লোকটাকে ধরতে হবে।

চলো, রাগ করে বলল মুসা, ব্যাটার কপালে দুঃখ আছে! ধরতে পারলেই হয়! আমি করলাম ভালমানুষী, আর আমাকে এমন করে ঠকাল!

 রাস্তায় বেরিয়ে দৌড় দিল তিনজনে। স্টুডিওর গেটে ওদের কাছে পাস চাইতে গেল দারোয়ান, পাত্তাই দিল না ওরা। ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে ঢুকে গেল। সোজা চলে এল সেটের কাছে, যেখানে ছবির শুটিং হচ্ছে।

গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভিড়ের জন্যে লোকটাকে চোখে পড়ল না মুসার। ভাবল ভেতরেই কোথাও আছে। ধাক্কা দিয়ে লোক সরিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল সে। চিৎকার করে উঠল এক মহিলা। কনুইয়ের তো খেয়ে পড়ে যেতে যেতে বাঁচল দু-জন লোক। রাগে, বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ওরা। কয়েকজনের হাতে পিস্তল, ওপর দিকে তুলে ফাঁকা গুলি করতে শুরু করল, মজা করার জন্যে। বেড়ে গেল চিৎকার-চেঁচামেচি। শিস দিয়ে উঠল কে যেন।

ভিড় থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছেন নীল ব্যারেট ক্যাপ পরী ছোটখাট একজন মানুষ। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, কাট! কাট! কাট!

একজন বিশালদেহী অভিনেতাকে নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করেছে মুসা। ভিড়ের মধ্যে তাকে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল লোকটা। অনেক টানা-হাচড়া করে দু-জনকে আলাদা করা হলো।

এগিয়ে এলেন নীল টুপি পরা ভদ্রলোক। চোখের তারা উজ্জল। দেখেই চিনে ফেলল মুসা। বিড়বিড় করল আনমনে, খাইছে! পরিচালক! এইবার বারোটা বাজাবেন আমার!

ঠকা খেয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তার, সেজন্যেই এ রকম একটা কাণ্ড ঘটাতে পেরেছে।

মুসার সামনে দাঁড়িয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলালেন পরিচালক। মুসাকে বিমূঢ় করে দিয়ে আচমকা তার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন, দারুণ! দুর্দান্ত অভিনয়, ইয়াং ম্যনি! এই জিনিসই চাচ্ছিলাম আমি! ভিড়ের মধ্যে গণ্ডগোল! একেবারে বাস্তব হয়েছে দৃশ্যটা!

 তোতলাতে শুরু করল মুসা, কি-কি-কিন্তু আমি তো অভিনয় করিনি! ম্যাট উইণ্ডসর নামে একটা লোককে খুঁজতে ঢুকেছিলাম। আমাকে ঢুকতে বাধা দিল ওরা, তাই খেপে গিয়েছিলাম।

সেটের চারপাশে চোখ বোলালেন পরিচালক। বোধহয় চলে গেছে। তুমি আসার একটু আগে শটটা নেয়া শেষ করেছি, যেটাতে ম্যাট অভিনয়। করছিল। শেষ হতেই চলে গেছে।

মুসার চেহারা দেখে মনে হলো ধসে পড়বে সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ডাকাতি করে নিয়ে গেছে আমার সব টাকা! ক্যামেরাটা বিক্রি করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন।

এগিয়ে এল কিশোর। মুসার হাত ধরে টান দিল, পাগল হয়ে গেলে নাকি? এসো।

ভিড়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, টাকার জন্যে ক্যামেরা বিক্রি করতে হবে কেন তোমার? আমরা আছি?

রবিন যোগ করল, তা ছাড়া এই কেসের জন্যে ওরকম একটা ক্যামেরা আমাদের দরকার হতে পারে।

কিশোর বলল, একটু দাঁড়াও। আমি পরিচালকের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে আসি।

পরিচালককে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ম্যাট উইণ্ডসর কোথায় থাকে জানেন?

না। অফিসে খোঁজ করতে পারো। হয়তো ওদের কাছে ঠিকানা আছে।

কিন্তু অফিসের ওরাও কিছু বলতে পারল না। লোকটা ভবঘুরে টাইপের। মাঝে মাঝে এসে উদয় হয়। অভিনয়ের কাজ পেলে করে। নগদ টাকায় পাওনা বুঝে নিয়ে চলে যায়।

মুসরি টাকাটা উদ্ধারের আর কোন উপায় দেখল না কিশোর। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

হোটেলে ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকটা শান্ত হলো মুসৗ। টাকার শোকের চেয়ে ঠকা খাওয়ার শোকটাই তার বেশি। বলল, লস অ্যাঞ্জেলেসে তার এক চাচা থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।

মুসা চলে গেল চাচার বাড়িতে, রবিন আর কিশোর চলল মিসেস লফারের সঙ্গে দেখা করতে।

পরিচয় পেয়ে গোয়েন্দাদের স্বাগত জানিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এল মিসেস লফার। বেশ সুন্দরী। বয়েস কম। স্বামীর জন্যে খুবই চিন্তিত। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে।

 নয় বছরের একটা ছেলে ঢুকল ঘরে। বাদামী চুল। মুখ ভর্তি তিল। অস্বস্তি নিয়ে তাকাতে লাগল কিশোর আর রবিনের দিকে।

তা আরও একটা ছেলে ঢুকল, তার বয়েস সাত। বোঝা গেল বড় ছেলেটার ভাই।

বড়টার নাম পল, ছোটটা নেল, গোয়েন্দাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ওদের মা। আদর করে বলল, তোমরা একটু ওঘরে যাও। আমি কথা বলে আসি।

ছেলে দুটো চলে গেলে করুণ সুরে মিসেস লফার বলল, বাপের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ওরা। বুঝতেই পারছি না কি ঘটল! তোমরা তার খোঁজ এনে দিতে পারলে চির কৃতজ্ঞ থাকব তোমাদের কাছে!

আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব আমরা, কিশোর বলল।

মিসেস লফারের কাছেও নতুন কিছু জানতে পারল না ওরা। কেবল একটা ব্যাপার সঙ্গে করে বাড়তি কাপড় নেয়নি লফার। তারমানে বাইরে কোথাও থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি সে।

লফারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার অফিসে চলে এল কিশোররা। দোতলার একটা দরজায় দেখা গেল নেমপ্লেট। টোকা দিল কিশোর।

সোনালি চুল এক মহিলা দরজা ফাঁক করল। বয়েসে তরুণী, সাতাশ আটাশ হবে। লফারের সেক্রেটারি, আন্দাজ করল কিশোর।

কি চাই? জানতে চাইল মহিলা।

দেখুন, আমরা মিস্টার লফারের ব্যাপারে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।

কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল সেক্রেটারি।

০৬.

শুনুন, শুনুন! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

আবার ফাঁক হলো দরজা। আগের চেয়ে কম। ভয় পেয়েছে মহিলা।

ভয় নেই, আমাদের ঢুকতে দিন, কিশোর বলল। আমরা মিসেস লফারের কাছ থেকে এসেছি।

দ্বিধা করল মহিলা। কি করে বিশ্বাস করব?

ফোন করুন। জিজ্ঞেস করুন কিশোর আর রবিন তাঁর কাছে গিয়েছিল কিনা?

দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার। অপেক্ষা করতে লাগল দুই গোয়েন্দা। খুলল পাঁচ মিনিট পর। ভয় চলে গেছে মহিলার। ডাকল, এসো।

 কিশোররা ঢুকতে আবার দরজা লাগিয়ে একেবারে তালা দিয়ে দিল সে। আর কেউ নেই ঘরে। ছোট ডেস্কে রাখা নেমপ্লেট দেখে জানা গেল মহিলা লফারের সেক্রেটারি, এবং তার নাম মিস পলী লয়েড।

কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে পলা বলল, তোমাদের দেখেই বুঝেছি, তোমরা খারাপ নও। কিন্তু সকালে এসেছিল দু-জন, মিস্টার লফারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার জন্যে, ওরা ভয়ঙ্কর। কলজের পানি শুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আমার। তারপর থেকে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। দরজায় তালা দিয়ে রাখি সারাক্ষণ।

কারা ওরা? জানতে চাইল রবিন, পুলিশ?

না। বিশালদেহী দু-জন লোক, রুক্ষ ব্যবহার। কাপড়-চোপড় ভাল না। ডাকাতের মত আচরণ করছিল। আগে জানলে ঢুকতে দিতাম না। এসে যখন বলল মিস্টার লফারের ব্যাপারে কথা বলতে চায়, ভাবলাম গোয়েন্দা টোয়েন্দা হবে।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।

কিশোর বলল, মিস্টার লফারের খোঁজ করছিল?

হ্যাঁ, করছিল, পল বলল। মিস্টার লফারের অফিসের ফাইল, রেকর্ড আর তাঁর কাছে আসা চিঠিপত্র দেখাতে আমাকে বাধ্য করল। কব্জি মুচড়ে ধরেছিল, কালশিটে পড়ে আছে, দেখাল সে।

হু, মাথা দোলাল রবিন, তারমানে বাজে লোকই ওরা। পুলিশকে জানিয়েছেন?

না, মাথা ঝাঁকাল পল। আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে পুলিশকে জানালে আস্ত রাখবে না।

কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, আমাদের যারা হুমকি দিয়েছে মনে হচ্ছে তাদের দলেরই লোক।

হতে পারে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। তবে লফারের খোঁজখবর নিতে যখন এসেছে, ধরে নেয়া যায় ওরা তাকে বন্দি করেনি। তবে কি অন্য কোন দলের হাতে পড়েছে লফার?

সাদা হয়ে গেল পলের মুখ। কি বলছ তোমরা এ সব!

সবই আমাদের অনুমান। মিস লয়েড, মিস্টার লফার লোক হিসেবে। কেমন, বলুন তো? তাকে কি পছন্দ করেন আপনি?

ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল পলের। ইয়ে, বছরখানেক আগে প্রথম যখন এখানে চাকরিতে ঢুকি তখন তো খুবই ভাল মনে হত। হাসিখুশি, সদা ব্যস্ত একজন মানুষ। শীই শাঁই করে ব্যবসায়ে উন্নতি হচ্ছে। সংসারে অশান্তি নেই। পছন্দ করার মতই একজন মানুষ। তারপর হঠাৎ করে বদলে গেলেন তিনি।

কি রকম?

বদমেজাজী হয়ে গেলেন। চেয়ারে বসে বসে কি চিন্তা করতেন। কাউকে সহ্য করতে পারতেন না। কেউ কাজের কথা বলতে এলেও তাকে ধমকাতে শুরু করতেন। যারা মাল কিনতে আসত, তাদেরও যেন বিশ্বাস করতে পারতেন না। ভঙ্গি দেখে মনে হত, প্রতিটি লোক যেন তাকে ঠকানোর জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। সবাইকে সন্দেহ করতেন।

এ সব করার পেছনে কোন কারণ ছিল? জিজ্ঞেস করল রবিন।

ছিল। খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তার। তার এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে আরেকটা ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় থেকে দু জনের বন্ধুত্ব। হঠাৎ করে সমস্ত টাকা মেরে দিয়ে ইয়োরোপে চলে গেল বন্ধুটি। মিসেস লফার এ সব খবর জানেন না। দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়বে বলে তাঁকে বলেননি মিস্টার লফার।

সেই বন্ধু ঠকিয়ে চলে যাওয়ার পর লুক ব্রাউনকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতেন না লফার। বলতেন, ব্রাউনের মত দুঃসাহসী বন্ধু হয় না। তারপর দু-জনেই গায়েব হয়ে গেলেন একদিন।

লুক ব্রাউন কি কাজ করতেন? জানতে চাইল কিশোর। ব্যবসা?

বলতে পারব না। তবে কোথায় থাকত, জানি। ঠিকানা দিচ্ছি, তোমরা পারলে খবর নাওগে।

নোটবুকে ঠিকানা লিখে নিল রবিন। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, দুঃসাহসী বন্ধু বলে কি বোঝাতে চেয়েছেন, মিস্টার লফার?

মাথা নাড়ল সেক্রেটারি। তা তো বলতে পারব না।

কিশোর বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস লয়েড। এক কাজ করুন, পুলিশকে ফোন করে সব কথা বলুন। লোকগুলোর হুমকির পরোয়া করবেন না। আবার এসে গণ্ডগোল করতে পারে। পুলিশই আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে। মিস্টার লফারের ব্যাপারে আর কিছু বলতে পারবেন। আমাদের?

আর? তার হবির ব্যাপারে বলতে পারি।

বলুন?

ঘোড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। শেটল্যাণ্ড পনি পুষতেন। এতে কোন কাজ হবে তোমাদের?

হতে পারে, বলা যায় না।

মহিলাকে আবারও ধন্যবাদ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল গোয়েন্দা।

হোটেলে ফিরে লিফট থেকে নেমে নিজেদের রুমের দিকে এগোল। করিডরের শেষ মাথায় একজন লোককে দেখা গেল। গায়ে খাটেী লাল জ্যাকেট। কোমরের বেল্টে চকচকে পালিশ করা তামার বকলেস।

লোকটাকে চেনা চেনা লাগল। চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলতে খুলতে রবিনকে প্রশ্ন করল কিশোর, কে ও?

বেয়ারা-টেয়ারা হবে, জবাব দিল রবিন।

ঘরে ঢুকেই থমকে গেল কিশোর। মনে পড়েছে। চেঁচিয়ে বলল, আরে ওই লোকটাই তো! যার ছবি তুলেছে মুসা, জঞ্জালের আড়ালে ঘাপটি মেরে। ছিল! ওকে ধরতে হবে!

ছুটে বেরিয়ে এল দু-জনে।

কিন্তু নেই লোকটা। চলে গেছে।

লিফটের অপেক্ষা না করে দৌড়ে নিচে নামল ওরা। লোকটাকে দেখা গেল না। ডেস্কে বসা ক্লার্কের দিকে এগোল কিশোর। লোকটার ছবিটা মানিব্যাগে রেখেছে। বের করে কুর্কিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই লোক কি আপনাদের এখানে চাকরি করে?

ভাল করে দেখে মাথা নাড়ল ক্লার্ক, না, কখনও দেখিইনি একে।

কিন্তু এইমাত্র আমাদের ঘরের করিডরে দেখে এলাম! হোটেলের বেয়ারার পোশাক পরা।

দাঁড়াও, দেখছি। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পোর্টারকে ডাকল ক্লার্ক, ভিক, শোনো তো? পোর্টার কাছে এলে ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, একে হোটেলে ঢুকতে দেখেছ? ওপরতলায় নাকি উঠেছিল। আমাদের বেয়ারার পোশাক পরা।

অবাক হলো পোর্টার। কই, দেখিনি তো?

তাহলে পোশাক পেল কোথায়? রবিন বলল, নিশ্চয় চুরি করেছে। আপনাদের স্টোর থেকে।

তা করতে পারে, ক্লার্ক বলল। এই লোকটার বয়েস চল্লিশ হবে। আমাদের কোন বেয়ারাই এত না। দাঁড়াও, হাউস ডিটেকটিভকে বলছি।

ডিটেকটিভের সঙ্গে দুই গোয়েন্দাও লেগে রইল। কোনখান থেকে পোশাক চুরি করে কোথায় বদলেছে, বের করা হলো। সিঁড়ি, চিলেকোঠা, এবং মানুষ লুকিয়ে থাকা যায় এ রকম সবখানে খুঁজে দেখা হলো। কিন্তু পাওয়া গেল না লোকটাকে।

হতাশ হয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। সঙ্গে সঙ্গে এল ডিটেকটিভ। জিজ্ঞেস করল, লোকটা দেখতে কেমন?

আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর, বা-বা, আসল কথাটা জিজ্ঞেস করছে এতক্ষণে। এই লোক আর কি ডিটেকটিভগিরি করবে! নীরবে ছবিটা বাড়িয়ে দিল সে।

দেখল ডিটেকটিভ। এই চেহারার কাউকে দেখতে পেলে গোয়েন্দাদের। জানাবে, কথা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে।

পালাল কি করে ব্যাটা? কিশোরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রবিন।

হয়তো কোন ঘরের ফায়ার-এসকেপ দিয়ে।

হাতমুখ ধুয়ে, খানিক বিশ্রাম নিয়ে, নাস্তা খেয়ে আবার বেরোল দুই গোয়েন্দা। পলার দেয়া ঠিকানা মোতাবেক লুক ব্রাউনের বাড়িতে যাবে।

নিজের বাড়ি নয়, একটা বোর্ডিং হাউসে ভাড়া থাকত ব্রাউন। হাউসের মালিক এক মহিলা, দরজা খুলে দিল। কথা বলে অতিরিক্ত। ভীষণ মোটা, বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে, পাক ধরতে শুরু করেছে চুলে। নাম মিসেস টোবারগট।

কিশোরদেরকে বসার ঘরে নিয়ে এল মহিলা। রান্নাঘর থেকে আসছে। খাবারের সুগন্ধ। নিশ্চয় রান্না করছিল মিসেস টোবারগট।

লুক ব্রাউনের ব্যাপারে জানতে চাইল কিশোর।

মিস্টার ব্রাউন? মহিলা বলল, ওর ব্যাপারে তো কত কথাই জানি। ভাল বোর্ডার ছিল। আমার রান্না খুব পছন্দ করত। তা শুধূমুখে তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি কেন? এক কাপ চা অন্তত দেয়া উচিত।

বিনয়ের সঙ্গে চা খাওয়াটা এড়াতে চাইল কিশোর। কিন্তু কোনমতেই শুনল না মিসেস টোবারগট। চা তো আনলই, তার সঙ্গে নিজের তৈরি বিস্কুটও নিয়ে এল।

মানুষকে খাওয়াতে আমার খুব ভাল লাগে, মিসেস টোবারগট বলল। খাওয়ার জন্যে কত চাপাচাপি করেছি ব্রাউনকে, মোটা বানাতে চেয়েছি। কিন্তু যে হাড্ডি সেই হাড়ি। আমার দেয়া সব খাবার খেত, কিচ্ছু ফেলে রাখত না। কিন্তু তালপাতার সেপাই থেকে বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি তার। অবাক কাণ্ড! আরি, খাচ্ছ না কেন? একটা বিস্কুটও ফেলে রাখা চলবে না। তোমাদের বয়েসী ছেলেদের অনেক বেশি খেতে হয়। নইলে শরীর টেকে না।

খাচ্ছি তো, আরেকটা বিস্কুট নিতে নিতে বলল কিশোর। খুব ভাল বানিয়েছেন। হ্যাঁ, ব্রাউনের কথা বলুন।

কি আর বলব, এক আজব লোক ছিল! সারাক্ষণই বাইরে যেত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেরোত। আসত আর যেত, যেত আর আসত, একেবারে যেন চড়ুই পাখি। এত ঘোরাফেরা করত বলেই বোধহয় স্বাস্থ্য ভাল হত না। চুলও পাতলা হয়ে যাচ্ছিল।

কাজ করত কখন? জানতে চাইল রবিন। কিছু তো একটা নিশ্চয় করত। নইলে আপনার ঘর ভাড়া দিত কি করে?

কি জানি কি করে! সেটা আরেক আশ্চর্য! ভাড়াটেদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনও তাদের কাছে জানতে চাই না আমি। আরি, চুপ করে আছ কেন? বিস্কুটগুলো শেষ করো। খাও, খাও, লজ্জা নেই, আরও এনে দেব।

মূসাকে দরকার ছিল, তাহলে খাইয়ে শান্তি পেত মিসেস টোবারগট ভাবল রবিন।

কিশোর বলল, তাহলে বলছেন খুব ভাল বোর্ডার ছিল ব্রাউন?

ছিল। একটা পয়সা বাকি রাখেনি আমার। আর রাখবে কি, ছয় মাসের খাবারের খরচ সহ ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দিয়েছিল। সে-ই বরং আমার কাছে পায়। টাকার বোধহয় কোন মায়া ছিল না তার।

বিস্কুটগুলো আপনার দারুণ! আরেকবার প্রশংসা করল কিশোর। হু, তা বাইরে যে যাচ্ছে, আপনাকে বলেছিল ব্রাউন?

হয়তো বলেছিল, আমার মনে নেই। থাকবে কি? এত বেরোয় যে লোক, সে বাইরে যাওয়ার কথা বললে কারও খেয়াল থাকে নাকি? মাঝে মাঝেই দীর্ঘদিনের জন্যে বেরিয়ে যেত।

 হঠাৎ দু-জনকে অবাক করে দিয়ে সামনে ঝুঁকল মিসেস টোবারগট। স্বর। নামিয়ে বলল, মনে হয় রাজনীতি বা কোন বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ছিল সে! ওই যে ল্যাটিন-আমেরিকান দেশগুলো আছে না, ওসব দেশে তো সব সময়ই গণ্ডগোল লেগে থাকে। আমার ধারণা, ওখানকার কোন দলের সঙ্গে জড়িত। ছিল। আমি যে বললাম কাউকে বলে দিয়ো না আবার!

না, না, বলব না! সতর্ক হলো কিশোর। কি করে বুঝলেন?

তার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে এমন সব ছবি দেখেছি, তাতেই মনে হয়েছে। প্লেনের মধ্যে তোলা তার ছবি, ওই প্লেনগুলো আবার ব্যবহার হয়। যুদ্ধের সময়। মাথায় ইয়াবড় হ্যাট তার, হ্যাঁটের কানা তো না, যেন গরুর গাড়ির চাকা। তার সঙ্গে আরও লোক আছে। সবার কোমরেই গুলির বেল্ট, খাপে ঝোলানো পিস্তল। আরি, বিস্কুট খাও না কেন?

 কই, খাচ্ছি তো! মহিলার কথা শুনতে শুনতে কৌতূহলে চিবানো থামিয়ে দিয়েছিল কিশোর, আবার কামড় বসাল হাতের বিস্কুটে।

হু, বোঝা গেছে। এই জন্যেই লফার বলত তার দুঃসাহসী বন্ধু, রবিন বলল।

নামটা চিনতে পারল মিসেস টোবারগট। বলল, হ্যাঁ, ওই ভদ্রলোককেও এখানে নিয়ে আসত ব্রাউন। মহিলার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এ সব খবর বলতে পারায় তার খুশিই লাগছে। মিস্টার লফারই আমাকে বলেছে কি সাংঘাতিক যোদ্ধা তার বন্ধু লুক ব্রাউন, কি ভাবে বিদেশীদের হয়ে লড়াই করেছে। ব্রাউনের কাছে এ সব কাজ নাকি রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের মত। বন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যেত ভদ্রলোক।

 লড়াইটা কোন দেশে করেছে, আপনি জানেন, মিসেস টোবারগট? প্রশ্ন। করল কিশোর।

নাহ। মনে থাকে না। তবে একটা জিনিস দেখাতে পারি তোমাদের, দেখো কিছু আন্দাজ করতে পারো কিনা। বিস্কুটগুলো কিন্তু শেষ করতে হবে, নইলে দেখাব না, হুমকি দিয়ে, উঠে চলে গেল মিসেস টোবারগট।

মহিলা চলে যাওয়ার পর রবিন বলল, কত রকম মানুষ যে থাকে দুনিয়ায়। বেশির ভাগ মানুষই মানুষকে খেতে দিতে চায় না; কিন্তু জোর করে খাওয়াতে চায়, এমন মানুষ এই প্রথম দেখলাম। এত বিস্কুট, শেষ করি কি। করে? তুমি খেয়ে ফেলে।

আমি পারব না। হাত মুছতে দেয়া কাগজে বিস্কুটগুলো মুড়ে পকেটে রেখে দিয়ে হাসল। মুসার জন্যে নিয়ে নিলাম। মিসেস টোবারগট ভাববে। আমরাই খেয়ে ফেলেছি।

মুসাকে আনলে খুব ভাল হত। কত খেতে পারে দেখা যেত।

মিসেস টোবারগট ফিরে এল। খালি প্লেট দেখে বেজায় খুশি। বলল, বাহ, এই তো চাই! না খাওয়া মানুষদের আমার একদম পছন্দ না। নাও, জিনিসটা তোমাদের দিয়েই দিলাম।

কিশোরের তালুতে একটা তামার মুদ্রা ফেলে দিল সে। ঝাড়ু দিতে গিয়ে ব্রাউনের ড্রেসিং টেবিলে পেয়েছি এটা। মনে হলো বিদেশী জিনিস। খুব পছন্দ হলো আমার। স্যুভনির হিসেবে রাখতে চাইলাম। তাকে সে-কথা বলতেই দিয়ে দিল আমাকে।

মুদ্রার লেখা পড়ল কিশোর, রিপাবলিকা ডি মেকসিকো! মুখ তুলে বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিসেস টোবারগট। আজ তাহলে উঠি।

হোটেলে ফিরে ওরা দেখল, মুসা এসে বসে আছে। মিসেস টোবারগটের বিস্কুট খাওয়ানোর কাহিনী শুনে তো কিশোরদের সঙ্গে গেল না বলে আফসোসেই বাঁচে না সে।

ব্রাউনের কথা সব শোনার পর বলল, খাইছে! বলো কি! মেসিকোয় বিদ্রোহীদের প্লেন চালিয়েছে ব্রাউন!

হ্যাঁ, কিশোর বলল। আর রিপ্লি শহরটা মেকসিকো থেকে দূরে নয়।

একটা ম্যাপ বের করে এনে মেঝেতে বিছাল সে। তিনজনেই কুঁকে এল তার ওপর। আঙুল রেখে দেখাল কিশোর, এই যে দেখো কলোরাডো নদী কোন দিকে বয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে এই নদী দিয়েই বোটে করে। মেকসিকোতে চলে গেছে লফার আর ব্রাউন।

নতুন বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েনি তো ব্রাউন? রবিনের প্রশ্ন। কিংবা অন্য কোনো বেআইনী কাজে?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। সেটাই জানতে হবে আমাদের।

.

০৭.

সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে এখন তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে আমাদের, কিশোর বলল। প্রথমে ধরা যাক সেই পাথরটার কথা, মরুভূমিতে যেটা পেয়েছি। হয়তো দামী পাথরের খোঁজে মরুভূমিতে গিয়েছিল লফার আর ব্রাউন। সেখানে ডাকাতের কবলে পড়ে ওরা। আরেক হতে পারে, ব্রাউনের কথায় পটে গিয়ে তার সঙ্গে বোটে করে মেকসিকোতে চলে গেছে লফার।

সুতরাং আমাদের প্রথম কাজ হবে মরুভূমিতে গিয়ে আরও সূত্র খোঁজা। টিলার ওপরের ছবিটাতে কোনো ইঙ্গিত থাকতে পারে। ওখানে কিছু না পেলে একটা বোট নিয়ে কলোরাডো নদী ধরে আমরাও চলে যাব মেকসিকোতে।

গুড আইডিয়া! খুশি হয়ে বলল মুসা। শুনেছি কলোরাডো নদীর কৈ মাছ নাকি দারুণ টেস্ট। মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে যাব আমরা। তিনটে কাজ হৰে তীতে। মাছ শিকারের আনন্দ পাব, তাজা খাবারও পাব, আর লোকে দেখলে ভাববে আমরা মাছ ধরতে বেরিয়েছি।

হাততালি দিল রবিন। বহি, চমৎকার! বুদ্ধি খুলে যাচ্ছে দেখছি তোমার! কিশোরের দিকে তাকাল। কিন্তু কথা হলো, নদী ধরে গিয়ে লাভটা কি হবে আমাদের?

লাভ? কিশোর বলল, নদীপথে লফাররা গেলে অনেক সময় লেগেছে নিশ্চয়, কারও না কারও চোখে পড়েছে। যেখানেই লোকালয় দেখব, জিজ্ঞেস করতে করতে যাব আমরা। মেকসিকোতে ঢোকার জন্যে অনুমতি লাগবে। আমাদের। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকেই নিতে সুবিধে।

বার্থ সার্টিফিকেট আর অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে মেকসিকান দূতাবাসে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। অনুমতি পেতে অসুবিধে হলো না। হোটেলে। ছেড়ে দিয়ে চলে এল এয়ারপোর্টে। বিমান নিয়ে আবার ফিরে চলল রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে।

বিমান বন্দরে প্লেন রেখে ট্যাক্সিতে করে ব্লাইদিতে চলে এল। রবিন বলল, আগে থেকেই একটা বোট ভাড়া করে রাখলে হয় না?

ট্যাক্সিতে করেই নদীর ঘাটে চলে এল ওরা। নানা রকম বোট বাঁধা আছে। মুসা বলল, তোমরা নৌকা ঠিক করোগে। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি। কতদিন বোটে থাকতে হবে, কে জানে। খাবার লাগবে।

সুপারমার্কেটের দিকে চলে গেল মুসা।

 ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে অন্য দু-জন চলল বোট ভাড়া করতে।

লাল-সাদা রঙ করা একটা বোট পছন্দ হলো ওদের। দুই ইঞ্জিন বসানো। ওরা যে কাজে যাচ্ছে, তাতে বিপদের সম্ভাবনা আছে। বাড়তি একটা ইঞ্জিন অনেক কাজে দেবে।

পুরানো ধরনের আঁটো পোশাক পরা এক লোক ডেকে বসে ছুরি দিয়ে কাঠ ঠেছে একটা পুতুল বানাচ্ছে। একবার মুখ তুলে চেয়েই আবার নামিয়ে নিল। কাজ বন্ধ করল না।

বোটটা কি ভাড়া হবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হয়তো, জবাব দিল লোকটা।

যতদিন ইচ্ছে রাখতে পারব?

আবার জবাব, হয়তো।

 দিন দুয়েকের মধ্যে লাগবে। দেয়া যাবে?

হয়তো।

ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইল। দুদিন পর এসে নেব। ঠিকঠাক পাওয়া যাবে তো?

হয়তো।

বোট থেকে নেমে আসতে শুরু করল রবিন। হয়তো ছাড়া শকুনটী আর কোন শব্দ জানে না নাকি?

হয়তো, হেসে জবাব দিল কিশোর।

মুসার খোঁজে সুপার মার্কেটের দিকে এগোল ওরা। কিছুদূর এগোতে খাবারের নানা রকম প্যাকেটের বিশাল এক চলমান বোঝা চোখে পড়ল ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না, কেবল বোঝাটার ওপরে পরিচিত একটা সমব্রেরো হ্যাট বসানো। আরও কাছে এসে পরিচিত গলায় কথা বলে উঠল বোঝা, অ্যাই, কিশোর!

হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হলো খাবারের বোঝ। প্যাকেট, টিন, ছিটকে পড়তে লাগল চারদিকে। বৃষ্টির মত এসে পড়ল রবিন আর কিশোরের কাঁধে। ওসবের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসা আমান। চোর! চোর! বলে চিৎকার করে দৌড় দিল রাস্তা দিয়ে।

কিন্তু চোরটা দৌড় দেয়ার কোন চেষ্টা করল না। সহজেই তাকে ধরে ফেলল মুসা। ছোটখাট একজন মানুষের কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল, চোর কোথাকার! আমার টাকা ফেরত দাও!

 রাস্তা থেকে যতটা সম্ভব খাবারের প্যাকেটগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল কিশোর আর রবিন। কাছে গেলে চিৎকার করে বলতে লাগল মুসা, এই ব্যাটাই সেদিন স্টুডিওতে চেক দিয়েছিল আমাকে! এর নামই ম্যাট উইন্ডসর!

কি বলছ তুমি, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! বিমূঢ় হয়ে গেছে যেন ম্যাট।

আমাকে চিনতে পেরেছ, নাকি পারোনি?

পারব না কেন? স্টুডিওতে আমাকে টাকা দিয়েছিলে, আমি তোমাকে একটা চেক দিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, মুখ বাঁকিয়ে ঝাঁঝাল কণ্ঠে মুসা বলল, সেই চেকটা ছিল জাল!

আরও অবাক হলো লোকটা। জাল! কিন্তু ও তো সরকারি চেক, জাল হয় কি করে?

সেটা তুমি জানো। চলো, পুলিশের কাছে চলো। অবাক হওয়ার ভানটা ওদের কাছেই করো। কলার ছাড়ল না মুসা। টেনে নিয়ে চলল। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, একটা কথা বলো দেখি এখন, চাঁদ, আমি যেখানেই যাই সেখানেই হাজির হয়ে যাও কি করে? ব্লইদিতে কি করছ?

আমারও তো সেই একই প্রশ্ন, তুমি এখানে এলে কি করে? আমার থাকাটা স্বাভাবিক, কারণ এখানেই আমার বাড়ি।

বিশ্বাস করল না মুসা। ব্যঙ্গের সুরে বলল, তাই নাকি! বলে গিয়ে সে কথা পুলিশকে!

থানায় এসেও ম্যাটের সেই একই কথা–সে কোন অপরাধ করেনি।

ডেস্ক সার্জেন্ট বলল মুসাকে, এখানে তার বাড়ি হওয়া অসম্ভব না। ব্লাইদিতে বহুবার দেখছি তাকে।

তাহলে লস অ্যাঞ্জেলেসে কি করছিল?

দেখো, আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে, মুসার প্রশ্নের জবাবে ম্যাট বলল। অনেক দিন থেকে আমি অসুস্থ। সিনেমায় কাজ করার। কথা ছিল বলেই সেদিন না গিয়ে পারিনি। কাজ শেষ হতেই চলে এসেছি। চেকটা যে জাল এর কিছুই জানতাম না আমি। টাকার অভাবে একটা সোনার ঘড়ি বিক্রি করেছিলাম। যার কাছে করেছিলাম, সে নগদ টাকার পরিবর্তে ওই চেক দিয়েছে। ঠিক আছে, আমারই অন্যায়, তোমার টাকা আমি ফিরিয়ে দেব।

ঘড়িটা কি এখানে বিক্রি করেছেন? সতর্ক হয়ে উঠেছে সার্জেন্ট।

না, লস অ্যাঞ্জেলেসে।

 লোকটা দেখতে কেমন?

আমার চেয়ে লম্বা, বয়েসেও বড়। আমাকে বলল, কোন হোটেলে নাকি কাজ করে।

কি ভেবে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল কিশোর। মুসার ভোলা ছবিটা বের করে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই লোক?

জঞ্জালের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা লোকটাকে ভাল করে দেখল ম্যাট। হ্যাঁ, এই লোকই! কিন্তু তোমরা এর ছবি পেলে কোথায়?

 সার্জেন্টও অবাক হলো। ড্রয়ার থেকে একটা চেক বের করে দেখাল, এ রকম চেক নিয়েছিলেন?

একই সঙ্গে বলে উঠল মুসা আর ম্যাট, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ রকম!

মাথা ঝাঁকাল সার্জেন্ট। গত হপ্তায় ব্লাইদি ব্যাংকে এটা ভাঙাতে এনেছিল এক লোক। তারমানে চেক জালিয়াতির একটা নতুন দল গজিয়েছে।

ম্যাটকে আরও কিছু প্রশ্ন করার পর নিশ্চিত হলো সার্জেন্ট, লোকটা সত্যি কথাই বলছে। সে অপরাধী নয়। মুসার মত সে-ও অপরাধের শিকার।

কি আর করা? থানা থেকে বেরিয়ে এল চারজনে।

মোটেলে ফিরল তিন গোয়েন্দা।

তদন্তের আলোচনা শুরু হলো। মুসা জিজ্ঞেস করল, মরুভূমিতে আবার কি খুঁজবে?

ছবিটা দেখব আরেকবার। হতে পারে, কিছু মিস করেছি আমরা।

কবে যাবে?

আজই।

.

০৮.

টিলার খানিক দূরে আগের জায়গাতেই ল্যাণ্ড করল মুসা। হেঁটে এসে টিলাটাতে উঠল ওরা। আগে আগে রয়েছে কিশোর। তার এখনও বিশ্বাস, ছবিটাতে রয়েছে লফারের নিরুদ্দেশ-রহস্যের জবাব। খুঁজতে শুরু করল সে।

 মরুর পাথুরে কঠিন মাটি আয়তাকার ভাবে দেবে গেছে এক জায়গায়। আলগী হয়ে আছে মাটি। আগের বার লক্ষ করেনি এটা। কেন করেনি, সেটাও বুঝতে পারল না। তবে হয় এ রকম। প্রথমবারে অনেক সময় অনেক খুঁজেও একটা জিনিস চোখে পড়ে না, দ্বিতীয়বারে সেটা সহজেই চোখে পড়ে যায়।

কেউ খুঁড়েছিল! বলে উঠল রবিন।

তাই তো মনে হচ্ছে! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। খুঁড়ে আবার মাটি দিয়ে গর্তটা বুজিয়ে দিয়েছে।

কি আছে নিচে? মুসার প্রশ্ন।

না দেখলে কি করে বুঝব? মুসা, আবার আমাদের ব্লাইদিতে ফিরে যেতে হবে। মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে হবে। একটা শাবল পেলেই

সেটা আমি একাই আনতে পারব। তোমরা বরং ইতিমধ্যে যা দেখার দেখে নাও। তাতে সময় বাঁচবে।

 ঠিকই বলেছে মুসা। কিশোর আর রবিন রয়ে গেল। মুসা চলে গেল মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি কিনে আনতে।

টিলার ওপরে, নিচে, আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল দু-জনে। নতুন কিছুই পেল না। ভয়ানক গরম। ওদের মনে হচ্ছে মাথায় হ্যাট না থাকলে মগজই গলে যেত। ছায়া বলতে কিছু নেই। ঘেমে নেয়ে গেল দেখতে দেখতে। আর কিছু না দেখে ছোট একটা ঝোপের পাশের সামান্য ছায়াতেই বিশ্রাম নিতে বসল ওরা।

কিশোর বলল, দানবের ছবির ওই ছড়ানো হাতের কোন অর্থ আছে।

কি?

বুঝতে পারছি না। বাঁ হাতটা যেদিকে নির্দেশ করছে সেদিকেই কিন্তু পাথরটা পাওয়া গেল।

আচ্ছা, পাথরটা কোন ধরনের নির্দেশক নয়তো? কোন কিছুর চিহ্ন? গুপ্তধন?

হতে পারে।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রবিন বলল, রাতে এসে ক্যাম্প করলে কেমন হয় এখানে? ব্রাউন আর লফার হয়তো পাহাড়ের কোন গুহায় লুকিয়ে আছে। রাতের বেলা গুপ্তধন খুজতে বেরোয়। নইলে ওই মাটি খুঁড়ল কে? কেনই বা খুঁড়ল? কি খুঁজেছে?

আল্লা মালুম! হাত ওল্টাল কিশোর।

এই গরমে অপেক্ষা করার মত কষ্ট আর হয় না। দু-জনেরই মনে হতে লাগল, যুগের পর যুগ পার হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ফিরে এল মুসা। প্লেনটা ল্যাণ্ড করতেই ছুটে গেল ওরা রবিন আর কিশোর। যন্ত্রপাতি নামাতে মুসাকে সাহায্য করতে।

মাথায় চওড়া কানওয়ালা হ্যাট, হাতে মাটি খোঁড়ার শাবল-কোদাল, সারি দিয়ে হাঁটা–মনে হচ্ছে যেন পুরানো আমলের প্রসপেক্টর, অর্থাৎ স্বর্ণ খুজিয়ের দল।

মুসা বলল, বাই চান্স যদি সোনা পেয়ে যাই, দারুণ হবে না!

হবে, কিশোর বলল, তবে অবাক হব না। অ্যারিজোনায় বেশ কিছু সোনার খনি আছে। স্প্যানিশরা যখন প্রথম এল এ দেশে তখন খুঁজে বের করেছিল। পরে হারিয়ে গেছে ওগুলো।

খনি কি আর হাঁটতে পারে নাকি যে কোথাও গিয়ে হারিয়ে যাবে? বুঝতে পারল না মুসা। হারায় কি করে?

 হেসে উঠল রবিন। এই সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না। পুরানো আমলের প্রসপেক্টররা তাদের খনির কথা গোপন করে রাখত, অন্যে কেড়ে নেয়ার ভয়ে। কাউকে বলত না। শেষে দেখা গেল নিজেও আসতে পারল না সোনা খুঁড়ে তোলার জন্যে। কালক্রমে বালিতে ঢেকে কিংবা ভূমিকম্পে মাটি ধসে বন্ধ হয়ে গেল খনির মুখ হারিয়ে গেল মাটির নিচে।

গর্তটার কাছে পলি করে খুড়তে লাগল ওরা। ঘামে চুপচুপে হয়ে গেল দশ মিনিটেই। হাল ছেড়ে দিয়ে মুসা বলল, দূর, খামোকা কষ্ট। এখানে কিছু পাওয়া যাবে না।

রবিন বলল, হয়তো ছিল। মূল্যবান পাথর। তুলে নিয়ে গেছে।

আমার তা মনে হয় না, একমত হতে পারল না কিশোর। পাথর-টীতর হলে দু-এক টুকরো পড়ে থাকতই। একটা কণাও নেই কেন?

তাহলে কিসের জন্যে খুড়েছিল? ইনডিয়ানদের গুপ্তধন? মুসার প্রশ্ন।

তা হতে পারে। স্প্যানিশ ভ্রমণকারীদের গুপ্তধনও হতে পারে। এই দানবের ছবিটার মধ্যেই রয়েছে এর জবাব।

তোমার ধারণা লফাররা এই গুপ্তধন খুঁজতেই এসেছিল?

আসতেও পারে।

কিন্তু কে খুঁড়ল এই গর্ত? একটা পায়ের ছাপও নেই। ভূতুড়ে ব্যাপার না? এই দুপুর রোদেও গায়ে কাঁটা দিল মুসার।

না। যে খুঁড়েছে, সে খুব চালাক লোক। পায়ের ছাপ মুছে দিয়েছে, ইনডিয়ানদের মত, গাছের ডাল দিয়ে ডলে।

মরুকগে সব! হাতের কোদালটা মাটিতে ফেলে দিল মুসা। আমার খিদে পেয়েছে।

কোদাল তুলে নিল রবিন। গর্তের নিচে আলগা মাটি যা অবশিষ্ট আছে তুলে ফেলতে লাগল। কোদালের ফলায় লেগে উঠে এল একটুকরো কাপড়।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। ওটা কি!

মুসাও উঠে এগিয়ে এল।

মাটির ভেতর থেকে বাদামী রঙের একটা রুমাল টেনে বের করল রবিন। মাটি ঝেড়ে পরিষ্কার করল। এক কোণে সুতো দিয়ে লেখা একটা অক্ষর: D.

কারও নামের আদ্যক্ষর, কিশোর বলল, যার বানানটী ডি দিয়ে শুরু।

তার মানে সেই লোক ব্রাউন কিংবা লফার নয়, রবিন বলল।

না

তারমানে, চেঁচিয়ে উঠল মুসা, মাটিও খুঁড়েছে অন্য লোকে! ভুল করে রুমাল ফেলে গেছে!

তাই তো মনে হচ্ছে।

সূত্র হিসেবে কাজে লাগতে পারে ভেবে রুমালটা পকেটে রেখে দিল রবিন।

সমস্ত আলগা মাটি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আর কোন সূত্র পাওয়া গেল না। আবার বলল মুসা, আমার খিদে পেয়েছে।

কিশোর বলল, এখানে এই রোদে বসে তো খাওয়া যাবে না। ছায়া দরকার।

কোথায় পাব ছায়া? চারপাশে তাকাতে লাগল মুসা।

মরুভূমির কিনারে পর্বত শুরু হয়েছে। সেটা দেখিয়ে কিশোর বলল, চলো, ওখানে উড়ে যাই। ছায়াও মিলবে, ঠাণ্ডাও।

উত্তম প্রস্তাব, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল মুসা।

রবিন বলল, বলা যায় না, পর্বতের ঢালে জ্যাসপারও পাওয়া যেতে পারে।

প্লেনের কাছে ফিরে এল ওরা। দরজা খুলতেই যেন ধাক্কা মারল এসে গরম বাতাস, ঝলসে দিতে চাইল চোখ-মুখ। বদ্ধ থাকায় ভেতরের বাতাস তেতে আগুন হয়ে আছে। এয়ারকুলার চালিয়ে ভেতরটা ঠাণ্ডা করে নিতে হলো।

উড়ে এসে পাহাড়ের ঢালে নামতে বিশেষ সময় লাগল না। খাবারের টিন আর পানির বোতল নিয়ে নামল তিনজনে। পর্বতের ঢালে ছায়া খুঁজতে শুরু করল।

বড় বড় পাথরের চাঙড় পড়ে আছে। ছায়ার অভাব নেই এখানে। অনেক বড় একটা চাঙড়ের নিচে বড় গর্তের মত অনেকখানি-জায়গী। তাতে বসে খাওয়া সারল ওরা। মুসা:ওখানেই চিত হয়ে শুয়ে নাক ডাকানো শুরু করল। রবিন আর কিশোর উঠল খানিকটা জায়গা ঘুরে দেখতে।

ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে ওপর দিকে হাত তুলে কিশোর বলল, ওই দেখে, একটা গুহার মুখ। ঢুকে দেখব।

চল্লিশ ফুট ওপরে রয়েছে গুহাটা। ওটার কাছে এসে ভেতরে তাকাল দু জনে।

অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না।

 পকেট থেকে টর্চ বের করল কিশোর। রবিনকে বলল, এসো, ঢুকব।

তার কথা শেষ হলো না; তীক্ষ্ণ, ভয়াবহ এক চিৎকার যেন চিরে দিল। পর্বতের নীরবতা। গুহামুখে বেরিয়ে এল একটা বিশাল জানোয়ার। গোয়েন্দাদের ওপর ঝাঁপ দেয়ার জন্যে তৈরি।

.

০৯.

হলদে চোখ মেলে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে আছে জানোয়ারটী। আমেরিকার একেক জায়গায় একেক নাম এর; কেউ বলে ওয়াইল্ড ক্যাট, কেউ বলে কুগার, আবার কেউ পার্বত্য সিংহ। ভয়ঙ্কর জীব। তামাটে চামড়ার নিচে থিরথির করে কাঁপছে অসাধারণ শক্তিশালী মাংসপেশী।

দৌড় দাও! চিৎকার করে বলল কিশোর।

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে লাফিয়ে নামতে শুরু করল সে। পেছনে রবিন। পায়ে লেগে পাথর গড়িয়ে পড়ল। ওরাও কয়েকবার পিছলে পড়তে পড়তে বাঁচল।

চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। বেরিয়ে এসে জানতে চাইল, কি হয়েছে।

জানল কিশোর।

কিশোরদের পেছনে কুগারটাকে দেখতে পেল না মুসা। পিছু নেয়নি ওটী। একবার হুঙ্কার ছেড়ে ভয় দেখিয়েই যথেষ্ট হয়েছে ভেবে ফিরে গেছে আবার গুহায়।

ধপ করে বসে পড়ল কিশোর। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওটা মেয়ে কুগার। নিশ্চয় বাচ্চা আছে গুহার মধ্যে। সেজন্যেই এত রাগ। ভেবেছে বাচ্চার ক্ষতি করতে গেছি।

গুহায় কি আছে তা তো জানলাম, রবিন বলল। আর ঢোকার দরকার নেই। ওখানে নেই ব্রাউন কিংবা লফার।

পর্বতের ঢালে বন আছে। সেটাতে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। চোখ খোলা। রাখল সূত্রের সন্ধানে। একদিকে ধসে পড়া একটা ছাউনি দেখে এগিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্দেহজনক কিছু পেল না ভেতরে।

আচমকা, ভয় ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল মুসা, এই, প্লেনের কাছ থেকে এসেছি কতক্ষণ হয়েছে। পাক্কা দুই ঘন্টা!

তাতে কি? সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কিশোরের। দরজায় তালা দেয়া আছে।

তা বটে। কিশোরের সঙ্গে এগোল মুসা, কিন্তু ভয়টা তাড়াতে পারল নী মন থেকে। খুঁতখুঁত করছে। বলল, বাপরে, বনের মধ্যেও এত গরম!

কয়েক গজ এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল মুসা। দেখো, আমার ভাল্লাগছে। না! কেমন জানি লাগছে। প্লেনটার যদি ক্ষতি করে কেউ?

এইবার আর না শুনে পারল না কিশোর। ভয়টা তার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। ফিরে চলল ওরা।

আধঘণ্টা লাগল বন থেকে বেরোতে। প্লেনটা চোখে পড়ল। ঠিকই আছে। বিরক্ত হয়ে কিশোর বলল, খামোক নিয়ে এলে! আরেকটু দেখতে চেয়েছিলাম…

বাধা দিয়ে বলে উঠল রবিন, ওই, দেখো!

মুসার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিকই সাবধান করেছে। গা শিউরানো অদ্ভুত এক দৃশ্য। শাঙ্কুব আকৃতির বিশাল একটা কি যেন মরুর বুক থেকে উঠে গেছে। আকাশের অনেক ওপরে। আগে কখনও না দেখলেও ওটা কি মুহূর্তে বুঝে ফেলল কিশোর। বালির ঘূর্ণি। ওদের দিকেই ধেয়ে আসছে।

কি-কি ওটা! চিনতে পারল না মুসা।

বালি-ঝড়! ভয় পেয়েছে কিশোর, গলা কাঁপছে। এই এলাকার লোকে বলে শয়তানের ঘূর্ণি! ঠিকই বলে, শয়তান ভর করে থাকে যেন বালির এই ঘূর্ণির মধ্যে। টর্নেডোর চেয়ে কম ভয়ঙ্কর না। প্লেনের ওপর দিয়ে বয়ে গেলে কিচ্ছু রাখবে না, ভর্তা বানিয়ে ফেলবে! জলদি সরাতে হবে! এসো!

ছুটল ওরা। ঝড় আসার আগে পৌঁছতে পারবে তো?

আরও জোরে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। রবিন আর কিশোরকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে।

প্লেনের কাছে পৌঁছল ওরা। ঝড়টা একশো গজ দূরে। এগিয়ে আসছে দ্রুত। দু-দিকের দুই ডানা চেপে ধরল কিশোর আর রবিন, মুসা ধরল লেজ।

তিনজনে মিলে ঠেলতে শুরু করল। নড়ে উঠল প্লেন। চাকায় ভর দিয়ে গড়িয়ে সরে যেতে শুরু করল। আরও জোরে ঠেলা দিল ওরা। গতি বাড়তে লাগল প্লেনের। সরে গেল অনেকখানি। বেকায়দা ভঙ্গিতে একটা পাথরে পা দিয়ে গোড়ালি মচকাল মুসা।

তবে প্লেনটাকে বাঁচাতে পারল ওরা। সামনে দিয়ে চলে গেল বালির ঘূর্ণি।

মাটিতে বসে গোড়ালি চেপে ধরে গোঙাচ্ছে মুসা।

ব্যথাটা কতখানি দেখার জন্যে তার পায়ে হাত দিতে গেল কিশোর।

চাপ লাগতে আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এমন অবস্থা, প্লেনও চালাতে পারবে না সে। তাকে এখন ফেলে রেখে তদন্ত চালানো সম্ভব নয়। অবশ্য দেখার আর নেইও কিছু।

মুসাকে প্লেনে উঠতে সাহায্য করল কিশোর আর রবিন। পাইলটের আসনে বসল এবার রবিন। রিভারসাইড কাউন্টি এয়ারপোর্টে ফিরে এল নিরাপদে।

ব্লাইদিতে মোটেলে ফিরে সবার আগে ডাক্তার ডাকা হলো।

মুসার পা ব্যান্ডেজ করে আর বেশ কিছু ট্যাবলেট গিলিয়ে দিয়ে ডাক্তার বললেন, কয়েক দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। ভালমতই মচকেছে।

রাতে ম্যাপ নিয়ে বসল কিশোর। ঠিক হলো মুসার জন্যে অপেক্ষা করবে না ওরা। সে আর রবিন বোটে করে এগিয়ে যাবে কলোরাডো নদী ধরে। ব্লাইদিতে থাকবে মুসা। জরুরী দরকার পড়লে ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিশোররী। পা ততদিনে ভাল হয়ে গেলে এবং প্লেনটীর প্রয়োজন পড়লে ওটা নিয়ে ওদের কাছে চলে যাবে মুসা।

ম্যাপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, মেকসিকোতে যেতে কত সময় লাগবে?

এমনিতে দূর তো খুব বেশি না, জবাব দিল কিশোর। একশো মাইল। কিন্তু পথ ভাল না। নদীটার দিকে তাকিয়ে দেখো–দ্বীপ আর পানির নিচে বালির চরার অভাব নেই। তার ওপর রয়েছে তিন তিনটে বাধ। অনেক সময় নষ্ট করবে।

ম্যাপ দেখে জানা গেল প্রথম বাঁধটার নাম ইমপেরিয়াল ড্যাম। ব্লাইদি থেকে আশি মাইল দূরে। দ্বিতীয়টা ল্যাওনা ড্যামি। আর তৃতীয়টা রয়েছে সীমান্ত ঘেঁষে, মেকসিকোর ভেতরে পড়েছে–মরিলস ড্যাম।

পরদিন ভোরবেলা উঠে মুসার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রবিন আর কিশোর। ঘাটে এসে দেখল, বোট তৈরি। এর মালিক কথার বেলা হয়তো হয়তো যতই করুক, কাজের বেলা ঠিক।

বোট ছাড়ল দুই গোয়েন্দা। প্রথমে হাল ধরল রবিন। নদীর পানির রঙ এখন বাদামী, ওপরটা আয়নার মত স্থির আর চকচকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রঙ বদলাবে। মরুভূমির অস্বাভাবিক নীরবতার মাঝে ইঞ্জিনের শব্দ বেশি করে কানে বাজছে।

দূ-তীরের একঘেয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে খুব শিগগিরই চোখ পচে গেল কিশোরের। সময় কাটানোর জন্যে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে বসল।

কয়েকটা বালির চরার পাশ কাটাল ওরা। ব্লাইদি থেকে একটা রাস্তা নদী পার হয়ে চলে গেছে, নদীর ওপরে ব্রিজ। সেটার নিচ দিয়ে পার হয়ে এল। বোট। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা বিশাল আকারের কৈ মাছ ধরে ফেলল কিশোর।

দূরে দেখা গেল রিপ্লির পাহাড় চূড়া। টিলাও চোখে পড়ল। চিনতে পারল। ওখানেই রয়েছে দানবীয় নকশাগুলো।

দুপুরের আগে তীরে বোট ভেড়াল রবিন। মাছগুলো নিয়ে নেমে পড়ল দু জনে। আগুন জ্বেলে রান্না করে খেতে বসল।

ইমপেরিয়াল ড্যাম আর বেশি দূরে নেই, রবিন বলল। পাঁচ ঘণ্টার বেশি তো চললাম।

খাওয়ার পর আবার বোট ছাড়ল ওর। কিছুক্ষণ পরেই বাঁধটা চোখে পড়ল। কাছে এসে ডকে বোট ভেড়াল। এই প্রথম একটা বড় ধরনের লোকালয় পাওয়া গেল। মানুষজন যা আছে, বেশির ভাগই জেলে, ডক শ্রমিক, ট্রাক ড্রাইভার।

এক ড্রাইভারের সঙ্গে খাতির করে ফেলল কিশোর। লফার আর ব্রাউনের চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইল ওদের দেখেছে কিনা।

ড্রাইভার বলল, দেখেনি। ওরা অনেক দূর থেকে খুঁজতে এসেছে শুনে আরও কয়েকজন ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করল সে। কেউ কিছু বলতে পারল না।

ওদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বোটে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। আবার বোট ছাড়ল। হাল ধরল কিশোর। আধমাইল মত যাওয়ার পর হঠাৎ একটা বালির টিবির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, দেখো, দেখো, সেই বেয়ারাটী!

.

১০.

শাই করে সেদিকে বোটের নাক ঘুরিয়ে দিল কিশোর। মাঝনদীতে রয়েছে। ওরী। কিনারে পৌঁছে বোট ভিড়িয়ে ডাঙায় নামতে নামতে অনেক সময় লাগিল। ঢিবির ওপারে আর দেখা গেল না লোকটাকে। বড় বড় পাথর আর পাহাড় রয়েছে ওখানে। কোথায় লুকিয়েছে কি করে খুঁজে বের করবে?

কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে লোকটাকে না পেয়ে আবার বোটে ফিরে এল ওরা। টিবিটীর কাছে পানিতে একটা সবুজ ঘোট মোটরবোট নোঙর করা। রবিন বলল, এই বোটে করেই হয়তো এসেছে ব্যাটা। খানিকটা এগিয়ে বসে থাকি চুপচাপ। এক সময় না এক সময় আসতেই হবে তাকে।

আবার নদীর মাঝখানে এসে নোঙর ফেলে মাছ ধরার ভান করতে লাগল দু-জনে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা লোক এসে বোটে উঠল। গায়ে নীল শার্ট। কিন্তু সে বেয়ারা নয়। তবে যে ভাবে ওদের বোটটার দিকে তাকাচ্ছে, সেটা সন্দেহজনক।

বোট ছাড়ল সে। মেকসিকোর দিকে যেতে লাগল। কোথায় যায়, দেখার জন্যে পিছু নিল গোয়েন্দারা। ওদের ধারণা হলো, সামনে কোথাও গিয়ে অপেক্ষা করবে বেয়ারার ছদ্মবেশী লোকটা। নীল শার্ট পরা লোকটা বোট তীরে ভিড়িয়ে তাকে তুলে নেবে।

আধ মাইল এগোনোর পর যেন ওদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল লোকটা। বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। শেষে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে ভেসে রইল। ওরা কাছাকাছি হলে হাত নেড়ে ডাকল।

বোট কাছে নিয়ে গেল কিশোর।

ককশ স্বরে জিজ্ঞেস করল লোকটা, আমার পেছনে লেগেছ কেন?

নিরীহ স্বরে কিশোর জবাব দিল, কই? আপনি যেদিকে যাচ্ছেন আমরাও সেদিকে যাচ্ছি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইল লোকটা। আবার বোট ছাড়ল। আগের মতই পেছনে লেগে রইল গোয়েন্দারা।

ল্যাশুনা ড্যাম দেখা গেল। রিজারভয়েরের ভেতরে ঢুকে আবার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল লোকটা। কিশোরদের ডেকে বলল, এবার কিন্তু আমি পুলিশ ডাকব!

ডাকুন না, জবাব দিল কিশোর। অন্যায় কিছু করিনি আমরা।

রবিন বলল, আপনার আর ডাকার দরকার হবে না। ওই যে পুলিশ আসছে।

পুলিশের লঞ্চ দেখেই ঘাবড়ে গেল লোকটা। গতি বাড়িয়ে ছুটতে শুরু করল। বাধা পেরিয়ে গিয়ে তীরে ভেড়াল নৌকা। লাফিয়ে ডাঙায় নেমে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দূরবীন চোখে লাগিয়ে বোটটাকে দেখছে একজন অফিসার। কাছাকাছি বোট নিয়ে গেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে, অফিসার?  বোটটা চুরি করে এনেছে ও, অফিসার জবাব দিল। সকালে রিপোর্ট করা হয়েছে আমাদের কাছে। তোমরা মনে হলো ওটার পিছু লেগেছিলে? কেন?

অল্প কথায় বুঝিয়ে বলল কিশোর, ওরা গোয়েন্দা। নিখোঁজ একজন মানুষকে খুঁজতে বেরিয়েছে। বেয়ারার ছদ্মবেশী লোকটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কি করে সবুজ বোটের পেছনে লেগেছে বলল।

কিশোররা মেকসিকোতে যাচ্ছে শুনে অফিসার বলল, নোকটাকে ধরতে যাচ্ছি আমরা। কি করতে পারলাম জানার ইচ্ছে থাকলে ইয়োমাতে গিয়ে থানায় খোঁজ কোরো। মেসেজ দিয়ে রাখব।

গতি বাড়িয়ে চলে গেল লঞ্চটা।

কিশোররাও এগোতে থাকল। পথে যেখানেই মানুষ-জন দেখতে পেল, জেলে নৌকা দেখল, থামিয়ে লফার আর ব্রাউনের খোঁজ নিল। কিন্তু ওরকম কাউকে দেখেছে বলে কেউ বলতে পারল না।

কেটে গেল দিনটা। সূর্য ডুবল। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল। নদীর কিনারে আর পানির ওপর পোকা খুঁজতে বেরোনো পাখিগুলোকে অস্পষ্ট লাগছে। আকাশের পটভূমিতে বাদুড়ের দলকে লাগছে কেমন অপার্থিব।

থামার সময় হয়েছে, কিশোর বলল।

নদীর মাঝে একটা বালির চরার ধারে নোঙর ফেলল ওরা। খাবারের টিন আর স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে নামল। ওখানেই ক্যাম্প করে রাত কাটানোর ইচ্ছে।

আগুন জেলে রান্না করতে বসল রবিন। হাত-পা ছড়িয়ে পাশে বসে রইল কিশোর। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল মাংস ভাজার সুগন্ধ। মাখন মাখানো পাউরুটি, ভাজা মাংস, পনির, আপেলের সস, আর টিনে করে আনা সেদ্ধ বাঁধাকপি দিয়ে খাওয়া সারল ওরা। ঢুকে পড়ল স্লীপিং ব্যাগের মধ্যে।

আকাশে তারার মেলা। নীরব রাত। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মাঝে নির্জন বালির চরায় শুয়ে থাকা। সে এক বিচিত্র অনুভূতি। খুব ভাল লাগছে কিশোরের। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, জন্মটা সার্থক।

নিরাপদে রাত কাটল। পরদিন ভোরে রওনা হলো আবার ওরা। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ইয়োমাতে পৌঁছে থানায় খোঁজ নিতে চলল। ওদেরকে স্বাগত জানাল ডিউটি অফিসার। নাম শুনে চিনতে পারল। লঞ্চ থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে তার কাছে, বোঝা গেল।

তবে গোয়েন্দাদের নিরাশ করল অফিসার। বোট চোরকে ধরা যায়নি। পুলিশের হাত ফসকে পালিয়ে গেছে লোকটা। তার পরিচয়ও জানতে পারেনি পুলিশ।

থানা থেকে বেরিয়ে বোটে এসে উঠল দু-জনে। তারপর আবার এগিয়ে চলী।

.

১১.

 দুপুরের পর সীমান্ত পেরিয়ে মেকসিকোর সোনোরা রাজ্যে ঢুকল ওরা। চেকপোস্টে খুব কড়াকড়ি। ডিউটি অফিসার ওদের জানাল, চোরাচালানি আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা নাকি ইদানীং খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। লফার আর ব্রাউনের কথা অফিসারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কিন্তু কিছু বলতে পারল না অফিসার।

বিকেলের ভয়ানক কড়া রোদের মধ্যে এগিয়ে চলল বোট।

বেশ কয়েক মাইল এগোনোর পর নদীর তীরে কয়েকটা ঝোপের ধারে পাঁচ-ছয়টা ছেলেমেয়েকে জটলা করতে দেখা গেল। নদীতে গোসল করতে এসেছে ওরা। সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর এই প্রথম মানুষ দেখতে পেল। গোয়েন্দারা। বচ্চিাগুলোর দিকে এগিয়ে গেল ওরা।

ওরাও বোট দেখে এগিয়ে এল। কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল। স্থানীয় ইনডিয়ানদের ছেলেমেয়ে।

হাত নেড়ে ডাকল কিশোর। কিন্তু কাছে এল না ওরা। ভয় পাচ্ছে। শেষে এক বুদ্ধি করল সে। বোট থেকে মাটিতে নেমে পকেট থেকে চিউয়িং গাম বের করল। এইবার গুটিগুটি এগিয়ে এল ছেলেমেয়েগুলো।

সহজেই ভয় কাটিয়ে দিল ওদের কিশোর আর রবিন। ইংরেজি জানে না ওরা, তবে স্প্যানিশ বোঝে। ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে ওদের কাছে জানতে চাইল, কোন বিদেশীকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছে কিনা।

একটা ছেলে জবাব দিল, দেখেছে। এই প্রথম হ্যাঁ-বাচক জবাব পেয়ে সতর্ক হলো গোয়েন্দারা। ছেলেটার বাড়ি কোথায়, জিজ্ঞেস করল। হাত তুলে পাহাড়ের দিকে দেখিয়ে দিল ছেলেটা।

বোট ঘাটে রেখে ছেলেটার সঙ্গে ওদের বাড়িতে চলল দুই গোয়েন্দা, তার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। দল বেঁধে ওদের সঙ্গে চলল বাকি ছেলেমেয়েগুলো। চিউয়িং গাম পেয়ে খুব খুশি ওরা। যে কোন সাহায্য করতে রাজি।

পাহাড়ের কোলে ওদের বাড়িঘর। যে ছেলেটী বিদেশী লোক দেখেছে বলেছে, তার বাবা কৃষক। ছেলের কথা সমর্থন করল। বলল, আমি দেখিনি, তবে শুনেছি। রিটার দিকে গেছে। আমেরিকান।

কি করে গেছে, জানতে চাইল কিশোর।

কৃষক জানাল, মরুভূমি দিয়ে এসেছিল লোকটা। কয়েক মাইল দূরে রেলস্টেশন আছে, রেলগাড়ি চলাচল করে। লোকটা লাইন ধরে হেঁটে গেছে সভবত স্টেশনে, তারপর গাড়িতে করে গেছে, ঠিক জানে না কৃষক।

কোন দিকে কি ভাবে যেতে হবে, জেনে নিল কিশোর। রবিনের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করল, ওরাও ওই পথেই যাবে। তাহলে হয়তো আরও খোঁজ মিলতে পারে। ঘাটে বোট রেখে যাবে। কৃষককে অনুরোধ করে বলল, সে বোটটা দেখেশুনে রাখতে রাজি হলে তাকে টাকা দেয়া হবে।

রাজি হলো কৃষক। অতএব আর কোন দ্বিধা নয়। রেললাইনের দিকে হাঁটা শুরু করে দিল দুই গোয়েন্দা।

কয়েকশ গজ এগোতেই চোখে পড়ল রেললাইন।

ঘড়ি দেখল কিশোর। ছটা বাজে। রেললাইন ধরে এগোলে রাতের আগে পৌঁছে যেতে পারবে স্টেশনে।

স্লীপার আর লাইনে ফেলে রাখা পাথর মাড়িয়ে এগিয়ে চলল ওরা।

ঘণ্টাখানেক চলার পর লাইনের ধারে ছোট একটা বাড়ি দেখা গেল। ওটাই স্টেশন। সেখানে এসে দেখা গেল একজন মাত্র লোক স্টেশনটা চালাচ্ছে। স্টেশন মাস্টার থেকে লাইনম্যান–সব সে একাই। তার নাম কাপারিলো। বিদেশী এবং আমেরিকা থেকে এসেছে শুনে বিশেষ খাতির করতে লাগল। ওরা গোয়েন্দা শুনে খাতিরের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল।

জানা গেল, কিছুক্ষণ পরই একটা মালগাড়ি আসবে, উত্তরে মেক্সিকালিতে যাবে। কিশোররা যেতে চাইলে তাতে ওদেরকে তুলে দেয়া সম্ভব হবে, এবং ওরা গোয়েন্দা বলেই এই কাজটা করতে রাজি আছে কাপারিলো। তবে যেহেতু মালগাড়িতে করে যাবে, টিকেট দিতে পারবে না। মালগাড়ি যাত্রী বহন করে না, সুতরাং টিকেট দেয়ারও নিয়ম নেই।

 কথায় কথায় কিশোর জানতে চাইল, আচ্ছা, কিছুদিনের মধ্যে আর কোন আমেরিকানকে এ স্টেশনে আসতে দেখেছেন? গত দু-তিন মাসের মধ্যে?

একটা মুহূর্ত নীরব থেকে মনে করার চেষ্টা করল যেন কাপারিলো। বলল, দেখেছি। ছোট্ট স্টেশন, যাত্রী খুব কম আসে। বিদেশী তে আরও কম। সে জন্যেই মনে আছে। কয়েক হপ্তা আগে একজন ঠিক এ রকম সময়েই হেঁটে এসে হাজির। স্টেশনে মালগাড়ি থামলে আমরা মাল খালাস করছি, এমন সময় দেখি চুরি করে একটা বগিতে উঠে পড়ল লোকটা।

হবে হয়তো কোন ভবঘুরে, রবিন বলল। টাকা ছিল না, তাই চুরি করে উঠেছে।

আমিও তাই ভেবেছি। গিয়ে ধরলাম। কাকুতি-মিনতি শুরু করল। লোকটা। বলল, আমেরিকা থেকে এসেছে। গাড়িতে থাকতে দিতে বলল। কারা নাকি তাকে তাড়া করেছে।

পুলিশ? বেআইনী ভাবে মেকসিকোতে ঢুকেছে লোকটা?

কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। তা তো জানি না। মরুভূমির ওপর দিয়ে অনেক পথ হেঁটে এসেছে। ওর অবস্থা দেখে দুঃখই লাগল। হঠাৎ মরুভূমির রাস্তায় হেডলাইট দেখলাম। একটা গাড়ি আসছিল। দেখেই লোকটা বলল, তাকে ধরতে আসছে ওরা। ট্রেনটা তখন ছাড়ার সময় হয়েছে। ভাবলাম, থাকগে, যকি। সত্যি হয়তো বিপদে পড়েছে লোকটা।

ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর স্টেশনে পৌঁছল গাড়িটা। লাফিয়ে নামল দু-জন লোক, আমেরিকান বলে মনে হলো। আমাকে জিজ্ঞেস করল কোন ভবঘুরেকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছি কিনা। লোকটা নাকি অপরাধী। কিন্তু আমার কাছে তাকে ওরকম মনে হয়নি।

তারপর? জানতে চাইল কিশোর। বুকের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তেজনা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে, এতদিনে আসল খবরটা পাওয়া গেছে।

ভ্রূকুটি করল কাপারিলো। বরং ওই লোকগুলোকেই খারাপ মনে হলো আমার। অনেক দিন আমেরিকায় ছিলাম আমি। ওখানকার অপরাধী দেখেছি। কি রকম অচিরণ করে জানি। বিশ্রী ভাষায় কথা বলে, গাল দেয়। বিশালদেহী, রুক্ষ চেহারার ওই দু-জনও এ রকমই করছিল।

উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারল না রবিন। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল যাতে কাপারিলো বুঝতে না পারে, ওই ভবঘুরেই নিশ্চয় লফার! আর লোকগুলো মনে হয় সেই দু-জন, যারা তার অফিসে গিয়ে তার সেক্রেটারিকে হুমকি দিয়েছে!

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মনে হয়।

কাপারিলোর দিকে তাকাল রবিন। জিজ্ঞেস করল, ভবঘুরে লোকটা লম্বা, না খাটো? দেখতে কেমন?

লম্বা। হালকা-পাতলা। মনে হলো অনেক পথ হেঁটে এসেছে। ভীষণ ক্লান্ত।

হু, মাথা দোলাল কিশোর। উত্তরে, সীমান্তের দিকে।

তাহলে, নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর, লফার এখনও বাড়ি পৌঁছল না কেন?

 হয়তো ধরা পড়েছে, রবিন বলল। যারা তার পিছে লেগেছিল, তারা ধরে ফেলেছে। কিংবা হয়তো তার বাড়ির ওপর নজর রাখা হয়েছে ভেবে ভয়ে বাড়িতে ঢুকছে না। অথবা এমনও হতে পারে, কোন বিপদে পড়েছে তার বন্ধু ব্রাউন, তাকে উদ্ধার করার জন্যে মেকসিকোতে রয়ে গেছে সে।

এইটা হতে পারে। ব্রাউনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নিজেদের মধ্যে। কথাগুলো বাংলায় চালিয়ে যাচ্ছে কিশোররা। কিন্তু সে লফারের সঙ্গে ছিল না কেন? মরুভূমি পেরিয়ে লফার একা এল কেন?

এই সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। দেখা গেল হেডলাইট।

কাপারিলো বলল, ওই যে, ট্রেন আসছে।

পতাকা দেখিয়ে ট্রেন থামাল সে। একটা বক্সকার দেখিয়ে তাতে উঠে যেতে বলল ছেলেদের।

কাপারিলোর সাহায্যের জন্যে তাকে অনেক ধন্যবাদ দিল কিশোর আর রবিন। হাত মেলাল। অন্ধকারে গা ঢেকে উঠে পড়ল বক্সকারে।

কয়েকটা মালের বাক্স গার্ডের গাড়িতে তুলে দিল কাপারিলো। আবার চলতে শুরু করল ট্রেন।

.

১২.

বক্সকারের বিশাল খোলা দরজার পাশে হাঁটু মুড়ে বসেছে কিশোর আর রবিন। ভেতরে আলো নেই। বাইরে চাঁদের আলো। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। সীমাহীন বালির রাজত্বে ছোট ছোট ঝোপঝাড় আছে। কোথাও মাথা তুলেছে পাথরের পাহাড়। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে বুনো জানোয়ার। আর কচিত-কদাচিত চোখে পড়ে একআধটা নিঃসঙ্গ মাটির তৈরি বাড়ি, এই এলাকায় অ্যাডবি নামে পরিচিত। এত রাতে আলো দেখা গেল না। কোন বাড়ির জানালায়।

এরপর কি করব আমরা? জিজ্ঞেস করল রবিন।

ট্রেনটা যতদূর যায়, যাব। লফার নিশ্চয় এইই করেছিল। গিয়ে দেখি, কি ঘটে?

 অহেতুক বসে থেকে লাভ কি? একটু ঘুমিয়ে নিই। গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। বাপরে বাপ, যা ঝাঁকি! ঘুমানো লাগবে না!

কিশোরও শুয়ে পড়ল তার পাশে।

ঝাঁকি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ঘুম ভাঙল ওদের। ট্রেন থেমে গেছে। লোকের কথা শোনা গেল। একটা মুখ উঁকি দিল বক্সকারের দরজায়। হাসি হাসি একটা কণ্ঠ বলল, ওঠো, উঠে পড়ো। আমেরিকায় যাওয়া আর তোমাদের হলো না।

ইউনিফর্ম দেখেই চিনে ফেলল কিশোর। বিড়বিড় করল, মেকসিকান পুলিশ!

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। বর্ডার পুলিশ। মেকসিকোতে এটা শেষ স্টেশন। অবৈধ যাত্রীকে দেখলেই আমরা এখানে নামিয়ে নিই।

তারমানে মেকসিকালিতে এসে গেছি?

হ্যাঁ, এসেছ। নামো তো এবার, আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। দেরি দেখলে বিরক্ত হয়ে যাবে, ব্যঙ্গের সুরে বলল পুলিশ অফিসার।

বক্সকার থেকে নামিয়ে ট্রেনের সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো কিশোরদের। ইঞ্জিনের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। সবার পরনেই ময়লা, মলিন পোশক। দরিদ্র কৃষক কিংবা শ্রমিক শ্রেণীর লোক সবাই।

কারা ওরা? রবিনের প্রশ্ন।

কিশোর জবাব দিল, হবে হয়তো আমাদেরই মত টিকেট ছাড়া যাত্রী। বেআইনী ভাবে বর্ডার পার হতে চেয়েছিল, আটকে দিয়েছে পুলিশ।

বড় একটা লরির পেছনে তোলা হলো ওদের।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? আবার প্রশ্ন করল রবিন।

জেলে হবে, আর কোথায়!

কিন্তু আমাদের জেলে নেবে কেন? আমরা তো অবৈধ ভাবে সীমান্ত পার হতে চাইনি!

চলতে শুরু করল লরি।

কিছুক্ষণ পর থানার শান বাঁধানো চত্বরে এসে ঢুকল। এগিয়ে এল কয়েকজন অস্ত্রধারী গার্ড। বন্দিদের নামিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হলো।

কিশোর আর রবিনকে লাইন থেকে বের করে দিল একজন অফিসার। আবার লরিতে ওঠানো হলো ওদের, তবে পেছনে নয়, সামনে, ড্রাইভারের পাশে। আবার পথে বেরিয়ে এল লরি। শহরের দিকে চলল।

অবাক হয়ে জানতে চাইল কিশোর, কি ব্যপিরি? আমাদের কোথায় নিচ্ছেন?

চোরাচালানি ধরার চেষ্টা করছে পুলিশ, জবাব দিল ড্রাইভার। তাই ট্রেন থেকে নোক নামিয়ে ধরে এনেছে। তোমরা নিশ্চয় তিন গোয়েন্দার লোক? শহরে নিয়ে গিয়ে তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাকে। সেটাই করছি।

আশ্চর্য! রবিন বলল। আমাদের নাম জানল কি করে?

 মিস্টার সাইমনের হাত নেই তো এতে? কিশোরের প্রশ্ন।

কি জানি? তবে কি তিনি আশেপাশেই কোথাও আছেন? লফারের। কেসটা নিজেই নিয়েছেন?

খোদাই জানে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

আলগোডোনেসে।

তাহলে আমাদের বোটটার কি হবে? আনব কি করে ওটা? প্রশ্নটা অবশ্য ড্রাইভারকে করল না কিশোর, নিজেকে করল।

তোমরা গোয়েন্দা, তাই না? পুলিশের হয়ে কাজ করছ?

হ্যাঁ। একজন আমেরিকান ভদ্রলোককে খুঁজছি। মেকসিকোতে এসে হারিয়ে গেছে।

তোমাদের বোটের কথা কি যেন বললে? কোথায় ওটা?

 কোথায় আছে জানাল কিশোর।

ড্রাইভার বলল, পুলিশ তোমাদের সাহায্য করবে। তোমরা হোটেলে উঠে বিশ্রাম নাও। বোটটা আনানোর ব্যবস্থা করব আমরা।

এক কাপড়ে চলে এসেছে। ঘণ্টাখানেক পর আলগোডোনেসের একটা দোকানে ঢুকল কিশোররা কিছু কাপড়-চোপড় কেনার জন্যে। খাঁটি মেকসিকান পোশাক কিনে পরল। মাথায় চাপাল উজ্জ্বল রঙের ব্যানডানা হ্যাট। উঁচু হিলওয়ালা মেকসিকান বুট কিনে পায়ে দিল।

শহরের সবচেয়ে বড় হোটেলটায় এসে রুম নিল ওরা। দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল কিশোরের মাথায়। নিজের নামকে স্প্যানিশ বানিয়ে লিখল, কিশোরীস্কো প্যাশোয়ে। আর রবিনের নাম রবিনাস্কো মিলফোর্ডো।

নাম দেখে মাথা দুলিয়ে ক্লার্ক বলল, বাহ, চমৎকার নাম। এক্কেবারে নতুন, আর কখনও শুনিনি।

হাসতে শুরু করল রবিন। বাংলায় জিজ্ঞেস করল, মানে কি এই নামের?

আমি কি জানি! আমেরিকার ফ্র্যাঙ্ক যদি মেকসিকোতে এসে ফ্রান্সিস্কো হয়ে যায়, কিশোরের কিশোরাস্কো হতে দোষ কি?

অকাট্য যুক্তি। চুপ হয়ে গেল রবিন।

ক্লার্ককে অনুরোধ করল কিশোর, আপনাদের গেস্ট বুকটা একটু দেখতে পারি? আমাদের দুজন বন্ধু আসার কথা। দেখি নাম আছে নাকি?

তোমাদের বন্ধুরা কি জেলে?

না, তবে নৌকা নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিল। আমদের চেয়ে বয়েস অনেক বেশি, চল্লিশের কাছাকাছি। দু-জনেরই হালকা-পাতলা শরীর, একজন বেশি লম্বা। নাম লফার।

মাথা নাড়ল ক্লার্ক। ওরকম কেউ ওঠেনি হোটেলে।

রেজিস্টার ঘেঁটে কিশোরও কিছু বের করতে পারল না। খাতাটা ঠেলে দিয়ে বলল, হয়তো অন্য কোন হোটেলে উঠেছে আমাদের বন্ধু। একজনের অবশ্য ঘোড়র প্রতি আকর্ষণ আছে। কাছাকাছি কোন ঘোড়ার রঞ্চি থাকলে, আর শেটল্যাণ্ড পনি থাকলে সেখানে উঠেও যেতে পারে।

তাহলে তো এদিকে তার আসারই কথা নয়, হাসিমুখে বলল ক্লার্ক। বর্ডারের কাছে একটা পনি ব্যাঙ্ক আছে ইয়োমা আর আড্রাডির মাঝামাঝি। নাম কুপার র‍্যাঞ্চ।

থ্যাংকস, হেসে বলল কিশোর। মনে হচ্ছে ওখান থেকেই বের করে আনতে হবে ওকে।

ঘরে ঢুকেই রবিন জিজ্ঞেস করল, কুপার রাঞ্চে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?

সূত্র যখন একটা পাওয়া গেছে, গিয়ে দেখাই উচিত।

তা-ও বটে। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়ার জন্যে রেস্টুরেন্টে নেমে এল ওরা। ওখান থেকে ফোন করল ব্লাইদিতে, মুসার কাছে।

ভেসে এল মুসার হাসিখুশি কণ্ঠ, বেঁচে তাহলে আছ?

না, হেসে জবাব দিল রবিন, পরপরি থেকে করছি। তবে বেহেশতেই আছি বলতে পারো। দোজখে যাইনি। তারপর খবর বলল।

আমি ভালই আছি। পায়ের ব্যথা সেরেছে। লফারের খোঁজ পেয়েছ?

পেয়েছি। তবে ঠিক কোথায় আছে বলতে পারছি না।

ও। আমিও এখানে বসে নেই। পা একটু ভাল হতেই প্লেন নিয়ে বেরিয়েছিলাম। মরুভূমির ছবি তুলে এনেছি। রাতের মরুভূমি যা দারুণ লাগে।

রাতের বেলা মরুভূমিতে গিয়েছিলে তুমি! ভূতের ভয় করেনি?

আমি একা যাইনি। একজন বন্ধু জুটে গেছে। একটা প্রাইভেট প্লেনের পাইলট, নাম ওয়ারনার বল। আমার ইনফ্রারেড ক্যামেরাটার ভক্ত হয়ে গেছে।

হু। কিশোর বলছে, প্রতিদিন এ সময় তোমাকে মোটেলে থাকতে। ফোনে যোগাযোগ করব। গুড বাই।

লাইন কেটে দিল রবিন। কিশোরকে খবর জানাল।

পরদিন সকালে শহরে লফার আর ব্রাউনের খোঁজ নিতে বেরেলি দু জনে। দোকানপাট, পেট্রোল স্টেশন, রেস্টুরেন্ট-সমস্ত জায়গায় ঘুরল। কোন লাভ হলো না। দুপুর নাগাদ ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে এল।

বিকেলে ওদের খোঁজ নিতে এল পুলিশের সেই ড্রাইভার। জানাল, ডকে নিয়ে আসা হয়েছে ওদের বোটটী।

হোটেল ছেড়ে দিল কিশোর। ডকে চলল।

 ঘণ্টাখানেক পরই আবার বোটে করে নদীপথে ইয়োমার দিকে ফিরে চলল দুই গোয়েন্দা। বিকেলের উত্তপ্ত রোদ থাকতে থাকতেই আরেকবার সীমান্ত অতিক্রম করল। আরও কিছুক্ষণ পর চোখে পড়ল ইয়োমা ডক।

ডকে এসে বোট বাঁধল ওর। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল কিশোর, কুপার ব্ল্যাঞ্চটা কোথায়। জানল, ওখান থেকে মাইল দুয়েকও হবে না।

দু-জনে দুটো রাকস্যাক বেঁধে নিয়ে নেমে পড়ল বোট থেকে। হেঁটে চলল মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া একটা সরু পথ ধরে।

চোখে পড়ল র‍্যাঞ্চের নিচু ছাতওয়ালা বাড়ি, আর ঘোড়া রাখার কোরাল।

রবিন বলল, জুতো না খুলে আর পারছি না। উফ, বাপরে বাপ, ফোঁসকা পরে গেছে। নতুন জুতো পরে আসাই বোকামি হয়ে গেছে!

বসে পড়ল সে। জুতো খুলে বিশ্রাম দিল পা দুটোকে। আবার পায়ে দিয়েই উঁক করে উঠল।

কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল কিশোর।

কি জানি মনে হলো বঁড়শি বিঁধেছে!

জুতোর মধ্যে বঁড়শি আসবে কোত্থেকে? ভুল করে একআধটা ভেতরে ফেলেনি তো?

নাহ, দেখার জন্যে আবার জুতোটা খুলে নিয়ে উপুড় করতেই টুপ করে পড়ল একটা ছোট, খড় রঙের জীব। কাঁকড়ার মত দাঁড়া, আর টিকটিকির মত লেজ। লেজটা ওপর দিকে বাঁকানো। মাথাটা সুচের মত চোখ।

সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাকড়া বিছে! সাংঘাতিক বিষাক্ত! বিষ বেশি ঢুকে থাকলে বারোটা বাজিয়ে দেবে!

বিছেটাকে জুতো দিয়ে পিষে মেরে ফেলে, তাড়াতাড়ি কাপড় ছিঁড়ে রবিনের পায়ে টনিকেট বেঁধে দিল কিশোর, যাতে রক্তবাহিত হয়ে বিষ হৃৎপিণ্ডে পৌঁছতে না পারে। ওখানে পৌঁছলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে বিষ। জিজ্ঞেস করল, হাঁটতে পারবে?

মাথা কাত করল রবিন, পারব।

কিশোরের কাঁধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগেল সে।

ওদেরকে আসতে দেখল দু-জন কাউবয়। রবিনের অবস্থা দেখে এগিয়ে এল। একজনের নাম রস ডুগান, আরেকজন চাক হারপার।

রবিনকে র‍্যাঞ্চে নিয়ে যেতে সাহায্য করল ওর।

হই-চই শুনে র‍্যাঞ্চের মালিক মিস্টার কুপারও বেরিয়ে এলেন। ভেতরে নিয়ে গেলেন রবিনকে। বরফ আনতে বললেন।

দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো বের করে আনল চাক হারপার।

ইতিমধ্যে বিষ-নিরোধক একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছেন রবিনকে কুপার। আহত জায়গায় বরফ ডলে দিতে লাগলেন। বললেন, ভাগ্যিস র‍্যাঞ্চের কাছে এসে কামড় খেয়েছ। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা না হলে মারাও যেতে পারতে! তা যাচ্ছিলে কোথায়?

আপনার এখানেই আসছিলাম, জবাব দিল কিশোর। একজন লোকের খোঁজে। লফারের চেহারার বর্ণনা দিল সে।

নিক কোরাসনের কথা বলছে না তো! বলে উঠল রস ডুগান।

নিক কোরাসন! বিড়বিড় করল কিশোর, নাম বানিয়ে বলেছে হয়তো। কুপারের দিকে তাকাল আবার, তারমানে ওরকম চেহারার একজন লোক আছে আপনাদের এখানে?

ছিল। এখন নেই। দুই হপ্তা চাকরি করেছে আমার এখানে।

১৩.

 সব কথা খুলে বলতে অনুরোধ করল কিশোর।

বলার তেমন কিছু নেই, কুপার বললেন। হঠাৎ একদিন এসে হাজির। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ময়লা কাপড়-চোপড়। যেন একটা ভূত। প্রথমে চাকরি দিতে চাইনি। কিন্তু খেপে যাওয়া একটা পনিকে যে ভাবে সামলাল, বুঝলাম ঘোড়ী চেনে, ঘোড়ার স্বভাব বোঝে। দিয়ে দিলাম চাকরি।

কোন সন্দেহ রইল না আর কিশোরের, নিক কোরাসনই মাটি লফার। জিজ্ঞেস করল, একা এসেছিল, না সঙ্গে অন্য কেউ ছিল?

 একাই এসেছিল, মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন কুপার, কিন্তু রাখতে পারলাম না! শেটল্যাণ্ড পনির ব্যাপারে এত জ্ঞান আমি আর কারোর দেখিনি। লোক হিসেবেও ভাল। আমার খুব কাজে লাগত। কতভাবে চেষ্টা করলাম রাখার জন্যে, থাকল না। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। দাঁড়াও, একটা জিনিস এনে দিচ্ছি। দেখো, কোন উপকার হয় কিনা তোমার। বাংকে ফেলে গিয়েছিল কোরাসন।

রসকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন কুপার।

রবিন বলল, কিশোর, কোন কারণে ব্রাউনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে লফার। উত্তরে চলে গেছে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। নামও গোপন করেছে। কারও কাছ থেকে ভাগছে মনে হয়। কাকে ভয় করছে?

আছে কোন শত্রু। সেই শত্রু তাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। তাই আমাদের অনুসরণ করছে। ভাবছে, আমরা তাকে লফারের কাছে নিয়ে যাব।

তাহলে বুঝতে হবে ওদের হাত থেকে লফার ফসকেছে যে বেশিদিন হয়নি। নইলে আমাদের বাধা দিত না শত্রুরা। চুপচাপ থেকে বরং আমাদের পিছে পিছে আসত।

কিশোর, এটাই আমাদের সুযোগ। একটা ফাঁদ পাততে পারি।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন কুপার। হাতে একটা সাধারণ পোস্ট কার্ড। বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দেখো, কিছু আছে কিনা।

মনযোগ দিয়ে কার্ডটা দেখল কিশোর। ঠিকানার লেখাগুলো কেমন জড়ানো। বলল, ডেনভার থেকে পোস্ট করা হয়েছে, নিক কোরাসনের নামে।

কি লেখা আছে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে রবিন। কীকে সম্বোধন করে লিখেছে?

কার্ডটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। ডিয়ার মার্টি।

তারমানে লফারকেই লিখেছে! আর কি লিখেছে?

মাত্র তিনটে অক্ষর, কার্ডটা রবিনের দিকে কাত করে ধরল কিশোর।

রবিনও দেখতে পেল, ঘন কালো কালিতে লেখা রয়েছে শুধু: YES

আর কিছু নেই।

অবাক হয়ে বলল রবিন, মানে কি এর?

কুপারও একই প্রশ্ন করলেন। কি মানে?

কিশোর বলল, মনে হয় এই প্রশ্নটার জবাব আমি দিতে পারব। তবে তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন, মিস্টার কুপার। এই কোরাসন ওরফে লফারকে সাহায্য করার চেষ্টা কি সত্যি আপনি করবেন?

করব না মানে? আমার দেখা সবচেয়ে বড় ঘোড়া বিশেষজ্ঞ। তাকে পেলে যে কোন র‍্যাঞ্চার বর্তে যাবে।

হাসল কিশোর। কিন্তু কাউবয় হিসেবে তাকে তো আপনি পাবেন না, মিস্টার কুপার। লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় ব্যবসায়ী এই লোক। কারখানার মালিক। আমার সন্দেহ এখন জোরদার হচ্ছে, তাকে কিডন্যাপই করা। হয়েছিল। কিডন্যাপারদের হাত থেকে পালিয়েছে। কোন কারণে পুলিশের কাছে যায়নি। কিডন্যাপাররা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওদের ধরতে আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?

করব, জবাব দিতে একটুও দ্বিধা করলেন না কুপার।

গুড। রবিন বলছে ফাঁদ পেতে ওদের ধরার চেষ্টা করলে কেমন হয়? আমিও তার সঙ্গে একমত। রবিন, কি ভাবে ফাঁদ পাতবে, ভেবেছ নাকি কিছু?

মাথা নাড়ল রবিন। না। তুমি একটা বুদ্ধি বের করো।

কুপরের দিকে তাকাল কিশোর। মিস্টার কুপরি, আপনার দুই সহকারীর সাহায্যও লাগবে আমাদের। রস আর চাককে আমাদের ছদ্মবেশ নিতে হবে। আমাদের পোশাকগুলো পরে অন্ধকারে গিয়ে বোটে উঠবে।

কিডন্যাপাররা ভাববে আমরাই উঠেছি, রবিন বলল। তারপর?

আমরা র‍্যাঞ্চের পোশাক পরে কাউবয় সেজে র‍্যাঞ্চের গাড়ি নিয়ে আগেই গিয়ে বসে থাকব। চোখ রাখব বোটের ওপর। দেখব, রস আর চাকের পেছনে কেউ লাগে কিনা। লাগলে তাকে ধরার চেষ্টা করব। কি মনে হয়, মিস্টার কুপার? কাজ হবে?

একটা কথাও না বলে উঠে দরজার কাছে চলে গেলেন কুপার। গলা চড়িয়ে ডাকলেন, কোরিন, রস আর চাককে আসতে বলো তো।

দুই কাউবয় এলে ওদেরকে তার পরিকল্পনার কথা বলল কিশোর। এক কথায় রাজি হয়ে গেল ওরা। লফারকে ওরাও পছন্দ করত। তা ছাড়া র‍্যাঞ্চের একঘেয়ে জীবনে উত্তেজনার খোরাক পেয়েছে।

এইবার বলো, কুপার বললেন, পোস্ট কার্ডের লেখাটার মানে কি?

কিশোর হাসল। নিজেকে লফারের জায়গায় কল্পনা করুন। মেকসিকো থেকে পালিয়ে এসেছে সে। পকেটে টাকা নেই, সাহায্য করার কেউ নেই, বাড়তি যন্ত্রণা হিসেবে কিডন্যাপাররা লেগে আছে পেছনে। শেটল্যাণ্ড পনির ব্যাপারে জ্ঞান আছে তার। সেই জ্ঞানকে পুঁজি করে র‍্যাঙ্কে চাকরি নিয়েছে, দুটো কারণে কিছু টাকা উপার্জন, এবং খাওয়া আর বিশ্রাম। কিন্তু এখানে থেকেও স্বস্তি পায়নি…

কেন?

বুঝে ফেলল রবিন। বলল, মেকসিকোর বেশি কাছাকাছি বলে। কিডন্যাপরির সহজেই তার খোঁজ পেয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আরও দূরে সরে যেতে চাইল সে। তখন ডেনভারের এক বন্ধুর কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখল। সম্ভবত জানতে চেয়েছে তার কাছে কোন চাকরি আছে কিনা। সেই বন্ধু জবাব দিয়েছে। ইয়েস বলে। এ ভাবেই জবাব দেয়ার কথা চিঠিতে লিখে দিয়েছিল লফার। কিন্তু ভুল করে মার্টির নাম সম্বোধন করে ফেলেছে।

শিস দিয়ে উঠলেন কুপার। তারমানে ডেনভারে চাকরি করতে চলে গেছে! কি চাকরি?

যে ব্যাপারে সে বিশেষজ্ঞ, জবাব দিল কিশোর। শেটল্যাণ্ড পনি। আমি শিওর, ওখানকার কোন ঘোড়ার র‍্যাঞ্চেই পাওয়া যাবে তাকে।

ঠিক! তুড়ি বাজালেন কুপার। অতি সহজ এই ব্যাখ্যাটা আগে আমার মাথায় ঢুকল না কেন?

সূর্য ডোবার আগে আগে বেরিয়ে পড়ল রবিন আর কিশোরের পোশাক পরা দুই কাউবয়। ডকে এসে লাল-সাদা বোটটায় উঠল। তীরে কয়েকজন জেলে আর শ্রমিক ঘোরাঘুরি করছে। তাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল কিশোর বেশী চাক, সব ঠিক আছে তো, রবিন?

মনে তো হয়, রাকস্যাকটা ডেকে ফেলে জবাব দিল রস।

ঘুরে তো দেখে এলাম। কি বুঝলে? ইয়োমার কোন হোটেলেই আছে। লফার, তাই না? চলো, ওখানেই যাব।

ডকের একপ্রান্তে নোঙর করা ছিল, অন্যপ্রান্তের দিকে চলতে শুরু করল বোট। কণ্ঠস্বর নামিয়ে রস বলল, কেমন করছি আমরা, চাক?

দারুণ! এক্কেবারে কিশোর পাশা আর রবিন।

ওদের ঘণ্টা দুই আগে কুপার র‍্যাঞ্চ থেকে একটা জীপ বেরিয়ে গেছে। ধুলোর মেঘ উড়িয়ে চলে গেছে ইয়োমার দিকে। বিশাল স্টেটসন হ্যাট আর ফ্রানেলের চেক শার্ট পরা চাক-বেশী কিশোর বসেছে চালকের আসনে। তার পাশে রসের ছদ্মবেশে রবিন। পায়ের ব্যথা অনেক কমেছে।

ইয়োমার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল দু-জনে। ডেস্কে বসে আছে সেই পুলিশ সার্জেন্ট, কয়েক দিন আগে যার সঙ্গে কথা বলেছিল ওরা। কিন্তু চিনতেই পারল না ওদেরকে। ভোঁতা গলায় জিজ্ঞেস করল, কি সাহায্য করতে পারি?

চীফের সঙ্গে দেখা করতে চাই, প্লীজ। বলবেন কিশোর পাশা আর রবিন মিলফোর্ড কথা বলতে এসেছে।

চমকে গেল সার্জেন্ট। বলল, আরে, তোমরা! চিনতেই পারিনি। কি হয়েছে?

ছোট্ট একটা ফাঁদ পেতেছি আমরা, সার্জেন্ট, কিশোর বলল।

কয়েক মিনিট পর সংক্ষেপে সব কথা চীফকে জানাল সে আর রবিন।

মাথা ঝাঁকিয়ে চীফ বললেন, প্ল্যানটা ভালই মনে হচ্ছে। তোমাদের সঙ্গে অফিসার স্যাডি রোভারকে দিচ্ছি। সাদা পোশাকে যাবে।

 লম্বা, পেশীবহুল মানুষ স্যাডি রোভার। কি করতে চায়, তাকে বুঝিয়ে বলল কিশোর।

ইয়োমা বোট ডকের কাছে একটা বালির ঢিবির আড়ালে লুকিয়ে বসল। তিনজনে। ছোট ছোট অনেক জলযান আসছে আর যাচ্ছে। ক্রমাগত ঢেউ তুলছে পানিতে। ডকে এমন কয়েকজনকে দেখা গেল, ভাবসাব দেখে মনে হলো ওদের নৌকা বাঁধা আছে জেটিতে।

স্যাডি জানাল, ওরা সন্ধ্যা হলে নৌকা ছাড়বে। তাদের মধ্যে একজন মেকসিকান দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোরের। ডকে সে-ই একমাত্র লোক, কোন বিশেষ নৌকার প্রতি যার নজর নেই। এক জায়গায় বসে তাকিয়ে আছে অন্য পাড়ের দিকে।

ফিসফিস করে রবিন বলল, ওই যে, ওরা আসছে।

আবার ডকে ভিড়ল লাল-সাদা বোঁটা। নোঙর ফেলল। ডেকে দাঁড়ানো চাক আর রসের দিকে নজর এখন মেকসিকান লোকটার। ওরা দু-জন তীরে নেমে রাস্তা ধরে এগোল। উঠে দাঁড়াল লোকটা। কোন দিকে না তাকিয়ে রস আর চাকের পিছু নিল।

কিশোররাও উঠে দাঁড়াল। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে মেকসিকান লোকটার পিছু নিল।

একটা হোটেলে ঢুকল চাক আর রস।

সাবধানে এগিয়ে গিয়ে হোটেলের জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল মেকসিকান।

এই ব্যাটাই আমাদের লোক, নিচু স্বরে ঘোৎ-ঘোৎ করে বলল স্যাডি।

নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়াল তিনজন লোক, টেরই পেল না। মেকসিকান। খপ করে তার হাত চেপে ধরল স্যাডি। কঠিন স্বরে বলল, তোমাকে অ্যারেস্ট করা হলো!

হাত ছাড়ানোর জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করল লোকটা। ছুটতে পারল না। তার অন্য হাত চেপে ধরল কিশোর। হোটেল থেকে বেরিয়ে এল চাক আর রস।

থানায় নিয়ে আসা হলো মেকসিকান লোকটাকে।

তার পকেট থেকে কাগজপত্র বের করে দেখে বললেন চীফ, নাম পেকারি সোয়ানো। বেআইনী ভাবে ঢুকেছে। একজন সহকারীকে নির্দেশ দিলেন, হাজতে ভরো।

অভিযান সফল হওয়ায় খুব খুশি চাক আর রস। হাত মেলাল দুই গোয়েন্দার সঙ্গে। কিশোর ওদের ধন্যবাদ দিল।

চাক বলল, আমরা তাহলে জীপটা নিয়ে যাই। কি হয়েছে শোনার জন্যে নিশ্চয় অস্থির হয়ে আছেন বস।

বাকিটা আর তাহলে দেখতে পারলেন না, হেসে বলল কিশোর।

আরও কিছু বাকি আছে নাকি?

সবে তো শুরু। আমার বিশ্বাস, আমাদের এই বন্দীটি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। যাবেও। কি বলেন, চীফ?

হাসলেন চীফ। যাওয়াই উচিত। তাকে আমরা যেতে দিলে সোজা সে যাবে তার বন্ধুদের কাছে। হুশিয়ার করার জন্যে।

 পরিকল্পনাটা বুঝে গেল চাক। বলল, পুরোটী দেখতে পারলে ভালই হত। কিন্তু বস নিশ্চয় ওদিকে অস্থির হয়ে আছেন। বেশি দেরি করা ঠিক হবে না আমাদের।

বেরিয়ে গেল চাক আর রস। তার একটু পরেই একজন অফিসার এসে জানাল, মেকসিকনি লোকটা পালিয়েছে। হাজতের দরজায় তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল স্যাডি। হোলস্টারে থাবা দিয়ে দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, চলো!

বাইরে বেরিয়ে এল কিশোররা। একটা বাড়ির ছায়ায় হারিয়ে যেতে দেখা গেল পেকারিকে। স্যাডির সঙ্গে আরও তিনজন অফিসার রয়েছে। সবাই পিছু নিল লোকটার।

দ্রুত হাঁটছে পেকারি। কয়েকটা গলি পেরিয়ে একটা ছাউনির মধ্যে ঢুকল।

ছাউনিটা ঘিরে ফেলল সাদা পোশাকধারী পুলিশ।

খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিল কিশোর। পেকারি বাদেও আর দু-জন লোক আছে, ওরাও মেকসিকান।

.

১৪.

লোকগুলোকে ধরে থানায় নিয়ে আসা হলো। কিন্তু মুখ খোলানো গেল না ওদের। কিছুই বলল না। যতই প্রশ্ন করা হলো, কেবল জানি না, জানি না করল।

চীফ বললেন, মনে হচ্ছে এগুলো চুনোপুটি। আসলেই কিছু জানে না।

রাতটা কুপারের র‍্যাঞ্চে কাটিয়ে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ল কিশোর আর রবিন। বোটে করে কলোরাডো নদী ধরে ফিরে এল ব্লাইদিতে। দুটো বাঁধ আর আঁকাবাঁকা নদীর বিপজ্জনক একশো মাইল পথ পেরোতে সারাটা দিনই প্রায় লেগে গেল।

ঘাটেই পাওয়া গেল বোটের মালিককে। ছুরি দিয়ে কেটে পুতুল। বানাচ্ছে।

ভাড়ার টাকা গুনে দিল কিশোর। পকেটে ভরতে ভরতে জিজ্ঞেস বলল লোকটা, ভ্রমণটা হয়তো ভালই হয়েছে?

কিশোর জবাব দিল, হয়তো।

মোটেলে ফেরার পথে রবিন বলল হেসে, আমরা যাওয়ার পর বসে বসে শুধু পুতুলই বানিয়েছে হয়তো?

কিশোরও হাসল, হয়তো। আলসে মানুষের অভাব নেই দুনিয়ায়।

মোটেলে ফিরে মুসাকে পাওয়া গেল না। ক্লার্ককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ওয়ারনার বল নামে একজন লোকের সঙ্গে সারারাতের জন্যে বেরিয়েছে।

পরদিন সকালেও কিছুক্ষণ তার জন্যে অপেক্ষা করল কিশোর আর রবিন। শেষে দেরি হয়ে যাবে বুঝে বেরিয়ে পড়ল। এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে করে ডেনভার রওনা হলো লফারকে খুঁজতে।

ডেনভার বিমান বন্দরের তথ্য কেন্দ্র থেকেই জানতে পারল কাছেই শোবারন পনি র‍্যাঞ্চ নামে একটা ঘোড়ার র‍্যাঞ্চ আছে, যেটাতে শেটল্যাণ্ড পনি উৎপাদন করা হয়। আশেপাশে বেশ কয়েক মাইলের মধ্যে ওই একটা ঘোড়ার র‍্যাঞ্চই আছে।

ট্যাক্সি নিল কিশোর। পাহাড়ী পথ ধরে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেল র‍্যাঞ্চটায়।

রবিন বলল, বেশি সহজে হয়ে গেল না? পাব তো লফারকে?

সহজ হলো কোথায়? কিশোর জবাব দিল, কত ঘোরা ঘুরলাম। তারপর তো জানলাম। তাকে পাব কিনা এখনও শিওর না।

রাঞ্চের সীমানায় ঢুকে একটা বাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল ট্যাক্সি।

নামতেই রবিনের চোখে পড়ল, একটা আস্তাবলে ঢুকছে লম্বা, চওড়া কাঁধওয়ালা একজন লোক। ইশারায় কিশোরকে আসতে বলে সেদিকে এগিয়ে গেল রবিন।

আস্তাবলে ঢুকল দু-জনে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল। একসারি চারকোণা স্টল, ঘোড়া রাখা হয় ওগুলোতে। সব খালি, একটা বাদে। ওটাতে বদমেজাজী একটা ঘোড়াকে শান্ত করার চেষ্টা করছে লম্বা লোকটা, রবিন যাকে দেখেছে।

পেছনে এসে দাঁড়াল গোয়েন্দারা।

রবিন জিজ্ঞেস করল, মিস্টার লফার?

ভীষণ চমকে ঝটকা দিয়ে ঘুরে তাকাল লোকটা। চোখে ভয়। বলল, আমার নাম নিক কেরিসন।

ভয় পাবেন না আমাদের, মিস্টার লফার, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আপনার মামা ওয়াল্ট ক্লিঙ্গলস্মিথ আপনার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছেন। আমাদের পাঠিয়েছেন আপনাকে খুঁজে বের করার জন্যে।

কে তোমরা?

আমরা গোয়েন্দা। আমি কিশোর পাশা, ও রবিন মিলফোর্ড। আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি আমরা, মিস্টার লফার, বিশ্বাস করতে পারেন। বন্ধু হিসেবে নিতে পারেন আমাদের।

বিশ্বাস! বন্ধু! ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল লফার। তিক্ত কণ্ঠে বলল, এই কথাগুলো আর বোলো না আমাকে! দুনিয়ায় বন্ধু বলে কিছু নেই, বিশ্বাসও নেই!

আপনার বন্ধু ব্রাউনের কি হয়েছে?

ও আমার বন্ধু নয়! আমিই হতে চেয়েছিলাম! গাধামির ফলও পেয়েছি হাতে হাতে! তিক্তকণ্ঠে বলল লফার। সমস্ত কিছুর পরও যাকে খানিকটা বিশ্বাস করেছিলাম, সে-ও আমাকে বোক পেয়ে ঠকাল। পটিয়ে-পাটিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের লোভ দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের করল, তারপর ধরে নিয়ে গেল মেকসিকোতে।

দু-জনে একসঙ্গে গিয়েছিলেন? জানতে চাইল রবিন।

মাথা ঝাঁকাল লফার। হ্যাঁ। রাতের বেলা, নৌকায় করে। আগেই খবর দিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল নৌকা। রাতে চুরি করে বর্ডার পার হয়ে মেকসিকোতে ঢুকেছি। ওখানে নিজের দলের সঙ্গে দেখা করেছে লফার।

শিস দিয়ে উঠল রবিন। মেকসিকান বিদ্রোহী?

না। ওই দল থেকে বেরিয়ে চলে এসেছে। নিজেই একটা দল গড়েছে। বেআইনী পথে টীকা কামানোর জন্যে।

তারমানে ব্রাউন ক্রিমিন্যাল।

 হ্যাঁ।

তারপর, বলুন, আপনাকে নিয়ে গিয়ে কি করল? জানতে চাইল কিশোর।

সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখত। হুমকি দিত আমি পালানোর চেষ্টা করলে, পালিয়ে গিয়ে পুলিশকে খবর দিলে, আমার পরিবারের ক্ষতি করবে। তারপরেও পালালাম ঠিকই, কিন্তু পুলিশের কাছে গেলাম না স্ত্রী-পুত্রের ক্ষতির ভয়ে। নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম। মালগাড়িতে করে বর্ডারে চলে গেলাম। ব্রাউনকে একটা চিঠি লিখে দিলাম, আমি পুলিশের কাছে যাইনি, আমার পরিবারের যেন ক্ষতি না করে। কিন্তু আমার পেছনে ঠিকই লাগল ওরা। ওদের ধারণা, অনেক বেশি জেনে ফেলেছি আমি। মুখ বন্ধ করে দেয়া দরকার।

কিন্তু আপনাকে বেরোতে রাজি করাল কি করে ব্রাউন?

সেটা বোঝাতে পারব না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লফার। বার বার বন্ধুদের বিশ্বাস করেছি, বার বার ওরা আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। ব্যবসায় মরি খেয়ে মাথাটা ঘোলা হয়ে গিয়েছিল। মনে করলাম, কোথাও বেরোলে হয়তো ভাল লাগবে। তাই ব্রাউন যখন বেড়াতে বেরোনোর কথা বলল, রাজি হয়ে গেলাম। প্লেন নিয়ে ওড়ার পর ব্রাউন বলল মরুভূমির দিকে যেতে, আমাকে নাকি একটা সারপ্রাইজ দেবে। ওখানে প্লেন রেখে আমাকে নিয়ে গিয়ে বোটে উঠল। আমি ভেবেছিলাম সে একজন দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারার। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। সাধারণ একজন অপরাধী ছাড়া সে আর কিছুই নয়।

তাকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া উচিত, কিশোর বলল। সেই কাজটাই করব। আপনার সাহায্য লাগবে আমাদের, মিস্টার লফার। বেআইনী কি কাজ করছে ব্রাউন, বলুন তো?

ভয় ফুটল লফারের চোখে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, না, এ সব কথা আমি বলতে পারব না! তাতে লাভও হবে না। মাঝখান থেকে আমার পরিবারের…

দেখুন, মিস্টার লফার, সারাজীবন পালিয়ে বেড়াতে পারবেন না আপনি। তাতে আপনার পরিবারেরও কোন লাভ হবে না। আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আপনার স্ত্রী আর ছেলেরা অস্থির হয়ে গেছে আপনার জন্যে।

চোখের কোণ ছলছল করে উঠল লফারের। কিন্তু কি করতে পারি আমি, বলো? বাড়ি তো যেতে পারব না!

কেন পারবেন না?

ব্রাউন আমাকে খুন করবে! আমার ছেলেদের মেরে ফেলবে!

অত সহজ না! জোর দিয়ে বলল রবিন। বলল, আর করে ফেলল। দেশে আইন-কানুন আছে। পুলিশের কাছে যান আপনি।

আবার নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লফার। পুলিশের কাছে আমি যেতে পারব না। কারণ আমিও অপরাধ করে বসে আছি।

মানে? জানতে চাইল বিস্মিত কিশোর।

ব্রাউনও জানে এটা। তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিলে সে-ও আমাকে ধরিয়ে দেবে। আমার হাত দিয়ে বেশ কিছু জাল চেক এখানে ওখানে পাচার হয়ে গেছে।

চেক? কি ধরনের? আমেরিকান সরকারের চেক?

না, ব্যক্তিগত চেক।

নানা ভাবে লফারকে বোঝাতে লাগল কিশোর আর রবিন। কিছুতেই বাড়ি ফিরে যেতে রাজি করাতে পারল না। তবে একটা কথা দিল–ওদেরকে না জানিয়ে শোবারন র‍্যাঞ্চ ছেড়ে আর পলিবে না।

হাইওয়ের ধারে একটা রেস্টুরেন্টে এসে খাওয়া সারল দুই গোয়েন্দা। ওখনি থেকে ফোন করল মুসাকে।

মূসা? কিশোর। ডেনভার থেকে বলছি। খবর আছে।

আমার কাছেও আছে! উত্তেজিত শোনাল মুসার কণ্ঠ। কিন্তু এত দেরিতে করলে? আমি তো ভেবেছিলাম আর করবেই না বুঝি! অনেক বড় একটা সূত্র পেয়েছি। আসো এখানে, বলব। ডেনভারে কি করছ তোমরা?

লফারকে খুঁজে বের করেছি।

 খাইছে! সত্যি?

হ্যাঁ। তবে খবরটা কারও কাছে ফাঁস কোরো না। কাল সকালের প্লেনে আসছি আমরা।

খাওয়ার পর আবার শোবারন র‍্যাঞ্চে ফিরে এল কিশোররা। সারাদিন কাজ করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে শ্রমিকেরা। কেউ অলস ভঙ্গিতে বসে আছে বারান্দায়, কেউ তাস খেলছে, কেউ গল্প করছে। সবার থেকে আলাদা বসে একটা জিন মেরামত করছে লফার। আগের চেয়ে অনেকটা শান্ত লাগছে তাকে।

কিশোরদের দেখে উঠে এল লফার।

 কিশোর বলল, লোকগুলো মনে হচ্ছে খুব ভাল।

হ্যাঁ, লফার বলল। ভাল লোক। আমার আসল নাম কেউ জানে না এখানে। এদের মাঝে ভালই কাটে।

হাঁটতে হাঁটতে মাঠের দিকে সরে গেল তিনজনে। সেখানে চরছে ঘোড়ার পাল।

কেন যে এখান থেকে বেরোতে চাইছেন না, কিশোর বলল, মাথায় ঢুকছে না আমার। জায়গাটা ভাল, আপনার জন্যে নিরাপদ, সবই বুঝলাম। কিন্তু এখানে থেকে তো জীবন কাটাতে পারবেন না। যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি।

 কি? কিশোরের মুখোমুখি দাঁড়াল লফার। মনে হচ্ছে খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।

এখুনি লস অ্যাঞ্জেলেসে ফেরার দরকার নেই আপনার। আমাকে আর রবিনকে সাহায্য করতে পারেন। ব্রাউনকে ধরব আমরা। তাকে ধরে পুলিশের হাতে দেব। হয়তো এর জন্যে আপনার সামান্য অপরাধ মাপও হয়ে যেতে পারে। ব্রাউনের হাত থেকেও রেহাই পাবেন।

দ্বিধা করল লফার। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে কিশোরের একটা হাত চেপে ধরল, ঠিক আছে, আমি রাজি। প্রথমে কোথায় যেতে হবে?

ব্লাইদি।

চমকে গেল লফার। কিন্তু ওখানে তো ব্রাউনের সম্পাইরা আছে। দেখলেই চিনে ফেলবে আমাকে!

চিনবে না। ছদ্মবেশ পরিয়ে নিয়ে যাব।

.

১৫.

পরদিন মাঝবয়েসী একজন প্রৌঢ় র‍্যাঞ্চারের ছদ্মবেশে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে প্লেন থেকে নামল লফীর। সামান্য খুড়িয়ে হাঁটতে বলে দিয়েছে তাকে কিশোর। ভালই অভিনয় করছে সে।

মোটেলেই অছে মুসা। ওদের আসার অপেক্ষা করছে। লাফ দিয়ে উঠে এসে জড়িয়ে ধরল কিশোরকে। তারপর রবিনকে। হাত মেলাল। তাকলি লফারের দিকে।

পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর। সব কথা জানাল। ব্রাউনকে ধরার প্ল্যান। করেছে যে বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এবার তোমার দারুণ খবরটা বলে ফেলো! কি সূত্র পেয়েছ?

দুদিন আগে রাতের বেলা ওয়ারনার বলের সঙ্গে মরুভূমিতে গিয়েছিলাম কিছু নিশাচর জানোয়ারের ছবি তোলার জন্যে। একটা ছবিতে জানোয়ারের সঙ্গে কি উঠেছে জানো? একটা লোকের ছবি। নদীর কাছ থেকে কোথাও সরে যাচ্ছিল সে।

এতে অবাক হওয়ার এমন কি ঘটল? রাতের বেলা নদী থেকে মরুভূমিতে নামতে পারে লোকে। তোমরাও তো গিয়েছ।

আসল কথাটা শোনোই না। লোকটা কে জানো? রকি বীচে তোমাদের ইয়ার্ডে যে আড়ি পেতে ছিল।

বলো কি! এইবার অবাক হলো কিশোর। লস অ্যাঞ্জেলেসের সেই বেয়ারা! হ্যাঁ, এইটা একটা সূত্র বটে!

ওদের কথা বুঝতে পারছে না লফার। তাকে বুঝিয়ে দিল কিশোর। চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলল, আমার ধারণা, ব্রাউনের দলের লোক ও। চিনতে পারছেন?

নাহ। আমাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, ওরা মেকসিকান। অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল লফার, তা থাকব কোথায় আমি? এই মোটেলে?

অসুবিধে কি? রবিন বলল।

না, অসুবিধে নেই। রুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে রেস্টুরেন্টে ঢুকল চারজনে। খাওয়ার পর কিশোর বলল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। মরুভূমিতে যাওয়ার কথা ভাবছি। নকশাগুলোর কাছে। তা ছাড়া ওখানে যখন ছদ্মবেশী বেয়ারাকে দেখা গেছে, কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয় আছে। ওখানে মাটি খোঁড়া হয়েছে, দেখেছি। আরও কোথাও খুঁড়েছে কিনা দেখব।

যারা খুঁড়েছে তাদের সঙ্গে ব্রাউনের দলের সম্পর্ক আছে ভাবছ নাকি? রবিনের প্রশ্ন।

থাকতেও পারে। রিপ্লিতে নদীর ধারে একটা কেবিন ভাড়া নেব আমরা। ওখানে থাকব। বোট ভাড়া করব। তাতে যতবার খুশি নদী পেরিয়ে মরুভূমিতে যাতায়াত করতে পারব।

এই পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি খুশি হলো লফার। কারণ লোকালয়, বিশেষ করে ব্লাইদি থেকে সরে যেতে পারবে।

বেশ, তাহলে ওই কথাই রইল, কিশোর বলল। সকালেই রওনা হব আমরা। কারও কোন কথা আছে?

এক কাজ কোরো, মুসা বলল, তোমরা তিনজন চলে যেয়ো। আমি বরং রাইদি থেকে বোট ভাড়া করে, বাজার করে নিয়ে যাব। খাবার তো লাগবে। সঙ্গে করে আমার বন্ধু ওয়ারনার বলকে নিতে চাই। ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়। দরকার পড়লে আমাদের সাহায্যও করতে পারবে।

মন্দ বলোনি। কেবিনটা বরং তার নামেই ভাড়া করব। তাতে খোঁজ খবর নিলেও আমাদের শত্রুরী কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।

পরদিন দুপুরে রিপ্লিতে পৌঁছে একজন কৃষকের কাছ থেকে একটা কেবিন ভাড়া করল কিশোররা। কেবিনটা পড়েছে নদীর এপারে ক্যালিফোর্নিয়ার সীমানায়। বাড়ির পেছনে ছড়ানো বারান্দা। ওখানে দাঁড়ালে নদী ও নদীর অন্য পাড়ে অ্যারিজোনার বিশাল টিলা আর পাহাড়গুলো চোখে পড়ে, যেখানে রয়েছে দানবীয় সব নকশী। হলুদ রঙের সুন্দর টীমারিস্ক গাছ ঘিরে রেখেছে। কেবিনটীকে।

বাসা পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কৃষক।

 খুউব, জবাব দিল কিশোর।

তবে একটা ব্যাপারে সাবধান থাকবে।

কি? সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর। ভাবল চোর-ডাকাতের কথা বলবে বুঝি।

সাপ। র‍্যাটল স্নেক।

কয়েক মিনিট পরই কৃষকের কথার প্রমাণ পাওয়া গেল। বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখার জন্যে বারান্দা থেকে নেমেছিল লফার। কিন্তু কয়েক পা এগোতে না এগোতেই বালির মধ্যে থেকে ফোঁস করে উঠল সাপ। আরেকটু হলেই তার পায়ে কামড়ে দিয়েছিল। লাফ দিয়ে এসে আবার বারান্দায় উঠল সে।

রবিন আর কিশোর মিলে সাপটীকে মেরে ফেলল।

কাঁপতে কাঁপতে লফার বলল, র্যাটলের বিষ যে কি জিনিস, হাড়ে হাড়ে জানা আছে আমার। ছোটবেলায় একবার কামড় খেয়েছিলাম। নেহায়েত আয়ু। আছে, তাই বেঁচেছি।

কেবিনের ভেতরও সাপ থাকতে পারে ভেবে প্রতিটি ঘর ভালমত খুঁজে দেখল ওরা।

রবিন বলল, আর থাকতে পারছি না আমি। পেটের মধ্যে কিছু নেই। খাওয়া দরকার।

খাওয়ার কথায় মুসার কথা মনে পড়ল কিশোরের। বলল, মুসারা তো। এখনও আসছে না।

সঙ্গে করে স্যাণ্ডউইচ এনেছে ওরা। খেয়ে নিল।

ইতিমধ্যে গোয়েন্দাদের ওপর অনেকটা বিশ্বাস এসেছে লফারের। নিজে নিজেই বলল, জানলে সব বলতাম তোমাদের। কিন্তু আমিও তেমন কিছু জানি না।

কোন ব্যাপারে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

এই ব্রাউনের দলের ব্যাপারে।

যা জানেন তাই বলুন। তাতেও সাহায্য হবে।

আসলে কিছুই জানায়নি ওরা আমাকে। ওদের দলে যোগ দিতে রাজি হইনি। ওদের আস্থা অর্জন করতে পারিনি।

ওদের কাজটা কি, সেটা কি বলতে পারবেন?

শিওর না। অনুমান করতে পারি কেবল। গোড়া থেকেই বলি। বর্ডার পেরোনোর পর একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল আমাকে ব্রাউন। আশেপাশে আর কোন বাড়িঘর নেই। বাড়িটায় তিনজন মেকসিকান আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ওদের হাবভাব ভাল লাগল না। কেমন করে যেন। তাকাচ্ছিল আমার দিকে। সবার মুখেই খালি টাকার গল্প। কি করে অল্প সময়ে। বেশি টাকা হাতানো যায়। সন্দেহ জাগল আমার। বোকার মত সেটা ফাস করে দিলাম ওদের কাছে। বললাম, ওদের সঙ্গে থাকব না। কিন্তু আমাকে আটকে ফেলল ব্রাউন। বেরোতে দিল না।

দুই বার আমাকে শহরে নিয়ে গেছে সে। ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে তার জাল চেক খাবারের দোকান থেকে ভাঙাতে বাধ্য করেছে। একটা মেকসিকান ব্যাংকের নামে ওই চেকগুলো তৈরি হয়েছে। যার নামে করা হয়েছে, সেটাও ছদ্মনাম।

পালালেন কখন?

বলছি। ওদের বেআইনী কাজে আমাকে যোগ দেয়ার জন্যে চাপ দিয়ে চলল ব্রাউন। কিছুতেই আমাকে রাজি করাতে না পেরে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিল একটা নিরালা জায়গায়। ঘরে আটকে সারাক্ষণ আমাকে পাহারা দিয়ে রাখা হত, সে-কথা তো বলেইছি। ওদের কাজের ব্যাপারে আমার সামনে আর মুখ খুলত না। আড়ি পেতে থেকে কথা শোনার চেষ্টা করেছি। জিঙ্ক প্লেটের কথা বলতে শুনে অনুমান করলাম কোন কিছু জাল করার ব্যাপারে আলোচনা করছে ওরা।

কি জাল করছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তা বলতে পারব না।

হঠাৎ বলে উঠল কিশোর, জবাবটা আমি বোধহয় দিতে পারব, মিস্টার লফার। কোন আমেরিকানের নাম ওদেরকে বলতে শুনেছেন?

শুনেছি। ডগলাস বার্ড।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। মরুভূমির গর্তে পাওয়া রুমালটার কোণে লেখা ছিল D. এখন বুঝল ওটা ডগলাসের নামের আদ্যক্ষর।

চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ডগলাস বার্ডই আমাদের ছদ্মবেশী বেয়ার!

লফার বলল, তার দু-জন সহকারী আছে। সিজার এবং মারফি।

তাই নাকি? কিশোর বলল, তাহলে আপনার অফিসে ওই দুজনই গিয়েছিল আপনার সেক্রেটারির কাছে খোঁজ নিতে। তাকে ভয় দেখিয়েছে। রাতের বেলা মরুভূমিতে বার্ডের ছবিই উঠে গেছে মুসার ক্যামেরায়। রকি বীচে তার মাথায় বাড়ি মেরে ছবি কেড়ে নিয়ে গেছে এই লোকই।

একটা ব্যাপার মেলাতে পারছি না, রবিন বলল।

 কি?

একটা পাথর। জ্যাসপার। মরুভূমিতে কুড়িয়ে পেয়েছি, আপনার প্লেনটী যেখানে পাওয়া গেছে, তার কাছে। মিস্টার লফার, দামী চোরাই পথিরেরও ব্যবসা করে নাকি ব্রাউনের দল? পাথর নিতেই হয়তো মরুভূমিতে গিয়েছিল বার্ড, মূসার ক্যামেরায় তার ছবি উঠে গেছে?

উঁহু! অবাক হয়ে মাথা নাড়ল লফার। আমার তা মনে হয় না। পাথর টারের কথা কখনও বলতে শুনিনি ওদের।

তাহলে অন্য কোন কারণে মরুভূমিতে গেছে বার্ড, কিশোর বলল। আবারও যেতে পারে। কখন যাবে জানি না। ওকে ধরতে হলে রাতের বেলা ওখানে হাজির থেকে পাহারা দিতে হবে আমাদের।

.

১৬.

ইঞ্জিনের মৃদু ফটফট শব্দ ভেসে এল নদীর দিক থেকে। বাড়ল শব্দটা। কথা থামিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল কিশোর আর রবিন। বড় একটা মোটরবোট আসতে দেখল। তাঁতে দু-জন লোক।

মনে হয় মুসারা আসছে, রবিন বলল।

কাছে এল বোটটা। মুসাকে চিনতে অসুবিধে হলো না। হাত নেড়ে চিৎকার করে তাকে ডাকতে লাগল ওরা।

বোটের নাক ঘুরে গেল। এগিয়ে এসে কেবিনের নিচে নদীর ঢালে তৈরি জেটিতে ভিড়ল।

একজন সুদর্শন তরুণকে নিয়ে নেমে এল মুসা। বয়েস বাইশ-তেইশ হবে। রোদের মধ্যে থাকতে থাকতে লোকটার চামড়া উজ্জ্বল বাদামী হয়ে গেছে। মাথা ভর্তি চুলের আসল রঙ ছিল সোনালি, এখন সাদা হয়ে গেছে মরুভূমির কড়া রোদে ঘুরতে ঘুরতে।

কিশোর আর রবিনের সঙ্গে ওয়ারনার বলের পরিচয় করিয়ে দিল মুসা।

হতি মেলানো আর কুশল বিনিময়ের পালা শেষ হলে হাতে হাতে বোট থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো নামিয়ে আনল ওরা। কেবিনে নিয়ে এল।

মার্টি লফারের সঙ্গে ও বলের পরিচয় করিয়ে দিল মুসা। হাসিখুশি লোকটাকে পছন্দ করল সবাই।

তিন গোয়েন্দার সব সদস্যই হাজির। রাতের বেলা কি ভাবে পাহারা দেবে, এই নিয়ে আলোচনায় বসল সবাই।

সিদ্ধান্ত হলো, বোটে করে অপর পারে চলে যাবে ওরা। টিলার ওপর উঠে লুকিয়ে থাকবে। ওখান থেকে আশপাশে বহুদূর চোখে পড়ে। কেউ এলে সহজেই দেখতে পাবে। বার্ড কিংবা তার সাঙ্গপাঙ্গরা এলে, তাঁদের ধরা হবে।

বিকেল হয়ে গেল। শুধু স্যাণ্ডউইচ খেয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়। খিদে পেয়ে গেল ওদের। রান্না চড়ানো দরকার। লফার বলল, ঘোড়া পোষা ছাড়া আরেকটা কাজ ভাল করতে পারি আমি। রান্না করতে দিয়েই দেখো।

কোন আপত্তি নেই কারও। সত্যি প্রমাণ করে দিল লফার, রান্নায়ও তার চমৎকার হাত। খেয়ে সবাই প্রশংসা করল।

বারান্দায় এসে বসল সবাই। গল্প করতে লাগল। সূর্য ডুবতে দেরি নেই। কেবিন ঘিরে রাখা গাছের জটলার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। চিৎকার করে উঠল, খাইছে! দেখো, কে এসেছেন।

ফিরে তাকাল সবাই।

মুসার মতই অবাক হয়ে গেল কিশোর আর রবিনও।

মিস্টার সাইমন!

হাসিমুখে এগিয়ে এলেন ডিটেকটিভ। তাঁকে এখানে দেখতে পাবে বল্পনাই করেনি তিন গোয়েন্দা। লাফ দিয়ে উঠে গেল এগিয়ে আনার জন্যে।

কেন এসেছেন, জানা গেল শিগগিরই। হাত-মুখ ধুয়ে, খেয়েদেয়ে সবার সঙ্গে বারান্দায় এসে বসলেন সাইমন। হেসে বললেন, কিশোর, কয়েক দিন ধরে তোমার আর রবিনের পিছে লেগে রয়েছি আমি। কলোরাডো নদী ধরে গেলে তোমরা, ফিরেও এলে। খুঁজতে খুঁজতে মিস্টার লফারের বন্ধু কুপারের র‍্যাঞ্চে গিয়ে হাজির হলে। আমিও গিয়েছি। মিস্টার কুপৗর আমাকে সব বলেছেন।

রবিন বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, স্যার। গোড়া থেকে বলুন। আমাদের পিছু নিলেন কেন?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নদীর পানির দিকে তাকিয়ে রইলেন সাইমন। কোনখান থেকে শুরু করছেন ভাবছেন যেন। বললেন, মিস্টার লফারকে খুঁজে বের করার দায়িত্বটা তোমাদের দেয়ার আগেই আরেকটা কেস পেয়েছিলাম আমি, একটা চেক জালিয়াতির কেস। সরকারি চেক জাল করা হচ্ছে। পুলিশ কোন কিনারা করতে পারছিল না।

চেক জালিয়াতি! মুসা বলে উঠল। কিশোর, আমি যেটা পেয়েছিলাম, ওটাও একই দলের কাজ নয়তো?

মুসা কি ভাবে চেক পেয়েছিল, সাইমনকে জানাল কিশোর।

মানিব্যাগ থেকে একটা চেক বের করলেন তিনি। মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দেখো তো এটার মত কিনা?

একবার দেখেই মাথা ঝাঁকাল মুসা, হা হা, ঠিক এই জিনিস। তবে ওটীতে টাকার অঙ্ক খুব কম ছিল।

তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই, চেকটা আবার মানিব্যাগে ভরতে ভরতে হাসলেন সাইমন। তোমরা আর আমি একই কেসে কাজ করছি।

আপনি মেকসিকোতেও গিয়েছিলেন, না? জানতে চাইল কিশোর।

হ্যাঁ। জালিয়াতদের ছাপাখানাটা খুঁজে বের করার জন্যে। মেকসিকান পুলিশের সহায়তায় বেরও করেছি, কিন্তু পালের গোদাটাকে ধরতে পারিনি। পালিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমেরিকায় ঢুকে পড়েছে ওরা।

ওখানে পুলিশের হাত থেকে আপনিই ছাড়িয়েছেন আমাদের।

হাসলেন ডিটেকটিভ। মাথা ঝাঁকালেন।

আমরা মেকসিকোতে আছি, পুলিশের হাতে ধরা পড়েছি, জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তোমাদের সেই স্টেশন মাস্টার কাপারিলো তোমাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়েই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। পুলিশ আমাকে জানিয়েছে। একজন আমেরিকানের পেছনে আরও দু-জন আমেরিকান লেগেছে শুনে অবাক হয়েছিল ওরা। সন্দেহ হয়েছিল, আমি হয়তো কিছু জানতে পারি। তাই জানিয়েছে। চেহারার বর্ণনা শুনেই বুঝে গেলাম, তোমরা ছাড়া আর কেউ নয়। পুলিশকে নিয়ে ছুটলাম সেই নির্জন স্টেশনে। মরুভূমির মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে নিতান্ত ভাগ্যক্রমেই আবিষ্কার করে ফেললাম জালিয়াতদের ছাপাখানা।

তারমানে না জেনেই আপনার কেসের সমাধানটাও আমরাই করে। দিলাম, হেসে বলল রবিন।

হা, অনেক সাহায্য করেছ তোমরা, স্বীকার করলেন সাইমন। মালগাড়িতে করে তোমাদের পিছু নেয়ার ব্যাপারটাও একটা সূত্র দিয়েছিল অমিৗকে। ভাবলাম, জালিয়াতদের সর্দারও ওই পথেই সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করবে না তো? তক্ষুণি পুলিশকে সতর্ক করে দিলাম। বললাম, সীমান্তের কাছে যত ট্রেন থামে সব চেক করতে।

আপনি জানতেন, তাতে আমরাও ধরা পড়ব। বলে দিলেন, আমাদের ধরলেও যাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তাই না?

আবার মাথা ঝাঁকালেন ডিটেকটিভ। ঠিকই আন্দাজ করেছ। বুঝে গিয়েছিলাম, মিস্টার লফারের খোঁজ তোমরা পেয়ে গেছ। তাঁর চিহ্ন অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছ। তাই আমিও তোমাদের পিছু নিলাম। আমার সন্দেহ হয়েছিল, জালিয়াতদের সঙ্গে তাঁর কোন যোগাযোগ আছে। তোমরা তাঁকে খুঁজে বের করতে পারলে তিনি তখন আমাকে তাদের কাছে যাওয়ার পথ। দেখাতে পারবেন।

প্রেসটার ওপর নজর রেখেছে পুলিশ। কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করেনি। জালিয়াতদের বুঝতেই দেয়া হয়নি যে ওটী আবিষ্কার হয়ে গেছে। জানলে সতর্ক হয়ে গা ঢাকা দিতে পারে রাঘব বোয়ালগুলো। ওদেরকে আগে ধরতে পারলে চুনোপুঁটিগুলোকে ধরা কিছু না। খবর পেয়েছি, আজ রাতে নতুন ছাপা অনেক জাল চেক আসবে একটা বিশেষ জায়গায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে দেয়া হবে সারা আমেরিকায়।

বিশেষ জায়গাটা কোথায়, বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি, কিশোর। বলল। নদীর ওপারে টিলার কাছে, যেখানে দানবীয় নকশা আঁকা আছে। ওখানে প্লেন থেকে ফেলে দেয়া হয় জাল চেকের বাণ্ডিল, নিচে লোক থাকে, তারা, ওগুলো নিয়ে নদীপথে ছড়িয়ে পড়ে, তুলে দেয় বিভিন্ন শহরের এজেন্টদের কাছে। তাই তো?

আমিও ঠিক একই অনুমান করেছি, সাইমন বললেন।

আজ রাতে ওদের ওপর হামলা চালানোর কথা ভাবছেন?

হ্যাঁ।

আপনি আসায় ভালই হলো। আমরাও আজ রাতে ওখানে গিয়ে পাহারা দেয়ার প্ল্যান করেছিলাম। কি ঘটছে জানতাম না। জানা থাকায় এখন সুবিধে হবে।

তাহলে আর বসে আছি কেন? উত্তেজিত হয়ে বলল মুসা। আমরা ছয়জন। লোক কম না। দু-চারজন হলে সহজেই কাবু করে ফেলতে পারব। নাকি পুলিশ নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন?

না, মাথা নাড়লেন সাইমন। বেশি লোকের আনাগোনা হলে টের পেয়ে যাবে ডাকাতেরা। প্লেন থেকে চোখেও পড়ে যেতে পারে। চেকগুলো হয়তো তখন ফেলবেই না।

.

১৭.

রাত আরেকটু বাড়তে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সবাই। মুসার নিয়ে আসা বোটটায় চড়ল।

নদীর ওপারে তারাখচিত আকাশের পটভূমিতে মাথা তুলে রেখেছে টিলার চূড়া। কালো, কেমন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে।

বোটের হাল ধরেছে বল। ইঞ্জিনের শব্দ শুনলে ডাকাতরা হুঁশিয়ার হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে সরাসরি না গিয়ে প্রথমে খানিকটা উজানে নিয়ে এল বোট। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। স্রোতের টানে ভাটির দিকে আপনাআপনি ভেসে চলল বোট। টিলার কাছাকাছি আসার পর নোঙর করল সে।

নিঃশব্দে মাটিতে নামল সবাই। পাড়ের ওপর উঠে এগিয়ে চলল সারি দিয়ে। বালি পার হয়ে এসে দাঁড়াল একশো ফুট উঁচু টিলার গোড়ায়। ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে।

এদিকের মরুভূমি বলের অতি পরিচিত। রাতে চলতেও অসুবিধে হয় না। তাই নেতৃত্বটা সে-ই নিল। আগে আগে চলল।

এদিকের ঢাল বড় বেশি খাড়া। তার ওপর রয়েছে আলগা পাথর। পা, পড়লে আর রক্ষা নেই। পিছলে পড়তে হবে। কোন রকম শব্দও করা চলবে না, শত্রুদের কানে চলে যেতে পারে। সুতরাং গতি হয়ে গেল খুবই ধীর।

তবে অবশেষে চূড়র কাছে পৌঁছাল দলটা। মাথা তুলেই ঝট করে নামিয়ে ফেলল বল। ফিসফিস করে জানাল, চারটে ছায়ামূর্তিকে চোখে পড়েছে।

সাইমন বললেন, ভাগাভাগি হয়ে এগোতে হবে এবার।

কিশোর আর রবিন ডানে সরে গেল। সাবধানে উঠে এল মালভূমির মত সমতল চূড়াটায়। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসল।

কিশোরের কাঁধে হাত রেখে আলতো চাপ দিল রবিন। নীরবে হাত তুলে দেখাল। তারার আলোতেও ঝোপের পাশের গুহামুখটা নজরে পড়ছে। আগের বার দিনের বেলা কেন নজরে পড়েনি বুঝতে অসুবিধে হলো না। মুখের অর্ধেকটা ঝোপের আড়ালে থাকে। বাকি অর্ধেকটীয় পাথর চাপা দিয়ে রাখলে সহজে কারও চোখে পড়বে না। চোরাই মাল কিংবা জাল চেক লুকিয়ে রাখার চমৎকার জায়গী।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা প্লেনের ইঞ্জিনের গুঞ্জন শোনা গেল।

একসঙ্গে জ্বলে উঠল অনেকগুলো আলো। আচমকা আলোকিত করে ফেলা হলো চুড়ার একাংশ। বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বেলে দানবীয় নকশাটার বাঁ হাতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে চারজন লোক। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। একজনকে চিনতে পারল কিশোর–ডগলাস বর্ড, অন্য তিনজন অপরিচিত। না না, আরও একজনকে চেনা গেল। সবুজ মোটরবোট চুরি করেছিল যে লোকটা, পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল, এ সেই লোক।

উড়ে এল প্লেনটী। একটা আলোও জ্বালেনি। টিলার মাথায় চক্কর দিল দু বার। কালো আকাশের পটভূমিতে ভালমতই চোখে পড়ছে ওটাকে। হঠাৎ সাদাটে একখণ্ড ধোঁয়ার মত কি যেন ছিটকে বেরোল ওটা থেকে।

চিনে ফেলল কিশোর। প্যারাশুট!

সরে যেতে লাগল প্লেনটা। তারমানে ওটার কাজ শেষ, চলে যাচ্ছে এখন

নেমে আসছে প্যারাশুট। কোন মানুষ নেই। দড়িতে বাধা বড় প্যাকেটের মত একটা জিনিস ঝুলছে। দানবের গায়ের ওপর নামল ওটা। দোল খেয়ে বিশাল এক ছাতার মত ধসে পড়ল প্যারাশুটটা। ঘিরে ফেলল চার লণ্ঠনধারী। আলো নিভিয়ে ফেলেছে। প্যারাশুট থেকে প্যাকেটটা খুলতে ব্যস্ত হলো। আক্রমণ করার এটাই উপযুক্ত সুযোগ।

রবিনকে নিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, আরও চারটে ছায়ামূর্তি বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসছে।

এ রকম কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরি ছিল না ডাকাতেরা। চমকে গেল। ওরা আঘাত হানার আগেই ওদের ওপর এসে পড়ল আঘাত। পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ পেল না তেমন। যোদ্ধা হিসেবেও ওরা ভাল না। কারাত জানা চার গোয়েন্দা, সেই সঙ্গে বাড়তি আরও দু-জন লোক, এতজনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। তাছাড়া সাইমনের কাছে রয়েছে পিস্তল।

কাবু করে ফেলা হলো চার ডাকাতকে।

হঠাৎ পাথর গড়ানোর শব্দ হলো। ঝট করে ঘুরে তাকাল মুসা। চোখে পড়ল দ্রুত ঢালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আরেকটা ছায়ামূর্তি। ডাকাতদের আরেকজন। ধরো, ধরো ব্যাটাকে! চিৎকার করে দৌড় দিল সে।

পালাতে পারল না লোকটা। ডাইভ দিয়ে তাকে নিয়ে মাটিতে পরল মুসা।

লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠল লফার, ব্রাউন!

হ্যাঁ, এই লোকটাই পালের গোদা, মিস্টার সাইমন বললেন। আপনার বন্ধু।

চারজনকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সে। প্লেনের দিকে নজর ছিল বলে প্রথমে আমাদের কাউকে চোখে পড়েনি। দলের চারজন লোককে আক্রান্ত হতে দেখে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সে। ওরা ধরা পড়ার পর পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু সর্বনাশ করে দিল পাথরটা। ওটাতে লাথি লেগে শব্দ হয়ে গিয়েছিল। দেখে ফেলেছিল মুসা।

দড়ির অভাব নেই। প্যারাশুট থেকে দড়ি কেটে নিয়ে পাঁচজনকে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো। ঝোপ আর পাথরের আড়ালে খুঁজে দেখা হলো আর কেউ লুকিয়ে আছে কিনা। না, আর কেউ নেই।

প্যারাশুটে করে নামিয়ে দেয়া প্যাকেটটা খুললেন সাইমন। বেরিয়ে পড়ল। নিখুঁত ভাবে বাণ্ডিল করা হাজার হাজার জাল চেক। ইউনাইটেড স্টেটস গভর্নমেন্টের নামে ছাপা।

যাক, প্রমাণ সহ হাতেনাতে ধরা পড়ল, সন্তুষ্ট হয়ে বললেন সাইমন। অস্বীকার আর করতে পারবে না কিছু।

একটা টর্চ হাতে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বলল, আমার সঙ্গে আসুন। একটা জিনিস দেখাব।

ঝোপের ধারে গুহামুখটার কাছে সবাইকে নিয়ে এল সে। আলো ফেলে দেখে বোঝা গেল, গুহা নয়, বড় গর্ত। ভেতরে পাওয়া গেল দড়ির বাণ্ডিল, মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি, আর আরও এক বস্তা জাল চেক।

আঁতকে গেল মুসা। বাপরে বাপ, কত! সব বাজারে ছাড়তে পারলে সর্বনাশ হয়ে যেত!

আসল কাজ শেষ। এবার বন্দিদের নিয়ে যেতে হবে। সেটা একটা বড় সমস্যা। সমাধান দিল মুসা। সে আর বল বোট নিয়ে যাবে পুলিশকে খবর দিতে। অন্যেরা ততক্ষণ ওখানেই বসে পাহারা দেবে বন্দিদের।

মুসা আর বল চলে গেল।

লণ্ঠন জেলে বন্দিদের কাছে বসে রইল অন্য চারজন।

আমাকে পুলিশে দিলে লফারও বাঁচতে পারবে না, আচমকা পাতলা, নাকি গলায় বলে উঠল ব্রাউন। সে-ও আমাদের দলে ছিল।

না, ছিল না, জোর প্রতিবাদ করলেন সাইমন। তোমাদের ভয়ে বহুদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে।

তাতে কি? আমাদের সঙ্গে কাজ করার পর পালিয়েছে। আমার কাছ থেকে জাল চেক নিয়ে বাজারে ছেড়েছে। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখুন।

বিষণ্ণ স্বরে জবাব দিল লফার, ও ঠিক কথাই বলেছে। আদালতে দোষ স্বীকার করতে রাজি আছি আমি।

তা কেন করবেন? কিশোর বলল। আপনি তো আর ইচ্ছে করে। করেননি। প্রাণের ভয় দেখিয়ে আপনাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে।

সেটা প্রমাণ করতে পারবে না সে, খিকখিক করে হাসল ব্রাউন। তবে জাল চেক দিয়ে যে জিনিস কিনেছে আমি প্রমাণ করতে পারব। কোন কোন দোকানে চেক ভাঙিয়েছে সে, মনে আছে আমার। ওরা সাক্ষ্য দেবে, চেকগুলো ব্রাউন ওদের দিয়েছে। পুলিশ আমার কিছুই করতে পারবে না। কারণ একটা চেকও আমি নিজের হাতে ভাঙাইনি। মরলে আর সবাই মরবে। আমার কিছুই হবে না।

খেপা কুকুরের মত দাঁত খিচাল বার্ড। ভীষণ রাগে চেঁচিয়ে উঠল, শয়তান! বদমাশ! তুমি নিজে ভাল থেকে আমাদের বিপদে ঠেলে দেয়ার ফন্দি করেছিলে! দাঁড়াও, আমিও ছাড়ব না! আমি সাক্ষ্য দেব, লফার নির্দোষ, তুমি। জোর করে ওকে দিয়ে বেআইনী কাজ করিয়েছ!

গুড, মাথা দোলালেন সাইমন, তাতে তোমার ভালই হবে। শাস্তির পরিমাণ কমবে। কি কি জানো তুমি, বলো তো?

বার্ড বলল, মাস চারেক আগে মরুভূমির ওপর দিয়ে প্লেনে করে ওড়ার সময় দানবীয় নকশাগুলো চোখে পড়ে আমাদের। একটা গুজব কানে এনেছিল ব্রাউনের, কোন একটা টিলার ওপরের একটা দানবের হাত গুপ্তধনের খনির দিকে নির্দেশ করে আছে। এই টিলার ওপরে দানবটা দেখতে পেয়ে সেই কথাই মনে পড়ল তার। আমাকে বলল সে-কথা। দুজনে মিলে তখন নানা জায়গায় খুঁড়তে আরম্ভ করলাম। তারপর সত্যি সত্যিই পেয়ে গেলাম লুকিয়ে রাখা সোনা।

সোনা! প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর। কোথায়? কোনখানে?

যে গর্তটা তোমরা দেখেছ একটু আগে। দানবের হাত নয়, একটা পা। নির্দেশ করছে গর্তটা।

কি ধরনের সোনা? জানতে চাইলেন সাইমন।

ইনডিয়ানদের সোনা। জানাজানি হলে খোয়াতে হতে পারে। তাই আমেরিকায় বিক্রি করার সাহস পেলাম না। নিয়ে গেলাম মেকসিকোয়। টাকাটা দু-জনে ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ব্রাউনের মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি এল। সে বলল, এই টাকা খাঁটিয়ে আরও অনেক অনেক বেশি টাকা আমরা আয় করতে পারি।

বুদ্ধিটা কি?

সে বলল, একটা ছাপাখানা করতে পারি আমরা। সেটীতে জাল নোট আর চেক ছাপতে পারি। সারা আমেরিকায় সে-সব ছড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করব। রাজি হয়ে গেলাম। ছাপাখানা বসল। জাল চেক ছাপা হতে লাগল। প্লেনে করে সেগুলো বর্ডার পার করে এনে এই টিলায় নামানোর ব্যবস্থা হলো। নির্জন জায়গা এটা। রাতে তো দূরের কথা, দিনেও সাধারণত আসে না এখানে লোকে। ঠিক হলো, এখানে এনে জমা করে রাখা হবে চেকগুলো। তারপর ধীরে ধীরে চালান করে দেয়া হবে বিভিন্ন শহরে। বাতিগুলোসহ প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস ওই গর্তে লুকিয়ে রাখতাম আমরা।

বুঝলাম, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিন্তু লফার এর মধ্যে এলেন কি করে?

সেটাও ব্রাউনের আরেকটা কুবুদ্ধি, ঘৃণায় মুখ বাকলি বার্ড। তার ওপর যাতে পুলিশের নজর না পড়ে সেজন্যে একজন সৎ, ভাল মানুষকে সামনে রাখতে চেয়েছিল। ভেবেছিল, ব্যবসায় মার খেয়েছে লফার, এই সুযোগে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে দলে টানতে পারবে। পারল না। জোর করে তাকে দিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই করতে পারল না। পালিয়ে গেল লফার। অনেক কিছু জেনে ফেলেছে ততদিনে সে। সুতরাং তার মুখ বন্ধ করাটা জরুরী। আমাকে পাঠাল রকি বীচে। ব্রাউন ভেবেছিল লফার তার মামার বাড়িতেই গিয়ে উঠেছে। গিয়ে জানলাম তার মামা ডিটেকটিভ ভিকটর সাইমনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তার ভাগ্নেকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যে। মোটর সাইকেল নিয়ে মিস্টার স্মিথের পিছে পিছে গেলাম সেখানে। সেখান থেকে স্যালভিজ ইয়ার্ডে।

মুসার মাথায় বাড়ি মেরেছিল কে? আপনি?

গম্ভীর হয়ে বলল বার্ড, হ্যাঁ। তাকে বেহুশ না করে ছবিগুলো আনা যেত না তার কাছ থেকে। ওঅর্কশপের দরজায় নোটটাও আমি রেখেছি। বললাম যখন, সব কথাই বলি। রকি বীচ থেকে একটা ভাড়া করা প্লেনে তোমাদের অনুসরণ করলাম আমি। স্যান বারনাডিনোতে ওই প্লেনটাই ধাক্কা মারতে যাচ্ছিল তোমাদের। পাইলটটা একটা গাধা। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তাহলে তাকে নিতাম না। আরেকটু হলেই তোমাদেরও মেরেছিল, আমাকেও। যাই হোক, ব্লইদিতেও লফারের প্লেনে তোমাদের হুমকি দিয়ে নোট আমিই রেখেছিলাম। রাতের বেলা চুরি করে ঢুকেছিলাম হ্যাঁঙ্গারে।

নোট লিখতে গিয়ে তো রীতিমত কাণ্ড করেছেন। একবার আর্টিস্ট, একবার কবি! রবিন বলল। এ সব করতে গেলেন কেন?

ভাবলাম, খানিকটা অন্য রকম করে দিলে হুমকির গুরুত্ব বাড়বে।

তা বেড়েছে বটে, স্বীকার করল কিশোর। জানতে চাইল, তিন মেকসিকানকে আমাদের পেছনে আপনারাই লাগিয়েছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ। আফসোস করে বলল বার্ড, ইস্, সোনাগুলো পাওয়ার পর ব্রাউনের কথা কেন যে শুনলাম! অত লোভ না করে আমার ভাগের টাকাটা নিয়ে নিলেই হত…।

আচ্ছা, আরেকটা কথা। মরুভূমিতে একটা দামী পাথর কুড়িয়ে পেয়েছি। আমরা। ওটা সম্পর্কে কিছু জানেন নাকি?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল বার্ড। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। নাহ্, পাথরের ব্যাপারে কিছু জানি না আমরা। তবে পর্বতের ওদিকে পাথর খুঁজতে যায় অনেকে। নিয়ে আসার সময় হয়তো ওদেরই কারও কাছ থেকে কোনভাবে পড়ে গেছে ওটা।

হু, বিড়বিড় করল কিশোর, তাই হবে!

পুলিশ নিয়ে মুসাদের ফিরতে অনেক সময় লাগল।

বন্দিদের নিয়ে চলে গেল পুলিশ। তাদের সঙ্গে গেলেন সাইমন। লফারও গেল। সমস্যা মিটে যেতেই বাড়ি যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে।

কেবিনে ফিরে চলল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে ওয়ারনার বল।

 রাত আর বেশি বাকি নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *