আম্রপালী – ১৫

১৫.

রবিবার ছুটির দিন। তবু সকাল সকাল দুটি খেয়ে নিয়ে বেলা দেড়টা নাগাদ বাড়ি থেকে বার হবার জন্য প্রস্তুত হলেন। হাতে ছাতা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তার ভিতর স্টীলের সেই ক্যাশবাক্স ছাড়াও ছিল একটা স্ট্যাম্প-প্যাড আর এক খণ্ড কাগজে সেই স্বীকৃতি “পত্রবাহকের নিকট ব্ল্যাকমেলিং বাবদ প্রথম ও শেষ কিস্তি হিসাবে পঁচিশ হাজার টাকা দশ ও বিশ টাকার নোটে বুঝিয়া পাইলাম।” গোটা-গোটা হরফে রসিদটা লিখতে লিখতে প্রফেসর তালুকদারের মনে হয়েছিল, তিনি বোধহয় ব্ল্যাকমেলিঙের ক্রিমিনোলজির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করে গেলেন : রসিদ নিয়ে ব্ল্যাকমেলিঙের প্রথম ও শেষ কিস্তি মেটানো। নিজের গাড়ি গ্যারেজ থেকে বার করলেন না। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে, মায় জুতোর ফিতেটা বেঁধে রামুকে বললেন, একটা ট্যাক্সি ডেকে আনতে–ভবানীপুরের পদ্মপুকুরে যাবেন।

ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল দরজায়। ডানে-বাঁয়ে দেখে নিয়ে সাবধানী প্রৌঢ় মানুষটি ছাতা বগলে, ব্যাগ কাঁধে ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন।

দুপুরের ফাঁকা রাস্তা। গোলপার্ক, সাদার্ন অ্যাভিন, শরৎ বসু রোড ধরে চক্রবেড়িয়ার মোড়ে পৌঁছাতে সময় লাগল বাইশ মিনিট। শরৎ বসু আর চক্রবেড়িয়ার মোড়ে, ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার বিপরীতে ট্যাক্সিটাকে থামালেন। তখন দুটো দশ। এখনো কুড়ি মিনিট সময় হাতে আছে। যথেষ্ট সময়। এটুকু পথ উনি হেঁটেই যেতে চান। ট্যাক্সি-ড্রাইভারটাকেই বা বেহুদ্দো সাক্ষী রাখেন কেন? ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ছাতাটা খুলে উনি গুটি গুটি জাস্টিস্ চন্দ্রমাধব রোড ধরে পশ্চিমমুখো চলতে থাকেন। কাঁধে ব্যাগ।

পথ এই মধ্যদিনে প্রায় নির্জন। দু-একটা গাড়ি যাচ্ছে হুস-হাস করে। রিকশার ঠুন-ঠুন। বাঁ-দিকে গুজরাতিদের একটা মেটার্নিটি হোম। তার পাশেই এক ভাজিওয়ালার দোকান। বিপরীত ফুটপাতে ‘দক্ষিণাকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। ঘড়িটা দেখলেন আবার : দুটো কুড়ি। এখনো দশ মিনিট বাকি।

হঠাৎ স্থির করলেন নির্ধারিত সময়ের আগেই উনি ঐ বেঞ্চিতে গিয়ে বসে থাকবেন। ছাতা মাথায়। দেখবেন জীনস-এর প্যান্ট পরা, টম্যাটো-রঙের স্পোর্টস্ গেঞ্জি গায়ে লোকটা কোন দিক দিয়ে পার্কে ঢোকে। লক্ষ্য করে দেখবেন সে একা আসে কি না। কী চেপে এল। প্রাইভেট কার হলে তার নম্বরটা ওঁকে দেখে নিতে হবে। ট্যাক্সি হলেও তাই। আর যদি হাঁটতে হাঁটতে আসে তবে ওর হাঁটার ধরনটা অনেকক্ষণ ধরে দেখবার সুযোগ পাবেন। ভবিষ্যতে আইডেন্টিটি প্যারেডে….

রাস্তাটা পার হয়ে পার্কের ভিতর যাবেন, বাঁ দিক থেকে একজন মোটরবাইক চালিয়ে প্রায় ওঁর ঘাড়ের উপর এসে ব্রেক কষে। ব্যাগ সামলে উনি দু-পা পিছিয়ে যান। লোকটা বললে, সরি।

উনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন। মোটর-সাইকেলের আরোহীর গায়ে হালকা নীল রঙের একটা উইন্ড-চিটার, মাথায় হেলমেট, চোখে গগল্‌স্‌। তার বাঁ-হাতে একটা চিরকুট। ডানে-বাঁয়ে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে, উত্তর দিক কোনটা, স্যার?

তালুকদার-সাহেব ওর থেকে প্রায় দু-মিটার দূরে সরে এসেছেন। তবু সেখান থেকেই মনে হল ওর হাতে ওটা একটা স্কেচ-ম্যাপ। প্রফেসর তালুকদারের কাছে কম্পাস নেই, কিন্তু উত্তর-দক্ষিণ নিশানাটা তাঁর গুলিয়ে যায়নি। হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

লোকটা বললে, তার মানে এইটা যদুবাবুর বাজার?

এবার সে তার ম্যাপের উপর তর্জনিটা রেখেছে।

কাগজটা দেখতে অধ্যাপক তালুকদার ঘনিয়ে এলেন ওর কাছে। লোকটা তার হাতে-ধরা ম্যাপের দিকে তাকিয়েই ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল ওঁর দিকে। সেটা মৃদুভাবে স্পর্শ করল ওঁর তলপেট। সেদিকে তাকিয়ে বজ্রাহত হয়ে গেলেন তালুকদার-সাহেব।

ওর মুঠিতে ধরা আছে একটা রিভলভার। খেলনার নয়, খাঁটি মাল!

উনি কী একটা কথা বলতে গেলেন। কথাটা শোনা গেল না। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই লোকটা কিক করে মোটরসাইকেলে আবার স্টার্ট দিল। প্রচণ্ড শব্দে তালুকদারের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল।

সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে, মোটরবাইকের শব্দকে ছাপিয়ে, গগল্‌স পরা লোকটা বললে, প্রফেসর তালুকদার! কোনও উচ্চবাচ্য করবেন না। আপনার কাঁধের ঝোলাটা–আমার কেরিয়ার ব্যাগে ভরে দিন। কুইক!

তালুকদার তখন থরথর করে কাঁপছেন। ত্রিসীমানায় একটা লোক নেই। ওদিকে খানকয় গাড়ি পার্ক করা আছে বটে, কিন্তু যাত্রীবিহীন। দক্ষিণাকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে একজন প্রৌঢ়া মহিলা খরিদ্দারকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে।

ভট ভট ভট বিকট শব্দের মধ্যেই লোকটা বললে, প্রফেসর! আপনি নিজে হাতে ভরে না দিলে আপনার কিডনিটা ফুটো করে ব্যাগটা ছিনিয়ে নেব কিন্তু। আমি তিন গুনব….এক…দুই..

উনি কাঁধ থেকে ব্যাগটা খুলে নিয়ে কিছু বলতে গেলেন। এবারও তাকে থামিয়ে দিয়ে লোকটা ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল। রেখে দিল ওর কেরিয়ার-ব্যাগে। তারপর একগাল হেসে বলল, আপনি পণ্ডিত মানুষ, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, আমি ‘মাস্তান’ নই। আমার নাম ‘নেপো’! মাস্তান—ঐ দেখুন–ঐ পার্কে ঢুকছে। বুড়ো আঙুল চুষতে। আঙুল তুলে সে পার্কের বিপরীত দিকে ইঙ্গিত করল।

একটি গাঁট্টাগোট্টা লোক গেট দিয়ে পার্কে ঢুকছিল। তার পরনে জীন্‌স্‌-এর প্যান্ট, গায়ে টম্যাটো রঙের গেঞ্জি। মাথায় হুড। সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। হেলমেট-পরা মোটর সাইকেলে-বসা একজন লোক আঙুল তুলে তাকে দেখাচ্ছে, তার হাতে রিভলভার!

লোকটা চোঁ-চোঁ দৌড় মারল এক দিকে।

মুহূর্ত-মধ্যে ফুলস্পীডে নেপো বেরিয়ে গেল উল্টো দিকে।

বজ্রাহত হয়ে মাঝ-সড়কে উনি ছাতা মাথায় দাঁড়িয়েই থাকলেন।

বাঁকের মুখে মিলিয়ে গেল মোটরবাইক। টম্যাটো-কালার স্পোর্টস্ গেঞ্জি তার অনেক আগেই হাওয়া।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তালুকদার সাহেবের। ভুল হয়ে গেল। সামান্যর জন্য। দক্ষিণাকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি দইয়ের ভাঁড় হাতে এতক্ষণে ও-দিকের ফুটপাতে ধরে বাড়িপানে হাঁটা ধরেছেন। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন ভদ্রমহিলা। তালুকদারকে দেখে। মাঝ-সড়কে ও বুড়োটা অমন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন ছাতা মাথায়? পাগল নাকি?

.

সোম-মঙ্গল দুটো দিন প্রচণ্ড টেনশনে কাটল। কলেজে গেছেন; কিন্তু যাবার আগে টেলিফোনটা রিসিভার থেকে নামিয়ে রেখে ঘর তালাবন্ধ করেছেন। উনি চাননি ওঁর অবর্তমানে মাস্তান বাড়িতে ফোন করে। সোম-মঙ্গল দুটো দিনই সন্ধ্যার পর দ্বার রুদ্ধ করে অপেক্ষা করেছেন টেলিফোনের উপর বাঁ-হাতটা রেখে রাত সাড়ে আটটায়। মাস্তান ফোন করেনি। পঁচিশ হাজার টাকার দাবী পুনরায় পেশ করে হুমকি দেয়নি।

কিন্তু–কেন? কেন? কেন?

ব্যাগটা যে ছিন্তাই হয়ে যাবে এটা জানতেন। নিশ্চিতভাবে। সেটা ছিন্তাই হবেই। আন্দাজে নয়, স্বাভাবিক যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত। মাস্তান টিপছাপসহ রসিদ দিয়ে যখন ব্ল্যাকমেলিঙের টাকাটা নিতে স্বীকৃত হল সেই মুহূর্তেই উনি সেটা বুঝে নিয়েছিলেন। অমন একটা রসিদ সে প্রফেসর তালুকদারের ব্যাঙ্ক ভন্টে রাখতে রাজি হবে না। কিছুতেই না। ঐ যুক্তিটা ধোপে টেকে না–ঐ দু-পক্ষের আর্সেনেলে হাইড্রোজেন বম্ব থাকা। তালুকদার ষাটের কোঠায়, মাস্তান বোধকরি বিশ-বাইশ। মাস্তানের প্রত্যাশিত মধ্যবয়সে তালুকদার সাহেবের ওয়ারিশ ব্যাঙ্ক ভল্ট খুলবে। তখন? হয়তো উনি সমস্ত ঘটনাটা একটা ‘এফ. আই. আর,’-এর মতো লিখে তার সঙ্গে ঐ রসিদ পিন দিয়ে গেঁথে তাঁর ব্যাঙ্কভন্টে রেখে গিয়েছেন। প্রতিশোধ নিতে। তাহলে?

প্রফেসর তালুকদার তাই আন্দাজ করেছিলেন, নর্দার্ন পার্কে পৌঁছবার পূর্বেই তাঁর ব্যাগটা ছিন্তাই হয়ে যাবে। সেজন্য সাবধানী মানুষটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি নিয়েছিলেন ঠিকই। সেজন্যই সেদিন চাঁদনির বাজারে ওঁকে একজোড়া টর্চের ব্যাটারি কিনতে হয়েছ, ইঁদুরমারা স্প্রিংকল, সোলডারিং তার কিনতে হয়েছে। সেজন্যই দু-দুটো দিন নির্জনকক্ষে সাধনা করতে হয়েছে।

কিন্তু ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মাস্তান নিজেই আসবে টাকাটা ছিনিয়ে নিতে। তাই মোটরসাইকেল আরোহীর অতর্কিত আবির্ভাবটা অপ্রত্যাশিত ছিল না ওঁর কাছে; কিন্তু দাবাবোড়ে-ছকের ও-প্রান্তে ঘোড়ার চালে ওঠশাই কিস্তিটা ওঁর নজরে পড়েনি। উনি ভাবতেই পারেননি, মাস্তান, এভাবে দাবা-ধরে ঘোড়ার চালে কিস্তি দিতে পারে।

তাই বেমক্কা ‘নেপো’র সহকারীর আবির্ভাবে উনি হতচকিত হয়ে পড়েন। মাস্তানকে ডিঙিয়ে দধিভক্ষণমানসে দ্বিতীয় একটি নেপোর আবির্ভাবটা ছিল হিসাবের বাইরে। দুজন যে দুদিকে পালালো! উনি কী করবেন?

কিন্তু সোম-মঙ্গল দু-দুটো দিনের মধ্যে মাস্তান টেলিফোন করল না। নতুন করে পঁচিশ হাজার টাকার দাবীটা পেশ করল না।

কেন? কেন? কেন?

হয় মস্তান, নয় নেপো, একজন না একজন তো তাকে ফোন করবেই। দুজনের মধ্যে যে ফাঁকে পড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *