চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে

চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে-৬৭

বনহুর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গে।

নগ্ন নারী মূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দীর্ঘ এলো চুল, অর্ধেক ছড়িয়ে আছে পিঠে অর্ধেক কাঁধের উপর দিয়ে নেমে এসেছে বুকের উপর–আরও নিচে উরু পর্যন্ত। যাদুকক্ষের লালচে আলোতে অদ্ভুত লাগছে মেয়েটাকে। রক্তাক্ত দেহ, তীক্ষ্ণ দুটি চোখ, টানা দুটি। সুন্দর সুঠাম যৌবনে উগ্রতায় ভরপুর যেন।

বনহুর দৃষ্টি ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

 মাদাম চীং এসে দাঁড়ালো তার পিছনে!

বনহুর ওর নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। কেমন যেন শির শির করছে বনহুরে দেহটা, এই বুঝি মাদাম চীং তার দেহ স্পর্শ করবে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো মাদাম তার দেহ স্পর্শ করলো না।

বনহুর ফিরে তাকাবে কিনা ভাবছে ঠিক ঐ মুহূর্তে মাদাম চীং একটা শব্দ করলো।

বনহুর চমকে ফিরে তাকাতেই অবাক হলো মাদাম চীং হাতে একটি পানি পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পূর্বে সে দেখেছে ওর হাত শূন্য, পানি সে পেলো কোথায়?

বনহুরের দৃষ্টি আবার এসে পড়লো মাদাম চীং এর নগ্ন দেহে।

মাদাম চীং পানি পাত্রটা এগিয়ে ধরলো বনহুরের দিকে।

বনহুর পিপাসায় কাতর, হাত বাড়ালো সে মাদাম চীং এর হাতের পানির পাত্রটার দিকে।

 মাদাম চীং পানি পাত্রটা বনহুরের হাতে না দিয়ে ওর মুখের কাছে তুলে ধরে।

বনহুর তখন এতো বেশি পিপাসার্ত যার জন্য সে কিছু ভাবতে পারেনা, পান করে সে ঐ তরল পদার্থ। কিন্তু একি তার সমস্ত শরীর কেমন যেন তোলপাড় করছে। চোখ দুটো আপনা আপনি মুদে আসছে।

বনহুর টলতে লাগলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

আর একটু তাহলেই সে পড়ে যাবে। এমন সময় একটি কঠিন আওয়াজ তার কানে এলো। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ দুটো তুলে ধরলো বনহুর সম্মুখে–দেখলো অদ্ভুত চেহারার একটি লোক সেই কক্ষে প্রবেশ করেছে।

এরপর আর কিছু মনে নেই বনহুরের। সংজ্ঞাহীন দেহটা ওর ঢলে পড়ে মেঝেতে নগ্ন নারী মূর্তির পায়ের কাছে।

যখন জ্ঞান হলো চোখ মেলতেই দেখলো সে এক সুন্দর বিছানায় শায়িত আছে। যে কক্ষে শায়িত সে কক্ষটা সুসজ্জিত না হলেও সুন্দর তাতে কোন ভুল নেই।

বিছানায় উঠে বসতেই কানে এলো চীনা ভাষায় একটি শব্দ বৎস আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো।

বনহুর কক্ষের চারিদিকে তাকালো কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলোনা সে। বনহুর আবার ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করলো। স্মরণ করতে চেষ্টা করলো সে এখন কোথায়। শরীরটা এখন বেশ ভাল লাগছে মাথাটাও তেমন ঝিম ঝিম করছে না। বনহুর আবার চোখ মেললো, মনে পড়লো সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশের কথা। সেই বিরাট গুহা বা ছাতের অন্ধকারে দোল খাচ্ছে কতকগুলো মৃত দেহ। দেয়ালের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তাভ লালচে আলোর রশ্মি। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর এক একটা মূর্তি যেন জীবন্ত এক একটা রাক্ষস। বিরাট বিরাট সাপের মূর্তি ওদের নিঃশ্বাসের ফোঁস ফোঁস আওয়াজ স্পষ্ট শুনেছে। যে শয্যায় সে অঘোরে ঘুমিয়েছিলো আসলে সেটা শয্যা ছিলোনা, কতকগুলো শব দিয়ে ভেলা তৈরি করে শয্যা বানানো হয়েছিলো। কি বিদঘুঁটে গন্ধ সেই শবদেহগুলোর। অসহ্য পিপাসায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ একটা শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিলো একটি নগ্ন নারীদেহ। সে চিনতে পেরেছিলো মাদাম চীংকে….কিন্তু সে তাকে পানি ভ্রমে কি খেতে দিয়েছিলো। এমন কোন জিনিস যা পান করার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিলো তারপর এক শব্দ ফিরে তাকাতেই দেখেছিলো একজন অদ্ভুত চেহারার মানুষ ……তারপর আর কিছু মনে নেই। এখন সে কোথায়, এতো পূর্বের সে কক্ষ নয় আর কেইবা তাকে এভাবে আরও কিছু সময় শুয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করলো……

একটা হাসির শব্দ হলো, চমকে উঠলো বনহুর ফিরে তাকাতেই আবার কানে এলো সেই কণ্ঠ-বৎস তুমি যা চিন্তা করছিলে সব জানতে পারবে। বুঝেছি এই মুহূর্তে জানতে চাও। বেশ, শোন, আমিই সেই অদ্ভুত মানুষ; আমাকে দেখনি তো কোনদিন, তাই চিনতে পারনি। আমিই চীনের শ্রেষ্ঠ যাদুকর হুয়াংচু।

বনহুর অর্ধ শায়িত অবস্থায় বসে কান পেতে শুনছিলো, দুচোখে তার বিস্ময়, মনে হচ্ছে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কেউ কথাগুলো বলছে কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছেনা। এমন কি তার নিঃশ্বাসের স্পষ্ট শব্দও শুনতে পাচ্ছে বনহুর।

হুয়াংচুর নাম শুনে তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে বসে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠে বনহুর-তুমি– তুমিই পৃথিবীর যাদু সম্রাট হুয়াংচু!

হাঁ, লোকে তাই বলে।

 কিন্তু তোমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন?

 সব সময় আমাকে তুমি দেখতে পাবে না।

 দেখতে পাব না?

পাবে কিন্তু বিশেষ কোন মুহূর্তে। যেমন তুমি একবার আমাকে যৎকিঞ্চিত দেখেছো। আমাকে দেখলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। যেমন তুমি সবচেয়ে সুন্দর তেমনি আমি সবচেয়ে কুৎসিত। একটা হাসির শব্দ শোনা গেলো।

তারপর আবার সেই কণ্ঠস্বর–আমার কন্যা মাদাম চীং বড় কুমনোবৃত্তি মেয়ে। তার কক্ষে তুমি কঙ্কাল এবং নর-দেহ দেখেছো এগুলি সব তার খেয়ালের শিকার। আমি যদি ঠিক মুহূর্তে গিয়ে হাজির না হতাম তাহলে তোমার অবস্থাও ঐ সব দেহগুলোর মত হতো। দস্যু সম্রাট…

চমকে উঠলো বনহুর। সে দস্যু, সে কথা হুয়াংচু জানলে কি করে? অবাক বিস্ময়ে তাকালো বনহুর সম্মুখে শূন্যতার দিকে।

কিছু বলবার আগেই পুনরায় শোনা গেলো সেই কণ্ঠস্বর-তুমি কে এ কথা আমার জানতে বাকি নেই। তুমি যে মুহূর্তে জিহাংহায় পা রেখেছে সেই মুহূর্তে আমি জানতে পেরেছি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দস্যু আজ চীন রাজ্যে পদার্পণ করলো।

বনহুর অস্ফুট শব্দ করে উঠলো—হুয়াংচু!

 হ–আমি তারপর থেকে তোমার দর্শন আসার প্রতিক্ষা করছিলাম দস্যু বনহুর।

আরও বিস্ময় জাগলো বনহুরের যাদুকর তার নামটাও জানে।

হাঁ তোমার নামও জানি এতে অবাক হবার কিছু নেই।

এবার বনহুর বলে উঠলো-হুয়াংচু তুমি আমার মনের কথা জানতে পারছো কি করে বলো?

বনহুর তুমি যাদু বিশ্বাস করোনা, যদি করতে তবে বুঝতে পারতে পৃথিবীতে এখনও তোমার জানার অনেক বাকি আছে।

বনহুর ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় এক গভীর চিন্তার অতলে। শুনতে পায় সে পদ শব্দ কেউ যেন বেরিয়ে গেলো তার কক্ষ থেকে।

বনহুর ভাবছে সত্যই সে যাদু বিশ্বাস করে না এবং করে না বলেই সে কোনদিন যাদু বিদ্যা নিয়ে চিন্তা করেনি। এই সুদূর জিহাংহায় এসেছে সে শুধু হামবার্ট কে খুঁজে বের করার জন্য, আর তার গোপন কার্যকলাপ সম্বন্ধে সব কিছু উদঘাটন করে তাকে নিঃশেষ করাই হলো তার মূল উদ্দেশ্য। হামবার্টকে খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগেনি তার। অপ্রত্যাশিতভাবে হামবার্ট ও তার গোপন ঘাটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ঐ শয়তানটাকে বনহুর শুধু হত্যাই করতে চায় না। ওর কুকর্মের মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে চায়।

হাঁ পারবে তুমি! আবার সেই কণ্ঠস্বর–পারবে কিন্তু তোমাকে এ জন্য সগ্রাম করতে হবে।

সংগ্রাম! বনহুর উচ্চারণ করলো।

হ বৎস সংগ্রাম কারণ ঐ শয়তান শুধু সাংঘাতিক নয় অতি ভয়ঙ্কর। বনহুর আমি তোমার আগমন প্রত্যাশায় ছিলাম। জানি তুমিই পারবে ঐ নর পশুকে শায়েস্তা করতে।

পারবো?

হাঁ পারবে। তুমি পারবে দস্যু বনহুর–তুমিই পারবে।

কিন্তু…….

জানি তুমি ভাবছো ওকে হত্যা করতে তোমার কোন অসুবিধা হবেনা কিন্তু ওর যে গোপন ব্যবসা কেন্দ্রগুলো আছে তা তুমি ধ্বংস করতে পারবে কিনা এ নিয়ে তোমার চিন্তা আছে।

হাঁ আমি ভাবছি সেই কথা। হামবার্টের গোপন ব্যবসা কেন্দ্রগুলো বিনষ্ট করাই আমার মূল উদ্দেশ্য এবং তার সঙ্গে ওকে সায়েস্তা করা।

এবার একটা হাসির শব্দ হলো।

যাদুকরের কণ্ঠ-হাসি থামিয়ে বললো-বৎস আজ পূর্ণ বিশ্রাম করো, আগামীকাল থেকে তোমাকে নিয়ে আমি কাজ শুরু করবো।

পুনরায় পদ শব্দ।

 কেউ যেন কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো।

বনহুর ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা এলিয়ে দিলো শয্যায়। সে অনুভব করলো এখন তার মোটেই ক্ষুধা বা পিপাসার ভাব নেই।

মুদে এলো বনহুরের চোখ দুটো।

যাদুকর হুয়াংচু বনহুরকে অজ্ঞান অবস্থায় একটি ইনজেকশান দিয়েছে যার জন্য ওর ক্ষুধা পিপাসা সমস্ত বিলোপ পেয়েছে।

*

মাদাম চীং এর দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। মেঝেতে পায়চারী করতে করতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।

সম্মুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি তরুণী। তার দেহে অদ্ভুত পোশাক, মাথায় অদ্ভুত টুপি। গায়ের আলখেল্লা ধরনের পোশাকটা পা পর্যন্ত। টুপিটা উঁচু হয়ে হাত দুই উঠে গেছে উপরের দিকে।

মাদাম চীং রাগত কণ্ঠে বললো–নাদাম, বাবা ঐ লোকটাকে নিয়ে কোথায় রেখেছে জানো?

মাদাম চীং, এ কথা আমরা জানবো কি করে। জানবেন আপনি। তবে আমরা সন্ধান নিয়ে আপনাকে জানাতে পারবো।

পারবে?

হাঁ পারবো।

সাবাস, নাদাম যদি ঐ যুবককে এনে দিতে পারো তাহলে আমার গলার এই মুক্তা হার তোমাকে দেবো।

মাদাম চীং।

হাঁ নাদাম পাবে। শুধু তুমি নও যে কোন ব্যক্তি আমার শিকার এনে দিতে পারবে তাকে আমি এ মুক্তা হার দিয়ে পুরস্কৃত করবো।

নাদাম অভিনবভাবে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বেরিয়ে গেলো।

মাদাম চীং হাত দুখানা মাজায় রেখে পুনরায় পায়চারী শুরু করলো। কিছুক্ষণ ভাবলো সে পায়চারী করতে করতে তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে করতালি দিলো।

অমনি দুজন বলিষ্ঠ লোক এসে দাঁড়ালো মাদাম চীং এর সম্মুখে।

মাদাম চীং বলে উঠলো কিসাংচু আর লারলিং তোমরা যাও অনুসন্ধান চালিয়ে দেখো কোথায়। সেই লোকটি থাকে আমি মিনা বাজার থেকে তুলে নিয়ে এসেছি।

কিংচু বলে উঠলো—মাদাম আমি জানি সে কোথায় আছে।

জানো?

হাঁ জানি।

পারবে তাকে আনতে? যদি পারো তবে এই মুক্তা মালা আমি তোমাকে দেবো।

কিসাংচুর চোখ দুটো জ্বলে উঠে, কারণ ঐ মুক্তার মালা বহু মূল্যবান। চীনের খাঁটি মুক্তা দিয়ে তৈরি ও মালা এ কথা জিংহাংহায় সবাই জানে। এ মালা ছিলো একদিন চীন সম্রাট কন্যা চিরাচুং এর গলায়। বৎসরে একদিন চিরাচুং রাজ্য ভ্রমণে বের হতো। হাতির পিঠে হাওদার মধ্যে বসে থাকতো সে, তখন তার গলায় শোভা পেত ঐ মুক্তা হার। অদ্ভুত এক আলোক রশ্মি বের হতে ঐ মালা থেকে। সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়তে চীন সম্রাটের কন্যার গলায়। যাদু সম্রাটের কন্যা মাদাম চীং এর নজরেও পড়লো ঐ মুক্তা হার। যেমন করে থোক ও মালা তার চাই। পিতাকে কথাটা জানালো মাদাম চীং। সম্রাট কন্যার কণ্ঠ হারের লোভ দেখে কন্যাকে সেদিন তিরস্কার করলো যাদুকর। কুদ্ধ হয়ে উঠলো সি পিতার তিরস্কারে এবং শপথ করলো যেমন করে হোক ও মুক্তার মালা তার চাই। মাদাম চীং এর অসাধ্য কোন কুকর্ম ছিলোনা, সে এক বৃদ্ধার ছদ্মবেশে চীন সম্রাটের দরবারে গিয়ে হাজির হলো। সমস্ত শরীরে তার চীন তপস্বিনীদের পোশাক, গলায় মালা, হাতে জপৃতসবী। মাথার চুল সম্পূর্ণ সাদা ধপ ধপে! মাদাম চীংকে এক বৃদ্ধা তপস্বিনী ছাড়া কিছু মনে হচ্ছিল না। চীন সম্রাট ওকে স্ব সম্মানে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন! কি অভিপ্রায় নিয়ে তার আগমন হয়েছে জানতে চাইলেন তিনি। মাদাম চীং কিছুক্ষণ ধ্যান মগ্ন থেকে চোখ মেলে বললো, সম্রাট বাহাদুর আমি আপনার কন্যা চিরাচুং এর অমঙ্গল বার্তা নিয়ে এসেছি।

মাদাম চীং এর কথা শুনে চীন সম্রাটের মুখ শুকিয়ে গেলো, তার এক মাত্র কন্যা চিরাচুং এর অমঙ্গল বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে এই তপস্বিনী।

চীন সম্রাট যেন আকাশ থেকে পড়লেন তিনি কর জোরে বললেন এ আপনি কি বলছেন তপস্বিনী মা?

হাঁ যা বলছি সত্য। তোমার মেয়ের সম্মুখে বিরাট একটি বিপদ এগিয়ে আসছে।

 সে বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন উপায় নেই কি?

আছে। আর আছে বলেই আমি এসেছি। তোমার কন্যার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া একান্ত দরকার। আমি তার দেহে মন্ত্র পাঠ করে ফুঁ দেবো তা হলে সে ঐ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে। কিন্তু আমি যখন তার শরীরে হাত বুলিয়ে ফুঁ দেবো তখন সে কক্ষে কারো থাকা চলবে না। কেউ যদি আত্নগোপন করে আড়াল থেকে দেখে তাহলে সম্রাট কন্যা ঐ মুহূর্তে মৃত্যু বরণ করবে কাজেই সাবধান……

চীন সম্রাট মাদামচীং এর পদধুলি গ্রহণ করে বলে আপনার আদেশ শিরধার্য তপস্বিনী মা। বলুন কোন সময় আপনি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান?

চিরাচুং যে মুহূর্তে রাজ্য ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসবে ঐ মুহূর্তে আমি তাকে একটি নির্ভূত কক্ষে নিয়ে মন্ত্রের দ্বারা তার দেহ শুদ্ধ করবো যেন কোন বিপদ তাকে কোনদিন স্পর্শ করতে না পারে। কিন্তু যে পোশাকে সে বাহির থেকে ফিরে আসবে ঐ পোশাক না পাল্টাতেই আমি তাকে নিভৃত কক্ষে নিতে চাই।

আপনার আদেশ যথার্থ পালিত হবে।

 তাহলে আজ চলি।

তপস্বিনী বেশি মাদাম চীং উঠে দাঁড়াল।

সম্রাট ওর পদধূলি গ্রহণ করে।

ঠিক যেদিন চিরাচুং রাজ্য ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এলো সে দিন ঐ মুহূর্তেই এসে হাজির হলো মাদাম চীং তপস্বিনীর বেশে।

আশে পাশেই যে কোথাও আত্মগোপন করে ছিলো, সব দেখছিলো মাদাম চীং আড়াল থেকে। সম্রাট কন্যার গলায় ঐ মুক্তা হার আছে কিনা তাও সে লক্ষ্য রেখেছিলো। মুক্তা মালাটা চিরাচুং এর কণ্ঠে জ্বল জ্বল করছে দেখলো মাদাম চীং এবং চীন সম্রাটের দরবারে প্রবেশ করলো সে মন্থর পদক্ষেপে।

চীন সম্রাট সিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিনন্দন জানালো।

পূর্ব হতেই সম্রাট কন্যাকে সব কথা বলে সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন। চিরাচুং হাতির পিঠ থেকে অবতরণ করে সেই নির্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশ করলো।

সম্রাট নিজে যাদুকরি মাদাম চীংকে স্ব-সম্মানে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন।

চীন সম্রাটের প্রাসাদ।

সে এক বিস্ময়।

যাদুকর মাদাম চীং কোনদিন প্রাসাদে প্রবেশে সক্ষম হয়নি আজ সে প্রবেশ করতে পেরে আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠলো। এগুলো সে ঠিক তপস্বিনীর গতিতে।

সেই নিৰ্ভত কক্ষ।

 চীন সম্রাট আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কক্ষের প্রবেশ পথ।

 মাদাম চীং এর মুখে হাসি।

 সে একবার চীন সম্রাটের মুখের দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালো দরজার দিকে।

সম্রাট পূর্ব হতেই সে কক্ষটিকে এমনভাবে সবার দৃষ্টির আড়াল করে রেখেছিলো যে কক্ষের আশেপাশে যাবার কারো সাধ্য ছিলো না।

সম্রাট তপস্বিনীকে পথ দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন দরবার কক্ষে।

 মাদাম চীং প্রবেশ করলো সেই কক্ষ মধ্যে।

দেখলো একটি আসনে বসে আছে চিরাংচুং। মাদাম চীং এর প্রথম দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সম্রাট কন্যার গলার মুক্তা হারে। চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন তার। মাদাম চীং কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করতেই সম্রাট কন্যা উঠে তাকে অভিবাদন জানালো।

মাদাম চীং অভিনব ভঙ্গিতে তার অভিবাদন গ্রহণ করলো।

সম্রাট কন্যা চিরাংচুং যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেইখানে এসে দাঁড়ালো মাদাম চীং। বললো সে চিরাংচুকে লক্ষ্য করে–বসো।

আসন গ্রহণ করলো চিরাংচুং।

মাদাম চীং বললো–চিরাংচুং আমি যতক্ষণ মন্ত্র পাঠ করবে ততক্ষণ তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে একদৃষ্টিতে কোন সময় অন্যদিকে তাকাবে না।

চিরাংচুং তাই করলো।

মাদাম চীং বিড়বিড় করে মুখ নাড়তে লাগলো।

চিরাংচুং এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো তপস্বিনীর চোখের দিকে।

বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেলো চিরাংচুর। ধীরে ধীরে সংজ্ঞা হারিয়ে ঢলে পড়লো আসনের

মাদাম চীং মুহূর্ত বিলম্ব না করে ওর গলা থেকে বহুমূল্য মুক্তা হার ছড়া খুলে নিলো।

তারপর আলগোছে বেরিয়ে এলো মাদাম চীং কক্ষের বাইরে।

দরবারে প্রবেশ করে বললো মাদাম চীং চিরাংচুং এর দেহে আমি শান্তি মন্ত্র পাঠ করে ফুঁ দিয়েছি। ও এখন ঘুমিয়ে আছে। যতক্ষণ ওর ঘুম না ভাঙে ততক্ষণ ওর কক্ষ মধ্যে কেউ প্রবেশ করবেন না যেন।

সেদিন মাদাম চীং কৌশলে হস্তগত করেছিলো চীন সম্রাট কন্যা চিরাংচুং এর মালাটা। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসার পর পরই মাদাম চীং তার ছদ্রবেশ ত্যাগ করেছিলো যেন ওকে কেউ পাকড়াও করতে না পারে বা চিনতে না পারে।

পরে সম্রাট কন্যা চিরাংচুং এর মুক্তা হার চুরি যাওয়া নিয়ে চীনরাজ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো। চীনা পুলিশ মহলে এ নিয়ে চলেছিলো তোলপাড় কিন্তু সেই তপস্বিনীর সন্ধান আর পাওয়া যায়নি।

সেই মহামূল্য মুক্তা হারের কথা শুনে কিংচু আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে বললো—আমি জানি সেই যুবক কোথায় আছে।

কিসাংচুর কথা শুনে মাদাম চীং এর মুখখানা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো, বললো সে–জানো? জানো তুমি?

হা জানি।

বাবা তাকে কোথায় রেখেছে জানো?

গুরুজী তাকে তার হীমাগারে রেখেছে।

হীমাগারে! দুচোখে বিস্ময় ফুটে উঠে মাদাম চীং এর। বলে আবার সেহীমাগারে প্রবেশে কারো সাধ্য নেই কিংচু।

জানি মাদাম।

তবে বলে কি হলো?

আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম।

মাদাম চীং ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললোজানতে চাইনি চেয়েছি তাকে এনে দিতে পারবে কিনা। কিংচু আমার সব কিছুর বিনিময়ে আমি ওকে পেতে চাই।

কিংচুর মুখখানা যেমন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো তেমনি মুহূর্তে নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে রইলো সে।

মাদাম চীৎ পুনরায় পায়চারী করে বললো। কয়েক মিনিট পায়চারী করার পর থেমে পড়ে বলে-কিসাংচু জানি হীমাগার থেকে তাকে বের করে আনা কত কঠিন তবু তাকে আনতে হবে।

কিংচু মাথা তোলে।

 মাদাম চীং বলে–এক কাজ করতে হবে কিংচু, পারবে?

পারবো যদি সম্ভব হয়।

সম্ভব না হলেও পারতে হবে।

বলুন মাদাম? কিসাংচু তাকালো আগ্রহ ভরে মাদাম চীৎ এর মুখের দিকে।

মাদাম চীং বললো-আমার যাদু গুহা মধ্য হতে একটি সুড়ংগ পথ খনন করে হীমাগারে নিয়ে যেতে হবে।

কিসাংচুর বিস্ময় আরও চরমে উঠলো, সে ঢোক গিলে বললো—–আপনার যাদু গুহা থেকে সুড়ংগ খনন করে নিতে হবে হীমাগার পর্যন্ত।

হাঁ কিংচু এ কাজ তোমাকে করতে হবে।

কিন্তু আমি একা, কি করে এ সম্ভব মাদাম?

একা নয় তোমার সঙ্গে আরও লোক থাকবে।

কিংচু বলে উঠলো–কিন্তু আপনার বাবা তার পূর্বেই সব জেনে নেবে এ কথা আপনি জানেন মাদাম।

হাঁ জানি তবু আমি এ কাজ করবো এবং প্রয়োজন হলে আমার শিকার হরণ ব্যাপারে তার সঙ্গে যুদ্ধ হবে।

পিতার সঙ্গে যুদ্ধ।

তা ছাড়া উপায় নাই। যাও তোমরা আমার গুহায় প্রবেশ করে সুড়ঙ্গ খননের আয়োজন করো।

কিন্তু..

বল কি বলতে চাও?

আপনার শিকার যদি তিনি সরিয়ে ফেলেন?

হীমাগারের বাইরে তাকে যেখানেই নিয়ে যাক আমি তাকে হরণ করবোই করবো। কাজেই হীমাগারে তাকে রাখা ছাড়া পিতার কোন উপায় নেই।

এখানে যখন মাদাম তার শিকারকে হরণ করে আনা নিয়ে গভীর আলোচনায় মত্ত আছে তখন সেই হীমাগারে বনহুর পায়চারী করে চলছে।

চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীরের আবেষ্টনী।

কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই।

যদিও কোন দরজা জানালা কিছু নজরে পড়ছে না বনহুরের তবু সে দেখতে পাচ্ছে সব কিছু কারণ হীমাগার অন্ধকার নয়। একটা দীপ্ত আলোকরশ্মি হীমাগারকে আলোকিত করে রেখেছে। আলেকরশ্মি কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না তবে বনহুর বেশ বুঝতে পারছে যে আলোয়। কক্ষটা উজ্জ্বল সে আলো প্রাকৃতিক আলো সূর্যের আলো-তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বনহুর আজ কদিন এই হীমাগারে বন্দী হয়ে আছে। যদিও তার কোন অসুবিধা হয়নি বা হচ্ছেনা তবু একটা ভীষণ অশান্তি প্রতি মুহূর্তে তাকে বিচলিত করে তুলছিল। যে কারণে সে এই সুদূর জিহাংহায় এসেছে সে কাজ তাকে শেষ করতে হবে। নর শয়তান হামবার্ট শুধু মানুষের শত্রুই নয় সে দেশের অভিশাপ। শত শত মানুষের রক্ত আর চক্ষু উপড়ে নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে চলেছে। এতে রক্ত আর চক্ষু সে কোথায় কি করে জানতে চায় বনহুর..

হঠাৎ বনহুরের চিন্তাধারায় বাধা পড়ে। অকস্মাৎ যেন কেউ তার কক্ষে প্রবেশ করে। ফিরে দাঁড়াতেই নজরে পড়ে বিরাট দেহী সেই অদ্ভুত মানুষটা।

বনহুরের চিনতে বাকি থাকে না যাদুকর হুয়াংচুকে।

বনহুরকে দুচোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠে হুয়াংচুং-বৎস আমি কদিন ধরে তোমাকে পরীক্ষা করে দেখেছি তুমি আমাকে দেখলে ভয় পাবে না বা সংজ্ঞা হারাবে না। আর সেই কারণেই আজ স্বশরীরে এসেছি তোমার সামনে।

বনহুর ভয় না পেলেও কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলো। কারণ হুয়াংচুর দেহটা এমন দেখতে ছিল যা সাধারণ মানুষের মত নয়।

বনহুর বললো–আমি আপনাকে দেখে ভয় পাইনি বা পাবার মত আমার মনের অবস্থাও হয়নি কারণ আপনি দেখতে যত ভয়ঙ্করই হন না কেন আপনি মানুষ।

আমি জানি বনহুর তুমি অতি দুর্দান্ত। ভয়ঙ্কর জীব জন্তুকেও তুমি কেয়ার করোনা তাও জানি। কিন্তু আমার কন্যা মাদাম চীং এসব ভয়ঙ্কর জীব জন্তুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।

হঠাৎ বনহুর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো।

হুয়াংচু গম্ভীর হয়ে বললো-মেয়ে ছেলে হলেও সে কাল নাগিনের চেয়েও বিষাক্ত ও সাংঘাতিক।

অস্ফুট কণ্ঠে বললো বনহুর বিষাক্ত।

 হা কারণ সে সূর্যের তপস্যা করে আর করে কাল নাগের।

এবার বনহুরের দুচোখে বিস্ময় ফুটে উঠে, বলে সে আপনার কন্যা সূর্য এবং কাল নাগের তপস্যা করে?

হা শুধু তপস্যা নয় সে সাধনা করে চলেছে।

 সে কেমন?

বৎস সে অতি ভয়ঙ্কর। আমি চেয়েছিলাম আমার কন্যাকে আমার যাদু বিদ্যা দ্বারা একটি সত্যিকারের মানুষ হিসাবে তৈরি করতে। যার দ্বারা পৃথিবীর মানুষের উপকার হবে কিন্তু বিপরীত হয়েছে। একটু থামলো হুয়াংচু তারপর বলতে শুরু করলো সে-মাদাম চীং যখন সাত মাসের শিশু তখন থেকে চললো তার উপর আমার সত্যিকারের যাদুবিদ্যা প্রয়োগ! বনহুর জানি তুমি যাদু বিশ্বাস করোনা, শুধু তুমি নও পৃথিবীর অনেক মানুষ যাদু বিশ্বাস করে না কিন্তু যাদু আছে। যাদুবিদ্যা শুধু থোকা বাজী নয়, এতে বিরাট একটা শক্তির আকর্ষণ আছে। তবে সব যাদুবিদ্যাই এই শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়না অনেক যাদু আছে যাদুকর মানুষের দৃষ্টি শক্তির উপর থোকা বাজী লাগিয়ে চালিয়ে যায়। বনহুর তুমি আমার দিকে তাকিয়ে দেখো কিন্তু আমার চোখের দিকে নয়।

এতোক্ষণ বনহুর অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে যাদুকর হুয়াংচুর কথা শুনছিলো। যদিও সে পূর্বে দৃষ্টি তুলে ধরে হুয়াংচুর মুখ দেখেছে কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্য। এবার বনহুর ভাল করে তাকালো। প্রথম নজরেই দেখলো বনহুর হুয়াংচুর চোখ দুটি মুদিত। ভাবলো তবে কি হুয়াংচু অন্ধ? সমস্ত মুখখানা যেন একটা পোড়া কাঠ। মাথায় এবং ভ্রুতে সামান্য চুল আছে কিনা সন্দেহ। আগুনে পুড়ে গেলে যেমন চুলের গোড়া গুলো কুঁকড়ে থাকে তেমনি একটু দেখাযায় মাত্র কুঁকড়ে আছে। নাকটা পোড়া কয়লার মত শক্ত এবং কালো। গলা থেকে পা পর্যন্ত অদ্ভুত আলখেল্লায়। ঢাকা। বনহুর ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।

হুয়াংচু বললো–তুমি মনে করছো আমি অন্ধ। কিন্তু আমি অন্ধ নই বনহুর। যতক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলেছি কোন সময় আমি তোমার দিকে চোখ মেলে তাকাইনি কারণ আমার দৃষ্টির তাপ তুমি সহ্য করতে পারবে না। সূর্য সাধনায় আজ আমার এ চেহারা।

সূর্য সাধনা।

হাঁ সূর্য সাধনা। সূর্য সাধনায় আমার চেহারা বীভৎস আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন আমি সাত ঘন্টা নিৰ্ণিমেষ নয়নে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকি।

সাত ঘন্টা প্রতিদিন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন আপনি?

হাঁ

আশ্চর্য।

তার চেয়েও আশ্চর্য আমার মেয়ে মাদাম চীং।

বনহুর তাকিয়ে দেখে হুয়াংচু দুচোখ বন্ধ করে তার সঙ্গে কথা বলে চলেছে। এতোদিন হুয়াংচু তার সম্মুখে স্পষ্টভাবে অবতীর্ণ হয়নি। আজ তাকে ভালভাবে লক্ষ্য করে একেবারে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। লোকটা বলে কি সে সূর্যের সাধনা করে এবং সে কারণে তার চেহারা এমন বিকৃত। এর চেয়েও এর কন্যা বেশি আশ্চর্য বলে কি হুয়াংচু……

হাঁ যা বলছি সত্য বলছি বস। কারণ তোমার কাছে আমি কোন কথা গোপন করবো না। তোমার দ্বারা আমি আমার চরম সাধনা সফল করতে চাই। আমি শুধু সূর্য সাধনা করে যা লাভ করেছি তার চেয়ে বেশি করেছে মাদাম চীং। প্রতিদিন তার দেহে একটি করে বিষধর কাল সাপ দংশন করে। সেই বিষকে হজম করে আসছে দীর্ঘ বিশ বছর ধরে।

বনহুর বলে উঠে বিশ বছর ধরে মাদাম চীং কাল নাগের বিষ হজম করে আসছে।

হাঁ। সূর্যের সাধনা যে করছে সাত মাসের শিশু অবস্থা থেকে। আর সর্প দংশনের বিষ ক্রিয়া হজম করছে সে সাত বছর বয়স থেকে। তার দৃষ্টিতে এখন আগুন ঠিকরে বের হয় তার স্পর্শে মানুষের মৃত্যু ঘটে। আমার কথা শুনে অবাক হচ্ছে বনহুর কিন্তু অবাক হবার কিছু নেই। আরও কিছু সাধনা আছে যে সাধনা করলে একজন অপরের মনের কথা জানতে পারে। যেমন আমি জানতে পারি তুমি কি ভাবছো, তোমার মনের কথা। জানতে পারি অনেক অলৌকিক ঘটনার কথা। যাদু অন্য কিছু নয় কতকগুলো উৎকট সাধনার প্রতিফলন হলো যাদু। এ কদিন তুমি আমাকে দেখতে পাওনি কেন এখনও জানো না। মনে করেছে আমি যাদু দ্বারায় অদৃশ্য হয়ে তোমার সম্মুখে হাজির হয়েছি। আসলে আমার অদৃশ্য হবার কোন ক্ষমতাই নেই। যদি অদৃশ্য হতে পারতাম তা হলে আজ তোমার স্মরণাপন্ন হতাম না। তোমার চোখে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে আমি এ কক্ষে প্রবেশ করেছি তাই তুমি আমাকে দেখতে পাওনি। হাঁ, তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে আমি কি করে তোমার চোখে ধা ধা লাগিয়ে ছিলাম। হয়তো তোমার স্মরণ আছে সেদিন আমার প্রবেশের পূর্বে এই কক্ষে একটি অদ্ভুত রশ্মি দেখতে পেয়েছিলে?

বনহুর স্মরণ করে তার পর বলে–হ একটা ঘোলাটে আলোক রশ্মি দেখেছিলাম।

ঐ আলোক রশ্মি দ্বারা তোমার চোখ দুটোতে এমনভাবে ধা ধা লেগে গিয়েছিলো যার জন্য তুমি আমাকে দেখতে পাওনি। আমি কেনো তুমি ঐ মুহূর্তে কাউকেই দেখতে পেতেন।

বনহুর ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় যাদু রহস্যের অতলে। যাদু বিদ্যা শুধু রহস্যের মায়া জাল নয় এখানেও রয়েছে বিজ্ঞানের সংযোজন। সূর্যের তাপের রশ্মিকে হজম করে দৃষ্টি শক্তি তেজদীপ্ত হয়, যে সৃষ্টি দ্বারা অনেক কিছু অসাধ্য সাধন করা চলে। সর্প দংশনে মানুষ সাপের চেয়েও বিষাক্ত হয়ে উঠে যার স্পর্শে মানুষের মৃত্যু ঘটে।

বনহুরের চিন্তাধারার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ইয়াংচু বলে উঠে হাঁ তুমি যা ভাবছো তাই, সত্যিকারের যাদু বিদ্যার সৃষ্টি বিজ্ঞান থেকে। কাজেই যাদুকে তুমি সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারো না। শোন বনহুর মাদাম চীং দৃষ্টির দ্বারা তোমাকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলেছিল এবং সে তোমাকে যে মুহূর্তে স্পর্শ করতো ঐ দন্ডে তোমার মৃত্যু ঘটতো। তোমার হয়তো স্মরণ আছে মাদাম চীং এর যাদু গুহায় বহু নর কঙ্কাল এবং শবদেহ দেখেছো। ঐ সব নর কঙ্কাল ও শবদেহ ওর লালসার শিকার। কন্যা হলেও আমি তাকে ঘৃণা করি।

শুব্দ হয়ে শুনলো বনহুর হুয়াংচুর কথাগুলো। যাদুকর যা বললো শুধু আশ্চর্যই নয় চরম বিস্ময়কর। সূর্যের সাধনা, নাগ সাপের সাধনা বলে কি লোকটা। সাপ দংশন করেও সে বেঁচে আছে।

 বলে উঠে হুয়াংচু-হাঁ সে বেঁচে আছে বেঁচে থাকবে। বনহুর তুমি যদি নিজের চোখে দেখতে চাও তবে এসো আমার সঙ্গে।

বনহুর বললো–চল হুয়াংচু চল আমি এ বদ্ধ কক্ষে আর থাকতে পারছি না।

কিন্তু না থেকেও তোমার কোন উপায় নাই বনহুর কারণ মাদাম চীং এর কবল থেকে তোমাকে রক্ষা করতে হলে আমার এই হীমাগার ছাড়া তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এই হীমাগারেও তোমাকে রেখে স্বস্তি পাচ্ছিনা কারণ হামাগার থেকে তোমাকে হরণ করার আয়োজন চলছে। জানি তার অসাধ্য কিছু নেই তবু সে পারবে না তোমাকে হীমাগার থেকে চুরি করতে।

হুয়াংচুর কথায় বনহুর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসি থামিয়ে বলে-দস্যু বনহুরকে চুরি করবে……হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

হুয়াংচু বলে উঠে— তুমি বিশ্বাস করতে পারবেনা জানি কিন্তু না করেও তোমার কোন উপায় নেই। করতালি দিলো হুয়াংচু।

সঙ্গে সঙ্গে এক জন চীনা দূত এসে দাঁড়ালো তার সম্মুখে।

হুয়াংচু বললো–একে নিয়ে যাও অতি সন্তর্পণে মাদাম চীং এর সাধনা গুহার অন্তরালে দাঁড়িয়ে দেখাও কি করে মাদাম চীং তার সাধনা করে চলেছে।

দূত ইংগিৎ করে বনহুরকে তার সঙ্গে আসার জন্য।

বনহুর ওকে অনুসরণ করে।

কেমন করে কোথা দিয়ে বনহুরকে নিয়ে হীমাগার থেকে বেরিয়ে আসে দূত। তারপর এক সময় তারা পৌঁছে যায় একটি পর্বতমালার পাদদেশ।

নির্জন পর্বতমালার পদদেশে একটি সুড়ংগ পথ দূত ঐ পথে বনহুরকে নিয়ে প্রবেশ করে। বেশ কিছু দূর এগুতেই একটা শব্দ তার কানে আসতে লাগলো। কেমন যেন ফোঁস ফোঁস শব্দ।

আরও কিছুটা এগুতেই দূত তাকে থামতে ইংগিৎ করলো একটা গর্তের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বললো সে।

বনহুর দূতের ইংগিৎ মত সেই ছিদ্র পথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চমকে উঠলো শুধু চমকে উঠলো নয় স্তম্ভিত আরষ্ট হয়ে গেলো। দেখলে মাদাম চীং একটা পাথর খন্ডে বসে আছে তার দেহ অর্ধ উলঙ্গ প্রায়। তার চারপাশে অগণিত নাগ সাপ ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে বিচরণ করছে। মাদাম চীং ইচ্ছামত এক একটি সাপের সম্মুখে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে নাগ সাপ দংশন করছে তার হাতে। কখনও সে পা এগিয়ে দিচ্ছে বনহুর অবাক হয়ে দেখলো শুভ্র কোমল দুটি পায়ে উরু অবধি অসংখ্য সর্প দংশনের জমকালো দাগ।

সর্প দংশনে মাদাম চীং এতোটুকু বেদনা কাতর হচ্ছেনা সে নীরবে সর্পবিষ হজম করে চলেছে।

দূত বনহুরকে নিয়ে ফিরে এলো হীমাগারে।

পরদিন পুনরায় দূতটি এসে হাসির হলো।

বনহুরকে সে ইংগিৎ করলো তার সঙ্গে আসতে।

বনহুর ওকে আজও অনুসরণ করলো। আজ যে পথে তাকে নিয়ে দূত অগ্রসর হলো সে পথ গত দিনের পথ নয়। সে এক অজ্ঞাত পথ।

বহুক্ষণ চলার পর এমন একস্থানে এসে দাঁড়ালো তারা যেখান থেকে বহুদূরে নজর পড়ে। বনহুরের হাতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তাকে সম্মুখে তাকিয়ে দেখতে বললো দূতটি।

বনহুর দূরবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখলো, স্পষ্ট দেখতে পেলো দূরে একটি নারী নিস্তব্ধ পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে আছে তার চোখ দুটো সূর্যের দিকে সীমাবদ্ধ।

প্রচন্ড সূর্যের তাপে মানুষ এক মুহূর্ত যেখানে দাঁড়াতে পারে না সেখানে দুচোখ সূর্যের দিকে তুলে একভাবে বসে আছে মাদাম চীং এ শুধু বিস্ময় নয় এক অদ্ভুত ব্যাপার।

বনহুর এবং দূত ফিরে এলো হীমাগারে। হুয়াংচু অপেক্ষা করছিলো বনহুরের জন্য বললো– বৎস এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কেনো আমি বলেছি মাদাম চীং সাংঘাতিক শুধু নয় ভয়ঙ্কর। তার নিঃশ্বাসে বিষ ঝরে। তার নখের আঁচড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার দৃষ্টি শক্তি মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে। বনহুর, মাদাম চীং তোমাকে হরণ করার চেষ্টা চালিয়ে চলেছে। যদি সে তোমাকে পায় তাহলে মৃত্যু তোমার অনিবার্য। শুধু মাদাম চীং নয় হামবার্টের প্রধান অনুচর ফাংফাও তোমাকে খুঁজে চলেছে জিহাংহায়। প্রতিটি জায়গায় সে তল্লাশী করে ফিরছে তোমাকে……

থামলো হুয়াংচু।

বনহুর বললো-কিন্তু আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত নই এ কথা তুমি জানো হুয়াংচু কাজেই তোমার এই হীমাগারে আমি আটক থাকতে রাজি নই।

বললো হুয়াংচু–তোমাকে আটক রাখার সাধ্য আমার নেই জানি কিন্তু কিছুদিন তোমাকে আমার হীমাগারে থাকতে হবে।

কেন?

 তোমাকে আমার প্রয়োজন।

 হুয়াংচু আমাকে যেমন তোমার প্রয়োজন তেমনি তোমাকে আমার প্রয়োজন।

 বলো বনহুর কি করতে হবে?

 হামবার্টের সম্মুখে তোমাকে হাজির হতে হবে।

কারণ?

কারণ হামবার্ট তোমাকে চায় এবং তোমার দ্বারা সে দস্যু বনহুরকে সায়েস্তা করতে মনস্থ করেছে।

কিন্তু আমি জানি সে তোমাকে কারো সাহায্যেই কাবু করতে পারবে না বরং তোমার কাছে হবে তার পরাজয়।

হুয়াংচু শুধু তাকে আমি পরাজিত করতে চাই না। আমি চাই তার সমস্ত কুব্যবসা কেন্দ্রগুলির সন্ধান নিয়ে ধ্বংস করতে। তুমি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে বলে আশা করি।

নিশ্চয়ই তুমি আমার সাহায্য পাবে। বলো বনহুর–আমাকে আদেশ করো।

হুয়াংচু তুমি বলেছিলে আমাকে তোমার প্রয়োজন, কি প্রয়োজন তা আজও বলেনি।

হাঁ বলিনি তবে তোমাকে নিয়ে আমার বিরাট কাজ বাকি। বনহুর তোমার কাজ শেষ হবার পর আমি তোমাকে নিয়ে আমার কাজ শুরু করবো। যদিও আজ থেকেই আমি তোমাকে নিয়ে কাজ শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমি স্থগিত রাখলাম আমার কাজ। বলো তোমার কি কাজ করতে হবে?

 হুয়াংচু তুমি জানো হামবার্ট দস্যু বনহুরের কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে জিহাংহায়।

জানি এবং সে তোমাকে সায়েস্তা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে আর সে কারণেই আমাকে সে সন্ধান করে ফিরছে।

হুয়াংচু তুমি সব অবগত আছে। এবার শোন হামবার্টের নিকটে তোমাকে যেতে হবে এবং তার সঙ্গে মিলিত হয়ে দস্যু বনহুরকে সায়েস্তা করার অজুহাতে জেনে নিতে হবে তার গোপন ব্যবসা কেন্দ্রগুলির আসল ঠিকানা।

এবার হুয়াংচু বলে উঠলো–বস তুমি হামবার্ট-এর গুপ্ত ব্যবসা কেন্দ্রগুলির অনুসন্ধান করছো তুমি জানোনা আরও একজন আছে যে দস্যু হামবার্টের চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং সেই হলো রক্ত আর চক্ষু ব্যবসার অধিনায়ক।

বনহুরের চোখ দুটো বিস্ময়ে গোলাকার হয়ে উঠলো। বললো বনহুর-কে সে হামবার্টের চেয়েও যে ভয়ঙ্কর? কোথায় সে বাস করে বলোবলো হুয়াংচু?

বনহুর আমি তাকে সায়েস্তা করার জন্যই তোমার প্রয়োজন বোধ করেছি। যা তুমি নিজেই যখন এ ব্যাপারে উৎসাহী তখন এক ঢিলে দুই পাখি মরবে।

আমিও তাই চাই যেন হামবার্টের চিহ্ন পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে পারি। আর মুছে ফেলতে পারি তার অভিশাপ ভরা সাধনা কেন্দ্রগুলো……

ঐ মুহূর্তে একটা শব্দ শোনা গেলো।

হুয়াংচু বললো–বনহুর মাদাম চীং এই হীমাগারে প্রবেশ করতে চেষ্টা করছে কিন্তু সে সক্ষম হবে না কারণ হীমাগার শুধু লৌহ আবেষ্টনী দিয়েই তৈরি করা নয় এর দেয়ালে আছে বৈদ্যুতিক কারেন্টের সংযোগ। যে মুহূর্তে এই হীমাগারের দেয়ালে বাইরে থেকে কেউ স্পর্শ করবে সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু ঘটবে।

বনহুরের দুচোখে বিস্ময় ফুটে উঠে তাকায় সে হুয়াংচুর মুখের দিকে।

হুয়াংচু দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলছিলো কারণ হুয়াংচু আজ তার দৃষ্টির সঙ্গে বনহুরের দৃষ্টি বিনিময় হলে বিপদ ঘটতে পারে। বনহুর অবশ্য এতে ভয় পায় না সে জানে এতে তার ক্ষতি হবে না হয়তো সংজ্ঞা হারাবে।

যেমন হারিয়েছিলো প্রথম দিন সে মাদাম চীংএর দৃষ্টি শক্তির তীব্রতায়।

যদিও বনহুরের দৃষ্টি শক্তির তীব্রতাও কম ছিলো না কিন্তু সূর্য সাধনার দৃষ্টি শক্তির কাছে তার দৃষ্টিশক্তি হার মেনে ছিলো।

বললো হুয়াংচু–বনহুর তুমি প্রস্তুত থাকো আজ আমি তোমাকে নিয়ে যাবো নতুন একস্থানে।

শব্দটা তখন আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো মাদাম চীংএর লোক হয়তো ভূগর্ভ থেকে হীমাগারে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে।

হুয়াংচু বেরিয়ে গেলো।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো এবার। অনেকগুলো এলোমেলো চিন্তা ঘুর পাক করছে তার মাথার মধ্যে। পায়চারী করে চললো সে!

শব্দটা সমান ভাবে চলছে।

কেমন যেন এক অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে মেঝের তলায়।

ভাবছে বনহুর একটা নারীর কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তাকে আত্মগোপন করতে হয়েছে। আশ্চর্য যে নারী আর দৃষ্টিতে বিষ যার, নখে বিষ, দাঁতে বিষ এমনি কি তার সমস্ত শরীরে বিষ। সেই নারী তাকে পাবার জন্য উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে……বনহুর হেসে উঠে হাঃ হাঃ করে। তারপর হাসি থামিয়ে পায়চারী করে চলে সে।

আচমকা শব্দটা নেমে গেলো।

বনহুরের চিন্তাধারায় বাধা পড়লো, সে পায়চারী বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। বেশ কিছুক্ষণ শব্দটা শুনতে শুনতে কানটা তার এক টানা শব্দে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। শব্দটা থেমে যাওয়ায় একটু আশ্চর্য লাগছে তার। বুঝতে পারে বনহুর হুয়াংচু বলেছিলো তার এই হীমাগারের তলদেশ ইলেকট্রিক কারেন্ট দ্বারা সংযুক্ত রয়েছে, যে স্পর্শ করবে সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হবে। হয়তো বা তাই হয়েছে।

মাদাম চীং তাকে হরণ করতে চেয়েছিলো কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো…তবে কি?

*

হুয়াংচু অদ্ভুত পোশাকে সজ্জিত হয়ে এগিয়ে চলেছে তার মাথায় অদ্ভুত টুপি পায়ে অদ্ভুত জুতা। গলায় অদ্ভুত ধরণের অনেকগুলো মালা। মালাগুলো ঝিনুক এবং পাথরের তৈরি। হাতের একটা অদ্ভুত ধরণের লাঠি। কাঁধে ঝোলা।

পিছনে স্বয়ং দস্যু বনহুর।

যে পথে তারা চলেছে সে পথও অদ্ভুত ধরণের। ঘন বন অতিক্রম করে এগুচ্ছে তারা। বন নয় সে এক অভিনব জঙ্গল অদ্ভুত অদ্ভুত গাছপালা আর লতা গুলা।

বনহুর আশ্চর্য হয়ে দেখছে বনের গাছপালাগুলো যেন এক একটা বড় বড় জীব জন্তু। কারণ প্রত্যেকটা গাছের গুঁড়ির আকার জন্তুর মত। এ আবার কেমন ধরণের বন মনে মনে ভাবে বনহুর।

থমকে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে দাঁড়ায় হুয়াংচু। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে! বলে সে বনহুরকে লক্ষ্য করে এ বন দেখে তুমি অবাক হচ্ছে বনহুর সত্যি বাকা হবারই কথা। কারণ এ বন সম্পূর্ণ অদ্ভুত। মায়া জাল বা যাদু নয় এ বন ছিলো জিহাংহার অতীতের কোন এক রাজ কুমারীর। সে অত্যন্ত ভালবাসতো পৃথিবীর জীব জন্তুকে এটা তারই বাগান ছিলো এক সময়। রাজ কুমারী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কারিগর এবং মালিদারা তার বাগানের গাছগুলোকে এমনভাবে তৈরি করিয়ে নিয়েছিলো যার জন্য এ বাগানে প্রত্যেকটা গাছের গুঁড়িকে এক একটা জীব জন্তু বলে মনে হতো। আজ সে রাজকুমারী নেই, যে রাজপ্রাসাদ আছে শুধু। তার অভিনব সেই বাগান যা আজ বিরাট এক জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কথাগুলো শেষ করে আবার চলতে লাগলো হুয়াংচু।

বনহুর ঐ মুহূর্তে কোন প্রশ্ন না করে তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললো।

এতো বড় বন অতিক্রম করা কম কথা নয়।

বনহুর ছাড়া অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে পড়তো কিন্তু বনহুর বিনা দ্বিধায় হেঁটে চলেছে।

হুয়াংচু বললো–বনহুর জানি তুমি ক্লান্ত না হলেও একটু বিশ্রাম চাও, কারণ অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে তুমি দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করেছে। আজ বহুপথ তোমাকে পায়ে হেঁটে চলতে হচ্ছে।

একটু হেসে বললো, বনহুর অশ্ব পৃষ্ঠ ছাড়াও পদব্রজে আমার বহুপথ চলার অভ্যাস আছে হুয়াংচু।

তবে চলো বৎস।

আবার চলা শুরু হয়।

চলতে চলতে বলে হুয়াংচু-জানো এখন তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?

 বলে বনহুর–নিশ্চয়ই কোন শুভ কাজে।

ঠিক বলেছো, বনহুর জিহাংহায় তোমাকে বেশি দিন ধরে রাখতে চাইনা কারণ মাদাম তোমার জন্য উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে তার কবল থেকে তোমাকে বেশিদিন সরিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা কাজেই আমি চাই তুমি হামবার্ট এবং তার ব্যবসা কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দিয়ে ফিরে যাও তোমার দেশে। এই মুহূর্তে আমি যে স্থানে তোমাকে নিয়ে যাবো সে স্থান অতি দুর্গম। জানি তুমি বহু দুর্গম পথ বিনা দ্বিধায় অতিক্রম করেছো এবারও পারবে।

বনহুর নীরবে শুনে যায়।

চলতে থাকে দুজনা।

 অবশ্য পাশাপাশি নয় হুয়াংচু সম্মুখে আর বনহুর পিছনে।

আরও কিছুটা অগ্রসর হবার পর হঠাৎ সম্মুখে একটা বিরাট সিংহ মূর্তি শ্বথ বৃক্ষ নজরে পড়ে। একটি সিংহমুখ যেন হা করে আছে। ডাল পালাগুলো ঝুলে আছে ঠিক কেশরের মত হুয়াংচু বললো-বনহুর এই যে সিংহ মুখ বৃক্ষ দেখতে পাচ্ছো এর মধ্যে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ পথ। এ পথে তোমাকে যেতে হবে প্রায় অর্ধ মাইল তারপর দেখবে তিনটা সুড়ঙ্গ মুখ একসঙ্গে রয়েছে তুমি মধ্যের পথ ধরে এগুবে তাহলেই তুমি তোমার উদ্দেশ্য সফলে সক্ষম হবে।

বনহুর অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো–সত্যি বলছো হুয়াংচু?

হ, হুয়াংচু মিথ্যা বলে না। বনহুর আমি আমার এক শিষ্যের কাছেই জেনেছিলাম তোমার অদ্ভুত শক্তির কথা এবং সেই থেকেই আমি প্রতিক্ষা করছিলাম। তোমাকে পেলাম আশ্চর্যভাবে। বনহুর জানি যাদু বিদ্যা যা আমি সঞ্চয় করেছি প্রাকৃতিক শক্তির কাছ থেকে কিন্তু তোমার শক্তি অসীম। দৈহিক শক্তি ছাড়াও তুমি তেজদীপ্ত বুদ্ধিমান তুমি সর্বদিকে জ্ঞানী। ঐ সুড়ঙ্গ পথে তুমি যেখানে গিয়ে তিনটা মুখ দেখতে পাবে তার মধ্যের পথ ধরে এগিয়ে গেলে দেখবে পাশাপাশি কয়েকটা সুড়ঙ্গ মুখ। একেবারে সর্ব দক্ষিণে যে সুড়ঙ্গ মুখ রয়েছে সেই সুড়ঙ্গ পথ চলে গেছে সোজা পাতাল পুরি হয়ে একদম চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে যেখানে রয়েছে রক্ত এবং চক্ষু ব্যাঙ্কের ডিপো। হামবার্টের অনুচর সমস্ত পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে থেকে হাজার হাজার লোককে খুন করে এই সব রক্ত আর চক্ষু সঞ্চয় করে এনে এখানে রেখেছে। ওরা জানে কেউ কোন দিন এর সন্ধান পাবে না।

হেসে উঠলো বনহুর তারপর বললো–যাদু সম্রাট তুমি যে রক্ত এবং চক্ষু ডিপোর সন্ধান আমাকে দিচ্ছো যে ডিপোর সন্ধান আমি অনেক পূর্বেই পেয়েছি। যখন আমি হোটেল পিউল পাং এ ছিলাম তখন চিংচু নামে এক শ্রমিকের ছদ্ম বেশে আমি সেখানে যাই এবং চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে সবকিছু জেনে নেই। তবে এ পথ পেয়ে ভালই হলো—ধন্যবাদ হুয়াংচু।

হুয়াংচু বললো-সুড়ঙ্গের শেষ মুখে দেখবে কয়েকটা মেশিন ঘর। আমি যাদু বিদ্যা নিয়ে কারবার করি তাই এ সব মেশিনের কিছু বুঝি না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে এবং তোমার দরকার মত এগুলো ব্যবহার করতে পারবে!

বনহুর বলে উঠে-হুয়াংচু তুমি বড় বুদ্ধিমান। বেশ এবার আমাকে পথ দেখিয়ে দাও। হামবার্টের নিকটে তোমাকে নিয়ে যাবার কোন প্রয়োজন মনে করছি না কারণ আমি নিজেই পারবো হামবার্ট এবং তার কুকর্মের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করতে।

হুয়াংচু বললো–কিন্তু যতক্ষণ তুমি ফিরে না আসবে ততক্ষণ আমি তোমার জন্য প্রতিক্ষা। করবো।

তা তুমি করতে পারো হুয়াংচু।

হুয়াংচু এবার সিংহ মূর্তি বৃক্ষের ঝুলন্ত ডাল-পালার কিছু অংশ তার হস্তস্থিত অস্ত্ৰদ্বারা কেটে ফেললো। বিস্ময় নিয়ে দেখলো বনহুর অপরিস্কার একটি সুড়ংগ পথে গাছটার অভ্যন্তর চলে গেছে। সুড়ংগ মুখে অনেকগুলো মাকড়সার জাল জট পাকিয়ে আছে। না জানি ওর মধ্যে কি ভয়ঙ্কর ওৎ পেতে আছে কে জানে।

হুয়াংচু বললো–বনহুর কোন ভয় নেই তোমার। এই নাও এটা রক্ষা কবচের মত একটি অস্ত্র। এর দ্বারা তুমি যে কোন ভয়ঙ্কর জীব জন্তুকে হত্যা করতে পারবে এবং এর আলোতে তুমি পথ চলতে পারবে।

বনহুর হেসে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, এবার সে প্রবেশ করবে ঐ অদ্ভুত সুড়ংগ মধ্যে ঠিক ঐ মুহূর্তে একটি বিরাট অজগর সেই সুড়ঙ্গ মধ্য হতে বেরিয়ে এলো।

বনহুর সংগে সংগে হুয়াংচুর দেওয়া অন্ত্রটা উদ্যত করে ধরলো।

হুয়াংচু বলে উঠলো–ওকে হত্যা করোনা বনহুর আমি ওকে কাবু করে ফেলেছি।

হুয়াংচু সাপটার গলার কাছে খপ করে ধরে ফেললো তারপর এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সাপটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

বনহুর অবাক হয়ে দেখলো সাপটা অল্পক্ষণের মধ্যেই কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েলো। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়লো সাপটা যাদুকর হুয়াংচুর হাতের উপর।

বনহুর বললো–সাবাস হুয়াংচু তোমার যাদু বিদ্যাকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।

বনহুর পর মুহূর্তেই প্রবেশ করলো সুড়ংগ মধ্যে।

জমকালো অন্ধকার। 

হুয়াংচু যে অস্ত্রটা বনহুরকে দিয়েছিলো সেটা দিয়ে কিছু আলোর ছটা বের হচ্ছিলো সেই আলোর পথ দেখে এগুতে লাগলো বনহুর।

অদ্ভুত এ সুড়ংগ পথ।

দুধারে পাথুরে দেয়াল, কিন্তু উপরিভাগ হতে বহু শিকড় ঝুলে পড়েছে সুড়ংগ মধ্যে। মাঝে মাঝে পথ বন্ধ করে দিয়েছে শিকড়গুলো।

বনহুর সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে।

 কোন কোন জায়গায় একেবারে পথ বন্ধ।

 বনহুর হুয়াংচুর দেওয়া অস্ত্রের দ্বারা শিকড় কেটে পথ তৈরি করে নিচ্ছিলো।

 সুড়ংগ পথে বহুদিন পৃথিবীর কোন আলো বাতাস প্রবেশ না করায় ভিতরে একটা চাপা গুমটো ভাব বিরাজ করছিলো। বনহুরের সমস্ত দেহ ঘামে ভিজে চুপসে উঠলো।

*

ফাংফা বহু সন্ধান করেও খুঁজে পেলোনা বনহুরকে।

হামবার্ট অগ্নি বর্ণ ধারণ করে ফাংফাঁকে কয়েকটা প্রশ্ন করলো তারপর ওকে হত্যা করলো নির্মমভাবে যেমন হত্যা করেছিলো চিংচুকে।

হামবার্টের চিন্তা নিশ্চয়ই কেউ গোপনে তার চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরের গোপন কেন্দ্রগুলির সন্ধান নিয়ে গেছে। যে ভুল ফাংফা করেছিলো তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড হলেও হামবার্ট নিশ্চিন্ত হলোনা। যেন নিজে তার অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে খোঁজ করে চললো।

যদিও হামবার্ট এ ব্যাপারে চিন্তিত ছিলো তবু তাদের ব্যবসার কাজ বন্ধ ছিলোনা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে বাস বা তাজা রক্ত আর সজিব চক্ষু। নানা দিক দিয়ে গোপন পথে এসব চলে আসছে হামবার্টের চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে রক্ত এবং চক্ষু ব্যাঙ্ক ডিপোতে।

তারপর এখন থেকে এসব চক্ষু এবং রক্ত ব্যাঙ্ক বাসগুলো সুড়ংগ পথে চালান যায় বিদেশে। হামবার্ট শুধু ধনী নয় সে ধন কুবেরু। কোটি কোটি টাকা তার আয়।

অবশ্য হামবার্টের একজন অংশীদার রয়েছে নাম তার সাংমাসিও সে অত্যন্ত বদরাগী এবং শয়তান, তবে হামবার্টের মত সুচতুর নয়। সাংমাসিওকে ভুলিয়ে হামবার্ট যা খুশি তাই সে করে যায়। কান্দাই দস্যু বনহুরের কাছে মার খেয়ে পালিয়ে এসে সে সাংমাসিওর কাছে নানা কথা বানিয়ে বলেছে। দস্যু বনহুর তাদের ব্যবসায় অংশীদার হিসাবে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু তাকে গ্রহণ না করায় সে ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের কান্দাই জঙ্গল বাড়ি ঘাটি আক্রমণ করেছিলো। হামবার্ট আরও বলে দস্যু বনহুরকে হত্যা করার জন্যই আমি জঙ্গল বাড়ি ঘাটি ধ্বংস করে ফেলি।

সাংমাসিও বিশ্বাস করে হামবার্টের কথা, কতকটা সে আশ্বস্ত হয় যাক জঙ্গল বাড়ি ঘাটি ধ্বংস করেও যদি এতো বড় এক শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং সে কারণেই সাংমাসিও নিশ্চিন্ত ছিলো দিব্যি আরামে। হামবার্ট যে দস্যু বনহুরের কাছে চরমভাবে মার খেয়ে জিহাংহায় পালিয়ে এসেছে এ কথা জানতো না সে।

সাংমাসিও কোন সময় বাহিরে যেতে না সে সব সময় চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে তাদের আসল ঘাটীতে থাকতো। হামবার্ট এক চক্ষুহীন এবং এক পা খোঁড়া হলেও সে বিচরণ করতে সারা পৃথিবীময়। তার অদ্ভুত আকাশ যানে সে ইচ্ছা মত সব জায়গায় যাওয়া আসা করতো।

সম্প্রতি বনহুরের সন্ধানে সে কান্দাই যাওয়া মনস্থ করে নিয়েছে এবং সে যাদুকর হুয়াংচুকে অন্বেষণ করে ফিরছে। হুয়াংচু দ্বারা হামবার্ট হত্যা করবে দস্যু বনহুরকে তাই তার এতো প্রচেষ্টা।

হামবার্ট এবং সাংমাসিও মিলে আলোচনা হচ্ছিলো। দুজন বসেছিলো দুটো আসনে। তাদের পিছনে ছিলো চক্রাকারে বিরাট আকার কয়েকটা মেশিন। এ মেশিনগুলো কতকটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ মেশিনের মত দেখতে। এগুলো ধীরে ধীরে চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। আসলে চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরের বদ্ধ বাতাস বের করে পৃথিবীর সচ্ছ বাতাস টেনে আনছে এ মেশিনগুলো।

আরও কতকগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত মেশিন রয়েছে যে সব মেশিন কেউ কোনদিন দেখেনি। ওদিকে কতকগুলো গ্যাস পাইপ, কোন কোন জায়গায় গ্যাস পাইপগুলো বেলুনের মত মোটা হয়ে গেছে। এ স্থানে অনেকগুলো সুইচ এবং মিটার সাজানো রয়েছে। কতকগুলো গ্যাস পাইপ এসে সংযোগ হয়েছে পাশের একটি দেয়ালের সঙ্গে।

যে কক্ষের দেয়ালে গ্যাস পাইপগুলো এসে সংযোগ হয়েছে সেই কক্ষটি হলো চক্ষু লক্ষা ব্যাঙ্ক। এখানে লাখ লাখ মানুষের দৃষ্টি শক্তি বিনষ্ট করে তাদের চোখগুলো উপড়ে এনে রাখা হয়েছে। বিরাট বিরাট কাঁচের জারের মধ্যে অগণিত চোখ থরে থরে সাজানো, পাশেই রক্ত রক্ষাকারক ব্যাঙ্ক। এ কক্ষের মধ্যেও নানা রকম গ্যাস পাইপ এবং মেশিন পত্র রয়েছে। বড় বড় কাঁচ পাত্রে তাজা লাল টকটকে রক্ত; কত অসহায় মানুষের বুকের রক্ত যে এখানে জমা করে রাখা হয়েছে তার কোন হিসাব নাই।

অদ্ভুত এ চীন প্রাচীরের অভ্যন্তর।

 কথা হচ্ছিলো হামবার্ট এবং মাংমাসিও।

মাংমাসিও বলছিলো-হামবার্ট তুমি যাই বল; আমাদের এ চীন প্রাচীরের অভ্যন্তর ঘাটির সন্ধান কেউ কোন দিন পাবে না তুমি মিছা মিছি চিন্তিত হচ্ছে।

হামবার্ট বলে উঠলো–মাংমাসিও চিংচু বেশে যে আমাদের চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো যে সাধারণ লোক নয়। কারণ আমার চোখকে ধূলো দেওয়া এ কম কথা মনে করো। ফাংফাঁকে হত্যা করেছি হত্যা করেছি তার সঙ্গী সাথী সবাইকে। চিংচু যে হোটেলে থাকে সে হোটেলের সবাইকে খুন করবো।

এতে কি লাভ হবে হামবার্ট?

লাভ এ হোটেলের খদ্দেরদের কেউ চিংচুর ছদ্মবেশে এসেছিলো কিন্তু কে যে যার এতো বড় সাহস।

হামবার্ট তুমি হোটেলের খদ্দেরদের হত্যা করে কোন ফল পাবে না। কারণ যে ব্যক্তি চিংচুর ছদ্মবেশে চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো সে নিশ্চয়ই ঐ হোটেলে থাকেনা কারণ যে জানে তুমি সর্বক্ষণ ঐ হোটেলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে।

ঠিক বলেছো মাংমাসিও সে কোন দন্ডে ঐ হোটেলে আসতে পারেনা। হাঁ, আমি শুনেছি যে ঐ হোটেলে ছিল যে হোটেলের মালিকের মেয়ে হুংমার সঙ্গে খুব মেলামেশা করতো ওর সঙ্গে নাকি ভাবছিলো হু, হুংমাকে ধরে ওর মুখে জেনে নিতে হবে কে সে? হাতে তালি দিলো হামবার্ট।

সঙ্গে সঙ্গে দুজন লোক কক্ষে প্রবেশ করলো।

হামবার্ট তাদের লক্ষ্য করে বললো—-পিউলপাং হোটেলের মালিক কন্যা হুংমাকে তোমরা কেউ চেনো?

একজন বললো–চিনিনা তবে চিনে নিতে পারবো হুজুর।

বেশ যাও হুংমাকে তোমরা ধরে নিয়ে এসে তারই কাছে জেনে নিতে পারবে কে সে এবং এখন সে কোথায় আছে যে চিংচুর বেশে ফাংফার চোখে ধুলো দিয়ে চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে আমাদের এই ঘাটিতে প্রবেশ করে সব জেনে নিয়ে গেছে। শুধু ফাংফাঁকেই ঠকায়নি লোকটা ঠকিয়েছে আমাকে। মাংমাসিও ইচ্ছা হয় নিজের চোখ দুটোকে নষ্ট করে ফেলি।

মাংমাসিও বলে উঠে–তুমি লক্ষ লক্ষ লোকের চোখ নষ্ট করে ফেলেছো একদিন তোমাকেও এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

চুপ করো মাংমাসিও এটা শুধু আমার স্বার্থের জন্য নয় এতে তোমার স্বার্থ আমার চেয়ে কম নয় তা ছাড়া আমাদের সমস্ত কোম্পানী রয়েছে..

যাক্ তুমি আদেশ করো তোমার সম্মুখে দুজন দাঁড়িয়ে আছে।

হামবার্ট বললো-হা যাও তোমরা হুংমাকে ধরে নিয়ে এসো যেন কেউ টের না পায়।

 চলে গেলো লোক দুজন।

হামবার্ট এবং মাংমাসিও নিজেদের কথা বার্তায় মনোযোগ দিলো।

*

হুংমা হোটেলের খদ্দেরদের সঙ্গে হাসি গল্প করলেও কেমন যেন একটা বিষণ্ণ ভাব সদা সর্বদা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মাঝে মাঝে উদাস হয়ে যায় সে প্রায়ই। তখন হুংমা নির্জনে গিয়ে বসে থাকে, কারো সঙ্গে তেমন প্রাণ খুলে কথা বলেনা।

এ ব্যাপার নিয়ে হুংমার বাবা ই হুংমার সাথে অসৎ আচরণ করে থাকে। হুংমা বাপের কথায় দুঃখ পায় কিন্তু কোন উত্তর দেয় না। রাজা ছিলো হুংমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হঠাৎ তাকে হারিয়ে হুংমা যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। মাদামচীং তাকে নিয়ে গেছে সে আর কোন দিন ফিরে আসবে একথা হুংমা ভাবতে পারে না।

সেদিন হুংমা বসেছিলো হোটেল পিউল পাং এর রেলিং এর ধারে হয়তো বা ভাবছিলো সে একটি পৌরুষদীপ্ত বলিষ্ঠ মুখের কথা ভাবছিলো তার সঙ্গে কতকগুলো দিনের কথা। ভাবছিলো কতকগুলো স্মৃতি বিজড়িত মুখের কথা।

এমন সময় একটি গাড়ি এসে থামলো হোটেলের সম্মুখে।

গাড়ি থেকে নামলো দুজন লোক।

হোটেলের বয় তাদের জন্য দরজা খুলে ধরলো।

ওরা দুজন প্রবেশ করলো হোটেলের মধ্যে।

 হুংমার দৃষ্টি এ দুটি লোককে এক নজরে বুলিয়ে নিলো কিন্তু সে তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো না। হুংমার বাবা কন্যার উদাসীন ভাব লক্ষ্য করে ক্রুদ্ধ হলো। নিজে সে। হুংমাকে ডেকে বললো-ংমা খদ্দের এসেছে তুমি তাদের প্রতি খেয়াল দিচ্ছো না কেনো?

হুংমা বললো–দেখতে পাইনি বাবা।

অবশ্য মিথ্যা বললো হুংমা তাতে কোন সন্দেহ নাই।

 এবার হুংমা উঠে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

লোক দুজন ততক্ষণে হোটেল কক্ষে প্রবেশ করে আসন গ্রহণ করেছে।

হুংমা সিঁড়ি বেয়ে নামতেই ওরা তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো ওর দিকে। চাপা গলায় বললো একজন–এই হলো হুংমা।

অপর জন বললল–মেয়েটি সুন্দরী বটে।

 হাঁ মিথ্যে নয়।

যাকে ও এতো ভাল বাসত সে নিশ্চয়ই ওর মনের মত ছিলো।

কথাবার্তার ফাঁকে আড় নয়নে তাকিয়ে দেখে নিলো ওরা হুংমাকে।

হুংমা ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে। লম্বা-গোঁফ জোড়া ঝুলে পড়েছে ওদের। মাথায় অদ্ভুত টুপি দুজনার মুখেই লম্বাটে সরু দাড়ি আছে। হুংমা হেসে উঠলো ওদের দেখে খিল খিল করে তারপর বললো, কি খাবে তোমরা?

দুজনের মধ্যে একজন খাবার ওর্ডার দিল।

হুংমা একটা কাগজ কলম নিয়ে লিখে নিলো ওর্ডারগুলো তারপর বয়কে ডেকে কাগজখানা ওর হাতে দিয়ে বললো–এ সব খাবার নিয়ে এসো।

বয় কাগজ হাতে চলে গেলো।

হুংমা লোক দুজনের চেহারা দেখতে লাগলো অবাক চোখে।

এমন সময় খাবার দিয়ে গেলো বয়।

হুংমা টেবিলে খাবারগুলো গুছিয়ে রাখছিলো। এটা তার কাজ। হোটেলের খদ্দেরদের মনোতুষ্টির কারণেই হুংমা এ সব কাজ করতো।

খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখতেই ওরা দুজন খেতে শুরু করলো।

ওরা দুজন খেতে খেতে মাঝে মাঝে হুংমার দিকে কিছু খাবার এগিয়ে দিচ্ছিলো। হুংমা বিনা দ্বিধায় খাবার তুলে নিয়ে খাচ্ছিল।

সন্ধ্যার অন্ধকার জমাট বেধে উঠেছে।

জিহাংহার পথ ঘাটে বিজলী বাতিগুলো জ্বলে উঠলো। পিউল পাং হোটেলের মধ্যেও আলো জ্বললো।

হোটেলের নতুন আগুন্তুক খদ্দেরদ্বয় এর খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় একজন পকেট থেকে একটা লাল টকটকে আপেল ফল বের করে হুংমার হাতে দেয়।

হুংমার চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সে ফল হাতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করলো কিন্তু কয়েক কামড় খেয়েছে অমনি হুংমার দেহটা ঢলে পড়ে পাশের চেয়ারে।

লোক দুজন চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নেয় আশে পাশে কেউ নেই, একজন হুংমার মাথার অংশে আর একজন পায়ের দিকে। হোটেলের বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো ওরা দুজন হুংমার সংজ্ঞাহীন দেহটা তুলে নেয় গাড়িতে।

ঠিক ঐ মুহূর্তে হুংমার-বাবা উপর থেকে দেখে ফেলে চিৎকার শুরু করে দেয় কিন্তু ততক্ষণে-হুংমাসহ খদ্দের দুজন গাড়ি চালিয়ে উল্কা বেগে পালিয়ে যায়।

হুংমার বাবার চিৎকারে হোটেলের লোকজন সবাই এসে ঘিরে দাঁড়ালো তার চার পাশে। সবার চোখে মুখে বিস্ময় ভাব কি হলো কি হলো।

হুংমার বাবা যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে, সে ভাবতেও পারেনি যে তারই হোটেলের কোন খদ্দের তারই মেয়েকে নিয়ে পালাবে। আংগুল দিয়ে হুংমার বাবা শুধু দেখিয়ে দিলো, যে পথে ওরা হুংমাকে নিয়ে ভেগেছে।

কয়েকজন ছুটলো কিন্তু কোথায় তখন ওরা।

কেউ কেউ পুলিশ অফিসে ফোন করলো, অল্পক্ষণে পুলিশ এলো কিন্তু কে কোথায় কারা হুংমাকে নিয়ে কোন পথে কোথায় চলে গেছে বলতে পারলো না কেউ।

হুংমাকে নিয়ে গাড়িখানা এলো পাথারী ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে সে জন্যক জীপ গাড়িখানার চার পাশে খড় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

এক সময় জিহাংহার শহর ছেড়ে জঙ্গল পথ ধরে ছুটলো গাড়িখানা তারপর এক সময় নির্জন প্রান্তরে এসে থামলো।

সেই লাইট পোষ্ট আলোক স্তম্ভ।

একজন জীপ থেকে নেমে লাইট পোষ্টের গায়ে সুইচ টিপলো সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো একটা সুড়ঙ্গ পথ! এবার লোক দুজনের মধ্যে একজন তুলে নিলো হুংমার সংজ্ঞাহীন দেহটা আল গোছে কাঁধের উপর।

প্রথম ব্যক্তি অবাক কণ্ঠে বললো–জাংচি-তুই তো বেশ শক্তি গায়ে রাখিস; একই মেয়েটাকে কাঁধে তুলে নিলি।

জাংচি জিলুংয়াং এর কথায় কান না দিয়ে পা বাড়ালোলা সুড়ঙ্গ পথের দিকে।

জিলুংয়াং ও তাকে অনুসরণ করলো।

সুড়ঙ্গ পথে কিছুটা অগ্রসর হবার পর তারা লিফটে চেপে বসলো{ হুংমা তখনও সংজ্ঞাহীন। হুংমার সংজ্ঞাহীন দেহটা জাংচির কাঁধেই রয়েছে।

জাংচি দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্বিকারভাবে।

এক সময় তারা হুংমা সহ পৌঁছে গেলো চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে।

হামবার্ট তার নিজস্ব বিশ্রামকক্ষে বসে বিশ্রাম করছিলো। একজন গিয়ে সংবাদ দিলো, পিংপা হোটেলের মালিক কন্যা হুংমাকে আমরা চুরি করে আনতে অক্ষম হয়েছি।

হামবার্ট উঠে দাঁড়িয়ে বললো-তোমরা আজও কথা বলতে শিখলেনা জিলুংয়াং। বলতে পারোনা যে হুংমাকে আমরা পাকড়াও করে এনেছি। একটা মেয়েকে চুরি করে এনে বাহাদুরী। করছে। চলো দেখি কোথায় সেই হুংমা!

মালিক সে এখনও অজ্ঞান আছে।

অজ্ঞান।

হাঁ মালিক, তাকে আপেলের মধ্যে সংজ্ঞাহীনের ঔষধ পুশ করে খাইয়ে দিয়েছিলাম।

একটা মেয়েকে তোমরা জ্ঞান সম্পূর্ণ অবস্থায় ধরে আনতে পারলেনা এমন অপদার্থ লোক। যাও যখন ওর জ্ঞান ফিরে আসবে তখন ডাকবে। কিন্তু সাবধান সে যেন জানতে না পারে কোথায় আছে। যাও জিলুংয়াং।

জিলুংয়াং চলে গেলো।

জাংচি ততক্ষণে হুংমাকে নিয়ে একটি ভাল বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর সংজ্ঞা ফেরানোর চেষ্টা করছিলো।

জিলুংয়াং এসে এ দৃশ্য দেখে কুদ্ধ কণ্ঠে বলে জাংচি তুই দেখছি ঐ মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছিস।

জাংচি চোখ তুলে তাকায় জিলুংয়াং মুখে কি বললি আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি।

হাঁ কতকটা তাই মনে হচ্ছে কারণ ওকে একাই কাঁধে করে বয়ে আনলি আবার ওকে এনে ভাল বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যত্ন শুরু করে দিয়েছিস।

জাংচি একটু হেসে বললো–প্রেম-ট্রেম কিছু নয় তবে ও একটা মানুষ তো তাই…

বড় দয়া জন্মেছে তোর মধ্যে দেখছি। জানিস মালিক বলেছে আমার অনুচরদের মধ্যে কোন সময় দয়া বা সহানুভূতি থাকবে না।

তাহলে কি তুই মেয়েটাকে মেরে ফেলতে বলিস।

 মেরে ফেলবি কেনো যেমন এনেছিস তেমনি ফেলে রাখ যখন হোক ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।

ঠিক ঐ সময় হুংমা একটু নড়ে উঠে তারপর বলে–জল আমাকে দাও…বাবা জল দাও…

জাংচি বললো–জিলুংয়াং যা তো এক ঘটি জল নিয়ে আয়।

 মুখ ভেংচে বললো জিলুংয়াংজানিস না কোন বন্দীকে জল খেতে দেওয়া হয়না।

রেখেদে দেখছিস না মেয়েটার ঠোঁট দুখানা শুকিয়ে গেছে।

ও বুঝেছি সুন্দরী বলে ওকে মনে ধরেছে তাই না।

চুপ কর জিলুংয়াং যাতা বলিস না, আমি নিজে গিয়ে ওকে পানি এনে দেবো। জাংচি চলে যায় এবং এক গেলাস পানি নিয়ে ফিরে আসে। হুংমার মাথাটা উঁচু করে ওকে খাইয়ে দেয় পানিটুকু তারপর বলে চুপ করে শুয়ে থাকো।

হুংমা বলে উঠে-না আমি শোবনা, বলো আমি কোথায়? এটা তো আমার বাড়ি বা হোটেল নয়।

জিলুংয়াং দাঁত মুখ খিচে বলে–এটা তোমার শ্বশুর বাড়ি। চুপ করে শুয়ে থাকো একটু পরে সব টের পাবে।

তোমরা কে? তোমরা দেখছি আমাদের হোটেলের সেই খদ্দের বললো হুংমা।

হাঁ ঠিক চিনতে পেরেছে তা হলো। বললো জাংচি।

 জিলুংয়াং কিছু বলতে যাচ্ছিলো বাধা দিয়ে বলে উঠলো হুংমা–তোমরাই তা হলে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো? বলো কেন তোমরা আমাকে এখানে এনেছো বলো কেন?

জাংচি বললোতোমাকে আমাদের প্রয়োজন তাই এনেছি। একটু সবুর করা সব জানতে পারবে।

হুংমা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠে, কারণ সে মোটেই শান্ত মেয়ে ছিলোনা। চঞ্চলভাবে উঠে দাঁড়ায় জোর কণ্ঠে বলে–বলবে না তোমরা আমাকে কেন এখানে এনেছো? কোন অধিকারে এনেছো বলো…হুংমা জিলুংয়াং এর মুখের দাড়ি চেপে ধরে ভীষণভাবে।

জিলুংয়াং তো যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে।

জাংচি দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছিলো। হুংমার কাছে জিলুংয়াং এর নাজেহাল অবস্থা দেখে সে হাসছিলো মৃদু মৃদু।

হুংমার কাছ থেকে জিলুংয়াং তার লম্বা দাড়ি ছাড়িয়ে নেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু হুংমা নাছোড়বান্দা।

ঠিক ঐ মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত হলো হামবার্ট। তার খোঁড়া পায়ে ভারী বুটের অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিলো। হুংমা ফিরে তাকাতেই জিলুংয়াং ওর হাত দুখানা থেকে দাঁড়ি গুচ্ছ মুক্ত করে নেয়।

রীতিমত হাঁপাচ্ছে হুংমা।

জিলুংয়াং মরিয়া হয়ে উঠেছিলো সে আংগুল দিয়ে নিজের দাঁড়ি থেকে ছেঁড়া দাড়িগুলো বের করে ফেলছিলো আর যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করছিলো।

হামবার্ট এসে দাঁড়ালো, যেন একটা সাক্ষাৎ যমদূত। হুংমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখেনিলো তীক্ষ্ণ নজরে।

হুংমাও তাকিয়েছিলো এক দৃষ্টিতে হামবার্টের চেহারার দিকে।

 হামবার্ট বললো এবার কর্কশ কণ্ঠে—-এরি নাম হুংমা?

জিলুংয়াং তখনও যন্ত্রণায় কাতর তাই জবাব দিলো জাংচি-হাঁ মালিক এরি নাম হুংমা এবং সে হোটেল পিউল পাং এর মালিকের মেয়ে।

অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো হামবার্ট—তাই তো হোটেল পিউল পাং এতে খদ্দের। হুংমা জানো আমিই তোমাকে এখানে ধরে আনিয়াছি।

দাঁতে দাঁত পিষে বললো হুংমা–তোমার চেহারা শয়তানের মত তাই তোমার কাজও জঘন্য। আমাকে তুমি কেনো ধরে আনিয়াছো? আর তুমিই বা কে?

আমি যেই হইনা কেন পরিচয় তোমার দরকার নেই। তোমাকে কেনো এনেছি সেই কথা বলছি শোন।

হুংমার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। তাকিয়ে আছে সে এক দৃষ্টে হামবার্টের মুখের দিকে।

হামবার্ট বললো-সুন্দরী মেয়েকে টোপ রেখে তোমার বাবা হোটেলে অনেক খদ্দের জোগাড় করে বলল রাজা কে আর সে গেলো কোথায়?

হুংমা অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলে, রাজা!

হাঁ রাজা যে চিংচুর ছদ্মবেশে আমার গোপন ঘাটিতে প্রবেশ করেছিলো।

হুংমা ধীরে ধীরে আপন মনে উচ্চারণ করে রাজা চিংচুর ছদ্মবেশে তোমার গোপন ঘাটিতে প্রবেশ করেছিলো?

হা। সে যে অপরাধ করেছে তার জন্য তাকে আমি আমার যাতাকলে নিষ্পেষণ করবো। তারজন্য আমি আমার অভিজ্ঞ সহকারী ফাংফাঁকে হত্যা করেছি হত্যা করেছি আরোও অনেককে। যদি রাজার সন্ধান না দাও তবে হত্যা করবো তোমাকে। কথাগুলো বলে থামলো হামবার্ট।

হুংমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো, রাজার জন্য সে নিজেই পাগল। রাজাকে সে নিজেই অহঃরহ খুঁজে ফিরছে কোথায় পাবে সে রাজাকে। রাজা তো হারিয়ে গেছে তার কাছ থেকে।

হুংমাকে ভাবতে দেখে বললো হামবার্ট–কোন রকম চালাকী করতে যেওনা হুংমা, আমার কাছে চালাকী চলবেনা সত্যি কথা বলবে।

হুংমা এবার হাতের পিঠে চোখ মুছে বললো-রাজাকে মিনা বাজারে হারিয়েছি।

রাজাকে মিনা বাজারে হারিয়েছো! এ সব কি বলছো হুংমা?

সত্যি।

মিথ্যে কথা। একটা জীবন্ত মানুষ হারিয়ে গেছে এ কথা তোমার হোটেলের লোকেরা বিশ্বাস করতে পারে কিন্তু আমি করতে পারিনা।

হুংমা মিথ্যা বলে না শয়তান। জানি না তুমি কে। তুমি রাজাকে খুঁজছো আমিও খুঁজছি তাকে। রাজাকে যদি এনে দিতে পারো যা চাও তাই দেবো আমি তোমাকে। পারবে তুমি রাজাকে এনে দিতে?

তোমার অভিনয় আমাকে ভোলাতে পারবেনা হুংমা। বলল সে কোথায়?

হাঁ আমি তার সন্ধান জানি কিন্তু যদি শপথ করে রাজাকে তুমি এনে দেবে তাহলে আমি বলবো কোথায় আছে সে।

হামবার্ট একবার নিজের সঙ্গী দুজনার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো তারপর বললো বেশ শপথ করছি বলো সে কোথায়?

হুংমা বললো–একদিন রাজাকে সঙ্গে করে বাজারে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওকে নিয়ে একটা দোকানে জিনিস কিনছি ঐ সময় যাদু সম্রাটের কন্যা মাদামচীং তার রথে চেপে মিনা বাজারে আসে এবং সে রাজাকে দেখে তুলে নিয়ে যায় সেইদিন থেকে আমি তাকে খুঁজে ফিরছি। তুমি যদি পারো রাজাকে এনে দিও। যা চাও আমি তাই দেবো তোমাকে……

হামবার্টের দৃষ্টি ধীরে ধীরে হুংমার মুখ থেকে সরে এলো, তাকালো সে সম্মুখের দিকে আপন মনে বললো–রাজাকে মাদামচীং তার রথে তুলে নিয়ে গেছে……সে এখন তাহলে যাদু সম্রাট কন্যা মাদামচীং এর প্রাসাদের আমোদ প্রমোদে মত্ত। অট্ট হাসিতে ভেঙে পড়ে হামবার্ট ফিরে তাকায় সে জাংচি আর জিলুংয়াং এর মুখে, কঠিন কণ্ঠে বলে জিলুংয়াং হুংমাকে বন্দী করে রাখোগে যতদিন আমি রাজাকে খুঁজে না পাই বা মাদামচীং-এর কাছে সে সত্যি আছে কিনা জানতে না পারি ততদিন সে বন্দী থাকবে। যদি সে মিথ্যা বলে থাকে তা হলে আমি হুংমাকে যাতা মেশিনে পিষে ওকে মাংস পিন্ডে পরিণত করবো যা রাজাকে পেলে করতে চাই সেই শাস্তি আমি দেবো হুংমাকে। আর জাংচি তুমি আয়োজন করো এই মুহূর্তে আমি যাদুকর কন্যা মাদামচীং এর প্রাসাদ উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো।

জিলুংয়াং বলে উঠলো–মালিক জাংচি হুংমাকে নিয়ে বন্দী করে রাখুক আমি যাবো আপনার সঙ্গে।

বেশ তাই চলো। বললো হামবার্ট।

জাংচি হুংমাকে নিয়ে চলে গেলো।

হামবার্ট বললো–জিলুংয়াং চলো আমি মাদামচীং এর সঙ্গে দেখা করবো এবং রাজাকে পাকড়াও করে এনে হত্যা করবো।

জিলুংয়াং বললো–কিন্তু মালিক……

কি বলো থামলে কেন?

মাদামচীং এর সঙ্গে দেখা করা সহজ নয় মালিক।

 তোমাদের কোন কথা আমি শুনতে চাইনা, চলো।

কিন্তু…..

কিন্তু কি?

পথ যে আমি চিনিনা মালিক।

 হতভাগা কোথাকার। যাও দেখো কে মাদামচীং-এর প্রাসাদের পথ চেনে তাকে নিয়ে এসো।

বেরিয়ে যায় জিলুংয়াং।

হামবার্ট পায়চারী শুরু করে।

কিছুক্ষণ পর জাংচি সহ ফিরে আসে জিলুংয়াং বলে সে মালিক জাংচি বলছে সে মাদামচীং এর প্রাসাদের পথে চেনে।

হামবার্ট বলে উঠে–তুমি চেনো জাংচি?

হ মালিক চিনি।

তবে তোমরা দুজনই চলো আমার সঙ্গে।

মালিক আমি পথের নির্দেশ দিচ্ছি আপনি চলুন।

 হামবার্ট জাংচি এবং জিলুংয়াং সহ রওয়ানা দিলো।

রওয়ানা দেবার আগে বললো হামবার্ট—ংমাকে ভালভাবে আটক করে রেখেছো তো?

 হ মালিক রেখেছি। বললো জাংচি।

অন্ধকার কক্ষে হুংমাকে বন্দী করে রাখা হলো। সে বন্দী সিংহীর মত কিছুক্ষণ রাগে দুংখে নিজের মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়তে লাগলো।

ঐ যে পর্বতমালা দেখছেন ওখানে একটা প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে ওটাই হলো মাদামচীং-এর বিশ্রামাগার। আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো জাংচি।

হামবার্ট তার গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। জিলুংয়াংও নেমে দাঁড়ালো তার সঙ্গে।

হামবার্ট বললো-তোমরা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করো আমি একাই যাবো মাদামচীং-এর সঙ্গে দেখা করতে।

কথা কয়টি বলে হামবার্ট রওয়ানা দিলো।

জাংচি আর জিলুংয়াং বসে রইলো গাড়ির মধ্যে।

হামবার্টের এক পা খোঁড়া হলে কি হবে তার চলন শক্তি ছিলো অতিদ্রুত কাজেই অল্পক্ষণেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো সে।

জাংচি আর জিলুংয়াং গাড়িতে বসে গল্প জুড়ে দিলো।

এক মিনিট দুমিনিট করে চললো ঘন্টার পর ঘন্টা হামবার্টের ফিরার কোন কথা নাই।

জিলুংয়াং বললো–জাংচি তোর কথা যদি মিথ্যা হয় তাহলে মালিক তোকে হত্যা না করে ছাড়বেনা।

জাংচির মুখখানা শুকিয়ে গেলো, তাই তো সে সঠিক কিছু জানে না। লোকের মুখে সে শুনেছে ঐ পর্বত মালার উপরে যে প্রাসাদ দেখা যায় ঐখানে নাকি থাকে মাদামচীং। যদি হামবার্ট গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তাহলে তাকে নির্মম মৃত্যুবরণ করতে হবে তাতে কোন ভুল নাই। ঢোক গিলে বলে জাংচি-ভাই জিলুংয়াং মালিককে আমি মিথ্যা বলিনি তবে যদি হঠাৎ মিথ্যা হয়ে যায় তা হলে আমাকে মরতে হবে যে?

জিলুংয়াং বলে—-তোমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবেই তবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করবি।

এখানে যখন জিলুংয়াং এবং জাংচির কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন হামবার্ট প্রায় মাদামচীং এর প্রাসাদের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। মাদামচীং চোখে দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে দেখে নিয়ে সহচরদের বলে– দেখো একটি লোক আমার প্রাসাদের দিকে আসছে ওকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসো।

সঙ্গে সঙ্গে দুজন অনুচর ছুটলো।

হামবার্ট এগুতে এগুতে কিছুটা হাঁপিয়ে পড়েছিলো সে একটা পাইপ বৃক্ষের নিচে বসে পড়লো। হামবার্টের মনে হলো এ ব্যাপারে সে নিজে এসে ভুল করেছে কারণ তার অনুচরের তো অভাব নেই হুকুম করলেই রাজাকে তারা পাকড়াও করে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু শুধু রাজাকে পাকড়াও করাই তার মূল উদ্দেশ্য নয় তার উদ্দেশ্য মাদামচীং এর সঙ্গে মোলাকাত করা এবং সেই কারণেই হামবার্ট এসেছে এখানে……

হামবার্টের চিন্তা ধারায় বাধা পড়ে অনুচরদ্বয় এসে দাঁড়ায়, দুজনের হাতে দুটো আগ্নেয় অস্ত্র।

হামবার্ট অবাক হয়না কারণ সে জানে এমন অবস্থায় তাকে পড়তে হবে তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে–কে তোমরা?

মাদামচীং এর একজন অনুচর দুজনের হয়ে জবাব দেয়—আমরা যাদুকরী মাদামচীং এর অনুচর।

হামবার্ট বলে উঠে–! তোমরা কি চাও?

তুমি মাদামচীং এর প্রাসাদ অভিমুখে কেন অগ্রসর হচ্ছে জানতে চাই? কথা কয়টি বললো একজন।

অপরজন বললো-জানোনা এ পথে অগ্রসর হলে সে আর ফিরে যেতে পারে না।

হামবার্ট এর মুখে অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠলো, বললো যে–তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাও?

হাঁ, যদি মঙ্গল চাও তবে ফিরে যাও।

যদি না যাই?

 মরবে।

জানো তোমাদের হাতে যে অস্ত্র, ও অস্ত্র আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার দেহে বুলেটের আঘাতে ক্ষত হয় না। কাজেই তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারবে না। বরং তোমরা যদি আমার হাত থেকে রক্ষা পেতে চাও তবে আমি যে প্রশ্ন করবে তার জবাব দাও।

হামবার্ট কথাগুলো বলে থামলো।

অনুচরদের একজন বললো বলো তোমার কি প্রশ্ন? যদি সন্তোষজনক হয় তবে রক্ষা পাবে, না হলে মৃত্যু তোমার অনিবার্য। মাদামচীং তোমাকে রেহাই দেবেনা। বলো তুমি কি জন্য। এ পথে অগ্রসর হয়েছে?

হামবার্ট মনে করে যদি এদের দুজনাকে ফুসলিয়ে জেনে নেওয়া যায় তা হলে হয়তো রাজাকে পাকড়াও করা অত্যন্ত সহজ হবে। তাই সে বললো–তোমরা যদি আমাকে হত্যা উদ্দেশ্যেই এসে থাকো তবে আমার একটা কথার জবাব দাও?

বলো কি জানতে চাও?–বললো প্রথম জন।

হামবার্ট বললো–মাদামচীং যে একটি যুবককে মিনাবাজার থেকে তুলে এনেছিলো সে যুবক এখন কোথায় যদি বলল তাহলে…

দ্বিতীয় জন বলে উঠে—মাদামচীংও তাকে খুঁজে ফিরছে কারণ যাদু সম্রাট তাকে হীমাগারে আটকে রেখেছে।

হীমাগার। নামটা উচ্চারণ করলো হামবার্ট।

প্রথম জন বললো–তুমি কোন জায়গা থেকে এসেছে হীমাগারের নাম শোননি। যাদুকর হুয়াংচুর হীমাগার কেউ কোন দিন স্পর্শ করতে পারে না। একবার নয় সাতবার মাদামচীং এর গুপ্ত অনুচর হীমাগারের ভিতরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছিলো তারা কেউ আর ফিরে আসেনি।

হামবার্ট বললো– রাজাকে নিয়ে আমার জন্যই কি মাদামচীং চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। বলতে চাও?

হাঁ। রাজাকে পাবার জন্য মাদামচীং উন্মাদ প্রায়! এতোগুলো গুপ্তচর প্রাণ হারালো তবু সে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেমন করে তোক ঐ যুবকটিকে তার চাই।

বলো কি?

হাঁ

হামবার্টের ললাটে চিন্তা রেখা ফুটে উঠলো, তাই তো হীমাগার থেকে রাজাকে বের করে আনা যখন এতো কঠিন তাহলে ওর সম্বন্ধে আর ভেবে লাভ নাই।

হামবার্ট ফিরে চললো যেখানে সে গাড়ি রেখে এসেছিলো সেখানে।

মাদামচীং এর অনুচরগণ ফিরে চললো এবং মাদামচীংকে গিয়ে জানালো লোকটা রাজার। সন্ধানে আপনার এখানে আসছিলো। রাজা আপনার এখানে নেই জেনে সে ফিরে গেছে।

মাদামচৗং এর মুখে একটু হাসির রেখা ফুটে উঠলো; সে নিজ মনেই বললো–রাজাকে হীমাগার থেকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নাই। সাতবার চেষ্টা চালিয়ে আমি ব্যর্থ হয়েছি। সাতবারে আমার সত্তর জন গুপ্তচর নিহত হয়েছে…অদ্ভুতভাবে হেসে উঠে মাদামচীং–এরপর আমি নিজে যাবো হমাগারে।

হামবার্ট ফিরে চললো তার আস্তানার উদ্দেশ্যে।

জাংচি এবং জিলুংয়াং মনে মনে খুশি হলো যা হোক রাজার ব্যাপার নিয়ে হামবার্ট আর মাথা ঘামাবেনা।

ফিরে এসে বললো জাংচি–মালিক হুংমাকে কি তার বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবো?

ওর জন্য তোমার এত মাথা ব্যথা কেনো? হামবার্টের গুহা থেকে কেউ কোনদিন ফেরৎ গেছে বলে কি জানো তোমরা জাংচি?

জাংচি মাথা চুলকায়।

এমন সময় কলিংবেল জাতীয় একটা বেল বেজে উঠে।

হামবার্ট এবং তার অনুচরদ্বয় তাকায় ছাদের দিকে।

 ছাদ থেকে একটা লিফট নেমে আসে নিচে।

লিফট থেকে নেমে দাঁড়ায় একটি লোক। আশ্চর্য লোকটা অবিকল হামবার্টের মত দেখতে।

 লোকটা নেমে এসে দাঁড়ালো হামবার্টের সম্মুখে।

হামবার্ট ওর সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করলো তারপর বললো সংবাদ কি কিওকা?

 পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিয়ে বললো সংবাদ ভাল নয় মালিক।

ভাল নয় মানে? তুমি তাহলে দস্যু বনহুরের সন্ধান পাওনি? হামবার্ট রুক্ষ কণ্ঠে কথাগুলো বললো।

কিওকার মুখখানা গুমটো হয়ে উঠেছে, বললো সে-আমি আমার সহচরদের দ্বারা অনেক খোঁজ করিয়েছি কেউ দস্যু বনহুরের খোঁজ দিতে পারেনি।

সেই কারণে তুমি ফিরে এসেছে?

হাঁ মালিক শুধু শুধু…….

না? তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা। হামবার্ট ক্ৰদ্ধভাবে পায়চারী করলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো-বুঝেছি, মৃত্যু ভয়ে তুমি পালিয়ে এসেছে কিওকা। কিন্তু মনে রেখো। দস্যু বনহুরের হাত থেকে রক্ষা পেলেও তুমি আমার হাত থেকে রেহাই পাবেনা।

কিওকা বললো—আপনি যে ভাবে কাজে আদেশ করেছেন, আমি সে ভাবেই কাজ করেছি। মৃত্যুর জন্য ভয় পেলে ও পথে পা বাড়াতাম না।

কিওকা তোমার জীবনের বিনিময়ে তোমার গোটা পরিবারকে আমি আজও জীবিত রেখেছি, না হলে কবে তোমার বংশ লোপ পেতো তুমিও রক্ষা পেতেনা কিওকা।

আমি জানি, আর জানি বলেই নিজের মৃত্যু পথ বেছে নিয়েছি।

হাঁ, মনে রেখো তুমি তোমার জীবনের বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে তোমার গোটা পরিবারের জীবন। যেদিন আমার বিশ্বস্ত অনুচর ফাংফা আমাকে মনে করে তোমাকে সম্মান দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলো তখন আমি উপস্থিত হয়ে নিজেই বিস্মিত হয়ে ছিলাম। ফাংফা আমাকে দেখে শুধু অবাকই হয়নি সেদিন একেবারে বোবা বনে গিয়েছিলো। ঐ দিনই আমি তোমাকে হত্যা করতে পারতাম কারণ তুমি জানো চীন দস্যু হামবার্ট কতবড় ভয়ঙ্কর। কিন্তু হঠাৎ সেদিন আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গিয়েছিলো। হা তোমাকে আমি নিজে হত্যা না করে স্বয়ং দস্যু বনহুরকে দিয়ে তোমার হত্যা ঘটালে সে কোনদিন আর হামবার্টের সন্ধান করবেনা……

সব আমি জানি মালিক।

এবং চিরদিন আমি আমার কাজ চালিয়ে যাবো এই চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে বসে। এ পৃথিবীর কাউকে আমি ভয় করি না শুধু ভয় করি দস্যু বনহুরকে। দস্যু বনহুর আমার যা ক্ষতি করেছে তা কোন দিনই পূরণ হবার নয়। কান্দাই পর্বতের তলদেশে আমার যে ঘাটি ছিলো তা সবগুলো ঘাটির চেয়ে প্রধান! কান্দাই ঘাটি ধ্বংস হওয়ায় আমি একেবারে মুষড়ে না পড়লেও অনেকটা দমে গেছি। যদিও আমার চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরের ঘাটি এখন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ত এবং চক্ষু রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র বা ঘাটি তবু…..যা যতদিন আমি দস্যু বনহুরকে শায়েস্তা করতে সক্ষম না হয়েছি ততদিন আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। হা তোমার মৃত্যুর মধ্যে আমি আত্নগোপন করতে চাই বুঝলে?

বুঝেছি মালিক।

 তবে কান্দাই থেকে ফিরে এলে কেন?

গোটা কান্দাই শহর তন্ন তন্ন করে ঘুরেছি…

তোমার সাহস হলো দস্যু বনহুরের সন্ধান করার?

না করে উপায় কি মালিক! জানি, আজ হলেও মরতে হবে কাল হলেও মরতে হবে।

তবে পুনরায় ফিরে যাও এবং কান্দাই পর্বতের নিচে যে কোন স্থানে একটি গুহা তৈরি করে সেখানে ঘাটি করে নাও। প্রতিদিন একটি করে অন্ততঃ লোক পাকড়াও করে এনে হত্যা করবে, মনে রেখে যেন লোকটাকে তুমি হত্যা করবে তার চোখ দুটো সম্পূর্ণ তুলে নেবে তারপর লাশটাকে ফেলে দিয়ে আসবে শহরের যে কোন স্থানে। এ সব কাজ অবশ্য তোমাকে নিজের হাতে করতে হবে না। এ সব কাজ করবে আমার লোকজন যারা তোমার মানে হামবার্টের সহচর হিসাবে সেখানে থাকবে। পর পর কয়েকটা হত্যালীলা সংঘটিত হলেই দস্যু বনহুর আপনা আপনি হাজির হবে। তুমি শুধু প্রতিক্ষা করবে কবে কোন মুহূর্তে এসে সে তোমার জীবন ছিনিয়ে নেবে তার জন্য। মূর্খ তুমি নিজে খুঁজে ফিরছো দস্যু বনহুরকে?

না খুঁজলে তাকে পাবনা বলেই খুঁজেছিলাম।

খুঁজতে হবে না, সে নিজেই খুঁজে নেবে তোমাকে। একটা কথা মনে রেখো কোনক্রমে মৃত্যুকালে যেন বলোনা যে তুমি আসল হামবার্ট নও। যদি দস্যু বনহুর জানতে পারে, তুমি হামবার্ট নও হামবার্ট আর একজন, তবে তোমার জীবন দিয়েও কোন ফল হবেনা, কারণ আমি তোমার বংশধরগণকে নির্মূল করবো।

হাঁ এ সব কথা পূর্বে তুমি বলেছিলো আমার স্মরণ আছে।

হামবার্ট এবার ফিরে তাকালো জাংচি এবং জিলুংয়াং এর দিকে–জাংচি জিলুংয়াং।

একসঙ্গে জবাব দেয় ওরা দুজন–বলুন মালিক?

সব শুনলে তো?

শুনলাম মালিক। জবাব দিলো দুজন একসঙ্গে।

এর মত নিরেট মূর্খ আর দ্বিতীয় জন নাই। বেটা নিজেই খুঁজে বেরিয়েছে দস্যু বনহুরকে। দস্যু বনহুর যেন মুড়ির মোয়া যে বাজারে পাওয়া যাবে।

জাংচি মাথা চুলকে বলে-দস্যু বনহুর তা হলে কেমন দেখতে মালিক? মুড়ির মোয়ার মত নয়?

জাংচি তুমি দেখছি এর চেয়েও বোকা। দস্যু বনহুর আমার মত মানুষ।

মালিক আপনার মত ভয়ঙ্কর দেখতে?

আমি দেখতে ভয়ঙ্কর নাকি? গর্জে উঠলো হামবার্ট।

মালিক আপনি খুব সুন্দর…….

তবে বললি?

আমার মনে ছিলোনা।

খবরদার আমার সম্বন্ধে কোন সময় খারাপ কথা মুখে আনবিনা। যাক হুংমা কোথায়?

হুংমা!

হাঁ

হুংমা বন্দীখানায়।

ওকে একবার আমার বিশ্রাম কক্ষে পাঠিয়ে দে।

জাংচি মাথা চুলকে বললো–কিন্তু হুংমা যে এখন ঘুমাচ্ছে। ও বড্ড ঘুম কাতুরে যদি ঘুম। ভাঙে তবে সে রেগেমেগে আগুন হবে।

আচ্ছা ঘুম ভাঙলে পাঠিয়ে দিস।

আচ্ছা দেবো।

জিলুংয়াং।

বলুন মালিক।

তুমি কিওকার সঙ্গে কয়েকজন অনুচর দিয়ে দাও। দ্বিতীয় হামবার্ট সেজে সে কান্দাই চলে যাক। যতক্ষণ দস্যু বনহুর তাকে হত্যা না করেছে ততক্ষণ আমি কান্দই এর পথে পা বাড়াতে পারছি না।

জাংচি বলে উঠে—-মালিক দস্যু বনহুরকে এতো ভয় পান কেন? তার চেয়ে আপনি তো অনেক শক্তিমান।

ভয় আমি পাইনা তবে দস্যু বনহুর বড় সাংঘাতিক তাই……. আচ্ছা যাও তোমরা! কিওকা তুমি আমার কথা মত কাজ করবে।

কিওকা হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে হামবার্টের তারপর বেরিয়ে যায়।

*

বৎস আমি জানতাম তুমি পারবে এবং সে কারণেই আমি এতোদিন ধরে প্রতিক্ষা করে এসেছি তোমার জন্য। বড় দুঃখ আমি তোমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারি না। সব সময় তোমার দিকে পিছন ফিরে কথা বলতে হয়। তোমাকে প্রাণ ভরে দেখার সাহসও আমি পাইনা যদি কোন অঘটন ঘটে সে জন্য আমি দায়ী হবো। কথাগুলো বলে থামলো যাদুকর হুয়াংচু।

বনহুর হেসে বললো হুয়াংচু তুমি যতখানি ভয় পাচ্ছো ঠিক ততখানি আমি নরম নই। তোমার সূর্য সাধনা দৃষ্টির চেয়ে আমার সাধারণ দৃষ্টি শক্তির তেজ কম নয়। সংজ্ঞা আমি হারাবো না হুয়াংচু।

জানি বনহুর তোমার দৃষ্টি শক্তির তেজ কম নয়। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি শক্তি বিষাক্ত। তোমার দৃষ্টি শক্তির যে তেজ তা বিষাক্ত নয়, কাজেই তোমার এবং আমার দৃষ্টি শক্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য। যাক, শোন বনহুর, তুমি যে সুড়ঙ্গ পথ আবিষ্কার করেছো এটাই যথেষ্ট। যে কোন মুহূর্তে তুমি হামবার্টের চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরের ঘাটিগুলো ধ্বংস করে ফেলতে পারো।

পারি, এবং তার জন্য তুমিই হবে ধন্যবাদের পাত্র হুয়াংচু।

বনহুর, ধন্যবাদ আমি চাইনা। আমি চাই প্রতিশোধ, হামবার্ট শুধু জিহাংহায় নয় সমস্ত পৃথিবীময় সে নানাভাবে হত্যালীলা সংঘটিত করে চলেছে। চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে লক্ষ লক্ষ লোকের রক্ত আর চক্ষু সে জমা করে রেখেছে। আরও সে কত লোককে হত্যা করবে তার শেষ নাই।

হুয়াংচু আমি তাকে আর হত্যার সুযোগ দেবো না। শুধু তাকে নয়, যারা তাকে এতোদিন তার কাজে সহায়তা করে এসেছে তাদেরকেও নির্মূল করবো।

কিন্তু, কবে তুমি করবে বনহুর? আমার ভয় হয় কোন মুহূর্তে মাদামচীং তোমাকে……

অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে বনহুর, হাসি থামিয়ে বলে–হুয়াংচু আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তার অন্ত নাই দেখছি।

তাইতো তোমাকে হিমাগারে আটকে রেখেছি।

 কিন্তু এভাবে আর কতদিন আমাকে মনি মুক্তার মত সিন্দুকে তুলে রাখবে হুয়াংচু?

 যতদিন তুমি এ দেশে থাকবে।

তবে কাজ হবে কি করে?

আমি যতক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকবে ততক্ষণ তুমি বাইরে থাকতে পারবে। মাদামচীং-এর। সাধ্য নাই সে আমার কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নেয়।

বেশ তুমি তাহলে আমার রক্ষক হয়ে আমার সঙ্গে থাকবে।

তাই থাকবো, তবু তোমাকে একা বাইরে যেতে দেবো না। কথাগুলো বলে বেরিয়ে যায় হুয়াংচু।

বনহুর হীমাগারে তার শয্যায় শুয়ে পড়ে।

সম্মুখে রেকাবীতে নানা রকম ফল সাজানো। বনহুর ফল তুলে নিয়ে ভক্ষণ করে চলে। মনে পড়ে তার আস্তানার কথা।

বনহুর এখানে যখন ভাবছে তখন আস্তানায় নূরী ঘুমন্ত পুত্রের পাশ থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। পুরুষের বেশে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে আসে আস্তানার বাইরে।

অশ্বশালা থেকে বেছে নিয়ে আসে একটি অশ্ব, তারপর উঠে বসে সে অশ্ব পৃষ্ঠে।

অন্ধকার হলে কি হবে নূরী, ঠিক পথ চিনে নিয়ে অশ্ব চালনা করতে থাকে। জঙ্গল পেরিয়ে আসে প্রান্তরে উল্কা বেগে ছুটতে থাকে অশ্বটি।

এক সময় বড় রাস্তায়।

অন্ধকারে রাস্তা স্পষ্ট দেখা না গেলে ও সে বেশ চিনে নেয় এই পথে সে বনহুরের সঙ্গে শহরে এসেছে বহুবার। এক সময় নূরী চৌধুরী বাড়ির পিছনে এসে নেমে দাঁড়ায়। তারপর বাগান পেরিয়ে প্রবেশ করে গাড়ি বারান্দায়।

বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে উপরে।

দারওয়ান তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলো।

নূরীর সমস্ত শরীরে কালো পোশাক। পুরুষের মত মাথায় পাগড়ি, পাগড়ির আঁচল দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকা।

নূরী উপরে এসে দেখতে পায় জানালা খোলা। অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করে সে ভিতরে। আলগোছে এসে দাঁড়ায় নূরী নূরের বিছানার পাশে।

অঘোরে ঘুমাচ্ছে নূর।

ওপাশের খাটে ঘুমিয়ে আছেন মরিয়ম বেগম। তার মৃদু মৃদু নাসিকা ধ্বনি হচ্ছে।

নূরী এসে দাঁড়ালো, পাশের টেবিলের ডিম লাইট স্বল্প আলো বিকিরণ করছিলো। নূরী পকেট থেকে একটি মোমবাতি বের করে জ্বালালো তারপর এগিয়ে ধরলো।

মোমের আলোতে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো সে নূরের মুখের দিকে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ছোট বেলার মুখখানা।

হঠাৎ এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে নূরের চিবুকের উপর। সঙ্গে সঙ্গে আর্ত কণ্ঠে শব্দ করে উঠে—আম্মি…আম্মি…চোখ মেলতেই কালো পোশাক পরা একটি ছায়া মূর্তি দেখতে পায়।

নূরী একটি মুহূর্ত বিলম্ব করে না সে মোম ফেলে দ্রুত বেরিয়ে যায় জানালা দিয়ে বাইরে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।

ততক্ষণে মনিরার ঘুম ভেঙে গেছে, ছুটে আসে সে পাশের ঘর থেকে।

এদিকে মরিয়ম বেগমের ঘুম ভেঙে যায়, তিনি ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছুটে আসেন—কি হলো কি হলোনূর, কি হলো।

মনিরা পাশে বসে নূরের মাথার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে কি হয়েছে নূর? দুঃস্বপ্ন দেখেছো বুঝি?

নূর তখন নিজের চিবুকে হাত বুলিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলছে–দুঃস্বপ্ন নয় আম্মি, দুঃস্বপ্ন নয়, সে এক জমকালো মূর্তি…ঐ ঐ জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে…..

মনিরার মুখ মন্ডল মুহূর্তে উজ্জল দীপ্ত হয়ে উঠে, মনিরা মনে করে ঠিক তার স্বামী এসেছিলো হঠাৎ নূর জেগে উঠায় পালিয়ে গেছে, আবার সে আসবে। একটা অপূর্ব আনন্দ উচ্ছ্বাস বয়ে যায় তার হৃদয়ে। বলে মনিরাও কিছু নয় বাবা তুমি ঘুমাও।

মরিয়ম বেগমও বুঝতে পারেন, এ মনিরের কাজ, তাই তিনিও বেশি উত্তেজিত হন না! নানাভাবে নাতাঁকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন।

নূর বলে উঠে–আম্মি তুমি আমাকে ঘুমাতে বলেছো? আমি নিজের চোখে দেখেছি, জমকালো মূর্তি হাতে তার মোমের আলো। ঐ দেখো মোমটা পড়ে আছে…নূর আংগুল দিয়ে মেঝে এক পাশে পড়ে থাকা একটি মোমবাতি দেখিয়ে দেয়।

এক সঙ্গে মোমটির দিকে তাকায় মনিরা এবং মরিয়ম বেগম। মোমবাতিটা যদিও নিভে গিয়েছিলো তবু মোমের সলতে থেকে মৃদু মৃদু ধূয়ো বের হচ্ছিলো তখনও।

মনিরা উবু হয়ে মোমবাতিটা হাতে তুলে নেয়।

নূর বলে উঠে-আম্মি এই দেখো মোমের ফোঁটা আমার চিবুকে পড়েছে এখনও জ্বালা করছে এখানে।

মনিরা পুত্রের চিবুকে হাত বুলিয়ে দেয়।

মরিয়ম বেগম কি বলবেন যেন ভেবে পান না। তিনি মনে মনে ভেবে চলেছেন মনির এসেছিলো হয়তো মোমের আলোতে সে সন্তানের মুখখানা ভাল করে দেখছিলো হঠাৎ এক ফোঁটা মোম পড়ে গিয়েছিলো ওর চিবুকে।

মনিরাকে লক্ষ্য করে বলে নূর-আম্মি তোমরা যাই বলো আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি কোন বদমাইস চোর হবে।

চোর! না না, চোর নয় বাবা। আর যদি সে চোর হবে তবে সে মোম জ্বেলে তোমার মুখে কি খুঁজছিলো।

জানি না, তবে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য নিয়েই সে এসেছিলো আশ্মি।

মরিয়ম বেগম বলেন–তুই কি ভয় পেয়েছিস দাদু?

হেসে বলে নূর, ভয় পাবো আমি কি যে বলো। তবে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, না হলে আমি তাকে ধরেই ফেলতাম।

নূরের ছোট্ট কচি মুখে বীরত্বপূর্ণ কথা শুনে খুশি হল মরিয়ম বেগম।

মনিরা অনেক বুঝিয়ে-ঝিয়ে পুত্রকে পুনরায় শয্যায় শুইয়ে ফিরে এলো নিজের কক্ষে। উক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে তাকালো অন্ধকারময় শহরটার দিকে। চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছা হলো, ওগো তুমি কোথায়। আমি যে তোমার জন্য ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে প্রতিক্ষা করছি। যদি তুমি এসেই ছিলে তবে ফিরে গেলে কেনো। মনিরা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তারপর ফিরে আসে বিছানায়। কিন্তু চোখে আর ঘুম আসনে না, জানি কোন মুহূর্তে আসবে সে। একটা হাতের স্পর্শের জন্য, একটা শান্ত কণ্ঠের প্রতিধ্বনির জন্য, মনিরা অপেক্ষা করতে থাকে।

এক সময় রাত ভোর হয়ে আসে।

মনিরার চোখের পাতা দুটো আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে মনিরা।

*

নূরী পুত্রের চুলে হাত বুলিয়ে আদর করছিলো। নিস্পলক নয়নে দেখছিলো সে পুত্রের মুখ।

ঘুম ভেঙে যায় জাভেদের।

চোখ মেলে বলে জাভেদ-আম্মি এতো ভোরে তোমার ঘুম ভেঙে গেছে?

হাঁ বাবা।

হঠাৎ জাভেদের দৃষ্টি মায়ের শরীরের দিকে চলে যায়। ধড়মড় করে উঠে বসে অবাক কণ্ঠে বলে–আম্মি তুমি এ পোশাক পরেছো কেনো? বুঝেছি তুমি নিজে বাপুর মত দস্যুতা করতে গিয়েছিলে?

নারে, না।

 তবে এ পোশাক কেনো পরেছো?

শহরে গিয়েছিলাম।

শহরে! কেন গিয়েছিলে শহরে আম্মু?

জাভেদ মাঝে মাঝে নূরীকে আম্মু বলে ডাকতো। এ ডাক অবশ্য বনহুর জাভেদকে শিখিয়েছিলো। ওকে কোলে নিয়ে বলতে বনহুর-তোমার আম্মু কই জাভেদ? বলো তোমার আম্মু কই?

জাভেদ আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিতো–ঐ তো আম্মু।

জাভেদ আম্মু বলতে ভালবাসে তাই সে বেশির ভাগ সময় আম্মু বলে। নূরীও বেশি খুশি হয়। যেন ঐ ডাক শুনলে।

নুরী জাভেদের চিবুকে নাড়া দিয়ে বললো–শহরেও আমার তোর মত একটা ছেলে আছে। তাকেই দেখতে গিয়েছিলাম।

আশ্চর্য হয়ে বলে জাভেদ—আম্মু শহরেও তোমার আর একটা ছেলে আছে?

হাঁ, বাপ।

সত্য আম্মু?

বললাম তো সত্য।

তবে এতোদিন বলোনি কেন আম্মু?

বলে কি হবে, সে তো কোনদিন আমার কাছে আসবে না, তাই বলিনা।

আম্মু, তুমি বুঝি ওকে আমার মত ভালবাসো?

হাঁ তোমাকে যেমন ভালবাসি তেমনি ভালবাসি তাকে।

 তাই বুঝি দেখতে যাও?

হাঁ, বাবা তাই ওকে না দেখে থাকতে পারি না।

আমাকে একদিন নিয়ে যাবে আম্মু?

বড় হলে যেও। আচ্ছা এবার উঠে পড়ো জাভেদ। তোমার শিক্ষক অপেক্ষা করছে।

আম্মু, তুমি যে বইগুলো দিয়েছিলে সবগুলো পড়া শেষ হয়ে গেছে।

সত্যি?

হাঁ, আম্মু।

বেশ, আজ আমি তোমার শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করবো।

 জাভেদ উঠে পড়ে।

সকাল বেলা মুখ হাত ধুয়ে সে প্রথম লেখাপড়া করতে বসে। তারপর নাস্তার পালা। নাস্তা শেষ হলে দ্বিতীয় শিক্ষক জাভেদকে নিয়ে অস্ত্র শিক্ষা দেয়। মল্ল যুদ্ধ শিক্ষা দেয় তৃতীয় শিক্ষক। চতুর্থ শিক্ষক সাঁতার শিক্ষা দেয়। পঞ্চম শিক্ষক জাভেদকে নিয়ে তীর ধনু চালনা শেখায়।

নুরী নিজে এসব শিক্ষার সময় উপস্থিত থাকে এবং কোথায় ভুল হচ্ছে না হচ্ছে দেখিয়ে দেয়। নূরীর স্বপ্ন জাভেদ তার বাবার চেয়ে কোন অংশে কম হবেনা। নূরী নিজেও মাঝে মাঝে জাভেদকে অস্ত্র শিক্ষা দেয়, ঘোড়ায় চড়া শেখায় সে নিজে পুত্রকে।

যদিও জাভেদ এখনও শিশু তবু সে মায়ের সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে অশ্ব বলগা ধরতে শিখেছে।

আজ নূরী জাভেদের পড়ার সময় এসে বসে এবং শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করে–ওর পড়া শোনা কেমন হলো?

শিক্ষক বললো-আমি আজই তোমার সঙ্গে দেখা করবো মনস্থ করে ছিলাম। তুমি নিজেই এসেছো ভালই হলো।

বলুন কি বলতে চান?

জাভেদের পড়া শোনা অত্যন্ত ভাল। বাড়িতে যতটুকু পড়ানো দরকার তা শেষ হয়ে গেছে।

সত্যি বললেন?

হ নূরী, তোমার ছেলে তার বাপের মতই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান! আমি জাভেদকে পড়াতে পড়াতে চলে যাই সেই অতীতের দিনগুলিতে। এমনি করেই আমি শিক্ষা দিতাম বনহুরকে। বনহুর যেমন পড়া শোনায় মনোযোগী ছিলো ঠিক জাভেদ তেমনি, ভুলে যাই এ বনহুর নয় তারই ছেলে..

বৃদ্ধা শিক্ষকের কথা শুনে হাসে নূরী।

এ শিক্ষক তাদেরই আস্তানার একজন শিক্ষিত দস্যু। নাম এর আলী মাসুদ। কালু খাঁর বিশেষ বন্ধু এবং সহচর ছিলো সে। বনহুরকে ছোট বেলায় লেখাপড়া শিক্ষার দায়িত্ব ছিলো আলী মাসুদের উপর। যুদ্ধ শিক্ষা এবং অস্ত্র চালনা শিক্ষা দিয়েছিলো কালু খাঁ নিজে বনহুরকে। বনহুর ও নূরী তাই। এখনও আলী মাসুদকে অত্যন্ত সম্মান করে।

আলী মাসুদের কথায় খুশি না হয়ে পারে না নুরী। নিজের কণ্ঠ থেকে মুক্তা মালা খুলে শিক্ষককে দেয়–নিন, আমার সন্তানকে আপনি যেভাবে প্রথম শিক্ষা দান করলেন তাতে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। নিন, এ মালা আপনি নিন আলী মাসুদ চাচা।

নূরীর কথায় চোখ দুটো আলী মাসুদের ছলছল করে উঠলো। সে বললো-নূরী তুমি আমার কন্যার মত, বনহুর আমার সন্তান। জাভেদ আমার নাতি……একটু থেমে বললো আবার–বুড়ো হয়েছি, এখন দস্যুতা করতে পারি না, এ টুকু যদি না পারি তবে কি করবো বলতো মা নূরী? জাভেদ পড়া শোনা করে বড় হচ্ছে আমার কত আনন্দ কিন্তু তেমনি মুষড়েও পড়ছি। জাভেদের পড়া আমার কাছে শেষ হলে আমি তখন কি করবো। জানিস মা নূরী, কালু খাঁ যেদিন বনহুরকে এনে আমার সম্মুখে দাঁড় করালো, দাঁড় করিয়ে বললো- মাসুদ আজ থেকে বনহুরকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব রইলো তোমার উপর। আমি নিজে কিছুটা শিক্ষা দিয়েছি কিন্তু যথেষ্ট নয়। এখন থেকে তুমি ওকে পড়াশোনা করাবে। আমি বনহুরকে শুধু দস্যুই করবে না সে হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দস্যু, শিক্ষা দীক্ষা শক্তি বুদ্ধি কৌশলে সে হবে পৃথিবীর বিস্ময়…..মা নূরী, আমি যে দিন বনহুরকে বুকে টেনে নিয়ে শপথ করেছিলাম কালু খাঁর বাসনা আমি পূর্ণ করবো। বনহুর আজ সমস্ত বিশ্বের বিস্ময়-কালু খাঁ তাকে এমন কোন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেনি যা সে পারে না।

নূরী অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলো আলী মাসুদের কথাগুলো। অনেকদিন সে এমন করে এই বৃদ্ধের কথা শোনেনি। অবশ্য আলী মাসুদ বনহুরের কান্দাই আস্তানায় ছিলোনা। সে বৃদ্ধ হবার পর অবসর মুহর্তে বনহুরের বিভিন্ন আস্তানায় দেখা শোনা করতো। জাভেদ বড় হবার পর বনহুর নিজে আলী মাসুদকে এনেছে কান্দাই আস্তানায় এবং সে নিজে জাভেদের পড়াশোনা শিক্ষা দেবার ভার ওর উপর সঁপে দিয়েছে। নূরী স্বামীর সম্বন্ধে কথা গুলো অবাক হয়ে শুনেছিলো।

বলে চলেছে আলী মাসুদ-সব শিক্ষা লাভ করেও বনহুরের স্পৃহা মিটলোনা সে বিমান চালনা শিখবে। কালু খাঁ পুত্রের আকাঙ্খা পূর্ণ করার জন্য তাকে পাইলটে ভর্তি করে দিলো। আরও মনে আছে বনহুর পাইলটের ইন্টারভিউ এ প্রথম স্থান অধিকার করেছিলো। দক্ষ পাইলট হয়েছিলো বনহুর। মা নূরী সব শিক্ষাই সে গ্রহণ করেছে কিন্তু একটা শিক্ষা সে আজও পায়নি সে হলো অসৎ কর্ম……কথাটা বলে হেসে উঠলো বৃদ্ধ মাসুদ, তার চোখে মুখে অপূর্ব একটা দীপ্ত ভাব ফুটে উঠলো।

বৃদ্ধের মুখোভাব লক্ষ্য করে নূরীর চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো আনন্দে।

বৃদ্ধা তবু বলে চলেছে—জীবনে বহু মানুষ দেখেছি কিন্তু এমন মানুষ দেখিনি যে বহু মূল্য মানিক হাতে পেয়েও সাগরের জলে নিক্ষেপ করে। বনহুর তাও করেছে! হাঁ আমি দোয়া করি তোমার জাভেদ যেন তার বাপের মত হয়।

নূরী নিজে কদমবুসী করলো এবং জাভেদকৈ করালো। তারপর বললো–আলী মাসুদ চাচা আপনার দোয়া যেন সফল হয়।

আলী মাসুদ হেসে বললো-নিশ্চয়ই হবে।

*

নূর!

বলল আম্মি?

সেদিন তুই কি সত্যি জমকালো পোশাক পরা কাউকে দেখেছিলি?

হাঁ আম্মি সত্যিই আমি দেখেছিলাম। সমস্ত শরীরে জমকালো পোশাক, মাথায় পাগড়ি, পাগড়ির আঁচল দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকা।

পুত্রের কথা শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যায় মনিরা, অস্ফুট কণ্ঠে বলে–সত্যিই কি তবে সে এসেছিলো?

নূর মায়ের মুখোভাব লক্ষ্য করে বলে উঠেসে কে আম্মি? তুমি কার কথা বলছো?

নুর কথাটা ধরে ফেলেছে, তাড়াতাড়ি বলে উঠে মনিরানা না ও কিছু নয়। তুই পড় নুর তুই পড়……

চলে যায় মনিরা।

নূর কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তারপর একটু হেসে পুনরায় পড়ায় মনোযোগ দেয়।

মনিরা ঐ দিনের পর থেকে সব সময় স্বামীর জন্য ব্যাকুল হৃদয়ে প্রতিক্ষা করছিলো কিন্তু কই সে এলো।

কিন্তু যার জন্য মনিরা ব্যাকুল হৃদয়ে প্রতিক্ষা করছিলো সে তখন সুদূর জিহাংহায় যাদুকর হুয়াংচুর হীমাগারে গভীর নিদ্রায় মগ্ন।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় বনহুরের।

তার কানে ভেসে আসে সেই শব্দ। মেঝের নিচে কোথাও শব্দটা হচ্ছে। আজ যেন শব্দটা আরও স্পষ্ট বলে মনে হলো তার কাছে।

তবে কি মাদামচীং এবার তাকে হরণ করার চেষ্টায় সাফল্য লাভ করবে। একটা নারীর জন্য তার এতো ভয় এবং সে কারণেই তাকে হুয়াংচু এই হীমাগারে আটক করে রেখেছে। বনহুর শয্যায় উঠে বসে, তাকায় সম্মুখের দিকে। ঐ জায়গা থেকেই শব্দটা আসছে।

বেশ স্পষ্ট শব্দটা, যেন মেঝেটার নিচে কোন যন্ত্র বা মেশিন চলছে। আর একটু তা হলেই মেঝে খুঁড়ে বেরিয়ে আসবে মাদামচীং নয় তার সহচরগণ।

হুয়াংচু বলেছে মাদামচীং-এর চোখে বিষ, দেহতে বিষ। তবে কি এই নারীকে সায়েস্তা করার কোন উপায় নাই। হুয়াংচু আরও বলেছে মাদামচীং-এর যাদু গুহায় যে সব মৃত দেহ রয়েছে সব তার খেয়ালের শিকার।

বনহুর হেসে উঠে-মাদামচীং তাকে নিজেও তার খেয়াল মত খেলা করতে চায়। তাকে ওর পছন্দ হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু……

হঠাৎ শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো।

বনহুর বুঝতে পারলো আজও মাদামচীং ব্যর্থ হলো তার কাজে। হুয়াংচুর হীমাগার সত্যি আশ্চর্য এক রক্ষা কক্ষ। যেমন পিতা তেমনি তার কন্যা। কিন্তু পিতার উদ্দেশ্য মহৎ আর কন্যার উদ্দেশ্য মন্দ।

মাদামচীংকে এভাবে নর হত্যা করতে দেবেনা সে। বনহুর শপথ গ্রহণ করে হামবার্ট ও তার চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরের গুপ্ত ঘাটিগুলো ধ্বংস করতে হবে তারপর মাদামচীংকে…..

হুয়াংচু একটি পথ বনহুরকে দেখিয়ে দিয়েছিলো ঐ পথে সে ভূগর্ত দিয়ে বহুদূর যেতে পারতো। বনহুর উঠে পড়লো বেশিদিন জিহাংহায় থাকা তার চলবেনা কারণ কান্দাই আস্তানায় ফিরে যাওয়া তার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। রহমান ওয়ারলেসে জানিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর বাংলাদেশে এক ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। একেই সেখানে মানুষ পাকিস্তানী হানাদারদের অত্যাচারে মৃত্যু প্রায় তারপর শুরু হয়েছে মুনফাঁকারী আর কালোবাজারীদের নিস্পেষেণ। দ্রব্যমূল্য চরম সীমায় পৌঁছেছে যার জন্য এক শ্রেণীর মানুষ কেঁপে উঠছে আংগুল ফুলে কলা গাছের মত, আর এক শ্রেণীর মানুষ অনাহারে ধুকে ধুকে মরছে। এদের বাঁচাতে হবে, যেতে হবে তাকে আবার বাংলাদেশে। কিন্তু তার পূর্বে জিহাংহায় রয়েছে অনেকগুলো কাজ। এ কাজগুলো শেষ না করে সে যেতে পারবেনা। পায়চারী করতে থাকে বনহুর, পাশের টেবিলে রাশি কৃত ফল মূল।

হুয়াংচু জানতো দস্যু বনহুরের প্রিয় খাদ্য হলো ফল মূল, তাই সে ওর জন্য নানারকম ফল সংগ্রহ করে দিতে। বনহুর এক থোকা আংগুর ফল হাতে তুলে নিয়ে মুখে দিতে যায় অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠে বাংলাদেশের শতশত অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ। বনহুর আংগুরের ঝোপটা রেখে দেয় রেকাবীতে।

সঙ্গে সঙ্গে সেই কণ্ঠস্বর-বৎস তুমি যা ভাবছো তা সত্য। শতশত অসহায় মানুষের মুখে আজ অন্ন নাই। পরনে বস্ত্র নাই, তিল তিল করে তারা ধুকে ধুকে মরছে। জানি তাদের কথা স্মরণ করে তুমি দুঃখ পাচ্ছো দুঃখ করে কি করবে। বাংলাদেশ সরকার কি কম চেষ্টা করছে এইসব দুঃস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্য। কিন্তু পারছেনা, কারণ এর পিছনে রয়েছে বিদেশী চক্রান্তের হাত ছানি…

হুয়াংচু তোমাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না। যাদু বিদ্যা আমি কোনদিন বিশ্বাস করিনা বা করতাম না একথা তোমাকে আগেও বলেছি। তুমিও বলেছে আমার মনের কথা আমি শুনে আশ্চর্য হয়েছি। তুমি বলেছে প্রাকৃতিক কোন শক্তিদ্বারা আসল যাদু বিদ্যা পরিচালিত হয়। সেদিনও আমার মনে সন্দেহ ছিলো, যদিও তুমি তার বহু প্রমাণ আমাকে দেখিয়েছিলে। আজ আমি তোমার কথা শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেছি। হুয়াংচু বাংলাদেশে আমি জন্মগ্রহণ করার। সৌভাগ্য অর্জন করিনি তবু আমি বাঙালি এই আমার গর্ব। আর সেই গর্বের অনুভূতিতেই বাংলার জন্য আমার মন কাঁদে মন কাঁদে বাঙালি ভাইবোনদের জন্য। ১৯৭১ এ আমি বাংলায়। গিয়েছিলাম। বাংলার সগ্রামী মানুষের মধ্যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সত্যি হুয়াংচু বাংলা জননীর যে আকর্ষণ আমি তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম আজও করেছি। তুমি ঠিকই বলেছে হুয়াংচু বিদেশী কোন চক্রান্তের বেড়াজালে আচ্ছন্ন আজ গোটা বাংলাদেশ। হুয়াংচু অচিরেই আমি বাংলাদেশ অভিমুখে রওয়ানা দেবো এবং আমার বিশ্বাস বাংলাদেশকে আমি বিদেশীর ষড়যন্ত্রমূলক বেড়াজাল থেকে মুক্ত করবো। বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা সার্থক হোক এটাই আমি চাই।

হুয়াংচু এতোক্ষন স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে বনহুরের কথাগুলো শুনছিলো। এবারে সে বলে উঠলো-বনহুর তোমার বাসনা পূর্ণ হবে। বাংলাদেশ যে অবস্থায় আজ দাঁড়িয়েছে তাতে বাঙালি জাতির জীবন আজ ওষ্ঠাগত তুমি যাও বাংলা জননীকে রাহু মুক্ত করো।

আশীর্বাদ করো হুয়াংচু।

আশীর্বাদ তোমার জন্য নয় বনহুর আশীর্বাদের অনেক উর্দ্ধে তুমি।

হুয়াংচু।

 হাঁ-বনহুর।

*

হামবার্ট ক্রুদ্ধ কণ্ঠে গর্জে উঠলো—ম্যানেজার দিন দিন আমাদের কোম্পানীর কাজ যেন শিথীল হয়ে পড়ছে। হিন্দল থেকে কোম্পানীর ম্যানেজার জানিয়েছে, এ মাসে সেখানে পাঁচশত চক্ষু সংগ্রহ হয়নি। ব্লাড ব্যাঙ্কের দশটা বাক্সও তারা পার্শ্বেল করে পাঠাতে সক্ষম হয়নি। পিরোজপুর থেকেও ঐ রকম সংবাদ। রাকসুয়া থেকেও আজ পর্যন্ত কোন সংবাদ পাচ্ছিনা।

ম্যানেজার মাথা চুলকে বললো-জঙ্গল বাড়ি ঘাটি দস্যু বনহুর ধ্বংস করে দেবার পর থেকে আমাদের কোম্পানীর কাজগুলো কেমন যেন…..

দস্যু বনহুর জঙ্গল বাড়ি ঘাটি ধ্বংস করেছে তাতে কোম্পানীর কিছু ক্ষতি হয়েছে তাতে আমাদের বিভিন্ন স্থানের কাজে শিথীলতা কেনো?

মালিক হয়তো কোম্পানীতে যারা কাজ করতো তাদের মধ্যে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি…

 আতঙ্ক! দস্যু বনহুরের ভয়ে আতঙ্ক?

হাঁ মালিক। দেখলেন তো, আমাদের জঙ্গলবাড়ি ঘাটি কান্দাই পর্বতের তলদেশে যেখানে কোনদিন কোন মানুষ প্রবেশে সক্ষম হবে না বলে আমরা সবাই জানতাম, সেই জঙ্গলবাড়ি ঘাটি দস্যু বনহুর ধ্বংস করে ফেললো।

হুঙ্কার ছাড়ে হামবার্ট-মূর্খ জঙ্গলবাড়ি ঘাটি ধ্বংস কে করেছে দস্যু বনহুর না আমি?

 মালিক শুনেছি আপনিই করেছেন কিন্তু…

বলো থামলে কেনো?

 কিন্তু দস্যু বনহুরের জন্যই তো….

আবার দস্যু বনহুরের জন্য বলছো?

মালিক আপনি যাই বলুন দস্যু বনহুরের ভয়েই আমাদের কোম্পানীর লোকজন আর ঠিক মত কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না।

দস্যু বনহুর, দস্যু বনহুর…দস্যু বনহুর কি এক সঙ্গে আমার সবগুলো ঘাটিতে গিয়ে হান; দেবে? হিন্দল, ফিরোজপুর, রাকসুয়া, জিহাংহা সব জায়গায় কি দস্যু বনহুর…

কতকটি তাই মালিক। দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই। সে এক সঙ্গে সব জায়গায় হানা দিতে পারে।

সত্যি বলছো ম্যানেজার?

সত্যি আমরা সেই রকম শুনেছি।

তবে সে আমার চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে কোনদিন হানা দিতে পারবে না।

মালিক বলেছি তো তার অসাধ্য কিছু নেই।

ম্যানেজার যতক্ষণ দস্যু বনহুরকে আমি হত্যা করতে সক্ষম না হয়েছি ততক্ষণ কোন কাজে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। কিওকা ঠিক আমার মত দেখতে…

হাঁ মালিক কিওকা ঠিক আপনার মত দেখতে এক পা খোঁড়া…

কি বললে আমার পা খোঁড়া?

 না না ভুল হয়েছে এক পা খাটো।

 হ তাই বলবে ম্যানেজার।

 আপনার মত কিওকার এক পা খাটো এক চোখ কানা…

 কি বললে আমার চোখ কানা? আমি তো জন্মের থেকে চক্ষুহীন।

হা ভুল হয়েছে, আপনার মতই এক চক্ষুহীন সেও। আপনার মুখে যেমন বসন্তের দাগ তেমনি ওর মুখেও। আপনি যেমন কদাকার দেখতে…

আবার ভুল করছো আমি কদাকার?

না না সুশ্রী। আপনার মতই কিওকা সুশ্রী।

 হাঁ সে সব দিকে ঠিক আমার মত…

শুধু আপনার মত সুচতুর শয়তান নয়।

 কি বললে?

বললাম আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান তাই…

শেষ দিকে আর একটা কথা তুমি উচ্চারণ করলে ভেবে দেখেছো এ জন্য তোমাকে আমি এই মুহূর্তে হত্যা করতে পারি?

পারেন। আলবৎ পারেন, কিন্তু করবেন না।

কেন, কেন করবো না?

কারণ এখন আপনি আমাদের সাহায্য ছাড়া বাঁচতে পারেন না। কারণ দস্যু বনহুরের আতঙ্কে আপনি চীন প্রাচীরের এই গুপ্ত স্থান ছাড়া বেরুতে পারছেন না।

ম্যানেজার তুমি সত্য কথা বলেছো, আমি এখন…যাক তুমি আমাকে শয়তান বললে তাও ক্ষমা করলাম। কিওকাকে হামবার্ট সাজিয়ে আমি কান্দাই পাঠিয়েছি।

অতি বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন মালিক!

হাঁ দস্যু বনহুর বুঝতেও পারবে না কিওকা আসল হামবার্ট নয় সে নকল।

 কিওকাকে হত্যা করার পর আপনি কি করবেন?

বনহুর যখন হামবার্টের সন্ধান থেকে ক্ষান্ত হবে আমি তখন দস্যু বনহুর হত্যায় আত্ননিয়োগ করবো। জানো ম্যানেজার দস্যু বনহুরকে নিপাত করতে পারলে তবেই আমি পুনরায় নব উদ্যমে পৃথিবীর সর্বত্র কাজ করতে সক্ষম হবো। যাদুকর হুয়াংচুর ক্ষমতা নাকি অসীম তাই আমি হুয়াংচুকে খোঁজ করছি। হয়তো পেয়েও যাবো…ম্যানেজার তুমি এক হাজার চক্ষুসহ দুটো আই ব্যাঙ্ক বাক্স জবরু অভিমুখে পাঠানোর জন্য তৈরি করে নাও। আগামী সপ্তাহে আমাদের একটি জাহাজ জবরু অভিমুখে রওয়ানা দেবে ঐ জাহাজে আই ব্যাঙ্কের বাক্স দুটো তুলে দিবে।

আচ্ছা মালিক।

তবে এখন যাও।

ম্যানেজার চলে যায়।

এতোক্ষণ এক পাশে জড়ো সড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো জিলুংয়াং আর জাংচি।

হামবার্ট বললো—–তোমরা এতোক্ষণ কি করছিলে?

এক সঙ্গে বললো জাংচি আর জিলুংয়াং–আপনাদের কথাবার্তা শুনছিলাম।

তোমরা দুজন বড় বদমাইস হয়েছে?

বদমাইস বটে তবে আপনার মত…

বলো থামলে কেন আমার মত কি?

মানে–মানে ম্যানেজার শেষ কথাটা যা বলেছিলো, মানে যার জন্য আপনি তাকে…

হত্যা করতে চেয়েছিলাম সেই কথা?

হাঁ মালিক।

আমি তবে শয়তান।

না মালিক শয়তানের বাবা।

 জাংচি মুখ সামলে কথা বলবে। এতোদিন কবে তোমরা যমের বাড়ি যেতে কিন্তু…

কিন্তু কেনো যাইনি মালিক?

কান্দাই জঙ্গলবাড়ি ঘাটি ধ্বংস হওয়ায় আমার অনেকগুলো অনুচর ধ্বংস হয়েছে…

এবার বুঝেছি।

কি বুঝেছো?

 জঙ্গল বাড়ি ঘাটি ধ্বংস হওয়ায় আপনি অনেকখানি দমে গেছেন মালিক।

দমে নয় কেমন যেন…

বুঝেছি একটা ভয় ভয় ভাব এসেছে আপনার মধ্যে।

 ভয়। খবরদার অমন কথা মুখে এনো না। ভয় করে না হামবার্ট কাউকে।

 দস্যু বনহুরকেও না।

না, শোন জাংচি জিলুংয়াং তোমরা যাই বলো আমি দস্যু বনহুরকে হত্যা না করে ছাড়বো না। এবং অল্পদিনের মধ্যেই আমি কান্দাই রওয়ানা দেবো।

কিন্তু কিওকা নিহত না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে মালিক।

হা অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই জিলুংয়াং। জাংচি হুংমা কে নিয়ে এসো আমি আজ ওর কাছে জেনে নেবো রাজার সঙ্গে ওর কত দিনের পরিচয় ছিলো।

জাংচি ঢোক গিলে বলে–মালিক হুংমা…

যাও কোন কথা শুনতে চাইনা হুংমাকে নিয়ে এসো গে।

জাংচি চলে যায়।

 জিলুংয়াংও তাকে অনুসরণ করে।

একটু পরে ফিরে আসে জাংচি এবং জিলুংয়াং।

 হুংমাকে ওরা সঙ্গে নিয়ে এসেছে।

 হামবার্ট বলে–হুংমা তুমি এখন কোথায় জানো?

 হুংমা কোন কথা বলে না।

হামবার্ট কর্কশ কণ্ঠ যতদূর সম্ভব নরম করে নিয়ে বলে-হুংমা তুমি এখন আমার গুপ্ত ঘাটিতে বন্দী আছো।

হুংমা বলে উঠে–কি বলতে চাও তুমি?

তোমাকে এখানে এনেছিলাম কেনো তা জানো?

হা জানি, রাজা কোথায় সেই খোঁজ জানার জন্য।

ঠিক বলেছো কিন্তু তুমি যা বলেছিলে সত্য হয়নি রাজাকে মাদামচীং পাকড়াও করে নিয়ে ফেলে। সে এখন মাদামচীং এর প্রাসাদে নাই।

হুংমা ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো–তবে রাজা কোথায় আছে?

সে যেখানেই থাক আমি তার সন্ধান জানি এবং যে কোন মুহূর্তে তাকে আনতে পারবো।

 সত্যি রাজাকে তুমি এনে দিতে পারবে?

হাঁ পারবো। তবে এক শর্তে……

 হুংমা ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে তাকায় হামবার্টের কুৎসিত মুখ খানার দিকে।

হামবার্টের দুচোখে লালসা।

কয়েক পা সরে আসে হামবার্ট হুংমার দিকে। বলে হামবার্ট-লুংমা যতদিন আমি রাজাকে আনতে না পারবো ততদিন তুমি আমার হবে বলে রাজি আছো?

মুহূর্তে হুংমার চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন। কয়েক পা পিছিয়ে গেলো হুংমা দ্রুতগতিতে।

হামবার্ট হেসে উঠলো কুৎসিত বিকৃত সে হাসি, বললো হুংমা পিছিয়ে যাচ্ছো কেনো? জানো এখানে কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না।

না না তুমি আমাকে আমার বাবার হোটেলে পাঠিয়ে দাও ঈশ্বরের শপথ তুমি আমাকে আমার বাবার হোটেলে পাঠিয়ে দাও।

হামবার্টের দুচোখে তখন ক্ষুদ্ধ শার্দুলের লালসা, সে দুহাত প্রসারিত করে এগিয়ে যায়।

জাংচি এবং জিলুংয়াং তখনও দাঁড়িয়েছিলো। হামবার্ট ওদের লক্ষ্য করে বললো–তোমরা চলে যাও জাংচি জিলুংয়াং।

ওরা হামবার্টকে কুর্নীশ জানিয়ে চলে গেলো।

 হামবার্টের দিকে তাকিয়ে হুংমার দুচোখ কপালে উঠেছে, রীতিমত হাঁপাচ্ছে সে।

 হামবার্ট এগুতে থাকে হুংমার দিকে।

হুংমা ততই পিছিয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় জিলুংয়াং প্রবেশ করে–মালিক।

 থমকে পিছু ফিরে তাকায় হামবার্ট জিলুংয়াংকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে সে বলে-কি চাও?

জিলুংয়াং মাথা চুলকে বলে–মালিক বড় হুজুর ডাকছেন।

গর্জে উঠে হামবার্ট বড় হুজুর-কে বড় হুজুর? যাও, আমিই সব, বড় হুজুর কে তাকে চিনিনা।

মালিক।

হাঁ, যাও–তাকে বলে দিও আজ থেকে প্রাচীরের অভ্যন্তর ঘাটির সমস্ত দায়িত্বভার আমি গ্রহণ করলাম। বড় হুজুরকে বন্দী করো……

মালিক আপনি কি বলছেন?

 যাও কোন কথা বলোনা জিলুংয়াং।

 আচ্ছা মালিক যাচ্ছি।

জিলুংয়াং বড় হুজুর বলে আর কেউ থাকবে না। আমি একাই আমার কোম্পানীর একচ্ছত্র অধিপতি মনে রেখো?

আচ্ছা মনে রাখবো। কথাটা বলে বেরিয়ে যায় জিলুংয়াং।

হামবার্ট অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তারপর আপন মনেই বলে–বড় হুজুর। কে বড় হুজুর ঐ জুজুবুড়োটা। ওকে তো আমি পার্টনার করে নিয়েছি। ও জানে সে আমার চেয়ে বড় কিন্তু নির্বোধের দল জানেনা হামবার্টের চেয়ে বড় কেউ হতে পারেনা। হুংমা তুমি আমার বুকে এসো—- প্রাণ ভরে তোমাকে ভালবাসবো। রাজ রাণীর চেয়েও সুখে থাকবে….

হুংমা আর্তকণ্ঠে বলে উঠে-না আমি রাজরানী হতে চাই না। তুমি আমাকে আমার বাবার হোটেলে রেখে এসো। আমাকে তুমি মুক্তি দাও……।

মুক্তি! হুংমা তোমার মত শত শত তরুণী আমার বন্দীশালায় আটক আছে। আমি তাদের ইচ্ছা মত ব্যবহার করি। তুমি যদি আমাকে ধরা না দাও তবে তাদের মত তোমার অবস্থাও হবে।

না না আমি তোমাকে চাই না।

তবে কি চাও?

আমাকে পৌঁছে দাও আমার বাবার হোটেলে।

ও আমাকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না? হোটেলের হাজার হাজার খদ্দেরকে খুশি করাই তোমার কাজ তাই না? কিন্তু মনে রেখো হুংমা চীন প্রাচীরের অভ্যন্তর থেকে আর তোমার মুক্তি নাই। চিরদিনের জন্য তুমি আমার শিকার হয়ে থাকবে। কথাগুলো বলে হামবার্ট হুংমাকে ধরতে যায়।

হুংমা আর্তনাদ করে উঠে–বাচাও, বাঁচাও…….

 হামবার্ট হুংমাকে ধরে ফেলেছে ততক্ষণে।

ঠিক ঐ মুহর্তে একখানা ছোরা এসে বিদ্ধ হয় হামবার্টের দক্ষিণ হস্তের বাজুতে।

সঙ্গে সঙ্গে হামবার্ট মুক্ত করে দেয় হুংমাকে, যন্ত্রণায় মুখখানা তার বিকৃত হয়ে উঠে, বাম হস্তে ছোরাখানা টেনে তুলে নেয় বাজু থেকে। বিস্ময় ভরা চোখে দেখতে পায় ছোরাখানায় গাঁথা রয়েছে একটা ছোট্ট ভাঁজ করা কাগজের টুকরা। যদিও যন্ত্রণায় হামবার্ট মরিয়া হয়ে উঠেছে তবু সে ছোরা থেকে ভাজ করা কাগজখানা খুলে নিয়ে মেলে ধরে চোখের সামনে। অস্ফুট শব্দ করে উঠে সে যন্ত্রণা কাতর কণ্ঠে-দস্যু বনহুর।

হুংমা কিছু বঝুতে না পেরে আলুথালু বেশে তাকিয়ে থাকে হামবার্টের যন্ত্রণা কাতর মুখের দিকে। হামবার্টের মুখোভাব লক্ষ্য করে হুংমা বুঝতে পারে কাগজের টুকরাখানায় কি লিখা আছে যা শয়তানটাকে ভীত আতঙ্কিত করে তুলেছে। হামবার্ট দস্যু বনহুর শব্দটা উচ্চারণ করলো তার সঙ্গে সঙ্গে পাশের একটা সুইচে চাপ দিলো :

একটা অদ্ভুত ধরণের শব্দ হলো।

অমনি কয়েকজন অনুচর এসে দাঁড়ালো হামবার্টের সম্মুখে। তারা হামবার্টের হাতে ছোরা এবং দক্ষিণ হস্তের বাজুতে তাজা লাল টকটকে রক্ত দেখতে পেয়ে হতভম্বের মত তাকাতে লাগলো।

হামবার্ট কঠিন এবং ভয় বিহ্বল কণ্ঠে বললো-হা করে কি দেখেছো। দস্যু বনহুর আমার চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে।

অনুচরদের মধ্যে জাংচি এবং জিলুংয়াংও ছিলো তারা এক সঙ্গে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো— দস্যু বনহুর!

হা এই দেখো, দস্যু বনহুর আমার ঘাটির কোন গোপন স্থানে আত্মগোপন করে আমার প্রতি ছোরা নিক্ষেপ করেছে। কান্দাই থেকে দস্যু বনহুর জিহাংহায় আমার পিছু ধাওয়া করেছে। সর্বনাশ হয়েছে জিলুংয়াং, সর্বনাশ হয়েছে জাংচি, তোমরা এই মুহূর্তে অনুসন্ধান চালাও।

জিলুংয়াং এবং জাংচি দল বল সহ ছুটলো।

 হামবার্ট বসে পড়লো একটা আসনে।

দুজন অনুচর তার বাজুতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করলো।

 একজনকে লক্ষ্য করে বললো হামবার্ট–হুংমাকে নিয়ে যাও বন্দীখানায় আটক করে রাখে।

একজন অনুচর হুংমা সহ চলে যায়।

হামবার্ট আসনে বসেও স্বস্তি পায় না, সে অবিরাম চিৎকার করতে থাকে–দস্যু বনহুর যেন পালাতে না পারে। তোমরা সমস্ত ঘাটি ঘেরাও করে সন্ধান চালাও

মুহূর্ত মধ্যে সমস্ত চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে ভীষণ একটা আলোড়ন শুরু হলো। দস্যু বনহুর চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে এটা শুধু বিস্ময় নয় এ যেন কল্পনাতীত।

হামবার্ট যন্ত্রণা ভুলে সে নিজেও সন্ধান চালালো। জিলুংয়াং এবং জাংচী তাকে সাহায্যে করলো।

ম্যানেজার হাহাং চিও ব্যস্ত সমস্ত হয়ে খুঁজতে লাগলো। ঘাটির সমস্ত কাজ এক সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হলো।

হামবার্ট ম্যানেজারকে কঠিন কণ্ঠে আদেশ দিলো–দস্যু বনহুর চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে তাকে যেমন করে তোক গ্রেপ্তার করতেই হবে। যদি তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারে। তাহলে মৃত্যু তোমার অনিবার্য।

ম্যানেজার হাহাংচিও গম্ভীর হয়ে পড়লো, হামবার্ট যে কত বড় হৃদয়হীন সে জানে এবং জানে বলেই তার মুখভাব চিন্তিত হলো।

কয়েক ঘন্টা ধরে চললো দস্যু বনহুরের সন্ধান।

 কিন্তু কোথাও দস্যু বনহুরকে পাওয়া গেল না।

হামবার্ট আদেশ দিলো এই মুহূর্তে সমস্ত সুড়ঙ্গ পথ রুদ্ধ করে দাও এবং সুড়ঙ্গ পথে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়ো।

হামবার্টের আদেশ পাওয়া মাত্র তার অনুচরগণ সুড়ঙ্গ পথের মুখ বন্ধ করে দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়লো। হামবার্ট এবং তার দল বল সবাই একটা বৃহৎ কক্ষের মধ্যে আশ্রয় নিলো।

হামবার্ট বললো—দস্যু বনহুর জানতো না সে কোথায় প্রবেশ করেছে। এবার তার আয়ু শেষ, তাতে কোন সন্দেহ নাই জাংচি?

বলুন মালিক।

সমস্ত সুড়ঙ্গ পথে দশ থেকে পনেরো মিনিটকাল বিষাক্ত গ্যাস আটকে রাখবে তারপর গ্যাস পাইপ যোগে উঠিয়ে নেবে। হাঁ তারই মধ্যে দস্যু বনহুর এ পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করবে……

জাংচি বলে উঠে–ঠিক বলেছেন মালিক এবার দস্যু বনহুর আপনা আপনি শায়েস্তা হবে।

জিলুংয়াং বলে–সে নিজে এসে নিজেই ফাঁদে পড়লো। মালিক আপনাকে ছোরা নিক্ষেপ করার শাস্তি সে হাতে হাতে পেয়ে গেলো।

কিন্তু আমার ব্যথা যে অসহ্য জিলুংয়াং। আমি যে সহ্য করতে পারছি না।

ম্যানেজার হাহাংচিও বলে উঠে–মালিক মাত্র কদিন একটু কষ্ট পাবেন তারপর আবার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। 

 ম্যানেজার তুমি তো বলবেই আসলে আমার কতখানি কষ্ট তা বুঝবেনা। উঃ! আঃ আঃ……ওরে শয়তান দল দেখ দস্যু বেটা মরলো কিনা?

জিলুংয়াং বললো–মাত্র দশ মিনিট বিষ গ্যাস ছাড়া হয়েছে আর দশ মিনিট যেতে দিন। মালিক দস্যু বনহুরের জীবন বড় শক্ত কিনা।

হাঁ যেমন সে সাংঘাতিক তেমনি তাকে শায়েস্তা করা দরকার। সে সুদূর কান্দাই থেকে এসেছে জিহাংহায়। কত বড় ধূর্ত সে কৌশলে চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। জাংচি কিওকাকে কান্দাই পাঠানো আমার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

তাই তো মনে হচ্ছে মালিক।

যাক সে জন্যে দুঃখ নাই। হাতের আঘাতটাও আমি হজম করে নেবো। সব জ্বালা আমার মিটবে দস্যু বনহুরকে মৃত অবস্থায় যখন দেখবো তখন। উঃ আঃ আঃ নানা কোন কষ্ট আমার হচ্ছেনা। যাও জিলুংয়াং দেখো বিশ মিনিট কেটেছে কিনা।

ম্যানেজার বলে উঠে,মালিক ঘড়ি আপনার বাম হাতের কব্জিতেই আছে…

দেখতে পারছি না।

 বুঝেছি চোখ আপনার ঘোলাটে হয়ে এসেছে বুঝি?

কতকটা তাই জিলুংয়াং। সব যেন অন্ধকার লাগছে…..হামবার্ট যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠে। পুনরায় বলে সে–জিলুংয়াং এবার বিষাক্ত গ্যাস পাইপের সুইচ অফ করে দাও।

দেব আরও একটু ছড়িয়ে পড়ুক। দস্যু বনহুরের বড় শক্ত জান কিনা।

কিন্তু জানো না জাংচি বিষাক্ত গ্যাসটা কত বড় মারাত্নক। ওটা যদি কোন ক্রমে চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে একটি প্রাণী রক্ষা পাবেনা। আমার সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্ক আর আই ব্যাঙ্ক নষ্ট হয়ে যাবে। সমস্ত সাধনা আমার ব্যর্থ হবে…

মালিক আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

জাংচি তুমি কোথায় যাচ্ছো?

হুংমাকে আপনার নিকটে আনতে যাচ্ছি।

না না ওকেও মরতে দাও।

 কেন হুংমাকে আপনি চান না?

না।

 কেনো?

দস্যু বনহুর ওরই সন্ধানে এখানে এসেছে। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি এবার। জাংচি আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি যে ব্যক্তি হোটেলে রাজার বেশে হুংমার অতিথি হিসাবে ছিলো, যে চিংচুর ছদ্মবেশে ফাংফার সঙ্গে চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে এসেছিলো সেই স্বয়ং দস্যু বনহুর। মাদামচীং তাকে ধরে নিয়ে গেলেও আটকে রাখতে পারেনি। সে পালিয়ে এসেছে…জাংচি যেওনা, একি আমার নিশ্বাস এমন বন্ধ হয়ে আসছে কেন?

একটু সবুর করেন বিষাক্ত গ্যাস পাইপের সুইচটা অফ করে দিয়ে আসি।

জিলুংয়াং বলে উঠে-জাংচি তুমি যেওনা। তুমি যেওনা…

হামবার্ট যেন আর্তনাদ করে উঠে–এ কক্ষেও বিষ গ্যাস প্রবেশ করেছে নাকি…

হাঁ মালিক শুধু এ কক্ষেই নয় চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরের সমস্ত জায়গায় বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে।

সর্বনাশ এখন উপায় জাংচি তুমিই তাহলে বিষাক্ত গ্যাস পাইপের সুইচ অফ করে দিয়েছো?

হাঁ হামবার্ট আমি।

তুমি

যাকে হত্যার জন্য তুমি বিষাক্ত গ্যাস ছাড়বার আদেশ দিয়েছিলে আমিই সেই….

তুমি তুমি দস্যু বনহুর?

 হা।

জাংচি কোথায় তবে?

এক সপ্তাহ আগে সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

জিলুংয়াং এবং হামবার্টের সমস্ত অনুচর সহ হামবার্ট তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছট ফট করছে। বার বার দুহাতে মুখ ঢাকবার চেষ্টা করছে তারা।

বনহুর মুখে মুখোস পরে নিয়েছে।

সে অট্ট হাসি হেসে উঠলো-হামবার্ট মৃত্যু মুহূর্তে শুনে যাও অন্যায় কোন দিন টিকে থাকতে পারেনা। তুমিই হত্যা করবার জন্য বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করেছিলে তুমিই সেই গ্যাসের শিকার হলে।

বনহুর দ্রুত বেরিয়ে আসে এবং হুংমাকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিলো সেই কক্ষে প্রবেশ করে। দেখতে পায় হুংমার সংজ্ঞাহীন দেহটা ভূতলে পড়ে আছে। বনহুর দ্রুত হস্তে ওর দেহটা তুলে নেয় হাতের উপর। তারপর লিফটে চেপে বসে।

লিফট খানা সঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে।

বনহুর হুংমার সংজ্ঞাহীন দেহটা কাঁধের উপর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চার পাশে তখন বিষাক্ত গ্যাস ধূম্রাকারে ছড়িয়ে পড়েছে।

*

ভয় নেই বনহুর হুংমার মৃত্যু হবেনা। এই ঔষধটা ওকে খাইয়ে দাও এবং এটা ওর নাকে ধরো। হুয়াংচু দুটো শিকড় জাতীয় ঔষধ হাতে দিলো বনহুরের।

বনহুর শিকড় দুটো নিয়ে হুংমার পাশে এগিয়ে গেলো।

ভূতলে শায়ীত হুংমা।

চোখ দুটো তার মুদিত! একরাশ এলোমেলো চুল ছড়িয়ে আছে ওর চোখে মুখে কাঁধে। হুংমার দেহে সেই পূর্বের পোশাক। যে পোশাক সে পিউল পাং হোটেলে পরতো। বিশেষ করে তার পোশাক ছিলো কতকটা পুরুষের মত। প্যান্ট সার্ট জুতো মোজা ব্যবহার করতে হুংমা।

হুয়াংচু বললো-বৎস আমি জানতাম তুমি পারবে। শয়তান হামবার্ট এবং তার ঘাটি তুমি ধ্বংস করেছে। ভেঙে চুরমার না হলেও চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরের সমস্ত কিছু বিষাক্ত গ্যাসের দ্বারা নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে আই ব্যাঙ্কের চোখগুলো নষ্ট হয়ে গেছে ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্ত। মরেছে। হামবার্ট এবং তার সহকারীগণ। একটি প্রাণীও সেখানে জীবিত নাই। বনহুর যে বিষাক্ত গ্যাসের অসীম শক্তি দ্বারা হামবার্টের সমস্ত শক্তি বিনষ্ট করেছে সে শক্তির একটি কাজ আছে যা যুগযুগ থাকবে।

বনহুর অবাক হয়ে শুনছিলো বললো-হুয়াংচু তুমি কি বলছো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না?

বনহুর শুনে রাখো যে গ্যাসের দ্বারা আজ হামবার্ট এবং তার দল বল নিহত হলো ঐ গ্যাসের এক অদ্ভুত শক্তি আছে। কোন দিন ঐ মৃতদেহগুলো পচে গলে যাবে না হাজার হাজার বছর পরেও ঐ চীন প্রাচীরের অভ্যন্তরে শব দেহগুলি ঠিক তেমনি থাকবে যেমন আছে এখন।

বনহুরের মনে পড়ে কোন এক দ্বীপের সেই অদ্ভুত আলোক রশ্মির কথা। বহু নাবিক সেই আলো দেখেছে কিন্তু কেউ কোন দিন সেই দ্বীপে নেমে দেখার সাহস পায়নি। গভীর রাতে দ্বীপের বুকে দেখা নীলাভ আলোক রশ্মি। বনহুর সেই দ্বীপে গিয়েছিলো এবং ভূগর্ভে আবিষ্কার করেছিলো এক অদ্ভুত সৃষ্টি। মাটির তলায় কোন এক সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করেছিলো সে, দেখেছিলো অগণিত সব দেহ। কযুগ পূর্বের সে সব মৃতদেহগুলি তবু পঁচে গলে যায়নি। শুকনো মাছের মত শক্ত হয়েছিলো।

হুয়াংচু বলে—-হাঁ যুগযুগ পরেও নর পশু হামবার্ট তেমনি থাকবে। তেমনি থাকবে তার কুকুর্মের নিদর্শনগুলো। দেরী করোনা বনহুর তাড়াতাড়ি হুংমাকে ঔষধ খাইয়ে দাও এবং ওর নাকে ঐ ঔষধ ধরো।

বনহুর বললোহ আমি তাই করছি।

হুয়াংচু বিদায় গ্রহণ করে।

বনহুর এগিয়ে আসে হুংমার কাছে। হুয়াংচুর দেওয়া ঔষুধের শিকড় নিয়ে ওর নাকের কাছে ধরে। কিন্তু যে ঔষধটা খাওয়াতে হবে ওটা ওকে খাওয়াবে কেমন করে। বনহুর শিকড় হাতে রগড়ে রস তৈরি করে নেয় তারপর ওর মুখ খানা উঁচু করে ধরে।

বনহুর হুংমার মুদিত আঁখি দুটির দিকে চেয়ে থাকে নির্বাক হয়ে, ফুলের মত সুন্দর একটি মুখ। বনহুর ও মুখটা ধরে ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে শিকড়ের রসটা খাইয়ে দেয়। একটা অনুভূতি নাড়া দেয় বনহুরের শিরায় শিরায়।

কিন্তু না তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে চলবে না, সে হুংমাকে ভালবাসে কিন্তু ওকে সে পাপ বাসনা নিয়ে স্পর্শ করতে পারে না।

বনহুর সরে বসে হুংমার পাশ থেকে।

রাত্রি তখন গভীর।

নির্জন কক্ষ।

হুংমার সংজ্ঞা এখনও ফিরে আসেনি।

বনহুর অদূরে একটা দেয়ালে ঠেশ দিয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে।

হঠাৎ হুংমা বলে উঠে-পানি পানি—-দাও।

বনহুর পাশের গেলাস থেকে পানি নিয়ে ওর মুখে দেয়। খুশি হয় বনহুর যা হোক হামবার্টের বিষাক্ত গ্যাসে হুংমার তা হলে মৃত্যু ঘটেনি।

হুংমা তাকায় এবার অস্ফুট কণ্ঠে বলে সে আমাকে আমার বাবার হোটেলে পৌঁছে দাও…..

বনহুর ঝুঁকে পড়ে বলে–হাঁ তোমাকে তোমায় বাবার হোটেলে পৌঁছে দেবো হুংমা।

 কে কে তুমি?

রাজা।

 রাজা তুমি! তুমি ফিরে এসেছো?

হাঁ হুংমা।

হুংমা দুহাতে বনহুরের কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে–রাজা আর আমি তোমায় যেতে দেবোনা। রাজ,..

বনহুর হেসে বলে বেশ আমি আর যাবোনা। তুমি এবার ঘুমাও কেমন?

 ঘুমাবো?

হাঁ কিন্তু তুমি আবার পালিয়ে যাবে না তো?

না হুংমা।

ঐ শয়তানটা কোথায়। ও আবার আমাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো?

না। ও চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে।

 বিদায় নিয়েছে মানে?

 মানে চলে গেছে আর তোমাকে পাকড়াও করতে আসবে না।

 সত্যি?

 হা হুংমা তুমি এখন ঘুমাও।

 তুমি ঘুমাবে না?

ঘুমাবো।

আমার পাশে শোবেনা তুমি?

না ঐ ওখানে……বনহুর উঠে গিয়ে মেঝেতে একটা চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।

*

 খট করে শব্দ হতেই ঘুম ভেঙে যায় মনিরার। সেই ঘটনার পর থেকে মনিরার চোখের ঘুম যেন কোথায় উবে গেছে। হঠাৎ তন্দ্রা এলেও সব সময় সজাগ থাকে ওর মন। না জানি আবার কখন আসবে সে। শব্দটা কানে যেতেই সন্তর্পণে উঠে বসে মনিরা তার বিছানায়।

পাশের ঘরে জানালা গলিয়ে কে যেন ভিতরে প্রবেশ করলো। জুতোর মৃদু শব্দ হচ্ছে কিন্তু এ শব্দটা তো তার স্বামীর জুতোর শব্দ নয়। কেমন যেন অপরিচিত এ আওয়াজ। তার স্বামীর বুটের আওয়াজ যে তার হৃদয়ে গাথা হয়ে আছে। তা ছাড়া সে তো ও ঘরে প্রবেশ করবে না। এসে সে প্রথম তারই কক্ষে আসবে। তাবে কি সে নয়।

মনিরা কান পাতে।

হাঁ জুতোর মৃদু শব্দ হচ্ছে।

অতি আলগোছে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে ও ঘরে। তবে কি চোর কিন্তু চোর এলে মোম জ্বেলে সে নূরকে দেখতে যাবে কেনো। মনিরার মনে সন্দেহ জাগলো। বিছানা ছেড়ে সে উঠে এলো, ধীরে ধীরে এগুলো সে পাশের ঘরে যাওয়ার মাঝের দরজার দিকে।

কিছুটা এগুতেই হঠাৎ চমকে উঠলো মনিরা, সমস্ত দেহ জমকালো পোশাকে আচ্ছাদিত কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে নূরের বিছানার পাশে।

ডিম লাইটের স্বল্প আলোতে তাকিয়ে আছে জমকালো মূর্তি নূরের মুখের দিকে। যদিও জমকালো মূর্তি এদিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলো তবু মনিরা বেশ বুঝতে পারে। আরও অনুমান করে মনিরা এ জমকালো মূর্তি তার স্বামী নয়, কারণ বনহুরের মত দীর্ঘ দেহী নয় জমকালো মূর্তি।

মনিরা পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ায় জমকালো মূর্তির পাশে। সঙ্গে সঙ্গে বলে—কে তুমি?

জমকালো মূর্তি দ্রুত পালিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই মনিরা পিস্তল চেপ ধরে তার পিঠে।

মনিরা এ ঘরে আসার সময় টেবিলের ড্রয়ার খুলে বের করে এনেছিলো পিস্তল খানা। পিস্তল চেপে ধরায় পালাতে পারে না জমকালো মূর্তি।

ততক্ষণে মরিয়ম বেগ এবং নূর জেগে উঠেছিলো। তাদের চোখেও মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। যদিও তারা ভয়ে আরষ্ট হয়ে গেছে তবু কেউ কোন শব্দ উচ্চারণ করতে সক্ষম হচ্ছে না।

মনিরা বললো–কে তুমি।

 জমকালো মূর্তি নীরব।

 পুনরায় জিজ্ঞাসা করে মনিরা-বলো কে তুমি আর এখানে কেন এসেছে।

নুর বলে উঠে—-আম্মি এই জমকালো মূর্তিই আমি সেদিন দেখে ছিলাম।

মরিয়ম বেগমও বললেন–হ একেই সেদিন আমি পলিয়ে যেতে দেখেছি। নূর শীগগীর পুলিশের কাছে ফোন করে দে…।

নূর রিসিভার হাতে তুলে নিতে যাচ্ছিল।

 মনিরা বলে উঠে–থামো নূর। একে আমি চিনি।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করে নুর—আমি তুমি ওকে চেনো? কে ও?

মরিয়ম বেগমও অবাক হয়ে বলেনমনিরা তুই ওকে কবে দেখেছিস তাই চিনতে পারলি?

হাঁ মামীমা আমি ওকে চিনি। তুমিও চেনো। মনিরা ওর মুখ থেকে কালো পাগড়ির আঁচল খানা সরিয়ে বললো-মামীমা ওকে চিনতে পেরেছেন।

একি এযে ফুল। বিস্ময় ভরাকণ্ঠে বললেন মরিয়ম বেগম।

এক সময় নূরী ফুল নাম নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল নূরকে দেখাশোনা করার জন্য। নূরের অবশ্য মনে নেই, সে অনেকদিন আগের কথা।

মরিয়ম বেগম বলেন–তুমি। তুমি কি মনে করে এখানে এসেছে?

মনিরা বললো– তুমি ওদিকে যাও।

 নূর মায়ের কথায় কিছুটা আশ্চর্য হয় তবু সে চলে যায় সেখান থেকে।

মনিরা রাগত কণ্ঠে বলে–কথা বলছেনা কেন? জানি তুমি কেন এসেছো? আমার স্বামীর পিছু নিয়েছিলে আবার আমার ছেলেকে……..

এবারে নূরী কথা বলে-আপনাকে আমি বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করি তাই আপনার কথাগুলো আমি হজম করে গেলাম। কিন্তু মনে রাখবেন নূর শুধু আপনার সন্তান নয় সে আমারও সন্তান। কথাটা বলেই নূরী ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়।

মনিরা পিস্তল হাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মরিয়ম বেগম উচ্চকণ্ঠে ডেকে উঠেনূর ছুটে আয় ও পালিয়ে গেছে। ওরে ও পালিয়ে গেছে…

নূর দ্রুত এলো, কিন্তু ততক্ষণে নূরী চলে গেছে। বাইরে রাজ পথে শোনা যায় অশ্বপদ শব্দ। নূর বললো–আম্মি কে ঐ মেয়েটা?

জানিনা।

দাদী আম্মা তুমি বললে ওর নাম ফুল? কে ঐ ফুল বলো দাদী আম্মা।

তুই ছোট ছিলি তখন তোর আব্বু ওকে এনেছিলো তোর দেখা শোনা করার জন্য। ও তোকে খুব ভালবাসতো জানিস নূর?

সত্যি দাদী আম্মা ওকে আমার খুব ভাল লেগেছে। কেমন মায়া ভরা চোখে তাকাচ্ছিলো আমার দিকে।

হাঁ তোকে চুপি চুপি দেখতে এসেছিলো।

ঠিক বলছো দাদী আম্মা ফুল আমাকে স্নেহ করে…..

মামীমা তুমি ওর কথা তুলে নূরের মন নষ্ট করনা। নূর ওকে চেনেনা…

আম্মি ওতো কোন ক্ষতি করেনি তুমি কেন ওকে বলে?

বকবোনা একশোবার বকবো। চোরের মত যে চুপিচুপি আসে সে কোনদিন ভাল হতে পারে না।

আম্মি হয়তো প্রকাশ্যে এলে তুমি তাকে স্বচ্ছ মনে গ্রহণ করতে পারবে না তাই সে চুপিচুপি এসেছিলো। কি সুন্দর ওর নামটা ফুল। ঠিক ফুলের মতই সুন্দর।

নূর এখন ঘুমোতে যাও।

মরিয়ম বেগম বুঝতে পারেন আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না তাই তিনি বলেন–যা দাদু শুয়ে পড়। নিজেও তিনি শুয়ে পড়লেন।

নূর বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।

মরিয়ম বেগম শুয়ে শুয়ে ভাবেন মেয়েটি কেন এসেছিলো। নূরকে দেখতে এসেছিলো তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কেন নূরকে সে দেখতে আসে। নূরকে ফুল ভালোবাসতো জানেন মরিয়ম বেগম, এটাও জানেন–মনিরা ফুলকে কেনো যেন সহ্য করতে পারে না। এলোমেলো একরাশ চিন্তা তার মাথার মধ্যে ঘুর পাক খেতে থাকে।

মনিরাও শয্যা গ্রহণ করে কিন্তু বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকে সে। বহুদিন পর আবার ও কেনো নতুন করে উদয় হলো। নূরকে সে ফুসলিয়ে নিয়ে যেতে চায় নাকি? যেমন তার স্বামীকে ঐ মেয়েটি বশ করতে চেয়েছিলো ওর প্রতি মনিরার মনে একটা সন্দেহের ছোঁয়া ছিলো।

ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে মনিরা।

নূরী তখন তার আস্তানায় এসে পৌঁছে।

অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়াতেই রহমান এসে দাঁড়ায় নূরীর পাশে। বলে রহমান-নূরী আজও তুমি কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিলে, না?

হাঁ, রহমান ভাই।

কিন্তু এ ভাবে যাওয়াটা তোমার মোটেই উচিৎ নয় নূরী। জানোতো ও বাড়ির উপর সদা সন্দা পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে।

জানি রহমান ভাই তবু পারি না নিজকে ধরে রাখতে। নূর যেন আমার নয়নের মণি। জাভেদের চেয়ে সে কোন অংশে কম নয়। সে যে আমার হুরের সন্তান……

নূরী কথাগুলো বলতে বলতে আত্মহারা হয়ে যায়।

রহমান নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নূরীর মুখের দিকে।

কান্দাই আস্তানায় তখন ভোরের বাতাস বইতে শুরু করেছে।

নাসরিন তার কন্যা ফুল্লরাকে নিয়ে এগিয়ে আসে। কন্যাকে নিয়ে নাসরিন অতি ভোরে ফুল। সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো।

নূরী ফুল্লরাকে টেনে নেয় কাছে তারপর ওর গালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে আদর করে।

ফুল্লরা এখন ছোট নেই বেশ বড় হয়েছে ছুটোছুটি করে বেড়াতে শিখেছে। কিছুটা ফুল নিয়ে এগিয়ে ধরে–বড় আম্মু ফুল নেবে?

ফুল্লরা নূরীকে বড় আম্মু বলতো আর নাসরিনকে আম্মু বলতো।

নূরী ফুল্লরাকে আদর করে হাসনু বলে ডাকতো। কারণ ফুল্লরা খুব হাসতো।

নূরী বললো–দাও হাসনু আমাকে ফুল দেবে দাও।

নূরীর দুহাতে ফুল ভরে দেয় হাসনু।

 এবার এগিয়ে চলে ওরা আস্তানার ভিতরে।

পূর্বাকাশে তখন ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে।

গুহায় প্রবেশ করতেই জাভেদ উঠে বসে তাকায় মায়ের দিকে আম্মি তুমি আজও বাইরে গিয়েছিলে?

হাঁ আম্মু।

 রোজ তুমি কোথায় যাও আম্মি?

তোর বড় ভাইয়াকে দেখতে গিয়েছিলাম।

বড় ভাইয়া?

 হাঁ, তোর আর একজন বড় ভাইয়া আছে।

সত্যি বলছো আম্মি, আমার বড় ভাইয়া আছে?

হাঁ।

 তবে এখানে আসেনা কেন?

 সে শহরের মানুষ।

ওঃ।

জাভেদ জানে শহরের মানুষ কোনদিন জঙ্গলে আসেনা আবার জঙ্গলের মানুষ কোনদিন শহরে যায় না। তাই সে মাকে আর কোনো প্রশ্ন করে না।

*

ভোরের আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় হুংমার। ধড় মড় করে উঠে বসে তাকায় সে কিন্তু একি সে যে তাদেরই হোটেল পিউলপাং এ নিজের কক্ষে শুয়ে আছে। রাজা কোথায়, তাকে তো সে দেখতে পাচ্ছেনা। হুংমা শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ায়, চিৎকার করে ডাকে রাজা…রাজা…রাজা…

রাজা তখন জাহাজ ঈগলের একটি ফাষ্ট ক্লাশ ক্যাবিনের সোফায় বসে সিগারেট পান করে চলেছে। একরাশ ধুমকুন্ডলি তার চার পাশে ঘুর পাক খাচ্ছিলো। তাকিয়ে আছে সে উদাস নয়নে সাগরের উত্তাল জলরাশির দিকে।

চীন সাগর অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে ঈগল। জাহাজ ঈগল চীন সাগরের সবচেয়ে বড় এবং দ্রুতগামী। এ জাহাজে প্রায় একশত জন নাবিক রয়েছে। আর খালাসি রয়েছে বহু।

যাত্রী প্রায় আট নয় হাজার।

যাত্রীদের জন্য সব রকম আমোদ প্রমোদ এবং খেলা ধুলার ব্যবস্থা আছে এ জাহাজে। হোটেল, সিনেমা হল, লাইব্রেরী, কোন কিছুর অভাব নেই।

বনহুর এখন নিশ্চিন্ত।

কান্দাই ফিরে চলেছে সে।

জিহাংহায় কাজ তার শেষ হয়েছে।

যাদুকর হুয়াংচুকে বনহুর প্রাণ ভরে ধন্যবাদ জানায়। সে তাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। যাদুকর হলেও তার মহৎ হৃদয় আছে। যার জন্য সে বনহুরকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলো, পুত্র সমতুল্য স্নেহে তাকে সহায়তা করেছে।

হামবার্ট এবং তার সর্বনেশে সাধনা কেন্দ্রগুলো বিষাক্ত গ্যাস দ্বারা সমূলে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে এটা তার জীবনে এক চরম সার্থকতা।

বনহুর যখন হুয়াংচুকে নিয়ে ভাবছে তখন জিহাংহায় মাদামচীং মরণ বান অস্ত্র নিয়ে পিতার সম্মুখে এসে হাজির।

হুয়াংচুকে লক্ষ্য করে বলে মাদামচীং–বাবা তুমি যাদুবিদ্যায় আমার চেয়ে বড় হতে পারো। কিন্তু নাগ সাধনায় আমি তোমার চেয়ে অনেক বড় মনে রেখো। বাবা যদি মঙ্গল চাও তবে আমার শিকার তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ফেরৎ দাও।

হুয়াংচু বিকট স্বরে হেসে উঠে–তোমার শিকার? হাঃ হাঃ হাঃ সে এখন বহুদূরে।

বহুদূরে মানে?

 জিহাংহার বাইরে চলে গেছে সে।

 বাবা।

হাঁ মাদাম তোমার কুৎসিত বাসনা আর সিদ্ধ হবে না তোমাকে আমি হীমাগারে বন্দী করলাম। তুমি আর কোনদিন হীমাগার থেকে পৃথিবীর আলোতে বের হতে পারবে না। তোমার শেষ পরিণতি হবে কার হাতে মৃত্যু।

বাবা।

মাদামচীং এর চার পাশে তখন লৌহ শিকলের বেড়াজাল পড়ে গেছে।

 ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যাচ্ছে হীমাগারের দিকে।

মাদামচীং চিৎকার করে উঠে–বাবা তুমি আমাকে হীমাগারে বন্দী করে রাখো কিন্তু কঙ্গার হাতে তুলে দিওনা।

ততক্ষণে মাদামচীং হীমাগারে আটকা পড়ে গেছে।

[পরবর্তী বই সাইক্লোনের কবলে দস্যু বনহুর]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *