৮. জো বেটিলো

০৮.

আমি জো বেটিলোকে ভালভাবে চিনি। ওর গুণের সীমা নেই। ওকফিন তৈরী করে। গর্ভপাত ঘটায়। ছুরি অথবা গুলির আঘাতে আহত ব্যক্তিদের ক্ষতস্থান সারায়। এ শহরে ওর একটা দোকান কোরাল গ্যাব-এর কাছে আছে।

গণ্ডগোলের জায়গা কোরাল গ্যাব। মাস্তানের স্বর্গপুরী। এখানে রোজ খুন জখমের ঘটনা ঘটে। পুলিশ রাত্রে দুবার টহল দেয়।

আমি অন্ধকারে ডেলমনিকোর পানশালার কাছে গাড়ি থামাই। রাত একটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। এক ঘেয়ে পিয়ানো বাজছে।

আমি বেটিলোর দোকানের দিকে এগোই। জানালা দিয়ে দেখি, কয়েকজন অপরিচিত লোক বসে মদ্যপান করছে। দরজার কাছে বসে আছে স্বল্পবাস পরিহিতা কয়েকটা মেয়ে।

দেয়ালের সঙ্গে মিশে অন্ধকারে এগিয়ে চলি। নাকে এলো নানা রকম খাবার আর হুইস্কির গন্ধ। চারিদিকে দেখে দেয়াল টপকে প্রাঙ্গনে নেমে পড়ি। জানালার ছিটকিনি ছুরির সাহায্যে খুলে জানালা গলিয়ে ভেতরে ঢুকি। চোরা টর্চ জ্বেলে দেখি ঘরের মেঝে ধুলোয় ভর্তি।

অন্য একটা ঘরে ঢুকে টর্চ জ্বালাই। দেয়াল ঘেঁষে তিন ডজন কফিন। সস্তা কাঠের তৈরী। আমার ডানদিকে আরও তিনটে উন্নত ধরনের কফিন।

একের পর এক কফিনের ঢাকনা তুলে পরীক্ষা করি। অবশেষে সস্তা কফিনগুলির মধ্যে একটা কফিনে অনিতা কার্ফকে দেখতে পেলাম।

চোরা টর্চের আলোয় অনিতার রক্তাক্ত মুখের চেহারা দেখে আমি শিহরিত হই। বেটিলো এখানে ওকে রেখেছে, ভাবতে ভাবতে অসাবধানে কফিনের ঢাকনা জোরে ফেলে দিলাম।

ঢাকনা পড়ার শব্দে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের মধ্যে ঢিবঢিব, কান খাড়া করে থাকি। হঠাৎ আমার মনে হয় আমার কাছে রিভলবার নেই। বেটিলো যদি এখানে আমাকে দেখতে পায়…ঝলসানো ছুরি…তারপর কফিনে।

দ্রুত চোরা টর্চ জ্বেলে তিন পা পিছিয়ে যাই। ওষুধের গন্ধে বমি পায়। ভৌতিক স্তব্ধতা।কাছেই শব্দ হয়। আমি সরে যাওয়ার আগেই একজোড়া হাত আমার গলায় সাঁড়াশীর মত চেপে বসে। ভয়ংকর চাপে আমার নিঃশাস প্রায় বন্ধ হয়ে এলো।

আক্রমণকারীর ইস্পাতের মত শক্ত হাত সরাবার শক্তি আমার নেই।ওর বুক স্পর্শ করে দূরত্ব বুঝে ডান হাত দিয়ে জোরে ঘুষি চালাই। আক্রমণকারী সরে যাবার আগেই আবার একটা মোক্ষম ঘুষি চালাই। লোকটা ছিটকে পড়ে যায়।

চোরা আলোতে দেখি বেটিলো যন্ত্রণাকাতর মুখে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। ওর ঘুষি এড়িয়ে আমি ওর ঘাড়ে প্রচণ্ড আঘাত করি। বেটিলো পড়ে যায়। কোন সুযোগ না দিয়ে ওর বুকের ওপর ঘনঘন আঘাত করি। বেটিলো যন্ত্রণায় কাতরায়। ওর চুল ধরে ওর মাথা ঠুকি মেঝের ওপর। ওর শরীর স্পন্দনহীন হয়ে ওঠে।

আধমিনিটে সমস্ত ঘটনা ঘটে যায়।

দরজা খুলে বারান্দায় পা দেওয়া মাত্র গুলির শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি শুয়ে পড়ি। আরও, তিনবার গুলির শব্দ হয়। যেই গুলি করুক–তার লক্ষ্য আমি নই।

দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনি। বারান্দায় পায়ের শব্দ। আর একটা দরজা বন্ধ হয়। তারপর স্তব্ধতা নামে।

***

রিভলবার ছাড়া কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিলো। মনে হল ওপরে কে খুন হল, আমার গিয়ে দেখা দরকার।

আমি হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় বারুদের গন্ধ পাই। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে চোরা টর্চ জ্বালাই। সামনেই একটা ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় বারুদের গন্ধ আর ধোঁয়া।

যে গুলি ছুঁড়েছে নিশ্চয়ই সে চম্পট দিয়েছে। তবু কান খাড়া করে উঠে দাঁড়াই। দরজার দিকে এগিয়ে যাই। ছোট্ট ঘর, বিছানায় একটা লোক শুয়ে আছে। পরনে পাজামা, উর্ধাঙ্গ নগ্ন। ওর সাদা ধবধবে বুকে দুটো গর্ত। লোকটা যে লী থেলার তা বুঝতে পারলাম।

এখনও থেলার বেঁচে আছে, ওর জন্যে কিছু করা দরকার। থেলার আমার দিকে তাকায়। বিছানার ওপর ঝুঁকে প্রশ্ন করি, কে তোমাকে গুলি করেছে? বল…আমাকে বল।

থেলার কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু কোন শব্দ বেরোয় না। আস্তে আস্তে সে হাত তুলে একটা আলমারি দেখায়।

কি আছে ওখানে? আমি আলমারি খুলে দেখি কিছু পোশাক আর একটা ছোট্ট সুটকেস।

তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকি। হঠাৎ বাইরে একটা শব্দ পেয়ে দরজা খুলে রেলিংয়ের ওপর বুকে দেখি একজন পুলিশ।

একটা নিচু কণ্ঠস্বর শুনি। জ্যাক, ওপরে কেউ আছে?

আর কিছু না শুনে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আবার খুঁজি। ছুরির সাহায্যে আলমারির কাঠ তুলি, একটা গর্ত চোখে পড়ে। চোরা টর্চের আলোয় দেখলাম একটা অটোমেটিক পিস্তল–টেলিস্কোপ লাগান। আর একটা চামড়ায় বাঁধানো নোটবই। জিনিস দুটো নিতেই দরজায় ধাক্কা পড়ল।

দরজা খোল। আমরা জানি তুমি ভেতরে আছ। আমরা পুলিশের লোক।

রিভলবার হিপ পকেটে ঢোকাই। নোটবুক কোটের পকেটে রেখে জানালার দিকে এগোই।

জানালা খোলার সময় একটা পুলিশ বলছে, পেছনে চলে এসো। লোকটা মনে হয় জানালা গলিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে।

জানালা গলিয়ে বাইরে এসে পাইপ বেয়ে ছাদে উঠি। একটা গুলির শব্দ।

একজন পুলিশ বলে, লোকটা ছাদে। আমি ওপরে যাচ্ছি।

এখান থেকে ডেলমোনিকোর পানশালার ছাদ দেখতে পাচ্ছি। দূরত্ব খুব বেশি নয়। উপায় নেই। আমাকে লাফ দিতেই হবে। সুতরাং ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে লাফ দিলাম।

লুকোবার মত ডেলমোনিকার ছাদে কোন জায়গা নেই। চাঁদের আলোয় আমাকে দেখে ফেলবে। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাই। কি ঘটবে জানি না। এক জায়গায় মাথা নিচু করে বসে থাকি। তারপর যেই দাঁড়াতে যাব–আমার ডানদিকে একটা দরজা খুলে যায়। ঘরের আলো আমার ওপর পড়ে।

আমি আক্রমণের জন্যে তৈরী হই। একটি মেয়ে স্বচ্ছ কালো নাইটি পরে আমার সামনে উপস্থিত হয়। মেয়েটি বেশ লম্বা। কৌতূহলের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যালো ডার্লিং…তুমি কি বিপদে পড়েছো?

বিপদ? সিস্টার, আমি ভীষণ গাড্ডায় পড়েছি।

পুলিশ?

হ্যাঁ।

ভেতরে চল। ওরা এখুনি ঘরে ঘরে খোঁজা শুরু করবে।

আমি ঘরে ঢুকি। চমৎকার জায়গা।

মেয়েটি বিছানায় বসে বলে, ডার্লিং…তুমি কী করেছো? একটু আগে গুলির শব্দ পেয়েছি। তোমার কাজ কী…?

ঝামেলার মধ্যে পড়েছি। পুলিশ আমায় তাড়া করেছে পালিয়ে এসেছি।

বেটিলো খুন হয়েছে কী?

না, অন্য আর একজন। বেটিলোর হাড় গুড়ো হয়েছে। হারামজাদা বেশ কিছুদিন নড়াচড়া করতে পারবে না।

চমৎকার। লোকটাকে আমি ঘৃণা করি।

বাইরে হাল্কা পায়ের শব্দ, নরম গলায় বলি, পুলিশ এসে পড়েছে।

ছাগলের দল। বলে সে দরজা বন্ধ করে দেয়ালে লাগানো বেল বাজায়।

ওরা ওপরে এসে পড়বে ডার্লিং। চিন্তা কর না।

 দরজায় ধাক্কা পড়ে, দরজা খোল! নইলে দরজা ভেঙে ফেলবো।

বাইরে গুলির শব্দ। দরজার কাছ থেকে মেয়েটিকে সরিয়ে আনি। মেয়েটির বিছানার চাদর হাতে তুলে জানলার কাছে এলাম। আরো গুলির শব্দ শুনি। পকেট থেকে অনেক নোট বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে, অনেক ধন্যবাদ, সিস্টার।

জানালা খুলে নামার জন্যে তৈরী।

মেয়েটি বলে, ডার্লিং দারুণ উত্তেজক ব্যাপার। দেখবে–ঘাড় যেন না ভাঙে।

 চাদরটি পাকিয়ে দড়ি তৈরী করে নিচে ঝুলিয়ে দিলাম।

দরজা বন্ধ করে দাও।

 মাটিতে পা রাখা মাত্র একটা কণ্ঠস্বর, এই, হা…তুমি…তোমাকে বলছি।

আমার হাত চেপে ধরে। আমি লোকটির চোয়াল লক্ষ্য করে প্রচণ্ড ঘুষি মারি। লোকটা পড়ে যায়। আমি গাড়ির দিকে দ্রুত ছুটতে থাকি।

***

রাত তিনটের সময় হর্থন এভিনিউতে একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামাই। এ স্থানে আগেও এসেছি। এখানে থাকার একটা সুবিধা যে, বাড়িগুলো সাউন্ড-ফ। কিন্তু এর চেয়ে আমি ভোলা জায়গায় তাবুতে থাকা শ্রেয় মনে করি।

মিস বোলাস গ্রাউন্ড ফ্লোরে দু’কামরাওলা ঘরে থাকে। হঠাৎ উপস্থিত হয়ে মিস বোলাসকে চমকে দেব। সামনের দরজা দিয়ে না গিয়ে এত রাত্রে সবার অগোচরে জানলা দিয়ে মিস বোলাসের বসার ঘরে উঁকি দিই। ওর শোবার ঘরের জানলায় টোকা মারি। তিনবার টোকা মারতেই জানলা খুলে যায়। ঘরে আলো জ্বলে।

দেশলাই ধরাই সিগারেটের জন্যে। মিস বোলাস জানালা দিয়ে আমাকে দেখতে পেল। তার চিনতে অসুবিধে হল না। সে আমাকে ইশারা করে।

আমি বলি, বৃষ্টি পড়ছে। এখন এক পেগ হুইস্কি না হলে মরে যাবো।

মিস বোলাস দরজার একপাশে সরে বলে, জানালায় টোকা শুনে ভাবছিলাম চোর-টোর এসেছে।

ছোট্ট ঘর কিন্তু ছিমছাম।একটা চেয়ারে বসে আমি মিস বোলাসের দিকে তাকাই।মুখের মেক আপ দেখে মনে হয় কিছুক্ষণ আগে ও সেজেছে। ওর চোখে ক্রোধের ঝিলিক।

চোর-টোরের কথা বাদ দাও! কই, পানীয় কোথায়? কী আছে তোমার কাছে?

টেবিলের দিকে যেতে যেতে বলে, দ্যাখ, আমি তোমার ওপর ভীষণ রেগে যাচ্ছি। আমার রাগ তো দেখনি।

হঠাৎ আমার ওপর রাগ কেন?

এভাবে এত রাত্রে ডেকে তোলা, বেশি বাড়াবাড়ি করছ না?

মদের গ্লাস টেবিলে রেখে বলি, হয়তো তাই। কিন্তু এত রাত্রে আমি তোমার কাছে ফষ্টিনষ্টি করতে আসিনি। জরুরী কাজ। কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না।

কিসের জরুরী কাজ?

প্রায় এক ঘণ্টা আগে লী থেলার খুন হয়েছে। দুটো বুলেট বুকটাকে ফুটো করে দিয়েছে।

মিস বোলাস খুব চালাক, মিস বোলাসের দু চোখের দৃষ্টিতে কিছুই বোঝার উপায় নেই।

লী থেলারকে কে গুলি করেছে?

সেই একই খুনী, যে ডানা, লীডবেটার আর অনিতা কার্ফকে খুন করেছে। জানতাম না যে অনিতা কাচের সঙ্গে তোমার জানাশোনা ছিল। আর তুমি ও লী থেলার একই বিছানায় শুতে।

ওসব পুরোনো ইতিহাস। কিন্তু…তুমি এসব জানলে কি করে?

নিক নেডিকের কাছে জানতে পারি। সে আমাকে লী থেলারের একটা ছবি দেখায় তাতে তুমিও ছিলে।

মিস বোলাস বলে, কফি বানাই। মনে হচ্ছে তুমি অনেক প্রশ্ন করবে।

বানাও। হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে অনেক আলোচনা আছে। মনে হচ্ছে লী থেলারের মৃত্যুতে তোমার কিছু আসে যায় নি।

কেন আমি কি লী থেলারের জন্যে মুষড়ে পড়বো? আমার কাছে ওর কোন অস্তিত্ব নেই।

রান্নাঘরে চলে যায় মিস বোলাস। আমি পঁয়তাল্লিশ পয়েন্টের রিভলবার বের করি। টেলিস্কোপে দু চোখ লাগাই কিছুই দেখতে পাই না? এমন জিনিস রিভলবারে লাগানো থাকে আগে দেখিনি। বড় ক্লান্ত লাগায় রিভলবারটি টেবিলের ওপর রাখি। ফ্লেগকে দেখাতে হবে। আগ্নেয়-অস্ত্র, গোলা বারুদ আর রক্তের ব্যাপারে ফ্লেগ এক্সপার্ট।

কান্নার আওয়াজে আমি সজাগ হই।

আমি এগিয়ে যাই। আধ খোলা দরজা। মিস বোলাস ইলেকট্রিক চুল্লীর কাছেদাঁড়িয়ে। দুহাতে মুখ ঢাকা।

মিস বোলাস, তুমি বস। আমি কফি তৈরী করছি।

চমকে দ্রুত চোখ মুছেমিস বোলাস বলে, আমিই বানাচ্ছি। প্লীজ, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

হাত ধরে ওকে এনে বসবার ঘরে বসাই।

কয়েক মিনিটের মধ্যে কফি বানিয়ে বসবার ঘরে ঢুকি। মিস বোলাসের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট, আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে। কফির কাপ টেবিলে রেখে হুইস্কি মেশাই।

এই নাও কফি। মিস বোলাস, এবার একটু খোলাখুলি বলো। তুমি লী থেলারের সঙ্গে এক যোগে কাজ করেছে, তাই না?

তীক্ষ্ণকণ্ঠে মিস বোলাস বলে, কী বলতে চাইছ তুমি?

আমার কিছু করার নেই। যাই ঘটুকনা কেন, মিঃ কার্ফকে আড়ালে রাখতে হবে। মিঃ ব্রান্ডনকে যদি খুনীর কথা জানাই–তাতেও বিপদ। বেনিকে খুন করেছে থেলার। তারপর থেলার খুন হয়। ডানাকে কিন্তু থেলার খুন করেনি। জানতে চাই খুনী কে?মনেহয় এ ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করতে পার।

তুমি অনুমান করতে পার না?

পারি। কিন্তু অনুমান আর জানা দুটো এক জিনিস নয়। খুনী কে, থেলার জানত–তাই ওকে সরে যেতে হলো। লীডবেটার জানত খুনী কে–ওকেও সরে যেতে হলো। মনে হয় তুমি জানকে খুনী? বল আমাকেনয়তো খুনী হয়তো তোমাকেও…।

একটা টেবিল মাঝখানে। মুখোমুখি বসে কফি খাচ্ছি। সে বলল, খুনীর হদিশ আমি জানি–এমন ধারনা হল কিভাবে?

একটা ধারণামাত্র। মনে হয় অনিতার খুনের পর তুমি আর থেলার একসঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলে। অনিতা যা বলেছে–মনে হয়, সেই গোপন তথ্য তুমি থেলারের কাছ থেকে জানতে পেরেছ।

থেলার যখন মৃত–তখন সেকথা ভেবে লাভ নেই। থেলারকে আমি ভালবাসতাম। ওই রাক্ষুসী না আসা পর্যন্ত আমি আর থেলার বেশ সুখেই ছিলাম।

একটা সিগারেট ধরিয়ে মিস বোলাস আবার বলে, আমার কাছ থেকে থেলারকে অনিতা কার্ফ ছিনিয়ে নেয়। দুদিন পরেই থেলারকে কলা দেখিয়ে মিঃ কার্ফকে সে বিয়ে করে। মিঃ কার্ফ যখন ওই রাক্ষুসীটাকে নিজের স্টেটে নিয়ে যায় একদিন আমি দেখতে পাই ওকে। খোঁজ খবর নিয়ে জানি অনিতা থেলারকে ডিভোর্স না দিয়েই কার্ফকে বিয়ে করেছে। আমি চুপ করে থাকতে পারি নি। একটা বেনামা চিঠি পাঠিয়ে কার্ফকে জানিয়ে দিয়েছি যে, অনিতা বিবাহিতা।

বড় অদ্ভুত ব্যাপার। বেনামা চিঠি তুমি পাঠাতে পার–আমি ভাবিনি।

আমার কি ক্ষতি করেছে অনিতা, তুমি কল্পনা করতে পার?অনিতার সঙ্গে থেলার দেখা করে। ঐ সময়ে বার্কলের সঙ্গে অনিতা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। থেলারের কথা শুনে অনিতা ভয় পায়। ব্যানিস্টারকে লোভ দেখিয়ে অনিতা নাইটক্লাবে আত্মগোপন করে। থেলার আমাকে সব জানায়। ডানার মৃত্যু অবশ্যই একটা দুর্ঘটনা। ওকে ভুল করে খুন করা হয়।

আমার চিঠি পেয়ে কার্ফ অনিতাকে জেরা করে। তোমার সঙ্গে দেখা করে অনিতা জানার চেষ্টা করেছিল বার্কলের সঙ্গে ওর আসনাই কার্ফ জানে কিনা। তোমার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার পর অনিতা টের পায়, কার্ফ ওকে অনুসরণ করছে। অনিতা ভয় পেয়ে ডানার কাছে যায়। ওর সাহায্য চায়। ডানা ওকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। কার্ফ বাইরে অপেক্ষা করে। অনিতা ডানাকে নেকলেসের লোভ দেখায় ও বলে,যদি ডানা ওর পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে কার্ফকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, অনিতা সহজেই লা এটোলিতে ফিরে যেতে পারবে। দুজনে পোশাক বদল করে। ফ্ল্যাট ছেড়ে আসার সময় ডানা হীরের নেকলেস বিছানার গদির নীচে লুকিয়ে রাখে। তার সন্দেহ ছিল–শেষ মুহূর্তে হয়তো অনিতার মত বদল হতে পারে। ডানাকে অনিতা মনে করে বালুকাবেলায় কার্ফ খুন করে। এখন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা পরিষ্কার।কার্ফই খুন করেছেলীডবেটারকে।

তুমি এসব জানলে কি করে?

লা এটোলিতে থাকাকালীন অনিতা সমস্ত ঘটনা চিঠিতে থেলারকে জানায়। থেলার আমাকে জানায়। কার্ফকে ব্ল্যাকমেইল করার ধান্দা থেলারের মাথায় অনিতা দিয়েছে।

লী থেলার তারপর কী করে?

থেলারের অর্থের লোভ প্রচণ্ড তাই রাজীহয়। তুমি ভাবছো, কিভাবে ডানার পোশাকবার্কলের আলমারিতে পাওয়া যায়। ঐ পোশাক অনিতার পরনে ছিল। অনিতার কিছু পোশাক সবসময় বার্কলের আলমারীতে থাকত। সে গোপনে বার্কলের শোবার ঘরে গিয়ে ডানার পোশাক ছেড়ে নিজের পোশাক পরে বেরিয়ে আসে। ফিরে গেছে লা এটোলিতে। অনিতাকে ব্যানিস্টার বের করে দেয়। অনিতা তোমার কাছে যায়। কেন না কার্ফ ওর পিছু নিয়েছিল। কার্ফের মনে হয়েছিল যে, তুমি অনেক কিছু জান। সে তোমার কেবিনে যায়–উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে খতম করা। তোমাকে না পেয়ে অনিতাকে দেখতে পায়। খুন করে অনিতাকে। থেলার অনিতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ফলে সে স্থির করে তোমার কাছে গিয়ে অনিতার খোঁজ করবে। তোমার কেবিনে পৌঁছতে থেলারের দেরী হল। তাই আগেই কার্ফ অনিতাকে খতম করেছে।

শ্লেষের সুরে বলি, তুমি বলতে চাও-থেলারকেও বুঝি কার্ফ খতম করেছে?

মিস বোলাস বলে,’থেলারকে আমি কার্য সম্পর্কে সাবধান করেছিলাম। থেলার আমার কথায় কান দেয়নি।

হঠাৎ আমি উঠে সোজা মিস বোলাসের শোবার ঘরে চলে যাই। মিস বোলাস সঙ্গে সঙ্গে এসে বলে, এখানে তোমার কী দরকার?

ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে আমি মাথা নেড়ে বলি, শোন খুকি, তুমি হয়ত ভাবছো আমার স্নায়ু দুর্বল। বাজী রেখে বলতে পারি, পায়ের শব্দ শুনেছি।

জানালা খুলে দেখি বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।

মিস বোলাস কঠিন কণ্ঠে বলে, তুমি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে।

শুধু তুমি আর আমি জানি-কার্ফ হত্যাকারী এবং আমরা দুজনেই এটা বিশ্বাস করি না। তাই না?

বিশ্বাস করা শক্ত। থেলার না জানালে আমিও বিশ্বাস করতাম না।

হেসে বলি, থেলার জানালেও আমি মানতে পারছি না। আমি যে খুব কেউকেটা ধরনের গোয়েন্দা। একবার বিছানার দিকে চেয়ে দ্যাখ। আজ রাত্রে তুমি এ বিছানায় ঘুমোও নি। জানালায় টোকা মারার আগে ঐখানে তুমি পোশাক ছেড়েছে।

এক পাটি জুতো উঁচু করে তুলে বলি, তুমি থেলারের ঘাড়ে গুলি করেছো-বেচারীর প্রচুর রক্ত পড়েছিল। হয়ত এখানেও তোমার পোশাক…এই যে দেখা যাচ্ছে…এই দ্যাখ। জুতোর কোনায় রক্তের দাগ।

মিস বোলাস বসবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, হাবিজাবি কি বলছে বুঝতে পারছি না।

 একপাটি জুতো দোলাতে দোলাতে আমি বোলাসের পিছু নিই।

আমার কথা জলের মত সহজ।কার্ফের বদলে নিজেকে ভেবেনাও। দেখবে ব্যাপারটা বুঝবে। তুমিই ডানাকে অনিতা ভেবে গুলি করেছো। লীডবেটারকে খুন করেছে কারণ ডানাকে উলঙ্গ করার সময় সে তোমাকে দেখেছিল। তুমিই প্রচণ্ড ঘৃনায় অনিতাকে খুন করেছে–তুমিই থেলারকে গুলি করেছো কারণ…বল, কেন তুমি থেলারকে খুন করলে?

মিস বোলাস জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। শক্ত হাতে সে কফি ঢালে। চোখ মুখে কোন ভাবান্তর নেই। বলে, ম্যালয়, তুমি কী সিরিয়াস?

এখনও পর্যন্ত তোমার অভিনয় খুব সুন্দর হয়েছে। চোখের জল, কার্ফের চমকপ্রদ গল্প। শান্তভাবে আমাকে অনুসরণ করে তোমার শোবার ঘরে ঢোকা–সব নিপুণভাবে করেছো তুমি। এবার বল তুমি কেন থেলারকে খুন করলে?

সে দৃঢ় গলায় বলে, থেলারকে আমি খুন করিনি। ওকে আমি ভালবাসতাম। কার্ফ ওকে খুন করেছে।

দুর্ভাগা–তোমার পুরনো বন্ধু থেলার একটা নোটবুক রেখে গেছে। মৃত্যুর আগে সে ওটা আমাকে দিয়ে যায়। আমি ওটা পড়েছি। পড়ার পর জানতে পারি যে, অনিতা তোমাকে ভয় করতো। সে জানত–ওকে তুমি খুন করার চেষ্টা করছ। তাই তোমার ঘরে এসে তন্ন তন্ন করে দেখেছি। আমি জানি কিছুক্ষণ আগে তুমি কোরাল গ্যাব থেকে ফিরেছে। এবার বল, তুমি থেলারকে খুন করেছে কেন?

হেসে বলে সে, হু, বাস্টার্ডটা তাহলে নোট বই রাখতে…ভারী মজার।

ফালতু কথা ছাড়। থেলার সম্পর্কে বল।

বলছি। আসলে ব্যাপারটা হলো–অন্যান্য হত্যাগুলি থেকে যখন নিষ্কৃতি পেয়েছি–তখন আর একটা বাড়তি খুন করলে কি হয়? অবশ্য ডানার ব্যাপারটা দুর্ঘটনা।

হ্যাঁ, ডানার পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক। ডানার ব্যাপার না হলে আমি মাথা ঘামাতাম না। ডানার খুনী হিসেবে তোমাকে ছাড়তেও পারি না।

এ ব্যাপারে তোমার বিশেষ কিছু করার নেই।

আমি দুটো জিনিস করতে পারি। নিজের হাতে আইন নিতে পারি অথবা পুলিশের কাছে যেতে পারি। তোমার ওপর বলপ্রয়োগ করতে চাই না। সুতরাং পুলিশ তোমার ব্যবস্থা নেবে। হয়ত আমাকেও ছেড়ে দেবে না।

তোমার এ ধরনের কাজ কার্ফ পছন্দ করবেন না।

তা জানি। যাক, মিঃ ব্রান্ডনকে ফোন করার আগে তুমি কী পোশাক পরে নেবে?

কী ইয়ার্কি করছে!

বেবি, এবার আর ইয়ার্কি নয়। বড় জোর পনের বছর সাজা হবে।

বেশ, তুমি যখন তাই চাইছ–সে ক্ষেত্রে আমার পোশাক বদলানোই ভাল।

কফির কাপ তুলে মিস বোলাস বলে, কফির সঙ্গে কী একটু হুইস্কি মেশাতে পারি। তুমি বিশ্বাস করবে না–আমি কিন্তু অসুস্থ বোধ করছি।

নিজেই নিয়ে নাও।

বোলাস কাপটা ছুঁড়ে মারল আমার দিকে। চোখের ওপর থেকে কফি সরাবার আগেই মিস বোলাস পয়েন্ট পঁয়তাল্লিশ রিভলবার তুলে নেয়।

শান্ত গলায় বলি, বিপদ আমি নিজেই ডেকে এনেছি।

ওই দিকে যাও। কোন রকম বাহাদুরি করবেনা। মনে রাখবে, থেলারের মত আমারও হাতের টিপ অব্যর্থ।

ওর শোবার ঘরে আমি পেছন ফিরতে ফিরতে ঢুকে পড়ি।

মিস বোলাস আদেশের ভঙ্গিতে বলে, দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াও।নড়াচড়া করলে গুলিতে তোমার মাথার খুলি ফুটো করে দেব। আমি পোশাক পাল্টাবো এখন।

সে আমাকে ভুল জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। আয়নায় মিস বোলাসকে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের মাঝখানে বিছানা। আমার দু’ইঞ্চি দূরে মিস বোলাস। ইতিপূর্বে ও চারজনকে খুন করেছে। আরও একজনকে খুন করা কোন ব্যাপার না।

কিছু বলার জন্যেই যেন বলি, দৃশ্যটা কেমন যেন বিশ্রী হয়ে উঠল। ডিটেকটিভের মুঠোয় সর্বদাই মেয়েটি ধরা পড়ে। যদি তুমি আমাকে গুলি কর–গল্পের পরিণতি হবে অনৈতিক।

মিস বোলাস হেসে বলে, অনৈতিক গল্পই আমি পছন্দ করি। তোমার গাড়ি কি বাইরে রেখেছো?

নিশ্চয়ই, চাবি দেব?

মিস বোস চেয়ারে বসে মোজা পরতে থাকে। কাছেই জানালার ওপর রিভলবার। মাঝখানে বিছানা না থাকলে একটা সুযোগ নিতাম।

চাবি পরে নেব। খবরদার নড়বে না।

সে ড্রয়ার হাতড়ায় কিন্তু একহাতে রিভলবারটা ধরা।

প্রশ্ন করি, কোথায় যাচ্ছ?

নিউ ইয়র্ক। তোমাকে ধন্যবাদ–পুলিশ কখনও আমায় সন্দেহ করবে না। নিউইয়র্কে নতুনভাবে জীবন শুরু করবো। আমার মত সুন্দরীর নতুন কিছু খুঁজে নেওয়া অসম্ভব হবে না।

মিস বোলাস একটা সবুজ সিল্কের হাত কাটা জামা তারনাইটির ওপর চাপায়। আমি সুযোগের অপেক্ষায় থাকি।মিস বোলাস যখননাইটির ওপর থেকে একটা পা ওপরে তোলে–আমি বিছানার ওপর দিয়ে ওর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

মিস বোলাসের চোখের পলক পড়ে না। একভাবে সে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্ধনগ্ন সুন্দর একটি রমনী দেহ। ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা যায়। ওর হাতে পয়েন্ট পঁয়তাল্লিশ রিভলবার ট্রিগারে ওর আঙুল চেপে বসে।

আমি পাগলের মত মিস বোলাসের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাই। কিন্তু অনেক…অনেক দেরী হয়েছিল ওর কাছে পৌঁছতে।

অটোমেটিক রিভলবার গর্জে উঠল। প্রথম গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় আর আগুনের তাপে আমার মুখ ঝলসে যায়। তারপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গুলিও। ততক্ষণে ওর কাছে গিয়ে জোরে আঘাত দিতেই রিভলবার ছিটকে পড়ে।

মিস বোলাস মেঝের ওপর পড়ে যায়। ওর মুখে আতঙ্কের ছাপ। দুচোখ বিস্ফারিত, মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে যায়। ওর বুক চিরে রক্তের ধারা গলগল করে বেরোয়। আমি বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। কিছুই বুঝতে পারি না।

আস্তে আস্তে মিস বোলাসের পাশে পড়ে থাকা রিভলবারের দিকে তাকাই। টেলিস্কোপিক নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এটা একটা ট্রিকগান। এমন রিভলবার যা কিনা খুনীকেই খুন করল। এমন রিভলবার যার গুলি পেছন দিকে ছিটকে যায়। থেলারের শেষ ছোট্ট কৌতুক, ওর আমাকে দেওয়া উপহার।

আমি সরে দাঁড়াই। এ ফ্ল্যাট শব্দ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। সুতরাং গুলির শব্দ কেউই শোনে নি। কিন্তু আমি কোন সুযোগ দিতে চাই না। বসবার ঘরে গিয়ে কফির কাপ তুলে নিলাম। খালি হুইস্কির বোতল এবং আমার টুপীও কয়েকটি সিগারেটের টুকরোতুলে নিলাম।চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আর কোন জিনিসে আমার হাতের স্পর্শ লেগে থাকল কিনা। টেবিলের ওপর রুমাল দিয়ে সযত্নে হাতের ছাপ মুছি। তারপর আলো নিভিয়ে বাইরে চলে এলাম।

সকাল হচ্ছে, আশেপাশে কেউ নেই। অবিরত বৃষ্টি পড়ছে। আমি দৃঢ় পায়ে গাড়ি লক্ষ্য করে দৌড় লাগাই।