৫. চোখমুখ ফ্যাকাশে

০৫.

আমার দিকে সে প্রায় আধ সেকেন্ড হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর আমাকে চিনতে পেরে তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হলেও সে ধৈর্য হারায় না। সে দু পা পিছিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করে। তার আগেই আমি দরজায় জোরে ধাক্কা মারি, সে ছিটকে যায় দূরে। সে নিজেকে সামলে সবেগে ঘরের কোণে অন্য দরজার দিকে ছুটে যায়। তার আগেই আমি তাকে ধরে ফেলি। বলি, মিসেস কার্ফ, ঘাবড়াবেন না। আপনার সঙ্গে কথা আছে।

এক ঝটকায় অনিতা কার্ফ হাত ছাড়িয়ে নেয়। তার দুচোখ জ্বলে। সে ফিসফিসিয়ে বলে, চলে যান। ঘরটা বেশ ছিমছাম। খাটে ঝকঝকে বিছানা। ড্রেসিং টেবিলে অনেক প্রসাধন সামগ্রী। নানারকম আলোয় ঘরের চেহারা মায়াবী। এ রকম ঘরে লক্ষপতির স্ত্রী আরামে থাকতে পারে। কিন্তু অনিতা কার্ফকে মোটেই সুখী দেখাচ্ছিল না।

উঃ, আপনার সন্ধানের জন্যে যা চেষ্টা করেছি। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

বেরিয়ে যান। আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব না।

নেকলেশ…আপনি কি ফেরত চান না?

মুখ রক্তশূন্য হয়ে ওঠে।

নেকলেশ…জানি না। আপনি কি বলতে চাইছেন?

আপনি সব জানেন। ডানা লিউইসকে আপনি নেকলেশটা কেন দিয়েছেন?

মিসেস কার্ফ ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে ড্রয়ার খোলে। সে একটা ছোট্ট অটোমেটিক রিভলবার নেয়। রিভলবার সমেত ওর কব্জি চেপে ধরে মোচড়াই।

ফেলে দিন রিভলবার।

মিসেস কার্ফ কনুই দিয়ে আমার বুকে আঘাত করে, আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি টলতে থাকি কিন্তু ওর কোমর জড়িয়ে টানি।

শান্ত হোন মিসেস কার্ফ। আপনার কিন্তু আঘাত লাগতে পারে।

মিসেস কার্ফ আমার মুখে ঘুষি মারে। আবার চেষ্টা করতেই আমি ওর হাত মুচড়ে দিলাম। ওর দুহাত পেছনে এনে জোরে মোচড়াতে থাকি। ওর হাত থেকে রিভলবার খসে পড়ে। একটা লাথিতে রিভলবারটা একেবারে খাটের নীচে।

যন্ত্রনায় মিসেস কার্ফ হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। গোঙানির সুরে বলে, আপনি আমার হাত ভেঙে দিয়েছেন।

ওর কব্জি ছেড়ে ওর কনুই চেপে দাঁড় করাই।

দুঃখিত মিসেস কার্ফ। মারপিট চেপে কথা বললে কাজ হবে। আপনার নেকলেশ ডানা লিউইসকে কেন দিয়েছেন?

আমি দিই নি।

আপনি ডানা লিউইসের সঙ্গে যখন ফ্ল্যাটে যান, তখন নেকলেশ পরেছিলেন। যখন বেরিয়ে আসেন, গলায় নেকলেশ ছিলনা।ওর ঘরে নেকলেশটা পাওয়া যায়। কেন নেকলেশ দিয়েছিলেন?

ওকে আমি দিইনি, বলছি না।

হয় আমার কাছে নয় পুলিশের কাছে মুখ খুলুন। মন স্থির করুন।

 হঠাৎ মিসেস কার্ফ ছুটে গিয়ে উপুড় হয়ে রিভলবার খোঁজে। কিন্তু ওটি ওর নাগালের বাইরে।

ওকে টেনে তুলি। আবার মিসেস কার্ফ আমাকে ঘুষি মারার চেষ্টা করে। আমি ওকে সবেগে ঠেলে দিলাম। মিসেস কার্ফ বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে।

ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলি, বলুন কেন ডানাকে নেকলেশ দিয়েছিলেন?

 মিসেস কার্ফ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, আমি দিইনি। নেকলেশটা চুরি হয়ে যায়।

ডানা লিউইসের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আপনি ট্যাক্সিতে চেপেইস্টবীচের দিকে গিয়েছিলেন কেন?

চোখে মুখে ভয়ের ছাপ নিয়ে মিসেস কার্ফ বলে, কি যা-তা বলছেন। ইস্টবীচে আমি যাইনি।

যখন ডানা লিউইসকে গুলি করা হয় আপনি তখন বালিয়াড়ির কাছেই ছিলেন। ওকে কি আপনি গুলি করেছেন?

ইস্ট বীচে আমি যাইনি। বেরিয়ে যান। আপনার কোন কথা আমি শুনব না।

অদ্ভুত ব্যাপার, মিসেস কার্ফ প্রথম থেকেই এত নীচু গলায় কথা বলছে যেন তার গলার আওয়াজ কেউ শুনতে না পায়। তাছাড়া ওর আতঙ্কিত চেহারা দেখে সন্দেহ হয়।

আপনি কিছুই জানেন না? তাহলে গা ঢাকা দিয়েছেন কেন? আপনি যে এখানে রয়েছেন মিঃ কার্ফ কি জানেন?

মিসেস কার্ফ কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার মুখে প্রচণ্ড আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে পড়ে।

ঘরে কেউ ঢুকেছে আমি টের পাইনি। আয়নায় তার ছায়া পড়তেই আমি ঘুরে দাঁড়াই।

ব্যানিস্টার দাঁড়িয়ে, অবশ্য ওর সঙ্গে আমার আলাপ নেই। ব্যানিস্টারের নজর আমার ওপরে।

ব্যানিস্টার বলে, নেকলেশ সম্পর্কে আপনি কী জানেন?

আমি বলি এ ব্যাপারে আপনি নিজেকে জড়াবেন না। অবশ্য যদি খুনের ব্যাপারে জড়াতে চান, আমার বলার কিছু নেই।

ব্যানিস্টার বলে, নেকলেশটা কোথায়?

লকারে পোরা। মিসেস কার্ফ খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন–আপনি কী সেটা জানেন?

 এখানে ওকে রাখার অর্থ জানেন? অবশ্য এসব ছোটখাট বিষয়ে আপনি মাথা ঘামান না।

ব্যানিস্টার অনিতাকে বলে, এই লোকটার কথাই কী আপনি বলছিলেন?

মিসেস কার্ফ মাথা নাড়ে কিন্তু তার মুখ ভয়ে বিবর্ণ।

ব্যানিস্টার আমাকে বলে, আপনি এখানে এলেন কিভাবে?

হেঁটেই এসেছি। এখানে আসা কী অন্যায়?

কঠিনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে দেয়ালে লাগানো বেল বাজায়। তারপর সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পজিসন নেয়।

তখন রিভলবারের প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে টের পাই। দরজা খুলে গেইট্রক্স ভেতরে ঢোকে জ্বর হেসে আমার দিকে তাকায়। ওর হাতে রিভলবার।

ব্যানিস্টার বলে, এই লোকটা এখানে কিভাবে এল?

মিস বোলাস নিয়ে এসেছে।

 শ্যানন ঘরে ঢোকে। ব্যানিস্টার বলে, মিস বোলাসকে নিয়ে এসো।

 ব্যানিস্টার অনিতা কাকে বলে, আপনি পাশের ঘরে চলে যান।

 মিসেস কার্ফ বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, এই ভদ্রলোকের কথা আমি বুঝতে পারছি না। মিথ্যা কথা বলে আমাকে ঝামেলায় জড়াবার চেষ্টা করছেন।

কর্কশ কন্ঠে ব্যানিস্টার বলে, বলছি না। পাশের ঘরে চলে যান।

মিসেস কার্ফ চলে যেতেই ব্যানিস্টার গেইটসকে বলে, কেউ ওপরে উঠতে পারবে না–আমার এই নির্দেশ অমান্য করা হল কেন? এ ধরনের ব্যাপার আবার ঘটলে তোমার এবং শ্যাননের এখানে জায়গা হবে না।

আমি ব্যানিস্টারকেবলি, আপনি কেন এব্যাপারে নিজেকে জড়াচ্ছেন?মিসেসকার্ফকে আমার কাছে ছেড়ে দিন।

ব্যানিস্টার একটা চেয়ারে বসে বলল, মনে করবেন না, এত সহজে ব্যাপারটা মিটে যাবে।

দরজা খুলে মিস বোলাস ঘরে ঢোকে তার পেছনে শ্যানন। তারপর দরজা বন্ধ হয়।

মিস বোলাসের চোখ মুখের ভাব শান্ত। একবার ঘরের চারিদিকে দেখে নিয়ে বলে, হ্যালো…আপনি এখানে এলেন? ।

ব্যানিস্টার বলে, তুমি এই ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছো?

ভদ্রলোক আমার সঙ্গেই এসেছেন। আপনি সভ্য বা সভ্যাদের সঙ্গে অতিথি আসুক সেটা চান না?

তোমাকে বা ভদ্রলোককে কারুকে চাই না। আমার সব সময় মনে হয়েছে একদিন না একদিন তুমি গণ্ডগোলের সৃষ্টি করবে।

মিস বোলাস হেসে বলে, কী সুন্দর আপনি কথা বলতে পারেন। আপনি যে হতাশ হননি, তাতেই আমার আনন্দ। আপনার ওই ফোতো কাপ্তানদের বলুন রিভলবার সরাতে। ডিক চলে এসো। ওরা আমাদের আটকে রাখতে পারবে না।

মিস বোলাসের কথায় আমি আশ্বস্ত হতে পারিনা। গেইটসের চাউনীতে মনে হয় একটু সুযোগ পেলেই ও আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

ব্যানিস্টার গেইটসকে বলে, এই লোকটানড়লেই গুলি করবে।তারপর সে শ্যাননকে ইশারা করে।

শ্যানন মিস বোলাসের নগ্ন বাহু চেপে ধরে। মিস বোলাস গা মোচড়ায়। শ্যানন অতর্কিতে জোরে ঘুষি মারে।মিস বোলাস ছিটকে ড্রেসিং টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বোতল নিচে পড়ে ভেঙে চৌচির। কাঁচের টুকরো মিস বোলাসের চোখে বিধে যায়। রক্তাক্ত হয় মুখ। সে আধ। খোলা চোখে মেঝের ওপর পড়ে থাকে।

দ্রুত এসব ঘটে যায়। এই সুযোগে আমি দ্রুত এগিয়ে গেইটসের কজীর ওপর আঘাত করি। ব্যানিস্টারের পায়ের কাছে রিভলবার ছিটকে যায়।

গেইটস টলতে থাকে। ওর মুখে আবার ঘুষি মারি ও ছিটকে দূরে চলে যায়। শ্যানন এগিয়ে আমায় ঘুষি মারে। আমি টাল সামলাবার চেষ্টা করি।শ্যাননের আর একটা ডান হাতের ঘুষি আমার চোয়ালে পড়ে। আমার চোখের সামনে আলো নিভে যায়। আমি অতল খাদে তলিয়ে যাই।

***

একটা মিটমিটে আলো জ্বলছে। একটু দূরে প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে দুজন তাস খেলছে।

কি ঘটেছে ভাবতে থাকি। শোবার ঘরের দৃশ্য মনে পড়ল। মিস বোলাস কোথায় আছে কে জানে।

ঘরটা বেশ বড়। চারিদিকে প্যাকিং বাক্সের ছড়াছড়ি। মনে হয় ভূগর্ভের একটা ঘর। উল্টোদিকের দেয়ালে শ্যানন আর গেইট।

আমি লোহার খাটে শুয়ে আছি। এতক্ষণে শ্যাননের ঘুষির ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছি। যতক্ষণ না আমার মাথার যন্ত্রণা যাচ্ছে ততক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকি। গেইটসের রিভলবারের কথা মনে পড়ল।

আমার পক্ষে গেইটসের মোকাবিলা করা সম্ভব। কিন্তু শ্যাননকে শায়েস্তা করতে হলে খুব জোরে ঘুষি মারতে হবে। অতীতের অনেক ঘুষির কাটা দাগ ওর মুখে।

গেইটস বলে, লোকটার এতক্ষণে জ্ঞান ফিরে আশা উচিত। বস ওর সঙ্গে কথা বলবে।

শ্যানন বলে, যখন আমি কাউকে ঘুষি মারি–মনে রাখবে, তার গায়ে ফুল ছুঁড়ে মারি না। তোমায় অন্যমনস্ক দেখছি, নির্ঘাৎ তুমি হেরে যাবে।

ওরা আমার মাথার থেকে তিন’গজ দূরে বসে। আমার নড়াচড়ায় গেইট ফিরে তাকায়। তার হাতে রিভলবার উঠল।

কর্কশ কণ্ঠে গেইট্‌স বলে, দ্যাখ বাপু, কোনরকম চালাকী কর না। তোমার অবস্থা তাহলে খুব খারাপ হবে।

শ্যানন’ বসকে খবর দাও। এই লোকটাকে আমি দেখছি।

চোয়ালের আহত স্থানে হাত বুলিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, মিস বোলাসের কি হয়েছিল?

ওর জন্যে মাথা ঘামাতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দাও।

আমার ভাগ্যে যাই থাকুক। মিস বোলাসের কথা তো ভাবতেই হবে। ও কোথায়?

মিস বোলাসের ব্যবস্থা হচ্ছে। চুপচাপ না থাকলে রিভলবারের বাট তোমার মাথা চৌচির করবে।

ঘড়িতে এগারোটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। অর্থাৎ ক্লাবে এসেছি দেড় ঘণ্টার ওপর। জানি না এরপর ভাগ্যে কি জুটবে।

ব্যানিস্টার এলো, পেছনে শ্যানন। গেইটস রিভলবার তাক করে রাখে।

প্রথমেই ব্যানিস্টার বলে, মিঃ ম্যালয় আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। নিজের পরিচয় আগে দেননি কেন? আমি অত্যন্ত দুঃখিত।

নিজের পরিচয় দেবার সময় দিলেন কোথায়?

চারতলায় আসার কোন প্রয়োজন ছিল না। মিসেস কার্ফ আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। সুস্থ বোধ করলে আপনি এখনই চলে যেতে পারেন।

আপনার ওই বেজিমুখো লোকটাকে রিভলবার সরিয়ে নিতে বলুন।

 ব্যানিস্টারের ইশারায় সে রিভলবার খাপে ঢুকিয়ে রাখে।

আমি বলি, চমৎকার, মিসেস কার্ফ কোথায়?

 চলে গেছে। আমি তাকে তাড়িয়েছি।

কোথায় গেছে?

জানি না। ওকে জিনিসপত্র গুছিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলেছি। প্রায় দশমিনিট আগে ও চলে গেছে। নেকলেশের ব্যাপারে আমি আগ্রহী। আপনি নিশ্চয়ই কিছু জানেন।

সিগারেট ধরিয়ে আমি ব্যানিস্টারের মুখের ওপর ধোয়া ছেড়ে বলি, নেকলেশ আপনার কী দরকার?

নেকলেশের ব্যাপারে মিসেস কার্ফ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই থাকতে দিয়েছি।

তাই নাকি। মিসেস কার্ফ আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে?

হ্যাঁ। কয়েকদিন আগে এক রাত্রে সে আমার সঙ্গে দেখা করে বলে তার নাকি নিরাপত্তা চাই। এর জন্যে অর্থ খরচ করবে। একসপ্তাহের জন্যে ক্লাবের একটা ঘর চায়। পাঁচশো ডলার দেবে।

হেসে ব্যানিস্টার বলে, মিসেস কার্ফ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া, সে একজন লক্ষপতিকে বিয়ে করেছে। তাই তাকে একটা ঘর দিয়ে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি। পরিবর্তে মিসেস কার্ফ আমাকে নেকলেশ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কাল রাত্রে সে আমাকে জানায় যে তার নেকলেশ চুরি গেছে। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারি নি। ওকে আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল, অবশ্য কারণ আমাকে জানায় নি। ওকে রাত্রে থাকতে দিই। যখন আমরা দেনা-পাওনা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, আপনি বাধা দেন। নেকলেশটা আমার প্রাপ্য। কোথায় সেটা?

ঘটনাটা শুনলে আপনি আর নেকলেশ দাবী করবেননা। নেকলেশটা পাওয়া গেছে যে মেয়েটা গতকাল রাতে খুন হয়েছে তার ঘরে। মেয়েটার নাম ডানা লিউইস। পুলিশ জানে না, নেকলেশটা আমাদের হস্তগত।

ডানা লিউইস কে? মিসেস কার্ফের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক?

ডানা আমাদের প্রতিষ্ঠানের একজন।মিঃ কার্ফ তার স্ত্রীর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে ওকে নিযুক্ত করেন। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না। তবে খবরটা নিজের কাছেই রাখবেন।

মিসেস কার্ফ কি ডানা মেয়েটাকে খুন করেছে?

জানি না। মনে হয় না।

 নিজের মনে বলে, নেকলেশের কথা আমার ভুলে যাওয়াই উচিত।

আমি বলি, কি জন্যে মিসেস কার্ফ অমন আতঙ্কিত ছিল?

জানি না। তবে আমার ক্লাবে থাকাকালীন সবসময়েই সে আতঙ্কিত ছিল। বারান্দায় কোন শব্দ শুনলেই চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠত। তাকে যখন আমি ক্লাব ছেড়ে যেতে বলি–তার মুখে মৃত্যুর ছায়া দেখেছি।

মিসেস কার্ফ আপনার কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিল, তাই না?

তাকে নাকি একটা লোক ভয় দেখাচ্ছে। সাংঘাতিক লোকটা তার খোঁজে ক্লাবে এলে যেন আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিই। ওই কারণে আপনার ওপর বলপ্রয়োগ করা হয়েছে।

ব্যানিস্টার আবার বলে, তারপর আপনার পরিচয় পেয়ে বুঝলাম মিসেস কার্ফ মিথ্যা কথা বলেছে। আর কিছু বলার নেই। এখন আপনি যেতে পারেন। আর কোনদিন এখানে আসবেন না। আমি ফালতু ঝামেলা পছন্দ করি না।

আমি উঠে বলি, মিস বোলাস কোথায়?

আপনার গাড়িতে বসে আছে।

জানেন, মিস বোলাস তার ওপর অত্যাচারের জন্যে আপনাদের বিরুদ্ধে কেস করতে পারে?

মিস বোলাস তা করবে না জানি। ও আমাদের অনেকদিন যাবৎ প্রতারনা করেছে। ওর শাস্তি প্রাপ্য ছিল।

তাহলে আমার কিছু বলার নেই। কোনদিক দিয়ে বেরোবার পথ?

মিঃ ম্যালয়কে পথ দেখাও। আর মনে রাখবে মিস বোলাস আর এই ভদ্রলোক যেন আমার ক্লাবে কখনও পা না রাখে।

দরজা খুলে দেখি নিভু নিভু আলোয় একটা রাস্তা। শ্যানন আমার পেছনে।

শ্যানন বলে, এগিয়ে যাও। সোজা গেলেই দেখবে গাড়ি রাখার জায়গা। ভাগ এখান থেকে। এখানে যদি আবার দেখি তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।

ঘুরে দাঁড়িয়ে শ্যাননের মুখে আঘাত করি। ঘুষিটা ছিল উঁচু দরের। ও পড়ে যাবার আগেই আমার সর্বশক্তি দিয়ে চোয়ালে একই জায়গায় আর একটা ভারী ঘুষি দিই। শ্যানন মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারপর ওর দু হাত পেছনে এনে, জোরে মোচড়াই। শ্যাননের নাক এবং মুখের ওপর জুতোর হিল দিয়ে প্রচণ্ড চাপ দিই।

কোন মহিলাকে কেউ শারীরিক নির্যাতন করলে আমি তাকে ক্ষমা করি না।

***

গাড়ি সান্টা বোসা স্টেটের গেটের সামনে থামিয়ে হর্ন বাজাই। ভাবছিলাম রাত একটায় গেটে কোন গার্ড থাকবে কিনা, কিন্তু একজন ছিল। অবশ্যই মিলস্ ছোকরা নয়, একটি লম্বা লোক গেট খুলে কাছে এলো।

লোকটা জোরালো ফ্ল্যাশ লাইট আমার ওপর ফেলতেই বলি, মিঃ কাষ্ণ কী এখনও ফিরে আসেন নি?

হ্যাঁ ফিরেছেন..এত রাতে? উনি কারো সঙ্গে দেখা করবেন কিনা..আপনার নাম?

নিজের পরিচয় দিলাম।

অপেক্ষা করুন, দেখছি উনি দেখা করবেন কিনা।

গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হই। দরজায় দাঁড়িয়ে খানসামা। সে নিঃশব্দে আমার টুপী হাতে নেয়। এ সময়ে আমার আগমনে সে হয়তো খুশি হয়নি।

খানসামা দরজা সামান্য খুলে নীচু গলায় বলে, স্যার, মিঃ ম্যালয় এসেছেন।

আমি ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

মিঃ কার্ফ বড় একটা আরাম কেদারায় বসে। দু আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটুর উপর খোলা বই।

মিঃ কার্ফ কর্কশ কণ্ঠে, কি চান আপনি?

রুক্ষ্ম গলায় আমিও বলি, মিসেস কার্ফের সঙ্গে কথা বলতে চাই। খুব তাড়াতাড়ি।

আবার আমরা ওই প্রসঙ্গে যেতে চাই না। আপনার সেক্রেটারীকে ইতিপূর্বেই জানিয়েছি যে মিসেস কার্ফের খোঁজ করলে কি ঘটতে পারে। ওই জন্যে এলে–এই মুহূর্তে আপনি চলে যেতে পারেন।

আপনি সকালের কথা ভুলে যান। তারপর অনেক ব্যাপার ঘটে গেছে। এমন কিছু সূত্র পেয়েছি যা আপনার স্ত্রীকে খুনের সঙ্গে জড়ানো। ব্যাপারটা পুলিশের কাছেও গোপন থাকবে না।

আপনার হাতে কি কোন সূত্র এসেছে?

সে এক দীর্ঘ কাহিনী। মিসেস কার্ফ কোথায়?

শহরের বাইরে, এসবের বাইরে আমার স্ত্রীকে রাখতে চাই। ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে না।

মিসেস কার্ফের সঙ্গে ইতিমধ্যেই আমার কথা হয়েছে।

শোনামাত্র মিঃ কার্ফের মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠে।

মিসেস কার্ফের সঙ্গে আপনার..কী বলছেন?

হ্যাঁ, তাই। মিস কেনসিংগারকে আজ সকালে বলেছেন যে, আপনার স্ত্রীকে শহরের বাইরে পাঠাচ্ছেন। আসলে কাল রাত্রে আপনার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। আপনি জানেন না, আপনার স্ত্রী কোথায় রাত কাটিয়েছে। আপনি হয়ত মনে করছেন–ডানা লিউইসকে মিসেস কার্ফ খুন করেছে। তাই তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। মিঃ কার্ফ, আপনার এই প্রচেষ্টা সফল হবেনা কারণ গতরাত দশটার পর মিসেসকা আমার সঙ্গে দেখা করেছে। জানতে চেয়েছেন কেন তাকে নজর বন্দী করে রাখা হয়েছে। মিসেস কার্ফ আমায় ঘুষ দিতে চেয়েছিল। আপনার কথা তাকে জানাই। আমার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে মিসেস কার্ফ ডানা লিউইসের কাছে যায়। কুড়ি মিনিট পরে মিসেস কার্ফ ডানার ফ্ল্যাট ছেড়ে যায়। ইস্টবীচের দিকে যাওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সিতে চাপে। প্রায় এক ঘন্টা পরে ডানা একটা টেলিফোন পেয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়ে। পরে তাকে লীডবেটার বালিয়াড়ির কাছে দেখতে পায়। পুলিশ ঝোঁপের আড়ালে ডানার ডেডবডি আবিষ্কার করে। পরে আমাদের প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী ডানা লিউইসের ফ্ল্যাটে মিসেস কার্ফের নেকলেশ খুঁজে পায়।

আমার কথা মিঃ কার্ফ অনড় অবস্থায় শুনছিলেন। নেকলেশের কথা শুনে তিনি চমকে উঠলেন।

 মিঃ কার্ফ দাঁতে দাঁত ঘষে বলেন, সব মিথ্যা।

নেকলেশ আমার কাছে রয়েছে মিঃ কার্ফ। অবস্থা ঘোরালে কেন না ডানার ফ্ল্যাট থেকে নেকলেশটা আনা আমাদের পক্ষে বেআইনী। পুলিশ থেকে বাঁচানোর জন্যে এই ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আপনাকে আমি আমার মকেল হিসেবে গ্রহণ করেছি। সুতরাং আপনাকে বাঁচানো এবং গোপনীয়তা রক্ষাযতদূর সম্ভবকরবো। সব নির্ভর করছেমিসেস কার্ফের ওপর। আরও একটি খুনের ফলে ব্যাপারটি বেশী ঘোরালো হয়েছে। লীডবেটার আজ দুপুরে খুন হয়েছে। হয় ও ডানা লিউইসকে খুন হতে দেখেছে, নয় খুনীকে।

আপনার ওপর কাজের ভার দিয়ে বোকামীকরেছি। আমি ঐ ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে চাই না। আপনার বিরুদ্ধে আমি কেস করবো। যেহেতু একটি অভিশপ্ত মেয়ে খুন হয়েছে…।

আপনার স্ত্রীর ওপর নজর রাখতে গিয়ে ডানা লিউইস খুন হয়েছে। সেটা আপনি ভালভাবেই জানেন। এ ব্যাপারে আপনারও অনেক দায়িত্ব।

আমার কোন দায়িত্ব নেই। দেখুন ম্যালয়,…এসব ব্যাপার থেকে আমাকে দূরে রাখুন। মেয়ের কথা আমাকে ভাবতে হবে।

এখন আমাদের মিসেস কার্ফের কথা আগে ভাবা দরকার। কোথায় সে?

আপনি তো মিসেস কার্ফের সঙ্গে কথা বলেছেন, আবার আমার কাছেজানতে চাইছেন কেন?

আমাদের আলোচনায় বাধা পড়েছিল। লা এটোলিতে সে লুকিয়েছিল। এখানে ফিরেছে কী?

মিঃ কার্ফ মাথা নাড়েন।

মিসেস কার্ফ কী আপনাকে কোন খবর দেয় নি?

না।

অনুমান করতে পারেন, মিসেস কার্ফ কোথায় যেতে পারেন?

না।

মিঃ কার্ফ শান্তভাবে বলেন, আমার স্ত্রী লা এটোলিতে সমস্ত রাত ছিল।

হ্যাঁ। ব্যানিস্টারকে মিসেস কার্ফ বলেছে–কোন একজন লোক তাকে বিরক্ত করছে। লোকটাকে শায়েস্তা করার কথা সে জানায়। পরিবর্তে ব্যানিস্টরকে নেকলেশ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় মিসেস কার্ফ। নেকলেশ না পাওয়ায় ব্যানিস্টার তাকে তাড়িয়ে দেয়।

মিঃ কার্ফ বিড়বিড় করে বলেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার! যে লোকটা তাকে বিরক্ত করছে–সে কে?

জানি না। খুঁজে বের করতে হবে। হয়ত সেই লোক মিসেস কার্ফকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করছে।

মেয়েটাকে আমার স্ত্রী গুলি করে নিতাই কি আপনার ধারনা?

জানি না। তবে ডানা এবং লীডবেটার পয়েন্ট পঁয়তাল্লিশ বন্দুকের দ্বারা খুন হয়েছে। কুড়ি গজ দূর থেকে লীডবেটারকে গুলি করা হয়েছে এবং কোন স্ত্রীলোকের পক্ষে তা সম্ভবনয়। আপনার স্ত্রীর যা আচরণ–তাকে এক নম্বর সন্দেহভাজন ব্যাক্তির তালিকায় রাখা চলে।

ওকে বিয়ে করা আমার বোকামী হয়েছে। যদি আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়করবো। কিন্তু ব্যাপারটা যেন পুলিশ বা সংবাদপত্র থেকে দূরে থাকে।

চিন্তা করবেন না। সবচেয়ে আগে মিসেস কার্ফকে খুঁজে বের করতে হবে। যদি আপনি ওকে অর্থ দেওয়া বন্ধ করেন, আপনার স্ত্রী…’।

তাই করতে হবে। কাল আমি ব্যাঙ্কে যাব।

অনেক দেরী হয়ে গেল। হ্যাঁ, চেকটা দেকেন কী?

সামান্য দ্বিধান্বিত ভাবে চেক লেখেন। এই নিন। আমাকে এই ঝামেলার হাত থেকে রক্ষা করুন–আবার আপনাকে দক্ষিণা দেব।

চেক পকেটে রেখে বলি, আপনাকেঝামেলামুক্ত করতে না পারলে চেক ফেরত দেব। আচ্ছা, কতদিন মিলকে কাজে লাগিয়েছেন?

মিলস্? কেন…সে কী এই ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত?

জানি না। শুনেছি মিলস্ খুব কাপ্তেনী চালে থাকে। তবে কি মিসেস কার্ফকে ভয় দেখিয়ে মিলস্ অর্থ আদায় করছে?

ওর সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। মাস খানেক হলো মিল এখানে কাজে লেগেছে। আমার বাটলার ফ্রাঙ্কলিনই কর্মী বাছাই করে। ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে কথা বলব কি?

এখন নয়, ওর ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দিন। আর আপনি যদি আপনার স্ত্রীর কোন খবর পান, আমার অফিসে জানাবেন।

আমি দরজার দিকে এগিয়ে যাই। মিঃ কার্ফ বলেন, আমার ব্যবহারের জন্যে আমি দুঃখিত। আমাকে ঝামেলামুক্ত করার জন্য যা করেছেন, তার জন্যে আমি খুশী।

খানসামা ফ্রাঙ্কলিন করিডরের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, মিস কার্য আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। এই দিকে একটু আসুন।

একটু আশ্চর্য হই। যাই হোক, খানসামার পেছনে হাঁটি।

খানসামা দরজায় আঘাত করে বলে, ম্যাডাম, মিঃ ম্যালয় এসেছেন।

 ঘরে বেড সাইড ল্যাম্পের আলো।মিসকার্ফ বিছানায় শুয়ে। সে খুঁটিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে।

ওকে খুঁজে পেয়েছেন?

এখনও পাইনি।

লা এটোলির নাইট ক্লাবে খুঁজেছেন?

ওখানে কি খুঁজে পাওয়া যাবে?

হয় ওখানে অথবা জর্জ বার্কলের বাড়িতে। এছাড়া অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই।

এত নিশ্চিন্ত হচ্ছেন কিভাবে?

ওকে আমি জানি। ও বিপদে পড়েছে তাই না? চোখে খুশির আভাস।

 মিসেস কার্ফ বিপদে পড়েছেন, এমন ধারণা হল কেন?

সে আপনার প্রতিষ্ঠানের মেয়েটাকে খুন করেছে। সম্ভবতঃ এই ব্যাপারটাকে নিছক বিপদ বলে আপনি মনে করবেন না।

আমরা জানি না, মিসেস কাই খুন করেছে কি না। আপনি কী জানেন?

মিসেস কার্ফ বন্দুক চালানোর অভ্যাস করছিল।

 কি ধরনের বন্দুক?

রিভলবার। যে কোন ধরণের বন্দুক হোক না ওই নিয়ে ভাবছেন কেন? গত এক সপ্তাহ ধরে মিসেস কার্ফ ইস্ট বীচে টার্গেট প্র্যাকটিস্ করেছে।

আপনি কিভাবে জানলেন?

ওর ওপর নজর রেখেছি।

অবাক হয়ে ভাবি, মিলস্ মিসেস কার্ফের ওপর নজর রেখেছে কিনা। বলি, যেহেতু একজন স্ত্রীলোক শুটিং প্র্যাকটিস করছে–এর অর্থ এই নয় যে সে খুনী।

তবে মিসেস কার্ফ লুকিয়ে রয়েছে কেন? সে এখানে ফিরে আসছে না কেন?

হয়ত কোন কারণ আছে। আপনি বার্কলে সম্পর্কে কী জানেন?

 বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে, বার্কলে হল মিসেস কার্ফের প্রেমিক। মিসেস কার্ফ প্রায়ই ওর প্রেমিকের কাছে যেত।

মিসেস কার্ফকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হচ্ছে–আপনি কি জানেন?

 বিশ্বাস করি না।

আপনার বাবার তাই বিশ্বাস।

বাবা একটা ছুতো খুঁজছেন। আসলে ও প্রেমিকদের পেছনে অর্থ খরচ করছে।

 তাই নাকি? আবার তাহলে আমি বার্কলের সঙ্গে কথা বলবো।

আপনি বার্কলের সঙ্গে দেখা করেছেন?

হ্যাঁ। আপনার বাবা কী বার্কলের ব্যাপারটা জানেন না।

 মাথা নাড়ে মিস কার্ফ।

মিসেস কার্ফের আলমারিতে অদ্ভুত সব জিনিস পাওয়া গেছে। ওইসব আপনার বাবার বন্ধুদের বাড়ি থেকে এসেছে। আপনার বাবার কাছে কী এসব শুনেছেন?

বারবার বলার দরকার নেই। মিসেস কার্ফ আমার অনেক জিনিস চুরি করেছে। ও একটা চোর।

আপনি তাকে ঘৃণা করেন, তাই না?

ওকে আমি পছন্দ করি না।

স্যুটকেশ ভর্তি অদ্ভুত জিনিসগুলি কেউ মিসেস কার্ফের আলমারিতে গোপনে রাখতে পারে। আগেও এমন ব্যাপার হয়েছে।

নির্বোধেরা এমন বিশ্বাস করবে। মিসেস কার্ফ একটা চোর। এমনকি ফ্রাঙ্কলিনের ঘর থেকেও অনেক জিনিস হারিয়েছে।

মিলস্ কিছু হারিয়েছে কি?

হয়ত হবে।

কিন্তু তেমন কিছু হলে মিলস্ অন্ততঃ আপনাকে বলতো–তাই না?

সে ফ্রাঙ্কলিনকে জানাত।

 মিলস্ মিসেস কার্ফের গাড়ি চালিয়েছে, তাই না?

তাতে কি হয়েছে?

বুঝতেই পারছেন…মিসেস কার্ফের যেমন চেহারা…আর মিলসেরও অনেক ফালতু অর্থ আছে…তাই ওরা দুজনে একত্রিত হয়েছে কিনা।

দুজনে একত্রে…কী জন্যে?

মিস কার্য, আপনি অনেক কিছু জানেন। আমাকে সব খুলে বললে ভাল করতেন।

 ভ্রু কুঁচকে মিস কার্ফ বলে, আপনার কথাবার্তা আমার ভাল লাগছে না।

অনেকেই পছন্দ করে না। কিন্তু তাদের অভিযোগ শুনতে আমার ভাল লাগে।

মনে হল জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কে যেন আমাদের কথা শুনছে।

মিসেস কার্ফকে খুঁজে পেলে কী তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন?

আপনি কি তাই চান?

সেটা কোন ব্যাপার নয়। আপনি.কী করবেন?

যদি সত্যি মিসেস কার্ফই ডানা লিউইসকে হত্যা করে থাকে তাহলে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। কিন্তু আমাকে নিশ্চিত হতে হবে।

এখনও আপনি নিশ্চিত নন?

এখনও মোটিভ খুঁজে পাইনি। মিসেস কা ডানাকে কেন গুলি করবে। আপনিই কিছু বলুন না, যাতে আমি বিশ্বাস করি।

আমার বাবা স্থির করেছেন যে যদি আগামী দু বছর মিসেস কার্ফ তার সঙ্গে থাকে–মিসেস কার্ফ প্রচুর অর্থ পাবে। মোটিভের পক্ষে এই তথ্য কী যথেষ্ট নয়?

বলতে চান বার্কলের ব্যাপারটা ফাঁস হলে ডিভোর্সকে রোধ করতে পারবে না মিসেস কার্ফ-ফলে প্রচুর অর্থ হারাবে। আর তাই ডানাকে হত্যা।

হ্যাঁ, তাই। ব্যাপারটা জলের মত সহজ।

কিন্তু বার্কলেরও তো অনেক অর্থ আছে।

কোথায় অনেক? বার্কলের ওপর মিসেস কার্ফ কখনও নির্ভরশীল হবে না।

এখনও ব্যাপারটা পরিস্কার নয়।

জানালার বাইরে কারো নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনি। আমার সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। আমি বুলি, অর্থের ব্যাপারটা প্রধান হলে মিসেসকার্য এখানে ফিরে আসতো।কখনও ব্যানিস্টারের কাছে গিয়ে আত্মগোপন করত না।

নিশ্চয়ই তাকে কেউ দেখে ফেলেছে।

মিস কার্ফ, আপনাকে নিশ্চয়ই কেউ সমস্ত ব্যাপারে সজাগ রাখে।

হ্যাঁ, যেহেতু কোথাও যেতে পারি না, আমাকে সজাগ থাকতে হয়। আমার কথাগুলো চিন্তা করবেন। এখন আমি ঘুমবো। আপনার বান্ধবীকে কে খুন করেছে জানালাম। আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। আপনি এখন যেতে পারেন।

মিসেস কার্ফ সম্পর্কে যদি আপনার অন্য কোন ধারণা থাকে জানাতে ভুলবেন না।

আমি আর কথা বলতে চাই না।

দরজা খুলে জানালার দিকে তাকাই। কি যেন জ্বলজ্বল করছে দেখতে পাই। হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা গামবুটের ঢাকনা। এই গামবুট মিলসূকে পরতে দেখেছি। জানালার বাইরে মিলস্ দাঁড়িয়ে ছিল…সম্ভবত মিস কার্ফ জানতো।

***

ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে কেবিনের দিকে যাই। আকাশে আঙুর ফলের মত চাঁদ জ্বলছে।

আমার মাথায় অনেক চিন্তা। এখন দরকার বরফ মেশানো হুইস্কি। তারপর চিন্তা করা যাবে।

পাহাড়ের ওপারে প্রভাতের ইশারা। আর নিজেকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে না। কেবিনের কাছাকাছি এসে দেখি বারান্দায় আলো। মনে পড়ল, মিস বোলাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসার সময় দরজা বন্ধ এবং আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম। এখন বারান্দার দরজা খোলা এবং আলো জ্বলছে।

গাড়ি থামাবার সময় মনে হল, জ্যাক কারমান অথবা পাওলা হয়ত আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে।

বারান্দায় পা দিয়ে থমকে দাঁড়াই। দরজা দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসে, বারুদের গন্ধ।

ঘরের মধ্যে আরও তীব্র বারুদের গন্ধ। জানালার সামনে একটা অটোমেটিক রিভলবার পড়ে আছে। কাছেই সোফার ওপর সাদা ব্রাউজ আর ব্ল্যাক পরিহিতা একজন স্বর্ণকেশী স্ত্রীলোক পড়ে আছে। তার কপালে গর্ত।

কাছে এগিয়ে দেখি স্ত্রীলোকটি মৃত। রক্তমাখা মুখ অনিতা কার্ফের।

অনিতা কার্ফের মৃত দেহের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকি। উল্টো দিকের দেয়ালে একজন মানুষের ছায়া পড়ে। মাথায় টুপী। হাতের মুঠোয় ভোতা ধরনের কি যেন। দ্রুত সব কিছু ঘটে যায়। মাথায় তীব্র আঘাত করে। মনে হয় আমি যেন শূন্যে উড়ে বেড়াচ্ছি। কার্পেটের ওপর ছিটকে পড়ি।

জ্ঞান ফিরে মদের তীব্র গন্ধ পেলাম। আমার সমস্ত শরীরে ঝাঝালো মদের গন্ধ। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। যে বিছানায় শুয়ে আছি মনে হল খুব নরম এবং গরম। মনে পড়ল একজন স্ত্রীলোকের চেহারা–তার কপালে গর্ত।

কার্পেটে এক জায়গায় সিগারেটের পোড়া দাগ। হ্যাঁ, নিজের কেবিনে বিছানায় শুয়ে আছি। আর সব দুঃস্বপ্ন।

ব্রান্ডননের কণ্ঠস্বর কানে এলো। উঃ, কী তীব্র মদের গন্ধ। স্ত্রীলোকটি কে? আগে কখনও দেখেছ?

মিফিন বলে, নতুন মনে হচ্ছে।

পিটপিট করে তাকাই। মিনি বিছানার কাছের জানালা খুলে দেয় টের পাই আমার মাথার খুলিতে অসম্ভব যন্ত্রণা।

মনে পড়ল সোফায় চিৎ হয়ে শুয়ে অনিতা কার্ফ। কপালে গর্ত। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে হলদে কুশনের ওপর। অটোমেটিক রিভলবার। চমৎকার দৃশ্য। ব্রান্ডন এই রকমই চেয়েছিল। যাকে বলে হাতে নাতে ধরা। মনে পড়ল ডানার হত্যার প্রসঙ্গে ওর অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্নের কথা।

একই বন্দুক ব্যবহার হয়েছে ডানা, লীডবেটার এবং অনিতা কার্ফকে খুন করার জন্যে। একই। প্রয়োগ ভঙ্গি। খুনী একজন। আর মোটিভ? ওর জন্যে ব্রান্ডন মোটেও মাথা ঘামায় না।

মিফিন কর্কশ কণ্ঠে বলে, ওহে ম্যালয়,…অনেক হয়েছে। এবার চোখ খোল।

মিফিন আমার বাহু ধরে নাড়ায়। মিফিনের হাত সরিয়ে বিছানায় উঠে বসি।দু হাত দিয়ে মাথা ধরে গোঙাই!

চুপ কর। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। নিজেকে চাঙ্গা কর।

তোমার কী মনে হয় আমি নাচছি?

ব্রান্ডন জেরার ভঙ্গিতে বলেন, ব্যাপারটা কী? আপনার এরকম মাতাল…।

আমি প্রশ্ন করি, আপনি কী চান? কে আপনাদের আমার কেবিনে ঢুকতে দিল?

আমার মুখের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ব্রান্ডন বলেন, কে ঢুকতে দিয়েছে অযথা চিন্তা করবেন না। এখানে কী ঘটেছে? এখানে ওই স্ত্রীলোকটি কে?

ওখানে বুঝি একজন স্ত্রীলোক রয়েছে?

মিফিনের দিকে তাকিয়ে ব্রান্ডন হুমকীর ভঙ্গীতে বলেন, এই ভদ্রলোক এমন ব্যবহার করছেন কেন?

ম্যালয় মাতাল, অন্য কিছু না।

যত সব! ওই স্ত্রীলোকটিকে নিয়ে এসো।

 আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। না, না, না, ওকে আমি দেখতে চাই না।

তখন একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ওকে নিয়ে আপনারা কী শুরু করেছেন? ওর কি অবস্থা–আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না?

মিস বোলাসের রিবনে আটকানো লাল চুল। পরনে লিনেনের ফ্রক। সেবলে, বলেছিলাম না, ওকে বিরক্ত করবেন না। ওকে একা শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না কেন?

মিস বোলাস আমার দিকে তাকিয়ে বলে, প্রিয়তম,এক পাত্তর মদ দেবনাকি? তোমার মাথায় এখনও খুব যন্ত্রনা হচ্ছে?

ব্রান্ডন বলেন, উঁহু উনি আর পানীয়ও চাননা আর আপনার মুখদর্শনকরতেও চাননা। ব্যাপারটা কী…এখানে কোন নাটক চলছে নাকি?

মনে হল আমি পাগল হয়ে গেছি। মিস বোলাসের পেছনে অন্য একটি ঘরে সোফা। নিশ্চয়ই মিস বোলাস সব কিছু লক্ষ্য করেছে। ব্রাক্তন ও মিফিন নিশ্চয়ই সব লক্ষ্য করেছে। অথচ ওদের হাবভাবে কোন উত্তেজনার চিহ্ন নেই। বলছে কিনা আমি মাতাল।

আমি এক পা এক পা করে এগিয়ে যাই। ব্রান্ডননের কথায় আমি থামি না। পাশের ঘরে কি আছে, আমাকে দেখতে হবে।

আমার বাহুর ওপর হাত রাখে মিস বোলাস। আমি কোন কিছু পরোয়া করিনা। ওকে একপাশে সরিয়ে আমি পাশের ঘরে যাই। সেইরকম ভাবে সোফা রয়েছে কিন্তু কিছু নেই। অটোমেটিক রিভলবার নেই। রক্তে ভেজা হলদে কুশন নেই, কিছু নেই।

***

আমি কিভাবে বিছানায় ফিরে এলাম মনে নেই।মিস বোলাস আমার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। ওর হাতে হুইস্কির গ্লাস। আমি উঠতে যাই, মিস বোলাস আমার ঠোঁটের কাছে গ্লাস ধরে।

হুইস্কি পান করি। মিস বোলাস সরে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ আমার সমস্ত শরীর কাঁপে। তারপর হঠাৎ টের পাই নিজেকে ভীষণ হাল্কা লাগছে।

মিস বোলাস হেসে আমার হাত থেকে গ্লাস নেয়। বলে, উঃ, তোমার যা অবস্থা দেখলাম…ভাবা যায় না। কোন তুলনা নেই।

আমি বিছানায় উঠে বসে বলি, এর থেকে তোমার শিক্ষা পাওয়া উচিত। এখন থেকে…।

ব্রান্ডননের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলি, এ কি!মিস বোলাস, আমার ঘরে পুলিশের লোক, দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি, ক্যাপ্টেন অফ পুলিশ মিঃ ব্রান্ডন আর মিঃ মিফিন বসে আছেন।

 ব্রান্ডন বলেন, ম্যালয়, এসব তামাশা বন্ধ করুন। আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে।

মিস বোলাসকে বলি, আরও পানীয় দাও। ব্রান্ডননের দিকে তাকিয়ে বলি, আপনি এখানে এসেছেন লেসকে বলি, আরওঅমাশা বন্ধ করুন

ব্রান্ডনও লাল চোখে বলেন, বাজে বকবক বন্ধ করুন। এখানে এসবকীহচ্ছে? আর এই মেয়েটি কে? এখানে ও কী করছে?

মিস বোলাস হুইস্কি নিয়ে এলো। ওকে বলি, কড়া কফি এনে দাও।

ব্রান্ডন হুমকির সুরে বলে, আমার কথা কী আপনার কানে গেছে?

মিস বোলাসকে হাতের ইশারায় সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলি, শুনেছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, যে আমার উত্তর আপনি পাবেন। আপনার কোন অধিকার নেই, জানতে চাওয়া মিস বোলাস কে? পোশাক খুলতে খুলতে বলি, এখন আমি স্নান করবো। যদি দরকার মনে করেন, অপেক্ষা করতে পারেন।

 ভাবলাম বাথরুমে মৃতদেহটা দেখতে পাবো। কিন্তু কেউ নেই। দু মিনিট ঠাণ্ডা জলধারা আমার মাথার যন্ত্রণা দূর করে দেয়। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ছে। আমি নয় ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম। মাথার পেছনে হাত দিয়ে বুঝি জায়গাটা নরম হয়ে গেছে।

মৃতদেহটা কে সরাল? কেন সরাল? খুনী কী পাগল? যদি সে মৃতদেহ আর বলুক না সরাত–ব্রন্ডনের হাত থেকে রেহাই পেতাম না। কে আমার মাথায় আঘাত করেছিল? খুনী?

দরজায় করাঘাতের সঙ্গে ব্রাউনের চিৎকার। বেরিয়ে আসুন ম্যালয়।

আমি বেরিয়ে আসতেই ব্ৰাভন রেগে বললেন, অনেক হয়েছে। হয় আপনি কথা বলুন অথবা পুলিশ হেড কোয়ার্টারে চলুন।

টেবিলের ওপর থেকে কফি নিতে নিতে বলি, যা বলার এখানেই বলবো। বলুন কি জানতে চান?

মিস বোলাস রান্নাঘরে গুনগুন করছে। উঁহু, অনিতা কার্ফের মৃতদেহ ও সরায়নি। তাহলে কে?

ব্রান্ডন বলে, বেনি কোথায়?

 উনি যে বেনিকে চেনেন, তা জানতাম না। বেশ সুন্দর গন্ধ কফিটার।

 আপনি এড বেনির কথা বলছেন?

হ্যাঁ। সে কোথায়?

সে স্যানফ্রান্সিসকোতে গেছে।

ওখানে কি কাজে গেছে?

আপনি জানতে চান কেন?

স্যানফ্রান্সিসকো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ওর সম্পর্কে জানতে চাইছে।

তাই না কি? বেশ তো, যা জানতে চায় বেনিকে প্রশ্ন করলেই পাবে। ব্যাপারটা কী?

 ব্রান্ডন কর্কশ গলায় বলেন, বেনিকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। ও বেঁচে নেই।

আমি পাগলের মত করে বলি, বেনি মারা গেছে?

 হ্যাঁ। বন্দর পুলিশ ওর মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে। ওদের ধারণা গতকাল রাতনটায় ওর মৃত্যু হয়েছে।

***

ওদের যাওয়ার দিকে জানালা দিয়ে দেখি। ব্রান্ডন ঘোঁৎ ঘোঁৎকরতে করতে গাড়িতে বসলেন। অন্য একটা গাড়িতে মিফিন, ওকে চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল।

একে একে ডানা, লীডবেটার, অনিতা কার্ক আর বেনি খুন হল। মিস বোলাস দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। আমি বলি, তুমি এখানে কখন এসেছিলে?

আজ সকাল নটায় আমি টেলিফোন করেছিলাম। অপারেটার জানায় রিং হয়ে যাচ্ছে কেউ রিসিভার তুলছে না।

জানালার কাছে আমার পাশে এসে মিস বোলাস বলে, কিছু করার ছিল না। তাই তোমার কেবিনে চলে আসি। এসে দেখি তুমি মেঝের ওপর পড়ে আছ। দরজা খোলা, আলো জ্বলছে। তোমায় বিছানায় শুইয়ে যখন জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছি তখন ওদের গাড়ির আওয়াজ পাই। তোমার সমস্ত শরীরে হুইস্কি ছড়িয়ে দিয়েছি। ওদের বলেছি যে, তুমি অতিরিক্ত পান করে মাতাল হয়েছে। আমি চাইনি ওরা জানতে পারুক যে কেউ অতর্কিতে আক্রমণ করে তোমায় এ অবস্থা করে পালিয়েছে। তুমিও নিশ্চয়ই তা চাওনি?—

উঁহু’ পকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে মিস বোলাসকে দিয়ে ধরাই।বলি, সমস্ত শরীরে হুইস্কি ছড়ানো–বেশ ভাল আইডিয়া, কেবিনে ঢোকার পর কাউকে দেখতে পাওনি?

কেউ ছিল না। কী হয়েছে?

আমার অপেক্ষায় আড়ালে কেউ ছিল। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আমার ঘাড়ের ওপর আঘাত করে।

তোমাকে দেখাশুনা করার কেউ নেই?

আজ রবিবার, টনি রবিবার কাজে আসে না।

রবিবার আমার অপেক্ষায় কেউ থাকেনা। রবিবার আমাকে দেখাশুনা করতে আসে সোনালী চুলের সুন্দর একটি মেয়ে।

শোবার ঘরে ঢুকে চারিদিকে তাকাই। বারুদের গন্ধ নেই।

মিস বোলাস বলে, কি ভাবছো তুমি?

কোন জবাব না পেয়ে আবার বলে, ম্যালয়, তোমার শরীর ভাল নেই। তুমি বিছানায় শুয়ে পড়।

ব্রান্ডন কি বললো, শুনলে না? আমাকে স্যানফ্রান্সিসকোতে গিয়ে বেনির মৃতদেহ সনাক্ত করতে হবে।”

উঁহু, কোথাও যাওয়ার মত তোমার অবস্থা নেই।হয় আমিঅথবা অফিরে অন্য কেউ যাবে।

চারটে এ্যাসপিরিন একসঙ্গে গিলে এক চুমুক কফি পান করি, আমাকে যেতেই হবে। বেনি আমার বন্ধু ছিল।

মিস বোলাস বলে, ডাক্তারকে ডেকে তোমার মাথার আহত স্থান পরীক্ষা করানো দরকার।

 নানা চিন্তায় আমার মন ভারী হয়ে ওঠে।

অস্বস্তির সঙ্গে মিস বোলাস বলে, যদি জানতে পারতাম তুমি কি ভাবছে। বেনি ছাড়া অন্য কোন ব্যাপার তোমাকে অস্থির করে তুলেছে।

উঁহু কেবল বেনির কথা ভাবছি। তুমি আর দেরীকরছে কেন? নিশ্চয়ই তোমার অনেক কাজ রয়েছে।

বাঃ বেশ কথা বলছে। তোমার জন্যে এতক্ষণ যা করলাম…এখনই চলে যেতে বলছো? জানি না, কি জন্যে তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছে না।

থাক, আর অভিমান করতে হবে না। দু’একদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। কিছু মনে কর না।

আমি শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করি।

***

তিনটে কুড়ি মিনিটে স্যানফ্রান্সিসকোর পরতোলা এয়ারপোর্টে বিমান থামে। বিমানে আমাদের সঙ্গে এসেছে সিনেমার নায়ক নায়িকার দল। ওদের দেখবার জন্যে গেটে ভিড় হয়।

কারমান বলে, ডিক, ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। একজন লোককে ভালভাবে জানার আগেই সে মরে যায়। বেনি কখন্ও বলেনি যে তার বড় ছেলে মেয়ে আছে আর ওর মা-ও বেঁচে আছে।

আঃ, এখন বেনির বউ ছেলেমেয়ের কথা বলে লাভ কী?

কারমান রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলে, হু’, তুমি ঠিকই বলেছে। আবহাওয়া আর একটু ঠাণ্ডা হলে ভাল লাগবে। জান, কাল রাতে…।

আবহাওয়ার কথা এখন থাক।

 ঠিক আছে।

সকালের কথা মনে পড়ল। পাওলা এসেছিল। বেনির ব্যাপারে ইতিপূর্বেই ব্রান্ডন পাওলার সঙ্গে দেখা করেছেন। অবশ্য ব্রান্ডন আমাদের কথা বিশ্বাস করেন নি। কারণ, বেনি খুন হয়েছে অন্যত্র।

ডানা, লীডবেটার আর অনিতা কার্ফের খুনের সঙ্গে বেনির হত্যার কোন সম্পর্ক নেই–এ ধারণা কারমানের। আমার ধারণা অন্যরকম। বেনি গতকাল বিকেল সাড়ে চারটেয় স্যান ফ্রান্সিসকোতে পৌঁছেছিল। রাত একটায় ওর মৃতদেহ পুলিশ আবিষ্কার করে। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী ওকে চার ঘণ্টা আগে খুন করা হয়েছিল। অর্থাৎ রাত ন’টায় ও খুন হয়েছিল।

পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সামনে ট্যাক্সি থামে। কারমানকে বলি, আমাকে কথা বলতে দাও।

 আমরা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে যাই। একজন লম্বা চেহারার অফিসার আমাদের বসতে বলে।

আমার নাম ডানিংহ্যাম–ডিটেকটিভ ডিস্ট্রিক কমান্ডার, আপনারা কী মৃতের আত্মীয়?

নিজেদের পরিচয় দিলাম। আমরা বেনির বন্ধু। আমার নাম শুনে ডানিংহ্যামের মুখ কঠিন হয়, তাতেই বুঝলাম ব্রান্ডন আমাদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য জানিয়েছে।

ডানিংহ্যাম বলে, মৃতদেহের সনাক্তকরণ আপনাদের করতে হবে। এই অফিসারকে আপনাদের নাম ঠিকানা জানান। তারপর আপনাদের মর্গে নিয়ে যাচ্ছি।

মার্বেল পাথরের বেদীর ওপর চাদরে ঢাকা তিনটি মৃতদেহ মর্গে ঢুকে দেখতে পেলাম। মাঝখানের মৃতদেহটির মুখের ওপর থেকে চাদর সরান হয়।

ডানিংহ্যাম কর্কশকণ্ঠে বলে, চিনতে পারছেন?

হ্যাঁ।

কারমানের চোখ মুখ ফ্যাকাশে দেখায়। ডানিংহ্যাম ওর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনিও চিনতে পারছেন তো?

কারমান মাথা নাড়ায়।

ডানিংহ্যামবলে, ঘাবড়াবেন না। যে কোন লোকের ভাগ্যে এরকমটা হতে পারে। চলে আসুন, বাইরে যাওয়া যাক।

আমার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়।

***

ঘরে দুটো বিছানা, একটা টেবিল। আরাম কেদারাটা দেখলে মনে হবে একদা এর ওপর হাতী বসতো।

হোটেলের বেয়ারা বলে, সব রকম ব্যবস্থা এখানে রয়েছে।

 কারমান বলে, এ ছাড়া আর কী ব্যবস্থা আছে?

বেয়ারা বলে, মদ পাবেন। অন্যান্য নেশার জিনিস আছে, আর পাকেন মেয়েমানুষ। অর্থ ছাড়ুন সব কিছুর ব্যবস্থা হবে।

আমরা মদ দিতে বলি।

বেয়ারা চলে গেলে কারমান বলে, আর একটু ভাল জায়গায় থাকার মত কী আমাদের হাতে অর্থ নেই?

কারমান আমার পাশে এসে দাঁড়ালে আমাদের হোটেলের উল্টোদিকে দোতলা বাড়িটার দিকে দেখাই, ওটা ভাড়াটেদের জন্যে নির্দিষ্ট।একতলায় একটা ফটোর দোকান-জ্বলজ্বল করছেলুইয়ের নাম।

কারমান, দ্যাখ। বেনি প্রথমে ওখানে থেকেই অনুসন্ধান শুরু করে। এক মিনিট–তোমাকে একটা ফটো দেখাচ্ছি।

বার্কলের ঘর থেকে পাওয়া অনিতা কার্ফের ফটোটা বের করি এবং কিভাবে পেয়েছি তা কারমানকে জানাই।

এখানে আসার পর বেনির প্রথম কাজ ছিল ফটোর বিষয়ে খোঁজ করা। ওকে একটা ফটোর কপি দিয়েছিলাম।

ফটো উল্টে রবার স্ট্যাম্প দেওয়া নাম ঠিকানা দেখিয়ে বলি, এখানে কেন এসেছি–এবার বুঝতে পারলে?

আরাম কেদারায় বসে কারমান বলে, আমাদের এখন কি করা উচিত?

রাত্রে কিছু করার নেই। কাল সকালে আমার প্রথম কাজ হবে লুইয়ের দোকানে হানা দেওয়া। ওকে অনিতা কার্ফের ফটো দেখাবো। জানিনা, কতদূর কাজ হবে। তবে একটা কিছু ঘটবেই। তোমার কাজ হবে, বিপদে পড়লে আমাকে রক্ষা করা, বুঝলে?

ঠিক আছে।

 দরজায় টোকা মেরে বেয়ারা দু বোতল হুইস্কি নিয়ে ঘরে ঢুকল।

কারমান বলে, তিনটে গ্লাস কেন?

একটা গ্লাস ভেঙ্গে যেতে পারে। অথবা কাউকে মদ্যপানে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। মিস্টার তৃতীয় গ্লাস রাখা সবসময় খুবই দরকার।

কারমান, বেশ বড় পেগ লাগাও। আমরা সবাই একসঙ্গে পান করবো। বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, তা কতদিন এখানে আছ?

দশ বছর। যখন প্রথম আসি, হোটেলটা খারাপ ছিল না। যুদ্ধের পর থেকে সব কিছু বদলে যায়।

কারমান বেয়ারাটিকে পানীয় দেয়। সে গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে হেসে বলে, দেখুন, তৃতীয় গ্লাস কেমন কাজে লাগে।

হুইস্কির সঙ্গে আমি চারটে এ্যাসপিরিন গিলে ফেলি।

 বেয়ারাটিকে বলি, ওহে শোন। কিছু অর্থ রোজগার করতে চাও?

কি করতে হবে?

স্মৃতিশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

আমার স্মৃতিশক্তি কি কাজে লাগবে?

বেনির ফটো বের করে বলি, মনে করে দ্যাখ–ওকে কখনও দেখেছ কিনা?

ফটোটি দেখে বেয়ারা মদের গ্লাস টেবিলের ওপর রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ই, আমাকে বুদ্ধ বানাতে চান। আমি পুলিশের কাছে কখনো মুখ খুলি না।

 কারমান বেয়ারাটির ঘাড় ধরে টানতে টানতে আমার পাশে বিছানায় ওকে বসায়, উল্লুক, কোথাকার! আমাদের কী পুলিশের লোকের মত দেখাচ্ছে?

ওঃ, আপনারা তাহলে পুলিশের লোক নন।

কুড়ি’ ডলার বের করে আমার পাশে রেখে বলি, আমাদের আচরণ কী পুলিশের মত?

লোভীর দৃষ্টিতে ডলারের দিকে তাকিয়ে বেয়ারাটি বলে, বলতে পারবো না। আজ দুপুরে পুলিশ এসে নানা রকম প্রশ্ন করেছে। মর্গে ভোলা ওর ফটো আমাকে দেখিয়েছে।

সে বুঝি এখানে ঘরভাড়া নিয়েছিল?

ডলারের দিকে হাত এগিয়ে বলে, হ্যাঁ, এখানে সে ছিল। কিন্তু ম্যানেজার পুলিশের কাছে তা গোপন করেছে।

বেয়ারাটি ডলার খামচে ধরে।

কারমানকে বলি, একে আরও পানীয় দাও।

দেখবেন আমি যেন বিপদে না পড়ি। কোনমতেই চাকরী হারাতে চাই না।

 কারমান মদের গ্লাস এগিয়ে দেয়।

শোন, ফটোর এই মানুষটি আমাদের বন্ধু। আমরা জানতে চাই কেন ওকে খুন করা হয়েছে। তোমার কোন ধারণা আছে?

জানি না। গতকাল বিকেল পাঁচটায় ভদ্রলোক ঘর ভাড়া নেন। এই ঘরের পাশেরটায় উনি ওঠেন। বেশিক্ষণ থাকেন না। বেরিয়ে যান। তারপর আর তাকে দেখতে পাইনি।

ও কি কোন ব্যাগ রেখে গেছে?

ম্যানেজারের কাছে, রয়েছে। ভদ্রলোক ঘরভাড়া দিয়ে যান নি।

ব্যাগটা নিয়ে এসো।

দু চোখ বড় করে বেয়ারা বলে, আমি পারবো না। ম্যানেজার দেখতে পেলে…যাও, নিয়ে এসো। নইলে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলবো।

এখনি আনতে হবে?

হ্যাঁ।

এই কাজের জন্য বেশি কিছু পাব কী?

আরও দশ ডলার তুমি পাবে।

বেয়ারা চলে গেলে কারমান বলে, চমৎকার। ডিক, তুমি কি করে বুঝলে যে, বেনি এখানে ঘর ভাড়া নিয়েছিল।

আমরা কী ফালতু এই হোটেলে ঘরভাড়া নিয়েছি? দাও…আরও হুইস্কি দাও।ওই হারামজাদার সঙ্গে বকবক করে আমার মাথা ধরে গেছে।

অনিতা কার্ফের ফটোটা সুটকেশ থেকে বের করে বিছানায় রাখি।

কারমান বলে, ফটো দেখে কী বেয়ারাটি চিনতে পারবে?

দেখা যাক, ভুলে যেও না, বেয়ারাটি এখানে দশ বছর যাবৎ আছে।

বেয়ারা ব্যাগ এনে বিছানার ওপর রেখে বলে, ব্যাগটি আবার ম্যানেজারের, ঘরে রেখে আসতে হবে। বিপদে পড়তে চাই না।

অনিতা কার্ফের ফটো ব্যাগের ভেতর তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলাম না। সব জিনিস গুছিয়ে ব্যাগটা মেঝেতে ফেলে বলি, নিয়ে যাও। দশ ডলার বেয়ারাকে দিয়ে বলি, মুখ বন্ধ রাখবে, বুঝলে?

বেয়ারা ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে, বলুন, আর কী করতে হবে?

 অনিতার ফটো দেখিয়ে বলি একে কখনও দেখেছো?

অনেকটা অনিতা গে’র মত দেখতে। হা…হা…নিঃসন্দেহে।

চুপ কর। অনিতা গে কে? সে কী করে? কোথায় তার দেখা পাব?

 জানি না, কোথায় ওর সন্ধান পাবেন। অনেকদিন হল কোথায় চলে গেছে, কে জানে। আর কী সে এখানে ফিরে আসবে?

উহ আর সে ফিরে আসবে না।