২.১ বৃদ্ধ ইহুদী নড়েচড়ে বসে

নাঙ্গা তলোয়ার ২য় খণ্ড

ইউহাওয়া বলে – “লাঈছ বিন মোশান উপস্থিত হয়ে ব্যাপারটা খুলে বললে ভাল হয় না? এ ব্যাপারে ঐ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির অবদানই বেশি।” “ঐ বৃদ্ধ যাদুকরকে এখন কি করে ডেকে পাঠাব?” কা’ব বিন আসাদ অসন্তুষ্টির একটু ভাব নিয়ে বলে– “তুমি বলতে থাক। তোমার উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।”

বৃদ্ধ ইহুদী নড়েচড়ে বসে বলে– “এখানেই তিনি আছেন। আমরা তাকে সঙ্গে করে নিয়েই এসেছি। শুধু তাই নয়, মুহাম্মাদকে যে কতল করবে তাকেও নিয়ে এসেছি। আর এখন আমরা বিলম্ব করতে পারি না। আমাদের একান্ত আশা ছিল, কুরাইশ, গাতফান এবং অন্যান্য সহযোগী গোত্রগুলো সম্মিলিতভাবে ইসলামের নাম-নিশানা দুনিয়া থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিবে। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি হয়েছে। প্রতিটি রণাঙ্গনে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। আমরা তাদেরকে মদীনা আক্রমণে প্ররোচিত করেছিলাম। তারা এ পর্যন্ত এসেও চরম কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে পালিয়ে গেল। ইহুদীদের খোদার কসম। কা’ব! মুসলমানদের উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ না করে খুবই অনুচিত কাজ করেছ।”

কা’ব বিন আসাদ কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে– “ইতোপূর্বে তার কারণ ব্যাখ্যা করেছি। কারণ সঠিক ছিল না ভুল?” বৃদ্ধ বলে– “সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেছে এখন আমরা কুরাইশদের বিজয়ের অপেক্ষা করতে পারি না।” সাথে সাথে ইউহাওয়াকে উদ্দেশ করে বলে– “লাঈছ বিন মোশানকে ডাক। অপরজন আপাতত বাইরে থাকুক।”

ইউহাওয়া রূম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই লাঈছ বিন মোশানকে নিয়ে ফিরে আসে। সে ছিল ৭০ থেকে ৮০ বছরের মাঝামাঝি বয়সের এক বৃদ্ধ। তার চুল-দাড়ি দুধের ন্যায় সাদা হয়ে গিয়েছিল। দাড়ি ছিল বেশ লম্বা। চেহারা লাল টুকটুকে। লাল-সাদায় মিশ্রিত গোধুমবর্ণ। পৌরুষদীপ্ত উজ্জ্বল কান্তি শরীর। তবে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বার্ধ্যকের ছাপ। উষ্ট্র রঙ্গের আলখেল্লা পরিহিত ছিল সে। হাতে ছিল বৃদ্ধকালের সাথি ‘লাঠি’। লাঠির উপরাংশ কারুকার্য খচিত ছিল। লাঠি মাটিতে রেখে দিলে মনে হত যেন জীবিত একটি সাপ ফনা তুলে আছে।

ইহুদী জগতে লাঈছ বিন মোশান একজন জাদুকর হিসেবে সুপরিচিত ছিল। নযরবন্দী এবং জাদু প্রদর্শনে সে খুব দক্ষ ছিল। মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী কোন এক গ্রামে তার বাসস্থান। সমাজে তার সম্পর্কে অনেক ধরনের কথা প্রচলিত ছিল। মৃতকে স্বল্প সময়ের জন্য জীবিত করতে পারত। যে কোন পুরুষ কিংবা মহিলাকে মুহূর্তে আয়ত্ত করা ও ভক্ত করার ক্ষমতা তার ছিল। ইহুদীরা তাকে বিশপ ও পাদ্রী বলে মান্য করত। সে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব ছিল।

সে কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই সবাই দাঁড়িয়ে যায়। সে আসন গ্রহণ করলে এক এক করে সকলেই বসে পড়ে।

“মোশানের বংশ-মর্যাদা সম্পর্কে কে না জানে?” কা’ব বিন আসাদ বলে– “হুদীদের খোদার কসম! আমাদের মধ্য হতে কেউ আপনাকে ডেকে পাঠানোর সাহস করতে পারে না। মনে হয় ইউহাওয়া আপনাকে নিয়ে এসেছে।”

“আমি কোন পয়গম্বর নই কা’ব!” লাঈছ বিন মোশান বলে– আমি এ জাতীয় আকর্ষণীয় শব্দ শুনতে চাইনা। সম্মান এবং মর্যাদা দেখানোর সময়ও নেই। কেউ না ডাকলেও আমি আসতাম। তোমরা গুরুদায়িত্ব পালন করতে সময় নষ্ট করে ফেলেছ বহুত। তোমাদের চেয়ে এই মেয়েটি শতগুণে ভাল। কারণ যে কাজ তোমাদের করার কথা সে তা নিজেই সম্পন্ন করেছে।”

কা’ব বিন আসাদ বলে–“শ্রদ্ধাভাজন ইবনে মোশান! আমরা এখনও এমন চুড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করিনি। মুহাম্মদকে হত্যার মত ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিলেও কোনক্রমেই ইউহাওয়াকে এ কাজে ব্যবহার করতাম না। এমন অসাধারণ সুন্দরী এবং যুবতী মেয়েকে আমরা ব্যবহার করতে পারি না।”

লাঈছ উদ্বেগের সাথে জানতে চায় –“কেন পারনা? সারা দুনিয়ার ইহুদীদের খোদার রাজত্বের কথা কি ভুলে গেছ?… দাউদের তারকার শপথ, গোটা মানব জাতির উপর বনী ইসরাঈলের রাজত্ব কায়েম করতে আমাদের বিরাট কুরবানী করতে হবে। মানুষের স্বভাবজাত দুর্বল বিষয়গুলো চিহ্নিত করে করে নিশানা করতে হবে। একজন পুরুষ কি চায় জান?… একদিকে ইউহাওয়া আর অন্যদিকে উন্নতজাতের বিশটি ঘোড়া এবং বিশজন গোলাম দাঁড় করিয়ে দিয়ে কাউকে যদি ইচ্ছামত গ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়, তাহলে দাউদের তারকার শপথ করে বলতে পারি, সে ঘোড়া এবং গোলামের পরিবর্তে ইউহাওয়াকেই গ্রহণ করবে।”

কক্ষে কিছুক্ষণের জন্য সুনসান নীরবতা নেমে আসে। কারো মুখে কোন কথা নেই। বিস্ফোরিত চোখগুলো চেয়ে থাকে লাঈছের দিকে।

“আমার অনুমান তোমরা আমার কথার মর্ম বুঝতে পারনি।” লাঈছ বলে– “তোমাদের মন-মস্তিষ্কে নারী ও তার রূপযৌবনের পবিত্রতা বদ্ধমূল হয়ে আছে।… আমার কথা মনোযোগ সহকারে শোন। লাজ-শরমের সাথে পবিত্রতার কোন সম্পর্ক নেই। এটি একটি শ্রেষ্ঠতম হাতিয়ার। শত্রুকে অচল ও তার চিন্তাশক্তি ভোঁতা করতে এ অস্ত্রের কোন তুলনা নেই। শত্রুকে ঘায়েল করতে এ অস্ত্র আমাদের ব্যবহার করতেই হবে। সৎ কাজ কাকে বলে? অসৎ কাজের সংজ্ঞা কী? আমি জানি, তোমরা কি জবাব দেবে। অবশ্যই তোমাদের জবাব যথার্থ। তবে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ইহুদীবাদের মর্মবাণী পৌঁছাতে হলে সৎ-অসৎ’ এর অর্থ তখন পাল্টে যাবে। মুহাম্মাদ অশ্লীলতা ও নাশকতার মূলোৎপাটনে বদ্ধপরিকর। আমাদেরকে তা জ্যান্ত রাখতে হবে এবং অভিনব পন্থায় নতুন নতুন অশ্লীলতা ও নাশকতা সমাজে জারী করতে হবে। তাই বলে আমরা নিজেরা নাশকতামূলক কর্মে জড়িয়ে পড়ব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজেদের গোলামীর শিকলে বন্দি করতে চাইলে অ-ইহুদীদেরকে পৃথিবীতেই বেহেশত দেখাতে হবে। বেহেশতের হুর তাদের সামনে ধরতে হবে। দামী মদ পান করাতে হবে। মানুষের মধ্যে পশুসুলভ প্রবৃত্তি রয়েছে। এই পশুত্ব কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। ভাল-মন্দের বিচারের সময় এখন নয়। এখন একমাত্র লক্ষ্য, ইহুদীদেরকে দুনিয়ার ড্রাইভিং সিটে বসাতে হবে। এর জন্য যা করা দরকার সবই আমাদের করতে হবে। তা যতই মন্দ ও কুরুচীপূর্ণ হোক না কেন। অল্প থেমে সে ইউহাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে– “ইউহাওয়া! তাদেরকে, ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে দাও।”

ইউহাওয়ার ঠোঁটে মুচকি হাসির আভা খেলে যায়। পরিকল্পিত ভঙ্গিতে দুই ঠোঁটের ওঠা-নামায় সে আভা দ্যুতিময় হয়ে কণ্ঠকে মোহনীয় করে তোলে। এক অজানা আকর্ষণে উপস্থিত সকলেই ইউহাওয়ার কান্তিময় হুররূপী চেহারার দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে। কারো চোখে পলক পড়ে না। ইউহাওয়া তার কাহিনী বলতে শুরু করে।

♣♣♣

কয়েক মাস পূর্বে মক্কা থেকে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। ইউহাওয়া লাজ-শরমের মাথা খেয়ে বলতে থাকে যে, খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ান-তিন প্রখ্যাত কুরাইশ সেনাপতিকে সে তার রূপ-যৌবনের জাদুতে পৃথক পৃথকভাবে বন্দি করতে চায়। তাদেরও পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ সৃষ্টির চেষ্টা করে কিন্তু তিনজনের কেউই তার জালে বন্দি হয় না। কাউকে সে ফুসলিয়ে প্ররোচিত করতে পারে না। তিন সেনাপতির অন্তরে কুরাইশ দলপতি ও সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ানের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করারও জোর প্রয়াস চালায়।

ইউহাওয়া বলে–“কিন্তু খালিদ মানুষ নয়, পাথর। স্পষ্টভাবে সে আমাকে প্রত্যাখ্যানও করে না আবার ঐ আকর্ষণও দেখায় না, আমি যা কামনা করছিলাম। আমার বিশ্বাস, ইকরামা এবং সফওয়ানের উপর খালিদেরই প্রভাব রয়েছে। এই তিন সেনাপতি যুদ্ধ প্রেমিক। যুদ্ধ-বিগ্রহ বিনে তারা আর কিছুই বোঝে না। দ্বিতীয় কোন বিষয় চিন্তাও করেনা।”

ইউহাওয়া হাল ছাড়ে না। অব্যাহত রাখে তার চেষ্টা। খালিদ থেকে দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। কারণ তার মন-মানসিকতায় একমাত্র এ চিন্তা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, মুসলমানদেরকে রণাঙ্গনে সরাসরি পরাস্ত করতে হবে এবং যুদ্ধবন্দী কিংবা লড়াইরত অবস্থায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যা করতে হবে।

একদিন ইউহাওয়া মক্কা থেকে চার মাইল দূরের এক গ্রামে যায়। বিকেলে সেখান থেকে রওনা হয়। তার সাথে আরো দুইজন মেয়ে এবং তিনজন পুরুষ ছিল। এরা সবাই ইহুদী। দু’টি ঘোড়ার গাড়িতে সওয়ার হয়ে তারা ফিরে চলে। অর্ধেক রাস্তা যেতে না যেতেই ভয়াবহ সাইমুম শুরু হয়। এতে বালুর টিলাগুলো কমতে কমতে এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। এ ঝড়ের গতি এতই তীব্রতর হয় যে, দেহের কোন স্থান খোলা থাকলে উৎক্ষিপ্ত বালু সেখানে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো আঘাত হানত। বালুকণা চামড়া ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করত। উট-ঘোড়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে এদিক-ওদিক ছুটে পালাত।

দুনিয়া থেকে আসমান পর্যন্ত উঁচু একটি কৃত্রিম দেয়াল আচমকা উত্থিত হয়ে আঘাত হানে এবং প্রাচীরটি নিমিষে ইহুদীদের বহনকারী ঘোড়ার গাড়িটি ধ্বংস করে দেয়। আকাশ রক্তিম হয়ে ওঠে। সমুদ্রে সৃষ্ট তুফানের প্রবল তরঙ্গরাশি যেমন জাহাজের উপর আছড়ে পড়ে তাকে ডুবিয়ে দেয়ার উপক্রম করে, ঠিক তেমনি ঘুর্ণির প্রবল ঝাপটা শক্তিশালী থাবা হয়ে তাদের ভূপাতিত করতে থাকে। বালুর ঢিবিগুলোর মূলোৎপাটন করে চলে। মরুঝড় চলাকালে দাঁড়িয়ে থাকলে বিপর্যয় ডেকে আনে। বেলচা দ্বারা বালু নিক্ষেপ করলে যেমন বালুর স্তুপ জমে তেমনি উৎক্ষিপ্ত বালু গায়ে আছড়ে পড়ে নিচে পড়ে জমা হয়। এভাবে বালু জমতে জমতে অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে বালুর টিবি হয়ে যায়। মানুষকে কেন্দ্র করে এই স্তুপ গড়ে ওঠার কারণে সে ব্যক্তি কৃত্রিমভাবে তার মধ্যে জীবিতই দাফন হয়ে যায়। কিন্তু সে জীবিত থাকে না। বালুর চাপে দম আটকে মারা যায়।

“ঘূর্ণিঝড় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসে।” ইউহাওয়া শোনায়– ঘোড়া ধূলিঝড় সহ্য করতে না পেরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। ঘূর্ণির দিকে মুখ করে ঘোড়াগুলো গাড়ি নিয়ে ছুটতে থাকে। এ পথে অস্বাভাবিক ছোট বড় গর্ত পড়ে। ঘোড়ার গাড়ি জোরে লাফিয়ে উঠে ঢুলতে থাকে। আরোহীও গাড়ি ঘোড়ার করুনার উপর উড়ে চলতে থাকে। গাড়ির ভিতরে এভাবে বালি বৃষ্টি হতে থাকে যে, নিজে নিজেকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না।…

“এক জায়গায় এসে গাড়ির এক পাশের চাকা গভীর গর্তে পড়ে যায়।” ইউহাওয়া একটু থেমে আবার সেই ভয়াল স্মৃতি মন্থন করে– “অথবা অন্য পাশের চাকা অস্বাভাবিক উঁচুতে উঠে যায়। গাড়ি এক দিকে এত উঁচু হয়ে যায় যে, কাত হয়ে উল্টে যাচ্ছিল। কিন্তু উল্টে না। তবে গাড়ি তীব্র ঝাঁকুনি খাওয়ায় উঁচু সাইড দিয়ে আমি বাইরে পড়ে যাই। গাড়ি নিজ গতিতে ছুটতে থাকে। গাড়ি থেকে পড়ে আমি গড়াগড়ি খেতে থাকি। এক সময় নিজকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াই এবং সাথিদের নাম ধরে ডাকতে থাকি। কিন্তু ঝড়ের তীব্র ঝাপটা এবং শো শো আওয়াজের কারণে আমার ডাক নিজের কান পর্যন্তই পৌঁছে না। সম্ভবত সাথিরা আমার পড়ে যাওয়া খেয়াল করতে পারেনি। আর খেয়াল করলেও কারো হিম্মত ছিল না যে, আমার নিঃসঙ্গতা দূর করতে সেও গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়বে।”….

“এমন ভীত-সন্ত্রস্ত আমি আর কোনদিন হইনি।” ইউহাওয়া চেহারায় কৃত্রিম উদ্বেগ সৃষ্টি করে বলে– “এবং এমন ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে পড়িনি। যেমনি ঝড় তেমনি অন্ধকার, চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমার আশেপাশে কোন রাস্তাও ছিল না। ঘোড়া মূল রাস্তা ছেড়ে যে এদিক-ওদিক চলছিল তাও আমার খেয়াল ছিল। আমি কোন উপায়ান্তর না করে কাপড়ে মুখ ঢেকে বাতাসের গতি লক্ষ্য করে চলতে থাকি। হাঁটছিলাম কিন্তু বাতাসের তীব্র দাপটে পা মাটিতে ঠিকমত রাখতে পারছিলাম না।”

ঘুর্ণিঝড় ইউহাওয়াকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে চলে। ঝড়ের শো শো আওয়াজ হঠাৎ বিকটরূপ ধারণ করে। ইউহাওয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিচের দিকে চলে। ঝড় তাকে দ্রুত নিয়ে চলে। এখানে এসে একটি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খায়। এটি ছিল বালির দেয়াল। ইউহাওয়া দেয়াল ধরে ধরে সামনে এগিয়ে চলে। এটা নিম্নভূমি হওয়ায় এখানে মাটির টিলা এবং ডাল-পালাবিহীন মরুবৃক্ষ ছিল। পরিবেশ ও প্রকৃতিগত কারণে ঝড়ের আওয়াজ অনেক নারীর একযোগে চিৎকারের মত শোনা যায়। মাঝে মধ্যে এমন আওয়াজও শোনা যায় যার সাথে ঝড়ের আওয়াজের কোন সম্পর্ক ছিল না। মানুষের আওয়াজ বলেও মনে হয়নি। প্রেতাত্মা ও হিংস্র জানোয়ারের আওয়াজের মত মনে হচ্ছিল।

ইউহাওয়া নিজেকে অত্যন্ত সাহসী মনে করলেও এখানে এসে ভয়ে কেঁদে ফেলে। তার বিশ্বাস ছিল, এক সময় ঘূর্ণিঝড় থেমে যাবে। সাথে সাথে এ কথাও সে ভুলে না যে, কোন পুরুষের কবলে পড়লে সে তাকে তার বাড়িতে নয়; বরং নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। এ সম্ভাবনাও তাকে অস্থির করে তোলে যে, সুযোগ বুঝে কেউ তার ইজ্জত লুট করে তারপর হত্যা করবে। ক্রমেই রাত ঘনীভূত হচ্ছিল। বাঘ-ভাল্লুকের আশঙ্কাও ছিল। সমস্ত উদ্বেগ বাদ দিলেও এ উৎকণ্ঠা এড়ানোর কোন উপায় ছিল না যে, মক্কার সাধারণ রাস্তা ছেড়ে তার বাহন ঘোড়ার গাড়ি মরুভূমিতে একবার পথ হারালে দ্বিতীয়বার পথের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব ছিল। পথহারা মুসাফিরের শেষ পরিণতি হতো মৃত্যু। ক্লান্ত বা পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে নয়। পিপাসার কারণে ছটফট করে মারা যেত।

হঠাৎ উটের বিড় বিড় আওয়াজ ভেসে আসে। তার আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বলে মনকে সান্ত্বনা দেয় যে, এটা ভিন্ন কিছু নয়; বরং ঘূর্ণিঝড়েরই আওয়াজ মাত্র। খালি চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। মাটির দেয়ালে হাত রেখে রেখে সে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। দেয়ালটি ছিল মূলত একটি বড় টিলা, যা কিছুদুর গিয়ে বাক খায়। পুনরায় শোনা যায় উটের আওয়াজ। এবারের এ আওয়াজ অতি নিকট থেকে আসে। এত নিকট থেকে যে, ইউহাওয়া প্রথমে আঁৎকে উঠে দু’কদম পিছনে চলে আসে। এটা উটেরই আওয়াজ বলে সে নিশ্চিত হয়।

বিরান মরুভূমিতে মানুষ ছাড়া উটের কথা ভাবাও যায় না। একটি উটের সাথে কমপক্ষে দু’তিনজন লোক অবশ্যই থাকবে। এখানে যারা আছে তারা তার সুহৃদ হওয়াটা এক প্রকার অসম্ভব। কারণ, সময়টা ছিল অত্যন্ত খারাপ। ধর্ষণ, খুন, লুণ্ঠন চলত নির্বিচারে। এসব ভেবে ইউহাওয়া সেখান থেকে সরে পড়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু কোন দিকে যাবে? কোথায় যাবে? এই জনহীন মরুভূমিতে তাকে কে একটু আশ্রয় দিবে? এদিকে ঘূর্ণিঝড় টিলা এবং মৃত্যুপ্রায় বৃক্ষের মাঝ দিয়ে গমনকালে ভীতিকর আওয়াজ সৃষ্টি করে চলছিল। মাটি ইউহাওয়ার পা শক্ত করে এটে ধরে। যাদের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে সে চলছিল এ সময়ে এসে আরেকবার তাদের উপর তার রাগ হয়। তার রাগের কারণ, জ্যান্ত একটা মানুষ পড়ে গেল অথচ পাশেই বসে থাকা একজনও জানল না।

♣♣♣

একটি অদৃশ্য শক্তি তাকে ধাক্কা মেরে একদিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে দেয়ালের মত খাড়া একটি টিলা ক্রমে ভিতর দিকে চলে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে স্থানটি ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে মুক্ত ছিল। এখান থেকে তিন-চার গজ দূর পর্যন্ত ইউহাওয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু কোন উট তার নজরে পড়ে না, দেয়ালের গা ঘেঁষে সে আরো ভিতরে চলে যায়। দু’কদম এগুতেই একটি গিরিমুখ দেখা গেল। কিন্তু গর্তের মধ্যে যেতে তার সাহস হয় না। সে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে।

“ভিতরে এস।” এক ব্যক্তির আহবান তার কর্ণকুহরে গিয়ে আঘাত হানে– বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভাই, ভিতরে এস।”

ইউহাওয়া নিজের অজান্তে সজোরে চেঁচিয়ে ওঠে এবং পিছনে ফিরে দৌড় দেয়। কিন্তু গিরি এলাকা থেকে বের হওয়া মাত্রই ঘূর্ণিবায়ু তার শরীর লক্ষ্য করে বেলচা দিয়ে বালু নিক্ষেপের মত বালু ছুঁড়ে মারে। ইউহাওয়া ঘাবড়ে পিছনে সরে আসে। এরই মধ্যে গুহা থেকে তার সন্ধানে আগত এক ব্যক্তি ঠিক তার সম্মুখে এসে দাড়ায়।

‘একি! তুমি মহিলা?” লোকটি উদ্বিগ্ন হয়ে আরো জিজ্ঞেস করে– “তুমি কি একা? একা তো হতে পারে না।”

‘আমার সাথে চারজন পুরুষ আছে।” ইউহাওয়া কাপড়ে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলে তাদের সাথে ঘোড়া আছে। তাদের সকলের সাথে তলোয়ার ও বর্শা রয়েছে।

“তারা কোথায়?” লোকটি জানতে চায়– “তুমি তাদের থেকে আলাদা হয়ে এদিকে কেন এসেছ?… তাদেরও এখানে নিয়ে এসো। গুহাটি বড়ই চমৎকার। সকলেই আরামে সেখানে বসতে পারব।”

ইউহাওয়া জায়গা থেকে নড়ে না। লোকটি তিন তিনবার তার সাথিদের এখানে আনতে বলে। কিন্তু ইউহাওয়ার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। সে সাথিদের ডাকতে যায় না আবার কথাও বলে না। এতে তার সন্দেহ বেড়ে যায়। লোকটি হঠাৎ ইউহাওয়ার উড়না ধরে টান মেরে চেহারা বের করে ফেলে।

‘তুমি অমুক ইহুদীর মেয়ে নও?” লোকটি ইউহাওয়ার বাবার নাম ধরে জানতে চায়– “তুমি একা?”

“হ্যাঁ, আমি একা।” ইউহাওয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে– “আমাকে একটু দয়া কর।”

এরপর ইউহাওয়া তার নিঃসঙ্গ হওয়া সহ বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলে। এখানে কিভাবে পৌঁছল তাও তাকে জানায়।

“আমার সাথে এস।” লোকটি এ কথা বলে তার হাত ধরে টেনে সাথে করে নিয়ে চলে।

“একটু দাঁড়াও।” ইউহাওয়ার কণ্ঠে অনুরোধ – “তোমরা মোট কতজন?… আমাকে তোমরা দয়া করবে তো?… আমার ধারণা মতে তোমরা কুরাইশী।”

“এখানে আমি একা। লোকটি বলে– “ঠিকই বলেছ, আমি কুরাইশী। তোমার প্রতি দয়াই করছি।”

“কয়েকবার আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি।” ইউহাওয়া কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বলে– “কিন্তু তোমার নাম আমি জানিনা।”

আমার নাম যারীদ বিন মুসাইয়িব।… কথা বাড়িও না। আমার সাথে এস।”

“পরে তো তুমি আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে?” ইউহাওয়া ধরা গলায় জানতে চায়– “আমি তোমাকে অসন্তুষ্ট করব না।”

ইউহাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তাল হারিয়ে ফেললেও উটের আওয়াজ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। এই উটটি ছিল যারীদের। উট গুহার বাইরে বসিয়ে যারীদ অধিকতর নিরাপদ হিসেবে একটি গুহাকে বেছে নিয়ে সেখানে বসে ঝড় থামার অপেক্ষা করে। ইউহাওয়া বিপদে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পৌঁছলে দুজনের এই আলাপচারিতা ও কথোপকথন হয়। যারীদ ইউহাওয়াকে গুহার ভিতর নিয়ে যায়। দীর্ঘ শরীর, হৃষ্ট-পুষ্ট এবং আকর্ষণীয় চেহারার এক টগবগে যুবক যারীদ। সে ইউহাওয়াকে গুহার ভিতর নিয়ে পানি পান করায়। এরপর খেজুর ভর্তি একটি থলে তার সম্মুখে রেখে দেয়।

যারীদ বলে– “চুপ করে বসে থাক। ঝড়ের বেগ কমছে। আমি তোমাকে অবশ্যই বাড়ি পৌঁছে দিব।” একটু থেমে সে ইউহাওয়াকে জিজ্ঞেস করে– “আমাকে অসন্তুষ্ট করবে না, একথা কেন বলছিলে?

‘বাড়িতে পৌঁছে দেবার বিনিময় হিসেবে।” ইউহাওয়া বলে– “এ ছাড়া বিনিময় হিসেবে আর কি দেবার আছে আমার?

“কোন বিনিময় নিতে চাই না।” যারীদ বলে– “আমি তাদের মত নই। যুদ্ধ করে তোমাকে আনতে পারলে তুমি আমার পুরস্কার হতে। কিন্তু এখানে তুমি আমার দয়া ভিক্ষা করেছ। দয়ার বিনিময় গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

ইউহাওয়া তার মুখের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। যারীদ কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শয্যা গ্রহণ করে। ইউহাওয়া তার সাথে হাল্কা কথাবার্তা বলে। পরক্ষণেই তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে যায় যে, যারীদের মনে কোন কুমতলব নেই। এমনকি যারীদ তার সাথে মন খুলে কথা বলে না। ইউহাওয়া নিরাপদ সাথি পেয়ে খুশী। কিন্তু যারীদের মত টগবগে যুবক তার নজরকাড়া রূপে এতটুকু মোহিত না হওয়ায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এটাকে তার রূপ-যৌবনের পরাজয় মনে করে।

“যারীদ!” ইউহাওয়া হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে– “আমি কি দেখতে সুন্দরী নই? আমাকে তোমার পছন্দ হয় না?”

যারীদ তার কথা শুনে হা হা করে হেসে ওঠে শুধু মুখে কিছুই বলে না।

“হাসছ কেন?” অসহায় ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করে ইউহাওয়া– “তোমার হাসি দেখে আমার পিলে চমকে গেছে।”

“খোদার কসম! তুমি খুবই সুন্দরী। যারীদ এবার বলে– “তুমি আমার পছন্দসই ঠিকই। কিন্তু যে বিপদ সংকুল অবস্থায় এবং যে মরুতে তোমার সাথে আমার সাক্ষাৎ সেখানে অন্যায় কোন কিছু করা আমি ভাল মনে করি না।… আমার পৌরুষকে উত্তেজিত করে তুলো না। তোমার দেহ আমাকে আকর্ষণ করে ঠিকই কিন্তু এই ভয়ে শুধু আমি আত্মসংযম করেছি যে, আমার দেবতা এ অপরাধে আমাকে অভিসম্পাত করবে যে, এক বিপদগ্রস্ত নারীকে আমি আশ্রয় দিয়েছি। অতঃপর তার দেহকে নিজে উপভোগ করেছি।”

যারীদ এরপর আর কোন কথা বলে না। ইউহাওয়ার অন্তর থেকে ভীতি দূর হতে থাকে। যারীদকে তার খুবই ভাল লাগে। যারীদের অনুপম চরিত্র আর অমায়িক ব্যক্তিত্ব তাকে জয় করে ফেলে।

“যারীদকে মক্কায় বহুবার আমি দেখেছিলাম।” ইউহাওয়া কা’ব বিন আসাদের বাসভবনের ঘটনা বর্ণনার এক পর্যায়ে বলে– “কিন্তু আমি কখনো তাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। নিজগোত্রে তার বিশেষ কোন সম্মান কিংবা উল্লেখযোগ্য কেউ ছিল না। কিন্তু সেদিন গুহায় তার একান্ত সান্নিধ্য এবং অন্ত রঙ্গভাবে তার সাথে বসে আমার উপলদ্ধি হতে থাকে যে, লোকটি বিশিষ্টজনদেরও অন্যতম।”

‘ঘুর্ণিঝড় যখন বন্ধ হয় তখন সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্ত যাওয়ার উপক্রম। সে আমাকে চলে আসতে বললে আমি তার পিছু পিছু গুহা থেকে বেরিয়ে আসি।

অনতি দূরেই তার উট টিলার সাথে লেগে বসা ছিল। সে উটে চড়ে আমাকে তার পশ্চাতে বসায়। তার ইশারা পেয়ে উট উঠে দাঁড়ায় এবং চলতে শুরু করে। ততক্ষণ আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রাকৃতিক আলোয় স্থানটি দেখতে চেষ্টা করি। খুবই ভয়ঙ্কর। এই ভীতিকর স্থান সম্পর্কে এর আগে কত কথা শুনেছিলাম। ঘূর্ণিঝড় চলাকালে কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় থেমে যাওয়ার পর চোখ ফিরালে সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। কোন কোন টিলা ছিল দেখতে অবিকল মানুষের মত। টিলাগুলোর রঙও ছিল হৃদয় কাঁপানো।”…

‘উষ্ট্রারোহনে আমি খুবই পাকা ছিলাম। উট দৌড়ানোও আমার জন্য মামুলী ব্যাপার ছিল। কিন্তু সেদিনের পড়ন্ত বিকেলে যারীদের পিছে উটে সওয়ার থাকা সত্ত্বেও আমার কেবল পড়ে যাওয়ার ভয় করে। যারীদের কোমরে হাত দিয়ে তাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরি। এক সময় আমার এ অনুভূতি জেগে ওঠে যে, আমি এক দুর্বল নারী মাত্র। আর যারীদ আমার রক্ষক। ধর্মের স্বার্থে আমি কি করছি তা অনেকেই জানে। কিন্তু এ তথ্য তো কেউ জানে না যে, পিতাই আমাকে এ পথে নামিয়েছেন।”

প্রসঙ্গক্রমে ইউহাওয়া তাদেরকে এ তথ্য জানিয়ে দেয় যে, কুরাইশরা বদরে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়ে এলে নিহতদের নিকটাত্মীয় মহিলারা হাত নাড়ায়ে নাড়ায়ে শোক প্রকাশ করে। ইউহাওয়ার পিতা ছিল একজন কট্টর ইহুদী। কুরাইশদের পরাজয়ে তার অশ্রু ঝরে। সে মন্তব্য করেছিল, এক হাজার কুরাইশ যোদ্ধা যদি মাত্র তিনশ তেরজন মানুষের নিকট পরাস্ত হয়, তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, “মুহাম্মাদের কাছে সত্যই কোন জাদু আছে।” সে অনুশোচনার স্বরে বলে – “মুহাম্মাদের অনুসারী তারাও তো কুরাইশ গোত্রের লোক। আসমান থেকে তারা আসেনি। তাহলে এই ক্ষুদ্র দলটি কিভাবে জয় পেল।

তখন ইউহাওয়ার বয়স কম। পরদিন তার পিতা পরিবারের সবাইকে ডেকে পূর্বরাতে দেখা স্বপ্নের কথা বলে। সে স্বপ্ন দেখেছিল, তার হাতে রক্তস্নাত একটি তরবারি। একটি লোক তার সামনে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। তার বস্ত্র রক্তে রঞ্জিত। ইউহাওয়ার পিতা চিনতে পারে না যে, নিহত লোকটি কে? স্বপ্নে একটি আওয়াজ তার কানে ভেসে আসে– “এটা তোমারই সম্পন্ন করতে হবে।” নিহত ব্যক্তি কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে যায়। লাশ নিজে নিজেই মাটির নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখান থেকে খুব সুন্দরী এক বালিকার অভ্যুদয় ঘটে। ঠোঁট ভরা থাকে তার মুচকি হাসিতে।

তার পিতা স্বপ্নটি দেখে ঘাবড়ে যায়। তাবীর জানতে লাঈছ বিন মোশানের কাছে যায়। স্বপ্নের বৃত্তান্ত তাকে খুলে বললে লাঈছ তাকে এই পরামর্শ দেয় যে, তোমার অল্পবয়স্কা মেয়ে ইউহাওয়াকে ইসলামের শিকড় কর্তনে উৎসর্গ কর। জাদুকর লাঈছ তার পিতাকে এ ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, মুহাম্মাদ নামে যিনি নবুওয়াতের দাবি করছেন তিনি এ মেয়েটির হাতেই নিহত হবেন অথবা এই মেয়েটি তাঁর নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির কারণ হবে। লাঈছ ইউহাওয়ার পিতাকে তার কাছে নিয়ে আসতে অনুরোধ জানায়।

ইউহাওয়াকে লাঈছ বিন মোশানের হাওলা করে দেয়া হল।

“আমি মেয়েটিকে উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়েছি।” লাঈছ বিন মোশান ইউহাওয়ার কথার মাঝখানে বলে– “ইহুদীদের খোদা তাকে যে রূপ-যৌবন দান করেছে, তাতে তাকে আকর্ষণীয় তরবারি কিংবা বিষাক্ত মিষ্টান্ন বলা যেতে পারে। কুরাইশ-মুসলমান সংঘর্ষে লিপ্ত হতে সে যে ভূমিকা পালন করেছে তা তোমাদের কারো পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র-প্রধানদেরকে এই মেয়েটি অত্যন্ত সফলভাবে ঐক্যবদ্ধ নিপুণ ব্যবস্থা সে আমাকে সামনে রেখে করেছে, তা তারই মুখ থেকে শোনা যাক।”

ইউহাওয়া বলতে শুরু করে, লাঈছ বিন মোশান তার মধ্যে এমন সাহস এবং এমন মেধার সমন্বয় ঘটায় যে, সে রূপের যাদুতে পুরুষকে কুপোকাত করতে কল্পনাতীত পারদর্শী হয়ে ওঠে। অপূর্ব সৌন্দর্যের পাশাপাশি তার মধ্যে পুরুষের ন্যায় সাহসও সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার উস্তাদ তাকে ঘুণাক্ষরেও একথা জানায় না যে, যে নতুন ধর্ম-বিশ্বাস রুখতে এবং যে মহান ব্যক্তিকে হত্যা করা তার অভিলাষ, সে ধর্ম-বিশ্বাস স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালারই প্রদত্ত এবং তিনিই ঐ মহান ব্যক্তিকে এই নতুন ধর্মমতের প্রচার-প্রসার এবং উন্নতির উদ্দেশে রাসূল করে জগতে প্রেরণ করেছেন।

ইউহাওয়াকে এমন চিন্তা-চেতনায় গড়ে তোলা হয় যে, সে নিজের ধর্মকেই কেবল পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম বলে মনে করত। সত্য পন্থীদের সাথে যে আল্লাহ পাক থাকেন– একথা তার মগজে প্রবেশ করত না। সে নিজ ধর্ম ছাড়া কিছুই বুঝত না, মানত না। লাঈছের প্রশিক্ষণ তাকে কট্টর ও ইহুদীবাদের অন্ধ ভক্তে পরিণত করে। আল্লাহ তায়ালা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে তাকে একাকী নিক্ষেপ করে বাস্তব চেতনায় অনুপ্রাণিত করতে চান কিন্তু সে আল্লাহর ইঙ্গিত ও অভিপ্রায় বুঝতে পারে না। বিপদে ফেলে ভুল ভেঙ্গে দেয়াই ছিল আল্লাহ্ পাকের অভিলাষ। দৃঢ় হিম্মত এবং অসীম সাহসিকতার ব্যাপারে তার মধ্যে যথেষ্ট অহংকার ছিল। সে নিজেকে এ ব্যাপারে পুরুষের ন্যায় বলে মনে করত। অথচ এখন সে এক অতি দুর্বল এবং চরম অসহায় এবং নারী ছাড়া আর কিছুই নয়।

ইউহাওয়া পুরুষের দেহ সম্পর্কে অপরিচিত ছিল না। যারীদ বিন মুসাইয়িবের দেহ এক পুরুষের দেহ ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। কিন্তু তার কাছে যারীদের দেহ অত্যন্ত পূত-পবিত্র মনে হয়। যারীদ তার কাছে যেন সাক্ষাৎ ফেরেশতা। তার এ অনুভবের কারণ, সে তার রূপ-যৌবন, রেশমী চুল এবং আকর্ষণীয় দৈহিক গঠনে বিন্দুমাত্রও প্রলুব্ধ হয়নি। যারীদের এই নির্মল চরিত্রের প্রভাব ইউহাওয়ার উপর এমন গভীর রেখাপাত করে যে, সে তার দেহের প্রতি এক ধরনের টান ও আকর্ষণ অনুভব করে।

মক্কা বেশি দূরে ছিল না। গভীর রাতে যারীদ ইউহাওয়াকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। কেল্লার মত গেট খুলতেই তার পিতাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন দেখা যায়। তার আশা ছিল না যে, তার মেয়ে জীবিত ফিরে আসবে। তার পিতা যারীদকে ভেতরে ডেকে নিয়ে শরাব দ্বারা আপ্যায়ন করে। যারীদ চলে গেলে ইউহাওয়া তার নিজের মাঝে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে।

পর দিনই ইউহাওয়া এক কাসেদের মাধ্যমে যারীদকে সাক্ষাৎ করতে বলে। খবর পেয়ে যারীদ তৎক্ষণাৎ চলে আসে। এটা ছিল অনুরাগের সাক্ষাৎ। এরপরেও তাদের রুটিন মাফিক সাক্ষাৎ হতে থাকে। ইউহাওয়া অনেক পূর্বেই যারীদকে ভালবেসে ছিল। বারবার দেখা-সাক্ষাতের পর যারীদের অন্তরেও ইউহাওয়ার প্রতি ভালবাসা জন্ম নেয়। তবে এ মহব্বত ছিল নিষ্কলুষ। ইউহাওয়া বিস্মিত না হয়ে পারে না, যখন দেখে তার আত্মার মাঝে মহব্বত অনুরাগ বিদ্যমান। সম্পর্ক গভীর হলে একদিন যারীদ ইউহাওয়ার কাছে জানতে চায়, সে তার সাথে কেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না?

“না।” ইউহাওয়া চমকে উঠে বলে– “আমি তোমার দেহের পূজারী। বিয়ে হয়ে গেলে এই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও অনুরাগ আর থাকবে না।”

“আমার অনেক মেয়ে, ছেলে নেই একটিও।” যারীদ উদাস ভাবে তাকে জানায়– “আমি দ্বিতীয় বিবাহ করতে ইচ্ছুক। আমি পুত্র চাই।”

ইউহাওয়া গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। কি জবাব দিয়ে তাকে শান্ত করবে ভেবে পায় না। যারীদের ব্যথা তাকে ব্যথিত করে। যেভাবেই হোক যারীদের এই ইচ্ছা সে পূরণ করতে চায়। দীর্ঘ চিন্তার পর একটি উপায় তার মাথায় আসে।

“লাঈছ বিন মোশান নামে আমাদের এক শ্রদ্ধাভাজন লোক আছেন।” ইউহাওয়া বলে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। তার হাতে এক অস্বাভাবিক শক্তি আছে। আমার বিশ্বাস, তিনি নিজ জ্ঞান ও ক্ষমতাবলে প্রথম স্ত্রীর গর্ভেই তোমাকে পুত্র-সন্তান দান করবেন। আমার সাথে এস। তিনি আমার দীক্ষাগুরু।”

যারীদ তার সাথে লাঈছ বিন মোশানের নিকট যেতে প্রস্তুত হয়ে যায়।

♣♣♣

অল্পদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে দু’পুরুষ কিংবা দু’নারীর মত গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একান্তে বসলে তাদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরোধী আলোচনাও হত। ইসলামের স্রোতধারা রোধে তারা পরিকল্পনাও করত। কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই সংক্রান্ত পদক্ষেপে যারীদ আগ্রহ দেখাত না। এটা আবার ইউহাওয়া ভালো মনে করত না। ইউহাওয়া তাকে উত্তেজিত ও প্ররোচিত করতে থাকে।

“তুমিই আমার ধর্ম।” যারীদ বিন মুসাইয়্যিব নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর ভঙ্গিতে একদিন ইউহাওয়াকে বলে– “তুমি আমার স্ত্রী হও বা না হও, তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারব না।”

“যারীদ একটি গোপন কথা তোমাকে বলি শোন। আমার পক্ষে কারো স্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়। পিতা আমার জীবনকে ইহুদীদের স্বার্থে ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছেন। লাঈছ বিন মোশান আমার এই করণীয় ধার্য করে দিয়েছেন যে, আমি যে করেই হোক ইসলামের শত্রু বৃদ্ধি করে যাব। আমার অন্তরে আমার ধর্ম ছাড়া একমাত্র তোমার মহব্বত রয়েছে। আমাকে তোমার বলে জানবে।”

একদিন যারীদ ইউহাওয়ার সাথে লাঈছ বিন মোশানের কাছে যায়। ইউহাওয়া প্রথমেই তাকে লাঈছের সামনে না নিয়ে বাইরে বসিয়ে রেখে নিজে ভিতরে প্রবেশ করে। যারীদের পরিচয় দিয়ে সে লাঈছকে পরিষ্কার ভাষায় জানায় যে, যারীদকে সে ভালবাসার দেবতা জ্ঞান করে। সে আরও জানায়, এই যারীদই তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। যারীদকে এখানে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যও তাকে জানায় যে, যারীদের কন্যা সন্তান অনেক। পুত্র-সন্তান একজনও নেই।

“যারীদের স্ত্রীর গর্ভে পুত্র-সন্তান দেয়ার ক্ষমতা আপনার আছে কি?” ইউহাওয়া ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

লাঈছ বিন মোশান বলে– “কেন নয়? আগে তাকে দেখতে হবে। এরপর চিন্তা করে বলব, তার সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায়। তাকে আমার কাছে আসতে বল।”

ইউহাওয়া বাইরে এসে যারীদকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বাইরে অপেক্ষা করে। দীর্ঘ সময় পরে লাঈছ তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ইউহাওয়াকে ভেতরে ডেকে নেয়।

“যে ব্যক্তি তোমার ন্যায় সুন্দরী-রূপসী নারীর সাথে এতদিন উঠা-বসা করেও ভালবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে, সে নিঃসন্দেহে খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক” লাঈছ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মন্তব্য করে– “অথবা সে এতই দুর্বলমনা যে, সে তোমার রূপের জাদুতে পূর্ণাঙ্গভাবে বন্দি হয়ে তোমার গোলামে পরিণত হবে।”

“যারীদ অবশ্যই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক।” ইউহাওয়া জোর দিয়ে বলে।

“যারীদের ভিতরগত সত্তাটি খুব দুর্বল।” লাঈছ বিন মোশান বলে– “তোমার ব্যাপারে তার সাথে আমার কোন কথা হয়নি। আমি তার সত্তায় ডুবে গিয়ে জেনেছি। লোকটি তোমার মধ্যে বন্দি।”

“পবিত্র গুরুজী।” ইউহাওয়া উদ্বেগের সাথে জানতে চায় তার সম্পর্কে এমন কথা আপনি কেন বলছেন? আমার ইচ্ছা, কেবল তাকে একটি ব্যবস্থা করে দেয়া। আমি তাকে এতই ভালবাসি যে, তার পুত্র-সন্তানের ব্যবস্থা অন্যপন্থায় না হলে আমিই তার পুত্রের গর্ভধারিণী হবো।”

“না বেটি।” লাঈছ দৃঢ়তার সাথে বলে–“তোমার গর্ভ থেকে তার পুত্র-সন্তান জন্ম নিবে না। ইহুদীদের খোদা যে পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য আমার এবং তোমার কাঁধে অর্পণ করেছেন, তা পালনে সে অন্যতম সহায়ক হবে।”

ইউহাওয়া অবাক হয়ে নীরবে লাঈছ বিন মোশানের চেহারার দিকে চেয়ে থাকে।

“তুমি যাকে ভালবাসার দেবতা ভাবছ সেই তথাকথিত নবুওয়াতের দাবিদারকে কতল করবে।” লাঈছ ক্রুর হেসে বলে– এ কাজে যারীদের সমকক্ষ আর কেউ হতে পারে না।”

ইউহাওয়া জিজ্ঞাসা করে– “এটা কি আপনার নিছক ভবিষ্যদ্বাণী? এ কিভাবে হত্যা করবে?”

“তাকে আমিই প্রস্তুত করছি” লাঈছ বলে।

“এ প্রস্তুত হবে না।” ইউহাওয়া বলে– “সে অনেকবার আমার কাছে বলেছে, তার কোন নির্দিষ্ট ধর্মমত নেই। মুহাম্মাদকে সে শত্রু ভাবে না। হত্যা-লুণ্ঠন তার একেবারে না পছন্দ।”

“অনায়াসেই সে সবকিছু করবে।” বুড়ো লাঈছ বলে –“তার দেমাগ থাকবে আমার নিয়ন্ত্রণে। তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে। একেবারে তিন দিন সে সূর্যের মুখও দেখবে না। এরপর যখন তাকে নিয়ে আসা হবে তখন তার মুখ থেকে শুধু এ কথাই বের হবে যে, নবীর দাবিদার কোথায়? আমি তাকে প্রাণে বধ করব।

“পবিত্র পিতা।” ইউহাওয়া ধরা গলায় অনুনয়ের স্বরে বলে– “এত কষ্ট যারীদ সহ্য করতে পারবে না। নিশ্চিত মরে যাবে। শুধু এ লোকটিই…।”

ইহুদীদের খোদার চেয়ে অধিক ভালবাসার যোগ্য আর কেউ নয়।” লাঈছ ইউহাওয়ার আবেদন মাঝপথে কেটে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে– “এতটুকু ত্যাগ তোমাকে সহ্য করতেই হবে। যারীদ আর কোনদিন মক্কায় ফিরে যাবে না।”

ইউহাওয়া ও যারীদ আর মক্কায় ফিরে যায় না। বুড়া লাঈছ উভয়কে তিনদিন তিনরাত একটি কক্ষে বন্দি করে রাখে। যারীদকে নিজের সম্মুখে বসিয়ে তার চোখে চোখ রাখে। এরপর তাকে কিছু পান করিয়ে দুর্বোধ্য ভাষা মন্ত্র উচ্চারণ করে। সে ইউহাওয়াকে একদম উলঙ্গ করে যারীদের পাশে বসিয়ে দেয়। লাঈছ ইউহাওয়াকে যে নির্দেশ দেয়, সে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা করে যায়।

“যারীদের চিন্তা-চেতনা কিভাবে আমি নিয়ন্ত্রণ করলাম তা এখানে সকলের সম্মুখে খুলে বলা সঙ্গত মনে করি না।” লাঈছ কক্ষের লোকদের উদ্দেশে বলে– “আমি তাকে আমার সাথে করেই নিয়ে এসেছি। তোমরা নিজ চোখে তাকে দেখতে পার।”

লাঈছ ইউহাওয়াকে ইশারা করলে সে বের হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর যারীদকে সাথে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। যারীদ ভেতরে প্রবেশ করে পালাক্রমে সবার প্রতি নজর বুলাতে থাকে।

যারীদ মুখ তুলে বলে– “সে এখানে নেই। আমি তাকে ভাল করেই চিনি। সে আমারই গোত্রের লোক। সে এখানে নেই।”

“সবর কর যারীদ।” বুড়ো লাঈছ বলে– “আমরা অবশ্যই তোমাকে তার পর্যন্ত পৌঁছে দিব। কাল হ্যাঁ, আগামীকালই যারীদ!… এখন বস।”

যারীদ ইউহাওয়ার গা ঘেঁষে বসে পড়ে এবং তার হাত ধরে আরো কাছে টেনে আনে।

খন্দক যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী দিন যখন মদীনার জনগণ বিজয়ের রজত জয়ন্তী উদযাপন করছিল এবং অপরদিকে কা’ব বিন আসাদের বাসভবনে ইসলামের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা অংকিত হয় ঠিক সে মুহুর্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানানো হয় যে, বনু কুরাইযার সরদার কা’ব বিন আসাদ মদীনা অবরোধ কালে কুরাইশ ও গাতফানের সাথে এক গোপন চুক্তি করে। হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সে চুক্তি ব্যর্থ করে দেন।

এটিও ছিল বিগত চারদিন আগের একটি ঘটনা। এ ঘটনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফু হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা এক ইহুদী গোয়েন্দাকে হত্যা করেছিলেন। গোয়েন্দাটি মুসলমানদের স্ত্রী ও সন্তানদের আশ্রিত ছোট কেল্লার বাইরে থেকে গোপনে প্রবেশ করা যায় কি-না তা নিরীক্ষা করছিল। কিন্তু সে হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর চোখে পড়ে যায়। তিনি ইহুদীকে চ্যালেঞ্জ করলে ইহুদী তাকে একজন দুর্বল নারী ভেবে বড় গর্বের সাথে আত্মপরিচয় দিয়ে বলেছিল, সে একজন ইহুদী এবং গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে। হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা অলৌকিকভাবে ইহুদীর তরবারির মোকাবিলা করেন লাঠির সাহায্যে এবং কৌশলে তাকে কুপোকাত করে করুণভাবে হত্যা করেন।

‘আল্লাহর কসম!” জনৈক সাহাবী জোরালো কণ্ঠে বলেন– ইহুদীদেরকে বিশ্বাস করা এবং তাদের চুক্তি ভঙ্গের অপরাধ ক্ষমা করা নিজ হাতের খঞ্জর নিজের হৃদপিণ্ডে আমূল বসিয়ে দেয়ার নামান্তর।”

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আসমা এবং হযরত নাফে রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, খন্দক যুদ্ধ শেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ জারী করেন– “তোমরা বনু কুরাইযাতে গিয়ে আসরের নামায পড়বে।”

হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আরেক হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন, জিব্রাইল বাহিনীর অশ্বখুরে উত্থিত ধুলিঝড় আমার নজরে এখনও ভাসছে। এ দৃশ্য তখনকার, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার চুক্তি ভঙ্গ এবং ঘৃণ্য প্রতারণার সাজা দিতে গিয়েছিলেন।

সকল ঐতিহাসিক একযোগে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে মুসলমানগণ সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র অবস্থায় রওনা হয়ে বনু কুরাইযার সব ক’টি দূর্গ অবরোধ করেন। বহু হাদীস থেকে জানা যায় যে, হযরত সা’দ বিন মুয়াজ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে বনু কুরাইযার নেতাদের প্রতি এই পয়গাম দিয়ে প্রেরণ করা হয় যে, চুক্তি লঙ্ঘণের শাস্তি যেন তারা নিজেরাই স্থির করে নেয়। হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু আহত ছিলেন। খন্দক যুদ্ধ চলাকালে হাব্বান বিন আরাফা নামক এক কুরাইশীর বর্শাঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।

♣♣♣

লাঈছ বিন মোশান, ইউহাওয়া এবং নেতা গোছের আরো তিন চার ইহুদী তখনও কা’ব বিন আসাদের কাছে বসা ছিল। যারীদ বিন মুসাইয়্যিবও সেখানে ছিল। তারা চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য রাতের আঁধারকে সর্বসম্মতভাবে বেছে নেয়। প্রস্তাব পাশ হওয়ার ঠিক মুহূর্তে এক ইহুদী দৌড়ে কক্ষে প্রবেশ করে।

“মুসলমানরা এসে গেছে।” ইহুদী ভীত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে– “এটা স্পষ্ট যে, তারা বন্ধু হয়ে আসছে না। ধূলা বলছে, তারা আসছে। ধূলা ডানে-বামে ছড়ানো।… দেখ। শীঘ্র চল এবং দেখ।”

কা’ব বিন আসাদ দৌড়ে বাইরে এসে দূর্গ-শীর্ষে ওঠে সেখান থেকে এক প্রকার দৌড়ে নিচে নামে এবং সোজা লাঈছ বিন মোশানের কাছে চলে যায়।

কা’ব বিন আসাদ কম্পিত কণ্ঠে বলে– “পবিত্র মোশান! আপনার জাদু কি ঐ বর্শা ও তলোয়ারগুলো টুকরো টুকরো করতে পারে, যা আমাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত?”

“হ্যাঁ, পারে।” বুড়ো লাঈছ কা’বকে অভয় দিয়ে বলে– “মুহাম্মাদের জাদু বেশি বেড়ে গেলে আমার জাদু দেখাতে বাধ্য হব।… তুমি উপরে গিয়ে কি দেখে এলে?”

“খোদার কসম!” কা’ব বিন আসাদ বলে– এই নু’আইম বিন মাসউদই চাণক্য গোয়েন্দাগিরি করেছে। আমি জানতামনা যে, সে মুসলমান হয়ে গেছে। মুসলমানরা এখন অবরোধের পর্যায়ে আছে। আমাদের বের হবার সকল রাস্তা বন্ধ।”

“এ দু’জনকে যে কোন পন্থায় বের করার ব্যবস্থা কর।” লাঈছ বলে– ইউহাওয়া! যারীদকে নিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাও। আমি তোমাদের পেছনে আসছি।”

‘লাঈছ বিন মোশান। আপনি উপরে যাচ্ছেন না কেন” কা’ব উৎকণ্ঠার সাথে বলে– “আপনার সেই প্রজ্ঞা এবং জাদু-নৈপুণ্য কোথায় গেল, যা আপনি…।”

বুড়ো লাঈছ বলে– “এ রহস্য বোঝা তোমার সাধ্যের বাইরে, হযরত মুসা আলাইহিস সালাম একদিনেই ফেরআউনকে ধ্বংস করে দেন নি। আমার হাতে যে লাঠি দেখতে পাচ্ছ তা ঐ লাঠি, যা দিয়ে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম পানিতে আঘাত করলে পানি দুভাগ হয়ে গিয়ে তাঁর সাথিদের জন্য রাস্তা তৈরী করে দিয়েছিল। এটা লাঠিরই মোজেযা ছিল যে, ফেরআউনের দলবল এবং সে নিজে মাঝ দরিয়ায় ডুবে ধ্বংস হয়ে যায়। যেভাবে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর গোত্রকে মিসর থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন, তদ্রুপ আমি তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব।”

ইউহাওয়া এবং যারীদ ইতোমধ্যে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। লাঈছ বিন মোশানও হাঁটা শুরু করে।

মুসলিম সৈন্যরা বনু কুরাইযার বসতির কাছে চলে এলে মহিলা এবং শিশু তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি করে। সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মহিলা এবং শিশুরা নিজ নিজ ঘরে পালিয়ে যেতে থাকে। মোকাবিলার জন্য একজনও কেল্লা হতে বের হয় না। যে সৈন্যরা পর্বতশৃঙ্গের দিক থেকে অবরোধের জন্য আসতে থাকে দুজন পুরুষ আর একজন নারী তাদের চোখে পড়ে। তিনজনই পালাচ্ছিল। বৃদ্ধ পুরুষ এবং মহিলাটি তাদের সাথিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। লোকটি বারবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছিল এবং সামনে যেতে চাচ্ছিল না।

এ তিনজন ছিল লাঈছ, যারীদ এবং ইউহাওয়া। লাঈছ যারীদের মগজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তোলে কিন্তু যারীদ এখন তার জন্যই আপদ হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বার আসক্তিতে এ সময় তার মন-মগজ তীব্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে তাদের হাত থেকে বারবার ছুটে যেতে চায়। ইউহাওয়া প্রেমের টানে তাকে সাথে নিয়ে চলে। তার প্রবল আশঙ্কা ছিল, যারীদকে ছেড়ে দিলে সে নির্ঘাত মুসলমানদের হাতে নিহত হবে। লাঈছের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। সে তাকে জোর করে হলেও এই উদ্দেশে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে এজন্য যে পরে সুযোগমত আবার তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হত্যার কাজে ব্যবহার করবে। তারা যতই তাকে নিয়ে যেতে চায়, সে ততই বলতে থাকে– “যে নিজেকে নবী বলে দাবি করে সে কোথায়?… সে আমাদেরই লোক।… আমার হাতেই তার মৃত্যু।… আমাকে ছেড়ে দাও।… আমি মদীনায় যাব।”

এক মুসলমান পর্বতশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে তাদের থামতে কড়া নির্দেশ দেয়। লাঈছ এবং ইউহাওয়া আওয়াজের উৎস লক্ষ্য করে পিছনে তাকিয়ে যারীদকে সেখানে ফেলে রেখে নিজেরা পালিয়ে যায়। যারীদ অসি কোষমুক্ত করে।

“মুহাম্মাদ কোথায়?” যারীদ তরবারি নাচিয়ে পর্বতশৃঙ্গের দিকে আসতে আসতে বলে– “সে আমাদেরই বংশের সন্তান। আমি তাকে ভালভাবেই চিনি। আমি তাকে হত্যা করব। সে নবুওয়্যাতের দাবি করছে।… ইউহাওয়া শুধুই আমার।”

“ইউহাওয়া হুবল ও উযযা দেবী হতেও পবিত্র।” যারীদ সামনে চলে এবং গর্জে উঠে বলতে থাকে– “নবী কই? তাকে সামনে হাজির কর।”

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এত বড় অপমান কোন্ মুসলমান সহ্য করতে পারে? যে মুসলমান তাদেরকে থামতে বলেছিলেন, তিনি ধনুকে তীর সংযোজন করেন এবং চোখের পলকে তীর যারীদের ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলির বেশ গভীরে চলে যায়। যারীদের এক হাতে ছিল তলোয়ার। তার অপর হাত মুহূর্তে ডান চোখে চলে গেলে হাত তীরের উপর গিয়ে পড়ে। সে থমকে দাঁড়ায়। শরীর দুলতে থাকে। হাঁটু মাটিতে গিয়ে লাগে। তলোয়ার ধরা হাত মাটিতে এমনভাবে গিয়ে পড়ে যে, তলোয়ারের আগা উর্ধ্বমুখী ছিল। যারীদ ধপাস করে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। তলোয়ারের অগ্রভাগ তার শাহরগে আমূল ঢুকে যায়। হাল্কা দাপাদাপি করে চিরদিনের জন্য নিথর ও নীরব হয়ে যায় সে।

আহত হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু কা’ব বিন আসাদের দরজায় গিয়ে নক করেন। কা’ব কোন খাদেম না পাঠিয়ে নিজেই গিয়ে দরজা খোলে দেয়।

“বনূ কুরাইযার নেতা!” হযরত সা’দ ভূমিকা ছাড়াই বলেন– “তোমার গোত্রের ছোট শিশুও জানে এবং দেখেছে যে, তোমাদের বসতি আমরা ঘেরাও করে ফেলেছি। তুমি অস্বীকার করতে পার যে, তুমি ঐ অপরাধ করনি, যার শাস্তি তোমার গোত্রের সকলে ভোগ করবে? চিন্তা করে দেখেছ, চুক্তি লঙ্গনের পরিণতি কত ভয়ানক?

কা’ব পরাজয়ের সুরে বলে– “অস্বীকার করি না। কিন্তু আবু সুফিয়ান আমার মাধ্যমে যে অপরাধ করাতে চেয়েছেন তা আমি করিনি।”

এজন্য করোনি যে, তুমি তার নিকট জামানত হিসেবে নেতৃপর্যায়ের লোক দাবি করেছিলে।” হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “এর পূর্বে তুমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলে যে, মদীনায় যেখানে মহিলা ও শিশুরা ছিল সেখানে তোমার গোত্র রাতের অন্ধকারে গেরিলা হামলা চালাবে। একজন গোয়েন্দাও তুমি প্রেরণ করেছিলে পাপিষ্ঠ নরাধম! তুমি ভুলে গিয়েছিলে যে, এক মুসলিম নারীও যদি সতর্ক থাকে তাহলে সে ইহুদীবাদের জঘন্য কারসাজি মাত্র একটি লাঠির দ্বারা ব্যর্থ করে দিতে পারে।”

“জানি, নু’আইম বিন মাসউদ তোমাদের এ তথ্য প্রদান করেছে যে, আমি তোমাদের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছি।” কা’ব বিন আসাদ পরাজয়ের ভঙ্গিতে বলে– “যা শুনেছ সবই সত্য। তবে আমি যা কিছু করেছি কেবল আমার গোত্রের নিরাপত্তার জন্যই করেছি।”

“ভাল কথা, এখন গোত্রের শাস্তি নিজেই নির্ধারণ কর।” হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “তোমার জানা আছে, চুক্তিভঙ্গকারী গোত্রকে কেমন ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তুমি নিজে কোন শাস্তি নির্ধারণ না করলেও তুমি অবগত আছ যে, তোমার গোত্রের পরিণাম কি হবে? বনু কায়নুকা এবং বনু নযীরের পরিণতির কথা ভুলে গেছ? আল্লাহর কসম! তোমার গোত্রের পরিণতি হবে আরো ভয়াবহ।”

কা’ব বিন আসাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে– “হ্যাঁ, সা’দ, আমি জানি, আমার গোত্রের পরিণতি কি হবে! আমাদের শিশু এবং মহিলারাও শেষ হয়ে যাবে। আমার সিদ্ধান্ত, চুক্তি মোতাবেক আমার গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করে ফেল মহিলা এবং বাচ্চাদেরকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। আমরা মারা গেলেও তারা তো জীবিত থাকবে।”

“শুধু জীবিতই থাকবে না।” হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “তারা আল্লাহর সত্য নবীর অনুসারী হয়ে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করবে।… পুরুষদের বাইরে বের করে দাও।”

♣♣♣

হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখান থেকে ফিরে আসেন।

তিনি ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন– “হে আল্লাহর রাসূল! বনু কুরাইযা নিজেরাই শাস্তি বেছে নিয়েছে। যুদ্ধ-সক্ষম পুরুষদের হত্যা করা হবে। আর নারী ও শিশুদেরকে আমাদের দায়িত্বে নিয়ে যেতে হবে।”

বনূ কুরাইযার পুরুষদের সকলে কেল্লা ছেড়ে বাইরে আসতে থাকে। কড়া অবরোধের জন্য কারো পালিয়ে যাবার সুযোগ ছিল না। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, ইহুদীদের ইতিহাস নৈরাশ্য, আর চুক্তি লঙ্ঘনের ইতিহাস। তাদের মানবেতিহাস এ সমস্ত অমোছনীয় কলঙ্কে ভরা। এ জন্য বিশ্বে তারা ‘আল্লাহর তিরস্কৃত’ জাতি হিসেবে পরিচিত। তাদেরকে যেই সম্মান প্রদর্শন করেছে, তারা তাকে চির লাঞ্ছিত করে ছেড়েছে। বনু কুরাইযাকে যদি ক্ষমা করে দেয়া হত তা হলে তা হত সাংঘাতিক বোকামির কাজ। মুসলমানরা জেনে-শুনে এ পথে পা বাড়ায় না। তারা যুদ্ধে সক্ষম সকল পুরুষকে হত্যা করে। আর বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদেরকে নিজেদের অভিভাবকত্বে নিয়ে নেয়।

দু’জন ঐতিহাসিক লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযায় সৈন্য প্রেরণ করলে ইহুদীরা প্রবলভাবে সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুসলমানরা দীর্ঘ পঁচিশ দিন যাবৎ তাদের অবরোধ করে রাখে। পরিশেষে ইহুদীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এই আবেদন করে যে, যেন হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের অনুরোধে সাড়া দেন এবং এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন যে, বনূ কুরাইযার যুদ্ধ সক্ষম পুরুষদের হত্যা করা হবে। এবং নারী ও শিশুরা গণিমত হিসেবে বিবেচিত হবে। সমঝোতা অনুযায়ী চারশ ইহুদীকে কতল করা হয়।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, মুসলমানদের সাথে বনু কুরাইযার সংঘর্ষ হয়নি। অবরোধের এক পর্যায়ে তারা তাদের অপরাধের শাস্তি মাথা পেতে নিতে কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

মদীনায় ইহুদীদের গণহত্যার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ইতোপূর্বে এমন ঘটনা আরো দু’বার ঘটেছে। বনু কায়নুকা এবং বনু নযীর নামক ইহুদীদের অপর দু’টি গোত্র চুক্তি ভঙ্গ করায় ইতোপূর্বে মুসলমানরা তাদেরকে এমনই শাস্তি দিয়েছিল। তখন তাদের নারী এবং শিশু-কিশোররা সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করেছিল। তৎকালে সিরিয়া ছিল ইরানীদের দখলে। পরে হিরাক্লিয়াস নামক এক খ্রিষ্টান নরপতি হামলা চালিয়ে সিরিয়া দখল করে নেয়। ইহুদীরা তার সাথেও গাদ্দারী করে। এতে বাদশা হিরাক্লিয়াস খুবই ক্ষেপে যায়। মদীনায় মুসলমানরা বনু কুরাইযাকে যে মুহূর্তে হত্যা করে চলে, ওদিকে হিরাক্লিয়াসও তখন বনূ নযীর ও বনূ কায়নুকার উপর প্রতিশোধ নিতে গণহত্যা চালায়।

হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত হিশাম বিন উরওয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন এবং বনু কুরাইযার ইহুদীদেরকে হত্যা করা হয়। হযরত হিশাম রাযিয়াল্লাহু আনহু তাও উল্লেখ করেছেন যে, তার সম্মানিত পিতা তাকে এ ঘটনা শুনিয়েছেন যে, খন্দক যুদ্ধে হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বুকের উপরিভাগে বর্শা বিদ্ধ হয়। বনু কুরাইযার শাস্তি শেষ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে মসজিদে নব্বীর কাছে হযরত মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য একটি তাঁবু স্থাপন করা হয়। চিকিৎসা ও সেবা যত্নের সুবিধার্থে তাকে এখানে রাখা হয়।

হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁবুতে শুয়ে পড়েন। কিন্তু কেন যেন ঘুম আসছিলনা। তিনি উঠে বসেন। আল্লাহর কাছে দু’আ করেন, হে আল্লাহ্ বড় সাধ ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যারা সত্য নবী বলে মানে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন উৎসর্গ করা। আপাতত লড়াই শেষ হওয়াতে আমার সাধ আর পূরণ হল না। তিনি আল্লাহর দরবারে বড় অনুনয়-বিনয় করে দুআ করেন, অল্পদিনের মধ্যে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে পর্যন্ত আমার হায়াত বৃদ্ধি করে দাও। আর যদি যুদ্ধের ধারাবাহিকতা আপাতত বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমার ক্ষত ভাল করে দাও, যাতে আমার জীবন তোমার পথে উৎসর্গ হয়।

হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দুআ অন্তত চারজন লোকে শুনেন। কিন্তু তারা এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ভোরে দেখা যায় হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাঁবু থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে আসছে। তাঁবুতে প্রবেশ করে জানা যায় তিনি শহীদ হয়ে গেছেন। হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর দরবারে শাহাদাত কামনা করেছিলেন। আল্লাহ তার দুআ কবুল করেছেন। তার প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের ব্যাণ্ডেজ খুলে যায়। আর তা হতে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণের ফলে রক্তশূন্য হয়ে তিনি চির কাঙ্ক্ষিত শাহাদাত লাভে ধন্য হন।

বনু কুরাইযার পরিণতির খবর মক্কায় পৌঁছলে সবচেয়ে বেশি খুশী হয় আবু সুফিয়ান।

“আল্লাহর কসম! বনু কুরাইযার নেতা কা’ব বিন আসাদ আমাদের সাথে যে গাদ্দারী করেছিল তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে।” আবু সুফিয়ান আনন্দে বলে– “তারা যদি গাদ্দারী না করে রাতের অন্ধকারে মদীনায় গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত রাখত, তাহলে আমাদেরই বিজয় নিশ্চিত হত। সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে মৃত্যু নয়, গণিমতের মাল দিতাম। খালিদ তুমি কি বল। বনু কুরাইযার পরিণতি কি বড়ই দুর্ভাগ্যজনক হয়নি?”

খালিদ আবু সুফিয়ানের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আবু সুফিয়ানের কথা তার মনঃপূত হয়নি।

“বনু কুরাইযার এই পরিণতিতে তুমি কি খুশি নও খালিদ?” আবু সুফিয়ান তাঁর চাহনি দেখে প্রশ্ন করে।

“মদীনা থেকে পশ্চাদপসারণের বেদনা এতই গভীর যে, যত বড়ই সুসংবাদ হোক না কেন আমার বেদনা প্রশমিত করতে পারবে না।” খালিদ বলেন– “গাদ্দারের বন্ধুত্ব শত্রুতার চেয়েও ভয়ঙ্কর। বলতে পার, ইহুদীরা এ পর্যন্ত কার সাথে অঙ্গীকার ঠিক রেখেছে? ইহুদীবাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিজ কন্যাকে অন্য জাতির পুরুষদের শয্যাসঙ্গী করতে কুণ্ঠাবোধ করে না তাদের মত নীচ জাতিকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না।”

“মুসলমান নয়, প্রবল ঝড়ই অবরোধ উঠিয়ে নিতে আমাদের বাধ্য করেছিল।” আবু সুফিয়ান বলে– “তাছাড়া খাদ্য সংকটও ছিল আমাদের।”

হযরত খালিদ গোস্বা ভরে একথা বলেন– “যুদ্ধের মানসিকতাই তোমার ছিল না।”

এরপর থেকে খালিদ অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকতেন। কেউ কথা বলতে চাপাচাপি করলে রেগে যেতেন। তার এই নীরবতাকে ঝড়ের পূর্বাভাস ভেবে আবু সুফিয়ান ভিতরে ভিতরে আতংকগ্রস্থ হয়ে ওঠে। খালিদ তাকে ভীতু-কাপুরুষ বলতেন। তিনি মনে মনে ওয়াদা করেছিলেন, যে করেই হউক মুসলমানদেরকে পরাজিত করবেনই। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে যখন মুসলিম বাহিনীর অপূর্ব রণকৌশল এবং বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা মনে পড়ত তখন মনে মনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হাজারো ধন্যবাদ দিতেন। এমন যুদ্ধ-স্পৃহা এবং সমর-কুশলতা ও প্রজ্ঞা কুরাইশদের মধ্যে ছিলনা। এ জাতীয় প্রজ্ঞা ও মেধা খালিদের মধ্যে ছিল। কিন্তু তিনি নিজ গোত্র থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পান না।

আজ মদীনার দিকে একাকী যাবার কালে খালিদের খন্দক রণাঙ্গন হতে সেই পশ্চাদপসারণের কথা স্মরণ হয়। মদীনায় আরেকটি আক্রমণ করার বড় ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু কুরাইশরা মোটেও সম্মত হয় না। তারা মদীনার নাম শুনলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেত।

একদিন তিনি জানতে পারলেন যে, মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে আসছে। আবু সুফিয়ানই তাকে এ সংবাদ জানায়।

“মক্কা আক্রমণ করতে মুসলমানদের দুঃসাহস শুধু এ কারণে হয় যে, আমরা বারবার প্রমাণ করেছি যে, কুরাইশরা মুহাম্মাদকে সত্যিকার অর্থেই ভয় পায়।” খালিদ আবু সুফিয়ানকে বলেন– “তুমি জনগণকে কখনো জানিয়েছ যে, মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে পারে? তারা এই হামলা প্রতিহত করতে প্রস্তুত আছে?”

আবু সুফিয়ান বলে– “এখন এটা বিশ্লেষণের সময় নেই যে, আমরা অতীতে কি করেছি আর কি করিনি। আমার গোয়েন্দারা জানিয়েছে যে, মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। তুমি এ বিষয়ে একটু চিন্তা করবে কি?”

“আমার চিন্তা করা হয়ে গেছে।” হযরত খালিদ বলেন– “আমাকে তিনশ অশ্বারোহী দাও। আমি পথেই মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করব। ‘কারাউল গামীম’ পাহাড়ের খাদে খাদে আমরা ওঁৎ পেতে বসে থাকব। তারা এ উপত্যকা হয়েই আসবে। আমি তাদেরকে এই পাহাড়ি ভূমিতে ধুঁকে ধুঁকে মারব।”

যত লাগে অশ্বারোহী নিয়ে যাও।” আবু সুফিয়ান তার আবেদনে সাড়া দিয়ে বলে– “এবং এখনই রওনা হয়ে যাও। এমন যেন না হয়, তোমরা সেখানে পৌঁছার আগেই তারা সে স্থান পেরিয়ে চলে আসে।

খালিদের পরিষ্কার মনে পড়ে, মুসলমান কর্তৃক মক্কার উপর আক্রমণ করতে রওনা হবার সংবাদ তার দেহে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল। তিনি ঐ দিনেই তিনশ অশ্বারোহী সমন্বয়ে এক শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে ফেলেন। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১৪০০ শত। অধিকাংশই পদাতিক। তিনশ অশ্বারোহীর নেতৃত্ব নিজের হাতে থাকায় খালিদ খুব উৎফুল্ল ও হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন এবার তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারো অধীনস্থ নন। যে কোন মুহূর্তে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে। মুসলমানদেরকে চুড়ান্তভাবে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি।

♣♣♣

দীর্ঘ এক বছর পর খালিদ এখন মদীনার পথে। নিজের বিশ্রাম এবং ঘোড়াকে যথা সময়ে পানি পান করিয়ে চলছিলেন। ঘোড়াকে ক্লান্ত হতে দেন না। মক্কা থেকেই ঘোড়া স্বাচ্ছন্দে পথ পাড়ি দিয়ে আসে। খালিদ ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক। তার দেমাগে ইচ্ছা বেশি উদয় হত। দেমাগের উপর সর্বদা তার কড়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু মদীনার পথে এসে দেমাগ তার উপর সওয়ার হয়ে যায়। স্মৃতির থাবা সামুদ্রিক তুফানের মধ্যে চলন্ত জাহাজের ন্যায় তার অভ্যন্তরে উত্থান-পতন ঘটাতে থাকে। ভারসাম্যহীনের মত তার অবস্থা কখনো এমন হত যে, তিনি খুব তাড়াতাড়ি মদীনায় যেতে চাইছেন। আবার কখনো চলার গতি বলে দিত যে, তার তাড়াতাড়ি যাওয়ার মোটেও তাড়াহুড়া নেই। তার চোখে দূরের বাড়ি-ঘরগুলো মরীচিকা মনে হয়। চলার সময় এগুলো ক্রমে দূরে সরে যেতে থাকে।

আরোহী মাথা ঝাঁকি দিয়ে আশেপাশে দেখে নেন। তার ঘোড়া একটু উঁচু জায়গা পার হচ্ছিল। দিগন্ত থেকে উহুদের পর্বতগুলো ইতোমধ্যে আরো উপরে উঠে আসে। খালিদের জানা ছিল একটু পরেই এই পাহাড়সমূহের গা ঘেঁষে মদীনার শহর ভেসে উঠতে থাকবে।

এ সময় স্মৃতি আরেকবার তাকে পশ্চাতে নিয়ে যায়। মদীনার পরিখা এবং তা হতে পশ্চাদপসারণের কথা স্মরণ হয়। পাশাপাশি মুসলমানদের হাতে ৪০০ ইহুদীর হত্যার দৃশ্যও তার চোখে ভেসে উঠে। বনু কুরাইযার এই মর্মান্তিক সংবাদে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বেজায় খুশি হলেও খালিদ খুশিও হননি আবার দুঃখও প্রকাশ করেননি।

“ইহুদীদের প্রতারণার উপর নির্ভর করে কুরাইশরা মুহাম্মাদের অনুসারীদের পরাস্ত করতে চায়।” খালিদের মাথায় এই একটি কথা বারবার উদয় হতে থাকে। তিনি চিন্তা থেকে এই কথাটি ঝেড়ে-মুছে ফেলতে সমস্ত মাথায় হাত বুলান।

স্মৃতির চাকা খালিদকে অতীত থেকে দূর অতীতে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘণ্টার টুনটুন শব্দ তাকে অতীত থেকে বের করে নিয়ে আসে। তিনি শব্দের উৎস খুঁজতে থাকেন। বামে বিস্তীর্ণ নিম্নভূমি ছিল। তিনি চলছিলেন উপর দিয়ে। বামের নিম্নপ্রান্তে গিয়ে তার চোখ স্থির হয়ে যায়। চারটি উট নিম্নপ্রান্ত দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেন। উটগুলো চলছিল একের পর এক, লাইন দিয়ে। উটগুলোর পাশে একটি ঘোড়াও চলছিল। উটে দুজন নারী, কতক শিশু এবং দু’জন পুরুষ ছিল। কোন উটে আসবাবপত্রও ছিল। ঘোড়ার আরোহী ছিল এক অশীতিপর বৃদ্ধ। তাদের চলায় যথেষ্ট গতি ছিল। খালিদ ঘোড়ার গতি একটু কমিয়ে দিলেন।

উট-ঘোড়া সমৃদ্ধ ছোট কাফেলাটি খালিদের কাছে এসে পড়ে। বৃদ্ধ অশ্বারোহী তাকে চিনে ফেলে।

“তোমার সফর শুভ হোক ওলীদের পুত্র!” বৃদ্ধ হস্তদ্বয় প্রসারিত করে দোলায় এবং বলে– “নিচে এস, কিছুদুর এক সাথে যাই।”

খালিদ লাগাম ধরে টান দেন এবং হালকাভাবে ঘোড়ায় পদাঘাত করেন। প্রশিক্ষিত ঘোড়া প্রভুর ইশারা পেয়ে চোখের পলকে নিচে নেমে আসে।

খালিদ নিজের ঘোড়াটি বৃদ্ধের ঘোড়ার পাশে নিয়ে গিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে বলেন– “আবু যুরাইয!… আমার অনুমান এরা তোমার পরিবার-পরিজন।”

বৃদ্ধ আবু যুরাইয বলে– “হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ, এরা আমার পরিবারের লোক।… তা খালিদ তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমার বিশ্বাস, নিশ্চয় মদীনায় নয়।… সেখানে তোমার কি দরকার?”

কাফেলাটি ছিল গাতফান গোত্রের। তারা বসতি স্থানান্তর করছিল। আবু যুরাইয নিজেই যখন বলে যে, খালিদ মদীনায় যাচ্ছে না তখন তিনি তার গন্তব্য না জানানোই ভাল মনে করেন।

কুরাইশদের বর্তমান ভাবনা কী?” আবু যুরাইয জানতে চায়। এ খবর কি সত্য নয় যে, মানুষ দলে দলে মুহাম্মাদকে নবী বলে স্বীকার করে নিচ্ছে? এ ধারা চলতে থাকলে সেদিন কি অতি নিকটে নয় যে, মদীনাবাসী একদিন মক্কার উপর চড়াও হবে আর আবু সুফিয়ান তাদের সামনে সারেন্ডার করবে?”

“যে নেতা নিজের পরাজয়ের বদলা গ্রহণ করা জরুরী মনে করে না, হাতিয়ার সমর্পণ করাটা তার নিকট কিছুই নয়।” খালিদ বলেন– “তোমার মনে নেই, আমরা সম্মিলিতভাবে মদীনা আক্রমণ করতে গেলে মদীনাবাসী আক্রমণ এড়াতে চতুর্দিকে পরিখা খনন করেছিল?” কিছুক্ষণ থেমে খালিদ আবার বলেন– “আমরা ইচ্ছা করলে পরিখা অতিক্রম করতে পারতাম। আমি অতিক্রম করেছিলামও। ইকরামাও ওপারে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের সৈন্যরা-যাদের মধ্যে তোমার গোত্রের সৈন্যরাও ছিল– আমাদের সহযোগিতা করেনি, দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে। দুঃখের কথা আর কি বলব, মদীনা থেকে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি পশ্চাদপসারণ করে, সে লোকটি ছিল আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ান।”

“আমার বাহুতে এখন আর বল নেই ইবনে ওলীদ” আবু যুরাইয দুর্বলতার কারণে কম্পমান একটি হাত খালিদের সম্মুখে তুলে ধরে বলে– “শরীরে একটু শক্তি থাকলেও আমি সে যুদ্ধে নিজ গোত্রের সাথে থাকতাম।… যেদিন আমার গোত্র মদীনা থেকে পশ্চাদপসারণ করে ফিরে আসে সেদিন আমি কেঁদেছিলাম।… যদি কা’ব বিন আসাদ গাদ্দারী না করত এবং মদীনায় তিন-চারটি গেরিলা আক্রমণ চালাত তাহলে বিজয় নিশ্চিত আমাদেরই হত।”

খালিদ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি আবু যুরাইযের প্রতি ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকান এবং চুপ থাকেন।

“ইউহাওয়া নাম্নী এক ইহুদী নারী যারীদ বিন মুসাইয়্যিব নামক তোমার গোত্রের এক ব্যক্তিকে মুহাম্মাদকে হত্যা করার উদ্দেশে প্রস্তুত করার ঘটনা তুমি শুনেছ?” আবু যুরাইয জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ।” খালিদ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেন– “শুনেছি। বড় লজ্জা করে যখন শুনি যারীদ আমার গোত্রের লোক ছিল। এখন সে কোথায়? এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল তার কোন খোঁজ নেই। শুনেছি ইউহাওয়া তাকে সাথে করে ইহুদী জাদুকর লাঈছ বিন মোশানের নিকট নিয়ে গিয়েছিল। মোশান মুহাম্মাদকে হত্যার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে গড়ে তোলে। কিন্তু মুসলমানদের তরবারির সামনে লাঈছের জাদু অসহায় হয়ে পড়ে। মুসলিম বাহিনী খন্দক হতে ফিরে সোজা বনু কুরাইযার বসতি অবরোধ করার সময় লাঈছ, ইউহাওয়া ও যারীদ সেখানে ছিল। কা’ব বিন আসাদের সহযোগিতায় এ তিনজন জানালা-পথে সরে পড়তে সক্ষম হয়। এরপরে আর কি হলো জানি না।” “জানালা-পথে তিনজন বের হলেও দু’জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।”

আবু যুরাইয পরবর্তী ঘটনা জানায়– “যারীদের মধ্যে লাঈছের জাদুর আছর হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলে যারীদ তাদের সাথে পালিয়ে যেতে অস্বীকার করে। বাধ্য হয়ে ইউহাওয়া এবং লাঈছ তাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঠিক এ মুহূর্তে তারা অবরোধকারী একদল মুসলিম সৈন্যের নজরে পড়ে যায়। সৈন্যরা তাদের থামতে বললে ইউহাওয়া ও লাঈছ প্রাণ বাঁচাতে যারীদকে রেখেই পালিয়ে যায়। জাদুর প্রভাবে যারীদের হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। সে মুসলিম সৈন্যর আওয়াজ পেয়ে তরবারি কোষমুক্ত করে সৈন্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যারীদ যেতে থাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম ধরে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি ও তাকে হত্যার কথা ব্যক্ত করে। এতে অবরোধকারী সৈন্যরা তীর ছুঁড়লে সে তীরের আঘাতেই যারীদ মারা যায়। একটু থেমে আবু যুরাইয আবার বলে– “লাঈছ এবং ইউহাওয়া জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও এখন তাদের মধ্যে মাত্র একজন বেঁচে আছে। আর সে হল লাঈছ। শুধু লাঈছ বিন মোশানই বেঁচে আছে।”

“আর ইউহাওয়া?” খালিদ গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চান– “তার কি হল? সে এখন কোথায়?”

“সে এখন প্রেতাত্মায় পরিণত।” আবু যুরাইয বলে– “সে এক দীর্ঘ কাহিনী, হৃদয়বিদারক ঘটনা। তুমি শুনতে চাইলে খুলে বলতে পারি। ইউহাওয়াকে তুমি ভাল করেই চেন। সে মক্কাতেই বাস করত। যদি বল যে, তাকে দেখে তোমার অন্তরে কখনো আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি এবং তোমার মধ্যে উষ্ণ শিহরণ জাগত না তাহলে আমি বলব, তুমি মিথ্যা বলছ। খালিদ! তোমাকে কেউ জানায়নি, কেন গাতফান কুরাইশদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল? অন্যান্য গোত্রের সরদাররাও কিভাবে আবু সুফিয়ানকে শীর্ষ নেতা হিসেবে মেনে নিল? এটা ইউহাওয়া এবং তার মত আরো চারজন ইহুদী নারীর জাদু ছিল। তাদের জাদুবলেই ‘অসম্ভব’ সম্ভবে পরিণত হয়েছিল।

ঘোড়া এবং উটগুলো যাচ্ছিল নিজস্ব গতিতে। উটের গলায় ঝুলানো ঘন্টা আবু যুরাইযের বাক-ভঙ্গির সাথে তাল মিলিয়ে মুগ্ধকর মিউজিক সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। খালিদ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল প্রতিটি শব্দ।

যারীদ বিন নুসাইয়্যিব ইউহাওয়ার প্রেমডোরে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর যুরাইয ইউহাওয়ার ঘটনা বলতে শুরু করে– “তুমি জান না ইবনে ওলীদ। ইউহাওয়া যারীদকে নিজের জাদুতে বন্দি করে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। আমি লাঈছ বিন মোশানকে চিনি। যুবক বয়সে আমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও সখ্যতা ছিল। জাদুগিরি এবং নজরবন্দি তার পিতার বিশেষ জ্ঞান ছিল। পিতাই তাকে এই বিদ্যা উত্তরাধিকার সূত্রে দান করে যায়। তুমি আমার কথা শুনছ তো ওলীদের পুত্র না কি বিরক্ত হচ্ছ? কথা বলা ছাড়া এখন আমার কিছুই করার শক্তি নেই।”

খালিদ হেসে উঠে বলেন– “শুনছি আবু যুরাইয! মনোযোগ দিয়ে শুনছি।”

“এটা তো তুমি জান যে, মুসলমানদের পরিখা এবং ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের সৈন্যরা মদীনার অবরোধ তুলে নিয়ে পিছু হঁটতে বাধ্য হওয়ার পর যখন মুহাম্মাদ কালবিলম্ব না করে বনু কুরাইযার কেল্লা অবরোধ করে।” আবু যুরাইয গোড়া হতে আরম্ভ করে– “তখন লাঈছ বিন মোশান, ইউহাওয়া এবং যারীদ কেল্লার মধ্যে ছিল। অবরোধের কথা জানতে পেরে তারা সুড়ঙ্গ পথে বাইরে বেরিয়ে যায়। কিন্তু পথিমধ্যে জনৈক মুসলিম সৈন্যের চোখে পড়ে যাওয়ায় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তারা যারীদকে ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আবু যুরাইয!” খালিদ বলেন– “এ ঘটনাও আমার জানা আছে যে, অবরোধের পর মুসলমানরা বনু কুরাইযার পুরুষদের হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদের সাথে নিয়ে যায়।”

“আমার কথা শুনতে শুনতে তুমি বিরক্ত হচ্ছ তাই না?” আবু যুরাইয হাসতে হাসতে বলে– “তুমি আমার সব কথা শুনছ না।”

খালিদ বলেন– “ঘটনা সেখান থেকে শুনাও যেখান থেকে আমি ইতোপূর্বে শুনিনি। আমি এ পর্যন্ত জানি যে, বুড়ো জাদুকরের যাদুর প্রভাবে যারীদ অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এক মুসলিম সৈন্যের বাণাঘাতে মারা যায় এবং লাঈছ ইউহাওয়াকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যায়।”

আবু যুরাইয বলে যায়। এর পরের ঘটনা হলো উহুদ পাহাড়ের মধ্যবর্তী যে বসতি আছে তারা এক রাতে কোন মহিলার চিৎকার শুনতে পায়। তৎক্ষণাৎ বাহাদুর প্রকৃতির তিন-চারজন লোক ঘোড়ায় চেপে তরবারি-বর্শা নিয়ে দ্রুত ছুটে আসে। কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজির পরও কোন নারীর দেখা তারা পায়নি এবং চিৎকারও থেমে যায়। তারা এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে চলে আসে।”

“চিৎকার মরুভূমির কোন শিয়াল কিংবা বাঘেরও তো হতে পারে।” খালিদ মাঝখানে বলে ওঠে।

বাঘ এবং নারীর চিৎকারের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবু যুরাইয বলে– “লোকজন এটাকে কোন মজলুম নারীর আর্তচিৎকার ভেবেছিল। তারা শেষে এই ভেবে ক্ষান্ত হয়ে যায় যে, হয়ত ডাকাতেরা কোন নারীকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে থাকবে কিংবা সে কোন জালেম স্বামীর স্ত্রী হবে। সফরে যাবার সময় স্বামীর যুলম সইতে না পেরে এমন চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু এই একই চিৎকার পরের রজনীতে আরেক এলাকায় শোনা যায়। সেখানকার কিছু লোকও চিৎকার শুনে ছুটে যায়। কিন্তু তাদের চোখেও কিছু পড়েনি। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় রজনীতেও থেকে থেকে এমনি নারী চিৎকার শোনা যেত এবং রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে এক সময় হারিয়ে যেত।…

তারপর পহাড়ী লোকেরা আরো জানায় যে, পরে আর্তচিৎকারের সাথে সাথে নারীর এ করুণ ডাকও ভেসে আসতে থাকে– “যারীদ তুমি কোথায়? এসো প্রিয়তম আমি তোমার অপেক্ষায়।” সেখানকার লোকেরা যারীদ নামে কাউকে চিনত না। এলাকার প্রধান লোকদের মন্তব্য যে, এটা কোন পুরুষের প্রেতাত্মা হবে, যা নারীরূপে চিৎকার করে ফিরছে।”

আবু যুরাইযের বলার ভঙ্গিতে দারুণ আকর্ষণ ছিল। যে কাউকেই সহজেই প্রভাবিত করত। কিন্তু খালিদের চেহারাতে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।

“লোকজন ঐ রাস্তায় চলাচল করা ছেড়ে দিয়েছে যেখানে এই চিৎকার শোনা যেত।” আবু যুরাইয বলে, “একদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ ভ্রমণরত দুই ঘোড়-সওয়ার দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে এক লোকালয়ে পৌঁছে। ঘোড়ার শরীর থেকে এমনভাবে ঘাম বের হয়, যেন সদ্য পানি হতে উঠে এল। অশ্বারোহীদ্বয় ভীত-সন্ত্রস্ত এবং ঠকঠক করে কাঁপছিল। তারা স্বাভাবিক হয়ে জানায়, এক উপত্যকার মধ্য দিয়ে গমনকালে তারা এক নারী কণ্ঠের এ আর্তনাদ শুনে– “যারীদ! দাঁড়াও! আমি আসছি।” আওয়াজ যেদিক থেকে আসে অশ্বারোহীদ্বয় সেদিকে তাকায়। একটি পর্বত-চূড়ায় এক মহিলা দাড়িয়ে তাদের লক্ষ্য করে এভাবে বলছিল। দূর থেকে তাকে যুবতীই মনে হয়। সে পর্বত থেকে তাদের উদ্দেশে নিচে অবতরণ করতে থাকলে অশ্বারোহীয় ভয়ে ঘোড়া উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়ে দেয়।…

“সম্মুখের মরুপ্রান্তরটি বাক খাওয়া ছিল। অশ্বারোহীদ্বয় মরুচক্রের শিকার হয়। তিন-চার বার একই স্থানে চক্কর দিতে থাকে। ভয়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলেছিল। এক মরুবাঁক পার হয়ে তাদের সম্মুখে ত্রিশ-চল্লিশ কদম দূরে এক যুবতী মহিলাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মহিলাটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ এবং মাথার চুল ছিল এলোমেলো। রক্তশূন্যতার কারণে লাশের ন্যায় ফ্যাকাশে সাদা ছিল তার চেহারা। অশ্বারোহীদ্বয় থমকে দাঁড়ায়। মহিলাটি দু’হাত প্রসারিত করে সামনের দিকে দৌড় দেয় এবং বলে– “দীর্ঘদিন যাবত আমি তোমাদের দু’জনের অপেক্ষায় ছিলাম।” অশ্বারোহীদ্বয় তার এ কথা শুনে ঘোড়া ঘুরিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে পালিয়ে যায়। বুড়ো আবু যুরাইয এ পর্যন্ত বলে চুপ করে থাকে এবং খালিদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেষ্টা করে। খালিদকে আনমনা দেখে সে তার হাত খালিদের রানের উপর রেখে বলে– “আমি দেখেছি তোমার কাছে কোন খাদ্য দ্রব্য নেই। তুমি চাইলে এখান থেকে প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ ও বিশ্রাম নিতে পার। আর কবে তোমার দেখা পাব, কে জানে। তোমার পিতা ওলীদ ব্যক্তিত্বশালী লোক ছিল। বলতে গেলে আমার হাতেই তোমার জন্ম। আমি তোমার আপ্যায়ন করতে চাই। অশ্ব থামিয়ে নিচে নেমে আস।

অতঃপর কাফেলাটি সেখানেই থেমে যায়।

♣♣♣

“ঐ নারীরূপটি কোন পুরুষ কিংবা মহিলার প্রেতাত্মাই হবে।” আবু যুরাইয খালিদের সামনে ভুনা গোশত পেশ করতে করতে বলে– “খাও, ওলীদের বেটা… এরপর আরেক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। একটি এলাকায় এক অপরিচিত ব্যক্তি এমন অবস্থায় এসে ধপাস করে পড়ে যে, তার মুখমণ্ডলে ক্ষতের দীর্ঘ রেখা ছিল। ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত পড়ছিল। তার পরিহিত বস্ত্র ছিল ছিন্ন ভিন্ন দেহের অন্যান্য স্থানেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। লোকটি ধপাস করে পড়েই অজ্ঞান হয়ে যায়। আশে-পাশের লোকজন তার ক্ষত স্থান ধুয়ে দেয় এবং চোখ-মুখে পানির ঝাপটা দেয়। কিছুক্ষণ পরে লোকটির জ্ঞান ফিরলে সে জানায়, সে দু’টি মরু পর্বতের মাঝ বরাবর পথ ধরে আসছিল। হঠাৎ এক পর্বতের উপর থেকে এক নারী চিৎকার করতে করতে এত দ্রুত নেমে আসে, যা কোন সাধারণ নারীর পক্ষে সম্ভব নয়।…

লোকটি এমনভাবে থমকে দাঁড়ায় যেন এক ভীষণ আতঙ্ক তার দেহের সকল শক্তি কেড়ে নিয়েছে। মহিলাটি এত দ্রুত আসে যে, নিজেকে সামলাতে না পেরে ঐ লোকটির সাথে ধাক্কা খায় এবং চিৎকার দিয়ে বলে– “তুমি এসে গেছ যারীদ। আমি জানতাম তুমি জীবিত। এসো এসো…।

‘লোকটি তাকে বলে, সে যারীদ নয়। কিন্তু মহিলা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তার হাত বাহুবন্ধ করে দস্তরমত টানতে শুরু করে এবং বলে– “তুমি যারীদ। আমার যারীদ।” লোকটি তার বাহুবন্ধন হতে মুক্তির জন্য তাকে ধাক্কা মারে। মহিলা পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। লোকটি তাকে কোন পাগলিনী ভেবে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার মহিলাটি তার দিকে এমনভাবে আসে যে, তার দাঁত বাঘের মত বাইরে বের করা ছিল এবং সে হাত এমনভাবে সম্মুখে মেলে রাখে যে, তার আঙ্গুলগুলো হিংস্র প্রাণীর পাঞ্জার মত বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লোকটি মহিলাটির এ রূপে ভয় পেয়ে পিছু হটতে থাকে। হঠাৎ এক পাথরে হোঁচট খেয়ে মাটির দিকে পিঠ করে চিত হয়ে পড়ে যায়। মহিলাটি তাকে উঠার সুযোগ না দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাঘ যেমন শিকারকে পাঞ্জার মধ্যে নিয়ে যায় তেমনি সেও তার পাঞ্জা ঐ লোকটির চেহারার উপর রেখে নখ দিয়ে নির্দয়ভাবে শক্ত আঁচড় কেটে দেয়।…

লোকটি মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেকে তার নিচ থেকে বের করে আনে। কিন্তু মহিলা তার লম্বা লম্বা নখগুলো লোকটির পার্শ্বদেশে ঢুকিয়ে দেয়। পরিহিত বস্ত্র ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। চামড়াও মারাত্মকভাবে ক্ষত করে। আহত লোকটি আরো জানায়, মহিলার চোখ মুখ থেকে আগুনের শিখা বের হওয়ার মত মনে হয়। এ পশুসুলভ আচরণে লোকটি তাকে মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ার মনে করে। লোকটির কাছে খঞ্জর ছিল কিন্তু সে খঞ্জর বের করার কথাও ভুলে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মহিলাটির চুল তার হাতের নাগালে এসে যায়। সে চুল মুঠোতে নিয়ে এমন জোরে ঝাঁকি দেয় যে, মহিলাটি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। এই সুযোগে লোকটি পড়ি মরি ছুট দেয়। পেছন থেকে ঐ মহিলার চিৎকার তার কানে ভেসে আসতে থাকে। সে ভয়ে পিছন ফিরে তাকায় না; রুদ্ধশ্বাসে সম্মুখ পানে দৌড়াতে থাকে। সে মোটেও বলতে পারে না যে, কিভাবে সে এই লোকালয়ে এসে পৌঁছল। চেহারার ক্ষতের কারণে সে অজ্ঞান হয় না; চরম আতঙ্কেই তার জ্ঞান হারায়।

এর কিছুদিন পর দু’মুসাফির জানায়, তারা রাস্তায় এক ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে। লাশের অবস্থা বলে, কোন হিংস্র প্রাণীর থাবায় সে মারা গেছে। মুসাফিররা আরো জানায়, মৃতব্যক্তির বস্ত্র ছিন্ন-ভিন্ন এবং সমস্ত শরীরে নখের আঁচর ছিল। মহিলাটি যেখানে থাকত বলে জানা যায় তার ধারে কাছে একটি ছোট্ট বসতি ছিল। সেখানকার বাসিন্দারা স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে সেখানে লাঈছ বিন মোশান পৌঁছে যায়। কিভাবে যেন সে জানতে পারে যে, এই অঞ্চলে একটি মহিলা যারীদ, যারীদ বলে ডাকে এবং চিৎকার করে। হাতের কাছে কাউকে পেলে মারাত্মকভাবে আহত করে ছাড়ে।”

আবু যুরাইয অবশিষ্ট কাহিনী এভাবে বর্ণনা করে, প্রেতাত্মা সম্পর্কে তার খুবই কৌতূহল ও আগ্রহ ছিল। লাঈছ বিন মোশানও ছিল তার পরিচিত ব্যক্তি। সে যখন জানতে পারে যে, এই ইহুদী জাদুকর প্রেতাত্মার ঘটনাস্থলে গিয়েছে তখন সেও ঘোড়ায় চড়ে সেখানে যায়। দুতিন এলাকায় জিজ্ঞেস করতে করতে সে ঐ এলাকায় উপস্থিত হয় যেখানে লাঈছ পূর্বেই এসেছিল।

‘আবু যুরাইয!” বুড়ো লাঈছ দাঁড়িয়ে হস্ত প্রসারিত করতে করতে বলে– “তুমি এখানে কি করে এলে?”

“আমি এই সংবাদ শুনে এসেছি যে, তুমি ঐ প্রেতাত্মাকে বাগে আনতে এখানে এসেছ।” আবু যুরাইয বলে– “আমি যা শুনেছি তা-কি সত্য যে, এটা প্রেতাত্মা হোক বা অন্য কিছু হোক দু’তিনজন লোককে মারাত্মক আহত করেছে?”

“সে প্রেতাত্মা নয় দোস্ত” লাঈছ বিন মোশান কথাটি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত আওয়াজে বলে– “সে জিউসের খাঁটি প্রেমিক এক যুবতী। সে নিজের জীবন-যৌবন, সবকিছু ইহুদী স্বার্থে ওয়াকফ করে রেখেছিল। হতভাগীর নাম ইউহাওয়া।”

“আমি মক্কাতে কয়েকবার তাকে দেখেছি।” আবু যুরাইয বলে– “তার কিছু সত্য-মিথ্যা ঘটনাও শুনেছি। এর মধ্যে এটাও রয়েছে যে, সে যারীদ নামক এক কুরাইশকে তোমার কাছে নিয়ে গিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যার জন্য তৈরি করেছিল।

আমি এটাও শুনেছি যে, তুমি এবং ইউহাওয়া মুসলমানদের অবরোধ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে আর যারীদ পেছনে থেকে যায়। যদি ইউহাওয়া জীবিত থাকে এবং প্রেতাত্মা না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তার এ দুর্গতি কিভাবে হল?

“সে নিজের সবকিছু আল্লাহর নামে ওয়াকফ করে রেখেছিল।” লাঈছ বিন মোশান বলে– “কিন্তু তারপরেও সে একজন মানুষই ছিল। তার দেহে ছিল ভরা যৌবন। সে যৌবনের তুফানের কাছে পরাজিত হয়। যারীদের প্রেম অন্তরে ঠাঁই দেয়। আমার জাদু-মন্ত্রের প্রভাব যারীদের উপর যতটুকু ছিল, ইউহাওয়ার আন্তরিক ভালবাসার প্রভাবও ঠিক ততটুকু ছিল।”

আবু যুরাইয বলে – “বুঝেছি। যারীদ বিন মুসাইয়্যিবের মৃত্যু তাকে পাগলিনী করেছে।… তোমার জাদুবিদ্যা এই নারীর উপর চালানো যায় না?”

লাঈছ বিন মোশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং শূন্য দৃষ্টিতে আবু যুরাইযের দুই স্কন্ধে দু’হাত রেখে ঝুঁকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে– “আমার জাদু তার কাছে ফেল। সে আমার উপরেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমার জাদু তখনই কাজ করত যখন আমি তার চোখে চোখ রাখতে পারতাম এবং আমার হাত অল্প সময়ের জন্য হলেও তার মাথার উপর থাকতে পারত।”

“প্রেমবিদ্যা সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তার আলোকে বলছি।” আবু যুরাইয বলে– সে অনেক আগে থেকেই যারীদের প্রেমে পাগল ছিল। ফলে তোমার কারণে যারীদকে হারিয়ে সে তোমাকে শত্রু মনে করে।”

“হ্যাঁ, আমাকে দুশমন মনে করা তার একমাত্র কারণ হলো, আমি যারীদকে আমাদের সাথে না নিয়ে মুসলমানদের দয়ার উপর ছেড়ে এসেছিলাম।” লাঈছ বিন মোশান বলে, “আমি তাকে সঙ্গে আনতে পারতাম। কিন্তু সে আমার তেলেসমাতির প্রভাবে এতই প্রভাবিত হয় যে, তাকে জোর করে আনতে গেলে আমার কিংবা ইউহাওয়াকে হত্যা করার সম্ভাবনা ছিল। আমি তার মস্তিষ্কে হিংস্রতার এমন প্রভাব চাঙ্গা করে দিয়েছিলাম যে, সে রক্তপাত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না। একটি গাছের প্রতি ইশারা করে যদি বলতাম, এই যে ‘মুহাম্মাদ’, তবুও সে তরবারি দ্বারা ঐ গাছে আক্রমণ করত। তাকে ছেড়ে যাওয়ার পেছনে আমার এই আশা ছিল যে, হয়ত সে কোনভাবে মুহাম্মাদ পর্যন্ত পৌঁছে তাকে হত্যা করতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে নিজেই মারা পড়ে।”

“এখন কি ইউহাওয়াকে বাগে আনতে পারবে?” আবু যুরাইয লাঈছকে জিজ্ঞেস করে।

“তাকে বাগে আনতে পারবো বলে আমি এখনও আশাবাদী।” লাঈছ বিন মোশান আবু যুরাইযের প্রত্যুত্তরে জানায়।

“আমাকে তোমার সঙ্গে নিতে কোন অসুবিধা আছে?” আবু যুরাইয জিজ্ঞেস করে এবং বলে– “আমি কৌতূহল নিবৃত্ত করতে চাই। কিছু শিখতে চাই।”

“বার্ধক্য বাধা না হলে যেতে চাইলে যেতে পার।” লাঈছ বিন মোশান বলে, কিছুক্ষণ পরই আমি রওনা হব। এলাকার কিছু লোকও আমার সাথে যাবে।”

♣♣♣

“এই ইবনে ওলীদ!” বৃদ্ধ আবু যুরাইয এ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে বলে পাশে বসা খালিদের কাঁধে হাত রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে– “আমরা দুই বুড়ো উটে চড়ে ঐ পাহাড়ের দিকে যাত্রা করি, যেখানে একটি নারীর উপস্থিতির কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর আমরা সংকীর্ণ এক উপত্যকায় প্রবেশ করি। আমাদের পেছনে ছিল ১০/১২ অশ্বারোহী এবং ৩/৪ উষ্ট্ররোহী। উপত্যকায় প্রবেশকালে সবাই তীর সংযোজন করে ধনুক প্রস্তুত করে নেয়। উপত্যকাটি সামনের দিকে গিয়ে প্রশস্ত হয়ে যায়। আমরা ডান দিকে মোড় নিতেই লাশ ভক্ষণরত কয়েকটি শকুন দৃষ্টিগোচর হয়। শকুনদের মাঝ হতে একটি শিয়াল দৌড়ে বের হয়। আমি তার মুখে মানুষের একটি হাত দেখি। আমরা সামনে অগ্রসর হই। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আরো দুটো শিয়াল বের হয় এবং শকুন দল উড়ে যায়। সেখানে মানুষের হাড় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। মস্তক ছিল আলাদা লাশের লম্বা চুল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিল। মস্তকের খুলির সাথেও কিছু চুল ছিল। চেহারার অর্ধেকাংশে তখনও চামড়া ছিল।… লাশটি ছিল ইউহাওয়া। লাঈছ বিন মোশান দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তার বিক্ষিপ্ত হাড়গোড় এবং অর্ধেক খাওয়া চেহারা দেখতে থাকে। তার চোখ থেকে অশ্রুধারা বেয়ে তার দুধের মত সাদা দাড়িতে আটকে যায়। শেষে আমরা ফিরে আসি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *