১.৪ ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম

ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম এবং ইবনে কুতাইবা রাযিয়াল্লাহু আনহু লিখেন, আরবের এই বিখ্যাত কবির জবাব শুনে হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান এবং এত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে, নিজেই ঐ সন্দেহভাজনকে পাকড়াও কিংবা হত্যা করতে তৎক্ষণাৎ বের হয়ে পড়েন। তার এটা ভাবার ফুরসৎ ছিল না যে, এক সশস্ত্র পুরুষের মোকাবিলা করতে যাবার সময় একটি লাঠি কোনমতে হাতে পেয়েই তিনি শত্রুর উদ্দেশে ছুটে যান। পথ আবিষ্কার করতে সচেষ্ট সন্দেহভাজনকে আত্মগোপন কিংবা পলায়নের সুযোগ না দিয়ে সন্দেহভাজনের অবস্থান চিহ্নিত করে সরাসরি তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ান।

“কে তুমি?” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা রূঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।

সন্দেহভাজন চমকে পিছনে তাকান। অসৎ উদ্দেশে না এসে থাকলে তার আচার-আচরণ অন্য রকম হত। সে চোখের পলকে বর্শা উঁচু করে নিক্ষেপের প্রস্তুতি নেয়। ইতোমধ্যে সন্দেহভাজনের চেহারার উপর হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর চোখ পড়লে তার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে, লোকটি একজন ইহুদী এবং সে বনু কুরাইযার লোকই হবে। সন্দেহভাজনও এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আগন্তক যেহেতু নারী এবং তার হাতে একটি সাধারণ লাঠি মাত্র, তাই সে তাকে বিশেষ কোন অনিষ্ঠ করতে পারবে না।

“তোর উপর আল্লাহর লা’নত পড়ুক।” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন– “তুই বনু কুরাইযার গুপ্তচর না?”

ইহুদী গুপ্তচর বলে– “মুহাম্মাদের ফুফু! চলে যাও এখান থেকে বলছি!” “তুমি কি আমার হাতে নিহত হতে চাও?…হ্যাঁ, আমি বনূ কুরাইযার লোক।”

“তবে তুমি জীবন নিয়ে ফিরে যাবার আশা করো না।” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা তার পরিচয় পেয়ে বলেন।

ঐতিহাসিকগণ লিখেন, ইহুদীদের এই আচরণের খবর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পেরে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। শহরে খাদ্য-সংকট চরম আকার ধারণ করে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার মৌলিক চাহিদার এক-চতুর্থাংশ আহার পায়। তীব্র খাদ্য-সংকটে পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে দ্রুত সাহায্য কামনা করেন। সাথে সাথে সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকরী বিকল্প কোন উপায় বের করার চেষ্টা করেন।

♣♣♣

এদিকে খন্দকের উভয় পাড় ছিল তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ। তখনকার অস্থিরতা ও চরম উত্তেজনার কথা খালিদের মনে ছিল। তিনি খন্দকের পাড় বেয়ে বার বার অশ্বে চড়ে প্রদক্ষিণ করেন। কোন স্থানে নাক গলিয়ে খন্দক পার হওয়া যায় কি-না এই ছিল তার মূল পরিকল্পনা। তিনি ছিলেন রণাঙ্গনের বীর সৈনিক। যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়া তিনি নিজের জন্য অপমান জনক মনে করতেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সম্মুখ যুদ্ধের কোন সুযোগ ছিল না। এখানে এই প্রক্রিয়ায় যুদ্ধ চলে যে, খন্দকের যে জায়গায় মুসলমানরা শিবির করে অবস্থান করছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কুরাইশ সৈন্য তার কাছে গিয়ে মুসলমানদের উপর তীর বৃষ্টি বর্ষণ করত। মুসলমানরা তীরের জবাব তীর দ্বারাই দিতেন। কুরাইশ কোন সৈন্য অপর স্থানে টহলরত সৈন্যের উপর তীর ছুঁড়লে সাথে সাথে একদল মুসলিম সৈন্য তার সাহায্যে চলে আসতেন। মুসলমানদের পক্ষ থেকে রাতে খন্দকে টহলরত সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ করা হত। কুরাইশদের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় তারা পরিখা হতে পিছু হঁটে ক্যাম্পে গিয়ে অবস্থান নিত।

মদীনায় খাদ্য-সংকট দুর্ভিক্ষের রূপ নেয়ায় বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যেমনি জানা ছিল, তেমনি তার নিকট এ তথ্যও ছিল যে, কুরাইশ সৈন্যের অধিকাংশই অভুক্ত। এক প্রকার না খেয়েই তাদের দিন কাটছে। এটা এমন এক নাজুক পরিস্থিতি যা মানুষকে পরস্পরের শর্ত মেনে নেয়া এবং চুক্তি মেনে সমঝোতায় পৌঁছতে বাধ্য করে।

ইতিহাস সে ব্যক্তির নাম লিখেনি, যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনভাবে কুরাইশের মিত্রগোত্র ‘গাতফানের’ সেনাপ্রধান ‘আইনিয়া’-এর নিকট এই উদ্দেশে প্রেরণ করেন যে, সে তাকে কুরাইশদের বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে অনুপ্রাণিত করবে। তাকে মুসলমানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশ্য শুধু এটুকুই ছিল যে, প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে গাতফান এবং আইনিয়া সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে বহুজাতিক বাহিনী দু’হাজার সৈন্য হারাবে। এ আশাও ছিল যে, গাতফানের অনুকরণ করে অন্যান্য গোত্রও কুরাইশদের বিদায় জানাবে এবং বহুজাতিক বাহিনী হতে বেরিয়ে যাবে।

“মুহাম্মাদ কি আমাদেরকে কেবল মৌলিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে আহ্বান জানাচ্ছে?” সেনাপতি আইনিয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতের নিকট জানতে চায়– “এ পর্যন্ত আমাদের যে অর্থ সম্পদ ব্যয় হয়েছে তা বহন কে করবে?”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূত বলে– “আমরা বহন করব, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের গোত্র নিয়ে এলাকায় ফিরে গেলে এ বছর মদীনায় যত খেজুর হবে তার এক তৃতীয়াংশ তোমরা পাবে। তোমরা নিজেরাই মদীনা এসে খেজুর বাগানগুলো স্বচক্ষে দেখে যাবে এবং চুক্তিবদ্ধ খেজুর নিজেরাই সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে।”

সেনাপতি আইনিয়া রণাঙ্গনে নিজে যুদ্ধ করা ও করানোতে বেশ পটু ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে খুবই অনভিজ্ঞ ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনে কুতাইবা লিখেন, এ ঘটনার কিছুদিন পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে একটা নিরেট গর্দভ আখ্যা দেন। বলিষ্ট দেহ এবং শারীরিক শক্তিসম্পন্ন এক সদা হাস্যোজ্জল সুপুরুষ ছিল আইনিয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতের সাথে সাক্ষাতের পর সে গাতফান সর্দারের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে।

“খোদার কসম! মুহাম্মাদ আমাদের দুর্বল মনে করে এই বার্তা প্রেরণ করেছে গাতফান বলে– তার দূতের কাছে জিজ্ঞেস কর, মদীনায় যারা আছে তারা কি প্রায় না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে না? আমরা তাদেরকে এভাবে ক্ষুধার্ত রেখে তিলে তিলে মারব।”

‘ক্ষুধার তাড়নায় আমাদের সৈন্যদের দুর্বল অবস্থার কথা কি আপনি জানেন না।” সেনাপতি আইনিয়া বলে– “মদীনাবাসী ক্ষুধার্ত থাকলেও নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। আর আমরা এলাকা ত্যাগ করে মরুভূমিতে পড়ে আছি। সৈন্যদের হতাশা ও উদ্বেগ আপনি লক্ষ্য করেন নি? আপনি কি এটাও লক্ষ্য করেন নি যে, আমাদের ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাণ এখন আর ততদূরে যায় না, তীরন্দাজদের উদরপূর্তি থাকলে যতদূর যেত? ধীরে ধীরে তাদের বাহুবল দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে আসছে।”

“মুহাম্মাদের প্রস্তাবের জবাব কি তুমি দিবে?” গাতফান উত্তেজিত কণ্ঠে জানতে চায়– “না-কি গোত্রপ্রধান হিসেবে আমিই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিব?”

সেনাপতি আইনিয়া বলে– “খোদার শপথ! রণাঙ্গনের জন্য আমি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারব আপনি তা নিতে পারেন না। অপরদিকে লড়াই ছাড়া অন্য বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত আপনি নিতে সক্ষম, তা আমার দ্বারা কখনও সম্ভব নয়। আমার জ্ঞান তরবারি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এত জটিল যে, এখানে আমার সৈন্যদের তরবারি, বর্শা এবং তীর অকেজো হয়ে গেছে। পরিখার ধারে কাছে যেতেও আমরা অক্ষম। অতএব, এ মুহূর্তে মুহাম্মাদের প্রস্তাবকে স্বাগত জানানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

গোত্রপ্রধান ও সেনাপ্রধানের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর মুহাম্মাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দূত অনুকূল জবাব নিয়ে ফিরে আসে। মুসলমানদের কূটনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়। সতর্ক দূত অতিগোপনে যায়। এবং কার্যোদ্ধার শেষে নিরাপদেই ফিরে আসে। কুরাইশদের কেউ তাকে দেখতে পায় নি। কারণ, গাতফানের সৈন্যরা আলাদা এক স্থানে অবরোধে অংশগ্রহণ করছিল।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা কিংবা সিদ্ধান্ত অমান্য করা কারো শক্তি ছিল না। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের শিক্ষা অনুযায়ী সকল সাহাবাকে একত্র করে সকলের মতামত গ্রহণ করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, মত প্রকাশে সকলেই স্বাধীন। তিনি এখন যে বিষয়ে আলোচনা করতে চান, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকলে সে খোলা মনে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে পারে। প্রকৃতপক্ষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলের অবিসংবাদিত নেতা হলেও তিনি একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। ফলে তিনি সকলের সম্মুখে তার পরিকল্পনা ও গৃহীত পদক্ষেপ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে শুনান। গাতফানের সাথে এ পর্যন্ত যে আলোচনা হয় তাও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করেন। যাতে করে কোনরূপ ভুল বুঝাবুঝির সুযোগ না থাকে।

“তা হতে পারে না।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্তের উল্টো দু’তিনটি কণ্ঠ বেজে উঠে “আমাদের তরবারি যাদের রক্ত চায়, তাদেরকে আমাদের উৎপাদিত শস্যের একটি দানা দিতেও প্রস্তুত নই। এখনও তো যুদ্ধ হয়নি। তাই যুদ্ধ না করেই কেন প্রকাশ করতে যাব যে, আমরা বর্তমানে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নেই।”

সমর্থনসূচক আরো কিছু ধ্বনি শোনা যায়। সাথে সাথে কিছু প্রমাণও পেশ করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে অধিকাংশের মতামত মনে করে পূর্ব পরিকল্পনা স্থগিত রাখেন। তবে এই নতুন সিদ্ধান্ত জানাতে দূতকে পুনরায় গাতফান ও আইনিয়ার কাছে প্রেরণ করা হয়নি। অধিকাংশের বিরোধিতার মুখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখলেও একথা সবাইকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং কৌশল ব্যতীত এই অবরোধ শেষ হবে না।

সত্য পন্থীদের সাহায্য করা আল্লাহর নীতি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে যে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, তা এক ব্যক্তির রূপে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তিনি হলেন হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি ছিলেন গাতফান গোত্রের লোক। বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে খুবই পরিচিত একজন। আল্লাহ্ পাক তাকে অসাধারণ মেধা দান করেছিলেন। কুরাইশ, গাতফান ও বনু কুরাইযা এই তিন গুরুত্বপূর্ণ গোত্রের উপরেই তার প্রধান্য ছিল। একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে গাতফান গোত্রের এই বিশিষ্ট ব্যক্তি মদীনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে এসে হাজির হন।

“আল্লাহর কসম! তুমি অন্য কওমের লোক।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগন্তুক হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখে বলেন– “তুমি আমাদের লোক নও। এখানে এলে কিভাবে?

“আমি আপনাদের নই ঠিকই কিন্তু আপনার লোক।” হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুখে হাসি টেনে বলেন “মদীনাতে আমার সাক্ষী আছে, অনেক আগেই আমি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছি। এতদিন আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। গাতফান সৈন্যদের সাথে শুধু এই উদ্দেশেই এসেছি যে, সুযোগ করে আপনার দরবারে এসে হাজির হব। জানতে পেরেছি, আপনি আমাদের গোত্রপতি ও সেনাপতিকে কুরাইশদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন ও রণাঙ্গন ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এর বিনিময়ও আপনি তাদের জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আলোচনা মাঝপথে এসে থেমে যায়। রহস্যজনকভাবে আপনি নীরবতা পালন করে চলেছেন।”

“তোমার উপর আল্লাহর রহম হোক।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলে সাথে সাথে এটাও জিজ্ঞাসা করেন– “তুমি কি আলোচনা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছ?”

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন– “না, হে আল্লাহর রাসূল।”,–“আপনার কাছে আসাই আমার মূল লক্ষ্য। মদীনাবাসী ঘোর মহাবিপদে নিপতিত। আমি কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে এখানে এসেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামের স্বার্থে এই প্রাণ উৎসর্গ করেছি। যে কোন কাজে এই জীবন ব্যয় করতে আমার কোন ওযর আপত্তি নেই।”…সেনাক্যাম্প থেকে অতিগোপনে বেরিয়ে এসেছি। সুযোগ বুঝে পরিখায় নেমে পড়ি, কিন্তু প্রহরীদের উপস্থিতিতে এপার আসা আত্মহত্যার শামিল ছিল। ফিরে যাওয়াও নিরাপদ ছিল না। উভয় সংকটে পড়ি। উপায়ান্তর না দেখে আল্লাহর কাছে আপনার নাম নিয়ে কাকুতি-মিনতি করি। আল্লাহ রহম করেন। প্রহরী টহল দিতে দিতে কিছুটা দূরে চলে গেলে পরিখা অতিক্রম করতে সক্ষম হই।

ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। গোত্রে তার অবস্থান কেমন তাও জানানো হয়। তার সাথে অল্পালাপেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারেন যে, তিনি উঁচু পর্যায়ের এবং বিচক্ষণ একজন পুরুষ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পর্যায়ে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন যে, বর্তমানে যে সংকটাপন্ন অবস্থা চলছে তা থেকে উত্তরণের জন্য বহুজাতিক বাহিনীর শরীক দলগুলোর মধ্যে কুরাইশদের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয়া একান্ত জরুরী। আর এটা তখনই সম্ভব হবে, যদি আমরা দু’তিনটি শরীক দলের সাথে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হতে পারি।

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “হে আল্লাহর রাসূল।” –“যদি নিজস্ব পন্থায় এ কাজটির দায়িত্ব আমি গ্রহণ করি, তাহলে হযরত আমার উপর আস্থা রাখবেন কি?”

“নু’আইম! আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন – “আমি তোমাকে এবং তোমার সদিচ্ছাকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিচ্ছি।”

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আমি নিজ গোত্রে ফিরে যাব।” কিন্তু একথা কাউকে জানাব না যে, আমি মদীনায় গিয়েছিলাম। এখন আমি কা’ব বিন আসাদের নিকট যাচ্ছি। হে আল্লাহর রাসূল! আমার কামিয়াবীর জন্য দোয়া চাই।”

রাতে মদীনায় বড় জোরদার পাহারা চলছিল। পশ্চাতে পরিখা ছিল না। ওদিকে সারিবদ্ধ পাহাড় প্রাকৃতিকভাবে প্রহরীর ভূমিকা পালন করে চলছিল। এদিকে পরিখাকে কেন্দ্র করে পাহারাদার ও টহলদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। শহরের কোন ব্যক্তির জন্যও এই নিঃছিদ্র প্রহরা এড়িয়ে বাইরে যাওয়া ছিল অসম্ভব। প্রহরী যাতে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গতিরোধ না করে, সে জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে একজন লোক পাঠিয়েছেন। লোকটি হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিরাপদে মদীনার বাইরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসেন। হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বনু কুরাইযার এলাকায় কা’ব বিন আসাদের গেটে এসে পৌঁছান, তখন রাতের প্রথম প্রহর। নক করলে গোলাম গেট খুলে দেয়।

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করেন– “তুমি আমাকে চেন কা’ব?”

“নু’আইম বিন মাসউদকে কে না চেনে?” কা’ব বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে– “আমি যতদূর জানি গাতফান গোত্র তোমার মতো নেতা পেয়ে সত্যই গর্বিত… বল নু’আইম! এই নিশীথ রাতে আমি তোমার কি কাজে আসতে পারি?… আমি দশ দিনের সময় চেয়েছি। কেবল ৬/৭ দিন হয়েছে। মুসলমানদের উপর গেরিলা আক্রমণ চালাতে আমার লোক সম্পূর্ণ প্রস্তুত।… তুমি কি এ ব্যাপারটি নিশ্চিত হতে এসেছ?”

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “এ জাতীয় বিষয়ে আলোচনা করতেই আমি এসেছি, কা’ব তুমি একজন আস্ত গাধা! কোন ভরসায় তুমি কুরাইশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছ?…এ প্রশ্ন তোল না যে, তোমার প্রতি কেন আমার এই সহমর্মিতা? আমি মুসলমানদেরও হিতাকাঙ্ক্ষী নই। তুমিতো ভাল করেই জান, আমি একজন নিরপেক্ষ জনদরদী। আমার হৃদয় তোমার গোত্রীয় যুবতী-রূপসী নারী, কন্যা, বধূ এবং বোনদের ভবিষ্যত চিন্তায় ব্যথিত, যারা তোমার আত্মঘাতী চুক্তির কারণে দু’দিন পরেই মুসলমানদের দাসী বাঁদীতে পরিণত হবে। এ চুক্তির মাধ্যমে তুমি নিজেদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছ। মুসলমানরা আক্রমণ করলে কুরাইশরা তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ; কিন্তু তার জন্য নিরাপত্তার গ্যারান্টিও তাদের থেকে আদায় করে নিয়েছি।”

“তাহলে কি কুরাইশদের পরাজয় নিশ্চিত?” কা’ব বিন আসাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।

তারা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে বসে আছে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– পরিখা তাদেরকে শহরে আক্রমণ করার সুযোগ দেবে বলে মনে কর?… ক্ষুধা-তৃষ্ণা কুরাইশ সৈন্যদেরকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমার গোত্র ক্ষুধায় অস্থির। আমি চাই না যে, আগামীকাল তুমি এই বলে আমার গোত্রের বদনাম করবে যে, গাতফান তোমাদেরকে মুসলমানদের করুণার উপরে ছেড়ে চলে গেছে। আমি চাই যেন এমনটি না হোক যে, ওদিকে যখন বাধ্য হয়ে আমরা ও কুরাইশরা অবরোধ তুলে চলে যাব তখন তুমি এদিকে মুসলমানদের উপর হামলা করে নিজেদেরকে তাদের দুশমন হিসেবে পরিচিত করাবে। বনূ কায়নূকা এবং বনু নযীরের পরিণতি অবশ্যই তোমার স্মরণ আছে। চুক্তিভঙ্গের দরুন মুসলমানরা তাদেরকে কেমন শাস্তি দিয়েছে তাও তোমার অজানা নয়।”

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর যুক্তিপূর্ণ কথায় কা’ব বিন আসাদ একদম চুপসে যায়। তৎক্ষণাৎ সে কিছু বলতে পারল না। নিজ হাতে সে সর্বনাশা চুক্তি করেছে, হয়ত মনের গহীনে তারই জল্পনা-কল্পনা হতে থাকে। চিন্তার কালো মেঘ ছেয়ে যায় তার চেহারায়। ভবিষ্যৎ চিন্তায় নীরব হয়ে যায় সে।

“আমি জানি, কুরাইশদের থেকে তুমি এর বিনিময় কত লাভ করেছ।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– কিন্তু কথা হলো, এ সকল ধন-সম্পদ এবং সুন্দরী নারী, যা কুরাইশ ও হুয়াই বিন আখতাব সরবরাহ করেছে, তার মালিক অবশেষে মুসলমানরাই হবে। শুধু তাই নয়, মৈত্রীচুক্তি ভঙ্গের অপরাধে তোমাদের মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।”

“তবে কি কুরাইশদের সাথে কৃত চুক্তি প্রত্যাহার করব?” কা’ব উদ্বেগের সাথে জানতে চায়।

“এখনই চুক্তি প্রত্যাহার করার প্রয়োজন নেই।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কৃত্রিম বিজ্ঞতাভাব ফুটিয়ে বলেন– “এতে তারা ক্ষুদ্ধ হতে পারে। তবে নিরাপত্তার জামানত অবশ্যই নেয়া চাই। আরবের রীতি অনুযায়ী কুরাইশদের গিয়ে বল, তাদের উচ্চপদস্থ কিছু লোক যেন জামিন হিসেবে দেয়। যদি তারা দাবি অনুযায়ী সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় লোক জামানত হিসেবে রাখে তাহলে বুঝবে তারা চুক্তির ব্যাপারে ন্যায়-নিষ্ঠ ও আন্তরিক।”

কাব বিন আসাদ বলে– “হ্যাঁ, নু’আইম। আমি জামিন হিসেবে তাদের লোক চাইব।”

♣♣♣

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কা’ব বিন আসাদের নিকট থেকে সফল মিশন শেষে রাতের আঁধার ভেদ করে পাহাড় অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত কুরাইশদের তাঁবুই এখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য। সোজা রাস্তা নিকটবর্তী হলেও পথিমধ্যে ছিল পরিখা। তিনি দূরের রাস্তা দিয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে চলতে থাকেন। তিনি গতরাত থেকে বিরামহীন চলছেন কিন্তু গোপনে চলায় এবং সাধারণ রাস্তা পরিহার করে চলায় দ্বিগুণ সময় ব্যায় হয়। হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন আবু সুফিয়ানের নিকট পৌঁছেন তখন আরেকটি রজনী শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার সমস্ত শরীর তীব্র ব্যথায় টনটন করছিল এবং প্রবল তৃষ্ণায় জিহ্বাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে বহু পানি পান করার পরেই তবে তিনি কথা বলার উপযোগী হন। আবু সুফিয়ান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

“তোমার অবস্থাই বলে দিচ্ছে তুমি স্বগোত্রীয় সৈন্যদের নিকট থেকে আসনি।” আবু সুফিয়ান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আরো জিজ্ঞাসা করে– “কোত্থেকে আসছ?”

‘বহু দূর থেকে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন– “একটি গুপ্তচর দলের সাথে সাক্ষাৎ করে আসছি। তোমরা বনূ কুরাইযার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছ ঠিকই কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক শুধু এই স্বার্থে যে, তারা আমাদের দ্বারা ইসলামের নিশ্চিহ্ন চায়।… বনু কুরাইযার দুই বন্ধুর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। ভাগ্যক্রমে মদীনায় এক পুরাতন বন্ধুর সাথেও দেখা হয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছি তাতে স্পষ্ট যে, কা’ব বিন আসাদ মুহাম্মাদের সঙ্গ ত্যাগ করেনি। উপরন্তু সে মুসলমানদের খুশী করতে এক নতুন ফন্দিও এটেছে। তোমরা তাকে মদীনা আক্রমণের অনুরোধ করেছ। কিন্তু সে কুরাইশ নেতৃস্থানীয় কিছু লোককে জামিন হিসেবে পেতে চায়। যাদেরকে সে মুসলমানদের হাতে তুলে দিবে আর মুসলমানরা তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় কতল করবে। এরপর ইহুদীরা ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত শক্তি নিয়ে আমাদের উপর হামলা চালাবে।… আমি তোমাদেরকে এই মর্মে সাবধান করতে এসেছি, যেন ইহুদীদের কথা শুনে জামিনস্বরূপ একজন লোকও না পাঠাও।”

আবু সুফিয়ান উত্তেজিত কণ্ঠে বলে– “খোদার কসম নু’আইম! তোমার তথ্য সত্য প্রমাণিত হলে বনু কুরাইযার বস্তি সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে দেব। কা’ব বিন আসাদের লাশ আমার ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ছেঁচরিয়ে ছেঁচরিয়ে মক্কায় নিয়ে যাব। কোন দিবাস্বপ্নে সে আমাদেরকে ধোঁকা দেয়ার দুঃসাহস করল?

“মদ এবং রূপসী রমনীর জাদুতে আপনিই তার চিন্তাজগৎ ঢেকে দিয়েছেন।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু একটু শ্লেষের সাথে বলেন– “মদ এবং নারী কাউকে কখনো আন্তরিকতা ও সততার উপর অটল থাকতে দেয়?”

“মদ এবং নারী কে তাকে দিয়েছে?” আবু সুফিয়ান অবাক হয়ে জানতে চায়– “হতভাগা কা’বের কি এতটুকু বোধ শক্তি নেই যে, আমি তার সাথে যে চুক্তি করেছি এতে তার জাতি ও ধর্মের নিরাপত্তা নিহিত? যদি মুহাম্মাদের ধর্ম বর্তমান গতিতে ছড়াতে থাকে তাহলে ইহুদীবাদ খতম হতে বাধ্য।”

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু মুখে গাম্ভীর্য টেনে বলেন– “ইহুদীদেরকে তোমরা এখনও চেননি, দুশমনদের কাছেও তারা তাদের দুশমনি প্রকাশ হতে দেয় না।… হুয়াই বিন আখতাবও একজন ইহুদী। সেই তোমাদের পক্ষ থেকে কা’বকে মদের সুরাহী এবং দুই রূপসী যুবতী সরবরাহ করেছে। আমি যখন কা’বের সাথে দেখা করতে যাই, তখন সে পূর্ণ মাতাল এবং তার দুই পাশে দুই নারী বিবস্ত্র অবস্থায় ছিল। সে নেশার ঘোরে আমাকে বলে, সে নাকি কুরাইশদেরকে আঙ্গুলের মাথায় নিয়ে নাচাচ্ছে।”

আবু সুফিয়ান তরবারির বাটে হাত রেখে বলে– “নু’আইম।” “আমি মদীনা থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে বনু কুরাইযার মূলোৎপাটন করব। তার এ সাহস কিভাবে হল যে, সে কুরাইশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে জামিন হিসেবে পেতে চায়!”

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আবু সুফিয়ান! এভাবে উত্তেজিত হয়ো না, ধীর-স্থির ও সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা কর এবং এ দৃঢ় সিদ্ধান্ত নাও যে, জামিন হিসেবে এক ব্যক্তিকেও কা’বের নিকট পাঠাবে না।”

আবু সুফিয়ান দৃঢ়তার সাথে বলে– “আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, মদীনাবাসী সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পার? তারা কোন অবস্থায় দিন অতিবাহিত করছে? আর কতদিন তাদের পক্ষে ক্ষুধা-তৃষ্ণার যাতনা সহ্য করা সম্ভব?”

আবু সুফিয়ানের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত হানার উপযুক্ত সুযোগ হাতে এসে যায় হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর।

“আমি সত্যিই হতবাক আবু সুফিয়ান!” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কপালে কৃত্রিম ভাঁজ সৃষ্টি করে বলেন– “দীর্ঘ অবরোধ সত্ত্বেও মদীনাবাসী হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত তাদের মধ্যে ক্ষুধার কোন নিদর্শন নেই। খাদ্যের স্বল্পতা অবশ্যই আছে, তবে মদীনাবাসীর প্রেরণা ও জযবা এত তীব্র যে, এটা কোন ব্যাপারই নয় এবং খাদ্যের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই তাদের।”

“এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আমাদের অবরোধ তাদের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি।” আবু সুফিয়ান হতাশার সুরে বলে।

“একদম না।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু হতাশার পরিধি বৃদ্ধি করতে আরো সংযোগ করে বলেন– অবরোধের ফলে তাদের উপর এই লাভ হয়েছে যে, তাদের প্রত্যেকেই এখন জযবা ও প্রেরণায় সমৃদ্ধ এবং ভরপুর।

“অথচ আমাদের ইহুদী গুপ্তচরদের রিপোর্ট হলো, মদীনার খাদ্যশস্য প্রায় নিঃশেষের পথে।” আবু সুফিয়ান হাল্কা উদ্বেগের সাথে বলে।

“তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে আরো উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বলেন– আমি আবারও সতর্ক করছি যে, ইহুদীদের উপর বিশ্বাস করা মোটেও ঠিক হবে না। মুসলমানদের অবস্থা ভাল নয়’– এই তথ্য প্রচার করে তারা তোমাদের উত্তেজিত করতে চায়। যেন মুসলমানদেরকে দুর্বল ভেবে তোমরা পরিখা পার হয়ে মদীনা আক্রমণ কর। তারা মূলত সুকৌশলে এক ঢিলে দুই পাখী শিকার করতে চায়। কুরাইশ এবং আমার গোত্র গাতফানকে মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।”

“আমি তাদের উদ্দেশ্য পুনরায় যাচাই করে দেখছি।” আবু সুফিয়ান এ কথা বলে এক গোলামকে আসতে বলে।

আগত গোলামের উদ্দেশে আবু সুফিয়ান নির্দেশের সুরে বলে– “ইকরামা এবং খালিদকে ডেকে আন।”

“যাই, গাতফান গোত্রপ্রধানকে খবরটা জানিয়ে আসি।” একথা বলে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখান থেকে প্রস্থান করেন।

খালিদ এবং ইকরামা আসার পর আবু সুফিয়ান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত কা’ব বিন আসাদ সংশ্লিষ্ট সকল ঘটনা খুলে বলে।

খালিদ বলেন– আবু সুফিয়ান! অন্যের ভরসায় আর যা কিছু হোক যুদ্ধ করা যায় না।” “আপনি এ দিকটি কখনো ভাবেন নি যে, বনু কুরাইযা মুসলমানদের ছায়াতে আছে। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে মুসলমানদের উপর হামলা করতে পারে। কিন্তু মুসলমানদের করুণার উপরই যে তারা বেঁচে আছে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। আপনি যুদ্ধ করতে এসে থাকলে একজন যোদ্ধার মতই যুদ্ধ চালিয়ে যান।”

“এ মুহুর্তে তোমাদের যে কোন একজন কা’ব বিন আসাদের কাছে যাওয়া কি সঙ্গত নয়?” আবু সুফিয়ান জানতে চায়– নু’আইমের নিকট জামিনের কথা বললেও তোমরা গেলে হয়ত তা বলবে না।… সৈন্যদের ক্ষুধার্ত অবস্থা দেখছ না? এমতাবস্থায় তাদের পক্ষে পরিখা অতিক্রম করা কি সম্ভব? এখন সঙ্কট নিরসনের এটাই একমাত্র উপায় যে, কা’ব মদীনার অভ্যন্তরে মুসলমানদের উপর গেরিলা আক্রমণ করবে।”

“আমি নিজেই যাব।” ইকরামা বলে– “আমি এটাও বলে যাচ্ছি যে, কা’ব যদি আমার নিকটও জামিনের শর্ত করে, তাহলে আমি আপনার কাছে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা না করেই চুক্তি বাতিল করে দিব।”

ইকরামার সাথে কি আমিও যাব?” খালিদ অনুমতি প্রার্থনার সুরে আবু সুফিয়ানের কাছে জানতে চান এবং বলেন– “তার একাকী যাওয়া ঠিক হবে না।”

“না।” আবু সুফিয়ান দৃঢ়তার সাথে জানান– “বিপদের মুখে একই সাথে দুই সেনাপতিকে আমি পাঠাতে পারি না। ইকরামা আত্মরক্ষার যত সৈন্য চায় নিয়ে যেতে পারে।”

তৎক্ষণাৎ ইকরামা রওনা হয়ে যায়। সাথে ছিল চার হাজার বডিগার্ড। অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে তাকে বনু কুরাইযার পল্লীতে পৌঁছতে হয়। ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মার্চ জুমাবার। অনেক কষ্টে পাহাড়ের পর পাহাড় মাড়িয়ে ইকরামা কা’ব বিন আসাদের বাড়ীতে পৌঁছে। ইকরামাকে দেখেই কা’ব তার আগমনের কারণ বুঝে ফেলে।

“এস ইকরামা!” কা’ব বিন আসাদ বলে– “তোমার আগমনের কারণ আমি জানি, কষ্ট করে তোমার আসার প্রয়োজন ছিল না। আমি তো দশ দিনের সময় চেয়ে নিয়েছি।”

কা’ব এক গোলামকে ডাক দেয়। গোলাম এলে তাকে মদ এবং মদের ভাণ্ড আনতে বলে।

“আগে আমার কথা শোন কাব।” ইকরামা সিদ্ধান্ত জানানোর ভাষায় বলে– আমি মদ পান করতে আসিনি। অতি সত্বর আমাকে ফিরে যেতে হবে। অবরোধ দীর্ঘায়িত করা আর আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা আগামী কালই মদীনা আক্রমণ করব। তুমি আমাদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ সৈন্যদের উপর কাল থেকেই হামলা শুরু কর। আমাদের এ কথাও জানা আছে যে, তুমি বাহ্যিকভাবে আমাদের চুক্তি করেছ কিন্তু মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তি গোপনে ঠিকই রেখেছ।”

এরই মধ্যে ডানাকাটা পরীরমত এক রূপসী ললনা শরাবের বোতল এবং পানপাত্র নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। ইকরামাকে দেখে মেয়েটি মুচকি হাসে। ইকরামা তাকে দেখলে তার চেহারায় গাম্ভীর্যের ছাপ আরো গাঢ়ভাবে পড়ে।

ইকরামা চড়া গলায় বলে– “কা’ব” “ভিত্তিহীন ও দু’দিনের এ সমস্ত বস্তুর বিনিময়ে তুমি নিজ ধর্ম ও জবান বিক্রি করে দিয়েছ?”

এ সময়ে কা’ব বিন আসাদের ইঙ্গিতে মেয়েটি ভিতরে চলে যায়।

“ইকরামা!” কা’ব বলে– “আমি তোমার চেহারাতে মনিবসুলভ ভাব দেখছি। মনে হচ্ছে, গোলাম ভেবে তুমি আমাকে নির্দেশ দিতে এসেছ। মুসলমানদের সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছিল বনু কুরাইযার নিরাপত্তার স্বার্থেই। আর তোমাদের সাথে আমার চুক্তি হয়েছে তোমাদের বিজয় আর মুসলমানদের পরাজয়ের জন্য। মুসলমানদের নিপাত করা আমার ধর্মীয় নির্দেশ। তোমাদের সাথে চুক্তি করা এ ধারাবাহিকতারই একটি চেষ্টা মাত্র। নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে আমি তোমাদের ব্যবহার করব। হুয়াই বিন আখতাবকে আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, গাতফান এবং কুরাইশরা যেন বনু কুরাইযার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। যাতে এমন পরিস্থিতি না হয় যে, তোমরা ব্যর্থ হয়ে চলে যাবে আর মুসলমানরা আমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।

হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু দু’পক্ষের মধ্যে যে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন, তা ইকরামার হৃদয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক আবু সুফিয়ানের মাধ্যমে আগেই ইকরামাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, কা’ব জামানত পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই কা’বের মুখ থেকে ‘জামানত’ শব্দ বের হওয়া মাত্রই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

“আমাদেরকে বিশ্বাস কর না?” ইকরামা গর্জে উঠে বলে– “তুমি কি মনে করছ যে, আমরা হয়ত ভুলে গেছি যে, মুহাম্মাদ আমাদের এবং তোমাদের দুশমন?”

কা’ব বলে– “আসলে তুমি যেটা বলছ তা আমার কথা নয়, তবে একথা অবশ্যই সত্য যে, আমাদের সম্মিলিত দুশমনকে যতটুকু আমরা জানি তোমরা ততটুকু জান না। আমি মেনে নিতে বাধ্য যে, আল্লাহ মুহাম্মাদকে যে অসাধারণ মেধা দান করেছেন, তা আমাদের কারো নেই।… আমার স্পষ্ট কথা, আমি জামানত চাই।”

“বল, কোন ধরনের জামানত তোমার চাই?” ইকরামা রাগতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

“কুরাইশ এবং গাতফান গোত্রের কয়েকজন নেতা আমাদের এখানে পাঠিয়ে দাও।” কা’ব জামানতের ব্যাখ্যা দিয়ে বলে “ইকরামা! এটা কোন নতুন কথা নয়। এটা তো পূর্ব নিয়ম। এ রীতি এবং শর্ত সম্পর্কে তোমরা ভাল করে জান। আমি জামানতের জন্য দাবিকৃত লোকের সংখ্যা বলিনি। সংখ্যা নির্ণয় করা তোমাদের উপরেই রইল। তোমরা ভাল করেই জানো যে, চুক্তির বিপরীত কোন কিছু করলে আমরা তোমাদের এ নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে হত্যা করে ফেলব।”

ইকরামা উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল–“তাদেরকে তোমরা হত্যা করবে না, তুমি তাদেরকে মুসলমানদের হাতে দিয়ে দিবে।”

ইকরামা একি বলছ।” কা’ব গভীর উৎকণ্ঠা আর বিস্ময় নিয়ে বলে– “তুমি আমাকে এতই হীন ভেবেছ যে, প্রতারণা করে আমি তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে মুসলমানদের হাতে হত্যা করাব? আমার উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পার।”

“ইহুদীদের উপর আস্থা রাখা আর সাপের উপর আস্থা রাখা একই কথা।” ইকরামা চাপা ক্ষোভের সাথে বলে– “নিজেকে এত বিশ্বস্ত মনে করলে কালই মদীনার ঐ ছোট কেল্লায় হামলা করে দেখাও তো, যেখানে মুসলমানদের মহিলা ও শিশুরা অবস্থান করছে?”

“কাল!” কা’ব কপালে চোখ তুলে বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলে– “কাল সাপ্তাহিক সুনির্দিষ্ট দিন। এটি ইহুদীদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র দিন। ইবাদত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ আমরা এ দিনে করি না। কোন ইহুদী সাবতের দিন কোন কাজ অথবা কারবার করলে কিংবা কারো উপর চড়াও হলে ইহুদীদের খোদা ঐ ব্যক্তিকে শূকর বা বানরে পরিবর্তন করে দেন।”

ইতোমধ্যে ইকরামা কা’বের মনোভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়। কা’ব শরাব গিলে চলছিল। ইকরামা শরাব স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। সে আবু সুফিয়ানকে বলে গিয়েছিল যে, চুড়ান্ত ফায়সালা করেই সে ফিরবে।”

“তুমি কাল আক্রমণ কর অথবা একদিন পর কর সর্বাবস্থায় তোমাদের ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন দেখার পরেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিব যে জামিন হিসেবে আমাদের লোক তোমাদেরকে দেয়া যায় কি-না!” ইকরামা বলে।

আমার কথাও বলে দিয়েছি যে, জামিন না পেলে আমি কিছুই করব না।” কা’ব পাল্টা হুমকির সুরে বলে– “তোমাদের লোক আমাদের হাতে এলেই আমরা তোমাদের কথায় মদীনার অভ্যন্তরে গণ্ডগোল সৃষ্টি করব। তোমরা দেখবে, মুহাম্মাদের পিঠে কিভাবে একটার পর একটা ছুরি বিদ্ধ হয়।”

ইকরামা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং রাগতস্বরে বলে– “তোমার মনে দুরভিসন্ধি আছে। তা না হলে বলতে, আমার কোন জামানতের দরকার নেই। এসো, সবাই মিলে মদীনাতেই মুসলমানদের কবর রচনা করি।”

কারো নির্দেশই যদি আমাকে মেনে চলতে হয় তাহলে মুহাম্মাদের নির্দেশ মেনে চলাকেই আমি ভালো মনে করি।” কা’ব ইকরামার রাগকে আমলে না এনে পাল্টা ঘোষণা করে বলে– “মুসলমানদের সাথেই আমাদের চলাফেরা। তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে যতটুকু সক্ষম, তোমাদের পক্ষে তা দেয়া সম্ভব নয়।”

ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম এবং ইবনে সা’দ লিখেন, হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিক্ষিপ্ত তীর অভিষ্ঠ লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত হানে। আর এ সবই ছিল তার কার্যকর প্রতিক্রিয়া। ইকরামা রাগান্বিতভাবেই কা’বের ঘর থেকে বের হয়। এভাবে কা’বের ঘরের ভিতরেই ঐ চুক্তির মৃত্যু ঘটে, ইহুদীবাদ ও কুরাইশদের মধ্যে যা বাস্তবরূপ পেলে মুসলমানদের কোমর ভেঙ্গে দিত। ইহুদীদের গুপ্ত হামলা যে অবস্থার সৃষ্টি করত, তা সামাল দেয়া মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব ছিল কি-না তা আল্লাহই ভাল জানেন। কূটনৈতিকভাবে তারা এক মহাবিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়।

♣♣♣

এদিকে ইকরামা যখন কা’ব বিন আসাদের বাসভবনের উদ্দেশে চলছে ওদিকে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন গাতফান গোত্রের সর্দারের নিকট বসা। কা’ব সংশ্লিষ্ট যে তথ্যের মাধ্যমে আবু সুফিয়ানকে উত্তেজিত করেন, গাতফান সর্দারের কানেও সে তথ্যগুলো পৌঁছেছে। গাতফান সংবাদের গুরুত্ব অনুধাবন করে সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতি আইনিয়াকে ডেকে পাঠায়।

“শুনেছ, কা’ব আমাদের কিভাবে প্রতারণা করছে?” গাতফান আইনিয়াকে বলে– “সে জামানত হিসেবে আমাদের নেতৃত্বস্থানীয় লোক চায়। এটা আমাদের অপমান নয়?”

সেনাপতি আইনিয়া বলে– “শ্রদ্ধাভাজন নেতা!” “আমি আপনাকে আগেও বলেছি, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়েই শুধু আমার সাথে আলোচনা করবেন। আমি শুধু সামনা-সামনি যুদ্ধ করতে জানি। আমি তাকে ঘৃণা করি, যে পেছন দিকে হতে আক্রমণ করে। তার প্রতিও আমার ঘৃণা, যে এভাবে পিঠে আক্রমণের সুযোগ করে দেয়। এত কিছুর পরও আপনি ইহুদীদের উপর আস্থা রাখতে চান? যদি কা’ব বিন আসাদ দাবি করে বসে যে, জামানত হিসেবে গাতফান গোত্রপ্রধানকে দিতে হবে, তবে কি আমি আপনাকে তার হাতে তুলে দিব?”

“কেউ এ রকম দাবি করলে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিব।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এরূপ বলেন– “আমি ইহুদীদেরকে জামানত হিসেবে মানুষ তো দূরের কথা একটি ভেড়া-বকরীও দিব না। খোদার কসম! কা’ব অবশ্যই আমাদেরকে অপমান করেছে।”

“আবু সুফিয়ানের মনোভাব কী?” গাতফান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রশ্ন করে।

“ঘটনা শুনে আবু সুফিয়ান তো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে কাঁপতে থাকে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আবু সুফিয়ান কা’ব এর নিকট থেকে এই অপমানের প্রতিশোধ লওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।”

“তাকে প্রতিশোধ লওয়াই উচিত।” সেনাপতি আইনিয়া বলে– “বনু কুরাইযার অবস্থান এমন আর কি! আমাদের এবং মুসলমানদের মাঝখানে চাপা পড়ে এমনভাবে পিষ্ট হয়ে যাবে যে, আরব ভূমি হতে তাদের নাম-নিশানা সম্পূর্ণ মুছে যাবে। পাওয়া যাবে না তাদের অস্তিত্ব খুঁজে।”

মদীনায় চলতি পথে খালিদের সুস্পষ্ট মনে পড়ে ঐ সময়ের কথা যখন ইকরামা বনু কুরাইযা হতে ফিরে এসেছিল। তিনি খুব দ্রুত তার কাছে যান।

এদিকে আবু সুফিয়ানও ঘোড়া ছুটিয়ে ইকরামার কাছে আসে। ইকরামার চেহারায় ছিল ক্রোধ এবং বিষন্নতার গভীর ছাপ।”

“বল কি খবর।” আবু সুফিয়ান দূর থেকেই তার কাছে জানতে চায়।

“খোদার কসম!” ইকরামা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামতে নামতে বলে– “কা’বের চেয়ে জঘন্য কোন মানুষ ইতোপূর্বে আমি দেখিনি। নু’আইমের রিপোর্ট সর্বাংশে সত্য।”

“জামানত হিসেবে আমাদের লোকের দাবি কি পুনরায় সে উত্থাপন করেছে?” কথার ফাকে খালিদ জিজ্ঞাসা করেন।

“হ্যাঁ, খালিদ!” মাথা নেড়ে ইকরামা বলে– “সে আমার সম্মুখে মদ পেশ করে এবং এমনভাবে কথাবার্তা বলে আমরা যেন তার কাছে ঋণী। সে স্পষ্টভাবে বলে যে, আগে জামানত হিসেবে লোক পাঠাও তারপরে আমি মদিনাতে গুপ্ত হামলা করব।”

“তাকে বলে এলে না কেন যে, কুরাইশদের তুলনায় বনু কুরাইযার অবস্থান উটের সাথে ইদুর যেমন।” খালিদ বলেন– “তার মাথা দেহ থেকে কেন বিচ্ছিন্ন করে দিলে না?”

ইকরামা বলে– “বড় কষ্টে হস্ত সংবরণ করেছি, তার সাথে আমাদের যে চুক্তি হয়েছিল তা ভেঙ্গে দিয়ে এসেছি।”

আবু সুফিয়ান অনেকটা ধরা গলায় বলে– “তুমি ঠিকই করেছ, তুমি ঠিক কাজই করেছ।” তারপর সে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।

এ ঘটনা বেশি দিনের নয়। আনুমানিক দেড়-দুই বছর আগের ঘটনা। তার পরও আজ মদীনায় যাবার কালে তার নিকট চির চেনা পথ-ঘাটগুলো কেমন যেন অচেনা মনে হয়। এমনকি মাঝে মধ্যে তার নিজেকেও নিজের কাছে অচেনা মনে হয়। আনমনা হয়ে পথ চলতে থাকেন। আবু সুফিয়ানের সেদিনের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ চেহারা এ সময় তাঁর নয়ন তারায় ভেসে ওঠে। খালিদ সেদিন আবু সুফিয়ানের প্রস্থানের অবস্থা দেখে অনুধাবন করেন যে, আবু সুফিয়ান মদীনায় আক্রমণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে চলে যাবার পর খালিদ এবং ইকরামা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

মাথা উঁচিয়ে ইকরামা এক সময় জানতে চায় কি চিন্তা করছ খালিদ? এ কথা বললে আমাকে দোষারোপ করবে যে, আবু সুফিয়ান গোত্রপ্রধান বলেই তার উপস্থিতি ও নির্দেশ এখনও আমি মেনে চলছি?” খালিদ সায় পাওয়ার জন্য ইকরামার দিকে চেয়ে বলেন– “আবু সুফিয়ান থেকে অধিক ভীরু ও কাপুরুষ নেতা কুরাইশরা কখনো পায়নি আর পাবেও না। কখনো তুমি জানতে চেয়েছ আমি কি ভাবছি। আমি আর বেশি বিলম্ব করতে পারছি না। আমি পরিখার এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত ঘুরে ঘুরে দেখেছি। পরিখার এক স্থান যেমনি সংকীর্ণ তেমনি অগভীর। এ স্থান দিয়ে পরিখা পার হওয়া যাবে বলে মনে হয়। তুমি আমার সাথে থাকলে এখনই ঐ স্থান দিয়ে কয়েকজন অশ্বারোহীকে পরিখা অতিক্রম করাতে চাই। আবু সুফিয়ান কোন গায়েবী সহযোগিতার অপেক্ষা করতে চাইলে থাকুক।”

ইকরামা উৎসাহিত কণ্ঠে বলে– “আমি তোমার পাশে কেন থাকব না খালিদ? আমার দ্বারা মুসলমানদের ঐ অট্টহাসি সহ্য করা সম্ভব হবে না, যা তারা যুদ্ধ ছাড়াই আমাদের পিছপা হবার কালে দিতে থাকবে। চল, আমি তোমার সাথে আছি।”

জুবাব পাহাড়ের পশ্চিমে এবং সালা পাহাড়ের পূর্বে ছিল ঐ সংকীর্ণ জায়গাটি। এখানে পরিখার প্রস্থ এতটুকু ছিল যে, তাজি ঘোড়ার পক্ষে তা লাফিয়ে অতিক্রম করা সম্ভব। এখন প্রয়োজন কেবল বীর-যোদ্ধা বাছাই করা। পদাতিক সৈন্য পরিখা নেমে ওপারে যাওয়া অসম্ভব। তবে এর আশে পাশেই মুসলমানরা তাঁবু ফেলে আছে।

খালিদ দুর থেকে আলোচিত জায়গাটি ইকরামাকে দেখান।

“সর্বপ্রথম আমার অশ্বারোহী বাহিনী পরিখা পার হবে।” ইকরামা বলে– “তবে এখনই আমি পুরো বাহিনীকে অতিক্রম করাব না। ওপারে গিয়ে মুসলমানদের একজনের মোকাবিলায় একজনকে আহ্বান করব। তারা এ পন্থার ব্যতিক্রম করবে না। আমার সাথে এসো খালিদ! আমি বাছাই করা অশ্বারোহী নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হব। তুমি এখনই পরিখা অতিক্রম করবে না। আমরা উভয়ে নিহত হলে কুরাইশদের ভাগ্যে পরাজয়ের তিলক ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। আবু সুফিয়ান বলতে গেলে অবরোধ তুলেই নিয়েছে। এখন শুধু ঘোষণা দেয়াটা বাকী। যুদ্ধের প্রেরণা তার সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে গেছে।

যে স্থান দিয়ে ঘোড়া লাফ দিয়ে কোন মতে ওপারে যাবার সম্ভাবনা নিয়ে পরিকল্পনা চলছিল, তা এমন স্থানে অবস্থিত ছিল যে, টহলদার রক্ষী অতি নিকটে এসে স্থানটি দেখে যেতে পারত। ইকরামা দেখে শুনে সাত অশ্বারোহী বাছাই করে। এর মধ্যে বিশাল বপুধারী এবং দৈত্য সমতুল্য আমর বিন আবদূদও ছিল। বিশালকায় দেহের কারণে তার নাম যশ দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ইকরামা বাছাইকৃত সাত অশ্বারোহীকে নির্ধারিত স্থানের অনতি দূরে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে স্থানটি পর্যবেক্ষণ করায়, যেন তারা টহলে কোনরূপ সন্দেহের সৃষ্টি করেনি।

“প্রথমে পরিখা অতিক্রম করব আমি।” ইকরামা হাঁটতে হাঁটতে সাত অশ্বারোহীকে তার পরিকল্পনা জানায়।

“সর্বপ্রথম আমার ঘোড়া অতিক্রম করাই কি উচিত হবে না?” আমর বিন আবদুদ আবেগের সাথে বলে।

“না, আমরা ইকরামা তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলে– “প্রথমে আমি যাব। আমার ঘোড়া যদি পরিখার ভিতর পড়ে যায়, তাহলে তোমাদের কেউ পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করবে না। প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তো তোমাদের সেনাপতিই দিবে।”

এ কথা বলেই ইকরামা ঘোড়ার লাগামে একটা ঝটকা টান মারে। ঘোড়া পরিখামুখী হওয়া মাত্রই ইকরামা ঘোড়ায় জোরে পদাঘাত করে। আরবি জাতের উন্নত ঘোড়া বাতাসের গতিতে চলতে থাকে। ইকরামা লাগাম আরো ঢিল করে দেয় এবং চলতি ঘোড়ায় আবার পদাঘাত করে কষে। ঘোড়ার গতি অস্বাভাবিক দ্রুততর হয়। পরিখার কিনারে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ইকরামা উচু হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঘোড়া নিজেকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয়। ওপারের উদ্দেশে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খালিদ দূরে দাঁড়িয়ে ইকরামার পরিখা অতিক্রম করার দৃশ্য দেখছিলেন। কুরাইশদের বহু সৈন্যও দর্শকের কাতারে এসে দাঁড়ায়। ইতিহাসও বিস্ময় নেত্রে চেয়ে থাকে।

ঘোড়ার সম্মুখের পা পরিখার ওপার কিনারার সামান্য আগে এবং পিছনের পা ঠিক কিনারায় গিয়ে পড়ে। ঘোড়া অতি দ্রুত গতিতে জোরে সম্মুখে এগিয়ে যায়। ঘোড়ার সম্মুখের দুই পা ভাঁজ হয়ে ডবল হয়ে যায়। তার মুখ মাটিতে আছড়ে পড়ে ইকরামা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। ঘোড়া দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যায়। ইকরামাও নিজেকে সামলে নেয়। এ মুহূর্তে পেছন দিক হতে একটি দ্রুততম কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে।

“ইকরামা! অগ্র গিয়ে দাড়াও।”

ইকরামা পলকে ফিরে তাকায়। আমর বিন আবদূদের ঘোড়াকে বাতাসে উড়ে আসতে দেখে। আমর রেকাবে ভর দিয়ে সম্মুখের দিকে ঝুঁকে ছিল। কারো আশা ছিল না যে, বহু ওজনের আরোহীর ঘোড়াটি পরিখা পার হতে পারবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমরের অশ্বটিও ঐ স্থানে গিয়ে পড়ে যেখানে ইকরামার ঘোড়া পৌঁছেছিল। আমরের ঘোড়ার পাগুলো এমনভাবে ভাঁজ হয়ে পড়ে যে, ঘোড়া ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। আমর ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম হয়। পরক্ষণেই ঘোড়া উঠে দাঁড়ায়। আমরও সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং চোখের পলকে ঘোড়ায় চেপে বসে।

আমরের পিছনে পিছনে ইকরামার আরো দু’অশ্বারোহী ঘোড়া নিয়ে উড়ে চলে। পরিখার কিনারায় এসে উভয় আরোহী নিজ নিজ ঘোড়ার পিঠ শূন্য করে দেয় এবং গর্দানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। উভয় ঘোড়া নিরাপদে পরিখা অতিক্রম করে।

কুরাইশ সৈন্যরা প্রাথমিক প্রচেষ্টার সফলতায় খুশিতে গগনবিদারী শ্লোগান দিতে থাকে। হঠাৎ শ্লোগান শুনে মুসলিম পাহারাদারগণ দৌড়ে আসেন। এরই মধ্যে ইকরামার আরো দু’টি আরোহী পরিখার পাড়ে এসে বাতাসের ভেলায় নিজেদেরকে ভাসিয়ে দেয়। এদের দেখাদেখি অবশিষ্ট সাত অশ্বারোহীর বাকীরাও নিজ নিজ ঘোড়া ছেড়ে দেয়। সকলে নিরাপদে পরিখা অতিক্রম করে।

ইকরামা মুসলিম প্রহরীকে ধমকের সুরে বলে– “থামো!” “আর কোন ঘোড়া পরিখা অতিক্রম করবে না। মুহাম্মাদকে ডাকো। তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহাদুরকে আসতে বল সে আমাদের কোন একজনকেও যদি পরাস্ত করতে পারে তাহলে বিনা যুদ্ধে আমাদেরকে হত্যা করার অধিকার তোমাদের থাকবে।… খোদার কসম! আমরা তোমাদের রক্ত এই তৃষ্ণার্ত বালুরাশিকে পান করিয়েই ফিরে যাব।”

♣♣♣

মুসলিম ক্যাম্পে হৈ চৈ পড়ে যায়। একটি কথা চারদিকে গুঞ্জন করে ফেরে– “কুরাইশ এবং গাতফানরা পরিখা অতিক্রম করে ফেলেছে।… মুসলমানগণ! তোমাদের পরীক্ষার সময় এসে গেছে।… হুশিয়ার… সাবধান… দুশমন চলে এসেছে।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে উৎকণ্ঠিত হতে দেন না। তিনি দেখেন যে, কুরাইশরা পরিখার ওপারে দাঁড়িয়ে অট্টহাসি হাসছে আর চটকদার উক্তি এবং কৌতুক করছে। ইকরামা ও তার সৈন্যদের দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগিয়ে যান। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুও তার সাথে ছিলেন। তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন যে, ইকরামা মল্লযুদ্ধ করতে এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আসতে দেখে আমর বিন আবদুদ ঘোড়া সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যায়।

আমর চিৎকার করে বলে– “হুবল এবং উযযার কসম! তোমাদের মধ্যে এমন একজনও দেখছি না যে আমার সাথে লড়তে সক্ষম।”

ঐতিহাসিক আইনী রাহিমাহুল্লাহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে লিখেন, মুসলমানদের নীরবতা সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে, তারা আমর-ভীতিতে কম্পমান। কারণ, আমরের বিশাল দেহ এবং প্রচুর শক্তির এমন এমন ঘটনা আরবের সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিল যে কারণে সবাই তাকে মানুষ নয়, অসুর শক্তির অধিকারী বলে বিশ্বাস করত। এ কথা সবাইকে বলতে শুনা যায় যে, আমর শক্তিশালী ঘোড়াকে পর্যন্ত অতি সহজভাবে কাঁধে তুলতে পারে এবং পাঁচশ অশ্বারোহীকে সে একাই পরাজিত করতে পারে। তার ব্যাপারে সকলেরই এই বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, অদ্যাবধি তাকে কেউ পরাস্ত করতে পারেনি আর অদূর ভবিষ্যতেও পারবে না।

আবু সুফিয়ান ভগ্নহৃদয়ে পরিখার কিনারে দাঁড়িয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল। খালিদ এবং সফওয়ানও অপলক নেত্রে তাকিয়েছিল। গাতফান, আইনিয়া এবং তার অধীনস্থ সমস্ত সৈন্য ওপারের প্রতিটি দৃশ্য অবলোকন করতে থাকে। সকলের মাঝে শুনশান নীরবতা। এপারে যেন কবরের নিস্তব্ধতা। গভীর উৎকণ্ঠার ছাপ ছিল কেবল হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চেহারাতে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি ছিলেন বোবা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অসহায় ভঙ্গিতে অমুসলিম সৈন্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনিও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন ওপারের শাসরুদ্ধকর প্রতিটি দৃশ্যের প্রতি।

“আমি জানি, তোমাদের কেউ আমার মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে সাহস করবে না।” আমরের আহ্বানে কেউ সাড়া না দেয়ায় সে নিজে বুক চাপড়িয়ে গর্ব করে বলতে থাকে।

পরিখার ওপারে হাসির রোল পড়ে যায়।

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু অনুমতি পাবার আশায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে চান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মনোভাব বুঝতে পেরে স্বীয় পাগড়ী মাথা হতে খুলে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাথায় স্বহস্তে বেঁধে দেন। নিজের তরবারিটিও হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে তুলে দেন। ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ লিখেন, এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জবান মুবারক থেকে বের হয়– “আলীর সাহায্যকারী একমাত্র তুমিই হে আল্লাহ।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রদত্ত তরবারি সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেন, কুরাইশের বিখ্যাত যোদ্ধা মুনাব্বেহ বিন হাজ্জাজের তরবারি ছিল এটি। বদর যুদ্ধে সে নিহত হয়। বিজয়ী মুজাহিদগণ তরবারিটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রদান করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপর থেকে সর্বদা নিজের সাথে এই তরবারিটিই রাখতেন। এখন সে তরবারিটি হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দিয়ে আরবের এক দৈত্যের মোকাবিলায় প্রেরণ করেন। ইতিহাসে এ তরবারিটি ‘জুলফিকার’ নামে প্রসিদ্ধ।

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’আ নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে আমর বিন আবদূদের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ান।

“আবু তালিবের পুত্র!” আমর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে সম্বোধন করে বলে– “তোমার কি স্মরণ নেই যে, তোমার পিতা আমার কত অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল? এটা কি অশোভনীয় নয় যে, আমি আমার প্রিয় বন্ধুর ছেলেকে নিজ হাতে হত্যা করব?”

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেন– “পিতৃবন্ধু! বন্ধুত্বের পরিচয় অনেক পূর্বেই তো ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে একবারের জন্য এ সুযোগ দিচ্ছি যে, তুমি আল্লাহকে সত্য এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নিয়ে আমাদের হয়ে যাও।”

“তুমি একবার এসব উচ্চারণ করতে সুযোগ পেয়েছ।” আমর তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলে– “দ্বিতীয়বার এ কথা আমার কানে আর আসবে না। মনে রেখ, আমি সব সময় বলব, আমি তোমাকে কতল করতে চাইনি।”

কিন্তু আমি তোমাকে কতল করতে চাই, আমর!” হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু তার স্নেহসুলভ উক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন– “অশ্ব থেকে নেমে আমার মোকাবিলায় আস। চেষ্টা করে দেখ, আল্লাহ্‌র রাসূলের তরবারি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পার কি-না?”

ঐতিহাসিকগণ আমরের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেন, সে ছিল বর্বর, জংলী। ক্রোধান্বিত হলে তার চেহারা বন্যজন্তুর ন্যায় হিংস্র ও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। সে অশ্ব থেকে লাফ দিয়ে নামে এবং মুহূর্তে তরবারি বের করে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এর উপর এত দ্রুত আক্রমণ করে যে, দর্শকরা এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে যায় যে, তার তরবারি হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দু’টুকরো করে ফেলেছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু সুকৌশলে এই মারাত্মক আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। প্রথম আঘাত অকল্পনীয়ভাবে ব্যর্থ হতে দেখে আমর প্রচন্ড ক্রোধে উপর্যুপরি হামলার পর হামলা চালাতে থাকে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুও অপূর্ব রণকৌশলে নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন। আমর বাস্তব এ দিকটা নিয়ে কখনো ভাবেনি যে, যে শরীর ও শক্তির উপর তার এত অহংকার তা সর্বত্র কাজে আসে না। তরবারি পরিচালনায় যে রকম দ্রুততা ও স্বাচ্ছন্দতা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রদর্শন করে চলেছেন, তা আমরের দ্বারা কখনো সম্ভব নয়। কারণ আমরের তুলনায় হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহ ছিল হালকা এবং আকারে স্বল্প দৈর্ঘ্যের। আমর শক্তিবলে ঘোড়াকে কাঁধে উঠাতে সক্ষম হলেও ঘোড়ার গতি তার মধ্যে কখনো আসতে পারে না। এ বৈশিষ্ট্য একমাত্র ঘোড়ার। একজন মানুষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, কৌশলের কাছে তার পরাজিত হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু আমরকে একটি আক্রমণও করেন না। আমর একে ‘ভীতির প্রভাব’ মনে করে। আমর সর্বোচ্চ শৌর্য প্রদর্শন করতে অবিরাম আঘাত করে চলে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ধৈর্যের সাথে সুকৌশলে নিজেকে এদিকে ওদিকে ছুঁড়ে দিয়ে আত্মরক্ষার চরিত্রে অভিনয় করতে থাকেন। শক্তির মোকাবিলা অনেক সময় বুদ্ধির মাধ্যমে করতে হয়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু দৈত্যকায় আমরের মোকাবিলায় এ কৌশল অবলম্বন করেন। তাই তিনি আক্রমণে না গিয়ে আত্মরক্ষার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমরকে ক্রমাগত মুক্ত আক্রমণের সুযোগ করে দেন। যাতে দৈত্যসদৃশ আমর উপর্যুপরি আক্রমণ করে অল্প সময়ের মধ্যে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। নির্বোধ আমর এ চাল না ধরতে পেরে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে ঘূর্ণাবর্তের অতলতলে নিক্ষিপ্ত করতে থাকে। এক সময় চালাকীর জয় হয়, বিশাল শক্তি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

পরিখার ওপারে কুরাইশ সৈন্যরা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অসহায়ত্ব দেখে এতক্ষণ হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ তাদের অট্টহাসি থেমে যায়। কারণ, দৈত্যসদৃশ আমর আক্রমণ করতে করতে এক সময় নিজেই থেমে যায়। অস্ত্র নিম্নমুখী করে কাষ্ঠের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রচণ্ড হাফাচ্ছিল। হয়ত সে এ কারণে দারুণ বিস্মিত হয় যে, এত আক্রমণ সত্ত্বেও তার দেহের তুলনায় এক-বিশাংশ পরিমাণ ক্ষুদ্র দেহের অধিকারী এই যুবকটি প্রভাবিত হচ্ছে না। আমর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বুঝতে পারেন যে, আমর শরীরের সমস্ত শক্তি উপর্যুপরি আঘাত করে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিয়েছে এবং এখন সিদ্ধান্তহীন হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তখন তিনি সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তরবারি একদিকে ছুঁড়ে ফেলে বিদ্যুৎ গতিতে আমরের দেহ জাপটে ধরেন এবং লাফিয়ে উঠে তার গর্দানকে নিজের বাহু বন্ধনে আটকে দেন। সাথে সাথে আমরের পায়ের সাথে নিজের পা লতার মত পেঁচিয়ে অভিনব কায়দায় তাকে ভূতলশায়ী করেন। আমর চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-তার বুকে চেপে বসেন।

শেষ মুহুর্তে আমর হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এর হস্তবন্ধন হতে গর্দান মুক্তির প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এর শক্তিশালী বাহুবন্ধন হতে সে গর্দানকে মুক্ত করতে পারেনি। এক সময় হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু গর্দান হতে এক হাত সরিয়ে নিজের কোমর থেকে খঞ্জর বের করে তার অগ্রভাগ আমরের শাহরগে চেপে ধরেন।

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “এখনও আমার আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনলে আমি তোমার প্রাণ ভিক্ষা দিব”

আমর যখন দেখে যে, সারা আরব তার যে শক্তির উপর গর্ববোধ করত, তা অর্থহীন হয়ে পড়েছে, তখন সে এই ঘৃণ্য আচরণ করে যে, বুকের উপর বসা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চেহারা লক্ষ্য করে থু থু নিক্ষেপ করে।

দর্শকদের আরেকবার অবাক হবার পালা। সবার ধারণা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খঞ্জর আমরের শাহরগ ভেদ করে দেহ থেকে গর্দান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু না, সবাইকে হতবাক করে তিনি আমরের বুক থেকে নেমে আসেন। খঞ্জরকে খাপে পুরে দিয়ে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল পরিষ্কার করেন। আমর হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এমনভাবে উঠে দাঁড়ায় যেন তার গায়ে শক্তি বলতে কিছুই নেই। শুধু আমরের নয়, বরং প্রতিটি দর্শকের ধারণা ছিল হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এবার তাকে জীবিত রাখবেন না। কিন্তু তিনি কিছুই না বলে স্বাভাবিকভাবে পাশে সরে গিয়ে দাঁড়ান।

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর এ অবাক করা আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন– “আমর! মহান আল্লাহর নামে আমি তোমার সাথে জীবন-মৃত্যু পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু মুখে থু থু মেরে তুমি আমার অন্তরে ব্যক্তিগত শত্রুতার উদ্রেক করেছ। এখন তোমাকে কতল করলে সেটা হতো আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে বদলা নেয়া। কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রুতার দরুণ আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। কারণ, হতে পারে আমার আল্লাহ এ বদলা গ্রহণ সমর্থন করবেন না। প্রাণ ভিক্ষা দিলাম। নিরাপদে চলে যেতে পার।”

আমর পরাজয় মেনে নেয়ার মত লোক ছিল না। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম পরাজয়। তাই কোনভাবেই সে এটাকে মেনে নিতে পারে না। সে এরই মধ্যে পরাজয়কে জয়ে পরিণত করার ফন্দী করে। আমরকে চলে যেতে বলে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুও চলে যেতে উদ্যত হন। কিন্তু নরাধম আমর যায় না। সে অলক্ষ্যে তরবারি বের করে কাপুরুষোচিতভাবে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আচমকা হামলার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হেফাজতের জন্য দু’আ করেছিলেন। তাই একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন আমরের তরবারি এবং হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গর্দানের মাঝখানে দু’চার আঙ্গুল ব্যবধান ছিল তখন হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু উদ্যত আঘাত সম্পর্কে জানতে পেরে দ্রুত ঢাল ধরেন। আমরের আঘাত এত প্রচণ্ড ছিল যে, তার তলোয়ার হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঢালকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। ঢালের ভগ্নাংশ হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কানের কাছে মাথার উপর পড়ে। এতে আঘাতের স্থান হতে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে।

আমর আক্রমণ করে ঢাল থেকে তরবারি ছাড়াচ্ছিল। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তরবারি অতি দ্রুত খাপ মুক্ত হয়ে আমরের গর্দানের উদ্দেশ্যে জোর লাফ দেয়। জায়গা পেয়েই তরবারি কাজ শুরু করে। আমরের গর্দান কেটে যায়। গর্দান পুরোটা না কাটলেও শাহরগ ঠিকই কেটে যায়। আঘাতের প্রচণ্ডতায় আমরের তলোয়ার হাত থেকে ছিটকে দুরে পড়ে। তার শরীরও দুলতে থাকে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্বিতীয় কোন আঘাত করেন না। প্রথম আঘাতের ফলাফল দেখেই তিনি বুঝে গেলেন যে, এ আঘাতই যথেষ্ট। আমরের পা জড়িয়ে যায়। হাঁটু মাটিতে গিয়ে ঠেকে। এক সময় কাটা কলাগাছের ন্যায় মাটিতে আঁছড়ে পড়ে। মদীনার মাটি তার রক্ত চুষতে থাকে।

পরিখার ওপারে শত্রু-সৈন্যেদের মাঝে এমন পীনপতন নীরবতা নেমে আসে, যেন পুরো সেনাবাহিনী দাড়িয়ে থেকেই মারা গেছে। এর বিপরীতে পরিখার এপারে মুসলমানদের তাকবীরধ্বনি আকাশ-বাতাশ মুখরিত করে তোলে।

আরব নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে যায়। মুসলমানদের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ইকরামা এবং তার সহযোগীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুরাইশদের ক্ষুদ্র দলটির জন্য লেজ খাড়া করে পালানো ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। তারা প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে যুদ্ধ করতে থাকে। এই সংঘর্ষে কুরাইশদের একজন মারা যায়। ইকরামা পলায়নের জন্য পরিখা অভিমুখে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। পরিখা অতিক্রমের সুবিধার্থে ইকরামা বর্শা ফেলে দেয়। খালিদ বিন আব্দুল্লাহ নামক এক অশ্বারোহী পরিখা পার হতে পারে না। তার অশ্বটি পরিখার ওপারের কিনারার সাথে বড় ধরনের ধাক্কা খায়। অশ্ব তার আরোহীকে নিয়ে নিচে পতিত হয়। অশ্বারোহী নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে উপরে উঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলমানরা পাথর বর্ষণ করে তার জীবনলীলা সাঙ্গ করে দেয়। প্রস্তরাঘাতে জর্জরিত হয়ে সেখানেই সে মৃত্যুবরণ করে।

♣♣♣

যে স্থান দিয়ে পরিখা পার হওয়ার ঘটনা ঘটে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে জোরদার প্রহরার নির্দেশ দেন।

পরের দিন খালিদ অধীনস্থ বাহিনী হতে বাছাই করা কয়েকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নিয়ে পুনরায় পরিখা অতিক্রম করতে যাত্রা করে।

“থামো খালিদ!” আবু সুফিয়ান খালিদের মনোভাব বুঝতে পেরে বলে –“গতকাল ইকরামা বাহিনীর ভয়াবহ পরিণতি দেখনি? আজ নিশ্চয় মুসলমানরা সেখানে আরো কড়া পাহারার ব্যবস্থা করবে।”

“লড়াই না করে পিছু হটার চেয়ে এটা কি ভাল নয় যে, তোমরা আমার লাশ আমার ঘোড়ায় চড়িয়ে মক্কায় নিয়ে যাবে?”

খালিদ বলেন– “যদি আমরা একে অপরের পরিণতি দেখে ভয় পেয়ে যাই তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমরা মুসলমানদের গোলামে পরিণত হব।”

আমি তোমার পথের বাধা হব না” “বন্ধু!” ইকরামা খালিদকে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে– “তবে আমার একটি কথা শোন। যদি তুমি আমার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যেতে চাও তবে যেয়ো না। আর যদি কুরাইশদের মান-মর্যাদা বিবেচনায় যেতে চাও তাহলে অবশ্যই যাও।”

মদীনায় যাবার পথে আজ খালিদের সেদিনের কথা আবার মনে পড়ে। পরিখা অতিক্রম করুক বা না করুক উভয় অবস্থায় মৃত্যু তার অনিবার্য হওয়া সত্ত্বেও কোন্ আকর্ষণে সেদিন তিনি পরিখার দিকে রওনা হন– এ প্রশ্নের সন্তোষ জনক জবাব সেদিনও তার কাছে ছিল না এবং আজও নেই।

৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ। দিবসের তৃতীয় প্রহর; বিকেলবেলা খালিদ বাছাই করা কতক অশ্বারোহী নিয়ে পরিখার দিকে এগিয়ে যান। তিনি পরিখা অতিক্রম করতে একটু দূর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। কিন্তু গোপন ঘাঁটিতে ওঁত পেতে থাকা মুসলিম রক্ষীরা বৃষ্টির মত তীর বর্ষণ শুরু করে। খালিদ পূর্ণশক্তিতে লাগাম টেনে ধরেন। ঘোড়া প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে পরিখার একদম কিনারায় এসে থেমে যায়। খালিদ ঘোড়া পশ্চাৎমুখী করেন এবং তীরন্দাজদের ডেকে পাঠান। তিনি এভাবে পরিকল্পনা করেন যে, তীরন্দাজ বাহিনী মুসলমানদের প্রতি তীর বৃষ্টি বর্ষণ করলে তারা মাথা উঁচু করতে পারবেনা। আর এই ফাঁকে তিনি পরিখা পার হয়ে যাবেন। কিন্তু মুসলমানরা দ্বিগুণ হারে তীর ছুঁড়তে থাকে। মুষলধারায় তীর-বৃষ্টি খালিদের সকল পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়। ব্যর্থ, হতাশা আর ভগ্নাহত হৃদয়ে তিনি ফিরে আসেন।

খালিদ দমে যাবার পাত্র নন। একবার ব্যর্থ হলেও আবার ঝুঁকি নেয়ার চিন্তা করেন। তিনি এমনভাবে অশ্বারোহীদেরকে অন্যত্র নিয়ে যান, মনে হয় পরিখার আর কোন আক্রমণের চিন্তা-ভাবনা তার আদৌ নেই। উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইবনে হিশাম এবং ইবনে সা’দ লিখেন, এটা ছিল খালিদের এক নতুন চাল। তিনি চলতে চলতে অধীনস্থ বাহিনী হতে নিজের সাথে আরো কতক অশ্বারোহী বৃদ্ধি করে নেন। তার ধারণা, তাদের এভাবে চলে যেতে দেখলে মুসলিম রক্ষীরা এদিক-ওদিক চলে যাবে। কিছুক্ষণ পর তিনি অকুস্থলে তাকিয়ে সেখানে একজনও দেখতে পাননা। তিনি দ্রুত অশ্বারোহীদের পরিখামুখী করে অপেক্ষাকৃত সরু স্থানে গিয়ে বাতাসের গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন।

খালিদের এই অভিনব কৌশল এতটুকু কার্যকর হয় যে, তারা তিন-চারজন অশ্বারোহী পরিখা পার হতে সক্ষম হয়। খালিদ ছিলেন সবার আগে। মুসলমান প্রহরীরা তৎক্ষণাৎ তাদের ঘিরে ফেলে। ওপারে যে সমস্ত অশ্বারোহী পরিখা অতিক্রমের অপেক্ষায় ছিল এপার থেকে মুসলিম রক্ষীরা তাদের প্রতি এমন অব্যাহতভাবে তীর বর্ষণ করে যে, তাদের অগ্রযাত্রা ব্যর্থ হয়ে যায়। তারা আর সামনে এগুতে পারে না। খালিদ ও তার সাথিদের জন্য মুসলমানদের ঘেরাও হতে বের হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটা ছিল বাঁচা-মরার লড়াই। খালিদ এদিক-ওদিক ঘোড়া ঘুরিয়ে এবং বারবার স্থান পরিবর্তন করে লড়তে থাকে। তার সাথিরাও ছিল যথেষ্ট অভিজ্ঞ। অসীম সাহসিকতা আর অপূর্ব ভঙ্গিমায় তারা লড়ে যায়। মুসলমানদের হাতে একজন নিহত হয়। খালিদ ক্রমে কোণঠাসা হয়ে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ শুরু করেন। তার হাতে কয়েকজন মুসলমান আহত হয়। পরে শাহাদাত বরণ করেন। এক পর্যায়ে তিনি পালাবার সুযোগ পেয়ে তার ঘোড়া পরিখা পার হয়ে চলে আসে। তার সাথিদের মধ্যে যারা জীবিত ছিল, তারাও পরিখা পার হতে সক্ষম হয়।

এরপরে কুরাইশদের আর কেউ পরিখা অতিক্রম করার সাহস করেনি। ইকরামা এবং খালিদের ব্যর্থতার পর বহুজাতিক বাহিনীর হতাশা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। খাদ্যশস্য বলতে কিছুই ছিলনা। সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ান অনেক আগেই আশা ছেড়ে দেয় এবং যুদ্ধ হতে হাত-পা গুটিয়ে নেয়। খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ান বহুজাতিক বাহিনী যে সদা তৎপর ও উজ্জীবিত তা প্রকাশ করতে চাতুর্যপূর্ণ এ মহড়া অব্যাহত রাখে, মাঝে মাঝে পরিখার কাছে গিয়ে মুসলিম সেনা ছাউনিতে তীর বর্ষণ করে। এর সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য মুসলমানরাও পরিখার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। তারা তীরের জবাব তীর দ্বারা প্রদান করে। এভাবে তীর চালাচালি চলে। মাত্র একদিন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

কুরাইশ, গাতফানসহ অন্যান্য গোত্র যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পরাজিত করতে আসে, তিনি কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ পাক তাঁকে এক গুরুত্বপূর্ণ মিশন এবং পবিত্র রেসালাতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। আল্লাহ্ তার রাসূলকে সাহায্য না করে কিভাবে নিরাশ করতে পারেন। মদীনার মুসলমানদের স্ত্রী-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, দিন-রাত সফলতা এবং পরিত্রাণের প্রার্থনায় রত। এত দুআ কিভাবে ব্যর্থ হবে?

৬২৭ খিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ মঙ্গলবার মদীনার আবহাওয়ায় হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। চারদিকে নিরবতা। বাতাস থেমে যায়। শীত-শীত ভাব। থমথমে অবস্থা। কিন্তু এটা ছিল ঝড়ের পূর্বাভাস। তুফানের পূর্বাভাস। হঠাৎ করে পৃথিবী অন্ধকারে ছেয়ে যায়। শুরু হয় ঘূর্ণিঝড়। বাতাস এত বেগে প্রবাহিত হয় যে, তাঁবু দোল খেতে থাকে এবং উড়ে যাবার উপক্রম হয়। বাতাসের ঝাপটা খুবই শীতল। আঁধারের তীব্রতা এবং বজ্রধ্বনিতে ঘোড়া, উট ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে রশি ছেড়ার মত অবস্থা।

মুসলিম ক্যাম্প ছিল পাহাড় সালা সংলগ্ন এলাকায়। যার ফলে ঘূর্ণিঝড় কুরাইশদের ন্যায় তাদের পর্যদুস্ত করে না। মক্কার সৈন্যরা ছিল খোলামাঠে। ঘূর্ণিঝড় তাদের রসদ-সামগ্রী উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁবু ছিড়ে ফেলে কিংবা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। নেতৃস্থানীয় এবং সাধারণ সৈন্য সকলেই ব্যক্তিগত কাপড় গায়ে জড়িয়ে বসে ছিল। তাদের জন্য ঘূর্ণিঝড় খোদার গজব হয়ে দেখা দেয়। থেকে থেকে বিকট বজ্রধ্বনি তাদের কানে শেলের মত আঘাত হানছিল।

আবু সুফিয়ান এই মহা দুর্যোগ সহ্য করতে পারে না। সে উঠে যায় কিন্তু ঘোড়া খুঁজে পায় না। কাছে একটি উট শুয়ে আরাম করছিল। আবু সুফিয়ান তার পৃষ্ঠে চড়ে উটকে দাঁড় করায়। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের বর্ণনামতে আবু সুফিয়ান যাবার কালে চিৎকার করতে থাকে– “কুরাইশগণ! কা’ব বিন আসাদ তোমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। ঘূর্ণিঝড়েও আমরা দারুণভাবে বিধ্বস্ত। এখানে থাকা আত্মঘাতির শামিল। মক্কায় ফেরৎ চল।… আমি চলে যাচ্ছি।… আমি চললাম।”

সে কারো উত্তর বা কোন কিছুর অপেক্ষা করে না। একাই মক্কাপানে উট হাঁকিয়ে দেয়।

আজ খালিদের চোখে ভাসতে থাকে একটি বেদনাবিধুর দৃশ্য। যে বহুজাতিক বাহিনী মক্কা ত্যাগ করে রওনা হলে খালিদের বুক ফুলে দ্বিগুণ হয়েছিল, তারা আবু সুফিয়ানের আহ্বানে তার পেছনে পেছনে ভীতু বাঘের মত দৌড়ে পালাতে শুরু করেছিল। খালিদ এবং আমর ইবনুল আসের ব্যক্তিগত ধারণা ছিল, হয়ত মুসলমানরা পিছু হঁটা সৈন্যদের উপর পেছন দিক হতে চড়াও হতে পারে। তাই তারা তাদের বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সৈন্যদের একেবারে পেছনে গিয়ে সতর্ক অবস্থান নেয়। আবু সুফিয়ান সর্বাধিনায়ক হয়ে নিরাপত্তার এদিকটা বিবেচনা করেনি। পলায়নের চিন্তায় সে ছিল বিভোর। মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাকারী।

পিছু হঁটা এই বাহিনীতে একমাত্র অনুপস্থিত ছিল হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন সময় যখন কুরাইশ সৈন্যরা ফিরে যায় তখন তিনি সুযোগ করে পরিখায় নেমে পড়েন এবং সোজা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট চলে যান।

আজ খালিদ ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দেয়। বিশ্ব-ইতিহাস নতুন দিকে মোড় নেয়।

♣♣♣

ঘূর্ণিঝড় জগদ্বাসীর সম্মুখে এ বাস্তবতা তুলে ধরে যে, আল্লাহ্ তায়ালা সত্যপূজারীদের সাথে থাকেন।

দুশমনের পিছু ধাওয়া ছিল অনেকটা ঐ তৃণের মতো যা ঘূর্ণিঝড়ের তোড়ে উড়ে যায়। অথচ কেউ কারো খবর রাখে না।

খালিদের এই আশঙ্কা ছিল যে, মুসলমানরা পিছু নিবে। কিন্তু মুসলমানরা স্বপ্নেও এ চিন্তা করে নি। স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে পশ্চাদ্ধাবন করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারত। আল্লাহ নিজেই যাদের ভাগিয়ে দিচ্ছেন। তাদের পশ্চাদ্ধাবন করাটা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হত না। অবশ্য সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে শত্রুদের উপর নজর রাখতে কয়েকজনকে উঁচু জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। যেন এমনটি না হয় যে, শত্রু কিছু দূর গিয়ে থেকে যাবে এবং আবার সংগঠিত হয়ে ফিরে আসবে।

ঘূর্ণিঝড় আরবের মাটি এবং বালু এত পরিমাণ উড়ায় যে, সামান্য দুরের কিছুও দেখা যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ পর তিন-চার জন মুসলমান অশ্বারোহী ঐ স্থান দিয়ে পরিখা অতিক্রম করে, ইকরামা এবং হযরত খালিদের ঘোড়া যে স্থান দিয়ে পরিখা অতিক্রম করে। তারা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত যায়। উৎক্ষিপ্ত ধুলা-বালু ছাড়া আর কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তারা যাত্রাবিরতি করে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে না।

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে ঘূর্ণিঝড় কিছুটা থামে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হয় এবং বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। দূরের দিগন্তে ভূপৃষ্ঠ থেকে ধূলি মেঘ উঠছিল। বহুজাতিক বাহিনীর পশ্চাদপসারণ ছিল এ ধূলিঝড়ের উৎস। ডুবন্তপ্রায় সূর্যের আলোতে এ ধূলিমেঘ স্পষ্টরূপে দেখা যায়। ধূলার কুণ্ডলী মক্কাভিমুখে যাচ্ছিল। পশ্চাদ্ধাবনে যাওয়া মুসলিম অশ্বারোহী দল গভীর রাতে ক্যাম্পে ফিরে আসে।

অনুসন্ধান টিম রিপোর্ট পেশ করে – “আল্লাহর শপথ! যারা আমাদের আকীদা-বিশ্বাস ধ্বংস এবং মদীনার ইট খুলতে এসেছিল, তারা এত ভীতি ও উদ্বেগ নিয়ে ফিরে গেছে যে, রাস্তায় কোথাও থামেনি। মুসাফিররা রাতেও কি কাফেলা থামায়? সৈন্যরা কি রাতেও যাত্রা অব্যাহত রাখে?… কেবল তারাই রাখে, যারা অতি দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে চায়।”

হাদীস এবং ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে জানা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিশ্চিত হন যে, শত্রুরা অত্যন্ত ঘাবড়ে পালিয়ে গেছে এবং সংগঠিত হয়ে পুনরায় ফিরে আসার কোনই সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি তলোয়ার, খঞ্জর নিজ হোলেস্টার থেকে বের করে রেখে দেন এবং আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে গোসল করেন।

এ রাতের পেট থেকে যে সকালের জন্ম হয়, তা মদীনাবাসীদের জন্য মহান বিজয় ও উৎসবের সকাল ছিল। দিক-বিদিক ‘আল্লাহু আকবার’ এবং উল্লাস ধ্বনিতে আত্মহারা ছিল। সবচে’ অধিক আনন্দ প্রকাশ করে নারী এবং শিশু-কিশোররা, যাদেরকে নিরাপত্তার জন্য ছোট ছোট কেল্লায় রাখা হয়েছিল। তারা বিজয়ের আনন্দে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে কেল্লা থেকে বের হয়ে আসে। মদীনার অলি-গলিতে মুসলমানরা উল্লাস প্রকাশ করে ফেরে।

বিজয়ের এই আনন্দ উদযাপনে বনু কুরাইযার ইহুদীরাও অংশ নেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে তাদেরকে কিছুটা ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন। বাইরে তারা নিজেদেরকে মুসলমানদের বন্ধু বলে প্রচার করত এবং বন্ধুর মতই উঠা-বসা করত। কুরাইশদের পালানোর কারণে তারা মুসলমানদের মতই আনন্দ-উল্লাস করে। কিন্তু তাদের নেতা কা’ব বিন আসাদ নিজের কেল্লায় বসা ছিল। তার পাশে স্বগোত্রেরই অপর তিন নেতৃস্থানীয় ইহুদী বসা ছিল। তৎকালীন যুগের সেরা সুন্দরী ইহুদী নারী ইউহাওয়াও সেখানে উপস্থিত ছিল। কুরাইশদের পিছু হঁটে যাবার খবর পেয়ে সে গতকাল সন্ধাবেলায় এখানে আসে।

কা’ব বিন আসাদ বলে– “মুসলমানদের উপর হামলা না করে আমরা কি সঠিক কাজ করিনি? নু’আইম বিন মাসউদ আমাকে যথার্থ পরামর্শ দিয়েছিল।

চুক্তির জামানত হিসেবে সে আমাকে কুরাইশদের থেকে মানুষ জামিন চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। সে এ তথ্যও জানায় যে, কুরাইশরা দ্বিগুণ সৈন্য নিয়ে এলেও পরিখা অতিক্রম করতে পারবে না। নু’আইম কুরাইশ পক্ষীয় হওয়ায় আমি তার পরামর্শ গ্রহণ করি।”

এক ইহুদী জানায়– “সে কুরাইশ পক্ষীয় নয়। সে মূলত মুহাম্মাদের অনুসারী।”

“ইহুদীদের খোদার কসম! তোমার কথা সত্য হতে পারে না। কা’ব বিন আসাদ চ্যালেঞ্জ করে বলে– “সে কুরাইশদের সাথে এসেছিল, কিন্তু তাদের সাথে ফিরে যায়নি।”

পূর্বের ইহুদী পুনরায় জানায় – “গতকাল সন্ধ্যায় আমি তাকে মুসলমানদের সাথে দেখেছি। অথচ এ সময়ের মধ্যে কুরাইশ সৈন্যরা মদীনা ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে পৌঁছেছে।”

“তারপরও তুমি কি করে জানলে যে, সে মুহাম্মাদের অনুসারী?” কা’ব উদ্বেগে জিজ্ঞাসা করে– “এমন কথা আমি মেনে নিতে পারি না, যা তুমি কারো কাছ থেকে শুনে নিশ্চিত হওনি।”

“এক মুসলিম বন্ধুকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম।” ইহুদী পরাজয় না মানার ভঙ্গিতে বলে– “নু’আইমকে দেখে বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, মুসলমানরা কি কুরাইশ যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্তাবস্থায় রাখছে।… দোস্ত জানায়, অনেক আগে থেকে নু’আইম মুসলমান। সুযোগ না পাওয়ায় এতদিন আসতে পারেনি। এখন সুযোগ পেয়ে চলে এসেছে।”

তাহলে তো সে আমাদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করেনি; বরং মুসলমানদেরকে আমাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।” কা’ব বিন আসাদ বিজ্ঞের মত বলে– “তবে সে যাই করুক না কেন, তা আমাদের পক্ষে গেছে। যদি আমরা কুরাইশদের কথা মেনে নিতাম তাহলে…।”

‘তাহলে মুসলমানরা আমাদের শত্রু হয়ে যেত।” কা’বের কথা কেড়ে নিয়ে এক ইহুদী বলে– তুমি এটাই বলতে চেয়েছিলে কা’ব? মনে রেখ, তবুও মুসলমানরা আমাদের শত্রু। মুহাম্মাদের নতুন ধর্মমত অঙ্কুরেই বিনাশ হবে। নতুবা একদিন আমাদের শেষ করবে মুহাম্মাদ।”

“খবর আছে, ইসলাম নামে যে ধর্মমতের প্রচার শুরু হয়েছে তা কত দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে চলেছে?” অতিশয় বৃদ্ধ তৃতীয় ইহুদী এই প্রথম মুখ খোলে– “ক্রমবর্ধমান এ পথে আমাদের বাধা দিতে হবে। থামাতেই হবে এ উর্ধ্বগতি।”

“কিন্তু কিভাবে?” কা’ব চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে উপায় জানতে চায়। “হত্যা” বৃদ্ধ ইহুদী ক্রুর হেসে বলে – “মুহাম্মাদের হত্যার মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব।”

“এমন দুঃসাহস কে করবে?” কা’ব বিন আসাদ আঁতকে উঠে বলে–“তুমি বললে একজন ইহুদীও এই ঘাতক হতে পারে। ঘটনাক্রমে যদি সে ব্যর্থ হয় তবে বনু কায়নুকা ও বনুনযীরের পরিণামের কথা আরেকবার স্মরণ কর। বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মুসলমানরা যেভাবে তাদের পাইকারীভাবে হত্যা করে আর যারা তাদের হাত থেকে রেহাই পায় তারা যেভাবে উর্ধ্বশ্বাসে দূর-দূরান্তের দেশে পালিয়ে যায় তাও মনে রাখা দরকার।

ইহুদীদের খোদার শপথ।” বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে দূরদর্শীর ভঙ্গিতে বলে – “আমার বিবেক তোমার থেকে অধিক না চললেও একেবারে কমও চলে না। তুমি আজ যে চিন্তা করছ, তা আমি এবং লাঈছ বিন মোশান অনেক আগেই করে রেখেছি। নিশ্চিত থাক, কোন ইহুদী মুহাম্মদকে হত্যা করতে যাবে না।”

“এই ঘাতক তবে কে হবে?” কা’ব বিন আসাদ সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে।

“কুরাইশ গোত্রেরই এক যুবক। বৃদ্ধ ইহুদী হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলে, “লাঈস বিন মোশান তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করেছে। আমার মতে, কাজটি সেরে ফেলার সময় এসে গেছে।”

যখন এর বিস্তারিত ও পরিকল্পনা আমি জানি না, তখন বনু কুরাইযার নেতা হয়ে কিভাবে আমি তার অনুমতি দিব?” কা’ব জানতে চায়– “আবু সুফিয়ান তাকে প্রস্তুত করেছে? খালিদ বিন ওলীদ প্রস্তুত করেছে?”

‘কা’ব! শুনে রাখ” বৃদ্ধ ইহুদী মুখে একথা বলে এবং ভূবন সুন্দরী ইউহাওয়ার প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।

♣♣♣

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *