১.১ আরব মরুর বুক চিরে

নাঙ্গা তলোয়ার – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-এর জীবনভিত্তিক উপন্যাস
অনুবাদ – মাওলানা মুজিবুর রহমান, প্রভাষক, আরবী, বানিয়াচং সিনিয়র ফাযিল মাদ্রাসা

উৎসর্গ

তাঁদের প্রতি
যাঁদের সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়,
ইসলামের সত্যবাণী
উদ্ভাসিত হয়েছে বিশ্বময়॥

ভূমিকা

হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের ঐ তলোয়ারের নাম যা কাফেরদের বিরুদ্ধে চিরদিন খোলা থাকে। হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘সাইফুল্লাহ্’ – ‘আল্লাহর তরবারী’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি নাম করা ঐ সকল সেনাপতি সাহাবীদের অন্যতম যাদের অবদানে ইসলামের আলো দূর-দূরান্তে পৌঁছতে পেরেছে। শুধু ইসলামী ইতিহাস নয়; বিশ্ব সমরেতিহাসও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদের কাতারে গণ্য করে থাকে। প্রখ্যাত সমরবিদ, অভিজ্ঞ রণকুশলী এবং স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞগণও হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রণকৌশল, তুখোর নেতৃত্ব, সমপ্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতীত্ব এবং বিচক্ষণতার স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।

প্রতিটি রণাঙ্গণে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। কাফেরদের সংখ্যা কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও তিনগুণ। ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোম সম্রাট এবং তার মিত্র গোত্রসমূহের সৈন্য ছিল ৪০ হাজারের মত। শত্রুর সৈন্য সারি সুদূর ১২ মাইল প্রলম্বিত, এর মধ্যে কোথাও ফাঁক ছিল না। অপরদিকে, মুসলমানরা (শত্রুবাহিনীর দেখাদেখি) নিজেদের সৈন্যদের ১১ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়। তাও প্রতি দু’জনের মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান ছিল।

শত্রুসৈন্যের বিন্যস্ত সারিও বৃহদাকার ছিল। সৈন্যরা একের পর এক সাজানো ছিল। একজনের পিছনে আরেকজন দাঁড়ানো। যেন একটি প্রাচীরের পিছনে আরেক প্রাচীর খাঁড়া। এর বিপরীতে মুসলমানদের সৈন্য বিন্যাসের গভীরতা ছিল না বললেই চলে।

ইতিহাস মুক। সমর বিশেষজ্ঞগণ বিস্মিত। সকলের অবাক জিজ্ঞাসা– ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা রোমীয়দের কিভাবে পরাজিত করল? রোমীয়দের সেদিন চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছিল। এ অবিশ্বাস্য ঘটনার পর বাইতুল মুকাদ্দাস পাকা ফলের মত মুসলমানদের ঝুলিতে এসে পড়েছিল।

এটা ছিল অভূতপূর্ব সমর কুশলতার ফল। ইয়ারমুক যুদ্ধে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে সফল রণ-কৌশল অবলম্বণ করেছিলেন আজকের উন্নত রাষ্ট্রের সেনা প্রশিক্ষণে গুরুত্বের সাথে তা ট্রেনিং দেয়া হয়।

হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এটা মানতে রাজি ছিলেন না যে, দুশমনের সৈন্যসংখ্যা বেশী হলে এবং তাদের রণসম্ভার অত্যাধুনিক ও উন্নত হলে আর মুসলমানরা সংখ্যায় কম হলে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া উদ্বেগজনক ও আত্মঘাতী হবে। এমন ঘটনাও তার বর্ণাঢ্য জীবনে ঘটেছে যে, তিনি সরকারী নির্দেশ এড়িয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ করে শাসরুদ্ধকর বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এটা তাঁর প্রগাঢ় ঈমান এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের ফসল ছিল। ইসলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অগাধ ভালবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল।

এছাড়া হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। যে কোন পাঠক শ্রোতাই তাতে চমৎকৃত হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করলে তিনি এতটুকু বিচলিত কিংবা ভগ্নাহত হননি। খলিফার নির্দেশের সাথে সাথে সেনাপতির আসন থেকে নেমে গেছেন সাধারণ সৈনিকের কাতারে। সেনাপতি থাকা অবস্থায় যেমন শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করেছেন, সৈনিক অবস্থায় তার থেকে মোটেও কম করেননি। ইয়ারমুক যুদ্ধশেষে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এক অভিযোগে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদীনায় তলব করেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মদীনায় এসে উপস্থিত হন এবং আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সেনাপতির সাথে ‘অসেনাপতিসুলভ’ আচরণ করলেও হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতিক্রিয়া এমন শান্ত ছিল যে, হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এর জন্য একটুও চাপের সম্মুখীন হতে হয়নি। তিনি অবনত মস্তকে খলিফার নির্দেশ শিরোধার্য বলে মেনে নেন। প্রদত্ত শাস্তি অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেন।

হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-বরখাস্তের দরুণ দুঃখিত হন ঠিকই কিন্তু তাই বলে খলিফার বিরুদ্ধে তিনি টুশব্দটি করেননি। খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কল্পনাও মাথায় আনেননি। নিজস্ব বাহিনী তৈরী করেননি। পৃথক রণাঙ্গন সৃষ্টি করেননি। তিনি এমন কিছু করতে চাইলে পুরো সেনাবাহিনী থাকত তাঁর পক্ষে। জাতির চোখে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ইতোমধ্যে দু’টি বিশাল সমরশক্তিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ায় তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এক ছিল পরাক্রমশালী ইরানী শক্তি আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অপর পরাক্রমশালী রোম শক্তি। হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে চরম নাকানি-চুবানি খাইয়ে পরাজিত করে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমা ইরাক এবং সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। খেলাফতের প্রতি ছিল তার অসীম শ্রদ্ধা। তিনি খলিফার সিদ্ধান্তে রুখে দাঁড়ান না। তিনি নিজের সম্মান-মর্যাদার কথা বিবেচনা না করে মাননীয় খলিফার মর্যাদা সমুন্নত রাখেন।

হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরিচয়, ইসলামের প্রতি তার অবদান এবং বর্তমান মুসলমানরা তার থেকে কি আদর্শ গ্রহণ করতে পারে-বক্ষমান উপন্যাসে পাঠক তা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারবেন।

ইসলামের ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সম্মুখীন হয়ছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার কোন কোন ঘটনায় পদখলনের শিকার হয়েছেন। একই ঘটনা একাধিকরূপে চিত্রিত হয়েছে। ফলে তা হতে সত্য ও বাস্তব তথ্য আহরণ পাঠকের জন্য গলদঘর্মের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।…

এ উপন্যাসের প্রত্যেকটি ঘটনা সত্য-সঠিকরূপে পেশ করতে আমরা বহু গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। সম্ভাব্য যাচাই-বাছাই করেছি এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা লিখেছি। মাঝে মাঝে এমন স্থানে এসে হোচট খেয়েছি যে, কোনটা বাস্তবভিত্তিক আর কোনটা ধারণা নির্ভরতা শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সেক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের উপর ভিত্তি করে বাস্তবতা উদ্ধারের প্রয়াস পেয়েছি। এ কারণে মতান্তর ঘটবে; আর তা ঘটাই স্বাভাবিক। তবে এ মতবিরোধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এবং অপ্রসিদ্ধ ঘটনায় গিয়ে প্রকাশিত হবে মাত্র।

যে ধাঁচে এ বীরত্বগাঁথা রচিত, তার আলোকে এটাকে কেউ উপন্যাস বললে বলতে পারে, কিন্তু এটা ফিল্মি স্টাইল এবং মনগড়া কাহিনী ভরপুর বাজারের অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত নয়। এর পাঠক উপন্যাসের চাটনিতে ‘ঐতিহাসিকতার পথ্য’ গলধঃকরণ করবেন গোগ্রাসে। এতে ঐতিহাসিকতা বেশী, ঔপন্যাসিকতা কম।

এটা কেবল ইতিহাস নয়, ইসলামী ঐতিহ্যের অবয়ব। মুসলমানদের ঈমানদীপ্ত ঝাণ্ডা। পূর্বপুরুষের গৌরব-গাঁথা এবং মুসলিম জাতির জিহাদী জযবার প্রকৃত চিত্র। পাঠক মুসলিম জাতির স্বকীয়তা জানবেন, সাহিত্যরস উপভোগ করবেন এবং রোমাঞ্চ অনুভব করবেন।

বাজারের প্রচলিত চরিত্রবিধ্বংসী উপন্যাসের পরিবর্তে সত্যনির্ভর এবং ইসলামী ঐতিহ্যজাত উপন্যাস পড়ুন। পরিবারের অপর সদস্যদের পড়তে দিন। নিকটজনদের হাতে হাতে তুলে দিন মুসলিম জাতির এ গৌরবময় উপাখ্যান।

এনায়েতুল্লাহ্ আলতামাশ
লাহোর, পাকিস্তান

প্রকাশকের মিনতি

▶ সম্মানিত পাঠকবৃন্দের প্রতি এটি আমাদের একটি আনন্দঘন আয়োজন। মজাদার পরিবেশনা। ইতিহাসের উপাদান, সাহিত্যের ভাষা আর উপন্যাসের চাটনিতে ভরপুর এর প্রতিটি ছত্র। শাসরুদ্ধকর কাহিনী ঝরঝরে বর্ণনা আর রুচিশীল উপস্থাপনার অপূর্ব সমন্বয় আপনার হাতের এই নাঙ্গা তলোয়ার।

▶ পাঠক অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। লাভ করবেন অনাবিল আনন্দ। তুলবেন তৃপ্তির ঢেকুর। নাঙ্গা তলোয়ারের ১ম ও ২য় খণ্ডের আত্মপ্রকাশের এ শুভ মুহূর্তে আমরা এ ব্যাপারে গভীর আশাবাদী।

▶ শমশীরে বে-নিয়াম-এর ভাষান্তর নাঙ্গা তলোয়ার, মূল লেখক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ। পাকিস্তানের জনপ্রিয় এই লেখকের সাথে বাংলাদেশের পাঠকবৃন্দকে নতুন করে পরিচয় করানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে আমাদের মনে হয় না। ইতোমধ্যে তার জ্ঞানদীপ্ত হাতের একাধিক উপন্যাস বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলার জনগণ এমন ঔপন্যাসিক পেয়ে বড়ই গর্বিত এবং আনন্দিত। এর জলন্ত প্রমাণ হলো – তার কোন উপন্যাস ছেপে বাজারে আসতে দেরী, ছাপা ফুরাতে দেরী না।

▶ এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ-এর এমনি একটি অনবদ্য উপন্যাস শমশীরে বে-নিয়াম যা এখন বাংলায় অনূদিত হয়ে নাঙ্গা তলোয়ার নামে আপনার হাতে।

▶ সবটুকু মেধা, যোগ্যতা, অধ্যাবসায় সেঁচে পাঠকের রুচিসম্মত মুক্তা-মানিক্য উপহার দিতে আমরা একটুও কার্পণ্য করিনি। ভুল-ভ্রান্তি এড়িয়ে যাবার প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছি। পাঠক এ গ্রন্থ হতে জানতে পারবে মর্দে মুজাহিদ সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহুদের ঈমানদীপ্ত চেতনা, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দুঃসাহসিক অভিযান ও বীরত্বগাঁথা। এবং লাভ করবেন মুসলিম মানসের দৃঢ়চেতা মনোবল। পাঠক সামান্যতম উপকৃত হলেও আমাদের শ্রম সার্থক হবে। অনুবাদের মূল উদ্দেশ্য পাবে বাস্তবতা। আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমীন!

নাঙ্গা তলোয়ার – ১ম খণ্ড

৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ, ৮ম হিজরি। আরব মরুর বুক চিরে মুসাফির চলেছেন একাকী। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বিশাল মরু অঞ্চলটি খুবই ভয়ঙ্কর। যে কোন মুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা। একে তো মরুভূমির স্বাভাবিক রুক্ষতা তার উপর আবার লুটেরাদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াবার আশঙ্কা। এ জন্য একাকী সফর করতে কেউ সাহস করত না। লোকেরা দল বেঁধে এ পথে যাতায়াত করত। কিন্তু এ মুসাফির কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি একাকী চলছেন উন্নত জাতের ক্ষিপ্ত গতির অশ্বপৃষ্ঠে। অশ্বের জিনের সাথে তার বর্মটি বাঁধা। কটিদেশে ঝুলানো তরবারি, হাতে বর্শা। প্রাচীনকালে পুরুষেরা দৈহিক দিক দিয়ে উঁচু-লম্বা, প্রশস্ত বুক এবং ভারী শরীর বিশিষ্ট ছিল। এ নিঃসঙ্গ পুরুষ মুসাফিরও তাদের মতই। তবে তাঁর অশ্বপৃষ্ঠে বসার ভঙ্গিই বলছিল, তিনি একজন বীর যোদ্ধা। কোন সাধারণ ব্যক্তি নন। লুটেরারা হামলা করতে পারে এমন কোন আশঙ্কাই তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল না। তাঁর মধ্যে এতটুকু ভীতিও ছিল না যে, তাঁর ঘোড়াটি লুট হয়ে যেতে পারে আর তাঁকে পায়ে হেঁটেই অবশিষ্ট পথ অতিক্রম করতে হবে। তাঁর চেহারাতে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা উঠানামা করছিল। তিনি ছিলেন চিন্তাযুক্ত। মনে হয় অতীতের স্মৃতি আওড়িয়ে ফিরছিলেন অথবা কিছু স্মৃতি ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।

ইতোমধ্যে মুসাফির একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছান। তাঁকে বহনকারী অশ্বটি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। একটু অগ্রসর হয়ে আবার সমতল পথ শুরু হয়। এখানে এসে আরোহী আচমকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন এবং ঘোড়া পশ্চাৎমুখী করেন। অশ্বপৃষ্ঠে বসেই তিনি পেছনে ফিরে তাকান। পেছনে ফেলে আসা মক্কা দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু মক্কা দেখা যায় না। অনেক পূর্বেই দূরের মেঘের আড়ালে সে নিজেকে আড়াল করে ফেলেছিল।

“আবু সুলাইমান। পেছনে ফিরো না। মক্কার কথা একদম ভুলে যাও। তুমিতো একজন বীর যোদ্ধা। নিজেকে দু’ভাগে কেটে ভাগ করে দিও না।

তোমার সিদ্ধান্তের উপর অটল থাক। তোমার অভীষ্ট লক্ষ্য এখন মদীনা।” এ ধরনের আওয়াজ যেন তাঁর কর্ণকুহরে ভেসে আসতে থাকে বারবার।

তিনি মক্কার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন। অশ্বকে মদীনামখী করেন। যথা নিয়মে অশ্বের বাগে হালকা ঝাঁকি দেন। অশ্বটিও ট্রেনিংপ্রাপ্ত। প্রভুর ইশারা পাওয়া মাত্রই সে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতে আরম্ভ করে।

মুসাফিরের বয়স ৪৩। কিন্তু বয়সের তুলনায় তাকে বেশ যুবক দেখাচ্ছিল। তাঁর পুত্রের নাম ‘সুলায়মান’, বাবার নাম ‘ওলীদ’। তবে খালিদ বিন ওলীদের চেয়ে ‘আবু সুলাইমান’ ডাকটা তার নিকট বেশী প্রিয় ছিল। তাঁর জানা ছিল না যে, ইতিহাস তাঁকে ‘খালিদ বিন ওলীদ’ নামে মনে রাখবে এবং এই নামটি ইসলামের গৌরব গাঁথা অনুপ্রেরণার উৎসে রূপান্তরিত হবে।

তখন তিনি মুসলমান হননি। ইতোমধ্যে ছোট-খাটো হামলাসহ উহুদ এবং খন্দকের দু’টি বড় যুদ্ধে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছেন। যুদ্ধ করেছেন বীরবিক্রমে। অপূর্ব রণকৌশলে।

৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। দূরন্ত ডানপিটে এক যুবক। যৌবনের আভা সমগ্র দেহে প্রতিভাত। তখনই তিনি নিজ গোত্র বনু মাখযুমের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। কুরাইশের অন্যান্য সাত গোত্রসমূহের মধ্যে বনু মাখযুম অন্যতম ছিল। কুরাইশদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা এই গোত্রের উপরই ন্যস্ত ছিল। কুরাইশরা হযরত খালিদের পিতা ওলীদের কথা মেনে চলতো। ২৪ বছর বয়সেই খালিদ স্বীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে বাবার মত কুরাইশ জাতির শ্রদ্ধা ও আস্থা হাসিল করেন। কিন্তু এই বিরাট সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বরং তা চিরতরে বিসর্জন দিয়ে খালিদ আজ মদীনার পানে ছুটে চলছেন।

দীর্ঘ পথ অতিক্রম কালে কখনো তাঁর মনে হত, একটি অদৃশ্য শক্তি যেন পশ্চাৎ থেকে তাকে টেনে ধরছে। যখন এই শক্তির উপস্থিতি তাঁর অনুভূত হত তখন তিনি ঘাড় ফিরিয়ে পশ্চাতে তাকাতেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ যেন আরেকটি আওয়াজ তিনি শুনতে পেতেন, “খালিদ! পশ্চাতে নয়, সম্মুখে তাকাও। মনে রেখো, যদিও তুমি ওলীদের পুত্র কিন্তু এখন সে মৃত। এখন তুমি সুলাইমানের পিতা। আর সে বেঁচে আছে।”

তার স্মৃতিতে দু’টি নাম ভেসে উঠে। ১. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; যিনি এক নতুন মতাদর্শের সূচনা করেছেন। ২.ওলীদ; যে একদিকে তাঁর পিতা এবং অপরদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর নব আদর্শের কট্টর দুশমন ছিল। পিতা এই বৈরিতা খালিদের দায়িত্বে অর্পণ করে মারা যায়।

খালিদের ঘোড়াটি দূরে পানির কূপ দেখে সেদিকে যেতে থাকে। তিনি ঘোড়ার গমন পথে দৃষ্টি দিয়ে জায়গাটি পর্যবেক্ষণ করেন। বৃত্তকায় একটি এলাকায় কিছু খেজুর গাছ আর বিক্ষিপ্ত কতক সরু কাণ্ড তাঁর নজরে পড়ে। সব মিলিয়ে এটি একটি ছোট ঝোপ ছিল ঘোড়ার গতি ছিল সেদিকেই।

খর্জুর বাগানে পৌঁছে খালিদ ঘোড়া থেকে নেমে মাথার পাগড়ী খুলে কূপের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন। অঞ্জলি ভরে পানি মাথায় দেন। দু’চার ঝাপটা নাকে-মুখেও দেন। তৃষ্ণার্ত ঘোড়াটিও তৃপ্ত হয়ে পানি পান করে। খালিদ ও ঝর্ণা থেকে পানি পান করেন। তারপর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে গদি নামিয়ে রাখেন। গদির সাথে বাঁধা ক্ষুদ্র কার্পেটটি খুলে একটি বড় বৃক্ষ তলে বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পড়েন।

♣♣♣

তিনি ক্লান্ত শরীরে একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। অতীতের মুহুর্তগুলো একের পর এক তার স্মৃতিতে উপস্থিত হতে থাকে। কেবল চোখই বন্ধ করে রইলেন। ঘুম এলোনা একটুও। সাত বছর পূর্বের একটি ঘটনা তাঁর স্মৃতির পটে ভেসে উঠে। তার গোত্রের লোকেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করার নীলনক্সা এঁকেছিল। এ পরিকল্পনা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা তার পিতার।

৬২২ খ্রিষ্টাব্দ এক গভীর রজনী। কুরাইশরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যার জন্য কিছু লোক নিয়োগ করে। এ সময় তাঁর বয়স ২৭। তিনিও রাসূল হত্যার ষড়যন্ত্রে শরীক ছিলেন বটে কিন্তু হত্যাকারীদের মধ্যে ছিলেন না। সুদীর্ঘ সাত বছর পূর্বের বিগত রজনীটির কথা গতকালের রাতের ন্যায় তার মনে জেগে আছে। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতি এক দিক থেকে স্পষ্ট থাকলেও অপর দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত নাখোশ। সন্তুষ্টির কারণ হচ্ছে তারই গোত্রের এক ব্যক্তি তাদের ধর্মবিশ্বাস, মূর্তিপূজাকে অসার আখ্যা দিয়ে নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবী করে আরব সমাজের দুশমনে পরিণত হয়েছে। এরূপ দুশমনের হত্যায় কে না খুশী হয়? পক্ষান্তরে নাখোশের কারণ হলো, তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে দুশমনকে সামনা-সামনি হত্যায় বিশ্বাসী ছিলেন। এভাবে গুপ্তহত্যা ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিরোধী। তবুও তিনি এর বিরোধিতা করলেন না।

গুপ্ত হত্যাকারীরা যে রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাসভবনে হানা দেয় সে রাতে তিনি সেখানে ছিলেন না। ছিল না ঘরের আসবাবপত্র কিছুই। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ঘাতকদের পাঠিয়ে এ আশায় গভীর ঘুমে হারিয়ে যায় যে, আগামীকাল ভোরের প্রথম শিরোনাম হবে ‘মূর্তিপূজার সমালোচক ও নতুন ধর্মমতের প্রবর্তক নিহত’। কিন্তু পরের ভোর তাদের জন্য কোন সুসংবাদ বয়ে আনল না। তিক্ত হলেও এক মহা দুঃসংবাদ তাদের হজম করতে হলো। হতাশা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র মক্কায়, চরমভাবে ব্যর্থ হয় তাদের ভয়ানক ষড়যন্ত্র। পেছনের মানুষ তাদের ব্যর্থতার সমালোচনা করে এই ভয়-ভীতিতে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। পরস্পর সাক্ষাতে শুধু এতটুকুই কানাকানি করে যে– “মুহাম্মাদ গেল কই? এদিকে হত্যার সুনির্দিষ্ট ক্ষণের অনেক আগেই ওহী মারফৎ ‘হত্যা-ষড়যন্ত্র’ অবগত হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভোর পর্যন্ত অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

সাত বছর পর খালিদ মদীনায় যাচ্ছেন। তাঁর স্মৃতিজুড়ে এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান। অথচ উহুদ যুদ্ধে তিনি হুবল ও উযযা দেবীর প্রধান দুশমন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাগপাশ এড়াতে সক্ষম হন। ফলে তাঁর সকল চেষ্টা অরণ্যে রোদন হয়।

খালিদের স্মৃতির সব ক’টি পর্দা ছিল বিগত ঘটনায় ভরপুর। স্মৃতির কুঠোরে সবই ছিল সংরক্ষিত। একটু অবসর পেয়ে এসব অতীত স্মৃতি এক এক করে তার সম্মুখে বর্তমান হয়ে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে স্মৃতি তাকে নিয়ে দাঁড় করায় ১৬ বছর পূর্বের একটি ঘটনা ও দৃশ্যের মুখোমুখি। তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ে ৬১৩ খিষ্টাব্দের এক দুপুর বেলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে তাঁর বাসভবনে এক ভূড়িভোজের দাওয়াত দেন। আহার পর্ব সমাপ্তির পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগত মেহমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন–

‘বনু আব্দুল মুত্তালিবের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। আমি আপনাদের সম্মুখে ইসলামের দাওয়াত পেশ করে চলেছি, সমগ্র আরবের আর কেউ তা পেশ করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা এর জন্য আমাকে মনোনীত করেছেন। তিনি আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি আপনাদেরকে যেন এমন এক ধর্ম-বিশ্বাসের প্রতি আহবান জানাই, যা আপনাদের ইহকালের সাথে সাথে পরকালের জীবনকেও সুখময় ও সাফল্যমণ্ডিত করবে।”

ওহী নাযিলের ৩ বছর পর এটা ছিল নিকটবর্তী আত্মীয়দের প্রতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বপ্রথম আহ্বান। খালিদ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তার পিতা ছিল আমন্ত্রিত মেহমান। পিতাই তাকে তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিল যে, “আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র মুহাম্মাদ দাবী করছে, সে নাকি আল্লাহর প্রেরিত নবী।”

আমরা স্বীকার করি যে, আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন কুরাইশদের একজন প্রভাবশালী নেতা।” “নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ কুলীন বংশের সন্তান। কিন্তু তাই বলে নবুওয়াতের দাবী এই বংশের লোক করবে কেন? হুবল ও উযার কসম। আমার বংশের মান মর্যাদা কারো থেকে কম নয়। নবুওয়াতের দাবী করে কেউ আমাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে-এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।”

“আপনি তাকে কি বললেন?” খালিদ জিজ্ঞেস করলেন।

“আমরা প্রথমে নীরব থাকলেও পরে সকলেই তার দাবী হেসে উড়িয়ে দিই। মুহাম্মাদের চাচাত ভাই আলী বিন আবু তালেব মুহাম্মাদের নবুওয়াতের স্বীকৃতি দিয়েছে। তাঁর পিতার সে বিদ্রুপাত্মক হাসি খালিদের আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।

৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের অন্য আরেক ঘটনা খালিদের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। সেদিনও তিনি মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী খর্জুর বাগানে শায়িত ছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত ও রিসালাত নেতারা মেনে না নিলেও অন্যান্যরা ঠিকই স্বীকৃতি দিচ্ছিল। এদের অধিকাংশই যুবক শ্রেণীর। অনেক নিঃস্ব-গরীব লোকও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এতে করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শক্তি সাহস বেড়ে গেল।

ইসলামের পূর্বযুগে আরব জাতি এক আল্লাহকে মেনে নিলেও অগণিত মূর্তির পূজাও করত। পুরুষরূপী মূর্তিগুলোকে ‘দেব’ আর নারীরূপী মূর্তিগুলোকে ‘দেবী’ হিসেবে মানা হত এবং তাদেরকে আল্লাহ্‌র পুত্র-কন্যা মনে করা হত।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রচারিত ইসলামের ক্রমোন্নতি দেখে কুরাইশরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। ইসলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের বেঁচে থাকার অধিকার নস্যাৎ করার প্রস্তুতি নেয়। হযরত খালিদের এ কথাও মনে পড়ে যে, তিনি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মক্কার অলি-গলি এবং হাটে-বাজারে মানুষ সমবেত করে ইসলামের দাওয়াত দিতে এবং এ কথা বলতে শুনেছেন যে, প্রতিমা তাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং অপকারও করতে পারে না। ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালা। তিনি এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। কাউকে তিনি তাঁর ইবাদতের মাধ্যমও বানাননি।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল কুরাইশদের চার নেতা।

১) খালিদের পিতা ওলীদ (২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আপন চাচা আবু লাহাব। (৩) আবু সুফিয়ান ও (৪) খালিদের চাচাত ভাই আবুল হাকাম তথা আবু জেহেল। মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার নিপীড়নের কুখ্যাত রেকর্ডটি এই পাপীষ্ঠেরই দখলে ছিল। ইসলাম বিদ্বেষ ও মুসলিম নিধনে তার পাষণ্ডতা সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে মুসলমানরা তার নাম রাখে আবু জেহেল। এ নামটি এত প্রসার লাভ করে যে মানুষের হৃদয় থেকে তার আসল নামটি মুছে যায়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই উঁচু-লম্বা, মোটা-তাজা এবং লৌহমানব লোকটি ইতিহাসে ‘আবু জেহেল’ নামেই কুখ্যাত।

♣♣♣

অতীতের এ স্মৃতিগুলো তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল। হয়তোবা ভিতরে ভিতরে খালিদ অনুশোচনায় দগ্ধও হচ্ছিলেন। কুরাইশরা কয়েকবার রাসূলের গৃহে অপবিত্র মল-মূত্র ছুঁড়ে মারে। যেখানেই কোন মুসলমান দাওয়াতী কাজ করত, সেখানেই কুরাইশরা উপস্থিত হয়ে হৈ-হুল্লুড় শুরু করে দিত। বেয়াদবি ও হট্টগোল করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ও কষ্ট দিত।

খালিদ এ ব্যাপারে পূর্ণ আশাবাদী ছিলেন যে, তার পিতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এ ধরনের কোন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেন নি। সর্বোচ্চ ভূমিকা তার এই ছিল যে, সে দু’বার কুরাইশদের তিন-চার নেতাকে নিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালেবের কাছে গিয়ে তাকে এই মর্মে সাবধান করে যে, তিনি যেন আপন ভাতিজাকে প্রতিমার সমালোচনা এবং ইসলামের দাওয়াত থেকে বারণ করেন। নতুবা সে কারো হাতে মারা যেতে পারে। আবু তালেব দু’বারই তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। তাদের দাবী আমলে নেননি।

খালিদের স্মরণ হয়ে যায় তার পিতার ত্যাগ ও কুরবানীর কথা। আম্মারা নামে তার এক সুদর্শন টগবগে যুবক ভাই ছিল। সে ছিল যেমনি মেধাবী তেমনি সৌখিন। ওলীদ তার এই সোনার ছেলে আম্মারাকে দুই কুরাইশ নেতার হাতে সমর্পণ করে বলল, একে মুহাম্মাদ এর চাচা আবু তালিবের নিকট নিয়ে গিয়ে বল, ওলীদের পুত্রটি দিয়ে গেলাম, তার পরিবর্তে মুহাম্মাদকে আমাদের যিম্মায় ছেড়ে দিন।

সেদিন খালিদ তাঁর পিতার সিদ্ধান্তের কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে যান এবং যখন তাঁর ভাই আম্মারা দুই কুরাইশ নেতার সঙ্গে চলে যায় তখন তিনি নির্জনে গিয়ে খুব ক্রন্দন করেছিলেন।

‘আবু তালেব’ দুই নেতা আম্মারাকে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালিবের সম্মুখে উপস্থিত করে বলে এই যুবককে নিশ্চয় তুমি চেন। এ আম্মারা বিন ওলীদ। তুমি এও জান যে, তোমার নেতৃতাধীন হাশেম বংশে এর ন্যায় জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ছেলে একটিও নেই। একে সাড়া জীবনের জন্য তোমার হাতে তুলে দিতে এসেছি। পুত্র হিসেবে গ্রহণ করলে সে আজীবন তোমার বাধ্য হয়ে থাকবে। আর গোলাম হিসেবে গ্রহণ করলেও সে তোমার জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হবে না।

কিন্তু আগে বল তোমরা তাকে কেন আমার হাতে তুলে দিচ্ছ?” আবু তালেব উৎসুক হয়ে জানতে চান –“মাখযুম গোত্রের মায়েরা কি সন্তান নিলাম দেয়া শুরু করেছে… বলো, এর বদলে কত দাম চাও?”

তার বদলে তোমার ভাতিজাকে দিয়ে দাও” এক নেতা বলে উঠে। “নিঃসন্দেহে তোমার ভাতিজা কলঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তোমার পিতৃপুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে নতুন ধর্মের প্রচার শুরু করেছে। দেখছো না, সে গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে পরস্পরকে দুশমনে পরিণত করেছে?”

“ভাতিজাকে নিয়ে তোমরা কি করবে?” জানতে চাইলেন আবু তালিব।

দ্বিতীয় নেতা জবাব দিল– “আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করব। এটা অবিচার কিংবা কোনরূপ অন্যায় হবে না। কেননা ভাতিজার বদলে আমরা তোমাকে নিজেদের সন্তান দিচ্ছি।”

“এটা খুবই অসঙ্গত প্রস্তাব আবু তালিব বলেন। “তোমরা আমার ভাতিজাকে নিয়ে কতল করবে আর আমি তোমাদের সন্তান লালন-পালন করব, অর্থাৎ তার পিছনে খরচ করব এবং তার সুন্দর জীবন গড়ে দিব। তোমরা আমার কাছে এ কেমন অযৌক্তিক প্রস্তাব নিয়ে এসেছো?… সম্মানের সাথে আমি তোমাদের বিদায় দিচ্ছি।”

খালিদ দুই নেতার সাথে ভাইকে ফিরে আসতে দেখে এবং এ বিনিময় প্রস্তাব গ্রাহ্য না হওয়ায় তিনি সেদিন মনে মনে বড় খুশি হয়েছিলেন।

♣♣♣

“মুহাম্মাদকে তুমি কি মনে করেছ – আবু সুলাইমান।” খালিদের ভিতর থেকে একটি প্রশ্ন উদয় হয়। তিনি চিন্তার রাজ্যে থেকেই মাথা নাড়ান এবং মনে মনে বলেন– কিছু নয়.. এটা ধ্রুব সত্য যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরীরে প্রচুর শক্তি আছে। কিন্তু তাই বলে রুকানা বিন আব্দে ইয়াযিদের ন্যায় বাহাদুরকে উচু করে আছাড় দেয়ার জন্য দৈহিক শক্তিই কখনো যথেষ্ট নয়।

রুকানা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচার নাম। সে তখনো অমুসলিম। বাহাদুর হিসেবে তার খ্যাতি ছিল সমগ্র আরব জুড়ে। বিভিন্ন সময় বহু বীর-বাহাদুর তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কিন্তু কেউ তার সামনে এসে টিকতে পারেনি। প্রত্যেককে দুগ্ধপোষ্য শিশুর ন্যায় পাঁজাকোলা করে এমন আছাড় মারে যে, তারা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। লড়াই-মারামারিই ছিল তার পেশা।

খালিদের পরিষ্কার মনে আছে যে, একদিন মুসলিম বিদ্বেষ ৩/৪ জন লোক রুকানাকে খুব পানাহার করিয়ে বলে যে, তোমার ভাতিজা কারো কথা শোনে না। কাউকে মানে না। সে কাউকে ভয়ও করে না। ইসলামের প্রচার-প্রসার থেকে নিবৃতও হয় না। মানুষ তার কথার যাদুতে ফেঁসে যাচ্ছে। তাকে একটু শায়েস্তা করতে পারবে?

“তোমরা আমার হাতে তার হাড় গোড় চুর্ণ-বিচুর্ণ করাতে চাও?”

রুকানা চেহারা কিছুটা বিকৃত করে অহমিকার স্বরে লোকদেরকে বল– “তাকে আমার মোকাবিলায় এনে দাও তো..। সে আমার নাম শুনামাত্রই মক্কা থেকে পালিয়ে যাবে। না, না; তার সাথে লড়াই করা আমি নিজের জন্য দুর্ণামের কারণ মনে করি।”

রুকানা প্ররোচকদের কথায় সাড়া দেয় না। মূলত সে কাউকেও নিজের তুল্য বলে স্বীকার করত না। রুকানাকে রাজি করাতে না পেরে মুসলিম বিদ্বেষীরা থ হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে আশা ত্যাগ করে না। যে কোন উপায়েই হোক রুকানার হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পরাজিত করে তাঁকে শায়েস্তা করতে বদ্ধপরিকর। মক্কার ইহুদীরা ছিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভয়ানক দুশমন। কিন্তু তারা কখনো প্রকাশ্যে দুশমনি করত না। ভিতরে ভিতরে কুরাইশদের বিভক্তি ও তাদের মধ্যে বৈরীতা সৃষ্টি করতে চাইত। তাদের কানে এ খবর পৌঁছে যায় যে, কুরাইশদের কিছু লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কুস্তি লড়তে রুকানাকে প্ররোচিত করছে, কিন্তু সে সম্মত হচ্ছে না।

কিছু দিন পর এক রাতে মক্কার এক গলি দিয়ে রুকানা যাচ্ছিল। তার পাশ দিয়ে অপূর্ব সুন্দরী এক ষোড়শী কন্যা অতিক্রম করে। জ্যোৎস্না রাতে মেয়েটি রুকানাকে চেনে এবং মুচকি হাসি দেয়। রুকানা ছিল বর্বর। সে নিজেও থেমে যায় এবং মেয়েটিও পথ আগলে দাঁড়ায়।

“তোমার জানা নেই, কোন নারী পুরুষের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলে তার অর্থ কি দাঁড়ায়?” রুকানা বাহাদুর তাকে প্রশ্ন করে বলে “কে তুমি সুন্দরী? তোমার পরিচয় কি?”

যুবতী জবাব দেয় “আমি আরমানের কন্যা সাবত।”

“ওহ্… আরমান ইহুদীর কন্যা?” রুকানা একথা বলতে বলতে যুবতীর স্কন্ধে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে বলে– “আমার শরীর কি তোমার এতই প্রিয়? আমার শক্তি কি…।”

“তোমার শক্তি আমাকে হতাশ করেছে।” রুকানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তার নিকট থেকে সরে যেতে যেতে সাবত বলে– “তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদকে তুমি ভয় কর তা আমি জানি।”

কে বলে এমন কথা?” রুকানা গর্জে উঠে জিজ্ঞাসা করে।

“সবাই বলে।” সাবত উত্তর দেয়–“আগে মুহাম্মাদকে পরাজিত করে দেখাও। আমার শরীরটা তোমাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেব।”

“খোদার ছেলে-মেয়েদের শপথ! তোমার দাবি বাস্তবায়ন করেই তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো।” রুকানা বলে– “তবে এটা বাস্তব যে, আমি মুহাম্মদকে ভয় করি বলে যে কথা তুমি শুনেছ তা একদম ভুল। আসল কথা হলো, আমার চেয়ে দুর্বলের সাথে লড়াকে আমি নিজের জন্য লজ্জাকর মনে করি। তবে এখন আমার আর কোন পরোয়া নেই। তোমার দাবি পূরণ করবই।”

♣♣♣

প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং রুকানাকে কুস্তি লড়তে আহ্বান করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ইবনুল আছীর নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রুকানাই সর্বপ্রথম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুস্তি লড়তে আহ্বান করে এবং তাঁকে এ কথাও বলে যে – “ভাতিজা! তুমি বড় হৃদয়বান এবং সাহসী। আমি জানি তুমি মিথ্যা বলা ঘৃণা কর। কিন্তু মানুষের বাহাদুরী আর সততার বাস্তব প্রমাণ হল লড়াইয়ের ময়দান। কুস্তির মঞ্চে আস। আমাকে পরাজিত করতে পারলে তোমাকে আল্লাহর প্রেরিত নবী বলে স্বীকৃতি দেব। আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমার ধর্ম কবুল করব।”

“এটা চাচা-ভাতিজার লড়াই হবে না।” নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকানার আহ্বানের জবাবে বলেন–“এক প্রতিমা পূজারী বনাম এক সত্য নবীর লড়াই হবে। দেখ, পরাজিত হয়ে যেন আবার ওয়াদার কথা ভুলে না যাও।”

মরুভূমির আঁধারের ন্যায় মক্কার ঘরে ঘরে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, মহা কুস্তিগীর রুকানা বনাম মুহাম্মাদের মধ্যে কুস্তি হবে। এতে পরাজিত ব্যক্তি বিজয়ীর ধর্ম গ্রহণ করবে। নির্দিষ্ট সময়ে মক্কার ছোট-বড়, নারী-পুরুষ এবং ইহুদীরা কুস্তিমঞ্চের নিকট এসে প্রচণ্ড ভীড় করতে থাকে। সবাই অপেক্ষমাণ। সকলের দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। কখন কুস্তি শুরু হবে। মন ভরে উপভোগ করবে দুই অসম লড়াকুর কুস্তিলড়াই। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। তারা তরবারি এবং বল্লমে সশস্ত্র হয়ে কুস্তিমঞ্চের আশেপাশে সতর্ক অবস্থান নেয়। কেননা, তারা আশংকা করে যে, কুরাইশরা কুস্তি লড়ার বাহানা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হয়ত হত্যা করে ফেলতে পারে।

আরবের সবচেয়ে বীর্যবান এবং বিশাল বপুধারী কুস্তিগীর রুকানা ইবনে আব্দে ইয়াযিদ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কুস্তি লড়তে মঞ্চে আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যথাসময়ে হাজির হন। রুকানা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টি হানে এবং উপহাস করতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। তিনি পূর্ণ স্থিরচিত্তে রুকানার চোখে চোখ রাখেন, যেন সে তাঁর অগোচরে আক্রমণ কিংবা আঘাত হানতে না পারে। রুকানা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চার পাশে এভাবে ঘুরতে থাকে যেভাবে বাঘ শিকারীর চারপাশে তাকে কাবু করার জন্য ঘুরে।

কৌতূহলী দর্শকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঠাট্টা করলেও মুসলমানরা ছিল চুপচাপ। তারা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছিল। সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে তাদের সবার হাত ছিল তরবারির বাটের উপর।

আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন এরপর হঠাৎ কি হল! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন পাল্টা আক্রমণ করলেন যে, মুহুর্তেই লড়াইয়ের মোড় ঘুরে গেল। জনতার উচ্চকিত আওয়াজ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। অবাক বিস্ময়ে জনগণ দেখল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অপূর্ব রণকৌশল আর শক্তির বিশালতা। ইবনুল আছীর লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকানাকে দু’হাতে উঁচু করে ধরে জোড়ে আছার মারেন। এতে রুকানা আহত ব্যাঘ্রের ন্যায় গর্জে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আক্রমণে তেড়ে আসে। তিনি এবারও অপূর্ব কৌশলে হামলা করেন এবং তাকে ধরে আবার মাটিতে ছুড়ে মারেন। সে পুনরায় আক্রমণ করতে উঠে দাঁড়ালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় বারের মত আবার তাকে উপরে তুলে আছাড় মারেন। বিশাল শরীরে পরপর তিনবার প্রচণ্ড আঘাত খাওয়ায় রুকানা কুস্তি লড়তে অযোগ্য হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে কুস্তি মঞ্চ থেকে নেমে আসে।

উপস্থিত জনতার উপর পিন-পতন নীরবতা নেমে আসে। সব মুখগুলো হঠাৎই নিরব হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতা এবং ফলাফল বিপর্যয়ে কুরাইশদের মাথা নীচু হয়ে চুপসে যায়। অপরদিকে হাতে গোনা মুসলমানরা আনন্দে নাঙ্গা তলোয়ার এবং বর্শা উর্ধ্বদিকে উঁচিয়ে মুহুর্মূহু গগনবিদারী আওয়াজ দিতে থাকে।

“চাচা রুকানা!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চঃস্বরে ডেকে বলেন “আপনার অঙ্গীকার পূরণ করুন এবং এখনই ঘোষণা করুন যে, আজ থেকে আপনি মুসলমান।”

কিন্তু রুকানা ইসলাম গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।

♣♣♣

“এটা কেবল দৈহিক শক্তি বলে সম্ভব হয়নি।” খালিদ খেজুর বাগানে শুয়ে শুয়ে মনে মনে বলছিলেন – “রুকানাকে এভাবে তিন তিনবার আছাড় মারা তো দূরের কথা, তাকে কেউ আজোবধি চিৎ করতে পারেনি।”

এ মুহূর্তে খালিদের চোখের সম্মুখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা মোবারক কমনীয় হয়ে ভেসে ওঠে। শৈশবকাল থেকেই তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভাল ভাবেই চিনতেন-জানতেন। কিন্তু কালক্রমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের মোড় অন্যদিকে ফিরে যায়। নবুওয়াত লাভের পর তাঁর জীবন যেরূপে আলোকিত হতে থাকে খালিদ সে রূপের সাথে মোটেই পরিচিত ছিলেন না। মক্কায় তিনি নবুওয়াতের দাবি করার পর খালিদ তাঁর সাথে কথা বলাই ছেড়ে দেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উত্তম শিক্ষা দিতে চান, কিন্তু রুকানার মত কুস্তিগীর নন তিনি হচ্ছেন রণাঙ্গনের লড়াকু বীর যোদ্ধা। এবং যুদ্ধ পরিচালনা করায় তখনকার সময় তাঁর জুড়ি ছিল না। কিন্তু তখন মুসলমানদের লড়াই করার পরিস্থিতি ছিল না।

মুসলমানরা যখন রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হওয়ার উপযোগী হলো তখন কুরাইশদের সাথে তাদের প্রথম ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন খালিদ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যে, ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হল না। এ জন্য তার দুঃখ ছিল সীমাহীন। এ যুদ্ধে ৩১৩ জন মুসলিম বীর মুজাহিদ ১০০০ কুরাইশকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। সেদিন খালিদ এ বেদনাদায়ক সংবাদ দাঁত কামড়ে সহ্য করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি এক খর্জুর বাগানে শায়িত। তার এখনো ভাবতে অবাক লাগে যে, নিরস্ত্রপ্রায় হাতে গোনা কয়েকজন লোক কিভাবে সশস্ত্র এক দুর্ধর্ষ বিশাল বাহিনীকে এভাবে পরাভূত করে? তাইতো সেদিন তিনি পরাজিত কুরাইশ যোদ্ধাদের নিকট জানতে চান যে, তাদের মধ্যে এমন কোন বিশেষত্ব রয়েছে, যার ফলে তারা এমন অসম যুদ্ধেও বিজয়ের তাজ কেড়ে নিতে সক্ষম হল?

খালিদ এ সমস্ত কথা আওড়াতে আওড়াতে হঠাৎ উঠে বসেন এবং আঙ্গুলের সাহায্যে বালুকাময় ভূমিতে বদর রণাঙ্গনের ছক এঁকে কুরাইশ ও মুসলমানদের অবস্থান এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময় গৃহীত বিভিন্ন কৌশল পরীক্ষা করেন। তার বাবাই তাকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করেছিল। বেয়াড়া এবং দুষ্ট ঘোড়া বাগে আনার প্রশিক্ষণও তাকে দিয়েছিল। ফলে যৌবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন বিখ্যাত অশ্বারোহী হয়ে উঠেন। উষ্ট্রারোহী হিসেবেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। সে খালিদ কে কেবল সৈনিকই নয়, যোগ্য সিপাহসালার হিসেবে গড়ে তুলেছিল। ফলে হযরত খালিদ এমন যুদ্ধপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, সমর বিষয়ক বিভিন্ন কলা-কৌশল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। যুদ্ধবিদ্যায় আশাতীত সাফল্য হেতু যুবক বয়সেই তিনি সৈন্য পরিচালনায় সর্বোচ্চ যোগ্যতা হাসিল করতে সক্ষম হন।

বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার দুঃখ ছিল খালিদের। এ যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয় তাকে এমন বেদনাহত করে যে, তিনি এর চরম প্রতিশোধ গ্রহণের দৃঢ় শপথ করেন। কিন্তু তার বর্তমান চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন ধারায় পরিচালিত। মক্কা হতে যাত্রার ক’দিন আগে তিনি দু’টি বিষয়ে গভীর চিন্তা করেন। এক. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিখ্যাত কুস্তিগীর রুকানাকে উপর্যুপরি তিনবার কপোকাত করা। দুই. বদর যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন দ্বারা হাজার সৈন্যের সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যদুস্ত করা। তিনি কিছুতেই একে দৈহিক শক্তির ফল বলে মানতে পারছিলেন না। তার সব সময় মনে হয়েছে, এটা অদৃশ্য শক্তিরই ফল। যার কাছে তারা বারবার পরাজিত হচ্ছে। অকেজো হয়ে যাচ্ছে তাদের হাতিয়ারগুলো। অসহায় হয়ে পড়ছে আরবের বিখ্যাত বীর-যোদ্ধারা, তারপরও বদর যুদ্ধের প্রতিশোধের আগুন তার মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলছিল।

বদরের রণাঙ্গন হতে বহু সংখ্যক কুরাইশের বন্দির ব্যাপারটি কুরাইশ নেতৃবৃন্দের জন্য একটি মারাত্মক চপেটাঘাত ছিল। খালিদের মধ্যেও এর বিরাট প্রভাব পড়েছিল। তাঁর সুস্পষ্ট মনে আছে, বদর যুদ্ধ চলাকালে মক্কার সাথে কুরাইশ বাহিনীর যোগাযোগ ছিল সম্পূর্ণ বিছিন্ন। রণাঙ্গনের সংবাদ মক্কাবাসীরা কিছুই জানত না। এদিকে মক্কাবাসী অত্যন্ত উদ্ধেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছিল। তারা প্রতিদিন এ আশায় বদর পানে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে যে, ওদিক থেকে কোন অশ্বারোহীর আগমন ঘটবে। আর সে বিজয়ের সুসংবাদ শুনিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করবে।

শেষ কালে কোন অশ্বারোহী নয়; বরং এক উষ্ট্রারোহী তারা দেখতে পায়। অপেক্ষমাণ উষ্ঠিত জনতা তার দিকে ছুটে যায়। কিন্তু এ আগন্তুক তাদের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনেনি। সমবেত জনতার আবেগ-উচ্ছাস স্তব্ধ হয়ে যায়, যখন তারা দেখে যে, সংবাদ বাহকের গায়ের জামা ছিড়া এবং সে ক্রন্দনরত।

এতে সবাই বুঝতে পারে, আগন্তুক সুসংবাদ বয়ে আনেননি। কারণ তৎকালীন আরবের নিয়ম ছিল, কেউ কোন দুঃসংবাদ নিয়ে এলে সে গায়ের বস্ত্র ছিড়ে ফেলত এবং কেঁদে কেঁদে আগমন করত। এটাই ছিল তখনকার বিপদ সংকেত। আগন্তুক জনতার মাঝে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই মর্মে সংবাদ প্রদান করে যে, কুরাইশ বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছে। যাদের আত্মীয়-স্বজনরা যুদ্ধে গিয়েছিল তারা একে অপরকে ডিঙ্গিয়ে আগন্তুকের কাছে এসে নাম ধরে ধরে তাদের জীবিত মৃত কিংবা আহত হওয়া সম্পর্কে আশ্বস্ত হতে চায়। রণাঙ্গন থেকে পলায়নপর কুরাইশরাও এর কিছুক্ষণ পর ম্লান মুখে এক এক করে মক্কায় চলে আসে।

রণাঙ্গনে নিহত ১৭ ব্যক্তি ছিল বনু মাখযুম গোত্রের। তাদের সকলের সাথে খালিদের রক্তের সম্পর্ক ছিল। আবু জেহেল ছিল খালিদের চাচাত ভাই এবং কুরাইশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। সেও নিহত হয়। ওলীদ নামে খালিদের আরেক ভাই হয় যুদ্ধবন্দি।

জনতার উপচে পড়া ভীড়ের মধ্যে অন্যতম কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দাও হাজির ছিল।

“এই দূত আমার পিতা ও চাচা সম্পর্কে কিছু বলতে পারো?” জিজ্ঞেস করে হিন্দা।

“আলী এবং হামযার হাতে আপনার পিতা নিহত হয়েছেন।” জবাবে দূত বলে। “আর আপনার চাচা শায়বাকে হামযা হত্যা করেছে। আপনার পুত্র হানজালা নিহত হয়েছে আলীর হাতে।”

হিন্দা প্রথমে হযরত আলী ও হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অশ্রাব্য ভাষায় গাল-মন্দ করে। অতঃপর শপথ করে বলে– “আল্লাহর শপথ। পিতা, চাচা এবং পুত্র হত্যার প্রতিশোধ আমি নেবই।”

আবু সুফিয়ান ছিল একদম নীরব। চুপ করে শোনা ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিল না।

এদিকে দূত কথা যতই বলছিল খালিদের রক্ত ততই টগবগ করছিল। পরাজয়ের খবরে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মর্মাহত।

বদরের রণাঙ্গনে কুরাইশদের বড় বড় নেতাসহ ৭০ জন মারা যায়। বন্দিও হয় সমসংখ্যক।

♣♣♣

খালিদ গাত্রোত্থান করেন। শয্যার কার্পেটটি মুড়িয়ে ঘোড়ার জিনের সাথে বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে মদীনাপানে যাত্রা করেন। তিনি স্মৃতির মণিকোঠা থেকে সব স্মৃতি বের করে দিতে চান। কিন্তু মন তার উড়ে উড়ে মদীনায় পৌঁছে যেতে থাকে যা বর্তমানে মুসলমানদের প্রধান কার্যালয় এবং যেথায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবস্থান করছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা স্মরণ হতেই স্মৃতি আবার তাঁকে পিছনে নিয়ে যায়। স্মৃতিতে ভেসে ওঠে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচালিত বদর রণাঙ্গনের ছবি। তাঁর আরো মনে পড়ে হিন্দার বলিষ্ঠ ঘোষণার কথা, যা সে স্বামী আবু সুফিয়ানকে শুনিয়ে বলছিল।

পিতা-চাচাকে ভুলতে পারি কিন্তু তাই বলে কি কলিজার টুকরা পুত্রকে ভুলে যাব? এ কথা মা কিভাবে ভুলতে পারে? আল্লাহর কসম! পুত্রের খুনের প্রতিশোধ নিতে আমি মুহাম্মাদকে কিছুতেই মাফ করব না। এ যুদ্ধ সেই করিয়েছে। হামযা এবং আলীকেও মাফ করব না। তারাই আমার পিতা, চাচা এবং পুত্রের হত্যাকারী।

“পুত্র হত্যার অসহ্য যন্ত্রনা আমার রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।” আবু সুফিয়ান বলছিল– “পুত্র হত্যার বদলা নেয়া আমার উপর ফরজ হয়ে গেছে। আমার এখন প্রধান কাজ হল, মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী গড়ে তোলা এবং তাকে এমন শিক্ষা দেয়া, যাতে সে আর কোন দিন অস্ত্র ধরার সাহস না করে।”

বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার ওকিনী লিখেন, আবু সুফিয়ান পরের দিনই সকল সর্দারকে ডেকে পাঠান। তাদের অধিকাংশই ছিল এমন, যারা বিশেষ কারণে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু প্রত্যেকেরই কোন না কোন নিকট আত্মীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিহত হয়েছে। প্রতিশোধ স্পৃহায় সকলের একসুর।

“আমার কিছু কথা বলার দরকার আছে?” আবু সুফিয়ান উপস্থিত নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে– “আমার ছেলে নিহত। তার হত্যার প্রতিশোধ না নিলে তাকে জন্ম দেয়ার অধিকার আমার থাকে না।”

একযোগে সকলেই তার কথায় সায় দেয়। এ বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ হয় যে, মুসলমানদের কাছ থেকে বদরের প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে।

“কি আপনাদের কেউ ঘরে বসে থাকতে পারবেন না। সবাইকে যুদ্ধে যেতে হবে।” খালিদ উপস্থিত কুরাইশ সর্দারদের লক্ষ্য করে বলেন– “বদরে আমরা শুধু এ কারণেই লাঞ্চনার সম্মুখীন হয়েছি যে, নেতৃবৃন্দের অনেকেই যুদ্ধে না গিয়ে ঘরে বসে থাকেন। আর যুদ্ধের ময়দানে প্রেরণ করা হয় তাদেরকে, যাদের মধ্যে কুরাইশী মর্যাদাবোধ ছিল না।”

“তবে কি আমার পিতার মধ্যেও কুরাইশী মর্যাদাবোধ ছিল না?” আবু জেহেলের পুত্র এবং খালিদের চাচাত ভাই ইকরামা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে– “সফওয়ান বিন উমাইয়ার পিতারও কি বংশ মর্যাদাবোধ ছিল না?… এত মর্যাদাবোধের অধিকারী হয়ে তুমি কোথায় ছিলে ওলীদের পুত্র?”

“পরস্পর যুদ্ধ করতে আমরা এখানে হাজির হইনি।” আবু সুফিয়ান বলে– “খালিদ কারো আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত করে এমন কথা বলা তোমার সঠিক হয়নি।”

“আমাদের কারো আত্মমর্যাদাবোধ আর বাকী নেই।” খালিদ বলেন– ‘মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের যতদিন শেষ করতে না পারব ততদিন আমরা আত্মমর্যাদাশালী জাতি হিসেবে গণ্য হব না। ঘোড়ার বাগের শপথ করে বলছি, রক্তের উত্তাপ আমার চক্ষুকে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ বানিয়ে ছেড়েছে মুসলমানদের তাজা রক্তই শুধু এ স্ফুলিঙ্গ নিভাতে পারে।… আমি আবারও বলছি যে, এবার আমাদের নেতাদের প্রথম কাতারে থাকতে হবে। আর আমার জানা আছে যে, রণাঙ্গনে আমি কোথায় থাকব। তবে অবশ্যই নেতার অনুগত থাকব। কিন্তু নেতা যদি আমাদের জন্য ক্ষতিকর কোন আদেশ চাপিয়ে দেন তবে সে নির্দেশ আমি মানব না।”

অবশেষে আবু সুফিয়ানকে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বাধিনায়ক ঘোষণা দিয়ে বৈঠক সেদিনের মত মুলতবি করা হয়।

খালিদের মনে পড়ে বদর যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা। মক্কাবাসীদের একটি কাফেলা ফিলিস্তিন থেকে মক্কা আসছিল। এটা ছিল একটি বাণিজ্যিক কাফেলা। মক্কাবাসী বিশেষত কুরাইশদের প্রত্যেকেই এই বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে। কম-বেশি সকলের মূলধন এতে ছিল। কাফেলাটির উটের সংখ্যা প্রায় এক হাজার এবং বাণিজ্যিক মালামাল ছিল প্রায় ৫০ হাজার দীনার সমমূল্যের। এ বাণিজ্য কাফেলার নেতা ছিল আবু সুফিয়ান। ৫০ হাজার দীনারে ৫০ হাজার দীনার মুনাফা করে বাণিজ্যিক সফলতার পূর্ণ স্বাক্ষর রাখে আবু সুফিয়ান।

কাফেলার প্রত্যাবর্তন রাস্তাটি মদীনার নিকটবর্তী রাস্তার সাথে সংযুক্ত ছিল। মুসলমানরা তাদের প্রত্যাবর্তনের কথা জেনে যায়। পুরো কাফেলাটি গ্রেফতার করতে তাদেরকে এক জায়গায় ঘিরে ফেলা হয়। কিন্তু স্থানটি অসমতল থাকায় আবু সুফিয়ান অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে একটি-দুটি করে সবগুলো উট তাদের ঘেরাও থেকে নিরাপদে বের করে দিতে পেরেছিল।

♣♣♣

খালিদের অশ্বটি ধীর গতিতে মদীনাপানে চললেও তার স্মৃতির ফিতা পেছন দিকে ঘুরছিল দ্রুতবেগে। কুরাইশরা একত্রিত হয়ে প্রতিশোধের ছক তৈরির সময় যে সমস্ত শব্দ উচ্চারণ করেছিল প্রতিটি শব্দ তার কানে এখন গুঞ্জরিত হতে থাকে।

“আমাকে নেতা হিসেবে মেনে থাকলে আমার প্রতিটি সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া তোমাদের জন্য অপরিহার্য।” আবু সুফিয়ান বলল– “আমার প্রথম সিদ্ধান্ত হল, বাণিজ্যিক মুনাফা হিসেবে লব্ধ ৫০ হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) এখনও আমি মালিকদের মাঝে বন্টন করিনি। আমি এ অর্থ বণ্টন করব না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ে এ সমুদয় অর্থ খরচ করা হবে।”

“ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং আমার গোত্রের সকলেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।” সকলের আগে খালিদ বলেন।

তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে চতুর্দিক থেকে আওয়াজ ওঠে “মেনে নিলাম” “মেনে নিলাম”।

“আমার দ্বিতীয় নির্দেশ হল।” আবু সুফিয়ান দ্বিতীয়বার গভীর কণ্ঠে বলে– “বদর যুদ্ধে যারা মারা গেছে তাদের আত্মীয়-স্বজন শোকাহত। আমি শোকাহত পুরুষদেরকে কপাল চাপড়াতে লক্ষ্য করেছি এবং মহিলাদেরকে বিলাপ করতে শুনেছি। মনে রেখ, নয়ন জলের শীতলতায় প্রতিশোধের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতাপ শীতল হয়ে যায়। বদরে নিহতদের স্মরণে আর ক্রন্দন করা চলবে না।… আমার তৃতীয় নির্দেশ, মুসলমানদের হাতে যারা যুদ্ধবন্দি, তাদের মুক্তির কোন উদ্যোগ নেয়া হবে না। আপনারা অবগত আছেন যে, মুসলমানরা বন্দিদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেছে এবং এই শ্রেণী অনুপাতে তাদের মুক্তিপণ এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে। আমরা মুসলমানদেরকে একটি কানাকড়িও দেব না। এ অর্থ আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যয় হবে।

মদীনায় যাওয়ার পথে অশ্বপৃষ্ঠে বসে যখন খালিদের এই মুহূর্তটির কথা স্মরণ হয় তখন স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তার পাঞ্জা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। ক্রোধের শিহরণ ওঠে তার সারা শরীরে। ঘটনাটি অনেক পূর্বের ছিল, তথাপি এ মুহূর্তেও তিনি রাগে জ্বলে ওঠেন। তাঁর ক্রোধের কারণ এই ছিল যে, কোন বন্দিকে মুক্ত করার জন্য কেউ মদীনায় যাবে না’-এই মর্মে সাধারণ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলেও জনৈক ব্যক্তি সংগোপনে মদীনায় গিয়ে মুক্তিপণ দিয়ে তার পিতাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। এরপর থেকে গোপনে মদীনায় গিয়ে নিকটতম আত্মীয়কে মুক্ত করে আনার প্রচলন অবাধে শুরু হয়ে যায়। যার ফলে বাধ্য হয়েই আবু সুফিয়ানকে তার আদেশ প্রত্যাহার করে নিতে হয়।

ওলীদ নামে খালিদের এক ভাই মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। কুরাইশরা যদি এভাবে যুদ্ধবন্দিকে মুক্ত করে না আনত, তাহলে খালিদ কখনো তাঁর ভাইকে ছাড়িয়ে আনতে যেতেন না। তার অন্যান্য ভাইয়েরাই তাঁকে এ ব্যাপারে বাধ্য করে। খালিদের মনে পড়ে তিনি নিজের মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে কখনো রাজী ছিলেন না। কিন্তু একটি চিন্তায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তিনি ভাবলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁরই বংশের একজন। তাঁর অনুসারী মুসলমানরাও কুরাইশ এবং মক্কারই লোকজন। আসমান থেকে নেমে আসা কোন ফেরেশতা বা অন্য কোন জাতি তারা নয়। এমন বাহাদুর তো তারা ছিলো না যে, মাত্র ৩১৩ জন এক হাজার সশস্ত্র সৈন্যকে পরাজিত করতে পারে তাদের মধ্যে এহেন শৌর্য-বীর্য এল কোত্থেকে যে, তারা আমাদের বিরুদ্ধে আমাদেরই লোকদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করছে?

“তাদের এক নজর দেখব।” খালিদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন– “মুহাম্মাদকে আরো গভীরভাবে নিরীক্ষণ করব।”।

এরপর তিনি তার ভাই হিশামকে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় যাত্রা করেন। চার হাজার দেরহামও সাথে নিলেন। কারণ, তিনি জানতেন, মাখযুম গোত্রপতি ওলীদের পুত্রের মুক্তিপণ চার হাজার দেরহামের কম হবে না।

বাস্তবেও তাই হয়। তিনি মুসলমানদের নিকট গিয়ে ভাইয়ের নাম বললে মুক্তিপণ আদায় ও যুদ্ধবন্দির মুক্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবী চার হাজার দিরহাম দিতে বলেন। মুক্তিপণের পরিমাণ একটু কম নিন” খালিদের ভাই হিশাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবীকে অনুরোধ করে বলে– “আপনারা তো পর নন; আমাদেরই লোক। পূর্ব সম্পর্কের কথা ভেবে একটু বিবেচনা করুন।”

“এখন তোমাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।” সাহাবী জবাবে বলেন– “আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হুকুম তামিল করছি মাত্র।”

“আমরা আপনাদের রাসূলের সাথে একটু কথা বলতে পারি কি? হিশাম জানতে চাইল।

“হিশাম!” খালিদ গর্জে উঠে বলেন– “নিজের মর্যাদার কথা বিবেচনা করে ভাইয়ের আশা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ছাড়লে না, তাকে মুক্ত করতে আমাকে সাথে নিয়ে এলে। সে যত মুক্তিপণ চায় দিয়ে দাও। মুহাম্মাদের সামনে গিয়ে তার কাছে কমপক্ষে আমি দয়া ভিক্ষা চাইতে পারব না।”

এরপর তিনি দিরহামপূর্ণ থলেটি সাহাবীর সম্মুখে ছুড়ে মেরে বলেন, গুণে নিয়ে ভাইকে আমাদের হাতে তুলে দাও।

মুদ্রা বুঝে পেয়ে ওলীদকে খালিদ ও হিশামের হাতে তুলে দেয়া হল। তারা তখনই মক্কার দিকে রওনা হল। পথিমধ্যে দু’ভাই ওলীদকে তাদের পরাজয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করে। তাদের আশা ছিল যে, ওলীদ যেহেতু বাহাদুর গোত্রের যুবক তাই সে সমর-বিচক্ষণতার আলোকে মুসলিম বাহিনীর রণ-কৌশল ও নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিবে। কিন্তু ওলীদের ভাবখানা এমন এবং ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা এমন ছিল যেন কেউ তাকে যাদু করেছে। কার প্রভাবে সে যেন প্রভাবিত।

“ওলীদ কিছু বলো।” খালিদ তাকে বলেন– “পরাজয়ের বদলা নিতে আমরা বদ্ধপরিকর। কুরাইশের সকল নেতা আসন্ন যুদ্ধে স্ব-শরীরে অংশ নেবেন।

আশেপাশের সমস্ত গোত্রকেও আমরা সাথে নিচ্ছি। মক্কায় সমবেত হওয়া ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে।”

“সমগ্র আরব একত্রিত করলেও তোমরা মুসলমানদের পরাজিত করতে পারবে না।” ওলীদ বলে– “বলতে পারি না যে, মুহাম্মাদের হাতে কোন জাদু আছে কি-না বা তার ধর্মবিশ্বাসই সত্য কি-না যে, তাদের হাতে বন্দি হয়েও তাদেরকে আমার খারাপ মনে হয়নি।”

“তাহলে তো তুমি জাতির গাদ্দার।” হিশাম বলে ওঠে–“হয় তুমি গাদ্দার নতুবা জাদুগ্রস্ত। ঐ ইহুদী সরদারতো ঠিকই বলেছে যে, মুহাম্মাদের নিকট মূলত কোন নতুন আকীদা-ধর্ম নেই। সে এক অদ্ভুত জাদুর শক্তি প্রাপ্ত হয়েছে মাত্র।”

“জাদুই হবে, অন্যথায় কুরাইশ বাহিনী বদরে পরাজিত হবার নয়” খালিদ বলেন।

ওলীদ তাদের কথা যেন শুনছিলই না। তার ঠোঁটে ছিল মুচকি হাসির রেখা। সে বার বার ঘাড় ফিরিয়ে মদীনার পানে তাকাচ্ছিল। মদীনার অদূরে জুলহুলায়ফা নামক স্থানে তিন ভাই যখন পৌঁছে তখন রাত হয়ে যায়। গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যায় জগৎ। রাত যাপনের উদ্দেশে তারা সেখানেই যাত্রা বিরতি করে।

ভোরে দেখা যায় ওলীদ লাপাত্তা। তার ঘোড়াটিও নেই। খালিদ ও হিশাম কিছুক্ষণ চিন্তার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, ওলীদ মদীনায় ফিরে গেছে। তারা তার উপর এক ধরনের প্রভাব অনুভব করছিল। আর তা ছিল মুসলমানদেরই প্রভাব। শেষে দুভাই মক্কায় ফিরে আসে। কিছুদিন পর মদীনা হতে ওলীদের মৌখিক বার্তা পায় যে, সে মুহাম্মাদকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যক্তিত্ব ও কথায় এতই প্রভাবিত হয় যে, অবশেষে ইসলামই গ্রহণ করে ফেলে।

ঐতিহাসিকগণ লিখেন, ওলীদ ইবনে ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ দৃষ্টি লাভ করে ধন্য হন এবং দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাসসহ কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন।

দুই কারণে সেদিন খালিদ ক্রোধান্বিত হয়। প্রথমত তার ভাই চলে গেছে। দ্বিতীয়ত অনর্থক চার হাজার দিরহাম গেল। মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে ভয়ানক শত্রুতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে মুসলমানরা এ অর্থ ফেরৎ দেয় না। অর্থ ফেরৎ না দেয়ার অন্য কারণ হলো, ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানিয়ে দেন যে, কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এ উদ্দেশে বেশুমার অর্থকড়ি জোগাড় করেছে।

খালিদ মদীনা পানে চলছেন সম্মুখের দিক থেকে উটের কুচের ন্যায় বিশাল কি যেন জমিন ফুঁড়ে উপরে উঠতে থাকে। খালিদ জানতেন এটা মদীনার ৪ মাইল উত্তরে উহুদ পাহাড়। ইতোমধ্যে খালিদ অপেক্ষাকৃত উঁচু টিলায় উঠতে শুরু করে।

“উহুদ… উহুদ।” খালিদের মুখ থেকে এক অস্ফুট আওয়াজ বের হয় এবং তাকে তাঁর উচু আওয়াজ শুনাতে থাকে–“আমি আবু সুলাইমান… আমি সুলাইমানের বাবা।” এর সাথেই একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ভয়ঙ্কর ধ্বনি এবং হাজার হাজার অশ্বের হ্রেষাধ্বনি ও তরবারির ঝনঝন আওয়াজও তার কানে বাজতে থাকে। তিনি এ যুদ্ধের জন্য বড় অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলেন এবং অপূর্ব রণকৌশলে যুদ্ধও করেন।

চার বছর আগের ঘটনা। তৃতীয় হিজরী সন মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মদীনা হামলা করতে প্রস্তুত সেনাবাহিনী মক্কায় সমবেত হয়ে এদের সংখ্যা ৩ হাজার। ৭’শত বর্মধারী দু’শ অশ্বারোহী। তিন হাজার উট ছিল যুদ্ধাস্ত্র ও রসদপত্রে বোঝাই। এ বিশালবাহিনী যাত্রার জন্য নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।

গতকালের ঘটনার মত খালিদ-এর মনে পড়ে যে, তিনি এ বিশাল বাহিনী দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। প্রতিশোধের দাবানল নির্বাপিত করার সময় এসে গিয়েছিল। আবু সুফিয়ান ছিল এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। খালিদ ছিলেন এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যের কমান্ডার। তার বোনও এ বাহিনীর সাথে গিয়েছিল। এ ছাড়া আরো চৌদ্দ জন নারী যেতে প্রস্তুত ছিল। এদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাসহ আমর ইবনুল আস এবং আবু জাহেলের পুত্র ইকরামার বিবিরাও ছিল। অবশিষ্ট ছিল শিল্পী-গায়িকা শ্রেণীর। সকলের কণ্ঠে ছিল হৃদয়বিদারক আওয়াজ। তাদের সাথে বাদ্যযন্ত্রও ছিল। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসব উত্তেজনাকর ও আবেগঘন গীত গেয়ে গেয়ে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখা এবং বদর যুদ্ধে নিহতদের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া।

আফ্রিকার এক হাবশী গোলামের কথা খালিদের বিশেষভাবে স্মরণ হয়। তার নাম ছিল ওয়াহাশী বিন হারব। সে কুরাইশ সর্দার যুবাইর বিন মুতঈমের ক্রীতদাস ছিল। সে দীর্ঘকায়, কৃষ্ণাঙ্গ এবং খুবই শক্তিশালী ছিল। বর্শা নিক্ষেপে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। তার কাছে ছিল আফ্রিকার তৈরী বর্শা। তার আফ্রিকী আরেকটি নাম ছিল। যুদ্ধ প্রিয় দেখে মুনিব যুবাইর তার এই আরবী নাম রেখেছিল– “বিন হারব।”

যুদ্ধ যাত্রার আগে যুবাইর বিন মুতঈম তাকে বলে– “আমি আমার চাচার খুনের প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু আমার সে সুযোগ হয়ত হবে না। বদর রণাঙ্গনে মুহাম্মাদের চাচা হামযা আমার চাচাকে খুন করেছে। এ যুদ্ধে হামযাকে খুন করতে পারলে তুমি আযাদ।

“হামযা আমার নিক্ষিপ্ত বর্শায় নিহত হবে।” মনিবের (আবেগময়) প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ওয়াহশী বলে।

সৈন্যদের সাথে আগত মহিলারা যেখানে ছিল সেখান দিয়ে এই উষ্ট্রারোহী হাবশী গোলাম যাচ্ছিল।

“আবু ওসামা” হঠাৎ করে কোন মহিলা ডাক দেয়।

এটা ওয়াহ্শীর আরেক নাম। ডাক শুনেই সে থমকে দাঁড়ায়। আওয়াজ অনুসরণ করে দৃষ্টিপাত করতেই দেখতে পায় যে, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী তাকে ডাকছে। সে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

“আবু ওসামা!” হিন্দা বলতে শুরু করে ভয় নেই। আমিই তোমাকে ডেকেছি। আমার হৃদয়ে প্রতিশোধের বহ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। তুমি এ আগুন ঠাণ্ডা কর আবু ওসামা।”

“বলুন, আমি কি করতে পারি।” গোলাম আবেগতাড়িত হয়ে বলল সেনাপতির স্ত্রীর হুকুমে নিজে কুরবান হতে আমি প্রস্তুত আছি।”

বদরে আমার পিতাকে খুন করেছে হামযা।” হিন্দা বলে “হামযাকে তুমি ভাল করেই চেন। চেয়ে দেখ, আমার সমস্ত শরীর স্বর্ণালঙ্কারে ঢেকে রয়েছে। হামযাকে খুন করতে পারলে এসব অলঙ্কারের মালিক হবে তুমি।”

ওয়াহশী হিন্দার শরীরস্থ অলঙ্কারের প্রতি একবার লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে মুচকি হেসে দৃঢ়কণ্ঠে বলল অবশ্যই আমি হামযাকে হত্যা করব।”

উহুদ যুদ্ধে সৈন্যদের গমনাগমনের কথা খালিদের মনে পড়ে। যে পথে তিনি যাচ্ছেন সে পথ দিয়েই সৈন্যরা সেদিন মদীনায় পৌঁছেছিল। তিনি সেদিন একটি উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তখন গর্বে তার বুক ফুলে গিয়েছিল। মদীনার মুসলমানদের প্রতিও তার অন্তরে সামান্য দয়ার উদ্রেক হয়েছিল। কিন্তু এই দয়ানুভব সেদিন তাকে ব্যথিত করেনি, বরং আনন্দিতই করেছিল কেননা এটা ছিল রক্তের বৈরীতা। সরাসরি মান-মর্যাদার বিষয়। মুসলমানদের পিষ্ট করাই ছিল তার একমাত্র অঙ্গীকার।

♣♣♣

উহুদ যুদ্ধের বহু দিন পর খালিদ জানতে পারেন যে, মক্কায় সৈন্যদের উপস্থিতি ও যুদ্ধ-প্রস্তুতির সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামপূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, সৈন্যদের যাত্রা, চলার গতি-বিধি, যাত্রাবিরতি এবং মদীনা থেকে তারা কতটুকু দূরত্বে আছে তার সঠিক খবর তিনি যথারীতি রেখেছিলেন। মদীনার উদ্দেশে সৈন্যদের মক্কা ত্যাগের খবর হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সুকৌশলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবহিত করেছিলেন।

মদীনার অনতি দূরে উহুদ পাহাড়ের কাছাকাছি একটি স্থানে কুরাইশ বাহিনী তাঁবু স্থাপন করে। স্থানটি ছিল সবুজ-শ্যামল এবং চমৎকার। পর্যাপ্ত পানিও ছিল। খালিদ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে, ইতোমধ্যেই দু মুসলিম গুপ্তচর এসে সমগ্র বাহিনীর উপর হাল্কা জরীপ চালিয়ে মদীনায় গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিস্তারিত খবর অবগত করেছেন।

৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে মার্চ, এদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দেন। ’শাইখাইন’ নামক একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে মুসলিম বাহিনী তাঁবু ফেলেন। নবীজীর সঙ্গে সৈন্য সংখ্যা ছিল একহাজার। একশ সৈন্যের মাথায় শোভা পাচ্ছিল লৌহ শিরস্ত্রাণ। মোজাহিদদের নিকট ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি। দুটোর একটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে।

এ যুদ্ধে মুসলমান নামধারী মুনাফিকদের চেহারা থেকে কপটতার মুখোশ খুলে পড়ে। মদীনার কিছু লোক বাহ্যত ঈমান গ্রহণ করলেও আন্তরিকভাবে তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু তারা এতই ধূর্ত ও সতর্ক ছিল যে, তাদেরকে আলাদা করা ও চিহ্নিত করা ছিল খুবই কঠিন। উহুদ যুদ্ধ মুনাফিকদের কপটতা প্রকাশ করে দেয়। কে সাচ্চা মুসলমান আর কে কপটচারী তা চিহ্নিত হয়ে পড়ে। মুজাহিদ বাহিনী মদীনা হতে ‘শাইখাইন’ পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা করলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নামে মদীনার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে এই মর্মে আপত্তি তোলে যে, সংখ্যায় কুরাইশ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর তিনগুণ। এমতাবস্থায় মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না; বরং আমরা মদীনার ভিতরে থেকে শত্রুর আগমনের অপেক্ষা করি। এখানে বসেই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবিলা করব।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নিকট পরামর্শ চাইলেন কিন্তু অধিকাংশের মতামত আসে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে যদিও ব্যক্তিগতভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতামত ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর মত, তবুও রায়ের আধিক্যের দিকে বিবেচনা করে তিনি মুসলিম বাহিনীকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্ত আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-মেনে নিতে পারেনি। সে মুসলিম বাহিনীর সাথে যেতে অস্বীকার করে। তার দেখাদেখি আরও ৩০০ সৈন্য তার অনুসরণ করে মূল বাহিনী থেকে পেছনে সরে যায়। এভাবে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এরা সকলেই মুনাফিক। আর আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এদের নেতা।

এখন তিন হাজারের মোকাবিলায় মুসলিম বাহিনী মাত্র ৭০০। তারপরেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘাবড়ে যাননি। তিনি এই মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়েই অগ্রসর হন এবং উহুদ পাহাড়ের নিকট শাইখাইন নামক স্থানে গিয়ে পুরো বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। খালিদ পাহাড়ের এক উঁচু শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে মুসলিম বাহিনীর সুবিন্যাস স্বচক্ষে দেখেন এবং সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ানের অনুমতিক্রমে স্বীয় অধীনস্থ সৈন্যদের জন্য একটি সুবিধাজনক স্থান বেছে নেন।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে প্রায় এক হাজার গজ দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন। পেছনে উপত্যকা। এক পাশে পাহাড়ের সারি, যা প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে পেছন দিক হতে মুসলিম বাহিনীকে রক্ষার জন্য উপযুক্ত ছিল। কিন্তু অপর পাশ ছিল সম্পূর্ণ খোলা। যে কোন সময় এ দিক দিয়ে শত্রুপক্ষের আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করলেন। তিনি উন্মুক্ত গিরিপথের এক জায়গায় ৫০ জন সুনিপুণ তীরন্দাজ মোতায়েন করেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন এ তীরন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক।

“দায়িত্ব বুঝে নাও আব্দুল্লাহ্!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জরুরী দিক নির্দেশনা দান করতে গিয়ে বলেন– পেছনে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। আমাদের পেছনের দিক হতে দুশমনের আনাগোনা হতে পারে, যা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। তাদের অশ্বারোহীর অভাব নেই। তারা পিছন দিক হতে আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তোমার তীরন্দাজ বাহিনীকে এই অশ্বারোহী সৈন্যদের মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখবে। শত্রুপক্ষের পদাতিক বাহিনী নিয়ে আমার কোন ভয় নেই।” ওকিদী এবং ইবনে হিশামসহ সকল নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক লিখেন যে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে স্পষ্টভাবে এ কথা বলেছিলেন যে, “আমাদের পেছনদিক একমাত্র তোমার সতর্কতা ও বিচক্ষণতার ফলে রক্ষিত থাকবে। তোমার সামান্য ভুল কিংবা অসাবধানতা আমাদেরকে মারাত্মক ক্ষতি ও চরম পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে…। আব্দুল্লাহ! মনোযোগ দিয়ে শোন, শত্রুদের পালিয়ে যেতে এবং আমাদের বিজয়ী হতে দেখলেও নিজ স্থান ছেড়ে যাবে না। তদ্রুপ আমাদের পরাজয়ের সম্মুখীন হতে দেখে তোমার বাহিনীর মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করা প্রয়োজন মনে হলেও নিজেদের স্থান ত্যাগ করবে না। পাহাড়ের এই উপরিভাগ যেন দুশমনদের দখলে চলে না যায়। এস্থান তোমাদের দখলে। এখান থেকে নিচে যতদূর পর্যন্ত তীরন্দাজদের তীর পৌঁছতে পারে সবটাই থাকবে তোমাদের কর্তৃত্বে।”

খালিদ মুসলমানদের সৈন্যবিন্যাস গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আবু সুফিয়ানকে বলে, আমার মনে হয় মুসলমানরা বিস্তীর্ণ ময়দানে যুদ্ধ করবে না। আবু সুফিয়ানের ছিল অধিক সৈন্যের গর্ব। ফলে সে চাচ্ছিল যুদ্ধ বিস্তীর্ণ ময়দানে হোক। যাতে তার পদাতিক ও অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী মুসলমানদেরকে পদপিষ্ট করে নিশ্চিহ্ন ও নিস্পেষিত করে ফেলে। অপরদিকে খালিদ ছিলেন অভিজ্ঞ সমরকুশলী। অতর্কিতে পেছনে কিংবা কোনো পার্শ্বভাগে হামলা, গেরিলা হামলা, সৈন্য বিন্যাস এবং তাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ-এসবই ছিল তার যুদ্ধবিদ্যার অন্তর্গত। তিনি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য বিন্যস্তকরা দেখেই বুঝতে পারেন যে, নিঃসন্দেহে মুসলমানরা রণাঙ্গনে পূর্ণ নৈপুণ্য দেখাতে যাচ্ছে।

আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। সে প্রথমে অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে মুসলমানদের দু’পার্শ হতে আক্রমণ করতে প্রেরণ করে। এক পার্শ্ব হামলার নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ নিজে আর অপর পার্শ্ব হামলার নেতৃত্বে থাকে ইকরামা। উভয়ের অধীনে ছিল ১০০ অশ্বারোহীর একটি করে বিশেষ বহর। সব অশ্বারোহীর কমান্ডার ছিল আমর ইবনুল আস। পদাতিক বাহিনীর সামনে থাকে ১০০ সুনিপুণ তীরন্দাজ। তালহা বিন আবু তালহা কুরাইশ বাহিনীর পতাকাবাহী। তৎকালে রণাঙ্গনে পতাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পতাকা ছিল প্রতিটি সৈন্যের প্রাণ-স্পন্দন। পতাকা যতক্ষণ পতপত করে উড়ত ততক্ষণ সৈন্যরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেত। আর পতাকা ভূপাতিত হলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যেত এবং বিদ্যুৎ গতিতে ভীত হয়ে সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিত।

♣♣♣

যুদ্ধের সূচনা হয়। কুরাইশদের পক্ষ থেকে আবু আমের নামক এক পাপাচারী কাতার ডিঙ্গিয়ে মুজাহিদদের অদূরে এসে দাঁড়ায়। তার পেছনে কুরাইশ গোলামদের একটি দলও ছিল। আবু আমের মূলত মদীনার বাসিন্দা। সে ছিল আউস গোত্রের সর্দার। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনায় গেলে সে শপথ করে, যে কোন মূল্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদেরকে মদীনা থেকে বিতারিত করে ছাড়বে। সে রূপসী সুন্দরী এক ইহুদী নারীর প্রেমে পাগল ছিল। তদুপরি ইহুদীদের অর্থ-সম্পদও তাকে এ ব্যাপারে উত্তেজিত করে তুলে। ইসলাম প্রশ্নে ইহুদীদের পদক্ষেপ ছিল মারাত্মক। অবশ্য বাহ্যিকভাবে তারা মুসলমানদের সাথে আনুগত্য ও শান্তি চুক্তি করে রেখেছিল। আবু আমের ছিল এই ইহুদীদের হাতের পুতুল। ইহুদীরা সুকৌশলে তাকে কুরাইশদের মিত্র হিসেবে প্রস্তুত রেখেছিল।

মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের বিরুদ্ধে লড়তে মদীনা থেকে রওয়ানা করলে আবু আমের কুরাইশদের কাছে চলে যায়। আউস গোত্রের অনেকেই ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মুসলিম বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করতে তারা কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আবু আমের মুসলিম বাহিনীর মধ্যে তার গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে উচ্চ আওয়াজে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

‘আউস গোত্রের আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বীর সন্তানেরা।” আর আমের বলে –“নিঃসন্দেহে আমার পরিচয় তোমরা ভাল করে জান। আমার কথা মন দিয়ে শোন এবং …।”

তার কথা শেষ না হতেই মুজাহিদ বাহিনীর মধ্য থেকে আউস গোত্রের এক বীর মুজাহিদ এই বলে গর্জে ওঠে যে, “পাপীষ্ঠ, নরাধম চুপ কর। তোর নামের উপর আমরা থু থু ফেলি।”

খালিদের দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে একটি দৃশ্য। আবু আমের আর তার সাথে গমনকারী গোলামদের প্রতি বৃষ্টির ন্যায় পাথর বর্ষিত হওয়ার কথা তার আবার স্মরণ হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, মুসলিম বাহিনী হতে আউস গোত্রের লোকেরাই এই পাথর বর্ষণ করে। পাথরের তীব্র আঘাত সহ্য করতে না পেরে আবু আমের ও তার সাথের গোলামরা দ্রুত চলে যেতে বাধ্য হয়।

ইহুদীরা উত্তেজনায় সময় ক্ষেপণ করছিল। যুদ্ধের গতি ও ফলাফল জানতে তারা ছিল অধীর আগ্রহী। আবু আমের যে ইহুদী রমণীর রূপের জাদুতে বন্দী ছিল সে আবু আমেরের মাধ্যমে তার মিশন সফল হওয়ার সংবাদ শুনতে অত্যন্ত উদগ্রীব ছিল। সে তখনও জানতনা যে, তার রূপ-যৌবনের যাদু মুসলমানরা অনেক আগেই পাথর বর্ষণ করে উড়িয়ে দিয়েছে। তার ইন্তেজার অর্থহীন।

আবু আমেরের এই ঘটনার পূর্বে কুরাইশদের সাথে আগত গায়িকারা সুমধুর সুরে গান পরিবেশন করে। বদরে নিহতদের বীরত্ব আর ত্যাগের বর্ণনায় ভরপুর ছিল গানের কথাগুলো। নর্তকীরা এমন ভঙ্গিতে নিহতদের বিবরণ তুলে ধরে, যার প্রতিটি শব্দই শ্রোতাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাদের অনেকেই জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমেও কুরাইশদের বীরত্বে বিস্ফোরণ আর রক্তে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।

নর্তকীদের পর্দার অন্তরালে চলে যাবার নির্দেশ হয়। মঞ্চে আসে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। চমৎকার ঘোড়ায় আরোহী। কণ্ঠে আকর্ষণীয় গান। তার কণ্ঠ যেমন ছিল উচ্চকিত তেমনি সুরের মধ্যেও ছিল বেশ আকর্ষণ। ঐতিহাসিকগণ তার গানের কলিগুলো না লিখলেও সবাই এটা বর্ণনা করেছেন যে, তার গান ছিল অশ্লীলতায় ভরপুর। নারী-পুরুষের গোপন বিষয়ের বিবরণ ছিল তার সঙ্গীতে। ইতিহাসে তার গানের কলির মধ্যে আব্দুদ্দার নামক এক ব্যক্তির আলোচনা আছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য বনু আব্দুদ্দার কওম। তৎকালে এই গোত্রটি কুরাইশ বংশের একটি সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসেবে পরিগণিত ছিল। বনু উমাইয়া এই গোত্রেরই একটি বিশেষ শাখা। হিন্দা সুরের মূর্ছনায় গেয়ে চলছিল:

আব্দুদ্দারের সূর্য সন্তানেরা

পরিবারের কর্ণধারেরা

আমরা আঁধার রাতের সঙ্গিনী

চার দেয়ালের ভিতরে আমরা জাদু দেখাই

এই জাদু খুবই তৃপ্তিদায়ক এবং দারুণ উপভোগ্য।

শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আমাদের বক্ষ তোমাদের জন্য উৎসর্গিত

পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে আমরা তোমাদের কাছেও আসবনা।

♣♣♣

এরপর আবু আমের আউস গোত্রকে বিভ্রান্ত করতে যায়। কিন্তু আউস গোত্র তীর দ্বারা তাকে জবাব দিলে সে চরম ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। সে ফিরে আসতেই কুরাইশরা মুজাহিদদের উপর তীর বর্ষণ করতে থাকে। মুজাহিদরাও তীরের জবাব তীর দ্বারাই দিতে থাকে। খালিদ মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে তার অধীনস্থ একশ অশ্বারোহী নিয়ে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হন। পাহাড়ের উপরিভাগে মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনীর গোপন অবস্থানের কথা তার জানা ছিল না। তীব্রগতিতে অগ্রসর হচ্ছিল তার বাহিনী। সুড়ঙ্গ ছিল সংকীর্ণ। একত্রে এ পথ অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে অশ্বারোহীদেরকে লাইন বেঁধে এক একজন করে পথ চলতে হত।

খালিদ অনেক ভেবে-চিন্তেই তার বাহিনীকে এ প্রান্তভাগে নিয়ে এসেছিলেন। পিতার প্রশিক্ষণ এবং নিজ প্রজ্ঞার আলোকে তার পরিকল্পনা ছিল যে, পার্শ্বদেশ হতে হামলা করে তিনি মুসলমানদের পিছু হটতে বাধ্য করবেন। যদি তাদের দৃঢ়তায় ফাটল ধরানো যায় এবং বিক্ষিপ্ত করা যায় তবে সহজেই তারা কুরাইশ বাহিনীর অন্যের পদতলে পিষ্ট হতে থাকবে। কিন্তু তার সকল পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায় যখন এ অশ্বারোহী দল মুসলিম বাহিনীর অদূরে থাকতেই মাথার উপর দিয়ে তীরের ঝাঁক উড়ে এসে প্রথম অশ্বারোহীকে চালনী করে ফেলে। এক একজন অশ্বারোহী কয়েকটি তীরের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। যে সমস্ত অশ্ব তীরের আঘাতে আহত হয় সেগুলো খালিদ বাহিনীর মাঝে কেয়ামতের বিভীষিকা সৃষ্টি করে চলে। ফলে পিছনের আরোহীরা অশ্ব ঘুরিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এদিকে কুরাইশ গায়িকারা মিউজিক বাজিয়ে আবার ঐ গান সম্মিলিত কণ্ঠে গাইতে থাকে, যা ইতোপূর্বে হিন্দা একাই গেয়েছিল।– “আব্দুদ্দারের সূর্য সন্তানেরা। আমরা রাতের আঁধারের সঙ্গিনী। আমরা চার দেয়ালের মাঝে জাদু দেখাই..।”

ঐতিহাসিক ওয়াকিদী লিখেন, তৎকালীন আরবের যুদ্ধ-রীতি অনুযায়ী এবার মল্লযুদ্ধের পালা আসে। কুরাইশ বাহিনীর পতাকাবাহী তালহা বিন আবু তালহা সর্বপ্রথম ময়দানে এসে মুজাহিদ বাহিনীর প্রতি হুঙ্কার ছুড়ে আহবান করে।

“প্রস্তুত হ দ্বীনের দুশমন!” দমকা হাওয়ার ন্যায় উড়ে এসে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলে– আমি তোর মোকাবিলায় প্রস্তুত।

তালহা এক হাতে পতাকা আঁকড়ে ধরেছিল। অপর হাতে তলোয়ার মাথার উপর ঘুরাতে ঘুরাতে সুযোগমত প্রচণ্ড বেগে হামলা করে। কিন্তু আঘাত শূন্যে মিলিয়ে যায়। সাথে সাথে নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণও তার শিথিল হয়ে পড়ে। দ্রুত সে নিজেকে সামলে নিতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু তাকে সামলানোর সুযোগ না দিয়ে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তরবারি এমন প্রচণ্ড বেগে আঘাত হানে যে, প্রথমে তার পতাকা ছিটকে পড়ে, অতঃপর সে নিজেও কপোকাত হয়। পতাকা পড়ে যেতেই কুরাইশ বাহিনীর এক ব্যক্তি দৌড়ে এসে পতাকা তুলে নিয়ে যায়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এ ব্যক্তিকেও ইচ্ছা করলে ধরাশায়ী করতে পারতেন কিন্তু এটা মল্লযুদ্ধের নীতি নয় বিধায় তাকে নিরাপদে চলে যাবার সুযোগ দেন।

তালহাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারই গোত্রের আরেক ব্যক্তি ময়দানে আসে।

“আমি প্রতিশোধ নিতে ওয়াদাবদ্ধ।” সে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে আসে– “আলী! সম্মুখে আস। আমার তলোয়ারের ধার দেখ।”

হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু নীরবে তার মুকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়ে আছেন। উভয়ে পরস্পরের প্রতি চোখ রেখে ময়দানে ঘুরতে থাকে। অতঃপর তরবারি আর ঢালে ঢালে ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হয়। আঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ঢাল-তলোয়ারের তামাশা চলতে থাকে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সকলের বিস্ফোরিত নেত্র নিবদ্ধ মপ্লযোদ্ধাদ্বয়ের প্রতি। ফলাফল হতে বেশী সময় লাগেনি। এক সময় সবাই দেখল যে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার রক্তে রাঙা। টপটপ করে তার তলোয়ার হতে রক্ত ঝরছে। আর তাঁর প্রতিপক্ষ মাটিতে লুটিয়ে ছটফট করছে।

এরপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে পালাক্রমে এক একজন করে আসতে থাকে আর মুজাহিদদের হাতে মারা যেতে থাকে।

কুরাইশদের সেনা কমান্ডার আবু সুফিয়ান তার পক্ষের বীরদের এভাবে কলাগাছের ন্যায় আছড়ে পড়তে দেখে রাগে ক্ষোভে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সমর-রীতি অনুযায়ী মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ তার জন্য ছিল সম্পূর্ণ আত্মঘাতমূলক সিদ্ধান্ত। কারণ সে কমান্ডার। সে নিহত হলে সৈন্যদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা আর ভীতি ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তারপরেও সে নিজের উপর নিজকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। এতক্ষণ সে ঘোড়ায় বসে যুদ্ধের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল। আচমকা সবাইকে হতবাক করে অশ্বে পদাঘাত করে তর্জন গর্জন করতে করতে নিজেই মল্লযোদ্ধারূপে ময়দানে চলে আসে।

তার স্ত্রী হিন্দা তাকে যেতে দেখে উষ্ট্রে আরোহণ করে সম্মুখে আসে এবং কণ্ঠে আবার ঐ গানের সুর ঝংকার তুলে, যার একটি কলি ছিল,“তোমরা কাপুরুষ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলে আমাদের শরীরের প্রাণও পাবে না।”

আবু সুফিয়ান অশ্বপৃষ্ঠে আর প্রতিপক্ষ মুসলমান পদাতিক। ইতিহাসে তিনি হানজালা বিন আবু আমর নামে খ্যাত। আবু সুফিয়ানের হাতে দীর্ঘ বর্শা। অশ্বারোহীর বর্শার আঘাত থেকে পদাতিক তলোয়ারধারী বেঁচে যাবে এ ধারণা কারোর ছিল না। আবু সুফিয়ানের ঘোড়া হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু কে লক্ষ্য করে তীর গতিতে ছুটে আসে। এই ছুটন্ত অবস্থায় আবু সুফিয়ান বর্শা উঁচু করে লক্ষ্যপানে নিক্ষেপ করে। কিন্তু হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত সুন্দর করে তার মোকাবিলা করেন। তিনি একদিকে সরে গিয়ে আঘাত ব্যর্থ করে দেন। এভাবে উপর্যুপরি তিনবার আক্রমণ ও তার ব্যর্থতার পালা চলে। তৃতীয়বার আবু সুফিয়ানের অশ্বটি সম্মুখে এগিয়ে গেলে হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিছু ধাওয়া করেন। ঘোড়া কিছুদূর গিয়ে যখন আবার পেছনে মোড় নেয় হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহুও ঠিক ঐ মুহূর্তে সেখানে গিয়ে হাজির হন। আবু সুফিয়ান ঘোড়ার একদম কাছে তাঁর অবস্থান টের পায়নি। ইতোমধ্যে হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার সামনের পা লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করলে ঘোড়া সঙ্গে সঙ্গে ভূপাতিত হয় আর আবু সুফিয়ানও অন্য দিকে ছিটকে পরে। পতিত আবু সুফিয়ানের উপর হযরত হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু আক্রমণোদ্যত হলে আবু সুফিয়ান ঘোড়াকে ঢাল বানিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে দ্রুত চক্কর কেটে আত্মরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে এভাবে নিজেকে বিপদের মুখে দেখে সাহায্যের জন্য কুরাইশদেরকে আহবান করতে থাকে।

এক পদাতিক কুরাইশ দ্রুত আসে। মুসলমানরা ধারণা করে যে, এ ব্যক্তি আবু সুফিয়ানকে শুধু উদ্ধারের জন্য এসেছে। কিন্তু নরাধম যুদ্ধরীতি ভঙ্গ করে পেছন হতে আঘাত করে হযরত হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শহীদ করে ফেলে এ সুযোগে আবু সুফিয়ান দৌড়ে সৈন্যদের মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

সর্বশেষ মল্লযোদ্ধা হিসেবে কুরাইশদের পক্ষ থেকে আসে আব্দুর রহমান বিন আবু বকর। ঐতিহাসিক ওয়াকিদী এই ঘটনার বিবরণ এভাবে দিয়েছেন যে, আব্দুর রহমান হুঙ্কার ছেড়ে ময়দানে এলে তারই পিতা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু পুত্রের মোকাবিলার জন্য ময়দানে অবতীর্ণ হন।

“সামনে আয় মুসলিম পিতার কাফের ছেলে।” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বাঘের ন্যায় হুঙ্কার দিয়ে বলেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাপ-বেটাকে সামনা-সামনি দেখে ছুটে এসে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গতিরোধ করেন।

তরবারি কোষবদ্ধ কর আবু বকর।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আদেশ করেন এবং তাঁকে নিয়ে পশ্চাতে চলে যান।

♣♣♣

সেদিনের যুদ্ধের আওয়াজ খালিদের কানে আজও ঝংকারিত হচ্ছে। রণাঙ্গনের বিভিন্ন দৃশ্য তার চোখের ক্যামেরা যতনে রেখেছিল। একেকটি পলক তাঁর সামনে একেকটি দৃশ্যের অবতারণা করছিল। মল্লযুদ্ধ শেষ হতেই কুরাইশ বাহিনী মুসলমানদের উপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ পাহাড়কে পেছনে রেখে অবস্থান এবং সৈন্যবিন্যাস করেছিলেন সেজন্য পেছন দিক থেকে আক্রমণের কোন সম্ভাবনা ছিল না। সংখ্যায় মুসলমানরা অল্প হলেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং অস্ত্র পরিচালনার নৈপুণ্য দ্বারা এ ঘাটতি পূরণ করে দিয়েছিলেন। কুরাইশদের সংখ্যা তিনগুণ না হলে তারা মুজাহিদ বাহিনীর সম্মুখে দাঁড়াতেই পারত না। অধিক সৈন্য বলে তারা লড়ে যাচ্ছিল মাত্র।

খালিদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পার্শ্ববাহিনীতে অবস্থান করছিলেন। এই বাহিনীর প্রতি আক্রমণ করা তার একান্ত আশা ছিল। তার অধীনস্থ অশ্বারোহী দলকে সংকীর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে দ্রুত এগিয়ে যেতে এবং মুসলমানদেরকে একযোগে আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিন্তু তার ইচ্ছায় বাঁধ সাধে হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইরের চৌকস তীরন্দাজ বাহিনী। মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী খালেদ বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পশ্চাদপসারণে বাধ্য করে। এখানে তার বেশ কিছু অশ্ব ও সৈন্য নিহত হয়। বিপুল জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি মেনে নিয়ে পিছু হটার সময় তাদের সাথে ছিল কয়েকটি ঘোড়া এবং আহত সৈন্যের এক দীর্ঘ লাইন। নিহত সৈন্য আর ঘোড়া সেখানেই পড়ে থাকে।

তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল যুদ্ধ। উভয় পক্ষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে লিপ্ত। ব্যস্ত সবাই সমর শক্তি প্রদর্শনে। কিন্তু এক ব্যক্তি ছিল এর ব্যতিক্রম। সে যুদ্ধ করছিল না। সে একটি বর্শা হাতে রণাঙ্গনে ঘুরছিল। যেন সে কাউকে খুঁজছে। লোকটির নাম ওয়াহশী বিন হারব। সে নিয়মিত যুদ্ধ এড়িয়ে হযরত হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তালাশ করে ফিরছিল। হযরত হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-ই আজ তার প্রধান লক্ষ্য বস্তু। কৌশলে তাকে হত্যা করতে চায় সে। তাঁকে হত্যা করতে পারলে ডবল পুরস্কার তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমত দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ। দ্বিতীয়ত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার শরীরের সকল অলঙ্কারের মালিকানা।

এক সময় সে হযরত হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখতে পায়। তিনি সিবা বিন আব্দুল উযযার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন।

তখনকার আরব সমাজে মহিলারা খৎনার কাজ করত। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের বর্ণনামতে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও আরব সমাজে খৎনার প্রচলন ছিল। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু সে সিবার প্রতি চড়াও হন তার মাতা খৎনার কাজ করত।

“খৎনাকারিণীর পুত্র।” হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু হুঙ্কার দিয়ে বলেন– এদিকে আয় এবং শেষবারের মত আমাকে দেখে যা।”

সিবা বিন আব্দুল উযযা হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিকে এগিয়ে আসে। ক্রোধে তার চেহারা লাল হয়ে উঠেছিল। তরবারি চালনায় ভীষণ পটু ছিল সে। হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহুও তার থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না। উভয়ই মুখোমুখি হয় এবং আঘাত পাল্টা আঘাত চলতে থাকে। ঢাল উভয়ের হামলা ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। সিবা পার্শ পরিবর্তন করে কৌশলী আক্রমণ করে। কিন্তু ঢাল তলোয়ারের মাঝপথে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এ সময়ে ওয়াহশী অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে অগ্রসর হয়। উঁচু-নিচু টিলা তাকে লুকিয়ে রাখে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি ছিল শত্রুর প্রতি নিবদ্ধ। সিবা ব্যতীত আর কেউ তাঁর নজরে পড়েনি।

ওয়াহশী নিজেকে আড়াল করে এক সময় কাছে পৌঁছে যায়। বর্শা নিক্ষেপে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। সে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এত কাছে পৌঁছে যায় যেখান থেকে তার নিক্ষিপ্ত বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সামান্যও সন্দেহ ছিল না। এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বর্শা হাতে তোলে পজিশন নেয় এবং মোক্ষম সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গুপ্ত হত্যার প্রতি যখন চূড়ান্ত তখন তিনি আক্রমণের পর আক্রমণ করে সিবাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছেন। এক সময় তিনি প্রচণ্ড বেগে তরবারি চালালে তরবারি সরাসরি সিবার পেটে আঘাত হানে। তিনি তরবারি এমনভাবে টেনে বের করেন যে, এতে তার পেট আরো ফেড়ে যায়। সিবা হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে যেতে তৎপর। এরই মধ্যে ওয়াহশী পূর্ণ শক্তিতে বর্শা নিক্ষেপ করে। ব্যবধান খুবই কম ছিল। বর্শা পেটের এত গভীরে প্রবেশ করে যে, তার ছুঁচালো মাথা পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে যায়। অতর্কিত এ ভয়ানক আক্রমণে তিনি সাথে সাথে লুটিয়ে পড়েননি। এদিক-ওদিক নজর ঘুরিয়ে হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেন। নজর ঘুরিয়ে ওয়াহশীকে দেখতে পান। পেটের বর্শা নিয়েই তিনি তার দিকে ছুটে যান। ওয়াহশী নিজ স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু বেশি দূরে যেতে পারেননি চার-পাঁচ কদম গিয়েই জমিনে লুটিয়ে পড়েন। ওয়াহশী দূরে দাঁড়িয়েই তার শরীরের নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করতে থাকে। নিথর হয়ে গেলে ওয়াহশী তাঁর মৃতদেহের নিকটে আসে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়ে যান। ওয়াহশী তাঁর শরীর থেকে বর্শা খুলে চলে যায়। সে ফিরে গিয়ে হিন্দা এবং মনিব জুবাইর বিন মুতঈমকে তালাশ করতে থাকে।

♣♣♣

উহুদের বিভিন্ন চিত্রগুলো খালিদের স্মৃতিপটে যতই ভাসতে থাকে তার অন্তর ততই ভারাক্রান্ত হয়। অশ্ব তাকে নিয়ে চলছিল আপন মনে। নিম্নাঞ্চল অতিক্রম করায় উহুদের পর্বতশৃঙ্গ দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে গিয়েছিল। তাঁর গোত্রের নারীদের কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। তারা কুরাইশ ও সমমনা গোত্রের মধ্যে বীরত্ব ও রক্তে ত্যাজ সরবরাহ করছিল। খালিদের আরো মনে পড়ে যে, তিনি যুদ্ধের পুরো দৃশ্য নিজচক্ষে দেখার জন্য নিকটবর্তী একটি উঁচু টিলায় আরোহণ করেন। এখান থেকে তিনি মুসলিম নারীদের দেখতে পান। রণাঙ্গন থেকে আহতদের নিয়ে এসে তাদের হাতে সোপর্দ করা হত। তারাই তাদের সেবা যত্ন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করত। তৃষ্ণার্তদের পানি পান করাত। এ ধরনের মহিলার সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ চৌদ্দজন। নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহাও ছিলেন তাদের মধ্যে।

তীব্র সংঘর্ষ কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলে। কুরাইশদের জোশ ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে। এক সময় স্বল্পসংখ্যক মুজাহিদ বিশাল কুরাইশ বাহিনীর উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। কুরাইশদের পতাকাধারী একজন নিহত হলে আরেকজন এসে পতাকা তুলে ধরত। এভাবে কয়েকবার পতাকা ভূলুণ্ঠিত হয়। শেষদিকে এক গোলাম এসে পতাকা তুলে ধরে, কিন্তু সেও নিহত হয় এরপর মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের আর কাউকেই পতাকা তোলার সুযোগ দেয়নি। কুরাইশরা রণে ভঙ্গ দেয়।

খালিদ কুরাইশ বাহিনীর পৃষ্ঠ প্রদর্শনের দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখেন। মুসলিম বাহিনী কর্তৃক তাদের পিছু ধাওয়াও তার নজরে আসে। কুরাইশরা রণে ভঙ্গ দিয়ে সেনা ক্যাম্পেও দাঁড়ায়নি। জিনিসপত্র ফেলে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় সকলেই পলায়ন করে। মুসলমানরা বিজয়ের আনন্দে এবং প্রতিশোধের স্পৃহায় কুরাইশদের ক্যাম্পের উপর চড়াও হয়। আনন্দ-শ্লোগান আর বিজয়-উল্লাসে চারদিক মুখরিত করে তোলে মুসলমানরা। কুরাইশরা এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পলায়ন করে যে, ভাগার সময় মহিলাদের ব্যাপারে চিন্তা করার সুযোগও তারা পায়নি। বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটেই তারা পালাতে থাকে কিন্তু মুসলমানরা তাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।

অশ্বারোহী দু’দলের কমান্ডার ইকরামা। আর অপর দলের কমান্ডার খালিদ নিজে। তাদের লক্ষ্য ছিল, পার্শ্ব-বাহিনীকে আক্রমণ করে পর্যদস্ত করে দেয়া। তারা সুযোগ খুঁজতে ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে যুদ্ধের গতি অন্য দিকে মোড় নেয়। যুদ্ধ কুরাইশদের সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থানে চলে যায়। তারপরেও ইকরামা ও খালিদ নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে পূর্বের জায়গায় অবস্থান করতে থাকে। চরম নৈরাশ্যজনক এ অবস্থার মধ্যেও খালিদের আশা ছিল যে, তিনি শেষ পর্যন্ত পরাজয়কে বিজয়ে বদলে দিতে পারবেন। তিনি সম্মুখ দিক হতে নয়; বরং এক পার্শ্ব দিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে অপেক্ষমাণ ছিলেন। কিন্তু এটা মোটেও সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। এর জন্য মরণ ফাঁদের ন্যায় এক সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ অতিক্রম করা আবশ্যক ছিল। সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে যেতে একবার উদ্যেগও নিয়েছিলেন, কিন্তু আগে প্রস্তুত মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী তাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়। তা সত্ত্বেও খালিদ এখনও এই সুড়ঙ্গ পথ ব্যবহারের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকেন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। মোক্ষম সুযোগ এসে গেল।

তীরন্দাজ বাহিনী তাদের অবস্থান থেকে কুরাইশদের পলায়নের দৃশ্য দেখতে থাকেন। পলায়নপর বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের ধন-সম্পদ হস্তগত করাটাও তাদের নজর এড়ায় না। গনিমতের আশায় তীরন্দাজরা এক এক করে তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে যায়। কমান্ডার আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। আমার দ্বিতীয় নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ স্থান ত্যাগ করবে না’– রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশটি দ্বিতীয়বার স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *