৫. দীর্ঘ সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে

দীর্ঘ সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ইলার স্টুডিওতে উঠে এলো ডেভিড। বাইরে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। ওর পরনে খোলা স্যান্ডেল আর ব্রোঞ্জ রঙের হালকা স্ন্যাক, চওড়া ভি-গলার খাটো হাতার শার্ট। সূর্যের আলো না পাওয়ায় বিবর্ণ হাতের রঙ। নরম ক্রীমের তুলনায় গাঢ় দেখাচ্ছে বুকের লোম। মাথার সূর্যের তাপ না লাগার জন্য আর মুখের উপর ছায়া রাখার জন্য পরে আছে চওড়া কানাওয়ালা টুপি।

 থেমে গেল সে। বুঝতে পারল শার্টের নিচে ঘামছে। ফুসফুস লাফাচ্ছে। ছাদে উঠে আসতেই শারীরিক ভাবে দুর্বল বোধ করল। পা দুটো কাঁপছে, পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে জায়গাটা। বন্ধ দরজা খুলে ভেতরের অন্ধকারে পা রাখল ডেভিড।

ঘরের মাঝখানে মেঝেতে সমরকন্দ থেকে আনা কার্পেটের উপর বসে আসে ইলা কাঁদেশ। তার পরনে সংক্ষিপ্ত বিকিনি। পদ্মাসনে বসে যোগ ব্যায়াম করছে সে। অজগরের মতো পেঁচিয়ে আছে ওর বিশাল পা দুটো। হাত দুটো সামনে তালুতে তাল ঠেকিয়ে রাখা ধ্যানস্থ হওয়ায় চোখ বন্ধ; মাথার উপরে টুপি চারটে চৌকোনা তৈরি করেছে বিচারকদের মতো।

 দরজার কাছে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়াল ডেভিড। কিন্তু নিঃশ্বাস নেবার আগেই হাসতে শুরু করল। শুরু হলো ছোট্ট বুদবুদের মতো হিসহিস শব্দ করে; তারপর হঠাৎ করেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। হাসির দমকে কাঁপতে লাগল সে। বুঝতে পারল আগের মতো আর ফিট নয় সে। এভাবেই বেঁচে থাকা শিখতে হবে তাকে।

ইলা বুঝতে পারল সবকিছু। নড়াচড়া না করলেও আনন্দরত বুদ্ধের ন্যায় ছোট্ট একটা চোখ খুলে তাকাল। এখন ব্যাপারটা হয়ে গেল আরো মজাদার আর হাস্যকর। দরজা থেকে গড়িয়ে হাসতে হাসতে একটা চেয়ারের উপর। পড়ে গেল ডেভিড।

‘তোমার আত্মা একেবারে শুকনো, ডেভিড মরগ্যান’, বলে উঠল ইলা। ‘তোমার কোন সৌন্দর্য বোধ নেই, সমস্ত আকর্ষণ শুধুমাত্র- বাকিটুকু আর বলতে পারল না সে। হাসতে হাসতে জেলির মতো গলে যেতে লাগল। প্রায় হেঁচকি ওঠার মতো অবস্থা হলো দু’জনের।

‘আমি জমে গেছি। অবশেষে থামলো ইলা। সাহায্য কর ডেভি’, ওফ

তাড়াতাড়ি ইলার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। হাঁটু গেড়ে বসে চেষ্টা করল ভাঁজ করা পা খুলে দিতে। একটু পরেই নানা কসরতের পর খুলে গেল পা। মট করে শব্দ হয়েই কার্পেটের উপর পড়ে গেল ইলা। একই সাথে খিকখিক করে হাসতেও লাগল।

 ‘সরো এখান থেকে।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল ইলা। আমাকে শান্তিতে একটু মরতে দাও। যাও তোমার নারীর কাছে, জেটির উপরে আছে।

তাকিয়ে দেখল দ্রুতপায়ে চলে গেল ডেভিড। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গেল ইলা। হাসি থামিয়ে বিড়বিড় করে উঠল, আমার ছোট্ট দুটো বিড়াল ছানা-ভেবে অবাক লাগছে ঠিক কাজটাই করেছি কিনা। চেহারায় খানিকটা চিন্তার ছায়া এসেও মুছে গেল। যাই হোক, দেরি হয়ে গেছে কাঁদেশ, আর হাত দিও না এতে। আগেই ভাবা উচিত ছিল যা ভাবার।

.

রঙিন তোয়ালে আর বীচ্ জ্যাকেট পড়ে আছে জেটির উপর। আরো আছে উঁচু ভলিউমে বাজাতে থাকা একটা ট্রানজিষ্টার রেডিও। ভারী রক টিউন বেজে উঠছে। খানিকটা দূরে উপসাগরে একা সাঁতার কাটছে ডেবরা, স্থির হয়ে শক্ত ভাবে উলটো সাঁতার কাটছে সে। প্রতিটি স্ট্রোকের সাথে সূর্যের আলোয় ঝিক করে উঠছে ওর বাদামী পা। পায়ের শব্দে পানি ছিটছে ফোয়ারের মতো।

থেমে ভেসে রইল ডেবরা। গোসলের টুপি একেবারে সাদা। ডেভিড দেখতে পেল খানিক থেমে রেডিওর শব্দ শুনল ডেবরা; আবার সাঁতার কাটতে লাগল। সরাসরি-জেটির দিকে ফিরে আসছে এখন।

পানি থেকে উঠে এসে মাথার টুপি খুলে চুল ঝাড়া দিল। শরীরের ত্বকের রং হয়ে গেছে গাঢ়, সূর্যের তাপে নিশ্চয়ই এই অবস্থা আর সারা শরীরে মুক্তোর মতো পানির ফোঁটা। দেহের প্রতিটি পেশী শক্ত আর দৃঢ়। আত্মবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে সে। প্রতি পদক্ষেপে ফুটে উঠল মানসিক শক্তির পরিচয়।

 গা মোছার সময় কাছেই দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেবরাকে। মনে হলো এত মাসের বিচ্ছেদ এক মিনিটেই মিটিয়ে নিতে চাইছে। পরিষ্কার ভাবে ডেবরার কথা মনে করতে পারতো ডেভিড। তার পরেও বুঝতে পারল অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছিল সে। যেমনটা মনে পড়ে তারচেয়েও নরম আর ঘন মেঘের মতো হয়ে গেছে ডেবরার চুল। দেহত্বকের চিক্কন ভাব ভুলে গিয়েছিল ডেভিড। আগের চেয়েও গাঢ় বর্ণের হয়ে গেছে। প্রায় তার চোখের মতো। নিশ্চয়ই প্রতিদিন অনেকটুকু সময় সূর্যের নিচে কাটায় সে। হঠাৎ করেই তোয়ালে ফেলে দিল ডেবরা। ঠিক করে নিল নিজের সংক্ষিপ্ত পোশাক। ডেভিড বুঝতে পারল কতটা প্রয়োজন তার এই মেয়েটাকে। এতটাই আকুতি জেগে উঠল যে বুকের মাঝে কিছুতেই তা আটকে রাখতে পারল না সে। হালকা পায়ে এগিয়ে গেল সে। তারপরেও জুতার নিচে শব্দ হতে লাগল অল্প অল্প।

সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে তাকাল অনিন্দ্যসুন্দর একটা মুখ। কিছু শুনতে পাবার ভঙ্গিতে থেমে দাঁড়াল। চোখ দুটো হয়ে গেল বড় বড়। চোখের তারায় ফুটে উঠল বুদ্ধির ঝিলিক। মনে হলো ডেভিডকে দেখতে পেল ও দুটো। ডেভিডের মনে হলো ঘুরে চলে যেতে উল্টো দিকে।

‘ডেভিড? নরম স্বরে কথা বলে উঠল ডেবরা। তুমি এসেছো ডেভিড?

উত্তর দিতে চেষ্টা করল ডেভিড। কিন্তু স্বর ফুটলো না গলায়। দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে এলো ডেবরা। দ্রুত, লম্বা লম্বা পা ফেলে। হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে জানতে চাইল।

ধরে ফেলল ডেভিড। শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল ডেবরা। কিছুটা রাগের ভঙ্গিতেও মনে হলো অনেকদিন ধরে অবহেলা করা হয়েছে তাকে।

‘আমি তোমাকে অনেক মিস্ করেছি ডেভিড। গলার স্বরে ফুটে উঠল রাগ। ওহ ঈশ্বর, তুমি কখনোই বুঝতে পারবে না আমি তোমাকে কতটা মিস করেছি।’

এই প্রথম কোন মানুষ তাকে দেখে দূরে সরে যায়নি–কোন সহানুভূতি বা অনুতাপ দেখায়নি–এত মাসের মধ্যে ডেভিডও বুঝতে পারল ও নরম হয়ে পড়েছে। শক্ত হাতে আলিঙ্গন করল ডেবরাকে।

অবশেষে দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা। ডেভিডের মুখের উপর হাত বুলিয়ে নতুন রং নতুন আদল অনুভব করতে চাইল ডেবরা।

বুঝতে পারল মুখ সরিয়ে নিতে চাইছে ডেভিড। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে হাত বুলাতে লাগল ডেবরা।

‘আমার আঙুলগুলো বলছে যে তুমি এখনো অনেক সুন্দর–

‘মিথ্যে কথা বলছে তারা। ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। কিন্তু ডেভিডের কথাকে পাত্তাই দিল না ডেবরা। কোমর দিয়ে ধাক্কা মারলো তাকে।

 ‘দক্ষিণ দিক থেকে আরো শক্তিশালী মেসেজ ভেসে আসছে আমার দিকে।’ নিঃশব্দে হাসল ডেবরা।

‘আমার সাথে দয়া করে আসুন স্যার।

ডেভিডের হাত ধরে হালকা পায়ে সিঁড়ি বাইতে লাগল ডেবরা। হাত ধরে যেন টেনে নিয়ে যেতে লাগল ডেভিডকে। অবাক হয়ে ডেভিড দেখল মেয়েটার স্বাচ্ছন্দ আর আত্মবিশ্বাসীর ভাব। কুঁড়েঘরে নিয়ে গেল ডেবরা ডেভিডকে। ঢোকার সাথে সাথে রুম হয়ে গেল আলো আঁধারে অন্তরঙ্গতাপূর্ণ।

 লেক থেকে উঠে আসায় এখনো ভেজা আর ঠাণ্ডা ডেবরার শরীর। কিন্তু ডেভিডের স্পর্শে জেগে উঠতে সময় লাগল না। এমনভাবে মিলিত হলো দু’জনে যেন এতেই তাদের মুক্তি। এতদিনকার একাকিত্ব আর অন্ধকার কেটে গেল নিমেষের মাঝে।

শারীরিক ভালোবাসাও মনে হলো তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারল না। এমনি সময়েও একে অন্যের হাত ধরে রাখল দু’জনে। একসাথে গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘুমালো। ঘুমের মাঝেও মনে হলো সচেতন রইল যেন আবার আলাদা না হয়ে যায়। কথা বলে, হাত ধরে রেখে, মাঝে মাঝেই ডেভিডের মুখে হাত বুলিয়ে দেয় ডেবরা। সোনালি রঙা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ডেবরা। এমনকি খাবার তৈরি করার সময়েও ডেবরার কাছে বা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে ডেভিড। মনে হলো যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ভয়ে একে অন্যের কাছ থেকে কিছুতেই আলাদা হতে চাইল না তারা।

দুই দিন কেটে যাবার পর কটেজ থেকে বের হলো দু’জনে। লেকের পাড়ে একসাথে হেঁটে বেড়ালো, জেটি থেকে সাঁতার কাটলো, সূর্যের তাপে স্নান করল। কিন্তু ইলা ছাদ থেকে তাদেরকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লেও প্রতিক্রিয়া হলো ডেবরার। ডেভিড জানতে চাইল।

‘ওর কাছে যাবো আমরা?’

না।’ তাড়াতাড়ি উত্তর দিল ডেবরা। এখনো না। আমি এখনো কারো সাথে তোমাকে শেয়ার করতে প্রস্তুত নই। আর একটু সময়, প্লিজ ডেভিড।

এরপর কেটে গেল আরো তিনটি দিন। সিঁড়ি বেয়ে দু’জনে উঠে এলো ইলার স্টুডিওতে। গগ্যার ছবির সামনে বসে আছে ইলা। আর কোন অতিথি নেই দেখে খুশি হলো ডেভিড আর ডেবরা।

‘আমি আরো ভাবছিলাম তোমার জন্য স্ট্রেচার আনাতে হবে ডেভিড। কিচিরমিচির শব্দে ডেভিডকে অভ্যর্থনা জানাল ইলা।

‘এভাবে বলো না তো ইলা।’ জানিয়ে দিল ডেবরা। লজ্জা পেয়ে গোলাপি হয়ে গেল সে। হেসে উঠল ইলা। এমনভাবে যে অন্য দু’জনও যোগ দিতে বাধ্য হলো।

তালগাছের নিচে বসল সবাই। মাটির জগ থেকে ওয়াইন নিয়ে নিল সকলে। আর বিরতি ছাড়াই চলল খাওয়া। হাসি-গল্প। ডেভিড আর ডেবরা একে অন্যকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে ইলা’র মন্তব্যে কিছুই মনে করল না।

ডেবরার পরিবর্তন হলো একেবারে নাটকীয়। সমস্ত শীতলতা চলে গেছে কোথায় যেন। যে আবরণে ঢেকে রেখেছিল নিজের অনুভূতি সেটাও খসে পড়েছে। ভালোবাসার স্পর্শে আবারও প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে মেয়েটা।

 ডেভিডের একেবারে পাশ ঘেঁষে বসে আছে সে। হাসছে প্রাণ খুলে, একটু পরপরই ঝুঁকে যাচ্ছে ডেভিডের দিকে। মনে হলো যেন নিজেকেই নিশ্চিত করতে চাইছে ডেভিডের উপস্থিতি সম্পর্কে।

আবারো ডেভিডের দিকে তাকাল ইলা। চাইল স্বাভাবিকভাবে হাসতে। কিন্তু অপরাধীর মতো মনে এলো আরো নানা ভাব–বিতৃষ্ণা আর অনুতাপ দানবীয় মাথাটাকে দেখলেই এমন লাগছে তার। মনে হলো প্রতিদিন এভাবে যদি বিশ বছর ধরে ও এটা দেখতে থাকে, এখনকার মতোই লাগবে তার।

ডেভিডের কোন একটা কথায় আবারো হেসে উঠল ডেবরা। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ডেভিডের দিকে।

বিধ্বস্ত মাথা নিয়ে ডেভিডও ঝুঁকলো ডেবরার দিকে।

অসাধারণ সুন্দর একটি মুখের উপর এরকম ক্ষত-বিক্ষত মাংসাল মুখোশটা দেখে অবাক হলো ইলা।

ঠিক কাজটাই হয়েছে। একবারের জন্য হলেও সঠিক কাজটিই করেছি আমি। ওদের দুজনকে দেখতে দেখতে কেমন হিংসা বোধ করল ইলা। এই দু’জন দুজনের কাছে পুরোপুরি বাধা পড়ে গেছে। পারস্পরিক আচরণ দিয়ে হয়ে উঠেছে অবিচ্ছেদ্য।

মন খারাপ করে ইলা ভাবল স্মৃতির কোণে থাকা প্রেমিকদের লাইনের ছায়া। মনে হলো এরকম কোন বন্ধনে যদি সে নিজেও আবদ্ধ হতে পারতো। নাক টানলো ইলা। ডেভিড আর ডেবরা দুজনেই প্রশ্নবোধক ভাবে তাকাল তার দিকে।

‘বেদনার শব্দ, ইলা ডার্লিং!’ বলে উঠল ডেভরা। আমরা স্বার্থপরের মতো আচরণ করছি। প্লিজ কিছু মনে করো না।

‘কোনই বেদনা নেই, বাছারা আমার।’ ব্যাপারটাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল ইলা। হাত ঝেড়ে বিদায় করে দিল নিজের স্মৃতির বোঝ। আমি তোমাদেরকে নিয়ে খুশি। তোমাদের মাঝে বেশ চমকপ্রদ কিছু ব্যাপার আছে–সুন্দর, শক্তিশালী আর অসাধারণ। নিজের জীবনের মতোই একে আগলে রেখো।’

নিজের ওয়াইন গ্লাস তুলে নিল সে। আমি টোস্ট করছি। আমি তোমাদেরকে দিয়েছি ডেভিড আর ডেবরা। কষ্ট সহ্য করেই এ ভালোবাসা হয়ে উঠেছে দুর্ভেদ্য।

 সিরিয়াস ভঙ্গিতে টোস্ট করল সকলে। সোনালি হলুদ সূর্যালোকের নিচে বসে সোনালি হলুদ তরল পান করতে লাগল তিনজনে। আবারো অবশ্য অ্যাড ফিরে এলো। হাসিখুশি হয়ে উঠল তিনজনে।

অবশেষে শারীরিক চাহিদা মেটার পর আত্মিক দিকে এগিয়ে গেল দু’জনে। এর আগে এভাবে কখনো কথা বলেনি দু’জনে। এমনকি মালিক স্ট্রিটের বাসাতেও বাহূল্যমণ্ডিত সব শব্দ ব্যবহার করতো।

 এখন সত্যিকার অর্থেই কথা বলা শিখেছে তারা। কোন কোন রাতে একেবারেই ঘুমোতো না তারা। জেগে থেকে অন্ধকারের মাঝে আবিষ্কার করে চলল একে অন্যের শরীর আর চেতনাকে। আনন্দের সাথে আবিষ্কার করল যে এ অভিযান বোধহয় কখনো শেষ হবে না। দুজনের মানসিক গণ্ডি কোন সীমানা দ্বারা আবদ্ধ নয়।

দিনের বেলা অন্ধ মেয়েটা ডেভিডকে শেখাতে লাগল কেমন করে দেখতে হয়। ডেভিড বুঝতে পারল যে নিজের চোখ আসলে কখনো ব্যবহারই করেনি সে। এখন দু’জনের হয়ে দেখার কাজ করার জন্য চোখকে সর্বোচ্চ ভাবে ব্যবহার করা শিখে গেল সে। প্রতিটি রঙ, গড়ন আর চলন হতে হবে একেবারে নিখুঁত। কেননা ডেবরার দাবি অগ্রাহ্য করা যাবে না। সবকিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই তার।

অন্যদিকে ডেভিড, যার নিজের আত্মবিশ্বাসই প্রায় টলে উঠেছিল, মেয়েটাকে শেখাতে থাকল কেমন করে নিজের উপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হয়। ডেভিডের উপর বিশ্বাস বেড়ে যেতে লাগল ডেবরার আর ওর চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হলো ডেভিড। সাহস নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে ডেভিডের পাশে চলতে থাকল ডেবরা। জানে স্পর্শ বা ছোট্ট শব্দ দিয়ে তাকে পথ দেখাবে, সতর্ক করবে ডেভিড। ওর জীবন নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল কটেজ আর জেটি–এটুকুর মাঝে। এখন ডেভিড পাশে থাকায় আবারো বাইরের দুনিয়ায় আসার সাহস পেল মেয়েটা।

তারপরেও প্রথমে প্রথমে সাবধানে বের হতে লাগল দুজনে। একসাথে লেকের পাশে বেড়ানো বা পাহাড় বেয়ে নাজারেথের দিকে উঠে যাওয়া। প্রতিদিন সবুজ লেকের পানিতে সাঁতার কাটা আর মশারি ঘেরা বিছানায় আলিঙ্গন।

আবারো কৃশকায়, শক্তপোক্ত আর সান ট্যানড় হয়ে উঠল ডেভিড। মনে হলো তারা পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমন একদিন ইলা জানতে চাইল

‘ডেবরা, নতুন বইয়ের কাজ শুরু করবে কবে?’ হেসে হালকা স্বরে উত্তর দিল ডেবরা।

‘আগামী এক বছরের মাঝে যে কোন সময়ে।

 এক সপ্তাহ পর ডেভিডের কাছে জানতে চাইল, এখন তুমি কী করবে, ঠিক করেছে ডেভি?

‘ঠিক এখন যা করছি, তাই।’ উত্তর দিল ডেভিড। তাড়াতাড়ি ডেবরাও সায় দিল। সব সময়। ঠিক এভাবেই কাটবে চিরকাল।

এরপর এ সম্পর্কে কোন কিছু না ভেবেই, নিজেদেরকে এর জন্য প্রস্তুত না করেই গির্জা, যেখানে আরো অনেকের সাথে তাদের দেখা হবে যাবার প্রস্তুতি নিল তারা।

স্পিডবোট ধার নিল ডেভিড। ইলার কাছ থেকে নিল বাজারের ফর্দ। পরিকল্পনা করল লেক থেকে তিবেরিয়াসে যাবে।

 লিডোর ছোট্ট পোর্টে নোঙ্গর করল তারা। তারপর হেঁটে প্রবেশ করল শহরে। ডেবরার সাহচর্যে এতটাই উৎফুল্ল ছিল ডেভিড যে তার চারপাশে খানিকটা উৎসুক দৃষ্টির ভিড় দেখলেও গ্রাহ্য করল না।

সিজন এখনো ভালো ভাবে শুরু হয়নি। তারপরেও শহর ভরে গেছে ভ্রমণার্থীতে। পাহাড়ের পায়ের কাছে স্কয়ারে পার্ক করে রাখা আছে অনেক বাস। লেকের সামনেও বাস আছে। তাই বোঝা গেল এ রাস্তা ভর্তি হয়ে আছে ভ্রমণার্থিতে।

হাতে প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে কেনাকাটা শুরু করল ডেভিড। একটু পরেই দেখা গেল ভারী হয়ে উঠেছে ব্যাগটা। এরপর তো উপচে ওঠার জোগাড় প্রায়।

 ‘রুটি আর হয়েছে। অনেক কিছু হয়ে গেছে। আর লাগবে না। নিজের মনেই ফর্দতে টিক চিহ্ন দিচ্ছে ডেবরা।

ইউকালিপটাস গাছের নিচ দিয়ে পাহাড়ের নিচে গেল দুজনে। পোতাশ্রয় দেয়ালের দিকে রঙিন ছাতার নিচে বসল একটা টেবিলে।

এমন ভাবে বসল যেন একে অন্যকে স্পর্শ করে রাখা যায়। পেশতা বাদাম খেতে খেতে ঠাণ্ডা বীয়ার পান করতে লাগল। সবকিছু সম্পর্কে কেমন উদাসীন মনে হলো তাদের। যদিও চারপাশের টেবিল ভরে আছে টুরিস্টে। চকচক করছে লেকের পানি। নরম আর গোলাকৃতি পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে একেবারে কাছে। একবার উপত্যকার ওপাশে নামল একটা ফ্যান্টম প্লেন। খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেল রহস্যজনকভাবে। এরপর কোন কিছু ছাড়াই আবার চলে গেল দক্ষিণে।

সূর্য নিচে নেমে এলে নোঙ্গড়ে বাঁধা স্পিডবোটের কাছে গেল দুজনে। হাত ধরে ডেবরাকে নামতে সাহায্য করল ডেভিড। তাদের উপরের দেয়ালে বসেছিল একদল টুরিস্ট। হতে পারে প্যাকেজের আওতায় তীর্থে এসেছে।

 মোটর স্টার্ট দিয়ে দেয়াল থেকে সরে আসতে লাগল ডেভিড বোট নিয়ে। ষ্টিয়ারিং ধরে পোতাশ্রয়ের মুখে নিয়ে যাচ্ছে স্পিডবোট। পাশে বসে আছে ডেবরা। নরম স্বরে শব্দ করতে লাগল বোট।

বড়সড় লালমুখো একটা টুরিস্ট তাকাল দেয়ালের উপর থেকে নিচে। মনে করল মোটরের গুঞ্জনে চাপা পড়ে যাবে তার গলার স্বর। এমন ভাবে বলে উঠল স্ত্রীকে।

‘দু’জনের দিকে তাকিয়ে দেখো মেবিস। বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, তাই না?

 ‘বাদ দাও বার্ট। তারা হয়তো বুঝতে পারবে।’

‘আরে ধূর! ওরা শুধুমাত্র হিব্রু বোঝে।

ডেবরা অনুভব করল তার হাতের নিচে শক্ত হয়ে গেল ডেভিডের হাত। বুঝতে পারল ঝটকা মেরে ছাড়া পেতে চাইছে ডেভিড। বুঝতে পারল রেগে উঠছে। কিন্তু শক্ত করে হাত ধরে শান্ত করতে চাইল ডেবরা।

‘চলো ডেভি, ওদের কথা ছাড়ো ডার্লিং, প্লিজ।

এমনকি কটেজের নিরাপত্তায় একা হবার পরেও চুপচাপই রইলো ডেভিড। শরীরে টেনশনের আভাস পেল ডেবরা। বাতাসও ভারী হয়ে আছে এতে।

একই ভাবে চুপচাপ নিঃশব্দে চিজ, রুটি, মাছ আর ফিগ দিয়ে রাতের খাবার শেষ করল দু’জনে। কী বলে ডেভিডের মন ভালো করে দেবে বুঝতে পারল না ডেবরা। কেননা শব্দগুলো তাকেও সমান ভাবে আঘাত করেছে। এরপর শুয়ে পড়ল তারা। দু’জনেই জানে জেগে আছে তারা। ডেবরাকে না ছুঁয়ে দুই হাত পাশে রেখে শুয়ে পড়ল ডেভিড। আর সহ্য করতে পারছে না ডেবরা। পাশ ফিরে ডেভিডের মুখে হাত বুলাতে লাগল। এখনো জানে না কী বলবে। কিন্তু নীরবতা ভাঙলো প্রথমে ডেভিড।

‘আমি মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই–আমাদের কাউকে দরকার নেই, তাই না?

না। ফিসফিস করল সে। আমাদের কাউকে দরকার নেই।’

জাবুলানি নামে একটা জায়গা আছে। আফ্রিকান জঙ্গলের মাঝে, কাছের শহরটাও বেশ দূরে। ত্রিশ বছর আগে আমার বাবা এটা কিনেছিল হান্টিং লজ হিসেবে। এখন এটা আমার…।’

‘বলো এ সম্পর্কে। ডেভিডের বুকের উপর মাথা রাখল ডেবরা। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কথা বলতে লাগল ডেভিড। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে এখন।

অনেক বড় একটা সমভূমি অঞ্চল আছে। যেখানে খোলা জায়গায় জঙ্গলের মতো জন্মে থাকে মোপানি, মোহোবাহোবা, মোটাসোটা বাবারস আর কয়েকটা আইভরি তাল। এছাড়াও আছে হলুদ রঙের ঘাস। সমভূমির শেষে পাহাড়ের সারি। দূর থেকে দেখতে মনে হয় নীলের সারি। পাহাড়ের মাথাগুলো দেখে মনে হবে রূপকথার কোন প্রাসাদের গ্রানাইটের চূড়া। পাহাড়ের মাঝে আছে ঝরনা; যার জল কখনো শুকায় না; আর পানিও বেশ পরিষ্কার আর মিষ্টি

‘জাবুলানি কথাটার অর্থ কী? জানতে চাইল ডেবরা।

এর মানে আনন্দের জায়গা। জানাল ডেভিড।

‘আমি যেতে চাই ওখানে তোমার সাথে।

‘আর ইস্রায়েল? তুমি মিস করবে না?’ ডেবরার উত্তরে প্রশ্ন করল ডেভিড।

না। মাথা নাড়ল ডেবরা। দেখো আমার সাথেই যাবে এটি, আমার হৃদয়ে থাকবে।’

তাদের সাথে জেরুজালেমে গেল ইলা। গাড়ির পেছনের সিটের পুরোটা জায়গাই দখল করল সে। বাসা থেকে কোন কোন ফার্নিচার নেয়া হবে সে ব্যাপারে মনস্থির করতে ডেবরাকে সাহায্য করবে ইলা। পরে সেগুলো বেঁধে জাহাজে তুলে দেয়া হবে। বাকি আসবাবপত্র ওদের হয়ে বিক্রি করে দেবে ইলা। অ্যারন কোহেন বাড়ি বিক্রির তদবির করবে। ডেভিড আর ডেবরা দু’জনেরই মন খারাপ হয়ে গেল এটা ভেবে যে তাদের ঘরে থাকবে অন্য কেউ।

বাড়িতে মহিলাদের রেখে মার্সিজিড নিয়ে ইন কারেমে গেল ডেভিড। বাগানের পাশের দেয়ালের কাছে পার্ক করে রাখল গাড়ি।

আঙ্গিনার কাছের ঘরটাতে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল ব্রিগ। দরজার কাছে ডেভিডের সম্ভাষণের উত্তরেও ঠাণ্ডা ভাবে তাকিয়ে রইল ব্রিগ। লৌহকঠিন অবয়বের মাঝে কোন সহজ ভাব নেই। নিষ্ঠুর যোদ্ধার চোখগুলোতে নেই কোন আন্তরিকতার চিহ্ন।

 ‘আমার ছেলের রক্ত হাতে নিয়ে এখানে এসেছো তুমি। বরফের মতো জমে গেল ডেভিড ব্রিগের চাহনি দেখে আর কথা শুনে। কিছুক্ষণ পরে দেয়ালের সাথে লাগানো উঁচু পিঠওয়ালা চেয়ার ইঙ্গিত করে দেখাল ব্রিগ। আড়ষ্ট পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসল ডেভিড।

 ‘যদি তুমি আরেকটু কম ভুগতে তাহলে আমি হয়তো আরো একটু বলার সুযোগ পেতাম। জানাল ব্রিগ। কিন্তু তুমি বুঝতেই পারছো যে প্রতিশোধ আর ঘৃণা কোন কাজের কথা নয়।’

মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে রাখল ডেভিড।

‘আমার হৃদয় বলা সত্ত্বেও হয়তো তোমার জায়গায় আমি হলে ওদের পিছু নিতাম না। এ কারণেই তোমাকে দোষারোপ করছি আমি। তোমার মাথা গরম। ভায়োলেন্স হলো বোকাদের আনন্দ আর বুদ্ধিমানদের শেষ ভরসা। এটি করার একমাত্র কারণ হলো যা তোমাকে তা রক্ষা করা–ভায়োলেন্সের অন্য কোন ব্যবহার কখনোই কাম্য নয়। তোমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছি আমি, তার অপব্যবহার করেছো তুমি। আর এর মাধ্যমে আমার ছেলেকে খুন করেছ, আমার দেশকে যুদ্ধের দোড়গোড়ার দাঁড় করিয়ে দিয়েছ।

নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়াল ব্রিগ। হেঁটে গিয়ে জানালার নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল বাগানের দিকে। দু’জনেই চুপ করে রইল। মোচের উপর হাত বুলাতে বুলাতে ছেলের কথা ভাবতে লাগল ব্রিগ।

অবশেষে ভারী হৃদয়ে কাঁধ নাড়িয়ে রুমের মাঝখানে আবারো ফিরে এলো।

‘কেন আমার কাছে এসেছে তুমি? ডেভিডের কাছে জানতে চাইল ব্রিগ।

 ‘আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই– স্যার।

‘আমাকে জিজ্ঞেস করছো নাকি জানাচ্ছো? আবারো প্রশ্ন করল ব্রিগ। এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই ডেস্কের কাছে গিয়ে বসে পড়ল, যদি তুমি এই ক্ষমতার অপব্যবহার করো–ওকে ব্যথা দাও বা অসুখী রাখো, মনে রেখো আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।’

উঠে দাঁড়িয়ে মাথার উপর কাপড়ের টুপিটা ঠিক ঠিক বসিয়ে নিল ডেভিড।

‘আমরা চাই আপনি বিয়েতে আসুন। ডেবরা বিশেষ ভাবে এটা চেয়েছে– আপনি আর ওর মা।

মাথা নাড়ল ব্রিগ। ওকে জানিয়ে আমরা আসব।

.

জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থনার স্থানটি উজ্জ্বল সাদা রঙে নির্মিত।

লাল পাপড়ির গাছটা ছেয়ে গেছে ফুলে। আর যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও বড় হয়ে গেছে বিয়ের পার্টি। পরিবারের একদম কাছের মানুষ ছাড়াও এসেছে ডেবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী, স্কোয়াড্রন থেকে রবার্ট আর আরো জনা কয়েক ছেলে, ইলা কাঁদেশ, ডাক্তার ইদেলমান আর শিশুসুলভ চেহারার চোখের সার্জন, যিনি ডেবরাকে নিয়ে কাজ করেছেন, অ্যারন কোহেন আর আরো ডজনখানেক ব্যক্তি।

সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনা পেরিয়ে ডেভিডের ভাড়া করে রাখা অভ্যর্থনাকক্ষে পৌঁছায় সকলে। সবাই বেশ চুপচাপ। কোন হাসি তামাশা নেইই প্রায়। ডেভিডের পুরোন স্কোয়াড্রনের তরুণ পাইলটেরা তাড়াহুড়া করে ফিরে গেল বেসে। আর তাদের সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল আনন্দের অভিনয়।

ডেবরার মা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আর ডেবরার আসন্ন প্রস্থানের কথা ভেবেও কাঁদতে লাগল মহিলা। শান্ত করার চেষ্টা করলো ডেবরা। যদিও কোন লাভ হলো না।

চলে যাবার আগে ডেভিডকে ডেকে একপাশে নিয়ে গেল ডাক্তার ইফেলমান।

‘ওর চোখের দিকে খেয়াল রেখো, কোন ঝাপসা ভাব, অতিরিক্ত লাল ভাব–কোন ধরনের ব্যথা, মাথাব্যথা–

‘আমি খেয়াল রাখবো।

করমর্দন করল দু’জনে। নতুন জীবনের জন্যে শুভ কামনা রইল। জানাল ডাক্তার।

এ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখল ডেবরা। কিন্তু একেবারে শেষমুহূর্তে আর পারল না। সে, তার মা আর ইলা কাঁদেশ হঠাৎ করেই লড বিমানবন্দরের বহির্গমন ফটকের কাছে এসে একে অন্যের কাঁধে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

শক্ত আর অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল ব্রিগ আর ডেভিড। মনে হলো ক্রন্দনরত কাউকে তারা চেনেই না। প্রথমবার সাবধানবাণী ভেসে আসতেই সংক্ষিপ্ত করমর্দন সেরে আস্তে করে ডেবরার হাত ধরে ঢুকে গেল ডেভিড, দরজার ভেতরে।

অপেক্ষারত বোয়িংয়ের সিঁড়িতে উঠে গেল একবারও পেছন দিকে না তাকিয়ে। বিশাল উড়োজাহাজ উড়ে গেল আকাশে। ঘুরে গেল দক্ষিণ দিকে। আর মনে হলো হারানো কিছু একটা খুঁজে পেল ডেভিড; শেষ ক’দিনের উদ্বেগ পড়ে রইল বহু নিচে, মাটির কাছাকাছি। নতুন কিছুর সম্ভাবনায় আচ্ছন্ন করে তুলল তাকে।

আস্তে করে চাপ দিল ডেবরার হাতে।

হ্যালো দেয়ার, মরগান। ডেভিডের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি মুখে হাসল অন্ধ মেয়েটা।

.

উত্তরে জাবুলানিতে যাবার আগে কেপ টাউনে সময় কাটানোর প্রয়োজন হলো।

মাউন্ট নেলসন হোটেলে স্যুইট নিল ডেভিড। আর এখানে বসেই অনুপস্থিতির জন্য জমে যাওয়া হাজারো কাজ শেষ করতে উদ্যত হলো ডেভিড।

তার ট্রাস্ট ফান্ডের দায়িত্বে থাকা অ্যাকাউন্ট্যান্ট দশ দিন সময় চাইল। এই দশ দিন সিটিং রুমে বসে কাগজপত্রের উপর কাজ করেই সময় কাটালো।

এই দুই বছরে ব্যয়ের তুলনায় আয়ের পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। আর এই অর্থ পুনরায় কোথাও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তৃতীয় ট্রাস্ট ফান্ড ও শীঘি বুঝিয়ে দেয়া হবে তাকে। সেসব আনুষ্ঠানিকতাও বাকি আছে।

ডেভিডের সম্পদের পাহাড় দেখে হতম্ভব হয়ে গেল ডেবরা।

 ‘তুমি তো প্রায় একজন মিলিয়নিয়ারই হয়ে গেছ।’ বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল ডেবরা।

 ‘হুম, আমি তো আর যেমন তেমন নই।’ একমত হলো ডেভিড। নিজের সম্পর্কে ওর রসিকতা শুনে স্বস্তি পেল ডেবরা।

মিটজি এলো তার নতুন স্বামীকে নিয়ে। যাই হোক ভাল কাটলো না সন্ধ্যাটা! মিটজি চেষ্টা করল এমন ভাব করতে যেন কিছুই বদলায়নি। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা গেল যে “ওয়ারিওর ডেকে চললেও তার মনোভাবের পরিবর্তন। হয়েছে।

সন্তানসম্ভবা মিটজি এতটাই বেসাইজ হয়ে গেছে শারীরিক ভাবে যে। অবাক হয়ে গেল ডেভিড। প্রায় অর্ধেক সময় কেটে যাবার পর প্রকৃত কারণ উপলব্ধি করল ডেভিড।

 প্রথম দিকে সে ভেবেছিল যে তার শারীরিক পরিবর্তন আড়ষ্ট করে রেখেছে মিটজিকে। কিন্তু একটু পরেই ব্যাপরটা খোলাসা করে দিল মিটজি। সিসিল মরগ্যান গ্রুপে ইতিমধ্যেই পল মরগ্যানের হাত ধরে কেউকেটা টাইপের কেউ একজন হয়ে উঠেছে। কিছুই জানে না এমন ভঙ্গিতে সিসিল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী গ্রুপে যোগ দেবার ব্যাপারে কিছু ভাবছো? আমি নিশ্চিত তুমি করার মতোও কিছু না কিছু নিশ্চয় পাওয়া যাবে হা, হা!”

আস্তে করে তাদেরকে নিশ্চয়তা দিল ডেভিড।

‘না, ধন্যবাদ। আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই সিসিল। আংকেল পল থেকে সব বুঝে নিতে পারো তুমি। আমার আশীর্বাদসহ।

‘গুড লর্ড, আমি এটা বলতেই চাইনি।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল সিসিল। কিন্তু বোকা মিটজি বলে উঠল, ‘ও সত্যিই বেশ ভালো করবে, ওয়ারিওর আর তোমার তো কখনোই এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না, তাই না।’

এই সন্ধ্যার পর এ সম্পত্তির সাথে আর দেখা হয়নি তাদের। আর পল মরগ্যান নিজে আছেন ইউরোপে। তাই বেশি যন্ত্রণা ছাড়াই পারিবারিক কাজ শেষ করল ডেভিড। জাবুলানি যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করল সে।

বার্নি ভেন্টার এক সপ্তাহ তাদের সাথে কাটিয়ে জঙ্গলে এয়ারস্ট্রিপ ঠিক করে দিল এয়ার ক্রাফটের জন্য। এছাড়াও মনমত পারফরমেন্স দিল ডেভিডকে। অবশেষে জোড়া ইঞ্জিন বিশিষ্ট পাইপারি নাঙাজো পছন্দ করল তারা। ছয় আসন বিশিষ্ট বিমানটাতে আছে দুটো বড় বড় ৩০০ এইচ পি. লিকোমিং ইঞ্জিন আর ট্রাইসাইকেল আন্ডারকার্ট। কোমরে হাত রেখে চারপাশে থেকে জরিপ করল বার্নি।

যাক, সে মিরেজ নয়। ল্যান্ডিং হুইলে লাথি মেরে নিজের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি আবার ডেভিডের দিকে তাকাল বার্নি।

‘আমি মিরেজ নিয়ে যথেষ্ট খেলা করেছি।’ জানিয়ে দিল ডেভিড। ওরা কামড় দেয়!

 শেষ দিনে পার্লের কাছে একটা ফার্মে গাড়ি চালিয়ে ডেবরাকে নিয়ে গেল ডেভিড। কুকুরের বাচ্চা প্রসব করায় মালিকের স্ত্রী। কুকুরের ঘরগুলোর কাছে যেতেই একটা ল্যাব্রাডর কুকুরছানা সরাসরি এগিয়ে এলো ডেবরার কাছে। ডেবরার পায়ে ঠাণ্ডা নাক ঘসে গন্ধ শুঁকতে লাগল। মাথায় হাত বুলাতে চাইল ডেবরা। কয়েক মিনিট পর সামনে ঝুঁকে কুকুরছানার লোমের গন্ধ নিল।

 ‘পুরোন চামড়ার গন্ধ আসছে ওর গা থেকে। বলে উঠল ডেবরা। কেমন গায়ের রঙ ওর?

কালো। জানাল ডেভিড। জুলুদের মতো কালো।

 ‘এই নামেই ওকে ডাকবো আমরা।’ জানিয়ে দিল ডেবরা।

 ‘জুলু।

তুমি ওকে পছন্দ করতে চাও?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

না।’ হেসে ফেলল ডেবরা। ও আমাদেরকে পছন্দ করেছে।’

পরদিন সকালে উত্তর দিকে উড়ে যাবার সময় পেছনের সিটে বসে মনে হলো মন খারাপ করল জুলু। এক লাফ দিয়ে উঠে এলো ডেবরার কাঁধের উপর দিয়ে কোলে। এবার মনে হলো দু’জনের ভালই জমবে।

‘মনে হচ্ছে আমাকে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। করুণ সুরে জানাল ডেভিড।

 বাদামী মালভূমি পার হয়ে মাটি ধপ করে খাড়া নেমে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে।

বুশ বাক রিজ আর চিকন সাপের মতো আঁকাবাঁকা সারি নদী দেখে পথ চিনে নিল ডেভিড। সমভূমি মাঝ দিয়ে পথ এগিয়েছে। খানিকটা উত্তরে কোর্স পরিবর্তন করল ডেভিড। দশ মিনিটের মাথায় দেখতে পেল নীল পাহাড়ের সারি।

‘এই তো আমাদের সামনেই। ডেবরাকে জানাল ডেভিড। বোঝা গেল তার উত্তেজনা প্রশমিত হলো ডেবরার মাঝেও। কুকুরটাকে নিজের কাছে চেপে ধরে ডেভিডের দিকে ঝুঁকে এলো।

কেমন লাগছে দেখতে?

 বড় বড় কাঠের গাছ সারা পাহাড় জুড়ে। আর নিচে ধূসর পাথরের গম্বুজ। সেখানে ঘন আর অন্ধকার ঝোঁপঝাড়। আঁধারের মাঝে নরম আলো ছড়াচ্ছে পুল। ডেবরার কাছে বর্ণনা দিল ডেভিড।

‘আমার বাবা এদের নাম রেখেছিল “মুক্তোর মালা…।” এরকমই দেখতে তারা। পাহাড়ের পেছনে গড়নে জমি বেয়ে বৃষ্টির জল যাবার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এগুলো। আবার ঠিক হঠাৎ করে সমভূমির বালুর অংশে হারিয়ে গেছে। পাহাড়ের উপর দিয়ে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নিচে নামতে লাগল ডেভিড। এর মাধ্যমেই জাবুলানির চরিত্রে বিশেষজ্ঞ যোগ হয়েছে। সমভূমির সমস্ত বন্য প্রাণীরা পানি পায় এখান থেকে। পশুপাখিরা শত মাইল পার হয়েও মুক্তোর তীরে আসে। প্লেন সমান করে থ্রটল পেছন দিকে টেনে দিল ডেভিড। নিচে নেমে আসতে লাগল এয়ারক্রাফট। এখানে আছে খড়ের চাল, সাদা দেয়াল। ফলে আবাসভূমি গরমকালে ঠাণ্ডা থাকে; ছায়া ঢাকা বারান্দা আর উঁচু উঁচু রুম-তোমার ভালো লাগবে।’

এয়ারস্ট্রিপ দেখে মনে হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর নিরাপদ। তার পরেও খানিকক্ষণ চক্রাকারে ঘুরে ল্যান্ডিংয়ে কাজ শুরু করল ডেভিড। গাছের ফাঁকে থাকা ছোট্ট পাকা ইমারতের তৈরি হ্যাঙ্গারে ট্যাক্সিইং করে গেল। হুইল ব্রেকে লাথি কষিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল।

চলে এসেছি।’ ঘোষণা করল সে।

.

ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ককে ব্লক করে রেখেছে যে কয়টি এষ্টেট, তার একটি হলো জাবুলানি। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক অঞ্চল। এই এস্টেটগুলো উৎপাদনক্ষম নয়। শস্য ফলানোর উপযুক্ত নয়, কয়েকটিতে তো শুধু বন্য প্রাণী চড়ে বেড়ায়। কিন্তু অমূল্য হচ্ছে এর প্রাণিজগত আর বনভূমি এতটাই খালি জায়গা আর শান্তি এখানে যে ধনী ব্যক্তিরা কার্পণ্য করেনি।  এখানে নিজেদের জন্য ভূমি ক্রয় করতে।

ডেভিডের পিতামহ যখন জাবুলানি ক্রয় করেছিল তখন প্রতি একরের জন্য মাত্র কয়েক শিলিং খরচ করতে হয়েছিল।

এরপর থেকে বছরের পর বছর ধরে পারিবারিক শিকার এস্টেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এটি। পল মরগ্যানের এসব ব্যাপারে কোন আগ্রহ না থাকায় উত্তরাধিকার সূত্রে ডেভিডের বাবা তারপর এখন ডেভিড হয়েছে এ ভূমির মালিক। আর এখন এই আঠারো হাজার একর আফ্রিকান বনভূমির মূল্য ছাড়িয়ে গেছে কল্পনার সীমা।

তারপরেও গত পনের বছরে মরগ্যান পরিবার এটি তেমনভাবে ব্যবহার করেনি। ডেভিডের বাবা উৎসাহী আর আগ্রহী প্রকৃতির শিকারি ছিল। তার সাথেই এখানে কেটেছে ডেভিডের বেশির ভাগ ছুটি। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর জাবুলানি আসা ধীরে ধীরে কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

শেষবার আসার পরেও প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। সেবার কোবরা স্কোয়াড্রন থেকে তার সঙ্গী অফিসাররা এসেছিল এখানে।

 তখনকার সময়ে এ জায়গার সর্বময়কর্তা ছিল স্যাম। কৃষ্ণ ওভারসিয়ার, বাটলার আর গেম রেঞ্জার।

স্যামের তদারকিতে সবসময় বিছানায় থাকতো পরিষ্কার নিজ পরিপাটি লিনেন, পালিশ করা মেঝে। দালানের বাইরের দেয়াল ছিল তুষারশুভ্র খড়ের চাল ও পরিচ্ছন্ন আর গোছানো। ডিপ ফ্রিজে সবসময় ভর্তি থাকতো স্টেক আর লিকার পূর্ণ থাকতে যত রকমের সম্ভব সব রকমের বোতল দিয়ে।

শক্ত হাতে ক্যাম্প চালাতো স্যাম। সাথে ছিল অর্ধডজন আগ্রহী আর প্রাণচঞ্চল সাহায্যকারী।

‘স্যাম কোথায়? ঘর থেকে হুড়োহুড়ি করে এয়ারক্রাফটের দিকে দৌড়ে আসা দু’জন ভূতত্যর কাছে এই ছিল ডেভিডের প্রথম প্রশ্ন।

 ‘স্যাম চলে গেছে।

‘কোথায়? উত্তরে দুর্বোধ্য আফ্রিকান কাঁধ ঝাঁকানি ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। লোকগুলোর পরণের কাপড় নোংরা আর সেলাইও প্রয়োজন। আচরণও কেমন কেমন, নিরুত্তাপ।

‘ল্যান্ড রোভার কোথায়?

 ‘মারা গেছে।

ঘরের কাছে হেঁটে গেল ডেভিড। সেখানে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার জন্য।

দালান দেখে মনে হলো এখনি ভেঙ্গে পড়ে যাবে। কালো খড় দেখে ফুটে উঠলো হতদরিদ্র দশা। দেয়ালগুলোতে শ্যাওলা। জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়ায় ধূসর বাদামী দাগ। ভেতরে সর্বত্র ধুলা। এখানে-ওখানে পাখি আর সরীসৃপের মল। ছাদে বাসা বেধেছে এগুলো।

 মশার জালে–যার মাধ্যমে চওড়া বারান্দায় কোন পোকা–মাকড় ঢুকতে পারতো না–মরিচা পড়েছে। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে।

সবজি বাগানেও কোন ফসল নেই। পাশের বেড়া টুকরো টুকরো অবস্থায় ভেঙে পড়ে আছে। বাসার চারপাশেও বড় বড় আগাছা। শুধুমাত্র ল্যান্ড রোভারই নয় পুরো বাড়ির কোন যন্ত্রাংশই ঠিক ভাবে কাজ করছে না। পানির পাম্প, টয়লেট ফ্লাশ, বৈদ্যুতিক জেনারেটর, মোটর ভেহিকেল–কিছুই ঠিক নেই।

‘ভয়াবহ অবস্থা হয়ে আছে সবকিছুর সামনের সিঁড়িতে বসে মগ থেকে মিষ্টি চা খেতে খেতে ডেবরাকে জানাল ডেভিড। ভাগ্যিস নিজেদের সাথে জরুরি কিছু রসদ নিয়ে এসেছিল ডেভিড।

“ওহ, ডেভি। আমি দুঃখিত। আমিই তো আসতে চেয়েছি এই জায়গায়। চারপাশ এত চুপচাপ যে বেশ শান্তি এখানে। আমার মনে হচ্ছে আমার নার্ভগুলো নির্ভার হয়ে গেছে এখানে এসে।

 ‘দুঃখিত হয়ো না। আমি তো তা নই। বিশেষ দশকের দিকে এই পুরোন কুঁড়েঘরগুলো বানানো হয়েছিল–তখনো সেভাবে যত্ন নিয়ে বানানো হয়নি। গলার স্বরে বোঝা গেল নতুন প্রেরণা খুঁজে পেয়েছে ডেভিড। অনেক দিন যাবৎ ওর কণ্ঠে একটা দৃঢ়তা ভাব আর টের পায়নি ডেবরা। ভালোই হলো এতে। পুরোটা ভেঙে নতুন করে বানানোর অযুহাত পাওয়া গেল।

 ‘আমাদের নিজেদের মতো করে? জানতে চাইল ডেবরা।

 ‘ঠিক তাই। আনন্দ ঝরে পড়লো ডেভিডের কণ্ঠে। তাই হবে। ঠিক তাই।’

পরের দিন কাছাকাছি সবচেয়ে বড় শহর নেলস্ট উড়ে গেল তারা। এর পরের সপ্তাহ পরিকল্পনা আর জোগাড় যন্তর নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ভাবে কেটে গেল যে, তারা তাদের সব বড় বড় সমস্যার কথা ভুলেই গেল। একজন স্থাপত্যবিদের সহায়তায় অনেক যত্ন নিয়ে নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনগুলোর কথা মাথায় রেখে নতুন বাসার নকশা ঠিক হলো-বাতাস চলাচল করে এরকম বড় সড় একটা স্টাডি ডেবরার জন্যে। ডেভিডের জন্য ওয়ার্কশপ আর অফিস। একজন অন্ধ রাধুনির জন্য সহজ ভাবে চলাচল যোগ্য নিরাপদ রান্নাঘর। রুম গুলোতে কোন বিপজ্জনক মোড় রইল না। সহজেই চেনা যায় এমন আকার আর সবশেষে একটা নার্সারি সেকশন। এ অংশের কথা ডেবরাকে জানাবার পর ডেভিডকে সে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন একটা প্ল্যান করছে, যা আমাকে জানাওনি।

‘ধীরে ধীরে জেনে যাবে। ঠিক আছে? নিশ্চয়তা দিল ডেভিড।

গেস্ট হাউজ করা হলো আলাদা আর স্বয়ংসম্পূর্ণ। মূল বাসা থেকে দূরে রইল এটি। এর থেকেও প্রায় কোয়ার্টার মাইল পেছনে তৈরি করা হলো ভূত্যদের থাকার কোয়ার্টার। সামনে গাছের পর্দা আর পাথুরে ভূমি।

নেলস্প্রুটে একজন বিল্ডিং কন্ট্রাকটরকে ঘুষ দিল ডেভিড। ফলে সব কাজ ফেলে রেখে চারটা ভারী ট্রাকে করে নিজের লোকদের নিয়ে জাবুলানিতে এসে হাজির হলো কন্ট্রাকটর।

মূল ঘর নিয়ে কাজ শুরু করল তারা। এই ফাঁকে ডেভিড ব্যস্ত হয়ে পড়ল এয়ারস্ট্রিপ নিয়ে। এছাড়াও খানিকটা বেঁচে বর্তে আছে এমন যন্ত্র আর ওয়াটার পাম্পও ঠিক করে ফেলল। কিন্তু ল্যান্ড রোভার আর বৈদ্যুতিক জেনারেটর পুরো বদলে ফেলতে হলো।

দু’মাসের মাঝেই বসবাসযোগ্য হয়ে গেল নতুন ঘর। সামনে বাগানের দিকে মুখ করে থাকা বিশাল জানালার নিচে নিজের টেপ রেকর্ডার বসালো ডেবরা। সন্ধ্যার বাতাস এসে শীতল করে তোলে রুম। ভরে ওঠে ফ্রাঞ্জিপানি আর পইনসেটিয়ার সুভাসে।

 জাবুলানিকে আরামদায়ক করে তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডেভিড। এ সুযোগে নিজের কাজ গুছিয়ে নিল ডেবরা।

খুব দ্রুত চারপাশ সম্পর্কে সব জেনে নিল সে স্পর্শ আর অনুভূতির মাধ্যমে। মনের মধ্যে গেঁথে নিল পুরো জায়গার ছবি। সপ্তাহখানেকের মাঝেই স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের মতো হাঁটাচলা করায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। এছাড়া ভৃত্যদেরকেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হলো যেন সেখানকার জিনিস সেখানেই রাখা থাকে। আর এই সব কাজে জুলু ল্যাব্রাডর কুকুরছানা চকচকে কালো ছায়া হিসেবে ঘুরতে লাগলরা ওর পিছুপিছু। অচিরেই বুঝে গেল যে ডেবরার প্রতি ওর সর্বক্ষণ নজর রাখা প্রয়োজন। তেমনি ভাবে ডেবরাই হয়ে উঠল তার প্রাণশক্তি।

শীঘ্রিই বুঝে গেল যে ডেবরার দিকে তাকিয়ে থাকা বা লেজ নাড়ানো অনর্থক। ডেবরার মনোযোগ পাবার জন্য ওকে কুই কুই আওয়াজ করতে হবে বা হাঁপানোর শব্দ করতে হবে। অন্যদিকে ভুলো মনা ডেবরা। কিছু বোকামি যেমন সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া বা হাঁটার রাস্তার কোন বেকুব ভৃত্যের রেখে যাওয়া বালতিতে যে পা বেঁধে পড়ে না যায় ডেবরা তাই কাঁধ দিয়ে গুতো দেয়া বা নাক ঘষার মতো কাজগুলো করতে হয় জুলুকে।

এরই মাঝে প্রতিদিন দুপুর পর্যন্ত নিজের রুমে বসে কাজ করার অভ্যেস তৈরি গেল ডেবরার। পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতো জুলু।

 ডেবরার রুমের বাইরের জানালার নিচে পাখির বড়সড় একটা গোসলের জায়গা ঠিক করে দিল ডেভিড। ফলে যে টেপ তৈরি করল তার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে শোনাতে অসংখ্য বন্য পাখির কিচিরমিচির। নেলঙ্কটে একটা টাইপিস্ট আবিষ্কার করে ফেলল ডেবরা, যে কিনা হিব্রু বলতে পারে। যতবার রসদ আনতে শহরে যেত সাথে করে ডেবরার রেকর্ড করা টেপ নিয়ে যেত ডেভিড। নিজের চিঠিপত্রের সাথে প্রতিবার আসার সময় টাইপ করা কাগজ নিয়ে আসতো ডেবরাকে পড়ে শোনানোর জন্যে।

এই কাজে একত্রে কাজ করতো তারা। জোরে জোরে প্রতিটি শব্দ ডেবরাকে পড়ে শোনাতো ডেভিড। ডেবরার কথা মতো ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিত। এভাবে দেখা গেল সবকিছু চিৎকার করে পড়ার অভ্যেস হয়ে গেল ডেভিডের। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে উপন্যাস, সবকিছুই চেঁচিয়ে পড়তে লাগল ডেভিড।

‘তুমি আশেপাশে থাকলে ব্রেইলির কী দরকার।’ মন্তব্য করে উঠল ডেবরা। কিন্তু শুধুমাত্র যে লিখিত শব্দই শুনতে চাইতো ডেবরা, তা নয়। চারপাশ সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ডেভিডকে বলতে হতো ওর কাছে। তার জানালার নিচে পানি খেতে, গোসল করতে আসা, একটা পাখিও কখনো দেখেনি ডেবরা। কিন্তু অচিরেই প্রতিটির আওয়াজ পরিচিত হয়ে গেল তার কাছে। নতুন কোন পাখি এলে চট করে বুঝে ফেলতে।

‘ডেভিড, নতুন একটি পাখি এসেছে। কেমন দেখতে, নাম কী?

আর শুধু পাখা নয়, প্রতিটি খুঁটি-নাটি জিনিস বর্ণনা করতে হলো ডেভিডকে। এছাড়াও তাদের নতুন বিল্ডিং দেখতে কেমন হয়েছে, জুলুর কথা, ভৃত্যদের সুস্পষ্ট চলন বলন, জানালা দিয়ে দেখা বাইরের দৃশ্য সবকিছু মিলিয়ে নতুন জীবনের শত শত প্রশ্নের নিরন্তর উত্তর দিয়ে চলতো ডেভিড।

 সময় মতো দালানের কাজ শেষ হলো আর অপরিচিত লোকজন জাবুলানি ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু ইস্রায়েল থেকে মালিক স্ট্রিটের বাসার ফার্নিচার আর অন্যান্য জিনিস না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত মনে হলো সত্যিকার অর্থে ঘর করা শুরু হলো না তাদের।

 ডেবরার কাজ করার ঘরের জানালার নিচে পাতা হলো জলপাই কাঠের টেবিলটা।

 ‘আমি ঠিকভাবে কাজ করতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল কী যেন নাই’ টেবিলের চারপাশে কারুকার্যের উপর হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল ডেবরা,–এখন পর্যন্ত।

টেবিলের পাশের দেয়ালের শেষ্যে রাখা হলো ওর সব বই। আর নতুন লাউঞ্জে চামড়ার সোফা সুন্দর মানিয়ে গেল পশুর চামড়ার রাগ আর উল দিয়ে বোনা কার্পেটের সাথে।

 ফায়ারপ্লেসের উপর ইলা কাদেশের আঁকা ছবিটাকে ঝুলিয়ে দিল ডেভিড। স্পর্শ করে করে এটার সঠিক অবস্থান মনের মাঝে গেঁথে নিল ডেবরা।

‘তোমার মনে হয় না এটা আরেকটু উপরে উঠলে ভালো হতো?

আর কোন কথা বলবে না মরগ্যান। আমাকে জানতে হবে যে এটি ঠিক কোথায় আছে।

এরপর বেডরুমে পাতা হলো বিশাল খাট। ঢেকে দেয়া হলো আইভরি রঙের বিছানার চাদর দিয়ে। এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুশি খুশি কণ্ঠে ডেবরা বলে উঠল।

‘এখন এখানে শুধু আরেকটা জিনিস বাকি আছে।’ ঘোষণা করল ডেবরা।

কী?’ ছদ্ম উদ্বিগ্নতার স্বরে জানতে চাইল ডেভিড। জরুরি কিছু?

এসো, এদিকে। হাত নেড়ে ডেভিডকে ডাকলো ডেবরা। “আমি তোমাকে দেখাচ্ছি এটা কতটা জরুরি।

.

এ ক’দিনের দৌড় ঝাঁপের মাঝে বাসা ছেড়ে আর কোথাও যায়নি তারা। কিন্তু হঠাৎ করেই এখন থেমে গেল সমস্ত কাজ।

 ‘আঠারো হাজার একর আর অসংখ্য চারপেয়ে প্রতিবেশী আছে আমাদের। চলো দেখে আসি সবাইকে।’ পরামর্শ দিল ডেভিড।

ঠাণ্ডা লাঞ্চের প্যাকেট সাথে নিয়ে নতুন ল্যান্ড রোভারে উঠে বসল তিনজন। জুলুকে জোর করে বসিয়ে রাখা হলো পেছনের সিটে। রাস্তাটা নেমে গেছে মুক্তোর ছড়ার দিকে। কেননা এস্টেটের সমস্ত প্রাণীর জীবনের কেন্দ্র হলো এটিই।

গাছপালার ফাঁকে ল্যান্ড রোভারকে পার্ক করে প্রধান পুলের কাছে তীরের উপর বানানো গ্রীষ্মের খড়ে ছাওয়া ঘরগুলোর দিকে নেমে গেল তারা।

পানি দেখে খুশি হয়ে উঠল জুলু। দু’জনের মাঝখানে খুশিতে লাফ-ঝাঁপ দিতে লাগল। বাতাসের মতোই পরিষ্কার পানি, কিন্তু গভীরে দেখা গেল কালো ছায়া।

মাটির মাঝে নখ ঢুকিয়ে গোলাপি একটা মোটাসোটা কেঁচো তুলে আনল ডেভিড। পানির গভীরে ছুঁড়ে ফেলতেই নিঃশব্দে উঠে এসে পানিতে আলোড়ন তুলল প্রায় তার হাতের সমান লম্বা একটা আকৃতি।

 ‘ওয়াও!’ হেসে ফেলল ডেভিড। চারপাশে এখনো এগুলো আছে। আমাদের উচিত ছিল সাথে করে বঁড়শি নিয়ে আসা। বালক বয়সে বহুদিন কাটিয়েছি আমি এখানে।

 স্মৃতিতে পূর্ণ হয়ে আছে এ জঙ্গল। চারপাশে বেড়াতে বেড়াতে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল তার। এরপর আস্তে আস্তে চুপচাপ হয়ে গেল ডেভিড। জানতে চাইল ডেবরা : কী হয়েছে ডেভিড? বুঝলল কিছু একটা হয়েছে।

 ‘কোন প্রাণী দেখতে পাচ্ছি না। অবাক কণ্ঠে বলে উঠল ডেভিড। পাখি, হ্যাঁ আছে। কিন্তু একটাও পশু দেখিনি এখন পর্যন্ত। বাসা ছাড়ার পর থেকে একটাও না। একটা জায়গায় এসে থেমে গেল ডেভিড। এ জায়গাটা পানি খাবার জন্য চমৎকার ছিল। সারা দিন-রাত ব্যস্ততা থাকতো এখানে পশুর পাল সত্যিকার অর্থেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে।’

ডেবরাকে ছেড়ে আরো খাদের দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। সতর্কতার সাথে উপুড় হয়ে বসে পরীক্ষা করতে লাগল মাটি। অল্প কয়েকটা কুদু আর ছোট্ট একটা বেবুনের দল। বহু মাস ধরে এখানে বড় কোন পাল আসেনি বা বছর খানেক ধরে।

 ডেবরার কাছে ফিরে আসার পর জানতে চাইল মেয়েটা, তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

 ‘পশুপাখি ছাড়া জাবুলানিকে কল্পনা করা যায় না। বিড়বিড় করে উঠল ডেভিড। চলল বাকি অংশে ঘুরে আসি। এখানে কিছু একটা আছে যা বোঝ যাচ্ছে না।

অলসভাবে ঘুরে বেড়াতে এসে পুরোদস্তুর শিকারির চোখে খোঁজা শুরু করল চারপাশ ডেভিড। প্রতিটি ঝোঁপ-ঝাড়ে চোখ বুলিয়ে দেখল। শুকিয়ে যাওয়া পানির নালা ধরে এগিয়ে গিয়ে হেঁটে দেখে এলো। এমনকি মাঝে মাঝেই ল্যান্ড রোভার থামিয়ে বন্য প্রাণীর সন্ধানে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল বালুভূমি।

 ‘এমনকি একটা ইম্পালাও নেই। উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত স্বরে বলে উঠল ডেভিড। এখানে হাজারে হাজারে থাকার কথা ছিল। আমার মনে আছে প্রায় প্রতিটি গাছের নিচে চকচকে বাদামী আর ব্যালে ড্যান্সারদের মতোই সুন্দর সব দল থাকতো।’

ল্যান্ড রোভারকে উত্তরদিকে ঘুরিয়ে নিল ডেভিড। গাছপালার ভিড়ে একটা ট্রাক লক্ষ্য করে ছুটে চলল।

‘এখনে একটা চারণ ভূমি আছে। যেটা অক্ষত থাকার কথা।’

দুপুরের একটু আগে ধুলায় ভর্তি পাকা রাস্তায় পৌঁছালো গাড়ি। জাবুলানির উত্তর সীমান্ত দিয়ে ছুটে চলেছে এ রাস্তা। রাস্তার পাশের বেড়া দেখা গেল ভাঙা। মাঝে মাঝেই কিছু কিছু অংশ আবার বোঝা গেল যে মাটি থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে।

‘হেল, নরক শুলজার হয়ে আছে চারপাশে। বেড়ার দিকে তাকিয়ে ডেবরাকে উদ্দেশ করে বলে উঠল ডেভিড। সীমান্ত ঘেঁষে আরো দুই মাইল এগিয়ে চলল।

এমনকি পাথরের পিলারের উপর ব্রোঞ্জের সাইনবোর্ড, যেটা ডেভিডের বাবা শখ করে লাগিয়েছিল ও যেটা নিয়ে বেশ গর্ব বোধ করতো ডেভিড— ভেঙে চুড়ে ঝুলে আছে।

‘ওয়েল, অনেক কাজ করতে হবে এখানে আমাদেরকে। নিশ্চিন্তির স্বরে বলে উঠল ডেভিড।

গেইটের বাইরে অর্ধেক মাইল গিয়েই হঠাৎ করে তীক্ষ্ণ একটা মোড় নিল গাড়ি। দুপাশে লম্বা লম্বা ঘাস। বালুময় রাস্তার পুরোটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কুদু ষড়। ভূতের মতো বিবর্ণ আর সারা গায়ে মনে হলো চক দিয়ে লাইন টেনে রাখা হয়েছে। একনজরেই বোঝা গেল কতটা শক্তি এর গায়ে। উঁচু মাথা, কালো শিং আছে এতে, বিশাল কান দুটো এমনভাবে ঝুলে আছে যে বোঝা গেল মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে সে।

মাত্র সেকেন্ডের জন্যে দেখা গেল এ ভঙ্গি, এরপরই ল্যান্ড রোভার দুইশ গজ দূরে থাকলেও ধোয়ার মতো মিলিয়ে যাবার জন্য উধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল জটা। এত দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা যে মনে হলো স্বপ্ন দেখছে ডেভিড। ডেবরাকে সবটুকু বর্ণনা করে সে।

‘আমাদেরকে দেখার সাথে সাথে চলে গেল। আমার মনে আছে আগে। ওরা কতটা শান্ত টাইপের ছিল। আমরাই বরঞ্চ লাঠি নিয়ে সবজি ক্ষেত থেকে তাড়া করতাম ওদেরকে।

আবারো মূল ট্র্যাকে ফিরে এলো ডেভিড। এরপর আরো একটা নতুন পথে চালিয়ে নিয়ে এলো ল্যান্ড রোভারকে। নতুন গজানো চারাগাছগুলো ইতিমধ্যেই ঘন আর লম্বা হয়ে উঠেছে। ছোট্ট গাড়িটা নিয়ে এগুলোর উপর দিয়ে চলতে লাগল তারা।

‘কী করছোটা কী তুমি? গাছের ডাল ভাঙার শব্দে চিৎকার করে উঠল ডেবরা।

‘এদেশে রাস্তা থেকে নেমে পড়লে তোমাকেই তোমার রাস্তা তৈরি করে নিতে হবে।

আরো চার মাইল যাবার পর, জাবুলানির পূর্ব সীমান্তে চলে এলো তারা; তাদের আর ন্যাশনাল পার্কের মাঝের বিভেদ রেখা, যে পার্ক কিনা গোটা ইস্রায়েল ভূমির চেয়েও বড়। মিলিয়ন একর পর্যন্ত বনভূমি এখনো পুরোপুরি অক্ষত। তিনশ পঁচাশি কি.মি. লম্বা আর আশি কি. মি. চওড়া এ বনভূমি এক মিলিয়নের বেশি বন্যপ্রাণীর আবাসভূমি। এটিই আফ্রিকাতে বেঁচে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য।

ল্যান্ড রোভার থামালো ডেভিড। ইঞ্জিন বন্ধ করে লাফ দিয়ে নামল। কিছু সময় রেগেমেগে চুপ করে থাকার পর হঠাৎই হেসে উঠল সে।

কী দেখে এত খুশি হয়ে উঠেছো তুমি? জানতে চাইল ডেবরা।

 ‘দেখো_শুধু দেখো একবার। বলে উঠল ডেভিড।

 ‘পারলে তো তাই করতাম।

সরি ডেবস্। খেলার বেড়া একটা। আট ফুট লম্বা একটা বেড়া। উপরের দিকে শক্ত কাঠের পোলটা বেশ চওড়া।

‘ওরা আমাদের জন্য বেড়া দিয়েছে। ন্যাশনাল পার্কের লোকজন আমাদের জন্য বেড়া দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে এখানে কোন জন্তু জানোয়ার নেই।

বাসার দিকে ফিরতে ফিরতে ডেবরাকে ব্যাখ্যা করল ডেভিড যে গার ন্যাশনাল পার্কে আগে কোন বেড়া ছিল না। সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকতে। জাবুলানির মিষ্টি পানি খেয়ে শুকনো মৌসুমে টিকে থাকতে জানোয়ারের দল।

বন্যপ্রাণীদের এই বিষয়টা মনে হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তোমার কাছে। চুপচাপ ডেভিডের কথা শোনার পর জুলুর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তর দিল ডেবরা।’

হ্যাঁ, হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা। ওরা যখন ছিল, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে সব সময় থাকবে। কিন্তু এখন নেই। এই না থাকাটা সত্যিই গুরুতৃপূর্ণ’ তিক্ত স্বরে হেসে উঠল ডেভিড।

‘আমার অবাক লাগছে যে আফ্রিকাতে এরকমটা সচরাচর হয় না– ব্যাপারটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।’

আরো প্রায় এক বা দুই মাইল এগিয়ে গেল তারা কোন কথা না বলে। এরপরই দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিল ডেভিড : ‘আমি ওদেরকে বাধ্য করব এই বেড়া। সরাতে। ওরা আমাদের সাথে এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। আমি এখনি হেড ওয়ার্ডেনের সাথে কথা বলব।’

ছেলেবেলার ছবি মনে করে কনরাডবার্গের কথা স্মরণ করল ডেভিড। সে সময় পার্কের দক্ষিণাংশের ওয়ার্ডেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে ভদ্রলোক। কিন্তু তখনো প্রধান হয়নি। মানুষটা সম্পর্কে বছরের পর বছর ধরে অনেক কল্প-কাহিনী গড়ে উঠেছে। এর মাঝে দুটো গল্পই পরিষ্কার বলে দেবে লোকটা কেমন।

রাত নামার পর পার্কের জনমানবহীন একটা জায়গায় ট্রাক নষ্ট হয়ে যায় কনরাডের। এরপর হেঁটে ঘরে ফেরার সময় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সিংহ আক্রমণ করে তাকে। ধস্তাধস্তির মাঝে ভয়ঙ্কর ভাবে আহত হয় কনরাড। পিঠের অর্ধেক মাংস খুবলে তুলে সিংহ। এছাড়া কাঁধের হাড় আর হাতও কামড়ে দেয় জঘন্য ভাবে। তারপরেও মাত্র ছোট্ট একটা ছুরি দিয়ে পশু রাজকে মেরে ফেলে কনরাড। গলার মাঝে উপর্যুপরি আঘাতে প্রধান শিরা কেটে যায়। এরপরও আবার উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচ মাইল হেঁটে ঘরে ফিরে আসে কনরাড। পেছন পেছন এসেছে হায়েনার দল, কখন সে পড়ে যাবে এই আলায়। যদিও সে পড়ে যায়নি।

অন্য আরেকটা ঘটনায় পার্কের পাশের এক এস্টেটের মালিক বার্গের একটা সিংহকে গুলি করে মেরে ফেলে। সীমান্তের অর্ধেক মাইলের মাঝে ঘটে এ ঘটনাটা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কাজ করতে লোকটা। বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। কনরাডের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠল।

‘এ ব্যাপারে তুমি কী করবে? বন্ধু। চাকরিটা তোমার পছন্দ নিশ্চয়ই?

নাকি? কিন্তু উপরের সব রকম চাপ অগ্রাহ্য করেও নিজের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করে বার্গ। কোর্ট থেকে শুনানীর আদেশ আসে। কোর্টের তারিখ যত কাছে আসে, চাপ ততই বাড়ে। কিন্তু দমবার পাত্র নয় বার্গ। অবশেষে কোর্টে দাঁড়িয়ে সাফাই দেয় সেই গুরুতুপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা। আদেশ ধার্য হয় এক হাজার পাউন্ড ফাইন অনাদায়ে ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড।

পরে বার্গের সঙ্গে করমর্দন করে লোকটা। জানায়, সাহসের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। হয়তো এই একটি কারণে এখন প্রধান ওয়ার্ডনের দায়িত্বে আছে বার্গ।

 টেলিফোনে কথা বলার পর গেম ফেন্সের কাছে ডেভিডের সাথে দেখা করার জন্য সম্মত হয়েছে বার্গ। বড়সড়, চওড়া আর লম্বা কনরাড বার্গ পেশীবহুল হাতে এখনো বহন করছে সিংহের কামড়ের দাগ। মুখের চামড়া রোদে পড়া লাল রঙের। পার্ক সার্ভিসের পক্ষ থেকে সানট্যান আর লম্বা টুপি পরে আছে সে। পরনের পোশাকে সবুজ ব্যাজ।

পেছনে সবুজ রঙের শেভি ট্রাক। দরজায় পার্কের স্মারক চিহ্ন আঁকা। পেছনে বসে আছে দু’জন কৃষ্ণ গেম রেঞ্জার। একজনের হাতে ভারী রাইফেল।

কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে বার্গ। টুপি পেছনে ঠেলে রাখা আর চাহনিতে ভয়ঙ্কর ভাব। বোঝাই গেল নিজের অঞ্চলের উপর শক্ত হাতে রাশ টেনে রেখেছে লোকটা। ডেবরার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে উঠল ডেভিড, এই রে, সমস্যা এসেছে।

বেড়ার ধার ঘেঁষে গাড়ি পার্ক করল ডেভিড। এরপর ডেবরাসহ নেমে এগিয়ে গেল।

মি. বার্গ। আমি ডেভিড মরগ্যান। আমার বাবা যখন জাবুলানি ক্রয় করেছিল তখন আপনাকে দেখেছিলাম আমি। আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হলে খুশি হবো আমি।

একটু হতচকিত হয়ে পড়ল বার্গ। বোঝাই যাচ্ছে জাবুলানির নতুন মালিক সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছে সে। এ জায়গাটা একেবারে বিচ্ছিন্ন চারপাশ থেকে। আর তার কাজই হলো সব খবর রাখা। তারপরেও এই বিভৎস চেহারার তরুণ আর তার অন্ধ কিন্তু সুন্দরী স্ত্রীর জন্য প্রস্তুত ছিল না কনরাড।

টুপি খুলতে গেল কনরাড। তারপর মনে হলো কী দরকার, মেয়েটা তো দেখতে পাবে না। বিড়বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করল বার্গ। হাত বাড়িয়ে দিল ডেভিড। চিন্তিত ভঙ্গিতে হাতটা ধরল বার্গ।

ডেবরা আর ডেভিড কাজ করছে একটা দল হিসেবে। অচিরেই নিজেদের ব্যবহার দিয়ে মুগ্ধ করে ফেলল বার্গকে। কনরাড নিজেও বেশ সহজ-সরল মানুষ। কথা বলতে বলতে আরো নরম হয়ে এলো সে। জুলুকে বেশ প্রশংসা করল সে। ল্যাব্রাডর নিয়ে কথাও শুরু হলো। থার্মস কফি বের করল ডেবরা। সবার জন্য মগ ভর্তি করে নিল ডেভিড।

‘ও স্যাম, তাই না? বার্গের রাইফেল নিয়ে বসে থাকা গেম রেঞ্জারকে দেখাল ডেভিড।

হ্যাঁ। সাবধানে উচ্চারণ করল বার্গ।

 ‘ও জাবুলানিতে কাজ করতো।

‘ও নিজের ইচ্ছেয় আমার কাছে এসেছে। ব্যাখ্যা করল বার্গ, যেন বিব্রতকর কিছু শুনতে না হয়।

 ‘ও আমাকে মনে করতে পারবে না। এখন যেমন দেখাচ্ছে তাতে তো নয়ই। কিন্তু ও রেঞ্জার হিসেবে ভালো। তাছাড়া ও না থাকায় দেখভালও হচ্ছে না ঠিক ভাবে। কাজের কথা বলার আগে ভূমিকা করল ডেভিড। আমাদেরকে ধ্বংস করেছে আপনার এই বেড়া। আস্তে করে লাথি কষালো ডেভিড মাটিতে।

 ‘কেন জানতে চাইছো?’ কফির মগ হাতে নিয়ে চারপাশে তাকাল বার্গ, হাত থেকে ছিটকে পড়ল কফি।

‘কেন করেছেন এমনটা?

কারণ আছে।

‘আমার বাবার সাথে বোর্ডে, একটা চুক্তি হয়েছিল। আগে সবসময় ভোলা থাকতে সীমান্ত। আমাদের জায়গাতে চারণভূমি আর পানি আছে, যা আপনার প্রয়োজন।

 ‘প্রয়াত মি, মরগ্যানের উপর শ্রদ্ধা রেখে বলছি’, ভারী কণ্ঠে বলে উঠল কনরাড বার্গ, ‘আমি কখনোই সীমান্ত খোলা রাখার পক্ষে ছিলাম না।’

 ‘কেন?

‘তোমার বাবা ছিল খেলোয়াড় মনোভাবের। এমন ভাবে শব্দটা মুখ থেকে ছিটকে বের করল বার্গ, যেন পচা মাংস ফেলল থু করে। যখনই আমার সিংহেরা এ লাইনের পাশ এসে তাকে জানার সুযোগ পেল তখনি একদল গাধা লেলিয়ে দিল তাদেরকে সরে যাবার জন্য।’

প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলতে চাইলেও ধীরে ধীরে আবার বন্ধ করে ফেলল ডেভিড। অনুভব করল তার মুখের মাংস পেশীগুলো লজ্জিত ভাবে কুঁকড়ে গেল। সত্যি বলেছে কনরাড, মনে পড়ল গাধার কথা, বাসার পেছনে রোদে শুকাতে দেয়া নরম ভেজা সিংহের চামড়ার কথাও মনে পড়ল।

 ‘উনি অনধিকার চর্চা করেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে উঠল ডেভিড। ‘আমার বাবার লাইসেন্স ছিল। ওগুলো আমাদের অংশে গুলি খেয়েছে।

না, তিনি পশু অপহরণকারী ছিলেন না। স্বীকার করল বার্গ। এ ব্যাপারে তিনি আরো চালাক ছিলেন। তিনি জানতেন যে আমি হয়তো রকেট পাঠাবো আর তিনিই হবেন চাঁদে পা রাখা প্রথম ব্যক্তি।

 ‘তো এই কারণে আপনি বেড়া দিয়েছেন?

না।’

 ‘তাহলে?

কারণ চৌদ্দ বছর ধরে জাবুলানি একজন বেপরোয়া মালিকের হাতে আছে। যেখানে যাই ঘটুক না কেন তাতে আর কিছু যায় আসে না। বৃদ্ধ স্যাম এখানে-’ ট্রাকের ভেতরে থাকা গেম রেঞ্জারের দিকে দৃষ্টি ইশারা করল বার্গ, সাধ্যমতো করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারপরও এ জায়গা হয়ে উঠেছে অপহরণকারীদের স্বর্গ। যত সহজে তুমি উচ্চারণ করলে যে পানি আর চারণ ভূমি আমার উপকারে লেগেছে তত দ্রুত ট্রিগার টিপেছে শিকারিদের আঙুল। স্যাম যখন এ ব্যাপারে কিছু করতে চেয়েছে, ওকে বেধড়ক মারধোর খেতে হয়েছে। তারপরেও ওকে থামাতে না পেরে এক রাতে ওর কুড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে পুড়ে মারা গেছে ওর দুই সন্তান

ডেভিড অনুভব করল আগুনের শিখার তীব্রতা, স্মৃতি উসকে দিল যন্ত্রণা।

 ‘আমি জানতাম না। ব্যথিত স্বরে জানাল ডেভিড।

না, তুমি ব্যস্ত ছিলে অর্থ তৈরিতে বা তোমার নিজস্ব আনন্দ উদযাপনে। রেগে উঠল বার্গ। তো সবশেষে আমার কাছে এলো স্যাম আর ওকে একটা কাজ দিলাম আমি। এরপর এ বেড়া লাগালাম।

 ‘জাবুলানিতে আর কিছুই নেই। কয়েকটা কুদু, একটা দুটা ডুকার ব্যস এইই। আর সবাই চলে গেছে।

“ঠিক বলেছো।

 ‘আমি সবাইকে ফেরত চাই।’

‘কেন?’ জবাবদিহি চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল বার্গ। যেন তোমার বাবার মতো খেলা করতে পারো? যেন তোমার বন্ধুদেরকে সপ্তাহান্তে ডেকে আমার সিংহগুলোকে মেরে ফেলতে পারো?’ বার্গ তাকাল ডেবরার দিকে। সাথে সাথে লাল চেহারা বদলে হয়ে উঠল ধূসর। আমি দুঃখিত মিসেস মরগ্যান। আমি এভাবে বলতে চাইনি।

 ‘ঠিক আছে মি. বার্গ। আমি বুঝতে পেরেছি আপনার কথা।

‘ধন্যবাদ, ম্যাম। এরপর আবারো হিংস্র ভাবে তাকাল ডেভিডের দিকে। মরগ্যান’স প্রাইভেট সাফারি সার্ভিস এটাই কী তোমার লক্ষ্য?

‘আমি জাবুলানিতে আর কোন গুলির শব্দ হতে দেব না।’ বলে উঠল ডেভিড।

‘আমার সন্দেহ আছে। সবাই একই কথা বলে। দেখা যাবে আবারো ওয়াটারলুর মতো যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এখানে।

না।’ বলে উঠল ডেভিড। এরকম হবে না।

‘তোমরা কসাইয়ের মাংস খাবে না পটের মাঝে যেটা থাকে। আবারো কাটা কাটা স্বরে প্রশ্ন করল বার্গ।

 দেখুন, মি. বার্গ। যদি আপনি বেড়া সরিয়ে নিন, তাহলে আমি জাবুলানিকে ব্যক্তিগত প্রাকৃতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করব’

বার্গ হয়তো আরো কিছু বলতো। কিন্তু ডেভিডের কথা শুনে চুপ করে গেল। হাঁ হয়ে রইল সে। ধীরে ধীরে মুখ বন্ধ করে বলল, তুমি জানো এর মানে কী? অবশেষে প্রশ্ন করল কনরাড। তুমি পুরোপুরি ভাবে আমাদের আওতায় চলে আসবে। আইনজীবী দিয়ে কাগজ বানিয়ে তোমাকে বেঁধে ফেলবো আমরা কোন মালিক সুলভ লাইসেন্স থাকবে না, কোন সিংহ গুলি করবে পারবে না।’

 ‘হ্যাঁ, আমি জানি। আমি পড়েছি আইনগুলো। আরো কিছু আছে এখানে। আমি আরো তিনদিকে বেড়া বসাবো আর ব্যক্তিগত গেম রেঞ্জার বাহিনী তৈরি করব–আর এসবই হবে আমার খরচে!

মাথা থেকে টুপি নামিয়ে রাখল কনরাড। তালুতে থাকা অল্প কয়েকটা ধূসর চুলকে হাত দিয়ে আঁচড়ে নিল।

‘দেখো বাছা, দুঃখিত স্বরে উচ্চারণ করল বার্গ, এরকম হলে আমি কেমন করে মানা করবো। এরপরই হাসল বার্গ। দেখা হবার পর এই প্রথম। মনে হচ্ছে এবার তুমি সত্যিই সিরিয়াস।

‘আমি এবং আমার স্ত্রী এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে এসেছি। আমরা কোন মরুভূমিতে বাস করতে চাই না।’

হ্যাঁ, মাথা নাড়ল বার্গ। পুরোপুরি অনুভব করতে চেষ্টা করল ডেভিডের কথা। তার সামনে থাকা সুন্দর মুখটার প্রতি প্রথম দিকের বিদ্বেষ ভাব কেটে গেল পুরোপুরি।

‘আমার মনে হয় প্রথমে আপনি যে বললেন পশু অপহরণকারী, তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে আমাদেরকে। কয়েকজনকে শায়েস্তা করে উদাহরণ তৈরি করা যাক। বলে চলল ডেভিড। বার্গের লাল চেহারা ভেসে গেল খুশির হাসিতে।

‘আমার মনে হয় প্রতিবেশী হিসেবে ভালই হবে তুমি। জানাল বার্গ।

আবারো বেড়ার উপর দিয়ে হাত মেলালো দুজনে। বিশাল মুঠির ভেতর মনে হলো ভেঙে যাবে ডেভিডের হাত।

‘আগামীকাল রাতে আমাদের সাথে ডিনার করতে আসবেন না? আপনি এবং আপনার স্ত্রী স্বস্তির স্বরে জিজ্ঞেস করল ডেবরা।

‘আমাদের জন্য এটা অনেক আনন্দের ব্যাপার হবে, ম্যাম।

 ‘আমি হুইস্কির বোতল বের করব। জানাল ডেভিড।

মহানুভবতা’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল বার্গ। কিন্তু মিসেসরা, আমি শুধু পুরাতন বাক ড্রাই জিন পান করি। একটু পানি মিশিয়ে।’

 ‘এ ব্যাপারে খেয়াল রাখবো আমি।’ সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল ডেভিড।

.

কৃশকায় নারী জেন বার্গ বয়সে কনরাড বার্গের মতোই হবে। শুকিয়ে যাওয়া চেহারা, বলিরেখা আছে আর সূর্যের দৌলতে বাদামী, চুলেও কটা রং সূর্যের কল্যাণে। মাঝে মাঝে ধূসরতার ছোঁয়া। আর যেমনটা ডেবরা মন্তব্য করল– সারা পৃথিবীতে সম্ভবত এই একজনকেই ভয় পায় কনরাড।

‘আমি কথা বলছি কনি। এই একটামাত্র বাক্যই যথেষ্ট। বিশালদেহী কনরাডের বাক্যবাণ থেমে যায় নিমেষের মাঝে। অথবা নিজের খালি গ্লাসের দিকে তাকালেই হাতির মতো দ্রুত ভঙ্গিতে সেটা ভর্তি করে আনতে ছোটে কনরাড। ফলে যে কোন গল্প বা কথা শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হয় বার্গকে। বলার সময় প্রতিটি কথা শুধরে দেবে জেন, ধৈর্য ধরে আবারো শুরু করার অপেক্ষায় থাকে কনরাড।

বেশ সতর্কতার সাথে মেইন কোর্স তৈরি করেছে ডেবরা। ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে বীফ স্টেক। চারটা খেয়ে ফেলল কনরাড একা। খুবই মজা করে যে খেলো তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু ওয়াইন দেখে খানিকটা আঁতকে উঠল।

‘এটা বিষ ছাড়া আর কিছু নয়। আমার এক আংকেলকে মেরে ফেলেছে। ওল্ড বাক জিন নিয়েই মেতে রইল। এমনকি ডেজার্ট খাবার সময়েও।

এরপরে বিশাল ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে গল্পে মেতে উঠল চারজন। কাঠের গুঁড়ি পুড়তে লাগল আর স্বষ্টচিত্তে জেনের সহায়তায় কনরাড বর্ণনা করতে লাগল যে জাবুলানিতে ডেভিডকে কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

‘উত্তর দিক থেকে গোত্রলোর কৃষ্ণরা আসে এদিকে

‘অথবা নদী পার হয়ে যোগ করল জেন।

অথবা নদী পার হয়ে। কিন্তু তারা মোটেই লক্ষ্মী নয়। অবশ্য তেমন ঝামেলাও করে না। বেশির ভাগ সময় জাল পাতে, তেমন হত্যা করে না’

 ‘কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে ভয়াবহ ভাবে। বেচারা জন্তুগুলো দিনের পর দিন বন্দী থাকে। তার কেটে হাড়ে ঢুকে যায়! বিস্তর ব্যাখ্যা দিল জেন।

‘আমি যেমনটা বলছিলাম। কয়েক জন রেঞ্জারকে কাজে লাগালেই–এটা থেমে যায়। সমস্যা হচ্ছে শ্বেত পশু অপহরণকারীদের নিয়ে। এদের কাছে আধুনিক রাইফেল আর হান্টিং ল্যাম্প

‘কিলিং ল্যাম্প,’শুধরে দিল জেন।

–কিলিং ল্যাম্প, এরাই বেশি ক্ষতি করে। মাত্র কয়েকটা ঋতুর মাঝে জাবুলানি একেবারে শেষ করে দেবে।

‘কোথা থেকে আসে এরা? জানতে চাইল ডেভিড। আবারো রেগে উঠছে সে। একই ভাবে রেগে উঠেছিল ইস্রায়েলের আকাশসীমা রক্ষা করার সময়েও।

 ‘এ জায়গা থেকে উত্তরে বড় একটা তামার খনি আছে। ফালাবোরা নামক জায়গায়। শত শত খনি শ্রমিক স্বাদ বদনোর জন্য এখানে আসে। এদিকে হামলা করে জীবিত যা পায় ধরে নিয়ে যায়—কিন্তু এখন এটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। যাই হোক এ কাজে তারা তেমন দক্ষও নয়।’

‘তাহলে দক্ষ কারা?

যেখানে ধুলার রাস্তাটা জাবুলানি থেকে গিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়েতে মিশেছে, এখান থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল হবে’ ব্যান্ডোলিয়ার পাহাড় নামে একটা জায়গা। নাম বলে দিল জেন।

সেখানে একটা জেনারেল ডিলারের অফিস আছে। এটা একটা ট্রেডিং পোস্ট হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সাধারণত উপজাতিরা গোত্রগুলো থেকেই আসে। মালিক আর পরিচালকের কাজ করে যে লোকটা, এ পদে তার প্রায় ৮ বছর হয়ে গেছে। পুরো সময় জুড়ে তার পেছনে লেগে আছি আমি। কিন্তু এত চালাক এই শয়তানটা–আমি দুঃখিত, মিসেস মরগ্যান-আমি তাকে বাগে পাইনি।’

‘সেই-ই একমাত্র?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘হ্যাঁ। সেই-ই। মাথা নেড়ে স্বীকার করল কনরাড। তাকে ধরতে পারলেই অর্ধেক দুঃশ্চিতা কমে যাবে তোমার।

কী নাম?

‘আক্কারস। জোহান আক্কারস।’ সাহায্য করল জেন। পুরাতন বাক খেয়ে চোখ খানিকটা ঢুলু ঢুলু করছে তার।

কীভাবে পাবো তাকে? গভীর চিন্তা থেকে জেগে উঠল ডেভিড। জাবুলানিতে এমন কিছু নেই যা তাকে আগ্রহী করবে–যে কয়েকটা কুদু আছে তা বেশি বন্য, চেষ্টায় কাজ হবে বলে মনে হয় না।

না, এই মুহূর্তে তাকে উসকানি দেয়ার মতো কিছু নেই তোমার হাতে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে

 ‘বেশি ভালো হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।’ দৃঢ় স্বরে ঘোষণা করল জেন। মাথা থেকে চুল খুলে কানের চারপাশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।

–সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তোমার পুলের কাছের মারুলা গাছগুলোতে ফল এলে আমার হাতিরা তোমাকে দেখতে আসবে। একমাত্র মারুলা জামের লোভ তারা সামলাতে পারে না। আমার বেড়া ভেঙ্গে চলে আসবে তারা। এটাকে মেরামত করার আগেই তোমার পাশে দেখবে মেলা বসে গেছে। তুমি যে কোন বাজি ধরতে পারো যে ঠিক সেই মুহূর্তে বন্দুকে তেল ঘষে প্রস্তুত হয়ে নেবে আমাদের বন্ধু আক্কারস। বেড়া ভাঙার ঘণ্টখানেকের মাঝে খবর পেয়ে যাবে সে।’

‘এই বার হয়তো সে একটা সারপ্রাইজও পাবে।’

‘তাই আশা করা যাক।

‘আমার মনে হয় নরম স্বরে জানাল ডেভিড’–আমরা হয়তো আগামীকাল ব্যান্ডোলিয়ার পাহাড়ে নেমে এই ভদ্রলোককে দেখে আসতে পারি।

 ‘একটা ব্যাপার নিশ্চিত’ অসংলগ্ন ভাবে বলে উঠল জেন, সে মোটেও ভদ্রলোক নয়।

.

ব্যান্ডোলিয়ার পাহাড়ে যাবার রাস্তাটা ভর্তি সাদা ধুলায়। স্যান্ড রোভারের পেছনে সারাক্ষণ দেখা গেল ধুলার ব্যানার ঝুলে আছে। পাহাড়টার আকৃতি গোলকার। ঘন গাছ ভর্তি আর ঠিক মহাসড়কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

রাস্তা থেকে চার থেকে পাঁচশ গজ দূরে ট্রেডিং পোস্ট। আম বাগানের পেছনে এর গাঢ় সবুজ আর চকচকে অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকার প্রায় সব জায়গায় এমন দেখা যাবে মাটির ইট দিয়ে বানানো দালানে লোহার ছাদ দেখা যায় নগ্ন ভাবে। দেয়ালে একের পর এক সাটা হয়েছে চা থেকে শুরু করে ফ্ল্যাশ লাইট ব্যাটারী সবকিছুর বিজ্ঞাপন।

সিঁড়ির সামনে, ধূলি-মলিন আঙ্গিনাতে ল্যান্ড রোভার পাক করল ডেভিড। সামনের সিঁড়ির গোড়ায় দেখা যাচ্ছে সাইন বোর্ড: ব্যান্ডোলিয়ার হিল জেনারেল ডিলার।

দালানের এক পাশে একটা পুরাতন সবুজ রঙের এক টন ওজনের ফোর্ড ট্রাক পার্ক করে রাখা। লাইসেন্স প্লেট ও স্থানীয় সিঁড়ির সামনের শেডের নিচে ডজন খানেকের বেশি সম্ভাব্য ক্রেতা ভিড় করে আছে। গোত্র অঞ্চলগুলো থেকে এসেছে আফ্রিকান নারীরা, পরনে লম্বা সুতির নকশা করা কাপড়, ধৈর্যের বাঁধ মনে হচ্ছে তর সইছে না, ল্যান্ড রোভারের দিকে তেমন মনোযোগই দিল না তারা। একজন তো আবার দাঁড়িয়েই বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। মুখ থেকে নিপেল না সরিয়েই বাচ্চাটা তাকিয়ে রইল আগন্তুকের দিকে।

আঙ্গিনার মাঝখানে মোটা সোজা হয়ে উঠে গেছে একটা পোল। ১৫ লম্বা। এর মাথার কাঠের একটা বাক্স মতন। মনে হচ্ছে কুকুরের ঘর। অস্ফুট শব্দ বের হলো ডেভিডের গলা দিয়ে। কেননা বাক্সের মাঝে থেকে দেখা দিল বড়সড় বাদামী আর লোমশ একটা প্রাণী। এক লাফে নেমে এলো মাথা থেকে, একেবারে পাখির মতো হালকা চালে লাফ দিল পশুটা। পোলের এক মাথা থেকে পশুর গায়ের শিকলটা লাগানো হয়েছে আরেক মাথায়। কোমরে স্ট্রাপ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

এর মতো এত বড় বৃদ্ধ পুরুষ বেবুন আমি আর দেখিনি।

তাড়াতাড়ি ডেবরাকে এর বর্ণনা দিল ডেভিড। শিকল যতটুকু তার মাঝেই ঘুরে বেড়াচ্ছে বেবুন। পোলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে মাটি কামড়াচ্ছে। শিকলের ঝনঝন শব্দ হচ্ছে তার পিছুপিছু। বোঝা গেল কতটা উদ্ধত তার স্বভাব। ঘাড়ের উপর উড়ছে ঘন কেশর। পোলের চারপাশে ঘোরা শেষ করে ল্যান্ড রোভারের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। মনে হলো মানুষের মত সব বুঝতে পারছে সে। ছোট বাদামী চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝুলে গেল নিচের চোয়াল।

কদাকার পশু। ডেবরাকে জানাল ডেভিড। ওজন না হলেও নব্বই পাউন্ড। কুকুরের মতো লম্বা মুখ, মুখের চোয়াল ভর্তি হলুদ বিষদাঁত। হায়েনার পরে এটিই সবচেয়ে ঘৃণিত প্রাণী এ অঞ্চলে। চতুর, নিষ্ঠুর আর লোভী। মানুষের সব বদগুণ আছে এটার মাঝে, একটাও সদগুণ নেই। চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল পশুটা আর প্রতি সেকেন্ডে অগ্নিমূর্তির মতো মাথা ঝাঁকাতে লাগল জটা।

ডেভিড যখন পুরো মনোযোগ দিয়ে বেবুনকে দেখছে এমন সময় দোকান থেকে বের হয়ে বারান্দার পিলারে দাঁড়াল একজন লোক।

‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি, মি, মরগ্যান? ঘন একরকম উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল লোকটা। লম্বা গড়ন, পুরোপুরি পরিষ্কার নয় এমন দলা মোচড়া খাকি স্ন্যাকস পরে আছে লোকটা। শার্টের গলা খোলা, পায়ে ভারী জুতা, প্যান্টের সাথে লাগানো ব্রেস আড়াআড়ি ভাবে কাঁধে উঠে গেছে।

‘আমার নাম জানেন আপনি? চোখ তুলে লোকটার দিকে তাকাল ডেভিড। মধ্যবয়স্ক লোকটার গম্বুজাকতির মাথায় অল্প কিছু ধূসর চুল। উজ্জ্বল গোলাপি প্লাস্টিক গাম দিয়ে লাগানো দাঁত, গালের কাছে চামড়া উঠে গেছে। গভীরে বসানো চোখ দুটো দেখে মড়ার খুলির মতো দেখাচ্ছে তাকে। হাসি মুখে ডেভিডের দিকে তাকাল লোকটা।

 ‘একমাত্র আপনিই হতে পারেন ক্ষতচিহ্ন ভর্তি মুখ আর অন্ধ স্ত্রী, জাবুলানির নতুন মালিক। শুনেছি নতুন ঘর বানিয়ে পুরোপুরি বসবাস শুরু করেছেন।

 মানুষটার হাতগুলো বিশাল। পুরো শরীরের তুলনায় বোঝা গেল ও দুটোই বেশি শক্তিশালী। আর কব্জির চিকন রগগুলো দেখে বোঝা গেল ওগুলো দড়ির চেয়েও বেশি শক্ত।

পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে পকেট থেকে ছুরি বের করল সাথে কালো শুকনো মাংস উত্তর আমেরিকার জার্কি, ক্যারিবিয়ার বোকন অথবা আফ্রিকার বিলটং যেকোন কিছুই হতে পারে। এমন ভাবে এক টুকরো কেটে নিল যেন তামাকের টুকরা, পুরে দিল মুখে।

 ‘যেমনটা জিজ্ঞেস করেছি, কী করতে পারি আপনার জন্য? ধীরে ধীরে চিবোতে লাগল লোকটা। প্রতিটি কামড়ে দাঁতের আওয়াজ পাওয়া গেল।

‘আমার পেরেক আর রং দরকার। ল্যান্ড রোভার থেকে নামল ডেভিড।

 ‘শুনেছি নেলস্প্রুটে সব কেনাকাটা সেরেছেন আপনি। হিসেবী দৃষ্টিতে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে রইল আক্কারস। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেভিডের ক্ষত-বিক্ষত চেহারা। ডেভিড দেখল লোকটার গর্তে বসানো চোখ দুটোর রং মেটে সবুজ।

 ‘আমার মনে হয় বন্যপ্রাণীকে খাঁচায় পুরে রাখা বা শিকলে বেঁধে রাখা নিয়ে আইন আছে। প্রায় সাথে সাথে আক্কারসের উপর রেগে গেল ডেভিড। কণ্ঠে পরিষ্কার বোঝা গেল তার ঝাঁঝ। আবারো ধীরেসুস্থে চিবোতে চিবোতে হাসল আক্কারস।

“আপনি আইনজীবী-তাই না?

‘এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘আমার অনুমতিপত্র আছে–দেখবেন?

মাথা নাড়ল ডেভিড। ফিরে হিব্রুতে কথা বলতে লাগল ডেবরার সাথে। দ্রুত লোকটার বর্ণনা দিল ডেভিড।

‘আমার মনে হয় লোকটা বুঝতে পেরেছে যে আমরা কেন এখানে এসেছি। সমস্যা বাধাতে চাইছে।’

‘আমি গাড়িতেই থাকছি। জানাল ডেবরা। ঠিক আছে। বারান্দার সিঁড়িতে পা দিল ডেভিড।

‘পেরেক আর রং?’ আক্কাসকে জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘ভেতরে যান।’ হাসছে এখনো লোকটা। কাউন্টারের পেছনে একজন নিগার সাহায্যকারী আছে আমার। সেই-ই আপনার দেখাশোনা করবে।

একটু দ্বিধা করেও ভেতরে ঢুকলো ডেভিড। কার্বালিক সাবান, কেরোসিন আর গমের গন্ধ আসছে ভেতর থেকে। তাকগুলো পূর্ণ হয়ে আছে সস্তা দরের মুদি মালামালে। আরো আছে ওষুধ, কম্বল, সুতির ফুলেল নকশা করা কাপড়। ছাদ থেকে ঝুলছে সেনাবাহিনীর মতো বড় জুতা, কোট, কুড়ালের মাথা, ঝড়ের সময় ব্যবহার উপযোগী লণ্ঠন। মেঝে ভর্তি হয়ে আছে টিনের ট্রাংক, ময়দার পাত্র, গম আরো শ’খানেক জিনিস, যে কোন গ্রামের ডিলারের কাছেই সাধারণত যা থাকে। আফ্রিকান অ্যাসিস্ট্যান্টকে খুঁজে পেয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিল ডেভিড।

বাইরে সূর্যের আলোয় ল্যান্ড রোভার থেকে নেমে গাড়ির গায়ে হালকা ভাবে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ডেবরা। সাথে লাফ দিয়ে নামল জুলু। বারান্দার কাছের দেয়ালের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল। সাদা প্লাস্টারের গায়ে হলুদ ইউরিনের জেট চালাচ্ছে অন্যান্য কুকুর।

নাইস উগ। বলে উঠল আকারস।

 ‘ধন্যবাদ।’ নগ্ন ভাবে মাথা নাড়ল ডেবরা।

আক্কারস তাড়াতাড়ি তার পোষা বেবুনের দিকে তাকাল। অভিব্যক্তি হয়ে উঠল শিয়ালের মতো ধূর্ত। মানুষ আর জটার মাঝে চোখাচোখি হয়ে গেল বিশেষ একটা ফন্দি। নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল বেবুন। এরপর উঠে নিজের ঘরে চলে গেল পোলের মাথায়।

হেসে সাবধানে আরেক স্লাইস মাংস কেটে নিল আক্কারস।

‘জাবুলানি ভালো লাগছে আপনার?’ ডেবরাকে প্রশ্ন করল আক্কারস। একই সাথে মাংসের টুকরাটা বাড়িয়ে ধরল জুলুর দিকে।

‘আমরা বেশ ভালো আছি এখানে। শক্তভাবে উত্তর দিল ডেবরা। বাড়িয়ে ধরা মাংস ওকলো জুলু। লেজ নাড়তে লাগল। কোন কুকুরই আসলে এর মায়া ছাড়তে পারবে না। আগ্রহ ভরে নিল কুকুরটা। আরো দু’বার জুলুকে মাংসের টুকরো দিল আক্কারস্। চকচকে চোখে নরম সিল্কের মতো মুখ বেয়ে গড়াতে লাগল লালা।

বারান্দার শেডের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা মনে হলো মজা পেতে শুরু করল এবার। আগেও এরকম হতে দেখেছে একটা কুকুরের সাথে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল সকলে। ডেভিড দালানের ভেতরে, তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুই জানে না ডেবরা, দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।

আক্কারস বড়সড় একটা মাংসের টুকরা কেটে ধরল জুলুর সামনে। কিন্তু জুলু নিতে এলে হাত সরিয়ে নিল। এতক্ষণে মাংসের স্বাদ বুঝে গেছে জুলু। চাইল নিয়ে নিতে। আবারো শেষমুহূর্তে তার সামনে থেকে সরিয়ে নিল আক্কারস। জুলুর ভেজা কালো নাকে অস্বস্তি ফুটে উঠল। নরম কানগুলো দাঁড়িয়ে গেল।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো আক্কারস। হাঁটা ধরল, পিছু নিল জুলু। আবারো তার সামনে ধরা হলো মাংসের টুকরা। এরপর নরম স্বরে বলে উঠল আক্কারস, নাও তো দেখি বাছা।’ আর মাংসের টুকরাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বেবুনের ঘরের নিচে। সামনের দিকে লাফ দিল জুলু। এখনো শক্ত হয়ে উঠেনি ওর পা তাই খানিকটা টালমাটাল হলো। গিয়ে পড়ল বেবুনের মাটি খামচে তৈরি করা বৃত্তের ভেতর। পোলের নিচে গিয়ে ক্ষুধার্ত ভাবে মাংসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জুলু।

 ঘর থেকে বের হয়ে এলো বেবুন। বাতাসে ভেসে নেমে এলো পনের ফুট লম্বা পোল থেকে নিচে। পা ফাঁক করে চোয়াল খুলে গিয়ে গরগর শব্দ করতে লাগল। বাঁকানো, ধারালো, হলুদাভ দাঁতগুলো হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর। নিঃশব্দে মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াল বেবুন। এগিয়ে গেল বেচারা অসহায় কুকুর ছানাটার দিকে। ঘাড়ে উঠেই জুলুর উপর চাপিয়ে দিল পুরো নব্বই পাউন্ডের বোঝা।

পড়ে গেল জুলু। বিস্মিত হয়ে গড়াতে লাগল কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর আগেই আবারো তাকে ধরল বেবুনটা।

ডেবরা শুনতে পেল জুলু কেঁদে উঠল। এগোতে লাগল সামনে, অবাক হয়েছে কিন্তু কী ঘটছে বুঝতে পারছে না।

পেট উপর দিকে দিয়ে শুয়ে আছে জুলু। পেট হয়ে গেল উন্মুক্ত। সিঙ্কের মতো কালো কালো পশমে ভর্তি। পেনিস তখনো পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। এক লাফে তার উপর চড়ে বসল বেবুন। শক্তিশালী পা দিয়ে চেপে ধরে রাখল জুলুকে মাটির সাথে। জুলুর পেটে বসিয়ে দিল লম্বা হলুদ বিষদাত।

ভয়াবহ মরণ চিৎকার করে উঠল জুলু। সাথে সাথে চিৎকার করে আগে বাড়লো ডেবরা।

এক পা সামনে বাড়িয়ে দিল আক্কারস। ফলে হাত আর কনুই দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল ডেবরা।

বাদ দিন, লেডি।’ হাসতে হাসতে ডেবরাকে মানা করল আক্কারস। বাধা দিতে গেলে আপনিও ব্যথা পাবেন।’

নরম পেটের মাঝে চোখা দাঁত ঢুকিয়ে মোচড় দিল বেবুন। এরপর সর্বশক্তি দিয়ে টান দিল। পাকস্থলীর পাতলা চামড়া ছিঁড়ে গেল সাথে সাথে। বেগুনি রঙের নাড়িভুড়ি বাইরে বের হয়ে এলো। ঝুলে রইল বেবুনের চোয়ালে।

আবারো আর্তনাদ করে উঠল কুকুরছানা। অন্ধের মতো নিজের পায়ের উপর উঠে দাঁড়াল ডেবরা।

‘ডেভিড!’ চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে। ডেভিড সাহায্য করো।

দৌড় দালানের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে ফেলল পুরো দৃশ্য। দরজার পাশে স্তূপ করে রাখা লাকড়ি থেকে একটা তুলে নিয়ে এক লাফে পার হলো বারান্দা। তিন লাফে পৌঁছে গেল কুকুরছানার কাছে।

বেবুনটা ডেভিডকে আসতে দেখেই ছেড়ে দিল জুলুকে। আবারো এক লাফে উঠে গেল পোলের ভেতর। চোয়াল লাল হয়ে আছে রক্তে। উত্তেজনা আর বিজয়ীর ভঙ্গিতে লাফ ঝাঁপ শুরু করে নিল পশুটা।

হাতের লাকড়ি ফেলে দিয়ে আস্তে করে অসহায় কুকুরছানার দেহটা তুলে নিল ডেভিড। ল্যান্ড রোভারের কাছে গিয়ে নিজের বুশ জ্যাকেট দিয়ে বেঁধে দিল পেট। নিজের হাত দিয়ে নাড়িভুতি আবার ঢুকিয়ে দিল ভেতরে।

 ‘ডেভিড, কী হয়েছে? আকুতি জানাল ডেবরা। হাঁটতে হাঁটতে হিতে তাকে জানাল ডেভিড।

‘ভেতরে বসো।’ ডেবরাকে জানাতেই ল্যান্ড রোভারের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল ডেবরা। কোলে তুলে নিল আহত জুলুকে। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসল ডেভিড।

নিজের দোকানের দরজায় ফিরে গেল আক্কারস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। নকল দাঁত খুলে পড়ে গেল হাসির দমকে।

নিজের ঘরে বসে বেবুনটাও লাফাচ্ছে মাস্টারের মতো খুশিতে। মি. মরগ্যান। আপনার পেরেক নিতে ভুলবেন না।

 ঘুরে আক্কারসের দিকে তাকাল ডেভিড। শক্ত আর গরম হয়ে উঠল তার চেহারা। গাল আর কপালের চামড়ায় যেন আগুন ধরে গেল। রাগে জ্বলে উঠল ঘন নীল চোখ জোড়া। নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল সে। পাশে ঝুলছে মুষ্টিবদ্ধ হাত।

তাড়াতাড়ি পেছন দিকে চলে গেল আক্কারস। দোকানের কাউন্টারের পেছনে পৌঁছে পুরাতন ডাবল ব্যারেলের শটগান হাতে তুলে নিল। মোটা মোটা বুড়ো আঙুল দিয়ে দুটো হ্যামার টেনে প্রস্তুত করে নিল গুলি করার জন্য।

‘সেল্ফ ডিফেন্স মি. মরগ্যান, উপস্থিত স্বাক্ষী আছে আমার। স্যাডিস্ট এর মতো তৃপ্তির স্বরে চিৎকার করে উঠল আক্কারস। আরেক ধাপ সামনে এগোলেই আপনাকে দেখে নেবো আমি।’

 সিঁড়ির মাথায় থেমে গেল ডেভিড। বন্দুকটা ঠিক তার পেটের দিকে তাক করা।

 ‘ডেভিড তাড়াতাড়ি-ওহ, প্লিজ তাড়াতাড়ি। ল্যান্ড রোভার থেকে উদ্বিগ্ন স্বরে চিৎকার করে উঠল ডেবরা, কোলের কাছে দ্রুত নিস্তেজ হয়ে আসছে কুকুর ছানাটার শরীর।

 ‘আবার দেখা হবে আমাদের।’ রাগের চোটে কণ্ঠ জড়িয়ে গেল ডেভিডের।

মজাই হবে তাহলে।’ বলে উঠল আক্কারস। ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল ডেভিড।

রাস্তা দিয়ে ধুলার মেঘ উড়িয়ে ল্যান্ড রোভারকে চলে যেতে দেখার পর শটগান সরিয়ে একপাশে রাখল আকারস। সূর্যের আলোর নিচে উঠানে এলো। ঘর থেকে বের হয়ে এসে লাফ দিয়ে নিচে নামল বেবুন। কোমর উঁচিয়ে নাচতে লাগল বাচ্চাদের মতো।

পকেট থেকে মিষ্টি বের করে ভয়ঙ্কর হলুদ বিষদাঁতের মাঝে ঢুকিয়ে দিল আক্কারস।

বাছা আমার। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল। ছোট ছোট কুতকুতে বাদামী চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইল বেবুনটা।

.

এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা সত্ত্বেও ত্রিশ মাইল পেরিয়ে মাত্র পঁচিশ মিনিটে জাবুলানিতে পৌঁছে গেল ডেভিড। হ্যাঙ্গারের পাশে স্কিড করে গাড়ি থামলো। হাতে কুকুরছানা নিয়ে দৌড় দিল এয়ার ক্রাফটের দিকে।

ফ্লাইটের মধ্যে কোলের উপর রেখে জুলুকে আদর করতে লাগল ডেবরা। কিন্তু গাঢ় রক্তে ভিজে গেল ওর স্কার্ট। চুপচাপ পড়ে রইল জুলু, মাঝে মাঝে একটু একটু ফোপানি ছাড়া আর কোন শব্দ হলো না। ওয়ারলেস টেলিফোনের মাধ্যমে কথা বলে নেলস্প্রুটে নিজেদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে নিল ডেভিড। টেক অফ করার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর পশু সার্জনের ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটার শুইয়ে দেয়া হলো জুলুকে।

প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অখণ্ড মনোযোগে কাজ করল সার্জন। ছিঁড়ে যাওয়া ধমনী আর পেটের পেশী সেলাই করা হলো।

 খুব খারাপ ভাবে আহত হয়েছে জুলু। আর ইনফেকশনের ভয়টাই বড় হওয়ায় জাবুলানিতে ফেরার সাহস হলো না তাদের। পাঁচ দিন পরে আবার জাবুলানিতে উড়ে আসার পরেও দুর্বল রইল জুরু। কিন্তু বিপদ কেটে গেছে। ফ্লাইট কোর্স বদলে ব্যান্ডোলিয়ার হিলের ট্রেডিং স্টোরে এলো ডেভিড।

সূর্যের আলোয় আয়নার মতো চকচক করছে টিনের চাল। নিজের মাঝে ঠাণ্ডা রাগ আর প্রত্যয়ের ভাব টের পেল ডেভিড।

মানুষটা আমাদের জন্য হুমকি।’ জোরে জোরে উচ্চারণ করল সে। আমাদের প্রতি আর জাবুলানিতে আমরা যা করতে চাইছি তার প্রতি সত্যিকারের হুমকি এই লোক।

 মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ডেবরা। জুলুর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কেননা ডেভিডের মতোই সে নিজেও ভয়ঙ্কর রেগে আছে।

আমি তাকে দেখে নেব।’ নরম স্বরে বলে উঠল ডেভিড। স্মৃতিতে ভেসে উঠল ব্রিগের কণ্ঠস্বর।

‘ভায়োলেন্সের একমাত্র অযুহাত হলো তোমার যা, তাকে নিরাপত্তা দেয়া।

 খাড়া ভাবে আবার উল্টো দিকে ঘুরে গেল প্লেন। ফিরে গেল জাবুলানির ল্যান্ডিং স্ট্রিপে।

.

কনরাড বার্গ ডেকে পাঠাল ওল্ড বাক জিন খাবার জন্য। এছাড়াও ডেভিডকে জানাল যে বোর্ড জাবুলানিকে প্রাইভেট নেচার রিজার্ভ ঘোষণার জন্য তার আবেদন মঞ্জুর করেছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও শীঘ তৈরি হয়ে যাবে।

‘তুমি কী চাও আমি বেড়াটা এখনি সরিয়ে নেই?

না।’ চিন্তিত স্বরে উত্তর দিল ডেভিড। থাকুক। আমি চাই না আক্কারসকে ভয় দেখাতে।

ঠিক আছে। একমত হলো কনরাড।

‘তাকে দেখে নেব আমরা। জুলুকে নিজের কাছে ডেকে নিল আর ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে দেখল। বাঞ্চোত, কোথাকার।’ বিড়বিড় করে অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকাল ডেবরার দিকে।

‘স্যরি, মিসেস মরগ্যান।

‘আমি এ ব্যাপারে একমত নই, মি. বার্গ। নরম স্বরে জানাল ডেবরা। কথা বলার সময় তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকে জুলু। এক পাশে মাথা নাড়ল সেও।

প্রতিটি তরুণ জিনিসের মতো, দ্রুত সেরে উঠল জুলু।

মুক্তোর ছড়ার কাছে পাহাড়ের পাদদেশে ঘন হয়ে থাকা মারুলা গাছে ফুল এলো। লাল লাল ফুলগুলো সত্যি দেখার মতো দৃশ্য বটে।

প্রায় প্রতিদিন ডেভিড আর ডেবরা দুজনে একসাথে ঘুরে আসে মারুলা বন থেকে। পুল পর্যন্ত হেঁটে আসে। ধীরে ধীরে নিজের শক্তি ফিরে পাচ্ছে জুলু। তাই প্রায় সময়ই পানি নিয়ে খেলা করে সেও।

এরপর আস্তে আস্তে নারী মারুলার গায়ে সবুজ রঙের তাল আকৃতির ফলগুলো পেকে হলুদ হয়ে গেল আর সেই সুগন্ধে ভারী হয়ে উঠল সন্ধ্যার বাতাস।

 সাবি থেকে নেমে এলো প্রথম দলটা। সবার প্রথমে বৃদ্ধ দুটো পুরুষ। চল্লিশ বছর ধরে মুক্তার ছড়ার কাছে বাৎসরিক তীর্থে আসে এগুলো। সাথে আছে পনেরোটা শাবকসহ গাভী, পায়ে পায়ে দৌড়াতে লাগল আর কম বয়সী অনেকগুলো।

দক্ষিণ দিক থেকে নেমে এলো ওগুলো। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। খোলা জায়গা থেকে দেখে মনে হয় ভূতের মতো ধূসর রঙের ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে ফলের চারপাশে। সাধারণত লম্বা একটা গাছে নজর আটকে যায় পুরুষ হাতির। মোটা কান্ডের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে এপাশ-ওপাশ করতে করতে হঠাৎ করে হেঁচকা টানে মাটির দিকে টেনে ধরে গাছটা। উপরের দিকের কয়েকটা কচি পাতাতেই তার মন ভরে যায়। এরপর দু’একটা বাকল মুখে পুরে উত্তরে হাঁটা ধরে।

এরপর কনরাড বার্গের বেড়ার কাছে এসে পুরুষ দুটো পরীক্ষা করে দেখে সব কিছু। কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় যেন আলোচনা করছে। বিশাল ধূসর কানগুলো নাড়তে থাকে। আর কয়েক মিনিট পর পর শুড় দিয়ে বালি তুলে নিজেদের পিঠে ছুঁড়ে ফেলে মাছি তাড়ায়।

 এই চল্লিশ বছর ধরে যাতায়াতের কল্যাণে নিজেদের রিজার্ভের সব চেনা হয়ে গেছে তাদের। গেম ফেন্সের কাছে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল যে এটা ভাঙা অপরাধ হবে। এছাড়া তাদের সুখ্যাতিও নষ্ট হবে।

কনরাড বার্গ ডেভিডের সাথে নিজের হাতিদের বুদ্ধি বিবেচনা নিয়ে কথা বলার সময় প্রচণ্ড সিরিয়াস ছিল। এমন ভাব করল যেন তারা স্কুল বয়।

চিন্তিত মুখে বৃদ্ধ পুরুষ হাতি দুটি ফিরে গেল নিজের বাহিনীর কাছে। কী করা যায় এ ব্যাপারে ধৈর্য সহকারে আলোচনা শুরু করল তারা। তিন দিন ধরে হাতির পালটা বেড়ার কাছে এলো আর গেল। অপেক্ষা করল। বিশ্রাম নিল এরপর হঠাৎ করেই পশ্চিমা বাতাস ধেয়ে এলো তদের দিকে। বয়ে নিয়ে। এলো মারুলা জামের সুগন্ধ।

রাস্তার ধারে ল্যান্ড রোভার পার্ক করে আনন্দে হেসে উঠল ডেভিড।

কনির বেড়ার জন্য এত কিছু।

 নিজের সম্মানবোধে বা ধ্বংসের আনন্দে একটাও বয়স্ক হাতি অন্যের তৈরি করা ফুটো দিয়ে ঢুকলো না।

সবাই নিজের মতো করে বেড়ার জায়গা ঠিক করে নিল। কংক্রিটের মাঝে শক্ত কাঠ পুঁতে রাখা। কোন সমস্যা ছাড়াই মাটির সাথে মিশে গেল সবগুলো। প্রায় এক মাইল জুড়ে ভেঙে পড়ে গেল সব বেড়া।

 প্রতিটি হাতি পুলের কাউকে ব্যবহার করে পেঁচানো তারের নগ্ন ফলা এড়িয়ে এলো।

এরপর সারারাত ধরে পুলের পাশে চলল ভোজ। হলুদ জামগুলো খেয়ে নিয়ে ভূরিভোজ শেষ হলো সকালবেলা। এরপর আবারো সুশৃংখল ভাবে বেড়ার কাছে ফিরে এলো দলটা। চাইল বেড়া ঠিক করে দাঁড় করিয়ে দিতে। হয়তো অপরাধবোধে ভুগতে লাগল অথবা আশা করল পুরো কাটার জন্য অন্য কোন দলকে অভিযুক্ত করবে কনরাড বার্গ।

যাই হোক, ভাঙা বেড়া দিয়ে সহজেই এপাশে চলে এলো অন্য দলগুলো।

এলো শক্তিশালী বাফেলার মতো শিংওয়ালা নীল রঙের মোটা মাথা আর কেশবওয়ালা প্রাণী। এরপর এল জেবরা।

অবশিষ্ট বেড়ার কাছে এসে ডেভিডের সাথে দেখা করল কনরাড বার্গ। নিজের ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে সতর্কতার সাথে পার হলো বেড়া। তাকে অনুসরণ কলো আফ্রিকান রেঞ্জার স্যাম।

ধ্বংসলীলা দেখে মাথা নাড়তে লাগল কনরাড।

‘এটা বৃদ্ধ মাহোম্মেদ আর ওর একচোখওয়ালা বন্ধুর কাজ। আমি যেখানেই দেখি চিনবো তাদের পায়ের ছাপ। এমন শয়তান একেকটা তাড়াতাড়ি ল্যান্ড রোভারে বসে থাকা ডেবরার দিকে তাকাল কনরাড।

 ‘ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই মি. বার্গ।’ ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে তাকাল ডেবরা।

আগুপিছু হয়ে পুরো বেড়া দেখল স্যাম। তারপর এসে তাদের কাছে। দাঁড়াল।

‘হ্যালো, স্যাম। অভিবাদন জানাল ডেভিড। অনেক সাধ্য-সাধনার পর সে বিশ্বাস করল যে এই ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস চেহারার লোকটাই হলো সেই সুদর্শন ডেভিড যে কিনা শিখেছিল কেমন করে বন্য একটা মৌমাছির চাকে হাত ঢুকাতে হয় মৌমাছিকে বিরক্ত না করে।

হাসিমুখে ডেভিডকে স্যালুট করল স্যাম। নিজের ইউনিফর্মকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে সে। তার বয়স ধারণা করা বেশ কঠিন, কেননা নাগুনিদের মতো বড়সড় মসৃণ চাঁদপানা মুখ–আফ্রিকার অভিজাত যোদ্ধা জাতি–কিন্তু মাথার উপরে পুরো সাদা চুল। ডেভিড শুনেছে যে জাবুলানিতে চল্লিশ বছর কাজ করেছিল সে। তাই ধরে নেয়া যায় যে বয়স ষাটের কাছাকাছি।

দ্রুত কনরাডের কাছে রিপোর্ট দিল সে। প্রাণীদের বর্ণনা আর সংখ্যাও বলে দিল যেগুলো জাবুলানিতে ঢুকেছে।

 বাফেলোর একটা দলও এসেছে। তেতাল্লিশটা আছে। সাধারণ জুলু ভাষায় বর্ণনা করল স্যাম, ডেভিড যেটা শিখতে চেষ্টা করছে। এগুলোই লাঙ্গুলেনের কাছে রিপাপ বাঁধে পানি খেয়েছিল এর আগে।

তার মানে এগিয়ে আসছে আক্কারস। এদের যে কোন বাফেলোই সুস্বাদু বিলটংয়ের জন্য যথেষ্ট। শুকনো মুখে তাকিয়ে রইলো কনরাড।

‘কতক্ষণ পরে সে জানতে পারবে যে বেড়া ভেঙ্গে পড়েছে? জানতে চাইল ডেভিড। দ্রুত র‍্যাপিড ফায়ারের ভঙ্গিতে স্যামের সাথে আলোচনা সেরে নিল কনরাড। প্রথম কয়েকটা বাক্য তো বুঝতেই পারল না ডেভিড। যাই হোক অবশেষে তর্জমা করে দিল কনরাড।

‘স্যাম বলছে যে ইতিমধ্যেই ওহ জানতে পেরেছে যে তোমার সব ভূত্য আর তাদের স্ত্রীরা আক্কারসের দোকান থেকে সদাইপাতি কেনে। লোকটা ভূতদেরকে টাকা দেয় এ তথ্য জানানোর জন্য। এর মানে স্যামের ধারণা যে তাকে মারার বন্দোবস্তও আক্কারস করেছিল। গভীর রাতে সুনসান রাস্তায়। তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে স্যামকে এছাড়া ঘর পুড়িয়ে দিয়ে জাবুলানি ছাড়া করতে চেয়েছে স্যামকে, আক্কারস।

এর মানে স্যাম আমাদের সাথে, তাই না? একমত হলো ডেভিড। বৃদ্ধ স্যাম চায় আমরা যেন আক্কাসকে ধরি—এ ব্যাপারে ও একটা প্ল্যানও করে রেখেছে।

তাই নাকি, শুনি তো কী?

‘যেহেতু রাতে তুমি আছো জাবুলানিতে তাই রাতের বেলা কিলিং ল্যাম্প নিয়ে অপহরণের চেষ্টা হয়তো করবে না আক্কারস। এ ব্যাপারে সব কৌশল সে জানে। আমরা তাকে কখনোই পাকড়াও করতে পারব না।’

‘তো?

তাই তুমি তোমার চাকরদেরকে বলবে যে দুই সপ্তাহের জন্য কেপটাউন যাচ্ছে। ব্যবসার কাজে। তুমি বাসা ছাড়ামাত্র খবর পাবে আক্কারস। বিশ্বাস করবে পুরো জাবুলানি তার হাতের মুঠোয়। এক ঘণ্টা ধরে প্রতিটি খুঁটিনাটি আলোচনা সেরে মাথা নেড়ে আলাদা হলো সকলে।

বাসায় গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসার সময় খোলা জঙ্গল থেকে বের হবার সময়ে লম্বা ঘাসের মাঝে দিয়ে তুষারকণার মতো উজ্জ্বল সাদা কিছু একটা উড়তে দেখল ডেভিড।

‘কিছু একটা আছে এখানে। তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল ডেভিড। চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল। এরপরেই ঘাসের মাঝে নড়াচড়া দেখল সে।

‘আহ, বাফেলো!’ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল ডেভিড। গাছের কিনারে ল্যান্ড রোভার দেখে থেমে গেল চারজনের ছোট্ট দলটা। মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল ল্যান্ড রোভার। কিন্তু ভয় পেল না।

এরপর লম্বা লম্বা ঘাসের মাঝ দিয়ে একের পর এক বের হয়ে এলো দলের বাকিরা। প্রত্যেকে একবার করে ল্যান্ড রোভার দেখে নিয়ে নিজের কাজে লেগে গেল। মোট তেতাল্লিশটা। যেমনটা ধারণা করেছিল স্যাম। এদের মাঝে সুদর্শন কয়েকটা পুরুষের ওজন না হলেও ২০০০ এল বি হবে আর লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট। বিশাল শিংগুলো মাথার মাঝ থেকে উঠে নিচের দিকে বেঁকে গেছে। মাথাগুলো কালো আর চকচকে।

আলো না মরা পর্যন্ত পুরো লিটার ছবি তুলল ডেভিড। সন্ধ্যা নামার পর চলে গেল তারা। রাতের খাবারের আগে ওয়াইনের বোতল খুললো ডেভিড। সিঁড়ির ধাপে বসে একসাথে দুজনে মিলে পান করল আর শুনল রাতের গুঞ্জন নিশাচর পাখির ডাক, উড়ন্ত পোকার শব্দ, অন্যান্য ছোট-ছোট প্রাণীর নিঃশব্দ চলাচলের আওয়াজ।

‘তোমার মনে আছে একবার আমি বলেছিলাম যে তুমি হচ্ছ বখে যাওয়া ছেলে, বিয়ের জন্য মোটেই উপযুক্ত নও? মোলায়েম স্বরে জানতে চাইল ডেবরা। চুল ভর্তি মাথা রাখল ডেভিডের কাঁধে।

‘আমি কখনোই ভুলবো না এটা।

‘আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এ মন্তব্য তুলে নিতে চাই।’ বলে চলল ডেবরা। আস্তে করে নিজের দিকে ডেবরার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল ডেভিড। নিজের চেহারার উপর ডেভিডের দৃষ্টি অনুভব করে হাসলো সে। লজ্জা মেশানো হাসি। আমি একটা ছোট্ট ছেলের প্রেমে পড়েছিলাম। বখে যাওয়া ছোট ছেলে যে কিনা শুধুমাত্র তীব্র গতির গাড়ি আর স্টার্টের কথা চিন্তা করতো।–’ বলে উঠল ডেবরা। কিন্তু এখন আমার পাশে আছে মানুষ, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।’ আবারো হাসল সে। আর আমি তার এদিকটাই বেশি পছন্দ করছি।’

নিজের দিকে টেনে নিয়ে ডেবরাকে কিস করল ডেভিড। একটু ক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবারো কথা বলে উঠল ডেবরা।

‘এই বন্য প্রাণীরা—এগুলো তোমার কাছে অনেক কিছু

 ‘হ্যাঁ?’ উৎসাহ দিল ডেভিড।

‘আমি বুঝতে পারছি। যদিও আমি কখনো এগুলোকে দেখিনি, আমার কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

‘ভাল লাগল শুনে।

‘ডেভিড, আমাদের এই জায়গাটা–বেশ শান্তির, একেবারে পরিপূর্ণ। মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা স্বর্গোদ্যান।

 ‘আমরা এটিকে তাই করে তুলবো। প্রতিজ্ঞা করল ডেভিড। কিন্তু রাতের বেলা বন্দুকের আওয়াজে জেগে উঠল সে। তাড়াতাড়ি উঠে ডেবরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।

 আবারো শোনা গেল। নীরব রাতে হালকা শোনাল। অনুভব করল রেগে উঠছে সে। কল্পনার চোখে যেন দেখতেও পেল লম্বা সাদা কিলিং ল্যাম্পের আলো। জঙ্গলের মাঝে ঘুরে ঘুরে হঠাৎ করে স্থির হচ্ছে কোন হতবাক অসহায় প্রাণীর উপর। অন্ধ চোখগুলো জ্বলছে রত্ন পাথরের মতো। টেলিস্কোপিক রাইফেলের জন্য চমৎকার শর্ট।

এরপরই হঠাৎ করে শোনা গেল রাইফেলের বিস্ফোরণ। মাজল ফ্ল্যাশের লম্বা ধোঁয়া। শক্ত মাটির উপর নরম শব্দে মৃতদেহ আছড়ে পড়ার শব্দ আর খুড়ের ঘসটানি আওয়াজ, তারপর আবারো চুপচাপ চারপাশ।

ডেভিড জানে যে এখন পিছু ধাওয়া করে কোন লাভ নেই। পাহাড়ের উপর নিশ্চয় বন্দুকবাজের দোস্ত থাকবে যেন কোন বাড়িতে আলো জ্বলে উঠলেই তাকে সংকেত দিতে পারে। অথবা কোন অটো ইঞ্জিন যদি জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিলিং ল্যাম্প বন্ধ করে অপহরণকারী নিঃশব্দে পালিয়ে যাবে। বৃথাই মাঝরাতে জাবুলানিতে ঘুরে মরবে ডেভিড। ধুরন্ধর শত্রু একমাত্র বুদ্ধির জোরেই কুপোকাত হবে।

আর ঘুম এলো না তার। ডেবরার পাশে জেগে বসে রইল আর শুনতে লাগল তার হালকা নিঃশ্বাসের শব্দ। মাঝে মাঝে দূরে রাইফেলের আওয়াজ। বোবা প্রাণীগুলো অসহায়ের মতো একটু পর পর ছুটে পালিয়ে গিয়েও তাকিয়ে দেখে তার দিকে ধেয়ে আসা অদ্ভুত আলোটাকে।

সারারাত রাগের চোটে এপাশ-ওপাশ করল ডেভিড। সকালবেলা দেখা গেল শুকুন উড়ছে।

 ভোরের গোলাপি আকাশে কালো বিন্দু। একের পর এক আসতে লাগল। চক্রকারে ঘুরে ঘুরে নামার প্রস্তুতি নিতে লাগল।

সকুকুজা ক্যাম্পে কনরাড বার্গকে টেলিফোন করল ডেভিড। এরপর ডেবরা আর জুলুকে নিয়ে উঠে বসল ল্যান্ড রোভারে। সকালের ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য নরম কাপড় জড়িয়ে নিল গায়ে। পাখিদের অনুসরণ করে পৌঁছে গেল যেখানে বাফেলোর দলের উপর আঘাত হেনেছে অপহরণকারীর দল।

প্রথম শবদেহের কাছে পৌঁছাতেই পাখির দল সরে গেল গাড়ির শব্দ পেয়ে। হায়েনার দল গিয়ে পালালো গাছের মাঝে। উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আবার দেখতে লাগল কী করে গাড়ি। ছোট লাল শিয়ালগুলো রুপালি পৃষ্ঠদেশ আর সাবধানী কান তুলে সম্মানজনক দূরত্ব পার হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে তাকাল।

শকুনগুলো মনে হলো অধৈর্য হয়ে উঠেছে। উড়ে উড়ে খেতে লাগল যা যা সম্ভব। ল্যান্ড রোভার একেবারে কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত ভ্রূক্ষেপ করল না। এরপর উড়ে গেল কাছের গাছের ডালে।

ষোলটা মৃত বাফেলোর দেহ দেখা গেল। দলটা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। এক লাইনে পড়ে আছে সব। প্রতিটি মৃত পশুর পেট দেখা গেল উন্মুক্ত। তারপর কোমরের মাংস কেটে নেয়া হয়েছে নিপুণ হাতে।

কয়েক পাউন্ড মাংসের জন্যে খুন করল এ অবোধ পশুগুলোকে। অবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে বলে উঠল ডেবরা।

‘হম, তাই’, চিন্তিত স্বরে জানাল ডেভিড। কিন্তু এটা হয়তো এতটা খারাপ নয়–কখনো কখনো তো ওয়াইল্ড বিস্টকে মেরে ফেলে লেজ দিয়ে ফ্লাই উইক বানাতে আর জিরোফকে গুলি করে হাড়ের মাঝে থাকা মজ্জার জন্যে।

‘আমি বুঝতে পারছি না। নিরাশ ভঙ্গিতে বলে উঠল ডেবরা। একটা মানুষ কীভাবে এমনটা করতে পারে? মাংসের এত তো অভাব পড়ে যায়নি।

 ‘না’, একমত হলো ডেভিড। এর কারণ আরো বড়। এই ধরনের হত্যা করতে সাহস লাগে। এই মানুষটা হত্যার আনন্দেই হত্যা করে। দেখে মজা পায় কীভাবে অসহায় প্রাণীটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করে তাজা রক্তের গন্ধ পছন্দ করে’–গলা ধরে গেল তার। এই একবার তুমি ঈশ্বরকে ধন্যবান জানাতে পারো যে তুমি চোখে দেখতে পারো না। নরম স্বরে জানাল ডেভিড।

কনরাড বার্গ দেখতে পেল তাদেরকে। নিজের রেঞ্জারদেরকে পাঠিয়ে দিল পশুদের মৃতদেহগুলো পরিষ্কারের কাজে। এত মাংস নষ্ট করার কোন মানে হয় না। অনেক লোকের খাদ্যের সংস্থান হবে এতে।

এরপর স্যামকে ডাকলো। পা গুনে দেখা গেল চারজন এসেছিল। একজনের পায়ে ছিল হালকা রাবারের সোলওয়ালা জুতা। বাকিদের খালি পা।

‘একজন সাদা লোক, কেননা লম্বা পা আর বড়সড় শরীর বোঝা যাচ্ছে। কালো তিনজন মাংস বহন করে নিয়ে গেছে। এখানে-সেখানে রক্ত পড়ে আছে ফোঁটায় ফোঁটায়।

সবাই স্যামকে অনুসরণ করে আস্তে আস্তে উঠে এলো জঙ্গল থেকে বাইরের রাস্তায়।

এখান থেকে পিছন দিকে গেছে তারা। পর্যবেক্ষণ করে জানাল স্যাম। চিন্তিত স্বরে ব্যাখা করল কনরাড।

‘পুরাতন কৌশল ব্যবহার করেছে তারা। সীমান্ত না পার হওয়া পর্যন্ত পেছন দিকে গেছে। বেড়ার কাছে গেলে তোমার মনে হবে তারা অন্যপথে গেছে- ভেতরে ঢোকেনি। তাই তাদের পিছু নিতে চাইবে না তুমি।

বেড়ার কাছে গিয়ে দেখা গেল একটা অংশে কিছু নেই। রাস্তা পার হয়ে পেছনে উপজাতিদের গ্রাম। বোঝা গেল সেখানে কোন একটা মোটর ভেহিকেল পার্ক করা ছিল। এরপর বালির রাস্তা ধরে আবারো মহাসড়কে গিয়ে মিশেছে চাকার দাগ।

 ‘টায়ারের দাগ প্লাস্টার কাস্ট করা যায় না? জানতে চাইলে ডেভিড। ‘সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না। মাথা নাড়াল কনরাড। তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো যে প্রতিবার বের হবার আগে চাকা বদলায় তারা। আর এ সেট বিশেষ ভাবে এ কাজের জন্যে। কাজ শেষ হবার পর লুকিয়ে রাখবে।

কার্টিজ শেল খরচের কথা কেমন মনে হয়? জোর দিয়ে বলল ডেভিড।

হালকা ভাবে হাসল কনরাড। এগুলো তার পকেটেই থাকে। এটা বেশ চালাক পাখি। পুরো দেশে সে তো তার প্রমাণ ছড়িয়ে রাখবে না। যখন কাজ করে তখনি তাকে ধরতে হবে। না আমাদেরকে ওকে এর মাঝে টেনে আনতে হবে। ব্যবসায়ী সুলভ মনোভাব দেখা গেল তার মাঝে। ঠিক আছে, তুমি এমন কোন জায়গার কথা ভেবেছো যেখানে স্যামকে রাখা যায়?

‘আমার মনে হয় ওকে একটা কোপজেতে রাখতে হবে। মুক্তোর ছড়ার কাছে। রাস্তায় একটু ধুলা দেখতে পেলেও আমাদেরকে সিগন্যাল দেবে। জায়গাটার উচ্চতা টু-ওয়ে রেডিওকে প্রয়োজনীয় রেঞ্চ দেবে।’

লাঞ্চ করার পর নাভাজোর লাগেজ কম্পার্টমেন্টে নিজেদের ব্যাগ রাখল ডেভিড। ভৃত্যদেরকে দুই সপ্তাহের বেতন দিয়ে দিল অগ্রিম ‘ভাল থাকবে তোমরা।’ জানাল তাদেরকে। এই মাস শেষ হবার আগেই ফিরে আসব আমি।’

খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল ইগনিশনে চাবি ঝুলছে। এমন ভাবে ল্যান্ড রোভার নিয়ে হ্যাঙ্গারে পার্ক করল ডেভিড। প্রস্তুত হয়ে আছে যাত্রার জন্যে। এরপর উঠে পশ্চিমে হেডিং সেট করল। ব্যান্ডেলিয়ার হিল আর আমগাছগুলো পার হয়ে গেল। জীবনের কোন চিহ্ন দেখা গেল না। কিন্তু নিজের কোর্স ধরে রাখল ডেভিড। যতক্ষণ পর্যন্ত না দিগন্ত থেকে হারিয়ে গেল পাহাড় সারি। এরপর আবার ঘুরে দক্ষিণে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের সকুকুজা ক্যাম্পে এলো।

এয়ারস্ট্রিপে নিজের ট্রাকে অপেক্ষা করছিল কনরাড বার্গ সেসনার জন্যে। গেস্টরুমে তাজা ফুল রেখে দিল জেন। এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমে পঞ্চাশ মাইল গেলেই জাবুলানি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *