৩. নতুন পদমর্যাদা

নিজের অফিসে ডেভিডকে ডেকে পাঠিয়ে তার নতুন পদমর্যাদা জানিয়ে দিল লে ডফিন। এখন থেকে নিয়মিত সবুজ’ স্ট্যান্ডবাই হিসেবে কাজ করবে ডেভিড। যার অর্থ প্রতি সপ্তাহে চারদিন কাটাতে হবে বেসে।

এবার, প্যারাট্রুপার ট্রেনিং নিতে হবে ডেভিডকে। অস্ত্রবিহীন যুদ্ধের শিক্ষা পাবে এতে। এই ধরনের যুদ্ধ শিক্ষা পেলে আরবীয় ভূমিতে আটকা পড়া যে কোন পাইলটের বেঁচে যাবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।

লে ডফিনের অফিস থেকে বের হয়ে সোজা কু-রুমে টেলিফোনের কাছে গেল ডেভিড। লাঞ্চের জন্যে লটারম্যান বিল্ডিং ত্যাগ করার আগেই ধরে ফেলল ডেবরাকে।

 ‘আমার বিছানা গরম করো বালিকা’, বলে উঠল ডেভিড। আগামীকাল রাতেই বাসায় পৌঁছে যাচ্ছি আমি।’

মার্সিডিজ চালিয়ে জেরুজালেমে পৌঁছালো জো আর ডেভিড। নিচু কণ্ঠে কথা বলে চলল জো। যদিও কিছুই শুনতে পেল না ডেভিড। তাই শেষমেশ পাঁজরে বুড়ো আঙুলের শুতে দিল জো

‘দুঃখিত জো। আমি কী যেন ভাবছিলাম। তোমার কথা শুনতে পাইনি।

“ঠিক আছে, এবার তাহলে থামাও চিন্তা। তোমার ভাবনা গিয়ে জানালায় কুয়াশা বানাচ্ছে।

কী বলছিলে তুমি?

 ‘আমি বিয়ের কথা বলছিলাম– হান্নাহ আর আমার।

ডেভিডের মনে পড়ে গেল যে বিয়ের আর মাত্র মাসখানেক বাকি। বুঝতে পারল এটা নিয়ে মেয়েরা কতটা উত্তেজিত হয়ে আছে। যেমন সবাই গ্রীষ্মের পরে বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। ডেবরার চিঠিগুলোতেও শুধু বিয়ের প্রস্তুতির কথাই লেখা থাকতো।

 ‘আমি খুব খুশি হবো, যদি তুমি আমার সাথে এসে দাঁড়াও আর আমার সাক্ষী হও। খানিকটা পরিবর্তন আসবে। এবার তুমি হবে উইংম্যান আর আমি টার্গেটে লাগাবো।’

ডেভিড বুঝতে পারল যে এই অনুরোধের মাধ্যমে ওকে কতটা সম্মান জানানো হয়েছে। তাই যথাযথ মর্যাদার সাথে অনুরোধ গ্রহণ করল সেও। মনে মনে অবশ্য বেশ খুশিও হলো। অন্যান্য যতো তরুণ ইস্রায়েলিয়দের সাথে সে কথা বলেছে তাদের মতোই জো আর ডেবরাও নিজেদেরকে ততটা ধর্মপ্রাণ মনে করে না। ডেভিড এখন জানে যে এটা একটা স্টাইল। নচেৎ তারা সবাই তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন। ইতিহাস আর জুদাইজম চর্চাতেও সিদ্ধহস্ত।

তাদের কাছে ধর্মপ্রাণ মানে কালো রোব গায়ে চাপিয়ে, লম্বা কানাওয়ালা টুপি পরিহিত অর্থডক্সের পরাকাষ্ঠা মিয়া শিয়ারিম হওয়া অথবা প্রতিদিনের জীবনে এমন আইন মেনে চলা যা কেবল পদে পদে বাধা দেবে তাদেরকে।

কিন্তু বিয়ে হবে ঐতিহ্য অনুযায়ী। প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান মেনে তবেই। একটা মাত্রই জটিল যে ব্যাপার তা হলো কড়া নিরাপত্তা বলয়ের ব্যবস্থা করা।

ব্রিগের বাগানে হবে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান। কেননা হান্নাহ পিতা-মাতাহীন সন্তান। এছাড়াও দুর্গের মতো দেয়াল আর বিচ্ছিন্ন বাগানটাকে নিরাপত্তা দেয়া সহজতর হবে।

অতিথিতের মাঝে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকবে।

সবশেষ হিসেবে দেখা গেছে অতিথির তালিকায় আছে পাঁচজন জেনারেল আর আঠারোজন কর্নেল। জানাল জো, এদের মাঝে ক্যাবিনেট মন্ত্রীরাও থাকবে। এমনকি গোল্ডা নিজেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে উপস্থিত হতে চেষ্টা করবে। তাই বুঝতেই পারছো ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরে আমাদের বন্ধুদের জন্য এর চেয়ে সহজ টার্গেট আর হতেই পারে না।’ হেসে ফেলে দুটো সিগারেট জ্বালিয়ে নিল জো। ডেভিডের দিকে বাড়িয়ে দিল একটা। যদি হান্নাহ’র জন্যে না হতো, তুমি তো জানই বিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে মেয়েরা কতটা উৎসুক থাকে, তাহলে আমি শুধু রেজিস্ট্রি অফিসে চলে যেতাম।

 ‘বোকা বানাবার চেষ্টা করো না।’ হেসে ফেলল ডেভিড, “তুমি নিজেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।’

‘হ্যাঁ, তাই।’ হেসে ফেলল জো। নিজেদের জায়গা পাবার মজাই অন্যরকম। যেমনটা তৈরি করেছো তুমি আর ডেবস্। আমার মনে হয় হান্নাহ। যথেষ্ট লক্ষ্মী আচরণ করেছে। প্রায় এক বছরের ভনিতার পর, থ্যাংকস্ গড়, শেষ হচ্ছে অপেক্ষা।

ইন কারেমে ব্রিগের বাসার বাইরের লেনে জোকে নামিয়ে দিল ব্রিগ।

‘আমি তোমাকে ভেতরে আসার কথা বলে বিরক্ত করব না। আমার মনে হয় তোমার অনেক পরিকল্পনা আছে।’ বলে উঠল জো।

‘ঠিক-টাই ভেবেছো।’ হেসে ফেলল ডেভিড। তোমাকে আর হান্নাহকে পাওয়া যাবে? আগামীকাল রাতে ডিনারে এসো।

আবারো মাথা নাড়াল জো। আমি হান্নাহকে অ্যাশকেশন নিয়ে যাবো ওর বাবা-মায়ের কবর পরিদর্শন করে আসতে। বিয়ে করার আগে এ ঐতিহ্য মানতে হয়। হতে পারে শনিবারে দেখা করব তোমাদের সঙ্গে।

 ‘ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব। ডেবরা নিশ্চয়ই তোমাকে দেখতে চাইবে। শালাম, জো।

শালাম’, শালাম। বিদায় জানিয়ে চলে এলো ডেভিড। রেসিং কারের গতিতে মার্সিডিজ নিয়ে ছুটলো পাহাড় অভিমুখে। হঠাৎ করেই কিসের তাড়া অনুভব করছে যেন নিজের মাঝে।

ছাদের দরজা স্বাগত জানানোর জন্য হাট করে খোলা। ডেবরা অপেক্ষা করছে ডেভিডের জন্য। আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে নতুন কেনা চামড়ার চেয়ারে পা ভাঁজ করে বসে আছে। মাত্রই চুল ধুয়ে এসেছে তাই চমৎকার চকচকে পাখার মতো ঝিকঝিক করছে কেশরাজি। হালকা সিল্কের ফোলা কাফতান পরে চোখের তারায় সোনালি মধু নিয়ে বসে আছে। সিল্কের ঝড় তুলে খালি পায়ে দৌড়ে গেল ডেভিডের কাছে। ডেভিড! ডেভিড! চিৎকার করে উঠল ডেবরা। কোলে তুলে এক পাক ঘুরে হাসতে লাগল ডেভিড।

এরপর গর্বিত ভঙ্গিতে রুমগুলো ডেভিডকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল ডেবরা। তার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছুই পরিবর্তন আর সংযোজন হয়েছে দেখতে পেল ডেভিড আর এখন সত্যিকারের ঘরের আবহও অনুভব করল। ডেভিড ডেবরাকে বুঝিয়েছে যে দামটা মোটেও কোন মুখ্য ব্যাপার নয়। একসাথে তাই ফার্নিচারের নকশা পছন্দ করেছে তারা। এ সমস্তই নির্মাণ করে ডেলিভারি দিয়ে গেছে ডেবরার বংশব্দ আরবীয় ব্যবসায়ী আর তাদের পরিকল্পনানুযায়ী দাঁড়িয়েছে ডেবরা। সমস্ত কিছুই বানানো হয়েছে নরম চামড়া আর কালো কাঠ দিয়ে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উজ্জ্বল তামা আর পিতল। রাগের চারপাশে বসানো হয়েছে এসব ফার্নিচার। যাইহোক, একটামাত্র জিনিস চোখে পড়ল যা আগে দেখেনি ডেভিড। বড়সড় ক্যানভাসে অয়েল পেইন্টিং। ছাদের দিকে মুখ করে থাকা সদ্য রং করা সাদা দেয়ালে ফ্রেমবিহীন পেইন্টিংটা ঝুলিয়ে রেখেছে ডেবরা। দেয়ালে এই একটামাত্র পেইন্টিং এর চারপাশে অন্য কিছু খুবই বেমানান লাগতো। ছবিটাতে ফুটে উঠেছে কর্কশ একটা দৃশ্য। মরুভূমি, যাতে ফুটে উঠেছে বন্যতা। রঙগুলো বেশ তীব্র আর রুম জুড়ে মনে হলো মরুভূমির সূর্যই আলো ছড়াচ্ছে।

 ডেভিডের হাত ধরে রেখে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইল ডেবরা। দেখতে চায় ডেভিডের প্রতিক্রিয়া।

“ওয়াও! অবশেষে বলে উঠল ডেভিড।

“তোমার পছন্দ হয়েছে? ভারমুক্ত হলো ডেবরা।

 ‘অসম্ভব। কোথায় পেয়েছো?

‘আর্টিস্ট উপহার দিয়েছে। আমার অনেক দিনের বন্ধু।

‘মেয়ে?

‘হ্যাঁ। আগামীকাল আমরা তিবেরিয়াস যাবো ওর সাথে লাঞ্চ করতে। আমি ওকে তোমার কথা বলেছি। তোমাকে দেখতে চেয়েছে।

কী পছন্দ করে সে?”

 সে আমাদের প্রথম সারির আর্টিস্টদের একজন। নাম ইলা কাঁদেশ। কিন্তু এছাড়া আর কিছু বলতে পারব না। একটাই প্রমিজ করতে পারি যে অসম্ভব মজার একটা দিন পাবে তুমি।’

ভেড়ার মাংস আর জলপাইয়ের বিশেষ খাবার বানিয়েছে ডেবরা। জলপাই গাছের নিচে ছাদে বসে খাবার খেলো দু’জনে। কথাবার্তা আবারো শুরু হলো জোর বিয়ে নিয়ে। এর মাঝেই হঠাৎ করে ডেভিড জিজ্ঞেস করে বসল, আমার কাছে আসার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়েছো তুমি বিয়ে ছাড়া?

একটুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল ডেবরা, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এও জানি যে, অপেক্ষার খেলা খেলার ব্যাপারে তোমার তেমন ধৈর্য নেই। আমি জানতাম যে যদি আমি এমনটা না করতাম তাহলে তোমাকে আবারো হারাতাম।

 ‘কিছুদিন আগপর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি যে এটা কত বড় একটা সিদ্ধান্ত। চুপচাপ ভাবতে লাগল ডেভিড। কোন কথা না বলে ওয়াইনে চুমুক দিল ডেবরা।

‘চলো বিয়ে করে ফেলি ডেবস। নীরবতা ভাঙলো ডেভিড।

হ্যাঁ। মাথা নাড়াল ডেবরা। বেশ ভালো আইডিয়া।

 ‘খুব তাড়াতাড়ি।’ তাড়া দিল ডেভিড। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

 হান্নাহর আগে নয়। আমি ওর কাছ থেকে ওর দিনটা কেড়ে নিতে চাই না।’

 ‘ঠিক আছে।’ একমত হলো ডেভিড। কিন্তু ঠিক তার পরপরই। যোগ করল সে।

মরগ্যান, তুমি নিজেই একটা তারিখ ঠিক করে নাও।’ জানিয়ে দিল ডেবরা।

পুরো তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে তবেই পৌঁছানো যাবে তিবেরিয়াসে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ল তারা। পিতলের কাজ করা বিছানার উপর এসে পড়ল সূর্যের প্রথম আলো। ডোরাকাটা দাগ পড়ল দেয়ালে। সময় বাঁচাতে গোসলও সেরে ফেলল একসাথে মুখোমুখি বসে।

ইলার মতো এমন খারাপ কারো সাথে আগে দেখা হয়নি তোমার। ডেভিডকে সাবধান করে দিল ডেবরা। সকালবেলা গোলাপি রিবন দিয়ে মাথার উপর চুড়ো করে চুল বেঁধে রাখায় ডেবরাকে দেখাচ্ছে ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের মতো। যত তুমি তাকে পছন্দ করতে চাইবে সে ততই খারাপ ব্যবহার করবে। তাই ধৈর্য হারিয়ো না তুমি।’ বলে চলল ডোবরা।

এক আঙুলে সাবানের ফেনা নিয়ে ডেবরার নাকের মাথায় বসিয়ে দিল ডেভিড। জানাল, আই প্রমিজ।

 জেরিকো পর্যন্ত গিয়ে উত্তরে জর্দান উপত্যকা ধরে এগিয়ে চলল তারা। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াও চলল পাশাপাশি। মাইন ফিল্ডের গায়ে ঝুলছে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি আর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে নিয়মিত টহলদার মোটরগাড়ি।

উপত্যকার উপরে আবহাওয়া বেশ গরম। তাই জানালা খোলাই থাকল গাড়ির। লম্বা বাদামী পায়ে বাতাস লাগার জন্য স্কার্ট কোমর পর্যন্ত তুলে নিল ডেবরা।

যদি তুমি সঠিক সময়ে লাঞ্চে পৌঁছাতে চাও, তাহলে এমনটা না করলেই ভালো।’ সতর্ক করে দিল ডেভিড। তাড়াতাড়ি স্কার্ট নামিয়ে নিল ডেবরা।

তুমি আশেপাশে থাকলে কিছুই নিরাপদ না। অভিযোগ করল ডেবরা।

অবশেষে শুষ্ক-শূন্যস্থান পার হয়ে গালিলির নিচে কিবুতজিমের উর্বর ভূমিতে পৌঁছালো তারা। আবারো বাতাসে ভেসে এলো কমলার তীব্র সুগন্ধ, এতটাই বেশি যে মনে হলো নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

এরও পরে দেখা মিললো তাল আর খেজুর গাছের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া লেকের জল। ডেভিডের হাত স্পর্শ করল ডেবরা।

‘আস্তে চালাও, ডেভি। তিববরিয়াসের এই আর কয়েক মাইল গেলেই ইলার বাসা। সামনে বাক নাও।

এই রাস্তাটা চলে গেছে লেকের তীরে। শেষ হয়েছে প্রাচীন পাথরের ব্লকের কাছে গিয়ে। ইতিমধ্যে আরো পাঁচড়ি গাড়ি পার্ক করে আছে পার্কিং লটে।

 ‘লাঞ্চ পার্টি দিয়েছে ইলা। দেয়ালের মাঝে গেইটের কাছে ডেভিকে নিয়ে গেল ডেবরা। ওপাশে ছোট্ট একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ। হেলেপড়া দেয়ালগুলো কেমন অদ্ভুত লাগছে দেখতে। পাথরগুলোও বয়সের ভারে কালো রং ধারণ করেছে, তাদের গায়ে জন্মে আছে উজ্জ্বল রঙের বোগেনভেলিয়া আর লম্বা তাল গাছের ডগাগুলো। লেক থেকে আসা বাতাসের কল্যাণে কাঁপছে একটু একটু করে। সবুজ লনে ফুটে আছে আরো সুন্দর সব উদ্ভিদ।

 ভেঙ্গেপড়া বাড়িটার একটা অংশকে ঠিকঠাক করে ছবির মতো সুন্দর লেক সাইড হোম বানানো হয়েছে। চওড়া বারান্দা আর পাথরের জেটি দেখা যাচ্ছে সেখানে, আবার একটা মোটর বোটও আছে নোঙর করা। লেকের সবুজ পানির ওপারে উঠে গেছে গাঢ় রঙের গোলান হাইটস্।

‘এটা ক্রুসেডার দুর্গ ছিল। ব্যাখ্যা করে বলল ডেবরা। লেকের ওপারে চলাচলের সময় ট্রাফিক পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছিল হর্নস অব হিতেমের দিকে, যেটি মুসলিমরা পবিত্র ভূমি থেকে ক্রসেডারদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার সময় ধ্বংস করে দেয়। অ্যালেনবি প্রশাসনের সময় কিনে নিয়েছিল ইলার দাদা। কিন্তু তারপর ধ্বংস হয়ে যায় আর স্বাধীনতার পর আবারো ঠিকঠাক করে নেয় ইলা।

পুরো জায়গাটার রোমান্টিক সৌন্দর্যটুকু যাতে নষ্ট না হয় সেটার কথা মাথায় রেখেই কাজ করা হয়েছে। তাই ইলার নন্দন চিন্তা ফুটে উঠেছে। পরিষ্কারভাবে। যদিও এই নারীকে স্বচক্ষে দেখে ব্যাপারটা দুর্বোধ্যই ঠেকল।

ইলা বেশ বড়সড়; শুধু মোটা বা লম্বার জন্য নয়, সব মিলিয়েই বিশাল। হাত আর পাগুলো বড় বড়, আঙুল ভর্তি দামী পাথরের আংটি, খোলা স্যান্ডেল ভেদ করে পায়ের লম্বা নখ দেখা যাচ্ছে লাল রঙে রঞ্জিত। দাঁড়ানোর পর দেখা গেল লম্বায় ডেভিডের সমান। কিন্তু শরীরের ফোলা আর চোখ ধাঁধানো নকশা করা পোশাক এতটাই ফুলে রইল যে মনে হলো দু’জন ডেভিডের জায়গা হয়ে যাবে স্বচ্ছন্দে। মাথায় কোঁকড়ানো চুলের পরচুলা লাগানো। লাল রঙের পরচুলা আর উজ্জ্বল সোনার কানের দুল। দেখে মনে হচ্ছে ইচ্ছেমতো চোখের মেক-আপ করেছে। মুখ থেকে পাতলা কালো চুরুট সরিয়ে কিস্ করল ডেবরাকে। এরপর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেভিডকে। কণ্ঠস্বরের সঙ্গে বের হলে এলো চুরুট আর ব্যান্ডির গন্ধ।

 ‘আমি আশা করিনি যে তুমি এতটা সুন্দর হবে।’ জানিয়ে দিল ইলা। ‘আমি সৌন্দর্য পছন্দ করি না। প্রায়শই এটি ধোকাবাজ হয়। সাধারণত এর আড়ালে ঢাকা থাকে ভয়ঙ্কর কোন কিছু যেমন কোবরার উজ্জ্বলতা অথবা ক্যান্ডি বারের মোড়ক, মিষ্টি আর নরম। নিজের কোকড়ানো শক্ত পরচুলায় হাত বুলালো ইলা। ছোট চোখজোড়া স্থির করল ডেভিডের ওপর। না আমি বরঞ্চ কুৎসিতকেই বেছে নেবো।

নিজের সমস্ত সৌন্দর্য দেখিয়ে হেসে ফেলল ডেভিড। হ্যাঁ।’ একমত হলো সেও। তোমার সাথে দেখা হয়ে আর তোমার কিছু কাজ দেখে একথা পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছি আমি।’

অদ্ভুত শব্দ করে হেসে আবারো চুরুট মুখে পুরে দিল ইলা। যাই হোক অন্তত কোন চকোলেট সৈন্যের সাথে দেখা হয়নি আমার। বিশাল পুরুষালি হাত তুলে দিল ডেভিডের কাঁধে। নিয়ে গেল অন্য অতিথিদের সাথে পরিচয় করাতে।

বারো জন মানুষের সংমিশ্রণ, প্রায় সবাই বুদ্ধিজীবী চিত্রকর, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক–ডোর পাশে বসে নরম রোদে বীয়ার আর মজার আলোচনাতে সন্তুষ্টই হলো ডেভিড। যাই হোক, এ শান্ত ভাব স্থায়ী হতে দিল না ইলা। একসাথে বসে চমৎকার অ্যালফ্রেসকো খাবার, ঠাণ্ডা মাছ আর ডিম নিয়ে বসে আবারো আক্রমণ করে বসল ডেভিডকে।

 তোমার সামরিক গর্বিত ভাব আর স্নেহ, আড়ম্বরতা আর সৌন্দর্য। আমার যেমনটা মনে হয় তোমার দেশপ্রেমের উপর গুটি আর সাহস তোমার নির্ভরতা আর শিষ্টাচারের আদেশ–এ সমস্তই ভড়ং। পৃথিবীকে গলানো মাংস দিয়ে ভরে দেবার জন্য তোমার বাহানা।

 ‘আমার অবাক লাগে ভেবে যে যদি এক প্লাটুন সিরিয়ান সৈন্য এখানে হামলে পড়ে তোমার সম্ভ্রমহানি ঘটানোর জন্য, তখনো কী তুমি এমনটাই

ভাববে কিনা। জানিয়ে দিল ডেভিড।

‘মাই বয়, আমি তো এরকম একটি সুযোগের জন্য স্বর্গের দিকে দুহাত তুলে প্রার্থনা করতেও প্রস্তুত আছি। এমন জোরে হেসে উঠল ইলা যে মাথার পরচুলা আরেকটু হলে পড়েই যেত। ঠিকঠাক মতো এটিকে যথাস্থানে বসিয়ে আবারো কথা বলা শুরু করল সে।

 ‘তোমার পুরুষালি বোমা, স্বার্থপর ঔদ্ধত্য, তোমার কাছে এই নারী টার্কির মতো পা দিয়ে ডেবরাকে দেখিয়ে দিল ইলা, তোমার কাছে হয়তো ও স্পার্ম গ্রহীতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই নারী যে ভবিষ্যতের ধারক, তা তোমার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করে না। ওর ভেতরে আছে চমৎকার লেখনী শক্তি। তোমার কাছে ও শুধুমাত্র

এবার বাধা দিয়ে উঠল ডেবরা। যথেষ্ট হয়েছে। আমার বেডরুম নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা চাই না আমি। যুদ্ধ করার প্রস্তুতি চোখে নিয়ে ডেবরার দিকে তাকাল ইলা।

 ‘তোমার প্রতিভা এমন কোন উপহার নয় যা তুমি যেভাবে খুশি ব্যবহার করবে। সমস্ত মানব জাতির সম্পত্তি এটি, তাদের প্রতি দায়িত্ব আছে তোমার। এই দায়িত্ব হলো তোমার প্রতিভাকে কাজে লাগাও, একে বাড়িয়ে তোল। ডেবরার বিরোধিতাকে একেবারেই আমল না দিয়ে বলে চলল ইলা, ‘এই তরুণ মঙ্গল দেবতাকে হৃদয় দেয়ার পর থেকে এক লাইনও লিখেছো তুমি? এই ছাদের উপর এক বছর আগে আমরা যে উপন্যাসের কথা আলোচনা করেছিলাম তার কী হলো? তোমার সব আবেগ উবে গেল? তোমার ওভারির নাচন

 ‘থামো ইলা!, ডেবরা প্রায় রেগে উঠল। গাল হয়ে উঠল লাল। বাদামী চোখ জ্বলছে।

 হা! হা!’ মাংসের হাড় রেখে দিয়ে শব্দ করে আঙুল চুষে নিল ইলা। ‘নিজের উপর লজ্জা হওয়া উচিৎ তোমার

‘ধুত্তেরি। ভয়ঙ্কর খেপে উঠল ডেবরা।

যা খুশি বলল আমাকে কিন্তু না লিখলে তুমিই পস্তাবে! লেখো নারী, লেখো?’ চেয়ারে হেলান দিল ইলা। ক্যাচক্যাচ করে আওয়াজ তুলল ভারী শরীর বহন করে। ঠিক আছে এখন তোমরা সাঁতার কাটাতে যেতে পারো। ডেভিড এখনো আমাকে বিকিনি পরিহিত অবস্থাতে দেখেনি যখন দেখবে তখন নিশ্চয়ই এই ছোট্ট মেয়েটার প্রতি সদয় হবে আরো!’

রাতের বেলা জেরুজালেমে ফিরে এলো তারা। সূর্যের আলো আছে তখনো। এছাড়াও মার্সিডিজের আসন প্রেম করার উপযুক্ত নয়। তারপরও ডেভিডের কাছ ঘেঁসে বসল ডেবরা।

 ‘ইলা ঠিক কথাই বলেছে। দীর্ঘ নীরবতার পর বলে উঠল ডেভিড। ‘তোমার লেখা উচিৎ, ডেবস।

‘ওহ, আমি করব। হালকা স্বরে জানাল ডেবরা।

কখন?’ জোর দিল ডেভিড। আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো ডেবরা।

‘এই তো কয়েকদিনের মাঝেই। ডেভিডের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল ডেবরা।

‘এই তো কয়েকদিনের মাঝেই। ডেবরার ভঙ্গি নকল করে বলে উঠল ডেভিড।

‘জ্বালাতন করো না তো মরগ্যান। প্রায় ঘুমিয়েই পড়ল ডেবরা।

‘ভান করা বন্ধ করো।’ মুক্ত হাত দিয়ে ডেবরার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিল ডেভিড। আর আমি কথা বলার সময় ঘুমাবে না।’

 ‘ডেভিড, মাই ডার্লিং, সারা জীবন পড়ে আছে সামনে তার চেয়েও বেশি। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা। তুমি আমাকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলেছে। তুমি আর আমি হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকবো আর সবকিছুর জন্যেই যথেষ্ট সময় পাবো।

সম্ভবত অন্ধকারের দেবতারা শুনতে পেয়েছে ডেবরার অহংবাণী। বিদ্রুপাত্মকভাবে তাই মাথা নেড়েছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে।

শনিবারে মালিক স্ট্রিটের বাসায় এলো জো আর হান্নাহ। লাঞ্চের পর সবাই মিলে ঠিক করল ডেভিডকে নিয়ে ট্যুরে যাবে। আর তাই চারজন মিলে গেল উপত্যকার ওপরে জিয়ন পর্বতে। প্রবেশ করল করিডোরের গোলক ধাঁধায়, যার মাধ্যমে যেতে হয় ডেভিডের কবরে। অসাধারণ অ্যামব্রয়ডারি করা কাপড় আর রূপার মুকুট আর টোরা কাভার দিয়ে ঢাকা। কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে গেলেই একই দালানে দেখা মিলবে যীশুর শেষ ভোজের কক্ষ। তাই এই দূর্গে জুদাইজম আর খ্রিস্টান তত্ত্ব একসাথে মিলে গেছে।

 এর পরে জিয়ন গেইট দিয়ে পুরোন শহরে প্রবেশ করল তারা। অনুসরণ করে চলল জুদাইজমের কেন্দ্রের দেয়াল। বিশাল পাথরের ব্লকের লম্বা চুড়া যা তৈরি হয়েছে সেই হেরোদের আমলে, ফলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তখনকার নান্দনিক ঐতিহ্য। হেরোদের দ্বিতীয় মন্দির যা দুই হাজার বছর আগে রোমানরা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।

প্রধান ফটকের কাছে সার্চ করে দেখা হলো তাদের। এরপর ধর্মপ্রাণ পূজারীদের সাথে মিশে এগিয়ে চলল দেয়ালের দিকে। বাধার কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। ডেভিডের মনের মাঝে জেগে উঠল গহীনে থাকা গোত্রীয় স্মৃতি। কেমন শূন্য একটা অনুভূতি যা পূর্ণ হবার অপেক্ষায় আছে।

 দেয়ালের মুখ দিয়ে প্রার্থনা করছে সকলে। এদের অনেকেই ইহুদিদের লম্বা কালো কোট পরে এসেছে। অন্যদিকে এ পুরুষদের তুলনায় ডান দিকে মোটামুটি চুপচাপ নিজেদের প্রার্থনা উৎসর্গ করছে নারীরা।

অবশেষে কথা বলে উঠল জো। গলার স্বরে খানিকটা অস্বস্তি। আমার মনে হয় আমারও গিয়ে শ’মা বলা উচিৎ।

হ্যাঁ। একমত হলো হান্নাহ। আমার সাথে আসবে ডেবরা?

একটু দাঁড়াও।’ ডেভিডের দিকে তাকাল ডেবরা। হ্যান্ডব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে এগিয়ে দিল ডেভিডের দিকে। আমি বিয়ের জন্য তৈরি করেছিলাম এটা। কিন্তু এখনই পরে নাও।

 একটা ইয়ামুলকা এগিয়ে দিল ডেবরা। কালো সাটিনের উপর অ্যামব্রয়ডারি করা প্রার্থনা টুপি।

‘জোর সাথে যাও। ও তোমাকে দেখিয়ে দেবে কী করতে হবে। ডেভিডকে জানাল ডেবরা।

নারীদের ভিড়ের কাছে চলে গেল মেয়েরা। মাথায় টুপি পরে নিল ডেভিড আর জোকে অনুসরণ করে নিচে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। একজন শামাস এগিয়ে এলে তাদের দিকে। লম্বা, রূপালি দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ। ডেভিডকে সাহায্য করল তার ডান বাহুতে ছোট্ট একটা চামড়ার থলে বেঁধে নিতে। এতে আছে টোরাহর একটা অংশ।

‘তো এখন তুমি এই শব্দগুলোকে তোমার হৃদয় আর আত্মায় ধারণ করে নাও আর তোমার ডান বাহুতেই তাদেরকে রাখবে।’

এরপর একটা টালিট ছড়িয়ে দিল ডেভিডের কাঁধে, উল দিয়ে বোনা একটা শাল। এরপর পথ দেখিয়ে দেয়ালের কাছে নিয়ে গেল আর শামাসদের সাথে সাথে বলতে লাগল ডেভিড :

‘শোন, ও ইস্রায়েল, প্রভু, আমাদের ঈশ্বর, প্রভু মাত্র একজন

বহুদিন আগে শেখা শব্দ মনে পড়ে গেল ডেভিডের। চোখ তুলে তাকাল বিশাল পাথরের ব্লক দিয়ে বানানো দেয়ালের দিকে। টাওয়ারের মতো উঁচু দেয়াল উঠে গেছে উপরের দিকে। ওর পূর্বে আসা হাজারো ধর্মপ্রাণ কাগজে নিজেদের প্রার্থনা লিখে গুঁজে রেখে গেছে পাথরের জয়েন্টের মাঝে। চার পাশে গুনগুন করে প্রার্থনা করছে সবাই। ডেভিডের মনে হলো যেন সে কল্পনা করতে পারছে যে প্রার্থনার সোনালি স্তম্ভ উঠে গেছে এই পবিত্র ভূমি থেকে স্বর্গপানে।

এরপর ইহুদি কোয়ার্টারে যাবার সিঁড়িতে উঠল তারা। পেটের মাঝে কেমন যে ভালো লাগার একটা অনুভূতি শিরশির করে উঠল।

সেই সন্ধ্যায় ছাদে বসে গোল্ডস্টার বিয়ার পান করার সময় অবচেতনেই কথা বলার বিষয় হয়ে উঠল ঈশ্বর আর ধর্ম।

জো বলে উঠল, আমি একজন ইস্রায়েলি, তারপর একজন ইহুদি। প্রথমে আমার দেশ; তারও অনেক পরে আসবে ধর্ম।

কিন্তু দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করার সময় তার মুখের অভিব্যক্তি মনে পড়ে গেল ডেভিডের।

বহু রাত পর্যন্ত চলল গল্প। নিজের ধর্মীয় ঐতিহ্যের বিশালত্ব উপলব্ধি করল ডেভিড।

‘আমি এ সম্পর্কে আরো বেশি কিছু জানতে চাই।’ স্বীকার করল সে। ডেবরা কিছুই বলল না। কিন্তু ডেভিডের লাগেজ গুছিয়ে দেয়ার সময় পরিষ্কার ইউনিফর্মের উপর রাখল হারমান ওকের এক কপি “দিজ ইজ মাই গড।”

এটা পড়ে ফেলল ডেভিড। এরপর যখন মালিক স্ট্রিটে এলো জানতে চাইল আরো কিছু। প্রতিবারই বই নির্বাচন করে দিল ডেবরা। প্রথমটাতে ইংরেজি, এরপর হিব্রুতে। ধীরে ধীরে এ ভাষার উপর দখল বেড়ে যেতে লাগল ডেভিডের। এ সমস্ত বই সবই যে ধর্মের উপর লেখা তা নয়। এদের মাঝে ইতিহাস আর ঐতিহাসিক উপন্যাসও থাকায় আস্তে আস্তে সভ্যতার এই প্রাচীন কেন্দ্রভূমি নিয়ে ডেভিডের আগ্রহ বৃদ্ধি পেল। তিন হাজার বছর ধরে যুদ্ধভূমি আর নানান দোলাচলে দুলছে এই ভূমি।

 ব্যাগের মাঝে ডেবরা যাই ভরে দিত, তাই পড়ে ফেলা অভ্যাস হয়ে গেল ডেভিডের। যোসেফাস ফ্লেভিয়াস থেকে লিওন ইউরিস পর্যন্ত।

এর মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহও বেড়ে গেল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সময় পেলেই দু’জন একসাথে ঘুরে বেড়াতে লাগল ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোতে। এর শুরু হলো মাসাডার পাহাড়ের মাথায় থাকা দুর্গ থেকে। যেখানে রোমের কাছে আত্মসমর্পণ না করে একে অন্যকে খুন করেছিল গোড়ারা। এরপর তেমন একটা পরিচিতি নেই–এমন ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতেও ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা।

বহুক্ষণ পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকা লম্বা দিনগুলোতে দু’জনে লাঞ্চ করতে কোন রোমান ধ্বংসাবশেষের উপরে বসে, তাকিয়ে দেখতে মরুভূমির উদরে জন্ম নেয়া ছোট্ট কাঁটা গাছের উপর বসে আছে শকুন। এরপর হয়তো দু’জনে মিলে খুঁজে দেখতো শেষবারের বৃষ্টিতে কোন প্রাচীন কয়েন বা পুরাতত্ত্ব উঠে এসেছে কিনা।

তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে কমলা আর সোনালি পাথরের লম্বা চূড়া। এত পরিষ্কার ঝকঝকে আলোয় মনে হচ্ছে বহুদিন ধরেই এসব দেখছে তারা। চারপাশ এতটাই নীরব যেন পৃথিবীর শেষ আর একমাত্র মানব-মানবী তারা দু’জনে।

এই দিনগুলোর মতো এত সুন্দর দিন আর আসেনি ডেভিডের জীবনে। স্কোয়াড্রনের স্টান্ডবাই থাকাকালীন কষ্টকর ঘণ্টাগুলোতে এর অর্থ আর উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে ডেভিড। আর দিন শেষে সব সময়েই আনন্দ, উঞ্চতা আর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করতে মালিক স্ট্রিটে তার ঘর।

বিয়ের জন্য বেস থেকে ছুটি নিয়েছে জো আর ডেভিড। এখন চারপাশ বেশ শান্ত আর লে ভফিনও কোন বাধা দিল না। কেননা অতিথি তালিকায় সেও আছে।

আগের দিন জেরুজালেমে পৌঁছে গেল তারা আর তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে গেল। ট্যাক্সি-ড্রাইভার আর ট্রাকার হিসেবে পরিশ্রম করতে হলো ডেভিডকে। ফুল থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্র, দূরের থেকে আসা আত্মীয়স্বজন সবাইকে বহন করল মার্সিডিজ।

ব্রিগের বাগান সাজানো হলো তালপাতা আর রঙিন ফেস্টুন দিয়ে। মাঝখানে রাখা হলো প্লাহ। নীল আর সোনালি রঙ দিয়ে তৈরি করা ধর্মীয় চিহ্ন, ডেভিডের তারকা, আঙুর, গম, তরমুজসহ উর্বরতার সমস্ত চিহ্ন বা প্রতীক। এই চাদোয়ার নিচে অনুষ্ঠিত হবে বিয়ের অনুষ্ঠান। জলপাই গাছের নিচে লম্বা টেবিলে সাজানো রয়েছে ফুলের বোল আর ফল দিয়ে বানানো খাবার। তিনশ অতিথির আসন পাতা হয়েছে। এছাড়াও নাচের জন্য রাখা হয়েছে খোলা জায়গা। বাদক দলের জন্যও উঁচু কাঠের স্ট্যান্ডের গায়ে পতাকা লাগানো হয়েছে।

পেশাদার খামার থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সতর্কতার সাথে মেন্য ঠিক করেছে রাঁধুনী আর নারীরা। প্রধান পদ দুটি বিশাল স্টাফ করা টুনা, উর্বরতার চিহ্ন আর পিতলের থালার উপর সাজানো বেদুইন ধাঁচে রান্না করা ভেড়ার মাংস।

বিয়ের রবিবারে ডেভিড ডেবরাকে নিয়ে গেল হাদাসা হাসপাতালের প্রধান শল্যবিদের বাসায়। হানা তার একজন থিয়েটারের বোন আর ভদ্রলোকের ইচ্ছে হান্নাহ বিয়ের পোশাক পরা থেকে প্রস্তুত হওয়া সবই করবে তার বাসায়। ডেবরা হান্নাহকে সাহায্য করবে। ডেভিড তাকে রেখে ইন কারেমে ফিরে গেল। বাসায় যাবার রাস্তা ইতিমধ্যে নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পাহারায় আছে সিক্রেট সার্ভিসের দল আর প্যারাট্রুপার।

জোর বিছানায় আধশোয়া হয়ে ডেভিড দেখতে লাগল কেমন করে কাপড় পরছে জো। এদিকে আবার আংটি হারিয়ে ফেলেছে, খুঁজেও পেয়েছে সাথে সাথে। অন্যদিকে নার্ভাস হয়ে ঘামতে ঘামতে শেষ। সুযোগ পেয়ে নানান আজেবাজে উপদেশ দিতে লাগল ডেভিড। নিচের বাগানে জড়ো হওয়া অতিথিদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল ডেভিড। দেখতে পেল মূল ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে সতর্কতার সাথে তল্লাশি চালাচ্ছে একজন এয়ারফোর্স কর্নেল, যদিও পুরোপুরি ভাবে সারা হচ্ছে কাজগুলো।

তারা বেশ তৎপর।’ মন্তব্য করল ডেভিড।

হান্নাহ বলেছে বাগানে যতটা সম্ভব কম পাহারা রাখতে। তাই কে ঢুকছে এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক তারা। অবশেষে সাজগোজ শেষ করল জো। কিন্তু ইতিমধ্যে ইউনিফর্মের বগলের নিচে ঘামের দাগ ফুটে উঠেছে।

কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল জো।

‘গড, যথেষ্ট হ্যান্ডসাম তুমি।’ জানিয়ে দিল ডেভিড।

‘গোল্লায় যাও তুমি, মরগ্যান। জো হেসে ফেলল। মাথায় টুপি বসিয়ে নিল ঠিকঠাকভাবে। ঘড়ির দিকে তাকাল। চলো।’

সেনাবাহিনীর প্রধান রাব্বি ব্রিগ আর অন্যান্যদের সাথে ব্রিগের স্টাডিতে অপেক্ষা করছে। চুপচাপ স্বভাবের রাব্বি ব্যক্তিগতভাবে ‘৬৭-এর যুদ্ধে মুক্ত করেছে দেশপ্রেমিকদের সমাধি। হেব্রনে এগিয়ে যাবার সময় ছত্রভঙ্গ আরবীয় লাইনের উপর দিয়ে জিপ চালিয়ে ঢুকে সমাধিস্থলের গেইট খুলে ফেলে রাব্বি। সাথে ছিল সাব-মেশিনগান। পিছু ধাওয়া করে ক্রন্দরত আরবীয় গার্ডকে ভেতরের দেয়ালের কাছে নিয়ে যায়।

বিগের ডেস্কে এসে বসে জো। সাইন করে কিতুব্বা, বিয়ের কন্ট্রাক্ট। এরপর জোর হাতে সিল্কের কাপড় তুলে দেয় রাব্বি। আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থিত দর্শনার্থীরা সবাই মাজাল টোভস’ গেয়ে অভিবাদন জানায় জোকে।

দলবলসহ বর নিচে এসে বাগানে অপেক্ষা করতে থাকে কনের আগমনের জন্য। প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মৃত বাবার জায়গায় প্রধান সার্জনকে নিয়ে হাজির হয় হান্নাহ। সাথে আসে উৎসবের সাজে সজ্জিত নারীগণ। এদের মাঝে ডেবরা আর ওর মা-ও আছে। সবার হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি।

ডেভিডের কাছে হান্নাহকে কখনোই তেমন আকর্ষণীয় মনে হয়নি। মেয়েটা বেশি লম্বা আর অভিব্যক্তি বা শরীরের দিক থেকেও কেমন কাঠখোট্টা। কিন্তু আজ সাদা বিয়ের পোশাক আর ওড়নায় পুরোপুরি বদলে ফেলেছে নিজেকে।

ফোলা সাদা স্কার্টের উপর দিয়ে একখণ্ড মেঘের মতো ভেসে এলো যেন হান্নাহ। ওড়নার কারণে মোলায়েম হয়ে আছে চেহারা। ভেতরের খুশি উপচে পড়ছে সবুজ চোখের তারায়। লাল-সোনালি চুল গালের দু’পাশে। ডেবরার দক্ষ হাতের মেক-আপে ঢাকা পড়েছে মুখের তিল। হান্নাহর হাড়সর্বস্ব নাকটাকেও সুন্দর করে দিয়েছে ডেবরা। তাই যতটুকু সম্ভব ততটুকুই সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে আজ।

এয়ারফোর্সের কল্যাণে বাদামী চামড়ার জোকে বেশ বড়সড় আর হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে বাগানের দরজায় এগিয়ে গেল হান্নাহকে এগিয়ে আনতে। এখানে আবার কনের মুখের উপর ওড়না নামানোর অনুষ্ঠান বেদেকেন ডিকালেও সম্পন্ন হলো।

এরপর জো চূপাহ চাঁদোয়ার নিচে গেল। এখানে কাঁধে টালিট নিয়ে অপেক্ষা করছে রাব্বি। জোর পেছনে হান্নাহকে নিয়ে এলো রমণীকুল।

সবার হাতেই জ্বলন্ত মোমবাতি। গুনগুন করে বিয়ের আশির্বাদ মন্ত্র উচ্চারণ করল রাব্বি। জোকে ঘিরে সাতবার ঘুরে মেজিক্যাল সার্কেল পূরণ করল কনে আর তার সঙ্গী নারীরা। পুরাতন নিয়মে এর অর্থ পাপাত্মাকে দূর করা। অবশেষে পাশাপাশি দাঁড়াল বর এবং কনে। মন্দিরের দিকে মুখ করা। অতিথি আর দর্শনার্থীরাও তাদের কাছাকাছি এগিয়ে আসার পর শুরু হলো বাকি আনুষ্ঠানিকতা।

ওয়াইনের পাত্র আশির্বাদ করে দিল রাব্বি। এখান থেকেই একত্রে পান করল বর-কনে। এরপর জো তাকাল হান্নাহর দিকে। ওর মুখের উপরের অংশ এখনো ওড়না দিয়ে ঢাকা। হান্নাহর ডান হাতের বুড়ো আঙুলে সোনার আংটি পরিয়ে দিল জো।

 ‘মোশি এবং ইস্রায়েলের নিয়মানুসারে এই আংটির মাধ্যমে আমার অংশ হলে তুমি।

 এরপর নিজের গোড়ালির নিচে গ্লাস ভেঙ্গে দিল জো। আর এই তীক্ষ্ণ শব্দের সাথে সাথে শুরু হলো গান-সুর আর আনন্দ-উল্লাস। জোর পাশ থেকে সরে ভিড়ের মাঝে পথ করে ডেবরার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড।

হলুদ রঙের গাউন পরে এসেছে ডেবরা। কালো চুলের মাঝে গুঁজে দিয়েছে তাজা ফুল। কোমর ধরতেই সুঘ্রাণ পেল ডেভিড। বিড়বিড় করে ডেবরার কানে কানে বলল, এরপর তুমি, আমার সুন্দরী! একইভাবে উত্তর দিল ডেবরাও ‘হ্যাঁ, প্লিজ!

হান্নাহর হাত ধরে সাজিয়ে রাখা নাচের মঞ্চে উঠে গেল জো। হালকা। সুরের সাথে বাদক দল বাজানো শুরু করল আর উপস্থিত সব তরুণ-তরুণীর দলও উঠে গেল নাচতে। বয়ষ্করা তালপাতার নিচে সাজানো লম্বা টেবিলের চারপাশে গিয়ে বসে পড়ল।

সমস্ত হাসি-আনন্দের মাঝেও খানিকটা নিরানন্দ যোগ করল ইউনিফর্মের দল। প্রতি দুই জনের একজন এসেছে যুদ্ধ সাজে। বাগানের প্রধান ফটক আর রান্নাঘরের প্রবেশদ্বারে কাঁধে উজি মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্যারাট্রুপার প্রহরী। সিক্রেট সার্ভিসের লোকদেরকে খুঁজে পাওয়াটাও সহজ। সিভিলিয়ান পোশাকে হাসি-বিহীন, সতর্ক চোখ-মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অতিথিদের মাঝে।

একসাথে নাচলো ডেভিড আর ডেবরা। ডেভিডের হাতের মাঝে বেশ হালকা আর উষ্ণ মনে হলো ডেবরাকে। বাজানো থেমে গেলে পর অপেক্ষাকৃত চুপচাপ একটা কোণায় গেল দুজনে। একসাথে দাঁড়িয়ে অন্য অতিথিদের নিয়ে কথা বলতে লাগল।

 ‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই। ডেভিডের কাঁধে ভর দিল ডেবরা। আমি তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি। কিছু এনে দেবে না?

‘এক গ্লাস ঠাণ্ডা সাদা ওয়াইন?’ পরামর্শ দিল ডেভিড।

হুম, তাই ভালো।’ হাসল ডেবরা। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে একে অন্যকে দেখল দু’জনে। হঠাৎ করেই কেমন একটা দুঃখবোধ জেগে উঠল ডেভিডের মাঝে। কেমন একটা হতাশা। মনে হলো কিছু একটা হারাতে বসেছে সে। এটি এমন একটি অনুভূতি যে মনে হলো বুকের মাঝে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। মুছে যেতে লাগল সব হাসি-আনন্দ।

 ‘কি হয়েছে, ডেভিড?’ ডেবরার নিজের অভিব্যক্তিও বদলে গেল। শক্ত করে ধরল ডেভিডের হাত। কিছু না। তাড়াতাড়ি ডেবরার কাছ থেকে সরে এলো। চেষ্টা করছে নিজেকে সামলাতে। কিছু না। আবারো বলে উঠল ডেভিড। কিন্তু শক্ত কিছু একটা মনে হলো আটকে গেছে পেটের মাঝে। ‘আমি তোমাকে ওয়াইন এনে দিচ্ছি। ডেবরার কাছ থেকে সরে এলো ডেভিড।

বারের দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। চোখে চোখ পড়তেই হাসল ব্রিগ। আড়চোখে তাকাল বাগানের দিকে। বাবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে জো। এক হাতে পত্নীকে ধরে রেখে হাসছে। মুখের কাপড় সরিয়েছে হান্নাহ। মেক আপের নিচ থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে তিল। তুষার-শুভ্র লেসের ফাঁক গলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল ডেভিড। কিন্তু থামলো না। এগিয়ে গেল খোলা বারের দিকে। বাগানের শেষমাথায় অবস্থিত বারে যেতে যেতেও টের পেল যে দুঃখের অনুভূতিটা এখনো তার ভেতরে দুমড়ে কাঁদছে। এই মুহূর্তে জোর সাথে কথা বলতে চায় না সে।

যেই মুহূর্তে ডেবরার কাছ থেকে সরে এলো ডেভিড, ঠিক সেই মুহূর্তেই বাগানের লোহার গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সাদা জ্যাকেট পরা ওয়েটারের দল। সবার হাতেই সুস্বাদু খাবারের থালা। সূর্যের আলোতেও দেখা গেল গরম ধোঁয়া উড়ছে। মাছ-মাংস আর মসলার গন্ধে ম ম করে উঠল বাতাস। হর্ষধ্বনি ভেসে হলো অতিথিদের কাছ থেকে।

টেবিল, রান্নাঘরের দরজা আর ঘর পর্যন্ত রাস্তা পাতা হয়েছে ওয়েটারদের জন্য।

ডেভিডের খুব কাছ দিয়ে হেঁটে গেল ওয়েটারের দল। হঠাৎ করেই খাবারের উপর থেকে লাইনের দ্বিতীয় ওয়েটারের দিকে মনোযোগ দিল ডেভিড। মাঝারি উচ্চতা আর গাঢ় গাত্রবর্ণ লোকটার মেহগনির মতো চেহারায় ঘন মোচ।

ঘামছে লোকটা। এ কারণেই ভালো করে তাকিয়ে রইল ডেভিড। ঘামে চকচক করছে লোকটার মুখ। মোচের উপর দিয়ে চিবুকে গড়িয়ে পড়ল ঘামের ফোঁটা। বিশাল উঁচু করে ধরতেই দেখা গেল সাদা জ্যাকেটের বাহুমূলে ঘামের দাগ।

ডেভিড তাকাতেই মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলো দু’জনের। ডেভিড বুঝতে পারল লোকটার মনের মাঝে কিছু একটা চলছে–ভয়, সম্ভবত অথবা প্রফুল্লতা। ওয়েটার বুঝতে পারল ডেভিড তাকিয়ে আছে। তাই চট করে চোখ সরিয়ে নিল।

ডেভিড বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কেন যেন সন্দেহ এলো মনে। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ত্রি-মূর্তি এগিয়ে টেবিলের দিকে।

ওয়েটার আবারো ফিরে তাকাল ডেভিডের দিকে। দেখল এখনো তাকিয়ে আছে ডেভিড। আস্তে করে লোকটা নিজের সঙ্গীদেরকে কিছু একটা বলে উঠল, দেখতে পেল ডেভিড। সে লোকটাও ফিরে তাকাল, ডেভিডের দিকে। আর এই দৃষ্টি দেখে ডেভিডের মাথা আর বুকের মাঝে বাজতে লাগল সতর্ক ঘণ্টা। বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বিপজ্জনক আর দুর্বিসহ। এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ রইল না তার।

হন্যে হয়ে প্রহরীদের খোঁজে চারপাশে তাকাল ডেভিড। ওয়েটারদের লাইনের শেষে দেখা যাচ্ছে দু’জনকে। একজন ডেভিডের পাশে গেইটের কাছে।

তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। পথিমধ্যে কে কী বলল কিছুই কানে গেল না তার। তাকিয়ে রইল ওয়েটার তিনজনের দিকে। দেখতে পেল ঘটনার শুরু করতে যাচ্ছে তারা।

এ ব্যাপারে বারংবার রিহার্সাল করে এসেছে তারা নিঃসন্দেহে। তিনজন ওয়েটার একসাথে হাসি-আনন্দে মত্ত অতিথিদের মাঝে টেবিলের উপর রাখল খাবারের থালা। খাবারের উপর থেকে প্লাস্টিক সরাতেই দেখা গেল কালো বস্তুগুলো।

 বাদামী-চেহারার ওয়েটার পিস্তল বের করল প্লাস্টিকের নিচ থেকে। সাথে সাথে ঘুরে দু’জন প্যারাট্রুপারকে গুলি করল পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে। দেয়াল ঘেরা বাগানে অটোমেটিক পিস্তলের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। দু’জন প্রহরীর উপর বুলেট-বৃষ্টির ফলে মনে হলে কোন দানব প্রায় কেটে অর্ধেক করে ফেলল তাদেরকে।

 ডেভিডের বাম পাশের ওয়েটারের চোখ দুটো উজ্জ্বল কালোজামের মতো। বানরমুখো লোকটা নিজের থালা থেকে পিস্তল তুলে নিল। গেইডের কাছে দাঁড়ানো প্যারাট্রুপারদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো।

গার্ডদের উপর প্রথমে আক্রমণ চলল। হাতের মুঠোয় গর্জে উঠল পিস্তল। রাবারের মতো থপ করে শব্দ করে ছিটকে পড়ল শরীরের মাংস।

নিজের উজি বের করার চেষ্টা করল গার্ড। কিন্তু মুখে ঢুকে গেল গুলি। মাথা পিছনে হেলে গেল বুলেটের থাক্কায়। প্যারাট্রুপারের বেরেট পিস্তল গোত্তা খেলো আকাশে। হাত থেকে পড়ে গেল মেশিনগান। টাইলসের উপর দিয়ে। গড়িয়ে এলো ডেভিডের কাছে। নিচু হয়ে ঝাঁপ দিল ডেভিড। এরপর অতিথিদের দিকে পিস্তল তাক করল আরবীয় বন্দুকধারীরা। বুলেট-বৃষ্টি শুরু করল। বন্দুকের শব্দের সাথে মিশে গেল চিৎকার, চেঁচামেচি আর কান্না।

বাগানের অপর পাশে একটা সিকিউরিটি এজেন্ট পিস্তল তুলে নিল হাতে। দু’বার গুলি করল বানরমুখো ওয়েটারকে লক্ষ্য করে। দেয়ালের দিকে পিছু হটলো ওয়েটার। কিন্তু ভারসাম্য হারালো না। নিজের মেশিন পিস্তল দিয়ে গুলি করল এজেন্টের দিকে। গড়িয়ে পড়ে গেল সিকিউরিটি এজেন্ট।

বাগান জুড়ে ছোটাছুটি শুরু করল আতঙ্কিত অতিথিরা। গুলির মুখে চিৎকার করছে, পড়ে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে।

হান্নাহর বুকে লাগল দু’টো গুলি। ধাক্কা খেয়ে পিছনে থাকা টেবিলের গ্লাস আর বোতলের উপর পড়ে গেল সে। সাদা বিয়ের গাউন ভেসে যেতে লাগল উজ্জ্বল রক্তে।

 নিজের পিস্তল খালি হয়ে যাওয়ায় সেটা ফেলে দিল মাঝখানের ওয়েটার। তাড়াতাড়ি তামার থালা থেকে দু’হাতে গ্রেনেড নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুঁড়ে মারলো মানুষের ভিড়ে। জোড়া বিস্ফোরণের সাদা ধোয়ার সাথে তীক্ষ্ণ শার্প নেল ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

 নারীদের তীব্র চিৎকার শোনা গেল চারপাশে আবারো নিচু হলো বন্দুকধারী। হাতে তুলে নিল আরো গ্রেনেড।

মাত্র সেকেন্ডের মাঝে ঘটে গেল এতকিছু।

দ্রুত গড়িয়ে গিয়ে উজি হাতে তুলে নিল ডেভিড। হাঁটু গেড়ে কোমরের কাছে ধরল মেশিনগান, প্যারাট্রুপারের ট্রেনিং থাকায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো কাজ শুরু করল সে।

আহত ওয়েটার দেখতে পেল তাকে। ডেভিডের দিকে ফিরে দুর্বলতা সত্ত্বেও ঘসটে-ঘসটে এগোতে লাগল দেয়ালের পাশ থেকে। একটা হাত পুরো গুঁড়ো হয়ে গেছে। কাঁধ থেকে রক্ত মাখা জ্যাকেটের মাঝে ঝুলছে। কিন্তু অন্যহাতে মেশিন পিস্তল তুলে নিয়ে তাক করল ডেভিডের দিকে।

প্রথমে গুলি করল ডেভিড। আরবীয়টার পেছনের দেয়ালের পাস্টার উঠে গেলে সঠিকভাবে গুলি করল সে। পেছনে ধাক্কা খেল দস্যটা। শরীর ঝাঁকি দিয়ে দেয়ালের সাথে লেগে আটকে রইল লোকটা। সাদা প্লাস্টারের উপর বইতে লাগল রক্তের ধারা।

রান্নাঘরের দরজার পাশে থাকা আরবীয়ের উপর বন্দুক তাক করল ডেভিড। লোকটা মাত্রই একটা গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ডান হাত পেছনের দিকে, দুই হাতের মুঠিতে ধরা ভয়ঙ্কর লোহার বল। চিৎকার করে বলল কিছু একটা, চ্যালেঞ্জ অথবা যুদ্ধের ডাক, বিজয়ের চিৎকার যা আহতদের চিৎকার ছাপিয়েও শোনা গেল।

কিন্তু লোকটা গ্রেনেড ছোঁড়ার আগেই আক্রমণ করল ডেভিডের বন্দুক। ডজনখানেক বুলেট ঢুকে গেল লোকটার পেটে আর বুকে। পায়ের উপর গ্রেনেড দুটি ফেলে দিল আরবীয়টা। থপ করে বসে পড়ে শূন্যহাতে আটকাতে চাইল নিজের রক্তবন্যা।

 গ্রেনেড গুলির ফিউজ শর্ট থাকায় প্রায় তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরিত হলো। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটার কোমরের নিচ থেকে নেই হয়ে গেল। একই বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছাদের শেষপ্রান্তে থাকা দুবৃত্তটাও পড়ে গেল। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ডেভিড।

আর শেষ আরবীয়টা ইতিমধ্যেই মাথা আর বুকে গ্রেনেডের অংশের কারণে আহত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও বেঁচে আছে লোকটা। চেষ্টা করল পাশে নিজের রক্তের মাঝে পড়ে থাকা মেশিন পিস্তলটাকে তুলে নেবার।

ভয়ঙ্কর রেগে উঠল ডেভিড। পাগলের মতো চিৎকার করা শুরু করল সে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ির মাথায় উঠে নিশানা করল আরবীয়ের দিকে।

আরব লোকটার হাতে মেশিন পিস্তল আর মাতালের মতোই হাত কাঁপছে তার। গুলি করল ডেভিড। একটা মাত্র বুলেট বের হয়েই খালি চেম্বার পড়ে গেল নিচে।

অন্যদিকে ছাদের উপরে রক্ত আর ঘামে চকচক করছে আরবীয়ের মুখ। চেতনা হারাবার আগে চেষ্টা করল মেশিন পিস্তলটাকে ঠিকভাবে নিশানা করার। দ্রুত মারা যাচ্ছে লোকটা। তারপরেও চেষ্টা করল শেষ শক্তিটুকু কাজে লাগাবার।

হাতে খালি অস্ত্র নিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড। পিস্তলের শূন্য চোখ খুঁজে নিল তাকে। ডেভিড দেখল আরবীয়ের চোখ সরু হয়ে গেল আর হঠাৎ করেই খুনীর মতো হয়ে উঠল লোকটা। বুঝতে পারল হাতের মুঠোয় পেয়েছে ডেভিডকে। ট্রিগারে চেপে বসল আঙুল।

 ঠিক এই রেঞ্জে হোস পাইপের মতো আঘাত করবে বুলেট। নড়ে উঠল ডেভিড, লাফ দিল সিঁড়ির নিচে; কিন্তু জানে যে দেরি হয়ে গেছে। আরবীয় লোকটা যেই মুহূর্তে গুলি করল ঠিক সেই মুহূর্তে ডেভিডের পাশ থেকে গর্জে উঠল একটা রিভলবার।

অর্ধেক মাথা কেটে গেল লোকটার। পিছনের সাদা দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ল খুলির মাঝে থাকা হলুদ পদার্থ। ট্রিগারে চেপে বসা আঙুল ঝাঁঝড়া করে দিল মাথার উপরে থাকা আঙুল লতা।

পাশে তাকিয়ে ব্রিগকে দেখতে পেল ডেভিড। মৃত সিকিউরিটি গার্ডের পিস্তল হাতে। এক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দু’জনে। এরপরই নেমে গিয়ে অন্য দুই মৃত আরবের কাছে গেল ব্রিগ। প্রতিবারে একজনের খুলিতে ঢুকিয়ে দিল একটা করে বুলেট।

ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত থেকে উজি ফেলে বাগানের দিকে দৌড় দিল ডেভিড।

মৃত আর আহতরা পড়ে আছে পাশাপাশি। মানবতার খণ্ডিত অংশ। আহতদের মৃদু গোঙানি, একটা শিশুর তারস্বরে কান্না, মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল সব চিৎকার ছাপিয়ে।

সারা বাগানময় ছড়িয়ে আছে রক্ত। সাদা দেয়ালের উপরেও ছোপ ছোপ রক্ত। ব্যান্ডস্ট্যান্ডে একজন বাদকের গায়ের উপর দিয়ে ধুলামাখা রক্ত বেরিয়ে আসছে। মসলাদার খাবার আর ছড়িয়ে পড়া ওয়াইনের গন্ধের সাথে রক্তের গন্ধও মিশে গেল। আরো পাওয়া গেল প্লাস্টার, ধুলা আর পোড়া বিস্ফোরকের গন্ধ।

ধোয়া আর ধুলার পর্দায় ঢাকা পড়লেও বাগানের ভগ্নদশা চোখ এড়ালো না। উড়ন্ত লোহার কল্যাণে গোড়া থেকে উঠে এসেছে জলপাই গাছ, ভিতরের সাদা কাঠ দেখা যাচ্ছে। আহতরা হামাগুড়ি দিচ্ছে ভাঙা গ্লাস আর প্লেটের টুকরার উপর। কাঁদছে লোকগুলো, চিৎকার করছে, ফিসফিস করে প্রার্থনা করছে পরিত্রাণের জন্যে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ডেভিড। পা দুটো মনে হলো আপনাতেই চলছে। পেশী সব বোবা হয়ে গেছে। বোধশক্তি লোপ পেয়েছে যেন তার।

ভেঙেপড়া অলিভ গাছগুলোর একটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে জো। তাকে পূর্বের চেয়েও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। শক্তিশালী পাদুটো দুপাশে ছড়িয়ে আছে, মাথা পিছন দিকে হেলে আছে আর মুখ আকাশপানে। কিন্তু চোখ দুটো বন্ধ আর চেহারায় ফুটে আছে নিঃশব্দ কান্না হাতের মাঝে হান্নাহর মৃতদেহ।

হান্নাহর মাথা থেকে খসে পড়েছে বিয়ের ওড়না, উজ্জ্বল তামাটে রঙের চুলের গোছা ঝুলে আছে পেছনে মাটিতেই পড়ে গেছে প্রায়। পাদুটো আর একটা হাত প্রাণহীনভাবে ঝুলে আছে পাশে। দুধ-সাদা মুখমণ্ডলে পরিষ্কারভাবে ফুটে আছে সোনালি তিলগুলো। ওয়েডিং গাউনের মাঝে ফুলের পাপড়ির মতো ফুটে আছে রক্তাক্ত ক্ষত।

চোখ সরিয়ে নিল ডেভিড। জোকে এ অবস্থায় দেখতে পারছে না ও। তার চেয়ে বরঞ্চ আস্তে আস্তে বাগানের এপাশে এসে আতঙ্ক নিয়ে খুঁজতে লাগল ডেবরাকে। ডেবরা! চাইল গলা উঁচিয়ে ডাকতে। কিন্তু খসখস শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হলো না। ঘন কালো রক্তে হড়কে গেল পা। ডেভিড হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল অজ্ঞান নারীদেহের উপর। ফুলের নকশা করা পোশাকে নারীদেহটি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো। ডেবরার মাকে চিনতে পারল না ডেভিড।

 ডেবরা।’ তাড়াতাড়ি করতে চাইল সে। কিন্তু পা দুটো কথা শুনল না। এরপরই ডেবরাকে দেখতে পেল সে। ঠিক দেয়ালের কোণে যেখানে রেখে গিয়েছিল তাকে, সেখানেই আছে ডেবরা।

 ‘ডেবরা! ডেভিড নিজের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন শুনতে পেল যেন। দেখে মনে হচ্ছে অক্ষত আছে ডেবরা। মার্বেল গ্রেসিয়ান মূর্তির নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। চুলে তখনো ফুল, পোশাক উজ্জ্বল, পরিপাটি।

 দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে আছে ডেবরা। চট করে দেখে মনে হলো যেন প্রার্থনা করছে। কালো চুলের ঢল মুখের সামনের অংশ ঢেকে রেখেছে। মুখের উপর দু’হাত দিয়ে রেখেছে ডেবরা।

‘ডেবরা। ডেবরার পাশে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল ডেভিড। আস্তে করে হাত রাখল কাঁধে।

‘তুমি ভালো আছো তো? আস্তে করে হাত নামালো ডেবরা মুখের উপর থেকে। সাথে সাথে যেন বরফের মতো জমে গেল ডেভিড। ডেবরার হাত ভর্তি রক্ত। উজ্জ্বল লাল রক্ত। ঠিক ক্রিস্টালের গ্লাসে ওয়াইনের মতোই উজ্জ্বল।

 ‘ডেভিড’, ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। আস্তে করে ঘুরলো ডেভিডের দিকে। তুমি এসেছো?”

শব্দ করে হতাশার শ্বাস বের হয়ে এলো ডেভিডের বুক চিরে। দেখতে পেল ডেবরার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। ঘন চোখের পাপড়িতে জড়িয়ে আছে জেলির মতো পদার্থ। অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী হয়ে উঠেছে রক্তাক্ত মুখোশ।

‘তুমি এসেছো ডেভিড?’ আবারো জানতে চাইল ডেবরা। অন্ধের মতো কিছু শোনার আশায় কান পেতে রইল ডেরা।

 ‘ওহ, ঈশ্বর ডেবরা।’ ডেবরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড।

 ‘আমি দেখতে পাচ্ছি না ডেভিড!’ হাত বাড়ালো ডেবরা। ওহ ডেভিড আমি দেখতে পাচ্ছি না।’

নিজের হাতে ডেবরার ভেজা হাত তুলে নিল ডেভিড। মনে হলো বুক ভেঙ্গে গেল তার।

.

ইন কারেম গ্রামের উপর আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে হাদাস্সাহ হাসপাতালের আধুনিক ভবন। দ্রুতগতিতে এসে পৌঁছালো অ্যামবুলেন্সের দল। ফলে বেঁচে গেল অনেক সংকটাপন্ন রোগী। হাসপাতাল ভরে গেল হঠাৎ যুদ্ধে আক্রান্ত আহতে-নিহতে।

তিনজন পুরুষ ব্রিগ, জো আর ডেভিড–সারারাত কাটিয়ে দিল হাসপাতালের ওয়েটিং রুমের কাঠের শক্ত বেঞ্চিতে বসে। আক্রমণের পেছনের কাহিনী জানতে পারার সাথে সাথে ব্রিগের কানে এসে তা ফিস ফিস করে জানিয়ে দিয়ে গেল সিকিউরিটি এজেন্ট।

গুপ্তঘাতকদের একজন ক্যাটারিং ফার্মের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী। আর অন্য দুজন তার চাচাতো ভাই, অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েছিল তারই সুপারিশে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে তাদের কাগজপত্র জালিয়াতি হয়েছে।

হঠাৎ করে আসা কাজের কারণে প্রধানমন্ত্রী আর তার কেবিনেট বিয়ের আসরে আসতে দেরি করেছেন। কিন্তু আক্রমণের সময় রাস্তায় ছিলেন তারা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তারা। ব্যক্তিগতভাবে আহত-নিহতের পরিবারের কাছে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

দশটার সংবাদে দামাস্কাস রেডিও একটি রিপোর্ট প্রচার করল। সাথে আল-ফাতাহ এ আক্রমণের দায়িত্ব স্বীকার করেছে। সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যরা করেছে কাজটি।

মধ্যরাতের খানিক আগে প্রধান অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এলো প্রধান সার্জন। তখনো থিয়েটারের সবুজ পোশাক আর জুতা পায়ে, মুখোশ ঝুলছে গলার কাছে। ব্রিগকে জানাল রুথ মোরদেসাইয়ের বিপদ কেটে গেছে। লাঞ্চ ফুটো করে কাঁধের নিচ দিয়ে বের হওয়া বুলেট ফেলে দিয়ে ফুসফুসকে সারিয়ে তুলেছে চিকিৎসকরা।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। বিড়বিড় করে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল ব্রিগ। পঁচিশ বছর ধরে একসাথে থাকা নারী ছাড়া কেমন অদ্ভুত মনে হলো জীবন। এরপরই তাকাল চোখ তুলে। “আমার মেয়ে?

মাথা নাড়ল সার্জন। চিকিৎসকরা এখনো ব্যস্ত তাকে নিয়ে। দোনোমনো করে উঠল সার্জন। কর্নেল হালমান কয়েক মিনিট আগে মারা গেছে।

এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল এগারোতে। আর চারজনের অবস্থা বেশ গুরুতর।

ভোরবেলা সৎকার বাহকেরা এসে পৌঁছালো কালো লিমুজিনে করে বাক্স নিয়ে। মৃতদেহ নিয়ে যাবে। ডেভিড মার্সিডিজের চাবি দিল জোর হাতে। যেন হান্নাহর মৃতদেহ নেয়া থেকে শুরু করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যোগাড় করতে পারে সে।

পাশাপাশি বসে আছে ডেভিড আর ব্রিগ। চিন্তামগ্ন, নিঘুম চোখ। কাগজের কাপে করে কফি পান করছে।

সকাল পার হবার পরে চক্ষু বিশেষজ্ঞ এলো তাদের দিকে। চল্লিশ বছর বয়সী হলেও মসৃণ চেহারার তরুণ ভদ্রলোক। বলিরেখাহীন চেহারা আর পরিক্ষার নীল চোখের সাথে খাপছাড়া লাগল চুলের সাদাটে ভাব।

‘জেনারেল মোরদেসাই?”

শক্তভাবে উঠে দাঁড়াল ব্রিগ। মনে হলো এক রাতেই বয়স বেড়ে গেছে দশ বছর।

‘আমি ডাক্তার ইদেলমান। আমার সাথে আসুন দয়া করে।

ডেভিডও উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ডাক্তার থেমে তাকিয়ে রইল ব্রিগের দিকে।

‘আমি ওর বাগদত্তা। ব্যাখ্যা করল ডেভিড।

‘প্রথমে আমরা একা কথা বললেই ভালো হবে জেনারেল। ইদেলমান চোখ দিয়ে পরিষ্কার সতর্কবাণী উচ্চারণ করল। মাথা নাড়ল ব্রিগ।

“প্লিজ, ডেভিড।

“কিন্তু’ আবারো কিছু বলতে চাইল ডেভিড। আস্তে করে তার কাঁধে হাত রাখল ব্রিগ। এই প্রথমবারের মতো কোন স্নেহবাৎসল্য প্রকাশ পেল দু’জনের মাঝে।

প্লিজ মাই বয়। ঘুরে দাঁড়িয়ে শক্ত বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। নিজের ছোট্ট অফিসে গিয়ে কোণের ডেস্কের ওপাশে বসে সিগারেট জ্বাললো ইদেলমান। ভদ্রলোকের হাত দুটো মেয়েদের মতো চিকন আর লম্বা। একজন পেশাদার সার্জনের মতোই দ্রুত লাইটার জ্বেলে নিল।

 ‘আমার মনে হচ্ছে আপনি কোন ভণিতা পছন্দ করবেন না। সাবধানে প্রশংসা করল ব্রিগের। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বলে চলল ভদ্রলোক,

‘আপনার মেয়ের কোন চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু হাত তুলে ব্রিগের ঠোঁটের কাছে স্বস্তির শব্দকেও থামিয়ে দিল ডাক্তার। ঘুরে তাকাল স্ক্যানারে ঝোলানো এক্স-রে প্লেটের দিকে। পিছনের লাইট জ্বালিয়ে দিতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল ছবি।

 ‘চোখ দুটো পুরোপুরি অক্ষত, বাইরের দিকে প্রায় কোন ক্ষতিই হয়নি– কিন্তু, ক্ষতিটা হয়েছে এখানে, এক্স-রে প্লেটের এক জায়গায় ধোঁয়াটে অংশে শক্ত একটা কিছু দেখাল ডাক্তার। এটি একটি ইস্পাতের টুকরো, খুবই ছোট্ট, নির্ঘাৎ গ্রেনেড় থেকে এসেছে। একটা পেন্সিলের মাথার চেয়ে বড় নয়। ডান দিক দিকে খুলির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। বড় একটা শিরা কেটে ফেলায় রক্তপাত হয়েছে। আই-বলের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ায় বিশেষ কোন টিস্যুর। গায়ে আঁচড়ও পড়েনি। কিন্তু অপটিক চিয়াশমা’র হাঁড়ের অংশে ঢুকে গেছে।

এক্স-রের উপর ছোট্ট ইস্পাতের টুকরো কোন পথে ডেবরার মাথায় ঢুকে গেছে দেখিয়ে দিল ডাক্তার। চিয়াশমা ফুড়ে বের হয়ে গেছে এটি। সিগারেটে লম্বা একটি টান দিয়ে ব্রিগের দিকে তাকাল ডাক্তার। কোন অনুভূতি বুঝতে পারল না।

এর মানে আপনি বুঝতে পারছেন জেনারেল?’ ডাক্তারের প্রশ্নে অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়ল বিগ। এক্স-রে স্ক্যানারের লাইট বন্ধ করে দিল ডাক্তার। ফিরে এলো ডেস্কে। ব্রিগের সামনে একটি স্ক্র্যাপ খাতা টেনে নিয়ে নিজের পকেট থেকে পেন্সিল বের করল। একের পর এক টান দিয়ে এঁকে ফেলল অপটিক্যাল চার্ট, আই বস, ব্রেইন, অপটিক্যাল নার্ভ।

 ‘অপটিক্যাল নার্ভ প্রতিটি চোখ থেকে বের হয়ে এই সরু পথে গিয়ে ফিউজে পৌঁছায়। এরপর শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে যায়।

মাথা নাড়ল ব্রিগ। নিজের পেন্সিল দিয়ে নার্ভের ফিউজ দেখাল ডাক্তার। ব্রিগের ক্লান্ত চেহারায় ফুটে উঠল হতাশা।

‘অন্ধত্ব?’ বিগ্রের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল ইদেলমান।

দুই চোখ?

‘আমার তাই মনে হচ্ছে।’

মাথা নামিয়ে নিজের চোখে হাত বুলাতে লাগল ব্রিগ। এরপর কথা বলল ইদেলমানের দিকে না তাকিয়ে।

‘চিরতরে? জানতে চাইল ব্রিগ।

‘ও আর কখনো রং, আকৃতি, আলো, অন্ধকার বুঝতে পারবে না? ছোট্ট ইস্পাতের টুকরা অপটিক চিয়াশমা ভেদ করে গেছে। সব দেখে মনে হচ্ছে নার্ভের বারোটা বেজে গেছে। মেডিকেল সায়েন্সে এমন কোন কৌশল এখনো নেই যা এটি ফিরিয়ে আনতে পারে। এক মুহূর্ত থেমে শ্বাস ফেলল ইদেলমান। সোজা কথায় বলতে গেলে আপনার মেয়ে আর কখনোই দুই চোখে দেখতে পাবে না।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে আস্তে করে মাথা তুলল ব্রিগ। তাকে জানিয়েছেন এ কথা? তাকাতে পারল না ইদেলমান।

‘আমি আশা করছিলাম যে আপনি বলবেন।

হ্যাঁ। মাথা নাড়ল ব্রিগ। এই-ই ভালো হবে। এখন দেখা করতে পারব ওর সাথে? জেগে আছে?’

‘হালকা সিডেটিভ দেয়া হয়েছে। কোন ব্যথা নেই শুধু একটু অস্বস্তি। বাইরে দিয়ে কিছুই বোঝা যাবে না। আর ইস্পাতের টুকরোটা বের করার কোন চেষ্টাও করা যাবে না। এর জন্যে বড় আকারের নিউরো সার্জারি লাগবে।’ উঠে দাঁড়িয়ে দরজা দেখিয়ে দিল ডাক্তার।

 ‘আপনি এখন দেখা করতে পারবেন। চলুন আমিই নিয়ে যাচ্ছি।’

ইমারজেন্সি থিয়েটারের বাইরের করিডোরের উভয় পাশের দেয়ালে স্ট্রেচারের সারি। নিজের অনেক অতিথিকে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকতে দেখতে পেল ব্রিগ! মাঝে মাঝে থেমে এক-দু’জনের সাথে কথা বলল সে। এরপর ইদেলমানের সাথে এগিয়ে গেল করিডোরের শেষ মাথায় রুমের দিকে।

জানালার নিচে লম্বা একটি বিছানায় শুয়ে আছে ডেবরা। চুলে লেগে আছে শুকনো রক্ত, বিবর্ণ দেখাচ্ছে ডেবরাকে। দুই চোখের উপরে মোটা তুলার ব্যান্ডেজ।

‘তোমার বাবা এসেছেন, মিস মোরদেসাই।’

 ইদেলমানের কণ্ঠ শুনে আস্তে করে মাথা ঘুরালে ডেবরা।

‘ড্যাডি?

 ‘এই তো আমি, বাবা।

ডেবরার বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরল ব্রিগ। নিচু হয়ে কি করল হাতে। কড় জীবাণুরোধক ওষুধের গন্ধ আসছে।

“মাম্মা?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ডেবরা।

‘বিপদমুক্ত। ব্রিগ আশ্বস্ত করল ডেবরাকে। কিন্তু হান্নাহ’ হ্যাঁ। ওরা জানিয়েছে আমাকে।’ বাবাকে থামিয়ে দিল ডেবরা। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে।

‘জো ভালো আছে?

 ‘ও অনেক শক্ত। ঠিক হয়ে যাবে।

 ‘ডেভিড? জানতে চাইল ডেবরা।

‘এই তো এখানে।

আগ্রহে এক কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইল ডেবরা। চেহারায় ফুটে উঠেছে আশার আলো। চোখ বাঁধা অবস্থাতেও চারপাশে খুঁজছে। ডেভিড।’ ডেকে উঠল ডেবরা। কোথায় তুমি? ধুত্তোরি। এই ব্যান্ডেজ … কিছু ভেবো না ডেভিড। এগুলো শুধু চোখকে আরাম দেয়ার জন্য দেয়া হয়েছে।’

না। ডেবরার কাঁধে হাত রেখে শান্ত করতে চাইল ব্রিগ। ও বাইরে অপেক্ষা করছে। সাথে সাথে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল ডেবরা।

‘ওকে আমার কাছে আসতে বলো প্লিজ।’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা।

‘হ্যাঁ। কিন্তু একটু পরে। প্রথমে কিছু কথা বলা প্রয়োজন-আমি কিছু বলতে চাই তোমাকে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা।

মনে হলো বুঝতে পেরেছে ডেবরা। বাবার গলার আওয়াজে এমন কিছু টের পেয়েছে সে যে একেবারে চুপ করে গেল। সেই চিরাচরিত নৈঃশব্দ।

ব্রিগ একজন সৈন্য। যদিও চেষ্টা করল যতটা সম্ভব মোলায়েম স্বরে জানাতে; কিন্তু নিজের কষ্টের ভারে সেটুকুও পারল না ব্রিগ। বাবার হাতের মাঝে থাকা ডেবরার হাত কাঁপতে লাগল। তারপর হয়ে গেল নিস্পন্দ।

কোন প্রশ্ন করল না ডেবরা। পিতা-কন্যা বসে রইল চুপচাপ। প্রথমে কথা বলল ব্রিগ।

‘আমি ডেভিডকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। জানাল ব্রিগ। দ্রুত কথা বলে উঠল ডেবরা।

না। শক্ত করে বাবার হাত ধরল সে। না। আমি এখন ওর সাথে দেখা করব না। প্রথমে আমাকে সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে।’

ওয়েটিংরুমে ফিরে গেল ব্রিগ। আগ্রহ নিয়ে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। নিখাদ মুখশ্রীতে বিবর্ণ ছাপ।

ওকে থামিয়ে দিল ব্রিগ। নো ভিজিটরস। ডেভিডের হাত ধরল ব্রিগ। কাল পর্যন্ত ওর সাথে দেখা করতে পারবে না তুমি।

‘খারাপ কিছু হয়েছে? কী হয়েছে? ডেভিড চাইল ছাড়া পেতে। কিন্তু ব্রিগ তাকে ছাড়ল না।

‘খারাপ কিছু নয়। ও ভালো হয়ে যাবে কিন্তু কোন ধরনের উত্তেজনা সহ্য করতে পারবে না এখন। আগামীকাল ওর সাথে দেখা করতে পারবে তুমি।

.

অলিভস্ মাউন্টেনের উপর পারিবারিক ভূমিতে সমাহিত করা হলো হান্নাহকে। ছোট অন্তেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিল তিনজন পুরুষ আর কয়েকজন আত্মীয়, যাদের অনেককেই যেতে হলো আরো শোকসভায়।

হাই-কমান্ডের সাথে মিটিং আছে ব্রিগের। অফিসের গাড়ি তাই অপেক্ষা করছে বাইরে। পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হবে। কোন না কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে নির্ঘাৎ। সমস্যায় জর্জরিত ভূ-খণ্ডে আবারো শুরু হবে। হাঙ্গামা।

মার্সিডিজে উঠে নিঃশব্দে বসে রইল জো আর ডেভিড। ইঞ্জিন চালু করার কোন চেষ্টাই করল না ডেভিড। জো সিগারেট ধরালো দুজনের জন্য। দু’জনেরই মনে হলো কোন উদ্দেশ্য নেই জীবনের, কোথায় যাবার তাড়া নেই।

কী করবে এখন তুমি? জোর কাছে জানতে চাইল ডেভিড।

‘আমাদের হাতে দুই সপ্তাহ সময় ছিল। নিচে অ্যাশকেলনে যাবার কথা রুদ্ধ হয়ে গেল জোর গলা। আমি জানি না। কিছু করারও নেই, তাই না।’

 ‘চলো কোথাও বসে একটু ড্রিংক করি? মাথা নাড়ল জো। আমার ইচ্ছে করছে না। আমার মনে হয় বেসে ফিরে যাওয়াটাই ভালো হবে। আজ রাতে নাইট ইন্টারসেপশন হবার কথা।’

 ‘হ্যাঁ। ডেভিডও রাজি হয়ে গেল দ্রুত, ‘আমিও যাবো তোমার সাথে। আগামীকাল পর্যন্ত ডেবরার সাথে দেখা করতে পারবে না। মালিক স্ট্রিটের বাসাও শীতল আর শূন্য মনে হবে। হঠাৎ করে তাই তারও মনে হলো বেসে যাবার কথা।

মোলায়েম অন্ধকারে আকাশে চাঁদকে মনে হচ্ছে বাঁকানো সারাসিন ব্লেডের ফলা। আর উজ্জ্বল তারাগুলোকে দেখাচ্ছে মোটামোটা রূপালি পাথরের ন্যায়।

পৃথিবীর অনেক উপরে উড়ে বেড়ালো তারা। উঠে গেল দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে। হারিয়ে গেল নাইট ইন্টারসেপশনের প্রাত্যহিক দায়িত্বে।

টার্গেট হিসেবে ঠিক করা হলো নিজেদের স্কোয়াড্রনের মিরেজ। নেগেত এর অনেক উপরে স্ক্যানারে ধরাও পড়ল এটি। লক্ করল জো, জানিয়ে দিল ট্যাক আর রেঞ্জ। খুঁজে পেয়ে অবশেষে টার্গেট জেটের বিস্ফোরণ ঘটালো ডেভিড। মখমলের মতো কালো রাতের বুকে লাল হয়ে জ্বলতে লাগল এটি।

নিঃশব্দে টার্গেটের পেটের নিচে চলে গেল ডেভিড নিজের প্লেন নিয়ে। এরপরই খাড়া ভাবে উঠতে লাগল উপরে। ঠিক যেমন ভাবে একটা বারাকুজা নিচ থেকে উঠে সমূদ্রের উপরে হুটোপুটি করে। এতটাই কাছ দিয়ে গেল ডেভিড যে টার্গেট মিরেজ হন্যে হয়ে ঘরে ফিরতে চাইল। এক মুহূর্ত আগপর্যন্ত ও টের পায়নি ডেভিডের অস্তিত্ব।

দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিঃশেষিত হয়ে অসাড়ে ঘুমোলো জো। কিন্তু তার নিচের বাঙ্কেই জেগে রইল ডেভিড। খুব ভোরবেলা উঠে শাওয়ার সেরে জোকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বের হয়ে আসল সে। গাড়ি চালিয়ে যখন জেরুজালেমের হাসপাতালে পৌঁছালো, ঠিক তখন উদয় হলো সূর্য। পাহাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়ল নরম সোনালি আর গোলাপি মুক্তার মতো আলো।

ডেস্কে নাইট সিস্টার জানাল, দুপুরবেলা ভিজিটিং আওয়ার্সের আগে ভেতরে যেতে পারবেন না আপনি। কিন্তু নিজের সবটুকু সৌন্দর্য ঢেলে দিয়ে হাসার চেষ্টা করল ডেভিড।

‘আমি শুধু জানতে চাই ও ভালো আছে তো? আমাকে সকালবেলা স্কোয়াড্রনে ফিরতে হবে।

কিন্তু মনে হলো ডেভিডের হাসি আর এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম কিছুই কাবু করতে পারেনি সিস্টারকে। নিজের লিস্ট চেক করে জানাল, আপনার ভুল হচ্ছে। আমাদের এখানে একজনেই মোরদেসাই আছেন। মিসেস রুথ মোরদেসাই।

‘ওর মা। জানিয়ে দিল ডেভিড। নিজের শীটে আবারও চোখ বুলাতে লাগল সিস্টার।

এই কারণেই আমি খুঁজে পাইনি।’ বিরক্তির স্বরে বিড়বিড় করে উঠল সিস্টার। গত রাতেই ডিসচার্জ হয়ে গেছে সে।’

‘ডিসচার্জড? হা করে তাকিয়ে রইল ডেভিড।

হ্যাঁ। গত রাতেই বাসায় ফিরে গেছে সে। এখন মনে পড়ল। তার বাবা এসে নিয়ে গেছে। আমি তখন মাত্র ডিউটিতে এসেছি। সুন্দর মতন মেয়েটার চোখে ব্যান্ডেজ।

‘হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল ডেভিড। ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

 দৌড়ে সিঁড়ি টপকে মার্সিডিজের কাছে ছুটলো সে। পা দুটো মনে হচ্ছে বেশ হালকা। দুঃচিন্তার বোঝা নেমে গেছে অবশেষে মাথা থেকে।

ডেবরা বাসায় গেছে। ডেবরা ভালো আছে। নিরাপদ আছে।

দরজা খুলে দিল ব্রিগ। ডেভিড ঢুকলো প্রাণহীন বাড়িটাতে। এখনো ইউনিফর্ম পরে আছে। কিন্তু পোশাকের ভাঁজ নষ্ট হয়ে কুঁচকে আছে। ব্রিগের মুখের চারপাশে বলিরেখা; চিন্তা, কষ্ট আর ঘুমের অভাবে রক্তাক্ত চোখ।

‘ডেবরা কোথায়? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ডেভিড। কাঁধ নেড়ে একপাশে সরে ডেভিডকে ভেতরে ঢোকার জায়গা দিল ব্রিগ।

 ‘কোথায় ও? আবারো জানতে চাইল ডেভিড। নিজের স্টাডিতে নিয়ে ডেভিডকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল ব্রিগ।

 ‘কেন আমাকে কিছু বলছেন না? রেগে উঠতে লাগল ডেভিড। বড়সড় রুমটা ভর্তি বই আর পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহে। একটা চেয়ারে বসল ব্রিগ নিজে।

‘গতকাল তোমাকে বলতে পারিনি ডেভিড। ও আমাকে বলতে মানা করেছিল। আমি দুঃখিত।

কী কথা?’ সতর্ক হয়ে উঠল ডেভিড।

‘ও চিন্তা করার সময় নিয়েছিল–নিজের মন ঠিক করার। আবারো উঠে দাঁড়াল ব্রিগ। পায়চারি শুরু করল। শূন্য কাঠের মেঝেতে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল পদশব্দ। মাঝে মাঝেই থেমে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল কোন সংগ্রহ। মনে হলো সান্ত্বনা পেতে চাইছে তার মন।

চুপচাপ শুনে গেল ডেভিড। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ল। এমন ভাবে মাথা নাড়ল মনে হলো যা শুনছে সেটা সত্যি বলে মানতে নারাজ সে।

‘সুতরাং বুঝতেই পারছো, এটাই সত্যি। আর কোন আশা নেই। ও অন্ধ। হয়ে গেছে ডেভিড, পুরোপুরি অন্ধ। ও এমন একটা জগতে চলে গেছে যেখানে কেউ ওর সঙ্গী হতে পারবে না।

 ‘কোথায় ও? আমি ওর কাছে যেতে চাই।’ ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। কিন্তু ব্রিগ মনে হলো শুনতেই পেল না। বলে চলল, ‘ও সিদ্ধান্ত নিতে সময় চেয়েছিল–আমি সে সময় দিয়েছি তাকে। গতরাতে, অন্তেষ্টিক্রিয়ার পরে আমি ওর কাছে ফিরে গিয়েছি, দেখেছি ও তৈরি হয়ে গেছে। সে এটা মেনে নিয়েছে, ভেবে দেখেছে কী করা দরকার।

 ‘আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই।’ আবারো বলে উঠল ডেভিড। আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।’

 এবার ব্রিগ তাকাল ডেভিডের দিকে। গলা ধরে এলো সহানুভূতিতে। না, ডেভিড। এই তার সিদ্ধান্ত। তুমি আর কখনো ওর সাথে দেখা করবে না। তোমার কাছে ও মৃত। এগুলো তারই কথা। ওকে বলো আমি মারা গেছি। শুধু মনে রাখবে আমার জীবন্ত স্মৃতি।

বাধা দিল ডেভিড। উঠে দাঁড়াল। কোথায় ও? ধুত্তোরি বলছেন না কেন? গলা কাঁপছে তার। আমি এখনি ওর সাথে দেখা করতে চাই।’ দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। ঝটকা মেরে খুলে ফেলল দরজা। কিন্তু ধরে ফেলল ব্রিগ।

‘ও এখানে নেই।

তাহলে কোথায়? ফিরে তাকাল ডেভিড।

 ‘আমি তোমাকে বলতে পারব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি ওর কাছে।

 ‘আমি ওকে খুঁজে বের করব

হয়তো যদি সাবধানে খোঁজো–কিন্তু এতে করে নিজের সম্মান আর ভালোবাসা হারাবে।’ বলে চলল ব্রিগ। আবারো ওর কথা পুনরাবৃত্তি করছি আমি ওকে বলল যে আমাদের মাঝে ভালোবাসা বা একে অপরের কাছে আমরা যা ছিলাম তার দাবি দিয়ে বলছি, ও যেন আমাকে আমার মতো থাকতে দেয়, কখনো আমার খোঁজ না করে।”

 ‘কেন? কিন্তু কেন?’ নাছোড়বান্দার মতো চিৎকার করতে লাগল ডেভিড। ‘ও কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে? ও জানে যে ও সব ধরনের আশার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। ও জানে যা ছিল অতীত আর কখনোই ফিরে আসবে না তা। ও জানে যেমনটা আশা করার অধিকার আছে তোমার তেমনটা আর হতে পারবে না সে। রেগে উঠে হাত ঝাড়া দিল ব্রিগ। শোন আমার কথা, ও জানে এটা স্থায়ী হবে না। ও আর কখনো তোমার স্ত্রী হতে পারবে না। তুমি এখনো অনেক তরুণ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর’ তাকিয়ে রইল ডেভিড ও জানে ধীরে ধীরে এ ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ, এক মাস অথবা এক বছর; তারপর এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। একজন অন্ধ নারীর কাছে বাঁধা পড়বে তুমি। ও এটা চায় না। ও চায় এটা এখনই শেষ হোক, তাড়াতাড়ি টানাহেঁচড়া না করে এভাবেই ভালো’

 ‘থামুন। চিৎকার করে উঠল ডেভিড। দয়া করে চুপ করুন। অনেক হয়েছে।

 চেয়ারে লাথি মারতেই গড়িয়ে পড়ে গেল ডেভিড। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দু’জনেই। দু’হাতে মুখ ঢেকে উঠে বসল ডেভিড। ছোট্ট জানালার নিচে দাঁড়িয়ে রইল ব্রিগ। বৃদ্ধ সৈন্যের মুখে এসে পড়ল সকালের আলো।

 ও আমাকে বলেছে তোমাকে প্রতিজ্ঞা করাতে দ্বিধা করল ব্রিগ, মুখ তুলে তাকাল ডেভিড, প্রতিজ্ঞা করো তুমি কখনো ওকে খোঁজার চেষ্টা করবে না।’

না। গোয়াড়ের মতো মাথা নাড়ল ডেভিড।

কাধ ঝাঁকালো ব্রিগ। যদি তুমি না মানো, আমি তোমাকে বলব_ও আমাকে বলেছে তুমি বুঝবে, যদিও আমার মনে হয় বুঝবে না–ও বলেছে যে আফ্রিকাতে অ্যান্টিলোপ নামে সুন্দর একটা প্রাণী আছে। কখনো কখনো তাদের একজনকে শিকারি ধরে নিয়ে যায়–যা সিংহ খেয়ে ফেলে।

মনে হলো চাবুকের বাড়ি খেল ডেভিড। মনে পড়ল কোন এক সময় সে নিজেই কথাগুলো বলেছিল ডেবরাকে। তারা দুজনেই তখন ছিল তরুণ আর নির্ভার।

‘ঠিক আছে। অবশেষে বিড়বিড় করল ডেভিড। যদি এটাই চায় সে তাহলে আমি প্রতিজ্ঞা করছি ওকে খোঁজার চেষ্টা করব না। যদিও এটা প্রতিজ্ঞা করছি না যে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করব যে ও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সম্ভবত আরো ভালো হয় যদি তুমি ইস্রায়েল ছেড়ে চলে যাও। পরামর্শ দিল ব্রিগ। সম্ভবত তোমার উচিৎ তোমার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া; যেখান থেকে তুমি এসেছে। আর যা হয়েছে সব ভুলে যেও।

 একমুহূর্ত থেমে কী যেন ভাবল ডেভিড। এরপর উত্তর দিল, না, আমার যা সবকিছুই এখানে। আমি এখানেই থাকবো।

 ‘ভালো। সিদ্ধান্তটা মেনে নিল ব্রিগ। এই ঘর তোমার জন্যে সব সময়েই খোলা।

‘ধন্যবাদ, স্যার।’ মার্সিডিজ যেখানে পার্ক করে এসেছে সেখানে চলে গেল ডেভিড। মালিক স্ট্রিটের বাসায় গেল। পা দিয়েই বুঝতে পারল কেউ এসেছিল।

আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়ালো লিভিং রুমে, অলিভ-কাঠের তৈরি টেবিল থেকে উধাও হয়ে গেছে বইগুলো। চামড়ার কাউচের উপরে ঝোলানো নেই কাঁদেশ পেইন্টিং। বাথরুমে গিয়ে দেয়াল কেবিনেট খুলতেই দেখা গেল ডেবরার সব টয়লেট্রিজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সমস্ত এক্সোটিক বোতল, টিউব, পট এমনকি ডেভিডের টুথব্রাশের পাশে থাকা ডেবরার টুথব্রাশও আর নেই।

ডেবরার ড্রয়ার শূন্য, ড্রেসগুলো নেই, তাগুলো খালি, ওর সমস্ত উপস্থিতির চিহ্নই মুছে ফেলা হয়েছে। শুধুমাত্র বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ওর পারফিউমের ঘ্রাণ আর রয়ে গেছে বিছানার উপরে আইভরি লেস কাভার।

বিছানার উপর গিয়ে বসল ডেভিড। লেসের উপর হাত বুলাতেই মনে পড়ে গেল অতীতের দিনগুলো।

বালিশের উপর পাতলা, চৌকোণা কিছু একটা পড়ে আছে। লেস্ কাভারের নিচে। কাভার তুলে সবুজ রঙের বইখানা হাতে তুলে নিল ডেভিড।

দিজ ইয়ার, ইন জেরুজালেম, বিচ্ছেদ হবার উপহারস্বরূপ পড়ে আছে বইটি। ঝাপসা হয়ে এলো ডেভিডের চোখ। নিজের এইটুকুই ফেলে গেছে ডেবরা।

.

অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো ইন কারেমে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সূচনা করল নতুন যুদ্ধ আর ভয়াবহতার। আন্তর্জাতিকভাবে বেড়ে গেল উদ্বেগ-উত্তেজনা। আরবীয় জাতিসমূহ বের করে আনল তেল বিক্রির অর্থে কেনা চমৎকার সব অস্ত্রের ভাণ্ডার। আরো একবার শপথ নিল যে তাদের কাছে প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত ভূ-খণ্ডে আর একজনও ইহুদির ঠাই হবে না।

বিভিন্ন নাজুক টার্গেটের উপর শুরু হলো নির্দয় আক্রমণ, অরক্ষিত দূতাবাস আর দুনিয়া জোড়া কনস্যুলেটগুলোও এর হাত থেকে রেহাই পেল না। বিচ্ছিন্ন জনপদে পত্ৰবোমা আর স্কুলবাসে নাইট অ্যামবুশের সংখ্যাও বেড়ে গেল।

এরপর অবস্থা দাঁড়াল আরো গুরুতর। একেবারে সরাসরি ইস্রায়েলের হৃৎপিণ্ডে আঘাত নেমে এলো। সীমান্ত লঙ্ন, কমান্ডো ধাঁচের লুটপাট, আকাশ সীমা লঙ্ঘন, শেল নিক্ষেপ, হুমকিস্বরূপ জনসভা আর অস্ত্রের ঝনঝনানি সবকিছু মিলিয়ে ছোট ভূ-খণ্ডের ভূমিটুকু হয়ে উঠল অশান্ত।

ইস্রায়েলিরা অপেক্ষা করতে লাগল, শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে লাগল– কিন্তু আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ডেভিড আর জো উড়ে বেড়াতে লাগল। যেখানে যৌক্তিক চিন্তা আর কাজকর্মের উপর প্রধান হয়ে দাঁড়াল স্বভাবজাত পদক্ষেপ।

খুঁজে বের করা, চিনে নেয়া, কাছে যাওয়া, ধ্বংস করে দেয়া–এসব কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সকলে যে দুঃখ-শোকে কাতর হবার সময়টুকু পর্যন্ত রইল না।

তারপরেও ক্ষোভ আর যাতনা, যা বয়ে বেড়াচ্ছে জো আর ডেভিড, মনে হলো চড়ে রইল তাদের ঘাড়ের উপর। প্রতিশোধের নেশায় মত্ত রইল দু’জনে।

শীঘ্রিই তারা দুজনে যোগ দিল সাবধানে বাছাই করা অর্ধ-ডজন স্ট্রাইক দলে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার জন্য তাদের ডেকে পাঠাল মরুর ফুল। বারংবার যুদ্ধের নির্দেশ এলো তাদের উপর। আর প্রতিবারই তাদের উপর হাই কমান্ডের বিশ্বাস হলো আরো পাকাঁপোক্ত।

নিজের ককপিটে বসে থাকে ডেভিড। পা থেকে মাথা পর্যন্ত গাড়ে জড়ানো ফুল-প্রেশার স্যুট। বন্ধ ফেইস-মাস্ক থেকে নিতে হয় অক্সিজেন। যদিও মিরেজ তখনো মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার ককপিটের নিচে ফিউজিলাজের গায়ে চারটি কালো, লাল আর সাদা, ক্ষুদ্রাকৃতির গোলাকার চিহ্ন আঁকা রয়েছে। শত্রুর খুলি।

এর অর্থ মরুর ফুল ব্রাইট ল্যান্স ফ্লাইটকে বিশ্বাস করে উচ্চ আকাশে ‘রেড’ স্ট্যান্ডবাই’র দায়িত্ব অর্পণ করেছে। স্টার্টার লাইন প্লাগ-ইন করে তৈরি কমপ্রেসারে বাতাস ভরার জন্য আর বিশাল ইঞ্জিনকে জীবিত করে ভোলার জন্য। মোটরের চারপাশে জড়ো হয়েছে গ্রাউন্ড ক্রুরা। মাত্র সেকেন্ডের নোটিশেই উড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত আছে মিরেজ বহর। ডেভিড আর জো উভয়েই প্রায় ষাট হাজার ফুট উপরেও সক্ষম থাকার মতো পোশাক পরে নিয়েছে। কেননা এতটুকু উচ্চতাতে যথাযথ প্রস্তুতি না থাকলে যে কোন মানুষের অংশে শ্যাম্পেনের মতো বুদবুদের নাচন শুরু হবে।

নিজের ছোট্ট ককপিটের মাঝে আটকে থেকে দিন-তারিখ-ঘণ্টার হিসেব করা ভুলে গেছে ডেভিড। শুধু মাত্র রেগুলার পনের মিনিট ব্রেক নিয়ে রুটিন চেক-আপ শেষ করে।

‘চেকিং ১১.১৫ আওয়ারসপনের মিনিটের বিরতি। মাইক্রোফোনে বলে উঠল ডেভিড। একই সাথে কানে ভেসে এলো জোর নিঃশ্বাসের শব্দ।

নিচে নামার সাথে সাথে যখন অন্য-ক্রু স্ট্যানড়বাইতে থাকা অবস্থায় অপেক্ষা করছিল, ডেভিড নিজের ট্রাক-স্যুট পরে দৌড়ে আসে পাঁচ থেকে ছয় মাইল। কেটে যায় শরীরের শক্তভাব। জড়তা ভাসিয়ে নেয় ঘাম। এরপরই শুনতে পায়–ইয়ারফোনে তীক্ষ্ণ চিৎকার আর কোন নতুন কণ্ঠস্বর,

‘রেড স্ট্যান্ডবাই—গো! গো!”

আদেশটি লাউডস্পিকারের মাধ্যমে আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারেও প্রতিধ্বনি তোলে। সাথে সাথে গ্রাউন্ড ক্রুরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে। মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় প্রি-ফ্লাইট রুটিন চেক-আপ। স্টার্টিং পজিশনে থ্রটল ঠেলে দেয় ডেভিড। জেগে উঠে ইঞ্জিন। সর্বশক্তি দিয়ে শুরু হয় ছুটে চলা।

 সামনে ওঠে যায় ব্লাস্ট ডোর। ব্রাইট ল্যান্স, টু। লিভার পাওয়ার টেক অফ করছে।’

 ‘টু কনফর্মিং। উত্তর দেয় জো। উভয়ে উঠে যায় আকাশে।

ব্রাইট ল্যান্স, ব্রিগ বলছি? ব্রিগের গলা শুনেও অবাক হয় না ডেভিড। তার মনেই হয়েছিল যে কমান্ডের দায়িত্বে নির্ঘাৎ বিগ থাকবে। পৃথক কণ্ঠস্বর আর ব্যক্তিগত নামের ব্যবহার শত্রুকে কোনরকম মিথ্যে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত রাখবে।

‘ডেভিড, উচ্চ আকাশে অনুপ্রবেশকারীর অস্তিত্ব টের পেয়েছি আমরা। চার মিনিটের মাঝেই আমাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করবে। যদি বর্তমান কোর্স অক্ষুণ্ণ রাখে। পঁচাত্তর হাজার ফুট উপরে এটির অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। তার মানে এটি একটি আমেরিকান ইউ টু। যদিও এটি হবার সম্ভাবনা বেশি তারপরেও রাশান স্পাই প্লেনও হতে পারে, যেটি আমাদের সাম্প্রতিক অস্ত্রের খোঁজে এসেছে।

“ঠিক আছে, স্যার। উত্তর দিল ডেভিড।

‘আমাদের আকাশ-সীমার বিরুদ্ধাচারণ করলেই স্টর্ম-ক্লাইম্ব করব আমরা।’

“ঠিক আছে, স্যার।

 ‘বিশ হাজার ফুট উপরে সমান্তরাল হয়ে যাও। ১৮৬ ডিগ্রি ঘুরে স্টর্ম ক্লাইম্বের জন্যে সর্বোচ্চ গতিতে উড়ে যাও।’

 বিশ হাজার ফুট উপরে উঠে সোজা এগিয়ে যেতে লাগল ডেভিড। আয়নায় তাকিয়ে দেখল লেজের কাছে জোর মিরেজ। ব্রাইট ল্যান্স টু, লিডার বলছি। দৌড় লাগাও।’

টু কনফর্মিং।

নিজের লেজ জ্বালিয়ে নিল ডেভিড। থ্রটস খুলে সবোর্ড এয়ারবর্ন পজিশনে প্রস্তুত হলো। লাফ দিল মিরেজ। নাক খানিকটা নিচু করে গতি বাড়িয়ে নিল ডেভিড।

দ্রুত তাদের গতি বেড়ে হলো মাক ১.২, মাক ১.৫।

সবকিছুই আছে মিরেজে। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিস মিসাইল আর উদ্বৃত্ত ফুয়েল ট্যাঙ্ক নেই। একমাত্র যে অস্ত্র বহন করছে তারা তা হলো দুটি ৩০ এম. এম. কামান।

হালকা ভাবে উড়ে গিয়ে পৌঁছে গেল বীরসেবা থেকে এইলাত পর্যন্ত। এ সময়ে একজন মানুষ হেঁটে হয়তো একটা ব্লক পার হতে পারবে বড়জোর। অবশেষে ১.৯ মাকে স্থির হলো তাদের গতি।

 ‘ডেভিড, ব্রিগ বলছি। তোমার গতিবিধি নজরে রাখছি আমরা। সঠিক কোর্স আর গতি ধরে এগোচ্ছো তুমি। ষোল সেকেন্ডের মাঝে ক্লাইম্ব করার জন্য প্রস্তুত হও।

“ঠিক আছে স্যার।

 ‘গণনা শুরু করছি, আট সাত, ছয় … দুই, এক। গোয় গোয়।

শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল ডেভিডের। মিরেজের নাক তুলতেই মুখ খুলে চিৎকার করে উঠল যুদ্ধ উত্তেজনায়। কিন্তু প্রেশার স্যুট সত্ত্বেও হঠাৎ করে দিক পরিবর্তনের ফলে সিট থেকে প্রায় পড়ে যাবার উপক্রম হলো। মাথার মাঝে ছলকে উঠল রক্ত। দৃষ্টি হয়ে গেল ধূসর থেকে কালো।

তারপর ও ঠিক-ঠাকভাবে উড়ে যেতে লাগল মিরেজ। ঝাপসা ভাব কেটে গিয়ে স্বচ্ছ হয়ে এলো দৃষ্টি। জি-মিটারের দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পারল গতি না হারিয়েও এতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে গিয়ে নয়বার ধাক্কা খেয়েছে ওর শরীর।

 এবার শান্ত হয়ে বসে সামনে তাকাল খোলা আকাশের দিকে। অলমিটারের কাঁটা ছুটছে ঊর্ধ্বমুখী।

নিচে পাথরের মতো অনড় জো’র মিরেজ। ঠাণ্ডা আর নিশ্চিত সুরে জানাল জো, ‘লিডার টু জানাচ্ছি, আমি টার্গেট দেখতে পেয়েছি।

এমনকি স্টর্ম ক্লাইম্বের মাঝে নিজের রাডার কাজে লাগিয়ে অনেক উপরে স্পাই প্লেনকে খুঁজে পেয়েছে সে।

 তারা দু’জনে মিলে তীরের মতো ছুটে চলল সামনের দিকে। ধনুক তাদেরকে ছুঁড়ে দিয়েছে বহুদূরে। আকাশে কিছু সময়ের জন্য ঝুলে রইল দু’জনে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আবারো নেমে আসে মাটিতে। এই কয়েক মুহূর্তের মাঝেই শত্রুকে খুঁজে খুন করতে হবে তাদের।

নিজের সিটে হেলান দিল ডেভিড। অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল আকাশ হয়ে গেল গাঢ় নীল। এরপরই আস্তে করে দেখা গেল মধ্যরাতের মতো কালো আবছায়া। মাঝে মাঝে তারার ঝিকিমিকি।

স্টাটোস্ফিয়ারের একেবারে উঁচু ধাপে উঠে গেছে তারা। পথিবীতে পরিচিত সবচেয়ে উঁচু মেঘেরও উপরে। ককপিটের বাইরে বাতাস হয়ে উঠল হালকা আর দুর্বল। জীবন ধারণের জন্য অপর্যাপ্ত। শুধুমাত্র কোনরকমে জ্বলতে লাগল মিরেজের ইঞ্জিন। ঠাণ্ডা বেড়ে দাঁড়াল ষাট ডিগ্রির মতো ভয়ঙ্কর বরফ অবস্থা।

ধীরে ধীরে দু’টো এয়ারক্রাফটের জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এলো। উড়ে বেড়াবার সমস্ত সৌন্দর্য যেন হারিয়ে গেল। মহাকাশের অনন্ত নক্ষত্ৰ বীথির কোলে ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা। বহুদূরে নিচে অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে উজ্জ্বল হয়ে রইল পৃথিবী।

কিন্তু চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করার এতটুকুও সময় নেই। হালকা বাতাসে হাচোড়-পাচোড় শুরু করল মিরেজ। নষ্ট হয়ে যেতে লাগল কন্ট্রোল সিস্টেম।

 টার্গেটের পিছনে লেগে রইল জো। সাবধানে, দৃঢ় পদক্ষেপে অনুসরণ করে চলল নিঃশব্দে। কিন্তু হঠাৎ করেই এত উচ্চতায় খেই হারিয়ে ফেলল দুজনে।

সামনের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। স্থির করার জন্য মিরেজের নাক সোজা করতে চাইল। কিন্তু সতর্ক সংকেত বেজে উঠল লাল আলো জ্বেলে। সময় আর উচ্চতা দুটোই বের হয়ে যাচ্ছে হাত গলে।

এরপরই হঠাৎ করে টার্গেটকে দেখতে পেল সে। মনে হলো একেবারে কাছে। বিশাল পাখা মেলে ভূতের মতো সামনে পড়ল, সামনে তাদের থেকে খানিকটা নিচে।

মরুর ফুল, ব্রাইট ল্যান্স বলছি। টার্গেট দেখতে পেয়েছি। আক্রমণের অনুমতি চাইছি।’ ডেভিডের ঠাণ্ডা গলার স্বর লুকিয়ে ফেলল হঠাৎ করে আসা রাগ আর ঘৃণা। টার্গেট প্লেনটাকে দেখার সাথে সাথে খেপে উঠল সে।

টার্গেট সম্পর্কে রিপোর্ট করো।’ ইতস্তত করতে লাগল ব্রিগ। একটা অচেনা টার্গেটের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ। মরুর ফুল, এটি একটি ইলুশিন মার্ক ১৭-১১। সেরকম দৃশ্যত কোন চিহ্ন নেই।’

আসলে কোন স্পষ্ট চিহ্নের দরকার নেই। একটা মাত্র জাতিরই হতে পারে এটা। খুব দ্রুত কাছে চলে যেতে লাগল ডেভিড। এর চেয়ে কম গতিতে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য মেশিনের প্রায় ঘাড়ের উপর পৌঁছে গেল সে। প্রকাণ্ড পাখাগুলো এমন ভাবে নকশা করা হয়েছে যেন স্টাটোস্ফিয়া দুর্বল বাতাসেরও সমস্যা না হয়।

দ্রুত কাছে চলে যাচ্ছি। মরুর ফুলকে সাবধান বাণী জানিয়ে দিল ডেভিড। প্রায় দশ সেকেন্ডের মাঝে শেষ হয়ে যাবে আক্রমণের সুযোগ।

হেডফোনের নীরবতা ভঙ্গ হলো। নিজের কামান প্রস্তুত করে নিল ডেভিড। চোখের সামনে বড় হয়ে উঠতে লাগল স্পাই প্লেনটা।

তৎক্ষণাৎ হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল ব্রিগ। হতে পারে দেশের হয়ে বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। কিন্তু জানে যে এরই মাঝে স্পাই প্লেনের ক্যামেরা সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেকর্ড করে নিয়েছে; যা শত্রু দেশের হাতে পড়লে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।

‘ডেভিড। কাটা কাটা স্বরে চিৎকার করে উঠল ব্রিগ। ‘ব্রিগ বলছি, আঘাত করো!

‘ঠিক আছে। নিজের মিরেজের নাক খানিকটা নিচু করল ডেভিড। বাধ্য মেয়ের মতো দায়িত্ব পালন করল মিরেজ।

টু, লিডার বলছি, আক্রমণ করছি।

“ঠিক আছে, লিডার।

খুব দ্রুত ইলুশিনের দিকে তেড়ে গেল মিরেজ। জানে যে হাতে মাত্র ‘ কয়েক সেকেন্ড আছে ফায়ার করার জন্য।

স্পাই প্লেনের পাখার উপর তাক করে ট্রিগারে চাপ দিল ডেভিড। সামনে তাকিয়ে যা দেখল মনে হলো বড়সড় একটা মাছের গায়ে আঘাত করেছে হারপুন।

তিন সেকেন্ড ধরে কামানের গোলা উগরে দিল ডেভিড স্পাই প্লেনের। কালো আকাশের পটভূমিতে উজ্জ্বল গোলা কাটতে লাগল পরপর। এরপর সামনে এগিয়ে বিশাল স্পাই দানবের পেটের নিচে চলে এলো ডেভিড। নিজের শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে। মনে হলো কোন রকেট।

পাশে চলে এলো জোর মিরেজ। কাভার করতে লাগল ডেভিডকে। অসহায়ের মতো ঝুলতে লাগল স্পাই প্লেন। লম্বা গোলাকৃতি নাক নিয়ে কালো আকাশের বুকে শীতল তারার পানে ছুটতে লাগল।

ট্রিগারে চাপ দিল ডেভিড। কামানের গোলার সাথে সাথে বিস্ফোরিত হলো স্পাই প্লেন। একটা পাখা পুরোপুরি ছিটকে গেল। বাকি কাঠামোটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল স্বর্গপানে।

‘হ্যালো, মরুর ফুল, ব্রাইট ল্যান্সের লিডার বলছি। টার্গেট খতম। নিজের কণ্ঠস্বর সংযত করতে চাইল ডেভিড। কিন্তু দেখল হাত কাঁপছে। এতটাই ঘৃণা জমে আছে যে শত্রুর মৃত্যুতেও শীতলতা কাটছে না।

আবারও ফায়ার ওপেন করার বোতামে চাপ দিল সে। জো, এটা হান্নাহর জন্য। কিন্তু মাত্র এবারই আর কোন উত্তর এলো না। এরপর ক্যারিয়ার বীমের ঝনঝনানি শুনে নিজের হোমিং সিগন্যাল অ্যাকটিভেট করল সে। নিঃশব্দে অনুসরণ করে বেসে ফিরে চলল জো।

.

ডেবরার প্রভাবে খানিকটা ধাতস্থ আচরণ করতে শিখেছিল ডেভিড। কিন্তু ওর প্রস্থানে আবারো খ্যাপাটে স্বভাব ফিরে এলো ডেভিডের মাঝে। তাই বেসে না থাকলেও উইং ম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হয় জোকে।

নিজেদের অবসরের বেশির ভাগ সময় একত্রেই কাটায় তারা। যদিও নিজেদের ক্ষতি নিয়ে কখনো কথা বলে না; তারপরেও এর মাধ্যমেই আরো কাছাকাছি পৌঁছে গেল ডেভিড আর জো।

প্রায়ই মালিক স্ট্রিটেই ঘুমিয়ে পড়ে জো। নিজের বাসা এর চেয়েও সুনসান, মৃত্যুপুরী। এই সংকটে বিগ বাসায় যাবার তেমন সময় পায় না। ডেবরাও চলে গেছে। তাই মাও নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভারে হয়ে পড়েছে বয়সের চেয়েও বুড়ো আর অথর্ব। শরীরে বুলেটের ক্ষত বুজে গেছে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষতগুলো সারাবার কোন ঔষধ নেই।

 ডেভিডের উন্মত্ততার একমাত্র দাওয়াই হলো সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ভুলে থাকা। আকাশে থাকাকালীনই একমাত্র শান্তি খুঁজে পায় সে। মাটিতে নামলেই হয়ে ওঠে অস্থির। তার পাশে বিশাল চেহারার জো শান্ত হয়ে থাকে। হালকা হাসি আর সহজ কথা বলে কৌশলে সমস্যা থেকে দূরে রাখে ডেভিডকে।

স্পাই প্লেন বিস্ফোরণের ঘটনাতে সিরিয়া উস্কানিমূলক পন্থা অবলম্বন করল। হিসাব কষে ইস্রায়েলী আকাশ সীমানায় অনুপ্রবেশ করা, আইন অমান্য করতে লাগল। যখনি আবার আক্রমণের আশঙ্কা দেখতে লাগল, লেজ গুটিয়ে পালাতে লাগল নিজেদের সীমানায়।

দু’বার নিজের স্ক্যানিং রাডারে এহেন আচরণের সবুজ লুমিনাস আলো জুলতে দেখল ডেভিড। প্রতিবারই নিজের ভেতর বরফ শীতল রাগের কম্পন অনুভব করে অবাক হয়ে গেল আর ঘৃণা যা ভারী পাথরের মতো বোঝা হয়ে আছে তার বুকের উপর। তৎক্ষণাৎ জোকে নিয়ে আক্রমণে রওনা হয় ডেভিড। কিন্তু প্রতিবারই নিজেদের রাডারের মাধ্যমে সতর্ক হয়ে যায় সিরীয়রা। ঘুরে গিয়ে গতি বাড়িয়ে হাস্যকর ভাবে পালিয়ে যায়।

ব্রাইট ল্যান্স, মরুর ফুল বলছি। টার্গেট আক্রমণাত্মক নয়। আক্রমণের ধরণ পরিবর্তন করো।’ সিরিয়ান মিগ ২১ নিজেদের সীমান্ত অতিক্রম করে এসেছিল। প্রতিবারই নিঃশব্দে উত্তর দিয়েছে ডেভিড, টু লিডার বলছি, আক্রমণ ত্যাগ করে স্ক্যান পুনরায় শুরু করো।

এই কৌশল করা হয়েছিল ডিফেন্ডারদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য। ইন্টারসেপটর স্কোয়াড্রনে টেনশন তাই মারাত্মক হয়ে উঠল। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল তারা। অল্পের জন্য রক্ষা পেল কয়েকটি ঘটনা। রক্ত গরম হয়ে উঠতে লাগল সকলের। অবশেষে উপর থেকে হস্তক্ষেপ এলো। কেননা মরুর ফুল চাইল নিজের ছেলেদেরকে বশে রাখতে। নিজের ক্রুদের সাথে কথা বলার জন্য পাঠানো হলো ব্রিগকে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিফিং রুমের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ব্রিগ বুঝতে পারল যে বাজপাখিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চোখের উপর পট্টি বেঁধে পা ধরে রাখলেই ব্যাপারটা শেষ হয় না। কেননা মাথার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে বুনোহাঁসের দল।

দার্শনিকের বেশ ধারণ করল ব্রিগ। তরুণ পাইলটদের কাছে থাকা নিজের সম্মানের সুবিধাটুকু নিতে চাইল।

 ‘যুদ্ধের উদ্দেশ্য শান্তি, যে কোন নেতার সবচেয়ে জরুরি যে রণকৌশল তা হলো শান্তি’ দর্শকদের মাঝ থেকে কোন সাড়া এলো না। নিজের পুত্রের কথা স্মরণ করল ব্রিগ। কেমন করে একজন প্রশিক্ষিত যোদ্ধার সামনে শান্তির কথা বলবে সে যে কিনা সদ্যই সমাহিত করে এসেছে নিজের নব পরিণীতা বধূকে? আবারো বলা শুরু করল ব্রিগ।

‘শুধুমাত্র একজন বোকাই শত্রুভূমিতে নিজেকে মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দেবে। এবার সবার কাছাকাছি পৌঁছতে পারল ব্রিগ। আমি চাই না, তোমরা কেউ একজন এমন কিছু ঘটাও যার জন্য আমরা প্রস্তুত নই, আমি তাদেরকে কোন অযুহাত দিতে চাই না। তারা এটাই চায়’ সবাই মনোযোগী হয়ে উঠল। এমন কী একজনকে মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক ভাবে বিড়বিড় করতেও দেখল বিগ।

 যদি তোমরা কেউ বড়সড় কোন সমস্যা পেতে চাও তোমাদেরকে দামাস্কাসে যেতে হবে না, আমার বাসার ঠিকানা জানো সবাই। প্রথমবার হাসানোর চেষ্টা করল ব্রিগ আর পেরেও গেল। সবাই মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। তো এটাই ঠিক হলো যে আমরা সমস্যা চাই না। আমরা এর উল্টো পথেই হাঁটতে চাই—কিন্তু নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে নয়। সময় যখন আসবে, আমিই তোমাদেরকে বলব, কোন নরম স্বর হবে না সেটা সবাই গর্জন করে উঠল, চাপা গরগরের শব্দ পেল ব্রিগ, শেষ করল, কিন্তু তোমাদেরকে এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চে এলো লে ডফিন।

যাই হোক তোমাদের সবাইকে একসাথে পেয়ে আমি একটা খবর দিতে চাই। এতে হয়তো সীমান্তে ওপারে মিগ ধাওয়া করতে চাও এমন গরম মাথাগুলো ঠাণ্ডা হবে। ব্রিফিং রুমের শেষে থাকা প্রোজেকশন বক্স খুললো লে ডফিন। বাতি বন্ধ করে দেয়া হলো, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, কয়েকজন কাশতে লাগলো, অভিযোগের সুরে বলে উঠল কেউ একজন।

 ‘কোন ফিল্ম শো দেখতে চাই না!’

 হ্যাঁ। কর্নেল বলে উঠল, ‘আরো একটা ফিল্ম শো। এরপর পর্দায় ভেসে ওঠা ছবির সাথে সাথে বলে চলল কর্নেল, এটা একটা সামরিক গোয়েন্দা চলচ্চিত্র। বিষয়, নতুন গ্রাউন্ড-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম। যেটা আরব ইউনিয়নের সেনাবাহিনীকে দিয়েছে সোভিয়েট ইউনিয়ন। এই সিস্টেমের কোড নেম সার্পেন্ট। এটি বর্তমান স্যাম থ্রি’ সিস্টেমের উন্নত সংস্করণ। যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি তাতে দেখা গেছে যে সিরিয়ান প্রতিরক্ষা ব্যুহতে ব্যবহার হচ্ছে এটি। এছাড়া মিশরীয়রাও ব্যবহার করছে। পরিচালনা করছে রাশান প্রশিক্ষক দল। কর্নেল যখন কথা বলে চলল তখন নিজের চেয়ারে বসে সবার মুখের দিকে তাকাল ব্রিগ। পর্দার রূপালি আলোয় পড়তে চাইল তাদের ভাষা। সবাইকে বেশ মনোযোগী মনে হলো। তন্ময় হয়ে প্রথমবারের মতো দেখতে পাওয়া নতুন অস্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছে যা কিনা হতে পারে ওদের মৃত্যুর কারণ।

 ‘একটি নির্দিষ্ট বাহন থেকে ছোঁড়া হবে মিসাইল। এখানে আকাশ থেকে ভোলা মোবাইল কলামের ছবি দেখতে পাচ্ছো তোমরা। খেয়াল করে দেখো প্রতিটি বাহনে এক জোড়া করে মিসাইল আছে। তাই বুঝতেই পারছো কতবড় হুমকি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে’।

ডেভিড মরগ্যানের সুদর্শন চেহারায় চোখে পড়ল। ব্রিগ দেখতে পেল সামনের দিকে ঝুঁকে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে ডেভিড। সহানুভূতি আর দুঃখবোধ জেগে উঠল ছেলেটার জন্য–এর মাধ্যমে নতুন করে শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য হলো ছেলেটা, প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করে চলেছে ডেভিড।

সার্পেন্টের উন্নত নকশা সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানা যায়নি। কিন্তু বিশ্বাস করা হচ্ছে যে অসম্ভব দ্রুত গতি সম্পন্ন এই মিসাইল সম্ভবত মাক ২.৫ গতিতে ছুটতে পারে। আর গাইডিং সিস্টেমে ইনফ্রা রেড হিট সীকার আর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রাডার কন্ট্রোল উভয় ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।

সুদর্শন তরুণের চেহারাটা দেখে ব্রিগ ভাবতে লাগল ডেবরা ভুল করেনি তো। হতেও তো পারে যে ডেভিড ব্যাপারটা মেনে নিতে পারতো না, পরক্ষণেই মাথা নাড়ল বিগ। সিগারেটের জন্য পকেটে হাত ঢোকালো। ছেলেটা একেবারে তরুণ, জীবনের স্বাদ এখনো ঢের বাকি, সুদর্শন চেহারা আর দৌলতের দাপটে অনেকটাই বখে যাওয়া। ও কখনোই মেনে নিয়ে চলতে পারতো না। সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে ডেবরা। বেশিরভাগ সময় তাই করেছে মেয়েটা। ঠিক পথটাই বেছে নিয়েছে। ডেবরা কখনোই ডেভিডকে ধরে রাখতে পারতো না। মুক্তি দিয়ে ভালই করেছে।

‘ধারণা করা হচ্ছে যে ১৫০০ থেকে ৭৫০০০ ফুট উচ্চতাতে টার্গেট খতম করতে সক্ষম সার্পেন্ট।

নড়েচড়ে বসল শ্রোতারা। এতক্ষণে পুরোপুরি বুঝতে পারল কতটা হুমকি সৃষ্টি করতে সক্ষম এই সার্পেন্ট।

ওয়ারহেডের মাধ্যমে টনখানেক বিস্ফোরণ বহন করা সম্ভব। এছাড়া একটা ফিউজ আছে। যদি টার্গেট ১৫০ ফুটের নিচে দিয়ে পার হয় তাহলে গুলি ছুড়বে এই ফিউজ। এই রেঞ্জের মাঝে তাই ভয়ানক হয়ে উঠবে এই সার্পেন্ট।’

 তখনো ব্রিগ তাকিয়ে রইলো ডেভিডের দিকে। রুথ আর সে অনেক মাস হয়ে গেল বাসায় আসতে দেখেনি ছেলেটাকে। ঘটনাটা ঘটার পরে মাত্র দু’বার জোর সাথে সাবাথ সন্ধ্যায় গিয়েছিল। কিন্তু বাসার পুরো পরিবেশ ছিল আড়ষ্ট। সবাই খুব সাবধান ছিল যেন ভুলেও ডেবরা নাম না ওঠে। দ্বিতীয়বারের পর আর কখনোই যায়নি ডেভিড। তাও প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল

‘এই স্টেজে “স্যাম থ্রি”-র মতোই কৌশল ব্যবহার করতে হবে।’

‘প্রার্থনা করো আর সবাইকে গুড লাক!’ ছোট্ট আর্তনাদ করে উঠল কেউ কেউ। হেসে উঠল বাকিরা।

 ‘–যতটা সম্ভব মিসাইলের দিকে ঘুরে যাওয়া, নিজের জেটে ব্লাস্টের রেডিয়েশন নজরে রাখা। সার্পেন্টকে বাধ্য করো উপরে গুলি ছুঁড়তে। যদি কখনো এমন হয় যে মিসাইল পিছু ছাড়ছে না তাহলে সরাসরি সূর্যের দিকে ঘুরে যাবে। মিসাইল তখন সূর্যের রেডিয়েশনকে টার্গেট করবে।’

আর যদি এটা কাজ না করে?’ জিজ্ঞেস করে উঠল একটা কণ্ঠ। আরেকজন উত্তর দিল হালকা চালে, ‘নিচের বাক্যটা বলতে থাকবে বারবার : “শোন ও ইস্রায়েল, প্রভু আমাদের ঈশ্বর, প্রভু মাত্র একজনই।” পুরাতন রসিকতা শুনেও এবার কেউ আর হাসল না।

ব্রিফিং রুম থেকে বের হবার সময় ডেভিডের কাছে এলো ব্রিগ।

‘আমরা তোমাকে আবার কখন দেখতে পাবো ডেভিড? অনেক দিন হয়ে গেল।’

‘আমি দুঃখিত স্যার। আশা করি জো জানিয়েছে আমার অপারগতার কথা।’

 ‘হ্যাঁ। কিন্তু জোর সাথে আজকেই আসো না কেন? ঈশ্বর জানে, খাবারে কমতি হবে না।

 ‘আজ রাতে আমার একটু ব্যস্ততা আছে স্যার।’ কৃতজ্ঞচিত্তে পাশ কাটলো ডেভিড।

‘বুঝতে পেরেছি।’ ও সি’র অফিসে যাবার সময় আবারো বলে উঠল ব্রিগ, ‘মনে রাখবে তোমার জন্য দরজা সবসময় ভোলা আছে।

 ‘স্যার!’ ব্রিগকে ডেকে উঠল ডেভিড। দ্রুত, অপরাধীর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ও কেমন আছে স্যার? তারপর আবারী, ডেবরা কেমন আছে? ওর সাথে দেখা হয়েছে আপনার–মানে এর মাঝে?

 ‘ও ভালো আছে।’ ভারী স্বরে উত্তর দিল ব্রিগ। যতটা ভালো থাকা সম্ভব।’

‘ওকে বলবেন যে আমি জানতে চেয়েছি?

না।’ গাঢ় নীল চোখের আকুতি অগ্রাহ্য করে উত্তর দিল ব্রিগ। না, তুমি জানো আমি এটা করতে পারব না।’

মাথা নেড়ে ঘুরে চলে গেল ডেভিড। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিঃশ্বাস ফেলে কর্নেলের রুমে ঢুকে গেল ব্রিগ।

ইন কারেমে জোকে নামিয়ে দিল ডেভিড। এরপর গাড়ি চালিয়ে পূর্ব জেরুজালেমের শপিং সেন্টারে এলো। নতুন সুপার মার্কেট মেলেখ জর্জ পঞ্চম এর সামনে পার্ক করে নামল সপ্তাহের বাজার করতে।

 ফ্রিজারের ট্রের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল ল্যাম্ব কাটলেট নিবে নাস্টেক। তারপরই খেয়াল হলো যে তাকে কেউ দেখছে।

 তাড়াতাড়ি ঘরে তাকাল ডেভিড। ঘন সোনালি চল ভর্তি মাখা নিয়ে মর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। দূরের একটা তাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। বোঝা গেল চুল রঙ করা হয়েছে। কেননা গোড়ার দিকে কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে। ডেভিডের থেকে নিঃসন্দেহে বড় হবে মহিলা। কোমর আর শরীরের উপরিভাগ বেশ স্ফীত। চোখের কোনে হালকা বলিরেখা। একদষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডেভিডের দিকে। এতই নগ্ন আগ্রহ চোখে যে হঠাৎ করে ডেভিডের নিজের নিঃশ্বাস হয়ে উঠল গরম। ঘুরে আবারো ফ্রিজারে মনোযোগ দিল ডেভিড। নিজের ওপরেই রেগে গেল আর অপরাধবোধ হলো মনে। অনেক অনেক দিন পর শরীরী আগ্রহ বোধ করল সে। ভেবেছিল আর কখনোই হবে না এমনটা। চাইল হাতের স্টেকের প্যাকেটকে ফ্রিজে ছুঁড়ে ফেলে চলে যেতে। কিন্তু পেটের মাঝে গুড়গুড় বোধ করছে। মনে হলো শিকড় গজিয়ে গেছে। তার। বুঝতে পারল তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মহিলা। নিজের হাতে মনে হলো নারী উপস্থিতির ছ্যাকা লাগল। নিঃশ্বাসে নারীসুলভ গন্ধ পেল

 ‘স্টেক’ই ভালো।’ মন্তব্য করে উঠল অচেনা নারী। হালকা মিষ্টি স্বরে ভেসে এলো কথাগুলো। চোখ দুটো সবুজ। দাঁতগুলো খানিকটা এলোমেলো হলেও সাদা। যতটা ভেবেছিল দেখা গেল বয়স তার চেয়েও বেশি। প্রায় চল্লিশ। সামনের দিকে অনেকটা উন্মুক্ত পোশাক।

মাঝে মাঝে মাশরুম রসুন আর লাল ওয়াইন দিয়ে রান্না করে দেখতে পারেন, ভাল লাগে।’

তাই?’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানতে চাইলো ডেভিড।

 হ্যাঁ। হেসে মাথা নাড়ল মহিলা ‘কে রান্না করবে? মা? স্ত্রী?

না। আমিই রান্না করব। একা থাকি আমি।’ জানিয়ে দিল ডেভিড। হেলে ডেভিডের খানিকটা কাছে এলো মহিলা।

মাথা ঘুরতে লাগল ডেভিডের। সুপারমার্কেটে আসার সময় ব্রান্ডি খেয়ে এসেছিল। সাথে খানিকটা আদা মিশিয়ে নিয়েছিল। খুব দ্রুত শেষ করেছে পুরো বোতল। বাথরুমে দৌড়ে গিয়ে বেসিনের উপর উগরে দিল সব। মনে হলো চারপাশের ঘরবাড়ি দুলছে চোখের সামনে। বেসিনের কোণা ধরে সামলালো নিজেকে।

 মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিল। পানির কণা ঝেড়ে ফেলে বেসিনে লাগানো আয়নায় নিজের চেহারা দেখে হাসতে লাগল বোকার মতো। চুলগুলো ভিজে গেছে। এসে পড়েছে কপালের উপর। এক চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো আয়নায় থাকা চেহারা ভেংচি মারছে তাকে।

 হাই দেয়ার, বয়। বিড়বিড় করে তোয়ালের জন্য হাত বাড়ালো। দেখল পানি পড়ে টিউনিক ভিজে গেছে। বিরক্ত হলো মনে মনে। টয়লেট সিটের উপর ছুঁড়ে ফেলল তোয়ালে। ফিরে এলো লিভিং রুমে।

নেই নারী দেহ। চামড়ার কাউচে এখনো খানিকটা অংশ ডেবে আছে মহিলার ভারে। জলপাই কাঠের টেবিলে পড়ে আছে নোংরা কাপ প্লেট। সিগারেটের ধোঁয়া আর মহিলার সুগন্ধিতে আচ্ছন্ন রুমের বাতাস।

 ‘কোথায় তুমি?’ তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে উঠল ডেভিড।

‘এখানে বিগ বয়। বেডরুমে এলো ডেভিড। বিছানার উপর শুয়ে আমন্ত্রণ জানাল মহিলা।

‘কাম অন, ডেভি। ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে আছে মহিলার কাপড়।

লেস কাভারের উপর শুয়ে আছে মহিলা যা কিনা ডেবরার-রাগে উন্মুক্ত হয়ে উঠল ডেভিড।

‘ওঠো। কাটা কাটা স্বরে বলে উঠল ডেভিড।

 ‘ওঠো এই বিছানা থেকে। ডেভিডের শক্ত ভাব টের পেয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে উঠে বসল মহিলা।

কী হয়েছে ডেভি?’

চলে যাও এখান থেকে। খেপে উঠল ডেভিড। যাও এখান থেকে বেশ্যা কোথাকার।’ কাঁপতে লাগল ডেভিড। চেহারা হয়ে উঠল বিবর্ণ, চোখ ভয়ঙ্কর নীল।

 আতঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে এলো মহিলা। চলে যাবার পর আবারো বাথরুমে ছুটে গিয়ে টয়লেট বোলে বমি করে দিল ডেভিড। এরপর বাসার সবকিছু পরিষ্কার করল। ধুয়ে ফেলল বাসন কোসন। চকচক না করা পর্যন্ত ঘষতে লাগল গ্লাসগুলো। অ্যাশট্রে পরিষ্কার করে জানালা খুলে তাড়িয়ে দিল সিগারেট আর পারফিউমের গন্ধ। এরপর সবশেষে বেডরুমে ঢুকে চাদর পাল্টে নতুন করে গোছালো বিছানা। লেস কাভারকে টানটান করে পেতে দিল আবারো।

পরিষ্কার টিউনিক আর ইউনিফর্মের টুপি পরে নিল। গাড়ি চালিয়ে গেল জাফা গেইট। বাইরের লটে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে ঢুকলো পুরাতন শহরে। ইহুদি কোয়ার্টারের প্রার্থনা মন্দির বানানো হয়েছে নতুন করে।

 উঁচু গম্বুজওয়ালা হলরুম হয়ে আছে শান্ত আর নিস্তব্ধ। শক্ত কাঠের বেঞ্চে বহুক্ষণ বসে রইল ডেভিড।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *