১. হল্যান্ডের পর্বতমালা

ঈগল ইন দ্য স্কাই – উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : জেসি মেরী কুইয়া

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

এই উপন্যাসটা লেখার সময় আমি একাধিক লোকের কাছ থেকে মূল্যবান সহযোগিতা পেয়েছি। মেজর ডিক লর্ড আর লেফটেনান্ট পিটার কুক যুদ্ধ বিমানের প্রযুক্তি এবং কৌশলগত নানা বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। ড. রবিন স্যানডল এবং ড. ডেভিড ডেভিস চিকিৎসা বিদ্যার নানা খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। শৌখিন মৎস্য শিকারি রেভারেন্ড অব রেডরাপ বইটির নাম বাছাই করতে সাহায্য করেছেন।

আমি তাদের সবার কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। ইস্রায়েলের অনেক নাগরিক আমাকে সাহায্য এবং আতিথিয়তা দিয়ে কৃতজ্ঞতার বাঁধনে জড়িয়েছে। কিন্তু আমি দুঃখিত-তাদের সবার নাম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।

আর বরাবরের মতো আমার বিশ্বস্ত গবেষক দরকারি প্রয়োজনের মুহূর্তে সমালোচনা, সাহস আর স্বস্তি যুগিয়েছে। আমার সৎ ছেলে-তার পুত্র-ডিয়েটার স্মিডটকে বইটা উৎসর্গ করলাম।

.

তিনটি জিনিস আমাকে বিস্মিত করে তোলে,
বুঝতে পারি না চতুর্থটি :
আকাশে ঈগল,
পাথরের উপরে সাপ,
গভীর সমুদ্রে জাহাজ,
আর একজন পুরুষের সাথে কুমারী।

প্রবাদ, ৩০-১৮-২০

তুষারাবৃত হটেনটটস্ হল্যান্ডের পর্বতমালা থেকে বয়ে আসা বাতাসটুকু আর্তনাদ করতে লাগল হারিয়ে যাওয়া পশুর মতো। নিজের ছোট্ট অফিসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষক। কূজো হয়ে ফ্লাইট জ্যাকেটের নোম দিয়ে বানানো পকেটে পুড়ে রেখেছে হাতের মুঠি।

দেখতে পেল লৌহ নির্মিত বিশাল হ্যাঙ্গারে নেমে এলো ড্রাইভার চালিত ক্যাডিলাক। নিগ্রো ড্রাইভার দেখে জাকুটি করে উঠল আনমনেই। সম্পদের ফাঁদে আটকা পড়ে বার্নি ভেন্টার সবসময়ে গভীর দ্বেষ অনুভব করে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে হ্যাঙ্গারের দেয়ালের বিপরীতে দর্শনার্থীদের জন্যে নির্ধারিত স্থানে পার্ক করা হলো ক্যাডিলাক। বালকসুলভ চপলতা নিয়ে পিছনের দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামল এক বালক। নিগ্রো ড্রাইভারের সাথে সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপ সেরে ত্রস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো বার্নির দিকে।

চলার মাঝে এমন একটা কিছু আছে যা সচরাচর কিশোরদের মধ্যে দেখা যায় না। লম্বা, ঋজু পদক্ষেপে এগিয়ে এলো ছেলেটি। এই তরুণ রাজকুমারকে এগোতে দেখে মনের মাঝে বিদ্বেষ ঘনীভূত হলো বার্নির। এসব আদরের পুটুলিদেরকে ঘৃণা করে সে আর দেখো এমনই ভাগ্য যে এদের সংস্পর্শে কাটাতে হয় দিনের বেশির ভাগ সময়। অসম্ভব বিত্তবানরাই কেবল ক্ষমতা রাখে সন্তানদের উড্ডয়নের রহস্য শেখানোর।

দু’বছর আগে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে, মেডিক্যাল টেস্টে অনুত্তীর্ণ হয় বার্নি। এর উপর নির্ভর করছিল সিনিয়র এয়ারলাইন ক্যাপ্টেন হওয়া। এখন সে নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের অপর পাশে। সম্ভবত এর সমাপ্তি হবে গতানুগতিক উড়ে গিয়ে। ক্লান্ত হয়ে লাইসেন্সবিহীন নীতিবোধ বর্জিত চার্টার কোম্পানির বেতনভূক্ত কর্মচারী হিসেবে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে গর্জন করে উঠল বার্নি, মাস্টার মরগ্যান, ঠিক বলছি কিনা?

‘ইয়েস, স্যার। কিন্তু আপনি আমাকে ডেভিড নামে ডাকতে পারেন। ছেলেটা হাত বাড়াতেই অভ্যাসবশে করমর্দন করল বার্নি–তৎক্ষণাৎ মনে হলো না করলেই ভালো হত। হাতটা শুকনো কিন্তু বজ্রকঠিন মুষ্টি।

‘ধন্যবাদ, ডেভিড। হতাশায় মুষড়ে গেল বার্নি। আর তুমি আমাকে “স্যার” ডাকতে পারো।

 সে জানতো যে ছেলেটার বয়স চৌদ্দ। কিন্তু বার্নির পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি দেহের একেবারে মাথায় মাথায় ছেলেটার উচ্চতা। হাসল ডেভিড আর প্রায় সাথে সাথে তার শারীরিক সৌন্দর্যে চমকে উঠল বার্নি। মনে হলো স্বর্গীয় ভাস্কর নিজ হাতে সযতনে গড়েছেন ছেলেটার শরীরের প্রতিটি অংশ। পুরো প্রভাবটা মনে হলো অপার্থিব, নাটকীয়। মনে হলো হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কোঁকড়া চুলের গাঢ় উজ্জ্বলতা, স্যাটিনের মতো ত্বক, গভীর চোখে আগুনের খেলা।

বার্নি সচেতন হয়ে খেয়াল করল যে সে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। এমনই মুগ্ধ হয়ে গেছে যে–তাড়াতাড়ি ঘুরে অন্য দিকে ফিরল।

‘এসো।’ পথ দেখিয়ে নিজের অফিসের দিকে হাঁটা ধরল বার্নি। দেয়ালে ঝুলছে মাছির ডিমে ভর্তি ন্যড ক্যালেন্ডার আর হাতে লেখা কয়েকটা নোটিশ।

 ‘ওড়াউড়ি সম্পর্কে কিছু জানো? হ্যাঙ্গারের শীতল বিষাদের মাঝে ঢুকতে ঢুকতে ডেভিডকে প্রশ্ন করল বার্নি। লম্বা সারিতে পড়ে আছে এয়ারক্রাফট সমূহ। দরজা দিয়ে বের হতেই হালকা শীতের উজ্জ্বল রোদে চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

‘কিছুই না, স্যার।’ সত্যি কথা স্বীকার করল ডেভিড। ঠিক হতে শুরু করল বার্নির মুড।

 ‘কিন্তু শিখতে চাও?

“ওহ্, হ্যাঁ স্যার। জোরাল উত্তরে ফিরে তাকাল বার্নি। ছেলেটার চোখ এত গাঢ় যে প্রায় কালোই বলা চলে। শুধুমাত্র সূর্যের আলো পড়লেই গাঢ় নীল হয়ে ওঠে।

‘ঠিক আছে–চললো শুরু করি। সামনেই কংক্রিটের উপর অপেক্ষা করে আছে এয়ারক্রাফট। এটা একটি সেসনা ১৫০ হাই-উইং মনোপ্লেন। চারপাশে ঘুরে চেক্ করতে লাগল বার্নি। অনুগত ছাত্রের মতো অনুসরণ করছে ডেভিড। কিন্তু কন্ট্রোল আর লিফট এবং উইং-ললাডিং সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে বলা শুরু করতেই বার্নি টের পেল যে ছেলেটা মোটামুটি ভালোই জানে। বার্নির প্রশ্নের উত্তরে ডেভিড একেবারে ঠিকঠাক জবাব দিয়েছে।

‘তুমি এ ব্যাপারে পড়াশোনা করেছে, মন্তব্য করল বার্নি।

‘হ্যাঁ, স্যার।’ হেসে উত্তর দিল ডেভিড। দাঁতগুলো অদ্ভুত রকম সাদা আর সমান সারিতে বসানো। হাসি থেকে চোখ ফেরানো দায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বার্নি বুঝতে পারল যে সে ছেলেটাকে পছন্দ করা শুরু করেছে।

‘রাইট, চলো ঢুকে পড়ি।

ছোট্ট ককপিটে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসে বার্নি ব্যাখ্যা করল কন্ট্রোল আর ইনস্ট্রমেন্ট সম্পর্কে, এরপর চালানোর পালা।

 ‘মাস্টার, সুইচ অন করো।’ লাল বোতামে চাপ দিল সে। ঠিক আছে, এবার এই চাবি–ঠিক একটা গাড়ি চালানোর মতো।

সামনে ঝুঁকে নির্দেশ মতো কাজ করল ডেভিড। ইঞ্জিন চালু হয়ে খানিক লাফালাফি করে অবশেষে নিয়মিত স্বরে গর্জন শুরু করল। ধীরে চলা শুরু করতেই রাডারস্ আর ফাইনাল চেক্ করা শিখে নিল ডেভিড। এরপর রেডিওর কাজ দেখে রানওয়েতে চলা শুরু করল প্লেন।

 ‘রাইট, রানওয়ের শেষ মাথায় কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ দাও। একে নিশানা করে থ্রটল খুলে দাও আস্তে করে।

মেশিনের গতি দ্রুত হয়ে উঠল। দূরে বেড়ার দাগ বরাবর এগিয়ে চলল দ্রুত।

আস্তে আস্তে হুইলে ফিরে এসো।’ আর উপরে উঠে গেল তারা। মাটি থেকে শূন্যে।

‘ধীরে বৎস, ধীরে’, জানাল বার্নি।

কন্ট্রোলে জমে যেও না। এভাবে তার সাথে আচরণ করো’থেমে গেল সে। এতদিন পর্যন্ত এয়ারক্রাফটকে একজন নারীর সমতুল্য মনে করতো। কিন্তু উপলব্ধি করল এবারের যাত্রায় এর অসামঞ্জস্য। মনে করো এটি একটি ঘোড়া। হালকা চালে দৌড়াও।

বুঝতে পারল হুইলের উপর থাকা ডেভিডের হাত আলগা হয়ে গেল। নিজের কন্ট্রোলেও একই কাজ করল সে।

 ‘এই, এই ডেভিড। আড়চোখে ডেভিডের দিকে তাকাল বার্নি। কিন্তু অসম্ভষ্টি দেখা দিল মনে। কেন যেন নিজের মাঝে একেবারে গভীরে মনে করেছিল যে এই ছেলেটা হয়তো একটা পাখি, ঠিক তার মতে, আকাশের নীল যার ঠিকানা। উড্ডয়নের প্রথম কয়েক মুহূর্ত জমোট বাঁধা ভয় লেপ্টে ছিল ছেলেটার চোখেমুখে। ঠোঁট আর নাকে সাদা মার্বেলের ছোঁয়া। গাঢ় নীল চোখে ছায়া; যেন নিচে গ্রীষ্মের সাগরে রয়েছে হাঙ্গরের দল।

 ‘বাম দিকের পাখা তুলে ফেলল। অসন্তুষ্ট বার্নি ডেভিডকে শান্ত করতে চাইল। উঠে এলো পাখা।

‘সমান করো তাকে’, নিজের হাত টেনে নিল বার্নি কন্ট্রোল থেকে। দিগন্ত বরাবর নাক সোজা করল প্লেন।

‘থ্রটল ব্যাক। ছেলেটা ডান হাতে টেনে দিল থ্রটল। আরো একবার তার দিকে তাকাল বার্নি। অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হয়নি। আর তখনই বার্নি বুঝতে পারল যে এটা ভয় নয়, আনন্দ। অত্যধিক আনন্দ।

 ‘ছেলেটা একটা পাখি, পাখিই। তৃপ্ত হলো বার্নি। কথাবার্তার মাঝে বার্নি ফিরে গেল ত্রিশ বছর আগে। মনে পড়ে গেল হলুদ একটা টাইগার মথের কথা, আর উড়ে যাবার জন্যে ছোট্ট একটা ছেলের আকুতির কথা।

কর্কশ নীল পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে বেড়াল তারা। সূর্যের আলো পিছলে পড়ছে তুষারের গায়ে। পিছু ধাওয়া করল বন্য বাতাস।

বাতাস সমুদ্রেরই মতো, ডেভিড উপরে ঘুরে বেড়ায়–আর ভেঙ্গে পড়ে। এর দিকে খেয়াল রেখো। মাথা নাড়ল ডেভিড। কিন্তু পুরো মনোযোগ সামনের দিকে। অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহূর্ত আত্মস্থ করে নিচ্ছে সে।

উত্তরে শূন্য জমির উপর গিয়ে ঘুরে গেল এয়ারক্রাফট। ধরল ফিরতি পথ। নগ্ন গোলাপি জমি বাদামি ধোয়ায় আচ্ছন্ন। সোনালি শস্য কাটা হয়ে গেছে।

তাদের সামনে সাদা বালুতটে সমুদ্র ভেঙ্গে পড়েছে ক্রিমের সারি নিয়ে। আটলান্টিক এখানে ঠাণ্ডা সবুজ। বাতাসের তোড়ে ভাঁজ হয়ে সাদা হয়ে নৃত্যরত।

 আবারো দক্ষিণে, উপকূলে সদ্য বালির উপর ছোট ছোট দেহ থেমে তাকিয়ে আছে উপরে তাদের দিকে, দক্ষিণে বিশাল পর্বতমালা, যেখানে থেমে গেছে ভূমি, এখান থেকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে সবকিছু। বন্দরে গাদাগাদি ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের সারি। পর্বতমালার নিচে সাদা দালানগুলোর জানালার কাঁচে লেগে ঝলকাচ্ছে শীতের রোদ।

আরো একটা টার্ন। আত্মবিশ্বাসী আর নিশ্চিত হয়ে কোলের উপর হাত রেখে বসে রইল বার্নি। রাডার বার থেকে তুলে নিয়েছে পা। টাইগারবার্গের উপর দিয়ে এয়ারফিল্ডের দিকে এগিয়ে চলল প্লেন।

‘ও, কে। জানাল বার্নি। চলে এসেছি। টাচ ডাউনের পর ট্যাক্সিং করে হ্যাঙ্গারে এসে থামলো এয়ারক্রাফট। মিকস্কার কন্ট্রোলকে পুরো টেনে দিতেই ইঞ্জিন মরে গেল।

এক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। কেউই নড়লো না বা কথাও বলল না। দুজনেই বুঝতে পারল যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু ঘটেছে, যা একে অন্যকে বলা দরকার।

“ঠিক আছে? শেষপর্যন্ত জানতে চাইল বার্নি।

“ইয়েস, স্যার।’ মাথা নাড়ল ডেভিড। স্ট্র্যাপ খুলে দু’জনেই মাটিতে নেমে এসে দাঁড়াল। কোন কথা না বলে দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে হ্যাঁঙ্গার পার হয়ে অফিসে এলো। দরজার কাছে এসে থেমে গেল।

‘পরের বুধবার? জানতে চাইল বার্নি।

‘হ্যাঁ, স্যার।’ বার্নিকে ছেড়ে অপেক্ষারত ক্যাডিলাকের দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। কয়েক কদম গিয়ে থেমে গেল। খানিকটা দ্বিধা সত্ত্বেও ফিরে এলো আবার।

‘এর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু এর আগে আর ঘটেনি আমার সাথে, লজ্জিত স্বরে জানাল ডেভিড। ধন্যবাদ, স্যার।’ তাড়াতাড়ি আবার চলে গেল সে। পিছনে তাকিয়ে রইল বার্নি।

গতির ঝড় তুলে চলে গেল ক্যাডিলাক। গাছের ভিড়ে শেষ দালানটার পেছনে বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। খানিকটা শোকাভিভূত হয়ে মাথা নাড়ল বার্নি। ফিরে গেল অফিসে। প্রাচীন সুইভেল চেয়ারে ধপ করে বসে ডেস্কের উপর জোড়া পা তুলে দিল। প্যাকেট থেকে একটা দোমড়ানো সিগারেট বের করে সোজা করে জ্বালিয়ে নিল।

‘সুন্দর?’ হেসে নিজেও স্বীকার করল। ক্র্যাপ!’ ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলল ম্যাচ বক্স। নিশানা ব্যর্থ হলো।

.

টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল মিটজি মরগ্যানের। বালিশের নিচে থেকে বের হয়ে অন্ধের মতো হাতড়াতে লাগল শব্দের উৎস।

‘লো।

‘মিটজি?

‘হাই ড্যাড, তুমি আসছো? বাবার গলা শুনে ঘুম ভেঙে অর্ধেক জেগে উঠল মিজি। মনে পড়ে গেল আজ তাদের পরিবারের সাথে হলিড়ে হোমে যোগ দেবার কথা বাবার।

‘সরি, বেবি। একটা ঘটনা ঘটেছে। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত আসতে পারব না আমি।’

“ওহ ড্যাড!’ নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করল মিটজি।

‘ডেভি কোথায়? আর কোন অভিযোগ শোনার আগে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করল মিটজির বাবা।

“ওকে, বলব তোমাকে ফোন করতে?

 ‘না, আমি অপেক্ষা করছি। ওকে ডেকে দাও বেবি।

বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়াল মিটজি। হাত দিয়ে চাইল চুলগুলোকে খানিক আঁচড়ে নিতে। উস্কোখুস্কো চুল এমন হয়ে আছে যেন সূর্যের আলো অথবা লবণাক্ত পানি বা ঝড়ো বাতাস বয়ে গেছে এগুলোর উপর দিয়ে। তার চেয়েও বাজে দেখাচ্ছে ছোট ছোট তিল। নিজের উপর অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল সে।

 ‘তোমাকে দেখাচ্ছে একটা পোকার মতো’, উঁচুস্বরে নিজেকে শোনাল  মিটজি, ‘একটা মোটাসোটা ছোট্ট পোকা….তিলওয়ালা। পরিবর্তনের সব চেষ্টা। ছেড়ে গায়ের উপর ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে নিল। ডেভিড তাকে এভাবে জিলিয়ন সময়ের চেয়েও বেশি বার দেখেছে। প্যাসেজে বের হয়ে এলো সে। বাবা মায়ের স্যুইট পার হয়ে এলো। মা এখন একা শুয়ে আছে সেখানে। বাসার লিভিং এরিয়ায় চলে এলো।

বাসা ভর্তি খোলা জায়গা, গ্যালারি, গ্লাস, স্টিল আর সাদা স্তম্ভ, সমুদ্রতটের কাছে বালিয়াড়ি থেকে উপরে উঠে গেছে। মিশে গেছে সমুদ্র আর আকাশের সাথে। গ্লাস শুধুমাত্র আলাদা করে রেখেছে। প্রভাতের অদ্ভুত আলোয় ভরে আছে চারপাশ।

প্লে-রুমের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে গত রাতের পার্টির নিদর্শন সমূহ, বিশজন অতিথি আর বালিয়াড়ির পাশে বড় হলিডে হোমস্ থেকে আগত সমান সংখ্যক জন ছাড়িয়ে গেছে নিজেদের সীমা-বিয়ার ফেলেছে, যত্রতত্র ছড়িয়েছে অ্যাশট্রে আর সিগারেটের মোড়ক।

আবর্জনার মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে অতিথি কক্ষের গোলাকার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল মিটজি। ডেভিডের দরজা চেক্ করে দেখল খোলা, ঢুকে পড়ল ভেতরে। বিছানা একেবারে নিপাট ভাঁজ হলেও চেয়ারের উপর পড়ে আছে ডেনিম আর ভেজা শার্ট। জুতো জোড়াও ফেলে রাখা হয়েছে অনাদরে।

হেসে ব্যালকনিতে পা বাড়ালো মিটজি। সমুদ্রতট থেকে অনেক উপরে ঝুলে আছে এটি। ঠিক গাংচিলদের বরাবর, ইতিমধ্যে রাতের বেলা সমুদ্রে ভেসে আসা পরিত্যক্ত আবর্জনা আর খাদ্যাবশেষের সন্ধানে উড়তে শুরু করেছে তারা।

 দ্রুত গাউন তুলে কোমরে পেঁচিয়ে নিল মিটজি। ব্যালকনির রেইলে উঠে পাশের ব্যালকনির রেইলে লাফ দিল। নিচে নেমে পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ল ম্যারিয়নের বেডরুমে।

ম্যারিয়ন ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। গোপনে গোপনে সে জানে যে এই আনন্দময় সম্পর্কের পেছনে কাজ করেছে ম্যারিয়নের পুতুলসুলভ সৌন্দর্যের জন্যে মিজির উপহার, পার্টি, ফ্রি হলিডে আর অন্যান্য আরো অনেক কিছু।

ঘুমের মাঝেও অসম্ভব সুন্দরী দেখাচ্ছে ওকে। নরম সোনালি চুল ছড়িয়ে আছে ডেভিডের বুকে। মিটজি মনোযোগ দিল নিজের কাজিনের দিকে। অনুভব করল বুকের মাঝ থেকে পেট পর্যন্ত নেমে গেল মোলায়েম একটা অনুভূতি। ডেভিডের বয়স এখন সতেরো। কিন্তু ইতিমধ্যেই পূর্ণাঙ্গ পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে সে।

মনে মনে ভেবে দেখল যে ডেভিডই ছিল পুরো পৃথিবীতে তার সবচেয়ে পছন্দের জন। ও এতো সুন্দর, এত লম্বা, ঋজু, সুন্দর আর চোখ জোড়া তো হৃদয়কে ভেঙ্গে দিতে পারে।

রাতের উষ্ণতায় নিজেদের চাদর একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল জোড়া দেহ। ডেভিডের বুকে দেখা যাচ্ছে ঘন, গাঢ় আর কোঁকড়া চুল। পেশীবহুল হাত-পা, চওড়া বুক।

‘ডেভিড, আলতো স্বরে কাঁধ ঝাঁকালো মিটজি। ওঠো।

 চোখ মেলে তাকাল ডেভিড। জেগে উঠল তৎক্ষণাৎ। হয়ে উঠল সচেতন।

 ‘মিটজি? কি হয়েছে?

 ‘প্যান্ট পড়ে নাও, বাছা। পাপা লাইনে তোমার অপেক্ষায়।

‘গড। উঠে বসল ডেভিড। বালিশে ফেলে দিল ম্যারিয়নের মাথা।

কয়টা বাজে?

 ‘অনেক। উত্তর দিল মিজি। তোমার উচিৎ অ্যালার্ম সেট করে ঘুমানো।

বিড়বিড় করে চাদরের খোঁজে হাত বাড়ালো ম্যারিয়ন।

 ‘ফোন কোথায়?

‘আমার রুমে–কিন্তু তুমি তোমার এক্সটেনশন লাইনে কথা বলতে পারো।

ব্যালকনির রেলিং টপকে ডেভিডের পিছুপিছু তার রুমে এলো মিটজি। শুটিসুটি মেরে উঠে বসল ডেভিডের বিছানায়। রিসিভার তুলে নিয়ে এক্সটেনশন কর্ডের সাথে ঘন কার্পেটের উপর অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল ডেভিড।

‘আংকেল পল? কথা বলল ডেভিড। কেমন আছো তুমি?

গাউনের পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট খুঁজে পেল মিটজি। সোনালি ডানহিল দিয়ে আগুন ধরালো। কিন্তু তৃতীয় বার টান দিতেই হাঁটা থামিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল ডেভিড। হেসে মিজির দুঠোঁটের ফাঁক থেকে সিগারেট নিয়ে টান দিল গভীরভাবে।

 ডেভিডের নগ্নতা তার উপর কী প্রভাব ফেলেছে লুকোতে চাইল মিটজি। আরেকটা সিগারেট খুঁজে নিল নিজের জন্য।

 ‘ও মরে যাবে আমি কী ভাবছি জানতে পারলে। মনে মনে বলল মিটজি। খানিকটা আনন্দ পেল এ ভাবনা থেকে।

কথা বলা শেষ করল ডেভিড। ফিরে তাকাল মিটজির দিকে।

 ‘সে আসছে না।

‘আমি জানি।

 ‘কিন্তু বার্নিকে পাঠাচ্ছে আমাকে তুলে নিতে।

এর মানে মাথা নেড়ে পিতাকে অবিকল অনুকরণ করল মিটজি।

‘তোমার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদেরকে ভাবতে শুরু করতে হবে এখন, মাই বয়। নিয়তি তোমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তার জন্যে প্রশিক্ষণ দিতে হবে তোমাকে।

বিড়বিড় করতে করতে ড্রয়ার হাতড়াতে লাগল ডেভিড রানিং শর্টসের খোঁজে।

‘আমার মনে হয় এখন তাকে বলা উচিৎ আমার।

হ্যাঁ। মিজি ও একমত হলো।

‘তোমার অবশ্যই তা করা উচিত। শর্টস পরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড।

‘আমার জন্যে প্রার্থনা করো ডল।

‘প্রার্থনার চেয়েও বেশি কিছু দরকার তোমার হে সৈনিক। আয়েশ করে বলল মিটজি।

সমুদ্রের ঢেউ এসে বেলাভূমিকে মসৃণ করে রেখে গেছে। এত সকালে আর কারো পা পড়েনি এখানে। স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে দৌড়ানো শুরু করল ডেভিড। পেছনে রেখে গেল ভেজা পায়ের ছাপ।

সমুদ্রের উপর গোলাপি আভা ছড়িয়ে উদয় হলো সূর্য। অটেনিকা পর্বতমালা স্পর্শ করতেই উড়তে লাগল ধোয়া কিন্তু কিছুই দেখল না ডেভিড। অভিভাবকের সাথে সম্ভাব্য সাক্ষাৎকারের ভাবনায় চিন্তিত সে।

জীবন এখন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়েছে। হাই স্কুল শেষ হয়েছে। সামনে তাই অসংখ্য খোলা পথ। সে জানে যে সে যে পথ বেছে নিতে চায় তার বিরোধিতা করবে সবাই। তাই এই শেষ কয়েক ঘণ্টা নিজের সংকল্প দৃঢ় করে নিতে চাইল মনে মনে।

একটা মৃত মাছের উপর ঝাক বেঁধে বসে আছে সামুদ্রিক পাখির দল। ডেভিড কাছে আসতেই উড়ে গেল মেঘের কাছে। সূর্যের কাছাকাছি গিয়েই ডেভিড জায়গাটা পার হতেই আবারো ফিরে এলো আগের জায়গায়।

লিয়ার জেটের শব্দ শোনার আগে এটাকে উড়ে আসতে দেখল সে। সূর্যোদয়ের বিপরীতে নিচ দিয়ে উড়ে এসে প্রায় নিঃশব্দে ডেভিডের কাছে এগিয়ে আসতে লাগল।

থেমে গেল ডেভিড। দীর্ঘক্ষণ দৌড়ানোর পরেও হালকাভাবে শ্বাস ফেলে দু’হাত মাথার উপর তুলে অভিবাদন করল। দেখতে পেল বার্নিও তাকে দেখে মাথা ঘুরিয়ে হেসে হাত তুলে প্রতিউত্তর জানাল।

লিয়ার প্রায় সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। একটা পাখা প্রায় ঢেউয়ের মাথা ছুঁয়ে দিল। এরপর ফিরে এলো ডেভিডের কাছে। ডেভিড শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লিয়ারের স্টিলের নাক নিচু হতে হতে মনে হলো বর্শার মতো এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে।

 ভয়ঙ্কর শিকারি পাখির মতন এসে থামলো তার পাশে। একেবারে শেষ মুহূর্তে ডেভিডের ধৈর্য ভেঙ্গে ভেজা বালিতে পড়ে গেল সে। লিয়ার উঠে নাক ঘুরিয়ে শুকনো এয়ারফিল্ডের দিকে চলে গেল।

‘সন অব আ বিচ’, বিড়বিড় করতে করতে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। নগ্ন বুক থেকে ঝেড়ে ফেলতে লাগল ভেজা বালি। মনে ভেসে উঠল বার্নির হাসি মুখ।

 ‘ভাল শিক্ষা দিয়েছি ওকে,’ ভাবল বার্নি, লিয়ারের কো-পাইলটের সিট থেকে দেখল ডেভিডকে।

মরগ্যানদের অন্ন ভোজনের পর থেকে ওজন বাড়তে শুরু করেছে বার্নির। বেল্টের উপর দিয়ে লজ্জিত ভাবে উঁকি দিচ্ছে মেদ। মুখটাও চওড়া হয়ে ঝুলে পড়ছে নিচের দিকে। মাথা ঢেকে রাখা টুপির আশপাশ দিয়ে রুপালি ঝলক দেখা যাচ্ছে।

ডেভিডকে উড়তে দেখে ছেলেটার জন্যে আবারো স্নেহ অনুভব করল বার্নি। তিন বছর ধরে মরগ্যান গ্রুপের চিফ পাইলটের দায়িত্ব পালন করছে সে। আর ভালো ভাবেই জানে যে কার তদারকিতে এটা হয়েছে। এখন তার সম্মান এবং নিরাপত্তা উভয়ই আছে। আরামদায়ক মেশিনে বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের নিয়ে উড়ে বেড়ায় সে। জানে নিজের জন্যেও চিন্তা নেই। মরগ্যান গ্রুপ নিজেদের খেয়াল রাখে।

এই জ্ঞান পাকস্থলিতে জমে যাবার সাথে সাথে খেয়াল করল তার শিষ্য জেট চালাচ্ছে নির্বিঘ্নে। এভাবে উড়ে যেতে পুরো মনোযোগ দরকার পড়ে। আর ছেলেটার চোখের তারায় এর কোন অভাব দেখল না বার্নি।

তাদের নিচে সমান্তরালে পড়ে আছে আফ্রিকার দীর্ঘ সোনালি সমুদ্রতট। মাঝে মাঝে পাথরের বাড়ি, ছোট রিসর্ট, মাছ ধরার গ্রামগুলো উপকূলরেখা ধরে এগিয়ে চলেছে লিয়ার জেট।

 সামনে পড়ে আছে আরো একটা সমুদ্রভূমি। কিন্তু নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ায় দেখতে পেল এ তটে মানুষের অভাব নেই।

 একজোড়া নারী দেহ সার্ক করতে এগিয়ে গেছে। হাই ওয়াটার মার্কের কাছে পড়ে থাকা তোয়ালে আর বিকিনির দিকে দৌড় লাগাল দ্রুত। কফি ব্রাউন ট্যান্ড চামড়ার সাথে অসামঞ্জস্য ঠেকল সাদা পশ্চাৎদেশের, আনন্দিত ভঙ্গিতে হাসল তারা।

 ‘তাদেরকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখাটা তোমার জন্যে ভালোই হলো ডেভিড।’ ছোট শরীরগুলো পেছনে ফেলে আসতেই হাসল বার্নি। উড়ে চলল দক্ষিণে।

কেপ আগুলহাস থেকে স্থলভূমিতে প্রবেশ করল তারা। পর্বতমালার উপর দিয়ে খাড়া উঠে গিয়ে থ্রটল হালকা করল ডেভিড। শহরের উপর দিয়ে এগিয়ে গেল ধীরগতিতে।

পাশাপাশি হেঁটে হ্যাঙ্গারে যেতে যেতে বার্নি খেয়াল করল ডেভিড এখন তার চেয়ে ছয় ইঞ্চি উঁচু।

 ‘ও যাতে তোমাকে ভয় দেখাতে না পারে, মাই বয়। সতর্ক করে দিল বানি। তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। দেখো যেন এর নড়চড় না হয়।’

 ডেভিড নিজের ব্রিটিশ রেসিং সবুজ এম.জি নিয়ে দে ওয়াল ড্রাইভে উঠে এলো। পর্বতের উপর থেকে নিচে শক্তি আর সম্পদের অন্যান্য নিদর্শনের মাঝে চারকোনা মরগ্যান বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

 বাইরে থেকে দেখলে একে পছন্দ করে ডেভিড। পরিষ্কার এবং কার্যকরী–ঠিক যেন একটা এয়ারক্রাফটের পাখা। কিন্তু স্বাধীনতার ব্যাপারটা প্রহেলিকা। এটা একটা দুর্গ আর জেলখানা।

নিজের রেসিং কার নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তাকিয়ে দেখল টাওয়ারের মতো মরগ্যান বিল্ডিংয়ের কাঠামোকে। এরপর র‍্যাম্পে উঠে গেল, যেখান থেকে পথ চলে গেছে নিচে আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যারেজে।

একটু পরেই প্রবেশ করল এক্সিকিউটিভ অ্যাপার্টমেন্টে টপ ফ্লোর। পাশ কাটিয়ে গেল ডেস্কের লম্বা সারিতে বসে থাকা বাছাই করা সুন্দরী ও দক্ষ টাইপ রাইটারদের। প্রত্যেককে অভিবাদন জানাল ডেভিড। সুন্দর মুখগুলোতে হাসি ফুটে উঠল, যেন একসাথে ফুটে আছে বাগানের প্রতিটি ফুল। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে মরগ্যান বিল্ডিংয়ের মাঝে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ডেভিড।

অভ্যন্তরীণ অংশের রক্ষক মার্থা গুডরিখ নিজের অফিসে টাইপরাইটার থেকে মুখ তুলে তাকাল। কঠিন আর বিজনেস লুক।

 ‘সুপ্রভাত মিস্টার ডেভিড। আংকেল অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে আর আমার মনে হয় আপনার একটা স্যুট পরে এলে ভালো হতো।

‘তোমাকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছে মার্থা। ওজন কমেছে আর তোমার চুলের ধরনটাও বেশ ভালো দেখাচ্ছে। কাজ হয়েছে, যেমনটা সব সময় হয়। মার্থার অভিব্যক্তি নরম হয়ে গেল।

‘আমাকে তেল দেবার চেষ্টা না করাই ভালো। সতর্ক করে দিল মার্থা।

পল মরগ্যান জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল নিচে মানচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা শহরের দিকে। কিন্তু ডেভিড ঢোকামাত্র ঘুরে তাকাল তাকে অভিবাদনের জন্যে।

‘হ্যালো, আংকেল পল। আমি দুঃখিত, চেঞ্জ করার সময় পাইনি। মনে হয়েছে সরাসরি আসাই ভালো।

“ঠিক আছে, ডেভিড। নাভী পর্যন্ত উন্মুক্ত ডেভিডের ফুলের নকশা করা শার্ট, চওড়া লেদার বেল্ট, সাদা টিলা পাজামা আর ভোলা স্যান্ডেলের উপর চোখ বুলিয়ে নিলো পল মরগ্যান। ভালোই দেখাচ্ছে ছেলেটাকে, মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো পল। এরকম অদ্ভুত আধুনিক কাপড়েও ভয়ঙ্কর লাবণ্যময় লাগছে তাকে।

‘তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। নিজের গাঢ় রঙের সনাতন কাটের স্যুটের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ভ্রাতুস্পুত্রের দিকে তাকাল মরগ্যান।

‘এসো, বসো। এখানে, ফায়ার প্লেসের কাছের চেয়ারে। সব সময়কার মতো খেয়াল করে দেখল তার নিজের যেটার কমতি আছে তাই আছে ছেলেটার উচ্চতা। খাটো পলের কাঁধ বেশ ভারী, সুগঠিত, মোটা পুরুষালি ঘাড় আর চৌকোনা মাথা। মেয়ের মতই তারও চুল নিকৃষ্ট, তারের মতো আর তার দৈহিক কাঠামোও কুমড়া ও পশুর মতো।

 প্রায় সব মরগ্যানই এরকম। কিন্তু ডেভিডের অভিজাত অবয়ব এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে। নিঃসন্দেহে সে তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে এহেন সৌন্দর্য। গাঢ় চুল আর উজ্জ্বল চোখ জোড়া আর এর পাশাপাশি দীপ্তিময় চলনবলন।

 ‘ওয়েল ডেভিড, প্রথমেই আমি তোমাকে অভিবাদন জানাতে চাই, তোমার ফাইনাল রেজাল্টের জন্যে। আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। গভীরভাবে বলে উঠল পল মরগ্যান, এছাড়াও আরো যোগ করতে পারতো-চিন্তা দূর হয়েছে এতে। ডেভিড মরগ্যানের শিক্ষার্থী জীবন ভরে আছে প্রবল সব ঝড়ে। অসম্ভব ভালো সাফল্যের পাশাপাশি এমন সব কদর্য কাণ্ড ঘটিয়েছে সে যে মরগ্যান পদবী আর সম্পদই একমাত্র পরিত্রাণ ছিল এক্ষেত্রে। গেমস মাস্টারের তরুণী স্ত্রীর। সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল সে। কতটুকু সত্যি জানে না পল, কিন্তু ভেবেছে এ ব্যাপারটার মসৃণ সমাপ্তির জন্যে বিদ্যালয়ের চ্যাপেলে অনুদান আর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেমস্ মাস্টারের জন্যে স্কলারশিপ হতে পারে চমৎকার পদক্ষেপ। এর পরপরই ডেভিড গণিতে জিতে নেয় ওয়েসেলস প্রাইজ। তাই ভুলে যাওয়া হয় সবকিছু–যতক্ষণ পর্যন্ত না ডেভিডের ইচ্ছে হয় হাউজমাস্টারের নতুন স্পোর্টস কার পরীক্ষা করে দেখার। ভদ্রলোকের অজ্ঞাতে ঘণ্টায় নব্বই মাইল বেগে চালানো হয় এটি। বলাবাহুল্য, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি গাড়িটা। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে কব্জিতে কাটা দাগ সমেত বের হয়ে আসে ডেভিড। পল মরগ্যানের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগেই কেবলমাত্র হাউজমাস্টারের রাগ প্রশমিত হয়। এর সাথে আরো যুক্ত হয় নতুন দামী মডেল কার আর মরগ্যান গ্রুপ ইস্ট হাউজের স্নানের অংশকে নতুন করে তৈরি করতে আর্থিক অনুদান প্রদান করে।

পল ভালো করেই জানে যে ছেলেটা বন্য প্রকৃতির আর এটাও জানে যে একমাত্র সেই তাকে বশ মানাতে পারবে। আর তাহলেই হয়ে উঠবে ক্ষুরধার অস্ত্র। পল মরগ্যান তার উত্তরাধিকারীর মাঝে যেসব গুণ দেখতে চায় তার সবগুলোই বিদ্যমান ডেভিডের মাঝে। জ্যোতি আর আত্মবিশ্বাস, উজ্জ্বল, দ্রুত মস্তিষ্ক, অভিমানপ্রিয়তা–কিন্তু সবকিছুর উপরে হলো তার দুর্ধর্ষ মনোভাব, প্রতিযোগিতার স্পৃহা, যেটা পলের মতে খুনীর মনোভাব।

‘ধন্যবাদ, আংকেল পল’, চিন্তিত মনে আংকেল পলের অভিবাদন গ্রহণ করল ডেভিড। নিঃশব্দে একে অন্যকে মেপে দেখছে। দুজন দুজনের সাথে কখনোই সহজ হতে পারে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই একে অপরের ঠিক বিপরীত আবার কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি এক রকম। সবসময় তাই মনে হয় যে দু’জনের পছন্দ পরস্পরের সাথে যুদ্ধে নেমেছে।

পল মরগ্যান এগিয়ে গেল জানালার কাছে। তাই পেছন থেকে আলো ছড়াতে লাগল সূর্য। এটা তার একটা বেশ পুরোনো কৌশল, অপরপক্ষ পড়ে যায় অস্বস্তিতে।

 ‘এমন না যে আমরা তোমার কাছ থেকে এর চেয়ে কম আশা করি।’ হাসল পল মরগ্যান, উত্তরে ডেভিডও হাসল। স্বীকার করল যে আজকাল সহজ হয়ে গিয়েছে।

‘আর এখন ভাবতে হবে তোমার ভবিষ্যত নিয়ে। বলে উঠল পল মরগ্যান, শীঘ্রি পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। যদিও আমার মনে হয় আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা বিজ্ঞান আর আইন-ই হবে উপযুক্ত। এই স্পষ্ট লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখে আমি আমার পুরোন কলেজে তোমার ভর্তির ব্যাপারে প্রভাব খাঁটিয়েছি।’

‘আংকেল পল, আমি উড়তে চাই। নরম স্বরে বলে উঠল ডেভিড। থেমে গেল পল মরগ্যান। অভিব্যক্তি খানিকটা পরিবর্তন হয়ে গেল।

‘তুমি তোমার পেশাগত জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছ মাই বয়। কোন আমোদ সম্পর্কে আলোচনা নয়।’

‘না, স্যার। আমি বলতে চেয়েছি যে আমি উড়তে চাই–জীবনের পথে।

‘তোমার জীবন এখানে-মরগ্যান গ্রুপ। এটি এমন কিছু নয় যে তোমার কাজের স্বাধীনতা আছে।’

‘আমি আপনার সাথে একমত নই, স্যার।

 জানালা ছেড়ে ফায়ার প্লেসের কাছে গেল পল মরগ্যান। হাতে একটা সিগার তুলে নিয়ে ডেভিডের দিকে না তাকিয়েই কথা বলা শুরু করল নরম স্বরে।

 তোমার বাবা বেশ রোমান্টিক ধাঁচের ছিল ডেভিড। এটা পেয়েছিল প্রথার বাইরে গিয়ে মরুভূমিতে ট্যাংক নিয়ে ঘুরে বেড়নোর সময়ে। মনে হচ্ছে। উত্তরাধিকার সূত্রে এই রোমান্টিসিজম পেয়েছো তুমি। এমন ভাবে বলল যেন কোন অসহ্যকর রোগ। ফিরে এলো যেখানে ডেভিড বসে আছে।

‘আমাকে বলল তোমার প্রস্তাব কী?

 ‘আমি এয়ারফোর্সে নাম লিখিয়েছি স্যার।

করে ফেলছো? সাইন করে ফেলেছা?”

 ‘হ্যাঁ, স্যার।’

 কত দিন?

 ‘পাঁচ বছর। শর্ট সার্ভিস কমিশন।

 ‘পাঁচ বছর’ ফিসফিস করল পল মরগ্যান। ওয়েল ডেভিড, জানি না কী বলব। তুমি জানো তুমিই শেষ মরগ্যান। আমার কোন পুত্র নেই। তাই এই বশাল কর্মযজ্ঞে আমাদের কোন প্রতিনিধি না থাকাটা অতীব দুঃখের ব্যাপার হবে। আমি ভাবছি তোমার বাবা থাকলে কী ভাবতেন

‘এর কোন মানে হয় না, আংকেল পল।’

 ‘আমার তা মনে হয় না, ডেভিড। আমার মনে হয় তুমি প্রতারণা করছে। মরগ্যান শেয়ারে তোমার ট্রাস্ট ফান্ড একটা বিশাল বাধা। এছাড়া আছে অন্যান্য সম্পত্তি। তোমার দায়িত্ব আর কর্তব্য নিয়ে ভাবছো না তুমি’

যদি সে চিৎকার করতো তবেই, ভয়ঙ্কর ভাবে ভাবল ডেভিড, জানে যে বার্নি যেমনটা বলেছে তাকে ভয় দেখানো হচ্ছে। যদি সে আমাকে এটা করতে বলতো তবেই আমি তাকে বলতাম এটা ঠেলে ফেলে দিতে। কিন্তু সে জানে যে দক্ষ লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। এমন এক মানুষ যে সারা জীবন ধরে মানুষ আর অর্থ দিয়ে অনর্থ ঘটিয়েছে। যার হাতে সতেরো বছর বয়সী একটা বালক ময়দার তাল ছাড়া আর কিছুই নয়।

‘দেখো ডেভিড, এর মাঝেই তোমার জন্ম। অন্য যে কোন কিছু হবে কাপুরুষোচিত, আত্মমর্যাদা লঙ্ঘন’ শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে গেছে মরগ্যান গ্রুপ। কোন একটা মাংশাসী গাছের মতে, গিলে ফেলবে, হজম করে ফেলবে। –তোমার ভর্তির কাগজ হাওয়া করে দেয়া কোন ব্যাপারই না। মাত্র একটা ফোন কল’ই এক্ষেত্রে যথেষ্ট।

‘আংকেল পল, প্রায় চিৎকার করে উঠল ডেভিড, চেষ্টা করছে শব্দের স্রোত বন্ধ করে দিতে।

‘আমার বাবা। সেও এটা করেছিল। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।”

‘হ্যাঁ, ডেভিড। কিন্তু সময় তখন ভিন্ন ছিল। আমাদের একজনকে যেতেই হতো। ও ছিল ছোেট–আর অবশ্যই ব্যক্তিগত কারণও ছিল। তোমার মা এক মুহূত থেমে গিয়ে আবারো বলে চলল,—আর যখন এটা শেষ হয়েছে তখন ফিরে এসে এখানে নিজের সঠিক দায়িত্ব পালন করেছে। আমরা তাকে এখন মিস্ করি ডেভিড। তার শূন্যস্থান পূরণ করার ক্ষমতা কারো নেই। আমি সবসময় আশা করি তুমি হয়তো তা পারবে।

কিন্তু আমি তা চাই না। মাথা নাড়াল ডেভিড। আমি আমার জীবন। এখানে অপচয় করতে চাই না। চারপাশের ম্যামথের সুবিশাল গ্লাস আর ইট, কাঠের কাঠামো দেখিয়ে বলল, আমি প্রতিটি দিন কাগজের স্তূপের উপর উবু। হয়ে কাটাতে চাই না’

‘এটা এমন নয়, ডেভিড। এটা বেশ চমকপ্রদ, চ্যালেঞ্জিং, পরিবর্তনশীল–’

‘আংকেল পল।’ আবারো গলার স্বর উঁচুতে উঠে গেল ডেভিডের।

‘এমন কোন লোককে তুমি কী বলবে যার পেট ভরে আছে ভালো খাবারে তার পরেও সমানে খেয়ে চলেছে?

শান্ত হও, ডেভিড। প্রথমবারের মতো বিরক্ত শোনাল পল মরগ্যানের কণ্ঠস্বর। অধৈর্য ভাবে একপাশে ঠেলে দিল প্রশ্নটা।

কী বলবে সে মানুষটাকে? আবারো জোর করল ডেভিড।

‘আমার মনে হয় তুমি তাকে পেটুক বলবে। উত্তর দিল পল মরগ্যান।

‘আর এমন কোন লোককে কী বলবে যার কোটি কোটি অর্থ থাকার পরেও জীবন কাটাচ্ছে আরো তৈরির আশায়?

পাথরের মতো জমে গলে পল মরগ্যান। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল নিজের রক্তের দিকে উত্তর দেবার আগে।

‘তুমি উদ্ধত হয়ে উঠছে। অবশেষে বলে উঠল পল মরগ্যান।

না, স্যার। আমি এটা বোঝাতে চাইনি। তুমি পেটুক নও–কিন্তু আমি হয়তো হয়ে যাবো।

ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের ডেস্কের কাছে গেল পল মরগ্যান। পিছনে অত্যাধিক উঁচু চামড়ার চেয়ারে বসে অবশেষে আগুন ধরালো সিগারে। আবার দীর্ঘ সময় ধরে চুপ করে রইল দুজনে। অবশেষে কথা বলল পল মরগ্যান।

তুমি ঠিক তোমার বাবার মতোই করবে। কিন্তু কীভাবে আমি তোমার পাঁচটা বছর বাঁচাবো অপচয়ের হাত থেকে।

‘অপচয় হবে না আংকেল পল। আমি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হয়ে ফিরব।’

‘আমার মনে হয় এ এতটুকু নিয়েই খুশি থাকতে হবে আমাদেরকে। ডেভিড উঠে আংকেলের চেয়ারের পাশে দাঁড়াল।

‘ধন্যবাদ। আমার জন্যে এটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

‘পাঁচ বছর, ডেভিড। এরপর তোমাকে চাই আমি।’ এরপর হেসে খানিকটা কৌতুক করল পল মরগ্যান, ‘অন্তত তোমার চুল কাটবে তারা।

উষ্ণ মাংসের মতো রঙের পৃথিবী থেকে চার মাইল উপর দিয়ে তরুণ দেবতার মতো স্বর্গের দিকে উড়ে চলল ডেভিড মরগ্যান। হেলমেটের সূর্য প্রতিরোধক অংশ বন্ধ। তাই চোখের রহস্যময় দৃষ্টি ঢেকে আছে। মিরেজ প্লেনে উড়ে চলে যে শক্তির আবেগ আর বিচ্ছিন্ন হবার উদগ্র বসানা জেগে উঠেছে, তা থেকে পাঁচ বছর কিছুতেই টলাতে পারেনি তাকে।

এয়ারক্রাফটের উপর সরাসরি পড়ছে সূর্যের আলো। নিচে পৃথিবীর উপরে নেকড়ের মতো বাতাসের তাড়া খেয়ে মেষের মতো উড়ে চলেছে মেঘের দল।

আজকের ফ্লাইটে কেমন একটা মন খারাপ ভাব, বিষণ্ণতা মিশে আছে। আগামীকাল তার শেষ দিন। দুপুর বেলায় কমিশন শেষ হয়ে যাবে আর যদি পল মরগ্যান চায় তাহলে সে হয়ে যাবে মিস্টার ডেভিড-মরগ্যান গ্রুপের নতুন বালক।

চিন্তাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে চাইল শেষ মুহূর্তের এই মূল্যবান মিনিটগুলো উপভোগ করতে। কিন্তু আবেশ কেটে গেল শীঘ্রিই।

জুলু স্ট্রাইকার ওয়ান, রেঞ্জ কন্ট্রেল থেকে বলছি। তোমার পজিশন রিপোর্ট করো।’

‘রেঞ্জ কন্ট্রোল, জুলু স্ট্রাইকার ওয়ান বলছি, রেঞ্জ পঞ্চাশ মাইল। স্ট্রাইকার ওয়ান, রেঞ্জ পরিষ্কার। তোমার টার্গেট চিহ্ন আট এবং বারো। উড়ে চলো সামনে।

হঠাৎ করে মিরেজের নাকের সামনে দিগন্ত বদলে গেল।

ডেভিড ডান হাতে দ্রুত উইপন সিলেক্টর প্যানেলের উপর এসে রকেট সার্কিট ল করে দিল।

সামনের দৃশ্য পুরোপুরি বৈচিত্র্যহীন। নিচু কাঁটা ঝোপে পূর্ণ মিরেজ নিচু করে আনায় পাখার মাথায় লাগছে। এ ধরনের উচ্চতায় গতি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি। আর প্রথম টার্গেট চিহ্নটা এসে প্রায় সাথে সাথে আবার রুপালি নাকের আড়ালে চলে গেল।

পাঁচ, ছয়, সাত-সাদা ভূমিতে কালো অক্ষরগুলো হারিয়ে গেল একে একে।

বামপাশে রাভারের উপর স্পর্শ আর লেগে থাকা, প্রতিটি কাজ হয়ে গেল অবচেতনে। সামনে রকেটের রেঞ্জের গোলাকার কাঠামো। এটিই ‘ কোক, উড্ডয়নের কলাকৌশলের কয়েকটা অর্থহীন শব্দের একটি, এটাই তাই টার্গেট।

 ভয়ঙ্কর মেশিনটাকে দ্রুত আর নিচুতে নিয়ে এলো ডেভিড, ওর দণ্ড মিটার এমন একটা স্পিড রেকর্ড করল যা প্রায় সব সৈনিক পর্যায়ের। সরাসরি ট্র্যাকে থেকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল। কাছে আসতেই মিরেজের নাক গুতো দিল “পিচ আপ” অংশে। এরপর টার্গেটের উপর ট্রিগার টেনে দিল ডান হাতের অংশ।

 কাঁপতে থাকা রূপালি মেশিনটা ঠিকঠিক নাক-নিচু করে রকেট চালানোর অলটিচ্যুড খুঁজে পেল একেবারে নির্দিষ্ট সময়ে। ডায়মন্ড আকৃতির রিফ্লেক্টর সাইটের একেবারে মাঝখানে দেখা গেল ‘কোক’ এর সাদা ধোঁয়া।

এ ধরনের বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটানোর জন্য নানা রকম দক্ষতা প্রয়োজন। স্প্রিং লোডে ট্রিগারে চাপ দিয়েছিল সে। এয়ারক্রাফটে বসে কোন কিছু বোঝা গেল না। জেটের গর্জনের নিচে রকেটের হিস্ শব্দটাও ঢেকে গেল। কিন্তু তার পাখার নিচ দিয়ে ধোয়ার লাইন টার্গেটে লাগাল। আর নিশ্চিন্তে ডেভিড থ্রটল টেনে দিল।

‘হোয়াইট আ ওয়ে টু গো।

উজ্জ্বল নীলে ভেসে গেল মিরেজের নাক। নিচের সিটে আরামে গা এলিয়ে বসল ডেভিড। হাসল। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি চাইছে তাকে সিটে ধরে রাখতে।

হ্যাল্লো, স্ট্রাইকার ওয়ান। রেঞ্জ কন্ট্রোল থেকে বলছি। একেবারে ঠিক ঠিক শুতে দিয়েছে নাক। এবার ডান পাশে। মানুষটাকে একটা কোক দাও। নাইস শ্যটিং। তোমাকে হারাতে খারাপ লাগছে ডেভি। রেঞ্জ ডিসিপ্লিন ছুঁয়ে গেল ডেভিডকে। ও অনেক মিস করবে–সবাইকে। নিজের জয়স্টিকের মাথায় লাগানো ট্রান্সমিট বাটনে চাপ দিল ডেভিড। কথা বলল হেলমেটের মাইক্রোফোনে স্ট্রাইকার ওয়ান থেকে বলছি, ধন্যবাদ আর বিদায়।’ ‘ওভার অ্যান্ড আউট।

গ্রাউন্ড ক্রুরাও ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। সবার সাথে হাত মেলালো সে। আজগুবি করদর্মন আর জঘন্য সব জোকস ঢেকে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে তাদের মাঝে গড়ে ওঠা সত্যিকারের স্নেহকে। এরপর তাদেরকে ছেড়ে গায়ে গ্রীজ আর তেলের গন্ধ নিয়ে এয়ারক্রাফটের সারির ধাতব অংশ দিয়ে চলে এলো ডেভিড।

থেকে একটির ঠাণ্ডা শরীরে চাপড় দিল। আর্দালি এসে দেখল উঁচু টেইল প্লেনের গায়ে আঁকা ফ্লাইং কোবরার দিকে তাকিয়ে আছে ডেভিড।

‘সি.ও.র কমপ্লিমেন্টস স্যার, এখনি ওনার কাছে রিপোর্ট করুন।

কর্নেল রাসটাস নড শুকিয়ে যাওয়া কাঠের মতো একজন মানুষ। বানরের মতো চেহারা। গায়ের ইউনিফর্মে মেডেল আর রিবনের অদ্ভুত ছড়াছড়ি। তিনি ব্যাটেল অব ব্রিটেনে হারিকেন, ইটালিতে মুসটাঙস, প্যালেস্টাইনে স্পিটফায়ার আর মেসারম্মিট ১০৯ আর কোরিয়াতে স্যাবারস চালিয়েছেন। বর্তমান। দায়িত্বের পক্ষে তার বয়স বেশি হলেও কেউই সাহস করে তাকে একথা বলতে পারে না। কেননা স্কোয়াড্রনের অনেক তরুণ সৈন্যের চেয়েও দক্ষ পাইলট আর যোদ্ধা তিনি।

‘তো অবশেষে তুমি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছো ডেভিড। অভিবাদন জানালেন কর্নেল।

‘মেস পার্টি পর্যন্ত নয়, স্যার।

 হ্যাঁ। মাথা নাড়লেন কর্নেল। এই পাঁচ বছর আমার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছো তুমি। আমার কাছে এক বালতি হুইস্কি পাওনা আছে তোমার। ডেস্কের পাশে শক্ত গদিওয়ালা চেয়ার দেখালেন ডেভিডকে। বসো ডেভিড।

এই প্রথম ডেভিডের ডাক নাম ধরে ডাকলেন তিনি, পদবী নয়। ডেস্কের কর্ণারে ফ্লাইং হেলমেট রেখে চেয়ারে বসল ডেভিড, আঁটসাঁট জি-স্যুটে অস্বস্তি হচ্ছে।

 সময় নিয়ে নিজের পাইপে ভয়ঙ্কর ম্যাগলিসবার্গ তামাক ভরলেন কর্নেল। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে দেখতে লাগলেন বিপরীত প্রান্তে বসা তরুণটিকে। পল মরগ্যান যে গুণ দেখতে পেয়েছিল একই জিনিস লক্ষ্য করলেন কর্নেল রাসটাস। উদ্ধত আর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব। একজন পাইলটের জন্য যা গুণ হিসেবে অনন্য।

অবশেষে পাইপ ধরিয়ে ঘন নীল ধোঁয়ার মেঘ ছেড়ে ডেস্কের উপর দিয়ে ডেভিডের দিকে ঠেলে দিলেন একতোড়া কাগজ।

 ‘পড় আর সাইন করো’, বললেন তিনি। এটা অর্ডার। দ্রুত কাগজগুলোতে চোখ বোলালো ডেভিড। এরপর মুখ তুলে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘আপনি এত সহজে ছাড়বেন না, স্যার।’ স্বীকার করল সে।

একটা দলিলে লেখা আছে ডেভিডের শর্ট সার্ভিস কন্ট্রাক্ট আরো পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। অন্যটি পদোন্নতির দলিল ক্যাপ্টেন থেকে মেজর।

‘তোমাকে আজকের তুমি’তে তৈরি করার জন্য আমাদের অনেক সময় আর অর্থ অপচয় হয়েছে। তোমার মাঝে আছে কিছু অসাধারণ প্রতিভা, আর আমরা একে বাড়িয়ে উন্নত করেছি আমি শব্দের অপচয় করব না–তুমি, এখন পুরো দস্তুর পাইলট।

‘আমি দুঃখিত, স্যার।

সত্যি কথাই বলল ডেভিড।

‘ধুত্তোরি। রেগে উঠল রাসটাস।

কী দরকার ছিল তোমার মরগ্যান হয়ে জন্ম নেবার। এত অর্থ–তারা তোমার পাখা দুটোকে আটকে ডেস্কের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবে।’

‘এটা অর্থ নয়।’ তাড়াতাড়ি বাধা দিল ডেভিড। অনুভব করল নিজের রাগ মিশে গেল এ অভিযোগে।

মাথা নাড়ল রাসটাইস। হ্যাঁ।’ বলে উঠলেন তিনি। এই ব্যাপারটাকেও ঘৃণা করি আমি।’ ডেভিডের ফিরিয়ে দেয়া দলিল তুলে নিয়ে রেখে দিলেন কর্নেল। তোমাকে প্রলোভিত করার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই না?

 কর্নেল, এটা ব্যাখা করা বেশ কঠিন। আমার শুধু মনে হয় যে আরো বেশি কিছু আছে করার। গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা সম্পর্কে খোঁজ করতে হবে আমাকে আর এটা এখানে নয়। আমাকে এটার খোঁজে যেতে হবে।’

গভীরভাবে মাথা নাড়লেন রাসটাস। “ঠিক আছে, তাহলে আমি চেষ্টা করেছি। এখন তুমি তোমার বহুদিন ধরে কষ্ট করা কমান্ডিং অফিসারকে মেসে নিয়ে যাও আর মরগ্যান মিলিয়ন খরচ করে তাকে হুইস্কি দিয়ে ভরে তোলো। উঠে দাঁড়িয়ে ধূসর মাথায় চড়ালেন ইউনিফর্ম ক্যাপ। আজ রাতে তুমি আর আমি একসাথে মাতাল হবো। দুজনেই আমরা কিছু হারাচ্ছি। সম্ভবত তোমার চেয়ে আমি বেশি।

.

সব দেখে মনে হচ্ছে যে সুন্দর আর শক্তিশালী মেশিনের প্রতি ভালোবাসা ডেভিড পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। ক্লাইভ মরগ্যান স্ত্রীকে নিয়ে নিজের নতুন কেনা ফেরারি স্পোর্টসকার চালিয়ে যাচ্ছিল একটা রসদ বোঝাই ট্রেনের পাশাপাশি। লেভেল ক্রসিংয়ের আলো ছিল নেভানো। ট্রাফিক পুলিশ হিসেব কষে জানিয়েছে যে সংঘর্ষের সময় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় দেড়শ মাইল।

এগারো বছর বয়সী পুত্রের জন্য বিস্তারিত আর বিস্তৃত বন্দোবস্ত করে গেছে ক্লাইভ মরগ্যান। বাচ্চাটা তৎক্ষণাৎ চলে যায় চাচা পাল মরগ্যানের হেফাজতে। লালন-পালনের জন্য রাখা হয়েছে ট্রাস্ট ফান্ডের সিরিজ।

স্নাতক হবার পর ফান্ডের প্রথমটিতে ডেভিডের সরাসরি ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। যার আয় প্রায় একজন সুপ্রতিষ্ঠিত সার্জনের সমকক্ষ। এই দিনে পুরাতন সবুজ এম.জি.র জায়গা নেয় পাউডার নীল মাজেরাতি, সত্যিকারের মরগ্যান প্রথানুযায়ী।

তেইশতম জন্মদিনে কারো ভেড়ার র‍্যাঞ্চের মালিকানা, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় ক্যাটেল র‍্যাঞ্চ আর জাবুলানি, সাবি স্যান্ড ব্লকে গেম, র‍্যাঞ্চ সমস্তই। চলে আসে তার হাতে। ট্রাস্টিরা এগুলো পরিচালনা করতে থাকে দক্ষ ভাবে।

পঁচিশ বছর জন্মদিনে দু’নম্বর ফান্ডের সুদও তার হাতে আসবে। এর পাশাপাশি দুটি বিশাল শহর-দালানের আলোচনাযোগ্য কাগজ ও পদবী– অফিস, সুপার মার্কেট কমপ্লেক্স, হাই-রাইজ হাউজিং প্রজেক্ট।

ত্রিশ বছর বয়সে পরবর্তী ফান্ডের পথ খুলে যাবে তার জন্য। প্রথম দুটি একত্রিত করলে যত বড় হবে ততটাই বড়। আর শুরু হবে মরগ্যান স্টকের প্রথম পাঁচটি তাকে দেয়ার প্রক্রিয়া।

এরপর থেকে প্রতি পাঁচ বছরে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত অন্যান্য ফান্ড খোলার পাশাপাশি মরগ্যান স্টকের অন্যান্য অংশও সে পেতে থাকবে। তাই সামনে পড়ে আছে সম্পদের পাহাড়, জমকালো বিত্ত, যেন সুস্বাদু খাবারের প্রদর্শনী, ফলে ক্ষুধাই মরে যায়।

দ্রুত দক্ষিণ দিকে ছুটে চলেছে ডেভিড। টারম্যাকে হিসহিস শব্দে গর্জে চলেছে মিশেলিন চাকা। ডেভিডের মনে বইছে চিন্তার ঝড়; এত সম্পত্তি; বিশাল স্বর্ণের খাঁচা, মরগ্যান গ্রুপ কোন প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো বিশাল মুখ হাঁ করে এগিয়ে আসছে তাকে গিলে খাবার জন্য। মনে হলো কোন জেলি ফিশের গহ্বরে যাবে সে। নিজের প্রাচুর্যের মাঝে বন্দী।

এহেন সম্ভবনায় মুষড়ে পড়ল ডেভিড। পেটের মাঝে কেমন শূন্য একটা অনুভব হলো।

আরো জোরে হোটতে লাগল মাজেরাতি। শক্তি আর গতির দ্বৈত মিশ্রণে শান্তি খুঁজতে চাইল। মন দিয়ে ছন্দের তালের মতো দ্রুত চালাতে লাগল। মাইলের মতই দ্রুত বেগে ঘণ্টাও পার হয়ে গেল। তাই দিনের আলো থাকতেই পৌঁছে গেল ক্লিফটন বীচ আর স্বচ্ছ সবুজ আটলান্টিকের দিকে মুখ করে থাকা মিটজির অ্যাপার্টমেন্টে।

বিশৃঙ্খল মিটজির অ্যাপার্টমেন্টে সবকিছুই প্রায় আগে মতই আছে। আগন্তুকদের জন্য খোলা আছে তার ঘর, যারা ওর দেয়া ড্রিংক পান করে, খাবার খায় আর কে কার চেয়ে বেশি উন্মাদ হতে পারে তার প্রতিযোগিতা করে।

প্রথম বেডরুমে ঢু মেরে ডেভিড দেখল অদ্ভুত একটা মেয়ে কোঁকড়া চুল। ছড়িয়ে ছেলেদের পাজামা পরে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়, মুখে আবার বুড়ো আঙুল।

দ্বিতীয় রুমে ভাগ্য খুলে গেল তার। কেউ নেই। যদিও বিছনার অবস্থা যাচ্ছে-তাই আর কেউ একজন পাশের টেবিলের উপর নাশতার ডিম ফেলে চলে গেছে।

কাঁধের ব্যাগ বিছানার উপর রাখল ডেভিড। স্নানের জিনিসপত্র বের করে নিল। দ্রুত বেশবাশ বদলে পাশের সিঁড়ি যেটা ধাপে ধাপে নেমে গেছে সমুদ্রতটে, দৌড়ানো শুরু করল–প্রথম দিকে হালকা পায়ে; তারপর হঠাৎ করেই এত জোরে দৌড়াতে লাগল যেন ভয়ঙ্কর কোন জন্তু তার পিছু ধাওয়া করে আসছে। চতুর্থ বিচের শেষে যেখান থেকে শুরু হয়েছে পাথর, বরফ শীতল পানিতে নেমে গেল ডেভিড। বাকোভেন পয়েন্টের কিনার পর্যন্ত চলে এলো। খোলা হাতে সাঁতার কাটায় হাড় পর্যন্ত যেন জমে গেল ঠাণ্ডায়। তাই তীরে উঠে এলে দেখা গেল ও নীল হয়ে কাঁপছে। কিন্ত বিমর্ষতা কেটে গেল পুরোপুরি। আর মিটজির অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে জগিং করার সময় আবারো উষ্ণ হয়ে উঠল শরীর।

 বাথরুম জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মেয়েদের অন্তর্বাসের পাহাড় ছড়িয়ে তবেই স্নান শেষ করল ডেভিড। বের হতেই সামনের দরজা খুলে উত্তরের বাতাসের মতে এগিয়ে এলো মিটজি।

‘কোথায় ছিলে তুমি, ওয়ারিওর?’ দরজার গায়ে তাল বাজাচ্ছে মিটজি। আমি গ্যারাজে তোমার গাড়ি দেখেছি। বুঝতে পেরেছি তুমি এখানে এসেছে!’

 ‘এখানেই আছি, ডল। জানাল ডেভিড। দরজায় দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল তারা। ওজন বেড়ে গেছে মিটজির। স্কার্টের ভাঁজ শক্ত হয়ে এঁটে আছে শরীরে। শরীর ভারী। বেগুনি সোয়েটারের নিচে যৌবন উঁকি দিচ্ছে। অবশেষে হার মেনেছে মায়োপিয়ার কাছে। ছোট্ট নাকের শেষ মাথায় বসে আছে মেটাল ফ্রেমের চশম। ইতস্তত ছড়িয়ে আছে চুল।

‘তুমি অনেক সুন্দর হয়ে গেছ।’ চিৎকার করে এগিয়ে এসে ডেভিডকে কি করল মিটজি। সোয়েটারে লেগে গেল ডেভিডের সাবান। সে অবস্থায় তাকে জড়িয়ে ধরল মিটজি।

‘ড্রিংক না কফি? জানাতে চাইল মিটজি। অ্যালকোহলের চিন্তায় বিবমিষা বোধ হলো ডেভিডের। কফিই ভালো হবে, ডল।

মগ ভর্তি কফি নিয়ে এসে বাথরুমের টয়লেট সিটে বসল মিটজি। বাথটাবে স্নানরত ডেভিড।

‘এবার বলল সবকিছু! আদেশ দিল মিটজি। কথার মাঝেই সুন্দরী কালো চুলের মেয়েটা ঢুকলো রুমে। এখনো পায়জামা পরিহিত অবস্থায় মুখে নিদ্রার আবেশ।

‘আমার কাজিন, ডেভিড। ও খুব সুন্দর তাই না? মিটজি পরিচয় দিল ডেভিডের। আর ও হো লিজ, ডেভিড।

কর্ণারে রাখা নোংরা ঝুড়ির উপর গিয়ে বসল মেয়েটা। আর এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে যে সাবধান করে দিল মিটজি। ধীরে ডার্লিং। এখান থেকেও আমি টের পাচ্ছি যে তোমার ওভারি নাচানাচি করছে পিং পং বলের মতো।

কিন্তু মেয়েটা এমন চুপ করে আছে যে শীমিই তার অস্তিত্ব ভুলে কথা বলা শুরু করল ডেভিড আর মিটজি। হঠাৎ করে কোন ভূমিকা না করেই বলে উঠল সে, ‘পাপা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঠোঁট চাটছে লতা পেঁচানো রাক্ষসের মতো। শনিবার রাতে তাদের সাথে ডিনার করেছিলাম আমি–এক কোটিরও বেশি বার তোমার নাম নিয়েছে। ওখানে টপ ফ্লোরে তোমাকে দেখাটা বেশ অদ্ভুত হবে। ধূসর রঙের স্যুট, সোমবার সকালের কনফারেন্স

হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াল ডেভিড। গায়ে থেকে ঝরে পড়ছে পানি। সবেগে সাবান ঘসতে লাগল নিম্নাগ্নে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েরা। কালো চুলের মেয়েটার চোখ দুটো এত বড় হয়ে গেল যেন সারা মুখে আর কিছু নেই।

আবারো বসে পড়ে গায়ে পানি দিল ডেভিড। বাথটাব উপচে পড়ছে পানি।

‘আমি যাচ্ছি না।’ ঘোষণা করল সে। নেমে এলো দীর্ঘ নীরবতা!

 “মানে কী–তুমি যাচ্ছো না?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে মিটজি।

‘এটাই। ব্যাখা করল ডেভিড।

 ‘আমি যাচ্ছি না মরগ্যান গ্রুপে।

 ‘কিন্তু তোমাকে যেতেই হবে!

কেন? জানতে চাইল ডেভিড।

‘ওয়েল, আমার কথার অর্থ যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে তুমি বাবার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে এয়ারফোর্সের পড়াশোনা শেষে ফিরে আসবে।

না।’ জানাল ডেভিড। আমি কোন প্রতিজ্ঞা করিনি। সে এমনিতেই মেনে নিয়েছিল। এক মুহূর্ত আগে তুমি যেমন বলছিলে সোমবার সকালে কনফারেন্সে উজ্জ্বল উপস্থিতি–আমি জানি আমি এসব পারব না। আমার ধারণা আমার সম্পর্কে ভালোই জানা আছে সবার।’

‘তাহলে কী করবে তুমি? প্রথম শোকের ধাক্কা কাটিয়ে উঠল মিটজি। গালগুলো উত্তেজনায় হয়ে উঠল গোলাপি।

‘আমি জানি না। আমি শুধু জানি যে আমি অন্যদের অর্জন পাহারা দিতে পারব না। মরগ্যান গ্রুপ মানে আমি নই। এটা তৈরি করেছে পূর্বপুরুষ, বাবা আর আংকেল পল। এটা অনেক বড় আর বেশ ঠাণ্ডা

উজ্জীবিত হয়ে উঠল মিজি, উজ্জ্বল চোখে নিজের সম্মতি জানাল। বিদ্রোহের সম্ভাবনায় নেচে উঠল তার মন।

 ডেভিড নিজেও এটা ভেবে গরম হয়ে উঠল। আমি আমার নিজের পথ খুঁজে বের করব চলার জন্য। আরো অনেক কিছু আছে করার। এর চেয়ে বেশি কিছু থাকতেই হবে।

‘হ্যাঁ, এত জোরে মাথা নাড়ল মিটজি যে আরেকটুকু হলে নাক থেকে চশমা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। তুমি ওদের মতো নও। কোন একটা এক্সিকিউটিভ স্যুইটে ঢুকিয়ে দিলে তুমি বোধ হয় মারাই যাবে।’

 ‘আমাকে এটা খুঁজে বের করতে হবে মিটজি। কোথাও না কোথাও নিশ্চয় আছে।

বাথটাব থেকে উঠে এলো ডেভিড। লাল-বাদামী বর্ণ ধারণ করেছে শরীর, ধোয়ার রেশ উঠছে শরীর থেকে। কথা বলতে বলতে টেরি রোব জড়িয়ে নিল গায়ে। মেয়েরাও তার পিছুপিছু বেডরুমে এসে বিছানার ধারে বসল পাশাপাশি। সানন্দে মাথা নেড়ে একমত হলো ডেভিডের স্বাধীনতা ঘোষণায়। আবারো বাদ সাধলো মিটজি।

বাবাকে কী বলবে তুমি? জানতে চাইল সে। ডেভিডের উত্তেজনা বাধা পেল এ প্রশ্নে। বুকের লোমে হাত রেখে ভাবতে লাগল সে। মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা করল মেয়েরা।

 ‘ও তোমাকে আবারও চলে যেতে দেবে না।’ সর্তক করে দিল মিটজি। ‘কোন যুদ্ধ ছাড়া।’

এই সংকটের মুহূর্তে সাহস উবে গেল ডেভিডের। আমি তাকে একবার বলেছি। আবার বলার তো দরকার নেই।

‘তুমি এমনিই দৌড় লাগাবে?’ আবারো জানতে চাইল মিজি।

‘আমি পালাচ্ছি না। আত্মমর্যাদা মাথায় রেখে বলে উঠল ডেভিড। বিছানার পাশের টেবিল থেকে ক্রেডিট কার্ডে ভর্তি শুয়োরের চামড়ার ফোল্ডার তুলে নিল।

 ‘নিজের ভবিষ্যত নির্ধারণের অধিকার নিশ্চয় আছে আমার। টেলিফোনের কাছে গিয়ে ডায়াল করা শুরু করল সে।

কাকে ফোন করছো?

 ‘এয়ালাইন।

কোথায় যাবে?

তাদের প্রথম ফ্লাইট যেখানে যায়।’

“ঠিক আছে। আমি তোমাকে কাভার দেবো।’ বিশ্বস্ত ভাবে ঘোষণা করল মিটজি। তুমি ঠিক কাজটাই করছে ওয়ারিওর।

 ‘এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ থাকতে পারে।’ একমত হলো ডেভিড। আমার রাস্তা–তাদের কথা বাদ দাও। আমি দেখে নেবো সবাইকে।

 ‘এ জন্য তোমার সময় আছে? দাঁত কিড়মিড় করল মিটজি। আর প্রথমবারের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় কথা বলে উঠল কালো চুলের মেয়েটা। একবারের জন্যও ডেভিডের উপর থেকে চোখ সরায়নি সে। আমি অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু আমি কী প্রথম জন হতে পারি?

কানে টেলিফোনের রিসিভার নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল ডেভিড। অবাক হয়ে দেখল মেয়েটা অসীম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।

শিপোল এয়ারপোর্টের কাঁচ ঘেরা হল থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। লোভীর মতো চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল নিজের মুক্তির পথ, কেউ তাকে খেয়াল করছে না দেখে আনন্দ নেচে উঠল মন। ঠিক তখনি কুনইতে হালকা স্পর্শ। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল লম্বা আর হাসিমুখে এক ডাচ তরুণ তাকে দেখছে রীমলেস চমশার ফাঁক দিয়ে।

 ‘মি. ডেভিড মরগ্যান? হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল ডেভিড।

হল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ান স্টিভ ডেরিং থেকে আমি ফ্রেডরিক ভ্যান গেন্ট বলছি। হলান্ডে মরগ্যান শিপিং লাইনস-এর হয়ে কাজ করতে পেরে আমরা গর্বিত। আপনার আগমনে আমরা সত্যি আনন্দিত।

‘গড, নাহ! তিক্ততায় ফিসফিস করে উঠল ডেভিড।

প্লিজ?

না, আমি দুঃখিত। আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। বিদায় দেয়ার ভঙ্গিতে হাত মেলালো ডেভিড।

‘আপনাকে দেয়ার জন্য আমার কাছে দু’টো গুরুত্বপূর্ণ টেলেক্স মেসেজ আছে মি, মরগ্যান।’ এগিয়ে দিল ভ্যান গেন্ট। আমি আমস্টারডাম থেকে বিশেষ ভাবে এ দুটো নিয়ে এসেছি।

প্রথমটি এসেছে মিজির কাছ থেকে যে ডেভিডের কথা লুকিয়ে রাখার শপথ নিয়েছিল।

‘তোমার পাত্তা বলে দেয়ার জন্য দুঃখিত। সিংহের মতো সাহসী আর ঈগলের মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠো। লাভ, মিটজি।’

‘বিশ্বাসঘাতক ডাইনী!’ বলে উঠেই দ্বিতীয় খাম খুলে ফেলল ডেভিড।

‘তোমার দ্বিধার কারণ বোঝা গেছে, পদক্ষেপ ক্ষমা করা হলো। বিশ্বাস করি দায়িত্ব পালনে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। এখানে তোমার স্থান সর্বদা উন্মুক্ত। স্নেহের সাথে পল মরগ্যান।

‘ধূর্ত বৃদ্ধ শিয়াল!’ বলেই উভয় মেসেজ চালান করে দিল পকেটে ডেভিড।

‘কোন উত্তর? জানতে চাইলে ভ্যান গেন্ট।

 ‘ধন্যবাদ, না। এত কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।

‘কোন সমস্য নেই, মি. মরগ্যান। আমি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে? আপনার কিছু প্রয়োজন আছে কী?

‘কিছুই না। কিন্তু আবারো ধন্যবাদ।’ করমর্দন করতেই মাথা নিচু করল ভ্যান গেন্ট আর চলে গেল। ডেভিড এগিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে। হাসিমুখে তাকাল মেয়েটা।

‘শুভ সন্ধ্যা, স্যার।’

ডেস্কের উপর দিয়ে নিজের অ্যাভিস কার্ড ঠেলে দিল ডেভিড।

‘আমি একটু দৌড়ঝাঁপ করতে চাই।’

‘দেখা যাক আমি কী করতে পারি। আমাদের একটা মুস্তাং মাক ওয়ান আছে?’ ক্রিম আর গোলাপি নিখাদ ত্বকের অধিকারী মেয়েটার চুল পুরো সোনালি।

এতেই কাজ হবে। নিশ্চয়তা দিল ডেভিড। ফর্ম ফিলআপ করতে করতেই জানতে চাইল,’ আমস্টারডামে কি এটা আপনার প্রথমবার আসা স্যার?”

 ‘তারা। আমাকে বলেছে ইউরোপের মধ্যে এই নগরীই সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল। ঠিক?’

‘যদি আপনার জানা থাকে কোথায় যেতে হবে।’ বিড়বিড় করল মেয়েটা।

‘তুমি আমাকে দেখাতে পারো?’ ডেভিড প্রশ্ন করতেই মুখ তুলে নিরপেক্ষ অভিব্যক্তি বজায় রেখে কিছু একটা হিসাব করল মেয়েটা চোখের দৃষ্টি দিয়ে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলে আবারো শুরু করল তার কাজ।

 ‘এখানে সাইন করুন স্যার। আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা হবে। এরপরই গলা নামিয়ে বলে উঠল, এই ব্যাপারে কিছু জানার থাকলে এই নম্বরে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন কাজের শেষে। আমার নাম গিলডা।’

বাইরের খালের ওপারে কোন পথে হাঁটা যায় এমন এক জায়গায় আরো তিনটা মেয়ের সাথে থাকার জায়গা শেয়ার করে গিলডা। সরু সিঁড়ি বেয়ে একটাইমাত্র স্যামসোনাইট স্যুটকেস নিয়ে ডেভিডকে উঠে আসতে দেখেও কোন বিস্ময় ফুটলো না তাদের চোখে। কেউ কোনরূপ বাধাও দিল না। যাই হোক নগরীর প্রাণচঞ্চল্য বলতে একের পর এক ডিসকো আর কফি বারে নিয়ে গেল তাকে গিল; যেখানে নেশায় বুঁদ হয়ে বিপ্লবের বাণী আওড়ায় ঘরপোড়া মানুষেরা। দু’দিনের মাঝেই ডেভিড আবিষ্কার করে ফেলল যে এ সব মদের স্বাদ কতটা বিস্বাদ, কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। আর গিলডার ভেতরটাও ঠিক তার বাইরেরটার মতই স্নিগ্ধ আর দাগহীন। ডেভিড শুনেছিল যে এ শহরের পুলিশ বাহিনী নাকি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে করিঙ্কৰ্মা, মনে পড়ে অস্বস্তি হলো তার। প্রকৃতপক্ষে তাদের মাঝে নিজের মতোই দিশেহারা ভাব লক্ষ্য করল ডেভিড। মনে হলো তারই মতো কিছু একটার অন্বেষনে নেমেছে তারাও। এর সাথে আবার খালের উপর থেকে নিচু ভূমির স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া মনে হলো যেন শেষবিচারের দিনে মৃতদের আত্মা উঠে আসছে। এছাড়া তোমার জন্ম যদি হয় আফ্রিকার সূর্যের নিচে তাহলে উত্তরের শীতল জলবায়ু ধূসর লাগবে বৈকি।

বিদায় জানানোর সময় দৃশ্যত কোন অভিব্যক্তি ফুটলো না গিলডার মাঝে। মুস্তাং ক্যাবের হিটার চালু করে দক্ষিণে ছুটলো ডেভিড। নামুর-এর বাইরের দিকে রাস্তার পাশে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। এত ঠাণ্ডাতেও তার পা উনুক্তি আর বাদামী। খাটো ফেডেড নীল ডেনিমের নিচে আকর্ষণীয়ই দেখাচ্ছে তা। সোনালি মাথা নাড়িয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল মেয়েটা।

রাবার টায়ারের ঘর্ষণ তুলে ব্রেক করল ডেভিড। পিছিয়ে গেল মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে। দেহাবয়ব পুরোপুরি স্লাভিক সমতল ভূমি। চুল সাদা সোনালি, মোটা হয়ে পিছনে ছড়িয়ে আছে, ডেভিড অনুমান করল মেয়েটার বয়স হতে পারে উনিশ।

ইংরেজি বলতে পারো?’ জানালা দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ডেভিড। পাতলা ফ্যাব্রিকের শার্টের উপর দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে যৌবনের ছোঁয়া।

‘না’, জানাল মেয়েটা, কিন্তু আমি অ্যামেরিকান জানি–কাজ হবে এতে?

‘রাইট অন!’ প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে দিল ডেভিড। ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে স্লিপিং ব্যাগ ঠেলে দিল সীটের উপরে মেয়েটা। নাম জানাল ডেভিডকে।

‘আমি ফিলি।

‘ডেভিড।

“তুমি কি শোবিজে আছো?

‘গড, না–কেন মনে হলো এমনটা?

 ‘গাড়ি চেহারা-কাপড় চোপড়।

 ‘গাড়ি। ভাড়া নেয়া কাপড় চুরির মাল আর আমি মুখোশ পরে আছি।’

ফানি ম্যান।’ বলেই সিটের উপর গুটিসুটি মেরে একটা বিড়াল ছানার মতো ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটা।

আর্ডেনসের জঙ্গল যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখানে একটা গ্রামে থামলো ডেভিড। কিনে আনল লম্বা মুচমুচে রুটি, ধোয়ায় ঝলসানো বন্য শুকরের মাংস আর মম্যাত শ্যাফনের বোতল। গাড়ির কাছে ফিরে আসতে–দেখল জেগে উঠেছে ফিলি।

‘ক্ষুধা পেয়েছে? জানতে চাইল ডেভিড।

হ্যাঁ, আড়ামোড়া ভাঙ্গলো ফিলি।

জঙ্গলের মধ্যে কাঠের গুঁড়ির একটা পথ চলে গেছে দেখতে পেল ডেভিড। অনুসরণ করতেই সবুজ রঙ ক্যাথেড্রালে পৌঁছে গেল তারা। সোনালি সূর্যের আলো চুঁইয়ে পড়ছে গম্বুজ থেকে।

চত্বরে উঠে চারপাশে তাকিয়ে দেখল ফিলি। আগ্রহে আর উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল, “খুব ভালো হয়েছে, ডেভি, বেশ সুন্দর চারপাশ!

পেপার কাপে দু’জনের জন্যে শ্যাম্পেন ঢেলে নিল ডেভিড। পেন নাইফ দিয়ে মাংসের ফালি কেটে নিল। এই ফাঁকে পাউরুটি টুকরো করল ফিলি। পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়ির উপর পাশাপাশি বসে খেতে শুরু করল, দুজনে।

 চারপাশ এতো নির্জন আর শান্ত–খুনোখুনির কোন চিহ্নই নেই। ‘এখানেই জার্মানিরা তাদের শেষ চেষ্টা করেছিল–জানো তুমি এটা?

মুখ ভর্তি রুটি আর মাংস নিয়েও উত্তর দিল ফিলি। আমি দেখেছি মুভিটা। হেনরি ফোল্ডা, রবার্ট রায়ান–পুরোপুরি ভোলামকুচির মতো আচরণ হয়েছে এখানে।

‘সমস্ত কুৎসিত আর মৃত্যুর স্মৃতি সরিয়ে আমাদের উচিৎ এখানে সুন্দর কিছু করা। স্বপ্নাতুর দৃষ্টিতে বলে উঠল ডেভিড। রুটি গলাধকরণ করে এক চুমুক ওয়াইন খেয়ে উঠে দাঁড়াল ফিলি। ফিরে গেল মুস্তাং-এর কাছে। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে এসে কচি পাতার উপর পেতে নিল।

 ‘কিছু বিষয় নিয়ে শুধু কথা বলাই ভালো–অন্যগুলো কাজ করার জন্য। ডেভিডকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল ফিলি।

প্যারিসে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল যে এটা হয়তো দরকার, হয়তো পরস্পরের জন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। গোঁয়ার সেন্ট লাজারের কাছে সুন্দর পরিষ্কার একটা রুম খুঁজে পেল শাওয়ার সহ। কনকডে থেকে ইটোলি পর্যন্ত সারাদিন হেঁটে বেড়ালো পথ থেকে পথে। এরপর আইফেল টাওয়ার পার হয়ে ফিরে এলো নটরডেমে। রাতের খাবার খেল রাস্তার পাশের ক্যাফে বাউল মিকে কিন্তু খাবার অর্ধেক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ল দু’জনে। হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেল কথা, একই মুহূর্তে টের পেল দুজনেই, একে অপরের পুরোপুরি অজানা হলেও উত্তেজনা কম হলো না। একসাথে রাত কাটিয়ে কেজো প্রেম আর শূন্য ভালোবাসার পরে সকালে শাওয়ার সেরে বের হতেই ডেভিডকে জানিয়ে দিল ফিলি, তুমি ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছ। এটা কোন প্রশ্ন নয়, বক্তব্য, তাই কোন উত্তরও দরকার হলো না।

 ‘রুটিতে কোন সমস্যা হবে তোমার? জানতে চাইল ডেভিড। মাথা নাড়াল ফিলি। হাজার ফ্রাংকের দু’টো নোট বের করে পাশের টেবিলে রাখল ডেভিড।

‘নিচে বিল পরিশোধ করে দেব আমি।’ ব্যাগ তুলে নিল ডেভিড।

প্যারিসের আকর্ষণ শেষ হয়ে গেছে তার জন্য। তাই আবারো দক্ষিণের পথ ধরল সূর্যের উদ্দেশে। আকাশ ভরে আছে কালো মেঘে ফন্টেন’তে যাবার আগেই বৃষ্টি শুরু হলো। এত বৃষ্টি হলো যে ওর ধারণা ছিল হয়তো গ্রীষ্ম মণ্ডলেই এমন ধারা বৃষ্টি হয়। কংক্রিটের হাইওয়ে ভেসে গেল বন্যায় আর গাড়ির উইন্ডস্কিন এতটাই ঝাপসা হয়ে গেল যে ওয়াইপার পর্যন্ত ব্যর্থ হলো স্বচ্ছ দৃষ্টির ব্যবস্থা করতে।

একাকী ডেভিড আর কোন জনমনিষ্যি সাথে না থাকায় বিমর্ষ বোধ করল। অন্যান্য গাড়িগুলো বৃষ্টিতে গতি ধীর করলেও দ্রুতগতিতে চলতে লাগল ডেভিড। ভেজা রাস্তায় পিছলে যেতে লাগল চাকা। এবার ব্যর্থ হলো গতির ঝড়। বৃষ্টি পিছনে রেখে দক্ষিণে বিউনিতে এসে মনে হলো একাকিত্বের দল নেকড়ের মতো ছুটে আসছে তার পিছনে।

যাই হোক, প্রথম সূর্যরশ্মি মন ভালো করে দিল তার। পাথরের দেয়ালের অনেক উপরে সবুজ আঙুরের ক্ষেতের ক্লান্তিকর সীমানা ছাড়িয়ে চোখ পড়ল সাদা-সবুজের মতো নরম বাতাস এগিয়ে আসছে মেরুপ্রান্তর থেকে। আরো আধা মাইল সামনে যাবার পর রাস্তা থেকে চোখে পড়ল সাইনবোর্ড। ক্লাব অ্যারোনোটিক দে প্রভেঙ্গে। অনুসরণ করতেই দেখতে পেল আঙুর ক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট পরিষ্কার একটা এয়ারফিল্ড। একটা এয়ারক্রাফট মারচেত্তি অ্যারোবেটিক একটু সিক্সটি মুস্তাং থেকে লাফ দিয়ে বের হলো ডেভিড। এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন মাতালের সামনে রাখা হয়েছে দিনের প্রথম ঢোক হুইস্কি।

ক্লাব অফিসে বসে থাকা ফরাসী লোকটাকে দেখে মনে হল অসফল সৎকারক। লগ বুক আর এক তোড়া লাইসেন্স দেখানোর পরেও কিছুতেই ডেভিডকে মারচেত্তি ভাড়া দিতে রাজি হলো না লোকটা। অন্যান্যগুলো থেকে ভাড়া দেয়া গেলেও মারচেত্তি কিছুতেই ভাড়া দেবে না। দলিলপত্রের উপর ৫০০ ফ্রাংকের নোট রাখল ডেভিড। মুহূর্তে এটা হাওয়া হয়ে গেল ফরাসীটার পকেটে। তারপরেও কিছুতেই শুধু মারচেত্তি একাকী দেবে না। উপরন্তু ডেভিডকে জোর দিল তার সাথে প্রশিক্ষকের আসনে বসতে।

সীমানার বেড়া টপকাবার আগে ধীরে ফোর পয়েন্ট রোল ঘুরালো ডেভিড। এটা হলো আদেশ লঙ্ঘন করার মতো। ফুরফুরে মেজাজের কাজটা করল সে। স্যাক্রেব্লিউ!’ বলে চিৎকার করে উঠল ফরাসি লোকটা; সিটে বসে জমে গেল যেন। কিন্তু বুদ্ধি খাঁটিয়ে কন্ট্রোলে হাত দিল না। কাজ শেষ করে তৎক্ষণাৎ উল্টো দিকে ঘুরে গেল মারচেত্তির পাখা। আঙুরের মাথা থেকে খুব বেশি হলে পঞ্চাশ ফুট উপরে। শব্দ করে শ্বাস ফেলল ফরাসি লোকটা, বুঝতে পারল দক্ষ লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। এক ঘন্টা পড়ে মাটিতে নেমে এলে হাসল ডেভিডের দিকে তাকিয়ে।

 ‘অসাধারণ!’ ডেভিডের প্রশংসা করে তার সাথে লাঞ্চ শেয়ার করল। রসুনের চাটনি, রুটি আর এক বোতল লাল ওয়াইন। মাদ্রিদ পর্যন্ত ডেভিডের সঙ্গী হলো আবারো উড়তে পারার আনন্দ আর রসুনের সুস্বাদু গন্ধ।

মাদ্রিদে এসে হঠাৎ করেই ঘটতে লাগল সব। মনে হলো যেন বহুকাল আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে সবকিছু। মনে হলো অর্ধেক ইউরোপ ঘুরে আসার অর্থ মাদ্রিদে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা অপেক্ষা করছে তার জন্য।

শহরে পৌঁছালো সন্ধ্যাবেলা। গত রাতে তাড়াহুড়া করেছে, কেননা এই সিজনে ষাড়ের দৌড়ের জন্য সময় মতো আসতে পারে যেন। এর উপরে হেমিংওয়ে, কনরাডসহ অন্যান্য রোমান্টিক সাহিত্যও পড়া আছে তার। বিস্মিত হয়ে ভাবে, জীবনের এই ক্ষেত্রেই কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য! বই পড়তে দারুণ লাগে-সৌন্দর্য, উত্তেজনা, সাহস আর সত্যের চরম ক্ষণ। ডেভিড চায় এই বিশাল প্লাজা ডে টরোসে বসে এটা দেখতে মূল্যায়ন করতে আর তারপরেও ইচ্ছে হলে পরে এই সিজনের পামপ্লোনা উৎসবে যাবে।

 গ্রান ভিয়া’তে উঠল ডেভিড। পরের দিনের জন্যে টিকিট জোগাড় করে দিল পোর্টার। এত দীর্ঘ পথ ড্রাইভ করে আসায় ক্লান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে চলে গেল। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে বেশ তাজা মনে হলো নিজেকে। রিংয়ের বাইরে এসে পার্কিং লটে এরই মাঝে ভিড় করে থাকা ট্যুরিস্ট বাসের মাঝে পার্ক করল মুস্তাংকে। এই সিজনে ভিড় জমে উঠেছে বেশ আগেভাগেই।

 রিং বাইরেটা দেখে চমক লাগল। দেখে মনে হলো মূর্তি পূজারী বা বর্বর কোন ধর্মের মন্দির, কিন্তু ভেতরটা সম্পর্কে জানে সে। ফিল আর ছবিতে অনেক দেখেছে। বালির রিং মসৃণ আর পরিষ্কার, মেঘে ঢাকা আকাশে উড়ছে পতাকা, গান বেজে চলেছে অর্কেস্ট্রায়, মানুষের মাঝে চিৎকার, উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

এই ভিড়ের মতো এত উত্তেজনা এর আগে কোন পুরস্কার বিতরণী বা আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলাতেও দেখেনি ডেভিড। সবাই মিলে চিৎকার করছে, সারির উপর সারি আগ্রহী সাদা সব চেহারা সুরের তালে যেন মাতাল হয়ে উঠেছে।

একদল তরুণ অস্ট্রোলিয়দের মাঝে বসেছে ডেভিড; যারা বিভিন্ন স্যুভেনির পোশাক পরে আছে আর মেয়েগুলো। পাখির ঝাঁকের মতই কিচিরমিচির করছে। তাদের একজন ডেভিডের উপর নজর দিল। সামনের দিকে ঝুঁকে তার কাঁধে টোকা দিয়ে নিজেদের মাঝে ছাগলের চামড়ার থলেতে রাখা ওয়াইন ভাগাভাগি সময়ে ডেভিডের দিকে এগিয়ে দিল একবার। একটা বিড়ালের মতই সুন্দরী মেয়েটা। চোখ দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল শুধুমাত্র ওয়াইন নয় অন্য আরো অনেক কিছুর আমন্ত্রণ জানালো ডেভিডকে। কিন্তু কোন নিমন্ত্রণই গ্রহণ করল না ডেভিড। উঠে গিয়ে এক ক্যান বিয়ার নিয়ে আসলো সে। প্যারিসের মেয়েটার সাথে কাটানো অভিজ্ঞতা এখনো বেশ চনমনে করে তুলল তাকে। সিটে ফিরে আসতেই অসি মেয়েটা তাকিয়ে রইল তার বিয়ারের ক্যানের দিকে। উজ্জ্বলভাবে হাসল ডেভিড।

দেরীতে আসা মানুষগুলো ভিড়ের মাঝে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে আর উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গস্পর্শী। দু’জন উঠে এলো ডেভিড যেখানে বসে সেখানকার কাছাকাছি। কমবয়সী একজোড়া বালক-বালিকা বয়স বোধ হয় বিশের গোড়ায়। কিন্তু যেটা ডেভিডের নজর কাড়লো তা হলো এই জোড়ার চারপাশে শুদ্ধ সম্পর্ক আর ভালোবাসার একটা আবেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হলো কোন স্বর্গীয় আভা তাদের পৃথক করে রেখেছে।

ডেভিড যেখানে বসে আছে তার পাশ দিয়ে হাত ধরাধরি করে উঠে গেল দু’জনে। পেছনে এক সারি উপরে গিয়ে বসল। উচ্চতা ভালো মেয়েটার লম্বা পা দু’খানায় খাটো কালো বুট। গাঢ় রঙের প্যান্টের উপরে আপেল সুবজ রঙা স্লয়েড জ্যাকেট, দামী না হলেও রুচির ছাপ আছে যথেষ্ট। সূর্যের আলোয় কয়লার মতো চকচক করছে চুল। কাঁধ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে নরম ঝরনার মতো। চেহারা বেশ বড়সড় আর রোদে পোড়া বাদামী। মুখটা বড় হওয়ায় বেশি সুন্দরী না হলেও চোখ দুটো বেশ প্রশস্ত। গাঢ় বাদামী, বন্য মধুর রঙ তাতে, মনে হলো সোনা মিশিয়ে তৈরি করেছেন সৃষ্টিকর্তা। মেয়েটার মতই ছেলেটাও লম্বা। সোজা-সাপ্টা দেহাবয়ব, গাঢ় দেহতৃক আর শক্তিশালী। বাদামী পেশীবহুল হাত দিয়ে মেয়েটাকে তার আসন দেখিয়ে দিল। হঠাৎ করেই ছেলেটার উপর কেমন রাগ আর হিংসা হলো ডেভিডের।

 ‘সন অব আ গান মনে মনে ভাবল ডেভিড। মাথা ঝুঁকিয়ে গোপন কথা বলতে লাগল তরুণ জোড়া। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। তার নিজের একাকিত্ব যেন বেড়ে গেল তাদের নৈকট্য দেখে।

ষাঁড়-চালকদের প্যারেড শুরু হলো। তাদের গায়ের স্যুটের সিকুইন আর অ্যামব্রয়ডারিতে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করে উঠল, মনে হলো কোন বিশাল চকচেক সরীসৃপ এগিয়ে চলেছে। অর্কেস্ট্রী বেজে উঠতেই ষাড়দের খাঁচা খুলে দেয়া হলো।

একটু সুযোগ পেতেই তরুণ জোড়ার দিকে তাকাল ডেভিড। অবাক হয়ে দেখল যে ছেলে-মেয়ে দুটো তাকেই দেখছিল। মেয়েটা ঠোঁট প্রায় ছেলেটার কানের কাছে এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল কিছু একটা। ডেভিডের মনে হলো তার পাকস্থলীর নিচে কিছু একটা গুড়গুড় করে উঠল সোনালি চোখ জোড়া দেখে। এক মুহূর্তের জন্য মেয়েটা আর ডেভিড তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। তারপরই অপরাধীর চোখ সরিয়ে নিল মেয়েটা। কিন্তু ছেলেটার সঙ্গী তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে, সহজভাবেই হাসল। এবার চোখ সরিয়ে নেবার পালা ডেভিডের।

তাদের নিচে রিংয়ে সবেগে বেরিয়ে এলো যড়। মাথা উঁচু করে ঘুরতে লাগল বালির উপর।

কালো চকচকে, সুন্দর ঘাড়টার ঘাড় আর কাঁধে পেশী নাচাতে লাগলে এক পাশ থেকে আরেক পাশে মাথা ঘোরানোর সময়। ষাঁড়ের গতি আর লাফালাফি দেখে ভিড়ের দর্শকেরা যেন পাগল হয়ে উঠল। পুরো রিং জুড়ে ঘুরে ঘুরে নিজের কসরত দেখাতে লাগল ষাড়টা। মাথায় শিংয়ের চমৎকার প্রদর্শনীর পর নিয়ে আসা হলো ঘোড়া।

ট্রাম্পেট বেজে উঠল ঘোড়ার আগমনে, এসব কিছুই হাস্যকর মনে হলে হতভাগ্য টাই ঘোড়াটার জন্য সাহসী অভ্যর্থনা, এক চোখ দিয়ে পিচুটি পড়ায় অবোধ জন্তুটা দেখতেই পারল না সামনে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।

ক্লাউনের মতো দেখাতে লাগল ঘোড়াটাকে। পিঠে মস্ত বড় সশস্ত্র মানুষ নিয়ে বাইরে এলো ঘোড়াটা, পড়ল ষাঁড়ের সামনে আর এখানেই শেষ হয়ে গেল সমস্ত সৌন্দর্য।

মাথা নিচু করে সামনে ছুটে গেল ষাড়টা। কালো বিশাল পিঠের উপর কুজোতে চাবুকের বাড়ি দিয়ে শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে ষ্টিলের বাড়ি মারা হলো ষাড়ের পায়ে। সাথে সাথে বের হয়ে এলো রক্তের ধারা। কালো, কুড অয়েলের মতো ঝরে পড়ল বালির উপর।

লোহার বাড়ি খেয়ে রাগে উন্মত্ত ষাড় ঘোড়ার উপর রাখা আসনে গুতো মারল। মনে হলো থিয়েটারের পর্দা সরে গেল। এমন ভাবে ঘোড়ার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ষাড়। ভয়ঙ্কর শিংয়ের তো খেয়ে আর্তনাদ করে উঠল ঘোড়া। বেচারা পশুটার পেট চিরে বেগুনি আর গোলাপি নাড়িভূড়ি বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বালির উপর।

ঘটনার বিমর্ষতায় মুখ শুকিয়ে গেল ডেভিডের। চারপাশের ভিড় রক্ত হিম করা চিৎকার করে উঠল। গায়ের যন্ত্রপাতি আর নিজের অন্ত্রের উপর পড়ে গেল ঘোড়া।

 ষাঁড়টাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। পড়ে যাওয়া ঘোড়াটার লেজ ধরে টেনে জোর করে শেষবারের মতো উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করা হলো। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো হতভাগ্য জটা। শরীরে আঘাত করে আবারো চলতে বাধ্য করা হলো। নিজের নাড়িভূড়ি থেকে টলতে টলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘোড়া।

এরপর ষাঁড়ের দিকে এগিয়ে গেল লোকেরা। ধীরে ধীরে জমকালো পশুটা হয়ে গেল ঘর্মাক্ত, রক্ত বের হওয়া মাংসপিণ্ড মুমূর্ষ ফুসফুস থেকে বের হতে লাগল ক্রিম রঙা ফেনা।

 ডেভিড চাইল চিৎকার করে তাদেরকে থামাতে। কিন্তু নিজেকে মনে হলো তার অসুস্থ। এ ধরনের প্রথায় নিজের উপস্থিতি নিয়ে জমে গেল যেন। বাকি সময় বসে রইল নীরবে। রিংয়ের মাঝখানে উঠে দাঁড়াল আঁড়টা। চারপাশে বালিতে মনে হলো জমি চাষ করা হয়েছে। নিজেকে নিয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করতে লাগল ষড়। উঠে দাঁড়াল মাথা নিচু করে, প্রায় বালির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে এমতাবস্থায় নাক আর ভোলা মুখ দিয়ে বের হতে লাগল ফেনা। ভিড়ের চিৎকার ছাপিয়েও ষাঁড়টার নিঃশ্বাসের যন্ত্রণার শব্দ কানে এলো ডেভিডের। পা হড়কাতে লাগল আঁড়টার। পিছনের পায়ের মাঝে থেকে বের হয়ে এলো হলুদ মল। এর থেকে বেশি আর কোন নির্যাতন হতে পারে না। উঁচু স্বরে ফিসফিস শুরু করে দিল ডেভিড।

না! না! থামাও! প্লিজ এটা থামাও!’

চকচকে স্যুট আর ব্যালে জুতা পরিহিত একটা লোক এগিয়ে এলো সমাপ্তি টানতে। ষাঁড়ের মেরুদণ্ডে আঘাত করল তরবারি দিয়ে। সূর্যের আলোয় দেখা গেল চিরে দু’ভাগ হয়ে গেছে হাঁড়। একপাশে হেলে গেল ষড়। আবারো উঠে দাঁড়ানোর আগে উগড়ে দিল মোটা রক্তের ধারা।

 বালির উপর থেকে আবারো তরবারি তুলে নিল লোকগুলো তুলে দিল একজনের হাতে। মৃত্যুপথযাত্রী জন্তুটার দিকে তাকিয়ে আবারো আঘাত করল হাঁড়ের উপর। অবশেষে গলার স্বরে দৃঢ়তা খুঁজে পেল ডেভিড। চিৎকার করে উঠল:

‘থামাও! অসভ্য বর্বর কোথাকার।’

মাঝখানে দাঁড়িয়ে বারোবার তরবারি হাতে চেষ্টা করল লোকটা। প্রতিবার হাত থেকে ছুটে গেল সেটা। আর শেষ বার পড়ে গেল ষড়। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ল রক্ত হারানোয় নির্যাতনে ভেঙ্গে পড়ে অবশেষে রণেভঙ্গ দিল। আবারো উঠে দাঁড়ানো দুর্বল চেষ্টা সত্ত্বেও শক্তি না থাকায় মেরে ফেলা হলো ষাড়টাকে। ঘাড়ের পেছনে ছুরি দিয়ে আঘাত করে বালির উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো–বালির উপর পড়ে রইল বাদামি রক্তের লম্বা ধারা।

এ ধরনের দানবীয় নিষ্ঠুরতায় বোবা হয়ে গেল ডেভিড। আস্তে করে পিছু ফিরে তাকাল মেয়েটার অবস্থা দেখতে। মেয়েটার সঙ্গী খুঁকে ফিসফিস করে কথা বলে চেষ্টা করছে ওকে শান্ত করতে।

আস্তে করে মাথা নাড়াল মেয়েটা, যেন বুঝতে পারছে না যে কী হচ্ছে চারপাশে আর মধু রঙা চোখ ভেসে যাচ্ছে পানিতে। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে, দুঃখের ভারে কাঁপছে আর গাল বেয়ে পড়ছে চকচকে চোখে জল।

 মেয়েটার সঙ্গী তাকে সাবধানে ধরে দাঁড় করিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসল। এমনভাবে চলে যেতে লাগল যেন সদ্য বিধবা তার স্বাধীর কবর ছেড়ে যাচ্ছে।

চারপাশে ভিড়ের মানুষ রক্ত আর ব্যথা দেখে হাসছে, চিৎকার করে আনন্দ করছে আর এতসব কিছুর মাঝে নিজেকে ডেভিডের মনে হলো সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। মন চলে গেছে কান্নারত মেয়েটার কাছে, এত মানুষের মাঝে একমাত্র মেয়েটাকেই মনে হলো সত্যিকারের মানুষ। যথেষ্ট দেখা হয়েছে, বুঝতে পারল, পামপ্লোনায় যেতে পারবে না আর। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার পিছু পিছু রিং থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। চাইল মেয়েটার সাথে কথা বলতে, বলতে চাইল সেও ব্যথিত। কিন্তু পার্কিংয়ে পৌঁছে দেখল তারা দুজনে ইতিমধ্যে একটা পুরোনো সিটরোন সিভি.১০০-তে চড়ে বসেছে। দৌড় দিল ডেভিড কিন্তু চলে গেল গাড়িটা। নীল ধোয়া ছেড়ে মিশে গেল উত্তরের পথে।

 গাড়িটার চলে যাওয়া দেখে মনে হলো তার অনেক বড় কোন ক্ষতি হয়ে গেল। হারিয়ে গেল গত কয়েকদিনের সুখস্মৃতি। কিন্তু দুদিন পরে আবারে দেখা হলো পুরোনা সিটরোনটার সাথে, যখন যে পামপ্লোনা উৎসবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে দক্ষিণে চলেছিল। আগের থেকে বৃদ্ধ মনে হলো সিটরোনটাকে। মোটা ধুলার আস্তরণে ঢেকে আছে গাড়িটা আর মাঝের টায়ারের উপর দেখা গেল ক্যানভাস। একপাশ এমন ভাবে হেলে আছে গাড়িটা যেন পাড় মাতাল।

 বার্সেলোনা যাবার পথে জারাগোজার বাইরের দিকে একটা ফিলিং স্টেশনে পার্ক করা গাড়িটা নজরে এলো ডেভিডের। রাস্তা থেকে নেমে নিজের গাড়ি গ্যাসোলিন পাম্পের পিছনে পার্ক করল ডেভিড। তেল মাখা ওভারওল পরনে একটা অ্যাটেনড্যান্ট সিটরোনের ট্যাংক ভরছে, তত্ত্বাবধান করছে রিংয়ে দেখা সেই পেশীবহুল তরুণ ছেলেটা। তাড়াতাড়ি মেয়েটোর খোঁজে চোখ বুলালো ডেভিড। কিন্তু গাড়িতে ছিল না মেয়েটা। এরপরই তাকে দেখতে পেল ডেভিড।

রাস্তার ওপাশে একটা ক্যান্টিনে বসে আছে মেয়েটা। কাউন্টারের পেছনে থাকা বৃদ্ধ মহিলার পেছনে। যদিও ডেভিডের দিকে পিছু ফিরে বসে আছে, কিন্তু মাথা ভর্তি কালো চুলের রাশি দেখে চিনতে পারল ডেভিড। রাস্তা পার হয়ে তাড়াতাড়ি দোকানে মেয়েটার পিছনে গেল সে। নিশ্চিত ভাবে নিজেও জানে না সে সে কী করছে।

 খাটো, ফুলের নকশা করা একটা ড্রেস পরে আছে মেয়েটা, কাঁধ আর পিঠ পুরো উন্মুক্ত। পায়ে খোলা স্যান্ডেল। কিন্তু বাতাসে তুষারকনা থাকায় কাঁধে শাল। কাছ থেকে দেখা গেল ত্বকে প্লাস্টিকের মসৃণতা। মনে হলো যেন হালকাভাবে তেল লাগিয়ে পালিশ করা হয়েছে। পিছনে উন্মুক্ত ঘাড়ে কোমল, সুন্দর চুল। মনে হল ডাটির উপর ফুল।

ডেভিড কাছে এগিয়ে গেল। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে শুকনো ফিগ কেনা শেষ করে খুচরো পয়সা নিচ্ছে মেয়েটা। বুক ভরে গন্ধ নিল ডেভিড। মনে হল মেয়েটার চুল থেকে ভেসে এলো গ্রীষ্মের গন্ধ। ইচ্ছে হলো মুখ ডুবিয়ে স্বাদ নিতে। বহু কষ্টে নিজেকে নিবারণ করল ডেভিড।

 হাসিমুখে পেছনে ফিরতেই দাঁড়িয়ে থাকা ডেভিডকে দেখতে পেল মেয়েটা। চিনতে পারল সাথে সাথে, কেননা ডেভিডের চেহারা এমন যে চট করে ভুলে যাবে না কোন মেয়ে। অবাক হয়ে গেল মেয়েটা। হাসি মুছে ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। অভিব্যক্তিতে কিছু বোঝ না গেলেও ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে রয়েছে আর চোখ জোড়া নরম উজ্জ্বল সোনালি এই অদ্ভুত নীরবতার সাথে ভবিষ্যৎ আরো বহুবার দেখা হবে ডেভিডের।

‘মাদ্রিদে দেখেছি তোমাকে। জানাল ডেভিড। ষাড়ের লড়াইয়ে।

হ্যাঁ, মাথা নাড়াল মেয়েটা। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস বা বিরক্তি কিছুই নেই।

‘তুমি কাঁদছিলে।’

‘তুমিও’, নিচুস্বরে পরিষ্কার করে কথা বলছে মেয়েটা, উচ্চারণে কোন খামতি নেই। বিদেশী নয়।

‘না’, অগ্রাহ্য করল ডেভিড।

‘তুমি কাঁদছিলে। নরম স্বরে জোর দিয়ে বলল মেয়েটা, ভেতরে ভেতরে কাঁদছিলে। এবার সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়াল ডেভিড। হঠাৎ করেই ফিগের ব্যাগ এগিয়ে দিল মেয়েটা।

‘নাও একটা। হেসে ফেলল মেয়েটা। উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। একটা নিয়ে মিষ্টি ফলে কামড় বসালো ডেভিড। মেয়েটা এগিয়ে গেল দরজার কাছে। মনে হলো একটা আমন্ত্রণ ভেসে এলো বাতাসে। পিছ নিল ডেভিড। একসাথে হেঁটে দরজার বাইরে গিয়ে রাস্তার ওধারে সিটরোনের দিকে তাকাল দু’জনে। অ্যাটেনড্যান্ট ট্যাংক ভরে দিয়েছে। মেয়েটার সঙ্গী অদ্ভুত পুরোন গাড়িটার বনেটের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে। সিগারেট ধরাতে গিয়ে চোখ তুলেই দেখল তাদেরকে। সাথে সাথে বোঝা গেল চিনতে পেরেছে ডেভিডকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফেলে দিল জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি।

নরম হুস একটা আওয়াজ হয়েই বাতাসে ভাসলো ধোঁয়া। কংক্রিটের উপর পড়ে থাকা গ্যাসোলিনের উপর পড়েছে ম্যাচের কাঠি। মুহূর্তের মধ্যেই দাউদাউ আগুন। চোখের পলকে সিটরোনকে প্রায় ঢেকে ফেলল আগুন। ক্ষুধার্তের মতো এগিয়ে আসছে। মেয়েটাকে ছেড়ে রাস্তার উপর দিয়ে দৌড় দিল ডেভিড।

 ‘পাম্প থেকে সরে যাও গর্দভ কোথাকার।’ চিৎকার করে উঠল সে। ড্রাইভার যেন জমে আছে।

নভেম্বর হাসিখুশি পাঁচ তারিখে ঘটল এই ঘটনা–হ্যান্ডব্রেক বন্ধ করে গিয়ারবক্স নিউট্রালে নিয়ে আসল ডেভিড। এরপর ড্রাইভার আর ও দু’জনে মিলে জ্বলন্ত গাড়িটাকে ঠেলে ফিলিং স্টেশনের বাইরের পার্কিংয়ে নিয়ে এলো। মনে হলো মাটি ফুড়ে উদয় হলো মানুষ, ভিড় জমে গেল চারপাশে। চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে, উপদেশ দিচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে।

ভেতরের সিট থেকে ব্যাগেজও উদ্ধার করা গেল শিখা গ্রাস করার আগেই তখনি পেট্রল অ্যাটেনড্যান্ট পৌঁছালো বিশাল বেগুনি রঙা আগুন নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে। ভিড়ের জনতা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ফেনার মেঘ ঢেকে ফেলল ছোট গাড়িটাকে, সাথে সাথে উত্তেজনা ও হারিয়ে গেল। মানুষজন চলে গেল যে যার পথে; তারপরেও হাসছে, কথা বলছে, নাস্তানাবুদ ফায়ার ফাইটারকে প্রশংসা করছে। অন্যদিকে নিজেদের পোড়া কালো সিটরোনের নিকে হতাশা দিয়ে তাকিয়ে রইছে তিনজন।

‘আমার মনে হয় ব্যাপারটা ভালোই হলো-বেচারা অনেক ক্লান্ত হয়ে। পড়েছিল। অবশেষে বলল মেয়েটা। যেন পা ভাঙা ঘোড়া নিয়ে শ্যাটং।

ইনস্যুরেন্স করা আছে? জানতে চাইল ডেভিড। হাসল মেয়েটার সঙ্গী।

মজা করছো–কে করবে এটার ইনস্যুরেন্স? আমি মাত্র একটা একশ ইউ এস ডলারের নোট দিয়েছি ওর জন্য।’

আগুনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া জিনিসপত্রের ছোট্ট একটা স্তূপ জড়ো করল তিনজনে মিলে। মেয়েটা দ্রুত সঙ্গীর সাথে কোন এক বিদেশী ভাষায় কী যেন আলোচনা করে নিল। বুঝতে না পারলেও মর্মার্থ ঠিকই ধরতে পারল ডেভিড। তাই মেয়েটা যখন তার দিকে তাকাল একটুও অবাক হলো না সে।

‘আজ সন্ধ্যায় বার্সেলোনায় একজনের সাথে দেখা করতে হবে আমাদেরকে। জরুরি প্রয়োজন।’

‘চলো তাহলে। জানাল ডেভিড।

মুস্তাংয়ে এনে ভোলা হলো সব লাগেজ। মেয়েটার সঙ্গী লম্বা পা দু’খানা ভাঁজ করে বসল গিয়ে পেছনের সিটে। নাম যোসেফ–কিন্তু মেয়েটা ডেভিডকে জানাল ছেলেটাকে জো নামে ডাকতে। মেয়েটার নাম ডেবরা আর পদবী নিয়ে কেউই মাথা ঘামালো না। ডেভিডের পাশের আসনেই বসল ডেবরা। দুই হাঁটু পরস্পরের সাথে এঁটে কোলের উপর রেখেছে হাত। একবার নজর বুলিয়েই দেখে নিল মুস্তাং আর এর সব সম্পত্তি। ডেভিড দেখতে পেল ডেবরা দেখে নিল দামী লাগেজ, নাইকন ক্যামেরা, জিস বাইনোকুলার রাখা গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে আর সিটের উপরে অনাদরে ফেলে রাখা দামী জ্যাকেট। এরপর আড়চোখে তাকাল ডেভিডের দিকে, মনে হলো প্রথমবারে মতো খেয়াল করল সিল্কের শার্ট আর কব্জিতে লাগান চিকন স্বর্ণের গয়না।

‘দরিদ্ররাই আর্শিবাদপ্রাপ্ত। বিড়বিড় করল ডেবরা, তারপরেও ধনী হওয়াটা এখনো আনন্দময়।

ব্যাপারটা উপভোগ করল ডেভিড। চাইল ডেবরা মুগ্ধ হোক, চাইল ডেভিড আর পিছনের সিটে বসা বড়সড় পেশীবহুল তরুণের মাঝে তুলনা করুক।

‘চলো তাহলে যাই বার্সেলোনা। হাসল ডেভিড।

নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে এলো। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে জোর দিকে তাকাল ডেবরা।

“ঠিক আছে তুমি? আগের বারের মতেই অচেনা ভাষায় জিজ্ঞেস করল ডেবরা জোকে।

‘যদি তা না হয়—ও পেছনে পেছনে দৌড়াতে পারে। একই ভাষায় উত্তর দিল ডেভিড। বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল ডেবরা। এরপরই খুশি হয়ে উঠল চেহারা।

‘এই! তুমি হিব্রু বলতে পারো!

‘বেশি একটা না।’ স্বীকার করল ডেভিড। বেশির ভাগটাই ভুলে গেছি। মনে পড়ে গেল দশ বছর বয়সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুদ্ধ করতে অদ্ভুত আর রহস্যময় একটা ভাষা নিয়ে। যেটা লিখতে হতো পিছনে থেকে সামনে, এমন একটা বর্ণমালা দেখতে মনে হয়–ব্যাঙাচি আর বেশির ভাগ উচ্চারণ গলার পেছন থেকে করতে হয়, অনেকটা গার্গল করার মতো।

‘তুমি ইহুদি? জানতে চাইল ডেবরা। সিট ঘুরিয়ে ডেভিডের মুখোমুখি হলো। হাসছে না, প্রশ্নের উত্তরটা যে ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বোঝা গেল তা।

মাথা নাড়ল ডেভিড।

না।’ হেসে ফেলল। আমি অর্ধ বিশ্বাসী, বিনা পালনকারী–একেশ্বরবাদী, বড় হয়ে উঠেছি প্রোটেস্ট্যন্ট খ্রিস্টান ঐতিহ্যনুযায়ী।

তাহলে হিব্রু কেন শিখলে?

‘আমার মা চাইতো, তাই। ব্যাখা করল ডেভিড। অনুভব করল পুরোন অপরাধবোধ।

 ‘আমি একদম ছোট ছিলাম যখন আমার মাকে খুন করা হয়। তারপর থেকে আর শেখা হয়নি। মা চলে যাবার পর ব্যাপারটা আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।’

‘তোমার মা জোর দিল ডেবরা, এগিয়ে এলো ডেভিডের দিকে, উনি কী ইহুদি ছিলেন?

 ‘হত্যা’, একমত হলো ডেভিড, কিন্তু বাবা ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট। নরক ভেঙ্গে পড়েছিল যখন তারা বিয়ে করেছিল। সবাই এর বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু আমার বাবা-মা পিছপা হয়নি।’

ডেবরা জো র দিকে তাকাল।

‘শুনেছে–ও আমাদের মতো একজন।

“ওহ বাদ দাও! হাসতে হাসতে বাধা দিল ডেভিড।

মাজালটোভ,’ বলে উঠল জো, মাঝে মাঝে জেরুজালেমে এসে আমাদের সাথে দেখা করো।

‘তোমারা ইস্রায়েলী? আগ্রহ জন্মালে ডেভিডের মাঝে।

 ‘আমরা দুজনেই।’ গর্ব আর সন্তুষ্টি ফুঠে উঠল ডেবরার স্বরে।

‘আমরা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি।

“নিশ্চয় মজাদার দেশ হবে এটা।’ দ্বিধা ফুটলো ডেভিডের কণ্ঠে।

‘জো যেমনটা বলেছে, সময় বের করে আসো না একবার। পরামর্শ দিল ডেবরা। ফিরে আসার অধিকার আছে, তোমার। এর পরই আবার বিষয়টা পরিবর্তন করে ফেলল। এই মেশিনটা কী এতটুকু গতিতেই দ্রুত ছুটতে পারে? সাতটার মাঝে বার্সেনোলায় পৌঁছাতে হবে আমাদেরকে।

সবার মাঝে খানিকটা সহজ ভাব এলো, মনে হলো কোন কোন অদৃশ্য বাধা ভেঙ্গে পড়েছে, মেয়েটা যেন কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শহরের বাইরে চলে এসেছে তারা। সামনের খোলা রাস্তা চলে গেছে এব্রো উপত্যকা হয়ে সমুদ্রের দিকে।

দয়া করে সিগারেট নেভাও আর সিট বেল্ট বেঁধে নাও।’ সাবধান বাণী দিয়ে গতির ঝড় তুলল ডেভিড।

চুপচাপ হাত কোলে নিয়ে ডেভিডের পাশে বসে রইল ডেবরা। তাকিয়ে রইল সামনে বাকের দিকে। মুস্তাংয়ের শরীরের নিচে এগিয়ে চলেছে সোজা মসৃণ রাস্তা। মুখে অল্প একটু আনন্দের হাসি, চোখে সোনালি আলোর নাচানাচি আর বুঝে গেল ডেভিড–যে তারই মতো গতিপাগল হলো এই মেয়েটা।

 চারপাশের সবকিছু বিস্মৃত হয়ে গেল ডেভিড। মনে রইল কেবল পাশে বসা মেয়েটার কথা। একই সাথে ঠিকঠাক এগিয়ে নিয়ে চলল গর্জনরত মেশিন।

 শুকনো ধূলিধূসরিত উপত্যকায় একের পর বাঁক আসছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে মুস্তাং নিয়ে এগিয়ে চলেছে ডেভিড। হুইল থেকে গিয়ার লেভেল নাচানাচি করছে, হাত-পায়ের আঙুল আর গোড়ালি দ্রুত প্যালের উপর জায়গা বদল করছে পুরো ব্যাপারটার উত্তেজনায় উঁচু স্বরে হেসে উঠল ডেবরা।

গ্রামের ক্যান্টিন থেকে চিজ, রুটি আর হোয়াইট ওয়াইন কিনে এনে পাথরের ব্রিজের উপর বসে লাঞ্চ শেষ করল তিনজনে। নিচে বয়ে চলল নদী। পর্বত থেকে নেমে এসেছে দুধসাদা তুষারকণা।

পাশাপাশি বসে থাকায় ডেভিডের উরুতে ডেবরার ছোঁয়া লাগল। উষ্ণ বোধ হলো ডেভিডের। ঠাণ্ডা বাতাস সত্ত্বেও মনে হলো ডেবরার গাল দুটো একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

কিন্তু ডেভিড অবাক হলো জোর আচরণে। মনে হলো ডেভিডের কাজকর্ম নিয়ে বা ডেবরার মিশতে চাওয়ার চেষ্টার দিকে ওর কোন নজর নেই। বরঞ্চ বাচ্চাদের মতো আনন্দ করছে নিজের পানিতে ছুটে চলা ট্রাউটের উপর পাথর ফেলে। হঠাৎ করেই ডেভিডের মনে হলো যে জো খানিকটা বাধা দিলে ভালো হতো, ডেভিড উপভোগ করতে নিজের বিজয়-এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছে সে।

 আরো এক টুকরো সাদা চিজের উদ্দেশে ডেবরার দিকে ঝুঁকে এলো ডেভিড। জো মনে হলো খেয়ালই করল না।

 কাম অন, যুদ্ধ করো, এমনি এমনি বসে থেকো না। মনে মনে বলল ডেভিড।

নিজেকে পরীক্ষা করতে চাইল সে। ছেলেটা বেশ বড়সড় আর শক্তিশালী। আর হাবভাব দেখে ডেভিড বুঝতে পারল যে জো নিজের প্রতি আস্থাশীল আর তার সাথে সমতুল্য মুখমণ্ডল মাংসল আর এতত একটা খারাপ নয়। ডেভিড জানে যে কোন কোন নারী এই রকম পছন্দ করে আর জোর অলস আর ধীর হাসি দেখে ভোলার কিছু নেই—চোখ দুটো দ্রুত আর তীক্ষ্ম।

 ‘তুমি ড্রাইভ করতে চাও, জো? হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে বসল ডেভিড। হালকা হাসিটা তেলের মতো ছড়িয়ে চকচক করে উঠল জোর চেহারা। কিন্তু চোখে সন্দেহ।

কিছু মনে করবে না যদি আমি ড্রাইভ করি?’ জিজ্ঞেস করল জো। কিন্তু সংকীর্ণ পিছনের সিটে বসে নিজের কাজে আফসোস হলো ডেভিডের। প্রথম পাঁচ মিনিট সংযত ভাবে গাড়ি চালালো জো। ব্রেকে স্পর্শ করে ঠিকঠাক দেখে নিল, গিয়ার দিয়ে ট্রাভেলের মজা নিতে চাইল।

 ‘ভয় পেও না। জানাল ডেভিড। কপাল কুঁচকে মনোসংযোগ করল ডেভিড। এরপর মাথা নেড়ে দৃঢ় হলো হাত। নব উদ্যমে গাড়ি চালানো শুরু করল। মুখ দিয়ে ফুস করে বাতাস ছাড়ল ডেবরা। প্রথম বাকের মুখে এসেই এমন ভাবে গাড়ি কাত হলো যে ডেভিডের ডান পা অবচেতনে ব্রেক প্যাডাল খুঁজতে গিয়ে ব্যথা পেল আর গলার কাছে মনে হলো শ্বাস আটকে গেল।

বার্সেলোনা বিমানবন্দরের বাইরে পার্কিং লটে জো যখন গাড়ি পার্ক করে ইঞ্জিনের চাবি বন্ধ করল, কয়েক মিনিট নিশ্চুপ রইল সবাই। এরপর আলতে করে বলে উঠল ডেভিড।

‘সন অব আ গান!

হেসে ফেললো সবাই। মনে মনে অনুশোচন হলো যে সে মেয়েটাকে ছিনিয়ে নেবে তার কাছে থেকে আস্তে আস্তে ছেলেটাকে পছন্দ করা শুরু করল সে। ছেলেটার কথাবার্তার অলস ভঙ্গি, চলাফেলা, হাসিতে আনন্দ খুঁজে পেল। নিজের প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় করল সে।

প্লেন আসারও এক ঘন্টা আগে চলে এসেছে তারা। রেস্টোরেন্টে একটা টেবিলে বসে তাকিয়ে রইল সবাই রানওয়ের দিকে। ডেভিড সাংগ্রিয়ার মাটির কলসের অর্ডার দিল। ডেবরা বসল জোর পাশে আর কথা বলার সময় একটা হাত তুলে দিল তার হাতে। এ ভঙ্গিতে সদ্য আসা জো’র প্রতি ভালোলাগা উঠে গেল ডেভিডের।

ওয়েটার সাংগ্রিয়া এনে রাখতেই ল্যান্ড করল একটা প্রাইভেট প্লেন। তাকিয়ে রইল জো।

নতুন এক্সিকিউটিভ গাষ্ট্ৰিষগুলোর একটা, ওরা বলেছিল যে মেয়েটা সুন্দরী হবে। এর এয়ারক্রাফটের বর্ণনা দেয়া শুরু করল কারিগরী ভাষায় আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল ডেবরা।

‘এয়ারক্রাফট সম্পর্কে কিছু জানো নাকি?” চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ডেভিড।

 ‘কিছু কিছু। স্বীকার করল জো। কিন্তু উত্তর দিতে চাইল ডেবরা।

‘জো এয়ারফোর্সে আছে।’ গর্বিত স্বরে উত্তর দিল সে। দু’জনের দিকেই তাকিয়ে রইল ডেভিড।

‘ডেবসও, হেসে ফেলল জো। ডেভিড মনোযোগ দিল মেয়েটার দিকে। ‘ডেবরা সিগন্যাল লেফটেন্যান্ট।

‘রিজার্ভে শুধুমাত্র। শুধরে দিল ডেবরা। কিন্তু জো উড়ে বেড়ায়। ফাইটার পাইলট।

‘উড়ে বেড়ায়। বোকার মতো বলল ডেভিড। জো’র পরিষ্কার আর স্থির দৃষ্টি দেখে আন্দাজ করা উচিৎ ছিল যে, এটা ফাইটার পাইলটের চিহ্ন। যেভাবে ও মুস্তাং চালিয়েছে বোঝা উচিৎ ছিল ডেভিডের। যদি সে একজন ইস্রায়েলী পাখি হয়–তাহলে ও অসংখ্য অভিযানে অংশ নিয়েছে। হেল, যতবার তারা উড়ে যায়। অসাধারণ সব কাজ করে। নিজের ভেতরে শ্রদ্ধার ঢেউ টের পেল সে।

‘কোন স্কোয়াড্রনে আছো তুমি–ফ্যান্টমস?

‘ফ্যান্টমস! ঠোঁট বাকাল জো।

‘এটা তো ওড়েই না। এটা কম্পিউটার চালায়। না, আমরা সত্যি উড়ি। তুমি মিরেজের নাম শুনেছো?

চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়াল ডেভিভ।

 হ্যাঁ। জানাল সে। শুনেছি তাদের সম্পর্কে।

 ‘ওয়েল, আমি মিরেজ চালাই।’ হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকাতে লাগল ডেভিড।

কী হয়েছে? জানতে চাইল জো। হাসি মুছে গেছে তার।

‘এখানে হাসার কী হলো?

‘আমিও তাই।’ জানিয়ে দিল ডেভিড। আমিও মিরেজ (Mirage) চালাই।’ এই ছেলের সাথে দ্বন্দ্বে যাবার কোন উপায় নেই। হাজারো ঘণ্টা কাটিয়েছি আমি মিরেজে। এবার অবাক হবার পালা জো’র। এরপর হঠাৎ করেই দুজনে একসাথে কথা বলা শুরু করল। ডেবরা একবার এর দিকে একবার ওর দিকে তাকাতে লাগল মাথা ঘুরিয়ে।

আরেক জগ সাংগ্রিয়ার অর্ডার দিল ডেভিড। জো আবার তাকে কিছুতেই বিল দিতে দেবে না। পনের বারের মতো আবারো বলে উঠল, “ওয়েল, ভালোই হলো। ডেভিডের কাঁধে চাপড় মেরে বলে উঠল, ‘কী বলল ডেবস?

 দ্বিতীয় জগের মাঝামাঝি এসে অ্যাভিয়েশনের উপর যখন আলোচনা জমে উঠেছে, বাধা দিল ডেভিড। কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমরা? প্রায় অর্ধেক স্পেন ভ্রমণ করে চলে এসেছি অথচ এখনো জানি না যে লোকটা কে?

 ‘লোকটা একটা মেয়ে’ হেসে ফেলল জো। উত্তর পূর্ণ করে দিল ডেবরা।

 হান্নাহ। হেসে তাকাল জোর দিকে। ওর ফিয়াসে। হাদাস্মা হাসপাতালে নার্সিং সিসটার আর আসছে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য।’

‘তোমার ফিয়াসে?’ ফিসফিস করে উঠল ডেভিড।

‘ওরা জুন মাসে বিয়ে করতে যাচ্ছে। ডেবরা তাকাল জোর দিকে। পুরো দুই বছর লেগেছে সিদ্ধান্ত নিতে।’

অস্বস্তিতে নড়েচড়ে উঠল জো। হাতে চাপ দিল ডেবরা।

 ‘তোমার ফিয়াসে?’ আবার জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘তুমি কেন বারবার একই কথা বলছো?’ জানতে চাইল ডেবরা। ডেভিড প্রথমে জোর দিকে নির্দেশ করে তাকাল ডেবরার দিকে।

‘কী, শুরু করল সে, আমি বুঝতে চাইছি। কে কী হচ্ছে এসব?’

হঠাৎ করেই বুঝতে পারল ডেবরা। হাঁ করে তাকিয়ে থেকে মুখ ঢাকল দুই হাতে। চোখ জ্বলছে। তুমি মানে তুমি ভেবেছো? ওহ্ না। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা। জোর দিকে তারপর নিজেকে দেখিয়ে বলে উঠল ‘এটাই ভেবেছো তুমি? মাথা নাড়ল ডেভিড।

 ‘ও আমার ভাই।‘ ধিক্কার দিয়ে উঠল ডেবরা। জো আমার ভাই, ইউ ইডিয়ট। যোসেফ ইস্রায়েল মোরদেসাই আর ডেবরা রুথ মোরদেসাই-ভাই বোন।

প্রথম নজরে দেখলে হান্নাহও বেশ বড়সড় একটি মেয়ে। উজ্জ্বল তামাটে রঙের চুল আর সোনালি তিল ভর্তি মুখমণ্ডল। জো থেকে খুব বেশি হলে এক থেকে দুইঞ্চি পরিমাণ খাটো। কিন্তু কাস্টমস গেইট দিয়ে বের হয়ে আসার পর সহজেই তাকে তুলে নিল জো, মেয়েটার পা উঠে গেল মাটি থেকে, বিশাল বক্ষবন্ধনে আবদ্ধ হলো দু’জনে।

তাই ব্যাপারটা স্বাভাবিক দেখল যখন তারা চারজন একসাথে রয়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে সবার লাগেজ এঁটে গেল মুস্তাংয়ে। পেছনের সিটে প্রায় জোর কোলের উপর বসে রইল হান্নাহ।

‘আমাদের হাতে আছে এক সপ্তাহ। জানাল ডেবরা। পুরো একটি সপ্তাহ। কী করব আমরা এটি নিয়ে?’

সকলে একমত হলো যে টোরেমোলিনস শেষ। এটা বেশ অনেক দূর দক্ষিণে। আর যখন থেকে মিশেনার দ্যা ড্রিফটারস রচনা করেছে তখন থেকেই এটা এলেবেলে মানুষদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।

‘প্লেনে একজনের সাথে কথা হয়েছে আমার। উপকূলের কাছে একটা জায়গা আছে। নাম কোলেরা। সীমান্তের কাছেই।‘

পরের দিন সকালবেলার মাঝামাঝি সময়ে কোলেরা পৌঁছাল সকলে। আর সিজনের একেবারে প্রথম দিকে হওয়ায় ছোট্ট হোটেলে সুন্দর রুম খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হলো না। প্রধান রাস্তার পাশেই হলো হোটেল। মেয়েরা রুম শেয়ার করতে রাজি হলো। কিন্তু ডেভিড নিজের জন্য আলাদা রুম নিতে চাইল। ইতিমধ্যে ডেবরাকে নিয়ে নানান পরিকল্পনা করে ফেলেছে সে।

ডেবরার নীল রঙের সংক্ষিপ্ত বিকিনি দেখে মনে হলো তার যৌবন ঢাকতে ব্যর্থই হয়েছে এ পোশাক। দেহতৃক স্যাটিনের মতো আর ট্যানড় হয়ে রঙ হয়েছে গাঢ় মেহগনি। যদিও কস্টিউমের পেছন দিকে উঁকি দিচ্ছে সাদা ঝলক। ভোয়ালে নেয়ার জন্য নিচু হতে স্পষ্ট বোঝা গেল তা। কোমর আর যথেষ্ট লম্বা পা নিয়ে ডেবরা একজন শক্তিশালী সাঁতারু–ঠাণ্ডা নীল জলে ডেভিডের সাথে একত্রে তাল মেলালো যখন তীর থেকে আধ মাইল দূরে পাথুরে দ্বীপে গেল দু’জনে।

 ছোট্ট দ্বীপটা মনে হলো তাদের নিজস্ব। মসৃণ একটা পাথর খুঁজে বের করে পাশাপাশি বসল আঙুলে আঙুল পেঁচিয়ে। লবণাক্ত জলে চুল ভিজে লেপ্টে আছে ডেবরার কাঁধে।

সূর্যের নিচে শুয়ে পুরো দুপুর জুড়ে কথা বলল দু’জনে। একে অপরের সম্পর্কে অনেক কিছুই আছে জানার।

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান এয়ারফোর্সের একজন তরুণ কর্নেল ছিল ডেবরার বাবা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চলে যায় ইস্রায়েলে। তারপর থেকে সেখানেই আছে। বর্তমানে মেজর জেনারেল। জেরুজালেমের যে অংশে তাদের বাসা, তা প্রায় পাঁচশ বছরের পুরাতন যদিও আনন্দের কোন কমতি নেই সেথায়।

হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির সিনিয়র লেকচারার ডেবরার বিশেষ একটি গোপন ব্যাপার হলো যে সে লিখছে চায়। তার রচিত কবিতার ছোট্ট একটা ভলিউম ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। মুগ্ধ হয়ে গেল ডেভিড। এক কুনইয়ের উপর সোজা হয়ে তাকিয়ে রইল শ্রদ্ধাভরে ডেবরার দিকে। খানিকটা ঈর্ষাও হলো। সামনেটা যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ডেবরা।

সূর্যের কারণে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ডেবরা। ঘন গাঢ় চোখের পাতায় উজ্জ্বল রত্ন পাথরের মতো জমে আছে জলের ফোঁটা। মেয়েটা সুন্দরী নয়, সিদ্ধান্ত নিল ডেভিড। কিন্তু বেশ সুশ্রী আর অনেক, অনেক সেক্সী। তাকে তার পেতেই হবে। এ ব্যাপারে ডেভিডের মাঝে কোন দ্বিধা না থাকলেও মনে হলো তাড়াতাড়ি করা দরকার। ডেবরার কথা উপভোগ করতে লাগল ডেভিড। নিজেকে প্রকাশের জন্য ওর চমৎকার কিন্তু অদ্ভুত একটা পথ আছে। পুরোপুরি মেলে ধরার পর উচ্চারণ হয়ে গেল নিরপেক্ষ যদিও তার আমেরিকান ব্যাকগ্রাউন্ডের ছোঁয়া খানিকটা রয়ে গেল। ডেবরা জানাল যে কবিতা রচনা মাত্র শুরু। ইস্রায়েলে বেড়ে ওঠার উপর একটা উপন্যাস রচনা করবে। খসড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে আর শোনার পর গল্পটা বেশ চমকপ্রদ লাগল ডেভিডের কাছে। এরপর বলতে লাগল ওর দেশ আর সেখানে বসবাসরতে মানুষের কথা। শুনতে শুনতে মনে হলো কিছু একটা চাঙ্গা হয়ে উঠল ডেভিডের মনের মাঝে নস্টালজিয়া, গভীরে থাকা গোত্রীয় স্মৃতি। আবারো হিংসা হলো তার। কোথা থেকে এসেছে আর কোথায় যাচ্ছে তার নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত ডেবরা। ডেবরা জানে কোথার তার জায়গা, কোথায় তার নিয়তি। এই কারণে মেয়েটাকে বেশ শক্তিশালী মনে হলো। ডেবরার পাশে বসে হঠাৎ করেই নিজেকে বেশ তুচ্ছ আর উদ্দেশ্যহীন মনে হলো ডেভিডের।

হঠাৎ করেই চোখ খুলে ফেলল ডেবরা। সূর্যের আলোয় পিটপিট করল একটু। এর পরই দেখল ডেভিডকে।

 ‘ওহ ডিয়ার। হেসে ফেলল ডেবরা। আমরা খুব দুঃখিত, ডেভিড আমি অনেক কথা বলি?’ মাথা নাড়ল ডেভিড। কিন্তু মেয়েটার হাসি দেখে কোন উত্তর দিল না। ডেবরা ও হয়ে গেল চুপচাপ।

সাবধানে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। মনোযোগ দিল। সূর্যের তেজে শুকিয়ে এলোমেলো হয়ে আছে চুল। তারপরেও বেশ মসৃণ সুন্দর আর গাঢ় কালো। গালের হাড় আর চোয়াল সযত্নে নির্মিত হয়েছে যেন, চোখ জোড়া স্বচ্ছ আর খানিকটা এশিয়াটিক ভাব, ঠোঁট পরিপূর্ণ আর দৃঢ়, লম্বা সুশ্রী নাক।

এগিয়ে এসে ডেভিডের গালে হাত রাখল ডেবরা।

‘তুমি খুব সুন্দর ডেভিড। তোমার মতো সুন্দর কোন মানুষ আমি আর দেখিনি।’

নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে ডেভিড। গাল বেয়ে গলা থেকে বুকে নামল ডেবরার হাত।

আস্তে করে সামনে এসে উষ্ণ আর লবণাক্ত ঠোঁটের স্বাদ নিল ডেভিড।

কিন্তু মসৃণ বাদামী পিঠে কস্টিউমের ভাজ খোলার চেষ্টা করতেই হতাশ হতে হলো ডেভিডকে। তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে গেল ডেবরার শরীর। ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল ডেভিডকে।

এরপরও ভদ্রভাবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে ডেবরাকে আলিঙ্গন করে রাখল ডেভিড। কানে কানে কথা বলে চাইল তাকে শান্ত করতে। ধীরে ধীরে সহজ হলো ডেবরা। আবারো হাত রাখল ডেভিডের গলায়।

 দক্ষ ডেভিড বিদ্রোহ দমনে অভ্যস্ত। তারপরেও স্তব্ধ হয়ে গেল যখন ডেবরা তার কাঁধে হাত রাখল পুনরায় যখন ডেভিড চেষ্টা করতে চাইল। শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে পাথর থেকে পড়ে গেল ডেভিড। কনুই দিয়ে পড়ে গড়িয়ে গিয়ে থামলো পানির কিনারায়।

রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। কিন্তু কস্টিউম ঠিক করে লম্বা পা দিয়ে পাথরের উপর উঠে দাঁড়াল ডেবরা। এরপর এক লাফে পড়ল পানির উপর। ডেভিডকে ডেকে বলল,

‘চলো বিচ পর্যন্ত রেস লাগাই।

চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল না ডেভিড। নিজের মতো করে সাঁতার কেটে অনুসরণ করল ডেবরাকে। এরপর গোমড়া মুখে পানি থেকে উঠতেই এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ডেবরা। তারপরই হেসে ফেলল।

 ‘মনে হচ্ছে তোমার বয়স মাত্র দশ।‘ কিন্তু কোন কাজ হলো না। চুপচাপ নিজের রুমে হেঁটে চলে গেল ডেভিড।

সন্ধ্যাবেলা ‘২০০১ A.D’ নামে ডিসকোথেক আবিষ্কার করার পরেও চুপচাপ রইল ডেভিড। সমুদ্রের দিকে মুখ করে থাকা ডিসকোটা চালায় কয়েকটা ইংরেজ তরুণ। এমন একটা টেবিলের পাশে জড়ো হলো তারা যেখানে ইতিমধ্যে দুজন বি.ই.এ. হোস্টেস আর কঠিন মুখের দাড়িওয়ালা বসে আছে। গান বাজাছে উচ্চ স্বরে আর সুরটাও এমন যে কিছুতেই শরীর সহজ করা যায় না। হোস্টেস দু’জন প্রায় ধর্মীয় ভক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। তাই দেখে ডেবরা আমন্ত্রণ জানাল ডেভিডকে। নারীসুলভ দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে মজা পেল ডেভিড। নিজের বরফশীতল মনোভাব ঝেড়ে ফেলে নাচতে শুরু করল ডেবরার সাথে।

একসাথে চমৎকার নাচলো দু’জনে। কর্কশ গানের তালে ও তাল মিলালো। আফ্রিকার পুরাতন একটি মুদ্রা এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলল যে অন্যান্য নাচিয়েরাও তাকিয়ে রইল।

গান পরিবর্তন হলো। ডেবরা এগিয়ে এসে ডেভিডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ডেভিডের মনে হল যেন কোন একটা শক্তি আসছে ডেবরার শরীর থেকে, যার ফলে জাগ্রত হয়ে উঠছে ওর শরীরের প্রতিটি ইন্দ্রিয় আর এও বুঝতে পারল যে এই নারীর সাথে যে কোন ধরনের সম্পর্কের পথ এত সহজ হবে না। এত গভীর ছিল এ উপলব্ধি যে প্রায় দ্রুতই আবার ভুলে গেল তা।

রেকর্ড শেষ হতেই হান্নাহ আর জোকে রেখে নীরব রাস্তায় নেমে এলো দু’জনে। পথ নেমে গেছে নিচে বিচের দিকে।

 আকাশে চাঁদ থাকায় বিচের উপর জড়ো হয়ে থাকা চুড়াগুলোও দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের গায়ে মনে হলো অসংখ্য হলুদ চিত্র। পাথুরে বিচে ভেসে আসছে সমুদ্রের ঢেউ। জুতো খুলে রেখে গোড়ালি অব্দি পা পানিতে ডুবিয়ে হাঁটতে লাগল দুজনে।

কয়েকটা পাথরের কাছে এসে খানিক গোপন জায়গা পেয়ে থেমে গেল একে অপরকে কিস করার জন্য। ডেবরার নরম অভিব্যক্তিতে দুপুরের অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তি হবে বলে ভাবল ডেভিড।

 এই ভুলের পরিণামে আবারো ধাক্কা খেল ডেবরার হাতে। কিন্তু এবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর রাগের গলায় বলে উঠল ডেবরা।

 ‘ধুত্তোরি! তুমি এখনো শেখোনি? আমি এটা করতে চাই না। যতবার আমরা একা হবো ততবারই এমন চেষ্টা করবে তুমি?

‘সমস্যা কী তাতে?’ ডেভিডও গলা তুলল। রেগে উঠছে ক্রমে। এটা বিংশ শতাব্দী ডালিং। কুমারী মেয়ে এই সিজনের স্টাইল নয়–তুমি শোননি?

 ‘আর বখে যাওয়া ছোট্ট ছেলেগুলোর উচিৎ বড় হয়ে ওঠা, যখন তারা নিজের দায়িত্ব নেবে। জ্বলন্ত দৃষ্টি হানলো ডেবরা।

থ্যাংকস!’ গড়গড় করে উঠল ডেভিড।

 ‘কোন পেশাদার কুমারীর কাছ থেকে অপমান পাবার জন্য আমি আশেপাশে থাকতে চাই না।’

ভালোই তো, চলে যাও তাহলে।’ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ডেবরা।

হুম, দ্যাটস আ গ্রেট আইডিয়া! ডেবরার দিকে পেছন ঘুরে বিচ থেকে চলে গেল ডেভিড। এতটা আশা করেনি ডেবরা। ছুটতে শুরু করল ডেভিডের পিছুপিছু-কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ থামালো তাকে। থেমে গিয়ে হেলান দিল একটা পাথরের গায়ে।

দুঃখে কাতর ডেবরা ভাবল, ওর উপর জোর করা উচিৎ হয়নি ডেভিডের। আমি ডেভিডকে চাই, সত্যি চাই, কিন্তু ভুডুর পর ডেভিডই হবে প্রথম। শুধু একটু সময় পেলেই ঠিক হয়ে যেত সবকিছু। জোর করা উচিৎ হয়নি। যদি ডেভিড ডেবরার গতিতেই এগোত তাহলে সঠিক কাজটাই করতে পারতো সে।

কেমন হলো ব্যাপারটা যে আমি ডুডু সম্পর্কে অনেক কিছু এখন ভাবতেও পারি না। মাত্র তিন বছর হয়েছে। কিন্তু ওর স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এমনকি মুখটাও মনে নেই ঠিকভাবে। অথচ ডেভিডের প্রতিটি অংশ একেবারে নিখুঁত ভাবে মনে আছে- প্রতিটি রেখা।

আমার হয়তো উচিৎ ডেভিডের পিছুপিছু গিয়ে ওকে ডুডুর কথা খুলে বলা। ওকে বলা যে, ধৈর্য ধরে আমাকে যেন একটু সাহায্য করে। এটাই হয়তো করা উচিৎ ভাবলেও কাজটা করল না ডেবরা। ধীরে ধীরে হেঁটে বিচ্ থেকে বের হয়ে আসল। নীরব শহরের মাঝ দিয়ে চলে গেল হোটেলের দিকে।

রুমের মাঝে হান্নাহর বিছানা একদম খালি। নিশ্চয় জোর সাথে। ডেবরা ভাবল আমারও তো কথা ছিল ডেভিডের সাথে থাকার। ডুডু মারা গেছে, আমি বেঁচে আছি। আমি ডেভিডকে চাই, ওর সাথেই আমার হওয়া উচিৎ কিন্তু ধীরে ধীরে কাপড় খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল ডেবরা, যদিও ঘুম হলো না মোটেই।

 ‘২০০১ A.D ডিসকোর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড। একটা হোস্টেস বেশ লম্বা, সোনালি চুল, গায়ের রঙ ইংরেজদের মতো, চোখ চায়না ডলের। চোখ তুলে ডেভিডকে দেখতে পেল মেয়েটা, চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিল ডেবরা আছে কিনা। হাসল।

একটা রেকর্ড শেষ না হওয়া পর্যন্ত একে অন্যকে স্পর্শ করা ছাড়াই নাচলো দু’জনে। এরপর ঝুঁকে কাছে গেল ডেভিড। জানতে চাইল,

‘তোমার কোন রুম আছে? মাথা নাড়ল মেয়েটা।

 ‘চল,’ জানালো ডেভিড।

ডেভিড যখন নিজের রুমে ফিরে এলো বাইরে তখন আলো। শেভ করে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ দেখে নিজেই হতবাক হয়ে গেল। কাউন্টারের কাছে লাগেজ জড়ো করে ডাইনারস ক্লাব কার্ড দিয়ে পরিশোধ করে দিল বিল।

 ব্রেকফাস্ট রুম থেকে জো আর হান্নাহর সাথে বাইরে বের হয়ে এলো ডেবরা। বিচে যাবার জন্য পোশাক পরে আছে সকলে। বাদিং গিয়ারের উপর। টেরি রোব জড়ানো। হাসিখুশি দেখাল সকলকেই–তারপরই ওরা দেখতে পেল ডেভিডকে।

‘অ্যাই!’ ডাক দিল জো। কোথায় যাচ্ছো তুমি?

যথেষ্ট দেখা হয়েছে স্পেন। জানাল ডেভিড। কয়েকটা ভালো উপদেশও পেয়েছি। চলে যাচ্ছি। এরপরই দেখতে পেল ডেবরার চোখে সরে গেল ব্যথার দ্রুত ছায়া। খানিকটা আত্মশ্লাঘা বোধ করল সে। হান্নাহ আর জো দুজনেই ঘুরে তাকাল ডেবরার দিকে। তাড়াতাড়ি ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিল ডেবরা। খানিকটা উজ্জ্বল ভাবে হেসে, এগিয়ে এলো সামনে। বাড়িয়ে দিল হাত।

‘তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ ডেভিড। আমি দুঃখিত যে তোমাকে চলে যেতে হচ্ছে। ভালো লেগেছে তোমার সঙ্গ।’ এরপরই গলার স্বর নেমে গেল খাদে। আশা করি যা খুজছো তা পেয়ে যাবে। গুডলাক।’

এরপর দ্রুত ঘুরে নিজের রুমে চলে গেল সে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল হান্নাহ। ডেভিডের দিকে বক্র দৃষ্টি হেনে চলে গেল ডেবরার পিছুপিছু।

ভালো থাকো, জো।

‘আমি তোমার ব্যাগ নিচ্ছি।

 ‘ঠিক আছে, লাগবে না। ডেভিড চেষ্টা করল জোকে থামাতে।

‘কোন সমস্যা নেই।’ জো লাগেজ নিয়ে নিল ডেভিডের হাত থেকে। মুস্তাং পর্যন্ত নিয়ে গেল। পেছনের সিটে রেখে দিল সব।

‘পাহাড়ের উপর পর্যন্ত যাবো তোমার সাথে আর হেঁটে ফিরে আসব।’ প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল জো, আরাম করে বসল। আমার একটু শরীরচর্চা করা দরকার।’

দ্রুত গাড়ি চালাতে লাগল জো। দুজনেই রইল চুপচাপ। ইচ্ছে করে সিগারেট জ্বালালো জো তারপর দিয়াশলাই ফেলে দিল জানালা দিয়ে।

 ‘আমি জানি কোথায় ভুল হয়েছে ডেভি। কিন্তু আমি অনুমান করতে পারছি।’

উত্তর দিল না ডেভিড। পথের দিকে নজর।

‘ও একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছে কিছুদিন আগে, মাত্র গত কয়েকদিনে এর একটু পরিবর্তন হলো। বেশ হাসিখুশি, আমারই তাই মনে হয়েছে সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।

তারপরেও চুপ করে রইল ডেভিড। কোন পাত্তাই দিল না জোর কথায়। মাথা মোটাটা নিজের ব্যাপারে নাক গলায় না কেন।

‘ও অসাধারণ একজন মানুষ ডেভি। এমন নয় যে আমার বোন বলে বলছি। ও সত্যিই তাই আর আমার মনে হয় ওর সম্পর্কে জানা উচিৎ তোমার-শুধু শুধু খারাপ ভেবো না।’

উপসাগর আর শহরের উপর পাহাড়ের মাথায় পৌঁছালো তারা। ডেভিড গাড়ি থামালো কিন্তু ইঞ্জিন চালু রাখল। তাকিয়ে রইল নিচে অনিন্দ্যসুন্দর নীল সাগরের দিকে। একসাথে মিলে গেছে পাথরের চূড়া আর পাইনের পাহাড়।

‘ডেবরার বিয়ের কথা চলছিল। নরম স্বরে বলতে লাগল জো। ছেলেটা ছিল চমৎকার, ডেবরার চেয়ে বড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে কাজ করতে তারা। এছাড়াও রিজার্ভের ট্যাংক ড্রাইভার ছিল ছেলেটা। সিনাইতে অভিযানের সময় ট্যাংকসহ পুড়ে যায়।’

ঘুরে জোর দিকে তাকাল ডেভিড। খানিকটা নরম হয়েছে চোখের দৃষ্টি।

‘ডেবরা ভেঙ্গে পড়ে একেবারে।’ একগুয়ে ভাবে বলতে থাকে জো। মাত্র গত কয়েক দিন ধরে আমি ওকে সত্যিকারের খুশি আর সহজ স্বাভাবিক দেখছি।’

কাঁধ ঝাঁকাল জো আর এমনভাবে হাসল যেন বিশাল সেন্ট বার্নারড কুকুর। পরিবারিক ইতিহাস বলার জন্য দুঃখিত ডেভি। শুধু ভেবেছি হয়তো এতে কোন উপকার হবে। বড়সড় বাদামী হাত বাড়িয়ে দিল জো। আমাদের ওখানে বেড়াতে এসো। তুমি জো জানো ওটা তোমারও দেশ। তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাতে ভালোই লাগবে আমার।’

হাত বাড়ালো ডেভিড। আমি হয়তো আসব কখনো জানিয়ে দিল সে।

‘শালোম।

‘শালোম জো। গুড লাক।’ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেল জো। রাস্তার পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ডেভিডের চলে যাওয়া। হাত নাড়াল সে আর প্রথম বাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়ি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *