০৬. আল্লাহর কসম

আল্লাহর কসম। হাকীক সম্প্রদায়ের মায়েরা আর এমন ছেলে জন্ম দেবেনা…

মুহাম্মদ বিন কাসিম নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে বন্দিশালার দিকে যাচ্ছিলেন। বিন কাসিমের নিরাপত্তারক্ষীরা দুর্গের এক বাসিন্দাকে পথ দেখানোর জন্য সাথে নিয়ে ছিল। সেই লোকটিই তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল জেলখানার দিকে। পথ প্রদর্শকের ঘোড়া তাদের আগে আগে দৌড়াচ্ছিল। এদিকে মুসলিম সৈন্যরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ বিন কাসিমের সামনে পড়ল, দুই মুসলিম সেনা এক তরুণীকে টেনে হেঁচড়ে একটি বাড়ি থেকে বের করছে, আর ওদের ছেড়ে দেয়ার জন্যে এক বৃদ্ধ কড়জোরে অনুরোধ করছে।

বিন কাসিম এই দৃশ্য দেখে ঘোড়া থামিয়ে দিলেন। বাধাগ্রস্ত হয়ে সৈনিক বাধাদানকারী বৃদ্ধের প্রতি ক্ষেপে গেল এবং তাকে হত্যা করার জন্য তরবারী উত্তোলন করল।

হঠাৎ করে সেই সৈন্যের কানে ভেসে এলো হুংকার “থামো, তরবারী নামিয়ে ফেলো” সৈনিক তরবারী নামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রধান সেনাপতি বিন কাসিম।

বিন কাসিম সৈনিকের মুখোমুখি ঘোড়া দাড় করিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, তোমরা কি আরব নও?

“জী হ্যাঁ, প্রধান সেনাপতি! আমরা অবশ্যই আরব।” বিনয়ের সাথে জবাব দিলো সৈনিক।

‘তোমরা কি মুসলমান নও? “আলহামদুলিল্লাহ’ অবশ্যই আমরা মুসলমান, মাননীয় সেনাপতি।

“তোমাদের রক্তে কি রোম-পারস্যের রক্তের কোন মিশ্রন ঘটেছে? আল্লাহর কসম! আমার প্রিয় রাসূল বেসামরিক নিরপরাধ নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর কখনো হাত তুলেননি। ছেড়ে দাও ওদের।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম তরুণী ও বৃদ্ধকে ইশারায় ঘরের ভিতরে চলে যেতে বললেন এবং তাঁর দুভাষীদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা সারা শহরে ঘোষণা করে দাও, বেসামরিক নারী, শিশু, বৃদ্ধদের ওপরে যদি কোন মুসলিম সেনা হাত তুলে তাহলে তাদের শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। কোন মুসলিম সেনা যেন বেসামরিক লোকের বিরুদ্ধে কোন ধরনের দমনমূলক পদক্ষেপ না নেয়।

খুব দ্রুততার সাথে বিন কাসিম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে জরুরী নির্দেশ দিয়ে বন্দীদের মুক্ত করার জন্য তাড়াতাড়ি কয়েদখানায় পৌছানোর জন্য উদগ্রীব ছিলেন। কারণ শত্রুরা পরাজয়ের প্রতিহিংসায় বন্দীদের হত্যা করার প্রবল আশঙ্কা করছিলেন তিনি।

শহরের মতো কয়েদখানার মধ্যেও হিন্দু কারারক্ষীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কারারক্ষীরা মন্দির চুড়া ভেঙ্গে পতাকা নীচে পড়তে দেখেই প্রাণ ভয়ে কারাগারে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করে। আর চিৎকার করতে থাকে, ডাভেল ভেঙ্গে পড়ছে, দেবীর গযব ধেয়ে আসছে, শহরের সব মানুষ পালাচ্ছে।

শহরের আতঙ্ক কারাভ্যন্তরেও আছড়ে পড়ল। কারারক্ষীরা প্রধান ফটক খুলে দিল। কয়েদখানার সকল প্রহরী ও কর্মচারী প্রাণভয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেল। কারাগারের ভিতরে যেসব বন্দি বিভিন্ন কক্ষে আটক ছিল তাদের বের হওয়ার পথ বন্ধ থাকায় মুক্তির জন্য দরজায় করাঘাত করতে লাগল।

বাইরের অবস্থা একপর্যায়ে কারাগারের পাতাল কক্ষেও ছড়িয়ে পড়ল। ওখানেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল আরবদেরকে। সংবাদ শুনে সকল আরব বন্দি মুক্তির আশ্বাসে আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হলো। তারা তখনও জানেনা মুসলিম সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করেছে। এমনটি তাদের ধারণার বাইরে। বন্দি আরবদের প্রতিটি দিনের সূর্য উদিত হতো জীবনের শেষ দিবস হিসাবে এবং প্রতিদিনের সূর্য অস্ত যেতো জীবনের শেষ রাত হিসাবে। তারা প্রতিটি মুহূর্তকেই মনে করতো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য আরবদেরকে কোন প্রহরী উপহাসচ্ছলে বলেছিল, দু’বার তোমাদের বাহিনীকে সেনাপতিসহ আমরা কচুকাটা করে ফেরত পাঠিয়েছি কিন্তু কাপুরুষগুলো আবারো আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছে।

ওরা আমাদের দুর্গ অবরোধ করেছে। দেখবে এবার মজা। কয় দিন ওরা এভাবে অবরোধ বহাল রাখতে পারবে। আরব সৈন্যরা দুর্গ অবরোধ করলেও বিজয়ী হয়ে তাদের মুক্ত করতে পারবে এ আশাবাদ খুব একটা জোরালো হতে পারছিল না এর আগের দু’টি অভিযানের পরাজয়ের সংবাদে। তাই নিত্যদিনের মতো আল্লাহর দরবারে আকুতি জানানো ছাড়া এহেন পরিস্থিতিতে তাদের আর কিছুই করার ছিলনা। তাদের সবগুলো কক্ষ যেমন ছিল মজবুত তেমনই শক্ত শিকলের দরজায় তালাবদ্ধ। আরব কয়েদীরা ইসলামী রীতি অনুযায়ী তাদের মধ্য থেকে ওমর বিন আওয়ানাকে দলনেতা মনোনীত করেছিল। দলনেতা হিসাবে কয়েদখানার বাইরে মানুষের ছুটাছুটির সংবাদ শুনে সে আরব বন্দীদের চিল্কার করে জানিয়ে দিলো, আরব বন্দিগণ। আমাদের মুক্তি নয়তো মৃত্যু সেই কাক্ষিত দিন সমাগত। সবাই দোয়া করো, বন্দিশালার প্রহরীরা আমাদের কাছে পৌছার আগে যেন স্বদেশী যোদ্ধারা আমাদের কাছে পৌছতে পারে। কোন হিন্দু প্রহরী যদি তোমাদের জোর করে বাইরে নিয়ে যেতে চায় তাহলে ওদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে চেষ্টা করা। মরতেই যদি হয়, তাহলে লড়াই করেই মরতে চেষ্টা করবে। আমাদের সবাইকে যদি একসাথে বের করতে চায় তাহলে পাতাল কক্ষেই আমরা ওদের উপর হামলে পড়বো। সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করো। আল্লাহর দয়া ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর নেই।” সর্দারের কথায় সবাই একমত পোষণ করল। নারী শিশুরা পর্যন্ত লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।

পাতাল কক্ষে যাওয়ার জন্য ওপর থেকে যে সিড়ি পথ নেমেছে হঠাৎ আরব সর্দার সেপথে বহুলোকের পদধ্বনী শুনতে পেল। সিঁড়ির কাছের কক্ষ থেকে আওয়াজ হলো, “সবাই হুশিয়ার হয়ে যাও। দরজা খোলার সাথে সাথেই শত্রুদের ভিতরে টেনে নেবে।”

সকল আরব বন্দি প্রস্তুত হয়ে গেল। নিস্তব্ধ নীরবতা। আরব বন্দিরা প্রথমে দেখতে পেল কয়েদখানার দারোগাকে। তার নাম কুবলা। তার হাতে ছিল এক গোছা চাবী। কয়েদীরা দেখল দারোগা কুবলার সাথে সাথে যে লোকটি আসছে সে কয়েদখানার কোন প্রহরী নয়। দেখতে দেখতে ত্রিশ চল্লিশ জন আরব সেনা পাতাল কক্ষে প্রবেশ করল। ওদের দেখে পাতাল বন্দিশালার প্রথম কক্ষের একবন্দি চিৎকার করে বলে উঠল, আল্লাহর কসম! তোমরা অবশ্যই আরব মুজাহিদ। তোমাদের শরীর থেকে আরব মুজাহিদের গন্ধ পাচ্ছি! একথা ধ্বনিত

হওয়ার সাথে সাথেই মাটির নীচের বন্দিশালার পরিবেশ বদলে গেল। কয়েদীরা মুক্তির আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বদেশী যোদ্ধাদের জড়িয়ে ধরল। ওরা ছিল বিন কাসিমের একান্ত নিরাপত্তা ইউনিটের সৈনিক।

সিঁড়ির কাছ থেকে এক কমান্ডার উচ্চ আওয়াজে হাঁক দিলো। “সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে চলে এসো। সিপাহসালার ওপরে অপেক্ষা করছেন।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম কয়েদখানার মাঝখানের খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট অবস্থায় তিনি বন্দিশালার পাতাল পথের প্রবেশ মুখের দিকে এক পলকে তাকিয়ে রয়েছেন।

কিছুক্ষণ পর তিনি নারী বন্দীদেরকে ওপরে উঠে আসতে দেখতে পেলেন। তারা দিনের আলোয় এসেই দু’হাতে চোখ বন্ধ করে ফেলল। দীর্ঘ দিন সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে তাদের চোখ হঠাৎ করে প্রখর সূর্যালোক সহ্য করতে পারছিলনা। সবাই চোখে অন্ধকার দেখছিল। সেনাপতি বিন কাসিম লক্ষ্য করলেন নারী শিশুদের পিছনে পুরুষরাও ওপরে ওঠা মাত্রই চোখ দু’হাতে বন্ধ করে ফেলছে।

“আরে বোকার দল। চোখ খোলল। চেহারা থেকে হাত সরাও। মুক্তি ভ্রাতা হিসেবে আগত বীর সেনাপতিকে দেখো।” আবেগের আতিশয্যে কম্পিত কণ্ঠে বলল বন্দীদের দলনেতা আমর বিন আওয়ানা।

বন্দীদের ওপরে আসতে দেখে এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন সেনাপতি বিন কাসিম! সবার আগে যে নারী দলটি পাতাল কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ততোক্ষণে তাদের দৃষ্টি শক্তি দিনের আলোকে সহ্য করে নিয়েছে। তারা দেখতে পেল, পরম সুশ্রী এক নওজোয়ান মাটিতে হাটু ভেঙ্গে দু’হাত প্রসারিত করে তাদের স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বলছে- “আমি কি ওয়াদা পূরণ করেছি? তোমরা কি কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দেবেনা, যে এই ছেলে আমাদেরকে বেঈমানদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে উদ্ধার করেছিল?”

নারীদের দলটি আগেই ঠায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, বিন কাসিমের আবেদন শুনে এক অর্ধবয়স্কা মহিলা এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমুই চুমুই ভরিয়ে দিতে দিতে বলল, “আল্লাহর কসম! সাকীফ গোত্রের আর কোন মা এমন বীর সন্তান জন্ম দিতে পারবে না।

যারই দৃষ্টি একটু ধাতস্থ হয়ে আসছিল, সেই বন্দিই মুহাম্মদ বিন কাসিমকে জড়িয়ে আবেগে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পর বিন কাসিম মুক্ত বন্দীদের নিয়ে জেলখানার দফতরে প্রবেশ করলেন। দফতরে দাঁড়িয়ে তিনি জেলখানার বদ্ধ কুঠিরে মুক্তিকামী বন্দীদের দরজায় কড়াঘাত করার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। যেসব বন্দির হাত মুক্ত ছিল কিন্তু হাত পায়ে বেড়ি ছিল, তারা শিকল ছিড়ে মুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল। ওদের শিকল ভাঙ্গার আওয়াজ ভেসে আসছিল বিন কাসিমের কানে। সব বন্দিই যেন পিঞ্জিরে আবদ্ধ পাখির মতো মুক্ত স্বজাতিদের সাথে উন্মুক্ত আকাশে উড়ার জন্য তড়পাচ্ছিল।

“দারোগাকে ধরে নিয়ে এসো এবং ওকে হত্যা করো।” নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম।

“নির্দেশ পেয়ে কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী পাতাল বন্দিশালার দিকে দৌড়ে গেল। তারা নীচের সব জায়গায় দারোগা কুবলাকে তালাশ করল কিন্তু কোথাও দারোগাকে খুঁজে পেল না। বন্দীদের কাছেও দারোগার কথা জিজ্ঞেস করল কিন্তু কেউ দারোগার সন্ধ্যান দিতে পারল না।

অবশেষে বুঝা গেল বিন কাসিম যখন মুক্ত আরব বন্দীদের মুক্তির আবেগঘন পরিবেশে সাফল্য ও কৃতজ্ঞতার আবেশে সিক্ত ছিলেন, আরব বন্দিরা তাকে ঘিরে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করছিল এবং তাকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতায় চুমুই চুমুই ভরিয়ে দিচ্ছিল, মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দি ও সৈন্যদের এই মগ্নতার সুযোগে দারোগা কুবলা জেলখানা থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যায়।

বিন কাসিম কয়েদখানায় প্রবেশ করেই দারোগার সাক্ষাত পেয়ে যান। দারোগা কুবলা বিনাবাক্য ব্যয় ও কালক্ষেপণ না করে আরব বন্দীদের অবস্থানের কথা বিজয়ী সেনাপতিকে জানিয়ে দেয় এবং নিজে পাতাল কক্ষের চাবী নিয়ে দরজা খুলে দেয় এবং বন্দীদের মুক্ত করে দেয়।

বিন কাসিমের নিরাপত্তারক্ষীরা দারোগার খুঁজে সারা কয়েদখানায় তল্লাশী করে প্রধান ফটকের কাছে গেলে তারা দুই কয়েদীকে দেখতে পেল, হাত পায়ে বেড়ী নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ওরা কয়েদখানার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ওদের জিজ্ঞেস করে নিরাপত্তা কর্মীরা জানতে পারল তারা দারোগাকে প্রধান গেট পেরিয়ে যেতে দেখেছে। এ খবর পেয়ে দুই নিরাপত্তারক্ষী দারোগাকে ধরে আনার জন্য ঘোড়া দৌড়াল। এরা কয়েদখানায় প্রবেশ করেই দারোগাকে দেখেছিল। কিছুদূর অগ্রসর হয়েই তারা দারোগাকে

পেয়ে গেল। তারা দারোগাকে পাকড়াও করে বিন কাসিমের কাছে নিয়ে এলো।

“তুমি কি ডাভেল দুর্গ থেকে পালিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেছিলে? দু’ভাষীর মাধ্যমে ধৃত দারোগাকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।

“সম্মানিত বিজয়ী সেনাপতি। আমার যদি প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালানোর ইচ্ছা থাকত, তাহলে এতো সহজে আপনার লোকেরা আমাকে ধরতে পারত না।”

“জীবন বাঁচানোর জন্য পালানোর কোন ইচ্ছাই কি তোমার ছিলনা?” জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম। তুমি নিহত হতে চাও।”

“না, আমি মৃত্যুবরণ করতে চাই না। বিজয়ী সেনাপতি হিসাবে প্রতিপক্ষের সৈনিক হিসাবে আমাকে হত্যা করা ছাড়া, হত্যার আর কোন কারণ আপনি আমার বেলায় পাবেন না।

“এসব নিরপরাধ লোকগুলোকে এতো দিন পর্যন্ত বন্দি করে রাখা কি তোমার অপরাধের জন্য যথেষ্ট নয়? এই অপরাধ কি ক্ষমা যোগ্য মনে কর তুমি?”

“নিরপরাধ এই লোকগুলোকে এতোদিন বাচিয়ে রাখা কি অপরাধ? বলল দারোগা। এদেরকে আমাদের রাজার হুকুমে বন্দি করা হয়েছে কিন্তু আমার হুকুমে বন্দিদশাতেও এদেরকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তাদের বন্দি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলে সেটির অপরাধে অপরাধী আমাদের রাজা। বন্দি অবস্থায় যদি এদের বিশেষ কোন কষ্ট দেয়া হয়ে থাকে তাহলে এজন্য আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। সম্মানিত সেনাপতি! আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে তাদেরকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমি তাদের কোন কষ্ট দিয়েছি কি-না? মুহাম্মদ বিন কাসিম আরব বন্দীদের কাছে দারোগা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সবাই একবাক্যে জানালো, এই দারোগা তাদের ওপর কোন জুলুম করেনি। বরং সে প্রতিদিন পাতাল কক্ষে গিয়ে তাদের প্রয়োজনাদির খোঁজ খবর নিতো। তাদের দেখা শোনা করতো। সবাই দারোগা কুবলার প্রশংসা করল।

“সম্মানিত সেনাপতি। আপনি জানেন না, এই বন্দীদের মধ্যে যে দু’জন তরুণী ছিল তাদেরকে আমি ডাভেল শাসকের কুদৃষ্টি থেকে বহু কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছি। ডাভেল শাসক যখন কারাবন্দীদের দেখতে আসতো, আমাকে খবর দিতো আমি খবর পেয়েই ওই দুই তরুণীকে ডাভেল শাসকের

দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখতাম। শুধু তাই নয় সম্মানীত সেনাপতি! উরুঢ় থেকে রাজা দাহির নির্দেশ পাঠিয়েছিল, ডাভেল অবরোধে শত্রু বাহিনী যদি বিজয়ী হয়ে যায়, তাহলে মুসলমান সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করার আগেই আরব বন্দীদের হত্যা করে ফেলবে। রাজার সেই নির্দেশ প্রয়োগের সময় আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু আমি রাজার হুকুম বাস্তবায়ন করিনি।”

তুমি ইচ্ছা করলেও তা পারতেন। জেলখানার সকল প্রহরীইতো পালিয়ে গিয়েছে। রাজা দাহিরের শাসনতো তখন খতম হয়ে গিয়েছিল, তবুও তুমি বন্দীদের মুক্ত করে দিলেনা কেন? জানতে চাইলেন বিন কাসিম।

তাদের আমি মুক্ত করে দিলে সবাই জানতো এই বন্দীদের মুক্ত করার জন্যই এসেছে আরব সৈন্য। ডাভেল মন্দিরের ওপর পাথর নিক্ষেপ ও মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পড়তে দেখেই ওরা প্রতিহিংসার আক্রোশে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। অবস্থা আন্দাজ করে আমি পাতাল বন্দিশালার প্রধান গেট বন্ধ করে দিয়েছিলাম এবং জেলখানার সকল প্রহরী পালিয়ে যাওয়ার পরও আমিই শুধু এখানে অপেক্ষা করছিলাম। আমি মনে মনে প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, নিরপরাধ এই বন্দীদেরকে মুসলিম বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে আমি এখান থেকে যাবো। আমি নিজের প্রতীজ্ঞা পূরণ করার পর এখান থেকে বের হয়েছি, জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে যাইনি।”

“এদের প্রতি তোমার এতোটা দয়া দেখানোর কারণ কি?” জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।

“এদের কোন অপরাধ ছিলনা। নিরপরাধ লোকগুলোকে বন্দি করে রাখার কারণে আমি এদের প্রতি দয়ার্দ্র হয়েছি। এই অপরাধে যদি আপনি আমাকে হত্যা করতে চান তাহলে তাদের কারো হাতে তরবারী দিয়ে বলুন, তাদের কেউ আমাকে হত্যা করে ফেলুক।” আরব বন্দিরা আগেই বিন কাসিমকে বলেছিল, দারোগা কুবলা তাদের প্রতি কোন অত্যাচার করেনি, বরং সদাচরণ করেছে। বিন কাসিম দারোগার উদ্দেশে বললেন, “তোমার মতো মানুষের ইসলাম গ্রহণ করা উচিত। তোমার এই মহানুভবতার মর্যাদা একমাত্র ইসলামই দিতে পারে। আমি তোমাকে বাধ্য করবো না, তোমাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি মাত্র। ইসলাম গ্রহণ করলে তুমিই বুঝতে পারবে কেন আমি তোমাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিচ্ছি।”

বিন কাসিমের মূল্যায়ণ ও সদাচরণে মুগ্ধ হয়ে দারোগা কুবলা ইসলাম গ্রহণ করল। দারোগা কুবলা ডাভেলের অধিবাসী ছিল না। সে ছিল তৎকালীন হিন্দুস্তানের দাহির শাসিত রাজ্যের একজন জ্ঞানী বিদ্বান ব্যক্তি। বিন কাসিম হুমাইদ নজদীকে ডাভেলের শাসক নিযুক্ত করে তার অধীনে দারোগাকে জেলখানার দারোগা পদে বহাল রেখেছিলেন এবং কুবলাকে হুমাইদের উপদেষ্টার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন।

কুবলাকে দারোগা পদে বহাল করে বিন কাসিম তার কাছে জানতে চান, আরব বন্দীদের মতো আরো কোন নিরপরাধ লোক কি বন্দিশালায় আছে?

“যে দেশের শাসক সত্য শুনতে পছন্দ করে না, সে দেশের কারাগারগুলো সত্যনিষ্ঠদের আবাসস্থলে পরিণত হয়। এই কারাগারে এদের মতো নিরপরাধ বহু বন্দি রয়েছে।” বলল কুবলা।

“কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয় কয়েদখানায় যারা রয়েছে এদের ব্যাপারে তুমিই ফয়সালা করবে।” বললেন বিন কাসিম। যারা নিরপরাধ তাদের ছেড়ে দেবে, আর অপরাধের তুলনায় যারা বেশী শাস্তি ভোগ করেছে তাদেরও মুক্ত করে দেবে। এখন থেকে সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিধান মতো ইনসাফ করা হবে। কারো প্রতি জুলুম করা চলবেনা।” বিন কাসিম মুক্তিপ্রাপ্ত আরব বন্দীদের সাথে অনেকক্ষণ কথা বললেন। পরিশেষে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন, যতো শীঘ্র সম্ভব তাদেরকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক।

বিন কাসিম মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের উদ্দেশে বললেন, যে বন্দিশালা থেকে কোন দিন কোন বন্দির জীবিত বের হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, সেই কঠিন বন্দিদশা থেকে তোমরা মুক্তি পেয়েছ, শুধু এজন্যই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করোনা। এজন্যও আল্লাহর শোকর আদায় করা দরকার, তোমরা এখানে বন্দি না।

হলে আমাকে এখানে পাঠানো হতোনা। যেহেতু আমাকে এখানে আসতে হয়েছে, এজন্য আমার ওপর কর্তব্য হয়ে গেছে এই কুফরিস্তানের প্রতিটি জনপদে ইসলামের আলো পৌছে দেয়ার। তোমাদের বন্দিত্ব শুধু আমার জন্যই নয় হিন্দুস্তানে ইসলাম প্রচারের একটা কার্যকর পথ তৈরী করে দিয়েছে। হিন্দুস্তানে ইসলামের আগমনের ইতিহাস যখন লিখা হবে তখন ইসলামের আগমনের আগে তোমাদের বন্দিত্বের কথা উল্লেখ করা হবে। সিন্ধু বিজয়ের ইতিহাসের পাশাপাশি তোমাদের বন্দিজীবনের কষ্ট দুর্ভোগের কথাও সগর্বে উল্লেখ করা হবে। তোমরা যে কষ্ট অত্যাচার সহ্য করেছ, আল্লাহ এর প্রতিদান

দেবেন। দোয়া করো, আমি যে সংকল্প নিয়ে এসেছি তা যাতে সফল করতে পারি। তোমাদের মুক্ত করার মধ্যেই আমার মিশন শেষ হয়ে যায়নি, আমার মূলকাজ শুরু হয়েছে মাত্র। অতঃপর বন্দিরা দেশের পথে রওয়ানা হলো। ডাভেলের পৌত্তলিক শাসক দুর্গ পতনের সাথে সাথেই সুযোগ মতো পালিয়ে গেল। দুর্গের ভিতরের প্রতিটি বাড়ি তল্লাশী করেও তাকে পাওয়া গেল না। ডাভেল থেকে পালিয়ে দুর্গশাসক নিরূন আশ্রয় নিলো। কারণ নিরূন ছাড়া তার পক্ষে রাজধানীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। রাজধানী উরু গেলে রাজা দাহির পরাজয় ও সৈন্যদের ফেলে পালিয়ে আসার জন্য তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো। তাই নিরূন শাসক শান্তিকামী সুন্দরীর কাছেই। আশ্রয়প্রার্থী হলো সে। রাজা দাহিরের কাছে যখন খবর পৌছলো, ডাভেল দুর্গের পতন ঘটেছে, মুসলমান বাহিনী দুর্গ দখল করে নিয়েছে, তখন রাগে ক্ষোভে আগুন হয়ে গেল দাহির। কেউ তখন রাজার মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু তার বুদ্ধিমান উজির সাহস করে রাজার একান্ত কক্ষে প্রবেশ করল।

কিসের জন্য এখানে এসেছ? সিংহের মতো গর্জে ওঠলো রাজা। তোমার এতো বুদ্ধি চাতুরী কোথায় গেল উজির? মহারাজ! আমাদের সৈন্যরা দু’বার আরব বাহিনীকে পরাজিত করেছে। এর ফলে তারা মনে করেছিল আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের সৈন্যরা ছিল বিজয়ের নেশায় উত্ত, এজন্য মুসলিম সেনাদের সতর্ক ও কৌশলী আক্রমণ এরা প্রতিরোধ করতে পারেনি।

“আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, ওরা নাকি আগে ডাভেলের মন্দির চূড়া ধ্বংস করে পতাকা ভূলুষ্ঠিত করেছে” বলল রাজা।

আপনাকে ঠিকই বলা হয়েছে মহারাজ। শত্রুবাহিনী আগে মন্দির চূড়া ভাঙ্গার জন্য পাথর নিক্ষেপ করেছে। মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পড়ার কারণে পতাকা দণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। আমাদের ভাগ্য ডাভেল পতাকা দরে সাথেই যুক্ত ছিল। পতাকা দণ্ড ভেঙ্গে পড়ার কারণে আমাদের সৈন্য সংখ্যা আরো চার গুণ বেশী হলেও পরাজিত হতে হতো। মহারাজ! মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পড়ার বিষয়টি মুখ্য নয়, আসল বিষয় হচ্ছে, আপনার রাজভাগ্য। বলল বুদ্ধিমান। মুসলিম বাহিনী যদি এভাবে একের পর এক দুর্গ জয় করতে থাকে তাহলে আপনার রাজধানী এবং শাসন ক্ষমতাও

সংকীর্ণ হয়ে আসবে। আপনি সব সময় আমাকে বিশ্বাস করেছেন এবং সতর্ক বুদ্ধিমান মনে করেছেন। আমার ওপর যদি এখনো আপনার আস্থা ও বিশ্বাস অটুট থেকে থাকে তাহলে আমি কিছু কথা বলতে চাই, আশা করি আপনি তাতে ক্ষুব্ধ হবেন না। “ঠিক আছে আমি রাগ করবনা। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে উজির। ডাভেল শত্রুরা কব্জা করে নিয়েছে। মনে করো শত্রুদের হাত আমার গলা পর্যন্ত এসে গেছে।

“আমরা এজন্য পরাজিত হচ্ছি মহারাজ, আমরা আমাদের ভাগ্যকে কিছু মাটির তৈরী পুতুলের সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলেছি। একটি পতাকা দণ্ড ভেঙ্গে পড়েছে তো কি হয়েছে? এটিতো একটুকরো কাপড় আর একপ্রস্ত বাঁশ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। অথচ মন্দিরের পুরোহিতেরা আমাদের সমাজে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, এই পতাকাদণ্ড দেবতারা নিজ হাতে ধরে রেখেছে। তারা মানুষকে বুঝিয়েছে, এই পতাকা দণ্ড ভেঙ্গে পড়লে মনে করবে তোমরাও ভেঙ্গে পড়েছ, দেবতাদের অভিশাপে পতিত হচ্ছো তোমরা। অথচ আমাদের প্রজা ও সৈন্যদের যদি বোঝানো হতো এই পতাকা আমাদের মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। এই পতাকা পর্যন্ত যেনো শত্রুরা কখনো আসতে না পারে। এভাবে লোকজনকে বোঝাতে পারলে পতাকার মান রক্ষার জন্য এরা জীবন বিলিয়ে দিতো।”

“জীবন দিতে তারা কসুর করেনি। মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পরার পর তখনকার সকল সৈন্য ও প্রজারা দুর্গফটক খুলে শত্রুবাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল।”

সে কথা আমি জানি মহারাজ! ডাভেল থেকে আসা লোকের কাছ থেকে আমি সব খবর নিয়েছি। আমাদের সৈন্য ও ডাভেলের অধিবাসীরা মুসলিম সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল, কিন্তু সেটি আক্রমণ ছিলনা মহারাজ। সেটিকে আত্মহত্যাই বলা উচিৎ। কারণ তারা সেই বিশ্বাস থেকেই শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল, পতাকা যেহেতু ভেঙ্গে পড়েছে, এখন আর শত্রুদের ঠেকানো যাবে না, তাই শত্রুদের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে এবং মৃত্যু বরণ করো।”

“হ্যাঁ, ওরা মৃত্যুইতো বরণ করেছে। কিন্তু এই গণহত্যার জন্য আমি ডাভেলের শাসক ও সেনাপতিদের জীবিত থাকতে দেবোনা। জানিনা ওরা এখন কোথায় আছে?

“এ ধরনের ভুল মহারাজের করা উচিৎ হবেনা” বলল বুদ্ধিমান। তাদের জীবিত থাকতে দিন তবে তাদেরকে তিরস্কার করুন। তাহলে দেখবেন ভবিষ্যত যুদ্ধে এই অপমানের কালিমা দূর করার জন্য এরা জীবন বিলিয়ে দেবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে মহারাজ! তাদের মধ্যে যদি এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গিয়ে থাকে যে, পতাকা দণ্ড ভেঙ্গে পড়ার কারণে তাদের ওপর দেবতাদের অভিশাপ পড়েছে, তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরা পরাজিত হতে থাকবে।”

“তাহলে আমি কি ওদের বলবো যে, তোমরা ধর্মান্তরিত হয়ে যাও।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল রাজা দাহির। আমি কি ওদের বলবো, মুসলমানদের ধর্ম সত্য, তাই তারা আমাদের পতাকা ভূলুণ্ঠিত করেছে। সত্য ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণেই তারা আমাদের দেবদেবীদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে?…বুদ্ধিমান! তুমি জ্ঞানী লোক। জ্ঞান-বুদ্ধি আমার চেয়ে তোমার বেশী হতে পারে কিন্তু জেনে রেখো, সিন্ধুতে আমি কখনো ইসলাম প্রবেশ করতে দেবো না।”

“আসতে আর না দেবেন কিভাবে, ইসলাম তো সিন্ধুতে এদের আগেই এসে গেছে মহারাজ! মহারাজ নিজেইতো ইসলামকে নিজের আঁচলে ঠাই দিয়ে রেখেছেন। যেসব আরবকে মহারাজ পরম আদর যত্নে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন, ওরা আমাদের হিতাকাঙ্খী নয় নিজ ধর্মের লোকদেরই হিতাকাক্ষী। তাই যদি না হবে তাহলে কে মুসলিম সেনাপতিকে বলল, মন্দিরের পতাকা ভেঙ্গে ফেলল, তাহলেই ডাভেলবাসীর পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাবে? কারণ শহরের দরজা বন্ধ ছিল। দুর্গের ভিতর থেকে কেউ বাইরে যায়নি, আরব সৈন্যদের পক্ষে এই রহস্য জানার কথা নয় যে, মন্দির চূড়ার পতাকা ফেলে দিলেই হিন্দুদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। এই রহস্য মাকরানে আশ্রিতরাই তাদের জানিয়েছে।

“ওদের বিরুদ্ধে এখন আমি কি ব্যবস্থা নিতে পারি?”

“কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয় মহারাজ! এখন ওদেরকে আপনার আরো কাছে টেনে নিতে হবে। ওদের সাথে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে জেনে নিতে হবে, মিনজানিক তৈরীর ফর্মুলা। তাদের মধ্যেও মিনজানিক তৈরী করার মত কারিগর থাকতে পারে। এ মুহূর্তে যদি আমরা দু’চার দশটি মিনজানিক তৈরী করে নিতে পারি, তাহলে মুসলিম সৈন্যদের ওপর রাতের অন্ধকারেও আমরা পাথর ও আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে পারবো। মুসলিম বাহিনী জায়গা

দখল করতে চাইলেও আমরা ওদের নতুন শিবির স্থাপনে বাধা দিতে পারবো।”

“এই তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে দাও। মাকরাণী মুসলমানদের মধ্যে যদি মিনজানিক তৈরীর কারিগর না থাকে তবে তাদের মধ্যে বিশ্বস্ত কাউকে মুসলিম সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে মিনজানিক তৈরীর কৌশল শিখে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করো। তুমি ওর মাধ্যমে জানতে চেষ্টা করো, মিনজানিকের গঠনটা কেমন এবং কি কাঠ দিয়ে তৈরী হয়। মিনজানিক তৈরীর কাজ শিখে আমাদের জানালে আমি তাকে এমন উপঢৌকন দেবো যে সাতপুরুষ খেয়েও শেষ করতে পারবে না।” ডাভেল দুর্গের পতন ছিল রাজা দাহিরের জন্য অশনি সংকেত। রাজা দাহির উজিরের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল কোন আনাড়ী লোক ছিলনা। দাহির নিজেও ছিল খুব ধূর্ত, চতুর চালবাজ। উজিরকে সে বাজিয়ে দেখতো। অবশ্য একথাও ঠিক উজির বুদ্ধিমান ছিল যথার্থই একজন বাস্তববাদী মানুষ। কিন্তু রাজা দাহির যেমন ছিল আত্মগর্বে বিভোর তেমনই অহংকারী ও অত্যাচারী। হিন্দু ধর্মের একনিষ্ঠ পূজারী ছিল দাহির। নিজ ধর্ম ও নিজের শাসন কাজে কারো নাক গলানোকে মোটেই সহ্য করতে পারত না। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলে যে কাউকে ধ্বংস না করে ক্ষান্ত হতে চাইত না এই ক্ষমতা লিপ্সু রাজা। রাজা দাহিরের চাল ছিল খুবই জটিল। কখন কার ওপর সে খড়গ চালাবে কারো পক্ষে বলা সম্ভব হতো না। তার মুচকি হাসি, তিরস্কার ও বকা চাউনির মধ্যে লুকিয়ে থাকতো অপার রহস্য। যার ফলে উজির, সেনাপতি শীর্ষ আমলা সবাই রাজাকে জমদূতের মতো ভয় করত। কোন পরাজিত সেনাপতিকে ক্ষমা করতো না দাহির।

উজির বুদ্ধিমানকে বিদায় করে দিয়ে প্রহরীকে কক্ষের দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলো রাজা। একাকী বসে গেল চিন্তা ভাবনায়। তার রাজন্যবর্গ মন্ত্রী উজিরগণ খাস কামরার বাইরে মহা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় অপেক্ষমাণ। তারা একে অন্যের দিকে তাকানোরও যেনো সাহস পাচ্ছে না। তারা শঙ্কিত রাজা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে, জানা নেই কখন কার ওপর এই আগুনের লাভা উদগীরণ করে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে ফেলবে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর রাজার খাস কামরার দরজা খোলার নির্দেশ শোনা গেল। দরজা খুলতেই রাজা নির্দেশ দিলো-জয়সেনাকে জলদি ডেকে পাঠানো হোক।

জয়সেনা ছিল রাজার অপর এক স্ত্রীর সন্তান। বহু পত্নী উপপত্নী ছিল রাজা দাহিরের। অবশেষে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য নিজ বোন মায়ারাণীকেও বিয়ে করে কিন্তু তার সাথে কোন দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেনি। জয়সেনা ছিল দাহিরের সেনাবাহিনীর সিন্ধু ইউনিটের সেনাপতি। দাহির যখন জয়সেনাকে ডেকে পাঠালো তখন সে সিন্ধু অঞ্চলের নিরূনের একটি ময়দানে অবস্থান করছিল। রাজার নির্দেশে জয়সেনার উদ্দেশে তখনি রওয়ানা হয়ে গেল দৃত।

মাঝ রাতের পর রাজধানীতে পৌছলে জয়সেনা। রাজা দাহির জয়সেনার অপেক্ষায় জেগে ছিল। সে ছেলেকে কোন বিশ্রামের অবকাশ না দিয়েই তার কক্ষে ডাকলো। কক্ষে এলে পরম মমতায় নিজের কাছে বসিয়ে বলল, “প্রিয় বৎস! আমাদের মাথার উপর কেমন বিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে তা কি তুমি আন্দাজ করতে পারছ?” “আমি পুরোপুরি জ্ঞাত মহারাজ। আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি। এখনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আপনাকে ভাবনার মধ্যে দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। আমি এক্ষনই ডাভেল আক্রমণের কথা ভাবছি মহারাজ।

“শোন। যুবক আর প্রবীণের মধ্যে এইতো পার্থক্য। যুবকরা করে ভাবে আর প্রবীণরা ভেবে চিন্তে কাজ করে। তোমার জানা আছে, নিরূনও আমাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ঘটনাটা বিষের বড়ির মতো আমার গলায় আটকে গেছে।”

বাবা মহারাজ! আপনার কি জানা নেই, আরব সেনাপতি আমার চেয়েও কমবয়সী। আমার বয়স কম, আমি তরুণ এজন্য আমাকে বোকা মনে করবেন না মহারাজ!

তোমাকে আমি বোকা মনে করছিনা। তাছাড়া তোমার আর মুসলিম সেনাপতির মধ্যে আমি তুলনাও করছিনা। বর্তমান পরিস্থিতিটা আমি তোমাকে বুঝাতে চাচ্ছি। আমি যা বলতে চাই তা বুঝতে চেষ্টা করো, সেই সাথে এটাও অনুধাবন করতে চেষ্টা করো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যুদ্ধটা এখন আর দুজন শাসক আর দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যুদ্ধ এখন দুটি ধর্মের সংঘাতে রূপ নিয়েছে। মুসলমানরা ডাভেল মন্দির চূড়ার পতাকা ভূপাতিত করে আমাদের দেবী ও ধর্মকে মিথ্যা করেছে। এখন আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে দেবদেবীদের অসম্মাণকারীরা তাদের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে পারে না। এ বিষয়টাও মাথায় রেখো।

মুসলমানদের যদি রোধ করতে না পারি তাহলে আমাদের বংশের নামে এই বদনাম ইতিহাস হয়ে থাকবে যে, আমরাই হিন্দুস্তানে মুসলমানদের আগমনের পথ খুলে দিয়েছি। যাক বেশী দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার সময় নেই। আরমান ভিলা ও ডাভেল হাতছাড়া হওয়াটা খুব মারাত্মক কিছু ছিলনা, কিন্তু রণকৌশলের দিক থেকে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শত্রুবাহিনী এখন দু’টি মজবুত দুর্গ কব্জা করে নিয়েছে। ডাভেল সিন্ধু অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বন্দর। শত্রুরা এখন অনায়াসে সমুদ্র পথে সব ধরনের সামরিক সরঞ্জাম আমদানী করতে পারবে। এদিকে নিরূন শাসক সুন্দরী যুদ্ধের আগেই শত্রুদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করেছে।” “পিতৃ মহারাজ! আমার সেনাবাহিনীকে নিরূনে চড়াও করে দিয়ে সুন্দরীকে ঘরে নজরবন্দি করে আমরা নিরূনকে কব্জায় রাখতে পারি।”

“না, তাতে নিরূনের লোকেরা তোমাদের বৈরী হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে যে, তোমাদের সেনাভিযানের কারণে নিরূনবাসী তোমাদের মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হবে। তুমি কি জানো না, উজির বুদ্ধিমান সুন্দরীর শাসনের বিরুদ্ধে ওখানকার মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য যাদু টোনার আশ্রয় নিয়েছিল, কিন্তু সে ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার মূলে ছিল আরব বাহিনী। হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুন্দরী ওদের এনেছিল, নয়তো ওরাই এগিয়ে এসেছিল। এ থেকেই প্রমাণিত হয়েছে, আরবদের সাথে সুন্দরী তলে তলে মৈত্রী গড়ে তুলেছে।

“পিতৃ মহারাজ! আপনি আমাকে অনুমতি দিলে আমি অকৃতজ্ঞ বৌদ্ধটাকে চিরদিনের জন্য গায়েব করে দিতে পারি।” বলল জয়সেনা। না, তাও করা যাবেনা। এ ধরনের কিছু করতে চাইলে অনেক আগেই আমি তা করতে পারতাম। কিন্তু এ মুহূর্তে এ ধরনের কোন কাজ করা ঠিক হবেনা। কারণ শত্রুদের গোয়েন্দা এখন আমাদের প্রতিটি মহল্লায় রয়েছে, আমাদের দুটি দুর্গ শত্রুদের দখলে চলে গেছে, এ মুহূর্তে ওই বৌদ্ধটাকে গায়েব করে দিলে নিরূনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিদ্রোহ করতে পারে। আর সেই বিদ্রোহে শত্রু বাহিনীই লাভবান হবে। আমি ভাবছি, ডাভেল থেকে যখন মুসলিম বাহিনী আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য রওয়ানা হবে, তখন নানা ছলাকলায় সুন্দরীকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আমার মনে হয় ডাভেল ত্যাগ করে শত্রু বাহিনী নিরূনের দিকেই অগ্রসর হবে। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তোমার সৈন্যদের নিয়ে ব্রাক্ষ্মণাবাদ চলে যাও। নদী পেরিয়ে তোমাদের

ওপারে চলে যেতে হবে। যাতে নদী তোমাদের পিছনে থাকে। এতে সুবিধা এই হবে যে, শত্রু বাহিনী তোমাদের অজ্ঞাতে পিছন থেকে আক্রমণ করতে পারবে না। নিরূনে আমাদের যে সেনাধ্যক্ষ আছে তার সাথে গোপনে সাক্ষাত করবে। তাকে বুঝাবে সে যেন কিছুতেই নিরূন হাতছাড়া হতে না দেয়।

“ওখানকার লোকেরা যদি আমাদের বাহিনীর জন্যেই কোন অসুবিধা সৃষ্টি করে তাহলে কি করতে হবে?”

“পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। যদি আমার কাছে সংবাদ পাঠানো সম্ভব হয়, তাহলে আমাকে দ্রুত বিষয়টি জানাবে। তাতে আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সময়ক্ষেপনের চেষ্টা করব। . আমি শত্রুবাহিনীর সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে চিঠি লিখছি। তাতে আমি ওকে আতঙ্কিত করার চেষ্টা করছি। আমি জানি দেশ ছেড়ে যে এতো দূর পর্যন্ত এসে আক্রমণ করার সাহস রাখে তাকে কোন কথায় ভয় দেখানো যাবে না, তবুও এতে আমি হাতে কিছুটা সময় পাবো আমার সেনাদের এই ফাকে সুবিধা মতো জায়গায় স্থানান্তরিত করে নেবো।” বলল রাজা দাহির। জয়সেনা কোন বিশ্রাম না করে সেই বৈঠক থেকে উঠেই তার সেনা শিবিরের দিকে রওয়ানা করল।

ডাভেল দুর্গে আটকে যাওয়া হিন্দু সৈন্যদের বন্দি করা হলো। যেসব হিন্দু সৈন্য সশস্ত্র মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হয়েছিল ওদের অধিকাংশই মারা পড়ল। ডাভেলের সক্ষম নাগরিকদের মধ্যেও অধিকাংশ মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পড়ার পর মুসলিম সৈন্যদের বিরুদ্ধে আক্রমণে যোগ দিয়েছিল, ফলে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক লোকও মারা যায়। দুর্গ জয়ের পর বিন কাসিম বেসামরিক লোকদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ফলে প্রাণ ভয়ে যেসব হিন্দু অধিবাসী দুর্গের বাইরে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল তারাও দুর্গে ফিরে এলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম যুদ্ধলব্ধ পণ্যসামগ্রী ও ধন-সম্পদ সৈন্যদের মধ্যে ভাগ-বণ্টন করে দিলেন, আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অংশ এবং বন্দীদেরকে জাহাজে তুলে ইরাক পাঠিয়ে দিলেন। আর হামিদ-বিন বিদায় নজদীকে ডাভেলের প্রশাসক নিযুক্ত করলেন। ডাভেলকে একটি মুসলিম অধ্যুষিত শহরে পরিণত করার জন্য বিন কাসিম শহরের মাঝখানে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিলেন এবং নিজ হাতে বিন কাসিম মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন।

বর্তমানে বিন কাসিমের নির্মিত সেই মসজিদ যেমন দেখা যায় না, ডাভেল দুর্গও অবশিষ্ট নেই। সেই দুর্গের ভগ্নাবশেষও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাসে ডাভেল দুর্গ ও বিন কাসিমের অভিযান অক্ষয় অম্লান হয়ে আছে। সম্ভবতঃ হিন্দুস্তানের বুকে সেটিই ছিল প্রথম মসজিদ।

কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সদাচরণে দুর্গের হিন্দু অধিবাসীরা এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, তারা শ্রদ্ধাভক্তির আতিশয্যে বিন কাসিমের মূর্তি তৈরী করে তাকেই পূজা করতে শুরু করে দিয়েছিল। অবশ্য একথাটির পক্ষে মজবুত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে একথা ঠিক যে অধিবাসীরা ছিল মুসলিম শাসনে প্রীত ও মুগ্ধ।

বিন কাসিমকে আরো সামনে অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা তাড়া করছিল, কিন্তু শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় না করে তার পক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ তিনি শুধু দেশ জয় করা ও ধনরত্ন কব্জা করার জন্য হিন্দুস্তানে অভিযান করেন নি। তার সামনে ছিল সুনির্দিষ্ট মিশন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম খালিদ বিন ওয়ালীদের মতোই জোরদার গোয়েন্দা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এ লক্ষ্যেই তিনি বিখ্যাত গোয়েন্দা বিশেষত্ব শা’বান ছাকাফীকে তার গোয়েন্দা প্রধান হিসাবে সাথে নিয়ে এসেছিলেন। সৈন্য সামন্ত নিয়ে তিনি ডাভেল দুর্গে অবস্থান করলেও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তিনি উরুঢ় ও নিরূনকেও তাঁর নখদর্পনের আওতায় নিয়েছিলেন।

হঠাৎ একদিন ডাভেল দুর্গের প্রধান ফটকের বাইরে আটজন শাহী অশ্বারোহী এসে থামল। তারা ফটকের প্রহরীদের জানালে তারা রাজা দাহিরের পক্ষ থেকে বিন কাসিমের জন্য জরুরী পয়গাম নিয়ে এসেছে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমকে পয়গামবাহীদের খবর দেয়া হলো।

“গেট খুলে ওদের ভিতরে নিয়ে এসো এবং ওদের দূতকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, আর সৈন্যদের সরকারী মেহমানের মর্যাদায় আপ্যায়ন করো।” নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। রাজা দাহিরের দূত বিন কাসিমের সামনে গিয়ে মাথা ঝুকিয়ে কুর্ণিশ করে নাটকীয় ভঙ্গিতে তাঁর বক্তব্য বলতে শুরু করলে, বিন কাসিমের দুভাষী তাঁর ভাষান্তরিত করে আরবীতে বলতে শুরু করল। বিন কাসিম দুভাষীকে বললেন, “ওকে বলল, এখানে উপস্থিতিই যথেষ্ট, আমরা মানুষের সামনে কোন মানুষকে মাথা ঝুকিয়ে কুর্ণিশ করা পছন্দ করিনা, আমাদের ধর্মও তা

অনুমোদন করে না। তুমি ওর কাছ থেকে পয়গাম নিয়ে নাও, আর ওকে কক্ষের বাইরে অন্য কক্ষে বসিয়ে দাও।” রাজা দাহিরের দূত প্রথম কোন আরব সেনাপতিকে দেখেছিল। সে বিন কাসিমের কথাবার্তা ও তার নীতিবোধ দেখে বিস্মিত হলো। আরো অবাক হলো এতো অল্প বয়সী এই তরুণ একজন গর্বিত বিজয়ী সেনাপতি। তদুপরি তার আখলাক, ভাবভঙ্গি কত মার্জিত। দূত পয়গাম বিন কাসিমের হাতে দিয়ে পুনরায় অভ্যাস বশতঃ তাকে কুর্ণিশ করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। দূত বেরিয়ে গেলে বিন কাসিম পয়গাম খুলে দেখলেন দাহির স্থানীয় ভাষায় পয়গাম লিখেছে। তিনি পয়গামটি দুভাষীর দিকে এগিয়ে দিলেন। দুভাষী পয়গাম পড়তে শুরু করল। ইতিহাস সেই পয়গামটি হুবহু সংরক্ষণ করেছে। রাজা দাহিরের পয়গামের বক্তব্য ছিল—

“এ পয়গাম রাজা চন্দ এর পুত্র দাহিরের পক্ষ থেকে যিনি সিন্ধু অঞ্চলের বাদশা আর হিন্দুস্তানের একজন রাজা। এটি সেই মহান রাজার পয়গাম সাগর, নদী পাহাড় জঙ্গল সর্বত্র যার নির্দেশে প্রতিপালিত হয়। আরবের এক অখ্যাত অল্প বয়স্ক অনভিজ্ঞ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতি এ পয়গাম লিখা হচ্ছে, যে নরহত্যায় অত্যন্ত নির্মম আর যুদ্ধলব্ধ মালে গণীমতের লিপ্সু। যে অনভিজ্ঞ সেনাপতি তার সৈন্যদেরকে ধ্বংস আর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার মতো বোকামীতে লিপ্ত।

হে অনভিজ্ঞ বালক, তোমার আগে আরো দু’জন সেনাপতি এমন অবাস্তব মানসিকতা নিয়ে এসেছিল যে, তারা সিন্ধুসহ গোটা হিন্দুস্তান জয় করে ফেলবে। তুমি কি ওদের করুণ পরিণতির কথা শোননি বা জানোনা? এই ডাভেল শহরের অধিবাসীরাই তাদেরকে এভাবে নাজেহাল করেছিল যে, তারা জীবন নিয়ে পালানোর অবকাশও পায়নি। ওরা আমাদের দুর্গ জয় করবে তো দূরে থাক, দুর্গপ্রাচীরের ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। কিন্তু তুমিও সেই অবাস্তব কল্পনা নিয়েই এসেছ। ডাভেল দুর্গজয় করে তুমি মনে হয় খুবই আত্মশ্লাঘা অনুভব করছ, কিন্তু আমি তোমাকে সতর্ক করে বলছি, ডাভেল বিজয়ের ফলে তোমার গর্ব করার কিছু নেই। কারণ এটি আমার বিশাল রাজত্বের ছোট একটি দুর্গ মাত্র। যেখানে কিছু ব্যবসায়ী, বণিক ও দোকানী বসবাস করে। এরা লড়াই করতে জানেনা। কখনো তাদের লড়াই করার প্রয়োজন পড়েনি। এদের ওপরে তোমরা কিছু পাথর নিক্ষেপ করাতেই ওরা ভয় পেয়ে পরাজয় মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া ডাভেল দুর্গে আমাদের

উল্লেখযোগ্য কোন সৈন্যও ছিলনা। এটাকে তুমি বড় বিজয় কিংবা আমাদের পরাজয় মনে করার মতো বিষয় নয়।

আমাদের অভিজ্ঞ সেনাধ্যক্ষদের একজনও যদি সেখানে থাকতো, তাহলে তোমাদের পরিণতিও আগের দুই সেনাপতির মতোই হতো।

তোমার তারুণ্যের প্রতি আমার মায়া হচ্ছে। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আর একপাও সামনে অগ্রসর হবে না। যতটুকু অগ্রসর হয়েছে সেখান থেকেই দেশে ফিরে যাও। আরো সামনে অগ্রসর হলে আমার ছেলে জয়সেনার মুখোমুখি হতে হবে তোমার। তুমি জানোনা, বড় বড় পরাক্রমশালী রাজা বাদশারাও তার ক্ষোভ থেকে বাঁচতে চেষ্টা করে। হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজারা পর্যন্ত তাকে ভক্তি করে। আমার ছেলে জয়সেনা সিন্ধু, মাকরান ও তুরানের শাসক। তার কাছে একশ জঙ্গি হাতি রয়েছে, যেগুলো যুদ্ধ ক্ষেত্রে উম্মাদের মতো যুদ্ধ করে এবং শত্রু বাহিনীকে পায়ের তলায় পিষে ফেলে। জয়সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে একটি সাদা হাতিতে আরোহণ করে, সে হাতি পর্যন্ত কোন অশ্বারোহী কিংবা বর্শাধারী সৈন্য যেতে পারেনা। সামান্য একটু বিজয়ে তুমি এতোটাই গর্বিত হয়ে গেছ যে, তোমার বিবেকের ওপর পর্দা পড়ে গেছে। আমার হুঁশিয়ারি লঙ্ঘন করলে তোমাকেও সেনাপতি বুদাইলের পরিণতি বরণ করতে হবে।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম পয়গামের বক্তব্য শুনে মুচকি হাসলেন। তিনি সকল সেনাধ্যক্ষ, ডেপুটি সেনাধ্যক্ষ ও ডাভেলের শাসক হুমাইদ বিন বিদায়কে ডেকে পাঠালেন। তারা এলে দুভাষীকে তাদের সামনে দাহিরের পয়গাম পড়ে শোনানোর নির্দেশ দিলেন। দুভাষী আবারো পয়গাম সবার সামনে পড়ে শোনালে সবাই হাসতে লাগলেন।

“রাজা আমাকে অহংকারী মনে করেছে।” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বিন কাসিম। অথচ সে নিজে কি একটা নির্বোধ ও পাষণ্ড নয়।…যাক, আমি এখন এর জবাবে যা লিখতে চাচ্ছি তা আপনারা সবাই শুনুন এবং মন্তব্য করুন।

বিন কাসিম রাজা দাহিরের পয়গামের জবাবে কি লিখবেন তা জানালেন। শুনে সবাই বলল, এমন একজন অহংকারীর পত্রের জবাব এতোটা ভদ্রোচিত ভাষায় দেয়া উচিত হবেনা। অবশেষে সবার পরামর্শের ভিত্তিতে একটি জবাবী পয়গাম রচিত হলো। বিন কাসিম দাহিরকে যে পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন, ইতিহাস সেটাকেও সংরক্ষণ করেছে।

“এ পয়গাম সেই মুহাম্মদ বিন কাসিম ছাকাফীর পক্ষ থেকে লিখা হচ্ছে, যিনি অহংকারী রাজা মহারাজা ও বাদশাদের মাথা নীচু করার সামর্থ রাখেন। আর যিনি যে কোন মুসলমানের রক্তের প্রতিশোধ নিতে সিদ্ধহস্ত। এই পয়গাম লিখা হচ্ছে, সেই অহংকারী, উন্মাদ দাহিরের কাছে যে একজন নির্বোধ, বেঈমান, চরিত্রহীন ও আপন বোনকে বিবাহকারী। যার এতটুকু বোধ নেই যে, পরিস্থিতি বদলাতে বেশী সময়ের প্রয়োজন হয় না এবং পরিস্থিতি অহংকারী ও আত্মম্ভরিতাকারীদের গর্বকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়। হে আহমক! তুমি উন্মাদের মতো মুখতা বশতঃ যা লিখেছ তা আমি পড়েছি। তাতে তো গর্ব অহংকার আর নীচুতা ছাড়া কিছু নেই। তোমার পয়গাম পড়ে আমি জানতে পারলাম, তোমার কাছে জঙ্গি হাতি, যাদু, অস্ত্র শস্ত্র ও সামরিক শক্তি রয়েছে। বুঝতে পেরেছি, এসব জিনিসের ওপর নির্ভর করেই তুমি গর্ব করছ। জেনে রেখো, আমার কাছে এতো শক্তি নেই কিন্তু আল্লাহর দয়া আর মেহেরবাণীই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। হে কাপুরুষ! হাতি ঘোড়া আর সৈন্যবাহিনী নিয়ে কেন গর্ব করো। হাতিতো একটা মানুষের চেয়েও অক্ষম প্রাণী।

যে নিজের শরীর থেকে একটা মাছিও তাড়াতে পারেনা। আমার যেসব সৈন্যকে তোমার দেশে অভিযান চালাতে দেখে তুমি বিস্মিত হচ্ছে, এরা সবাই আল্লাহর সৈনিক। আল্লাহ এদের ভাগ্যেই বিজয় লিখে রেখেছেন। দেখবে এরাই বিজয়ী হবে কারণ এরা যে আল্লাহর প্রিয়। শুনে রাখো, আমরা তোমার দেশে কখনো অভিযান চালাতাম না কিন্তু তোমার দুশ্চরিত্র, শত্রুতা আর মাত্রাতিরিক্ত অহংকার আমাদেরকে তোমার দেশে অভিযান চালাতে বাধ্য করেছে। সন্দিপ থেকে আরবগামী আমাদের মুসাফিরদের জাহাজ তুমি লুট করেছ, তদুপরি তাদের বন্দি করেছ। অথচ তুমি জানতে, মুসলিম খলিফাকে সারা দুনিয়ার শাসকরা শ্রদ্ধা করে তার শক্তিকে সবাই সম্মান করে। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র তুমিই এমন এক শাসক যে আমাদের শক্তিকে হেয় করেছ, আর গায়ে পড়ে আমাদের সাথে শত্রুতা সৃষ্টি করেছ। তুমি ভুলে গেছ, তোমার বাপ-দাদা আমাদের খেলাফতকে কর দিতো। তুমি ক্ষমতায় বসে কর দেয়া তো বন্ধ করেই দিয়েছ, সেই সাথে মৈত্রী চুক্তি ভঙ্গ করে আমাদের প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু করে দিয়েছ। এজন্য খেলাফত থেকে তোমাকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।

আমার বিশ্বাস, যেখানেই তোমার ও আমার মধ্যে মোকাবেলা হোক না কেনো, আমরাই বিজয়ী হবে। তোমাকে অবশ্যই পরাজয়ের গ্লানী পোহাতে হবে। আমি হয় তোমার মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ইরাক পাঠাবো নয়তো নিজের জীবন বিলিয়ে দেবো।

তুমি যেটাকে তোমার দেশে সেনাভিযান বলছে, এটা আমাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর পথে জিহাদ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমরা এযুদ্ধে এসেছি। আমরা কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই, তারই সাহায্য কামনা করি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের নিপ্রাণ মূর্তির বিপরীতে সদা জাগ্রত আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করবেন।”

বিন কাসিমের এই পয়গাম দাহিরের দূতের হাতে দিয়ে বিদায় করা হলো।

আজ থেকে সাড়ে বারো’শ বছর আগে সিন্ধু অঞ্চলের যে অবস্থা ছিল, তা এখন আর নেই। সিন্ধু নদী বহুবার তার গতিপথ বদল করেছে। এখন আর একথা কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয় বিন কাসিমের অভিযানের সময় সিন্ধু অঞ্চলে প্রবেশের মূল রাস্তা কোনটি ছিল। সিন্ধু তীরের কোন জায়গায় কোন ধরনের লোকজনের বসতি ছিল। সেই যুগের কোন চিহ্নই আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সিন্ধু নদের সাথে যুক্ত ছিল আরো বহু শাখা প্রশাখা, অসংখ্য খাল নালা। যেগুলো সিন্ধু নদীতে এসে পতিত হয়েছিল। এখন আর সেই সব শাখা প্রশাখা নেই। অধিকাংশই শুকিয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। প্রবাহ বন্ধ হয়ে খাল-নালা ঝর্ণাগুলোও জমিনের সাথে মিশে গেছে। সেই সময় ব্রহ্মণ্যবাদে ছিল সিন্ধু অঞ্চলের একটি বড় শহর। রাজা দাহিরের ছেলে জয়সেনা তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ব্ৰহ্মণ্যবাদে অবস্থান নিল। যে সময় রাজা দাহির তার ছেলেকে ডাভেল থেকে প্রায় আড়াই’শ মাইল দূরের রাজধানী উরুটে বলছিল, এই যুদ্ধ এখন আর দু’জন শাসক আর রাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ এখন দুটি ধর্মের আদর্শিক সংঘাতে পরিণত হয়েছে। ঠিক সেই দিন ডাভেলে মুহাম্মদ বিন কাসিম জুমার খুতবায় সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “এই অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য আমাদের অর্জিত হয়েছে, আমরা বন্দীদের মুক্ত করেছি, হিন্দুদের পরাজিত করে শাস্তি সরূপ কিছু সংখ্যককে ইরাকেও পাঠিয়ে দিয়েছি। গণীমতের মাল এবং করও আদায় করেছি কিন্তু বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, আমাদের ওপর আরো কর্তব্য রয়ে গেছে।”

বিন কাসিম বললেন, বন্ধুগণ! তোমরা দেখেছ, মন্দির চূড়ায় উড্ডীন পতাকা লুটিয়ে পড়তেই হিন্দুরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। ওদের বিশ্বাস ছিল মন্দির চূড়ার পতাকা যতোক্ষণ অবিচল থাকবে ততোক্ষণ তাদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না। এরা মাটি পাথরের মূর্তি পূজা করে, কাল্পনিক দেবদেবীকে এরা মাবুদ মনে করে, আল্লাহর সাথে এদের কোন পরিচয় নেই। এরা জানেই না, আল্লাহ সব চেয়ে ক্ষমতাবান, তিনিই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন তিনি এক অদ্বিতীয়, তার কোন শরীক সমকক্ষ নেই। একমাত্র আল্লাহই মানুষের ইবাদতের যোগ্য। তোমরা কি দেখনি, আল্লাহ মানুষের ইবাদতের যোগ্য। তোমরা কি দেখনি, আল্লাহর সৃষ্ট মাখলুক হয়েও এরা আল্লাহকেই জানেনা। আল্লাহর পবিত্র নামের সাথেও এদের পরিচয় নেই। ওদের প্রভু হলো পতাকা, পুতুল, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি। এদেরকে আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্য আমাদের অবশ্যই পালন করতে হবে। রাজা দাহির তার ছেলেকে যখন বলছিল, আমাদের একথা প্রমাণ করতে হবে দেবদেবীদের অসম্মানকারী দেবদেবীদের অভিশাপ থেকে কখনো রেহাই পায় না। ঠিকই সেই সময় বিন কাসিম তার সহযোদ্ধাদের বলছিলেন, আমাদের ওপর কর্তব্য হলো, এদেরকে বুঝিয়ে দেয়া যেসব দেবদেবীর কাল্পনিক মূর্তি বানিয়ে তোমরা পূজা-অর্চনা করো, এরাতো নিজেদের গায়ে বসে থাকা একটা মাছি তাড়ানোর ক্ষমতাও রাখেনা।

বিন কাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এদেশের যে কোন মানুষের সাথে তোমাদের দেখা হয় তাহলে সম্মান ও ইজ্জতের সাথে তাদের সাথে কথা বলবে, তাদের মর্যাদা মমতা ও মায়া দিয়ে মন জয় করতে চেষ্টা করবে। তাদের একথা বুঝাতে চেষ্টা করবে, আরব অনারব সবাইকে এক আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু অযৌক্তিক ভাবে তোমরা নিজেরা মাটি পাথর দিয়ে প্রভু তৈরী করেছ। তোমরা যদি এখানকার মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে ব্যর্থ হও, তাহলে আমরা আল্লাহর সেই নির্দেশ অমান্যের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে, যে নির্দেশে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা যদি কাউকে গোমরাহীর পথে চলতে দেখো তবে তাদের সঠিক পথ দেখাও।” একাজটি এমন যে, কোন দৃষ্টিহীন মানুষকে আছাড় খেতে খেতে পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেখে তার হাত ধরে সঠিকপথে উঠিয়ে দেয়ার মতো। রাজা দাহির বিন কাসিমের অগ্রাভিযানকে দুটি ধর্মের সংঘাত বলে অভিহিত করে আর বিন কাসিম সেটিকে হক ও বাতিল, সত্য এবং মিথ্যার

সংঘাত বলে চিহ্নিত করেন। বিন কাসিম দুর্গ জয়ের পর পরই হাজ্জাজকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফও যথা সময়ে করণীয় সম্পর্কে পয়গাম বিন কাসিমকে জানিয়ে দিলেন। হাজ্জাজ বললেন, সঠিক সময়ে সমুদ্রপথে তোমার রসদ পৌছে যাবে। আমি প্রয়োজন মতো সব ধরনের জিনিসই পাঠিয়েছি।

মুহাম্মদ বিন কাসিম গোয়েন্দা বিভাগকে খুবই সক্রিয় রেখেছিলেন। তাঁর একান্ত গোয়েন্দাদের সাথে আরো যোগ হয়েছিল স্থানীয় কিছু সংখ্যক সামরিক কর্মী। এরা বিন কাসিমের সব্যবহারে মুগ্ধ ও ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিয়ে সর্বান্তকরণে বিন কাসিমকে সহযোগিতা করছিল। এছাড়া আলাফী চারজন চৌকস যুবককে বিন কাসিমের সহযোগিতার জন্য পাঠিয়েছিলেন, এরা এই এলাকার ভাষা ও পথঘাট সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল ছিল। তা ছাড়া গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী নিজেই তার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ছদ্মবেশে নিরূন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে আসেন। বাকী সব গোয়েন্দা সদস্য ছদ্মবেশে সারা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুদের অবস্থা ও সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করছিল।

গোয়েন্দা রিপোর্টে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, রাজা দাহির দুর্গের বাইরে এসে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হবেনা। এ থেকে এই সমীকরণ করা সম্ভব ছিলনা যে, রাজা দাহির সম্মুখ মোকাবেলার সাহস রাখেনা। মুহাম্মদ বিন কাসিম গোয়েন্দা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বুঝতে পেরেছিলেন, রাজা দাহির এমন কোন ময়দানে সম্মুখ সমরে মোকাবেলা করতে চায় যখন মুসলিম বাহিনীর সমরশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে, তারা দীর্ঘ সফরের ধকল সইতে না পেরে ক্লান্ত ও অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়বে। বিন কাসিম বুঝতে পারলেন, রাজা দাহির মুসলিম সৈন্যদেরকে বিভিন্ন দুর্গ জয় করে বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিতে চায়। পরপর জয়ের আগ্রহে বিন কাসিমের বাহিনীর মধ্যে হতাহতের সংখ্যা যখন বেড়ে যাবে, রসদ কমে আসবে, সক্ষম যোদ্ধারা হয়ে পড়বে ক্লান্ত তখন ডাভেল বন্দর থেকে রসদ পৌছার পথ বন্ধ করে দেবে দাহির এবং বন্দর থেকে দূরের কোন সুবিধা জনক ময়দানে বিন কাসিমের সৈন্যদের চ্যালেঞ্জ করবে দাহির বাহিনী।

বিন কাসিম দাহিরের সম্ভাব্য রণকৌশল সম্পর্কে সেনাধ্যক্ষদের অবহিত করলেন।

তিনি সেনাপতিদের বললেন, আপনারা সবাই অভিজ্ঞ যোদ্ধা। বন্দর থেকে রসদ ও সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত রাখতে আমাদের উচিত দাহিরের রাজধানী পর্যন্ত যে কয়টি দুর্গ আছে সবগুলো কব্জা করে নেয়া। পথে কিছু বসতি রয়েছে এগুলোকেও কব্জা করে নিয়ে ওখানে আমাদের কিছু সৈন্য মোতায়েন করতে হবে। তারা ঝটিকা টহল দিয়ে রসদ সাপ্লাই পথ উন্মুক্ত রাখবে।

অগ্রবর্তী গোয়েন্দারা যে সব রিপোর্ট দিয়েছিল, তা থেকে বিন কাসিম জানতে পারেন, সামনে সবার আগে রয়েছে সিসিম নামের একটি ছোট ধরনের দুর্গ। এর পরই নিরূন (হায়দারাবাদ) অবস্থিত। বিন কাসিমের টার্গেট হলো হায়দারাবাদ। ডাভেল থেকে তখনকার হায়দারাবাদের পথ সোয়াশ মাইলের কম ছিলনা।

হায়দারাবাদ এলাকা থেকে সাকিরা নামের একটি ছোট্ট নদী ডাভেল দিয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। নদী ছোট হলেও গভীর এবং স্রোতস্বীণী। বিন কাসিম সবগুলো মিনজানিক মাঝারী নৌকাতে বোঝাই করে নদী পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে নৌকা বোঝাই করে আরো প্রচুর রসদ সামগ্রীও নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

কয়েকদিন পর নৌকার একটি বহর নদী পথে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। নৌকা বহরে পালতোলা নৌকা যেমন ছিল, দাড়টানা মাঝি মাল্লা চালিত নৌকাও ছিল। নৌকার রসদপত্র রক্ষার জন্য বহুসংখ্যক তীরন্দাজকে নৌকা বহরের আশেপাশে নিয়োগ করা হলো। যাতে শত্রুবাহিনী আক্রমণ করতে চাইলেও নৌকার ধারে কাছে যেতে না পারে। তা ছাড়াও নদীর উভয় তীরে মোতায়েন করা হলো অশ্বারোহী ইউনিট। এরা নৌবহরকে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

নৌবহর রওয়ানা করিয়ে দিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট মতো ছক আঁকা পথ ধরে অবশিষ্ট সৈন্যরা স্থলপথে অগ্রসর হচ্ছিল। শাবান ছাকাফী ডানে বামে ও সামনে গোয়েন্দা দল নিযুক্ত করে রেখেছিলেন সন্দেহজনক কোন লোককে দেখতে পেলেই তাকে পাকড়াও করার জন্য। তাদের চেষ্টা ছিল রাজার বাহিনীর অজ্ঞাতে নিরূন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু এমনটা কিছুতেই সম্ভব ছিলনা। কারণ নদীর উভয় তীরে বহু বসতি পল্লী ছিল। এসব পল্লীর লোকেরা নৌবহর পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া অশ্বারোহীদের দেখে বিদেশী সৈন্য বলে চিনতে পেরেছিল। তাছাড়া নদীতেও বিচরণকারী বহু সাধারণ মানুষেরও দেখা পেয়েছিল মুসলিম নৌবহর।

তখন শ্রাবন মাস। প্রচণ্ড গরম। আরব দেশের মানুষের জন্য গরম কোন অসহ্যকর বিষয় নয়। তারা মরুভূমির লুহাওয়ায় বেড়ে ওঠে, তপ্ত বালুর ওপর দিয়ে মরুভূমিতে ঘোড়া দৌড়াতে অভ্যস্ত কিন্তু সিন্ধু অঞ্চলের গরম তাদের কাছে অচেনা, এ যেন শরীরের সব পানি শুষে নেয়।

এক পর্যায়ে সিসিম দুর্গের কাছে নৌবহর পৌছে যাত্রা বিরতি করল। দুদিনপর পদাতিক সৈন্যরাও সেখানে পৌছাল। বিন কাসিম সবাইকে ক্যাম্পিং এর নির্দেশ দিলেন। সেই রাতে বসরা থেকে এক দূত পয়গাম নিয়ে এলো। ডাভেল দুর্গ হয়ে স্থলপথে সে সিসিম পৌছল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পয়গাম নিয়ে এসেছে দূত। হাজ্জাজ লিখেছেন

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পক্ষ থেকে সেনাপতি বিন কাসিমের নামে…। আমরা কায়মনোবাক্যে তোমাদের বিজয়ের জন্য দোয়া করছি। আশা করি বিজয়ী বেশেই তুমি ফিরে আসবে। আল্লাহ পাকের রহমত ও নুসরতে আমাদের শত্রুরা দুনিয়াতেই শাস্তি ভোগ করবে এবং চিরদিনের জন্য পরকালের আযাবে নিপতিত হবে। শত্রুদের হাতি, ঘোড়া, ধনদৌলত তোমাদের কব্জায় যাবে মনের মধ্যে এ ধরনের কোন লিল্লা জায়গা দিওনা। ধনসম্পদ প্রাপ্তির চেয়ে এটা কি বেশী সুখকর নয় যে, সকল সহযোদ্ধাদের নিয়ে তুমি দুনিয়াতে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করবে। সম্পদের লোভ যদি না করো তাহলে সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারবে…। তোমাদের নিয়ে আমরাও গর্ব করতে পারবো।

বিজিত এলাকার ছোট বড় প্রতিটি লোকের সাথে তোমাদের আচরণ হবে প্রীতি ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। শত্রুদেশে বিজয় লাভের পরও ওখানকার মানুষের মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মাতে চেষ্টা করবে যে, দেশটি তাদেরই। কোন দুর্গ বিজয়ের পর প্রাপ্তধন সম্পদ কখনো নিজের কব্জায় রাখবেনা। সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে। কোন সৈনিক যদি খাবার মতো জিনিস বেশীও নিজের কাছে রাখে তবে তা ছিনিয়ে নিও না, তাকে তিরস্কারও করোনা। বিজিত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পর জরুরী পণ্য সামগ্রীর দাম নির্ধারণ করে দেবে। যেসব পণ্য ডাভেল দুর্গে পড়ে রয়েছে, সৈন্যদের প্রয়োজনে সেগুলো ব্যয় করবে। ডাভেল দুর্গের কোষাগারে পড়ে থেকে অব্যবহারের কারণে যাতে কোন পণ্য নষ্ট না হয়। কোন দুর্গ বা অঞ্চল জয় করার পর সেখানকার দুর্গকে আগে সুরক্ষিত করবে এবং খেয়াল করবে লোকজন যাতে নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারে।

বিজিত এলাকার মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করবে এবং সেখানকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও সকল পেশার লোকজন যাতে সুখে শান্তিতে নিজ নিজ কাজ করতে পারে তা লক্ষ্য রাখবে। ওখানকার কৃষি জমিগুলো যাতে অনাবাদি না থাকে। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করুন। ২০ রজব ৯৩ হি. ৯১২ খৃ.। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের এই পয়গাম বিন কাসিমকে আরো উজ্জীবিত করল। তিনি সেনাবাহিনীর সকল সেনাধ্যক্ষ ও কমান্ডারদের তলব করে এ চিঠি পড়ে শোনালেন এবং বললেন, সকল সৈন্যকেই পয়গাম পৌছে দিতে। দুদিন সিসিমে অবস্থান করেই বিন কাসিম (নিরূন) হায়দারাবাদের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। নৌকা বহরও নৌপথে এগিয়ে চলল। সাতদিন এক নাগাড়ে পথ চলার পর বিন কাসিমের বাহিনী নিরূনের নিকটবর্তী বলহার নামক স্থানে পৌছল।

বলহার এসে বিন কাসিমের বাহিনী পানি সংকটের সম্মুখীন হলো। এলাকাটি ছিল পানি শুন্য। ধারে কাছে কোথাও সামান্যতম পানির উৎস পাওয়া গেল না। মনে হচ্ছিল এখানে কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। সৈন্যদের গমন পথ আর নদীর মধ্যে দূরত্ব অনেক। সেনাবহরে পর্যাপ্ত পানি ছিলনা। দীর্ঘক্ষণ পানি পান না করায় তৃষ্ণায় ঘোড়া ও উটগুলোও চেঁচাতে শুরু করে দিল। যতোটুকু পানি সেনা বহরে সংরক্ষিত ছিল এ দিয়ে বড়জোড় একদিন পাড়ি দেয়া সম্ভব। এমন অবস্থায় আরো সামনে অগ্রসর হয়ে ঝুকি বাড়ানোর বিষয়টি সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। ভরদুপুরে সূর্যের তাপে পরিস্থিতি আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠল। বিন কাসিম ভরদুপুরে সকল সৈন্যকে একত্রিত করে বৃষ্টির জন্য বিশেষ (ইস্তিসকার) নামাযের মাধ্যমে মোনাজাত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সকল সৈন্য এক জায়গায় জমায়েত হয়ে কিবলামুখী হয়ে দাড়ালো। সবাই বিন কাসিমের ইমামতিতে দু’রাকাত নামায আদায় করল। নামায শেষে সেনাপতি বিন কাসিম আবেগপূর্ণ ভাষায় আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে লাগলেন। সেই ঐতিহাসিক দোয়ার কথাগুলোও ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়েছে। বিন কাসিম মোনাজাতে বললেন

“হে পথভ্রষ্ট পথহারা বিপন্ন বান্দাদের পথ প্রদর্শক প্রভু! হে ফরিয়াদির ফরিয়াদ শ্রবণকারী রব! তোমার ভাষা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম এর বরকতে আমাদের আবেদন কবুল করো…।”

ইতিহাস লিখেছে সেই দিন বিন কাসিমের মুখে আর কোন কথা উচ্চারিত হচ্ছিল না, ভাবাবেগে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, আর তার সৈন্যদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মোনাজাত শেষ করতে না করতেই চারিদিক অন্ধকার করে এমন মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হলো যে, মরুভূমিতেও পানি জমে সাগর সদৃস্য রূপ ধারণ করল। বৃষ্টিতে বিন কাসিমের সৈন্যরা পরম তৃপ্তির সাথে পানি পান করল এবং বহণযোগ্য পরিমাণ পানি সংগ্রহ করে নিলো। সেই স্থানে একদিন অবস্থান করে বিন কাসিম পর দিনই নিরূনের উদ্দেশে রওয়ানা করলেন। নিরূন থেকে সেনাবাহিনী কিছুটা দূরে থাকতেই তাদের দিকে এক উষ্ট্রারোহীকে আসতে দেখা গেল। লোকটি সোজা চলমান সেনাবাহিনীর সেই অংশের দিকে অগ্রসর হলো যে অংশে বিন কাসিম অশ্বারোহণ করে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সে ছিল মুসলিম গোয়েন্দা। ছদ্মবেশে নিরূন থেকে সে গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে এসেছিল। আরোহী সোজা বিন কাসিমের সামনে গিয়ে থেমে গেল।

“ কি খবর এনেছ? গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।

“সম্মানিত সেনাপতি! নিরূন শাসক সুন্দরী হঠাৎ নিরূন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।”

“কোথায় গিয়েছেন তিনি? তার কি হদীস নেই? “তিনি জরুরী তলবে রাজধানীতে গেছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।” “শহরের লোকদের মনোভাব কি?

“শহরের লোকজন লড়াই করতে চায়না। কিন্তু রাজা নিরূনের সেনাপ্রধান পরিবর্তন করেছে। নতুন সেনাপতির নির্দেশে সেনারা লোকজনকে ভয় দেখাচ্ছে। মুসলিম বাহিনী শহরে ঢুকতে পারলে পাইকারী লুটতরাজ করবে, নারী শিশুদের ধরে নিয়ে যাবে। কারো ঘরের কিছুই থাকবেনা। শহরের সকল খাদ্য পণ্য ওরা নিয়ে যাবে।

“এর মানে হলো সেনাবাহিনী মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত?” “জী হা’ সেনাপতি। সেনারা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত।” বিন কাসিম সেনাদের চলার গতি বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত নিরূন দুর্গ অবরোধ করলেন। সেই সাথে ঘোষণা করে দিলেন, নিরুনের সৈন্যরা যদি বিনা যুদ্ধে দুর্গ আমাদের কাছে হস্তান্তর না করে আমাদেরকে যদি দুর্গ দখল করতে হয় তাহলে কোন সামরিক যোদ্ধার প্রাণ রক্ষা হবে না।

নিরূন শাসক সুন্দরীকে রাজধানীতে ডেকে পাঠানো ছিল একটা চক্রান্তের অংশ। মুসলিম বাহিনী নিরূনের দিকে অগ্রাভিযান করছে এ সংবাদ পেয়ে রাজা দাহির জরুরী পরামর্শের কথা বলে নিরূন শাসক সুন্দরীকে রাজধানীতে আসার খবর পাঠায়। কারণ নিরূন শাসক মুসলমানদের সাথে আগেই মৈত্রী চুক্তি করেছিল এবং মুসলিম সুলতানকে কর দিতে সম্মত হয়েছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিন কাসিমকে এক পয়গামে বলেছিলেন, তিনি নিরূন পৌছলে নিরূন শহরের প্রবেশপথ উন্মুক্ত পাবেন, তাকে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থাও থাকবে। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের জন্য নিরূন দুর্গের প্রবেশপথ খোলা ছিল না।

শহরের প্রবেশ পথ বন্ধ হলেও তিনি শহরের ওপর মিনজানিক থেকে পাথর নিক্ষেপের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কারণ তাতে বেসামরিক বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ তার গোয়েন্দারা খবর দিয়েছে শহরের লোজন মোকাবেলা করতে অনিচ্ছুক। হিন্দু সৈন্যরা শহরবাসীকে নানাভাবে উস্কাতে চেষ্টা করছে।

রাজা দাহির রাজধানীতে নিরূন শাসক সুন্দরীকে বিনা প্রয়োজনে আটকে রাখে। রাজা ভেবেছিল নিরূনে তার পাঠানো নতুন সেনা প্রধান শহরবাসীদের সঙ্গী করে মুসলিম বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে।

এভাবে কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন সকালে রাজা দাহির সুন্দরীকে তার একান্ত কক্ষে ডেকে পাঠালেন। রাজার কাছে খবর গেল নিরূন শাসকের জন্য অতিথিশালার যে কক্ষ বরাদ্ধ ছিল তাতে তিনি নেই। সম্ভাব্য সব জায়গায় তাকে তালাশ করা হলো কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। আসলে পাওয়ার কথাও নয়। সুন্দরী ততোক্ষণে রাজধানী ত্যাগ করে বহু দূর চলে গেছেন। তীব্র বেগে ঘোড়া দৌড়িয়ে নিরূনের দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন সুন্দরী। তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষীরাও রাজধানী থেকে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। আসলে তারাও নিরূন শাসকের সাথেই ফিরে যাচ্ছিল। কারণ মুহাম্মদ বিন কাসিম শহরে প্রবেশ করতে না পেরে নিরূন অবরোধ করলেন। কিন্তু শহর দখলে আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে অনুগত স্থানীয় এক চৌকস গোয়েন্দাকে এই বলে রাজধানীতে সুন্দরীর কাছে পয়গাম পাঠালেন, শহরের প্রবেশ পথ বন্ধ। আমাদের প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না, অথচ আপনার সাথে রয়েছে আমাদের মৈত্রী চুক্তি। আপনিও শহরে অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় আমি কি করব? দ্রুত আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

সুন্দরীর কাছে যথারীতি পৌছে গেল বিন কাসিমের গোয়েন্দা। খবর পেয়েই সুন্দরী বিচলিত হয়ে পড়লেন, ভাবলেন, আরে এ জন্যই তো

টালবাহানা করে রাজা আমাকে এখানে আটকে রেখেছে, অথচ কোন জরুরী কথা হচ্ছে না আমার সাথে। তিনি একান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের বললেন, আমাদের এক্ষুণই নিরূন ফিরে যেতে হবে। দুর্গ থেকে এভাবে ঘোড়াগুলোকে বাইরে নেবে যে, আমরা চলে যাচ্ছি এমন সন্দেহ যাতে কেউ করতে না পারে। কারো সন্দেহ হোক বা না হোক রাজধানী ত্যাগ করে নিরূন রওয়ানা তারা করবেনই এমন পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিরূন শাসক কৌশলে দুর্গ থেকে বেরিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে নিরূনের পথ ধরলেন। রাত পেরিয়ে তারা যখন নিরূন পৌছলেন তখন বেলা অনেক ওপরে ওঠে গেছে। সুন্দরী অবরোধ ডিঙ্গিয়ে শহরের প্রধান ফটক দিয়ে শহরে এলেন। অবরোধ তখনো নিষ্ক্রিয়। অবরোধকারীরা কোন আক্রমনাত্মক তৎপরতা তখনও করেনি। সেদিন শেষে রাত নেমে এলো।

নিরূন শাসককে দেখে অবরোধ প্রতিরোধকারী সৈন্যরা প্রধান ফটক খুলে দিল। সুন্দরী শহরে প্রবেশ করে ফটক আর বন্ধ না করার নির্দেশ দিলেন। তিনি একান্ত একজন নিরাপত্তা রক্ষীকে দিয়ে বিন কাসিমের কাছে পয়গাম পাঠালেন, “আপনি আসুন, শহরে প্রবেশ করুন। এ শহর আপনি ও আপনার সহযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।”

অবাক করার মতো কাণ্ড ছিল বিন কাসিমের জন্য। নিরূন শাসক অতিপুরনো বন্ধুত্বের মতো বিন কাসিমকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানালেন। মূল্যবান উপহার উপঢৌকন দিলেন এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গোটা মুসলিম বাহিনীকে দুর্গে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আরো ঘোষণা করলেন, নিক্সনের অধিবাসীরা বিন কাসিমের যোদ্ধাদের বিশ্বস্ত থাকবে।”

বিন কাসিম ভেবেছিলেন নিরূনের হিন্দু সৈন্যরা কোন গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু মুসলিম বাহিনীকে নিরূনের অধিবাসীরা এতোটাই আনন্দচিত্তে বরণ করে নিলো যে, হিন্দু বাহিনীর আশঙ্কা হলো, তারা কোন ধরনের বিরূপতা দেখালে মুসলিম বাহিনীর আগে নিরূনের অধিবাসীরাই তাদের ইহলীলা সাঙ্গ করে দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *