০৩. পরাজয়ের গ্লানি

পরাজয়ের গ্লানি হাজ্জাজ হজম করে নিলেন বটে কিন্তু এ পরাজয় তার ঘুম, নাওয়া-খাওয়া, আরাম স্বস্তি সবই দূর করে দিলো। স্বভাবতই হাজ্জাজ ছিলেন কঠিন হৃদয়ের মানুষ। সেই সাথে আগ্রাসী। তার স্বভাব চরিত্রে ক্ষোভ ও গব ছিল রক্তের শিরায় শিরায় মেশানো। হাজ্জাজ যখন কারো বিরুদ্ধে ক্ষেপে যেতেন তখন মনে হতো তার হৃদয়ে দয়া মায়ার লেশমাত্র নেই। মায়া মমতা কি জিনিস এটা বোধ হয় হাজ্জাজ কখনও বুঝেন নি। খেলাফতের যেসব বিদ্রোহী ভয়ে আরব দেশ ত্যাগ করে আরব সাগরের এপারে এসে মাকরানে বসতি স্থাপন করেছিল, তারা কোন না কোন শর্তে খলিফার আনুকূল্যে দেশে ফিরে যেতে পারত।

কিন্তু তাদের কেউ হাজ্জাজের ভয়ে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করারও সাহস করত না। কারণ তারা জানত খলিফা তাদের বিদ্রোহের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেও হাজ্জাজ তাদের কখনও ক্ষমা করবে না। যে হাজ্জাজের নির্মমতা ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে খলিফা নিজেও গুণে গুণে তার সাথে কথা বলতেন, সেই হাজ্জাজের পক্ষে এতো বড় পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করা সম্ভব ছিল না। হাজ্জাজ যখন খবর পেলেন, তার পাঠানো সেনাবাহিনী শোচনীয়ভাবে দাহির বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছে এবং সেনাপতি নাবহান মৃত্যুবরণ করেছেন, তখন তিনি সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলকে ডেকে তাকে ডাভেল আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে বললেন—

“তোমাকেও যদি রণাঙ্গন থেকে পিছপা হতে হয়, তাহলে এদিকে আর ফিরে এসো না। যেসব বিদ্রোহী মাকরানে বসতি গড়েছে, ওদের ওখানে গিয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিও। কারণ ওদের জন্য আরবের দরজা বন্ধ। ওখানে গিয়ে মরে যেয়ো। আমি যে কোন মূল্যে রাজা দাহিরের কব্জা থেকে

ডাভেলের দুর্গ ছিনিয়ে আনতে চাই, সেই সাথে চাই দাহিরের মৃত কিংবা জীবিত দেহ। এর বিকল্প অন্য কিছু আমার দরকার নেই।”

“আপনার ভাগ্য প্রসন্ন হোক ইবনে ইউসুফ! বললেন সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল। আমি ডাভেল ফেরত সৈন্যদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, সেনাপতি আব্দুল্লাহ রণাঙ্গনে পিঠ দেখায়নি। সাহসিকতার সাথে সে শত্রুদের মোকাবেলা করেছে। সে দাহির বাহিনীর মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে ওদের মধ্যভাগে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু রাজা দাহিরের ছিল হস্তি বাহিনী। ওরা হাতির ওপর থেকে অসংখ্য তীর বৃষ্টি ছুড়ে তাকে ঘায়েল করে ফেলে। মুহতারাম ইবনে ইউসুফ! আপনি ইরাকের শাসক। আব্দুল্লাহর বাহাদুরী ও মৃত্যুকে কাপুরুষতার ভারতীয় আবর্জনা দিয়ে ঢেকে দেবেন না। মৃত্যু যে কোন মানুষের জীবনে যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে। আল্লাহর কুদরতকে নিজের কব্জায় নেয়ার চেষ্টা থেকে বিরত হোন সম্মানিত আমীর!”।

“আল্লাহর কসম করে বলছি ইবনে তোফায়েল। তোমার এই সাহসিকতার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আসলে পরাজয়ের গ্লানি ও প্রতিশোধের আগুন আমাকে এমন ভয়ানক কুফরী কথার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন।” বুদাইল! তুমি একটু ভেবে দেখো। আমার সিন্ধু অভিযানে খলিফা মোটেও রাজি ছিলেন না। তাকে অনেক ফুসলিয়ে রাজি করিয়েছি। এই ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতি ও পরাজয়ের খবর পেয়ে তিনি আমাকে যে পয়গাম পাঠিয়েছেন, তা আমার মাথাকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, “ইবনে ইউসুফ! আমি সিন্ধু অভিযানে সম্মতি না দেয়ার কোন কারণ উল্লেখ

করায় আপনি রুষ্ট হয়েছিলেন। এখন বুঝলেন তো কেন আমি এতোদিন আপনাকে সিন্ধু অভিযানের অনুমতি দেইনি?” পুনর্বার আমাদের অভিযানের জন্য কি খলিফার অনুমতি পাওয়া যাবে? হাজ্জাজকে জিজ্ঞেস করল সেনাপতি বুদাইল। “কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই আমার। এটা আমার পরাজয়, এটা ইসলামের পরাজয়। এ পরাজয়কে অবশ্যই বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। আমি আমীরুল মুমিনীনকে বুঝাতে চাচ্ছি, সিন্ধু এলাকার অধিকার কেন আমাদের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে।

বুদাইল! তুমি নিজেও বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করো। আমি এখন দু’জনের পরাজয়ের শিকার। রাজা দাহিরের কাছেই শুধু আমি পরাজিত হইনি, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের দৃষ্টিতেও আমি পরাজিত। তুমিও যদি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করো, তাহলে জীবনের জন্য আমার হাত পা অকার্যকর হয়ে

যাবে, আর আরব সাগরের ওপারে সন্দীপ (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) ও মাকরানে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে আরো অসহায় করে তুলবে। এরপর দেখবে হিন্দুস্থানের জলদস্যুরা কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে অবাধে তাদের জাহাজ ও ঘরবাড়ি লুটতরাজ করে তাদের ধরে ধরে গোলাম বাদী বানাবে।”

“না, এমনটি হবে না, ইবনে ইউসুফ!” বলল বুদাইল বিন তোফায়েল।

এ কথা একটু চিন্তা করো বুদাইল! আমার ধর্মের এক নির্যাতিতা কন্যা আমাকে সাহায্যের আহবান জানিয়েছে। বন্দিদশা থেকে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য ডাক দিয়েছে। সেই নির্যাতিতা আরব কন্যার ফরিয়াদ এখানে নিয়ে আসা লোকটি আমার সামনে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মারা গেছে। সে আমার কাছে খবর পৌছানোর দায়িত্ব জীবন দিয়ে পালন করেছে। কিন্তু আমি যদি এর পরও স্বজাতির এসব নির্যাতিতা নারী শিশুদের উদ্ধারে তৎপরতা না চালাই, কেয়ামতের দিন আমি ওদের সামনে কোন্ মুখে দাঁড়াব।”

বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলকে পুনরায় আক্রমণের জন্য ব্রিফিং দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় রাজা দাহির তার রাজধানী অরুঢ় এ তার খাস কামরায় উপবিষ্ট। তার সামনে মাকরানে বসতি স্থাপনকারী আশ্রিত মুসলিম নেতা হারেস আলাফীকে ডেকে আনা হলো। দাহির বাহিনীর হাতে সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন নাবহানের মৃত্যু ও মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ের পর এটাই দাহির ও আলাফীর প্রথম সাক্ষাত। “শাইখ আলাফী! তোমাদের শত্রুকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি, এতে তুমি কী খুশী হওনি?”

“না মহারাজ! এ পরাজয়ে আমরা খুশী হতে পারি না। এটা শুধু শাসকগোষ্ঠী বনি উমাইয়ার পরাজয় নয়। এটা মুসলমানদের পরাজয়। ইসলামের পরাজয়।” বলল আলাফী।

“তাহলে তো আমাদের বিজয়েও তোমরা খুশী হতে পারোনি।” বলল রাজা দাহির।

“মহারাজ! আপনার চেহারা ছবি, আপনার দৃষ্টি অভিব্যক্তি বলছে, আপনি আমার সাথে নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চান। এসব উপকথার চেয়ে কি এটা ভালো হয় না, যে কথা বলার জন্য আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন সে আলোচনা শুরু করুন।”

“ঠিকই বলেছ আলাফী! বলল রাজা দাহির। আমি একটা জরুরী কথা বলার জন্যই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুমি আমাকে পরামর্শ দাও, আরবরা কি পুনর্বার আমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে?”

“আরববাসীর আত্মমর্যাদাবোধ যদি মরে গিয়ে না থাকে, তাহলে পুনর্বার হামলা করাটা নিশ্চিত বলা যায়। খলিফা হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কট্টরপন্থী ও নির্মমতার জীবন্ত মূর্তি। সে অতো সহজে এ লজ্জাজনক পরাজয় হজম করে নেবে না। এবারের যুদ্ধে সে আপনার সমরশক্তির সঠিক আন্দাজ করে নিতে পারবে। পুনর্বার আক্রমণ করলে সে কোন মতেই পরাজয় বরণ করতে আসবে না।”

“তখন কি তোমরা আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না?”

“না, মহারাজ! আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের ঠিকানা আরব দেশ। আমরা এখানে আশ্রিত হলেও স্বজাতি ও স্বদেশীদের বিরুদ্ধে আমরা তরবারী ধরতে পারবো না।”

“আরব বাহিনী যদি পুনর্বার আক্রমণ করে, তাহলে তোমাদের সহযোগিতা আমাদের খুব প্রয়োজন হবে। এ সহযোগিতার জন্য তোমরা যে প্রতিদান চাও, আমি তাই তোমাদের দেবো। তোমরা যদি চাও, তাহলে যে এলাকায় তোমরা থাকো সেটি তোমাদের জন্য স্বাধীন করে দিতে পারি। তখন সেটি হবে একান্তই তোমাদের রাজ্য।”

“আমরা আপনাকে এতটুকু সহযোগিতা করতে পারি যে, আমরা আপনার বিরুদ্ধে তরবারি ধরব না। আমরা নিরপেক্ষ থাকব।” বললেন আলাফী।

“একটু ভেবে চিন্তে বলো আলাফী! ধমকির স্বরে বলল রাজা দাহির। আমি তোমাদেরকে এখানে বসতি স্থাপন করতে দিয়েছি। ইচ্ছে করলে আমি তোমাদের আবার ঠিকানা ছাড়া করতে পারি। যেভাবে আবাদ করেছি, সেইভাবে বরবাদও করতে পারি। তোমাদেরকে আমরা দেশ থেকে বের করে দিতে পারি, কয়েদখানায় বন্দি করতে পারি।”

মহারাজ! আমাদের ব্যাপারে কোনকিছু করার আগে আপনার উজির বুদ্ধিমানের সাথে পরামর্শ করে নিন।” বললেন আলাফী। আমি আবারো আপনাকে বলছি, আমরা আপনাকে এই সহযোগিতা করতে পারি যে, আপনার বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধে শরীক হবো না আর আপনার পক্ষেও যুদ্ধ করব না। আমরা থাকব সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। আপনার একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়, আপনি যাদের লুট করেছেন, এদের সাথে আমাদের লোকজনও রয়েছে। রয়েছে নারী শিশু বৃদ্ধ

ও অসহায় লোক। আপনি আমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এর বিপরীতে আমরা আমাদের লোকজনকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে পারি। আপনি তো শুধু হুমকি দিয়েছেন। আমরা বাস্তবে ঘটিয়ে দেখাতে পারি।”

“আমি তোমাদেরকে একথা কিভাবে বিশ্বাস করাবো, বন্দিরা কোথায় রয়েছে আমি তা জানি না। আমি কাউকেই জাহাজ লুট করার নির্দেশ দেইনি। জাহাজ লুণ্ঠনকারীরা অত্যন্ত লড়াকু জাতির লোক। তোমরাও জাহাজ লুটের জন্যে আমাকে অভিযুক্ত করলে? এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তোমাদের ওপর আর আমার ভরসা করা ঠিক হবে না।”

আলাফী দাঁড়িয়ে গেলেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “মহারাজ! আমরা আপনার সবচেয়ে প্রতাপশালী শত্রুকে যেভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম এরা পুনর্বার আপনার বিরুদ্ধে আক্রমণ করার কথা চিন্তা করতেও ভয় পাবে। হিন্দুস্তান থেকে যদি আপনার বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ করতে চায়, তাহলে আমরা তাদেরকে চিরদিনের জন্য খতম করে দিতে পারব। কিন্তু আমরা আরব আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারব না। আপনাকে বুঝতে হবে, আমাদের বিরোধ শাসকদের সাথে ধর্ম জাতি ও সালতানাতের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষোভ নেই।”

“এতে পার্থক্য আর কি রইলো?” বলল দাহির। রাজা আর রাজ্যের মধ্যে তো কোন তফাত নেই। যে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, তাকে আমি রাজ্যের দুশমন, দেশ ও জাতির শত্রু, বিদ্রোহী মনে করব।”

“ইসলামী শাসনে কোন রাজা থাকে না।” বললেন আলাফী। এখানকার খলিফাকে কখনো রাজা মনে করা হয় না আর নাগরিকদেরকে কখনও প্রজা ভাবা হয় না। কেউ যদি খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তাকে খলিফা খেলাফত ও শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে অভিহিত করতে পারে না। এসব কথা থাক মহারাজ! আমি আপনাকে আবারো বলছি, আমরা আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারব না।”

কথা শেষ করে হারেস আলাফী রাজার কোন কথা শোনার অপেক্ষা না করেই সেখান থেকে চলে এলেন। রাজমহলের বাইরে তার ঘোড়া অপেক্ষমান। তিনি অশ্বারোহণ করে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর এক লোক হঠাৎ তার পথ আগলে ‘আসসালামু আলাইকুম বললে আলাফী ঘোড়া থামিয়ে দিলেন।

“কে তুমি?” স্থানীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন আলাফী।

“আপনার স্বদেশী। আরবী ভাষায় জবাব দিলো লোকটি। আমার নাম বেলাল বিন উসমান।”

“আল্লাহর কসম! তোমার চোখের দৃষ্টিতে আমি মরুভূমির ঝিলিক দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি এখানে কিভাবে এলে? কি করছ?”

“আমি রাজমহলের নিরাপত্তা রক্ষী।” বলল বেলাল। বনী উসমান কবিলার ছেলে আমি। আপনি কি আমার বাবা উসমান বিন হিশামকে চিনতেন?”

“এসো বেটা, এসো। আমরা যখন দেশ ছেড়েছি, তখন তুমি হয়তো খুবই ছোট ছিলে…। তোমার বাবাতো পাহাড় চিড়ে কলিজা বের করে আনতে পারতেন। একমাত্র আল্লাহকে ভয়কারী এই মানুষটিকে সমীহ করতো না এমন মানুষ তখন আরবে ছিল না। তিনি বিশেষ কোন নেতা ছিলেন না বটে; কিন্তু নেতারাও তার সামনে মাথা হেট করে দিত।…যাক সেসব কথা। এখন বলো তো! এখানে কিভাবে এলে? আর আমাদের কাছে এলে না কেন?” বেলালের ইঙ্গিতে আলাফী ঘোড় থেকে নেমে এলেন এবং উভয়েই একত্রে হেঁটে এগুতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে বেলাল আলাফীকে জানালো, কিভাবে সে দেশ ত্যাগ করেছে এবং কেমন করে রাজমহলের নিরাপত্তারক্ষী নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু মায়ারাণীর সাথে একান্ত সম্পর্কের কথা আলাফীর সাথে চেপে গেল বেলাল। “যাক, আমি যে জন্য পথ রোধ করে আপনাকে থামিয়েছি, সে কথা বলছি। কিন্তু ভয় করছি, আপনি রাজার উপকার ভোগী। রাজা দাহির আপনাদের ওপর এতো বেশী অনুগ্রহ করেছে, যার ফলে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রাজ আনুকুল্যের চাপে আপনারা তলিয়ে গেছেন কি-না!”

“এমন আশঙ্কা কেন করছো ইবনে উসমান!”

“আমি দেখেছি, কাফেরদের অনুগ্রহে অনেকের ঈমান চাপা পড়ে যায়।…আমি আপনার উদ্দেশ্যে এসব কথা এ জন্য বলছি, রাজা দাহির আরবদের জাহাজ লুট করিয়েছে এবং আরব শিশু কন্যাসহ মুসলমান হজ্জ যাত্রীদেরকে বন্দি করে রেখেছে। আরব সৈন্যদের আক্রমণে আশা করেছিলাম বন্দিরা মুক্তি পাবে। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা গুড়িয়ে দিয়ে আরব বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো।”

“আরে বাবা! তুমি আসলে কি বলতে চাও, সে কথা বলো। যেসব বিষয় আমি তোমার চেয়েও ভালো জানি, সেসব কথা আমাকে বলার দরকার কি?”

“হ্যাঁ, আমি বলতে চাচ্ছি, বন্দীদের উদ্ধারের জন্য আপনি কি কিছু করবেন? বনী উমাইয়ার প্রতি আপনার ক্ষোভ ও ঘৃণা কি নির্যাতিত নিরপরাধ লোকগুলোর সাহায্য করতে বাধা দিচ্ছে?”

বেলালের সংশয় ও শঙ্কা দূর করতে আলাফী রাজা দাহিরের সাথে তার কথোপকথন ও তার সর্বশেষ অবস্থানের কথা জানালেন।

“আমার মনে হয় খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক একটি পরাজয়েই এখানকার বন্দি মুসলমানদের কথা ভুলে গেছে।” “খলিফা ভুলে যেতে পারে; কিন্তু হাজ্জাজ ভুলবে না। আমি তাকে ভালোভাবে চিনি। সে খুনের বদলা খুনের বিনিময়েই নিয়ে থাকে।” “কিন্তু আমি হাজ্জাজের আক্রমণের অপেক্ষা করবো না। আপনি তো জানেন, কেমন বাবার রক্ত শরীরে বহন করছি। এতোদিন পরামর্শ নেয়ার মতো কাউকে পাইনি আমি। আজ রাজমহলে আপনার আসার কথা শুনে পূর্ব থেকেই অপেক্ষায় ছিলাম। রাজমহল থেকে আপনাকে বের হতে দেখেই আমি আপনার সাথে কথা বলার জন্য পথ আগলে দাঁড়িয়েছি।”

“তা তো বুঝলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে তুমি কি করতে চাও?”

“আমি বন্দীদেরকে মুক্ত করতে চাই।” বলল বেলাল। কিন্তু কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে তারা যাবে কোথায়? আপনি কি তাদের আশ্রয় দিতে পারবেন?

“ইবনে উসমান! তুমি যদি বন্দীদের মুক্ত করতে পারো, তাহলে তাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। আমি তাদেরকে জায়গা করে দেবো। এবং সুযোগ মতো তাদেরকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো-তুমি এদেরকে মুক্ত করবে কিভাবে?

“এজন্য আমাকে রাতের বেলায় কয়েদখানায় প্রবেশ করতে হবে। হয়তো জীবনবাজী রাখতে হবে। এমনও হতে পারে, আমরা কয়েদখানায় প্রবেশ করে আর কোনদিনই বাইরে আসার সুযোগ পাবো না।”

“তোমরা কতোজন?” “তিন চার জনের বেশী নয়।” বললো বেলাল।

বেলাল ও আলাফী হাটতে হাটতে কথায় কথায় বন্দীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা তৈরী করল। এমতাবস্থায় দুর্গের প্রধান ফটক এসে গেল। আলাফী বেলালকে বললেন “এখন আর আমার সাথে তোমার যাওয়া ঠিক হবে না, দুর্গের ভিতরেই তুমি থেকে যাও।”

বেলাল যখন প্রাসাদে ফিরে আসছিল, তখন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল দাহিরের বন্দিশালা থেকে বন্দীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা। কারণ আলাফী তাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। সেই সাথে সুন্দর পরিকল্পনাও দিয়েছেন। মায়ারাণীর প্রতি বেলালের মনে খুবই ক্ষোভের সঞ্চার হলো। বেলাল অনেকবার মুসলিম বন্দীদেরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য মায়ারাণীকে রাজা দাহিরের কাছে প্রস্তাব করার কথা বলেছে। কিন্তু প্রতিবারই মায়ারাণী তাকে একথা বলে নাকচ করে দিয়েছে যে, রাজা দাহিরের ওপর তার কোনই প্রভাব নেই। রাজা এ ব্যাপারে কারো কথা শুনবে না। রাজ কাজে নাক গলানো রাজা মোটেও পছন্দ করে না।”

মায়ারাণীর আগের সেই রূপ সৌন্দর্য নেই। এতোদিনে সে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু মায়রাণীর বয়স বাড়লেও বুড়িয়ে যায়নি। রাজকীয় আরাম আয়েশে থাকার কারণে শরীরের কাঠামো একটুও ভাঙেনি। এখনও প্রায়ই মায়ারাণী বেলালকে একান্তে ডেকে নিয়ে বহুক্ষণ কাছে রাখে। কিন্তু বেলালের এই অনুরোধ না রাখায় বেলাল মায়ারাণীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বেলাল মায়ারাণীকে তাদের ভালোবাসার দোহাই দিয়ে বলেছিল, বিষয়টি রাজার কাছে উত্থাপনের জন্য। কিন্তু বেলাল বুঝতে পারল মায়ারাণী আসলেই রাজার কাছে অসহায়। এদিকে বেলাল ও আলাফী বন্দীদের মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করছে, আর অপর দিকে বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার সেনাপতি বুদাইলকে অভিযানের শেষ দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। হাজ্জাজ বলছিলেন-বুদাইল! তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছ, সিন্ধু অভিযানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব কতখানি? আমি অনেক আগেই সিন্ধু অঞ্চলের উপকূল দখল করতে চেয়েছিলাম। আশা করি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছ তুমি।”

“হ্যাঁ’ ইবনে ইউসুফ! আমি বুঝতে পেরেছি, সিন্ধু উপকূলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেই শ্রীলংকা ও মাকরানে আমাদের জাহাজ নিরাপদে যাতায়াত করতে পারবে।” বললেন সেনাপতি বুদাইল।

“আল্লাহর কসম! তুমি আমার মনের কথাই বলেছ বুদাইল! তুমি হয়তো জানো, আমীরুল মুমিনীন শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি সিন্ধু আক্রমণের ঘোর বিরোধী। তিনি নির্বিবাদে হুকুমত করতে চান। আসলে অত্যধিক শান্তিকামিতা দুশমনকেও দোস্ত বানিয়ে ফেলে। অত্যধিক শান্তিপ্রিয় মানুষ এটা বুঝতেই চায়

আদর্শিক দুশমন কখনো বন্ধু হতে পারে না। দুশমনই থেকে যায়। তুমি তো জানো, আমীরুল মুমিনীন আমাকে সিন্ধু অভিযান থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, আমি এখন তার অনুমতি ছাড়াই পুনর্বার অভিযান চালাবো।”

“এতে আমীরুল মুমিনীন বিগড়ে যাবেন না তো?” জিজ্ঞেস করলেন সেনাপতি বুদাইল।

“বিগড়ে গেলে যাক। আমিরুল মুমিনীনের সন্তুষ্টির চেয়ে আমার কাছে জাতির সম্মান বেশী গুরুত্বপূর্ণ। খেলাফতের মসনদে বসে ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক বুঝতেই পারছেন না, আজ যদি আমরা এক ব্রাহ্মণ রাজার দাপটে এভাবে চুপসে যাই, তাহলে দু’দিন পরেই সে আমাদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে। ব্রাহ্মণদের মেজাজ আমি জানি। যে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য নিজের সহোদর বোনকে বউ বানিয়ে রাখতে পারে, ওর ওপর কিভাবে আস্থা রাখা যায়?

“একটি বিষয় তো আপনি ভাবেননি ইবনে ইউসুফ” বললেন সেনাপতি বুদাইল। সিন্ধ রাজা দাহির তার দেশে পাঁচশ বিদ্রোহী মুসলমানকেও আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। শুনলাম ওইসব আরবরা তার পক্ষে একটি যুদ্ধও করেছে এবং রাজা দাহিরের প্রবল শত্রুকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। এমন আশঙ্কা তো উড়িয়ে দেয়া যায় না, খেলাফতের শত্রু এসব বিদ্রোহী মুসলমান আমাদের বিরুদ্ধেও হাতিয়ার তুলে নেবে?”

“তা হতে পারে।” বললেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। আমি ওদের খবর নেয়ার জন্য গোয়েন্দা লাগিয়ে দিয়েছি। এখনও পর্যন্ত এমন কোন খবর আসেনি যে, ওরা আমাদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেবে। এরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও আমাদের এজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ এরা আমাদের বিদ্রোহী, আমাদের বিরুদ্ধে দুশমনদের পক্ষ নেয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে, যাদেরকে আমরা দ্বীপান্তর করেছি। আর কিছু স্বেচ্ছায় দেশ ত্যাগ করেছে। এদের মনে উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা রয়েছে। এই ঘৃণা ও ক্ষোভ তাদেরকে বিরোধিতার প্ররোচনা দিতে পারে। এটা মনে রেখেই আমাদের অভিযান পরিচালনা করতে হবে।”

“হ্যাঁ’ ইবনে ইউসুফ। আমি এ পরিস্থিতির জন্য তৈরী। কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না। যেদিন থেকে মুসলমানদের তলোয়ার পারস্পরিক সংঘাতে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে, উম্মতের অধঃপতন সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে। যেই আমার সামনে আসুক না কেন, আমি তাকে দ্বিখণ্ডিত করতে কসুর করবো না। কিন্তু আমার ভয় হয়, মুসলমান ভাইদের শিরে তরবারী চালাতে আমার হাত কাঁপে কি-না।”

“তার মানে হলো, তখন তোমার প্রতিপক্ষ মুসলমান ভাই তোমার শরীর থেকে তোমার মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তাই না?” বললেন হাজ্জাজ। শোন বুদাইল! খলিফার অনুমতি না নিয়েই এতো দূরের ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিযান চালাতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি নিছক আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়; মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত স্বার্থে। মুসলমানদের আত্মমর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে। বুদাইল! তোমার মনে রাখতে হবে, মসনদ টিকিয়ে রাখতে খলিফা ওয়ালিদ যদি তার সহোদর ভাইকে গলাটিপে হত্যা করতে পারে। মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে আমি কিছু লোকের প্রাণ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না। আমি খেলাফতের বিশ্বস্ত তা ঠিক, তবে নিজের অবস্থানক আমি অবশ্যই এতোটুকু মজবুত করতে চাই যাতে খলিফা আমার ব্যাপারে নাক গলাতে চিন্তা-ভাবনা করে।…একথাও মনে রাখবে বুদাইল: তোমার ভাগ্য এখন আমার হাতে। তুমি যদি সিন্ধু জয় করতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে সেখানকার প্রশাসক নিযুক্ত করব।”

“হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তৎকালীন খলিফার সমান্তরাল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন কিন্তু খলিফার মতো তিনি দোস্ত-দুশমন চিনতে ভুল করতেন না। কারা তার শত্রু, আর কারা মিত্র, এ ব্যাপারে তার হিসাব ছিল নির্ভুল। মুসলমানদের জাহাজ লুণ্ঠনকারী রাজা দাহিরকে চরম শিক্ষা দিতে তিনি অতিমাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিশোধ স্পৃহা তাকে পাগলপ্রায় করে তুলেছিল। “ইবনে তোফায়েল! সেনাপতি বুদাইলের উদ্দেশ্যে বললেন হাজ্জাজ। তুমি আর আম্মান ফিরে যাবে না। তোমাকে মাত্র তিনশ অশ্বারোহী দিচ্ছি। আমি মাকরানের শাসক মুহাম্মদ বিন হারুনকে পয়গাম পাঠিয়েছি, সে তোমাকে তিন হাজার সৈন্য দেবে। তুমি সোজা মাকরানে চলে যাবে। সেখানে গেলে মুহাম্মদ বিন হারুন তোমার ওখানে করণীয় কি তা বলে দেবে। আমার সকল গোয়েন্দা কর্মীরা তার সাথে যোগাযোগ রাখে।

রাজা দাহির তার উজির বুদ্ধিমানকে ডেকে পাঠালো।

“বিজ্ঞ উজির কি ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?” উজিরকে জিজ্ঞেস করল রাজা দাহির। উজির কি মনে করেন, আরব দেশের দিক থেকে আরেকটা তুফান আসবে?”

“তুফান আসাটা তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা মহারাজ! তুফান কখনো পূর্বদিক থেকে আসে কখনো পশ্চিম দিক থেকে আসে। তুফান যেদিক থেকেই আসুক না কেন, সেটা লক্ষণীয় বিষয় নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে আমরা সেই তুফান মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি কতটুকু নিয়েছি। আমি একথা বলতে পারি, আরব দেশ থেকে একটা ঝড় অবশ্যই আমাদের দিকে আসবে, এজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে মহারাজ!” “রমলের রাজার আক্রমণ প্রতিরোধে তুমি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলে আশ্রিত আরব মুসলমানদের সহযোগিতা নেয়ার জন্য। তোমার পরামর্শে আমি তাদের সহযোগিতা চাইলে তারা রমলের বাহিনীকে শোনচীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। এবার সম্ভাব্য আরব আক্রমণে আমি আরব সর্দারকে ডেকে এনে সহযোগিতা চেয়েছিলাম। আরব সর্দার আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সে আমাকে উল্টো আরব বন্দীদের মুক্ত করে দিতে বলেছে। আরো জানিয়েছে, মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না। এখন তুমিই বলল, এদের ব্যাপারে আমি কি করতে পারি? আমি কি এদের অকৃতজ্ঞতার স্বাদ বুঝিয়ে দেবো?”

“না মহারাজ! বলল উজির। শত্রু সংখ্যা বাড়াবেন না। এদেরকে শত্রু বানালে এরাও সুযোগ বুঝে পিছন দিক থেকে আঘাত হানবে। তাদের সাথে বন্ধুত্ব আরো মজবুত করুন, আর গোয়েন্দা লাগিয়ে ওদের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করুন। অবশ্য এদেরকে বন্ধু মনে করে কখনো বিশ্বাস করবেন না। মুসলমানদেরকে সব সময় শত্রু ভাবতে হবে। সেই সাথে ওদেরকে মাকরানেই সীমাবদ্ধ থাকার নির্দেশ করুন। তাদেরকে যদি অবাধ যাতায়াতের অনুমতি দেন, তাহলে তারা ইসলামের প্রচার করতে শুরু করবে। আসলে এরা এমন শত্রু যে শত্রু মহারাজের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে। আর এটি এমন অন্ধকার যে অন্ধকার মহারাজের প্রদীপের নীচেই বিরাজ করছে।”

“এরা যদি আরব আক্রমণ কারীদেরকে গোপনেও কোন সহযোগিতা করে, তাহলে আমি ওদের সবাইকে খুন করে ফেলব। সিন্ধু ও সারা ভারত বর্ষে শুধু হিন্দু ধর্ম থাকবে, আর কোন ধর্ম থাকবে না।” বলল রাজা দাহির। বন্দীদের ছেড়ে দিলে এর কি প্রতিক্রিয়া হবে এ নিয়ে কি মহারাজ কোন চিন্তা ভাবনা করেছেন?” বলল উজির। “না উজির! এ নিয়ে আমি কোন চিন্তা-ভাবনা করিনি।” বলল রাজা দাহির। বন্দীদেরকে আমি মুক্ত করে দিলে আরব শাসকরা আমাকে দুর্বল

ভাবতে থাকবে। তাছাড়া আমি আরব দূতের কাছে তো অস্বীকার করেছি বন্দিরা আমার নাগালের ভিতরে নেই, আমি তাদের বন্দি করিনি। এখন আমি কোন মুখে ওদের মুক্ত করে ওরা আমার কাছেই বন্দি ছিল একথা প্রমাণ করব।, এটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বন্দীদের বাকী জীবন বন্দিশালাতেই কাটাতে হবে।”

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরব মুসাফিরদেরকে অরুঢ়ের এক দুর্গম বন্দিশালায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্দিশালার প্রশাসকের নাম ছিল কুবলা। সে ছিল কট্টর হিন্দু। রাজা দাহিরের সময় অঢের জেলখানা ছিল খুবই বিখ্যাত। বন্দিশালার ভিতরটা ছিল বিশাল। এতে কোন মানুষকে ঢুকানো হলে, সে আর সভ্য জগতের বাসিন্দার মধ্যে গণ্য হতো না। বন্দিশালায় কয়েদীদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো যা সভ্য জগতের মানুষ ভাবতেও শিউরে উঠতো। বন্দিশালার একটি গারখানায় ছিল অনেক কক্ষ। আরব বন্দীদেরকে এসব কক্ষে রাখা হয়। একেকটি কক্ষে এক একটি কবিলা রাখা হয়েছিল।

সে রাত ছিল বন্দীদের প্রথম রাত। মধ্য রাতের পর বন্দিশালার দারোগা বন্দীদের দেখতে এলো। বন্দীদের যখন কয়েদখানায় ঢুকানো হচ্ছিল কয়েদখানার দারোগা কুবলা তাদের দেখেছিল। বন্দীদের মধ্যে ছিল যুবতী সুন্দরী তরুণী। এদের দেখার উদ্দেশ্যেই রাতের দ্বিপ্রহরে দারোগা কুবলা বন্দিশালায় নতুন বন্দীদের দেখতে এসেছিল। কুবলা বন্দিশালার বন্দীদেরকে নিজের কেনা গোলাম বাদী ভাবতো। কোন বন্দি কোন দিন কুবলার কাছ থেকে কোন মানবিক আচরণের প্রত্যাশা করতো না। আরব মুসাফির বন্দিরা মুসলমান হওয়ার কারণে অমুসলিম কুবলার কাছ থেকে সদাচারের প্রত্যাশা করার কোনই অবকাশ ছিল না। মাটির নীচের বন্দিশালার সিঁড়িতে পৌছলে কুবলার কানে ভেসে এলো ক্ষীণ আওয়াজের গণসঙ্গীতের মতো আওয়াজ। কবলা আওয়াজ শুনে থেমে গেল এবং আওয়াজটি বুঝার চেষ্টা করল। সমবেত কণ্ঠের এ আওয়াজ তার ভালো লাগল। সাধারণত বন্দীদের শিকলের আওয়াজ, চাবুক পেটানোর শব্দ ও আর্তচিৎকার শুনতে সে অভ্যস্ত। কিন্তু জাহান্নাম সদৃশ এই জিন্দানখানায় সঙ্গীতের মতো মিষ্টি মধুর আওয়াজ নির্মম নিষ্ঠুর কুবলার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলো।

তখন কুবলার সাথে বন্দিশালার কয়েকজন কর্মকর্তা ছিল। কুবলাকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে তাকালো।

“এরা আজকের আনা নতুন কয়েদী। মনে হচ্ছে এরা আরব ও মুসলমান। যখন থেকে এদেরকে এখানে আনা হয়েছে তখন থেকেই তাদের মতো করে জপতপ করছে।” বলল এক কর্মকর্তা।

কুবলা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামতে লাগল। যতোই এগুতে লাগলো তার কানে গুঞ্জন আরো বেশী পরিষ্কার হয়ে ওঠল। আরো বেশী আকর্ষণীয় মনে হতে থাকল। জেলখানার ছোট্ট কক্ষগুলোর সামনে দিয়ে কুবলা পায়চারী করতে থাকে। কোন কক্ষে ছিল দু’জন বন্দি, কোন কক্ষে তিনজন আবার কোন কক্ষে গোটা একটি দল। বন্দিরা সবাই কিবলামুখী হয়ে কলেমা তাইয়্যেবা জপছে। তাদের কেউ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজনবোধ করেনি, কে এসেছে? কুবলা শেষ কক্ষের পাশে গিয়ে এক প্রহরীর কানে কানে কি যেন বলল। প্রহরী চেচিয়ে বলল, “সকল বন্দি খামোশ হয়ে যাও। জেলার সাহেব সবার উদ্দেশ্যে কথা বলবেন।”

বন্দিরা নীরব হয়ে গেল। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল কেউ কেউ। ক্ষোভ, ঘৃণা ও নিন্দায় মুখরিত হয়ে উঠলো কয়েকজন। তাতে এতোটাই শোরগোল শুরু হয়ে গেল যে কে কি বলছে কিছুই বোঝা গেল না। কক্ষগুলোর দরজা ছিল তালাবদ্ধ, প্রহরীরা লোহার ডাণ্ডা পেটাতে লাগল। কিন্তু চেচামেচি নিয়ন্ত্রণে আনার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না।

“সবাই একসাথে চেচামেচি করলে তো কিছুই শোনা যাবে না। তোমাদের একজন কথা বলো” গম্ভীর কণ্ঠে বলল কুবলা। আমি তোমাদের কাছে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।” “এদিকে এসো” কুবলাকে নিজের দিকে ইঙ্গিত করলেন এক আরব বৃদ্ধ। কে তুমি? কথা যা বলার আমার কাছে বলো।”

কুবলা বৃদ্ধের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বৃদ্ধ বলল, “তুমি কি এই কয়েদখানার দারোগা? এটা কেমন জুলুম বলল, আমাদের কেন কয়েদখানায় বন্দি করা হলো?” “আমি কাউকে কয়েদখানায় বন্দি করতে পারি না, আর ইচ্ছে করলেই কাউকে এখান থেকে ছেড়ে দিতেও পারি না” বলল কুবলা। আমি নিছক

হুকুমের তাবেদার। তোমরা আমাকে গালিগালাজ করলে লাভ হবে না। আমি তোমাদের কাছে কিছু কথা জানতে চাই। আচ্ছা, তোমরা সবাই মিলে কি গাইছিলে? এ আওয়াজ আমার খুব ভালো লেগেছে।”

“এ আওয়াজ কি তোমার অন্তরকে মোমের মতো নরম করে দেয়নি?” জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ। “হ্যাঁ, অবশ্যই আমি কিছুটা প্রভাবিত হয়েছি। আমাকে বলো তো তোমরা কি বলছিলে?”

“এ আরব বৃদ্ধ মালাবার অঞ্চলে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। ভারতীয় অঞ্চলে তার ব্যবসাও দীর্ঘদিনের। এজন্য সিন্ধু অঞ্চলের ভাষা তার জানা ছিল। তিনি সিন্ধি ভাষা যেমন বুঝতে পারেন অনুরূপ বলতেও পারেন। বৃদ্ধ বললেন, এটা কোন সঙ্গীত নয়। এটা আমাদের কলেমা। এর মর্মার্থ হলো, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই, ইবাদত করার যোগ্য আর কেউ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তাছাড়া আমাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফের কিছু আয়াত সবাই মিলে পড়ছিলাম।”

“এর দ্বারা তোমাদের কি উপকার হবে?” জানতে চাইলো কুবলা।

“সবচেয়ে বড় কথা হলো বিপদে এ কলেমা পাঠ করলে অন্তরে প্রশান্তি আসে, আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন। তাছাড়া এর বরকতে এই জাহান্নাম থেকেও মুক্তির ব্যবস্থা হবে” বললেন আরব বৃদ্ধ।

“তোমরা কি বিশ্বাস করো, তোমাদের সবাইকে এখান থেকে ছেড়ে দেয়া হবে? জিজ্ঞেস করল কুবলা।

“আমরা যদি অপরাধী হতাম, তাহলে এই বন্দিদশা থেকে আর মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতাম না, তখন আল্লাহর কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাইতাম। আমরা নিরপরাধ। অন্যায়ভাবে আমাদেরকে বন্দি করা হয়েছে। আমাদের সহায়-সম্পদ লুটে নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ তাআলা অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের কাছে এবং তোমাদের রাজার কাছে আমরা কোন সাহায্যই চাইবো না। তোমাদের রাজার ধ্বংস লেখা হয়ে গেছে” বললেন বৃদ্ধ। “তোমরা কি মহারাজের ধ্বংসের জন্য তোমাদের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করছ?” জিজ্ঞেস করল কুবলা।

“না, আমরা কারো অমঙ্গল কামনা করি না। শাস্তি ও পুরস্কারের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। তুমি যদি নেক কাজ করো তার পুরস্কার পাবে আর জুলুম অত্যাচার করলে তোমার ওপরও জুলুম করা হবে।”

আরব বৃদ্ধের এ কথা শুনে কুবলা যে অসৎ ইচ্ছা নিয়ে বন্দি পরিদর্শনে এসেছিল তার মন থেকে সব কুচিন্তা দূর হয়ে গেল। রাজা দাহিরের নির্দেশ ছাড়া সে কোন কয়েদীকে মুক্তি দিতে পারত না ঠিক; তবে কুবলা কুরআন শরীফের তেলাওয়াত ও আরব বন্দির কথা শুনে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তা বন্দীদের জন্য খুবই ইতিবাচক প্রমাণিত হলো। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা দাহিরের প্রধান জেলখানার দারোগা কুবলা ছিল জ্ঞানী, বিদ্বান ও একজন লেখক ব্যক্তি। জেলখানার প্রশাসনে সাধারণত এমন লোকেরাই নিযুক্ত হয়ে থাকে, যারা নিরীহ বন্দীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করে নির্দোষ মানুষের হাড় গুড়ো করে প্রশান্তি লাভ করে থাকে। কিন্তু কুবলার মতো পণ্ডিত মানুষকে রাজা দাহির জেলখানার দারোগা নিযুক্ত করেছিল কেন তা বলা মুশকিল।

সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল যেদিন মাত্র তিনশ অশ্বারোহী নিয়ে বসরা থেকে রওয়ানা হলেন, সেদিন রাতে মায়ারাণীর বিশেষ নিরাপত্তারক্ষী বেলাল বিন উসমান তার তিন সাথীকে নিয়ে আরব মুসাফিরদের বন্দি করে রাখা জেলখানার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। জায়গাটি ছিল অন্ধকার। সেখানে ছিল কয়েকটি জানালা। দিনের বেলায়ই বেলাল জায়গাটি দেখে গিয়েছিল। কয়েদখানার দেয়ালে মাঝে মাঝে বুরুজ। চার কোণের চারটি বুরুজের ওপর পাহারারত সশস্ত্র প্রহরী। বেলাল তার সাথীদেরকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেল যেটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। বেলাল দেয়ালের নীচে দাঁড়িয়ে হুক লাগানো রশি দেয়ালের উপরে ছুড়ে মারলে হুক দেয়ালের ওপরে আটকে গেল। রাতের নিস্তব্ধ নীরবতায় দেয়ালের ওপরে লোহার হুক নিক্ষিপ্ত হওয়ার আওয়াজটি হয়তো প্রহরীরাও শুনতে পেয়েছিল। বেলাল ও সাথীরা দেয়ালের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হুকের ঝংকার ধ্বনীতে প্রহরীদের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইল। দীর্ঘক্ষণ তারা উৎকর্ণ থেকেও ওপরে কোন শব্দ পেলো না। সবার আগে বেলাল রশিটা শক্তভাবে ধরে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে রশি বেয়ে দেয়ালের ওপরে উঠে পড়ল।

দেয়ালের ওপরের অংশটি ছিল যথেষ্ট চওড়া। অনায়াসে দেয়ালের ওপর দিয়ে কেউ ঘোড়া হাঁকাতে পারতো। দেয়ালের ওপরে উঠে বেলাল একটি ছোট বুরুজের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। একে একে বেলালের তিনসঙ্গীও ওপরে উঠে এলো। তাদের সবারই হাতে তরবারী আর কোমরে গুঁজে রাখা খঞ্জর। তাদের কারো কয়েদখানার ভিতরের অবস্থা জানা ছিল না। কয়েদখানার কোথায় কি সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না। আরব মুসাফিরদের কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছে এ সম্পর্কেও তারা ছিল অজ্ঞাত। বিশাল জেলখানা। জেলখানার দেয়ালের ওপরে জায়গায় জায়গায় মশাল জ্বলছে। আসলে ভাবাবেগে বেলাল বন্দীদের মুক্ত করতে এ অভিযানে নেমে পড়েছিল। অভিযান শুরু করার আগে তার প্রয়োজন ছিল জেলখানার ভিতরের অবস্থা জেনে নেয়া। সে হারেস আলাফীকে বলেছিল, জেলখানার প্রহরীদের হত্যা করে সে ওদের হাতিয়ার বন্দীদের দিয়ে দেবে, এরপর সবাই মিলে বাকী প্রহরীদের পরাস্ত করে প্রধান গেট খুলে বন্দীদের মুক্ত করে মাকরানে পৌছে দেবে।

বেলাল তার তিনসঙ্গীকে দেয়ালের ওপরে ওঠার জায়গাতে রেখে এক কোণের বুরুজের দিকে অগ্রসর হলো। পা টিপে টিপে অগ্রসর না হয়ে এমনভাবে অগ্রসর হলো, তাকে দেখে মনে হবে সে যেন জেলখানার কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বেশ কবছর যাবত রাজমহলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য থাকার কারণে বেলাল নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ কোড ও সাংকেতিক ভাষা জানতে এবং বলতে পারত। সে যখন বুরুজের কাছাকাছি পৌছল প্রহরী তাকে দেখে হাঁক দিলো।

“কে রে ওখানে?” হাঁক দিলো প্রহরী। “হ্যাঁ, হঁা, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক।” বলল বেলাল।

“প্রহরী তাকে জেলখানার কোন পদস্থ কর্মকর্তা মনে করে বুরুজের ভিতরেই দাঁড়িয়ে রইলো। বেলাল তরবারী কোষমুক্ত করে ধীরে ধীরে বুরুজের দিকে অগ্রসর হলো। বুরুজের ভিতর দিকটা ছিল অন্ধকার। চারটা খুঁটির ওপরে গম্বুজ আকার ছাদ দিয়ে তৈরী বুরুজ চতুর্দিকে খোলা। বেলাল প্রহরীর কাছে গিয়ে তরবারীর আগাটা বুকে চেপে ধরে বলল, তোমার অস্ত্র ফেলে দাও। সে কোমরে কোষবদ্ধ তরবারী ও খঞ্জর হাতে নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করল। বেলাল

তাকে মেঝের ওপরে ফেলে তরবারীর আগা তার ঘাড়ের ওপরে চেপে ধরে বলল, “আরব কয়েদীরা কোথায়? সত্যিকথা বলবে এবং গড়িমসি না করে এক্ষুণিই বলবে।”

প্রহরী বলল, “আরব বন্দিরা মাটির নীচের কয়েদখানায়।” “সেখানে যাওয়ার পথ কি? নীচের কয়েদখানার চাবি কার কাছে?”

“আমি তোমাকে সব বলছি, কিন্তু আমার ঘাড় থেকে তরবারী সরিয়ে নাও। তুমি আমার জীবন কেড়ে নিও না। আমি তোমার কাজে কোন অসুবিধা করবো না। কারণ এই বন্দিশালাটা আমার বাবার সম্পত্তি নয়, আর আমার বাবা এদেশের রাজাও নয়। আমরা তো পেটের দায়ে চাকরী করি মাত্র।”

প্রহরীর কথায় বেলাল তার ঘাড় থেকে তরবারী সরিয়ে নিলো। “ঠিক আছে, এখন বল।” তাড়া দিলো বেলাল।

“আমি তোমার সাথে বন্ধুর মতো কথা বলছি, তুমিও আমার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করবে এটাই প্রত্যাশা করি। তুমি যদি একা হও, কিংবা তোমরা পাচ সাতজন হয়ে থাকে, তাহলে আমি পরামর্শ দেবো, তোমরা ফিরে চলে যাও।”

“কেন?” জিজ্ঞেস করল বেলাল।

“তোমরা যদি বন্দীদের মুক্ত করতে এসে থাকো, তা তোমরা করতে পারবে না। আমি তোমাকে সরলভাবে বলছি, তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কি বললো, তাহলে আমি তোমাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারব। আমাকে যদি বিশ্বাস করো তাহলে যা জিজ্ঞেস করবে, আমি তা তোমাকে বলে দেবো। তবে আমি তোমাকে বলতে পারি উদ্দেশ্যে সফল হতে পারবে না তোমরা, খুবই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবে।” বলল প্রহরী।

“আগে বলো তো হঠাৎ করে আমার প্রতি তোমার এতোটা হৃদ্যতা কেন সৃষ্টি হলো?” জিজ্ঞেস করলো বেলাল। তুমি কি মৃত্যুর ভয়ে এতোটা সহজ হয়ে গেলে? মৃত্যুকে তোমরা এতোটাই ভয় কর? আমাকে দেখো, স্বজাতি বন্দীদের মুক্ত করতে জীবন বাজি রাখছি আর তোমরাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু..?”

“আরে দোস্ত…! কিসের জন্য জীবন বাজি রাখব আমি?” বলল প্রহরী। এদের আটকে রাখার জন্য? যেসব নিরপরাধ মানুষকে ডাকাতি করে অন্যায়ভাবে এখানে আটকে রাখা হয়েছে। এসব হচ্ছে রাজা মহারাজাদের

পাপ। এসব পাপের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে আমি কখনও প্রস্তুত নই। নিরপরাধ আরব বন্দীদের মুক্ত করতে কেউ আসলে আমি কেন সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব। আমার সাধ্য থাকলে তালা খুলে আমি ওদের মুক্ত করে দিতাম। কারণ আমি জানি এদের আটকে রাখার কারণে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে একটা মহাবিপদ ধেয়ে আসছে, আর এ বিপদ আসছে তোমাদের দেশ থেকে।”

“আমি মনে করেছিলাম তুমি এতোটা বুদ্ধিমান হবে না। কিন্তু তুমি বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলছ,” বলল বেলাল।

“ঠিকই বলেছ। এগুলো আমার কথা নয়। আমাকে এসব সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন আমার বাবা। বাবা বলেছেন, আমাদের রাজা একবার আরব সৈন্যদের পরাজিত করে মনে মনে খুব উৎফুল্ল। হয়েছেন কিন্তু তিনি আরবদের মানসিকতা সঠিক জানেন না। আরব সৈন্যরা নিশ্চয়ই আবার আঘাত হানবে, তখন আর রাজার পক্ষে তাদের প্রতিরোধ সম্ভব নাও হতে পারে। আমাদের রাজা নিজেকে আসমানের দেবতা মনে করছে। কিন্তু সে যে অপরাধ করেছে, যে পাপ করেছে এর শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। সে তার বোনকে বিয়ে করেছে, এই অপরাধের শাস্তি না হয়েই পারে না।” “আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করব, এখন এর ঠিক ঠিক জবাব দেবে? প্রহরীকে সতর্ক করল বেলাল। প্রহরী বেলালকে নীচে নামার রাস্তা দেখিয়ে দিলো এবং পাতাল কক্ষের চাবি সম্পর্কে বলল, পাতাল কক্ষের চাবি কোন প্রহরীর কাছে থাকে না। ওইসব চাবি একটি কক্ষে রাখা আছে। সেই কক্ষ বাইরে থেকে তালাবদ্ধ থাকে। চাবির ঘরটিই কয়েদখানার দফতর। সেখানে দুই প্রহরী থাকে। তারা সাধারণ সিপাই নয় উঁচুপদের কর্মকর্তা। জেলখানার কোথায় কোথায় প্রহরী পাহারারত রয়েছে তাও জানিয়ে দিলো।

প্রহরীর মাথায় পাগড়ী ছিল। বেলাল এক ঝটকায় প্রহরীর মাথা থেকে পাগড়ী ছিনিয়ে নিল। প্রহরীকে ধাক্কা দিয়ে উপুড় করে মেঝেতে চেপে ধরলো। প্রহরীকে পিঠমোড়া করে হাত পা বেঁধে ফেলল বেলাল। অবশিষ্ট পাগড়ী ছিড়ে প্রহরীর চোখ বেঁধে দিলো।

“আমি তোমাকে প্রাণে মারবো না দোস্ত।” প্রহরীর উদ্দেশ্যে বলল বেলাল। কিন্তু তোমার উপর আমি ভরসাও করতে পারছি না। যদি কেউ আসে তাহলে তোমার বাঁধন খুলে দেবে।”

প্রহরীকে বেঁধে রেখে বেলাল তার সাথীদের কাছে ফিরে এলো। সাথীদের নিয়ে সে বাঁধা প্রহরীর বুরুজে গিয়ে প্রহরীর গোপন সুড়ঙ্গ পথের সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে গেল। সুড়ঙ্গ পথটি ছিল গোলক ধাধা সৃষ্টিকারী। পথটির কোন কোন স্থানে মনে হতো পাতালের দিকে নেমে যাচ্ছে। বেলাল ধাধা সৃষ্টিকারী পথটি সাথীদের নিয়ে অতিক্রম করে পৌছে গেল প্রহরীর বলা চাবির ঘরে। সে ঘরের সামনে পৌছে বেলাল দেখলো লোহার দরজা। কিন্তু দরজাটি ছিল খোলা। লোহার গেটটি ঘরের বহিঃপার্শ্বে, ভিতরের দিকে আরো একটি দরজা। প্রথম দরজার দু’পাশে দুটি কক্ষের একটি খোলা অপরটি তালাবদ্ধ। আর ঘরের মূল দরজায় ভিতর থেকে অনেক বড় একটি তালা ঝুলছে। যে ধরনের তালা সাধারণত দুৰ্গসমূহের প্রধান গেটে লাগানো থাকে। বেলাল ও সাথীরা পাশের খোলা কক্ষে ঢুকে পড়ল। দরজার দু’পাশের দেয়ালে মশাল জ্বলছে। বেলাল একটি মশাল হাতে নিয়ে ঘরের ভিতরটিতে দেখতে পেল দু’পাশে দুটি চৌকিতে উর্দি পরিহিত দু’জন লোক বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। বেলাল উভয়কে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে দিলো। ঘুমন্ত লোকগুলো হন্তদন্ত হয়ে জেগে বুকের ওপর উন্মুক্ত তলোয়ারধারী অচেনা লোক দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল।

বেলাল ওদের নির্দেশ করল “পাতাল কক্ষের চাবি দাও। আর সদর গেটের চাবিও আমাদের হাতে দিয়ে দাও।”

প্রহরীদের একজন দেয়ালের পাশে গিয়ে দেয়াল থেকে একটি পাথর সরিয়ে এর ভিতর থেকে একটি চাবি বের করে বেলালের হাতে তুলে দিলো। যে কোন অজ্ঞাত মানুষের পক্ষে বোঝার উপায় ছিল না, দেয়াল থেকে এ পাথরটি আলাদা করা যেতে পারে। বেলাল ধমক দিয়ে বলল, “আমি পাতাল কক্ষ ও সদর দরজার চাবি চাচ্ছি।”

প্রহরী ভয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে তালাবদ্ধ দরজা খুলে দিলো এবং বেলালের দিকে তাকালো। বেলাল মশাল নিয়ে প্রহরীর কাছে গেল। প্রহরী বেলালকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। বেলাল দেখতে পেলো সেই কক্ষের দেয়ালের সাথে অসংখ্য চাবি ঝুলানো রয়েছে। অসংখ্য চাবির গোছা থেকে

দু’টি তুলে প্রহরী বেলালকে দেখিয়ে বলল, এটাতে পাতাল কক্ষের চাবি আর এটাতে সদর দরজার চাবি রয়েছে। কক্ষটি ছিল যথেষ্ট বড়। দেয়ালের একপাশে ঝুলানো ছিল অনেকগুলো চাবির গোছা, আর অপর পাশের দেয়ালে কতগুলো তরবারী, বর্শা, খঞ্জর ঝুলছে। বেলাল ও তার তিন সঙ্গী মিলে দুই প্রহরীর পাগড়ী দিয়ে বুরুজের প্রহরীর মতোই ওদেরকে হাত পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে রাখলো। এরপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো এবং যথাস্থানে মশাল রেখে বেলাল সাথীদের নিয়ে কয়েদখানার ভিতরে প্রবেশ করল। কয়েদখানার এক পাশে বড় বড় হল রুমের মতো প্রশস্ত কক্ষ। আর অপর পাশে ছোট ছোট অসংখ্য কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে মশাল জ্বলছে। অধিকাংশ বন্দি ঘুমাচ্ছে। আর কেউ কেউ কষ্ট যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কারা কক্ষের মশালের আলো ফাক দিয়ে বাইরে পড়ছে। এই আলোতে টহল দিচ্ছে প্রহরীরা। বেলাল তার সাথীদের নিয়ে আলো আঁধারীর মাঝে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। তারা কোন মতে প্রহরীদের দৃষ্টির অগোচরে পাতাল কক্ষে নামার সিড়ি কোঠায় চলে এলো। পাতাল কক্ষের সিড়ি কোঠা ছিল গর্তের মতো। সিঁড়ি কিছু ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে। মাঝামাঝি মশাল জ্বালানো। মশালের আলোর আভায় সিঁড়ি কোঠার ওপর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। বুরুজের প্রহরীর বলা কথা মতো বেলাল ও সাথীরা পাতাল কক্ষের সিড়ি পর্যন্ত বিনা বাধায়ই পৌছে গেল।

পাতাল কক্ষের সিড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে বেলাল শ্লোগান দেয়ার মতো করে বলল, “আল্লাহর কসম! আজ তোমরা এই জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে।”

তখন রাত দ্বিপ্রহর পেরিয়ে শেষ প্রহরে পড়েছে। শেষ রাতের নিস্তব্ধ নীরবতায় বেলালের হাঁকে সব কয়েদী জেগে উঠল এবং হৈ চৈ শুরু করে দিলো। “চুপ করো সবাই! মুক্ত হতে এখনো আরো কাজ বাকী রয়েছে।” উচ্চ আওয়াজে কয়েদীদের উদ্দেশ্যে বলল বেলাল। বেলালের কথায় সবাই নীরব হয়ে গেল। বেলাল বলল, আমাদের সবার হয়তো জেলখানার প্রহরীদের সাথে লড়াই করতে হবে।”

পাতাল কয়েদখানার প্রথম কক্ষের তালা খোলার জন্য বেলাল চাবি ঘুরাতে লাগল। কিন্তু তালা কিছুতেই খুলছে না। চাবি ছিল অনেকগুলো। একটি একটি করে সবগুলো চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করল বেলাল, কিন্তু কিছুতেই তালা খোলা সম্ভব হলো না।

“মনে হয় আমাদের ধোকা দিয়েছে। বলল বেলালের এক সাথী। ওই বেঈমান মনে হয় আমাদের সঠিক চাবি দেয়নি।” সবাই একই কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করছিল ঠিক এমন সময় হঠাৎ একটা মৃদু কম্পন, সেই সাথে একটা হাল্কা বিস্ফোরণের আওয়াজ ও একজনের বিকট আর্তচিৎকার শোনা গেল। সবাই চকিতে এদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখল বেলালের এক সাথী ঝুঁকে রয়েছে, তার পিঠের দিকে বর্শা প্রবেশ করে পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে এবং দেখতে দেখতে বেলালের এই সাথী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সবাই সিঁড়ি কোঠার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, সেখানে দশ বারোজন সশস্ত্র লোক দূর নিক্ষেপণ যোগ্য বর্শা হাতে দাঁড়ানো। বেলাল দেখল ওদের সাথে বুরুজের সেই প্রহরীও রয়েছে যাকে সে হাত পা বেঁধে রেখে এসেছিল। “আরব বন্ধু!” বুরুজের প্রহরী বেলালের উদ্দেশে বলল, আমি তোমাকে সতর্ক করে বলেছিলাম, নীচে যেয়ো না। কিন্তু তুমি আমার কথা শোননি। তুমি হয়তো ভেবেছিলে বাঁধা অবস্থায় সারা রাত আমাকে পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমি জানতাম কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাঁধন খুলে দেয়ার লোক এসে পড়বে। আমার প্রাণ বাঁচানোর প্রতিদান আমি তোমাকে সতর্ক করার মাধ্যমে আদায় করেছিলাম, এখন আমি যার নুন খাই তার হক আদায় করছি। এখান থেকে কোনদিন কোন বন্দি বেরিয়ে যেতে পারেনি। তোমরাও আর বেরিয়ে যেতে পারবে না। জল্লাদ ছাড়া আর কেউ তোমাদেরকে এখান থেকে বের করতে পারবে না।”

“তরবারী ফেলে নিরস্ত্র হয়ে ওপরে উঠে এসো। নয়তো নিক্ষিপ্ত বর্শায় তোমাদের পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়া হবে।” নির্দেশের কণ্ঠে বলল এক অফিসার ধরনের লোক।

অবস্থা বেগতিক দেখে বেলাল সাথীদের উদ্দেশ্যে অনুচ্চ আওয়াজে বলল, “বন্ধুরা! এরা আমাদের জীবিত রাখবে না। এসো লড়াই করেই মরি।” বেলাল ও সাথীদের হাতে ছিল উন্মুক্ত তরবারী। এরা বিজলীর মতো উন্মুক্ত তরবারী উঁচিয়ে সিড়ি টপকে ওপরে উঠে এলো। কিন্তু ওপরে দাঁড়ানো জেল প্রহরীরা প্রস্তুত ছিল এমনটির জন্যেই। তারা দূর নিক্ষেপণযোগ্য বর্শা তাক করে রেখেছিল এদের দিকে। বেলালের এক সাথী ওপরে উঠে আঘাত হানার আগেই তার পেট বিদ্ধ করলো প্রহরীদের নিক্ষিপ্ত বর্শা। সে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ল আর অসাড় দেহ গড়িয়ে নীচে পড়তে লাগল। বেলালও তার

অপর এক সঙ্গীর তরবারী এক প্রহরীর পেট বিদ্ধ করল বটে। কিন্তু তরবারী টেনে আর দ্বিতীয় আঘাতের সুযোগ পেল না। প্রহরীদের আঘাতে পড়ে গেল বেলালের সঙ্গী। একই সঙ্গে তিনটি বর্শা বিদ্ধ করল বেলালের সেই সঙ্গীকে। আর বেলাল পা পিছলে কয়েক ধাপ নীচে পড়ে গেল। এমতাবস্থায় কয়েকজন প্রহরী তাকে ঝাপটে ধরে ওপরে টেনে নিয়ে সুরক্ষিত একটি লোহার গারদে ভরে তালা লাগিয়ে দিলো। এ ঘরটিতে তাজা ও পঁচা মানুষের রক্তের দুর্গন্ধ। বেলালের মনে হলো, এখানে প্রতিদিনই হয়তো কোন না কোন মানুষকে জবাই করা হয়। ঘরের দেয়ালেও ছিটা-ফোটা রক্তের দাগ।

বেলা একটু বেড়ে ওঠার পর রাজা দাহির তার খাস কামরায় লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে, ওপাশ থেকে এপাশে পায়চারী করছিল। আর রাগে ক্ষোভে ফুঁসছিল। অধোবদনে তার সামনে দণ্ডায়মান মায়ারাণী। “ক্ষুব্ধ কণ্ঠে রাজা বলল, “তোমার কথায় আমি ওদেরকে প্রাসাদে রাখতে অনুমতি দিয়েছিলাম। অথচ তুমি খোজ নিয়ে দেখো, মহাভারতের কোন রাজা দুরের কথা কিংবা কোন প্রজাও মুসলমানকে বিশ্বাস করে না। তোমার কথায় আজ আমাকে এতোটা মূল্য দিতে হলো। যারা গো-মাতাকে হত্যা করে, তাদেরকে কোনভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। তুমি বলতে পারো, আমি চার পাচশ আরবকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি কি দেখনি আমি ওদের কতোটা নিরাপদ দূরে রেখেছি। তাছাড়া ওদেরকে আমি স্বাধীন ছেড়ে দেইনি। ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য বেদুঈনের ছদ্মবেশে বহু সংখ্যক সেনাকে আমি ওদের এলাকায় ছড়িয়ে রেখেছি। মাকরানে মুসলমান বসতির চারপাশে যেসব বেদুঈন পরিবার রয়েছে এরা সবাই আমার সেনাবাহিনীর লোক। কারণ আমি জানি, আরবরা প্রতি আক্রমণ করতে পারে, আর এরা তাদের সগোত্রীয় ভাইদের সহযোগিতা করতে পারে এ আশঙ্কা আমি উড়িয়ে দিতে পারি না। এজন্য ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধ করার জন্য আমি ছদ্মবেশে সেনা মোতায়েন করে রেখেছি।

“ওদেরকে বিশ্বস্ত ও সৎ ভেবে আমি নিরাপত্তা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিলাম।” বলল মায়ারাণী। এটাকে আমার অভিজ্ঞতা বলতে পারো। ওরা যে অপরাধ করেছে-এর শাস্তি তো ওরা পেয়েই গেছে। আর যে ধরা পড়েছে; ওকে তুমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড …..।”

“এমন নিমক হারামকে আমি বেঁচে থাকতে দেবো না। গজরাতে গজরাতে বলল রাজা দাহির। আমি জেল দারোগাকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি ওকে জল্লাদের হাতে সোপর্দ করার আগে ওর কাছ থেকে এটা বের করতে চেষ্টা করতে যে, ওর সাথে আর কারা ছিল? কারা ছিল ওদের সহযোগিতায়? অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় আরব সর্দার আলাফীর সাথে ওদের যোগাযোগ ছিল কিংবা ওদের কেউ এদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে থাকবে। কয়েদখানার দারোগা ওর পেট থেকে এসব কথা বের করেই ছাড়বে। যদি কিছুই না বলে তাহলে বলে দিয়েছি ওকে জল্লাদের হাতে দিয়ে দিতে।

“বেলালের ব্যাপারে এমন কঠোর ফয়সালা শোনার পরও রাণীর চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। যে বেলালের প্রতি আসক্ত হয়ে সার্বক্ষণিকভাবে সঙ্গ পাওয়ার জন্য রাণী ওকে রাজমহলে নিয়ে এসেছিল। বেলাল যাতে রাণীকে ছেড়ে চলে না যায় এজন্য কৌশলে বেলালের সঙ্গীদেরকে মহলের নিরাপত্তা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নিয়েছিল রাণী। বেলালের প্রেমের পরশে দীর্ঘ দু’দশকের মতো সময় পার করে দিয়েছে রাণী। আর আজ প্রাণের লোকটি মৃত্যুর মুখোমুখী। তাও এমন কঠিন মৃত্যু যা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অতি প্রত্যুষেই জেলখানার দারোগা নিজে এসে রাজা দাহিরকে সংবাদ দিয়ে গেছে গতরাতে জেলখানায় সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে। তখনই রাজা দাহির ধূত বেলাল বিন উসমানের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছিল। রাজা বেলালকে মৃত্যুদন্ত্রে নির্দেশ দিয়েছে। বলেছে, বেলালের তিনসঙ্গীর মরদেহকে দাফন কিংবা সকার না করে জেলখানার বাইরে ফেলে দিতে। রাজার নির্দেশে বেলালকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিয়েছিল জেলখানার দারোগা কুবলা। বেলালকে একটি শক্ত তক্তার মধ্যে দুইয়ে দু’পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে উপুড় করে রাখলো। দু’হাতের কজিতে রশি বেঁধে দু’দিক থেকে দু’দল লোক চিক্কার দিয়ে টানতে লাগল আর কুবলা জিজ্ঞেস করতে লাগল, বল তোর সাথে আর কে কে ছিল? বেলালের মনে হচ্ছিল তার হাত দুটো শরীর থেকে ছিড়ে যাচ্ছে। কুবলা বেলালকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল “বল মাকরানের কোন মুসলমান তোর এই অভিযানের কথা জানে?” বেলালের শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে গেল। কষ্ট যন্ত্রণায় চেহারা নীল হয়ে গেল।

কুবলা বেলালের কাছে জানতে চাইলো “বলল, আলাফীর সাথে তোর কি কথা হয়েছিল?”

বেলাল বলল, “আমার তিন সঙ্গী ছাড়া আমার সাথে আর কেউ ছিল না। যারা আমার সাথে ছিল তারা সবাই মারা গেছে। আমি জীবনে কখনো মাকরান যাইনি। আমার অভিযানের কথা আর কেউ জানে না।” কুবলা যতোবার বেলালকে জিজ্ঞেস করল, ততোবার একই জবাব দিলো বেলাল।

আসল কথা বলছে না ভেবে কুবলা শাস্তির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো। এভাবে চললো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত।

দুপুরের দিকে বেলাল জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। দুপুরের পর বাঁধন খুলে দিলে বেলালের শরীর অসাড় হয়ে গেল। ওকে টেনে-হেঁচড়ে সেই পুঁতিদুর্গন্ধময় কক্ষে রেখে তালাবদ্ধ করে দিলো প্রহরীরা। কষ্ট যন্ত্রণায় বারবার বেলাল পানি পান করতে চাচ্ছিল কিন্তু পানির পেয়ালা তার মুখের কাছে নিয়ে ফিরিয়ে আনা হলো, পানি পান করতে দেয়া হলো না। ক্ষুধা তৃষ্ণায় বেলালের মুখ ব্যাদান হয়ে গেল।

দুপুরের পর আবারো একটি খাড়া তক্তার সাথে বেলালকে বেঁধে চার হাত পা ওজনী পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলো, আর দারোগা কুবলার জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকল। কিন্তু বেলালের মুখ থেকে নতুন কোন কথাই বের হলো না। রাতের বেলায় আবারো সেই অন্ধকার দুর্গন্ধময় কক্ষে তাকে ফেলে রাখলো। কক্ষের দুর্গন্ধ আর নিজের শরীরের ঘামের দুর্গন্ধ মিলে আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠল। রাত নামার সাথে সাথে পোকা-মাকড়, বিচ্ছু বেলালের অসাড় দেহটাকে ঘিরে ধরল। নাকে মুখে, সারা শরীরে বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের কামড়ে জ্বালা বিষের যন্ত্রণায় বেলালকে মৃতপ্রায় করে তুলল। উহ্ করার বোধটুকুও বেলালের অবশিষ্ট রইল না।

মধ্য রাতে সেই কক্ষের দরজা খুলে বেলালকে টেনে-হেঁচড়ে আবার শাস্তির জায়গায় নিয়ে গেল প্রহরীরা। এবার পা দুটো ছাদের সাথে রশি বেধে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। বেলালের ঝুলন্ত হাত দুটো মাটি থেকে আধা হাত উঁচুতে ঝুলে রইল। হাত ওপরে উঠানোর শক্তি নেই। এবার শুরু হলো চাবুক। এক একটি চাবুকের আঘাতে বেলালের শরীরের চামড়া উঠে আসতে লাগল, সেই সাথে ফিনকি দিয়ে ঝরতে থাকল রক্ত। আর চলল কুবলার

জিজ্ঞাসাবাদ। বল? তোর সাথে কি কথা হয়েছিল আলাফীর? মাকরানের কে কে তোর সহযোগী ছিল? কারা ছিল এই পরিকল্পনায়?

কিন্তু বেলালের মুখে না শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ বের হলো না।

বেলাল বলল, আমার সাথে যারা ছিল, তারা সবাই মারা গেছে। অবশেষে আফসোস করে কুবলা বেলালের উদ্দেশ্যে বলল, “আরে হতভাগা! এভাবে কেন মরছো? বলে ফেলো এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকো। বলল, এই তিন ব্যক্তি ছাড়া তোমার সহযোগিতায় আর কে কে ছিল?”

“বেলালের কণ্ঠে কথা উচ্চারিত হচ্ছিল না। কথা বলার মতো শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল বেলালের। বহু চেষ্টা করে শুধু এতটুকু বলল, ছিল একজন।” “ছিল!” স্বীকারোক্তি শুনে কুবলা চাবুক মারা বন্ধ করে দিলো এবং ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিলো। এরপর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো “বলো, কে সে? তিনজন ছাড়া আর কে ছিল তোমার সাথে?”

“আল্লাহ! আমার আল্লাহ্ ছিল আমার সাথে।” এ কথা শুনে রেগে গিয়ে আবারো কয়েক ঘা চাবুক লাগিয়ে দিলো কুবলা। বলল, ডাক তোর আল্লাহকে। এখান থেকে তোকে আর তোদের সাথীদের মুক্ত করে নিক।”

“হ্যাঁ, আল্লাহ্ সবাইকে মুক্ত করবেন। আমার আল্লাহ্ আসছেন। আসলেই টের পাবে।” এভাবেই কেটে গেল রাত। সকাল বেলায় শাস্তির কক্ষ থেকে বেলালের অসাড় দেহটি জল্লাদের গারদে রেখে তালাবদ্ধ করতে নির্দেশ দিলো জেল দারোগা কুবলা। আজো বেলালকে খানাপানি কিছু দেয়া হয়নি। দিনের বেলায় শুরু হলো নতুন ধরনের শাস্তি। সারা দিন ভয়ংকর শাস্তি দেয়ার পর রাতের বেলায় আবারো ফেলে রাখা হলো জল্লাদের গারদে। এখন আর বেলালের কোন হুঁশ জ্ঞান নেই। নিথর অসার মৃতপ্রায় বেলাল পড়ে রইল মেঝেতে। বোধশক্তি আছে কি-না তাকে দেখে কারো পক্ষে বলা মুশকিল। খুবই হাল্কাভাবে নাকের কাছে হাত রাখলে নিঃশ্বাস অনুভব করা যায়। চাবুকের আঘাত পোকায় কামড়ানো ফোলা ক্ষতবিক্ষত শরীরে নিঃশ্বাসের ওঠানামা বোঝা যায় না। তৃতীয় দিন সকাল বেলায় রাজা দাহিরকে বলা হলো, তিনদিন বিরামহীন চেষ্টার পরও বেলাল কারো নাম উচ্চারণ করেনি। জ্ঞাত অজ্ঞাত কারো

সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেনি। বেলালকে যেসব শাস্তি দেয়া হয়েছে সবিস্তারে জেল দারোগা কুবলা সবই জানালো রাজাকে। সেই সাথে বেলাল কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাও ব্যক্ত করল সবিস্তারে। অবশেষে কুবলা বলল, “আমার মনে হয় সঙ্গী তিনজন ছাড়া এর সাথে আর কারো যোগসূত্র ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতো। মাকরানের আরবদের সম্পর্কে তাকে অজ্ঞাতই মনে হয়েছে।”

“ঠিক আছে, জল্লাদের হাতে দিয়ে দাও ওকে। আর হ্যাঁ, বধ করার আগে খাবার দিও। অনাহারে কাউকে বধ করা ঠিক নয়।”

“রাজার নির্দেশে খাবার ও পানি দেয়া হলো বেলালকে। পানি পান করে বেলালের প্রাণ ফিরে এলো এবং কিছুটা বোধশক্তি ফিরে পেল। সন্ধ্যায় কুবলা তাকে বলল, “আজ রাত তোমার জীবনের শেষ রাত। যদি কোন শেষ ইচ্ছ বা কথা থাকে তাহলে ব্যক্ত করতে পারো।”

“একটাই আমার ইচ্ছা, একটাই আমার শেষ কথা, নিরপরাধ আরব নারী শিশুদের মুক্ত করে দাও।”

“আরে বোকা! এটা আমার সাধ্যের বিষয় নয়।” বলল কুবলা।

“আর একটি ইচ্ছা আছে আমার। দীর্ঘদিন আমি মায়ারাণীর সেবা করেছি। সে যদি একবার এখানে আসতো তাকে একটু দেখে নিতাম।”

“এটাওতো আমার সাধ্যের বাইরে।” বলল দারোগা কুবলা। রাণীকে এখানে আসার কথা আমি কোন্ অধিকারে বলব?”

“মরার আগে আমার প্রতি এতটুকু দয়া করো। রাণীর কাছে আমার এ পয়গাম পৌছে দেখো, সে অবশ্যই আসবে।”

“তাই যদি হয়, যে রাণী তোমার কথায় এখানে আসবে, তাহলে তাকে বলে তুমি মুক্ত হয়ে যাও। সে তো রাজার কাছ থেকে যে কোন দাবী আদায় করিয়ে নিতে পারে। ইচ্ছা করলে তোমার প্রাণও বাঁচিয়ে দিতে পারবে।” বলল জেল দারোগা কুবলা।

পরদিন ভোরেই মায়ারাণী জেলখানায় এসে উপস্থিত। বেলালের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার অন্তিম সাক্ষাতের আবেদনে রাণী আসবে। আর তার আবেদন ছাড়াই তার মুক্তির ব্যবস্থা করবে।

“আগের মতো প্রেমিকার মতো করে আসেনি রাণী। রাণী এসেছে পূর্ণ রাজকীয় জাঁকজমক নিয়ে। তার সাথে সুসজ্জিত রাজকীয় প্রহরী। মায়ার পরনেও রাজকীয় পোশাক। আগে পিছে জন পনেরো গার্ড। রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে জেলখানায় প্রবেশ করে রাণী সোজা গিয়ে দাঁড়াল জল্লাদ গারদের সামনে। দূর থেকেই দেখা যায় মরার মতো পড়ে আছে বেলাল। থেতলানো চেহারা ও শরীর। সারা গায়ে রক্তমাখা। ক্ষতবিক্ষত চেহারা দেখে পূর্ব পরিচয় না থাকলে বেলালকে চেনাই ছিল দায়। মায়ারাণী গারদের পাশে গিয়ে বেলালকে ডাকলে বেলাল কোন মতে উঠে লোহার বেড়া ধরে দাঁড়াল। “এসেছে রাণী! আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে। আমার দেশের নিরপরাধ বন্দীদের মুক্ত করতে চেয়েছিলাম আমি। তুমিও এ কাজটি করতে পারতে। কিন্তু তুমি আমার কথা রাখলে না। টালবাহানা করে প্রত্যাখ্যান করেছিলে।” “বেলাল! তুমি আমাকে বলো তো, এ কাজ করতে কে তোমাকে উস্কানী দিয়েছে? তুমি তো এমন কাজ করতে পারো না। কে তোমাকে প্ররোচিত করেছিল? কার কথায় তুমি একাজ করতে গেলে?”

“হায়। একথা জানার জন্য তো জেলখানার দারোগা আমার হাড় গুড়ো করে দিয়েছে, শরীরের চামড়া তুলে ফেলেছে, সারা শরীর থেতলে দিয়েছে। আমার কাছে একথার কোন জবাব নেই। যদি জবাব থাকতো, তাহলে আমার এ দশা হতো না রাণী!”

মায়ারাণী প্রেমের দোহাই দিয়ে বেলালের কাছ থেকে জানতে চাইলো, আসলে তোমার সাথে এ কাজে আর কে কে ছিল? কিন্তু বেলাল যে হারেস আলাফীর সাথে মিলে এই পরিকল্পনা করেছিল রাণীর প্ররোচনাতেও তা মুখে আনলো না। আসলে রাণী প্রেমের টানে বেলালের মতো রাজদ্রোহীর সাথে জেলখানায় সাক্ষাত করতে আসেনি। এসেছিল প্রেমের বাহানা নিয়ে বেলালের অপরাধের শিকড় তালাশ করতে।

“মায়া! তুমি তো ইচ্ছা করলে আমাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারো। রাজা তোমার কথা শোনে। আমাকে বাঁচিয়ে দিলে আমি আর এদেশে থাকবো না, দেশ ছেড়ে চলে যাবো।” “না। আমি তোমার কাছে যে কথা জিজ্ঞেস করেছি, তুমি তার জবাব দাওনি। তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। আমি তোমাকে বাঁচাতে পারি না।”

“না, রাণী না। আসলে এর পিছনে কারো উস্কানী ছিল না। বিবেকের তাকিদেই আমি নিরপরাধ স্বদেশীদের মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। তোমাকেও তো এদের মুক্তির ব্যাপারে রাজাকে বলার জন্যে অনুরোধ করেছিলাম। আমি তোমাকে ধোঁকা দেইনি। আমি তোমাকে ধোকা দিতে পারি না। তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক, তাতে ধোকা দেয়া সম্ভব নয়। তোমার সাথে আমি কিছুই আড়াল করিনি। মায়া। আমি তোমার কাছে জীবন ভিক্ষা চাচ্ছি। তুমি আমাকে রক্ষা করো রাণী!”

অস্বাভাবিক নির্যাতন, কঠোর শাস্তি, ক্ষুধা তৃষ্ণা আর মানসিক যন্ত্রণায় বেলালের শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি ছিল না। জীবনের স্বপ্নে বাঁচার জন্য সে মায়ার প্রতি প্রাণ বাঁচানোর আবেদন করে। কারণ শরীরের চেয়েও বেলালের দেমাগের অবস্থা বেশী খারাপ হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া দীর্ঘদিন রাজপ্রাসাদে রাণীর প্রেমের জালে আটক থেকে কষ্টসহিষ্ণু আরব জীবনকে হারিয়ে বিলাস আরামে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল বেলাল। এজন্যই জীবনের জন্য মায়ার কাছে আবেদন করে। নয়তো সহজাত আরবরা এমন একটি ঘটনার পর কষ্ট ও যন্ত্রণা যতোই হোক, জীবন ভিক্ষার জন্য এভাবে আকুতি জানায় না। কিন্তু বেলালের আকুতি মায়াকে মোটেও প্রভাবিত করতে পারেনি।

“না, আমি তোমাকে বাঁচাতে পারবো না।”

“সেই সময়টির কথা স্মরণ করো রাণী। যখন তুমি আমার কাছে একটু আদর, একটু সোহাগ, একটু প্রেমের পরশের জন্য ভিখারিণীর মতো অনুরোধ জানাতে। যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে সবার চোখের আড়ালে তুমি আমাকে দিনের পর দিন কাছে রাখতে সেইসব মুহূর্তের কথা একদিনে ভুলে যেয়ো না রাণী!”

“হু, মহব্বত! ঘৃণাভরে বলল রাণী। বেলাল! সেটিকে মহব্বত বলছে তুমি! আমি যদি তোমাকে ভালোই বাসতাম, তোমার প্রেম যদি আমার মনে সত্যিকার অর্থেই জায়গা করে নিতো, তাহলে হয় আমি তোমার ধর্মে দীক্ষা নিতাম, নয়তো তোমাকে আমার ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতাম। সেটি প্রেম ছিল না, সেটি ছিল শারীরিক প্রয়োজন। যাকে কোন মানুষই অস্বীকার করতে পারে না।

গৃহপালিত জন্তু পোষে, আমিও প্রয়োজনের তাকিদে তোমাকে পুষেছিলাম। সেই প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে। আমি এজন্যই তোমাকে বলতাম, ধর্মের কথা আমার সামনে উচ্চারণ করো না। এখন তুমি রাজদ্রোহী। তুমি যে অপরাধ করেছে, একটু চিন্তা করে দেখো, তুমি যদি রাজা দাহিরের জায়গায় থাকতে, তাহলে কি এমন অপরাধীকে ক্ষমা করতে?”

একথা বলেই মায়ারাণী সেখান থেকে সরে গেল। কুবলা মায়ার জন্যে অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে মায়ারাণীর উদ্দেশ্যে বলল, কি হুকুম মহারাণী?

“আগে যা ছিল তাই।” বলল মায়ারাণী।

মায়া জেলখানা থেকে বের হতেই বন্দি গারদ থেকে বেলালকে বের করে আনা হলো। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছিল না। তাকে টেনে হেঁচড়ে বের করলো প্রহরীরা। বেলালকে পিঠমোড়া করে বাঁধা হলো। তার পা দুটোও বাঁধা হলো শক্ত রশি দিয়ে। এরপর তাকে হামাগুড়ি দিয়ে মাথা নীচ করে বসিয়ে দেয়া হলো জল্লাদের বলিখানায়। জল্লাদ তার মাথার চুল ধরে নীচের দিকে ঝুকিয়ে দিয়ে দীর্ঘ চওড়া একটি ধারালো রামদা দিয়ে এক কোপে ঘাড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। সেই সাথে চিরদিনের জন্য দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেল বেলাল।

বেলালের শিরোচ্ছেদের দুদিন পর সেনাপতি বুদাইল বিন তোকায়েল হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশে তিনশ অশ্বারোহী নিয়ে মাকরানে পৌছলেন। মাকরানের গভর্নর মুহাম্মদ বিন হারুন হাজ্জাজের নির্দেশে তিন হাজার অশ্বারোহী সেনাকে প্রস্তুত রেখেছিলেন। সেনাপতি বুদাইল মাত্র একরাত মাকরান যাপন করে পরদিন ফজরের নামায পড়েই ডাভেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সেনাপতি বুদাইল জানতেন না, আরব বন্দীদেরকে কোন জায়গায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। ইতিহাসে বলা হয়েছে মাকরানের গভর্নরও জানতেন না, বন্দি আরব মুসাফিরদেরকে রাজা দাহির কোথায় বন্দি করে রেখেছিল।

হাজ্জাজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, সবার আগে ডাভেল কব্জা করবে কারণ। ডাভেল সিন্ধু অঞ্চলের একমাত্র সমুদ্র বন্দর। হাজ্জাজ মনে করেছিলেন সমুদ্র বন্দর কব্জায় এসে গেলে সমুদ্র পথে সামরিক সাহায্য ও রসদপত্র পাঠানো সহজ হবে। হাজ্জাজের নির্দেশ পালন করতেই সর্বাগ্রে সেনাপতি বুদাইল ডাভেল বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন।

রাজা দাহির মাকরানের আশ্রিত মুসলমানদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য মাকরানের আশপাশে বহু সেনা সদস্যকে বেদুঈনের বেশে পরিবারপরিজনসহ নিয়োগ করে রেখেছিল। হারেস আলাফী দ্বিতীয়বার আরব আক্রমণ প্রতিরোধে অস্বীকৃতি জানানোর পর দাহির তার গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে

জোরদার করে। রাজা দাহিরের ছদ্মবেশী সেনাদের একজন সেনাপতি বুদাইলের অগ্রবর্তী সেনাদেরকে ডাভেলের দিকে অগ্রসর হতে দেখে একটি দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ডাভেলের দিকে রওয়ানা হয়।

ডাভেলের অধিবাসী ও সেনা কর্মকর্তারা মুসলমানদের এ অভিযান সম্পর্কে একেবারেই বেখবর ছিল। কিন্তু রাজা দাহিরের গোয়েন্দা সদস্য বুদাইলের সহকর্মীদের একদিন আগেই ডাভেল পৌছে ডাভেলের শাসককে বলল, আরব সেনারা আসছে। সে তার দেখা সেনা বাহিনীর সংখ্যা ও অবস্থা সম্পর্কেও সংবাদ দিলো। খবর পাওয়া মাত্রই ডাভেলের শাসক শহর জুড়ে প্রচার করে দিলো, “সবাই হুশিয়ার হয়ে যাও, সকল যুবক তুণ ধনু নিয়ে তৈরী হয়ে যাও, আরব মুসলমানরা আবার শহর দখল করার জন্য এগিয়ে আসছে। সেনাবাহিনী শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করবে, বেসামরিক লোকেরা শহরের ভিতরে অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকবে। দেবদেবী ও মন্দিরের সম্মান রক্ষায় জীবন বিলিয়ে দেয়ার আবার সময় এসেছে।”

ডাভেল ছিল শহরের প্রধান মন্দীরের নাম। মন্দিরের নামেই শহরের নাম হয়ে যায় ডাভেল।

ডাভেলের শাসক সংবাদবাহী অশ্বারোহীকে বলল, তুমি অরুঢ় চলে যাও এবং রাজা দাহিরকে গিয়ে মুসলিম ফৌজ আসার খবর দাও।” ডাভেলের শাসক তার সেনাবাহিনীকে শহরের অদূরে ময়দানে এগিয়ে নিলো এবং যুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবাইকে কাতারবন্দি করে রাখলো। ডাভেলের শাসক এমন একটি এলাকায় সেনাবাহিনীকে নিয়ে গেল যে এলাকা পেরিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ডাভেলে প্রবেশ করতে হবে। এলাকাটি ছিল অসমতল, অসংখ্য উঁচু নীচু টিলা ও গিরি খন্দকে ভরা। ডাভেল শাসক তার সেনাদেরকে বিভিন্ন উঁচু টিলার আড়ালে লুকিয়ে রাখলো। এবং কিছু সৈন্যকে রাখলো সমতল এলাকায়। এ জায়গাটি ছিল আড়াল থেকে অতর্কিত আক্রমণের জন্য খুবই উপযোগী। মুসলমানদের এ এলাকা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। তাদের জন্যে এলাকাটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সিন্ধী সেনাদের মনোবল ছিল চাঙা। কারণ এর আগে তারা মুসলিম বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। আর মুসলিম বাহিনীর সেনাপতিকেও তারা শহীদ করে দিয়েছিল। সেই বিজয়ের

ঘটনা বলে সিন্ধুবাহিনীর সেনাপতিরা সেনাদের মনোবল আরো চাঙা করে তুলেছিল।

সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল তার সেনাদের নিয়ে অনেকটা নির্ভয়েই আসছিলেন। অবশ্য আরবদের যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবে তিনি সেনাদের একটি অংশকে অনেক আগে অগ্রবর্তী দল হিসাবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের দু’জন পিছিয়ে এসে সেনাপতি বুদাইলকে জানালো পথিমধ্যে ডাভেলের সৈন্যরা ওঁৎ পেতে রয়েছে। এরা দু’জন ডাভেল সেনাদের যে অবস্থায় দেখেছিল তা সবিস্তারে সেনাপতি বুদাইলকে জানালো। সেনাপতি বুদাইল ছিলেন অভিজ্ঞ যোদ্ধা। তিনি শত্রুদের রণপ্রস্তুতির খবর শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন, প্রতিপক্ষ তাদের আগমন সংবাদ অনেক আগেই পেয়ে গেছে। তিনি সেনাদেরকে তিনভাগে ভাগ করে একটি অংশ নিজের সাথে রেখে মূল পথে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং অপর দুই ভাগকে দু’দিকে অনেকটা ঘুরে শত্রু বাহিনীর পিছন দিয়ে দু’বাহুতে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। শত্রুপক্ষ ওঁৎ পেতে ছিল। তাছাড়া তারা মুসলিম বাহিনীর আগমন সংবাদ সরবরাহের জন্য কিছু সেনাকে অগ্রবর্তী দল হিসাবে পাঠিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শত্রু বাহিনীর অগ্রবর্তী দল সেনাপতি বুদাইলের বাহিনীকে তিনভাগ করে দু’ভাগ দু’পাশের বাহুতে আক্রমণের প্রস্তুতির খবর সংগ্রহ করতে পারেনি। শত্রু বাহিনীর অগ্রবর্তী দল শুধু সেনাপতি বুদাইলের কমান্ডে পরিচালিত সেনাদের দেখে ছিল। বুদাইলের সাথে যে সেনাবাহিনী ছিল শত্রুবাহিনী তাদেরকেই গোটা মুসলিম বাহিনী কিংবা অগ্রবর্তী বাহিনী ভেবেছিল। সেনাপতি বুদাইল গতি মন্থর করে দিলেন, যাতে তার ডান বামের দু’দল শত্রুদের ওঁৎপেতে থাকা জায়গায় দূরবর্তী পথ ঘুরে চলে আসতে পারে।

মুসলিম বাহিনীর দুই অংশ পথ ঘুরে শত্রুদের ওঁৎপেতে থাকা জায়গায় পৌছে দুদিক থেকে একই সাথে হামলা করলো। এই অতর্কিত আক্রমণটিকে শত্রু বাহিনী মনে করল আরব বাহিনী দুদিক থেকে তাদের চেপে ধরেছে। ফাঁদ পেতে রাখা ডাভেল বাহিনী নিজেরাই ফাঁদে আটকে গেল। এমনটির জন্য ডাভেল বাহিনী মোটেও প্রস্তুত ছিল না, তাই ডাভেল সৈন্যদের মধ্যে দেখা দিলো বিশৃঙ্খলা।

সেনাপতি বুদাইল শত্রু বাহিনীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি যখন দেখলেন, তার পাঠানো অন্য দু’ভাগের সেনারা শত্রু বাহিনীকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করেছে, তিনিও তার বাহিনী নিয়ে শত্রুদের মধ্যভাগে আঘাত হানলেন। হিন্দুরা তিনদিক থেকে যুগপৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেল, এখন তারা বিজয়ের জন্য নয়, প্রাণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর জন্য আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করছিল। রণক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। ডাভেল বাহিনী বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে লাগল। কিন্তু এমতাবস্থায়ই সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এলো। আর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে শত্রু বাহিনীর সেনারা পালাতে শুরু করলো। রাতের অন্ধকার সেদিনের মতো যুদ্ধ মুলতবি করে দিলো। সেনাপতি বুদাইলের সেনারা ছিল সফর ও যুদ্ধে ক্লান্ত। তারা সফরের অবস্থাতেই যুদ্ধ করেছে ফলে তাদের পক্ষে আর ডাভেলের দিকে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখা সম্ভব হলো না। সেনাপতি বুদাইলের নির্দেশে সেখানেই রাতযাপনের সিদ্ধান্ত নিলো তারা।

সকালে সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল ডাভেলের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের চার পাশে অসংখ্য শত্রুসেনাদের মরদেহ ছড়িয়ে রয়েছে। রাতে শত্রুসেনাদের মরদেহ বাঘ, শিয়াল জংলী জানোয়ারেরা ছিড়ে খেয়েছে আর সকাল হতেই শকুন ভিড় করেছে মরা দেহের ওপর। অসংখ্য শকুন শত্রুদের মরদেহ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। কোন শত্রু দল তাদের মরদেহ ওঠানোর জন্য আসেনি।

রণাঙ্গন থেকে ডাভেলের দিকে রওয়ানা করে মুসলিম বাহিনী বেশী দূর অগ্রসর না হতেই একদিক থেকে বিরাট আকারে ধুলিবালি উড়তে দেখা গেল। সৈন্য ও সেনাপতিদের জন্য এই ধুলিবালি অপরিচিত কোন জিনিস নয়। বুদাইল ধুলিস্তর দেখেই বুঝতে পারলেন শত্রুবাহিনী এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই এ বাহিনী সিন্ধুরাজার সৈন্য। সেনাপতি বুদাইল সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে নিলেন।

দেখতে দেখতে ধুলোবালির অন্ধকার এগিয়ে আসতে লাগল। যখন একেবারে কাছে চলে এলো তখন বুদাইল দেখতে পেলেন বিশাল এক বাহিনী উট ও ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসছে। এদের মধ্যভাগে রয়েছে হস্তিবাহিনী।

ঐসিহাসিকগণ লিখেন, সিন্ধুরাজা দাহির ডাভেল সেনাদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছিল এ বাহিনী। দাহিরের বাহিনীতে চার হাজারের চেয়ে বেশী

অশ্বারোহী ও উষ্ট্রারোহী সৈন্য ছিল। তা ছাড়া আধা ডজন প্রশিক্ষিত হাতিও ছিল। বলা হয় রাজা দাহিরের পালক পুত্র জেসিয়া এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল।

ডাভেলের দিকে মুসলিম সেনারা অগ্রসর হচ্ছে এ খবর অরুটে পৌছার সাথে সাথেই রাজা দাহির দ্রুতগতিতে সেনা অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিল। এ বাহিনী জানতো না, ডাভেলের সৈন্যরা প্রথম সংঘর্ষেই পরাজিত হয়ে পালিয়েছে। সেনাপতি বুদাইল অগ্রাভিযান মুলতবী করে সেনাদেরকে তিনভাগ করে ছড়িয়ে দিলেন। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে সেনা সংখ্যা তিন হাজারের নীচে নেমে এসেছিল। পূর্বদিনের লড়াইয়ে কয়েকশ সৈন্য আহত ও কিছু সংখ্যক নিহত হয়। সিন্ধু বাহিনীর সুবিধা ছিল, তাদের প্রত্যেকেই ছিল অশ্বারোহী, নয়তো উষ্ট্রারোহী প্রশিক্ষিত হাতিও ছিল তাদের সহযোগী। এছাড়া তারা ছিল বিজয়ের নেশায় উজ্জীবিত।

সেনাপতি বুদাইল আগে আক্রমণ না করে শত্রুদেরকে আগে আঘাত হানার সুযোগ দিলেন এবং তার বাহিনীকে বেশী এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে দিলেন। হিন্দুরা প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত হানলো। মুসলিম বাহিনী কয়েকবার দুই প্রান্তে আঘাত করার চেষ্টা করলো কিন্তু দাহিরের ছেলে খুবই দক্ষতার সাথে তার বাহিনীকে প্রত্যাঘাত থেকে বাঁচিয়ে মোকাবেলা করছিল।

দেখতে দেখতে যুদ্ধ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হলো। হাতির ওপর থেকে মুসলিম বাহিনীর দিকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। দাহির পুত্র জেসিয়া ছিল একটি হাতির ওপরে উপবিষ্ট। দিনের শেষ ভাগে মুসলমানদের জন্য যুদ্ধটি কঠিন হয়ে উঠলো। সেনাপতি বুদাইল জেসিয়ার হাতিটিকে অকেজো করে দেয়ার জন্য মধ্যভাগে অগ্রসর হয়ে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেনাপতি বুদাইল তার একান্ত রক্ষীদের নিয়ে জেসিয়ার হাতির কাছাকাছি পৌছে জেসিয়ার হাতির শুঁড় কাটার চেষ্টা করছিলেন। আর হাতির ওপর থেকে অসংখ্য তীর তার দিকে ছুড়ে মারছিল শত্রু সেনারা। এক পর্যায়ে সেনাপতি বুদাইল হাতির কাছে চলে গেলেন, তিনি হাতির শুঁড়ে আঘাত হানবেন, এমন সময় তার কোন সহযোদ্ধার বর্শা হাতির শুঁড়ে আঘাত হানে। হাতি বিকট চিৎকার দিলে সেনাপতি বুদাইলের ঘোড়া ভড়কে গিয়ে উল্টো লাফিয়ে ওঠে। এতে সেনাপতি বুদাইল ঘোড়র পিঠ থেকে পড়ে গেলেন। অমনি শত্রু সেনারা তাকে ঘিরে ফেলল। তিনি পড়ন্ত অবস্থা থেকে ওঠার আগেই শত্রুবাহিনী তাকে ধরে ফেলল কিন্তু দাহির পুত্র গর্জন করে

বলল “ওকে ধরার দরকার নেই ছেড়ে দাও।” সেনারা ছেড়ে দিতেই জেসিয়ার নিক্ষিপ্ত বর্শা তার বুকে বিদ্ধ হলো এবং সেনাপতি বুদাইল শাহাদাত বরণ করলেন।

কেন্দ্রীয় কমান্ডের অভাবে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। বিক্ষিপ্তভাবে আরব সৈন্যরা সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই করল। কিন্তু যুদ্ধের কায়া পাল্টে গেল। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে আহত ও নিহতের সংখ্যা বাড়তে লাগল। অবশেষে অন্ধকার উভয় বাহিনীর মধ্যে দেয়াল সৃষ্টি করলে যে যেদিকে পারে পালাতে লাগল। অন্যথায় মুসলিম বাহিনী প্রায় নিঃশেষে নিহত হতো কিংবা বন্দি হয়ে পৌত্তলিকদের জিন্দানখানায় ধুকে ধুকে মরতে হতো।

সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের মৃত্যু ও মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ের খবর যখন বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পৌছাল, অপমান ক্ষোভ ও অনুতাপে তার মাথা ঝুকে গেল। হাজ্জাজের মনে হচ্ছিল বর্শা সেনাপতি বুদাইলের বুক বিদীর্ণ করেনি, হাজ্জাজের নিজের বুক বিদীর্ণ করেছে। তিনি যখন মাথা ওপরে ওঠালেন, তখন ক্ষোভে তার চেহারা রক্তিম হয়ে গেছে, চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে রক্তবাণ। “এতোটা কাপুরুষ তো ছিল না বুদাইল!” অনুতাপ অনুশোচনা স্বগতোক্তি করলেন হাজ্জাজ। সে একটি শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করে আরেকটি বাহিনীর কাছে হেরে গেল কেন?”

“আমীরে ইরাক! আপনার ওপর আল্লাহ্ রহম করুন। আল্লাহ্ সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের বীরত্ব ও শাহাদাত কবুল করুন। তিনি ভীরু কাপুরুষ ছিলেন না। তিনি শত্রুদের আক্রমণ করতে দুশমনদের মধ্যভাগে চলে গিয়েছিলেন। সেনাপতির কথা ভুলে তিনি সিপাহীতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি হিন্দু সেনাপতির রক্ষণভাগ গুড়িয়ে দিয়েছিলেন। শত্র সেনাপতির নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে তার ঘোড়াকে শত্রু সেনাপতির হাতির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় হাতির ওপর থেকে শত্রু বাহিনী তার ওপর যেভাবে তীর বর্শা নিক্ষেপ করছিল, তা থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করে শত্রু সেনাপতিকে বহনকারী হাতির শুঁড় কেটে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আহত

হাতির ভয়ঙ্কর চিৎকারে তার ঘোড়া ভড়কে গিয়ে লাফিয়ে উল্টে পড়লে তিনি মাটিতে পড়ে যান, আর শত্রু বাহিনীর বর্শা তার গায়ে আঘাত হানে। তার

এই সাহসিকতা বর্ণনাতীত। আল্লাহর কসম! তিনি ভীরু ছিলেন না, ভয় শংকার লেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে।”

ডাভেল থেকে ফিরে আসা তিন সেনার একজন এ কথাগুলো হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে বলল।

“তুমি কি সেখানে উপস্থিত ছিলে?”

“জী, হ্যাঁ, আমীরে ইরাক! আমি যা বলছি, নিজের চোখে তা দেখে এসেছি। আমি তার পিছনেই ছিলাম, তিনি যখন বর্শার আঘাতে লুটিয়ে পড়েন, তখন তার কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে ছিলাম আমি।”

“বুদাইল মারা গেল আর তুমি পালিয়ে এলে? রক্তচক্ষু নিয়ে সেনার দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন হাজ্জাজ। ওর জীবন বাঁচাতে তুমি মরণ স্বীকার করতে পারলে না। সিংহের মতো বাহাদুর সেনাপতিকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করে তুমি পালিয়ে এলে?”

কথা শেষ করতে করতে হাজ্জাজ তরবারী কোষমুক্ত করে এক আঘাতেই সেনার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন।

“কাপুরুষ, ভীতু! ভীতু না হলে কেউ সেনাপতিকে শক্ৰবেষ্টিত রেখে পালিয়ে আসতে পারে না” বলে হাজ্জাজ রক্তমাখা তরবারীটি তার একান্ত প্রহরীর দিকে ছুড়ে মারলেন।

দ্বিতীয় অভিযানের শোচনীয় পরাজয়ের খবরও যথারীতি দামেশকে পৌছে গেল। খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক পরপর দু’বার অভিযান ও পরাজয়ের সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়ে হাজ্জাজকে দামেশকে আসার জন্য বার্তা পাঠালেন।

“আমীরুল মুমিনীন! খলিফার বার্তার লিখিত জবাব দিলেন হাজ্জাজ। আপনি নিষেধ করার পরও কেন দ্বিতীয়বার আমি সিন্ধু অঞ্চলে সেনা পাঠালাম আর শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলাম, এর জবাবদিহির জন্য যদি ডেকে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে এ মুহূর্তে আমি আসতে পারছি না। প্রথম অভিযানের সময় আমি এ শর্তে আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলাম যে, যে ক্ষয়ক্ষতি এ অভিযানে হবে আমি রাজকোষ এর দ্বিগুণ সম্পদে ভরে দেবো। আমি তখনই আমিরুল মুমিনীনের মুখোমুখী হবো, যখন আমার শর্ত আমি পূরণ করতে সক্ষম হবো। সিন্ধু অভিযান এখন আমার অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এখন আমি আমার ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু অভিযানে পাঠাব। আশা করি আমিরুল মুমিনীন আমার এ সিদ্ধান্তে বাধা দেবেন না। জাতির সামনে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করবেন। পৌত্তলিকদের অহমিকা চূর্ণ করে মুসলমানদের বিজয় কেতন সিন্ধু রাজার রাজপ্রাসাদে উড্ডীন করার সুযোগ দিয়ে জাতির আত্মসম্মান অক্ষুন্ন রাখার সুযোগ দেবেন।”

“ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক হাজ্জাজের চারিত্রিক অবস্থা জানতেন। জানতেন হাজ্জাজ কোন ব্যাপারে জিদ ধরলে তা না ঘটিয়ে ক্ষান্ত হয় না। এসব কারণে হাজ্জাজকে তিনি রীতিমত আতঙ্ক মনে করতেন।

খলিফার দূত হাজ্জাজের সকাশে থাকাবস্থায়ই সেনাপতি আমের বিন আব্দুল্লাহ হাজ্জাজের সাথে দেখা করতে এলেন এবং বললেন

“সম্মানিত আমীর! আপনি যদি আমাকে সিন্ধু অভিযানে পাঠান, তাহলে আমি কেবল আগের দু’পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েই ক্ষান্ত হবো না, অভিযানে যতো ব্যয় হয়েছে, তাও পূরণ করে দেবো। আর সিন্ধু এলাকার কর্তৃত্ব আপনার পায়ের নীচে এনে দেবো।” “তোমার মনে যদি কোন বদ চিন্তা না থেকে থাকে, একজন সেনাপতি হিসাবে এ প্রস্তাব করে থাকো, তাহলে তোমার প্রস্তাবের জন্য আমি মোবারকবাদ জানাই। কিন্তু আমার মন বলছে, এ অভিযানের সাফল্য ঘরে তুলতে হলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রয়োজন।” সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের খুবই প্রিয় ব্যক্তি। সেনাপতি বুদাইলের রণকৌশল ও বীরত্বের প্রতি হাজ্জাজ ছিলেন আস্থাশীল। সেনাপতি বুদাইলের মৃত্যুতে হাজ্জাজ খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি একদিন বসরার কেন্দ্রীয় মসজিদের মুয়াযিনকে ডেকে বললেন, “আল্লাহ্ তোমার ওপর রহম করুন এবং তোমার কণ্ঠের আওয়াজকে আরো বুলন্দ করে দিন। তুমি আজ থেকে প্রত্যেক আযানের পর সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের নাম উচ্চ আওয়াজে উচ্চারণ করবে, যাতে আমি তার কথা ভুলে না যাই, তার রক্তের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতির ব্যাপারে সতর্ক থাকি এবং প্রতি নামাযের পর বুদাইলের জন্য দোয়া করতে পারি।”

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দ্বিতীয় সিন্ধু অভিযান যখন ব্যর্থ হয়েছে এবং সেনাপতি বুদাইলের শাহাদাত ও মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ে হাজ্জাজ প্রতিশোধ স্পৃহায় অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছেন, তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম পারস্যের সিরাজ এলাকার গভর্নর। কয়েক মাস আগে হাজ্জাজ বিন ইউসুফই মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে এই বলে পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, রায়া এলাকায় যে উপজাতীয়রা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, এসব বিদ্রোহ দমনের জন্য তুমি সেনা অভিযানের প্রস্তুতি নাও। সেনাভিযান ছাড়া এসব উপজাতীয় বিদ্রোহ দমনের বিকল্প কোন পন্থা নেই। উপজাতীয়দের বিদ্রোহের দুঃসাহস চিরতরে নিঃশেষ করে দাও। নয়তো এরা এক সময় সালতানাতের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন হাজ্জাজের নির্দেশে উপজাতীয় বিদ্রোহ দমনে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন এবং রায়া অঞ্চলের বিদ্রোহ দমনে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছেন, ঠিক এমন সময় তাঁর কাছে হাজ্জাজের পয়গাম এলো–

“প্রিয় বৎস! আজ সেই সময় উপস্থিত, যার জন্য আমি তোমাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি। রায় অভিযান মুলতবি রেখে তুমি সিরাজেই অবস্থান নাও। আমি তোমার জন্য সৈন্য পাঠাচ্ছি। কয়েক দিনের মধ্যে বাহিনী পৌছে যাবে। তোমাকে সিন্ধু অভিযানে যেতে হবে। আমি যে কোন মূল্যে সিন্ধু অঞ্চলকে সালতানাতের পতাকাতলে দেখতে চাই। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে অবিলম্বেই জানতে পারবে। ইতোমধ্যে আমাদের দুটি অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিস্তারিত দূতের কাছ থেকে জেনে নিও। আল্লাহর কাছে শুধু এতটুকুই কামনা, তিনি যেন তোমার এ অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত না করেন।”

তৃতীয় ও চূড়ান্ত সিন্ধু অভিযানের প্রস্তুতির জন্যে হাজ্জাজ নাওয়া খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলেন। দিনরাত তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও রসদপত্রের আয়োজনে। এক শুক্রবারে বসরার সকল পুরুষকে একত্রিত করে তিনি ভাষণ দিলেন— “হে বসরাবাসী! তোমাদের মনে রাখা উচিত, সময় দু’ধারী তরবারীর মতো। সময় শতত পরিবর্তনশীল। আজ এর পক্ষে তো কাল ওর পক্ষে। সময় কখনো আমাদের অনুকূলে থাকে, আবার কখনো আমাদের প্রতিকূলে চলে যায়। অনুকূল পরিস্থিতিতে আমাদের আলস্যে ভর করা উচিত নয়। সময় অনুকূলে থাকার সময় আমাদের উচিত নিজেদের শক্তিকে শাণিত এবং সেনাবাহিনীকে

সংগঠিত ও সুসংহত করা। আর সময় প্রতিকূলে চলে গেলে সময়ের বয়ে আনা প্রতিকূলতাকে শক্ত ও দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা। সর্বাবস্থায় আল্লাহর শোকর আদায় করা। আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও অফুরন্ত অনুগ্রহ বিস্মিত হওয়া মোটেও ঠিক নয়। আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহর অনুগ্রহের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়…। প্রিয় বসরাবাসী! আমি সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের কীর্তি ভুলতে পারছি না। স্বজাতির এক অসহায় কন্যার ফরিয়াদ আমার কানে সব সময় ধ্বনিত হচ্ছে। হাজ্জাজ! আমাদের উদ্ধার করো, হাজ্জাজ। আমাদের সাহায্য করো…।” বুদাইলের রক্তের প্রতিশোধও আমাকে অস্থির করে তুলেছে। মনে হয় সে আমাকে ডাকছে, হাজ্জাজ প্রতিশোধ নাও, হাজ্জাজ পৌত্তলিকদের দর্প চূর্ণ করো…। আল্লাহর কসম! আমি অসহায় আরব নারী-শিশুদের উদ্ধার ও সেনাপতি বুদাইলের রক্তের প্রতিশোধ নিতে ইরাকের সমস্ত সম্পদ ঢেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবো না। পৌত্তলিকদের উচিত শিক্ষা না দেয়া পর্যন্ত আমার চিত্ত স্থির হবে না।

হে আরববাসী! শুধু আরবদের জাত্যাভিমান নয়; ইসলামের চেতনার মর্ম মূলে আঘাত হেনেছে এক মূর্তিপূজারী বেঈমান রাজা। রাজা দাহির আমাদের নারী-শিশু বন্দি করে আমাদের তিরস্কার করছে। তোমরা কি দুশমনদের বুঝিয়ে দিতে অক্ষম যে, কোন্ জাতিকে উস্কানী দিচ্ছে এ পৌত্তলিক। নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় যে জাতি অবলীলায় প্রাণ বিসর্জন দিতে ভ্রূক্ষেপ করে না, অসহায় আর্তের সাহায্য যে জাতির ঐতিহ্য, সেই জাতির ধমনী কি আজ এমনই শীতল হয়ে গেছে, শরীরের রক্ত কি জমে গেছে? স্বীয় কন্যা-জায়াতরুণীদের সম্ভ্রম ও শিশুদের জীবন বাঁচানোর আর্তনাদেও কি আমাদের চৈতন্যোদয় হবে না?

হাজ্জাজের ভাষণ শেষ হতে না হতেই চতুর্দিক থেকে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার, জিহাদ, আল জিহাদ, লাব্বাইকা ইয়া হাজ্জাজ। শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠল। আবেগ উত্তেজনায় উত্তাল হয়ে ওঠল সমাবেশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *