৭. কার্লটন হোটেলে

কার্লটন হোটেলে উঠলেন সেনটেইন আর শাসা। ত্রিশ শতাংশের মালিকানা থাকাতে শহরে এলে তার জন্য বরাদ্দ হয়ে যায় রয়্যাল স্যুইট।

গসিপ হবার সম্ভাবনা আছে জেনেও রাত দুটো অব্দি হোটেলের টপ ফ্লোরের নাইট ক্লাবে একসাথে নাচলেন ব্লেইন আর সেনটেইন। ঠিক করেছেন এ কয়েকদিন মাথা থেকে ব্যবসা সরিয়ে কেবল রেইনকেই মনোযোগ দিবেন।

পরের দিন কেপটাউন ছেড়ে আসার জন্য ইসাবেলাকে যে কারণ দেখিয়েছেন সেই ইউনিয়ন বিল্ডিঙ্গের মিটিংয়ে ব্যস্ত রইলেন ব্লেইন। তাই শাসার সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেলেন সেনটেইন।

বিকালবেলায় সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় গেলেন। লেকে নৌকা বাইবার ফাঁকে ফাঁকে শাসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও কথা বললেন। সেনটেইন শুনে খুশি হলেন যে ছেলে এখনো মাস্টার্স ডিগ্রি শেষে কোর্টনি মাইনিং আর ফিন্যান্স কোম্পানির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছে।

অতঃপর কার্লটনে ফিরে এসে বক্সিং দেখার জন্য প্রস্তুতি। হুইস্কি আর সোডা নিয়ে আচেয়ারে বসে সাজগোজে মত্ত সেনটেইনকে দেখছেন ব্লেইন। ব্যাপারটা সেনটেইনও উপভোগ করেন। মনে হয় যেন নব বিবাহিত দম্পতি তারা দু’জনে। সাজ শেষে নিজের লম্বা স্কার্ট পরে এক পাক ঘুরে জানতে চাইলেন, “আমি আগে আর কখনো বক্সিং ম্যাচ দেখিনি। একটু বেশিই সাজগোজ হয়নি তো?”

“একদমই না।”

“ওহ, গড, আমার ভীষণ নার্ভাস লাগছে। যদি সুযোগ পাই তো ওকে যে কী বলব সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না” থেমে গেলেন সেনটেইন। “টিকিট তো পেয়েছে তাই না?”

 ব্লেইন টিকিট দেখাতেই হেসে ফেললেনই সেনটেইন। “ফ্রন্ট রো। এছাড়া কার আর ড্রাইভারও পেয়েছি।”

ডিনার জ্যাকেটের কাঁধে সিল্কের স্কার্ফ পেঁচিয়ে স্যুইটে ঢুকল শাসা।

“ওকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে” ছেলেকে দেখে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন, “কেমন করে ওকে আমি ওসব বদসঙ্গ থেকে বাঁচাব?”

 মা’কে শ্যাম্পেন ঢেলে দিলো শাসা। ব্লেইনকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার হুইস্কি বদলে দিব স্যার?”

“থ্যাংকস; কিন্তু আমার জন্য এই একটাই যথেষ্ট শাসা।” তবে ছেলের একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত সেনটেইন। মদের ব্যাপারে শাসার কোনো আসক্তি নেই।

“ওয়েল মা, জানতে চাইল শাসা,” “হঠাৎ করে তুমি বক্সিং দেখতে কেন আগ্রহী হলে? এ খেলার উদ্দেশ্য জানো?”

 “মনে হয় রিংয়ে উঠে দু’জন তরুণ কেবল পরস্পরকে মেরে ফেলতে চায়। তাই না?”

“একদম ঠিক বলেছো সেনটেইন।” হা হা করে হেসে ফেললেন ব্লেইন। এই প্রথমবারের মত সেনটেইনের চিন্তা হল যে ব্লেইন আর তাকে নিয়ে শাসা নয়া জানি কী ভাবে। তবে এসব ভেবে সন্ধ্যাটাকে মাটি করতে চান না। তাই শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুতৃপূর্ণ দুই পুরুষের হাত ধরে লিমোজিনে চড়ে বসলেন সেনটেইন।

উইটওয়াটারস্রান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামের চারপাশে তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। তাই বাধ্য হয়ে দুইশ গজ দূরে থাকতেই গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বাকিদের সাথে এগোতে লাগলেন তিনজনে।

হলের চারপাশে আর ভেতরে প্রচণ্ড হইচই চলছে। নিজেদের সিটে বসার পর আশপাশে তাকিয়ে সেনটেইন খুশি হয়ে গেলেন দেখে যে ভিড়ের মধ্যে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের সমান আর প্রায় সকলেই ইভনিং ড্রেস পরে এসেছে।

প্রাথমিক পর্যায় শেষে পার হয়ে গেল আরেকটা দফা। অধীর আগ্রহে তাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন সেনটেইন। আর যেই না মাত্র শেষ হওয়া খেলার ফাইটাররা ঘর্মাক্ত মুখে রিং থেকে নেমে এল, হল জুড়ে বসে গেল তুমুল এক হর্ষধ্বনি। সবাই গলা বাড়িয়ে কেবল ড্রেসিংরুমের দিকে তাকাচ্ছে।

 প্রোগ্রাম বুক চেক করে ব্লেইনও বিড়বিড় করে উঠলেন, “হুম, সময় হয়েছে।”

আর তারপরেই লোমহর্ষক দর্শক।

“ওই তো সে এসেছে।” সেনটেইনের হাত স্পর্শ করলেন ব্লেইন। কিন্তু কিছুতেই যেন মাথা ঘোরানোর সাহস পাচ্ছেন না সেনটেইন।

“ইশ না আসলেই বোধ হয় ভালো হত।” আপন মনেই ভাবলেন তিনি। তারপর কী মনে করে সিটে আরো জমে গিয়ে বললেন, “ও যেন আমাকে দেখতে না পায়।”

কোচ আর দু’জন সেকেন্ডকে নিয়ে প্রথমে রিংয়ে এল লাইট হেভিওয়েট চ্যালেঞ্জার ম্যানফ্রেড ডি লা রে। সাথে সাথে চিৎকারে ফেটে পড়ল স্টিলেনবশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীর দল। সবার হাতে উড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙে রাঙানো ব্যানার। পাল্টা চিৎকার করে উত্তর দিল উইটের ছাত্ররা। সম্মিলিত গর্জনে মনে হচ্ছে কানে তালা লেগে যাবে। যাই হোক, রিংয়ে উঠে খানিক ডান্স করেই গ্লাভস পরিহিত হাত দুটো মাথার উপর তুলে ধরল ম্যানফ্রেড। কাঁধে দুলছে। সিল্কের গাউন।

মাথার লম্বা চুলগুলো মেঘের মত গাঢ় আর ঘন হয়ে আছে। শক্তিশালী চোয়াল, উন্নত কপাল আর গাল যেন শিল্পীর হাতে কুঁদে তৈরি করা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে চোখে পড়ে ছেলেটার দুটো চোখ। ঘন জ্বর নিচে তাকিয়ে আছে যেন শিকারি বিড়াল।

চওড়া কাঁধ দুটো থেকে বাকি শরীর পিরামিডের মত নেমে এসেছে কোমরের উপরে। মেদহীন শরীরে স্পষ্টভাবে ফুটে রয়েছে প্রত্যেকটা পেশি।

ম্যানফ্রেডকে দেখার সাথে সাথে চিনে ফেলল শাসা। শক্ত হয়ে বসে রইল নিজের চেয়ারে। পরিষ্কারভাবে মনে পড়ে গেল মাছের পের ভেতরে ডুবে যাওয়ার স্মৃতি।

 “আমি ওকে চিনি মা” দাঁতে দাঁত ঘসে ঘোঁত ঘোত করে বলে উঠল শাসা। “ওয়ালবিস বের জেটিতে আমি ওর সাথেই ফাইট করেছিলাম।” ছেলের দিকে না তাকিয়ে কিংবা মুখে কিছু না বলে শাসার হাত ধরে ওকে শান্ত করতে চাইলেন সেনটেইন। তারপর চোরা চোখে তাকালেন ব্লেইনের দিকে। যা দেখলেন তাতে আরো মুষড়ে পড়লেন তিনি।

কর্নেলের থমথমে মুখখানা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যে তার ভেতরে কতটা ঝড় বইছে। সেনটেইনের ব্যভিচারিতার প্রমাণ চোখের সামনে দেখে নিশ্চয়ই সে লোকটার উপর চটে উঠছেন যে তার গর্ভে ম্যানফ্রেডকে দিয়েছে আর সবচেয়ে বড় কথা সে কাজে সেনটেইনেরও সমান মাত্রায় অংশগ্রহণ ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জীবন বাজি রেখে যে অচেনা মানুষটার বিরুদ্ধে লড়েছেন সে লোকটিই কিনা সেনটেইনের শরীর স্পর্শ করেছে যা একান্তভাবে কেবল ব্লেইনেরই।

 “ওহ গড, আমি কেন এখানে এলাম?” আপন মনে নিজেকেই গালি দিলেন সেনটেইন আর সাথে সাথে উত্তরটাও পেয়ে গেলেন।

“আমার শরীর থেকে জাত শরীর, আমার রক্তকে দেখার জন্য।”

মনে পড়ে গেল গর্ভে বেড়ে উঠা ছোট্ট ম্যানফ্রেডের কথা। বুকের গভীর থেকে উঠে এল মাতৃত্বের হাহাকার। মাথার ভেতরে যেন স্পষ্ট শুনতে পেলেন সদ্য ভূমিষ্ঠ ম্যানফ্রেডের কান্না।

“মাই সান!” প্রায় সজোরেই ডুকরে উঠলেন সেনটেইন, “আমার নিজের ছেলে।”

রিংয়ের ভেতরে দাঁড়ানো সুদর্শন তরুণ ঠিক সেই মুহূর্তেই মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি তার দিকে তাকাল। দু’হাত পাশে ঝুলিয়ে চিবুকটাকে উঁচু করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ম্যানফ্রেড। হলুদ চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে তীব্র ঘৃণা। সপাং করে যেন চাবুকের বাড়ি খেলেন সেনটেইন। আর তার পরেই ম্যানফ্রেড ডি লা রে ইচ্ছে করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল নিজের কর্ণারে।

চারপাশের হৈচৈ’র মাঝে চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে রইলেন তিনজন। শাসা, সেনটেইন আর ব্লেইন। পরস্পরের দিকে কেউ তাকাল না পর্যন্ত। কেবল কোলের ওপর রাখা সিকুইনের শাল খামচে ধরে ঠোঁট চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন সেনটেইন।

লাফ দিয়ে রিংয়ে উঠে গেল বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। ম্যানফ্রেডের চেয়ে এক ইঞ্চি খাটো হলেও ইয়ান রাশমোরই বেশি চওড়া আর হাত দুটোও অত্যন্ত পেশিবহুল। মোটা মাথার উপর কোঁকড়ানো কালো চুল দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ছেলেটা কতটা ভয়ংকর আর বুনো স্বভাবের।

বেল বাজার সাথে সাথে তুমুল চিৎকারের মধ্যে দিয়ে রিংয়ের মাঝখানে এল দুই ফাইটার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভয়ে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন।

যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছে তেমনিই আচমকা শেষ করে সেকেন্ডের ছোট্ট ভিড়ে যার যার দলের কাছে চলে গেছে দুই ফাইটার। দ্রুতহাতে স্পঞ্জ করে, মেসেজ করে দিয়েছে সেকেন্ড খেলোয়াড়েরা। সাথে কানে কানে ফিসফিস করে কীসব বলেছে।

 বড়সড় আকার আর কালো দাড়িঅলা কোচের হাতের বোতল থেকে মুখ ভর্তি পানি পান করে নিয়েছে ম্যানফ্রেড। কুলকুচো করে কী মনে করে যেন আবার সেনটেইনের দিকে তাকাল। ভিড়ের মাঝে ঠিকই তাকে খুঁজে নিয়েছে ওই ভয়ংকর জোড়া চোখ। তারপর ইচ্ছে করেই পায়ের কাছে রাখা বালতিতে থুথু ফেলল। চোখের দৃষ্টি কিন্তু একটুও বদলালো না। সেনটেইন বুঝতে পারলেন যে ছেলেটা তাকে কতটা ঘৃণা করে। কুঁকড়ে গেলেন সেনটেইন আর ঠিক তক্ষুণি পাশ থেকে বিড়বিড় করে উঠলেন ব্লেইন। “এই রাউন্ড ড্র হবে। ডি লা রে একটুও ছাড় দিচ্ছে না।”

এরপরই বক্সাররা আবার মাঝখানে চলে এল। চামড়ায় মোড়ানো মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে পরস্পরের দুপাশে ঘুরছে দু’জনে। যে যেখানে অপরজনের আঘাত পেয়েছে লাল হয়ে গেছে শরীরের সে অংশ। আস্তে আস্তে এতটা নিষ্ঠুরতা আর ব্যথা দেখে মনে হয় অসুস্থ হয়ে যাবেন সেনটেইন।

 “এবারে রাশমোর পার পেয়ে গেছে।” রাউন্ড শেষ হতেই আস্তে করে জানালেন ব্লেইন। কর্নেলের এতটা শান্ত ভাব দেখেই বরঞ্চ খেপে যাচ্ছেন সেনটেইন। ওদিকে ব্লেইন বলেই যাচ্ছেন, “পরের দুই রাউন্ডেই ওকে শেষ করতে হবে ডি লা রে কে। নতুবা রাশমোর জিতে যাবে। ওর আত্মবিশ্বাস কেবল বেড়েই যাচ্ছে।”

সেনটেইনের মন চাইল উঠে দাঁড়িয়ে হল থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু পা দুটো যেন সীসার মত ভারি হয়ে গেছে। আবারো বেল বাজার সাথে সাথে ফ্লাডলাইটের আলোয় এল দুই বক্সার। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সেনটেইন। জানেন তিনি কখনোই ভুলতে পারবেন না এসব দৃশ্য।

 রাশমোরের উপর চড়াও হল ম্যানফেড। দাঁত কিংবা হাড় কিছু একটা ভাঙার শব্দ শুনেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। কিন্তু তার সে চিৎকার হারিয়ে গেল দর্শকদের তুমুল গর্জনের মাঝে। নিজের মুখের ভেতরে আঙুল পুরে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছেন সেনটেইন। চোখের সামনে দেখছেন তার শরীর থেকে জাত সন্তানের চোখ দুটোতে কী ভয়ংকর হত্যার নেশা খেলা করছে। ঠিক যেন খুনে একটা পশু হয়ে গেছে ম্যানফ্রেড। পা ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে গেল রাশমোর। চিৎ হয়ে শুয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল মাথার উপরকার লাইটের দিকে। চুরমার হয়ে যাওয়া নাক থেকে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। এখনো এত উন্মত্তের মত ম্যানফ্রেড ঘুরছে যে সেনটেইনের মনে হল বুঝি নেকড়ের মত গর্জে উঠবে কিংবা রক্তাক্ত রাশমোরের মাথাটা ছিঁড়ে বাতাসে দোলাবে।

“আমাকে বাইরে নিয়ে চলো ব্লেইন” ফুঁপিয়ে উঠলেন সেনটেইন। “এখান থেকে অন্য কোথায় নিয়ে চলো।” হাত ধরে সেনটেইনকে দাঁড় করিয়ে বাইরে নিয়ে এলেন ব্লেইন।

পেছনে আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে গেল রক্ত হিম করা গর্জন। হাইভেন্ডের শীতল প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন যেন একটুর জন্য ডুবে মরার হাত থেকে বেঁচে গেছেন।

***

“কালাহারির সিংহ বার্লিনে নিজের টিকিট পেয়ে গেছে। প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা ম্যানফ্রেডের সংবাদ পড়ে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। বিছানার কিনারে নিউজপেপারটাকে রেখেই তাড়াতাড়ি টেলিফোন হাতে তুলে নিলেন।

 “শাসা, আমরা কত তাড়াতাড়ি রওনা দিতে পারব?” ঘুমকাতুরে চোখে বিড়বিড় করে কী যেন উত্তর দিলো শাসা। এদিকে গালে শেভিং ফোম নিয়েই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন ব্লেইন।

“তুমি ঠিক করে ফেলেছে?” সেনটেইন ফোন নামিয়ে রাখতেই জানতে চাইলেন ব্লেইন।

“ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই।” উত্তরে জানালেন সেনটেইন, “দেখেছো না ও আমার দিকে কেমন করে তাকিয়েছিল।”

“হয়ত আবার কখনো ব্লেইন চাইলেন সেনটেইনকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু। তার চোখে বিষণ্ণতা দেখে দৌড়ে এসে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরলেন ব্লেইন।

অলিম্পিক ট্রায়ালসের প্রথম দিনেই প্রায় এক সেকেন্ডে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে নিজের সেরাটা দেখাল ডেভিড আব্রাহামস। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে আশানুযায়ী তেমন ভালো করতে পারল না। কিন্তু এরপরেও লিস্টে সবার আগেই এল তার নাম। পাশে বসে বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে দিলো শাসা। ডেভিডও বার্লিন যাচ্ছে।

***

দুই সপ্তাহ পরে জোহানেসবার্গের ইনান্ডা ক্লাবে বসল পোলো ট্রায়াল। ফাইনাল ডে’র শেষ ম্যাচে ব্লেইনের নির্ধারিত A’ টিমের বিপরীতে সম্ভাব্য B’ টিমের জন্য নির্বাচিত হল শাসা।

 গ্রান্ডস্টান্ডে বসে শাসার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা খেলাটা দেখলেন সেনটেইন। কিন্তু বুঝতে পারছেন যে এটুকুই যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে দলের দুই নম্বরের খেলা ক্লাইভ রামসে যাকে হয়ত বার্লিনে পাঠানো হতে পারে। সারা সপ্তাহ জুড়ে চমৎকার খেলল। বেয়াল্লিশ বছর বয়স্ক রামসে এর আগেও প্রায় ত্রিশটা ম্যাচে ব্লেইনের সেকেন্ড হিসেবে খেলেছে। সেনটেইন জানেন যে নির্বাচকেরা তাই নিশ্চয়ই রামসেকে রেখে তরুণ আর মেধাবী হলেও অভিজ্ঞতাহীন শাসাকে নির্বাচন করবে না।

ইতিমধ্যেই নির্বাচকদের সিগারেটের ধোয়া আর মাথা নাড়ানো দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন সেনটেইন। লোকগুলো হয়ত খানিক বাদেই ঘোষণা দিবে যে, “ইয়ং কোর্টনি আগামীবার তার চান্স পাবে।” মনে হচ্ছে লোকগুলোকে এখন থেকেই ঘৃণা করা শুরু করে দেবেন সাথে ব্লেইন ম্যালকমস’কেও কিন্তু হঠাৎ করেই ভিড়ের মধ্য থেকে এত প্রচণ্ড হুল্লোড় উঠল যে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।

মাঝমাঠে ক্লাইভ রামসেকে চ্যালেঞ্জ করেছে শাসার টিম-মেট। ব্যাপারটা হয়ত ইচ্ছেকৃত নয় কিন্তু ফাউল করে ক্লাইভকে ঘোড়র উপর থেকে শক্ত গ্রাউন্ডে ফেলে দিল ছেলেটা। সন্ধ্যার সময়ে এক্স-রে রিপোর্টে দেখা গেল যে রামসের হাড়ে বেশ কয়েকটা ফাটল দেখা গেছে। অর্থোপেডিক সার্জন অপারেশন করতে বাধ্য হয়েছেন। নির্দেশ দিলেন যে, “অন্তত এক বছরের জন্য পোলো খেলা বন্ধ।”

তাই নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত এখন কী হয় শোনার জন্য উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে রইলেন সেনটেইন। আর আগে যেমনটা বলেছিলেন ঠিক সেভাবেই শাসার নাম এলে সিলেকটর’স রুম থেকে বের হয়ে এলেন ব্লেইন ম্যালকমস। একটু বাদেই অবশ্য চেয়ারম্যান ডেকে নিয়ে জানালেন যে, “ভেরি ওয়েল, ইয়ং কোর্টনি ক্লাইভের জায়গায় খেলবে।” স্বভাবতই উল্লসিত হয়ে উঠলেন ব্লেইন। আনমনে এর আগে কতদিন ভেবেছেন যে শাসার মত তার নিজের একটা ছেলে থাকলে কত না ভালো হত।

তাই প্রথম সুযোগেই সেনটেইনকে ফোন করলেন ব্লেইন, “শুক্রবারের আগে ঘোষণা দেয়া হবে না। তবে বার্লিনের টিকিট পেয়ে গেছে শাসা।”

অস্থির হয়ে উঠলেন সেনটেইন, “ওহ, ব্লেইন ডার্লিং, শুক্রবার পর্যন্ত কীভাবে ধৈৰ্য্য রাখব আমি?” আনন্দিত কণ্ঠে জানালেন, “তিনজন একসাথে বার্লিন যাব। কত মজা হবে তাই না! চাইলে ডেইমলার নিয়েই ইউরোপে যাওয়া যাবে। প্যারিসে কয়েকটা দিন কাটালে তুমি আমাকে লাজারেতে ডিনার করাতে নিয়ে যেও। অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে। ঠিক আছে, শনিবারে দেখা হলে বাকি কথা বলব।”

“শনিবার?” ভুলেই গিয়েছিলেন ব্লেইন।

“স্যার গ্যারির জন্মদিন, পাহাড়ের উপর পিকনিক!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন, “বছরের এমন কয়েকটা দিনেই কেবল আমরা বৈধভাবে একসাথে সবার সামনে আসতে পারি।”

“এত তাড়াতাড়ি আবার স্যার গ্যারির জন্মদিন চলে এল? কত দ্রুত সময় যাচ্ছে!”

“ওহ, ব্লেইন, তুমি কিন্তু কোনো বাহানা করবে না। এ বছর তো ডাবল সেলিব্রেশন হবে। জন্মদিন আর শাসার বার্লিন যাওয়া। প্রমিজ করো যে আসবে।”

খানিক দ্বিধায় ভুগলেন ব্লেইন। এরই মাঝে ইসাবেলা আর মেয়েদেরকে কথা দিয়ে রেখেছেন যে সপ্তাহান্তের ছুটিতে নানীর বাসায় নিয়ে যাবেন।

 “আই প্রমিজ সুইটি, আমি সময়মত চলে আসব।” সেনটেইন কখনো জানতেও পারবে না যে, এর জন্য ইসাবেলা তাকে কতটা শাস্তি দিবে।

আসলে অনবরত শারীরিক ব্যথা আর ওষুধ খাবার কারণেই খিটখিটে হয়ে গেছেন ইসাবেলা। মনে মনে নিজেকে এই বলে বোঝালেন ব্লেইন যে, ইসাবেলা এখনো সেই বিয়ের সময়কার মতই অনিন্দ্যসুন্দরী আছেন। কেবল ভয়ংকর সে অ্যাকসিডেন্টের কারণেই দিনকে দিন কংকালে পরিণত হচ্ছেন। বাঁকানো হাড় জিরজিরে পা দুটোতে একটুও মাংস নেই।

ঠোঁটগুলোও এত শুকিয়ে গেছে যে বেরিয়ে পড়েছে সবকটা দাঁত। তাই হাসলে কিংবা রেগে গেলে দেখা যায় সাদা মাঢ়ি।

শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে দেহত্বক। স্পষ্ট দেখা যায় হাত আর কপালে নীল শিরা। কেবল চোখ দুটোই হল জীবন্ত।

“কীভাবে এমনটা পারলে ব্লেইন?” তীক্ষ্ম কণ্ঠে জানতে চাইলেন ইসাবেলা, “তুমি কিন্তু আমার কাছে প্রমিজ করেছিলে, ঈশ্বর জানে আমি এই উইকেন্ডের জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছি।” একের পর এক বাক্যবাণে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ইসাবেলা। চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, যাও তোমার পিকনিক করে এসো। জানি, আমি তোমার কাছে কতটা বোঝ। জানি আমার সাথে কয়েক মিনিট কাটাতেও তোমার কত আপত্তি”

 আর সহ্য করতে পারলেন না ব্লেইন। হাত তুললেন স্ত্রীকে শান্ত করার জন্য; বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, মাই ডিয়ার। আমারই ভুল হয়েছে। ঠিক আছে এ ব্যাপারে আমরা আর কখনো কথা বলব না। আমি তোমার সঙ্গেই যাব।” হঠাৎ করেই ইসাবেলার চোখ দুটোতে প্রতিশোধপরায়ণতার হাসি ফুটতে দেখে জীবনে প্রথমবারের মত স্ত্রীকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করলেন ব্লেইন। কিন্তু সাথে সাথেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে অপরাধবোধেও ভুগতে শুরু করলেন। তাই তাড়াতাড়ি হুইল চেয়ারের কাছে গিয়ে দু’হাত দিয়ে ইসাবেলার হাড়সর্বস্ব হাত দুখানা ধরে সাবধানে স্ত্রীর ঠোঁটে কিস্ করে বললেন,

“আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ।” কিন্তু হঠাৎ করেই মনের মাঝে ভেসে উঠল কফিনের ভেতরে শুয়ে থাকা ইসাবেলার শান্ত, সুন্দর, পবিত্র চেহারার দৃশ্য। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে ছবিটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন ব্লেইন। কিন্তু মনে হল কিছুতেই পারছেন না।

 “ওহ, খানিক সময় একসাথে কাটাতে পারলে কত মজাই না হবে, তাই না!” স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরলেন ইসাবেলা, বললেন “এমনিতে তো আমরা কথা বলার তেমন সুযোগই পাই না। তুমি সারাক্ষণ পার্লামেন্টে নয়ত পোলো ফিল্ডে থাকো।”

 “প্রতিদিন সকাল আর সন্ধ্যায় তো তোমার সাথে দেখা হচ্ছে।” সাফাই গাইলেন ব্লেইন।

 “কিন্তু কথা তো হয় না। এমনকি এখন পর্যন্ত বার্লিন নিয়েও কথা হল।”

“আলোচনা করার বেশি কিছু কী আছে ডিয়ার?” সাবধানে স্ত্রীর হাত ছাড়িয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন ব্লেইন

“অবশ্যই আছে।” মাঢ়ি দেখিয়ে হেসে ফেললেন ইসাবেলা; কিন্তু বিরক্ত হলেন ব্লেইন, “অনেক ধরনের প্রস্তুতি নেয়া বাকি আছে। তাহলে টিম কখন রওনা হবে?”

“আমি হয়ত টিমের সঙ্গে যাব না।” আবারও সাবধানে উচ্চারণ করলেন ব্লেইন, “হয়ত কয়েক সপ্তাহ আগেই রওনা দিব। কারণ লন্ডন আর প্যারিস থেমে ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চ গভর্নমেন্টের সাথে আলোচনা সেরে তবেই বার্লিন যাব।”

“ওহ, ব্লেইন তারপরেও তো আমি তোমার সঙ্গে যাবে আর এ কারণেই অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে।” বললেন ইসাবেলা।

নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলেন ব্লেইন। জানেন যে ইসাবেলা তাকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন, “ইয়েস। সাবধানে পরিকল্পপনা করতে হবে।”

কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব। তাহলে তিনি সেনটেইনের সাথে কীভাবে সময় কাটাবেন! তাই বললেন, “তবে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে ডিয়ার; এই ভ্রমণের জন্য তোমার শরীর না খারাপ হয়ে যায়!”

“তুমি চাইছে না যে আমি তোমার সঙ্গে যাই, তাই না?” চড়া গলায় জানতে চাইলেন ইসাবেলা।

“না তা না “

“আমার কাছ থেকে সরে যাবার জন্য এরকম সূবর্ণ সুযোগ তো তুমি আর পাবে না।”

“ইসাবেলা, প্লিজ নিজেকে শান্ত করো। নয়তো তোমার”।

“আমার প্রতি তোমার কত টান দেখানোর জন্য খবরদার কোনো ভান করবে না, নয় বছর ধরে তোমার কাছে আমি বোঝা হয়ে আছি। আমি নিশ্চিত যে এখন তুমি আমার মৃত্যুও কামনা করো।”

“ইসাবেলা” কথাটার সত্যতা উপলব্ধি করে কেঁপে উঠলেন ব্লেইন।

“ওহ, আমার সামনে ন্যাকামি করো না ব্লেইন ম্যালকমস। হয়ত আমি এই চেয়ারে বন্দি হয়ে আছি; কিন্তু আমি সব দেখি, সব শুনি।”

“এভাবে কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছেই নেই।” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “তুমি আবার যখন শান্ত।

“বসো!” হিসহিস করে উঠলেন ইসাবেলা, “তোমার ইচ্ছে মতন যখন তখন ওই ফরাসি বেশ্যাটার কাছে আর ছুটে যেতে দিব না!” এমনভাবে কুঁকড়ে উঠলেন ব্লেইন যেন মুখে চাবুকের বাড়ি খেয়েছেন। ওদিকে ইসাবেলা বলেই চলেছে, “ওহ, ঈশ্বর অবশেষে কথাটা বলেই ফেললাম। আরো কতবার যে বলতে চেয়েছি তোমার কোনো ধারণাই নেই। বলতে পেরে আমার কল যে শান্তি লাগছে। বেশ্যা, দুশ্চরিত্রা!”

“এভাবে যদি বলতে থাকো, তাহলে আমি চললাম” সতর্ক করে দিলেন। ব্লেইন।

“বেশ্যা! বেশ্যা!”

 ঘুরে দাঁড়িয়েই হাঁটা ধরলেন ব্লেইন।

“প্লিজ কাম ব্যাক! ব্লেইন!” পেছন থেকে চিৎকার করতে লাগলেন ইসাবেলা, “ব্লেইন, আয়্যাম সরি। প্লিজ কাম ব্যাক!” স্ত্রীকে অবজ্ঞা করতে পারলেন না ব্লেইন। ফিরে এলেন কিন্তু এত রেগে গেছেন যে হাত-পা কাঁপছে। তাই পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। নরম স্বরে বললেন, “অল রাইট। সেনটেইন কোর্টনি সম্পর্কে যা বলেছ তা সত্যি। আই লাভ হার। কিন্তু এটাও সত্যি যে আমরা দুজনেই চেষ্টা করেছি যেন তুমি কোনোভাবে আঘাত না পাও। তাই ওর সম্পর্কে আর এভাবে কথা বলবে না। সে চাইলে বহু বছর আগেই আমি ওর কাছে চলে যেতাম তোমাকে ছেড়ে। ঈশ্বর আমায় মাফ করুন; কিন্তু এটাই সত্যি। কেবলমাত্র সেই আমাকে এখানে থাকতে বাধ্য করেছে।”

ব্লেইনের মনে হল ঠিক তার মতই কাঁপছেন ইসাবেলা; অথবা এটা তার মনের ভুলও হতে পারে। খানিক বাদে ইসাবেলা বললেন, “আমি জানি আমি তোমার সাথে বার্লিন যেতে পারব না। এরই মাঝে উ, যোসেফের সাথে কথা বলেছি আর তিনিও আমাকে এতটা ধকল নিতে মানা করেছেন। এটাও জানি যে, তুমি আর সে মিলে নানা প্ল্যান করেছে। নিজের ক্ষমতা খাটিয়ে শাসা কোর্টনিকে টিমে ঢুকিয়েছ যেন তাকে সঙ্গে নেয়ার অজুহাত পাও। জানি তোমরা রোমাঞ্চকর সময় কাটানোর প্ল্যান করছে আর আমি তোমাকে বাধা দিতে পারবোও না–”

ক্ষেপে গিয়ে ইসাবেলাকে থামানোর জন্য হাত তুললেন ব্লেইন। আবারো– তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ইসাবেলার গলা।

“ওয়েল, শুনে রাখো তাহলে তোমরা দুজনে যে হানিমুনের প্ল্যান করছো তা কিছুতেই সত্য হবে না। আমি তারা আর ম্যাথিল্ডাকে বলেছি যেন ওরা তোমার সঙ্গে যায়। তাই দুই মেয়েই উত্তেজিত হয়ে আছে যাওয়ার জন্য। এখন এটা তোমার ব্যাপার। নিজের মেয়েদেরকে হতাশ করবে নাকি বার্লিনে রোমিও হয়ে ঘুরে বেড়াবে।” আরো চড়া হল ইসাবেলার গলা, “আর তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি! যদি ওদেরকে সাথে নিতে অস্বীকৃতি জানাও ব্লেইন ম্যালকমস, আমি ওদেরকে এর পেছনের কারণটাও বলে দিব। ঈশ্বরের কসম ওদেরকে বলে দিব যে ওদের প্রাণাধিক ড্যাডি কতটা মিথ্যুক, প্রতারক আর বেশ্যাগিরি করে বেড়ায়।”

***

বিখ্যাত স্পোর্টস রাইটার থেকে শুরু করে সাধারণ খেলা-পাগল দর্শক পর্যন্ত সকলেই আশা করছিল যে ম্যানফ্রেড বার্লিনে পাঠানো বক্সিং স্কোয়াডে থাকবে। কিন্তু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা এল আর সাথে এটাও জানা গেল যে, রুলফ স্ট্যান্ডারকে হেভিওয়েট টিমে আর ট্রম্প বিয়ারম্যানকে কোচ হিসেবে পাঠানো হচ্ছে তখন গর্ব আর আনন্দে ফেটে পড়ল স্টিলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয় আর গোটা শহর।

এমনকি ওসেয়া ব্র্যান্ডওয়াগের কমান্ডিং জেনারেল পর্যন্ত উল্লসিত হয়ে মিটিংয়ে বললেন যে, “এদের মত তরুণরাই আমাদের জাতিকে তার নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে দিবে।” বুকের উপর মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত রেখে সমন্বয়ে স্যালুট করার পাশাপাশি সকলের সামনে ম্যানফ্রেডকে র‍্যাঙ্কের ব্যাজ পরিয়ে দেয়া হল।

এতটা সম্মানজনক অভিজ্ঞতা ম্যানফ্রেডের আর কখনোই হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিল, যে কোনো মূল্যে ওর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাবে।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহজুড়ে আরো তুঙ্গে উঠে গেল এ উত্তেজনা। সবার জন্য সবুজ আর সোনালি ব্লেজার, পানামা হ্যাট তৈরি থেকে শুরু করে একের পর এক ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে শেখানো হল জার্মান আদব-কায়দা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রোফাইলসহ সবকিছু।

দেশের সবকটা নিউজ পেপার আর ম্যাগাজিন থেকে সাংবাদিকেরা এসে ম্যানফ্রেড আর রুলফের সাক্ষাৎকার নিল। তাছাড়া ন্যাশনাল রেডিওতে দিস ইজ ইউর ল্যান্ড নামে প্রোগ্রামেও তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান হল।

তবে এত সবকিছুর মাঝেও শান্ত রইলেন কেবল একজন। “তুমি এতদিন আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে যে মনে হচ্ছে পুরো জীবন কেটে যাবে।” বলে উঠল সারাহ।

“বাচ্চা মেয়েদের মত ফ্যাচফ্যাচ করো না।” হেসে উড়িয়ে দিল ম্যানফ্রেড, “তুমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখবে সব শেষ আর বুকে সোনার মেডেল ঝুলিয়ে আমিও ফিরে আসব।”

“খবরদার আমাকে আর কখনো বাচ্চা মেয়ে ডাকবে না।” তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল সারাহ।

হাসি বন্ধ করে চুপ মেরে গেল ম্যানফ্রেড, “ঠিকই বলেছো। তুমি এর চেয়েও বেশি কিছু।”

ম্যানফ্রেড আর রুলফের সান্ধ্যকালীন ট্রেনিংয়ের সময়ে টাইম কীপারের দায়িত্ব পালন করে সারাহ। আংকেলের কাছ থেকে ধার করা স্টপওয়াচ, ভেজা তোয়ালে আর এক ফ্লাস্ক ঠাণ্ডা আর তরতাজা অরেঞ্জ জুস নিয়ে পাহাড়ের কোণে দু’জনের জন্য অপেক্ষা করে। ম্যানফ্রেড আর রুলফ মিলে একপাক দৌড়ে জুস পান করে আবার যখন দৌড়ানো শুরু করে তখন উপত্যকার ভেতরে গিয়ে পরের স্টেজের জন্য অপেক্ষা করে সারাহ।

 জাহাজে চড়ার দুই সপ্তাহ আগে এক সন্ধ্যায় রুলফের স্টুডেন্টস রিপ্ৰেজিন্টিটিভের মিটিং পড়ে যাওয়ায় একাই দৌড়াতে এল ম্যানফ্রেড।

 হারটেনবশ পর্বতের চূড়ায় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল সারাহ্। অস্তগামী সূর্যটাকে পেছনে নিয়ে বসে থাকায় মনে হচ্ছে যেন সোনালি মুকুট পরে আছে মেয়েটা। পাতলা স্কার্ট ভেদ করে ফুটে ওঠা মেয়েটার অনিন্দ্যসুন্দর দেহাবয়ব দেখে পরিশ্রমের চেয়েও বেশি হাঁপাতে লাগল ম্যানফ্রেড।

“ও এত সুন্দর।” সারাহ’র এই রূপ আগে কেন চোখে পড়েনি ভেবে অবাকও হয়ে গেল। শেষ পথটুকু নিঃশব্দে উঠে এল উপরে। বুকের ভেতরে অনুভব করছে এক রাক্ষুসে ক্ষিদে।

ওকে দেখেই কয়েক পা এগিয়ে এল সারাহ। সাথে সাথে যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের আকুতি। ভেজা তোয়ালে এগিয়ে দিল মেয়েটা। হাত না বাড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ম্যানফ্রেড। তাই নিজেই এসে ওর গলা আর ঘাড় মুছে দিতে শুরু করল সারাহ। ফিসফিস করে বলল, “গত রাতে আমি কী স্বপ্ন দেখেছি জানো? যেন আমরা আবার ঠিক সেই ক্যাম্পে ফিরে গেছি। রেলওয়ে পথের ধারের সেই ক্যাম্পের কথা মনে আছে ম্যানি?”

মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড। গলা দিয়ে মনে হচ্ছে স্বর ফুটছে না।

“আমি আমার মাকে কবর দিতে দেখেছি। ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা। আর তারপরেই বদলে গেছে সবকিছু। মা’র পরিবর্তে তোমাকে পেলাম। তুমি এত সুন্দর কিন্তু রুগ্ন ছিলে আর আমিও এত দুঃখী ছিলাম যে মনে হল মরে যাই। অথবা তোমার সাথে থাকতে পারি সবসময়।”

 এবারে হাত বাড়িয়ে সারাহকে বুকে টেনে নিল ম্যানফ্রেড। ওর ঠাণ্ডা দেহে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা; গলা কাঁপিয়ে বলল, “ওহ ম্যানি আমি তোমাকে হারাতে চাই না। প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো, নয়ত আমি বাঁচবো না।”

“আই লাভ ইউ সারি।” খসখসে গলায় জানাল ম্যানফ্রেড।

“ওহ, ম্যানি।”

“হুম, আগে আর কখনো এভাবে বুঝতে পারিনি।” ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে উঠল ম্যানফ্রেড।

“আর ম্যানি, আমি কিন্তু এটা সব সময়ই জানতাম। সেই প্রথম দিনের প্রথম মিনিট থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। এভাবে শেষ দিন পর্যন্ত বাসব।” মুখ উঁচু করে তাকাল সারাহ্, “কিস, মি ম্যানি।”

মেয়েটার স্পর্শ পেতেই বাস্তববোধ আর যুক্তির কথা ভুলে গেল ম্যানি। পথের পাশে পাইনের ধারে নিয়ে গড়িয়ে পড়তেই গায়ে এসে লাগল সিল্কের মত নরম বাতাস। ..

এতক্ষণ কী ঘটে গেল প্রথমটাতে কিছুই বুঝতে পারল না ম্যানি। তারপর বহুক্ষণ বাদে যেন বহুদূর থেকে ফিরে এল চেতনাবোধ। আতঙ্ক নিয়ে সারাহর দিকে তাকিয়েই তাড়াতাড়ি নিজের পোশাক ঠিক করে নিল; বলল, “আমরা আসলে ক্ষমার অযোগ্য এক অপরাধ করে ফেলেছি।

“না।” তীব্রভাবে মাথা নাড়ল সারাহ। “না, ম্যানি দু’জন যখন পরস্পরকে ভালোবাসে তখন সেটা কীভাবে অপরাধ হতে পারে। এটা তো ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা পবিত্র এক প্রাপ্তি।”

 আংকেল ট্রম্প আর দলের সাথে ইউরোপে যাওয়ার আগের দিন প্রাসাদে নিজের পুরনো রুমেই ঘুমালো ম্যানফ্রেড, অন্ধকার গাঢ় হতেই চুপিচুপি উঠে এসে ওর চাদরের নিচে শুয়ে পড়ল সারাহ।

ভোরবেলা বাইরে ওকের ডালে ঘুঘু না ডাকা অব্দি ম্যানির সাথেই রইল। তারপর ওকে কিস করে ফিসফিস করে জানাল, “এখন আমরা সত্যিই দু’জন দু’জনের হলাম, চিরদিনের জন্য।”

***

আর মাত্র আধা ঘণ্টা পরেই শুরু হবে যাত্রা। অথচ সেনটেইনের স্টেটরুমে এখনো এত ভিড় যে মাথার উপর শ্যাম্পেনের গ্লাস তুলে অতিথিদের মধ্যে দিয়ে পথ করে এগোচ্ছে স্টুয়ার্ডের দল। বন্ধুদের মধ্যে কেবল ব্লেইন ম্যালকমসই অনুপস্থিত। দুজনে মিলে আগেই ঠিক করে নিয়েছে যে একই মেইল শীপে ভ্রমণের কথা কাউকে জানানো হবে না। আর জাহাজ বন্দর থেকে দূরে যাবার পরই কেবল পরস্পরের সাথে দেখা করবে।

পুরো পার্টি জুড়েই সেনটেইনের পাশে রইলেন ছেলের হাত ধরে গর্বিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ানো অ্যাবি আব্রাহামস আর লম্বা চওড়া, বিষণ্ণ ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস্। দু’জনে উইন্ডহক থেকে উড়ে এসেছেন তাকে বিদায় জানানোর জন্য। তাছাড়া স্যার গ্যারি, অ্যানা, ওড বা জেনারেল স্মুট আর ফোলানো চুলের চশমা পরিহিত ছোটখাটো স্ত্রী তো আছেনই।

একেবারে কোনার দিকে একগাদা তরুণী পরিবেষ্টিত হয়ে, দাঁড়িয়ে আছে শাসা। এক মুহূর্তের জন্য কেবল মেয়েদের খিলখিল ছাপিয়ে পোর্টহোলের ফুটো দিয়ে চোখে পড়ল আরেক তরুণীর মাথা।

তাও মেয়েটার চেহারা না দেখে কেবল পিছনটুকু দেখল। লম্বা, চিকন ঘাড়ের উপর লালচে বাদামি কোঁকড়া চুলের মেলা। কিন্তু সেই একঝলক দেখেই নিজের সামনের মেয়েগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলল শাসা।

সাথে সাথে বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পোর্টহোলের ওপাশে তাকালেও কেবল মেয়েটার পিছনটুকুই দেখল। সরু কোমর আর সুনিপুণ গোড়ালির অধিকারী মেয়েটা স্কার্ট দুলিয়ে এমনভাবে চলে গেল যে শাসা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল একে যে করেই হোক দ্বিতীয়বার দেখতে হবে।

 “এক্সকিউজ মি, লেডিস” নারী দর্শকের হাহাকার সত্ত্বেও দরজার দিকে এগিয়ে গেল শাসা। কিন্তু সাথে সাথে গমগম করে বেজে উঠল সাইরেন। শাসা বুঝতে পারল যে হাতে একদম সময় নেই। এমন সময়ে ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস এসে তার হাত ধরে শুভ কামনা জানাতেই মেয়েটার কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করল শাসা। কিন্তু লালচে বাদামি চুলগুলো যেন কিছুতেই মাথা থেকে সরছে না। তাড়াতাড়ি বের হয়ে ডেকের চারপাশে চোখ বোলালেও সেনটেইন এসে ছেলের হাত ধরে টানাটানি শুরু করলেন, “বাবু চলো। ডাইনিংরুমের বসার ব্যবস্থা দেখে আসি।

“কিন্তু মা তুমি তো ক্যাপ্টেনের টেবিলে বসার নিমন্ত্রণ পেয়েছে”।

“ইয়েস, কিন্তু তুমি আর ডেভিড তো পাওনি। ডেভিডকে সঙ্গে নিয়ে এসো। জায়গা পছন্দ না হলে বদলে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।”

শাসা বুঝতে পারল যে মার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে। মায়ের চোখের এই “ম্যাকিয়াভেলিয়ান স্টাইল তার চেনা আছে।

 “ঠিক আছে চল।” অনিচ্ছে সত্ত্বেও রাজি হল শাসা। তারপর তিনজনে মিলে ওয়ালনাটের প্যানেলকৃত সিঁড়ি বেয়ে নিচের ডেকে ফার্স্ট ক্লাস ডাইনিং রুমে নেমে এল।

সিঁড়ির পাদদেশে দেখা গেল ছোট্ট একদল পর্যটকের ভিড়ে হেডওয়েটারের মাথা। জাদুর মতই তার পকেটে হাওয়া হয়ে গেল পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট আর সাথে সাথে পুরনোটা মুছে নতুন করে লেখা হল সিটিং প্ল্যানের নাম।

দলটা থেকেই খানিক দূরে লম্বা পরিচিত এক অবয়ব দেখেই সাথে সাথে লোকটাকে চিনে ফেলল শাসা। এমন আগ্রহ নিয়ে লোকটা সিঁড়ির দিকে তাকাল যে বোঝা গেল কারো জন্য অপেক্ষা করছে আর সেনটেইনকে দেখে যে এক হাসি দিলো এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে সেই কেউটা কে।

“ওহ, খোদা, মা” বিস্মিত হয়ে গেল শাসা, “ব্লেইন যে আজই যাচ্ছে আমি তো জানতাম না–” কিন্তু কথার মাঝখানেই থেমে যেতে হল। শক্ত করে ছেলের হাত খামচে ধরলেন সেনটেইন।

“ওরা এসব আগে থেকেই ঠিক করে এসেছে।” যা বোঝার বুঝে নিল শাসা। “নিজের মা সম্পর্কে এমনটা ভাবতে না পারলেও ওরা আসলে পরস্পরকে ভালোবাসে। এত বছরে কিছুতেই আমার চোখে পড়েনি।” তারপরেই মনে হল যে পিতার সাথে তার কখনো দেখা হয়নি সে জায়গায় বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়া হলে সে ব্লেইন ম্যালকমসকেই বেছে নিবে।

ওদের কাছে এগিয়ে এলেন ব্লেইন, “সেনটেইন, তোমাকে দেখে সত্যি আশ্চর্য হয়েছি।”

হাসতে হাসতে ডান হাত বাড়িয়ে দিল মা, “ওহ, ব্লেইন ম্যালকম আমারও কোনো ধারণাই ছিল না যে আমরা একই জাহাজে আছি।”

অন্যদিকে শাসা মনে মনে ভাবল, “বাহ, কী চমৎকার অভিনয়। এত বছর ধরে আমাদেরকে তাহলে তোমরা মিলে বেকুব বানিয়েছে।”

কিন্তু হঠাৎ করেই বদলে গেল সবকিছু। ব্লেইনের পিছু পিছু সেনটেইনের দিকে এগিয়ে আসছে দুই তরুণী।

“সেনটেইন, আমার মেয়েদেরকে স্মরণ আছে নিশ্চয়। তারা আর ম্যাথি জ্যানিন।”

“তারা।” গানের মত করে মাথার মাঝে নামটাকে আউরে নিল শাসা। “তারা কত সুন্দর একটা নাম।” বোটের ডেকে এই মেয়েটাকেই একঝলক দেখেছিল। কিন্তু যা ধারণ করেছিল বাস্তবে মেয়েটা তার চেয়েও শতগুণ বেশি সুন্দরী।

ম্যাথিল্ডা ছয় ফুটের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো হলেও তারা বেশ লম্বা। ম্যাডোনার মত শান্ত ডিম্বাকৃতি চেহারা। দেহত্বক যেন ক্রিম আর ফুলের পাপড়ির মিশেলে তৈরি। চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব।

সেনটেইনের সাথে কুশল বিনিময় করে সরাসরি শাসার দিকে তাকাল তারা।

 “শাসা, তোমারও নিশ্চয় তারাকে মনে আছে। ওভো চার বছর আগে ওয়েল্টেভ্রেদেনেও এসেছিল।” বলে উঠলেন ব্লেইন।

অ্যা সেই ছিচকাঁদুনে মেয়েটা? শাসার যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনোমতে বলল,

“এতদিন পরে আবার তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে তারা।”

“সাবধান তারা ম্যালকমস। আগবাড়িয়ে ভাব জমানোর কোনো প্রয়োজন নেই।” তবে শাসাকে প্রথমবার দেখে তারা নিজেও বেশ বেসামাল হয়ে পড়েছিল।

যাই হোক, নিজেকে চট করে সামলেও নিল। বিড়বিড় করে বলল, “ওহ আমাদের আগেও দেখা হয়েছিল? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।” এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমার সাথে আবার দেখা হয়ে ভালো লাগছে শাসা।”

 “ইয়েস শাসা” মনে মনে একমত হয়ে পবিত্র কবচের মত করে হাতটাকে নিজ হাতে নিল শাসা। “তারপর থেকে আর কখনো দেখা হয়নি কেন?” মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেও সাথে সাথে উত্তরটাও পেয়ে গেল। “পুরোটাই যেন সাজানো ছিল। মা আর ব্লেইন চায়নি যে আমরা তাদের সম্পর্কের কথা জেনে যাই। তারা যদি আবার ফিরে গিয়ে নিজের মাকে বলে দেয়!” কিন্তু তারপরেও ওদের উপর এখন আর কোনো রাগ দেখাতে পারল না উল্লিসিত শাসা।

“তোমাদের টেবিল রিজার্ভেশন দেয়া হয়ে গেছে?” তারার হাত না ছেড়েই জানতে চাইল শাসা।

 “ড্যাডি ক্যাপ্টেনের টেবিলে বসবে।” চোখে স্নেহ নিয়ে বাবার দিকে তাকাল তারা। “আমরা একাই থাকব।”

“তাহলে আমরা চারজন একসাথে বসতে পারি।” তাড়াতাড়ি বলে উঠল শাসা। পরস্পরের সাথে চকিত বিনিময় করলেন সেনটেইন আর ব্লেইন। বোঝা গেল স্বস্তি পেয়েছেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ যে কোনদিকে যাচ্ছে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও ধারণা করতে পারলেন না।

ওদিকে ডেভিড আব্রাহামসের সাথে হাত মেলাতে গিয়ে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল ম্যাথিল্ডা জানিন। দু’বোনের মধ্যে সে-ই দেখতে তেমন ভালো নয়।

পুরো ভ্রমণটাই সকলের জন্য বয়ে নিয়ে এল বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি। বিস্ময় আর আনন্দের মত হতাশাও এল পাশাপাশি। সাউদাম্পটন যাওয়া পর্যন্ত চৌদ্দ দিনের মাঝে চার তরুণ-তরুণী নিয়ে তেমন মাথাই ঘামালেন না ব্লেইন আর সেনটেইন। কেবল লাঞ্চের আগে পুলের পাশে ককটেল পান আর ডিনারের পরে ডান্স। ব্যস তারপরেই পিতা-মাতাকে একগাদা অজুহাত দেখিয়ে নিচের ডেকে উধাও হয়ে যায় চার ছেলে-মেয়ে। উপরের ডেকে অবশ্য তখন নিজেদের আনন্দে ডুবে যায় ব্লেইন আর সেনটেইন।

এর আগে লেবু-সবুজ রঙা ওয়ান পিস বাথিং স্যুট গায়ে চাপানো তারার চেয়ে আর কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখেনি শাসা। পুল থেকে উঠে এলে ভেজা শরীরে ঠিক যেন হুরপরী হয়ে যায় এই মেয়ে। অন্যদিকে ম্যাথিল্ডা আর ডেভিড তো সারাক্ষণ একে অন্যকে কেবল হাসায়। যদিও কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে এক-আধটা কিস করা ব্যতীত ক্যামেলের সাথে হওয়া অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি কখনোই করেনি ডেভিড।

 তবে ডেভিডের মত এতটা নীতিবান না হলেও সুবিধে করতে পারছে না শাসা। প্রায় এক সপ্তাহ লেগে থাকার পর তারা কেবল তাকে নিজের পিঠে আর কাঁধে সানট্যান অয়েল লাগাবার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে কিস করতে চাইলেও দু’হাত দিয়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে শাসাকে সরিয়ে দেয় তারা। একই সাথে এটাও খেয়াল করেছে যে তারা ম্যালকমসের রাজনৈতিক সচেতনাবোধও বেশ প্রখর। যদিও মা আর শাসা দুজনেই অস্পষ্টভাবে জানে যে কোন একদিন পার্লামেন্টই হবে শাসার গন্তব্য তারপরেও তারার মত করে দেশের জটিল সব সমস্যা নিয়ে মোটেও ভাবে না শাসা। মেয়েটা তো বলে যে, “ড্যাডির মত আমারও ধারণা যে গুটি কয়েক কালোদের হাত থেকে ভোটের অধিকার ছিনিয়ে না নিয়ে বরঞ্চ তাদের সবাইকে এ সুযোগ দেয়া উচিৎ।

“সবাইকে!” হাঁ হয়ে গেল শাসা। “তুমি সত্যিই তা বিশ্বাস করো।”

“হ্যাঁ, করি। একেবারে হুট করে না। বরঞ্চ, এমন কোনো সরকারের মাধ্যমে যাদের সত্যিই শাসন করার মত দক্ষতা আছে। তাদেরকেই ভোট দেয়া হবে যাদের শিক্ষা আর দায়িত্ববোধের জ্ঞান আছে। দুই প্রকারের মাঝে শ্বেতাঙ্গ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ উভয় নারী-পুরুষই এ দায়িত্ব পালন করতে পারবে।”

মেয়েটার কথা চিন্তা করতেই কেঁপে উঠল শাসা।

“নিজের দেশেই কীভাবে আমরা একজনকে জমির মালিক হতে বাধা দিতে পারি? কিংবা নিজেদের শ্রমটাকে শ্রেষ্ঠ মার্কেটে বিক্রি করা অথবা যৌথ দর কষাকষি থেকে তাকে বাইরে রাখা?”

লেনিন আর শয়তানেরই অস্ত্র হল ট্রেড ইউনিয়ন। ছোট্টবেলা থেকে এমনটাই জানে শাসা।

 “তার মানে ও একটা বলশেভিক, কিন্তু, ওহ ঈশ্বর এত সুন্দর এক বলশেভিক!” তাড়াতাড়ি তারার লেকচার থামানোর জন্য ওকে তুলে দাঁড় করাল শাসা।

“চলো, সাঁতার কাটতে যাই।”

“ছেলেটা সত্যিই একটা বেকুব।” মনে মনে ক্ষেপে উঠল তারা। কিন্তু অবাক কাণ্ড হল, যখন অন্য রমণীরা সানগ্লাসের পেছন থেকে শাসার দিকে তাকিয়ে দেখে তখন ইচ্ছে করে নখ ঢুকিয়ে তাদের চোখগুলোকে তুলে নেয়। রাতের বেলা নিজের বাঙ্কে শুয়ে আপন মনে তারা ভাবে, “যদি আমি ওকে শুরু করার সামান্যতম সুযোগও দেই, জানি কিছুতেই থামাতে পারব না। এমনকি হয়ত থামাতে চাইবও না” সাথে সাথে শক্ত হয়ে গেল তারা।

“ধীরে বৎস, ধীরে।”

***

জাহাজের কার্গো হোন্ডে ব্লেইন ম্যালকমূসের বেন্টলি আর সেনটেইনের ডেইমলার দেখে সবাই ভাবল আবার বুঝি কাকতালীয়ভাবেই মিলে গেছে সবকিছু।

“আমরা তাহলে পুরো একটা কনভয় নিয়ে বার্লিনে যেতে পারব।” সেনটেইন এমনভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন যেন চিন্তাটা এই মাত্রই মাথায় এল। ঠিক হল সেনটেইন আর ব্লেইন বেন্টলিতে চড়ে যাবেন আর ছেলেমেয়েরা একসাথে ডেইমলারে।

মর্ট হোম নামক ছোট্ট গ্রামখানার রাস্তার পাশের হোটেলের সামনে এসে থামল পুরো কনভয়। সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন সেনটেইন। ডেস্কে পিছন থেকে বের হয়ে তাকে দেখেই চিনে ফেললেন সরাইখানার বুড়ি মালকিন। সাথে সাথে উত্তেজনায় কিচির-মিচির শুরু করে দিলেন বৃদ্ধা, একই সাথে ছুটে এসে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরে একের পর এক কিস করলেন গালে।

 তাদের জন্য বরাদ্দ করা হল সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রুমগুলো। রাতের খাবারের আয়োজন দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন সেনটেইন; টেরিনস, ট্রাফেলস আর টার্ট সাথে এ অঞ্চলের বিখ্যাত ওয়াইন। এর পাশাপাশি টেবিলের সাথে দাঁড়িয়ে গত উনিশ বছরের সমস্ত জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে আর ভেগে যাওয়ার কাহিনি বর্ণনা করে শোনালেন বুড়ি ম্যাডাম।

পরের দিন ভোরবেলা সবাইকে ঘুমে রেখে শ্যাতুর উদ্দেশে বের হয়ে গেলেন সেনটেইন আর শাসা। ভাঙা ইট সুরকি আর কালো হয়ে যাওয়া দেয়াল, শেলের গর্ত আগাছাময় পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে নিজ বাবার কথা স্মরণ করে কাদলেন সেনটেইন। যিনি কিনা অগ্রসরমান জার্মানদের হাতে সঁপে দেয়ার বদলে আপন শরীরসহ জ্বালিয়ে দিয়েছেন এই বিশাল দুর্গ।

মাতা-পুত্র একসাথে দুর্গের পেছনকার পাহাড় চূড়ায় এসে দাঁড়াতেই দূরের ফলবাগান আর বনভূমি ইশারা করে দেখালেন সেনটেইন, যুদ্ধের সময় এখানেই ছিল এয়ারফিল্ড।

“এখানেই ঘাটি বানিয়েছিল তোমার বাবার স্কোয়াড্রন। প্রতিদিন সকালবেলা আমি হাত নেড়ে তাদেরকে বিদায় পাঠাতাম।”

“ওরা তো এস ই ফাইভ চালাত, তাই না?”

“শেষের দিকে। প্রথমে কেবল পুরনো শপউইদ ছিল।” চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “তোমার বাবার মেশিনটার রঙ ছিল উজ্জ্বল হলুদ। এখনো চোখে ভাসে ওর ফ্লাইং হেলমেট। সব সময় কী করত জানো, আমার পাশ দিয়ে উড়ে যাবার সময় গ্লাস তুলে ফেলত যেন আমি ওর চোখ দেখতে পাই। ওহ শাসা, ওযে কতটা হাসিখুশি আর তারুণ্যে ভরপুর ছিল যে কী বলব, ঠিক যেন নীল আকাশে উঠে যেত এক তরুণ ঈগল।”

তারপর পাহাড় থেকে নেমে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে দু’জন আঙুর ক্ষেতের কাছে চলে এলেন। উত্তর দিকের কোনার একটা গোলাঘরের সামনে আসতেই গাড়ি থামাতে বললেন সেনটেইন। অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল শাসা। খড়ে ছাওয়া দালানটার দরজার কাছে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েই গাড়ির কাছে ফিরে এলেন সেনটেইন। বললেন, “তোমার বাবা আর আমি এখানে এসে দেখা করতাম।” সাথে সাথে শাসা বুঝে গেল যে এখানেই প্রথম ক্ৰণ হিসেবে পৃথিবীতে মায়ের গর্ভে এসেছিল সে।

গ্রামে ঢোকার মুখে ছোট্ট গির্জাটার পাশে কবরস্থান। একেবারে কোনার দিকে একটা ইউ গাছের নিচেই আছে মাইকেল কোর্টনির সমাধি। সমাধি পাথরটাকে সেনটেইন নিজেই আফ্রিকা থেকে অর্ডার দিয়ে আনালেও আগে কখনো দেখেননি। দু’পাশে ডানা ছড়িয়ে যেন আকাশে উড়ে যাচ্ছে মার্বেলের একটা ঈগল।

মাতা-পুত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়ল সমাধি ফলক। লেখা আছে : এখানেই শুয়ে আছেন ক্যাপ্টেন মাইকেল কোর্টনি। মারা গেছেন উনিশে এপ্রিল ১৯১৭। দু’জনে মিলে পরিষ্কার করে দিলেন সমাধি পাথরের চারপাশে গজানো। আগাছা। তারপর মৃত মাইকেল কোর্টনির সমাধির পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে একসাথে প্রার্থনা করল শাসা আর সেনটেইন।

কিন্তু অবাক ব্যাপার হল পিতার সমাধিতে এসেও তেমন কোনো শূন্যতা বোধ করছে না শাসা। এর চেয়ে বরঞ্চ যখন ছয়শ’ মাইল দূরে মাইকেল কোর্টনির বিছানাতে ঘুমায়, তার পুরনো টুইড জ্যাকেট গায়ে দেয় কিংবা শটগান আর বঁড়শি স্পর্শ করে তখনই বাবাকে আরো বেশি অনুভব করে শাসা।

ফিরে আসার সময়ে গির্জায় আসতেই দেখা হল ফাদারের সঙ্গে। কিন্তু বয়সে একেবারে তরুণ যাজককে দেখে তেমন খুশি হলেন না সেনটেইন। মনে হল তার অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের সুতোটা বুঝি ছিঁড়ে গেল। যাই হোক, তারপরেও গির্জার মেরামত আর মাইকেলের সমাধিতে প্রতি রবিবার তাজা ফুল রাখার জন্য বিশাল অঙ্কের দুইটা চেক লিখে যাজকের হাতে দিলেন সেনটেইন।

 পরের দিন প্যারিসে চলে গেল পুরো দল। আগেভাগেই খবর পাঠিয়ে রিটজ হোটেল বুক করে রেখেছেন সেনটেইন। ব্লেইন আর সেনটেইন বিভিন্ন ধরনের মিটিং, লাঞ্চ আর সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে ডিনারে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় ভরপুর প্যারিসকে নতুন করে আবিষ্কার করল চার তরুণ-তরুণী। একসাথে আইফেল টাওয়ারের একেবারে চূড়ায় উঠে ঘুরে বেড়ানো আর সীন নদীর তলায় অসাধারণ ব্রিজটা দেখা ছাড়াও মাঝরাতে সেনটেইন আর ব্লেইনকে গুড নাইট জানিয়ে বাধ্য মেয়ের মত বেডরুমে ঢুকে যাওয়া তারা আর ম্যাথিল্ডাকে সাথে সাথে ব্যালকনি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায় ডেভিড আর শাসা। অতঃপর চারজনে মিলে মন্টপার নামের সেলারে গিয়ে শোনে জ্যাজ।

প্যারিস ছেড়ে যাবার সময়ে সবারই তাই বেশ মন খারাপ হল। তবে জার্মান বর্ডারে আসতেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল সবার মন। যাই হোক, সীমান্ত চৌকির কাছে ডেইমলার আর বেন্টলি পার্ক করে পায়ে হেঁটে এগিয়ে জার্মান অফিসারদের সামনে একজোড়া পাসপোর্ট রাখলেন ব্লেইন।

তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেনটেইনের সাথে গল্প আরম্ভ করলেন। এদিকে একের পর এক পাসপোর্টের পাতা উল্টে সবকিছু চেক করে দেখছে জার্মান অফিসার। কিন্তু একেবারে শেষের পাসপোর্ট। অর্থাৎ ডেভিড আব্রাহামসের পাসপোর্ট তুলে নিয়ে কেমন অদ্ভুত আচরণ শুরু করে দিলেন লোকটা।

বারেবারে পাতা উল্টে পরীক্ষা করা, ডেভিডের দিকে তাকানো এ সবকিছু দলটারও চোখ এড়ালো না। সবাই তাই পুরোপুরি নিশ্ৰুপে বিস্মিত হয়ে তাকাল পরস্পরের দিকে।

 “আমার মনে হয় কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে ব্লেইন” বলে উঠলেন সেনটেইন। কিছু না বলে ডেস্কের কাছে এগিয়ে গেলেন ব্লেইন। জানতে চাইলেন, “কোন সমস্যা?”

সাথে সাথে শুদ্ধ ইংরেজিতে উত্তর দিলো জার্মান অফিসার।

“আব্রাহামস, এটা একটা ইহুদি নাম, তাই না?”

 বিরক্ত হলেন ব্লেইন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই আচমকা এগিয়ে এসে ডেভিড উত্তরে জানাল, “হ্যাঁ এটা একটা ইহুদি নাম!” চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে ওর পাসপোর্টের উপর টোকা দিলো অফিসার।

“তার মানে স্বীকার করছ যে, তুমি একজন ইহুদি?”।

“আমি ইহুদি।” একটুও নরম না হয়ে উত্তর দিলো ডেভিড।

“কিন্তু তোমার পাসপোর্টে তো লেখা নেই যে তুমি একজন ইহুদি।” বলে উঠলো কাস্টমস্ অফিসার।

“লেখা থাকা কী উচিত ছিল?”

 ডেভিডের প্রশ্ন শুনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অফিসার বলল, “তুমি জার্মানিতে ঢুকতে চাও, আর তুমি একজন ইহুদি?”

“আমি অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়ার জন্যই জার্মানিতে প্রবেশ করতে চাই। জার্মান সরকারই আমাকে আমন্ত্রণ দিয়ে এনেছে।”

“আহ! তুমি অলিম্পিক অ্যাথলেট, একজন ইহুদি অলিম্পিক অ্যাথলেট?”

“না আমি একজন দক্ষিণ আফ্রিকান অলিম্পিক অ্যাথলেট। আমার ভিসা হয়েছে?”

এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অফিসার বলল, “এখানেই অপেক্ষা করো প্লিজ।” ডেভিডের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে রুমের ভেতরের দিকে চলে গেল অফিসার।

ভেতরে জার্মান ভাষায় আলাপ চলছে শুনে সবাই ঘুরে তারার দিকে তাকাল। ছয়জনের দলটাতে একমাত্র সেই জার্মান বোঝে।

“অফিসার কী বলছে? জানতে চাইলেন ব্লেইন।

“ওরা খুব দ্রুত “ইহুদি” আর “অলিম্পিকস” শব্দ দুটো নিয়ে কথা বলছে।” তারা উত্তর দেয়ার সাথে সাথে নিজের সুপিরিয়রকে নিয়ে ফিরে এল জার্মান অফিসার।

“আব্রাহামস কে?” জানতে চাইলেন সুপিরিয়র।

“আমি।”

 “তুমি একজন ইহুদি? স্বীকার করছে যে তুমি একজন ইহুদি?”

“হ্যাঁ। আমি একজন ইহুদি। আগেও বলেছি। আমার ভিসাতে কোনো ভুল আছে?”

“তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে প্লিজ।” এবার তিনজন অফিসার একসাথে ভেতরে চলে গেল। সাথে ডেভিডের পাসপোর্ট। খানিক বাদেই ঝনঝন করে টেলিফোন বেজে উঠতেই সবাই মিলে আবারে তারার দিকে তাকাল।

 “এসব কী হচ্ছে?”

“লোকটা বার্লিনে কারো সাথে কথা বলছে। ডেভিড সম্পর্কে জানাচ্ছে।” উত্তর দিলো তারা।

শেষ হল টেলিফোনের আলোচনা। সবশেষে শোনা গেল “হেইল! হিটলার!” তারপর রেখে দেয়া হল ফোন।

তিনজন অফিসার একত্রে আবার ফিরে এল ব্লেইনদের সামনে। ডেভিডের পাসপোর্টে স্ট্যাম্প লাগিয়ে হাসিমুখে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন সুপিরিয়র।

“থার্ড রাইখে স্বাগতম!” ডান হাতের খোলা তালু এগিয়ে চিৎকার করে বললেন, হেইল হিটলার!”

নার্ভাস ভঙ্গিতে খিকখিক করে হেসে উঠল ম্যাথিন্ডী জ্যানিন। মেয়ের হাত চেপে ধরে তাড়াতাড়ি পুরো দলকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন ব্লেইন।

বাকি পথ আর কেউ তেমন কোনো কথা বলল না।

পথের পাশের প্রথম সরাইখানাতেই থেমে গেল দুটো গাড়ি। আর এবারই প্রথম বিছানা, বাথরুম পরীক্ষা না করেই রুম নিয়ে নিলেন সেনটেইন। ডিনার শেষেও কেউই কার্ড খেলা কিংবা গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার আগ্রহ পেল না। তাই দশটা বাজার সাথে সাথেই যে যার রুমে ঢুকে গেল।

যাই হোক, পরদিন সকালবেলা নাশতা করার সময়েই আবার হাসি-খুশি হয়ে উঠল সবার মন। স্বরচিত কবিতা শুনিয়ে পুরো দলকে হাসাল ম্যাথিল্ডা।

অনিন্দ্যসুন্দর জার্মান গ্রামের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেই কেটে গেলে পরের দিনগুলো। এরকমই একদিন হৈ-হুঁল্লোড়, গান আর অসংখ্য মানুষে ভর্তি সরাইখানায় লাঞ্চ খেতে বসে শাসা বলল, “সবাই বেশ খুশি আর সমৃদ্ধশালী মনে হচ্ছে, তাই না?”

“কারণ এটা হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে কোন গরিব কিংবা বেকার নেই” উত্তরে জানালেন সেনটেইন। কিন্তু ব্লেইন কিছুই বললেন না। চুপচাপ ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিলেন।

সেদিন সন্ধ্যায় উত্তরের সমভূমিতে ঢুকল গাড়িদ্বয়। কিন্তু শাসা আচমকা এত হঠাৎ করে ডেইমলার ব্রেক করল যে ড্যাশবোর্ড ধরে তাল সামলাল ডেভিড আর পেছনে বসা মেয়েটাও ভয়ে কিচির-মিচির করে উঠল।

 ইঞ্জিন চালু অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে এল শাসা। চিৎকার করে বলল, “ডেভিড! ডেভিড! দেখো, এত সুন্দর কিছু তুমি আর কখনো দেখোনি, তাই না!

বাকিরাও বেরিয়ে এসে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। বেন্টলি থামিয়ে ব্লেইন আর সেনটেইনও এলেন।

হাইওয়ের পাশেই একটা এয়ারফিল্ড। হ্যাঁঙ্গার বিল্ডংগুলোর রঙও রুপালি। আর উপরে ঠিক যেন সূর্যের কাছ থেকেই স্ট্রিপের দিকে এগিয়ে আসছে তিনটা ফাইটার এয়ারক্রাফট।

শাসা আর ডেভিডের দিকে তাকিয়ে ব্লেইন জানতে চাইলেন, “ওরা কারা?”

দু’বন্ধু একসাথে উত্তর দিলো, “১০৯,”

“মেসারস্মিটস।”

এয়ারক্রাফটের ডানার কিনার থেকেই দেখা যাচ্ছে মেশিনগান। মাঝখানের প্রপেলার ভেদ করে দেখা যাচ্ছে কামানের চোখ।

“ইস, এগুলোর একটা যদি চালাতে পারতাম! সবকিছু হারাতেও রাজি আছি তাহলে?”

“একটা হাত

 “একটা পা-_

 “মুক্তির আশা”

একযোগে এয়ারফিল্ডের দিকে উড়ে আসছে তিন ফাইটার পাইলট।

ছেলেদের উত্তেজনা মেয়েদের মাঝেও সংক্রমিত হল। নিচু হয়ে ঠিক তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল ওয়্যার মেশিন। হাততালি দিয়ে হাসতে শুরু করল দুই তরুণী।

“এই ধরনের একটা মেশিন চালানোর জন্য যুদ্ধে যাওয়াটাও স্বার্থক।” হঠাৎ করেই শাসার মুখে মন্তব্যটা শুনে রেগে গেলেন ব্লেইন। মুখ লুকাতে তাই বেন্টলির দিকে তাকালেন।

 আস্তে করে তার পাশের সিটে উঠে বসলেন সেনটেইন। চুপচাপ মিনিট পাঁচেক যাবার পর বললেন, “ও মাঝে মাঝে একদম বোকার মত কথা বলে। আয়্যাম সরি ব্লেইন; জানি ও তোমাকে কতটা আপসেট করেছে।”

 দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্লেইন, “আমরা সবাই আসলে এক।” ভাবি এই “গ্রেট গেইম” সারা জীবনের গৌরব আর আমরা হব হিরো। কিন্তু এর সাথে যে কতটা আতঙ্ক মিশে থাকে। রোদের মাঝে পড়ে থাকলে পাঁচ দিন পরে একটা মৃতদেহ থেকে কতটা গন্ধ ছড়ায় তা কি আর কেউ ভাবে!”

 “আর কখনো এরকম হবে না।” তীক্ষ্ণস্বরে জানালেন সেনটেইন, “প্লিজ, আর এরকমটা ঘটতে দিও না!” চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা জ্বলন্ত এয়ারক্রাফটের ছবি; আগুন যেদিন কেড়ে নিয়েছে ওর ভালোবাসার মানুষটাকে। আর আচমকা মাইকেলের মুখটাও মুছে গিয়ে ফুটে উঠল শাসার চেহারা।

“প্লিজ গাড়ি থামাও ব্লেইন। আমার কেমন যেন গা গুলাচ্ছে।” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন।

***

জোর হাতে গাড়ি চালালে দলটা সেদিন রাতেই বার্লিন পৌঁছে যেত। কিন্তু পথিমধ্যে ছোট্ট একটা শহরে কোনো একটা উৎসবের আয়োজন দেখে সেনটেইন জানতে পারলেন যে আজ এখানকার রক্ষাকর্তা সাধুর দিবস।

“ওহ, ব্লেইন, চলো এখানেই থেকে যাই।” ফেস্টিভ্যালে যোগ দিল পুরো দল।

সন্ধ্যাবেলায় হল শোভাযাত্রা। জাতীয় পোশাক পরে নাচল সোনালি চুলের পরীর মত ছোট্ট মেয়েদের দল আর ইউনিফর্ম পরল ছেলেরা।

প্যারেডের শেষে টাউন স্কয়ারে মশালের আলোয় সবাই একসাথে নাচল। সবার মাঝে বিতরণ করা হল বিয়ার, পিগস ট্রটারস, স্মোকড ম্যাকারেল আর চিজ।

আর তারপরই আচমকা বদলে গেল পুরো পরিবেশ। বেড়ে গেল বাজনার আওয়াজ। স্কয়ারে এলেন চারজন লোক। সবার পরনে বাদামি ইউনিফর্ম আর হাতে স্বস্তিকা ব্যান্ড। প্রত্যেকের হাতে ছোট্ট কাঠের কালেকশন বক্স। প্রতিটা টেবিলে ছড়িয়ে পড়ল চারজন।

সবাই বক্সে সাধ্যমত দান করল। কিন্তু কেউই বাদামি ইউনিফর্মধারী লোকগুলোর দিকে কেন যেন তাকাল না। এর পরিবর্তে নার্ভাস ভঙ্গিতে নিজেদের আনন্দ চালু রাখার চেষ্টা করল।

“ওরা কারা?” সরল কণ্ঠে জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“এস এ।” উত্তরে জানালেন ব্লেইন, ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টির চোখ রাঙানো ছেলের দল।”

ওদের আগ্রহ এক এসএ’র চোখে পড়তেই ব্লেইনদের কাছে এগিয়ে এল লোকটা। চোখ সরু করে বলল, “পেপার দেখাও!”

 “ও আমাদের কাগজপত্র দেখতে চায়!” অনুবাদ করে দিল তারা। নিজের পাসপোর্ট এগিয়ে দিলেন ব্লেইন।

 “আহ! বিদেশি ট্যুরিস্ট” বদলে গেল লোটার আচরণ। হাসিমুখে ব্লেইনকে আবার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ন্যাশনাল সোশালিস্ট জার্মানির স্বর্গোদ্যানে স্বাগতম।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন। তারা আবার লোকটার কথা অনুবাদ করে বলল, “সে বলছে যে তোমরা এখন দেখবে জার্মান জনগণ কতটা সুখী, আরো কী সব যেন বলল আমি বুঝতে পারি না।”

“ওকে বলো আমরাও সব সময় তাই চাই।”

উচ্ছ্বসিত লোকটা খুশিতে নিজের গোড়ালি ঠুকে বলে উঠল, “হেইল হিটলার!” আর শুনে তো ম্যাথিল্ডার হাসি আর কিছুতেই থামে না।

ব্লেইন কড়া চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। যাই হোক এসএ’র দল স্কয়ার ছেড়ে চলে যেতেই আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পুরো স্কয়ারের জনগণ।

***

আগে আগে চলেছে ডেইমলার। জার্মান রাজধানীর শহরতলীর কাছে পৌঁছে গেছে ব্লেইনের দল।

“এত খাল, এত পানি আর এত গাছ।”

“পুরো শহরটাই একগাদা খালের উপরে তৈরি করা হয়েছে।” জানাল তারা।

“তুমি কীভাবে এত কিছু জানো?” ওকে থামিয়ে দিলো শাসা। কৌতুক করে কথাটা বললেও সত্যিই অবাক হয়েছে সে।

 “অন্য অনেকের চেয়েও আমি সত্যি একটু বেশি জানি, বুঝলে।” খানিকটা রেগে গেল তারা। কথাটা শুনে কেন যেন কুঁকড়ে উঠল ডেভিড।

“ভেরি ওয়েল, মিস সবজান্তা” শাসা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো তারাকে “যদি তুমি এত বুদ্ধিমান হও তাহলে বলো তো পাশের ওই সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে?”

কালো অক্ষরগুলো নিমিষেই জোরে জোরে পড়ে ফেলল তারা, এখানে লেখা আছে যে : ইহুদিগণ! সোজা এগিয়ে যাও! সোজা এগিয়ে যাও! এই রাস্তা তোমাদেরকে জেরুসালেমে নিয়ে যাবে!”

কী বলেছে বোঝার সাথে সাথে অস্বস্তিতে পড়ে গেল তারা। তাড়াতাড়ি ডেভিডের কাধ স্পর্শ করে বলল, “ওহ ডেভিড, আমি সত্যিই দুঃখিত। এমনটা আমার কখনোই বলা উচিত হয়নি!”

শিরদাঁড়া উঁচু করে বসে সোজা সামনের উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল ডেভিড। কয়েক সেকেন্ড বাদে হালকা হেসে আপন মনেই ফিসফিস করে বলল, “ওয়েলকাম টু বার্লিন। আর্য সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র।”

***

“ওয়েলকাম টু বার্লিন! ওয়েলকাম টু বার্লিন!” তাদেরকে প্রায় অর্ধেক ইউরোপ ঘুরিয়ে আনা ট্রেনটা ধীরে ধীরে স্টেশনে ঢুকে গেল। সাথে সাথে বাজনার আওয়াজে হারিয়ে গেল স্টিম ইঞ্জিনের হিমহিম শব্দ।

“ওয়েলকাম টু বার্লিন!” ট্রেন থামার সাথে সাথে দৌড়ে এল অপেক্ষারত দর্শক। ব্যালকনি বেয়ে নিচে নামতেই সবার ভিড়ের ভেতর পড়ে গেল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। দর্শকদের সবাইই হ্যান্ডশেক করছে, মেয়েরা:হাসছে। অন্য অ্যাথলেটদের অবস্থাও তাই।

“অ্যাটেনশন প্লিজ! মে আই হ্যাভ ইউর অ্যাটেনশন” স্টিলের চশমা আর গাঢ় রঙা ইউনিফর্ম গায়ে লম্বা এক লোক এগিয়ে আসতেই থেমে গেল বাজনা।

“সবার আগে ফুয়েরার আর জার্মান জনগণের কাছ থেকে আপনাদেরকে জানাচ্ছি উষ্ণ অভ্যর্থনা। একই সাথে একাদশতম অলিম্পিকেও স্বাগতম। এখানে অপেক্ষারত মোটরগাড়ি আপনাদেরকে অলিম্পিক ভিলেজে নিয়ে যাবে। এবার আগামী কয়েক সপ্তাহের জন্য যে ইয়াং লেডি আপনাদের গাইড ও দোভাষী হিসেবে কাজ করবে তার সাথে পরিচিত হোন।”

 মেয়েটাকে দেখেই উচ্ছ্বাসের মাত্রা ছাড়াল দর্শকেরা, “এই হচ্ছে হেইডি ক্রেমার।” জিমন্যাস্টদের মত লম্বা আর শক্তিশালী গড়নের মেয়েটার মধ্যে কমনীয়তারও কোনো অভাব নেই। মাঝদুপুরে আফ্রিকান আকাশের মত নীল আর স্বচ্ছ চোখ জোড়া দেখে ম্যানফ্রেডের মনে হল যে এত সুন্দর মেয়ে জীবনে আর কখনোই দেখেনি সে। সাথে সাথে আনমনে অবশ্য সারাহর কাছে সর্যিও চাইল।

“এবার হেইডি আপনাদের লাগেজ তুলে লিমোজিনে রেখে দেবে। এখন থেকে যেকোনো প্রয়োজনে হেইডিকে বলবেন! সে আপনাদের বড় বোন আর সম্মায়ের কাজ করবে!”

এই কথা শুনে তো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। তবে মিনিট খানেকের ভেতরই বোঝা গেল যে হেইডি কতটা করিকর্মা।

ম্যানফ্রেড, আংকেল ট্রম্প আর রুলফ স্ট্যান্ডার একটা গাড়িতে উঠে বসতেই হাইহিল পায়ে দিয়েও দৌড়ে এদিকে ধেয়ে এল হেইডি। দেখে তো সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। নিজ দেশে কখনো কোনো মেয়েকে হাইহিল পড়তে দেখেনি ম্যানফ্রেড।

সামনের প্যাঁচেঞ্জার ডোর খুলে ভেতরে মাথা গলিয়ে দিল হেইডি, “জেন্টেলম্যান, আমি যদি আপনাদের সাথে আসি তাহলে কোনো সমস্যা নেই তো?” মেয়েটার প্রাণবন্ত হাসি দেখে সবার সাথে আংকেল ট্রম্পও যোগ দিলেন, “না! না! প্লিজ উঠে আসুন!”

ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে দরজা আটকেই পিছু ফিরল হেইডি। দু’হাতে নিজের সিট আঁকড়ে ধরে জানাল,

“আপনাদের সাথে দেখা করতে পেরে আমি বেশ উত্তেজিত। আফ্রিকা সম্পর্কে এতকিছু পড়েছি যে; বিভিন্ন ধরনের প্রাণী, জুলু! একদিন আমিও সেখানে বেড়াতে যাব। আমাকে প্রমিজ করুন যে আপনাদের সুন্দর দেশটা সম্পর্কে আমাকে সব বলবেন, আমিও আমার অনিন্দ্যসুন্দর জার্মানি সম্পর্কে সব বলব।”

সবাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেতেই মেয়েটা আংকেল ট্ৰম্পের দিকে তাকাল। “এবার, যদি আমার ধারণা সত্যি হয় আপনিই রেভারেন্ড ট্রম্প বিয়ারম্যান, বক্সিং কোচ?” খুশি হলেন আংকেল, বললেন, “তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান।”

“আমি আপনার ছবি দেখেছি।” স্বীকার করল হেইডি। “এতটা জমকালো দাডিইবা কীভাবে ভুলি?” আংকেল তো বলা যায় ধন্য হয়ে গেলেন। এবার আপনি ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।”

“ও হচ্ছে রুলফ স্ট্যান্ডার, আমাদের হেভিওয়েট বক্সার আর ও ম্যানফ্রেড ডি লা রে; আমাদের লাইট হেভিওয়েট।” সবার পরিচয় দিলেন আংকেল।

 ম্যানফ্রেড নিশ্চিত যে ওর নামটা শুনে মেয়েটার মনে কিছু একটার উদ্রেক হল। কারণ মুখের কোনা তুলে কেমন যেন চোখ দুটো সরু করে ফেলল। তারপরই অবশ্য বলল যে, “আমরা সবাই ভালো বন্ধু হব নিশ্চয়ই।” জার্মানিতে উত্তর দিল ম্যানফ্রেড, “আমার দেশবাসী, আফ্রিকান জনগণ সবসময়ই জার্মানিদের ভালো বন্ধু

হয়েছে।”

“ওহ, তোমার জার্মান তো একেবারে নিখুঁত।” খুশি হল হেইডি, “সত্যিকারের জার্মানদের মত কথা বলা কোথায় শিখেছো?”

“আমার পিতামহ আর মা দুজনেরই রক্ত ছিল বিশুদ্ধ জার্মান।”

 “তাহলে তো আমাদের দেশে তুমি সত্যিকারের আনন্দ পাবে।”

এতক্ষণ জার্মানিতে বললেও এখন আবার ইংরেজিতে বিভিন্ন কিছুর বর্ণনা দিতে আরম্ভ করল হেইডি।

অবশেষে যখন অলিম্পিক ভিলেজের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পৌঁছাল মার্সিডিজ বহর, দলটাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল অপেক্ষারত মশালধারী হিটলার ইয়ুথ বাহিনি। আরেকটা বাদক দল বাজাল দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সঙ্গীত।

 দালানের ভেতরে ঢুকে সবার হাতে বুকলেট আর রঙিন কুপন ধরিয়ে দিল হেইডি। যেখানে প্রত্যেকের রুম, বেড়সহ অলিম্পিক কমপ্লেক্সে যাওয়া-আসার বাস আর লকার নাম্বার পর্যন্ত সবকিছু লেখা আছে। এই বাড়িতে আপনারা নিজেদের শেফ আর ডাইনিং হল পাবেন। পছন্দ মতন খাবারসহ চাইলেই। ডাক্তার আর ডেন্টিস্টও পাবেন। রেডিও, টেলিফোন, লন্ড্রিসহ টাইপ রাইটার হাতে সেক্রেটারি” এত নিখুঁত ব্যবস্থাপনা দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেল বিয়ারম্যান বাহিনি।

“প্লিজ, নিজ নিজ রুম খুঁজে নিন। আপনাদের লাগেজ ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে। আজ রেস্ট নিন। আগামীকাল সকালবেলা আমি আপনাদেরকে অলিম্পিক কমপ্লেক্সে বেড়াতে নিয়ে যাব। এর মাঝে কিছু প্রয়োজন হলেই আমাকে জানাবেন।”

 “আমি জানি ওর কাছে কী চাইতে হবে।” কোনো একজন ওয়েট লিফটারের ফিসফিস শুনেই রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল ম্যানফ্রেড।

“একেই আমি বলব নারী!” ঘোঁতঘোত করে উঠলেন ট্রম্প বিয়ারম্যান। “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমি বৃদ্ধ আর বিবাহিত; তাছাড়া ঈভের বাসনা থেকেও দূরে আছি।” ততদিনে সকলেরই আংকেল বনে গেছেন ট্রম্প বিয়ারম্যান; তার মুখে কথাটা শুনে সবাই সমবেদনার শব্দ করে উঠতেই, আচমকা কঠোর হয়ে উঠলেন আংকেল, “অল রাইট, ইউ লেজি ইয়াং ডগস। ডিনারের আগে জলদি দশ মাইল দৌড়ে এসো!”

পরদিন সকালবেলা নাশতা সেরে নিচে নামতেই দেখা গেল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে হেইডি। সকলের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিল, ছোটখাটো কিছু সমস্যার চটপট সমাধান করে দিয়েই দলটাকে নিয়ে ছুটল বাস স্টেশনের দিকে।

এরই মাঝে ভিলেজে এসে পৌঁছেছে অন্যান্য দেশের অ্যাথলেটগণ। রাস্তাজুড়ে দেখা গেল বিভিন্ন দেশের নারী-পুরুষ আর শোনা গেল বিভিন্ন ভাষা। স্টেডিয়ামে পৌঁছে আরো অবাক হয়ে গেল আংকেলের দল।

হল, জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুল, ট্রাক আর ফিল্ড থিয়েটারের এক বিশাল বড় কমপ্লেক্স। সারা সকাল লেগে গেল পুরোটা ঘুরে দেখতে। হেইডি সবারই হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিলেও কয়েকবার এসে ম্যানফ্রেডের সাথে সাথেও হটল। দুজনেই জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারাটা যেন তৈরি করে দিল। অন্যরকম এক অন্তরঙ্গতা। এমনকি রুলফও খেয়াল করল ব্যাপারটা।

লাঞ্চের সময় তাই কিছুই হয়নি এমন সরল ভঙ্গিতে জানতে চাইল, “তোমার জার্মান শেখা কতদূর এগোচ্ছে?” ম্যানফ্রেড তেড়ে উঠতেই হেসে ফেলল রুলফ।

***

পরের দিনগুলোতে ট্রেনিং সেশনে সবাইকে খাটিয়ে মারলেন আংকেল টুম্প। স্থানীয় বক্সিং ক্লাব থেকে পার্টনার জোগাড় করে দিল হেইডি।

কিন্তু মাথায় মোটা প্যাডের কাভার পরে আসা সত্ত্বেও ম্যানফ্রেডের সামনে বেচারারা কেউই এক কিংবা দু’রাউন্ডের বেশি টিকতে পারল না। নিজের কর্নারে ফিরে গিয়ে চারপাশে তাকালে ম্যানফ্রেড প্রতিবারই দেখত হেইডি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নীল চোখ দুটোতে খেলা করে সচকিত আগ্রহ।

ট্রেনিংয়ের মাত্র চারদিনের মাথায় হেইডিকে একা কাছে পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড। জিমনেশিয়ামে কসরৎ শেষ করে শাওয়ার নিয়ে যেই না বাস স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছেছে ম্যানফ্রেড, অমনি পেছন থেকে ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল হেইডি, বলল, “আমিও গ্রামে যাচ্ছি। শেফের সাথে কথা বলতে হবে। তোমার সাথে আসি?” মেয়েটা নিশ্চয় ওর জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। তাই পুলকিত বোধ করলেও খানিকটা নার্ভাস হয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড।

দুজনে একসাথে হেঁটে বাস স্টেশনে পৌঁছে গেল। “আমি অন্যান্য দেশের বক্সারদেরকেও দেখেছি।” বলে উঠল হেইডি, “বিশেষ করে লাইট হেভিওয়েটের প্রতিযোগীদেরকে আর তোমাকে তো দেখেছিই।”

“হ্যা!” অস্বস্তি ঢাকতে ভ্রূ কুচকে তাকাল ম্যানফ্রেন্ড, “আমিও দেখেছি।” “তাই বলছি তোমার কাউকে ভয় পেতে হবে না। তবে আমেরিকান ছাড়া।”

 “সাইরাস লোম্যাক্স।” একমত হল ম্যানফ্রেড। “রিং ম্যাগাজিন তো ওকে পৃথিবী সেরা অ্যামেচার লাইট হেভিওয়েটের খেতাব দিয়ে দিয়েছে। আংকেল ট্রম্পও বলেছেন যে, সে সত্যিই ভালো খেলে। খুব শক্তিশালী আর নিগ্রো হওয়ায় খুলি একেবারে যেন সলিড আইরি।”

“তুমি যদি সোনা পেতে চাও তাহলে ওকেই হারাতে হবে। মেয়েটার মুখে শোনা শব্দটা শুনেই বেড়ে গেল ম্যানফ্রেডের পালস্ রেট। “আর তোমার জন্য চিৎকার করতে আমি তো সেখানে থাকবই।”

“থ্যাঙ্ক ইউ হেইডি।”

বাসে উঠে বসল ম্যানফ্রেড আর হেইডি। বাসের অন্য পুরুষ যাত্রীরাও যখন সপ্রশংস দৃষ্টিতে হেইডিকে দেখল কেন যেন বেশ গর্ব অনুভব করল ম্যানফ্রেড যে মেয়েটা ওর পাশে বসেছে। “আমার আংকেলও বক্সিং খুব পছন্দ করেন। আমার মত তারও ধারণা যে আমেরিকান নিগ্রোটাকে হারাতে পারলেই তোমার জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আংকেল তোমার সাথেও দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে আছেন।”

“তোমার আংকেল অনেক ভালো মানুষ।”

“আজ সন্ধ্যায় উনার বাসায় ছোট্ট একটা রিসেপশন পার্টি আছে। আমাকে। বলেছেন যেন তোমাকে নিমন্ত্রণ দেই।”

“আসলে সেটা তো সম্ভব না” মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড, “মানে আমার ট্রেনিং শিডিউ”

“আমার আংকেল কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ আর প্রভাবশালী একজন মানুষ।” মাথা একপাশে ঝুঁকিয়ে মিষ্টি করে হাসল হেইডি, “তেমন সময়ও নষ্ট হবে না। কথা দিচ্ছি রাত নয়টার আগেই তোমাকে ঘরে পৌঁছে দেব।” ম্যানফ্রেড তখনো দ্বিধা করছে দেখে মেয়েটা বলল, “তুমি যদি আসো তাহলে আমার আংকেল আর আমি অনেক খুশি হব।”

“আমারও একজন আংকেল আছেন, আংকেল ট্রম্প”

“যদি আমি আংকেল ট্ৰম্পের অনুমতি জোগাড় করে দেই, তাহলে কি তুমি রাজি হবে?”

প্ল্যানমত সন্ধ্যা সাতটায় ভিলেজের সদর দরজায় মার্সিডিজ নিয়ে চলে এল হেইডি। মেয়েটার অনাবৃত কাঁধ দুটো একেবারে তুষার শুভ্র আর নীল টাফেটা ককটেইল ড্রেসটাতে চোখের সাথে দারুণ মানিয়ে গেছে।”

“তুমি অনেক সুন্দর কণ্ঠের বিস্ময় লুকাতে পারল না ম্যানফ্রেড। আগে আর কখনো কোনো মেয়েকে এভাবে বলেনি ম্যানি।

চোখ নামিয়ে ড্রাইভারকে আদেশ দিল হেইডি, “রূপাট্রাস চলো।”

মার্সিডিজের সিটে রিলাক্স হয়ে বসল ম্যানফ্রেড। ওদিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ওর পরিবার আর দেশ নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে হেইডি। খানিক বাদে ম্যানফ্রেডের মনে হল যে মেয়েটা দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কেও অনেক জানে।

“দ্য ইংলিশ” তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল হেইডি, “যেখানেই গিয়েছে সাথে করে যুদ্ধবিগ্রহ আর নির্যাতন নিয়ে গেছে, আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, আমার নিজের জার্মানি। আমরাও কম ভোগ করিনি। যদি আমাদের প্রাণপ্রিয় ফুয়েরার না থাকতেন তাহলে হয়ত এখনো ইহুদি আর ইংরেজদের যাতার নিচে কষ্ট করতে হত।”

“ইয়েস, তোমাদের ফুয়েরার সত্যিই মহান।” তারপর হিটলারের আত্মজীবনী থেকে উদ্ধৃতি দিল ম্যানি। শুনে বিস্মিত হয়ে গেল হেইডি, “মাইন ক্যাম্প। তুমি ফুয়েরারের উদ্ধৃতিও জানো!” ম্যানফ্রেডের মনে হল আরেক উঁচুতে উঠে গেল তাদের সম্পর্ক।

 হ্যাভেল লেকের তীরে বিশাল সব বাগানের পাশেই অবস্থিত রূপাসট্রাস হাউজ। পার্কিং লটে দেখা গেল আরো ডজনখানেক লিমোজিন। গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে দিল ম্যানফ্রেড। হেইডির সাথে ঢুকল রিসেপশন রুমে। ইতিমধ্যেই এসে পড়া অতিথিদের বেশিরভাগেরই ইউনিফর্মে চকচক করছে সামরিক ব্যাঙ্ক আর রেজিমেন্টের পদক। অন্যদিকে বব কাট চুলের নারীদের পরনে সিল্ক আর ভেলভেট। সবারই বলতে গেলে খালি কাধ স্পষ্ট শোভা ছড়াচ্ছে পার্টিতে।

জুটি হিসেবে ম্যানফ্রেড আর হেইডিকে এত সুন্দর লাগছে যে ওদেরকে ঢুকতে দেখেই থেমে গেল সকলের কথাবার্তা। একটু পরেই অবশ্য আবার গুঞ্জন তুলল সবাই।

“এই তো আংকেল সিগমন্ড।” উচ্ছ্বসিত হেইডি ইউনিফর্ম পরিহিত লম্বা এক ব্যক্তির কাছে ম্যানফ্রেডকে টেনে নিয়ে গেল।

“হেইডি, মাই ডিয়ার” ঝুঁকে হেইডির হাতে চুমু খেলেন আংকেল; বললেন, “যতবার তোমাকে দেখি মনে হয় যেন আগের বারের চেয়েও সুন্দরী হয়ে যাও।”

“ম্যানফ্রেড, ইনি আমার আংকেল কর্নেল সিগমন্ড বোল্ড আর আংকেল ও হল হের ম্যানফ্রেড ডি লা রে, দ্য সাউথ আফ্রিকান বক্সার।”

ম্যানফ্রেডের সাথে করমর্দন করলেন আংকেল বোন্ড। বললেন, “হেইডি বলেছে তোমার পূর্বপুরুষও নাকি জার্মান ছিলেন?”

ভদ্রলোকের একটা চোখের পাতা নিচে নামানো আর একটু পরপরই জলে ভরে যাচ্ছে চোখ। ডান হাতের লিনেন রুমালটা দিয়ে অবশ্য সাথে সাথেই পানি মুছে নিচ্ছেন আংকেল।

“সত্যিই তাই কর্নেল। আপনার দেশের সাথে আমার বেশ গভীর একটা সম্পর্ক আছে।” উত্তর দিল ম্যানফ্রেড।

 “আহ, তুমি তো দেখছি বেশ ভালো জার্মান বলো।” ম্যানফ্রেডের বাহুতে হাত রাখলেন:আংকেল, “আজ সন্ধ্যায় এখানে এমন কয়েকজন আছেন যারা তোমার সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু তার আগে আমাকে বললো আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ বক্সার সাইরাস লোম্যাক্স সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? আর ওর সাথে খেলার জন্য তোমার কৌশলটাই বা কী হবে?”

এভাবেই পুরো সন্ধ্যা জুড়েই হেইডি কিংবা আংকেল মিলে অতিথিদের সাথে ম্যানফ্রেডের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে একটু বেশি সময় কাটাতে হল জেনারেল জোলারর সাথে। লম্বা এই অফিসারের গায়ের ছাই রঙা ইউনিফর্মের গলায় আছে আয়রন ক্রস। লোকটার চেহারা সাদামাটা হলেও প্রখর বুদ্ধিমান যে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি আর রাজনীতি নিয়ে ম্যানফ্রেডকে অনেক প্রশ্ন করলেন জোলার। ম্যানফ্রেডের মনে হল অফিসার দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল আর তাই অনেক খবরই রাখেন। একটু বাদেই এসে ম্যানির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হেইডি।

 এক্সকিউজ মি জেনারেল জোলার; আমি বক্সিং কোচকে প্রমিজ করে এসেছি যে রাত নয়টার মধ্যেই তার স্টারকে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”

“তোমার সাথে পরিচিত হয়ে বেশ ভালো লাগল ইয়াংম্যান।” ম্যানফ্রেডের সাথে হাত মেলালেন জেনারেল, “আমাদের দেশও ভালো বন্ধু হওয়া উচিৎ।”

“এক্ষেত্রে আমি আমার সাধ্যমত সব করব।” আশ্বস্ত করল ম্যানফ্রেড।

 “গুড লাক ফর দ্য গেমস, হের ডি লা রে।”

ফেরার পথে মার্সিডিজে উঠে হেইডি বলল, “আমার আংকেল তোমাকে বেশ পছন্দ করেছেন। উনার বন্ধুরাও, যেমন জেনারেল জোলার।

“সন্ধেটা আমারও দারুণ কেটেছে।”

“তুমি মিউজিক পছন্দ করো ম্যানফ্রেড?”

প্রশ্নটা শুনে খানিক অবাক হয়ে গেল ম্যানি; বলল, “খানিকটা পছন্দ করি; তবে এক্সপার্ট নই।”

“ওয়াগনার?”

“ইয়েস; ওয়াগনারকে অনেক ভালো লাগে।”

“আংকেল সিগমন্ড আমাকে আগামী শুক্রবারের বার্লিন ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার দুইটা টিকিট দিয়েছেন। ওয়াগনারের প্রোগ্রামও হবে। জানি তুমি যে সন্ধ্যায় তোমার প্রথম ম্যাচ খেলবে; কিন্তু তারপরে আমরা সেলিব্রেট করতে পারি, কী বলল?” খানিক দ্বিধা করেই হেইডি আবার বলল, “সরি, তুমি হয়ত ভাবছো আমি একটু বেশিই তাড়াহুড়া করছি। কিন্তু কথা দিচ্ছি যে-”

 “না, না; তোমার সাথে যেতে পারলে আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করব। হারি বা জিতি যাই ঘটুক না কেন।

 “তুমিই জিতবে” সহজ গলায় জানিয়ে দিল হেইডি, “আমি জানি তুমিই জিতবে।”

ম্যানফ্রেডকে টিম হাউজের সামনে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি নিয়ে আবার রূপাসট্রাসে ফিরে এল হেইডি।

 কর্নেল হাউজে আসতেই দেখা গেল চলে গেছে বেশিরভাগ অতিথি। একেবারে সবশেষ জনকে বিদায় জানিয়ে হেইডিকে তার পিছনে আসার আদেশ দিলেন কর্নেল। মেয়েটার সাথে এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে তার আচরণ। দুজনে এখন উচ্চপদস্থ অফিসার আর সাধারণ কর্মচারী মাত্র।

ওক কাঠের দরজা খুলে রুমে ঢুকে গেলেন কর্নেল। পিছু নিয়ে ঢুকে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রইল হেইডি। পাথরের ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছেন জেনারেল জোলার। দুজনের জন্য কান্যাক ঢেলে নিলেন কর্নেল।

“তো ফ্রাউলেন” নিজে লেদার চেয়ারে ডুবে গিয়ে এতক্ষণে হেইডিকে বসার নির্দেশ দিলেন কর্নেল, “বসো।”

নম্রভাবে হেসে শিরদাঁড়া উঁচু করে কাউচে গিয়ে বসল হেইডি।

“সাবজেক্ট নিয়ে জেনারেল জোলারের মন্তব্য কী জানতে পারি?” প্রশ্নটা শুনে ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকালেন জেনারেল জোলার।

 “সাবজেক্টে মায়ের বিষয়টা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। কর্নেলকে জানালেন জোলার, “ও যে বলছে ওর মা জার্মান তা কী নিশ্চিত হওয়া গেছে?”

“না, এখন পর্যন্ত নয়। তারপরেও দক্ষিণ আফ্রিকাতে আমাদের লোকজন লাগিয়েছি এ ব্যাপারে খবর নেয়ার জন্য। তবে সবার ধারণা যে জঙ্গলের মাঝে সন্তান প্রসবের সময় মারা গেছেন ওর মা। তবে ওর পিতামহী যে জার্মান ছিলেন আর ওর বাবা যে আফ্রিকাতে কাইজারের সেনাবাহিনিতে লড়াই করেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।”

“ইয়েস, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।” এবার হেইডির দিকে তাকালেন জোলার, “সে তোমার ব্যাপারে কতটা আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্রাউলিন?”

“নিজের জার্মান রক্ত নিয়ে সে বেশ গর্ব বোধ করে আর জার্মান জনগণকেও বন্ধু ভাবে। ফুয়েরারেরও বেশ ভক্ত। এমনকি মাইন ক্যাম্প থেকে উদ্ধৃতিও দিতে পারে।”

 খকখক কাশি দিয়ে সিগারেট ধরালেন জেনারেল। তারপর আবার মনোযোগ দিলেন ফ্রন্ট কাভারে ঈগল আর স্বস্তিকা চিহ্নঅলা লাল ফাইলটার দিকে। অন্যদেরকে ঝাড়া দশ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে অবশেষে তাকালেন হেইডির দিকে।

“সাবজেক্টের সাথে তুমি কতটা সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছ ফ্রাউলেন?”

“কর্নেল বোল্টের আদেশানুযায়ী আমি ওর কাছে নিজেকে বেশ বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে তুলে ধরেছি। বুঝিয়েছি যে বক্সিংয়ে আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে; তাছাড়া ওর পিতৃভূমির সমস্যা নিয়েও ভাবি।”

“ফ্রাউলেন ক্রেমার আমার শ্রেষ্ঠ • অপারেটরদের একজন।” জানালেন কর্নেল, “আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ওকে বক্সিং আর দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান দান করা হয়েছে।” মাথা নেড়ে জেনারেল বললেন, “আর কী বলার আছে, বলো ফ্রাউলেন।”

“ওর দেশের মানুষের রাজনৈতিক উচ্চাকাভক্ষার প্রতি আমি আমার সহানুভূতি দেখিয়েছি। আর এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছি যে, আমি হয়ত ওর বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু।”

“তার মানে তোমাদের মাঝে কোনো শারীরিক সখ্যতা?”

“না, জেনারেল, ভেবে দেখেছি যে এত দ্রুত এগোতে গেলে সাবজেক্ট বিগড়ে যেতে পারে। ওর ফাইল থেকে যতটা জেনেছি সে এক কঠোর ধর্মীয় ব্যাগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। এর পাশাপাশি কর্নেল বোন্ডও এখনো কোন রকম শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আদেশ দেননি।”

“শুড।” সম্মত হয়ে মাথা নাড়লেন জেনারেল, “ব্যাপারটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফুয়েরার নিজে আমাদের এ অপারেশন সম্পর্কে জানেন। আমার মতই উনারও ধারণা যে, দক্ষিণ আফ্রিকা কৌশলগতভাবে আমাদের পৃথিবীব্যাপী স্বার্থ পূরণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অঞ্চল। সুয়েজ খাল আমাদের সাথে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানানোয় এই একটিই পথ খোলা আছে। এর সাথে আবার এ অঞ্চল আমাদের প্রয়োজনীয় সামরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ক্রোম, হিরে, প্লাটিনাম গ্রুপ ম্যাটেরিয়াল সব এখানে পাওয়া যায়। সাবজেক্টের সাথে আমার সাক্ষাতের পর তাই আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে এগোনো যায়। তার উপরে আবার এ অপারেশনকে ডিপার্টমেন্ট থেকেও বৈধতা দিয়ে “লাল” রেটিং দেয়া হয়েছে।”

“ভেরি গুড, মাই জেনারেল।”

 “এ অপারেশনের কোড নেইম হবে হোয়াইট সোর্ড।”

 “ঠিক আছে।”

“ফ্রাউলেন ক্রেমার, এই অপারেশনের পুরো দায়িত্ব এখন তোমার। প্রথম সুযোগেই ওর সাথে শারীরিকভাবে এতটা জড়িয়ে পড়বে যেন ওর উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হয়।”

“ভেরি ওয়েল, মাই জেনারেল।”

“হয়ত এক্ষেত্রে সাবজেক্টের সাথে তোমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। সেক্ষেত্রে তোমার কোনো সমস্যা নেই তো?”

একটুও দ্বিধা না করে হেইডি উত্তরে জানাল, “না, মাই জেনারেল। আপনি আমার দায়িতুবোধ আর বিশ্বস্ততার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে পারেন।”

“ভেরি গুড, ফ্রাউলেন” ভয়ংকর শব্দের কাশি দিয়ে ভাঙা গলায় জেনারেল জানালেন, “কর্নেল, সাবজেক্ট যদি গেমসে গোল্ড মেডেল পেয়ে যায় তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য আরো ভালোভাবে পূর্ণ হবে। তাহলে দেশে তার সম্মানও বেড়ে যাবে।”

“বুঝতে পেরেছি জেনারেল।”

“আচ্ছা লাইট হেভিওয়েট টাইটেলের জন্য কোনো শক্ত প্রতিযোগী নেই তো যে কিনা আবার জার্মান?”

“না, জেনারেল। সাবজেক্টই একমাত্র শ্বেতাঙ্গ প্রতিযোগী। এ ব্যাপারে পর্ণ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, সাবজেক্ট যেসব খেলা খেলবে তার রেফারি আর বিচারক হবে আমাদের পার্টির সদস্য। তবে হ্যাঁ, নক আউটের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়াটা হয়ত সমস্যা হয়ে যাবে”।

“ঠিক তাই বোন্ড, কিন্তু আপনিও সাধ্যমত যা সম্ভব করবেন আর ফ্রাউলেন ক্রেমার, নিয়মিত তোমার রিপোর্ট সরাসরি কর্নেলের কাছে জমা দিবে।”

***

কোর্টনি আর ম্যালকমস পরিবার অলিম্পিক ভিলেজে না উঠে জাঁকজমকপূর্ণ ব্রিস্টল হোটেলে উঠে গেল। যদিও ডেভিড আব্রাহামস পূর্বের ওয়াদামত অ্যাথলেটিক কোচ আর টিম মেটদের সাথে অ্যাপার্টমেন্ট হাউজেই উঠল। ফলে দেখা গেল ম্যাথিল্ডা জ্যানিন আর তারা দু’বোন পালাক্রমে একবার অ্যাথলেটিক ট্রেনিং ফিল্ডে আর আরেকবার পোলো ফিল্ডে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে।

“তোমার কিন্তু জোর সম্ভাবনা আছে ডেভিড” কোচের কথা শুনে আপুত আব্রাহামস তনয় ম্যাথিল্ডার সন্ধেয় এক-দুই ঘণ্টা বাইরে থাকার আবদারও উড়িয়ে দিল।

এদিকে জার্মান ঘোড়া দেখে ব্লেইন আর শাসাও বেশ খুশি। সহিস, আস্তাবল আর সমস্ত ইকুপমেন্টও নিখুঁত হয়েছে। পুরো দল নিয়ে তাই প্র্যাকটিসে নেমে পড়লেন ব্লেইন।

ফিল্ডে প্র্যাকটিস করার সময় আরেকটা কাজ হল প্রতিপক্ষকে পর্যবেক্ষণ করা। আমেরিকানরা আটলান্টিক পার করে নিজেদের ঘোড়া পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আর্জেন্টিনিয়ানরা তো আরেক কাঠি সরেস। সাথে সহিসও নিয়ে এসেছে।

“এই দুই দলকেই হারাতে হবে।” সতর্ক করে দিলেন ব্লেইন। “তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল জার্মানরাও বেশ ভালো করছে।”

 “ওদের যে কাউকেই হারিয়ে দেয়া আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না।” নিজের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বসল শাসা, “যদি ভাগ্য একটু সহায় হয়।”

***

১৯৩৬ সালের পহেলা আগস্ট সকাল নয়টার মধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অলিম্পিক স্টেডিয়ামে জড়ো হল এক কোটি মানুষ।

স্টেডিয়ামের বাইরে একরের পর একর খোলা জায়গায় সুউচ্চ বেল। টাওয়ারে লেখা হল : “আমিই ঘোষণা করছি পৃথিবীর তারুণ্য।” এর নিচে জড়ো হল সমস্ত অ্যাথলেটগণ।

সকালের শীতল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে দূরাগত এক গুঞ্জন। ধীরে ধীরে স্টেডিয়ামের দিকে এগিয়ে আসছে চার দরজার খোলা মার্সিডিজ গাড়ির এক লম্বা বহর। রাস্তার দু’পাশে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চাশ হাজার স্টর্ম ট্রপারস। একেবারে সামনের গাড়িটা কাছে আসতেই ডান হাত তুলে নাজি স্যালুট করল সবাই। মার্সিডিজ থেকে নেমে এলেন অ্যাডলফ হিটলার।

 “তো এই হল সে পাগল লোকটা!” ব্লেইনের মাত্র পাঁচ কদম দূর দিয়ে হেঁটে গেলেন হিটলার। আরো হাজার বার ছবিতে যেমন দেখেছেন বাস্তবের মানুষটাও ঠিক সেরকম। পরিপাটি করে আঁচড়ানো কালো চুল; ছোট্ট চারকোনা মোচ। কিন্তু সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে হিটলার তার দিকে তাকালেন সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না ব্লেইন। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল গাঁয়ের লোম; মনে হল এইমাত্র যেন ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে উঠে আসা কোনো নবীর চোখে চোখ রাখলেন ব্লেইন! অথবা বলা যায় এক উন্মাদ।

হিটলারের পেছনে আসছেন তার স্নেহভাজন গোয়েবলস আর গোয়েরিং। একটা টানেলের ভেতর দিয়ে ওপাড়ের আলোকিত মঞ্চে উঠে গেলেন হিটলার ও তার দল।

প্যারেডে একসাথে হাঁটছে শাসা আর ডেভিড। আনন্দ আর উত্তেজনায় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল দুই বন্ধু। শাসার বেশ কিছুদূর সামনে দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। একমনে কেবল হিটলারকেই দেখছে। ইচ্ছে হল ডান হাত উঁচিয়ে ঘোষণা করে “হেইল হিটলার।” কিন্তু না; নিজেকে সংযত করল। কারণ বহু তর্ক-বিতর্কের পর ব্লেইন ম্যালকম আর অন্যান্য ইংরেজিভাষী দলগুলো কেবল ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে স্যালুটের ভঙ্গি করল। সাথে সাথে মৃদু শিস দিয়ে দুয়ো ধ্বনি তুলল জার্মান দর্শক। উঁচু মঞ্চে থাকা সবচেয়ে পছন্দের মানুষটাকে ইচ্ছে মতন সম্মান দেখাতে না পেরে ম্যানফ্রেডের চোখ ভরে গেল জলে। এমনকি অনুষ্ঠানের বাকি সময়টুকুতেও ভুলতে পারল না এই ক্ষোভ।

***

ব্রিস্টলে নিজের স্যুইটে ব্লেইনকে নিয়ে ডিনার করতে বসেছেন সেনটেইন। দিনটা এতটাই উত্তেজনায় কেটেছে যে দু’জনে যেন এখনো ঘোরের মধ্যে আছেন।

“দুনিয়াকে কী এক শো দেখাল তাই না!” মন্তব্য করলেন সেনটেইন; “আমার মনে হয় না এতটা কেউ কখনো কল্পনা করতে পেরেছে আগে।”

“আসলে এটাই সত্যি।” উত্তরে জানালেন ব্লেইন, “নরেমবার্গ র‍্যালি দেখোনি! নাজিরা এখন প্রাচীন রোমানদের চেয়েও দর্শনীয় শো করতে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।”

“আমার কিন্তু বেশ ভালো লেগেছে।”

“তবে অনেক কিছুই কিন্তু একটু বেশি লোক দেখানো হয়ে গেছে। হের হিটলার পুরো দুনিয়ার কাছে প্রদর্শন করেছেন তার নাজি জার্মানির সুপারম্যানদেরকে। কিন্তু হ্যাঁ, তোমার সাথে আমিও একমত যে ফন্দিটা কাজে লেগেছে। আনন্দের পাশাপাশি অশুভ এক ছোঁয়া পুরো অনুষ্ঠানকে সার্থক করে তুলেছে।”

“ব্লেইন, তুমি কিন্তু দিনকে দিন একটু বেশিই খুতখুঁতে হয়ে যাচ্ছ।”

“এটাই তো আমার আসল গুণ।” তারপরই হঠাৎ করে আলোচনার বিষয় বদলে ফেললেন ব্লেইন।

 “প্রথম রাউন্ড ম্যাচের পোস্টার ছাপা হয়েছে। ভাগ্য ভালো যে প্রথমে আর্জেন্টিনা কিংবা ইয়াঙ্কিদেরকে পাইনি।”

***

প্রথমেই প্রতিপক্ষ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ানদেরকে পেলেন ব্লেইন আর শাসা। আর সাথে সাথে উবে গেল তাদের সহজে জেতার আশা। বাধ্য হয়ে ডিফেন্সিভ খেললেন ব্লেইন। প্রথম তিন রাউন্ডে তত তাদেরকে একটুও আগে বাড়তে দেয়নি অসি দল। তবে শাসা পুরোপুরি নিজের ক্যাপ্টেনের নির্দেশমত “কাট লেফট”, “কাভার দ্য ফল” কিংবা “ব্রেক ব্যাক” মেনে চলেই খেলল। আর খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলেও চতুর্থ রাউন্ডে গিয়ে সাফল্যের দেখা পেল শাসা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদযাপন করল বিজয়ের আনন্দ। যদিও সত্যি অবিশ্বাস্য হয়েছে খেলাটা।

তবে জয়ের আনন্দ ফিকে হয়ে গেল যখন শুনল পরের রাউন্ডের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা।

***

ডেভিড আব্রাহামসের প্রথম ইভেন্ট ৪০০ মিটার দৌড় কিন্তু সবাইকে হতাশ করল। চার নম্বর হল ডেভিড। সে রাতে ডিনার না খেয়েই তাড়াতাড়ি বিছানায় ঘুমাতে গেল ম্যাথিল্ডা। তবে দুদিন পরেই আবার বদলে গেল পরিস্থিতি। দুইশ মিটার হিট জিতে সেমি ফাইনালে উঠে গেল ডেভিড।

***

প্রথম প্রতিপক্ষ হিসেবে ফরাসি মরিসকে পেলো ম্যানফ্রেড ডি লা রে। “মাম্বার মতই দ্রুত র‍্যাটেলের মতই সাহসী” ভিড়ের মাঝেও ম্যানফ্রেডের কানের কাছে গুনগুন করে শুনিয়ে দিলেন আংকেল ট্রম্প।

 চতুর্থ সারিতে কর্নেল বোন্ডের পাশে বসে আছে হেইডি। ম্যানফ্রেন্ডকে নড়ে উঠতে দেখে উত্তেজনায় কেঁপে উঠল মেয়েটা। ঠিক একটা বিড়ালের মতই দুলছে ম্যানি।

এর আগপর্যন্ত খেলার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ বোধ করত না হেইডি। সব ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি, ক্যানভাস আর চামড়া থেকে উঠে আসা ঘামের গন্ধ, জম্ভর মত একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখলেই বিবমিষা জাগত। কিন্তু এখন সিল্ক, লেস আর পারফিউমের গন্ধে সুবাসিত সুবেশী দর্শকদের মাঝে বসে পরিবেশটা তেমন খারাপ লাগল না আর।

গোমড়া মুখে ম্যানফ্রেড ডি লা রে’ও বদলে গিয়ে ভয়ংকর এক বন্য পশুতে পরিণত হয়েছে। কালো জ্বর নিচে ছেলেটার হলুদ জোড়া চোখ, ফরাসিটার রক্তাক্ত মুখ আর সাদা ক্যানভাসের ওপর তাঁকে হাটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা ম্যানফ্রেডকে দেখে মনে মনে যেন শারীরিক শীর্ষ সুখ অনুভব করল হেইডি।

এমনকি সেই সন্ধ্যায় স্টেট অপেরা হাউজে ম্যানফ্রেডের পাশে বসেও একই রকম উত্তেজনা অনুভব করল ম্যানফ্রেডের জার্মান গাইড। খানিক ঝুঁকে হাত রাখল ম্যানফ্রেডের বাহুতে। বুঝতে পারল ছেলেটাও বহু কষ্টে নিজের রাশ টেনে রেখেছে।

 আগের বারের মতই মার্সিডিজ পাঠিয়ে দিয়েছেন কর্নেল বোল্ড। অপেরা হাউজ থেকে নেমে আসতেই দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার। কিন্তু গাড়িতে উঠে কেন যেন ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলল ম্যানফ্রেড।

“কী হয়েছে?” তাড়াতাড়ি জানতে চাইল হেইডি।

“কিছু না।”

দৃঢ় হাতে ম্যানফ্রেডের কাঁধ স্পর্শ করল মেয়েটা; বলল, “কী, এখানে ব্যথা হচ্ছে?”

“পেশি কেমন যেন টান হয়ে আছে, কালই ঠিক হয়ে যাবে। সমস্যা নেই।”

“হ্যানস, আমাদেরকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে চলো।” ড্রাইভারকে আদেশ দিল হেইডি। “মুক্তি আমাকে শিখিয়েছে ফার্ন দিয়ে তৈরি হারবাল ওষুধ সত্যিই জাদুর মত কাজ করে।”

“না, না এর কোনো প্রয়োজন নেই— বাধা দিতে চাইল ম্যানফ্রেড।

“অলিম্পিক ভিলেজে যাবার পথেই পড়বে আমার অ্যাপার্টমেন্ট। বেশি সময়ও লাগবে না। এরপরই হানস তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।” ওর সন্দেহের উদ্রেগ না করে কীভাবে ওকে একা করে পাওয়া যাবে এটা নিয়ে শঙ্কিত ছিল হেইডি; কিন্তু দেখা গেল এখন তার সাজেশন শুনে আর কিছু বলল না ম্যানফ্রেড। বাকি পথটুকু একেবারে চুপচাপ বসে রইল ছেলেটা। ভয়ে ওকে আর স্পর্শ করল না হেইডি।

ওদিকে মনে মনে সারাহকে ভাবতে চাইল ম্যানফ্রেড। কিন্তু কেন যেন ওর চেহারা স্পষ্টভাবে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ইচ্ছে করল হানসকে বলে সোজা টিম হাউজে নিয়ে যেতে; কিন্তু সেটাও করল না। বুঝতে পারছে যা করছে তা ভুল হচ্ছে কিন্তু বাধাও দিতে পারছে না। আর একেকটা ম্যাচের পর তো ব্যাপারটা আরো কঠিন হয়ে যায়। যেন ওর শরীরের ওপর শয়তান এসে ভর করে। মেয়েটাকে মানা করে দেয়ার জন্য মুখ খুলতে গেল ম্যানি। কিন্তু দেখা গেল সামনের দিকে ঝুঁকে ড্রাইভারকে হেইডি বলছে, “থ্যাঙ্ক ইউ হানস। আমাদেরকে এই কর্নারে নামিয়ে দাও। তারপর ব্লকের শেষে গিয়ে অপেক্ষা করো।” গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করল হেইডি। তাই চুপচাপ পিছু নেয়া ছাড়া ম্যানির আর কিছু করার রইল না।

বিল্ডিংয়ের লবিটা কেমন যেন আঘো-অন্ধকারে ঢাকা।

“আয়্যাম সরি ম্যানফ্রেড; আমি টপ ফ্লোরে থাকি আর এখানে কোনো এলিভেটরও নেই।”

উপরে যাওয়ার পরিশ্রমে খানিকটা সুস্থির হল ম্যানফ্রেড। ঢুকল হেইডি, বলল, “এই হল আমার প্রাসাদ।” ক্ষমা চাইবার মত করে হেসে ফেলল। তারপর বিছানা দেখিয়ে ম্যানিকে বলল, “ওখানে বসো ম্যানফ্রেড।”

গায়ের জ্যাকেট খুলে কার্বাডে ঝুলিয়ে রাখল হেইডি। মেয়েটার উন্নত বুক দেখে চট করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল ম্যানি। তাড়াতাড়ি দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখল বইয়ের তাক। নিজেকে শাসন করল এই বলে যে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে হবে।

 ছোট্ট বাথরুমটাতে গিয়ে সবুজ একটা বোতল হাতে নিয়ে ফিরে এল হেইডি। ম্যানির সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, “তোমার শার্ট আর কোর্ট খুলে ফেলো।” হাঁ করে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। এরকম কিছু তো ভাবেইনি। তাই বলল,

“সেটা ঠিক হবে না হেইডি।”

নরম স্বরে হেসে বিড়বিড় করে হেইডি জানাল, “লজ্জা পেও না তো ম্যানফ্রেড। জাস্ট, ভাবো যে আমি একজন নার্স।

নিজেই ম্যানফ্রেডকে সাহায্য করল। তারপর কোর্ট আর শার্ট ভাজ করে চেয়ারের ওপর রেখে সবুজ বোতল থেকে লোশন নিয়ে ঘষতে লাগল ম্যানফ্রেডের স্কিন।

 “রিল্যাক্স।” ফিসফিস করে কথা বলছে হেইডি; কণ্ঠে মাদকতা এনে বলল, “এইতো এই জায়গাটা কেমন যে শক্ত হয়ে আছে। রিল্যাক্স, ব্যথাটাকে একেবারে দূর করে দাও।” আস্তে করে সামনে ঝুঁকে এল হেইডি; “আমার গায়ে হেলান দাও ম্যানফ্রেড। হ্যাঁ, এই ভাবে।”

 ম্যানফ্রেডের সামনে দাঁড়িয়ে জোর করে ওর কোমর ধরে নিজের কোলে টেনে নিল হেইডি। আচমকা নারী দেহের কোমল স্পর্শ পেয়ে ম্যানফ্রেড নিজেও পুলকিত হয়ে উঠল,

“তুমি এত হার্ড আর স্ট্রং ম্যানফ্রেড-” আস্তে আস্তে ভেসে গেল সমস্ত বিবেক-বুদ্ধি বিবেচনা। মেয়েটার গায়ের গন্ধে দিশেহারা বোধ করল ম্যানি। কিন্তু মেয়েটার ব্যাকুলতা টের পাবার আগে সে নিজেই যেন আকুল হয়ে বলে উঠল,

“হেইডি, আই লাভ ইউ, ওহ খোদা, আমাকে মাফ করো। কিন্তু সত্যি বলছি আই লাভ ইউ।” কেঁপে উঠল ম্যানির গলা।

“ইয়েস, আমি জানি” ফিসফিস করে উত্তরে জানাল হেইডি “আর আমিও তোমাকে ভালোবাসি।”

আস্তে করে ম্যানফ্রেডকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল হেইডি। তারপর আস্তে আস্তে খুলে ফেলল নিজের ব্লাউজ। দমবন্ধ ম্যানফ্রেডের মনে হল এত সুন্দর দৃশ্য বুঝি আর কখনোই দেখেনি।”

সেই রাতে বিস্ময় আর আনন্দে কতবার যে ম্যানফ্রেড হেইডিকে “আই লাভ ইউ” বলল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

***

ফাইনালের প্রথম দিনে টিম টিকিট থেকে দুবোনের জন্যও টিকিট জোগাড় করে আনল শাসা। কিন্তু সিট দুটো বেশ উপরে পড়ল। ম্যাথি শাসার বাইনোকুলার ধার করে নিয়ে উদ্বিগ্নমুখে তাকাল নিচের দিকে।

“আমি ওকে কিছুতেই দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল ম্যাথিল্ডা।

 “ও এখনো বের হয়নি।”

ওকে আশ্বস্ত করল শাসা, “আগে একশ’ মিটারের দৌড় হবে- “ কিন্তু ভেতরে ভেতরে ম্যাথিল্ডার মতই টেনশনে আছে সে নিজেও। আজ সেমি ফাইনালের ২০০ মিটার দৌড় দিবে ডেভিড। শাসার অন্য পাশে বসে তারাও মুখ কালো করে রেখেছে; তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে।

“এসব মোটেই উচিত হচ্ছে না। তারার চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি ওর দিকে তাকাল শাসা।

“কী?”

 “তোমরা একটা শব্দও শুনছো না।”

“আমি সরি কিন্তু তুমি তো জানো যে ডেভিড যেকোনো মুহূর্তে বাইরে বেরিয়ে আসবে” আর সাথে সাথে মনে হল যেন হাততালির শব্দে কানে তালা লেগে যাবে। একশ’ মিটার দৌড় শেষ করার পর নির্ধারিত হয়ে গেছে বিজয়ী অ্যাথলেট।

“ওই তো!” শাসার হাত চেপে ধরল তারা, “ওদের কথা শোনো।”

ওদের কাছাকাছি একদল দর্শক চিৎকার করে উঠল, “আরেকজন আমেরিকান নিগ্রো জিতে গেল। আমেরিকানদের উচিত লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়া।”

“এই লোকগুলো এত বিরক্তিকর কী যে বলব।” চোখ গরম করে বক্তার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাল তারা। খুঁজে না পেয়ে শাসার দিকে ফিরে বলল, “জার্মানিরা হুমকি দিয়েছে যে সব মেডেল নিচু জাত অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ আর ইহুদিদেরকে দেয়া যাবে না।” কণ্ঠস্বর আরো তুলে ফেলল তারা, “লোকগুলো কতটা আহম্মক চিন্তা করো।”

“কুল ডাউন।” ফিসফিস করে উঠল শাসা।

 “কেন?” পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল তারা, “ডেভিডও তো একজন ইহুদি।”

“অফ কোর্স।” অস্বস্তিতে চারপাশে চোখ বোলালো শাসা, “কিন্তু এখন থামো, তারা। এসব কথা বলার জন্য সঠিক সময় এটা নয়।”

“আমার মনে হয়—-” শাসার কথা শুনে যেন আরো ক্ষেপে উঠল তারা। কিন্তু ওর চেয়েও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ম্যাথি বলে উঠল, “ওই তো এসে গেছে, ডেভিড এসে গেছে!”

 স্বস্তি পেয়ে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাসা। চিৎকার করে বন্ধুর উদ্দেশে বলল, “রান, ডেভি বয়, রান?”

ট্রাকের এক কর্নারে নিজেদের ওয়ার্ম আপ সেরে নিচ্ছে দুইশ মিটারের ফাইনালিস্টগণ। তারপর কিছুক্ষণ পরেই নিজ নিজ ব্লকে দাঁড়িয়ে দৌড়ের জন্য তৈরিও হয়ে গেল। সাথে সাথে যেন পিনপতন নীরবতা নেমে এল পুরো স্টেডিয়ামে। উপুড় হয়ে হুইসেলের জন্য অপেক্ষা করছে সব রানার।

 গর্জে উঠল রেফারির পিস্তল। সাথে সাথে নিখুঁত লাইন বজায় রেখে দৌড় শুরু করল অ্যাথলেটগণ। হঠাৎ করেই লাইন ভেঙে একে অন্যকে হারানোর চেষ্টায় ফুলে উঠল ট্র্যাকের মধ্যভাগ। কালো চিতাবাঘের মত দেখতে এক অ্যাথলেট সবাইকে ছাড়িয়ে আগে বাড়তেই চিৎকার করে উঠল পুরো স্টেডিয়াম।

“কী হচ্ছে, কী এটা?” চিৎকার করল ম্যাথিল্ডাও।

 “জেন্সি ওয়েনস জিতে গেছে।” গলার স্বর তুলে উত্তর দিল শাসা।

“জানি, কিন্তু ডেভিডের কী হয়েছে?”

 “জানি না, সবাই এত কাছাকাছি দৌড়াচ্ছে যে দেখা যাচ্ছে না।”

নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল সবাই। অবশেষে গমগম করে উঠল লাউড স্পিকার। জার্মান ভাষায় ঘোষণা করা হল বিজয়ীদের নাম।

 “জেসিওয়েনস, কার্টার ব্রাউন” আর তারপরই কানে যেন মধু বর্ষণ করল, “ডেভিড আব্রাহাম।”

উত্তেজনার চিৎকার জুড়ে দিল ম্যাথিল্ডা, “আমার মনে হচ্ছে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব; আমাকে ধরো প্লিজ। ডেভিড ব্রোঞ্জ পেয়েছে!”

নিজের সিটে বসেই লাফালাফি শুরু করে দিল ম্যাথিল্ডা। আনন্দের চোটে দরদর করে জল নামছে মেয়েটার চোখ বেয়ে। অন্যদিকে নিচের সবুজ মাঠে বিজয়ীদের জন্য তৈরি পিরামিডের তিন নম্বর ধাপে দাঁড়িয়ে গলায় ব্রোঞ্জের মেডেল পরে নিল ডেভিড।

ব্রিস্টলে সন্ধ্যায় সেনটেইনের স্যুইটেই সেলিব্রেশন করল চার ছেলেমেয়ে। তারপর পুরো রাত উপভোগ করল অপিম্পিকের সাজে সজ্জিত বার্লিনের রাতের জীবন।

 একটা ক্যাফের সামনে এসে থামতেই স্ন্যাপস্ অর্ডার করল শাসা, “আস্তে আস্তে খাও।” কানের কাছে ফিসফিস কর উঠল ডেভিড। জানে শাসা কখনো এক গ্লাস ওয়াইন কিংবা বিয়ারের বেশি পান করে না।

“ডেভি, মাই বয়, রোজ রোজ তো আর আমার দোস্ত মেডেল জিতে না, তাই না।”

“মাতলামি করলে আমি কিন্তু তোমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে পারব না।” বন্ধুকে সতর্ক করে দিল ডেভিড।

আবার একটা কফি শপের পাঁয়তারা কষছে শাসা; এমন সময় ডেভিড বলল, “আর কোনো শ্যাম্পেন না, প্লিজ।” বাধা দিতে চাইল ডেভিড।

ওকে পাত্তা না দিয়ে আঙুল তুলে ওয়েট্রেসকে ডাকল শাসা। চারটা টিউলিপ গ্লাসে করে হলুদ ওয়াইন ঢেলে দিল মেয়েটা।

সে রাতে চারজন মিলে হাসছে, ওয়াইন গিলছে। কিন্তু সেকেন্ডের জন্যও কেউ ভাবতে পারেনি যে কী ঘটতে যাচ্ছে এরপর।

“ওহ ডিয়ার” বিড়বিড় করে উঠল তারা, “দেখো অশ্বারোহীর দল চলে এসেছে।”

 বাদামি ইউনিফর্ম পরিহিত ছয় স্ট্রম টুপারের দল ঢুকে পড়ল শপে। নিশ্চয় তাদের রেজিমেন্টেরও কোনো ফাংশন ছিল। কারণ, দু’জনের হাতে ব্যানার। বোঝা গেল যে তারা ইতিমধ্যেই বেশ ড্রিংকস করে এসেছে। তবে ওদেরকে দেখে কফি শপের বাকি কাস্টমারদের অনেকেই তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে কোট গায়ে নিয়ে বের হয়ে গেল।

ঠিক শাসাদের পাশের খালি টেবিলটাতেই এসে বসল ছয়জন ট্রুপার। কফি শপের মালিক কোনো ধরনের ঝামেলা যাতে না হয় তাই স্বয়ং এসে ছয়জনের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। যদিও লোকটা যে টেনশনে আছেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তারপর নাজি স্যালুট করে বিদায় নেয়ার চেষ্টা করতেই ছয়জনও সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পায়ের জ্যাকবুট ঠুকে চিৎকার করে বলে উঠল “হেইল হিটলার!”

পুরো এক গ্লাস শ্যাম্পেন খেয়ে ফেলা ম্যাথি জ্যানিন তো এ দৃশ্য দেখে খুকখুক করে হাসি আর থামাতেই পারে না। সঙ্গে সঙ্গে ওর দিকে ঘুরে তাকাল ছয় স্ট্রর্ম ট্রুপার।

“চুপ করো, ম্যাটি!” সাবধান করতে চাইল শাসা; কিন্তু হয়ে গেল হিতে বিপরীত। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে বিষম খেলো ম্যাথিন্ডা। পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নিজেদের টেবিল ছেড়ে শাসাদের কাছে চলে এল ছয়জন ট্রুপার।

দলের লিডার, মধ্যবয়স্ক এক সার্জেন্ট কিছু একটা বলতেই স্কুল গার্লদের মত জার্মানে উত্তর দিল তারা, “আহা, ভারি গলায় ইংরেজিতে পাল্টা জানাল সার্জেন্ট, “তোমরা ইংরেজ।”

 “আমার বোন আসলে বেশ ছোট আর বোকা।” কড়া চোখে ম্যাথিল্ডার দিকে তাকাল তারা, ওদিকে ম্যাথিল্ডা তো মুখে রুমাল চেপে হেসেই যাচ্ছে।

“ওরা ইংরেজ।” নিজের দলকে এমনভাবে কথাটা বলল সার্জেন্ট যেন এর মানে হল ওরা তো এমনিতেই পাগল হয়। কিন্তু যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দলে একজন আবার ডেভিডকে দেখে থেমে গেল। বলল, “তুমি তো ডেভিড আব্রাহামস, ইহুদি রানার।” মুখ কালো করে ফেলল ডেভিড। এবারে ছয়জনের প্রত্যেকেই থমথমে মুখে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল আর সার্জেন্ট বলল, “ইহুদি আর নিগ্রোরা যে মেডেল জিতে যাচ্ছে তাতে তো ইংরেজ আর আমেরিকানদের লজ্জা হওয়া উচিত। না?” কেউ কোনো উত্তর দেয়ার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে নম্রভাবে হাসল শাসা; বলল, “আমার মনে হয় আপনাদের কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। ও আসলে ইহুদি নয়; ও তো জুল।”

“এটা কীভাবে সম্ভব?”

অবাক হয়ে গেল সার্জেন্ট, “জুলুরা তো কালো হয়।”

আবারো ভুল করছেন। জুলুরা জন্মগতভাবেই সাদা। কেবল রোদে পুড়েই কালো হয়। আমার বন্ধু সবসময় ছায়াতেই থেকে অভ্যস্ত।”

“তুমি নিশ্চয় তামাশা করছে, তাই না?” খানিকটা ক্ষেপে উঠল জার্মান সার্জেন্ট।

 “অফ কোর্স অ্যায়াম চোকিং!” লোকটা যেভাবে জোকিং বলেছে সে উচ্চারণেই বলে উঠল শাসা।

“শাসা, বাদ দাও।” বলে উঠল ডেভিড, “ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু ততক্ষণে শ্যাম্পেনের নেশায় ঘোরের মধ্যে চলে গেছে শাসা। আচমকা কেউ কিছু বোঝার আগেই সার্জেন্টের বুকে টোকা দিয়ে বলল, “আসলে, মাই ডিয়ার ফেলো, আপনি যদি ইহুদির খোঁজ করে থাকেন, তাহলে আমিই এখানকার একমাত্র ইহুদি।”

“তোমরা দুজনেই ইহুদি?” চোখ সরু করে জানতে চাইল সার্জেন্ট।

“বোকার মত কথা বলবেন না তো। আমি তো এরই মাঝে বলেছি যে ও জুলু আর আমি ইহুদি।”

“তুমি মিথ্যে বলছো।” পাল্টা জবাব দিল সার্জেন্ট।

ততক্ষণে কফি শপের বাকি খদ্দেররাও পূর্ণ মনোযোগে শুনছে দুই দলের বাগবিতন্ত। যারা ইংরেজি বোঝে না ওদেরকে অনুবাদ করে দিচ্ছে তাদের বন্ধুরা।

শ্যাম্পেনের প্রভাব আর অন্যরা তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল শাসা, “দেখা যাচ্ছে আপনাকে প্রমাণও দিতে হবে। তাহলে তো ইহুদিদের অতি প্রাচীন এক সিক্রেট আপনাকে বলতেই হবে। আমিই শোনাচ্ছি।”

মজার কিছু শোনার আশায় উৎসুক হয়ে পড়ল কফি হাউজের দর্শক। কিন্তু অস্বস্তিতে খানিকটা নড়ে উঠল স্টর্ম ট্রুপারদের দল।

“চুপ করো শাসা।” আবারো বন্ধুকে সাবধান করে দিল ডেভিড।

 “ও কী বলতে চাইছে?” ম্যাথিল্ডাও মজা পাচ্ছে।

“শাসা কোর্টনি বেহুদা ঝামেলা করো না।” বলে উঠল তারা।

 কিন্তু ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে শাসা কবিতার মত ছন্দে বলে উঠল, “রাব্বি রাই তো তোমাদেরকে হেইল, কী যে লোকটার নাম ওটা বলতে শিখিয়েছে।”

আর যায় কোথায়! হুঙ্কার তুলে ডান হাত দিয়ে সোজা শাসার নাক বরাবর ঘুসি চালাল সার্জেট। শাসা চট করে নিচু হয়ে গেলেও মদের নেশায় টাল হারিয়ে হুড়মুড় করে টেবিলক্লথ হাতে পেঁচিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। ঝনঝন ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল গ্লাস। শ্যাম্পেনের বোতল গড়িয়ে আশপাশে ভেসে গেল ওয়াইন। সব স্টর্ম ট্ৰপার একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাসার মাথা আর শরীরে মারতে লাগল ঘুসির পর ঘুসি।

কিন্তু ডেভিড যেই না ওকে সাহায্য করতে যাবে, পেছন থেকে ওকে টেনে ধরল আরেকজন ট্রুপার। ডান হাতটাকে কোনো মতে ছাড়িয়েই লোকটার নাক বরাবর আঘাত করল ডেভিড। ফলে ট্র্যপারটা ওকে ছেড়ে নিজের নাক চেপে ধরলেও অন্য দু’জন এসে ডেভিডের হাত মুচতে দিল পেছন দিকে।

 “ওকে ছাড়ো” চিৎকার করে একজনের কাঁধ বরাবর লাফ দিয়ে লোকটার চুল টেনে ধরল ম্যাথিল্ডা, “ডেভিডকে ছাড়! শুয়োর কোথাকার!”

মেয়েদের চিৎকার আর ফার্নিচার ভাঙার আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল শপের মালিক।

“শাসা কোর্টনি” প্রচণ্ড ক্ষেপে গেছে তারা, “তুমি বদমাশ ডাকাতদের মত করছে। এক্ষুণি বন্ধ করো এসব।”

কিন্তু একদল বাদামি ইউনিফর্মের নিচে আসলে চাপা পড়েছে শাসা। সমানে দু’হাতে কিল ঘুসি চালাচ্ছে। তাই তারার কথার উত্তরও দিতে পারল না। অন্যদিকে স্ট্রিট ফাইটিংয়ে তো ট্রুপাররা এমনিতেই দক্ষ।

এদিকে ম্যাথিল্ডাকে তুলে রুমের এক কোনায় ছুঁড়ে মারল একজন আর তিনজন মিলে শাসাকে তুলে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে চলল কিচেনের দিকে।

তাড়াতাড়ি একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে পথ ছেড়ে দিল কফি শপের মালিক। তারপর শাসা ও ডেভিডকে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গলিতে নিয়ে গেল লোকগুলো।

কাউকে কোনো কিছু বলতে হল না। এ ধরনের খেলা তারা আগেও বহুবার খেলেছে। তাই প্রফেশনালদের মতই দুই বন্দিকে দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে একের পর এক লোক টুপার গিয়ে পালাক্রমে মারল মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীরে।

ওদের পিছু নিয়ে ম্যাথিল্ডাও বেরিয়ে গিয়ে চেষ্টা করল কিছু করতে। কিন্তু আলতো এক ধাক্কা খেয়েই উড়ে এসে পড়ল ডাস্টবিনের ওপরে।

এদিকে মালিকের সাথে এসে রাগারাগি করছে তারা, “পুলিশকে ডাকুন। এক্ষুণি। ওরা তো দু’জন নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলছে!”

কিন্তু অসহায় ভঙ্গিতে কেবল মাথা ঝাঁকালো মালিক, “কোনো লাভ নেই ফ্রাউলেন, পুলিশ আসবে না।”

মার সহ্য করতে না পেরে দু’ভাজ হয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল শাসা। সে অবস্থাতেই তিনজন ট্রুপার মিলে সমানে ওর বুক আর পেটে মারল জ্যাক বুটের লাথি।

অন্যদিকে ডেভিডকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে হাপাতে লাগল আরেক ট্রুপার। এবার পিছিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখল যে কতটা মেরেছে। অবশেষে ফাইনাল এক আপার কাট বসালো ছেলেটার দুলতে থাকা মাথায়। আঘাতের চোটে পিছনের দেয়ালে ঠকে গেল ডেভিডের মাথা। দু’জন এরপর দু’পাশ থেকে ছেড়ে দিতেই সশব্দে রাস্তার উপর পড়ে গেল ডেভিড। .

 সেভাবেই পড়ে রইল বেচারা। জ্যাক বুটের লাথি এড়ানোর জন্য নড়াচড়ার শক্তিটুকুও শরীরে নেই। ফলে আগ্রহ হারিয়ে নিজেদের টুপি আর ব্যানার গুছিয়ে হেলেদুলে গলি পেরিয়ে দু’জন পুলিশ কনস্টেবলের পাশ দিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে চলে গেল স্ট্রম ট্রুপারদের দল।

ম্যাথিল্ডা তাড়াতাড়ি ডেভিডের পাশে বসে কোলে তুলে নিল ওর থেতলানো মাথা।

“আমার সাথে কথা বলো ডেভিড” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। তারাও তাড়াতাড়ি ভেজা একটা কাপড় নিয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে শাসার পাশে বসে পড়ল। একই সাথে এটাও খেয়াল রাখল যেন শাসা ওর উদ্বেগ দেখে না ফেলে।

 বেশ কয়েক মিনিট পরে আবার আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল। উঠে বসে দুটো হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখেই ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠল শাসা। এক কনুইয়ের ওপর ভর করে খানিক উঁচু হয়ে একটা দাঁতসহ রক্ত মাখা থুথু ফেলল ডেভিড।

“ঠিক আছো তো, ডেভি মাই বয়?” ফাঁকা ঠোঁট নিয়ে জানতে চাইল শাসা।

“শাসা, আর কখনো আমাকে বাঁচাতে এসো না” ভাঙা গলায় উত্তর দিল ডেভিড, আরেকটু হলে তো জানটাই চলে যেতো।”

ম্যাথিল্ডা দু’জনকে ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। কিন্তু শাসাকে অক্ষত দেখেই আবার চোটপাট শুরু করল তারা।

 “তোমার মত এতটা আহম্মকি আমি আর কাউকে কখনো করতে দেখিনি শাসা কোর্টনি। তাই যা যা হয়েছে সেসব বলা যায় তুমি হাতে ধরে ডেকে এনেছো।”

“একটু বেশিই বলে ফেললে, ওল্ড গার্ল।” একে অন্যের গায়ের উপর ভর দিয়ে কোনোমতে গলি ছেড়ে বেরিয়ে এল শাসা আর ডেভিড। কোনার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক কনস্টেবল ওদেরকে দেখেই খেঁকিয়ে উঠল।

“লোকটা কী বলল?” তারার কাছে জানতে চাইল শাসা।

 “যা বলেছে বেশ বলেছে” শীতল গলায় অনুবাদ করে শোনাল তারা, “পরেরবার জনসমক্ষে মারামারি করার জন্য তোমাকে গ্রেফতার করা হবে।”

ছেলেদের সাথে সাথে হাঁটল ম্যাথিল্ডা। কিন্তু রাগত চেহারা নিয়ে কয়েক কদম আগে রইল তারা। অন্যদিকে পথচারীরাও চোখ পড়লেই চট করে আতঙ্কমাখা দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে ভিন্ন দিকে।

 চারজনে মিলে ব্রিস্টলের এলিভেটরে চড়তেই চিন্তিত মুখে ম্যাথিল্ডা জানতে চাইল, “আচ্ছা শাসা, তোমার সেই যে অলিভ পর্বতে কী যেন গাছের নাম, গল্পটা আমি বুঝিনি। আবার শোনাবে?”

নিজেদের ব্যথার চোটে প্রায় ডাবল হয়ে যাওয়া শাসা আর ডেভিড একসাথে চোখ গরম করে ম্যাথিল্ডার দিকে তাকিয়ে বলল, “প্লিজ ম্যাটি, আর কিছু বলল না। হাসতে গেলেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে।”

কঠিন দৃষ্টি নিয়ে বোনের দিকে তাকাল তারা; “দাঁড়াও শুধু দেখো আমি ড্যাডিকে বলছি যে এই পুরো ব্যাপারটাতে তুমি কতটা জড়িত ছিলে, ইয়াং লেডি।” মেয়েটা ঠিকই বলেছে। শোনার সাথে সাথে ক্ষেপে গেছেন ব্লেইন; কিন্তু সেনটেইনের মত নয়।

দেখা গেল শাসা শুধু পাজরের চারটা হাড় আর কলার বোনই ভাঙেনি বরঞ্চ দলে ওর অনুপস্থিতির কারণেই দুদিন পরের ম্যাচে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে গেছে ওর পোলো টিম। আর ডেভিডের ভাগ্য ভালো যে কেবল দুটা দাঁত হারানো ছাড়া তেমন বড় আর কোনো ক্ষতি হয়নি।

“তেমন কোনো সমস্যা নেই।” সব দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নিলেন সেনটেইন, “অন্তত কোনো পাবলিসিটি হয়নি। কিন্তু ভুল ভেবেছেন তিনি।

সেই রাতে কফি হাউজের দর্শকদের মধ্যে রয়টারের দক্ষিণ আফ্রিকান সংবাদদাতাও ছিল। ফলে দেশের সবাই জেনে গেল যে শাসা কোর্টনি কতটা বীরত্বের সঙ্গে তার ইহুদি বন্ধু, ব্রোঞ্জ মেডালিস্ট স্প্রিন্টারের সম্মান রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছিল। কেপটাউনে পৌঁছার পর দেখা গেল সবার কাছে রীতিমত ছোটখাটো এক হিরো বনে গেছে শাসা।

 “আচ্ছা এর ফলে ভবিষ্যতে কতজন ইহুদি ভোটারকে ব্যাগে পুরতে পারবে শাসা বলল তো?” চোখ কুঁচকে হিসাব মেলাতে বসলেন সেনটেইন। দেখে মিটিমিটি হাসিতে ফেটে পড়লেন ব্লেইন, “মাই গড, তুমি পারোও!”

***

লাইট হেভিওয়েট ডিভিশনের একেবারে ফাইনাল পালা পর্যন্ত কানায় কানায় পূর্ণ রইল বিশাল বড় বক্সিং হল। ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে রিং পর্যন্ত সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বাদামি ইউনিফর্ম পরিহিত স্ট্রর্ম ট্রুপারদের দল।

“মনে হয়েছে যে, ওরা হয়ত কাজে লাগতে পারে।” রিংয়ের পাশের সিটে বসতে গিয়ে চারজন বিচারকের ওপর চোখ পড়তেই ক্রেমারকে বললেন কর্নেল বোল্ড, চারজনের সবাই জার্মান আর পার্টির সদস্য। যদিও, সবাইকে একত্রিত করার জন্য কর্নেলকে খানিকটা কলকাঠিও নাড়তে হয়েছে।

প্রথম প্রতিযোগী হিসেবেই রিংয়ে এল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। ওকে ইতিমধ্যেই নিজেদের হিরোর জায়গা দিয়ে দিয়েছে জার্মান স্পোর্টিং পাবলিক।

 মানুষ হুল্লোড় তুলতেই গ্লাভস পরা হাত তুলে ওদের জবাব দিল ম্যানি। সাথে সাথে হেইডির উপরেও চোখ পড়ল। কিন্তু মেয়েটা তো একটুও হাসছে না। সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তাতেই যেন প্রয়োজনীয় প্রাণশক্তিটুকু পেয়ে গেল ম্যানি। হঠাৎ করেই চোখে পড়ল সেই নারীর মুখ। সাথে সাথে ক্ষেপে উঠল ম্যানফ্রেড। হেইডির কাছ থেকে মাত্র তিনটা সিট পরেই বসেছে।

“কেন সবসময় আমার পিছু তাড়া করে?” অবাক হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। অন্যান্য ম্যাচেও আরেকবার সেই নারী আর বড় নাকতলা লম্বা বদরাগী চেহারারার লোকটাকে দেখেছে।

কালো চোখ দুটোতে অদ্ভুত এক রহস্যময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সেনটেইন। ইচ্ছে করেই তার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড আর সাথে সাথে রিংয়ে এল সাইরাস লোম্যাক্স।

আমেরিকানটার চকলেট দুধরঙা পেশিবহুল শরীরটার উপরে বসানো মাথাটা পুরোপুরি আফ্রিকান। “এরকম শয়তান আর কারো সাথে কখনো খেলোনি তুমি। তাই মনে রাখবে ওকে হারাতে পারার মানে সবাইকে হারাতে পারা।” ম্যানিকে আগেই সাবধান করে দিয়েছেন আংকেল ট্রম্প।

রেফারি এসে দুজনকেই রিংয়ের মাঝখানে ডাকলেন। ম্যানফ্রেডের নাম ঘোষণা হতেই উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল সমস্ত দর্শক। নিজেকে আচমকা বেশ শক্তিশালী আর দুর্ভেদ্য অনুভব করল ম্যানি। আংকেল এসে ওর মুখে আলগা মাটি পরিয়ে দিলেন। তারপর ম্যানফ্রেডের কাঁধে চাপড় মেরে কানের কাছে হিসহিস করে বললেন, “মাম্বার মতই দ্রুত! র‍্যাটেলের মতই শক্তিশালী!”

মাথা নেড়ে উজ্জ্বল সাদা আলোর নিচে এগিয়ে এল ম্যানফ্রেড। অন্যদিকে কালো একটা চিতা বাঘের মতই পা ফেলছে সাইরাস।

পুরো ম্যাচেই দু’জনে সমান-সমান লড়াই করল। কেমন করে যেন দু’জনে আগে থেকেই বুঝে নিল অপরজনের কৌশল। তাই মাথা ঝুঁকিয়ে, হাত ঠেকিয়ে দড়ি ব্যবহার করে প্রতিবারই বেঁচে গেল পরস্পরের হাত থেকে।

 পাঁচ-ছয়-সাত, এর আগে আর দীর্ঘক্ষণ কখনোই খেলেনি ম্যানফ্রেড। প্রতিবারই দ্রুত এসে গেছে বিজয়। সাদা ক্যানভাসে লুটিয়ে পড়েছে ওর প্রতিপক্ষ। কিন্তু আংকেল ট্ৰম্পের কষ্টকর ট্রেনিংয়ের শিক্ষাই তাকে রিংয়ে অটুট রাখল। জানে শুধু অপেক্ষা করতে হবে। তাহলেই বিজয় তার হবে। অন্যদিকে আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সাইরাস। ঘুসিতে আর আগের মত ধার নেই। তার মানে একটু বাদেই ছেলেটা কোনো ভুল করে বসবে।

সপ্তম রাউন্ডের মাঝ বরাবর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

সরাসরি একটা লেফট বসালো সাইরাস। কিন্তু আঘাতের আগেই কীভাবে যেন এমনটা হবে আন্দাজ করেছিল ম্যানি। তাই পাল্টা আঘাত করল সাইরাসের চিবুকে।”

যতটা দ্রুত সম্ভব তার চেয়ে খানিক দেরিতে শ্বাস নিল সাইরাস। অন্যদিকে প্রস্তুত হয়ে ছিল ম্যানি। অভিজ্ঞতা আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বশে বুঝতে পারল যে কোথায় মারতে হবে। উঠে দাঁড়াতে একটু দেরি করতেই ওর হাত আর মাথার মাঝখানে জায়গা পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড।

তবে মজার ব্যাপার হল, ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই ঘুসি চালিয়ে দিল। সচরাচর যেভাবে মারে সেভাবে দুই হাতে নয়; ভয়ংকর এক সিঙ্গল স্ট্রোক। এটাই সূচনা করল সব সমাপ্তির।

ম্যানফ্রেড আমেরিকানটার মাথার পাশে সর্বশক্তি দিয়ে এত জোরে আঘাত করল দাঁতে দাঁত ঠেকে গেল। নিজের সমস্ত ট্রেনিংয়ের জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, শক্তি আর হৃদয় দিয়ে পরিষ্কার এক আঘাতে ধরাশায়ী করল প্রতিপক্ষকে।

ফলাফল যেন আগেই টের পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড। শুকনো ডালের মত ভেঙে গেছে ডান হাতের হাড়। ব্যথার চোটে মাথায় যেন আগুন লেগে গেছে। কিন্তু জানে বিজয় তারই হয়েছে; তাই ব্যথার চেয়েও আনন্দটাই বেশি হচ্ছে।

পায়ের কাছে ক্যানভাসের উপর দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে আমেরিকানটা; কিন্তু তারপরেও কেন যেন একটু একটু হতাশ লাগছে। কারণ প্রচণ্ড আহত হলেও টলতে টলতে আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সাইরাস। ছেলেটার চোখ দুটো সাদা নির্জীব হয়ে গেছে; মাথা থেকে গড়াচ্ছে রক্ত। তারপরেও উঠে দাঁড়াল সাইরাস।

“মেরে ফেল!” চিৎকার করে উঠল সমস্ত দর্শক, “ওকে মেরে ফেল!”

ম্যানফ্রেড বুঝতে পারল যে আরেকবার ডান হাত তুললেই সাঙ্গ হবে সাইরাসের দাঁড়িয়ে থাকার সাধ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওর নিজের ডান হাতটাও গেছে।

 মাতালের মত টলতে টলতে দড়ির উপর গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল সাইরাস। বহুকষ্টে চেষ্টা করল উঠে দাঁড়ানোর জন্য।

“বাম হাত” মনে মনেই ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড, “বাম হাত দিয়েই ওকে ঘায়েল করতে হবে। আর তারপরেই নিজে আহত হওয়া সত্ত্বেও ব্যথা ভুলে লোম্যাক্সের পিছু নিল ম্যানি।

কিন্তু ছেলেটার মাথা বরাবর বাম হাত চালালেও কোনো এক দিব্য শক্তিবলে যেন দুই হাত ছুঁড়ে ম্যানির কাঁধ ধরে খামচে ধরল সাইরাস। তারপর এত জোরে চেপে ধরল যে আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিল দর্শক। ম্যানফ্রেড চাইল ঝাড়া দিয়ে ওকে ছুঁড়ে ফেলার জন্য। কিন্তু বজ্ৰআটুনী কিছুতেই আলগা করছে না সাইরাস। “ব্রেক! ব্রেক!” রেফারি এসে চিৎকার করলেও একটুও ছাড় দিলো না।

অবশেষে যখন রেফারি দু’জনকে আলাদা করল ততক্ষণে সাইরাস আবার ফিরে পেয়েছে নিজের দৃষ্টিশক্তি। মরিয়া হয়ে ম্যানফ্রেড আবার বাম হাত চালালেও চট করে সরে গেল সাইরাস আর তখনই বেল বাজল।

“কী হয়েছে ম্যানি?” ম্যানিকে ধরে ওর কর্নারে নিয়ে গেলেন আংকেল ট্রম্প। “তুমি তো ওকে কাবু করেই ফেলেছিলে, তাহলে আবার হঠাৎ কী হল?”

“আমার ডান হাত।” ব্যথায় কাতরানো শুরু করল ম্যানফ্রেড। আর আংকেল ট্রম্প কব্জির উপর হাত রাখতেই শুরু করল চিৎকার। ফুলে গেছে হাত।

“আমি তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু এই হাত নিয়ে তো তুমি। লড়তে পারবে না!”

চাবুকের মত সপাং করে ক্ষেপে উঠল ম্যানফ্রেড, “না!” ভয়ংকর হলুদ চোখ জোড়া মেলে রিংয়ের দিকে তাকালেই চোখে পড়ল রিংয়ের উপর নিজের দলের লোকজন সাইরাসের সেবা করে ওকে চাঙ্গা করে তুলতে চাইছে।

আবার বেল বাজতেই শুরু হল অষ্টম রাউন্ড। উঠে এল ম্যানফ্রেড; কিন্তু হতাশ হয়ে দেখল যে নতুন উদ্যমে নড়াচড়া শুরু করেছে সাইরাস। যদিও এখনো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে আগু-পিছু হয়ে ম্যানফ্রেডের আঘাতের অপেক্ষা করছে। যদিও ম্যানির ডান হাতের অবস্থা দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে বুঝে গেল.যে কী করতে হবে।

 “তুমি শেষ, বুঝলে এগিয়ে এসে ম্যানির কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল সাইরাস, “ডান হাত শেষ, হোয়াইট বয় এখন আমিই তোমাকে খেয়ে ফেলব!” পাঞ্চ খেয়ে পিছিয়ে পড়ল ম্যানি! বন্ধ হয়ে গেল বাম চোখ আর মুখের মধ্যেও অনুভব করল নোতা রক্তের স্বাদ।

 এরপরই বাম হাতে প্রচণ্ড ঘুসি চালাল সাইরাস। অভ্যাসবশে ডান হাত দিয়ে ঠেকাতে গেল ম্যানি। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যথার চোটে যেন অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। টলে উঠল পায়ের নিচের মাটি। একের পর এক আহত চোখটাতে পাঞ্চ চালালো সাইরাস। ফলে বেগুনি হয়ে ফুলে উঠল ম্যানির মুখ। চোখটা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। অবশেষে বেজে উঠল বেল। শেষ হল অষ্টম রাউন্ড।

 “আরো দুইটা রাউন্ড” ফোলা চোখের উপর আইসপ্যাক ধরলের আংকেল, “দেখতে পাচ্ছ ম্যানি?” মাথা নেড়ে নবম রাউন্ড খেলার জন্য উঠে এল ম্যানফ্রেড। এবারে দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এল সাইরাস।

কিন্তু সোসাহে ডান হাতে পাঞ্চ মারতেই ম্যানফ্রেড বাম হাতে চালালো পাল্টা আক্রমণ, ফলে কেঁপে উঠেই পিছিয়ে গেল সাইরাস।

অবশ্য খানিক বাদেই আবার এগিয়ে এল। এভাবে কাছে এসে, পিছিয়ে গিয়ে বিভিন্নভাবে একের পর এক ঘুসি দিয়ে ম্যানফ্রেডের ফোলা চোখকে নিশানা বানিয়ে ফেলল লোম্যাক্স। একেবারে শেষ পাঞ্চে সফলও হল। টসটসে পাকা ফলের মত কেটে গেল ম্যানফ্রেডের ফোলা বেগুনিরঙা চোখ। ম্যানফ্রেডের মুখ বেয়ে বুকের ওপর গড়িয়ে পড়ল রক্ত।

কিন্তু রেফারি এসে আহত স্থান পরীক্ষা করার আগেই বেজে উঠল বেল। টলতে টলতে নিজের কর্নারে চলে এল ম্যানফ্রেড। আংকেলও দৌড়ে এলেন।

 “আমি থামানোর ব্যবস্থা করছি” চোখের ভয়ংকর ক্ষতটা পরীক্ষা করে ক্ষেপে উঠলেন, “তুমি তো এভাবে লড়াই করতে পারবে না, তাতে চোখটাই হারাতে হবে।”

“যদি আপনি এখন খেলা বন্ধ করে দেন” ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিল ম্যানি, “তাহলে আমি কোনোদিনও আপনাকে আর ক্ষমা করব না। হলুদ চোখ জোড়া ধকধক করে জ্বলে উঠতেই আংকেল বুঝতে পারলেন যে এর প্রতিটা শব্দ মন থেকে বলছে ম্যানফ্রেড। তাই ক্ষত পরিষ্কার করে দিলেন আংকেল। রেফারি এসে আলোর দিকে তুলে ধরে পরীক্ষা করল ম্যানফ্রেডের চোখ।

সব দেখে আস্তে করে জানতে চাইল, “তুমি কী খেলতে পারবে?”

“ভক আর ফুয়েরারের জন্য, হ্যাঁ” নরম স্বরে জানালো ম্যানি। মাথা নেড়ে চলে গেল রেফারি। যাবার আগে বলে গেল, “তুমি আসলে অনেক সাহসী একটা মানুষ।” হাত নেড়ে খেলা শুরু করার জন্য সিগনাল দিল রেফারি।

শেষ রাউন্ডটাতে তো বলা যায় রিংয়ের উপর নরক ভেঙে পড়ল। ম্যানফ্রেডের সারা শরীরে যেন হাতুড়ির বাড়ি মারল সাইরাস। একের পর এক ক্ষতের দাগে ছেয়ে গেল বুক পেট মুখ। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। ম্যানি। আঘাত ঠেকাবার শক্তিটুকুও যেন পাচ্ছে না।

প্রতিবার নিঃশ্বাস নেয়ার সময় ব্যথার চোটে জ্বলে যাচ্ছে বুক। ডান হাতের ব্যথা কাঁধ হয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়াতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে দৃষ্টিশক্তি। একমাত্র ভালো চোখও যেন নিভে আসতে চাইছে। ফলে সাইরাসের পাঞ্চগুলো যে কোথা দিয়ে আসছে, দেখতেই পাচ্ছে না ম্যানি। তারপরেও দাঁড়িয়ে রইল।

উন্মাদ হয়ে উঠল সমস্ত দর্শক। কিন্তু তাদের রক্তপিপাসা খানিক বাদেই উঠে গিয়ে কেমন যেন আতঙ্ক অনুভব করল সবাই। সমস্বরে চিৎকর করে রেফারিকে বলল যেন বন্ধ করা হয় এ নিষ্ঠুরতা। কিন্তু তারপরেও দাঁড়িয়ে রইল ম্যানফ্রেড। মাঝে মাঝে কেবল বাম হাতে দুর্বল চেষ্টা করছে সাইরাসকে থামানোর জন্য।

 অবশেষে, দেরিতে হলেও বেজে উঠল বেল। তখনো নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। রিংয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেবল এক পাশ থেকে আরেক পাশে নড়ছে। নিজের কর্নার যে কোন পাশে সেটাও বুঝতে পারছে না, চোখে দেখছে না। দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন আংকেল ট্রম্প। চোখের পানি মুছতে মুছতে ম্যানিকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন ওর কর্নারে।

“আমার ছোট্ট ম্যানি, আমার আসলে উচিত হয়নি তোমার কথা শোনা!”

অন্যদিকে রিংয়ের উপরে জড়িয়ে ধরল। জিতে গেছে ধরে নিয়ে লোম্যাক্স নিজেও নাচ শুরু করল। এখন কেবল বিচারকদের ঘোষণার অপেক্ষা। মনে মনে ভাবছে বিচারকেরা ওকে জয়ী ঘোষণা করলেই সাথে সাথে গিয়ে এতটা সাহসের জন্য ম্যানফ্রেডকে সাধুবাদ জানিয়ে আসবে।

এক হাতে বিচারকদের কার্ড আর আরেক হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে রিংয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়াল রেফারি। লাউড স্পিকারে গমগম করে উঠল তার কণ্ঠ, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান। আজকের অলিম্পিক গোল্ড মেডেল বিজয়ী হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যানফ্রে ডি লা রে।”

 নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো হল। ম্যানফ্রেড নিজেও যেন বিস্ময়ে তিনটা হার্টবিট মিস করল। আর তারপরেই চারপাশে শুরু হয়ে গেল চিৎকার। চেঁচামেচি আর দুয়ো ধ্বনি।

 পাগলের মত রিংজুড়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল সাইরাস লোম্যাক্স। দড়ি ধরে টানাটানি করে বিচারকদের উদ্দেশে কীসব বলতেই শত শত দর্শক এগিয়ে এসে চেষ্টা করল রিংয়ে উঠে পড়ার জন্য; যেন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিবাদ জানাতে পারে। অবস্থা বেগতিক দেখে হলের পেছন দিকে কারো উদ্দেশে মাথা নাড়লেন কর্নেল বোল্ড। আর সাথে সাথে এগিয়ে এসে রিং আর দর্শক সারির মাঝখানে ছড়িয়ে পড়ল বাদামি শার্ট পরিহিত স্ট্রর্ম ট্রুপারদের দল। উন্মত্ত জনতাকে সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে দিতেই তাড়াতাড়ি ড্রেসিংরুমে চলে গেল ম্যানফ্রেড।

অন্যদিকে লাউড স্পিকারে চিৎকার করে এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা : বোঝানো শুরু করল রেফারি; কিন্তু কে শোনে তার কথা। মানুষের গর্জনে ঢাকা। পড়ে গেল বাকি সব শব্দ।

***

“মেয়েটা তোমার চেয়ে না হলেও পাঁচ-ছয় বছরের বড় হবে।” সাবধানে শব্দ ঠিক করে বলে উঠলেন আংকেল ট্রম্প। ম্যানি আর আংকেল মিলে টেজেল গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করছেন। এমন সময়ে ম্যানি উত্তর দিল, “ও আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। কিন্তু সেটা কোনো সমস্যা নয় আংকেল ট্রম্প। আমি ওকে ভালোবাসি আর সেও। এটাই হল বড় কথা।” ম্যানির ডান হাতে এখনো প্লাস্টার।

 “কিন্তু তোমার বয়স এখনো একুশও হয়নি, তাই অভিভাবকদের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবে না।”

 “আপনিই তো আমার অভিভাবক।” মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি আংকেলের দিকে তাকাল ম্যানি। টোপাজের মত হলুদ চোখ জোড়া দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন আংকেল।

“তোমার স্ত্রীকে তুমি কীভাবে সাপোর্ট দিবে?”।

“রাইখ’স ডিপার্টমেন্ট অব কালচার এখানেই বার্লিনে ল’ ডিগ্রি শেষ করার জন্য আমাকে একটা স্কলারশিপ দিয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ে হেইডি’র চাকরি ছাড়াও অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আর লইয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার আগে পেশাদার বক্সিং খেলেও আয় করতে পারব আমি। আর তার পরেই আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাতে ফিরে যাব।”

“তুমি ইতিমধ্যেই সব প্ল্যান করে ফেলেছো!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আংকেল ট্রম্প। মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড! দ্রু’র উপরকার ক্ষত চিহ্নে আঙুল বুলিয়ে বলল, “আপনি নিশ্চয় আমাকে মানা করবেন না আংকেল? দেশে ফেরার আগেই আমরা চাই আপনি আমাদের বিয়ে দিয়ে যান।”

“শুনে খুশি হলাম।” মুখে বললেও কিন্তু মনে মনে মন খারাপ করে ফেললেন আংকেল ট্রম্প। এই ছেলেটাকে তিনি ভালোভাবেই চেনেন, জানেন ও কতোটা জেদি। একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তাকে টলানো কিছুতেই সম্ভব নয়।

“আপনি আমার বাবার মতন।” সহজ সুরে জানালো ম্যানি, “বলা যায় বাবার চেয়েও বেশি। তাই আপনার আর্শীবাদ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

 “ম্যানি! ম্যানি! আমার তো কোনো নিজের ছেলে নেই, তুমিই আমার সেই ছেলে। তাই তোমার কিসে ভালো হবে সবসময় আমি তাই চেয়েছি। শুধু এটুকু বলব যে আরেকটু অপেক্ষা করলে হয় না? এত আড়াহুড়া করে ব্যাপারটাতে জড়িয়ে না পড়লেই বোধ হয় ভালো হবে।”

 “কিন্তু আমার তো কোনো পিছুটান নেই।”

“তোমার ট্রুডি আন্টির কথা ভাবো–“

“আমি জানি উনি আমার ভালোই চেয়েছেন সবসময়।” আংকেলকে থামিয়ে দিল ম্যানফ্রেড।

“হ্যাঁ। সেটা তো সত্যি। কিন্তু সারাহর কথাও যদি একটু ভাবো”

“ওর আবার কী হয়েছে?” ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠল ম্যানি। যদিও ভেতরের অপরাধবোধের হল্কা ঢাকতে গিয়ে শক্ত করে ফেলল চেহারা।

“সারাহ, তোমাকে ভালোবাসে। ও তোমাকে সর্বদাই ভালোবেসে এসেছে ম্যানি। এমনকি ব্যাপারটা আমার চোখেও পড়েছে।”

 “সারাহ, আমার বোন। আমিও ওকে ভালোবাসি। ভাইয়ের মতই ভালোবাসি। কিন্তু হেইডিকে নারী-পুরুষের মাঝে যে ভালোবাসা হয় তেমনভাবে ভালোবাসি।”

 “আমার মনে হয় তুমি ভুল করছে ম্যানি। আমি তো সব সময় ভেবেছি যে তুমি আর সারাহ্–”

 যথেষ্ট হয়েছে আংকেল ট্রম্প। আমার আর আপনার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমি হেইডিকে বিয়ে করব, আশা করছি আপনি এর জন্য অনুমতি আর আর্শীবাদ দিবেন। প্লিজ আংকেল ট্রম্প?”

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন আংকেল, “আমি তোমাকে দুটোই দিব, মাই সান, আর আনন্দ নিয়েই তোমাকে বিয়েও দিব।”

***

গ্রুনেওয়াল্ডে হেভেল লেকের তীরে কর্নেল সিগমন্ড বোন্ডের বাড়ির বাগানেই বিয়ে করল হেইডি আর ম্যানি। অলিম্পিক গেমস শেষে পুরো দল দেশে ফিরে গেলেও ম্যানির বিয়ের জন্য স্ট্যান্ডার আর আংকেল ট্রম্প থেকে গেলেন। স্ট্যান্ডার হল সাক্ষী আর আংকেল যাজক হিসেবে বিয়ে দিলেন।

 হেইডি অনাথ হওয়াতে কন্যাদানের দায়িত্ব নিলেন সিগমন্ড বোন্ড। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাগানের এক কোণেই আয়োজন করা হল এক বিশাল মধ্যাহ্নভোজ। বাজনার তালে তালে অস্থায়ী কাঠের মঞ্চে নেচে বেড়াল সকল অতিথি।

বাহুতে নবপরিণীতা সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে ম্যানফ্রেড এতই মশগুল ছিল যে বুঝতেই পারেনি আচমকা বদলে গেছে পার্টির পরিবেশ। বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে আসা একদল অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তপায়ে এগিয়ে গেলেন কর্নেল বোল্ড। বাদক দলও সঙ্গে সঙ্গে নাজিদের কুচকাওয়াজের গান বাজানো শুরু করে দিল।

বিয়েতে আগত অতিথিরা সবাই নাচ থামিয়ে মনোযোগী ছাত্রের মত দাঁড়াতেই ম্যানি নিজেও অবাক হয়ে হেইডির পাশে স্থির হয়ে দাঁড়াল। আর ঠিক তক্ষুণি কাঠের মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট দলটাকে দেখে ম্যানি বুঝতে পারল যে তার বিয়েকে কতটা সম্মান দেয়া হয়েছে।

গলা পর্যন্ত উঁচু সাদা জ্যাকেট পরে হাসিমুখে ম্যানফ্রেডের দিকে এগিয়ে এলেন অ্যাডলফ হিটলার। মাথা নেড়ে বললেন, “আমি শুনেছি তুমি নাকি জার্মানির বন্ধু, হের ম্যানফ্রেড ডি লা রে।”

“আমার শরীরে বইছে জার্মান রক্ত। আমি জার্মানির সত্যিকারের বন্ধু ছাড়াও আপনার এক নগণ্য ভক্ত। আপনার উপস্থিতি যে আমাকে কতটা কৃতার্থ করেছে তা বলে বোঝানোর ভাষা আমার নেই, বিশ্বাস করুন।”

“আমেরিকান নিগ্রোটার ওপর তোমার সাহসী বিজয়ের জন্য কনগ্রাচুলেশনস।” হাত বাড়িয়ে দিলেন হিটলার, “আর রাইখের কন্যা বিয়ে করার জন্যও কনগ্রাচুলেশনস।” ডান হাতে প্রাস্টার থাকায় অক্ষত বাম হাত দিয়ে হিটলারের সাথে করমর্দন করল ম্যানি। উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল ওর সারা শরীর।

“আই উইশ ইউ গ্রেট জয়” হিটলার বললেন, “আর তোমার এই বিয়ে যেন জার্মানি আর তোমাকে একসূত্রে গেঁথে রাখে।”

ঠাণ্ডা আর শুকনো হলেও ফুয়েরারের হাতটা বেশ শক্তিশালী। আবেগে মনে হল গলার কাছে কান্না জমে গেল। ধরাগলায় ম্যানি বলে উঠল, “মাই ফুয়েরার, আমাদের এই বন্ধন সবসময় অটুট থাকবে।”

মাথা নেড়ে হেইডির সাথে হাত মেলালেন অ্যাডলফ হিটলার। মেয়েটার চোখেও আনন্দের অশ্রু। আর তারপরেই যেভাবে আচমকা এসেছিলেন তেমনিই বিয়ের আসর ছেড়ে হঠাৎ করেই চলে গেলেন হিটলার। যাবার আগে অবশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুয়েকজন অতিথির সাথে টুকটাক কথাও বললেন। তারপর হাসি মুখে বিদায় নিলেন।

“আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি যে “ ম্যানফ্রেডের হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে উঠল হেইডি, “সত্যিই পূর্ণ হয়েছে আমার আনন্দ।”

 “এই তো মহানুভবতা” একদৃষ্টে হিটলারের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। “চিন্তা করতেও কষ্ট হয় যে তিনি ঈশ্বর নন, মরণশীল মানুষ মাত্র।”

***

স্টিলেনবশের ছোট্ট গ্রামটার মেইন স্ট্রিট ধরে সাইকেল চালিয়ে আসছে সারাহ বেস্টার। ফুটপাথে পথচলতি যার সাথেই দেখা হচ্ছে তার দিকেই তাকিয়ে হাত নাড়ছে, হাসছে মেয়েটা। বাইসাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে রেখে দিয়েছে বই-খাতা।

আজ সকালেই মাত্র গত টার্মের রেজাল্ট দিয়েছে। তাই চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরে ট্রুডি আন্টিকে বলতে যে সে পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। স্কুলে এটাই তার শেষ বছর। অক্টোবরে সতেরোতে পা দিয়ে আগামী বছরই মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসবে সারাহ।

ম্যানি শুনলেও ওকে নিয়ে কত গর্ব বোধ করবে। ছেলেটার উৎসাহেই তো আজ স্কুলের টপ গার্লদের একজন হতে পেরেছে সারাহ। ম্যানির কথা মনে পড়তেই যেন স্বপ্নের ঘোরে চলে গেল। এতদিন ধরে ছেলেটা ঘরের বাইরে; কিন্তু অসুবিধা নেই। আসার সময়ও হয়ে গেছে। রাতের বেলা আর একা একা বসে কাদার কোনো দরকার নেই। ম্যানি ফিরে আসবে, শক্তিশালী, নরম হৃদয় আর ওর ভালোবাসার মানুষ ম্যানি সবকিছু ঠিক করে দিবে।

মনে মনে ম্যানিকে বিয়ে করা, ওর জন্য নাশতা তৈরি, শার্ট ধুয়ে দেয়া, একসাথে পাশাপাশি চার্চে বসাসহ আরো কত যে কল্পনা করে রেখেছে সারাহ। প্রতি সকালে ঘুম ভেঙেই পাশের বালিশে ম্যানির অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি চুলভরা মাথা দেখবে ভাবতেই মনে হল পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার আছে।

বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই দেখতে পেল গেইটের কাছে পোস্টম্যান দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি সাইকেল থেকে নেমে এল সারাহ, “আমাদের জন্য কিছু আছে মি. গ্লোবলার?”

 সারাহর দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল একটা হাসি দিল পোস্টম্যান। তারপর চামড়ার ঝোলা থেকে একটা খাম বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একটা টেলিগ্রাম। বিদেশ থেকে এসেছে। কিন্তু এটা তো তোমার জন্য নয় বাছা, তোমার আন্টির জন্য।”

 “ঠিক আছে। আমি সাইন করে নিচ্ছি!” রিসিটের ওপর সাইন করে টেলিগ্রামটা নিয়েই সদর দরজার সিঁড়িতে উঠে গেল সারাহ।

ট্রুডি আন্টি!” চিৎকার জুড়ে দিল সারাহ, “একটা টেলিগ্রাম! আপনি কোথায়?”

রান্নার গন্ধ নাকে আসতেই বুঝতে পারল যে কোথায় যেতে হবে। চুলার উপরে ফুটছে পিচ আর ফিগ জ্যাম। আগুনের আঁচে লাল হয়ে আছে আন্টির চেহারা।

“ওহ, ঈশ্বর! তুমি আর কবে বড় হবে সারি; এখন তো আর ছোট্ট খুকি নও”

“একটা টেলিগ্রাম! দেখুন, সত্যিকারের একটা টেলিগ্রাম! এই প্রথম আমাদের বাড়ি এসেছে!”

 এমনকি কথাটা শুনে ট্রুডি আন্টিও মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসলেও আবার কী মনে করে যেন পিছিয়ে গেলেন; বললেন, “আমার হাতে ময়দা লেগে আছে। এটা তুমিই খুলে ফেলো সারি।”

খামের মুখ ছিঁড়ে ফেলল সারাহ্” আমি পড়ি?” অনুমতিও নিয়ে নিল।

 “ইয়েস ইয়েস, পড়ো, কার কাছ থেকে এসেছে?”

আংকেল ট্ৰম্পের কাছ থেকে, উনি সাইন করে লিখেছেন যে “তোমার কর্তব্যপরায়ণ স্বামী।”

“একেবারে গাধা বুড়ো কোথাকার! অহেতুক তিনটা শব্দের জন্য টাকা গচ্চা দিল।” ঘোঁতঘোত করে উঠলেন ট্রুডি আন্টি, “বাকিটা পড়ো।”

“লিখেছেন, ম্যানফ্রেড

আচমকা থেমে গেল সারাহ; মুখের হাসি-খুশি ভাবও উধাও হয়ে গেল। হাঁ করে হাতের কাগজটার দিকে চেয়ে রইল বেচারা।

“পড়ো, বাছা” তাগাদা দিলেন আন্টি, “কী লিখেছে পড়ো।”

প্রায় ফিসফিসের মত করে আবার পড়া শুরু করল সারাহ্, “তোমাকে জানাচ্ছি যে ম্যানফ্রেড আজ হেইডি ক্রেমার নামে এক জার্মান মেয়েকে বিয়ে করেছে। তাছাড়া বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরিকল্পনাও করেছে। তাই সে আর আমার সাথে ঘরে ফিরছে না। আশা করছি আমার মতই ওর জন্য শুভ কামনা জানাবে। তোমার কর্তব্যপরায়ণ স্বামী ট্রম্প বিয়ারম্যান।”

চোখ তুলে তাকাল সারাহ। দেখে আন্টিও ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।

“আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে- “ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ট্রুডি আন্টি, “না, আমাদের ম্যানফ্রেড কখনো এমন করতে পারে না, এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে যেতে পারে না। আর তারপরই সারাহর দিকে ভালোভাবে তাকালেন; হঠাৎ করেই যেন পুরো ফ্যাকাশে ছাইরঙা হয়ে গেছে মেয়েটার চেহারা।

“ওহ, মাই লিটন সারি সহানুভূতিতে আর্দ্র হয়ে গেল আন্টির মন; তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সারাহর হাত ধরতে চাইলেন; কিন্তু তার আগেই মেঝের উপর টেলিগ্রাম ফেলে একছুটে বাইরে চলে গেল মেয়েটা। তারপর গেইটের কাছে রাখা বাইসাইকেলটাকে তুলে নিয়েই যত জোরে সম্ভব পেডাল করে সরে এল বাড়ি থেকে দূরে। বাতাসে উড়ে গেল মাথার টুপি। ইলাস্টিক থাকায় অদ্ভুত ভঙ্গিতে গলার সাথে ঝুলতে লাগল। তবে অবাক ব্যাপার হল, চোখ দুটো একদম শুকনো খটখটে হয়ে আছে। এতটা বিস্মিত হয়েছে যে চেহারা থেকে ফ্যাকাসে ভাবটা এখনো যায়নি। ব্যথা হয়ে গেল পা, তারপরেও সোজা ছুটে চলল পাহাড়ের দিকে।

রাস্তাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ায় সাইকেল থেকে নেমে হাঁটা শুরু করল সারাহ। পাইন বনের ভেতর দিয়ে চলে এল একেবারে চূড়ায় পৌঁছে গেল সে জায়গায় একদিন যেখানে ম্যানফ্রেডকে উজাড় করে দিয়েছিল ওর শরীর, মন আর আত্মা।

এতটা উঠে আসার পরিশ্রমের পর ধাতস্থ হতেই হাতের ওপর মুখ রেখে ফুঁপিয়ে উঠল সারাহ। আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হতেই নামল বৃষ্টি। তারপরেও চুপচাপ পাইনের মেঝেতে শুয়েই রইল। বুকের ভেতরে আপন মনে কেবল চিৎকার করে বলছে যে, “ম্যানফ্রেড তুমি কোথায় গেলে? কেন আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম?”

সকাল হবার খানিক আগে গ্রাম থেকে উঠে আসা সার্চ পার্টি সারারাত খোঁজার পরে পাহাড়ের চূড়ায় এসে উদ্ধার করল সারাহকে।

 “নিউমোনিয়া হয়েছে, ম্যাডাম বিয়ারম্যান।” পরদিন রাতে পর পর দু’বার ডাক্তার ডাকতে হল। অতঃপর পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত জানালেন ডাক্তার, “কিন্তু মনে হচ্ছে ওর জীবনের জন্য আপনাকেই লড়তে হবে, সে নিজে তো মনে হচ্ছে বাঁচতে চাইছে না।”

ডাক্তার সারাহকে শহরের হাসপাতালে নিতে চাইলেও অনুমতি দিলেন না আন্টি। তিনি নিজে রাত-দিন মেয়েটার সেবা করলেন। জ্বর এলেই স্পঞ্জ নিয়ে সারাহর গা মুছিয়ে দিতেন, সারাক্ষণ বিছানার পাশে বসে ওর হাত ধরে রাখতেন। দিনে দিনে শুকিয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে গেল সারাহ। কোটরের ভিতরে ঢুকে গেল মেয়েটার দ্যুতিময় দুটো চোখ।

অবশেষে ষষ্ঠ দিনে উঠে বসল সারাহ। ট্রুডি আন্টির সাহায্য ছাড়াই খানিকটা স্যুপও খেল। আবার এলেন ডাক্তার। সারাহকে ভালভাবে পরীক্ষা করে যাবার সময় সিরিয়াস ভঙ্গিতে আন্টিকে কী যেন জানিয়েও গেলেন। খানিক বাদে সারাহর রুমে এসে বিছানার পাশের চেয়ারে বসলেন আন্টি।

 “সারাহ” ওর পাতলা আর ঠাণ্ডা হাত ধরে আন্টি জানতে চাইলেন, “শেষ কবে তোমার পিরিয়ড হয়েছে বাছা?”

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কোনো উত্তর না দিয়ে আন্টির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সারাহ। আর তারপরই প্রথমবারের মত কেঁদে ফেলল বেচারা। বুকের গভীর থেকে উঠে আসা কান্নায় ভিজে গেল গর্তে বসা চোখ।

“ওহ, মাই লিটল গার্ল” সারাহকে ধরে বসালেন আন্টি, “কে তোমার সাথে এমন করেছে?”

নিঃশব্দে কেঁদেই চলেছে সারাহ; মাথার চুলে বিলি কেটে দিয়েছেন আন্টি। তারপর আস্তে করে আবার বললেন, “তোমাকে বলতেই হবে–” আচমকা হঠাৎ কী মনে পড়তেই যেন বরফের মত জমে গেল সারাহর মাথার ওপরে • থাকা আঙুল; বুঝতে একটু কষ্ট হল না যে মেয়েটা কী সুকাচ্ছে।

“ম্যানি, ম্যানিই করেছে!”

এটা কোনো প্রশ্ন ছিল না; অমোঘ এক সত্য যা শোনার সাথে সাথে ফুঁপিয়ে উঠল সারাহ।

“ওহ সারি মাই পুওর সারি!”

অবচেতনেই চোখ ঘুরিয়ে টেবিলের ওপর ম্যানফ্রেডের ছবির দিকে তাকালেন আন্টি। ছবিটার নিচে আবার লেখা ছোট্ট সারিকে বড় ভাই ম্যানি।”

“কী ভয়ংকর ব্যাপার!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আন্টি, “এখন আমরা কী করব?”

পরদিন রান্নাঘরে কাজ করছেন আন্টি; এমন সময় খালি পায়ে সেখানে এল সারাহ।

“তোমার বিছানা থেকে নামা উচিত হয়নি সারি” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাটা বললেও আন্টির দিকে একবারও তাকাল না মেয়েটা।

 শরীর দুর্বল থাকাতে এটুকু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই রান্নাঘরের চেয়ারে একটু জিরিয়ে নিল।

ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে চিমটা দিয়ে খুলে ফেলল চুলার ঢাকনা। লকলকে করে জ্বলছে কমলা রঙের শিখা। আর তক্ষুণি আন্টি বুঝতে পারলেন যে মেয়েটা হাতে করে ম্যানির ছবি নিয়ে এসেছে। চোখের সামনে ধরে কয়েক সেকেন্ড ছবিটা দেখেই আগুনের মধ্যে ফেলে দিল সারাহ।

দ্রুত পুড়ে কালো হয়ে গেল কার্ডবোর্ড ফ্রেম। ছবিটাও ছাই হয়ে মিশে গেল আগুনে। তারপরও শক্তি খাটিয়ে চিমটা দিয়ে ছাইগুলোকে নেড়ে দিল সারাহ্। অতঃপর আবার ঢাকনি আটকে রেখে দিল চিমটা। কাজ শেষ হতেই মেয়েটা এমনভাবে কেঁপে উঠল যে, আরেকটু হলেই পড়ে যেত। তাড়াতাড়ি এসে ওকে ধরে ফেললেন আন্টি। তারপর চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।

বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর নরম স্বরে সারাহ্ বলে উঠল; “আমি ওকে ঘৃণা করি।” চোখ শুকোবার জন্য চট করে অন্যদিকে তাকালেন ট্রুডি আন্টি।

 তারপর বললেন, “এখন কী করতে হবে সে ব্যাপারেও আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

“আমি জানি কী করতে হবে।” সারাহর কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়ে গেলেন আন্টি। মেয়েটা যেন আর সেই ছোট্ট মিষ্টি সারাহ নেই; জীবন তাকে ক্ষত বিক্ষত করে শক্ত এক নারীতে পরিণত করে গেছে।

এগারো দিন পরে স্টিলেনবশে ফিরে এল রুলফ স্ট্যান্ডার। আর ছয় সপ্তাহ পরে ডাচ রিফর্মড চার্চে বিয়ে করল সারাহ্ আর রুলফ। ১৯৩৭ সালের মোলই মার্চ পৃথিবীতে এল সারাহ্’র ছেলে। ক্ষীণকায়া সারাহ্ বড়সড় শিশুটিকে জন্ম দিতে গিয়ে বেশ কষ্টই পেল।

ডেলিভারির পরপরই সারাহর সাথে দেখা করার অনুমতি পেল রুলফ। ডেলিভারি রুমে এসে দোলনায় শুয়ে থাকা নবজাতককে দেখল রুলফ।

“তোমার কী ওকে দেখে ঘেন্না লাগছে?” বিছানায় শুয়ে জানতে চাইল সারাহ। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্নটা নিয়ে ভাবল রুলফ; তারপর মাথা নেড়ে বলল, “ও তো তোমারই অংশ আর তোমার সাথে জুড়ে থাকা কোনো কিছুতেই আমি কখনো ঘৃণা করতে পারব না।”

নিজের হাত বাড়িয়ে দিল সারাহ্। বিছানার কাছে এসে ওর হাত ধরল রুলফ। সারাহ্ বলল, “তুমি অনেক হৃদয়বান একজন মানুষ, রুলফ। কথা দিচ্ছি, আমিও একজন আদর্শ স্ত্রী হব।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *