৬. আন্ডারগ্রাউন্ডে নামার পর

আন্ডারগ্রাউন্ডে নামার পর জীবনে প্রথমবারের মত প্রচণ্ড ভয় পেলেন হেনড্রিক। মনে হল কথা বলা কিংবা চিন্তার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। এমনকি চিৎকার করারও বল পাচ্ছেন না।

মাথায় বাতি লাগানো রুপালি হেলমেট আর রাবারের গামবুট, ওভারঅল পরে কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের সাথে এক লাইনে দাঁড়াবার পর থেকে এ ভয়ের সূচনা।

শ্যাফটে নামার আগে স্টিলের জালের ফোকর দিয়ে দেখা গেল পাইথনের মত কেবল, আর মাথার উপরে হেজগিয়ার। চোখ তুলে তাকাতেই মনে হল, আকাশের গায়ে ঝুলে আছে চাকা। একশ’ ফুট উপরে অনবরত ঘুরছে।

ফোকরের গেইট খুলে যেতেই হঠাৎ করে পেছনের খাঁচায় হুড়মুড় করে পড়ে গেল কৃষ্ণাঙ্গের দল, সাথে হেনড্রিক। স্যুর জন মানুষ কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একত্রে। দরজা বন্ধ হতেই ধপ করে নেমে গেল মেঝে। মাথার উপরকার কম্পার্টমেন্টে উঠে এল আরো সত্তর জন।

তারপর তীব্রবেগে নামতে শুরু করল খাঁচা। আতঙ্কের চোটে যেন মরে যাবার দশা। পেট গিয়ে বুঝি পাজরে আটকে গেল। অন্ধকারের মধ্যে টানেল ধরে ছুটছে এক্সপ্রেসের ট্রেনের মত খাঁচা। মাথার উপরে এত বিশাল ওজনের পাথর আছে ভাবতেই তীব্র ভয়ে মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাবে। কানের উপরেও চাপ বাড়ছে। প্রথমে এক মাইল তারপর আরো এক মাইল নেমে গেল খাঁচা।

আচমকা থেমে যেতেই মনে হল বুঝি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবেন। রাবারের মত বোধ হয় হাড় থেকে মাংস খসে পড়ে যাবে। গেইট খুলতেই মেইন হলেজে নেমে এলেন হেনড্রিক। চকচকে ভেজা পাথরে মোড়া গুহার দেয়াল। সুয়ারেজ লাইনের ইঁদুরের মতন চারপাশে ছোটাছুটি করছে শত শত মানুষ।

আর আছে পানি। পায়ের নিচে ছাদ থেকে সর্বত্র পানি আর পানি ঝরে পড়ছে। গরম, আর্দ্রতা আর বদ্ধ জায়গায় দমবন্ধ হবার বোধ হওয়ায় আবহাওয়াও ভারি হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কানের পর্দা না জানি ফেটে যায়। অতঃপর স্টোপ নামক বিশাল খোলা চেম্বারে না পৌঁছানো পর্যন্ত গেল না এই আতঙ্ক।

এখান থেকে স্বর্ণবাহী আকরিক এরই মাঝে বাইরে বেরিয়ে গেছে। গ্যাংয়ের লোকেরা হেনড্রিককে তার স্টেশনে দিয়ে গেল। এখানে বিদ্যুতের বারে নিচে অপেক্ষায় রইলেন কখন আসবে শ্বেতাঙ্গ শিফট বস্। স্টেশন হল তিন পাশেই পাথরঅলা একটা চেম্বার। প্রবেশমুখে নাম্বার। পেছনের দেয়ালের সাথে লম্বা একটা বেঞ্চ আর ল্যাট্রিন।

পুরো দল বেঞ্চে বসতেই রোল কল করল বস বয়দের দল। শ্বেতাঙ্গ শিফট বস নিউ হ্যামার বয় কোথায় জানতে চাইলে উঠে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। তার সামনে চলে এল ক্রোঞ্জি, শিফট বস্। নাক ভাঙা লোকটা মনোযোগ দিয়ে খানিকক্ষণ হেনড্রিককে দেখল। মাথার ক্ষতচিহ্ন আর ভাঙা দাঁত দেখে বুঝতে পারল তারা দুজনেই পোড় খাওয়া শক্তপোক্ত মানুষ। উপরের সূর্যের আলোতে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিভেদ থাকলেও মাটির এই অভ্যন্তরে সবাই কেবল মানুষ।

“তুমি হ্যামার চেনো? যানাকালোতে জানতে চাইলেন ক্রোজি।

“জানি।” আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিলেন হেনড্রিক। দুই সপ্তাহ হ্যাঁমারের উপর প্র্যাকটিস করে এসেছেন।

চোখ পিটপিট করে তাকাল ক্রোঞ্জি। নিজের ভাষা শুনে খুশিই হয়েছে। বেরিয়ে গেছে মুখের সবকটা দাঁত। “আমি সি আর সি’র পাথর ভাঙাদের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গ্যাংটাকে চালাই” হাসতে হাসতেই বলল, “তাই তোমাকে পাথর ভাঙা শিখতেই হবে দোস্ত, নয়ত আমি তোমার মাথা ভেঙে দিব। বুঝলে?”

“বুঝতে পেরেছি।” পাল্টা হাসলেন হেনড্রিক। ক্রোঞ্জি গলা তুলে বাকিদেরকে বললেন, “হ্যামার বয়েজ সবাই এখানে আসো৷”

বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল হেনডিকের মতই বড়সড় পাঁচজন লোক। জ্যাক হ্যামার চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। এ কাজে প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি দরকার হয়। তাই অন্যান্য পাথর ভাঙার দলগুলোর চেয়ে এরা ডাবল বেতন আর বোনাস পায় সাথে সম্মানও।

ইলেকট্রিক বাল্বের নিচে ব্ল্যাকবোর্ডে সবার নাম লিখে দিল ক্রোঞ্জি। সবার নিচে হেনরি তাবাকা আর একেবারে প্রথমেই বড়সড় জুলু জামা। নিজের জ্যাকেট খুলে লাইন বয়ের হাতে ছুঁড়ে মারল জামা; কালো কালো পেশি কিলবিল করে উঠল সারা শরীরে।

“হা!” হেনড্রিকের দিকে তাকিয়ে জামা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “তত মরুভূমি থেকে এক ছোট্ট ওভাম্বো শিয়াল এসেছে নাকি!” সবাই হেসে উঠল জামার কথা শুনে।

 “আমি তো ভেবেছি জুলু বেবুনেরা কেবল ভ্রাকেনস বার্গের ওপর উঠে গা চুলকায় যেন তাদের গলা বহুদূর পর্যন্ত শোনা যায়।” হেনড্রিকের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল লোকগুলো। তারপরেই অবশ্য খিকখিক করে হেসেও ফেলল।

“অল রাইট, তোমাদের মুখ বন্ধ করো।” বলে উঠল ক্রোঞ্জি, “চলো কয়েকটা পাথর ভাঙা যাক। নিজের দলকে নিয়ে চলে এল পাথরের দেয়ালের কাছে। এর আড়ালেই আছে সোনা।”

জায়গাটার ছাদ বেশ নিচু। একজন মানুষকে উবু হয়ে এগোতে হলেও পাশাপাশি বেশ চওড়া। দু’পাশেই শোনা যাচ্ছে অন্য দলের আওয়াজ। পাথরে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে তাদের কণ্ঠস্বর। অন্ধকারে লণ্ঠনের আলো তৈরি করেছে বিচিত্র সব নকশা। “তাবাকা!” ডাক দিল ক্রোঞ্জি, “এদিকে এসো!” সাদা রঙের ছিটে দিয়ে কোথায় কোথায় গর্ত করতে হবে তা চিহ্ন দিয়ে রেখেছে।

জেলিগনাইট চার্জের মাধ্যমে খুব হিসাব করে বিস্ফোরণ ঘটানো হল। কাটারের দল এসে পরিষ্কার করে দিল জায়গাটা। তুলে নিয়ে গেল আকরিক পাথর।

“শায়া!” ক্রোঞ্জির আদেশ পেয়ে ড্রিলের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। মেশিনগানের মত দেখতে যন্ত্রটা পাথরের মেঝের ওপর পড়ে আছে। লম্বা হোস পাইপের মাধ্যমে মেইন হল থেকে আসছে বাতাস।

দ্রুতহাতে হেনড্রিক আর তার লাইন বয়রা মিলে যন্ত্রটাকে সাদা রঙের চিহ্নে কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারপর ড্রিলের পেছনে দাঁড়িয়ে ডান কাঁধে তুলে নিলেন যন্ত্রটা। লাইন বয়ের দল সরে যেতেই ভাল্ব খুলে দিলেন হেনড্রিক।

 ফলাফলে সৃষ্টি হল, প্রচণ্ড শব্দ। মনে হচ্ছে যেন কানের পর্দা ফেটে যাবে। ড্রিলের মাত্র ইঞ্চিখানেক জায়গায় আবদ্ধ বাতাস ৫০০ পাউন্ড ওজন নিয়ে তীব্রগতিতে হুশ করে বেরিয়ে যেতেই পাথরের গায়ে গিয়ে বিঁধে গেল বিশ ফুট লম্বা স্টিলের মাথা।

কাঁধে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে কেঁপে উঠলেও শক্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন হেনড্রিক। কিন্তু চোখের সামনে যেন অন্ধকার দেখছেন। তারপরেও দেরি না করে শিফট বসের কথা মত তাক করলেন ড্রিলের মাথা। একটু আগে তৈরি করা গর্ত থেকে হলুদ কুয়াশা এসে ছড়িয়ে পড়ল হেনড্রিকের চোখেমুখে। কালো চামড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ঘাম। উদোম পিঠ দিয়ে যেন মাটি ঝরছে। কাঁধে এত ভারি ড্রিলের কারণে মিনিটখানেকের মধ্যেই ব্যথা হয়ে গেল সারা শরীর। ড্রিলের তীব্র ঝাঁকুনিতে এক মিনিটে হাজারবার কেঁপে উঠছে দেহতুক। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যথা। চারপাশে শব্দের কোনো কমতি নেই। তারপরেও মনে হচ্ছে তিনি কালা হয়ে গেছেন। যদিও ঠিকই টের পেলেন উপরের দিক থেকে ভেসে আসা ড্রিলের গর্জন।

দৌড়ে এল লাইন বয়। হাতলঅলা যন্ত্রটাকে প্রথম গর্ত থেকে বের করে হেনড্রিককে সাহায্য করল দ্বিতীয় দাগের কাছে নিয়ে যেতে। আবার ভাল খুলে দিলেন হেনড্রিক। সাথে সাথে শুরু হল প্রচণ্ড শব্দ আর তীব্র ঝাঁকুনি। যাই হোক আস্তে আস্তে যেন অসাড় হয়ে গেল শরীর। যেন কোকেন ভরে দেয়া হয়েছে চামড়ায়; তাই আর কিছু তেমন টের পেলেন না।

এমনিভাবেই পুরো ছয় ঘণ্টার শিফট পার হয়ে গেল। শেষ হওয়ার পর পা থেকে মাথা পর্যন্ত হলুদ কাদায় মাখামাখি হয়ে উঠে এল সবাই। এমনকি বিশালাকার জুলু জামা পর্যন্ত ঘোলাটে চোখে টলতে টলতে উঠে এল।

স্টেশনে বসে ব্ল্যাকবোর্ডে সবার নামের পাশে কাজের পরিমাণ লিখে রাখল ক্রোঞ্জি। জামা ষোলটি ড্রিল করেছে। হেনড্রি বারো; অপরজন দশ।

“হাহ!” ভূগর্ভ থেকে উপরে উঠে আসার সময় বিড়বিড় করে উঠল জামা।” প্রথম শিফটেই শিয়ালটা দুই নম্বরে উঠে এসেছে।” অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে হেনড্রিক কোনোমতে উত্তর দিলেন, “দ্বিতীয় শিফটেই শিয়ালটা সবার উপরে উঠে যাবে।”

কিন্তু সেটা কখনোই ঘটেনি। জুলুর চেয়ে তিনি কখনোই একটা পাথরও বেশি ভাঙতে পারেননি। কিন্তু প্রথম মাসের শেষে হেনড্রিক যখন কোম্পানির বিয়ার হলে তার স্বাড়ের দল নিয়ে বসেছেন দুইটা এক গ্যালনের জগভর্তি পরিজের মত থকথকে আর পুষ্টিকর বিয়ার নিয়ে, কাছে এগিয়ে এল জামা।

হেনড্রিকের সামনে এক গ্যালনের একটা জগ রেখে বলল, “এই মাসে আমরা একসাথে পাথর ভেঙেছি তাই না শিয়াল?”

“আগামী মাসে তার চেয়েও বেশি হবে, কি বলিস বেবুন?”

 হেনড্রিকের কথা শেষ হতেই দু’জনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

ষাড়ের দলের ভ্রাতৃসংঘের প্রথম জুলু সদস্য হল জামা। এরকম গোত্রগত বাধা টপকানো সচরাচর সবার জন্যে সহজ ছিল না।

***

পুরো তিন মাস কেটে যাবার পর আবার ভাইয়ের দেখা পেলেন হেনড্রিক। তবে ততদিনে সি আর সি খনির কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের ওপর নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। জামা হল তার লেফটেন্যান্ট। জুলু, ম্যাটাবেল প্রভৃতি গোত্রের লোকেরাও এখন ষাড়ের সদস্য। বাফেলো টিমে যোগ দেয়ার জন্য একমাত্র শর্ত হল বিশ্বস্ততা আর ক্লার্ক, বস বয় কিংবা কোম্পানি পুলিশ হলেও চলবে।

আর যারা বাধা দিল কিংবা প্রত্যাখ্যান করল তাদের ফলাফল হল ভয়াবহ। যেমন এরকম একজন জুলু বস বয় মেইল হলেজের মোল তলা থেকে পড়ে মারা গেল। পাথরের নিচে পড়ে কাদা হয়ে গেল থেতলানো শরীর।

 কোম্পানি পুলিশের একজন প্রত্যাখ্যান করাতে নিজের সেন্ট্রি বক্সেই ছুরির ঘা খেয়ে মারা গেল। আরেকজন রান্নাঘরের উনুনে জীবন্ত পুড়ে গেছে।

তাই অবশেষে যখন মোজেসের দূত বার্তা নিয়ে এল তখন বিনা বাধাতেই মিটিংয়ের জন্যে বাইরে চলে এলেন হেনড্রিক।

যদিও সরকারের কঠোর নিয়ম হল কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকেরা কাঁটাতারের ঘেরা খনির ভেতরেই থাকবে। চেম্বার অব মাইনস আর জোহানেসবার্গ শহর পিতাদের ধারণা শত শত হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদেরকে স্বর্ণের খনিতে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবার অধিকার দেয়ার মানে হবে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা। এর পূর্বে ১৯০৪ সালে চাইনিজ কুলীদেরকে এনে এরকম ধাক্কা খেয়েছিল প্রশাসন। স্বর্ণখনি জুড়ে আইন অমান্য করা, জুয়া খেলা আর নারী সংসর্গ নিয়ে ঝামেলা এত বেড়ে গিয়েছিল যে ১৯০৮ সালে বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা দিয়েও চাইনিজদেরকে জাহাজে করে স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, তারপর থেকে শ্রমিকদের কম্পাউন্ডে থাকার ওপর কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করেছে সরকার।

তবে সি আরসির গেইট দিয়ে হেনড্রিক এমনভাবে বেরিয়ে গেলেন যেন তিনি অদৃশ্য। তারার আলোয় খালি মাঠ পেরিয়ে আগাছা ভরা রাস্তা ধরে হেঁটে চলে এলেন এক পরিত্যক্ত শ্যাফটের মাথায়। মরচে পড়া করোগেটেড শেডের পিছনে পার্ক করে আছে একটি কালো ফোর্ড সেজান। হেনড্রিক এগোতেই জ্বলে উঠল হেডলাইট। গায়ের ওপর তীব্র আলো পড়তেই যেন জমে গেলেন হেনড্রিক।

তারপরেই অবশ্য বাতি নিভে গেল। শোনা গেল মোজেসের কণ্ঠস্বর, “দেখতে পেয়েছি ভাই।”

পরস্পরকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন দু’জনেই। খানিক বাদে হেনড্রিক হেসে জানালেন, “হাহ।” তুমি তাহলে এখন শ্বেতাঙ্গদের মতই গাড়ি চালাও।”

“এই মোটর কার বোরর সম্পত্তি।” হেনড্রিককে গাড়ির কাছে নিয়ে যেতেই ভেতরে ঢুকে চামড়ার মোড়া আসনে আরাম করে শ্বাস ফেললেন। “হাঁটার চেয়ে তো ভালো।”– “এখন আমাকে বলল ভাই সিআরসিতে কী ঘটছে?” হেনড্রিক নিজের লম্বা একখানা রিপোর্ট শেষ না করা পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনলেন মোজেস। তারপর মাথা নেড়ে বলল,

“তুমি আমার মনোবাসনা বুঝতে পেরেছে। আমি ঠিক এটাই। চেয়েছিলাম। ভ্রাতৃসংঘে সমস্ত গোত্র থেকেই তোক নিতে হবে। স্বর্ণখনির প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি গোত্রে আমাদেরকে পৌঁছাতে হবে।”

 “এসব তুমি আগেও বলেছো” ঘেত ঘেত করে উঠলেন হেনড্রিক।

“কেন সেটা কিন্তু কখনোই বলোনি ভাই। আমি তোমার ওপর ভরসা রাখি কিন্তু আমি যাদেরকে জড়ো করেছি সবার কেবল একটাই জিজ্ঞাসা, কেন? এই কাজে আমাদের লাভ কী? ভ্রাতৃসংঘ থেকে আমরা কী পাবো?”

“আর তুমি কী উত্তর দিয়েছে ভাই?”

“আমি শুধু বলেছি যে ধৈর্য ধরতে হবে। উত্তরটা না জানলেও এমন ভাব করেছি যেন আমি জানি। আর ওরা যদি বাচ্চাদের মত বেশি ঘ্যানঘ্যান করে আমিও দেই প্যাদানি।” একথা শুনে হেসে ফেলল মোজেস। কিন্তু হেনড্রিক মাথা নেড়ে জানালেন, “হেসো না ভাই, ওদেরকে এভাবে মেরে বেশিদিন চুপ করিয়ে রাখতে পারব না।”

ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখল মোজেস, “তোমাকেও আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু এখন বলো সিআরসিতে এত মাস ধরে কাজ করার পর তুমি কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মিস করেছো?”

উত্তরে হেনড্রিক জানালেন, “নারী সঙ্গ।”

“ঠিক আছে রাত শেষ হবার আগেই পেয়ে যাবে। আর কিছু?”

 “ভালো মদের জন্য পেটের ভেতরটা যেন চুলকাচ্ছে।”

“ভাই”, সিরিয়াস ভঙ্গিতে মোজেস জানাল, “তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই দিয়ে দিয়েছে। ভ্রাতৃসংঘ থেকে তোমার লোকেরা এইসব কিছুই পাবে। শিকারি কুকুরদের মুখে টোপ হিসেবে দেয়া হবে অর্থসহ সবকিছু। তবে বাফেলো টিমের হর্তাকর্তারা আরো অনেক অনেক কিছু পাবে।” ফোর্ডের ইঞ্জিন চালু করল মোজেস।

 গাড়ি নিয়ে দক্ষিণে শ্বেতাঙ্গদের পাড়ায় চলে আসতেই পরের রাস্তাগুলো হয়ে পড়ল সরু আর ভাঙাচোরা। যেখানে-সেখানে খানা-খন্দ। তারপরই আবার শহরের আলো পেছনে ফেলে ফোর্ড চলে এল তেরপলে ঢাকা বস্তির ধারে। খড়ির চুলার আগুনে চারপাশে জমেছে কমলা ধোয়া। গায়ে গায়ে লাগানো কারাগেটেড টিনের লেন দেখে মনে হচ্ছে বুঝি সেনাবাহিনির মত বড়সড় দল।

“কোথায় এসেছি আমরা?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক।

এমন এক শহরে যেটাকে কেউ পাত্তা দেয় না; যে শহরের মানুষের অস্তি ত্বই নেই।”

হেড লাইটের আলো পড়তেই সামনে পিছনে দেখা গেল অদ্ভুত সব দৃশ্য। একদল কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে-মেয়ে মিলে রাস্তার কুকুরকে তাড়া করেছে। পথের ধারে পড়ে আছে মাতাল কিংবা মরা মানুষের দেহ, কারোগেটেড টিনের দেয়ালের একপাশে হামাগুড়ি দিয়ে জলবিয়োগ করছে কোনো এক নারী, আগুনের পাশে বসেই টিনের পাত্রে করে খাচ্ছে এক পরিবার; গাড়ির আলো দেখে বড় বড় চোখ করে তাকাল সবাই। বোঝা যাচ্ছে চারপাশে এরকম আরো হাজার হাজার আছে।

“এটা হল ড্রেকস ফার্স।” জানাল মোজেস। “শ্বেতাঙ্গদের গোল্ডির পাশেই গড়ে ওঠা শহরতলী।”

“কতজন আছে?”

“পাঁচ হাজার দশ হাজার কেউ জানে না, জানতে চায়ও না।” ফোর্ড থামিয়ে হেডলাইট আর ইঞ্জিনের সুইচ বন্ধ করে দিল মোজেস।

আশপাশে নীরবতা নেমে এলেও ঠিক যেন নিস্তব্ধ হল না। ভেসে আসছে অসংখ্য টুকরো টুকরো আওয়াজ। ছোট্ট শিশুর কান্না, নারীকণ্ঠের গান, পুরুষদের গালাগালি, নাকডাকা, জুয়া খেলাসহ আরো বহু শব্দ।

ফোর্ড থেকে বের হয়ে অন্ধকারেই হাঁক দিল মোজেস। সাথে সাথে বস্তিগুলো থেকে চলে এল ডজনখানেক বাচ্চা ছেলে-মেয়ের দল।

“আমার মোটরগাড়ি পাহারা দাও।” আদেশ দিয়েই ছোট্ট একটা কয়েন ছুঁড়ে দিল মোজেস। শূন্যে থাকতেই বাতাস থেকে লুফে নিল ছেলে-মেয়েদের দলের একজন।

“বাবা!” শিশুকণ্ঠের কিচির-মিচির শুনতে শুনতেই ভাইকে নিয়ে শ’খানেক গজ দূরের বস্তিতে চলে এল মোজেস। কাছে এগোতেই বেড়ে গেল নারী কণ্ঠের গানের শব্দ। অন্যান্য আরো বহু কণ্ঠের আওয়াজের পাশাপাশি নাকে এল পুরনো মদ আর খোলা চুলায় মাংস ভাজার ঘ্রাণ।

লম্বা একটা নিচু দালানের সামনে পৌঁছে গেল দুই ভাই। মোজেস দরজায় নক্ কতেই তার চেহারার উপর ঝলসে উঠল লণ্ঠনের আলো।

 “তো ভাই” হেনড্রিকের হাত ধরে খোলা দরজার ভেতরে ঠেলে দিল মোজেস, “এটা হচ্ছে তোমার প্রথম সনদবিহীন পানশালা। যা যা প্রমিজ করেছি এখানে তুমি তার সবকিছু পাবে; নারী, এবং মদ।”

ঘরের ভেতরে মানুষের এত গাদাগাদি ভিড় যে তামাকের নীল ধোয়ার কুয়াশাতে হারিয়ে গেছে দূরের দেয়াল। ঘামে আর উত্তেজনায় চকচক করছে কালো মুখগুলো। খনির শ্রমিক লোকগুলোর কেউ কেউ এত মদ খেয়েছে যে মেঝের ওপর নিজের বমির মাঝেই শুয়ে পড়েছে। শ্বেতাঙ্গ নারীদের অনুকরণে মুখে রঙ মেখেছে বিভিন্ন গোত্র থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ নারীর দল। নাচ গানের সাথে কোমর দুলিয়ে খুঁজে নিচ্ছে খদের।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল মোজেসকে দেখেই যেন জাদুর মত কাজ হল। সবাই দু’পাশে সরে তাকে পথ করে দিল। ভাইয়ের পেছন পেছন এগোলেন হেনড্রিক। অবাক হয়ে গেলেন ভেবে যে মাত্র কয়েক মাসেই মোজেস কতটা সম্মান অর্জন করে নিয়েছে এদের কাছ থেকে।

পানশালার একেবারে কোনার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এক গার্ড। কুৎসিত চেহারার লোকটাও মোজেসকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানাল। তারপর ক্যানভাসের পর্দা তুলে ওদেরকে ভেতরে যেতে দিল।

এ রুমটাতে তেমন ভিড় নেই। উপরন্তু কাস্টমারদের জন্য বেঞ্চ আর টেবিলও দেখা যাচ্ছে। এখানকার মেয়েগুলোও বেশ তী। কোনার দিকের পৃথক একটা টেবিলে বসে আছে বিশালাকার এক কৃষ্ণাঙ্গী। চর্বির ভাজে ঢাকা পড়ে আছে বড়সড় এই জুলু নারীর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। সামনের টেবিলের ওপর জড়ো হয়ে আছে তামা আর রুপার কয়েন, বিভিন্ন রঙা ব্যাংক নোটের ছোঁড়া আর প্রতি মিনিটে আরো অর্থ এনে জড়ো করছে তরুণী মেয়েদের দল।

মোজেসকে দেখেই নিখুঁত সাদা দাঁত দেখিয়ে পার্সেলিনের মত হেসে উঠল সর্দার রমণী। তারপর কোনোরকমে গড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতির মত উরু দুলিয়ে এগিয়ে এল মোজেসের কাছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে এমনভাবে গামাকে অভিবাদন জানাল যেন সে কোনো গোত্রপতি।

“ইনি মামা জিংগা” হেনড্রিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল মোজেস, “ড্রেকস ফার্মের সবচেয়ে বড় পানশালা আর পতিতালয়ের মালিক। কদিন বাদে হয়ে উঠবেন কেবল একমাত্র।”

আর ঠিক তখনই হেনড্রিক বুঝতে পারলেন যে, টেবিলের বেশিরভাগ পুরুষই তাঁর পূর্বপরিচিত। বাফেলো টিমের সদস্যরাও হেনড্রিককে দেখে সহাস্যে এগিয়ে এল কাছে। অপরিচিতদের কাছে তার পরিচয় দেয়ার সময় বলল,

“এই হল হেনরি তাবাকা। যে কিনা সেই শ্বেতাঙ্গ ওভারশিয়ারকে খতম করেছিল—

নতুনদের চোখেও স্পষ্ট শ্রদ্ধা দেখতে পেলেন হেনড্রিক।

“আমার ভাই গত তিন মাসে কোনো ভালো পানীয় কিংবা নারীর স্পর্শ পায়নি।” মাঝখানের টেবিলের মাথায় বসে জানাল মোজেস।

 খিকখিক করে হেসে ফেলল মামা জিংগা, “আমার মেয়েরা ফোর্ডসবাগ থেকে শুরু করে বাপসফন্টেইন পর্যন্ত বিখ্যাত। এমনকি অনেক শ্বেতাঙ্গও তাদের খোঁজে এখানে আসে।”

“তাদের জন্য হয়ত ভাল” একমত হল মোজেস, “কিন্তু আমার ভাইয়ের জন্য নয়।”

 কেপ ব্র্যান্ডির বোতল নিয়ে মেয়েদের একজনকে দু’ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিল মামা জিংগা।

অতঃপর ভোর হবার পরে ড্রেকস ফার্স থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন হেনড্রিক আর মোজেস। ফোর্ডের কাছে আসতেই দেখা গেল তখনো গাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে ছেলে-মেয়েদের দল। গত রাতেই মামা জিংগার পানশালার পেছনের রুমে বসে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনা সেরে নিয়েছে দুই ভাই। নিজ নিজ লেফটেন্যান্টকে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছে যার যার এরিয়া আর দায়িত্ব।

“কাজ কিন্তু এখনো বহু বাকি আছে ভাই” ফোর্ড স্টার্ট করে ভাইকে জানাল মোজেস। “আমাদের গোত্রের ছাগলের মত করে সবকটা ছোট ছোট পানশালা আর পতিতালয়কে খেঁকিয়ে নিজেদের দলে আনতে হবে আর এর জন্য একমাত্র একটা রাস্তাই খোলা আছে।”

“জানি কীভাবে করতে হবে।” মাথা নাড়লেন হেনড্রিক।

“একজন জেনারেলও প্রয়োজন।” স্পষ্ট চোখে হেনড্রিকের দিকে তাকাল মোজেস। “তোমার সিআরসি ত্যাগের সময় চলে এসেছে ভাই। এখন এ কাজেই প্রয়োজন তোমার সমস্ত সময় আর শক্তি। মাটির নিচে পাথর ভেঙে শক্তি অপচয়ের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন থেকে তুমি কেবল সৌভাগ্য আর ক্ষমতার জন্যেই মাথা ভাঙবে।” হালকা স্বরে হেসে ফেলল মোজেস। “তোমার হিরেগুলোর জন্য আর দুঃখ করো না। আমি তোমাকে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু দিব।”

সিআরসি’র সাথে হেনড্রিকের চুক্তি বাতিল করে দিলেন মার্কাস আর্চার, এছাড়া স্পেশ্যাল ট্রেনের জন্যে ট্রাভেল পেপারসও ইস্যু করে দিয়েছেন। কিন্তু এ ট্রেনে হেনড্রিক কখনোই চড়েননি। বরঞ্চ শ্বেতাঙ্গদের রেকর্ড থেকে হারিয়ে ছায়ার মত মিশে গেলেন শহরতলীর ভেতরে।

মামা জিংগা তার পানশালার পেছনে শুধুমাত্র হেনড্রিকের জন্যই এক ঘর বরাদ্দ করে দিল। এ ছাড়া তার মেয়েদের কেউ না কেউ সব সময় হেনড্রিকের কাপড় ধোয়া, রান্না করার আর আনন্দ দানের কাজে তৈরি থাকত।

 ড্রেকস ফার্মে প্রবেশের ছয় দিনের মাথায় বাফেলো টিমের ক্যাম্পেইন চালু করে দিলেন হেনড্রিক। উদ্দেশ্যে হল একেবারে স্পষ্ট। ড্রেকস ফার্মই হবে তাদের নিজস্ব দুর্গ।

 প্রথম রাতেই বিরোধিতা করেছে এরকম বারোটি পানশালা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মাতাল কাস্টমারসহ অঙ্গার হয়ে গেল এগুলোর মালিক। শ্বেতাঙ্গদের ফায়ার ইঞ্জিনের আওতার বাইরে থাকায় আগুনের লকলকে শিখা নেভানোর জন্যে কোনো চেষ্টাই হল না। বরঞ্চ ড্রেকস ফার্মের অধিবাসীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন উপভোগ করল সার্কাসের দৃশ্য। আগুন দেখে শিউরে উঠে নাচানাচি শুরু করল শিশুদের দল। আতশবাজির মত মদের বোতল ফাটতে দেখে অট্টহাসি দিল সবাই।

তবে মেয়েদের প্রায় সবাই বেঁচে গেছে। অনেকেই বিবস্ত্র হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেও সহৃদয় পুরুষের দল এসে তাদেরকে নিয়ে গেল মামা জিংগার আশ্রয়ে।

পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ছাইয়ের ওপর নির্মাণ করা হল নতুন পানশালা। মেয়েরাও আবার যার যার কাজে ফিরে এল। এখানে পেল আরো ভালো থাকা-খাওয়ার সুযোগ। সাথে নিজস্ব বাফেলো যেন কাস্টমাররা তাদের সাথে প্রতারণা কিংবা খারাপ আচরণ করতে না পারে।

“দয়া থেকেই জন্ম নেয় হৃদয়ের বিশ্বস্ততা আর দৃঢ়তা” নিজের বাফেলোদেরকে বুঝিয়ে দিলেন হেনড্রিক। আর তার এই “হ্যাপি হাউজ” পলিসি সাদরে গ্রহণ করল ড্রেকস্ ফার্মাসী। শহরতলিতে বসবাসরত সকল কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের দেখভাল করতেন হেনড্রিক। তাই কিছুদিনের মাঝেই বন্ধ হয়ে গেল পকেটমার আর ছিঁচকে চোরদের দৌরাত্ম। বেড়ে গেল মদের মান। মামা জিংগা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করা শুরু করলেন সব রকমের পানীয়।

মদ্দা হাতির মত কড়া স্বাদের এই মদ মানুষকে মাতাল করলেও অন্ধ কিংবা ব্লেইনের কাজ বন্ধ করে দিত না। তাই মাত্র দুই শিলিং খরচ করলেই মিলে যেত আনন্দ।

গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে আসা মেয়েদেরকে ড্রেকস ফার্মে নিয়ে আসত হেনড্রিকের লোকজন। কিংবা বিভিন্ন জায়গায় বাফেলোদেরকে পাঠিয়ে তিনিই তাদেরকে বিভিন্ন কিছুর লোভ দেখিয়ে শহরে আনতেন।

জোহানেসবার্গের নগর পিতার দল আর পুলিশ শহরতলীর এসব কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও বিকল্প কোনো উপায় না পেয়ে এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কেননা এসব পানশালা বন্ধ করে দিলে কোথায় যাবে অবৈধ এত অধিবাসী? তাই মাঝেমাঝে হানা দেয়া, গ্রেফতার আর কদাচিৎ ফাইন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল তাদের দায়িত্ব। কিন্তু যেহেতু রহস্যময় কারণে ড্রেকস ফার্ম থেকে খুন-খারাবি আর ডাকাতির মত ঘটনাও উধাও হয়ে শান্ত হয়ে গেল চারপাশ তাই তারাও আর এ দিকটা মাড়াত না। র‍্যান্ডের খনি শ্রমিকদের কাছে স্বর্গ হয়ে উঠল এ ফার্ম। তারপরেও এখনো হাজার হাজার কাস্টমার আছে যারা ড্রেকস ফার্ম চেনে না। এদের ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে উঠল মোজেস গামা।

“তারা যেহেতু আমাদের কাছে আসতে পারছে না; আমাদেরকেই ওদের কাছে যেতে হবে।” কী করতে হবে হেনড্রিককে বুঝিয়ে দিতেই পুরো এক বহর সেকেন্ড হ্যান্ড ডেলিভারী ভ্যান কিনে সেগুলো সারাইয়ের জন্য কৃষ্ণাঙ্গ মেকানিক লাগিয়ে দিলেন হেনড্রিক।

 প্রতি সন্ধ্যায় মদ আর মেয়েদেরকে নিয়ে এসব ভ্যান পৌঁছে যেত দূর দূরান্তের খনিগুলোতে। তারপর গাছের নিচে কিংবা পরিত্যক্ত কোনো দালানের ভেতর দাঁড়াতেই খনি শ্রমিকদের কম্পাউন্ডের বাফেলো গার্ড কাস্টমারদেরকে যাওয়া-আসার সুযোগ দিত। প্রাপ্ত অর্থ থেকে শেয়ার পেত সবাই।

 “তো ভাই, তুমি কি এখনো তোমার ছোট্ট পাথরগুলোর কথা ভাব?” দু’বছর বাদে একদিন হেনড্রিকের কাছে জানতে চাইল মোজেস।

 “যেমনটা তুমি বলেছিলে” মিটিমিটি হাসলেন হেনড্রিক, “একজন মানুষ যা যা চাইতে পারে তার সমস্ত কিছুই এখন আমাদের হাতে।”

“তুমি এত সহজে সন্তুষ্ট হও।” খানিকটা পরিহাসের সুরে বলে উঠল মোজেস।

 “আরো কিছু আছে নাকি?” আগ্রহী হয়ে উঠলেন হেনড্রিক।

“সবে তো শুরু হয়েছে, ভাই।”

“এরপরে কী আছে?”

“তুমি ট্রেড ইউনিয়নের নাম শুনেছো?” জানতে চাইল মোজেস, “জানো এটা কী?”

 দ্বিধায় পড়ে গেলেন হেনড্রিক, “খনি আর রেলওয়েতে কাজ করে এমন শ্বেতাঙ্গদের ট্রেড ইউনিয়ন আছে বলে শুনেছি। কিন্তু তেমন কিছু তো জানি না। ভেবেছি এসবে আমাদের তো কোনো দরকার নেই।”

 “তুমি ভুল ভেবেছো ভাই।” আস্তে করে জানাল মোজেস, “আফ্রিকানস মাইন ওয়ার্কাস ইউনিয়ন নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে। এ কারণেই তুমি আর আমি গোন্ডিতে এসেছি।”

 “আমি তো ভেবেছি আমরা কেবল অর্থের জন্যই এসেছি।”

“পঞ্চাশ হাজার ইউনিয়ন সদস্য প্রতি সপ্তাহে এক শিলিং করে দিচ্ছে এটা অর্থ নয়?” হেনড্রিককে দেখে হেসে ফেলল মোজেস। লোভে চকচক করছে তার ভাইয়ের মুখ।

“অনেক বিশাল পরিমাণ অর্থ হবে, ভাই!”

হানি মাইনে ওয়ার্কাস ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কেন অসফল হয়েছিল তা ভালোই মনে আছে মোজেসের। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকরা এতই সরল যে রাজনৈতিক কোনো সচেতনতাই তাদের নেই।

“গোত্রের ধারণাই আমাদের পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা।”

হেনড্রিককে বুঝিয়ে দিল মোজেস। “কিন্তু যদি নিজ নিজ গোত্র ভুলে সবাই এক হয়ে উঠতে পারি তাহলেই অসীম হয়ে উঠবে আমাদের ক্ষমতা।”

“কিন্তু আমরা তো এক নই। বুঝতে পেরেছেন হেনড্রিক, “একজন ওভাষো থেকে একজন জুলু তো ঠিক একজন রাশান। কাজাকের কাছ থেকে একজন স্কটম্যানের মতই পৃথক।”

“হা!” হেসে ফেললেন মাজেস। “তার মানে তোমাকে যে বইটা দিয়েছিলাম তুমি সেটা পড়েছো? প্রথম যখন গোল্ডিতে এসেছি তুমি তো তখন রাশান কাজাকের নামও জানতে না”।

 “পৃথিবী আর এখানে বসবাসরত মানুষদের সম্পর্কে তুমি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে” একমত হলেন হেনড্রিক, “এখন বলল কেমন করে একজন জুলু এক ওভাম্বোকে ভাই ডাকতে পারবে। কীভাবে শ্বেতাঙ্গদের হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতাকে নিজের করে নিতে পারব আমরা?”

“এগুলোর কিছুই অসম্ভব নয়। আমাদের মতই রাশিয়াতেও বিভিন্ন গোত্র আছে। তাতার, স্লভ, ইউরোপীয়, এশিয়াটিক; কিন্তু এক মহান নেতার ছায়ায় একত্রিত হয়ে তারা আমাদের শাসকের চেয়েও বড় এক স্বৈরশাসক পরাস্থ করে দিয়েছে। তাই কৃষ্ণাঙ্গদের এমন এক নেতা দরকার যে তাদেরকে সঠিক কাজটি করতে বাধ্য করবে। এতে যদি হাজার কিংবা কোটি লোককে প্রাণও দিতে হয় তাতেও যেন কিছু না যায় আসে।”

“তোমার মতই এক নেতা ভাই?” হেনড্রিকের প্রশ্ন শুনে অদ্ভুত এক প্রহেলিকাময় হাসি দিল মোজেস।

 “সবার আগে মাই ওয়ার্কাস ইউনিয়ন” বলল, যেমন করে একটা শিশু হাঁটতে শেখে তেমনভাবে প্রতি পদক্ষেপে এক পা এক পা করে। শুরুটা বেদনাদায়ক হলেও সঠিক কাজটা করতে মানুষকে বাধ্য করতে হবে।”

“আমি আসলে ঠিক নিশ্চিত নই” বিশাল গোলাকার ন্যাড়া মাথাটা দুলিয়ে হেনড্রিক জানতে চাইলেন, “আমরা আসলে কী খুঁজছি ভাই? ধন-সম্পদ না ক্ষমতা?”

“আমরা আসলে সত্যিই ভাগ্যবান।” উত্তরে মোজেস জানাল, “তুমি চাও ধন-সম্পদ আর আমি ক্ষমতা। আমি যে পথ বেছে নিয়েছি তাতে প্রত্যেকেই আমরা নিজ নিজ আকাক্ষিত বস্তু পেয়ে যাব।”

কিন্তু প্রতিটি খনিতে বাফেলোদের নির্দয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইউনিয়ন তৈরি করাটা তেমন ফলপ্রসূ হল না। কেননা কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের লেবার অ্যাসোশিসনের ব্যাপারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই গোপনে কাজ করতে হয়। অন্যদিকে শ্রমিকরা নিজেরাও বিরোধিতা করছে। এছাড়া উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ভরসার অভাবে সাধারণ শ্রমিকরা নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দিতেও চায় না।

যাই হোক, ডা. মার্কাস আর্চারের পরামর্শ আর দিক-নির্দেশনায় ধীরে হলেও কয়েকটা খনিতে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে পারল বাফেলো টিম। বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার আর কয়েকজন মারা গেলেও দেখা গেল বিশ হাজার চাঁদ দানকারী সদস্য জুটে গেল।

বিভিন্ন খনির স্বার্থ সংরক্ষণকারী চেম্বার অব মাইনসের সদস্যরা প্রথমে আঁতকে উঠেই এই ক্যানসারকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাইলেও ভেবে দেখল মাটির গভীর থেকে হলুদ ধাতুটাকে তুলে আনতে হলে ঝুট-ঝামেলা কমানো দরকার। তাই শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হলে তাদেরই স্বার্থ হানি হবে বুঝতে পেরে প্রথমেই খুব সাবধানে অনানুষ্ঠানিক এক আলোচনা সেরে নেয় আফ্রিকান মাইন ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেলের সাথে।

বুদ্ধিমান আর যুক্তিবাদী এই সেক্রেটারি জেনারেলের মধ্যে বলশেভিকের কোনো ছোঁয়া না দেখে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে চেম্বার অব মাইনসের সদস্য বৃন্দ।

 “এই লোকটার সাথে কাজ করা যাবে। কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া তার প্রভাবও খারাপ না। শ্রমিকদের মুখপাত্র হিসেবে যথেষ্ট ভদ্র। তাই মনে হয় না তাকে ম্যানেজ করা তেমন কষ্ট হবে। তাই প্রথম মিটিঙেই চেম্বার অব মাইনস ইউনিয়নের সন্তুষ্টি মোতাবেক কয়েকটা সমস্যা সমাধান আর ওয়ার্কাসদের লাভ হবে এমন কিছু পদক্ষেপও নিয়ে নিল।

এরপর থেকে শ্রমিকদের যেকোনো সমস্যাঁতেই মোজেস গামাকে পাঠিয়ে দিত চেম্বারে। ফলে দ্রুত তা নিকেশও হয়ে যেত। এতে শক্ত হল মোজেসের অবস্থান। তবে ইউনিয়নও কখনো কোনো সহিংস পদক্ষেপ নেয়নি।

“আমার ভাইয়েরা বুঝতে পেরেছো?” মামা জিংগার পানশালাতে অনুষ্ঠিত আফ্রিকান মাইন ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সেন্ট্রাল কমিটির প্রথম মিটিঙে বলল মোজেস, “আমরা যখন দুর্বল তখন যদি ওরা আমাদের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে আমরা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাব। এই স্মাট লোকটা একটা আস্ত শয়তান আর সেই হল সরকারের ধনুকের তীর। ১৯২২ সালে শ্বেতাঙ্গ ইউনিয়ন স্ট্রাইকারদের বিরুদ্ধে মেশিনগান হাতে সৈন্যদেরকে লেলিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। তাহলে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে কী করবে ভাবো, ভাইয়েরা আমার, আমাদের রক্ত দিয়ে পৃথিবীতে পানি ছিটাবে। ধৈর্য হচ্ছে আমাদের লোকদের সবচেয়ে বড় শক্তি। সময় হচ্ছে আমাদের অস্ত্র, আর শ্বেতাঙ্গদের শত্রু। তাই আমার ভ্রাতৃবৃন্দ, ধৈর্য রাখো। একদিন এই শ্বেতাঙ্গরা ঠিকই বুঝতে পারবে যে আমরা তাদের হালের বলদ নই। আবিষ্কার করবে যে আমরা হচ্ছি। কালো কেশরঅলা সিংহ, সাদা মাংসের জন্য মরিয়া হয়ে আছি।

***

“বছরগুলো কত দ্রুত পার হয়ে গেল তাই না? মনে হচ্ছে মাত্র সেদিন ট্রেনে চেপে মরুভূমি পার হয়ে গোল্ডিতে এসেছি।” রবিবারের সকালবেলাতে ব্যস্ত রাস্তায় মনোযোগ দিয়ে ফোর্ড চালাচ্ছে মোজেস। পাশে বসে সুউচ্চ খনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন হেনড্রিক। খুব বেশি জোরে কিংবা আস্তে নয়, একেবারে নিয়ম মেনে মাত্র কয়েক মাস আগে আসা নতুন প্রযুক্তির ট্রফিক লাইট অনুসরণ করে গাড়ি চালাচ্ছে মোজেস।

 “কখনো অপ্রয়োজনে কাউকে তোমার দিকে আকর্ষণ করো না ভাই।” হেনড্রিককে উপদেশ দিয়ে মোজেস বলল, “শ্বেতাঙ্গ কোনো পুলিশ যেন তোমাকে থামাবার কোনো অজুহাত না পায়। এমনিতেই তোমার মোটর কার দেখে তোমাকে সে ঘৃণা করছে।”

সামনের রাস্তাটা একেবেঁকে চলে গেছে জোহানেসবার্গ কাট্রিক্লাবের দিকে। গাছের সারির ফাঁক দিকে চকচক করে উঠল কান্ট্রিক্লাবের সাদা দেয়াল। ফোর্ডের গতি ধীর করে ক্লাব প্রোপারটির মধ্যে চলে এল মোজেস। রাস্তার পাশের মাইলপোস্টে লেখা রিভোনিয়া ফার্ম।”

রাস্তাটা অসমান হওয়াতে ফোর্ডের হুইল ছোটাল ধূলিঝড়। দুপাশেই পাঁচ থেকে দশ একরের ছোট ঘোট প্লট। আর একেবারে শেষ মাথায় ডা. মার্কাস আর্চারের সম্পত্তি। তিনি অবশ্য খামার গড়ে তোলার কোনো চিন্তাই করেননি। ঘোড়া-মুরগি কিংবা সবজির ক্ষেত কিছুই নেই। কেবল চারপাশে চওড়া বারান্দাঅলা সিঙ্গেল একটা চারকোনা দালান।

গাম গাছের নিচে আরো চারটি গাড়ি দেখা যাচ্ছে। ফোর্ড থামিয়ে দিল মোজেস।

“ঠিকই বলেছো ভাই, বছরগুলো বড় বেশি দ্রুত পার হয়ে গেল। মানুষ যখন কোনো উদ্দেশ্যের পেছনে ছছটে তখন এমনই হয়। বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের পৃথিবী। ঘটে গেছে যুগান্তকারী সব ঘটনা। রাশিয়ার বিপ্লবের পর উনিশ বছর কেটে গেছে, ট্রাঙ্ক দেশান্তরে গেছে। রাইনল্যান্ড নিয়ে নিয়েছে হিটলার আর ইউরোপে তো যুদ্ধের কথা হচ্ছে, যে যুদ্ধ পুঁজিবাদের অভিশাপ ধ্বংস করে বিপ্লবকে বিজয়ী করে তুলবে।”

হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “এগুলো নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে।”

“তুমি আবারও একটা ভুল করলে ভাই। এসব নিয়েই আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাবা দরকার।”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করব।” ভাইয়ের হাত স্পর্শ করল মোজেস, “চলল ভাই, তোমাকে নতুন করে পৃথিবী দেখতে শেখাবো।” ফোর্ডের দরজা খুলে নেমে এল মোজেস। সাথে হেনড্রিক। দুজনে একসাথে এগোল পুরনো বাড়িটার দিকে।

চোখ-কান খোলা রেখে মুখটাকে বন্ধ রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বুঝলে ভাই।” সামনের বারান্দার সিঁড়িতে পা দিয়ে ভাইকে বুঝিয়ে বলল মোজেস। এভাবেই তুমি অনেক বেশি কিছু শিখতে পারবে।”

দু’ভাইকে দেখে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন মার্কাস। মোজেসকে দেখে খুশিতে চকচক করে উঠল ডাক্তারের চেহারা। মোজেসের কোমরে হাত দিয়ে হেনড্রিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তুমি নিশ্চয় হেনরি, আমরা তোমার কথা প্রায়ই বলি।”

“আপনার সাথে আমার আগেও দেখা হয়েছিল ডাক্তার।”

“সে তো বহু বছর আগে।” মাথা নেড়ে আর্চার জানালেন, “আর তুমি আমাকে মাকাম নামেই ডাকবে। তুমি তো আমাদের পরিবারেরই সদস্য।” মোজেসের দিকে তাকাতেই ডাক্তারের চোখে ফুটে উঠল গভীর আকুলতা। হেনড্রিকের মনে হল যেন কোনো নব পরিণীতা বধূ স্বামীর জন্য অস্থির হয়ে আছে।

হেনড্রিক জানেন যে মোজেস এখানে মার্কাসের সাথেই বসবাস করে। আর এই সম্পর্ক নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাও নেই। গত কয়েক বছরে তাদের সফলতার পেছনে মার্কাসের উপদেশ আর সহযোগিতা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তিনি তাও ভালো করেই জানেন। ভাইয়ের জায়গায় থাকলে তিনিও যে তাই করতেন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

“মোজেস তোমাকে আরো আগে কেন আনেনি তাই বুঝতে পারছি না।” খেলার ছলে মোজেসের হাতে চাপড় মারলেন আর্চার।

 “অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তি এখানে আছেন যাদের সাথে তোমার আরো আগেই দেখা হওয়াটা উচিত ছিল। এখন চলো। তোমার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিই।” হেনড্রিকের হাত ধরে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গেলেন আর্চার।

রান্নাঘরের লম্বা হলুদ কাঠের টেবিলে বসে আছেন এগারোজন লোক। পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ হলেও বাকিরা সকলে কষ্ণাঙ্গ। একেবারে তরুণ থেকে শুরু করে পকূকেশ বৃদ্ধ পর্যন্তও আছে। টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে সবার সাথে হেনড্রিককে পরিচয় করিয়ে দিল মোজেস। একেবারে মাথায় বসে আছে,

“ইনি হচ্ছেন রেভারেন্ড জন ডিউব। কিন্তু তুমি হয়ত তাকে মাফুকুজেলো নামে ডাকতে শুনেছো।”

 বিস্ময় আর শ্রদ্ধায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন হেনড্রিক।

“বাবা!” সুদর্শন বৃদ্ধ জুলুকে অভিনন্দন জানালেন হেনড্রিক। জানেন যে এই রেভারেন্ড জুল জাতির রাজনৈতিক নেতা। দ্য ম্যান অব ন্যাটাল নামক সংবাদপত্রের সম্পাদক ছাড়াও তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হল লোকটা দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশের কৃষ্ণাঙ্গ জাতিসমূহের মুখপাত্র হিসেবে একমাত্র সংগঠন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট।

 “আমি তোমাকে চিনি।” আস্তে করে জানালেন জন ডিউ, “তুমি নতুন ট্রেড ইউনিয়নের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করেছে। স্বাগতম, মাই সন।”

জন ডিউব থাকাতে রুমের বাকিদের প্রতি তেমন একটা আগ্রহ বোধ করলেন, না হেনড্রিক। যদিও মাত্র বছর বিশেকের এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকেও দেখা যাচ্ছে।

“এই হল আমাদের তরুণ লইয়ার”

“না, না! এখনো হইনি!” তাড়াতাড়ি বলে উঠল তরুণ।

“শীঘ্রই তো হবে। নিজেকে শুধরে নিল মোজেস, “ও হচ্ছে নেলসন ম্যান্ডেলা, ট্রান্সকেইয়ের প্রধান হেনরি ম্যান্ডেলার ছেলে।”

শ্বেতাঙ্গদের রীতি অনুযায়ী হেনড্রিক তরুণের সাথে করদর্শন করলেন। তারপর আইনের ছাত্রটির চোখের দিকে তাকাতেই মনে হল, “ও একটা তরুণ সিংহ।”

তবে টেবিলের শ্বেতাঙ্গরা হেনড্রিককে তেমন আকর্ষণ করতে পারল না। কেবল তাদের যেটা দেখে অবাক হল তা এই শ্বেতাঙ্গদের ভদ্রতা। এমন এক সমাজ যেখানে শ্বেতাঙ্গরা কেবল রূঢ় কণ্ঠে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে আদেশই দিতে জানে, সেখানে এদের ভদ্রতা দেখে তো চোখ উপরে উঠে যাবার জোগাড় হল। কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই তারা হেনড্রিকের সাথে হাত মেলালো। টেবিলে তাকে পাশাপাশি বসার জন্য জায়গা দিল; একই বোতল থেকে ওয়াইন ঢেলে দেয়া ছাড়াও একই প্লেটের খাবারও এগিয়ে দিল। কথা বলার সময়েও তাকে সম-মর্যাদা দিয়ে কমরেড কিংবা ভাই বলেই সম্বোধন করছে।

অন্যদিকে মার্কাস আর্চার মনে হচ্ছে রান্নাবান্নায় সিদ্ধহস্ত। কাঠের লাকড়ি দিয়ে স্টোভের ওপর বসে টইটম্বুর এমন সব সুদৃশ্য খাবার তৈরি করে আনলেন যে দেখে কিংবা খেয়ে মাছ, পাখি নাকি চারপেয়ে জন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না হেনড্রিক। অন্যরাও ভরপেট খেয়ে তারিফ করল।

মোজেস হেনড্রিককে পারতপক্ষে কথা না বলার জন্যেই উপদেশ দিয়ে এসেছে। বললেও মাত্র একটা শব্দ। অথচ অনন্যরাও কিন্তু ঠিকই শ্রদ্ধাভরে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে।

টেবিলের আলোচনায় তেমন একটা উৎসাহ পেলেন না হেনড়িক। তবে বুঝতে পারলেন যে সকলে স্পেন নিয়েই উত্তেজিত হয়ে আছে। শ্বেতাঙ্গদের দুজন আবার যত দ্রুত সম্ভব স্পেনে যাবার ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছে। অন্যরাও সাথে সাথে তাদেরকে জোর সমর্থন দিল। মনে হচ্ছে স্প্যানীয় জাতি শীঘ্রই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।

 রোববারের লম্বা সন্ধ্যাটা জুড়ে আরেকটা শব্দ বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হল আর তা হল “দ্য পার্টি” আর ধীরে ধীরে সবাই হেনড্রিকের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হয়ে উঠল। ভাগ্যিস মোজেস তাকে ডাস ক্যাপিটাল লেনিনের লেখা বিশেষ করে অন ডুয়াল অথরিটি আর হোয়াট ইজ টু বি ডান পড়তে দিয়েছিল। বৃহৎ হুজ্জত করে সে খানিকটা পড়েছে। এরপর মার্কন্স আর লেনিনের এনেশিয়াল থটসও পড়তে দিয়েছে মোজেস।

এবার সবাই যখন সরাসরি তার দিকে তাকাল হেনড্রিক বুঝতে পারল যে কোনো একটা টেস্ট হবে। ভাইয়ের দিকে তাকালেও মোজেসের অভিব্যক্তি দেখে কিছুই বুঝতে পারলেন না হেনড্রিক। আর ঠিক তক্ষুণি পরিষ্কারভাবে মার্কাস আর্চার জানালেন, “তবে কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের মাঝে স্থাপিত ট্রেড ইউনিয়ন নিজেই বিপ্লবের সফলতার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে প্রশ্নের ভাবটা স্পষ্ট আর চোখেও কৌতুকের ঝিলিক নিয়ে এমনভাবে তাকালেন যে কোথা থেকে এত সাহস পেলেন বুঝে ওঠার আগেই হেনড্রিক হুঙ্কার ছাড়লেন,

“আমার কিন্তু তা মনে হয় না।” প্রত্যাশা নিয়ে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন বাকি সবাই, “যে কোনো লড়াইয়ের ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যাবে যে ওয়ার্কারদেরকে সহায়তা না করা হলে তারা কেবল ট্রেড ইউনিয়ন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। নিজেদের শক্তি সামর্থ্য একত্রিত করে শুধু মালিকপক্ষে আর পুঁজিবাদী সরকারের বিপক্ষে লড়বে। কিন্তু নিজেদের আদর্শের প্রতি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বস্ত পেশাদার বিপ্লবী আর সামরিক কায়দার নিয়মানুবর্তিতা ব্যতীত চূড়ান্ত বিজয় অর্জন কখনোই সম্ভব নয়।”

 লেনিনের হোয়াট ইজ টুবি ডান থেকে হেনড্রিককে ইংরেজিতে উদ্ধৃতি দিতে শুনে এমনকি মোজেস পর্যন্ত মুগ্ধ চোখে তাকালেন। বাকিরাও হাসি মুখে পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। অন্যদিকে হেনড্রিক নিজে কিন্তু আবার নির্বাকের খোলসে ঢুকে পড়লেন।

 তবে এটুকুই যথেষ্ট। তাকে আর কোনো কিছুই বলতে হল না। সে রাতে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একে একে মোটরকারে চেপে সবাই যখন চলে গেল তখন আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল মোজেসের মন। বিভোনিয়া ফার্ম থেকে ভাইকে বের করে আনতে পেরেছেন।

সাউথ আফ্রিকান ক্যুনিস্ট পার্টি আর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস দু’দলেরই পূর্ণ সদস্য হয়ে গেলেন হেনড্রিক।

***

হেনড্রিকের জন্যে গেস্ট বেডরুম ঠিক করে রেখেছিলেন মার্কাস আর্চার। গত কয়েক ঘণ্টার মাঝেই রোপিত হয়ে গেছে তার ভাগ্যরেখার বীজ আর সে সাথে নির্ধারিত হয়ে গেছে জীবন-মৃত্যুর সীমানা। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লেও এক ধরনের উল্লাস আর উকণ্ঠায় ছেয়ে গেল হেনড্রিকের মন।

কিন্তু বাইরে অন্ধকার থাকতেই এসে ডেকে দিলেন মোজেস। মার্কাস নিজেও দু’ভাইয়ের সাথে হেঁটে হেঁটে ফোর্ড পর্যন্ত এলেন।

হেনড্রিকের সাথে হাত মিলিয়ে মার্কাস বললেন, “এগিয়ে চলুন কমরেড। আগামীর দিনগুলো আমাদেরই হবে।”

সোজা শহরে না এসে সুউচ্চ এক খনির নিচে গাড়ি থামালেন মোজেস। তারপর দু’ভাই মিলে খাড়া পাঁচশ ফুট পেরিয়ে উঠে এলেন একেবারে চূড়ায়। আর ঠিক তখনি দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ভোরের সূর্য। সোনালি রঙ ধারণ করল শীতের কুয়াশা।

“এখন নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছো?” ভাইয়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন মোজেস। আচমকা তার সমস্ত পরিকল্পনা একেবারে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন হেনড্রিক।

“তুমি আসলে এর কোনো অংশ চাও না, এমনকি সবচেয়ে বড় অংশটুকুও না।” দুহাত দু’পাশে ছড়িয়ে যেন গোটা দিগন্তকেই আলিঙ্গন করবেন হেনড্রিক এমনভাবে বললেন, “তুমি এর সবটুকু চাও। পুরো ভূমি আর এর সমস্ত কিছু!” বিস্ময় মাখা কণ্ঠে ভাইয়ের ঘোষণা শুনে হেসে ফেললেন মোজেস।

যাক ভাই তাহলে এবারে বুঝতে পেরেছে।

***

দুজনে চুপচাপ আবার নেমে ফোর্ডের কাছে চলে এলেন। গাড়িতেও কেউ কোনো কথা বললেন না। ড্রেকস ফার্মের কাছাকাছি এক লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়ি থামতেই শীতের সকালে ছেঁড়া কাপড় গায়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ শিশু এসে ফোর্ডের সাইড উইন্ডো দিয়ে মোজেসের দিকে বাড়িয়ে ধরল একটা ভাঁজ করা নিউজ পেপার। জানালার কাঁচ নামিয়ে বাচ্চাটার দিকে তামার মুদ্রা ছুঁড়ে দিয়েই পেপারটাকে দু’জনের মাঝখানে রেখে দিলেন মোজেস।

আগ্রহ নিয়ে ভাজ করা কাগজটা মেলে ধরলেন হেনড্রিক। হেড লাইনে লেখা :

 দক্ষিণ আফ্রিকা দল বার্লিন অলিম্পিক গেমসের জন্যে নির্বাচিত হয়েছে।
পুরো জাতির শুভ কামনা রইল তাদের প্রতি।

সংবাদের নিচে সাঁটা ছবিটাকে দেখেই ফোকলা দাঁতে হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “আমি এই শ্বেতাঙ্গ ছেলেটাকে চিনি।”

“আমিও।” মোজেসও সায় দিল। দুজনেই ছবিগুলোর লম্বা সারির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন।

***

ম্যানেফ্রেড জানে যে আংকেল ট্রম্প বহু রাত অব্দি জেগে কাজ করে। যতবার মাঝরাতে ব্লাডারের চাপে ওর ঘুম ভেঙে যায়, বাইরে আউট হাউজের পথে এলে ততবার ঘুমকাতুরে চোখে দেখতে পায় যে আংকেলের স্টাডিতে তখনো বাতি জ্বলছে।

এরকম একবার ট্রুডি আন্টির বাধাকপির বাগানের মধ্যে দিয়ে এসে জানালার শার্সির ভেতরে উঁকি দিতেই দেখা গেল যে লোমওয়ালা বিশাল এক ভালুকের মত ডেস্কে বসে আছেন আংকেল। একগাদা কাগজ যত্রতত্র এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যেন এইমাত্রই হারিকেন বয়ে গেছে ডেস্কের ওপর দিয়ে। খসখস করে কীসব যেন লিখে চলেছেন আংকেল। ম্যানফ্রেড ভেবেছিল হয়ত গির্জায় বক্তৃতা দেবার জন্য খসড়া লিখছেন। কিন্তু প্রায় দু বছর ধরে রাতের পর রাত কেন এত পরিশ্রম করছেন সেটা ভেবে দেখেনি।

তারপর একদিন সকালবেলা ধূলিমাখা পথ বেয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে এল এক কৃষ্ণাঙ্গ পোস্টম্যান : সাথে একগাদা স্ট্যাম্প আর স্টিকার লাগানো মোমের সিলওয়ালা বাদামি কাগজে মোড়ানো বিশাল এক প্যাকেট। হলের ছোট্ট টেবিলটার উপর বিশাল প্যাকেটটাকে রেখে দিলেন ট্রুডি আন্টি। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল ছেলে-মেয়ের দল। তারপর যেই না বিকেল পাঁচটায় ঘোড়া ছুটিয়ে আংকেল এলেন, সবার আগে দৌড়ে গেল সারাহ্, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “পাপা তোমার জন্য পার্সেল এসেছে।”

প্যাকেটটাকে পরীক্ষা করে জোরে জোরে লেবেল পড়ে শোনালেন আংকেল। পেছনে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। তারপর ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে মুক্তোর হাতল লাগানো পেন নাইফ বের করে ইচ্ছে করেই নাটুকে ভঙ্গিতে বুড়ো আঙুলের ডগায় ফলার ধার পরীক্ষা করে নিলেন আংকেল। অবশেষে সাবধানে প্যাকেটের দড়ি কেটে খুলে ফেললেন বাদামি মোড়ক।

 “বই!” দীর্ঘশ্বাস ফেলল সারাহ। বোঝা গেল এটা কিছুতেই আশা করেনি। তাই মেয়েরা একে একে রুম থেকে চলে গেলেও বাকি রয়ে গেল কেবল ম্যানফ্রেড।

একই বইয়ের মোটা মোটা ছয়টা কপি। লাল বোর্ডে বাঁধানো; সোনালি হরফের টাইটেল চকচক করছে। এদিকে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ম্যানফ্রেডের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করছেন আংকেল। তবে একেবারে উপরের বইটার মলাটে টাইটেল দেখে খানিকটা বিমর্ষ হয়ে গেল ম্যানিঃ দ্য আফ্রিকানার : হিজ প্লেস ইন হিস্ট্রি অ্যান্ড আফ্রিকা।

যে ভাষা এখনো তেমন সমাদৃত হয়নি সেই আফ্রিকান ভাষায় লেখা দেখে ম্যানফ্রেড বেশ অবাক হল। কারণ গুরুত্বপূর্ণ সব কিছুই সাধারণত ডাচ্ ভাষায় লেখা হয়। মুখ ফসকে কথাটা বলেও ফেলত। কিন্তু ঠিক সে সময়েই লেখকের নামের দিকে চোখ পড়তেই বিস্ময়ে বলা যায় ছানাবড়া হয়ে গেল ওর চোখ। আংকেল টুম্প।”

বিনয়ে বিগলিত হয়ে মিটিমিটি হাসলেন আংকেল।

“আপনি লিখেছেন।” গর্বে ভরে উঠল ম্যানির বুক, “আপনি একটা বই লিখেছেন।”

“ইয়েস, বাছা” বিশাল থাবা দিয়ে বইগুলো তুলে নিজের স্টাডির দিকে হাঁটা ধরলেন আংকেল। তারপর ডেস্কের ওপর জড়ো করে রাখতেই অবাক হয়ে দেখলেন যে ম্যানফ্রেডও পিছুপিছু স্টাডিতে চলে এসেছে।

“অ্যায়াম সরি, আংকেল” ম্যানফ্রেড বুঝতে পারল এভাবে আসাটা ঠিক হয়নি; জীবনে এর আগে কেবল একবারই এ রুমে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল তাও আবার আংকেলের হুকুমে “আমি আপনাকে না জিজ্ঞেস করেই চলে এসেছি। ভেতরে আসব?”

“ইতিমধ্যেই ভেতরে এসে গেছে।” খানিকটা কড়া হতে চাইলেন আংকেল, “যাই হোক, থাকো তাহলে কিছুক্ষণ।”

পেছনে হাত দিয়ে ডেস্কের পাশে এসে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। এ বাসায় এসেই লেখাপড়ার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শিখেছে ম্যানফ্রেড। জেনেছে বই হল মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

“আমি কি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?” জানতে চাইলে মাথা নাড়লেন আংকেল। আঙুল দিয়ে লেখকের নাম স্পর্শ করল ম্যানফ্রেড : “দ্য রেভারেন্ড টুম্প বিয়ারম্যান।”

তারপর একেবারে উপরের বইটাকে হাতে তুলে নিল। যদিও দুরুদুরু বুকে ভাবছে যেকোনো মুহূর্তেই হয়ত গর্জন করে উঠবেন আংকেল। যাই হোক সেরকম কিছুই হল না। পাতা উল্টে সস্তা হলদে কাগজের উপর ছাপা অক্ষরগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ম্যানি।

“আমি কি এটা পড়তে পারি? প্লিজ আংকেল ট্রম্প?” ভাবল এবার হয়ত আংকেল রেগে যাবেন। কিন্তু না; নরম স্বরে বললেন, “তুমি পড়তে চাও?” প্রথমে খানিকটা আশ্চর্য হলেও পরে হেসে ফেললেন, “ওয়েল আমি তো এ কারণেই লিখেছি, যেন লোকে এ বই পড়ে।”

তারপর আচমকা ছোঁ মেরে ম্যানফ্রেডের হাত থেকে বইটাকে কেড়ে নিয়েই ডেস্কে বসে গেলেন আংকেল। নাকের উপর চশমা বসিয়ে খুলে ফেললেন প্রথম পাতা, খসখস করে কী যেন লিখলেন অতঃপর পুনরায় নিজের লেখা পড়ে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন ম্যানির দিকে। দেখা গেল ভেতরে জ্বলজ্বল করছে।

ম্যানফ্রেড ডি লা রেকে,

এমন এক তরুণ যে কিনা ইতিহাস আর আফ্রিকার মাঝে সর্বযুগের জন্যে আমাদের জনগণের স্থান নির্ধারণে সাহায্য করবে। তোমার আংকেল।

ট্রম্প বিয়ারম্যান।

বুকের কাছে বইটাকে চেপে ধরেই দরজার কাছে পিছিয়ে এল ম্যানফ্রেড। ভয় পাচ্ছে আবার না জানি আংকেল ছোঁ মেরে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এটা আমার, সত্যিই আমার জন্যে?” ফিসফিস করে উঠল ম্যানি।

 “হ্যাঁ, এটা তোমার।” আংকেল মাথা নাড়তেই ধন্যবাদ জানাবার কথা টথা ভুলে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড।

পরপর তিন রাত ভোর পর্যন্ত জেগে থেকে কাঁধের ওপর কম্বল চাপিয়ে কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোতে পড়ে শেষ করল পুরো বই। সহজ ভাষায় লেখা পাঁচশ পাতার বইটাতে পবিত্র গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি থাকলেও নেই কোনো অহেতুক বর্ণনা কিংবা বিশেষণের বাড়াবাড়ি। হৃদয় দিয়েই এর সবটুকু অনুভব করল ম্যানি। নিজ জাতির সাহস আর বীরতে গর্ববোধ করলেও ক্ষেপে উঠল তাদের প্রতি নির্যাতন দেখে। কোলের ওপর বইটাকে রেখে কাঁপা কাঁপা ছায়ার দিকে তাকাতেই যেন দেখতে পেল তার তরুণ জাতির দুর্দশা।

ঠিক তখনই মনে হল যেন ম্যানির অন্তরের ক্ষোভ টের পেয়েছেন আংকেল আর তাই নেমে এলেন নিচে। নুড়ি পাথরের উপর শোনা গেল তার পদশব্দ। তারপর শেডের ঘরে ঢুকলেন আংকেল ট্রম্প। দরজায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ সময় নিলেন মোমবাতির আলোতে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্য। এগিয়ে এসে বসলেন ম্যানফ্রেডের পাশে।

পুরো পাঁচ মিনিট দু’জনে নিঃশব্দে বসে থাকার পর আংকেল জানতে চাইলেন,

“তুমি তাহলে পুরোটা পড়ে শেষ করেছো?”

বহুকষ্টে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল ম্যানফ্রেড, “আমার মনে হয় আজ পর্যন্ত এতটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বই লেখা হয়নি।” ফিসফিস করে বলল, “ঠিক বাইবেলের মতই গুরুত্বপূর্ণ।”

“এটা একটু বেশি হয়ে গেল বাছা” তীব্র চোখে তাকাতে গিয়েও সন্তুষ্টচিত্তে নরম হয়ে গেলেন আংকেল। আগ্রহ নিয়ে ম্যানফ্রেড বলে উঠল, “জীবনে প্রথমবারের মত বুঝলাম আমি কে আর কেনই বা এখানে আছি।”

“তার মানে আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি।” বিড়বিড় করে উঠলেন আংকেল। খানিক বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন, “বই লেখা কিন্তু খুব বেদনায়ক একটা কাজ। ঠিক যেন অন্ধকারের মাঝে একাকী বসে কাদা, যেখানে কেউ তোমাকে শুনতে পাচ্ছে না, তোমার বিষাদের উত্তরও দিচ্ছে না।”

“আমি আপনার কথা শুনেছি, আংকেল ট্রম্প।”

“ইয়েস, তুমিই শুনেছো কেবলই তুমি।”

যাই হোক, আংকেল ট্ৰম্পেরও ভুল হচ্ছে। বাইরের অন্ধকারে কান পেতে রয়েছে আরো বহুজন।

***

হঠাৎ করে গ্রামের মাঝে কোনো আগন্তুক এলে সেটা নিয়ে চারপাশে সাড়া পড়ে যায়। তারপর যদি হয় সংখ্যায় তিনজন তাহলে তো আর কথাই নেই। চারপাশে কেবল তাদের নিয়েই আলোচনা।

সাপ্তাহিক মেইল ট্রেনে চেপে দক্ষিণ থেকে এসেছে এই তিন আগন্তুক। কিন্তু বিধবা ভরসটারের বোর্ডিং হাউসে ঢোকার পর রবিবারের আগপর্যন্ত তাদেরকে আর দেখাই গেল না। অতঃপর ডাচ্ রিফর্মড চার্চের ডিকনদের মত সাদা নেষ্টাই আর কালো স্যুট পরে এসে বসল গির্জার বেদীর নিচে একেবারে সামনের সারিতে।

 বছরের পর বছর ধরে যেসব পরিবার এই বেঞ্চগুলোতে বসত তারাও কোনো উচ্চবাচ্য না করে গিয়ে বসল পেছনের দিকে।

আগন্তুকদের উপস্থিতির কথা এমনভাবে রটে গেল যে তাদেরকে ইতিমধ্যেই “তিন পন্ডিত” নাম দেয়া হয়েছে, যারা গত কয়েক বছরে গির্জার ছায়াও মাড়ায়নি তারাও কৌতূহল নিয়ে আজ এসেছে। সবশেষ কভেন্যান্ট ডে কিংবা ডিগান’স ডেতেও এত লোক কখনো গির্জায় আসেনি।

প্রার্থনা সঙ্গীতও হল অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সারাহর গান শুনল ম্যানফ্রেড। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ঘোমটার নিচেও মেয়েটাকে দেখাচ্ছে পরীর মতন। চৌদ্দ বছর বয়সেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে ওর নারীত্ব। যতবার ওর দিকে তাকায়, নিঃশ্বাসের কষ্টে ভোগে ম্যানি।

শেষ হল স্তবগান। জনাকয়েকের কাশির পর পুরোপুরি নিশ্চুপ হল চারপাশ। আর আংকেল ট্ৰম্পের বাণী পাঠ তো পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা জুড়েই বিখ্যাত। বলা যায় উইন্ডহকের চলচ্চিত্র হাউজের পরেই সেরা বিনোদন হল আংকেলের উপদেশ। আর আজ তো আংকেল চমৎকার ফুরফুরে মেজাজে আছেন। বিশেষ করে প্রথম সারিতে বসা তিন আগন্তুক যারা এ তল্লাটে এসে যাজকের সাথে দেখা করার সৌজন্যটুকু পর্যন্ত করেনি, তাদেরকে দেখে কয়েকগুণ বেড়ে গেল আংকেলের আগ্রহ।

“পাপিষ্ঠের দল।” হাত মুঠো পাকিয়ে এমন এক গর্জন ছাড়লেন যে গির্জার ছাদের কাঠে বাড়ি খেয়ে সে শব্দ আবার প্রতিধ্বনি হতেই নিজেদের চেয়ারে বসেই ঝাঁকি খেলো তিন আগন্তুক; যেন তাদের ওপর কামানের গোলা পড়েছে। “অনুশোচনাহীন পাপাচারীদের দ্বারা ভরে গেছে ঈশ্বরের গৃহ” একের পর এক বাক্যের তুবড়ি ছোটালেন আংকেল। প্রথমে ভয়ংকর সব অভিযোগ তারপর আবার বিশেষ করে কণ্ঠে মুক্তির আশ্বাস এবং সবশেষে আবারো তীক্ষ্ণ আঘাত। কয়েকজন নারী তো প্রকাশ্যেই কান্না জুড়ে দিল। অবশেষে সমস্বরে আমেন আর হাল্লেলুইয়া ও হাঁটু গেড়ে প্রতিটি আত্মার জন্য প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শেষ হল সমস্ত কিছু।

এরপর সবাই এমনভাবে হুড়মুড় করে গির্জা থেকে বেরিয়ে এল যেন ভূমিকম্প কিংবা সামুদ্রিক ঝড় থেকে বেঁচে ফিরেছে। কেউ হাসছে। কেউ নার্ভাস ভঙ্গিতে হাঁটছে। সবার শেষে বের হল সেই তিন আগন্তুক। দরজার কিনারে দাঁড়ানো আংকেলের সাথে প্রত্যেকেই আবার হাত মিলিয়ে জরুরি কী যেন আলোচনাও করে নিল।

মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনে ট্রুডি আন্টির সাথে কিছু একটা পরামর্শ করে নিলেন আংকেল ট্রম্প। তারপর লোকগুলোকে জানালেন, “আপনারা এসে আমার বাসায় বসলে আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করব।”

 অতঃপর চারজন পুরুষ বেশ ভাবগম্ভীর মুখ নিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা ধরল। খানিক দূর থেকে তাদের পিছু নিল ট্রুডি আন্টি আর ছেলে-মেয়েদের দল। মেয়েদেরকে নির্দেশ দিতেই বিশেষ দিনের জন্য গচ্ছিত রাখা পর্দা লাগিয়ে দিল ডাইনিংরুমে। সেই সাথে টেবিলে রাখা হল মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আন্টির কিচেন সেট।

তবে তিন আগন্তুক কিন্তু আন্টির রান্নার প্রশংসা করে একটুও সময় নষ্ট করল না। বরঞ্চ নিজেদের আলোচনা নিয়েই ব্যস্ত রইল। ছেলে-মেয়েরাও চুপচাপ গোল গোল চোখে তাকিয়ে খেয়ে উঠে গেল। এরপর পুরুষদের কফি পান আর ধূমপানের শেষে শুরু হল দ্বিতীয়বার প্রার্থনা।

এবার আংকেল উপদেশ দেবার জন্যে বেছে নিলেন, “ঈশ্বর বন্যতার মাঝেও তোমার জন্যে পথ খুঁজে রেখেছেন। নিজের সমস্ত পান্ডিত্য আর মেধা দিয়ে বললেও এবার কিন্তু আংকেল নিজের বই থেকেও বহু উদ্ধৃতি দিলেন। অন্যদিকে ম্যানফ্রেড খেয়াল করে দেখল যে একটু পরপরই পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করছে আগন্তুক তিনজন।

সোমবার সকালবেলাতেই দক্ষিণের মেইল ট্রেনে চড়ে গেল তিনজন। কিন্তু এরপর প্রতিটা দিন এমনকি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে সবাই কেমন যেন আশা নিয়ে প্রতীক্ষায় রইল। এমনকি আংকেল পর্যন্ত সচরাচর যে ধরনের আচরণ করেন না তাই করলেন। প্রতিদিন সকালে পোস্টম্যানের আশায় সদর দরজায় পায়চারি করেন। যত দিন যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে ততই অস্থির হয়ে উঠছেন।

এমনিভাবে তিন সপ্তাহ কেটে যাবার পর হতোদ্যম আংকেল আশা ছেড়ে দেয়ার পর অবশেষে এল সেই কাঙিক্ষত চিঠি।

হল টেবিলের উপর পড়ে থাকা চিঠির খামের ওপর গির্জার হাই মডারেটরের সীল দেখেছে ম্যানফ্রেড। কিন্তু আংকেল খামটা তুলে এস্তপায়ে স্টাডিতে গিয়ে একেবারে ওর মুখের উপর দড়াম করে লাগিয়ে দিলেন দরজা। রাতের খাবারের জন্যে পাক্কা বিশ মিনিট অপেক্ষা করলেন, ট্রুডি আন্টি। তারপর আংকেলের দেখা মিলল। সে রাতে বেড়ে গেল ঈশ্বরের স্তুতি বন্দনা। চোখ পাকিয়ে ম্যানফ্রেডকে ইশারা করল সারাহ। ভ্রুকুটি করে মেয়েটাকে সাবধান করে দিল ম্যানি। যাক! অবশেষে আমেন বললেন আংকেল। কিন্তু তারপরেও সুপের চামচ না তুলেই উজ্জ্বল মুখে তাকালেন আন্টির দিকে।

“মাই ডিয়ার ওয়াইফ” আংকেল বললেন, “এতগুলো বছর ধরে তুমি অত্যন্ত ধৈর্য ধরেছো আর কখনো কোনো অভিযোগও করোনি।”

লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন আন্টি “ছেলে-মেয়েদের সামনে কী বলছো তুমি!” কিন্তু চওড়া হল আংকেলের মুখের হাসি।

“ওরা আমাকে স্টিলেনবশে পাঠাচ্ছে।” আংকেলের ঘোষণা শুনেই সবাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে সবকটা চোখ।

কেপটাউন থেকে ত্রিশ মাইল দূরে অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রাম স্টিলেনবশ। দালানকোঠাগুলো তুষারের মত ধবধবে সাদা ডাচ স্টাইলে হোয়াট ওয়াশ করা। সতেরশ শতকে গভর্নর ভ্যান স্টেলের আদেশে লাগানো সুদৃশ্য ওকের সারিঅলা রাস্তাগুলোও বেশ চওড়া।

 ছোট্ট মফস্বলের চারপাশ জুড়ে আঙুরের ক্ষেত আর পেছনে যেন স্বর্গমত সুউচ্চ পবর্তমালা।

ছবির মত সুন্দর ছোট্ট এই শহর কিন্তু আফ্রিকাবাসীর দুর্গও বলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিগুলোও সবুজ ওকের নিচে অবস্থিত। এখানেই হল আফ্রিকান বুদ্ধিজীবীদের কেন্দ্রস্থল। ট্রম্প বিয়ারম্যান নিজেও এখানকার ছাত্র। বিখ্যাতদের সকলেই এখানকার সন্তান : লুই বোথা, হার্টজগ, জ্যা ক্রিশ্চিয়ান স্মুটস, স্টিলেনবশ থেকে আগত না হলে কেউই ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকার সরকারি পদে আসীন হতে পারবে না। দক্ষিণ আফ্রিকার অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজ হল এই স্টিলেনবশ আর এখানকার গির্জার দায়িত্ব এখন দেয়া হল ট্রম্প বিয়ারম্যানকে। এখন থেকে এই সম্মানের জোরে নিজস্ব প্রতিপত্তি খাটানোর সুযোগ পাবেন আংকেল। তিনিই হবেন স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন। সবকিছুই এখন সম্ভবপর। মডারেটরশীপ, সাইনড কাউন্সিল সবকিছু। কোনো কিছুই এখন আর অসম্ভব নয়।

“সেই বই” হাঁফ ছাড়লেন ট্রুডি আন্টি, “আমি কখনো ভাবতেই পারিনি। বুঝতে পারিনি যে”।

“হ্যাঁ, সেই বই।” মিটিমিটি হাসছেন আংকেল,

“আর ত্রিশ বছরের কঠোর পরিশ্রম। ইকবুম স্ট্রাটের বড়সড় প্রাসাদ আর বছরে এক হাজার পাব। ছেলে মেয়েদের প্রত্যেকে পৃথক রুম আর গির্জার খরচে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে। এখন থেকে আমি সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর মেধাবী তরুণদের সামনেই উপদেশ দিব। বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিলেও থাকব। আর তুমি, মাই ডিয়ার ওয়াইফ, প্রফেসর আর সরকারের মন্ত্রীদেরকেই তোমার টেবিলে পাবে। তাদের পত্নীরা তোমার সঙ্গী হবে “ আচমকা অপরাধবোধে চুপ করে গেলেন আংকেল, “এখন আমরা সবাই প্রার্থনা করব। ঈশ্বরের কাছে অহংকার আর লোভের জন্য ক্ষমা চাইব। সবাই হাঁটু গেড়ে বসো।” চিৎকার করে উঠলেন আংকেল ট্রম্প।

আবার যখন সবাই উঠে চেয়ারে বসার সুযোগ পেল ততক্ষণে পুরো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে স্যুপ।

***

দু’মাস পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব পড়ে আসা সদ্য ডমিনির হাতে এখানকার ভার বুঝিয়ে দিয়ে স্টিলেনবশ চলে গেল পুরো বিয়ারম্যান পরিবার।

বিদায়ের দিন যেন শত মাইলের মধ্যে বসবাসকারী প্রত্যেক নারী-পুরুষ আর শিশু চলে এল ওদেরকে স্টেশনে বিদায় জানাতে। এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ম্যানফ্রেড নিজেও বুঝতে পারেনি যে এদের কাছে আংকেল ট্রম্প কতটা আপন ছিলেন। নারীদের কেউ কেউ কেঁদে ফেলল। সবাই তাদের জন্যে উপহার নিয়ে এল, গির্জার স্যুট পরে এল পুরুষেরা; আংকেলের সাথে হাত মিলিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল। জ্যাম, দুধের ডেজার্ট আর এত বিলটং আনল যে পুরো এক সেনাবাহিনি খাওয়ানো যাবে।

চারদিন পরে সেন্ট্রাল কেপ টাউন রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন পরিবর্তন করল বিয়ারম্যান পরিবার। স্টিলেনবশ রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে স্বয়ং গির্জার ডিকন তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। কয়েকদিনের মাঝেই বিয়ারম্যান পরিবার উপলব্ধি করল যে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে তাদের প্রাত্যহিক জীবন।

একেবারে বলা যায় প্রথম দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করে দিল ম্যানফ্রেড। ভোরবেলা থেকে শুরু করে মাঝরাত পর্যন্ত খাটুনির পর দু’মাস শেষে বসল এক সপ্তাহের যন্ত্রণাদায়ক ভর্তি পরীক্ষাতে। তারপর রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করাটা আরো দুরূহ হল। যাই হোক, বিয়ারম্যান পরিবার থেকে বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা পড়াশোনার অভ্যাস এবারে কাজে দিল। জার্মান ভাষায় প্রথম, গণিতে তৃতীয় আর সব মিলিয়ে অষ্টম স্থান লাভ করে ভর্তি হল আইন অনুষদে।

কিন্তু বাড়ি ছেড়ে ছেলেদের হোস্টেলে উঠাতে প্রথমটাতে কঠোর আপত্তি জানিয়েছিলেন ট্রুডি আন্টি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টারকে ডেকে খানিকটা ফিনান্সিয়াল অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেবার মাধ্যমে ম্যানফ্রেডের পক্ষ নিয়েছেন আংকেল। বলেছেন, “চারপাশে মেয়ে দেখতে দেখতে ছেলেটা কোনো এক সময়ে পাগল হয়ে যাবে। তাই ওর অন্যান্য তরুণদের সাহচর্যে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন উপভোগ করা উচিত।”

 তাই পঁচিশে জানুয়ারি ছাত্রদের হোস্টেলে উঠে এলেও প্রথম কয়েকটা মিনিটের মধ্যেই দমে গেল ম্যানফ্রেডের উৎসাহ। ভাবতেও পারেনি যে নবাগতদের জন্যে পুরনো ছাত্ররা কতটা মধ্যযুগীয় বর্বর অভ্যর্থনার আয়োজন করে রাখে।

নিয়ম করে দেয়া হল যে নতুনদের কেউ বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে কথা তো দূরের ব্যাপার সোজাসুজি তাকাতেও পারবে না। তাহলেই গলায় সেক্স ম্যানিয়াকের সাইন বোর্ড ঝুলবে। প্রতিটি কাজে কেবল সিনিয়র ছাত্র নয় এমনকি জড় বস্তুরও অনুমতি নিতে হবে। যেমন হে মহান দরজা আমি কি আপনার মধ্যে দিয়ে যেতে পারি কিংবা টয়লেট মহাশয় এই অধম আপনার উপর বসার অনুমতি চাইছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখানেই শেষ নয়; প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় রুমে রেইড দেয় সিনিয়র ছাত্ররা। বিছানাপত্র সব মেঝেতে ফেলে পানি ঢেলে দেয়। ড্রয়ার থেকে সবকিছু বের করে ভেজা কম্বলের উপর রেখে দেয়। ফলে কাঁপতে কাঁপতে নতুন ছাত্র বেচারাদেরকে বেডরুমের বাইরের প্যাসেজের শূন্য টাইলসের উপর ঘুমাতে হয়। এর উপরে আবার সবচেয়ে সিনিয়র অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রুলফ স্ট্যান্ডার তার হাউজ কমিটিকে নিয়ে আসে কক্ষ পরিদর্শনের জন্য।

ইন্সপেকশন শেষে নবীনদের শাস্তি হয় এক ঘণ্টার মাঝে রুম ঝকঝকে করে রুট মার্চে যাওয়া।

যার মানে হল কেবল আন্ডারপ্যান্ট পরে মাখায় বালিশ নিয়ে ঘুমন্ত শহরের রাস্তায় হাঁটা। বালিশটা একটা দড়ি দিয়ে গলার সাথে লাগানো থাকে আর হাত দুটোও পিছমোড়া করে বেঁধে দেয়া হয়। পুনরায় হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে বেজে যায় ভোর চারটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম লেকচার শুরু হয় সকাল সাতটায়। বেশিরভাগ সময় নাশতা করারও ফুরসৎ মেলে না।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ছেলেদের এসব ছেলেমানুষীতে নাক গলায় না। ম্যানফ্রেডও এ সম্পর্কে শুনেছে কিন্তু ভাবতেও পারেনি যে মজাদার অত্যাচারের নিষ্ঠুরতা এতটা ভয়াবহ হবে। একবার তো একটা ছেলে সইতে না পেরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়েই ফেরেনি। প্রসঙ্গটাও সবাই ভুলে যায়।

 শারীরিকভাবে সুদর্শন আর বড়সড় হওয়ায় ম্যানফ্রেড প্রথম থেকেই বড় ভাইদের সুনজরে পড়ে যায়। দাঁতে দাঁত ঠেকিয়ে সমস্ত কিছু সহ্য করে যায় ম্যানি। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহে দেখা গেল কমন রুমের বোর্ডে পিন দিয়ে লাগানো নোটিশ লেখা হয়েছে :

নতুনদের সবাইকে শনিবার বিকেল চারটায় বিশ্ববিদ্যালয় জিমেনেশিয়ামে বক্সিং স্কোয়াডে অংশ নেয়ার জন্য উপস্থিত হতে হবে।

রুলফ স্ট্যান্ডার

 বক্সিং ক্যাপ্টেন

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলই কোনো না কোনো খেলার জন্য বিখ্যাত। তেমনি ম্যানফ্রেডের হল রেস্ট এন্ড পিস হল বক্সিংয়ের আখড়া। তাছাড়া আংকেল ট্রম্প নিজেও এখানকার বাসিন্দা ছিলেন বলে ম্যানডেও এখানেই আসতে চেয়েছে।

নির্দিষ্ট সময়ানুযায়ী জিসনেশিয়ামে আসতেই দেখা গেল জড়ো হয়েছে তিনশ’ দর্শক। সিনিয়র এক ছাত্র এসে সামরিক কায়দায় মিছিমিছি সার বেঁধে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে টেনিস, শর্ট আর ভেস্ট পরালো। তারপর উচ্চতা অনুযায়ী লকারের সামনে দাঁড়াতে হল।

 রুলফ স্ট্যান্ডার এসে মিলিয়ে দেখল তার হাতে রাখা তালিকা। বোঝ গেল গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সবাইকে খেয়াল করে যার যার গুণগুলোও আবিষ্কার করে রেখেছে। সবচেয়ে লম্বা ম্যানফ্রেড লাইনের সবার শেষে থাকায় ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল রুলফ।

ম্যানফ্রেডকে এমনিতেই বাছাই করে রেখেছে। তাই জানতে চাইল,

“আগে কখনো বক্সিং খেলেছো?” কিন্তু ম্যানির উত্তর শুনে কালো করে ফেলল মুখ।

“কখনো ম্যাচ খেলিনি স্যার। কিন্তু কিছু প্র্যাকটিস আছে।”

১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক গেমসে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যে দল যাবে, তার অন্যতম বাছাই হল রুলফ স্ট্যান্ডার। তাই ম্যানফ্রেডের কথা শুনে সিনিয়র ছাত্ররাসহ সবাই হেসে ফেলল। যাই হোক রুল উত্তরে জানাল, “অল রাইট, আমরা ফ্লাইওয়ে দিয়ে শুরু করব।” তারপর সবাইকে হটিয়ে জিমনেশিয়ামে নিয়ে এল।

হলের শেষ মাথার লম্বা একটা বেঞ্চে নবীনদেরকে বসতে দেয়া হল। যদিও সেখান থেকে রিংয়ের তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সামনের সারিতে ভালো জায়গাগুলো দখল করল রুলফ আর তার দল।

এরই ফাঁকে ম্যানফ্রেডের নজরে এল সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে কে যেন ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তাড়াতাড়ি সিনিয়রদের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। না, ওরা রিং নিয়েই ব্যস্ত। তাই প্রথমবারের মত সরাসরি মেয়েটার দিকে তাকাল ম্যানি।

ভুলেই গিয়েছিল যে সারাহ কতটা সুন্দর। আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে যেন আরো সুন্দরী হয়ে গেছে। উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে ওর গাল। চকচকে চোখে লেসের রুমাল নিয়ে হাত নাড়ল ম্যানফ্রেডের উদ্দেশে।

হাব-ভাবে কিছুই প্রকাশ না করে কেবল চোখ টিপে ছিল ম্যানফ্রেড। দুহাতে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে ধপ করে আংকেল ট্ৰম্পের বিশালাকার দেহের পাশে বসে গেল সারাহ।

“ওরা দুজনেই এসেছে!” যারপরনাই খুশি হয়ে উঠল ম্যানফ্রেড। এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত বুঝতেই পারেনি যে গত কয়েক সপ্তাহ কতটা একাকিতে কেটেছে। আংকেল ট্রম্পও মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। এমনভাবে হাসলেন যে কালো দাড়ি ভেদ করে ফুটে উঠল ঝকঝকে সাদা দাঁত।

শুরু হল প্রথম পালা : দু’জন নবীন খেলা শুরু করতেই খানিক বাদে ক্যানভাসে দেখা গেল রক্তের ছিটে। তাই দ্বিতীয় দফায় খেলা বন্ধ করে দিল রুলফ। তারপর পরাজিত ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “ওয়েল ডান। যাই হোক হেরে যাওয়াতে কোনো লজ্জা নেই।”

এরপর একের পর এক ছাত্ররা এল। সকলেই চাইল সেরাটা দিতে। কিন্তু বোঝা গেল তারা কতটা আনাড়ি।

অবশেষে ম্যানফ্রেড একাই রয়ে গেল বেঞ্চে।

“অল রাইট, দেখা যাক এবার তুমি কী করতে পারো।” ওর হাতে গ্লাভস পরিয়ে দিল এক সিনিয়র। কাধ থেকে তোয়ালে ফেলে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। আর ঠিক তখনি চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে এল রুলফ ট্যান্ডার। গ্লাভস পরিহিত দু’হাত তুলে সহাস্যে দর্শকদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, আমাদের শেষ প্রতিযোগিতার জন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকাতে আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমিই তার সাথে বক্সিং করতে চাই।”

হুল্লোড় তুলল হলভর্তি দর্শক। কেউ কেউ বলল, “ওর সাথে একটু সদয় আচরণ করো রুলফ।” “বেচারাকে মেরে ফেলো না যেন” ইত্যাদি ইত্যাদি। হাত নেড়ে সবাইকে আশ্বস্ত করল রুলফ। আগ্রহ নিয়ে তাকাল মেয়েদের দিকে। তারাও ছয় ফুট লম্বা সুদর্শন রুলকে দেখে সমানে কিচির-মিচির করছে।

 সামনের সারির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে আড়চোখে সারাহ্ আর আংকেলের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড।

“ওকে হারিয়ে দিও, ম্যানি। নিজের সিটে বসে চিৎকার করে উঠল সারাহ। উত্তেজনায় একবার বসছে, একবার উঠছে। পাশে থেকে আংকেলও মাথা নাড়লেন, “মাম্বার মতই দ্রুত, বাছা! র‍্যাটেলের মত সাহস নিয়ে। তবে আংকেলের মৃদু শব্দগুলো কেবল ম্যানিই শুনল। চিবুক তুলে রিংয়ে ঢুকতেই মনে হল নতুন উদ্যমে হালকা হয়ে গেছে দুটো পা।

রেফারির দায়িত্ব পালন করছে আরো এক সিনিয়র ছাত্র : এই কর্নারে আছেন একশ পঁচাশি পাউন্ড ওজনে ধারী কেপ অব গুড হোপ অ্যামেচার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন রুলফ স্ট্যান্ডার। আর এই কর্নারে আছে একশ তিয়াত্তর পাউন্ড ওজনের নবীন ম্যানফ্রেড ডি লা রে।”

 নিজের কর্নারে দাঁড়িয়ে হালকা পায়ে নাচছে রুলফ। তারপর পরস্পরের পাশে চক্রাকারে ঘুরতে গিয়ে হেসেও ফেলল। খানিক বাদেই অবশ্য উবে গেল তার হাসি।

সামনের প্রতিদ্বন্দ্বীর চেহারায় কোনো ভীরুতার আভাসমাত্র নেই। পেশিবহুল কাঁধের ওপর সোনালি চুলের মাথা বসানো ম্যানফ্রেডের মেঘের উপর ভেসে বেড়ানো পা দুটোতে ভয়ের লেশ বলতে কিছু নেই।

“ও একটা যোদ্ধা!” রেগে উঠল রুলফ। “আমাকে মিথ্যে বলেছে, ভালোভাবেই জানে ও কী করছে।” এরপর চেষ্টা করল রিংয়ের মাঝখানে চলে যেতে কিন্তু ম্যানফ্রেড বিপজ্জনকভাবে বাম পাশে চলে আসায় সরে আসতে বাধ্য হল রুলফ।

দু’জনের একজনও এখন পর্যন্ত কোনো ঘুষি ছোড়েনি। কিন্তু নীরব হয়ে গেল সমস্ত দর্শক। সকলেই বুঝতে পারছে যে অন্য রকম একটা কিছু ঘটতে চলেছে আজ। স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখল বদলে গেছে রুফের গা ছাড়া ভাব, ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ওর পা। যারা ওকে চেনে দেখতে পেল রুলফের মুখ আর চোখের কোণে দুশ্চিন্তার রেখা।

টেস্টিং শট হিসেবে বাম পাশে ঘুষি চালাল রুলফ। অপরজন কিন্তু মাখা কেকানোর কষ্টটুকুও করল না। বরঞ্চ গ্লাভস দিয়ে উদ্ধৃতভাবে ঠেকিয়ে দিল রুলফের আক্রমণ। প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তির আঁচ পেয়ে রীতিমত চমকে উঠল রুলফ। সোজা গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ম্যানফ্রেডের চোখের দিকে। এটাও তার একটা কৌশল। আই কন্ট্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানো।

কিন্তু ছেলেটার টোপাজ কিংবা হলুদ স্যাফায়ারের মত অদ্ভুত হালকা রঙা চোখ দুটো দেখে রুলফের মনে পড়ে গেল তাদের খামারবাড়ির উপরকার পাহাড় থেকে বাবার সাথে ফাঁদ পেতে ধরা শাবকখেকো চিতা বাঘের চোখ দুটোর কথা। এই ছেলেটার চোখ দুটোও ঠিক সেরকম। এখন তো আবার বদল হয়ে গেল দুর্ভেদ্য শীতল সোনালি এক রঙ।

রুলফ স্ট্যান্ডারের বুক যে ভয়ে ধুকপুক করে উঠল তা নয় বরঞ্চ কেমন যেন ভয়ংকর বিপদের পূর্বাভাসে শঙ্কিত হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে রিংয়ে ওর সাথে একটা জানোয়ার খেলছে। চোখ দুটোতে ঝিলিক দিচ্ছে হত্যা করার ক্ষুধা। আর তাই ইচ্ছে করেই আঘাত হানল রুলফ।

 বাম হাত দিয়ে হলুদ চোখ দুটো বরাবর মারল ঘুষি। কিন্তু শূন্যে আঘাত হানল ওর গ্লাভস। মরিয়া হয়ে ভারসাম্য রক্ষায় বাম কনুই তুলতেই মনে হল কিছু একটা যেন ওকে ফালাফালা করে দিল। বুঝতেই পারল না কখন ঘুষি খেল। আগে আর কখনোই এমনটা বোধ করেনি। মনে হচ্ছে বুকের পাজরগুলো ভেঙেচুড়ে ফুসফুস ফেটে গিয়ে বের হয়ে গেল সব বাতাস। গলা দিয়ে কেবল এক ধরনের হিশহিশ আর্তনাদের শব্দ বের হচ্ছে।

 ধাক্কা খেয়ে পিছনের দড়ির ওপর পড়তেই রশি তাকে পাথরের গুলতির মত ছুঁড়ে মারল সামনের দিকে। মনে হচ্ছে যেন সময়ও থেমে গেছে; নেশাখোরের মত আচ্ছন্ন হয়ে গেছে চোখের দৃষ্টি। কিন্তু এইবার মুঠিটাকে ঠিকই দেখতে পেল। মনে হল গ্লাভসের ভেতরে কোনো মাংস কিংবা হাড় নয় লোহা ঢুকানো হয়েছে। থেতলে গেল ওর মাংস। কিন্তু রুলফ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সরে যাবার সাধ্যটুকুও নেই। এবারের আঘাতটা হল আরো মারাত্মক, কল্পনাও করতে পারবে না এতটা অবিশ্বাস্য। কোমরের নিচ থেকে যেন মোমের মত গলে গেল দুটো পা।

ইচ্ছে হল গলা ছেড়ে চিৎকার করে; কিন্তু প্রচণ্ড কষ্ট সত্ত্বেও গিলে ফেলল কান্না! মন চাইল আরেকটা ঘুষি আসার আগেই নিচে নেমে যায়। কিন্তু দড়ি দুটো আবার তাকে সামনে ছুঁড়ে পাঠাল।

হাত দুটো দুপাশে ঝুলে পড়ল। অসহায় চোখে দেখল এগিয়ে আসছে আরেকটা ঘুসি। নিজের সমস্ত ওজন নিয়ে মেঝেতে মুখ ডুবিয়ে ধপ করে পড়ে গেল রুলফ। ঠিক যেন একটা মৃত লাশ। সাদা ক্যানভাসের উপর উপুড় হয়ে পড়ে রইল নিথর রুলফ স্ট্যান্ডার।

সেকেন্ডের মাঝেই শেষ হয়ে গেল সমস্ত কিছু। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল দর্শকের দল। পরাভূত শরীরটা ঘিরে এখনো দুলকি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ম্যানফ্রেড। চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে সেই অদ্ভুত হলুদ আলো। ঠিক যেন কোন মানুষ নয়; হত্যার নেশায় মত্ত কোনো জানোয়ার।

এরপর হঠাৎ করেই ভিড়ের মধ্য থেকে মেয়ে কন্ঠের চিৎকারের সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল তুমুল হৈচৈ। বিস্ময়ে আনন্দ ধ্বনি তুলে ছুটে এল ছেলেদের দল। রিংয়ের দড়ির কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যানফ্রেডের কাঁধে, হাঁটুর কিনারে। কয়েকজনে আবার তুলে নিল রক্তাক্ত রুলফের দেহ।

অন্যদিকে মেয়েরা এতটাই অবাক হয়ে গেছে যে সাদা হয়ে গেছে সবার চোখ-মুখ। আনন্দ আর আতঙ্কে অনেকে তখনো চিৎকার করছে। বকের মত গলা বাড়িয়ে দেখল রুলফের রক্তমাখা গাল আর ভেজা চুল, আবার তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকাল তরুণীদের দল। সিনিয়রদের সাথে চেঞ্জিং রুমে চলে যাচ্ছে ম্যানফ্রেড। ভয় আর আতংক ভুলে কেউ কেউ যেন শারীরিক আকর্ষণও অনুভব করল। এর ভেতরে একজন আবার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছুঁয়ে দিল ম্যানফ্রেডের কাঁধ।

হাত ধরে সারাহকে শান্ত করলেন আংকেল ট্র। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে চলে এলেন বাইরে।

“ও এত অসাধারণ খেলেছে, এত দ্রুত, এত সুন্দর, ওহ, আংকেল ট্রম্প, আমি আমার জীবনে এরকম আর কিছু কখনোই দেখিনি। তাই না?”

মনে মনে একমত হলেও মুখে কিছুই বললেন না আংকেল ট্রম্প। সারা পথ বকবক করতে করতে বাসায় ফিরল সারাহ। কেবল সদরের সিঁড়িগুলোর একেবারে মাথায় উঠে পিছনে তাকিয়ে আংকেল জানালেন, “ওর জীবনটাই বদলে গেল আজ থেকে। সেই সাথে আমাদেরও।” বিড়বিড় করে বললেন, “ঈশ্বরের কাছে শুধু একটুকুই প্রার্থনা যে, আজ যা ঘটল তার জন্য যেন আমাদের কাউকেই অনুশোচনা করতে না হয়। কারণ আমিই এর জন্য দায়ী।”

***

আরো তিনদিন চলল নবীন বরণের নামে অত্যাচার। এ সময়টুকুতেও সঙ্গী নতুন ছাত্র ছাড়া আর কারো সাথে ঝামেলায় গেল না ম্যানফ্রেড। তাদের কাছে তো বলা যায় ও রীতিমত হিরো হয়ে গেছে।

তবে শেষ রাত হল সত্যিই ভয়াবহ। চোখ বেঁধে সবাইকে সরু একটা দন্ডের ওপর মাথার ওপর বালতি নিয়ে বসিয়ে রাখা হল সারারাত। আর যখন ইচ্ছে তখন এসে বালতির গায়ে কোদালের কোপ মারত সিনিয়র কোনো ভাই। সে রাতটা মনে হল বুঝি শেষই হবে না। যাই হোক, ভোরবেলা চোখের পট্টি খুলে বালতিগুলো সরিয়ে নেয়া হল। আর সবার উদ্দেশে বক্তৃতা দিল রুলফ স্ট্যান্ডার।

“মহোদয় সকল!” সবাই চোখ পিটির পিটির করে তাকাল। বিশ্বাসই হচ্ছে না যে স্ট্যান্ডার এত ভালো সমোধন করছে। যাই হোক, ঘুমের অভাবে আর বালতির বাড়ির চোটে নতুনেরা এমনিতেই যেন কানে কম শুনছে। স্ট্যান্ডার আবারো বলল, মহোদয় সকল, তোমাদেরকে নিয়ে আমরা গর্বিত, আমি এখানে আসার পর থেকে যতগুলো নবীন দল পেয়েছি তাদের মাঝে তোমরাই হলে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমরা যা বলেছি বিনা বাক্যব্যয়ে তোমরা তাই করেছ। ওয়েলকাম টু রেস্ট অ্যান্ড পিস। এই হল এখন তোমাদের আর আমরা তোমাদের ভ্রাতা।” আর তার পরই ঘুরে ঘুরে নতুন সকলের সাথে পিঠ চাপড়ে আলিঙ্গন করল সিনিয়র ছাত্ররা।

 “চলো সবাই! পাবে যাব। আমরা বিয়ার খাওয়াবো।” রুলফ স্ট্যান্ডারের হাঁক শুনে মার্চ করতে করতে সবাই শহরের পুরনো ড্রসডি হোটেলে চলে এল।

নির্ঘুম শরীরে মদের ছোঁয়া পেতেই হালকা হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের মাথা। বার কাউন্টারে বসে মনের আনন্দে হাসছে এমন সময় কী যেন মনে হতেই ঘুরে তাকালো পিছনে।

দু’ভাগ হয়ে গেছে চারপাশের ভিড়। একেবারে মাঝখান দিয়ে থমথমে মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে রুলফ স্ট্যান্ডার। ম্যানফ্রেডের হার্ট বিট বেড়ে গেল। রিংয়ের সেই লড়াইয়ের পর আজ আবার তারা যে রিংয়ে নামছে বুঝতে একটুও কষ্ট হল না। খালি বিয়ারের মগ নামিয়ে তাকালো বাকিদের দিকে। সবারই চোখে-মুখে শঙ্কা।

একেবারে ম্যানফ্রেডের সামনে এসে থেমে গেল রুলফ। চারপাশ থেকে এগিয়ে এল নবীন আর সিনিয়র ছাত্রের দল। কেউ একটা শব্দও যেন মিস করতে চায় না। উদ্বেগে যেন নিঃশ্বাস ফেলার কথাও ভুলে গেছে সকলে।

 “আমি দুইটা কাজ করতে চাই।” ঘোঁতঘোত করে উঠল রুলফ স্ট্যান্ডার। ম্যানফ্রেড ঢোঁক গিলতেই হাসিমুখে ডান হাত বাড়িয়ে দিল রুলফল।

“প্রথমত, তোমার সাথে হাত মেলানো আর দ্বিতীয়ত তোমার বিয়ারের বিল মেটানো। ঈশ্বরের কসম ম্যানি, তোমার মত ঘুষি এর আগে আমাকে আর কেউ দেয়নি।” হাসির হুল্লোড় উঠল চারপাশে। সেই থেকে বন্ধু হয়ে গেল সবাই।

তবে সবকিছু এখানেই শেষ হবার কথা থাকলেও শেষ হল না। চতুর্থ বর্ষের ছাত্রের দল, সিনিয়র আর বক্সিং ক্যাপ্টেন ও নবীনদের মাঝে তখনো একটা বিভেদ রয়েই গেছে। পরের দিন সন্ধ্যায় ডিনারের ঘণ্টাখানেক আগে ম্যানির দরজায় কে যেন নক করল। দরজা খুলতেই অ্যাকাডেমিক গাউন আর হুড পরে ভেতরে ঢুকেই আর্মচেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল রুলফ। ম্যানির ডেস্কে পা তুলে দিয়ে সহজ সুরে বক্সিং আইন আর দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার ভূগোল নিয়ে আলোচনা করে গেল ঘণ্টা না বাজা পর্যন্ত। তারপর যাওয়ার আগে জানাল, “কাল সকালে ভোর পাঁচটায় তোমাকে ডেকে দিব। দুই সপ্তাহ পরে আই কিদের সাথে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ আছে। এদিকে ম্যানির বিস্ময় দেখে বলল, “ইয়েস ম্যানি, তুমিও স্কোয়াডে আছো।”

এরপর থেকে দেখা গেল প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় ডিনারের আগে গাউনের নিচে বিয়ার নিয়ে ম্যানির রুমে আসে রুলফ। এমনিভাবে গাঢ় হল দু’জনের বন্ধুতু।

 বাকিদের মাঝে বেড়ে গেল ম্যানির মর্যাদা আর দু’সপ্তাহ পরে আই কি দলের সাথে ফোর ওয়েট ডিভিশন ম্যাচে প্রথমবারের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে রঙের ফোয়ারা ছোটাল ম্যানি। আই কি হল কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিক নেইম যাদের সাথে স্টিলেনবশের পুরনো শত্রুতা আছে। আই কিরা ইংরেজি ভাষী আর স্টিলেনবশ যার নিক নেইম ম্যাটিস তারা আফ্রিকান ভাষায় কথা বলে। দু’পক্ষে শত্রুতা এতটাই ঐতিহ্যবাহী যে ত্রিশ মাইল দূর থেকে বাস ভর্তি লোক এল এ ম্যাচ দেখতে।

ম্যানির প্রতিদ্বন্দ্বী হল লরি কিং, যে কিনা গত চল্লিশ অ্যামেচার ম্যাচের ভেতরে একবারও হারেনি। অথচ ম্যানফ্রেড ডি লা রের নাম কেউ শোনেনি এর আগে।

কিন্তু লরি কিং শুনেছে আর তাই সিরিয়াস হয়েই খেলেছে। প্রথম রাউন্ডের পুরোটা সময় চেষ্টা করেছে সরে সরে থাকতে। আর এই ফাঁকে ম্যানফ্রেডকে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ছেলেটা দ্রুত হলেও যতটা শুনেছে অতটা বিপজ্জনক নয়। মাথার বাম পাশে লাগাতে পারলেই ঘায়েল করতে পারবে। কিন্তু এই থিওরি টেস্ট করতে গিয়েই সব সর্বনাশ হয়ে গেল। লরি দেখল কেবল একজোড়া ভয়ংকর হলদেটে চোখ তপ্ত দুপুরের কালাহারি সূর্যের মত ওর মুখের উপর জ্বলছে। আর তারপরেই গালের চামড়া ছিঁড়ে রিং বোর্ডের উপরে মাথা ঠুকে পড়ে গেল লরি। ঘুষিটা যে কোথা দিয়ে এল দেখতেও পেল না। দ্বিতীয় রাউন্ডে আর খেলতে পারল না লরি। মাতালের মত টলতে টলতে আরেকজনের কাঁধে ভর দিয়ে চল গেল ড্রেসিংরুমে।

সামনের সারিতে বসে আহত মদ্দা ষাড়ের মত সমানে চিৎকার করছেন আংকেল ট্রম্প। অন্যদিকে আনন্দ আর উত্তেজনায় হাপুস নয়নে কাঁদছে সারাহ।

পরের দিন সকালবেলা আফ্রিকান সংবাদপত্র “দ্য সিটিজেন” পত্রিকায় ছাপা হল “কালাহারির সিংহ” ম্যানফ্রেড কেবল জেনারেল জ্যাকোবাস হারকিউলিস ডি লা রের গ্রেট ভ্রাতুস্পুত্রই নয়, বক্সিং চ্যাম্পিয়ন আর লেখক, স্টিলেনবশের বর্তমান ফাদার রেভারেন্ড ট্রম্প বিয়ারম্যানেরও আত্মীয়।

রুলফ স্ট্যান্ডার আর পুরো বক্সিং স্কোয়াড বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাতে ম্যানেফ্রেডের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই ও সোসিওলজির লেকচার শেষে বের হয়ে আসতেই সবাই মিলে ওকে ঘিরে ধরল।

“তুমি তো আমাদেরকে আচ্ছা বোকা বানিয়েছ ম্যানি” ভয়ংকর স্বরে জানাল রুলফ, “কখনো বলোওনি যে ট্রম্প বিয়াম্যান তোমার আংকেল। খোদার কসম ম্যান, উনি পাঁচ বছর ধরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। স্ল্যাটার আর ব্ল্যাক জ্যাপথা তো উনার হাতেই কাবু হয়েছিল।”

“বলিনি নাকি?” কপট চিন্তার ভাঁজ ফেলল কপালে ম্যানি। “বোধ হয় খেয়াল ছিল না।”

“ম্যানি, এখন উনার সাথে তাহলে পরিচয় করিয়ে দাও।” কাতর অনুনয় জানাল ভাইস ক্যাপ্টেন। “আমরা সবাই উনার সাথে দেখা করতে চাই, প্লিজ ম্যান প্লিজ।”

 “তোমার কী মনে হয়? উনি আমাদের টিমের কোচ হতে রাজি হবেন? তুমি একবার জিজ্ঞেস করবে আর যদি ট্রম্প বিয়ারম্যান আমাদের কোচ হন তো” কথাটার সম্ভাবনায় বিভোর হয়ে চুপ করে গেল রুলফ।

“আমি বলি কি” সাজেশন দিল ম্যানি, “যদি রবিবারের সকালবেলার উপাসনায় তুমি বক্সিং দলকে নিয়ে গির্জায় আসতে পারো তাহলে দেখবে আন্টি নির্ঘাৎ লাঞ্চে দাওয়াত করবেন। আর আমার ট্রুডি আন্টির রান্না তো খাওনি।”

 যেই কথা সেই কাজ। দাড়ি কামিয়ে চুল আঁচড়ে, নিজেদের সেরা পোশাকটা পরে গির্জায় হাজির হয়ে গেল পুরো বক্সিং স্কোয়াড। স্তবগানের সময় তো ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গেল ওদের হুঙ্কার।

লাঞ্চটাকে নিজের রন্ধন বিদ্যার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন আন্টি। সারা সপ্তাহ জুড়ে মেয়েদেরকে নিয়ে ডিনার প্রস্তুত করলেন। অন্যদিকে সপ্তাহের পর সপ্তাহে হোস্টেলের সাদামাটা খাবার খেয়ে বিরক্ত হয়ে যাওয়া একদল তরতাজা তরুণ তো মনোযোগের ভাগ-বাটোয়ারা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেল। একদিকে লম্বা টেবিলের মাথায় বসে স্মৃতিচারণ করছেন স্বয়ং ট্রম্প বিয়ারম্যান; অন্যদিকে কিচির-মিচির করছে আন্টির সুন্দরী মেয়েরাও; এদিকে আবার টেবিল উপচে পড়ছে অত্যন্ত সুস্বাদু সব রোস্ট, পুডিং আর বিভিন্ন খাবার।

খাওয়া শেষে আস্ত হরিণ গিলে ফেলা পাইথনের মত ফোলা পেট নিয়ে উঠে দাঁড়াল রুলফ। পুরো টিমের পক্ষ থেকে ধন্যবাদের বক্তৃতা দিতে গিয়ে আংকেলকে অনুনয় করল যেন তিনি তাদের কোচের দায়িত্ব নেন।

 প্রথমে পুরো চিন্তাটাকেই হাসি মেরে উড়িয়ে দিলেন আংকেল। কিন্তু ছেলেদের সম্মিলিত একের পর এক কারণ দেখিয়েও পার পেলেন না। সমস্ত বাহানা খারিজ করে দিল বক্সিং স্কোয়াড। আর শেষপর্যন্ত তাই রাজি না হয়ে পারলেন না ট্রম্প বিয়ারম্যান। তবে উল্লসিত ছাত্রদের সাথে করমর্দন করতে গিয়ে এটাও মনে করিয়ে দিলেন যে, “তোমরা নিজেরাই কিন্তু নিজেদের খাল খুঁড়লে, বুঝেছ? কিছু কিছু বাক্য তো আমি একদম শুনতে পারি না, যেমন : আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, যথেষ্ট হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।” বোঝা যাচ্ছে আংকেল নিজেও কতটা আনন্দিত হয়েছেন।

অতঃপর ভরপেট খেয়েদেয়ে সন্ধ্যাবেলা একসাথে হলে ফিরে এল ম্যানি আর রুলফ। সারাটা পথ কেন যেন রুলফ একটাও কথা বলেনি। কেবল মেইন গেইটের কাছে এসে বলল,

“ম্যানি, একটা কথা বলো তো, তোমার কাজিন, ওর বয়স কত?

“কোন জন?” আগ্রহ না দেখিয়েই জানতে চাইল ম্যানি। “মোটাটা, গারট্রড আর ব্রণ মুখেরটা রেনাটা” “না! না, ম্যানি, বেকুবের মত কথা বলো নয়া” ওকে থামিয়ে দিল রুলফ। “নীল নয়না যে সুন্দরী যার মাথাভর্তি সিল্কি সোনালি চুল। ওকেই আমি বিয়ে করব।”

সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেড মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

“আর কক্ষনো একথা বলবে না। কেঁপে উঠল ম্যানির গলা। রুলফের জ্যাকেট চেপে ধরে বলল,

 “তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি কিন্তু। সারাহ্ সম্পর্কে এরকম আর বললে সিধে মেরে ফেলব।”

মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরেই ম্যানফ্রেডের মাথা থাকায় ভয়ংকর হলুদ চোখ জোড়াতে জ্বলে ওঠা খুনের নেশা স্পষ্ট দেখতে পেল রুলফ। বলল,

 “হেই ম্যানি, কী হয়েছে? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। তুমি কী পাগল হয়ে গেছ? আমি কক্ষনো সারাহকে অপমান করব না।”

ম্যানফ্রেডের চোখ থেকে আস্তে আস্তে দূর হয়ে গেল হলদেটে আগুন। রুলফকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “ও তো একটা বাচ্চা মেয়ে। এভাবে বলাটা তোমার উচিত হয়নি ম্যান।”

 “বাচ্চা মেয়ে?” অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হেসে উঠেই জ্যাকেট ঠিক করে নিল রুলফ। অন্ধের মত কথা বলো না ম্যানি। ও বাচ্চা মেয়ে নয়। ও হল সবচেয়ে সুন্দরী, কিন্তু ঝড়ের বেগে গেইট পার হয়ে ভেতরে ঢুকে গেল খ্যাপা মানি।

“তার মানে ব্যাপারটা তাহলে এই বন্ধু!” ফিসফিস করে উঠল রুলফ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত দুটো পকেটে ভরে হাঁটা ধরতেই মনে পড়ল খাওয়ার সময় কেমন করে ম্যানির পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সারাহ। হঠাৎ করেই খানিকটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলেও নিজেকেই প্রবোধ দিল রুলফ, “এখনো হাজার হাজার সুন্দরী রুলফ স্ট্যান্ডারকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে বুঝলে!” কাঁধ ঝাঁকিয়ে ম্যানির পিছু পিছু গেইটের ভেতরে ঢুকে পড়ল রুলফ।

***

এরপর টানা বারোটা ম্যাচ জিতে গেল ম্যানফ্রেড। প্রতিটাই নক আউট, তৃতীয় রাউন্ডের মাঝেই খেলা শেষ। স্পোর্টস রাইটার সবাই একবাক্যে মেনে নিল ওই হল কালাহারির সিংহ। কিন্তু আংকেল ট্রম্প কপট বকুনির মাধ্যমে বললেন,

“অল রাইট, বাছা, যত পারো জিতে নাও। কিন্তু মনে রেখো তুমি কিন্তু চিরকাল তরুণ থাকবে না। শেষপর্যন্ত কিন্তু মানুষের পেশি কিংবা মুঠি নয়, মাথাটাই ঠিকে থাকে। এ কথাটা কক্ষনো ভুলে যেও না।” তাই ট্রেনিং সেশনের মত পড়াশোনাতেও সমান মাত্রায় মনোযোগ ঢেলে দিল ম্যানি।

কদিন বাদেই দেখা গেল মাতৃভাষা আফ্রিকানের মত করেই গড়গড় করে জার্মান বলতে পারছে। অন্যদিকে বাধ্য না হলে ইংরেজি বলতে চায় না। একই সাথে রোমান ডাচ ল’কে সবদিক থেকে যুক্তিযুক্ত মনে হল।

বক্সিংয়ের সুবাদে স্টিলেনবশ ক্যাম্পাসে রীতিমত তারকা বনে গেল ম্যানফ্রেড। প্রফেসরদের কেউ কেউও তাই বিশেষ খাতির করে মাঝে-মধ্যে। তবে দু’একজন আবার প্রথমে ম্যানফ্রেডের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পরে তারাও বুঝতে পারেন যে ছেলেটা আসলে একেবারে গাধা নয়। এরকমই একজন প্রফেসর হলেন ডা. হেনড্রিক ভারউড। এক শনিবার রাতে যখন ম্যানফ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইট হেভিওয়েট টাইটেল জিতে গেল তখন জিমনেশিয়ামের দ্বিতীয় সারিতেই বসেছিলেন প্রফেসর। তিনি এই প্রথমবারের মত রাগবি ফুটবল ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অ্যাথলেটিক টুর্নামেন্ট দেখলেন।

এর কয়েকদিন পরেই হিস্ট্রি অব লিবারেলিজম নিয়ে লেখা তাঁর পেপার নিয়ে আলোচনা করার জন্য ম্যানফ্রেডকে ডেকে পাঠালেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন দুজনে। তারপর বের হবার উদ্দেশে দরজার কাছে এগোতেই ম্যানফ্রেডকে থামিয়ে দিয়ে প্রফেসর বললেন, “দেখো এই বইটা হয়ত তুমি এর আগে আর পড়োনি।” ম্যানিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “যতদিন ইচ্ছে তোমার কাছে রাখো। কিন্তু পড়া শেষে আমাকে তোমার মতামত জানিয়ে যাবে।”

পরের লেকচার ধরার জন্যে ম্যানফ্রেড এত তাড়াহুড়া করছিল যে টাইটেলটাও পড়ে দেখেনি। নিজের রুমে এসে ডেস্কের উপর ছুঁড়ে ফেলল বই। অন্যদিকে সন্ধ্যাবেলায় রুলফ চলে আসাতে মাঝরাতে পাজামা বদলে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারে ভারারও ফুরসত পায়নি।

সে সময়ই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল বইটা। টাইটেল দেখে মনে পড়ল এটার কথা আগেও শুনেছে। পুরোটাই জার্মান ভাষায় লেখা। এরপর ভোরবেলা পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঘরে না আসা পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে কেবল পড়েই গেল। অবশেষে শেষ হল পুরো বই। আরো একবার টাইটেলটাকে পড়ে নিল ম্যানফ্রেড : মাইন ক্যাম্প, লেখক অ্যাডলফ হিটলার।

দিনের বাকি সময়টুকু কেমন যেন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে গেল। লাঞ্চের সময় হুড়োহুড়ি করে আবার রুমে ফিরে এল বইটা পড়ার জন্যে। লেখক যেন সোজা ওর সাথেই নিজের জার্মান আর আর্য রক্ত নিয়ে কথা বলছেন। অদ্ভুত হলেও মনে হল এ বইটা বুঝি কেবল ওর জন্যই লেখা হয়েছে।

.

সুনিপুণভাবে লেখক তার আফ্রিকান রক্তের ওপর এমনভাবে আলো ফেললেন যে সেই পাতাটা পড়তে গিয়ে রীতিমত হুহু করে কেঁদে উঠল ম্যানফ্রেডের হৃদয়।

নিগ্রোদেরকে ইহুদিরাই রাইনল্যান্ডে নিয়ে এসেছে। যেটির পরিষ্কার উদ্দেশ্য আর গোপন চিন্তা ছিল ঘূণ্য শ্বেতাঙ্গ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া।

কেঁপে উঠল ম্যানফ্রেড। আফ্রিকাতে আসার পর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এভাবেই কেঁদে আসছে ওর জাতি।

বক্সিং রিংয়ে ও কখনো এতটা নিস্তেজ হয়ে পড়েনি। বইটাকে শেষ করে এতটাই বিধ্বস্ত অনুভব করল ম্যানফ্রেড। এ সময়ে যাওয়াটা সমীচীন মনে না হলেও দৌড়ে প্রফেসরের কাছে চলে এল ম্যানফ্রেড। এরপর দুজনে মিলে মাঝরাত অব্দি আলোচনা করল।

পরের দিন উচ্চপদস্থ আরেকজনের কাছে সুপারিশ করলেন প্রফেসর : “আমি এমন একজনকে পেয়েছি যে কিনা আমাদের তরুণদের উপরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম আর ভবিষ্যতের জন্য এক মহামূল্যবান অস্ত্র।

এক গোপন সংগঠনের হাই কাউন্সিলের কাছে চলে গেল ম্যানফ্রেডের নাম :

“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একজন। রেস্ট অ্যান্ড পিসের সিনিয়র ছাত্রের সাথেও ওর ভালো যোগসাজশ আছে”

“ওকে রিক্রুট করে নাও।” অর্ডার দিলেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।

***

সপ্তাহে পাঁচদিন ম্যানফ্রেড আর রুলফ একত্রে খাঁড়া আর সুউচ্চ পর্বতগাত্রের মাঝে ট্রেনিং করে। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় পা ফেলাটাও অসম্ভব দুষ্করই বলা চলে। তারপর পাঁচ মাইল এগোবার পরে শ্বেতশুভ্র এক ঝরনার পানি পান করে দু’জন। রুলফ খেয়াল করে দেখেছে যে, ম্যানফ্রেড পিচ্ছিল আর ভেজা পাথরের উপর হাঁটু গেড়ে বসে দুহাত কাপের মত বানিয়ে পান করে পরিষ্কার শীতল পানি।

“ওকে নির্বাচন করাটা সত্যিই ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে।” মনে মনে সুপিরিয়রদের সাথে একমত হল রুলফ। পরনের হালকা ভেস্ট আর শর্টস ভেদ করেও দেখা যাচ্ছে ম্যানফ্রেডের শক্তিশালী কিন্তু কমনীয় শরীর। আর তামাটে চুলগুলো ছাড়াও ছেলেটার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে ধারাল অংশ হল ওর সোনালি রঙা টোপাজের ন্যায় চোখ দুটো। এমনকি এই তরুণের আত্মবিশ্বাস দেখে রুলফ নিজেও অভিভূত।

“ও একজন অসাধারণ নেতা হবে। ঠিক আমরা যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি।”

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। হাত দিয়ে মুখ থেকে মুছে ফেলল পানির ছিটে।

“চলো তাহলে। বাসায় ফিরতে হবে।”

 কিন্তু রুলফ ওকে থামিয়ে দিলো, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

ভ্রূ কুঁচকে তাকাল ম্যানফ্রেড। “ওই, আমরা তো সারাক্ষণই কথা বলছি। এছাড়া আর কিছু করি নাকি? যাই হোক, এখানে কেন?”

“কারণ অন্য কেউ আড়ি পাততে পারবে না। আর তুমি ভুল বলেছে ম্যানি, আমাদের কেউ কেউ শুধু কথা বলা ছাড়াও অনেক কিছু করছে। আমরা আসলে তোমার যে ধরনের লড়াই পছন্দ, সেই অ্যাকশনের জন্য তৈরি হচ্ছি।”

ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা রুলফের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। “কে? কোন অ্যাকশন?” মাথা নাড়ল রুলফ।

“দেশপ্রেমিক একদল গোপন আফ্রিকান, আমাদের লোকদের নেতা, যারা এ জাতির সরকার, শিক্ষা আর বাণিজ্যিক উচ্চপদগুলোতে বসে আছেন। তাঁরা ম্যানি, আর তারা কেবল আজকের নয় ম্যানি, আগামীকালকেরও যেমন তুমি আর আমি এরাই।”

 “গোপন কোনো সংগঠন?” খানিকটা পিছিয়ে গেল ম্যানি। “না, ম্যানি তার চেয়েও বেশি। গোপন এক সেনাবাহিনি আমাদের ভাগ্য বিড়ম্বিত জনগণের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত আছে। নিজ দেশের মাহাত্ম ফিরিয়ে আনার জন্য মরতেও পিছপা হবে না।”

কথাগুলো শোনার সাথে সাথে অজানা এক শিহরণে সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেডের হাত আর ঘাড়ের লোম। তাই উত্তরটাও এল সাথে সাথে। “সৈন্যদল, ম্যানি।” বলে চলল রুলফ।

“তুমিও কী তাদের একজন রুলফ?” জানতে চাইল ম্যানি। “ইয়েস আর তুমিও। তুমি আমাদের সুপ্রিম কাউন্সিলের নজর কেড়েছে। তাই আমাকে বলা হয়েছে যেন আমাদের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণী এ লড়াইয়ে তোমাকে নিমন্ত্রণ জানাই।”

“কে আমাদের নেতা? এই গোপন সেনাবাহিনির নামইবা কী?”

“জানবে। বিশ্বস্ত থাকার শপথ নেয়ার পর তোমাকে সবকিছু বলা হবে।” হাত বাড়িয়ে ম্যানির পেশিবহুল বাইসেপ ধরল রুলফ।

“তুমি কী এ দায়িত্ব পালনে সম্মত আছ? আমাদের সাথে যোগ দিতে চাও ম্যানফ্রেড ডি লা রে? আমাদের ইউনিফর্ম পরে একসারিতে যুদ্ধ করবে?”

একদিকে সন্দিহান হয়ে উঠল ম্যানফ্রেডের শিরায় শিরায় বয়ে চলা ডাচ রক্ত। অন্যদিকে তার ভেতরকার জার্মানিক অংশ আধুনিক কালের টিউটোনিক নাইটস, ভয়ংকর একদল যোদ্ধা সংগঠনের অংশ হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। নিজের অজান্তেই তার ফরাসি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে মিলিটারি জাঁকজমক, ইউনিফর্ম আর ঈগলের প্রতি ভালোবাসা।

তাই বাড়িয়ে দিলো হাত, রুলফের কাঁধ ছুঁয়ে কমরেডসুলভ গভীর দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দেখল দুই বন্ধু। “সমস্ত হৃদয় দিয়ে নরম স্বরে জানাল ম্যানফ্রেড, “আমি তোমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য প্রস্তুত আছি।”

***

পূর্ণিমার আলোতে ভেসে যাচ্ছে স্টিলেনবশ পর্বতমালা। দক্ষিণে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ গ্রেট ক্রস। এরই নিচে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গোপন সংগঠনের নেতারা। সবার হাতে জ্বলন্ত মশাল। জায়গাটা লোকচক্ষুর খানিক অন্তরালে থাকায় তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পুরোপুরি আদর্শ। গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তিনশ’ সৈন্য। ঢালু পেরিয়ে বনের ভিতর ফাঁকা জায়গাটাতে জেনারেলের কাছে এগিয়ে এল একদল নতুন রিক্রুট। সবার আগে নেতাদের নজরে পড়ল ম্যানফ্রেড ডি লা রে, কালো শার্ট, চকচকে রাইডিং বুট জুতা পরিহিত ছেলেটার মাথা খালি; বেল্টের খাপে কেবল একটা ড্যাগার।

এগিয়ে এসে ম্যানফ্রেডের এক পা সামনে দাঁড়াল হাই কমান্ডার। লম্বা চওড়া সুদর্শন লোকটার শক্ত চোয়াল আর কালো শার্টের নিচে মোটাসোটা পেটের আভাস পাওয়া গেলেও চওড়া কাঁধ দুটো নির্দ্বিধায় যে কোনো দায়িত্ব সামলানোর জন্য উপযুক্ত।

দেখার সাথে সাথে লোকটাকে চিনে ফেলল ম্যানফ্রেড, জাতীয় সংবাদপত্রের রাজনীতির পাতায় এ চেহারা সে বহুবার দেখেছে। প্রভিন্সিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে তার প্রভাব প্রতিপত্তিও বিশাল।

“ম্যানফ্রেড ডি লা রে” শক্তিশালী কণ্ঠে জানতে চাইলেন কমান্ডার, “তুমি কী রক্তশপথ নিতে প্রস্তুত আছো?”

“আমি প্রস্তুত আছি।” পরিষ্কার কণ্ঠে জানিয়ে রুপালি ড্যাগারটাকে বের করে নিল ম্যানি।

পেছনের সারি থেকে বেরিয়ে এল পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরিহিত রুলফ স্ট্যান্ডার। নিজের হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে নল ঠেকালো ম্যানফ্রেডের বুকে। কিন্তু একটুও নড়ল না ম্যানি। জানে এটাও শপথ অনুষ্ঠানের অঙ্গ। এর মানে। হল ম্যানফ্রেড যদি কখনো ওর শপথ ভঙ্গ করে তাহলে রুলফ তাকে মেরে ফেলবে।

এরপর ম্যানফ্রেডের হাতে চামড়ার থলে তুলে দিলেন কমান্ডার। যেটির মাথায় জ্বলজ্বল করছে সংগঠনের প্রতীক। নিচে শপথবাক্য, এক হাতে থলে ধরে অন্য হাতে নিজ বুকে ছুরি ধরল ম্যানফ্রেড। এর মানে হল ভ্রাতৃসংঘের আদর্শের জন্য নিজের জীবন দান করে দিল।

“সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আর আমার কমরেডদের সম্মুখে জোরে জোরে উচ্চারণ করল ম্যানি “নিজেকে আমি জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সঁপে দিলাম। শপথ নিলাম যে সুপিরিয়রদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আর যদি কমরেডদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি তাহলে যেন আমার উপর প্রতিশোধ নেয়া হয়। কমরেডদের উদ্দেশে তাই ঘোষণা করছি যে,

সামনে এগিয়ে গেলে
আমাকে অনুসরণ করো
পিছু হটে এলে
আমাকে মেরে ফেল
মারা গেলে আমার প্রতিশোধ নিও
তাই আমাকে সাহায্য করো
হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর!”

কব্জির উপর রুপালি ফলাটাকে ঢুকিয়ে দিলো ম্যানফ্রেড। গাঢ় লাল রঙা ফিনকি ছোটা রক্তে মশালের আলোয় ভিজিয়ে নিল চামড়ার পার্চমেন্ট।

এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল হাই কমান্ডার। পেছন থেকে হর্ষধ্বনি দিলো পুরো দল। পাশে দাঁড়িয়ে সোড় করা পিস্তল হোলস্টারে ঢুকিয়ে ফেলল রুলফ স্ট্যান্ডার। গর্বের অশ্রুতে ভরে উঠেছে ওর চোখের পাতা। কমান্ডার পিছিয়ে যেতেই দৌড়ে এসে ধরে ফেলল ম্যানির ডান হাত। রুদ্ধস্বরে ফিসফিস করে জানাল, “মাই ব্রাদার, এবারে আমরা সত্যিকারের ভাই হলাম।”

***

নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ইয়ার এন্ডের পরীক্ষা দিতে বসল ম্যানফ্রেড। ফলাফলে দেখা গেল একশ’ তেপ্পান্ন জনের মাঝে তৃতীয় হয়েছে।

 রেজাল্টের তিনদিন বাদে কোচকে সাথে নিয়ে স্টিলেনবশ বক্সিং স্কোয়াড ইন্টার ভার্সিটি চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিতে শহর ছাড়ল। এবারের ভেন্য হল জোহানেসবার্গের উইট ওয়াটারস্ট্রান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্রেনে চেপে হাজার পথ পাড়ি দিবে স্টিলেনবশ দল। তাই রেলওয়ে স্টেশনে এসে হাসি-আনন্দের গান গেয়ে তাদেরকে বিদায় জানাল ছাত্র আর ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের দল।

ট্রুডি আন্টি আর মেয়েদেরকে কিস করে বিদায় নিলেন আংকেল ট্রম্প। একই সাথে ম্যানফ্রেড। রঙিন ব্লেজারে লম্বা-চওড়া ম্যানিকে এত সুন্দর লাগছে যে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারল না সারাহ্! সবার সামনে কেঁদে ফেলল।

“কেমন বাচ্চা মেয়েদের মত করছে দেখো” খসখস কণ্ঠে গলা জড়িয়ে থাকা সারাহর কানে কানে জানাল ম্যানি। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওর নিজেরও কেমন অদ্ভুত একটা ফাঁকা অনুভূতি হচ্ছে।

“ওহ, ম্যানি, তুমি এত দূরে চলে যাচ্ছ” ম্যানির ঘাড়ে চোখের পানি লুকাতে চাইল সারাহ্, “এর আগে তো আমরা আর কখনো এতটা দূরে যাইনি।”

“চুপ করো, বান্দরী, সবাই তোমাকে দেখছে।” সারাহকে মৃদু বকুনি দিলো ম্যানি, “আমাকে কিস্ করো এখন, তাহলে ফেরার সময় গিট আনব।”

“আমি কোনো উপহার চাই না। শুধু তোমাকে চাই।” নাক টানল সারাহ। তারপর মুখ উঁচু করে ম্যানিকে কিস করল। সাথে সাথে কী যে হল। নেচে উঠল ম্যানফ্রেডের সমস্ত শরীর। যেন বুকের ভেতরে দামামা বাজছে। মাথা পর্যন্ত ভরে উঠল অন্যরকম এক মাদকতায়। বুঝতে পারল নিজের শরীর তার সাথে বিশ্বাসঘাকতা করতে চাইছে। তাই ঝট করে সারাহকে দূরে সরিয়ে দিয়েই হনহন করে হেঁটে উঠে গেল কোচের ব্যালকনিতে।

এদিকে কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সারাহ্। হাত দুটো তখনো বাড়িয়ে রেখেছে। আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে পর্বতের দিকে ছুটল ট্রেন।

অবশেষে সামনের এক বাঁকের মাথায় গিয়ে মেয়েটা চোখের আড়াল হতেই জানালা থেকে মাথা ক্যারিজের ভেতরে ঢুকিয়ে নিল ম্যানফ্রেড। ঘুরতেই দেখল সবকটা দাঁত বের করে হাসছে রুলফ স্ট্যান্ডার। খানিকটা অপরাধীর ভঙ্গিতে ঘোঁতঘোঁত করে উঠল ম্যানি “মুখ বন্ধ করো হোঁতকা কোথাকার!”

***

পুরো দশদিন ধরে চলল আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা। প্রতিজন প্রতিযোগীকে দুদিন করে লড়তে হল।

 নিজের ডিভিশনে ম্যানফ্রেডের নাম্বার হল দ্বিতীয়। যার মানে হল ওকে সম্ভবত ফাইনাল রাউন্ডে চ্যাম্পিয়নস বেল্টের জন্য খেলতে হবে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন উইটওয়াটার স্নান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যস্নাতক এক প্রকৌশলের ছাত্র। নিজের খেলোয়াড় জীবনে কখনোই না-হারা ছেলেটা অলিম্পিকের জন্য সম্ভাব্য পছন্দ হয়ে আছে।

“উল্কার মত ঊর্ধ্বগতির ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত কঠিন এক পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছে কালাহারির সিংহ। ও কি পারবে নিজের ইমেজ বজায় রাখতে? সবার মুখে মুখে এখন কেবল এই এক প্রশ্ন আর এর উত্তর আমাদেরকে কেবল ইয়ান রাশমোরই দিতে পারে।” লিখেছে র‍্যান্ড ডেইলি মেইলের বক্সিং সংবাদদাতা।

একেবারে বিনা কষ্টে নিজের প্রথম দুই দফা জিতে নিল ম্যানফ্রেড। প্রতিদ্বন্দ্বীরা ওর খ্যাতিতে আগে থাকতেই খানিকটা কাবু হয়েছিল। তাই বুধবারে ম্যানফ্রেডকে বিশ্রামের জন্য সময় দেয়া হল।

এই দিনে অন্য কেউ জাগার আগেই হল থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড। জোহানেসবাগের সকালের ট্রেনটা ধরার জন্য নাশতাও করল না। খোলা তৃণভূমির ওপর দিয়ে প্রায় এক ঘন্টা ভ্রমণ করতে হবে।

প্রিটোরিয়া স্টেশনে নেমে হালকা কিছু খেয়ে নিয়েই পায়ে হেঁটে চলল সেন্ট্রাল জেলখানার দিকে।

কদর্য চেহারার চারকোনা দালানটার অন্দরসজ্জাও বাজে। বন্দিদের এখানেই ফাঁসি হয়। যারা যাবজ্জীবনের সাজা ভোগ করছে তাদের জীবনও এখানেই কেটে যায়।

ভিজিটরের ডেস্কে গিয়ে গোমড়ামুখো সিনিয়র ওয়ার্ডারের সাথে কথা বলে আবেদন ফরম পূরণ করল ম্যানফ্রেড।

 “বন্দির সাথে সম্পর্ক” প্রশ্নটা দেখে প্রথমে দ্বিধায় ভুগলেও একটুক্ষণ বাদেই বড় বড় অক্ষরে লিখল, “পুত্র।”

ওয়ার্ডারের দিকে ফরমটা বাড়িয়ে দিতেই পড়ে নিয়ে মনোযোগ সহকারে ম্যানফ্রেডকে দেখল সিনিয়র লোকটা। তারপর বলল, “এত বছরে তার কাছে কখনোই কোনো ভিজিটর আসেনি।”

“আমি আগে আসতে পারিনি” সাফাই গাইল ম্যানি, কারণ কিছু সমস্যা ছিল।”

“সবাই তাই বলে।” হঠাৎ করেই সূক্ষ্ম একটু পরিবর্তন এল ওয়ার্ডারের চেহারায়, “তুমি তো বক্সার তাই না?”

“হুম তাই।” মাথা নেড়ে ওবি’র গোপন সংকেত দিলো ম্যানফ্রেড। বিস্মিত চোখ জোড়া অবশ্য সাথে সাথেই ফরমের উপর নামিয়ে নিল ওয়ার্ডার।

“ঠিক আছে, বসো ও তৈরি হলে তোমাকে ডাকব।” তারপর কাউন্টারের উপর থেকে খানিকটা লুকিয়ে পাল্টা একটা সংকেত দিলো।

 “শনিবার রাতে ওই বাঞ্চোতটাকে মেরে ফেলো।” ফিসফিস করে জানিয়েই ঘুরে গেল ওয়ার্ডার। আশ্চর্য হলেও খুশি মনে ভ্রাতৃসংঘের বিস্তৃতির পরিধি নিয়ে ভাবল ম্যানি।

দশ মিনিট পরেই ওয়ার্ডার এসে সবুজ রঙা একটা সেলে নিয়ে গেল ওকে। সেলের অনেক উপরে একটা খোলা জানালা। সাধারণ একটা টেবিল আর তিনটা চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। একটা চেয়ারে অচেনা এক লোককে দেখে অবাক হয়ে গেল ম্যানফ্রেড।

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল লোকটা। বয়স আর কঠিন পরিশ্রমের ভাবে নজ মানুষটার ভাজ খাওয়া চামড়ায় অসংখ্য বলিরেখা আর রোদে পোড়া দাগ। খুলির সাথে লেপ্টে আছে তুলার মত চুল। বর্ণহীন চোখ দুটোতে কান্নার জল।

“পাপা?” অবিশ্বাস নিয়ে বাবার কাটা হাতের জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইল ম্যানডে। নিঃশব্দে কেঁদে ফেললেন লোথার।

“পাপা!” প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল ম্যানফ্রেড, “ওরা তোমার সাথে কী করেছে?”

ওয়ার্ডারের চোখ এড়িয়ে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল ম্যানফ্রেড।

“পাপা! পাপা!” খসখসে ইউনিফর্মের নিচে বাবা পাতলা কাঁধ দুটোতে হাত বুলিয়ে দিলো ম্যানির। তারপর নিঃশব্দে অনুনয় নিয়ে তাকাল ওয়ার্ডারের দিকে।

 “আমি তোমাদেরকে একা রেখে যেতে পারব না।” বুঝতে পারলেও মাথা নাড়ল ওয়াডার। “এটাই নিয়ম।”

“প্লিজ” ফিসফিস করে উঠল ম্যানফ্রেড।

“ভাই হিসেবে তাহলে প্রতিজ্ঞা করো যে সে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে নয়া?”

“কথা দিলাম!” উত্তরে জানাল ম্যানফ্রেড।

“দশ মিনিট। এর বেশি আর সময় দিতে পারব না।” যাবার সময় সবুজ স্টিলের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো ওয়ার্ডার।

 “পাপা, আস্তে করে কাঁপতে থাকা লোথারকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পাশেই হাঁটু গেড়ে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড।

 খোলা হাতের তালু দিয়ে ভেজা গাল মুছে নিলেন লোথার ডি লা রে। হাসতে চেষ্টা করলেও কেঁপে উঠল গলা, “দেখো কেমন বুড়িদের মত ফ্যাচফ্যাচ করছি। আসলে তোমাকে দেখে চমকে গেছি। এখন ঠিক আছি। এবার দেখি, তোমার মুখখানা একটু দেখতে দাও।”

গভীর আগ্রহ নিয়ে একদৃষ্টে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন লোথার, “তুমি কত বড় হয়ে গেছে, শক্তিশালী আর সুগঠিত। তোমার বয়সে আমিও ঠিক এরকম ছিলাম।” আঙুল দিয়ে ম্যানফ্রেডকে ছুঁয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা হাত দুটোর চামড়া ঠিক হাঙ্গরের চামড়ার মতই কর্কশ।

“তোমার কথা আমি শুনেছি বেটা। ওরা আমাকে অন্তত সংবাদপত্রটা পড়তে দেয়। তোমার সম্পর্কে লেখা সবকিছু আমি কেটে আমার ম্যাট্রেসের নিচে রেখে দিয়েছি। আই অ্যাম সো প্রাউড অব ইউ। এ জায়গার সবাই আমরা তোমাকে নিয়ে সত্যিই গর্বিত।”

“পাপা! ওরা তোমার সাথে কেমন আচরণ করে?” বাবাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।

“ফাইন, ম্যানি, ফাইন।” নিচের দিকে তাকালেন লোথার। হতাশায় বেঁকে গেল তার ঠোঁট দুটো। “যাবজ্জীবন আসলে অনেক দীর্ঘ একটা সময়। অনেক দীর্ঘ ম্যানি। মাঝে মাঝেই মরুভূমি, হঠাৎ ধোয়ার মত উধাও হয়ে যাওয়া দিগন্ত আর খোলা আকাশের কথা মনে পড়ে।” হঠাৎ কথা থামিয়ে হাসার চেষ্টা করেই বললেন, “আর ভাবি তোমার কথা, প্রতিদিন। এমন কোনো দিন নেই যেদিন প্রার্থনা করি না যে, “হে, ঈশ্বর, আমার ছেলেক দেখে রেখো।”

 “না, পাপা প্লিজ।” কাতর স্বরে জানালো ম্যানফ্রেড। “এভাবে বলল না। তাহলে আমিও কেঁদে ফেলব।” উঠে দাঁড়িয়ে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাবার কাছে এসে বসে বলল, “প্রতিদিন আমিও তোমার কথা ভাবি, বাবা। তোমাকে চিঠি লিখতেও মন চায়। আংকেল ট্ৰম্পের সাথে কথাও বলেছি। কিন্তু উনি বলেছেন এই ভালো যে “

হাত ধরে ছেলেকে থামিয়ে দিলেন লোথার, “হ্যাঁ, ম্যানি। এই ভালো। ট্রম্প বিয়ারম্যান অনেক বুদ্ধিমান। উনি সত্যিই জানেন যে কিসে ভালো হবে।” ছেলেকে আশ্বস্ত করার জন্য হেসে বললেন, “তুমি কত লম্বা হয়ে গেছে। চুলের রঙটাও ঠিক আমার মতই পেয়েছে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বুঝলে। এখন বলল জীবন নিয়ে তোমার প্ল্যান কী? তাড়াতাড়ি করো। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।”

“আমি স্টিলেনবশে ল’ নিয়ে পড়ছি। প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছি।”

 “ওহ, ওয়াও, মাই সান। তারপর?”

“আমি এখনো জানি না পাপা, কিন্তু মনে হয় দেশের জন্য যুদ্ধ করা উচিত। আমার মনে হয় আমাদের লোকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই আমার ডাক এসেছে।”

 “রাজনীতি?” জানতে চাইলেন লোথার। ম্যানফ্রেড মাথা নাড়লে বললেন, “পথটা অনেক কঠিন। বহু গলিগুজি আছে। আমি অবশ্য সবসময় সোজা পথ পছন্দ করতাম। একটা ঘোড়া আর হাতে রাইফেল। অবশ্য দেখো সে পথ আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। কষ্টের হাসি হাসলেন লোথার ডি লা রে।

 “আমিও লড়ব পাপা। যখন সঠিক সময় আসবে আর ময়দানও আমিই বেছে নিব।”

 “ওহ, মাই সান। ইতিহাস আমাদের লোকদের সাথে অনেক নির্দয় আচরণ করেছে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় এভাবেই বুঝি সবকিছু শেষ হবে।”

“ভুল বলছো পাপা!” শক্ত হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের চেহারা।

“আমাদের দিনও আসবে। এরই মাঝে ভোরও হয়ে গেছে। আর বেশি দিন এভাবে মুখ বুজে থাকতে হবে না।” মন চাইল বাবাকে খুলে বলে, কিন্তু রক্তশপথের কথা স্মরণ করে চুপ করে গেল।

 “ম্যানি” কাছে ঝুঁকে এলেন লোথার; সাবধানে সেলের চারপাশে তাকিয়ে ম্যানফ্রেডের শার্টের হাতা খামচে ধরে জানতে চাইলেন, “হিরেগুলো এখনো তোমার কাছে আছে?” সাথে সাথে ছেলের চেহারায় উত্তরটাও পেয়ে গেলেন।

“কী হয়েছে তাহলে?” সত্যিই মন খারাপ করে ফেললেন লোথার। “আমি কেবল তোমাকে ওগুলোই দিয়েছি। কোথায় রেখেছো?”

“আংকেল ট্রম্প বহু বছর আগে খুঁজে পেয়ে আমাকে দিয়ে পাথরগুলো ভাঙ্গিয়েছেন।”

ভেঙে ফেলেছেন?” হা হয়ে গেলেন লোথার।

 “ওগুলো নাকি শয়তানি কয়েন বলেই হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলতে আমাকে বাধ্য করেছেন। পুরো গুড়ো হয়ে গেছে সবগুলো।”

পুরনো দিনের মতই বাবার ক্রোধ জ্বলে উঠতে দেখল ম্যানফ্রেড। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে সেলের মধ্যে পায়চারি শুরু করলেন লোথার। “ট্রম্প বিয়ারম্যান, তোমাকে যদি হাতের কাছে পেতাম এখন! সবসময় এরকম মাথামোটা গর্দভ ছিলে” থেমে গিয়ে আবার ছেলের কাছে ফিরে এলেন।

 “ম্যানি, এখানট বাকিগুলো কিন্তু আছে। মনে আছে না সেই যে কোপজে, মরুভূমির পাহাড়? ওখানে তোমার জন্য রেখে এসেছি। তুমি গিয়ে নিয়ে আসবে।”

 মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। এত বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে মন থেকে যেন সেই স্মৃতি মুছে যায়। এর সাথে জড়িয়ে আছে দুঃখ, আতঙ্ক আর অপরাধবোধ। জীবনের সে অধ্যায়টাকে পুরো বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টায় অবশেষে সফল হলেও আজ বাবার কথায় আবার তেতো হয়ে গেল যেন গলার ভেতরটা।

“আমি ফেরার রাস্তা ভুলে গেছি পাপা। আর কখনোই ওখানে যেতে পারবো না।”

ছেলের হাত ধরে ঝাঁকি দিলেন লোথার। “হেনড্রিক।”

বিড়বিড় করে বললেন, “সোয়ার্ট হেনড্রিক! ও জানে সে তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।”

“হেনড্রিক” চোখ পিটপিট করে তাকাল ম্যানফ্রেড। অতীত থেকে ছিটকে এল ভুলে যাওয়া একটা নাম, তারপর হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশাল টাক আর কালো কামানের গোলার মত মাথা। “হেনড্রিক, কিন্তু সে তো চলে গেছে। কোথায় তাও জানি না। কখনো আর দেখা হয়নি।”

“না! না! ম্যানি। হেনড্রিক উইটওয়াটারস্লভের আশপাশেই কোথাও আছে। ও এখন অনেক প্রভাবশালী হয়ে গেছে। নিজের গোত্রের প্রধান।”

“তুমি কীভাবে জানো, পাপা?”

“আঙুর ক্ষেত। এখানে আমরা সব খবরই পাই। ওরা বাইরে থেকে সব ধরনের খবর আর সংবাদ নিয়ে আসে। হেনড্রিক সেভাবেই আমাকেও খবর পাঠিয়েছে। আমাকে এখনো ভোলেনি। আমরা দুজন তো কমরেড ছিলাম। একসাথে দশ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শত শত যুদ্ধ করেছি। জানিয়েছে যদি এই দেয়ালগুলো পার হতে পারি তাহলে ওর সাথে দেখা করার জন্য জায়গাও ঠিক করে দিবে।” এরপর সামনে ঝুঁকে ছেলের মাথাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “তুমি গিয়ে ওকে খুঁজে বার করো। ওই তোমাকে ওকাভাঙ্গো নদীর তীরের গ্রানাইটের পাহাড়ে নিয়ে যাবে আর ওহ, ঈশ্বর, তোমার সাথে আবার মরুভূমিতে যেতে পারলে আমি কী যে খুশি হতাম।”

সেই মুহূর্তেই তালায় ঝনঝন শব্দ শোনা গেল। মরিয়া হয়ে ছেলের হাতে ঝাঁকুনি দিলেন লোথার। “আমার কাছে প্রমিজ করো যে তুমি যাবে ম্যানি।”

“পাপা, ওই পাথরগুলো সত্যিই ভালো না।”

 “প্রমিজ করো, মাই সান, এতগুলো বছর ধরে আমি শুধু শুধু বন্দি থেকে কষ্ট করিনি; তুমি গিয়ে পাথরগুলো আনবে।”

“আই প্রমিজ, পাপা।” ওয়ার্ডার ভেতরে ঢুকতেই ফিসফিস করল ম্যানি।

“সময় শেষ। আমি দুঃখিত।”

 “আমি কি কাল এসে আবার বাবার সাথে দেখা করতে পারব?”

মাথা নাড়ল ওয়ার্ডার। “মাসে মাত্র একবার।”

“আমি তোমাকে চিঠি লিখব পাপা।” পিছু ফিরে পাপাকে জড়িয়ে ধরল ম্যানফ্রেড, “এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে তোমাকে চিঠি লিখব।”

অভিব্যক্তিহীনভাবে মাথা নাড়লেন লোথার; চোখ বন্ধ করে কোনো রকমে বললেন, “ঠিক আছে। মাঝে মাঝে চিঠি লিখো।” তারপরই সেল থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।

একদৃষ্টে সবুজ বদ্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। ওয়ার্ডার এসে ওর কাধ স্পর্শ করে বলল, “চলো।” গেইট দিয়ে দিনের আলোতে বেরিয়ে আসার পর সুউচ্চ নীল আফ্রিকান আকাশটাকে দেখে মনে পড়ল বাবার ইচ্ছেগুলোর কথা।

আর ঠিক তখনই এক ধরনের অন্ধ রাগে ভরে গেল বুকের ভেতরটা। দিনের পর দিন কেবল বেড়েই চলল এ রাগ। উল্লসিত দর্শক সারির মাঝখান দিয়ে খুনে এক রাগ নিয়ে ফাইনালে রিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল ম্যানফ্রেড।

***

ব্লেইনের আগেই ঘুম থেকে জেগে উঠলেন সেনটেইন। ঘুমিয়ে নষ্ট করা প্রতিটা মুহূর্তকেই কেন যেন তার ভীষণ অপছন্দ। বাইরে তখনো রাতের অন্ধকার। যদিও দেয়াল ঘেরা ছোট্ট বাগানটা থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কলকাকলি।

বেশ কয়েক মাস ব্যয় করে এই কটেজটাকে খুঁজে পেয়েছেন সেনটেইন। কারণ তিনি এরকমই ঘেরাটোপে ঢাকা খুঁজছিলেন। যেন তার ডেইমলার আর ব্লেইনের নতুন বেন্টলির জন্য আবডালে পার্কিং থাকে। এ দুটো গাড়িই চট করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়। এখান থেকে পার্লামেন্ট মাত্র দশ মিনিটের। পথ। তাছাড়া পর্বতের দৃশ্যও খুঁজছিলেন যেন জানালা খুললেই মন ভরে যায়। তার চেয়েও বড় কথা, এমন এক রাস্তা চাইলেন যেখানে তাদের কোনো বন্ধু, বিজনেস পার্টনার অথবা পার্লামেন্টের মেম্বার কিংবা শত্রু ও প্রেসের লোকজন থাকার কথা চিন্তাও করবে না।

অবশেষে এই কটেজটাকে খুঁজে পেয়ে তাই সেন্ট্রাল রুমে দাঁড়িয়ে আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন সেনটেইন, “এখানে সব হাসিখুশি মানুষেরা থেকে গেছেন। আমরাও এটাই নিচ্ছি।”

রেজিস্ট্রারের দলিলে নিজের এক হোল্ডিং কোম্পানির নাম লিখলেও কোনো আর্কিটেক্ট কিংবা ডেকোরেটরকে বিশ্বাস করেননি। পুরো ঘরের মেরামত আর অন্দরসজ্জা তিনি নিজ হাতে করেছেন।

“এটা হতে হবে এ যাবৎকালের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ লাভ ননস্ট।” কাজ চলাকালীন প্রতিদিন কাঠমিস্ত্রি, প্লাম্বার আর রঙমিস্ত্রিদের সাথে কথা বলেছেন। ছোট ছোট চারটা বেডরুমকে ভেঙে বিশাল বড় একটা রুম বানানো হয়েছে। যেখানে ফ্রেঞ্চ জানালা আর দেয়ালঘেরা বাগানে যাবার শাটার আছে। ব্লেইন আর নিজের জন্য পৃথক বাথরুমও তৈরি করিয়েছেন।

বিছানাটা তো জাদুঘরে রাখার মত অসাধারণ হয়েছে। প্রথমবার দেখার পরে ব্লেইনের মন্তব্য ছিল, “অফ সিজনে এখানেই পোলো খেলা যাবে।” বিছানা থেকে তাকালেই যেন চোখে পড়ে এমনভাবে ঝোলানো হয়েছে টার্নারের আঁকা সোনালি সমুদ্র আর রৌদ্রের ছবি। ডাইনিংরুমে ঝাড়বাতির নিচে আছে বোর্ত।

 চারজন স্থায়ী পরিচারকসহ একজন মালিও আছে এ কটেজে। মালয় শেফ তৈরি করে মসলাদার সব সুস্বাদু খাবার।

এতকিছু সত্ত্বেও মাসে একবার এখানে রাত কাটাতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করেন সেনটেইন। আর মাঝে ব্যস্ত সূচি থেকে এক-আধ ঘণ্টার সঙ্গ তো আছেই। কখনো হয়ত মাঝরাতে শেষ হল সংসদ অধিবেশন অথবা কোনো এক সন্ধ্যা যখন ইসাবেলার ধারণা থাকে ব্লেইন হয়ত পোলো প্র্যাকটিস কিংবা কেবিনেট মিটিংয়ে গেছেন। আস্তে করে লেসের বালিশের ওপর মাথা ঘুরিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকালেন সেনটেইন। শাটারের ফাঁক গলে আসা ভোরের আলোয় মনে হচ্ছে আইভরি কুঁদে তৈরি করা কোনো মূর্তি যেন ব্লেইন। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছেন কোনো রোমান সিজার।

ব্লেইনের যেন ঘুম না ভেঙে যায় তাই সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকে পড়লেন সেনটেইন। চুল আঁচড়ে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে না কোনো পাকা চুল নেই। তারপর দাঁত ব্রাশ করে মুখে ক্রিম লাগালেন। ব্লেইন কিন্তু কোনো কসমেটিকস পছন্দ করেন না।

মাঝে মাঝেই ব্লেইন ঠিক ফরাসিদের মত রোমান্টিক হয়ে ওঠে। আপন মনেই হেসে ওয়ার্ডরোব থেকে সিল্কের পোশাক গায়ে জড়িয়েই রান্নাঘরে দৌড়ে গেলেন সেনটেইন। পরিচারকদের সবাই বেশ তৎপর হয়ে আছে। কারণ আজ মনিব ঘরে আছেন আর তাকে সবাই বেশ পছন্দও করে।

“তৈরি হয়েছে হাজী?” মক্কা থেকে হজ্ব করে আসাতে শ্রদ্ধা দেখিয়ে শেফকে এই নামেই ডাকেন সেনটেইন; লাল ফেজ টুপির নিচের মাখন হলুদ রঙা দাঁত দেখিয়ে হাসলেন হাজী। হাতে একজোড়া মোটাসোটা রসালো কিপার।

 “মাত্র গতকালকের মেইল বোটে এসেছে ম্যাডাম।” গর্বে ভরে উঠল যেন হাজীর বুক।

“হাজী তুমি সত্যিই একজন জাদুকর।” হাততালি দিয়ে উঠলেন সেনটেইন। স্কচ কিপারস ব্লেইনের সবচেয়ে পছন্দের নাশতা। ওর পছন্দ মতই তো বানাচ্ছো তাই না?”

এ প্রশ্ন আবার করতে হয় এমন একটা ভাব নিয়ে নিজের স্টোভের দিকে তাকাল হাজী।

স্ত্রীর চরিত্রে এভাবে অভিনয় করাটা সেনটেইনের কাছে অত্যন্ত আমুদে একটা খেলা। মনে হয় যেন ব্লেইন কেবলই তাঁর। বাকি পরিচারকদের কাজ তদারকি করে আবারো অন্ধকার বেডরুমে ফিরে এলেন সেনটেইন।

ব্লেইনের পাশে শুতে গিয়ে সত্যিই মনে হল আনন্দে দম বন্ধ হয়ে যাবে। এত বছর পরেও আজও ব্লেইনকে কাছে পেলে তরুণী মেয়েদের মতই খুশি হয়ে উঠেন।

হঠাৎ করেই হাত বাড়িয়ে সেনটেইনকে কাছে টেনে চাদরের নিচে নিয়ে নিলেন ব্লেইন।

“তুমি এতক্ষণ জেগেই ছিলে?” চমকে উঠে খানিকটা আর্তনাদ করে উঠলেন সেনটেইন। “ওহ, তুমি এত ভয়ংকর যে তোমাকে আসলে কোনো ভরসা নেই।”

মাঝে মাঝে এখনো পরস্পরকে এভাবেই উদ্দাম আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দেন ব্লেইন। অদ্ভুত এক শারীরিক আবেশে যেন সৃষ্টি হয় দেয়ালে ঝোলানো টার্নালের মত উজ্জ্বল সব রঙ। অবশেষে নিঃশেষ হয়ে একে অন্যের আলিঙ্গন ছেড়ে শুয়ে পড়তেই শোনা গেল ছাদের উপর হাজীর ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজানোর টুংটাং আওয়াজ।

চায়না সিল্কের রোব এনে ব্লেইনকে দিলেন সেনটেইন। সাধারণত এ ধরনের পোশাক পরেন না ব্লেইন। তাই জন্মদিনের উপহার হিসেবে যখন সেনটেইনের হাত থেকে মুক্তা লাগানো অ্যামব্রয়ডারি করা রোবটা নিয়েছিলেন তখন বলেছেন, “দুনিয়ার আর কারোর সামনে আমি এটা পরতে পারব না।” “সেটাই ভালো। আর যদি পরোও আমি যেন দেখতে না পাই। তাহলে খবর আছে!” সাবধান করে দিয়েছিলেন সেনটেইন। তবে এখন কিন্তু পোশাকটা বেশ পছন্দই করেন ব্লেইন।

অতঃপর হাতে হাত রেখে দু’জনে ছাদে উঠে এলেন, দেখে তো বেজায় খুশি হাজী আর মিরিয়াম। দ্রুত কিন্তু নিপুণ চোখে ফুলদানির গোলাপ থেকে শুরু করে লিনেন ক্লথ, সিলভার জগে আঙুরের রস পর্যন্ত সবকিছু চেক করে পেপারের ভাজ খুলে ব্লেইনকে পড়ে শোনানো শুরু করলেন সেনটেইন।

 প্রতিবার একই কায়দা: প্রথমে হেডলাইন, তারপর সংসদের রিপোর্ট-এর সাথে দু’জনের মন্তব্যও থাকে। তারপর বাণিজ্যিক আর স্টকের সংবাদ। সবশেষে খেলার পাতা, বিশেষ করে পোলো।

“আচ্ছা সিক্রেট সোসাইটি মানে গোপন সংগঠন মানে আসলে কী?”

“আরে ধুর হের হিটলার আর তাঁর রাজনৈতিক গুণ্ডাগুলোর আদলে গড়া কোনো সামরিক সংগঠন হবে হয়ত।”

“তাই নাকি?” কফির কাপে চুমুক দিলেন সেনটেইন। ইংলিশ ব্রেকফাস্টে এখনো তেমন করে অভ্যস্ত হতে পারেননি। বললেন, “তুমি তো দেখি পুরো ব্যাপারটা হালকা বলে উড়িয়ে দিলে।” এরপর চোখ সরু করে তাকালেন, “নাকি বলতে চাইছো না?”

ব্লেইনের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। তাই অপরাধীর ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন ব্লেইন।

“কিছু তোমার চোখ এড়ায় না, না?”

ভ্রূ কুঁচকে খানিক বাদে ব্লেইন জানালেন, “আমরা আসলে সত্যিই চিন্তিত।” জানেন সেনটেইন কখনো বিশ্বাসভঙ্গ করবেন না। এমনকি ওড বাস বলছেন যে, ১৯১৪ সালের বিদ্রোহের পর থেকে আমরা আর কখনো এত বড় হুমকির মুখোমুখি হইনি, যখন কাইজারের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য কমানোদেরকে আহ্বান করেছিলেন ডিওয়েট। পুরো ব্যাপারটাই সম্ভাব্য একটা বিস্ফোরণ ক্ষেত্র বলতে পারো।” চুপ করে গেলেন ব্লেইন। কিন্তু সেনটেইন জানেন যে, তিনি আরো কিছু বলার জন্য মনস্থির করছেন। তাই চুপচাপ অপেক্ষা করলেন। অবশেষে ব্লেইন বললেন, “অল রাইট, শোনো, ওড বাস তো আমাকে অনুসন্ধান কমিটিরও হেড হতে নির্দেশ দিয়েছেন, কবিনেট পর্যায়ে খুবই গোপনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সংগঠিত ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগের ভেতরে ঢুকতে হবে।”

 “কিন্তু তুমিই কেন ব্লেইন? এটা তো কদর্য একটা কাজ, তাই না?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমি নন-আফ্রিকান বলেই তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন।”

“হুম, আমিও ওবির কথা শুনেছি। কয়েক বছর ধরেই শুনছি। কিন্তু মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে কেউ কিছুই জানে না।” “অ্যান্টি-সেমিটিক, অ্যান্টি-ব্ল্যাক, ডান ঘেঁষা জাতীয়তাবাদী এ সংগঠন গোপন রক্তের শপথ নেয়। মাঝরাতে র‍্যালি করে আর মাইন ক্যাম্পকে তাদের প্রেরণা মনে করে।”

“আমি নিজে এখনো হিটলারের এ আত্মজীবনী পড়িনি। সবাই দেখি এটি নিয়ে কথা বলছে। ইংরেজি কিংবা ফরাসি অনুবাদ কি আছে?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“অফিশিয়ালি প্রকাশিত হয়নি। তবে আমি ফরেন অফিস থেকে অনুবাদ পেয়েছি। আগ্রাসন আর গোঁড়ামি মনোভাবের এক চূড়ান্ত উদাহরণ। আমি তোমাকে আমার কপিটা ধার দিতাম, কিন্তু সাহিত্যের বিচারে একেবারে বাজে লেখা হয়েছে আর আবেগের বাড়াবাড়ি দেখেও তুমি অসুস্থ বোধ করবে।”

“হয়ত তিনি তেমন বড় কোনো লেখক নন” বললেন সেনটেইন, “কিন্তু ব্লেইন আর যাই হোক না কেন হিটলার কিন্তু ওয়েমার রিপাবলিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে জার্মানিকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছেন। জার্মানি হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে কোনো বেকারত্ব নেই আর অর্থনীতিও বেশ বেগবান। গত নয় মাসে তো আমার নিজের শেয়ারই প্রায় ডাবল হয়ে গেছে।” হঠাৎ করেই ব্লেইনের অভিব্যক্তি দেখে চুপ করে গেলেন সেনটেইন, “কী হয়েছে? কোনো সমস্যা ব্লেইন?”

হাতের ছুরি, কাঁটা চামচ নামিয়ে রেখে একদৃষ্টে তার দিকেই তাকিয়ে আছে কর্নেল।

“কী? তোমার শেয়ার আছে? তাও আবার জার্মান অস্ত্র শিল্পে?” আস্তে করে জানতে চাইলেন ব্লেইন। মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

“স্বর্ণের দাম পড়ার পর আমার বিনিয়োগের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আয়” চুপ করে গেলেন সেনটেইন। এ বিষয়ে এর আগে আর কথা বলেননি।

“আমি কখনো আমার জন্য তোমার কাছ থেকে কিছু চাইনি, তাই না?” ব্লেইনের কথা শুনে সাবধানে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

“না, কখনোই না।”

“ওয়েল, এখন তাহলে চাইছি। জার্মান অস্ত্র শিল্পে তোমার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দাও।”

 অবাক হয়ে গেলেন সেনটেইন। হতভম্বের মত জানতে চাইলেন, “কেন ব্লেইন?”

“কারণ এটা হল ক্যান্সারের পক্ষে বিনিয়োগ কিংবা বলতে পারো চেঙ্গিস খানের অভিযানের সহায়তা করা।”

 মুখে কোনো উত্তর না দিলেও কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেল সেনটেইনের চোখের দৃষ্টি। কেমন যেন কুঁচকে গেল চোখের দু’টো মণি। প্রথমবার যখন এরকম দেখেছিলেন সেবার ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ব্লেইন। কয়েক দিন লেগেছে বুঝতে যে এরকম সময়ে মাথার ভেতর অঙ্কের জটিল সব হিসাব মেলান সেনটেইন।

হঠাৎ করেই ধপ করে জ্বলে উঠল তার চোখ। একমত হয়ে হেসে ফেললেন সেনটেইন। সম্মতিসূচক স্বরে জানালেন, “গতকালের দাম পর্যন্ত একশ ছাব্বিশ হাজার পাউন্ড লাভ হয়েছে। তাই এমনিতেই আমার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেবার সময় এসেছে। পোস্ট অফিস খোলার সাথে সাথেই লন্ডনের ব্রোকার হাউজকে তার পাঠিয়ে দেব।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, মাই লাভ।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন রেইন, কিন্তু আশা করছি অন্য কোথাও থেকে তুমি আরো বেশি লাভ করবে।”

“তুমি হয়ত পরিস্থিতি নিয়ে একটু বেশিই ভাবছো পরামর্শ দিলেন সেনটেইন, “হিটলারকে হয়ত যতটা খারাপ ভাবছো ততটা খারাপ সে নয়।”

“আমি যতটা ভাবছি ততটা খারাপ তাকে হতে হবে না সেনটেইন, মাইন ক্যাম্পে যতটা আতঙ্ক ছড়িয়েছেন ততটা খারাপ তো বটেই। মুখভর্তি খাবার নিয়ে আরামে চোখ বন্ধ করে দিলেন ব্লেইন। তাকে এত আনন্দ নিয়ে খেতে দেখে সেনটেইনও প্রায় সমান তৃপ্তি পেলেন। “এবার আমাকে খেলার পাতা পড়ে শোনাও ডার্লিং।” চোখ খুলেই হেসে ফেললেন ব্লেইন।

ধীরে-সস্তে পাতা উল্টে জোরে জোরে পড়া শুরু করলেন সেনটেইন। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মুখ থেকে যেন রক্ত সরে গেল। নিজের সিটে বসেই কেঁপে উঠলেন।

হাতে ছুরি, চামচ নামিয়ে রেখে লাফ দিয়ে উঠে এলেন ব্লেইন। “কী হয়েছে?” প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছেন কর্নেল। কিন্তু কাধ ঝাঁকিয়ে তার হাত সরিয়ে দিয়েই খোলা সংবাদপত্রের দিকে তাকিয়ে থরথর করে আবার কেঁপে উঠলেন সেনটেইন।

তাড়াতাড়ি তার চেয়ারের পেছনে এসে উঁকি দিয়ে খেলার পাতাটা পড়ে নিলেন ব্লেইন। প্রথমে রেসের খবরাখবর থাকলেও পাতার নিচের দিকে সেনটেইনের দৃষ্টি অনুসরণ করে কোয়ার্টার কলাম বক্সে একটা ছবি দেখলেন ব্লেইন। একজন বক্সার। হাতের মুঠি উঁচু করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে এক সুদর্শন তরুণ। কিন্তু সেনটেইন তো কখনো ভুলেও বক্সিংয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাননি। দ্বিধায় পড়ে গেলেন ব্লেইন। তাড়াতাড়ি ছবির পাশের হেডিংটাও পড়ে ফেললেন। তারপরেও বিস্ময় কাটল না। অতঃপর ছবির নিচের ক্যাপশন দেখলেন : “কালাহারির সিংহ, ম্যানফ্রেড ডি লা রে, ইন্টারভার্সিটি লাইট হেভিওয়েট বেল্টের চ্যালেঞ্জার।”

“ম্যানফ্রেড ডি লা রে” নরম স্বরে নামটা উচ্চারণ করলেন ব্লেইন। কোথায় যেন শুনেছেন এ নাম। আর তারপরেই মনে পড়ে গেল সবকিছু। আলতো করে চেপে ধরলেন সেনটেইনের কাঁধ।

“ম্যানফ্রেড ডি লা রে! তুমি উন্ডহকে যে ছেলেটাকে খুঁজেছিলে। সে তাই নয়া?”

নয়া তাকালেও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন সেনটেইন।

“ওর সাথে তোমার কী সম্পর্ক সেনটেইন?”

অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন সেনটেইন। নয়ত উত্তরটাকে ভিন্নভাবেও দিতে পারতেন। কিন্তু এ মুহূর্তে শব্দগুলো যেন মুখ থেকে ছিটকে বের হল, “ও আমার ছেলে। আমার অবৈধ সন্তান।”

ধপ করে দু’পাশে ঝুলে পড়ল ব্লেইনের হাত।

“আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে গেছি!” কী করেছেন সাথে সাথে বুঝে ফেললেন সেনটেইন। ভাবলেন, “আমার ওকে বলাটা উচিত হয়নি। ব্লেইন কখনোই বুঝবে না। আমাকে কখনো আর মাফ করবে না।”

পিছু ঘুরে তাই তাকাবার সাহস পর্যন্ত পেলেন না সেনটেইন। মাথা নামিয়ে তাই দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন।

 “আমি ওকে হারিয়ে ফেললাম। মনে মনে ভাবলেন সেনটেইন, “ব্লেইন এত সৎ মানুষ যে এটা সহ্য করতে পারবে না।”

আর ঠিক তখনি কাঁধে ব্লেইনের স্পর্শ পেলেন। আস্তে করে দু’হাতে ধরে সেনটেইনকে দাঁড় করালেন কর্নেল। সহজ সুরে বললেন, “আই লাভ ইউ।”

 কান্নার দমকে কথা বলতে পারলেন না সেনটেইন। কেবল শক্ত করে দু’হাতে ব্লেইনকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

“ওহ ব্লেইন, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো।”

“যদি তুমি আমাকে এ সম্পর্কে কিছু বলতে চাও, আমি সাহায্য করতে পারি। যদি বলতে না চাও তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। কেবল একটা কথা, যাই হোক না কেন, তুমি যেটাই করে থাকো না কেন তোমার প্রতি আমার অনুভূতির কখনো কোনো নড়চড় হবে না।”

“আমি তোমাকে বলতে চাই” স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। কান্না থামিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি আসলে তোমার কাছ থেকে কখনোই কিছু লুকাতে চাই না। আরো আগেই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভীতুর ডিম বলে পারিনি।”

“তুমি হয়ত অনেক কিছু, মাই লাভ, তবে ভীতুর ডিম মোটেও নয়।” সেনটেইনকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারও কাছে টেনে আনলেন যেন সারাক্ষণ প্রিয় নারীর হাত ধরে রাখতে পারেন।

 “এবার বলো।” আদেশের সুরে জানালেন ব্লেইন।

“এটা অনেক বড় একটা কাহিনি ব্লেইন, নয়টার সময়ে তো তোমার কেবিনেট মিটিং আছে।”

“রাষ্ট্রীয় কাজ পরেও করা যাবে।”

মুচকি হাসলেন ব্লেইন, “তোমার খুশিই হল দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।”

তাই একে একে সবকিছু খুলে বললেন সেনটেইন। কীভাবে লোথার ডি লা রে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন, হানি ডায়মন্ড খনি খুঁজে পাওয়াসহ মরুভূমিতে ম্যানফ্রেডের জন্ম পর্যন্ত সবকিছু শুনলেন ব্লেইন। কিছুই লুকালেন না সেনটেইন, লোথারের জন্য ভালোবাসা। এটাও ব্যাখ্যা করে বললেন যে, কীভাবে এই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়ে গেল যখন তিনি জানতে পারলেন যে লোথার তার পালক মা সেই বয়স্ক বুশম্যান নারীকে কীভাবে হত্যা করেছিলেন। আর তাই এর ফলে সবটুকু ঘৃণা গিয়ে পড়ল গর্ভে থাকা লোথারের সন্তানের ওপর। এমনকি সদ্যোজাত শিশুটিকে দেখতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সেনটেইন। কিন্তু লোথার তাঁর সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই পরম আদরে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। ব্যাপারটা অন্যায় হয়েছে।” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন, “কিন্তু সে সময় আমি এত দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম যে তাছাড়া কোর্টনি পরিবারের প্রতিক্রিয়ার কথাও ভেবেছিলাম। ওহ ব্লেইন, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে পরে আমি এত অনুশোচনায় ভুগেছি যে, যতটা ঘৃণা লোথারকে করেছি, ততটাই নিজেকেও করেছি।”

“তুমি কি জোহানেসবার্গে গিয়ে ওর সাথে আবার দেখা করতে চাও?” জানতে চাইলেন ব্লেইন, “চ্যাম্পিয়নশীপ দেখার উদ্দেশ্যেও যেতে পারি আমরা।”

বিস্মিত হয়ে গেলেন সেনটেইন, “আমরা? আমরা ব্লেইন?”

“আমি তো তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না। যেখানে তোমার মানসিক যাতনার হুমকি আছে।”

“কিন্তু তুমি কীভাবে যাবে? ইসাবেলা?”

“তোমার জরুরিটাই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” সহজ গলায় জানালেন ব্লেইন, “তুমি কি যেতে চাও?”

“ওহ ইয়েস ব্লেইন, ইয়েস।” লেস লাগানো টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে শেষ অশ্রুবিন্দু পর্যন্ত মুছে ফেললেন উল্লসিত সেনটেইন।

 মুহূর্তের মধ্যেই আবার দায়িত্ববোধের খোলস পড়ে নিলেন। বললেন, “আজ সন্ধ্যার দিকে সাউথ ওয়েস্ট থেকে ফিরবে শাসা। উইন্ডহকে অ্যাবিকে ফোন করে ফ্লাইট টাইম জেনে নিব। তাহলে আগামীকালকেই জোহানেসবার্গ চলে যাব। কখন ব্লেইন?”

“তুমি যতটা তাড়াতাড়ি চাও। আজ সন্ধ্যার মাঝেই ডেস্কের কাজ গুছিয়ে ওড বাসের সাথে কথা বলে নিব।”

“বছরের এই সময়ে আবহাওয়াও ভালো থাকার কথা হয়ত হাই ভেস্তে শুধু মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাবে।” কব্জি ঘুরিয়ে রোলেক্স ঘড়ির দিকে তাকালেন সেনটেইন, “আচ্ছা শোনো, একটু দ্রুত তৈরি হতে পারলে তুমি এখনো কেবিনেট মিটিংটা ধরতে পারবে।”

গ্যারেজ পর্যন্ত গিয়ে আদর্শ স্ত্রীর মত ব্লেইনকে বিদায় জানালেন সেনটেইন। তারপর একেবারে শেষ মুহূর্তে তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, “শাসা আসার সাথে সাথেই আমি তোমার অফিসে ফোন করব। মিটিংয়ে থাকলে ডোরিসের কাছে মেসেজ দিয়ে রাখব।” পৃথিবীতে অল্প যে কয়জন মানুষ তাদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানে তাদের একজন হল ব্লেইনের সেক্রেটারি ডরিস।

বেন্টলি চলে যাওয়ার সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে অ্যাবিকে ফোন করলেন সেনটেইন, “ওরা তো পাঁচ ঘণ্টা আগেই প্লেনে উঠেছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানালেন অ্যাবি। “ডেভিডও ওর সাথে আছে।”

“বাতাসের গতি কেমন অ্যাবি?”

“ঘণ্টায় বিশ থেকে ত্রিশ মাইল।”

“থ্যাঙ্ক ইউ। ঠিক আছে আমি মাঠে ওদের জন্য অপেক্ষা করব।”

“আরেকটা ব্যাপার” খনিকটা দ্বিধার স্বরে জানালেন অ্যাবি, “গতকাল ওরা বেশ গোপনে প্লেনে উঠেছে। এমনকি আমাকেও এয়ারফিল্ডে যেতে দেয়নি। তাই মনে হচ্ছে হয়ত সাথে কোনো সঙ্গী আছে। আশা করছি বুঝতে পারছেন।”

সাথে সাথে ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন সেনটেইন, যদিও ভালো করেই জানেন যে ডি থাইরি রক্ত প্রবাহ এত সহজে হার মানবে না। অতি সূক্ষ্মভাবে আবার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ছেলের এই আগ্রহে গর্বও বোধ করেন বলা চলে। যাই হোক বিষয় পাল্টে বললেন, “ধন্যবাদ অ্যাবি। আমি নতুন লীজে সাইন করে দিয়েছি। তুমি কনট্রাকট নিয়ে কাজ শুরু করে দিতে পারো।” আরো পাঁচ মিনিট ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা সেরে ফোন রেখে দিলেন সেনটেইন। তারপর লন্ডনে শেয়ার বিক্রির জন্য খবর পাঠিয়ে মিরিয়াম আর হাজীকে বলে দিলেন তার অনুপস্থিতিতে কী কী করতে হবে। তারপর হিসাব করে দেখলেন যে দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাবে শাসা।

এরপরই ডেইমলার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সেনটেইন। পথিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ কাটানোর সময় আরেকবার মনে পড়ে গেল শাসার কথা। সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে এ বছর শেষ করেছে শাসা।

 ওকে নিয়ে ব্লেইনের দাবি, “সেনটেইন, তুমি ছেলেকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবো। ওকে একটু নিজের মত থাকতে দাও না। তুমি নিজে সফল বলেই এতটা আধিপত্য বজায় রাখতে চাও। তুমিই তো সব করে ফেলেছে। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য ওই বেচারা আর কিইবা করতে পারে?”

“ব্লেইন, আমি ওর ওপর জোর খাটাতে চাই না।”

 “আমি বলেছি যে তুমি কতৃত্ব করতে পছন্দ করো। করছে সেটা তো বলিনি।”

“তুমি যে মাঝে মাঝে কী বলল আমার মাথায় ঢোকে না।”

“শাসাকে জিজ্ঞেস করো।” মিটিমিটি হেসে সেনটেইনের কাঁধে হাত রেখে ব্লেইন বলেছিলেন, “তোমার দড়ি মাঝে মাঝে একটু আলগা হতে দিও সেনটেইন। ও যেন নিজের ভুল আর অর্জন দুটোই উপভোগ করতে পারে। তুমি যেসব পশু খাও না তাদেরকে হত্যা করাটা অপছন্দ হলেও ছেলেটাকে শিকারে হাত পাকাতে দাও। কোর্টনিরা তো এ বিষয়ে বিখ্যাত। ওর সামনে শিকার আর পোলোটা তুমি কখনো করোনি।”

“আর ফ্লাইং?”

 “হ্যাঁ, ফ্লাইংও।”

“ঠিক আছে, এখন থেকে ও যত খুশি পশু হত্যা করবে। আমি আর কিছু বলবো না। কিন্তু ব্লেইন, ও কী অলিম্পিকের জন্য পোলো টিম তৈরি করতে পারবে?”

“ফ্রাঙ্কলি বলতে গেলে, না, মাই ডার্লিং।”

“কিন্তু ও তো বেশ দক্ষ। শাসা নিজে তোমাকে বলেছিল না?”

“হ্যাঁ।” সম্মত হলেন ব্লেইন, “ও হয়ত ভালো। কিন্তু ওর অভিজ্ঞতার অভাব আছে। যদি ওকে নির্বাচন করা হয় তাহলে ও হবে এযাবৎকালের সবচেয়ে তরুণ খেলোয়াড়। কিন্তু আমার মনে হয় না ওকে বাছাই করা হবে।”

একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। ব্লেইন নিজেও অভিব্যক্তিশূন্য চোখে তাকালেন। জানেন সেনটেইন কী ভাবছেন। ক্যাপ্টেন হিসেবে জাতীয় নির্বাচকের দায়িত্বে আছেন ব্লেইন।

“ডেভিড বার্লিনে যাবে।” জানালেন সেনটেইন।

“ডেভিড আব্রাহাম তত ঠিক গ্যাজেল হরিণ বলা যায়। ও এখনই দুইশ’ মিটারে সারা পৃথিবীতে চতুর্থ আর চারশ’ মিটারে তৃতীয়। অন্যদিকে শাসাকে জায়গা পেতে হলে অন্তত পৃথিবী সেরা দশজন ঘোড়সওয়ারের সাথে লড়তে হবে।” যুক্তি দেখালেন ব্লেইন।

“শাসাকে বার্লিনে পাঠানোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।”

“ঠিক তাই। তুমি পারবে।” একমত হলেন ব্লেইন। “আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মাই লাভ, আমি সর্বোতভাবে চেষ্টা হঠাৎ থেমে গেলেন ব্লেইন, প্রত্যাশা নিয়ে তাকালেন সেনটেইন, “করব যে নির্বাচকদের কাছে শাসার নাম এলে আমি যেন রুম ছেড়ে চলে আসতে পারি।”

 “ও এত বেশি নীতিবান?” জোরে জোরে চিৎকার করেই হতাশায় ডেইমলারের স্টিয়ারিং হুইল চেপে ধরলেন সেনটেইন। সাথে সাথেই অবশ্য চোখের সামনে আইভরি আর সোনালি কারুকাজ করা বিশাল বিছানার দৃশ্যটা ভেসে উঠতেই আনমনে হেসে উঠে ভাবলেন, “নাহ, কথাটা সবক্ষেত্রে খাটে না।”

ধূ-ধূ করছে পুরো এয়ারফিল্ড। ডেইমলারকে হাঙ্গ্যারের পাশে পার্ক করে রাখলেন সেনটেইন। যেন শাসা আকাশ থেকে দেখতে না পায়। তারপর একটা ট্রাভেলিং কার্পেট বের করে ঘাসের ওপর বিছিয়ে বসলেন। হাতে গত সপ্তাহের শেষ না করা বই। মাঝে মাঝেই আবার চোখ তুলে দেখছেন উত্তরের আকাশে।

***

ঘোড়া নিয়ে দৌড়ানোর মত আকাশে উড়ে বেড়ানোটাকেও সমান মাত্রায় উপযোগ করে ডেভিড আব্রাহামস। যদিও অ্যাবি আব্রাহামস সারা জীবন ধরেই সেনটেইনের সাথে কাজ করে আসছেন, তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরই শাসা আর তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তারপর দু’বন্ধু মিলে তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ফ্লাইং ক্লাব; যার জন্য টাইগার মথ ট্রেনারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সেনটেইন।

 ডেভিড আইন নিয়ে পড়ছে; যার আরেকটা উদ্দেশ্য হল উইন্ডহকে বাবার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হওয়া। তাই ছেলেটাকে ভাললাভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর শাসার সাথে ওর বন্ধুত্বকেও মেনে নিয়েছেন সেনটেইন।

বাবার চেয়েও লম্বা ডেভিডের চেহারাটাও সদা হাস্যোজ্জ্বল, মাথার চুলগুলো কোঁকড়া আর বাবার মতই পাখির ঠোঁটের মত নাক। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল ছেলেটার গাঢ় সেমিটিক জোড়া চোখ আর সংবেদনশীল হাত যা এখন ড্রাগন র‍্যাপিড প্লেনের কন্ট্রোল কলাম ঠুয়ে আছে। ঠিক মনোযোগ দিয়ে উপাসনা করার মতই প্লেন চালায় ডেভিড। অন্যদিকে শাসা চালায় দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারসুলভ মনোভাব নিয়ে।

নিজের জীবনের সাথে জড়িত সবকিছুর সম্পর্কেই সমান আবেগপ্রবণ ডেভিড। আর ওর এই গুণের জন্যই ছেলেটাকে এত পছন্দ করে শাসা।

ফাইনাল পরীক্ষার পরদিন হানি মাইনে একসাথে উড়ে এসেছে দু’জনে। ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস আগে থাকতেই তাদের জন্য ক্যাম্পিং ইকুপমেন্ট, স্টাফ, ট্র্যাকার আর শেফ ভর্তি দুইটা চার টন ওজনের ট্রাক রেডি রেখেছিলেন। এ অভিযানের ইনচার্জ হল শিকার আর বন্য জগতের বিষয়ে বিজ্ঞ কোম্পানির এক কর্মচারী।

তাদের গন্তব্য ছিল ক্যাপ্রিভিস্ট্রিপ। এ অঞ্চলে প্রবেশাধিকার এমনিতেই সংরক্ষিত। তবে ব্লেইন ম্যালকমস তাদের জন্য প্রবেশ আর শিকার করার লাইসেন্স জোগাড় করে দিয়েছেন।

উজ্জ্বল আনন্দে কেটে গেল ক্যাম্পের কয়টা দিন। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতেই পায়ে হেঁটে যাত্রা করে ফিরতে ফিরতে আবার ডুবে যেত সূর্য। দু’জনেই সিংহ মেরেছে আর একই সাথে অনুভব করেছে শিকারিসুলভ বিষণ্ণতা। প্রতীজ্ঞা করেছে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করবে এ বন্য সম্পদ আর বাঁচাবে মানুষের লোভের হাত থেকে। আর অত্যন্ত ধনী এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করার সুবাদে শাসা উপলব্ধি করেছে যে, একদিন তার উপরেই বর্তাবে এই দায়িত্ব। মেয়েদেরকে সাথে আনার ব্যাপারেও অবশ্য ওর আগ্রহই বেশি ছিল।

ত্রিশ বছর বয়সী বিশালাকার এক ডিভভার্সি নারীকে নিজের জন্য বেছে নিয়েছে শাসা। ডেভিড মহিলার নাম দিয়েছে “জাম্বো”। কারণ হিসেবে বলেছে, “ও এতই মোটা যে পাশাপাশি দুটি হাতি হেঁটে যেতে পারবে তার মাথার উপর দিয়ে।”

আর শাসার ইচ্ছেতেই সাথে করে নিজের বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে জাম্বো। লম্বা মেয়েটাও একজন ডিভোর্সি। পাতলা হাত দুটোতে একগাদা চুড়ি আর গলায় পুঁতির মালা। ডেভিড তার নাম দিয়েছে “ক্যামেল”। দু’জনের আরেকটা গুণ হল তাদেরকে যে জন্য আনা হয়েছে ক্লান্তিহীন, নিপুণতার সাথে তা পালন করা ব্যতীত বাকি দিন ক্যাম্পে চুপচাপ কাটিয়ে দেয় দু’বান্ধবী। এমনকি ক্যাম্প ফায়ারের আশপাশে আড়ি পেতে ডেভিড আর শাসার কথা শোনারও কোনো চেষ্টা করে না।

“এতটা আনন্দের ছুটি আমি আর কখনো কাটাইনি।” পাইলটের সিটে হেলান দিয়ে বসে স্বপ্ন চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে শাসা। তারপর কী মনে হতেই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে কেপটাউনে পৌঁছাতে তো এখনো এক ঘণ্টা বাকি।” সেফটি বেল্ট খুলে উঠে দাঁড়াল।

“কোথায় যাচ্ছ?” জানতে চাইল ডেভিড।

“প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না, বুঝলে। তবে ক্যামেলকে ককপিটে আসতে দেখলে অবাক হয়ো না।”

 “জাম্বোর জন্য আমার সত্যিই ভয় হচ্ছে।” মাথা নাড়ল ডেভিড। মিটিমিটি হেসে বন্ধুর কাঁধে চাপড় দিলো শাসা।

এক ঘণ্টা বাদে পর্বতের পাশ দিয়ে উড়ে এয়ারস্ট্রিপে প্লেন নিয়ে নামল শাসা। এতটাই দক্ষভাবে ঘাসের ওপর র‍্যাপিডকে নামিয়ে আনল যেন টোস্টের উপর মাখন লাগাচ্ছে। অতঃপর ট্যাক্সিইং করে হ্যাঁঙ্গারে নিয়ে এল প্লেন। আর ঠিক যেই মুহূর্তে ইঞ্জিন বন্ধ করল তখনই চোখে পড়ল হ্যাঁঙ্গারের ছায়ায় পার্ক করা হলুদ ডেইমলার। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন। “ওহ, খোদা, মা এখানে! জলদি মেয়েদেরকে মেঝেতে শুইয়ে দাও।”

“দেরি হয়ে গেছে।” গুমরে উঠল ডেভিড। “পোর্টহোল দিয়ে তোমার মায়ের দিকে হাত নাড়ছে জাম্বো।”

ক্যামেলকে নিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয় নিচে নেমে গেল জাম্বো। মায়ের রাগ যে কোথায় গিয়ে জমা হচ্ছে ভাবতে বসে শক্ত হয়ে গেল শাসা।

মুখে কিছুই বললই না সেনটেইন। কিন্তু দেখা গেল আগে থেকেই একটা ট্যাক্সি এনে রেখেছেন। মেয়েদের কথা মা কীভাবে জানল তা কখনোই জানতে চায়নি শাসা। কেবল ট্যাক্সির ব্যাকসিটে বেসামাল নারী দু’জনকে তুলে দেয়ার সময় কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন সেনটেইন।

“ওদের লাগেজ ট্যাক্সির বুটে তুলে দাও।” তির্যক দৃষ্টি হেনে ছেলেকে আদেশ দিয়েই কাজ সেরে ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। “যেখানে যেতে চায় নামিয়ে দিও।”

চোখ গোল করে তাকিয়ে নিজের সিটে বসে রইল ক্যামেল; কিন্তু ট্যাক্সি গেইট দিয়ে বেরিয়ে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত জানালা দিয়ে হাত নেড়ে একের পর এক কিস ছুঁড়ে দিল জাম্বো শাসার উদ্দেশে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মা যে কী করবে ভাবতে লাগল শাসা।

কিন্তু “ট্রিপটা বেশ মজার হয়েছে তাই না ডার্লিং” মিষ্টি স্বরে জানতে চেয়েই গাল উঁচু করে দিলেন সেনটেইন। আর নারী দু’জনের কথা আর কখনোই উল্লেখ করল না মাতা-পুত্র কেউই।

“অসাধারণ!” স্বস্তি আর কৃতজ্ঞতায় মায়ের গালে কিস করল শাসা। মাকে সব বিস্তারিত বলতে চাইলেও ছেলেকে থামিয়ে দিলেন সেনটেইন। বললেন, “পরে। এখন তুমি র‍্যাপিডে তেল ভরে পুনরায় চেক্ করে নাও। আমরা কাল জোহানেসবার্গ যাচ্ছি।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *