৫. রায় ঘোষণা

“প্রথম তিন অপরাধের জন্য বন্দির সর্বোচ্চ শাস্তি হল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু,” রায় ঘোষণার জন্য পুনরায় বিচারকের আসনে বসে জানালেন হর্থন, “তথাপি, আমার তেত্রিশ বছরের কর্মজীবনে যা দেখিনি আজ তাই অবলোকন করলাম এই কোর্টরুমে। মিসেস সেনটেইন ডি থাইরী কোর্টনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে সাক্ষ্য দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উনার মহানুভবতা আমলে নিয়ে এখন পরবর্তী রায় ঘোষণা করা হবে। নিজ আসন থেকে সেনটেইনের উদ্দেশে খানিক মাথা ঝুঁকিয়ে হর্থন আদেশ দিলেন,

“বন্দিকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য বলা হচ্ছে।”

“লোথার ডি লা রে তোমার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ সাক্ষ্য-প্রমাণসহ প্রমাণিত হওয়াতে তোমাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হল।”

বিচারকার্য শুরু হবার পর থেকে এই প্রথমবারের মত লোথার ডি লা রে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। রায় শুনে কেঁপে উঠল তার ঠোঁট, অক্ষত হাতটা উঠিয়ে কালো রোব পরিহিত বিচারকের কাছে আকুতি জানিয়ে চিৎকার করে বললেন,

“আমাকে বরঞ্চ মেরেই ফেলুন, জন্তুর মত খাঁচায় আটকে না রেখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন।

তাড়াতাড়ি কারারক্ষীরা এসে দু’পাশ থেকে লোথারকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। এমনকি প্রধান বিচারক পর্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন কথাগুলো শুনে। আর দর্শকেরা তো এমনভাবে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল যেন শেষকৃত্যের শোকার্ত বাহিনি।

“আমাকে মেরে ফেলুন। নিজের আসনে বসে রইলেন সেনটেইন। বুঝতে পারছেন এ তিনটা শব্দ তাকে সারা জীবন ধরে তাড়িয়ে বেড়াবে। মাথা নিচু করে হাত দিয়ে চোখ ঢাকলেন আর সাথে সাথে ভেসে উঠল সেই কালহারি মরুভূমিতে দেখা লোধারের চিত্র।

“ওহ!” অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন সেনটেইন।

“এত সুন্দর কিছুর এতটা নিষ্ঠুর পরিণতি কেমন করে হয়? আমরা একে অন্যকে তো বটেই ধ্বংস করেছি আমাদের ভালোবাসার সন্তানকেও।”

কাছেই কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অবশেষে চোখ খুলে তাকালেন। ব্লেইন এসেছেন।

 “এবারে বুঝতে পারছি যে তোমাকে ভালোবাসা কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।” ম্যালকমসূকে দেখেই অপরাধবোধ আর সকল ব্যথা ভুলে গেলেন সেনটেইন।

তাঁর হাত দুটো ধরে ব্লেইন জানালেন, “নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করছি যেন তোমার সামনে না আসতে হয়। তবে আজ তুমি যা করলে এরপর দায়িত্ব অথবা সম্মান কোনোকিছুই আমার কাছে আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি আসলে আমারই অংশ। তোমার সাথেই থাকতে চাই।”

“কবে?”

“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”

“ব্লেইন, আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে অন্যদেরকে শুধু যন্ত্রণাই দিয়েছি। আর নয়। আমিও তোমাকে চাই কিন্তু তোমার পরিবারকে ধ্বংস করে নয়।”

“ব্যাপারটা হয়ত সত্যিই বেশ কঠিন; কিন্তু আমি তোমাকে চাই”

“আমি জানি।” উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন, “আমাকে জড়িয়ে ধরে। ব্লেইন, খানিকক্ষণের জন্য হলেও জড়িয়ে ধরো।”

অন্যদিকে শূন্য আদালত প্রাঙ্গণে সেনটেইনকে না পেয়ে কোর্ট রুমের দরজা খুলে ঢুকতে যাবেন অ্যাবি আর চোখের সামনে দেখলেন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কর্নেল আর সেনটেইন। যেন পরিবেশ নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন অ্যাবি। আর মনে মনে প্রার্থনা করলেন, “ঈশ্বর, এই লোকটা যেন তাকে পূর্ণ করতে পারে।”

***

“ইডেন বোধ হয় এরকমই ছিল” আপন মনেই ভাবলেন সেনটেইন, “আর ইও নিশ্চয় আমার মতই অনুভব করেছিলেন।”

শূন্য কোর্টরুমে কাটানো মুহূর্তগুলোর পর প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেছে। এর মাঝে একবারও কর্নেল আর সেনটেইন দুজনের সাথে দেখা করেননি। এর মাঝে ব্লেইন ছিলেন উইন্ডহকে আর সেনটেইন ওয়েন্টেভেদ্রেনে যুদ্ধ করেছেন হিরের লোকসান সামলে নিজের খনিকে তুলে দাঁড় করানোর জন্যে।

 এতদসত্ত্বেও ক্লান্ত, শ্রান্ত সেনটেইন প্রতি মুহূর্তে ভেবেছেন ব্লেইনের কথা। স্বভাবসুলভ দ্রুতগতি ছেড়ে এখন গাড়ি চালাচ্ছেন অত্যন্ত ধীরে। সেই ভোরবেলায় ওয়েল্টেভ্রেদেন ছেড়ে চলে এসেছেন একশ বিশ মাইল। রিয়ার ভিউ মিররে নিজের চেহারা দেখে নিয়ে ভাবলেন, “আজ কোনো হতাশা নয়। কেবল ব্লেইন আর এই জাদুকরী প্রকৃতির কথাই ভাবব।” উপত্যকার একেবারে চূড়ায় উঠে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন সেনটেইন। চোখের সামনে বিশাল সমুদ্র, বেন গুয়েলার সবুজ স্রোত। খোলা জানালা দিয়ে আসা সমুদ্রের বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেল চুল। লাল, কমলা আর হলুদ রঙের বুনোফুলে ছাওয়া সমুদ্র তীরের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন সেনটেইন।

শেষ চিঠিতেই ব্লেইন সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, “জায়গা দেখে আঁতকে উঠো না। মাত্র দুইটা রুম, মাটির ল্যাট্রিন আর মাটির চুলা। ছোটবেলায় এখানেই ছুটি কাটাতাম আমরা, তবে বাবা মারা যাবার পর থেকে আমি একাই আসি। আর কাউকে কখনো আনিনি। তার মানে তুমিই প্রথম।” রাস্তার একটা ম্যাপও দিয়েছিলেন সাথে।

তাড়াতাড়ি কাগজটা বের করে নিচে তাকালেন সেনটেইন। খড়ের ছাদ। বয়সের ভারে কালো হয়ে গেলেও হোয়াইট ওয়াশ করা দেয়ালগুলো ফেনার মতই উজ্জ্বল। চিমনি থেকে ধোয়াও উড়ছে। দালানের পেছনেই দেখা যাচ্ছে মানুষের অবয়ব। সাথে সাথে চঞ্চল হয়ে উঠলেন সেনটেইন।

কিন্তু বহুল ব্যবহৃত ফোর্ডের ইঞ্জিন কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না। এতই দুরাবস্থা চলছে যে অতীতের প্রতিবছর নতুন ডেইমলারের স্মৃতি যেন গত জন্মের কথা মনে হল।

অতঃপর হ্যান্ডব্রেক ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে কোনোমতে পৌঁছালেন নিচে। দূর থেকেই সেনটেইনকে দেখে দৌড়ে এলেন ব্লেইন। পরনে কেবল একজোড়া খাকি শর্টস আর হাতে জ্যান্ত লবস্টার। সমুদ্রের নোনা জল লেগে লম্বা চুলগুলো ভিজে কোঁকড়া হয়ে আছে। কর্নেলের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেনটেইন।

***

খোলা চুলার সামনে তেপায়া টুলের উপর বসে আছেন ব্লেইন। শেভিং মগ আর ব্রাশ নিয়ে তৈরি সেনটেইন। ক্ষুণ্ণ মুখে অনুযোগ করলেন কর্নেল।

“পুরো পাঁচ মাস লেগেছে এত বড় করতে, আমার কত সাধের দাড়ি।”

“না” দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন, সেনটেইন, “এর চেয়ে বরঞ্চ একটা শজারুকে কিস করা ভালো হবে।” নিচু হয়ে কর্নেলের উপরের ঠোঁটের দু’পাশে ফোম লাগিয়ে দিলেন।

উদ্দাম ভালোবাসবাসির পর এখনো উদাম শরীরেই টুলের উপর বসে আছেন ব্লেইন। খেয়াল হতেই তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন সেনটেইন। বুঝতে পেরে চট করে তোয়ালে টেনে নিলেন কর্নেল। মাথা নেড়ে সেনটেইন বললেন, “দ্যাটস বেটার। এবার কাজ করা যাক।” টেবিলের উপর থেকে রেজার তুলে দ্রুত একের পর এক টান দিলেন।

“এটা তুমি কোথায় শিখেছ?”

“আমার পাপা! বাবার দাড়ি সবসময় আমিই টেনে দিতাম। এখন স্থির হয়ে বসো!”

কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন ব্লেইন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কাজ সেরে, রেজার রেখে সরেও এলেন। পিছিয়ে এসে পরীক্ষা করে বললেন, “হুমম।” তারপর একটুও দ্বিধা না করে ঝপাৎ করে বসে গেলেন ব্লেইনের কোলে। খুলে পড়ে গেল কর্নেলের কোমরের ভোয়ালে।

খানিক বাদে আগুন থেকে ব্লেইনকে চুরুট ধরিয়ে এনে দিলেন সেনটেইন। তারপর দুজনেই ঢুকে পড়লেন কম্বলের নিচে।”

“আচ্ছা তুমি কি সেই ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছিলে? অ্যাবি আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন।” অলস কণ্ঠে জানতে চাইলেন কর্নেল।

সাথে সাথে শক্ত হয়ে গেল সেনটেইনের শরীর; ব্লেইনকে বুঝতে না দিয়ে কোনোমতে মাথা নেড়ে জানালেন, “না।”

“আমার ধারণা ও লোথার ডি লা রে’র ছেলে? তাই না।”

“হ্যাঁ।” একমত হলেন সেনটেইন। “আমার শুধু চিন্তা হচ্ছিল যে পিতার রায়ের পর নিশ্চয় ছেলেটা একা আর অসহায় হয়ে গেছে।”

“ঠিক আছে। আমি ওর খোঁজ করব। আর যদি কোনো খবর পাওয়া যায় তাহলে তোমাকে জানিয়ে দিব।” সেনটেইনের চুলে বিলি কেটে দিলেন ব্লেইন।

এরপর দুজনেই চুপ করে গেলেন। বাইরের দুনিয়ার কথা উঠতেই কেটে গেল দু’জনার আবেগঘন মুহূর্তের রেশ।

“ইসাবেলা কেমন আছে?” সেনটেইনের মনে হল গালের নিচে ব্লেইনের বুকের পেশি আচমকা শক্ত হয়ে গেল। চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে উত্তর দিলেন ব্লেইন, “অবস্থা দিনকে দিন খারাপই হচ্ছে। এ আলসার ভালো হবার নয়।”

“আয়্যাম সরি ব্লেইন।”

“সে গত সোমবার থেকে হাসপাতালে। তাই তো আমি বাইরে আসার সুযোগ পেলাম। মেয়েরা তাদের দাদীর কাছে।”

“শুনে তো আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে।”

“তোমার সাথে দেখা না হলে আমি মরেই যেতাম।”

খানিক চুপ করে থেকে হাতের চুরুটটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ব্লেইন, “মনে হচ্ছে ইসাবেলাকে ইংল্যান্ড যেতে হবে। সার্জন দেখবেন। গাইজ হাসপাতালে কাজ করেন। উনি নাকি অলৌকিক কাণ্ডও ঘটাতে পারেন।”

“কখন?” সেনটেইনের বুকের মাঝে যেন কামানের গোলা ঢুকে গেল। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

“বড়দিনের আগেই।”

“তাহলে তো তোমাকেও ওর সাথে যেতে হবে।”

“তার মানে হবে আমার দায়িত্বে ইস্তফা দিয়ে সুযোগগুলো নষ্ট…” চুপ করে গেলেন ব্লেইন। এর আগে নিজের উচচকাক্ষা নিয়ে এভাবে আর সেনটেইনের সাথে কথা বলেননি।

 “ভবিষ্যৎ কেবিনেটে যোগ দিয়ে হয়ত প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়ে যাওয়া।” ব্লেইনের কথা শেষ করে দিলেন সেনটেইন।

 “আমাকে কি খুব নির্দয় মনে হচ্ছে?” জানতে চাইলেন ব্লেইন, “নিজের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ইসাবেলাকে একা ছেড়ে দিচ্ছি?”

“না”, সিরিয়াস হয়ে উঠলেন সেনটেইন। “উচ্চাকাঙ্ক্ষা কী তা আমি ভালোভাবেই জানি।”

“তারপরেও আমি বলেছিলাম, কিন্তু ইসাবেলাও জোর দিল যেন আমি এখানেই থাকি।” সেনটেইনকে নিজের বুকে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন ব্লেইন। “ও আসলেই এক অসাধারণ মানুষ, এত সাহস। ব্যথা এখন প্রায়ই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। প্রতি রাতেই ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়।”

 “নিজেকে খানিকটা অপরাধী মনে হলেও তমাকে কাছে পেয়ে সত্যিই খুশি হয়েছি ব্লেইন। ওর কাছ থেকে আর কিছু কেড়ে নিচ্ছি না।”

কিন্তু এটা যে কতবড় মিথ্যে সেটাও তিনি ভালোভাবেই জানেন। ব্লেইন ঘুমিয়ে পড়লেও বহুক্ষণ অব্দি জেগে রইলেন সেনটেইন।

 সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে দেখলেন যে বাঁশের ফিশিং রড নিয়ে তৈরি হয়ে গেছেন ব্লেইন।

“বিশ মিনিটের মধ্যে নাশতা তৈরি হয়ে যাবে বলে বের হতে না হতেই ফিরে এলেন নিজের হাতের সমান লম্বা এক রুপালি মাছ নিয়ে। তারপর সেনটেইনের কাছে এসে কুটিল হাসি দিয়ে বললেন, “সাঁতার।”

 চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন, “তুমি পাগল! জমে নিউমোনিয়ায় মারা যাব এত ঠাণ্ডা পানিতে নামলে।” টেনে নিয়ে তাকে পাথর ভর্তি গভীর পুলের মধ্যে ডুবিয়ে ধরলেন ব্লেইন।

স্বচ্ছ আর পরিষ্কার পানি এতটাই ঠাণ্ডা যে গোসল শেষে দেখা গেল দু’জনেই পুরো গোলাপি হয়ে গেছেন। যাই হোক, এরপর লেবুর রসে ভেজা সুস্বাদু মাছ, বাদামি ব্রেড আর খামারের হলুদ বাটার দিয়ে নাশতাও বেশ উপাদেয় লাগল।

ভরপেট খেয়ে আবারও দুজনে মিলে বিছানায় শুয়ে আছেন; এমন সময় বালিশ থেকে খসে পড়া পালক দিয়ে ব্লেইনের বন্ধ চোখের পাতা আর ঠোঁটের উপর খেলতে গিয়ে সেনটেইন নরম স্বরে জানালেন, “ব্লেইন, আমি ওয়েল্টেভেদেন। বিক্রি করে দিচ্ছি।”

সাথে সাথে চোখ মেলে উঠে বসলেন কর্নেল, “বিক্রি করে দিচ্ছি মানে?”

“অর্থাৎ দিতে হচ্ছে।” সহজভাবেই উত্তর দিলেন সেনটেইন, “এস্টেট, বাড়ি আর যাবতীয় সবকিছু।”

“কিন্তু কেন ডার্লিং? আমি জানি তোমার কাছে এগুলোর মূল্য কতটা তাহলে কেন বিক্রি করে দিচ্ছো?”

“ইয়েস। ওয়েল্টেভ্রেদেন আমার কাছে অনেক কিছু। কিন্তু তার চেয়ে বেশি হচ্ছে হানি মাইন। যদি এস্টেটটা বিক্রি করে দেই তাহলে নগণ্য পরিমাণে হলেও খনিটাকে বাঁচাবার সুযোগ পেয়ে যাব।”

“অবস্থা যে এতটা খারাপ, আমার তো ধারণাই ছিল না।”

“তুমি কেন, কেউ জানে না মাই লাভ।”

“কিন্তু তারপরেও হানি থেকে কি কোনো লাভ হচ্ছে না?”

“না ব্লেইন। আজকাল কেউই আর হীরে কেনে না। এই ভয়ংকর সন্ধ্যা আমাদের কোর্টকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে যা পেতাম এখন তার অর্ধেকেরও কম পাই। কিন্তু এ সময়টা যদি কাটিয়ে দিতে পারি কিংবা পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে হয়ত” থেমে গেলেন সেনটেইন। “তাই ওয়েন্টেভেদেনটা বিক্রি করতেই হবে। তাহলে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্তত টিকে থাকতে পারব আর ততদিন পর্যন্ত নিশ্চয় এই মন্দা আর থাকবে না।”

“হ্যাঁ, তা তো বটেই, আচ্ছা সেনটেইন, আমার কাছে টাকা আছে। যদি

কর্নেলের ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন।

 “না, ব্লেইন, এটা ইসাবেলা আর তার মেয়েদের প্রাপ্য।”

 “আমার অর্থ আমি চাইলে”।

“ব্লেইন! ব্লেইন! আমার এখন এক মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ প্রয়োজন। আছে তোমার কাছে? এর চেয়ে কমে কিছুই হবে না।”

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “এত? না, আমার কাছে এর তিন ভাগের এক ভাগও নেই সেনটেইন।”

“তাহলে এ ব্যাপারে আমরা আর কথা বলব না, ঠিক আছে?” দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন সেনটেইন, “এখন আমাকে দেখাও তো ডিনারের জন্য ক্রেফিশ কীভাবে ধরব? একসাথে যতদিন আছি আমি আর কোন রকম মন খারাপ করা কথা বলতে চাই না।”

শেষবিকেলে দুজনে একসাথে কুঁড়েঘরের পেছনে ঢালুর উপর উঠে গেলেন। হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ালেন বুনোফুলের ভিড়ে।

“দেখো ব্লেইন, কেমন করে প্রতিটা ফুল আকাশের সূর্যের দিকেই তাকিয়ে থাকে! আমিও ওদেরই মতন আর তুমিই হলে আমার সূর্য, মাই লাভ!”

খুঁজে খুঁজে পছন্দমত ফুল নিয়ে মুকুট বানিয়ে সেনটেইনের মাথায় পরিয়ে দিলেন ব্লেইন। বললেন, “আর তুমি হলে আমার অন্তরের রানি।”

বুনো ফুলের চাদরে শুয়ে উদ্দাম ভালোবাসায় মেতে উঠলেন ব্লেইন আর সেনটেইন, তাদের নিচে চূর্ণ হয়ে গেল লাল কমলা পাপড়ি আর বাতাসে সুবাস ছড়িয়ে দিল মাদকময় সুগন্ধ।

খানিক বাদে ব্লেইনের হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে রইলেন সেনটেইন। অস্ফুট কণ্ঠে জানালেন, “জানো আমি কদিন বাদে কী করব?”

“বলল।” জড়ানো গলায় জানালেন ব্লেইন, “এমন এক কাজ করব যাতে লোক বছরখানেক পরে বলবে সেনটেইন কোর্টনি ডুবে গেলেও স্টাইল করেই হেরেছে।”

“মানে?”

“এবারের বড়দিনের পার্টি হবে সর্বকালের সেরা ধুমধাড়াক্কা। এক সপ্তাহের জন্য ওয়েল্টেভ্রেদেন হয়ে যাবে ওপেন হাউজ, প্রতি রাতে শ্যাম্পেন আর নাচ।”

“সত্যিই তাই করবে?”

“এর ফলে আমরা দুজনে একসাথে জনসমক্ষে আসারও একটা অজুহাত পেয়ে যাব। তুমি আসবে না?”

“নির্ভর করবে আসলে।” সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানালেন ব্লেইন। দুজনেই’। জানেন যে সবকিছু ইসাবেলার উপরেই নির্ভর করবে, “আমাকে খুব জোরালো কোনো বাহানা খুঁজতে হবে।”

“তোমাকে বাহানা আমিই দিচ্ছি।” উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সেনটেইন, “আমি না হয় পোলো সপ্তাহের আয়োজন করব, বিশ গোলের টুর্নামেন্ট। সারাদেশের সব টপ প্লেয়ারদেরকে আমন্ত্রণ করব। আর তুমি তো জাতীয় ভাবেই চ্যাম্পিয়ান। তার মানে এ আয়োজন প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।”

“সত্যিই পারব না। তুমি খুব চালাক।” সপ্রশংস দৃষ্টিতে মাথা নাড়লেন ব্লেইন।

“সে ফাঁকে শাসার সাথেও দেখা করিয়ে দেব। আমি তোমাকে চিনি শোনার পর থেকেই তোমাকে দেখতে চাইছে।”

“তাহলে খুবই ভালো হয়। তুমি কিছু জুনিয়র টিমকেও দাওয়াত করতে পারো। তোমার ছেলের ঘোড়া চালানোও দেখা হয়ে যাবে।”

“ওহ ব্লেইন! এটা অত্যন্ত চমৎকার একটা আইডিয়া?” আনন্দে হাততালি দিলেন সেনটেইন, “আমার বাবু সোনাটা, আহারে বেচারা হয়ত এইবারই নিজের ঘোড়া নিয়ে খেলার শেষ সুযোগ পাবে। কারণ ওয়েল্টেভেদেন বিক্রি করে দিলে তো ঘোড়াগুলোকেও হারিয়ে ফেলতে হবে।” মুহূর্তের জন্য চোখে বিষাদের ছায়া ঘনালেও আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চেহারা “কিন্তু যেমনটা বলেছি, বিদায় নিলেও স্টাইল করেই বিদায় নেব।”

***

ওয়েল্টেভ্রেদেনের আমন্ত্রণে খেলতে আসা জুনিয়র দলগুলোর মধ্যে সবশেষে টিকে রইল শাসার টিম আর নাটাল জুনিয়র। শাসার দল ওয়েল্টেভ্রেদেনের রক্ষণ ভাগ ঠেলে নয় গোল দিয়ে দিল ম্যাক্সের নাটাল জুনিয়র। এর উপর আবার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে অসম্ভব ক্ষেপে উঠল শাসা। রাগে দুঃখে আর হতাশায় সহিসের উপর তেতে উঠল শাসা, “তুমি জিনের বেল্ট ঠিকভাবে আটকাওনি।”

“কিন্তু আপনিও চেক করেছিলেন।”

“খবরদার আমার মুখে ওপর কথা বলবে না।” তারপর সহিস অ্যাবেলের দিকে না তাকিয়েই মাঠের ওপাশে নাটালের লাইনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এবার টাইগার শার্ক নিয়ে যাব। ওর সামনের পায়ের ব্যান্ডেজ চেক করে এখানে নিয়ে আসো।” কম বয়সী টাইগার শার্ক হল বে স্ট্যালিয়ন জাতের ঘোড়া। মাত্র এক বছর ধরে এটাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শাসা খেলার উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। তবে বিশাল শক্তিশালী কাঁধ আর হ্যামার হেডের কুৎসিত চেহারার ঘোড়াটার আচরণও জেদী টাইপের। কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ লাথি ছুঁড়ে বসে। অন্যসময় হলে শাসা হয়ত অপেক্ষাকৃত শান্ত গ্রাম পুডিং নামে ঘোড়াটাকেই নিত; কিন্তু ম্যাক্স নিজের কালো স্ট্যালিয়ন বেছে নিতেই শাসা বুঝতে পারল তাকে কী করতে হবে।

অন্যদিকে ওয়াগনের মাঝখানের হুইলের ওপর হেলান দিয়ে বসে নিঃশব্দে শাসাকে দেখছেন ব্লেইন। হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করা, এক চোখের ওপর ঝুঁকে আছে চওড়া কানঅলা পানামা টুপি। মোটের ওপর শাসাকে দেখে খুশিই হলেন ব্লেইন। জেতার ইচ্ছেটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আর এ কথা কেবল পোলো গ্রাউন্ড নয় জীবনের সবক্ষেত্রেই খাটে। শাসা কোর্টনির মাঝে এ গুণ আছে কিনা নিশ্চিত না হলেও মায়ের ক্রমাগত চেষ্টায় বড়দের প্রতি এবং নিজ স্কুলে শাসা অত্যন্ত সুবোধ আচরণ করে।

গত চারদিন ধরেই ওকে খেয়াল করছেন ব্লেইন। তাই বুঝতে পেরেছেন যে সহজাতভাবেই ছেলেটা ঘোড়া চালানোতে দক্ষ। নির্ভীক হবার কারণে অবশ্য মঝে মাঝেই লাইন ক্রস করে চলে যায়। তবে ব্লেইন জানেন অভিজ্ঞতার সাথে সাথে নিজেকে ঠিকই বদলে নিতে শিখবে শাসা।

আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় হবার জন্য আরো প্রয়োজন প্রচণ্ড পরিশ্রম করার ক্ষমতা। যা বয়স, দৃঢ় মনোবল আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তৈরি হবে। আর সবশেষ জিনিসটা হল একজন খেলোয়াড় বছর চল্লিশ পেরোলেই কেবল ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।

এবার হাসিমুখে নরম স্বরে শাসাকে কাছে ডাকলেন ব্লেইন, “শাসা, একটু কথা বলা যাবে?”

“অবশ্যই স্যার।” শ্রদ্ধাভরে মাথার টুপি খুলে এগিয়ে এল শাসা।

“আচ্ছা প্রথমে তুমি চার গোল দিলে; কিন্তু শেষে ম্যাক্স পাঁচ দিয়ে দিল। ভাবো তো, কোথায় হয়েছে পরিবর্তনটা?”

মাথা নাড়তেই আচমকা বুঝতে পারল শাসা, “ও আমাকে নিজের অফ সাইডে টেনে নিয়ে গেছে।”

“রাইট।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “পাঁচদিন কেউ ওকে অন্য দিক দিয়ে হারাতে পারেনি। তুমি তাই তোমার ঘোড়া নিয়ে সোজা এসে অন্তত একবার হলেও ওর কাছে তেড়ে যাবে। ম্যাক্স দেখো নিজের ওষুধে নিজেই কুপোকাৎ হয়ে পড়বে। এক ডোজই যথেষ্ট হবে।”

“মানে ফাউল করব স্যার?” হা হয়ে চেয়ে রইল শাসা। জীবনে প্রথমবার কেউ তাকে এরকম একটা উপদেশ দিল। পরিচিত হবার আগে থেকেই ব্লেইনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে শাসা। আর ব্লেইন সত্যিই চায় যে তাদের দুজনার মধ্যেকার সম্পর্কটা আন্তরিক হোক। শুধু যে তার ভালোবাসার নারীরই সন্তান শাসা তাই না, এই বুদ্ধিমান চমৎকার ছেলেটা নিজেকে উদ্যমী আর নির্ভীক হিসেবেও প্রমাণ করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, ব্লেইন জানেন তিনি নিজে কখনো পুত্রসন্তানের বাবা হতে পারবেন না।

 “ওর নিজের চাল দিয়েই ওকে হারাতে হবে শাশা।” ব্লৈইনের পরামর্শ শুনেই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শাসার চেহারা।

 “ধন্যবাদ স্যার।” শক্ত টুপিটাকে আবার মাথায় পরেই চলে গেল শাসা। তারপর সহিসকে ডেকে বলল, “বান্টি, আমরা দিক পরিবর্তন করব।” টাইগার মার্ককে নিয়ে এগিয়ে এল অ্যাবেল। হালকাভাবে তার কাঁধে হাত রেখে শাসা জানাল, “তুমি ঠিকই বলেছো, আমিও বেল্ট চেক করেই নিয়েছিলাম।” তারপর আবার একই কাজ করার ভঙ্গি করে উঠে দাঁড়াতেই দাঁত বের করে হেসে ফেলল অ্যাবেল। পা-দানি স্পর্শ না করেই টাইগার শার্কের পিছনে উঠে বসল শাসা।

 নিজের ওয়াগন হুইল নিয়ে গ্রাউন্ডস্টান্ডের দিকে চলে এলেন ব্লেইন। এদিক-সেদিক তাকিয়ে সেনটেইনকে খুঁজলেন।

 একগাদা পুরুষকে নিয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস কোর্টনি। স্যার গ্যারি, জেনারেল স্মুট ছাড়াও একজন ব্যাঙ্কার কেবিনেট মিনিস্টার আর ম্যাক্সের বাবাও আছেন।

দেশের খ্যাতিমান খেলোয়াড়ের দল শুধু নয় সেনটেইনের আমন্ত্রণে ওয়েন্টেভ্রেদেন এসেছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সংবাদপত্রের সম্পাদক, মাইনিং ম্যাগনেটসহ প্রভাবশালী আর গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তিত্ব।

দুর্গে প্রত্যেকের জায়গা না হওয়ায় কাছের আলপেন হোটেলেরও সমস্ত রুম ভাড়া নেয়া হয়েছে। এ উপলক্ষে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পাঁচ দিন ধরেই অবিরাম চলছে এ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। দিন-রাত গান, ক্যাবারে, ফ্যাশন শো, চ্যারিটি সেল, ট্রেজার হান্ট, টেনিস, তাস খেলা, ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য পাঞ্চ অ্যান্ড জুডিসহ আছে নানা অনুষ্ঠান।

“আর আমিই শুধু জানি যে এখানে আসলেই কী ঘটছে।” চোখ খুলে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন। “এতটা পাগলামি সত্যিই অবিস্মরণীয়, দুর্দশার মাঝে থেকেও ওর যে এত সাহস, সে কারণেই এই নারীকে আমি এতটা ভালোবাসি।”

কেউ উনার দিকে তাকিয়ে আছেন অনুভব করেই ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন সেনটেইন, এক মুহূর্তের জন্য মনে হল যেন থেমে গেল পুরো বিশ্বচরাচর। দুজনের মাঝে নেই কোনো সময় কিংবা বাস্তব। তারপরেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলে সেনটেইন।

ব্লেইনের মনে হল এক্ষুণি ছুটে যান ওই নারীর কাছে; বুক ভরে ঘ্রাণ নেন সেনটেইনের পারফিউমের। কিন্তু তা না করে সংকল্পচিত্তে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোলেন স্ট্যান্ডে ইসাবেলার হুইল চেয়ারের দিকে। আজই প্রথম টুর্নামেন্টে আসার মতন নিজেকে সুস্থ মনে করেছেন ইসাবেলা। তাই তার হুইল চেয়ার ওঠার মতন র‍্যাম্প বানানোর আদেশ দিয়েছেন সেনটেইন।

বাবাকে দেখেই স্ট্যান্ড থেকে নেমে দৌড়ে এল দুই মেয়ে। এক হাতে হাঁটু পর্যন্ত স্টার্ট ধরে রেখেছে দুজনেই, আরেক হাতে সামলাচ্ছে চওড়া কানঅলা টুপি। ব্লেইনের হাত ধরে হাসতে হাসতে টেনে নিয়ে গেল মায়ের হুইল চেয়ারের কাছে। ইসাবেলার এগিয়ে দেয়া বিবর্ণ গালে কিস্ করলেন ব্লেইন। ওষুধের প্রভাবে তার চোখ দুটো ও ঢুলুঢুলু হয়ে আছে।

“আই মিস ইউ ডার্লিং” ফিসফিস করে সত্যি কথাটাই জানালেন ইসাবেলা।

 “আমি ছেলেটার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। এখন ভালো লাগছে?”

“ধন্যবাদ। ওষুধে সত্যিই কাজে দিয়েছে।” এত করুণ হলেও সাহসমাখা ছিল ইসাবেলার হাসিতে। তাই উপুড় হয়ে পরীর গালে আবার কিস করলেন ব্লেইন। তারপর চোখ তুলেই আবার চোরা চোখে সেনটেইনের দিকে তাকালেন। দেখা গেল তিনিও এদিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়তেই মাথা ঘুরিয়ে নিলেন সেনটেইন।

“পাপা, দলগুলো নেমে আসছে।” বাবাকে ধরে সিটে বসিয়ে দিল তারা। “কামঅন ওয়েল্টেভেদ্রেন” আনন্দে চিৎকার জুড়ে দিল মেয়েটা।

দিক পরিবর্তন করে সাইড লাইনে দলবলসহ চলে এল শাসা। চিবুকের সাথে টুপির দড়ি ঠিকঠাক করেই ব্লেইনের খোঁজে স্ট্যান্ডে তাকাল।

শাসাকে দিক পরিবর্তন করতে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল ম্যাক্স। কোথাও কোনো গড়বড় আছে বুঝতে পেরেই চক্কর মেরে মাঠের ওপাশে নিজের দু’নম্বরকে হাত ইশারা করে আগের জায়গায় ফিরে এল।

এবার ছিল বান্টির শট। নিজের ঘোড় নিয়ে যেই না এগিয়ে এল ছেলেটা অমনি নিজের কালো স্ট্যালিয়ন নেমেসিসকে নিয়ে তেড়ে এল ম্যাক্স। আর শক্তিশালী বড়সড় ঘোড়াটা তুষার ঝড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল বান্টির ওপর।

তাড়াতাড়ি উৎসাহ দেয়ার জন্য চিৎকার করে উঠল শাসা, “তোমার লাইন বান্টি, জায়গা ছেড়ো না।” কিন্তু ঠিক সে সময় নেমেসিসের কাঁধে বুড়ো আঙুল দিয়ে গুতো দিল ম্যাক্স। অ্যাংগেল পাল্টে বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে গেল নেমেসিস। দাঁড়িয়ে থাকলে ভয়ংকর একটা ফাউল হত। কিন্তু ভয় পেয়ে নিজের ঘোড়া নিয়ে সরে দাঁড়াল বান্টি। আর সে সুযোগে বিজয়ের মত গিয়ে জায়গা দখল করল ম্যাক্স। কিন্তু যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে লাঠি তুলে সমস্ত মনোযোগ দিল সাদা বলটার দিকে।

ফলে শাসা যে নিয়ার সাইড থেকে আসছে সেদিকে লক্ষ্যই করেনি। শাসার হিলের বাড়ি খেয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এল টাইগার শার্ক। তীক্ষ্ণ একটা মোচড় নিয়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল নেমেসিসের ওপর। আরেকটু হলে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল শাসা।

যাই হোক, ব্লেইনের কথাই ঠিক। এটা ম্যাক্সের দুর্বল সাইড। সামনের হাঁটুর মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে হোঁচট খেলো নেমেসিস। শূন্যে উঠে নিজের ঘোড়ার মাথার ওপর পড়ে গেল ম্যাক্স। কিন্তু লাগাম তখনো হাতে ধরা। আতঙ্কিত শাসার মনে হল নেমেসিস বুঝি ম্যাক্সকে মেরেই ফেলবে।

তবে সহজাত অ্যাথলেটিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাতাসের মাঝেই বিড়ালের মত ঘুরে গিয়ে বাঁকাভাবে মাটিতে পড়ল ম্যাক্স। প্রথমে খানিক কোনো কথা না বললেও মাঠের দু’পাশ থেকে আম্পায়ারদের বাঁশি শুনেই চিৎকার শুরু করল, “ও আমার সাথে ফাউল করেছে। আমার লাইন ক্রস করে এসেছে। আরেকটু হলেই আমি মারা পড়তাম।” কাঁপতে কাঁপতে সাদা হয়ে গেছে ম্যাক্স। তারপরেও ভয় আর হতাশায় উঠে লাফাতে লাগল সবার সামনে।

মাঠের মাঝখানে এসে আলোচনা জুড়ে দিল দুই আম্পায়ার। এদিকে অনবরত প্রতিবাদ করে গেল ম্যাক্স। কিন্তু চোখ ঘুরিয়ে টাইগার সার্কের দিকে তাকাতেই শাসার আম্পায়ারদেরকে প্রভাবিত করার ইচ্ছে চলে গেল। বুঝতে পারল উত্তেজিত দর্শকরাও ন্যায়বিচারের জন্য চিৎকার শুরু করেছে।

কিন্তু আম্পায়ার দু’জনে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এগিয়ে গেল গ্রান্ডস্টান্ড থেকে নেমে আসা রেফারির দিকে।

“গুড শট শাস!” এগিয়ে এল বান্টি, “বেয়াদবটার জন্মের শিক্ষা হয়েছে।”

“মনে হচ্ছে আমাকে মাঠ থেকে বের করে দেবে বান্টি।” উত্তরে জানাল শাসা।

“কিন্তু তুমি তো লাইন ক্রস করোনি। আমি সব দেখেছি।”

শান্ত হয়ে গেল শাসা। আচমকা মনে হল এত অতিথিদের সামনে যদি তাকে মাঠ থেকে বের কর দেয়া হয় তাহলে দাদা গ্যারি কোর্টনি আর মা সেনটেইনের মনোভাব কী হবে। সবার সামনে নিজেদের বাড়ির অপমান করল শাসা। নার্ভাস হয়ে স্ট্যান্ডের দিকে তাকালেও বুঝতে পারল না ব্লেইন ম্যালকমসই বা কী ভাবছেন। ততক্ষণে আম্পায়ারদের একজন সোজা শাসার কাছেই এগিয়ে এল,

“মিঃ কোর্টনি!”

“স্যার!” সিধে হয়ে বসল শাসা যে কোনো খারাপ সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুত।

“আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাকে সাবধান করা হচ্ছে। এ ধরনের বিপজ্জনক খেলার ব্যাপারে ওয়ার্নিং মনে রেখো।”

“বুঝতে পেরেছি স্যার।” ভাবলেশহীন থাকতে চাইলেও ভেতরে ভেতরে আনন্দে ফেটে পড়েছে শাসা। এ যাত্রায় পার পেয়ে গেছে।

 “খেলা শুরু করো মি. কোটনি।” ঘোষণা দিয়ে সরে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে শাসার মনে হল তার উদ্দেশে চোখ টিপে দিলেন আম্পায়ার।

 খেলা শেষ হবার মাত্র তিন মিনিট আগে পেনাল্টি শট খেলতে তাদের এলাকায় চলে এল ম্যাক্স। কিন্তু শাসার দলের স্টাফ বেচারা নাটালের গুঁতো খেয়ে সুবিধে করতে পারল না। তবে শাসাকে বল পাস করে দিল। এদিকে বান্টিও পেছনে থাকায় ও একা নাটাল ঘোড়সওয়ারদের সাথে পেরে উঠল না।

অন্তত ড্র হলেও তো করতে হবে। হাতঘড়ি দেখে শাসাকে জানাল বান্টি।

“উঁহু ড্র যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে জিততেই হবে।” ভয়ংকর গলায় জবাব দিল শাসা।

“আর মাত্র আধা মিনিট বাকি। এবারে বল সোজা এগিয়ে এল বান্টির দিকে। কিন্তু মিস্ করায় এখন গোল আর তাদের মাঝে আছে কেবল স্টাফ গুডম্যান। ওকে সাহায্য করার জন্য দৌড় দিলেও মনে মনে চিন্তায় পড়ে গেল শাসা। আর বুঝি কোনো আশা নেই। কিন্তু না, দুরুদুরু বুকে নাটালদের মাঝখানে এগিয়ে এল স্টাফ। বলকে এমন ঘুরিয়ে মারল যে সোজা বান্টির লাইনে গিয়ে পড়ল। বান্টিও বল নিয়ে পুরো মাঠে তাড়া করল।

 “আমার দিকে দাও বান্টি।” মাঠের বাম পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল শাসা।

“হিয়ার ডিগার হিয়ার।” ঘোত ঘোত করতে করতে ম্যাক্সও এগিয়ে এল।

হিট করল বান্টি। কিন্তু বল গিয়ে নাটালের পেছনের ঘোড়ার সামনের খুড়ে গিয়ে আবার বান্টির ঘোড়ার পা-দানি ছুঁয়ে চলে এল ওয়েল্টেভ্রেদেনের সীমানায়।

কী ঘটবে সাথে সাথে টের পেয়ে গেল। তাই টাইগার শার্ককে নিয়ে এগিয়ে এসে বলে মেরে পরিবর্তন করে দিল দিক। তারপর এত জোরে ছুটল যে কাত হয়ে পড়ে গেল ঘোড়া। কিন্তু “হাহ!” বলে পেটে শাসার গুতো খেয়েই আবার উঠে দাঁড়াল। সামনেই ড্রিবলিং করছে বল।

খানিকটা ঝুঁকে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে বলটাকে নাটালদের গোলের সীমানার দুইশ গজ দূরে ছুঁড়ে মারল শাসা।

টাইগার শার্ক নিজেও চমৎকার কাজ দেখাল। শাসা যেন ফুল শট পায় সে রকম দূরত্বে সরে এসে সাহায্য করল। প্লাম পুডিং নিজে থেকে এতটা বিচার বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারত না। তবে খানিক গিয়েই থেমে গেল বল। এবারে দূরত্ব দেড়শ’ গজ, দুলে উঠল শাসার হৃদয়। বিজয় বুঝি তাদেরই হবে।

“হাহ!” আবারো তত দিল টাইগার শার্কের পেটে। কিন্তু ঠিক সে সময় নেমেসিস নিয়ে ম্যাক্সও চলে এল। সোজা শাসার দিকেই এগিয়ে আসছে ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন।

পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ বাধার ঠিক আগমুহূর্তে খানিক সরে গেল শক্তিশালী টাইগার শার্ক আর নেমেসিস। ফলে এখন দু’জনের বিপরীত দিকে ছুটে যাচ্ছে শাসা আর ম্যাক্স। উত্তেজনায় চিৎকার করে দাঁড়িয়ে গেল সমস্ত দর্শক।

গত বছর এরকমই মুখোমুখি সংঘর্ষে এক ঘোড়সওয়ারকে মারা যেতে দেখেছে শাসা। অন্যজনের পা ভেঙে গিয়েছিল।

“আমার লাইন!” সামনের দিক থেকে তেড়ে আসা ম্যাক্সের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল শাসা।

“চুলায় যাও, কোর্টনি।”

 পাল্টা শাসিয়ে গেল ম্যাক্স।

স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ম্যালকম ঠিকই টের পেলেন শাসার ভেতরকার পাগলামী। এটা কোনো সাধারণ সাহস নয়। একবার তিনি নিজে এরকম দুঃসাহস দেখিয়ে হাতে শুধুমাত্র একটা গ্রেনেড নিয়ে তেড়ে গেছেন নো ম্যানস ল্যান্ডের জার্মানদের বিরুদ্ধে।

ম্যাক্সের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ইচ্ছে করেই সোজা এগিয়ে গেল শাসা। অখন্ড মনোযোগ দিয়ে দেখল বিশাল স্ট্যালিয়নের ভেজা নাক। এমনকি নেমেসিসের প্রত্যেকটা রক্তবাহী শিরা পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল তার চোখের সামনে, মুখ উঠিয়ে তাকালো ম্যাক্সের দিকে। ক্রোধে ধকধক করছে নাটাল অধিপতির চেহারা। স্থির দৃষ্টিতে তাকালো শাসা।

আচমকা ম্যাক্সের মুখেও আতঙ্ক ফুটে উঠল। বুঝতে পারল সরাসরি ধাক্কা খেলে কপালে কী আছে। তাই নিজে থেকেই একেবারে অন্তিম মুহূর্তে ঘুরিয়ে দিল নেমেসিসের নাক। এদিকে তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে শক্ত হাতে বাড়ি মেরে বলটাকে সোজা পোস্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল শাসা।

একটু পরেই বিজয়ী দল এগিয়ে এল স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো ব্লেইনের কাছে। কেবল বন্ধুত্বসুলভ একটা হাসি দিলেও শাসার ওপর অত্যন্ত খুশি হয়েছেন কর্নেল ম্যালকমস। পাশে বসে থাকা ইসাবেলাও টের পেল স্বামীর অনুভূতি। ভালো ভাবেই জানেন ব্লেইন পুত্রসন্তানের জন্য কতটা উৎসুক ছিলেন। হঠাৎ করেই তাই নিজের ওপরই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন ইসাবেলা। আচমকা বলে বসলেন, “এই ছেলেটা বড্ড বেশি বেপরোয়া আর দায়িত্বহীন।” নিজের রাগ ঝাড়তে বেমক্কা মন্তব্য করে বসলেও জানেন ব্লেইন মনঃক্ষুণ্ণ হবেন। তারপরেও নিজের সহ্যশক্তিও যেন হারিয়ে ফেললেন, বললেন, “একেবারে মায়ের মতই হয়েছে–” ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। রাগে জ্বলে উঠল তার চোখ। তবুও স্ত্রীকে বুঝতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “দেখি, তোমার জন্য লাঞ্চ নিয়ে আসি।” লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন ম্যালকমস।

ইসাবেলার মনে হল বুঝি হাউমাউ করে কেঁদে উঠবেন, “আয়্যাম সরি, আমি আসলে তোমাকে অনেক ভালোবাসি ব্লেইন।”

 ইসাবেলা লাল মাংস খেতে পারবেন না। তাই মাছের সন্ধানে ব্যুফে টেবিলের মাঝখানে এলেন ব্লেইন। কোর্টনির শেফদের দক্ষতা আসলেই প্রশংসার যোগ্য। এত সুন্দর করে পরিবেশন করা হয়েছে যে অতিথিদের বেশিরভাগই এসে আনন্দিত হয়ে চেখে দেখলেন বিভিন্ন পদ। এতটাই আনমনা ছিলেন যে সেনটেইনের উপস্থিতিও টের পাননি ব্লেইন।

“তুমি আমার ছেলেকে কী বলেছো কর্নেল যে ও এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠল?” তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন ব্লেইন। সেনটেইনকে এত কাছে পেয়ে সত্যিই খুশি হয়েছেন।

“পুরুষদের কথা, বুঝলে? পাঁচ কান করতে নেই।”

হেসে ফেললেন সেনটেইন, “যাই হোক। সত্যিই কাজে লেগেছে। ধন্যবাদ ব্লেইন।”

“এর কোনো প্রয়োজনই নেই, ও নিজেই সবটুকু করেছে। শেষ গোলের মত এতটা দর্শনীয় কিছু আমি আসলেই অনেক দিন দেখিনি। দেখবে সামনে ও আরো কত ভালো করবে।”

“গোলটা দেখার পর আমার কী মনে হয়েছে জানো?” মাথা নেড়ে আরেকটু কাছে এগিয়ে এলেন কর্নেল।

“বার্লিনের কথা মনে পড়েছে।” চমকে উঠলেন ব্লেইন। তারপরেই ঘটনাটা মনে পড়তেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন।

.

বার্লিন ১৯৩৬। দ্য অলিম্পিক গেমস্। হেসে ফেললেন ব্লেইন।

“তুমি সত্যিই সিরিয়াস?” একদৃষ্টে তাকালেন সেনটেইনের দিকে। “অবশ্যই। ঘোড়াগুলো রাখার মতন সামর্থ্য আমার আর নেই। কিন্তু ওর দাদা নাতির খেলা দেখতে ভালোবাসেন, আর যদি টপ কোনো প্লেয়ারের পরামর্শ পায় তো নিজের বিস্ময় কাটাতে খানিকটা সময় নিলেন ব্লেইন। তারপর বললেন,

“তোমার ক্ষমতা দেখে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। তোমার অসাধ্য বোধ হয় কিছুই নেই, তাই না?”

কিন্তু প্রশ্নটা শুনেই সেনটেইনের চোখ চকচক করে উঠতেই আবার বলে উঠলেন, “আমি আমার প্রশ্ন ফিরিয়ে নিচ্ছি ম্যাডাম।”

পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন দু’জনে। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি। নয়ত তাদের মধ্যেকার ভালোবাসার এত নগ্ন বহিঃপ্রকাশ আর গোপন থাকত না। একটু পরে আস্তে করে চোখ সরিয়ে নিলেন সেনটেইন।

 “জেনারেল স্মুট তোমাকে খুঁজছিলেন, আমরা স্ট্যান্ডের পেছনে ওকের নিচে বসেছি। স্ত্রীকে নিয়ে চাইলে চলে এসো।” ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন সেনটেইন।

 হুইল চেয়ার ঠেলে ইসাবেলা সহ তাদের কাছে চলে এলেন ব্লেইন। চারপাশের আবহাওয়াও বেশ চমৎকার। প্রকৃতিও আজ সেনটেইনের টুর্নামেন্টে সাহায্য করেছে। হালকা বাতাসও আছে। ডিসেম্বরে শীত পড়লেও ওয়েল্টেভেদেন কনস্টানশিয়া উপত্যকার পেছনে পড়ায় বেঁচে গেছে।

 ব্লেইনকে এগিয়ে আসতে দেখে ওয়েটারকে সরিয়ে দিয়ে নিজের হাতে শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে ইসাবেলার কাছে এলেন সেনটেইন।

 “ধন্যবাদ, কিন্তু আমার লাগবে না।” মিষ্টি হেসে প্রত্যাখ্যান করলেন ইসাবেলা। এক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন।

তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন ম্যালকমস “যদি কিছু মনে না করেন বলে শ্যাম্পেনের গ্লাসটাকে নিয়ে নিলেন। কৃতজ্ঞ চোখে হেসে ফেললেন সেনটেইন। হুইল চেয়ারের জন্য জায়গা করে দিল বাকি অতিথির দল। এদিকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলে উঠলেন,

 “হুভার আর তার আধিপত্যবাদ নীতির কবলে কেবল ইউএস নয় আমাদেরও বিস্তর ক্ষতি হচ্ছে। তা না হলে এতদিনে এই মন্দা কেটেই যেত। ঈশ্বর জানেন আর কতদিন এমনটা সইতে হবে।” জেনারেল মুটের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন “ওড় বাস আপনার কী ধারণা?”

মিটিমিটি হেসে নীল চোখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে সুট জানালেন, “ডিয়ার আলফ্রেড, আমি তো অর্থনীতিবিদ নই, একজন বৃক্ষপ্রেমী মাত্র। সাথে সাথে অন্যদের মাঝে সংক্রামিত হল তার হাসি। সবাই জানে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ডের সাথে নিয়মিত বৈঠক করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে তিনিই বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

 “তাহলে তো স্বর্ণের স্ট্যান্ডার্ডের কথা বাদ দিয়ে আমার গোলাপগুলোকে দেখুন ওড বাস।” অতিথিরা যে এরকম আলোচনায় স্বস্তি পাচ্ছেন না তা ঠিকই বুঝতে পারলেন সেনটেইন।

 লম্বা টিউলিপ গ্লাসে শ্যাম্পেন হাতে হাসি-ঠাট্টায় মত্ত হলেও শূন্যতায় ভরে গেছে তার অন্তর। জানেন দুঃস্বপ্ন হলেও এটাই সত্যি। তার সবকিছু শেষ হতে চলেছে। আজকের স্মৃতি নিয়েই এগোতে হবে অনিশ্চিত আর নিয়ন্ত্রণহীন ভবিষ্যতের দিকে। হঠাৎ করেই কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে আস্তে করে হাততালি দিলেন ব্লেইন। অন্যরাও তাই করল।

“এই তো এসে গেছে বিজয়ী হিরো- “ কে যেন হেসে ফেলতেই নিজের সিটে নড়ে উঠলেন সেনটেইন। ফ্লানেল আর ব্লেজার পরে গোসল সেরে মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে শাসা। যতটুকু দ্ৰতা প্রয়োজন মুখে ঠিক ততটুকুই হাসি।

“ওহ বাবু, আমি সত্যিই তোমার জন্য গর্বিত।” ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেকে কি করলেন সেনটেইন। এবার সত্যিকারের অস্বস্তিতে পড়ে গেল শাসা। ছেলেকে এত সুন্দর লাগছে যে সেনটেইনের ইচ্ছে করল বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আত্মসংবরণ করে ওয়েটারকে শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে আনতে বললেন মিসেস কোর্টনি। অবাক হয়ে গেল শাসা।

ছেলের হাতে চাপ দিলেন সেনটেইন, “বিশেষ দিনে খাওয়া যায়। নাও।”

নাতির পাশে চলে এলেন স্যার গ্যারি। “কাম অন, মাই বয়। চ্যাম্পিয়ন হয়ে কেমন লাগছে বলো।”

“প্লিজ দাদু, আমি বন্ধুদের কাছে যেতে চাই। তবে সবার জন্য পরে একটা সারপ্রাইজ আছে।”

 “সারপ্রাইজ!” নিজের চেয়ারে বসলেন সেনটেইন। ছেলের কাণ্ড তিনি ভালোই জানেন। আগেরবার ফায়ার ওয়ার্কাসের নামে পুরনো গোলাঘরসহ পাঁচ একর গাছ পুড়িয়ে দিয়েছিল শাসা। তাই জানতে চাইলেন, কেমন সারপ্রাইজ “বলে দিলে তো মজাই নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু প্রাইজ গিভিং’র আগে আমরা মাঠ খালি করে ফেলতে চাই। ভাবলাম তোমাকে বলে রাখি।” সবটুকু শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে আরো জানাল, “আমার এখনো বহু কাজ বাকি আছে। তাই যাচ্ছি মা।” হাত তুলে থামাতে গেলেও চলে গেল শাসা।

এদিকে ব্লেইন আর জেনারেল স্মুটও কী যেন আলোচনা করতে করতে উঠে গেলেন দূরে। আগ্রহ নিয়ে তাকালেন সেনটেইন। পরস্পর বিপরীত একটা জুটি সাদা দাড়ির ছোটখাটো এক দেশনেতা আর লম্বা-চওড়া এক যোদ্ধা ও ল’ইয়ার।

জেনারেল স্মুট জানতে চাইলেন, “নিউ ইয়ার পর্যন্ত কি তুমি বাইরে থাকতে পারবে?”

জানতে পারি কী হবে জেনারেল?” জিজ্ঞেস করলেন ব্লেইন।

 “আমি তোমাকে হাউজে দেখতে চাই। জানি এর জন্য তোমাকে বেশ কিছু আত্মত্যাগ করতে হবে ব্লেইন। এখানে উইন্ডহকে বেশ চমৎকারভাবেই দায়িত্ব পালন করছে আর এতে তোমার নিজস্ব সম্মান ও ক্ষমতাও বাড়ছে। তাই আমার যে চাওয়া তুমি প্রশাসকের পদে ইস্তফা দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পার্টির হয়ে নির্বাচন করো তা অনেক বড় বলিদান হবে।”

উত্তর দিলেন না ব্লেইন। সত্যিই এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারবেন কিনা বুঝতে পারছেন না।

গার্ডেনস’র হয়ে লড়াই করে হার্টজনের বিরুদ্ধে জিতে গেলেও কেবল বিরোধী দলে সিট পাবেন। এর চেয়ে প্রশাসকের পদ অনেক আকর্ষণীয়।

“আমরা তো বিরোধী দলে ও বাস।” সহজ স্বরে জানালেন ব্লেইন। উত্তর দেবার আগে হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে কিকোউ ঘাস নাড়াচাড়া করে দিলেন স্যুট,

“ব্লেইন, তোমার জন্য এটা করব। তাই কথা দাও।”

“অবশ্যই।”

“এখন যদি আমার ওপর ভরসা রাখো তাহলে ছয় মাসের মধ্যে একটা মন্ত্রণালয় পাবে।”

ব্লেইনের চোখে অবিশ্বাস দেখে থেমে গেলেন সুট। গভীরভাবে দম নিয়ে জানালেন, “কোয়ালিশন ব্লেইন, হার্টজগ আর আমি একটা কোয়ালিশন কেবিনেটের ব্যাপারে কাজ করছি। মনে হচ্ছে আগামী বছরের মার্চ নাগাদ ঘোষণা দিতে পারব। আইন মন্ত্রণালয় আমি নিব আর পছন্দ মতন চারজন মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারব। আমার লিস্টে তুমিও আছে।”

আই সি।” পুরো ব্যাপারটার বিশালত্ব অনুভব করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেলেন ব্লেইন। তিনি তো সবসময় এটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখে বললেন,

“গুড বাস, হার্টজগ কেন সম্মত হল সেটাই তো মাথায় আসছে না?” কারণ জানে যে জাতি এখন আর তাকে তেমন বিশ্বাস করে না। তাছাড়া নিজের দলেও বিশৃঙ্খলা চলছে। ওর নিজের কেবিনেট এখন দুর্বিনীত আচরণ করছে।”

“ইয়েস ওড বাস। সত্যিই এটা আমাদের জন্য সুযোগ বটে। কিন্তু গত মাসের ট্রান্সভ্যাল আর জার্মিস্টলের বিজয়ের পর এখন চাইলে আমরাই তো জাতীয় নির্বাচন করতে পারি। জিতেও যাব। কোয়ালিশনের কোনো প্রয়োজনই নেই।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলেন প্রাজ্ঞ জেনারেল। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছো ব্লেইন। কিন্তু তাতে তো লোকে হার্টজগের বিরুদ্ধে ভোট দিবে। আমাদের পার্টিকে ভালোবেসে নয়।”

স্মুট যে কত গভীর আর মহৎ মনের মানুষ বুঝতে পেরে অভিভূত হয়ে গেলেন ব্লেইন।

 “এখন খুব দুঃসময় চলছে। আমাদের চারপাশেই নাচছে ঝড়ো মেঘ। তাই শক্ত একটা কোয়ালিশন কেবিনেট দরকার। তাই সবাইকে একত্র হওয়া দরকার। একের পর এক পুরনো খনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে একসময় আমাদের ভালোবাসার দক্ষিণ আফ্রিকাই নিঃশেষ হয়ে যাবে।”

মাথা নাড়লেন ব্লেইন। পুরো দেশ আজ এসব নিয়ে চিন্তিত। একদিকে শ্বেতাঙ্গ জনগণ খরা আর আদি যুগের কলাকৌশলের কারণে খামারগুলো হারাচ্ছে, দক্ষতার অভাবে বেকার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিশটা গোত্রে বিভক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা গ্রাম ছেড়ে দলে দলে উন্নত জীবনের আশায় শহরের বেকার অপরাধী মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আইন ভঙ্গ করে প্রথমবারের মত অনুভব করছে রাজনৈতিক শক্তির আকর্ষণ।”

“এই সমস্যা আসলেই এখনো আমাদের অগোচরে রয়ে গেল।” ব্লেইন বুঝতে পারলেন সুটের দুশ্চিন্তা। আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতিরা না জানি এর জন্য আমাদেরকেই দোষারোপ করে।”

 “সত্যিই তাই ব্লেইন। আর এ কারণে কোয়ালিশন আর কো-অপারেশন চাই। বিরোধ নয়।”

“সবকিছু কেমন যেন দ্রুত বদলে গেল তাই না? নরম স্বরে জানতে চাইলেন ব্লেইন, “মনে হয় যেন গতকালও বেশ সমৃদ্ধ আর সুখী ছিলাম।”

“তোমাকে আমার দরকার ব্লেইন, চিন্তা করার জন্য কি সময় চাও?” জিজ্ঞেস করলেন সুট।

মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “না। কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন ওড় বাস।”

“আমি জানতাম তাই বলবে।”

চোখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই সেনটেইনকে দেখে দূর থেকেও লজ্জা পেয়ে গেলেন ব্লেইন। চারপাশের মন্দা থেকেই তাঁর স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, সেনটেইন যে ঐশ্বর্য হারাচ্ছেন কেপ টাউনে গিয়ে তিনি তাই ভোগ করবেন ভাবতে গিয়ে ভীষণ লজ্জা পেলেন কর্নেল।

আর তারপর ইসাবেলাকে দেখেই খানিকটা কমে গেল অপরাধবোধ। এদিকে আবার মুট বললেন, “আমি আরো চারদিন এখানকার অতিথি হয়ে থাকব। এই ফাঁকে ব্যারি হার্টজগের সাথে গোপন একটা মিটিং করে কোয়ালিশনের ব্যাপারে ফাইনাল কথাও বলা হবে। তাই তুমি কাছেই থেকো। যেন ডাকলেই পাওয়া যায়।”

“অবশ্যই।” বহু কষ্টে নিজের আবেগ দমন করলেন ব্লেইন। “আপনি কি। চান আমি এখনই ইস্তফা দিয়ে দেই?”

 “চিঠিটা ড্রাফট করে রাখো। হার্টজগকে আমি তোমার কারণগুলো বুঝিয়ে বলার পরে তুমি নিজেই তার হাতে রেজিগেনশন তুলে দিও।”

বারবার আড়চোখে হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই মুট তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলেন ব্লেইনকে, “যাও তোমাকে ম্যাচের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আশা করছি আমি কাপটা তোমার হাতেই তুলে দিব।”

খুব ক্লোজ একটা ম্যাচে ব্লেইন ম্যালকমদের কেপ A’ টিম ট্রান্সভ্যাল A’ কে হারিয়ে দিল। কিন্তু পুরস্কার বিতরণীর সময় দেখা গেল সবাই আসলেও জুনিয়র চ্যাম্পিয়নদের দেখা নেই।

“শাসা কোথায়?” টুর্নামেন্টের আয়োজক সাইরিলের দিকে তাকিয়ে বেঁকিয়ে উঠলেন সেনটেইন।

অসহায় চোখে সাইরিল জানাল, “আমাকে তো বলেছিল যে চল আসবে।

 এটাই যদি ওর সারপ্রাইজ হয় তো–উৎসুক অতিথিরা তাকিয়ে আছে দেখে দ্রুত নিজের রাগ ঢেকে হেসে ফেললেন, বললেন, “ঠিক আছে ওদেরকে ছাড়াই শুরু করতে হবে।”

কিন্তু জেনারেলের পাশে নিজের আসনে বসতে না বসতেই মাথার উপর শোনা গেল উড়োজাহাজের গর্জন। ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে শব্দটা। দর্শকরাও আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল। মাথার উপর আসতেই ছোষ্ট্র সিঙ্গল ইঞ্জিনের এয়ারক্রাফটাকে চিনতে পারলেন সেনটেইন। পুশ মথ। সোজা স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে এগোতেই আচমকা তীব্র গতিতে নাক খাড়া করে আকাশের উপরে চলে গেল বিমান। আতঙ্কে চিৎকার শুরু করল এক নারী।

এদিকে এয়ারক্রাফটের সাইড উইন্ডো দিয়ে শাসার মুখখানা দেখেই স্তম্ভিতে হয়ে গেলেন সেনটেইন। মনে পড়ে গেল মাইকেল কোর্টনির মুখ। যেন শাসা নয় মাইকেলই ককপিট থেকে হাত নাড়ছে।

প্লেন পাগলের মত বার কয়েক চক্কর মেরে ওক গাছের উপর আসতেই দাঁড়িয়ে গেলেন সেনটেইন। বুক চিরে বেরিয়ে এল নীরব আর্তনাদ। মনে হল মর্ট হোমের দুর্গের উপর হলুদ স্কাউট প্লেনের ক্ষত-বিক্ষত ধ্বংসাবশেষ নিয়ে নেমে আসছেন মাইকেল।

“মাইকেল!” মনে মনে স্বামীর নাম ডাকতে লাগলেন সেনটেইন। চোখের সামনে ভেসে উঠল লম্বা বিচু গাছের উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়া হলুদ প্লেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে জ্বলে উঠল ভয়ংকর সুন্দর এক ফুলের শিখা, খোলা ককপিটের মানুষটা চোখের সামনেই জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল।

“মাইকেল!” আতঙ্কে সেনটেইনের দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে। এমন সময় অলৌকিক মুছে গেল সব দৃশ্য। পোলো ফিল্ডের ওপর চমৎকারভাবে ল্যান্ড করল ছোট্ট নীল মেশিন। ট্যাক্সিং করে স্ট্যান্ডের কাছে এসে থেমে গেল প্লেন। কেবিনের দু’পাশের দরজা খুলে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে নেমে এল শাসা কোর্টনি.আর তার বিজয়ী তিন বন্ধু।

“সারপ্রাইজ এভরিবডি।” একসাথে চিৎকার জুড়ে দিল ছেলেরা। সাথে সাথে হাততালি দিয়ে হাস্যমুখে তাদের বরণ করে নিল সমস্ত দর্শক। এগিয়ে এসে জেনারেল স্মুটের কাছ থেকে রুপার কাপ নিল শাসা।

এতটুকু ককপিটে যে এতজনের জায়গা হয়েছে সেটা দেখেই তো সেনটেইন অবাক হয়েছেন। তার উপরে এখন আবার পাইলটের আসন ছেড়ে নেমে এল জক মারফি। তার মানে সেই হল নাটের গুরু। তিনি নিজে শাসাকে সবসময় ওড়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে আসলেও বাবার ছবি বিছানার পাশে নিয়ে ঘুমায় তার ছেলে। তাই এরকমটা তো হওয়ারই কথা। কিন্তু একেবারে না বলে-কয়ে শাসা এরকম করবে সেনটেইন ভাবতেই পারেননি। যাই হোক, চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন যে শাসা কাপ হাতে নিয়ে ধন্যবাদসূচক স্পিচ দিচ্ছে :

লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, আপনারা হয়ত ভাববেন যে জক মারফি পুশ মখ চালিয়েছেন। সে কিন্তু কন্ট্রোল স্পর্শই করেনি। তারপর টেকো মাথা ইনস্ট্রাকটরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, “দেখলে, বলেছিলাম না আমি আমার বাবার মতই হব।”

সবাই আবার হাততালি দিয়ে শাসাকে উৎসাহ দিয়ে উঠলেও ধক ধক করে উঠল সেনটেইনের বুক।

***

যেমন করে এসেছিল তেমনি আচমকা ওয়েল্টেভ্রেদেনের জীবন উলট-পালট করে দিয়ে চলে গেল সকল অতিথি। পড়ে রইল কেবল হতশ্রী পোললা গ্রাউন্ড, খালি শ্যাম্পেনের বোতল, একগাদা আবর্জনা আর নোংরা টেবিলক্লথ। সেনটেইনের অস্ত্র ভান্ডারের শেষ পোলাটাও ছোঁড়া হয়ে গেছে। মনের মাঝে তাই বিষাদের আবাস।

শনিবারেই চলে এল আমন্ত্রিত কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভিজিটরের দল। বায়োগ্রাফির কাজ করার জন্য সুটকে নিয়ে স্টাডিতে চলে গেলেন স্যার গ্যারি। প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে এসেই লোকটার মুখোমুখি পড়ে গেলেন সেনটেইন আর শাসা। ক্ষুণ্ণ মনে এগিয়ে গেলেন সেনটেইন।

এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ডাইনিংরুমের তৈজসপত্র পরীক্ষায় ব্যস্ত ডেভেনপোস্ট চোখ তুলে তাকালেন মা আর ছেলের দিকে।

ঠোঁট কামড়ে ধরে বিষণ্ণ মুখে এগিয়ে এলেন সেনটেইন।

“সথেবি থেকে মি. ডেভেনপোর্ট এসেছেন শাসা। উনি আমাকে আমাদের পেইন্টিংস আর ফার্নিচার সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিবেন।”

“ওহ, তাহলে তো ভালোই হয়।” আগ্রহী হয়ে উঠল শাসা। আপনি এটা দেখেছেন স্যার? এটা আমার মায়ের সবচেয়ে পছন্দের পেইন্টিং। মা যেখানে জন্মগ্রহণ করেছে সেই এস্টেটের ছবি।”

স্টিলের ফ্রেমের চশমা ঠিকঠাক করে সাইডবোর্ডের ওপর রাখা তৈলচিত্রটা দেখার জন্যে ঝুঁকতেই ফ্রায়েড ডিমের তেল লেগে গেল ডেভেনপোর্টের ওয়েস্ট কোটে।

“১৮৭৫ সালের সাইন করা। সিসলির শ্রেষ্ঠ সময় ছিল তখন।” নোটবুক বের করে খসখস করে কী যেন লিখে নিলেন ডেভেনপোর্ট, “এটা থেকে পাঁচশ পাউন্ড পাওয়া যাবে।”

 “মাত্র পাঁচশ?” জানতে চাইলেন সেনটেইন; বোঝা গেল দাম শুনে খুশি হননি, “আমি তো এর চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছি।” এক কাপ কফি নিয়ে টেবিলের মাথায় চলে এলেন।

“মিসেস কোর্টনি, মাত্র গত মাসেই আমরা নিলামের আয়োজনে ডি মার্লের জন্য চাহিদার চেয়ে নগণ্য এক দাম পেয়েছি। এখন ক্রেতাদের মর্জি মতন চলছে সবকিছু, বুঝলেন।”

“ওহ, চিন্তা করবেন না স্যার” প্লেটে একগাদা ডিম আর মুচমুচে বেকন নিয়ে নিল শাসা, “এগুলো বিক্রির জন্য নয়। তাই না মা?”

কোনো উত্তর না দিয়ে সেনটেইনের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন ডেভেনপোর্ট।

“এবারে সামনের স্যালুনের ভ্যান গঁগের কথা বলি” আসার পর থেকে এই প্রথম শুঁটকি মাছ নিয়ে সত্যিকারের আগ্রহ দেখালেন; মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বললেন,

“আমেরিকাতে ভ্যান গঁগের চাহিদা বেশি। তাই ছবি তুলে আমাদের গুরুতুপূর্ণ কয়েকজন ক্লায়েন্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করছি চার থেকে পাঁচ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত পাওয়া যাবে।”

হাতে কাঁটা চামচ আর ছুরি নামিয়ে রেখে মায়ের দিকে তাকাল বিস্মিত শাসা।

“মি, ডেভেনপোর্ট আমার মনে হয় এ ব্যাপারে পরে কথা বললেই ভাল হয়।” তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন, “পুরো দিন পড়ে আছে। এখন আসুন নাশতাটা উপভোগ করা যাক।”

অর্ধেক খেয়েই উঠে গেল শাসা; কী হয়েছে বুঝতে পেরে সেনটেইন জানতে চাইলেন, “কোথায় যাচ্ছো?”

“আস্তাবলে। আমার ঘোড়াগুলোর খুড় বদলানো হচ্ছে।”

“চলো আমিও যাই।”

পুরোপুরি নিঃশব্দে পাশাপাশি হেঁটে চলল মা আর ছেলে। শাসা চাইছে মা কিছু বলুক আর সেনটেইন কী বলবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছেলেকে আরো আগেই সবকিছু খুলে বললে ভালো হত।

আস্তাবলের গেইটের কাছে আসতেই ছেলের হাত ধরে আঙুর ক্ষেতের দিকে টেনে নিলেন সেনটেইন। ঝরনার কিনারে ওক বেঞ্চের ওপর বসলেন দু’জনে। ছোট্ট একটা পাথুরের গ্রোটো থেকে বেরোচ্ছে মিষ্টি পানির বুদবুদ। খাবার পাবার আশায় কিনারের কাছে চলে এল ট্রাউটের ঝাঁক।

 “শাসা, সথেবী পৃথিবীর বিখ্যাত নিলাম প্রতিষ্ঠান আর ডেভেনপোর্ট আমাদের হয়ে ওয়েন্টেলেদেন বিক্রির জন্যই এখানে এসেছেন।” পরিষ্কার কণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করার সাথে সাথে নিশ্চুপ হয়ে পড়লেন সেনটেইন। হতাশার ভারে কাঁপতে কাঁপতে মনে হচ্ছে যেন পড়েই যাবেন।

“মানে পেইন্টিংসগুলো?” সাবধানে জানতে চাইল শাসা।

 “না শুধু পেইন্টিংস নয়, ফার্নিচার, কার্পেট, রুপার তৈজসপত্র সবকিছু।” খানিক থেমে নিজেকে ধাতস্থ করে জানালেন বাকিটা, “এই এস্টেট, দুর্গ, তোমার ঘোড়া সবকিছু।”

 একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল শাসা। মায়ের কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। সেই চার বছর বয়স থেকেই ওয়েল্টেলেদেন আছে।

“শাসা, আমরা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি, বাবু। সেই ডাকাতির পর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। তাই ঋণ পরিশোধের জন্য ওয়েল্টেলেদেন বিক্রি করতেই হবে।” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ভাঙা গলায় জানালেন, “আমরা আর ধনী নই শাসা, সব ধ্বংস হয়ে গেছে।” ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। সেও বুঝি মায়ের মতই ভেঙে পড়বে। কিন্তু না, হাত বাড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল শাসা।

“আমরা গরিব হয়ে গেছি শাসা” বুঝতে পারলেন ছেলে মানসিকভাবে কতটা বিশৃঙ্খলতার মাঝে পড়ে গেছে।

“তুমি জানো মা” অবশেষে মুখ খুলল শাসা, “আমি কয়েকজন গরিব লোককে চিনি। স্কুলের কয়েকটা ছেলে, ওদের বাবা-মায়ের অবস্থা তেমন ভালো না। কিন্তু তাতে কিন্তু ছেলেগুলোর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ওরা বেশ হাসিখুশি থাকে। তাই একবার অভ্যেস হয়ে গেলে তখন আর কোনো কষ্ট হবে না।”

“আমার কখনো অভ্যাস হবে না শাসা। আমি এ অবস্থাকে ঘৃণা করি।” জানালেন সেনটেইন।

“আমিও তাই। ইশ তোমাকে যদি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারতাম।” শাসা নিজেও মনে হল ক্ষেপে গেছে।

শাসাকে রেখে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে এলেন সেনটেইন। পথে অবশ্য দু’একবার থেমে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীদের সাথেও কথা বললেন। তার পরিবারের সদস্য হতে পেরে লোকগুলো সত্যিই খুশি। ওদের হাস্যমুখ দেখে আরো মন খারাপ হয়ে গেল। তাই আঙুর ক্ষেতের কোনায় পাথরের দেয়ালের উপর উঠে খানিক ঘুরে বেড়ালেন আঙুরের গাছের সারির মাঝখানে। থোকায় থোকায় ফুটে আছে নতুন আঙুর। হাত বাড়িয়ে ফলগুলো স্পর্শ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন। যেন বিদায় নিতে এসেছেন। সাথে কেউ না থাকায় অনেকক্ষণ একাকী দাঁড়িয়ে কাঁদলেন সেনটেইন।

হতাশা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার দৃঢ় মনোবল। ব্যর্থতার ভারে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন যে মনে হচ্ছে সবকিছু নতুন করে শুরু করার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। জীবনে প্রথমবারের মত হারিয়ে ফেলেছেন সামনে এগিয়ে যাবার সাহস আর ইচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকেন। আচমকা ইচ্ছেটা এত প্রবল হয়ে উঠল যে, পা চালিয়ে আর ক্ষেত থেকে বের হয়ে আসলেন। লনের উপর দিয়ে দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চলে এলেন স্টাড়িতে। তারপর ডেস্কের কাছে গিয়ে খুলে ফেললেন ড্রয়ার।

একবার স্যার গ্যারিই এই পিস্তলটা উপহার দিয়েছিলেন। পিস্তল এসেছে। ইটালি থেকে। হাতলে হানি মাইনের হিরে।

চেক করতেই দেখা গেল প্রতিটা চেম্বারে লোড করা আছে বুলেট। সেনটেইন গভীর ভাবে দম নিয়ে পিস্তলের নল ঠেকালেন নিজের মাথায় আর আশ্চর্য যে হাত দুটো একটুও কাঁপছে না।

কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতেই রুমের ওপাশের দেয়ালে ঝোলানো আয়নায় চোখে পড়ল নিজের প্রতিবিম্ব। দু’পাশের ফুলদানিতে বাগান থেকে আনা তাজা হলুদ ফুল থাকায় মনে হচ্ছে বুঝি ফুলে ছাওয়া কফিনেই শুয়ে আছেন।

তবে আচমকাই কেন যেন আবার প্রচণ্ড রাগ হল। মনে হল গরম কয়লার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে গাল। “নাহ, এত সহজে পার পাওয়া যাবে না। তাই পিস্তল খুলে পিতলের কার্টিজ পুরো কার্পেটে ছড়িয়ে অস্ত্রটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন দূরে। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

তার রাইডিং বুটের আওয়াজ পেয়েই সুইটের কাছে এসে জড়ো হল পরিচারিকার দল। গোলাকার মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন সেনটেইন।

“লিলি আমার গোসলের পানি দিয়েছো?” তাড়াতাড়ি বাথরুমের দিকে দৌড় দিল লিলি আর দ্বিতীয় জন তার পিছু নিয়ে ড্রেসিংরুমে গেল।

“গ্লাডিস, দেখো তো লিলি পানি গরম করেছে কিনা।”

হলুদ সিল্কের রোব পরে বিশাল মার্বেল টাবের কাছে চলে এলেন সেনটেইন। চিবুক পর্যন্ত পানিতে ডুবে গিয়ে চাইলেন মনের রাগ কমাতে। কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠল হিরের হাতলঅলা পিস্তল। জোর করে দৃশ্যটাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করলেন সেনটেইন কোর্টনি।

“তুমি তো কখনো এতটা কাপুরুষ ছিলে না সেনটেইন।” গোসল সেরে সামার কালারের ড্রেস পরতে পরতেই নিজেকে জানালেন সেনটেইন। এমনকি সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় মুখটাকেও হাসি-খুশিই রাখলেন।

নিচে অপেক্ষা করছেন ডেভেনপোর্ট আর সিরিল স্নেইনি।

“অনেক সময় নষ্ট হল জেন্টেলম্যান, চলুন শুরু করা যাক।”

এত বড় প্রাসাদের প্রতিটি আইটেমের নাম্বার দেয়া, বর্ণনা লেখা, কাঙ্ক্ষিত মূল্য নির্ধারণ, ছবি ভোলা প্রভৃতি সবকিছুর ক্যাটালগ করাটা বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজ। দশ দিন বাদেই ইংল্যান্ডে চলে যাবেন ডেভেনপোর্ট। তার আগেই সমস্ত কাজ সমাধা করতে হবে। প্রকৃত নিলাম শুরু হবে তিনমাস পরে।

কয়েকদিন বাদে ডেভেনপোর্টের যাত্রার সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে জাহাজ ঘাটে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন সেনটেইন। সচরাচর এসব দায়িত্ব সিরিলই পালন করেন।

 কেপটাউনবাসীর জন্য মেইল শিপ দেখা বেশ উত্তেজনাময় একটা ঘটনা। তাই প্যাসেঞ্জার আর তাদেরকে বিদায় জানাতে আসা অতিথির ভিড়ে গিজগিজ করছে বন্দর।

 ফার্স্ট ক্লাস এনট্রির কাছে এসে প্যাসেঞ্জার লিস্ট বের করে দেখলেন সেনটেইন। খুঁজে পেলেন ম্যালকমস, মিসেস ই. কেবিন এ-১৬ ম্যালকমস, মিস টি. এ-১৭ ম্যালকমস, মিস এস, এ-১৭।

তার মানে পরিকল্পনামত জাহাজে চড়েছে ম্যালকমস, পরিবার আর সেই পোলো টুর্নামেন্টের পর আর ব্লেইনের সাথে দেখাও হয়নি। তাই কর্নেলের সাথে দেখা হওয়ার আশায় জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের ধোয়ায় ঢাকা স্যালুন আর লাউঞ্জের মাঝে দিয়ে ঘুরে এলেন সেনটেইন।

কিন্তু নাহ, পাওয়া গেল না। তাহলে সম্ভবত ইসাবেলার কেবিনে উঠেছেন। ইচ্ছে হল তক্ষুণি ছুটে চলে যান ১৬ নম্বর কেবিনে। কিন্তু তা না করে মেইল লাউঞ্জে বসে পরিচিত কয়েকজনের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন।

উপস্থিত সবাই তার প্রতি কতটা মনোযোগ দিচ্ছে দেখে মনে মনে খুশি হলেন সেনটেইন। অর্থাৎ পোলো টুর্নামেন্টে ঢালাও খরচ করে মানুষের মাঝে তার আর্থিক দৈন্যতার ফিসফাস বন্ধ করে দিতে পেরেছেন। কিন্তু শীঘই তা পালটে যাবে। ভাবতেই তিক্ত হয়ে উঠল মন। যাই হোক, বেজে উঠল জাহাজের ভে। ফাইনাল ওয়ার্নিং সুলভ বাজানো হচ্ছে এ বাঁশি।

ব্লেইনের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। তারপর মি. ডেভেনপোর্টর সাথে হ্যান্ডশেক করে খাড়া গ্যাংওয়ে বেয়ে নিচে নেমে এলেন সেনটেইন।

হঠাৎ করে চোখে পড়ল ব্লেইনের বড় মেয়ে তারার উপর। বয়সে বড়সড় মেয়েটাকে গাঢুরঙা ড্রেসে চমৎকার দেখাচ্ছে। চুলগুলো আধুনিক ঢঙ্গে বাঁধা। পাশেই ওর বোন রেলিং থেকে ঝুঁকে কার উদ্দেশে যেন পাগলের মত রুমাল নাড়ছে। পেছনে ইসাবেলার হুইল চেয়ার।

আর তারপরেই তাকে দেখতে পেলেন। দৈত্যাকৃতির লোডিং ক্রেনে চড়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন কর্নেল ব্লেইন। পরনে ট্রপিক্যাল স্যুট আর নীল-সবুজ রেজিমেন্ট টাই। ভিড় থেকে দূরে সরে এলেন সেনটেইন। যেন নিজের মত করে চেয়ে দেখতে পারেন ব্লেইনের চেহারা। “ওই হল একমাত্র যা আমি কখনো হারাব না। ওয়েন্টেলেদেন আর হানি না থাকলেও সে ঠিকই থাকবে।” ভাবনাটায় আনন্দ থাকলেও হঠাৎ করে মনে হল, “যখন আমার ধন সম্পদ কিছুই থাকবে না, সাধারণ এক নারী আর পুত্রসন্তানের মা হয়ে যাব তখনো কি ব্লেইন আমাকে ভালোবাসবে?” ভাবতেই রীতিমত যেন অসুস্থ বোধ করলেন সেনটেইন।

খানিক পরেই বেজে উঠল সাইরেন। আস্তে আস্ত চলতে শুরু করল। জাহাজ। কিন্তু ব্লেইন এখনো ক্রেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের ওপর হাত দিয়ে লম্বা জাহাজের খোঁজে টেবিল মাউন্টেনের দিকে তাকালেও চেহারায় নেমে এল বিষণ্ণতা। আর তারপর হঠাৎ করে মাথার টুপি খুলে ঘুরে নিচে তাকাতেই দেখলেন দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন।

আচমকা নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী বোধ করলেন সেনটেইন। ব্যক্তিগত এই মুহূর্তেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ব্লেইনের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছিলেন ভাবতেই লজ্জা পেলেন। কর্নেলের চেহারাও মনে হল শক্ত হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ক্রেন থেকে নেমে টুপি মাথায় দিয়ে হেঁটে এলেন সেনটেইনের কাছে। আস্তে করে জানতে চাইলেন, “আমরা একা হতে পারি? তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্যে আর তর সইছে না।”

সাথে সাথে কেটে গেল সেনটেইনের সমস্ত ভয় আর দ্বিধা। আনন্দে দিশেহারা হয়ে মনে হল সেই তরুণ বয়সে ফিরে গেছেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে ভাবলেন, “ব্লেইন আমাকে সর্বদা ভালোবাসবে।”

***

হাই অফিসের কোনো রকম চিহ্নবিহীন একটা গাড়িতে চড়ে ওয়েন্টেভ্রেদেনে এলেন জেনারেল জেমস ব্যারি মুনিক হার্টজগ। লম্বা আর সুদর্শন হার্টজগ লাইব্রেরিতে ঢুকতেই সবুজ কাভার দেয়া টেবিলের ওপাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন জ্যান সুট।

“তো!” হাত মেলাতে গিয়ে খিটখিটে স্বরে হার্টজগ জানালেন, “আলোচনার জন্য যতটা আশা করেছিলাম মনে হয় না ততটা সময় পাওয়া যাবে।”

চোখ নামিয়ে ব্লেইন ম্যালকমস, ডেনিস রিটজ আর নিজের আরো দুজন মনোনীত প্রার্থীর দিকে তাকালেন সুট। যাই হোক, হার্টজগ আর ফিন্যান্স মিনিস্টার নিকোলাস হ্যাঁভেঞ্জা না বসা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বললেন না।

“আমরা এখানে নিরাপদ তো?” লাইব্রেরির মেহগনি কাঠ দিয়ে বানানো জোড়া দরজার দিকে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইলেন হার্টজগ! চোখ বোলালেন সিলিং পর্যন্ত লম্বা সদৃশ্য কাঠের তাকে মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো সেনটেইনের বইয়ের কালেকশনের ওপর।

 “পুরোপুরি নিরাপদ।” প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন জ্যান মুট, “আমি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, এখানে আঁড়িপাতার মতন কিছু ঘটবে না।”

প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়তেই নিজের বক্তব্য শুরু করলেন হাভেঞ্জা, “আপিল ডিভিশন থেকে তিয়েলমান রুজ পদত্যাগ করেছেন।” সবাই ভাবত দক্ষিণ আফ্রিকাতে হার্টজগের উত্তরসূরি হচ্ছেন তিয়েলমান। কিন্তু গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে মতবিরোধ লাগাতে রাজনীতি থেকে সরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এখন সেখান থেকেও সরে গেছেন।

“উনি তো বেশ প্রভাবশালী।” সবিস্ময়ে জানালেন ব্লেইন।

“কিন্তু আমাদের নীতি নিয়ে তো কোনো সন্দেহ প্রকাশের সুযোগও দেয়া যায় না।” মন্তব্য করলেন হার্টজগ “তাই আমাদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে গোন্ডের ক্ষেত্রে ঐকমত্য গড়ে তোলা। যেন রুজ কোনো ঘোষণা দিলেও আমরা তার চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকতে পারি।” সরাসরি স্মুটের দিকে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী।

 “আমিও এতে একমত।” উত্তরে জানালেন মুট। “কাজ শুরু করার আগেই আমাদের নব কোয়ালিশনের অস্তিত্বকে হুমকির মাঝে ফেলাটা বরদাশত করা যাবে না।”

 “এখন একটা সংকটকাল চলছে।” মাঝখানে বলে উঠলেন হাভেঞ্জা, “এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি জানতে পারি ওড বাস?”

“আপনি সেটা জানেন। মনে আছে নিশ্চয় আমি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের ক্ষেত্রে গ্রেট ব্রিটেনের নীতি অনুসরণ করতে বলেছিলাম। এখনো আমি সে কথাই বলব।”

“আপনার কারণগুলো কি আরেকবার জানাবেন?”

একটা সময় আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম যে দক্ষিণ আফ্রিকার গোল্ড পাউন্ড স্টালিং-র সাথে যুদ্ধ শুরু করবে, তাই কিন্তু হয়েছে।” অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন সরকারের দুই প্রধান ব্যক্তি। “ফলে মূলধনের অভাবে পঙ্গু হয়ে গেল আমাদের শিল্প আর হাজার হাজার শ্রমিক তাদের কাজ হারাল।

“কিন্তু এখন যদি আমরা এই পর্যায়ে এসে স্বর্ণের স্ট্যান্ডার্ড পরিত্যাগ করি তাহলে দেশের কী উপকার হবে?”

“তাহলে সবার আগে চাঙ্গা হয়ে উঠবে আমাদের স্বর্ণ খনির ওপর নির্ভরশীল শিল্প। যেমন খনিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলা খুলে যাবে। নতুন নতুন খনিতে আরো হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। আমার আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।”

হঠাৎ করেই হার্টজগ জানালেন, কিন্তু টাইমিং? স্টক এক্সচেঞ্জে তো তাহলে বিশৃঙ্খল শুরু হবে যাবে। বড়দিনের আগে আর মাত্র তিনটা ট্রেনিং ডে আছে। তাই এক্সচেঞ্জ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।” হার্টজগের কথা শুনেই মনে মনে উত্তেজনা অনুভব করলেন ব্লেইন। তার মানে প্রধানমন্ত্রী স্মুটের আইডিয়া মেনে নিয়েছেন।

“তিয়েলমানকেও আমি তার ঘোষণা প্রচারের জন্য রুখে দিতে পারব।” নিজের কথা শেষ করলেন, হার্টজগ।

সেইদিন সন্ধ্যায় ওয়েল্টেভ্রেদেনে নিজের ফোর্ডের দিকে হাঁটতে গিয়ে ভেতরে অসীম ক্ষমতার স্বাদ টের পেলেন ব্লেইন ম্যালকমস। রাজনীতিতে যোগ দেবার মাধ্যমে তিনি ধ্বংস করে দেবেন তার দেশ আর জনগণকে বিনাশকারী অপশক্তি এই ক্ষমতার তরবারি।

“আমিও এখন ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছি।”

ইচ্ছে করেই প্রধানমন্ত্রীর আর বাকি গাড়িগুলোকে সাইড দিলেন কর্নেল। তারপর সবাই চলে যেতেই আরো খানিক অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে কেউ তার পিছু নিচ্ছে না।

তাই ফোর্ডের ইঞ্জিন চালু করে ইউ টার্ন নিয়ে চলে এলেন সেনটেইনের বাড়ির পেছনের দিকে। একের পর এক পাইনের সারি থাকায় দুর্গ থেকে এ রাস্তাটা চোখে পড়ে না।

 গাছের নিচে ফোর্ড পার্ক করে কিছুদূর হেঁটে এগোতেই চোখে পড়ল হোয়াইট ওয়াশড় করা দেয়াল। ঠিক যেমনটা সেনটেইন বলেছেন সেভাবে ডুবন্ত সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে কটেজ।

দরজায় থেমে গেলেন ব্লেইন। খোলা চুলার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সেনটেইন ব্লেইনের পদশব্দ পাননি। তাই তার অজান্তে মন ভরে সেনটেইনকে দেখে নিচ্ছেন ব্লেইন। গভীর এক মমতায় ভরে উঠল কর্নেলের বুক। সামান্য গলা খাকারি দিতেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।

“আমি আরো ভেবেছি তুমি আসবে না।” দৌড়ে গিয়ে ব্লেইনকে জড়িয়ে ধরে কিস করলেন। তারপর বললেন,

“তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

 “হুম। দিনটা বেশ লম্বা ছিল।”

“এসো।” ব্লেইনকে হাত ধরে খোলা চুলার পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন সেনটেইন। তারপর জ্যাকেটটাও খুলে কাবার্ডে রেখে নিয়ে এলেন হুইস্কির গ্লাস।

“ঠিক আছে”।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “পারফেক্ট।” চোখ বুলিয়ে কটেজের সাদাসিধে ফার্নিচার, ফুলের ভাস্ দেখে বললেন, “বেশ সুন্দর।”

ওদিকে চুরুট রেডি করতে গিয়ে সেনটেইন জানালেন, “সারাদিন খেটে তোমার জন্য সব সাজিয়েছি। স্যার গ্যারিকে বিয়ে করার আগে অ্যানা এখানে থাকত। তারপর থেকে খালিই পড়ে আছে। এখন আমরা থাকব ব্লেইন।” ব্লেইনের হাতে চুরুট দিয়ে তার পায়ের কাছে কুশন এনে বসলেন সেনটেইন। তারপর কর্নেলের হাঁটুর ওপর হাত রেখে তাকালেন মুখের দিকে।

কতক্ষণ থাকবে?”

“ওয়েল” গভীর চিন্তায় পড়ে যাবার ভান করলেন কর্নেল, “তুমি আমাকে কতক্ষণ চাও? এক ঘণ্টা? নাকি আরো বেশি হাত দিয়ে তার হাঁটু চেপে ধরলেন সেনটেইন, “পুরো রাত।”

 ওয়েন্টেলেদেনের রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসা রোস্টেড বী টার্কি আর নিজের ক্ষেতের আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইন দিয়ে ডিনার সারলেন দুজনে।

তারপর আগুনের সামনে মাদুর পেতে বসে কফি খেতে খেতে সেনটেইনের চুলে মাথায় ঘাড়ে আঙুল বুলিয়ে দিলেন ব্লেইন।

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?” আচমকা সেনটেইন উঠে দাঁড়াতেই জানতে চাইলেন কর্নেল।

“চুরুট শেষ করে এসো, দেখে যাও।”

সেনটেইনের আদেশ কি আর ফেলতে পারেন কর্নেল। তাই বেডরুমে ঢুকতেই দেখলেন নিচু বিছানাটার মাঝখানে নাইট ড্রেস পরে বসে আছেন সেনটেইন। দুহাত বাড়িয়ে ডাকলেন কর্নেলকে।

অন্যান্য রাতগুলোর তুলনায় আজ তাদের ভালোবাসা হল বেশ ঢিমেতালে। যেন প্রতিটি মুহূর্তই হল বিশেষ। এতদিনে সেনটেইনের শরীর আর তার চাহিদা সম্পর্কে জেনে গেছেন ব্লেইন। তাই নিজের দায়িতুও তিনি সম্পূর্ণরূপে পালন করলেন। মনে হল পরস্পরের রক্তও যেন আজ এক সুরে নেচে উঠল। মনে হল যেন দুজনে মিলে আজ এক হয়ে উঠলেন।

***

কটেজের জানালা দিয়ে পাখিদের কিচির-মিচির ভেসে আসতেই ঘুম থেকে জেগে উঠলেন ব্লেইন। পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো মাথার ওপর তৈরি করেছে অদ্ভুত সোনালি সব নকশা।

আস্তে আস্তে পাশ ফিরে সেনটেইনের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকালেন ব্লেইন। বালিশ ছুঁড়ে ফেলে ম্যাট্রেসের ওপর শুয়ে আছেন তার ভালোবাসার নারী। ঠোঁট দুটো প্রায় তার কাধ স্পর্শ করে রেখেছে। বন্ধ চোখের পাতার চামড়ার নিচে ফুটে উঠেছে নীল শিরা। মুখের কোণে খানিকটা চিন্তার ভাঁজ। “মাই পুওর ডার্লিং, তোমার এই দুঃসময়ে শুধু যদি কিছু করতে পারতাম।” আচমকা কথাটা মনে হতেই শক্ত হয়ে উঠল রেইনের শরীর।

পাশে শুয়ে থাকা এই নারী তাঁকে বিনা শর্তে ভালোবেসেছেন। চাইবার আগে ব্লেইনকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন। সেনটেইনই বলেছেন এমন কিছু তারা কখনোই করবেন না যাতে অন্য কেউ ব্যথিত হন। অথচ বিনিময়ে ব্লেইনের কাছ থেকে সোনা কিংবা প্রতিজ্ঞা কিছুই চাননি।

অন্যদিকে সম্মান আর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেকে মহৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্লেইন। ভালোবাসা হয়েছে উপেক্ষিত। তাহলে তিনি কার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন? যাকে ভালোবাসেন তার সাথে নাকি স্ত্রীর সাথে?

আস্তে করে চাদর সরিয়ে উঠে গেলেন ব্লেইন। ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে গেলেন সেনটেইন। তিনি গত রাতেই বাথরুমে নতুন রেজর আর টুথব্রাশ রেখে দিয়েছেন ব্লেইনের জন্যে। দেখে তো মনে মনে আরো বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন কনেল।

পা টিপেটিপে রুমে এসে দাঁড়ালেন বিছানার পাশে। আপন মনেই ভাবলেন, “আমি এখন চলে গেলেও সেনটেইন কখনোই আমার বিশ্বাসঘাতকতা টের পাবে না। কিন্তু না তাতে তো তিনিও শান্তি পাবেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

নিচু হয়ে চোখের পাতা স্পর্শ করতেই জেগে গেলেন সেনটেইন। ব্লেইনকে দেখে তৃপ্ত মুখে হাসলেন,

“ডার্লিং কয়টা বাজে?”

“সেনটেইন, ঘুম ভেঙেছে?”

তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন সেনটেইন, “ওহ ব্লেইন, তুমি পোশাক পরে তৈরিও হয়ে গেছো? এত তাড়াতাড়ি!”

“আমার কথা শোনো সেনটেইন, ব্যাপারটা খুবই জরুরি।”

মাথা নেড়ে মনোযোগ দিয়ে কর্নেলের দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“আমরা গোল্ড ছেড়ে দিচ্ছি।” খসখসে গলায় জানালেন ব্লেইন; অপরাধবোধের চোরাকাটা বিধে আছে কণ্ঠে। “মাত্র গতকালকেই ওড় বাস আর ব্যারি হার্টজগ মিলে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিউ ইয়ারে খোলার আগেই ঘোষণা দিয়ে দেবেন।”

পুরো পাঁচ সেকেন্ড শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকার পর আচমকা কথাটার মর্ম বুঝতে পারলেন সেনটেইন। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল চোখ। কিন্তু হঠাৎই আবার নিভে গেল সেই আলো।

“ওহ, গড, মাই ডার্লিং, এত গোপন একটা তথ্য আমাকে দিয়েছে। তোমার কর্তব্যের কথাও ভাবোনি।” আবেগে কেঁপে উঠল গলা, “তুমি সত্যিই আমাকে এতটা ভালোবাসো।”

 কিন্তু ব্লেইন এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যে সেনটেইন বুঝতে পারলেন কর্নেলের অনুশোচনা; বিছানার উপর হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ব্লেইন, তুমি আমাকে যা বলেছো আমি এর কোনো অন্যায় ফায়দা লুটব না, আমি কাউকে বলব না”।

“সেনটেইন আমি কখনোই তোমাকে ঘৃণা করতে পারব না, কখনোই না।” লম্বা লম্বা পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন কর্নেল।

সেনটেইনের মন চাইল ছুটে গিয়ে ব্লেইনের পিছু নেন; কিন্তু বুঝতে পারলেন এ মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। উপলব্ধি করলেন আহত সিংহের মতই কিছু সময় একাকী কাটাতে চান ব্লেইন।

***

ওয়েল্টেভ্রেদেনে নিজের ডেস্কে বসে আছেন সেনটেইন। সামনে আইভরি আর পিতলের তৈরি টেলিফোন।

মনে মনে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন যা করতে চাইছেন তা সমাজ আর আইনের চোখে জঘন্য অপরাধ। এমনকি বিপজ্জনক এই ভ্ৰমণ হয়ত তাকে সম্মানহানির কলংক আর কারাগার পর্যন্ত নিয়ে যাবে।

আর ঠিক তক্ষুনি বেজে উঠল ফোন। গভীর দম নিয়ে হ্যান্ডসেট তুললেন সেনটেইন।

 “আমি মি. সোয়েলসকে লাইন দিয়েছি মিসেস কোর্টনি” শোনা গেল সেক্রেটারির গলা।

ধন্যবাদ নাইজেল।”

“মিসেস কোর্টনি” একটু পরেই কথা বললেন সোয়েলস; স্টকব্রোকার ফার্মের সিনিয়র পার্টনার জানালেন, “উৎসবের শুভেচ্ছা নিন।”

ধন্যবাদ মি, সোয়েলস। আপনার জন্যে একটা বায়িং অর্ডার আছে। আজ মার্কেট বন্ধ হবার আগেই ফিল আপ করা চাই।”

“অফকোর্স।”

“প্লিজ পাঁচশ হাজার ইস্ট র‍্যান্ড প্রোপাইটরি মাইনস্ কিনুন।” পুরোপুরি নিস্তব্ধতা নেমে এল ফোনের ওপাশে।

বহুক্ষণ বাদে অবশেষে সোয়েলস বললেন, “এটা তো প্রায় ছয়শ’ হাজার পাউন্ড।

“ঠিক তাই।”

 “মিসেস কোর্টনি-” ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন সোয়েলস।

 “কোনো সমস্যা?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।

না, না, আসলে আমি এত অবাক হয়ে গেছি যে, যাই হোক আমি এক্ষুণি কাজ করে দিচ্ছি।”

 “আপনার কন্ট্রাকট নোট পাবার সাথে সাথে আমি চেক পাঠিয়ে দেব।” তারপর একটু বিরতি দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “নাকি এক্ষুণি কোন ডিপোজিট চান?”

নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলেন সেনটেইন। কারণ যদি সোয়েলস চেয়ে বসে এত বড় অ্যামাউন্ট উনি কোত্থেকে দিবেন?

“ওহ, মিসেস কোর্টনি। আমি সত্যিই লজ্জিত। ঠিক আছে কোন তাড়াহুড়া নেই। আমরা আপনাকে কনট্রাকট নোট পাঠিয়ে দিচ্ছি। আগামীকাল সকালেই কনফার্ম করতে পারব।”

 সেনটেইনের হাত এতটাই কাঁপছে যে টেলিফোন সেট জায়গামত রাখতে গিয়েও হিমশিম খেয়ে গেলেন।

“এটা আমি কী করলাম। এত বড় জালিয়াতির জন্যে ন্যূনতম দশ বছর সাজা তো নিশ্চিত! দেউলিয়া হওয়া সত্ত্বেও আরো হাফ মিলিয়ন ঋণের বোঝা মাথায় নিচ্ছেন। ভাবলেন এক্ষুণি ফোন করে অর্ডার ক্যানসেল করে দেবেন। কিন্তু তার আগেই আবার রিং বেজে উঠল,

“মিসেস কোর্টনি মি, এন্ডারসন আর গাইলস লাইনে আছেন।”

“ঠিক আছে নাইজেল” তারপর নিজের ধীরস্থির ভাব দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন, “মি. অ্যান্ডারসন আপনার জন্যে একটা পারচেজ অর্ডার আছে।”

দুপুরের মধ্যে এরকম সাতটা পৃথক ফার্মে ফোন করে মোট সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ডের গোল্ড মাইনিং শেয়ার কিনে নিলেন সেনটেইন। অবশেষে আর স্থির থাকতে পারলেন না।

সেক্রেটারিকে বাকি দুটো ফোন বাতিলের আদেশ দিয়ে চলে এলেন প্রাইভেট বাথরুমে।

সাথে সাথে মুখে হাত দিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলেন পোর্সেলিনের বেসিনে। ধুয়ে-মুছে গেল লজ্জা, আতঙ্ক আর অপরাধবোধ। গলা আর বুক এত জ্বালা করে উঠল যেন অ্যাসিডে ঝলসে গেছে সবকিছু।

***

সেই শাসার ছোটবেলা থেকেই বড়দিন তাদের জন্য বিশেষ একটা দিন। কিন্তু এবার সেনটেইনের ঘুম ভাঙল একরাশ মন খারাপ নিয়ে।

নাইট গাউন পরিহিত অবস্থাতেই নিজের স্কাইটে বসে ছেলের সাথে উপহার বিনিময় করলেন।

মাকে নিজের হাতে তৈরি কার্ড আর ফ্রাঙ্ক মরিয়াকের নতুন নভেল উপহার দিল শাসা; কাভারে লেখা,

 “যাই ঘটুক না কেন আমরা দুজন একসাথেই আছি।” –শাসা

আর ছেলেকে গগলসসহ লেদারের ফ্লাইং হেলমেট দিলেন সেনটেইন। দেখে তো শাসা মহা বিস্মিত। তার মানে মা এখন আর ফ্লাইংকে মানা করবেন না।

“হ্যাঁ, বাবু, তুমি চাইলে ফ্লাইং শিখতে পারো।”

“কিন্তু খরচ? মানে

 “সে চিন্তা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।”

“না মা।” দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল শাসা, “আমি আর শিশু নই মা। এখন থেকে যতটা পারি তোমাকে সাহায্য করব। তাই তোমার জন্য, আমাদের জন্যে দুর্বিসহ কিছু হোক তা চাই না।”

তাড়াতাড়ি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষলেন সেনটেইন। যেন ছেলে তার চোখের পানি দেখতে না পায়।

“আমরা মরুভূমির সন্তান ডার্লিং। আমাদের কিছু হবে না।”

তারপর সারাদিন অতিথি আপ্যায়ন আর হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকলেও কাটল না মনের মেঘ। পরিচারকদেরকে দেখার বাহানায় চলে এলেন পর্দা ঘেরা স্টাডিতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন নিজের যোদ্ধার প্রতিবিম্ব।

দুপুরের ঠিক আগে আগে বিশপস-এর হেড মাস্টার ফাদার ক্যামন আসাতে অবশ্য সত্যিই খানিকক্ষণের জন্য ভুলে গেলেন সব দুশ্চিন্তা। মা ছেলেকে এক পাশে টেনে নিয়ে ফাদার জানালেন,

“মিসেস কোর্টনি আপনার ছেলে তো স্কুলে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে। যদিও আমাদের সাথে আর মাত্র সামনের বছরটাই আছে। যাই হোক, ওকে আমরা নতুন বছরের জন্যে স্কুলের হেড আর বোর্ড অব গভর্নরের হেড হিসেবে নির্বাচন করেছি।”

সাথে সাথে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন উল্লসিত সেনটেইন, “মা, প্রিন্সিপ্যালের সামনে নয়।” লজ্জা পেয়ে মাকে আস্তে করে শাসিয়ে দিল শাসা।

 “শুধু তাই না মিসেস কোর্টনি, আপনাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বোর্ডে আপনিই হবেন প্রথম নারী।”

তৎক্ষণাৎ রাজি হতে মন চাইলেও চোখের সামনে আর্থিক দুর্দশার চিত্র। ভেসে উঠতেই দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন, “আমি সত্যিই অনেক সম্মানিত বোধ করছি হেড মাস্টার। কিন্তু আমি উত্তরটা আপনাকে নিউ ইয়ারের পরে জানাব।”

তারপর সবশেষ অতিথি চলে যাবার পর পুরো পরিবার নিয়ে পোলো ফিল্ডে নেমে এলেন। সকল স্টাফ, তাদের পরিবার, পিতা-মাতা নিয়ে হাজির হলেন মাঠে। পেনশনভুক্ত বয়স্ক স্টাফরাও এলেন। সবাইকে খামে ভরে ক্রিসমাস বোনাস দিলেন সেনটেইন। বয়স্ক নারীদের অনেকেই জড়িয়ে ধরায় কেঁদে ফেললেন আবেগাপ্লুত সেনটেইন।

শাসা তাই বাদকদলকে ইশারা দিল চমৎকার কিছু বাজিয়ে শোনাবার জন্য। “আলবামা”-র সুরের সাথে সাথে এস্টেটের মিষ্টি ওয়াইন খেয়ে আবার হাসি-আনন্দে মেতে উঠল সবাই।

 ওয়েল্টেভ্রেদের বড়দিনের আরেকটা ঐতিহ্য হল পারিবারিক ডিনার। সেই ছয় বছরের জন্মদিনের পর থেকে এ দিনে নিউ স্টেটমেন্ট থেকে আবৃতি করে শোনায় শাসা। তারপর মা-ছেলে মিলে আবার উপহার বিলি করে সবার জন্য।

বীফ, টার্কির রোস্ট আর ব্ল্যাক ক্রিসমাস পুডিং দিয়ে ডিনার সারার পর সবাই যে যার বেডরুমে চলে গেল। আর এই ফাঁকে জানালা গলে কটেজে চলে এলেন সেনটেইন।

ব্লেইন অপেক্ষা করছেন। সোজা তাই কর্নেলের দিকে দৌড়ে এলেন তিনি, “আমরা সবসময় একসাথে থাকতে পারি না।”

***

নিউ ইয়ারস ডে’তে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ না পেলেও প্রতি ঘন্টায় রেডিওতে খবর শুনছেন সেনটেইন। কিন্তু বুলেটিনে কোনো রাজনৈতিক খবরই নেই। এদিকে ব্লেইনও নিজের নির্বাচনী কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

দিন শেষে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঘুমাতে যাবার পরেও ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখলেন। তাই ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ঘুমের চেষ্টা বাদ দিয়ে উঠে পড়লেন। রাইডিং বুট পরে অন্ধকারেই ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলেন পাঁচ মাইল দূরের ক্লেয়ারমন্ট স্টেশনে।

প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতেই ভ্যান থেকে ছুঁড়ে দেয়া হল নিউজ পেপারের বান্ডিল। সাথে সাথে বিলি করার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের দল, তাদের একজনকে রুপার শিলিং দিয়ে একটা পত্রিকা নিয়ে নিলেন সেনটেইন।

আগ্রহ নিয়ে পাতা উল্টাতেই যেন কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি। হেডলাইনে লেখা—

 দক্ষিণ আফ্রিকা গোল্ড স্ট্যান্ড পরিহার করেছে। ফলে গোল্ড মাইনগুলোর জন্যে এ এক বিশাল সু-সংবাদ।

কোনো রকমে নিচের ছোট কলামগুলোতে চোখ বুলিয়ে আবার ফিরে এলেন ওয়েল্টেলেদেনে। ঘোড়া নিয়ে সোজা পাথরের দেয়ালের উপর উঠে ছুটে বেড়ালেন আঙুর ক্ষেতের মাঝখানে, ওয়েল্টেভ্রেদেন তার, এ সবকিছু ভার। আনন্দে যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন সেনটেইন।

তারপর ঘোড়া আস্তাবলে রেখেই ছুটে এলেন দুর্গে। মন চাইছে কারো সাথে কথা বলতে, ইশ, যদি ব্লেইনকে পাওয়া যেত। কিন্তু ডাইনিংরুমে পাওয়া গেল স্যার গ্যারিকে।

“খবরটা শুনেছো?” সেনটেইনকে দেখে উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইলেন স্যার গ্যারি, “ছয়টার রেডিওতে বলেছে। হার্টজগ কী করেছে। মাই গড! আমরা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পরিহার করেছি। তাই যাদেরই এক্ষেত্রে শেয়ার আছে তাদের অর্থ এখন দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার কী হয়েছে বাবা?”

নিজের চেয়ারে হতভম্বের মত বসে আছেন সেনটেইন,

“না, না, কিছু হয়নি।” উন্মাদের মত দু’পাশে মাথা নেড়ে জানালেন, “আর কোনো ভয় নেই। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, সবকিছু।”

***

এই প্রথমবারের মত লাঞ্চ টাইমে ওয়ল্টেভ্রেদেনে ফোন দিলেন ব্লেইন। অদ্ভুত এক কণ্ঠে কেবল জানালেন, “বিকেল পাঁচটায় কটেজে এসো।”

“ইয়েস, আমি চলে আসব।” আরো কিছু বলতে চাইলেন সেনটেইন; কিন্তু ফোন কেটে দিলেন ব্লেইন।

এক ঘণ্টা আগেই কটেজে পৌঁছে তাজা ফুল, বিছানাতে নতুন চাদর আর শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে তৈরি হয়ে রইলেন সেনটেইন। খানিক বাদেই এলেন ব্লেইন,

 “ওহ, ডিয়ার আমি যে কতটা কৃতজ্ঞ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।” জানালেন সেনটেইন।

“আমিও তাই চাই, কোনো কথা না! এ ব্যাপারে আমরা কখনোই কোনো কথা বলব না। যেন কখনোই এরকম কোনো কিছু ঘটেনি। প্লিজ প্রমিজ করো যে তুমিও আর কখনো তুলবে না এ প্রসঙ্গ।”

কথা দিচ্ছি। তুমি যা চাও সেভাবেই সব হবে।” স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। হাসতে হাসতে ব্লেইনকে কিস করে বললেন, “শ্যাম্পেন?” পরস্পরের ভালোবাসার নামে টোস্ট করলেন দুজনে।

ব্রোকারদের মধ্যে সবার আগে সেনটেইনকে ফোন করলেন মি. সোয়েলস; মার্কেটের মতই উচ্ছ্বসিত গলায় জানালেন,

“মাই ডিয়ার মিসেস কোর্টনি, আপনার সময়জ্ঞান সত্যিই অলৌকিক। আপনার পুরো পারচেজ অর্ডার পূরণ করতে না পারলেও পঁচিশ শিলিংয়ে চারশ’ চল্লিশ হাজার ই আর পি এম কিনেছি। যা এখন পঞ্চাশ শিলিং আর আরো বাড়ছে। সপ্তাহ শেষে না ষাট হয়ে যায়

“বিক্রি করে দিন।” সেনটেইনের কথা শুনে ভিরমি খেলেন সোয়েলস।

“ম্যাডাম, আমি কি কিছু বলতে–

“বিক্রি করুন। সবগুলো বিক্রি করুন।” তাড়াতাড়ি ফোন রেখে নিজের লাভ হিসাব করে দেখলেন সেনটেইন। কিন্তু আবার ফোন বেজে উঠল। এভাবে একের পর এক ব্রোকারের আনন্দিত ফোন শেষে এল উইন্ডহকের কল।

“ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস আপনার কণ্ঠস্বর শুনে কী যে ভালো লাগছে।”

“ওয়েল মিসেস কোর্টনি, এখন থেকে হানি মাইন আবার লাভের মুখ দেখবে। ডি বিয়ার্স তার জঘন্য কোটা দিয়েও আমাদেরকে আটকাতে পারবে না।” অথচ ড. এর গলা শুনে মনে হচ্ছে শোকে তিনি পাথর হয়ে গেছেন।

 “আমাদের আর কোনো ভয় নেই, জোন, আই লাভ ইউ। আমি এক্ষুণি হানির উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি।”

 ফোন রেখে ছেলের খোঁজে গেলেন সেনটেইন। নিচের আস্তাবলে কৃষ্ণাঙ্গ সহিসদের সাথে খোশগল্প করছে শসা,

“বাবু, আমি এক্ষুণি কেপ টাউনে যাচ্ছি। তুমি যাবে?”

 “কেন মা?”

“সারপ্রাইজ!”

সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাসা। স্ট্যান্ড স্ট্রিটের পোটারস মোটর শোরুমে চলে এলেন মা আর ছেলে। দৌড়ে এলেন সেলস ম্যানেজার,

“মিসেস কোর্টনি আপনাকে অনেকদিন দেখিনি। উইশ ইউ আর ভেরি হ্যাপি নিউ ইয়ার।

“ধন্যবাদ মি, টিমস। এবার বলুন কত তাড়াতাড়ি আমার নতুন ডেইমলার ডেলিভারি দিতে পারবেন?”

“হলুদ হবে নিশ্চয়?”

“অবশ্যই!”

“আর ফিটিংস ভ্যানিটি, ককটেইল কেবিনেট!”

 “সব থাকবে?”

 “আমি এক্ষুণি আমাদের লন্ডন অফিসে ফোন করে দিচ্ছি। চার মাস?”

 “না। তিন মাস করুন মিঃ টিমস।”

 মায়ের আচরণ দেখে অবাক হয়ে গেছে শাসা। বলেই বসল, “মা, আমাদের তো টাকা

“ধুর বাবু, দেউলিয়া হতেও স্টাইল লাগে।”

 “এখন কোথায় যাবো?”

“পোস্ট অফিস!”

তারপর সথেবি’কে ক্যানসেল অর্ডার পাঠিয়ে মাউন্ট নেলসন হোটেলে লাঞ্চ করলেন সেনটেইন আর শাসা।

***

মিটিং শেষ হবার সাথে সাথে ছুটে আসার প্রমিজ করেছিলেন ব্লেইন। তাই কথামত চলেও এলেন। কিন্তু কর্নেলের চেহারা দেখে আঁতকে উঠলেন সেনটেইন,

“কী হয়েছে ব্লেইন?”

 “চলো একটু হাঁটি সেনটেইন, সারাদিন রুমে বন্দি হয়েছিলাম।”

“এস্টেটের পেছনে চূড়ায় পড়ে থাকা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে সূর্যাস্ত দেখলেন দু’জনে; কিন্তু কর্নেলের বিষণ্ণতা কাটল না।

“আমাকে বলল কী হয়েছে, ব্লেইন? মুখ ঘুরিয়ে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন।

“ইসাবেলা।”

 “কী হয়েছে ওর?” আচমকা নামটা শুনে দমে গেলেন সেনটেইন।

“ডাক্তারেরা ওর জন্য আর কিছুই করতে পারবে না। নেক্সট জাহাজে চড়েই সাউদাম্পটন থেকে ফিরে আসছে।”

 নিস্তব্ধতার মাঝেই রুপালি সমুদ্রে ডুবে গেল সূর্য। পৃথিবীর মত সেনটেইনের বুকের মাঝে নেমে এল অন্ধকার।

“ব্যাপারটা কত আজব তাই না।” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন,

“তোমার কারণেই এখন আমি চাইলে পার্থিব যে কোনো কিছু পেতে পারি শুধু তোমাকে ছাড়া।”

***

পিঠে খাবারের বস্তা নিয়ে রাতে নতুন চাঁদ ওঠার সাথে সাথে ক্রাল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সোয়ার্ট হেনড্রিক আর তার ভাই মোজেস। তারপর গাছে উঠে ঈগলের বাসা থেকে কাটিজ পেপারের প্যাকেটগুলোও নিয়ে এল মোজেস।

তাদের গ্রাম কিংবা গোত্রের আর কারো পিছু নেয়া সম্ভব নয় এমন দূরত্বে এসে বোল্ডারের আড়ালে আগুন জ্বেলে বিশ্রাম নিতে বসল দুই ভাই। প্যাকেট খুলে ছোট একটা পাত্রে হিরেগুলো নিয়ে দেখলেন হেনড্রিক। অন্যদিকে খাবার তৈরি করল মোজেস।

তারপর কার্টিজ পেপারগুলোকে পুড়িয়ে ফেললেন হেনড্রিক। এরপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তেই পারিজের নরম গোলাটাকে চুলায় বসিয়ে দিল মোজেস। বুদবুদ ওঠা শুরু করতেই হীরেগুলোকে থকথকে পারিজে ঢেলে দিলেন হেনড্রিক। ফলে পারিজ ঠাণ্ডা হলেই শক্ত ময়দার মধ্যে গোপন হয়ে যাবে হীরে। এভাবে একের পর এক গোলাকার রুটি বানিয়ে চামড়ার ব্যাগে ভরে আবারো ঘুমন্ত গ্রামে ফিরে এল দুই ভাই।

সকাল হতেই আবার গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল মোজেস আর হেনড্রিক। প্রথম মাইল পর্যন্ত কেঁদে-কেটে গান গেয়ে সঙ্গ দিল গ্রামের নারীরা। তারপর মাথার ওপর বোঝা নিয়ে দিগন্তের ওপাশে হারিয়ে গেল দুই ভাই। কয়েকদিন বাদেই পায়ে হেঁটে রিক্রুটমেন্ট স্টেশন পৌঁছে গেল দুজনে। মরুভূমির এক কিনারে প্রত্যন্ত এক রাস্তায় এক রুমের জেনারেল ডিলার স্টোর থেকেই আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক সরবরাহ করা হয়।

হেনড্রিক আর মোজেস গিয়ে দাঁড়াতেই তাদের শূন্য আর ভাবলেশহীন দৃষ্টির দিকে তাকালেন ট্রেডার। জানতে চাইলেন, “নাম?”

“হেনরি তাবাকা।” মোজেসের সাথে আত্মীয়তা কিংবা লোথার ডি লা রে আর তার চুরির সাথে যেন কোনো সখ্যতা প্রকাশ না পায় তার জন্য নিজেই এ নাম বেছে নিয়েছেন হেনড্রিক।

“নাম?” এবারে মোজেসের দিকে তাকালেন ট্রেডার।

 “মোজেস গামা।”

 “তোমরা আগে কখনো খনিতে কাজ করেছো? ইংরেজি বলতে পারো?”

 “ইয়েস, বাসি…।” দাঁত বের করে হেসে ফেললেন ট্রেডার।

“গুড! ভেরি গুড! এরপর গোল্ডি থেকে ঘরে ফিরে এলেই দেখবে বড়লোক হয়ে গেছ।” তারপর কার্ড আর বাসের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

“বাস তাড়াতাড়ি এসে পড়বে। বাইরে অপেক্ষা করো।”

পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা ট্রেডিং স্টোরের পাশে অপেক্ষা করার পর নীল ধোয়া উড়িয়ে এল রেলওয়ে বাস।

 নিজেদের যৎসামান্য লাগেজ ঠেলেঠুলে উপরে তুলে দিল দুই ভাই। যদিও একগাদা হাঁড়ি-পাতিল, বাক্স, ছাগল আর জ্যান্ত হাঁস-মোরগে আগে থেকেই ভর্তি হয়ে আছে বাসের ছাদ। তারপর কোচে চড়ে শক্ত কাঠের বেঞ্চিতে বসে পড়ল দু’জনে।

সারি সারি কৃষ্ণাঙ্গ প্যাসেঞ্জার নিয়ে দুদিন বাদে বাস এসে পৌঁছালো উইন্ডহকের শহরতলীতে। বিশালাকার আয়তনের এক কৃষ্ণাঙ্গ ওভারসিয়ার সবাইকে নিয়ে গেইটের ভেতরে ঢুকাল। শ্বেতাঙ্গ স্টেশন ম্যানেজার অবশ্য তাদের সবাইকে নিয়োগ দিলেন কেবল হাড়জিরজিরে এক বুড়োকে ছাড়া।

হেনড্রিককে দেখেই চেয়ারে সিধে হয়ে বসলেন ম্যানেজার, “তোমার নাম কি?”

“তাবাকা।”

 “ইংরেজি বলতে পারো?” চোখ সরু করে তাকালেন ম্যানেজার। ঝামেলাবাজদের খুঁজে বের করতে তিনি ওস্তাদ। এটাই তার কাজ। কারো চোখের দিকে তাকালে তিনি তাদের ভেতরকার বুদ্ধিও টের পান।

“পুলিশের সাথে তোমার কোনো ঝামেলা আছে? হয়ত কারো গরু চুরি করেছো? কিংবা ভাইয়ের বউয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি?”

সোজা-সাপ্টা তাকিয়ে রইলেন হেনড্রিক।

 “আমাকে উত্তর দাও।”

“না”

“আমার সাথে কথা বলার সময় বাস ডাকবে। বুঝতে পেরেছো?”

“ইয়েস, বাস।” সাবধানে উত্তর দিলেন হেনড্রিক। টেবিলের ওপর রাখা পুলিশ ফাইলটা খুলে আস্তে আস্তে পাতা উল্টালেন ম্যানেজার। মাঝে মাঝে আবার চোখ তুলে হেনড্রিকের চেহারার অপরাধবোধের কোনো ছায়া পাওয়া যায় কিনা তাও দেখে নিলেন।

 “ক্রাইস্ট, ওদের গা থেকে এত গন্ধ আসছে।” টেবিলের ওপর ফাইলটাকে ছুঁড়ে বিয়ারের বোতল আর গ্লাস নিয়ে অফিসে ঢুকে গেলেন ম্যানেজার, “ওদেরকে সরিয়ে নিয়ে যাও।”

দুই ভাইয়ের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ কাঁটাতারের পেছনকার কুঁড়েঘরগুলোয় গত দশদিন ধরে অপেক্ষা করছে তিনশ’ কৃষ্ণাঙ্গ। এবার তাদের পরবর্তী যাত্রার সুযোগ এসেছে। সে রাতেই তিনটা রেলওয়ে কোচে সবাইকে তুলে দেয়া হল।

“তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো সবাই। স্টিমার অপেক্ষা করছে। তোমাদের গোল্ডিতে নিয়ে যাবে।”

কোচে ওঠার পর দেখা গেল আরেকজন শ্বেতাঙ্গ ইনচার্জ, রোদে পোড়া লম্বা লোকটার শার্টের হাতা গোটানো থাকায় দেখা যাচ্ছে বাইসেপস। চুলগুলো সোনালি, কপালের ওপর নেমে এসেছে কালো টুপি। হাতের চাবুকটা দিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই একটু পর পর পাশ দিয়ে যাওয়া কৃষ্ণাঙ্গের খালি পায়ে বাড়ি দিচ্ছে। ব্যথা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছে বেচারা কৃষ্ণাঙ্গ।

হেনড্রিক কাছে যেতেই তামাক খেয়ে কালো হওয়া দাঁত দেখিয়ে হাসল ইনচার্জ। ক্যাম্প ম্যানেজার তাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। তাই এবারে চাবুক উঁচিয়ে হেনড্রিকের হাঁটুর পেছনে খোলা জায়গায় মারল লোকটা।

 সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন হেনড্রিক। মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন ওভারসিয়ারের নীল চোখের দিকে।

“ইয়েস!” নরম স্বরে হেনড্রিককে উত্তেজিত করতে চাইল ইনচার্জ। চোখে প্রচণ্ড আগ্রহ। চাইছে সবার সামনেই হেনড্রিককে এক হাত দেখে নিতে। এই কোচে চড়ে পাঁচদিনের পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই সব সময় প্রথমেই সবাইকে শায়েস্তা করতে চায় ইনচার্জ। একজনকে কজা করতে পারলেই বাকিরাও সিধে হয়ে যায়।

“এসো, কাফির।” গলা নিচু করে ব্যক্তি হিসেবে হেনড্রিককে অপমান করতে চাইল ইনচার্জ। নিজের এসব কাজ সে সত্যিই উপভোগ করে।

কিন্তু হেনড্রিক তার চেয়েও দ্রুত এক লাফ দিয়ে কোচের সিঁড়িতে উঠে পড়ায় লোকটার চাবুক এবার হেনড্রিকের পায়ে না লেগে বাতাসে শিস কাটল।

পেছনে থেকে মোজেস দেখল ওভারসিয়ারের খুনি অভিব্যক্তি। হিসহিস করতে করতে ইনচার্জ জানালো, “এখানেই শেষ নয় বুঝলে।” ভাইয়ের পাশে বসে তাই হেনড্রিককে সাবধান করে দিল মোজেস, “লোকটা দেখো আবার তোমার পিছে লাগবে।” দক্ষিণের দিকে ছুটল ট্রেন।

তারপর পরদিন বিকেলবেলা আধঘণ্টার জন্য থামল ট্রেন। দু’জনে কৃষ্ণাঙ্গ বস্ বয়কে সঙ্গে নিয়ে ভিড়ে ভিড়াক্কার কোচে খাবার দিতে এল ওভারসিয়ার। সবার জন্য একই মেনু, সাদা গমের কেকের উপর এক চামচ বিন স্ট্য।

কিন্তু সোয়ার্ট হেনড্রিকের পালা আসতেই বস বয়কে সরিয়ে ওভারসিয়ার নিজে এল। হেনড্রিকের ডিশ নিয়ে ইচ্ছে করেই এক চামচ বেশি স্টু দিয়ে বলল, “গোল্ডিতে যাবার জন্য এই কাফিরের বেশি শক্তি দরকার। তারপর প্লেটটাকে বাড়িয়ে ধরল হেনড্রিকের দিকে।

তবে যেই না হেনড্রিক ধরতে যাবে, প্লেটটাকে ফেলে দিল ইনচার্জ। সোয়ার্টের পায়ের উপর ছড়িয়ে পড়ল গরম স্টু। গমের পরিজাকে পা দিয়ে মেঝেতে মেখে দিল ওভারসিয়ার। সব শেষ করে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে আবার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসল, বলল, “ওই কালা, একটাই। রেশন পাবি। চাইলে মেঝে থেকে চেটে খা।”

তারপর উৎসাহ নিয়ে তাকাল যে হেনড্রিক নিশ্চয় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু না, চোখ নামিয়ে প্লেট থেকে বাকি পরিজা আঙুল দিয়ে বল বানিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিলেন হেনড্রিক।

 পরাজিত হয়ে আরো ক্ষেপে গেল ওভারসিয়ার, “বেজন্ম নিগারের দল, তোরা বোধ হয় নিজের গু’ও খাবি।”

কোচের দরজাগুলোর ছিটকিনি বাইরের দিকে থাকে। চাবি থাকে ওভারসিয়ারের বেল্টে। অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে নতুন রিক্রুটদের অনেকেই হোমসিকনেসে ভোগে। তাই ছুটন্ত কোচ থেকেও মাঝে মাঝেই লাফ দেয় নিচে। তাই রাতের বেলাও লণ্ঠন হাতে নিয়ে কোচের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় ওভারসিয়ার। মাথা গুনে দেখার পাশাপাশি আলো ধরে প্রতিবার হেনড্রিকের ঘুমও ভাঙিয়ে দেয় ইচ্ছে করে।

 সোয়াটকে জ্বালাতন করাটা যেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে ওভারসিয়ার। কিন্তু মোজেস ভাইকে থামিয়ে রাখে, “ধৈর্য ধরো ভাই। রাগকে ভেতরে সযত্নে লালন করো। যেন তুমি একে নিজের ইচ্ছেমত কাজে লাগাতে পারো।”

আস্তে আস্তে যেন প্রতিটা ব্যাপারে মোজেসের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন হেনড্রিক। ওর বুদ্ধি এত ক্ষুরধার যে, সঠিক সময়ে জিভে সঠিক শব্দটাই চলে আসে। আর মোজেসের উপস্থিতিতে সবাই মুগ্ধ হয়ে বাধ্য হয় ওর কথা শুনতে।

আর কয়েকদিনের মধ্যেই হাতেনাতে এর প্রমাণও পেলেন। এক সাথে প্রথমে শুধু গরম কোচের মধ্যে বসে থাকা কাছাকাছি লোকগুলোই কেবল মোজেসের কথা শুনত। নতুন জায়গা আর সেখানের মালিকপক্ষ তারা কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের কাছ থেকে কী আশা করে, না পেলে কী শাস্তি দেবে সব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে মোজেস। আস্তে আস্তে অন্যান্য বেঞ্চ থেকে গলা বাড়িয়ে ওর কথা শোনার জন্য আগ্রহী হয় বাকি মুখগুলো, “আরেকটু জোরে বলো গামা, যেন আমরাও শুনতে পাই।”

স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে বুঝিয়ে বলে মোজেস, “বুঝলে, গোন্ডিতে এত কৃষ্ণাঙ্গকে একসাথে দেখবে যে পঞ্চাশটা ভিন্ন গোত্রের সবগুলো ভাষাই শুনতে পাবে। কেউ কেউ হয়ত শ্বেতাঙ্গদের মতই আমাদের দুশমন হবে। সুযোগ পেলেই তোমাদের ওপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবে। তাই নিজেকে রক্ষা করতে চাইলে সবসময় আশপাশে বিশ্বস্ত বন্ধু রাখবে। একজন নেতাও চাই। আর এর পরিবর্তে নেতাকে দিবে তোমার বিশ্বস্ততা।”

কয়েকদিনের ভেতরেই লোকগুলো উপলব্ধি করে যে, মোজেস গামাই হল সেই নেতা যে তাদেরকে সবরকম বিপদ থেকে বাঁচাতে পারবে। তাই তিন নম্বর কোচের পোত্র-প্রধান হয়ে গেল মোজেস। তাদের শঙ্কা দূর করে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ভালো করে পরখ করে দেখল মোজেস। নিজের একেবারে কাছাকাছি বসার সুযোগ করে দিল আর এরাই হয়ে উঠল তার গার্ড।

 এ সমস্ত কিছুই হেনড্রিকের চোখের সামনে ঘটছে। ছোট ভাইয়ের এরকম ব্যক্তিত্ব দেখে তারও বুক গর্বে ভরে উঠল। নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে মাথা পেতে নিলেন ভাইয়ের আজ্ঞা। আর মোজসের সাথে সাথে তারও প্রতিপত্তি বেড়ে গেল। আপন মনেই ভাবলেন, “পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এটুকু মনে হচ্ছে যে বৃহৎ কোনো কাজের সূচনালগ্নেই দাঁড়িয়ে আছি। তাই মোজেস গামার দেখানো পথেই আমি চলব। এর বেশি আর কোনো কিছু জানার প্রয়োজন নেই।

মনোযোগ দিয়ে মোজেসের মুখে শোনেন অজানা সব নাম আর আইডিয়ার কথা। অদ্ভুত এক উত্তেজনা আর শিহরণে যেন নেচে ওঠে রক্ত।

“লেনিন”, বলে চলে মোজেস “কোনো মানুষ নয়, ঠিক যেন পৃথিবীতে নেমে এসেছেন ঈশ্বর” ওর মুখেই শুনলেন যে উত্তরের বিভিন্ন জাতির মানুষ নাকি এই দেবতাপ্রতিম লেনিনের ছায়ায় একত্রিত হওয়ার পরে হয়ে উঠেছে দেবতারই অংশ।

 পৃথিবী আগে যা কখনো দেখেনি মোজেসের মুখে সে যুদ্ধের কথা শুনে জেগে উঠল সকলের হৃদয়।

আচমকাই কোচের দরজা খুলে ভেতরে এল শ্বেতাঙ্গ ওভারসিয়ার। মুখে অট্টহাসি; কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো ইনচার্জকে দেখেই তাড়াতাড়ি নিজেদের চোখ নামিয়ে নিল কৃষ্ণাঙ্গের দল। কিন্তু মোজেসের কাছাকাছি বসে থাকা তার নির্বাচিত কয়েকজন ঠিকই টের পেল যে তাদেরকে কার সাথে কোন যুদ্ধে লড়তে হবে।

 কোচের বাতাসে বারুদের গন্ধ পেল শ্বেতাঙ্গ ওভারসিয়ার। তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে হেনড্রিকের খোঁজ করতেই দেখা গেল কোচের মাঝখানে বসে আছেন ওভাষো।

 “একটা পচা আলু পুরো বস্তাটাকেই নষ্ট করে দেয়।” তিক্ত মেজাজ নিয়ে বেল্টের সাথে লাগানো টিনের গদাটাতে হাত দিল ইনচার্জ। কেননা ছোট্ট কোচে লম্বা চাবুকটা ব্যবহার করা একটু কষ্টকর হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং চৌদ্দ ইঞ্চি কাঠ দিয়ে তৈরি গদাটা হাড় ভাঙা কিংবা কাউকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। হেনড্রিককে অবজ্ঞা করার ভান করে আস্তে আস্তে কোচের ভেতরে হাঁটা শুরু করল ওভারসিয়ার। কৃষ্ণাঙ্গদের চোখে-মুখে কেমন একটা বিদ্রোহের আঁচ টের পেতেই বুঝে নিল এসব কার কাজ।

 “শুরুতেই ব্যাটাকে শায়েস্তা করা দরকার ছিল। যাই হোক, শান্তি পেতে হলে আর দেরি করা যাবে না।”

আড়চোখে হেনড্রিকের দিকে তাকিয়ে কোচের দরজার কাছে গিয়েও হঠাৎ করেই থেমে গেল ওভারসিয়ার। আপন মনে হাসতে হাসতে আবার এগিয়ে এল হেনড্রিকের সিটের পাশে।

“আমার দিকে তাকা, কাফির।” চিবুক তুলে একদৃষ্টে ইনচার্জের দিকে তাকিয়ে রইলেন হেনড্রিক।

“তোর লাগেজ কই?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন হেনড্রিক, কারণ উপরের তাকে লাগেজের মধ্যেই আছে হীরে। অবচেতনেই চোখ চলে গেল সেদিকে।

“গুড।” বস্তটাকে তুলে হেনড্রিকের সামনে মেঝের উপর আছাড় মারলো ওভারসিয়ার।

“খোল।” কোমরে হাত রেখে আদেশ দিল শ্বেতাঙ্গ।

“কাম অন।” হেনড্রিক তারপরেও বসে আছেন দেখে কুব্ধ হয়ে উঠল। লোকটা, “তাড়াতাড়ি খোল কাফির, ভেতরে কী আছে দ্যাখা।”

আস্তে করে সামনে ঝুঁকে চামড়ার বস্তার মুখটা খুলে দিলেন হেনড্রিক। তারপর আবার নিজের জায়গায় এসে সিধে হয়ে বসলেন।

উপুড় হয়ে বস্তাটাকে ধরে মেঝের উপর ভেতরের সবকিছু ফেলে দিল ইনচার্জ। প্রথমেই বের হল কম্বল, কিছু কাপড় আর চামড়ার খাপে মোড়ানো নয় ইঞ্চি লম্বা ছুরি।

“বিপজ্জনক অস্ত্র। কোচে এরকম কিছু রাখা যাবে না।”

“বলে ছুরির ফলা জানালার খাপে নিয়ে ঢুকিয়ে দুই ভাগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে।

তারপরেও নড়লেন না হেনড্রিক। প্রায় এক মিনিট অপেক্ষা করেও কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে গমের আটা দিয়ে তৈরি রুটি পায়ের বুট দিয়ে উল্টে দিল ওভারসিয়ার।

“এটা আবার কোন ছাতার মাথা?” এবারে হেনড্রিক না নড়লেও তার কালো ধোঁয়াটে চোখের ঝিলিক স্পষ্ট দেখতে পেল ওভারসিয়ার। “আচ্ছা, এবার তাহলে ব্যাটাকে কাবু করা সহজ হবে।” পাউরুটিকে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকল লোকটা।

 “কাফির ব্রেড। কিন্তু কোম্পানির নিয়ম হল কোচের ভেতর কোনো খাবার রাখা যাবে না।” বিড়বিড় করেই পাউরুটিকে ও জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল ওভারসিয়ার। সাথে সাথে নিচের স্টিলের হুইলে ঢুকে শত শত টুকরা হয়ে গেল রুটি। খিকখিক কর হেসেই আরেকটা ব্রেডের জন্যে হাত বাড়াল ইনচার্জ।

 আর যায় কোথায়। বহুক্ষণ ধরে সহ্য করছিলেন হেনড্রিক। কিন্তু হীরে হারিয়ে এবার অন্ধ ক্রোধে যেন পাগলা কুত্তা হয়ে গেলেন। তবে ওভারসিয়ারও প্রস্তুত ছিল। হেনড্রিক এগোতেই গদার ফলা সোজা ধরলেন তার গলায়। আহত জায়গায় হাত দিয়ে পেছন দিক বেসামাল হয়ে পড়ে গেলেন হেনড্রিক। এরই সাথে খুলির সামনের অংশে গদার দ্বিতীয় বাড়ি খেয়েই পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। আরেকটু হলেই পড়ে যেতেন। কিন্তু ওভারসিয়ার তাকে ধরে আবার সিটে বসিয়ে দিল।

ঠিক কাঠের গায়ে কাঠুরে যেমন করে কুঠার দিয়ে কোপ দেয় তেমনিভাবে হেনড্রিকের খুলির উপর আঘাত করল ইনচার্জ। চামড়া ফেটে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। এভাবে গুনে গুনে তিনবার কোপ মারতেই জ্ঞান হারালেন হেনড্রিক।

ডান হাতে গাদাটাকে নিয়ে এবার মুখ ঘুরিয়ে কোচের বাকিদের দিকে তাকাল ওভারসিয়ার। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল আতঙ্কে হতভম্ব কৃষ্ণাঙ্গদের দল।

 মেঝেতে মাথা ঠুকে পড়ে থাকায় সিটের সারির মাঝখান দিয়ে সাপের মত এঁকেবেঁকে এগোল হেনড্রিকের রক্তের ধারা। তাই দেখে হেসে উঠল নিজের পারফরম্যান্সে তপ্ত ওভারসিয়ার। ঠিক যেভাবে কাজটা করতে চেয়েছিল সেভাবেই হয়েছে।

তারপর একের পর এক রক্তমাখা পাউরুটি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল জানালার বাইরে। সব শেষ করে হেনড্রিকের ওপর উপুড় হয়ে শার্ট দিয়ে মুছে নিল নিজের গদা। এরপর আবার বেল্টের সাথে ঝুলিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল অন্য কক্ষে।

 নিজের কোচের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রসাদে হেসে ফেলল ওভারসিয়ার। যাক, সব এখন আবার শান্ত হয়ে যাবে। আর কোনো সমস্যার আশঙ্কা নেই।

কিন্তু যেই না ইনচার্জ বেরিয়ে গেল ওমনি তৎপর হয়ে উঠল মোজেসের দল। নেতার কাছ থেকে কয়েকটা আদেশ পেয়েই হেনড্রিককে তুলে নিজের সিটে বসাল। কয়েকজন গেল পানি আনতে আর মোজেস নিজে তার লাগেজ খুলে বের করে নিল বাদামি রঙা পাউডার। তারপর হেনড্রিকের খুলিতে লাগিয়ে দিল সমস্ত গুঁড়ো। ছাই আর লতা-পাতা দিয়ে তৈরি এই মিশ্রণ মাংস লাগাতেই বন্ধ হয়ে গেল রক্ত। তারপর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিল ভাইয়ের মুখ। অপেক্ষা করল কখন ফেরে হেনড্রিকের জ্ঞান, মোজসের বাবার পনের জন স্ত্রী থাকাতে তার ভাই-বোনের সংখ্যা ত্রিশেরও বেশি। কারো প্রতি তাই গোত্রের টানের উর্ধ্বে কোনো ভালোবাসা নেই আর হেনড্রিক তো এমনিতেই তার চেয়ে অনেক সিনিয়র। তবে ছোটবেলা থেকেই হেনড্রিকের নানা দুঃসাহসিকতার কাহিনি শুনে বড় হয়েছে মোজেস। সুতরাং আজ ওভারসিয়ার আর তার ভাইয়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে টেস্টিং হিসেবে নিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের এই নব নেতা। ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক। কারণ নিজের লেফটেন্যান্ট হিসেবে ইস্পাতের মত শক্ত একজনকেই চায় মোজেস ঠিক যেমন স্ট্যালিনকে বেছে নিয়েছিলেন লেনিন। একটু পরেই চোখ খুলে ঘোলা দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালেন হেনড্রিক। গুঙ্গিয়ে উঠে মাথার ক্ষতে হাত বোলাতেই মনে পড়ল সবকিছু।

“হিরেগুলো?” নিচু গলায় জানতে চাইলেন হেনড্রিক।

 “নেই।”

“খুজতে হবে তাহলে।” মাথা নাড়ল মোজেস।

“না। এতক্ষণে ঘাসের বীজ হয়ে মিশে গেছে। কোথায় পড়েছে সেটাও জানি না। আর তাছাড়া, ভাই, আমরা হলাম এই কোচের বন্দি। তাই ফিরে যাবার উপায় নেই। হিরেগুলোর কথাও ভুলে যাও।”

চুপচাপ বসে ভাইয়ের দেখানো যুক্তি নিয়ে ভাবলেন হেনড্রিক। এদিকে মোজেসও অপেক্ষা করছেন। এবার সে কোনো আদেশ দেয়নি।

 কিংবা কোন পথনির্দেশও না। দেখা যাক হেনড্রিক নিজে ওর কাছে আসেন কিনা।

“তুমি ঠিকই বলেছো ভাই” অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন হেনড্রিক “হিরেগুলো চলে গেছে। কিন্তু এ কাজ যে করেছে তাকে আমি দেখে ছাড়ব।”

কোনো রকম আবেগ-উত্তেজনা না দেখিয়ে মোজেস চুপ করে বসে রইল।

“এত চালাকির সাথে ওকে খুন করব যে আর কেউ কিছু টের পাবে না।” এখনো কথা বলছে না মোজেস। সে যে রকম হবে ভেবেছিল, হেনড্রিক সেভাবেই এগোচ্ছেন। তারপরেও আরেকটা ব্যাপার বাকি রয়ে গেছে। দেখা যাক হেনড্রিক নিজে সেটা টের পান কিনা।

“তোমার কি মনে হয় ভাই? এই সাদা কুত্তাটাকে মেরে ফেলা উচিত না আমার?” মোজেস গামার অনুমোদন চাইলেন হেনড্রিক। নিজেকে তিনি সত্যিই ভাইয়ের হাতে সমর্পণ করেছেন। হেসে ফেলল মোজেস। ভাইয়ের বাহুতে হাত রেখে বলল, “হ্যাঁ, তাই উচিত ভাই।”

এরপর পরবর্তী এক ঘণ্টা আর কোনো কথাবার্তা না বলে নিজের সিটে গুম হয়ে বসে রইলেন হেনড্রিক। মাঝে মাঝে কেবল প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। খানিক বাদে উঠে গিয়ে জানালাগুলো চেক করে চলে এলেন ল্যাট্রিনের সামনে। ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে পরীক্ষা করলেন খোলা গর্ত। নিচে দেখা যাচ্ছে শাঁই শাঁই করে ছুটে চলা পাথুরে ট্রেন লাইন। ল্যাট্রিনে জানালা ও একটা স্কু লাগানা কাঠের ফ্রেমে তারের জালি দেয়া পাল্লা।

সবকিছু চেক করে চুপচাপ নিজের সিটে এসে ফিসফিস করে মোজেসকে বললেন, “সাদা বেবুনটা আমার ছুরি নিয়ে গেছে। আমার আরেকটা লাগবে।”

মোজেস কিছু জিজ্ঞেস করল না। এটাও টেস্টেরই অংশ। দেখতে চায় কারো সাহায্য ছাড়া হেনড্রিক সফল কিংবা বিফল হয়ে কেমন আচরণ করে। কেবল পাশের কয়েকজনকে বলে দিতেই বেঞ্চের নিচে দিয়ে হেনড্রিকের হাতে পৌঁছে গেল একটা ছুরি।

 ছুরি নিয়ে ল্যাট্রিনে ঢুকে জানালার পাল্লার আটটা ক্রু সাবধানে, খুলে ফেললেন হেনড্রিক। তারপর অপেক্ষা করলেন কখন কোচ ডানদিকে মোড় নেয় সেজন্যে। খোলা জানালা দিয়ে মুখ বের করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে সে সময় এসেছে।

কোচের ছাদের দু’পাশেই উঁচু মতন বর্ডার দেয়া। জানালা বেয়ে উঠে ছাদে চলে এলেন হেনড্রিক। সামনের কোচ ডানদিকে বেঁকে যাওয়ায় জানালা দিয়ে তাকে কেউই উঠতে দেখল না। চোখ বন্ধ করে জানালা থেকে ছাদের কিনার ধরে দাঁড়িয়ে সবকিছু মুখস্থ করে নিলেন হেনড্রিক। তারপর কোচের উপরের অংশ দেখে আবার ল্যাট্রিনে নেমে এলেন। ফ্রেমটাকে আবার জানালার উপর লাগিয়ে রাখলেও গুলোকে ঢিলে করে রেখে দিলেন।

পরের দিন খুব ভোরবেলা খাবারের ট্রলি নিয়ে এল ওভারসিয়ার আর তার বেয়ারা। তারপর অন্ধকার নামার আগে খালি ডিশ নিতে এল বেয়ারাদের একজন।

“কাল রাতেই তোমরা গোল্ডি পৌঁছে যাবে। সেখানকার শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার তোমার ক্ষতের চিকিৎসা করে দিবেন।” খানিকটা সহানুভূতি নিয়েই জানাল বেচারা, “অনেক শক্ত একটা শিক্ষা পেয়ে গেলে দোস্ত, লোকটাকে আর ঘাটাইও না।” যাবার আগে বন্ধ করে দিল কোচের দরজা।

 সূর্যাস্তের সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন হেনড্রিক। মালভূমিতে উঠে আসায় বদলে গেছে চারপাশের প্রকৃতি। ঘাসের রঙ বাদামি আর নদী ভাঙনের চোটে লাল হয়ে গেছে মাটি।

 সারা জীবন গৃহহীন বন্য জীবন করে অভ্যস্ত হেনড্রিক বেড়া দিয়ে আলাদা করা মানুষের বসতি দেখে বিরক্তিতে নাক কুঁচকালেন। আশপাশের গ্রাম দেখে মনে হচ্ছে উইন্ডহকের মতই বিশাল।

 “গোল্ডির দেখা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো।” জানিয়ে দিল মোজেস। বাইরে রাত নেমে আসতেই ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে গায়ে-মাথায় কম্বল জড়িয়ে ফেলল কোচের সবাই।

ওভারসিয়ার তার প্রথম রাউন্ড শেষ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন হেনড্রিক। এবার তার চোখের ওপর আলো ফেললেও ঘুমের ভান করলেন না আর। বরঞ্চ শূন্য চোখে পিটপিট করে তাকালেন। তারপর ইনচার্জ দরজায় তালা দিয়ে চলে যেতেই নিজের সিটে উঠে বসলেন।

অন্যদিকে মোজেসও জেগে রইল, কিন্তু কিছু বলল না। সোজা ল্যাট্রিনে গিয়ে স্ক্রগুলো খুলে ফেললেন হেনড্রিক। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগতেই শিরশির করে উঠল মাথার ক্ষত। কয়লার ধোয়া থেকে চোখ বাঁচানোর জন্য অন্ধের মত উপরে উঠে ধরে ফেললেন কোচের ছাদের কিনার।

মোটামুটি মসৃণভাবেই উঠে এলেন উপরে। খানিক থেমে বিশ্রাম নিয়ে। হাঁপানি বন্ধ হতেই হামাগুড়ি দিয়ে এগোলেন সামনের কোচের উদ্দেশে।

ঝকঝক করছে রাতের আকাশ। তারার আলোয় রুপালি হয়ে আছে চারপাশ। বাতাসের ঝাঁপটা সামলে ছুটন্ত রেলের ওপর ভারসাম্য রেখে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। হঠাৎ করেই মনের মাঝে কেমন যেন কু ডাক ডাকতেই দেখলেন সামনে থেকে ছুটে আসছে গাঢ় একটা অবয়ব। একেবারে ঠিক সময়ে শুয়ে পড়তেই মাথার উপর দিয়ে হুশ করে চলে গেল পানির ট্যাংকি। মিনিটখানেক বিশ্রাম নিয়ে ধাতস্থ হয়েই আবার ছাদের কিনার দিয়ে নিচে উঁকি দিলেন। পেট পেতে শুয়ে তাকাতেই দেখা গেল নিচে ব্যালকনি। এক কোচ থেকে আরেক কোচে যেতে হলে এখান দিয়েই পার হতে হবে। তাই কেউই হেনড্রিকের নজর এড়িয়ে পার পাবে না।

পায়ের কাছে একটা ভেন্টিলেটরও পাওয়া গেল। প্যান্টের বেল্ট খুলে গিঁট বানিয়ে ফাসটাকে গলিয়ে দিলের নিজের এক পায়ে। তাই সোজা হয়ে শুয়ে থাকলেও কোনো ভয় নেই। ইলেকট্রিক বাল্ব লাগানো থাকায় আলোকিত হয়ে আছে নিচের বারান্দা। নিচে থেকে কেউ তাকালেই উপরে দেখতে পাবে তার মাথা আর চোখ। গাছের ওপর শুয়ে থাকা চিতা বাঘের মতই অপেক্ষা করলেন হেনড্রিক।

 এভাবে কেটে গেল দুই ঘণ্টা। মাথার ওপর তারার গতি দেখে বরফের সূচের মত বিঁধছে শরীরে। কিন্তু যে কোনো শিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অপেক্ষা করা। আর এ ধরনের খেলা তিনি আগেও খেলেছেন।

আচমকাই নিচের দরজা থেকে ভেসে এল চাবির ঝনঝন শব্দ। আর এর ঠিক মুহূর্তখানেক পরেই উদয় হল টুপি পরা শ্বেতাঙ্গ ওভারসিয়ার। সাথে সাথে দুই কোচের মধ্যেকার ফাঁকের বারান্দায় ঝাঁপ দিলেন হেনড্রিক। লোথারের কাছে শেখা ডাবল লকের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে জাপটে ধরলেন ইনচার্জের গলা। আরেক হাত দিয়ে লোকটার কনুই ধরে মাটি থেকে উপরে তুলে ফেললেন তার পা।

 কাশি দেবার মত করে খকখক করে উঠল ওভারসিয়ার। ঠিক যেন ফাঁসিতে ঝুলছে। মাথা থেকে খসে পড়ল টুপি। উন্মাদের মত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চাইছে গলার কাছের পেশিবহুল হাতটাকে ধরতে। পরস্পরের চোখ ইঞ্চিখানেক দূরতে না আসা পর্যন্ত লোকটাকে তুলে ফেললেন হেনড্রিক। তারপর রক্ত জমাটবেঁধে কালো হয়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত দাঁতের মাঢ়ি বের করে হাসলেন। ব্যালকনির আলোতে তাকে চিনে ফেলল ওভারসিয়ার, ধকধক করে উঠল লোকটার চোখ।

 “ইয়েস মাই ফ্রেন্ড” ফিসফিস করে উঠলেন হেনড্রিক, “আমিই সেই কাফির।” তারপর লোকটাকে আরো ইঞ্চিখানেক তুলে ফেলে ছাদের কিনারে ঠেসে ধরলেন মাথা। ইচ্ছে করেই খুলির গোড়ায় মেরুদণ্ডতে চাপ দিচ্ছেন। হাপুনে গাথা মাছের মতই ছটফট করতে লাগল ওভারসিয়ার কিন্তু চিবুকের নিচে ধরে লোকটাকে সহজেই তুলে ফেললেন হেনড্রিক।

বুঝতে পারছেন যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যাবে ওভারসিয়ারের স্পাইনাল কর্ড। তাই শেষবারের মত ঝাঁকি দিয়ে আরেক ইঞ্চি তুলে ধরতেই শুকনো ডালের মত মট করে ভেঙে পড়ল লোকটার ঘাড়। হেনড্রিকের চোখের সামনে আস্তে আস্তে নিভে গেল ইনচার্জের নীল চোখের আলো।

তারপর মৃতদেহটাকে খানিক পেণ্ডুলামের মত দুলিয়ে রেলিঙের ওপারে ফেলে দিলেন। কোচের ছুটন্ত হুইলের নিচে পড়ে সাথে সাথে মাংসের কিমায় পরিণত হল ওভারসিয়ারের শরীর।

 খানিক জিরিয়ে নিজের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হবার সময় দিলেন হেনড্রিক। ততক্ষণে আধমাইল পেছনে পড়ে গেছে লোকটার কাটা শরীর।

আবারো ভেন্টিলেটর থেকে বেল্ট খুলে কোমরে বেঁধে নিয়ে রেলওয়ে কোচের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সোজা ল্যাট্রিনের জানালার উপর চলে এলেন। ভেতরে ঢুকে ঠিকঠাক বসিয়ে দিলেন জানালার পাল্লা। নিজের সিটে গিয়ে বসতেই দেখা গেল তাকিয়ে আছে মোজেস গামা। ভাইকে দেখে মাথা নেড়েই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন হেনড্রিক। মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

বস, বয়দের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভেঙে গেল ঘুম। জেগে উঠে বুঝলেন যে ট্রেনও থেমে আছে। প্লাটফর্মের সাদা বোর্ডে গ্রামের নাম লেখা “ভ্ৰাইবাগ।”

খানিক বাদে চারপাশে ছেয়ে গেল রেলওয়ে পুলিশ। সবাইকে নামার আদেশ দিতেই প্লাটফর্মে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল কৃষ্ণাঙ্গদের দল। নাম ডাকার পর বোঝা গেল যে কেউই অনুপস্থিত নেই।

মাথা হেলিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন হেনড্রিক। চিবুক দিয়ে ইশারা করেছেন হুইল আর তাদের কোচের বগির নিচের দিকে। সবখানে লেগে আছে রক্তের ছিটে আর লাল লাল মাংস।

তারপর সারাদিন ধরে স্টেশন মাস্টারের অফিসে জনে জনে তল্লাশি নিল পুলিশ। বিকেলের মধ্যেই অবশ্য কোনো প্রমাণ না পেয়ে ওভারসিয়ারের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা ভেবে এ ব্যাপারে আগ্রহও হারিয়ে ফেলল।

তাই সন্ধের দিকে সবাইকে তুলে নিয়ে আবারো দুলে উঠল ট্রেন।

***

চারপাশে মানুষের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন হেনড্রিক। সবার ভিড় ঠেলে জানালার কাছে যেতেই বাইরে দেখা গেল বেশ উঁচু এক পর্বত। অদ্ভুত দেখতে পবর্তমালাটা এতই সুন্দর যে, ঢেকে আছে পুরো উত্তরের আকাশ, উপরের দিকে নিখুঁত সমতল পবর্তটা দেখে সত্যিই বিস্মিত হলেন হেনড্রিক।

“এটা আবার কোন ধরনের পাহাড়?”

“গভীর নিচ থেকে কেটে আনা পাথর দিয়ে মানুষই এই পাহাড় তৈরি করেছে ভাই।”

 যতদূর চোখ যায়, ঘাসের ওপর ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে আছে সমান্তরাল পিঠের মাটির উঁচু উঁচু ভূপ। লম্বা জিরাফের মত ইস্পাত আর বিশালাকার হুইল সহ মেশিন যেন পৌঁছে গেছে আকাশে।

 “একেবারে পৃথিবীর তল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এসব যন্ত্র। আর পাথুরে উদরের ওই হলুদ সোনার জন্যেই ঘাম ঝরায় শ্বেতাঙ্গদের দল, একে অন্যের সাথে মিথ্যে বলে, ধোঁকাবাজি এমনকি মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না।” হেনড্রিককে বুঝিয়ে দিল মোজেস।

সামনে ট্রেন যত এগোচ্ছে ততই বাড়ছে সকলের বিস্ময়। চারপাশে এত উঁচু দালান যে চমকে উঠল কৃষ্ণাঙ্গের দল। আর রাস্তা যেন ইস্পাতের নদী। হনহন করে ছুটছে একের পর এক গাড়ি। আকাশে উঠে যাওয়া চিমনিগুলো তৈরি করেছে কালো মেঘ। মানুষের সংখ্যা দেখে তো তাজ্জব হবার জোগাড়। লক্ষ, লক্ষ। রুপালি হেলমেট আর রাবার বুট ছাড়াও সারা গায়ে হলুদ কাদার ছিটে। দিশেহারা বোধ করল কোচের শ্রমিকরা।

“মেয়েরা কোথায়?” হঠাৎ হেনড্রিকের প্রশ্নটা শুনেই হেসে ফেলল মোজেস।

“কোন মেয়ে ভাই?”

 “কেন? আমাদের গোত্রের কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েরা?”

“তুমি যে ধরনের মেয়েদের চেন এখানে সেরকম কেউ নেই। এখানে সবাই শুধু স্বর্ণ খোঁজে।”

আরো একবার সবাইকে খেদিয়ে নিয়ে ঢোকানো হল বেড়ার ওপাশের সাদা ব্যারাক বিল্ডিংয়ে। সারি সারি দালানের সাইনবোর্ডের মাথার উপরে লেখা :

উইটওয়াটারস্রান্ড নেটিভ লেবার অ্যাসোসিয়েশন।

কয়েকজন বস বয়ের দল এসে সবাইকে কাপড় খুলে ফেলার নির্দেশ দিল। মুখে সারাক্ষণ হাসি ধরে রেখে জানাল, “তোমরা তো সাথে করে চুল দাড়ির মধ্যে জন্তু-জানোয়ারও নিয়ে এসেছে। কিন্তু বুঝলে ভায়া, এখানে তো তোমাদের উকুনের কোনো ঠাই নেই।” তারপর সবার মাথায় নীল রঙা মলম মাখিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল কার্বলিক সাবান।

গোসল সারার পর সবাইকে চেক করে দেখলেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দল।

 “তোমার মাথা আর মুখে কী হয়েছিল?” হেনড্রিককে দেখে জানতে চাইলেন এক ডাক্তার, “না, না, ঠিক আছে বলতে হবে না, আমি জানতে চাইনা। বোঝা গেল এ ধরনের ক্ষত আগেও দেখেছেন, “ট্রেনের ওই বজ্জাত ইনচার্জগুলো তো? ঠিক আছে। ডেন্টিস্টের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি কিন্তু মাথায় আর সেলাই দেয়া যাবে না, দেরি হয়ে গেছে। মোহনীয় দাগগুলোকে বয়ে বেড়াতে হবে তোমার। এসব বাদ দিলে তুমি কিন্তু বেশ সুদর্শন বুঝলে?” হেনড্রিকের চকচকে কালো পেশির ওপর চাপড় দিলেন ডাক্তার, “তোমাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ দিব। বোনাসও পাবে।”

 এরপর সবাইকে ধূসর-রঙা ওভারঅল, বুটের পাশাপাশি ভূরিভোজনও করানো হল।

“আমি যে রকম ভেবেছিলাম, সে রকম তো নয়। খাবার ভালো, সাদা লোকগুলোও হাসছে। ট্রেনের মত কোনো মারধর নেই।” আয়েশ করে স্ট্যাপে চামচ ডোবালেন হেনড্রিক।

“ভাই, গাধারাই কেবল নিজের গরু মারে। আর এই সাদা লোকগুলো গাধা নয়।” অন্যান্য ওভাষোদের একজন নিজের উদ্যোগে মোজেসের খালি প্লেট নিয়ে রান্নাঘর থেকে ভরে নিয়ে এল। আজকাল এসব আর তাকে বলতে হয় না। ওর অনুগত কৃষ্ণাঙ্গের দল নিজেদের দায়িত্ব মনে করেই তা করে দেয়। তার উপরে আবার ওভারসিয়ারের মৃত্যুতে মোজেস আর তার লেফটেন্যান্ট সম্পর্কে রটে গেল বহু বীরত্বের কাহিনি।

পরদিন ঘুম ভাঙতেই গমের কেক আর দুধ খেয়ে সবাই ছুটল ক্লাসরুমে।

“দেশের প্রতিটি কোনা থেকে চল্লিশটি ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের মানুষ এসেছে এখানে।” শ্রদ্ধাবনত কৃষ্ণাঙ্গরা, সরে মোজেস আর হেনড্রিকের বলার জায়গা করে দিল। “এখন ওরা আমাদেরকে গোল্ডির নিজস্ব ভাষা শেখাবে যেন সবাই একই ভাষায় পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।”

বয়স্ক এক জুলু বস বয় নাম ফানাকালো হল তাদের ইনস্ট্রাকটর; যার নামের অর্থ হল লাইক দিস। লাইক দ্যাট। কয়েক সপ্তাহ পর দেখা গেল সবাই ফানাকালো নামটা ভুলে গিয়ে ওকে এই নামটাই দিয়ে দিল লাইক দিস! লাইক দ্যাট।

হেলমেট, লণ্ঠন, হাঁতুড়ি, কোদাল, সেফটি রেইল, চেঁছে ফেলার যন্ত্র, বিভিন্ন পোশাকসহ প্রতিটি আইটেম ডিসপ্লে করে দেখাল ফানাকালো, তারপর একে একে আমি, তুমিসহ শেখাল হাত, মাথা, পাসহ সবকিছুর ইংরেজি প্রতিশব্দ।

সারা সকাল ভাষা শেখার পর লাঞ্চের পর সবাইকে বিশ জনের দলে দলে ভাগ করে পাঠিয়ে দেয়া হল আরেক ক্লাসরুমে। ওয়াল টু ওয়াল লম্বা টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সবাইকে স্বাগত জানাল আদা রঙা চুল-দাড়ি আর সবুজ চোখের এক শ্বেতাঙ্গ। ডাক্তারের মত পোশাক পরিহিত লোকটার ইংরেজি কেবল মোজেস আর হেনড্রিকই বুঝছে। যদিও তারা কাউকেই নিজেদের এ দক্ষতার কথা বলেনি। বরঞ্চ চোখেমুখে ভ্যাবাচ্যাকা ভাব ফুটিয়ে তুলে লোকটার কথা শুনল দুই ভাই, “অল রাইট, আমার নাম ডা, মার্কাস আর্চার এবং আমি একজন মনোবিজ্ঞানী। এখন তোমাদের বুদ্ধিমত্তার একটা পরীক্ষা নিয়ে দেখব যে কে কোন কাজের জন্যে উপযুক্ত। ঠিক আছে? এক বস বয়ের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার মাথা নাড়তেই সে বাকিদেরকে অনুবাদ করে বোঝাল যে, “এই লাল মানুষটা যা বলছে করো। যেন আমরা বুঝতে পারি যে তোমরা কতটা আহাম্মক। বুঝলে?”।

প্রথম পরীক্ষাটা হল ব্যক্তির মেকানিক্যাল শেপ সম্পর্কে ধারণা কতটুকু জানার জন্য কাঠের বিভিন্ন গড়নের ব্লক একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমে আটকানোর পাজল।

এ পর্যন্ত ১,১৬,৮১৬ জনের পরীক্ষা নিয়েছেন ডাক্তার। কিন্তু কেউই আড়াই মিনিটের আগে শেষ করতে পারেনি। অথচ আজ মোজেস মাত্র এক মিনিট ছয় সেকেন্ডে মিলিয়ে ফেলেছে পুরো পাজল। ডায়াস থেকে নেমে মোজেসের কাছে গেলেন ডাক্তার। ব্লকগুলোকে ঠিকঠাকভাবে সাজানো হয়েছে দেখে মনোযোগ দিয়ে তাকালেন ওর অভিব্যক্তিহীন অবয়বের দিকে।

এমনিতেই রুমে ঢোকার সাথে সাথে মোজেসের দৈহিক গঠন দেখে মুগ্ধ হয়েছেন কালো চামড়াপ্রিয় ডা. মার্কাস। এই কারণেই পাঁচ বছর আগে আফ্রিকায় চলে এসেছেন হোমা সেক্সয়াল ডাক্তার আর্চার।

ম্যাগডালিন কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়াকালীন নিজের এই গোপন সত্য টের পেয়েছেন ডাক্তার, আর যে মানুষটা এই আনন্দের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার কাছেই পেয়েছেন কার্ল মার্কস আর স্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কম্পানিস্ট পার্টি। আর ব্রম্নমবেরির কমরেডদের সাহচর্য পেলেও লন্ডনে কখনোই মন বসাতে পারেননি ডাক্তার। তাই পরবর্তীতে ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজির ওপর পড়াশোনা করেছেন। আফ্রিকান খনি শ্রমিকদের জন্যে কাজ করার সুযোগও করে দিয়েছে পার্টি। আর এতদিন নেশার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তার কৃষ্ণাঙ্গ প্রীতি। তাই সাউথ আফ্রিকান কম্যুনিস্ট পার্টির প্রয়োজনে সানন্দে সাড়া দিতে রাজি হয়ে গিয়েছেন ডা, আর্চার।

 গত পাঁচ বছরে চেম্বার অব মাইনসের সাথে কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সন্তুষ্টিও কম নয়। পার্টির সাথে তার সম্পর্ক খুব সাবধানে গোপন করা হলেও যতই দিন যাচ্ছে মার্কাসজমের প্রতি ততই প্রবল হচ্ছে ডাক্তারের আস্থা আর এক্ষেত্রে কাজগুলো এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রেণি ও গোত্রভিত্তিক বিভেদ, দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক সমাজের সাথে শ্বেতাঙ্গ বুর্জোয়াদের সম্পদের আকাশ-পাতাল ফারাক দেখে এই দেশকে আরো ভালেবেসে সাহায্য করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন ডাক্তার।

আর এখন তো মিশরীয় দেবতার মত তরুণ মোজেসকে দেখে রীতিমত অস্থির হয়ে উঠেছেন আর্চার।

 “তুমি ইংরেজি বলতে পারো তাই না?” জিজ্ঞেস করতেই মাথা নাড়ল মোজেস।

নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়াতে মঞ্চের দিকে ফিরে গেলেন ডাক্তার। চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে গিয়ে কেঁপে উঠল আঙুল।

বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল পুরো বিকাল। সবাইকে বিভিন্ন লেবেলে ভাগ করার পর মেইন স্ট্রিমে রইল কেবল একজন। মোজেস গামা। প্রথমটার মতই একের পর এক কঠিন সব পরীক্ষা উতরে গেল এই তরুণ। ডাক্তার আর্চার নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, তিনি এক দুর্লভ প্রতিভা আবিষ্কার করেছেন।

 পাঁচটার মধ্যে সবাই বিদায় নিলেও রেজিস্ট্রার চেক করে মোজেসকে কাছে ডাকলেন ডাক্তার। “গামা! তোমাকে দিয়ে আমি আরেকটা কাজ করাতে চাই।”

বারান্দার শেষ মাথায় নিজের অফিসে মোজেসকে নিয়ে চলে এলেন মার্কাস।

 “তুমি লেখাপড়া জানো গামা?”

“ইয়েস ডাক্তার।”

“এটা আসলে আমার থিওরি যে একজন লোকের হাতের লেখা দেখে তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই আমি চাই তুমি আমার জন্যে কিছু লিখো।”

 ডেস্কে পাশাপাশি বসে মোজেসের দিকে বিভিন্ন বইপত্র এগিয়ে দিলেন ডাক্তার। সহজভাবে গল্প করতে করতে জানালেন, “এই লেখাগুলোই আমি ব্যবহার করি।”

 নার্সারি ছড়া লেখা কার্ড এগিয়ে দিলেন ডা, মার্কাস। তারপর ঝুঁকে এলেন মোজেসের কাছে। বড় বড় অক্ষরে স্বাচ্ছন্দ্যে সার্বিক শব্দগুলো লিখে ফেলল। মোজেস। বোঝা গেল মানসিক শক্তির দিক থেকে এই তরুণ কতটা বলীয়ান।

হাতের লেখা দেখার ছলে আস্তে করে মোজেসের উরুতে হাত রাখলেন ডাক্তার। খানিকটা চমকে উঠল মোজেস। সাবধানে কলমটা নামিয়ে প্রথমবারের মত সোজাসুজি তাকাল ডাক্তারের সবুজ চোখ জোড়ার দিকে।

 “গামা” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ডাক্তার জানালেন, “তুমি এত বুদ্ধিমান যে কোদাল দিয়ে মাটি তুলে তার অপচয় করা উচিত নয়।” আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে মোজেসের পা স্পর্শ করলেন মার্কাস।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মোজেস। অভিব্যক্তির পরিবর্তন না হলেও আস্তে করে ফাঁক করে দিল দুটো পা। দেখে তো ঠকঠক করে উঠল ডাক্তারের বুক।

“আমি তোমাকে আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নিব, গামা।” ফিসফিস করে মার্কাস জানাতেই এই প্রস্তাবের গুরুত্ব ভেবে দেখল মোজেস। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার নেই এমন সব অঞ্চলেও এখন আর কেউ ওকে ঠেকাতে পারবে না। গোল্ড মাইনিং শিল্পের সব শ্রমিকদের ফাইল চাইলেই পাওয়া যাবে। চোখের পলকে হাতে এসে যাবে সব সুযোগ। আর এই যে ডাক্তারের চাহিদা তা নিয়েও ওর কোন মাথাব্যথা নেই। যদি এই শ্বেতাঙ্গ তার কাছে নারী হিসেবেই আসতে চায়, তাতেও আর কোনো সমস্যা নেই।

“ইয়েস ডাক্তার, আমি আপনার সাথে কাজ করব।” উত্তরে জানিয়ে দিল মোজেস।

***

ব্যারাক রুমে শেষরাতে সকল লেফটেন্যান্টকে নিজের কাছে ডেকে নিল মোজেস। বলল, “শীঘই তোমরা এখান থেকে গোল্ডিতে চলে যাবে। তবে হয়ত সবাই একসাথে থাকার সুযোগ নাও পেতে পারো। কেউ হয়ত ভূ-গর্ভে কাজ পাবে, কেউ উপরের প্ল্যান্টে। কিন্তু ভুলবে না যে আমরা সবাই ভ্রাতা। তোমাদের নিয়ে আমার অনেক জরুরি কাজ আছে। তাই আমিই তোমাদের খুঁজে বের করব। সেভাবেই প্রস্তুত থাকবে যেন ডাক দিলেই আমার কাছে চলে আসতে পারো। ঠিক আছে?”

“এহ হে!” সমস্বরে সকলে জানাল নিজেদের ইচ্ছে “আমরা তোমার ছোট ভাই। তাই যা বলবে শুনব।”

 “সবসময় মনে রাখবে যে আমিই তোমাদের বড় ভাই। আমি তোমাদের কারো কোনো ক্ষতি হতে দিব না। তোমাদের বিরুদ্ধে সকল কর্মের প্রতিশোধ নেয়া হবে। ইতিমধ্যেই দেখেছে যারা আমাদের ভ্রাতৃসংঘের সাথে লড়তে আসবে তাদের কী হবে।”

“আমরা দেখেছি” সকলেই বিড়বিড় করে উঠল, “আর তা হল মৃত্যু।”

“হ্যাঁ, মৃত্যু।” সবাইকে নিশ্চয়তা দিল মোজেস। “বিশ্বাসঘাতকতা করলেই মৃত্যু।”

“সকল বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যু।” সবাই মিলে আরো একবার একত্রে চিৎকার করে উঠল। মোজেস গামার মোহনীয় জাদুশক্তি সবাইকে কজা করে ফেলেছে।

“আমি আমাদের ভ্রাতৃসংঘের জন্য একটি প্রতীক খুঁজে পেয়েছি। মোজেস জানাল, আর তা হল ষাড়, কালো আর শক্তিশালী। সবাই এটাকে ভয় পায়। আমরাই হলাম সেই ষাঁড়ের দল।”

“আমরা হলাম ষাঁড়ের দল” অত্যন্ত গর্বিত বোধ করল উপস্থিত কৃষ্ণাঙ্গরা, “সবাই এখন আমাদেরকে ভয় পাওয়া শিখবে।”

“গোপন এসব চিহ্নের মাধ্যমে আমরা আমাদের লোকদের চিনে নিব।”

ডান হাত দিয়ে চিহ্নটা দেখিয়ে দিল মোজেস, “এভাবেই তোমার সামনে এলে তুমি তোমার ভ্রাতাকে ঠিকই চিনে নিতে পারবে।

অন্ধকার ব্যারাকে পরস্পরের সাথে হাত মিলিয়ে সবাই একে অন্যকে অভিবাদন জানাল। সূচনা হল এক নতুন ভাতসংঘ “আমি শীঘ্রই তোমাদেরকে ডাক দিব। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গরা যা বলে তোমাদেরকে তাই করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করে শিখতে হবে। সময় আসলে যেন তা কাজে লাগাতে পারো সেভাবেই তৈরি থাকতে হবে। তারপর সবাইকে যার যার বাঙ্কে পাঠিয়ে দিয়ে একসাথে বসল হেনড্রিক আর মোজেস। ফিসফিস করে বলল,

“ভাই, তুমি সাদা পাথরগুলো হারিয়ে ফেলেছ। এতক্ষণে পাখি আর ছোট ছোট জন্তু-জানোয়ার পাউরুটির টুকরোগুলোকেও খেয়ে ফেলেছে। ওগুলো চিরতরে হারিয়ে গেছে ভাই।”

“হ্যাঁ, ওগুলো হারিয়ে গেছে।” বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন হেনড্রিক। “অনেক অনেক যুদ্ধ, রক্ত আর পরিশ্রমের পরেও বাতাসে বীজের মতই ছড়িয়ে গেছে পাথরগুলো।”

 “সেগুলো আসলে অভিশপ্ত ছিল।” ভাইকে সান্তনা দিতে চাইল মোজেস, “দেখার পর থেকেই আমি বুঝতে পেরেছি যে পাথরগুলো কেবল মৃত্যু আর বিপর্যয় বয়ে আনবে, সেগুলো আসলে শ্বেতাঙ্গদের খেলনা। খরচ করা কিংবা বিক্রি যেটাই করতে যাবে ঠিক ঠিক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাবে। আর তারপরে ফাঁসির দড়ি কিংবা কারাগার জুটত তোমার কপালে।

 চুপচাপ বসে কথাগুলো যে কতটা সত্য তাই ভাবছেন হেনড্রিক। কীইবা করতেন পাথরগুলো দিয়ে? কৃষ্ণাঙ্গরা তো নিজেদের জন্য জমিও কিনতে পারে না। তাছাড়া কোনো কৃষ্ণাঙ্গই মোটরগাড়িতে চড়তে পারে না।

“না, ভাই।” নরম স্বরে জানাল মোজেস, “ওগুলো তোমার জন্যে নয়। বরঞ্চ তোমার পিতৃপুরুষদের কথা ভাবো যারা তোমার মাঝে স্পৃহা ছাড়িয়ে দিয়ে মিশে গেছেন মাটিতে।”

আস্তে করে ঘোতঘোত করে উঠলেন হেনড্রিক, “তারপরেও এরকম সম্পদ গোপনে হাতে নিলেও তো কত ভালো লাগত। আমারই থাকত।”

“হিরে কিংবা শ্বেতাঙ্গদের সোনা ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ অনেক সম্পদ আছে ভাই।”

“কোন সম্পদ?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক।

“আমাকে অনুসরণ করো। আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।”

“কিন্তু কী সেটা তো বলো।” জোর করলেন হেনড্রিক।

“সময়মত ঠিকই বুঝতে পারবে ভাই।” হেসে ফেলল মোজেস। “সম্পদ আপনাতেই আসবে। এখন আমার কথা শোনো, বোম্বু, আমার ছোট্ট ডাক্তার নারী হিসেবে আদর পেতেই বেশি পছন্দ করে। সে তোমাকে সেন্ট্রাল ব্যান্ড কনসলিডেন্টেড নামে গোল্ডিতে পাঠাবে। গভীর সব শ্যাফট আছে সেখানে। আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করবে তাই নাম কামাবার চেষ্টা করো। আমি ডাক্তারের উপর প্রভাব খাটিয়ে আমাদের সেরা দশজনকে তোমার সাথে পাঠিয়ে দিব। এই সঁড়ের দল হবে তোমার যোদ্ধা। এদেরকে দিয়ে শুরু করলেও খুব তাড়াতাড়ি তোমার চারপাশে দ্রুত, শক্তিশালী আর নির্ভীকদেরকে জড়ো করে নিও।”

“ওদেরকে নিয়ে আমি কী করব?”

“তৈরি করে রাখবে। আমি শীঘ্রই ডেকে পাঠাব। খুব শীঘ্রি।”

 “অন্য বঁড়দের কী হবে?”

“বোম্বু ওদেরকে আমার পরামর্শমত দশজনের দল হিসেবে অন্যান্য গোল্ডিতে পাঠিয়ে দিবে। সর্বত্রই আমাদের ছোট ছোট দল থাকবে। আস্তে আস্তে সংখ্যায় বেড়ে তারা এত বিশাল এক কালো ষাড়ের পাল হয়ে উঠবে যে সবচেয়ে ভয়ংকর সিংহও চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পাবে।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *