৪. ঘোড়া থামালেন সেনটেইন

চূড়ায় পৌঁছে ঘোড়া থামালেন সেনটেইন। কিন্তু পানির গন্ধ পাবার সাথে সাথে উন্মাদ হয়ে উঠেছে ঘোড়া। মরুভূমির এমন অনেক অভিযাত্রীর কথা শুনেছেন যারা নিজেদের পশুদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পানির তৃষ্ণায় মারা যায়। কারণ অবলা জীবগুলো ছুটে গিয়ে কাদা-মাটি বানিয়ে ফেলে গোটা পুকুর। তবে সার্জেন্ট আর কর্নেল এ কাজে বেশ অভিজ্ঞ। তারা পরিস্থিতি ভালোভাবেই সামলে নিলেন।

 ঘোড়াগুলো পানি খেয়ে উঠে যাবার পর বুট জুতা খুলে সম্পূর্ণ কাপড় পরেই পানিতে নেমে গেলেন সেনটেইন।

তীরে ওঠার সময় আড়চোখে তাকাতেই দেখেন যে শার্ট খুলে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে মাথায় ছিটে দিচ্ছেন ব্লেইন। এই প্রথম কর্নেলকে উদোম গায়ে দেখলেন সেনটেইন। বুকের ঘন কোকড়া লোম থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়া পানির বিন্দু দেখে শিহরিত হয়ে উঠল তার সারা শরীর। পালিশ করা মার্বেলের মত দেহখানা দেখে মনে পড়ে গেল মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডের কথা।

সেনটেইনকে এগোতে দেখে তাড়াতাড়ি শার্ট পরে নিলেন ব্লেইন। সাথে সাথে ভিজে গেল কাপড়। কর্নেলের ভদ্রতা দেখে হেসে ফেললেন সেনটেইন, জানালেন, “ডি লা রে এখানে কোনো বাড়তি ঘোড়া পায়নি।”

অবাক হয়ে গেলেন কর্নেল, “কীভাবে বুঝলেন?”

“কিউয়ি বলেছে দু’জন মানুষ অনেকগুলো ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করলেও বহুদিন আগেই আবার চলেও গেছে। ইয়েস আমিও নিশ্চিত।”

হাত দিয়ে ভেজা চুল ঠিক করে নিলেন ব্লেইন, “তার মানে লোথারের পরিকল্পনাতে কোনো একটা গড়বড় হয়েছে।”

 “কিউয়ি বলছে ওরা নাকি পায়ে হেঁটে সামনে এগিয়েছে।” হঠাৎ করেই বনের কিনার থেকে শোনা গেল কিউয়ির গগনবিদারী চিৎকার। তাড়াতাড়ি সেদিকে ছুটলেন দুজনে।

অ্যাকেশিয়া গাছের নিচে পড়ে আছে খাবারের পাত্র, টিনজাত মাংস, কম্বল। পা দিয়ে জিনিসগুলো উল্টে দিলেন ব্লেইন,

 “দেখো ওরা কতটা মরীয়া হয়ে সব ফেলে গেছে। হর্স আয়রনও পড়ে আছে। শেষবারের মতন নদীতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।”

 “এখানে দেখো ব্লেইন,” সেনটেইনের কাছে যেতেই দেখা গেল বালির উপর পড়ে আছে ব্যান্ডেজ।

“ওর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ও মারা যাচ্ছে ব্লেইন।” অদ্ভুত হলেও সত্যি সেনটেইন কেন যেন বিজয়ের উল্লাসও বোধ করছেন না।

চড়া গলায় সার্জেন্টকে ডাকলেন ব্লেইন, “আমরা ঘণ্টাখানেকের মাঝেই আবার রওনা দেব। সবার খাওয়া হয়েছে কিনা দেখো।” তারপর সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে নিজেকে ভালোই সামলেছেন।

ছায়ার নিচে পাশাপাশি এসে বসলেন দুজনে। গরম আর ক্লান্তিতে ক্ষুধাও মরে গেছে। চুরুট ধরাতে গিয়েও কী মনে করে রেখে দিলেন কর্নেল। সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

 “প্রথম দেখায় আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি তোমার হিরের মতই সুন্দর, জেদী আর বুদ্ধিমান।”

“আর এখন?”

“তোমাকে আমি পঙ্গু ঘোড়ার জন্যে কাঁদতে দেখেছি। এতটা ক্ষতি করেছে যে তোক তার জন্যেও তোমার চোখে গভীর সমবেদনা দেখেছি। কালক্লান্ড ছাড়ার পরেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর এখন তো শ্রদ্ধাও করি। বুঝলে?

“এটা কি ভালোবাসার চেয়ে ভিন্ন কিছু?”

“অবশ্যই।”

আর কিছু না বলে দুজনেই কিছুণ চুপ করে রইলেন। তারপর সেনটেইন জানালেন, “ব্লেইন, অনেকদিন ধরেই আমি একা। কেবল আমার ছেলেকে নিয়ে ভেবেছি। ওর জন্য নানান পরিকল্পনা করেছি। যখন মরুভূমিতে এসেছিলাম তখন থেকেই জানি যে আমিই আমার ভরসা। আপন শক্তি আর মনোবল ছাড়া বাকি সবকিছু মিথ্যা। এখনো এ ধারণার পরিবর্তন হয়নি। আমার জন্য কেউই নেই। তাই না ব্লেইন?”

চোখ না সরিয়েই কর্নেল উত্তরে বললেন, “যদি

উনার হয়ে লাইনটা শেষ করলেন সেনটেইন, “ইসাবেলা আর মেয়েরা তো আছে।”

 মাথা নাড়লেন ব্লেইন। “কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে পারি তাই না ব্লেইন?”

 “আমার সাথে এতটা কঠোর হয়ো না। আমি কখনোই কোনো প্রতিজ্ঞা করিনি তোমার কাছে।”

“আয়্যাম সরি।” নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপ করে গেলেন সেনটেইন। একটু পরে জানালেন, “সত্যিই তাই। তুমি তো আমার কাছে কোনো প্রমিজ, করোনি।” তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলল। আমাদের সময় শেষ।”

***

এবার বাধ্য হয়ে নিজেদের পাঁচটা ঘোড়াও রেখে যেতে হল। আর বাকিগুলোকে ক্লান্ত হতে না দেয়ার জন্য ব্লেইন খানিক হাঁটছেন, খানিক আবার ঘোড়ায় চড়ে এগোচ্ছেন।

কেবল বুশম্যান ভ্রাতৃদ্বয়কে গরম, তৃষ্ণা কিংবা ক্লান্তি কিছুই কাবু করতে পারেনি।

এদিকে প্রচণ্ড কাহিল হয়ে পড়েছেন সেনটেইন। শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা পর্যন্ত ব্যথায় টনটন করছে। জিহ্বা যেন ভারি হয়ে চামড়ার মত শক্ত হয়ে গেছে। মাথায় কেবল একটাই চিন্তা যে আবার কখন পানির কাছে। পৌঁছাতে পারবেন।

দলের কেউ কোনো কথা বলছে না। পাছে সেটুকু শক্তিও নষ্ট হয়ে তাদেরকে আরো ক্লান্ত করে তোলে।

মনে মনে ভয় পেয়ে গেলেন সেনটেইন। কিছুতেই সারেন্ডার করা চলবে না। বহুকষ্টে মাখাটা উপরে তুলে রাখলেন যেন পায়ের কাছে ঝুলে না পড়ে। কয়েক কদম এগিয়ে গেছেন ব্লেইন। প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আর মনোবল খাটিয়ে পা চালিয়ে নিজেও চলে এলেন তার পাশে। তৎক্ষণাৎ মনে হল এই তো নিজ শরীরের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে জিতে গেছেন।

এদিকে ফিরে হাসলেন ব্লেইন। যদিও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, কত কষ্ট করে তা করছেন, “ওই টিবিগুলো কিন্তু মানচিত্রে নেই।”

এতক্ষণ সেনটেইনের চোখে পড়েনি। এবার চোখ তুলে তাকাতেই তিনিও দেখতে পেলেন। মাইলখানেক সামনেই জঙ্গলের মাথা কুঁড়ে বেরিয়েছে মসৃণ গ্রানাইট।

“একেবারে কাছের পাহাড়টার কাছে গিয়েই আমরা পানি পান করব।” সেনটেইনের অবসাদ পরিষ্কারভাবে অনুভব করছেন কর্নেল।

 “গাধাকে গাজর দেখাচ্ছে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন।

খানিক বাদে গ্রানাইটের কাছে পৌঁছে দেখা গেল লোথার ডি লা রে’র সর্ব শেষ ঘোড়ার দেহ।

নতুন মানুষকে দেখে বেচারা মাথা উঠাতে চাইলেও অল্প পরিশ্রমে আবার হেলে পড়ল মাটিতে। খানিক দূর গিয়ে ঘুরে এল কিউয়ি। তারপর চোখ উপরের দিকে তুলে কী যেন দেখাল।

 অন্যরাও এগিয়ে গিয়ে খাড়া সুউচ্চ গোলাকার গ্রানাইটের চূড়ার দিকে তাকাল। না হলেও দুইশ থেকে তিনশ ফুট উঁচু। কিন্তু পৃষ্ঠদেশ দূর থেকে যতটা মসৃণ লেগেছিল বাস্তবে তা নয়। তাছাড়া বহুদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর উষ্ণ আবহাওয়ায় জায়গায় জায়গায় ক্ষয়েও পড়েছে। ফলে ছোট ছোট সিঁড়ি মতন তৈরি হয়েছে যেটার উপর পা রেখে উপরে হয়ত ওঠা যাবে; তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে সে সিদ্ধান্ত।

একেবারে চূড়ার নিখুঁত গোলাকার বোল্ডারগুলো দেখে সেনটেইনের মনে পড়ে গেল ছোটবেলার ফ্রান্সে দেখা সমাধিকক্ষ কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলের মাঝের মায়ান মন্দিরের কথা।

 নিজের ঘোড়া নিয়ে গ্রানাইট চূড়ার পাদদেশে চলে গেলেন ব্লেইন। আর তখনি কী যেন একটা দেখে অবাক হলেন সেনটেইন। মাথার বোল্ডারগুলোর পেছনে যেন নড়ে উঠল একটা ছায়া।

“ব্লেইন, সাবধানে! ওই যে উপরে- কিন্তু সেনটেইনের সতর্কবাণী শুনে সরে আসার আগেই গমের বস্তার মত ধপ করে পাথরের মেঝেতে পড়ে গেলেন ব্লেইন আর তার ঘোড়া। উপর থেকে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসা বুলেটে ধরাশায়ী হয়েছে তার ঘোড়া।

মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন আর সে সময়ই কানে এল মসার রাইফেলের আওয়াজ। তার মানে শব্দের আগেই বুলেটটা যথাস্থানে পৌঁছে গেছে।

চারপাশে যেন নরক ভেঙে পড়েছে। আতঙ্কিত ঘোড়াগুলোকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সৈন্যদের দল। নিজের ঘোড়া নিয়ে কর্নেলের কাছে ছুটলেন সেনটেইন। মৃত ঘোড়াটার পাশেই পড়ে আছেন ক্লেইন। কিন্তু তাকে তুলে দাঁড় করাবার আগেই আরেকটা বুলেট এসে ঝাঁঝরা করে দিল হ্যাঁনসমেয়ারে ঘোড়াকে; মাথা মাটিতে ঠুকে পড়ে গেলেন সার্জেন্ট।

 তাই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়েই সেনটেইনের দিকে দৌড় দিলেন ব্লেইন। কোনো রকম জিন ধরেই ছুটছেন সামনে। তারপরেও সেনটেইনকে মানা করলেন যেন ঘোড়া না থামায়। এদিকে চকিতে একবার পিছনে তাকাতেই সেনটেইনের চোখে পড়ল বুলেট এসে শেষ করে দিয়ে গেছে আরেকজন সৈন্যকে।

অতএব কেবল বেঁচে আছে সেনটেইনের ঘোড়া। বাকি সবগুলো মাথায় গুলি খেয়ে মারা গেছে। দেড়শ’ কদম দূর থেকে এতটা নিখুঁত রেঞ্জে গুলি করা যার-তার কাজ নয়।

ছুটতে ছুটতেই সামনে দেখলেন কয়েকটা মরা মোপানির ডাল পড়ে প্রাকৃতিক দুর্গ মতন তৈরি হয়েছে। লাগামের দড়ি ছেড়ে গড়িয়ে সেদিকে চলে গেলেন কর্নেল। “গাধার মতন গিয়ে ওদের অ্যাম্বুবুশে পা দিলাম।” বোঝ গেল নিজের উপরেই বেজায় ক্ষেপে গেছেন। তারপর ঝট করে সেনটেইনের ঘোড়ার পা-দানি থেকে রাইফেল নিয়ে তীরের মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। আহত হলেও অক্ষত আছেন সার্জেন্ট। তাড়াতাড়ি বাকি সৈন্যদেরকে নিয়ে চলে এলেন সেনটেইনদের কাছে।

তবে মজার ব্যাপার হল প্রথম গুলির শব্দ শোনার সাথে সাথে হাওয়া হয়ে গেছে বুশম্যান দুই ভাই। সেনটেইন ভালোভাবেই জানেন এতক্ষণে হয়ত ওচি প্যানেও পৌঁছে গেছে।

লি এনফিল্ড বের করে ছুটন্ত সৈন্যদেরকে কাভার দিলেন ব্লেইন। কিন্তু চারশ’ গজ দূরের চূড়ার লোকটাকে কিছুতেই দেখা যাচ্ছে না। বারুদের নীল ধোয়া তাকে আড়াল করে রেখেছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে তীরে এসে পৌঁছে গেলেন সার্জেন্ট আর তার দল। সবাই যে যার রাইফেল ঠিকই নিয়ে এসেছে দেখে সন্তুষ্ট হলেন কর্নেল।

“ওরা কেবল প্রতিটি ঘোড়ার মাথা টার্গেট করেছে। কোনো মানুষকে নয়।” কোনোরকমে দম নিতে নিতে জানালেন হ্যানসমেয়ার।

 “আমার আশপাশেও একবারও গুলি ছোড়েনি।” বললেও সেনটেইন, বুঝতে পারলেন যে লোথার তবে বিপদে ফেলতে চান না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই যে তার মাথায় বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

এনফিল্ড রিলোড করে হাসলেন ব্লেইন। যেন বেশ মজা পেয়েছেন, এমনভাবে বললেন, “শয়তানটা আসলে নিজের নামের পাশে খুনি তকমাটা লাগাতে চায় না। তারপর হ্যাঁনসমেয়ারের কাছে জানতে চাইলেন, “কতজন আছে উপরে?”

 “জানি না। তবে একের বেশি। একজন এতটা ফায়ার করতে পারবে না।”

“অল রাইট। চলো তাহলে খুঁজে দেখি আসলেই কতজন আছে।” সেনটেইন আর সাজেন্টের দিকে ঝুঁকে নিজের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন কর্নেল।

বাইনোকুলার নিয়ে গিরিখাতের মুখে চলে এলেন সেনটেইন। তারপর ঘাসের গুচ্ছের পেছনে লুকিয়ে দূরবিন একেবারে গ্রানাইটের চূড়ার দিকে ফোকাস করলেন।

“রেডি!”

সেনটেইনের ঘোষণা শুনে হ্যানসমেয়ার উপরের লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পরপর দুবার গুলি ছুড়লেন। ব্লেইনের নিজের রাইফেলের ওপর হেলমেট পরিয়ে রেখেছিলেন। তাই সার্জেন্টের গুলির সাথে সাথে প্রতিউত্তর হিসেবে ঝাঁঝরা হয়ে গেল কর্নেলের হেলমেট।

“তিনজন।” দূরবীন চোখে সবকিছু পরিষ্কার দেখে জানালেন সেনটেইন।” আমি তিনটা মাথা দেখেছি।”

“গুড।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন।

ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো থলে থেকে পানির বোতল এনে কর্নেলকে দেখালেন সেনটেইন, “মাত্র এটুকুই আছে।” চার ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম পানি দেখে অবচেতনেই ঠোঁট চাটলেন কর্নেল,

“কোনো সমস্যা নেই। অন্ধকার নামলেই বাকি বোতলগুলোও উদ্ধার করে নিয়ে আসব।” তারপর কর্কশ কণ্ঠে সার্জেন্টকে আদেশ দিলেন, “দুজনে সৈন্য নিয়ে ঘুরে আরেক পাশে চলে যান। কেউ যেন ওদিক দিয়ে পালাতে না পারে।”

***

গ্রানাইটের চুড়ার গোলাকার বিশাল এক বোল্ডারের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন লোথার ডি লা রে। কোলের মাঝে মসার রাইফেল। কপালের ওপর লুটিয়ে পড়েছে নরম সোনালি রঙা চুল।

দক্ষিণের মোপানি জঙ্গলটার দিকেই একমনে তাকিয়ে আছেন। খাড়া গ্রানাইটের দেয়াল বেয়ে ওঠার ধকল এখনো সামলাতে পারেননি।

“আমাকে এক বোতল পানি এনে দাও, ব্যস।” হেনড্রিককে জানাতেই কথামত কাজ করলেন ওভাষো।

মাথা নেড়ে গ্রানাইটের স্ল্যাবের ওপর পড়ে থাকা বাকি জিনিসগুলোও চেক করে দেখলেন লোথার। চারটা হ্যান্ড গ্রেনেড, যেগুলোতে কাঠের হ্যাঁন্ডেল লাগানো আছে। এছাড়া ক্লেইন বয় তার রাইফেল রেখে যাচ্ছে, সাথে বুলেট। তার মানে লোখারের কাছে দুইটা মসার রাইফেল আর দেড়শ’ রাউন্ড গুলি, আছে।

“অল রাইট” সব দেখেশুনে জানালেন লোথার। আমার যা যা দরকার সব আছে। তোমরা এবার রওনা দাও।”

 নিজের কামানের গোলার মত মাথাটা ঘুরিয়ে দক্ষিণে তাকালেন হেনড্রিক। পিছু ধাওয়াকারীদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না এখনো। কিন্তু মাথা সরাতে যেতেই আবার থেমে গেলেন। “ধুলা!” প্রায় পাঁচ মাইল দূরে হলেও অস্পষ্ট কুয়াশার মত ঠিকই দেখা যাচ্ছে।

“হ্যাঁ।” মিনিটখানেক আগে লোথারও খেয়াল করেছেন।

“হয়ত জেব্রার দল হবে। এখন যাও। দেরি হয়ে যাবে।”

কিছু না বলে লোখারের হলুদ রঙা চোখের দিকে তাকালেন হেনড্রিক। সাধারণত কখনো লোথারের আদেশের বিপক্ষে যান না। জানেন সেটাই সঠিক কিন্তু এবারে কেন যেন কিছু বলতে মন চাইল; অথচ ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন না। টের পেলেন যেন নিজের শরীরের একটা অংশকেই রেখে যাচ্ছেন এই রৌদ্রে ক্ষয়ে যাওয়া পাথরগুলোর ওপরে। কেবল সহজ, সাধারণভাবে জানালেন, “আমি ওর খেয়াল রাখব।” মাথা নাড়লেন লোথার।

 “আমি একটু ম্যানির সাথে কথা বলতে চাই।” রক্তে বিষ মিশে যাওয়ায় কেঁপে উঠলেন, বললেন, “তোমরা নিচে গিয়ে অপেক্ষা করো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব।”

 “চল,” উঠে দাঁড়িয়ে ক্লেইন বয়কে ইশারা করে শিকারি চিতার মতই ক্ষিপ্রগতিতে কিনারের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেলেন হেনড্রিক। কেবল যাবার আগে একবার পিছু তাকিয়ে ডান হাত তুলে লোথারকে বললেন,

“ভালো থেকো।

“তুমিও ভালো থেকো, বন্ধু।” এর আগে কখনো বন্ধু শব্দটা উচ্চারণ করেননি লোথার। শুনে তাই খানিকটা কেঁপে উঠলেও আর কিছু বললেন না হেনড্রিক।

 “ম্যানফ্রেড” বাবার কাছে এসে বসল ম্যানফ্রেড। একাগ্র মনে তাকিয়ে দেখল বাবার চেহারা, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি। ফিসফিস করে বলে উঠল, “পা, আমি যাব না। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।”

 নিজেকে নরম হতে দিলেন না লোথার, “আমি যা বলেছি তুমি ঠিক তাই করবে।”

“পা—”

 “তুমি সবসময় আমার বাধ্য ছেলে হয়ে থেকেছে ম্যানি। তাই তোমাকে নিয়ে আমি অনেক গর্ব করি। এখন আর অবাধ্য হয়ো না। আমি যেন না ভাবতে পারি যে আমার ছেলে একটা কাপুরুষ।”

“আমি কাপুরুষ নই!”

“তাহলে যা করতে হবে তাই করো।” ম্যানি আর কিছু বলার আগে কর্কশ কণ্ঠে লোথার আদেশ দিলেন, “যাও, হ্যাঁঙারস্যাকটা নিয়ে এসো।”

কথামত কাজ করল ম্যানি। পায়ের কাছে ব্যাগ রেখে সুস্থ হাত দিয়ে খুলে ফেললেন লোথার। একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন কাগজ। তারপর গ্রানাইটের উপর ছড়িয়ে দিলেন সবগুলো হীরে। খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে বড় আর সাদা দশটা পাথর বেছে নিলেন।

 অতঃপর ছেলেকে আদেশ দিলেন, “তোমার জ্যাকেট খোলো।”

ম্যানফ্রেড জ্যাকেট খুলে বাবার হাতে দিলে পর লাইনিংয়ের মাঝে ছোট্ট একটা গর্ত করে ফেললেন,লোথার।

 “এই হীরেগুলোর মূল্য হবে হাজার হাজার পাউন্ড। যা দিয়ে তোমার বড় হওয়া আর পড়াশোনার সব খরচ মেটানো যাবে। আঙুল দিয়ে ঠেলে ঠেলে সবকটা পাথরই লাইনিংয়ের মাঝে ঢুকিয়ে দিলেন।

 “কিন্তু বাকিগুলো সংখ্যায় অনেক বেশি আর ভারি হওয়ায় লুকানোও কষ্টকর হবে। তাই তুমি সাথে নিয়ে না যাওয়াই ভালো।” বহু কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন লোথার, “এসো।”

তারপর বড় বড় বোল্ডারগুলো ধরে চলে এলেন এমন এক জায়গায় যেখানে গ্রানাইটের মাঝে চিকন একটা ফাঁক আছে। দেখে মনে হবে বাটালি দিয়ে কাটা হয়েছে। ফাটলটা মাত্র হাত ঢোকানোর মত চওড়া হলেও ভেতরে বেশ গভীর। উঁকি দিয়েও তল দেখা যায় না। ত্রিশ ফুট মতন হতে পারে।

হ্যাঙারস্যাকের দড়ি উপুড় করে ফাটলের মধ্যে ঢেলে দিলেন লোথার। তারপর ফিসফিস করে ছেলেকে জানালেন, “এই জায়গাটা মনে রেখো। প্রয়োজনের মুহূর্তে তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে এসব পাথর।”

পিতা-পুত্র দুজনে একসাথে উঁকি দিতেই প্রায় ত্রিশ ফুট নিচে হালকা রঙের আভা চোখে পড়ল। তবে না জানলে পথচারীদের কেউ বুঝতেই পারবে না যে এখানে কোনো সম্পদ লুকানো আছে।

“অল রাইট। হেনড্রিক তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এখন যাও ম্যানি।” হামাগুড়ি দিয়ে জায়গাটা থেকে সরে এলেন লোথার।

ইচ্ছে করল শেষবারের মতন ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন; বুক ভরে ছেলের গন্ধ নেন, নাকে-মুখে চুমু দেন। কিন্তু নড়লেন না লোথার। জানেন তাহলে দু’জনেই দুর্বল হয়ে পড়বেন। তাই কর্কশ কন্ঠে আদেশ দিলেন, “যাও!” ফুঁপিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রইল ম্যানি।

“আমি তোমার সাথে থাকব।” ছেলের কব্জি ধরে অতঃপর হাত দিয়ে কাঁধ চেপে ধরলেন লোথার। “তুমি কি চাও আমি তোমার এই কাঁদুনে চেহারাটাই মনে রাখি?” ..

“পা, প্লিজ আমাকে তোমার কাছে থাকতে দাও।”

ছেলের হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এসে প্রচণ্ড জোরে ম্যানিকে এক চড় কষালেন লোথার। সাথে সাথে গালে ফুটে উঠল লাল লাল দাগ; এমন কি নাক কেটে ঠোঁটের উপরও গড়িয়ে পড়ল রক্ত। এতটাই বিস্মিত হয়ে গেল যে বাবার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল ম্যানি।

 “চলে যাও এখান থেকে নিজের সর্বশক্তি জড়ো করে ধমক দিলেন লোথার।

নড়ে উঠে সামনে এগোল ম্যানি। চোখে এখনো অবিশ্বাস। কিছুতেই ভাবতে পারছে না যে বাবা কেন এমন করল। কিনারের দিকে যেতেই হোঁচট খেয়ে আবার পিছু ফিরে তাকাল,

“বাবা! প্লিজ, আমাকে”

 “যাও, আর কোনো কথা নয়, যাও!”

এগোতে গিয়ে ধপাস করে ওপাশে গড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেন্ড। আর ছেলে চোখের আড়াল হতেই প্রথমবারের মত ফুঁপিয়ে উঠে নিঃশব্দে পুরো শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন লোথার।

“জ্বর, আসলে জ্বরটাই বোধ হয় আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে।” নিজেকে প্রবোধ দিলেও কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ছেলের অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি চেহারা। আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলেন, “মাফ করে দে বাবা, মাফ করে দে। নয়ত তোকে বাঁচানো যেত না।”

***

লোথার নির্ঘাত বেহুশ হয়ে পড়েছিলেন। কারণ আচমকা জেগে উঠে প্রথমে ঠাহর করতে পারলেন না যে কোথায় আছেন কিংবা কীভাবে এসেছেন এ জায়গায়। তারপরেই অবশ্য হাতের ক্ষতের গন্ধে সবকিছু মনে পড়ে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে চুড়ার কিনারে গিয়ে নিচে তাকাতেই চোখে পড়ল ছোট্ট দুই মানবাকৃতির দেহ।

“বুশম্যান!” ওদের এত দ্রুত এগিয়ে আসার কারণটাও বুঝতে পারলেন লোথার, “ও আমার পিছনে পোষা বুশম্যানদের লাগিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই তার সমস্ত কৌশলও বৃথা গেছে। কারণ পদচিহ্ন দেখে কারো পিছু নিতে এদের মত ওস্তাদ অন্য কোনো গোত্র নেই।

বুশম্যানদের পেছনে পেছনে আসছে মোট সাতজন। কিন্তু চোখ দুটো সরু করেও ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে নারী শরীরটাকে আলাদা করতে পারলেন না লোথার। মোপানির ঘন ঝাড়ে আটকে যাচ্ছে দৃষ্টি। এবার নিজের প্রস্তুতির দিকে মনোযোগ দিলেন। পিছু ধাওয়াকারীদেরকে যতদূর সম্ভব দেরি করিয়ে দিতে হবে আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যেন ওরা ভাবতে বাধ্য হয় যে তিনি গোটা দল নিয়েই উপরে বসে আছেন।

এক হাতে কাজ করাটা সত্যিই দুঃসাধ্য। তারপরেও বহু কষ্টে ক্লেইন বয়ের রাইফেলটাকে সমভূমির দিকে নিশানা করে ফিট করে রাখলেন।

 খানিক বাদে বাদেই মিনিটখানেকের জন্য হলেও বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। পা দুটো যেন কিছুতেই আর ভার বইতে নারাজ। অন্যদিকে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসছে।

 আবারো একবার নিচে তাকাতেই দেখলেন যে প্রায় সমভূমির কিনারে চলে এসেছে পিছু ধাওয়াকারী। এবারে সেনটেইনকে চিনতে পারলেন। এমনকি গলার কাছে পেঁচানো হলুদ স্কার্ফটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জ্বরতপ্ত শরীরেও অনুভব করলেন এক অম্ল-মধুর শ্রদ্ধা, “হায় ঈশ্বর, কখনোই হারতে চায় না। মনে হয় নরকের ওপাড়েও ঠিকই পিছু নেবে।”

তারপর নষ্ট পানির বোতলগুলোর কাছে গিয়ে তিন সারিতে সাজিয়ে লেদার স্ট্র্যাপ দিয়ে এমনভাবে সাজালেন যেন চাইলেই এক টানে কাজে লাগানো যায়।

“সোজা গুলি করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আসলে।” ফিসফিস করে নিজেকেই যেন শোনালেন লোথার। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে গলা; পুরো শরীর যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। তাড়াহুড়া করে পানির বোতলের মুখ খুলে কয়েক ঢোঁক খেয়ে নিতেই অবশ্য ভালো লাগল। অতঃপর নিজের জ্যাকেট ভাজ করে কুশন বানিয়ে উপরে মসার রাইফেল রেখে তাক করলেন সামনের দিকে। ততক্ষণে নিচে মৃত ঘোড়াটার কাছে এসে পৌঁছে গেছে সেনটেইনের দল। এতগুলো ঘোড়া দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন লোথার।

 বহু নিচে লুটিয়ে পড়ল ব্লেইন ম্যালকমসের ঘোড়া। নিজের মসার ছাড়াও স্ট্যাপ টেনে ক্লেইন বয়ের রাইফেলও কাজে লাগাচ্ছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হল ঘটনার উত্তেজনায় যেন কমে গেছে দেহের তাপমাত্রা। স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে দৃষ্টিশক্তি। একের পর এক বুলেট গিয়ে ধরাশায়ী হল সবকটা ঘোড়া কেবল বেঁচে গেল সেনটেইনেরটা। কিন্তু কিছুতেই সেদিকে ট্রিগার টিপতে পারলেন না।

মোপানির পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল সেনটেইন। সাথে ব্লেইন। শোনা যাচ্ছে ছুটন্ত সৈন্যদের আর্তচিৎকার। চাইলে তাদেরকেও পরিষ্কার নিশানা বানিয়ে ফেলতে পারেন লোথার। তবে এর পরিবর্তে ভাবলেন দেখা যাক কতক্ষণ এভাবে পার করে দেয়া যায়।

 একেবারে শেষ সৈন্যটাও মোপানির আড়ালে চলে যেতেই খেয়াল হল প্রচণ্ড কাঁপছেন আর একই সাথে ঘামছেন।

“না, না, এভাবে হবে না। তৈরি হতে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে।”

এবার দ্বিতীয় রাইফেলের কাছে গিয়ে রিলোড করে নিলেন। খানিক বাদেই চোখে পড়ল গিরি সংকটের মুখে হেলমেট। সেই বোয়ার যুদ্ধের সময় থেকেই সকল সৈন্য চেনে এই অনর্থক হাস্যকর কৌশল।

“ঠিক আছে দেখা যাক তাহলে। কে কাকে খোয়াড়ে পোরে।” হেসে ফেললেন লোথার।

দুটো রাইফেল থেকে একসাথে গুলি ছুড়লেন। পাশাপাশি খালি পানির বোতলের তূপ ধরেও ঝাঁকুনি দিলেন। অত নিচ থেকে আকাশের দিকে তাকালে যে কেউ বোতলগুলোকেও রাইফেলম্যান বলে ভুল করবে।

এবার নিশ্চয়ই পাহাড়টাকে চক্কর কাটার জন্য সৈন্য পাঠাবে।” অনুমান করলেন লোথার। কোনো সমস্যা নেই; মসার প্রস্তুত আছে।

 “অন্ধকার নামতে এখনো পাঁচ ঘণ্টা বাকি। হেনড্রিক আর ম্যানি নদী তীরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কাল ভোর হয়ে যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত এদেরকে আটকে রাখতেই হবে।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই ডান দিকে নড়াচড় দেখা গেল। লোকগুলোর মাথার উপরের মোপানির গুঁড়ি টার্গেট করে গুলি ছুড়লেন লোথার। ভেজা সাদা গাছের ছাল ছিটিয়ে পড়ল বাতাসে।

“ভাগ, বেজন্মার দল ভাগ।” আবার হেসে ফেললেন। হিস্টিরিয়ার মত কিছুতেই যেন থামতে পারছেন না। তবে এরই ফাঁকে চোখের সামনে ভেসে উঠল ম্যানির মুখ।

“বাছা আমার। ঈশ্বর, আমি কেমন করে ওকে ছাড়া থাকব।”

আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে অন্ধকারে ছেয়ে গেল চোখের সীমানা। মাথাটাও আপনাতেই বুকের উপর ঝুলে পড়ল। চেতনা হারালেন লোথার।

একটু পরেই আবার জ্ঞান ফিরতে খেয়াল হল যে সূর্যের অসহ্য গরমটা কমে গেছে। বুক ভরে ঠাণ্ডা বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেন। সাথে সাথে তৃষ্ণাও পেল। কিন্তু বোতলের ঢাকনা খোলাটাও যেন এক কঠিন পরিশ্রম। এক চুমুক খেতেই গড়িয়ে পড়ে ভিজে গেল শার্ট। উত্তপ্ত পাথরে পড়তেই বাষ্প হয়ে উড়ে গেল মূল্যবান পানিটুকু। বোতলটা তুলে মুখ আটকে ফুঁপিয়ে উঠলেন লোথার।

কিন্তু কান পাততেই শুনতে পেলেন পাহাড়ে মানুষের আওয়াজ। গ্রানাইটের সিঁড়িতে স্টিলের লরির ঠকঠাক শুনেই কাঁধে রাইফেল নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিনারের কাছে এসে পাথরে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

উপরে যেহেতু আসেনি, তার মানে এখনো সিঁড়িতে। সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে কান পাতলেন লোথার। হ্যাঁ, ওই তো কাছেই চলে এসেছে। এমনকি কাপড়ের খসখসানির শব্দও কান এড়ালো না।

ওরা পেছন থেকে উঠছে।” এমনভাবে বললেন যেন ছোট্ট কোনো শিশুকে বোঝাচ্ছেন কী ঘটছে। কাঠের হ্যাঁন্ডেলের দিকে তাকাতেই মনে হল, “ওরা বড় বেশি কাছে চলে এসেছে।”

গ্রেনেডটাকে তুলে ফায়ারিং পিন টান দিলেও প্রথমটাতে জ্যাম হয়ে থাকায় কাজ হল না। তারপর এটার উপর ভর দিয়ে বসে টানতেই খুলে এল পিন।

সময় হিসাব করে কিনার দিয়ে গড়িয়ে ফেলে দিলেন গ্রেনেড। সাথে সাথেই কে যেন চিৎকার করে উঠল,

“হায় হায়! এটা একটা গ্রেনেড়!” প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন লোথার।

“যা ব্যাটা ইংরেজ শেয়াল।” হাঁচোড়-পাঁচোড় করে পালানোর জন্যে ফিরতি পথেই নামতে শুরু করল নিচের দল। কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ ঘটল না।

হাসি থামিয় দিলেন লোথার। “ধুত্তোরি।”

আর তার পরেই দেরিতে হলেও হঠাৎই কানে এল প্রচণ্ড গর্জন। চূড়া থেকে অনেক নিচে বিস্ফোরিত গ্রেনেডের আওয়াজ ছাপিয়েও শোনা গেল একজন মানুষের আর্তনাদ।

তাড়াতাড়ি আবার নিচে উঁকি দিলেন লোথার। তিনজন খাকি ইউনিফর্মড সৈন্য দেখা দিতেই কোমরের কাছে মসার তুলে পরপর গুলি ছুড়লেন। আর যায় কোথায় পড়িমড়ি করে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল সবকটা মাথা। একজন আবার শার্পনেলের গুতো খেয়ে আহত হয়েছে। সঙ্গীরা ধরে তাকে নিরাপদে অন্যদিকে সরিয়ে নিল।

এতসব পরিশ্রমের ধকলে একেবারে নিঃশেষ হয়ে পড়লেন লাথার। প্রায় একঘন্টা সেখানেই পড়ে থেকে বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবার গেলেন দক্ষিণ দিকে। নিচে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল মৃত ঘোড়ার ঢোলা পেট। পানির বোতলগুলো এখনো সেখানেই আছে। তার মানে এগুলোর কাছে চুম্বকের টানে ওদেরকে আসতেই হবে।” আপন মনেই ভাবলেন লোথার।

খানিক বাদে মনে হল আবার বুঝি তার দৃষ্টিশক্তি আঁধার হয়ে এসেছে। কিন্তু না পশ্চিমে তাকাতেই দেখা গেল মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যের শেষ কমলারশ্মি। তারপর ঝুপ করে নেমে এল আফ্রিকার রাত। চুপচাপ শুয়ে থেকে নিচের লোকদের নড়াচড়ার জন্যে অপেক্ষা করছেন লোথার। কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব রহস্যময় যেসব আওয়াজ যেমন শিকারি বাদুরের ডানা ঝাঁপটানো শেয়াল আর কীট-পতঙ্গের শব্দ ছাপিয়ে মানুষের তৈরি শব্দ শোনা বেশ কঠিন কাজ।

 তবে লোহার পা-দানির উপর ক্লিক শব্দ হতেই সচকিত হয়ে উঠলেন লোথার। হাত ঘুরিয়েই ছুঁড়ে মারলেন গ্রেনেড। বিস্ফোরণের আলোয় দেখা গেল মৃত ঘোড়াগুলোর কাছে বেশ কয়েকজন হাঁটছে। দু’জনে ধারণা করলেও নিশ্চিত না হয়েই ছুঁড়ে মারলেন দ্বিতীয় গ্রেনেড।

আরো একবার কমলা আলোয় চোখে পড়ল মানুষের ছুটন্ত দেহ। নাহ, পানির বোতল নিতে পারেনি।

কিন্তু তাঁর নিজের গ্রেনেডও শেষ। আর মাত্র একটা আছে। বুকের কাছে পরম ধনের মত সেটাকেই আঁকড়ে ধরে উঁচু গলায় বলে উঠলেন, “ওদেরকে কিছুতেই পানি নিতে দেব না। আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত আটকে রাখতেই হবে।” অথচ ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন শরীরের কাহিল দশা। মাথা ক্রমাগত ঘুরছে। তারপরেও দূরত্ব আর সময়ের হিসাব করে বের করলেন, “আর আট ঘণ্টা গেলেই নিরাপদে নদী পার হয়ে যাবে হেনড্রিক আর ম্যানি।”

লোথার!” আচমকা নিজের নাম শুনে ভাবলেন জ্বরতপ্ত মনের কল্পনা; কিন্তু না। আবার শোনা গেল, লোথার।”

উত্তর দেবার জন্যে মুখ খুলেও আবার বন্ধ করে ফেললেন। দেখা যাক কী বলতে চায় সেনটেইন কোর্টনি।

 “লোথার, আমাদের একজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।” লোথার হিসাবে করে দেখলেন সেনটেইন বনের কিনারে বসে কথা বলছেন। কল্পনার চোখে স্পষ্ট দেখলেন সাহসী আর গাঢ়রঙা দু চোখ জোড়া।

 “আমি এখনো কেন তোমাকে এত ভালোবাসি?” ফিসফিস করে উঠলেন লোথার।

“ওর জন্য পানি দরকার।” সেনটেইনের গলা যেন স্পর্শ করে গেল লোখারের সারা শরীর। আবেগে চোখে জল এসে গেল পর্যন্ত।

“লোথার! আমি পানি নিতে আসছি।”

“আরো কাছে চলে এল সেনটেইনের গলা। তার মানে গাছের সীমানার বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

“আমি একদম একা লোথার।” একেবারে খোলা জায়গায় মাঝামাঝি চলে এলেন সেনটেইন।

 “পিছিয়ে যাও!” চিৎকার করতে চাইলেন লোধার। কিন্তু পারলেন না। “আমি তোমাকে পানি নিতে দেব না, ম্যানির জন্য এটা করতেই হবে।”

গ্রেনেডের ফায়ারিং রিংয়ের হুক ধরলেন লোথার।

“আমি প্রথম ঘোড়াটার কাছে পৌঁছেছি, শুধু এক বোতল পানি নেব ব্যস।” জানিয়ে দিলেন সেনটেইন। একেবারে লোথারের হাতের মুঠোয় চলে এসেছেন সেনটেইন। চাইলে গ্রেনেডটাকে ছুঁড়তেও হবে না। শুধু গড়িয়ে দিলেই হবে। কিন্তু ঘৃণা নয় বরঞ্চ এত ভালোবাসেন এই নারীকে যে কেঁদে ফেললেন লোথার।

“আমি ফিরে যাচ্ছি লোথার, শুধু একটা বোতল নিয়েছি।”

এবারে কিন্তু সেনটেইনের গলায় এক ধরনের কৃতজ্ঞতা, তাদের সম্পর্কের এক ধরনের স্বীকৃতি টের পেলেন লোথার। এ এমন এক বন্ধন, সময় যার গায়ে এতটুকু আঁচড় ফেলতে পারেনি।

তারপরেই আবার শোনা গেল সেনটেইনের গলার স্বর প্রায় ফিসফিস করে লোথারকে বললেন, “ঈশ্বর যেন তোমাকে ক্ষমা করে দেন, লোথার ডি লা রে।”

আর তার পরেই চুপচাপ হয়ে হয়ে গেল চারপাশ।

মন খারাপ করে ফেললেন লোথার। এতটা গভীরভাবে আর কখনোই আহত হননি। সবকিছু এমনভাবে সমাপ্ত হল যে মনে হল অসহ্য হয়ে উঠল এ বেদনার ভার। গলার কাছে উঠে আসা কান্না থামাবার জন্য কাঁধের ওপর মাথা কাত করে দিলেন। আচমকাই টের পেলেন তিনি যেন কোনো অতল গহ্বরে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন আর পড়েই যাচ্ছেন।

***

“মারা গেছে।” পড়ে থাকা মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বল উঠলেন ব্লেইন ম্যালকম। অন্ধকারে দু’দিক দিয়ে চূড়ায় উঠেছে তার দল তারপর ভোর হতেই একত্রে ধেয়ে এসেও অবাক হয়ে গেলেন, “কিন্তু বাকিরা কোথায়?”

তাড়াতাড়ি বোল্ডারদের পিছনে খুঁজে এলেন সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার, “পাহাড়ে আর কেউ নেই স্যার। নিশ্চয় ভেগে গেছে।”

“ব্লেইন!” তাড়াতাড়ি ডাকলেন সেনটেইন, “কী হয়েছে?” ওঠার আগে জোর করেই তাকে নিচে রেখে এসেছেন ব্লেইন। কিন্তু ঠিকই চলে এলেন সেনটেইন। “ওরা কোথায়?” আর তারপরেই মৃতদেহটা দেখে সেখানেই বসে পড়লেন। লোথারের পাশে। “ওহ, ঈশ্বর।”

“ওহ, তাহলে এই লোকটাই ডি লা রে।” জানতে চাইলেন ব্লেইন।

“বাকিরা কোথায়? উদ্বিগ্ন মুখে ব্লেইনের দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“এখানে আর কেউ নেই।” মাথা নাড়লেন কর্নেল।” ডি লা রে আমাদেরকে বোকা বানিয়ে ওদেরকে সরে পড়তে সাহায্য করেছে। এতক্ষণে বোধ হয় নদী পার হয়ে গেছে।”

 ম্যানফ্রেড। এই প্রথমবারের মত ছেলের নাম মনে আনলেন সেনটেইন। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল, হৃদয়ের গভীরে পুত্র হারানোর মত শোকও বোধ করছেন। চেয়েছিলেন ও এখানেই থাকুক। ছেলেকে শেষবারের মতন অন্তত দেখবেন। চোখ মেলে লোথারের দিকে তাকাতেই হাহাকারে ভরে উঠল সেনটেইনের অন্তঃস্থল।

কনুইয়ের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে পড়ে আছেন লোথার। আস্তে করে তার কানের নিচে করোটিভ আর্টারীতে হাত রেখেই চমকে উঠলেন সেনটেইন। দেহতৃক এখনো বেশ উত্তপ্ত হয়ে আছে।

“ও বেঁচে আছে।”

“তুমি নিশ্চিত?” ধুপ করে সেনটেইনের পাশেই বসে পড়লেন ব্লেইন। দু’জনে মিলে লোথারকে গড়িয়ে সোজা করতেই দেখা গেল পড়ে আছে আরেকটা গ্রেনেড।

“তুমি ঠিকই বলেছ।” নরম গলায় জানালেন ম্যালকমস, “সে চাইলেই কিন্তু তোমাকে গত রাতেই খুন করতে পারত।”

লোথারের মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। সুদর্শন সোনালি মুখখানা জ্বরের অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে গেছে।

“প্রচণ্ডভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে শরীর। বোতলে আর পানি আছে?” ব্লেইন লোথারের মুখে পানি ঢালতেই হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেন সেনটেইন।

“রক্ত দূষিত হয়ে গেছে।” পচা মাংসের গন্ধও পেলেন। “হাত কেটে ফেলতে হবে। হাতের ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন হায়েনা কিংবা চিতা কামড়ে দিয়েছে।

“নদীর কাছে একটা পর্তুগিজ রোমান ক্যাথলিক মিশন আছে। যদি জীবিত ওখানে নিয়ে যেতে পারি তাহলে বলতে হবে যে সে সত্যিই ভাগ্যবান।” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন। “সার্জেন্ট, তোমার একজন সেনা পাঠিয়ে ফার্স্ট এইড কিট নিয়ে এসো আর বাকিদেরকে পাহাড়ের প্রতিটি ইঞ্চি খোঁজার কাজে লাগিয়ে দাও। মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যমানের হীরে খোয়া গেছে।”

কর্নেলকে স্যালুট করে ত্ৰস্তপায়ে চলে গেলেন সার্জেন্ট।

আবারো সেনটেইনের পাশে বসে পড়লেন ব্লেইন, “ফার্স্ট এইড কিট আসতে আসতে ওর দেহ তল্লাশি করে দেখা যাক। যদি কোনো হীরে থেকে থাকে।”

“সম্ভাবনা সত্যিই নেই। নিশ্চয় ছেলে আর ওই ওভাম্বো রাফিয়ানটাকে দিয়ে দিয়েছে।”

লোথারের নোংরা টিউনিক খুলে পরীক্ষা করে দেখলেন কর্নেল। আর ক্ষতস্থান মুছে পরিষ্কার সাদা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন সেনটেইন।

খানিক বাদেই ফিরে এলেন হ্যানসমেয়ার। “কিছুই নেই স্যার।”

“ঠিক আছে সার্জেন্ট। এখন এই হতচ্ছাড়াটাকে ঘাড় গলা না ভেঙেই নিচে নামাতে হবে।”

পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে গেল পুরো দল। লোথার আর আহত সৈন্যকে মোপানির ডাল দিয়ে তৈরি খাঁটিয়াতে শুইয়ে অবশিষ্ট একমাত্র ঘোড়ার সাথে জুড়ে দেয়া হল।

কিন্তু সবাই উত্তরমুখে হাঁটা ধরলেও দাঁড়িয়ে গেলেন সেনটেইন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকাভাবে ব্লেইনের কাঁধে ভর দিয়ে জানালেন, “ব্লেইন, আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এই বৈরী প্রকৃতি আমার অনেক কিছুই কেড়ে নিল।”

“বুঝতে পেরেছি। হিরের লোকসান আসলেই খুব বড় ক্ষতি করে দিল। তবে এখনো হীরে উদ্ধারের আশা শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু।”

না ব্লেইন। আমরা দুজনেই জানি এ কথা সত্যি নয়। হিরেগুলো আর ফিরে পাব না।”

“চুপ করে রইলেন রেইন। সত্যিই মিথ্যে আশা দেয়ার কোনো মানে হয় না।

“আমি সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি ব্লেইন। আস্তে আস্তে ধসে পড়বে এত দিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা স্বপ্ন। হ্যাঁ, হয়ত ভিক্ষা চেয়ে ধার করে কিছুটা সময়ের জন্যে নিষ্কৃতি পাব; কিন্তু ভিত্তিটাই তো নড়বড়ে হয়ে গেছে। এক মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ মোটেই ছোট কোনো পরিমাণ নয় ব্লেইন।”

সেনটেইন, আমি কিন্তু দরিদ্র নই, “আমিও তোমাকে সাহায্য করতে হাত বাড়িয়ে ব্লেইনের ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখলেন সেনটেইন।

 “তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া আছে কেবল সামনের দিনগুলোতে আমি শান্তির কোনো একটা আশ্রয় চাই।”

“যখনই প্রয়োজন হবে আমাকে পাবে সেনটেইন। শুধু একবার ডেকে দেখো, প্রমিজ করছি আমি ছুটে আসব।”

“ওহ, ব্লেইন, যদি সত্যিই তাই হত!” মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন ব্লেইন।

“ইয়েস সেনটেইন” এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন ব্লিইন।

***

কনুইয়ের দুইঞ্চি নিচ থেকে লোথার ডি লা রে’র হাত কেটে ফেলে দিলেন পর্তুগিজ মিশনের যাজক ডাক্তার। অপারেশনের পুরো সময়টাতে সার্জিক্যাল মাস্ক মুখে দিয়ে ডাক্তারকে সাহায্য করেছেন সেনটেইন। তবে শেষ হতেই ছুটে গিয়ে বমি করাও কিছুতেই আটকাতে পারেননি। মিশনের কুঁড়েঘরে তাকে একাকী একটা রুম দেয়া হলেও বিতৃষ্ণা কাটাতে পারলেন না সেনটেইন। মনে হচ্ছে সারা শরীরে, চুলে, তুকে ছড়িয়ে পড়েছে গ্যাংগ্রিনের গন্ধ। একদা যে মানুষটাকে ভালোবেসেছিলেন তার পঙ্গু মুখচ্ছবি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

কিন্তু তারপরেও কাজ হল না। পরের দিন দুপুরবেলা যাজক এসে বিড়বিড় করে জানালেন নিজের মনস্তাপের কথা, “আমি আসলে দুঃখিত। সংক্রমণ এত তীব্র যে আরেকটু কাটতে হবে।”

দ্বিতীয়বার ব্যাপারটা আরো অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল। আরেকটু হলে বোধ হয় তিনি নিজেই অজ্ঞান হয়ে যেতেন। সেনটেইনের চোখের সামনে লোথারের আহত হাত কাঁধের নিচ থেকে কেটে ফেলে দিলেন ডাক্তার।

পরবর্তী তিনদিন কোমায় পড়ে রইলেন লোথার। মনে হল বুঝি জীবন মৃত্যুর সীমানাও পার হয়ে গেছেন।

এমনকি ডাক্তারও আশা করতে ভয় পেলেন।

যাই হোক, তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় লোথারের রুমে ঢুকতেই সেনটেইনের চোখে পড়ল হলুদ চোখ দুখানা মেলে তাকে দেখলেন লোথার।

তারপর আরো দুদিন পর ব্লেইনকে যাবার অনুমতি দিলেন ডাক্তার, মওকা পেয়ে আনুষ্ঠানিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন কর্নেল।

 “আমার সার্জেন্ট তোমার সার্বক্ষণিক চার্জে থাকবে। তারপর উইন্ডহকে নিয়ে যাবার পর বিচার হবে।”

বিবর্ণ, হাড়সর্বস্বদেহ নিয়ে ভাবলেশহীন চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন লোথার।

“তো, লোথার ডি লা রে ফাঁসির দড়ি এড়াবার মত ভাগ্যবান হয়ত তুমি নও। তবে যদি হিরেগুলো কোথায় আছে বলল, তাহলে হয়ত লড়াই করার খড়কুটো পেয়ে যাবে।”

মিনিটখানেক অপেক্ষায় পরেও লোখারের দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলেন না কর্নেল। বরঞ্চ মাখা হেলিয়ে নদীর দিকে চেয়ে রইলেন লোথার।

“তুমি তো জানেনা যে আমিই এ অঞ্চলের প্রশাসক। সুতরাং আমার সুপারিশে অবশ্যই কাজ হবে। হিরেগুলো দিয়ে দও। বিনিময়ে তোমার জীবনের নিশ্চয়তা আমি দিব।”

চোখ বন্ধ করে ফেললেন লোথার।

“তো ঠিক আছে লোথার। দুজনেই বুঝতে পারলাম কী ঘটতে যাচ্ছে।” সার্জেন্টকে ডেকে চব্বিশ ঘণ্টাই লোথারকে গৃহবন্দি রাখার আদেশ দিলেন কর্নেল।

অতঃপর লম্বা লম্বা পা ফেলে নদীর তীরে কুঁড়েঘরে অপেক্ষারত সেনটেইনের কাছে চলে এলেন ব্লেইন। ধপ করে ক্যাম্প চেয়ারে বসেই একটা চুরুট ধরালেন। লোথারের ওপর রাগকে কিছুতেই কেন যেন দমাতে পারছেন না।

“লোকটার সাথে কিছুতেই আপোষ করা গেল না। আমি নিজে তাকে হিরের বিনিময়ে জীবন ফিরিয়ে দেবার নিশ্চয়তা দিলাম। অথচ কত বড় সাহস! উত্তর পর্যন্ত দিল না।”

 চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে জানালার ওপাশের নদীর দিকে তাকালেন ব্লেইন, “তুমি ভেবো না। যা করেছে তার জন্যে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে।”

“ব্লেইন” কর্নেলের পেশিবহুল বাদামিরঙা বাহুতে আলতো করে হাত রাখলেন সেনটেইন, “তোমার মত মানুষের ক্ষেত্রে এতটা বাতুলতা শোভা পায় না।”

“সেনটেইন, তুমি জানো এই অভিযানে আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি আমার কাজ ফেলে এখানে এসেছি। প্রিটোরিয়াতে আমার ঊর্ধ্বতনদেরকে নাখোশ করেছি। তাই হ্যানসমেয়ার আর তার সৈন্যরা এখানেই ডি লা রের কাছে থাকবে। সুস্থ হয়ে উঠলে উইন্ডহকে নিয়ে আসবে। তবে আমরা নদীপথে রুন্টু গিয়ে পুলিশ ট্রাক ঠিক করে নেব।”

সেনটেইনও মাথা নাড়লেন, “হুম, আমাকেও ফিরে গিয়ে অনেক কিছুর দেখভাল করতে হবে।”

“কাল সকালের প্রথম আলো ফুটলেই আমরা রওনা দেব।”

“ব্লেইন, যাবার আগে আমি লোথার ডি লা রের সাথে একবার কথা বলতে চাই।” খানিকটা দ্বিধার স্বরে জানালেন সেনটেইন, একাকী। প্লিজ ব্লেইন মানা করো না।”

***

কুঁড়েঘরের ভেতরকার অন্ধকারের সাথে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্য দরজার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন।

পায়ের ওপর সস্তাদরের কম্বল বিছিয়ে পাড়ুর মুখে বসে আছেন লোথার।

“সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার কয়েক মিনিটের জন্য কি আমি একা থাকতে পারি এখানে?”

 পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হ্যানসমেয়ার ফিসফিস করে সেনটেইনকে অভয় দিয়ে গেলেন, “আমাকে এক ডাক দিলেই চলে আসব মিসেস কোর্টনি।”

একা হয়ে কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর সেনটেইনই প্রথম কথা বললেন,

 “তুমি যদি আমাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে থাকো তাহলে বলতে হবে যে সফল হয়েছে।” মুখে কিছু না বলে হাতবিহীন কাঁধে হাত বোলালেন লোথার। দৃশ্যটা সত্যিই বেদনাদায়ক। তারপর জানতে চাইলেন, “কে কাকে শেষ করেছে সেনটেইন?” চোখ নামিয়ে নিলেও খানিক বাদে সেনটেইন আবার জানতে চাইলেন,

“আমার কাছ থেকে যা চুরি করেছে তার একটা অংশও কি ফেরত দিতে পারবে না? অন্তত বহু আগে আমাদের মাঝে যে সম্পর্ক ছিল তার খাতিরে?”

 এবারও উত্তর না দিয়ে অক্ষত হাত তুলে বুকের পুরাতন একটা চিহ্নের উপর হাত বোলালেন লোথার। কেঁপে উঠল সেনটেইন।

লুসার পিস্তল দিয়ে গুলি করে একদা এ দাগ তিনিই তৈরি করেছেন লোখারের বুকে।

“ছেলেটার কাছে আছে হিরেগুলো, তাই না?” তোমার বেজন্মা ছেলে বলতে গিয়েও নিজেকে কোনোমতে শুধরে নিয়ে বললেন, “তোমার ছেলে?”

লোথার চুপ করে আছেন শুনে জেদের স্বরে সেনটেইনের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, “আমাদের ছেলে ম্যানফ্রেড?”।

“তোমার মুখ থেকে কথাটা শুনব কখনো ভাবিনি।” কণ্ঠস্বরের আনন্দ আর খুশি লুকাতে পারলেন না শোখার, “যখন তুমি ওকেও ধ্বংস করার খেলায় মেতেছে তখন কি মনে হয়নি যে ও আমাদেরই ভালোবাসার নিদর্শন?”

“না” তীব্রভাবে মাথা ঝাঁকালেন সেনটেইন, “তুমি আমাকে এখনো চেনোনি।”

“ও তোমার পথে এলে তুমি অবশ্যই ওকে শেষ করে দিতে।” সোজা সাপটাভাবেই জানিয়ে দিলেন লোথার।

“তোমার সত্যিই তাই মনে হয়?” একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন, “তোমার ধারণা আমি এতটাই নিষ্ঠুর যে নিজের ছেলের ওপর প্রতিশোধ নেব?”

“তুমি তো কখনো ওকে স্বীকৃতিই দাওনি।”

 “এখন দিচ্ছি। গত কয়েক মিনিটে তো বেশ কয়েকবারই বলেছি এ কথা।”

 “তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ যে ওর কোনো ক্ষতি করবে না?”

“আমাকে প্রমিজ করতে হবে না, লোথার ডি লা রে! তুমিও তা জানো। আমি ম্যানফ্রেডের কখনো কোনো ক্ষতি করব না।”

“আর এর পরিবর্তে আমার কাছ থেকে নিশ্চয় কিছু চাও” সামনে ঝুঁকে এলেন লোথার। শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় বেশ ঘামছেন। পুরো রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সেই কটু গন্ধ।

“তুমি কি পরিবর্তে কিছু দিতে চাও?” আস্তে করে জানতে চাইলেন সেনটেইন।

 “না। নাথিং, কিছুই না।” ক্লান্ত হয়ে আবার পাশ বালিশে হেলান দিলেন লোথার, “এখন তাহলে তোমার প্রতিজ্ঞা ফিরিয়ে নিবে নিশ্চয়?”

“আমি তো কোনো প্রতিজ্ঞাই করিনি। তবে হ্যাঁ আবারো বলছি, আমাদের ছেলে ম্যানফ্রেড আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ইচ্ছাকৃতভাবে কখনোই ওর কোনো ক্ষতি করব না। তবে তোমার ক্ষেত্রে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”

মুখ ঘুরিয়েই সার্জেন্টকে ডাক দিলেন সেনটেইন।

পেছন থেকে দুর্বল স্বরে ডাক দিলেন লোথার। বলতে চাইলেন, “পাহাড়ের চূড়ার ফাটলের ভেতরেই পড়ে আছে তোমার হীরে কিন্তু সেনটেইন যখন তাকালেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বললেন, “বিদায় সেনটেইন।” অবশেষে সবকিছু সাঙ্গ হল।

***

আফ্রিকার সবচেয়ে সুন্দর নদীগুলোর একটা হল ওকাভাঙ্গো। তবে স্বচ্ছ হ্রদ আর প্যাপিরাসের ঝাড় থাকলেও কালাহারির মরুভূমির কাছে এসে শীর্ণ হয়ে নিষ্ঠুর বালির নিচে হাওয়া হয়ে গেছে পুরো নদী।

এ নদীর সবচেয়ে চওড়া অংশ দিয়েই এবার বাড়ি ফিরবেন সেনটেইন আর ব্লেইন। বাহন হিসেবে আছে বিশ ফুট লম্বা ক্যাম্প। জলহস্তীর আচানক আক্রমণ ঠেকাবার জন্য কোলের ওপর লি এনফিল্ড নিয়ে বসে আছেন ব্লেইন।

আফ্রিকার এ অংশে আগে আর কখনো আসেননি সেনটেইন। তাই নদী আর এর তীরবর্তী জীবনযাত্রা তার জন্যে সম্পূর্ণভাবেই নতুন। অন্যদিকে এ অঞ্চল সম্পর্কে ব্লেইন অত্যন্ত দক্ষ। ১৯১৫ সালে জেনারেল স্মুটের বাহিনির সাথে এসেছিলেন বিধায় এখানকার প্রতিটি গাছ, পাখি আর প্রাণী সম্পর্কে জানেন।

 খানিক বাদে হঠাৎ করেই বদলে গেল নদীর প্রকৃতি। কোনো কোনো জায়গা এতটাই সরু যে তীক্ষ্ণ পাথরে ঘষা খেয়ে ক্যানুই ফুটো হয়ে যাওয়ার দশা হল। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় প্রায় দম বন্ধ করে বসে আছেন সেনটেইন। যেন সেই ছোট্টবেলার মত শিশু হয়ে রোলার কোস্টারে চড়ছেন। একটু পরেই অবশ্য চওড়া হয়ে এল দু’পাশ। নদী তীরের সমভূমির ওপর চড়ছে বুনো সঁড়ের দল। বিশালাকার প্রাণীগুলোর গায়ে শুকিয়ে যাওয়া মাটি, ট্রাম্পেটের মত কান। ষাড়ের পাল কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখল সেনটেইনদের ক্যানু।

নদীর ধারের লম্বা গাছগুলোর প্রায় প্রতিটির উপর দেখা গেল উজ্জ্বল সাদা মাথাঅলা ঈগল। এছাড়া বালুতীরে আয়েশ করে পড়ে আছে বিদঘুটে চেহারার লম্বা সব কুমির।

হঠাৎ করেই ক্যাম্প দেখে তেড়ে এল মসৃণ গোলাকার পাথরের ন্যায় ধূসররঙা জলহস্তী। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠেই দ্রুত কয়েকবার গুলি ছুড়লেন ব্লেইন। কুঁকড়ে উঠলেন সেনটেইন। ভাবলেন এই বুঝি মদ্দা জলহস্তীটার স্বচ্ছ গোলাপি চোখ দুখানা থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটবে রক্ত। কিন্তু না, জন্তুটার কপালেরও কয়েক ইঞ্চি উপরে নিশানা করেছেন ব্লেইন। দক্ষ হাতে ক্যানু নিয়ে সরে এল মাঝি। আর মনে হল যেন নিজের ব্যর্থতার লজ্জা ঢাকতেই সবুজ পানির মধ্যে ডুব দিল বিশাল জলহস্তী।

“তুমি ওকে মারোনি দেখে আমি খুশি হয়েছি ব্লেইন।”

সংকটের মুখেও কর্নেলের ঠাণ্ডা মাথা আর মানবতাবোধ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সেনটেইন।

কিন্তু আপন মনেই ভাবলেন, “আমি কি স্কুল গার্ল হয়ে গেলাম নাকি। কেবল ওরাই এমন হিরোগিরি পছন্দ করে।” খিকখিক করে হেসে ফেললেন সেনটেইন।

অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ব্লেইন জানতে চাইলেন, “কী দেখে এত মজা পেলে?”

“একটা মেয়ে সব সময় অপেক্ষা করে কখন তার প্রিন্স চার্মিং এসে তাকে আগুন খেকো ড্রাগনের হাতে থেকে বাঁচাবে।”

“ধুর।“

“মানে? সান্তাক্লজ আর পরীদের তুমি বিশ্বাস করো না?”

“তোমার মাথায় একটু ছিট আছে বুঝলে?”

“হুম, জানি।” মাথা নাড়লেন সেনটেইন, “আর তোমাকে সাবধান করে দেবো ভেবেছি; কারণ এটা কিন্তু ছোঁয়াচে বুঝলে?”

“বড় দেরিতে বলে ফেললে।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন কর্নেল।

“গুড। সামনে ঝুঁকে এলেন সেনটেইন। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে কিস করলেন ব্লেইনের কানের পিছনে।

 কেঁপে উঠলেন ব্লেইন। “দেখো তুমি কী করেছো?” হাত মেলে ধরতেই দেখা গেল সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেছে। “এরকম আর করবে না।”

 “আমিও তোমার মত কোনো প্রমিজ করি না।” সেনটেইনের কথা শুনে অনুশোচনার মেঘ ঘনাল ব্লেইনের চোখে। তাই দেখে মুড বদলাবার জন্যে সেনটেইন তাড়াতাড়ি বললেন,

“ওহ, ব্লেইন পাখিগুলোকে দেখো।” নদীর উপর যেন কমলা রঙের মেঘ জমেছে। একসাথে উড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার উজ্জ্বল লালরঙা পাখি।

এরপর দুজনে আর তেমন কথাবার্তা না বলে চুপচাপ বসে রইলেন। তবে এই নীরবতাই যেন পরস্পরকে আরো বেশি কাছে নিয়ে এসেছে।

 মাঝিদের সাথে কথা বলে রাত কাটাবার জন্য বড় একটা দ্বীপ বেছে নিলেন ব্লেইন। লম্বা লম্বা প্যাপিরাসে ঘেরা হৃদের পানি একেবারে স্বচ্ছ আর সবুজ। তীরে নেমে রাইফেল তুলে নিলেন ব্লেইন।

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

জানতে চাইলেন সেনটেইন।

 “দেখি, ডিনারের জন্য কিছু পাই কিনা।”

“ওহ, ব্লেইন আজকে অন্তত কোনো জীব হত্যা করো না। আজ সত্যিই একটা বিশেষ দিন।”

“বীফ খেতে খেতে তোমার ক্লান্ত লাগছে না?”

 “প্লিজ…”

হেসে রাইফেলটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে দিলেন ব্লেইন। তারপর তদারক করে দেখে এলেন কুঁড়েঘর আর মশারীর অবস্থা। সন্তুষ্ট হয়ে মাঝিদেরকে পাঠিয়ে দিলেন ক্যানুতে।

“ওরা কোথায় যাচ্ছে?” ক্যানু স্রোতে ভাসতেই জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“আমি ওদেরকে ওপাশের গ্রামে ক্যাম্প করতে বলেছি।” উত্তর দিয়েই চট করে চোখ সরিয়ে নিলেন ব্লেইন। সেনটেইন নিজেও অন্যদিকে তাকালেন। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই একাকী হওয়ার অনুভূতি আচমকা দু’জনকেই লাজুক করে তুলেছে।

তাড়াতাড়ি ক্যাম্পের কাছে গিয়ে নিজের থলে খুলে বসলেন সেনটেইন। ব্লেইনের দিকে না তাকিয়েই বললেন, “আমি হ্রদে যাচ্ছি। গত রাতের পর থেকে তো গোসল হয়নি।”

“তাহলে তোমার কোনো শেষ ইচ্ছে থাকলে জানিয়ে দিয়ে যাও।”

“মানে?”

“এটা ওকাভাঙ্গো নদী সেনটেইন। ছোট্ট মেয়েদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে কুমীর।”

“তাহলে তুমি রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো”

 “আনন্দচিত্তে ম্যাডাম?”

 “চোখ কিন্তু বন্ধ থাকবে।”

 “তাহলে কুমির দেখব কেমন করে?”

হ্রদের নিচের সাদা বালি এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, চোখ এড়িয়ে কুমির আসার কোনো উপায় নেই। তীরে সবচেয়ে উঁচু পাথরটার উপর সেফটি ক্যাচ অফ করে এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে এসে বসলেন ব্লেইন।

“আপাতত উঁকি-ঝুঁকিও বন্ধ।” সেটেইনের সাবধান বাণী শুনে বহুদূরের একপাল হাঁসের দিকে উদাস চোখে চেয়ে রইলেন কর্নেল ব্লেইন ম্যালকমস। তবে সেনটেইনের কাপড় খোলার খসখস শব্দ কিন্তু কান এড়ালো না।

“ঠিক আছে এবার কুমিরের খোঁজ করতে পারো।”

হ্রদের তলদেশে শরীর ডুবিয়ে বসে পড়লেন সেনটেইন। কেবল মাথাটা উপরে ভেসে আছে। চুলগুলো সব চুড়ো করে বাঁধা।

প্রায় পাঁচ বছর আগে ঘোড়র উপর থেকে পড়ে গিয়ে অথর্ব হয়ে গেছেন ইসাবেলা ম্যালকম। তখন থেকেই ব্লেইন আর তার মাঝে পুরুষসুলভ কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও একবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই ব্যর্থতার কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে ওঠেন ব্লেইন। তাই প্রচণ্ড মনোবল খাটিয়ে নিজের দৈহিক চাহিদাকে ভুলে আছেন কর্নেল। কিন্তু আজ আচমকা টের পেলেন এক আগ্রাসী ঝড়ের পূর্বসংকেত। যা লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাবে তার সবকিছু।

হঠাৎ করেই বন্য আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলেন সেনটেইন।

 “ব্লেইন!”

তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন কর্নেল। কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে নিরাভরণ দেহে ঠকঠক করে কাঁপছেন সেনটেইন। গভীর পানি থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে একটা কুমির।

 “দৌড় দাও সেনটেইন, রান।” ব্লেইনের চিৎকার শুনে সেনটেইনের সম্বিত ফিরলেও সরীসৃপটা যেন ঘোড়র বেগে ধেয়ে আসছে।

ছুটে এসে হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নেমে গেলেন ব্লেইন। কোমরের কাছে উদ্যত রাইফেল। কিন্তু সেনটেইনের জন্য নিশানা তা করতে পারছেন না।

 “ডাউন! মাথা নামিয়ে বসে পড়ো।” সাথে সাথে সামনের দিকে ঝাঁপ দিলেন সেনটেইন আর একই সময়ে গুলি ছুঁড়লেন ব্লেইন।

 বুলেট গিয়ে সোজা ঢুকে গেল কুমিরের খুলিতে। পিঠ বেঁকিয়ে জটা পানিতে এত প্রচণ্ড আলোড়ন তুলল যে ফেনার মাঝে ডুবে গেলেন ব্লেইন আর সেনটেইন। কোনোমতে তাকে তুলে দাঁড় করিয়েই এক হাতে রাইফেল আরেক হাতে সেনটেইনের পিঠ ধরে তীরের দিকে দৌড় দিলেন ব্লেইন।

পাথুরে কিনারে পৌঁছেই ব্লেইনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেনটেইন। ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। কোনোমতে জানালেন, “ওহ ব্লেনি, কী ভয়ংকর এক দানব।”

“ঠিক আছে। এখন আর কোনো ভয় নেই ডার্লিং।” পাথরের সাথে রাইফেলটাকে ঠেস দিয়ে রেখে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরলেন ব্লেইন।

বিড়ালের মত গুটিগুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন। বুঝতে পারলেন এসে গেছে সেই মুহূর্ত। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না ব্লেইন। ছোট ছেলে-মেয়ের মত পরস্পরের হাত ধরে প্যাপিরাসের বনে ছুটলেন দুজনে।

প্রকৃতির আদিমতার মাঝে হারিয়ে গেলেন ব্লেইন আর সেনটেইন। মনে হচ্ছে তারাই বুঝি পৃথিবীর একমাত্র মানব আর মানবী। গলা চিড়ে চিৎকার করে নিজের সমস্ত একাকিত্ব আর বেদনা বাতাসে মিলিয়ে দিলেন সেনটেইন।

***

পরের দিন সকালবেলা। রুন্টুর সীমান্ত পোস্টের কাছে এগোতেই এসে গেল বিচ্ছেদের ক্ষণ। এ অঞ্চলের দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশ সার্জেন্ট আর তার গার্ডদের কবলে পড়ে দুজন দুজনের দিকে তাকানোর সুযোগ পর্যন্ত হারিয়ে ফেললেন। অবশেষে উইন্ডহকে পৌঁছাতেই শেষ হল-এ অত্যাচার।

কিন্তু তখন তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে পুরো পৃথিবী- ইসাবেলা, বাবার কাছে কে আগে আসবে সে প্রতিযোগিতায় রত তারা আর ম্যাটিল্ডা, পুলিশ, রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, টুয়েন্টিম্যান জোনস, আব্রাহাম, স্যার গ্যারি, উদ্বেগ আর অভ্যর্থনা জানিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মেসেজ।

তারপরেও যেন এত হৈ-হট্টগোলের কিছুই সেনটেইনকে স্পর্শ করতে পারল না। বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাবতে লাগলেন সেই সবুজ নদী, দু’জনের হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটা, একত্রে কাটানো রাত্রি।

রেলওয়ে কোচ থেকে শাসাকে ফোন করেও নিরস আগ্রহে শুনলেন ছেলের গণিতের নম্বর।

তারপরেও দু’বার ব্লেইনের সাথে কথা বলার জন্যে ফোন করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবার অন্য কেউ ফোন ধরেছে। তাই কথা না বলেই রেখে দিতে বাধ্য হয়েছেন সেনটেইন।

পরের দিন প্রশাসকের অফিসে দু’জনের আবার দেখা হল। ব্লেইনের প্রেস কনফারেন্সে থাকায় রুমভর্তি ছিল কেবল সাংবাদিক আর হুইল চেয়ার নিয়ে ইসাবেলা। বহুকষ্টে তাই কর্নেলের সাথে বন্ধুত্বসুলভভাবে হাত মেলানোর নিপুণ অভিনয় করলেন সেনটেইন। ব্লেইনের সাথে একাকী কথা বলার কোন সুযোগই পেলেন না।

নিজের অফিসে ফিরতেই দেখা গেল অপেক্ষারত আব্রাহামের সঙ্গে।

“সেনটেইন আপনি কিন্তু দেরি করে ফেলেছেন। বোর্ডরুমের সবাই গত একঘণ্টা ধরে বসে আছে।”

“তাহলে বসে থাকুক। সমস্যা কী?” এতটা কড়া ভাষা বের হল যে সেনটেইন নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। অথচ এই ব্যাংকই তার একমাত্র ভরসা।

“হিরেগুলো হারিয়ে ভয়ে তাদের একেকজনের চেহারায় দশ রকমের হলুদ রঙ ফুটে উঠেছে, সেনটেইন।”

ব্যাংক ডিরেক্টরের দল সেনটেইন শহরে এসেছেন শোনার পর থেকেই এই মিটিঙের জন্য অপেক্ষা করছেন।

“ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস কোথায়?”

“উনিও বোর্ডরুমে আছেন।” মোটা মোটা একটা ফোল্ডার এগিয়ে দিলেন অ্যাবি, “এখানে সুদ পরিশোধের শিডিউল দেয়া আছে।”

 খানিক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন সেনটেইন। প্রতিটা আর পরিমাণ সবকিছুই তার মুখস্থ। একই সাথে এসব ঠেকানোর পরিকল্পনাও করে ফেলেছেন। যদিও শুনলে হয়ত যে কারো হাস্যকর বলে মনে হবে।

 “সিংহের গুহায় ঢোকার আগে আমাকে জানতে হবে এরকম নতুন আর কিছু কি আছে?”

 “লন্ডনের লয়েডস থেকে দীর্ঘ একটা টেলিগ্রাম এসেছে। তারাও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।” 

মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

“সেটাই তো ধারণা করেছিলাম। আপনার কী মনে হয়? ব্যাপারটা কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাব?”

“আমার মনে হয় তাতে কেবল সময় আর অর্থেরই অপচয় হবে।”

“আর কিছু?”

“ডি রিয়ারস্। স্যার আর্নেস ওপেনহেইমার নিজে মেসেজ পাঠিয়েছেন।”

“ইতিমধ্যেই গন্ধ শুঁকে চলে এসেছেন, না?” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন। মাথা থেকে ব্লেইনের ছবি কিছুতেই তাড়াতে পারছেন না।

“কিম্বলি থেকে বৃহস্পতিবারে উইন্ডহকে পৌঁছাবেন স্যার আর্নেস্ট।”

 “সত্যিই কাকতালীয় ব্যাপার।” কাষ্ঠ স্বরে হাসলেন সেনটেইন।

 “আপনার সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিং করতে চান।”

“ভদ্রলোকের নাকটা ঠিক হায়েনার মত আর চোখ দুটোও শকুনের চোখ। শত শত মাইল দূরে থেকেও মৃতপ্রায় পশুর গন্ধ ঠিকই পেয়ে যান।”

“উনি হানি মাইনের পিছনে লেগেছেন সেনটেইন। গত তের বছর ধরেই ঘুরছেন মওকামত পাওয়ার আশায়।”

 “সবাই তো হানির পেছনেই লেগেছে অ্যাবি। কিন্তু ঈশ্বরের দিব্যি এজন্য আগে ওদেরকে আমার সাথে লড়তে হবে।”

দু’জনেই একসাথে উঠে দাঁড়ালেন বোর্ডরুমে যাওয়ার জন্য।

হাঁটতে গিয়ে দেয়ালের সাথে লাগানো আয়নায় চোখ পড়তেই চুলগুলোকে হালকা ঠিক করে জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলেন। ব্যস তিনি তৈরি। কেটে গেছে মাথার ধোঁয়াশা ভাব। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী আর আত্মবিশ্বাসী সেনটেইন কোর্টনি। মনের মাঝে কেবল একটাই মন্ত্রঃ- হানি আমার, কেউ এটা আমার কাছ থেকে নিতে পারবে না।

***

অন্ধকারের মধ্যে দিয়েও দ্রুত পায়ে উত্তর মুখে এগিয়ে চলেছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। সাথে হেনড্রিক আর ক্লেইন বয়। একটু আগে বাবার কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত অবহেলাই তার মনোবলকে দৃঢ় করে তুলেছে।

কিন্তু পাহাড় চূড়ায় ফেলে আসা একাকী মৃত্যুপথযাত্রী বাবার কথা মনে হতেই কেঁদে উঠল পুরো অন্তর। “ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি বাবা, তুমি একদিন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।” বয়স্ক পুরুষের মতই ক্লান্তিহীন দেহে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেনড্রিকের সাথে এগোল প্রায় তার সমান উচ্চতার ম্যানি।

এমনি করেই কেটে গেল পুরো রাত। অবশেষে নদী তীরে যখন পৌঁছাল তখন গাছের মাথায় উঠে এসেছে সূর্য।

কোনোরকমে খানিকটা পানি খেয়েই আবার শুরু হল যাত্রা। দিনেরবেলা নদীর পাড়ে খোলা জায়গা এড়িয়ে শুকনো মোপানির বনে লুকিয়ে রইল তিনজন। তারপর অন্ধকার নামার পর আবার পথে নামল ছোট্ট দলটা।

এরকমভাবে বারোটা রাত কঠোর পরিশ্রমের পর হেনড্রিক নিশ্চিত হলেন যে কেউ তাদের পিছু নেয়নি।

“আমরা কখন নদী পার হবো, হেনি?” জানতে চাইল ম্যানি।

“কখনোই না।” উত্তরে জানালেন হেনড্রিক।

 “কিন্তু বাবার তো প্ল্যান ছিল পর্তুগিজে গিয়ে তারপর লুয়ান্ডাতে যাব।”

“সেটা তোমার বাবার কথা ছিল। কিন্তু এখন তো সে আর আমাদের সাথে নেই। উত্তরে তো বটেই এমন কি পর্তুগিজে কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন অনেক কঠিন। ওরা জার্মান বোয়া কিংবা ইংরেজদের চেয়েও কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বেশি ঘৃণা করে। দেখা যাবে আমাদের হিরে কেড়ে নিয়ে শ্রমিকের কাজে লাগিয়ে দিবে। না ম্যানি তা হতে দেয়া যাবে না। আমরা এখন ওভামোল্যান্ডে নিজের গোত্রের মাঝে ফিরে যাব। সেখানে আমাদের সাথে মানুষের মত আচরণ করা হবে; জানোয়ারে মত নয়।”

“কিন্তু পুলিশ তো তাহলে আমাদেরকে খুঁজে বের করে ফেলবে।”

“কেউই আমাদেরকে দেখেনি ম্যানি।”

“তারপরেও তো সবাই জানে তুমি আমার বাবার বন্ধু।”

দাঁত বের করে হেসে ফেললেন হেনড্রিক। “ওখানে তো আর আমার নাম হেনড্রিক নয়। আর ওরা হাজারবার শপথ নিয়েও বলবে যে আমি কোনো শ্বেতাঙ্গ ডাকাতকে চিনিই না, বুঝলে? তাছাড়া আমার এক ভাইও আছে। ও এত চালাক যে হিরেগুলোর হিল্লে হয়ে যাবে। আমরা তাই ঘরেই ফিরে যাব, ম্যানি।”

“তাহলে আমার কী হবে? আমি তো তোমার সাথে ওভাষোর গোত্রে যেতে পারব না।”

 “তোমার জন্যও আমি একটা প্ল্যান করে রেখেছি।” পিতাসুলভ মনোভাব নিয়ে ম্যানফ্রেডের কাঁধে হাত রাখলেন হেনড্রিক, “তোমার বাবা আমার ওপর ভরসা করতেন। তাই তোমার কোনো ভয় নেই। তোমাকে আমি অবশ্যই নিরাপদ কোনো জায়গায় পৌঁছে দিয়ে তবেই বাড়ি ফিরব।”

“তুমি চলে গেলে আমি একেবারে একা হয়ে যাবো হেনড্রিক।” হাত নামিয়ে নিলেন হেনড্রিক। মুখে কিছুই বললেন না।

সে রাতেই নদী ছেড়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে যাত্রা শুরু করল হেনড্রিক, ম্যানফ্রেড আর ক্লেইন বয়। মানুষের বসতি এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত ধীরে চলতে চলতে অবশেষে বিশতম দিনে পৌঁছে গেল এক ওভাদো গ্রামে।

কিন্তু চট করে গ্রামে না ঢুকে উপত্যকার পেছনে লুকিয়ে রইল তিনজনে। যেন অচেনা কাউকে দেখলে সতর্ক হওয়া যায়। গ্রামের দিক থেকে আসা সব ধরনের শব্দও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলেন হেনড্রিক আর ক্লেইন বয়। এভাবে বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড।

বিকেলের দিকে অবশ্য বদলে গেল পরিস্থিতি। ঢালু পেরিয়ে একপাল ছাগল নিয়ে গ্রামের দিকে ঢুকতে যাচ্ছে উদোমদেহী এক শিশু।

বাচ্চাটাকে দেখেই হালকাভাবে শিষ দিলেন হেনড্রিক।

চমকে উঠে ভয়ে ভয়ে বাচ্চাটা এদিকে তাকাতেই হেনড্রিক আরেকবার শিষ দিলেন। এবার সাবধানে কাছে এগিয়ে এল ছোট্ট মানুষটা। হঠাৎ করেই হেনড়িককে দেখে বিশাল এক অট্টহাসি দিয়ে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার। বুকে।

হেনড্রিক নিজেও হেসে উঠে কোমর পর্যন্ত বাচ্চাটাকে তুলে ফেললেন আদর করার জন্য।

 “ও আমার ছেলে।” হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ম্যানির জ্ঞাতার্থে অবশেষে জানালেন হেনড্রিক। কিচির-মিচির করে বাবাকে বিভিন্ন সংবাদও দিয়ে দিল বাচ্চাটা।

“গ্রামে অচেনা কেউ নেই। কয়েকদিন আগে পুলিশ এলেও এখন চলে। গেছে। ব্যাখ্যা দিলেন, হেনড্রিক।

তারপর ছেলেকে কোলে নিয়েই পাহাড় থেকে নেমে ঢুকে গেলেন গ্রামে। নগ্ন উর্ধাঙ্গ নিয়ে দল বেঁধে কাজ করছে চারজন ওভাষো নারী। এদেরই একজন হেনড়িককে দেখে চিৎকার দিয়ে ছুটে এলেন ঠিক বাচ্চাটারই মতন। শরীরে কুঁচকানো চামড়া, দন্তবিহীন বয়স্ক এই নারী আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন হেনড্রিকের পা।

“আমার মা” পরিচয় করিয়ে দিলেন হেনড্রিক।

একেবারে কোনার কুঁড়েঘরের প্রবেশ দ্বারে বসে আছে কালের একমাত্র পুরুষ। মনে হচ্ছে হেনড্রিকদের আগমনে সৃষ্ট হৈ-চৈয়ে তার কোনো রকম ভাবান্তর হল না। হেনড্রিকের চেয়ে বয়সে ছোট হলেও লোকটার পেশি কঠোর পরিশ্রমের ফলে অত্যন্ত মজবুত আর তার চারপাশে বেশ একটা আত্মবিশ্বাসের আবহ। চেহারাখানাও তরুণ ফারাওয়ের মত। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল তার কোলের উপর ম্যাকলের হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড বইটা পড়ে আছে।

 শান্ত ভঙ্গিতে হেনড্রিককে অভ্যর্থনা জানালেও এ দুজন যে বেশ আপন কোনো আত্মীয় তা বুঝে গেল ম্যানফ্রেড।

“এই হচ্ছে আমার বুদ্ধিমান সবজান্তা ছোটভাই। আমাদের বাবা এক হলেও মা ভিন্ন ও আমার চেয়ে অনেক ভালো ইংরেজি বলে আর বইও পড়ে। ওর ইংরেজি নাম হল মোজেস।”

“ও হানি হিরে খনিতে কাজ করে। কিন্তু মাথা নেড়ে তা এড়িয়ে গেল মোজেস।

 “এখন আর করি না ভাই। একমাস আগে চাকরি চলে গেছে। তাই এখন কেবল রৌদ্রে বসে বিয়ার খাই, বই পড়ি, চিন্তা করি আর পুরুষদের যা যা করণীয় তা করি।” শেষ হবার সাথে সাথে একত্রে হো হো হেসে উঠল দুই ভাই।

পশ্চিমা ইউরোপীয় পোশাক ছেড়ে নিজ গোত্রের সাদাসিধে কাপড় পুনরায় পরতে পেরে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠলেন হেনড্রিক। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত জনের সাথে পোষা প্রাণী, মাঠের শস্য, বৃষ্টি ইত্যাদি নিয়ে গল্প করতে গিয়ে এতটাই মশগুল হয়ে গেলেন যে, ভুলেই গেলেন বর্তমান সমস্যা। তাই মনে পড়তেই সবকিছু মোতজাসকে খুলে বললেন।

“ইয়েস” ভাইয়ের অবস্থা শুনে মাথা নাড়ল মোজেস।

“পুলিশ এসেছিল। বেশ কয়েকদিন থেকেও গেছে। প্রথমে হাসি-খুশি থাকলেও শেষের দিকে হুমকি আর ধমক-ধামক দিত। সোয়ার্ট হেনড্রিককে খুঁজতে এসেছিল। তোমার মা সহ কয়েকজন নারীকে মেরেছেও হেনড্রিকের চোয়াল শক্ত হতে দেখে মোজেস তাড়াতাড়ি সামলে নিল, “উনি কিন্তু বৃদ্ধ হলেও বেশ শক্ত। বাবার হাতে আগেও তো মার খেয়েছেন। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও কেউ সোয়াট হেনড়িককে চিনতে পারেনি। তাই ক্লান্ত হয়ে চলে গেছে পুলিশের কুত্তাগুলো।”

“ওরা আবার ফিরে আসবে। হেনড্রিক আনমনে জানাতেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিল মাজেস।

“হা শ্বেতাঙ্গরা কিছু ভোলল না। প্রিটোরিয়াতে পঁচিশ বছর আগে খুনের দায়ে এক লোককে ফাঁসি দিয়েছে। ওরা অবশ্যই আবার আসবে।”

সবার হাতে হাতে ঘুরছে কালো একটা বিয়ারের পাত্র।

“ওরা বলে গেল যে হানির রাস্তায় নাকি বড়সড় হিরে চুরির ঘটনা ঘটেছে। আর তুমি যে শ্বেতাঙ্গের সাথে চলতে-ফিরতে যুদ্ধ করতে, মাছ ধরতে সবুজ সমুদ্রে যেতে, তার নামও বলে গেছে। হিরে নেয়ার সময় তুমিও নাকি তার সাথে ছিলে। তাই সুযোগ পেলেই তোমার গলায় দড়ি পরিয়ে দেবে।”

মিটিমিটি হেসে উঠলেন হেনড্রিক, এরকম একটা কাহিনি আমিও শুনেছি বৈকি। আমার পরিচিত এক আত্মীয়ের হাত দিয়ে নাকি চুরি হয়েছে সব হিরে।”

 “তোমাকে এসব ডাহা মিথ্যে কে বলল?” বিবর্ণ মুখে হেসে ফেলল মোজেস। ক্লেইন বয়কে ইশারা দিলেন হেনড্রিক। চামড়ার একটা ব্যাগ এনে বাবার সামনে রেখে দিল ক্লেইন বয়। ব্যাগের মুখ খুলে কার্টিজ পেপারে মোড়া ছোট ছোট প্যাকেটগুলো বের করে মাটিতে সাজিয়ে রাখলেন হেনড্রিক। এক সারিতে মোট চৌদ্দটা প্যাকেট হল।

প্রথম প্যাকেটটা নিয়েই ছুরির ফলা দিয়ে কাগজ ছিঁড়ে ফেলল মোজেস। মোমের সীল দেখে বলল, “এটা তো হানি মাইনের সীল।” সাবধানে ভেতরের জিনিসগুলো দেখেও অবশ্য তার মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হল না। একে একে চৌদ্দটা প্যাকেট দেখে অবশেষে নরম স্বরে জানাল, “মৃত্যু। সাথে করে শত শত হাজার হাজার মৃত্যু নিয়ে এসেছে।”

 “তুমি বিক্রি করতে পারবে না?” হেনড্রিকের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল মোজেস।

 “একসাথে এত হিরে আমি জীবনেও দেখিনি। তার উপর যদি একত্রে বিক্রি করতে যাই তো আমাদের সবার উপরেই মৃত্যুর খড়গ নেমে আসবে। তাই ভেবে দেখি কী করা যায়। তবে ততদিন পর্যন্ত এগুলোকে আমাদের বসতির মধ্যেও রাখা যাবে না।”

অতঃপর পরদিন সকালবেলা হেনড্রিক, মোজেস আর ক্লেইন বয় মিলে গিরিসংকটের একেবারে চূড়ায় গিয়ে লিডউড গাছ খুঁজে বের করল। মাটি থেকে ত্রিশ ফুট উপরে গাছের গুঁড়ির মধ্যে ফাঁপা একটা ফোকর আছে। মাঝে মাঝে এক জোড়া ঈগল এসে বাসা বাঁধে। যাই হোক বাকি দু’জন নিচে দাঁড়িয়ে পাহারা দিল আর গাছে উঠে পাখির বাসার মধ্যে হীরে ভর্তি চামড়ার থলে রেখে দিল ক্লেইন বয়।

***

এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। একদিন এসে মোজেস জানাল, “ভাই, তুমি আর আমি বোধ হয় আর এখানে থাকতে পারব না। তোমার মাঝে আমি অস্থিরতার আগমন টের পাচ্ছি। যে জীবন আগে অনেক মধুর ছিল তা এখন তিক্ত লাগে। বিয়ারের স্বাদও আগের মত ভালো লাগে না।”

হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “তুমি যে এতকিছু জানো আমি তো জানতামই না ভাই, মানুষের মনের কথাও টের পাও!”

 “আমাদের এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। পাথরগুলোও এখানে রাখাটা বিপজ্জনক।”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন হেনড্রিক “বলল আমি শুনছি।”

“আমি আসলে এমন এক কলার কথা বলছি যেটাকে শ্বেতাঙ্গরা রাজনীতি বলে; যেখানে আমাদের কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার নেই।”

মুখ বাঁকিয়ে হেনড্রিক বললেন, “তুমি আজকাল একটু বেশি বেশি বই পড়ছে। এসব কাজে কোনো ফায়দা নেই বুঝলে।”

 “ভুল বললে ভাই। এ কলাতে এত সম্পদ আছে যার কাছে তোমার ওইসব পাথর তুচ্ছ।”

কিছু বলার জন্য মুখ খুলেও আস্তে করে বন্ধ করে ফেললেন হেনড্রিক। এ ব্যাপারে এমন করে সত্যিই আগে আর কখনো ভাবেননি। কিন্তু আজ ভাইয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আর আগ্রহ দেখে তিনিও বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

“ভাই, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমাদের এখানকার পাট চুকিয়ে দেয়া উচিত।”

সম্মতি দিলেন হেনড্রিক। তিনি নিজে সারা জীবন যাযাবর হয়ে ঘুরেছেন। তাই এতে তার কোনো সমস্যাই নেই।

“কিন্তু আমরা যাব কোথায়?”

ভাইয়ের কথা শুনে হেনড্রিকের হাত ধরল মোজেস, “এ ব্যাপারে পরে আলোচনা করব। তবে তার আগে সাথে করে যে শ্বেতাঙ্গ ছেলেটাকে নিয়ে এসেছো তাকে সরিয়ে দিতে হবে। ও আসলে হিরের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক। ওর গন্ধ শুঁকে শুঁকে পুলিশ এখানেও চলে আসবে।”

 শারীরিক আর মানসিক উভয় দিক দিয়েই মোয়ার্ট হেনড্রিক অত্যন্ত শক্তিশালী একজন পুরুষ। কোনো কিছুতেই ভয় নেই। যা চান তার জন্য প্রচণ্ড কষ্ট করতেও রাজি। তবে একটা সমস্যা হল সারা জীবনই অন্য কাউকে অনুসরণ করে এসেছেন। এবারও তাই হল।

“তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই হবে ভাই।” মনে হল এতদিনে পাহাড়ের উপর ফেলে আসা মানুষটার স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য উপযুক্ত কাউকে পেয়েছেন।

***

“আমি এখানে আগামীকাল সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যদি এর ভেতরে তুমি আর ফিরে না আসো তাহলে ধরে নেব যে নিরাপদ আছে। ঠিক আছে?”

“তোমার সাথে আর দেখা হবে না হেনি?” মন খারাপ করে ফেলল ম্যানফ্রেড হেনড্রিকও মিথ্যে প্রতিজ্ঞা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলেন।

*এখন থেকে আমাদের ভাগ্য ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে আমাদেরকে, ম্যানি। তবে তোমার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে আর কে জানে আবার হয়ত কোনোদিন আমাদের ভিন্ন রাস্তা একসাথে মিলে যেতেও পারে।” ম্যানির কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিলেন। টের পেলেন ছেলেটা আসলেই বয়স্ক পুরুষ হয়ে উঠেছে। পেশিগুলো এরই মাঝে বেশ মজবুত হয়ে গেছে। “ভালো থেকো ম্যানি আর ঠিক বাবার মত মানুষ হয়ে উঠো।”

হালকাভাবে ধাক্কা খেয়েও দাঁড়িয়ে রইল ম্যানফ্রেড।

“হেনড্রিক তোমাকে আমার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।”

“যাও ম্যানি। জানি তুমি কী বলতে চাও।”

কম্বল আর ব্যাগখানা তুলে নোংরা ধূলিমাখা রাস্তায় নেমে এল ম্যানফ্রেড। আস্তে আস্তে হেঁটে সামনের গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে আর ওই গির্জার মাথা দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকছে নতুন এক জীবন।

 তবে আনমনেই প্রধান রাস্তা ছেড়ে পাশের স্যানিটারি লেইনে চলে এল। শেষ মাথায় যাজকের বাড়ির পেছনের দরজায় পৌঁছে হুড়কো খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

কিন্তু খানিক এগিয়েও ভয়ংকর এক হাক শুনে থেমে গেল ম্যানফ্রেড। উচ্চ কণ্ঠে আরেকটা চিৎকার শোনা গেল। এদিক-ওদিক তাকাতেই বোঝা গেল শব্দগুলো উঠানের শেষ মাথার কাঠের বাড়িটা থেকেই আসছে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দরজার ফুটো দিয়ে উঁকি দিল ম্যানফ্রেড। অন্ধকারে চোখ সইয়ে আসার পর চোখে পড়ল মাটির মেঝের একেবারে মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন ট্রম্প বিয়ারম্যান।

চোখ দুটো বন্ধ করে দু’হাত উপরে তুলে প্রার্থনা করছেন বিয়ারম্যান।

“ওহ ইস্রায়েলের প্রভু ঈশ্বর, তোমার ভূতত্যর প্রয়োজনের সময় মুখ ফিরিয়ে থেক না। তোমার ইচ্ছে যদি আমি না জানি তো এই দায়িতু কীভাবে পালন করব? আমি নগণ্য মানুষ, একাকী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। আমার দিকে তাকাও প্রভু”

আচমকা চোখ মেলে তাকালেন ট্রম্প। মাথা ঘুরিয়ে সোজা তাকালেন ম্যানফ্রেডের দিকে। ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে উঠে আসা কোনো নবীর চোখের মত দেখে নিলেন ছেলেটার অন্তর।

ভয়ে ভয়ে আকৃতিবিহীন ঘামে ভেজা টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে বুকের কাছে ধরল ম্যানি।

 “আমি ফিরে এসেছি ওম, আপনি যেমনটা বলেছিলেন।”

ভয়ংকর ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন ট্রম্প। পেশিবহুল দু’খানা পা, চওড়া কাধ আর ধূলিমাখা সোনালি চুলের ম্যানফ্রেডের চোখ দুটোতে দেখতে পেলেন দৃঢ় মনোবল আর বুদ্ধিমত্তার ছাপ।

 তাই আদেশ দিলেন, “এদিকে এসো।” ব্যাগ রেখে ম্যানের কাছে এগিয়ে যেতেই হাত ধরে বসিয়ে দিলেন ট্রম্প।

“তোমার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাও বস। ঈশ্বরের গুণকীর্তন করা যে তোমার বাবা আমার কথা শুনেছে।”

সুবোধ বালকের মত চোখ দুটো বন্ধ করে হাত জড়ো করল ম্যানফ্রেড।

 কিন্তু একের পর এক প্রার্থনা করে “আমেন” বলতে বলতে ছেলেটার মাথা ঘুরে উঠল ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে। একই সাথে হাঁটুও ব্যথায় মোচড় দিচ্ছে এমন সময় ঝট করে ম্যানফ্রেডের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন টুম্প। “মেভু। তুমি কোথায়?”

 রুদ্ধশ্বাসে রান্নাঘরে দৌড়ে এলেন ট্রুডি বিয়ারম্যান। কিন্তু নোংরা আর ছেঁড়া কাপড় পরিহিত ম্যানফ্রেডকে দেখেই আবার দাঁড়িয়ে গেলেন।

“আমার এত সুন্দর রান্নাঘর। মাত্রই আমি পরিষ্কার করে গেছি।”

“প্রভু ঈশ্বর ওকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।” সুর করে বলে উঠলেন ট্র। “ওকে আমাদের ঘরেই রেখে দিব। আমাদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবে, আমাদের একজন হয়েই থাকবে।”

“কিন্তু ও এত নোংরা।”

 “তাহলে ওকে পরিষ্কার হতে সাহায্য করো।”

ঠিক সেই মুহূর্তে ট্রুডি বিয়ারম্যানের বড়সড় শরীরটার পেছন থেকে ভেতরে তাকাল ভীতসন্ত্রস্ত চেহারার ছোট্ট একটা মেয়ে। ম্যানেফ্রডকে দেখার সাথে সাথেই ফুঁপিয়ে উঠল বেচারি।

কিন্তু সারাহকে দেখে অবাক হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। মেয়েটার একদা বিবর্ণ গাল দুটো এখন আপেলের মত গোলাপি হয়ে গেছে। হাড়জিরজিরে হাতেও মাংস লেগেছে। সোনালি চুলগুলো সুন্দর বেণি বাধা আর পরনের স্কার্টটাতেও একটা দাগ নেই।

দু’হাত বাড়িয়ে ম্যানফ্রেডের কাছে ছুটে আসতে চাইল সারাহ। কিন্তু পেছন থেকে আটকে ধরলেন ট্রুডি।

“অলস মেয়ে কোথাকার। তোমাকে না আমি অংক করতে দিয়ে এসেছি। এক্ষুণি যাও, শেষ করো।” ধাক্কা দিয়ে সারাহাকে রুম থেকে বের করে দিয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন। “আর তুমি, চুলগুলো তো মেয়েদের মত লম্বা। পরনের কাপড় তো আর কী বলব। এখানে আমরা সবাই খ্রিস্টান বুঝলে, তোমার বাবার মত বন্য নই।”

“আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে ট্রুডি আন্টি।”

“সবাই যখন খাবে তুমিও তখন খাওয়া পাবে আর পরিষ্কার হওয়ার আগে তো নয়ই।”

তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “গরম পানির গিজার কীভাবে চালাতে হয় ছেলেটাকে দেখিয়ে দাও।”

 এখানেই শেষ না, ম্যানফ্রেডের শত আপত্তি সত্ত্বেও বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে নিজে তদারক করে, ওর গায়ে সাবান ঘষে গোসল করিয়ে দিলেন ট্রুডি।

তারপর ম্যানফ্রেডের কোমরে মাত্র একটা ভোয়ালে জড়িয়ে টেনে নিয়ে এলেন নিচের বাগানে। ফলের বাক্সের উপর বসিয়ে কেটে দিলেন ছেলেটার চুল। একটু পরে মাথায় হাত বুলিয়ে ম্যানফেড় নিজেই হা হয়ে গেল। গলা ঘাড় আর কানের পিছনটা বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।

অতঃপর ম্যানফ্রেডের নোংরা কাপড়-জামা সব জড়ো করে ফার্নেসে ঢুকানোর জন্যে তৈরি হলেন ট্রুডি। একেবারে শেষ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে জ্যাকেটটা তুলে নিল ম্যানি। আলতো করে ছুঁয়ে দেখল লাইনিং।

ছেলেটার মুখভার দেখে ট্রুডির দয়া হল, “ঠিক আছে, ধুয়ে কয়েকটা সেলাই করে দিলেই হবে।”

তারপর ম্যানফ্রেডের ক্ষুধা নিবারণকে যেন ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নিলেন ট্রুডি। শেষ করার আগেই ভরে দিলেন ম্যানির প্লেট।

অন্যদিকে পাখির মত টুকটুক করে খায় বলে সারাহও বিস্তর বকা হজম করল। যাই হোক, খেতে গিয়েও ম্যানফ্রেডের ওপর থেকে চোখ সরাল না মেয়েটা।

সারাহ আর বিয়ারম্যান পরিবারে এমনিতেই পূর্ণ হয়ে গেছে পুরো বাড়ি। তাই উঠানের শেষ মাথার যন্ত্রপাতি রাখার ছাউনির এক কোনায় ম্যানফ্রেডকে শোয়ার জায়গা দেয়া হল। প্যাকিং কেসকে উল্টে কার্ড বানিয়ে দিলেন ট্রুডি। আর লোথার খাঁটিয়ায় মাট্রেস ও পুরাতন পর্দা ঝুলিয়ে করা হল ঘুমানোর বন্দোবস্তু।

যাই হোক, যাওয়ার আগে ট্রুডি বারবার সাবধান করে দিলেন, “মোমবাতির অপচয় করো না। প্রতি মাসের শুরুতে কেবল একটাই পাবে। কারণ আমাদেরকে অনেক হিসাব করে চলতে হয়। বুঝলে?”

জীবনে প্রথমবারের মত নিজের একটা রুম আর বিছানা পেয়েছে ম্যানি। গ্রিজ আর প্যারাফিনের গন্ধ সত্ত্বেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও জানে না।

আচমকা গালে হালকা স্পর্শ পেয়েই ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল ম্যানফ্রেড। মনে হল যেন বাবার গ্যাংগ্রিন আহত হাতটাই বুঝি কবর থেকে উঠে এসেছে। কম্বল সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়।

“ম্যানি, ম্যানি আমি!”

সারাহও ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল সাদা নাইট ড্রেস গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে মেয়েটা। রুপালি মেঘের মত কাঁধ ছাপিয়ে পড়েছে লম্বা চুল।

 “তুমি এখানে কী করছো?” আলতো স্বরে জানতে চাইল ম্যানেফ্রড, “তোমার এখানে আসাটা উচিত হয়নি। ওরা যদি দেখে তো-” চুপ করে গেল ম্যানি। কী ঘটবে না জানলেও এই নিরাপত্তা বোধের আনন্দ যে উবে যাবে তা বেশ টের পেল।

 “আমার একটুও ভালো লাগত না এখানে।” সারাহর কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল যে সে কাঁদছে। “তুমি যাবার পর থেকেই আমার কিছু ভালো লাগত না।

মেয়ে দুটো তো আমাকে আবর্জনা বলে ডাকে। আমি ওদের মত পড়তে পারি না, অংক জানি না, মজা করে কথা বলতে পারি না যে তাই। তোমরা আমাকে এখানে রেখে যাবার পর প্রতি রাতে আমি কেঁদেছি।”

সব শুনে ম্যানফ্রেডের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল! প্রথমে নার্ভাস লাগলেও আস্তে করে সারাহকে ধরে বিছানায় ওর পাশে বসালো। “আমি চলে এসেছি। এখন থেকে আর কোনো সমস্যা হবে না।”

ম্যানফ্রেডের ঘাড়ে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল সারাহ। দৃঢ় কণ্ঠে ম্যানফ্রেড জানাল, “ব্যস সারি, কান্না থামাও। তুমি আর ছোট্ট খুকি নও। সাহসী হতে হবে এখন।”

“কাঁদছি কারণ এখন অনেক আনন্দ হচ্ছে।”

“এমনকি আনন্দের সময়েও কাদা যাবে না।” আদেশ দিল ম্যানফ্রেড, “বুঝেছ?” কোনোমতে নিজের চোখ মুছে নিল সারাহ।

“আমি প্রতিদিন তোমার কথা ভেবেছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি যেন তোমাকে ফিরিয়ে আনেন। আচ্ছা তোমার সাথে একটু বিছানাতে শুয়ে থাকি? ঠাণ্ডা লাগছে।”

“না।” শক্ত হয়ে উঠল ম্যানফ্রেডের গলা।

“একটু ক্ষণের জন্য শুধু।” ম্যানফ্রেড আর কিছু বলার আগেই বিছানায় উঠে কম্বলের নিচে ওর পাশে শুয়ে পড়ল সারাহ। পাতলা নাইট গাউনের নিচে ওর শরীর এত ঠাণ্ডা হয়ে পড়েছে যে বাধা দিতে পারল না ম্যানফ্রেড।

“শুধু পাঁচ মিনিট। তারপরেই কিন্তু চলে যেতে হবে।”

সারাহর চুলগুলো এত সুন্দর আর নরম যে নিজেকে হঠাৎ বেশ বড় বড় বলে মনে করল ম্যানি। আস্তে আস্তে মেয়েটার চুলে হাত বুলিয়ে দিল।

“তোমার কি মনে হয় ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন? অনেক দিন লাগলেও তুমি কিন্তু ঠিকই এসেছো, তাই না।” নরম স্বরে জানাল সারাহ।

 “কে জানে। আমি প্রার্থনার বিষয়ে বেশি কিছু জানি না। আমার পা কখনোই তেমন প্রার্থনা করত না। আমাকেও শেখায়নি।”

 “ওয়েল, এখন থেকে কিন্তু করতে হবে। এই ঘরে সবাই সারাক্ষণ প্রার্থনা করে।

***

বাইরে তখনো অন্ধকার। কানের কাছে প্রচণ্ড গর্জন শুনে ম্যানফ্রেডের ঘুম ভেঙে গেল। “দশ সেকেন্ড আর তার পরেই তোমার গায়ে কিন্তু ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিব।” কাঁপতে কাঁপতে আংকেল ট্ৰম্পের সাথে আস্তাবলের পাশে ঘোড়ার খাবারের জায়গায় চলে এল ম্যানফ্রেড।

 “তরুণদের পাপ লাঘব করার জন্য ঠাণ্ডা পানির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই, বুঝলে? এখন যাও। নাশতার আগেই আস্তাবল পরিষ্কার করে ঘোড়াগুলোকে খাইয়ে দেয়া চাই।”

তারপর সারাদিন কেটে গেল একের পর এক কাজ, প্রার্থনা আর স্কুলের ওয়ার্ক করে। তবে হাঁটু গেড়ে থাকাটাই হল সবচেয়ে কষ্টের। সারাক্ষণেই আংকেল অথবা আন্টি কিছু না কিছুর জন্য ঈশ্বরকে আবদার জানিয়েই চললেন।

যাই হোক, প্রথম সপ্তাহের শেষে অবশ্য সবকিছু গা সওয়া হয়ে গেল। এমনকি ওর হলুদ চোখ জোড়ার কঠিন দৃষ্টি দেখলে ট্রাম্পের মেয়ে দুটিও ভয়ে পালাত।

 কিন্তু বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। তাই আপন মনেই ওদেরকে এক হাত দেখে নেয়ার প্রতিজ্ঞায় মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করল ম্যানি। আস্তে আস্তে টের পেল ওরা কীভাবে সারাহকে জ্বালাতন করছে। এমন গোপনে আর নির্দয়ভাবে করত যে কেউ টের পেত না। হয়ত গালি দিল, কিংবা মুখ ভেংচাল। নিজেদের খেলা থেকে সারাহকে বাদ দিয়ে তামাশা করল। অথবা সারাহর ইস্ত্রি করা কাপড়ে কালি ঢেলে দিল, বোয়া প্লেটে তেল লাগিয়ে দিত ইত্যাদি ইত্যাদি।

একদিন বিয়ারম্যানের মেয়েদেরকে হাতেনাতে ধরে ফেলল ম্যানফ্রেড। তারপর চুলের বেণী ধরে কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে সাবধানও করে দিল, “দৌড়ে গিয়ে মাকে কাহিনি বলার কোনো দরকার নেই বুঝলে?” হঠাৎ করেই সুবোধ বালিকায় পরিণত হল দুই বোন। তখন থেকে ওদের অত্যাচারের হাত থেকে অবশেষে নিষ্কৃতি পেল সারাহ।

সপ্তাহ শেষে, রবিবারের গির্জায় টানা পাঁচবার সাহায্যকারীর কাজ শেষ করে যেই না নিজের বিছানায় এসে বসল ম্যানফ্রেড, দরজায় দেখা দিল দুই বোনের একজন,

“পা তোমাকে স্টাডিতে ডাকছে।” এর আগে আর কখনো যাজকের বাড়ির সামনের অংশে আসেনি ম্যানফ্রেড। তাছাড়া দুই বোনের কাছে অনেকবারই শুনেছে যে স্টাডিতে ডাক পড়ার মানে হল কোনো না কোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিংবা শাস্তি ভোগ করতে হবে। ভয়ে কাঁপছে ম্যানফ্রেড। বুঝতে পেরেছে নিশ্চয় সারাহর রাতে ওর কাছে আসাটা সবাই টের পেয়ে গেছে। যাই হোক, আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে পা দিল ম্যানফ্রেড।

 ডেস্কের পেছনে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন আংকেল, “ভেতরে এসো বাছা। আর দরজাটা বন্ধ করে দাও।” তারপর ধপ করে বসে পড়লেন নিজের চেয়ারে।

কী বলবে মনে মনে তাই গুছিয়ে নিল ম্যানফ্রেড। কিন্তু তার আগেই আংকেল বলে উঠলেন, “ওয়েল আমি তোমার আন্টির কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়েছি যে এতদিন তোমার পড়াশোনার প্রতি কেউ খেয়াল না করলেও এ ব্যাপারে নাকি তুমি বেশ আগ্রহী।” ম্যানফ্রেড এতটাই স্বস্তি পেল যে এর পরের কথাগুলো প্রায়ই শুনতেই পারল না। “আমরা দমন-নিপীড়নের শিকার ম্যানফ্রেড। তাই শত্রুকে ঠেকাবার একটাই উপায় আছে। আর তা হল শক্তি, বুদ্ধি আর নির্দয়তার ক্ষেত্রে তাদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়া।”

নিজের ভাবনা ছেলেটার সামনে তুলে ধরতে তিনি ব্যস্ত রইলেন যে ওর দিকে আর না তাকিয়ে স্বপ্নাতুর চোখে বলে চললেন বিভিন্ন কথা।

ম্যানফ্রেডও ফুসরত পেয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল পুরো কামরার সাজসজ্জা। হঠাৎ করেই দেয়ালের ছবিগুলোর মধ্যে আবিষ্কার করল এক ভিন্ন ট্রম্প বিয়ারম্যানকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুলের ক্লিন, শেভ চেহারার বছর পঁচিশের ট্রম্প। পেশিবহুল শক্তিশালী দেহ। সামনেই ছোট একটা টেবিলে একগাদা কাপ আর ট্রফি। ছবিতে হাস্যরত সুদর্শন চেহারার ওই তরুণকে বেশ রোমান্টিকও লাগছে।

“আপনি বক্সার ছিলেন” আচমকা বলে উঠল ম্যানফ্রেড। এত অবাক হয়ে গেছে যে চুপ করে থাকার কথাও ভুলে গেল। কথার মাঝখানে বাধা পেয়ে বিশাল বড় মাথাটা ঘুরিয়ে এদিকে তাকালেন ট্রম্প। ম্যানফ্রেডের দৃষ্টি অনুসরণ করে ছবিটা দেখে জানালেন,

“শুধু বক্সারই না। আমি ছিলাম চ্যাম্পিয়ন। লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ান।”

চোখ ফিরিয়ে ম্যানফ্রেডের সপ্রশংস দৃষ্টি দেখে তিনি নিজেও বেশ আপুত হলেন।

“এই বেল্ট আর কাপগুলো কি আপনি পেয়েছিলেন?”

 “অবশ্যই। ফিলিস্তিনিদের কোমর আর উরু ভেঙে দিয়েছিলাম না।”

“শুধু ফিলিস্তিনিদের সাথেই লড়েছিলেন আংকেল ট্রম্প?”

  “ওরা সবাই আসলে আমার কাছে ফিলিস্তিনিই ছিল।” হাত মুঠো পাকিয়ে ম্যানফ্রেডের নাকের কয়েক ইঞ্চি সামনে বেশ কয়েকটা পাঞ্চ মেরে দেখালেন ট্রম্প বিয়ারম্যান।

“আমি মাইক উইলিয়ামকেও হারিয়ে দিয়েছি, বুঝেছ? ১৯১৬ সালে জ্যাক লালোরের কাছ থেকে পদবী নিয়েছি।” হঠাৎ করেই কোলের উপর হাত রেখে আবার চুপচাপ হয়ে গেলেন আংকেল, “আর তারপর তো তোমার ট্রুডি আন্টি আর ঈশ্বরের প্রভু আমাকে রিং থেকে ডেকে এনে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ দিলেন।” আংকেলের চোখ থেকে বিদায় নিল ময়দানের স্মৃতি।

“বক্সিং আর চ্যাম্পিয়ন হওয়া এ দুটোই আমার জীবনের সবচেয়ে জরুরি কাজ।” একনিঃশ্বাসে বলে ফেলল ম্যানফ্রেড। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ছেলেটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন বিয়ারম্যান।

“তুমি ফাইট করতে চাও?” চকিতে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে যেন ষড়যন্ত্র করছেন এমন ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন আংকেল।

এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠল যে ম্যানফ্রেডের গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হল না। কেবল তীব্র বেগে মাথা নাড়ল।

কিন্তু তোমার আন্টি তো এসব পছন্দ করে না। একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। মারামারি আসলে গুণ্ডাদের কাজ। এসব মাথা থেকে তাড়াও বাছা। অন্য কোনো উচ্চ চিন্তা করো।” মুখে বললেও আংকেল কিন্তু নিজে তা বিশ্বাস করেন না। তবুও ম্যানফ্রেডের সামনে মাথা নেড়ে হাত দিয়ে নিজের দাড়ি ঠিক। করতে লাগলেন।

 “এর পরিবর্তে আমার কথা শোনো। আমি আর তোমার আন্টি দু’জনেই চাইছি যে তুমি কয়েকদিনের জন্য ডি লা রে পদবীটাকে ব্যবহার করো না। অন্তত তোমার বাবার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ারম্যান পদবীটা ব্যবহার করো। এমনিতেই সংবাদপত্রে বেশ কয়েকবার চলে এসেছে এ নাম। তাছাড়া আগামী মাসেই উইন্ডহকে আবার তোমার বাবার কেস আদালতে উঠবে।”

“আমার বাবার বিচার?” হাঁ করে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। “কিন্তু বাবা তো মারা গেছে।”

“মারা গেছে? তোমার তাই ধারণা?” উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের পিছন থেকে বের হয়ে ম্যানফ্রেডের কাছে এলেন বিয়ারম্যান, “আমাকে ক্ষমা করো বাছা। তোমাকে আরো আগেই বলা উচিত ছিল। তোমার বাবা মারা যায়নি। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। আগামী মাসের বিশ তারিখে উইন্ডহকে সুপ্রিম কোর্টে তার বিচার হবে।”

 কেঁপে উঠল ম্যানফ্রেড। ওর কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন ট্রম্প বিয়ারম্যান, তারপর নরম স্বরে জানালেন, “এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে কেন তোমার নাম পরিবর্তনের কথা বলেছি?”

***

দ্রুতহাতে কাপড় ইস্ত্রি করা শেষ করে বাসা থেকে বের হয়ে এল সারাহ। এবার কাঠের স্তূপের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে দেখতে লাগল ম্যানফ্রেডের কাজ।

শার্ট খুলে দ্বিতল হাতলের লম্বা কুঠার নিয়ে কাঠ কাটছে ম্যানফ্রেড। ঘামে ভিজে গেছে ছেলেটার উদোম পিঠ আর বুক।

 হাতের তালুতে থুথু ছিটিয়ে খানিকটা পিছিয়ে এল ম্যানি। তারপর আদেশের সুরে বলে উঠল, “পাঁচের ঘরের নামতা….একই সাথে মাথার উপর কুঠারটাকে ঘুরিয়ে কাঠের গুঁড়ির ওপর দিল কোপ। “পাঁচ একে পচ।” কুঠারের তালে তালে বলা শুরু করল সারাহ্। “পাঁচ দু’গুণে দশ।” মাথা সমান লম্বা একফালি কাঠ কেটে নিল ম্যানি। এভাবে কাটতে কাটতে ঠিক যখন মেয়েটা পাঁচ দশে পঞ্চাশ” বলল ঠিক তখন পুরো কাঠটা দুটুকরো হয়ে গেল। পিছিয়ে এসে হাতলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হেসে ফেলল ম্যানফ্রেড।

“ভেরি গুড, সারি, একটাও ভুল হয়নি।”

খুশিতে চকচক করে উঠল সারাহর চোখ; কিন্তু হঠাৎ তখনই ম্যানফ্রেডের কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখে আবার শক্ত করে ফেলল শরীর। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে স্কার্ট তুলে ঘরের দিকে দৌড় দিল।

ঝট করে পিছু ফিরল ম্যানফ্রেড। শেড়ের নিচে থেকে এদিকেই তাকিয়ে আছেন আংকেল ট্রম্প। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে ম্যানফ্রেডের কাছে এসে দাঁড়ালেন। কী মনে করে আবার ওর চারদিকে একবার ঘুরে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছেন ম্যানফ্রেডের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবকিছু।

অস্বস্তিতে পড়ে গেল ম্যানি।

“তোমার বয়স কত বাছা?”

জানতে চাইলেন বিয়ারম্যান।

উত্তর শুনে মাথা নেড়ে বললেন, “আর তিন বছর হলেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাবে। লাইট হেভিওয়েটের জন্যে তুমি পুরোপুরি ঠিক আছে আর তারপর কোনো ঝামেলা না বাঁধলে হেভিওয়েট পর্যন্ত যেতে পারবে।”

উত্তেজনায় ম্যানফ্রেডের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। অথচ আংকেল ট্রম্প আর কিছু না বলে কাঠের স্কুপের দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের জ্যাকেট খুলে পরিপাটি করে ভাজ করে একপাশে সরিয়ে রাখলেন, তারপর টাই খুলে শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে এলেন ম্যানির কাছে।

 “তো তুমি বক্সার হতে চাও?” হাতের কুঠারটাকে কাঠের নিচে ঢুকিয়ে রেখে আংকেলের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। ডান হাতের তালু বাড়িয়ে দিলেন আংকেল। বললেন, “হিট ইট!” হাত মুঠো করে ঘুরিয়ে মারল ম্যানি।

“তুমি কি সোজা সেলাই করছো নাকি আটা বানাচ্ছ? জোরে মারো। আরো জোরে। এই তো। গুড! এবার বামে! হুস! বামে! ডানে! আবার বামে!”

 দু’হাত সামনে বাড়িয়ে হেলে-দুলে যেন নাচলেন আংকেল। ম্যানফ্রেড নিজেও এখন আগ্রহ নিয়ে ঘুষি চালাচ্ছে।

 “অল রাইট।” অবশেষে হাত সরিয়ে নিলেন আংকেল।

“এবারে আমার মুখে মারো। একেবারে বোতামের ওপর। দেখা যাক পিঠে লাগাতে পারো কিনা।”

হাত নামিয়ে পিছিয়ে এল ম্যানফ্রেড।

 “না, আংকেল আমি এটা পারব না।”

 “কেন?”

 “আপনাকে মারাটা উচিত হবে না।”

“আমরা তো এখন বক্সিং করছি।” চিৎকার করে উঠলেন আংকেল। “আমি তো আরো ভেবেছি তুমি লড়তে চাও। আমি ভেবেছি তুমি বুঝি পুরুষ হয়ে উঠতে চাও। এখন তো দেখি বাচ্চাদের মত ঘ্যানঘ্যান করছে। তারপর নাকি সুরে ম্যানফ্রেডকে নকল করে বললেন, “না আংকেল আপনাকে মারাটা উচিত হবে না।”

তারপর হঠাৎ করেই ডান হাত দিয়ে ম্যানফ্রেডের গালে এত জোরে ঘুষি মারলেন যে চামড়ায় দাগ পড়ে গেল।

“তুমি পুরুষ নও! কখনো ফাইটার হতেই পারবে না।”

পরের আঘাতটা এত জোরে এল যে ম্যানফ্রেড ঠিকভাবে ঠাহরই করতে পারল না। এত ব্যথা পেল যে চোখ ভরে গেল জলে।

“তোমার জন্য আসলে মেয়েদের স্কার্ট বানাতে হবে। তাই না?”

খুব সাবধানে ম্যানফ্রেডকে পরখ করে দেখছেন আংকেল। চাইছেন বিশৃঙ্খল মনোজগতের অধিকারী এই কিশোরকে স্থির করার জন্যে। আরেকটা আঘাত করে এবারে ম্যানফ্রেডের নিচের ঠোঁট কেটে দিলেন।

 “কাম অন!” একের পর এক অপমান করে নিঃশব্দে চ্যালেঞ্জ করলেন ছেলেটাকে।

আর তারপরেই যা ঘটল দেখে ভরে গেল তার বুক। উল্লাসিত হয়ে দেখলেন যে বদলে গেল ম্যানফ্রেডের চোখের দৃষ্টি। আচমকা সেখানে ধপ করে জ্বলে উঠল হলুদ আলো। ঠিক যেমনটা শিকারকে আক্রমণের আগমুহূর্তে থাকে সিংহের চোখে। এগিয়ে এল ম্যানফ্রেড।

যদিও আংকেল এমনটাই চাইছিলেন, তারপরেও ম্যানফ্রেডের গতি আর আক্রমণের তীব্রতায় ভারসাম্য হারিয়ে টলে উঠলেন আংকেল। কেবল ফাইটারের জাত দক্ষতার গুণেই এ যাত্রা বেঁচে গেছেন। তারপরেও টের পেলেন ভয়ংকর এক প্রাণীকে বুঝি তিনি নিজেই গুহা থেকে টেনে বের করে এনেছেন।

আর তারপরেই মনে পড়ে গেল রিংয়ের অভিজ্ঞতা আর পুরনো সব কৌশল। নিচু হয়ে এঁকেবেঁকে এড়িয়ে গেলেন ম্যানফ্রেডের সবকটা আঘাত। তবে বিস্মিত হলেন ছেলেটার সক্ষমতা দেখে, “কেমন সুন্দর করে দু’হাতে ঘুষি মারছে। যেন জন্ম থেকেই খেলে।”

ম্যানফ্রেডের চোখের দিকে তাকাতেই শিরশির করে উঠল আংকেলের দেহ। “না জানি দুনিয়ার ওপর কোনো প্রলয়ঙ্করী ঝড় উড়ে আসছে।”

“ও একটা খুনি। ঠিক একটা চিতার মতই রক্ত দেখার আনন্দে খুন করবে। আমাকে যেন দেখছে না। দেখছে নিজের শিকার।”,

ভাবতে গিয়ে যেই না আংকেল একটু আনমনা হলেন অমনি চোয়ালের মধ্যে দাঁত ঢুকে গেল, গোড়ালির হাড় ভেঙে গেল ম্যানফ্রেডের ঘুষি খেয়ে, মনে হচ্ছে পা দুটো বুঝি আর তার দেহের ভার বইতে পারছে না। তিনি নিজে সেই বাইশ বছর আগে খেলা ছেড়েছেন অথচ ছেলেটা যেন মেশিন। দুটো হাতই সমানে ঘুরছে। হলুদ চোখ দুটোর আগুনে দৃষ্টি তো কিছুতেই তাকে আড়াল হতে দিচ্ছে না।

নিজেকে সামলে নিয়ে বাম হাত দিয়ে পাল্টা পাঞ্চ মারলেন বিয়ারম্যান, যা দিয়ে ব্ল্যাক জেপটাকে কুপোকাৎ করেছিলেন।

হঠাৎ করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ম্যানফ্রেড।

“এই তো হয়েছে। কোনোমতে শ্বাস নিতে নিতে জানালেন আংকেল। “এভাবেই হাঁটু গেড়ে বসে তোমার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাও।” তারপর নিজেও ম্যানফ্রেডের পাশে বসে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সর্বশক্তিমান ঈশ্বও, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই তরুণের মাঝে এতটা শক্তি দান করার জন্যে। ডান হাতটা যেন সরাসরি তোমার আশীর্বাদে ধন্য হয়ে এসেছে। যার জন্য সর্বদা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব প্রভু!”।

 এখনো ম্যানফ্রেডের মাথা ঘুরছে। চোয়াল ঘষে কোনোমতে তাও প্রার্থনা শেষে বলল, “আমেন।”

“কিছুদিনের মধ্যেই আমরা কাজ শুরু করব প্রভু। শেডের কাছে রিং বানিয়ে আমাদের এই সৎকর্মের প্রয়াসে তোমার সদা সহযোগিতা কামনা করছি যেন তোমার ভৃত্য ঢুডি বিয়ারম্যানের নজর থেকে এটাকে বাঁচাতে পারি।”

***

এরপর দেখা গেল বেশিরভাগ দিন বিকেলবেলাতেই স্ত্রীকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে কোনো এক খ্রিস্টভক্তের সাথে দেখা করার অজুহাতে বাড়ির বাইরে চলে আসেন আংকেল ট্রম্প। অন্যদিকে উইন্ডহক রাস্তার ধারের গাছের ঝাড়ের পিছনে খাকি শর্টস পরে প্রস্তুত হয়ে থাকে ম্যানি।

ট্রুডির অগোচরে ট্রাঙ্ক থেকে বহু পুরাতন একজোড়া গ্লাভস্ বের করে এনেছেন আংকেল। কিন্তু ম্যানফ্রেডের হাতে দিতেই নাকের কাছে তুলে মুখে বিতৃষ্ণার ভাব ফুটিয়ে তুলল ছেলেটা।

 “ঘাম রক্ত আর চামড়ার গন্ধ বাছা, বুক ভরে ঘ্রাণ নাও। এখন থেকে এটাই তোমার জীবন।”

খানিকক্ষণের জন্যে চোখে সেই হলুদ আলো জ্বলে উঠলেও হেসে ফেলল ম্যানফ্রেড,

“ভালোই। তেমন দুর্গন্ধ না।”

“এর চেয়ে ভালো আর কিছু নেই। বুঝলে।” একমত হয়ে শেডের নিচে বালুভর্তি কিটব্যাগের কাছে ওকে নিয়ে গেলেন আংকেল।

“শুরু করার জন্যে আমি তোমার বাম হাতের কাজও দেখতে চাই। এটাকেও শেখাতে হবে। যেন শক্তি আর সামর্থের অপচয় না ঘটে।”

দুজনে মিলে বানিয়ে ফেলেছেন রিং। কোনার পোলগুলোকে মাটিতে গেঁথে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে দিয়েছেন। তারপর মেঝের ওপর পেতে দিয়েছেন ক্যানভাস।

ম্যানফ্রেড আর আংকেল ট্ৰম্পের মধ্যকার এই বিশেষ সম্পর্কের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে পারবে না এই শর্তে শপথ নেয়ার পর প্রবেশাধিকার পেয়েছে সারাহ। যদিও ও কেবল লজ্জার মাথা খেয়ে ম্যানফ্রেডের পক্ষই নেয়।

এভাবে দুটো সেশন শেষ হবার পর দেখা গেল আংকেল ট্রম্প আঘাত না পেলেও স্টিম ইঞ্জিনের মত হাঁপাচ্ছেন। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে তাই ম্যানিকে জানালেন, “এভাবে চলবে না। হয় তোমার জন্য নতুন পার্টনার খুজতে হবে; নয়ত আমাকেই নতুন করে প্র্যাকটিস শুরু করতে হবে।”

 এরপর আবার সেই গাছের নিচে থেকে ঘোড়া নিয়ে ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরে আসেন আংকেল আর ম্যানফ্রেড।

যাই হোক, একেবারে যে কাজ হয়নি তা নয়। কাকতালীয়ভাবেই কয়েকদিন পর দেখা গেল যে আংকেলের কাধ আর বুকের নিচের চর্বির ভাজ উধাও হয়ে ফুটে উঠল শক্ত পেশি। ধীরে ধীরে রাউন্ডের সময় দুই থেকে বাড়িয়ে চার মিনিটে প্যাছালো। আর এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হল সারাহকে। সাথে আংকেল ট্ৰম্পের সস্তাদরের রুপালি পকেটঘড়ি।

এভাবে প্রায় একমাস কেটে যাবার পর আংকেল যেটা বলবেন বলে স্বপ্নেও ভাবেননি সেটাই মনে মনে স্বীকার করলেন “ওকে এখন অনেকটাই বক্সারদের মত দেখায়।” যদিও মুখে ম্যানফ্রেডকে বললেন, “এবারে গতি চাই। তোমাকে ঠিক মাম্বার মতই হতে হবে, র‍্যাটল স্নেকের মতই সাহসী।” দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী এই মাম্বা সাপ। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষকে কামড় দেবার চার মিনিটের মাঝে মেরে ফেলতে সক্ষম এই সাপের বিষ। অন্যদিকে র‍্যাটেলের সম্পর্কে লোকগাঁথা আছে যে, পুরুষাঙ্গের প্রতি এ প্রাণীর অন্যরকম দুর্বলতা আছে। তাই মুহূর্তের মধ্যে ছুটে এসে যে কোনো পুরুষ প্রাণী মানুষ কিংবা সিংহ, হাতি যাই হোক না কেন সবগুলোর পুরুষাঙ্গে আঘাত করে।

 “চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।” শেডের পেছনকার দেয়ালের সাথে লাগোয়া কাবার্ডের ঢাকনা খুলে চামড়া আর রাবারের তৈরি একটা জিনিস বের করে ম্যানফ্রেডের হাতে দিলেন আংকেল।

“এটা কী আংকেল ট্রম্প?”

“তোমার জন্য কেপটাউন থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি। চলো দেখাচ্ছি।”

তারপর খুলে ম্যানফ্রেডকে দেখালেন। দাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আংকেলের হাসি।

“কেমন হয়েছে?”

“এত সুন্দর উপহার এর আগে কেউ আর দেয়নি আমাকে। কিন্তু এটা কী?”

 “তুমি নিজেকে বার বলে দাবি করো অথচ স্পিড ব্যাগ চেন না?

“স্পিড ব্যাগ। এটা তো অনেক দামি!”

 “হুম। কিন্তু তোমার আন্টিকে বলতে যেও না আবার।”

“এটা দিয়ে আমরা কী করব?”

“দেখ তবে!” বলেই ফ্রেমের সাথে আটকানো ব্যাগটাতে একের পর এক ঘুষি চালালেন আংকেল। দুহাত একসাথে চালানোর ফলে খানিক পরেই হাঁপিয়ে উঠলেন।

“স্পিড বুঝলে, ঠিক মাম্বার মতই।”

আংকেল ট্ৰম্পের মহানুভবতা আর আগ্রহ দেখে যা বলতে চেয়েছিল তা বলতে গিয়ে শরমে মরে গেল যেন ম্যানফ্রেড। অথচ না বলে উপায়ও নেই। তাই বহুকষ্টে নিজের সমস্ত সাহস জড়ো করে কোনোমতে বলে ফেলল, “কিন্তু আমাকে তো যেতে হবে আংকেল।”

 অবাক হয়ে চোখে একগাদা অবিশ্বাস নিয়ে ওর দিকে তাকালেন আংকেল, “চলে যেতে হবে? তুমি আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবে?” গলার কাছে পেঁচানো তোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিলেন, “কেন?”

 “আমার পা। তিনদিনের ভেতরেই পা’র বিচার শুরু হবে। তাই আমাকে ওখানে যেতেই হবে আংকেল। তবে কথা দিচ্ছি, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার ফিরে আসব।”

 মুখ ঘুরিয়ে দৌড়াতে লাগলেন আংকেল ট্রম্প। সাথে সাথে এল ম্যানফ্রেড। ঘোড়র কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত আর কেউ কোনো কথা বলল না।

তারপর ঘোড়ার গাড়িতে বসে লাগাম টেনে সামনের হুইলের পাশে দাঁড়ানো ম্যানফ্রেডের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার নিজের যদি এরকম বিশ্বস্ত একটা ছেলে থাকত তবে বেশ হত।” দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলেন আংকেল।

পরের দিন সন্ধ্যায় ডিনার শেষ করে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে গ্যেটে পড়ছে ম্যানফ্রেড। এতটাই তন্ময় হয়ে ছিল যে কখন আংকেল ট্রম্প এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন সেটাও টের পায়নি। ম্যানফ্রেডের হাত থেকে বই নিয়ে রেখে দিলেন আংকেল, বললেন, “চোখ খারাপ হয়ে যাবে তো৷” ট্রুডি আন্টির ভয়ে বহু ঝামেলা করে মোমবাতির আলোকে ঢেকে এতক্ষণ পড়েছে।

তাড়াতাড়ি উঠে বসল ম্যানফ্রেড। আংকেলও পাশে এসে বসলেন। খানিক বাদে ম্যানফ্রেডের দিকে না তাকিয়েই বললেন, “আগামীকাল নিজের ফোর্ড নিয়ে টটেনবাক্ উইন্ডহকে যাচ্ছে। সাথে একশ’ টাকি থাকলেও তোমার জায়গা হয়ে যাবে। ট্রেনের চেয়ে সস্তা হবে বুঝলে।”

“ধন্যবাদ, আংকেল ট্রম্প।”

“শহরে বুড়ি এক বিধবা আছে, রাধেও ভালো। তুমি ওর কাছেই থাকবে। আমি চিঠি লিখে দিয়ে দিব।” কোটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ম্যানির কোলে রেখে দিলেন।

 ধন্যবাদ আংকেল।” এছাড়া আর কী বলা যায় ভেবে পেল না ম্যানফ্রেড। মন চাইল আংকেলের গলায় হাত ধরে খসখসে দাড়িতে মুখ ঘষে; কিন্তু কিছু না করে চুপ চাপ বসে রইল।

“অন্যান্য আরো খরচ আছে। জানি না এখানে কীভাবে ফিরবে। যাই হোক— আবার কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন একটা বের করে ম্যানফ্রেডের খোলা হাতের তালুতে রেখে দিলেন আংকেল।

চকচকে দুটো কয়েন দেখে মাথা নাড়ল ম্যানি

“আংকেল”।

“কিছু বলল না। বিশেষ করে তোমার আন্টিকে তো নয়ই।” এই বলে আংকেল উঠে দাঁড়ালেন আর এমন সময় তার শার্টের হাত ধরে ফেলল ম্যানফ্রেন্ড।

“আংকেল আমি আপনাকে এসব কিছুই পরিশোধ করে দিবো।”

“জানি তুমি পারবে। আনন্দ আর গর্বের মাধ্যমে হাজার গুন ফিরিয়ে দেবে কোনো একদিন।”

“না, না, অন্য কোনো দিন নয়। এক্ষুণি।”

বিছানা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে নেমে চারটা ইটের উপর দাঁড়ানো নিজের প্যাকিং কেসের ওয়ার্ডরোবের কাছে গেল ম্যানি। তারপর বাক্সের নিচে হাত ঢুকিয়ে হলুদ একটা ব্যাগ বের করে আবার আংকেলের কাছে ফিরে এল।

“এইবার, আপনার হাত বাড়িয়ে দিন, আংকেল।”

“যেন মজা পাচ্ছেন এমন ভঙ্গি করে বিশাল হাতের থাবা বাড়িয়ে ধরে হাসলেন আংকেল। “এখানে কী আছে?” কিন্তু সাথে সাথে হাসি বন্ধ কর যেন নিজের আসনে জমে গেছেন এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন ম্যানফ্রেডের দেয়া পাথরগুলোর দিকে।

“হিরে আংকেল ট্রম্প,” ফিসফিস করে উঠল ম্যানফ্রেড, “আপনাকে ধনী বানিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। যা চান সব কিনতে পারবেন।”

“তুমি এগুলো কোথায় পেয়েছ?” ঠাণ্ডা স্বরে জানতে চাইলেন আংকেল,

“তোমার কাছে কীভাবে এল?”

“আমার বাবা। উনিই আমার জ্যাকেটের সেলাইয়ের মধ্যে ভরে দিয়েছেন। বলেছেন এগুলো দিলে আমার পড়াশোনা আর যা যা প্রয়োজন সব হয়ে যাবে।”

 “তার মানে এই!” নরম হয়ে গেল আংকেলের গলা, “সংবাদপত্রে এ কয়দিন ধরে যা লিখছে সব সত্য। তোমার বাবা আসলেই ডাকাত। আর তুমিও তার সাথে ছিলে। তাই না? উত্তর দাও।” আচমকা চিৎকার করে উঠে বললেন, “ওর সাথে তুমিও ঠিক এই ভয়ংকর কাজটা করেছ?” ম্যানফ্রেডের শার্ট ধরে ঝাঁকুনি দিলেন আংকেল, “আমাকে বলো। সবকিছু খুলে বলল। সেই ইংরেজ নারীর উপর তোমার বাবা যখন আক্রমণ করে এসব চুরি করেছে তখন তুমিও ওর সাথে ছিলে?”

“না! না!” তীব্র বেগে মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড, “এসব সত্য নয়। বাবা। কখনো এমন কিছু করবে না। এগুলো আমাদের হিওে, বাবা আমাকে সব বলেছেন।”

 “ওর সাথে তুমি ছিলে কিনা সেটা বলো?” আরেকটা চিৎকার করে ম্যানিকে থামিয়ে দিল আংকেল।

“না, আংকেল। উনি একাই গেছেন। যখন ফিরে এসেছেন তখন দেখেছি যে মারাত্মকভাবে আহতও হয়েছেন। বাবার হাত –কব্জি–”

 “ধন্যবাদ ঈশ্বর।” উপরের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আংকেল। “ওই পাপী লোকটাই ওকে মন্দ পথে টেনে নিয়ে গেছে।”

“আমার বাবা পাপী নন।” জোরগলায় প্রতিবাদ জানাল ম্যানফ্রেড।

“বরঞ্চ উনার সাথেই প্রতারণা করা হয়েছে।”

“একদম চুপ।” ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন ট্রম্প বিয়ারম্যান, “তুমি যা বলছো তা ঈশ্বরের চোখে জঘন্য অপরাধ। এক্ষুণি এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”

ম্যানফ্রেডকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে কালো একটা কামারের নেহাইয়ের সামনে ঠেলে দিলেন। তারপর বললেন, “চুরি করা যাবে না। ঈশ্বর এটা হাজারোবার বলেছেন।” নেহাইয়ের ওপর একটা হিরে রেখে বললেন, “এই পাথরগুলো হল সেই পাপাত্ম ফল।” পাশের ব্ল্যাক থেকে চার পাউন্ডের স্নেজহ্যামার টেনে নামিয়ে ম্যানফ্রেডের হাতে ধরিয়ে দিলেন আংকেল,

“এগুলোকে এক্ষুণি ধ্বংস করে ফেলতে হবে।”

“ক্ষমা চেয়ে নাও। ঈশ্বরের দয়ার জন্য প্রার্থনা করো, তারপর ভেঙে ফেলো সব পাথর।”

হাতে হাতুড়ি নিয়ে হিরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানফ্রেড।

“ভাঙো; ঈশ্বরের নামে ভেঙে ফেলো সবগুলো। যেন তোমার পাপের বোঝা লাঘব হয়।”

 আস্তে আস্তে হাতুড়িটাকে উপরে তুলেও থেমে গেল ম্যানি। চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেল আংকেলের রক্তচক্ষু।

“তাড়াতাড়ি ভাঙো। এক্ষুণি।” ঠিক কাঠ কাটার সময় যেমন করে মাথার উপর ঘুরিয়ে আঘাত করে তেমনিভাবে হীরের ওপর হাতুড়ি নামিয়ে আনল ম্যানফ্রেড। চিনির চেয়েও উঁড়ো গঁড়ো হয়ে পাউডার হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল হিরে। কিন্তু দ্যুতি এতটুকু কমেনি। মোমবাতির আলোতে যেন মেঝেতে আগুন ধরে গেল। এভাবে একের পর এক পাথর এনে নেহাইয়ের ওপর রেখে দিলেন আংকেল।

মাঝরাতেরও পরে সমস্ত হিরে গুড়ো করে মেঝেতে সাদা ধুলার ওপর হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করল ম্যানফ্রেড আর ট্রম্প বিয়ারম্যান।

 “ও ঈশ্বর, তোমার এই তরুণ ভূত্যকে তার অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষমা করে দাও।”

 তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ম্যানফ্রেডকেও তুলে দাঁড় করালেন আংকেল। বললেন, “এখন বিছানায় যাও। আপাতত তোমার আত্মার মুক্তির জন্য যা যা সম্ভব করা হয়েছে।”

পোশাক খুলে কম্বলের নিচে শুয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড। কী মনে করে যেন আংকেল আবার জানতে চাইলেন, “যদি তোমাকে যেতে বারণ করি তারপরেও কি তুমি কাল সকালে উইন্ডহক যাবে?”

“আমার বাবা!” ফিসফিস করে উঠল ম্যানি।

“আমার কথা মান্য করবে না?”

 “জানি না আংকেল। আমার পা–”

“তুমি এরই মাঝে অনেক অনুতাপ করার মত কর্ম করে ফেলেছে। তাই অবাধ্যতায় আর কিছু যাবে-আসবে না। তাছাড়া তোমার বিবেক তোমাকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে যেতে তোমাকে কোনো বাধাও দিবো না। তবে তোমার নিজের আর আমার খাতিরে একটা কথা শোনো, উইন্ডহকে গিয়ে বিয়ারম্যান পদবী ব্যবহার করবে। ডি লা রে নয়। ঠিক আছে?”

***

“আজই রায়। যদিও আমি কখনো আগে থেকেই কোনো কেস সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করি না তারপরেও বলছি যে এই লোকের অবশ্যই ফাঁসি হবে। এই ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই।” সেনটেইন কোর্টনির মুখোমুখি বসে ঘোষণা করলেন আব্রাহাম।

 “আপনি এতটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে অ্যাবি?” ফ্রেঞ্চ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা স্বল্পবসনা সেনটেইন কোর্টনির কোমর আর নিতম্বের প্রশংসা না করে পারলেন না অ্যাবি। আনমনে তাই চুরুটে জোর টান দিয়ে বললেন,

 “প্রথমত লোকটার অপরাধের মাত্রা। পরিকল্পনা করে জঘন্য মনোভাবের সাথে তা বাস্তবায়ন করা। সামরিক স্থাপনাতে হামলা, ডাকাতি। পুলিশের ওপর গুলি আর গ্রেনেড ছোঁড়াসহ আরো বহু কিছু।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন। বাইরে বেশ শান্ত আর স্থির থাকলেও মনের গহীনে তিনি নিজেও অপরাধবোধে ভুগছেন। কেননা লোথারকে এই জঘন্য অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য পরিস্থিতি তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন।

“দ্বিতীয়ত” চুরুট সরিয়ে রাখলেন অ্যাবি, “লোকটার রেকর্ড। যুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতা আর বিদ্রোহের কারণে পুলিশ তার মাথার দামও ঘোষণা করেছিল।”

“কিন্তু যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য তো তাকে প্রধানমন্ত্রী আর আইন মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।”

 “তারপরেও এসব অপরাধ তার বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিবে।” সবজান্তার মত মাথা নাড়লেন অ্যাবি, “ক্ষমা পেয়েছিল বলেই আইনের অবজ্ঞা করায় বিচারকেরা এখন আরো বেশি ক্ষুব্ধ হবেন।”

 হাতের চুরুটটার ছাই পর্যবেক্ষণ করে অ্যাবি জানালেন, “তৃতীয়ত লোকটার মাঝে অনুতাপের লেশমাত্র নেই। লুটের মাল কোথায় রেখেছে সেটা নিয়ে কিছুতেই মুখ খোলেনি।”

হিরের কথা শুনেই সেনটেইনের মুখ কালো হয়ে যাওয়ায় অ্যাবি তাড়াতাড়ি বলে দিলেন বাকি পয়েন্ট “চতুর্থত, অপরাধের সবচেয়ে আবেগ উদ্রেককারী অংশটা হল সমাজের একজন গণমান্য নারীর ওপর হামলা।” আচমকা হো হো করে হেসে ফেললেন অ্যাবি, “যে নারী এমনই অসহায় যে নিজেকে বাঁচাতে নিরূপায় হয়ে লোকটার হাত কামড়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে আপনার সাহসও তার বিরুদ্ধেই যাবে।”

 হাতঘড়ি চেক করে দেখলেন সেনটেইন, “চল্লিশ মিনিট পরেই আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হবে। আমাদের ওঠা উচিত।”

তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন অ্যাবি, “পুরো ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি আসলে মুখিয়ে আছি।”

 “এখন না, অ্যাবি। তাকের ওপরে রাখা আয়নায় নিজের টুপি ঠিক করে নিলেন সেনটেইন। কালো কাপড়ের ভেইলটাকে এক চোখের উপর দিয়ে ছোট্ট কোনাটাকে কাত করে দিলেন। তারপর কুমিরের চামড়ার হ্যান্ডব্যাগকে বগলের নিচে নিয়ে বললেন, “আপনার কাছ থেকে আরও বিশদ কিছু শোনার আগে আসলেই কী হচ্ছে চলুন তা দেখি।”

 অ্যাবির ফোর্ডে চেপে পাহাড়ে উঠে এল দুজনে। আদালত প্রাঙ্গণের সামনে জড়ো হওয়া সাংবাদিকের দল সাথে সাথে ক্যামেরা নিয়ে চলে এল ফোর্ডের জানালাতে। হাতব্যাগ মুখের সামনে ধরে নেমে এলেন সেনটেইন। তবু সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে ছুঁড়ে দিল নানান প্রশ্ন,

“হিরেগুলোর বিষয়ে কি কোনো ডিল হবে?”

 “এ ব্যাপারে আপনার মনোভাব কী?”

দ্রুত এগিয়ে এসে সেনটেইনের কব্জি ধরে ভিড় থেকে সরিয়ে নিয়ে এলেন অ্যাবি।

“আমার জন্য এখানেই অপেক্ষা করুন” বলেই অ্যাবির হাত ছাড়িয়ে বারান্দা পার হয়ে লেডিস টয়লেটে চলে গেলেন সেনটেইন। এর ঠিক বিপরীত পাশেই ডিফেন্স রুম। কেউ পিছু নেয়নি নিশ্চিত হয়ে সোজা রুমে ঢুকে তীক্ষ্ণ গলায় জানালেন, “এক্সকিউজ মি জেন্টেলম্যান, আমি আপনাদের সাথে কয়েকটা কথা বলতে চাই।”

অ্যাবিকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন কয়েক মিনিট পরে ফিরে এসেও তাকে সেখানেই পেলেন সেনটেইন।

“কর্নেল ম্যালকমস এসেছেন” অ্যাবির মুখে কথাটা শোনার সাথে সাথে বাকি জগৎ বিস্মৃত হয়ে গেলেন লেডি কোর্টনি।

তাড়াতাড়ি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, “কোথায়?”

“আবার চলেও গেছেন।” অ্যাবির উত্তরের সাথে সাথে আদালতের জোড়া দরজা খুলে যাওয়ায় পিলপিল করে মানুষ ঢুকতে শুরু করল ভেতরে।

“চার্লি আমাদের জন্য সিট রেখে দিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে যাবার প্রয়োজন নেই।” অ্যাবি সেনটেইনের হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেলেন সামনে।

সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ব্লেইনের লম্বা-চওড়া অবয়ব খুঁজলেন সেনটেইন। প্রেসের লোকজন সরে যেতেই দেখা গেল তার বিপরীত পাশের সারিতেই বসে আছেন কর্নেল। তিনি নিজেও সেনটেইনকে খুঁজছিলেন। তাই পরস্পরের চোখে চোখ পড়া মাত্রই কোনো রকম হাসি বিনিময় ছাড়াই হয়ে গেল বিস্তর কথা।

“ওই তো এসে গেছে।” আচমকা অ্যাবির কথা শুনে মনে হল বুঝি ব্লেইনের কথা বলছেন; কিন্তু সেনটেইন চোখ তুলে দেখলেন যে ওয়ার্ডার লোথারকে নিয়ে এসেছে আদালতের ভেতরে।

 রঙচটা নীল শার্ট আর গাঢ় স্ন্যাকস পরিহিত লোথারকে বেশ দুর্বল আর বুড়ো মানুষের মতন দেখাচ্ছে। চুলগুলোও সব একেবারে সাদা হয়ে গেছে। দেহত্বক দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে কোনো প্রাণ নেই।

বেঞ্চে বসেও মাথা তুলে কোর্টরুমের ভেতরে কাকে যেন খুঁজলেন লোথার। চোখের মাঝে উদ্বেগ। কিন্তু এর পরপরই সেনটেইন স্পষ্ট দেখলেন লোথারের চোখে খুশির আনন্দ ফুটে উঠল। তার মানে কাক্ষিত মানুষটাকে পেয়ে গেছেন। গত পাঁচ দিন ধরেই একই দৃশ্য দেখছেন সেনটেইন। এবারে তাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন পেছনের মানুষগুলোর দিকে। কিন্তু লোথারকে যে কে আকর্ষণ করেছে তা বুঝতেই পারলেন না।

 “সাইলেন্স” নিজের আসন গ্রহণ করলেন বিচারক হর্থন। তিনি আর তার দুই সহকারীর কেউই অবশ্য ইংরেজ আদালতের মতন রঙিন উইগ লাগাননি। কেবল কালো গাউন আর সাদা নেকটাই পরেছেন। যাই হোক, থেমে গেল সব ফিসফিসানি, হাঁচি, কাশি।

সবাই দম বন্ধ উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী রায়ের জন্য। নিজ নিজ নোটবুকের ওপর কলম নিয়ে প্রস্তুত সাংবাদিকদের দল। লোথার নিজেও ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছেন। কিন্তু বিচারকের চেহারা দেখেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার চেহারা।

তবে এসব নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ করছেন না হন। তিনি তাঁর বিশাল নথি পড়েই চলেছেন। প্রথমে লোথারের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ সবিস্ত েির বর্ণনা করলেন। তিনটি হত্যাচেষ্টা, সশস্ত্র ডাকাতি আর দু’বার পরিকল্পিত আক্রমণের মত জঘন্য কাণ্ড। সব মিলিয়ে ছাব্বিশটি অভিযোগ পড়ে শোনানোর জন্য উনি বিশ মিনিট সময় ব্যয় করলেন।

এরপর ব্লেইন ম্যালকমসের দিকে তাকিয়ে কর্নেলকে ধন্যবাদ দিলেন তার উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য।

নিজের জায়গা থেকে বসে কর্নেলের স্পষ্ট অস্বস্তি ঠিকই টের পেলেন সেনটেইন। কেননা হর্থন তাকাবার সাথে সাথে গোলাপি হয়ে উঠল ব্লেইনের কানের ডগা।

এরপরই হর্থন তাকালেন তাঁর দিকে। সেনটেইনের বীরত্ব আর সাহসের প্রশংসা করে তার অবদানের জন্যও ধন্যবাদ জানালেন হন।

তিনি যখন কথা বলছেন সে সময় সেনটেইনের দিকে শক্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন লোথার। তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিজের হ্যান্ড ব্যাগের দিকে তাকালেন সেনটেইন।

অন্যদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। তাই তার আনীত প্রমাণও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই কর্নেল ম্যালকমস, সেনটেইন কোর্টনি ও পুলিশ বহিনীর সাক্ষ্য-প্রমাণকেই সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেয়া

মাথা ঘুরিয়ে হর্থনের দিকে তাকালেন লোথার। ছাব্বিশটি অপরাধের দায়ে লোথার ডি লা রেকে দন্ডিত ঘোষণা করলেন প্রধান বিচারক। সাথে সাথে আদালতকক্ষ জুড়ে শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন।

 সেনটেইনের পাশে বসে মাথা নাড়লেন অ্যাবি। “বলেছিলাম না, ফাঁসিই হবে। আর কোনো সন্দেহ নেই।”

 হট্টগোল শুনে প্রচণ্ড জোরে নিজের হাতুড়ি ঠুকে চিৎকার করে উঠলেন হর্থন, “চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে ডিফেন্সের পক্ষ থেকে আর কোনো ক্ষমা প্রার্থনা আছে কিনা শুনতে চাই।” সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন ডিফেন্সের তরুণ ব্যারিস্টার।

লোথার ডি লা রে নিজের ডিফেন্সের ব্যয় বহনে অক্ষম হওয়ায় আদালত থেকেই তার জন্য মিঃ রেজিনান্ড ওসমশুকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

“মাই লর্ড, মিটিগেশন কিংবা অপরাধ উপশমের জন্যে আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে হাজির করতে চাই।”

“মি, ওজমন্ড এই পর্যায়ে এসে আপনি নতুন করে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত করতে চাইছেন?” রেজিনাল্ডের কথা শুনে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন হর্থন, “ঠিক আছে, আপনাকে অনুমতি দেয়া হল।”

ধন্যবাদ মাই লর্ড” নিজের আসন্ন সফলতার আনন্দে এতই খুশি হলেন যে প্রায় চিৎকার করে ডাকলেন ওসমন্ড, “প্লিজ স্ট্যান্ডে আসুন মিসেস সেনটেইন ডি থাইরী কোর্টনি।”

সাথে সাথে যেন বিস্ময়ে জমে গেল পুরো কোর্টর রুম। এমনকি হর্থন পর্যন্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। কিন্তু সেনটেইন নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই সবাই এত হৈ-চৈ শুরু করে দিল যে, পুনরায় গর্জে উঠলেন হর্থন “এ ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি আমি কখনোই বরদাশত করব না। সবার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হবে। সাথে সাথে আবার শান্ত হয়ে গেল সবাই। এমনকি সাংবাদিকেরা পর্যন্ত নিজ নিজ আসনে বসে পড়ল।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সত্য বলার শপথ নিলেন সেনটেইন। উঠে এলেন মি. ওসমন্ড, “মিসেস কোর্টনি আপনি কি আদালতকে জানাবেন যে কতদিন ধরে অভিযুক্তকে চেনেন-” তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিয়ে বললেন, “অভিযুক্ত নয় বন্দি লোথার ডি লা রেকে কতদিন ধরে চেনেন?”

“প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে।” আড়চোখে লোখারের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন সেনটেইন।

“আপনাদের প্রথম সাক্ষাতের সময়টা কি দয়া করে ব্যাখ্যা করবেন?”

“১৯১৯ সালে প্রোটিয়া ক্যাসল ডুবে যাবার পর পানিতে ভেসে আমি স্কেলিটন উপকূলে চলে আসি। তারপর প্রায় দেড় বছর ধরে একদল স্যান বুশম্যানের সাথে পুরো কালাহারি মরুভূমিতে ঘুরে বেড়িয়েছি।”

 এই গল্প সকলেরই জানা। কিন্তু এখন সেনটেইনের নিজের জবানীতে রোমাঞ্চকর এই গল্প যেন চোখের সামনে মূর্ত হয়ে নবজীবন লাভ করল।

একে একে জানালেন তার হতাশা, একাকিতু আর ভয়ংকর পরিশ্রমের কথা। শুনে পিনপতন নীরবতা নেমে এল পুরো কক্ষে। সবাই যেন তার সাথে ঘুরে বেড়াল সেই মরুর বুকে। কোমরে বাঁধা শিশু পুত্রকে নিয়ে ঘোড়ার চিহ্ন ধরে ক্যাম্প ফায়ারের কাছে ছুটে গিয়ে সিংহের কবলে পড়ার কথা শুনে শিহরিত হল আদালতকক্ষে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। রোমহর্ষক সেই স্মৃতি স্মরণ করতেই আচমকা থেমে গেলেন সেনটেইন।

তাড়াতাড়ি করে তাগাদা দিলেন ওসমন্ড “সেই সময়ই কি লোথার ডি লা রে’র সাথে পরিচয় হয়?”

নিজেকে সামলে নিয়ে সেনটেইন জানালেন, “আমি দুঃখিত। আসলে সবকিছু এমনভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে যে নিজেকে ধরে রাখা

“প্লিজ মিসেস কোর্টনি, আপনি চাইলে আদালত আপনাকে সময়

“না, না, মাই লর্ড, এর কোনো প্রয়োজন নেই।” কাধ নেড়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন, “হ্যাঁ, সে সময়েই লোথার আসে। তার ক্যাম্পও ধারে-কাছে থাকায় সিংহের গর্জন শুনেই সতর্ক হয়ে উঠেছিল, ঠিক যখন সিংহটা আমার পায়ে নখর ঢুকিয়ে দিতে এসেছে তখনি গুলি চালায় প্রাণীটার ওপর।”

“তার মানে তিনি আপনার জীবন রক্ষা করেছিলেন।”

“হ্যাঁ, আমাকে আর আমার শিশুপুত্রকে নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।”

ঘটনার নাটকীয়তায় যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেল পুরো আদালতকক্ষ। মাথা নামিয়ে নিয়ে উত্তেজনাটা সবাইকে উপভোগ করার সুযোগ দিলেন মি. ওসমস্ত। তারপর খানিক বাদে জানতে চাইলেন,

 “এরপরে কী ঘটেছিল ম্যাডাম?”

“সিংহটা ছুটে এসে আমাকে গাছের উপর ছুঁড়ে দিয়েছিল। তাই বিশাল মোপানির উপর থেকে পড়ে গিয়ে আমার অবস্থাও ছিল মৃতপ্রায়। এরপরেও বহুদিন ধরে আমি অচেতন ছিলাম। নিজের কিংবা আমার ছেলের কোনো রকম দেখভালও করতে পারতাম না।”

“এক্ষেত্রে বন্দির প্রতিক্রিয়া কী ছিল?”

“উনিই আমার সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। আমার ক্ষত পরিষ্কার করতেন। আমার বাচ্চারও দেখাশোনা করেছেন।”

“তার মানে দ্বিতীয়বারের মত আপনার জীবন বাঁচিয়েছেন।”

“ইয়েস” মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন সেনটেইন।

“তো, এখন মিসেস কোর্টনি, এতগুলো বছর কেটে যাবার পরে বর্তমানে আপনি অত্যন্ত ধনী এক নারী?”

সেনটেইন চুপ করে রইলেন; ওসমন্ড বলেই চললেন, “হঠাৎ করেই তিন বছর আগে আমাদের বন্দি আপনার সম্মুখে উদয় হয়ে তার ফিশিং ও ক্যানিং এন্টারপ্রাইজের জন্য আর্থিক সহযোগিতার আবেদন করেন?”

 “উনি আমার কাছে নয়, আমার কোম্পানি কোর্টনি মাইনিং ও ফিনান্সের কাছে আবেদন করেন ঋণের জন্যে।”

এরপর একে একে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনার পর লোথারের ক্যানিং ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত এসে থামেন ওসমন্ড। “তো মিসেস কোর্টনি তার মানে লোথার ডি লা রে’র বিশ্বাস যে ইচ্ছেকৃতভাবে না হলেও আপনার কর্মকান্ডের মাধ্যমে উনার সাথে অন্যায় করা হয়েছে সেটা একেবারে অমূলক নয়?”

 দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন, “আমি সর্বদা ব্যবসায়ের নীতি মেনেই পদক্ষেপ নিয়েছি। যাই হোক, লোথার ডি লা রে’র অবস্থান থেকে অবশ্য আমার কর্মপন্থা ইচ্ছেকৃত বলেই মনে হবে।”

“আপনি উনাকে ধ্বংস করে ফেলেছেন এ ধরনের কোনো অভিযোগ কি তিনি তুলেছেন?”

চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে উঠলেন সেনটেইন।

“আয়্যাম সরি মিসেস কোর্টনি, আপনি কি একটু উচ্চস্বরে জানাবেন কী বলেছেন?”

ভয়ংকরভাবে ক্ষেপে উঠলেন সেনটেইন; গলা কাঁপিয়ে বললেন, “ইয়েস; তার ধারণা আমিই তাকে ধ্বংস করেছি।”

“মিঃ ওসমন্ড!” নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন হর্থন। তীব্রকণ্ঠে জানালেন, “আপনার সাক্ষীর সাথে আরো নমনীয় আচরণ করার জন্য আদেশ করা হচ্ছে। তারপর আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ঘোষণা দিলেন যে মিসেস কোর্টনির সুবিধার্থে কোর্ট ১৫ মিনিটের জন্য মুলতবি করা হল।

নির্দিষ্ট সময় শেষে আবারো কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালেন সেনটেইন। জেরা করার জন্যে উঠে এলেন মি. ওসমন্ড।

তৃতীয় সারি থেকে ব্লেইন ম্যালকমস হাসির মাধ্যমে সেনটেইনকে উৎসাহিত করতে চাইলেন; কিন্তু দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন সেনটেইন। নয়ত কোর্টরুমে উপস্থিত প্রতিটি লোক জেনে যাবে তার অনুভূতির কথা।

তবে ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝে গেলেন প্রতিদিন সকালবেলায় লোথার ডি লা রে’র চঞ্চল চোখ জোড়া কাকে খোঁজে। গ্যালারির একেবারে কোনার দিকে যেন লোথারেরই চোখ তার দিকে তীব্র হলুদ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। টোপাজ পাথরের মত হলুদ, ভয়ংকর আর উজ্জ্বল চোখ জোড়ার ওপর বাঁকানো দ্রু। কিন্তু এগুলোর মালিক লোথার নয়; তরুণ আর শক্তিশালী এই চেহারা কার তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলেন সেনটেইন কোর্টনি। নিজের ছোট ছেলেকে তিনি কখনোই দেখেননি। এমনকি তার ইচ্ছাতেই জন্ম নেবার সাথে সাথে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ওই ছোট্ট শরীর। হঠাৎ করেই নিজের সমস্ত সত্তাজুড়ে এমন এক শূন্যতা অনুভব করলেন যে, কেঁদে ফেললেন সেইটেইন।

“মিসেস কোর্টনি! মিসেস কোটনি!” হর্থনের চিৎকারে সচকিত হয়ে মাথা তুলে তাকালেন সেনটেইন।

“আপনি ঠিক আছেন তো মিসেস কোর্টনি?”

“ধন্যবাদ, মাই লর্ড, আমি পুরোপুরি সুস্থ।” বহু কষ্টে নিজেকে সামলালেন যেন ওই চেহারাটার দিকে আর চোখ না চলে যায়।

“তো মিসেস কোর্টনি, আপনি শটগান নিতে যাবার সময়েও কি উনি আপনাকে বাধা দেননি?”

“না।”

“আপনি আমাদেরকে এরই মাঝে জানিয়েছেন যে, শটগান হাতে নিয়ে অস্ত্রটাকে রিলোড করার চেষ্টা করেছিলেন?”

“কারেক্ট।”

“তাহলে রিলোড করতে পারলে কি অস্ত্রটাকে ব্যবহারও করতেন?”

“ইয়েস।”

“মানে আপনি হত্যা করার জন্যে গুলি করতেন?”

“এবারে অবজেকশন জানালো বাদী পক্ষের উকিল। হর্থনও জানালেন সেনটেইন চাইলে এ প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারেন। কিন্তু সেনটেইন উত্তরে পরিষ্কার কণ্ঠে জানালেন, “ইয়েস আমি তাকে খুন করতাম আর তিনিও জানেন যে সুযোগ পেলেই আমি তাকে মেরে ফেলব।”

উত্তেজনায় ফেটে পড়ল পুরো আদালতকক্ষ। আর এতসব হট্টগোলের মধ্যে চোখ তুলে গ্যালারির দিকে তাকালেন সেনটেইন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। ম্যানফ্রেড চলে গেছে। কারণটা কিছুতেই অনুমান করতে পারলেন সেনটেইন। এদিকে ওসমন্ড আবার প্রশ্ন শুরু করায় সেদিকে মনোযোগ দিতেও বাধ্য হলেন। তবে প্রশ্নটা খেয়াল না করায় বললেন, “আমি বুঝতে পারছি না।” “বন্দি কি আপনার ওপর প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছেন যেন তাকে গুলি ছুঁড়তে না পারেন?”

“না। কেবল শটগানটাকে সরিয়ে নিয়েছে।”

“আর তারপরেই আপনি তার কব্জি কামড়ে দিয়েছেন। প্রথমে যেখানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে ও পরবর্তীতে হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু পালাবার সময়ে উনি কি আপনার কোনো ক্ষতি করে গিয়েছিলেন।”

“না।“

“ব্যথা তো নিশ্চয় অত্যন্ত তীব্র ছিল। তারপরেও তিনি আপনার কোনো রকম ক্ষতি করে নি?”

“না, মাথা নাড়লেন সেনটেইন,

“বরঞ্চ সে–” উপযুক্ত শব্দ খুঁজলেন, যেন সঠিক কী বলবেন পাচ্ছেন না, তারপর জানালেন,

 “অদ্ভুত রকমের ভদ্র আচরণ করেছে।”

“ঠিক আছে। এবার বলুন, বন্দি সে স্থান ত্যাগের পূর্বে আপনার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানি কি রেখে গিয়েছিলেন?”

“হুম। চেক করে দেখেছেন যেন আমি পর্যাপ্ত পানি পাই আর এও বলেছেন যেন উদ্ধারকারী দল আসা পর্যন্ত ভাঙা গাড়িটার কাছ থেকে দূরে না যাই।”

“এবারে মিসেস কোর্টনি খানিকটা আমতা আমতা করে উঠলেন। ওসমন্ড। “সংবাদপত্রে এসেছে যে, বন্দি নাকি আপনার সম্মানে আঘাত করে এমন আচরণ-”।

তেড়ে উঠলেন সেনটেইন, “এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা আর বানোয়াট।”

  “ধন্যবাদ ম্যাডাম। আমার আর একটা মাত্র প্রশ্ন আছে। আপনি তো বন্দিকে ভালোভাবেই চেনেন। তাকে কখনো গুলি করতে দেখেছিলেন?”

“দেখেছি।”

“আপনার বরাত দিয়েই বলছি, যদি বন্দি চাইতেন তাহলে অনায়াসেই আপনি কিংবা কর্নেল ম্যালকম অথবা পুলিশ বাহিনির যে কাউকে গুলি করতে পারতেন?”

 “লোথার ডি লা রে’র মত এতটা দক্ষ বন্দুকবাজ আমি খুব বেশি দেখিনি। কয়েকবারই এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে উনি চাইলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারতেন।”

“আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, মাই লর্ড।”

নিজের নোটপ্যাডে খানিকক্ষণ খসখস করে লিখে পেনসিল সরিয়ে রাখলেন হর্থন। তারপর বাদীপক্ষের উকিলের কাছে জানতে চাইলেন, “আপনি কি সাক্ষীকে ক্রস একজামিন করতে চান?”

গোমড়া মুখ করে উঠে দাঁড়ালেন প্রসিকিউটর। তারপর বললেন, “না। মিসেস কোর্টনির জন্য আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।”

মিসেস কোর্টনি, আপনার আনীত প্রমাণের জন্য আদালত আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। এখন আপনি নিজ আসনে গিয়ে বসুন।”

আরো একবার গ্যালারির দিকে তাকিয়ে ছেলেকে দেখার জন্য সেনটেইন এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠলেন যে, নামতে গিয়ে বেঞ্চে পা বেঁধে পড়ে গেলেন। সাথে সাথে যার যার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অ্যাবি আর কর্নেল ব্লেইন। আব্রাহামই আগে সেনটেইনের কাছে পৌঁছে অতঃপর হাত ধরে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে।

 “অ্যাবি” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন, “আমি যখন বয়ান দিচ্ছিলাম তখন গ্যালারিতে একটা কিশোর ছেলে ছিল। আমি বর্ণনা দিচ্ছি। সোনালি চুল, বয়স তের হবে, যদিও সতের দেখায়। নাম ম্যানফ্রেড, ম্যানফ্রেড ডি লা রে, আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।”

“এখন?” অবাক হয়ে গেলেন অ্যাবি।

“এক্ষুণি।”

“কিন্তু চূড়ান্ত রায় মিস্ করে ফেলব তো।”

“গো!” ফোঁস করে উঠলেন সেনটেইন, “ছেলেটাকে খুঁজে বার করুন। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ত্রস্ত ভঙ্গিতে কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন আব্রাহাম।

আবার উঠে দাঁড়ালেন রেজিনাল্ড ওসমন্ড। সেনটেইনের বাক্যসমূহের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে আবেগপ্রবণ ভাষায় জানালেন, “বন্দির বিশ্বাস যে তিনি মিসেস কোর্টনির দাক্ষিণ্য পাবার যোগ্য।” এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে কেন লোথারকে দয়াশীলতা দেখানো উচিত তার ওপরে বক্তৃতা দিলেও সেনটেইন বাবার চেয়ে বেশি ছেলেকে নিয়েই ভাবছেন। ওর চোখের দৃষ্টিতে এমন এক ঘৃণা ছিল যা তিনি চাইলেও ভুলতে পারছেন না আর ম্যানফ্রেডের সেই তাকেই অভিযুক্ত করেছে অপরাধী হিসেবে। বহু বছর ধরেই যে অপরাধীকে তিনি মাটিচাপা দিয়ে রেখেছেন।

বুঝতে পারছেন কেন এতদিন স্বার্থপরের মত ছেলের চেহারা না দেখে থেকেছেন। কারণ মাতৃহৃদয় ভালোভাবেই জানে যে ওই মুখ দেখার সাথে সাথে এত কষ্ট করে গড়ে তোলা অবরোধ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। আর ঠিক তখন রেজিনাল্ড ওসমন্ড তার সবশেষ আর্তি পেশ করলেন।

“লোথার ডি লা রে’র বহু কর্মই তাকে একজন সৎ আর সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে মাই লর্ড, যদিও উনার সাজা অনেক তীব্র হওয়া উচিত তথাপি আমি সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আকুতি জানাব যেন এই অঙ্গ হারানো দুর্ভাগা মানুষটার প্রতি দয়া দেখানো হয়।”

আবারো নিশুপ হয়ে গেল পুরো কক্ষ। এভাবে বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে যাবার পর চোখ তুলে তাকালেন হর্থন, বললেন

“ধন্যবাদ মি. ওসমন্ড। দুপুর দুইটা পর্যন্ত কোর্ট মুলতবি করা হল। তারপর রায় ঘোষণা করা হবে।”

তাড়াহুড়া করে কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে অ্যাবিকে খুঁজলেন সেনটেইন। কোর্ট হাউজের সামনের দিকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুলিশের গার্ডদের সাথে কথা বলছিলেন আব্রাহাম। কিন্তু সেনটেইনকে দেখার সাথে সাথে দৌড়ে এলেন। “খুঁজে পেয়েছেন ওকে?” উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“অ্যায়াম সরি! কিন্তু এরকম চেহারার কেউ নেই এখানে।”

“যেভাবেই হোক ছেলেটাকে খুঁজে বার করুন অ্যাবি। যত টাকা লাগে খরচ করুন। পুরো শহরে খুঁজে দেখুন। ছেলেটাকে আনা চাই।”

 “অল রাইট, সেনটেইন। আমি দেখছি কী করা যায়। ওর নাম বললেন ম্যানফ্রেড ডি লা রে, বন্দির কিছু হয় নাকি?” .

“ওর ছেলে।”

“ঠিক আছে।” তারপর চোখে গভীর দুর্ভাবনা নিয়ে সেনটেইনের দিকে তাকালেন অ্যাবি, “আমি কি জানতে পারি কেন এত মরিয়া হয়ে ছেলেটার সাথে দেখা করতে চাইছেন?”

“না, পারেন না।”

 অ্যাবি চলে যেতেই আপন মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন সেনটেইন, “কেন আমি ওকে দেখতে চাই” কারণটাও বেশ স্পষ্ট, “কারণ ও আমার ছেলে।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *