৩. সকালবেলা ক্যাম্প গুটিয়ে

পরের দিন সকালবেলা ক্যাম্প গুটিয়ে রাখার জন্য পরিচারকদের রেখে বিরস বদনে নিজ নিজ ঘোড়ায় চেপে মাইনের পথ ধরল শাসা আর তার মা। দুপুরে খানিক কাটা ঝোঁপের নিচে বিশ্রাম নিলেও ক্রমেই সূর্যের তাপ বেড়ে যাওয়ায় ঘোড়া নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে চলে এল দুজনে।

হঠাৎ করেই সিধে হয়ে বসে হাত দিয়ে চোখের ওপর ছায়া বানিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল শাসা।

“কী হয়েছে সোনা?”

অ্যানালিসা ওকে এই পাথুরে খাদের ভেতরেই নিয়ে এসেছিল।

“কিছু একটা তোমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।” সেনটেইনের কথা শুনেই শাসার মন চাইল মাকে পাহাড়ে দেবতার মন্দিরে নিয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটার কাছে করা শপথের কথা মনে হতেই আবার থেমেও গেল।

“আমাকে বলতে চাইছে না?” ছেলের চেহারা দেখেই মনের ভাব আঁচ করে ফেলেছেন সেনটেইন।”

মাকে বললে কিছু হবে না। মনে হবে কোন আগন্তুককেই বলছি, আপন মনে খানিক ভেবে-চিন্তে গড়গড় করে মাকে সবকিছু উগরে দিল শাসা, “উপরের খাদের ভেতরে এক বুশম্যানের কংকাল আছে। তোমাকে দেখাব?”

বিবর্ণ হয়ে গেল সেনটেইনের চেহারা, “কী বললে? একটা বুশম্যান? কীভাবে জানলে যে বুশম্যানেরই কংকাল?” ফিসফিস করে জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“খুলির গায়ে এখনো চুল লেগে আছে, কিউয়ি আর ওর গোত্রের লোকদের মত চুল।”

“কীভাবে খুঁজে পেয়েছে এই জায়গা?”

 “অ্যানা-” বলতে গিয়েও অপরাধবোধে চুপ করে গেল শাসা।

“মেয়েটা তোমাকে দেখিয়েছে?

 “হ্যাঁ।” চোখ নামিয়ে নিল শাসা।

“আবার খুঁজে বের করতে পারবে?” ফিরে এল সেনটেইনের মুখের রঙ। আর কেমন যেন উত্তেজিতও হয়ে উঠল।

“হ্যাঁ বোধ হয় পারব। জায়গাটাতে চিহ্ন দিয়ে রেখেছি।” মুখ তুলে চূড়ার দিকে তাকিয়ে জানাল শাসা।

“চলো আমাকে নিয়ে যাও।” আদেশ দিলেন সেনটেইন।

 “ঘোড়া রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হবে কিন্তু।”

তবে উঠতে গিয়ে জান বের হয়ে যাবার দশা। প্রচণ্ড গরম আর কাঁটা ঝোপে লেগে ছিঁড়ে গেল হাত-পা।

খানিক বাদে মাতা-পুত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে খুঁজতে লাগল। শিস দিয়ে আর নাম ধরে ডেকে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখল যেন হারিয়ে না যায়।

হঠাৎ করেই শাসার ডাকে আর কোনো সাড়া দিচ্ছেন না সেনটেইন। ছেলেটা তো চিন্তায় পড়ে গেল।

“মা, তুমি কোথায়?

 “এই তো! এখানে!” মনে হচ্ছে সেনটেইন ব্যথা পেয়েছেন।

গলার আওয়াজ অত্যন্ত অস্পষ্ট। তাড়াতাড়ি পাথর ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে গেল শাসা। সূর্যের আলোয় মাকে দেখে মনে হচ্ছে তার গায়ের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। মাথার টুপি খুলে কোমরের কাছে ধরে রেখেছেন। গাল দুটোও ভেজা। প্রথমে শাসার মনে হল ঘাম। কিন্তু না একটু পরেই বুঝতে পারল মা কাঁদছেন।

“মা?” আস্তে আস্তে মা’র পেছনে এসে দাঁড়াল শাসা। বুঝতে পারল মা মন্দিরটা খুঁজে পেয়েছেন।

ডালপালা কাঁচের জার সব সরিয়ে ফেললেন সিনটেইন। তাই দেখে ভয় পেল শাসা।

“অ্যানালিসা বলেছে এটা নাকি এক জাদুকরের কংকাল।”

 কিছু না বলে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

“অ্যানা আরো বলেছে এই জাদুকর নাকি সবার একটা করে ইচ্ছে পূরণ করে।”

 “হানি” দম বন্ধ করে যেন নামটা উচ্চারণ করলেন সেনটেইন, “আমার অত্যন্ত প্রিয় বুড়ি মা।”

“মা!” সেনটেইন কাঁপতে থাকায় মায়ের কাধ ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করল শাসা। “তুমি কীভাবে জানো?”

ছেলের বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেও কোনো উত্তর দিলেন না সেনটেইন।

“পুরো পাহাড়ের গুহায় হয়ত এমন আরো শত শত কংকাল আছে।” নাছোড়বান্দার মত তীব্র বেগে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

“এটা হানি।” দুঃখে কষ্টে বুজে আসতে চাইছে সেনটেইনের গলা। “এই তো উটের হাড়ের থেকে তৈরি পুঁতি লাগানো আছে পোশাকে।” এতক্ষণে ধুলার মাঝে অর্ধেক ঢেকে রাখা শুকনো চামড়ার ফালিটাকে দেখতে পেল শাসা। “আমার কোনো প্রমাণেরও দরকার নেই। কারণ আমি জানি ও হানি।”

“বসো মা।” মাকে ধরে পড়ে থাকা একটা পাথরের ওপর বসিয়ে দিল শাসা।

“আমি ঠিক আছি। আসলে হঠাৎ করে চমকে উঠেছি। বছরের পর বছর ধরে ওকে খুঁজেছি, জানতাম ওকে কোথায় পাওয়া যাবে।” চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে কী যেন দেখলেন সেনটেইন, “ওয়ার দেহও নিশ্চয় এখানেই আশপাশে কোথাও আছে।” চোখ তুলে উপরের গির্জার ছাদের মত ঝুলে থাকা চূড়ার অংশের দিকে তাকালেন সেনটেইন,

“দুজনেই শয়তানটার বন্দুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য বোধ হয় ওখানে এসে লুকিয়ে ছিল। একসাথেই নিচে পড়েছে।”

“কে ওদেরকে গুলি করেছে মা?” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় সেনটেইন জানালেন, “লোথার। লোথার ডিলা রে!”

***

তারপর পুরো একঘণ্টা ধরে খাদের তলায় আর আশপাশে দ্বিতীয় কংকালের খোঁজ করল শাসা আর সেনটেইন। কিন্তু অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন, “নেই। থাক তাকে এভাবেই পড়ে থাকতে দাও শাসা, কেউ যেন বিরক্ত না করে।”

 ছোট্ট পাথুরের মন্দিরটা থেকে নিচে নেমে এল দু’জনে। ফেরার সময় তুলে আনল বুনোফুল।

 “প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছে দেহাবশেষ তুলে সুন্দরভাবে সমাধিস্থ করি।” মন্দিরের সামনে আবার হাঁটু গেড়ে বসে ফিসফিস করে জানালেন সেনটেইন, “কিন্তু হানি তো খ্রিস্টান নয়। এই পাহাড়ই তাঁর পবিত্র ভূমি। এখানেই সে শান্তিতে থাকবে।”

যত্ন করে ফুলগুলোকে সাজিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।

“তোমাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে আমি সে ব্যবস্থা করব প্রিয়তম মাতামহ। আবার তোমার কাছে আসব।” শাসার হাত ধরলেন সেনটেইন। একসাথে উঠে এসে বসলেন নিজ নিজ ঘোড়ার পিঠে।

***

পরের দিন সকালবেলা নাশতার সময় মোটামুটি সহজ হয়ে গেলেন সেনটেইন। যদিও চোখের নিচে অনিদ্রার গাঢ় কালি লেগে আছে; ছেলেকে জানালেন, “কেপটাউনে ফেরার আগে এটাই এখানে আমাদের শেষ সপ্তাহ।”

“ইশ, এখানেই যদি থেকে যেতে পারতাম।”

“এটা তো বেশ দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তোমাকে তো স্কুলে যেতে হবে। আর আমারও অনেক দায়িত্ব আছে। তবে আমরা আবার ফিরে আসব, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। এই শেষ সপ্তাহে তুমি ওয়াশিং প্লান্ট আর সেটিং রুমে কাজ করবে। দেখো বেশ ভালো লাগবে।”

 আর মা যে কতখানি সত্যি তো বলাই বাহুল্য। মুগ্ধ হয়ে শাসা দেখে কীভাবে ধীরে ধীরে সচল কনভেয়ার বেল্টে করে মিল হাউজের চূর্ণ পাথর এনে ওয়াশিং প্লান্টে ফেলা হয়। তারপর ধাপে ধাপে প্রকৃত নুড়িগুলোকে আলাদা করে গ্রিজের ড্রামে ধোয়া হয়। ভেজা নুড়িগুলো সহজেই উপরে উঠে আসে। কিন্তু হিরে শুকনো থাকে আর এটাই হল এর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হিরে যখনই গ্রিজের গায়ে লাগে তখনই পোকার মত আটকে যায়। বিস্ময়ে শাসার চোখ সরে না। পুরো সকাল এভাবেই একটা থেকে আরেকটা বিশাল বড় বড় হলুদ ড্রামের পাশে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেয় শাসা।

সবশেষে ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস এসে প্রত্যেকটা হীরেকে ওজন করে দেখেন। তারপর সাথে সাথে আবার চামড়ায় মোড়ানো খাতায় লিখে রাখেন সে হিসাব।

“তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ মাস্টার শাসা কোনো পাথরই হাফ ক্যারটের কম নয়।”

“হ্যাঁ স্যার”, ব্যাপারটা নিয়ে তো ভাবেইনি শাসা, “তাহলে ছোট পাথরগুলোর কী হয়?”

“গ্রিজের গায়ে আটকে থাকার জন্য ন্যূনতম একটা ওজন লাগে। অনেক সময় অনেক বড় বড় হীরেও কিন্তু নুড়ি পাথরের সাথে বেরিয়ে যায়। তাই হাত দিয়ে প্রতিটি পাথর চেক করে দেখতে হয়। এই কাজে অবশ্য মেয়েরাই ভালো। তাদের ধৈর্য আছে আর চোখও তীক্ষ্ণ।”

জোনস লম্বা একটা রুমে শাসাকে নিয়ে এলেন যেখানে পুরো রুম জুড়ে একটাই টেবিল; বালতি বালতি ভেজা পাথর এনে টেবিলের ওপর ফেলা হয়। আর নারী শ্রমিকরা তা থেকে হীরে বাছাই করে।

অতঃপর শিফট শেষে জোনসের সাথে ফোর্ডে চড়ে অফিস ব্লকে চলে এল। শাসা। কোলের ওপর রাখা ছোট্ট স্টিলের বাক্সটাতে রয়েছে আজ দিনের সংগ্রহ।

ওদের অপেক্ষাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সেনটেইন। জোনস আর শাসাকে নিজের অফিসে নিয়ে গেলেন। “তো, তোমার ভালো লাগেনি?”

শাসার কাছে জানতে চাইলেও ছেলের উত্তেজনা দেখে হেসে ফেললেন।

“অসাধারণ মা, আর দেখ আমরা কী এনেছি। ছত্রিশ ক্যারেট, কিমন দৈত্যকার একটা হিরে দেখেছো?!” টেবিলের ওপর বক্স রাখতেই ডালা খুলে দিলেন জোনস। শাসা এত গর্বভরে মাকে হিরেটা দেখাল যেন সে নিজ হাতে খনি থেকে তুলে এনেছে।

 “সত্যিই বেশ বড় একমত হলেন সেনটেইন। “কিন্তু রঙটা তেমন নিখুঁত নয়। আলোর সামনে ধরে দেখো হুইস্কি আর সোডার মত বাদামি। ভেতরের কালো দাগগুলো তো খালি চোখেও দেখা যাচ্ছে।”

শাসার আনা হিরের এত খুঁত বের হয়েছে দেখে মনমরা হয়ে গেল ছেলেটা। দেখে হেসে ফেললেন সেনটেইন, “ড, জোনস, ভল্টটা খুলবেন প্লিজ? ওকে কয়েকটা সত্যিকারের নিখুঁত হীরে দেখানো যাক।”

 ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একগোছ চাবি বের করে শাসাকে বারান্দার শেষ মাথার স্টিলের দরজার কাছে নিয়ে এলেন জোনস। তারপর তালা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন আন্ডারগ্রাউন্ডের ভল্টে। শাসার সামনেও পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে গোপন কম্বিনেশন নাম্বার ঘোরাতে ভুল করলেন না।

“ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড পাথরগুলোকে এসব পাত্রে রাখা হয়। এভাবে হাই গ্রেড় হিরেকে একেবারে আলাদা সযত্নে সংগ্রহ করা হয়।” স্ট্রংরুমে হাঁটতে গিয়ে দু’পাশে সারিবদ্ধ পাত্র দেখালেন জোনস।

এরপর ভল্টের ভেতরের দেয়ালের গায়ে লাগানো ছোট্ট স্টিলের দরোজাটা খুলে পাঁচ সংখ্যার বাদামি কাগজ মোড়ানো প্যাকেট তুলে নিলেন।

“এগুলোই হচ্ছে আমাদের শ্রেষ্ঠ হিরে।” শাসার হাতে প্যাকেট তুলে আবার একের পর এক দরজা আটকে উপরে উঠে এলেন দু’জনে।

সেনটেইন অফিসেই ছিলেন। শাসা এসে মায়ের হাতে প্যাকেট দিতেই খুলে ফেললেন।

আর বিশাল সব হিরের দ্যুতি দেখে শাসার রীতিমত দম বন্ধ হবার জোগাড়।

“মাই গড! মা! অবিশ্বাস্য!”

“চলো এবার ড, জোনসের কাছে এ সম্পর্কে কিছু শুনি।” স্মিত মুখে বসে রইলেন সেনটেইন।

“ওয়েল মাস্টার শাসা, এটা একেবারে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটা হিরে যেটার আটটা কোনো আছে। আরেকটা আছে যেটার বারোটা মাথা। কিন্তু কতটা নিখুঁত গোল আর আকারহীন দেখেছো। তাই বুঝতে পারছো কতটা বিভিন্ন র ীতে আসে এই হীরে।” কয়েকটা হীরে দেখিয়ে শাসাকে বুঝিয়ে বললেন জোনস। কিন্তু তার নিজের বিষণ ভাব কেন যেন এতটা সম্পদ হাতে নিয়েও একটুও কমল না।

“তবে কেটে পলিশ করার পর এই তেলতেলে আভাটাও চলে যাবে।”

 “এটার ওজন কত?” জানতে চাইল শাসা।

 “আটচল্লিশ ক্যারট।” রিকোভারী বই দেখে জানালেন সেনটেইন।

“কিন্তু মনে রেখ, কেটে পলিশ করার পর কিন্তু এর এই ওজনের অর্ধেকও থাকবে না।”

“তখন এটার দাম কত হবে?” টুয়েন্টিম্যান জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“অনেক অনেক টাকা, মাস্টার শাসা।” সৌন্দর্যের পূজারিণী হিসেবে এর ওপর আর্থিক মূল্যের বোঝা চাপাতে পছন্দ করেন না জোনস; তাই আবার নিজের লেকচার শুরু করলেন, “এবার তোমাকে দেখাব কীভাবে পাথরের রঙের তুলনা

 জানালার বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। কিন্তু সেদিকে কারো হুশ নেই। রুমের বাতি জ্বেলে দিলেন সেনটেইন। এভাবে আরো এক ঘণ্টা ধরে মনোযোগ সহকারে হিরের বিভিন্ন দিক বুঝিয়ে বললেন জোনস। শাসা নিজেও প্রশ্ন করে অনেক কিছু জেনে নিল। অতঃপর হিরেগুলোকে প্যাকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালেন জোনস।

কী মনে হতেই সুউচ্চ কণ্ঠে আওড়াতে লাগলেন বাইবেলের পঙক্তি; খেয়াল হতেই আবার তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে নিলেন বাকিদের কাছে, “ফরগিভ মি, আমার যে কী হয়েছে হঠাৎ করে।”

“এজিকিয়েল?” আদুরে ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন।

“আটাশ অধ্যায় তের আর চৌদ্দ পঙক্তি।” মাথা নেড়ে চোখ নামিয়ে নিলেন জোনস; এই নারীর জ্ঞানে সত্যিই সে মহা মুগ্ধ হয়েছে।

 “ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস” পথ আঁকড়ে ধরল শাসা, আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি। এ পাথরগুলোর মূল্য কত?”

 “তুমি কি পুরো প্যাকেজের দাম জানতে চাইছো?” অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন জোনস।”

“ইয়েস স্যার। আমাকে বলুন কত দাম হবে।”

“ওয়েল, ডি রিয়ারস যদি আমাদের শেষ প্যাকেজের সমমূল্যের অর্থ প্রদান করে তাহলে এক মিলিয়ন পাউন্ডের বেশিই হবে।” কাতর ভঙ্গিতে অংকটা জানালেন জোনস।

“এক মিলিয়ন পাউন্ড?”

শাসার হতভম্ব ভাব দেখে মনে মনে চিন্তিত হলেন সেনটেইন। ভাবলেন যাক, কোনো সমস্যা নেই। ওকে আমিই শেখাব। ছেলেকে বললেন,

“মনে রেখ শাসা, এটার পুরোটাই কিন্তু লাভ নয়। খরচ মেটাতে হবে। তারপর ট্যাক্স কালেকটরদের খায়েশ মেটাতে হবে।”

হঠাৎ করেই মাথায় একটা আইডিয়া আসাতে তাড়াতাড়ি ডেস্ক ছেড়ে উঠে এলেন সেনটেইন।

“আপনি তো জানেন আমি আর শাসা শুক্রবারে উইন্ডহক যাচ্ছি। তাই হিরেগুলো আমিই ব্যাংকে নিয়ে যাবো ডেইমলারে করে”।

“মিসেস কোটনি।” আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন জোনস। “আমি এতটা কিছুতেই অনুমতি দিতে পারব না। হায় ভগবান, পুরো এক মিলিয়ন অর্থের সমমূল্যের হিরে। নিজেই যদি রাজি হই তাহলে নিজেই অপরাধ করব।” সেনটেইনের অভিব্যক্তি বদলে যেতেই চুপ করে গেলেন জোনস। এই নারীকে তিনি ভালোভাবেই চেনেন। জানেন তাকে চ্যালেঞ্জ করে কতবড় ভুল করেছেন। তাই তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্য বললেন, “আমি কেবল আপনার কথাই চিন্তা করছি। হাজার হাজার মাইল জুড়ে এত বহু মূল্যবান হিরে নিয়ে ভ্রমণ করা মানে হল ডাকাতদেরকে সেধে ডেকে আনা।”

 “কিন্তু আমার কাছে হিরে আছে তা সবাই টের পাবে কীভাবে? আমি তো ঢাক ঢোল পিটিয়ে কাউকে বলতে যাচ্ছি না।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালেন সেনটেইন।

“ইস্যুরেন্স” অবশেষে সঠিক শব্দটা খুঁজে পেয়েছেন জোনস। “যদি সশস্ত্র পাহারা ব্যতীত প্যাকেজের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তো ইস্যুরেন্স সেটা কাভার করবে না। আপনি কি সত্যিই এতটা ঝুঁকি নিতে চান?”

এমন একটা যুক্তি ছুঁড়ে দিয়েছেন যা হয়ত সেনটেইনকে কাবু করতে পারে। ব্যাপারটা নিয়ে খানিক ভেবে তাই সেনটেইন কাধ ঝাঁকাতেই স্বস্তি পেলেন জোনস।

“ওহ, ঠিক আছে ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস, আপনি আপনার মত কাজ করুন।”

***

মরুভূমির বুক চিরে হানি মাইনে যাবার রাস্তা লোথার নিজ হাতে খুঁড়েছেন। এখানকার প্রতিটা মাইলে এখনো লেগে আছে তার ঘাম। তবে এসব কিছুই সেই বারো বছর আগেকার কথা। তারপরেও কয়েকটা পয়েন্টের কথা স্পষ্ট মনে আছে যাতে করে তার পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।

গারহার্ড ফুরির সাথে দেখা করার পর দ্বিতীয় দিন সকালবেলা এরকমই একটা স্থানে পৌঁছালেন লোথার। এখানে পাথর ফেলে হিরের ট্রাকের রাস্তা আটকানোর পাশাপাশি শুকনো নদীবক্ষের বালির নিচে ঘোড়াদের জন্য পানিও পাওয়া যাবে।

 আবার জায়গাটা এতটাই বিচ্ছিন্ন যে পুলিশে খবর দিলে, বাহিনি নিয়ে আসতেই লোথাররা পালিয়ে যাবার যথেষ্ট সময় পাবেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে হেনড্রিককে জানালেন, এখানেই আমাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে।”

টেলিগ্রাফ লাইনের কাছেই নদীতীরে প্রাথমিকভাবে তাবু খাটানো হল। এরপর পিলারে উঠে মেইন টেলিগ্রাফ লাইনের সাথে নিজের ইয়ারফোন জয়েন্ট করে নিলেন লোথার। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো একঘেয়ে হলেও হানি মাইনের কোনো মেসেজই তিনি মিস করতে চান না। তাই দিনের বেলা উত্তপ্ত মরুভূমির গরমে বসে বসে নোটবুকে তুলে নেন সমস্ত ডটস্ আর ড্যাশেস। পরে সেগুলোকে আবার অনুবাদ করেন।

দিনেরবেলা বলতে গেলে লোথার একাই থাকেন। হেনড্রিক ম্যানফ্রেড তার ঘোড় নিয়ে মরুভূমিতে যায়। যেন শিকারের পাশাপাশি এই পরিবেশে বাস করার শিক্ষাটাও হয়ে যায়। তাই অবসর পেয়ে লোথার কেবল ভাবেন তার পরিকল্পনার দুর্বল দিকগুলো নিয়ে। বলা বাহুল্য, সবার প্রথমেই মনে পড়ে ফুরির নাম। কাপুরুষ লোকটা সহজেই নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে।

 হঠাৎ করেই ইয়ারফোনে বিজবিজ শব্দ হতেই নোটবুক তুলে নিলেন লোথার। পাতার উপর নেচে বেড়াল লোথারের পেনসিল। অবশেষে উইন্ডহক স্টেশন মেসেজ রিসিভ করে নিতেই ইয়ারফোন নামিয়ে অনুবাদ করলেন লোথার :

পেন্টিফগারকে বলা হচ্ছে সানডে রাতের জন্যে জুনোর প্রাইভেট কোচ তৈরি রাখতে।

পেন্টিফগার হলেন আব্রাহাম। আব্রাহামস আর জুনো হল সেনটেইন কোর্টনির কোড নেইম। কেপটাউনের উদ্দেশে রওনা দেবেন সেনটেইন। ঘটনাটা ঘটার সময় এই নারী আশপাশে থাকবে না ভেবেই স্বস্তি পাচ্ছেন লোথার।

কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যেন সেনটেইনের সাথে দেখা করার জন্যে মন কেঁদে উঠল। ডেইমলার নদীতীর পার হবার সময়ে কেবল একঝলক! “ঠিক আছে, এতে করে হিরের ট্রাক আসার আগে রিহার্সালও হয়ে যাবে।” যুক্তি সাজালেন লোথার।

শনিবার দুপুরবেলা বহুদূর থেকে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এল ডেইমলার। দশ মাইল দূর থেকে ধূলিঝড় দেখে ম্যানফ্রেড আর হেনড্রিককে সিগন্যাল দিলেন লোথার।

অগভীর কয়েকটা পরিখা খুঁড়ে কাটা গাছের ডালপালা দিয়ে নিজেদেরকে আড়াল করে লুকিয়ে আছে পুরো দল। ব্লক সৃষ্টির জন্য জড়ো করা পাথরগুলোকেও একেবারে নিপুণ হাতে প্রাকৃতিকভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন লোথার। রিহার্সাল হওয়ায় কেউ আর মুখোশ পরল না।

শেষবারের মত সবকিছুর উপর চোখ বুলিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান গাড়ির দিকে তাকালেন। কিন্তু কেন যেন রাগও হল, “দেখো কাণ্ড কত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে, ঠিক ঘাড় ভেঙে মরবে।” যদিও অশুভ চিন্তাটা তাড়াতাড়ি আবার মাথা থেকে তাড়িয়েও দিলেন।

 শেষ মুহূর্তে গাড়ি এত জোরে ছুটে এল যে, মনে হল সব উপড়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু না, মোক্ষম সময়ে গ্রুটল বন্ধ করে দিয়ে দরজা খুলে নেমে এলেন সেনটেটন। লোথার যেখানে পরিখার মধ্যে উবু হয়ে বসে আছেন তা থেকে খুব বেশি হলে বিশ কদম সামনে। বেড়ে গেল লোথারের হৃৎপিণ্ডের গতি; আপন মনেই ভাবলেন “কেন আমি এমন করছি? এই নারী আমার সাথে এত প্রতারণা আর অবজ্ঞা করেছে?” শক্ত হতে চেয়েও পারলেন না লোথার। প্রাণশক্তিতে ভরপুর সেনটেইনের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক উজ্জ্বল দ্যুতি।

ঝট করে কাটা ঝোপে ঠিক লোখারের দিকেই যেন মুহূর্তখানেক তাকিয়ে ছেলেকে ডাক দিলেন সেনটেইন, “চলো আমরা হেঁটে গিয়ে দেখে আসি, ক্রসিং নিরাপদ হবে কিনা।”

লোথার যেখানে শুয়ে আছেন সেদিকেই এগিয়ে আসছে মা আর ছেলে। নিজের ট্রেঞ্চ থেকে সব দেখছে ম্যানফ্রেড সেনটেইন যে ওর মা সেটা ও জানে না কিংবা মায়ের দুধ পান করা অথবা কোলে ওঠা এ জাতীয় কোনো স্মৃতিও তার নেই। অতএব পুরো মনোযোগ দিল শাসার প্রতি।

শাসার সুদর্শন চেহারা দেখে জ্বলে উঠল ম্যানফ্রেড। মনে পড়ে গেল ছেলেটার বাম হাতের ঘুষির ক্ষত। যাই হোক, শুকনো নদীবক্ষে নেমে অ্যাকেশিয়া ডাল বিছানো পথটাকে আবার ঠিকঠাক করে দিল শাসা।

ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে ডেইমলারের দিকে ফিরে তাকালেন সেনটেইন। দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লোথার। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছেন না।

 “অল সেট, মা।” অ্যাকেশিয়া ডালগুলোকে আবার সুন্দর করে পেতে দিয়ে উঠে এল শাসা।

“চলো তাহলে এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ডেইমলারে চড়ে বসল দু’জনে। শুকনো নদী পেরিয়ে বহু দূরে চলে গেলেন সেনটেইন। মরুভূমিতে মিলিয়ে গেল ইঞ্জিনের গর্জন। আচমকাই কেঁপে উঠলেন লোথার।

কয়েক মিনিট ধরে কেউ কোনো নড়াচড়া করল না। একটু পরে সবার আগে উঠে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। কিন্তু কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও লোথারের চেহারা দেখে আবার চুপ করে গেলেন।

আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ডেইমলার যেখানে থেমেছিল সেখানে দাঁড়ালেন লোথার। ইচ্ছে হল নিচু হয়ে মেনটেইনের স্পর্শ করা ধুলা ধরে দেখতে। কিন্তু হঠাৎ করেই পেছন থেকে কথা বলে উঠল ম্যানফ্রেড।

“ও একটা বক্সার।” খানিকক্ষণের জন্যে তো লোথার বুঝতেই পারলেন না যে ছেলেটা শাসার কথা বলছে।

“চলো, ক্যাম্পে যাই।” বাবার কথা শুনে হাত দুটো পকেটে ভরে চুপচাপ ডাগ আউটের উদ্দেশে হাঁটা ধরল ম্যানফ্রেড।

“তুমি বক্সিং জানো, পা?” আবারো মনে সাধ জাগতেই জানতে চাইল ছেলেটা।

“আমার তো মানুষের দুপায়ের মাঝখানে লাথি মারতেই বেশি ভালো লাগে রে ম্যানি। তারপর ধর বোতল কিংবা বন্ধুকের হাতল দিয়ে ঠাস করে একটা বারি। ব্যস।

“আমি বক্সিং শিখতে চাই।” বলে উঠল ম্যানফ্রেড।

হয়ত আইডিয়াটা অনেক দিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল; তবে এবারে একেবারে ঘোষণা হিসেবে আবির্ভূত হল এ সিদ্ধান্ত।

***

“ওহ, অ্যাবি আপনি জানেন এ ধরনের লোকজন আমি কতটা অপছন্দ করি। রুম ভর্তি সিগারেটের ধোয়া, অপরিচিতদের সাথে বকবক উফ”, বিরক্তি বাড়ল সেনটেইনের কণ্ঠে।

“এই লোকটা হয়ত কখনো অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে সেনটেইন।”

গোমড়া মুখে বসে রইলেন সেনটেইন। কারণ কথাটা সত্যি। অ্যাডমিনিস্ট্রেটরই বলতে গেলে এ অঞ্চলের হর্তাকর্তা।

“আগেরগুলোর মতন এও বোধ হয় কোনো এক বুড়ো হামবড়া হবে।”

“আমি অবশ্য এখনো দেখিনি।” স্বীকার করলেন আবি।

“উইন্ডহক মাত্রই পৌঁছেছেন আর আগামী মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও আমাদের সুমেরু অঞ্চলের খনির কাগজ তার ডেস্কের উপরেই সিগনচারের আশায় পড়ে আছে।”

সেনটেইন চোখ উল্টাতেই অ্যাবি মনে করিয়ে দিলেন, “দুই হাজার স্কয়ার মাইল উর্বরা জমির অধিকার নেয়ার জন্যে কয়েক ঘণ্টা কষ্টে কাটানো যায় না?”

কিন্তু সেনটেইন এত সহজে রাজি হবার পাত্রী নন; বললেন, “আমরা তো আজ সন্ধ্যায় ট্রেনে ওঠার কথা। শাসা বুধবার থেকে কলেজে যাবে।” নিজের প্রাইভেট কোচের স্যালুনের ভেতরে পায়চারি করছেন সেনটেইন।

 “মঙ্গলবারেই আরেকটা ট্রেন ছাড়বে। আপনি তখন যাবেন। মাস্টার শাসা আজ চলে যাক। স্যার গ্যারি আর উনার স্ত্রী কেপটাউনে শাসাকে তুলে নেবেন। তারপর শাসার দিকে তাকিয়ে হাসলেন আব্রাহাম, “একা একা নিশ্চয়ই যেতে কোনো কষ্ট হবে না, ইয়ং ম্যান?”

 আব্রাহামের চতুর বুদ্ধি টের পেলেন সেনটেইন; এটা শাসার জন্যে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল।

“অবশ্যই মা। তুমি এখানে থাকো। নতুন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সাথে দেখা করাটা অত্যন্ত জরুরি।”

বাতাসে হাত ছুড়লেন সেনটেইন, “আব্রাহাম যদি আমি বিরক্তির চোটে মরে যাই তাহলে সারা জীবন আপনি এর দায়িত্ব বয়ে বেড়াবেন কিন্তু।”

 প্রথমে হিরের স্যুট পরতে চাইলেও মত বদলে হলুদ সিল্কের ইভনিং ড্রেসটাই বেছে নিলেন। সাথে কানে একজড়ো সলিটেয়ার ডায়মন্ড। তবে গলায় পরলেন বিশাল হলুদ ডায়মন্ডের পেনড্যান্ট। যা প্রাটিনাম চেইনের সাথে চমৎকার আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম।

ভারি গোথিক ইমপেরিয়াল রীতিতে তৈরি ইঙ্ক প্যালেসে ঢুকেই বলরুমের চারপাশে চোখ বোলালেন সেনটেইন। যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাই এসেছেন, সাথে তাদের স্ত্রী আর শহরের বিখ্যাত জমিদার ও ব্যবসায়ীর দলও আছে।

এদের ভিড়ে সেনটেইনের নিজস্ব কয়েকজন ম্যানেজার আর জুনিয়র ম্যানেজারও আছেন। যাই হোক, সবার সাথে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ সারতে অ্যাবি এসে তাড়াতাড়ি সেনটেইনকে নিয়ে গেলেন যেন তিনি তটস্থ হবার আগেই কাজ সারা যায়। সেনটেইনের হাত ধরে রিসেপশন লাইনের দিকে নিয়ে গেলেন আবি, “অ্যাডমিনিস্ট্রেটর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্লেইন ম্যালকমস। যুদ্ধ শেষে মিলিটারি ক্রুসের সাথে বারও পেয়েছেন। আর ব্যক্তিগত জীবনে একজন আইনজীবী আর

এতক্ষণ হোস্টের দিকে তেমন একটা নজর দেননি সিনটেইন। মনোযোগ দিয়ে অ্যাবির আরেক হাত ধরা র‍্যাচেলের মুখে স্যুপের রেসিপি শুনেছেন। যদিও মওকা পেলেই র‍্যাচেলকে হটিয়ে দিতেও প্রস্তুত আছেন। এমন সময় আচমকা মাইকে তাদের নাম ঘোষণা করল এ.ডি.সি, “মি. অ্যান্ড মিসেস আব্রাহাম ও মিসেস সেনটেইন ডি থাইরি কোর্টনি চোখ তুলে সামনে তাকাতেই মোহিত হয়ে গেলেন সেনটেইন। এমনকি অবচেতনেই আঁকড়ে ধরাতে আব্রাহামের কনুইতে ঢুকে গেল সেনটেইনে নখ।

কৃষ্ণকায় ব্লেইন ম্যালকম লম্বায় ছয় ফুট হবেন। এমন আমুদে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন যেন যেকোনো সময় নাচ শুরু করবেন।

“মিসেস কোর্টনি” হাত বাড়িয়ে দিলেন ব্লেইন, “আপনি আসায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী এতক্ষণ আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।” পরিষ্কার, মার্জিত আর শিক্ষিত এই কণ্ঠস্বর শুনে সেনটেইনের ঘাড়ের নিচে যেন শিরশির করে উঠল।

ম্যালকমসের সাথে হ্যান্ডশেক করলেন সেনটেইন। পাশাপাশি ভদ্রলোকের চেহারাটাও পরীক্ষা করে দেখলেন। পাথরের মত ভারি আর বিশাল কপাল, চোয়ালের হাড় এবং গাল। ঠিক যেন তরুণ সুদর্শন আব্রাহাম লিংকনের প্রতিমূর্তি, বয়সও কম। মাত্র চল্লিশ।

হঠাই খেয়াল করলেন যে এখনো ম্যালকমসের হাত ধরে আছেন। আর সেনটেইনের মত আগ্রহ নিয়েই ওর দিকে তাকিয়ে আছেন কর্নেল সাহেব। ওদিকে র‍্যাচেল আর অ্যাবি আগ্রহ নিয়ে ওদের দুজনকেই দেখছেন।

আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিলেন সেনটেইন। আতঙ্কিত হয়ে অনুভব করলেন যে গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে যা একবারও ঘটেনি।

 “আমি যথেষ্ট ভাগ্যবান যে এর আগেও আপনার পরিবারের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে।” উজ্জ্বল সাদা দাঁত দেখিয়ে বলে উঠলেন ম্যালকমস। বড়সড় মুখটা হাসলে আরো বৃহৎ দেখায়। খানিকটা কেঁপে উঠে সেনটেইনও হাসলেন। “তাই নাকি?” স্কুল গার্লদের মত লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন। লোকটার অদ্ভুত সবুজাভ চোখ দুটো বারবার তাকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে।

“আমি ফ্রান্তে জেনারেল শন কোর্টনির অধীনে যুদ্ধ করেছি। উনি সত্যিকারের একজন জেন্টলম্যান ছিলেন।” ম্যালকম বলে চললেও তার মাথার ওপর টাক দেখে একটু বিরক্ত হলেন সেনটেইন।

“আমি শুনেছি আপনি নাকি ১৯৭১ সালে কয়েক সপ্তাহের জন্য জেনারেলের হেড কোয়ার্টারেও ছিলেন। আমি সে বছরের শেষ দিকেই উনার স্টাফ হয়েছি।” গভীরভাবে দম নিয়ে অবশেষে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন সেনটেইন। মাইকেল আর শাসার কথাও ভাবতে হবে। তাই বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দিয়ে সরে পড়াই ভালো হবে।

 “আমি খুব সম্মানিত বোধ করব, মিসেস কোর্টনি-” হাত বাড়িয়ে দিলেন ব্লেইন আর মুহূর্তখানেকের দ্বিধা ছাড়াই আঙুল দিয়ে তার কনুই স্পর্শ করলেন সেনটেইন।

অন্যান্য জুটিরা নাচতে নাচতে দূরে সরে তাদের জন্যে খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। আর ব্লেইন সত্যিই একজন অসাধারণ ড্যান্সার। নিজেকে এতটা হালকা আর স্বাচ্ছন্দ্য কখনো বোধ করেননি সেনটেইন।

প্রজাপতির মত ঘুরে ঘুরে নাচলেন দু’জনে। প্রতিটি মুদ্রা কাউন্টার টার্নে এত মজা পেলেন যে, মিউজিক বন্ধ করে বাদক দল ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেও সেনটেইন একটুও ক্লান্ত হলেন না। বরঞ্চ বাজনেদারদের ওপর রাগই হল। আরেকটু বাজালে কী হত! মেঝেতে সবার মাঝখানে হাত ধরে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসছেন ব্লেইন ম্যালকমস আর সেনটেইন কোর্টনি। বাকি জুটিরা তাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিচ্ছে।

এখন আর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা শোভা পায় না। তাই আস্তে করে পিছিয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন।

“আমার মনে হয় শ্যাম্পেন হলে খারাপ হবে না” সাদা জ্যাকেট পরিহিত ওয়েটারকে ইশারা দিলেন ব্লেইন।

 ভিড়ে ভিড়াকার পুরো রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জনে। এক দু’জন সাহসী আত্মা কাছে আসতে চাইলেও কাধ আর মাথা দিয়ে স্পষ্ট বিরক্তির ভাব প্রকাশ করলেন সেনটেইন। তা দেখে বাকিরাও দূরে সরে গেল।

খানিক বাদে দ্বিতীয়বার ডান্স ফ্লোরে একসাথে নাচার পর ব্লেইন জানালেন, “আমি আমার স্ত্রীর সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই মিসেস কোর্টনি, মে আই?”

হঠাৎ করেই প্রচণ্ড হিংসা অনুভব করলেন সেনটেইন। কিছু না বলে কেবল মাথা নাড়লেন। নিজের কণ্ঠস্বরকেও বিশ্বাস নেই।

মেঝের উপর দিয়ে মেইন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন ব্লেইন। মুখগুলোর মধ্যে খোঁজ করলেন সেনটেইন। না জানি কে হবেন সেই ভাগ্যবতী। দু’পাশে সরে পথ করে দিল বাকি নারী-পুরুষের দল। আর ওই তো সে, অনিন্দ্যসুন্দর বিষণ্ণ মাখা দু’চোখ তুলে সেনটেইনকে দেখছে। বয়সেও তরুণ মেয়েটার পুরো অবয়বে তা আর বিনয় ছড়িয়ে থাকলেও হাসিতেও কেমন দুঃখের ছাপ!

“মিসেস কোর্টনি ইনি হলেন আমার স্ত্রী ইসাবেলা।”

“আপনি বেশ চমৎকারভাবে ডান্স করেছেন মিসেস কোর্টনি। আপনাকে আর ব্লেইনকে দেখে আমি বেশ মজা পেয়েছি।”

 “ধন্যবাদ মিসেস ম্যালকমস” ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেও কোনোমতে ফিসফিস করলেন সেনটেইন।

হুইল চেয়ারে বসে আছেন ইসাবেলা ম্যালকমস। পেছনে নার্সও দাঁড়িয়ে আছে। ইভনিং ড্রেসের নিচে দিয়েও দেখা যাচ্ছে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া পায়ের গোড়ালি।

“ও তোমাকে কখনো ছাড়বে না” নিজের দুঃখে যেন কেঁদেই ফেলবেন সেনটেইন; আপন মনে বললেন, “ও কখনো পক্ষাঘাশ্রস্ত পত্নীকে ছেড়ে যাবে না।”

***

সূর্য ওঠারও একঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন সেনটেইন আর সাথে সাথে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের ভালো লাগার আবেশ। চাদর ছুঁড়ে ফেলে নগ্নপায়ে মেঝের ওপর নামতেই চোখ গেল মাইকেল কোর্টনির ফ্রেমে বাঁধানো ছবির দিকে।

 “অ্যায়াম সরি, মাইকেল।” ফিসফিস করে জানালেন, “আমাকে ক্ষমা করো ডার্লিং, অনেক দিন ধরেই আমি একা। এখন ওকে চাই মাইকেল, ওকে বিয়ে করে নিজের করে পেতে চাই।” তারপর ছবিটাকে হাতে নিয়ে খানিক পেটের কাছে চেপে ধরলেও পরে আস্তে করে ড্রয়ারে রেখে দিলেন সেনটেইন।

কোনোমতে গায়ে চায়নিজ সিল্কের ড্রেসিং গাউন জড়িয়েই কোচের ডেস্কে বসে স্যার গ্যারির কাছে ব্লেইন ম্যালকমসের সমস্ত তথ্য জানতে চেয়ে টেলিগ্রাফ পাঠালেন।

 এরপর সেক্রেটারিকে ফোন করে আনিয়ে মেসেজটা ধরিয়ে দিয়েই বললেন, “আব্রাহামকে ফোন দাও।”

“সেনটেইন এখন মাত্র সকাল ছয়টা বাজে। আর গতরাতে তিনটার আগে বিছানাতেই যেতে পারিনি।” ঝাঁকিয়ে উঠলেন অ্যাবি।

“তিন ঘণ্টার ঘুমই এক দক্ষ লইয়ারের জন্য যথেষ্ট। অ্যাবি, আমি চাই আজ সন্ধ্যায় আমার সাথে ডিনারের জন্য কর্নেল ম্যালকমস আর তার পত্নীকে নিমন্ত্রণ করবেন।”

দীর্ঘ কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে চুপ করে রইলেন আব্রাহাম।

“আপনি আর র‍্যাচেলও আসবেন। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন সেনটেইন।

“এতটা শর্ট নোটিশে উনার মত ব্যস্ত মানুষ আসতে পারবেন না।” খুব সাবধানে প্রতিটি শব্দ বাছাই করলেন অ্যাবি।

“উনাকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত পাঠিয়ে দিন। কোনোভাবেই যেন প্রথমে ওয়াইফের কাছে না যায় আপনার বার্তাবাহক।” অ্যাবির কথায় পাত্তাই দিলেন না সেনটেইন।

 “উনি আসতে পারবেন না।” তবুও জেদ করলেন অ্যাবি। “অন্তত আমি ঈশ্বরের কাছে সে প্রার্থনাই করব।”

“মানে? কী বলতে চান?” সাপের মত ফোঁস করে উঠলেন সেনটেইন।

“আপনি আগুন নিয়ে খেলছেন। মোমবাতির শিখা নয়। একেবারে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা বুশ ফায়ারের আগুন।”

নিজের দু’ঠোঁট কামড়ে ধরে সেনটেইন জানালেন, “নিজের চরকায় তেল দাও, আমি আমারটা বুঝব।”

খিলখিল করে হেসে উঠলেন সেনটেইন। অবাক হয়ে গেলেন আব্রাহাম। আগে কখনো সেনটেইনকে এভাবে হাসতে শোনেননি।

 এবার সত্যিই বেশ উম্মা প্রকাশ পেল আব্রাহামের গলায়,

“সেনটেইন আমি যেন আপনার ব্যাপারে মাথা ঘামাই সে কারণে প্রতি মাসে আপনিই আমাকে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন। এমনিতেই আপনার গত রাতের আচরণ নিয়ে সকাল হলেই কথা বলতে শুরু করবে পুরো শহর। সবাই আপনাকে দেখেছে।”

“অ্যাবি, আপনি আমি দু’জনেই জানি যে যা ইচ্ছে করার ক্ষমতা আমার আছে। তাই না? আপনি শুধু নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিন, প্লিজ!”

দুপুরবেলা বেশ খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলেন সেনটেইন। সেক্রেটারি চারটার পরে ঘুম থেকে তুলে জানাল তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন কর্নেল ও তাঁর ওয়াইফ, শুনে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন। তারপর বললেন স্যার গ্যারির পাঠানো উত্তর পড়তে।

 লোকটার বয়স হিসাব করেও খুশি হয়ে উঠলেন। সিংহ জাতক হিসেবে কর্নেলের বয়স এখন মাত্র ঊনচল্লিশ। আগ্রহ নিয়ে পড়তে লাগলেন সেনটেইন অক্সনের গ্র্যাজুয়েট কর্নেলের দুই কন্যার নাম তারা ইসাবেলা ও মাতিল্ডা জানিন। উনার পিতাও ছিলেন বিখ্যাত লইয়ার আর মাইনিং এন্টারপ্রেনার।

কিন্তু কন্যাদ্বয়ের কথা শুনে চমকে উঠলেন সেনটেইন। ছেলেমেয়ে সম্পর্কে তো তিনি ভাবেনইনি।

“যাক মহিলা অন্তত ব্লেইনকে কোনো পুত্রসন্তান দিতে পারেননি।” ভয়ংকর কথাটা মাথায় আসতেই সেনটেইন নিজেই অপরাধবোধে দগ্ধ হলেন। তাই স্যার গ্যারির পাঠানো দীর্ঘ কেবলের বাকি অংশ পড়লেন : এস এ পার্টি ক্ষমতায় এলে কেবিনেট র‍্যাঙ্ক বেড়ে যাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল। জেনারেল সুটের স্টাফ হিসেবেও কাজ করেছেন। পড়ে যারপরনাই খুশি হলেন সেনটেইন। কিন্তু শেষ লাইনে সর্বক্ষেত্রে সতর্ক থাকার জন্যে স্যার গ্যারির পরামর্শ পড়ে বেজায় ক্ষেপেও উঠলেন।

“আমার কিসে ভালো হবে তা নিয়ে সবার এত মাথাব্যথা কেন?” রেগে মেগে আয়নার দিকে তাকাতেই চেহারা শান্ত হয়ে গেল। এমনকি তরুণীদের মত মনোযোগ দিয়ে খুঁজলেন কোথাও কোনো খুঁত পাওয়া যায় কিনা। চোখের কোণে চুলের সমান চিকন লাইন দেখে হাহাকার করে উঠল বুক।

“সব সুদর্শন পুরুষগুলো কেন এরই মাঝে বিয়ে করে বসে আছে?”

***

ইসাবেলা ম্যালকমসের খাতিরদারি আর হুইল চেয়ারকে ব্যালকনিতে টেনে তোলার জন্যে নিজের চারজন পরিচারককে প্রস্তুত করে রাখলেন সেনটেইন। তবে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে পত্নীকে নিজের কোলে তুলে নিলেন ব্লেইন ম্যালকমস। তারপর এমনভাবে কোচের সিঁড়িতে উঠে এলেন যেন তার কোনো ওজনই নেই। স্কার্টের নিচ দিয়ে ঝুলছে ইসাবেলার বোধশক্তিহীন দুটো পা। দেখে হঠাৎ করেই সমবেদনা অনুভব করলেন সেনটেইন।

কিন্তু স্যালুনে ঢুকে সেনটেইনের অনুমতি না নিয়েই একেবারে শ্রেষ্ঠ চেয়ারটাতে নিজের স্ত্রীকে বসিয়ে দিলেন ম্যালকমস। সচরাচর এখানে সেনটেইনই বসেন। সিল্ক কার্পেটের ওপর ইসাবেলার পা দুটোকে পাশাপাশি রেখে স্কার্ট দিয়ে ব্লেইন এমনভাবে ঢেকে দিলেন যে বোঝা গেল আগেও এ কাজ বহুবার করেছেন।

এরপর ইসাবেলা ব্লেইনের গালে আস্তে করে আঙুল ছুঁয়ে এমনভাবে হাসলেন যে দেখে হতাশায় ছেয়ে গেল সেনটেইনের হৃদয়। মনে হল অ্যাবি আর স্যার গ্যারির কথাই বোধ হয় ঠিক।

এতক্ষণে সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ইসাবেলা আর সাথে সাথে বদলে গেল তার হালকা বাদামি আর সোনালি রঙা চোখের রঙ। সেনটেইনের গাঢ় বুনো মধুরঙা চোখের দিকে তাকিয়ে যেন চ্যালেঞ্জ জানালেন, যেন নিজের হাতের গ্লাভস খুলে সেনটেইনের মুখে চপেটাঘাত করলেন।

 “কত বড় সাহস!” রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন সেনটেইন, “আমি ভেবেছিলাম ব্লেইনের দিকে আর হাত বাড়াব না। কিন্তু তুমি যদি যুদ্ধ করতে চাও, তবে আমিও রাজি আছি। দেখা যাক কী হয়।” নিঃশব্দে ইসাবেলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন সেনটেইন।

ডিনারের জন্য রকলবস্টারের ড্রেসিং আর রোস্টের সস তিনি নিজের হাতে বানিয়েছেন। তাই খাবারগুলো সবাই অত্যন্ত উপভোগ করল। ইসাবেলা আর সেনটেইনও পরস্পরের সাথে হাসি-খুশি আচরণ করেছেন দেখে ব্লেইন ও অ্যাবিও দারুণ খুশি। অন্যদিকে চুপচাপ বসে রইলেন র‍্যাচেল আব্রাহম, স্পষ্ট বুঝতে পারলেন কী ঘটছে। তাই আনমনে ইসাবেলাকেই সমর্থন করলেন। জানেন তার নিজের ছোট্ট কুটিরের উপরেও সর্বদা শিকারির নিঃশ্বাস পড়ছে।

“আপনার তো দু’জন মেয়ে তাই না মিসেস ম্যালকমস? খুব কষ্ট হয়, না? ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা থাকলেই কাজ বেশি বাড়ে।” প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে কতটা গবেষণা করেছেন জানিয়ে দিলেন সেনটেইন।

অন্যদিকে টেবিলের শেষ মাথায় বসে কেঁপে উঠলেন র‍্যাচেল। ছুরির এক খোঁচায় ইসাবেলার ব্যর্থতাকে তুলে ধরেছেন এই নারী।

“ওহ, বাসার কাজের জন্য আমি যথেষ্ট সময় পাই। বাইরে ব্যবসা করি না। তো! তাছাড়া আমার ডার্লিং মেয়েরা বাবার অন্ধ ভক্ত।”

হুম, বোঝা গেল ইসাবেলাও সমানভাবে পারদর্শী। নিপুণভাবে মেয়েদেরকে ব্লেইনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। বিষয় পরিবর্তন করে রাজনীতিতে চলে গেলেন সেনটেইন।

আর আলোচনার পুরো সময়টুকু জুড়ে উপভোগ করলেন ব্লেইনের কণ্ঠস্বরের ওঠানামা ও মাধুর্য। এতটাই শ্রুতিমধুর মনে হল যে, মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে, ছোট-খাটো মন্তব্য করে আরো উৎসাহ দিলেন। আপন মনে ভাবলেন, আমিই এত কাবু হয়ে পড়েছি; সাধারণ লাখ লাখ ভোটার তো অঙুলি হেলনে কেবল তাকেই ভোট দেবে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা একটু বেশিই দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে। তারা দুজনে এমনভাবে মগ্ন হয়ে কথা বলছেন যেন রুমে আর কেউ নেই। তাই তাড়াতাড়ি ইসাবেলার দিকে ফিরলেন।

“আপনারও স্বামীর মত একই ধারণা মিসেস ম্যালকমস?”

হা হা করে হেসে উঠে স্ত্রীর মত জানিয়ে দিলেন কর্নেল সাহেব। “আমার স্ত্রী আসলে রাজনীতি একেবারেই পছন্দ করে না, তাই না ডিয়ার?” নিজের ডিনার জ্যাকেটের পকেট থেকে সোনার ঘড়ি বের করে চোখ বোলালেন ম্যালকমস।

“মাঝরাতেরও বেশি হয়ে গেছে। সময়টা আসলে এত দারুণ কেটেছে যে, সময়েরই হুঁশ নেই।”

“ইউ আর রাইট ডার্লিং” স্বস্তি পেলেন ইসাবেলা।

“কিন্তু আমি তো ব্র্যান্ডি আর সিগার ছাড়া যেতে দেব না।” বাদ সাধলেন সেনটেইন। কিন্তু নার্ভাস ভঙ্গিতে কাঁপতে থাকা সেক্রেটারিকে দেখে থেমে যেতে হল। হাতে টেলিগ্রাফ।

“কী হয়েছে? লোকটা এমনভাবে কাঁপছে যেন নিজের মৃত্যু পরোয়ানা হাতে ধরে রেখেছে।

“ড, টুয়েন্টিম্যান জোনসের কাছ থেকে এসেছে। ইটস আর্জেন্ট।”

টেলিগ্রাফের পাতা হাতে নিয়েও আগে অতিথিদের তদারক করলেন সেনটেইন। ব্লেইন আর অ্যাবিকে হাভানার চুরুট, লিকার দিয়ে এক্সকিউজ মি বলে চলে এলেন নিজের বেডরুমে। টেলিগ্রাফ মেসেজটা পড়ে দেখলেন :

গারহার্ড ফুরির নেতৃত্বে অবরোধ কমিটি সমস্ত কাজ বাতিল করে বসে আছে। তারা চাকরিচ্যুত সকলের পুনঃবহাল আর চাকরির নিশ্চয়তা দেবার দাবি তুলেছে। আপনার নির্দেশনার জন্য অনুরোধ করছি।

বিছানার উপর বসে রাগে কাঁপছেন সেনটেইন। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা। এটা তার খনি, তার হিরে। তিনি তো তাদেরকে মজুরি দিচ্ছেন। তার মানে চাকরি দেয়া আর কেড়ে নেয়া উভয় অধিকারই তার হাতে। শিপমেন্ট বাতিল হয়ে গেছে মানে? এটার উপর নির্ভর করছে উনার ভাগ্য। কে এই গারহার্ড ফুরি? ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল ট্রান্সপোর্ট ড্রাইভারের কথা।

এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন করিডোরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার সেক্রেটারি।

“মি, আব্রাহামকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।”

আব্রাহাম দরজার ভেতরে পা রাখতেই মেসেজ লেখা কাগজটা ধরিয়ে দিলেন সেনটেইন।

“আমার সাথে এরকম করার ওদের কোনো অধিকার নেই” ভয়ংকর রকম ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার দিলেন।

“কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল তাদের সে অধিকার সত্যিই আছে। ১৯২৪ অ্যাক্ট অনুযায়ী”

“আমার সামনে আইন কপচাবেন না” অ্যাবিকে কথা শেষ করতে না  দিয়েই সেনটেইন বলে উঠলেন, “একদল বলশেভিকে বাচ্চা যে খাওয়ায় তার হাতেই কামড় দেয়।”

“সেনটেইন তাড়াহুড়া করে কিছু করা যাবে না। যদি

“অ্যাবি, এক্ষুণি ডেইমলার রেডি করে জোনসকে টেলিগ্রাফ করে জানিয়ে দিন যেন আমি না আসা পর্যন্ত কিছু না করে। কোনো সমঝোতা না, কিছু না।”

 “আপনি না কাল সকালে চলে যাবেন?”

“না।” ফোঁস করে উঠলেন সেনটেইন, “আমি আধঘণ্টার মধ্যেই রওনা দিচ্ছি। অতিথিরা চলে যাক আর যত তাড়াতাড়ি পারেন ডেইমলার রেডি করুন।”

“রাত একটা বাজে সেনটেইনের চেহারা দেখে বাকিটা আর বলার সাহস পেলেন না অ্যাবি।

কোনোমতে নিজেকে ঠাণ্ডা করে স্যালুনে ফিরে এলেন সেনটেইন।

“কোনো সমস্যা হয়েছে মিসেস কোর্টনি?” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “আমি কি কোনো সাহায্য করতে পারি?”

 “আরে না, না সব ঠিক আছে। শুধু খনিতে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।”

“আজ রাতেই?”

 “হ্যাঁ, এক্ষুণি-_”

“একা একা যাবেন আপনি?” ব্লেইনের মুখে চিন্তার রেখা দেখে উফুল্ল হয়ে উঠলেন সেনটেইন। “রাস্তা তো বেশ দূর।”

 “আমি আসলে একা ট্রাভেল করতেই বেশি পছন্দ করি।” পরের বাক্যটা বেশ জোর দিয়ে বললেন, “কিংবা বলা যায় সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। আমার কয়েকজন কর্মী অববোধ ডাকাতেই যাবার তাড়া। হয়ত সংঘর্ষের মুখেও পড়তে হতে পারে।”

তাড়াতাড়ি আশ্বাসের সুরে ব্লেইন বলে উঠলেন, সরকারের তরফ থেকে আমি নিজে আপনাকে সবরকম সহায়তার নিশ্চয়তা দিচ্ছি। চান তো পুলিশও পাঠিয়ে দিতে পারি।”

“ধন্যবাদ, আপনাকে ডাকা যাবে জেনেই বেশ স্বস্তি পেলাম।”

“কাল সকালের আমার প্রথম কাজই হবে এটা। কিন্তু কয়েক দিন হয়ত লেগে যেতে পারে।” আবারো দু’জনে নিচু গলায় কথা বলে এমন আচরণ করছেন যেন চারপাশে আর কেউ নেই।

 “ডার্লিং মিসেস কোর্টনি উনার ভ্রমণের জন্য তৈরি হবেন নিশ্চয়ই।” স্ত্রীর কথা শুনে ব্লেইন এমনভাবে চমকে উঠলেন যেন ইসাবেলার অস্তিত্বের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটাই। আমাদের এক্ষুণি চলে যাওয়া উচিত।”

ইসাবেলার হুইল চেয়ারের পাশে হেঁটে হেঁটে রেলওয়ের প্লাটফর্ম পর্যন্ত গেলেন সেনটেইন।

অপেক্ষারত শেভ্রলেতে সাবধানে ইসাবেলাকে তুলে দিয়ে দরজা আটকে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন।

“ও অসাধারণ, সাহসী এক নারী। আমি ওকে ভালোবাসি তাই কখনো একা ছাড়তে পারব না; কিন্তু মনে হচ্ছে–” চুপ করে সেনটেইনের হাত ধরলেন ব্লেইন।

“হ্যাঁ, আমিও যদি নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন। তারপর ব্লেইনের হাত ছেড়ে দিয়ে ঝুঁকে জানালার ওপাশে ইসাবেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেপ টাউনে এলে অবশ্যই ওয়েল্টেভ্রেদেনে আসবেন?”

এতক্ষণে খসে পড়ল ইসাবেলার শান্ত সুন্দর মুখশ্রীর মুখোশ। প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বললেন,

“ও আমার। তুমি কখনোই ওকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। নিজের সিটে হেলান দিয়ে বললেন ইসাবেলা। ব্লেইনও ঢুকে পড়ে পত্নীর হাত ধরলেন। বোঝা গেল একটু আগের কথাটা শুনতে পাননি।

চলে গেল শেভ্রলে। স্ট্রিটলাইটের আলোয় একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন।

***

লোথার ডি লা রে কানের পাশে ইয়ারফোন নিয়েই ঘুমিয়েছেন। তাই বিপবিপ আওয়াজ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, “হেনি, তাড়াতাড়ি মোমবাতি জ্বালাও, এত রাতে টেলিগ্রাফে যোগাযোগ করছে, নিশ্চয়ই জরুরি কিছু।”

নোটবুক হাতে নিয়ে টুয়েন্টিম্যান জোনসের মেসেজ অনুবাদ করে তো হতভম্ব হয়ে গেলেন লোথার।

“গারহার্ড ফুরি। গাধার বাচ্চাটা কোন আক্কেলে এরকম একটা কাজ করতে গেল।” তাড়াতাড়ি ডাগ আউট থেকে বের হয়ে শুকনো নদীবক্ষের উপর পায়চারি শুরু করলেন লোথার।

 “অবরোধ, এখন কেন অবরোধ ডাকতে গেল? শিপমেন্ট বাতিল হয়ে গেছে মানে ডায়মন্ড অবরোধকারীরা হিরে-খনি থেকে বের হতে দিচ্ছে না।” হঠাৎ করেই থেমে গিয়ে নিজের হাত মুঠি করে বাতাসে ঘুষি ছুড়লেন, “তার মানে বেকুবটা আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে চাইছে না। এখন কী হবে? আমার সব প্ল্যান ভেস্তে গেল।”

অন্ধ রাগে কেঁপে উঠল লোথারের সর্বাঙ্গ।

“আমার সমস্ত পরিশ্রম আর ঝুঁকি বৃথা গেল। ঘোড়াগুলোকে এত কষ্ট করে চুরি করলাম; সব পণ্ড হল এই পেট মোটা হলুদ শয়তানটার জন্য”

মনে হচ্ছে ফুরি এখন চোখের সামনে থাকলে নির্দ্বিধায় খুন করে ফেলতেন লোথার।

“বাস!” দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগলেন হেনড্রিক, “তাড়াতাড়ি এসো! টেলিগ্রাফ!”

 দু’লাফ মেরে ডাগআউটে ফিরে এসে হেডসেট তুলে নিলেন লোথার। উইন্ডহকের কোর্টনি অপারেটর খনিতে মেসেজ পাঠাচ্ছে—

 “আমি এক্ষুণি আসছি তার আগে কোন ওয়াদা কিংবা সমঝোতা নয়। কোম্পানি স্টোর এক্ষুনি বন্ধ করে দিন। অবরোধকারী ও তাদের কাছে সমস্ত খাবার-দাবার বিক্রি বন্ধ। তাদের চালাঘরের পানি আর বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করে দিন। অবরোধ কমিটিকে আরো জানিয়ে দিন যে পুলিশ ফোর্সও রওনা দিয়েছে।”

ফুরির উপর সমস্ত রাগ আচমকা ভুলে গিয়ে আনন্দে হেসে ফেললেন লোথার।

“ফুরি আর তার চ্যালাদের কোনো ধারণাই নেই যে, তাদের উপর কোন ঝড় নেমে আসছে। ওহ ঈশ্বর। সেনটেইন কোর্টনির পথে পড়ার চেয়ে ছোট একটা লাঠি নিয়ে কালো মাম্বার সাথে লড়াই করাটাও আরো বেশি সহজ।”

কী যেন ভাবলেন লোথার। তারপর হেনড্রিক আর ম্যানফ্রেডকে তাড়াতাড়ি জানালেন, “আমার মনে হচ্ছে অবরোধ থাক বা না থাক, হিরে খনি থেকে বেরিয়ে উইন্ডহকে যাবেই যাবে। তবে ফুরি বোধ হয় আসছে না। তাই প্যাকেজটা আমাদের হাতে লক্ষ্মীর মতন তুলে দেয়ারও কেউ নেই। যাই হোক, হিরে আসছে মানে আমাদের কার্যও ঠিকই সিদ্ধি হবে।”

পরের দিন রাত এগারোটা বাজে তাদের পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেল হলুদ ডেইমলার। দিয়াশলাই জ্বালিয়ে নিজের ঘড়ি চেক করে দেখলেন লোথার। “তার মানে গত রাতে টেলিগ্রাফ পাবার আধা ঘণ্টা পরেই রওনা দিয়ে দিয়েছে। তার মানে পাক্কা বাইশ ঘণ্টা ধরে ড্রাইভ করে একা একা পার হয়ে এসেছে এতটা পথ।” হাল্কাভাবে শিষ দিয়ে উঠলেন লোথার। “এভাবে গেলে আগামীকাল দুপুরের আগেই হানি খনিতে পৌঁছে যাবে। সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।”

***

সামনেই দেখা যাচ্ছে নীল পাহাড়ের সারি। কিন্তু এখন এ দৃশ্য উপভোগ করার মত সময় আর মন কোনোটাই সেনটেইনের নেই। বত্রিশ ঘণ্টা ধরে টানা গাড়ি চালাচ্ছেন। পথের পাশে গাড়ি রেখে মাত্র দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন। ক্লান্তিতে হাড়ের গিটগুলো পর্যন্ত অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু তারপরেও চোখের সামনে সূর্যের গনগনে রোদে জ্বলতে থাকা খনির টিনের ছাদগুলো দেখে নিমিষেই ভুলে গেলেন সমস্ত অবসাদ।

ডেইমলার থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খানিক হাত-পা ঝেড়ে নিলেন। রিয়ারভিউ মিররে চেহারাটাও দেখলেন। ওয়াটার ব্যাগ থেকে পানি নিয়ে কাপড় ভিজিয়ে তাই ক্লান্ত মুখখানাও মুছে নিলেন। সাদা রঙের ডাস্ট জ্যাকেট খুলে ফেলতেই সারা শরীর আবার পরিষ্কার আর নিখুঁত দেখাল। এতক্ষণ সবকিছু দেখেছে অ্যাভিনিউর কর্নারে থাকা একদল নারী আর ছোট ছেলে মেয়ের জটলা। তাদের পাশ দিয়েই গাড়ি চালিয়ে অ্যাডমিন বিল্ডিংয়ে চলে এলেন সেনটেইন।

গেইটের বাইরে জনাবিশেক লোক এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মালিককে দেখে এই শ্বেতাঙ্গ কর্মীদের দলই হাতে হাত রেখে লাইন করে দাঁড়িয়ে থমথমে মুখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

 ডেইমলারের হন চেপে ধরে মেঝের সাথে এক্সিলারেটর ঠেসে ধরলেন। সেনটেইন। সোজা লাইনটার মাঝ বরাবর এগিয়ে যেতেই সবাই বুঝল তাদেরকে চাপা দিতেও তিনি একটুও ভ্রূক্ষেপ করবেন না। একেবারে শেষ মিনিটে দু’পাশে ছিটকে পড়ল পিকেটারদের দল।

একেবারে বারান্দার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালেন সেনটেইন। জ্যাকেট আর টাই ঠিক করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন জোনস।

 “আমরা ভেবেছি আপনি হয়ত কালকের আগে আসতেই পারবেন না।”

“আপনার বন্ধুরা” ডেইমলার নিয়ে তেড়ে আসার সময় পিকেটারদের ছোঁড়া পাটকেলে ভাঙা কাঁচ দেখালেন সেনটেইন।

“ওরা আপনার উপর আক্রমণ করেছে? এটা ক্ষমার অযোগ্য, সত্যি।”

 “ঠিক তাই, আর ক্ষমার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই।”

জোনসের সরু কোমরে ঝুলছে বিশাল এক সার্ভিস পিস্তল। পেছনেই ছোটখাটো ব্রানটিংহ্যাম। উনার চশমা পরা চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি বুঝি কেঁদে ফেলবেন। তারপরেও কাঁপা কাঁপা হাতে ডাবল ব্যারেল শর্টগান ধরে রেখেছেন।

তাঁকে সাহস দিতে চাইলেন সেনটেইন; বললেন, “আপনি সত্যিই একজন সাহসী লোক। আমি আপনার কথা কখনো ভুলব না।

অতঃপর অফিসে গিয়ে নিজের ডেস্কে বসলেন সেনটেইন, জোনসের কাছে জানতে চাইলেন, ক’জন আমাদের পক্ষে আছে।”

“মাত্র আটজন অফিস স্টাফ।”

 “রজার আর ম্যাক্সিয়ারও?”

সিনিয়র দু’জন ওভারসিয়ারের কথা জানতে চাইলেন সেনটেইন।

 “ওরা দুজনেই কমিটিতে আছে।

 “ফুরির সাথে?”

 “ওরা তিনজনই তো সর্বেসর্বা।”

“ওরা যাতে আর কখনো কাজ করতে না পারে সেটা আমি অবশ্যই নিশ্চিত করব।” তিক্ত কণ্ঠে সেনটেইনের ঘোষণা শুনে জোনস বিড়বিড় করে উঠলেন।

“আমার মনে হয় এটাও মনে রাখতে হবে যে, ওরা কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। একত্রে জড়ো হবার লিগ্যাল অধিকার তাদের আছে”।

জোনসের আমতা আমতা কথা শুনে ক্ষেপে গেলেন সেনটেইন।

“এখন যখন আমি খনিটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করছি, ওদের জন্য এতকিছু করেছি, তারপর তো কোন অধিকারই নেই। আপনি কোন পক্ষে বলুন তো জোনস?”

ব্যথাভরা চোখ নিয়ে তাকালেন জোনস, “আপনি কেমন করে এই প্রশ্নটা করলেন? প্রথম যেদিন আপনার সাথে দেখা হয়েছে সেদিন থেকেই তো আপনার বাধ্যগত। আমি কেবল লিগ্যাল অবস্থানটা দেখাবার চেষ্টা করেছি।”

সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে জোনসের হাত ধরলেন সেনটেইন।

“আমায় ক্ষমা করুন জোনস। আমি আসলে ক্লান্ত আর বেশ দিশেহারা বোধ করছি।” বলেই কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। তাড়াতাড়ি তাকে ধরে চামড়ার মোড়া সোফায় বসিয়ে দিলেন জোনস, “শেষবার আপনি কখন ঘুমিয়েছেন?”

“এখন আপনাকে ঘুমাতে হবে। অন্তত আট ঘণ্টা। বাংলো থেকে আপনার জন্যে পরিষ্কার কাপড় আনার ব্যবস্থা করছি।”

“কিন্তু আমাদেরকে ওদের সাথে কথা বলতে হবে।”

“না।” মাথা নেড়ে পর্দা টেনে দিলেন জোনস। “খানিক বিশ্রাম না নিলে সঠিক সিদ্ধান্তও নিতে পারবেন না।

চোখের পাতা চেপে ধরলেন সেনটেইন, “আপনি ঠিকই বলেছেন, যমন সবসময় বলেন।”

“সন্ধ্যা ছয়টায় আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে দেব। আর স্ট্রাইক কমিটিকেও জানিয়ে দিচ্ছি যে আপনি আটটায় ওদের সাথে মিটিং করবেন। তাহলে নিজেদের রণকৌশল ঠিক করে নেয়ার জন্য আমরাও হাতে দু’ঘণ্টা সময় পাব।”

***

সন্ধ্যায় অফিসে এসেছে স্ট্রাইক কমিটির সদস্যরা। আর কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে ঝাড়া তিন মিনিট তিনজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। ইচ্ছে করেই সবগুলো চেয়ার সরিয়ে কেবল তার আর জোনসদের জন্য দুটো রেখেছেন।

 “বর্তমানে সারাদেশে হাজার হাজার লোক তাদের চাকরি হারাচ্ছে।” আবেগহীন গলায় সেনটেইন জানালেন, “তাদের যে কেউ এসে সানন্দে তোমাদের জায়গায় বসে যাবে।”

“এতে কোনো ছাতার কাজ হবে না, বুঝলেন।” মাঝারি উচ্চতার ম্যাক্লিয়ারের মুখে কথাটা শুনে চটে উঠলেন সেনটেইন।

“আমার সামনে এসব আজেবাজে কথা বললে এক্ষুণি বেরিয়ে যাও ম্যাক্লিয়ার।”

“আপনি আমাদের অধিকার ভালোভাবেই জানেন মিসেস কোর্টনি।” বিষণ ভঙ্গীতে হাসল ম্যাক্লিয়ার।

রজারের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “তোমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?” এক বছর আগে জোহানেসবার্গে নিয়ে পত্নীর অপারেশন করিয়েছেন রজার যার সবটুকু খরচ বহন করেছেন সেনটেইন।

“ভালো আছে।” নাজুক ভঙ্গিতে জানাল রজার।

 “তোমার এই মূর্খামি সম্পর্কে তার কী ধারণা?” চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকাল রজার। সেনটেইন বললেন, “ছোট তিনজনের মুখ নিয়েই নিশ্চয় বেশি চিন্তিত হয়ে আছে, তাই না?”

“আমরা যা করছি সবাই একসাথেই করছি” তাড়াতাড়ি বলে উঠল ফুরি। নারীরাও

কিন্তু তাকে কথা শেষ করার সুযোগ দিলেন না সেনটেইন, “দয়া করে আমি কথা বলার সময় মাঝখানে কিছু বলবে না ফুরি।”

তবে এবার আর ফুরিকে দমাতে পারলেন না। তেড়েফুড়ে সক্রোধে গর্জন করে উঠল ড্রাইভার “আপনার এই বেহুদা খনি আর এর হিরে সব এখন আমাদের কজায়। তাই আপনিই আমাদের কথা শুনতে বাধ্য এখন। আমরা না চাইলে এক টুকরো হিরেও বাইরে যাবে না। স্ট্রংরুমে যে মোটাসোটা প্যাকেট রেখে দিয়েছেন সেটাও কখনো বাইরের আলো দেখবে না যদি না আমাদের কথা শোনেন।” সমানে ফড়ফড় করে কথা বললেও মনে মনে উভয় সংকটে পড়ে যাওয়া ফুরি আন্দাজ করে নিল সেনটইনের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। তাহলে লোথারের হাত থেকে সে নিজেও বেঁচে যাবে।

মনোযোগ দিয়ে ফুরির চেহারা দেখলেন সেনটেইন। মনে হচ্ছে লোকটার পিছনে অন্য কেউ আছে। তাই বললেন, “ঠিক আছে। আমি শুনছি। বলো কী বলতে চাও।”

হাতের কাগজ মেলে একের পর এক দাবি পড়ে শোনাল ফুরি। চুপচাপ বসে রইলেন সেনটেইন। কিন্তু তার গলার কাছে তাজা রক্তের আভা দেখে জোনস ঠিকই বুঝতে পারলেন যে তিনি কতটা রেগে গেছেন।

শেষ করে একটা কপি সেনটেইনের দিকে বাড়িয়ে ধরল ফুরি।

“আমার ডেস্কে রেখে দাও। চাকরিচ্যুত সবাইকে তিন মাসের সমপরিমাণের চেয়েও বেশি টাকা আর গুড রেফারেন্স লেটার দেয়া হয়েছে। তুমি নিশ্চয় জানো।” কাগজটাকে স্পর্শও করতে চান না সেনটেইন।

“ওরা আমাদের বন্ধু।” এখনো নিজের জেদ ছাড়ছে না ফুরি।

“ঠিক আছে। এখন তোমরা যাও।” সেনটেইন উঠে দাঁড়াতেই অবরোধ কমিটি পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

“আপনি তো আমাদেরকে কোনো উত্তর জানালেন না?” জানতে চাইল ম্যাক্সিয়ার।

“যখন আমি প্রস্তুত হব তখন।”

তিনজনে দরজার দিকে হাঁটা ধরলেও কী মনে হতেই ঘুরে সেনটেইনের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল ম্যাক্সিয়ার।

“ওরা আমাদের পানি-গ্যাস কেটে দিয়েছে।”

“আমার আদেশে।” বিনা সংকোচে মেনে নিলেন সেনটেইন।

“আপনি জানেন আমরা চাইলে হিরেসহ আপনার সবকিছু নিয়ে নিতে পারি। আপনি থামাতেও পারবেন না।”

“তাহলে তো আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। এসো। স্টোর ভেঙে সব নিয়ে নাও। ডিনামাইট দিয়ে স্ট্রংরুম উড়িয়ে সব হিরে নিয়ে যাও। আমার কিছু যায় আসে না তাতে।”

লোকেরা বেরিয়ে যেতেই জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “ও ঠিকই বলেছে। সবার আগে হিরের কথা মাথায় রাখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উইন্ডহকে নিয়ে যেতে হবে।”

“তাহলে পুলিশ এসকর্ট দিয়ে পাঠিয়ে দিই।” জোনসের পরামর্শ শুনে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

 না। পুলিশ আসতে এখনো পাঁচদিন বাকি। কাল ভোরের আগেই হিরেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। ইসুরেন্সে দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা গৃহযুদ্ধের কাভার নেই। এইসব বেকুবদের হাতে হিরেগুলো পড়লে আমি শেষ হয়ে যাবো। জোনস।”

“বলুন আপনি কী করতে চান।”

 “ডেইমলারকে গ্যারেজে নিয়ে চেক করে তেল ভরে নিন। পেছনের দরজা দিয়ে হিরে লোড করে দেব।” অফিসের গোপন দরজাটা দেখালেন ইঙ্গিতে “মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে গ্যারাজের বিপরীত দিকের কাঁটা তার কেটে দিবেন।”

“গুড” বুঝতে পেরে খুশি হলেন জোনস।” তাহলে ম্যানিটারি লেইন দিয়ে বের হওয়া যাবে। পিকেটাররা মেইন গেইটে থাকায় কিছু টের পাবে না। সেকেন্ডের মাঝে উইন্ডহকের রোডে উঠে যাওয়া যাবে।”

“আমি একাই এতদূর চলে এসেছি। তাই একা একাই ফিরে যাবো। আপনাকে এখানে প্রয়োজন আছে। নয়ত ওরা অন্য কোনো দুরভিসন্ধি করে খনির ক্ষতি করবে।”

সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলেন জোনস। এই খনি তার গর্ব, একই সাথে কন্যা কিংবা স্ত্রীর মতই সেনটেইনকেও একইরকম ভালোবাসেন। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এটাই ঠিক হবে।

“ঠিক আছে। আমি অ্যাবিকেও টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দেব যেন এসকর্ট টিম পাঠিয়ে দেয় আপনার জন্যে।”

 “আমি বের না হওয়া পর্যন্ত জানাবেন না। হয়ত লাইনে পিকেটাররা আঁড়ি পেতে রেখেছে। এ কারণেই টেলিগ্রাফ লাইন এখনো সচল আছে।”

 মাথা নাড়লেন জোনস।

 “ঠিক আছে। কখন রওনা দিতে চান?”

“রাত তিনটায়।”

“ভেরি ওয়েল, মিসেস কোর্টনি। আমি বাবুর্চিকে বলে আপনার জন্যে হালকা ডিনার রেডি করাচ্ছি। আর আপনিও একটু রেস্ট নিয়ে নিন। সবকিছু প্রস্তুত করে আড়াইটায় আপনাকে ডেকে দেব।”

***

কাঁধে জোনাসের স্পর্শ পাবার সাথে সাথে উঠে বসলেন সেনটেইন।

 “আড়াইটা বাজে। ডেইমলার রেডি আর হিরেও লোড় হয়ে গেছে। কাঁটাতারও কেটে রেখেছি।”

“আমি পনেরো মিনিটের মাঝেই তৈরি হয়ে যাচ্ছি।”

একটু পরেই অন্ধকার গ্যারাজে ডেইমলারের পাশে এসে দাঁড়ালেন দু’জনে।

“কাঁটাতারের মধ্যে চিহ্ন দিয়ে রেখেছি ইশারা দিয়ে দেখাতেই পঞ্চাশ গজ দূরে ছোট সাদা একটা পতাকা উড়তে দেখলেন সেনটেইন।

ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল হিরের বোতল গাড়ির বুটের ভেতরে আর টপ হিরের প্যাকেট আপনার পাশের সিটেই রেখে দিয়েছি।” ছোট্ট কালো সুটকেসটাতে পিতলের তালাও লাগানো আছে।

“গুড। নরম ড্রাইভিং দস্তানা পরে নিলেন সেনটেইন।

“দশ নাম্বার বার্ডশট লোড করে শটগানকেও প্রস্তুত করে দিয়েছি। কেউ থামাতে চাইলেই ফায়ার করবেন। ব্যাটা মরবে না, তবে ঝাঁকুনি খাবে।”

আস্তে করে হেসে হুইলের পেছনে উঠে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলেন সেনটেইন।

“এছাড়াও বুটের ভেতরে স্যান্ডউইচ আর কফির ফ্লাক্স আছে।”

সাইড উইন্ডো দিয়ে জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “আপনি না থাকলে আমার যে কী হত।”

“প্লিজ সাবধানে থাকবেন। হিরে তো কিছু না। আমরা আরো মাটি খুঁড়ে বের করতে পারব। কিন্তু আপনি হলেন আপনিই। একক এবং একমাত্র।” নিজের কোমর থেকে সার্ভিস রিভলবারটা নিয়ে ড্রাইভার সিটের পেছনের পকেটে রেখে দিলেন জোনস। “আশা করছি হয়ত এটা ব্যবহারই করতে হবে না। গুড লাক!” পিছিয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলেন ডক্টর।

সেনটেইন স্টার্ট দিতেই মৃদু স্বরে নড়ে উঠল ডেইমলারের সাত লিটার ওজনের ইঞ্জিন। নিশানা করে ঘন্টায় চল্লিশ মাইল বেগে কাঁটাতারের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলেন বাইরের মেইন রোডে। তীব্র বেগে গর্জন করে সামনে ছুটল ডেইমলার।

কিন্তু হঠাৎ করেই পেছনের মেইন গেইট থেকে কোনাকুনি দৌড় দিল কয়েকজন পিকেটার। হেড লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে লোকগুলোর ক্রোধে উন্মত্ত মুখ। শটগান তুলে নিলেন সেনটেইন। এমন সময় ঠিক ডেইমলারের সমান্তরালে পৌঁছে গেল দু’জন পিকেটার।

তাদের পা বরাবর গুলি ছুড়লেন সেনটেইন। কানে তালা লাগানো শব্দের পাশাপাশি ঝলকে উঠল কমলা রঙের শিখা। চমকে উঠে পা দুটো চেপে বসে পড়ল বেচারা দুই খনি শ্রমিক। পাশ দিয়ে হুশ করে পার হয়ে গেল ডেইমলার।

***

“পেটি ফগার জুনো একা রাত তিনটায় মালামাল নিয়ে রওনা দিয়েছেন। এক্ষুণি তাই উনার এসকটের জন্য স্বশস্ত্র বাহিনি পাঠান।”

মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় হাতের প্যাডের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন লোথার ডি লা রে।

একা” আপন মনেই ফিসফিস করে বললেন, “জুনো একা মাল নিয়ে আসছে। ওহ খোদা, একা এতগুলো হিরে নিয়ে আসছে। দ্রুতহাতে হিসাব করে দেখলেন তিনটায় রওনা দিয়েছে তার মানে দুপুরের পর এক ঘণ্টার মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাবে।”

ডাগআউট থেকে বেরিয়ে নদীতীরে উঠে এলেন লোথার। চুরুট ধরিয়ে চোখ মেলে তাকালেন আকাশের দিকে। খানিক বাদেই চারপাশে ফুটে উঠল ময়ুররঙা ভোরের আলো।

 খানিক বাদে ডাগআউট থেকে বেরিয়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে এলেন হেনড্রিক। তারপর আগুনের ধারে এসেই দেখলেন লোথার চা বসিয়েছেন। আমাদেরকে পরিকল্পনা বদল করতে হবে।” চোখ পিটপিট করে তাকালেন হেনড্রিক। “কেন?”

“ও একাই হীরে নিয়ে আসছে। তার মানে এত সহজে কেড়ে নিতে দিবে না। আর আমি তাকে আহত করতে চাই না।”

“গোল্লায় যাও তুমি। আমি তো কিছুই বুঝতে_”

“তোমাকে এত কিছু বুঝতে হবে না।” খসখসে কণ্ঠে লোথার জানালেন, “আর এটাই একমাত্র কারণ নয়। একজন একাকী নারীর জন্যে একজন পুরুষই যথেষ্ট। ওতো তোমাকে চেনে। তাই তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি ম্যানির সাথে থাকবে। কাজ শেষ হলেই যেন রওনা দিতে পারি সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে।”

আসলে হেনড্রিককে তিনি যা জানালেন না তা হল, সেনটেইনের সাথে শেষবারের মত একাকী একবার দেখা করতে চান।

***

আচমকা রাস্তার উপর আলগা মাটি আর পাথর দেখে ধুলার মেঘ উড়িয়ে ব্রেক কষলেন সেনটেইন।

“ধুত্তরি।” এই রাস্তা পরিষ্কার করতে কিংবা আরেকটা পথ খুঁজে পেতে খালি খালি দেরি হবে ভাবতেই বাতাসে গালি ছুড়লেন। ডেইমলারকে খানিকটা পিছিয়ে এনে রেখে প্রথমবারের মত আতঙ্ক অনুভব করলেন সেনটেইন।

সামনে আর পিছনে দু’দিকেই ভেঙে পড়েছে রাস্তার কিনারা। উদ্বিগ্ন মুখে চারপাশে তাকাতেই প্রচণ্ড কাশিও পেল।

এরপর ধুলার মেঘ থামতেই দেখা গেল সামনের রোড। একপাশে একটু ব্লক করা হলেও চিকন একটা ফাঁকাও আছে। যদিও ডেইমলারের দেহ সেখান দিয়ে বেরোতে পারবে না। তবে গাড়িতে একটা কোদাল আছে। তাই এত্ত গরমে কয়েক ঘণ্টার পরিশ্রমের কথা ভাবতেই আবার মনে বিতৃষ্ণা এল। কিন্তু দরজার হাতলে হাত রেখেও অজানা এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠতেই ঝট করে চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকালেন সেনটেইন।

অনেক উপরের চূড়া থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে এক লোক। পরনের নীল শার্টে ঘামের দাগ। লম্বা-চওড়া মানুষটাকে দেখে সৈন্য কিংবা শিকারি বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভয়ংকর কথা হল কোমরের কাছের রাইফেলটা সোজা তার দিকেই তাক করা আর পরনের মুখোশটাও বেশ ভয়ের। লোকটা কী চায় তাও বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।

আর তারপরেই মনে পড়ল যে শটগানটাও রি-লোড করতে ভুলে গেছেন।

এমন সময়ে কথা বলতে লাগল আগন্তুক, ইঞ্জিন বন্ধ করে বাইরে বের হও!”

গাড়ি থেকে বের হলেও মরিয়া হয়ে চারপাশে তাকালেন সেনটেইন। আতঙ্ক ভুলে গিয়ে কী করা যায় তাই ভাবছেন। এক মনে সামনের ফাঁকা জায়গাটা দেখে ঠিক করলেন, “অন্তত বেরুবার চেষ্টা তো করা যায়।” নিচু হয়ে আবার তাই গাড়িতে ঢুকে গেলেন।

 “স্টপ!” গর্জে উঠল লোকটা। কিন্তু লো গিয়ারে ডেইমলার চালু করে দিয়েছেন সেনটেইন। লাফিয়ে আগে বাড়ল গাড়ি।

 লোকটার চিষ্কারের পাশাপাশি ক্যাবের উপর গুলির সতর্ক বার্তা পেলেও থামলেন না। প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে ছুটতেই একপাশে কাত হয়ে গেল ডেইমলার। সেনটেইন নিজেও থরথর করে কাঁপছেন। কোনোমতে হুইল চেপে ধরে সিটে বসে আছেন।

ডাইভার সিটের পাশের হুইল এসে মাটি পাথরের উপর ধাক্কা খেতেই উইন্ডশিন্ডের গায়ে আছাড় খেলেন সেনটেইন। বুনো পশুর মত ধাড়াম করে ধাক্কা খেল ডেইমলার। তবুও তিনি হুইল ছাড়লেন না।

চামড়ার মোড়ানো সিটের উপর ছিটকে পড়লেন সেনটেইন। টের পেলেন ডেইমলারের পেটের ভেতর যেন বক্সারের ঘুষি খেয়ে সেদিয়ে গেল একগাদা পাথর। কিচকিচ করে উঠল রাবারের টায়ার। এত যুদ্ধ করেও অবশেষে গুলির মত ছিটকে ওপাশে পড়ল ডেইমলার। প্রচণ্ড শব্দে কিছু ভেঙে পড়ার আওয়াজ পেলেন সেনটেইন। বাধা ভেঙে পেরিয়ে আসতে পারলেও আহত হয়েছে গাড়িটা। সাথে নিয়ন্ত্রণও চলে গেছে। স্টিয়ারিং নেই। থ্রটলও জ্যাম হয়ে গেছে।

তরতর করে নদীবক্ষে নেমে যাচ্ছে ডেইমলার। পাগলের মত চিৎকার করছেন সেনটেইন। ইগলিশন সুইচের জন্য হাত বাড়ালেও কাত হয়ে পড়ে গেলেন পাশের হিরের স্ক্যাটকেসের ওপর। সমানে দুলতে দুলতে এগোচ্ছে গাড়ি। পাজরে গুঁতো খেয়ে আবার দড়াম করে বিপরীত দিকে ছিটকে পড়লেন।

রাস্তার কিনার দিয়ে শুকনো নদীবক্ষে আছড়ে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে গড়িয়ে পড়লেন সেনটেইন। বলের মত ডাবল হয়ে নরম সাদা মাটিতে অবশেষে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু বুনো জানোয়ারের মত গর্জন করতে করতে গিয়ে দূরের নদীবক্ষে পড়ে গেল ডেইমলার। মাটিতে ডুবে গেল নাক। আকাশের উপর চাকা তুলে উপুড় হয়ে গেল বিশাল গাড়ি। বনেট ভেঙে বেরিয়ে আসা তেলে ভিজে গেল বালি।

দাঁড়িয়েই দৌড়াতে লাগলেন সেনটেইন। গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেল বালিতে। আতঙ্কে যেন সময়ের গতিও থেমে গেছে। মনে হচ্ছে কোনো এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছেন।

পেছনে তাকাবার সাহসও হচ্ছে না। ভয়ংকর মুখোশ পরিহিত লোকটা নিশ্চয়ই কাছে কোথাও আছে। যেকোনো মুহূর্তেই হয়ত এসে তার ঘাড় চেপে ধরবে কিংবা গুলি করবে। তারপরেও দৌড়ে ঠিক ডেইমলারের কাছে পৌঁছে গেছেন। হাঁটু গেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলেন ড্রাইভারের সিটের পাশে। শটগান তুলে নিয়েই গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট খুলে শেলগুলো বের কর নিলেন। কিন্তু হাত দুটো এত কাঁপছে যে হাঁটুর কাছে বালির ওপর ছড়িয়ে পড়ল সবগুলো বুলেট।

 কোনোমতে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে ফাঁকা ব্যবহৃত কার্টিজগুলো ফেলে দিলেও হঠাৎ করেই অস্ত্রটা কে যেন ছিনিয়ে নিয়ে নিল।

এসে গেছে তার আতঙ্ক। লোকটা বোধ হয় চিতা বাঘের মতই দৌড়াতে পারে। নয়ত এত দ্রুত কেমন করে চূড়া থেকে নেমে এল। খালি শটগান ছুঁড়ে ফেলে দিল লোকটা। পঞ্চাশ ফুট দূরে পড়লেও সে নিজেও খানিকটা ভারসাম্য হারিয়ে টলে উঠল। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন সেনটেইন। হাঁটু দুটো ভাঁজ করে সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার বুকের উপর আঘাত করলেন।

অপ্রত্যাশিত এই আক্রমণে দুজনেই একসাথে বালির ওপর আছাড় খেলেন, কিন্তু সেনটেইনই আগে নড়ে উঠলেন।

পিস্তল! মনে হতেই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে ডেইমলারের মাঝখানের দরজার হ্যাঁন্ডেল ধরলেন সেনটেইন। কিন্তু দরজা আটকে গেছে। তাড়াতাড়ি ড্রাইভার সিটের পেছন দিয়ে হাত ঢুকাতে চাইলেন। কিন্তু টের পেলেন কাঁধের মাংসের ভেতরে ঢুকে গেলো হাড়সর্বস্ব কতগুলো আঙুল। সাড়াশির মত ধার টেনে-হিঁচড়ে গাড়ির কাছ থেকে তাকে সরিয়ে আনল লোকটা। চট করে মাথা ঘোরাতেই ময়দার বস্তার মুখোশের মধ্যের ফুটোয় দেখা গেল একজোড়া মানুষের চোখ। সাথে সাথে সেদিক লক্ষ্য করে নখ ঢুকিয়ে দিলেন সেনটেইন।

লোকটা ঝাঁকি দিয়ে মাথা সরিয়ে নিলেও তার বুড়ো আঙুল আটকে যাওয়ায় চিবুক পর্যন্ত ছিঁড়ে গেল মুখোশ। লোকটা সেনটেইনের কব্জি ধরে ফেলল আর তৎক্ষণাৎ সরে যাওয়ার পরিবর্তে ডান হাঁটু দিয়ে অন্তকোষ লক্ষ্য কর প্রচণ্ড এক লাথি কষালেন সেনটেইন। ব্যথায় মোচড় খেলেও উরু দিয়ে তার হাঁটুতে শুতে দিল লোকটা।

কুঁকড়ে উঠলেও মাথা নিচু করে লোকটার কব্জি কামড়ে ধরলেন সেনটেইন। একই সাথে শরীরের নিম্নাঙ্গে সমানে কিল, ঘুষি চালাচ্ছেন। যদিও লাথির বেশিরভাগই লাগল লোকটার ইস্পাত কঠিন মাংসে কিংবা হাড়ে।

 সেনটেইনকে নিয়ন্ত্রণ করার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে লোকটা। বোঝ গেল যে এরকম বুনো আক্রমণের কল্পনাও করেননি। একই সাথে কব্জিতেও নিশ্চয় ব্যথা পাচ্ছে। সেনটেইনের মুখ ভরে গেল উষ্ণ আর নোনা রক্তে।

এবারের খালি হাত দিয়ে সেনটেইনের ঘন কোঁকড়া চুলের গোছা মুঠো করে ধরে পিছন দিকে হ্যাঁচকা টান দিল লোকটা। যে কোনো মুহূর্তে হয়ত মাথায় গুলি চালাতেও পারে। চোখ বন্ধ করে ফেললেন সেনটেইন। কিন্তু মনে হচ্ছে লোকটার সে ধরনের কোনো আঘাত করার প্ল্যানই নেই।

হঠাৎ করেই বুঝতে পারলেন যে মুখের ভেতরে কামড়ে রাখা কব্জির শিরা ছিঁড়ে ফেলছেন। কামড় একটুও আলগা না করে মুখের কোনা বেয়ে ফেলতে লাগলেন ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত। এতক্ষণে ব্যথায় মুষড়ে উঠল লোকটা। সেনটেইনের চোয়াল খামছে ধরায় জ্বলে উঠল চোখ।

 তবে এবারও লোকটাকে অবাক করে দিয়ে তার হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিলেন ডেইমলারের দিকে। ..

 এবারে সোজা ড্রাইভারের সিটের পেছনের পকেটে হাত ঢুকাতেই রিভলবারের হাতল পেলেন। কিন্তু ঘামে হাত তেলতেলে হয়ে কাঁপতে থাকায় আর কিছুতেই শক্ত করে ধরতে পারলেন না। এই ফাঁকে পেছনে চলে এল লোকটা। চুলের মুঠি ধরে পেছন দিকে টেনে রাখলেন। হাত থেকে স্বশব্দে ক্যাবের ভেতরে পড়ে গেল ভারি পিস্তল।

আবার লোকটার দিকে ঘুরেই রক্ত লাল দাঁত দিয়ে মুখোশটা কামড়ে ধরলেন সেনটেইন। ছেঁড়া মুখোশটা স্থানচ্যুত হয়ে খানিকক্ষণের জন্যে লোকটাকে অন্ধ করে দিল। আবারো দুজনে একসাথে জড়াজড়ি করে পড়ে গেলেন নিচে। আঁচড়ে কামড়ে যুদ্ধরত সেনটেইন। হঠাৎ করেই একেবারে শান্ত হয়ে হাঁ হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকালেন।

মুখোশের একটা অংশ পুরোপুরি খসে পড়ায় লোকটার চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

“লোথার।”

নিজের নাম শুনে লোকটাও চমকে উঠল। তবে খানিক বাদেই ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পুরো মুখোশ খুলে ফেললেন লোথার। তাড়াতাড়ি সেটা দিয়েই নিজের কব্জি পেঁচিয়ে নিলেন। আঘাতটা সত্যিই গুরুতর।

উঠে বসে লোথারের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। ফিসফিস করে জানতে চাইলেন,

“কেন এরকম করছো?”

“তুমি জানো কেন।” দাঁত দিয়ে কব্জির বাঁধনে গিট দিলেন লোথার আর একই ফাঁকে পড়িমড়ি করে ক্যাবের দিকে ছুট লাগালেন সেনটেইন। কিন্তু পিস্তল ধরার আগেই পেছন থেকে থেকে তাকে বালির উপর ফেলে দিলেন লোথার।

 তারপর তিনি নিজে পিস্তলটাকে তুলে খুলে ফেললেন ছুরি। উপরের বাহুতে খোঁচা দিয়ে রক্ত পড়া সাময়িকভাবে বন্ধ করলেন।

 “ওগুলো কোথায়? নিচে পড়ে থাকা সেনটেইনের উদ্দেশে বলে উঠলেন লোথার।

“কি নিয়ে কথা বলছো?”

উপুড় হয়ে ডেইমলারের ক্যাবের ভিতর থেকে কালো বাক্সটা বের করে আনলেন লোথার। জানতে চাইলেন “চাবি?”

ঘাড় তেড়া করে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। এবার আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বাক্সটাকে বালির উপর রেখে খানিকটা পিছিয়ে এলেন লোথার। পিস্তলের সিঙ্গেল একটা গুলিতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল বাক্সের তালা। ঢাকনার কালো রঙ উঠে বেরিয়ে পড়ল চকচকে ধাতু।

পিস্তলটাকে পকেটে পুরে ঢাকনা তুলে ফেললেন লোথার। ভেতরে বাদামি কাগজে মোড়া বেশ কয়েকটা ছোট ছোট প্যাকেট থরেথরে সুন্দর করে সাজানো আছে। মুখ আবার লাল মোম দিয়ে আটকানো একটা প্যাকেট হাতে তুলে নিতেই চোখে পড়ল জোনসের হাতের লেখা :

১৫৬ পিস, সর্বমোট ৩৮২ ক্যারট।

“আমি জানতাম যে তুমি একজন খুনী, কিন্তু এরকম ছিঁচকে চুরিও করো তা তো বুঝতে পারিনি।” বলে উঠলেন সেনটেইন।

“তুমি আমার নৌকা আর কোম্পানি চুরি করেছে। তাই চৌর্যবৃত্তি নিয়ে কথা না বলাই ভালো।” বাক্সটাকে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন লোথার। ঘুরে গিয়ে তারপর ডেইমলারের বুট চেক করে দেখলেন।

“গুড, বুদ্ধি করে সাথে বাড়তি পানি এনেছে। এই বিশ গ্যালন দিয়ে এক সপ্তাহ কাটতে পারবে। তার আগেই অবশ্য আব্রাহামের লোক চলে আসবে।”

“শুয়োর কোথাকার।” রাগে কাঁপছেন সেনটেইন।

“তবে যাবার আগে টেলিগ্রাফের তার কেটে দিয়ে যাবো।”

 “ওহ গড, লোথার।”

“গাড়িটার আশপাশেই থাকো। মরুভূমির প্রথম আইনই হল এটা। তাই। যত্রতত্র ঘুরে মরো না। দুই দিনের ভেতরে ওরা তোমাকে পেয়ে যাবে। বছরের পর বছর ধরে তোমার ছেলেকে আমি বড় করছি। অথচ তুমি ফিরে এসে আমার সমস্ত কিছু তছনছ করে দিলে।” বালি থেকে শটগানটাকে তুলে নিয়ে বড় একটা পাথরের উপর আছড়ে ভেঙে ফেললেন লোথার। তারপর নিজের মসার কাঁধে ঝুলিয়ে অন্য হাতে সুটকেসটাকে নিয়ে নিলেন। ব্যথায় টিনটন করছে আহত হাত।

“আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত করতে চাইনি আর কখনো তোমার সামনে আসব না সেনটেইন, গুড বাই।”

“আমাদের আবার দেখা হবে।” লোথারের কথায় বাধা দিলেন সেনটেইন। “তুমি আমাকে ভালোভাবেই চেন। তাই নিশ্চয় বুঝতে পারছে যে তোমার আজকের কাজের হিসাব পুরো না করা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না।

মাথা নাড়লেন লোথার, “আমি জানি।” তারপর ঘুরে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলেন।

“লোথার!” খানিকটা নরম হল সেনটেইনের গলা, “চলো একটা সমঝোতায় আসা যাক। আমার হিরের বিনিময়ে তোমার কোম্পানি আর নৌকাগুলোর দেনা মাফ করে দিচ্ছি।”

 “উঁহু, হু।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসলেন লোথার, “এখন আর সেগুলোর কোন কার্যক্ষমতা নেই, কিন্তু তোমার হিরে–

“সাথে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড আর আমি প্রমিজ করছি যে এ ব্যাপারে পুলিশকে কিছু জানাব না।” নিজের কণ্ঠস্বরে মরিয়া ভাব লুকাতে চাইলেন সেনটেইন।

“শেষবার আমি এমনভাবে অনুনয় করেছিলাম, মনে আছে? আর কোনো দর কষাকষি নয় সেনটেইন। আমি চললাম।”

“অর্ধেক লোথার, অর্ধেক হীরে অনন্ত রেখে যাও।”

 “কেন?”

 “একদা আমাদের মাঝে যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল তার খাতিরে?”

 তিক্ত কণ্ঠে হাসলেন লোথার “এর থেকে ভালো আর কিছু মাথায় এল?”

“অল রাইট। তাহলে শোনো, আমার অবস্থা এমনিতেই খারাপ। আর যদি তুমি এখন এগুলো নিয়ে যাও তাহলে আমি সর্বনাশ হয়ে যাবো।”

 “তুমি আমার নৌকাগুলো কেড়ে নেবার পর যেমন আমি হয়েছিলাম।”

 বালির উপর দিয়ে থপথপ করে হাঁটা শুরু করলেন লোথার। উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন,

 “লোথার ডি লা রে! তুমি আমার প্রস্তাব পায়ে ঠেলেছে। তাহলে আমার শপথও মনে রেখো, তোমাকে ফাঁসির দড়িতে না ঝোলানো পর্যন্ত আমি বিশ্রাম নেব না।”

একবারও পেছনে তাকালেন না লোথার। কেবল মাথা নাড়লেন।

লোখারের শরীর চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতেই বালির ওপর ধপ করে বসে পড়লেন সেনটেইন। টের পেলেন যে তাঁর কাঁপুনি কিছুতেই থামছে না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঠোঁট আর চিবুক থেকে মুছে গেল শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।

তবে মুখে নোনা স্বাদ পেতেই অনুভব করলেন ফিরে এল মনোভাব আর দেহের শক্তি। বহু কষ্টে উঠে ডেইমলারের কাছে গেলেন। কাকতালীয়ভাবে হলেও পানি এখনো জায়গামতই আছে। তাই মুছে ফেলতে পারলেন রক্ত আর চোখের জল।

তারপর উল্টানো ডেইমলারের বুটের কাছে গিয়ে হাত দিয়ে বালি সরিয়ে খুলে ফেললেন ডালা। দুটো বিশ গ্যালন পানির ক্যান আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিরের বোতল নিয়ে কিনারের দিকে বালুর মাঝে গর্ত করে লুকিয়ে ফেললেন যাতে পানি ঠাণ্ডা রাখা যায়। তারপর আবার ডেইমলারের কাছে এসে অধৈর্যভাবে খুঁজতে লাগলেন বাকি সারভাইভাল প্যাক। হঠাৎ করেই মনে হল হায় হায় টেলিগ্রাফ ট্যাপ বুঝি ফেলে এসেছেন। কিন্তু না টুল বাক্সে ঠিক পাওয়া গেল।

তারের বোঝা আর ট্যাপ ভর্তি হ্যাঁঙারসাক নিয়ে লোথারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পিছু নিলেন সেনটেইন। খানিক বাদেই লোথারের ঘোড়ার খুঁড়ের চিহ্নও পেয়ে গেলেন। দাগ দেখে এগোতেই দুইশ গজ দূরের টেলিগ্রাফ তার ছেঁড়ার জায়গাটা নজরে পড়ল। লাইন যেখানে নদী পার হয়ে গেছে সেখানে পৌঁছাতেই অনেক নিচে লোথারদের ক্যাম্পের অবশিষ্টাংশ চোখে পড়ল। তাড়াহুড়া করে বালি ছিটিয়ে আগুন নেভানো হলেও লাকড়ি এখনো ধিকিধিকি জ্বলছে।

তারের বান্ডিল আর হ্যাঙারসাক রেখে কিনার বেয়ে নিচে নেমে এলেন সেনটেইন। ডাগআউটে পৌঁছেই তিনটা ম্যাট্রেস দেখে বুঝতে পারলেন তারা বেশ কয়েকদিন যাবৎ এখানে থেকেছেন।

এখনো ম্যানফ্রেডকে নিজের ছেলে বলে ভাবতে পারেন না সেনটেইন। ধারণা করলেন সে ছাড়াও সোয়ার্টও সাথে ছিল।

ডাগআউট থেকে বেরিয়েও খানিক দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। যাই হোক পূর্বদিকে কালাহারি। লোথাররা নিশ্চয় সেদিকে যাবেন না।

 “তার মানে উইন্ডহকে ফিরবে।” অনুমান করেই পরবর্তী কর্তব্য ঠিক করে ফেললেন। এক্ষেত্রে কাজে লেগে গেল তার বুশম্যান ট্রেনিং।

“ওরা তাহলে দক্ষিণে গেছে।” এবার ক্যাম্পের দক্ষিণাংশ ঘুরে এসেও গতকালকের খুড়ের দাগ ছাড়া নতুন কোনো চিহ্ন না পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন।

“তাহলে কি উত্তরে? এদিকে তো ওকাভাঙ্গো নদী আর পর্তুগীজদের অঞ্চল।” যাই হোক কী মনে করে উত্তরে খুঁজতেই সাথে সাথে পেয়ে গেলেন তরতাজা খুড়ের দাগ।

“তিনজন ঘোড়সওয়ার সবার সাথে একটা করে বাড়তি ঘোড়া। এক ঘণ্টাও হয়নি রওনা দিয়েছে। লোথার হয় পাগল নয়ত মাথায় অন্য কোনো প্ল্যান আছে।” মাইলখানেক দাগগুলোকে অনুসরণ করে এগিয়েই বুঝতে পারলেন তার ধারণা কতটা সত্যি।

“লোকটা বদ্ধ পাগল। অ্যাংগোলা সীমানার দিকে গেছে। এখানেই তার পুরনো আস্তানাও আছে যখন আইভরি চোরাচালান করত। তাই সীমান্ত পার হবার আগেই ওকে ধরতে হবে।”

পরমুহূর্তেই মনে হল, “তার মানে কতটা সাবধানে সবকিছু পরিকল্পনা করেছে। আমরা পারব তাকে ধরতে?”

আবার নিজেই নিজেকে সাহস দিলেন, “টিকে থাকতে হলে আমাকে পারতেই হবে।”

এস্তপায়ে আবারো পরিত্যক্ত ক্যাম্পে ফিরে এলেন সেনটেইন।

মাটি থেকে ছেঁড়া টেলিগ্রাফের তার কুড়িয়ে নিজের ভালো তার পেঁচিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তারপর নিজের ট্যাপ সার্কিটে বসিয়ে টার্মিনালের সাথে শ্রু দিয়ে ড্রাই সেল ব্যাটারি লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল একটাও মোর্স কোড স্মরণ নেই। পরক্ষণেই অবশ্য সব আবার মনে পড়ে গেল। পিতলের চাবির উপরে দ্রুত তালে পড়তে লাগল হাতুড়ির বাড়ি।

“জুনো বলছি। শুনছো?”

 দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড বাদেই বিপ বিপ করে উঠল হেড ফোন, “বলুন”

সংক্ষিপ্ত কয়েকটা শব্দে জোনসকে ডাকাতি আর নিজের অবস্থান জানিয়ে বললেন,

“অবরোধকারীদের সাথে আলোচনা করে সমঝোতা করে নিন। কারণ হিরে উদ্ধার করা প্রথম জরুরি কাজ। তারপর ট্রাক নিয়ে উত্তরে ওচি প্যানে চলে যান আর মনগঙ্গো জঙ্গলে বুশম্যানদের বসতি খুঁজে বুশলিডার কিউয়িকে বলুন “নাম চাইল্ড কালেয়া।” কিউয়িকে আপনার সাথে নিয়ে আসবেন।” বুশম্যানদের ভাষায় কালেয়া মানে হল “সাহায্য প্রার্থনা।” যা কোনো গোত্রের সদস্যই অবহেলা করতে পারে না।

 মেসেজ পাঠানো শেষ করে হলুদ সিষ্কের স্কার্ফ দিয়ে মুখমণ্ডলের ঘাম মুছে ফেললেন সেনটেইন। এরপর আঙুলগুলোকে খানিক ব্যায়াম করে নরম বানিয়ে আবারো কী বোর্ড নিয়ে উইন্ডহকে মেসেজ পাঠাতে বসলেন।

অপারেটর একটু আগে জোনসের কাছে পাঠানো বার্তা পেয়েছে নিশ্চিত হয়ে বললেন,

“আগের মেসেজসহ এখন যা বলব সবকিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল ব্লেইন ম্যালকমসকে জানাবে। ডাকাতকে ধরা আর চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধারে উনার সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এছাড়াও গত তিন মাসে খুব বড়সড় কোনো ঘোড়া চুরির ঘটনায় লোথার ডি লা রের বিরুদ্ধে রিপোর্ট পেয়েছে কিনা তাও জানাও।”

অপারেটর সেনটেইনের বার্তা লিখে নিয়ে পাল্টা জানাল,

“পেটিফগার জুনোর নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তিত। উইন্ডহক থেকে ভোর পাঁচটায় সশস্ত্র পাহারাদার বাহিনি রওনা দিয়েছে। তাই সেখানে জুনো ম্যালমসের জন্য অপেক্ষা করলে ভালো হয়।”

কাজ সেরে অপেক্ষা করার সময় পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাবতে লাগলেন সেনটেইন।

কয়েকটা ব্যাপার পুরোপুরি পরিষ্কার। যেমন সোজা পথে লোথারকে ধরা যাবে না। তার মানে ঘোড়া চাই। ট্রাক নিয়ে কোনো কাজ হবে না। এসব এলাকাতে চষে বেড়ানোর ফলে লোথার এ অঞ্চল যতটা ভালোভাবে জানে কোনো শ্বেতাঙ্গ তা পারবে না। তবে হ্যাঁ বুশম্যান কিউয়ির কথা আলাদা।

চোখ বুজে উত্তরাঞ্চলের মানচিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করলেন সেনটইন। বিশাল এই নিষিদ্ধ মরুভূমিকেই বলা হয় বুশম্যানল্যান্ড।

যেহেতু সাথে ঘোড়া আছে লোথার পানির কাছে অবশ্যই যাবে আর পনের বছর আগে তাকে দত্তক নেয়া দাদাজানের কাছে এরকম দুটো জায়গার কথা শুনলেও সে স্মৃতি অনেকটাই ভুলে গেছেন সেনটেইন।

হঠাত করেই টেলিগ্রাফের বিপ বিপ শব্দে ছিঁড়ে গেল চিন্তার সুতো। আগ্রহ নিয়ে পড়ে দেখলেন :

 ম্যালকমস জানিয়েছেন গত মাসে ওকাহান্ডার মিলিটারি ক্যাম্প থেকে ছাব্বিশটা ঘোড়া চুরি গেছে। আর কি প্রয়োজন তাও জানতে চেয়েছেন ম্যালকমস।

“দেখেছ, আমার ধারণাই ঠিক। লোথার পুরো মরুভূমিতেই পোস্ট বসিয়েছে।” আপন মনে উত্তরাঞ্চলের মানচিত্র স্মরণ করে দূরত্ব মেপে আবার বার্তা পাঠালেন সেনটেইন।

“ডাকাতের দল সোজা ওকাভাঙ্গো নদীমুখে যাচ্ছে। বাড়তি ঘোড়াসহ মরুভূমির বিষয়ে দক্ষ এমন ভ্রাম্যমাণ বাহিনি পাঠিয়ে দিন। কালক্রান্ড মিশন স্টেশনে বুশম্যান নিয়ে আমিও যাচ্ছি।”

***

উইন্ডহকের বাহিনির আগে জোনসই সেনটেইনের কাছে পৌঁছে গেলেন। কোম্পানির ট্রাককে এগিয়ে আসতে দেখেই মাথার উপর দু’হাত তুলে ইশারা দিতে দিতে দৌড়ে গেলেন সেনটেইন।

লাফ দিয়ে নেমেই লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়ে এলেন জোনস। সাথে সাথে সেনটেইনকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“থ্যাঙ্ক গড, আপনি সুস্থ আছেন।”

কিন্তু কী করছেন বুঝতে পেরেই তাড়াতাড়ি সেনটেইনকে ছেড়েও দিলেন। বোঝা গেল বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন।

“কিউয়িকে পেয়েছেন?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“ওই তো ট্রাকে আছে।”

দৌড় দিয়ে ট্রাকের কাছে গেলেন সেনটেইন। কিউয়ি আর তার ভাই মোটা কিউয়ি ভয়ে জড়োসডো হয়ে বসে আছে। তাদের জন্যে এ অভিজ্ঞতা পুরোপুরি নতুন।

 সেনটেইনকে দেখেই তাই আনন্দে কিচির-মিচির করতে করতে নাম চাইল্ড” বলে এগিয়ে এল।

 “ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমাদের সাথেই আছি। আর এরা সকলেই ভালো লোক। ভেবে দেখ তো ফিরে গেলে পুরো কালাহারির মধ্যে তোমরা কত গল্প করবে। একেবারে বিখ্যাত হয়ে যাবে।” ছোট্ট শিশুর মত জড়িয়ে ধরে দুই ভাইকে আশ্বস্ত করলেন সেনটেইন।

 “এখন আমরা কিছু দুষ্ট লোককে খুঁজে বের করব যারা আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছে। তোমরা তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমাকে নিয়ে যাবে। তারপর তোমাদেরকে এত উপহার দেব যা কেবল এতদিন স্বপ্নেই দেখেছ। আর এরপর তোমাদের দুভাইয়ের গুনগান করবে সকলে, তাহলে এখন তাড়াতাড়ি চলো সেই শয়তানগুলোকে খুঁজে বের করি।”

জোনসের কাছে ফিরে এলেন সেনটেইন।

 “ডি লা রে ইন্ডাস্ট্রিট্রিয়ালগুলো রেখে গেছে। আমি সেগুলোকে নদীর তীরে পুঁতে রেখেছি।” কিন্তু জোনসের সাথে বাকি দুজনকে দেখে তো তার চোখ বিস্ময়ে থ বনে গেল। গারহার্ড ফুরি আর ম্যাক্লিয়ার।

“আপনাকে সুস্থ দেখে আমরা সবাই সত্যি খুশি হয়েছি মিসেস কোর্টনি।” লাজুক গলায় জানাল ম্যাকক্লিয়ার। “যা করার দরকার আমরা সব করব। একসাথে”।

 “ধন্যবাদ ম্যাক্লিয়ার, কারণ হিরে নেই মানে বেতনও নেই। এখন আমরা সবাই মিলে কালক্লান্ডে যাবো। ফুয়েল আছে তো ফুরি?

“সকালের ভেতরেই সেখানে পৌঁছে দেব, মিসেস কোর্টনি।” প্রমিজ করল ড্রাইভার।

ফুরি তাদেরকে যে পথ দিয়ে কালক্রান্ড নিয়ে এল তা তাদেরকে লোথারের প্রায় ৮০ মাইল কাছাকাছি নিয়ে এল। তবে এমনট হতে পারে যে সেনটেইনের অনুমান ভুল। যদিও এরকম সম্ভাবনার কথা তিনি মাথায়ও আনতে চাইছেন না।

“মনে হচ্ছে গত কয়েক ঘণ্টায় এখান দিয়ে আরো কয়েকটা ট্রাক গেছে। আপনার কী মনে হয় ম্যালকমদের পাঠানো পুলিশ বাহিনি? উইডস্ক্রিনের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে জোনসের কাছে জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“হলে তো ভালোই হত। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সাপ্লাই কনভয়। হয়ত মিশন স্টেশনে ঘোড়া আর পুলিশের জন্য আমাদেরকেও অপেক্ষা করতে হবে।”

খানিক বাদেই সামনে দেখা গেল মিশন স্টেশনের ছাদ। তারপর আরো একটু সামনে এগোতেই উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন, “লুক! গির্জার পাশেই ট্রাক” উইন্ডমিলের কাছে ঘোড়া। আরে দেখুন উর্দি পরা সৈন্য। কর্নেল ম্যালকমস তার প্রমিজ রেখেছেন।”

 বালিরঙা পুলিশ ট্রাকের পাশেই থামল ফুরি। সাথে সাথে নেমে দৌড় দিলেন সেনটেইন। ছোট্ট চার্চের পাশের দালানের বারান্দায় বেরিয়ে এল লম্বা চওড়া এক দেহ। হালকা পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এগিয়ে এল তার দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে সেনটেইন জানালেন, “কর্নেল ম্যালকমস’ আমি আশা করিনি যে আপনি নিজে এখানে আসবেন।”

“আপনি সম্পূর্ণ সহযোগিতা চেয়েছেন মিসেস কোর্টনি হাত বাড়িয়ে দিলেন ম্যালকমস। পরস্পরের হাত বেয়ে সাথে সাথে যেন প্রবাহিত হল নীল বিদ্যুৎতরঙ্গ।

“আপনি নিশ্চয় মরুভূমিতে যাচ্ছেন না?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“আমি না গেলে আপনিও যাচ্ছেন না কিন্তু।” হেসে ফেললেন ম্যালকমস, প্রধানমন্ত্রী জেনারেল হার্টজাগ আর বিরোধী নেতা জেনারেল মুট দু’জনেই আমাকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন যেন আপনাকে চোখের আড়াল না করি। “কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। নয়ত বুশম্যান দু’জনকে কেউ সামলাতে পারবে না। আর ওরা ছাড়া ডাকাতেরা উধাও হয়ে গেলেও কিছু করার থাকবে না।”

বুঝতে পেরে মাথা নাড়লেন ম্যালকমস, “তাহলে আমাদের দুজনকেই যেতে হবে। এরপর হঠাৎ করেই স্কুল পড়ুয়া দুষ্টু ছেলের মত হাসি দিয়ে বললেন, “আমি ছাড়া আপনার আর কোন গতি নেই।”

 একমুহূর্তের জন্য লোথার, হিরে, ম্যালকমসের স্ত্রী- সবার কথা ভুলে গেলেন সেনটেইন। কেবল মনে হল এই সুযোগ। তারা দুজন একাকী সময় পাচ্ছেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে জানতে চাইলেন,

“আমরা কখন রওনা দিচ্ছি?”

তাড়াতাড়ি পিছু ফিরে হাঁক দিলেন ম্যালকমস, “সবাই যার যার ঘোড়ায় চড়ে বসো। আমরা এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি।”

আর সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “আপনার মনোভাবটা এবার খুলে বলুন। আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

হেসে ফেললেন সেনটেইন, “আপনার কাছে কোন ম্যাপ আছে?”

“এদিকে আসুন।” সেনটেইনকে মিশন অফিসে নিয়ে দু’জন ডমিনিকান ফাদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ম্যালকমস। তারপর ডেস্কের ওপর বিছিয়ে বসলেন নিজের লার্জ স্কেল ম্যাপ।

 “এখানে ডাকাতি হয়েছে” আঙুল দিয়ে মানচিত্রে লোথারের ক্যাম্প দেখালেন সেনটেইন “তারপর ওরা এই দিকে গেছে। পর্তুগিজের উদ্দেশে। কিন্তু তাহলে তো তিনশ’ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে।”

“তাহলে আপনি পূর্বদিকে এগিয়ে পথিমধ্যে ওদেরকে আটকাতে চান। এটা তো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মত হয়ে যাবে।”

“পানি। নিশ্চয়ই বাড়তি ঘোড়াগুলোকে পানির কাছে ছেড়ে যাবে, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।”

“কিন্তু এরকম কোনো জায়গা তো দেখছি না?”

“মানচিত্রে না থাকলেও সে ঠিকই জানে কোথায় পাওয়া যাবে। আমার বুশম্যান দু’জনও বলতে পারবে।”

মানচিত্র ভাঁজ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ব্লেইন। “আপনার সত্যি মনে হচ্ছে এরকমটা সম্ভব?”

“আপনাকে মাথায় রাখতে হবে যে সে এই মরুভূমিতেই সারা জীবন চড়ে বেরিয়েছে। তাই ওকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।”

“লোকটার রেকর্ড চেক করে দেখেছি আমি।” ম্যাপটাকে লেদার কেসে ভরে মাথায় খাকি রঙের শোলার হেলমেট পরে নিলেন ব্লেইন। উচ্চতা যেন আরো বেড়ে গেল তাতে। “বিপজ্জনক লোকটার মাথার দাম একবার দশ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত উঠিয়েছিল পুলিশ।”

দরজায় দেখা দিলেন এক সার্জেন্ট, “সব প্রস্তুত কর্নেল।”

“মিসেস কোর্টনির ঘোড়ায় লাগাম পরানো হয়েছে?”

“ইয়েস স্যার।” বাদামিরঙা পেশিবহুল লোকটাকে দেখে সেনটেইনও খুশি হলেন।

“উনি সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার” সেনটেইনকে স্যালুট করলেন সার্জেন্ট।

 তারপর দ্রুত ফাদারদের সাথে করদর্শন করে বাইরে চলে এল সবাই।

জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “আপনার সাথে যেতে পারলে খুশিই হতাম মিসেস কোর্টনি। কিন্তু আজ থেকে বিশ বছর আগে হলে এটা কোনো ব্যাপারই ছিল না।”

সদয় ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন, “আমাদের জন্য শুভ কামনা করবেন সেটাই যথেষ্ট।”

নিজের ঘোড়ায় চেপে ব্লেইনের পাশে চলে এলেন সেনটেইন। তারপর বুশম্যান ভাইদেরকে ডেকে বললেন, “আমাদেরকে পানির কাছে নিয়ে চলো কিউয়ি।”

জন্মসূত্রে দৌড়াতে ওস্তাদ বুশম্যান ভাইদের পিছু নেয়ার জন্য দৌড়াতে লাগল সেনটেইনদের ঘোড়ার পাল।

পরস্পরের পাশাপাশি নীরবে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন সেনটেইন আর ব্লেইন। পেছনে সার্জেন্ট আর চার সেনা সদস্য। চোখের কোনা দিয়ে অবশ্য ম্যালকমসকে ঠিকই খেয়াল রেখেছেন সেনটেইন। বুঝতে পেরেছেন কেন পোলো প্লেয়ার হিসেবে এত বিখ্যাত কর্নেল সাহেব!

 নরম পাথুরে স্তর পার হয়ে প্রথমবারের মত কথা বল “আপনার কথাই ঠিক। এ পথে ট্রাক নিয়ে আসা যেত না।”

সামনে বুশম্যান ভ্রাতৃদ্বয় একবারও না থেমে সোজা দৌড়ে চলেছে। নিশ্চিতভাবে চেনে তাদের গন্তব্য। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় অবশ্য যাত্রা থামিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে নিজের লোকদের খবর নিচ্ছেন ব্লেইন। পাঁচ মিনিট বিরতি দিয়ে আবার শুরু হচ্ছে যাত্রা।

পুরোপুরি অন্ধকার নামার পর সবাইকে আমার নির্দেশ দিলেন কর্নেল। পানি আর ঘোড়াগুলোর তদারক করে তারপর এলেন অগ্নিকুণ্ডের কাছে। এখানেই বসে আছেন সেনটেইন। বুশম্যানদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজের আর ক্লেইনের জন্য খাবার বানিয়েছেন।

“ম্যান থেকে ক্যাঙিয়ার বাদ দিতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত স্যার। বিফ স্টু দিয়েই কাজ সারতে হবে।”

 পেট ভরে তাই খেলেন কর্নেল। তারপর আগুনের লাকড়ি থেকে চুরুটও ধরালেন। মুগ্ধ কণ্ঠে সেনটেইনকে জানালেন “এভাবে খেতে পারাটা আসলেই উপাদেয়।”

 ঘোড়ার জিনের কাপড় এনে বসলেন ব্লেইন। সকালের জন্য প্যাকিং শেষ করে এলেন সেনটেইন। তারপর খানিক দ্বিধা করলেও অবশেষে এসে কর্নেলের পাশেই বসে পড়লেন। দুজনের মাঝে মাত্র ইঞ্চিখানেকের ফাঁক।

***

পরদিন সকালবেলা। ভোরের আলো ফোঁটারও বহু আগেই বেরিয়ে পড়েছে পুরো দল। পথ দেখাচ্ছে বুশম্যান দুই ভাই। একটু পরেই সূর্য উপরে উঠে পড়ায় গরমে টেকা দায় হয়ে পড়ল। এমনকি ঘোড়ার পিঠে ঘাম শুকিয়ে সাদা লবণের ক্রিস্টাল জমে গেল।

হঠাৎ করেই থেমে গেল কিউয়ি। বোচা নাক টেনে বাতাসে কিসের যেন গন্ধ শুকলো, মোটা কিউয়িও একই রকম করছে।

 “ওরা কী করছে?” পেছন থেকে জানতে চাইলেন ব্লেইন। কিন্তু সেনটেইন উত্তর দেবারও ফুরসৎ পেলেন না। বাঁশির মত সুর তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে কিউয়ি।

“পানি।” ঘোড়ার পিঠে সিধে হয়ে বসলেন সেনটেইন, “ওরা পানির গন্ধ পেয়েছে।”

“আপনি সিরিয়াস?” হা করে তাকিয়ে আছেন ব্লেইন।

“প্রথম দেখলে আমারো বিশ্বাস হত না। ওয়া তত পাঁচ মাইল দূর থেকেই গন্ধ পেত।” চলুন আপনাকে প্রমাণ দেখাই। হেসে ঘোড়া হোটালেন সেনটেইন।

ধুলার কুয়াশার মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠল বেগুনিরঙা ছোট শিলা পাহাড়। নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসল সেনটেইনকে। জায়গাটা তিনিও চিনতে পেরেছেন। শেষবার যখন এখানে এসেছেন তখন পেটে শাসা ছিল।

কিন্তু তার আগেই পাশাপাশি থেমে গিয়ে পায়ের নিচের মাটি পরীক্ষা করতে লাগল দুই বুশম্যান। কিচির-মিচির করে সেনটেইনকে কিছু বলতেই তিনি নিজেও বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

 “ঘোড়ার খুঁরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। নির্ঘাত লোথার ডি লা রে। আমার আর কোনো সন্দেহই নেই। দক্ষিণ দিক থেকে তিন ঘোড়সওয়ার এসে ঝরনার দিকে গেছে।”

 নিজের স্বস্তি লুকাতে হিমশিম খাচ্ছেন সনটেইন। তার মানে তাঁর অনুমান সঠিক। লোথার আর হিরে আর খুব বেশি দূরে নেই।

 কতক্ষণ আগে কিউয়ি?” উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চাইলেন কিউয়ির কাছে।

“আজ সকালে নাম চাইল্ড।” আকাশের দিকে তাকিয়ে রি অবস্থান ইশারা করে লোথারদের সময় জানাল কিউয়ি।

“সূর্যোদয়ের ঠিক পরে। অতএব আমরা মাত্র আট ঘণ্টা পিছিয়ে আছি।”

“তার মানে আরো বহুদূর বাকি। প্রতিটা মিনিটকে কাজে লাগাতে হবে। চলুন রওনা দেই।” ব্লেইনও সিরিয়াস হয়ে উঠেছেন।

 ছোট্ট পাহাড়টা থেকে আধমাইল দূরে থাকতেই সেনটেইন আবার জানালেন, “কয়েক সপ্তাহ ধরে এখানে আরো একপাল ঘোড়া থেকে গেছে। সবদিকেই চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। অর্থাৎ লোথার এখানে নিজের লোকদেরকে প্রস্তুত রেখেছিল।” পাহাড়ের নিচে তিনটি কালো টিবি মতন দেখে চুপ করে গেলেন আবার।

“এগুলো কী?” ব্লেইন নিজেও অবাক হয়ে গেছেন।

“মৃত ঘোড়া। কাছে যেতেই চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন, “ক্লান্ত ঘোড়াগুলোকে মেরে রেখে গেছে লোথার।”

 “না। কোনো বুলেটের গর্ত তো দেখছি না।” ঘোড়া থেকে নেমে পরীক্ষা করে দেখলেন ব্লেইন।

চারপাশে তাকিয়ে কিউয়িকে কাছে ডাকলেন সেনটেইন “এবার ঘোড়ার দাগ কোথায় গেছে দেখো।” তারপর নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা সামনের ঝরনার দিকে এগোলেন।

ছোট্ট পাহাড়টার নিচেই পাওয়া গেল ঝরনা। পনের ফুট তলায় চকচক করছে পানি। পাহাড়ের পাশেই এক স্তর নরম শিলা এমনভাবে বারান্দার মত ঝুলে আছে যে পানির ওপর সরাসরি সূর্যের তাপ পড়তে পারে না। বাথটাবের মত ছোট্ট এই পুলটাতে সেনটেইনের জানামতে লবণ আর বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আর একই সঙ্গে পশু-পাখির মল মূত্রও মিশে আছে।

 কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুলটাতে মনোযোগ দিলেও কিনার ঘেঁষে মানুষের হাতে তৈরি ছোট্ট কাঠামোটা দেখে আঁতকে উঠে মুখে হাতচাপা দিলেন সেনটেইন।

মোটা একটা কাঁটাগাছ তুলে সাইনপোস্ট হিসেবে মাটিতে পুঁতে পাথরের পিরামিড বানিয়ে সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। একেবারে উপরে খালি একটা হাফ গ্যালনকে হেলমেটের মত পরিয়ে রাখা হয়েছে। এর উপরে কালো কালিতে লেখা এই কুয়া বিষাক্ত আর্সেনিক।

সেনটেইনের পাশে চলে এলেন ব্লেইন। নিঃশব্দে সাইনটা পড়ে জানালেন, ঘোড়াগুলো তাহলে এ কারণেই মারা গেছে।” রাগে কেঁপে উঠল কর্নেলের গলা। ঘোড়ার নাক ঘুরিয়ে নিজের সৈন্যদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, “সার্জেন্ট, বাকি পানির অবস্থা কী? এই কুয়াটা বিষাক্ত। এটার পানি খাওয়া যাবে না।” নরম সুরে শিস দিয়ে উঠলেন হ্যানসমেয়ার,

“তাহলে তো ভালোই হল। আবার কালক্রান্ডে ফিরে যেতে হবে।”

 রাগ আর হতাশায় সেনটেইন নিজেও কাঁপছেন। “এত সহজে পার পেয়ে, গেল শয়তানটা।”

পানির গন্ধ পেয়ে ছাড়া পাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে তার ঘোড়া। তাই বহু কষ্টে থামাতে হচ্ছে অবোধ জীবটাকে।

 আবারো এগিয়ে এলেন ব্লেইন, “আয়্যাম সরি সেনটেইন। আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। পানি ছাড়া এগোনো আত্মহত্যারই শামিল।” আস্তে করে জানালেন কর্নেল।

“আমি জানি।”

“নোংরা একটা চাল চেলেছে ব্যাটা। মরুভূমির মাঝে এরকম বিষাক্ত পানির পরিণাম ভয়াবহ হয়। আগেও একবার এর নজির দেখেছি। ১৯১৫ সালে যখন ওয়ালবিসে ছিলাম-ছোট কিউয়ি কিচির-মিচির করে এগোতেই থেমে গেলেন কর্নেল। জানতে চাইলেন, “ও কী বলছে?”

“ওদের মধ্যে একজন নাকি অসুস্থ। কিউয়ি এই ব্যান্ডেজগুলো পেয়েছে।” তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিউয়িকে আদেশ দিলেন সেনটেইন, “জলদি হাত থেকে ফেলো কিউয়ি।” পুঁজের বদগন্ধ পাচ্ছেন। নিজের বেয়নেটের হাতল দিয়ে বালির উপর ফেলে কাপড়গুলোকে পরীক্ষা করে দেখলেন ব্লেইন।

“মুখোশ!” লোথারের ময়দার বস্তার ফালি আর খাকি শার্টের ভেঁড়া অংশ চিনতে পারলেন সেনটেইন।

“অন্যরা যখন ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত তখন অসুস্থ লোকটা মাটিতে শুয়ে ছিল। তারপর সবাই মিলে তাকে ঘোড়ায় উঠিয়েছে।” ঘোড়ার খুড়ের চিহ্ন দেখে গড়গড় করে বলে দিল কিউয়ি।

“ধস্তাধস্তির সময় আমি ওর হাতে কামড় দিয়েছিলাম, হাড় পর্যন্ত আমার দাঁত লাগায় আঘাতটা বেশ গম্ভীর হয়েছে।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন।

“মানুষের কামড় সাপের কামড়ের মতই মারাত্মক।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “আর সাথে সাথে চিকিৎসা না হলে ব্লাড পয়জনিং হয়ে যাবে। লোথার ডি লা রে গুরুতরভাবে অসুস্থ। সাথে যদি পানি থাকত তাহলে ওকাভাঙ্গোর নদীর কাছে পৌঁছাবার আগেই তাকে ধরতে পারতাম।” সেনটেইনের গোমড়া মুখ দেখার ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘোড়া ঘুরিয়ে সার্জেন্টের দিকে চলে গেলেন কর্নেল, “রাতের বেলা আবার আমরা রওনা দেব। ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই হাফ অংশ করে পানি পাবে।”

কিন্তু সেনটেইন স্থির থাকার পাত্রী নন। ঘোড়া নিয়ে আবার পুলের কাছে। ফিরে এলেন,

“এভাবে কী করে করতে পারলে লোথার? এরকম ভয়ংকর একটা কাজ?”

কী মনে হতেই ঘোড়া থেকে নেমে উপুড় হয়ে কিনারে বসে আঙুল দিয়ে পানি স্পর্শ করলেন। ঠাণ্ডা, পুরোপুরি মৃত্যুর মতই ঠাণ্ডা সে পানি।

মনে পড়ে গেল ব্লেইনের মন্তব্য। একই সাথে স্মৃতির গহীন থেকে উঁকি দিল লোথারের প্রায়শ্চিত্তের কথা। তাকে একবার লোথার বলেছিলেন।

“আমরা আসলে বাধ্য হয়ে কাজটা করেছিলাম। ইউনিয়ন ফোর্স এত পিছু নিয়েছিল যে না করে উপায় ছিল না, কিন্তু পরিণামটা যদি জানতাম।”

তখন লোথারকে সত্যিই ভালোবাসতেন সেনটেইন। উঠে গিয়ে তাই ওর হাত ধরে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কিন্তু লোথার বলেছিলেন, “এ ধরনের মূর্খামি আমি আর করিনি। এক মাস পরে খুনীর মত আবার ফিরে গিয়েছিলাম সেখানে। জেব্রা, ডোমসবক, পাখি, শিয়াল এমনকি শকুন পর্যন্ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ লজ্জা আমি কিছুতেই ভুলতে পারব না।

ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসলেন সেনটেইন। উত্তেজনার চোটে ভুলে গেলেন ক্রোধ। পানি আবার স্পর্শ করে ঢেউ বানিয়ে দিলেন।

“না, সে সত্যিই লজ্জিত ছিল। একই কাজ আর দুবার করবে না।”

জোরে চিৎকার করেই কাঁপতে লাগলেন সেনটেইন, “এই নোটিশটা আসলে ভুয়া।” কিন্তু মৃত ঘোড়াগুলোর কথা মনে হতেই আবার থেমে গেলেন। “হয়ত বালতিতে ভরে ওগুলোকে খাওয়ানো হয়েছে। পুরো পুকুরে নিশ্চয়ই কিছু মেশায়নি।”

এরপর মাথা থেকে টুপি খুলে উপরকার ময়লা সরিয়ে পানি ভরে নিলেন সেনটেইন। কিন্তু যেই না পানিতে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবেন পেছন থেকে চিৎকার করে ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে পানি ফেলে সেনটেইনের হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন রেইন। রাগে ধকধক করে জ্বলছে কনেলের চোখ, “পাগল হয়ে গেলেন নাকি?”

এত জোরে সেনটেইনকে ধরেছেন যে হাত কেটে বসে গেল ব্লেইনের নখ।

“ব্লেইন আমি ব্যথা পাচ্ছি।”

“ব্যথা? মন চাইছে আপনাকে চড় লাগাই”।

“আরে ব্লেইন এসব কিছুই ভুয়া। আমি নিশ্চিত, প্লিজ আমার কথা শুনুন।” কর্নেলের এরকম আচরণে সেনটেইনও ভয় পেয়ে গেছেন। তাকে ছেড়ে দিলেন ব্লেইন।

 “আমি সত্যি বলছি। সে পানিতে কোনো বিষ মেশায়নি। বাজি ধরে বলছি, সত্যি।”

 “কিন্তু কীভাবে বুঝলেন?” ঘোঁত ঘোঁত করলেও আগ্রহ বোধ করলেন ব্লেইন।

ওর সাথে আমার পরিচয় ছিল। তখন ওকে ভালোভাবেই চিনতাম। একবার এরকম করেছে ১৯১৫ সালে। কিন্তু তারপর আর না করার শপথ ও নিয়েছে।”

“তাহলে মৃত ঘোড়াগুলো?”

“হ্যাঁ সেগুলোকে হয়ত বিষ খাইয়েছে। তাছাড়া ওগুলো এমনিতেই ক্লান্ত ছিল। হয়ত সিংহের পেটেই যেত। তাই ও নিজেই শেষ করে দিয়ে গেছে।”

লম্বা লম্বা পা ফেলে পানি কিনারে গিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলেন ব্লেইন।

“তার মানে আপনি এই সুযোগ– “ থেমে গিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সার্জেন্টকে ডাকলেন কর্নেল,

“সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার।”

 “স্যার” এস্তপায়ে দৌড়ে এলেন সার্জেন্ট।

 “ক্লান্ত একটা ঘোড়া নিয়ে এসো আমার কাছে।”

সার্জেন্ট কথামত কাজ করতেই আবার আদেশ দিলেন, “ওকে পানি খাওয়াও।”

 “স্যার?” অবাক হয়ে গেলেন সার্জেন্ট। এতে বিষ আছে স্যার।”

“আছে কিনা আমরা সেটাই খুঁজে বের করব। পানি খাওয়াও।”

ছেড়ে দিতেই লম্বা গলা ডুবিয়ে পুকুরের পানি খেতে লাগল কালো ঘোটকীটা।

সবার চোখের সামনেই ফুলে ঢোল হয়ে গেল ঘোড়ার পেট।

“আমি কিন্তু ঘোড়া ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করিনি। যদি আমার অনুমান মিথ্যা হয়!” ফিসফিসিয়ে বললেন সেনটেইন।

খানিক বাদেই কর্নেল আবার আদেশ দিলেন, “সার্জেন্ট ওকে লাইনে নিয়ে যাও।”

তারপর নিজের হাতঘড়ি চেক করে বললেন, “ঘোড়াটাকে এক ঘণ্টা সময় দিলাম।” এরপর সেনটেইনের হাত ধরে পাথরের ছাদের নিচে ছায়ায় বসিয়ে দিলেন। জানতে চাইলেন, “এত ভালোভাবে ওকে কীভাবে চিনতেন?”

 “আমার কর্মচারী ছিল, সেও অনেক বছর আগে। খনির প্রথম দিককার শ্রমিক। ইঞ্জিনিয়ার, জানেন তো।”

 “হুম। ফাইলে পড়েছি।” কিছুক্ষণ চুপ করে জানালেন, “তবে নিশ্চয়ই বেশ সুসম্পর্ক ছিল? একজন মানুষের অপরাধ জানা চাট্টিখানি কথা নয়।”

কিছু না বলে চুপ করে রইলেন সেনটেইন।

কিন্তু মিটিমিটি হাসলেন ব্লেইন। “আসলে হিংসা মোটেও সুখকর কিছু নয়। ঠিক আছে। বাদ দিন। আমি আমার প্রশ্নটা তুলে নিচ্ছি।”

ব্লেইনের কাঁধে হাত দিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি দিলেন সেনটেইন।

তাকিয়ে দেখলেন মিশন ছাড়ার পর থেকে আর শেত্ করেননি ব্লেইন। নতুন দাড়িতে তাকে চমৎকার দেখাচ্ছে।

কর্নেল সেনটেইনের দিকে তাকাতেই দেখা গেল সবুজ চোখেতে জ্বলছে তাকে পাওয়ার আকুতি।

হঠাৎ করেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। “ওহ, ঈশ্বর আমাদেরকে ক্ষমা করুন।” বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন। একাকী বসে রইলেন সেনটেইন।

অবশেষে ডাকতে এলেন হ্যানসমেয়ার। পুলের কাছে এসে জানালেন, “কর্নেল ম্যালকমস, আপনাকে ডাকছেন মিসেস কোর্টনি।”

যেন স্বপ্নের ঘোরে ফিরে এলেন সেনটেইন। পুরো দুনিয়া থেকে নিজেকে অদ্ভুত রকমের বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে।

 ক্লান্ত ঘোটকিটার কাছে দাঁড়িয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ব্লেইন। সেনটেইন কাছে এসে দাঁড়াতেই পরস্পরের দিকে তাকালেন দুজনে।

“আমরা একসাথেই সামনে এগোব।

 “ইয়েস ব্লেইন।” আনন্দ ঝরে পড়ল সেনটেইনের কণ্ঠে।

কয়েক সেকেন্ড বাদেই চড়া গলায় সার্জেন্টকে আদেশ দিলেন কর্নেল, “বোতলগুলো ভরে নাও। আর ঘোড়াগুলোকেও পেট ভরে পানি খাওয়াও, নয় ঘন্টা মেকআপ করার জন্যে ছুটতে হবে সামনে।

.

সারারাত ধরে পথ চলল পুরো দল। আকাশের তারা আর চাঁদের রুপালি আলোয় ঘোড়ার খুড়ের চিহ্ন দেখে পথ দেখাল দুই বুশম্যান।

 ভোরের ঘণ্টাখানেক বাদে গত রাতে ডাকাতদের ক্যাম্পের ভাঙা অংশের কাছে পৌঁছাল কর্নেলের দল। নিজের অসম্ভব ক্লান্ত দুটো ঘোড়াকে ফেলে গেছেন লোথার। পরিত্যক্ত ক্যাম্প ফায়ারের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে অবলা জীব দুটো। সাথে সাথে অবশ্য বালি সরিয়ে দিয়েই আগুনে ফুঁ দিল কিউয়ি আর ছাই থেকে দপ করে জ্বলে উঠল শিখা। দেখে তো খুশি আর ধরে না।

 “ওরা যতক্ষণ ঘুমিয়েছে ততক্ষণে আমরা পাঁচ ছয় ঘণ্টা এগিয়ে এসেছি।” আপন মনে বিড়বিড় করে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন।

 চেস্টনাট রঙা ঘোটকী দুটো একেবারে শেষ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মাথা ঝুলছে। কালো জিভও বেশ ফুলে উঠেছে। তাই দেখে কর্নেল জানালেন, “ওদেরকে পানি খাইয়ে অপচয় করেনি শয়তানটা।”

“হুম, তুমি ওদেরকে খতম করে দাও।”

 “এ কারণেই তো লোথার ওদেরকে ফেলে গেছে।”

“মানে?”

“গুলি।” ব্যাখ্যা করে শোনালেন ব্লেইন, “নিজে গুলি করলে তো শব্দ হত”

“ওহ ব্লেইন! তাহলে আমরা কী করব?”

“কফি আর নাশতা বানান। আবার রওনা হবার আগে আমাদের সবারই কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম দরকার।” জিন থেকে নেমে নিজের কম্বলের রোল খুললেন কর্নেল, “ততক্ষণে আমি দেখি কী করা যায়।”

প্রথম ঘোটকীটার কাছে গিয়ে ডান হাতে পিস্তল ধরে ভেড়ার লোমের ব্লাঙ্কেটে জড়িয়ে নিলেন ব্লেইন।

সাথে সাথে পড়ে গেল ঘোড়াটা। খানিক তাকিয়েই নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সেনটেইন। দ্বিতীয় ঘোটকীর দিকে এগিয়ে গেলেন ব্লেইন।

***

পাখি ডানা ঝাঁপটানোর মত করে দুলে উঠল বাতাস। পুরোপুরি কোনো শব্দ না হলেও সোয়াত হেনড্রিক আর লোথার ডি লা রে দু’জনেই নিজ নিজ ঘোড়ার ওপর সচকিত হয়ে বললেন। দম বন্ধ করে কী যেন ঘটার অপেক্ষায় রইলেন দুজনেই।

আবারো শোনা গেল দূরাগত এক বন্দুকের আওয়াজ। পরস্পরের দিকে তাকালেন হেনড্রিক আর লোথার।

“আর্সেনিকের কৌশলটা আসলে কাজে লাগেনি।” যা বোঝার বুঝে গেল বড়সড় কৃষ্ণাঙ্গ ওভাষো।

“তোমার উচিত ছিল পানিতে সত্যিকারের বিষ মিশিয়ে দেয়া।”

দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন লোথার।

“ডাইনির মত ঘোড়া ছোটাচ্ছে। আমাদের মাত্র চার ঘণ্টা দূরত্বে আছে। এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে তাই বা কে জানত।”

“এতটা নিশ্চিত হয়ো না।”

একটু দ্বিধা না করে লোথার জানালেন, “ও আমার কাছে প্রমিজ করেছে যে আসবেই।”

লোথারের হাতে কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজে হলুদ পুঁজের দাগ। কার্টিজের বেল্ট জড়িয়ে গলার সাথে ঝুলিয়ে রেখেছেন আহত হাত। মুখে বহুরঙা না কামানো দাড়ি।

 মাথা ঘুরিয়ে পেছনের সমভূমির দিকে তাকাতে গিয়ে আরেকটু হলে পড়েই যেতেন। তাড়াতাড়ি জিনের সাথে আটকানো কালো কেস ধরে নিজেকে সামলালেন।

 “পা!” বাবার সুস্থ হাত ধরে টান দিল ম্যানফ্রেড; চোখে উদ্বেগ, “তুমি ঠিক আছে তো?”

উত্তর দেবার আগে চোখ বন্ধ করে ফেললেন লোথার; ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন যে হাতের মাংস পর্যন্ত ফুলে ছড়িয়ে পড়েছে ইনফেকশন। রক্তে মিশে গেছে বিষ। চামড়া এতটাই ফুলে গেছে যে পাকা তালের মত টসটস করছে। চোখ আর মাথার তালু পর্যন্ত জ্বলছে ব্যথায়।

“চলো” ফিসফিস করে ছেলেকে জানালেন, “দেরি করলে চলবে না।”

লোথারের ঘোড়ার লাগাম টেনে নিলেন হেনড্রিক।

“দাঁড়াও!” হঠাৎ করেই জানতে চাইলেন লোথার “পরবর্তী পানির পুকুরটা কত দূরে?”

“আগামীকাল দুপুরের আগেই পৌঁছে যাব।”

জ্বরের তাপে মাথাও যেন ঠিকমত কাজ করছে না, তবুও হেনড্রিককে বললেন ঘোড়ার আয়রনের কথা।

মাথা নাড়লেন হেনড্রিক। সামনের ঘোড়াগুলো সত্তর পাউন্ড বোঝা বহন করছে। এখন সময় হয়েছে এগুলো ফেলে দেবার।

“দেখা যাক সে টোপ গিলে কিনা।” ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলেন লোথার।

***

ক্রমেই সেনটেইন নিজেও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু সেটা কাউকে টের পেতে দিতে চান না।

 চোখের কোনা দিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকালেন। এমনভাবে সোজা, ঋজু দেহে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে যে মনে হচ্ছে একটুও অবসন্ন হননি। কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই সেনটেইনের অবস্থা বুঝে ফেললেন কর্নেল। নরম স্বরে জানালেন, “দশ মিনিটের পানি বিরতি নেয়া যাক।”

“আমি ঠিক আছি তো।” তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন।

“আমরা সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এটা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই আসলে।” তারপর চোখের ওপর হাত দিয়ে সামনে কী যেন দেখলেন।

“কী হয়েছে?”

“বুঝতে পারছি না।” বুকের কাছের দূরবিন তুলে ফোকাস করলেন ব্লেইন। তারপর সেনটেইনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন গ্লাস। “ব্লেইন?” আচমকা চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। “হিরে! এটাই তো হিরের কেস! ওরা হিরে ফেলে গেছে।”

 মুহূর্তেই সব ক্লান্তি অবসাদ উঠে গেল। ব্লেইন বাধা দেবার আগে ঘোড়ার পিঠে গুঁতো দিয়ে টগবগিয়ে সামনে এগোলেন সেনটেইন।

 চিৎকার করতে করতে পিছু নিলেন ব্লেইন। তাড়াতাড়ি সার্জেন্টও এগোল বাধ্য হয়ে।

হঠাৎ করেই তীব্র হ্রেষাধ্বনি দিয়ে আতঙ্কে লাফাতে লাগল সেনটেইনের ঘোড়া। বাড়তি ঘোড়াগুলোও এরকমই রকম পাগলের মত করছে। ব্লেইন তাই দেখে ঘুরতে গিয়েও দেরি করে ফেললেন।

“থামো!” মরিয়া হয়ে হাত নেড়ে সার্জেন্টকে থামাতে চাইলেন কর্নেল। কিন্তু তাও কাজ হল না। পুরো দলের ঘোড়াগুলো যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে।

তাড়াতাড়ি নেমে নিজের ঘোড়ার সামনের পা দুটো চেক করে দেখলেন সেনটেইন। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পেছনের পা দুটো তুলতেই বিস্ময়ে অবিশ্বাসে হাঁ হয়ে গেল চেহারা। মরচেপড়া লোথার চোরকাঁটা লেগে কেটে গেছে খুড়। গাঢ় রক্তে কাদা মাটির পেস্ট হয়ে গেছে মরুভূমির বালি।

 আস্তে করে ঘোড়ার পা তুলে চোরকাটা তুলে ফেলতে চাইলেন সেনটেইন। কিন্তু বেশ ভেতরে ঢুকে গেছে লোথার কাঁটা। ব্যথায় কাঁপছে ঘোড়া। বহু কষ্টে মোচড় দিয়ে দিয়ে সবশেষে সফল হলেও রক্তপাত বেড়ে গেছে বেচারা ঘোড়ার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন ব্লেইনও দুটো চোরাকাটা বের করেছে।

 “হর্স আয়রন, যুদ্ধের পর থেকে এ ভয়ংকর জিনিসগুলো আর দেখিনি।” জানালেন ব্লেইন। তিন ইঞ্চি তীক্ষ্ণ এই চার মাথা তারার আকৃতির লোথার চোরকাটা মানুষ কিংবা পশু অথবা টায়ার সবকিছুকেই অথর্ব করে দিতে ওস্তাদ।

চারপাশে তাকিয়ে এরকম অসংখ্য চোরকাটা দেখতে পেলেন সেনটেইন। উপরে ধুলার পরত থাকায় চট করে চোখে না পড়লেও কার্যক্ষমতা ঠিকই আছে।

হ্যানসমেয়ার আর তার সৈন্যদের ঘোড়াগুলো পেছনে থাকায় চোরকাটার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এবারে নিজ নিজ ঘোড়া দূরে রেখে সাবধানে এগিয়ে এলেন কর্নেলের দিকে। ব্লেইন আর সেনটেইনের বাড়তি ঘোড়াসহ মোট ছয়টা ঘোড়া প্রচণ্ডভাবে জখম হয়েছে।

সব দেখে রাগে কাঁপতে কাঁপতে আদেশ দিলেন কর্নেল, “সার্জেন্ট, আমাদের জিনের সবকিছু তোমার দুইটা ঘোড়ায় তুলে দাও আর সৈন্য পাঠিয়ে হর্স আয়রন কতটুকু পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে খুঁজে দেখো। এক মিনিটও নষ্ট করা যাবে না।”

সাবধানে পা ফেলে আস্তে আস্তে কেসটার দিকে এগিয়ে গেলেন সেনটেইন। হাতে নিতেই দেখা গেল ভেতরে ফাঁকা কিছু নেই। শূন্য চোখে তাই পেছনে তাকালেন।

দ্রুতহাতে কাজ করছে সার্জেন্টের লোকেরা। নতুন করে কালো একটা ঘোড়া নিয়ে সেনটেইনের দিকে এগিয়ে আসছেন সার্জেন্ট। পেছনে সৈন্যরাও এক সারিতে এগোচ্ছে। একটু পর পর উপুড় হয়ে দেখে নিচ্ছে পথে কোনো কাঁটা আছে কিনা। যাই হোক, সেনটেইন ভালোভাবেই জানেন যে এখানেই শেষ নয়। লোথার নিশ্চয় আরো ব্যবস্থা করে রেখেছে।

কোমরের কাছে লি এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে ছয়টা অথর্ব ঘোড়ার দিকে তাকালেন ব্লেইন। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে প্রার্থনা করছেন এমনভাবে মাথাটা নিচু করে ফেললেন।

তারপর ধীরে ধীরে রাইফেলের হাতল কাঁধে তুলে একের পর এক গুলি ছুঁড়তেই ঝাঁকি দিয়ে পড়ে গেল সবকটা ঘোড়া।

 ফুঁপিয়ে উঠলেন সেনটেইন। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কান্নার ফোঁটা। খানিক বাদে নিজের ঘোড়া নিয়ে তার পাশে চলে এলেন ব্লেইন। সেনটেইনের চোখের জল দেখেও কিছু বললেন না। কেবল সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, “আমরা প্রায় এক ঘণ্টা পিছিয়ে পড়েছি। টুপ ফরোয়ার্ড।”

এরপর রাত নামার আগে আরো দু’বার এমন ভাবে থেমে যেতে হল। চোরকাটা পেরিয়ে সাবধানে এগোতে গিয়ে নষ্ট হল মূল্যবান কিছু সময়।

***

বুশম্যানল্যান্ড ছাড়িয়ে কাভাঙ্গো অঞ্চলে পা রাখতেই নাটকীয়ভাবে বদলে গেল চারপাশের দৃশ্য।

প্রাচীন বালিয়াড়ির গা ঘেঁষেই জন্মেছে লম্বা সব গাছ। উইলো সোপানি আর আলবিজিয়ার ঝাড়ও আছে। মরুভূমির ঘাসে ঢেকে আছে অগভীর উপত্যকাসমূহ। এখানকার মাটি খুঁড়লেই পানির দেখা মেলে। প্রকৃতিও তাই অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে চারপাশ। কালক্লান্ড ছাড়ার পর এই প্রথমবারের মত চোখে পড়ল জেব্রা আর লাল সোনালি ইম্পালা হরিণ।

লোধার ডি লা রে এতটাই অসুস্থ যে তার একপাশে হেনড্রিক আর আরেক পাশে চলছে ক্লেইন বয়। জ্বরের ঘোরে হঠাৎ হঠাৎই হেসে উঠছেন লোথার। কখনো আবার এত নড়ছেন যে না ধরলে মাটিতেই পড়ে যাবেন। পেছন পেছন আসছে ম্যানফ্রেড।

 ঘোড়ার পা-দানির ওপর দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে সামনে তাকালেন হেনড্রিক। যা দেখলেন তাতে তো খুশি আর ধরে না। লম্বা সব সোপান আর চারটা বিশাল ছাতার মত অ্যাকেশিয়া গাছ। ঠিক যেমনটা তাঁর স্মৃতিতে আছে। আর এগুলোর মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে টলটল পানি।

 শেষ কয়েক কদম কোনোমতে দৌড়ে গেল ঘোড়ার পাল। সোজা পুকুর বরাবর ছুটে গেলেন হেনড্রিক আর ক্লেইন বয়। তারপর শুরু হল পাগলামি। পানিতে হেসে-খেলে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলেন দুজনে।

 বাবাকে নামতে সাহায্য করল ম্যানফ্রেড। তারপর টুপি ভরে পানি নিয়ে এল। বসা থেকে ধুপ করে পড়ে গেলেন লোথার। ছেলে পানি নিয়ে আসতেই তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে শুরু করলেন কাশি।

একটু পরেই পাশে এসে বসলেন হেনড্রিক। সারা গা ভেজা। তখনো হাসছেন। কিন্তু কী মনে হতেই যেন আচমকা থেমে গেলেন। চারপাশে তাকিয়ে আপন মনেই বলে উঠলেন,

“এখানে কেউ নেই কেন? বাফেলো আর লেগস কোথায় গেল?” তাড়াহুড়ো করে দৌড় দিলেন কাছাকাছি একটা অ্যাকেশিয়ার ছাতার দিকে।

পুরোপুরি শূন্য আর পরিত্যক্ত। ক্যাম্প ফায়ারের কয়লা চারপাশে ছড়ানো। খুব বেশি হলে একদিন আগের। ত্রস্তপায়ে জঙ্গল ঘুরে আবার লোথারের কাছে এগিয়ে এলেন হেনড্রিক।

 “ওরা পালিয়েছে। লোথারও মনে মনে সে রকমটাই ভাবছিলেন, “দশটা ঘোড়া, প্রতিটা পঞ্চাশ পাউন্ড করে, এত লোভ সামলাতে পারেনি।” পানি খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবারো খানিকটা তরতাজা হয়ে উঠেছেন লোথার।

“ব্যাটারা নির্ঘাৎ ঘোড়াগুলো পর্তুগিজদের কাছে বেঁচে বউদের কাছে ফিরে গেছে।” ধপ করে বসে পড়লেন হেনড্রিক।

“আমার কাছে প্রমিজ করো হেনড্রিক আবার ওদের সাথে দেখা হলে তুমি ওদেরকে ধীরে, অতি ধীরে ধীরে খুন করবে।”

“এটাই এখন আমার একমাত্র স্বপ্ন।” ফিসফিস করে উঠলেন সোয়ার্ট, “যার যার পুরুষাঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে দু’জনকেই খাইয়ে দেব।”

 চুপচাপ পুলের কিনারে নিজেদের চারটা ঘোড়ার ছোট্ট দলটার দিকে তাকিয়ে বসে রইল সকলে।

কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে রাখার সময়ও তো নেই। তাই নীরবতা ভাঙলেন লোথার, “আরো অন্তত সত্তর মাইল গেলে নদী পাওয়া যাবে। আস্তে আস্তে নিজের হাতের নোংরা কাপড়টা খুলতেই দেখা গেল পুরো জায়গাটা ফুলে তরমুজ হয়ে আছে। কনুই পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ঘা। চামড়া ফেটে গড়িয়ে পড়ছে বদ রক্ত আর রস। আর গন্ধের চোটে লোখারের নিজেরই বমি পেল। কনুইয়ের উপর দিকটা তেমন না ফুললেও চামড়ার নিচে পরিষ্কার টকটকে লাল রেখা দেখা যাচ্ছে।

“গ্যাংগ্রিন” নিজেকেই যেন শোনালেন, “হাতটাকে কেটে ফেলতে হবে।” আসলে কার্বলিক এসিড সলুশন দিয়ে ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করেছিলেন। তাতেই আরো বেড়ে গেছে গ্যাংগ্রিন। কিন্তু ম্যানির জন্যে আমাকে টিকে থাকতেই হবে।” তাড়াতাড়ি চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকালেন।

“আমাকে কয়েকটা ব্যান্ডেজ দাও।” গলার স্বর যথাসম্ভব শান্ত আর দৃঢ় রাখতে চাইলেও কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শোনাল।

 ও আমাদের চেয়ে কতটুকু পিছিয়ে আছে হেনি?” ব্যান্ডেজের গিঁট বাঁধতে গিয়ে জানতে চাইলেন লোথার। বাড়তি যেখানে যতটুকু কম্বল আর কাপড়ের টুকরা ছিল সব এখন এ কাজেই লাগছে।

“আমরা সময় বাঁচাতে পেরেছি। অনুমান করলেন হেনড্রিক, “কিন্তু ঘোড়া?”

 একটা ঘোড়া পানির কিনারে শুয়ে পড়েছে। তার মানে বেশ শ্রান্ত।

“পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা হবে।” অথচ নদী এখনো সত্তর মাইল দূরে। আর যদি ওরা সীমান্তে গিয়েও পিছু নেয়া বন্ধ না করে?” আর ভাবতে চাইলেন না লোথার। তার বদলে ফিসফিস করে বললেন, “ম্যানফ্রেড হিরেগুলো নিয়ে এসো।”

বাবার কাছে ক্যানভাসের হ্যাঁঙারস্যাক নিয়ে এল ম্যানফ্রেড। সাবধানে ব্যাগ খুললেন লোথার।

আটাশটা বাদামি কাগজে মোড়ানো প্যাকেটগুলোকে মোট চার ভাগে ভাগ করলেন।

“সবার সমান। আমরা যেহেতু মূল্য জানি না তাই সবচেয়ে ছোটজনকে আগে বেছে নেবার সুযোগ দেব। ঠিক আছে?” হেনড্রিকের দিকে তাকালেন লোথার।

সোয়াট হেনড্রিক বুঝতে পারলেন সবাই মিলে আর নদীতীরে এগোনো হবে না। লোখারের মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অবাক হয়ে ভাবলেন কিসের টানে এই লোকটার সাথে এতদিন ধরে আছেন। একসাথে তারা অনেক কিছু সয়েছেন, দেখেছেন। ভালোবাসা না বন্ধুত্ব! বুঝতে না পারলেও আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় তেতো হয়ে উঠল মন।

 “ঠিক আছে।” লোথার আর ম্যানি দু’জনেই তাঁর কাছে সমান।

 “বেছে নাও ম্যানি।” আদেশ দিলেন হেনড্রিক।

“আমি জানি না।” হাত দুটো পেছনে নিয়ে অপারগতা দেখাল ম্যানি। “তাড়াতাড়ি যাও।” সাপের মত ফণা তুললেন লোথার। এগিয়ে এসে সবচেয়ে কাছের ভাগটা দেখাল ম্যানি।

“তুলে নাও।” এবারে কৃষ্ণাঙ্গ ক্লেইন বয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেছে নাও।”

আর মাত্র দুটো ভাগ বাকি। তা দেখে ফাটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হাসলেন লোথার,” তো তোমার বয়স কত হেনি?”

“ধরো বসন্তের প্রথম ফুলটার মত।” ওভাষোর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেললেন।

 লোথারের হাসি দেখে হেনড্রিকের বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল; বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ছোট। সবসময় তো নার্সের মত তাই তোমার সেবা করলাম।”

নিজের প্যাকেটগুলোও ম্যানফ্রডকে দিয়ে লোথার জানালেন, “এগুলো হ্যাঁঙারস্যাকে ভরে রাখো। তারপর পানির বোতল ভরে নাও। আর মাত্র সত্তর মাইল গেলেই নদী।”

 সবকিছু প্রস্তুত করে নিয়ে লোথারকে তুলতে গেলেন হেনড্রিক। কিন্তু বিরক্ত হয়ে তার হাত সরিয়ে দিলেন লোথার। তারপর অ্যাকেশিয়ার গুঁড়ি ধরে উঠে দাঁড়ালেন।

আর সোজা হতে না পারায় একটা ঘোড়াকে পানির কিনারেই ফেলে আসতে হল। এক মাইল পেরোবার পর আরেকটা পড়ে গেল। তবে বাকি দুটো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঠিকই এগোচ্ছে। খানিক বাদে তাও না পারায় একটার ওপর পানির বোতল তুলে দিয়ে আরেকটার ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন লোথার।

একমনে উত্তরে এগিয়ে চলেছে চারজনের ছোট্ট দলটা। মাঝে-মাঝে বিনা কারণেই লোথার চড়া গলায় গান গেয়ে ওঠেন। দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে ম্যানফ্রেড। কিন্তু পরক্ষণেই ভাঙা গলায় এমন গালি দেন যে ছুটে এসে বাবার কোমর জড়িয়ে ধরতে হয়।

“ইউ আর আ গুড বয় ম্যানি। এখন থেকে তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। স্কুলে যাবে, পুরোদস্তুর ভদ্রলোক হয়ে উঠবে, আমরা একসাথে বার্লিন যাবো, অপেরা”।

“ওহ পাপা, কথা বলো না তো।” ছেলের গায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে চলেন লোথার। নয়ত কখন মুখ থুবড়ে পড়ে যেতেন এই কালাহারির উষ্ণ বালির ভেতরে।

বহুদূরে সূর্যের আলোয় রূপার মত চকচক করছে গ্রানাইট পাথর।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *