নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে

নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে

নির্জন বাংলোর সম্মুখে গাড়ি রেখে নেমে পড়লো মিঃ কাওসারী, তারপর গাড়ির দরজা খুলে বললো–আসুন মিস্ হামিদা……মিঃ কাওসারী মিস্ হামিদার হাত ধরে নামিয়ে নিলো। খুলে দিলে মুখের রুমাল আসুন আমার সঙ্গে।

মিঃ কাওসারী অগ্রসর হলো নির্জন বাংলোর দিকে।

মিস হামিদা রিজভী বাধ্য হলো তাকে অনুসরণ করতে। চোখেমুখে তার ভীতিভাব ফুটে উঠেছে।

বাংলোটা কান্দাই শহরের কোন জায়গায় সঠিক বলা মুশকিল। বহুকালের পুরানো বাংলো। সংস্কার অভাবে বাংলোর দেয়ালের চুনবালি খসে পড়েছে, স্থানে স্থানে আগাছা জননছে। বাংলোর আশেপাশে কোনো লোকালয়ের চিহ্ন নেই।

 বাংলোর কক্ষের সম্মুখে এসে থামলো মিঃ কাওসারী, ফিরে তাকালো মিস্ হামিদার দিকে। রাত গম্ভীর হলেও চাঁদের আলোতে স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিলো সব।

 মিঃ কাওসারীর শহরের বিভিন্ন পথে গাড়ি চালিয়ে কান্দাই-এর শেষ প্রান্তে এই নির্জন বাংলোয় পৌঁছতে বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গিয়েছিলো। মিঃ কাওসারী যখন পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণের উৎসব থেকে মিস্ হামিদা রিজভীকে নিয়ে গাড়িতে চেপে বসেছিলো তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে নটা বেজেছিলো মাত্র। এখন রাত একটা পঁচিশ।

 মিস হামিদা রিজভী বললো—আপনি কে? আর কেনই আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে এলেন?

মিঃ কাওসারী বললো– সব জানতে পারবেন। আসুন। দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো সে।

 মিস্ হামিদা রিজভীও প্রবেশ করলো তার সঙ্গে।

কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে চমকে উঠলো মিস হামিদা জমাট অন্ধকারময় চারিদিক। মিঃ কাওসারী অন্ধকারময় কক্ষমধ্যে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।

মিস হামিদা রিজভী স্পষ্ট শুনতে পেলো মিঃ কাওসারী দিয়াশলাই জ্বাললেন। আলোকিত হয়ে উঠলো কক্ষটা। অবাক হলো মিস্ হামিদা, কক্ষটার বাইরে থেকে সেটাকে যতই পুরানো জীর্ণ মনে হোক, ভিতরটা সুন্দর পরিচ্ছন্ন।

মিঃ কাওসারী দিয়াশলাই কাঠি জ্বেলে মোমবাতি জ্বালালো। ফিরে দাঁড়াবার পূর্বেই মাথার ক্যাপ খুলে হাতে নিলো সে।

সঙ্গে সঙ্গে মিস্ হামিদা রিজভী অস্ফুট কণ্ঠে বললো– আপনি! সওদাগর জাহাঙ্গীর আলী।

ও, চিনে নিয়েছে তাহলে ইরানী?

 হাঁ, আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন, কোনো দিনই ভুলবো না আপনাকে।

কিন্তু আজ তোমার জীবন রক্ষার্থে এখানে নিয়ে আসিনি ইরানী। তোমার বাবা আমাকে জব্দ করতে চেয়েছিলো, তাই তার মেয়েকে হরণ করে আমি জব্দ করেছি। এখন ইচ্ছা করলে আমি তোমাকে হত্যাও করতে পারি।

মিঃ কাওসারীর কথাবার্তায় অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ইরানী, তার কথাগুলো যেন কেমন হেয়ালিপূর্ণ মনে হচ্ছিলো, বললো এবার সে– আমি বুঝতে পারছি না আপনার কথাগুলো। আমার বাবা আপনাকে জব্দ করতে চেয়েছিলো, এ কেমন কথা? আপনিই বা আমাকে এভাবে হরণ করে এনে কিভাবে আমার বাবাকে জব্দ করেছেন?

তোমার বাবা মনসুর ডাকু চেয়েছিলো দস্যু বনহুকে হত্যা কিংবা বন্দী করতে…..কিন্তু দস্যু বনহুরকে বন্দী করা যত সহজ মনে করেছিলো সে, তত সহজ নয়, বুঝলে?

আপনি……আপনিই দস্যু বনহুর? ইরানীর দু’চোখে বিস্ময় ঝরে পড়ে। নির্বাক হয়ে যায় তার কণ্ঠ।

বনহুর মাথার ক্যাপটা হাতে খুলে নিয়েছিলো, এবার ক্যাপটা টেবিলে রাখে। একটু হেসে বলে খুব অবাক হয়েছে দেখছি।

হাঁ, আমি ভাবতে পারিনি আপনিই দস্যু বনহুর।

 কেন, অসম্ভব কিসে?

আমি জানতাম, দস্যু বনহুর যেমন ভয়ঙ্কর নাম, তেমনি ভয়ঙ্কর দেখতে… হঠাৎ যেন ইরানী। ক্ষেপে উঠলো ভীষণভাবে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো- আমার বাপুকে তুমি কম নাজেহাল করোনি, আমি নিজেও তোমাকে খুঁজে ফিরছি অনেকদিন থেকে। ইরানী বনহুরকে তুমি বলে সম্বোধন করতে শুরু করলো।

তাই নাকি? বললো বনহুর।

হাঁ। তাছাড়া আমার বাপুর গোপন আস্তানার বন্দীশালা থেকে তুমি তোমার সন্তানসহ পালাতে সক্ষম হয়েছিলে।

সত্যি কথা।

আজি আবার তুমি ছদ্মবেশ ধারণ করে আমাকে হরণ করে এনেছো। আমার বাপুকে তুমি বারবার এভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছো। আমার বাপুর হাতে তোমার নিস্তার নেই কিছুতেই।

এ জন্য আমি অত্যন্ত ভীত, আশঙ্কিত হয়ে পড়েছি ইরানী। তাছাড়া তুমি যখন আমাকে খুঁজে ফিরছিলে তখন আমার সৌভাগ্য বলতে হবে। এবার খুঁজে পেয়েছে, বলো কি প্রয়োজন আমাকে?

তোমাকে আমি পূজা করবো বলে খুঁজিনি, আমার বাপুর প্রতি তুমি যে অন্যায় আচরণ করেছে তার প্রতিশোধ নেবো।…..

ও, এই কথা। বেশ, এই মুহূর্তে তুমি আমাকে বন্দী করতে পারো; কিন্তু তোমার প্রাণরক্ষক আমি, এ কথাও যেন ভুলে যেও না।

একদিন আমি তোমাকে চিনতে না পেরে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছি।

না হলে কি করতে?

যদি জানতে পারতুম তুমিই দস্যু বনহুর তাহলে আমি তোমার সাহায্য কিছুতেই গ্রহণ করতাম না।

বটে!

হাঁ, দস্যুকন্যা হলেও আমি তোমাকে……

 থামলে কেন, বলো?

 আমি তোমাকে ঘৃণা করি।

চমৎকার! দস্যু হয়ে দস্যুকন্যার কাছে এর বেশি কি আশা করতে পারি?

ঠিক সেই মুহূর্তে ইরানী কাপড়ের আড়াল হতে একটা সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা বের করে বসিয়ে দিতে গেলে বনহুরের বুকে।

বনহুর ইরানীকে বাধা না দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, তারপর বললো– পারবে না, পারবে না আমার বুকে ছোরা বিদ্ধ করতে।

 ইরানীর হাতখানা ছোরাসহ থেমে গিয়েছিলো মাঝপথে। অবাক হয়ে গিয়েছিলো ইরানী বনহুরের হাসি দেখে। এমন করে হাসতে সে তার বাপুকেও দেখেছে। কিন্তু বনহুরের হাসির মত সে হাসি নয়। বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে যায় ইরানী, নিজকে সামলে নিয়ে বলে তোমাকে হত্যা করে আমি দায়ী হতে চাই না, কারণ আমার বাপু তোমাকে তিল তিল করে হত্যা করবে।

সেই দিনের প্রতীক্ষা করে তাহলে।

হাঁ, তাই করবো।

এখন তাহলে বিশ্রাম করো। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় বনহুর– রাত দুটোর। বেশি। হাঁ, আমারও বিশ্রামের প্রয়োজন।

বনহুর নিজ শরীর থেকে জামা খুলতে থাকে।

ইরানী নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে বনহুরের দিকে। ভয়-বিস্ময় ফুটে উঠে তার মুখমণ্ডলে।

বনহুর বলে- ইরানী, তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি এই শয্যায় নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারো। আমি সোফায় বিশ্রাম করবো।

ইরানী তবু নিশুপ যেন সে পাথরের মূর্তি বনে গেছে। দস্যুকন্যা হলেও সে নারী। একটা যুবকের সঙ্গে একই ঘরে কি করে রাত কাটানো সম্ভব।

বনহুর ততক্ষণে জামাটা খুলে আলনায় রেখে এগিয়ে যায় সোফার দিকে।

টেবিলে মোমবাতিটা প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে।

 ইরানী দু’পা সরে দাঁড়ালো।

 বনহুর বললো, কি হলো, শয্যা গ্রহণ করবে না?

না।

 তবে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকবে?

 তাও থাকবো না।

তবে কি করতে চাও?

আমাকে যেতে দাও। যেতে দাও বলছি……

আবার অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে বনহুর–যেতে দেবো বলে হরণ করে আনিনি ইরানী। যতদিন তোমার বাবা মনসুর ডাকু আমার বশ্যতা স্বীকার না করবে, ততদিন তোমার মুক্তি নেই।

আমাকে বন্দী করে আমার বাবাকে তুমি বশ্যতা স্বীকার করাতে চাও? কিন্তু মনে রেখো, আমার বাবা তোমার চেয়ে কোনো অংশে খাটো নয়। তুমিও দস্যু, বাবাও ডাকু। তুমিও পরের ঐশ্বর্য হরণ করে বিশ্ববিখ্যাত দস্যু হয়েছে, আমার বাবাও তাই…

কাজেই আমরা উভয়ে সমান, এইতো?

 ইরানী কথা বলে না, রাগে ফুলতে থাকে সে।

বনহুর সোফায় গা এলিয়ে দেয়।

*

মনসুর ডাকু আর গোমেশ দস্যু বনহুরকে হত্যা অথবা বন্দী করতে গিয়ে এভাবে পুলিশের হাতে বন্দী হবে, এ যেন তারা ভাবতেই পারেনি। মনসুর ডাকুকে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ তার পরিচয় জানতে পেরেছিলো। আরও জানতে পেরেছিলো, মনসুর ডাকুর সঙ্গী তারই প্রধান অনুচর গোমেশ।

দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার উদ্দেশ্য নিয়েই মনসুর ডাকু মিঃ হাসেম রিজভীর বেশে নিজকে। পরিচিত করে পুলিশ মহলকে এই উৎসবের পরামর্শ দিয়েছিলো। মনসুর ডাকুর অভিসন্ধি ছিলো, পুলিশ মহল দস্যু বনহুরকে বন্দী করতে সক্ষম না হলেও সে গোমেশের দ্বারা তাকে হত্যা করবে। সব আশা তার বিনষ্ট হয়েছে, দস্যু বনহুরকে হত্যা করা দূরের কথা, নিজেরাই গ্রেপ্তার হলো পুলিশের হাতে। শুধু তাই নয়, ইরানীকে হারাতে হলো। দস্যু বনহুর যে ইরানীকে নিয়ে ভেগেছে তা মনসুর ডাকু ভালভাবেই টের পেয়েছে। মনসুর ডাক বন্দী হয়ে হিংস্র বাঘের মত ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। যত রাগ হলো তার গোমেশের উপর। গোমেশের লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায়ই তার সব আয়োজন ব্যর্থ হলো। বন্দী হয়েছে আফসোস নেই তার তেমন কিছু অমন জেল সে কতবার যে জীবনে খেটেছে, তার ঠিক নেই। আজ যদি দস্যু বনহুরকে হত্যা করে তারা জেলে যেতো তবু শান্তি পেতো।

অবশ্য পুলিশ মহলও জানতে পেরেছিলো যে, তাদের এই উৎসবে স্বয়ং দস্যু বনহুরের আগমন ঘটেছিলো এবং মিঃ জাফরীর অনুপস্থিতির জন্য তাকে কেউ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়নি। সেই সুযোগ নিয়ে দস্যু বনহুর পুলিশের চোখে ধোকা দিয়ে নিজে মিঃ কাওসারীর বেশে উৎসবমঞ্চে আত্নপ্রকাশ করেছিলো। শুধু তাই নয়, হামিদা রিজভীবেশিনী মনসুর ডাকুর কন্যাকে নিয়ে উধাও হয়েছে।

অল্পক্ষণের মধ্যে ব্যাপারটা শহরের সর্বত্র জানাজানি হয়ে যায়।

মিঃ রুস্তমবেশী রহমান সরে পড়েছিলো ততক্ষণে সকলের অলক্ষ্যে। কিছু পরে তার সন্ধান করতে গিয়ে মিঃ হাসান যেন হতভম্ভ হয়ে যান। একটা চিঠি পান তিনি তার সহকারীর হাতে।

মিঃ হাসান চিঠিখানা হাতে নিতেই একটু ধোকা লাগলো, তার কারণ এমন সময় কে তাকে চিঠি দিতে পারে? তিনি চিঠিখানা মেলে নিয়ে পড়লেন—

 মিঃ হাসান, আপনারা আজ যে দুজনকে বন্দী করতে পেরেছেন, এরা শুধু দেশের শত্রু নয়, এরা দেশবাসীরও শত্রু- মনসুর ডাকু ও তার প্রধান সহচর। আমি দস্যু বনহুরের প্রধান সহচর, রহমান। আপনাদের কড়া পাহারার বেষ্টনী ভেদ করে আমি পালিয়েছিলাম, সেজন্য আমি লজ্জিত।
— রুস্তম

 চিঠি পড়া শেষ করে মিঃ হাসান যেন ফেটে পড়লেন রুস্তম… মিঃ রুস্তম দস্যু বনহুরের প্রধান অনুচর রহমান? কে এই চিঠি দিলো, শীঘ্র তাকে গ্রেপ্তার করো।

কিন্তু কোথায় সেই রুস্তম। সে তখন পুলিশ অফিসের উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে উধাও হয়েছে।

সমস্ত উৎসব প্রাঙ্গণ এক মহাবিপদ সংকেত ধ্বনিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কে কোন দিকে ছুটাছুটি করছে তার ঠিক নেই। মিঃ আরিফ চৌধুরীকে সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত মনে হচ্ছে। তিনি মনসুর ডাকু এবং গোমেশকে গ্রেপ্তার করেও যেন স্বস্তি পাচ্ছেন না। তার যত আক্রোশ দস্যু বনহুরের উপর, তাকে বন্দী না করতে পেরে তিনি যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছেন।

এদিকে মিঃ জাফরীর কোনো সন্ধান নেই। উৎসব শুরু হবার পূর্বে তাঁর পুলিশ অফিসে আসার কথা ছিলো। বাসাতে ফোন করেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ মহলে ভীষণ একটা আলোড়ন শুরু হলো।

পুলিশ ফোর্স ততক্ষণে মনসুর ডাকু ও গোমেশকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে হাজত অভিমুখে রওনা দিয়েছে।

এখানে পুলিশ মহল যখন নানারকম উদ্বিগ্নতার মধ্যে রয়েছে, তখন নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে দস্যু বনহুর নিদ্রামগ্ন।

মনসুর ডাকুর কন্যা ইরানী শয্যায় শয়ন করে ঘুমিয়ে পড়েছে। যদিও তার ইচ্ছা ছিলো না শয্যা গ্রহণ করে কিন্তু কতক্ষণ সে বসে বসে কাটাবে? একসময় শয্যায় এসে চুপচাপ বসে ভাবছিলো, তারপর কখন যে শুয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই।

রাত গভীর হয়ে আসে একসময়।

বনহুর ফিরে তাকালো খাটের দিকে। ইরানী অঘোরে ঘুমাচ্ছে। হাই তুলে উঠে বসলো সে আলনা থেকে জামাটা নিয়ে গায়ে দিলো, ক্যাপটা পরে নিলো মাথায়।

তারপর ঘরের মেঝের এক স্থানে পা দিয়ে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে একটা সিঁড়ির ধাপ জেগে উঠলো। বনহুর সেই সিঁড়ির ধাপে পা রেখে নেমে চললো নিচের দিকে।

ইরানী কিন্তু আসলে ঘুমায়নি, সে ঘুমের ভান করে লক্ষ্য করছিলো দস্যু বনহুরকে।

বনহুর যখন মেঝের একস্থানে পা দিয়ে চাপ দিলো তখন ইরানী মনোযোগ সহকারে দেখে নিলো সব। বনহুর মেঝের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হতেই ইরানী শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, মেঝের যে স্থানে বনহুর পা দিয়ে চাপ দিয়েছিলো, সেই স্থানে ইরানী দিয়ে চাপ দিতেই একটি সিঁড়ির মুখ বেরিয়ে এলো।

ইরানী সেই সিঁড়ির উপর পা দিতেই সা করে সিঁড়ি সহ নেমে চললো নিচে। দুলতে লাগলো তার দেহটা, কোনো রকমে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো পরিচিত সেই হাসির আওয়াজ। তাকিয়ে দেখলো সে দাঁড়িয়ে পড়েছে একটা কক্ষের মেঝেতে, সম্মুখে একটা আসনে উপবিষ্ট স্বয়ং দস্যু বনহুর।

হাসি থামিয়ে বলে উঠলো দস্যু বনহুর– ঘুমাওনি তাহলে।

কঠিন কণ্ঠে বললো ইরানী না।

বেশ, এসেছো যখন বসো। পাশের একটা আসন দেখিয়ে বললো বনহুর।

ইরানী কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইলো।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো আসন ছেড়ে, বললো- এসো তবে আমার সঙ্গে।

 ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো ইরানী কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?

তুমি না আমাকে বন্দী করতে চাও?

 হা, সুযোগ পেলে তোমাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করবো না দস্যু।

চমৎকার উক্তি, দস্যুকন্যার মতই তোমার কথা। কিন্তু কয়েকদিন আমার অতিথি হয়ে তোমাকে থাকতে হবে এবং সেই কারণেই এখন আমার সঙ্গে তোমাকে গমন করতে হচ্ছে।

আমি যদি না যাই তোমার সঙ্গে?

বাধ্য হবো তোমাকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যেতে। কিন্তু মনে রেখো দস্যু বনহুর কোনোদিন নারীর অসম্মান করে না। কাজেই তুমি নিশ্চিন্তে আমার সঙ্গে আসতে পারো।– এবার ইরানী বনহুরকে অনুসন্ধান করলো।

কিছুটা অগ্রসর হতেই একটা সুড়ঙ্গমুখ বেরিয়ে এলো। বনহুর সেই সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করলো।

ইরানীও প্রবেশ করতে বাধ্য হলো।

সুড়ঙ্গমধ্যে ঝাপসা অন্ধকার হওয়ায় বনহুর একটি মোমবাতি হাতে নিয়ে এগুলো।

 অদ্ভুত সে সুড়ঙ্গপথ।

ইরানী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে, নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে এমন একটি সুড়ঙ্গপথ আছে, সে ভাবতেও পারেনি। খানিকক্ষণ চলার পর একটা কক্ষের মধ্যে তারা প্রবেশ করলো। কক্ষটি অতি সুন্দরভাবে সজ্জিত। একপাশে মোমদানিতে কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে। একদিকে খাট, খাটে সুন্দর ধবধবে বিছানা পাতা। খাটের পাশেই একটা বইয়ের সেলফ, তাতে অনেকগুলো বই। সুন্দরভাবে সাজানো। ওদিকে একটা ড্রেসিং টেবিল, টেবিলে প্রসাধনী সামগ্রী থরে থরে সাজানো। টেবিলের মাঝখানে একটি ফুলদানি, কিন্তু ফুলদানিটি শূন্য, তাতে কোনো ফুল শোভা পাচ্ছে না।

ইরানী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ভূগর্ভে এমন সুন্দর একটি কক্ষ আছে, কেউ ভাবতে পারবে না।

 দেয়ালে কতকগুলো ছবি টাঙ্গানো। ইরানী এই ছবিগুলোর মধ্যে একজনকে চিনতে পারলো– সে হলো দস্যু বনহুর।

পাশের একটা ছবির দিকে তাকিয়ে ইরানী বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো- এটা কার ছবি?

বনহুর একটু হেসে বললো আমার বাপুর।

ছবিখানা দস্যু কালু খার। বিশাল বপু, মাথায় একরাশ ঝাঁকড়া চুল, বিরাট একজোড়া গোঁফ, বড় বড় দুটো চোখ, চোখে তীব্র চাউনি। ছবিখানা যেন একটা জীবন্ত মানুষ।

 বনহুর ইরানীকে অবাক হয়ে ছবিখানা লক্ষ্য করতে দেখে বললো– আমার বাপু আমার মতই, তাই না?

উই। তোমার বাপু ঠিক তোমার উল্টো।

তার মানে?

মানে তোমার চেহারাটা তোমার বাপুর ঠিক বিপরীত।

যেমন তোমার বাপুর পাশে তুমি, তাই না?

ইরানী মাথা নিচু করলো।

বনহুর বললো– তুমি এই কক্ষে বিশ্রাম করো।

 চোখ তুলে তাকালো ইরানী।

 বনহুর পুনরায় বললো– কাজ শেষ করে আবার ফিরে আসবো। মুক্তি দেবো তোমাকে।

কথাগুলো বলে বনহুর সুড়ঙ্গপথে বেরিয়ে গেলো।

সঙ্গে সঙ্গে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ হয়ে গেলো।

 বনহুর ফিরে এলো মধ্যকার কক্ষে।

কক্ষমধ্যে প্রতীক্ষা করছিলো বনহুরের কয়েকজন অনুচর, সর্দারকে দেখামাত্র কুর্ণিশ। জানালো।

বনহুর বললো– মিঃ জাফরীকে পৌঁছে দিয়েছো?

একজন বললো—-হ সর্দার।

 কোথায় তাকে পৌঁছে দিলে?

সর্দার, আপনি যেভাবে আদেশ করেছিলেন।

তার বাসায় পৌঁছে দিয়েছো?

 হাঁ সর্দার।

 তখন কি তার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো?

না, সর্দার, মিঃ জাফরীর জ্ঞান এখনও ফিরে আসেনি। তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে।

অন্যান্য খবর কি?

মনসুর ডাকু আর গোমেশকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বললো মঙ্গলা নামক এক অনুচর।

বনহুর স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো মনসুর ডাকু এবং তার সহচর গোমেশ গ্রেপ্তার হয়েছে?

হাঁ, সর্দার।

রহমানের সংবাদ?

 উনি আস্তানায় ফিরে গেছেন।

পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণের উৎসব তাহলে বিফলে যায়নি। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে না। পারলেও তারা এক প্রখ্যাত ডাকুকে গ্রেপ্তার করেছে, কি বলো?

হাঁ।

তাজ এসেছে?

 হাঁ, তাজ এসেছে সর্দার। বললো মাহমুদ নামক আর এক অনুচর।

বনহুর বললো- তোমরা ঠিকমত কাজ করে যেও।

কথাটা বলে বনহুর সিঁড়ির ধাপে পা রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িটা উঠে গেলো উপরে।

পূর্বের সেই নির্জন বাংলোর মধ্যে পৌঁছে গেলো বনহুর। এবার সে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ড্রেস পাল্টে নিজের দস্যু-ড্রেস পরে নিলো। তারপর বাংলো থেকে বেরিয়ে আসতেই তাজ এগিয়ে এলো, প্রভুকে সে অন্ধকারেও চিনেতে পারলো। আনন্দসূচক শব্দ করলো তাজ –চি হি চি হি…

বনহুর তাজের পাশে এসে পিঠ চাপড়ে আদর করলো। তারপর চেপে বসলো তার পিঠে।

তাজ ছুটতে শুরু করলো।

নিস্তব্ধ-নির্জন পথে তাজের খুরের শব্দ অদ্ভুত এক আওয়াজের সৃষ্টি করে চললো। পথের। দুপাশে ঘন জঙ্গল না হলেও বেশ ঝোঁপঝাড় আর আগাছা রয়েছে। মাঝে মাঝে অশ্বখ আর দেবদারু গাছ প্রবীণ প্রহরীর মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

পথের আশেপাশে তেমন কোনো বাড়িঘর বা দালান-কোঠা নেই। যদিও মাঝে-মধ্যে কোথাও দু’একটা বাড়ির চিহ্ন দেখা যায় সেও পোড়োবাড়ি। জনমানবের চিহ্ন নেই কোথাও। বাড়িগুলোর ইট খসে পড়েছে, ছাদ ধসে গেছে। বাড়িঘরগুলোর মেঝেতে আগাছা জন্মেছে। এককালে এসব বাড়িঘরে সম্ভ্রান্ত পরিবার বসবাস করতেন। আজ কালের অতলে তলিয়ে গেছে তাদের সব অস্তিত্ব। শুধু অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইট-চুন-বালি খসে পড়া জীর্ণ দেয়ালগুলো।

বনহুরের অশ্ব পদশব্দে এইসব জীর্ণ বাড়িগুলোর দেয়ালে প্রতিধ্বনি জাগছে। তারই আওয়াজ সৃষ্টি করছে একটা অদ্ভুত সুর।

 অশ্বপৃষ্ঠে জমকালো পোশাক পরা দস্যু বনহুর এসে নামলো তার কান্দাই শহরের ঘাটিতে। রাত তখন শেষ প্রহর। বনহুর আস্তানার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে। এ কক্ষটা ঠিক কোনো অফিস কক্ষ বলে মনে হয়। কক্ষের চারপাশে চারখানা বড় বড় আলমারী সাজানো রয়েছে। মাঝখানে সেক্রেটারীয়েট টেবিল। টেবিলে পাকার কাগজ-খাতাপত্র।

 বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই টেবিলের চারপাশে বসে বিশ্রামরত অনুচরগণ উঠে কুর্ণিশ জানালো। বনহুর টেবিলের মাঝখানে একটি চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে একটা ড্রয়ার উঠে এলো উপরে। ড্রয়ারের মধ্যে একটা চাবি ছিলো, বনহুর চাবিটা নিয়ে এগিয়ে গেলো ওদিকে বড় একটা আলমারীর কাছে। আলমারীর দরজা খুলতেই একটা সিঁড়ির মুখ দেখা গেলো। বনহুর ভিতরে প্রবেশ করতেই আলমারীর দরজা বন্ধ হলো।

বনহুর ওপাশের সিঁড়ি বেয়ে তার গোপনকক্ষে চলে গেলো। ওয়্যারলেস খুলে ধরলো, রহমানের সঙ্গে কিছু আলোচনা করে নিলো। হয়তো পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে উৎসব সম্বন্ধে জেনে নিলো সব কথা। তারপর সে আস্তানার অভ্যন্তরে ভূগর্ত-কক্ষে নেমে এলো।

বিরাট দরবারকক্ষ এটা।

কোনো আসবাবের বালাই নেই। শুধু কয়েকখানা লোহার চেয়ার। একপাশে একটা সুউচ্চ আসন, ঠিক মঞ্চের মত। এই মঞ্চে পঁড়িয়ে বনহুর তার অনুচরদের কাজের নির্দেশ দেয়।

 একপাশে একটি লোহার দরজা, সেই দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, সুসজ্জিত একটি কক্ষ। এই কক্ষটি সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন আসবাবে পূর্ণ। এটাই বনহুরের শহরের আস্তানায় তার বিশ্রামকক্ষ।

 পাশেই একটা কক্ষে থাকে মাহমুদা, যাকে বনহুর একদিন অসহায়-অনাথা বলে আশ্রয় দিয়েছিলো তার আস্তানায়। ভেবেছিলো, পরে সুযোগমত তাকে তার কোনো আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দেবে। কিন্তু মাহমুদা আর যেতে চায়নি। আর যাবেই বা সে কোথায়, তার একমাত্র পিতা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। পিতাকে হারিয়ে অসহায়া মাহমুদা অকুল সাগরে ভাসছিলো। বনহুর মাহমুদাকে বোনের দৃষ্টি নিয়ে দেখতে, ওকে স্নেহ করতে সে অপরিসীম। কিন্তু মাহমুদা নিজের অজ্ঞাতে কখন ভালবেসে ফেলেছিলো বনহুরকে।

মাহমুদা তার নিজের পূর্বনাম পাল্টে মাহমুদা রেখেছিলো। সে ভাবতো, তার নামটাই হয়তো অপেয়া, তাই এই বয়সে বাবা মা-আত্মীয়স্বজন সবাইকে হারিয়েছে। বনহুর কথাটা শুনে হেসে বলেছিলো–বেশ, তোমার যদি এ নাম ভাল লাগে, তাই বলে ডাকবো।

কাজেই বনহুর ওকে এই নামেই ডাকতো।

এখানো মাহমুদার যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য সব রকম ব্যবস্থা ছিলো। মাহমুদার কাছে থাকার জন্য এক বিশ্বাসী বৃদ্ধাকে রেখে দিয়েছিলো সে।

আজ বনহুরের আগমনে মাহমুদা খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটে এলো।

 বনহুর হেসে বললো–কেমন আছো মাহমুদা?

 ভাল না। কোনো অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?

না।

 তবে কি হলো?

এতদিন পর আসো, আমার বড় খারাপ লাগে।

জানোত, আমি সব সময় নানা কাজে ব্যস্ত থাকি?

 জানি, তবু তোমার পথ চেয়ে থাকি।

মাহমুদা, এমনি করে কতদিন তুমি আমার পথ চেয়ে থাকবে? বোন, তুমি সভ্য সমাজে ফিরে যাও, আমি তোমার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেবো। তোমার বিয়েতে বহু অর্থ ব্যয় করবো, যাতে তোমার কোনো অসুবিধা না হয়। বাড়ি-গাড়ি ঐশ্বর্য সব পাবে মাহমুদা।

বনহুরের মুখে ‘বোন’ সম্বোধন মাহমুদাকে এক স্বর্গীয় দীপ্তিতে দীপ্তময় করে তুললো, সে কোনো কথা বলতে পারলো না।

 রাত ভোর হবার পূর্বে বনহুরকে কান্দাই জঙ্গলে তার আস্তানায় ফিরে যেতে হবে। বনহুর উঠে দাঁড়ালো, মাহমুদাকে লক্ষ্য করে বললো–আবার শীঘ্র আসবো বোন। এতদিন তোমার কথা ঠিকভাবে খেয়াল না করে আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করো বোন।

মাহমুদা মাথা নত করে রইলো, তার চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

বনহুর চিবুকটা তুলে ধরলো মাহমুদার, বললো–একি,তোমার চোখে পানি কেন? তুমি কাঁদছো?

না। কই, কাঁদিনি তো! মাহমুদা তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলো আঁচলে।

বনহুর একটু হেসে বললো–হাঁ, কেঁদো না যেন কোনো সময়।

 বনহুর বেরিয়ে গেলে কক্ষ থেকে।

মাহমুদা বনহুরের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো, কতদিন না সে এই মানুষটিকে দেখেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তাকে এতটুকু বিচলিত বা চঞ্চল হতে দেখেনি, দেখেনি তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন। তার মত সুন্দরী যুবতীকে কতদিন নির্জনে পেয়েও বনহুর কোনোদিন তাকে জানায়নি কোনো প্রেম নিবেদন। বরং মাহমুদা তার মধ্যে দেখতে পেয়েছে এক স্বর্গীয় দীপ্তিভাব।

 শ্রদ্ধায় নত হয়ে এসেছে তখন মাহমুদার মাথাটা। আজ কত কথা মনে পড়েছে তার, কত স্মৃতিভরা দিন ভেসে উঠছে তার মনের পাতায়।

আসলে মাহমুদা উচ্ছৃঙ্খল, চঞ্চল বা মন্দ মেয়ে ছিলো না, সে ধীর-স্থির-বুদ্ধিমতী মেয়ে। বনহুরের দয়ায় সে আজ এখানে আশ্রয় পেয়েছে, এমনি বেঁচে থাকার প্রেরণাও পেয়েছে। একদিন তার সব ছিলো, আজ তার কিছু নেই। এখানে যদি সে আশ্রয় না পেতো তাহলে হয়তো কোথায় ভেসে যেতো তৃণকুটার মত কে জানে।

মাহমুদা খান্দানী বংশের মেয়ে, তার চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। সুদীর্ঘ দেহ, সুন্দর দুটি চোখ, দীর্ঘ কৃষ্ণ কালো একরাশ ঘন চুল। যে কোনো পুরুষের কামনার বস্তু মাহমুদা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু বনহুরের মনে মাহমুদার এ অপরূপ সৌন্দর্য কোনোদিন আলোড়ন জাগায়নি। কতদিন ঘনিষ্ঠ হয়ে কত আলাপ-আলোচনা চলেছে তাদের মধ্যে-বনহুরের সান্নিধ্য- মাহমুদার দেহ-মনে শিহরণ জাগিয়েছে তবু সে ওর মধ্যে খুঁজে পায়নি কোনো পরিবর্তন।

কতদিন কত কথা বনহুরকে নিয়ে সে ভেবেছে- অভিমান হয়েছে এবার এলে সে তার সঙ্গে কোনো কথাই বলবে না। কিন্তু ও এলে পারেনি মাহমুদা নিশ্চুপ থাকতে। ছুটে এসেছে তার পাশে। ওর হাস্যোদ্দীপ্ত মুখমণ্ডল তাকে মুখরা করে তুলেছে।

আজ মাহমুদা বুঝতে পারে, এতদিন সে ভুল করেছে। যাকে সে প্রাণ দিয়ে কামনা করেছে তাকে সে কোনোদিন পাবে না। মাহমুদার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।

 বনহুরকে নিয়ে পুলিশ মহলে আবার নতুন করে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণের উৎসব থেকে বনহুর মনসুর ডাকুর কন্যাকে নিয়ে উধাও হয়েছে। যাকে গ্রেপ্তার করার জন্য এত আয়োজন, তাকে গ্রেপ্তার করা দূরের কথা, কেউ চিনতেও পারলো না, বরং মার্কিন গোয়েন্দা মিঃ লাউলং এর পাশে বসে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করে গেলো।

মিঃ আরিফ চৌধুরী মিঃ লাউলং, মিঃ হাসান এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার সর্বক্ষণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেমন করে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করা যায়। সবচেয়ে বেশি রাগ মিঃ জাফরীর কারণ তাঁকে কৌশলে বনহুর বন্দী করে রেখে নিজে উৎসবে যোগ দিবার সুযোগ করে নিয়েছিলো।

পুলিশ অফিসে আজ সন্ধ্যায় এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে, এখানে মিঃ জাফরী বলবেন কেমন করে তাকে বনহুর আটক করেছিলো।

মিঃ লাউলং এবং আরও অনেক বিশিষ্ট পুলিশ অফিসার থাকবেন এই বৈঠকে। সকলের মনেই মিঃ জাফরীর ঘটনা জানার বাসনা প্রবলভাবে দানা বেঁধে আছে। সন্ধ্যার পূর্বেই পুলিশ অফিসের সামনে মোটরকারের ভীড় জমে উঠলো।

একসময় সবাই জড়ো হলেন। পুলিশ অফিসের ভিতরে বৈঠক বসলো। মিঃ জাফরী এবং অন্যান্য অফিসার গোলাকার হয়ে বসেছেন। সকলের উদ্বিগ্নভরা দৃষ্টি মিঃ জাফরীর মুখে।

মিঃ জাফরীর মুখমণ্ডল গম্ভীর, কেমন যেন একটা অপমানিত ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে।

মিঃ আরিফ বললেন-দিন দিন দস্যু বনহুরের স্পর্ধা চরমে উঠছে। যেভাবে যোক তাকে শায়েস্তা না করলেই নয়।

কিন্তু কিভাবে তাকে শায়েস্তা করবেন বলুন? পুলিশ মহল তো চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। কথাটা বললেন ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন।

মিঃ হাসান বললেন—তার জীবন্ত প্রমাণ হলেন আমাদের মিঃ জাফরী। তিনি দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে আজ নয়, কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত সংগ্রাম চালিয়ে চলেছে।

হাঁ, আমার চেষ্টার কোথাও ভুল নেই। এত নিপুণতার সঙ্গে কাজ করেও আমি দস্যু বনহুরকে শায়েস্তা করতে পারলাম না। সমস্ত আয়োজন আমার ব্যর্থ হয়েছে বারবার।

মিঃ আরিফ বললেন–দস্যু বনহুর কি করে সেদিন আপনাকে এমনভাবে আটক করলো, সেটাই আমরা আজ পর্যন্ত ভেবে পাচ্ছি না।

 সে অতি আশ্চর্য ব্যাপার মিঃ চৌধুরী। পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে উৎসবে আসবো বলে দ্রুত অফিসের কাজ সেরে নিচ্ছিলাম, এমন সময় আমার পুরোন ভৃত্য এসে আমাকে জানালো, বাসার ভিতরে ডাকছেন। আমি তাড়াতাড়ি কাগজপত্র গুছিয়ে ভিতরে চলে গেলাম। দেখলাম, আমার স্ত্রী এক গেলাস গরম দুধ হাতে দাঁড়িয়ে আমার প্রতীক্ষা করছেন। আমাকে দেখেই বললেন, আজ বিকেলে দুধ খাওনি, এখন খেয়ে নাও। আমার আপত্তি জানাবার সময় ছিলো না, স্ত্রীর হাত থেকে দুধের গেলাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পান করলাম, তারপর নেমে এলাম নিচে। গাড়ি-বারান্দায় আমার গাড়ি অপেক্ষা করছিলো, আমি সোজা গাড়ির পিছন আসনে চেপে বসলাম। ড্রাইভার জানতো, আমি পুলিশ অফিসের উৎসবে যোগ দেবার জন্যই এ সময় বাড়ি থেকে বের হচ্ছি। কাজেই ড্রাইভারকে আমি কিছু না বলে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে নীরবে পান করে চললাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো, তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন মিঃ জাফরী। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছিলেন, পুলিশ অফিসারগণ, কারও মুখে কোনো উক্তি উচ্চারিত হচ্ছিলো না। সবার চোখেমুখেই বিস্ময়।

মিঃ আরিফ বললেন–নিশ্চয়ই দুধের সঙ্গে কোনো—

মিঃ হাসান বললেন—স্যার, তা কেমন করে সম্ভব হয়। দুধতো অন্য কেউ দেয়নি, দিয়েছেন মিসেস জাফরী।

এখানেই তো আশ্চর্য হবার কথা। বললেন মিঃ লাউলং।

এখানে সব আলাপ আলোচনা ইংরেজিতেই হচ্ছিলো, কাজেই মিঃ লাউলং-এর বুঝতে কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। তিনি আরও বললেন–দুধের সঙ্গেই যে কোনো ঔষধ মেশানো ছিলো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 মিঃ জাফরী গম্ভীরভাবে মাথা দোলালেন–হাঁ, আমারও সেই রকম মনে হচ্ছে। কিন্তু—-

মিঃ লাউলং আবার বললেন–কিছুই আশ্চর্য নয় মিঃ জাফরী, আপনার স্ত্রী দুধের গেলাস আপনাকে এনে দেবার পূর্বে দুধে কেউ ঔষধ মিশিয়ে রেখেছিলো, এমনও তো হতে পারে।

ঠিক, আপনার বাবুর্চির মধ্যে শয়তানি থাকতে পারে। বললেন মিঃ আরিফ।

মিঃ জাফরী বললেন–বাড়ির বাবুর্চি কেন, পুরোন ভত্য থেকে দারোয়ান পর্যন্ত সবাইকে আমি আটক করে রেখেছি। সবাইকে শাস্তি দিয়েছি, কিন্তু কাউকে স্বীকার করাতে পারিনি।

মিঃ লাউলং বললেন, দস্যু বনহুর দেখছি মহা চাল চেলেছে। আচ্ছা, আমি নিজে একবার ওদের জেরা করে দেখবো। মিঃ জাফরী, তারপর কি হলো বলুন?

 মিঃ জাফরীর মুখোভাব অত্যন্ত ম্লান, নিষ্প্রভ মনে হচ্ছিলো। তিনি একটু চিন্তা করে বললেন–যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, দেখলাম আমার অফিস কক্ষের একটা চেয়ারে বসে আছি।

পুলিশ অফিসারগণ সবাই বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন।

 মিঃ হাসান বললেন–কি আশ্চর্য ব্যাপার।

হাঁ, আশ্চর্য বটে। বললেন মিঃ লাউলং।

 মিঃ আরিফ চৌধুরী বললেন—-তারপর কি দেখলেন?

 মিঃ জাফরী গম্ভীর গলায় বললেন–প্রথমে আমি কিছু চিন্তা করতে পারলাম না। মনে হলো মাথাটা বড় বিম ঝিম করছে যখন স্বাভাবিক হলাম তখন সব কথা মনে পড়লো—পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে উৎসবে যোগ দিবার জন্য আমি আমার গাড়িতে যাচ্ছিলাম–কিন্তু কেমন করে আবার আমার অফিস-রুমে এলাম, কিছুই ভেবে পেলাম না।

অনেকক্ষণ নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছিলেন মিঃ ইয়াসিন। তিনি প্রবীণ পুলিশ অফিসার, এবার তিনি বললেন–দস্যু বনহুরকে নিয়ে আমরা যতই চিন্তা-ভাবনা করি না কেন, তার অদ্ভুত কার্যকলাপ আমাদের আরও অবাক করবে। তাকে আরও রহস্যময় বলে মনে হবে।

ঠিকই বলেছেন মিঃ ইয়াসিন, জীবনে বহু চোর-গুণ্ডা-বদমাইশ দস্যু-ডাকু দেখেছি এবং গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি কিন্তু এমন বিস্ময়কর দস্যু আমি দেখিনি। কথাগুলো স্থিরকণ্ঠে বললেন মিঃ আরিফ।

মিঃ লাউলং ভাবছিলেন, তিনি বিশ্বের প্রখ্যাত গোয়েন্দা, আর কিনা তার চোখে ধূলো দিয়ে দস্যু বনহুর এতগুলো কাজ করে গেলো অথচ তাকে গ্রেপ্তার করতে তিনি সক্ষম হলেন না। এ আফসোস তাকে ভীষণভাবে ম্লান করে দিয়েছে তিনি নিজ মনে অত্যন্ত লজ্জা বোধ করছিলেন, মুখমণ্ডল রাঙ্গা হয়ে উঠেছে তার। মাঝে মাঝে অধর দংশন করছিলেন তিনি।

এখানে যখন দস্যু বনহুরকে নিয়ে নানা রকম জল্পনা কল্পনা চলেছে তখন দস্যু বনহুর তার আস্তানায় বিশ্রামকক্ষে বিশ্রাম করছিলো। হঠাৎ তাঁর কানে ভেসে আসে নূরীর গানের সুর। নূরীর কন্ঠ বনহুরকে চঞ্চল করে তোলে, শয্যা ত্যাগ করে সে উঠে দাঁড়ায়।

নূরীর কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ায় বনহুর।

শিশু জাভেদকে দোলনায় শুইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিলো নুরী, ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে গেয়ে দোলনায় দোল দিচ্ছিলো। মাঝে মাঝে চুমু দিচ্ছিলো জাভেদের ছোট্ট লাল টুকটুকে ঠোঁটে। মায়ের চুমুতে ফিকফিক করে হেসে উঠছিলো জাভেদ।

ঘুমানোর পরিবর্তে জাভেদকে হাসতে দেখে নূরী ক্রুদ্ধ হবার ভান করে কোমল হস্তে মৃদু চড়

 বনহুর এতক্ষণ চুপ করে মা ও ছেলের তামাশা দেখছিলো, এবার সে পিছন থেকে নুরীর চোখ দুটো ধরে ফেলে। নরীর গান থেমে যায়, কিছুমাত্র অবাক না হয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, স্বামীর হাত দু’খানা সরিয়ে দিয়ে বললো—যাও, লজ্জা করে না? দেখছে না জাভেদ কেমন তাকিয়ে আছে?

ও, তাই তো, বড় ভুল হয়েছে। বনহুর নূরীকে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যায় জাভেদের দোলনার পাশে। জাভেদ তখন হাত পা নেড়ে ফিক ফিক করে হাসছিলো।

বনহুর জাভেদকে তুলে নিলো হাতের উপর শিস্ দিয়ে আদর করতে লাগলো সে ওকে। একসময় হাতের তালুতে দাঁড় করিয়ে উঁচু করে ধরতেই নূরী ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠলো—আরে পড়ে যাবে যে?

এত সহজ নয় নূরী, তোমার জাভেদ দেখ কত শক্ত হয়েছে।

ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, তোমার শক্ত হাতের ছোঁয়ায় ওর নরম দেহটা আজকেই শক্ত হয়ে গেলো।

ভবিষ্যতের দস্যু জাভেদকে তার পিতার হাতের পরশে গড়ে উঠতে দাও নুরী, অমন নরম হতে দিও না।

বনহুরের কোল থেকে নূরী জাভেদকে কোলে নেয়, তারপর জাভেদের নরম তুলতুলে গণ্ডে ছোট্ট একটি চুমু দিয়ে বলে–এবার ঘুমাও কেমন? দোলনায় শুইয়ে দেয় নুরী জাভেদকে।

বনহুর বলে—গান গাও নইলে জাভেদ ঘুমাবে না।

না, আর গাইবো না। তুমি চোরের মত চুপি চুপি শুনছিলে কেন, বলো?

নূরী বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয়, বলে-থাক, আর বলতে হবেনা। এবার যাও দেখি।

উ হুঁ, যাবো না। বনহুর নূরীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে।

নূরী বলে উঠে– ছিঃ ছিঃ দেখছো না জাভেদ রয়েছে?

বনহুর দোলনার দিকে উঁকি দিয়ে দেখে বলে-ঐ দেখো ঘুমিয়ে পড়েছে।

নূরী তাকিয়ে দেখলো, সত্যি জাভেদ মুখের মধ্যে বুড়ো আঙ্গুলটা রেখে চুষতে চুষতে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেছে।

বনহুর নূরীর হাত ধরে তার বিশ্রামকক্ষের দিকে নিয়ে চললো। নিজ কক্ষে প্রবেশ করে নূরীকে শয্যায় বসিয়ে দিলে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো–এবার আমাকে ঘুম পাড়াও।

তুমি বুঝি কচি খোকা হয়েছ?

কেন, আমি একেবারে বুড়ো হয়ে গেছি বুঝি? গান গাও, সেই ঘুমপাড়ানি গানটা।

বেশ গাইছি, যদি না ঘুমাও তবে কিন্তু শাস্তি দেবো।

আচ্ছা, আচ্ছা দিও। বনহুর মিছামিছি চোখ মুদলো।

 এমন সময় ভেসে এলো বাইরে থেকে রহমানের গলা–সর্দার।

বনহুর নূরীর কোল থেকে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর বললো–রহমান ডাকছে, হয়তো কোনো জরুরী কথা আছে। ঘুমানো আর হলো না নূরী।

নূরীর মনটা ভার হয়ে এলো, কোনো কথা বললো না সে।

বনহুর বেরিয়ে আসতেই রহমান কুর্ণিশ জানালো। তারপর বললো—সর্দার, একটা সংবাদ। আছে।

চলো, দরবারকক্ষে চলো, ওখানেই সব শুনবো।

 বনহুর আর রহমান দরবারকক্ষে প্রবেশ করতেই বনহুরের অনুচরগণ তাকে কুর্ণিশ জানালো। সশস্ত্র অনুচরদল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলো।

বনহুর আর রহমান এগিয়ে গেলো আসনের দিকে।

 রহমান একপাশে সরে দাঁড়ালো।

সর্দার আসন গ্রহণ করতেই কায়েসের ইঙ্গিতে এগিয়ে এলো হাশমত। কুর্ণিশ জানালো সে রাইফেল হাতে মিলিটারী কায়দায়। এককালে হাশমত মিলিটারীতে কাজ করতে বলে তার। চালচলনে মিলিটারী কায়দা এখনও পরিলক্ষিত হয়। হাশমত বনহুরের কান্দাই শহরের ঘাঁটিতে থাকে এবং তার কাজ সর্বক্ষণ শহরের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো–কোথায় কে বা কারা কিভাবে মানুষের সর্বনাশ করছে।

হাশমত কুর্ণিশ জানাতেই বনহুর বললো–কি সংবাদ হাশমত?

 হাশমত বললো–সর্দার, একটা ভয়ঙ্কর সংবাদ, যা কান্দাই এর দশ কোটি মানুষকে মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে চলেছে।

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো বনহুর-কি এমন সংবাদ, বলো?

 হাশমত বলতে শুরু করলো-সর্দার, কান্দাই-এ এক দুস্কৃতি ব্যবসায়ীদল নতুন এক ব্যবসা শুরু করেছে। তারা নাপাম বোমার বিষাক্ত গ্যাস মিশিয়ে সরিষার তেল তৈরি করছে। যে তৈল দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না তেলে কোনো ভেজাল আছে। খাঁটি সরিষার তেলের মত রং-গন্ধ সবকিছু কিন্তু সেগুলো যে অতি ভয়ঙ্কর মারাত্মক বিষাক্ত তেল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্দার, এই পত্রিকাখানা পড়লে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

হাশমত কাপড়ের তলা হতে একটা পত্রিকা বের করে এগিয়ে ধরলো বনহুরের দিকে।

বনহুর পত্রিকাখানা হাতে নিয়ে রহমানকে দিয়ে বললো–পড়ো। রহমান পত্রিকাখানা মেলে পড়তে শুরু করলো–

“সরিষার তেলে নাপাম বোমার বিষাক্ত গ্যাস মিশায়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশবাসীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেছে”

ডাইক্লোরথিল সালফাইড অর্থাৎ সাধারণভাবে পরিচিত মাস্টার্ড গ্যাস-এর সাহায্যে কৃত্রিম সরিষার তেল উৎপাদন করে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সুপরিকল্পিতভাবে সরিষার তেল ব্যবহারকারী কান্দাই-এর দশ কোটি মানুষকে তিলে তিলে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মুখে ঠেলে দিতেছে। নির্ভরযোগ্য বিশেষজ্ঞ মহলসূত্রে জানা গিয়েছে, বাজারে সরবরাহকৃত শতকরা একশত ভাগ সরিষার তেলই বিষাক্ত নাপাম বোমার উপরোক্ত উপকরণে দূষিত। প্রায় এক বছর পূর্বে কান্দাই এ-র কোন এক পল্লীতে অনুরূপ অসৎ কার্যের সূত্র পাওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত দেশের শতকরা একশত ভাগ মানুষের এই ভোজ্য দ্রব্যটির বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার কোন পরীক্ষা, তথ্য বা প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। উপরন্তু এই অসাধু ব্যবসায়ে লিপ্ত কান্দাই-এ ধৃত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, জনসাধারণকে তাও জানান হয় নি।

বিশেষজ্ঞ মহলসূত্রে জানা গিয়েছে যে, ডিক্লোরোথিল সালফাইড মিশ্রিত কথিত সরিষার তৈলে প্রকৃত সরিষার তৈলের ভাগ একেবারেই নেই।

জানা গিয়েছে যে সাদা প্যারাফিনের সাথে উক্ত বিষাক্ত গ্যাস ও রং মিশ্রিত করে আজ দীর্ঘদিন যাবৎ বাজারে সরিষার তৈল হিসাবে বিক্রয় করা হচ্ছে। উক্ত বিষাক্ত কৃত্রিম সরিষার তৈল খাইয়া দেশের বিপুল সংখ্যক নরনারী তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন।

এতক্ষণ বনহুর স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছিলো, বলে উঠলো সে থাক, আর পড়তে হবে না।

রহমান ক্ষান্ত হলো, কাগজখানা ভাঁজ করে রাখলো হাতের মুঠায়।

রহমান বললো–সর্দার, এসব ব্যবসায়ী শুধু দেশের শত্রু নয় দেশের জনগণের মরণ ছোবল।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো আসন ত্যাগ করে, তারপর বললো–বিষদাত ভেঙ্গে দিতে হবে এই বিষধর সাপগুলোর। রহমান, তুমি আজই হাশমতের সঙ্গে গিয়ে নিজে এসব দুষ্কৃতি ব্যবসায়ীর সঠিক ঠিকানা জেনে এসো।

আচ্ছা সর্দার।

এবার পুলিশের হেফাযতে নয়, আমি নিজে এদের শায়েস্তা করবো।

রহমান বললো–পুলিশ মহল আজ পর্যন্ত এর কোনো কিছুই করতে সক্ষম হয়নি।

পুলিশ মহলের গাফলতিই এসব শয়তান দুস্কৃতি ব্যবসায়ীকে এতদূর অগ্রসর হতে সহায়তা করেছে। বললো কায়েস।

হাশমত বলে উঠলো–পুলিশ মহল যদি সত্যিকারের নজর দিতো তাহলে এমনভাবে দেশ অধঃপতনের দিকে যেতো না। এইসব দুষ্কতি ব্যবসায়ী মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে পুলিশ মহলকে বোবা বানিয়ে রেখেছে। তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। জনগণ এ ব্যাপার নিয়ে হাজার মাথা ঠোকাঠুকি করেও কিছু ফল পায়নি।

এবার বললো বনহুর-পুলিশ মহলের মুখ বন্ধ করে যারা দেশবাসীর সর্বনাশ করে চলেছে, আমি এবার তাদের মুখ বন্ধ করে দেবো চিরতরে। দাঁতে দাঁত পিষলো সে, তার দক্ষিণ হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হলো। একটু থেমে বললো আবার বনহুর–শুধু এই সরিষার তেলে ভেজালকারী নয়, আমি দেশের সর্বনাশক ভেজালকারীদের সমুচিত শাস্তি দেবে। যারা খাদ্যদব্যে নানারূপ বিষাক্ত ভেজাল মিশিয়ে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে বসে আছে, আমি শুষে নেবো এসব ব্যবসায়ীর বুকের রক্ত।

রহমান বললো—-সর্দার, আজকাল প্রতিটি খাদ্যের সঙ্গেই ভেজাল মেশানো হচ্ছে। চাউলে পাথর, আটার মধ্যে তেঁতুল বীজের গুড়া, তুলাৰীজের গুড়া। চিনির সঙ্গে আটা-ময়দা, দুধের সঙ্গে পাউডার দুধ, ঘির সঙ্গে ডালড়া এমন কোনো খাদ্য নেই যা ভেজাল বিহীন পাওয়া যায়।

শুধু স্বাভাবিক ভেজাল হলে তবু হতো রহমান। দেশের মানুষ সব অর্থের লোভে জানোয়ার বনে গেছে। জানোয়ার বললেও ভুল বলা হয়, কারণ জানোয়াররা এমন সর্বনাশ করতে পারবে না, যেমন করছে আজকের মানুষগণ। এসব ধনকুবেরু ব্যবসায়ী পশুর অধম, ঘৃণ্য জানোয়ার কুকুরের সঙ্গে এদের তুলনা করা যায়। মানুষনামী জীব এরা সব বুঝে, জানে-তবু মানুষ হয়ে মানুষের সর্বনাশ করে। কথাগুলো বলে থামলো বনহুর।

 রহমান এবং অন্যান্য অনুচর নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিলো। তারা সর্দারের কথাগুলো শুনছিলো মনোযোগ সহকারে।

বনহুর আবার বলতে শুরু করলো–এইসব ব্যবসায়ী সুপরিকল্পিতভাবে দেশের জনগণের চরম সর্বনাশ করে চলেছে, তাদের সহায়তা করে চলেছে দেশের কতকগুলো মানুষনামী জানোয়ার, যাদের জন্য দেশের শান্তি চিরতরে সমাধিস্থ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই সব শয়তান দল গোপনে আরও অনেক রকম ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে–ছেলেচুরি ব্যবসা, নারীহরণ ব্যবসা, এমনি আরও কত জঘন্য ব্যবসা যা মুখে আনাও পাপ। রহমান, এবার আমি এসব দুষ্কৃতি। অসাধু ব্যবসায়ীর শায়েস্তা ব্যাপারে মনোযোগ দেবো। আরও কিছু লোককে আমি শায়েস্তা করবো, দেশের শাসক হয়ে যারা শোষণ করে চলেছে–এসব ব্যবসায়ীকে যারা প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। মোটা অঙ্ক ঘুষ খেয়ে যারা মোটা বনে গেছে, আমি তাদের রক্ত শোষণ করবো এবার———

বনহুরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে, চোখ দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। বারবার তার হাতখানা কোমরের বেলটে ছোরার বাটে এসে ঠেকছে। অধর দংশন করছে বনহুর।

*

কান্দাই-এর সর্বশ্রেষ্ঠ মিল মালিক মওলানা ইয়াকুব আলী মাশহাদী তাঁর মিল পরিদর্শন করে ফিরে এলেন অফিস কক্ষে। একটি নয় কান্দাই শহরে তার কয়েকটি মিল রয়েছে। তার একটি মিলে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করে। মাসিক আয় তার পাঁচ লাখ টাকার বেশি। শুধু কান্দাই শহরে নয়, দেশের বাইরেও তাঁর মিল রয়েছে। এসব মিল থেকে বছরে কোটি কোটি মণ সরিষার তেল দেশ-বিদেশে চালান যায়।

মওলানা ইয়াকুব আলীর মুখে সব সময় আল্লাহ আল্লাহ বুলি। নামাজ পড়ে কপালে দাগ পড়ে গেছে। পাজামা-পাঞ্জাবী শেরওয়ানী, মাথায় টুপি, মুখে একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি। মুখে সর্বক্ষণ আল্লাহর নাম স্মরণ করলেও মনে মনে টাকার অঙ্ক কষেণ তিনি সব সময় চোখে সোনার ফ্রেমে আঁটা চশমা, আংগুলে হীরের আংটি–একটি নয়, দশ আংগুলে সাতটি।

লাখ লাখ টাকা তার আয় হলেও শ্রমিকদের মজুরি দেবার সময় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে হিসেব করে দেবার নিয়ম। কড়া হুকুম আছে তার কর্মচারীদের উপর-একটি পয়সা যেন এদিক-সেদিক না হয়।

অবশ্য কয়েকজন কর্মচারীর বেতন বেশ মোটা অঙ্কের দেন তিনি। কারণ এরাই তার ডান হাত! এদের দ্বারাই চলেছে তার ব্যবসা। মওলানা সাহেব এই সব কর্মচারীকে অত্যন্ত সমীহ করে চলেন। তার কারবার যে সম্পূর্ণ ভেজালের উপর চলছে, তার প্রধান সহায়ক এরা।

মওলানা সাহেব এবাদত করেন, মুখে জিকির করেন, মাঝে মাঝে হজ্বে যান পুণ্য সঞ্চয় করতে কিন্তু কোনো অসহায় ব্যক্তি যদি সারাদিনের ক্ষুর্ধাত হয়ে একটা পয়সা সাহায্য চায়, তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেন বিনা-দ্বিধায়।

 আজ পর্যন্ত কোনো অসহায় ব্যক্তি তার কাছে এতটুকু দয়া বা সাহায্য পায়নি। দেশের কোনো মঙ্গল সাধনে তিনি একটি পয়সা ব্যয় করেননি কোনোদিন।

এহেন মওলানা ইয়াকুব আলী মাশহাদীই সেই তেল ব্যবসায়ীদের একজন যারা নাপাম বোমার বিষাক্ত গ্যাস মিশিয়ে দেশবাসীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

মওলানা মাশহাদী অফিস রুমে এসে বসলেন তার অফিসকক্ষ এগারো তলা ছাদের এক বিশিষ্ট জায়গায় অবস্থিত, সহসা কেউ এই কক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তার সঙ্গে যারা এই ব্যবসায় গভীরভাবে লিপ্ত তারা এবং তার বিশেষ কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া কেউ এখানে আসতে পারে না।

মওলানা মাশহাদী অফিসকক্ষে বসে ফোনের পর ফোন করে চললেন। তাঁর টেবিলে একটি বা দুটি নয় কয়েকটি রিসিভার সাজানো রয়েছে।

মওলানা সাহেব যখন বিভিন্ন স্থানে কারবার নিয়ে কোনো আলাপ করছিলেন, ঠিক সেমুহূর্তে নিচে ১নং লিফটের মুখে এসে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক। হাতে এ্যাটাচি ব্যাগ, চোখে গগলস্ মাথায় ক্যাপ, ঠোঁটের ফাঁকে দামী চুরুট।

১নং লিফটে মওলানা মাশাহাদী এবং তাঁর ব্যবসায় জড়িত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া এ লিফট অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারতো না।

ভদ্রলোকটি কার্ড বের করে দেখালেন লিফ্টম্যানকে।

লিফট ম্যান সঙ্গে সঙ্গে লিফটের দরজা খুলে দিলো।

ভদ্রলোকটি তার হস্তস্থিত চুরুটের শেষ অংশ মেঝেতে ফেলে বুটের গোড়ালি দিয়ে পিষে ফেললেন তারপর লিফটে প্রবেশ করলেন।

এগারো তলায় পৌঁছতেই লিফট থেকে নেমে এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোকটি মওলানা মাশহাদীর অফিস রুমের দিকে।

অফিস রুমের দরজায় রাইফেলধারী পাহারাদার দাঁড়িয়ে কড়া পাহারা দিচ্ছে।

ভদ্রলোকটি একটা কার্ড বের করে দারোয়ানের হাতে দিলেন।

দারোয়ান কার্ড হাতে চলে গেলো ভিতরে।

ভদ্রলোক শুনতে পাচ্ছেন মওলানা মাশহাদী ফোনে কার সঙ্গে যেন আলাপ করছেন। তার ব্যবসা ব্যাপারে আলাপ চলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দারওয়ান ভিতরে প্রবেশ করে সেলুট দিয়ে কার্ডখানা এগিয়ে ধরলো মওলানা সাহেবের দিকে।

 মওলানা মাশহাদী তার মূল্যবান ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসে হাত বাড়ালেন, দক্ষিণ হাতে তার রিসিভার। কার্ডখানা নিয়ে চোখের সামনে ধরেই বললেন—ভিতরে আসতে বলল।

দারওয়ান বেরিয়ে গেলো।

ভদ্রলোক নতুন একটা চুরুটে অগ্নি সংযোগ করছিলেন। দারওয়ান জানালো–ভিতরে যান।

ভদ্রলোক চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে ভিতরে প্রবেশ করলেন।

মওলানা মাশহাদী রিসিভার রেখে সোজা হয়ে বসলেন। ভদ্রলোক তার সম্পূর্ণ অপরিচিত, কিন্তু কার্ড ছিলো তাঁর বিশিষ্ট এক সহকারীর, চমকে উঠলেন মাশহাদী সাহেব; বললেন–আপনি

কেন কার্ড পাননি? জবাব দিলেন ভদ্রলোক।

মাশহাদী সাহেব কার্ডখানা আবার চোখের সামনে তুলে ধরলেন, বললেন তিনি আপনাকে আমি চিনি না। কার্ডখানায় যার নাম লেখা, সে আমার ব্যবসার সহায়, আমার বন্ধু।

মনে করুন, আমার নাম আর আপনার বন্ধুর নাম এক। আমিওতো আপনার ব্যবসায়ে সহায়তা করতে পারি? যাক, আপনি যখন আমাকে বসতে বলতে সাহসী হলেন না তখন আমি নিজেই আসন গ্রহণ করছি।

 মওলানা মাশহাদী অবাক হয়ে গেছেন একেবারে। ভদ্রলোকটির কথাবার্তা কেমন যেন হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। অবাক হয়ে তাকালেন তিনি ভদ্রলোকটির মুখের দিকে।

ভদ্রলোক তার এ্যাটাচি খুলে একটি চুরুট বের করে এগিয়ে ধরলো—পান করুন।

মাশহাদী সাহেব তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে তাকালেন, চোখেমুখে তার কেমন অবিশ্বাসের ছায়া।

ভদ্রলোক হেসে বললেন–আমাকে অবিশ্বাস করার কিছুই নেই। আমি আপনার ব্যবসার সুনাম শুনে এসেছি। আপনার সঙ্গে কারবার চালাবো।

 এবার ভদ্রলোকের কথাবার্তায় অনেকখানি স্বচ্ছ হয়ে এলেন মাশহাদী সাহেব। তিনি বললেন–আপনি কোনো কোম্পানি থেকে এসেছেন?

কোনো কোম্পানি আমার নেই তবে প্রচুর অর্থ আছে। অর্থ দিয়ে আমি অর্থ ধরতে চাই। মওলানা সাহেব, আপনার সঙ্গে বায়নাপত্র চুক্তিবদ্ধ হতে চাই। কত টাকা আপনাকে প্রথম নিতে হবে জানতে পারলে আমি টাকা–

টাকার কথায় মওলানা সাহেবের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠলো বললেন তিনি টাকার কথা পরে হবে। আপনি যদি ব্যবসা করতে চান তাহলে পাকা কথাবার্তা হয়ে নিক।

 বেশ, যা ভাল মনে করেন আমি তাই চাই। তবে হাঁ, টাকা পয়সা আমি সঙ্গেই এনেছি। একলাখ পঞ্চাশ হাজার।

এবার হাসি বের হলো মওলানা সাহেবের মুখে, তিনি লোলুপ দৃষ্টিতে টেবিলে রাখা এ্যাটাচি ব্যাগটার দিকে তাকাতে লাগলেন।

একথা সেকথার ফাঁকে ভদ্রলোকটি চুরুটের বাক্সটা এগিয়ে ধরলেন মাশহাদী সাহেবের দিকে-নিন, ততক্ষণে একটি সেবন করুন।

মাশহাদী সাহেব কথার ফাঁকে অন্যমনস্কভাবে একটা চুরুট তুলে নিয়ে মুখে খুঁজলেন।

ভদ্রলোক নিজ হাতে মওলানার চুরুটে অগ্নিসংযোগ করলেন–আলাপ চলতে লাগলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই চেয়ারের উপর ঢলে পড়লেন কোটিপতি মওলানা ইয়াকুব আলী মাশহাদী।

সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক ডাকলেন– দারওয়ান, দারওয়ান—

দারওয়ান অফিসকক্ষে প্রবেশ করতেই ভুদ্রলোক ব্যস্তকণ্ঠে বললেন–তোমাদের সাহেব হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন, এঁকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।

দারওয়ান হতভম্বের মত বেরিয়ে যাচ্ছিলো।

 ভদ্রলোক বললেন–তুমি আমাকে সাহায্য করো। আমার গাড়িতেই ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।

দারওয়ান তার হাতের রাইফেলখানা দেয়ালে ঠেশ দিয়ে রেখে ধরলো।

মওলানা সাহেবের দেহটা ভদ্রলোক এবং দারওয়ান মিলে লিফটের দরজায় নিয়ে এলো। লিফট ম্যানতো অবাক, বললো–সাহেবের কি হয়েছে?

ভদ্রলোক ব্যস্তকণ্ঠে বললেন-হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। বেশি লোক জানাজানি হলে বিলম্ব হতে পারে, কাজেই শীঘ্র হাসপাতালে নিতে পারলে বাঁচতে পারেন। অবস্থা মোটেই ভাল নয়—-লিফ ম্যানও এগিয়ে এলো সাহায্য করতে বেশি ভাবার সময় কারো ছিলো না, দারওয়ান ও লিফট ম্যানের সাহায্যে ভদ্রলোক মওলানা মাশহাদীর সংজ্ঞাহীন দেহটা তুলে নিলেন নিজের গাড়িতে।

গাড়িখানা নিচেই অপেক্ষা করছিলো, দু’চারজন কর্মচারী যারা আশেপাশে ছিলো সবাই ছুটে এলো তারাও সাহায্য করলো মালিককে গাড়িতে উঠানোর ব্যাপারে। অবশ্য কেউ ভেবে পাচ্ছে না। কি ব্যাপার।

মওলানা মাশহাদীর সংজ্ঞাহীন দেহসহ ভদ্রলোকের গাড়িখানা উল্কাবেগে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

কথাটা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত কর্মচারীর মধ্যে।

ম্যানেজার এবং মাশহাদীর সহকারিগণ ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এলো। মাশহাদীর অফিসরুমে প্রবেশ করে থ’ বনে গেলো। কে সে ভদ্রলোক যিনি তাদের মালিককে হঠাৎ অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ফোন করা হলো, কিন্তু আশ্চর্য হাসপাতালে মওলানা মাশহাদী এবং তার বিশিষ্ট বন্ধুর পাত্তা নেই। লোক ছুটলো চারিদিকে। কোথায় গেলো। সেই সবুজ রংয়ের গাড়িখানা?

পুলিশ অফিসে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ অফিসার মিঃ হুদা কয়েকজন পুলিশসহ হাজির হলেন। মিঃ হুদা কান্দাই থানা অফিসার। যেমন চেহারা তেমনি তার ব্যবহার। দু’আনা পয়সা পেলে ও পকেটে ফেলা তার অভ্যাস।

মওলানা মাশহাদী সাহেবের সঙ্গে মিঃ হুদার যোগাযোগ ছিলো অত্যন্ত বেশি। খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হলেন বিশাল বপু নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে।

প্রথমেই অফিস রুমের দারওয়ান এবং লিফট ম্যানকে গ্রেপ্তার করলেন মিঃ হুদা। তারপর জেরা শুরু করলেন রীতিমত।

মিঃ হুদা দারওয়ান এবং লিফটম্যানকে হাজতে পাঠালেন কিন্তু আসল রহস্য উদ্বাটন হলো না কিছু। সমস্ত অফিসে এক মহা হুলস্থুল পড়ে গেলো।

 ম্যানেজার ও মওলানার সহকারিগণ অত্যন্ত উদ্বিগ্নতার সঙ্গে ছুটাছুটি করতে লাগলো। কেউ কেউ ছুটলো গাড়ি নিয়ে কান্দাই-এর বিভিন্ন হাসপাতালে।

কেউ বললেন—কান্দাই পুলিশ অফিসে ফোন করা হোক পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরীর কাছে।

কিন্তু মিঃ হুদা এতে প্রথমে মত দিছিলেন না, পরে বাধ্য হয়ে বললেন–হাঁ, এতক্ষণ আমাদের ভুল হয়েছে, শীগগীর পুলিশ সুপারের কাছে জানানো দরকার।

 পুলিশ, অফিসে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ আরিফ চৌধুরী মিঃ হাসানসহ চলে এলেন। একটা বিস্ময়কর ঘটনা এটা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মিঃ আরিফ এসে মিঃ হুদাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি কোনো ক্ল পেয়েছেন?

মিঃ হুদা জানালেন—স্যার, আমি অফিস রুমের দারওয়ান এবং লিফটম্যানকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠিয়েছি, কারণ এদের দু’জনের সহায়তায় দুষ্কৃতিকারী মহান ব্যক্তি মওলানা সাহেবকে নিয়ে উধাও হতে পেরেছে।

মিঃ আরিফ নিজে পুনরায় অফিসকক্ষ পরীক্ষা করে দেখার জন্য মওলানা মাশহাদী সাহেবের অফিস রুমে প্রবেশ করলেন। তার সঙ্গে মিঃ হাসান, মিঃ হুদা এবং কয়েকজন পুলিশ অফিসার ছিলেন।

 মিঃ আরিফ অফিস রুমে প্রবেশ করেই প্রথমে আবিষ্কার করলেন, তার টেবিলে একটি অর্ধদগ্ধ চুরুট পড়ে আছে। তিনি চুরুটটি হাতে তুলে নিয়ে মওলানা মাশহাদীর ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন-মওলানা মাশহাদী কি চুরুট পান করতেন?

ম্যানেজার বলে উঠলেন–না, তিনি চুরুট পান করতেন না। তিনি সিগারেট পান করতেন।

 মিঃ আরিফ চুরুটটি উঁচু করে ধরে বললেন–এটি তবে কে পান করেছিলো?

 ম্যানেজার মাথা চুলকে বললো—ঠিক বলতে পারছি না স্যার।

মিঃ আরিফ চুরুটটি কাগজে মুড়ে পকেটে রাখলেন। তারপর কাগজপত্র যা টেবিলে ছিলো, নেড়েনেড়ে দেখতেই ম্যানেজার মুখ গম্ভীর করে ফেললেন–স্যার, এসব কাগজপত্র মওলানা সাহেবের মানে——-

ও বুঝেছি, অত্যন্ত গোপনীয়।

না না, ঠিক তা নয় তবে—

 তবে আপনি কি বলতে চান?

মানে এসব কাগজপত্র কাউকে দেখানো নিষিদ্ধ আছে।

কিন্তু আইনের চোখে যা কর্তব্য আমি তাই করছি। মওলানা মাশহাদী সাহেবের অন্তর্ধান ব্যাপারে এসব কাগজপত্রের মাধ্যমে কু’ আবিষ্কার করতে সক্ষম হতে পারি। দেখুন, শুধু টেবিলে রক্ষিত কাগজপত্র নয়, প্রয়োজন হলে আপনাদের আলমারী এবং ড্রয়ারে রক্ষিত কাগজপত্র আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

ম্যানেজারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো, তিনি মওলানা সাহেবের সহকারীদের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।

মিঃ হুদার মুখও কালো হয়ে উঠেছে। মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে তিনি মওলানা সাহেবকে বহু সাহায্য করেছেন। এ ব্যাপারে ঘাটতে গেলে মিঃ হুদার সঙ্গে আরও কিছুসংখ্যক পুলিশ অফিসার জড়িয়ে পড়বেন। তাই মিঃ হুদাও বললেন–স্যার, মওলানা সাহেবের অন্তর্ধান ব্যাপারে কাগজপত্র ঘেটে কোনো ফল হবে মনে হয় না।

মিঃ আরিফ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—ফল হবে কি না আমি জানি। আপনি কাগজপত্র সব পরীক্ষা করেন দেখুন এবং পুলিশ অফিসে জমা দিন।

 এবার মিঃ হুদার মুখমণ্ডল স্বচ্ছ য়ে এলো, আগ্রহভরা কণ্ঠে বললেনস্যার, আমি নিজে সব পরীক্ষা করে দেখবো এবং সন্দেহ জনক কাগজপত্র পেলে পুলিশ অফিসে জমা দেবো।

 মিঃ আরিফ মিঃ হুদার উপর এসব কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখার এবং সঠিক রিপোর্ট পেশ করার দায়িত্ব দিয়ে বিদায় গ্রহণ করলেন।

মিঃ আরিফ চৌধুরী এবং তাঁর সহকারি বিদায় গ্রহণ করলেন।

 হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মিঃ হুদা, এতক্ষণে তার দেহে প্রাণ ফিরে এলো যেন। ম্যানেজার এবং মিঃ হুদার মধ্যে গোপনে কিছু আলাপ-আলোচনা হলো তখনকার মত।

*

পুলিশ মহলে মওলানা মাশহাদীর অন্তর্ধান নিয়ে ভীষণ একটা আলোড়ন শুরু হলো। শুধু পুলিশ মহল নয়, সমস্ত কান্দাই শহরে ছড়িয়ে পড়লো ব্যাপারটা। বিভিন্ন পত্রিকায় নানাভাবে এ নিয়ে লেখালেখি চললো।

পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরী মওলানা মাশহাদীর টেবিলের চুরুটটি পরীক্ষা করে জানতে পারলেন, মওলানা সাহেবকে কে বা কারা অজ্ঞান করে নিয়ে গেছে। এর বেশি কোনো ক্ল আবিষ্কারে সক্ষম হলো না পুলিশ মহল।

 মিঃ হুদার রিপোর্টে তেমন কোনো কিছু পাওয়া গেলো না সন্দেহজনক কাগজপত্রও পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।

শহরে যখন মাশহাদীর অন্তর্ধান নিয়ে ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে এমন দিনে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হলেন মাশহাদীর ব্যবসায় সাহায্যকারী আলী আকবর রিজভী। তিনিও এই তেলের ব্যবসায় সহযোগিতা করে লাখপতি বনে গেছেন।

আলী আকবর রিজভী তাঁর শয়নকক্ষ থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তিনি নিজে উধাও হয়েছেন, না তাঁকে কেউ হরণ করে নিয়ে গেছে, বলা মুস্কিল।

 পুলিশ মহল খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, মওলানা মাশহাদীর অন্তর্ধানের সাথে আলী আকবর রিজভীর নিরুদ্দেশের যোগাযোগ রয়েছে, কারণ উভয়ে একই ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।

আলী আকবর রিজভীর উধাওয়ের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে ভীষণ এক আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। পথে ঘাটে-মাঠে সর্বস্থানে এই নিয়ে ভীতভাবে সব আলাপ-আলোচনা চললো।

অনেক সন্ধান করেও পুলিশ মহল এ ব্যাপারে কোনো কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো না।

হঠাৎ একদিন মওলানা মাশহাদীর তেল-কারখানায় আগুন জ্বলে উঠলো। সে কি ভীষণ আগুন কোথা থেকে আগুন লাগলো বুঝা গেলো না। শুধু তাই নয়, তেল গুদামে আগুন জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। লাখ লাখ ড্রাম তেল মজুত আছে এই গুদামে।

 ম্যানেজার এবং মাশহাদীর সহকারি কর্মচারিগণ হায় হায় করে উঠলো, ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগলো। দমকল বাহিনীর কাছে ফোন করা সত্ত্বেও দমকল বাহিনী এলো না কোনো সাহায্য করতে।

ম্যানেজার যখন পুনরায় ব্যস্ত হয়ে রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে দমকল বাহিনীর কাছে ফোন করতে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তার পিছনে এসে দাঁড়ালো এক জমকালো মূর্তি। ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বললো–দমকল বাহিনী আসবে না সাহেব, কারণ তারা আপনার ফোন পাবে না। লাইন কেটে দেয়া হয়েছে—

 কে–কে তুমি? ম্যানেজারের হাত থেকে রিসিভার খসে পড়লো।

জমকালো মূর্তি বললো-আমি তোমাদের যমদূত। এতদিন যা করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। শোন যা বলছি—

ম্যানেজার ভীতভাবে বললো–তুমিই তাহলে এই আগুন–

হাঁ, আমিই আগুন জ্বেলে দিয়েছি কোটি কোটি জনগণের জীবননাশক তেল তৈরি মিল কারখানায় আর গুদামে।

এতবড় সর্বনাশ তুমি করেছো?

বছরের পর বছর তোমরা শত শত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে যে সর্বনাশ করেছে, তার তুলনায় এ সর্বনাশ কিছু নয়।

এক্ষুণি পুলিশে জানিয়ে তোমাকে গ্রেপ্তার করাবো।

হাঃ হাঃ হাঃ পুলিশ তোমাদের বাধ্য চাকর, যা হুকুম করো তাই করে তারা। পুলিশের মুখ তোমরা বন্ধ করো পয়সা দিয়ে, এবার আমি পুলিশের মুখ খুলে দেবো এই এটা দিয়ে—জমকালো মূর্তি তার হাতের রিভলভারখানা উঁচু করে ধরলো।

ম্যানেজার ঢোক গিললো, ভয়ে মড়ার মুখের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার মুখমণ্ডল। বললো তবু সাহস করে–তুমি আমাকে হত্যা করবে?

এত সহজে হত্যা করবে না, কারণ তোমাদের পাপের মাপ অনুযায়ী বিচার করে হত্যার শাস্তি হবে।

ম্যানেজার বললো-তুমিই বুঝি মালিককে—-

হাঁ, আমিই তোমাদের মালিককে সরিয়েছি। শুধু তাই নয়, তোমাদের এই তেল ব্যবসায় যারা লিপ্ত আছে তাদের সবাইকে সরাবো।

কে তুমি?

বললাম তোমাদের যমদূত।

ম্যানেজার এবং জমকালো মৃর্তি যখন নির্জনে অফিস কক্ষে কথা হচ্ছিলো তখন বাইরে এবং আশে পাশে মহা হৈ চৈ কলরব শোনা যাচ্ছিলো, তার সঙ্গে তেল কারখানার মেশিন বিস্ফোরিত হবার প্রচণ্ড শব্দ ভেসে আসছিলো। এসব আওয়াজের মধ্যে জমকালো মূর্তির হাসি বা কথা বলার শব্দ কারো কানে পৌঁছাচ্ছিলো না।

ম্যানেজার জমকালো মূর্তির হাতের রিভলভার লক্ষ্য করে শিউরে উঠছিলো, না জানি কখন তার বুকে এসে বিদ্ধ হয় ওর একটা গুলি। তবু সাহস করে বললো–তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও অল্পক্ষণে দমকল এসে যাবে—

 জমকালো মূর্তি বললো–ততক্ষণে তোমাদের মৃত্যুসুধা তৈরির মিল-কারখানা ভস্মীভূত হয়ে যাবে। হাঁ, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তোমার টেবিল থেকে সবুজ রংয়ের রিসিভার তুলে নাও এবং মাশহাদীর সহকারি পার্টনার মকবুল হোসেন, হীরালাল, ফুলচাঁদ ও রস্তম রিজভীকে ডাকো।

ম্যানেজারের মুখে বিস্ময় জেগে উঠলো, জমকালো মূর্তি সকলের নাম জানলো কি করে; অবাক হলেও সে বললো— তুমি তো তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছো বললে?

তোমাদের অফিসের তার বিচ্ছিন্ন করিনি, কারণ তোমাদের সবকটাকেই আমার প্রয়োজন। নাও, হাতে তুলে নাও ঐ সবুজ রংয়ের রিসিভারখানা।

তাঁরা কি এখন একত্র আছেন?

 হাঁ, তারা মিলের দক্ষিণে হেড অফিসে আছে, কারণ আগুন সেদিকে যাবে না বলেই তারা সেখানেই জড়ো হয়ে প্রাণ রক্ষার উপায় খুঁজছে, আর ভাবছে কি করে এই সর্বনেশে আগুন জুললো। নাও, বিলম্ব করো না। হাঁ, মনে রাখবে, আমি ঐ আলমারীর আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকবো কিন্তু আমার রিভলভারখানা ঠিক তোমার বুক লক্ষ্য করে উদ্যত থাকবে।

ম্যানেজার সবুজ রংয়ের রিসিভারখানা তুলে নিলো হাতে। হাত তার কাঁপছে চারিদিকে আগুন, সম্মুখে দণ্ডায়মান মৃত্যুদূত; তবু বললো—হ্যালো, আমি ম্যানেজার বলছি,—হ্যালো, মকবুল হোসেন, হীরালাল, ফুলচাঁদ আর রুস্তম রিজভী–এদের সঙ্গে নিয়ে শীঘ্র চলে আসুন– হ্যালো, দেরী করবেন না—হাঁ হাঁ, আমি—-আমি বি—–দে-পড়েছি—আমার—চারিদিকে—আ——-

জমকালো মূর্তি আর বিলম্ব না করে সরে দাঁড়ালো কিন্তু তার রিভলভার ঠিক রইলো ম্যানেজারের দিকে।

ম্যানেজার একচুল নড়ার সাহসী হচ্ছে না, তার ভয়-বিহ্বল দৃষ্টি রয়েছে রিভলভারের ডগায়।

অল্পক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলেন মওলানা মাশহাদীর সহকারী পার্টনারগণ। সকলের মুখেই উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে, হন্তদন্তভাবে সবাই কক্ষে প্রবেশ করে ম্যানেজার সাহেবকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন—সর্বনাশ হয়ে গেলো, সর্বনাশ হয়ে গেলো ম্যানেজার সাহেব—

কেউ বললেন–তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় দমকল বাহিনীর অফিসে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি—

কেউ বললেন—-সব নিঃশেষ হয়ে গেলো—

কিন্তু ম্যানেজারের মুখে কোনো কথা নেই, সে যেন বোবা বনে গেছে।

সবাই এসে ঘিরে দাঁড়ালেন ম্যানেজারকে–কি ব্যাপার, অমন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে অথচ মুখে কোনো কথা নেই। আগুন দেখে মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?

কিন্তু অত ভাবার সময় কারো ছিলো না, মানেজারকে প্রশ্ন করে কোনো জবাব না পেয়ে তারা বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই দেখলেন দরজা বন্ধ।

ঠিক সেই মুহূর্তে জমকালো মূর্তি একটা ঔষধ ছড়িয়ে দিলো কক্ষমধ্যে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, সবাই ঢলে পড়লে মেঝের কার্পেটে। কালো মূর্তির মুখে মুখোস থাকায় তার কোনো পরিবর্তন ঘটলো না।

অন্যান্যের সঙ্গে ম্যানেজারও অজ্ঞান হয়ে পড়লো, তার দেহটা টেবিলে আটকে রইলো আর পা দু’খানা ঝুলতে লাগলো নিচে।

দরজা খুলে গেলো।

জমকালো মূর্তি শিস দিলো, সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলে কয়েকজন জোয়ান বলিষ্ঠ লোক। প্রত্যেকের দেহেই জমকালো পোশাক, মুখে মুখোস। কাউকে চিনার জো নেই।

 জমকালো মূর্তির নির্দেশমত এক-একজনকে দু’জন বলিষ্ঠ লোক ধরাধরি করে বয়ে নিয়ে চললো।

এদিকে লোকজনের তেমন জটলা ছিলো না সবাই জড়ো হয়েছে মিলের আশে পাশে দূর থেকে আগুন দেখে চিৎকার করছে আর ছুটাছুটি করে বৃথা আগুন নিভানোর চেষ্টা করছে।

 জমকালো মূর্তি সর্বাগ্রে পিছনে তার সঙ্গীরা এক-একজনের সংজ্ঞাহীন দেহ বয়ে নিয়ে চলেছে। অদূরে একটি তেলবাহী ট্রাকে কয়েকটা ড্রাম বসানো আছে। ড্রামগুলো তেলভর্তি ড্রামের মত যদিও সাজানো কিন্তু আসলে সবগুলো খালি ছিলো।

 জমকালো মূর্তির নির্দেশে সংজ্ঞাহীন দেহগুলোকে এক-একটা খালি ড্রামে ভর্তি করে ফেললো তার সঙ্গীরা। বাইর থেকে কেউ যেন বুঝতে না পারে সেগুলো খালি ড্রাম।

 জমকালো মূর্তি তার সঙ্গীকে গাড়িতে ড্রামের আড়ালে উঠে বসার ইংগিত করে নিজ দেহ থেকে জমকালো ড্রেস খুলে ফেললো। নিচে বেরিয়ে এলো ড্রাইভারের ড্রেসে। দ্রুত ড্রাইভ আসনে উঠে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো সে।

এদিকে দমকল বাহিনী যখন এসে পৌঁছলো তখন কান্দাই এর সর্বশ্রেষ্ঠ তেল ব্যবসায়ী মওলানা মাশহাবীর তেলের মিল পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে এসেছে প্রায়। আকশচুম্বী অগ্নির লেলিহান শিখা কান্দাই শহরকে আলোকিত করে তুলছে।

 গুদামে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে।

তেলভর্তি ড্রামগুলো এক-একটা কামানের গোলার মত আওয়াজ করে ফেটে পড়ছে। কানে যেন তালা লেগে যাচ্ছে।

সেকি ভীষণ দৃশ্য!

 চারিদিক থেকে অগণিত দমকল বাহিনী এসে পড়েছে তারা প্রাণপণে আগুন নিভানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু আগুন যেন আরও লেলিহান শিখা বিস্তার করে আকাশপথে উঠে যাচ্ছে।

এমন অগ্নিকাণ্ড কান্দাই শহরে কোনো দিন ঘটেছে কিনা সন্দেহ।

এই অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ সমস্ত কান্দাই শহরে ছড়িয়ে পড়লো। পুলিশ ফোর্সসহ ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ঘটনাস্থলে এসে পড়লেন কান্দাই পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার। সঙ্গে মিঃ লাউলংও এলেন ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ জেনে। অবশ্য তাঁর আসার কারণ ছিলো; কেননা, আজ যে তেল মিল-কারখানায় অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে কয়েকদিন পূর্বে তার মালিক অদ্ভুতভাবে উধাও হয়েছেন। পার্টনার আলী আকবর রিজভীও নিখোঁজ হয়েছেন বিস্ময়করভাবে।

নিশ্চয়ই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে এসব নিখোঁজ ব্যাপারের যোগাযোগ আছে পুলিশ মহলে এই রকম সন্দেহ করা হচ্ছে এবং সেই কারণেই পুলিশ মহল ছুটে এসেছে কর্তব্য সাধনে।

*

ইরানীকে বনহুর বন্দী করে রাখলেও আসলে সে চুপ রইলো না। যে কক্ষে ইরানী বন্দী ছিলো সেই কক্ষের দেয়ালে, মেঝেতে বিছানার নিচে সব যায়গায় অনুসন্ধান করে দেখতে লাগলো কোথাও বেরুবার কোনো পথ আছে কিনা।

এখানে তার জন্য সব কিছুর ব্যবস্থা ছিলো। স্নানাগার পাঠাগার, বিশ্রামকক্ষ, খাবার কক্ষ কিন্তু আশ্চর্য, কোনো কক্ষ দিয়েই বাইরে যাবার কোনো পথ ছিলো না। খাবার কক্ষে দুধের টিন, চিনি-রুটি, মাংসের কাটলেট, কিছু কিছু ফলমূল যা অনেক দিন ভাল থাকবে, এই ধরনের খাবার যথেষ্ট ছিলো। ইরানীর খাওয়ার কোনো অসুবিধা ছিলো না। কিন্তু ইরানী আসলে বন্দিনী হয়ে থাকার মেয়ে নয়। মনসুর ডাকুর মেয়ে–কালনাগিনীর মত ভয়ঙ্কর ছিলো সে।

একদিন ইরানী স্নানাগারের মধ্যে আবিষ্কার করলো একটি ক্ষুদ্র সুড়ঙ্গমুখ।

ইরানী সেই সুড়ঙ্গমধ্য দিয়ে অতি সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলো। সুড়ঙ্গমুখটা জলোচ্ছাসের নিচে থাকায় সহসা বুঝতে পারে না। ইরানী অতি কৌশলে এই সুড়ঙ্গমুখ আবিষ্কার করে ফেললো। দু’চোখে তার আনন্দদ্যুতি। এবার সে বাইরের জগতে ফিরে যেতে পারবে।

ভিতরে যতই অগ্রসর হচ্ছে ততই ক্রমান্বয়ে প্রশস্ত মনে হচ্ছে। ইরানীর খুশি ধরছিলো না যেন–সে ভাবছে,এবার দস্যু বনহুরকে দেখাবে মজাটা তাকে বন্দী করে রাখলেও বন্দী সে নেই।

 সুড়ঙ্গপথ দিয়ে প্রবেশ করার সময় জলোচ্ছ্বাসের পানিতে তার দেহের বসন সিক্ত হয়ে গিয়েছিলো, কাজেই ঠাণ্ডায় কাঁপতে শুরু করলো তার দেহটা। সুড়ঙ্গমধ্যে উঁচু-নীচু ছোট বড় পাথরের স্তর থাকায় চলতে অসুবিধা হচ্ছিলো খুব ইরানীর, তবু সে এগিয়ে চলেছে সম্মুখে। জমাট অন্ধকার চারিদিকে, নিজের হাতখানাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। বারবার মাথায় আঘাত লাগছিলো, হাতড়ে হাতড়ে অগ্রসর হচ্ছে ইরানী! বহুক্ষণ চলার পর হাঁপিয়ে পড়লো সে এই সুড়ঙ্গপথের যেন শেষ নেই।

বসে বসে জিরিয়ে নিলো সে কিছুক্ষণ।

আধঘণ্টা বিশ্রাম করার পর আবার উঠে পড়লো ইরানী, গুটি গুটি মেরে চলতে লাগলো দেয়াল ধরে ধরে। হঠাৎ ইরানী শিউরে উঠলো, ওদিকে যদি কোনো পথ না থাকে তাহলে কি হবে? এই অন্ধকারে আর কতদূর এগুনো যাবে? তবু চলতে লাগলো–সে বুঝতে পারলো, সুড়ঙ্গ মধ্যে যখন নিশ্বাস নিতে তার কষ্ট হচ্ছে না তখন নিশ্চয়ই ওদিকে হাওয়া প্রবেশের কোনো পথ বা মুখ আছে।

 ইরানী প্রাণের মায়া বিসর্জন দিয়ে চলতে লাগলো। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে কোনো হিংস্র জীব ওঁৎ পেতে আছে কিনা কে জানে! ডাকুকন্যা সে, মৃত্যুকে ভয় করে না। উদ্দেশ্য তার যেমন করে হোক, দস্যু বনহুরকে কাবু করতেই হবে। তার পিতাকে বনহুর বারবার নাজেহাল করেছে, তার সমুচিত শাস্তি দিতে হবে। ইরানীর মনে প্রতিহিংসার বহ্নি জ্বলে উঠে।

মরিয়া হয়ে সে এগিয়ে চলেছে, পাথরে হোঁচট খেয়ে পায়ের আংগুল দিয়ে রক্ত ঝরছে। কপালের স্থানে স্থানেও চোট লেগে ফুলে উঠেছে এক জায়গায় কেটে রক্ত ঝরছে।

আরও কিছু সময় চলার পর হঠাৎ ইরানীর কানে ভেসে এলো পুরুষ কণ্ঠের গম্ভীর আওয়াজ কিন্তু খুব স্পষ্ট নয়। বহু দূর থেকে যেন শব্দটা ভেসে আসছে।

ইরানী থমকে দাঁড়ালো, সে বুঝতে পারলো এই সুড়ঙ্গমুখ শেষ হয়েছে এমন কোনো এক স্থানে যেখানে মানুষ রয়েছে। তার পালানোর আশা উবে গেলো। তবু দমলো না ইরানী এগিয়ে চললো ধীরে ধীরে। মনকে সে কঠিন করে নিলোমরতে হয় মরবে তবু ফিরে যাবে না।

সুড়ঙ্গমুখ আবার বেশ ছোট হয়ে আসছে, যেমন ছিলো প্রবেশকালে। কিন্তু আর বেশিদূর এগুতে হলো না, একটা আলোকরশ্মি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তার। শুধু আলোকরশ্মি নয়, কণ্ঠস্বর এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এই কণ্ঠ যে তার বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে; মাঝে মাঝে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। এ যে সেই অদ্ভুত হাসি! ইরানী অতি সতর্কভাবে সুড়ঙ্গমুখে এসে দাঁড়ালো যাতে তাকে দেখা না যায় এবং সে যেন সব দেখতে পায়। বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো ইরানী দেখলো সুড়ঙ্গমুখ যেখানে শেষ হয়েছে সেটা একটা বিরাট গুপ্তগুহা। নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে এমন যে রহস্যময় সুড়ঙ্গ রয়েছে কেউ বুঝতে পারবে না।

 ইরানী সুড়ঙ্গমধ্যে আত্মগোপন করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সম্মুখের দিকে, দেখলো কতকগুলো লোককে হাতে এবং পায়ে শিকল পরানো অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। লোকগুলোর চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। সুপুষ্ট, নাদুস নুদুস, দেহের পোশাক-পরিচ্ছদ মূল্যবান। কারো পরনে স্যুট, কারো বা শেরোয়ানী-পা-জামা, কারো বা পুরনো ধুতি সার্ট। চুলগুলো এলোমেলো, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে ভয়ার্ত করুণ চোখে অসহায় দৃষ্টি। লোকগুলোকে দেখে বলির পূর্বে ছাগলের কথা মনে পড়ছে। ইরানী নিষ্পলক বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে দেখছে। এই বন্ধনযুক্ত ব্যক্তিগুলোর সম্মুখে দণ্ডায়মান দু’টি ব্যক্তি, তাদের দেহে জমকালো পোশাক। একজনের হাতে জমকালো আগ্নেয় অস্ত্র রিভলভার। সেই গুপ্তকক্ষের দেয়ালে মশাল জ্বলছে দপ দপ করে। মশালের আলোতে জমকালো মূর্তির হস্তের রিভলভার খানা ঝকমক করছে। তার সঙ্গে দেহের কালো পোশাকও ঝকমক করছে যেন দেখলে শিউরে উঠে শরীর।

ইরানী রুদ্ধনিশ্বাসে তাকিয়ে দেখছে, জমকালো মূর্তির প্রথম জন তার পরিচিত-স্বয়ং দস্যু বনহুর। দ্বিতীয় জনকে চেনে না ইরানী। বনহুরের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে—নামাজ পড়ে কপালে দাগ ফেলেছেন মওলানা সাহেব, বেহেস্তের পথ আপনার জন্য তো উন্মুক্ত রয়েছে, কাজেই মরতে কোনো আপত্তি আপনার নেই জানি। হাঁ বলুন কিভাবে আপনি বেহেস্তে যেতে চান?

সম্মুখস্থ লোকটিই মওলানা মাশহাদী, কান্দাই-এর সর্বশ্রেষ্ঠ তেল ব্যবসায়ী। বনহুরের কথায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন শুধু; কোনো কথা বললেন না।

বনহুর ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি হেসে বললো–এত পুণ্যি করেও বেহেস্তে যেতে নারাজ মনে হচ্ছে। যেন! বেহেস্তে যাবার পূর্বে অবশ্যি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে আপনাকে মওলানা সাহেব। একটু থামলো বনহুর, তারপর দু’পা সম্মুখে এগিয়ে দাঁড়ালো—বলুন আপনার সঙ্গী যারা এখানে আপনার সঙ্গে জান্নাতে যাবার জন্য অংশী হতে এসেছেন, তাদের কার সঙ্গে আপনার কেমন সম্বন্ধ?

মওলানা মাশহাদী ভয়ার্ত দৃষ্টি তুলে একবার বনহুরকে দেখে নিয়ে মাথাটা নত করলেন।

বনহুর বললো আবার বেশিক্ষণ আপনাদের নিয়ে সময় কাটাবার অবসর আমার নেই, এজন্য আমি দুঃখিত। জবাব দিতে বিলম্ব হলে বাধ্য হবো জোর করে জবাব আদায় করতে। রিভলভারখানা দোলালো বনহুর কথার ফাঁকে।

মওলানা শুকনো ঠোঁট দু’খানা জিভ দিয়ে চেটে ভিজিয়ে নেবার চেষ্টা করে বললেন আমাকে পানি দাও।

হাঃ হাঃ হাঃ, পানি—-পানি নয়, জান্নাতের দরজায় হুর পরীরা আপনার জন্য শারাবান তহুরা নিয়ে অপেক্ষা করছে। বেহেস্তের শরবৎ পানের জন্য অপেক্ষা করুন আর কিছুক্ষণ। আপনি নাপাম বোমার গ্যাস মিশিয়ে তেল তৈরি করে দেশের অগণিত জনগণের যে উপকার করেছেন তার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ দিচ্ছি। কারণ প্রতিদিন আপনি দেশের লাখ লাখ মানুষকে জান্নাতে পাঠাবার সুব্যবস্থা করেছেন। সেজন্য দুনিয়ার বিস্বাদ পানি আপনার জন্য নয়, আপনার জন্য বেহেস্তি শারাব। এবার বলুন এদের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার ব্যবসার কেমন সম্বন্ধ?

 ভয়ার্ত চোখে সঙ্গীদের দিকে তাকালেন মওলানা মাশহাদী তারপর ঢোঁক গিলে বললেন— এরা সবাই আমার ব্যবসার অংশীদার।

কি রকম, অর্থ দিয়ে না পরিশ্রম দিয়ে এরা আপনার তেল ব্যবসায় অংশ গ্রহণ করেছেন?

মওলানা মাশহাদী আলী আকবর রিজভীর দিকে তাকিয়ে বললেন-এর সঙ্গে আমার অর্থের যোগাযোগ। আমার ব্যবসায় আলী আকবর রিজভীর বহু অর্থ রয়েছে।

তাহলে সে আপনার অংশীদার কি বলেন?

 হাঁ তবে সমান নয়।

আপনার চেয়ে কতগুণ কম হবে আন্দাজ?

সিকি অংশীদার।

আর এরা? বনহুর অন্যান্যের সঙ্গে ম্যানেজারকেও দেখালো।

মওলানা মাশহাদী বললেন–এরা সবাই আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। এরা অর্থ। দিয়ে কেউ অংশীদার হননি—

 দেখুন মওলানা সাহেব, আপনি সঠিকভাবে আমার কথার জবাব দিবেন। কারণ আপনার

উত্তরের উপর নির্ভর করছে এদের জান্নাতে যাবার টিকেটের হার। হাঁ, এরা তাহলে আপনার কর্মচারী বলতে পারেন।

হাঁ, আমার ব্যবসায় এরা সহায়তা করার জন্য এদের আমি মোটা মাহিনা—

 মানে মোটা অঙ্ক দিয়ে থাকেন, এই তো?

হাঁ।

শুধু কি এরাই আপনাকে সাহায্য করে থাকেন, না আরও লোক আছে আপনার সাহায্যকারী? সত্যি কথা বলবেন কিন্তু—বনহুর রিভলভার নাড়াচাড়া করছিলো আর পায়চারী করছিলো আপন মনে।

বনহুরের বুটের আওয়াজ নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ গুপ্ত গুহার মেঝেতে অদ্ভুত এক শব্দ সৃষ্টি করে চলেছে। আর কোনো শব্দ নেই, শুধু বুটের আওয়াজের প্রতিধ্বনি আর মাঝে মাঝে বনহুরের গম্ভীর কঠিন কণ্ঠস্বর যেন কেঁপে কেঁপে সমস্ত কক্ষমধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।

ইরানী স্তব্ধ হয়ে শুনছে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখছে।

মওলানা মাশহাদী বললেন–এরা আমার কান্দাই শহরে তেল ব্যবসায় সাহায্য করে থাকেন। কান্দাই-এর বাইরেও আমার সহকারী কর্মচারী আছেন যাদের সাহায্যে আমার তেল দেশ-বিদেশে পরিবেশন হয়ে থাকে।

হুঁ, আপনার ব্যবসা দেখছি বহু দেশে বিস্তার লাভ করেছে। আচ্ছা বলুন, কোন কোন দেশে আপনার তেলের কারবার চালু আছে?

মওলানা সাহেবের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না, তিনি প্রাণ ভয়ে ফাসীর মঞ্চের আসামীর মত কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিচ্ছিলেন আর অন্য সকলে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিলো মওলানা মাশহাদী আর বনহুরের মুখে। তাদের অবস্থাও মমস্পর্শী, এক একজন যেন জীবন্ত শয়তানের মত কুঁকড়ে গেছে যমদূতের ভয়ে।

বললেন মওলানা সাহেব–পৃথিবীর অনেক দেশেই আমার কোম্পানি থেকে তেল চালান হয়ে থাকে। কান্দাই, জ, ঝাম মন্থনা দ্বীপ–

থামলেন কেন, বলুন আর কোন্ কোন্ দেশে?

বোম্বে, কলিকাতা—

 ভারতেও দেখছি আপনি তেল ব্যবসার পসার জমিয়েছেন। আর কোন দেশে? পাকিস্তানে?

 জ্বি হাঁ, পাকিস্তানেও আমার ব্যবসা চলছে—

 পুলিশ একবার আপনার পাকিস্তান ব্যবসা কেন্দ্রে হানা দিয়েছিলো?

 হাঁ।

 কিন্তু পুলিশের মুখ আপনারা বন্ধ করে দিয়েছিলেন পয়সা দিয়ে?

না, মানে মানে—

বলুন হা!

জি হা–জ্বি হা—

আপনার সেই বিশ্বব্যাপী তেল পরিবেশক তেল তৈরি কারখানাটি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে মানে ভস্মীভূত হয়ে গেছে, তার সঙ্গে ভস্মীভূত হয়েছে আপনার তেলাগার যে তেলাগারে আপনার কোটি কোটি টাকার তেল মজুত ছিলো।

 হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মওলানা মাশহাদী সাহেব। তিনি করুণ চোখে তাকালেন সঙ্গীদের মুখে।

ম্যানেজার এবং অন্যান্য সকলে প্রাণের চিন্তায় অস্থির তাই তারা কোনো কথাই মালিককে জানাতে পারেনি। এবার বলে উঠলো ম্যানেজার সব গেছে—সব নিঃশেষ হয়ে গেছে স্যার—সেও কেঁদে উঠলো এবার উচ্ছ্বসিতভাবে।

বনহুর অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়লো—-হাঃ হাঃ হাঃ—বনহুরের হাসির শব্দে ভূগর্ভ নিস্তব্ধ কক্ষের পাথুরের দেয়ালগুলোর থর থর করে কেঁপে উঠলো যেন। মুহূর্তে থেমে গেলো মওলানা মাশহাদী এবং ম্যানেজার সাহেবের রোদন। নাকের পানি আর চোখের পানি এক করে তাকালেন বনহুরের মুখের দিকে। হাত-পায়ে শিকল বাঁধা থাকায় চোখের পানি মুছে ফেলার কোনো উপায় ছিলো না।

বনহুর বললো—পূর্বে সাবধান করা সত্ত্বেও আপনাদের জঘন্য ব্যবসা পুরাদমে চালিয়ে আজ রোদন করতে লজ্জাবোধ হচ্ছে না? রহমান?

বলুন সর্দার?

ইরানী আড়াল থেকে চমকে উঠলো দস্যু বনহুরের পাশে দণ্ডায়মান জমকালো পোশাক পরা ব্যক্তিই তাহলে তার সহকারি রহমান। ইরানী তার বাবার মুখে শুনেছিলো, দস্যু-বনহুরের সহকারি প্রধান অনুচরের নাম রহমান। অবাক হয়ে সে দেখতে লাগলো।

বনহুর বললো-মওলানা সাহেবকে জান্নাতে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে সর্বশেষে। কারণ তিনি এদের মালিক, আগে যাবেন তার কর্মচারী এবং সহকারিগণ। হ, আর একটি কথা মওলানা সাহেব, বলুন কান্দাই পুলিশ অফিসার মিঃ হুদা ও মিঃ কাইয়ুমের সঙ্গে আপনার কি সম্বন্ধ? বলুন?

তার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।

আবার মিথ্যা কথা; প্রচণ্ড ধমক দিলো বনহুর। একটু থেমে বললো–মিঃ হুদাই বললেন আপনার সঙ্গে তার কি সম্বন্ধ ছিলো। রহমান, মিঃ হুদাকে হাজির করো।

রহমান কুর্ণিশ জানিয়ে চলে গেলো, একটু পরে ফিরে এলো সঙ্গে কান্দাই দুর্নীতি দমন বিভাগের পুলিশ অফিসার মিঃ কাইয়ুম হেলালী, কান্দাই থানা অফিসার মিঃ নজমুল হুদা এবং আরও একজন পুলিশ অফিসার।

বনহুরের সম্মুখে এনে দাঁড় করালো তাদের।

প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া পরানো।

 বনহুর মিঃ কাইয়ুম, মিঃ হেলালী এবং মিঃ হুদাকে একনজর দেখে নিলো, তারপর বললো আপনারাই দেশের দুর্নীতি দমন করে থাকেন, চমৎকার আপনাদের নীতিবোধ। এমন না হলে দেশের উন্নতি সাধন হবে কি করে? আচ্ছা মিঃ হুদা, বলুন দেখি এই মওলানা সাহেবের সঙ্গে আপনার কেমন ভাব?

মিঃ কাইয়ুম হেলালী মিঃ হুদা এবং তাদের সঙ্গী ভদ্র লোকটির মুখে ভয়, বিস্ময় আর চঞ্চলতা। মওলানা মাশহাদী এবং তাঁর সঙ্গীদের এখানে এমন অবস্থায় দেখে তাদের পিলে চমকে গেছে, বিবর্ণ মুখে তাকিয়ে দেখছে এক-একবার করে।

 বনহুরের কথায় মিঃ হুদা গলায় সাহস টেনে বললেন–আমি উনাকে চিনি এইমাত্র। তাছাড়া উনার সঙ্গে আমার কোনো ভাব বা সম্বন্ধ নেই।

 বনহুর রিভলভার দিয়ে মিঃ হুদার তলপেটে খুব জোরে আঘাত করে বললো—আবার মিথ্যা কথা।

রিভলভারের আঘাতটা খুব জোরে লেগেছিলো মিঃ হুদার তলপেটে তিনি যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করে বললেন—বলছি–বলছি–

বলুন? একবর্ণ মিথ্যা বললে–

বনহুরের কথা শেষ হয় না বলে উঠেন মিঃ হুদী-মওলানা সাহেব আমাকে টাকা দিয়ে মিঃ কাইয়ুম সাহেবকে হাতে রেখে তার ব্যবসা—থেমে পড়লেন মিঃ কাইয়ুমের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে।

বনহুর বুঝতে পারলো মিঃ কাইয়ুম দুর্নীতি দমন বিভাগের উপরওয়ালা কাজেই তার সম্বন্ধে বলতে ভয় পাচ্ছেন, বিশেষ করে তার সাক্ষাতে। বললো বনহুর–মিঃ হুদা আপনি মিছামিছি ভয়। পাচ্ছেন আপনাদের উপরওয়ালা সাহেবকে, কারণ তিনি আর আপনি এখন একেবারে সমান। যেমন পৃথিবীতে মানুষ ধনী-দরিদ্র বহুরকম থাকে কিন্তু মৃত্যুর পর তারা যখন হাশরের ময়দানে আবার জেগে উঠবে তখন তারা সবাই সমান। সবাই ইয়া নফসী ইয়া নফসী বলে বিলাপ করতে। থাকবেন, আজ আপনারা আমার এই দরবারে সবাই সমান অবশ্য জীবিত অবস্থাতেই। হাঁ, এবার নির্ভয়ে বলুন।

 মিঃ হুদা প্রাণভয়ে সব বলে গেলেন, কিভাবে মওলানা মাশহাদী পুলিশের মুখ বন্ধ করে তার ব্যবসা চালিয়ে চলেছিলেন। পুলিশ মহলের যারা প্রধান কর্মকর্তা তাঁরা এ সবের কিছু জানেন না, একথাও প্রকাশ পেলো মিঃ হুদার কথায়। আরও জানা গেলো, কিভাবে তারা বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ হতে মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে তাদের অসৎ ব্যবসায় সহায়তা করে দেশবাসীদের চরম অবস্থার সৃষ্টি করেছেন বা করে চলেছেন। উপরওয়ালা কর্মকর্তাগণের মধ্যেও অনেকেই লোভের মোহে অন্ধ হয়ে নিম্নস্তরের কর্মচারী দ্বারা ঘুষ গ্রহণ করে থাকেন। এসব কর্মকর্তাই হলেন দেশ ও দশের সর্বনাশের মূল। দেশের উপরওয়ালা কর্মকর্তাগণ যদি চরিত্রবান, ন্যায়পরায়ণ, সৎ ব্যক্তি হতেন তাহলে দেশ আজ এমন অধঃপতনে যেতো না।

বনহুর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সব শুনলো। শুধু বনহুর নয়, মওলানা মাশহাদী এবং তার সহকর্মিগণও শুনলেন। পুলিশ অফিসারদ্বয়ও শুনলেন। আর শুনলো ইরানী আড়াল থেকে সব কথা।

 মিঃ হুদার মুখ দিয়েই বের হলো আরও কয়েকজন অসৎ ব্যবসায়ীর নাম, যারা বিভিন্ন জিনিসে ভেজাল মিশিয়ে জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

 বনহুর রহমানকে আদেশ দিলো এদের পাকড়াও করে তার দরবারের হাজির করতে।

রহমান বললো- আচ্ছা সর্দার, আপনার কথামত সবাইকে আমি খুঁজে বের করবো এবং হাজির করবো দরবারে।

বনহুর এবার এগিয়ে এলো মওলানা মাশহাদীর সম্মুখে। বাম হাতে তার চুলের গোছা ধরে টেনে বের করে আনলো সারির মধ্য থেকে। দাতে দাঁত পিষে কঠিন কণ্ঠে বললো সব তো শুনলেন, এবার বলুন কি পুরস্কার এর জন্য চান?

মওলানা মাশহাদীর মুখ মড়ার মুখের মত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, কোনো কথা তিনি বললেন না। শুধু ভয়ার্ত চোখে তাকাতে লাগলেন।

বনহুর বললো– রহমান? বলুন সর্দার?

এই মুহূর্তে অগ্নিদগ্ধ শলাকা দ্বারা মওলানা সাহেবের হাত দুখানা ছিদ্র করে দাও, এটা তাঁর প্রথম পুরস্কার। কারণ ঐ হাত দ্বারাই তিনি বহু অর্থ ঘুষ দিয়েছেন এবং বহু অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

রহমান করতালি দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে দু’জন জমকালো লোক একটি জ্বলন্ত কয়লার কড়াই হস্তে কক্ষে প্রবেশ করলো। জ্বলন্ত কড়াইয়ের মধ্যে দুটি লৌহশলাকা। অগ্নিদগ্ধ শলাকা দুটি লাল হয়ে উঠেছে।

কক্ষমধ্যে বন্দীগণ শিউরে উঠলেন।

মওলানা মাশহাদী জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটছেন, চোখ দুটো তার ভয়ে গোলাকার হয়ে উঠেছে।

বনহুরের ইঙ্গিতে কালোলোক দুটি অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা দুটি তুলে মওলানা সাহেবের নিকটে এসে দাঁড়ালো।

মওলানা সাহেব হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন— এবারের মত আমাকে ক্ষমা করে দিন, আর আমি কোনো দিন অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করবো না।

আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তাছাড়া সম্মানিত ব্যক্তি, ‘আপনি’ না বলে তুমি বললেই ভাল দেখাবে। হাঁ, এবার ইনার হাত দু’খানা মুক্ত করে দাও।

রহমান মওলানা মাশহাদীর হাতের লৌহশিকল খুলে দিলো।

বনহুর মওলানাকে লক্ষ্য করে বললো- নিন, এবার হাত পাতুন, আপনার প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করুন।

মওলানা মাশহাদী ধপ করে বসে পড়লেন দস্যু বনহুরের পায়ের কাছে, করুণ কণ্ঠে বললেন এবারের মত আমাকে মাফ করো। আমি নাকে কানে খৎ দিচ্ছি……

বনহুর হেসে উঠলো অট্টহাসিরত– দস্যু বনহুর কোনোদিন অপরাধীকে ক্ষমা করে না মওলানা সাহেব। আপনি যা কর্ম করেছেন তার পুরস্কার শুধু নেবেন। রহমান?

রহমান মওলানা মাশহাদীকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলো।

জমকালো লোক দুটি এবার মওলানার হাত দু’খানা দু’জনে এঁটে ধরে অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা। বিনা দ্বিধায় হাতের তালুতে প্রবেশ করিয়ে দিলো।

একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন মাশহাদী সাহেব।

সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভদ্রলোক অস্ফুট শব্দ করে চোখ বন্ধ করলেন, তাদের দেহে প্রাণ আছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না, নীরব হয়ে গেলেন সবাই।

বনহুর বললো– ম্যানেজার ছাড়া প্রত্যেককে এই পুরস্কার দেওয়া হোক।

ভীষণভাবে আর্তনাদ করে উঠলো সবাই।

বনহুর হাসিতে ফেটে পড়লো- এতদিন আরাম-আয়েশে ঐ হাত দুখানা দিয়ে সুকাজ করে গেছেন। আজ তার ফলাফল ভোগ করুন। রহমান, বিলম্ব করো না।

জমকালো লোকগুলো পুনরায় অগ্নিদগ্ধ শলাকা নিয়ে আলী আকবর রিজভীর দিকে অগ্রসর হলো।

 রহমান খুলে দিলো তার হাতের বন্ধন।

মওলানা মাশহাদী তখন প্রাণফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। আলী আকবরকেও তার পুরস্কার দেওয়া হলো। তারপর এক একজনকে এই চরম শাস্তি দিয়ে চললো দস্যু বনহুর।

 ওরা যখন যন্ত্রণায় প্রাণফাটা চিৎকার করে উঠেন, বনহুর তখন হাসিতে ফেটে পড়ে, যার যে কাজের বর্ণনা দিতে থাকে সে।

প্রত্যেকের হাতে অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা প্রবেশ করানো শেষ হলো। মিঃ হুদাও বাদ পড়লো না, তার হাতের তালুতে যখন অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা দ্বারা ছিদ্র করা হয় তখন তিনি নিজের পুলিশের চাকরি জীবনকে বারবার ধিক্কার দিতে লাগলেন।

বনহুর বললো– মিঃ হুদা, আপনি পুলিশ চাকরিকে অযথা দোষারোপ করছেন। চাকরি সবই ভাল যদি আপনি ন্যায়নীতি মেনে কাজ করেন। যে-কোন চাকরির মাধ্যমে আপনারা দেশের জনগণের উপকার করতে পারেন, কিন্তু আপনারা তা না করে মানুষ হয়ে মানুষের বুকের রক্ত শুষে নেন। অর্থের মোহে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে জানোয়ার বনে যান। আজ যে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, এটা যেন লোকসমাজে প্রচার লাভ করে, তার জন্য আপনাদের পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাণহীন দেহগুলো কান্দাই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় রেখে আসা হবে। আপনাদের দেহের উপর থাকবে আপনাদের সুকর্মের বর্ণনালিপি।

 বনহুরের কথাগুলো যেন এক-একটা বজ্রধ্বনির মত শোনাচ্ছে, শিউরে উঠছেন মওলানা মাশহাদী এবং অন্য সকলে। হাতের যন্ত্রণা যেন এই মুহূর্তে ভুলে গেছেন তারা। নিজ নিজ পরিণতির জন্য রোদন করছেন সবাই। আজ কেই কারো নয়, কেউ আজ কাউকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন না কেউ কারো দিকে তাকিয়ে দেখছেন না।

এবার বনহুরের রিভলভার গর্জে উঠলো।

কেউ কিছু জানার পূর্বেই লুটিয়ে পড়লো মওলানা মাশহাদীর তেল কোম্পানীর ম্যানেজার। শুধু একটা তীব্র আর্তনাদ জেগে উঠলো রিভলভারের গুলীর সঙ্গে সঙ্গে।

ম্যানেজারের রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে পড়ে বার দুই ঝাঁকুনি দিয়ে নীরব হয়ে গেলো।

অসহায় করুণ চোখে ভয়, ভীতি আর বেদনা নিয়ে সবাই তাকালো ম্যানেজারের রক্তাক্ত দেহের দিকে।

বনহুর বললো– ম্যানেজার দোষী হলেও তার দোষের পরিমাণ লঘু ছিলো, তাই তাকে অতি সহজে বিদায় দিলাম।

না জানি এবার কার বক্ষ ভেদ করবে বনহুরের গুলী কে জানে। বন্দীগণ মরিয়া হয়ে পড়েছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই যেন পাথর বনে গেছে। এতক্ষণ হাতের যন্ত্রণায় অস্থির ছিলো, ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর ছিলো, সব তারা বিস্মৃত হলো মুহর্তমধ্যে। দস্যু বনহুরের হস্তে আজ তাদের মৃত্যু সুনিশ্চয়।

ইরানী আড়ালে আড়ষ্ট হয়ে সব দেখছে। ডাকুকন্যা হলেও তার তো প্রাণ আছে, মায়া-মমতা আছে। দস্যু বনহুর এতখানি হৃদয়হীন, নির্দয়, নরপিশাচ সে ভাবতে পারেনি। এই মুহূর্তে তার হাতে কোনো অস্ত্র থাকলে সে দস্যু বনহুরকে হত্যা করতেও পিছপা হতো না।

ইরানীর চিন্তাজাল বিছিন্ন হয়ে যায়, আবার বনহুরের রিভলভার গর্জে উঠে। তাকিয়ে দেখলো সে অজ্ঞাত পুলিশ অফিসারটির দেহ ভূতলে গড়াগড়ি যাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পাথুরে মেঝেটা।

বনহুরের রিভলভার পুনরায় গর্জে উঠলো, এবার লুটিয়ে পড়লো মওলানা মাশহাদীর একজন কর্মচারী।

মওলানা মাশহাদী বনহুরের পায়ের উপর উবু হয়ে কেঁদে পড়লেন বাঁচাও, আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দাও……

 প্রাণ ভিক্ষা…… হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ……

ততক্ষণে জমকালো লোক দুটো ধরে সরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো মওলানা মাশহাদীকে।

বনহুরের রিভলভার একটির পর একটি বক্ষ ভেদ করে চললো।

সর্বশেষ মিঃ হুদা আর মওলানা বাকি রয়েছেন।

বনহুরের চোখ দুটো হত্যার নেশায় জ্বলছে যেন। সেকি অদ্ভুত মূর্তি দস্যু বনহুরের! মিঃ হুদা আকুল হয়ে কেঁদে জোড়হাতে বলে উঠলেন— আমাকে হত্যা করো না, বনহুরের রিভলভারের গুলী তার বক্ষ ভেদ করে বেরিয়ে গেলো।

মওলানা এবার মেঝেতে বসে মাথা ঠুকে কাঁদতে লাগলেন। নিজের পাপের জন্য অনুতাপে ভেঙ্গে পড়লেন।

বনহুর দাঁত পিষে বললো আমার কাছে কোনো ক্ষমা নেই। তবে তওবা করে নাও, খোদা যদি তোমাকে ক্ষমা করেন।

কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বনহুরের রিভলভারের একটি গুলী মওলানা মাশহাদীর মাথার খুলি উড়িয়ে নিয়ে যায়।

 মাশহাদীর বিশাল দেহটা চিৎ হয়ে পড়ে যায় মেঝেতে। বার দুই ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়। রক্তের বন্যা বয়ে চলে পাথুরে মেঝেটায়।

 ইরানী এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেলে। শুনতে পায় সে বনহুরের কণ্ঠ– রহমান, এমনি করে আমাকে দেশের শত্রু বিনাশ করতে হবে।

রহমানের গলার স্বর সর্দার, এদের সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করবো?

 হাঁ, যেভাবে তোমাকে নির্দেশ দেওয়া আছে সেভাবে কাজ করবে।

রহমান করতালি দিলো।

অমনি কয়েকজন লোক ট্রেচারের মত খাটিয়াসহ প্রবেশ করলো। তারপর মৃতদেহেগুলো এক-একটা খাটিয়ায় তুলে নিয়ে প্রস্থান করলো।

সবাই চলে গেলে রহমান কুর্ণিশ জানিয়ে প্রস্থান করলো এবার।

একটা মৃত্যু বিভীষিকাময় প্রথমে ভাব সমস্ত কক্ষটাকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

ইরানী তখনও দু’চোখে হাত রেখে সুড়ঙ্গমধ্যে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 হঠাৎ শুনতে পায় ইরানী বেরিয়ে এসো।

চমকে চোখ থেকে হাত সরিয়ে নেয় ইরানী। সম্মুখে তাকিয়ে অবাক হয়, দেখতে পায় দস্যু বনহুর তাকে আহবান জানাচ্ছে।

ইরানীর মুখমণ্ডল ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠে। সে ভাবতেও পারেনি, দস্যু বনহুর তার অবস্থান জানতে পেরেছে। ভয়-বিহ্বল পদক্ষেপে সুড়ঙ্গমধ্য হতে বেরিয়ে এলো ইরানী। দেহটা তার বেতসপত্রের মত খরথর করে কাঁপছে!

বনহুর নিজকে স্বাভাবিক করে নিয়ে একটু হেসে বললো– ইরানী, ডাকুর মেয়ে হয়ে তুমি এত ভীতু?

ইরানী ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো– দস্যু বনহুর, তুমি নরপিশাচ।

 তারপর আর কি?

শয়তান।

 শয়তান আমি নই।

মেঝের রক্তস্রোতের দিকে তাকিয়ে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বললো ইরানী–এত রক্তপাত করেছ, তুমি শয়তান নও বলতে চাও?

রক্তপাত করলেই সে শয়তান হয় না ইরানী। বনহুর কথার ফাঁকে দেয়ালে একটা সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের নীচ দিয়ে হু হু করে জলস্রোত বয়ে এলো, মেঝের চাপ চাপ রক্ত ধুয়ে নিয়ে চলে গেলো স্রোতধারা। সমস্ত মেঝে আবার পূর্বের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেলো।

বনহুর বললো আবার— বলো, এবার তুমি কোন শাস্তি চাও আমার কাছে?

তুমি নররক্ত পিপাসু। বেশ, আমার রক্তও যদি তুমি পান করতে চাও, করো। কিন্তু মনে রেখো, আমার বাপু তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করবে না।

হাসালে ইরানী, আমাকে তুমি হাসালে। দস্যু বনহুর কোনো দিন কারো কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হতে জানে না, ক্ষমা সে কামনাও করে না কারো কাছে।

তুমি জীবন্ত আজরাইল……

তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। হাঁ, একটা কথা, তোমার বাবা এবং তোমার বাবার বন্ধু গোমেশ এখন জেলে।

আমার বাবা জেলে?

হাঁ, সেদিন সেই উৎসবমঞ্চেই তার আসল রূপ পুলিশের কাছে প্রকাশ পায় এবং সে আর গোমেশ গ্রেপ্তার হয়।

ইরানী গম্ভীর চিন্তিত হয়ে পড়লো।

বনহুর হেসে বললো- তোমার বাবা আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য ফাঁদ পেতেছিলো, সেই ফাঁদে সে নিজেই আটকা পড়েছে। আর হারিয়েছে তার কন্যাকে। জানো তোমার পরিণতি কি?

ইরানীর দু’চোখে করুণ দৃষ্টি ফুটে উঠে- তুমি আমাকে হত্যা করবে এইতো?

 যদি হত্যা না করি? বনহুর ইরানীর দিকে এগুতে লাগলো।

ইরানী ভীতভাবে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।

বনহুর এগুচ্ছে, মুখে একটা ব্যঙ্গপূর্ণ হাসির আভাস। চোখ দুটো যেন তীব্র হয়ে উঠেছে।

ইরানী এবার সত্যি সত্যি ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলো, সে প্রথম দিন বনহুরের দৃষ্টিতে এমন চাউনি লক্ষ্য করেনি, আজ যেন বনহুর মাতালের মত ক্ষেপে উঠেছে। সেদিন বনহুরকে বেশ ভদ্র বলে মনে করেছিলো, আজ তার হৃদয় কেঁপে উঠে। এই নির্জন কক্ষমধ্যে আর দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই যে তাকে বনহুরের কবল থেকে রক্ষা করবে।

 বনহুর বললো তোমার বাবা আমাকে শায়েস্তা করার জন্য যেমন আগ্রহী, তুমিও তেমনি। কাজেই আমি তোমাকে কিছুতেই আজ রেহাই দেবো না।

ইরানী ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বললো–তুমি আমাকে মুক্তি দাও, মুক্তি দাও বনহুর …

মুক্তি। দস্যু বনহুর এত বোকা নয় যে, মুক্তি দেবে মনসুর ডাকুর কন্যা ইরানীকে। তোমাকে আমি কিছুতেই মুক্তি দেবো না। বনহুর ইরানীকে ধরতে যায়।

ইরানী সরে যায় এক কোণে।

বনহুর সরে এসে খপ করে ধরে ফেলে ইরানীর ওড়নার এক প্রান্ত।

ইরানী ওড়না ছেড়ে নিয়ে দ্রুত সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করে, তারপর প্রাণ পণে ছুটতে থাকে সে। কানে ভেসে আসে বনহুরের অদ্ভুত হাসির শব্দ।

তাকে পালিয়ে যেতে দেখে হাসছে বনহুর।

*

মিঃ আরিফ চৌধুরীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

টেবিলে ফোনটা একটানা ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে চলেছে। রাগতভাবে উঠে এসে রিসিভারটা হাতে তুলে নিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন–হ্যালো, স্পিকিং আরিফ চৌধুরী…… কি বললেন, মওলানা মাশহাদীর লাশ পাওয়া গেছে?….তার শয়নকক্ষের শয্যায়… …আচ্ছা এক্ষুণি আসছি।

 মিঃ আরিফ যখন ফোনে কথা বলছিলেন তখন মিসেস আরিফ কক্ষে প্রবেশ করছিলেন, স্বামীর কথাগুলো তার কানে প্রবেশ করে। অবাক কণ্ঠে বলে উঠেন–কি বললে, মওলানা মাশহাদীর লাশ পাওয়া গেছে?

রিসিভার রাখতে রাখতে বললেন মিঃ আরিফ- হ, মওলানা মাশহাদীর লাশ নাকি তাঁর শয়নকক্ষের বিছানায় পাওয়া গেছে। মিঃ হাসান ফোন করেছিলেন, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।

মিঃ আরিফের চোখেমুখে একটা দারুণ উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠলো।

মিসেস আরিফের মুখে কোনো কথা নেই, তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন- একি আশ্চর্য ব্যাপার, বলো তো? যে মওলানা সাহেবের এত নাম-ডাক তার একি চরম অবস্থা হলো। এতবড় তেল কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই হলো। মওলানা সাহেব নিখোঁজ হলেন। আজ আবার শুনছি তার শয়নকক্ষের বিছানায় তার লাশ ………

মিঃ আরিফ পোশাক পরতে পরতে জবাব দিলেন–শুধু কি তাই, মওলানা মাশহাদীর তেল কারখানার ম্যানেজার এবং মাশহাদীর পার্টনার যারা ছিলেন তাদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বলো কি?

হাঁ, সবাই তারা নিখোঁজ …… কথাটা বলে আরিফ সাহেব ক্যাপ মাথায় চড়ালেন।

মিসেস আরিফ বললেন চা-নাস্তা না খেয়েই যাচ্ছে?

 সময় নেই … … কথাটা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন মিঃ আরিফ চৌধুরী।

মিসেস আরিফ চা তৈরি করছিলেন, তিনি থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

*

পুলিশ অফিসে গাড়ি পৌঁছতেই মিঃ আরিফ চৌধুরী নেমে পড়লেন। ব্যস্ত হয়ে অফিসরুমে প্রবেশ করতেই মিঃ ইয়াসিন বললেন- চলুন স্যার, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

মিঃ আরিফ বললেন– মিঃ হাসান কি মওলানা মাশহাদীর বাসায় অপেক্ষা করছেন?

হাঁ, মিঃ লাউলং এবং মিঃ হাসান সংবাদ পাওয়া মাত্র সেখানে গেছেন।

তাহলে আর বিলম্ব করা উচিত নয়, চলুন মিঃ ইয়াসিন। বলে মিঃ আরিফ চৌধুরী গাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

গাড়িতে বসে নানারকম আলাপ-আলোচনা করতে লাগলো।

 মিঃ আরিফ চৌধুরী বললেন– মিঃ কাইয়ুম এবং মিঃ হুদার অন্তর্ধান সমস্ত পুলিশ মহলে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ তারা কোথায় উধাও হলেন, আশ্চর্য!

মিঃ ইয়াসিন বললেন— মওলানা মাশহাদীর উধাও এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্বন্ধ নেইতো স্যার?

আমার মনে হয়, মওলানা মাশহাদীর উধাওয়ের সঙ্গে এদের নিশ্চয়ই সম্বন্ধ আছে। বললেন মিঃ আরিফ। তারপর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললেন–মিঃ হুদার কাছে আমি কিছু কাগজপত্র দেখার ভার দিয়েছিলাম। মওলানা মাশহাদী সাহেব হঠাৎ তার অফিসরুম থেকে যেদিন নিখোঁজ হন, সেদিন তার টেবিলে একটি অর্ধদগ্ধ দামী চুরুট পাওয়া যায়। আমার মনে তখন সন্দেহ হয়েছিলো এবং চুরুটটি আমি পকেটে রেখে কাগজপত্র দেখার ভার মিঃ হুদার উপর দিয়ে চলে আসি।

মিঃ ইয়াসিন বললেন– তারপর মিঃ হুদা আপনাকে কি রিপোর্ট দিয়েছিলেন?

মিঃ হুদা পরে জানিয়ে ছিলেন, মওলানা মাশহাদীর অফিসরুমে কোনোরূপ সন্দেহজনক কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। কিন্তু মিঃ হুদা আমাকে সেদিনই গভীর রাতে ফোন করে জানিয়েছিলেন, কে বা কারা তাকে হুমকি দিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলো।

মিঃ ইয়াসিন বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন স্যার, তার মানে কি?

মানে যেদিন মিঃ হুদা আমাকে মওলানা মাশহাদীর অফিসরুমের কাগজপত্র ইনকোয়ারী রিপোর্ট পেশ করেছিলেন, ঐদিন তাঁকে মৃত্যুর হুমকি দিয়ে কে বা কারা চিঠি দিয়েছিলেন?

 সে চিঠি কি মিঃ হুদা আপনাকে দেখিয়েছিলেন?

না। মিঃ হুদাকে বলা সত্ত্বেও তিনি সে চিঠি পুলিশ অফিসে জমা দেননি এবং চিঠির কথা যেন চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

মিঃ ইয়াসিনের ঐ জোড়া ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠলো, তিনি বললেন– নিশ্চয়ই স্যার, এমন কোনো চিঠি যা তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে জড়িত ছিলো। যে কারণে তিনি চিঠিখানা ভীতিজনক জেনেও পুলিশ মহলে গোপন করে গেছেন। মিঃ কাইয়ুমও নাকি এমনি ধরনের কোনো চিঠি পেয়েছিলেন শুনেছিলাম?

হাঁ, আপনি ঠিক শুনেছেন মিঃ ইয়াসিন, মিঃ কাইয়ুমকেও এই রকম একটা সাবধানবাণী পত্র দেওয়া হয়েছিলো। জানি না একথা কতখানি সত্য। কারণ, এ চিঠি সম্বন্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না, মিঃ কাইয়ুম কাউকে কিছু বলেননি কোনো দিন।

তবে এ কথা কি করে পুলিশ মহলে জানাজানি হলো ভেবে পাচ্ছি না স্যার?

মিঃ কাইয়ুম সাহেবের চাকর বলেছিলো, কাইয়ুম সাহেব হঠাৎ অন্তর্ধান হবার কয়েক দিন। পূর্বে তিনি নাকি একখানা চিঠি পেয়েছিলেন, সেই চিঠিখানা পড়ার পর মালিক কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে পড়েছিলেন। চিঠিতে কি লেখা ছিলো চাকর জানে না— তা আজও সকলের কাছে অজ্ঞাত।

কথায় কথায় তাঁদের গাড়িখানা মওলানা মাশহাদীর বাড়ির গেটে প্রধেশ করলো।

বাড়ির ফটকে দারওয়ান ছাড়াও দু’জন পুলিশ রাইফেল হাতে কড়া পাহারা দিচ্ছিলো। তারা মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিনকে গাড়িতে দেখে সেলুট করে সরে দাঁড়ালো।

গাড়িখানা মওলানা মাশহাদীর রাজপ্রাসাদময় বাড়ির ফটক পেরিয়ে গাড়ি-বারান্দায় এসে থামলো।

এখানেও কয়েকজন পুলিশ কড়া পাহারায় রত ছিলো। মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন গাড়ি থেকে নেমে এগুতেই একজন পুলিশ অফিসার বললেন- আসুন স্যার।

মিঃ হাসান ও মিঃ লাউলং সাহেব কোথায়? বললেন মিঃ আরিফ।

 পুলিশ অফিসারটি বললেন– তারা উভয়ে মওলানা মাশহাদীর শয়নকক্ষে আছেন।

আচ্ছা চলুন।

মিঃ আরিফ ও মিঃ ইয়াসিন অনুসরণ করলেন পুলিশ অফিসারটিকে।

মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন হলঘরের টানা-বারান্দা বেয়ে উপরে উঠতে গেলে তাঁদের কানে নারীকণ্ঠের চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো। হয়তো বা মওলানা মাশহাদীর স্ত্রী এবং আত্নীয়রা কাঁদছেন। পর্দানশীন্ মহিলা, তাই জোরে কাঁদার অধিকার তাদের নেই।

সমস্ত বাড়িখানা কেমন যেন থমথম করছে। শোকের ছায়ার চেয়ে ভীতিভাবটাই যেন বেশি। বাড়ির দারওয়ান, চাকর-বাকর সকলের মুখেই যেন ভয়াতুর ভাব ফুটে উঠেছে।

 মিঃ আরিফ মিঃ ইয়াসিন পুলিশ অফিসারটির সঙ্গে মওলানা মাশহাদীর শয়নকক্ষে এসে হাজির হলেন।

সমস্ত বাড়িটা শ্বেত পাথরে তৈরি। বাড়ির প্রত্যেকটা কক্ষ অতি মূল্যবান এবং সুন্দর আসবাবে সুসজ্জিত। মওলানা মাশহাদীর শয়নকক্ষও মূল্যবান আসবাবে পরিপূর্ণ।

 মিঃ আরিফ ও মিঃ ইয়াসিন কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই নজরে পড়লো খাটের উপর চিৎ হয়ে শায়িত মওলানা মাশহাদী। কেমন যেন একটা গন্ধ তাদের নাকে প্রবেশ করলো।

 মিঃ লাউলং ও মিঃ হাসান মওলানা মাশহাদীর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা চিঠি মনোযোগ সহকারে পড়ছেন।

অন্যান্য দু’চার জন যারা বিশিষ্ট লোক কক্ষমধ্যে ছিলেন তারাও ঝুঁকে পড়ে লক্ষ্য করছিলেন মিঃ হাসানের হাতের চিঠিখানা।

মিঃ আরিফ ও মিঃ ইয়াসিন এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়ালেন কিন্তু দৃষ্টি তাদের এসে পড়লো শয্যায় শায়িত মওলানা মাশহাদী সাহেবের মৃতদেহের উপর। মওলানা মাশহাদীর হাত দু’খানা দু’পাশে ঝুলছে, হাতের পাতায় বিরাট ক্ষত-কিন্তু একি। হাতের ক্ষত যেন অগ্নিদগ্ধ মনে হচ্ছে। যে গপ্পাটা তাদের নাকে প্রবেশ করছিলো তা ঐ অগ্নিদগ্ধ হাতের তালুর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আরও লক্ষ্য করলেন মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন, মওলানা মাশহাদীর মাথার দক্ষিণ পাশের কিছুটা অংশ উড়ে গেছে জমাট রক্ত শুকিয়ে চাপ ধরে আছে। জামাকাপড়েও বহু স্থানে রক্তের ছাপ শুকিয়ে কাল হয়ে আছে।

মিঃ লাউলং এবং মিঃ হাসান চিঠি থেকে দৃষ্টি ফেরালেন।

 মিঃ হাসান বললেন—স্যার, এই চিঠিখানা মওলানা মাশহাদীর বুকের জামার সঙ্গে আটকানো ছিলো।

 মিঃ আরিফ চিঠিখানা হাতে নিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন– এযে দস্যু বনহুরের চিঠি দেখছি।

বললেন মিঃ হাসান–হাঁ স্যার দস্যু বনহুরেরই এই কীর্তি।

 মিঃ ইয়াসিন অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন– দস্যু বনহুর।

মিঃ আরিফ চৌধুরী তখন চিঠিখানা পড়তে শুরু করেছেনঃ

মওলানা মাশহাদীকে হত্যা করে আমি অসাধু ব্যবসায়ীগণকে সাবধান করে দিচ্ছি। অর্থের লোভে যারা দেশের জনগণকে ধোকা দিয়ে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে জনগণের সর্বনাশ করবেন, তাদের আমি ক্ষমা করবো না। যেমন করিনি মওলানা মাশহাদীকে।
—- দস্যু বনহুর

একবার নয়, তিন-চারবার চিঠিখানা পড়লেন তিনি স্পষ্টকণ্ঠে। মিঃ আরিফ মিঃ লাউলং সাহেবকে চিঠিখানা পড়ে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন।

মওলানা মাশহাদীর বিকৃত লাশের দিকে তাকিয়ে সবাই শুধু বিস্ময়ে স্তব্ধ হননি, দস্যু বনহুর কিভাবে শাস্তি দিয়ে মওলানা সাহেবকে হত্যা করেছে দেখে সবাই যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছেন।

সবাই বুঝতে পারেন মওলানা মাশহাদীর ব্যবসা কতখানি অসৎ জঘন্য ছিলো। তার তেল কারখানা এবং তেলের গুদাম ভস্মীভূত হবার পিছনে কার অদৃশ্য ইঙ্গিত ছিলো, এবার সব স্পষ্ট হয়ে যায় সবার কাছে।

 মওলানা মাশহাদীর লাশ কিভাবে তার শয়নকক্ষে এলো, এটাও কম বিস্ময়কর নয়। পুলিশ অফিসারগণ একেবারে থ হয়ে গেলেন যেন। অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো সঠিক সন্ধান জানতে পারলেন না।

মিঃ আরিফ চৌধুরী মওলানা মাশহাদীর লাশ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে পুলিশ অফিসে ফিরে এলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন মিঃ লাউলং, মিঃ হাসান এবং মিঃ ইয়াসিন।

পুলিশ অফিসে গোলাকার হয়ে বসে এই রহস্যময় হত্যা এবং মওলানা মাশহাদীর ব্যবসা নিয়ে নানারকম আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো।

একসময় মিঃ ইয়াসিন মিঃ আরিফকে লক্ষ্য করে বললেন– স্যার, একটা কথা আমি জানতে পারিনি এখনও?

বলুন?

যে চুরুটটি আপনি মাশহাদীর টেবিলে পেয়েছিলেন সেটা পরীক্ষা করে কি জানা গিয়েছিলো?

ও, হাঁ, আপনাকে সে কথা বলা হয়নি মিঃ ইয়াসিন। সেই চুরুট পরীক্ষা করে জানা গিয়েছিলো, চুরুটের মশলার সঙ্গে নেশাযুক্ত এমন একটা ঔষধ মেশানো হয়েছিলো যা পান করে মওলানা মাশহাদী সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

মিঃ আরিফের কথা শেষ হতে না হতে একজন পুলিশ ব্যস্ত হয়ে অফিসরুমে প্রবেশ করে সেলাম জানায়, তারপর বলে উঠে—স্যার, গুলবাগ পার্ক রোডের পাশে মিঃ হুদা সাহেবের মৃতদেহ পাওয়া গেছে……এক নিশ্বাসে কথাটা বলে হাঁপাতে থাকে পুলিশটি।

মিঃ আরিফ এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার সবাই সবাই একসঙ্গে বলে উঠেন– মিঃ হুদা সাহেবের লাশ?

হা স্যার, আমি এইমাত্র গুলবাগ পার্ক রোড থেকেই আসছি। এক্ষুণি আপনাদের যেতে হবে সেখানে।

অন্যান্য অফিসার সবাই যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। মিঃ আরিফ বলে উঠলেন– চলুন দেখা যাক কি ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশ অফিসারগণ সবাই গাড়ি নিয়ে ছুটলেন গুলবাগ পার্ক রোডের উদ্দেশ্যে।

সবাই পৌঁছে দেখলেন সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। গুলবাগ পার্ক কান্দাই শহরের সুন্দর এক নামকরা পার্ক। এই পার্কের সম্মুখে রোডের পাশে একটি বাক্সের মধ্যে মিঃ হুদার লাশ শায়িত রয়েছে।

জায়গাটা লোকের ভিড়ে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে।

 মিঃ আরিফ এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার এগুতেই পুলিশরা ভিড় সরিয়ে দিলো।

মিঃ আরিফ, মিঃ লাউলং, মিঃ ইয়াসিন এবং মিঃ হাসান এসে দাঁড়ালেন বাক্সটার পাশে। বাক্সটা বড় কাঠের বাক্স, ঠিক কতকটা শবাধারের মত দেখতে।

মিঃ আরিফ বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন।

দু’জন পুলিশ বাক্সটার ঢাকনা খুলে ফেললো।

সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠেন মিঃ আরিফ চৌধুরী– উঃ কি ভয়ানক হত্যাকাণ্ড।

মিঃ ইয়াসিন ঝুঁকে বাক্সটার মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মুখখানা বিকৃত করে ফেললেন, কি ভয়ানক বীভৎস দৃশ্য। দেখলেন মিঃ হুদার সরকারি পোশাকটা জমাট রক্তে কালো হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ পাশের বুকের কাছে জামার কিছু অংশ ছিদ্র হয়ে রক্ত চাপ হয়ে শুকিয়ে আছে। মুখখানা কিঞ্চিৎ ফাঁকা, চোখ দুটো উধ্বমুখে মেলিত। বাক্সটা খোলার সঙ্গে কতকগুলো মাছি বাক্সে প্রবেশ করে মিঃ হুদার মুখ গহবরে প্রবেশ করতে লাগলো। একটা পঁচা গন্ধ স্থানটাকে বিষাক্ত করে তুলেছিল। মিঃ ইয়াসিন নাকে রুমাল চাপ দিতে বাধ্য হলেন।

মিঃ আরিফ এবং অন্যান্য সকলেও নাকে রুমাল চাপা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য লাশটার এত সহজে পচন ধরতো না যদি বাক্সে হাওয়া প্রবেশের পথ থাকতো।

বাক্সে থাকায় মিঃ হুদার লাশ পচে গন্ধ হয়ে গিয়েছিলো এবং লাশটি ফুলে উঠেছিলো।

মিঃ আরিফ ঝুঁকে কিছু একটা তুলে নিলেন বাক্স হতে। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, মিঃ আরিফের হাতে একখানা ভাঁজ করা কাগজ।

মিঃ ইয়াসিন বললেন ওটা কি স্যার?

মিঃ আরিফ ভাঁজ করা কাগজখানা মেলে ধরে বললেন একখানা চিঠি। নিচের নাম দেখে নিয়ে বললেন আবার দস্যু বনহুর লিখেছে।

দস্যু বনহুর?

 হাঁ। আমি পড়ছি শুনুন। মিঃ আরিফ চৌধুরী পড়তে শুরু করলেন—

দেশের নিপীড়িত জনগণের রক্ষক হলেন পুলিশ মহল। রক্ষক হয়ে যদি ভক্ষক হয় তবে জনগণ কার কাছে আশ্রয় নেবে, কার পাশে এসে দাঁড়াবে ভরসা নিয়ে? জনগণের রক্ত শুষে নিয়ে যারা দেশের দুশমনকে প্রশ্রয় দেয়। তাদের জন্য এই চরম শাস্তি। ঘুষ খোর যারা তাদের আমি সাবধান করে দিচ্ছি।
– দস্যু বনহুর।

মিঃ ইয়াসিন হঠাৎ বলে উঠলেন সমুচিত শাস্তিই দরকার ঘুষখোর নরপিশাচ অফিসার যারা আছেন তাদের জন্য …….

মিঃ আরিফ তাকালেন মিঃ ইয়াসিনের মুখে– কি বললেন?

না স্যার, কিছু না। তবে হাঁ, আমার সন্দেহ ছিলো মিঃ হুদা অত্যন্ত ঘুষ খেতেন।

 মিঃ আরিফ বললেন- এইসব অফিসারই পুলিশ মহলের কলঙ্ক।

মিঃ ইয়াসিন বললেন আবার পুলিশ মহল হলো দেশের জনগণের সেবক। তারা নিঃস্বার্থভাবে দেশের উপকার করে যাবেন, তা নয়– তারাই অন্যায়-অনাচার করে চলেছেন। দেখুন স্যার, আজকাল ছোটখাটো অফিসারগণ দেশের জনগণকে এসব ঘুষের মাধ্যমে নাজেহাল পেরেশান করে চলেছে….

 মিঃ আরিফ বললেন- সে সব কথা পরে ভেবে দেখা যাবে, এবার মিঃ হুদার লাশ পুলিশ অফিসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

ঠিক সেই মুহূর্তে গুলবাগ পার্কের হেড মালি ছুটে এলো, রীতিমত হাঁপাচ্ছে সে। চোখেমুখে তার ভীতির ভাব ফুটে উঠছে, ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ালো সে পুলিশ অফিসারদের সম্মুখে হুজুর লাশ…হুজুর লাশ…অনেক লাশ…

মিঃ হাসান বলে উঠেন–লাশ? কোথায় অনেক লাশ?

 হুজুর পার্কের মধ্যে…

 মিঃ আরিফের দিকে তাকালেন মিঃ হাসান।

প্রত্যেক পুলিশ অফিসার একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলেন। বললেন মিঃ ইয়াসিন চলুন স্যার, দেখা যাক কি ব্যাপার?

সবাই এগুলেন গুলবাগ পার্কের মধ্যে।

আগে আগে চললো পার্কের হেড মালি।

কিছুদূর অগ্রসর হয়ে কতকগুলো ফুলগাছের ঘন ঝাড়। সেই ঝাড়ের আড়ালে আসতেই সকলে যেন হতভম্ভ হয়ে পড়লেন। তাঁরা দেখলেন পাশাপাশি কয়েকটা মৃতদেহ শায়িত রয়েছে। প্রথম নজর পড়তেই তারা চিনলেন মিঃ কাইয়ুমকে। তার দেহে স্যুট শোভা পাচ্ছে। তার পাশে আরও কয়েকটি মৃতদেহ লম্বালম্বি সুন্দরভাবে গুছিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

পুলিশ অফিসারগণ মৃত দেহগুলো সনাক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁরা সবাই বিস্ময়ে থ’ মেরে গেলেন, দেখলেন মিঃ কাইয়ুম সহ প্রত্যেকের হাতের তালুতে একইভাবে অগ্নিদগ্ধ শলাকা প্রবেশের চিহ্ন বিদ্যমান।

 মিঃ আরিফ প্রত্যেকটা লাশ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। সবচেয়ে আশ্চর্য হলেন, মওলানা মাশহাদীর তেল কোম্পানীর ম্যানেজারের হাতের তালুতে কোনো ক্ষত নেই।

মিঃ হাসান বললেন স্যার, দেখুন প্রত্যেকটি লাশের দক্ষিণ বাজুর জামার সঙ্গে ছোট্ট একটুকরা কাগজ আটকানো রয়েছে মনে হচ্ছে।

 মিঃ আরিফ এবং অন্যান্য অফিসার দেখলেন, সত্যি লাশ গুলোর দক্ষিণ বাজুর সঙ্গে এক একটা কাগজের টুকরা আটকানো।

মিঃ হাসান খুলে নিলেন কাগজের টুকরাগুলো। মিঃ কাইয়ুমের বাজু হতে কাগজের টুকরাটা মিঃ আরিফ হাতে নিয়ে পড়তে লাগলেন

দুর্নীতি দমন করতে গিয়ে নিজেরাই যারা দুর্নীতির মহারাজ
বনে যান তাদের জন্য এই পুরস্কার।
– দস্যু বনহুর

 দ্বিতীয় চিঠিখানা এবার হাতে নিলেন মিঃ আরিফ। তাতে লেখা আছে–

অসৎ ব্যবসায়ী যারা তাদের আমি এই পুরস্কার দিয়ে থাকি।
– দস্যু বনহুর

 তৃতীয় চিঠিখানা পড়লেন তিনি।

অর্থের পিপাসায় যারা আত্মহারা হয়ে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাদের জন্য এই পুরস্কার।
–দস্যু বনহুর

 চতুর্থ চিঠিখানা পড়তে শুরু করলেন—

সাবধান বাণী যে অমান্য করে তাকে আমি শাস্তি এই দিয়ে থাকি।
– দস্যু বনহুর

মিঃ হাসান আর একখানা চিঠি মিঃ আরিফ চৌধুরীর হাতে দিলেন— স্যার, এটা ম্যানেজারের জামার হাতলে ছিলো।

মিঃ আরিফ চিঠিখানা হাতে নিলেন এবং উচ্চকণ্ঠে পড়তে লাগলেন।

 অসৎ ব্যক্তির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট থাকে তাদেরকেও আমি ক্ষমা করি না।
– দস্যু বনহুর।

 চিঠিগুলো-পড়া শেষ করে বললেন মিঃ আরিফ– দস্যু বনহুর দেখছি চরমভাবে তার কাজ শুরু করেছে।

মিঃ লাউলং বললেন— এত বেশি প্রশ্রয় সে পেয়েছে যার জন্য সে পুলিশ অফিসারের উপরও জঘন্য আচরণ শুরু করেছে। যেমন করে তোক তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের কৌশল অবলম্বন করতেই হবে। মিঃ কাইয়ুম এবং মিঃ হুদাকে হত্যার জন্য তাকে সমুচিত শাস্তি দান করতে হবে।

 মিঃ হাসান বললেন- এতগুলো হত্যা সে একসঙ্গে করেছে এর জন্য তাকে কিছুতেই রেহাই দেওয়া যায় না।

মিঃ ইয়াসিন বললেন— তাকে গ্রেপ্তার করাটাই দুরূহ ব্যাপার। মিঃ জাফরী তাকে বহুবার নাগালের মধ্যে পেয়েও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হননি।

মিঃ আরিফ বললেন– মিঃ জাফরী যা করতে সক্ষম হননি তা আমাদের সমাধা করতে হবে। দস্যু বনহুরকে আর কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না।

মিঃ লাউলং বললেন এবার এই সময় মিঃ জাফরীকে আমাদের একান্ত প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু ভদ্রলোক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হসপিটালে যাওয়ায় দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে আমাদের অনেক অসুবিধা পোয়াতে হবে।

মিঃ আরিফ বললেন— ঠিকই বলেছেন, মিঃ জাফরী ছাড়া দস্যু বনহুরকে সনাক্ত করা সহজ হবে না আমাদের পক্ষে। কারণ, আমরা কেউ দস্যু বনহুরের আসল রূপের সঙ্গে পরিচিত নই।

মিঃ ইয়াসিন দস্যু বনহুরকে প্রকাশ্য দেখেছেন, তার সঙ্গে অনেকবার কথাবার্তাও হয়েছে, তবু তিনি চেপে গেলেন। নীরবে শুনতে লাগলেন অন্যান্য অফিসারের আলাপ-আলোচনা মিঃ ইয়াসিন পুলিশের চাকরি করলেও তিনি দস্যু বনহুরকে মনে মনে সমীহ করেন। তিনি জানেন, দস্যু বনহুর যা করে তা পুলিশ মহলের চোখে এবং দেশের ধনকুবেরদের কাছে দোষণীয় হলেও অন্যায় সে করে না। অন্যায়েরই গলা টিপে সে হত্যা করে।

একসঙ্গে এতগুলো লাশ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। অল্পক্ষণে গুলবাগ পার্কের চারিদিক লোকে লোকরণ্য হয়ে উঠলো। পুলিশের বিপুল বাধা সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক জনতা পার্কের ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো।

 বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার ভিড় জমালো আশেপাশে।

 মিঃ আরিফ এবং পুলিশ অফিসারগণ ডায়েরী করে নিলেন, তারপর লাশগুলো পুলিশ অফিসে নিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ দিয়ে তারা গাড়িতে চেপে বসলেন।

এই হত্যাকাণ্ডের কথা বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেলো। নিহত মওলানা মাশহাদী এবং অন্যান্য নিহত ব্যক্তির ফটো বের হলো বিভিন্ন আকারে। মৃতদেহের সঙ্গে পাওয়া দস্যু বনহুরের চিঠিগুলোও প্রকাশ করা হয়েছে।

এসব পত্রিকা পাঠ করে দেশের জনগণ বিস্মিত হলো। শুধু বিস্মিতই হলো না, তাদের মধ্যে এক বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি হলো।

কান্দাই-এর পথে-ঘাটে, দোকানে, হোটেলে, সিনেমা হলে, সর্বত্র ঐ এক কথা। সকলের হাতে হাতে পত্রিকা, সবার মুখে মুখে একই আলোচনা। মওলানা মাশহাদী এবং তার ব্যবসায় অংশীদারগণও পুলিশ অফিসারদের নিহত ব্যাপার নিয়ে মহা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

অসৎ উপায়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে তাদের হৃৎপিণ্ড ধকধক করে উঠলো, শিউরে উঠলো তাদের শিরা-উপশিরাগুলো। প্রতি মুহূর্তে বনহুরের আগমন আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন রইলো তারা।

 যেসব পুলিশ অফিসার এবং বিভিন্ন অফিসের কর্মচারীগণ যারা অবিরত জনগণের নিকট হতে ঘুষ খেয়ে থাকে তাদের অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়লো, প্রতি মুহূর্তে তার মৃত্যুর জন্য কুঁকড়ে পড়লো। না জানি কখন কোন দণ্ডে দস্যু বনহুর আজরাইলের বেশে এসে হাজির হবে, ঠিক নেই।

 শহরে সবাই আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতে লাগলো। একসঙ্গে এতগুলো হত্যাকাণ্ড কম কথা নয়। যারা অসৎ ব্যবসায় লিপ্ত ছিলো তারা তাদের ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দিলো। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো হতে ক্ষান্ত হলো তারা। তবুও নিশ্চিন্ত নয় এসব ব্যক্তি, কারণ তাদের অপরাধের বোঝা কম নয়।

যারা ঘুষখোর অফিসার তারা নিজেদের সংযত করে নিলেন। অর্থ দেখে ভরে শিউরে উঠেন তারা, এই অর্থের লোভেই সেই নির্মম মৃত্যু ঘটেছে। দস্যু বনহুর উচিত সাজা দিয়ে দেশবাসীকে সাবধান করে দিয়েছে।

*

সমস্ত কান্দাই শহরে যখন দস্যু বনহুর এবং তার এই অদ্ভুত হত্যাব্যাপার নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, তখন চৌধুরী বাড়ির মনিরা ও মরিয়ম বেগম এসব পত্রিকা নিয়ে উদ্বিগ্নভাবে দেখছে।

মনিরা পত্রিকাখানা মরিয়ম বেগমের সম্মুখে মেলে ধরে ক্রুদ্ধভাবে বললো- দেখো মামী মা তোমার গুণবীর পুত্রের কার্যকলাপ দেখো, সে কি মানুষ, না হৃদয়হীন নরপিশাচ……

মরিয়ম বেগম বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন- ও কথা বলিসনে মা। আমার বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আমার মনির কিছুতেই এমনভাবে হত্যা করতে পারে না।

এই দেখো, পড়ে দেখো সব। কতগুলো হত্যাকান্ড সে নিমর্মভাবে করেছে।

 নিয়ে যা, আমি ওসব দেখতে চাই না মনিরা। আমার মনির কিছুতে এ হত্যা করেনি।

হঠাৎ পিছনে গম্ভীর শান্ত কণ্ঠস্বর–হাঁ, তোমার মনিরই এ হত্যা করেছে মা।

কে-কে, মনির তুই।

হাঁ মা, তোমার মনির।

মনির এবং মরিয়ম বেগম নির্জন কক্ষে বসে এসব আলাপ-আলোচনা হচ্ছিলো। রাত তখন। গভীর।

পাশের ঘরে নূর ঘুমাচ্ছে।

মরিয়ম বেগম এশার নামাজ শেষ করে যখন মোনাজাত করছিলো তখন মনিরা পত্রিকাগুলো হাতে নিয়ে শাশুড়ীর নামাজ কক্ষে প্রবেশ করেছিলো এবং প্রশ্ন করেছিলো তার পুত্রের আচরণ সম্বন্ধে। স্বামীর প্রতি একটা রাগ-অভিমান তাকে ক্ষুদ্ধ করে তুলেছিলো তাই মনিরা পুত্রের কর্মের কৈফিয়ত তলব করতে এসেছিলো তার জননীর কাছে।

বনহুর হেসে এগিয়ে এলো, মা এবং স্ত্রীর মাঝখানে এক পাশে বসে পড়লো।

 মরিয়ম বেগম বিস্ময়-বিমূঢ় কণ্ঠে বললেন- এসব হত্যা তুই করেছিস মনির?

 হাঁ মা।

মরিয়ম বেগম পুত্রের জামার অংশ চেপে ধরলেন– তুই মানুষ না পশু?

তোমার ছেলে পশু নয় মা, মানুষ মানুষ বলেই সে অমানুষিক কাজ সহ্য করতে পারে না। মা, যাদের আমি হত্যা করেছি তারা দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু, জনগণের শত্রু……শুধু এদের হত্যা করেই আমি ক্ষান্ত হইনি, প্রয়োজন হলে আমাকে আরও বহু হত্যা করতে হবে।

মনির। অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠেন মরিয়ম বেগম।

তোমার ছেলে আজ মনির চৌধুরী কিন্তু যখন সে হত্যার নেশায় মেতে উঠে তখন সে মনির চৌধুরী থাকে না। সে তখন হৃদয়হীন নরপিশাচ রূপ ধারণ করে……কথাগুলো রাগতভাবে বললো মনিরা।

বনহুর ভ্রূ বাকা করে মৃদু হেসে তাকালো মনিরার মুখের দিকে।

মনিরা উঠে চলে গেলো দ্রুত তার নিজের কক্ষে।

বনহুর মায়ের হাত দু’খানা চেপে ধরলো হাতের মুঠায়, মিনতিভরা করুণ কণ্ঠে বললো মা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না মা। তোমার ছেলে হৃদয়হীন নরপিশাচ নয়, কিন্তু… … বনহুর থামলো। ধীরে ধীরে তার মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো, হয়তো দেশের শয়তান-দুশমন যারা তাদের কথা মনে উদয় হলো, দাঁতে দাঁত পিষে বললো- কিন্তু তোমার ছেলে সেই মুহূর্তে নিজকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারে না যখন দেশের শত্রুর সম্মুখে সে হাজির হয়।

 মরিয়ম বেগম পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে। একটা অদ্ভুত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় বনহুরের মুখে। কিছু পূর্বের মনির যেন পাল্টে যায় মুহূর্তে।

বনহুর নিজকে সংযত করে নেয়, বলে– মা, আমাকে ক্ষমা করো?

ওরে তুই আমার জীবনের সম্বল, তোকে আমি ক্ষমা না করে পারি। হাঁ বাবা, মনিরা তোর উপর অভিমান করেছে।

 বনহুর একটু হেসে মায়ের মুখে তাকিয়ে যে পথে মনিরা কক্ষ ত্যাগ করেছিলো সেই পথে চলে যায়।

মরিয়ম বেগম দুহাত তুলে ধরেন উপরের দিকে–হে খোদা, তুমি আমার মনিরকে সুমতি দাও। ওকে তুমি সুপথে চালাও প্রভু… … ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে তার গণ্ড বেয়ে।

*

মনিরা বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো।

 বনহুর এসে পাশে বসে পিঠে হাত রাখে, ডাকে সে– মনিরা।

কোনো জবাব না দিয়ে মনিরা উচ্ছ্বসিতভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

বনহুর মনিরাকে তুলে নেয়, বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে— ছিঃ ওভাবে কাঁদতে আছে। কি অপরাধ আমি করেছি তোমার কাছে বলো?

মনিরা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে আমার স্বামী হয়ে তুমি নরঘাতক, তুমি নরপিশাচ। বলল, আরও বলো মনিরা? তোমাকে আমি হত্যা করবো, দেবো না আর আমি তোমাকে হত্যা করতে। হেসে বললো বনহুর বেশ তো তাই করো, তোমার সামনে বান্দা হাজির রয়েছে।

মনিরা স্বামীর মুখে তাকালো, স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর মুখখানা তাকে আত্নহারা করে ফেললো। এই মুহর্তে বনহুরকে দেখলে কেউ ভাবতেও পারবে না সে কোনো সময় লৌহমানবের মত কঠিন হতে পারে।

মনিরা ভুলে গেলো সব, স্বামীর বুকে মাথা রাখলল।

বনহুর নিজের হাতে মনিরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো—-কেন আমি এদের হত্যা করেছি যদি ভালভাবে বুঝতে চেষ্টা করতে মনিরা তাহলে তুমি আমার উপর রাগান্বিত হতে পারতে না। যাদের আমি হত্যা করেছি তাদের অপরাধ সীমাহীন।

কি ক্ষতি তারা তোমার করেছিলো?

আমার ক্ষতি যারা করে তাদের আমি পূজা করি– মনিরা। কিন্তু দেশের যারা ক্ষতি করে, দেশের জনগণের যারা সর্বনাশ করে তাদের আমি ক্ষমা করি না। কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠে বনহুর।

মনিরা এরপর স্বামীকে এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে সাহসী হলো না।

 মনিরা স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বললো আর কিছু বলব না তোমাকে। না জেনে আমি তোমার কাজে ক্রুদ্ধ হই, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

বনহুর মনিরার মাথায়-পিঠে গভীর স্নেহে হাত বুলিয়ে বলে —শুধু তুমি নও, মাও আমার কাজে সন্তুষ্ট নন মনিরা। কেউ আমার কাজে সন্তুষ্ট নয়, তবু আমি আমার কাজ করে চলেছি। যাক ও সব কথা। মনিরা?

বলো?

একটা কথা বলবো বলে এসেছি।

 বলো?

ভূমিকা না করেই বলছি।

তাই বলো?

অনেকদিন আগে একটি মেয়ে আমার শহরের আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিলো। তার কেউ না থাকায় তাকে কোথাও পৌঁছে দিতে পারিনি।

তাই তুমি কি বলতে চাও? মনিরার কথার স্বর কেমন যেন ভারী মনে হলো।

বনহুর বললো–ওর বয়স হয়েছে, আর কতদিন এমনিভাবে রাখা যায়, তাই……

বলো কি বলতে চাও?

মেয়েটি কিন্তু খুব সুন্দরী…।

এসব আমাকে শোনাচ্ছো কেন? যাও তাকে নিয়েই থাকবে, যাও। মনিরা স্বামীর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ওদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে।

বনহুর বলে আবার আগে সব শোন, তারপর যা হয় করো। মেয়েটির বিয়ে হওয়া একান্ত দরকার। সে আমাকে বড় ভাই বলে জানে, আমি তাকে বোনের মত স্নেহ করি।

এবার মনিরা চোখ তুলে তা আমাকে কি করতে বল।

একটা ভাল পাত্র খুঁজে দাও মনিরা।

 কেন, তুমি পারো না? কত লোক তোমার অংগুলি হেলনে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিচ্ছে, আর একটি সৎপাত্র পাও না?

তুমি তো জানো মনিরা, সভ্য সমাজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কতখানি। কাজেই তোমার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখলাম না। ওর নাম মাহমুদা–মাহমুদার জন্য একটি পাত্র খুঁজে দাও।

বলো তোমার বোনের জন্য কেমন পাত্রের প্রয়োজন?

মাহমুদা শুধু আমার বোন নয়, তোমারও বোন। তোমার যেমন পছন্দ তেমনি একটি ছেলে দেখবে ওর জন্য।

বেশ, তোমার বোনটিকে আমার দেখা দরকার তো?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই মাহমুদাকে এনে দেবো তোমার কাছে, এখানেই ওকে রাখবে।

আচ্ছা, তাই হবে। আমার এক বান্ধবীর ভাই আছেন–উচ্চশিক্ষিত, অল্পদিন হলো বিদেশ থেকে ডক্টরেট নিয়ে ফিরেছেন, একটা সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ের খোঁজ করছেন তিনি।

 বনহুর বললো-দেখো মনিরা, মাহমুদার আজ কেউ না থাকলেও তার বংশমর্যাদা কম নয়। সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে সে। কাজেই কোনো অসুবিধা নেই বুঝলে?

 বুঝেছি। এবার বলো, তোমার বোন না আমার বোন বলে চালিয়ে নেবো?

তোমার বোনই বলো মনিরা, সেটাই মানাবে ভালো, বলো দেশের বাড়ির চাচার মেয়ে বা খালার মেয়ে।

অত শিখিয়ে দিতে হবে না তোমাকে। যা হয় আমিই বলবো।

আমাকে বাঁচালে মনিরা।

*

পুলিশ মহল দস্যু বনহুরের সন্ধানে উঠে পড়ে লেগে গেলো। চারিদিকে পুলিশ-ফোর্স ছুটাছুটি করে ফিরছে। গোয়েন্দা বিভাগ ছদ্মবেশে এখানে-সেখানে আত্মগোপন করে অনুসন্ধান করে চলেছে। এবার পুলিশ মহল দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে এক লাখ টাকা ঘোষণা করেছে।

শুধু কান্দাই শহর নয়, আশে পাশের দেশগুলোতেও দস্যু বনহুরকে নিয়ে ভীষণ আলোড়ন শুরু হয়েছে।

এদিকে দেশের জনগণের মধ্যে বিপুল একটা আনন্দোচ্ছাস জলস্রোতের মত বয়ে চলেছে। দেশের অসৎ ব্যবসায়ী এবং ঘুষখোর যারা, তাদের মুখ চুন হয়ে গেছে। কেউ কোনো কুকর্ম করতে সাহসী হচ্ছে না।

মওলানা মাশহাদীর একটি তেলবাহী জাহাজ পাকিস্তান অভিমুখে রওনা হয়ে গিয়েছিলো। সেই জাহাজখানাও সমুদ্র গর্তে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে পাঁচ লাখ মণ তেল ছিলো। কে বা কারা জাহাজখানাকে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত করেছে, পুলিশ মহল অনুসন্ধান করেও জানতে পারেনি-আন্দাজেই ধরে নিয়েছে দস্যু বনহুরের কাজ এটা।

আরও যে সব কল-কারখানা থেকে ভেজাল মেশানো খাদ্যদ্রব্য তৈরি হতো, সব কলকারখানা জ্বলে উঠলো। মওলানা মাশহাদীর হত্যা এবং তার তেল কারখানা বিনিষ্ট হওয়ার পরও সব অসৎ ব্যবসায়ী দুঃসাহসিকতার সঙ্গে গোপনে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে সাহসী হয়েছিলো তাদেরও ক্ষমা করলো না বনহুর।

উন্মাদ হয়ে উঠেছে যেন দস্যু বনহুর। কোনো বাধাবিঘ্ন তাকে ক্ষান্ত করতে সক্ষম হচ্ছে না। পুলিশ মহল বা দুর্নীতি দমন বিভাগ এতদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাদের শায়েস্তা করতে পারেনি, দস্যু বনহুর তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

 সেদিন ইউসুফ আলী কোরেশী–ঔষধ কারখানার মালিক তার ব্যবসা গুটিয়ে দেশত্যাগ উদ্দেশ্যে গোপন শলা-পরামর্শ করছিলো। কারণ, তার ব্যবসা ছিলো অত্যন্ত অসৎ এবং জঘন্যতর। ইউসুফ আলী তার ঔষধের ব্যবসায় অসাধু উপায়ে বহু অর্থ উপার্জন করেছেন। কান্দাই শহরে যখন দস্যু বনহুরের নির্মম হত্যালীলা চলেছে তখন ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ইউসুফ আলী। সে জানতো দস্যু বনহুরের কোপদৃষ্টি থেকে তার পরিত্রাণ নেই।

ইউসুফ আলী তাই ভীত হয়ে পড়েছিলো, গোপনে সরে পড়ার আয়োজন করছিলো সে কারখানা আপাততঃ বন্ধ রেখে। টাকা-পয়সাসহ পালাবে-এই ছিলো তার মনের বাসনা।

গভীর রাত।

ইউসুফ আলী তার শয়নকক্ষে ম্যানেজারের সাথে গোপনে আলাপ আলোচনা করছিলো। ভোর রাতে যে বোয়িং প্লেনখানা কান্দাই ঘাটি ত্যাগ করবে তাতেই তারা সরে পড়বে, সেইমত ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।

সম্মুখের সুটকেসে লাখ লাখ টাকার বাণ্ডিলগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মূল্যবান স্বর্ণ অলঙ্কারে আরও একটি ব্যাগ পূর্ণ।

চারিদিকে দরজা বন্ধ।

কোথাও জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই।

ইউসুফ আলী কোরেশী ওভারকোট পরে নিয়েছে, মাথায় ক্যাপ। পকেটে গুলীভরা। রিভলভার। পায়ে ভারী বুট।

উঠে দাঁড়ালো ইউসুফ আলী, পালাবে এবার সে।

ম্যানেজারের হাতে চাবির গোছা দিয়ে বললো-আপনি সব দেখেশুনে চালিয়ে নেবেন।

আর আপনি কবে ফিরবেন স্যার?

যতদিন কান্দাই শহর থেকে দস্যু বনহুরের অস্তিত্ব মুছে না যাবে।

ইউসুফ আলীর কথা শেষ হয় না, পিছন থেকে এগিয়ে আসে একটি ছায়ামূর্তি।

চমকে উঠে ইউসুফ আলী ও তার বিশ্বস্ত ম্যানেজার।

ইউসুফ আলী কোরেশী দ্রুত ওভারকোটের পকেটে হাত ভরতে যায় কিন্তু পারে না।

 ছায়ামূর্তি গর্জে উঠে-খবরদার, পকেটে হাত দিতে চেষ্টা করবেন না।

ইউসুফ আলী হাত দু’খানা তুলে ধরতে বাধ্য হলো।

ম্যানেজার তো ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছিলো, হাত দুখানা সে তুলে ধরেছিলো প্রথমেই। কারণ, ছায়ামূর্তির হস্তের চকচকে কালো রিভলভারখানা তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিলো।

 ইউসুফ আলী কোরেশী হাত তুলতে বাধ্য হলো বটে, কিন্তু সে পালাবার জন্য প্রবলভাবে চেষ্টা করতে লাগলো। তবু সাহস করে বললো-কে তুমি দস্যু বনহুর?

চিনে নিতে পেরেছে তাহলে? তাছাড়া তুমি জানতে আমি আসতে পারি।

ইউসুফ অবশ্য আন্দাজে ধরে নিয়েছিলো ছায়ামূর্তি দস্যু বনহুর হতে পারে। কিন্তু সে আশা করতে পারেনি, দস্যু বনহুর তার বন্ধ কক্ষে প্রবেশে সক্ষম হবে। দু’চোখে বিস্ময় ঝরে পড়ে ইউসুফ আলী কোরেশীর।

দস্যু বনহুর এগিয়ে আসে আরও দু’পা।

ইউসুফ আলী কোরেশীর হৃৎপিণ্ড ধক ধক করে উঠে, ঢোক গিলে বলে–আমার এ বন্ধ কক্ষে তুমি কিভাবে প্রবেশ করলে?

হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বনহুর, তারপর বলে–এইটুকু জানেন না কোরেশী সাহেব দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই। আপনি ভূগর্ভে বসে যদি অসৎ কাজ করে যান তবু আমার কাছে আত্মগোপন করতে পারবেন না। মাটি খুঁড়ে আমি সেখানে হাজির হবো। এবার বুঝতে পেরেছেন এখানে কেমন করে এসেছি।’

কি চাও তুমি আমার কাছে?

 এতদিন আপনি যে মহৎ এবং সৎ কাজ করেছেন তার পুরস্কার দিতে এসেছি। ঔষধে ভেজাল মিশিয়ে আপনি কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন, আর সেই ঔষধ ব্যবহার করে অকালে প্রাণ দিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। দেখুন এমন মহান ব্যক্তি আপনি কাজেই হঠাৎ থেমে যায় বনহুর। ম্যানেজারকে লক্ষ্য করে বলে–আপনার বিচার আজ স্থগিত রইলো। আপনি বেরিয়ে যান এবং শীঘ্র পুলিশে সংবাদ দিন। যান যান বলছি–

 ম্যানেজার ভয়-বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে দস্যু বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো, কথাগুলো তার কানে পৌঁছছিলো কিনা সন্দেহ। কেমন যেন হাবা বনে গেছে ম্যানেজার ভুদ্রলোক। দস্যু বনহুর তাকে বেরিয়ে যেতে বলছে এবং পুলিশে সংবাদ দিতে বলছে, এ যেন কেমন অবিশ্বাস্য কথা।

বনহুর পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলে–হা করে কি দেখছেন? যান পুলিশ অফিসে ফোন করুন যে, দস্যু বনহুর আপনার মালিককে পুরস্কার দেবার জন্য হাজির হয়েছে–যান এবার।

ম্যানেজার ভদ্রলোক মরি-বাচি করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। একবার ফিরে তাকাতেও সাহসী হলো না সে।

ম্যানেজার ভদ্রলোক বেরিয়ে যেতেই বনহুর ইউসুফ আলী কোরেশীর বুকে চেপে ধরলো রিভলভার কিন্তু গুলী না ছুঁড়ে বাম হাতে নিজ কোমরের বেল্ট থেকে ছোরাখানা একটানে খুলে নিয়ে বসিয়ে দিলো সে ইউসুফ আলীর তলপেটে।

একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো ইউসুফ আলী কোরেশী।

বনহুর ইউসুফ আলীর দেহটা ধরে ফেললো দু’হাতের উপর তারপর শুইয়ে দিলো বিছানায়।

*

মিঃ আরিফ চৌধুরীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

মিসেস আরিফ বলছেন–ওগো শুনছো, তোমার ফোন—

হ্যাঁ কি বললে ফোন?

 হাঁ, দেখো কে ফোন করেছে।

মিঃ আরিফ বিছানা থেকে ঝুঁকে টেবিল থেকে রিসিভারখানা হাতে তুলে নিয়েই বললেন কে বলছেন? মিঃ হারুন? কি বললেন–ইউসুফ ভিলা থেকে কেউ ফোন করেছে?

ওদিক থেকে ভেসে আসে মিঃ হারুনের কণ্ঠ–হা স্যার ইউসুফ আলীর কক্ষে নাকি দস্যু বনহুর প্রবেশ করেছে–শীঘ্র সেখানে যাবার জন্য পুলিশ অফিসে ফোন করেছেন ইউসুফ আলী কোরেশীর ম্যানেজার…….হ্যালো স্যার, আপনি এক্ষুণি পুলিশ অফিসে আসুন—

দস্যু বনহুর—আচ্ছা আসছি–আপনি পুলিশ ফোর্স নিয়ে তৈরি থাকুন–অফিস ইনচার্জে এখন আপনি আর কে আছেন?

স্যার আমি এবং হাওয়ালদার কেরামত মিয়া আছি। কেরামত মিয়া পুলিশ অফিস ইনচার্জে থাকবে, আমি আপনার সঙ্গে ইউসুফ ভিলায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি—স্যার, চলে আসুন।

আসছি, আপনি পুলিশ ফোর্স এবং অস্ত্রশস্ত্র তৈরি রাখুন, মিঃ আরিফ রিসিভার রেখে দ্রুত শয্যা ত্যাগ করলেন।

মিসেস আরিফ স্বামীকে উঠে পড়তে দেখে তিনিও শয্যা ত্যাগ করেছিলেন, বললেন–দস্যু বনহুর?

হাঁ এক ঔষধ ব্যবসায়ীর বাড়িতে তার আবির্ভাব ঘটেছে। জামাটা গায়ে পরতে পরতে বললেন মিঃ আরিফ চৌধুরী।

মিসেস আরিফ বললেন আবার-দস্যু বনহুর ঔষধ ব্যবসায়ীর বাড়িতে হানা দিয়েছে, বলো কি?

তাইতো বলছে—

 কিন্তু আমার কেমন যেন ভয় করছে।

কোনো ভয় নেই, দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার উদ্দ্যেশেই আমি কান্দাই এসেছি, ভয় পেলে চলবে কেন; তুমি থাকো, হাঁ যদি কোনো সংবাদ হয় তোমাকে ফোন করে জানাবো। কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলেন মিঃ আরিফ চৌধুরী।

মিসেস আরিফ অস্ফুট কণ্ঠে বললেন–খোদা, তুমি ওকে দস্যু বনহুরের কবল থেকে রক্ষা করো।

 দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াতেই আর্ত চিৎকার করে উঠেন মিসেস আরিফ, তিনি দেখতে পান—তার কক্ষের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে কালো পোশাক পরা একটি লোক!

মিসেস আরিফকে চিৎকার করতে দেখে হেসে বললো কালো পোশাক পরা লোকটি—-ভয় নেই, আমিই দস্যু বনহুর।

দস্যু বনহুর—-

হাঁ। আপনার স্বামী এখন আমাকে গ্রেপ্তার উদ্দেশ্যে পুলিশ অফিস অভিমুখে রওনা দিলেন। কিন্তু কোনো ফল হবে না, ইউসুফ আলীকে তার কাজের পুরস্কার দেওয়া হয়ে গেছে।

মিসেস আরিফ অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন দস্যু বনহুরের দিকে। দস্যু বনহুরের মুখখানা সম্পূর্ণ দেখতে না পেলেও তার চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে তার প্রশস্ত ললাটের কিছু অংশ। পাগড়ীর আঁচলে বনহুরের মুখমণ্ডলের নিচ অংশ ঢাকা, তবু বেশ বুঝতে পারেন মিসেস আরিফ লোকটি অদ্ভুত সুন্দর। চোখ দুটিতে অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ভাবেন মিসেস আরিফ, দস্যু বনহুর সেতো ভয়ঙ্কর এক মূর্তি কিন্তু—

মিসেস আরিফের চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে বলে বনহুর—আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন আমাকে এখানে দেখে, না?

হাঁ, আপনি কি করে এখানে এলেন? বললেন মিসেস আরিফ।

বনহুর হেসে বললো–দস্যু বনহুর যেখানে ইচ্ছা সেখানে গমন করতে পারে। আপনাদের পিছন জানালার শাশী খুলে আমি এসেছি। কিন্তু কেন এসেছি, এবার শুনুন। দেখুন, আমি যা করে চলেছি তা মানুষের কল্যাণ আশায়। দেশের শত্রু বিনাশে আমি উন্মাদ। আপনার স্বামীকে দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে সময় নষ্ট না করে দেশের অসৎ অসাধু দুর্নীতিপরায়ণ যাদের জন্য আজ দেশের জনগণ নির্যাতিত নিষ্পেষিত তাদের দমনে আত্মনিয়োগ করতে বলুন। আচ্ছা চলি–বনহুর যে পথে এসেছিলো সেই পথে বেরিয়ে গেলো।

মিসেস আরিফ নির্বাক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন দস্যু বনহুরের চলে যাওয়া পথের দিকে। মনে তার শুধু বিস্ময়ই নয়, একটা প্রচণ্ড জিজ্ঞাসা–দস্যু বনহুর এসেছিলো তার কক্ষে-পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরীর কক্ষে–এ কি করে সম্ভব? যে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য সমস্ত পুলিশ বাহিনী অহরহ কান্দাই শহর চষে ফিরছে সেই দস্যু বনহুর এসেছিলো তার সম্মুখে। মিসেস আরিফ কেমন যেন সম্বিৎহারা হয়ে পড়েন, দস্যু বনহুরকে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন–একি সত্যি না স্বপ্ন? নিজের দৃষ্টিকেই মিসেস আরিফ যেন বিশ্বাস করতে পারেন না।

এখানে মিসেস আরিফ যখন দস্যু বনহুর সম্বন্ধে বিষয় নিয়ে ভাবছেন তখন মিঃ আরিফ মিঃ হাসান এবং পুলিশ ফোর্স নিয়ে পৌঁছে গেছেন ইউসুফ ভিলাতে।

মিঃ আরিফ মিঃ হাসান যখন গাড়ি থেকে নামলেন, তখন ম্যানেজার এসে হাইমাই করে কেঁদে উঠলেন স্যার আপনারা আসার পূর্বেই মালিককে খুন করে দস্যু বনহুর উধাও হয়েছে।

কি বললেন জনাব ইউসুফ সাহেব খুন হয়েছে। এক সঙ্গে মিঃ আরিফ এবং মিঃ হাসান উচ্চারণ করলেন।

 মিঃ হাসান বললেন–চলুন স্যার, দেখা যাক।

মিঃ আরিফ বললেন–চলুন।

 ম্যানেজার রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বললো–সব গেছে স্যার–সব গেছে। এগুলো সে অফিসারদ্বয়ের সঙ্গে।

মিঃ ইউসুফ আলী কোরেশীর কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন তাঁরা, মিঃ ইউসুফ আলী তাঁর শয্যায় শায়িত আছেন কিন্তু তার শয্যার উপরে তাজা লাল রক্তের স্রোত বয়ে চলছে। একটি সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে ইউসুফ আলী কোরেশীর তলপেটে।

মিঃ হাসান চোখ ঢেকে ফেললেন–সেকি ভীষৎস হত্যাকাণ্ড।

মিঃ আরিফ ছোরাখানা তুলে নিলেন হাতে; সঙ্গে সঙ্গে একটি চিঠি দেখলেন চিঠি খানা মেলে ধরতেই তার নজরে পড়লো তাতে লিখা আছে

“সব চেয়ে বড় অপরাধ ঔষধে ভেজাল মিশানো ইউসুফ আলী কোরেশী ঔষধে ভেজাল মিশিয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। আজ তার পুরস্কার পেলেন।”
– দস্যু বনহুর

 কিছুক্ষণ থ’হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মিঃ আরিফ, তার চোখেমুখে একটা বিরাট বিস্ময় ফুটে উঠেছে। এত সাবধানতা, চারিদিকে পুলিশ পাহারা তবু শহরে দস্যু বনহুর স্বচ্ছন্দে তার কাজ। চালিয়ে চলেছে। এবার তিনি বললেন-আশ্চর্য দস্যু বনহুর দেখছি যাদুবিদ্যা জানে।

 ম্যানেজার বললেন–স্যার, একেবারে খাঁটি সত্য। দস্যু বনহুর কি করে যে মিঃ কোরেশীর বন্ধ কক্ষে প্রবেশ করলো ভেবে পাচ্ছি না।

 ম্যানেজার সাহেব সব কথা বললেন মিঃ আরিফ চৌধুরীর কাছে। কিভাবে দস্যু বনহুরের আবির্ভাব ঘটেছিলো, কিভাবে সে তাকে বেরিয়ে যাবার জন্য আদেশ দিয়েছিলো, কিভাবে তাকে। পুলিশ অফিসে ফোন করার জন্য বলেছিলো–সব খুলে বললেন তিনি।

 কিন্তু ইউসুফ আলী কোরেশী যে অজস্র টাকা সুটকেসে নিয়ে পালাচ্ছিলেন, সে কথা ম্যানেজার গোপন করে গেলেন পুলিশের কাছে। সে কথা প্রকাশ করতে গেলে আবার তাকেও পুলিশ দোষী করে বসে কাজেই তিনি গোপন করলো টাকার কথা।

মিঃ আরিফ এবং মিঃ হাসান লাশ পরীক্ষা করে অবাক হলো, কারণ ইউসুফ কোরেশীর দেহে বাইরে যাবার পোশাক কেন? তিনি তো শয্যায় শায়িত রয়েছেন অথচ গায়ে ওভারকোর্ট, মাথায় ক্যাপ, পায়ে ভারী বুট।

 মিঃ আরিফ বললেন–ম্যানেজার আপনি ঠিক করে বলুন, আপনার সাহেব কি এত রাতে বাইরে যাচ্ছিলেন কিংবা তিনি গভীর রাতে কোথাও থেকে বাসায় ফিরেছিলেন?

 এবার ম্যানেজারের মুখ বিবর্ণ হলো, সে ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলেও প্রকাশ হয়ে পড়লো।

কথায় কথায় মিঃ আরিফ আসল ব্যাপারখানা বের করে নিলেন ম্যানেজারের কাছ থেকে। হাজার হলেও অভিজ্ঞ পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরী। যদিও তাঁর বয়স খুব বেশি নয়, কিন্তু কার্যদক্ষতায় তিনি পুলিশ মহলে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন।

ম্যানেজার মুদ্রলোকও শেষ পর্যন্ত আটকে পড়লো পুলিশের হাতে।

ইউসুফ আলী কোরেশীর লাশ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে বাসায় ফিরতে বিলম্ব হয়ে গেলো অনেক আরিফ চৌধুরীর।

 ভোর বেলা বাসায় পৌঁছে তিনি যা জানতে পারলেন তাতে শুধু স্তব্ধ হয়েই গেলেন না, একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়লো। চাকরের মুখে শুনে উপরে গেলেন মিঃ আরিফ স্ত্রীকে নিশ্চুপ বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে প্রথমে থমকে দাঁড়ালেন, তারপর শয্যার পাশে এসে বসলেন। মিঃ আরিফ যেন কেমন হতভম্ভ হয়ে পড়েছেন তিনি বেশি বিচলিত হয়েছেন দস্যু বনহুর তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করেনি তো? তাড়াতাড়ি শয্যার পাশে এসে ঝুঁকে পড়লেন স্ত্রীর মুখে-শামীমা— শামীমা—

মিসেস আরিফ স্বামীকে দেখে উঠে বসলেন।

মিঃ আরিফ ব্যস্তকণ্ঠে বললেন-কি হয়েছে শামীমা? কি হয়েছে তোমার?

মিসেস আরিফ স্বামীর মুখে দৃষ্টি তুলে ধরে বললেন–দস্যু বনহুর এসেছিলো।

শুনলাম ওদের কাছে। কোনো ক্ষতি করেনি তো সে? মিঃ আরিফের কণ্ঠে একরাশ ব্যস্ততা ঝরে পড়ে।

মিসেস আরিফ বললেন-না।

বাঁচালে! আমাকে বাঁচালে শামীমা। ঐ শয়তান দস্যুটা এখানে কেন এসেছিলো? কোনো অলঙ্কারাদি নিয়ে যায়নি তো? মিঃ আরিফ স্ত্রীর গলায় ও হাতে তাকিয়ে লক্ষ্য করেন।

কারণ মিসেস আরিফের গলায় মূল্যবান হার ও হাতে বালা ছিলো।

মিসেস আরিফ স্বামীর কথায় বললেন–দস্যু বনহুকে তুমি দেখোনি তাই তার সম্বন্ধে এমন উক্তি করছো? শয়তান সে নয়—শয়তান তোমরা, যারা দেশের সত্যিকারের দুশমনদের প্রশ্রয় দিয়ে দেশকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

এ তুমি কি বলছো শামীমা? মিঃ আরিফ স্ত্রীর কথায় যেন একেবারে হতবাক হয়ে যান।

মিসেস আরিফ বললেন আবার–দেশ ও দশের যারা সর্বনাশ করে চলেছে তাদের তোমরা কি শাস্তি দিচ্ছো বলো? তোমরা আসল দোষীকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হও,না, তোমরা শুধু ঘুরে বেড়াও আলেয়ার পিছনে। জানো কত অমানুষ আজ মানুষের মুখোস পরে তোমাদেরই আশেপাশে সাধু সেজে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুযোগ নিয়ে মানুষ হয়ে মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। দিন দিন দেশের জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে–

শামীমা, তুমি কি পাগল হলে?

 পাগল হইনি—

 দস্যু বনহুর কি তোমার উপর যাদু করে গেছে?

যাদুকর সে নয়, যাদুকর আমাদের দেশের কতকগুলো মানুষ। যারা তোমাদের মানে পুলিশ হর্তাকর্তাদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয় আর সমাজের চরম সর্বনাশ করে চলেছে। যদি মঙ্গল চাও তবে দস্যু বনহুরের সন্ধান ত্যাগ করে যারা দেশের বিষাক্ত কীট তাদের সন্ধান করো। তাদের খুঁজে বের করে চরম শাস্তি দাও– শুধু তুমি নও সমস্ত পুলিশ বাহিনীকে সজাগ করে দাও, দেশের শত্রুদের খুঁজে বের করে চরম শাস্তি দেয়, যে শাস্তির পর আর তারা অসৎ কাজে লিপ্ত হবে না।

শামীমার কথাগুলো মিঃ আরিফের কানে যেন এক একটা বজ্রধ্বনির মত প্রবেশ করতে থাকে। সবগুলো কথা যেন গেঁথে যায় তার মনে। এমন উক্তি শামীমা শিখলো কোথা থেকে—- মিঃ আরিফ বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন স্ত্রীর দিকে। এবার মিঃ আরিফ বললেন–দস্যু বনহুর দেখছি তোমার কানে যাদুমন্ত্র দিয়ে গেছে।

ঠাট্টা করো না, আমি যা বলছি শোন।

সব তো শুনলাম।

তবে এখন থেকে সেভাবে কাজ করবে! তোমরা পুলিশ মহলে এত হর্তাকর্তা থাকতে দেশে এমন অন্যায় অনাচার কি করে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে? আমার মনে হয়, সরকার যদি এদিকে তীক্ষ্ণ নজর দেন, অপরাধিগণকে তাদের সমুচিত শাস্তি দেন, তাহলে দেশে শান্তি ফিরে আসবে। অন্যায় অসাধু কাজগুলো কমে গেলে দস্যু বনহুরও আর তোমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না—-

তুমি পুলিশ সুপারের স্ত্রী হয়ে দস্যু বনহুর সম্বন্ধে এমন কথা উচ্চারণ করতে তোমার বাধছে না? জানো, এটা তোমার চরম অপরাধ।

তারজন্য তুমি আমাকে হাজতে দিতে পারো, ফাঁসি দিতে পারো–যা খুশি তাই করতে পারো, তবু আমি বলবো, তোমাদের চেয়ে দস্যু বনহুর অনেক বড় অনেক মহৎ। কারণ সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। তুমি তো জানো দস্যু বনহুর নির্দোষ ব্যক্তির কেশও স্পর্শ করে না।

অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে কিছু ভাবলেন মিঃ আরিফ তারপর বললেন—-শামীমা সব বুঝি, সব জানি কিন্তু আমি চাকরি করি। আমাকে অনেক চিন্তা করে কাজ করতে হয়। দেশের চারিদিকে যে অন্যায় অনাচার দিন দিন বেড়ে চলেছে, তা বুঝেও কিছু করার তেমন কোনো সুযোগ করে উঠতে পারি না। কারণ দেশের যারা নেতৃস্থানীয় তারাই আজ দেশের সর্বনাশের মূল। অনেক সময় বুঝেও আমাদের না বুঝার ভান করতে হয়। হয়তো আমি জানি, আমার পাশেই বসে আছেন যিনি তিনিই একজন অসৎ অসাধু অন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি, কিন্তু তিনি দেশের একজন নেতা। বলো, এমন অবস্থায় আমরা পুলিশ মহল কেমন করে দেশের দুর্নীতি দূর করতে পারি?

 হোক সে নেতা, হোক সে ধনকুবের তাই বলে তোমরা তাদের আশ্রয় দেবে?

প্রশ্রয় আমরা দেই না শামীমা এসব ব্যক্তির কুকর্মে সহায়ক দেশের জনগণ। দেশের জনগণের প্রশ্রয়েই এরা দেশ ও দেশের জনগণকে শোষণ করে চলেছে। সমস্ত দেশবাসী যদি এসব অসৎ ব্যক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো তাহলে এরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সাহসী হতো না।

জনগণ নিরীহ অসহায় আর তারা বুঝেই বা কি, এসবে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

তুমি মিথ্যা বলোনি শামীমা—।

মিঃ আরিফের কথা শেষ হয় না, টেবিলে ফোনটা বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং করে।

রিসিভার হাতে উঠিয়ে নিলেন মিঃ আরিফ-হ্যালো, আমি মিঃ আরিফ চৌধুরী বলছি–

ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর হ্যালো মিঃ চৌধুরী আপনি মিঃ কোরেশীর লাশ মর্গে পাঠিয়ে চলে এসেছেন দেখছি যাক ভাল কথা আপনার স্ত্রীর মুখে এতক্ষণে সব জেনে নিয়েছেন নিশ্চয়ই আমি আপনার বিনা অনুমতিতে আপনার বাসায় গিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম—

মিঃ আরিফ যেন হতবাক হয়ে গিয়েছেন, শক্ত করে রিসিভার খানা চেপে ধরে বললেন–আপনি কে-কে কথা বলছেন? হ্যালো, হ্যালো আপনি—

ওদিকে হাসির মৃদু শব্দ–আপনি এখনও আমাকে চিনতে পারেননি–হ্যালো মিঃ চৌধুরী আমি দস্যু বনহুর বলছি–

দস্যু বনহুর–

মিসেস আরিফ সরে এলেন শয্যা থেকে, স্বামীর মুখে দস্যু বনহুর নামটা শুনে তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বিপুল আগ্রহে ঝুঁকে পড়লেন রিসিভারের পাশে।

 মিঃ আরিফ চঞ্চল ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন-দস্যু বনহুর তুমি আমার বাসায় আসার সাহসী হয়েছিলে কি করে? জানো না তোমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য সরকার এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন—

জানি, আর জানি বলেই অন্য কারো বাড়ি না গিয়ে আপনার বাসায় হাজির হয়েছিলাম কিন্তু কেন গিয়েছিলাম সে কথা এতক্ষণ জেনেছেন নিশ্চয়ই। আবার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আপনারা দেশের শত্রু বিনাশে আত্মনিয়োগ করুন। হ্যালো মিঃ চৌধুরী আপনারা যদি সবাই ন্যায় আর ন্যায্য দৃষ্টি নিয়ে প্রত্যেকে কাজ করেন তাহলে আমাকে এমনভাবে হত্যালীলা চালাতে হবে না। দেশের যারা শত্রু, দুর্নীতি যাদের পেশা, তাদের খুঁজে বের করে বিচার করুন শাস্তি দিন।

 মিঃ আরিফ শুনেই চলেছেন–তিনি কি জবাব দেবেন ভেবে পান না যেন আরষ্ট হয়ে গেছেন। তিনি।

ওপাশ থেকে শোনা যায় সেই বলিষ্ঠ পৌরুষ কণ্ঠস্বর এ ব্যাপারে অবহেলা করলে আমি বাধ্য হবো ইউসুফ আলী কোরেশীর মত সবাইকে শায়েস্তা করতে–

এবার মিঃ আরিফ বললেন-হ্যালো, তুমি কোথা থেকে বলছো, নিশ্চয়ই জানাতে ভয় পাবে না—-

না, মোটেই না—আপনি যখন আমার উপস্থিতি স্থান জানার জন্য উৎসুক তবে নিশ্চয়ই জানাবো—হ্যালো মিঃ চৌধুরী শুনুন আমি আমার শহরের আস্তানা থেকে বলছি। আজ তাহলে বিদায় বন্ধু–

ওপাশে রিসিভার রাখার শব্দ হলো।

 মিঃ আরিফ চৌধুরী যেন পাথরের মূর্তি বনে গেছেন। রিসিভার রাখার কথাটাও যেন ভুলে গেছেন তিনি। আরষ্ট হয়ে বসে রইলেন। তিনি হয়তো ভাবছেন, যে দস্যু, বনহুর গ্রেপ্তারে তিনি এদেশে এসেছেন, যার সন্ধানে তিনি অহরহ ছুটাছুটি করে ফিরছেন, যাকে গ্রেপ্তারের জন্য একলাখ টাকা সরকার ঘোষণা করেছেন, সেই দস্যু বনহুর এই মাত্র তার সঙ্গে ফোনে আলাপ করলো। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে গেছে সে–

মিসেস আরিফ স্বামীকে আরষ্ট হয়ে বসে থাকতে দেখে বললেন–কি হলো তোমার?

 এ্যা—রিসিভার রেখে বললেন মিঃ আরিফ–দস্যু বনহুর শহরের কোনো এক স্থান হতে আমার সঙ্গে আলাপ করলো। আমাকে সাবধান করে দিলো, যেন দেশের শত্রু বিনাশে আত্মনিয়োগ করি।

মিসেস আরিফ বললেন–এটা পুলিশ মহলের একান্ত কর্তব্য।

ঠিক বলেছো শামীমা দেশের চারিদিকে আজ যেভাবে অন্যায় অনাচার দুর্নীতি চলেছে, তাতে দেশের জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

তাই চাই এর প্রতিকার।

 হাঁ, চাই এর প্রতিকার।

*

ইরানী ফিরে তাকালো, দেখলো দস্যু বনহুর তার দিকে এগিয়ে আসছে।

ইরানী ভয় বিহ্বলভাবে শয্যায় উঠে বসলো তার দু’চোখে ফুটে উঠেছে একটা ভীতিভাব।

 বনহুর আরও সরে আসছে।

কক্ষের মোমের আলোতে বনহুরের চোখ দুটো যেন জ্বলছে সমস্ত শরীরে তার জমকালো ড্রেস, মাথার পাগড়ীর কিছু অংশ দিয়ে মুখমণ্ডলের নিচের দিকটা ঢাকা।

বনহুর ঠিক ইরানীর শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালো।

ইরানী সরে গেলো আরও দূরে। নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে মাত্র তারা দুটি প্রাণী। মনসুর ডাকুর কন্যা হয়েও আজ সে সম্পূর্ণ অসহায়। হাজার সাহসী হলেও সে নারী, আর দস্যু বনহুর এক দুঃসাহসী পুরুষ।

ইরানী জানে, তার বাবা দস্যু বনহুরের প্রতি কত নির্মম আচরণ করেছে। তাকে বন্দী করে তার উপর চালিয়েছে অকথ্য অত্যাচার। কষাঘাতে জর্জরিত করেছে তার সমস্ত দেহ। তাকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করার জন্যও সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিলো কিন্তু অলৌকিকভাবে উদ্ধার পেয়েছিলো সেদিন বনহুর। সব আজ ইরানীর মনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে। তাছাড়া বনহুরের শিশু পুত্রকে তার পিতা কী চরম শাস্তি দিয়েছিলো। এতটুকু কচি শিশু, তাকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে মারার চেষ্টা চালিয়েছিলো তাকে একফোঁটা পানি না দিয়ে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে ছিলো–ইরানীর চোখে ভাসতে থাকে এসব দৃশ্য।

 বনহুর বলে উঠেইরানী সেদিন তুমি পালিয়ে আমার হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছিলে। কিন্তু আজ কোথায় পালাবে?

ইরানী ব্যাকুল অসহায় দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকালো। ভয়-বিহ্বল কন্ঠে বললো–দস্যু হলেও তুমি না মহৎ–তুমি নাকি কারো ক্ষতি করো না–

অট্টহাসি হেসে উঠলো দস্যু বনহুর, তারপর হাসি বন্ধ করে বললো–কে তোমাকে এ কথা বলেছে, দস্যু ডাকু এরা কোনো দিন মহৎ হয় না। তোমার বাবাকে দেখে কি তুমি বুঝনি। ইরানী আমার শিশু পুত্রের প্রতি তার আচরণ কোনো দিন আমি ভুলবো না।

তুমি আমার প্রতি সেই প্রতিশোধ নিতে চাও?

 এতক্ষণে তাহলে বুঝতে পেরেছে। বনহুর এবার নিজের মুখের নিচের অংশ থেকে পাগড়ীর আঁচলখানা সরিয়ে ফেলে।

 ইরানী দেখতে পায় বনহুরের মুখে একটি কঠিন প্রতিহিংসা ভাব ফুটে উঠেছে। হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠে যেন তার। আজ কিছুতেই বনহুরের কবল থেকে রক্ষা নেই। তার বাবা বনহুর এবং তার সন্তানের প্রতি যে জঘন্য আচরণ করেছিলো আজ তাকেই তার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হবে। পিতার প্রতি রাগে ফুলতে থাকে ইরানী মনের দারুণ ক্রোধ দমন করে মিনতিভরা কণ্ঠে বলে— বনহুর তুমি আমাকে এবারের মত ক্ষমা করো—

তুমি তো জানো, দস্যু বনহুর কাউকে ক্ষমা করে না।

তোমার যে রূপ আমি সেদিন দেখেছি, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। তবু করজোড়ে বলছি, আমাকে তুমি পরিত্রাণ দাও–আজকের মত পরিত্রাণ দাও।

বনহুরের মুখে একটা ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি ফুটে উঠে। দাতে দাঁত পিষে বলে–এতদিন তোমাকে ক্ষমা করে পরিত্রাণ দিয়েছি ইরানী আজ তুমি রেহাই পাবে না—-বনহুর খুলে ফেলে মাথার পাগড়ীটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় বিছানার উপর।

ইরানী বিছানা থেকে নেমে সরে যায়, ভীত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় বনহুরের দিকে।

বনহুর বলে তুমি না আমায় বন্দী করবে বলেছিলে? এই তো তোমার সম্মুখে আমি হাজির। পালাচ্ছো কেন?

না না, আমি আমি তোমাকে বন্দী করতে চাইনি।

 মিথ্যা কথা বলতে বাধছে না তোমার? পিতার সঙ্গে তুমিও যোগ দিয়ে দস্যু বনহুরকে পুলিশের কবলে পাকড়াও করানোর জন্যই কি তোমরা সেদিন পুলিশ প্রাঙ্গণে উৎসবে যোগ দাওনি? তোমার বাবা ভদ্রলোক সেজে মস্ত একফাঁদ পেতেছিলো কিন্তু সে ফাঁদে সে নিজেই আটকা পড়েছে। তুমিও আটকা পড়তে কিন্তু আমি তোমাকে উদ্ধার করেছি।

সেইজন্য তুমি আমাকে এভাবে–

হাঁ, আজ আমি অবসর আছি, নেই কোনো কাজ, তাই এসেছি তোমার বিচারে। বনহুরের মুখেচোখে ফুটে উঠে একটা অদ্ভুত ভাবের আভাস।

ইরানী বুঝতে পারে আজ দস্যু বনহুরের কবল থেকে তার পরিত্রাণ নেই। মরিয়া হয়ে ইরানী পিছু হটতে থাকে।

বনহুর আরও সরে আসে।

নিস্তব্ধ কক্ষের মেঝেতে বনহুরের ভারী বুটের আওয়াজ একটা অদ্ভুত ভাবের সৃষ্টি করে চলেছে। এগুচ্ছে বনহুর ইরানীর দিকে। দক্ষিণ হাতখানা তার সম্মুখে প্রসারিত।

ইরানী একটা ফুলদানি তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারে বনহুরের দিকে।

বনহুর লুফে নিয়ে টেবিলে রাখে।

এবার ইরানী ওপাশ থেকে একটা সূতী ধার ছোরা নিয়ে বনহুরের বুক লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে।

ছোরাখানা গিয়ে বিদ্ধ হয় পিছন দেয়ালের একটি গোলকা চিহ্নের ঠিক মাঝখানে। সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে যায়। ইরানী যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই জায়গাটার মেঝে ফাঁক হয়ে যায় আকস্মাৎ ইরানী পড়ে যায় অতল গহ্বরে।

বনহুর হেসে উঠে- হাঃ হাঃ হাঃ।

[পরবর্তী বই মৃত্যু বিভীষিকা]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *