অরুণাচলের ইয়েতি

অরুণাচলের ইয়েতি

কর্নেলের মাথায় কখন কোন মতলব গজিয়ে ওঠে, আগে থেকে তার আঁচ পাওয়া ভারি কঠিন। এক উৎকট গ্রীষ্মের সকালে তাই যখন তার তলব পেলুম, আজই দুপুরের ফ্লাইটে গৌহাটি রওনা হতে হবে এবং আমি যেন তৈরি হয়েই বেরোই—একটুও অবাক হইনি।

এই বুড়ো দাড়িওলা টেকো লোকটিকে প্রশ্ন করলে সব সময় জবাব মেলে না। তাই গৌহাটি পৌঁছনো অব্দি কোনও প্রশ্ন করিনি। দেখেছি, প্লেনে ওঁর হাতে একটা মোটা ইংরেজি কেতাব এবং তার পাতায় বুঁদ হয়ে আছেন। বইটার নাম : দি প্রি-হিসটোরিক অ্যানিম্যালস অফ ইন্ডিয়া।

গৌহাটিতে আমরা একটা প্রাইভেট লজে উঠলুম। বুড়ো আগে থেকেই দেখলুম ব্যবস্থা করে রেখেছেন। লজের মালিক হংসধ্বজ সান্যাল। পঞ্চাশের এদিকেই বয়স। শক্তসমর্থ গড়নের মানুষ। একটু গম্ভীর চালচলন। পোড়খাওয়া চামড়া গায়ে। তিনটে চা বাগিচার মালিক নাকি উনি। বিমানঘাঁটি থেকে আমাদের গাড়ি করে নিয়ে গেছেন।

কর্নেল চমৎকার সাজানো বসার ঘরে একটা ইজিচেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে বসে অস্ফুট একটা আরামের আওয়াজ তুললেন—আঃ! তারপর বললেন—মিঃ সান্যাল, আপনার পার্টনার ভদ্রলোক কি এখনও আসেননি?

হংসধ্বজ বললেন-আগরওয়াল? এসে পড়বে নেক্সট ফ্লাইটে। তারপর আশেপাশের অবস্থা দেখে নিয়ে একটু হেসে আবার বললেন—সন্ধ্যা ছটায় ল্যান্ড করবে। ঝড়জলের সম্ভাবনা দেখছি না আজ। আগরওয়ালের পয় আছে।

ঘড়িতে তখন বিকেল তিনটে। আমরা লাঞ্চ সেরেই কলকাতা থেকে বেরিয়েছি। তবু সান্যাল সায়েব ব্যস্ত হয়ে উঠলেন অতিথি সৎকারে। সেই ফাঁকে কর্নেলকে এতক্ষণে প্রশ্ন করে ফেললুম-হ্যালো ওল্ড বস! ব্যাপারটা কী?

কর্নেল চোখ বুজে কী যেন ভাবছিলেন। চোখ খুলে বললেন—তুমি কি কিছু বলছ ডার্লিং?

খচে গিয়ে বললুম-না।

কর্নেল হেসে উঠলেন। তারপর আমার চোখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন- জয়ন্ত তুমি তো খবরের কাগজের লোক। একজন ক্রাইম রিপোর্টার। দৈনিক সত্যসেবক তোমাকে…

বাধা দিয়ে বললুম—আমাকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা মাইনে দিয়ে পুষছে। তাতে আপনার কী? আপনিও তো মিলিটারি সার্ভিসে কম পেতেন না!

কর্নেল একইভাবে তাকিয়ে বললেন—জয়ন্ত, ইয়েতি কাকে বলে জানো নিশ্চয়? হিমালয় পর্বতমালার এই রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক দানবের খবর মাঝে মাঝে তোমাদের কাগজেও বেরিয়েছে। সম্প্রতিও বেরিয়েছে। আশা করি তা লক্ষ্য করেছ। জয়ন্ত, রিপোর্টার হিসেবে এবার একটা দারুণ রকমের সুযোগ তুমি পেয়ে যাচ্ছ। ইয়েতির ওপর একটা অনবদ্য কভারেজ দৈনিক সত্যসেবকে এক্সক্লসিভলি বেরোলে কী ব্যাপার ঘটবে, টের পাচ্ছ কি? তোমার মাইনে তো বাড়বেই—উপরন্তু ম্যাগসেস পুরস্কার প্রাপ্তিও ঘটতে পারে। সুতরাং বৎস, দয়া করে মাথাটা ঠাণ্ডা করো।

আমি থ ততক্ষণে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলুম বুড়োর দিকে।

কর্নেল বললেন-সম্প্রতি এই পূর্বাঞ্চলে অরুণাচল প্রদেশের চৌখাম আদিবাসীরা দুটো অদ্ভুত প্রাণীকে পাকড়াও করেছে। এই জঙ্গল লোহিত জেলার পাহাড়ি এলাকার খামতি উপত্যকায় রয়েছে।

এবার মুখ খুললুম।-হ্যাঁ। আমরা বক্স করে সে খবর ছেপেছি। দশ ফুট উঁচু দুটো জানোয়ার-দেখতে অবিকল নাকি মানুষের মতো। একটা পুরুষ অন্যটা স্ত্রী। বিশেষজ্ঞরা তাদের পরীক্ষা করে দেখছেন। কেউ বলছেন, এক জাতের গেরিলা—কেউ বলছেন, একরকম ভালুক। কারও মতে এরাই হচ্ছে সেই ইয়েতি বা তুষার দানব। কোনও কারণে তুষার এলাকা থেকে চলে এসেছিল।…

—দ্যাটস রাইট, জয়ন্ত। বলে কর্নেল তাঁর পকেট থেকে একটা কাগজের কাটিং বের করলেন। পড়তে থাকলেন সেটা।….. ১৯৫৭ সালে জুগন হিমল থেকে টম স্লিক এভারেস্টের পূর্বে তিনশো মাইল এলাকা ইয়েতির খোঁজে তোলপাড় করেন। ককেশাস অঞ্চলে ১৯৪৬ সালে এক রুশ অভিযাত্রীদল ইয়েতির খোঁজে বেরিয়ে একটা একশো বছরের পুরনো বিশাল কঙ্কাল আবিষ্কার করেন। রুশ বিশেষজ্ঞদের মতে ককেশাসে এখনও ইয়েতি আছে। ১৯৬৯ সালের জুনে থাই-বর্মা-লাওস সীমান্তে মেকং নদীর ধারে দুটো অতিকায় মনুষ্যাকৃতি প্রাণী দেখা গিয়েছিল। দর্শক ছিল অনেক। প্রাণীরা তাদের দিকে পাথর ছুড়েছিল। রেঙ্গুনের এক দৈনিক পত্রিকায় খবরটি বেরোয়।

বাধা পড়ল সান্যাল সায়েবের কথায়-কর্নেল, ও তো কাগজের খবর। আমার পার্টনার বন্ধু আগরওয়ালসায়েব কী বিবরণ দিয়েছেন আপনাকে জানি না। তবে…

পাল্টা বাধা দিয়ে কর্নেল গম্ভীর হয়েই বললেন—হ্যাঁ। সেটা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ বলা যায়। তাই শুনেই আমি উৎসাহ দেখিয়েছি। সত্যি বলতে কী, ওঁর কথায় এতটুকু গরমিল অথবা সন্দেহ। করার মতো কিছু খুঁজে পাইনি মিঃ সান্যাল।

হংসধ্বজ হেসে উঠলেন। বললেন—এবার আমার দিক থেকে ব্যাপারটা শুনুন কর্নেল। গত ২৫শে মে অরুণাচলের উপজাতি অধ্যুষিত খামতি এলাকার জঙ্গলে আমি ও আগরওয়াল ক্যাম্প করে দিন-রাত্রিটা কাটাই। আমাদের সার্ভেয়ার টিম পাহাড়ের তলায় খোঁড়াখুঁড়ি করছিল। ওখানে সাতশো একর মতো জায়গা আমরা সরকারের কাছে লিজ নিয়েছি। সেখানে সীসের খনি আছে বলে আমাদের ধারণা। যাই হোক, হঠাৎ অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায়। নাকে কেমন একটা বিকট গন্ধ লাগে। ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছিল। সার্ভেয়ার কুলিকামিনরা আশেপাশে তাঁবুতে ঘুমোচ্ছিল। আমাদের তাবুতে পাশাপাশি দুটো ক্যাম্পখাটে আমি ও আগরওয়াল। গন্ধটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল তাবুটার ওপর কোনও জন্তু চাপ দিচ্ছে। টর্চ নেব এবং আগরওয়ালকে ডাকব ভাবছি, কিন্তু কোন ফুরসত পেলুম না। আচমকা কী একটা জন্তু আমার ঝাপিয়ে পড়ল। আমার বুকে বসে সেটা মানুষের মতো দুহাতে আমার গলা টিপে ধরল। দম আটকে গেল। কিন্তু ঝাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়েছিলুম একটুখানি, সেটা পাশের ক্যাম্পে কেউ কেউ শুনতে পায়। তার ফলে তক্ষুনি হল্লা শুরু হয়। বন্দুকের আওয়াজ করা হয়। ওরা তো জানে না, আমার তাঁবুতেই কী ঘটেছে। আগরওয়াল বোকার মতো দৌড়ে বেরিয়ে যায়। তার পাশেই আমি আক্রান্ত ও বুঝতে পারেনি। আমার ধারণা ওই, হল্লা ও আওয়াজে ভয় পেয়ে জন্তুটা আমাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে সবার বীরত্ব উবে যায়। আন্দাজ সাতফুট উঁচু-বরফের মতো সাদা উলঙ্গ প্রকাণ্ড ওই মূর্তি দেখলে তা অস্বাভাবিক মনে হয়। যাই হোক, সে যখন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, তখন একজন সার্ভেয়ার গুলি ছোড়ে। আশ্চর্য! দানবটা ঘুরেও তাকায় না। জঙ্গলে উধাও হয়ে যায়। তখন দুঃসাহসী আগরওয়াল তার পিছনে দৌড়ে যায়।

কর্নেল বললেন—দানবটা বাইরে যাওয়ার পর আপনি কি দেখেছিলেন ওটাকে?

হংসধ্বজ বললেন—না। কারণ, আমি বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারিনি। অজ্ঞান হয়ে গেছলুম।

—তবে কেমন করে জানলেন যে ওটা প্রকাণ্ড এবং বরফের মতো সাদা?

—আমার লোকেরা বর্ণনা করেছে।

—হুম! আগরওয়াল সায়েব আমাকে যা বলেছেন—তা আপনার বর্ণনার সঙ্গে এক। উনি কিছুদূর তাড়া করে ফিরে আসেন। পাহাড়ের আড়ালে ওটা অদৃশ্য হয়।

বলে কর্নেল চুরুট বের করে জ্বেলে নিলেন। তারপর ফের বললেন—আগরওয়াল সাহেব ফিরে এসে আপনাকে অজ্ঞান দেখেন। তখন লোকজনকে খুব বকাবকি করেন। তাদের অবশ্য দোষ ছিল না। ওই বিস্ময়কর প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটা প্রত্যক্ষ দেখে সবাই আতঙ্কে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা মিঃ সান্যাল, যে সার্ভেয়ার ভদ্রলোক গুলি ছুড়েছিলেন, তিনি কি এখনও আছেন ওখানে?

হংসধ্বজ মাথা নাড়ালেন।—সে একটা দুঃখের ব্যাপার কর্নেল। ভদ্রলোক ওই ভয়ানক প্রাণীটা দেখার পর থেকে কেমন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর চাকরি ছেড়ে চলে যান। খুব অভিজ্ঞ খনিতত্ত্ববিদ ছিলেন। ধাতুবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ বটে। কী করি? থাকলেনই না যখন, আটকালুম না। আর শুধু উনি একা নন—সার্ভেয়ার গ্রুপের বাকি সবাই চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছে। এলাকার কুলিকামিনারও পালিয়েছে। অবশেষে নতুন সার্ভেয়ার গ্রুপ এবং কুলিকামিন সংগ্রহ করেছি আমরা।

আমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলুম ভেতরে ভেতরে। তাহলে সেই রহস্যময় ভয়ঙ্কর দানবের খোঁজেই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এখানে চলে এসেছেন? উত্তেজনা দমন করলুম। অরুণাচলে ইয়েতি নামে একটা সম্ভাব্য রিপোর্টাজ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দৈনিক সত্যসেবকের বিক্রিসংখ্যা আবার একদফা বেড়ে যাবে।…

সন্ধ্যায় এসে পৌঁছলেন হরিহর আগরওয়াল। বয়সে হংসধ্বজেরই কাছাকাছি। আয়তনে একটু মোটা এই যা। রংটা ধবধবে ফর্সা। খুব হাসিখুশি মানুষ। দুজনে ছাত্রজীবন থেকেই বন্ধু। চা বাগিচা ও একটা খনিতে দুজনের অংশীদারীত্ব সমান সমান। চমৎকার বাংলা বলতে পারেন আগরওয়াল। অবাঙালি বলে চেনা কঠিন। এসে জানালেন—নতুন সার্ভেয়ার গ্রুপ এবং লোকজন অলরেডি চলে গেছে। কাজ শুরু হয়েছে। শীগগির পৌঁছনো দরকার। নয়তো তারাও পালাবে।

পরদিন সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হল। ট্রেনে লামডিং, ডিমাপুর হয়ে তিনসুকিয়া এবং তারপর ডিব্ৰুগড়। সেখান থেকে আবার ট্রেনে ডাঙ্গোরি। ডাঙ্গোরি থেকে জিপের ব্যবস্থা করা ছিল। লোহিত নদী পেরিয়ে মদিয়া নামে একটা জায়গায় পৌঁছলুম—সেখানেই সভ্যজগতের সীমানা শেষ হয়েছে। দুটো দিন দুটো রাত কেটে গেল রাস্তায়। মদিয়া থেকে দুর্গম পাহাড় ও জঙ্গল শুরু। রাস্তা বলতে তেমন কিছু নেই। আমাদের জিপ কিন্তু হেলেদুলে নির্ভয়ে চলতে থাকল।

খামতি পৌঁছলুম সন্ধ্যা নাগাদ। তখন শরীর একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। নার্ভও বিপর্যস্ত। কর্নেল বুড়ো কিন্তু আশ্চর্য নির্বিকার। সারাপথ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন। এই সব অঞ্চলেই নাকি উনি ছিলেন এবং সব নখদর্পণে। এমনকি অনেক পাহাড়ি সর্দারের সঙ্গে ভাব হয়েছিল-কনেলের বিশ্বাস, দেখলে তারা এখনও চিনতে পারবে।

একটা সুদৃশ্য উপত্যকায় সান্যালসায়েবদের লোকেরা কাজ করছে। ছোট নদী আছে। তার দুধারে নিবিড় জঙ্গল। জঙ্গলের একদিকে খনি খোঁড়ার এবং মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। তাঁবুগুলো একটা টিলার গায়ে। কাজের চেয়ে হল্লাটা খুব বেশি মনে হল। সম্ভবত ইয়েতির আতঙ্কে সবাই জড়োসড়ো। এখানে ওখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তার ওপর এখন নিজেদের জেনারেটর থেকে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আলোয় জায়গাটা দিনের মতো ফর্সা হয়ে রয়েছে। মনে হল, ইয়েতির কর্তাবাবার সাহস হবে না, আবার এখানে এসে ঢু মারে। কর্নেল জায়গাটা দেখতে দেখতে একটু হেসে ঠিক তাই বলে উঠলেন।

খাওয়ার পর ক্যাম্পচেয়ারে বসে সবাই যখন গল্পগুজব শুরু করেছে, আমি তখন তাবুর ভেতরে গড়িয়ে পড়েছি। শরীর একেবারে অচল। ঘুম পাচ্ছে প্রচণ্ড আতঙ্কও হচ্ছে—যদি ইয়েতি এসে আমারও গলা চেপে ধরে।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে অব্দি বাইরে ওদের কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলুম। কর্নেল বলছিলেন—ইয়েতির চামড়া কেমন মনে হয়েছিল বললেন মিঃ সান্যাল? খসখসে-শক্ত, তাই না? দ্যাটস পসিবি।

হংসধ্বজবাবুর গলা শুনলুম।-হ্যাঁ, খসখসে, শক্ত! কেমন যেন প্লাস্টার আঁটা মানুষের মতো।…

তারপর ঘুমিয়ে গেছি। এমন গভীর ঘুম জীবনে ঘুমোইনি। ইয়েতি এলে দিব্যি আমাকে মেরে যেতে পারত। ঘুম যখন ভাঙল, অভ্যাসমতো হাতঘড়ির দিকে তাকালুমছটা। কিন্তু প্রচুর রোদ ফুটেছে বাইরে। অরুণাচল কি না। তখন নিজের ঘুমের প্রতি ব্যাজার হলুম। এমন ঘুম তো কলকাতায় দেখি না আসতে! এই ইয়েতির জঙ্গলে এত ঘুম!

পাশের ক্যাম্পখাটের দিকে তাকিয়ে দেখি বুড়ো নেই। উঠে পড়লুম। বাইরে যেতেই দেখা হল হংসধ্বজের সঙ্গে। বললেন—গুড মর্নিং মিঃ চৌধুরি!

—গুড মর্নিং! কর্নেল কোথায়?

-উনি তো পাঁচটায় বেরিয়েছেন। ওরা নিষেধ করেছিল—শোনেননি। এখন আগরওয়াল ওঁর খোঁজে গেল। … উদ্বিগ্ন মুখে হংসধ্বজ একথা বললেন।

আমি হেসে বললুম—ভাববেন না। ওঁর নানান বাতিক। সঙ্গে অদ্ভুত ক্যামেরা দেখেছেন? বাইনাকুলারটাও আশা করি দেখেছেন? হয়তো দেখবেন, ইয়েতির ছবি তুলে নিয়েই ফিরে আসবেন।

হংসধ্বজ তবু আশ্বস্ত হতে পারলেন না। বললেন—এলাকার উপজাতীয় কোনও কোনও গোষ্ঠী এখনও খানিকটা বন্য স্বভাবের এবং হিংস্র। সভ্য মানুষ দেখলে মেরে ফেলে। তাছাড়া বৈরী নাগারাও থাকতে পারে! বেশিদূর গিয়ে পড়লে……

বাধা দিয়ে বললুম— কর্নেল তো বলেছিলেন, এলাকা ওঁর চেনা। ভাববেন না। ওই বুড়োকে তো আমি চিনি।

চা-ব্রেকফাস্টের পর আমাকে হংসধ্বজ ওঁদের খনির কাজ দেখাতে নিয়ে গেলেন। সব ঘুরে দেখতে দশটা বেজে গেল। তারপর কর্নেল ফিরলেন। সঙ্গে আগরওয়ালও আছেন। আগরওয়াল এসেই বললেন—সান্যাল! ইউরেকা! এইজন্যেই তো আমি তোমাকে বলেছিলুম-কর্নেল সায়েব ছাড়া এই ইয়েতি রহস্য ফাঁস করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ক্ল পাওয়া গেছে।

হংসধ্বজ অবাক হয়ে বললেন তার মানে?

–কর্নেল এই ইয়েতির পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন। আমিও গিয়ে স্বচক্ষে দেখলুম। একেবারে মানুষের মতো!

কর্নেল একটু হেসে বললেন—না, কতকটা মানুষের মতো!

হংসধ্বজ উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করলেন—কোথায় দেখলেন? কত দূরে? কাছাকাছি নাকি?

—খুব বেশি দূরে নয়। ওই নদীর বালিতে—মাত্র তিনশো গজ দূরে।

হংসধ্বজের মুখ সাদা হয়ে গেল।—সর্বনাশ! বলেন কী!

আগরওয়ালকে দেখে মনে হল, ভয় পাননি। বললেন—শুধু তাই নয়। ওই পায়ের ছাপ অনুসরণ করে আমরা ওপারের পাহাড়ের একটা গুহার সামনে পৌঁছলুম। গুহায় অবশ্য ঢুকতে সাহস পাইনি। পরে লোকজন নিয়ে ঢুকব বলে দুজনে বড় একটা পাথর ঠেলাঠেলি করে মুখটা বন্ধ করে লেমু। সান্যাল, অবিকল সেই রাতের মতো বিটকেল গন্ধও আমি টের পেয়েছি সেখানে।

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন—আমি অবশ্য পাইনি।

আমি বললুম-ইয়েতির কাছে ওই পাথরটা কি বাধা হবে মনে করেন কর্নেল?

ও তো এক ধাক্কায় গুহার দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে আসবে।

কর্নেল মাথা নাড়লেন আবার।—ইউ আর রাইট, জয়ন্ত।

—তাহলে পাথর ঠেলাঠেলি করতে গেলেন কেন, শুনি?

—আগরওয়াল সায়েব জেদ করলেন, তাই।

আগরওয়াল ব্যস্তভাবে বললেন-কর্নেল! পাথরটা কিন্তু এমনভাবে খাঁজে আটকে দিয়েছি আমরা যে গুহার ভেতর থেকে ঠেলে সরানো অসম্ভব।

কর্নেল তাঁর দিকে ঘুরে বললেন—ইউ আর রাইট।

আমি হতভম্ব। আমাকেও রাইট বললেন, আবার আগরয়ালকেও রাইট বলেন? অর্থাৎ ইয়েতিটা গুহার মুখের পাথর ঠেলে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং পারবে না—এমন পরস্পরবিরোধী কথা কেন বললেন কর্নেল? বুড়িয়ে বাহাতুরে ধরেছে নির্ঘাৎ। মনে মনে হাসলুম—আবার উদ্বিগ্নও হলুম।

হংসধ্বজ ভয়ে ভয়ে বললেন—আপনি কি মনে করেন, সত্যি গুহার মধ্যে ইয়েতি আছে?

কর্নেল আবার মাথা নাড়লেন।—জানি না। তবে পায়ের ছাপ আমরা গুহার ভেতর অব্দি দেখেছি। এটুকুই বলতে পারি। যাইহোক, আপনারা তোক জোগাড় করুন। দুঘন্টার মধ্যে আমরা বেরোব…..

একটু পরেই দেখি, খবরটা কীভাবে পাচার হয়ে গেছে। ইতস্তত জটলা এবং আলোচনা চলছে। কুলিকামিন, সার্ভেয়ার গ্রুপ সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। হংসধ্বজ এবং আগরওয়াল বেগতিক দেখে সবাইকে সাহস দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেই ফাঁকে কর্নেল আমার হাত ধরে টানলেন। তারপর একটা গাছের তলায় গিয়ে চাপা এবং গম্ভীরস্বরে বললেন—জয়ন্ত! এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছি এখানে এসে। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু এখানে এসে যা বুঝতে পারছি তাতে….

বাধা দিয়ে বললুম– পুরো ব্যাপারটা গুল?

– স্রেফ গুলই বা বলি কী করে? আগের লোক যারা জনাকতক এখনও দলে রয়েছে, সকালে তাদের প্রত্যেকের কাছে ঘটনাটা জেনেছি। সবাই ইয়েতিকে দেখেছে। বিরাট সাদা মূর্তি। দুহাত সামনে ঝুলিয়ে হেঁটে গেছে। সে-রাতে ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছিল। দেখতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অথচ আমার ইনটুইশন বলছে—জয়ন্ত, আমার সেই বিস্ময়কর ইনটুইশনের কথা স্মরণ করো—যা থেকে আমি আবহাওয়ায় কোনও হত্যাকাণ্ডের গন্ধ টের পাই।

ভয় পেয়ে বললুম-সে কী; আপনার মনে হচ্ছে এখানেও কোনও হত্যাকাণ্ড হবে?

—হবে, জয়ন্ত। আই জাস্ট স্মেল ইট। কিন্তু কীভাবে হবে—কে খুন করবে, কেই বা খুন হবে—কিছু জানি না। কিছু বুঝতে পারছি না। আমি নিজেকে এক অসহায় দেখছি—কহতব্য নয়।

উদ্বিগ্ন মুখে বললুম—হংসধ্বজ আর আগরওয়ালের মধ্যে পার্টনারশিপের ব্যাপারে কোনও রেষারেষি নেই তো?

—কোনও প্রমাণ পাইনি। কলকাতায় আগে ওঁদের কনসার্ন সম্পর্কে খোঁজখবর স্বাভাবিক কৌতূহলবশতই নিয়ে এসেছি। দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বললে ভুল হয়—একেবারে একাত্মা। একসঙ্গে খায় ও ঘুমোয়। দুজনেই বাবার ত্যাজ্যপুত্ৰ-ঘরপালানো দুঃসাহসী ছেলে। যা কিছু সম্পত্তি করেছে সব নিজের উদ্যমে। তাছাড়া, যা বুঝেছি—এইসব সম্পত্তি অর্জন, ওদের কাছে নেশার মতো। উদ্দেশ্যহীন। জীবনে এমন অনেক মানুষ আছে জয়ন্ত—যারা নেশার ঘোরে নানা কাজ করে বেড়ায়। টাকার মালিক হওয়াটাই তাদের সুখ নয়—সুখ বিচিত্র সব কাজে। এমন মানুষ এই দুই বন্ধু। এদের মধ্যে এমন কি ঘটতে পারে, আমি জানি না—যাতে কেউ কাউকে খুন করতে চাইবে?

আমি চুপ করে থাকলুম। বুড়োর এ স্বভাবের কথা জানি। কেউ কোনও ব্যাপারে ডাকলেই উনি তার সম্পর্কে বিশদ হালহদিশ না জেনে এগোবেন না। ইয়েতিই হোক, আর বাড়িতে ভূতের ঢিল। পড়ুক কিংবা চুরি-ডাকাতিই হোক—মক্কেলের আতিপাতি জানা চাই।

কর্নেল টুপি খুলে টাকে বাতাস লাগাচ্ছিলেন। হঠাৎ বললেন—এস জয়ন্ত, আমরা সার্ভেয়ার গ্রুপের হেড ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করি। উনি শুনেছি ভারতের শ্রেষ্ঠ ভূতত্ত্ববিদদের অন্যতম। অনেক চড়া দামে ওকে হংসধ্বজবাবুরা কমাসের জন্য এনেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার আজকাল এসব ব্যাপারে এক্সপার্টদের সহায়তা পাইয়ে দিচ্ছে—তাই ওঁকে পেতে অসুবিধে হয়নি। তুমিও কোথাও খনিটনির সম্ভাবনা খুঁজে বের করো না! সরকার তোমাকে সবরকম টেকনিক্যাল নো-হাউ দিয়ে সাহায্য করবে। করবে নাকি জয়ন্ত?

কথাটা বলে কর্নেল হাসতে হাসতে পা বাড়ালেন। কিন্তু হাসিটা কেমন শুকনো মনে হল।…

 

দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যেই হংসধ্বজ আর আগরওয়াল প্রায় একশো লোকের একটা অভিযাত্রী বাহিনী গড়ে তুললেন। অধিকাংশই ওই অঞ্চলের অধিবাসী। তারা যেমন দুঃসাহসী, তেমনি গোঁয়ার মানুষ। অস্ত্রশস্ত্র প্রত্যেকের হাতেই রয়েছে। বন্দুকও মোট পাঁচটি। আমি ও কর্নেল সঙ্গে এনেছিলুম শিকারের রাইফেল। হংসধ্বজ ও আগরওয়ালেরও শিকারের রাইফেল আছে। হেড সার্ভেয়ার মিঃ পরেশ পুরকায়স্থের নিজস্ব রাইফেল রয়েছে। তাছাড়া আমাদের প্রত্যেকের একটা করে রিভলবারও আছে। কাজেই আয়োজন খুব সাংঘাতিক হল। দেখলুম স্থানীয় লোকেরা ঢাকও নিয়েছে কয়েকটা। শিঙাও আছে গোটা দুই।

এছাড়া কয়েক টিন পেট্রোল আর ফার্স্ট এডের সরঞ্জামও নেওয়া হল। সার্ভেয়ার গ্রুপের সঙ্গে একজন ডাক্তারও ছিলেন এখানে। ব্রজবিলাস বর্মন আমাদের লোক। তিনি বড় ভীত মনে হল। মুখ পাংশু। ভিড়ের ভিতর ঢুকে অনিচ্ছায় পা বাড়ালেন।

রীতিমতো ইয়েতি অভিযান। সব খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। জব্বর রকমের রিপোর্টাজ লিখতে হবে কাগজের জন্যে।

একঘন্টা কষ্টকর যাত্রার পর প্রায় দুর্গম এক পাহাড়ের গুহার সামনে আমরা পৌঁছলুম। কর্নেলকে দেখলুম, যেন মোটেও নেতৃত্ব নিতে রাজি নন। সব আগরওয়ালের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। অনেক জল্পনার পর ব্যুহ সাজানো হল কয়েকটা। গুহামুখ থেকে তিরিশ গজ দূরে একটা ঝোপের আড়ালে হংসধ্বজের নেতৃত্বে একদল ওত পেতে বসল। দুটো দল যথাক্রমে হেড সার্ভেয়ার পরেশবাবু ও ভীতু ডাক্তারের নেতৃত্বে ডাইনে ও বাঁয়ে পাথরের আড়ালে বসল। চতুর্থ দল গুহামুখের উপরে পাহাড়ে গেল। সেখানে গাছ ও পাথরের আড়ালে তারাও বসল। চতুর্থ দল গুহামুখের উপরে পাহাড়ে গেল। সেখানে গাছ ও পাথরের আড়ালে তারাও বসল। তাদের নেতাকে আমি চিনি না—মনে হল সার্ভেয়াদের কেউ। পঞ্চম দলে আমি ও কর্নেল–সঙ্গে কুড়িজন উপজাতীয় কুলিকামিন। আমরা চলে গেলুম পাহাড়ের পিছনের দিকে–একটা ফাটলে গিয়ে ঠাসাঠাসি বসে পড়লুম। ফাটলটা ভূমিকম্পের ফলে হয়েছে। আন্দাজ হাত ছয়েক চওড়া। অনেক ছোট বড় পাথরে ভর্তি। ইয়েতি তাড়া করলে নির্ঘাত মারা পড়তে হবে। এখানে বসার কারণ, গুহার অন্যমুখে ইয়েতি বেরোলে আমরা তাকে আক্রমণ করব। কিন্তু তাকে প্রাণে মারা চলবে না। ঠ্যাং খোঁড়া করে কাবু করতে হবে, অর্থাৎ জ্যান্ত ধরারই প্ল্যান করা হয়েছে।

কথা হয়েছে, গুহার মুখে শুকনো লকড়ি ঠেসে দিয়ে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন ধরানো হবে। ধোঁয়া দেখলেই আমরা প্রত্যেকটি দল সতর্ক হব।

হঠাৎ দেখি কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দলের একজনকে ডেকে হিন্দিতে বললেন—নাতানুক! তুমি ওদের লিডার হও। আমি আর এই জয়ন্তবাবু নীচের দিকে গিয়ে বসি। না না—আমরা দুজনই যথেষ্ট। মনে রেখো, তুমিই লিডার নাতানুক?

নাতানুক নামে লোকটা প্রৌঢ়। দারুণ শক্ত সমর্থ চেহারা–বেঁটে খাটো, থ্যাবড়া নাক, কুতকুত চোখে হাসি। বুঝলুম ও খুশি হয়েছে। কুলিদের সর্দার সে। সায় দিয়ে একটা ধারালো প্রকাণ্ড দায়ের মুঠো যেভাবে চেপে ধরল, মনে হল ইয়েতির একটা ঠ্যাং সে কাটবেই। আমরা পিছনের দিকে দ্রুত এগোলুম। অবশ্য আমি কর্নেলের মতলব একটুও টের পাচ্ছি না। পাথরের বাধা পেরিয়ে অনেক কষ্টে ওঁকে অনুসরণ করছি। মনে প্রচণ্ড উত্তেজনা। তাহলে সেই কিংবদন্তিখ্যাত রহস্যময় তুষারদানব সত্যি কি স্বচক্ষে দেখার অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চলেছি? আমার সঙ্গে ক্যমেরাও আছে। ফিল্ম রেডি। শুধু শাটার টেপার ওয়াস্তা। এই প্রথম দৈনিক সত্যসেবকের পাতায় সত্যিকার ইয়েতির ছবি দেখা যাবে। হে ঈশ্বর, সদয় হও!

কিন্তু কর্নেল থামবার তালে নেই। কোথায় যাচ্ছেন উনি? ফাটলের শেষে একটা ভোলা জায়গায় পড়লুম। অমনি পাহাড়ের অন্যদিক থেকে ভেসে এল তুমুল চিৎকার ও বন্দুকের শব্দ। তারপর ধোঁয়া দেখতে পেলুম। কর্নেল বলে উঠলেন—জয়ন্ত! কুইক, ওই পাথরের আড়ালে চলো।

প্রকাণ্ড পাথরের পিছনে গিয়ে বসলুম দুজনে। চেচামেচির সঙ্গে ঢাকের আওয়াজ ও বন্দুকের শব্দ বাড়তে থাকল। রুদ্ধশ্বাসে মুহূর্ত গুনছি। জানি না ইয়েতিটা কোনদিকে বেরোবে। পাহাড়ের উপর আকাশে মেঘের মতো ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি।

তারপর আমার পাঁজরে খোঁচা দিলেন কর্নেল। তাকিয়েই আমি হতবাক, চোখ নিস্পলক। ক্যামেরার কথা ভুলেই গেলুম। দিন দুপুরের ঝলমলে রোদে এদিকটা ভরে আছে। পাহাড়ের এ-পিঠ সম্পূর্ণ ন্যাড়া। উপরের একটা খাঁজের তলায় দাঁড়িয়ে আছে …

হ্যাঁ, সেই কিংবদন্তিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক তুষার মানব অথবা দানব। সেই রহস্যময় ইয়েতি! বিশাল উঁচু ও চওড়া দেহ। উলঙ্গ। সম্পূর্ণ সাদা। চামড়া যেন ভাঁজবহুল। হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম। স্বপ্ন দেখছি না তো? আমাদের মাথার উপর পাথরের চাতালে আন্দাজ কুড়িফুট দূরত্বে প্রাণীটা দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। লাফ দিলেই আমাদের উপর এসে পড়বে।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর কর্নেল আচমকা হাততালি দিলেন। আর অমনি ইয়েতিটা আমাদের দেখতে পেল। তারপর চাতালের অন্যদিকে সরে গেল। আমি রাইফেল তুললেই কর্নেল বললেন—ক্যামেরা জয়ন্ত, ক্যামেরা!

তখন রাইফেল নামিয়ে ক্যামেরা তুলে পটাপট কয়েকটা ছবি নিলুম। ততক্ষণে ইয়েতি লাফ দিয়েছে। চাতাল আছে ধাপে ধাপে। কয়েকটি লাফে আমাদের পাথরটার আড়ালে যেতেই কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠলুম। দেখলুম, ইয়েতিটা সমতলে পড়ে দৌড়চ্ছে। একেবারে মানুষের মতো দৌড়চ্ছে। কর্নেল দৌড়তে শুরু করলেন তার পিছনে। আমি একটু ইতস্তত করে তাকে অনুসরণ করলুম। চেঁচিয়ে উঠলুম-সাবধান কর্নেল।

গাছপালার মধ্যে তখন ঢুকে পড়েছে জন্তুটা। কর্নেল কি পাগল? তিনি পিছনে দৌড়চ্ছেন—আমিও বোকার মতো দৌড়চ্ছি। হাঁফাতে হাঁফাতে বললুম, গুলি করুন। কর্নেল, গুলি!

কর্নেল আমাকে বোকা বানিয়ে জোরে হেসে উঠলেন এবং চাপা গলায় ইয়েতিটার উদ্দেশে বললেন—আমরা আপনার বন্ধু মিঃ সান্যাল! প্লিজ, একটু দাঁড়ান। আপনার কোনও ভয় নেই।

আমাদের চারপাশে ঘন জঙ্গল। ছায়া আছে। ইয়েতিটা তক্ষুণি দাঁড়িয়ে গেল। ঘুরে মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে উঠল—কে আপনারা?

কর্নেল অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন—আমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইনি কলকাতার দৈনিক সত্যসেবকের প্রখ্যাত রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরী। আর জয়ন্ত, ইনিই হলেন আদি ও অকৃত্রিম মিঃ হংসধ্বজ সান্যাল।

আমি আকাশ থেকে পড়লুম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলুম। কর্নেল বললেন—আপাতত মিঃ সান্যাল, আপনার গায়ের প্লাস্টারগুলো আগে ছাড়িয়ে ফেলা দরকার। আপনার আর ইয়েতি সাজবার কোনও কারণ নেই। আমি সব টের পেয়েছি।

ইয়েতি ক্লান্তস্বরে বললেন—কিন্তু আগরওয়াল আর ওই শয়তান প্রতারকটার কী হবে? ওদের যে আমি শাস্তি দিতে পারলুম না! বরং আমাকেই ওরা পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করল।

কর্নেল হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন—সেজন্যে আইন আছে, মিঃ সান্যাল। এসব ব্যাপারে আপনি আমার ওপর নির্ভর করতে পারেন। কিন্তু প্রতিশোধ নিতে আপনি যে অভিনব পন্থা নিয়েছেন, তা মোটেও কাজের নয়; উল্টে আপনিই পুড়ে মরতেন।

এখন চলুন কোনও ঝরনায় গিয়ে সেখানে গায়ের প্লাস্টার খুলে আমরা তিনজনে কোনও উপজাতীয়দের গ্রামে যাব। সেখানে আপনাকে নিরাপদে রেখে আমরা দুজনে ফিরব। কথা দিচ্ছি, আগামিকাল যে কোনও সময় আমরা এসে আপনাকে নিয়ে যাব। ততক্ষণে আপনার পার্টনার আগরওয়াল এবং তার সহকারী জাল হংসধ্বজ সান্যালকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানবেন।…

 

তখন বিকেল হয়েছে।

দাফাং নামে একটা গ্রামের মোড়লের বাড়ি সত্যিকার হংসধ্বজবাবুকে রেখে আমরা ফিরলুম ক্যাম্পে। দেখি, সবাই কখন ফিরেছে। আমাদের দেখে আগরওয়াল ও জাল হংসধ্বজ দৌড়ে এলেন। কর্নেল ক্লান্ত স্বরে বললেন—ইয়েতিটার পিছনে অনেকদূর গিয়েছিলুম। গুলিও করলুম। কিন্তু আমাদের বরাত। পালিয়ে গেল।

কথামতো আমি ইনিয়ে বিনিয়ে সব ব্যাপারটা বানিয়ে শোনালুম। শুনে ওঁরা খুব নিরাশ হলেন। তারপর কর্নেলের পরামর্শমতো আমি কলকাতায় আমার কাগজে খবর পাঠাতে তক্ষুণি মদিয়া যেতে চাইলুম। জিপের ব্যবস্থা হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অনেক রাতে সেখানে সরকারি বাংলোর চৌকিদারকে ঘুম থেকে তুলিয়ে নিজের পরিচয় দিলুম। জিপের ড্রাইভারকে বললুম—আপাতত এখানেই রাত কাটাতে চাই। কাল সকালে আমরা ফিরব। সে রাজি হল। রাস্তা দুর্গম—তাতে বৈরী নাগাদের ভয় আছে। রাতে ফেরা নিরাপদ নয়।

সেই রাতেই কর্নেলের চিঠি নিয়ে থানায় যোগাযোগ করলুম। তারপর রাতটা বাংলোয় কাটিয়ে পরদিন সকালে ক্যাম্পে পৌঁছলুম। পুলিশ আসবে কথামতো দুপুরের মধ্যেই।

কিন্তু তখনও রহস্যের চাবিকাঠি কর্নেলের হাতে। এই ওঁর অভ্যাস।

কর্নেল কিছুক্ষণের জন্যে একবার একা জঙ্গলে ঘুরে এলেন। বিরল জাতের পাখি দেখতেই বেরিয়েছিলেন। আমি আগরওয়ালদের নানা কথায় ভুলিয়ে রাখলুম। তারপরে সবে লাঞ্চ সেরে কর্নেল ও আমি তাঁবুতে গড়াচ্ছি—পুলিশের জিপের আওয়াজ কখন শোনা যাবে সেই প্রতীক্ষা করছি—হঠাৎ আগরওয়ালের তাবু থেকে চাপা ধস্তাধস্তির শব্দ কানে এল। কর্নেল অমনি লাফিয়ে উঠে বললেন-কুইক জয়ন্ত! রিভলভার লোড করে নাও। চলে এস। দেখলুম উনিও রিভলভার হতে নিলেন! দুজনে দৌড়ে আগরওয়ালের তাঁবুতে গেলুম। কর্নেল পদা তুলেই গর্জে উঠলেন—মিঃ আগরওয়াল, দাঁড়ান!

উঁকি মেরে একপলকেই দেখলুম দৃশ্যটা। দুটো ক্যাম্প খাটের মাঝে মেঝেয় জাল হংসধ্বজকে ফেলে তার বুকে বসে আছেন আগরওয়াল। দুহাতে গলা টিপে ধরেছেন।

আগরওয়াল তখুনি উঠে কাঠ হয়ে দাঁড়লেন। কর্নেল বললেন—কাজে নেমে ঝগড়া মারামারি কাজের কথা নয় মিঃ আগরওয়াল। বখরা নিয়ে এসব ক্ষেত্রে খুনোখুনি হয়েই থাকে। তবে খুন করে ইয়েতির ঘাড়ে চাপানোের আর উপায় নেই মশাই!

আগরওয়াল ঘোঁত ঘোঁত করে বললেন—কী বলছেন, বুঝতে পারছি না।

–নিশ্চয় পারছেন। বিশেষ করে যখন সত্যি সত্যি ইয়েতির আবির্ভাব ঘটেছে। তখন সবাই টের পেয়ে গেছেন বই কি। নিশ্চয় আঁচ করেছেন, এই ইয়েতিটা আসলে কে!…কর্নেল একটু হাসলেন।—অবশ্য, আপনি যখন আমার কাছে ইয়েতির খবর নিয়ে যান, তখন একটুও ভাবেননি যে ওই ইয়েতিটা আপনার পার্টনার ও আজীবন বন্ধু হতভাগ্য হংসধ্বজ সান্যাল। তখন সত্যিকার ইয়েতির আতঙ্কেই আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু এবার যখন কথায় কথায় আমি এই জাল হংসধ্বজের কাছে জেনে নিলুম যে ইয়েতির গায়ের চামড়া খসখসে শক্ত এবং ভঁজবহুল—কতকটা প্লাস্টারের মতো, তখনই আপনি সন্দেহ করতে শুরু করেন। তারপর ওই গুহার দরজায় গতকাল সকালে আমার সঙ্গে গিয়ে ঠিক আমারই মতো এমন কিছু চিহ্ন আপনার চোখে পড়েছিল, যাতে ইয়েতিটা যে কে চিনতে আপনার দেরি হয়নি। তাই তাকে পুড়িয়ে মারতে ব্যবস্থা করলেন। সবই ঠিক ছিল। বাদ সাধলুম আমি। গুহার পেছন দিকটায় আমি থাকতে চাইলুম। তাতে আপত্তির কারণ ছিল না। কারণ ইয়েতি বেরোলে নাতানুক সর্দাররা ঝোঁকের বশে তাকে মেরেই ফেলত। আপনি কৌশলে ইয়েতির লাশটা নিশ্চয় আমার অগোচরে নষ্ট করার ব্যবস্থা করতেন। কিংবা একটা গল্প রটাতেন। যাই হক, এবার আপনি দ্বিতীয় খুনের উদ্যোগে ব্যস্ত ছিলেন। কারণ, এই জাল হংসধ্বজ সব টের পেয়ে আপনাকে ব্ল্যাকমেল শুরু করেছিলেন। গত রাতে সুবিধে হয়নি—কারণ জয়ন্ত ছিল না বলে আমি জাল হংসধ্বজকে শুতে ডাকলুম। তাই মরিয়া হয়ে আজ কাজে নেমেছিলেন।

জাল হংসধ্বজ উঠে বসেছিল। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—সবে ঘুম এসেছে। হঠাৎ দেখি ব্যাটা আমার বুকে চেপে গলা টিপে ধরেছে। উঃ! আগে যদি জানতুম ওর মতলবটা কী!

কর্নেল বললেন—হ্যাঁ। ওর তর সইছিল না। স্পষ্ট বোঝা যায়, এরপর আগরওয়াল চাদর মুড়ি দিয়ে লাশ ঢেকে রাখতেন। আমাদের বলতেন— সান্যাল অসুস্থ, বিশ্রাম নিচ্ছেন। তারপর রাতে হইচই করে রটাতেন যে ইয়েতিটা এসেছিল! সেই গলা টিপে মেরে গেছে। বাঃ! চমক্কার সুযোগ! কারণ, গুহায় তখন ইয়েতিটা মারা পড়েনি। অতএব কি না প্রতিশোধ নিয়ে গেছে। অপূর্ব, মিঃ আগরওয়াল!

পুলিশের জিপের আওয়াজ শোনা গেল এতক্ষণে!….

আমরা মদিয়ার ডাকবাংলোয় রাত কাটাচ্ছিলুম। কলকাতা ফিরে আসছি। অরুণাচলের ইয়েতি নিয়ে ভাবছি, কর্নেল বললেন—বৎস জয়ন্ত কি হতাশায় ভুগছ?

—অবশ্যই! ইয়েতি যে গুল, সাতকাহন লেখার মানে হয় না।

—কিন্তু তার বদলে সীমান্তে গুপ্তচর চক্ৰ উচ্ছেদের কী চমৎকার একটা খবর তোমরা এবার ছাপাবার সুযোগ পেলে দেখ!

অবাক হয়ে বললুম-গুপ্তচর চক্র! তার মানে? কোথায় গুপ্তচর?

কর্নেল দাড়ি চুলকে বললেন—ও, আই অ্যাম সরি। তোমাকে মূল ব্যাপারটা তো বলাই হয়নি।

—কিছু বলা হয়নি। কেনই বা জাল হংসধ্বজ—কেন এসব ঘটল…

—এক মিনিট। বলছি সব। বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। আরামে হাত পা ছড়িয়ে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন : হংসধ্বজ সান্যাল লোকটি সৎ-কিন্তু নির্বোধ। তাছাড়া তাঁর মাথায় কিঞ্চিৎ পাগলামিও আছে। নানান অদ্ভুত কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাও করেন না। দুর্গম এলাকায় খনি খোঁজা তাঁর বাতিক। নেফা এলাকায় তিনি সেই উদ্দেশ্যেই যাতায়াত করতেন। আর তাঁর বন্ধু। হরিহর আগরওয়াল তার উল্টো—অসম্ভব ধূর্ত। যেভাবে হোক, এই এলাকায় এসে আগরওয়াল হংসধ্বজের অগোচরে এক বিদেশি রাষ্ট্র ও বৈরী নাগাদের যোগাযোগের মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে। হংসধ্বজ আগে জানলে তাকে বাধা দিতেন। জানলেন সীসের খনি খুঁজতে এসে যখন ক্যাম্প করা হল, তখন। বিস্ময়ে দুঃখে হতচকিত হলেন হংসধ্বজ। বোঝানোর চেষ্টা করলেন বন্ধুকে। কিন্তু তখন আর আগরওয়ালেরও ফেরার পথ নেই। বৈরী নাগাদের যে গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ, তখন উল্টো গাইলে তারা তাকে মেরে ফেলবে—আবার হংসধ্বজকেও খুন করবে।

এদিকে হংসধ্বজ তাঁকে শাসাচ্ছেন-নাগাদের সঙ্গে আর এতটুকু যোগাযোগ রাখলে পুলিশকে জানাতে বাধ্য হবেন। অবশ্য সেটা নিছক হুমকি। এই সীসের খনি আর বন্ধুত্ব দুই-ই হংসধ্বজের কাছে মূল্যবান। আগরওয়াল দেখলেন, যেদিকে পা বাড়াবেন, সেদিকেই বিপদ। যদি চিরদিনের নির্বোধ ও ছিটগ্রস্ত এই বন্ধুটি সত্যি সত্যি ঝোঁকের বশে টহলদার পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কানে কথাটা তুলে দেন, সাংঘাতিক কাণ্ড হবে। শেষ অবধি আগরওয়ালের মাথায় খুন চড়ে গেল। ক্যাম্পে তখনও সার্ভেয়াররা পৌঁছায়নি। কেবল একদল কুলি জোগাড় করা হয়েছে। তারা স্থানীয় লোক। এসে হাজিরা দিয়েই নিজেদের গাঁয়ে ফিরে যায়। একরাতে আগরওয়াল ঘুমন্ত বন্ধুর বুকে বসে গলা টিপে ধরলেন। যখন দেহটা নেতিয়ে পড়ল, চুপিচুপি সেটা নিয়ে গিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে ফেলে দিলেন। রান্না ও অন্যান্য কাজের লোক জনা পাঁচ ছিল। তারা কেউ টের পেল না। সকালে রটিয়ে দিলেন, হংসধ্বজ রাতে মদিয়া গেছেন। ফিরতে দু একদিন দেরি হবে। ওদিকে একটা পাহাড়ের খাদে যেখানে দেহটা ফেলেছেন, তার নিচেই নদী। নদীতে গভীর বালি আছে। আশ্চর্য শক্ত প্রাণ হংসধ্বজের! পরদিন একদল উপজাতীয় শিকারি তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে যায় নিজেদের গাঁয়ে। সেবাশুশ্রুষা করে। তারপর সাত মাইল দূরে বাংলা মিশনারি হাসপাতালে রেখে আসে। এ ঘটনা ২০শে মে ঘটেছিল। ২৩শে মে ক্যাম্পে সার্ভেয়াররা আসে। কাজ শুরু হয়। কিন্তু রাঁধুনি চাকরবাকর সবাইকে রাতারাতি তখন সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা এই ভূতুড়ে বন-বাদাড় থেকে পালাতে পারলে বেঁচে যায়। সব ছিল সমতলের বাসিন্দা। নতুন রাঁধুনি ও চাকর-বাকর এনেছে আগরওয়াল। আর এনেছে ওই জাল হংসধ্বজকে। হংসধ্বজের উদ্যোগে এবং তাঁর পার্টপারশিপেই খনির লাইসেন্স, সরকারি লোন ও টেকনিক্যাল সহায়তার ব্যবস্থা। অতএব হংসধ্বজ একজন থাকা চাই পাশে। পরে যখন দরকার বুঝত, তখন সে জালটাকেও খতম করে দিত এবং ইয়েতির নামেই সেটা রটাত। এই জঙ্গলে মানুষ খুন করা এমন কিছু কঠিন নয়। যাই হোক, জাল হংসধ্বজকে নিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ চলছিল। ২৫শে মে রাতে হঠাৎ ক্যাম্পে ইয়েতির আবির্ভাব ঘটল। ভয় পেয়ে গেল আগরওয়াল।

ইয়েতিটা সেও স্বচক্ষে দেখল। একেবারে সত্যিকার আতঙ্ক। সার্ভেয়াররা পালিয়েছে। কুলিরা ভেগে গেছে। তাই সে কলকাতায় গিয়ে আমার শরণাপন্ন হল। কোন এক সূত্রে আমার সঙ্গে তার অল্পস্বল্প চেনা ছিল। আমি ইয়েতিটা ধরতে বা হত্যা করতে পারলে তার সীসের খনি এবং গুপ্তচরচক্র দুটোই বজায় থাকে।

এবার প্রশ্ন করলুম—ইয়েতির প্ল্যান হংসধ্বজবাবুর মাথায় এল কীভাবে?

কর্নেল হেসে উঠলেন। বললেন—মে মাসের মাঝামাঝি এই এলাকায় একজোড়া দশফুট উঁচু মানুষের মতো প্রাণী ধরা পড়ে উপজাতীয়দের হতে। সে খবর তোমরাও বক্স করে ছেপেছিলে। আসলে আমার ধারণা ও দুটো একজাতের ভালুক।

বললুম-হংসধ্বজবাবুর মাথায় তাহলে ওই থেকেই ইয়েতি সেজে প্রতিশোধের বাসনা গজায়?

কর্নেল আরও জোরে হাসলেন—ভদ্রলোক রীতিমতো পাগল। অনায়াসে কোনও সেনাবাহিনীর কাছে বা টহলদার পুলিশকে জানাতে পারতেন। তা না করে শত মাইল দূরের বাংলা মিশনারি হাসপাতাল থেকে সারা গায়ে প্লাস্টার জড়ানো অবস্থায় রাতারাতি উধাও হন। জঙ্গলে এসে সাদা কাপড়ে বাকি অংশও জড়ান। ওই বিকটমূর্তিতে হানা দেন ২৫ মে রাতে। ভাগ্যিস, গুলি ফসকেছিল ওদের। অথচ কাণ্ড দেখ, তবু দমে যাননি ভদ্রলোক। পাগল আর বলে কাকে? অবিবাহিত লোকেরা যত বয়স বাড়ে, তত অদ্ভুত হয়ে ওঠে। তুমি ভাগ্যিস বিয়েটা সেরে নিয়েছ জয়ন্ত।

হেসে বললুম—ওই পাহাড়ের গুহায় থাকতেন হংসধ্বজ। কিন্তু খেতেন কী?

—হ্যাঁ। গুহাটা থাকার উপযোগী। আর খেতেন চুরি করে।

—চুরি করে? সে কী?

—হ্যাঁ। রাতে উপজাতিদের গ্রামে হানা দিতেন চুপি চুপি। ওই বিকটমূর্তি দেখে অমন হিংস্র লোকেরাও গর্তে সেধিয়ে যেত কিনা। কুকুরগুলোও ভয়ে কাঠ হয়ে যেত। গোটা এলাকা জুড়ে এখন ইয়েতির খবর শুনতে পাবে। ভাগ্যিস সভ্য জগতের বাইরে পাহাড় জঙ্গল এলাকা। নয়তো ধুন্ধুমার পড়ে যেত। হাঁ-জয়ন্ত শোন! এই এলাকায় ইয়েতিকে বলে বুরু। মনে রেখো, বুরু। এই উপজাতীয়রা এত সাহসী ও হিংস্র মানুষ, অথচ তারা বুরুর নাম শুনলে কেঁচো হয়ে যায়।

একটু চুপ করে থেকে বললুম-গৌহাটিতে আমাদের জাল হংসধ্বজই রিসিভ করেছিলেন। এতটুকু টের পাইনি কিন্তু।

কর্নেল বললেন—না। আমার কেমন একটু লেগেছিল। গেটে নেমপ্লেটটা যেন সদ্য বসানো হয়েছে। টাটকা চকচকে পালিশ। তাছাড়া বাড়ির চাকরগুলোও মনে হল নতুন এসেছে। মনে একটা খটকা লেগেছিল বইকি। তখন থেকেই আমার তদন্ত শুরু।

—ওর আসল নাম কী?

—চন্দ্রনাথ সিং। পাঞ্জাবি।

লাফিয়ে উঠলুম-বলেন কী! এতটুকু ধরতে পারিনি কথাবার্তায়।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন—আমি পেরেছিলুম। তবে যা জাল তা সহজেই যদি জাল বলে ললাকে ধরতে পারে, তাহলে জাল হতে যাবে কোন দুঃখে? এটি খাঁটি জাল। তাই ধরা কঠিন ছিল।

একটু পরে আমি বললুম—আমার রিপোর্টাজের নাম তাহলে হওয়া উচিত ছিল অরুণাচলের বুরু। কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। চোখ বুজে কী ভাবছেন কে জানে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *