১৪. ধূমকেতু

অধ্যায় ১৪ ধূমকেতু

আমি যদি ধূমকেতু হতাম তাহলে বর্তমানকালের মানুষের অধঃপতিত জাতি গণ্য করতাম।

আগের যুগে ধূমকেতুর প্রতি শ্রদ্ধা সার্বিক ও গভীর ছিল। একটা ধূমকেতু সিজারের মৃত্যুর বার্তা বহন করেছিল। আর একটি ইঙ্গিত রেখেছিল যে, সম্রাট ভেসপাসিনের মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু এই সম্রাট নিজে সবল চিত্তের মানুষ ছিলেন। তাই দাবি করলেন, ঐ ধূমকেতু নিশ্চয় অন্য কোনো তাৎপর্য বহন করছে। সম্রাটের যুক্তি ছিল এ রকম: ধূমকেতুটি কেশাচ্ছন্ন, অথচ তিনি নিজে নিষ্কেশ। তবে কম লোকই এই ধরনের কঠোর যুক্তি কবুল করতে পেরেছিলেন। মাননীয় (The Venerable) বিড বলেছেন, ধূমকেতুরা রাষ্ট্রবিপ্লব, মড়ক, যুদ্ধ, বাতাস এবং উত্তাপের সূচনাবাহক। জন নকস ধূমকেতুর মধ্যে স্বর্গীয় ক্রোধের চিহ্ন দেখতে পেতেন, অন্যান্য স্কটল্যান্ডবাসী প্রটেস্টান্টরা ভাবতেন ধূমকেতু রাজাকে সতর্ক করে দিচ্ছে পোপের শিষ্যদের উচ্ছেদ করা হোক।

আমেরিকা, বিশেষ করে নিউ ইংল্যান্ড, ধূমকেতুর প্রতি উপযুক্ত মনোযোগ দিয়েছে। ১৬৫২ সালে আকাশে একটা ধূমকেতুর উদয় ঘটে যখন বিখ্যাত মি: কটন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর মৃত্যুর পর ধূমকেতুটা আড়ালে চলে যায়। দশ বৎসর পর নতুন ধূমকেতু অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় সুখ এবং লাম্পট্য ও ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক পরিধান করে ঈশ্বরের সৃষ্টি অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য বোস্টনের দুষ্ট অধিবাসীদের সর্তক করে দেয়। ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট বিখ্যাত Increase Mather-এর বিবেচনায় ধূমকেতু এবং সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হার্বাডের প্রেসিডেন্ট এবং ঔপনিবেশিক গবর্নরদের মৃত্যুর বার্তা বহন করে এনেছিল। তাই তিনি তার অনুসারীদের আদেশ করেন প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে যাতে তিনি আকাশের নক্ষত্ররাজির স্থলে ধূমকেতু না পাঠান।

এইসব কুসংস্কার ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হয় হ্যাঁলির এই আবিষ্কার দ্বারা যে অন্তত একটি ধূমকেতু গ্রহের মতো সূর্যের চারদিকে নিয়মমাফিক ঘোরে। নিউটন যখন ঘোষণা দিলেন ধূমকেতুরা মধ্যাকর্ষণ সূত্র মেনে চলে, সেটাও কুসংস্কার নিরসনে সাহায্য করে। পুরোনো ধ্যান-ধারণার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপকদের নিষেধ করা হয়েছিল তারা যেন কিছুকালের জন্য এসব নতুন তত্ত্বের উল্লেখ না করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য গোপন করে রাখা যায় নি। আজকের দিনে এমন জগতের কল্পনা করা দুরূহ যেখানে উচ্চ-নিচু, শিক্ষিত কি অশিক্ষিত ব্যক্তি ধূমকেতু নিয়ে মাতবেন এবং যখনই ধূমকেতুর আগমন ঘটে তখন আতঙ্কগ্রস্ত হবেন। আমরা অনেকেই ধূমকেতু একবারও দেখিনি। আমি দুটি ধূমকেতু দেখেছি। কিন্তু সে দুটি ধূমকেতু প্রত্যাশার কম হৃদয়গ্রাহী ছিল। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন এসেছে তার কারণ শুধু যৌক্তিকতা নয়; কৃত্রিম আলোকসজ্জাও এর কারণ। একটি আধুনিক শহরের রাস্তায় রাত্রিকালীন আকাশ দেখা যায় না। মফস্বল শহরে গাড়ির সম্মুখ-বাতি জ্বালিয়ে আমরা চলাফেরা করি। আমরা আকাশ মুছে দিয়েছি। এ-কালের গুটিকয় বিজ্ঞানীই শুধু নক্ষত্র, গ্রহ, উল্কা এবং ধূমকেতু সম্পর্কে সচেতন আছেন। অন্য যে-কোনো কালের চেয়ে আজকের আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের দুনিয়া অনেক বেশি মানুষের হাতে গড়া। এতে কিছুটা ক্ষতি এবং লাভও হয়েছে। মানুষ তার রাজ্যে নিরাপদ থেকে তুচ্ছ, উদ্ধত এবং কিছু পরিমাণে উন্মাদরোগগ্রস্তও হচ্ছে। তবে আমি মনে করি না যে ১৬৬২ সালে বোস্টন শহরে ধূমকেতু যে নৈতিক ক্রিয়া করেছিল, আজকের দিনে তা পারবে; এখন তা করতে গেলে আরো সবল ওষুধের দরকার করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *