২. বিউলির ডাল

২. বিউলির ডাল 

ভাদ্রের যে এমন নাভিশ্বাসের গরম আছে ইন্দুবালা আগে কখনও জানতেন না। কিংবা ঠাহর করতে পারেননি তেমন। বিয়ের পর ছেনু মিত্তির লেনে এসে বুঝতে পেরেছিলেন শহুরে দমবন্ধ করা পরিবেশ কাকে বলে। গায়ে গায়ে ঠেকানো বাড়ি। চৌকো খোলা ছাদ। বাড়ির ভেতর থেকে একটুস খানি আকাশ। কর্পোরেশান কলের ছিরছিরে জল। শ্যাওলা ওঠা স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। বড় সোঁদা সোঁদা গন্ধ। আশে পাশে কোনো নদী নেই। পুকুর নেই। তার বদলে বাড়ির সামনে আছে মুখ হাঁ করা বড় বড় নর্দমা। তার দুর্গন্ধ। হুল ফোঁটানো মশা। গা ঘিনঘিনে মাছি। আর সন্ধ্যে হলেই টিমটিমে বিজলিবাতি। এটাই নাকি কলকাতা। এখানে আসার জন্য মানুষ স্বপ্ন দেখে। গড় হয়ে প্রণাম করে না-দেখা কালীঘাটের মায়ের কাছে। বটতলায় সত্যপীরের সিন্নি চড়ায়। মুখের খাবার বন্ধক রাখে ঈশ্বরের কাছে। একবার কলকাতায় আসতে পারলে ট্রাম, বাস, মনুমেন্ট, ফেরিওয়ালার কাছে কাঁচের চুড়ি। এইটুকু সাধের জন্য এতটা কষ্ট করা? শ্বশুর বাড়ির কোনো এক সমবয়সী মেয়েকে কোনো একদিন হয়তো নিজের মনের এই কথাগুলো বলে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা তাঁর সহজ সরল ভঙ্গিতে। তাঁর গেঁয়ো বিদ্যে তখনও শহরের মানুষের জটিল কুটিল মনের তল পায়নি। পরে যে পেয়েছিল তেমনটাও নয়। সারা বাড়ি ছড়িয়ে ছিল কোনো এক গাঁয়ের মেয়ের কলকাতাকে দুর-ছাই করার সংবাদে। শাশুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিলেন “কোথাকার কোন রাজরাজেশ্বরী এল রে। পাকা দালান কোঠায় পা পড়ে না। শুনেচি তো সেখানে শেয়াল কুকুর ঘুরঘুর করতো”। তা ঠিক খুলনার কলাপোতায় সন্ধ্যে হলে বাঁশ বাগানে শেয়াল ডাকতো। তুলসী তলায় জোনাকিরা ভিড় করে আলো জ্বালাতো। মাথার ওপর সারা আকাশ জুড়ে থাকতো তারা। লণ্ঠন লাগতো না। ভাদ্রের এই সময়ে কাঠচাঁপার গন্ধে আকাশ-বাতাস ভরে যেতো। বিয়ের যেদিন সম্বন্ধ এলো অশ্বথ তলায় সেদিন অষ্টপ্রহর। রাজশাহী থেকে এসেছে কীর্তনের নাম করা সব দল। ছানা এসেছে খুলনা শহর থেকে। বড় ভিয়েন বসেছে সামনের বিশালাক্ষী তলার ভোগের ঘরে। এদিকে বাড়িতে ঠাম্মা বানাচ্ছে তুলতুলে নরম মোমের মতো তালের পিঠে। কলাপাতায় গরম গরম সেই ভাপ ওঠা পিঠে আজও যেন ইন্দুবালার চোখে জলছবি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ততক্ষণে অষ্টপ্রহরের মালসা-ভোগের দই চিড়ের জন্য মানুষের কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। ইন্দুবালার তাড়া আছে। সে মালসা ভোগও খাবে। তার সাথে বাড়িতে গিয়ে ঠাম্মার তৈরী তালের পিঠে। এদিকে দূর থেকে ধূর্জটি পিওন আসছে সাইকেলে চেপে। তারস্বরে চিৎকার করছে। বাবার নাম ধরে “ও ব্রজমোহন বাবু … শুনছেন…চিঠি আছে”। চিঠির কথায় ইন্দুবালা ফিরে তাকায়। একটু আড়াল নিয়ে দেখতে পায় বাবার হাতে একটা পোস্টকার্ড। ধূর্জটি পিওন বলে, “মাস্টারবাবু এত ঘনঘন চিঠি আসছে কেন বলুন তো? ইণ্ডিয়াতে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করলেন নাকি? এদিকে কি ছেলের অভাব ছিল? আমার ভাইপো তো এখন ঢাকায় সুতোর কলে কাজ করছে”। উত্তরে বাবা কিছু বলেননি। তাকিয়ে ছিলেন দূরে কপোতাক্ষের ওপার থেকে ভেসে আসা কালো মেঘের দিকে। তিনি জানতেন ওই মেঘে ধরা আছে বৃষ্টির জল। ঠিকঠাক বৃষ্টি হলে ক্ষেতের ফসল ভালো হবে। মেয়ের বিয়ের আর চিন্তা থাকবে না। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিলে তিনি পোস্টকার্ডখানা সাবধানে পকেটে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বাবার পেছন পেছন দূরত্ব রেখে বাড়ির পথ ধরলেন ইন্দুবালা। 

ওঁ মা সিদ্ধেশ্বরী সহায় 
সম্মানীয়, ব্রজমোহনবাবু 
মহাশয়, আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনার পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব হওয়ার ত্রুটি মার্জনা করিবেন। কলিকাতা হইতে খুলনার দূরত্ব বিস্তর। না হইলে আমি স্ব-শরীরে উপস্থিত থাকিয়া সমস্ত পাকা কথা আপনাকে জানাইয়া আসিতাম। ঈশ্বর সাক্ষী, ইতিমধ্যে অনেক বাক্যালাপই আমাদের পত্র মারফত হইয়াছে। পূর্বের পত্রে আপনার কন্যা ইন্দুবালার যে চিত্রখানি পাঠাইয়া ছিলেন তা আমার পুত্র মাস্টার রতনলাল মল্লিকের বড় পছন্দ হইয়াছে। পাত্রী গৌরবর্ণা, শিক্ষিতা, গৃহ কর্মে নিপুণা, আমার পুত্রের যথার্থ উপযোগী। আপনাদের অমত না থাকিলে এবং করুণাময় ঈশ্বরের কৃপা হইলে এই শ্রাবণে আমার পুত্রের সহিত আপনার কন্যার চারিহাত এক করিবার মনোবাসনা পোষণ করি। যত শীঘ্র সম্ভব আপনাদের মতামত জানাইবেন। 

–নমস্কারান্তে
শেফালীরানী মল্লিক 

পোস্টকার্ডটি এনে মায়ের হাতে দিয়ে ছিলেন বাবা। ততক্ষণে গোটা কলাপোতা জেনে গেছে ইন্দুবালার বিয়ের ঠিক হয়েছে কলকাতায়। একদিক থেকে ব্রজমোহনকে বেশ নিশ্চিন্ত লাগছিল সেদিন। কারণ পারতপক্ষে তিনি চাননি মেয়ের এদিকে বিয়ে হোক। ভেবেছিলেন তার সোনার বরণ কন্যের যথাযথ মর্যাদা করতে পারবে ওপারের লোজনেরা। তাই খুব ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বয়সে বেশি দোজবরে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের একমাত্র মেয়ের। বাড়িতে আপত্তি উঠেছিল তীব্র। ঠাম্মা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। মা বলেছিল “এর চেয়ে মেয়েটাকে একটা কলসি আর গামছা দাও না। বোসদের পুকুরে ডুবে মরুক”। ভাইটা ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। হরিমতি দু-দিন দুধ দেয়নি। বিচালিও খায়নি। ভোলা কুকুরটা ঠায় শুয়েছিল দোর ধরে। তবুও কারও কথা শোনেননি বাবা। আর কেউ না জানুক তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কোনো না কোনো সময়ে বাপ ঠাকুরদার এই ভিটে ছেড়ে তাঁদের একদিন চলে যেতেই হবে। সেদিনের ভয়ে তিনি সারাক্ষণ অতিষ্ঠ হয়ে থাকতেন শেষের দিকে। তাঁকে অবশ্য কষ্ট করে চোরের মতো রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে আসতে হয়নি। খান সেনাদের ঢোকার অনেক আগেই তিনি চোখ বুজেছিলেন কপোতাক্ষের তীরে। বাপ-ঠাকুরদার ভিটেতে। কোনো এক অগ্রহায়ণের শিশিরে ভিজতে ভিজতে। আর বাকিরা জ্বলে পুড়ে মরেছিল স্বাধীনতার আগুনে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হোক, এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এক আশ্বিনের রাতে শিউলির গন্ধে। 

ইন্দুবালার বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে পুজো-আচ্চা হতো বেশি। শনি নামের যে এক দেবতা আছে, তার যে প্রত্যেক শনিবার পুজো হয় ইন্দুবালা এখানে এসে তার কথা সঠিক ভাবে জানতে পারেন। সেদিন বাড়িতে নিরামিষ। শাশুড়ি বউয়ের উপোস। সন্ধ্যেবেলা বারের পুজো দিয়ে তার প্রসাদ উঠোনে দাঁড়িয়ে খেয়ে তবে উপোস ভাঙতো। এছাড়াও শাশুড়ি ছেলের মতি গতি ফিরিয়ে আনার জন্য নানা মন্দিরে হত্যে দিতেন। পাঁজি ধরে ধরে করতেন নানা নিয়ম উপাচার। পূর্ণিমায় রাধারমণের মন্দিরে দেওয়া হতো বাতাসার হরির লুঠ। অমাবস্যায় সিদ্ধেশরীর মন্দিরে পোয়াটাক চাল ডালের অন্নভোগ। এইসব কর্মকাণ্ড তিনি একা কখনই করতেন না। ছেলের নতুন বউকে সঙ্গে নিতেন। পাখি পড়ানোর মতো সব কিছু শেখাতেন। খুব কঠিন নিয়মে বেঁধে রাখতেন। ইন্দুবালার গ্রামে ষষ্ঠী, ওলাইচণ্ডী, পুণ্যি পুকুর ব্রতে এত অনুশাসন ছিল না। চাপড়া ষষ্ঠীতে কাঁঠাল পাতার ভেতরে গুড় আর কলা দিয়ে মাখা আটার সিন্নি খেতে দিব্যি লাগতো। বাড়িতে হতো খুদ চালের পায়েস। এইসব কথা শুনলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা হাসাহাসি করতো। তাচ্ছিল্যের নামে অপমান করতো। সেসব গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। পূর্ণিমা-অমাবস্যায়, তিথি নক্ষত্রের ফেরে ভালো দিনে ইন্দুবালাকে সঙ্গে নিয়ে মানুষে টানা রিক্সায় গঙ্গা স্নানে যেতেন শাশুড়ি। প্রথম দিনের ঘটনা আজও মনে আছে ইন্দুবালার। স্বামী ডেকে এনেছেন এমন এক জিনিস যা দেখতে আধভাঙা ঢাকাওয়ালা গাড়ির মতো। সামনে টানা দুটো শুড়ের মতো লাঠি। তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা সিঁড়িঙ্গে মতো লোক। তার হাতে একটা ঝুমঝুমি। “এরেই বুঝি টানা রিক্সা বলে”? স্বামীর সঙ্গে কথা হয় না শাশুড়ির সামনে। তা ছিল নিয়ম ভঙ্গের সামিল। শাশুড়ি জবাব দেন, “দেখেছো কখনও বাপের আমলে? নাও ওঠো এবার”। সেই বিষম বস্তুটায় উঠতে গিয়ে ইন্দুবালা কেঁদে ফেলেন আর কি! রিক্সায় বসার সাথে সাথে রিক্সা বুঝি উলটে যায়। শাশুড়ি চিৎকার করে বলেছিলেন, “বাঙাল মেয়ে কি সাধে বলি? রিফিউজির রক্ত যাবে কোথায়? আমারও যা কপাল”। উঠতে বসতে ইন্দুবালাকে ‘বাঙাল’ বলাটা এই বাড়ির রেওয়াজ ছিল। আর রিফিউজি’ তো তখন কলকাতার আকাশে বাতাসে। কান পাতলেই শোনা যেত। শাশুড়িই ধরিয়ে দিয়েছিলেন ‘বাঙাল’ শব্দটা। পরে বাড়ির লোকের অভ্যেসে পরিণত হয়। মানুষকে এভাবে যে সম্বোধন করা যায় সেটা ইন্দুবালা এপারে না এলে বুঝতে পারতেন না কোনোদিনও। এমনকি গায়ে পড়ে অপমানটাও। অনেক ছোটো বেলায় বাড়ির মাটির দাওয়ায় হেরিকেন জ্বালিয়ে এক সময়ের টোলে পড়ানো দাদু যখন কৃতদাসদের গল্প করতেন তখন শিউরে উঠতেন ইন্দুবালা। সারা দিন কাজ করতো মানুষগুলো। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। উঠতে বসতে মার। জাতের নামে অপমান। গায়ের রঙে অপমান। কাজ না পারলেই অন্ধকুঠুরিতে বন্ধ করে রাখা। এক এক সময় ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িটাকে অন্ধকুঠুরি মনে হতো ইন্দুবালার। মনে পড়ে যেত সেই রাতগুলো। দাদুর গল্প বলার আসরের মাঝে ঠাম্মা এসে কড়া ধমক লাগাতো। “বাচ্চা গুলান রাতে ঘুমাবে সেই খেয়াল আছে তো? থামাও তোমার হাবিজাবি গল্প”। ইন্দুবালা রাতে স্বপ্ন দেখতেন তিনি সেই কৃষ্ণকায় দাসের মতো পিছমোড়া হয়ে বাঁধা আছেন। গায়ে লেখা কতগুলো সংখ্যা। প্রচণ্ড ভয়ে ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে ঠাম্মাকে পাশে খুঁজে পেতেন না। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে উঠোন পেরিয়ে ঠাম্মা তখন গোয়াল ঘরে। হরিমতির দুধ দুইছেন, বাছুরকে আদর করছেন। বিচালি আর ভেলি গুড় মাখিয়ে খাওয়াচ্ছেন। ঠাম্মার গা থেকে ভেসে আসছে খুলনার গন্ধ। কলাপোতার গ্রাম। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকেন ইন্দুবালা। পাছে চোখ খুললে স্বপ্নটা যদি চলে যায়। 

চোদ্দ গুষ্টি ঘটির মাঝে কেন যে তাঁর শাশুড়ি বাঙাল মেয়ে বউ করে নিয়ে এসেছিলেন সেই সময়ে বুঝতে পারেননি ইন্দুবালা। অনেক পরে বুঝেছিলেন। কিন্তু সেদিকে গল্পের মোড় ঘোরাতে গেলে অনেকটা পথ যেতে হবে। উনুনের আঁচ হবে নিভন্ত। যা ইন্দুবালা কোনোদিনই সহ্য করতে পারবেন না। তাঁর হোটেলে উনুনের আঁচ মানে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। টগবগ করে ফোঁটা ভাতের গন্ধ মানে এই বাড়িতে প্রাণ আছে এখনও। এতদিন পরেও। বাড়িতে জমিদারি আমলের ভাঁড়ারে শাশুড়ি থাকাকালীন চালের অফুরান জোগান না থাকলেও ইন্দুবালার জীবনে প্রাণের অফুরান হয়নি কখনও। বাগবাজার ঘাটে গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম দিনে তাঁর কপোতাক্ষের কথা মনে পড়েছিল। বাড়ি থেকে লাল চেলী পড়ে, গা ভর্তি সোনা নিয়ে চলে আসার সময় মনে পড়েছিল ইচ্ছামতীর কথা। গ্রামের পাশে বোসদের বড় পুকুরটার কথা। সবার কথা স্মরণ করে ইন্দুবালা ছলছল চোখে গঙ্গায় ডুব দিয়েছিলেন। বিড়বিড় করে বলেছিলেন ভালো থাকুক ইচ্ছামতী…কপোতাক্ষ…বোসদের পুকুর। মাস ছয়ের মধ্যে বড় ছেলে পেটে এলে গঙ্গার পাট চুকলো তাঁর। শাশুড়িও অসুস্থ হলেন। 

বুড়ি খিটখিটে হলেও বউয়ের নিন্দা অন্যলোকে তার সামনে করছে কোনোদিন সহ্য করতে পারতেন না। তৎক্ষণাৎ মুখের ওপর জবাব দিতেন। ঠাম্মা শিখিয়েছিল ওপারের রান্না। আর শাশুড়ি খুব যত্ন করে, চিৎকার চেঁচামেচি করে, বাড়ি মাথায় উঠিয়ে শেখালেন এপারের রান্না। ওপারের রান্নায় যেখানে মিষ্টতার অভাব ছিল এপারে এসে সেগুলোতে একটু একটু মিষ্টি পড়লো। আর এপারের রান্নায় মিষ্টি সরে গিয়ে কাঁচা লঙ্কা বাটা এলো। মরিচ ঝাল এলো। চুইঝালের গন্ধ এলো। মৌরির ফোড়ন এলো। সারা বাড়ি ম ম করতে থাকলো ঘটি বাঙালের রান্নার সুবাতাসে। জ্ঞাতি কুটুমরা আড়ালে আবডালে কানাকানি করতো। কিন্তু হাঁড়ির খবর কিছুতেই বাড়ির বাইরে বেরোতে দিতেন না শাশুড়ি। তিনি জানতেন শকুনের চেয়েও হিংস্র হলো ওরা। যারা তার ছেলেকে নরকের দরজায় নিয়ে গেছে। মুখে হাঁ গো কী গো করলেও সারাক্ষণ শাপ শাপান্ত করতেন কুটুমদের নামে। ইন্দুবালাকে পই পই করে শিখিয়েছিলেন, “চিনে রাখ বউ এদের। কোনো শলা পরামর্শ করতে যাবি না ওদের সাথে”। ইন্দুবালা কোনোদিন যাননি। জীবনের চরম বিপদের সময়ও না। শাশুড়ি বুঝেছিলেন এই সংসার ডোবার হাত থেকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তাহলে সে এই বাঙাল মেয়েই। সাধে কি ছবি আসা ইস্তক তিনি ছুটেছিলেন গঙ্গার ধারে মায়ের বাড়িতে? মহারাজ ছবি দেখে বলেছিলেন “শেফালী, তোমার ঘর দুয়ার উত্তরসূরীদের বাঁচাবে এই মেয়ে। লক্ষ্মীমন্ত জেনে রেখো।” একটুও সময় নষ্ট করেননি তিনি আর। নিজের পেটের ছেলেকে ভালো করে চিনতেন। সংসারটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে খুলনার কলাপোতা গ্রামে চিঠি লিখতে বসেছিলেন। চোখের সামনে উজাড় হয়ে ছিল নাতি পুতিদের স্বপ্ন। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো ঘর আলো করে তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিজের চোখে দেখার জন্য বিভোর হয়ে থাকতেন বুড়ি। ইন্দুবালা তাঁর সেইসব স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন যা যা তিনি চেয়েছিলেন ছেলের বউয়ের কাছ থেকে। মুখ ফুটে কোনোদিনও শাশুড়ির মুখের ওপর কথা বলেননি। এক এক সময় নিজেই আশ্চর্য হয়েছেন। কলাপোতার সেই কলবলে মেয়েটা এই ছেনু মিত্তির লেনে এসে কী করে চুপ হয়ে গেল একদম? আসলে হতেই হতো। যে তীব্র যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনার অভিঘাত তাঁর ওপর দিয়ে চলেছিল দিনের পর দিন সেই সবের জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিল না। নিজেও কোনোদিন ভাবতে পারেননি এমনটা ঘটতে পারে। যে নির্মল ছন্দে জীবনের শুরু হয়েছিল তার পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছিলেন। চারপাশে এমন একটা মানুষও ছিল না, যাকে মনের কথা বলেন। এরও অনেক দিন পরে এক মাছওয়ালীকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। যে না থাকলে আজকের ইন্দুবালা এমন ভাবে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারতেন না। কিন্তু সেতো গল্পের ধরতাইয়ের দিক। আর এখন এই মুহূর্তে বুকের চাপা কষ্ট কাকে বলবেন ইন্দুবালা? সেইসব কথা কিছুটা জানে কর্পোরেশানের ওই ছিরছিরে জল পড়া কল আর বাগানের আমগাছ, নারকেল গাছ। তার ডালে কদাচিৎ এসে পড়া পাখিগুলো। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না বেরোয় মুখের ভেতর কাপড় খুঁজে নিতেন ইন্দুবালা। শুকনো মাটিতে চোখের জল পড়লে বৃষ্টি নামতো শহর জুড়ে। শাশুড়ি জল ভরা মেঘের দিকে তাকিয়ে তাঁর সংসারের মঙ্গল কামনা করতেন। 

সেদিন এমনই ছিল ভাদ্রের আকাশ। ঘরে ছিল গুমোট গরম। দুই ছেলের পর মেয়েটা তখন পেটে। শাশুড়ি আর হাঁটতে চলতে পারেন না। খুবই অসুস্থ। ঘরের বিছানায় শুয়ে সব কিছু। ইন্দুবালা প্রাণপণে সেবা করেন তাঁর এই ভরা অবস্থায়। তখন দুদিন প্রায় খাওয়া নেই বুড়ির। হঠাৎ একদিন সকালে ইন্দুবালার কাছে আবদার করলেন, “বউ একটু বিউলির ডাল রাঁধলে দুটো ভাত খেতে পারতুম”। ইন্দুবালা তাড়াতাড়ি উনুন ধরিয়েছিলেন সেদিন। ডাল সেদ্ধ করে মৌরি ফোড়ন দিয়েছিলেন। নামানোর আগে একটুখানি চিনি। বুড়ি ওঘর থেকে চিৎকার করছিলেন হাঁপ ধরা গলায়। “হলো তোর বউ? আর কত দেরী?” পদ্মকাটা বাটিতে ডাল ঢেলে, কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে যত্ন করে খাইয়েছিলেন শাশুড়িকে। সবটুকু ভাত আর ডাল বিছানার সাথে মিশিয়ে যাওয়া বুড়ি কোথায় যে নিয়ে নিচ্ছিলো ইন্দুবালা নিজেও তা বুঝতে পারছিলেন না। খাওয়া শেষ হলে বুড়ির চোখ গড়িয়ে নেমেছিল করুণাধারা। আশীর্বাদ করেছিলেন, “সবাইকে এইভাবে খাইয়ে পরিয়ে সুখী রাখিস বউ”। কথিত আছে মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ কথা খনার বচনের থেকেও নাকি ফলপ্রদ। সত্যি তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল ইন্দুবালার জীবনে। না হলে এতগুলো মানুষকে এই বয়সেও খাওয়াতে পারেন? তবে যেটা তিনি এখনও বুঝতে পারেননি মানুষ কী করে জানতে পারে এটাই তার শেষ খাওয়া? না হলে সেই ভাত খাওয়ার পর বুড়ি আর মুখে কুটোটি নাড়েনি সারাদিন। পরের দিন সকাল বেলায় চা নিয়ে শাশুড়ির ঘুম ভাঙাতে গিয়ে শুধু দেখেছিলেন পাঁচিলের গা ঘেষা জানলার দিকে তাকিয়ে আছেন বুড়ি অপলক দৃষ্টিতে। আকাশে তখন ভাদ্রের জল ভরা মেঘ। মা… মা… বলে দুবার ডেকেছিলেন ইন্দুবালা। শেফালীরানী আর কোনোদিন সাড়া দেননি। ছেনু মিত্তির লেনের অনেক পুরোনো বাড়ির মতো ইতিহাস হয়ে রয়ে গিয়েছেন মনের মণিকোঠায়। 

ধনঞ্জয় হাঁপাতে হাঁপাতে দোতলায় আসে। হড়বড় করে বলে যায় কথা। “আমি কত বারণ করলাম। শুনুচি না আমার কথা। ওই ছেলেগুলানরে আরও মাথায় তুলুচি…। তো এমন হউচি”। ইন্দুবালা হেসে পারেন না। ধনঞ্জয়ের ভাষা ঘটি, বাঙাল ওড়িয়া মিলে মিশে একাকার। মাথার চুলগুলো সব সাদা ধবধবে। তাও ছোটো ছোটো করে ছাঁটা। আবার যত্ন করে একটা টিকিও রেখেছে। গামছা ছাড়া অন্য কিছু তিনি পরতে দেখেননি ধনঞ্জয়কে। শীতকালে শুধু গায়ে উঠতো একটা চাদর। তাও খুব জোরাজুরি করার পর। ইন্দুবালার জীবনে যেন অন্ধের যষ্টি এই ধনঞ্জয়। জীবনের নাড়ি নক্ষত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ধনার কাছ থেকে সবটা শোনার আগেই সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পান ইন্দুবালা। কারা আসছে? এইসময় তো কোনো পুজো নেই। চাঁদার বালাই হওয়ার কথা নয়। আর ছেলে ছোকরাগুলো চাঁদা চায় না তার কাছে। আবদার করে এটা ওটা নিয়ে যায়। কিংবা দুবেলা খেয়ে যায় সবাই মিলে এসে। বড় একটা কেউ দোতলায় ওঠে না নাতি-নাতনি ছাড়া। কিন্তু তাদেরও তো এখন আসার সময় নয়। কিছুদিন আগেই তো সুনয়নীকে ঠেলে পাঠালেন নিজের বাবার বাড়ি। শুনেছেন কোনো কলেজে নাকি পড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে সে এসে পড়লেও এখন তার মোটেই আসার কথা নয়। ইন্দুবালা এগিয়ে যান দোতলার সিঁড়ির কাছে। সামনেই যাকে দেখতে পান, সে কিংশুক। উলটো দিকের মেসে থাকে। কলেজে পড়ছে। মাঝে মাঝেই রান্না খেয়ে দিদা বলে জড়িয়ে ধরে। ফরসা দেখতে। চোখে আবার গান্ধি ফ্রেমের কালো চশমা। শহরে নতুন উঠেছে। আর চাঁদি পর্যন্ত ছাঁটা ফুলকাট চুল। তার ওপরটায় আবার ঢেউ খেলানো বাবড়ি। বড় ভালো লাগে এমন সব আজব সাজগোজ দেখতে ইন্দুবালার। ছেলেটা দোতলার একেবারে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়ায়। ধনঞ্জয় তেড়ে আসে। এরপর সে এগোতে দেবে না কাউকে। হড়বড় করে বলে যাওয়া কথায় যেটুকু বোঝা যায় কিংশুক হোটেলের সামনে টাঙানো কালো বোর্ডের লেখা মুছে দিয়েছে। যেখানে প্রতিদিনের মেনু লেখা থাকে। ইন্দুবালা বলেন “এ তো ভারী অন্যায় কিংশুক। আমার লেখা মোছো কী করে?” কিংশুক তখনও হাঁপাচ্ছে। তার সদ্য তারুণ্য হার মানতে শেখার নয়। “শোনো দিদা। সত্যি বলছি। আমি তো ছিলামই না কয়েকদিন। বাড়ি গিয়েছিলাম। কাল লাস্ট ট্রেনে বর্ধমান থেকে ফিরেছি। মুড়ি জল খেয়ে শুয়ে পড়েছি…। না না প্লিজ তুমি আগে আমার কথা শোনো। আজ সকালে উঠে দেখি ইন্দুবালা ভাতের হোটেল রান্না হবে কচুর ডালনা, মুসুরির ডাল, আর ট্যাঙরা মাছ? এ কেমন কথা দিদা? আজ সুজিতের জন্মদিন ও খাবে কী? এ্যাই সুজিত তুই আবার রূপম, সাবেরের পেছনে লুকোচ্ছিস কেন? এদিকে আয়”। পেছনের ছোট খাটো ভিড় ঠেলে যে ছেলেটা এগিয়ে আসে তাকে দেখে চমকে ওঠেন ইন্দুবালা। কোঁকড়ানো চুল। গালে হালকা দাড়ি। কালো বার্নিশে গায়ের রঙ। হাসলে টোল পড়ে গালে। চোখে শুধু চশমাটুকু নেই। এতোদিন পরে এইভাবে কেউ ফিরে আসে? সত্যি কি আসা যায়? তিনি শুধু জানেন অলোক কোনোদিন ফিরবে না। ফিরতে পারে না। কারণ অলোকের বুক ফুড়ে ঢুকে গিয়েছিল পাঁচ-ছটা গুলি। তার দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশের জিপ। অন্ধকারে ডুবে থাকা এই কলকাতা শহর শুধু সাক্ষী ছিল তার। “কী হলো দিদা? কথা বলছো না কেন?” কিংশুক সমেত ছেলেদের দলটা তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। “সুজিতকে আগে কখনও তো দেখিনি”। বিড়বিড় করে বলে ওঠেন ইন্দুবালা। কিংশুক হেসে ফেলে। “ও এই কথা … তা দেখবে কী করে? ওকে তো হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।” হো হো করে হেসে ওঠে ছেলের দল। আর যে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন ইন্দুবালা অপলক দৃষ্টিতে যেন বহু যুগের ওপার থেকে সে যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। স্টুডেন্ট হোস্টেলের খাবার নিয়ে আন্দোলন করছিল বলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাড়িয়ে দিয়েছে সুজিতকে। ছেলেটা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো ইন্দুবালাকে। এমনিতে কারও প্রণাম নিতে চান না তিনি। কিন্তু আজ নিলেন। কেন নিলেন নিজেও ঠিক জানেন না। আপত্তি করার সময় হয়তো দেয়নি ছেলেটা। শুধু মনে মনে ইন্দুবালা জানতে চাইলেন, “অমন ভাসা ভাসা চোখ নিয়ে এতোদিন পরে ফিরে এলে কেন অলোক?” 

বড় বেতের ঝুড়ি দিয়ে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকতো রান্নাঘরে। অনেক রাতে শহর নিশুতি হলে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের পেছনের দরজায় কড়া পড়তো একবার। ওটা সাংকেতিক শব্দ। মানে “জেগে আছো কমরেড ইন্দুবালা?” “কমরেড? সেটার আবার কী মানে?” অলোক ফস করে সিগারেট জ্বালায়। “বন্ধু …সাথী..সহযাত্রী…সহযোদ্ধা…এক এক সময় এক এক রকমের মানে। আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। তা না জেনে আমাদের খাওয়াচ্ছেন কোন সাহসে? গোটা শহর আমাদের কী বলে জানেন?” ইন্দুবালা ঘাড় নাড়েন, না জানেন না। অলোক শিড়দাঁড়া সোজা করে বলে “নকশাল”। ইন্দুবালার চকিতে মনে পড়ে যায় অলোকের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনের কথা। সবেমাত্র হাতের সব কাজ সেরে হোটেল বন্ধ করে দোতলায় উঠবেন। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন। ধনঞ্জয় সে সময়ে কয়েকদিনের জন্য দেশে গেছে। হাওয়ার শব্দ ভেবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দোতলার সিঁড়ির দিকে ইন্দুবালা। কিন্তু আবার শব্দটা হলো। হ্যাঁ এবার স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন তিনি। থমকে দাঁড়াতেই হলো। রান্নাঘরের পেছনের দরজার দিক থেকে আসছে শব্দটা। ওদিকটায় বাগান। বাগানের শেষে পাঁচিল। লোকজন আসবার হলে সামনের দরজা দিয়ে আসে তারা। পেছনের দরজা সচরাচর কেউ ব্যবহার করে না ইন্দুবালা আর ধনঞ্জয় ছাড়া। তাহলে কি অন্য কেউ? কোন মতলবে? সেই সময়ে ইন্দুবালার বাড়ি নিয়ে শরিকি ঝামেলা তুঙ্গে। স্বামী নেই, শাশুড়ি নেই, মাঝে মাঝেই কেউ না কেউ বাড়িতে এসে হম্বিতম্বি করে চলে যায়। একলা বিধবা পেয়ে লিখিয়ে নিতে চায় সবকিছু। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারাই আবার গুণ্ডা পাঠালো না তো! আঁশ বটিখানা হাতে তুলে নেন ইন্দুবালা। একটাকে শেষ না করে আজ নিজেও শান্তি পাবেন না। তারপর না হয় বাচ্চাগুলোকে সঙ্গে করে নিজেই যাবেন থানায়। আর নিজে মরে গেলে তো শেষ হয়ে গেল সব কিছু। পরক্ষণেই মনে হয় তাহলে বাচ্চাগুলোকে দেখবে কে? ওরা যে বড্ড ছোটো। নিজের মারা যাওয়ার চিন্তাটাকে আপাতত সরিয়ে রাখেন ইন্দুবালা। মনে প্রচণ্ড সাহস জুগিয়ে এগিয়ে যান দরজার দিকে। “কে? কে ওখানে?” উত্তর আসার বদলে আবার একবার কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। আর নিজেকে সামলাতে পারেন না ইন্দুবালা। রাগের মাথায় খুলেই ফেলেন দরজা। “আয় তোদের শেষ করবো আজকে আমি”। কিন্তু সেই লোডশেডিং-এর রাতে সামনে এরা কারা? বাগানের মধ্যে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে সব। নড়েও না, চড়েও না। কুপিখানা তুলে ধরেন ইন্দুবালা। আর ঠিক তখনই আলোছায়ার মধ্যে উপলব্ধি করেন এরা তো গুণ্ডা নয়। তার চারপাশে জ্ঞাতি কুটুমদের মতো সম্পত্তি লোভী কুলাঙ্গার নয়। চোখগুলো ভাসা ভাসা যেন কোনো এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। সবচেয়ে রোগা ছেলেটা এগিয়ে আসে। “কিছু মনে করবেন না। এতো রাতে বিরক্ত করলাম আপনাকে। আমার নাম অলোক। আর এরা আমার বন্ধু। আমাদের একটু খেতে দেবেন? দু-দিন কিছু খাওয়া হয়নি।” অনেক রাতে ভাত বসিয়েছিলেন ইন্দুবালা। সাথে ছিল একটু আলু পোস্তর চচ্চড়ি। চেটেপুটে খেয়ে চলে গেল ছেলে মেয়েগুলো। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই আসতে থাকলো অনেক রাতে। কখনও অলোক একা। অথবা সঙ্গে করে দু তিনজনকে নিয়ে। ওরা খাবারের পয়সা দিতে পারতো না। চাইতেন না ইন্দুবালা কোনোদিন। কিন্তু একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন নিজের চারপাশ জুড়ে। আর বদমায়েশ আত্মীয়রা তার ওপর খবরদারি দেখাতে আসতো না। ভয় দেখাতে তো নয়ই। বরং তাঁকে দেখলে সরে পড়তে টুপটাপ। লছমী কোথা থেকে খবর এনে দিল, “আচ্ছাসে ওদের ডরা দিয়া মাজি তোর ওই ছেলে মেয়ে গুলো। তুইও সাবধানে থাকিস। ওরা নকশাল আছে। কখন আবার পুলিশ আসে।” কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ইন্দুবালার গা। “নকশাল”? আজকেই তো কালেক্টর অফিসের কেরানিরা খেতে এসে কি সব ফিসফিস করে আলোচনা করছিল। “কটা ছেলে মারা গেছে। গঙ্গার ঘাটে বোমা। সব নকশাল … নকশাল…। বিপ্লব করে দিন দুনিয়া পালটে দেবে”। 

অলোক তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। “এইবার তো জেনে গেলেন আমরা কে? নিশ্চই এর পরের বার থেকে আর দরজা খুলবেন না।” ইন্দুবালা কি সেদিন কিছু বলতে পেরেছিলেন? নাকি তার চোখ ভারী হয়ে আসছিল জলে। মনে পড়ে যাচ্ছিল ভাইয়ের কথা। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র গড়ার দাবিতে সেও তো তখন মুক্তি যোদ্ধা। অনেক দিন পরে লুকিয়ে বাড়িতে এসেছিল দুটো ভাত খাবে বলে। মাও সেদিন বেড়ে দিয়েছিল গরম ভাত। প্রথম গ্রাস মুখে তোলার আগেই বাড়িটা দাউ দাউ করে জলে ওঠে। মাকে, ভাইকে কাউকেই বেরোতে দেয়নি খান সেনারা ওই জ্বলন্ত কুণ্ড থেকে। মালাউন পুড়িয়ে পুণ্য করেছিল তারা। ভাই কি সেদিন চিৎকার করেছিল? নাকি সেই লেলিহান শিখার মধ্যে মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসেছিল? মা কি তাকে সেদিন রাখালের পিঠে খাওয়ার গল্পটা বলছিল? নাকি ঘুম পাড়ানিয়া গান শোনাচ্ছিল সুর করে করে? এগুলো সেই পাগলাটে লোকটার কাছে জানা হয়নি সেদিন। জানতে পারেননি ইন্দুবালা। তার আগেই সে চলে গিয়েছিল। কোথায়? কেউ জানে না। “আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না কমরেড। ধরে নিচ্ছি আপনি আর চান না আমরা এখানে আসি।” দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল অলোক। ইন্দুবালা অস্ফুটে বলেছিলেন, “একদিন রাতে যখন দরজা ধাক্কিয়ে ভাত খেতে এসেছিলে তখন তো জানতে চাইনি কিছু। আজ কেন জানাচ্ছ? মা বলতো অতিথির কোনো পরিচয় হয় না। ধর্ম হয় না। তাঁরা হন ঈশ্বর”। তাকাতে পারেনি অলোক ইন্দুবালার দিকে। সে সাহস তার ছিল না। যদিও দুটো ঘোরেল পুলিশ ইন্সপেক্টর আর গোটা একটা গোয়েন্দা দপ্তরকে সে আদাজল খাইয়ে ঘোরাচ্ছিল সেই সময় কলকাতার রাস্তায়। অলিতে গলিতে। লালবাজারে একজন তাঁদেরও ওপরের লোক হাতে লোহার বেড়ি নিয়ে বসে ছিলেন এইসব বেয়াদপ ছেলে মেয়েদের কাছে নিজের সাদা-কালো আমিকে চিনিয়ে দেবার জন্য। রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তারা। এতো সব দস্যিপনা করা ছেলেটা সেই নিশুতি রাতে এক সহজ সরল গেঁয়ো বাঙাল বিধবার কথার পিঠে কথা জুড়তে পারেনি। শুধু বিড়বিড় করেছিল “ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি না কমরেড। কিন্তু আপনারা থাকুন। আপনারা থাকলে আমরা থাকব।” 

অনেক রাত পর্যন্ত কান পেতে থাকতেন ইন্দুবালা। অপেক্ষা করতেন অলোকের জন্য। তার সঙ্গীদের জন্য। সারাদিন ওরা খালি পেটে, পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটে বেড়িয়ে অধিকার আদায় করছে। মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার। চাড্ডি ভাত-ডালের অধিকার। অপমানিত না হয়ে স্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়াবার অধিকার। ঠুক শব্দ শুনলেই নিজে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেন ইন্দুবালা। ছেলেটা সাতদিনের ভাত একদিনে খেয়ে কোথায় যে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে যেত কে জানে! মজা করে ইন্দুবালা তার একটা ছদ্ম নাম দিয়েছিলেন, প্যাঁচা। প্যাঁচার জন্য রোজ ভাত বাড়া থাকতো। কিন্তু প্যাঁচা রোজ আসতো না। তার আসা সম্ভব ছিল না। রাতের অন্ধকারে শুধু একটা গলা ফিসফিস করে ভেসে বেড়াতো “কমরেড ইন্দুবালা আপনারা থাকলে আমরা থাকবো।” কিন্তু কই। ইন্দুবালা তো আছেন। তাহলে অলোক নেই কেন? সুশান্ত নেই কেনো? গোরা নেই কেন? কৃষ্ণা নেই কেন? প্যাঁচার দলটা যে আর ভাত খেতে আসেনি কোনোদিন। এরও অনেক পরে শুনেছিলেন বরানগর ঘাটে পিচ আর ব্লিচিং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল রক্ত। অলোকের দেহটা দুবার নড়ে উঠে স্থির হয়ে গিয়েছিল সেদিন। চোখদুটো খোলা ছিল আকাশের দিকে। তারায় ভরা আকাশ দেখছিল কি অলোক? নাকি বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন শহর জুড়ে? ধুয়ে যাচ্ছিল রক্ত। মিশে যাচ্ছিল গঙ্গার জলের সাথে। ভেসে চলছিল নিথর দেহগুলো ঢেউয়ের তালে তালে সপ্ত ডিঙার মতো। অজানা এক স্বপ্নে। সত্তরের দশক মুক্তির দশক হতে পেরেছিল কিনা ইতিহাস তার মূল্যায়ন করেনি কোনোদিন। করবে কিনা তাও জানা যায় না। কিন্তু সেদিনও এক বিধবা হোটেল মালিক হাঁড়িতে কিছুটা চাল বেশি নিয়েছিলেন। যদি ফিরে আসে ছেলে-মেয়েগুলো। যদি তার কাছে এসে আবার ভাত চায়। অপেক্ষায় ছিলেন রাতের পর রাত। কিন্তু তারা কেউ ফেরেনি। 

কেউ যেন একটা হাত ধরে ইন্দুবালার। ছানি না পাকা ঘোলাটে চোখে সামনে তাকান তিনি। কিংশুক দাঁড়িয়ে। পাশে সুজিত। আরও পেছনে ইন্দুবালার সব চাঁদপানারা। “দেখবে না দিদা তোমার বোর্ডে কী লিখেছি? তারপরে তুমি ডিসিশান নিও এইগুলো আজ রান্না করবে নাকি করবে না”। ওরা দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামে। ইন্দুবালা কি আর অত তড়বড় করতে পারেন? হাঁটুর ব্যথা, গেঁটে বাত নিয়ে এক দঙ্গল ছেলের সঙ্গে যখন সেই কবেকার কালো সিমেন্টের বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ান তখন তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে ভাদ্রের বৃষ্টির মতো। কবেকার অলোক, গোরা, সুশান্ত, কৃষ্ণা যেন কিংশুক, সুজিত, রূপম, সাবেরের হাত ধরে এসে লিখে গেছে তার বোর্ডে। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের আজকের মেনুতে জ্বলজ্বল করছে ভাত, বিউলির ডাল, আলুপোস্ত, কালো জিরে দিয়ে পার্শে মাছের ঝোল, বিলাতি আমড়ার চাটনি। ইন্দুবালা জানেন এরপর তিনি আর স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না। যতক্ষণ না ছেলেগুলোর মুখে হাপুস হুপুস শব্দ ওঠে। যতক্ষণ না সারা বাড়ি ছড়িয়ে যায় বিউলির ডালে মৌরি ফোড়নের গন্ধে। পার্শে মাছে কালো জিরের পাশে কাঁচা লঙ্কার আবেশ করা ঝোলে। আলু পোস্তর একটু কাঁচা তেলের সুবাসে। বিলাতি আমড়ার টকে সর্ষের মনকাড়া তীব্র ঝাঁঝে। টেবিলে কলাপাতা পাতা হয়। মাটির গ্লাসে জল। লেবু, নুন, লঙ্কা। এক পেট খিদে আর চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে কবেকার হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের হয়ে এখনকার প্রজন্ম ভাত খায় ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। ইন্দুবালা আজও বিশ্বাস করেন অতিথির কোনো ধর্ম হয় না। বর্ণ হয় না। জাত, গোত্র কিছু না। অতিথি হন ঈশ্বর। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *