মায়াজাল

ভলিউম ২৯ – মায়াজাল – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৯৮

০১.

রবিনের টোকার সাড়া দিল না সোফি।

পাশে দাঁড়ানো মারলার দিকে তাকাল। রবিন। আবার টোকা দিল দরজায়। জবাব নেই এবারেও। উঁকি দিয়ে দেখল রান্নাঘরের টেবিলে ঘাড় গুঁজে বসে আছে সোফি। অবাক হলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

সোফির সামনে টেবিলে বিছানো একটা পত্রিকা। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস।

কি হয়েছে, সোফি? জিজ্ঞেস করল মারলা। খবর সব ভাল তো?

জবাব দিল না সোফি। দুহাতে গাল চেপে ধরে তেমনি ভঙ্গিতে বসে আছে। অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ ও, জানা আছে মারলার। তবু অবাক লাগল। আচরণটা স্বাভাবিক নয়।

সোফির পেছনে এসে পিঠে হাত রাখল রবিন, খুব খারাপ কিছু?

গাল থেকে হাত সরিয়ে মুখ তুলে তাকাল সোফি। চোখ লাল। কোন কথা না বলে কাগজের নিচ থেকে গোলাপী রঙের একটা খাম বের করল। বাড়িয়ে ধরল সেটা। হাত কাঁপছে।

কি এটা? বলতে বলতে খামটা নিল রবিন। মুখ খোলা। ভেতর থেকে বের করল একটা চিঠি। অদ্ভুত চিঠি। লিখেছে:

শোনো,
তোমার ধারণা তুমি আমাকে চেনো। আসলে চেনো না। হয়তো ভাবছ আমি তোমার বন্ধু। না, তা-ও নই। আমি তোমার তত্ত্বাবধায়ক। তোমার ভালমন্দ দেখাশোনার দায়িত্ব এখন থেকে আমার। মন দিয়ে শোনো।
এই চিঠির নিচে একসারি নাম দেখতে পাচ্ছ। সবার ওপরে রয়েছে। তোমার নামটা। তুমি যে আমার বাধ্য আছ তার ছোট্ট একটা প্রমাণ দিতে হবে। তারপর তোমার নামটা সারির ওপর থেকে কেটে পাশের তারকাচিহ্নের যে কোনও এককোণার ভেতরে লিখে দেবে। একবার তারকায় ঢুকে যেতে পারলে আর চিন্তা নেই, ওখানেই থাকবে তুমি, বেরোনোর প্রয়োজন হবে না।
সাবধান: আবার বলছি–তারকার কোণায় লিখবে, ভুলেও মাঝখানে নয়। তাহলে সেটাকে তোমার অবাধ্যতা ধরে নেব আমি। মারাত্মক বিপদে পড়বে। আমার কথামত কাজ সেরে তোমার পরের নামটা যার চিঠিটা ত্বর কাছে পাঠিয়ে দেবে। তোমাকে কি করতে হবে সেই নির্দেশ পাবে টাইমস পত্রিকার বিজ্ঞাপনের পাতায় একটা বক্সের মধ্যে। তারকাচিহ্ন আঁকা থাকবে বিজ্ঞপ্তির ওপর। সুতরাং চিনতে অসুবিধে হবে না কোনটা তোমার জন্যে। অক্ষরগুলো সব উল্টোভাবে লেখা থাকবে–যেমন dog-কে লেখা হবে god। ঠিকমত সাজিয়ে নিলেই পেয়ে যাবে আসল বাক্যটা। চিঠি পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে অবশ্যই তোমাকে তোমার বাধ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
তালিকায় বাকি যাদের নাম আছে ইচ্ছে করলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে পারো। বাধা নেই। আমার ধারণা, আমার মতই ওরাও তোমার বন্ধু নয়, মুখে যতই বন্ধু বন্ধ করুক। তালিকার বাইরে কারও সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করবে না। যদি করো, রেগে যাব আমি।
একটা কথা পরিষ্কারভাবে জেনে রাখো, তোমাদের গোপন কথাটা জানি আমি। কিন্তু সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার। পুলিশকে জানাতে যাব না।
আমার কথার অবাধ্য হলে মারাত্মক পরিণতি অপেক্ষা করবে তোমার জন্যে। ভয়ঙ্করভাবে মৃত্যু ঘটবে তোমার।
–তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক।

চিঠিটা পড়ে মারলার হাতে দিল রবিন।  

মারলা পড়ে বলে উঠল, দূর, যত্তোসব ছাগলামি। কেউ রসিকতা। করেছে। দলামোচড়া করে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, বাধা দিল রবিন, দাঁড়াও। দেখি, দাও তো। আরেকবার পড়ে দেখি।

পড়ে দেখার কিছু নেই, রাগ করে বলল মারলা। যে পাঁচজনের নাম আছে এটাতে, তাদের কেউই পাঠিয়েছে ভয় দেখানোর জন্যে। ক্লডিয়া হতে পারে।

কেন, ড্যানিয়েল নয় কেন? ভুরু নাচাল রবিন।

হ্যাঁ, ড্যানিয়েলও হতে পারে। রবিনের দিকে তাকাল মারলা। বাজে রসিকতার অভ্যাস আছে ওদের দুজনেরই। ফেলো ওটা। অ্যাই সোফি, গুম হয়ে বসে না থেকে ওঠো তো। চলো, বারগার খেয়ে আসি মলে গিয়ে। কিছু কেনাকাটাও আছে আমার।

যাও তোমরা। আমি বাড়ি যাব। সোফি, বইটা দাও তো, কাল যেটা এনেছিলে। পড়া শেষ হয়নি আমার।

ওদের কথা, যেন কানেই ঢুকল না সোফির। ফিসফিস করে বলল, উড়িয়ে দিয়ো না ব্যাপারটাকে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও কিন্তু দিয়েছে। এই দেখো।

পড়ে ভুরু কুঁচকে গেল রবিনের। তত্ত্বাবধায়ক লিখেছে: বৃহস্পতিবারের মধ্যে তোমার কুকুরছানাটাকে পানিতে চুবিয়ে মারো, সোফি।

বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকাল রবিন, হু, বললেই হলো। ফাজলেমি পেয়েছে। পাত্তাই দিয়ো না এসবে।

বিজ্ঞাপনটার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে বলল মারলা, এ কাজ ক্লডিয়া ছাড়া আর কারও নয়। কারণ ও মানসিক রোগী।

কিন্তু রোগী হলেও ক্লডিয়া জন্তু-জানোয়ার অপছন্দ করে না, রবিন বলল। ও নিজে যখন কুত্তা পালে সোফির কুকুরটাকে মারতে বলবে, এ কথা বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। আর বললেই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে না একথাও জানে ক্লডিয়া। ভয়টা আসলে দেখাতে চেয়েছে অন্য কেউ।

আরেকবার চিঠিটার দিকে তাকাল রবিন। টাইপরাইটারে টাইপ করা। বিড়বিড় করে বলল, তত্ত্বাবধায়ক আসলে কি চাইছে বুঝতে পারছি নাঃ.

রেগে উঠল মারলা, এর মধ্যে বোঝাবুঝির কি আছে? স্রেফ ভয় দেখানোর জন্যে করেছে এই কাজ। সোফি ভয় পাচ্ছে ভেবে এখন নিশ্চয় একা একাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ফেলো ওটা, ফেলে দাও। সোফি, ওঠো তো। চলো।

চেয়ারে বসল রবিন। চিঠির নামগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মুসার নামও আছে। কিন্তু আমারটা নেই কেন?

কিশোরেরও তো নেই। তাতে কি হয়েছে?

কিশোরের না থাকার একটা যুক্তি আছে। ও এখন রকি বীচে নেই। তা ছাড়া সেদিন রাতে আমাদের সঙ্গে গাড়িতেও ছিল না। কিন্তু আমি তো গাড়িতেও ছিলাম, বাড়ি থেকেও চলে যাইনি। আমারটা নেই কেন?

তোমার কথা ভুলে গেছে আরকি। সেজন্যেই তো বলছি, রসিকতা।

গম্ভীর হয়ে ভাবছে রবিন। তার বিশ্বাস, রসিকতা করেনি তত্ত্বাবধায়ক। যা করতে বলেছে, সত্যিই চায় সেটা করা হোক। নইলে বিপদ ঘটাবে। ওদের গোপন কথা জানে বলে কি বোঝাতে চেয়েছে? মরুভূমিতে ওরা যে। অ্যাক্সিডেন্টটা করে এসেছে সেটার কথা? এ ছাড়া আর তো কোন, গোপনীয়তা নেই ওদের।

কনসার্ট শুনতে গিয়েছিল সেদিন ওরা। চিঠিতে যাদের নাম রয়েছে, সবাই গিয়েছিল। দিন পনেরো আগে পঁচটা টিকেট এসেছিল ডাকে। কে পাঠিয়েছে জানা যায়নি। সকাল বেলা যার যার বাড়ির ডাকবাক্সে খামের মধ্যে একটা করে টিকেট পেয়েছে সবাই। সেই সঙ্গে একটা করে নোট। তাতে কার কার কাছে টিকেট পাঠানো হয়েছে, নাম লেখা ছিল। অবিকল একই ধরনের নোট পেয়েছে সকলেই।

ভেবেছে ওদেরই কোন বন্ধু মজা করার জন্যে একাজ করেছে। পরে বলে চমকে দেবে। কোনকিছু সন্দেহ না করে কনসার্ট দেখতে গিয়েছিল ওরা মরুভূমির কাছে একটা শহরে।

রাতের বেলা মরুভূমির মাঝের রাস্তা দিয়ে আসার সময় বাজি ধরে হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়েছিল ড্যানি। অন্ধকারে দেখতে পায়নি লোকটাকে। একটা তীক্ষ্ণ বাঁক পেরোতেই করল অ্যাক্সিডেন্ট। কিভাবে যে চাকার নিচে এসে পড়ল লোকটা বলতেও পারবে না সে। গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল। মারা গিয়েছিল লোকটা। পরিচয় জানার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে ওরা। পকেটে মানিব্যাগ ছিল না, আইডেন্টিটি ছিল না, ভিজিটিং কার্ড ছিল না লোকটার। সে যে কে, জানার কোন উপায় ছিল না। ওকে নিয়ে, কি করা যায়, একেকজন একেক কথা বলা শুরু করল। কেউ বলল পুলিশকে জানাতে, কেউ করল বিরোধিতা। পুলিশকে জানাতে গেলে বিপদে পড়ার ভয়ে শেষে মরুভূমির মাঝেই লোকটাকে কবর দিয়ে এসেছে ওরা। এ কাজে মুসা আর রবিনের একেবারেই মত ছিল না। ড্যানির আতঙ্কিত অবস্থা দেখে আর অনুরোধ ঠেকাতে না পেরে শেষে চুপ হয়ে গেছে,

 রবিনের দিকে তাকাল মারলা। তুমিও মনে হয় চিঠিটাকে সোফির মত সিরিয়াসলি নিয়েছ?

হ্যাঁ, না নিয়ে উপায় নেই। আমাদের গোপন কথা জানে বলেছে। আর গোপন কথাটা যে কি, সেটা তুমিও জানো, উঠে দাঁড়াল রবিন। মুসা আর ড্যানির সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ক্লডিয়াই বা বাকি থাকে কেন তাহলে? মারলা বলল। আমি নিজে তাকে ফোন করে জানিয়ে দেব যে তার চিঠিটা পেয়ে পেটে মোচড় দেয়া শুরু হয়ে গেছে আমাদের। হেসে আরও গড়াগড়ি খাক।

মারলার ব্যঙ্গতে কান দিল না রবিন। চিঠিটা নিয়ে গিয়ে রাখল ফোনের পাশে। রিসিভার তুলে ডায়াল করল।

 বাড়িতে নেই মুসা। ওর বাবা-মাও নেই। বেড়াতে গেছেন। আরও অন্তত এক হপ্তার আগে ফিরবেন না। বাড়িতে একা থাকে মুসা। অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজটা রেখে ড্যানির নম্বরে ডায়াল করল রবিন। তাকেও পাওয়া গেল না। আবার অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ রাখতে হলো। তারপর খানিকটা দ্বিধা করেই ক্লডিয়াদের বাড়ির নম্বরে ফোন করল। সে-ও বাড়িতে নেই। এই ছুটির সময়টায় কাউকে পাওয়া যায় না। সবাই যেন বাড়ি ছাড়ার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে। অগত্যা ওখানেও অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ রাখতে হলো।

রিসিভার নামিয়ে রেখে এসে বলল রবিন, কারও ফোন না আসা পর্যন্ত ভাবছি এখানেই বসে থাকব।

 কি যে বলো না, মুখ বাঁকাল মারলা। ফালতু একটা চিঠির জন্যে ঘরে বসে থাকব? সারাটা দিন নষ্ট! ঠিক আছে, তোমাদের ইচ্ছে হলে থাকো। আমি যাচ্ছি। হাত বাড়াল রবিনের দিকে, গাড়ির চাবিটা দাও। মলে আমাকে যেতেই হবে।

চুপ করে বসে থাকো তো! কিছুটা কড়া স্বরেই বলল রবিন। তোমাদের চাপে পড়ে একটা বোকামি তো করেই এসেছি সেদিন মরুভূমিতে। আর কোন কথা শুনছি না। গোপন কথা জানে যদি না বলত, পাত্তা দিতাম না। আমাদের দলের বাইরের কেউ যদি হয়ে থাকে, জেল খাঁটিয়ে ছেড়ে দিতে পারবে। রেকমেইল করে ঘুম-খাওয়া হারাম করে দিতে পারবে। এখন আমাদের সবার একসঙ্গে থাকা দরকার। কিছু ঘটলে একসঙ্গে সেটাকে ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

 হাল ছেড়ে দিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসে পড়ল মারলা। অহেতুক দুশ্চিন্তা করছ তোমরা, আমি বলে দিলাম।

তোমার কথা সত্যি হলে তো বাঁচি।

এই সময় রান্নাঘরে ঢুকল সোফির কুকুরছানাটা। কাছে এসে আদর করে মনিবের হাত চাটতে শুরু করল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সোফি। মুখে। উদ্বেগের হাসি।

যে যতই বলুক আর ভয় দেখাক, দৃঢ়কণ্ঠে বলল সে, টমিকে আমি চুবিয়ে মারতে পারব না।

প্রশ্নই ওঠে না, তার সঙ্গে সুর মেলাল রবিন। আরেকবার তাকাল অদ্ভুত চিঠিটার দিকে। দেখাই যাক না, কি করতে পারে সে!

.

০২.

বাড়ি থেকে বেরিয়ে মলে চলে এল মুসা। সেরাতে মরুভূমির ঘটনাটার পর মন প্রায় সময়ই খারাপ থাকে। খারাপ হয়ে আছে মনটা। খিদেও পেয়েছে। কিশোর নেই, নাহলে স্যালভিজ ইয়ার্ডে গিয়ে আড্ডা দিতে পারত। রবিনও থাকছে ব্ল্যাক ফরেস্টে ওদের গোস্ট লেনের বাড়িতে।

রোদের মধ্যে গাড়িটা পার্ক করে রেখে একটা খাবারের দোকানে ঢুকল সে। আগে খেয়ে নেয়া যাক। তারপর ভাববে কোথায় যাবে। ম্যাকডোনাল্ডের তৈরি চিকেন বার্গার, পটেটো ফ্রাই আর কোকের অর্ডার দিল। সে। এই দোকানে পার্ট টাইম চাকরি করে সোফি। ওকে না দেখে ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করল সোফির কথা। ক্যাশিয়ার বলল, ডিউটি শেষ। করে চলে গেছে সোফি। সেদিন আর আসবে না।

খাবারগুলো নিয়ে গুডলাক ফাউনটেইনের পাশের টেবিলটায় এসে বসল মুসা। বিরাট হাঁ করে বার্গারে কামড় বসাল। চমৎকার বানায়। ওর খুব। পছন্দ। মজা করে চিবাতে চিবাতে তাকাল ঝর্নাটার দিকে। ওটার পানিতে পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে কোন কিছু চাইলে নাকি ইচ্ছে পূরণ হয়। পকেট থেকে একটা পয়সা বের করে ছুঁড়ে মারল সে। আস্তে করে গিয়ে অস্থির পানির নিচের ছোট গোল বেদিটাতে পড়ল পয়সাটা। ওখানে ফেলা খুব কঠিন কাজ। চাইবার মত কোন কিছু এ মুহূর্তে মনে পড়ল না মুসার। শেষে বলল, আমার মনটা ভাল হয়ে যাক।

বাহ, দারুণ হাত তত তোমার। সাংঘাতিক নিশানা, মেয়েলী কণ্ঠের হালকা হাসি মেশানো কথা শুনে ফিরে তাকাল মুসা।

পাশের টেবিলে বসে আছে এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী। একেবারে সিনেমার নায়িকাদের মত সুন্দরী। ঝলমলে সোনালি চুল। বড় বড় চোখের মণি সবুজ। ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক। খাড়া তীক্ষ্ণ নাক। পরনে নার্সের সাদা পোশাক। কফি খেতে খেতে ম্যাগাজিন পড়ছিল। মুসার চোখে চোখ পড়তে মিষ্টি করে হাসল। মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টে বলল, কাজ হবে না। রোজই পয়সা ফেলি আমি। কোন চাওয়াই পূরণ হয় না আমার। হয় চাওয়াটা ঠিকমত হয় না, নয়তো মাত্র একটা পয়সা ফেলি বলে মন ওঠে না ঝর্নার।

মুসাও হাসল। এক পয়সায় ঝর্নার মন না উঠলে সিকি ফেলে দেখতে পারেন। বেশি ঘুষ পেলে আপনার ইচ্ছে পূরণ করেও দিতে পারে।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মেয়েটা। ঠোঁট ওল্টাল। যার পয়সায় হয়, তার সিকিতে কেন, লক্ষ ডলারেও হবে না। ইচ্ছা পূরণ হওয়ার কথা সব ফালতু। আমি আসলে পয়সা ফেলি হাতের নিশানা পরখ করার জন্যে। বেদিটাতে ফেলতে চাই। একদিনও পারিনি।

রোজ আসেন কেন?

 লাঞ্চ করতে। কাছেই চাকরি করি আমি। হাসপাতালে।

নার্স?

বলে বটে নার্স, কিন্তু কাজ করায় অন্য, মুখ বাকাল মেয়েটা। আজ সকাল থেকে খালি টেস্ট টিউবে রক্ত নিয়েছি মানুষের।

চাকরিটা মনে হয় পছন্দ না আপনার?

নাহ! এগুলো কোন কাজ নাকি?

 করেন কেন?

সময় কাটানোর জন্যে। তুমি কি করো? হাই স্কুলে পড়ে নিশ্চয়?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

 ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছে?

ইচ্ছে তো হয় অনেক কিছুই। একেকবার একেকটা। কখনও মনে হয়। টীচার হব, কখনও মনে হয় দূর, ছেলে পড়িয়ে কি লাভ? তারচেয়ে মেকানিক হওয়া অনেক ভাল…

 হাসল মেয়েটা, ডিসাইড করা মুশকিল, তাই না? তোমার বার্গার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত বকবক করি আমি। আমি এখান থেকে না গেলে আর খেতে পারবে না।

আধখাওয়া বার্গারটা কখন প্লেটে নামিয়ে রেখেছিল মুসা, ভুলে গিয়েছিল। তুলে নিল আবার। হঠাৎ খেয়াল করল, মনটা আর আগের মত খারাপ নেই। কথা বলতে বলতে ভাল হয়ে গেছে।

না না, আপনি বসুন। খেতে খেতেও কথা বলতে পারি আমি। আমার কোন অসুবিধে হয় না। আপনার নামটাই কিন্তু জানা হলো না এখনও।

ক্রিসি, পাশে কাত হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। তোমার?

মুসা আমান, বার্গারের শেষ টুকরোটা প্লেটে রেখে ক্রিসির হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল মুসা। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।

এসব গতবাধা কথা ন্যাকা ন্যাকা লাগে আমার।

হাসল ক্রিসি। দাঁতগুলো সাদা হলেও ঠিক স্বাভাবিক নয়, সামান্য বাঁকা। তবে দেখতে খারাপ লাগে না। মুসাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কোথাও দেখেছি। কোথায়, বলো তো?

পত্রিকায় হতে পারে, ভাবল মুসা। ওদের স্কুলের বাস্কেটবল টীমকে জিতিয়ে দিয়ে হিরো হয়ে গিয়েছিল সে। বলল, কি জানি। দেখেছেন হয়তো কোনখানে। এখানেও হতে পারে। রোজ আসেন যেহেতুএখানকার বার্গার। আমার খুব পছন্দ।

হ্যাঁ, তাই হবে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দ্রুকুটি করল ক্রিসি। তোমার ঘাড়ে কি হয়েছে? নাকি সমস্যাটা মেরুদণ্ডে?

অবাক হলো মুসা। কি করে বুঝলেন?

 ঘাড় যেভাবে শক্ত করে রাখছ।

খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। বেশি নড়াতে গেলেই খচ করে লাগে।

ডিপ-টিস্যু ম্যাসাজ নিয়ে পড়াশোনা করছি আমি। হাসপাতালে কাজ ( করায় প্র্যাকটিসের সুযোগও পেয়ে গেছি। এই ম্যাসাজে রোগীর সাংঘাতিক আরাম হয়। ব্যথা চলে যায়।

শুধু ম্যাসাজেই? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।

হ্যাঁ, হাতব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে খসখস করে ফোন নম্বর আর ঠিকানা লিখে মুসার দিকে বাড়িয়ে দিল ক্রিসি। এটা রাখো,। ব্যথা বাড়লে যদি প্রয়োজন মনে করো আমাকে ফোন কোরো। বাসায় চলে এলেও বিরক্ত হব না।

কাগজটা সাবধানে পকেটে রাখতে রাখতে হাসল মুসা, গিনিপিগ বানাতে চান?

সত্যি কথা বলব? ঘাড় কাত করল ক্রিসি, চাই। সব ধরনের রোগীর ওপরই পরীক্ষা চালাতে চাই আমি। এরকম মালিশে কোন কোন ব্যথা আরাম হয়, জানাটা জরুরী। ভবিষ্যতে নার্সের চাকরি ছেড়ে ম্যাসাজ পার্লার খুলে বসব।

বলা যায় না, চলেও আসতে পারি একদিন। মাঝে মাঝে ব্যথাটা যা বাড়ে..কি ম্যাসাজ বললেন?

 ডিপ-টিস্যু। ঘড়ি দেখল ক্রিসি। বাপরে, অনেক দেরি করে ফেললাম। উঠে দাঁড়াল সে। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল, মুসা..

গতবাধা কথা। ন্যাকা ন্যাকা।

 হেসে ফেলল ক্রিসি। শোধটা নিয়েই নিলে। চমৎকার কাটল সময়টা। সত্যি ভাল লাগল। বিকেলের পর আর বেরোই না আমি। তোমার ম্যাসাজ দরকার হলে ওই সময়টায় এসো।

ঘাড় কাত করল মুসা।

মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল ক্রিসি। চোখ ফিরিয়ে প্লেটের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল খানিকটা বার্গার পড়ে রয়েছে। অবাক লাগল। হলো কি আজ ওর? খাওয়ার কথা ভুলে যাচ্ছে বার বার?

.

০৩.

ড্যানিদের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে সবে থেমেছে মুসা, তার পেছন পেছনই ঢুকল ড্যানির গাড়িটাও।

এগিয়ে গেল মুসা। ড্যানি গাড়ি থেকে নামতেই বলল, তার মানে বাড়ি ছিলে না। ভালই হলো, দেরি করে এসেছি। বসে থাকতে হলো না।

ড্যানি জানতে চাইল, ছিলে কোথায়? ফোন করে পাওয়া যায় না…

ড্যানিয়েল হার্বার, মুসার ক্লাসফ্রেন্ড। সব সময় হাসিখুশি থাকে। মাথায় ঘন চুলের বোঝা। নাকের ডগাটা মোটা। বড় বড় কানের দিকে ভালমত লক্ষ। করলে চেহারাটা যেন কেমন মনে হয়। কালো দুই চোখে তীক্ষ্ণবুদ্ধির ছাপ। পড়াশোনায় ভাল। অ্যারোনটিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছে।

 মলে গিয়েছিলাম, মুসা জানাল। বাড়িতে রান্না করে খেতে ইচ্ছে করছিল না।

গাড়ির সীটে ফেলে রাখা একটা বাদামী কাগজে মোড়া বাক্স বের করল ড্যানি। খাবারের প্যাকেট। আরেকটা ঠোঙাও তুলে নিয়ে বলল, এসো।

সামনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সে। মুসা ঢুকল পেছনে। লিভিংরূমে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, জয় কোথায়?

ড্যানির ছোট বোন জয়। সাত বছর বয়েস। ভীষণ ভালবাসে ওকে ড্যানি।

আছে।

একা ফেলে গিয়েছিলে!

ড্যানির বাবা-মা বাড়ি নেই, জানে মুসা। ছেলে-মেয়েকে রেখে তারাও বেড়াতে গেছেন।

কি করব? কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল ড্যানি। পেছনের উঠানে একটা পাখি কুড়িয়ে পেয়েছে। বেড়ালে বোধহয় ডানা ভেঙে ফেলেছে ওটার। তুলে এনে সেবাযত্ন শুরু করল। আমাকে হুকুম করল, জলদি দোকানে গিয়ে পাখির দানা নিয়ে এসো। ওকে সঙ্গে নিতে চাইলাম। বলে, ও না থাকলে নাকি পাখিটা মরে যাবে।

লিভিংরূমে ঢুকল জয়। ভাইয়ের বড় বড় কান পায়নি, তবে নাকটা পেয়েছে। চুলের রঙও এক রকম। দুজনের একই স্বভাব-কথা বলার সময়। অনবরত হাত নেড়ে নেড়ে নানা রকম ভঙ্গি করতে থাকে।

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আছে জয়। এগিয়ে এসে ভাইয়ের হাত থেকে ঠোঙাটা প্রায় কেড়ে নিল। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, মুসাভাই, ভাইয়া তোমাকে পাখিটার কথা বলেছে? জানালার নিচে পড়ে ছিল।

বলেছে, হেসে জবাব দিল মুসা। সেবাযত্ন করে নাকি অর্ধেক ভাল করে ফেলেছ।

বাচ্চা তো। কষ্ট বেশি সেজন্যে। ঠোঙার মুখ খুলে ভেতরে তাকাল। জয়। ভাইকে জিজ্ঞেস করল, বাচ্চা পাখির দানা এনেছিস তো?

দানা তো এক রকমই রাখে দোকানে, ড্যানি বলল। বড় পাখি যা খায় ছোটগুলোও তাই খায়। আমার মনে হয় না খাবারের তফাত বুঝতে পারে ওরা।

পারে না মানে? নিশ্চয় পারে! দাঁড়া, দেখে আসি খায় নাকি। নাহলে আবার যেতে হবে তোকে দোকানে। দোকানদারকে কড়া করে বলবি যাতে বাচ্চার দানা দেয়। দৌড়ে চলে গেল জয়।

খাইছে! যদি সত্যি না খায়?

 কি আর করব? শঙ্কিত ভঙ্গিতে চুলে হাত চালাল ড্যানি। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। যেতেই হবে আবার। কিন্তু সত্যি কি বাচ্চা পাখি আর বুড়ো পাখিদের খাবার আলাদা?

মনে হয় না। কখনও খেয়াল করিনি।

মুসাকে নিজের বেডরূমে নিয়ে এল ড্যানি। ঢুকেই দেখল অ্যানসারিং মেশিনের লাল আলোটা টিপটিপ করছে।

এগিয়ে গেল ড্যানি। রিসিভার ভোলার জন্যে হাত বাড়িয়ে বলল, বাড়ি ফিরেই যখন দেখি কেউ আমার খোঁজ করছিল, ভাল লাগে খুব। নিশ্চয় কোন বন্ধু।

যদি ইনশুয়ারেন্সের দালাল হয়?

ওরা কখনও মেসেজ রাখে না। হুট করে বাড়িতে ঢুকে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। ভাল করেই জানে, বলেকয়ে এলে কাউকে পাবে না। কেউ ওদের সামনে যাবে না। বাড়িতে থাকলেও নেই বলে দেবে। তবু মনে যখন করিয়ে দিয়েছ, সাবধান হওয়াই ভাল। বলা যায় নাঃ::

প্লে করল ড্যানি। একটামাত্র মেসেজ। রবিন করেছে। বেশ উদ্বিয় মনে হচ্ছে ওর কণ্ঠ। বলেছে, ড্যানি যখনই ফিরুক, সঙ্গে সঙ্গে যেন সোফিদের বাড়িতে ফোন করে।

অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকাল ড্যানি। মুসাও অবাক। জবাব দিতে পারল না। কোনমতে বলল, ওই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু নয় তো?

কোন… ঢোক গিলল ড্যানি। বুঝে ফেলেছে। ভয়ে ভয়ে তাকাল মুসার দিকে। আমার ফোন করতে ভয় লাগছে। কি জানি কি শুনব! প্লীজ, তুমি করো!

 মুসাও দ্বিধা করতে লাগল। ঠিক আছে, করছি। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল।

একবার রিঙ হতেই রিসিভার তুলে নেয়ার শব্দ পেল মুসা। জবাব দিল সোফি, হালো?

মুসা। রবিন আছে?

আছে।

কি হয়েছে, সোফি?

রবিনকে দিচ্ছি, কথা বলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে সোফির, ওর কাছেই শোনো।

রিসিভার হাত বদল হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল মুসা।

 কোত্থেকে বলছ, মুসা? জানতে চাইল রবিন।

ড্যানিদের বাড়ি থেকে।

ড্যানি আছে?

আছে। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কি হয়েছে?

দ্বিধা করতে লাগল রবিন। কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না।

বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে মুসার। নিশ্চয় মরুভূমির। ব্যাপারটাই। বলে ফেলো।

মুসা?

বলো না। শুনছি তো।

লম্বা একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল রবিন। মুসা, কে জানি একটা অদ্ভুত চিঠি পাঠিয়েছে।

কি বললে? রবিনের কথাটা যেন বুঝতে পারেনি মুসা।

অদ্ভুত একটা চিঠি। না দেখলে বুঝবে না।

মরুভূমির কথা কিছু লিখেছে?

পরিষ্কার করে বলেনি। তবে মনে হয় ওই কথাটাই বলতে চেয়েছে। ড্যানিকে জিজ্ঞেস করো তো, ও আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে লিখেছে কিনা?

ও কেন দেখাবে? করল তো ও-ই।

তবু…

আচ্ছা, করছি! জিজ্ঞেস করল মুসা, ড্যানি, সোফিকে ভয় দেখানোর জন্যে কোন চিঠি লিখেছ?

ভুরু ওপরে উঠে গেল ড্যানির, না তো!

সত্যি?

মিথ্যে বলব কেন?

না, কোন চিঠিটিঠি লেখেনি, রবিনকে জানাল মুসা।

 ঠিক বলছে তো?

ড্যানির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। উদ্বিগ্ন লাগছে ড্যানিকে। না, বলছে না। চিঠিটা পড়ো তো শুনি।

পড়ে শোনাল রবিন। কোন পোস্ট অফিসের সিল আছে জানাল। মুসা চুপ করে থাকায় জিজ্ঞেস করল, মুসা, শুনছ?

হ্যাঁ। ঢোক গিলল মুসা। বুকের দুরুদুরু আরও বেড়েছে।

চিঠির কথামতই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, রবিন জানাল। সাঙ্কেতিক ভাষায়। লিখেছে: সোফির কুকুরের বাচ্চাটাকে ওর নিজের হাতে চুবিয়ে মারতে হবে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে।

দম বন্ধ করে ফেলল মুসা। বলো কি?

মুসা, কেউ জোক করেনি তো? ক্লডিয়া? কিংবা অন্য কেউ?

 কি জানি। জিজ্ঞেস না করে বলি কিভাবে। ওকে ফোন করেছিলে?

নাহ। ভাবলাম তুমি করলেই ভাল হয়। তোমার সঙ্গে খাতির বেশি।

বেশি আর কই…

তবু

ঠিক আছে। করব।

মুসা, নামের সারিতে আমার নামটা নেই।

তাই নাকি?

ইন্টারেস্টিং, তাই না?

না, ডেঞ্জারাস! সোফি আবার ভাবছে না তো তুমি লিখেছ?

না, ভাবছে না।

 ভাবনা চলেছে মুসার মাথায়। চিঠিতে যে কজনের নাম লেখা আছে, সবার এই বিপদের জন্যে ড্যানি দায়ী। গাড়িটা সে চালাচ্ছিল। আহাম্মকি করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টটা করেছে।

মুসা?

বলো।

খুব মুষড়ে পড়েছে সোফি।

পড়বেই। প্রথম পরীক্ষাটা ওকেই দিতে হবে। জোক, না সত্যি, এটা আগে ওকেই প্রমাণ করতে হবে। কুকুরের বাচ্চাটাকে না মারলে হয়তো সত্যি সত্যি বিপদে পড়তে হবে তাকে। এখনও কিছুই বলা যাচ্ছে না কি ঘটবে!

ডিসাইড করতে পারছে না ও কি করবে।

পারা সম্ভবও নয়। ঠিক আছে, আমি এখনই ক্লডিয়াকে ফোন করছি। দেখি কি বলে?

যা বলে জানিয়ো। তাড়াতাড়ি। ওকে না পেলেও জানিয়ো। রাখব?

রাখো।

লাইন কেটে দিয়ে ড্যানিকে সব জানাল মুসা।

গম্ভীর হয়ে গেল ড্যানি। পায়চারি শুরু করল। ফিরে তাকিয়ে বলল, ক্লডিয়া যদি না লিখে থাকে তো ভয়ের কথা। বাইরের কেউ লিখেছে। অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা জানে। জানল কি করে?

 সেটা পরেও ভাবা যাবে। ক্লডিয়াকে ফোন করে দেখো আগে কি বলে।

আবার রিসিভার কানে ঠেকাল মুসা।

ফোন ধরলেন মিসেস নিউরোন, ক্লডিয়ার আম্মা। জানালেন, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পর্বতের ওদিকে বেড়াতে চলে গেছে সে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিল মুসা।

কি বলল? মুসার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ড্যানি।

 বেড়াতে চলে গেছে। ইয়োজিমাইটে। বৃহস্পতিবারের আগে ফিরবে না।

হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে আবার পায়চারি শুরু করল ড্যানি। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। মুসা, কি মনে হয় তোমার? ক্লডিয়াই একাজ করেছে?

কি জানি। তবে না করার সম্ভাবনাই বেশি। কেন করবে? সে নিজেও এতে জড়িত। পুলিশকে না জানানোর জন্যে চাপাচাপিটা সে-ই বেশি। করেছিল। সে নিজে যে ব্যাপারে ভয়ে অস্থির, সেটা বলে সোফিকে ভয় দেখানোর কথা ভাবাটাই অর্থহীন। তা ছাড়া রবিন বলল, খামের ওপর। লোকাল পোস্ট অফিসের সিল মারা। ক্লডিয়া গেছে সাতদিন আগে। চিঠিটা। এসেছে আজকে। যদি সত্যিই ও লিখে থাকত, ইয়োজিমাইট পোস্ট অফিসের সিল থাকত।

তা ঠিক। আচ্ছা, সোফি, মারলা আর রবিন মিলে আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছে না তো? ভয় দেখানোর জন্যে?

রবিনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ কানে বাজতে লাগল মুসার। উঁহু! রবিন তো এ ধরনের রসিকতা করবেই না। সোফি আর মারলাও করবে না। তা ছাড়া। ক্লডিয়ার মতই ওদেরও করার কোন যুক্তি নেই।

সেটাই তো কথা। তাহলে?

উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ড্যানি। বাইরে তাকাল। ভাল এক ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি আমরা। তত্ত্বাবধায়ক–কি অদ্ভুত নাম! নির্ঘাত লোকটা উন্মাদ। বিকৃত মস্তিষ্ক। ভয়ানক নিষ্ঠুর। নইলে একটা কুকুরের বাচ্চাকে চুবিয়ে মারার কথা কল্পনাও করতে পারত না।

তোমার কি ধারণা সোফি সত্যি বিপদের মধ্যে আছে? আমার ফোনের অপেক্ষা করছে ওরা। একটা কিছু বলতে হবে।

মলিন হাসি হাসল ড্যানি। বাচ্চাটাকে মেরে ফেললে অবশ্য সোফির আর কোন রকম বিপদের আশঙ্কা থাকে না।

তা থাকে না। কিন্তু ওকাজ কি আর করা যায় নাকি!

যায় না। আমি হলে অন্তত পারতাম না। বলো, ক্লডিয়া বেড়াতে গেছে। ওর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। কিংবা বলতে পারো, আমাদেরও অনুমান চিঠিটা ক্লডিয়াই লিখেছে। সবার মুখ থেকে এক কথা শুনলে সোফি খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারবে।

তা পারবে না। ও নিশ্চিত হতে চাইবে।

জানালার কাছ থেকে ফিরে এসে মুসার মুখোমুখি দাঁড়াল ড্যানি। একটা কথা বলি?

বলো।

এভাবে সর্বক্ষণ একটা দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপের মধ্যে না থেকে পুলিশের কাছে চলে যাই। সব খুলে বলি। আমার একার জন্যে তোমাদের সবাইকে এভাবে ভোগানোর…

অনেক দেরি করে ফেলেছি। সোজা নিয়ে গিয়ে জেলে ভরবে পুলিশ এখন। তা ভরুক..তবে ভাবছি, পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। সবাই যখন এতে জড়িত, সবার একসঙ্গে বসে আলোচনারও দরকার আছে।

তাহলে তো ক্লডিয়াকেও থাকতে হবে মীটিঙে। কবে আসছে ও?

বললাম না বৃহস্পতিবার।

 সোফিকে কবে পর্যন্ত সময় দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক?

বৃহস্পতিবার।

তারমানে কুকুরের বাচ্চাটাকে না মারলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বেঁচে থাকছে সোফি। তাহলে আর অত চিন্তার কিছু নেই। তত্ত্বাবধায়ক কিছু ঘটানোর আগেই মীটিঙে বসার সময় পাচ্ছি আমরা।

.

০৪.

ওদের জন্যে বৃহস্পতিবারটা এল আর গেল কোন রকম নতুনত্ব না নিয়ে। ক্লডিয়া ফিরল না। অতএব আলোচনায় বসাও আর হলো না।

সারাদিন সাফির সঙ্গে কাটাল মারলা। মলে কেনাকাটা করল। সিনেমা দেখতে গেল। সারাটা দিন মোটামুটি শান্তই রইল সোফি। রাত বারোটা পর্যন্ত তার সঙ্গে সঙ্গে রইল মারলা। রাতেও থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু সোফি বলল লাগবে না। তার আম্মা ফিরেছেন।

সকালে ফোন করে খবর নেবে বলে বাড়ি ফিরে গেল মারলা।

কথামত পরদিন সকালে ফোন করল সে। ভালই আছে সোফি।

খবরটা সবাইকে জানিয়ে দিল মারলা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা। যাক, চিঠিটা আসলেই একটা ফালতু রসিকতা ছিল।

ক্লডিয়ার ফেরার অপেক্ষায় রইল সবাই। কিন্তু ফিরল না সে। মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল আরও একদিন দেরি হবে।

শুক্রবার রাত।

সকাল সকাল শুয়ে পড়ল রবিন। মাথা ধরেছে। গত কদিন ধরে যা উত্তেজনা যাচ্ছে। শোয়র সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। নানা রকম অদ্ভুত স্বপ্ন। দেখতে লাগল। কানের কাছে দমকলের ঘন্টা শুনে যেন ঘুম ভেঙে গেল ওর। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল বিছানায়।

ফোন বাজছে। চমকে গেল। এতরাতে কে? বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করল যেন ওর। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। হালো?

রবিন?

হ্যাঁ। কে?

মিসেস হল।

ধড়াস করে এক লাফ মারল রবিনের হৃৎপিণ্ড। দম আটকে এল। সোফির কি হয়েছে? ভাল আছে ও?

ফুঁপিয়ে উঠলেন সোফির আম্মা। জানি না। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সোফি। আমাকে এখুনি যেতে বলেছে। সোফির বাবা বাড়ি নেই। আমিও চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না। রবিন, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে? এই অবস্থায় আমি গাড়ি চালাতে পারব না।

এতটাই অস্থির হয়ে পড়েছেন মহিলা, ভুলে গেছেন বহুদুরে থাকে রবিন। গাড়িতে করে যেতেও অন্তত একটি ঘণ্টা লাগবে ওর।

নিশ্চয় পারব, বলল রবিন, তবে আমার আসতে তো অনেক সময় লেগে যাবে। তারচেয়ে মুসাকে ফোন করে দিচ্ছি, সে আপনার অনেক কাছাকাছি থাকে। আমিও আসছি। হাসপাতালে দেখা হবে।

আচ্ছা, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন মিসেস হল। মেয়ে কেমন আছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম। কোন জবাব দিল না হাসপাতাল থেকে। ও মরে যায়নি তো?

না, মিসেস হল। সোফির অবস্থা সম্পর্কে এখনও শিওর না হয়তো ওরা। সেজন্যেই কিছু জানাতে পারেনি। ভাববেন না। কিছু হয়নি সোফির। কোন্ হাসপাতালে নিয়েছে?

জেনে নিয়ে মুসাকে ফোন করল রবিন।

অবাক কাণ্ড। একবার রিঙ হতেই রিসিভার তুলে নিল মুসা। যেন তৈরি হয়ে বসেছিল ফোনের কাছে। ঘুমায়নি, ওর কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারল রবিন। ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে একটা। কি করছে মুসা?

মুসা?।।রবিন। খারাপ খবর আছে।

সোফির?

তুমি কি করে জানলে?

অনুমান। কি হয়েছে ওর?

 মিসেস হল ফোন করেছিলেন, কি হয়েছে মুসাকে জানাল রবিন।

দশ মিনিটের মধ্যেই চলে যাচ্ছি আমি।

তুমি খারাপ খবর শোনার জন্যে বসে ছিলে, তাই না? ঘুমাওনি কেন?

 ঘুম আসছিল না।

কি মনে হয়, মুসা? সোফি কি মারা গেছে?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। জানি না! আজকাল আর কোন কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না…অ্যাক্সিডেন্টটার পর থেকে কোন কিছু বেশি। ভাবলেই মাথা ধরে…

আমারও!

.

সোফি মারা গেছে!

খবরটা একই সঙ্গে শুনল ওরা তিনজন। রবিনদের গোস্ট লেনের বাড়ি থেকে হাসপাতাল অনেক দূর। তবু মুসার গাড়িটা যখন হাসপাতালের পার্কিং লটে ঢুকল, তার মিনিটখানেক পর রবিনও ঢুকল। মুসা ঠিকমতই সোফিদের বাড়িতে পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রচণ্ড অস্থিরতার কারণে নানা রকম অঘটন ঘটিয়ে বেরোতে দেরি করে ফেলেছেন মিসেস হল।–

হাসপাতালে মেয়ের খবর শুনে বেহুশ হয়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি নার্সরা ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল তাকে। রবিনের মাথা ঘুরছে। যে ডাক্তার ওদের খবরটা দিলেন, বলার ভঙ্গিতে মনে হলো মৃত্যু নয়, সাধারণ সর্দি লাগার খবর দিচ্ছেন যেন। মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, সবুজ সার্জিক্যাল গাউনে রক্ত লেগে আছে। ইমার্জেন্সি রূমে ডিউটি করেন। সারাক্ষণ জখমী রোগী আসতেই আছে। গাড়ি দুর্ঘটনা, ছুরি মারামারি, গুলিতে আহত রোগী, আসে বিরামহীনভাবে। এত দেখতে দেখতে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে ডাক্তারের। মৃত্যু আর কোন প্রতিক্রিয়া করে না তার মনে। কাউকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শোনাতে বিন্দুমাত্র মুখে আটকায় না আর।

অ্যাক্সিডেন্টটা হলো কিভাবে? হাঁটু কাঁপছে রবিনের। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।

মাথা নেড়ে বললেন ডাক্তার, শুনিনি। পুলিশকে জিজ্ঞেস করে দেখো।

বোকার মত প্রশ্ন করে বসল রবিন, সত্যি মারা গেছে, নাকি ভুল হয়েছে। আপনাদের? মানে, আমি বলতে চাইছি এখনও কোন সম্ভাবনাঃ…ভালমত চেষ্টা করলে এখনও হয়তো বাঁচানো যায়…

শূন্য দৃষ্টি ফুটল ডাক্তারের চোখে। হাসপাতালে আনার অনেক আগেই মরে গেছে। হাত ছোঁয়ানোরও সুযোগ পাইনি আমরা।

পুলিশ চলে যাওয়ার আগেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মুসার দিকে তাকাল রবিন। মুখের যা ভঙ্গি করে রেখেছে মুসা, তাতে বোঝা যায় ওর মানসিক অবস্থাও সুবিধের না। তাকে নিয়ে পার্কিং লটে বেরিয়ে এল রবিন। যে অ্যাম্বুলেন্সে করে সোফিকে আনা হয়েছে, তার ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে একজন পুলিশ অফিসার।

এগিয়ে গেল রবিন। এক্সকিউজ মি, অফিসার, বলল সে। কার অ্যাক্সিডেন্ট করা যে মেয়েটাকে এক্ষুণি নিয়ে এলেন আপনারা, আমি তার বন্ধু। ডাক্তারের কাছে শুনলাম মারা গেছে। আপনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন?

 তরুণ অফিসার। সুন্দর করে ছাঁটা বাদামী গোফ। নীল ইউনিফর্ম চমৎকার ফিট করেছে। গাড়ি ঘেষে দাঁড়িয়ে রবিনের দিকে তাকাল। ডাক্তারের মত ভাবলেশহীন মুখ নয়। অন্তত খানিকটা অনুভূতি এর আছে।

 হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, রবিনের বাহু স্পর্শ করল অফিসার। তোমার বন্ধুর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। এত অল্প বয়েসেই শেষ হয়ে গেল বেচারি।

কিভাবে অ্যাক্সিডেন্ট করল?,

গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়েছিল। রাস্তার ধারের একটা অলিভ গাছ। এমন গুতেই মেরেছে, গাছটাও শেষ, গাড়িটাও ভর্তা।

ব্রেক ফেল করেছিল নাকি? না চাকা পিছলে গিয়েছিল?

কোনটাই না। চাকা পিছলালে ব্রেক করত। তাতে স্কিড মার্ক থাকত। ওরকম কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। নেশার ঘোরে থাকলে কিংবা ঘুম পেলে অনেক সময় স্টিয়ারিঙে হাত ঠিক থাকে না। তীব্র গতির সময় স্টিয়ারিং সামান্য ঘুরলেও গাড়ি অনেক সরে যায়। রাস্তায় সামান্য পরে পরেই গাছ। গুতে লাগিয়েছে বোধহয় ওসব কোন কারণেই। গাড়ির অবস্থা দেখে মনে হয় ষাট মাইল বেগে ছুটছিল।

ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছে?

পায়ের ভার বদল করল অফিসার। অস্বস্তি বোধ করছে। কোন সন্দেহ নেই তাতে।

এত শিওর হচ্ছেন কি করে?

শুনলে ভাল লাগবে না তোমাদের।

 গোলাপী কাগজে লেখা চিঠিটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল রবিনের। তবু, বলুন।

মুখ নিচু করল অফিসার। দেখো, সত্যি ভাল লাগবে না।

আমি জানতে চাই।

জানালা ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল ওর মাথা। গাছের ডালে গলা টান লেগে ঘাড় ভেঙেছে। প্রচণ্ড ঝাড়া লেগে…

বলুন? কি হয়েছিল প্রচণ্ড ঝাড়া লেগে?

গাল চুলকাল অফিসার। দেখো, অ্যাক্সিডেন্টে মানুষ মারা গেলে লাশের চেহারা আর চেহারা থাকে না। তার ওপর যদি ধড় থেকে গলা ছিঁড়ে গিয়ে মাথাটা…

আর সহ্য করতে পারল না মুসা। কপাল টিপে ধরল।

 রবিনও কাঁপতে শুরু করেছে।

আগেই বলেছিলাম তোমাদের, সহ্য করতে পারবে না, অফিসার বলল। বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার পাশের একটা ঝোপে পাওয়া গেছে ওর মাথাটা।

০৫.

ব্ল্যাক ফরেস্ট পার্কে বসে আছে ওরা। পার্কটা শহরের একধারে, হাই স্কুলের পেছনে। পাশ দিয়ে বইছে গ্রে উইলো রিভার। নির্জন পার্ক। বিমর্ষ, গভীর পরিবেশ।

ক্লডিয়াও এখন আছে ওদের সঙ্গে। পর্বত থেকে ফিরেছে। সেদিন সকালের ডাকে একটা চিঠি পেয়েছে ড্যানিয়েল। সোফির চিঠিটার হুবহু নকল। তফাত কেবল নামের সারিতে ওপরের নাম অর্থাৎ সোফির নাম নেই। সাঙ্কেতিক একটা বিজ্ঞপ্তিও ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। লিখেছে:

ছোট বোনের ডান হাত পুড়িয়ে দাও

কে ডেকেছে এই মীটিং? জানতে চাইল রবিন। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছে। তার পাশে বসে একটা ঘাসের ডগা দাঁতে কাটছে মারলা। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। খবরটা শোনার পর থেকে কারোরই মন-মেজাজ ভাল নেই।

মীটিং ডাকিনি, ক্লডিয়া বলল। সবাইকে একজায়গায় হতে বলেছি যার যা ইচ্ছে বলার জন্যে।

লাভটা কি তাতে?

যদি কোন সমাধান বেরিয়ে আসে।

ভাল কথা, রবিন বলল। তাহলে বসে আছ কেন সবাই চুপচাপ?

বুঝতে পারছি না কিভাবে শুরু করব। আজকে আর উগ্র পোশাক পরেনি ক্লডিয়া, সাধারণত যেমন পরে থাকে সে। খাটো করে ছাঁটা তুষারশুভ্র চুল। চুলের রঙ আর শার্টের রঙ এক। পরনে নীল জিনস। ঠোঁটে লিপস্টিক আছে, তবে খুবই পাতলা করে লাগানো। মেকআপ নেয়নি বললেই চলে। ওর এই মেকআপ নিয়ে মারলা তো প্রায়ই ইয়ার্কি মেরে বলে এক কেজি পাউডার আর আধা কেজি লিপস্টিক না হলে ক্লডিয়ার মেকআপই হয় না। আজ সেসব প্রায় কিছুই নেই।

নড়েচড়ে বসল ড্যানি, এরপর আমার পালা। চিঠি এবং গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে যা যা জানি সেটা নিয়ে প্রথমে আলোচনা করতে পারি আমরা। তারপর করতে পারি যা জানি না সেটা নিয়ে। কেমন হয়?

ভাল, নিচুস্বরে বলল মুসা। সবার কাছ থেকে সামান্য দূরে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছে। সারারাত ঘুমায়নি। এখন সকাল এগারোটা। বাজে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কথাবার্তা শেষ হলে এখানে এই ঘাসের মধ্যে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়বে।

এই চিঠি এমন কেউ লিখেছে, শুরু করল ড্যানি, যে আমাদের সবাইকে চেনে। আমাদের গোপন ব্যাপারটা সম্পর্কে জানে। প্রথমে ভেবেছিলাম রসিকতা করছে, কিংবা ফাঁকা বুলি ঝাড়ছে সে। কিন্তু সোফির খুন হওয়ার পর এখন বুঝতে পারছি সে সিরিয়াস। সোফিকে তত্ত্বাবধায়কই খুন করেছে।

কি সব ছেলেমানুষের মত কথা বলছ, ড্যানির কথায় একমত হতে পারল না ক্লডিয়া। সোফি গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। পুলিশের মতে এটা নিছকই দুর্ঘটনা। রাতের বেলা এত জোরে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।

এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত, রবিন বলল। ওর মনের যা অবস্থা হয়েছিল, তাতে অন্যমনস্ক থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। এর জন্যে অবশ্যই দায়ী করতে হবে তত্ত্বাবধায়ককে। তার মানে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে এই খুনের জন্যে সে-ই দায়ী।

কিন্তু বড় বেশি কাকতালীয়; মেনে নিতে পারছে না ড্যানি।

তোমার কি ধারণা অলৌকিক কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করে সোফিকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে বাধ্য করেছে তত্ত্বাবধায়ক? হাত নাড়ল রবিন, আমি, একথা বিশ্বাস করতে রাজি না।

কিন্তু একটা কথা তো ঠিক, মারলা বলল, চিঠিতে লিখেছিল ওর কথার অবাধ্য হলে মারাত্মক পরিণতি ঘটবে। সোফি অবাধ্য হয়েছে, ওর কথামত কুকুরের বাচ্চাটাকে চুবিয়ে মারেনি, অতএব তাকে মরতে হলো। আর কি। ভয়ঙ্কর মৃত্যু! ধড় থেকে মাথাই আলাদা… কেঁপে উঠল মারলা। চোখের কোণে পানি টলমল করে উঠল। সোফির জন্যে থেকে থেকেই কাঁদছে। খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল।

 বেশি নাটকীয় করে ফেলছ সবকিছু, অত আবেগের ধার দিয়ে গেল না ক্লডিয়া। অ্যাক্সিডেন্ট হলে আরও কত বিকৃত হয়ে যায় মানুষের দেহ। টুকরো টুকরো হয়ে যায়, থেতলে ভর্তা হয়ে যায়। সেই তুলনায় এটা তো কিছুই না।

তা ঠিক, একমত হয়ে মাথা দোলাল ড্যানি। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক অ্যাক্সিডেন্ট বলে ধরে নেয়াই ভাল। কারণ ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক গাড়িতে ছিল না। থাকলে সে-ও বাচত না। চিঠি যখন লিখতে পারে, তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ভূত নয় সে। তোমার-আমার মতই মানুষ। আমার ধারণা, সরাসরি ও খুন করেনি সোফিকে। তবে পরোক্ষভাবে যে এই খুনের জন্যে সে দায়ী, তাতেও কোন সন্দেহ নেই।

 আচ্ছা, মুসা বলল, গাড়ির যন্ত্রপাতির মধ্যে কোন কারসাজি করে রাখেনি তো তত্ত্বাবধায়ক? যাতে ব্রেক ফেল করে…

ব্রেক ফেল করে মারা যায়নি সোফি। মনে করিয়ে দিল রবিন, পুলিশ অফিসার কি বলল? গাছের সঙ্গে তো লাগিয়েছে। তারমানে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে রাস্তা থেকে সরে ধাক্কাটা লাগিয়েছিল সোফি। এর মধ্যে জেমস বন্ড ভিলেনদের শয়তানি খুঁজে লাভ নেই।

কিন্তু শয়তানি তো কেউ একজন করছে। এই চিঠিই তার প্রমাণ।

তবে সে সোফিকে খুন করেনি, এটাও ঠিক, জোর দিয়ে বলল ক্লডিয়া।

ড্যানি বলল, আমার প্রশ্ন, এই তত্ত্বাবধায়ক লোকটা কে?

কেউ জবাব দিতে পারল না। একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। জবাবের আশায়। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রবিন বলল, আমার কি মনে হচ্ছে জানো? মরুভূমিতে যে লোকটাকে কবর দিয়ে এসেছি আমরা, তার কোন পরিচিত লোক কিংবা বন্ধু হতে পারে।

সে কেন করবে একাজ?

প্রতিশোধ। আমরা ওর বন্ধুকে খুন করেছি। সে এখন আমাদের শাস্তি দেবে।

ব্ল্যাকমেইল?

না, তাহলে টাকা চাইত। বা অন্য কোন কিছু। সে আমাদের এমন সব কাজ করতে বলছে, যাতে আমরা ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা পাই।

সেই লোকটা কে? আবার আগের প্রশ্নে ফিরে গেল ড্যানি।

কি করে বলব? হতাশ ভঙ্গিতে দুই হাত তুলল রবিন। জানলে তো গিয়ে চেপেই ধরতাম। যে লোকটাকে গাড়ি চাপা দিলাম তার পরিচয়ই জানি না, আর এর কথা জানব কিভাবে?

 এখন কিশোরকে খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের, হাই তুলতে তুলতে। বলল মুসা। এত জটিল একটা ধাঁধার সমাধান ও ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না।

আবার এক মুহূর্ত নীরবতার পর ক্লডিয়া বলল, আমাদের মধ্যে কেউ কাজটা করিনি তো? জোক করার জন্যে? সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল সে।

তুমি কিছু করেছ কিনা তুমি জানো, মারলা বলল, তবে আমি এই জঘন্য চিঠি লিখিনি। সোফিকেও আমি খুন করিনি।

আবার খুনের কথা আসছে কেন? ও তো নিজে নিজে অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। আমি বলতে চাইছি চিঠিটার কথা:..

লিখলে তাহলে তুমিই লিখেছ, রেগে গেল মারলা, তোমার মাথায়ই ছিট আছে। এখানে ছিলেও না অনেকদিন। চিঠি লিখে ডাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে। তোমার এই জঘন্য শয়তানির জন্যেই ঘাবড়ে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে সোফি মারা গেছে। ওর মৃত্যুর জন্যে তুমি দায়ী।

দেখো, মুখ সামলে কথা বোলো! আগুন জ্বলে উঠল ক্লডিয়ার চোখে। চিঠিটা যেদিন পেয়েছ তোমরা তার বহু আগে আমি শহর থেকে চলে গেছি…

আহ, কি শুরু করলে তোমরা! বিরক্ত হয়ে হাত নাড়ল রবিন। নিজেরা নিজেরাই মারামারি শুরু করে দিচ্ছ! থামো! চুপ করো!

মুসা বলল, অহেতুক নিজেদের সন্দেহ করছি আমরা। আমাদের মধ্যে কেউ তত্ত্বাবধায়ক নই। আসল কথা বাদ দিয়ে বসে বসে ঝগড়া করলে কাজ এগোবে না।

সরি! নিজেকে সামলে নিল মারলা।

 ক্লডিয়ারও চোখের আগুন নিভে এল।

ড্যানি বলল, সমস্যাটা এখন আমার কাঁধে। কারণ এরপর আমাকে টার্গেট করেছে তত্ত্বাবধায়ক। যে কাজটা করতে বলেছে মরে গেলেও আমি তা করতে পারব না।

তা তো সম্ভবই নয়, মাথা নাড়ল ক্লডিয়া। যত বড় হুমকিই দিক তত্ত্বাবধায়ক, ছোট বোনের হাত পোড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।

পুলিশকে জানানো দরকার, রবিন বলল।

 মাথা সোজা করল মারলা। পাগল হয়েছ?

না, হইনি। একটা অন্যায়কে ধামাচাপা দিতে গিয়েই আজ আমাদের এই অবস্থা। কেউ মানসিক শান্তিতে নেই। বুকে হাত রেখে কেউ বলতে পারবে না ঘটনাটার পর কোন একরাত শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছে কেউ। আর সেই অপরাধটা গোপন করার কারণেই চিঠি লিখে হুমকি দেয়ার সুযোগ পেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক।

পুলিশকে জানালে এখন জেলে যেতে হবে, ভোঁতা গলায় বলল ড্যানি। তাতে আমার অন্তত আপত্তি নেই। কারও থেকে থাকলে সে গিয়ে আগে একজন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারো।

তোমার শাস্তিটাই সবচেয়ে বেশি হবে, ড্যানি, মারলা বলল। কারণ গাড়িটা তুমি চালাচ্ছিলে। লোকটাকে তুমি চাপা দিয়েছ…

সেজন্যেই তো যেতে চাই। যতই দিন যাবে, মনের যন্ত্রণা বাড়বেই, শুধু, কমবে না। এই পনেরো দিনে সেটা ভালমতই বোঝা হয়ে গেছে আমার। কোন শাস্তির ভয়েই আর ব্যাপারটা গোপন রাখতে রাজি নই আমি।

কিশোর থাকলে আমাদের এই অবস্থা হত না, রবিন বলল। একটা না একটা ব্যবস্থা করেই ফেলত ও।

কি করত? ভুরু নাচাল ক্লডিয়া। এটা কোন রহস্য নয় যে তার সমাধান করবে। জলজ্যান্ত একজন লোককে গাড়িচাপা দিয়ে মেরে ফেলেছি। আমরা। কিশোর কি করবে? সবারই কমবেশি দোষ ছিল সেদিন। ড্যানি তো বলেইছিল, কনসার্ট শুনে মাথা গরম হয়েছিল ওর, চেঁচামেচিতে কানের মধ্যে ঝা-ঝা করছিল, তারপরেও ওকে গাড়ি চালাতে দিলাম কেন? দিলাম তো দিলাম, শান্তভাবে চুপচাপ বসে থাকলেই পারতাম। এমন হট্টগোল শুরু করলাম গাড়ির মধ্যে, এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগলাম, স্যান্ডউইচ নিয়ে খাবলাখাবলি শুরু করলাম যেন জীবনে খাইনিঃ…এবং তার ওপর হেডলাইট না। জেলে অন্ধকারে গাড়ি চালানোর বাজি..

থাক, ওসব স্মৃতিচারণ করে আর লাভ নেই এখন, বাধা দিল রবিন। ভাবলেও রাগ লাগতে থাকে। বরং ড্যানির ব্যাপারটা নিয়ে কি করা যায় তাই বলো।

যদি মনে করো, ক্লডিয়া বলল, তত্ত্বাবধায়কের কথা না শুনলে সত্যি সে কোন অঘটন ঘটাবে, তাহলে পুলিশের কাছে যাওয়াই ভাল।

ঘটায় কিনা সেটা দেখলে কেমন হয়? প্রস্তাবটা ড্যানিই দিল।

সত্যি দেখতে চাও?

চাই বলাটা ভুল হবে। হুকুম যা দিচ্ছে তাতে তো পরিষ্কার সে একটা উন্মাদ। কোন সুস্থ লোক এসব করার কথা বলতে পারত না। কাপুরুষ বলো আর যা-ই বলো, কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়াই উচিত এখন। আমার, তত্ত্বাবধায়কের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কোথায় গেছি জানতেও পারবে না সে, ক্ষতিও করতে পারবে না।

.

০৬.

পুরানো প্রিয় জায়গায় ফিরে যেতে ভাল লাগে মানুষের। বিশেষ করে সেই জায়গাটা যদি কোন কারণে তার কাছে নিষিদ্ধ হয়ে যায় তাহলে আকর্ষণ যেন আরও বেড়ে যায়। রকি বীচে ফিরে অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতে কখন যে স্কুলের স্টেডিয়ামের কাছে চলে এল মুসা, নিজেও বলতে পারবে না। বাইরে গাড়ি রেখে মাঠে ঢুকল। বাস্কেটবল খেলতে তাকে আপাতত বারণ করে দিয়েছেন ডাক্তার। তবে এটাও বলেছেন, মেরুদণ্ড ব্যথা করলেও হালকা ব্যায়ামে কোন অসুবিধে হবে না। ভাল দৌড়াতে পারে সে। মানে, পারত। কোয়ার্টার মাইল আর হাফমাইলে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এখনও কি শরীরের সে-ক্ষমতা অটুট আছে?

শার্ট-প্যান্ট-জুতো খুলে রেখে শুধু আন্ডারওয়্যার পরে মাঠের একধার থেকে দৌড়ানো শুরু করল সে। প্রথমে খুব ধীরে। গতি বাড়তে লাগল। ছন্দময় পদক্ষেপ। দেখতে দেখতে গতি উঠে গেল অনেক।

জোরে জোরে দম ফেলছে। কিন্তু পরিশ্রম লাগছে না। বাহ্, ভালই তো পারছে। যেন মুক্তির আনন্দ। ডানাভাঙা পাখির ডানা ফিরে পাওয়ার মত। মন থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় হয়ে যাচ্ছে সমস্ত দুশ্চিন্তা। বিষণ্ণতা কেটে যাচ্ছে।

এক মাইল দৌড়াল সে-দুই মাইল:-তিন-চার…

থামল যখন, দেহের প্রতিটি পেশি অবশ হয়ে গেছে। ঘামছে দরদর করে। হেঁটে চলে এল মাঠের ধারে একটা গাছের নিচে। সবুজ ঘাসে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে। আকাশ দেখতে পাচ্ছে। নীল, পরিষ্কার আকাশ। মন উড়ে গেল যেন সুদূর মহাশূন্যে। ভেসে বেড়াতে লাগল শরীরটা।

ঘুম ভাঙলে দেখল আকাশের নীল রঙ ধূসর হয়ে গেছে। ঝলমলে রোদ হারিয়ে গেছে বহু আগে। তারা ফুটবে এখনই। অন্ধকারের দেরি নেই। কি কাণ্ড! সারাটা দিন গাছের নিচে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল, অথচ মনে হচ্ছে এই তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে শুয়েছে।

উঠে বসল। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। ব্যথা করছে সর্বাঙ্গ। এত ঘুমিয়েও ঝরঝরে হয়নি। তবে দুশ্চিন্তা করল না সে। ব্যায়ামে দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে আবার হঠাৎ শুরু করলে এরকমই হয়। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এল কাপড়গুলো যেখানে ফেলে গিয়েছিল সেখানে। পরে নিল। ধীরেসুস্থে করছে সবকিছু। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। দিনটা.তো কাটাল। এখন কি করবে? যাবে কোথায়? বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভাবতে ভাবতে চলে এল। গাড়ির কাছে।

স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে উঠে বসল। পা দুটো আড়ষ্ট লাগছে। মাথা ধরেছে। গাড়িতে ওষুধের শিশি আছে। ব্যথা পাওয়ার পর থেকে টাইলিনল ট্যাবলেট রাখে সঙ্গে। শিশিটা বের করে দুটো ট্যাবলেট নিয়ে মুখে পুরল। চিবিয়ে গুড়ো করে পানি ছাড়াই গিলে ফেলল তেতো ওষুধ। শিশিটা আবার রাখতে গিয়ে হাতে ঠেকল একটা কাগজের টুকরো। ফেলে দেয়ার জন্যে বের করে আনল। স্ট্রীটল্যাম্পের হ্যালোজেন লাইটের আলোয় লেখার ওপর চোখ পড়তেই কাগজধরা আঙুল দুটো শক্ত হয়ে গেল। ক্রিসি ট্রেভারের ঠিকানা আর ফোন নম্বর।

ঘড়ি দেখল। মোটে সাতটা বাজে। কানে বেজে উঠল ক্রিসির কণ্ঠ: বিকেলের পর আর বেরোই না আমি। তোমার ম্যাসাজ দরকার হলে ওই সময়টায় এসো।

কিন্তু আজ শনিবার। ওর মত অল্পবয়েসী একজন মহিলা কি ছুটির সন্ধ্যায় ঘরে বসে থাকবে? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে না যাক, সিনেমায়ও তো চলে যেতে পারে? যাওয়ার আগে ফোন করে নেয়া দরকার।

গাড়ি চালিয়ে সবচেয়ে কাছের ফোন বুদটায় এসে ক্রিসির নম্বরে ডায়াল করল সে।

তৃতীয় রিঙে ধরল ক্রিসি। বাড়িতেই আছে। হালো?

ক্রিসি? আমি মুসা।

একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল ক্রিসি। তারপর ভেসে এল তার উচ্ছল কণ্ঠ, হাই, মুসা। কেমন আছ?

ভাল। আপনি কেমন?

 ভাল। একা একা ঘরে বসে অবশ্য বিরক্ত লাগছে। কি করছ?

একা একা রাস্তায় ঘুরতে আমারও ভাল লাগছে না। দিনের বেলা খুব দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম। ব্যথা করছে।

তারমানে ম্যাসাজ লাগবে? হাসল ক্রিসি। নো প্রব্লেম। চলে এসো।

যে মলে ওদের দেখা হয়েছিল তার কাছাকাছিই একটা নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকে ক্রিসি। মুসা বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল। কালো প্যান্ট আর সাদা ব্লাউজ পরেছে। নার্সের সাদা পোশাকের চেয়ে এই কাপড়ে অনেক বেশি সুন্দরী লাগছে ওকে। সবুজ চোখে উজ্জ্বলতা। লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে আন্তরিক হাসি।

এসো, ভেতরে এসো, দরজা থেকে সরে জায়গা করে দিল ক্রিসি। নোংরা করে রেখেছি। কিছু মনে কোরো না।

ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল মুসা। নোংরাটা কোথায় বুঝতে পারল না। কেবল একটা কফি-টেবিলে পড়ে থাকা দুটো পেপারব্যাক বইয়ের পাশে রাখা একটা কফির পট আর একটা মগে আধমগ কফি ছাড়া। ঘরের সমস্ত আসবাব বেশ উঁচু মানের। ক্রিসির বাবা-মা মনে হয় খুব ধনী। টাকা দিয়ে তারাই বোধহয় সাহায্য করে। হাসপাতালে নার্সের চাকরি করে এত বিলাসিতায় বাস করা সম্ভব নয়।

কেমন একটা বিচিত্র ধোয়া ধোয়া গন্ধ ঘরের বাতাসে। কোন ধরনের সুগন্ধী? বুঝতে পারল না মুসা।

ওর মুখ দেখেই অনুমান করে ফেলল যেন ক্রিসি, বোঝা যায়?

যায়। কিসের? মশার কয়েল?

না না, কয়েলের এত ভাল গন্ধ হয় নাকি। ও তো দম আটকে দেয়। এটা ধূপের গন্ধ। ইনডিয়ায় খুব ব্যবহার এটার, জানো: বোধহয়। মশা তাড়াতে কাজ করে ধূপের ধোয়া। আরও নানা কাজে, বিশেষ করে দেবদেবীর পূজায় ব্যবহার করে ওরা এই জিনিস।

এখানে তো মশা নেই। আপনি কিসের পূজা করেন?

হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ক্রিসি। করি যেটারই হোক। কফি খাবে?

 দিতে পারেন। মাথাটা খুব ধরেছে।

দুধ দিয়ে না দুধ ছাড়া?

 দুধ দিয়ে। চিনি দেবেন বেশি করে যাতে তেতোটা না থাকে।

রিফ্রিজারেটরের দিকে ঘুরল ক্রিসি। আমি খাই খুব কড়া। দুধ চিনি ছাড়া। আর এত গরম, জ্বলতে জ্বলতে ভেতরে নামে। কি, অবাক লাগছে শুনতে? হাসপাতালের সব নার্সই এরকম খায়। নাইট ডিউটি করতে হয় যে।

হাসপাতালে আসলে কাজটা কি করেন আপনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

এই নানা রকম টুকটাক কাজ, দুধ আর চিনি বের করে আনল ক্রিসি। একটা কাপও আনল। পট থেকে কফি ঢেলে তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে ঠেলে দিল মুসার দিকে। বাজে চাকরি। ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছি আমি।

সেটা কি ঠিক হবে?

মুসার মুখোমুখি বসল ক্রিসি। সবুজ চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল, কেন হবে না?

 ঘরের জিনিসপত্রের দিকে ইঙ্গিত করল মুসা, বেতন তো ভালই পান মনে হচ্ছে। নাকি বাবার টাকা আছে?

বাবার টাকাই বলতে পারো, মগ তুলে কফিতে চুমুক দিল ক্রিসি। দেখা হওয়ার পর থেকেই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি। তুমি ফোন করবে জানতাম।

কি করে জানলেন?

অনুমান। খেলোয়াড়রা চায় ওষুধপত্র খেয়ে, ম্যাসাজ করে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগ আর ব্যথা কমিয়ে ফেলতে। খেলার মাঠ ছাড়া থাকতে পারে না তো।

হেসে ফেলল মুসা। ঠিকই বলেছেন। এখন কোত্থেকে এসেছি জানেন? মাঠ থেকে। দিনের বেলা এমন দৌড়ান দৌড়েছি…তারপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম গাছের নিচে। এক ঘুমে পার করে দিয়েছি সারাটা দিন।

হাসল ক্রিসি। কফিটা শেষ করো। তারপর শুরু করছি।

.

০৭.

পার্ক থেকে ফেরার পর গুম হয়ে বাড়িতে বসে রইল রবিন। একা বাড়িতে কিছুই ভাল লাগছে না। খেতে ইচ্ছে করছে না। টিভি দেখতে ইচ্ছে করছে না। এমনকি বই পড়তেও ভাল লাগছে না। না খেলে শরীর ভেঙে পড়বে। তাই সামান্য কিছু মুখে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। মুসার মতই আগের রাতটায় তারও ঘুম হয়নি।

বিকেলে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। ক্লান্ত, ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল। হালো?

ওপাশের কণ্ঠটা শুনে সচকিত হয়ে উঠল মুহূর্তে। কিশোর! ফিরেছ! কখন?

এই তো খানিক আগে। মুসাদের বাড়িতে ফোন করলাম। পেলাম না। ও কোথায়, জানো নাকি?

কিশোর, উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছে রবিন। অনেক কথা আছে। তুমি তো ছিলে না, জানোও না। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করা দরকার। এখুনি। ইয়ার্ডে আসছি আমি। তুমি কোথাও বেরিয়ো না।

এসো। বেরোব না।

.

হু, ভাল বিপদেই পড়েছ! আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। পুলিশের কাছে না যাওয়াটাই বোকামি হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ভুল। ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের কাছে গিয়ে খুলে বলতে পারতে।

কি করব? রবিন বলল। সবাই এমন বিরোধিতা শুরু করল, বাধা দিতে লাগল, কিছুই করতে পারলাম না। অ্যাক্সিডেন্টটা করে ড্যানি তো পুরোপুরি বোকা হয়ে গিয়েছিল। কথাই বেরোচ্ছিল না মুখ দিয়ে।

স্যালভিজ ইয়ার্ডে জঞ্জালের নিচে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে মুখোমুখি বসে আছে দুজনে। কিশোর বসেছে ডেস্কের ওপাশে তার চেয়ারে। অন্যপাশে একটা টুলে পিঠ বাকা করে বসেছে রবিন।

ওই সব ঘোড়ার ডিম কনসার্টগুলো এই জন্যেই আমার ভাল লাগে না, মুখ বাকিয়ে বলল কিশোর। কোন আনন্দ তো নেইই, যত রাজ্যের হট্টগোল আর পাগলামি। গায়কদের দেখে মনে হয় না ওরা কোন সুস্থ লোক। সব যেন উন্মাদ। ওসব দেখে বেরোলে কোন লোকের মাথা ঠিক থাকে? ড্যানি তো সহ্য করতে পারে না জানোই, গাড়ি চালাতে দিলে কেন?

সেটাও হয়ে গেছে আরেক বোকামি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রবিন। যা হবার তা হয়েছে। এখন কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, তাই বলো? পুলিশের কাছে যাব?

ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। কয়েক সেকেন্ড পর মাথা ঝাঁকাল, যেতে তো হবেই। সঙ্গে সঙ্গে গেলে শুধু ড্যানির। শাস্তি হত, জেলে যেত সে একা। তবে তোমরা বেঁচে যেতে…

সেজন্যেই তো গেলাম না।

কিন্তু এখন সবাইকে জেলে যেতে হবে। ড্যানি যাবে অ্যাক্সিডেন্ট করে খুন করার অপরাধে, আর তোমরা যাবে লাশ গুম করতে তাকে সহযোগিতা আর সত্য গোপন রাখার অপরাধে। বাঁচতে আর কেউ পারবে না।

না পারলে নেই। জেলে গিয়ে বসে থাকা বরং অনেক ভাল। একে তো অপরাধ করে মানসিক চাপে ভুগছি, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই তত্ত্বাবধায়কের যন্ত্রণা। সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। শীঘ্রি এ থেকে মুক্তি না পেলে পাগল হয়ে যাব।

চুপ করে ভাবতে লাগল কিশোর।

অধৈর্য হয়ে উঠল রবিন, কি ভাবছ?

উ! ঠোঁট থেকে আঙুল সরাল কিশোর। পুলিশের কাছে তো যেতেই হবে। ভাবছি, নিজেরা আগে একবার তদন্ত করে দেখলে কেমন হয়।

কি তদন্ত করবে?

 এই তত্ত্বাবধায়ক লোকটা যদি তোমাদের কেউ না হয়ে থাকে তাহলে বাইরের লোক। অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা সে জানে। আমার প্রথম প্রশ্ন: কি করে জানল? তোমাদের মধ্যে মুখ ফসকে কেউ বলে ফেলেছে অন্য লোকের সামনে। তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে খুন হওয়া লোকটার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়কের কোন সম্পর্ক ছিল। কিংবা অ্যাক্সিডেন্টটা সেরাতে ঘটতে দেখে। ফেলেছে সে।

না, দেখেনি, আমি শিওর। ওই সময় ত্রিসীমানায় কোন লোক কিংবা গাড়ি দেখা যায়নি। কেউ ছিল না।

তাহলে জানল কি করে? বেশ, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, যেভাবেই হোক জেনেছে…

জেনেছে তাই বা কি করে বলব? চিঠিতে তো উল্লেখ করেনি। কেবল লিখেছে: তোমাদের গোপন কথাটা আমি জানি। অনেক ব্ল্যাকমেইলারই একরম আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে কামিয়াব হয়ে যায়, সেজন্যেই বলে এমন করে।

তা হয়। কিন্তু আমাদের এই বিশেষ লোকটি আসল কথাটা জানে না এটা ভেবে ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। ও জানতেও পারে। তত্ত্বাবধায়ককে খুঁজে বের করতে হলে এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে সেই মৃত লোকটার পরিচয়। জানা। এমনও হতে পারে লোকটাকে ড্যানি খুন করেনি। ত্রিসীমানায় আর কোন গাড়ি দেখোনি বলছ। এমনও হতে পারে আগেই তাকে খুন করে এনে রাস্তার ওপর ফেলে রেখেছিল কেউ। এবং সেই কেউটা হতে পারে এই তত্ত্বাবধায়ক। কেবল এইভাবেই তোমাদের কথা তার জানা সম্ভব।

এতক্ষণে হাসি ফুটল রবিনের মুখে। এই না হলে কিশোর পাশা। এতদিন ধরে এই সহজ কথাটা ওদের কারও মাথায় আসেনি। তাহলে এই সম্ভাবনার কথাটা আমরা গিয়ে পুলিশকে বললেই তো পারি?

না, মাথা নাড়ল কিশোর, আমি বিশ্বাস করছি বলেই যে ওরাও করবে, তা না-ও হতে পারে। করাতে হলে এর স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ জোগাড় করা দরকার।

কি করে করবে? কোন সূত্রই তো নেই।

পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ওদের কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি। গত এক মাসে যত লোক নিখোঁজ হয়েছে, তাদের লিস্ট বের করব। ওদের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করব আমাদের বিশেষ লোকটাকে। এখন ওর চেহারা-সুরৎ সম্পর্কে যতটা পারো, জানাও আমাকে। কবর দেয়ার আগে দেখেছ তো?

মাথা ঝাঁকাল, রবিন। যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে লোকটার চেহারার বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করুল রবিন। বয়েস সাতাশ-আটাশ, ককেশিয়ান, সুদর্শন। গায়ে। ছিল তামাটে স্পোর্টস কোট আর হালকা বাদামী স্ন্যাকস।

হু, চমৎকার, একটা পেপারওয়েট নিয়ে উল্টো করে গোল মাথাটা টেবিলে রেখে ঘোরাতে লাগল কিশোর। আচ্ছা, ড্যানি সত্যি সত্যি শহর ছেড়ে চলে যাবে তো?

তাই তো বলল।

 কোথায় যাবে কাউকে কিছু বলেছে?

জানি না। মুসাকে বলতে পারে। ওর সঙ্গে খাতির বেশি।

না বললেই ভাল করবে, পেপারওয়েটটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল কিশোর।

কেন? মুসা মরে গেলেও কাউকে বলবে না।

জবাব না দিয়ে আচমকা উঠে দাঁড়াল কিশোর। চলো, বেরোই। পুলিশ। অফিসে যেতে হবে।

.

০৮.

 রকি বীচ পুলিশ স্টেশনের কম্পিউটার রূমটা বেশ সাজানো-গোছানো। ঢোকার মুখে ডেস্কে বসে কাজ করছেন একজন অফিসার। তিন গোয়েন্দাকে চেনেন। কম্পিউটার থেকে কিছু তথ্য নিতে চায় জানাল কিশোর।

কেন, কোন কেসের তদন্ত করছ নাকি?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।

কি কেস?

এখনও বলার সময় আসেনি।

কিশোর পাশার স্বভাব জানা আছে অফিসারের। হেসে ঢোকার অনুমতি দিয়ে দিলেন।

ঘরটা এখন খালি। কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। কোন কাজ না পড়লে, অর্থাৎ তথ্যের দরকার না হলে কেউ ঢোকে না এখানে। সারাক্ষণ বসে ডিউটি দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

ঢুকেই রবিনের উদ্দেশ্যে লেকচার শুরু করল কিশোর, কম্পিউটার হলো আগামী প্রজন্মের ডিটেকটিভ। সঠিক প্রোগাম আর সঠিক ডাটা সরবরাহ করতে পারলে যে কোন ধাঁধার জবাব দিয়ে দিতে পারে কম্পিউটার। রহস্য সমাধান করতে চাইলে এর চেয়ে যোগ্য গোয়েন্দা আর কোথাও পাবে না। এর জন্যে কয়েকটা প্রোগ্রামও লিখেছি আমি। আমার নিজস্ব উদ্ভাবন। কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজছিলাম। পেয়ে গেছি আজ। আমি যেটা ব্যবহার করব, একধরনের ফিল্টার বা ছাঁকনি বলতে পারো একে। আসল লোকটাকে ছাড়া বাকি সব বাদ দিয়ে দেবে। এটা করতে পারা খুব জরুরী। সময় বাঁচবে অনেক। প্রতিমাসে লস অ্যাঞ্জেলেসে কত লোক যে নিখোঁজ হয়, হিসেবটা শুনলে তুমি আঁতকে উঠবে।

যায় কোথায় ওরা? জানতে চাইল রবিন।

কোথায় আর যাবে? বেশির ভাগই পালায়। অসুখী স্বামী কিংবা স্ত্রী। পালিয়ে বাঁচে।

হুহ

হাসছ?

তো কি করব? খুনের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।

একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। এদের কেউ কেউ খুনও হয়ে যায়। এখানকার কেসফাইলগুলো যদি সব পড়তে তাহলে হাসি মুছে যেত মুখ থেকে। মনে হত দুনিয়াটা বড় বিশ্রী জায়গা। এখানে হাসির কিছু নেই।

তোমার লেকচারটা একটু থামাও না দয়া করে।

 কেন, ভাল লাগছে না?

 মানুষের চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে আমার ভাল লাগে না।

বলো কি! মানুষ নিয়ে গবেষণা করাটাই তো সবচেয়ে মজার। এত রহস্যময় আর বিচিত্র প্রাণী সারা দুনিয়ায় আর একটাও খুঁজে পাবে না তুমি। মানুষ যে কি করে আর করে নাঃ অত

 দোহাই তোমার, কিশোর, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে দুহাত তুলল রবিন, কচকচি ভাল্লাগছে না! যা করতে এসেছ, করো।

চিন্তিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আনমনে মাথা দোলাল কিশোর, হু, তোমার মনমেজাজ এখন খুব খারাপ। দুশ্চিন্তায় ভরা। এসব কথা এখন তোমার ভাল লাগবে না।

একটা কথা সত্যি করে বলো তো। মানুষ জাতটাকে কি তুমি পছন্দ করো না?

করব না কেন? নিজেও তো মানুষ। মানুষের স্বভাব জানার এত আগ্রহ কেন আমার জানো? ওদের সাহায্য করার জন্যে। মানুষ যেসব অপরাধ করে, কেন করে সেটা যদি না জানো, ভাল গোয়েন্দা তুমি কোনদিনই হতে পারবে না।

একটা কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসে পড়ল কিশোর। নিখোঁজ মানুষদের ফাইলটা খোলার নির্দেশ দিল কম্পিউটারকে। যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল রবিন, ফাইল খুলতে তারচেয়ে বেশি সময় লাগিয়ে দিল কম্পিউটার। ফাইলগুলো সব একজায়গায় নেই। বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবগুলোকে জোগাড় করে একখানে এনে খুলতে সময় লাগবেই। অপেক্ষা করতে হবে।

নামগুলো সব লাইন দিয়ে ফুটে উঠলে এক এক করে বাছাই শুরু করল কিশোর। রাশি রাশি নাম থেকে বাছাই করে রাত এগারোটায় ছয়টা নামে এনে ঠেকাল। কমে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দুজনেই।

এবার কি করবে? জানতে চাইল রবিন।

দুটো কাজ, দুই আঙুল তুলল কিশোর। এক, ফোন বুক দেখে ঠিকানা জেনে নিয়ে ওদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। হয়তো দেখা যাবে ছয়জনের মধ্যে কয়েকজনই আর নিখোঁজদের মধ্যে নেই, বাড়ি ফিরে গেছে। তালিকা থেকে বাদ যাবে ওরা। আরও কমে আসবে নিখোঁজের সংখ্যা। দ্বিতীয় কাজটা করতে পারি পত্রিকা দেখে। বিজ্ঞাপনের পাতার নিখোঁজ সংবাদে ওদের নাম-ঠিকানা দিতে পারে। তাতে সময় লাগবে অনেক বেশি। মাইক্রোফিল্ম করে কম্পিউটারে ভরে রাখা প্রতিটি পাতা দেখে দেখে ওই ছয়জনের নাম-ঠিকানা বের করতে সারারাতও লেগে যেতে পারে। তারপরেও কথা আছে, যদি পত্রিকায় থাকে। নইলে কষ্টটাই সার হবে।

কিন্তু এখন তো বাজে রাত এগারোটা। এত রাতে মানুষের বাড়িতে ফোন করবে?

 উপায় কি? সময় এখন অতি মূল্যবান। কথা না বলে এসো হাত লাগাও। সেরে ফেলি। পত্রিকায় খোঁজার চেয়ে ডিরেক্টরিতে খোঁজাই সহজ হবে।

আসলেই সহজ হলো। পনেরো মিনিটেই ছয়জনের মধ্যে চারজনেরই ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। দেরি না করে ফোন শুরু করল। প্রথমজন কিশোর দুটো কথা বলার আগেই ফোন রেখে দিল। দ্বিতীয়জন মহিলা। নিখোঁজ লোকটার কথা বলতেই কাঁদতে শুরু করল। শিকারে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল তার স্বামী। কয়েকদিন পর ভালুকের গুহার সামনে পাওয়া যায় তার। ক্ষতবিক্ষত লাশ। তৃতীয়জনও মহিলা। তার বাড়ির নিখোঁজ লোকটার কথা জিজ্ঞেস করতেই রেগে উঠল। জানাল, আরেক মহিলার কাছে চলে গেছে। তার স্বামী। খোঁজ পাওয়া গেছে। চতুর্থ নম্বরটায় রিঙ হয়েই চলল, হয়েই চলল। ধরল না কেউ।

কয়েকবার চেষ্টা করে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। মনে হয় বাড়ি নেই। দেখা যাক, খানিক পরে আবার করব।

বাকি দুজন?

নামের তালিকার দিকে তাকাল কিশোর। ডেভন ব্রেক আর ইয়ান জোসেফ। ডিরেক্টরিতে তো পেলাম না।

ভুরু নাচাল রবিন, কি করবে?

 ডিরেক্টরিতে যখন পেলাম না, পত্রিকাতেই দেখতে হবে।

খুব বেশিক্ষণ লাগল না প্রথম নামটা বের করতে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ডেভন ব্রেকের ওপর লেখা একটা প্রতিবেদন পেয়ে গেল রবিন। ছবি সহ। দেখেই চোখ কপালে। সেই চেহারা। মরুভূমিতে চিত হয়ে পড়ে থাকা লাশের মুখটা ভেসে উঠল কল্পনায়। একই পোশাক। তামাটে রঙের স্পোর্টস কোট। যেটা সহ ওকে কবর দিয়েছিল ওরা। ছবির সঙ্গে লাশটার তফাত কেবল ওটার ঠোঁটের কোণে রক্ত ছিল, এটার নেই। কম্পিউটারের পর্দার, দিকে কাঁপা কাঁপা তর্জনী তুলে প্রায় ফিসফিস করে বলল, এই সেই লোক!

তুমি শিওর?

ঢোক গিলল রবিন, এই চেহারা জীবনে ভুলব না।

প্রতিবেদনটা একই সঙ্গে পড়তে শুরু করল দুজনে। লিখেছে:

‘ব্যবসায়ী নিখোঁজ

তেত্রিশ বছর বয়স্ক ডেভন ব্রেক, একজন দোকানদার, সাত দিন ধরে নিখোঁজ। সান্তা মনিকার স্থায়ী অধিবাসী তিনি। দোকানটা তাঁর বাবার। প্রায় বাইশ বছর চালিয়েছেন। গানের ক্যাসেট, রেকর্ড, এসব বিক্রি হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলে দোকান চালাত। তাঁর মা মিসেস ড্রেক একজন টীচার। অবসরে সমাজ-সেবার কাজ করেন। ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াতে বড়ই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। হুট করে কোথায় গেছে, বা কোথায় যেতে পারে তাঁর ছেলে, এ সম্পর্কে কোনই ধারণা নেই তার। ওয়েস্টউড বুলভারে তাদের বাড়ি। গত দশ বছর ধরে সমাজ-সেবার কাজ করে আসছেন মহিলা। তাদের বিরুদ্ধে। কখনও কোন অভিযোগ শোনা যায়নি, কেউ কখনও বদনাম করেনি। ডেভন ব্রেকের কোন খোঁজ যদি কারও জানা থাকে, দয়া করে নিচের ঠিকানায় খবর দিলে বাধিত হবেন মিসেস ব্রেক।‘

চেয়ারে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল রবিন, তারমানে ভাল মানুষটাকে খুন করলাম আমরা।

তোমরাই তার মৃত্যুর কারণ কিনা এখনও জানো না, কিশোর বলল। বলেছি না, এমনও হতে পারে আগেই তাকে কেউ খুন করে নিয়ে গিয়ে মরুভূমির ধারের ওই রাস্তায় ফেলে এসেছিল।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে রবিন বলল, গোপনে ওকে কবর দেয়াটা যে কত দিক থেকে ভুল হয়ে গেছে: ইস! পুলিশকে যদি জানাতাম, মহিলা জেনে যেতেন এতদিনে তার ছেলের কি হয়েছে। ইস্, মহিলা নিশ্চয় রোজ ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। তার ছেলে আর কোনদিনই ফিরে আসবে না জানলে এই পথ চাওয়ার কষ্ট থেকে বাঁচতেন।

আমার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না লোকটাকে তোমরা খুন করেছ। ও চাপা পড়ার সময় চিৎকার শুনেছ?

না। চিৎকার করার কোন সুযোগই হয়তো পায়নি সে।

যে ভাবে চাপা পড়েছে বলছ, তাতে মনে হয় রাস্তায় হাঁটার সময় হঠাৎ করে চাকার নিচে চলে এসেছিল সে। সেটা কি সম্ভব? ভেবে দেখো, হাঁটার সময় কারও গায়ে ধাক্কা লাগলে শব্দ হবে, লোকটা চিৎকার করবে সেসবও কোন কিছুই শোনোনি তোমরা।

গাড়ির মধ্যে এত বেশি চেঁচামেচি করছিলাম আমরা, শোনার সুযোগই ছিল না…

কি জানি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একটা ভুলের শিকার হয়েছ তোমরা। ভয় তোমাদের স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতাও নষ্ট করে দিয়েছে। যেহেতু কবর দিয়ে ব্যাপারটা গোপন করে ফেলেছ, ওর মাকে কষ্ট দিয়েছ, সেটা পূরণের এখন সবচেয়ে ভাল উপায় হলো আসল খুনীকে ধরে আদালতে সোপর্দ করা। রাত দুপুরে ওই মরুভূমিতে কি করতে গিয়েছিল তার ছেলে, সেটা জানতে হবে আগে।

কিছুটা শান্ত হলো রবিন। কি করে জানব কে খুন করেছে?

অবশ্যই তদন্ত করে। আজ রাতে আর কিছু করার নেই আমাদের। বাড়ি গিয়ে ভালমত একটা ঘুম দাও। কাল সকালে উঠে ব্রেকের দোকানে যাব। ঠিকানা যখন জেনে গেছি, খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে না। ওর মার। সঙ্গে দেখা করে কথা বলব।

কি লাভ হবে? নিখোঁজ সংবাদটা দেখে তো মনে হয় না ছেলে কোথায় যেতে পারে এ ব্যাপারে মিসেস ব্রেকের কোন রকম ধারণা আছে।

অনেক সময় জানলেও চেপে যায় মানুষ। নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এমন সব কারণ থাকে, যেগুলো লজ্জা কিংবা অস্বস্তিতে পড়ার ভয়ে ফাস করতে চায় না। যে নিখোঁজ হয়েছে তার খোঁজ পাওয়ার জন্যে যতটুকু দরকার, তার বেশি বলে না। রবিনকে কম্পিউটারের সামনের চেয়ারটা থেকে সরিয়ে তাতে বসল কিশোর। আবার খুলল ডেভন ব্রেকের ফাইলটা। হাতের তালুতে থুতনি রেখে পর্দার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল।

কি দেখছ? জানতে চাইল রবিন।

জবাব না দিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করল, কনসার্টের দিনটা কত তারিখ। ছিল?

জুলাইর শেষ দিন। একতিরিশ।

কিন্তু এই প্রতিবেদনটার তারিখ দেখো। জুলাইর মাঝামাঝি। বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছে তোমরা ওকে ধাক্কা দেয়ার দুই হপ্তা আগে। ওর ঠোঁটের কোণে তাজা রক্ত দেখেছ তোমরা। তারমানে মারা গেছে সে একতিরিশ তারিখেই। বাড়ি থেকে বেরোনোর প্রায় পনেরো দিন পর।

ইনটারেসটিং তো!

গুড। মাথায় তাহলে ঢুকতে আরম্ভ করেছে। আমি ভাবছি ওই দুটো হপ্তা কোথায় ছিল ডেভন? কার সঙ্গে? পর্দার দিকে আঙুল তুলল কিশোর। যেন জবাব চায় কম্পিউটারের কাছে। সেটা জানলে খুনী কে সেটাও জানতে পারব সহজেই।

*

পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিশোর কোথায় যাবে জানতে চাইল রবিন। কিশোর বলল, রকি বীচে। স্যালভিজ ইয়ার্ডে। গোস্ট লেনে ওদের বাড়িতে থাকতে অনুরোধ করল রবিন। কিশোর বলল, জরুরী কাজ আছে। সকালে উঠেই তাকে বেরোতে হবে। গোস্ট লেন থেকে বেকায়দা। রকি বীচে যাওয়াই ভাল।

আর কিছু বলল না রবিন। চুপচাপ গাড়ি চালাল।

হঠাৎ জিজ্ঞেস করল কিশোর, আংকেলরা কবে ফিরবেন?

দেরি হবে।

হু

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। এবার রবিন কথা বলল, কিশোর, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। চিঠিতে আমার নাম নেই। গাড়িতে সেরাতে আমরা যারা যারা ছিলাম, তাদের মধ্যে শুধু আমার নামটাই নেই।

ঝট করে সোজা হলো কিশোর। আগে বলোনি কেন?

ভুলে গিয়েছিলাম। কেন লিখল না বলো তো? এত কিছু যখন জানে তত্ত্বাবধায়ক, নিশ্চয় জানে আমি কে?

তা তো জানেই। সব জানে সে। সেজন্যেই তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।

কেন?

নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য আছে ওর। অকারণে করছে না এসব। আমি শিওর, কারণটা ভয়ানক কিছু।

০৯.

কফি খাওয়া শেষ হলে লম্বা একটা টেবিলের কাছে মুসাকে নিয়ে এল ক্রিসি। বলল, কাপড় খুলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো।

খাইছে! কাপড় খুলব?

 হাসল ক্রিসি, কেন, লজ্জা লাগছে? আরে সব খুলতে হবে না। শুধু শাট আর গেঞ্জিটা খোলো। ঘাড়ের কাছটা ডলতে হবে না?

হাঁপ ছাড়ল মুসা, তাই বলুন। আমি তো ভাবলাম…

পাশের ঘরে চলে গেল ক্রিসি। একটা তোয়ালে আর দুটো শিশি নিয়ে ফিরে এল। একটা শিশিতে বড়ি, আরেকটাতে মালিশ। তোয়ালেটা একটা চেয়ারের হেলানে রেখে জিজ্ঞেস করল, রেডি?

হ্যাঁ

উপুড় হয়ে টেবিলে শুয়ে পড়তে গেল মুসা।

দাঁড়াও, শিশি খুলে দুটো বড়ি বের করল ক্রিসি। এদুটো আগে খেয়ে নাও।

পেইন কিলার?

 রোগীর অত কথা জানার দরকার নেই, রহস্যময় কণ্ঠে বলে চোখ মটকে হাসল ক্রিসি। যা করতে বলছি করো।

পানি দিয়ে বড়ি দুটো গিলে টেবিলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা।

ডান হাতের তালুতে তেল নিয়ে ডলে ডলে দুই হাতেই মিশিয়ে নিল। ক্রিসি। আস্তে করে হাত দুটো রাখল মুসার পিঠে। শিউরে উঠল মুসা। তেলের কারণে নাকি হাতের স্পর্শে, বুঝতে পারল না। তবে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

ডলতে শুরু করল ক্রিসি। আস্তে আস্তে চাপ বাড়াচ্ছে।

কেমন লাগছে?

ভাল, অস্বস্তি বোধটা চলে যাচ্ছে মুসার।

তোমার মনে কোন দুশ্চিন্তা আছে, যেন কথার ছলে কথাটা বলল ক্রিসি। প্রশ্ন নয়।

উহু

স্বীকার না করলে কি হবে? আমি জানি, আছে।…পিঠ অত শক্ত কোরো না। আরও ঢিল করো।-হ্যাঁ, এখন বলো তো দেখি তোমার সমস্যাটা কি?

চুপ করে রইল মুসা। এক ধরনের ঘোর লাগছে মাথার মধ্যে। ঝিমুনি ঝিমুনি ভাব। স্বপ্নের জগতে চলে যাচ্ছে যেন সে। সত্যি, ম্যাসাজ করতে জানে বটে ক্রিসি। এত আরাম লাগছে! যেন জাদু করে ব্যথাটা কমিয়ে দিচ্ছে।

ঘুমে জড়িয়ে এল তার চোখ।

ঘুমিয়ে পড়ল..

*

বারান্দা দিয়ে হেঁটে চলল মুসা। পাশে একটা দরজা দেখে থামল। দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে একটা বেডরূম। বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্তে নাক ডাকাচ্ছে ওর বন্ধু ড্যানি।

ড্যানি? আস্তে করে ডাকল মুসা। শুনছ? ওঠো। উঠে পড়ো।

 আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ল ড্যানি। হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, কে?

আমি, ড্যানি। মুসা।

ওর কথা যেন শুনতেই পায়নি ড্যানি। দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলা, কেরিআন্টি, দাঁড়াও, আসছি।

আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায়ই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। মুসার পাশ দিয়েই গেল অথচ ফিরেও তাকাল না ওর দিকে।

 কি হলো? দেখল না কেন ওকে? ড্যানি কি অন্ধ হয়ে গেছে? না সে নিজেই ভূত হয়ে গেছে–মানুষের চোখে অদৃশ্য?

দরজায় দাঁড়িয়ে বারান্দায় উঁকি দিল ড্যানি।

একটা শব্দ কানে আসছে মুসার। নিচতলা থেকে।

আবার খালার নাম ধরে ডাকতে লাগল ড্যানি। তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল।

নিচে কিসের শব্দ দেখার জন্যে তার পেছন পেছন দৌড় দিল মুসা। চিৎকার করে সাবধান করল ড্যানিকে, ড্যানি, বাইরে যেয়ো না। তত্ত্বাবধায়কটা কোনখান থেকে তাকিয়ে আছে কে জানে!

কিন্তু শুনল না ড্যানি। ওভাবে আন্ডারওয়্যার পরেই নিচতলার সদর দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে তাকাল। গ্যারেজ থেকে মনে হয় শব্দটা আসছে। গাড়ির গায়ে সিরিশ দিয়ে ঘষছে যেন কেউ।

কে ওখানে? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল ড্যানি।

যেয়ো না, যেয়ো না! বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল মুসা। ওই লোকটা হবে।

শুনল না ড্যানি। কে কে করতে করতে বেরিয়ে চলে গেল। হাত ধরে। টেনে ওকে ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু জোর পেল না। মনে হলো একটা ছায়াকে ধরেছে। খুব সহজেই ওর হাতের মুঠো থেকে পিছলে বেরিয়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা লন ধরে দৌড় দিল ড্যানি।

ড্যানি, আল্লার দোহাই লাগে তোমার, থামো! চিৎকার করে বলল মুসা।

গ্যারেজের ভেতরে ঘষার শব্দ থেমে গেছে। সুইচের জন্যে হাতড়াতে শুরু করল ড্যানি। পাওয়ার পর যখন টিপে দিল তখনও অন্ধকার হয়ে রইল গ্যারেজ। আলো জ্বলল না। দ্রুকুটি করল সে। বড় বড় হয়ে গেল চোখ যখন দেখল তার আন্টির গাড়ির বেশ খানিকটা জায়গার রঙ ঘষে ঘষে তুলে ফেলা। হয়েছে।

 তুলুক, তাগাদা দিল মুসা, দেখার দরকার নেই। জলদি চলো এখান থেকে।

গ্যারেজের ভেতরে শব্দ হলো আবার। বোকার মত দুঃসাহস দেখিয়ে বসল ড্যানি। গ্যারেজের ভেতরে যেতে যেতে ডাকল, অ্যাই, কে ওখানে?

ঝপঝপ করে একগাদা তরল পদার্থ এসে পড়ল ওর গায়ে। ভিজে গেল গা। ঝনঝন করে মেঝেতে একটা বালতি পড়ার শব্দ হলো। কি ঘটছে ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই খস করে ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। গাড়ির হুডের কাছে। দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়ামূর্তি। বিদঘুঁটে গন্ধ ঢুকল মুসার নাকে।

ড্যানি! চিৎকার করে উঠল সে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করছে, যতই চিৎকার করুক না কেন, গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না।

জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ড্যানির দিকে ছুঁড়ে মারল ছায়ামূর্তি। বুকে লেগে কাঠিটা পড়ল পায়ের কাছে জমে থাকা ট্রেলে। দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। একটা সেকেন্ড বোকা হয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল ড্যানি। পরক্ষণে জীবন্ত এক মানব-মশালে পরিণত হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল কমলা রঙ আগুন। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল পা থেকে মাথায়। অদ্ভুত এক কাকতাড়ুয়া পুতুলের মত নাচানাচি শুরু করল, ড্যানি। ভয়াবহ যন্ত্রণায় অমানুষিক চিৎকার করছে।

ওকে ধরার চেষ্টা করল মুসা। আগুন থেকে বাঁচাতে চাইল। একটা কিছু করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু কিছুই করতে পারল না। কিছু করার নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল ড্যানি। চামড়া পুড়ে, কুঁচকে, বিকৃত হয়ে যাচ্ছে মুখ। মাঢ়ীসহ দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। ভয়াবহ দৃশ্য। কিন্তু শুধু চিৎকার করা ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না। মুসা। চোখের সামনে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু ঘটতে দেখেও সহ্য করতে হচ্ছে। চিৎকার-চিৎকার-চিৎকার…

*

চোখ মেলতে ছাতের দিকে নজর গেল মুসার। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় রয়েছে। কেয়ারও করল না। যেখানে খুশি থাক। দুঃস্বপ্নটা যে কেটেছে এতেই সে খুশি। এত ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কমই দেখেছে।

পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল, সোফায় কুকড়ি-মুকড়ি হয়ে ঘুমাচ্ছে ক্রিসি। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল ওর কোথায় রয়েছে, বিকেলে কি কি ঘটেছিল, সব।

কিন্তু বিছানায় এল কি করে? ছিল তো টেবিলে। ম্যাসাজে আরাম পেয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারমানে ক্রিসি ওকে বয়ে এনেছে। জোর তো সাংঘাতিক!

উঠে বসল মুসা। ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। ঘুমানোর পর এরকম তো লাগার। কথা নয়! মাথার মধ্যে ঘোরটা এখনও কাটেনি। গাটাও গোলাচ্ছে ও। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একে শরীর অসুস্থ, তার ওপর গত কিছুদিন ধরে যে পরিমাণ উত্তেজনা আর মানসিক চাপ যাচ্ছে, এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ঘাড়ের ব্যথাটা কমেছে। বাড়ি যাওয়ার তাগিদ অনুভব করল সে। নিজের বিছানায় ছাড়া ঘুমিয়ে শান্তি নেই।

দুঃস্বপ্নটা চেপে আছে এখনও মনে। ড্যানির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা এতই বাস্তব লেগেছিল, ভুলতে পারছে না। এত জায়গা থাকতে কেন কেরিআন্টির বাড়িতে ওকে দেখল, তারও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। ড্যানির ওখানে যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। যদিও কাউকে বলে যায়নি। কিন্তু অনুমান করতে কষ্ট হয় না।

কেরিআন্টি থাকেন সান্তা বারবারায়।

বিছানা থেকে নেমে একটা ভোয়ালে টেনে নিয়ে বাথরূমে রওনা হলো মুসা। ম্যাসাজ টেবিলটার পাশ কাটানোর সময় ফোনের ওপর নজর পড়তেই থমকে দাঁড়াল। একটা ফোন করলে কেমন হয়? দূর! কি ভাবছে! স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় নাকি?

কিন্তু ইচ্ছেটা তাড়াতে পারল না মন থেকে। শেষে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলে রিসিভার। ক্রিসির দিকে তাকাল। তেমনি ঘুমাচ্ছে। নম্বর টিপল। ওপাশে রিঙ হচ্ছে। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে মুসা।

ফোনটা ড্যানিই ধরল। কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তাতে অস্বস্তি বোধ করল না মুসা। দুঃখ নেই মোটেও। বরং স্বস্তি। একটা বিরাট বোঝা নেমে গেল মন থেকে। স্বপ্নটা মিথ্যে। ড্যানি বেঁচে আছে।

কি ব্যাপার? জানতে চাইল ড্যানি।

 তুমি ভাল আছ নাকি শিওর হয়ে নিলাম।

হাই তুলল ড্যানি। ভালই আছি। এখানে এসেছি তুমি জানলে কি করে?

অনুমান, স্বপ্নের কথাটা চেপে গেল মূসা। সরি, তোমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম। যাও, শুয়ে পড়োগে। কেরিআন্টি কোথায়?

বেড়াতে গেছে।

 আচ্ছা, রাখি। দুদিন পর যোগাযোগ করব।

ওখানে সব ঠিক আছে?

আছে। গুড নাইট, ড্যানি।

গুড নাইট।

রিসিভার নামিয়ে রাখল মুসা। ফিরে তাকাতে দেখে সোফায় সোজা হয়ে বসে আছে ক্রিসি। চোখে চোখ পড়তে হাসল। কোথায় ফোন করলে?

সান্তা বারবারায়। আমার এক বন্ধুকে।

 অ। কেমন লাগছে এখন?

ব্যথাটা কমেছে।

আবার হাসল ক্রিসি। কমতেই হবে। বলেছিলাম না, আমার ম্যাসাজে জাদু আছে? … যাচ্ছ কোথায়?

বাথরূমে। বাড়ি যাব। ঘুমাতে হবে।

 কেন, এখানে অসুবিধে কি?

আমার কোন অসুবিধে নেই। অসুবিধেটা আপনার। বিছানা আমি দখল করে রাখলে সোফায়ই থাকতে হবে আপনাকে…

তাতে কি? আমার অসুবিধে হচ্ছে না।

কিন্তু আমার হবে। অস্বস্তিতে ঘুমাতে পারব না আমি। শরীরটাও যে রকম খারাপ লাগছে, না ঘুমালে মারা পড়ব।

বাথরূমের দিকে এগোল মুসা।

.

১০.

 পরদিন রবিবার। সকালবেলা রবিনকে ফোন করল কিশোর। খবর আছে। ডেভন ব্রেকের দোকানের নতুন মালিক ওরই চাচা উইনার ব্রেক। মিসেস ব্রেকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে দোকানটা। লোকটা কোন সহযোগিতা। করতে রাজি হয়নি। এমনকি ব্রেকের বাড়ির ফোন নম্বরটাও দিতে চায়নি।

রবিনকে মাথা ঠাণ্ডা রাখার পরামর্শ দিল কিশোর। গোস্ট লেনে এখন ঘনঘন যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বহুদিন পর বাড়ি ফিরেছে। ইয়ার্ডে কাজ জমে গেছে অনেক। তা ছাড়া আরও কাজ আছে।

 সারাটা দিন মুসার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল রবিন। কিন্তু পেল না। ওকে। কোথায় যে গেছে, কেউ বলতে পারল না।

সোমবারেও মুসার খবর নেই।

এমনকি সোফির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে এল না।

ব্ল্যাক ফরেস্ট গোরস্থানের গির্জার সামনে রাখা হলো কফিন। আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা এল শোকের কালো পোশাক পরে। মারলার পাশে দাঁড়ানো রবিন। চুপচাপ তাকিয়ে আছে কয়েক গজ দূরের কফিনটার দিকে। সোফি যে মারা গেছে, মাথাটা আলাদা, ধড়ের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে সেলাই। করে দিয়েছে হাসপাতালের ডাক্তার, এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। একঘেয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে মৃত্যুর ওপারের সেই সবুজ তৃণভূমি আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া টলটলে পানির নহরের বর্ণনা করে চললেন পাদ্রী। রূপকথার মত লাগছে রবিনের কাছে।

অনুষ্ঠান শেষ হতে বহু সময় লাগল। সোফিকে কবর দেয়ার পর তার মা বাবার কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে নানা কথা বলতে লাগল রবিন। কোন সাহায্য লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করল। নিজের কানেই বড় ফাপা শোনাল কথাগুলো। কি সাহায্য করবে সে? তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? সোফি ছিল তাদের একমাত্র মেয়ে।

সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেল। রবিনের ফিরতে ইচ্ছে করল না। একা বাড়িতে মন টিকবে না। মুসাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়ার্ডে গিয়ে কিশোরের সঙ্গেও আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো সম্ভব নয়। ও বলে দিয়েছে ব্যস্ত থাকবে।

গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের কাছে চলে এল সে। পাহাড়ে চড়তে ভাল লাগে। ওর। কিন্তু আজ লাগল না। চুড়ায় খানিকক্ষণ বসে থেকে আবার নেমে এল নিচের উপত্যকায়। লেকের পাড়ে বসে রইল, ঘোরাঘুরি করল, লেকের শান্ত পানিতে ঢিল ছুঁড়ল। অন্যমনস্ক। সারাক্ষণ মন জুড়ে রইল সোফির মৃত্যু, রহস্যময় তত্ত্বাবধায়কের চিঠি, মুসার জন্যে দুর্ভাবনা।

সারাটা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরল সে। বাবা-মা ফেরেননি। কি করবে? মুসাকে ফোন করল আবার। পাওয়া গেল না। একটা বই নিয়ে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে আধশোয়া হলো বিছানায়। কিছুতেই মন বসাতে পারল না। ড্যানির চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখন মুসাকে নিয়ে। ড্যানি কাউকে কিছু না। বলে পালিয়েছে, বাঁচার জন্যে। মুসাও কি তাই করল?

সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, বলতে পারবে না। টেলিফোনের শব্দটা যেন ঘুমের মধ্যেও কানে বোমা ফাটাল তার।

চোখ মেলতেই নজর পড়ল ঘড়ির দিকে। বারোটার বেশি। কেঁপে উঠল বুক। কে করল? কোন দুঃসংবাদ ছাড়া এত রাতে কেন ফোন করবে?

কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল। হালো?

রবিন? কাঁদো কাদো স্বরে মারলা বলল। ড্যানি…

 কি হয়েছে ড্যানির?

 ও নেই…

ইমপসিবল!

ফোঁপাতে লাগল মারলা। সান্তা বারবারায় ওর খালার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। এইমাত্র ফোন করে জানাল আমাকে মুসা। ও বাড়ি ফিরে এসেছে।তত্ত্বাবধায়ক ঠিকই খুঁজে বের করেছে ড্যানিকে। গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। …উফ, কি ভয়ঙ্কর!… রবিন, এবার আমার। পালা…

মুসা ছিল কোথায় এতদিন, কিছু বলেছে?

জিজ্ঞেস করিনি। করতে মনে ছিল না। ড্যানির কথা শুনেই…

আমি আসব তোমার ওখানে?

 না না! হঠাৎ, যেন বহু দূরাগত মনে হলো মারলার কণ্ঠ। কেউ আর, এখন আমার কাছে এসো না। আমার কাছ থেকে দূরে থাকো। আমি জানি। যে-কোন সময় একটা চিঠি এসে হাজির হবে আমার নামে!

কিন্তু মীটিং হওয়া দরকার আমাদের। আলোচনা করতে হবে। পুলিশকে খবর দিতে হবে। আর বসে থাকা যায় না।…অ্যাই, মারলা, আমার। কথা শুনছ?

লাইন কেটে দিয়েছে মারলা। ওকে আর ফোন করে লাভ নেই। ধরবে না।

কিশোরকে ফোন করল রবিন। ঘুম থেকে টেনে তুলল। সব কথা জানাল।

দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর কিশোর বলল, এখন লাইনে। আছে মারলা। তারপর ক্লডিয়া। সবশেষে মুসা। কাল সকালের, ডাকেই একটা চিঠি পাবে মারলা, কোন সন্দেহ নেই তাতে। এই তত্ত্বাবধায়ক লোকটা মিথ্যে হুমকি দেয়নি। কাল অবশ্যই একটা মীটিং ডাকা উচিত তোমাদের। যাদের যাদের নাম আছে।

আমিও সেকথাই ভাবছি। সকালে?।

 সকালে না, বিকেলে করো। আমিও আসতে পারব। সকালে কাজ আছে।

মারলা আর ক্লডিয়া মীটিঙে বসলে হয়। মারলা তো এখনই আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল না। খবরটা দিয়েই লাইন কেটে দিয়েছে। ওর কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছে। কি করব বুঝতে পারছি না।

 আলোচনায় বসতেই হবে। জায়গা ঠিক করো। বিকেলে হলে আমিও থাকব।

কি বোঝাবে ওদের? পুলিশের কাছে যেতে বলবে তো?

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কিশোর বলল, দেখি, কি করা যায়।

 সকালে কি কাজ তোমার?

ডেভনের দোকানে যাব। তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু উল্টো রাস্তা হয়ে যায়। বাসে করে চলে যেতে পারব। তোমার আসার দরকার, নেই। বরং বাড়িতে থেকে রেস্ট নাও। টাইমসের অফিসেও যাব একবার। বিজ্ঞাপনটা কে দেয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।

পারবে?

দেখা যাক। রাখি এখন। অত চিন্তা কোরো না। ঘুম না এলে বরং একটা ঘুমের বড়ি খেয়ে নাও। সকালে উঠে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আলোচনায় বসার ব্যবস্থা করে রাখবে। সময় আর জায়গা ঠিক করে আমার অ্যানসারিং মেশিনে জানিয়ে রেখো। বাড়ি এসেই যাতে পেয়ে যাই।

আচ্ছা।

আর, রবিন…

বলো?

শয়তানটাকে ঠেকাতেই হবে আমাদের। আবার কারও ক্ষতি করার আগেই।

কিন্তু খুঁজে বের করব কিভাবে ওকে?

 করব। যেভাবেই হোক। ছাড়ব না।

অত শিওর হচ্ছ কি করে?

অপরাধ করতে করতে এক না এক সময় ভুল করেই ফেলে অপরাধী। অপরাধ বিজ্ঞান তা-ই বলে। তত্ত্বাবধায়কের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হবে না। ঠিক আছে, রাখলাম। কাল দেখা হবে।

আচ্ছা।

লাইন কেটে দিল রবিন। এরপর ফোন করল মুসাদের বাড়ির নম্বরে।

.

১১.

পরদিন ব্ল্যাক ফরেস্ট পার্কে আবার মিলিত হলো ওরা। মারলা, ক্লডিয়া, রবিন আর মুসা। আজ দলের দুজন কম। সোফিও নেই, ড্যানিও নেই।

 কেউ যেন কারও দিকে তাকাতে পারছে না। মুখ নিচু করে গম্ভীর হয়ে আছে।

সকালের ডাকে ঠিকই একটা চিঠি পেয়েছে মারলা। নামের স্তম্ভে ড্যানির নামটা নেই। সবার ওপরে এখন মারলার নাম। টাইমস পত্রিকায় পার্সোন্যাল সেকশনে একটা সাঙ্কেতিক বিজ্ঞাপন। মানে করলে হয়:

তোমার ডান হাতের তর্জনী কেটে কাটা আঙুল সহ চিঠিটা ক্লডিয়ার কাছে পাঠিয়ে দাও

কথা বলতে যাচ্ছিল ক্লডিয়া, কিন্তু ওকে থামিয়ে দিল রবিন। কিশোরের জন্যে অপেক্ষা করছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই ফোন করে কিশোরের অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ দিয়ে রেখেছে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের উপত্যকা ধরে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে এল সে।

ফিরে তাকাল সবাই।

গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসেছে মুসা। তার কাছে এসে সবার মুখোমুখি বসল কিশোর।

কথা শুরু করল রবিন, একটা কথা এখনও জানানো হয়নি তোমাদের। ওই লোকটা কে, জেনে ফেলেছে কিশোর।

কোন লোকটা? নেহাত সাদামাঠা স্বরে জানতে চাইল ক্লডিয়া।

 সেই লোকটা। মরুভূমিতে যাকে খুন করেছি আমরা।

মুহূর্তে সতর্ক হয়ে উঠল সবাই। একটা ঘাসের ডগা চিবুচ্ছিল মুসা। তাড়াতাড়ি ফেলে দিয়ে বলল, খাইছে! বলো কি? কে?

ডেভন ব্রেক।

কে সে?

সান্তা বারবারার এক দোকানদার।

অ, কোন উৎসাহ পেল না ক্লডিয়া। এ কথা এখন জেনেই কি আর না জেনেই বা কি। লোকটা তো এখন মৃত। আমরা ওকে খুন করেছি। কিশোর, তোমার জন্যে আলোচনা আটকে দিয়ে বসে আছে রবিন। কি নাকি বলবে তুমি আমাদের?

হ্যাঁ, বলব, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তোমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে এমন কিছু পয়েন্ট আমি উল্লেখ করতে চাই। তবে তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো। ড্যানি কোথায় গিয়েছিল এ কথাটা তোমাদের মধ্যে কে জানতে?

কেউ না, মারলা জবাব দিল। কাউকে না জানিয়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্যটাই ছিল জেনে গিয়ে মুখ ফসকে কাউকে যাতে বলে না দিতে পারি আমরা, কোনমতেই তত্ত্বাবধায়কের কানে না যায়।

তা তাহলে তত্ত্বাবধায়ক কি করে জানল ও কোথায় গেছে? কিশোরের। প্রশ্ন।

কেউ জবাব দিতে পারল না।

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। কেউ একজন নিশ্চয় জানো তোমরা। কে? মুসার দিকে তাকাল সে। মুসা, তুমি? তোমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল ড্যানির। বলে গেছে?

কিশোর ছাড়া অন্য সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল মুসা, ও যে। ওর আন্টির বাড়ি গিয়েছিল, এ কথা জানতাম আমি।

কি করে? প্রায় চিৎকার করে উঠল রবিন।

 চুপ করে রইল মুসা।

জবাব দিচ্ছ না কেন? ভুরু নাচাল মারলা। কি করে জানলে?

আমি ওকে ওখানে ফোন করেছিলাম। দেখলাম আছে নাকি। মানে, ভাল আছে নাকি।

কিন্তু জানলে কি করে ওখানে আছে?

মুখ নিচু করল মুসা। হাতের তালু দেখতে দেখতে জবাব দিল, জানি না।

দেখো, তুমি কিছু লুকাচ্ছ আমাদের কাছে। কঠোর হয়ে উঠল ক্লডিয়ার কণ্ঠ। দুদিন ধরে নাকি তোমার কোন পাত্তা নেই। রবিন বহুবার ফোন করেছে বাড়িতে, তোমাকে পায়নি। কোন বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতেও যাওনি। কোথায় ছিলে?

দ্বিধা করতে লাগল মুসা।

কোথায় ছিলে? আবার জিজ্ঞেস করল মারলা।

একটা মেয়ের বাড়িতে, অবশেষে জানাল মুসা।

 তাজ্জব হয়ে গেল সবাই। মুসা আমান মেয়ের বাড়িতে থেকেছে।

কোন মেয়ে?

কে সে?

কি নাম?

 কোথায় থাকে?

তোমরা চিনবে না, যেন মস্ত কোন অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে জবাব দিল মুসা। নতুন পরিচয় হয়েছে।

কি নাম ওর? জানতে চাইল রবিন।

 ক্রিসি। ক্রিসি ট্রেভার। আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে।

ওখানে কেন গিয়েছিলে?

ম্যাসাজ করাতে। সেদিন গুডলাক ফাউনটেইনে বসে বারগার খাচ্ছিলাম। মেয়েটাও খাচ্ছিল। আমাকে পানিতে পয়সা ছুঁড়ে মারতে দেখে প্রশংসা শুরু করল। এভাবেই আলাপ। কথায় কথায় জানাল সে হাসপাতালে কাজ করে। আমিও একসময় বললাম আমার ঘাড়ের ব্যথার কথা। সে তখন বলল, খুব ভাল ম্যাসাজ করতে পারে সে। আমার ব্যথাটা কমিয়ে দিতে পারবে। ঠিকানা দিল, সময় করে যাওয়ার জন্যে। পরশুদিন স্কুলের মাঠে। দৌড়াদৌড়ি করে ব্যথাটা বাড়ালাম। ক্রিসির কথা মনে পড়ল। চলে গেলাম। ওর কাছে। খুকখুক করে কাশল মুসা। সত্যি, ভাল ম্যাসাজ করে ও। ব্যথাটা কমিয়ে দিয়েছে। সেদিন রাতেই চলে আসতে চেয়েছিলাম। আসতে দিল না। জোর করে ধরে রাখল। বলল, ওর ম্যাসাজ শেষ হয়নি। রোগীকে পূর্ণ সুস্থ না করে বাড়ি পাঠানো উচিত না। কি আর করব! কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, জোরাজুরি করেও লাভ হলো না। আসতে দিল না তো দিলই না। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম আসে না বলাতে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিল।

কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল মারলা, ড্যানি যে আন্টির বাড়ি গেছে একথা জানলে কি করে তুমি, এখনও বলোনি কিন্তু।

কি বলব? হতাশ ভঙ্গিতে দুই হাত ওল্টাল মুসা।

 কি করে জানলে?

অত দ্বিধা করছ কেন? মারলার সঙ্গে সুর মেললি রবিন।

বলতে তো পারি। কিন্তু বললে তোমরা বিশ্বাস করবে না।

 কেন? না করার কি হলো? ব্যাপারটা কি বলো তো?

 ভূত বিশ্বাস করি বলে তো সবাই হাসাহাসি করো আমাকে নিয়ে…

তারমানে বলতে চাও ভূতে খবরটা দিয়েছে? তীক্ষ্ণ হয়ে গেল মারলার কণ্ঠ।

মাথা নাড়ল মুসা, কে দিয়েছে জানি না। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলাম। দেখি, ড্যানি আন্টির বাড়িতে গেছে। আমিও আছি সেখানে। রাতে গ্যারেজে একটা শব্দ শুনে দেখতে চলল সে। চিৎকার করে অনেক মানা করলাম। শুনল না। গ্যারেজে ঢুকল। ওখানে অপেক্ষা করছিল লোকটা। একটা ছায়ামূর্তি। বালতিতে করে ড্যানির গায়ে পেট্রল ছুঁড়ে দিয়ে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে ছুঁড়ে মারল…উফ, এতই বাস্তব! এখনও দেখতে পাচ্ছি।

অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর ক্লডিয়া বলল, আশ্চর্য! স্বপ্ন যে মাঝে মাঝে সত্যি হয় এটাই তার প্রমাণ।…যদিও আমি বিশ্বাস করি নাঃ লোকটার চেহারা দেখেছ?

মাথা নাড়ল মুসা, না। অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল। ড্যানির গাড়ির রঙ তুলে ফেলেছিল সিরিশ দিয়ে ঘষে। ঘষার শব্দ করে কৌতূহল জাগিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ড্যানিকে:

আবার নীরবতা। কাশি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোর। যা ঘটার তো ঘটে গেছে, এখন আসল কথায় আসা যাক। যে কারণে আজকের এই মীটিং। আমার একটা পরামর্শ আছে। তোমাদের বাঁচার এখন সবচেয়ে সহজ উপায় হলো পুলিশের কাছে গিয়ে সব জানিয়ে দেয়া।

হু, ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে ভরুক, ঝাঝাল কণ্ঠে বলল মারলা। তাহলে এতদিন গোপন রেখে লাভটা হলো কি?

কোন লাভই হয়নি। ক্ষতি হয়েছে বরং অনেক। জেলে ঢোকাটাই এখন তোমাদের জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ। মরার চেয়ে জেলে যাওয়া ভাল।

কাঁপা গলায় মারলা বলল, কিন্তু এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যাটা ওখানেও আমাদের ছাড়বে না। ড্যানি কোথায় আছে তার জানার কথা নয়। মুসা। তাকে বলেনি। আর আমরা তো কেউ জানতামই না। কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সবজান্তা। অলৌকিক ক্ষমতা আছে ওর। দূর থেকে যেন অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে সোফির অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাল, ড্যানি কোথায় আছে। জেনে নিয়ে পুড়িয়ে মারল…জেলের বদ্ধ জায়গায় আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে যাব। বেরোতেও পারব না…

বাধা দিয়ে বলল কিশোর, মুক্ত থেকেই বা কি লাভ হলো ড্যানির? জেলেই বরং তোমরা নিরাপদ। ওখানে অন্তত পুলিশ থাকবে তোমাদের পাহারা দেয়ার জন্যে। তত্ত্বাবধায়কের সাধ্য হবে না ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে জেলের মধ্যে ঢোকে:

যদি ভূত-প্রেত কিছু না হয়, বিড়বিড় করল মুসা।

ভূতফুত কিছু না। ও জলজ্যান্ত মানুষ। মারলার সর্বনাশ করার আগেই ওকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।

কোথায় আছে কি করে জানব? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তাকে খুঁজতেই বেরিয়েছিলাম আজ সকালে।

 কোন খোঁজ পেলে?

পত্রিকার অফিস থেকে কিছু বের করতে পারিনি। যারা বিজ্ঞাপন দিতে। আসে তাদের নামধাম পরিচয় গোপন রাখে ওরা। পুলিশ গিয়ে চাপাচাপি করলে অবশ্য না বলে পারবে না। তবে তার আগে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।

মানে, পুলিশকে সবকথা জানানোর আগে?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ। দেখি আরেকটু সময় নিয়ে, আর কিছু বের করতে পারি কিনা।

তত্ত্বাবধায়ক ধরা পড়লে খুন হওয়ার আর ভয় থাকবে না আমাদের, এটা ঠিক। মুখ বাকাল ক্লডিয়া। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট করে মানুষ খুনের দায় থেকে রেহাই পাব না কোনমতে।

সেটা পরের কথা, পরে দেখা যাবে। এখনকার বিপদ থেকে আগে বাঁচা দরকার।

ব্রেকের দোকানে গিয়ে কি জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

 ডেভনের চাচার সঙ্গে কথা বলেছি। বিশেষ সাহায্য-সহায়তা করল না। ও নিশ্চয় কিছু জানে। কিন্তু চেপে গেল আমার কাছে। অনেক চাপাচাপি করে ডেভনদের বাড়ির ঠিকানা আদায় করে এনেছি।

ওর মা যেখানে থাকে?

হ্যাঁ

দেখা করেছ?

না। যাব এখন।

আমিও যাব।

চলো।

মীটিং এখানেই শেষ। মারলার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, বাড়ি গিয়ে চুপ করে বসে থাকোগে। আমার ওপর ভরসা রাখো। তোমার একটা চুলও ছিঁড়তে পারবে না তত্ত্বাবধায়ক

গাড়ির হর্ন শোনা গেল।

 ঘনঘন হর্নের শব্দে ফিরে তাকাল সবাই। সোনালি চুল একটা মেয়ে হাত নেড়ে মুসাকে ডাকছে।

ও-ই ক্রিসি, উঠে দাঁড়াল মুসা। কি জন্যে এল আবার… পা বাড়াল ও গাড়ির দিকে।

.

১২.

সান্তা মনিকায় ছোট একটা লাল ইটের বাড়িতে থাকেন মিসেস ব্রেক। কিন্তু পাওয়া গেল না তাকে। বার বার দরজার ঘণ্টা বাজিয়েও সাড়া মিলল না। বাড়ি নেই। তারমানে দেখা করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।

বাড়িটার আশেপাশে খানিকক্ষণ ঘুরঘুর করল কিশোর আর রবিন। লোকে কিছু বলে না, তবে সন্দেহের চোখে তাকায়।

এ ভাবে ঘোরাঘুরি না করে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসার পরামর্শ দিল রবিন। খাওয়াও যাবে, বসারও ব্যবস্থা হবে।

খাওয়া সারতে ইচ্ছে করে অনেক দেরি করল ওরা। বেরিয়ে এসে আবার মিসেস ব্রেকের দরজার ঘণ্টা বাজাল। এবারেও সাড়া নেই। তারমানে এখনও ফেরেননি।

খাওয়া তো হলো। আর কি করে সময় কাটানো যায়? ভাবতে লাগল। ওরা। কিশোর বলল, চলো, সিনেমা হলে গিয়ে বসে থাকি।

অতএব গেল সেখানেই। একটা সায়ান্স ফিকশন ছবি। ভবিষ্যতের মানুষদের কাহিনী। যারা মানব-জীবনের ওপর বিরক্ত হয়ে গিয়ে রোবট হয়ে যেতে চায়। সীটে বসে ঘুমিয়ে পড়ল রবিন। আগের রাতে ড্যানির মৃত্যুসংবাদ শোনার পর আর ঘুমাতে পারেনি। কিশোর পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল আনমনা হয়ে।

ছবি শেষ হলে রবিনকে ডেকে তুলল সে। রাত দশটা বাজে।

ঘুম খারাপ হয়নি। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে রবিনের।

 হল থেকে বেরিয়ে আবার মিসেস ব্রেকের বাড়ি চলল ওরা।

এবার পাওয়া গেল তাঁকে। একবার বেল বাজাতেই খুলে দিলেন। দুজনের ওপর নজর বোলাতে লাগলেন। বলো?

মোটাসোটা, খাটো মহিলা। নার্ভাস ভঙ্গিতে বার বার ডান চোখটা কাঁপে। বয়েসের তুলনায় মাথার চুলে ততটা পাক ধরেনি। ক্লান্ত লাগছে তাকে।

মিসেস ব্রেক? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

মহিলা মাথা ঝাঁকাতে পরিচয় দিল সে, আমার নাম কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু, রবিন।

আপনার নিখোঁজ ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি আমরা, বলে ফেলল রবিন।

ঘাবড়ে গেল কিশোর। এখনই এটা বলা উচিত হয়নি রবিনের। যদি মানা করে দেন মহিলা, কথা বলবেন না, বিফল হয়ে ফেরত যেতে হবে। কষ্ট করে এতক্ষণ সময় কাটানোর কোন অর্থ থাকবে না।

তবে মহিলা ওদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না…? মহিলা বললেন কি বলতে এসেছ?

আপনার ছেলের কি হয়েছে জানি আমরা, কিশোর বলল। সব ঘটনা আপনাকে খুলে বলতে চাই। ঘরে আসব?

ডেভিকে তোমরা চিনতে? অনিশ্চিত শোনাল মহিলার কণ্ঠ।

না, জবাব দিয়েই চট করে কিশোরের মুখের দিকে তাকাল রবিন, আবার বেফাঁস কিছু বলে ফেলল কিনা বোঝার জন্যে। তার কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে বলল, ওকে কবর দিতে সাহায্য করেছে যারা, তাদের মধ্যে আমি একজন।

কেঁপে উঠলেন মিসেস রেক। কে তোমরা?

 নাম তো বললামই, জবাব দিল কিশোর। আমরা শখের গোয়েন্দা।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন মহিলা। তারপর সরে জায়গা করে দিলেন, এসো।

বসার ঘরে ওদের বসতে দিয়ে বললেন, আমি কফি খাব। তোমরা খাবে?

কফি? কিশোর বলল, এসব জিনিস আমরা খুব একটা খাই না। ঠিক আছে, দিন এককাপ। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। সেই কখন থেকে এসে আপনার বাড়ির কাছে ঘুরঘুর করছি দেখা করার জন্যে…

আমার বোনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বোলো এক মিনিট। নিয়ে আসছি।

রান্নাঘরে চলে গেলেন মিসেস ব্রেক

ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো একটা বাধানো ফটোগ্রাফ চোখে পড়ল রবিনের। কিশোরের গায়ে কনুইয়ের গুতো দিয়ে বলল, ওই যে, ডেভন।

ছবিটার দিকে তাকিয়ে কাঁটা দিল রবিনের গায়ে। ওর মনে হলো, ওরই দিকে তাকিয়ে আছে ডেভন। ছবির চোখে যেন নীরব জিজ্ঞাসা–কেন আমাকে এত তাড়াতাড়ি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে? কি ক্ষতি আমি করেছিলাম তোমাদের? তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। চোখ সরিয়ে নিল।

ট্রেতে করে কফি নিয়ে এলেন মিসেস ব্রেক। কেটলি থেকে কাপে কফি ঢালতে তাকে সাহায্য করল কিশোর।

ওদের মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন মিসেস ব্রেক। কাপে চুমুক দিলেন। হ্যাঁ, বলো, কি বলতে এসেছ।

কনসার্ট দেখে ফেরার পথে মরুভূমিতে যা যা ঘটেছিল, খুলে বলল রবিন। কবর দেয়ার কথায় আসতেই নীরবে কাঁদতে শুরু করলেন মহিলা। রবিনের চোখেও পানি এসে গেল। পুলিশের কাছে কেন যায়নি ওরা এই কৈফিয়ত দিতে গিয়ে কথা আটকে যেতে লাগল তার মুখে।

 আপনাকে খবর দেয়ার কথা ভেবেছি আমরা, রবিন বলল। লোকটা কে, কোথায় বাস করে, কিছুই জানতাম না। জানলে খবরটা ঠিকই দিতাম, যেভাবেই হোক। এই যে, জানার পর পরই চলে এলাম, একটুও দেরি করিনিঃ…ওর বাড়িতে কি করে খবর দেয়া যায় সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমরা। একবার মনে করলাম পুলিশকে একটা উড়োচিঠি দিয়ে জানিয়ে দিই অমুক জায়গায় অমুক দিন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। লাশটাকে অমুক জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও ভয় ছিল খোঁজ করতে করতে ঠিকই আমাদের হদিস করে ফেলবে পুলিশ। দম নেয়ার জন্যে থামল সে।

সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, আবার বলল রবিন, ওকে খুন করতে চাইনি আমরা। কিভাবে গাড়ির নিচে চলে এল সেটা এখনও মাথায় ঢুকছে না আমার। লাশটা দেখার পর মনে হয়েছিল, রাস্তার ওপর শুয়ে ছিল আপনার ছেলে। বেহুশ হয়ে। অন্ধকারে স্রেফ তার ওপর দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দেয়া হয়েছে। চাকার নিচে কিছু পড়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলে আমার বন্ধু ড্যানি। নিচে নেমে দেখি কি আর বলব! মিসেস ব্রেক, আপনার ছেলেকে খুন করেছি আমরা। যে কোন শাস্তি দিতে পারেন। আমাদের। ইচ্ছে করলে এখনই পুলিশে ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারেন।

রবিনকে অবাক করে দিয়ে তার বাহুতে হাত রাখলেন মহিলা। বিশ্বাস করতে পারল না সে। রেগে ওঠার বদলে সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। আশ্চর্য!

ওর লাশের কি হলো এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, মিসেস ব্রেক বললেন। রোজ রাতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, কোথায় পড়ে আছে লাশটা? জানতাম মারা গেছে ও। কে খুন করেছে তা-ও জানি। তোমরা ওকে খুন করোনি, রবিন। অহেতুক কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই। ওর লাশের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়েছিল তোমার বন্ধু। তোমাদের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা। যায়নি। আগেই খুন হয়ে গিয়েছিল।

চোখে অবিশ্বাস নিয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। কিশোর নির্বিকার। রবিন তাকাতেই চোখ টিপল। অর্থাৎ, কি, বলেছিলাম না?

কফির কাপটা নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলেন মিসেস ব্রেক। পুরো ব্যাপারটা তোমাদের খুলেই বলি। খুব মানসিক কষ্টে আছ তোমরা, বোঝা যাচ্ছে। কপালে হাত ডললেন তিনি। তোমাদের সব বলতে পারলে আমারও মনটা খানিক হালকা হবে।

চুপ করে রইল ওরা। শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে।

কপাল থেকে হাত নামালেন মিসেস ব্রেক। কোন্‌খান থেকে শুরু করব? প্রথম থেকেই বলি সব। ভালই চলছিল আমাদের মা-ছেলের সংসার। ঠিকমত দোকানে যেত ডেভি, ব্যবসা করত, ঠিকমত বাড়ি ফিরত। কোন রকম বদনেশা ছিল না। রাতে খাবার টেবিলে সারাদিন যা যা করত সব আমাকে বলত। একরাতে হঠাৎ করেই মেয়েটার নাম বলল। প্রায়ই আসত সিডি ডিস্ক কিনতে। উদ্ভট গান তার বেশি পছন্দ। মেয়েটার নাম মায়া। তেমন গুরুত্ব দিলাম না। দোকানে কত ধরনের কাস্টোমারই আসে। সবার গানের রুচিও একরকম না। এটা নিয়ে মাথা ঘামালাম, না। তবে ঘামানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আজ আমার ডেভি বেঁচেই থাকত।

বদলাতে শুরু করল ডেভি। অসহিষ্ণু, বদমেজাজী হয়ে উঠল। কারণে অকারণে আমার সঙ্গে খেচাখেচি শুরু করে দিত, আগে যেটা সে কখনোই করত না। ওর এই পরিবর্তনে শঙ্কিত হলাম আমি। অনিদ্রা রোগেও ধরল ওকে। দোকান থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে লাগল। তারপর একদিন আর ফিরলই না। দুদিন কোথায় কাটিয়ে ফিরে এল। বুঝলাম কোন মেয়ের পাল্লায়। পড়েছে। সেই মেয়েটাও হতে পারে, মায়া। ভাবলাম, পড়ে পড়ুকগে। জোয়ান বয়েসী ছেলে। পড়বেই। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে যখন এড়িয়ে গেল, সন্দেহ হলো আমার।

তারপর একদিন বাথরূমে তাকে কোকেনের প্যাকেট বাছাই করতে দেখে ফেললাম। কলজে কেপে গেল আমার। গানের জগতে হেরোইন আর অন্যান্য নেশায় জড়িয়ে যাওয়াটা একটা অতি সাধারণ ব্যাপার, জানা আছে আমার। এই বিষ যে কোথায় নিয়ে যায় মানুষকে, তা-ও জানা। সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেলাম। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে সর্বনাশ ঠেকানোর কোন পথই আর খোলা থাকবে না। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর দোকানের ভার ওর ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কোন গণ্ডগোল করেনি কখনও, তাই হিসেব নেয়ার কথাও ভাবিনি। সেদিন ভাবলাম। হিসেব নিতে গিয়ে দেখি কিছুই নেই। সব খুইয়ে বসে আছে। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট শূন্য। আমি একটা স্কুলের টীচার। দোকানদারি না করলেও চলে যাবে মা-ছেলের। তাই দোকানের জন্যে চিন্তা না করে আগে ছেলের দিকে নজর দিলাম। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলাম ওকে। প্রথমে রাজি হতে চাইল না। আমিও লেগেই রইলাম। শেষমেষ আমার চাপাচাপিতে ক্লিনিকে যেতে যেদিন রাজি হলো, সেদিন এমন। একটা জিনিস দেখে ফেললাম, বুঝলাম ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েও আর লাভ নেই।

বাগানে ফুলগাছের পাতা ছাটতে গিয়ে পচা গন্ধ লাগল নাকে। খুঁজতে খুঁজতে দেখি একটা ঝোপের ধারে নতুন গর্ত। মাটি চাপা দেয়া। অল্প একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল সবুজ একটা পলিথিন ব্যাগ। তার ভেতরে তিনটে জানোয়ারের ধড়, মাথা কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে–কুকুর, বেড়াল এমনকি একটা খটাশও আছে। গায়ের চামড়া জায়গায় জায়গায় কামানো। ডেভিকে জিজ্ঞেস করলাম। অস্বীকার করল না ও।

আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখালাম ওকে। কাকুতি-মিনতি শুরু করল। বলল সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে আবার ভাল হয়ে যাবে। আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না জানতাম, সেজন্যেই ভয় দেখিয়েছিলাম। কোন বদমাশদের দলে যোগ দিয়েছে জিজ্ঞেস করলাম। বলে দিল সব। ওই মেয়েটাই ওর সর্বনাশ করেছে।

কয়েক দিন আর বাড়ি থেকেই বেরোল না ডেভি। একদিন মায়া এসে হাজির হলো। ডেভির চেয়ে দুতিন বছরের ছোট হবে। খুব সুন্দরী। ডেভির সঙ্গে ফিসফাস করে কি সব বলল। সন্দেহ হলো আমার। ওরা গাড়িতে করে বেরিয়ে যেতেই আমিও গাড়ি নিয়ে পিছু নিলাম।

বড় একটা গুদামের মত বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল ওরা। খানিক দূরে গাড়িতে বসে রইলাম। ঘন্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেল। রাত হলো। তখনও ওদের বেরোনোর নাম নেই। আমার আশেপাশে যে সেব লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম, একটাকেও ভাল লোক বলে মনে হলো না। সব গুণ্ডাপাণ্ডা। ভয় পাচ্ছিলাম রীতিমত। রাত বারোটা পর্যন্ত বসে থেকে আর থাকার সাহস হলো না। বাড়ি না ফিরে চলে গেলাম আমার বোনের বাড়িতে। কি করা যায় ওর সঙ্গে পরামর্শ করতে।

পরদিন পুলিশ নিয়ে গেলাম ওই গুদামে। দুজন অফিসার ভেতরে ঢুকল। আমি বসে রইলাম বাইরে, পুলিশের একটা পেট্রল কারে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এল অফিসার দুজন। মুখ সাদা। একজন রাস্তার ধারে দেয়ালের কাছে গিয়ে বমি শুরু করল। অন্যজন আমাকে জানাল, ভেতরে কেউ নেই। তবে যা আছে দেখলে সহ্য করতে পারব না। ভাবলাম ডেভির কিছু হয়েছে। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকে পড়লাম গুদামে।

অনেকক্ষণ একটানা কথা বলার পর দম নেয়ার জন্যে থামলেন মিসেস ব্রেক।

শয়তান উপাসকদের আস্তানা ছিল ওটা, তাই না? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ভুরু কোচকালেন মিসেস ব্রেক, তুমি জানলে কি করে?

আপনার কথা শুনে। ওভাবে জন্তু-জানোয়ার বলি দিয়ে উপাসনা করে শয়তান উপাসকরাই। বলি দেয়ার জন্যে মানুষ তো আর সহজে মেলে না আজকাল যাই হোক। কি দেখলেন?

দৃশ্যটা কল্পনায় ভেসে উঠতে চোখমুখ বিকৃত করে ফেললেন মিসেস ব্রেক। কি যে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছিল ওখানে, বলে বোঝাতে পারব না। সব জায়গায় রক্ত, কোথাও শুকনো, কোথাও আধাশুকনো, কোথাও প্রায় তাজা। পশুর চামড়া আর নাড়ীভুড়ি ছড়িয়ে আছে সবখানে। বিচিত্র সব নকশা এঁকে রেখেছে মেঝেতে। কোনটা বৃত্ত, কোনটা পাঁচ কোণওয়ালা তারকা, কোনটা ছয় কোণ। ওগুলোর মধ্যে দুর্বোধ্য নানা রকম চিহ্ন আঁকা। কোন কোনটার মধ্যে নামও লিখেছে। সবই রক্ত দিয়ে। কালো রঙের আধপোড়া প্রচুর মোমবাতি পড়ে আছে মেঝেতে। কয়েক সেকেন্ডের বেশি ছিলাম না, কিন্তু তাতেই মাথা ঘুরতে শুরু করল আমার। মনে হলো পাগল হয়ে যাব। ছুটে বেরিয়ে এলাম বাইরে। অফিসাররা আমাকে নানা ভাবে শান্ত করার চেষ্টা করল। ডেভির জন্যে কষ্টে মনটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। এত ভাল স্বভাবের একটা ছেলে আমার এ কাদের সঙ্গে মিশল! ওরা শুধু খারাপ নয়, ভয়ানক খারাপ, নরকের ইবলিস! ছেলের আশা ছেড়ে দিলাম।

তারমানে শয়তান উপাসকদের কাণ্ডকারখানা অজানা নয় আপনার? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ব্রেক। না। বইতে পড়েছি।

আপনার ছেলেকে ওরা পটিয়ে-পাটিয়ে বলি দেয়ার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল।

আবারও মাথা ঝাঁকালেন মিসেস বেক। চোখে পানি টলমল করে উঠল আবার।

বলো কি! আঁতকে উঠল রবিন। এই যুগে খোদ আমেরিকা শহরে নরবলি!

ফিরে তাকাল কিশোর। আমেরিকা হলে কি হবে? মানুষের চরিত্র হতো। আর বদলায়নি। আদিম যুগেই রয়ে গেছে। বিবেক-বুদ্ধি বেশি যাদের, তারা জোর করে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে নিজেকে। যারা পারে না…যাকগে, মিসেস ব্রেকের দিকে তাকাল কিশোর, তারপর কি হলো?

মায়া হলো একজন শিক্ষানবীস, মিসেস ব্রেক বললেন। পুরোপুরি ডাইনী হতে হলে শুধু পশু বলি দিলে চলবে না, নরবলি দিতে হবে। শয়তান। উপাসকদের বিশ্বাস, যে যত বেশি মানুষ খুন করতে পারবে, কিংবা অন্যকে প্ররোচনা দিয়ে তার সাহায্যে ছলে-বলে-কৌশলে খুন করাতে পারবে, সে তত বেশি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। বলি দেয়া আত্মাগুলো দখলে চলে আসবে তার। যে যত বেশি নিষ্ঠুর হবে, আত্মাগুলো তার আদেশ তত বেশি পালন করবে। আমার ছেলেকে বোকা পেয়ে প্রথম শিকার হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেছিল মায়া।

কি করে জানলেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। মায়ার সঙ্গে কথা বলেছিলেন? নাকি ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছেন?

মিসেস ব্রেকের এক চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। মোছার চেষ্টা করলেন না তিনি। ধরা গলায় বললেন, ওর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি আমার। গুদাম থেকে পালানোর দুদিন পর একদিন রাতদুপুরে ফোন। করল আমাকে। কেমন আছি জিজ্ঞেস করল। ওটাই তার সঙ্গে শেষ কথা। আর কথাও হয়নি, দেখাও না। নিখোঁজ হয়ে গেল।

মায়াকে জিজ্ঞেস করেননি ও কোথায় গেল?

না। তবে ওর বাবা-মার সঙ্গে দেখা করেছি।

কোথায়? গলা লম্বা করে সামনে মুখ বাড়িয়ে দিল কিশোর। কখন?

 মর্গে। ওদের মেয়েকে শনাক্ত করতে এসেছিল।

মায়াও মারা গেছে!

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ব্রেক। হ্যাঁ। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে তোমাদের, কিন্তু তবু বলি, ও মরাতে আমি খুশি হয়েছি। বেঁচে থাকলে আমার ছেলের মত আরও কত ছেলের যে সর্বনাশ করত কে জানে। যা হোক, আমি সেদিন গুদামে পুলিশ নিয়ে গিয়ে দেখে আসার পর কি ঘটল বলি। গুদামটার ওপর সাদা পোশাকে নজর রাখল গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু শয়তান উপাসকদের কেউ আর ফিরে এল না সেখানে। মায়ার নাম বললাম পুলিশকে। শুধু নামটাই জানাতে পেরেছিলাম, তখনও ওর পরিচয় জানতাম না। নাম আর চেহারার বর্ণনা।

একটা কথা, বাধা দিয়ে বলল কিশোর, ওর চুলের রঙটা বলতে পারেন?

সোনালি।

হু! চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর।

 একথা কেন জানতে চাইলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আছে, কারণ আছে। মিসেস ব্রেক, আপনি বলুন।

মায়া নামের কোন মেয়েকে খুঁজে বের করতে পারল না পুলিশ। ডেভিকেও না। ওর সন্ধান জানার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম। জানতাম, আর কোনদিন ফিরে আসবে না আমার ছেলে। খুন করে কোথাও ফেলে দেয়া হয়েছে ওকে। তবু, মায়ের মন বুঝ মানল না, দিলাম। এক রাতে পুলিশ ফোন করল। স্যান বার্নাডিনো ভ্যালি হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করল আমাকে। একটা মেয়ের লাশ নাকি নেয়া হয়েছে। হাসপাতালে যার সঙ্গে মায়ার চেহারা মিলে যায়।

যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, পুলিশের অনুরোধ এড়াতে না পেরেই গেলাম। দেখা হলো মায়ার মা-বাবার সঙ্গে। মায়াকে শনাক্ত করলাম। ওর আসল নাম সারাহ। হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে। মরার আগে নাকি অদ্ভুত কাণ্ড করছিল সে। একটা বেড়াল বলি দিয়ে সারা গায়ে রক্ত মেখে, কালো মোম জ্বেলে, ঘরের মেঝেতে তারকা একে তার ওপর বসে শয়তানের উপাসনা করছিল। কিছুদিন থেকেই মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তার বাবা। চিৎকার শুনে তার ঘরে গিয়ে দেখেন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে মেয়ে। অবস্থা খারাপ দেখে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। হাসপাতালে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মারা গেল সে। মরার আগে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে ডেভিকে সে খুন। করেছিল।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে দম নিলেন তিনি। তারপর রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডেভিকে তোমরা খুন করোনি। খুন করে মরুভূমিতে ফেলে রেখে এসেছিল তাকে মায়া।

কত তারিখ ছিল সেটা? জানতে চাইল কিশোর।

জুলাইর একতিরিশ।

রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, ওই দিনই তোমরা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলে না?

হ্যাঁ

মাথা ঝাঁকাল কিলোর। মিসেস ব্রেকের দিকে ফিরল, তারপর?

মিসেস ব্রেক বললেন, সারাহ নিজের মুখে স্বীকার করেছে ডেভিকে ওইদিন খুন করেছে সে। ওইদিনই রাতে বেড়াল বলি দিয়ে উপাসনা করেছে। ওইদিনই মারা গেছে। হাসপাতালের মর্গে নিজের চোখে ওর লাশ দেখেছি। আমি। শুধু আমি একা নই, ওর মা-বাবাও দেখেছেন। ডাইনী তো আর হতে পারল না। শুধু শুধু ছেলেটাকে আমার খুন করল।

আবার একটা মুহূর্ত নীরব থাকার পর মিসেস ব্রেক বললেন, সবই বললাম তোমাদের। ডেভির লাশটা যে খুঁজে পেয়েছ তোমরা, শেয়াল-কুকুরে খাওয়ার জন্যে ফেলে না রেখে কবর দিয়ে এসেছ, সেজন্যে তোমাদের কাছে। আমি কৃতজ্ঞ। আবার গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। কোনখানে দিয়েছ, মনে আছে? খুঁজে বের করতে পারবে?

পারব, মাথা কাত করল রবিন।

ঠিক আছে, একদিন নিয়ে যেয়ো আমাকে।

আচ্ছা।

আজ তাহলে উঠি আমরা, মিসেস ব্রেক? কিশোর বলল। অনেক রাত হলো। অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার..

সময় আর নষ্ট করলে কোথায়? বরং ডেভির খোঁজ জানিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞ করে দিলে। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। … কিশোর, সেরাতে তুমিও কি গাড়িতে ছিলে?

না, আমি ছিলাম না। বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি তখন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বহুদূরে। রবিন আর মুসা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফিরে এসে যখন শুনলাম, মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মানুষ খুনের দায়ে ওরা জেলে যাবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল…

না জেনে শুধু শুধুই কষ্ট পেয়েছ তোমরা। খুন করেছে আরেকজন, ভোগান্তিটা গেল তোমাদের…

ওহহো, মিসেস ব্রেক, একটা কথা, কিশোর বলল, জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছিলাম। মনে করতে হয়তো খারাপ লাগবে আপনার। তবু এত কথা যখন বললেন, এটাও জেনেই নিই। কিভাবে খুন করেছিল সারাহ, বলেছে?

কেঁপে উঠলেন মিসেস ব্রেক। ঠোঁটের কোণ কুঁচকে গেল। ঘুমের মধ্যে মাথার চাঁদিতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চোখা একটা পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছিল ডাইনীটা…

আর বলতে পারলেন না মিসেস ব্রেক। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

তাকে শান্ত হওয়ার সময় দিল কিশোর। রবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, পেরেক-টেরেক কিছু দেখেছিলে তোমরা?

নাহ, মাথা নাড়ল রবিন। অত কিছু দেখার মত অবস্থা ছিল না কারও। সবাই খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল। আতঙ্কিত।

হু। তারমানে খুজলে এখনও চাদিতে পেরেকটা পাওয়া যাবে।

চাদিতে পেরেক ঢোকালে তো মাথা থেকে রক্ত বেরোত। ঠোঁটের কোণ থেকে কেন?

সরু পেরেক ঢোকালে রক্ত আর কতটা বেরোবে? সামান্যই। ব্যথার চোটে মরার আগে নিশ্চয় জিভে কামড় লেগে গিয়েছিল ডেভনের। জিভ কেটে রক্ত বেরিয়ে ঠোঁটের কোণে লেগে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়াল কিশোর। মিসেস ব্রেককে সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পেল না। কোনমতে বলল, আজ তাহলে যাই, মিসেস ব্রেক…

বোসো। যাওয়ার আগে আরও একটা অদ্ভুত খবর শুনে যাও। পরদিন সারাহর বাবা মিস্টার জবার মর্গ থেকে মেয়ের লাশ আনতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কবর দেয়ার জন্যে। পাওয়া যায়নি লাশটা। রহস্যময় ভাবে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও হদিস করতে পারেনি লাশটার কি হয়েছিল।

এটা একটা খবর বটে। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল কিশোর। মিস্টার জবারের ঠিকানাটা দিতে পারেন?।

নাম জানি। কোন শহরে বাস করেন সেটা জানি। কিন্তু ঠিকানা জিজ্ঞেস করিনি। পুরো নাম গ্রেগরি জবার। রিভারসাইডে থাকেন। ইনফরমেশন থেকে ওদের ফোন নম্বর জেনে নিতে পারলে ঠিকানা বের করা। কঠিন হবে না।

রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, চলো। মিসেস ব্রেককে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমরা। ওনার এখন একা থাকা দরকার।…অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে, মিসেস ব্রেক। আমাদের দিয়ে যদি কোন রকম সাহায্য হবে মনে করেন কখনও, দ্বিধা-সঙ্কোচ না করে খবর দেবেন।

১৩.

জবারের বাড়ি যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল কিশোর। ইনফরমেশন থেকে ঠিকানা জোগাড় করেছে। কিন্তু রবিন বলল আগে মারলাকে দেখতে যাওয়া দরকার। পার্কের মীটিং থেকে যাওয়ার সময় ওর মনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল।

মারলাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে কিশোরকে গাড়িতে বসতে বলে, দেখতে চলল রবিন। মারলার ঘরের একটামাত্র জানালায় আলো জ্বলছে। বাকি পুরো বাড়িটাই অন্ধকার। বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। ভেজানো দরজা ঠেলে উঁকি দিল রবিন।

চিত হয়ে শুয়ে আছে মারলা। মৃদু শব্দে মিউজিক বাজছে। রবিনের সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল। চোখ কেমন ঘোর লাগা, লাল টকটকে। মাথার কাছের টেবিলে রাখা একটা আধখাওয়া মদের বোতল। অবাক হলো রবিন। মারলা তো মদ খায় না!

রবিন, বিড়বিড় করল মারলা, তুমি নাকি?

কেন দেখতে পাচ্ছ না? এগিয়ে গিয়ে বিছানার কাছে দাঁড়াল রবিন। কি। হয়েছে তোমার?

ছাতের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মারলা। কি হয়েছে? কিছুই না। খুব ভাল আছি আমি। ড্যানির যা অবশিষ্ট আছে, কাল নিয়ে আসবে। ওর মা আমাকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন, একটা বাক্স কিনে নিয়ে যেতে পারব কিনা। ভাবতে পারো? দুই হপ্তা আগে রাস্তায় দেখে জোর করে বাজারে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে, পছন্দ করে ড্যানিকে একটা প্যান্ট কিনে দেয়ার জন্যে। কাঁদতে শুরু করল সে। কথা জড়িয়ে গেল। আর এখন এল কফিন কিনে দেয়ার অনুরোধ।

ওর বাহুতে হাত রাখল রবিন। ড্যানির জন্যে তোমার চেয়ে কষ্ট আমার কম হচ্ছে না, মারলা। ও আমার বন্ধু ছিল। তত্ত্বাবধায়কের শয়তানি আমরা বন্ধ করবই। প্রতিশোধ নেব। কিশোর আর আমি অনেকখানি এগিয়ে গেছি। মরুভূমিতে পড়ে থাকা লোকটার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এলাম

কোন আগ্রহ বোধ করল না মারলা। তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে লেগে সুবিধে করতে পারব না আমরা। বরং যা করতে বলে করে ওর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া উচিত।

না, ওর কথা শুনব না আমরা।

শোনাই উচিত! নইলে সোফি আর ড্যানির অবস্থা হবে। বাঁচতে হলে ওর কথা শুনতেই হবে, ব্যথায় ককিয়ে উঠল মারলা। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। বোতলটার দিকে বাঁ হাত বাড়াল, যদিও ডান হাত দিয়েই নেয়ার সুবিধে বেশি।

টান দিয়ে বোতলটা সরিয়ে ফেলল রবিন। অনেক খেয়েছ। ঘুমাও। এখন। কাল সকালে এসে দেখে যাব আবার।

বোতলটা দেয়ার জন্যে অনুরোধ করতে লাগল মারলা। নিজে উঠে রবিনের হাত থেকে কেড়ে নেয়ারও যেন শক্তি নেই। বাঁ হাতটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দাও, প্লীজ!

বারবার বা হাত বাড়াতে দেখে অবাক হলো রবিন। সন্দেহ হলো ওর। একটানে মারলার গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে ফেলল।

মারলার ডান হাতে ব্যান্ডেজ বাধা। আনাড়ি হাতে বেঁধেছে। রক্তে ভিজে গেছে। রক্ত লেগে গেছে হাতটা বিছানার যেখানে ফেলে রেখেছিল সেখানকার চাদরে।

ডান হাতের তর্জনীটা নেই দেখাই যাচ্ছে।

মারলা! চিৎকার করে উঠল রবিন। তুমি কি মানুষ! করলে কি করে একাজ! নিজের আঙুল নিজে কেটে ফেললে!

উঠে বসল মারলা। চোখেমুখে রাগ আর ভয় একসঙ্গে ফুটেছে। আর কি। করতে পারতাম? একটা আঙুলই তো শুধু গেছে। যাক। প্রাণটা তো বাচল। জানো, খুব একটা কষ্ট হয়নি। ভালমত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নিলাম। তারপর ধারাল ছুরি দিয়ে কষে এক পোচ। ব্যস, গেল আলগা হয়ে। চিঠিটার সঙ্গে একটা খামে ভরে রেখেছি…,

থামো! আর শুনতে চাই না!

থামল না মারলা। ওটা এখন নিয়ে যেতে হবে ক্লডিয়ার কাছে। বিজ্ঞপ্তিতে তাই বলেছে। ডাকে তো আর পাঠানো যাবে না। রক্ত দেখলেই সন্দেহ করবে। কি আর করব? নিজেকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। খামটা একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব।

কাজটা করা তোমার মোটেও উচিত হয়নি…

এটাই উচিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক মানুষ না। পিশাচ! সোফি আর ড্যানির কি দুর্গতি করেছে দেখলেই তো। যেখানে খুশি যেতে পারে সে। যা ইচ্ছে করতে পারে। এর পরেও ওকে ঘটানোর সাহস হবে? কথা না শুনলে। কি ঘটত বুঝেই একাজ করেছি। টুকরো টুকরো হয়ে কিংবা ছাই হয়ে মরার চেয়ে একটা আঙুল খোয়ানো অনেক ভাল।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে রবিন বলল, কি জানি কোনটা ভাল! কিন্তু এখন তুমি ওই শয়তানের তারকায় ঢুকে পড়েছ।

তাতে কি হয়েছে? একটা আঙুলের বিনিময়ে বেঁচে তো গেলাম।

কি জানি বাচলে না আরও মরলে! একদিন হয়তো আরও বেশি পস্তাতে হতে পারে এর জন্যে।…ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব? যাবে?

অদ্ভুত দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকাল মারলা। সাহায্য লাগবে না। আমি নিজেই গাড়ি চালাতে পারব। মাত্র তো একটা আঙুল গেছে। বাকি নয়টাই এখনও ঠিক। তুমি কি ভেবেছ একটা আঙুল বাদ যাওয়াতেই পঙ্গু হয়ে গেছি আমি?

তোমার আব্বা-আম্মাকে ডাকব?

আহ, বললাম তো আমার কোন সাহায্য লাগবে না, বিরক্ত হলো। মারলা। এখন ওদের দেখালে হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেবে। যে জন্যে নিজের আঙুল খোয়ালাম, সেটাও আর করতে দেবে না। কথার অবাধ্য না হয়েও তত্ত্বাবধায়কের আক্রোশ থেকে বাঁচতে পারব না তখন। বরং সকলেই জানুক। ততক্ষণে ব্যথাও শুরু হবে, তত্ত্বাবধায়কের ফাঁদ থেকেও বেরিয়ে আসব। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলে নিজেই যেতে পারব… তুমি যাও। এখানে কিছু আর করার নেই। বোতলটা দিয়ে যাও দয়া। করে।

*

গাড়িতে বসে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। এত দেরি করছে কেন রবিন? নেমে গিয়ে দেখে আসার কথা যখন ভাবছে এই সময় এল সে। সব কথা জানাল। জবারের সঙ্গে দেখা করে এসেই ক্লডিয়াদের বাড়িতে যাবে, ঠিক করল ওরা। মারলার পরের নামটা ক্লডিয়ার। তত্ত্বাবধায়ক এরপর ওর নামেই মেসেজ পাঠাবে। মারলা কি করেছে সেটা জানিয়ে ক্লডিয়াকে সাবধান করে দেয়া দরকার।

গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পাশে চুপচাপ বসে আছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে।

কি ভাবছ? রবিনের চোখ সোজা সামনের দিকে। ঝলমলে জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে যেন। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমা নাকি আজ? আচ্ছা, শয়তান উপাসকরা কি পূর্ণিমাকে বেছে নেয়? নাকি অমাবস্যা?

সেটা নির্ভর করে কোন ধরনের পূজা ওরা করছে।

কিশোর, একটা কথা ভাবছি। আমাদের এই তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে ওই শয়তান উপাসকদের কোন সম্পর্ক নেই তো?

সোজা হলো কিশোর। আমিও এতক্ষণ ধরে এই কথাটাই ভাবছি…

*

রিভারসাইডে পৌঁছে মিস্টার জবারের বাড়িটা খুঁজে বের করতে পুরো একটা ঘণ্টা লেগে গেল ওদের। দুজনে একসঙ্গে এসে দাঁড়াল তার দরজার সামনে।

শহরের দরিদ্রতম এলাকায় বাস করেন। এখানে পুরো ব্লকের সব বাড়িই পুরানো। চাঁদের আলোয় বিচিত্র দেখাচ্ছে, যেন কার্ডবোর্ডের তৈরি ছাউনি সব।

মিস্টার জবারের বাড়িটা আরও বেশি পুরানো। মলিন, বিবর্ণ, হতদরিদ্র চেহারা।

 দরজায় থাবা দিল কিশোর। বেশ কয়েকবার থাবা দেয়ার পর দরজা খুলে। দিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। ছেঁড়া পর্দার ওপাশ থেকে উঁকি দিলেন। বাড়িটার চেহারার সঙ্গে মিল রাখতেই যেন পরনের পোশাকটাও তার অতি পুরানো।

কি? জিজ্ঞেস করলেন জবার।

আমরা আপনার মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি, কিশোর বলল। যাদের সঙ্গে মিশেছিল, তারা আবার জ্বালানো শুরু করেছে। আমরা ওদের শয়তানি বন্ধ করতে চেষ্টা করছি। সেজন্যে আপনার সাহায্য দরকার।

কে তোমরা?

আমার নাম কিশোর। ও রবিন। আমরাও ওদের শয়তানির শিকার। সাংঘাতিক বিপদে ফেলে দিয়েছে। উদ্ধার পেতে চাই।

সারাহকে চিনতে নাকি তোমরা?

না। তবে তার সব কথা জানি। কিভাবে মারা গেছে শুনেছি। মারা যাওয়ার আগে যে লোকটাকে খুন করেছে তার কথাও জানি।

ওই ইবলিসগুলোর সঙ্গে মেশার আগে একটা পিঁপড়ে মারারও ক্ষমতা। ছিল না ওর। কি মেয়েটাকে কি বানিয়ে ফেলল! কেঁপে উঠল বৃদ্ধের কণ্ঠ। এসো। ভাল ছেলে বলেই মনে হচ্ছে তোমাদের। দেখি, কি সাহায্য করা যায়।

মিসেস জবারকে ডিস্টার্ব করব না তো আবার? বিনীত ভঙ্গিতে বলল কিশোর।

না না, ও ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমাচ্ছে। একটু আস্তে কথা বললেই হবে। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকেই ঘুম-নিদ্রা একেবারে গেছে বেচারির। কড়া কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় এখন।

 বসার ঘরে ওদেরকে নিয়ে এলেন মিস্টার জবার। বয়েস ষাটের কাছাকাছি হবে। সারাহ্ নিশ্চয় ওদের বেশি বয়েসের সন্তান। কিংবা পালিতা কন্যাও হতে পারে।

রবিন আর কিশোরকে বসতে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বলো এখন, কি জানতে চাও?

কি করে মারা গেল আপনার মেয়ে? জানতে চাইল কিশোর। সে একাই কথা বলছে। রবিন চুপ করে আছে।

যেদিন মারা গেল সেদিন রাতে ওর ঘর থেকে একটা চিৎকার শুনলাম। মনে হলো প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি বুক চেপে ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি করছে সারাহ। বুঝলাম হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাঁচাতে পারল না। বুক চেপে ধরে কাশতে লাগলেন জবার। অবস্থা দেখে মনে হলো যেন তাঁরই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে কাশি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ে মানুষ খুন করেছে একথা তোমাদের কে বলল?

মিসেস জোসেফিনা ব্রেক।

বেচারি, একটা সেকেন্ড মুখ নিচু করে রাখলেন মিস্টার জবার। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কাছে কি জানতে চাও?

আপনার মেয়ের যে কোন বন্ধুর নাম, যে ওই শয়তান উপাসকদের সঙ্গে জড়িত ছিল, কিংবা এখনও আছে।

ওর কোন বন্ধু ছিল না। ও ছিল একেবারে একা। নিঃসঙ্গ। এত সুন্দরী ছিল, কিন্তু কোন দিন কোন ছেলেবন্ধু জোটেনি। কোন ছেলে এসে ওর সঙ্গে যেচে বন্ধুত্ব করতে চায়নি। খুব অবাক লাগত আমার। কোন মেয়ে ওকে কখনও ফোন করত না। কেন, কখনও বুঝতে পারিনি। এখনও পারি না। জন্মের পর থেকেই খুব শান্ত ছিল মেয়েটা। হৈ-হট্টগোল পছন্দ করত না। কারও সঙ্গে কথা বলত না। একা একা নিজের মত থাকত। সেই মেয়েটাই শেষে কি হয়ে গেল!

কার সঙ্গে প্রথম মেলামেশা করেছিল, জানেন নাকি? এতক্ষণে একটা প্রশ্ন করল রবিন। কথা তো সে নিশ্চয় কারও সঙ্গে বলেছে। নইলে শয়তান উপাসকদের খপ্পরে পড়ল কি করে?

নাহ, জানি না! ক্ষোভের সঙ্গে জবাব দিলেন মিস্টার জবার। যদি জানতাম এই অবস্থা হবে, তাহলে তো কড়া নজরই রাখতাম। কি করে যে ওই ইবলিসগুলোর সঙ্গে পরিচয় হলো, কিছুই বলতে পারব না।

এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে কয়েকটা বাধানো ছবির ওপর দৃষ্টি আটকে গেল রবিনের। একটা বুকশেলফের ওপর দাঁড় করানো। জবারদের পারিবারিক ছবি।

চেয়ার থেকে উঠে পায়ে পায়ে সেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। একটা ছবিতে একা একটা মেয়ে বসে আছে। লাল চুল। সবুজ চোখ। বেড়ালের চোখের মত জ্বলছে। মেয়েটার চোখ দেখলেই মনে হয় মানসিক রোগী। কোন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এরকম করে তাকায় না। হাত নেড়ে কিশোরকে ডাকল রবিন।

কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর, কি?

দেখো তো চিনতে পারো নাকি?

একবার তাকিয়েই বলে উঠল কিশোর, বিকেলে মুসাকে ডেকেছিল যে সেই মেয়েটার মত না?

মাথা ঝাঁকাল রবিন। হ্যাঁ। কেবল চুলের রঙ বাদে।

ফিরে তাকাল কিশোর, মিস্টার জবার, সারাহর কোন যমজ বোন ছিল?

না তো! উঠে এলেন তিনি। কেন?

ছবির দিকে আঙুল তুলল কিশোর, আজ বিকেলে অবিকল এই চেহারার একটা মেয়েকে দেখেছি আমরা।

কাকে দেখেছ কে জানে। আমার মেয়ে মারা গেছে পনেরো দিন আগে। ওকে দেখতেই পারো না।

কিন্তু দেখেছি, জোর দিয়ে বলল রবিন, কোন সন্দেহ নেই আমার।

অসম্ভব! জোর দিয়ে বললেন মিস্টার জবার।

দ্বিধায় পড়ে গেল রবিন, চেহারার তো কোন অমিল নেই। চুলের রঙে মিলছে না যদিও। কিন্তু সেটাও কোন ব্যাপার নয়। হেয়ার ড্রেসারের দোকানে গিয়ে যে কেউ লাল চুলকে সোনালি করিয়ে নিতে পারে।

ঠিক বলেছ, ওর সঙ্গে একমত হয়ে বলল কিশোর। মিস্টার জবার, আপনি যা-ই বলুন না কেন, আপনার মেয়ে বেঁচে আছে…

কি বলছ তোমরা মাথায় ঢুকছে না আমার! নিজের চোখে ওকে মর্গে মৃত দেখে এলাম…

কিন্তু পরদিন গিয়ে আর লাশটা খুঁজে পাননি…

পাইনি। তাতে অত অবাক হওয়ার কিছু নেই। হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ গায়েব হওয়াটা নতুন ঘটনা নয়। কঙ্কাল বিক্রির লোভে ডোমেরাই অনেক সময়…

উত্তেজিত হয়ে সবাই কিছুটা জোরে জোরে কথা বলা শুরু করেছিল, তাতে ঘুম ভেঙে গেল মিসেস জবারের। ভেতরের ঘর থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, গ্যারি, কার সঙ্গে কথা বলছ?

কারও সঙ্গে না, মাই ডিয়ার, জবাব দিলেন মিস্টার জবার। ঘুম আসছে না তো, একা একাই। তুমি ঘুমাও। আমি আসছি একটু পরেই, রবিন আর কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ফিসফিস করে বললেন, জলদি পালাও। তোমাদের দেখলে সারারাতেও আর ঘুমাবে না। বকবক করতেই থাকবে।

বকবকে কিশোরেরও বড় ভয়। রবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, মিস্টার জবার, পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 রবিনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। বাইরে বেরিয়েই বলে উঠল, সারাহকেই দেখেছি আমরা। সেরাতে মারা যায়নি সে। হার্ট অ্যাটাকে অনেক সময় কমাতে চলে যায় মানুষ। মৃত্যুর সমস্ত লক্ষণ ফুটে ওঠে শরীরে। ডাক্তাররাও ভুল করে ফেলেন। সারাহর ক্ষেত্রেও নিশ্চয় ওরকম কিছু ঘটেছিল। হুঁশ ফেরার পর পালিয়েছে।

হ্যাঁ, এটা হওয়া বিচিত্র নয়। এমনও হতে পারে হার্ট অ্যাটাকটা ছিল তার বাহানা। মেডিটেশন করে করে এত ক্ষমতাই অর্জন করেছে, ইচ্ছে করলে সুপ্তির এমন এক জগতে চলে যেতে পারে, যাতে মনে হয় মরেই গেছে…অনেক পীর-ফকির তো এসব করেই মানুষকে ধোকা দেয়

জানি! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। জলদি গাড়িতে ওঠো। মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।

ক্লডিয়াদের ওখানে যাব না?

যাও। ওকে সাবধান করা দরকার। তাড়াতাড়ি করো।

*

এত রাতেও ক্লডিয়াদের গেট খোলা। হাঁ হয়ে খুলে আছে। হয় কেউ গাড়ি নিয়ে ঢুকেছে, ঢোকার পর আর বন্ধ করেনি। নয়তো কেউ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। লাগানোর সময় ছিল না।

সোজা গাড়িবারান্দায় ঢুকল রবিন। গাড়ি থামাল। নেমে গিয়ে বেল বাজাল। খুলে দিলেন কুড়িয়ার বাবা মিস্টার নিউরোন। পরনে পাজামা। ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। রবিনকে চেনেন।

এত রাতে তোমারও দরকার পড়ল নাকি ক্লডিয়াকে? কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল মেজাজ ভারী হয়ে আছে তার। কোন কারণে খাপ্পা। পুলিশের লোক। চোর-ডাকাত নিয়ে কারবার। মেজাজ খিঁচড়ে থাকাটা অস্বাভাবিক না।

মানে! অবাক হলো রবিন। কি বলছেন, আঙ্কেল? আরও কেউ এসেছিল নাকি?

কি যে সব হয়েছে আজকাল তোমাদের, বুঝি না! আমাদের কি অমন বয়েস ছিল না নাকি? রাত দুপুরে যত্ত সব জরুরী কাজ পড়ে গেল সবার। তোমার দেখা করাটাও নিশ্চয় জরুরী?

সত্যি বলছি, আঙ্কেল, আসলেই জরুরী। ক্লডিয়াকে একটু ডেকে দেবেন, প্লীজ?

ও কি বাড়ি আছে নাকি যে ডেকে দেব। খানিক আগে মারলা এসেছিল। হাতে করে একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে এসেছিল। ডান হাতে তোয়ালে জড়ানো। কি যে বলল ক্লডিয়াকে কে জানে। একটু পরেই দেখি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছিস? বলে, মুসাদের বাড়ি। …কেন?: জরুরী কাজ আছে। এজন্যেই তো বলছি রাত দুপুরে এমন কি কাজ পড়ে গেল যে… সরাসরি রবিনের দিকে তাকালেন মিস্টার নিউরোন। কোথাও যাওয়ার কথা আছে নাকি তোমাদের?

আছে বলাটাই নিরাপদ ভেবে তা-ই বলে দিল, রবিন। পুলিশী সন্দেহ এবং জেরা এড়ানোর জন্যে। জেরার মধ্যে পড়লেই ফাস করে দিতে হবে সব। কোন উপায় থাকবে না। তার পেট থেকে সমস্ত কথা আদায় করে নেবেন মিস্টার নিউরোন। এখনও সব কথা পুলিশকে জানানোর জন্যে তৈরি নয় ওরা।

বেরোনোর সময় সঙ্গে করে কিছু নিয়ে গেছে? জানতে চাইল রবিন।

হ্যাঁ। একটা পলিথিনের ব্যাগে করে কি যেন নিয়ে গেল।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আঙ্কেল। শুধু শুধু এত রাতে কষ্ট দিলাম। সরি।

কিন্তু ঘটনাটা কি…কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

পর্বতে, বলার সময় মিস্টার নিউরোনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রাখল রবিন। মিথ্যে কথা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। তাড়াতাড়ি এসে গাড়িতে উঠল।

দরজায় দাঁড়িয়ে তখনও ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন মিস্টার নিউরোন। চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে। হাজার হোক পুলিশের লোক। সন্দেহটা বোধহয় ঠিকই করে বসেছেন।

গাড়িতে উঠে কিশোরকে সব জানাল রবিন। তারপর বলল, ব্যাপারটা মোটেও ভাল ঠেকছে না আমার, কিশোর। ক্লডিয়া মুসাদের বাড়ি গেল কেন?

তাই বললেন নাকি মিস্টার নিউরোন? নিশ্চয় তত্ত্বাবধায়কের কাজে গেছে, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল কিশোরের গলা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মারলার কাটা আঙুল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসাকে জানানোর জন্যে ক্লডিয়াকে জরুরী কোন মেসেজ দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক। জলদি যাও এখন মুসাদের বাড়িতে।

ক্ষতির আশঙ্কা করছ নাকি তুমি?

সে তো বটেই।

 কি ক্ষতি?

স্টার্ট দাও, বলছি। তোমার নামটা নেই কেন চিঠিতে, বুঝে ফেলেছি আমি। রবিন, ভয়ানক বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি আর মুসা!

.

১৪.

চোখ মেলল মুসা। আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কদিন ধরে যে কি হয়েছে তার বুঝতে পারছে না। ঘুমালেই দুঃস্বপ্ন দেখে।

ছাতের দিকে চোখ পড়ল। পরিচিত ছাত। নিজেদের বাড়ি।

পাশ ফিরে তাকাল। বিড়ালের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে সোফায় ঘুমাচ্ছে। ক্রিসি। নিজের ঘরে যেমন ঘুমাত, তেমনি ভাবেই। কিছুতেই ওকে বিছানায় শুতে রাজি করাতে পারেনি মুসা।

হাত-পা টানটান করে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙল মুসা। পা লম্বা করে দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এল বিছানা থেকে। মুখের ভেতরটা শুকনো। মাথা ধরেছে। কদিন ধরে এই ব্যথাটা লেগেই আছে, কখনও টিপ টিপ করে, কখনও তীব্র। ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়েও পুরোপুরি সারানো যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে অদ্ভুত একটা ঘোর লাগা ভাব। সেই সঙ্গে ক্লান্তি। বহুবার বলেছে ক্রিসিকে। গুরুত্বই দেয়নি সে। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।

 জানালার কাছে এসে বাইরে রাতের শহরের দিকে তাকাল সে। নির্জন রাস্তা। পৃথিবী মনে হচ্ছে না। যেন অন্য কোন গ্রহ। নিজের শরীরটাকেও নিজের লাগছে না তার। পেশিতে পেশিতে ব্যথা। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো। কোনমতেই তাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না ক্রিসি। কোন না কোন ছুতোয় সঙ্গে রয়ে যাচ্ছে। বিকেলে মীটিং থেকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিজের বাসায়। মুসা রাজি হয়নি। শেষে যেচে-পড়েই ওর সঙ্গে চলে এসেছে ওদের বাড়িতে। খানিকটা গাইগুই করলেও চক্ষুলজ্জায় সরাসরি মানা করতে পারেনি মুসা।

কিন্তু কেন?

কি চায় ওর কাছে ক্রিসি?

 কেন ওর সঙ্গে ছায়ার মত লেগে আছে?

এতদিনে বুঝে গেছে শুধু ম্যাসাজ করার জন্যে ওকে ডেকে নেয়নি সে। তাকে দিয়ে কিছু একটা করাতে চায়। যে কারণে আটকে রেখেছে। নিজের চোখে চোখে রেখেছে। কি করতে হবে সেটা এখনও বলেনি। তবে বলবে। শীঘ্রি। অনুমান করতে পারছে মুসা।

গেট দিয়ে একটা গাড়ি ঢুকল। এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। গাড়ি বারান্দায় এসে থামল গাড়িটা।

ফিরে তাকাল মুসা।

জেগে গেছে ক্রিসি। ওর সবুজ চোখ পুরোপুরি সজাগ। ঘুমের সামান্যতম ছোঁয়া নেই। বিড়ালের মত। বিড়াল যেমন জাগার সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে যায়, ঠিক তেমনি।

এত রাতে কে? দরজার দিকে এগোতে গেল মুসা।

বাধা দিল ক্রিসি। দাঁড়াও ডাকুক আগে। তোমার কাছেই এসেছে।

সদর দরজায় ঘণ্টা বাজল। চোখের ইশারা করল ক্রিসি, এবার যাও। সাবধান থাকবে।

কেন?

 যা বললাম কোরো। আমার কথার অবাধ্য হলে বিপদে পড়বে।

থমকে গেল মুসা। হুমকি দিল নাকি ওকে ক্রিসি? ওর কণ্ঠস্বর এরকম বদলে গেছে কেন?

আবার ঘণ্টা বাজল। ক্রিসির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে এগোল মুসা। নিচে নেমে দরজা খুলে দিল। ও ভেবেছিল রবিন কিংবা কিশোর হবে। কিন্তু ক্লডিয়াকে আশা করেনি। ওর হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ।

তুমি!

হ্যাঁ, ভোতা, শুকনো গলায় বলল ক্লডিয়া, তোমার জন্যে এনেছি এটা। ব্যাগটা বাড়িয়ে দিল, নাও। যা খুশি করো এটা নিয়ে।

ব্যাগটা নিল মুসা, ঘটনাটা কি, বলো তো?

মারলা তার কাজ সেরে চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে আমাকে, কেমন যান্ত্রিক গলায় বলল ক্লডিয়া। ওকে যা করতে বলা হয়েছে সে করেছে। আমাকে যা বলা হয়েছে এখন আমি সেটা করলাম।

কে বলেছে?

তত্ত্বাবধায়ক। আমাদের ডাকবাক্সে একটা নোট পেয়েছি। দুটো মেসেজ লেখা আছে তাতে। একটা আমার জন্যে। একটা তোমার জন্যে। ব্যাগের মধ্যে আছে সেটা। আর একটা পিস্তল আছে।

পিস্তল?

 হ্যাঁ, আমার আব্বারটা। তত্ত্বাবধায়ক তোমার কাছে পৌঁছে দেয়ার হুকুম দিয়েছে আমাকে। মেসেজ পড়লেই সব জানতে পারবে। যা যা দিলাম এই ব্যাগে, সব তোমার প্রয়োজন হবে।

এই সময় মুসার পাশে এসে দাঁড়াল ক্রিসি।

দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ক্লডিয়ার। এক পা পিছিয়ে গেল।

দাত বের করে দরাজ হাসি হাসল ক্রিসি। পিস্তলটাতে গুলি আছে তো, ক্লডিয়া?

ঢোক গিলল ক্লডিয়া। আপনাকে চেনা চেনা লাগছে?

চেনা মানুষকে তো চেনাই লাগবে, রহস্যময় কণ্ঠে জবাব দিল ক্রিসি। সময় যাক, আরও ভাল করে চিনতে পারবে। তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে, করেছ নিশ্চয় ঠিকঠাক মত?

আ-আপনাকেও কিছু করতে বলেছে নাকি তত্ত্বাবধায়ক?

হেসে উঠল ক্রিসি। কথা কম বলো। ভাগো এখন, যাও। ক্লডিয়ার মুখের ওপর দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিল সে। মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ব্যাগ খোলো।

ব্যাগের ভেতরে হাতড়াতে লাগল মুসা। ক্লডিয়া তার বাবার পিস্তলটা নিয়ে এসেছে। বের করে হাতে নিল। বলে গেছে গুলি ভরা আছে। দেখার প্রয়োজন বোধ করল না সে। মাথার মধ্যে কেমন করছে। ঘোরটা যেন। বাড়ছে। গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। এমন লাগছে কেন?

পিস্তলটা একহাতে নিয়ে আবার ব্যাগ হাতড়াল মুসা। মারলার কাটা আঙুলটা বের করে আনল। সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে ফেলে দিল ওটা। ব্যাগ। আর পিস্তলটাও পড়ে গেল মেঝেতে। ভাগ্য ভাল, ঝাঁকুনি লেগেও গুলি ফুটল না।

 কাটা আঙুল এবং পিস্তল, দুটোই মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল ক্রিসি। আঙুলটা নিজের পকেটে ভরে পিস্তলের চেম্বার খুলল। খোলার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল এ কাজে অভ্যস্ত সে। ব্যবহার করতে জানে।

ম্যাগাজিন গুলিতে ভর্তি।

খলখল করে হেসে উঠল ক্রিসি। আজকের রাতটা হবে আমাদের মহাআনন্দের রাত। জলদি তোমার মেসেজটা পড়ে ফেলো।

 কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে কাগজের টুকরোটা বের করল মুসা। দোমড়ানো লাল কাগজে লেখা নোট। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের উজ্জল আলোয় লেখাটা পড়ার চেষ্টা করল সে কষ্ট হলো বুঝতে, তবে পড়তে পারল। উল্টো করে লেখা বাক্যটার মানে করলে হয়:

রবিনের খুলি উড়িয়ে দাও

 নোটটাও হাত থেকে খসে পড়ে গেল মুসার। আমি পারব না!

পারবে, পারবে। না পারার কোনই কারণ নেই। নইলে কি ঘটবে জানো? জেলে যেতে হবে তোমাকে।

গেলে যাব। তবু রবিনকে খুন করতে পারব না আমি। মাথা খারাপ নাকি!

তাহলে তোমাকে খুন হতে হবে, কঠিন হয়ে গেল ক্রিসির কণ্ঠ। তারপরও বাঁচবে না রবিন। তাকে খতম করার ব্যবস্থা করা হবে। একবার যখন টার্গেট হয়ে গেছে, তত্ত্বাবধায়কের হাত থেকে তার নিস্তার নেই…

তত্ত্বাবধায়কের কথা আপনি জানলেন কি করে?

মুচকি হাসল ক্রিসি। কারণ আমিই তত্ত্বাবধায়ক। এতক্ষণে তোমার বুঝে যাওয়ার কথা। আমি তো ভাবলাম বুঝে গেছ।

মাথার ঘোলাটে ভাবটা কাটছে না মুসার। ঘোরটা যাচ্ছে না। ভাবল, আবার দুঃস্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু এভাবে খুন-খারাপি করে, একজনকে দিয়ে আরেকজনকে খুন করিয়ে লাভটা কি আপনার?

লাভ আছে। আমার গুরু বলেছেন নিজের হাতে খুন করার চেয়ে অন্যকে দিয়ে খুন করিয়ে মৃত আত্মাগুলোর মালিক হতে পারলে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হওয়া যায়। কারণ এতে চালাকির দরকার হয়। শয়তান নিজে চালাক। তাই চালাক মানুষকে পছন্দ করে। আমি নিজে কতটা চালাক সেটা বোঝার জন্যে, এবং একই সঙ্গে আত্মার মালিক হওয়ার জন্যে এই ফাঁদ পেতেছি আমি। তোমাদের টার্গেট করেছি। কনসার্টের টিকেটগুলো তোমাদের কাছে আমিই পাঠিয়েছিলাম। বোকার মত আমার ফাঁদে ধরা দিয়েছ তোমরা।

তোমরা কনসার্ট থেকে ফেরার আগে ডেভন গাধাটাকে খুন করে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখেছিলাম। কাকতালীয় ভাবে হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি চালিয়ে আমার সুবিধে করে দিলে তোমরা। আমার বিশ্বাস, এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন খোদ শয়তান। লোকটাকে যে তোমরাই খুন। করেছ এটা তোমাদের বোঝাতে কোন কষ্টই হলো না আমার। চিঠি দিয়ে তখন তোমাদের ব্ল্যাকমেইল করা সহজ হয়ে গেল আমার জন্যে। ঘাবড়ে গিয়ে সোফি অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যাওয়াতে আরও ভড়কে গেলে তোমরা। ওকে আর আমার নিজের হাতে মারতে হয়নি। তবে আমার চিঠি পাওয়াতেই ঘাবড়ে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সে। ওর আত্মার মালিক তাই আমি। শয়তানি হাসি ফুটল ক্রিসির ঠোঁটে। ড্যানিকে আমিই পুড়িয়ে মেরেছি। আমার অবাধ্য হয়ে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল বলে ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। তবে ওর খোঁজ দেয়ার জন্যে তোমাকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়…

আমি খোঁজ দিয়েছি! মূসা অবাক। কখন?

সেরাতে ওকে ফোন করাটা মোটেও উচিত হয়নি তোমার। ফোন করে নিজের অজান্তেই আমাকে জানিয়ে দিলে ও কোথায় আছে…

রাগ মাথাচাড়া দিচ্ছে মুসার মগজে। পা বাড়াতে গেল সে।

পিস্তল নেড়ে নিষেধ করল ক্রিসি, উঁহু! মারা পড়বে! একটু এদিক ওদিক দেখলেই গুলি মেরে দেব। আমি যে সেটা পারব, তোমার বিশ্বাস করা উচিত।

বিশ্বাস করল মুসা। এখন আমাকে কি করতে হবে?

বললামই তো, রবিনকে খুন করো।

তাতে আমার লাভটা কি হবে? বন্ধুকে খুন করব। তাকে খুনের দায়ে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ

নিতে যাতে না পারে, সে ব্যবস্থা আমি করতে পারি। তবে এক শর্তে।

বলে ফেলুন।

আমাদের দলে যোগ দিতে হবে।

শয়তানের দলে!

শয়তানকে ঘৃণা করা উচিত না। শয়তান ভীষণ ক্ষমতাশালী। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি জানি, গুরুরও হবে। তোমার মত ছেলে আমাদের দরকার।

 ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। তারপর চমকের পর চমক। আস্তে আস্তে ঘোরটা কেটে যাচ্ছে মুসার। মাথার ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। কেন এই ঘোর, শরীর খারাপ লাগা, মাথা ধরা, দুঃস্বপ্ন দেখা, তা-ও অনুমান করতে, পারছে এখন। ম্যাসাজ করার আগে দুটো করে বড়ি খাইয়েছে ওকে ক্রিসি। নিশ্চয় তার মধ্যে ভয়ঙ্কর নেশা জাতীয় কোন জিনিস দিত। আফিম-টাফিম জাতীয় কিছু। বলল, কিন্তু আপনার কথায় বিশ্বাস কি?

বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোন পথ নেই এখন তোমার। তবে সত্যি বলছি, তোমাকে দিয়ে আমাদের দলের অনেক কাজ হবে। সেজন্যেই তোমাকে মারব না। তা ছাড়া শুরুতেই একটা খুন করে ফেলে সাধনার একটা বড় ধাপ ডিঙিয়ে যাবে তুমি। এরপরের ধাপগুলো ডিঙানো খুব একটা কঠিন হবে না তোমার জন্যে। মহাক্ষমতাধর হয়ে যাবে তুমি অল্প বয়েসেই। আবার পিস্তল নাচাল ক্রিসি, ভেবে দেখো, কোনটা করবে? বেঁচে থেকে ক্ষমতাশালী হবে, না অকালে ধ্বংস হবে?

ভাবল মুসা। ক্ষমতাশালীও হতে চায় না, ধ্বংসও হতে চায় না। ঘাড় কাত করল, ঠিক আছে, আমি রাজি। হাত বাড়াল, দিন পিস্তলটা।

উঁহু, অত সহজে না, মাথা নাড়ল ক্রিসি। তোমাকে সেই জায়গাটায় নিয়ে যাব, যেখানে কবর দিয়েছ ডেভনকে। নাটকীয়তার জন্যে করছি ভেবো না। ওর আত্মা ঘোরাফেরা করছে ওর কবরের কাছে। সাধনা করে সোফি আর ড্যানির আত্মাকেও ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। রবিনকে ওখানে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হলো চারজন। ছয়টা তারকার বাকি দুটো কোণও ভরব আমি আর দুজনকে দিয়ে–মারলা আর ক্লডিয়া। ইতিমধ্যেই তারকার কোণে ঢুকে পড়েছে ওরা। একবার যখন ঢুকেছে, বেরোতে আর পারবে না। তারকার ছয়টা কোণ ভর্তি করার পর মাঝখানে ঢোকাব আমার নাম…

কি করে ঢুকবেন? আপনাকেও তো মরতে হবে তাহলে।

মরব। তবে আবার বেঁচে ওঠার জন্যে। হৃৎপিণ্ডে ছুরি ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করব। তারকার ছয়টা আত্মাকে বশ করার পর ওদের সাহায্যেই বেঁচে উঠব আবার। বেঁচে থাকব অনন্তকাল। অসীম ক্ষমতার অধিকারী হব আমি…

আপনার পাগলা গুরুটা বুঝিয়েছে বুঝি এসব? নেশার ঘোর পুরোপুরি কেটে গেছে মুসার। উন্মাদ না হলে কোন ছাগলে বিশ্বাস করে…

ধক করে জ্বলে উঠল ক্রিসির বিড়াল-চোখ। খবরদার, আমার গুরুকে নিয়ে ঠাট্টা করবে না! যা বলছি করো, প্রমাণ পেয়ে যাবে কার কথাটা সত্যি।

হ্যাঁ, প্রমাণই দরকার আমার। বলুন, কি করতে হবে।

.

১৫.

 মুসাদের বাড়ির সদর দরজায় টেপ দিয়ে সঁটা কাগজটা প্রথম চোখে পড়ল রবিনের। তাতে গোটা গোটা করে লেখা:

রবিন, মরুভূমিতে সেই লোকটার কবরের কাছে যাচ্ছি আমি। তুমি এখনই চলে এসো। আসবে অবশ্যই। জরুরী কথা আছে।–মুসা।

অবাক হলো রবিন। ডেকে দেখাল কিশোরকে।

গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। বিপদের গন্ধ পাচ্ছি আমি, রবিন। সাবধান থাকতে হবে।

যাবে না ওখানে?

যাব তো বটেই। না গেলে মুসাকে বাঁচানো যাবে না। চলো। রাতের বেলা এখন জায়গাটা খুঁজে পাবে তো?

পাব।

খুব একটা অসুবিধে হলো না রবিনের। মোড়ের কাছে পাহাড়ের একটা খাড়া দেয়ালের কাছে এসে গাড়ি থামাল। সেরাতে গাড়ির গুতো লেগে বালির দেয়ালে গর্ত হয়ে গিয়েছিল। সেটা দেখাল কিশোরকে।

রাস্তা থেকে কতটা দূরে কবর দিয়েছিলে? জানতে চাইল কিশোর। টর্চ জ্বালার প্রয়োজন নেই। দেখার জন্যে চাঁদের আলোই যথেষ্ট।

এই পঞ্চাশ কদম হবে। কিন্তু আর গাড়ি কই? মুসার তো আমাদের আগেই চলে আসার কথা।

যেখানে যেতে বলেছে সেখানে আগে যাই চলো। নিশ্চয় আসবে।

রাস্তা থেকে নেমে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই রাতটার কথা ভাবল রবিন। একটা ভয়াবহ অশুভ রাত। অন্ধকার। ঝোড়ো বাতাসে বালি উড়িয়ে এনে ওদের চোখে-মুখে ফেলছিল। লোকটাকে কবর দিতেও কত যে অসুবিধে ভোগ করেছে ওরা। ইস, যদি খালি জানত, ও আগেই মরে। গিয়েছিল। ওরা খুন করেনি। তাহলে কি এই ঝামেলায় পড়তে হয়।

আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বিশাল গোল চাঁদ। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। আর সেদিন ছিল অমাবস্যার অন্ধকার। কোন কুক্ষণে যে হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি চালানোর বাজিটা ধরেছিল ওরা। ডাকে আসা রহস্যময় টিকিট পেয়ে কনসার্টে যাওয়াটাও পাপ হয়েছে। সেজন্যেই এই শাস্তি…

কিন্তু ওরা কি আর জানত ওদের কোন বন্ধু মজা করে নয়, তত্ত্বাবধায়কই শয়তানি করে টিকেটগুলো পাঠিয়েছিল, ওদের ফাঁদে ফেলার জন্যে। কিভাবে। জানবে? কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্যাকটাস আর মরুর শুকনো ঝোপে ঘেরা একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল দুজনে। গোল খোলা জায়গাটাকে ঘিরে যেন প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় ক্যাকটাসগুলো। চাঁদের আলোয় লম্বা ছায়া পড়েছে। মাটিতে। ওগুলোর মাঝখানে তিন-চার ফুট গভীর একটা খাদ। খাদের তলায়। পাথরের স্তূপ। বালি খুড়ে কবর দেয়ার পর পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। কবরটা যাতে শেয়াল বা মরুভূমির অন্য কোন লাশখেকো জানোয়ারে তুলে নিয়ে যেতে না পারে।

হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই যে…

ওর কথা শেষ হতে না হতেই উহ্ করে উঠল কিশোর। গড়িয়ে পড়ে গেল খাদের মধ্যে।

কি হলো! বলে চিৎকার দিয়ে ফিরে তাকিয়েই রবিন দেখল মুসা দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা বেজবল ব্যাট, কোমরের বেল্টে গোঁজা পিস্তল। ক্যাকটাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাড়ি মেরে ফেলে দিয়েছে কিশোরকে।

 পাগল হয়ে গেলে নাকি? বলতে গেল রবিন। কিন্তু তাকেও এক ধাক্কায়। খাদে ফেলে দিল মুসা।

খিলখিল হাসি শোনা গেল আরেকটা গাছের আড়াল থেকে। বেরিয়ে এল সোনালি চুল সেই মেয়েটা। ওর হাতেও একটা রূপালী রঙের পিস্তল। আদেশ দিল, ব্যাটটা ফেলো। পিস্তল খুলে নাও। শেষ করে দাও ওকে।

ব্যাট ফেলে কোমর থেকে পিস্তল খুলে নিল মুসা।

বালিতে পড়ায় তেমন ব্যথা পায়নি রবিন। কোনমতে উঠে বসে চিৎকার করে বলল, কি করছ, মুসা? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

না, রবিনের দিকে পিস্তল তাক করে জবাব দিল মুসা, আমার মনিব। তত্ত্বাবধায়কের হুকুম পালন করছি। ক্লডিয়া এসে এই পিস্তল সহ মেসেজ রেখে। গেছে। তাতে বলা হয়েছে গুলি করে তোমার খুলি উড়িয়ে দিতে। সেটাই করতে যাচ্ছি। নইলে ভয়ঙ্কর মৃত্যু ঘটবে আমার।

মুসা, শোনো বোকামি কোরো না…

 পিস্তল কক করল মুসা। বিদায়, রবিন।

শোনো, মুসা, প্লীজ!

 কি শুনব?

 আমাকে খুন করলেও ও তোমাকে ছাড়বে না। আমি জানি…

সেজন্যেই তো ওদের দলে যোগ দিতে যাচ্ছি আমি। তোমার আত্মা চুরি করে একদিন মহাক্ষমতাধর হয়ে যাব।

এসব কথা তোমাকে বুঝিয়েছে বুঝি ডাইনীটা? তোমার মগজ ধোলাই করে দিয়েছে…

দেরি করছ কেন, মুসা? ক্রিসি বলল। গুলি করো।

হ্যাঁ, করছি। একটা কথা মনে পড়ল। যুদ্ধের সময় জার্মানরা অনেক বন্দিকে দিয়ে কবর খোঁড়াত, তারপর কবরের কিনারে ওদের দাঁড় করিয়ে  করত। ডিগবাজি খেয়ে গর্তে উল্টে পড়ত গুলি খাওয়া মানুষগুলো। দেখতে নাকি খুবই ভাল লাগত ওদের। আমার এখন সেটা দেখতে ইচ্ছে করছে।

হা-হা করে অট্টহাসি হাসল ক্রিসি। নির্জন মরুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সে-শব্দ। বাহ, আমার নির্বাচনে ভুল হয়নি। শয়তানের উপাসনা করতে হলে এই মানসিকতাই তো দরকার। যে যত নিষ্ঠুরতাই বলুক এসব কাজকে, আমি বলব না। এগুলোই তো মজা। প্রথম পরীক্ষায় উতরে গেলে তুমি, মুসা। ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছেই পূরণ হোক। খাদ থেকে উঠে আসতে বলো ওকে। আমার নির্দেশেরও কিছুটা পরিবর্তন করে দিচ্ছি। মাথায় নয়, পেটে গুলি করো ওর। যাতে অনেকক্ষণ ধরে কষ্ট পেয়ে গুঙিয়ে গুঙিয়ে মরে। দেখতে ভাল লাগবে।

অ্যাই, উঠে এসো, পিস্তল নেড়ে কঠোর কণ্ঠে আদেশ দিল মুসা। চাঁদের আলোয় চকচক করছে কালো নল।

ফিরে তাকাল রবিন। বেহুশ হয়ে পড়ে আছে কিশোর। নড়ছে না।

গর্ত থেকে বেরোতে অতিরিক্ত দেরি করল রবিন। ভাবছে, থাবা দিয়ে মুসার হাত থেকে পিস্তলটা ফেলে দেয়া যায় কিনা। কিন্তু তাতেও লাভ হবে না। ক্রিসির হাতেও পিস্তল আছে।

খাদ থেকে উঠে এল রবিন। তার বায়ে রয়েছে এখন ক্রিসি, মুসা ডানে। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারে।

তোমার প্ল্যানটা কি, সারাহ? জানতে চাইল রবিন। সময় বাড়াচ্ছে। বাঁচার যদি কোন সুযোগ পাওয়া যায়।

হেসে উঠল ক্রিসি। আমি আর এখন সারাহ নই। সারাহ ঢুকে পড়েছে তারকার মধ্যে। মায়াও নই। সে-ও গেছে। আমি এখন ক্রিসি।

আমাদের সবাইকেই তারকায় ঢোকানোর শখ হয়েছে নাকি তোমার? ক্রিসির পিস্তলটার দিকে তাকাল রবিন।

শখ নয়, এটা আমার প্রয়োজন। ছয়টা আত্মা দরকার আমার। ছয় কোণে ছয়টা ভরে দিয়ে মাঝখানে থাকব আমি। ওরা হবে আমার গোলাম। তিনটে পেয়ে গেছি–ডেভন, সোফি আর ড্যানি। তোমাকে নিয়ে হবে চারজন। আমার ভাগ্য ভাল, না চাইতেই এসে হাজির হয়েছে আরও একজন, খাদে পড়ে থাকা কিশোরকে দেখাল ক্রিসি। ওকেও নেব। শেষটা পূরণ করে নেব মারলা কিংবা ক্লডিয়াকে দিয়ে। যাকে সুযোগমত পাই।

আর মুসা? ওকে দিয়ে কি করবে?

ও হবে আমার ডান হাত। আমার বাহন। আমার প্রধান গোলাম। ওকে দিয়ে যা ইচ্ছে করাব আমি… মুসার দিকে ফিরল ক্রিসি। মুসা, দেরি করছ কেন? দাও পেটে একটা বুলেট ঢুকিয়ে। খাদে পড়ে কেঁচোর মত মোচড়াতে থাকুক। আহ, কি মজাই না হবে দেখতে! করো করো, গুলি করো!

হ্যাঁ, করছি, রোবটের মত যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর মুসার। রোবটের মতই নড়ল। পিস্তল তুলল রবিনকে তাক করে। নাহ, হচ্ছে না। এই, আরেকটু পিছাও। খাদের আরও কিনারে যাও। নইলে ডিগবাজিটা হবে না ভালমত।

পেছনে সরতে গিয়ে কিশোরের দিকে চোখ পড়ল রবিনের। একটু যেন। নড়ল মনে হলো? নাকি চোখের ভুল?

পিছিয়ে গেল রবিন।

একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটল। লাফ দিয়ে সরে গেল মুসা। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরেই বাড়ি মারল ক্রিসির পিস্তলধরা হাতে। ঠিক একই সময়ে ঝটকা দিয়ে উঠে বসে ক্রিসির পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল কিশোর।

মুসার বাড়িতে পিস্তলটা উড়ে চলে গেল ক্রিসির হাত থেকে। কিশোরের টানে পড়ে গেল ক্রিসি খাদের মধ্যে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু। ততক্ষণে বেজবল ব্যাটটা তুলে নিয়েছে কিশোর। নির্দ্বিধায় বসিয়ে দিল ক্রিসির। মাথায়। এক বাড়িতেই বেহুশ।

ওকে বেঁধে ফেলা দরকার! চিৎকার করে বলল মুসা। ওই ডাইনীকে বিশ্বাস নেই!

তারমানে ওর কোন অলৌকিক ক্ষমতাই নেই, এমন ভঙ্গিতে বলল। রবিন, যেন নিরাশই হয়েছে। তাহলে এত সহজে কাবু করা যেত না।

কথা পরে, আগে দড়ি! মুসা বলল।

 দড়ি কোথায় পাব? গাড়িতেও তো নেই।

তাড়াতাড়ি কোমরের বেল্টটা খুলে নিল মুসা। ওটা দিয়ে ক্রিসির হাত পিছমোড়া করে নিজেই বাধল।

আর কিশোরও ওদের বেল্ট দুটো খুলে দিল। ভালমত বাঁধতে আর অসুবিধে হলো না।

খাদের কিনারে পা ঝুলিয়ে জিরাতে বসল রবিন। মুসাকে বলল, ভাল অভিনয় শিখেছ তো। আমি তো বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম তুমি সত্যি সত্যি ক্রিসির গোলাম হয়ে গেছ।

গত কয়েক দিন গোলাম হয়েই ছিলাম। আফিম না কি জানি খাইয়ে আমাকে সারাক্ষণ নেশার ঘোরে রেখে দিত। আজ সেটা সময়মত কেটে না, গেলে কি যে ঘটাতাম কে জানে!

এমনিতেই কম ঘটিয়েছ নাকি? উফ, ঘাড় ডলতে ডলতে বলল। কিশোর। বাড়িটা আরেকটু আস্তে মারতে পারলে না?

পারতাম। তাহলে আমাকে বিশ্বাস করত না ক্রিসি। ফাঁকিটা আর দিতে পারতাম না। সত্যি কি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলে নাকি?

নাহ, মাথা নাড়ল কিশোর। তুমি যদি অভিনয় করতে পারো, আমি পারব না কেন?…গাড়িটা রেখেছ কোথায় তোমরা? রাস্তায় তো দেখলাম না।

মোড়ের কাছ থেকে একশো গজ দূরে, ঝোপের ধারে। পড়ে থাকা ক্রিসিকে দেখাল মুসা, একে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিভাবে নেয়া যায় বলো তো?

বয়ে নেব, আর কিভাবে? বলেই কান পাতল কিশোর। কিসের শব্দ? পুলিশের সাইরেন না?

তাই তো মনে হচ্ছে! খবর পেল কিভাবে?

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাঁকের কাছে পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ শোনা গেল। দৌড়ে আসতে দেখা গেল কয়েকটা ছায়ামূর্তিকে। সবার আগে আগে ছুটে আসছে একটা মেয়ে।

ক্লডিয়া! চাঁদের আলোতে চিনতে কষ্ট হলো না ওকে।

পিস্তল হাতে খাদের কাছে এসে দাঁড়াল তিনজন পুলিশ অফিসার। তাদের মধ্যে একজন ক্লডিয়ার বাবা মিস্টার নিউরোন।

*

ফেরার পথে রবিনের গাড়িতে করে চলেছে কিশোর, মুসা আর ক্লডিয়া। ওদের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি, পেছনে আরেকটা। সামনেরটাতে ভোলা হয়েছে হাতকড়া লাগানো ক্রিসিকে। মুসার জেলপিটা স্টার্ট নিচ্ছিল না, যেটাতে করে সে আর ক্রিসি এসেছে। রাস্তার ধারে ঝোপের ধারেই ওটা ফেলে রবিনের গাড়িতে করে ফিরে চলেছে চারজনে।

গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পাশে মুসা।

পেছনের সীটে কিশোর আর ক্লডিয়া।

একটা কথার জবাব দাও তো, কিশোর বলল, তুমি জানলে কি করে। আমরা এখানে আছি?

মুসাকে ব্যাগটা দিয়ে বাড়ি ফিরতেই পাকড়াও করল আমাকে আব্বা, ক্লডিয়া জানাল। দুই ধমক দিয়েই জেনে নিল কোথায় গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে থানায় ফোন করে পেট্রল কার আনাল। আমাকে নিয়ে ছুটল মুসাদের বাড়িতে। দরজায় মুসার নোটটা দেখে কারোরই বুঝতে অসুবিধে হলো না। কোথায় তোমাদেরকে পাওয়া যাবে।

হু, তিক্তকণ্ঠে বলল কিশোর, আজকাল আর গোয়েন্দাগিরি নিয়ে গর্ব করার উপায় নেই। সবাই খুব সহজেই সব কিছু বুঝে ফেলে।

তাতে কি কোন ক্ষতি হয়েছে? হাসল ক্লডিয়া। ক্রিসি ডাইনীটার বোঝা বওয়া থেকে তো রেহাই পেলে।

তা পেয়েছি, সামনের সীট থেকে বলে উঠল মুসা। তবে সবচেয়ে আনন্দ লাগছে ওর ভয়ঙ্কর মায়াজাল কেটে যে বেরোতে পেরেছি সেজন্যে। মাথা থেকে একটা পাহাড় নেমে গেছে মনে হচ্ছে। উফ, কি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মাঝেই না কেটেছে পনেরো-ষোলোটা দিন!

ডাকে আসা উড়োটিকেট পেলে কনসার্ট দেখতে যাবে আর? পেছন থেকে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আরও! তওবা! তওবা! দুই গালে চটাস চটাস চাটি মারতে শুরু করল মুসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *