আরেক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন

ভলিউম ২৯ – আরেক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৯৮

০১.

ঝড় একবার হয়ে গেছে। আকাশের অবস্থা, দেখে মনে হচ্ছে শেষ হয়নি, আবারও হবে।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ছোট্ট শহর হিলটাউনে দোকানপাট সব আটটা বাজলেই বন্ধ হয়ে যায়। আর এখন বাজে রাত এগারোটা। তার ওপর ঝড়। ঘরের বাইরে লোকজন স্বভাবতই কম।

এখানকার স্ট্রিপ মলটা এমন আহামরি কিছু নয়। একটা লন্ড্রি, একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং একটা ভিডিও আর্কেড, ব্যস। আর কিছু নেই। স্টোরটা বন্ধ হয়ে গেছে আগেই। লন্ড্রিও বন্ধ। খোলা রয়েছে কেবল ভিডিও আর্কেড। মাঝরাতের আগে কখনোই বন্ধ হয় না।

ভেজা, তেলতেলে হয়ে আছে পার্কিং লট। চকচক করছে। একটামাত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আজ। একটা ক্লাসিক কনভার্টিবল। ছাতটা খোলা। যেন বৃষ্টিতে ভেজার পরোয়া নেই।

ওটার মালিক লেসলি কার্টারিসও বৃষ্টিকে পরোয়া করে না। করার উপায়ও নেই। তাহলে পেট চলবে না। ঝড়ের মধ্যেও বাড়িতে বাড়িতে পিজ্জা সাপ্লাই দিতে হয়েছে ওকে। বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই আর্কেডে এসেছে ভিডিও গেম মেশিনের ওপর রাগ ঝাড়তে।

সে ভেবেছে সে-ই একমাত্র কাস্টোমার, তাকে বিরক্ত করবে না কেউ। ভারটিউয়াল ম্যাসাকার-২ খেলছে। নিজেকে পর্দার একজন ভারটিউয়াল ফাইটার কল্পনা করে নিয়ে তাক করে লাথি মারছে শত্রুকে। যদিও হাই স্কুলের, ফুটবল ম্যাচে খেলার মত আনন্দ নেই এতে। কিন্তু স্কুলে খেলতে যাওয়ার আর উপায় নেই। দুই বছর আগেই সে পাট চুকিয়ে এসেছে।

বোতামে টিপ দিয়ে গাড়ির গিয়ারের মত করে জয়স্টিক ধরে টান দিল লেসলি। কয়েক মাস আগেই হাই স্কোর লিস্টে নাম উঠে গেছে তার। BPE নাম সই করে রেখেছে কোন একজন হেরে যাওয়া খেলোয়াড়। শয়তানি করে সমস্ত হাই স্কোর লিস্ট লক করে দিয়েছে আজকে। চাপাচাপি করে তাতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল লেসলি, কিন্তু ভরসা কম। ইতিমধ্যেই দুজন খেলোয়াড়কে হারিয়ে বসে আছে। তৃতীয়টাকেও হারাতে চলেছে

এই যে, ভাই, পেছন থেকে ডেকে বলল একটা ভোতা কণ্ঠ, আমি খেলছিলাম ওখানে।

কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরে তাকাল লেসলি। ফ্যাকাসে চেহারার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। মাথায় তেলকালি লাগা বেজবল ক্যাপ। গায়ে, টি-শার্টেও কালি।

বাথরূমে গিয়েছিলাম, ছেলেটা বলল।

তো আমি কি করব? কর্কশ জবাব দিল লেসলি। দেখেই রাগ লাগছে। তার। এই ছেলেটাই বোধহয় সেই হেরে যাওয়া খেলোয়াড়। বয়েস আঠারো-উনিশ। বখাটে চেহারা। মোটেও পছন্দ হলো না লেসলির। তার ধারণা, পাড়ায় পাড়ায় মস্তানি আর মেয়েদের পেছনে লাগা ছাড়া এর অন্য কোন কাজ নেই।

পর্দার দিকে নজর ফেরাল সে। দেরি হয়ে গেছে। কারাতের কোপ মেরে তার ভারটিউয়াল ফাইটারের ঘাড় মটকে দিয়েছে শত্রুপক্ষের এক যোদ্ধা। তাকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গভরা মন্তব্য আর পিত্তিজালানো যান্ত্রিক হাসি ছুঁড়ে দিল মেশিন। আরও রাগিয়ে দেয়ার জন্যেই যেন উজ্জ্বল লাল আলোয় গেম ওভার লেখাটা টিপটিপ করতে লাগল চোখের সামনে।

বিরক্ত হয়ে মেশিনকে এক চড় মারল লেসলি। ঝটকা দিয়ে ঘুরে তাকাল হাড্ডিসার ছেলেটার দিকে। সব রাগ গিয়ে পড়ল ওর ওপর। খেলা পণ্ড করেছে বলে। গর্জে উঠল, দিলে তো!

ক্যাপের ছায়ায় মুখের অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে ছেলেটা। খেলা তো আপনি আমারটা নষ্ট করলেন। আমি ওখানে খেলছিলাম। মাঝখান থেকে আপনি ঢুকে পড়লেন।

তুমি গেলে কেন?

বাথরূম পেলে কি করব? আপনি অন্য কোন মেশিনে খেলতে পারতেন। এটাতেই কেন?

তুমি যে খেলছিলে কি করে জানব?

খেলাটা খোলা ছিল। ছিল না?

কতজনে অর্ধেক খেলে ফেলে রেখে চলে যায়…

বিলিই খেলছিল ওখানে, বলে উঠল আরেকটা কণ্ঠ। আপনি ওর খেলাটা নষ্ট করেছেন।

ঘুরে তাকিয়ে মোটাসোটা একটা ছেলেকে দেখতে পেল লেসলি। লম্বা চুল। কোমরে ঝোলানো কয়েন রাখার ব্যাগ। ওর নাম উইলিয়াম গ্লেজব্রুক। কিন্তু সবাই ডাকে পটেটো। নামটা চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। ডাকতে ডাকতে এটাই নাম হয়ে গেছে এখন। আসল নামে কেউ ডাকে না। লোকে জিজ্ঞেস করলে সে নিজেও এই নাম বলে। বোধহয় আসল লম্বা নামটা ভাল লাগে না তারও, খাটোটাই পছন্দ।

তুমি আবার কে? খেঁকিয়ে উঠল লেসলি। ওর চামচা?

 না, নাইট ম্যানেজার, জবাব দিল পটেটো।

মেশিনের দিকে সরে এল বিলি। সরুন।

লেসলির সন্দেহ হলো এই হাড্ডিসার ছেলেটাই মেশিনের রহস্যময় BPF। রাগ বেড়ে গেল তার। বিলির বুকে হাত রেখে জোরে এক ধাক্কা মারল।

একটা টেবিলের পায়ায় পা বেধে উল্টে পড়ল বিলি। টুপিটা খুলে পড়ে গেল। অদ্ভুত একটা দাগ দেখা গেল মাথার একপাশে।

ভুরু কুঁচকে গেল লেসলির। কিসের দাগ? মগজ অপারেশন করেছিল নাকি? ঠিক কাটা দাগের মত নয় দাগটা। বরং পোড়া দাগের সঙ্গে মিল বেশি।

হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল বিলি। লেসলির মনে হলো, একটা কিলবিলে পোকা পায়ের চাপে ভর্তা হওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি সরে যেতে চেষ্টা করছে। নোংরা পাথরের তলায়। কল্পনাই করতে পারল না পোকাটা কি ভয়াবহ বিষাক্ত!

ঠিক এই সময় বিদ্যুৎ চলে গেল।

অন্ধকারে চিৎকার করে উঠল পটেটো, মানা করেছিলাম, শুনলেন না! নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনলেন! এখন আর কেউ ঠেকাতে পারবে না ওকে…

*

মাটিতে পড়ে থেকে ধীরে ধীরে লম্বা দম নিল বিলি ফক্স। রাগ কমানোর জন্যে নয়, বরং বাড়ানোর জন্যে। আর্কেড় এখন অন্ধকার। পার্কিং লটের বৃষ্টিভেজা। বাতিটা থেকে মলিন আলোর আভা এসে পড়েছে ঘরে।–

ক্যাপটা কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। শান্ত ভঙ্গিতে মাথায় পরল আবার। আগুন জ্বলছে মনে। কিন্তু প্রকাশ পেতে দিচ্ছে না। উত্তেজিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেয়ে এভাবে আস্তে আস্তে খেলে যাওয়ার মজা অনেক বেশি।

কোণের জুকবক্সটা গমগম করে বেজে উঠল হঠাৎ। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, তা ও বাজছে। কোথা থেকে শক্তি পেল ওটা বুঝতে পারল না লেসলি। দি নাইটওয়াকার বাজতে লাগল কানফাটা শব্দে। গানটা যে বিলির প্রিয় গান, তা-ও জানা নেই ওর।

লেসলির কাছে সরে এল বিলি। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার দান তুমি খেলেছ। এবার আমার পালা।

বিলির কণ্ঠে এমন কিছু রয়েছে, অস্বস্তি বোধ করতে লাগল লেসলি। আর লাগার সাহস পেল না। পিছিয়ে এল। হ্যাঁ, খেয়ে আর কাজ পেলাম না, তোমার সঙ্গে ফালতু সময় করি! কণ্ঠের সেই একটু আগের জোরটাও নেই আর।

দরজার দিকে রওনা দিল সে।

*

পার্কিং লটের খোলা বাতাসে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লেসলি। আর্কেডের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না সেসময়মত বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, বিদ্যুৎ ছাড়াই জুকবক্স বেজে ওঠা। কৌতূহল থাকলেও সাহস দেখাতে পারল না। বরং তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছে তাগাদা দিচ্ছে মনে।

গাড়িতে উঠে ইগনিশনে মোচড় দিল সে। ফুল ভলিউমে বেজে উঠল রেডিও। গানটা পরিচিত। অতি পরিচিত।

দি নাইটওয়াকার!

আর্কেডের জুকবক্সে এই গানই বাজছিল।

ও কিছু না! সেফ কাকতালীয়! মন থেকে ভয় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। মোচড় দিয়ে অফ করে দিল রেডিওর সুইচ।

কিন্তু বেজেই চলল গান।

অসম্ভব! এ হতেই পারে না! নব ঘুরিয়ে কাটাটা পার করে দিল ডজনখানেক স্টেশন।

গান বন্ধ হলো না।

ফিরে তাকিয়ে দেখল আর্কেডের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে হাড্ডিসার ছেলেটা। শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে এদিকে।

ফার্স্ট গিয়ার দিল লেসলি। অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরল। ভেজা চত্বরে পিছলে গেল চাকা। তারপর এগোতে শুরু করল।

মনে পড়ল, কিছুদিন থেকে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটছে এই ছোট্ট শহরটাতে। রহস্যময়ভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ। চৌরাস্তায় পর পর কতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোও রহস্যময়। যারা ভূত বিশ্বাস করে, তাদের কেউ কেউ বলছে ভূতের উপদ্রব।

আর্কেডের ঘটনাটাও ভূতুড়ে মনে হচ্ছে লেসলির কাছে। বিদ্যুৎ ছাড়া যন্ত্র বাজে কিভাবে? বুঝে গেছে, আর্কেডের দরজায় দাঁড়ানো ওই ছেলেটার সঙ্গে এসবের নিশ্চয় কোন সম্পর্ক রয়েছে। অতএব পালাতে হবে ওর কাছ থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

গেটের কাছে এসে বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। মিসফায়ার করল না। পুটপুট করল না। কোন আগাম সঙ্কেত দিল না। এঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কোন রকম নিয়ম-কানুন না মেনে স্রেফ থেমে গেল। গাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

মরিয়া হয়ে ইগনিশনে মোচড় দিতে লাগল লেসলি। কাজ হলো না। চালু হলো না এঞ্জিন। কোন শব্দই করল না।

রেডিওতে বেজেই চলেছে দি নাইটওয়াকার।

দরজায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আজব ছেলেটা।

হঠাৎ আলোর বিস্ফোরণ ঘটল যেন। সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। ঝট করে ঘুরে গেল লেসলির মুখ। গাড়ির অ্যানটেনায় লাগানো পিজ্জা ডেলিভারি সাইনটাতে আগুন লেগে গেছে। পরক্ষণে ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা লাগল শরীরে। বুক থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ল হাত, পা, আর মাথায়। মনে হলো কোটর থেকে খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে চোখ। প্রচণ্ডভাবে মোচড় খেতে শুরু করল দেহটা। সীটের ওপর লাফাতে লাগল পানি থেকে তোলা মাছের মত। পেশীর ব্যথা অসহ্য।

বুঝে নিল লেসলি, এই পার্কিং লট থেকে জীবন্ত বেরোতে পারবে না সে। মুঠো হয়ে গেল হাতের আঙুল। ওগুলোর মাথা থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গ। কোনমতে হাত বাড়িয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল সে। এত বেশি হাত কাঁপছে, হাতলটাই ধরতে পারল না। কাঁপুনির চোটে মাথাটা গিয়ে বাড়ি খেল দরজার পাশে।

কিন্তু কিছুই করার নেই আর ওর!

কিছুই করার নেই মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া!

*

আর্কেডের দরজায়-দাঁড়িয়ে লেসলিকে মারা যেতে দেখল বিলি। কোন রকম আবেগ তৈরি হলো না তার মনে। করুণা জাগল না।

অবশেষে গাড়ির রেডিও থেকে তার মনো-আকর্ষণ সরিয়ে আনল সে। চুপ হয়ে গেল রেডিও। নীরব হলো পার্কিং লট। কনভার্টিবলের সামনের সীট থেকে একঝলক পোড়া ধোয়া বেরিয়ে উঠে গেল স্ট্রীট ল্যাম্পের আলোর দিকে।

এতক্ষণে ঘুরে দাঁড়াল বিলি। ঢুকে গেল আবার আর্কেডের ভেতর।

পেছনে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে পটেটো। বিলি তাকাতেই হেসে একটা কয়েন বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।

কিন্তু নিল না বিলি। গেম মেশিন চালু করতে ওটার আর প্রয়োজন নেই। যে-কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্র এখন তার গোলাম। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সার্কিটে ঢোকার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে ওর মনের। বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সামর্থ্য আছে।

ভুরু থেকে এক ফোঁটা ঘাম মুছে ফেলে মেশিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। তাকাল শুধু ওটার দিকে। তাতেই যেন জাদুমন্ত্রের বলে আপনাআপনি চালু হয়ে গেল মেশিন।

মুখের একটা পেশী কাঁপাল বিলি। মুহূর্তে শুরু হয়ে গেল নতুন খেলা। কয়েন ফেলার পর যেমন করে হয়।

ক্রমেই ক্ষমতা বাড়ছে আমার, আপনমনে বিড়বিড় করল সে। নতুন আরেক রেকর্ড তৈরি করব খুব শীঘ্রি।

.

০২.

হিলটাউনের কাউন্টি বিল্ডিংটা আহামরি কিছু নয়। রঙ ওঠা, পুরানো। নতুন এলেও দ্বিতীয়বার ওটার দিকে চোখ তুলে তাকানোর কথা ভাববে না কেউ। করনির্ধারক, সমাজসেবকের আস্তানা আর হলভর্তি রেকর্ডপত্র আছে ওটাতে। আর আছে কাউন্টি করোনার হিউগ ওয়াগনারের অফিস।

অস্বস্তি বোধ করছেন করোনার। যে রায় দিয়েছেন, তাতে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। জীবনে অনেক দেখেছেন, অনেক তার অভিজ্ঞতা। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে যা শুরু হয়েছে হিলটাউনে, এরকম কাণ্ড ঘটতে আর দেখেননি কোনদিন। অন্য চারটা মৃত্যুর মত লেসলি কার্টারিসের মৃত্যুটাকেও অপঘাতে মৃত্যু বলে রায় দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু খুতখুত করছে মনটা।

তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। তিনটে কিশোর ছেলে আর একজন। সুন্দরী মহিল। লাশটা দেখছে ওরা।

তিরিশ মিনিট আগে তার অফিসে ঢুকেছিল। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড আর পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের একটা প্রশংসাপত্র তার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে লাশটা দেখার অনুমতি চেয়েছিল ছেলেগুলো। মহিলা জানিয়েছে, সে একজন ডাক্তার। লাশটা পরীক্ষা করতে চায়।

একবার রায় দেয়ার পর সেটা নিয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবতে চান না। ওয়াগনার। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। ওরা যদি নতুন কিছু বের। করতে পারে করুক না। ক্ষতি কি?

ঘটনাটা সত্যি অদ্ভুত। নমুনা দেখে বজ্রপাতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না একে। কিন্তু লেসলি যখন মারা গেছে, তখন একবারও বজ্রপাত হয়েছে বলে রেকর্ড নেই।

লাশের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে ডাক্তার এলিজা। চোখে লাগানো প্রোটেকটিভ গগলস। পেশাদারী দৃষ্টিতে তাকাল মৃত ছেলেটার বাঁ কানের ভেতর। লাশের মাথা পুরো নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে একই ভাবে দেখল ডান কানের ভেতরটাও। ভাল করে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকাল তিন গোয়েন্দার দিকে, যারা ওকে অনুরোধ করে নিয়ে এসেছে এখানে। অবশ্য নিজেরও খানিকটা ইচ্ছা আর কৌতূহল জন্মেছিল গত কিছুদিনে হিলটাউনের অদ্ভুত মৃত্যুগুলোর কথা পত্রিকায় পড়ে।

রকি বীচ হাসপাতালের ডাক্তার এলিজা। তিন গোয়েন্দার বন্ধু। একবার একটা বিশেষ কাজে তাকে সাহায্য করেছিল ওরা। সেই থেকে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

দুটো কানের পর্দাই ফেটে গেছে, তিন গোয়েন্দাকে জানাল সে। ভোতা কণ্ঠস্বর। সামান্য একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল কি পড়ল না।

ডাক্তারী পাস করতে গিয়ে বহু লাশ পরীক্ষা করেছে এলিজা। অনেক ধরনের মৃত্যু দেখেছে। মানুষের শরীর অনেক কাটাকুটি করেছে। কিন্তু লাশ দেখলে তার এখনও মন কেমন করে। কেবলই মনে হয়, হাড়-মাংসে তৈরি এই নিথর দেহটাও একদিন তার মতই জ্যান্ত ছিল, চলেফিরে বেড়াত, কথা বলত। এরও আশা ছিল, নেশা ছিল, স্বপ্ন ছিল।

দস্তানা পরা হাতের আঙুল দিয়ে লাশের এক চোখের পাতা টেনে খুলল। সে। মৃত চোখের দিকে তাকাল। মণিটা একধরনের ঘোলাটে পাতলা পর্দায়। ঢাকা পড়েছে। অন্য চোখটা পরীক্ষা করেও একই জিনিস দেখতে পেল।

দুই চোখেই ছানি, কিশোর বন্ধুদের জানাল এলিজা। কণ্ঠস্বর এখনও ভোতা। কিশোর পাশার দিকে তাকিয়ে বলল, অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে হয়েছে সম্ভবত।

সম্ভবত কেন? এলিজার কথায় অবাক হয়েছে কিশোর। শিওর হতে পারছেন না?

জবাব দিল না এলিজা। কি বলবে, ভাবছে। অ্যানাটমিক্যাল স্কেলের ওপর রাখা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ তুলে নিল। মুখ খুলে ভেতরে তাকাল।

ব্যাগের ভেতরের জিনিসটাকে প্রথম দর্শনে মনে হয় পোড়া মাংসের টুকরো। পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু অভিজ্ঞ ডাক্তারের চোখ ঠিকই চিনতে পারল। জিনিসটা মানুষের হৃৎপিণ্ড। ময়না তদন্তের সময় লাশের বুক থেকে কেটে বের করে আনা হয়েছে।

বুকের মধ্যেই হার্টটা পুড়ে কাবাব হয়ে গেছে, এলিজা বলল। আশ্চর্য! করোনারের দিকে তাকাল সে। মিস্টার ওয়াগনার, আপনার কি ধারণা?

হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা আর রবিন। কিছু বুঝতে পারছে না। বোঝার জন্যে মাথাও ঘামাচ্ছে না। ডাক্তারই যখন পারছে না ওরা কি বুঝবে? তবে কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে শুনছে এলিজার কথা।

করোনার বললেন, এভাবে হার্টের টিস্যু ড্যামেজ হতে দেখিনি আর। তবে… গাল চুলকালেন তিনি। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিলেন বোধহয়। বক্ষাস্থির নিচে এভাবে পুড়ে কিংবা পাজরের হাড় ফেটে যেতে পারে একটা কারণেইহাই-ভোল্টেজে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক শক খেলে। বজ্রপাতে…

বাধা দিয়ে বলল এলিজা, কিন্তু কোন জায়গা দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবেশ করেছে। শরীরে, তার কোন চিহ্ন নেই। তারের ছোঁয়া লাগলে সেখানে দাগ কিংবা ক্ষত থাকার কথা।

আমার কাছেও এটাই অবাক লাগছে। দাগ নেই কেন?

ছেলেটা মারা গেছে ইলেকট্রিক শকে, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শকটা লাগল কোনদিক দিয়ে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

ঢোক গিললেন ওয়াগনার। আমার অনুমান, গাড়ির ছাতে পড়েছিল বজ্রটা। সেখান থেকেই কোনভাবে ছেলেটার শরীরে ঢুকেছে।

তারমানে বলতে চাইছেন ধাতব বডির ছোঁয়া? তাতেও চামড়া পুড়বে। দাগ কোথায়?

কি জানি! এই প্রশ্নটার জবাব পেলে তো সব পরিষ্কারই হয়ে যেত।

তাহলে অপঘাতে মৃত্যু রায় দিলেন যে?

তাতে ভুল করিনি। অপঘাত মৃত্যুই তো। ইলেকট্রিক শক। আমরা কেবল শিওর হতে পারছি না, শকটা লাগল কিভাবে।

করোনারের মতই এলিজাও কিছু বুঝতে পারছে না। কিশোরের দিকে তাকাল। যুক্তি যেখানে অচল সেখানে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। আর সেটা খুব ভাল পারে এই ছেলেটা। কল্পনার দৌড় আর বুদ্ধি এত বেশি, কিভাবে যেন প্রায় শূন্য থেকেও বের করে নিয়ে আসে মূল্যবান সূত্র। ইতিমধ্যেই কোন জবাব, কোন উদ্ভট ব্যাখ্যা তার মাথায় ঠাই গেড়ে ফেলেছে কিনা বুঝতে চাইল। অবাস্তব কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না কিশোর। ভূতুড়ে ঘটনাকে ভূতের কাণ্ড না ভেবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। দেখা যাক, এই ঘটনাটার কি ব্যাখ্যা দেয়।

কিশোর কিছু বলার আগেই দরজার দিকে ঘুরে গেল করোনারের চোখ। সেটা লক্ষ করে এলিজাও তাকাল সেদিকে। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বিশালদেহী লোক। বুকে শেরিফের ব্যাজ।

কোন কেসের দায়িত্ব নিলে পুলিশ কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে খাতির রাখার চেষ্টা করে কিশোর। নইলে তদন্তে প্রচুর অসুবিধে হয়। শেরিফ যদি ওদের কাজে বাধা দেন, পছন্দ না করেন, তার এলাকা থেকে বের করে দেন, কিছু করার থাকবে না। হিলটাউনে যখন পৌঁছেছিল ওরা, শেরিফ ছিলেন না এখানে। জরুরী একটা কাজে পাশের শহরে গিয়েছিলেন। সেই সুযোগে কোন রকম বাধার মুখোমুখি না হয়ে সহজেই করোনারের অফিসে ঢুকে পড়েছিল ওরা। এখন তিনি এসেছেন। ওদের তদন্তটাকে কোন চোখে দেখবেন কে জানে। করোনারের মত এত সহজে যদি তদন্ত করার অনুমতি না দেন?

এলিজার এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। লাশ পরীক্ষা করতে এসেছে, করছে। করা হয়ে গেলে চলে যাবে। গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে থাকতে হবে না এখানে। অতএব শেরিফের তোয়াক্কা তার না করলেও চলবে। কিভাবে ঘটনাটা ঘটেছে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফিরে তাকাল করোনারের দিকে, এ নিয়ে এরকম মৃত্যুর ঘটনা পাঁচটা ঘটল হিলটাউনে। পত্রিকায় পড়লাম। বাকি লাশগুলোর গায়েও কি কোন রকম দাগ ছিল না?

পায়ের ওপর ভার বল করলেন ওয়াগনার। অস্বস্তিবোধটা বাড়ল। না, ছিল না। ওগুলোকেও বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটেছে–এই রায় দিতে বাধ্য হয়েছি আমি।

তারমানে আপনি বিশ্বাস করেন না বজ্রপাতেই মারা গেছে লোকগুলো? আচমকা যেন প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল কিশোর।

অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন ওয়াগনার। জবাব দিতে পারলেন না। কিংবা আসল কথাটা স্বীকার করতে হয় বলে ইচ্ছে করেই দিলেন না।

দরজায় দাঁড়িয়ে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রেখে কথাগুলো শুনলেন। শেরিফ। তারপর কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সবার। করোনারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা?

পরিচয় দিলেন ওয়াগনার।

হু! তাহলে তোমরা গোয়েন্দা, মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। এক এক করে নজর বোলালেন তিনজনের মুখে। তোমাদের জানা না-ও থাকতে পারে, তাই নিজের পরিচয়টা দিয়েই নিই। আমি শেরিফ মরফি রবার্টসন।

দেখেই অনুমান করে নিয়েছি, স্যার, খুশি করার জন্যে বিনীত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। রহস্যময় মৃত্যুর খবরগুলো পত্রিকায় পড়ে ইনটারেস্টেড হয়েছি। শখের গোয়েন্দা আমরা, একটা কার্ড বের করে দিল সে।

ভুরু কুঁচকে তিনটে নামের নিচে প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলোর দিকে তাকালেন শেরিফ। এগুলো কেন? নিজেদের কাজের ব্যাপারে সন্দেহ আছে নাকি?

সন্দেহ নেই, কণ্ঠস্বরটাকে বড়দের মত ভারিক্কি করে তুলে কিশোর বলল, এগুলোর মানে, যে কোন ধরনের রহস্যের তদন্ত করতে আগ্রহী আমরা। জটিল, উদ্ভট কিংবা ভুতুড়ে কেস হলে আরও ভাল। এমন অনেকগুলো কেসের কিনারা করেছি আমরা, বহুদিন ধরে পুলিশ যার কোন সমাধান খুঁজে পায়নি। এই দেখুন না, ইয়ান ফ্লেচারের প্রশংসাপত্রটা বের করে দেখাল সে। আমাদের সার্টিফাই করেছেন ক্যাপ্টেন নিজে।

কার্ডটা ফিরিয়ে দিতে দিতে আবার মাথা আঁকালেন শেরিফ। হু! তারপর তাকালেন ডাক্তারের দিকে।

আমি ডক্টর এলিজা, হাত বাড়িয়ে দিল এলিজা।

হাত মেলালেন শেরিফ। কি সাহায্য করতে পারি, বলুন?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। বুঝে গেল, এক্ষুণি বেরিয়ে যেতে বলবেন না শেরিফ। তবে শেষ পর্যন্ত তদন্ত করতে দেবেন কিনা স্পষ্ট নয় এখনও।

কিশোরের দিকে তাকাল এলিজা। আবার ফিরল শেরিফের দিকে। এখানে গত কিছুদিনে বজ্রপাতের কারণে যেসব মৃত্যু ঘটেছে বলে বলা হয়েছে, সেগুলোর সপক্ষে তেমন কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি..

কিছু মনে করবেন না, ডাক্তার, বজ্রপাতের ব্যাপারে আপনি কতখানি জানেন?

জানি। অনেক কিছুই।

আপনি কি জানেন, বাড়িতে ঘরের মধ্যেও অনেকে বজ্রপাতের শিকার হয়? হয়তো শাওয়ারে গোসল করছিল তখন, কিংবা টেলিফোনে কথা বলছিল। এমনও দেখা গেছে, হলঘরে অনেকে মিলে নাচার সময় তাদের মধ্যে কোন একজন বাজ পড়ে মরে গেছে। বাকিদের কারও কিচ্ছু হয়নি। শিওর হয়ে কেউ বলতে পারে না কখন, কোথায় বাজ পড়বে। সাধারণ বিজ্ঞান বইতে আমরা পড়ি মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, আর তাতেই বজ্রপাতের সৃষ্টি। কিন্তু ভেতরে এত প্রশ্ন আর রহস্য রয়ে গেছে, অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীও তার জবাব দিতে পারেন না। জানেন সেটা?

আসলে আপনি কি বলতে চাইছেন, শেরিফ?

এতক্ষণে হাসি ফুটল শেরিফের মুখে। বলতে চাইছি, শরীরের দাগ নিয়ে যে প্রশ্নটা আপনি তুলেছেন, সাধারণ ইলেকট্রিক শকের বেলায় সেটা থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু বজ্রপাত একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার…হিলটাউনে বাস না, করলে হয়তো আপনার মতই কথা বলতাম। কিন্তু এখন আর বলব না। কারণ রোজ সকালে এখানকার বেশ কিছু বিজ্ঞানীর সঙ্গে বসে আমাকে নাস্তা খেতে হয়।

চোখ মিটমিট করল এলিজা, তাতে কি?

বুঝলেন না? শেরিফের চোখ দুটোও এখন হাসছে। এখানে এই হিলটাউনে বজ্র উৎপাদন করে আমাদের বিজ্ঞানীরা। বিশ্বাস হয়?

জবাব দিল না এলিজা।

আমরা বজ্র বানাই, শেরিফ বললেন। শহরের ধারে অস্টাডোরিয়ান লাইটনিং অবজারভেটরিতে। আকাশের দিকে মাথা তুলে চেয়ে থাকে ওখানে একশো আইওনাইজড রড। বিদ্যুৎকে খুঁচিয়ে বজ্র তৈরি করে ওগুলো।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলল এলিজা, এখবরটা তো জানতাম না!

তারমানে ঠিকমত হোমওয়ার্ক করেন না আপনি, রসিকতা করলেন শেরিফ।

বস্ত্রের ব্যাপারে যা-ই বলেন না কেন, স্যার, এই ময়না তদন্তের রিপোর্টে গলদ আছে।

কে বলল?

একজন ডাক্তার হিসেবে আমি বলছি। কারণ দাগ নেই…

সেই কথাটাই তো বোঝাতে চাইছি এতক্ষণ ধরে। সাধারণ শক হলে দাগ থাকত। এটা হয়তো কোন ধরনের অসাধারণ শক, তাই নেই। বজ্রপাত সম্পর্কে এখনও সব জানেন না বিজ্ঞানীরা, আগেই তো বললাম। হতে পারে, কিছু কিছু বজ্রপাতে বিদ্যুৎ এমন ভাবে ঢুকে যায় মানুষের শরীরে, ভেতরটা ঠিকই পুড়ে কয়লা হয়, কিন্তু চামড়ায় বা অন্য কোথাও কোন দাগ বা ক্ষত থাকে না…

রিমোট কন্ট্রোলড ইলেকট্রিক শক! বিড়বিড় করল কিশোর।

কি বললে? ঝট করে তার দিকে ঘুরে গেলেন শেরিফ। রিমোট? বুদ্ধিমান ছেলে! হয়তো ঠিকই বলেছ, রিমোট কন্ট্রোলড লাইটনিং। স্পর্শ ছাড়াই বিদ্যুৎ পাচার করে দেয় মানুষের শরীরে কে জানে! কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি। একে একে চোখ বোলালেন রবিন আর মুসার দিকে। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালেন, দেখে অবশ্য চালাক-চতুরই লাগছে তোমাদের। ঠিক আছে, করো তদন্ত, বাধা দেব না। তবে এমন কিছু করবে না, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবে না, যাতে কেউ তোমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারে। যদি করে, শহর থেকে তোমাদের চলে যেতে বলতে বাধ্য হব আমি।

থ্যাংকিউ, স্যার, হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। কেউ খারাপ রিপোর্ট করবে না, কথা দিতে পারি।

*

কিভাবে মারা গেছে, কি মনে হয় তোমার? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল এলিজা।

করোনারের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে একটা কফিশপে নাস্তা আর কফি খেতে বসেছে ওরা।

আমি ডাক্তার নই। আপনাদের আলোচনা থেকে যা বুঝলাম, একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, কিশোর বলল, বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটেনি। লেসলির।

মুসা বলল, শেরিফের সঙ্গে তো একমত হয়ে এলে…

বজ্রপাতে মারা গেছে এ ব্যাপারে একমত হইনি। বলেছি ইলেকট্রিক শক। বজ্রপাত আর ইলেকট্রিক শক এক জিনিস নয়।

কিন্তু বজ্রপাতে বিদ্যুতের কারণেই মারা যায় মানুষ।

তা যায়। তবে লেসলি বাজ পড়ে মারা যায়নি। কিংবা সাধারণ ইলেকট্রিক শকও খায়নি। তাহলে শরীরে দাগ নিশ্চয় থাকত।

তাহলে কিসে মরল? ভুরু নাচিয়ে জানতে চাইল রবিন।

ইলেকট্রিক শকেই মরেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সেই বিদ্যুটা বড় আজব! পরিবহনের জন্যে তার লাগে না এর, কোন মাধ্যম লাগে না। বাতাসের ইথারই যথেষ্ট। আরও একটা ব্যাপার। যেন মন আছে, মগজ আছে, চিন্তা-ভাবনা করে শিকার বেছে নেয়ার ক্ষমতা আছে ওটার।

এমন করে বলছ যেন ওটা একটা প্রাণী!

কেন, প্রাণীরা কি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না?

তা তো পারেই। অনেক প্রাণীই আছে যারা নিজের দেহে বিদ্যুৎ তৈরি করতে সক্ষম। চুপ হয়ে গেল রবিন।

একপাশে চেয়ারে রাখা ব্রীফকেস খুলে একটা ফাইল বের করল। কিশোর। সেটা থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে টেবিলে বিছাল। কি লেখা, দেখার জন্যে গলা বাড়িয়ে দিল রবিন আর মুসা।

দেখুন, এলিজাকে বলল কিশোর, একটা হিসেব বের করেছি। এই এলাকায় যারা যারা বজ্রপাতের শিকার হয়েছে তাদের সবারই বয়েস সতেরো থেকে একুশ। সবাই পুরুষ। লেসলি কার্টারিসও সেই দলেই পড়ে। এর মানে। কি? মনে কি হয় না, বুঝেশুনে, শিকার বাছাই করে মৃত্যুবাণ মারছে সেই আজব বিদ্যুৎ?

 বিস্মিত হলো এলিজা। তাকিয়ে রইল কিশোরের দিকে।

লেসলি কার্টারিস কোন জায়গায় মারা গেছে, একবার দেখা দরকার, কিশোর বলল। আপনার কাজ আপনি করে দিয়েছেন। যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। আপনাকে না দেখালে শিওর হতে পারতাম না। যাই হোক, এবার আমাদের তদন্ত শুরু। দেখা যাক আমার যুক্তির সপক্ষে কোন সূত্র মেলে। কিনা। আপনি আমাদের সঙ্গে যেতে চান?

মাথা নাড়ল এলিজা, যাওয়ার তো খুবই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আরেকটা জরুরী কাজ আছে। নতুন কিছু জানলে জানাবে অবশ্যই। আমার সাহায্যের প্রয়োজন আছে বুঝলে তখন নাহয় চলে আসব। এখন তো আমাকে আর কোন দরকার নেই তোমাদের?

মাথা নাড়ল কিশোর, না, নেই।

.

০৩.

স্ট্রিপ মলের পার্কিং লট থেকে এখনও বের করে আনা হয়নি লেসলি কার্টারিসের গাড়িটা। শেরিফের লোকেরা গাড়ি ঘিরে অরেঞ্জ-কোন বসিয়ে। গাড়িটাকে আলাদা করে রেখেছে। কেউ যাতে ওটার কাছে না যায়, কিছু না ধরে।

গাড়িটার পেছনে হাতখানেক দূরে ঝুঁকে বসল কিশোর। স্কিড় করে যাওয়া চাকার দাগ দেখতে পেল।

গাড়ির ভেতরে উঁকি দিচ্ছে মুসা।

একটা ফাইল হাতে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। ফাইল পড়ে বলল, রাত বারোটা সতেরো মিনিটে এই গাড়ির ভেতরে লেসলির লাশটা পেয়েছে পুলিশ। শর্ট সার্কিট হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে সমস্ত ইলেকট্রিক্যাল সিসটেম। ওয়্যারিঙের তার সব পুড়ে, গলে গেছে।

কিশোরের কাছে এসে দাঁড়াল সে।

এখনও ঝুঁকে বসে আছে কিশোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাকার দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। সেগুলো রবিনকে দেখিয়ে বলল, মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে পালাতে চেয়েছিল লেসলি।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কার কাছ থেকে? কেন?

উঠে দাঁড়াল কিশোর। মলের দিকে তাকাল। কখন শেষ পিজ্জাটা ডেলিভারি দিয়েছিল লেসলি?

ফাইল দেখল রবিন। এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। কেন?

এগারোটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এখানকার সব স্টোর, ভিডিও আর্কেডের ওপর স্থির হলো কিশোরের দৃষ্টি। সম্ভবত এই আর্কেডটা বাদে।

*

আর্কেডের ভেতরের মান নীলচে আলো চোখে সইয়ে নিতে সময় লাগল তিন গোয়েন্দার। সামনের কাউন্টারে বসে কয়েন গুণে গুণে কাগজের টিউবে ভরে রাখছে একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে।

দশ…এগারো-বারো… গুণছে সে। কাউন্টারে ঝুঁকে গভীর মনোযোগে কাজ করছে। প্রতিটি মুদ্রা ভালমত দেখছে। তেরো…

এক্সকিউজ মি! ছেলেটার প্রায় কানের কাছে গিয়ে বলল রবিন।

ময়লা একটা আঙুল তুলে রবিনকে অপেক্ষা করতে ইশারা করে গুণে চলল ছেলেটা। তেরো…উম, চোদ্দ-..

কিশোরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল রবিন

অহেতুক দাঁড়িয়ে না থেকে আর্কেডের ভেতরটা দেখতে শুরু করল কিশোর। মুসা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

ছেলেটার দিকে ঘুরল রবিন। আগের চেয়ে জোরে বলল, এক্সকিউজ মি, প্লীজ!

 ঘর্মাক্ত, গোলআলুর মত একটা গোল মুখ ঘুরল রবিনের দিকে। ছোট ছোট দুই চোখের দৃষ্টি স্থির হলো ওর মুখের ওপর। অবাক হয়ে ভাবতে লাগল। রবিন, ছেলেটার মুখ কি কোনকালে বন্ধ হয়? নাকি সব সময়ই ওরকম অর্ধেক ফাঁক হয়ে খুলে থাকে?

অপেক্ষা করছে রবিন। কি চাই, কি সাহায্য করতে পারি, এ ধরনের কোন প্রশ্নের অপেক্ষা। কিন্তু কিছুই বলল না ছেলেটা। তাকিয়ে রইল হাঁ করে। শেষে রবিনকেই কথা শুরু করতে হলো, কি নাম তোমার?

আঁ? এই একটা শব্দ উচ্চারণ করে আবারও দীর্ঘ মুহূর্ত রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। আস্তে করে মাথা ঝাঁকিয়ে যেন কথা বের করার চেষ্টা চালাল মগজের ভেতর থেকে। শেষে কোনমতে বলল, পটেটো।

মাথা ঝাঁকাল রবিন। হাসল। চমৎকার নাম। একেবারে মানানসই। পটেটো, তোমার একটা মিনিট সময় নষ্ট করতে পারি আমি?

হ্যাঁ, মলিন হাসি হাসল পটেটো। বলো।

জ্যাকেটের পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করল রবিন। পটেটোকে দেখিয়ে বলল, আমি একজন গোয়েন্দা।

পলকে পটেটোর প্রায় ফ্যাকাসে মুখটা আরও রক্তশূন্য হয়ে যেতে দেখল সে। ইঁদুরের মত চি চি করে উঠল, তো আমি কি করব?

কার্ডটা সরিয়ে রাখল রবিন। কাল রাতেও কি এখানে তোমারই ডিউটি ছিল?

মাথা ঝাঁকাল পটেটো, হ্যাঁ। রোজ রাতেই থাকে।

একটা ছবি দেখাল রবিন, এই লোকটাকে চিনতে পারো?

ছবিটা দেখল পটেটো। কুঁচকে যাচ্ছে ভুরু। দ্রুত চিন্তা চলেছে তার মনে, মুখ দেখেই বোঝা যায়। নাহ্, অবশেষে জবাব দিল সে, কখনও দেখিনি।

এমনভাবে মানা করে দেবে ছেলেটা, ভাবেনি রবিন। বলল, দেখো না, আরেকটু ভালমত দেখো। কাল রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে এখানে এসেছিল সে।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগল পটেটো। যেন কে ঢুকল কে বেরোল এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তার। ভঙ্গি দেখাল যেন কথাও বুঝতে পারছে না।

এমন সরাসরি মিথ্যে বলছে ছেলেটা! এভাবে যে মিথ্যে বলে তার মুখ থেকে কথা আদায় করা কঠিন। অসহায় বোধ করল রবিন। মুসার দিকে তাকাল।

পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল পটেটোর দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শোনো, আলু মিয়া, মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তোমাদের পার্কিং লটে খুন হয়েছে ছবির এই লোকটা, পড়ে থাকা আধপোড়া গাড়িটা দরজা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখিয়ে বলল, ওই যে ওটা এর গাড়ি। ওই সময় তুমি এখানে থাকলে দৃশ্যটা তোমার চোখে না পড়ার কথা নয়। একটা গাড়ি আগুনে পুড়ছে, আর তুমি কিছু দেখোনি…

তাই তো, আস্তে করে বলল পটেটো। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। ওপর-নিচে দ্রুত ওঠানামা শুরু করল তার মাথা। মুসার বাহুর শক্তিশালী পেশীর দিকে তাকিয়ে যেন হঠাৎ করে মনে পড়ে গেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল নিগ্রো ছেলেটার ঘুসি ছুটে আসছে কিনা তার গোল নাকের ডগাটাকে ভোঁতা করে দেয়ার জন্যে। হায় হায়… গাড়ির দিকে আঙুল তুলে সেটা আবার ঠেকাল রবিনের হাতের ছবিতে, এই লোকটাই সে?

*

আর্কেডের একেবারে পেটের মধ্যে সারি সারি ভিডিও গেম মেশিনের পাশ দিয়ে চলেছে কিশোর। ওগুলোর সামনে দাঁড়ানো ছেলেগুলো বেশির ভাগই তার সমবয়েসী, কেউ দুএক বছরের ছোট, কেউ বড়। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ তুলে কেউ কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। হয়তো ভাবছে ওদের মতই কিশোরও ভিডিও গেম খেলতে এসেছে।

একটা ক্লাসিক উরটিজার জুকবক্সের পাশ কাটাল সে। কমপ্যাক্ট ডিস্ক লাগানো আছে ওটাতে। ভিডিও গেম মেশিনগুলোর কাছে কেমন ভারিক্কি দেখাচ্ছে ওটার চেহারা।

মেশিনগুলোর পাশ কাটাতে গিয়ে একটা মেশিন দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। থমকে দাঁড়াল। Virtual Massacre-II মেশিন। পর্দায় স্তম্ভ তৈরি করে ফুটছে খেলে রেখে যাওয়া খেলোয়াড়দের নাম, সই, তারিখ আর সময়। একটার নিচে আরেকটা।

তাকিয়ে রইল কিশোর। নামের সারি শেষ হতেই একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য, ফুটল। একজন যোদ্ধা কারাতের কোপ দিয়ে মেরে ফেলল আরেকজন যোদ্ধাকে। মুমূর্ষ যোদ্ধার মুখ থেকে ফোয়ারার মত ছিটকে বেরিয়ে এল এক ঝলক রক্ত। পরক্ষণে বলে উঠল একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ: খেলবে, এসো। আমি জানি তোমার পকেটে একটা সিকি আছে:

শেষ ওকে দেখেছি এই মেশিনটাতে একটা সিকি ঢোকাতে, পাশ থেকে বলল আরেকটা কণ্ঠ।

 ফিরে তাকাল কিশোর। গোলআলুর মত মুখওয়ালা টিনেজ অ্যাটেনডেন্ট রবিনের সঙ্গে কথা বলছে মেশিনটার দিকে তাকিয়ে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মুসা।

তারপর বেরিয়ে গেল, পটেটো বলছে। কিছুক্ষণ পর শুনলাম অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।

কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওকে দেখতে লাগল কিশোর। কিন্তু একটা চোখ রয়েছে মেশিনের পর্দায়। নামের স্তম্ভ ফিরে আসার অপেক্ষা করছে।

পটেটোর দিকে তাকাল রবিন, অ্যাম্বুলেন্স আসার আগে বাইরে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে তোমার?

মাথা নাড়ল পটেটো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ মিটমিট করল। বলা কঠিন। আমি বলতে চাইছি, এতটাই শোরগোল শুরু হয়েছিল, আলাদা করে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, বলেই ঝট করে ফিরে তাকিয়ে দেখে নিল মুসাকে, সে আবার অস্বাভাবিক কিছু ঘটানোর তালে আছে কিনা। এরকম ঘটনা ঘটলে যা হয় আরকি।

কাছাকাছি এমন কাউকে দেখেছ, যে মনে করতে পারবে কোন কিছু দেখেছে?

অ্যা…না মনে পড়ছে না।

পটেটোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল কিশোর। কথা গোপন করার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে টিনেজ অ্যাটেনডেন্ট, বুঝতে অসুবিধে হলো না তার। কাকে বাঁচাতে চাইছে সে? কেন? মেশিনের পর্দায় ফিরে গেল তার। দৃষ্টি। আবার ফিরে এসেছে নামের স্তম্ভ।

অই, আলু, চিৎকার করে উঠল একটা ছেলে, আমার ভাঙতি পয়সা কই?

বাচল যেন পটেটো।এক্সকিউজ মি বলে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল, সেদিকে।

রবিন, এদিকে এসো, হাত নেড়ে ডাকল কিশোর। পর্দার দিকে হাত তুলল, দেখো।

কি? চোখের পাতা সরু করে তাকাল রবিন।

 ফাইল। বজ্রপাতের শিকার অন্য ছেলেগুলোর নাম কি ছিল?

ফাইল খুলল রবিন। একটা লিস্ট দেখল। হ্যারি গাটস… মরিস নিউম্যান..বিলি ফক্স বব-..

দাঁড়াও দাঁড়াও! বিলি ফক্স। ওর মিডলনেমটা কি? লেখা আছে?

 আছে।

 বিলি পিটার ফক্স?

হ্যাঁ।

বজ্রপাতের শিকার হয়েছিল পাঁচজন। তাদের মধ্যে একজন বেঁচে গিয়েছিল। তার নাম বিলি পিটার ফক্স। তাই তো?

ফাইলের দিকে আরেকবার তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ। তুমি জানলে কি করে?

ওই দেখো, আবার পর্দার দিকে হাত তুলল কিশোর। হাই স্কোরারদের মধ্যে ওর নাম সই করা আছে নামের আদ্যক্ষর। বি পি এবং এফ। কি দাঁড়াল? বিলি পিটার ফক্স।

পর্দার কাঁচে সইটার ওপর আঙুল রাখল সে। ধীরে ধীরে পাশে সরাল আঙুলটা। তারিখ এবং সময় লেখা আছে। লেসলি কার্টারিসের নাম আছে। কখন খেলেছে, সময় লেখা আছে

পর্দা থেকে হাত সরিয়ে এনে দৃনে দুই সহকারীর মুখোমুখি হলো। কিশোর। এর একটাই মানেনসৰি কাৰ্টারিস খুন হওয়ার সময় বিলিও–এখানে ছিল।

.

০৪.

ওয়াকম্যানের হেডফোন কানে লাগিয়ে একটা বুইক গাড়ির পেটের নিচে ঢুকে, কাজ করছে বিলি ফক্স। এ শহরের অর্ধেক ছেলেই মেকানিক। বিলিকে যা দিচ্ছেন তার অর্ধেক বেতনে ওর চেয়ে দক্ষ মেকানিক রাখতে পারতেন জোসেফ হাওয়ার্ড। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে মায়া হয়েছে। তাই ইচ্ছে করেই বেতন বেশি দিচ্ছেন।

চিত হয়ে থেকেই পিঠ উঁচু করে পিঠের নিচের গদিটা টেনে ঠিক করল বিলি। পাশে হাত বাড়াল রেঞ্চের জন্যে। পেল না। কোথায় ওটা দেখার জন্যে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। চোখে পড়ল একজোড়া সুন্দর পা।

 হাসিতে ঠোঁটের একটা পাশ নিচে নেমে গেল ওর। যে কোন জায়গায় লক্ষ পায়ের মধ্যে ওগুলোকে চিনে নিতে পারবে সে। স্কুলে, এখানে ওখানে, নানা জায়গায় ওই পা আর পায়ের মালিককে হাজার বার দেখেছে। জীবনে। এক জিনিস বলতে সবচেয়ে বেশি দেখেছে বোধহয় ওই পা-জোড়া।

 গ্যারেজের কংক্রীটের মেঝেতে হাই-হীলের খটখট শব্দ তুলে গাড়িটার দিকে এগিয়ে আসছে পায়ের মালিক। চিত হয়েই হাত আর পায়ের সাহায্যে নিজের শরীরটাকে মুচড়ে গাড়ির নিচ থেকে বের করে আনল বিলি। স্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

ওকে হঠাৎ এভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখে চমকে গেল হাই-হীলের মালিক। পিছিয়ে গেল এক পা।

তাড়াতাড়ি কানের ওপর থেকে হেডফোন সরিয়ে নিল বিলি। বেজবল ক্যাপটা টেনে ঢেকে দিল মাথার কাটা দাগ। তার সবচেয়ে মধুর আর মোলায়েম হাসিটা উপহার দিয়ে বলল, মিলি, কেমন আছ?

ওফ, বিলি, যা কাণ্ড করো না! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!

কথা হারিয়ে ফেলল বিলি। ভয় দেখানো দূরে থাক, কোনমতেই সামান্য চমকে দিতেও চায় না সে মিলিকে।

সরি, মিলি, মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল সে। তার মতে পুরো কাউন্টিতে এত সুন্দর চোখ অন্য কোন মেয়ের নেই। হয়তো পুরো আমেরিকাতেও এত সুন্দরী নেই আর কেউ। এটাও কেবল ওর ধারণা। মিলি হলো বিলির বয়েসী একেবারে নিখুঁত সুন্দরী একটা মেয়ে।

 নিজের হাতের দিকে তাকাল সে। তেলকালি মাখা। গ্যারেজে থাকলে সব সময়ই হাতে ময়লা লেগে থাকে। হাত দুটো সরিয়ে নিল।

বাবা কোথায়? জানতে চাইল মিলি।

 প্রশ্নটা নিরাশ করল বিলিকে। সে ভেবেছিল শুধু তার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছে মিলি। ওর সঙ্গে কথা বলতে।

একটা নষ্ট গাড়ি আনতে গেছেন।

মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বিলি। ওকে সামনে দেখলে কিছুতেই, চোখ সরাতে পারে না। লক্ষ করেছে এতে অস্বস্তি বোধ করে মিলি। কিন্তু সে সরাতে পারে না, কি করবে? এত সুন্দর একটা মুখের ওপর থেকে চোখ সরায় কি করে মানুষ? শিল্পীর হাতেগড়া চেহারা!

আর কি করতে পারি তোমার জন্যে? জিজ্ঞেস করল বিলি।

আর কিছু না। বাবা বলেছিল, আজ একসঙ্গে লাঞ্চ খাব আমরা।

দ্রুত ভাবনা চলল বিলির মাথায়। মিস্টার হাওয়ার্ড যখন নেই, সে নিজেও তো খাওয়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে মিলিকে। ও নিশ্চয় সেটা পছন্দ করবে।

তোমার কি খিদে পেয়েছে? জানতে চাইল বিলি। তোমাকে আমি খাওয়াতে পারি। কি খাবে? হেসে বলল, আমার কাছে জেলি ডোনাট আছে। কালকের বানানো। তবে এখনও তাজা। খাবে একটা?

নিজের অজান্তেই এক পা আগে বাড়ল সে।

পিছিয়ে গেল মিলি। মাথা নাড়ল।

বিলি মনে করল তার নোংরা পোশাক দেখেই সরে গেছে মিলি। ওর ঝলমলে জামাকাপড় আর চকচকে জুতোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বিলির বুক থেকে। খাবে না কেন? কালকের বলে?

এই সময় একটা টো ট্রাক ঢুকতে দেখা গেল গ্যারেজের গেট দিয়ে। এসে গেছেন মিস্টার হাওয়ার্ড–মিলির বাবা এবং বিলির বস।

ট্রাকটাকে দেখামাত্র তাড়াতাড়ি দুই পা পিছিয়ে গেল বিলি।

কাছে এসে দাঁড়াল ট্রাক। ক্যাব থেকে বেরিয়ে এলেন জোসেফ হাওয়ার্ড লম্বা, সুদর্শন। মিলির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, সরি, দেরি হয়ে গেল। অনেকক্ষণ এসেছিস?

মাথা নাড়ল মিলি, না, এই এলাম।

ওই অভাগা পিজ্জা-বয়টার পোড়া গাড়িটা আনতে আনতে দেরি হয়ে। গেল।

মেয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে বিলির দিকে তাকালেন হাওয়ার্ড। বিলি, পোড়া গাড়িটার একটা ব্যবস্থা করো। তাড়াহুড়ো নেই। ও হ্যাঁ, ভাল কথা, রেডিওতেই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম কয়েকটা ছেলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। শখের গোয়েন্দা। আমাকে এসে ধরল। বললাম, আমার গ্যারেজেই কাজ করে। ছেলেগুলোকে ভাল মনে হলো আমার। বলে দিলাম, তুমি অবশ্যই দেখা করবে।

বিষণ্ণ, গভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বিলি। মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকে, গোয়েন্দা, না? আমার কাছে কি কাজ ওদের? গাড়ি সেরে দেয়ার জন্যে ভাল মেকানিক চায়?

কিন্তু নিশ্চিত জবাবটা পেল না। ESR।

মেয়ের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন হাওয়ার্ড। সেদিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে টো ট্রাকটার দিকে পা বাড়াল সে।

*

হু, এই বোকাটাই তাহলে মারা পড়েছে?

লেসলি কার্টারিসের ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল বিলি। লেসলির স্কুল জীবনের ছবি। ঝাকড়া চুল, সুন্দর স্বাস্থ্য, মিষ্টি হাসিতে দুনিয়া জয় করার ভঙ্গি। এধরনের মানুষকে অপছন্দ করে বিলি, দুচোখে দেখতে পারে না। নিজের চেয়ে ভাল স্বাস্থ্য আর সুন্দর চেহারার কাউকে দেখলেই ঈর্ষা হয় তার। ঘৃণা হয়। একে শেষ করে দিয়েছে বলে অনুশোচনা তো দূরে থাক, খুশি হলো মনে মনে।

ঘটনাটা খুব দুঃখজনক, নীরস কণ্ঠে বলল সে।

ছবিটা দিয়েছে কিশোর। কিন্তু রবিনের হাতে ফিরিয়ে দিল বিলি। কিশোরের তীক্ষ্ণ চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। দৃষ্টি তো নয়, যেন ধারাল ছুরি। অন্তরের অন্তস্তলটা পর্যন্ত যেন দেখে নেয়। রবিন কিংবা মুসার দিকেও তাকাল না সে। যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটুরখাটুর শুরু করল। অনুভব করল, তিন জোড়া চোখ এখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিচের দিকে মুখ নামিয়ে রেখে কাজ করার ভান করতে করতে জানতে চাইল, কি করে মারা গেল?

শেরিফ আর করোনারের কাছে শুনলাম বজ্রপাতে, জবাব দিল কিশোর।

না হেসে পারল না বিলি। হ্যাঁ, এরকম ঘটনা এখানে আজকাল হরহামেশাই ঘটে। মোড়ক খুলে একটা চিউঙিং গাম মুখে ফেলে চিবাতে শুরু করল। কোথায় মরল?

 ভিডিও আর্কেডের বাইরে, জানাল কিশোর। লোকটা যখন মারা গেছে। আকাশে মেঘ থাকলেও একবারও বিদ্যুৎ চমকায়নি। বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়নি।

বিলির ওপর থেকে ক্ষণিকের জন্যেও চোখ সরাচ্ছে না সে।

অস্বস্তি বোধ করতে লাগল বিলি। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন ছেলেটা? কিছু আঁচ করে ফেলেছে? নাকি কায়দা করে ওর পেটের কথা বের করার চেষ্টা এটা?

কাল রাতে তুমি ওখানে গিয়েছিলে, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হ্যাঁ, সত্যি জবাবটাই দিল বিলি। নিজেকে বোঝাল, মিথ্যে যত কম বলে পার করা যায়, ততই মঙ্গল। এই ছেলেটাকে ফাঁকি দেয়া সহজ হবে না।

তাহলে নিশ্চয় অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে তোমার?

মাথা নাড়ল বিলি। দেখো, আমি যখন খেলা নিয়ে মেতে থাকি, দুনিয়ার কোন কিছুই চোখে পড়ে না আমার। অ্যাটম বোমা ফাটালেও শুনতে পাব না

আমি কেন, কালা নাকি মোটর মেকানিক বিলি। চট করে ভা।

 কেন, কালা নাকি ব্যাটা তুই? মনে মনে রেগে উঠল মুসা। প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করেছে এই মোটর মেকানিককে।

যেন তার মনের কথাটাই শুনে, ফেলল বিলি। চট করে চোখ তুলে তাকাল মুসার দিকে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে নিগ্রো ছেলেটা। তবে কোঁকড়া-চুল ছেলেটার মত দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা নেই এর, আছে ঝাজ।

আবার চোখ নামিয়ে নিজের কাজে মন দেয়ার ভান করল বিলি।

কিশোর বলল, বিলি, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি? নিজেকে কি ভাগ্যবান মনে করো তুমি?

আমি? নিজের বুকে হাত রাখল বিলি। মনে মনে বলল, বেকুবটা বলে কি? আমি ভাগ্যবান হলে দুনিয়ায় হতভাগা মানুষ আর কে? নাহ, চোখ দেখে যতটা মনে হয়েছে, ততটা বুদ্ধিমান তো নয়। জবাব দিল, না, সেটা মনে করবার কোন কারণ নেই।

কেন ভাগ্যবান, বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি। তোমার মাথায়ও বাজ পড়েছিল। কিন্তু বেঁচে গেছ। বাকি সব কজন মারা গেছে। ওদের চেয়ে তুমি ভাগ্যবান নও?

 হঠাৎ মাথার কাটা দাগটা চুলকাতে শুরু করল বিলির। বাজ পড়েছিল ঠিক ওখানটাতেই। অন্য যে কেউ হলে সঙ্গে সঙ্গে পরপারে চলে যেত। কিন্তু সে তো যায়ইনি, বেঁচে গেছে, আগের চেয়ে ক্ষমতাশালী হয়েছে আরও। ওর বেঁচে যাওয়াটা ডাক্তারদের কাছে একটা বিস্ময়।

হ্যাঁ, সেদিক থেকে আমাকে ভাগ্যবান বলতে পারো অবশ্য। প্রশ্নটা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে বিলিকে। কিশোরকে বিদেয় করার জন্যে একটা বুদ্ধি বের করল সে।

কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আগুন! তোমার পকেটে ধোয়া!

চট করে চোখ ফেরাল কিশোর। সত্যিই তার জ্যাকেটের পকেট থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে।

হাসি ঠেকানোর জন্যে জোরে জোরে চিউয়িং গাম চিবাতে লাগল বিলি।

পকেট থেকে সেলুলার ফোনটা টেনে বের করল, কিশোর। ধোয়া বেরোচ্ছে ওটা থেকে।

আগুন লাগল কি করে? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মুসা। ব্যাটারি কখনও এভাবে পোড়ায় বলে তো শুনিনি!

হাতে ছ্যাকা লাগতে তাড়াতাড়ি যন্ত্রটা ফেলে দিল কিশোর। মাটিতে পড়ে গলতে শুরু করল ওটার প্লাস্টিক বডি। ধোয়া বেরোচ্ছে অনবরত। হাতের তালুতে আঙুল বোলাতে লাগল সে।

 পুড়ে যাওয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা নাড়ার ভঙ্গি করল। বিলি, এসব আধুনিক যন্ত্রপাতির ওপর বিশ্বাস নেই। কখন যে কোন অঘটন ঘটাবে কিশোরের দিকে এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল সে। তোমাদের কথা শেষ হলে যেতে পারো। আমার জরুরী কাজ পড়ে আছে।

গম্ভীর হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। তারপর বলল, সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ। অনেক বিরক্ত করলাম তোমাকে।

না-না, ও কিছু না।

একটা এঞ্জিন খোলায় মন দিল বিলি।

০৫.

ছোট্ট যে বাংলো বাড়িটাতে বাস করে বিলি আর তার মা, এই এলাকার সবচেয়ে পুরানো বাড়ি ওটা। রঙ চটে গেছে বহুকাল আগে। কাত হয়ে পড়েছে একপাশে। সামনের সিঁড়ির তিনপাশ ঘিরে আগাছা জন্মেছে। ড্রাইভওয়েটা ঘাস আর আগাছায় ঢেকে গিয়ে চেনাই যায় না। বাড়ির সামনে সুপ হয়ে আছে জঞ্জাল।

বাড়ি ফিরে বিলি দেখল তন্ময় হয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তার মা। নিজের সমান লম্বা একটা কাউচে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়েছেন। টক-শো হচ্ছে টিভিতে। গভীর মনোযোগে ওদের বাদানুবাদ শুনছেন তিনি।

দরজায় দাঁড়িয়ে মুচকি হাসল বিলি। পর্দার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে চ্যানেল বদলে গিয়ে দেখা গেল এমটিভি।

ঝটকা দিয়ে ফিরে তাকালেন মা। চিৎকার করে বললেন, রিমোট টেপাটেপি করছিস কেন? দে আগেরটা!

গায়ে শক্ত কি যেন লাগল তার। চোখ নামিয়ে দেখেন রিমোটটা তাঁর পাশে কাউচেই পড়ে আছে। বিস্মিত চোখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে।

বিলি তখন টিভির দিক থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছে। চকোলেট মিল্কের একটা ব্যাগ কাটতে ব্যস্ত। রিমোট টিপে অনুষ্ঠান আবার আগের চ্যানেলে ফিরিয়ে আনলেন মা।

কি যে ছাইপাশ দেখো তুমি, মা, বিলি বলল। যত সব ছাগলের দল!

ছাগল হোক আর যাই হোক, টেলিভিশন তো ওদেরকে দাওয়াত করে নিয়ে যায়, কাটা জবাব দিলেন-মা। তোকে তো নেয় না।

ছাগলে ছাগল চেনে, পাগলে পাগল, যেন কি একটা মস্ত রসিকতা করে ফেলেছে ভেবে খিকখিক করে হাসতে লাগল বিলি। বিশ্রী ভঙ্গিতে শব্দ করে ঢেকুর তুলল।

মাথা নাড়তে নাড়তে মা বললেন, ভদ্ৰব্যবহার করতে পয়সা লাগে না, বিলি। তুই আর মানুষ হবি না কোনদিন। কোন মেয়ে তোর এই জঘন্য ঢেকুর। তোলা সহ্য করবে?

যে করবে, তাকে দেখলে তোমার জবান বন্ধ হয়ে যাবে, মা।

ছেলের দৌড় জানা আছে মায়ের। তার কথাকে গুরুত্বই দিলেন না। আবার মনোযোগ ফেরালেন টেলিভিশনের দিকে।

মা যতই খোঁচা দিয়ে কথা বলুক, ভাবছে বিলি, টেলিভিশনের ওই গর্দভগুলোর দলে কোনদিন যোগ দেব না আমি। ওদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা আমার, অনেক বড় কাজ করতে পারি। সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিতে পারি।

মনে মনে নানা রকম পরিকল্পনা করতে লাগল বিলি। সবগুলোই মিলিকে জড়িয়ে। ওকে বাদ দিয়ে কোন কিছু করার ইচ্ছে নেই তার। মিলি তার সঙ্গে অন্য মেয়েদের মত খারাপ আচরণ করে না। তাকে অবহেলা করে না। এড়িয়ে চলে না। তাকে বোকা বলে না। তার রসিকতায় হাসে। তার খাতায় ভাল ভাল কথা লিখে দেয়। তাকে উৎসাহ দেয়। তাকে যে পছন্দ করে, তার জন্যে মায়া আছে, তার খারাপ কিছু হলে কষ্ট পাবে, এটা স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয়। তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়।

দরজায় টোকার শব্দ ভাবনার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনল বিলিকে। বিশেষ ধরনের পরিচিত টোকা। পটেটো এসেছে। দরজা খুলতে যাওয়ার আগে টেলিভিশনের দিকে তাকাল বিলি আরেকবার। মুহূর্তে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল তাতে। ছবি ঠিকই থাকল, শব্দ হয়ে গেল গোলমেলে। কিছু বোঝ যায় না। মুচকি হাসল সে। গেল বিরক্তিকর গাধাগুলোর বকবকানি।

মা কিছু বলার আগেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পটেটো। ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে এখানে কথা না বলতে ইশারা করল। নেমে গেল আঙিনায়।

 পিছন পিছন গেল পটেটো। বললে বিশ্বাস করবে না, বিলি। আজ কারা এসেছিল আর্কেডে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না!

অনুমান করতে বলছ? গোয়েন্দা।

থমকে দাঁড়াল পটেটো। কি করে জানলে?

 গ্যারেজেও হানা দিয়েছিল ওরা।

তোমাকে খুঁজে বের করল কিভাবে?

সেটাই তো আমি জিজ্ঞেস করতে চাই তোমাকে! কঠিন হয়ে উঠল বিলির কণ্ঠ। নিশ্চয় কোন ফাঁকে ভুল করে আমার নামটা বলে দিয়েছ ওদের কাছে।

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল বিলি। ওর সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খেয়ে গেল পটেটো।

না না, আমি একবারও তোমার নাম বলিনি। সত্যি।

মাঠে বেরিয়ে এসেছে ওরা। বিলিদের বাড়ির পেছনের তৃণভূমিটা বছরের এসময়ে সবুজ ঘন ঘাসে ভরা থাকে। এক সময় এটা ফক্স পরিবারের সম্পত্তি ছিল, বিলির দাদার। কিন্তু পরে হাতছাড়া হয়ে যায়। যেমন করে সব কিছু খুইয়েছে ওরা।

কাঁটাতারের বেড়াটা লাফ দিয়ে পেরিয়ে এল বিলি। তারের মাঝের ফাঁক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল পটেটো।

থাকো ওখানেই! বিলি বলল।

 ঢাল বেয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল সে।

পটেটো ভাবল ওর ওপর রেগে যাওয়ায় ওকে সঙ্গে যেতে মানা করছে বিলি। সত্যি বলছি, বিলি, আমি কিছু বলিনি। তোমার কোন ক্ষতি কি আমি করতে পারি?

পাহাড়ের ওপরে ছোট একটা চত্বরমত জায়গা আছে। ঘাস খেতে খেতে ওখানে উঠে যায় গরুর পাল। রাতে বেশির ভাগ নেমে আসে। কিছু কিছু বেশি দুঃসাহসী গরু আছে, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, রাতেও থেকে যায় ওখানেই। গরু কি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়, ভাবতে অবাক লাগে বিলির।

তুমি চলে যাও, পটেটো, ফিরে তাকিয়ে বলল বিলি। আমার এখন কাবাব খেতে ইচ্ছে করছে।

 ভারী দম নিল পটেটো। কাঁপা গলায় বলল, এখন? না না বিলি, গরু ঝলসানোর সময় এটা নয়!

 জবাবে হা-হা করে হাসল বিলি। যাও, চলে যাও। প্র্যাকটিসটা চালু রাখতে হবে আমাকে। নইলে শেষে দেখা যাবে অস্ত্র ভোতা হয়ে গেছে। ঠিকমত কাজ করছে না আর।

প্লীজ, বিলি, এখন ওসব করতে যেয়ো না!

ওর কাকুতি-মিনতিতে কান দিল না বিলি। আবার হেসে উঠল। সে কিছু করতে গেলে পটেটোর এভাবে বাধা দেয়া দেখে মজা পায়।

মানুষের সাড়া পেয়ে এক এক করে জেগে উঠতে শুরু করেছে গরুগুলো। বাবা করে ডাকছে। বুঝতেই পারছে না কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে, ওদের ভাগ্যে।

পটেটোর কাছ থেকে সুরে এসেছে বিলি। পাহাড়ের ওপরে উঠে। আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাল। মেঘ জমেছে। তারা ঢেকে দিচ্ছে। ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। পা ফুলে উঠল মেঘ। ঘন নীল, হয়ে গেল রঙ। বিদ্যুৎ-শক্তিতে বোঝাই। প্র্যাকটিস করার উপযুক্ত সময়।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি আমি, আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল বিলি। আমি রেডি। চলে এসো!

আরও ছড়িয়ে পড়ল মেঘ। সব তারা ঢেকে দিল। ঝোড়ো বাতাসের গর্জনের মাঝে গরুগুলোর ডাকাডাকি বেড়ে গেল। আকাশের অনেক উঁচুতে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন।

আমি এখানে! চিৎকার করে বলল বিলি। এই যে এখানে! পারলে এসে ধরো আমাকে! বলেই যতটা জোরে সম্ভব দৌড়াতে শুরু করল সে। গরুগুলোর মাঝখানে চলে এল।

কই আসছ না কেন? আকাশের দিকে তাকিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল সে। এসো! ধরো আমাকে!

দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে সে। তাকিয়ে আছে রেগে যাওয়া মেঘের দিকে। বা এসো এসো! ধরো। আমি অপেক্ষা করছি! ওপর দিকে দুই হাত তুলে দিল সে। এসো! ধরো আমাকে।

বিলি দেখেছে, এভাবে ওপর দিকে হাত তুলে দিলে বিদ্যুৎ ছুটে আসে তার দিকে। বাড়ির ছাতে বসানো দণ্ডের মত আকর্ষণ করে সে বিদ্যুৎকে।

ফেটে পড়ল যেন আকাশটা। কোটি কোটি সাপের আঁকাবাকা জ্বলন্ত লেজ সৃষ্টি করে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎ-শিখা। বজ্রপাত ঘটতে লাগল ধরণী কাঁপিয়ে।

অন্যান্যবারের মত এবারেও ব্যতিক্রম ঘটল না। বিদ্যুৎ-শিখা ছুটে ছুটে আসতে লাগল তার দিকে। গরুগুলোর মাঝখান দিয়ে ছুটে বেড়াতে লাগল সে। বিদ্যুৎ তাকে ধরতে না পেরে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে গরুগুলোকে আঘাত হানতে লাগল। ভয়ে চিৎকার শুরু করেছে ওগুলো। বজ্রপাতে ঝলসে যাচ্ছে। মাংসপোড়া দুর্গন্ধে ভরে গেল বাতাস।

একটা বজ্র আঘাত হানল বিলিকে। শিরা বেয়ে তীব্র গতিতে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে। হাতের আঙুলের মাথা দিয়ে ছড়ছড় করে ছিটকে বেরোতে লাগল স্ফুলিঙ্গ। পায়ের পাতা আর আঙুল বেয়ে নেমে গেল মাটিতে।

পড়ে গেল বিলি।

 থেমে গেল বজ্রপাত, কমে এল বিদ্যুৎ চমকানো।

মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে বিলি। যেন অগ্নিপরীক্ষায় ক্লান্ত। দেহটা অসাড়। হাত-পা ঠিকমত নড়াতে পারছে না। অন্য কোন মানুষ হলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। বিলির কিছু হয়নি। তবে প্রচণ্ড ইলেকট্রিক শক সামলে নিতে কিছুটা সময় লাগবে।

দূর থেকে এতক্ষণ এই ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে পটেটো। দৌড়ে এল কাছে। পড়ে থাকা দেহটার ওপর ঝুঁকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, বিলি! তুমি ঠিক আছ তো? বিলি!

খবরদার! ধোরো না এখন আমাকে! ফোঁস করে উঠল বিলি। উঠে বসল। ওর কানের দুল, দাঁতের গর্ত ভরাট করা ধাতুতে এখনও স্পার্ক করছে। বিদ্যুৎ। শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ জমে আছে। বাতাসে বিদ্যুতের গন্ধ।

খুব ভাল আছি, হাসিমুখে জবাব দিল সে।

.

০৬.

 একটা মরা গরুর সামনে এসে দাঁড়ালেন শেরিফ রবার্টসন। হতভাগ্য প্রাণীটার খোলা নিষ্প্রাণ দুই চোখে এখনও মৃত্যুক্ষণের বিস্ময়ের ছাপ প্রকট। ওটার সামনে থেকে সরে গিয়ে সেলুলার ফোন তুলে কানে ঠেকালেন। হিলটাউন শেরিফ ডিপার্টমেন্টে মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি সরিয়ে কিছু কিছু যেসব আধুনিক জিনিস ঢোকানো হচ্ছে, এই ফোনটা তার একটা।

পুরানো বন্ধু অস্টারিয়ান লাইটনিং অবজারভেটরির প্রোজেক্ট ডিরেক্টর হোমার বেলের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। গতরাতের বিদ্যুৎ-ঝড় সম্পর্কে শেরিফকে বিস্তারিত জানাচ্ছেন বেল।

 হুঁ-হাঁ করে করে বেলের কথার জবাব দিচ্ছেন শেরিফ। এই সময় একটা খয়েরি রঙের সীডান গাড়ি এসে থামতে দেখলেন।

ফ্যাক্স করে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিতে পারবে? গোয়েন্দাদের দিকে চোখ রেখে ফোনে বললেন শেরিফ। পারলে এখনই পাঠাও। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, হোমার। রাখি?

সুইচ টিপে লাইন কেটে যন্ত্রটা পকেটে রেখে দিলেন শেরিফ। কাত হয়ে আরেকটা মরা গরুর পাশ কাটিয়ে গাড়িটার দিকে এগোলেন।

গাড়ি থেকে নেমে আসছে তিন গোয়েন্দা।

আরও একটা গরুর পাশ কাটালেন শেরিফ। মাছি ভনভন করছে এটার  ওপর।

ছেলেগুলোর মুখোমুখি হতে অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি। এরকম ঝামেলায় আর জীবনে জড়াননি। হিলটাউনে অপরাধ খুব কম হয়। মাঝেসাঝে দুচারটে মাতলামি, ঠগবাজি আর ছিঁচকে চুরির ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটে না। বড় বড় চুরি-ডাকাতি ঘটার মত সম্পদ নেই শহরটাতে।

ঢাল বেয়ে উঠে আসতে আসতে ওপর দিকে তাকাল কিশোর। কোমরে হাত দিয়ে ওদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন শেরিফ। এমন ভঙ্গি করে আছেন কেন? অস্বস্তি বোধ করছেন নাকি?

এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল কিশোর।

 শেরিফ বললেন, খবর তাহলে পেয়ে গেছ?

হেসে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কি দেখলেন? বজ্রপাতেই মারা গেছে?

কেন, অন্য কিছু আশা করেছিলে নাকি?

পত্রিকাওলারা তো বজ্রপাতে মারা যাওয়ার কথাই লিখেছে, ঘুরিয়ে জবাব দিল কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। আঙুল তুলে দেখালেন। পাহাড়ের ওপরের ঘাসে ঢাকা চত্বরে তিনটে গরু মরে পড়ে আছে।

এগিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখল কিশোর। প্রতিটা গরুর শরীর ঝলসে গেছে। রস মত বেরোচ্ছে। ফিরে এসে বলল, তারমানে আসল বজ্রপাতেই মারা গেছে এগুলো, বিড়বিড় করল সে। শেরিফের দিকে তাকাল, রিমোট কন্ট্রোলড নয়।

মাথা দুলিয়ে বললেন শেরিফ, তাই তো মনে হয়। অবজারভেটরির। হোমার বেলের সঙ্গে কথা বললাম এইমাত্র। ওই বনের ওপাশে মাইলখানেক দূরে ওটা।

 ফিরে তাকাল কিশোর। যেন গাছপালার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে। অবজারভেটরিটা দেখতে চায়।

বজ্রপাতের কথা কিছু বলেছে?

বলেছে। কাল রাতে বেশ কিছু বাজ পড়েছে এই পাহাড়ের ওপর। পৃথিবীর যে কোন জায়গার যে কোন বজ্রপাতের ঘটনা ধরা পড়ে ওদের যন্ত্রে। রেকর্ড থেকে যায়। বিদ্যুৎ চমকালে একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে বেতার তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয়,

শুম্যান রেজোন্যান্স বলে একে, শেরিফের মুখ থেকে কথাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বলল কিশোর। বিজ্ঞতা জাহির করে আনন্দ পেতে দিল না তাঁকে। প্রতি সেকেন্ডে আট সাইকেল। সাধারণ ট্রানজিসটর রেডিও দিয়েও ধরা। যায়।

চুপ হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছেন শেরিফ। এই ছেলেটার সঙ্গে সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে। এ ডক্টর এলিজা নয়। কখন লজ্জা দিয়ে দেবে। কে জানে!

হেসে খোঁচাটা দিয়েই দিল কিশোর, দেখলেন তো, আমি হোমওয়ার্ক ঠিকমতই করি।

হেসে ফেললেন শেরিফ। কাল রাতে যে সাধারণ বজ্রপাতেই মারা গেছে গরুগুলো, এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কারণ নেই।

তারমানে সন্দেহ আছে আপনার?

দ্বিধা করলেন শেরিফ, একটা ব্যাপারেই খটকা লাগছে–একসঙ্গে একই জায়গায় এতগুলো বাজ পড়ল কিভাবে? অবস্থা দেখে মনে হয় যেন কেউ ওগুলোকে ঠিক এখানেই পড়তে বাধ্য করেছিল!

কয়েক গজ সরে গিয়ে একটা সমতল জায়গায় দাঁড়ালেন তিনি। ঘাস ওখানে পাতলা। হাত নেড়ে ডাকলেন, এসো, দেখে যাও।

এগিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

আঙুল তুললেন শেরিফ। জুতোর খোঁচায় সরিয়ে দিলেন খানিকটা জায়গার বালি।

একসঙ্গে ঝুঁকে তাকাল মুসা, কিশোর আর রবিন।

দেখেছ? কালো একটা জিনিস পা দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন শেরিফ, বলো তো এটা কি? ভাবলেন, এটার জবাব অন্তত দিতে পারবে না। কিশোর। চোখে চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাথা তুলে হাসিমুখে তাকালেন ওর দিকে।

আরেকটু নিচু হয়ে ভাল করে দেখল কিশোর। মুখ তুলে বলল, ফুলগারাইট। তাই না?

হাসি চলে গেল শেরিফের মুখ থেকে। এটাও জানো!

নিরীহ কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, বজ্রপাতে এরকম হয় বজ্র যেখানে পড়ে, প্রচণ্ড তাপে সেখানকার বালি গলে কাচ হয়ে যায়।

মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। উ?

 হাত দিয়ে ডলে কালো জিনিসটার ওপরের বালি সরাল কিশোর।

কি করছ?

 তদন্ত।

একটা মুহূর্ত চুপ করে রইলেন শেরিফ। তারপর বললেন, কিরতে থাকো। তবে এখানে নতুন আর কিছু পাবে বলে মনে হয় না। আমি যাই। আমার কাজ আছে।

বলে আর দাঁড়ালেন না তিনি। লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন নিজের গাড়ির দিকে।

বসে পড়ল কিশোর। কালো জিনিসটার একপাশে আঙুল ঢুকিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগল।

কি করছ? শেরিফের প্রশ্নটাই করল আবার রবিন।

সূত্র খুঁজছি?

 কিসের?

এখনও শিওর নই। দেখি আগে।

আর কিছু বলল না রবিন। মুসাও চুপচাপ দেখছে।

কালো, শক্ত কাচটা টেনে তুলতে গিয়ে খানিকটা ভেঙে ফেলল কিশোর। হাতে নিয়ে লেগে থাকা বালির কণা সরিয়ে চোখের সামনে এনে দেখতে লাগল। তারপর বাড়িয়ে দিল দুই সহকারীর দিকে, দেখো এখন। বজ্রপাতে বালি গলে কাচ হয়, এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু কাচের মধ্যে মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে, এটা কোন সত্য?

 খাইছে! বলো কি? ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি? ভয়ে ভয়ে কাচটার দিকে তাকাল মুসা। হাতে নেয়ার সাহস করল না।

 কিন্তু রবিনের ওসব ভয় তেমন নেই। কাচটা নিয়ে দেখতে লাগল। কালো, পুরু কাচের মধ্যে সত্যিই একটা জুতোর ছাপ। জুতোর তলার সামনের অংশ। পুরোটাই পড়েছিল। পেছনটা রয়ে গেছে মাটিতে গেঁথে থাকা কাচের ভাঙা অংশে।

বিশ্বাস করতে পারছে না। হাত দিয়ে ডলে সরিয়ে দিতে চাইল ছাপটা। বুঝতে চাইল, সত্যি ছাপ, না কাচের গায়ে পড়া আলোর কারসাজি।

নাহ্, সত্যিই ছাপ! কোন সন্দেহই নেই আর তাতে।

এক কাজ করো না কেন? সহকারীদের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। এটা নিয়ে কোন ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে চলে যাও পরীক্ষা করানোর জন্যে।

তুমি কি করবে?

বনের দিকে মুখ ফেরাল সে, অবজারভেটরিতে যাব।

.

০৭.

হিলটাউনের বজ্রপাত সম্পর্কে কিছু বলুন, স্যার, অনুরোধ করল কিশোর।

তেমন কিছু বলার নেই। সারা বছরই বজ্রপাত ঘটে এখানে। সময় অসময় নেই।

অস্টাডোরিয়ান লাইটনিং অবজারভেটরির পরিচালক ডক্টর হোমার বেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে কিশোর। পাহাড়ের ঢালে ওক বনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বিরাট বিল্ডিংটা। যেন বাইরের কেউ দেখে ফেললে কি জানি কি ক্ষতি হয়ে যাবে। চ্যাপ্টা, লম্বা বাড়িটার ছাতে রেডার অ্যান্টেনা আর মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সমিটারের মিলিত চেহারার একটা যন্ত্র। বসানো। পুরো ছাতে খাড়া করে বসানো সারি সারি লাইটনিং রড।

ভেতরে বড় একটা সাজানো গোছানো ঘরে আলোকিত ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে শো করছে বিদ্যুতের ইতিহাস। যে কোন স্কুলছাত্র বিপুল আগ্রহ নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে ঘরটার দিকে। তবে দেখার জন্যে ওদের যে ঢুকতে দেয়া হয় না, অনুমান করে নিয়েছে কিশোর। শেরিফ রবার্টসন সাহায্য না করলে সে নিজেও ঢুকতে পারত না।

 ধূসর হয়ে আসা চুলদাড়ির ফাঁক দিয়ে হাসি দেখা গেল ডক্টর বেলের। ঠোঁটে। সব সময় এখানকার আকাশে মেঘ জমে, মেঘের ফাঁকে বিদ্যুৎ চমকায়, শোনা যায় বজ্রের গুড়ুগুড়ু।

এর কারণ কি, স্যার?

ভুরু উঁচু করলেন বেল। সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি আমরা। এত বেশি জমে কেন এখানে?

স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল কিশোর। ছাতের কোন জায়গা বাদ দেয়া হয়নি। এমনকি স্কাইলাইটেও বসানো হয়েছে। লাইটনিং রড। কাচের ভেতর দিয়ে ছাতের বিরাট কিস্তৃত যন্ত্রগুলো চোখে পড়ছে।

এই রড বসানোর আসলেই কি কোন দরকার ছিল?

বজুকে বিশ্বাস নেই। কখন যে কোথায় গিয়ে পড়বে কেউ জানে না। যত বেশি রড লাগানো যাবে, ওগুলোর আকর্ষণে তত বেশি ছুটে আসবে। বজ্র। কেন ওগুলো ছুটে আসে, জানা সহজ হবে। কেউ কেউ জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করে একে। বলে, বজ্রের মন আছে, চিন্তা করার ক্ষমতা আছে।

ডিসপ্লের সামনে পায়চারি শুরু করলেন ডক্টর। তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে নানা প্রশ্ন করতে লাগল কিশোর। নোটবুকে টুকে নিল। ডিসপ্লেতে। নানা ধরনের বজ্রের কথা লেখা আছে। মনোযোগ দিয়ে পড়ল সেগুলো।

নানা রকম যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে টেসলা কয়েল। বাতাস থেকে বিদ্যুৎ শুষে নেয়। আরেকটা আছে জ্যাকবৃস্ ল্যাডার। সমান্তরাল দুটো দণ্ডের একটা আরেকটাকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত নীল বিদ্যুৎ ছুঁড়ে দিচ্ছে। এরকম একটা গবেষণাগারের পরিচালক হওয়ার জন্যে গর্ব বোধ করবেন যে কোন বজ্র বিজ্ঞানী। ডক্টর বেলও তাই করছেন।

ছাতের ওই যন্ত্রটা দিয়ে কি হয়, স্যার? জানতে চাইল কিশোর।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জবাব দিলেন ডক্টর, কেমিক্যাল স্টোরেজ। ওয়েট সেল।

রীতিমত অবাক হলো কিশোর। মানে ব্যাটারি?

আঙুল তুলে ঘরের চারপাশটা দেখালেন ডক্টর। এখানকার সমস্ত যন্ত্রপাতি বস্ত্র থেকে শক্তি আহরণ করে চলে, কিশোর। ছাতের রডগুলোতে আঘাত হানে বজ্র। তাকে ধরে ফেলি আমরা। শক্তিটাকে জমিয়ে রেখে কাজে লাগাই। ধরার ব্যবস্থাটা এখনও নিখুঁত করতে পারিনি। তবে আশা করছি, করে ফেলতে পারব।

তার মানে আকাশের যে কোনখান থেকে বুকে টেনে আনার ব্যবস্থা করেছেন আপনারা। যদি কোন কারণে আপনাদের লাইটনিং রডে আঘাত না হানে বজ্র? অন্য কোনখানে গিয়ে পড়ে, তখন? মানে, আমি বলতে চাইছি, স্যার, অ্যাক্সিডেন্ট তো ঘটতেই পারে, তাই না?

প্রশ্ন শুনে আস্তে করে ডিসপ্লের দিক থেকে কিশোরের দিকে ঘুরলেন। ডক্টর। কিশোরের আপাদমস্তক দেখতে দেখতে চেহারায় ভাবের পরিবর্তন ঘটল।

দেখো, লোকে মনে করে আমরা এখানে বসে বজ্র তৈরি করি। যন্ত্রপাতিগুলোর সাহায্যে আকাশে মেঘ জমাই, সেটা থেকে বজ্র.. শান্তকণ্ঠে বললেন তিনি। কিন্তু আমরা সেটা করি না। আকাশে আপনাআপনি মেঘ জমে, বজ্র তৈরি হয়, আমরা সেটা নিয়ে গবেষণা করি মাত্র। বজ্রপাতে শুধু হিলটাউনেই নয়, সারা পৃথিবীতেই মানুষ মারা যায়। তাদের মৃত্যুর জন্যে যেমন আমরা দায়ী নই, হিলটাউনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর জন্যেও আমরা দায়ী নই। আমাদের অবজারভেটরি বসানোর বহু বহুকাল আগে থেকেই বজ্রপাত হত এখানে।

কিন্তু এখনকার মত এত নিশ্চয় হত না?

 থমকে দাঁড়ালেন ডক্টর বেল। ভুরু কোচকালেন। কি বলতে চাও?

 কিছু মনে করবেন না, স্যার। আমি বলতে চাইছি, আপনাদের। অবজারভেটরি কোনভাবে এখানকার আকাশে মেঘ জমানোয় সাহায্য করছে না তো? হয়তো তাতেই বজ্রপাত হচ্ছে বেশি বেশি…

মোটেও না! রেগে উঠলেন ডক্টর। বোঝা গেল, এই প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে আরও বহুবার হতে হয়েছে। হিলটাউনের আকাশে সব সময়ই মেঘ। বেশি জমত, বজ্রপাত হত বেশি, সেজন্যেই অবজারভেটরি তৈরির জন্যে বেছে নেয়া হয়েছে এই জায়গা।

সরি, স্যার। আমি কিছু ভেবে ওকথা বলিনি…

আবার পায়চারি শুরু করলেন ডক্টর। নরম হলো না ভঙ্গি।

প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়ার জন্যে বলল কিশোর, স্যার, বজ্রপাতে মারা। যাওয়া মানুষদের রেকর্ড রাখেন আপনারা?

কাধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্নটাকে যেন ঝেড়ে ফেলে দিলেন ডক্টর। না, রাখি না। আমরা শুধু কবে কোথায় কতবার বজ্রপাত ঘটল, তার রেকর্ড রাখি। মানুষ মরল কি বাচল, সে-খবরে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।

তারমানে হিলটাউনে বজ্রাহত হয়ে কতজন বেচে গেল, সেটাও নিশ্চয়। বলতে পারবেন না?

ভুরু কুঁচকে ফেললেন বেল। সেটা জানলে কি লাভ হবে তোমার?

 দেখতাম আরকি, গায়ে বাজ পড়ার পরেও বেঁচে যায়, ওরা কেমন মানুষ?

কেমন আবার। তোমার আমার মতই স্বাভাবিক মানুষ।

কোনও অসাধারণ ক্ষমতা নেই ওদের বলতে চাইছেন?

নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ডক্টর, কিশোর পাশা, অযথা সময় নষ্ট করছ তুমি আমার। আমাদের এই প্রতিষ্ঠান একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। ভুডু কিংবা ব্ল্যাক ম্যাজিকের আখড়া নয়।

একটা ব্রোঞ্জের মূর্তির দিকে তাকাল কিশোর। দেবরাজ জিউসের মূর্তি। হাতের দণ্ড থেকে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে। মিথলজি যদি বিজ্ঞান গবেষণাগারে থাকতে পারে ম্যাজিক থাকলে দোষ কি?–প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল তার। বলল, আমিও বিজ্ঞানের কথাই বলছি, স্যার। জাদুবিদ্যা নয়। জানতে চাইছি, বজ্রপাতে আহত মানুষদের মধ্যে এমন কোন পরিবর্তন ঘটে কিনা, এমন কোন ক্ষমতা জন্মায় কিনা, যেটা বিস্ময়কর, অথচ তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।

কাধ ঝাঁকালেন ডক্টর। শুন্যে দুই হাতের তালু চিত করে বললেন, ক্ষমতা জন্মায় কিনা জানি না, তবে বজ্রাহত হয়েও বেঁচে যায় কিছু কিছু মানুষ। বিদ্যুৎ সহ্য করার ক্ষমতা খুব বেশি ওদের। সব মানুষের সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা এক রকম হয় না। সহজ একটা উদাহরণ দিচ্ছি। পেটের কথাই ধরো। বাদুড়ের পোকা লাগা কাঁচা মাংস খেয়ে হজম করে ফেলতে দেখেছি– আমি অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের। তুমি-আমি কি সেসব খাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারব? যদি বা গিলি, পেটে সহ্য হবে না। ফুড পয়জনিং হয়েই মরে। যাব। মানুষের নানা রকম সহ্য ক্ষমতার এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ দেয়া যায়। তাই বলে ওদেরকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না কোনমতেই।

আমিও ঠিক এই কথাটাই জানতে চাইছি, স্যার, নিজের ধারণার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় খুশি হলো কিশোর। ওসব জিনিস গিলে হজম করতে পারাটাও একটা বিশেষ ক্ষমতা, এটা নিশ্চয় অস্বীকার করবেন না। নইলে আমি-আপনি পারি না কেন?

তা অবশ্য ঠিক। তবে ক্ষমতা না বলে একে অভ্যাস বললেই ঠিক হবে। আফ্রিকায় কিছু ওঝাকে দেখেছি, ভয়াবহ বিষাক্ত মাম্বা সাপের কামড়েও কিচ্ছু হয় না ওদের। জিজ্ঞেস করেছিলাম। প্রথমে মুখ খুলতে চাইল না। পরে বলল, ছোটবেলা থেকে, অল্প অল্প করে বিষ রক্তে ঢুকিয়ে সহ্য করতে করতে শেষে এমন সহ্যক্ষমতা জন্মেছে, কোন বিষেই আর কিছু হয় না। ঘড়ি দেখলেন ডক্টর বেল। তোমার আর কোন প্রশ্ন আছে?

না, স্যার। অনেক সময় দিলেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। চলি, গুডবাই।

দরজার দিকে পা বাড়াল কিলোর।

*

হুয়ারটন কাউন্টি বিল্ডিঙের ফরেনসিক ল্যাবরেটরির ওয়েইটিং রূমে বসে আছে মুসা আর রবিন। দুটো কারণে অপেক্ষা করছে–একটা, ফুলগারাইটের ছাঁচ শুকানোর। আরেকটা, কিশোরের আসার।

বার বার ছাঁচটার দিকে তাকাচ্ছে রবিন। টিপে দেখছে শক্ত হলো কিনা। মুসার দিকে ফিরে বলল, ভাল একটা সূত্র পাওয়া গেল।

তা তো গেল, মুসা বলল। কিন্তু এই সূত্র ধরে এগোনোর উপায়টা কি?

ঘরে ঢুকল কিশোর।

ফুলগারাইটের স্তর থেকে আস্তে করে ছাঁচটা টেনে খুলে আনল রবিন। চমৎকার একটা নকল তৈরি হয়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আধখানা জুতোর ছাপ। কিশোরকে দেখিয়ে বলল, অনেক তথ্য জমা হয়ে আছে এখানে, কি বলো?

একটা ব্রাশ দিয়ে ছাঁচের গায়ে লেগে থাকা আলগা প্লাস্টিক আর বালির কণা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলল, দেখে মনে হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড মিলিটারি বুট। সাড়ে আট নম্বর।

ভুরু কোঁচকাল কিশোর। বিরাট পা।

কার, কিছু অনুমান করতে পারছ?

 কিশোর জবাব দেবার আগেই মুসা বলল, বিলি ফক্স?

সেই সম্ভাবনাই বেশি, কিশোর বলল। এখনই গিয়ে ওর জুতো পরীক্ষা করা দরকার।

.

০৮.

মহাসড়কের মাঝখানে একটা চৌরাস্তা। চারকোনাতেই ট্র্যাফিক লাইট আছে। গত কয়েক মাস ধরে অতিরিক্ত অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে এখানে। কারণটা বুঝতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। মহাসড়কে সাধারণত একটানা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে হঠাৎ ট্রাফিকপোস্টে লাল আলো জ্বলতে দেখলে থামতে চায় না। চালকেরা, কিংবা থামতে গড়িমসি করে। সেকারণে দুর্ঘটনা ঘটে অনেক সময়। কিন্তু এ হারে নয়।

সেদিনকার বিষণ্ণ, নিরানন্দ দিনটিতে দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছে চৌরাস্তার দিকে। বাদামী ক্রাইসলার গাড়িটা দূর থেকেই সবুজ আলো দেখেছে। গতি না কমিয়ে ছুটতে থাকল। অন্য রাস্তা ধরে আসা নীল ইমপালাটাও সবুজ আলো দেখে গতি কমাল না। দুটো গাড়ির একজন চালকও লক্ষ করল না-করার কথাও নয়–চারটে পোস্টের সবুজ বাতিই একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে।

তীব্র গতিতে চৌরাস্তার দিকে ছুটে গেল দুটো গাড়ি। পরক্ষণে নীরবতা খাখা হয়ে গেল টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে। সাই সাই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একে অন্যের পথ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল।

বেঁচে গেল নেহাত ভাগ্যের জোরে। প্রায় গায়ে গা ছুঁয়ে পাশ কাটাল। একটা আরেকটার।

অই, পাগলের বাচ্চা পাগল! গাল দিল এক ড্রাইভার।

বাপের রাস্তা পেয়েছে? বলল আরেকজন।

দুই চালক খেঁকিয়ে উঠে যেন গায়ের ঝাল মেটাতে গাড়ি ছোটাল আরও জোরে।

আপনমনে হাসল বিলি ফক্স। একটা পরিত্যক্ত বাড়ির ছাতে উঠে ছাতের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এই লাল আর সবুজ আলোর খেলাটা ভিডিও গেমের চেয়ে তার কাছে অনেক বেশি মজার। মানুষকে ভড়কে দিতে পেরে। আনন্দ পায় সে। যাদের চমকে দিচ্ছে তারা প্রায় সবাই পরিচিত বলে মজাটা আরও বেশি।

সব মানুষকেই ভড়কে দিতে চায় না বিলি। যারা শত্রু, শুধু তাদের। ভয় দেখায় ওই সব সহপাঠীদের যারা ওকে নর্দমার কীট মনে করে। ওই সব দোকানদারদের, সে দোকানে ঢুকলেই যারা সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকায়। ওই সব শহরবাসীদের যারা তার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকায়, পেছনে আজেবাজে কথা বলে। ওদের কাউকেই ছাড়তে রাজি নয় সে। সুযোগ পেলেই ভোগাবে, এটা তার স্থির সিদ্ধান্ত। ভিডিও আর্কেডে পিজ্জাওলাটার হৃৎপিণ্ড কাবাব বানিয়েছে। একটা মথকে আগুনে পুড়তে দেখলে যতখানি দুঃখ হবে, সেটুকুও নেই তার জন্যে। সামান্যতম অনুশোচনা নেই।

গাড়ি দুটো কোনমতে বেঁচে চলে যাওয়ার পর অপেক্ষা করে বসে আছে সে, এই সময় পটেটোকে আসতে দেখল।

বাড়ির কাছে এসে ওপরে তাকিয়ে বিলি আছে কিনা দেখল পটেটো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে শুরু করল ওপরে।

জায়গাটা খুব পছন্দ বিলির। চারপাশে বহুদূর চোখে পড়ে। অনেক কিছু দেখা যায়। নিরিবিলি বসা যায়। তার নতুন আবিষ্কৃত এই খেলাটা এখানে বসার আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে আরও দুটো গাড়ি আসতে দেখল বিলি। নতুন মডেলের গাড়ি। নিশ্চয় অ্যান্টিলক ব্রেক। এ ধরনের ব্রেক কতটা কাজের পরখ। করে দেখা যাক, ভাবল সে।

পটেটো এসে বসল তার পাশে। কি খবর, দোস্ত? কি করছ?

কিছু না, রাস্তার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল বিলি।

কিছু তো একটা করছই।

জবাব দিল না বিলি। চৌরাস্তার দিকে তাকিয়ে একটা মাইন্ড-পালস ছাড়ল। মনের জোরে ঘটনা ঘটানোর ব্যাপারটার নাম দিয়েছে সে মাইন্ড পালস। এরই সাহায্যে ট্র্যাফিক লাইটের লাল আলোকে সবুজ করে দেয় সে, সবুজ আলোকে লাল। দুদিক থেকে যে দুটো গাড়ি আসছে তার একটা জীপ, আরেকটা মিনিভ্যান। সবুজ আলো দেখে গতি কমাল না কেউ। একেবারে কাছাকাছি হওয়ার আগে কেউই বুঝতে পারল না যে অন্যজন গতি কমাবে না। সবুজ আলো দেখেছে দুজনেই, কমাবে কেন? একেবারে শেষ মুহূর্তে ব্রেক চেপে থেমে দাঁড়াল গাড়ি দুটো। বোঝা গেল কাজের জিনিস অ্যান্টিক ব্রেক।

বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে, পটেটো বলল। এটা শহর না ইঁদুরের গর্ত! বেরোনো উচিত আমাদের। আর ভাল্লাগছে না এখানে। চলো, লাস ভেগাসে চলে যাই। ধ্বংস করার… হেসে ফেলল পটেটো। তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, মানে, আমি বলতে চাইছি, খেলার অনেক নতুন জিনিস পেয়ে যাবে ওখানে।

মাথা নাড়ল বিলি। লাস ভেগাসে যাচ্ছি না আমি। কোথাও যাব না মিলিকে ফেলে।

মিলির নাম উচ্চারণ করতেও ভাল লাগে তার। মনটা আনন্দে ভরে যায়।

মিলি, মিলি বলে বার বার চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়।

বিলির দিকে তাকাল পটেটো। চোখ ঘুরিয়ে বলল, কি করে ভাবলে বললেই ও তোমার সঙ্গে চলে যাবে? স্কুলে ও তোমার দিকে তাকায় না। কথা বলে না।

কথাটা ঠিক। এ নিয়ে অনেক ভেবেছে বিলি। হতে পারে, স্কুলে অন্য কারও সামনে তার দিকে তাকাতে লজ্জা পায় মিলি। কত ধরনের লাজুক মেয়ে থাকে না। মিলিও হয়তো তেমনি। তার মানে এই নয় মিলি ওকে ভালবাসে না। অন্য কেউ সামনে না থাকলে তো কথা বলে। বলবে না-ই বা কেন? বিলি খারাপটা কিসে? স্বাস্থ্য ভাল না। ও অনেকেরই থাকে না। গরীব। সে তো পৃথিবীর বেশির ভাগ লোকই। কিন্তু তার মত অসাধারণ ক্ষমতা আর হকার আছে? এই ক্ষমতা ঠিকমত ব্যবহার করতে পারলে কোটিপতি হতে বেশিদিন লাগবে না।

স্কুলের কথা বাদ দাও, বিলি বলল। ওকে বোঝানো দরকার যে আমি ওকে ভালবাসি।

কি করে?

 চৌরাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল বিলি। কি করে মন জয় করা যায় মিলির? কি করে বোঝানো যায় সে একজন যোগ্য লোক? গাড়ির দিকে মন নেই আর তার। ট্রাফিক লাইটের দিকে তাকাচ্ছে না। বিড়বিড় করছে, ওকে বোঝাতে হবে ওকে আমি কতটা ভালবাসি। ওর কথা ছাড়া। আর কিচ্ছু ভাবি না আমি।

পটেটো প্রশ্নটা করায় খুশিই হলো বিলি। কি করে মিলিকে তার প্রতি আকৃষ্ট করা যায়, এই ভাবনাটা জোরাল হলো তার মনে।

পটেটোর প্রথম প্রশ্নটার জবাব এখনও দিতে পারেনি বিলি, আরেকটা প্রশ্ন তার পাতে তুলে দিল পটেটো, জনাব মজনু সাহেব, আরও একটা কথা–মিলি তোমার বসের মেয়ে। সেকথাটা ভুলে যেয়ো না।

পা তুলে হাঁটু ভাজ করে বসল বিলি। দুই হাত দিয়ে বুকের ওপর চেপে ধরল দুই পা। সেটা কোন সমস্যাই না।

কেন, সমস্যা নয় কেন?

ওটার ব্যবস্থা আমি করে ফেলতে পারব, কাঁধ ঝাঁকাল বিলি। দিলাম নাহয় ওর মনটাও ধ্বংস করে।

বিলির কথা ঠিক বুঝতে পারল না পটেটো। ওর মন? ও তোমার বস, বিলি…

মরে গেলেই ও আর আমার বস থাকবে না, খারাপ কথাটা এরকম করে বলতে চাইল না বিলি। কিন্তু পটোটোকে নিয়ে সমস্যা হলো ভেঙে না বললে ও কিছু বুঝতে পারে না। মন থাকে হৃৎপিণ্ডে। ওটা কাবাব বানিয়ে দেব। যাবে নষ্ট হয়ে। নিজের রসিকতায় মজা পেয়ে নিজেই হেসে উঠল।

আঁতকে উঠল পটেটো। পাগল নাকি! খবরদার, ওই টিকটিকিগুলোর কথা ভুলো না। ওদের ছোট করে দেখলে ভুল করবে। বিশেষ করে কোঁকড়াচুলোটাকে। ওর চোখ দেখেছ? চোখের দিকে তাকালেই ভয় লাগে। মনের ভেতর কি আছে সব যেন দেখতে পায়। মিস্টার হাওয়ার্ডের ক্ষতি করতে যাওয়া তোমার ঠিক হবে না, বিলি। আরেকটা কথা ভেবেছ? ওর। মেয়ে যদি বুঝে ফেলে তুমি ওর বাপকে খুন করেছ, কোনদিন আর ভালবাসবে? চরম ঘৃণা করবে তখন। বরং, অন্য কোনভাবে মিলির মন জয়। করার চেষ্টা চালাও।

ঠিক কথাই বলেছে পটেটো। কিন্তু কোন কিছু নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা করতে ভাল লাগে না বিলির। ঝট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শেষ করে ফেলাই ওর পছন্দ। দেরি সহ্য হয় না। তবু এক্ষেত্রে চিন্তা এবং সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।

মিলি সুন্দরী, পটেটো বলল, তা ছাড়া ধনীর একমাত্র কন্যা। ওর মত মেয়ে কোন গুণধর লোককেই বিয়ে করতে চাইবে।

পটেটোর চোখের দিকে তাকাল বিলি, আমার গুণ আছে।

চোখ সরিয়ে নিল পটেটো, হ্যাঁ, তা আছে।

দূরে পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে একটা বড় ট্রাককে নেমে আসতে দেখা গেল। অন্যদিকে হিলটাউন পাস ধরে ছুটে আসছে একটা সাদা ফোর্ড গাড়ি।

বেশ, বিলি বলল, কতটা গুণ আর যোগ্যতা আমার আছে, মিলিকে দেখাব আমি।

মুখ ফেরাল পটেটো। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল বিলির দিকে। কি করে দেখাবে? গলা কাঁপছে ওর।

হাসল বিলি। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে এখনও তোমার পুরোপুরি ধারণা নেই, পটেটো। অনেক কিছু করতে পারি আমি। রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে চোখ ফেরাল সে। খেলাটা এখন আর খেলা নেই ওর কাছে, জরুরী কাজ হয়ে উঠেছে। ওর পরিকল্পনার একটা অংশ। একটা সাংঘাতিক পরীক্ষা। ভাবতে গিয়ে হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। এ পরীক্ষায় জয়ী হতে পারলে A+ দেয়া উচিত তাকে, ভাবল সে।

 মিলিও তখন বুঝে যাবে ওর ক্ষমতা। ওর যোগ্যতার প্রমাণ পাবে। ওর। প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে।

কাছাকাছি চলে এসেছে দুটো গাড়ি। ট্র্যাফিক লাইটের দিকে মন ফেরাল বিলি। মগজের কোন এক রন্ত্রে যেন নাড়ীর স্পন্দনের মত টিকটিক করে বাজতে শুরু করল একটা বিশেষ শক্তি। স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। অনুভব করতে পারছে। মাইন্ড-পালসকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছাশক্তির জোরে বিদ্যুৎ সঙ্কেত পাঠিয়ে দুদিকের লাল আলোকে সবুজ করে দিল। গুনতে শুরু করল: এক…দুই…তিন…

ধ্রাম!

প্রচণ্ড শব্দ। সাদা গাড়িটার পেটে গুলো মেরেছে ট্রাক। ডিগবাজি খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে পথের পাশের খাদে গিয়ে পড়ল গাড়িটা। ট্রাকের ড্রাইভারও নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এলোপাতাড়ি ছুটছে। ঝাঁকি লেগে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল ওতে বোঝাই বাঁধাকপি। একটা টেলিফোন পোস্টে তো খেয়ে অবশেষে থামল ওটা।

হেসে উঠল বিলি। আহ, কি খেলটাই না দেখাল! পায়ের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল সে। উঠে দাঁড়াল। সত্যি দারুণ! এমনটা সচরাচর দেখা যায় না!

জোর করে হাসল পটেটো। না হাসলে যদি আবার বিলি রেগে যায়। কিন্তু খুশি মনে হলো না ওকে।

ওর বাহুতে থাবা মারল বিলি, কি ব্যাপার, খুশি না নাকি? দেখো, দেখে যাও। এমন খেলা পয়সা দিয়েও পাবে না।

জবাব দিল না পটেটো।

চলো, পটেটোর হাত ধরে টান দিল বিলি। কাছে গিয়ে দেখি।

০৯.

বিলিদের আগাছাভরা পুরানো চত্বরে বড়ই বেমানান লাগছে তিন গোয়েন্দার ভাড়া করে আনা চকচকে নতুন গাড়িটা।

টোকা দিতে দরজা খুলে দিলেন বিলির মা। ঘরে নিয়ে গেলেন তিন গোয়েন্দাকে। ওদের অনুরোধে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন বাড়ির ভেতরটা। হলের শেষপ্রান্তের একটা পুরানো দরজা ধরে টান দিলেন। ক্যাচকোচ করে প্রতিবাদ জানাল মরচে পড়া কজা। বিলির ঘরের বদ্ধ বাতাসের ভাপসা গন্ধ গোয়েন্দাদের নাকে এসে ধাক্কা মারল যেন।

আমার ছেলের স্বভাব ভাল না, মা বললেন, আমি নিজেই স্বীকার করছি সেটা। যে কারণে অনেকেই ওকে দেখতে পারে না। কিন্তু কারও ক্ষতি করার একটা পিঁপড়ে মারারও ক্ষমতা নেই ওর। কি করেছে ও?

দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। ইঙ্গিতে চেপে যেতে বলল ওদের। বিলির মায়ের দিকে ফিরে বলল, এঘরে কয়েকটা মিনিট আমরা একা থাকতে চাই, মিসেস ফক্স। কোন অসুবিধে আছে?

ঘর থেকে পিছিয়ে বেরিয়ে গেলেন বিলির মা। আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর। যত আস্তেই লাগাক, কজার প্রতিবাদ বন্ধ করতে পারল না।

বাড়ির বাকি ঘরগুলোও শোচনীয়, তবে এটার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। নরক বানিয়ে রেখেছে বিলি। দিনের বেলাতেও অন্ধকার। জানালার সমস্ত পর্দা, টেনে দেয়া। বাতাস চলাচল করতে পারে না বলে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। ভাপসা গন্ধের মধ্যে শ্বাস নেয়া কঠিন। বিছানাটা অগোছাল। মেঝেতে ছিটানো বহুকালের অধোয়া ময়লা কাপড়-চোপড়। যেখানে সেখানে ফেলে রেখেছে মোটর গাড়ির বাতিল যন্ত্রাংশ। ছাত আর দেয়ালের হেন জায়গা নেই, যেখানে গাড়ির ছবি আর ভিডিও গেমের পোস্টার লাগায়নি। বড় একটা ফিশ অ্যাকোয়ারিয়ামও দেখা গেল। তবে ওটা বিলির কিনা বোঝা গেল না। বহু আগেই শুকিয়ে গেছে। শ্যাওলা শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়ে লেগে রয়েছে। নোংরা কাচের দেয়াল আর তলার পাথরে। মাছের চিহ্নও নেই।

পোস্টারগুলোর ওপরে আবার বিভিন্ন ম্যাগাজিন থেকে ছবি কেটে নিয়ে লাগিয়েছে বিলি। বিখ্যাত সব খেলোয়াড়, গায়ক, মডেল আর অভিনেতার ছবি, যাদের সঙ্গে কোনকালে দেখা হয়নি ওর। ওগুলোর পাশে সাটানো ছোট একটা সাদাকালো ছবি দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোরের। একটা মেয়ে। মডেলগুলোর চেয়ে কম সুন্দরী নয়। বয়েস খুবই কম। কিশোরীই বলা চলে। নিষ্পাপ চাহনি।

বিলির আলমারি খুঁজতে লাগল মুসা আর রবিন।

আজেবাজে জিনিসের মধ্যে ঘাটতে ঘাটতে একটা ছেঁড়া জুতো পেয়ে গেল মুসা। বের করে দেখাল। কিশোর, দেখো, সাইজটা বোধহয় ঠিকই আছে।

সাড়ে আট?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

শুধু এতেই প্রমাণ হয় না লেসলি কার্টারিসকে খুন করেছে সে, রবিন বলল।

জবাব না দিয়ে আবার ছবিটার দিকে ফিরল কিশোর।

পেলে কিছু ওর মধ্যে? ছবিটা দেখিয়ে জানতে চাইল রবিন।

বুঝতে পারছি না, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। তবে মনে হচ্ছে কোন বৈশিষ্ট্য আছে।

কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন।

আরও জুতো পাওয়া যায় কিনা খুঁজছে মুসা।

ছবিটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রবিন, মেয়েটা কে?

জানি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোরও তাকিয়ে আছে ওটার দিকে। মনে হচ্ছে কোন বর্ষপঞ্জি থেকে কেটে নেয়া।

ঘুরে দাঁড়াল মুসা। আলমারি থেকে একটা বর্ষপঞ্জি বের করে দেখিয়ে বলল, এটা থেকে নেয়নি তো?

কোন পাতা থেকে ছবিটা কাটা হয়েছে, বের করতে সময় লাগল না। যে পাতায় ছবিটা ছিল, সেখানে চারকোনা কাটা। নিচে একটা নাম।

মিলি হাওয়ার্ড, পড়ল রবিন।

হাওয়ার্ড! চোখের পাতা সরু করে ফেলল কিশোর। পরিচিত লাগছে না!

*

টো ট্রাকে বসে কফি খাচ্ছেন জোসেফ হাওয়ার্ড, এই সময় ফোন এল। দুই ঢোকে বাকি কফিটুকু শেষ করে কাগজের কাপটা ছুঁড়ে ফেললেন বাইরে। এঞ্জিন চালু করে গিয়ার দিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘোরালেন। ছুটলেন হিলটাউন পাসে।

গত দুই মাসে কতবার যে তিনি এখানে এসেছেন, হিসেব নেই আর। চৌরাস্তায় অতিরিক্ত অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে ইদানীং। বহুবার আসতে হয়েছে তাকে এখানে, দোমড়ানো গাড়ি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ব্যাপারটা খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে তার কাছে। বিশেষজ্ঞ ডেকে এনে চৌরাস্তার ট্র্যাফিক লাইটগুলো পরীক্ষা করে জানা দরকার, সমস্যাটা কোথায়? কাউন্টি প্ল্যানিং কমিশনে চিঠি লেখার কথাও ভেবেছেন তিনি।

তবে আজ আর ওসব কথা ভাবছেন না। আনমনে গাড়ি চালাতে চালাতে বরং ভাবছেন ছেলেটার কথা। বিলি ফক্স। গতকাল লাঞ্চের সময় গ্যারেজে গিয়েছিল মিলি। ওকে নার্ভাস মনে হয়েছে। আচরণে অস্থিরতা ছিল। কয়েকবার ওকে জিজ্ঞেস করার পর শুধু বিলির নামটা বলেছে। আর কিছু বলেনি।

কয়েক মাস আগে মিলির চাপাচাপিতে ছেলেটাকে কাজে নিয়েছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে একটা মায়া জন্মে গেছে ওর ওপর। পিতৃস্নেহই বলা যায়। ছেলেটার ভাঙা স্বাস্থ্য, বিষণ্ণতা, অমিশুক আচরণ এবং কাজের দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা এ সব কিছু তার প্রতি মমতা বাড়িয়ে দিয়েছে তার।

কিন্তু যত মমতাই জন্মাক, বিলি যদি তাঁর একমাত্র মেয়ের অশান্তির কারণ হয়ে থাকে, ওকে বিয়ে করা ছাড়া উপায় থাকবে না। কিন্তু কি বলে ওকে বিদেয় করবেন? কাজের ব্যাপারে কোন খুত পাওয়া যায়নি তার। কোন ছুতো দেখিয়ে বরখাস্ত করা যাবে না। মিথ্যে বলতে পারবেন না তিনি। ছেলেটাকে তিনি পছন্দ করেন, মুখের ওপর এসো না-ও বলে দিতে পারবেন না। তাহলে? আজ বিলির ছুটি। সময় আছে। পরে শান্ত মাথায় ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করা যাবে।

অ্যামবুলেন্সের পেছন পেছন চৌরাস্তায় পৌঁছলেন হাওয়ার্ড। গাড়ি থামিয়ে কাজ শুরু করার আগে চারপাশে একবার চোখ বোলালেন। গর্তে পড়ে আছে। নতুন মডেলের একটা ফোর্ড। একটা পুরানো ট্রাক টেলিফোন পোস্টে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনটা এমন করে রাস্তা জুড়ে রয়েছে, পুবদিকে। যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। গাড়ি জমে গেছে। এই শূন্যতার মাঝেও কি করে যেন ভিড় জমে গেছে কৌতূহলী দর্শকের।

পার্কিং ব্রেক টেনে দিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন হাওয়ার্ড। ট্রাকের পেছনের সরু ফাঁক দিয়ে একবারে একটামাত্র গাড়ি বেরোতে পারে। শেরিফের অফিসের একজন ডেপুটি ওখানে দাঁড়িয়ে গাড়িগুলোকে বের করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

সেদিকে এগিয়ে গেলেন হাওয়ার্ড- কি হয়েছে?

কি আর হবে, বিরক্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে জবাব দিল ডেপুটি, পোলাপানের কাণ্ড! বাপের নতুন গাড়ি পেয়েছে। নতুন লাইসেন্স পেয়েছে। চালানো শুরু করেছে বেপরোয়া। ফলে যা ঘটার ঘটেছে। গাড়ির একেবারে পেট বরাবর মেরে দিয়েছে ট্রাক।

ছেলেটার কি অবস্থা?

বাঁচবে বলে মনে হয় না।

আহহা!

বিলির ওপর নতুন করে মায়াটা বেড়ে গেল হাওয়ার্ডের। ওকে ভাগানোর চিন্তাটা মাথা থেকে আপাতত বাদ দিলেন। কিছু করার আগে ব্যাপারটা নিয়ে মিলির সঙ্গে ভালমত আলোচনা করতে হবে। বিলির কতখানি দোষ, বিবেচনা করা দরকার। এমনও হতে পারে।

বুকের বাঁ পাশে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা ভেঙে তছনছ করে দিল সমস্ত চিন্তা ভাবনা। মুখ বিকৃত করে ফেললেন। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। ব্যথা সহ্য করে কোনমতে ফুসফুসে বাতাস টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়লেন।

কি হলো? বুঝতে পারছেন না তিনি। এমন লাগছে কেন? আরেকবার দম নিলেন। বাঁ কাধটা অবশ হয়ে যাচ্ছে। এটাকেই কি বলে হার্টবার্ন? হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে? মিলির আশঙ্কাই ঠিক। অনেক দিন থেকে তাকে চর্বিওয়ালা জিনিস খেতে বারণ করে আসছে। শোনেননি। চর্বিই তার বেশি পছন্দ।

খসখসে গলায় ডেপুটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ট্রাকটা সরাব?

লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া গাড়িগুলোকে সরাতে ব্যস্ত ডেপুটি। হাওয়ার্ডের দিকে না তাকিয়েই বলল, শেরিফকে জিজ্ঞেস করুন।

ট্রাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন শেরিফ। ড্রাইভারের স্টেটমেন্ট নিচ্ছেন।

হাওয়ার্ডের বুকের ব্যথাটা কমছে না। বরং বাড়ছে। বুক ডলতে ডলতে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন। শ্বাস নিতেও কষ্ট। একবারে বাতাস টেনে ফুসফুস ভরে না ফেলে অল্প অল্প করে টানছেন।

 ফিরে তাকাতে তাঁর ওপর চোখ পড়ল ডেপুটির। কি হয়েছে, মিস্টার হাওয়ার্ড? এমন লাগছে কেন আপনাকে? অসুস্থ নাকি?

সমস্যাটা বলতে যাচ্ছিলেন হাওয়ার্ড, এই সময় ভিড়ের কিনারে একটা পরিচিত মুখ চোখে পড়ল।

বিলি ফক্স! ওকে এখানে দেখবেন ভাবেননি

একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার। মনে হলো বুকের মধ্যে ঢুকে গেছে। বিলি। ব্যথাটাকে জুলুনি থেকে আস্তে আস্তে ঠেলে ভয়াবহ যন্ত্রণার দিকে নিয়ে। যাচ্ছে। বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে আরম্ভ করল যেন তার।

বিলি কি করে তার ভেতরে ঢুকবে! এই উদ্ভট ভাবনা কেন?

অনুভূতিটা কিছুতেই যাচ্ছে না মন থেকে। হৃৎপিণ্ড খামচি দিয়ে ধরে তাকে খুন করছে ছেলেটা।

ডেপুটির দিকে ফিরে কথা বলার জন্যে মুখ খুললেন। যন্ত্রণাকাতর একটা গোঙানি বেরোল, শুধু। ব্যথার আরেকটা বর্শা এসে ঘ্যাঁচ করে বিধল যেন হৃৎপিণ্ডে। চোখের সামনে মহাসড়কটা আবছা হয়ে এল।

হাওয়ার্ডের দেহটা বাঁকা হয়ে যেতে দেখল ডেপুটি। গাড়ি সরানো বাদ। দিয়ে দৌড়ে এসে ধরে ফেলল তাঁকে।

*

ভিড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে আরও অনেকের সঙ্গে স্বরচিত বাস্তব নাটকটা দেখছে বিলি।

কি হলো, বিলি? শঙ্কিত কণ্ঠে জানতে চাইল পটেটো।

কানেই তুলল না বিলি। জবাব দিল না।

হাওয়ার্ডের হৃৎপিণ্ডটা তার বুকের খাঁচায় বেঁচে থাকার জন্যে আকুলি বিকুলি করছে। রাস্তার ওপর শুইয়ে দেয়া হয়েছে তাঁকে। চিৎকার করে। ডাক্তারদের ডাকছে ডেপুটি।

হাওয়ার্ডকে মাটিতে দেখে দৌড়ে এলেন একজন ডাক্তার।

আপনমনে হাসল বিলি। কিছুই করতে পারবে না ওরা, ভাবল সে। বোকার দল। চেষ্টাই হবে সার। কাজের কাজ কিছু হবে না।

কি হয়েছে? চিৎকার করে জানতে চাইলেন ডাক্তার।

হাওয়ার্ডের পাশ থেকে উঠে গিয়ে ডাক্তারকে জায়গা করে দিল ডেপুটি। বুঝলাম না! বেহুশ হয়ে গেলেন হঠাৎ!

ভাল করে দেখার জন্যে পাশে সরল বিলি।

পটেটোও সরে এল তার সঙ্গে সঙ্গে।

হাওয়ার্ডের গলার কাছে আঙুল চেপে ধরে নাড়ী দেখছেন ডাক্তার।

আনমনে মাথা নাড়ছে বিলি। যেন ক্রিকেট খেলায় নিজের দলকে হারতে দেখে হতাশ হয়েছে খুব।

নাড়ী তো নেই! এক সহকারীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। ডাক্তার। জলদি ব্যাগটা নিয়ে এসো!

অ্যামবুলেন্সের দিকে দৌড় দিল সহকারী।

লম্বা দম নিয়ে পা বাড়াল বিলি।

 তার হাত খামচে ধরল পটেটো।

 ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিল বিলি।

কি করছ? ফিসফিস করে বলল আতঙ্কিত পটেটো। চলো, পালাই!

ঠাণ্ডা, চিকন ঘাম ফুটেছে তার কপালে।

 কিন্তু ফিরেও তাকাল না বিলি। এগিয়ে চলল দৃঢ়পায়ে।

শার্টের বুকের কাছটা খুলে ফেলেছেন ডাক্তার। স্টেথো লাগিয়ে দেখতে শুরু করলেন। তার মুখের ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে হাওয়ার্ডের অবস্থা।

খুব খারাপ!

মুমূর্ষ বসের দিকে এগিয়ে চলেছে বিলি। কেউ লক্ষ করল না তার উপস্থিতি। কিংবা করলেও গুরুত্ব দিল না। সবাই উত্তেজিত। নানা কারণে। কার্ডিয়াক কিট নিয়ে দৌড়ে এল ডাক্তারের সহকারীরা। প্রথমজনের সঙ্গে আরও একজন এসেছে। ডাক্তার তখন হাওয়ার্ডের বুকে ম্যাসেজ করছেন। জাগিয়ে তুলতে চাইছেন নিথর হয়ে পড়া হৃৎপিণ্ডটাকে।

দ্রুতহাতে হাওয়ার্ডের শরীরে ইলেকট্রোডের তার লাগানো শুরু করল ডাক্তারের সহকারীরা। একঘেয়ে শব্দ কানে আসছে বিলির। মনিটরে দেখতে পাচ্ছে হার্টের গতিবিধির সবুজ রেখাটা। আঁকাবাকা ঢেউ তোলার বদলে স্থির হয়ে আছে।

পাম্প শুরু করলেন ডাক্তার। হৃৎপিণ্ডটাকে সতেজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন।

মেশিনের সঙ্গে যুক্ত তারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে বিলি। সিনেমায় কারও হার্ট অ্যাটাক হলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এভাবে তার লাগায়, দেখেছে সে।

কিছুতেই কিছু করতে না পেরে সহকারীর দিকে তাকালেন ডাক্তার, তিনশো জুল দাও।

দিয়েছি। চার্জ হয়ে আছে, জবাব দিল এক সহকারী।

কই, হয়নি তো।

কিন্তু আমি তো দিয়েছি…

হাঁ করে যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার এবং তার দুই সহকারী। মাটিতে পড়ে থাকা মানুষটার মতই যন্ত্রও নিথর। মৃত।

মনে মনে হাসল বিলি। যন্ত্রের ব্যাটারি শুষে নেয়া কিছুই না তার জন্যে। ট্রাফিক লাইট বদলে দেয়ার চেয়ে অনেক সহজ।

ঘটনাটা কি? কাজ করছে না কেন? অবাক হয়ে গেছেন ডাক্তার। যাও তো, আরেকটা নিয়ে এসো।

উঠে আবার অ্যামবুলেন্সের দিকে দৌড় দিল এক সহকারী। অন্যজন ডাক্তারের সঙ্গে বসে মেশিনটা চালানোর চেষ্টা করেই চলেছে।

পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল বিলি।

নড়ে উঠল হাওয়ার্ডের চোখ। তার কথা তিনি শুনতে পাবেন কিনা, বুঝবেন কিনা জানে না বিলি। বোঝার চেষ্টাও করল না। তার কাজ এখন সে করে যাবে। বিড়বিড় করে শান্ত, মোলায়েম কণ্ঠে বলল, চিন্তা করবেন না, মিস্টার হাওয়ার্ড। টিভিতে কি করে ভাল করে ওরা আমি দেখেছি।

ডান হাতের আঙুলগুলো ছড়িয়ে সামনে বাড়িয়ে ধরল দুই হাত। হাওয়ার্ডের বুকের দিকে তাক করল।

জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ এক অদ্ভুত জিনিস, ভাবল বিলি। একে নিয়ন্ত্রণ করা কি সাংঘাতিক উত্তেজনার কাজ!

মধ্যে বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ ছোটাতে শুরু করল সে। ঘুরতে ঘুরতে মগজে জমা হচ্ছে। অনুভব করতে পারছে। তীরে আছড়ে পড়ার জন্যে ছুটে চলা ঢেউয়ের মত শক্তি সঞ্চয় করছে স্ফুলিঙ্গগুলো। মগজ থেকে বের করে আনল সে। ঘাড়ে নামাল। সেখান থেকে পার করে দিতে লাগল ডান হাতে। বাহু আর আঙুল বেয়ে পৌঁছে গেল আঙুলের ডগায়। ইথারে ভর করে অদৃশ্য বিদ্যুৎ-শক্তি ঢুকে যেতে শুরু করল হাওয়ার্ডের বুকে।

চার্জ হয়ে যাচ্ছে নিথর হৃৎপিণ্ড। আচমকা ঝটকা দিয়ে ধনুকের মত পেছনে বাঁকা হয়ে গেল হাওয়ার্ডের শরীর। মাটির ওপর থেকে ফুটখানেক ওপরে উঠে গেল পিঠ। ধড়াস করে পড়ল আবার।

ততক্ষণে দ্বিতীয় মেশিনটা নিয়ে এসেছে ডাক্তারের সহকারী। কিন্তু ওটার আর প্রয়োজন নেই। চালু হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ড।

মনিটরও সচল হয়ে গেছে আবার। কোন্ জাদুবলে আবার চার্জ হয়ে গেছে ওটার ব্যাটারি। সবুজ রেখাটা ঢেউ তুলতে শুরু করেছে। কানে স্টেথো লাগানোই আছে ডাক্তারের। নিখুঁত, স্পষ্ট হার্টবীট কানে বাজছে তার। সুস্থ, সবল মানুষের হৃৎপিণ্ডের মত। খানিক আগে যে মারাত্মক অ্যাটাক হয়েছিল, তার কোন লক্ষণই নেই।

অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার আর তার দুই সহকারী।

হার্ট তো চলছে! চালু হলো কি করে?,

বুঝতে পারছেন না ডাক্তার। এতক্ষণে চোখ পড়ল বিলির ওপর। খানিক দুরে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখাচোখি হতেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। সিনেমার অভিনেতাদের কায়দায় কাঁধ ঝাঁকাল। কোন ব্যাখ্যা দেয়া থেকে বিরত রইল।

হিরো হয়ে গেল সে। এমন হিরো, যাকে সবাই ভালবাসে।

ওকে নিয়ে এখন গর্ব বোধ করবে মিলি। আপন করে পাওয়ার জন্যে অস্থির হবে।

বিলির অন্তত তা-ই মনে হলো।

.

১০.

হিলটাউন কমিউনিটি হাসপাতালের নার্স স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। জোসেফ হাওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে। কিন্তু ইমার্জেন্সি বিভাগের এক কেবিনে সেই যে তাঁকে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছেন ডাক্তাররা, আর খোলার নাম নেই। দেখা করার ব্যাপারে ক্রমেই নিরাশ হয়ে পড়ছে সে।

কিন্তু সময়টা অহেতুক নষ্ট হতে দিচ্ছে না। বিলি ফক্সের মেডিক্যাল ফাইলের পাতা ওল্টাচ্ছে। প্রথমবার এসেছিল বজ্রপাতের শিকার হয়ে। রাতের বেলা। দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে, মাস পাঁচেক আগে। ঘাড়, মাথা আর পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। কয়েকদিন রাখার পর ডাক্তাররা লক্ষ করলেন প্রি-এগজিস্টিং কনডিশনে রয়েছে সে। ডাক্তারি পরিভাষায় এসে বলে অ্যাকিউট হাইপোকেলামিয়া।

একটা ধারণা রূপ নিতে শুরু করল কিশোরের মনে। মুসার দিকে তাকাল। জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। রবিনকে পাঠিয়েছে ডক্টর এলিজাকে ফোন করতে। এলিজাকে পেলে তাকে দিয়ে কমিউনিটি হাসপাতালের ডাক্তারদের ফোন করিয়ে জেনে নেবে হাওয়ার্ডের অবস্থা।

পেছনে একটা শব্দ হলো।

ফিরে তাকাল কিশোর।

হলওয়ের ওয়াটার কুলারটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মিলি হাওয়ার্ড। হাত থেকে পড়ে যাওয়া পেপার কাপটার দিকে চোখ। মেঝেতে পানি।

মোছার জন্যে নিচু হতে গেল সে।

দাঁড়াও, পা বাড়াল কিশোর, আমি মুছে দিচ্ছি।

তাড়াতাড়ি পড়ে যাওয়া কাপটা, তুলে ওয়েস্টবাস্কেটে ফেলল। একটা পেপার টাওয়েল দিয়ে মেঝের পানি মুছে আরেকটা কাপে পানি ভরে বাড়িয়ে দিল মেয়েটার দিকে।

থ্যাংক ইউ, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মিলি।

তাকিয়ে আছে কিশোর। হাওয়ার্ডের মেয়ে। একে ধরেই তাঁর কাছে যেতে হবে এখন।

মেয়েটী ভীত এবং ক্লান্ত।

 কেন?

বাবার জন্যে দুশ্চিন্তায়?

মিলি, সহানুভূতির সুরে বলল কিশোর, তোমার বাবার জন্যে আমি দুঃখিত।

থ্যাংক ইউ, আবার বলল মিলি। ভাল করে তাকাল কিশোরের দিকে। চোখে জিজ্ঞাসা।

ওকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখল না কিশোর। জানাল, আমার নাম কিশোর পাশা। সখের গোয়েন্দা। হাত নেড়ে মুসাকে ডাকল। পরিচয় করিয়ে দিল, ও আমার বন্ধু ও সহকারী, মুসা আমান। এখানকার লোক নই আমরা। রকি বীচ থেকে এসেছি।

 মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মিলি, চিনতে পেরেছি। কাল আমাদের গ্যারেজে গিয়েছিলে তোমরা।

কিশোরও মাথা ঝাঁকাল। জানি, তোমার মন এখন খুব খারাপ। তবু কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

মাথা নাড়ল মিলি। হাসি ফোঁটাল মুখে। না না, মন ঠিক হয়ে গেছে। কি জানতে চাও?

বিলি ফক্সের ব্যাপারে।

মুহূর্তে মুখের ভাব বদলে গেল মিলির। বোঝা গেল, সে অনেকই কিছুই জানে।

অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় ও গিয়েছিল, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ঝিক করে উঠল মিলির চোখ। এ দৃষ্টি কিশোরের চেনা। কোণঠাসা শিকারি জানোয়ারের চোখে দেখেছে। তারমানে মিলি জানে বিলি ফক্সই কিছু করেছে। কি করে জানল?

হ্যাঁ, গিয়েছিল। আর কিছু জানার আছে? অধৈর্য কণ্ঠে মিলি বলল, তাড়াতাড়ি করো, প্লীজ। আব্বাকে দেখতে যাব।

কিশোরকে চুপ করে ভাবতে দেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল মিলি। কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকাল একবার। তারপর ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

জানালা দিয়ে ওকে দেখতে পাচ্ছে কিশোর। বাবার বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসল। বেহুশ হয়ে আছেন হাওয়ার্ড। প্রায় ডজনখানেক মেশিনের সঙ্গে তার আর নল দিয়ে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে তার শরীর।

ওই যে, রবিন এসেছে, পেছন থেকে বলে উঠল মুসা।

ফিরে তাকাল কিশোর।

কাছে এসে দাঁড়াল রবিন। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছে এলিজা। তাজ্জব হয়ে গেছে ডাক্তাররা।

কেন?

এটা দেখলেই বুঝবে, লম্বা, সরু একটা কাগজ কিশোরের হাতে তুলে দিল রবিন। জোসেফ হাওয়ার্ডের ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম।

কাগজটার দিকে তাকাল কিশোর। লম্বা, সোজা একটা রেখা। তারপর হঠাৎ করে বেঁকে গিয়ে ছোট-বড় ত্রিকোণ তৈরি করেছে। স্বাভাবিক হার্টবীটের সঙ্কেত। মাঝে মাঝে বর্শার মত চিহ্ন রয়েছে।

 তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, এটা দেখে কি বুঝব? ডাক্তারি বুঝি না আমি।

রবিন বলল, একজন নার্স আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এই যে বর্শার মত জিনিস, এগুলো হার্ট চালু হওয়ার সময়কার… তখন কোন ধরনের বৈদ্যুতিক অনুপ্রবেশ ঘটেছিল হাওয়ার্ডের হৃৎপিণ্ডে।

তো?

ডাক্তার বলছেন ডিফাইব্রিলেটরে চার্জ ছিল না। প্যাডেলগুলো অচল ছিল।

খাইছে! বলে উঠল মুসা, গ্রীক ভাষা বলছ নাকি?

না, ডাক্তারি শব্দ। আমিও বুঝি না। আমাকে যা বলা হলো, তাই উগরে দিলাম।

মোদ্দা কথাটা কি তাই বলো? হাতের কাগজটা নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হার্ট এভাবে চালু হওয়ার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না ডাক্তাররা। মরা হার্ট হঠাৎ চালু হয়ে গেল।

মুসার দিকে তাকাল কিশোর।

 অজ্ঞতার ভঙ্গি করে হাত ওল্টাল মুসা।

আবার রবিনের দিকে ফিরল কিশোর। এবার এসো, আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। নার্স স্টেশনের ফাইল র‍্যাকের দিকে এগোল সে। বিলি ফক্সের ফাইলটা তুলে নিয়ে বাড়িয়ে দিল। নাও। দেখো। বিলি ফক্স ভর্তি হয়েছিল এ হাসপাতালে। ওর মেডিক্যাল চার্টটা দেখো…

ফাইলটা হাতে নিয়ে দ্রুত পাতা উল্টে চলল রবিন। একটা পাতার পাশে লেখা নোটে আঙুল বোলাতে বোলাতে পড়ল। থেমে গেল একটা লাইনে এসে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এ তো অদ্ভুত কথা! ব্লাড টেস্ট অ্যাকিউট হাইপোকেলামিয়া শো করছে!

মুচকি হাসল কিশোর। রবিনের চোখেও পড়ল তাহলে। পড়ে কিনা, এটাই দেখতে চেয়েছিল সে।

কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স, তাই?

হ্যাঁ।

এবং ইলেকট্রোলাইট আমাদের শরীরে বৈদ্যুতিক স্পন্দন সৃষ্টি করে।

 হ্যাঁ। হার্টের প্রতিটি বীটের সময়… চুপ হয়ে গেল রবিন। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কি বলতে চাইছ তুমি?

এটা আমার ধারণা মাত্র, রবিন। নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি নাতবু, যদি ধরে নিই, বিলির শরীরের ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স ওকে প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী করে তুলেছে? অন্যান্য বিদ্যুৎ-উৎপাদনকারী প্রাণীর মত সে-ও তার নিজের দেহে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে? অস্বাভাবিক হাই-ভোল্টেজ?,

হা করে তাকিয়ে আছে মুসা। এতটাই অবাক হয়েছে, যেন ভূত দেখতে পাচ্ছে সামনে।

কতটা হাই? অবাক রবিনও হয়েছে।

ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রামের কাগজটা নাচাল আবার কিশোর, যতটা হলে একজন মানুষের হৃৎপিণ্ড নিয়ে খেলা করতে পারে কেউ। কাবাব করতে। পারে, আবার মরাটাকে জ্যান্ত করে তুলতে পারে।

ফ্যান্টাসি, কিশোর! রূপকথা মনে হচ্ছে! মাথা নাড়তে নাড়তে রবিন বলল, মানুষের শরীর কখনও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না।

মানুষের শরীর এবং মন সম্পর্কে কখনোই শিওর হয়ে বলা যায় না কিছু। অনন্ত শক্তির অধিকারী মানুষের মন। মনের শক্তি দিয়ে কি না করতে পারে মানুষ? শরীরটাকেও মনের জোরে ইচ্ছেমত চালাতে পারে। ভারতীয় যোগীদের কথাই ধরো। কিংবা ব্যালে ড্যান্সাররা। ওরা যে সব কাণ্ড করে, আমরা জানি বলে এখন আর অবাক লাগে না। হঠাৎ করে দেখলে কি বিশ্বাস করতে পারতাম? সবচেয়ে বড় কথা, অন্য প্রাণী যে কাজটা করতে পারে, মানুষ কেন সেটা করতে পারবে না? কেন নিজের দেহে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে না?

পারবে, যদি তার শরীরে ওই প্রাণীদের মত বিশেষ যন্ত্রগুলো থাকে।

হ্যাঁ, যদি থাকে। উত্তেজিত ভঙ্গিতে রবিনের দিকে এক পা এগোল কিশোর। কিংবা তৈরি করে দেয়া যায়!

মানে? বুঝতে পারল না রবিন।

এমন হতে পারে, রবিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি কিশোর, বিলি ফক্সের শরীর সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশি বিদ্যুৎ সহ্য করতে পারে। ফুলগারাইটে পাওয়া ওর জুতোর ছাপ আমার মাথায় এধারণাটা ঢুকিয়েছে। বজ্রপাতে লক্ষ লক্ষ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ শরীরে প্রবেশ করেছে ওর, পা বেয়ে মাটিতে নেমে গেছে। কোন ক্ষতি হয়নি ওর। লাভ হয়েছে। শরীরের বিশেষ কোষে কোষে জমা করে নিয়েছে সেই শক্তি, ব্যাটারির মত।

কি বলছ তুমি! ওকে কোন ধরনের লাইটনিং রড মনে করছ?

 শুধু রড নয়, ও নিজে একটা জেনারেটরও বটে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, এই শক্তি দানবে পরিণত করেছে তাকে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। আবার আঘাত হানার আগেই ঠেকাতে হবে এই দানবকে।

তোমার কথার মাথামুণ্ড আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কিশোর! এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে মুসা, যেন পাগল হয়ে গেছে কিশোর। সারা জীবন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছ ভূত বিশ্বাস করি বলে, এখন নিজেই…

হাসল কিশোর, ভূত আমি এখনও বিশ্বাস করি না, মুসা। এখানে যেটা ঘটছে, যা দেখতে পাচ্ছি, সেটা পিওর সায়ান্স, খাঁটি বিজ্ঞান। দেখেও অস্বীকার করি কিভাবে?

.

১১.

পাঁচ মাস আগে হঠাৎ করেই জানতে পারে বিলি, এক সাংঘাতিক ক্ষমতা তৈরি হয়েছে ওর মধ্যে।

প্রথম যেদিন বজ্রপাতের শিকার হলো, সেদিনকার কথা মনে পড়ল তার। রাত করে ভিডিও আর্কেড থেকে বাড়ি ফিরছে। মাঠের মধ্যে দিয়ে চলেছে। হঠাৎ কালো হয়ে গেল আকাশ। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো। হিলটাউনে এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। ঝড়বৃষ্টি আর বজ্রপাতের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখানকার অধিবাসীরা। তাই বিশেষ গুরুত্ব দিল না বিলি। তাড়াহুড়ো না করে স্বাভাবিক গতিতেই হেঁটে চলল বাড়ির দিকে।

বাতাস বইতে শুরু করল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। ওপর দিকে তাকাল সে। পাহাড়ের ঢালে বনের আড়ালের অবজারভেটরিটা দেখার চেষ্টা বেকরল। লোকে বলে ওটার লাইটনিং রডগুলোই যখন-তখন বিদ্যুৎ-ঝড়ের সৃষ্টি। করে এখানে। ওটা তৈরি করার আগে ঝড়বৃষ্টি হলেও এত বজ্রপাত হত না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ শহরবাসীকে বুঝিয়েছে, ওটা হওয়াতে বরং ভাল হয়েছে ওদের। লাইটনিং রডগুলো বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে, টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। লোকের মাথায় পড়ে না আর।

বৃষ্টির বেগ এতটাই বেড়ে গেল, না দৌড়ে আর পারল না বিলি। আরও আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বিদ্যুতের আলোয় দূরে চোখে পড়ছে ওদের বাড়িটা। লম্বা লম্বা ঘাস। এমনিতেই হাঁটতে বাধা দেয়। ভিজে গিয়ে অক্টোপাসের শুড় হয়ে গেল যেন। পা জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইছে কেবলই। বুটের চাপে হুস হুস শব্দ হচ্ছে। দৌড়ানো কঠিন করে তুলল বিলিল জন্যে।

চতুর্দিক আলোকিত করে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাল হঠাৎ। এতক্ষণ যেগুলো চমকেছে, তার চেয়ে আলো অনেক বেশি। পরক্ষণে বিকট শব্দ। বিলির মনে হলো আকাশটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তার নিজের মাথাটাও। শরীরে এমন তীব্র ব্যথা আর কখনও অনুভব করেনি। চিৎকার করতে চেয়েছে। মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয়নি। শরীরের সমস্ত পেশী যেন জট পাকিয়ে গিয়েছিল। চুলে আগুন ধরে গিয়েছিল।

 সাতদিন পর জ্ঞান ফিরেছিল ওর। সারা গায়ে ব্যান্ডেজ। মমি বানিয়ে ফেলা হয়েছিল দেহটাকে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিল সে। কেউ ছিল না পাশে।

প্রথমে দেখা করতে এলেন মা। এসেই শুরু করলেন বকাবকি, চিৎকার, চেঁচামেচি। বোকার মত ঝড়বৃষ্টি দেখেও মাঠের মধ্যে দিয়ে আসতে গিয়েছিল কেন সে, তার জন্যে একশো একটা কথা শোনালেন। গালাগালে তেতো হয়ে গিয়েছিল তার মন।

 পটেটোও দেখা করতে আসেনি। আসার উপায় ছিল না ওর। অসুখ হয়ে সে-ও তখন হাসপাতালে।

ছাড়া পাওয়ার একদিন আগে এসে একমুঠো রজনীগন্ধার সুবাস ছড়িয়ে যেন তার সঙ্গে দেখা করল মিলি হাওয়ার্ড। একটি কুকিজ নিয়ে এসেছিল তার জন্যে। সেই সঙ্গে একটা সুখবর। তার বাবা একজন লোক খুঁজছেন। ওদের গ্যারেজের কাজের জন্যে। বিলির কথা বলেছে মিলি। বাবা রাজী হয়ে গেছেন। আপাতত একটা বেতন ধার্য করা হয়েছে। কাজ দেখাতে পারলে ভবিষ্যতে চাকরির পদোন্নতি হবে এবং বেতনও বাড়বে।

মিলিকে ওই মুহূর্তে দেবী মনে হয়েছিল বিলির। তার অন্ধকার বিরক্তিকর জীবনে আলোর মত। তখনই ঠিক করে ফেলেছিল, ওকে সুখী করবে সে। জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে। সেটা করার জন্যে যা যা দরকার, সব করবে।

এর দুদিন পর একটা টর্চ লাইটের বাতিল ব্যাটারি বদলাতে গিয়ে নিজের ক্ষমতাটা প্রথম টের পেল বিলি। এতটাই চার্জ হয়ে গেল ব্যাটারি, টর্চের বাল সেটা সহ্য করতে না পেরে কেটে গেল। ব্যাটারিগুলো ফেটে গিয়ে অ্যাসিড গলে বেরিয়ে হাতে লাগল তার। শুরু হলো একটার পর একটা পরীক্ষা। দুই ঠোঁটে বা চেপে ধরে আলো জ্বেলে পটেটোকে অবাক করে দিল।

প্রথমে ব্যাপারটা খুব মজার মনে হয়েছে ওর কাছে।

কিন্তু এখন আর মজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জরুরী কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে অতিমাত্রায় বিপজ্জনক করে ফেলেছে সে নিজেই।

ঘরে বসে কথাগুলো ভাবছিল বিলি, এই সময় গাড়ির আওয়াজ শুনল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, তিন গোয়েন্দা নামছে গাড়ি থেকে।

*

দরজায় দাঁড়ানো গোয়েন্দাদের ফাঁকি দেয়ার জন্যে বেডরূমের জানালা দিয়ে। বেরিয়ে গেল বিলি। বিদ্যুৎ যেন প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়তে চাইছে তার ভেতরে। মাঠের ওপর দিয়ে ছুটল সে।

কিন্তু দেখে ফেলল গোয়েন্দারা।

বিলি! বিলি! ডাকতে ডাকতে দৌড়ে আসতে লাগল কিশোর। পেছনে রবিন আর মুসা।

একবার ভাবল বিলি, দৌড়ে পালায়। কিন্তু পালিয়ে কোন সুবিধে করতে পারবে না, বুঝে গেছে। বরং ওরা কি বলে শোনা যাক। ইস, মস্ত ভুল হয়ে গেছে! ঝোঁকের মাথায় হাওয়ার্ডের ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলার পর থেকেই ভাবছে সে। আরও সময় নিলে পারত। চৌরাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটানোর পর পরই ওরকম একটা কাণ্ড না ঘটিয়ে অন্য কোথাও অন্য কোন সময় কাজটা করা উচিত ছিল। তাতে ওর ওপর সন্দেহ জাগত না কারও। আরও একটা বড় ভুল হয়ে গেছে–পটেটোর সামনে এটা করা।

পটেটো ওর বন্ধু, ঠিক আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর গলার কাঁটা না হয়ে ওঠে।

মাঠের মাঝখানে এসে তাকে ধরে ফেলল তিন গোয়েন্দা। কিশোর তার হাত ধরল। ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল বিলি। দাঁত কিড়মিড় করল। রাগে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।

ধোরো না! আমাকে থোরো না! চিৎকার করে উঠল বিলি। ওখানেই তিনজনুকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে ইচ্ছে করল। তাহলে রেহাই পাবে সে। ওরা আর বিরক্ত করতে পারবে না।

কিন্তু জানে একাজ করা উচিত হবে না। এরা মরলে পুলিশ আর গোয়েন্দা বিভাগের কড়া নজর পড়ে যাবে ওর ওপর। পিলপিল করে পিঁপড়ের সারির মত আসতে আরম্ভ করবে ওরা। ওকে ধ্বংস না করে ছাড়বে না।

বিলির রাগ দেখে পিছিয়ে গেল কিশোর। ঠিক আছে, ধরব না।

আর কখনও আমাকে ছোবে না বলে দিলাম!

তোমার সঙ্গে আমাদের কথা আছে, বিলি, ওকে শান্ত করার জন্যে বলল রবিন।

 কি কথা? আমি কিছু করিনি, নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। কথাটা বিলির।

ওর মুখোমুখি দাঁড়াল কিশোর। কেউ বলছে না তুমি কিছু করেছ। আমরা ভাবলাম আমাদের কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে তুমি। সেজন্যেই এসেছি। যদি দিতে পারো, ভাল। না পারলে

লম্বা দম নিল বিলি। বেরোনোর জন্যে ছটফট করছে বিদ্যুৎ। জোর করে ঠেকিয়ে রেখেছে। জমে ওঠা শক্তিটাকে ধীরে ধীরে কমানো শুরু করল। কমাতে কমাতে ধিকিধিকি আগুনের পর্যায়ে নিয়ে এল।

বেশ, অবশেষে বলল সে, কি জানতে চাও?

*

কাউন্টি জেলের ইন্টারোগেশন রূমে বসে আছে রবিন। বিলিকে চোখ ডলতে দেখছে। খুব ক্লান্ত লাগছে ওকে। নিরীহ ভাবভঙ্গি। কেমন ভঙ্গুর। ভাবাই যায় না গোবেচারা চেহারার ওই অতি সাধারণ ছেলেটা তার রোগাটে শরীরের ভেতর থেকে ওই ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক শক্তি বের করতে পারে। বিলি একাজ। করতে পারে, এটা এখনও কেবল অনুমানের পর্যায়েই রয়েছে। কোন প্রমাণ জোগাড় করা যায়নি। সত্যি কি এতটা ক্ষমতা আছে বিলির?

মুখ তুলে তাকাল বিলি। শীতল, হিসেবি দৃষ্টি। দেখে অবিশ্বাস দূর হয়ে গেল রবিনের। হ্যাঁ, পারে। এই ছেলে ধ্বংস করতে পারে!

আর কতবার বলব, বিলি বলল, ওই লোকগুলো কিভাবে মারা গেছে আমি জানি না!

তাহলে আমাদের দেখে পালাচ্ছিলে কেন?

প্রচণ্ড জোরে টেবিলে চাপড় মারল বিলি। বার বার বলছি, ঘুরতে বেরিয়েছিলাম!

সব সময় ওরকম জানালা দিয়েই বেরোও নাকি?

ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে জ্বলে উঠল বিলির চোখ। প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, তোমাদের তো একটা মেডেল দেয়া উচিত আমাকে। আমার বসের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছি বলে।

নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল রবিন। নাহ, বড় কঠিন ঠাই। এর। পেট থেকে কথা আদায় করতে পারবে না। বার বার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে। বিলির জবাবেরও কোন পরিবর্তন নেই। জোরাল প্রমাণ না পাওয়া গেলে ওকে আর বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না।

সত্যি বাঁচিয়েছ কিনা এখনও শিওর না আমরা, বলে চেয়ার ঠেলে উঠে। দাঁড়াল রবিন।

চেয়ারে হেলান দিল বিলি। রবিনকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে। প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল সে। কেন? কেউ কি তোমাদের বলেছে কিছু? পটেটো বলেছে?

বাইরে বসে আছে একজন ডেপুটি। রবিনকে দরজা খুলে দিল।

শেষবারের মত বিলির দিকে ফিরে তাকাল রবিন। সামনে ঝুঁকে বাকা হয়ে বসেছে এখন বিলি। দুই হাতে খামচে ধরেছে টেবিলের কিনার। অসহায় লাগছে ওকে। রবিনের চোখে চোখ পড়তেই বদলে যেতে শুরু করল ভঙ্গিটা। জানোয়ারের মত জ্বলে উঠতে শুরু করল দুই চোখ-না, জানোয়ার নয়। রবিনের মনে হলো বৈদ্যুতিক বাতির মত!

বেরিয়ে এল রবিন।

 হলওয়েতে ওর সঙ্গে দেখা করল কিশোর আর মুসা। কিশোর আশা করেছিল, রবিনকে যেহেতু নিরীহ চেহারার মনে হয়, তার কাছে মুখ খুলবে। বিলি। সেজন্যেই কথা বলতে পাঠিয়েছিল। বুঝল, সুবিধে করতে পারেনি রবিন। তবু জিজ্ঞেস করল কিশোর, কি খবর?

কিছুই বলে না। বার বার একই কথা, সে একজন হিরো।

ধরে থাবড়া লাগানো দরকার। ফুঁসে উঠল মুসা।

লাগাতে গেলে তোমাকেও খতম করে দেবে, হাত নেড়ে ওকে শান্ত হতে ইশারা করল কিশোর। রবিনকে জিজ্ঞেস করল, জোসেফ হাওয়ার্ডকে কিভাবে বাঁচিয়েছে? কিছু বলল?

কিছুই না। গোপন বিদ্যা নাকি জানে সে। কোন্ এক গুরুর কাছে শিখেছে।

কোন্ গুরু?

বলবে না বলে দিয়েছে।

মাথা দোলাতে দোলাতে কিশোর বলল, হু। রবিন, আমার ধারণা পুরো ঘটনাটাই ওর সাজানো নাটক।

মানে? তুমি বলতে চাইছ হার্ট অ্যাটাকটাও ওই ঘটিয়েছে?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

 এসব ঝামেলা কেন করতে গেল?।

জানি না, আনমনে বলল কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল। তবে এমন একজনকে চিনি যে জানে।

.

১২.

হিলটাউনের সবচেয়ে দামী এলাকায় সুন্দর একটা দোতলা বাড়ির সামনে মুসাকে গাড়ি রাখতে বলল কিশোর। রবিনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ঠিকানা ঠিক আছে তো?

নোটবুক দেখে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে রবিন জানাল, হ্যাঁ, এটাই।

আসার পথে মিলির কথা রবিনকে জানিয়েছে কিশোর। হাসপাতালে ওর সঙ্গে কিভাবে দেখা হয়েছে বলেছে।

বেল বাজানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে দিল মিলি। বিশ্রাম নেয়ার জন্যে হাসপাতাল থেকে যদি বাড়ি এসে থাকে সে, সফল হয়নি সে চেষ্টা। বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বস্ত লাগছে তাকে।

তিন গোয়েন্দাকে দেখে জমে গেল যেন।

 মিলি…. শুরু করতে গেল কিশোর।

কিন্তু তাকে চুপ করিয়ে দিল মিলি। সরি। এখন কথা বলতে পারব না। হাসপাতালে রওনা হচ্ছিলাম। ভঙ্গি দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে।

বিলি ফক্সকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মিলি, মোলায়েম করে বলল কিশোর। কিছুক্ষণ আগে শেরিফকে বলে তাকে আটকানোর ব্যবস্থা। করেছি।

তাকিয়ে রইল মিলি। কিছু বলল না।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে লক্ষ করছে কিশোর। ঠিকই অনুমান করেছিল। মিলি কিছু জানে। বলতেও চায়। কিন্তু ভয় পাচ্ছে।

ভেতরে আসব? স্বর আরও নরম করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

দ্বিধা করল মিলি। তারপর সরে গিয়ে পুরো মেলে ধরল দরজা।

লিভিং রূমে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। সুন্দর করে সাজানো। দামী আসবাব, ঘর সাজানোর সরঞ্জাম, কার্পেট, টবে লাগানো গাছ আর অ্যানটিক প্রচুর আছে। তবে বাড়াবাড়ি নেই।

আমি হাই স্কুলে পড়ি, বলার মত অন্য কোন কথা যেন খুঁজে পেল না মিলি। বিলিও একই ক্লাসে পড়ে।

ওর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন তোমার? জানতে চাইল রবিন।

আমার তরফ থেকে সাদামাঠা। কিন্তু ও বোধহয় আমাকে পছন্দ করে একটু বেশিই করে। ওর জন্যে দুঃখ হয় আমার। অস্বস্তি বোধ করছে। মিলি। যেন কোন সাংঘাতিক অন্যায় কিংবা বেআইনী কাজ করে ফেলেছে বিলির পছন্দের দাম দিতে না পেরে। সহপাঠী। অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল হাসপাতালে। মায়া দেখাতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম গরীব মানুষ, লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে দুচারটে পয়সা পাক…কিন্তু…

গ্যারেজের চাকরিটা কি তুমিই তোমার বাবাকে বলে নিয়ে দিয়েছিলে নাকি? জানতে চাইল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল মিলি। হ্যাঁ। তার কয়েক দিন পর থেকেই ফোন আসতে থাকল। রিং হয়। আমি ধরলে কিছু না বলেই ছেড়ে দেয়।

কি করে বুঝলে বিলিই করত?

ভ্রূকুটি করল মিলি। আমাকে দেখলে যেভাবে গদগদ হয়ে তাকিয়ে থাকে…যা-ই হোক, বুঝতে পারতাম ঠিকই। কিশোরের দিক থেকে রবিনের দিকে ফিরল সে। মুসাকে দেখল। আবার ফিরল কিশোরের দিকে। বিলিই যে করত কোন সন্দেহ নেই আমার।

ওর কথা বিশ্বাস করল কিশোর। কিন্তু মিলির এসব কথা বিলির বিরুদ্ধে প্রমাণ নয়। এখনও এমন কিছু বলেনি সে, যেটা দিয়ে ফাসানো যায় বিলিকে।

কখন থেকে সন্দেহ করলে অঘটন ঘটাতে শুরু করেছে বিলি?

সরাসরি কিশোরের চোখের দিকে তাকাল এতক্ষণে মিলি। ও নিজেই আমাকে বলেছে।

বিস্ময়ে সামনে ঝুঁকে গেল রবিন। মানুষ খুন করেছে এ কথা বলেছে ও?

 না, তা অবশ্য বলেনি। তবে ওর নাকি ক্ষমতা আছে। ভয়ঙ্কর ক্ষমতা।

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, কবে বলেছে?

শেষ লোকটাকে খুন করার পর।

লেসলি কার্টারিসকে?

মাথা ঝাঁকিয়ে মুখ নিচু করে ফেলল মিলি। আমি ওর কথা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম আমাকে ভজানোর জন্যে গল্প করছে। কিন্তু আজ যা ঘটল মুখ তুলল সে। বুঝতে পারছি এক বর্ণও মিথ্যে বলেনি। যা বলেছে, সবই করতে পারে।

আর কাউকে বলেছ একথা?

হাসল মিলি। ছোট্ট, বিষণ্ণ হাসি। মাথা নাড়ল। কে বিশ্বাস করবে এসব আজগুবী কথা?

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

আমি এখন রীতিমত ভয় পেয়ে গেছি, মিলি বলল। আমি ওকে এড়িয়ে চলতে গেলে না জানি কি করে বসে বাবাকে করল.. আমাকে করতে কতক্ষণ? বাবাকে একবার বাঁচিয়ে রেখেছে, দ্বিতীয়বার

মুখে হাত চাপা দিল মিলি।

এগিয়ে গিয়ে সান্তনা দেয়ার ভঙ্গিতে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে রবিন। এখন আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই তোমার। তুমি এবং তোমার বাবা দুজনেই নিরাপদ। আমরা আছি।

চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারল না মিলি। কাউকে জমিয়ে রাখা কথাগুলো বলে মনের ভার লাঘব হয়েছে। ভাবসাব দেখে মনে হলো রবিনের কথা বিশ্বাস করেছে। ভরসা জন্মেছে তিন গোয়েন্দার ওপর।

*

 ফেরার পথে আলোচনা করতে করতে চলল তিন গোয়েন্দা। উপায় খুঁজতে লাগল কি করে বিলির মত একটা ভয়াবহ বিপজ্জনক এবং মারাত্মক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করানো যায়।

বিষাক্ত কেউটের চেয়েও ভয়ঙ্কর ও, কিশোর বলল। হাইভোল্ট বিদ্যুৎ। ছোঁয়া লাগলেই মৃত্যু। আমি ভাবছি, না ছুঁয়েও…

যা সব কথা শুরু করেছ না তুমি আমার জিনের আসরও এর চেয়ে কম উদ্ভট! গাড়ি চালাতে চালাতে বলল মুসা। রাস্তার দিকে নজর।

কয়েক মিনিট পর জেলখানায় পৌঁছল ওরা। যে কোন রকম অঘটন দেখার জন্যে তৈরি।

গাড়ি থেকে নেমে সবার আগে ভেতরে ঢুকল কিশোর। অজানা আশঙ্কায় অস্থির। কি দেখতে পাবে কে জানে! ডেপুটিকে দেখল টেবিলে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে। সে ছাড়া আর কেউ নেই ঘরে। তারমানে কোন ক্ষতি হয়নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল কিশোর, বিলি কোথায়?

ডেপুটি জবাব দেয়ার আগেই জানতে চাইল রবিন, অন্য কোন জেলে ট্রান্সফার করেছেন?

কিশোরের পেছন পেছন ঢুকেছে সে। মুসা রয়ে গেছে গাড়িতে।

বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি, পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।

 ফিরে তাকাল দুজনে। শেরিফ রবার্টসন।

ছেড়ে দিয়েছেন? বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।

আর কি করব? হাতের ফাইলটা নেড়ে বললেন, এটা পড়ার পর ছেড়েছি। তোমরাই তো লিখে রেখে গেছ।

ছেড়ে দেয়ার কথা লিখিনি.. রবিন বলল।

দৌড় দিল কিশোর। যেতে যেতে বলল, মিলিকে ফোন করতে যাচ্ছি।

একটা মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন শেরিফ। চোখ ফেরালেন রবিনের দিকে। ফাইলটা খুলে পড়লেন, নিজের শরীরে বিদ্যুৎ তৈরি করে সেটার সাহায্যে খুন করে সে! রবিনের দিকে তাকিয়ে চোখের পাতা সরু করে বললেন, অনুমান? না সত্যি বিশ্বাস করো একথা?

বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি রাখল রবিন। শেরিফের মতই চোখের পাতা সরু করে জবাব দিল, করি। আমাদের বিশ্বাস ওই পাঁচটা রহস্যময় খুনের জন্যে বিলিই দায়ী। আপনি ওকে ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছেন, স্যার। কি যে অঘটন ঘটাবে এখন সে-ই জানে!

শুকনো হাসি হাসলেন শেরিফ। তোমরা বলতে চাইছ বজ্র ছুঁড়ে মারতে পারে বিলি?

এটাই তো আপনার রিমোট কন্ট্রোলড ইলেকট্রিক শকের জবাব, তাই না?

গভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ, মনে হচ্ছে। তবে বিশ্বাস করতে পারছি না। ফাইলটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেললেন তিনি। বুঝতে পারছি না কি করব! তোমাদের কথা বিশ্বাস করে শেষ বয়েসে শেষে তোক হাসাব নাকি কে জানে!…অবশ্য ইয়ান ফ্লেচারের ওপর ভক্তি আছে আমার। ও যখন তোমাদের সার্টিফাই করেছে…

আপনার দ্বিধা করার কিছু নেই, স্যার। আপনিই বলেছেন বজ্রের ব্যাপারে অনেক কথাই অজ্ঞাত রয়ে গেছে। বড় বড় বিজ্ঞানীরাও সব জানেন না। আর বজ্র মানেই বিদ্যুৎ। এখানে একটা কথা, অন্য জীব যদি নিজের দেহে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে, মানুষই বা পারবে না কেন?

মুখ খুলেও আবার বন্ধ করে ফেললেন শেরিফ। প্রশ্নটা করে ওকে কোণঠাসা করে দিয়েছে রবিন। জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না।

দৌড়ে ফিরে এল কিশোর। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে রবিনকে জানাল, মিলি বাড়িতে নেই!

নিশ্চয় হাসপাতালে রওনা হয়ে গেছে, বলেই দরজার দিকে ছুটল রবিন।

বেরিয়ে গেল দুজনে।

পেছনে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন শেরিফ। ভীষণ একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছে তাকে ছেলেগুলো।

১৩.

রাত বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ভাল লাগছে না পটেটোর। বিলি ফক্স আর তার ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক খেলার ভাবনা কিছুতেই দূর করতে পারছে না। মন থেকে। মাঝেমধ্যে একআধটু উত্তেজক বিকৃত খেলা যে ভাল লাগে না। তার, তা নয়। তবে ইদানীং বড় বেশি বিকৃত খেলা শুরু করে দিয়েছে বিলি, যেটা তার সহ্যের বাইরে। এসব খেলার কথা ভাবতেও ভাল লাগছে না আর ওর।

খালি ঘর। খানিক আগে একটা ছেলে আর তার বান্ধবী এককোণে দুটো মেশিনে খেলছিল। ওরাই আজকের শেষ খেলোয়াড়। চলে গেছে। একা একা বসে এখন কমিক পড়ার চেষ্টা করছে পটেটো। মন বসাতে পারছে না।

ঠিক বারোটায় উঠে গিয়ে মেইন ব্রেকার অফ করে আলো নিভিয়ে দিল সে।

অন্ধকার হয়ে গেল আর্কেড়। তবে পুরোপুরি নয়। একধারে একটা আলো জ্বলেই রইল। ভিডিও গেম মেশিনের স্ক্রীনের আলো। সতর্ক ভঙ্গিতে পা টিপে টিপে সেটার দিকে এগোল সে। Virtual Massacre-II মেশিনটা চলছে বিদ্যুৎ ছাড়াই। পর্দায় ফাইটারদের ওপরে ফুটে উঠেছে নামের একটা স্তম্ভ। বিশটা নাম। সবগুলো একজনের-বি, পিএফ.।

এই, যাহ! লেখাগুলোকে বলল সে। যেন ধমক দিলেই কথা শুনবে মেশিন। অপেক্ষা করতে লাগল মেশিন বন্ধ হওয়ার। হলো না। বিড়বিড় করে বলল, বিলি, আমি জানি, তুমি একাজ করছ।

জবাব নেই।

 হঠাৎ ঝমঝম করে বেজে উঠল জুকবক্সটা। দি নাইটওয়াকারস।

ঘটনাটা নতুন নয় পটেটোর কাছে। কিন্তু এ মুহূর্তে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। জোর করে হাসল।

কি হয়েছে বিলি? কিছু বলতে চাও? দরজার দিকে পা বাড়াল পটেটো। আতঙ্ক চেপে রাখার চেষ্টা করছে। ওর চারপাশের বাতাস ঘন, ভারী হয়ে। উঠেছে। অদ্ভুত এক ধরনের গন্ধ। বিদ্যুৎ-ঝড়ের পর যেমন হয়।

প্রতিটি পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে আরও বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে। এ এক ভয়ানক পরিস্থিতি। আতঙ্ক কিছুতেই বাগ মানাতে পারছে না। একটা মানুষখেকো হাঙরের সঙ্গে সাঁতার কাটছে যেন। জানে নিচের গভীর পানিতে কোনখানে রয়েছে ওটা, কিন্তু ও দেখতে পাচ্ছে না। সময়মত ঠিকই ভুস করে উঠে আসবে ওকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।

দরজা খোলার জন্যে ঠেলা দিল পটেটো। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল। আবছা আলোয় অনেকটা আঙুলের আন্দাজে খুঁজে বের করল সঠিক চাবিটা। হাত ভীষণ কাঁপছে।

চিৎকার করে উঠল সে, কি করছ? বলেছিই তো ওদের কিছু বলিনি আমি!

জুকবক্সে মিউজিকের কানফাটা ঝমঝম ছাড়া কেউ জবাব দিল না তার কথার।

 বাইরে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কাঁপা হাতে কোনমতে চাবিটা তালায় ঢোকাল সে। তালা লাগানোর পর একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না। ছুটে নামল চত্বরে। ঝোড়ো বাতাস বইছে।

 পার্কিং লটে এসেও শব্দের অত্যাচার থেকে নিস্তার পেল না। এখন বাজনা বাজাচ্ছে বাতাসের শব্দ। গাছগুলোও যেন স্পীকারে পরিণত হয়েছে। আকাশে মেঘ গুমগুম করে বাজিয়ে চলেছে হেভি মেটাল মিউজিক।

ওকে ঘিরে বইছে প্রবল বাতাসের ঘূর্ণি। এখনও দেখতে পাচ্ছে না বিলিকে। চিৎকার করে বলল, বিলি, বিশ্বাস করো! আমি কিছু বলিনি ওদের! শিশুর মত অসহায় ভঙ্গিতে কেঁদে উঠল। আমি তোমার বন্ধু, বিলি! আমার সঙ্গে এমন করছ কেন?

এতক্ষণে জবাব মিলল। মিউজিকের চেয়ে জোরাল শব্দে, রোদের চেয়ে উজ্জ্বল বিদ্যুতের একটা হলকা এসে লাগল ওর পিঠে। হৃৎপিণ্ডটাকে পুড়িয়ে দিয়ে বুক ভেদ করে গিয়ে ঢুকে গেল মাটিতে।

মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পটেটো। পকেট থেকে সিকিগুলো ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। পার্কিং লটে কংক্রীটের মেঝেতে ঝনঝন শব্দ তুলল। কিছুই কানে ঢুকল না তার। ঢুকবেও না আর কোনদিন।

*

আর্কেডের হাতে দাঁড়িয়ে পার্কিং লটে পড়ে থাকা ওর বন্ধুর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছে বিলি। মনের মধ্যে খুঁজে দেখল, যে কাজটা করেছে তার জন্যে কোন রকম দুঃখবোধ, অনুশোচনা আছে কিনা। নেই। একটুও খারাপ লাগছে না। ভয়বাহ বিদ্যুৎ যেন তার ভেতরটাকেও পুড়িয়ে, মুছে অনুভূতি আর আবেগশূন্য করে দিয়েছে। যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেলেছে। ফেরার উপায় নেই আর। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়া। যা শুরু করেছে সেটার শেষ করতেই হবে।

ভয় পায় না সে। মিলি যদি সঙ্গে থাকে দুনিয়া জয় করার চেষ্টাতেও আপত্তি নেই।

সব পারবে।

 প্রবল বেগে বাতাস বইছে। উত্তরের আকাশে মেঘ জমছে। ঝড় আসবে।

দেখেও দেখল না বিলি। কেয়ারও করল না। ঝড়বৃষ্টি দেখার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী কাজ এখন পড়ে আছে তার সামনে। ছাত থেকে নেমে আসতে লাগল পটেটোর লাশটা তুলে নেয়ার জন্যে।

.

১৪.

হাসপাতালে যাওয়ার সময় সারাটা পথ আরও জোরে গাড়ি চালানোর জন্যে মুসাকে তাগাদা দিতে থাকল কিশোর। পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে চলছে, তা-ও মনে হচ্ছে ওর, অনড় হয়ে আছে গাড়িটা।

মিলিকে কথা দিয়েছে, সে আর তার বাবা নিরাপদে থাকবেন। রাখার দায়িত্ব ওদের। বাঁচাতে না পারলে মিলির কাছে ছোট হয়ে যাবে তিন গোয়েন্দা। মান থাকবে না শেরিফ রবার্টসনের কাছে।

হাসপাতালের সামনে গাড়িটা পুরোপুরি থামার আগেই দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে গেল কিশোর। দৌড় দিল লিফটের দিকে। ঘন ঘন চাপ দিচ্ছে বোতামে। এলিভেটর, মুসা এবং রবিন তার কাছে একসঙ্গে পৌঁছল।

পাঁচ তলায় উঠে এলিভেটরের দরজা ফাঁক হওয়া শুরু করতেই বেরিয়ে পড়ল কিশোর।

হলে ডিউটিরত বিস্মিত নার্সকে বলল, জলদি সিকিউরিটিকে ফোন করুন। বলে দিন, হাসপাতালের পরিচিত লোক ছাড়া আর কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়।

 নার্স কি বলে না বলে তার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল না সে। দৌড় দিল হাওয়ার্ডের কেবিনের দিকে। জানালা দিয়েই মিলিকে দেখতে পেল। অস্থিরতা নেই। বসে আছে বাবার বিছানার পাশে চেয়ারে।

ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল দরজা। আস্তে করে ডাকল, মিলি!

ফিরে তাকাল মিলি। সতর্ক হয়ে গেছে মুহূর্তে। উঠে এগিয়ে এল। কি?

আমাদের সঙ্গে এখুনি যেতে হবে তোমাকে।

কোথায়? কেন?

হাজত থেকে বিলিকে ছেড়ে দিয়েছেন শেরিফ।

তাই নাকি! যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল মিলি। কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল মুসা আর রবিনের দিকে। কিন্তু তোমরা আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলে। বলেছ আমরা নিরাপদ।

বলেছি। হাতে সময় কম। জলদি এসো। যেতে যেতে বলব…

মাথা নাড়ল মিলি। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন বাবাকে নাড়াচাড়া করা একদম উচিত হবে না। ওঁকে একা ফেলে যেতে পারব না আমি।

 কিশোরের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল মুসা। আমি তোমার বাবাকে পাহারা দিচ্ছি। তুমি ওদের সঙ্গে চলে যাও।

না! আমি যাব না!

জেদ কোরো না, মিলি!

বললাম তো আমি যাব না! টেবিলে রাখা হাতব্যাগটা নিয়ে এল মিলি। খুলে একটা পিস্তল বের করে দেখাল। বাবার। নিশানা খুব একটা খারাপ না। আমার। বাবাই গুলি চালানো শিখিয়েছে।

ওরকম হাজারটা পিস্তল দিয়েও বিলির বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। ভয়ঙ্কর ক্ষমতা ওর। যত তাড়াতাড়িই করো, পিস্তল তুলে গুলি করতে যেটুকু সময় লাগবে তোমার, ওর ততটা লাগবে না। মনে মনে শুধু বলবে

দপ করে নিভে গেল বাতি। কয়েক সেকেন্ড পরেই জ্বলে উঠল আবার। চালু হয়ে গেছে হাসপাতালের স্বয়ংক্রিয় জেনারেটর। ইমারজেন্সি পাওয়ার।

 থাবা দিয়ে মিলির হাতের পিস্তলটা প্রায় কেড়ে নিল কিশোর। ও এসে গেছে!

*

হলের অনেক নিচে টুং করে মৃদু একটা শব্দ হলো। মিলি, কিশোর, রবিন, মুসা, সবাই শুনতে পেল সেটা। গলা লম্বা করে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল মুসা। শব্দটা কিসের বুঝতে চায়।

হল আর বেশির ভাগ জায়গাতেই ডিম লাইট জ্বলছে। সবচেয়ে বেশি। আলো আছে করিডরে, এলিভেটরের কাছে।

উঠে আসছে এলিভেটর।

সেদিকে দৌড় দিল তিনজনে।

টুং!

চারতলায় থেমেছে এলিভেটর। ঠিক ওদের নিচে। এলিভেটরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে পিস্তলটা চেপে ধরে সামনে বাড়াল কিশোর। বিলির। দিক থেকে কোন রকম ক্ষতির সম্ভাবনা দেখলে নির্দ্বিধায় গুলি চালাবে। তারপর যা হয় হোক।

টুং!

পাঁচতলায় থামল এলিভেটর। দরজার দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে কিশোর। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে স্নায়ুগুলো। ট্রিগার ছুঁয়ে থাকা আঙুলটা চেপে বসতে প্রস্তুত।

খুলে যাচ্ছে দরজা। এলিভেটরের মেঝেতে দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ।

পিস্তল নামাল কিশোর। পড়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে পারল। ভিডিও আর্কেডের সেই ছেলেটা। পটেটো।

রবিনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে ইশারা করল সে। বুঝতে পারল রবিন। এলিভেটরে ঢুকে পটেটোর গলার কাছে হাত দিয়ে নাড়ী দেখল। মনে পড়ল, হাজতে বসে ওর কথা জিজ্ঞেস করেছিল বিলি। ইস্, তখন গুরুত্ব। দেয়নি! দেয়া উচিত ছিল। এখন দেরি হয়ে গেছে অনেক।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রবিন, নেই!

এলিভেটরে ঢুকে স্টপ সুইচটা টিপে দিল কিলোর যাতে ওই তলাতেই আটকে থাকে ওটা। বেরিয়ে এল আবার।

পেছনে এসে দাঁড়াল ডিউটি-নার্স। এলিভেটরের দেহটা দেখে অস্ফুট গলায় বলে উঠল, ও, লর্ড!

ওর দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। এই তলায় ওঠার আর কোন উপায় আছে?

হাত তুলে হলের শেষ মাথা দেখাল নার্স। সিঁড়ি। নিজেকে সামালানোর চেষ্টা করছে এখনও।

দুই সহকারীর দিকে ফিরল কিশোর। মিলির কাছে থাকো। ওদের পাহারা দাও।

তুমি কোথায় যাচ্ছ? জানতে চাইল মুসা।

 বিলিকে ধরতে। পটেটোর লাশটা এদিকে পাঠিয়ে আমাদের নজর সরিয়ে রাখতে চাইছে সে। সেই সুযোগে… কথা শেষ না করেই সিঁড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোর।

*

সিঁড়িঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। চোখে আলো সয়ে আসার অপেক্ষা করল। মেইন লাইন থেকে বিদ্যুৎ না পাওয়ায় এখানে বেশি পাওয়ারের আলোগুলোর কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে নিভে আছে। জ্বলছে অতি সামান্য পাওয়ারের লাল বাল্ব। বিচিত্র এক অপার্থিব লালচে আলো সৃষ্টি করেছে। সরাসরি যেসব জায়গায় আলো পড়ছে না সেই কোণগুলোতে ছায়া।

আস্তে করে গলা বাড়িয়ে কোণের দিকে তাকাল সে। সিঁড়ির ধাপ দেখল।

কেউ নেই।

যতটা সম্ভব নিঃশব্দে নামতে শুরু করল সে। ধাতব সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত এবং শব্দ না করে নামা খুব কঠিন কাজ।

হাত লম্বা করে পিস্তলটা সামনে বাড়িয়ে রেখেছে।

 মোড় ঘুরল একটা। কাউকে দেখা গেল না।

বাকি ধাপ কটা দৌড়ে পেরোতে শুরু করল। নিচে প্রায় পৌঁছে গেছে। এই সময় একটা গুঞ্জন কানে এল। কোন ইলেকট্রিক্যাল কয়েল খারাপ থাকলে যেমন মৃদু একটা শব্দ ওঠে, তেমনি। মাঝে মাঝে চড়চড় ফড়ফড় করে উঠছে। বাকি কয়েকটা ধাপ নিঃশব্দে নেমে কান পাতল সে।

কোন সন্দেহ নেই। কানের ভুল নয় তার। লম্বা করে দম নিল। সিঁড়িতে এক ধরনের গন্ধ। ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না গন্ধের রকমটা। তবে সচল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে বোঝাই ঘরে যে রকম গন্ধ পাওয়া যায়, অনেকটা সেরকম।

উত্তেজনায় টানটান স্নায়ুগুলোকে ঢিল করার চেষ্টা চালাল সে। সেটা করা সম্ভব নয় আর এখন কোনমতেই। বরং পিস্তলটায় আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল হাতের আঙুলগুলো। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। আক্রমণ করতে আসা বিলিকে দেখামাত্র গুলি করবে।

কিন্তু কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। বরং নষ্ট করে দেয়া সার্কিট ব্রেকারটা চোখে পড়ল। তারের সঙ্গে পেন্ডুলামের মত দুলছে এপাশ ওপাশ। বাক্সটা যেন প্রচণ্ড আক্রোশে টেনে খুলে আনা হয়েছে। ছেঁড়া তারের মাথা একটার সঙ্গে আরেকটা লাগলেই বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে। চড়চড় ফড়ফড় আওয়াজটা হচ্ছে তখনই।

পিস্তল নামাল কিশোর। হতাশ হয়েছে। বিলি এখানে এসেছিল সন্দেহ নেই। স্পষ্ট প্রমাণ রেখে গেছে। এখন কোথায়?

*

হিলটাউন কমিউনিটি হাসপাতালের অন্ধকার করিডর ধরে শিকারী বিড়ালের মত এগিয়ে চলেছে বিলি। ভাল বলতে আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে। ওর নিজেরই মনে হচ্ছে বহুদূরে কোথাও ফেলে এসেছে সেসব। কিন্তু তাই নিয়ে কোন আফসোস নেই ওর। একটা চিন্তাই রয়েছে তার মন জুড়ে। একটা চেহারা। মিলি হাওয়ার্ড!

শিরায় বইছে প্রচুর পরিমাণে অ্যাড্রেনালিন। অতি সতর্ক করে তুলেছে তাকে। অতিরিক্ত সচেতন। অনুভব করছে বৈদ্যুতিক-জ্যোতি ঘিরে ফেলছে তাকে, অনেকটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মত। দেয়ালের ভেতরের বৈদ্যুতিক তারগুলোর অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে। পুঁয়াপোকা যেমন নিজের শরীরকে খোলসে আবদ্ধ করে ফেলে, ভয়ের উৎপত্তি হয় যেখান থেকে মগজের সেই অংশটাকে তেমনি ভাবে বন্ধ করে দিয়ে জোসেফ হাওয়ার্ডের কেবিনের দিকে এগিয়ে চলল সে।

দরজা খুলল। পর্দা সরাল।

বিছানা আছে। তাতে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে মিস্টার হাওয়ার্ডকে। কিন্তু মিলি কই?

 মিলি! ডাক দিল সে। কোথায় তুমি?

পেছন থেকে কঠোর স্বরে বলে উঠল একটা কণ্ঠ, নোড়ো না, বিলি!  আমি রবিন বলছি! আমার হাতে পিস্তল আছে!

ঘুরে তাকাল বিলি। অন্ধকারে একটা পর্দার আড়ালে মানুষ আছে, অস্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। পর্দার একটা জায়গা উঁচু হয়ে আছে। পিস্তলের নল দিয়ে ঠেলে রাখলে যেমন হয়।

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার অবচেতন মনের গভীরে কোথায়। যেন কে বলে উঠল, ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু পেল না সে। ভয়ের অনুভূতিটাকে ঘিরে ফেলেছে আশ্চর্য এক খোলস। কিংবা কোন ধরনের শক্তি। হতে পারে সেটা চৌম্বক ক্ষেত্র।

অন্ধকার ছায়া থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল মিলি।

গোয়েন্দা কিংবা পিস্তলের কথা মন থেকে বেমালুম উধাও করে দিল বিলি। সেসব আর কোন গুরুত্ব বহন করে না তার কাছে। এখন তার একমাত্র আকর্ষণ মিলি।

এসো, মিলি, হাত বাড়িয়ে ডাকল সে। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে।

খবরদার, বিলি, পর্দার আড়াল থেকে ধমকে উঠল রবিন, ওকে ধরবে না!

মিলির সঙ্গে আমার কথা আছে। তাই না মিলি? ভাবছে বিলি, যদি ওর। ক্ষমতা প্রয়োগ করে মিলিকে কাছে টেনে নিয়ে আসা যেত, তাই করত।

যা বলার এখানেই বলো। কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না, আদেশ দিল। রবিন।

মিলির চোখের দিকে তাকাল বিলি। মুখটা রয়েছে ছায়ার মধ্যে। দেখা যায় না কিছু। সে চোখে কিসের খেলা চলছে বুঝতেও পারল না সেজন্যে। তুমি কি আসবে?

বললাম তো, ও তোমার সঙ্গে কোথাও যাবে না, রবিন বলল।

বাধ্য হয়ে আবার পর্দার দিকে ঘুরল বিলি। এত কাছে থেকে মাত্র ছোট্ট একটা ভাবনা দিয়েই শেষ করে দিতে পারে ওকে। চিৎকার করে শাসাল, দেখো, ইচ্ছে করলে এক্ষুণি তোমাকে খতম করে দিতে পারি আমি!

আমিও তোমার মাথায় গুলি করতে পারি। কাপড়ের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি তোমাকে। বরফের মত শীতল কণ্ঠে আদেশ দিল রবিন, তোমাকে তিন সেকেন্ড সময় দিচ্ছি বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।…এক…

অনেক হয়েছে। চিৎকার করে উঠল বিলি। অনেক সহ্য করেছি তোমাদের জ্বালাতন! গোয়েন্দা বলে এতদিন বজ্র ছুঁড়ে মারিনি। কিন্তু ইচ্ছে করলেই পারি সেটা, বিশ্বাস করো।

দুই! গুণল রবিন।

ঠিক এই সময় বিলির সামনে চলে এল মিলি। বাধা হয়ে দাঁড়াল দুজনের সামনে।

অবাক হলো না বিলি। যেন জানত, মিলি আসবে।

থামো, রবিন! পর্দার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল মিলি। আর একটা কথাও বোলো না!

 বলেই বিলির দিকে ঘুরল সে। এখন ওর চোখ দেখতে পাচ্ছে বিলি। পানি টলমল করছে সেচোখে। দেখে তার নিজের চোখেও পানি চলে এল। এই তো চেয়েছিল সে। একজনের দুঃখে আরেকজন কাঁদবে। কষ্ট পাবে। অবশেষে তাকে বুঝতে পারল মিলি। বুঝল, সে ওকে কতটা চায়।

তারপর শুনতে পেল সেই কথাটা, যেটা শোনার জন্যে গত কয়েকটা মাস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে সে।

মিলি বলল, ঠিক আছে, আমি তোমার সঙ্গে যাব। যেখানে যেতে বলো, সেখানেই যাব। কিন্তু কারও কোন ক্ষতি কোরো না, প্লীজ!

করব না, কথা দিল বিলি। তুমি যা বলবে তাই করব আমি, মিলি।

 মনে হতে লাগল ওর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এটা।

কিন্তু বাদ সাধল রবিন। বলল, যা বলার এখানেই বলো, আমাদের। সামনে। এখান থেকে মিলিকে বেরোতে দেব না আমরা। আমি একা নই। মুসা আর কিশোরও আছে আমার সঙ্গে। যত শক্তিশালীই হও, তিনজনের সঙ্গে কোনমতেই পারবে না তুমি, বিলি।

জ্বলে উঠল বিলির চোখ। ভাবল, গাধাগুলো জানে না আমার শক্তির খবর। তিনজনকে মুহূর্তে ধোয়া বানিয়ে উড়িয়ে দিতে পারি কল্পনাও করতে পারছে না।

তাড়াতাড়ি বিলির আরও কাছে চলে এল মিলি। মাথা নেড়ে চিৎকার করে উঠল, না না, বিলি! চলো, আমি তোমার সঙ্গে যাব। ওদের কথা শুনব না।

ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল বিলি। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল মনে হলো মিলির শরীরে। হাসল বিলি। লজ্জা পাওয়া শিশুর হাসি। চলো। এসো।

মিলির কোমর জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে দরজার দিকে পিছাতে শুরু করল বিলি। চোখ রবিনের দিকে। গুলি করে কিনা দেখছে। নিরাপদেই। বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। লাগিয়ে দিল দরজাটা। তারপর নবের দিকে তাকিয়ে একটা মনো-বাণ ছাড়ল। মুহূর্তে গলে গেল ধাতু। বিকৃত, অকেজো হয়ে গেল তালাটা।

কেবিনের মধ্যে আটকা পড়ল রবিন। বিলি দরজা লাগিয়ে দিতেই পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ডান হাতের তর্জনীর দিকে তাকাল একবার। যেটা পর্দায় ঠেসে ধরে পিস্তলের নল বুঝিয়ে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করেছিল বিলিকে।

দরজার নবের অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল সে। মোচড় দিয়ে খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করল একবার। বুঝল, হবে না। এগিয়ে গিয়ে টিপে ধরল একটা বোতাম। ইমার্জেন্সি বাটন। টিপলেই তাড়াহুড়ো করে ছুটে আসবে নার্স।

.

১৫.

 বাইরে পার্কিং লটের বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা। তাজা। পরিষ্কার। যেন মুক্তির গন্ধ মিশে রয়েছে তাতে। হঠাৎ করেই এই অন্ধকার রাতটা এক ধরনের অদৃশ্য আলোয় ভরে উঠল যেন, অনুভব করল বিলি। আলোটা আলো নয়, এক ধরনের আনন্দ। বিচ্ছুরিত হচ্ছে মিলির কাছ থেকে। ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বুকে কান না লাগিয়েও ডাক্তারের স্টেথো দিয়ে শোনার মত শুনতে পাচ্ছে সে। ওর মগজের পাগল হয়ে ওঠা বিদ্যুৎ-তরঙ্গও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে।

ও আমাকে ভালবাসে, ভাবল বিলি।

জীবনে তুমিই একমাত্র ভাল ব্যবহার করলে আমার সাথে, মিলিকে বলল সে। নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল। এতটা উষ্ণ আর কোমল কণ্ঠস্বর যে ওর গলা দিয়েও বেরোতে পারে, ভাবেনি কোনদিন। রাগ চলে গেছে। মানুষ খুনের ঘটনাগুলো যেন এখন দূর অতীতের ধোয়াটে দুঃস্বপ্ন। ওসব ভুলে যেতে চায় সে। ওগুলোর কথা আর মুহূর্তের জন্যেও মনে করতে চায় না।

সেই প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে ক্লাসে দেখা হলো আমার, মনে আছে? জিজ্ঞেস করল বিলি। সবুজ একটা ফুক পরেছিলে তুমি। বড় বড় হলুদ ফুল। কি সুন্দরই না লাগছিল তোমাকে। ছেলেমানুষের মত হেসে উঠল সে। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। নামেও কি মিল, দেখছ? মিলি! বিলি!

মিলির হাতটা কাঁপছে, টের পেল বিলি। নিশ্চয় শীতে, ভাবল সে।

কোথায় যাচ্ছি আমরা? দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইল মিলি। কোথায় নিয়ে। যাচ্ছ আমাকে?

তাই তো! এই প্রথম মনে পড়ল বিলির, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে? কখনও তো ভেবে দেখেনি। একটাই চিন্তা ছিল, কোনমতে মিলিকে হাসিল করা। সেটা করেছে। এখন কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবে?

তা তো জানি না, জবাব দিল সে। তুমি যেখানে যেতে চাও, সেখানেই নিয়ে যাব। যে কোন দোকানের ক্যাশ মেশিন থেকে সহজেই টাকা বের করে নিতে পারব আমি। যে কোন গাড়ি জোগাড় করতে পারব। তুমি শুধু মুখ ফুটে বলো একবার।

সামনে একসারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোর দিকে হাত তুলে বলল, দেখো। কোনটা পছন্দ? ওই অ্যাকর্ডটা? ম্যাক্সিমা? ঘুরে তাকাল মিলির দিকে। কোনটা পছন্দ?

কিন্তু মোটেও খুশি মনে হলো না মিলিকে।

ওর হাত ছেড়ে দিল বিলি। পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, জাপানী গাড়ি পছন্দ না হলে অন্য দেশ দেখি? টরাসটা কেমন মনে হচ্ছে? কিংবা ওই ফোর্ডটা?

ফোর্ড গাড়িটার দিকে শুধু তাকিয়ে থেকেই ওটার এঞ্জিন চালু করে ফেলল সে। গাড়ির উজ্জ্বল হেডলাইটের আলোয় চকচক করতে লাগল ভেজা চত্বরটা।

আনমনে মাথা নাড়তে লাগল সে। নাহ, এসব গাড়ি তার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। মিলির জন্যে আরও ভাল কিছু চাই। একটা মার্সিডিজ দরকার। কিংবা ফেরারি।

 দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এগুলো, নাক কুঁচকে বলল বিলি। চলো অন্য কোনখানে। চলে যাই। ভাল গাড়ি খুঁজে বের করতে হবে। আপাতত এখান থেকেই কোন একটা নিয়ে কাজ চালানো যাক।

হঠাৎ নতুন একজোড়া হেডলাইটের আলো ঘুরে এসে পড়ল ওদের গায়ে। কয়েক গজ এগিয়ে থেমে গেল গাড়িটা। পুলিশের গাড়ি। লাফ দিয়ে সেটা থেকে নেমে এলেন শেরিফ রবার্টসন। হাসপাতাল থেকেই তাকে ফোন করে দিয়েছে কিশোর।

 এটা কোন সমস্যাই নয় বিলির কাছে। ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে। শেরিফকে। ভয় পেয়ো না, মিলি। চুপ করে খালি দেখো, লোকটার কি করি আমি।

জবাব না পেয়ে মিলি কোথায় আছে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল সে।

কিন্তু মিলি নেই ওর পাশে। প্রাণপণে ছুটছে। দেখতে দেখতে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে চলে গেল অন্যপাশের ঘাসে ঢাকা মাঠে।

না! মিলি! যেয়ো না! চিৎকার করে উঠল বিলি।

ওর স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে দূরে। সইতে পারছে না সে। নিজেকে বড় একা মনে হতে লাগল আবার।

*

অ্যাই বিলি, দাঁড়াও! নড়বে না বলে দিলাম! যেন মানুষ নয়, একটা পাগলা, কুত্তার উদ্দেশে ধমকে উঠলেন শেরিফ।

 কিন্তু দাঁড়াল না বিলি। বুনো জানোয়ারের মত ঘুরে দৌড় মারুল। নজর অনেক সামনে। পলকের জন্যে দেখল একটা ঝোপ পার হয়ে গিয়ে ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ছে মিলি।

কোথায় যাচ্ছে, নিজেও জানে না মিলি। একটাই চিন্তা, ওই দানবটার। কাছ থেকে সরে যেতে হবে যত দূরে পারা যায়। বাঁচতে হলে ওর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে হবে। অন্ধকার রাত। কুয়াশা পড়ছে। বনের মধ্যে আরও বেশি অন্ধকার। এখানে হয়তো ওকে দেখতে পাবে না বিলি। কিন্তু বলা যায় না কিছু। দেখার অলৌকিক চোখও থাকতে পারে ওর, কে জানে!

ঠিক এই সময় ঝোপের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে এসে পড়ল একটা ছায়ামূর্তি। ওকে জাপটে ধরল। চিৎকার করতে যাচ্ছিল মিলি। মুখ চেপে ধরল। সাড়াশির মত কঠিন আঙুল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ওকে ঘন ঝোপের মধ্যে।

কোনমতে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল মিলি। ভেবেছিল বিলির জলন্ত চোখে চোখ পড়বে। কিন্তু তার বদলে অস্পষ্ট একটা অবয়ব ফুটতে দেখল আকাশের পটভূমিতে। চুলগুলো যেন কেমন। চেহারার কিছুই বোঝা গেল না। দানবের হাত থেকে ভূতের খপ্পরে এসে পড়ল নাকি!

ফিসফিস করে বলল ভূতটা, ভয় পেয়ো না, মিলি! আমি মুসা। একদম চুপ করে থাকবে। টু শব্দ কোরো না। কাছাকাছিই আছে ও।

ঝোপের মধ্যে মিলিকে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল মুসা। মাঠ পেরিয়ে আসতে দেখল বিলিকে।

ওকে আর রবিনকে কেবিনে পাহারায় রেখে কিশোর চলে যাওয়ার পর মুসা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কেবিনের বাইরে। অন্ধকার ছায়ায় গা মিশিয়ে বিলির আসার অপেক্ষা করছিল। রবিন ভেতরে, সে বাইরে, দুজন দুই জায়গায় থেকে পাহারা দিচ্ছিল।

বিলি যখন মিলিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল, নিঃশব্দে পিছু নিয়েছিল ওর। ওকে পরাস্ত করার জন্যে সুযোগ খুজছিল। কোন উপায় দেখেনি। যে লোক শুধুমাত্র ইচ্ছা-শক্তির সাহায্যে একজন মানুষকে মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারে, তার সঙ্গে সামনাসামনি লাগতে যাওয়া চরম বোকামি। সেই বোকামি করেনি মুসা। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।

মিলি যখন বিলির কাছ থেকে সরে যেতে শুরু করল, ওকে সাহায্য করার জন্যে পিছে পিছে ছুটল মূসা। অবশ্যই গাছপালা আর ঝোপের আড়ালে থেকেছে। সাবধান ছিল, বিলির চোখে যাতে না পড়ে…

মিলি! মিলি! ডাকছে আর শিশুর মত ফোপাচ্ছে বিলি। কোথায় তুমি? সাড়া দাও। প্লীজ। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। মাথায় তুলে রাখব। মিলি! মিলি!

আরও কাছে চলে এল সে। কাঁদতে লাগল।

 কিন্তু তাকে শান্ত করার জন্যে ঝোপ থেকে বেরোল না মিলি। ওই দানবের সামনে যেতে চায় না আর। ওর কাছে গেলে ওর কথা মানতে হবে। সেটা মানা সম্ভব নয় মিলির পক্ষে। না মানলে ধৈর্য হারিয়ে এক সময় না এক সময় রেগে উঠবে বিলি। মায়াদয়ার বালাই না রেখে তখন ধ্বংস করে দেবে ওকেও।

কি চাই তোমার, মিলি? কাঁদতে কাঁদতে বলছে বিলি। যা চাও তাই দেব! সব দেয়ার ক্ষমতা আছে আমার।

কুয়াশার চাদর ভেদ করে জ্বলে উঠল একটা আলোক রশ্মি। টর্চ। কঠিন কণ্ঠে আদেশ দিলেন শেরিফ, অ্যাই, ঘোরো এদিকে! তোমার কি হয়েছে জানি না আমি। তবে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব চাই।

আমি কোন প্রশ্নের জবাব দেব না! চিৎকার করে বলল বিলি। বরং আমার কথার জবাব চাই। ও কোথায়? মিলি কোথায়?

গাছের মাথা কাঁপিয়ে দিয়ে যেন ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল একঝলক ঝোড়ো বাতাস।

আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে উঠল বিলি, জবাব দিচ্ছ না কেন আমার কথার? কোথায় আছে ও? খুঁজে বের করো! জলদি!

মেঘ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো।

কিশোর এসে দাঁড়াল শেরিফের পাশে। হাতে উদ্যত পিস্তল। ফিসফিস করে বলল, কোন কিছু করতে যাবেন না এখন, শেরিফ। চোখের পলকে মেরে ফেলবে আপনাকে ও।

কিন্তু রোখ চেপে গেছে শেরিফের। ওর শয়তানির নিকুচি করি আমি। তুমি সরো!

ওদের কারও দিকেই আর নজর নেই এখন বিলির। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেই চলেছে। মেঘের কাছে, বাতাসের কাছে, বিদ্যুতের কাছে ওর প্রশ্নের জবাব চাইছে। বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করছে–মিলি কোথায়? মিলি কোথায়? মিলি কোথায়?

রাগে হাত মুঠো করে ওপর দিকে তুলে আঁকাতে লাগল সে। কিন্তু মেঘ ওর প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। ক্রমেই রেগে যাচ্ছে বিলি। আক্রোশ গিয়ে পড়ল বনের ওপর। ওই গাছই মিলিকে আড়াল করে রেখেছে।

মনকে আদেশ দিল সে। ভয়াবহ বজ্র-বাণ ছুটে গিয়ে আঘাত হানল একটা গাছের মাথাকে। গ্রেনেড ফাটার মত বিস্ফোরণ ঘটল যেন। আগুন লেগে গেল গাছের মাথায়। কয়েকটা ডাল ফেটে চৌচির হয়ে গোড়া ভেঙে ঝুপঝুপ করে পড়ল মাটিতে।

আরেকটা গাছের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল বিলি। তারপর আরেকটা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করতে লাগল। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে যেন।

ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশও যেন খেপে উঠতে লাগল। ফুলে উঠল মেঘ। বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল ঘনঘন। বিকট শব্দে বাজ পড়ল।

মহা খেপা খেপেছে যেন আজ দুই দানব। একজন মাটিতে। আরেকজন আকাশে। দুটোতে মিলে প্রলয় কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে। তছনছ করে দেবে। বেচারা হিলটাউন শহরটাকে।

তাজ্জব হয়ে এই কাণ্ড দেখছেন শেরিফ। কিন্তু বেশিক্ষণ চলতে দেয়া যায় না এসব। মহাক্ষতি করে দেবে তাহলে বিলি। পিস্তল তুলে আচমকা গর্জে উঠলেন, বিলি, থামো! থামো বলছি! নইলে গুলি করব বলে দিলাম!

ফিরে তাকাল বিলি। বিদ্যুতের আলোয় বাঘের চোখের মত জ্বলছে ওর। দুই চোখ।

পিস্তল হাতে এগিয়ে গেলেন শেরিফ। বিলিকে হাতকড়া পরানোর ইচ্ছে।

কিন্তু তার সে ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। হঠাৎ গুঙিয়ে উঠে বুক চেপে ধরলেন। পিস্তলটা পড়ে গেল হাত থেকে। টলে পড়ে যাচ্ছেন। ধরার জন্যে ছুটে গেল কিশোর।

ঠিক এই সময় বাজ পড়ল। প্রচণ্ড শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বন, পাহাড়, মাটি। চোখের কোণ দিয়ে পলকের জন্যে দেখতে পেল কিশোর, আকাশ থেকে তীব্র নীল একটা আগুনের শিখা ছুটে এসে লাগল বিলির মাথায়।

.

১৬.

লস অ্যাঞ্জেলেস স্টেট সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালের চওড়া করিডরে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। দরজায় লাগানো অভঙ্গুর কাচের মধ্যে দিয়ে বিলি ফক্সের সেলের ভেতরে তাকাল। ছোট্ট ঘর। টেলিভিশনের দিকে চেয়ে আছে বিলি। ভাবলেশহীন চেহারা। শূন্য দৃষ্টি। বোঝা যাচ্ছে অনুষ্ঠান দেখছে না। দেখার মত অবস্থাও নাকি নেই ওর। সেদিনকার সেই বিদ্যুৎ-ঝড় ওর মনকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে। এটা অবশ্য ডাক্তারদের কথা।

কিশোর এই রায় বিশ্বাস করতে রাজি নয়। বিলির মাথায় বাজ পড়তে দেখেছে নিজের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে মরে যাওয়ার কথা ওর। মাটিতে পড়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মরেনি। কয়েক মিনিটের জন্যে অবশ হয়ে গিয়েছিল। হাত-পা। নড়াচড়া করেনি। সেই সুযোগে মাথায় পিস্তলের বাড়ি মেরে ওকে বেহুশ করেছিল মুসা। শেরিফের গাড়ি থেকে দড়ি এনে হাত-পা বেঁধে ফেলেছিল।

হিলটাউন কমিউনিটি হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে রেখে কয়েক ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ডাক্তাররা তাকে এখানকার হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। সেটা দুদিন আগের কথা।

আজকে তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। কিন্তু কিশোরের ধারণা, ও ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাইবে না। তবুও এসেছে। যদি বলে।

দেখা করার অনুমতির জন্যে একজন নার্সকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছে কিশোর, এই সময় পায়ের শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখে ডক্টর এলিজা আসছে।

কখন এলেন?

এই তো, পনেরো মিনিট।

বিলিকে দেখতে নিশ্চয়?

মাথা ঝাঁকাল এলিজা। এখানে বিলিকে আনার পর থেকেই দিনে কয়েকবার করে এসে তাকে দেখে যাচ্ছে সে। তোমরা?

আমরাও দেখা করতে। অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা করছি।

দরজার কাচের ভেতর দিয়ে বিলিকে দেখল এলিজা। আবার কিশোরের দিকে ফিরল। করোনারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। শেরিফ রবার্টসনের মৃত্যুটাকে দুর্ঘটনা বলে রায় দিয়েছেন তিনি।

বজ্রপাতে মৃত্যু?

মাথা ঝাঁকাল এলিজা। ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির সঙ্গেও কথা বলেছি। কেসটা কিভাবে সাজাবেন বুঝতে পারছেন না তিনিও।

যে টেস্টগুলো করাতে বলেছিলাম, করিয়েছেন?

করিয়েছি?

কি বুঝলেন?

সব ঠিক আছে। ইলেকট্রোলাইট, ব্লাড গ্যাস লেভেল, ব্রেন ওয়েভ…সব আর দশজন সাধারণ মানুষের মত।

অস্বাভাবিক কোন কিছু নেই শরীরে? কিছুই না?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল এলিজা। কি করে এটা আন্দাজ করেছিলে, বলো তো?

করাটাই স্বাভাবিক…এরকম অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী সচরাচর হয় না কোন মানুষ। বিদ্যুৎ হজম করতে পারে কেউ কেউ, কিন্তু পাচার করতে পারে। বলে শুনিনি কখনও।

দ্বিধা করতে লাগল এলিজা। অকারণে কেশে গলা পরিষ্কার করল। তারপর বলল, ডাক্তারি শাস্ত্রে এটা বিস্ময়কর এক ঘটনা। মানুষের দেহযন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা! যে যন্ত্র দিয়ে কাজটা করেছে বিলি, সেটা দেখতে অনেকটা বৈদ্যুতিক বান মাছের বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রের মত। জন্ম থেকেই হয়তো ছিল ওটা ওর শরীরে। জন্মের সময় খুব ছোট ছিল, অক্ষম, ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। বজ্রপাতের পর কোনভাবে চার্জ হয়ে গেছে ওটা।…প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়াল! ওকে নিয়ে ভালমত গবেষণা করা দরকার।

হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। বিলির দিকে তাকাল। ডাক্তাররা যতই বলুক সব ধুয়ে মুছে গেছে, বিলির ক্ষমতা কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়নি।

ভুরু কোঁচকাল এলিজা। কি করে বুঝলে?

টেলিভিশনের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।

 ঘুরে গেল তিন জোড়া চোখ।

একের পর এক চ্যানেল পরিবর্তন হচ্ছে টেলিভিশনের।

এলিজা বলল, কিছু তো বুঝতে পারছি না।

চ্যানেল পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা দেখছেন?

হ্যাঁ, কিন্তু এতে

কি দিয়ে বদলাচ্ছে ও? রিমোট তো হাতে নেই।

এতক্ষণে মুসা আর রবিনও লক্ষ করল, রিমোটটা টেলিভিশনের ওপরেই ফেলে রাখা হয়েছে। বেশ খানিকটা দূরে বসে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে বিলি।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল এলিজার। ঠিক থাকাটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ওর এই ক্ষমতা নষ্ট না করে না দিলে তো আবার শুরু করবে শয়তানি।

দেখুন চেষ্টা করে, পারেন কিনা? তাহলে আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে যাবে বিলি।

যা-ই বলো, ওর সঙ্গে তোমাদের দেখা করতে যাওয়া উচিত হবে না মোটেও! তোমরা ওর এক নম্বর শত্রু। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কখন কি করে, বসে…

ফিরে এল নার্স। যাকে অনুমতির জন্যে পাঠিয়েছিল কিশোর।

অনুমতি পাওয়া যায়নি। ওদের দেখলে খেপে উঠতে পারে বিলি, ডাক্তারেরও এটাই ধারণা।

 এলিজা বলল, আমি ইচ্ছে করলে অনুমতি এনে দিতে পারি। কিন্তু, আবারও বলছি, উচিত হবে না।

দরজার বাইরে থেকেই বিলির সঙ্গে কথা বলার শেষ চেষ্টা করল কিশোর। চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকল।

সাড়া দিল না বিলি। মুখও তুলল না। একভাবে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের দিকে। কিশোর ডাকাডাকি শুরু করলে একটা পরিবর্তনই শুধু ঘটল, টেলিভিশনের চ্যানেল বদলানো বন্ধ হয়ে গেল।

দুই সহকারীর দিকে ফিরল কিশোর। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, হবে না। কথা বলবে না ও। চলো, যাই। আর কিছু করার নেই আমাদের এখানে।

*

একটা কথা বুঝতে পারছি না, মুসা বলল। বাসে করে রকি বীচে ফিরছে ওরা। ছোঁয়া না লাগিয়েই বিদ্যুৎ পাচার করে কিভাবে বিলি?

প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি। কিংবা টেলিপ্যাথি জাতীয় কিছু। টেলিপ্যাথিকে একধরনের রিমোট কন্ট্রোল সিসটেম বলতে পারো। দেখা যাক, বেঁচে যখন আছে ও, গবেষণাতেই বেরিয়ে পড়বে।

ওর ব্যাপারটাকে টেলিপ্যাথি নাম দিলে ভুল হবে, রবিন বলল, টেলিভোলটেজ হলে কেমন হয়?

মন্দ না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *