৬. মানুষ কেনা-বেচার বাজারে

জাঞ্জিবার-এ মানুষ কেনা-বেচার বাজারে এযাবত কালের সবচেয়ে দামি পণ্য আজকে বিক্রয়ের জন্য আনা হয়েছে। জাঞ্জিবারের লোকেরা গর্ব সহকারে বলাবলি করছে, পৃথিবীর কোথাও এত উচ্চদামের মানুষ পাওয়া যায় না। বিক্রয়ের পূর্বে জুডিথকে একটা আবদ্ধ ঘরে নিয়ে রাখা হলো যেখানে সব দাসকেই বিক্রয়ের পূর্বে রাখা হয়। এতদিনে জুডিথ প্রিন্স জাহানের হারেমের জামাকাপড় পরতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ সেসব জামাকাপড় খুলে তাকে একটা এপ্রনের মতো কাপড় পরতে দেয়া হয়েছে। কাপড়টা শুধু তার গলা থেকে সামনের দিকে ঝুলে আছে। তার হাতদুটো পেছন দিকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মাথায় একটা রশি বাঁধা যেটা ধরে তাকে টেনে একদল বিক্রেতার মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যারা বিক্রয়ের পূর্বে তাদের পণ্যগুলোকে ভালভাবে দেখে নিচ্ছিল।

জুডিথকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করা হলো। সে তার বুকের ওপর একটা শক্তহাত অনুভব করল। মহিলারা সবজি কেনার পূর্বে যেভাবে পরীক্ষা করে দেখে অনেকটা সেরকমভাবেই হাতদুটো তাকে পরখ করে দেখছিল। পা দুটোর মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান রেখে তাকে বাঁকা হয়ে দাঁড়াতে বলা হলো। তার পেছন দিকটা বিক্রেতাদের দিকে ফেরানো আছে যেন তারা তার গোপন অঙ্গগুলো ভালভাবে দেখতে পারে। এরপর লোকগুলো তার ঠোঁটদুটো সরিয়ে দাঁতগুলো পরীক্ষা করে দেখল। ঘোড়া কেনার সময় যেভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয় অনেকটা সেরকমভাবে।

হাল এবং অ্যাবোলির সাথে কিছুদিন আগের এক আলাচনার কথা মনে পড়ল ওর। ওলন্দাজদের কেপ কলোনীর দাসদের ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করছিল ওরা।

“তোমার সমস্যা কী জান, গান্ডওয়েন? তুমি সবসময় লড়াই করতে চাইতে। কিন্তু দাসদের প্রথম যে জিনিসটা শিখতে হয় তা হলো লড়াই করে কিছু পাওয়া যায় না। মনিব তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তোমাকে চাবুক মারবে। এরচাইতেও খারাপ যা করবে তা হাল তোমাকে কোনো খাঁচায় বা মাটির নিচে কোনো গর্তে বন্দি করে রাখা হবে। সূর্যের খরতাপে তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলবে। বৃষ্টিতে ভিজতে বলবে। তাই তাদেরকে সেই আনন্দটা পেতে দিও না। তাদের নিষ্ঠুরতা, আর তাদের অপমানকে সহ্য করতে হবে, কিছুই বলা যাবে না। সহ্য করতে হবে এই কারণে যে কেবল এইভাবেই তুমি বেঁচে থাকতে পারবে, তোমার সন্তান বেঁচে থাকতে পারবে। সেই সাথে প্রার্থনা করতে হবে, মনে মনে আশা করতে হবে যে একদিন তুমি মুক্ত হবে।”

সে কারণেই জুডিথ চুপচাপ সবকিছু সহ্য করে রইলো। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে সে হালকে খুঁজতে থাকল। অবশ্য সে বুঝতে পারছে না যে সে কী সত্যিই হালকে এখানে প্রত্যাশা করছে কি-না। সে শুধু জানতে চায় হাল তার জন্য এখানে এসেছে, নাকি আসেনি। জুডিথকে এই অবস্থায় দেখতে পাওয়াটা তাদের দুজনের জন্যই অনেক অসম্মানের ব্যাপার। কিন্তু তার চাইতেও বেশি অসম্মানের ঘটনা ঘটছে এখানে। লোকগুলো খুঁটিয়ে দেখার পর আবার তা নিয়ে জনসম্মুখে আলোচনা করছে যেন সে কানে শুনতে না পাওয়া কোনো পশু।

 কুটনৈতিক মিশনে তার বাবার সফরসঙ্গী হিসেবে জুডিথ শুধু ভেনিসেই যায়নি, বরং ইউরোপের অন্যান্য অনেক শহরেও ঘুরে বেড়িয়েছে। তরুণ বয়সের কারণে এবং ভাষার দক্ষতার কারণে সে সেসব শহরের মানুষের সাথে মিশে যেতে পেরেছে খুব সহজে। বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ভাষা, অ্যামহারিক এবং অ্যারাবিক ভাষা ছিল তার নখদর্পণে। কিন্তু সেই ভাষার দক্ষতাটাকেই এখন তার কাছে অভিশাপ মনে হচ্ছে। কারণ আশেপাশের লোকগুলোর কথা তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে।

একটা ওলন্দাজ তার বন্ধুকে বলছে, “তুমি কী জান এই গাভীটা তার পেটে একটা বাছুর বহন করছে? তাও আবার একটা সাদা চামড়ার লোকের!”

এক পর্তুগীজ ব্যবসায়ী আরেক ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করছে। “সুলতান কেন এই কালো রত্নটাকে বিক্রি করছে? এই রত্ন যদি আমার কাছে থাকত তবে আমি তাকে বিছানার সাথে বেঁধে রাখতাম।”

“আমি জানতে পেরেছি যে এটা নাকি একধরনের প্রতিশোধ,” উত্তরে আরেকজন বলল। “তার জন্ম নিশ্চয়ই কোনো উচ্চ সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ওর হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখ। অন্যান্য দাসদের মতো নয়। তাকে যখন ব্লক-এ উঠানো হবে তখন নিশ্চয়ই তার পরিচয় উন্মোচিত হবে। তারা বলছে শুধু এর নাম উচ্চারিত হলেই দাম দশ হাজার সিলভার রুপি বেড়ে যাবে।”

“তাহলে এ কে, সেবার রানী?”

“তার নাম যাই হোক না কেন, আমি সেটা পরোয়া করি না। সপ্তাহের যেকোনো একদিন আমি শুধু এর জন্যই বরাদ্দ রাখবো।”

“এরপর দ্বিতীয়বার যখন তাকে বাঁকা হয়ে দাঁড়াতে বলা হলো তখন একটা অ্যারাবিক কণ্ঠ বলে উঠল, তার ঠোঁটগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ। এরকম নারী যে-কোনো পুরুষের জন্যই আকাঙ্ক্ষিত বস্তু।”

“তুমি কী এর জন্য দর হাকাবে?”

“কী দরকার টাকা নষ্ট করার? এরকম নারী বিনামূল্যেই নিজেকে তোমার হাতে সমর্পণ করবে।”

এরকম অসহ্যকর পরিস্থিতি এবং অস্থিরতার মধ্যে সে রাত পার করল। সকালে তাকে এক বাটি মণ্ড জাতীয় খাবার এবং এক বালতি পানি খেতে দেয়া হলো। এরপর এক আফ্রিকান নারী তার সারা শরীরে তেল মেখে চকচকে করে দিল।

সময় যেন জুডিথ-এর জন্য থমকে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক দাসকে তুলে দেয়া হচ্ছে বিক্রয়ের মঞ্চে। নিলামদার আরবি ভাষায় একের পর এক নতুন পণ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সবার কাছে। দাস ব্যবসায়ীরা তাদের মক্কেলদের আকর্ষণ করার জন্য পণ্যের বিভিন্ন ভাল দিকগুলো উল্লেখ করছে। এরপর নিলামদারের নিজস্ব একজন দাস এসে জুডিথ-এর গলার রশি ধরে টেনে নিয়ে গেল। হঠাৎ সে শুনতে পায় নিলামদার তার বর্ণনা দিচ্ছে। “মাননীয় ভদ্রমহোদয় গণ, আমি আপনাদের সামনে এখন এক কালো রত্নকে হাজির করব। সে হচ্ছে সুলতান সাদিক খান জাহান-এর নিজস্ব সম্পত্তি। এই কালো রত্ন বোকার মতো ভেবেছিল যে সে জাঞ্জিবার-এ এসে গোয়েন্দাগিরি করবে কিন্তু সাদিক খান জাহান তাকে ধরে ফেলে। এই রমণীর নাম হচ্ছে জেনারেল জুডিথ নাজেত।”

ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ গুঞ্জন ধ্বনি শুরু হলো। সেই গুঞ্জন ধ্বনি বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাল যে নিলামদারকে চিৎকার করে সবাইকে থামাতে হলো। “সে হচ্ছে ইথিওপিয়ার নাস্তিক লোকদের গর্ব। কিন্তু আস্তিকদের ক্লেশের কারণ। যারা আল্লাহ তায়ালায় বিশ্বাস করে তাদের হত্যাকারী। কিন্তু আমাদের গ্রেট প্রিন্স তাকে অবশেষে ধরেছেন। কিন্তু তার অসীম মহানুভবতার কারণে তিনি এখন একে যে কারো হাতে তুলে দিতে রাজি আছেন।”

গুঞ্জন আবারো বাড়তে থাকে। সেটা থামার পূর্ব পর্যন্ত নিলামদার অপেক্ষা করল, এরপর আবারও বলতে শুরু করল, “এই রমণী শুধু একটা মহিলা শয়তানই নয়। সে একটা বেশ্যাও বটে। এক ইংরেজ-এর জন্য সে তার শরীর পেতে দিয়েছে। শুধু তাই নয় সেই ইংরেজ-এর সন্তান সে পেটে ধারণা করে আছে। সেই ইংরেজটার নাম হচ্ছে ক্যাপ্টেন হেনরি কার্টনি। সে কি-না এল তাজার নামে পরিচিত। খোদায় বিশ্বাসীদের জাহাজ সে বাজেয়াপ্ত করত নির্দয়ভাবে। ভদ্রমহোদয়গণ আমাদের পরবর্তী পণ্য হচ্ছে জেনারেল জুডিথ নাজেত এবং তার পেটের সন্তান!”

এরপর গুনগুন, শোরগোল বাড়তেই থাকে। জুডিথকে নিয়ে বিক্রি করার ব্লক-এর ওপর দাঁড় করানো হয়।

.

হাল তার কপাল থেকে ঘাম মুছছে বারবার, সেই সাথে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তার হার্টকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। বাজারের একপাশে ছোট একটা ঘেরাও করা জায়গা আছে। সেখানে দুটো বেঞ্চ রাখা আছে। ধনী ক্রেতারা যেন আরামে বসে থাকতে পারে সেকারণেই এই ব্যবস্থা। এর থেকে একটু দূরে পর্দা দিয়ে ঘেরা আরেকটা বিশেষ জায়গা আছে। সুলতান এবং বিশেষ বিশেষ অতিথিদের সেখানে বসতে দেয়া হয়।

হাল নিজেকে সূর্যের খরতাপের নিচে সাধারণ জনগণের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। বাইরের দরজার দিকে হৈ চৈ-এর মাঝে সে মিশে আছে। দাস বিক্রয়ের জায়গাটা চার ধাপ বিশিষ্ট মঞ্চের মতো মনে হচ্ছে। একেবারে উপরের ধাপে রয়েছে বিক্রয়ের জন্য আনা দাসগুলো। যেন আগত ক্রেতারা এবং সাধারণ দর্শনার্থীরা তাদেরকে খুব ভালভাবে দেখতে পারে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে নিলামদার। ভিড়ের মাঝে কোনো বিডারকে ভালভাবে খেয়াল করার জন্য সে মাঝে মাঝে তৃতীয় ধাপে নেমে আসছে। এরপর শেষ ধাপে রয়েছে নিলামদারের শক্তিশালী দুজন দাস। যদি কেউ পালিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় তবে দাস দুজন তাদেরকে আটকে ফেলবে।

হাল মাঝামাঝি অংশের একপাশে অবস্থান করছে। জাঞ্জিবার-এ যে রাতে জুডিথকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সে রাত থেকে এখনো পর্যন্ত হাল শেভ করেনি। এমনকি চুলও কাটেনি। চুল দাড়ি লম্বা হয়ে তার মুখের প্রায় সবটুকু ঢেকে রেখেছে। সেই সাথে সে এমন ছদ্মবেশ ধারণ করেছে যে তাকে যেন একজন ক্যাপ্টেন মনে না হয়। তাকে একজন দাস ব্যবসায়ীর মতই লাগছে এখন।

 হাল-এর জন্য আরও একটা চিন্তার ব্যাপার আছে–আবোলি রিভারস-এর জাহাজ একিলিস-এ রয়ে গিয়েছে। অ্যাবোলির সাথে বিগ ডেনিয়েল এবং বাউ এর অন্যান্য বিশ্বস্ত নাবিক রয়েছে। ওদেরকে রাখা হয়েছে এই কারণে যাতে দস্যু ক্যাপ্টেনটা হালকে রেখে পালিয়ে যেতে না পারে কিংবা কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

“আমি দুঃখিত পুরনো বন্ধু,” হাল তাকে বলেছিল। তুমি যদি আমার সাথে থাক তাহলে তারা সহজেই আমাকে চিনে ফেলবে। কারণ তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব বহু দিনের। এ যাত্রায় মি, ট্রোম্প আমাকে সঙ্গ দিবে। এটাই বরং নিরাপদ।

 অবশ্য হাল জানে যে সেও যদি অ্যাবোলির মতো উপকূলে না যেত সেটা তার জন্য অনেক নিরাপদ হত। কিন্তু রিভারস-এর মতো কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। রিভারস যে তার জুডিথকে কিনে আবার জাহাজে ফেরত আসবে এতটা আস্থা রাখার মতো লোক সে নয়। কারণ পেশাগতভাবে সে একজন চোর এবং দস্যু। সে যে আবার জুডিথকে চুরি করে নিয়ে যাবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দিবে।

একের পর এক সব দাস নিলামে বিক্রি হয়ে গেলে সবশেষে জুডিথ-এর জন্য ডাক দেয়া হয়। দিনের সবচেয়ে সেরা পণ্য হিসেবে জুডিথ-এর নাম উল্লেখ করা হলো, সেই সাথে তার রসালো বর্ণনা দেয়া হলো। হাল যে তার সন্তানের পিতা এটাও উল্লেখ করতে ভুলল না তারা। জুডিথ-এর হাতদুটো পেছন দিকে বাঁধা আছে। তাই সামনের লোকগুলোর লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার কোনো রাস্তাই তার সামনে খোলা ছিল না।

হাল-এর ক্রোধ বাড়তে বাড়তে এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে যেমনটা সে তার জীবনে কোনোদিন অনুভব করেনি। তার রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়েছে। তার নিঃশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তার দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে শুরু করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে কোনো শত্রুকে বধ করার জন্য সে উন্মত্ত হয়ে আছে। তার ডান হাতের মুষ্টি কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে যেন সে যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ার-এর বাট ধরে আছে।

“না,” ট্রোম্প হাল-এর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “মোটেও না! আমি আপনার অনুভূতি বুঝতে পারছি। আমি জানি আপনি তাদের সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। রিভারসকে তার কাজ করতে দিন। আপনি যদি এখন আপনার নিজের দিকে সমস্ত আকর্ষণ টেনে আনেন তাহলে সব পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়ে যাবে।”

 ট্রোম্প কি বলছে তার একটি কথাও হাল ভালভাবে বুঝতে পারল না। কিন্তু তার শারীরিক বাধা এবং কণ্ঠের আওয়াজে হাল-এর রাগ কিছুটা শান্ত হলো।

হাল তার শরীর ও মনকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে বোঝনোর চেষ্টা করতে লাগল যে নিলামদার দর হাঁকানোর পূর্ব পর্যন্ত হলেও তাকে শান্ত থাকতে হবে। দস্যু রিভারসকে তার কাজ করতে দিতে হবে। নয়ত সব কিছু বিনষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু তারপরও সে সরাসরি জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে চিৎকার করে উঠে, চিন্তা করো না, প্রিয়তমা। আমি এখানে আছি। তোমার সাথেই আছি।

.

জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় কিছু কিছু পুচকে ছোরা দেখা যায় যারা ক্ষুধার্ত পথচারীদের কাছে ফলমূল কিংবা অন্যান্য খাবার বিক্রি করে। পথচারীদের পকেট থেকে কিছু টাকা আদায় করাই এদের উদ্দেশ্য।

সেরকমই একটা ছেলে নিলামের বাজারে এখানে সেখানে ঘুরছে। কিন্তু, সে কারো কাছ থেকে কোনো টাকা আদায় করার চেষ্টা করছে না। সে চুরি করার চেষ্টা করছে। বিক্রয়ের দিকে যে তার মনোযোগ আছে সেটাও বলা যায় না। মাঝে মাঝে সে করুণ চোখে জুডিথ-এর দিকে তাকাচ্ছে। তবে তার সমস্ত মনোযোগ একজনের দিকেই নিবিষ্ট আছে। তাকে সেভাবেই পরিষ্কারভাবে আদেশ দেয়া আছে। সে যাই করুক যেখানেই যাক তাকে অনুসরণ করবে। তার ওপর থেকে তোমার চোখ সরাবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত না সে এবং তুমি উপকূল থেকে চলে আসবে অথবা তাকে এই দ্বীপের বাইরে কোথাও নিয়ে যাবে।”

.

গ্রে প্রিন্স জাহানকে প্ররোচনা দিয়েছে যে তার উচিত ভিড়ের মাঝে কার্টনিকে খুঁজে বের করা। এটা সত্য যে বুজার্ড ক্যাপ্টেন কার্টনিকে আমার চেয়ে ভাল চিনে। সে বলতে থাকে, কিন্তু তার আগমনই ভিড়ের মধ্যে সবাইকে এলোমেলো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। “আমি বহুবছর যাবত মানুষের ব্যবসা করে আসছি। মানুষ চেনার উপায় আমি জানি। আমি ক্যাপ্টেন কার্টনিকে খুঁজে বের করার মতো যথেষ্ট চিনি, কিন্তু ভিড়ের দিকে না তাকিয়ে আমি ক্যাপ্টেন কার্টনিকে খুঁজে বের করার উপায় জানি।”

আর তাই সে পর্দা দিয়ে ঘেরা জায়গাটার প্রথম সারিতে বসল। তার দুই পাশে সুলতান-এর গার্ডরা দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে জুডিথ, এর দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। গ্রে-র মনে ক্ষীণ ইচ্ছে জাগছিল একবার দর হাঁকানোর। এমন সুন্দরী রমণীর জন্য যে কোনো পুরুষের মনেই ইচ্ছে জাগতে পারে। কিন্তু জুডিথ-এর দিকে সে একজন ক্রেতার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না কিংবা একজন প্রেমিক পুরুষের দৃষ্টিতেও তাকাচ্ছে না। তার অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে একারণেই সে জুডিথ-এর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

জুডিথ চায় না পশুর ন্যায় নিচু জাতের কোনো লোক তাকে কিনে নিয়ে যাক। সে জেনারেল পদমর্যাদার অধিকারী এবং তার শরীরে উচ্চবংশীয় রক্ত বইছে। যত কঠিন পরিস্থিতিই আসুক না কেন সে সেই সম্মান এবং স্পিরিট রক্ষা করার চেষ্ট করবে। সেই সাথে সে জানে যে যত বাধাই আসুক না কেন হাল তার জন্য এখানে আসবে। কিন্তু কোথায় সে?

 জুডিথ বুঝতে পারছে যে হাল ছদ্মবেশে আসবে। তাই জুডিথ ভিড়ের ভেতর সেই সবুজ চোখের গভীরতা খুঁজে বেড়াতে থাকে যা তাকে হালের উপস্থিতির নিশ্চয়তা দেবে। একইসাথে সে খুঁজতে থাকে হাল-এর নাকের বাঁকানো অংশটাকে, কিংবা সেই ভঙ্গিমা বা চেহারার সেই চিহ্নটা, যার কারণে তাকে যুবক রাজার মতো মনে হয়।

এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে একসময় সে তার প্রিয় মানুষটির দেখা পেয়ে গেল সে। ভিড়ের মাঝে দুটি চোখের দৃষ্টি তার অক্ষিপটে ধরা পড়ে। সে জানে এই সেই ব্যক্তি, কারণ এই চোখের দৃষ্টি সে অন্তরের অন্তস্তল থেকে চেনে। দেখা পাওয়া মাত্র মনের ভেতরের সেই খুশি সে ধরে রাখতে পারে না। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।

জুডিথ-এর মুখে হাসি ফুটতে দেখে গ্রে’র মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সে জুডিথ এর দৃষ্টি অনুসরণ করে ভিড়ের দিকে তাকাল। অগোছালো কিছু সম্ভ্রান্ত কাপড় পরা শ্যামবর্ণের লম্বা একজন পুরুষ ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রে সেই পুরুষের দৃষ্টি অনুসরণ করে আবারও জুডিথ-এর দিকে তাকাল। এরপর সে গার্ডদের দিকে ফিরে অন্য কোনোরকম আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি বলল, “ওই যে তোমাদের সেই লোক, ক্যাপ্টেন কাটনি। এখন তোমাদের লোকদের বল তাকে ধরে আনতে।”

বুজার্ড প্রিন্স জাহানের ঘেরাও করা জায়গার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে তার সব সময়কার সঙ্গী দাসটিও দাঁড়িয়ে আছে। বুজার্ডকে পেছনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই কারণে যে তার কারণে যেন জনগণের মাঝে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়। কিন্তু গতকাল সন্ধের ঢেউয়ে যখন একিলিস জাহাজ জাঞ্জিবার এসে পৌঁছায় এর কিছু সময় পরই বুজার্ড এবং বেনবুরি কার্টনির অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে এবং মনে মনে পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে।

রিভারস যখন ট্রেস ম্যাকোকোস-এ পৌঁছে এক বোতল রাম-এর অর্ডার দিয়েছিল তখন বুজার্ড বেনবুরিকে সাথে নিয়ে ট্রেস ম্যাকোকোস-এর মালিক এর সাথে আলোচনায় মগ্ন।

তিনজন ক্যাপ্টেন-াদের কার্যকলাপ ও কুকীর্তি একই সূত্রে গাথা-কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়ল। তারা তিনজন একে অপরকে বহু আগে থেকেই চিনে। রিভারস জানায় যে সে জাঞ্জিবার-এ একটি দাস কিনতে এসেছে। তিন নাম্বার রামের বোতল শেষ করতে করতে সে আরো জানায় এই দাস সাধারণ কোনো দাস নয়, সুলতান-এর প্রিয় দাস।

কিন্তু রিভার একজন দস্যু। কোনো দাস ব্যবসায়ী নয়। একজন মানুষ হঠাৎ করে ছুতার মিস্ত্রী থেকে মুদ্রণকারী হয়ে যেতে পারে না। কেউ যদি এভাবে হঠাৎ করে পেশা বদলে ফেলে তবে তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ আছে। বেনবুরি তার দুজন বিশ্বস্ত লোককে একিলিস-এর ওপর নজর রাখতে পাঠায়। তারা যা দেখতে পায় এতে করে বেনবুরির কাছে কারণটা পরিষ্কার হয়ে যায়।

এরপর নিলাম যখন ক্লাইমেক্সের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল তখন অবশেষে রিভারস বিডিং করা শুরু করে। এটা দেখে বুজার্ড কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যায়। প্রিন্স-এর ঘেরাও করা জায়গার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল সে। বুজার্ড তার মাথাটা এদিক সেদিক নাড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল সবার কাছে। এরপর সে আবারও পিছিয়ে গেল। এরপর আর একটিও কথা না বলে প্রিন্স জাহান-এর ব্যক্তিগত বক্স-এর পেছন দিকের সিঁড়ি দিয়ে মাটিতে নামতে শুরু করল বুজার্ড। ওর জন্য ঠিক করা দাসটা ওর পেছনে-পেছনে আসছিল। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডরা সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিল, কারণ তারা জানে যে বুজার্ড প্রিন্স জাহানের সৃষ্টি। এবং সে তাদের মনিবের কথা অনুযায়ীই সব কাজ করে। তাই বুজার্ড যখন জনগণের সামনের দিয়ে হেঁটে ঘেরা দেয়া জায়গাটার পেছনে চলে গেল, তখনো তাদের মনে কোনো সতর্কতা সংকেত বেজে উঠল না।

রিভারস নিলামের দর নিজের দিকে টেনে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু একজনই আছে এখন। মূল্য প্রায় তিন লাখ সিলভার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এত বেশি দামে এ পর্যন্ত কোনো দাসই বিক্রি হয়নি। এই পরিমাণ দর পরিশোধ করতে হলে হয়ত কার্টনিকে তার জাহাজ, পারিবারিক সম্পত্তি সব বিক্রি করতে হবে। কিন্তু তাতে রিভারস-এর কিছু যায় আসে না।

 সে যখন নিলামে জয় প্রায় নিশ্চিত করতে যাচ্ছে ঠিক তখনই সে অনুভব করল যে কেউ একজন পেছন থেকে এসে তার গলায় ছুরি বসিয়েছে। মাফ করবেন ক্যাপ্টেন, লোকটি তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে থাকে। ক্যাপ্টেন বেনবুরি আপনাকে তার অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন, এবং বলেছেন যে আপনি যদি এখান থেকে বেরিয়ে শান্তিপূর্ণভাব আপনার জাহাজে ফেরত যান তবে আমরা আপনাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকব।

“তোমাদের ক্যাপ্টেনকে গিয়ে বলবে …” রিভারস বলতে শুরু করল। এরপর সে মাঝপথে থেমে গেল এবং চিন্তা করে দেখল যে ডেট জাহাজটা এরমধ্যে তার দখলে চলে এসেছে। এখন সে যদি বেঁচে থাকে তবে সে তার সম্পদ উপভোগ করতে পারবে। তাই সে তার কথার সুর বদলিয়ে ফেলল। “তাকে বলবেন যে আমি তাকে শুভকামনা জানিয়েছি। আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব যদি তোমরা এখন আমাকে জাহাজে যেতে সাহায্য কর।”

গ্রে তার একচোখ নিলামের দিকে এবং অন্যচোখ দিয়ে কার্টনির ওপর নজর রাখার চেষ্টা করছে। গার্ডদের একটা দল সাধারণ পোশাকে জনগণের মাঝে মিশে আছে। এরা কার্টনির কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে কি-না এটা বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাল-এর সমস্ত মনোযোগ নিলাম-এর দিকে। নিলাম-এর দর নিয়ে তার দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য এমনকি সারাজীবনের জন্য হয়ত তাকে ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু জুডিথ এবং তার সন্ত নি যদি তার কাছে থাকে তবে এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ।

সাহস পাওয়ার জন্য সে ট্রোম্প-এর দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু ওলন্দাজটা তার পাশে নেই। সে এটা নিয়ে বেশি কিছু ভাবল না। লোকজনের ভিড়ের মাঝে হয়ত কোথাও দূরে সরে গিয়েছে লোকটা।

এরপর সে আবার নিলাম-এর দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু নিলাম ডাকা যে শেষ হয়ে গিয়েছে এটা বুঝতে তার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। নিলামদার জনৈক ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞেস করছে যে সে দর আরও বাড়াবে কি-না। সে নিশ্চয়ই রিভারসকে জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু রিভারস করছেটা কী?

ঠিক তখনই হাল-এর পেটে কেউ একজন আঘাত করল। ব্যথায় উঠল সে। এরপর সে মাথায় আরও একটা আঘাত অনুভব করল।

দাস নিলাম-এর সামনের ঘটনাগুলো তার আর জানা হলো না।

*

গেট খুলে দেয়ার পরপরই সর্বপ্রথম যারা নিলামের মাঠে প্রবেশ করে নিলাম-এর মঞ্চের পাশে জায়গা করে নিয়েছিল তারা এ জানতো যে তাদেরকে এখানে অনেকটা সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে। নিলাম শেষ হওয়ার পূর্বে তারা এখান থেকে বেরুতে পারবে না। অনেকে পানির বোতল, শুকনো খাবার এবং রাম-এর বোতল নিয়ে এসেছে। কয়েকজন মিলে মঞ্চের সামনের অংশের একদিকে একটা ছোটখাট ক্যাম্প তৈরি করেছে। সেখানে রয়েছে নানারকম খাদ্য সম্ভার, কাঠের পিপা ভর্তি বিয়ার। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা পিপা শেষ হয়ে গেল। আরেকটা পিপা সামনের সারিতে লোকজনের বসার জায়গার নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঐ পিপাটার ছিপি খোলা ছিল। ওটার ভেতর গান পাউডার ভর্তি করে গড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সকলের অজান্তে।

ক্যাম্পে আসা লোকজন সবাই মনোযোগ দিয়ে নিলাম ডাকা দেখছিল, কেউ খাচ্ছিল, কেউ পাইপ টানছিল।

কিন্তু একজন নাবিক নিলাম-এর দিকে তাকিয়ে ছিল না। সে প্রিন্স-এর ঘেরাও করা জায়গার দিকে তাকিয়ে ছিল। বুজার্ড যখন সামনে এগিয়ে এসে তার মাথা নাড়াল, তখন সেই নাবিকটি তার পাইপে লম্বা টান দিয়ে একটা কাগজে আগুন ধরিয়ে দিল।

এরপর লোকটা সেই আগুন গান পাউডার-এর লাইনে ধরিয়ে দেয়। তারপর যা হওয়ার তাই হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিৎকার শোনা যায়। আগুন! বাঁচাও! আগুন।

বিক্রি এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু নিলামদার শেষ দর-এর জন্য অপেক্ষা করল না। সে জুডিথকে টেনে স্টেজ থেকে নামিয়ে পেছনের দিকে একটা ঘরে নিয়ে গেল।

মুখোশ পরা লোকটা সেখানে অপেক্ষা করছিল। “আমি একে নিয়ে যাচ্ছি,” সে বলল।

নিলামদার অনেকটা দোটানার মধ্যে পড়ে যায়। তার বিশ্বাসভাজন লোকেরা মুখোশ পরা লোকটাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। “কিন্তু আমার টাকা,” নিলামদার মুখোশ পরা লোকটাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে বলল। “আমাকে বলা হয়েছিল যে এই দাস কোনোভাবেই বিক্রি করা যাবে না। আর আমাকে এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কমিশনও দেয়ার কথা ছিল।”

“কাল সকালে প্রাসাদে যেও, তুমি তোমার কমিশন পাবে। কিন্তু এখন আমি একে নিয়ে যাচ্ছি,” বুজার্ড বলল। এরপর সে জুডিথ-এর গলায় বাধা দড়ি ধরে টান দিয়ে বলল, “তুমি যদি স্বাভাবিক মানুষের মতো দৌড়ে আমার সাথে যেতে না চাও তবে আমি তোমাকে এটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাব।”

জুডিথ বাইরে এলোমেলোভাবে ছুটে পালানো লোকজনের চিৎকার শুনতে পেল। “তুমি কী আমাকে প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ?” সে জিজ্ঞেস করল।

বুজার্ড মাথা নাড়াল। জুডিথ বুজার্ড-এর পেছন পেছন দৌড়ে ভিড় থেকে পালিয়ে বাইরে চলে আসলো। ওখানে এসে দেখল, প্রিন্স-এর বাহন বাইরে অপেক্ষা করছে। “উঠে বস,” বুজার্ড বলল। “কেউ যদি দেখতে না পায় তবে আপনি নিরাপদ থাকবেন।”

জুডিথকে যেমনটা বলা হলো, তেমনটাই করল সে। আগুন লাগার পূর্বেই জুডিথ-এর মনে অদ্ভুত একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। এখানে অনেক রকম মানুষ সমবেত হয়েছে। তাই অনেক রকম লোভ-লালসা এবং প্রতিহিংসাও একত্রিত হয়েছে। সে অনেকটা সময় ধরে সৈন্যদের মাঝে কাটিয়েছে। সে জানে যেকোনো মুহূর্তে এসব উপাদান বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

“ঈশ্বর, হালকে নিরাপদে রেখ, সে প্রার্থনা করতে থাকল। যদি সে নিরাপদে থাকে এবং আমি প্রিন্স এর প্রাসাদে ফিরে যাই তাহলে হয়ত আমরা মিলিত হব না। কিন্তু তারপরও একটা আশা থেকে যাবে।

বাহনে উঠে বসার পর সে খেয়াল করল যে, এখনো তার হাত পেছনে বাধা। এমনকি গলায়ও রশিটা বাধা আছে। প্রিন্স এর বন্দি থাকা অবস্থায় কখনো তার সাথে এমনটা করা হয়নি। তাহলে কেন বুজার্ড তার সাথে এমনটা করছে এখন?

বুজার্ড দেখতে পেল যে জুডিথ পেছনে উঠে বসেছে। সে তার দাসটাকেও পেছনের সিটে বসতে বলল। এরপর সে হেঁটে বাহনের সামনে এসে ডাইভারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। “তুমি কী আমাকে উঠতে সাহায্য করবে? সে ড্রাইভারেরর পাশের সিটের দিকে ইশারা করে বলল।”

ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বুজার্ডকে টেনে তোলার চেষ্টা করল।

বুজার্ড লোকটির হাত শক্তভাবে ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিচের দিকে টান দিল। চালকটি তার আসন ছেড়ে মাটিতে পড়তে শুরু করল।

চালকটি যখন নিচে পড়ে গেল তখন বুজার্ড তার তলোয়ারটি লোকটির গলায় বসিয়ে শক্তভাবে টান দিল। লোকটি যখন রক্তশূন্য হয়ে মারা যেতে শুরু করল তখন বুজার্ড কোনোভাবে ড্রাইভারের আসনে উঠে বসলো। সে তার তিন আঙুলবিশিষ্ট একমাত্র হাতটি দিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে শক্তভাবে টান দিল। প্রাণী দুটো তার কণ্ঠের তীব্রতা বুঝতে পেরে বাহনটাকে সর্বোচ্চ বেগে রাস্তা বরাবর ছুটিয়ে নিয়ে গেল।

যেখান থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল তার কাছাকাছিই ছিল গ্রে’র অবস্থান। তাই যারা প্রথম এলার্ম শুনতে পেয়েছিল, তাদের মধ্যে সে একজন।

 গার্ডদের ক্যাপ্টেন-এর প্রধান দায়িত্ব প্রিন্স-এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তার মালিককে বাহন-এ উঠিয়ে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা নিশ্চিত করার পর এদিকে কী ঘটেছে সেটা দেখার জন্য সে আবারও নিলাম-এর বাজারে ফিরে আসলো। কয়েক মিনিট পরে গ্রে তাকে খুঁজে পায়। প্রিন্স নিরাপদে পৌঁছেছে কি-না এটা জিজ্ঞেস করার পর সে তার আসল দুশ্চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাইলো। “তোমরা কী কার্টনিকে খুঁজে পেয়েছ?”

ক্যাপ্টেন না-সূচক মাথা নাড়াল, “না,” “আপনি যেখানে বলেছেন আমার লোকেরা সে জায়গার দিকেই যাচ্ছিল। ঠিক তখনই আগুন ধরে গেল। এরপর তারা সেখানে পৌঁছে আর কার্টনিকে খুঁজে পায়নি।”

“তাহলে, সে নিশ্চয়ই লোকজনের সাথে এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছে।”

গার্ড ক্যাপ্টেন মাথা নাড়ায়। “না, আমার লোকেরা সেদিকে নজর রেখেছে। লোকজন যখন বেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছেছে আমার লোকেরা সেখানেও এল তাজারকে খুঁজে পায়নি।”

“তাহলে আমি তাকে খুঁজে বের করব।” কনসাল গ্রে বলল। সেই সাথে সে মনে মনে আরো বলল, “আমার নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”

বাহনটা ঠকঠক করে যেতে যেতে একসময় থেমে গেল। বুজার্ড চালকের আসন থেকে নেমে এসে পেছনের দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠল, “বেরিয়ে আসুন।”

 জুডিথ ভ্রুকুঁচকে তাকাল। বুজার্ড সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় যদিও বাইরের অংশটা পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না। তবুও তার মনে হলো যে এটা প্রিন্স-এর প্রাসাদ নয়।”

“আমি কোথায়?” সে জিজ্ঞেস করল। বুজার্ড উত্তর দিল না। তার পরিবর্তে শুধু বলল, “একে ধর।”

সে সামনে থেকে সরে গেলে সেখানে দুজন লোক এসে হাজির হলো। একজন আফ্রিকান এবং একজন সাদা চামড়ার লোক পূর্বেই সেখানে দাঁড়িয়ে। ছিল। তারা জুডিথ-এর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। জুডিথ ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে অন্যপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করল।

কিন্তু ঐপাশেও সে অন্য একজন লোকের বাহুতে গিয়ে পড়ল। লোকটি তাকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে। এরপর এমনভাবে জুডিথকে কাঁধের ওপর তুলে ফেলল যেন জুডিথ স্রেফ ছোট্ট শিশু। এরপর সে জুডিথকে নিয়ে দ্রুত দৌড়াতে থাকে। ছোট পাথর বসানো পথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে সে পানির ধারে পৌঁছে যায়। এরপর পানির ওপর বসানো কতগুলো পাতলা নৌকোর ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে থাকে লোকটা। যখন তারা লংবোট-এ গিয়ে পৌঁছে তখন দ্রুত লংবোট ছাড়ার আদেশ দেয় সে।

গ্রে তার নিজের বাড়িতে পৌঁছে তার চাকরদেরকে ডাক দেয়। তাদের হাতে কিছু নামের তালিকা ধরিয়ে দেয়। সেখানে সম্মানিত কার্পেট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অনেক ক্রিমিনালও রয়েছে। তাদেরকে বলে দেয় কোথায় এসব লোকদের পাওয়া যাবে। এরপর ওদেরকে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে বলে। সে নিজেও বেরিয়ে পড়ে।

সে যেসব ধনী ব্যবসায়ী এবং ওমানী অভিজাত লোকদের সাথে কথা বলল তারা ক্যাপ্টেন কার্টনির ব্যাপারে খুব বেশি কিছু তথ্য দিতে পারল না। কিন্তু তার চাকরেরা ফিরে আসার পর তাদের মাঝে দু-একজন তাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সে কিছু নতুন নাম খুঁজে পেল এবং সেসব লোকদের ঠিকানায় খোঁজ নেয়া শুরু করে দিল। এরপর কনসাল গ্রে আবিষ্কার করল যে ক্যাপ্টেন কার্টনির সাথে কী ঘটেছে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে। আপনমনে কিছুক্ষণ চিন্তা করল সে। তার প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে এখন কারো সাহায্যের প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে কেবল একজনই তাকে সাহায্য করতে পারে। একথা মনে আসা মাত্রই সে প্রিন্স জাহানের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।

*

ধীরে-ধীরে চোখ খোলার চেষ্টা করল হাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না সে। কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু না, পারছে না। এরপর সে বুঝতে পারল যে তার মাথায় পট্টি বাঁধা এবং মুখটা কাপড় দিয়ে আটকানো আছে। সে তার পেছন দিকটা দেয়ালে ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে। তার হাত বাঁধা, গোড়ালিতে শেকল পরানো। এককথায় তাকে অসহায় জীবই বলা যায়।

যদিও সে শুনতে পাচ্ছে এবং গন্ধ শুঁকতে পারছে। এই দুটি ইন্দ্রিয়ই তাকে আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে বলে দিচ্ছে। কুকুরের ময়লা, আবর্জনা যুক্ত স্থানে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এবং একটু দূর থেকে সে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।

হাল-এর ভয় হচ্ছে কুকুরটি যদি এসে তাকে আক্রমণ চালায় তবে তার কিছুই করার থাকবে না। কুকুরের চিৎকার-এর সাথে সাথে আরেকজন লোকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সে কুকুরটাকে থামানোর চেষ্টা করছে। লোকটার হাতে ধরা চাবুক দিয়ে সে বাতাসে আঘাত করছে-সেই শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবকিছু নীরব হয়ে যায়, হাল-এর চিন্তা-ভাবনা তখন আশে পাশের জগৎ থেকে সেই লোকটির কাছে চলে যায় যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। রিভারস নিশ্চয়ই তার সাথে প্রতারণা করেছে। কিন্তু সেটার ব্যাখ্যা কী হতে পারে। এরপর তার স্মৃতি সেই পুরনো মুহূর্তটায় ফিরে যায়। সে পাশে তাকিয়ে দেখে যে ট্রোম্প তার পাশে নেই।

“আমি কি চরম বোকা। কেন আমি ব্যাপারটা বুঝলাম না? ট্রাম্প আমাকে রিভারস-এর কাছে নিয়ে গিয়েছে। তাদের দুজনের নিশ্চয়ই একত্রে কোনো পরিকল্পনা ছিল আমার বিরুদ্ধে, হাল মনে মনে ভাবতে লাগল।

ওদের দুজনের প্রতারণার কথা মনে করে হাল-এর পেটের ভেতর সবকিছু যেন মোচড় দিয়ে উঠছে। হাল যেখানে বসে আছে তার কিছু দূর থেকে সে লোকজনের অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। লোকটির কথার সাথে সাথে চিৎকার এবং হৈ হুল্লোর-এর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য হাল-এর মনে হলো যে সে সম্ভবত এখনো নিলাম-এর বাজারে রয়েছে।

তাকে ব্লক-এর পেছনে আনা হয়েছে। কিন্তু কথাগুলো নিলাম-এর লোকগুলোর মতো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা আবদ্ধ জায়গায় কয়েকজন লোক কথা বলছে। এরপর গোলমাল আবার হঠাৎ করে বাড়তে থাকে। হাল-একটা দরজা খোলার শব্দ শুনতে পায়। কুকুরটি আবারও ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে। এবার পূর্বের চেয়ে বেশি উচ্চস্বরে। সেই সাথে কুকরটির মালিকের ক্রমাগত চিৎকার এবং চাবুকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কিছু চাবির ঝনঝন আওয়াজ শুনতে পায় হাল। এরপর চাবির আওয়াজ আর কুকুর-এর ঘেউ ঘেউ শব্দ তার কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে। কিন্তু তবুও সে কুকুরের শব্দ এবং চিৎকার আর হৈ হুল্লোর শুনতে পাচ্ছে।

 ডগফাইট। হাল চিন্তা করল, কিন্তু আমি এখানে কী করছি? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই কেউ একজন হাল-এর বাহু খামচে ধরে তাকে দাঁড় করানোনার চেষ্টা করল। ওদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল হাল। ওদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে পিছিয়ে গেল। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। লোকগুলো তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে হালকে ধরে রেখেছে।

এরপর হাল আর লড়াই করার চেষ্টা করল না। এখন আর কিছুই করার নেই। ভাল কোনো সুযোগের জন্য নিজের শক্তিটুকু জমিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আরেকবারের জন্য ভয় তাকে ঘিরে ধরে। এই ভয় তার বর্তমান অবস্থার চেয়ে বরং ভবিষ্যতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে সেই কারণে। কিন্তু এই লোকগুলোকে কিছুতেই দুর্বলতা বুঝতে দেয়া যাবে না। তার নিঃশ্বাসের গতি আস্তে আস্তে কমানোর চেষ্টা করল সে। একই সাথে তার মনোযোগ এই পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে অন্যকোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। সে সাগরের কথা চিন্তা করল, তার জাহাজের কথা মনে করল, তার বাবার সেই অমানবিক কষ্ট এবং দুঃসহ জীবনের কথা ভাবল যে জীবন মৃত্যুর পূর্বে তার বাবাকে কাটাতে হয়েছে। তবুও তার পিতা তার সম্মান এবং মর্যাদাকে বিসর্জন দেন নি। হাল বুঝতে পারছে এখন তাকে সেই পথই অনুসরণ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার হৃদস্পন্দন বুঝতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দেবে না।

সে বুঝতে পারছে কেউ একজন এসে তার হাতের বাঁধন কেটে দিচ্ছে। হাতের বাঁধন কাটা শেষ হলে একজন তার বাম হাত সামনে টেনে নিয়ে একটা লোহার রিং পরিয়ে দিল। রিং-এর সাথে লাগানো শেকলের কারণে হাতটাকে তার বেশ ভারী মনে হচ্ছে।

আবারো তার মনে ভয় ফিরে আসতে শুরু করলে সে উচ্চস্বরে বলে উঠল, “আমার নাম কার্টনি” যতটা না লোকগুলোকে শোনানোর জন্য, তারচেয়ে বরং নিজের উদ্দেশ্যেই কথাটা বলল সে। লোকগুলো তার কথার উত্তরে কিছুই বলল না। লোকগুলো হয়ত বুঝতেই পারেনি হাল কী বলেছে।

বাইরের দিক থেকে আসা লোকগুলোর গোলমাল এবং হৈ চৈ বাড়তেই থাকে। শেষবারের মতো চিৎকার এবং বশির আওয়াজ শোনা যায়। হাল বুঝতে পারে ডগফাইট শেষ হয়েছে।

হাল অনুভব করে তার গলার শেকল ধরে কেউ টানছে এবং তার মাথাটাকে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে। তার উচ্চতার প্রায় অর্ধেকটা বাকা হতে হয় তাকে। তখন সে বুঝতে পারে যে এই দরজাগুলো নিশ্চয়ই কুকুরগুলোর প্রবেশের জন্য রাখা হয়েছে।

বাইরে বেরিয়ে আসার পর তার পৃথিবী হঠাৎ করেই হৈ চৈ এবং লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরে উঠল।

বাতাসে তাজা রক্তের গন্ধ পেয়ে তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। মানুষের আনন্দের জন্য এখানে হত্যাকাণ্ড ঘটছে এটা সে মনে স্থান দিতে চাচ্ছে না। ঠিক তখনই সে কাছাকাছি আরেকটা শব্দ শুনতে পায়। অন্য একজন মানুষ গার্ডদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য তর্জন গর্জন করছে।

“ভদ্রমহোদয়গণ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম,” অ্যারাবিক ভাষায় একজন চিকন লোক উচ্চস্বরে আনুষ্ঠানিক উপস্থাপনা শুরু করল। তার কথা শুরু হতেই ভিড়ের মাঝে সবাই চিৎকার শুরু করে দিল। “নতুন কিছু দেখার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করুন। এরকম রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা এর পূর্বে কখনও আপনারা উপভোগ করেননি। এখানে কোনো দৌড়াদৌড়ি হবে না। লুকোচুরি হবে না। শুধু রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।”

 হাল শুনতে পায় একটি কষ্ঠ তার পাশ থেকে বলছে, “এই নাও, এটা ধর” এবং একটি তলোয়ার-এর বাট তার ডান হাতের তালুতে চাপ দিতে থাকে। সে যখন তলোয়ার-এর বাটটা ধরে তখন অ্যাবোলির কথাগুলো তার মাথায় বাজতে থাকে। তলোয়ার শিক্ষা দেয়ার সময় অ্যাবোলি এই কথাগুলো তাকে বলেছিল।

“তলোয়ারটাকে হাত দিয়ে গাছের ডাল ধরার মতো শক্ত করে ধরবে না গাল্ডওয়েন। তাহলে তলোয়ারটা তোমার কাছে ভারী এবং মৃত অস্ত্র বলে মনে হবে। আঙুল দিয়ে তলোয়ারটাকে খুব আলতো করে ধরবে। তাহলে আঙুল দিয়ে তলোয়ারটাকে তরল পদার্থের ন্যায় নাড়াচাড়া করতে পারবে।”

সে তলোয়ারটা তুলে ধরে হাতের মধ্যে এর অবস্থান নিশ্চিত করল। তলোয়ারটা একবার উঠিয়ে একবার নামিয়ে, নাড়াচাড়া করে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করবে সেটা ঠিক করে নিল সে।

 “গুড, গান্ডওয়েন,” হাল অ্যাবোলির কণ্ঠ শুনতে পায়, “এখন তুমি খুব সহজেই তোমার আক্রমণের দিক পরিবর্তন করতে পারবে। এভাবে ধরে রাখলে তলোয়ারটা তোমার হাতে জীবন্ত থাকবে।”

সে তলোয়ারটা মুখের সমান উচ্চতায় তুলে আনল। চোখবাধা অবস্থাতেই কিছুক্ষণ তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। তলোয়ারটা গালের সাথে লাগিয়ে এর ধার এবং গঠন বোঝার চেষ্টা করল। এরপর বাতাসে কয়েকবার তলোয়ার চালিয়ে অনুশীলন করার চেষ্টা চালালো। সেই সাথে এটাও ভাবতে লাগল যে তার সামনের প্রতিদ্বন্দ্বীও নিশ্চয়ই একই কাজ করছে।

“আজকে দাসের বাজারে আপনারা নিশ্চয়ই অনেকে নাস্তিক বেশ্যা নাজেকে দেখেছেন,” সমবেত জনতা চিৎকার করে উঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আগুন লেগে যাওয়ার কারণে তার বিক্রি শেষ হয়নি। কিন্তু নাজেত হুত করেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। বাতাসে হারিয়ে গিয়েছে।”

 “না”, কাপড় মুখে থাকা অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠল হাল। “সে হারিয়ে যেতে পারে না। তাকে পুনরায় কেউ আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারবে না। আমরা যখন মিলিত হব তখন একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। তাকে আর দৃষ্টির আড়াল হতে দেব না।”

“কিন্তু আমরা আপনাদের জন্য এরচেয়ে ভাল কিছুর আয়োজন করেছি : এল তাজার-এর হত্যাকাণ্ড। আপনারা জানেন বা দেখেছেন যে সে একজন ভাল যোদ্ধা। এখানেও তার জন্য যুদ্ধের আয়োজন করা হয়েছে। একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সে যুদ্ধ করে যাবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। জনতার চিৎকার থেমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘোষণাকারী অপেক্ষা করল। এরপর আবার বলতে শুরু করে দিল। তোমরা কেউ যদি চোখের বাধন এবং মুখের গ্যাগ খোলার চেষ্টা কর তবে তোমরা যেখানেই দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই তোমাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হবে এবং কুকুরকে খেতে দেয়া হবে।”

এরপর অনুষ্ঠানের প্রধান আহ্বায়ক তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “প্রস্তুত হও।”

হাল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। পা দুটোর মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে এক পা সামনে এগিয়ে নিল সে। এরপর হাঁটু দুটোকে সমকোণে বাঁকিয়ে দাঁড়াল যেন অভিকর্ষজ তুরণের কেন্দ্রবিন্দু পায়ের গোড়ালি বরাবর থাকে।

হাল চিৎকার সমবেত জনতার চিৎকার শুনতে পায়, “ফাইট,” “ফাইট”, “ফাইট।”

হাল জানে তার প্রতিপক্ষ এগিয়ে আসছে তার দিকে। তাই সে ডানদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মুখটাকে আঘাতের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য তলোয়ারটাকে মুখ বরাবর তুলে ধরে। প্রতিপক্ষের তলোয়ারটা ঝনঝন শব্দে হাল-এর তলোয়ার এ আঘাত করল। এরপর লোকটি আবারও দূরে সরে যায় এবং হাল-এর শেকলে টান পড়ে।

হাল চারদিকে এত আওয়াজ-এর মাঝেও কান পেতে রাখে যদি এমন কিছু শুনতে পারে যেটা তাকে সাহায্য করবে। প্রতিপক্ষের পদধ্বনি এবং নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছু শুনতে পায় না সে। তবে এ থেকেই সে প্রতিপক্ষের অবস্থান সম্পর্কে কিছু ধারণা পায়। সে সামনের দিকে এগোতে থাকে যেন তার শেকলটা কিছুটা শিথিল হয়। এরপর কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই সে পিছিয়ে পড়ে এবং শরীরটাকে বাঁকাতে থাকে। এতে করে শেকলে পুনরায় টান পড়ে; প্রতিপক্ষের শরীর এটাকে বাধা দিচ্ছে। এরপর সে তার তলোয়ারটাকে বাতাসের মধ্যে ডানে বায়ে উপরে নিচে সবদিকে চালনা করতে থাকে।

কিন্তু সে কোনো কিছুকেই আঘাত করতে সমর্থ হয় না। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারে না যে প্রতিপক্ষ কী তার কাছাকাছি এসেছে? প্রতিপক্ষের তলোয়ার কী তাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়েছে?

“কোথায়, তুমি বন্ধু? এদিকে আস, আমরা খেলা শেষ করি।” হাল তার ডানপাশে একটা কিছুর নড়াচড়া বুঝতে পারে। তলোয়ারটা ভূমির সমান্তরালে ডান থেকে বামে ঘোরাল; প্রতিপক্ষের মাথা কেটে ফেলার চেষ্টা করছে সে। তখনই সে দুই তলোয়ার-এর ঘর্ষণ-এর আওয়াজ শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে তার প্রতিপক্ষও তার কাছাকাছি অবস্থানে থেকে আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে।

 এরপর হাল নিজের তলোয়ারটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের গতিরোধ করে দ্রুত তার মাথায় আঘাত করল। এবার সে ঘোঙানির মতো আওয়াজ শুনতে পায়, সেই সাথে তার তলোয়ারটা নরম কিছু একটাকে আঘাত করেছে। প্রতিপক্ষ তার তলোয়ার দিয়ে হাল-এর তলোয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।

তার প্রতিপক্ষ আঘাত পেয়েছে। এই সুযোগ তাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রতিপক্ষ এই আঘাত কাটিয়ে ওঠার আগেই তাকে আঘাত করতে হবে। সে শেকলের লাইন বরাবর এগিয়ে যায় এবং তলোয়ারটা ডানে বায়ে দ্রুত ঘোরাতে থাকে।

ক্লান্তিতে তার বুক ধরফর করতে থাকে, পেশিগুলো অবশ হয়ে আসছে। তার ওপর মুখে গ্যাগ লাগানো থাকায় সে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। শুধু নাক দিয়ে বাতাস নিতে পারছে যেটা তার শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারছে না। একদিকে তার শরীর অক্সিজেন নেয়ার জন্য যুদ্ধ করছে আর অন্যদিকে তার মন দৃষ্টিহীনতার জন্য ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ছে। তার মন তাকে চিৎকার করে বলছে তলোয়ার দিয়ে মাংস কেটে নিজেকে ছোট করে ফেলতে যেন সে সহজেই কোথাও লুকিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এখানে লুকানোর কোনো জায়গা নেই, নেই কোনো রাস্তা।

অ্যাবোলি তাকে শিখিয়েছে তলোয়ার হচ্ছে হাতের বাড়তি একটা অংশ। তাই তলোয়ার হচ্ছে জীবন্ত একটা কিছু যেটা রক্তের জন্য হাহাকার করে। কিন্তু এইবার তার তলোয়ার মাংস নয় শক্ত কোনো স্টীল বা লোহাকে আক্রমণ করল যার কম্পন তার বাহুতে কাঁপিয়ে পুরো পেশিতে ছড়িয়ে পড়ল। এবার অন্যলোকটি শেকলটা উপরের দিকে টানতে থাকে। এতে করে হাল সামনের দিকে ধাক্কা খায়। লোকটি হাল-এর ডান বাহুর পাশ দিয় এসে শেলকটা হাল এর গলায় প্যাচিয়ে ফেলল।

মাটিতে পড়ে গেল হাল। সে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। সে বুঝতে পারে যে লোকটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে, তার অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। লোকটির কনুই হাল-এর পেছনে ধাক্কা দিচ্ছে। লোকটি নিজের পা দিয়ে হালকে প্যাচিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তার প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী। হাল লাথি দেয়ার চেষ্টা করল, এরপর গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করল। হাল-এর মুখ ফুলে গেল। এখন সে মাথায় অনেক চাপ অনুভব করছে যেন যে-কোনো মুহূর্তে মাথাটা ফেটে যাবে। চোখগুলো বের হয়ে আসবে।

চারপাশে কোনো কোলাহল বা হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে না। চারদিকে নীরবতা বিরাজ করছে। নিজের হার্টের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছে হাল যেটা আস্তে আস্তে ধীরগতি সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে।

“আমি মারা যাচ্ছি।”

 “না, হেনরি। তুমি এখানে মারা যাবে না।” আমি নিষেধ করছি।

 “বাবা?”

“উঠ, উঠ হেনরি। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াও। এই লোকটিকে হত্যা কর। তোমাকে পারতেই হবে।”

 এখনো কী সে তলোয়ার হাতে ধরে আছে? হ্যাঁ। কিন্তু তার শক্তি আস্তে আস্তে কমে আসছে। তাকে এখনি শক্তভাবে আঘাত করতে হবে। সে তার তলোয়ার ধরা হাতের মুষ্টি আস্তে-আস্তে আলগা করল। আঙুল দিয়ে তলোয়ার এর হিল্ট শক্তভাবে অনেকটা হাতুরির মতো করে ধরল। এরপর মুখে গ্যাগ লাগানো অবস্থাতেই সে চিৎকার করে তরবারির পমেল দিয়ে লোকটির মাথায় আঘাত করল।

যেভাবেই হোক লোকটি এখনো হাল-এর গলায় শেকল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শেকলের টান আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে। হাল-একটার পর একটা আঙুল শেকলের নিচ দিয়ে গলার চামড়ার ওপর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এটুকুই নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য যথেষ্ট। তার শরীরে নতুনভাবে রক্তচলাচল শুরু হয়েছে। ভাল হাত দিয়ে আবারো সে তলোয়ারটা উপরে উঠিয়ে আনে এবং লোহার হিল্ট দিয়ে লোকটির মাথায় দ্বিতীয়বার আঘাত করে। বাম হাতের পুরোটাই সে শেকলের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সে এবার একটানে শেকলটা গলা থেকে উপরে ফেলে দিয়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল। যদিও এখনো তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

 হাল মাটিতে পড়া শেকলের লাইন অনুসরণ করতে থাকে। গ্যালারিতে সমবেত জনতার চিৎকার বাড়ছে। যতই সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই চিল্কারের তীক্ষ্ণতা বাড়ছে। আর তখনই, শেকলের ঝনঝন আওয়াজ পাওয়া গেল। হাল বুঝতে পারে লোকটি কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাই সে তার তলোয়ারটা সামনের দিকে চালনা করল। প্রতিপক্ষের তলোয়ার-এ আঘাত করল ওটা। এরপর কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলতে থাকে। রক্তের ছিটেফোঁটা এসে ওর শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। হাল বুঝতে পারল যে তার প্রতিপক্ষের শক্তি শেষ হয়ে আসছে।

পরবর্তী আক্রমণটা প্রতিপক্ষের মাংস ভেদ করে হাড়-এ গিয়ে লাগল। হাল শক্তভাবে তলোয়ারটা পুনরায় পেছন দিকে টান দিয়ে সরিয়ে ফেলল। আশেপাশের চিৎকার আস্তে আস্তে কমতে থাকে। হাল বুঝতে পারে খেলা শেষ হয়েছে। জিতে গিয়েছে সে। তাই সে রক্তমাখা তলোয়ারটা বাম বাহুর নিচে রেখে ডানহাত দিয়ে চোখের বাঁধন মাথার ওপর উঠিয়ে ফেলল।

এরপর সে তলোয়ারটা ফেলে দিয়ে দুহাত দিয়ে মুখের গ্যাগ খামচে ধরে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। কারণ তার পেটের সবকিছু উল্টে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে।

গ্যাগ সরে যাওয়ার পর তার চোখের সামনে সে যা দেখল সেটার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

তার সামনে পড়ে থাকা আহত ব্যক্তিটা হচ্ছে ক্যাপ্টেন ট্রোম্প।

ওলন্দাজ লোকটা হাঁটুগেড়ে বসে আছে। তার কপাল থেকে রক্ত ঝড়ছে। হাল তরবারির পমেল দিয়ে যে আঘাত করেছিল সেখানে থেকে রক্ত পড়ছে। তার কাঁধে আঘাত লেগেছে। নাকের হাড় ভেঙে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে ক্ষতটা তার শরীরে হয়েছে সেটা তার বুকের ওপর। বুকের খাঁচার কয়েকটা হাড় বের হয়ে আছে।

হাল-এর মনে মিশ্র ধরনের অনুভূতি কাজ করতে থাকে। ভয় এবং অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করল। সে তার বন্ধুসম মানুষটাকে শেষ করে দিয়েছে। তার মধ্যে লজ্জাবোধও কাজ করছে এই কারণে যে এই লোকটাকে সে প্রতারক ভেবেছিল। অথচ ট্রোম্প তার বিশ্বস্ততার পুরস্কার এইভাবে পেল। হাল-এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে ট্রোম্প-এর সামনে বসে পড়ল। ট্রোম্প প্রাণপণে চেষ্টা করছে চোখের বাধন খুলে ফেলতে। হাতের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কারণেই হোক কিংবা কৌশল না জানার কারণেই হোক সে সেটা খুলতে পারছে না। হাল বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। ট্রাম্পের চোখের বাঁধন খুলে দিতে যে খুব লজ্জা বোধ করছে সে। ট্রোম্প যদি এভাবে মৃত্যুবরণ করে তাহলে অন্তত সে কোনোদিন জানতে পারবে না কে আসলে তার হত্যাকারী।

“তাকে এভাবেই মরতে দাও,” হাল আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে চিৎকার করে উঠল। আকাশটাও মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।

সে যুদ্ধক্ষেত্রের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকল যেন সে তার মনে জমা অজস্র প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতে পারে আশেপাশে। কিন্তু অপরিচিত কতকগুলো শক্রর চেহারা ছাড়া সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত চারজন মানুষকে সে দেখতে পায় যারা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছিল, ওরা তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছে। এরপর হাল একটা শিশুর অপূর্ণ চোখ দেখতে পায়। চোখদুটি তার কাছে পরিচিত মনে হয়। কিন্তু এতক্ষণ ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে তার মস্তিষ্ক কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছে না যে কোথায় দেখেছে সে শিশুটিকে। তার বদলে এখন তার কি করা উচিত সেই দিকে মনোনিবেশ করল সে। হাল কাঁপা কাঁপা হাতে ট্রোম্প-এর কাছে পৌঁছায়, এরপর তার চোখের বাধন খুলে দেয়।

 “আমি দুঃখিত,” হাল বিড়বিড় করে বলল। আমি খুবই দুঃখিত…ঈশ্বরের দোহাই আমাকে ক্ষমা কর…বন্ধু।

ট্রোম্প তীক্ষ্ণভাবে হাল-এর দিকে তাকানোর চেষ্টা করল কিন্তু তার চোখের পাতার শক্তি আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। সে সামনের দিকে পড়ে যেতে শুরু করে, কিন্তু তার আগেই হাল তাকে ধরে ফেলল। হাল ট্রোম্প-এর মাথার পেছনের বাঁধন খুলে ওর মুখ থেকে গ্যাগটা সরিয়ে ফেলল। কোনো কথা না বলে ট্রোম্পকে সে মরতে দিতে চায় না। কিন্তু ট্রোম্প-এর মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না।

হাল তার বন্ধুকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে যখন অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা সোজা করল, তখন সে দেখতে পেল অস্ত্র হাতে চারজন লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

“তাকে কেনেল-এর ভেতরে নিয়ে যাও। অনুষ্ঠানের প্রধান আহবায়ক ঘোষণা করল। দুজন লোক তাকে টানতে টানতে সোজা করে দাঁড় করাল। হাল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে তীব্র কণ্ঠে গর্জন করে বলে উঠল, “আমি এখনো বেঁচে আছি। তোমরা আর কী করতে চাও? ইউ বাস্টার্ডস?”

প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ভিড়ের মধ্যে থাকা জনতা চিৎকার করে উঠল, নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে শুরু করল, সেই সাথে আধখাওয়া মাংসের টুকরা তারদিকে ছুঁড়ে দিতে লাগল প্রবল আক্রোশে।

ঠিক তখনই তীব্র এবং তীক্ষ্ণ এক চিৎকার শোনা গেল। জনতা এলোমেলো হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে দিল। এমনকি যে গার্ডরা হালকে নিয়ে যেতে এসেছিল, তারাও ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। তখনই সে বুঝতে পারে কেন সবাই এমন করছে। অন্তত ত্রিশ জনের মতো একটা সৈন্যবাহিনী মাঠে প্রবেশ করেছে। ভিড়ের মধ্যদিয়ে চাবুক চালিয়ে তারা তাদের জায়গা করে নিচ্ছে। হালকে ধরে রাখা গার্ডরাও এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে দিয়েছে। হালও দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিল। কিন্তু তার পূর্বেই সৈন্য দল তাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলল। কমান্ডর-এর পোশাক পরিহিত লোকটি সামনে এগিয়ে এসে মাথার হেলমেট খুলে বলল, “ক্যাপ্টেন কার্টনি। দয়াকরে আমাদের সঙ্গে চলুন। মাননীয় মহারাজা সাদিক খান জাহান আপনার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।”

*

প্রিন্স জাহান আসার পূর্বের কয়েক ঘণ্টা হালকে একটা সেল-এ বন্দি করে রাখা হলো। কঠিন এবং নিষ্ঠুর প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার জন্য হাল নিজেকে প্রস্তুত করছিল কিন্তু জাহানের প্রথম প্রশ্ন শুনে তাকে বেশ অবাক হতে হলো।

 “তোমার স্বদেশী, প্রিন্স শুরু করল, “বুজার্ড নামে সেই লোকটার কথা বলছি। সে কি আগে থেকেই এরকম শুকরের মতো নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে? এমনকি সে যখন মানুষ ছিল তখনও?”

হাল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। “সে জন্যই নিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা এবং চৌর্যবৃত্তির প্রবণতা নিয়ে। এটা তার রক্তে মিশে আছে।”

“হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। সে জুডিথ নাজেতকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। এতে আমি খুবই রাগান্বিত হয়েছি কারণ সে আমার সম্পত্তি ছিল…”

“সে কারও সম্পত্তি ছিল না। সে একজন স্বাধীন মানুষ।”

“কিন্তু স্যার হেনরী, সে আর স্বাধীন নয়। জাহান বলতে থাকে, সে এখন বুজার্ডের জাহাজের একজন বন্দি, যে জাহাজ দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেছে। এটা। আমার ভুল। আমার তাকে আরও ভালভাবে জানা উচিত ছিল, যে লোক এধরনের কাজ করতে পারে তার কোনো লজ্জা-শরম থাকে না। সে যদি একজন মুসলমান হত তাহলে তার এটা জানার কথা যে সে নবি ও পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার সাথে প্রতারণা করেছে। সে যদি হাজার বারও মৃত্যবরণ করত তবুও তার পাপের শাস্তির। সমান হত না। কিন্তু তুমি আলাদা। তুমি তোমার ঈশ্বরের জন্য যুদ্ধ করেছ।”

“আমার ঈশ্বরের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এবং সেই রমণীর জন্য যাকে আমি ভালবাসি।”

জাহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়াতে থাকে। “আহ, আমি সেজন্য তোমাকে দোষারোপ করছি না। রমণীদের মধ্যে সে হচ্ছে রাণী। সে যখন আমার হারেমে ছিল আমার সেরা উপপত্নীটাও তাকে হিংসা করত। তার সৌন্দর্যকে হিংসা করত। ভয় পেয়ো না, আমি তাকে কলুষিত করি নি। যদিও আমি অন্য যে কোনো জীবিত পুরুষের মতোই প্রলুব্ধ হয়েছিলাম।”

“তাহলে কেন করেন নি? আপনি চাইলেই তাকে কলুষিত করতে পারতেন। কী আপনাকে বাধা দিয়েছে?”

 “এটা একটা ভাল প্রশ্ন করেছ,” জাহান বলল। “তুমি ঠিক বলেছ। এই দেয়ালের ভেতরে এমনকি বাইরে আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করতে পারি। কিন্তু আমি ঠিক কি চিন্তা করছিলাম…?” প্রিন্স কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল, এরপর আবার বলতে শুরু করল। আমি তার সাথে কথা বলেছি। আমি তাকে বলেছি যে তোমাকে ধরার পূর্ব পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব। আমি বলেছি সে যদি বাধা দেয় তাহলে আমি জোর করবো। তখন তুমি এবং সে দুজনেই মারা যাবে। কিন্তু সে নিজের জন্য মোটেও চিন্তিত ছিল না।”

 “অনেক পুরুষের চেয়েও সে বেশি সাহসী। কিন্তু সে চায় না যে তুমি তার জন্য কষ্টভোগ কর।”

 ঘৃণায় হাল-এর কণ্ঠ ভারী হতে শুরু করে। আপনি কী নারীদের এভাবেই প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করেন? তারা যদি অস্বীকার করে তবে তাদেরকে এভাবেই হুমকি দেন?”

জাহানের অমায়িক প্রতিক্রিয়া বরফের মতো ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। “তুমি হয়ত খুব সাহসী নয়ত খুব বোকা যে কারণে তুমি এ ধরনের কথা বলতে পারছ। তুমি জানো, এ কথার কারণে আমি তোমাকে হত্যা করতে পারি?”

 “কোনো কারণ ছাড়াই আপনি আমাকে হত্যা করতে পারেন এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি কী এটাই চান?”

“হ্যাঁ,” প্রিন্স একমত হয়। “কিন্তু তুমি যাই চিন্তা কর না কেন আমি জীবন মৃত্যুর ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হতে চাই না। এমনকি আমি আমার ইচ্ছে পূরণের জন্য নারীদের বাধ্য করি না বা আঘাতও করি না। যেমন ধর, আমার হারেমের নারীরা আমার সম্পত্তি। আমার খুশির জন্য তাদেরকে রাখা হয়েছে। এটা তাদের দায়িত্ব এবং অবশ্যই তাদের এটা পালন করতে হবে। কিন্তু আমি তাদেরকে কখনও আঘাত করিনি বা হুমকি দেইনি। বরং আমি যখন একজনকে বেছে নেই, তখন অন্যরা হিংসাবোধ করে। তাই জুডিথ নাজেতকে বাধ্য করে আমি কোনো আনন্দ পেতাম না। যদিও আমার বাহিনীকে পরাজিত করায় তার প্রতি রুষ্ট ছিলাম আমি কিন্তু সে কারণে আমি তাকে ঘৃণা করি না। আমি তাকে সম্মান করি। একজন নারী হয়েও সে সত্যিকার যোদ্ধার মতো যুদ্ধ করেছে। আমি যদি তাকে হুমকি দিতাম কিংবা বাধ্য করতাম তবে আমি নিজের অবস্থানটা অনেক নিচুতে নামিয়ে ফেলতাম।”

“সেটা অবশ্য ভাল কথা। কিন্তু তারপরও আপনি তাকে বিক্রির জন্য দাসদের অবস্থানে নামিয়ে এনেছেন।”

“সেটা করা হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। তোমাকে জাঞ্জিবার-এ ফিরিয়ে আনার জন্য বাধ্য করতে। আমি তোমাকে এখানে আমার সামনে দেখতে চেয়েছিলাম। আমি সেই বারাকুডাকে দেখতে চেয়েছিলাম যে কি-না আমার জাহাজগুলোকে সারডাইনস মাছের মতো নিঃশেষ করে দিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমার নিজ হাতে তৈরি একহাত ওয়ালা দানবটার যুদ্ধ করাতে। লড়াইটা আমাকে অনেক বিনোদন দিত।” প্রিন্স নিজের চেহারায় একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল যেন সে হাল-এর সমবেদনা পাওয়ার চেষ্টা করছে। “তুমি জান, এই বয়সে আমার জন্য বিনোদন-এর নতুন কোনো উপাদান খুঁজে বের করাটা কতটা কঠিন?”

“কিন্তু আপনার দানব আপনার সাথে প্রতারণা করেছে।”

“হ্যাঁ, সে করেছে। এখন তোমাকে যা করতে হবে তা হলো তাকে হত্যা করতে হবে।”

“প্রথমে আমার তাকে খুঁজে বের করতে হবে।”

“সেটাতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।” জাহান বলে উঠে, “বেনবুরি নামে আরেক ইংরেজ-এর সাথে তার যোগাযোগ আছে।”

“আমি তাকে চিনি। পেলিকান নামে একটা জাহাজের মালিক সে। হাল জাহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু সে ইংরেজ নয়। সে স্কটিশ।”

“সেটা কী একই হল না?”

 “না, একই ব্যাপার নয়।”

“হাহ, প্রিন্স খুব অবাক হলো। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে এইমাত্র নতুন কিছু শিখেছে। যাই হোক, আমরা বেনবুরির একজন নাবিককে ধরতে পেরেছি। তার মাস্টার-এর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা তাকে বলতে বাধ্য করেছি। একটা পানশালায় আক্রমণ করে আমরা তাকে ধরেছি। আর তোমাকেও সেখানেই পেয়েছিলাম।”

“আমি রাতের বেলায় চিৎকার শুনেছিলাম,” হাল বলল।

“ভদ্র ভাষায় বোঝাতে গেলেও লোকে ওমনই করে। সে যাই হোক, আমরা লোকটার কাছ থেকে জানতে পেরেছি ক্যাপ্টেন বেনবুরি এবং বুজার্ড তোমার স্ত্রীকে লোবো নামে এক পর্তুগীজ-এর কাছে বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে। আমি লোকটিকে চিনি। তার একটি সোনার খনি আছে। আমি তোমাকে সেখানে পৌঁছে দিতে পারি।”

“কীভাবে?”

“তোমাকে এখান থেকে এমন এক অভিযাত্রায় নিয়ে যাওয়া হবে সেটাতে তুমি কোনো আনন্দ পাবে না। কিন্তু লোবোর কাছে যাওয়ার এটাই একমাত্র সম্ভাব্য পথ। তুমি যদি তাকে আক্রমণ করতে চাও তবে ব্যর্থ হবে। তার খনিতে পৌঁছার একটাই রাস্তা খোলা আছে। যদি তুমি যেতে চাও তবেই পাঠানো হবে। তার খনিতে নিয়ে যাওয়া লোকদের সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কাজ করায়। একারণে তার সবসময় নতুন নতুন লোকের প্রয়োজন হয়,..”

হাল এমনভাবে কাধ ঝাঁকায় যেন পরিশ্রম তার কাছে কিছুই না। “আমি জানি কঠোর পরিশ্রম কাকে বলে। প্রমাণস্বরূপ আমি আমার পিঠের চাবুকের দাগগুলো দেখাতে পারি। এরপরও আমি বেঁচে আছি।”

“হতে পারে,” জাহান বলল। “কিন্তু প্রথমে তোমাকে সেখানে যেতে হবে। সেটা কোনো সহজ কাজ নয়। যে লোকেরা তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবে তারা তোমাকে দেখামাত্র আনন্দের সাথে হত্যা করতে রাজি হয়ে যাবে।”

“আমার তো মনে হচ্ছে আমার মৃত্যুটা আপনি বুজার্ড-এর চেয়েও বেশি করে চান”, হাল বলল।

“ফুউউহ, প্রিন্স জাহান এমনভাবে শব্দ করল যেন কেউ তার পছন্দের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করছে। “আমি চাই তোমরা সবাই মৃত্যুবরণ কর। তোমার মতো ইংরেজ কিংবা সেই স্কটম্যান… তোমরা সবাই আমার কাছে সমান। এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে একটা জাহাজে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তোমার জীবন মৃত্যুর দায়দায়িত্ব আমি নিব না। তোমার বিচারের দায় দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা’-র হাতে।”

.

দাস বিক্রয়ের বাজার শেষ হওয়ার পর বিকেল বেলা মসি গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন-এর কেবিনে বসে আছে। গোল্ডেন বাউ জাহাজটি শহর থেকে বেশ দূরে জাঞ্জিবার-এর উপকূলে নোঙর করা আছে। সে মাথাটা নিচু করে কাঁদছে আর সবাইকে কাহিনী শোনাচ্ছে।

“আমার কিছু একটা করা উচিত ছিল। লেডি জুডিথকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন হেনরিকে বন্দি করা হয়েছে এবং মি, ট্রোম্প মারা গিয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত ছিল!”

“নিজেকে দোষ দিও না লিটল স্পেরো।” অ্যাবোলি ছেলেটাকে সান্তনা দিয়ে বলে, “আমি তোমাকে যা বলেছিলাম তুমি ঠিক তাই করেছ। ক্যাপ্টেন দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তুমি তাকে অনুসরণ করতে পেরেছ। তোমার কারণেই আমরা জানতে পেরেছি যে, কার্টনিকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তোমার কারণেই আমরা ক্যাপ্টেন কার্টনির খোঁজে লোক পাঠাতে পেরেছি। সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এখন আমরা জানি যে ক্যাপ্টেনকে নিয়ে মার্দি ডি ডিউস জাহাজটি কোয়েলিম্যান-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। আমরা জানি যে তাকে দাস হিসেবে সোনার খনিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তুমি না থাকলে আমরা এসব কিছুই জানতে পারতাম না, বুঝতে পেরেছ মসি?”

বালকটি মাথা নাড়াল যেন সে আবোলির কথা শুনতে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে।

“গুড,” অ্যাবোলি বলতে থাকে। মসি এখন শোন, “তোমাকে বলছি যে আমরা কিভাবে ক্যাপ্টেন কার্টনিকে উদ্ধার করব।”

ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে যেন কোনো ছোট্ট শিশু রূপকথার গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।

 “প্রথমে, যে জাহাজে আমাদের ক্যাপ্টেনকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমরা সেটা অনুসরণ করব। যদি আমরা সাগরের মাঝে জাহাজটাকে ধরতে পারি তবে আক্রমণ চালাবো এবং ক্যাপ্টেনকে ফিরিয়ে আনব,” অ্যাবোলি বলতে থাকে।

“তোমরা কী সেই খারাপ লোকটাকে হত্যা করবে যে আমার ক্যাপ্টেনকে ধরে নিয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, আমরা তাদের দিকে এই ভাবে তাকাব…” অ্যাবোলি তার চেহারায় এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল যে মসিও ভয় পেয়ে যায়।

 “তারপর আমরা তাদের শরীরে এইভাবে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিব,” সে তার হাতটা সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে দেখাল। “এভাবে”, “এভাবে।”

“কিন্তু আমরা যদি সময় মতো তাদের জাহাজটা ধরতে না পারি?”

“তাহলে আমি আমার অ্যামোডোডা ভাইদের নিয়ে উপকূলে যাব। যে খনির দিকে আমাদের ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা আমাদের জন্মভূমি কিং ডম অব দ্য মনোমাটাপা থেকে বেশি দূরে নয়। তাই ওখানকার সবকিছু আমরা ভালভাবে চিনি। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে নিয়ে উপকূলে ফিরে আসব। উপকূলে তুমি, মি. টেইলার, মি. ফিশার, এবং বাউ-এর অন্যান্য নাবিক অপেক্ষা করবে।”

 “তাহলে তুমি বলছ যে ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে তুমি নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে”, মসি জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ

“তুমি প্রতিজ্ঞা করছ?”

অ্যাবোলি খুব ভাবগম্ভীর হয়ে মসির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ক্যাপ্টেনকে সেই সময় থেকে চিনি যখন সে ছোট্ট বালক ছিল। সে আমার নিজের ছেলের মতো। আমি তার কোনো ক্ষতি হতে দেবনা। তাই লিটল স্প্যারো, আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে ক্যাপ্টেন এবং লেডি জুডিথকে আমি তোমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবই।”

*

“ম্যাডাম, আপনার এবার খাওয়া উচিত, মেয়েটি খুব অনুনয়ের স্বরে বলতে লাগল। জাঞ্জিবার-এর বাজার থেকে কিনে আনা খাসির পনির, ফলমূল এবং অন্যান্য হরেক রকমের খাবার অনেকক্ষণ যাবত টেবিল-এ রেখে দেয়া হয়েছে। জুডিথ এর কিছুই স্পর্শ করে দেখেনি। যদিও তার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে ক্ষুধায় সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু ওই লোকটির দেয়া খাবার খাওয়ার মানে হচ্ছে তার কাছে আত্মসমর্পণ করা। মেয়েটি করুণ চেহারা নিয়ে জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার ভেতরে যে বেড়ে উঠছে তার কথা অন্তত চিন্তা করুন। তার জন্য হলেও আপনাকে শক্ত হতে হবে।”

 জুডিথ এক টুকরো পনির উঠিয়ে মুখে দেয়। মেয়েটি জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। পরক্ষণেই ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে তাকাল। যে কোনো মুহূর্তে যে কেউ হয়ত চলে আসতে পারে।

সময়টা ছিল গোধূলি বেলা। পেলিকান নোঙর করেছে। তার মানে বুজার্ড যেকোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে।

যখন তারা জুডিথকে জাঞ্জিবার-এ নিয়ে আসে তখনই তাকে জাহাজের একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে আটকে রাখা হয়, যেটাতে প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেজন্য তাকে একটা বালতি ধরিয়ে দেয়া হয়। তাকে পরতে দেয়া হয় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত এক কেবিন বয়-এর জামা কাপড়। বাইরের পৃথিবীর সাথে তার সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তাকে শুধু মাঝে মাঝে বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ করা হত। হাল তাকে শিখিয়েছিল জাহাজের ঘণ্টা হিসেব করে কীভাবে সময় নির্ধারণ করতে হয়। তাই সে জানে দুই দিন দুই রাত যাবত সে এখানে আছে। এবং সকাল দশটা বাজার সাথে-সাথে একজন নাবিক এসে তার সাথে যাওয়ার জন্য জুডিথকে নির্দেশ দিয়ে গেল। তাকে জাহাজের ফোরক্যাসেল-এ নিয়ে যাওয়া হলো। বন্দিখানাটা যদিও অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে তবুও বরং এটাই ভাল। কারণ এখানে অন্তত তার একজন নারীসঙ্গী আছে। তাকে এখানে নিয়ে আসার কিছু সময় পরেই মেয়েটিকে এখানে ঠেলে দেয়া হয়।

“আমি আপনার খাবার প্রস্তুত করে দেব এবং আপনার দেখাশোনা করব,” মেয়েটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, কারণ বুজার্ড তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। “জাহাজের উপরে আপনি যেমনটা আরামে থাকতেন আমি আপনাকে ঠিক ততটা আরামে রাখার চেষ্টা করব।”

 “ধন্যবাদ,” জুডিথ মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল। এরপর বুজার্ড-এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”

 তার চোখদুটো বন্দিখানার চারদিকে ঘুরতে থাকে। সে এমন থাকে যেটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বুজার্ডের মুখোশের বাইরে থেকেও তার তিরস্কারমূলক হাসি জুডিথ বুঝতে পারছিল। তার ওপর কি ধরনের আক্রমণ আসতে পারে সেটার আভাস সে আগে থেকেই পাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল যে কতটা দুর্বল ও অসহায় হয়ে পড়েছে। সে বুজার্ডকে এ সময় যতটা ভয় পাচ্ছিল এতটা ভয় সে এর আগে কোনো পুরুষকে পায়নি। এই ভয় পাওয়ার কারণে জুডিথ মনে মনে নিজেকে ঘৃণা আর তিরস্কার করছিল। সে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। সে তার গর্ভের সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। তার ভয় হচ্ছে বুজার্ড হয়ত যে-কোনো মুহূর্তে তার হাতের ছুরি তুলে নিয়ে ওর পেট চিরে বাচ্চা বের করে নিয়ে আসবে।

“এই মেয়ে, তোমার মুখ বন্ধ কর,” বুজার্ড রুক্ষ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠে। “তুমি খুশি থাক যে তোমার সাথে একজন দাসী দেয়া হয়েছে। নয়ত তোমাকে এখানে একা একা মরতে হত।” এরপর আর কোনো কথা না বলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল সে।

কিছু সময় পার হওয়ার পর মেয়েটি কথা বলতে শুরু করল। “ওরা বলেছে যে আপনার গর্ভে সন্তান আছে। বেশিদিন হয়নি যে আমার নিজেরও একটি সন্তান ছিল।” মেয়েটি কথা শেষ করার পূর্বেই তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

জুডিথ মেয়েটিকে ডেকে তার সাথে খেতে বলল। প্লেট-এর খাবার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়েটি থামল না। এটা দেখে জুডিথ তার নিজের অংশটুকুও সেই মেয়েটিকে খেতে দিল। তার নাম হচ্ছে অ্যান মিসেন। সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক বণিক-এর জাহাজে ছিল। সেই জাহাজ বোম্বের (মুম্বাই) পথে যাত্রা করছিল। মাদাগাস্কার-এর দক্ষিণাংশে এসে তারা পেলিকান জাহাজের পাশ দিয়ে যেতে থাকে। তাদের জাহাজটি মনে করে পেলিকান জাহাজ হয়ত কোনো বিপদে আছে। তারা ক্যাপ্টেন বেনবুরিকে আশ্বস্ত করে যে তারা তাকে যে কোনো রকম সাহায্য করতে রাজি আছে। ইন্ডিয়াম্যানদের জাহাজটি যখন পেলিকান জাহাজের খুব কাছে চলে আসে তখন পেলিকান-এর নাবিকের ইন্ডিয়াম্যানদের জাহাজ আক্রমণ করে। ধনসম্পদ লুট করে তারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। অ্যানের স্বামী-যে কিনা কোম্পানির একজন কেরানি ছিল আরও উচ্চপদে যোগদানের জন্য বোম্বে (মুম্বাই) যাচ্ছিল। সে তার স্ত্রীর সামনে খুন হয়ে যাওয়ার পূর্বে প্রচণ্ড বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল।

 “আমি কখনো জানতামই না যে তার এত সাহস আছে,” অ্যান জুডিথকে বলতে থাকে। তার গল্প বলা দেখে জুডিথ বুঝতে পারে সেই ঘটনার কারণে অ্যান এখনো স্তব্ধ হয়ে আছে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গিয়েছে। জুডিথ-এর আর সাহস হয়নি বাচ্চাটির কথা জিজ্ঞেস করার। তারা নতুন জীবন শুরু করার জন্য ইংল্যান্ড ছেড়ে আসার পূর্বেই হয়ত বাচ্চাটি মারা গিয়েছে।

তারা যখন খাবার শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল, তখন তাদের মনে হচ্ছিল যে তারা পাঁচ বারের খাবার একবারে খেয়ে ফেলেছে। এরপর অ্যান বলল, “এবার আমাকে আপনার জীবনের গল্প বলুন।”

এর আগে একবার বুজার্ড জুডিথকে দেখতে এসে তাকে জেনারেল নাজেত বলে সম্বোধন করেছিল। আর তখন থেকেই জুডিথের অতীত জীবনের গল্প শোনার ব্যাপারে অ্যান-এর আগ্রহ বেড়েই চলছে। ইথিওপিয়ায় বেড়ে উঠা তার শৈশব। তার ইউরোপ ভ্রমণ, এরপর তার সৈনিক জীবন সবকিছুর ব্যাপারেই অ্যান-এর আগ্রহ। “আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে আপনি কিভাবে জেনারেল হলেন। মানে পুরুষরা কীভাবে তাদের পরিচালনার ভার আপনার হাতে তুলে দিল।”

“কারণ সম্ভবত এটাই যে আমি শুধু একজন নারীর জীবন বেছে নেয়ার জন্য বড় হইনি।” জুডিথ বলতে থাকে। “আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। তার কোনো ছেলে সন্তান ছিলনা। তাই তিনি একটা ছেলেকে যা কিছু শেখাতে পারতেন তার সব কিছুই আমাকে শিখিয়েছেন। আমি ঘোড়ায় চড়তে শিখেছি। তলোয়ার চালনা করতে শিখেছি, যুদ্ধ করতে শিখেছি। বন্দুক চালাতে শিখেছি। আমাকে যখন রাতের বেলা গল্প শোনানো হত সেগুলো কোনো রাজপুত্রের গল্প ছিল না। সেগুলো ছিল মহাবীরদের গল্প-আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, হান্নিবল এবং আফ্রিকান বিখ্যাত জেনারেলদের গল্প।

“এবং আপনিও। অ্যান বলল। কারণ ইতোমধ্যেই জুডিথ তার হিরোইন” এ পরিণত হয়েছে।

জুডিথ হেসে বলল, “আমি হানিবল নই! কিন্তু আমি শিখেছি কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়। কীভাবে যুদ্ধে জয়লাভ করতে হয়। কারণ, আমার বাবা ছিলেন উপজাতীয়দের প্রধান। তারা আমাকে আমার পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তাই আমার পিতা অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে যদি কখনো রাজার পক্ষ থেকে আরব আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার জন্য সৈন্যদলে ডাক পড়ত তখন আমি তাদের পরিচালনা করে নিয়ে যেতাম। প্রধান সেনাদলের সাথে যোগ দেয়ার পূর্বেই আমরা এল গ্যাং-এর কিছু লোকদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের প্রতিহত করেছিলাম। এই বিজয়ের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আমরা যখন প্রধান সৈন্যদল-এর কাছে পৌঁছে যাই তখন সবাই আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে উল্লাসধ্বনি করতে থাকে। প্রধান সৈন্যদল আমাকে গ্রহণ করে অত্যন্ত আনন্দের সাথে। আমি হয়ে যাই তাদের নেতা। তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। একসময় আমি নিজেকে দেখতে পেলাম সমগ্র সৈন্যদলের প্রধানরূপে। দেখলাম যে তারা সবাই আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অনুসরণ করতে চাইছে না।”

“আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি সেসময়ে যেসব বৃদ্ধ জেনারেল ছিল তারা সবাই আপনাকে হিংসে করতো”, অ্যান বলতে শুরু করল। কিন্তু জুডিথ উত্তর দেয়ার আগেই তালা খোলার শব্দ পেলো। কেবিন-এর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেছে বুজার্ড, সেই সাথে তার শরীর থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধও।

 “ঝড় আসছে,” বুজার্ড বলল। তার পেছনে কেবিনের দরজাটা দুলতে শুরু করে দিল। সে টেবিলের ওপর রাখা খালি প্লেট-এর দিকে একনজর তাকিয়ে দেখল, এরপর জুডিথ-এর দিকে তাকাল। অ্যান তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে কেবিনের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ায় যেন সে আগুন থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বুজার্ড তার দিকে লক্ষ করছে না।

 “তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?” প্রতিবারের মতো এবারও জুডিথ একই প্রশ্ন করল।

“যেখানেই যাই না কেন, আপনি সেটা উপভোগ করবেন না, এটা নিশ্চিত।” বুজার্ড উত্তর দেয়। সে জুডিথকে এমনভাবে দেখতে থাকে যেন কোনো ক্রেতা নিলামে উঠা কোনো দাসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

 “হাল কার্টনি তোমাকে খুন করে ফেলবে”, জুডিথ বলল। “সে তোমাকে খুঁজে বের করবে। এরপর তোমার অস্তিত্বকে বিলীন করে দেবে।”

এবার বুজার্ড সামনে এগিয়ে এলো-কিন্তু জুডিথ-এর দিকে নয়, অ্যান-এর দিকে। সে তার থাবা দিয়ে অ্যান-এর গলা প্যাচিয়ে ধরে তাকে কেবিনের দেয়ালের সাথে আটকে ফেলল। অ্যান চিৎকার করতে চাইছিল কিন্তু তার সে সামর্থ্য ছিল না। এরপর বুজার্ড তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত মুঠ করে অ্যান-এর পেট-এ আঘাত করে বসলো। ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল অ্যান।

মুখোশ পরা দানবটা এবার জুডিথ-এর দিকে এগিয়ে এলো। জুডিথ তার পেট-এ হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে রেখেছে যেন সে তার পেট বাঁচিয়ে মুখে আঘাত করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

“যতবার আপনি আমার কথার অবাধ্য হবেন, ততবার মেয়েটার এই অবস্থা হবে।” বুজার্ড-এর কথা তার মুখোশের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তার পেছনে অ্যান ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার।

“আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার বেশ বড়সড় কারণ আছে। কিন্তু…” বুজার্ড পেছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, “সে আমার কাছে কিছুই না। ওর কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে। ওকে আমি যা খুশি করতে পারি।”

“তুমি একটা কাপুরুষ,” জুডিথ চিৎকার করে উঠল।

বুজার্ড ঘুরে আবারও মেয়েটির দিকে গেল। মেয়েটি উপুড় হয়ে এক হাত উঁচিয়ে নিজেকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। বুজার্ড নিচু হয়ে বসে এবার মেয়েটির মুখে আঘাত করে বসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবারো জুডিথ-এর দিকে গেল দানবটা।

“আর কিছু বলবেন?”

জুডিথ দানবটার সাথে যুদ্ধ করার জন্য, ওকে শাস্তি দেয়ার জন্য যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। কিন্তু খালি হাতে চোখের পানি ফেলা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

আর তাই, সে মাথা নাড়াল।

“গুড।” “যখন ঝড় আঘাত হানবে তখন আপনি নিরাপদে থাকার জন্য মেঝেতে বসে শক্তভাবে বিছানার খুঁটি ধরে রাখবেন। তাহলে কোনো ক্ষতি হবে না।” সে জুডিথ-এর বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল। “অ্যান-এর কোনো বিছানা নেই। শুধু মেঝেতে একটা কম্বল পাতা আছে। অথবা আপনারা একজন আরেকজনকে ধরে রাখতে পারেন। এরপর সে দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজায় পৌঁছে আবার একটু দাঁড়িয়ে জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “আপনি শুধু শুধু প্রার্থনা করে আপনার সময় অপচয় করবেন না। যদি মনে করেন আপনার নায়ক এসে আপনাকে উদ্ধার করবে, তো বলে রাখলাম, সে আশা কোনোদিনও পূরণ হবে না। সে বলতে থাকে, কারণ কার্টনি হয়ত এতক্ষণে মারা গিয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য তাকে অনেক আগেই ষাড়ের মতো বেঁধে কসাই খানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

আর এইটুকু বলেই সে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।

*

মাদ্রি দি ডিয়াস হচ্ছে তিন মাস্তুলযুক্ত পর্তুগীজ জাহাজ। সাগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় এ জাহাজ। এই জাহাজের মাধ্যমে দাস থেকে শুরু করে হরেক রকম জিনিসপত্র ইস্ট ইন্ডিয়া, ওটোম্যান সাম্রাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। আর এত বড় ব্যবসার বাহক হওয়ার কারণে একে নিয়ে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন এর মালিক ক্যাপ্টেন জা’আও বারোসকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।

মহারাজা সাদিক খান জাহান কার্টনি নামের এই ইংরেজটাকে কোয়েলিমান এ নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনোরকম সম্মানী দেন নি। তিনি শুধু একজন কর্মচারীকে এই লোকটার সাথে পাঠিয়েছেন। কর্মচারিটি ইংরেজটাকে জাহাজের ডেক-এর ওপর ছেড়ে দিয়ে বারোসকে আরবিতে বলেছে যে মহারাজা এই লোকগুলোকে আপনার জাহাজে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন।

“আচ্ছা, ঠিক আছে।” মুখের ওপর থাকা পুরনো দাগটার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দিল সে। এই পুরোনো অভ্যাসটা সে এখনো ছাড়তে পারেনি।

“সেনর লোবো খনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য ওদেরকে কিনে নিয়েছেন।”

“বুঝলাম।”

“খুব ভাল, আর…একেও ওদের সাথে যোগ কর। কর্মচারী লোকটি হালকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল। সে একজন ইংরেজ। মহারাজা একে সেনোর লোবোর জন্য বিশেষ পুরস্কার হিসেবে দিয়েছেন-যদি সে এই ভ্রমণে বেঁচে থাকে আরকি।”

“খুবই ভাল পুরস্কার।” বারোস বলতে শুরু করল। “সে একজন সাদা চামড়ার মানুষ বলে বলছি না, এই লোকটা দেখতেও খুবই শক্তিশালী আর স্বাস্থ্যবান। ভাল দাঁতও রয়েছে। আমি নিশ্চিত সেনোর লোবো এর কাছ থেকে ভাল ফলন ঘটাতে পারবে।”

“সেটার খুবই সম্ভাবনা আছে। কর্মচারীটি একমত হয় এবং আবার বলতে শুরু করে, “মহামান্য রাজা জানিয়েছেন যে সমুদ্র যাত্রায় যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এবং এই লোকের কোনো ক্ষতি হয় তবে এটার দায়ভার তোমাদেরকে নিতে হবে না।”

 “তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন একে নিয়ে আমরা যা খুশি করতে পারি?”

“ঠিক তাই”। “মহামান্য রাজা এই লোকের ভাগ্য আল্লাহ তাআলার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী এবং অসীম দয়ালু।”

“বেশ মজার একটা বিধান জারি করেছেন উনি,” বারোস বলে উঠল। “আমি বিধানটা মনে রাখার চেষ্টা করব।”

এরপর হাল তার ছোট্ট জীবনে দ্বিতীয়বার-এর মতো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। তাকে একটা অন্ধকার, উষ্ণ, মানুষের বিসর্জনকৃত তরল পদার্থের দুর্গন্ধময় স্থানে দাসদের থাকার জায়গায় আবদ্ধ করে রাখা হলো।

হাল ভেবে দেখল ছয়দিন যাবত তারা জাঞ্জিবার থেকে বাইরে আছে।

“এই বদমাশটা এখন আবার কী খুঁজে বেড়াচ্ছে?” হাল আড়চোখে জাহাজের লণ্ঠন বাতিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে জিজ্ঞেস করল।

পর্তুগীজ নাবিকেরা তাদের কনুই-এর বাকে নাক টেকে সামনে এগুতে থাকে। শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে যাওয়া একজন আফ্রিকান লোক মাথা নিচু করে বসেছিল। পর্তুগীজ নাবিকেরা তার কাছাকাছি চলে আসলেও যখন দেখতে পায় লোকটি নড়ছে তখন নিচু হয়ে লোকটিকে পরীক্ষা করে দেখতে থাকে। এরপর মাথায় ধাক্কা দিলে লোকটি চোখ বড় বড় করে নড়েচড়ে উঠে। এরপর তাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা অন্য একটা আফ্রিকান-এর দিকে এগুতে থাকে।

“একে দেখতে বেশ ঋষ্টপুষ্ট মনে হচ্ছে,” চাবুক হাতে নেয়া একজন পর্তুগীজ অন্য একজনকে উদ্দেশ্য করে বলে।”

“দেখ, আমি এইখানে আরেকটা পেয়েছি”, অন্য নাবিকটি বলে উঠে। একে দেখতে বেশ শক্ত সামর্থ্য মনে হচ্ছে। হাল পর্তুগীজদেরকে খুব ভালভাবে জানত। তাই সে কোনোরকম নড়াচড়া করল না বা খুব একটা অগ্রাহ্য ভাব নিয়ে তাকাল না। নাবিকটি তার আরও কাছে এসে বলল, “আরে, এ তো দেখি সাদা চামড়ার লোক।”

“এদেরকে নিয়ে এস,” চাবুক হাতে লোকটি বলল।

হাল এবং আফ্রিকান লোকটি পর্তুগীজ নাবিকদের পিছু পিছু যেতে থাকে। পায়ের শেকল না খুলেই মই দিয়ে ওদের দুজনকে উপরে উঠতে বলা হয়।

 “আহ, এ যে দেখছি সেই ইংরেজটা,” ক্যাপ্টেন বারোস বলে উঠে।। এরপর সে পেশিবহুল অন্য দুজন দাস-এর দিকে ফিরে বলল, “বাহ এদেরকে দেখতে বেশ শক্তিশালী ও ঋষ্টপুষ্ট মনে হচ্ছে। খুব ভাল, অসাধারণ পছন্দ। সাদার বিপরীতে কাল…”

ক্যাপ্টেন বায়োস তার অফিসার এবং তার কেবিন বয়-এর সাথে প্রধান মাস্তুলের পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের প্রত্যেকের মাথায় সূর্য থেকে বাঁচার জন্য বড় হ্যাট পরা রয়েছে। বালকটি দেখতে অনেকটা বাতোস-এর মতই দেখতে এবং বারোস-এর মতই মাথা টান টান করে ঔদ্ধত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাল প্রায় নিশ্চিত যে এটা বারোস-এর ছেলে।

“তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে চল, ফার্নান্দেজ, বায়োস একটা ধূসর চুলের খোঁড়া লোককে ইঙ্গিত করে বলল, যার একটা পা কৃত্রিমভাবে লাগানো। আমি প্রতিজ্ঞা করছি তুমি যদি এর চাইতে আস্তে চল তবে তোমার আরেকটা পা কেটে ফেলা হবে।”

“আমি কী সার্জনকে বলব তার কাটার যন্ত্র নিয়ে আসতে?” একজন লম্বা চেহারার অফিসার বলতে থাকে। এরপর আমরা সেটাকে বাজি হিসেবে ব্যবহার করব।” অন্যান্যের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায় এমনকি সেই বালকটাও হাসতে থাকে।

 খোঁড়া লোকটি ছয় তারযুক্ত একটা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। পর্তুগীজ-এর স্পানিশ ভাষায় যেটাকে ‘ভায়োলা ডা ম্যানো বলা হয়। যার অর্থ হচ্ছে হাতের বেহালা। এরূপ নামকরণের পেছনে কারণ হচ্ছে এটা কাঠির বদলে আঙুল দিয়ে বাজানো হয়। খোঁড়া লোকটি রাগে ফেটে পড়ে জবাব দেয়,” আমি যতটা দ্রুত সম্ভব তত দ্রুতই আসছি, বারোস।” সে রাগে গজ গজ করতে করতে প্রধান মাস্তুলের কাছে পৌঁছে যায়।

ক্যাপ্টেন বারোস ক্লান্ত দৃষ্টিতে হাল-এর দিকে তাকায়। নোংরা ভিখারীর মতো লোকটা কেন তার সাথে এভাবে কথা বলছিল সেটা হল বুঝে উঠতে পারে না। আমি তার এইভাবে কথা বলার দুঃসাহস মেনে নিয়েছি কারণ সে আমার বাবার বন্ধু ছিল এবং সে খুবই ভাল একজন মিউজিশিয়ান, “বারোস ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধ লোকটার হাতে ধরা বাদ্যযন্ত্রটা ভালভাবে তাকিয়ে দেখল। ওটার বাকানো পাশে ছয় জোড়া তার লাগানো আছে। “সে সম্ভবত এই ভায়োলা ডা ম্যারোস এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। আমি যতদূর জানি এটা তার দাদার ছিল।”

 “গ্রেট গ্রান্ডফাদার। এমনকি উনার সময়ও এটা প্রায় পুরানোই ছিল।” ফার্নান্দেজ তাকে শুধরে দেয়।

ক্যাপ্টেন বারোস হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয় না আমাদের যুবক ইংরেজটা কখনো এ ধরনের বাদ্যযন্ত্র দেখেছে, তাই নয় কী?”

 “শুধু ছবিতে দেখেছি”, হাল জবাব দেয়। তাদের কথোপকথন দেখে মনে হচ্ছে দুজন ভদ্রলোক বড় কোনো বিশ্রামাগারে বসে কথা বলছে, একজন বন্দি এবং একজন ক্যাপ্টেন-এর মধ্যকার কথোপকথন বলে মনেই হচ্ছে না।

বারোস মাথা নাড়াল। “হ্যাঁ, এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার যে ভায়োলা ডা ম্যানো অনেক দিন যাবতই ফ্যাশন জগতের বাইরে রয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো এটা ব্যবহার করি তাই না। ভদ্রমহোদয় গণ?” পাঁচজন অফিসার মাথা নাড়ায় এবং দাঁত বের করা হাসি দেয়। “তোমরা ইংরেজরা হচ্ছ সভ্য জাতি। যে কোনো সভ্যতার চিহ্ন হচ্ছে সংগীতের প্রতি তার ভালবাসা। তুমি কী তাই মনে কর না ইংলিশম্যান?”

এরপর বারোস ক্যাট ও টেইলার নামক চাবুকটি হাতে ধরা লোকটির দিকে তাকায়, এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে হাল-এর গোড়ালিতে লাগানো লোহার বেড়ির দিকে ইঙ্গিত দেয়। লোকটি তার কোমড় থেকে চাবি বের করে লোহার বেরি খুলে দিয়ে হালকে বন্ধনমুক্ত করে দিল

“তোমরা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ,” বারোস পেশিবহুল কালো চামড়ার দাসটাকে দেখিয়ে বলল। “সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমার শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলবে।”

“এখন খুব সূক্ষ্ম একধরনের প্রতিযোগিতা হবে, তার সামনে দাঁড়ানো আরেকজন অফিসার ভ্রূ কুঁচকে বলে।

 হাল তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে দাসরা সবসময় একধরনের নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে যেন কোনোভাবেই তাদের জীবন বিপন্ন না হয়। সবসময় মাথা নিচু করে চলার চেষ্টা করে, চোখদুটোকে অবনত করে রাখে। কিন্তু এই লোকটি সরাসরি ক্যাপ্টেন-এর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পেশিবহুল পুরো শরীরই প্রায় নগ্ন। শুধু কোমড়ের নিচের অংশে এক টুকরো কাপড় প্যাচানো আছে। হাল মনে মনে ভাবতে লাগল এর বিপরীতে সে কীভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন বারোস-এর মনে যে প্রতিযোগিতার কথা খেলা করছে সেটা কোনো শারীরিক যুদ্ধ ছিল না।

হাল এবং পেশিবহুল দাসটার চারপাশ থেকে লোকজন দূরে সরে যেতে থাকে। ওদের দুজনের জন্য ডেকের ওপর বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়। ওরা দুজনেই বেশ গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। এই নিঃশ্বাস ভয় কিংবা পরিশ্রমের জন্য নয়। এতদিন বন্দী থাকার পর মুক্ত বাতাস পেয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে দুজনেই।

“তোমরা আমাদের জন্য নাচবে,” বারোস বলতে শুরু করল। “তোমরা ফার্নান্দেজ-এর সুরের তালে তালে নাচবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সুর বাজানো বন্ধ করবে ততক্ষণ তোমরা নাচতেই থাকবে।”

 “তবে কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে নাচ থামিয়ে দিতে পার। তবে মনে রেখ যে আগে নাচ থামাবে সে তার ফল পাবে।”

হাল-এর পেছনে দাঁড়ানো দাসটি ক্যাপ্টেন বাতোস-এর একটি কথাও বুঝতে পারে নি। জাহাজের একজন আফ্রিকান নাবিককে ডেকে এনে বারোস এর কথাগুলো তার ভাষায় বুঝিয়ে দেয়া হলে দাসটি সবকিছু বুঝতে পারে।

“কী ফল পাবে?” হাল জিজ্ঞেস করে।

বারোস একজন অফিসার-এর দিকে তাকাল যে তার একটা পা রেলিং এর পাশে রাখা একটা রশির কুণ্ডলীর ওপর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যে প্রথম নাচ থামাবে তাকে রশির এক প্রান্তে বেঁধে জাহাজ থেকে পানিতে ছেড়ে দেয়া হবে। এরপর বারোস তার লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা যারা এই নাচের ফলাফলের বাজিতে হেরে যাবে তারা মাছ ধরে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবে।” এরপর সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে দুই বাহু প্রসারিত করে বলল, “আমি ওদের বিনোদনের দিকটা সবসময় খেয়াল রাখি, দেখেছ? একারণেই আমার নাবিকেরা আমাকে এত ভালবাসে।”

তার পেছনে এরই মধ্যে বাজির পণ নিয়ে দরকষাকষি শুরু হয়ে গিয়েছে।

হাল মাদ্রি দি ডিয়াস-এর প্রধান মাস্তুল-এর দিকে তাকায়। একই সাথে বারোসও সেদিকে তাকায়।

“আহ!” বারোস আক্ষেপ করে বলে উঠে।” “আপনি মনে করছেন আট নটের এই স্পিড আমরা ধরে রাখতে পারব না, তাই না?”

হাল মনে মনে এই জাহাজের পেছনে আসা হাঙরগুলোর কথা চিন্তা করতে লাগল।

“আমরা হিসাব করে দেখেছি যে সাধারণত হাঙরদের গতি হচ্ছে দুই নট। ক্যাপ্টেন বারোস বলতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে সে তার গতি অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। এরপর সে তার অফিসারদের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমরা কী মনে কর?”

“আমরা হাঙরের গতি আট নটের উপরে পর্যন্ত রেকর্ড করেছি, ক্যাপ্টেন। কিন্তু এই গতি হাঙর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না,” কোয়ার্টারমাস্টার বলে উঠে।

বারোস মাথা নাড়ায়, এরপর হাল-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। “অবশ্য এসব আপনাদের চিন্তার বিষয় নয়। আপনারা যতদূর সম্ভব নেচে যাবেন। এরপর বারোস পায়ের গোড়ালি বাঁকিয়ে ফার্নান্দেজ-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং হাত ছড়িয়ে ইশারা করে। ফার্নান্দজ আপনি শুরু করুন। তবে এমন সুর বাজাবেন যেন ইংলিশম্যান-এর পছন্দ হয়।”

ফার্নান্দেজ তার বাদ্যযন্ত্রের তারে আঙুল চালানো শুরু করে।

 আফ্রিকান লোকটি আর হাল উভয়েই পরস্পরের দিকে তাকাল।

 “শুরু করুন”, ক্যাপ্টেন বায়োস বলে উঠে।

চাবুক হাতে ধরা লোকটি হাল এবং আফ্রিকান লোকটাকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। কোনো উপায় না দেখে নাচতে শুরু করে দিল হাল।

.

“আমার তো মনে হচ্ছে কোয়েলিম্যান অথবা উপকূলের কাছাকাছি কোনো বন্দরেই আমরা নোঙর ফেলতে পারব না। বেনবুরি বুজার্ড-এর দিকে তাকায়। তারা দুজনেই পেলিকান-এর কোয়ার্টার পেক-এর রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকিয়ে তাকিয়ে বুজার্ডের মাথা নাড়ানো এবং বোট উঠানামা দেখছে, “প্রায় সব বন্দরই পর্তুগীজদের নিয়ন্ত্রণে। তারা নিজেরা এবং আরবদের ছাড়া অন্য কাউকে সেখানে বাণিজ্য করতে দিবে না। উপকূলে একটা দাস নিয়ে যাওয়াও তাদের কাছে ব্যবসা।”

“চুরি করে কোনো দাসকে উপকূলে নিয়ে যাওয়াটা এখানকার আইন অনুযায়ী মারাত্মক ধরনের অপরাধ,” বুজার্ড তার ফেসফেসে কণ্ঠে বলে উঠে। “তুমি কী চিন্তা করেছো তাহলে?”

“পেরেরিয়া নামে আমার আরেকজন সঙ্গী আছে। সে জানে খনিগুলো কোথায় অবস্থিত। যদি তার কাছে একটা সেক্সট্যান্ট যন্ত্র থাকত তবে সে বলে দিতে পারত যে খনিগুলো কোথায় অবস্থিত। একবার যদি তুমি সেখানে যাও তবে সে তোমাকে ভাষাও বুঝিয়ে দেবে। আমি জানতে পেরেছি যে এই লোবা লোকটার পর্তুগীজ এবং স্থানীয় কিছু ভাষা ছাড়া অন্য কোনো মাতৃভাষা নেই। ডেল্টা নদী হয়ে আমি তোমাকে উপকূলে রেখে আসব। সেখানে সাদা চামড়ার কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না। আমি তোমাকে কোয়েলিম্যান এ নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বরং এদিক দিয়ে গেলে তুমি খনির অনেক কাছাকাছি চলে যেতে পারবে।”

“আমাদের কাউকে না কাউকে যেতেই হবে”, বেনবুরি যুক্তি দেখাল। ‘‘আমি এই জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাব।”

“আমার মনে হয় না আফ্রিকার আবহাওয়ায় এই ভ্রমণে জুডিথ নাজেত এর সৌন্দর্যের কোনো উন্নতি হবে। বরং অবনতি হবে।” বুজার্ড অজুহাত দেখাল।

“ওহ, সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। সে সাদা চামড়ার কোনো মানুষ নয়। অন্যান্যের মতো সেও কালো চামড়ার অধিকারী। সে ওখানে ভালই থাকবে।”

*

হাল ফার্নান্দেজ-এর সুরের তালে তালে নাচতে আরম্ভ করে। যদিও ক্যাপ্টেন সুরটাকে আরও মেলোডিয়াস করতে বলছিল। ধূসর দাড়িযুক্ত বৃদ্ধ লোকটি তার চিকন নড়বড়ে হাতের আঙুলগুলো বাদ্যযন্ত্রের তারের ওপর দিয়ে ছন্দের তালে-তালে নাড়িয়ে যাচ্ছে। সে এতটাই সহজে সুর উঠাচ্ছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো রমণী বাথটাবের গরম পানিতে গোসল করতে করতে বাদ্যযন্ত্রের তারগুলোকে স্রেফ নাড়িয়ে যাচ্ছে, আর ওগুলো নিজে থেকেই মেলোডি সৃষ্টি করে ফেলছে।

 হাল নিজেও এই সুরের তালে তালে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অপমান ভুলে পেশিতে শক্তি আনার চেষ্টা করছে। হাল বাধ্য হয়ে এসব কিছু করছে শুধু একটা কারণেই। সেটা হচ্ছে জুডিথ। ওর জন্য তাকে বেঁচে থাকতেই হবে।

হাতদুটো পেছনে নিয়ে ক্রমানুসারে পায়ের গোড়ালি এবং আঙুলের ওপর ভর দিয়ে নাচার চেষ্টা করছে সে। এভাবে তালে তালে পায়ের পাতা উঠা-নামা করাতে জাহাজের ডেক-এর ওপর এক ধরনের মৃদু ছন্দ তৈরি হয়েছে।

 তবে ফার্নান্দেজ-এর বাজানো সুরটা হাল-এর পরিচিত হওয়াতে তার জন্য একটু সুবিধাই হয়েছে। কিন্তু আফ্রিকান দাসটাকে দেখে মনে হচ্ছে ভায়োল ডি ম্যানো নামক বাদ্যন্ত্রটি সে ইতপূর্বে কখনো দেখেনি।

 বাদ্যযন্ত্রটিতে নতুন এক ধরনের সুর তোলা হয় যেটা হাল চিনতে পারছে না। কিন্তু এরপরেও সে সহজতালে এলোমেলোভাবে নৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে। নাবিকেরা সারাদিন পরিশ্রমের পর যেভাবে ঘুমে ঢুলতে থাকে, এই নাচ অনেকটা সেরকম। সে তার শরীরটাকে শক্তভাবে ধরে রেখে সুদক্ষ কৌশলে হাতদুটো উঠা-নামা করানোর চেষ্টা করছে। সে তার পাদুটোকে এক-দুই-তিন তালে উঠিয়ে-নামিয়ে এমনভাবে নাচার চেষ্টা করছে যেন দর্শকরা দেখে মুগ্ধ হয়। এরপর সে যখন আফ্রিকান লোকটির দিকে তাকাল, তখন দেখতে পেল যে সে পাখি যেভাবে ডানা ঝাঁপটায় অনেকটা সেরকম ভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে। এমনকি আফ্রিকান লোকটিকে দেখে খুব একটা ঘর্মাক্তও মনে হচ্ছে না। অথচ হাল-এর শরীর থেকে ঘাম-এর ফোঁটা ডেক-এর ওপর এসে পড়ছে।

পর্তুগীজ অফিসাররা এসব দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল। তাদের কেউ কেউ হাসছিল এবং হাততালি দিচ্ছিল সুরের তালে তালে। তাদের মাঝে কেউ হাল এর দিকে তাকাচ্ছে আবার কেউ আফ্রিকান লোকটির দিকে তাকাচ্ছে, সেই সাথে নিজেদের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে কেন তার বাজিতে জেতা উচিত। ক্যাপ্টেন বারোস-এর মুখে সবসময় হাসি লেগেই আছে। বাকি নাবিকেরা রেলিং-এর পাশে জড়ো হয়ে নাচ দেখছে।

হাল যেন গানের তালে হারিয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের তাল দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ডেক-এর ওপর আছড়ে পড়ছে। ঠিক যেমনটা ফার্নান্দেজ-এর আঙুলগুলো বাদ্যযন্ত্রের তারের ওপর দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে নেচে বেড়াচ্ছে।

“নিগ্রো লোকটা যেন কোবরার মতো নেচে যাচ্ছে, পর্তুগীজ একজন অফিসার বলে উঠে।

“দেখে মনে হচ্ছে সে তার ঈশ্বরের জন্য ধ্যান করতে করতে নাচছে।” আরেকজন অফিসার বলে উঠে। সূর্য এখন মধ্য আকাশ থেকে কিরণ দিচ্ছে। সাগরের ওপর দিয়ে ভেসে আসা উত্তাপ মাদ্রি দি ডিয়াস-এর স্টারবোর্ড-এর ওপর পড়ছে। এতটাই তাপ অনুভূত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছে, স্টারবোর্ড-এর ওপর জলন্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। হাল-এর নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। তার পাদুটি আস্তে আস্তে ভারী হয়ে আসছে। পানির জন্য তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। তার ঘর্মাক্ত শরীর থেকে পানি পড়ে পায়ের কাছে ডেকের অংশটা ভিজে যাচ্ছে। সে ভয়ে আফ্রিকান লোকটার দিকে তাকাচ্ছে না। যদি সে দেখতে পায় যে লোকটা এখনো তার চেয়ে শক্তিশালী এবং দৃঢ় অবস্থায় রয়েছে তাহলে হয়ত তার আত্মবিশ্বাসটুকু আরও ক্ষীণ হয়ে যাবে। সে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। যদিও এখনো সে আফ্রিকান লোকটার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।

এরপর সে আবারো মনোযোগ দিয়ে নাচতে লাগল।

ব্যথা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। পায়ের ছোট ছোট হাড় থেকে শুরু করে উরুর শক্তিশালী পেশিতে, এমনকি গলা পর্যন্ত। মাথাটা তার কাছে বিশাল ভারী কোনো বস্তু মনে হচ্ছে। তারপরও আফ্রিকান লোকটার জন্য তার মায়া হচ্ছে। কারণ হাল নাচছে তার স্ত্রী এবং আগত সন্তানের জন্য। এছাড়া সাগরের বুকে থাকতে থাকতে তার শরীর শক্তিশালী এক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তার পেশি এবং টেনডন যে কোনোরকম শারীরিক পরিশ্রম মেনে নিতে পারে।

কিন্তু তবুও সেই যন্ত্র এখন আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে। কিছুতেই নাচের গতি এবং তাল ধরে রাখতে পারছে না। ভায়োলা ডা মানো থেকে যে সুর বের হচ্ছে সেটার সাথে কিছুতেই ছন্দ মিলছে না। সে শুনতে পাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে সবাই হাসছে। সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে। তাকে কেমন দেখাচ্ছে আসলে? মনে-মনে ভাবল হাল। ব্যথায় এবং তৃষ্ণায় তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে ভাবতে লাগল যে তাকে হয়ত সাহারা মরুভূমি দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনো নেতিয়ে পড়া বুড়োর মতো লাগছে। যদিও তার শরীর তাকে থামিয়ে দিতে চাচ্ছে কিন্তু তার হাঁটু থামছে না। তার নড়াচড়া যদিও কোনো প্যারোডি নাচের মতো হচ্ছে তবুও কেবল মৃত্যুই এটাকে একেবারে থামিয়ে দিতে পারে।

তবে এটা খুবই অবাক করার বিষয় যে ফার্নান্দেজ এখনো সমান তালে বাজিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখে মোটেও ক্লান্ত মনে হচ্ছে না। তবে সেটা হাল-এর চিন্তার বিষয় না। হাল-এর হাত দুটো যেন অকেজোভাবে শরীরের পাশে লেগে আছে এবং থুতনিটা সে কিছুতেই বুকের কাছ থেকে উঠাতে পারছে না।

 “চালিয়ে যা কুত্তা!” কেউ একজন গর্জে উঠল। সাথে-সাথে একটা চাবুক আফ্রিকান লোকটার পেছনে এবং কাঁধে এসে আঘাত করল। লোকটার রক্তের ছিটেফোঁটা হাল-এর ঠোঁটে এসে লেগেছে।

“মনে হচ্ছে আজকে রাতের ডিনারের জন্য হাঙরগুলো কিছু কালো মাংস পেতে যাচ্ছে। একজন অফিসার বলে উঠে।

 “এখনো খেলা শেষ হয়নি,” আগেরজনকে থামিয়ে দিয়ে আরেক অফিসার বলল, “তোমার ইংরেজকেও খুব একটা তরতাজা মনে হচ্ছেনা।”

দর্শকরা সবাই কথা বলছিল, সেই সাথে চিৎকার দিয়ে উঠছিল। কিন্তু সেসব শোনার মতো শক্তি হাল-এর ছিল না। তার লম্বাচুলগুলো পেছনে থেকে সরে এসে তার মুখের ওপর পড়ছিল। তার পাদুটো কী নড়ছিল নাকি দাঁড়িয়েছিল সেটা অনুভব করার সামর্থ্য যেন তার ছিল না। সে আবারো বাতাসে চাবুক দিয়ে আঘাত করার শব্দ শুনতে পায়। এবার হয়ত চাবুক তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তারপরই সে হোঁচট খায় এবং এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে কোনোমতে পতন ঠেকিয়ে দেয়। তার মন চিৎকার করে উঠে : যে করেই হোক দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সে তাই করে। কিন্তু যখন সে উঠে দাঁড়িয়ে তার বাঁ দিকে তাকায়, তখন সে দেখতে পায় আফ্রিকান লোকটি নিচে পড়ে যাচ্ছে। তার মাথা ঝুলে পড়েছে এবং সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য হাহাকার করছে।

হাল চারদিক থেকে আনন্দধ্বনি শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে এই চিৎকার তার জন্য। কিন্তু তারপরও সে নাচতে থাকে।

প্রথমে পায়ের গোড়ালি, এরপর পায়ের বুড়ো আঙুল। বাম পা সামনে, ডান পা সামনে, বাম পা পেছনে, ডান পা পেছনে। এভাবে সে তালে তাল মিলিয়ে এখনো নেচে যাচ্ছে।

“যথেষ্ট হয়েছে, কোয়ার্টারমাস্টার চিৎকার দিয়ে উঠে।

 “আচ্ছা, এবার থাম, ইংলিশম্যান, তুমি জিতে গেছ”, ক্যাপ্টেন বারোস তার হ্যাটটা খুলে উপরের দিকে ধরল-খেলা শেষ হওয়ার ইংগিত। “তোমার দেশীয় লোকজন নিশ্চয়ই তোমাকে নিয়ে গর্বিত হবে।”

“পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াও। তোমাকে হাঙরের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হবে আজ।” চাবুক হাতে থাকা লোকটি আফ্রিকান-এর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে। “আমি বলছি”, উঠে দাঁড়াও। চাবুক-এর আঘাত পুনরায় আফ্রিকান লোকটির ওপর পড়ল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল হাল, এরপর চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রবল আক্রোশে। তারা দুজনেই নিচে পড়ে গেল। লোকটির গলা প্যাচিয়ে ধরল হাল।

 “কাপুরুষ”, হাল চিৎকার দিয়ে উঠে। রাগে এবং ক্ষুধায় তার মনে হচ্ছিল সে এই ঘৃণ্য শয়তানটাকে খুন করে ফেলবে। আফ্রিকান লোকটির প্রতি তার প্রতিযোগিতার চেয়ে বরং সহমর্মিতা বেশি প্রখর হয়ে উঠেছে। সে মাথা নিচু করে চাবুক হাতে ধরে রাখা লোকটির নাকে জোরে আঘাত করল।

“আমাকে ছেড়ে দাও,” লোকটি চিৎকার করে উঠে। তবুও হাল তাকে ছাড়ল না। লোকটিকে শূন্যের ওপর তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। এরপর আবার তার ওপর গিয়ে পড়ল হাল।

“তাকে এভাবে ধরে রাখ”, বারোস চিৎকার করে উঠল। ইতোমধ্যেই কয়েকজন অফিসার এসে হালকে টেনে চাবুকওয়ালার কাছ থেকে সরিয়ে এনেছে। তাদের মাঝে একজন লোক হাল-এর চুলগুলো নিজের হাতে প্যাচিয়ে পেছন দিকে টেনে ধরল।

“বদমাশ ইংরেজ”, বাতোস আবারো চিৎকার দিয়ে উঠে। “তুমি কী চাও এই নিগ্রোটার সাথে তোমাকেও খুন করা হোক?” এরপর সে হালকে আঘাত করে বসলো। হাল-এর ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়তে থাকে দরদর করে।

 “আমি তোমাকে খুন করে ফেলব,” হাল গর্জে উঠল। তার মাথা থেকে জুডিথ এবং তার সন্তানের চিন্তা কিছু সময়ের জন্য দূর হয়ে যায়। সে কেবল আফ্রিকান লোকটির কথাই ভাবতে থাকে।

সে জানে এরপর তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। সে তার পেটের পেশি শক্ত করে ফেলে যখন দেখে বারোস-এর মুষ্টি তার দিকে এগিয়ে আসছে। বাতাস ভেদ করে বারোস-এর মুষ্টি হালকে আঘাত করে। কিন্তু তারপরও হাল বারোসকে স্প্যানিশ বেশ্যার দুগ্ধজাত সন্তান বলে গালি দিতে থাকে।

বারোস কোনো জবাব না দিয়ে রেলিং-এর দিকে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে মোটা কাঠের টুকরো তুলে এনে হাল-এর কানের উপরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করল সে।

হাল-এর দৃষ্টিসীমার মধ্য থেকে সাদা আলো সরে গিয়ে সবকিছু অন্ধকার হতে শুরু করল। “ইংলিশম্যান, তোমার মধ্যে একজনকে পেলে সামুদ্রিক প্রাণীরা বড় খুশি হবে,” এরপর সে তার লোকদের দিকে ফিরে বলল, “আরেকটা রশির ব্যবস্থা কর।”

তারা হাল এবং আফ্রিকান লোকটার বুকের ওপর খুব শক্ত করে রশি বেঁধে ফেলল। হাল এরপর আর কোনোরকম প্রতিরোধ গড়ে না তুলে আত্মসমর্পণ করাটাই উত্তম বলে ভাবল। কিন্তু আফ্রিকান লোকটা এরপরও বাধা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এরপর হাল এবং আফ্রিকান লোকটাকে নিচে নামাতে লাগল ওরা। রশির একপাশ জাহাজের নাবিকেরা ধরে আছে এবং অন্যপাশে হাল আর আফ্রিকান লোকটা ঝুলে আছে। হাল তার হাতের এবং পায়ের পেশি ব্যবহার করে রশি ধরে জাহাজে আটকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু রশি নামাতে নামাতে যখন তাকে সাগরের পানিতে পৌঁছে দেয়া হলো, তখন সে তীব্র চিৎকার করে উঠল।

মাদ্রি দি ডিয়াস-এর লোকেরা যখন রশিটাকে ছাড়তে ছাড়তে সাগর পর্যন্ত নামিয়ে ফেলল তখন হাল এবং আফ্রিকান লোকটি সাঁতার কাটার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ। সাগরের পানি দুদিকে সরিয়ে মাথাটা ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করা ছাড়া ওদের আর কিছুই করার ছিল না। হাল শরীর বাঁকিয়ে লাথি দিয়ে পেছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হলো না।

সে অন্যদিকে তাকিয়ে যখন দেখল যে আফ্রিকান লোকটি এখনো ডুবে যায়নি তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আফ্রিকান লোকটি এতটাই টানটানভাবে রশিটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে যে দেখে মনে হচ্ছে তার হাতের পেশি ফুলে গিয়েছে।

“ধরে রাখ”, সে চিৎকার করে উঠল। সে তার হাত দিয়ে কোনো কিছু শক্তভাবে ধরে রাখার মতো ইশারা করে দেখাল যাতে লোকটি যদি তার কথা শুনতে না পায় তবুও যেন তার ইশারা দেখে বুঝতে পারে। “ভালভাবে ধরে রাখ। তারা শীঘ্রই আমাদেরকে উপরে উঠিয়ে নেবে।” হাল-এর মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন বায়োস নিশ্চয়ই এতটা বোকা লোক নয় যে তাদের মতো শক্তিশালী দুজনকে দাস হিসেবে খাটানোর বদলে হাঙরের খাবার হতে দেবে।

 জাহাজের অফিসাররা তাদের মাথার হ্যাট খুলে সামনের দিকে ঝুঁকে হাল এবং আফ্রিকান লোকটাকে দেখছে। তারা সবাই জাহাজের পেছন দিকে রেলিং এ জড়ো হয়েছে। হাল তাদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। সেই সাথে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর পালও দেখছে পাচ্ছে সে। অন্তত দুই ডজন নাবিক মাস্তুলের রশি বেয়ে উপরে উঠছে এখন।

সে হয়ত জাহাজের গতি কমানোর চেষ্টা করছে, হাল ভাবল। সাথে-সাথে সে সতর্ক হয়ে পড়ল, কারণ সে জানে যে জাহাজের গতি দুই থেকে তিন নট কমে গেলে কী হবে। কিন্তু সে জাহাজের উপম্যাস্টম্যানকে প্রধান মাস্তুলের ওপরে দেখতে পায়। তারা সবাই উপগ্যালান্ট গোটানোর চেষ্টা করছে। যখন তা সম্পন্ন হয় তখন জাহাজের গতি অনেকটা কমে যায়। এরফলে সহজেই হাল তার মাথাটা পানির ওপর ভাসিয়ে রাখতে পারে। সে যখন আফ্রিকান লোকটির দিকে তাকায় তখন দেখল যে লোকটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।

বোকাটা ভাবছে আমরা বেঁচে গিয়েছি! আপন মনে ভাবল হাল। ও এখনো মনে করছে যে আমরা কোনোমতে এই ট্রায়ালটা পার হয়ে আবারো জাহাজে ফেরত যেতে পারব!

আর এরপরই, হালের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে পেছনে ফিরে তাকানোর ইশারা করল। রশিটাকে শক্ত করে ধরে পেছনে ঘুরে তাকাল হাল।

আর ঠিক তখনই সে তার পেছনে কয়েক গজ দূর থেকে ভেসে আসা হাঙরের ডানাটাকে দেখতে পেল।

ওপর থেকে জাহাজের লোকেরা চিৎকার করছে। তারা সবাই জাহাজের রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়েছে দেখার জন্য।

“গড, হেল্প আস”, হাল বিড়বিড় করে বলতে থাকে। টাইগার শার্ক-এর ঝক এখন তার থেকে মাত্র কয়েক হাত পেছনে আছে।

সমুদ্রে ভ্রমণের ফলশ্রুতিতে সে বিভিন্ন প্রজাতির শার্ক দেখেছে ইন্ডিয়ান। সাগরে : ব্ল্যাক টিপ শার্ক, হ্যাঁমারহেড শার্ক, দ্য গ্রেট হোয়াইট শার্ক। এর মধ্যে গ্রেট হোয়াইট শার্ক আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলতে পারে। তবে নাবিকদের কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে এই নাক বোচা টাইগার শার্ক। কারণ এরা হচ্ছে সবচেয়ে অতৃপ্ত এবং অসন্তুষ্ট। হাল পঁচিশ ফিট লম্বা টাইগার শার্কও দেখেছে। সে এই টাইগার শার্কদের পুরো লংবোট তছনছ করে সবাইকে খেয়ে ফেলতেও দেখেছে।

আফ্রিকান লোকটি ভয়ে চিৎকার করছে। কিন্তু তাকে দেয়ার মতো কোনো উপদেশ হাল-এর কাছে নেই। এখন আর করার মতো কিছুই নেই শুধু আশাকে জিইয়ে রাখা ছাড়া। যদি ওটা এগিয়ে আসে, তবে সামথ্যের শেষটা দিয়ে লড়াই করব। হাল ভাবল।

মাদ্রি দি ডিয়াস-এর গতি অন্তত চার নট-এর মতো কমেছে, যার ফলে হাল-এর মনে হলো, বারোস হয়ত ফোরমাস্ট থেকে কিছুটা ক্যানভাস নামানোর আদেশ দিয়েছে। তবে যাই ঘটুক না কেন, এতে করে হাল-এর রক্ত সাগরের পানির চাইতে আরও অনেক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে আশা করতে থাকে যে পর্তুগীজরা হয়ত তার সাথে মজা করছে। হাঙর আক্রমণ করার পূর্বেই তাদেরকে হয়তো উপরে উঠিয়ে নিবে ওরা।

কিন্তু বণিক নাবিকেরা এখনো তাদেরকে নিয়ে বাণিজ্য করা বন্ধ করেনি। তাদেরকে বাজির পণ বানিয়ে জুয়া খেলছে ওরা।

হাল টেরও পেল না যে কখন একটা হাঙর তাকে আক্রমণ করে বসেছে। একটা বড় পাখার মতো মাথা হঠাৎ করেই তার ডান উরুতে আঘাত করল। এরফলে হাল-এর শরীর ডানদিকে পুরোটা ঘুরে গেল। তার হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে এখন। হাল আবার ভেসে উঠে ফুসফুসটা বাতাসে পূর্ণ করে নিল। হাঙরটা তাকে আরো একবার ধাক্কা দিল। হাল পানির নিচে ডুবে গিয়ে হাঙরটাকে খুঁজতে থাকে।

পানির নিচে ওটাকে দেখতে পেল সে। প্রায় ত্রিশ গজ পেছনে মাথা নাড়িয়ে সাঁতার কাটছে ওটা।

এখন নিশ্চয়ই লোকগুলো তাকে জাহাজের ওপর উঠিয়ে নেবে? তারা নিশ্চয়ই হাঙর-এর আক্রমণ দেখতে চেয়েছে। এবার যারা বাজিতে জিতে গিয়েছে তারা নিশ্চয়ই তাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য করবে।

কিন্তু তারা এখনো তা করছে না। আর তখনই হাল-এর ভয় চরমে পৌঁছে। গেল। কারণ আরও একটি হাঙর এগিয়ে আসছে আক্রমণ করার জন্য। এটার লেজ হালকে এমনভাবে চাপা দিতে থাকে যেন হালকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। পানির নিচেই চিৎকার করে উঠল হাল, এরপর পুরো শরীরটাকে বাকিয়ে দানবটার কাছ থেকে সরে আসলো। সে তার বা পায়ের গোড়ালি দিয়ে হাঙরটার লম্বা নাকে আঘাত করে বসলো। ফলে হাঙরটা সরে গিয়ে জাহাজের কাত হওয়া অংশের নিচে তলিয়ে গেল।

এরপর আরেকটা হাঙর এগিয়ে আসতে থাকে ওর দিকে। ওর খর্ব আর বলিষ্ঠ গড়ন, চওড়া আর পাতলা নাক দেখে হাল বুঝতে পারে যে এটা বুল শার্ক। ওটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে হাল-এর দিকে এগিয়ে আসে। হাঙরটা যখন হালকে আঘাত করতে উদ্যত হলো, সে তখন আবারো পানির নিচে চলে গেল। হাঙরটা হাল-এর এত কাছাকাছি ছিল যে সে ঐ বিস্ময়কর সৃষ্টির চোখদুটো খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিল। তারপর হাঙরটা আরো দূরে সরে গেল। হাল তার শরীরটাকে বাঁকিয়ে উপরে তুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো পানির নিচে ডুব দিল।

এর পরের হাঙরটা মুখ খুলে হালকে আক্রমণ করতে আসলো। এর করাতের মতো দাঁতগুলো পানির ভেতরেও চকচক করছিল। এইরকম ভয়ের মুহূর্তেও হাল-এর জুডিথ-এর কথা মনে পড়ে গেল। কারণ এটাই হয়ত তার জীবনের বেঁচে থাকার শেষমুহূর্ত। তবুও সে মৃত্যুর কাছে এত সহজে হার মেনে নিল না। সে চিৎকার করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাঙরটাকে লাথি দেয়ার চেষ্টা করল। এরপর কোনো না কোনোভাবে হাঙরটা ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে পড়ল।

এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হালকে প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি সময় পার করতে হয়েছিল। সে হাঙরগুলোর নাকে আর চোখে আঘাত করছিল। কোনো না কোনোভাবে হাঙরগুলোর হা করা গ্রাস থেকে হাল বেঁচে গেল। হালের এতক্ষণ মনে হচ্ছিল যে আফ্রিকান লোকটিও হয়তো তার মতো একইভাবে প্রতিহত করে যাচ্ছে। কিন্তু যখন তার বাম কাঁধে তীব্র আঘাত লাগল তখনই তার সেই ভাবনা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। লোকটি আর চিৎকার করছে না। হয়ত সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হয়ত সে হাঙরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে পড়েছে, হাল ছেড়ে দিয়েছে। হাল যখন নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য পানির ওপর ভেসে উঠল তখন জাহাজের ওপর থেকে তীব্র চিৎকার শুনতে পেল। ক্যাপ্টেন বারোস আফ্রিকান লোকটির রশি ধরে রাখা নাবিকদের ওপর চিৎকার করছিল। শুনে মনে হচ্ছিল যে ওকে হাঙরদের খাবার হতে দিয়েছে বলে ক্ষেপেছে সে। বোকা লোকটা কী প্রত্যাশা করেছিল?

হাল তখন শুধু নিজের কথাই ভাবছিল। পানিতে আফ্রিকান লোকটির রক্ত আর মাংস হাঙরগুলোকে যেন পাগল করে তুলেছে, তারা শিকারের জন্য আরও মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি হালকে সময়মত উঠিয়ে ফেলা না হত তাহলে হয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হত না।

এরপর সে বুঝতে পারে যে সে আস্তে আস্তে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর কাছাকাছি যাচ্ছে। তারা হালকে উপরে উঠিয়ে নিচ্ছে। উপরে উঠাতে উঠাতে হালকে যখন লারবোর্ড-এর উপরে টেনে তোলা হয় সে তখন প্রায় মৃত। তার খুব একটা বোধশক্তিও ছিল না।

হাল-এর পায়ে যখন লোহার বেড়ি পরানো হচ্ছিল তখন বাধা দেয়ার মতো বিন্দুমাত্র শক্তিও ছিল না ওর শরীরে।

 “অভিনন্দন, ইংলিশম্যান, তুমি অনেক সাহসিকতার সাথে হাঙরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে,” বারোস হালকে উদ্দেশ্য করে বলল।

উত্তর দেয়ার মতো কোনো সামর্থ্য হাল-এর ছিল না। কিন্তু সে বেঁচে আছে এখনো-এটাই দেখার বিষয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *