৫. জাঞ্জিবার দ্বীপ

জাঞ্জিবার যদি একটি দ্বীপ হয় এবং এটার উপকূলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বসবাস করে তবে ট্রেস ম্যাকাকোস অথবা থ্রি মাংকিস হচ্ছে– সেই জায়গা যেখানে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বাসস্থান। এটা হচ্ছে শহরের সবচেয়ে পুরনো, নোংরা অংশের মধ্যে থাকা একটা জায়গা যেটা একটা সরু গলির মধ্য দিয়ে শহরের এক পাশ থেকে অপর পাশে বয়ে গিয়েছে। এখানে আগে দেদারসে মদ বিক্রি করা হতো। ওমানি কর্তৃপক্ষ মদ হারাম বলে তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও এখনো কিছু অবিশ্বাসী অধার্মিক ব্যক্তিরা হরহামেশাই মদ বিক্রি করে এখানে অনেক ব্যক্তিই টেভার্ন এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে। তারা অনেক বড় অংকের টাকাও প্রদান করে। অনেক জাঞ্জিবারবাসির মতো তারা এখানে কাঁচা স্পিরিটকে রাম হিসেবে কিংবা বিশ্রী গন্ধ যুক্ত ভিনেগারকে ওয়াইন হিসেবে খাওয়ার জন্য নয়, বরং মোরগযুদ্ধ কিংবা ডগফাইট উপভোগ করার জন্য।

টেভার্নস-এর প্রধান অভ্যর্থনা কক্ষে বিভিন্ন ধরনের লোকের সমাগম হয়। জলদস্যু, চোরাকারবারী, দাস-ব্যবসায়ী বণিক, বিভিন্ন পদমর্যাদার জাহাজের লোক। যাদের স্বাগত জানানোর জন্য রয়েছে বিভিন্ন রকমের পোশাকে সুসজ্জিত নারী। খরিদদারদের আকর্ষণ করার জন্য রমণীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন রঙ-এর পাউডারের গন্ধে জায়গাটার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এরকম পরিবেশে বুজার্ড যখন তার একজন ব্যক্তিগত দাস এবং দুজন পাহারাদার নিয়ে হাজির হয়, তখন সেখানে হৈ চৈ পড়ে যায়। পাহারাদার দুজনের কাজ বুজার্ডকে শুধু রক্ষা করাই নয়, জাহানের হাত থেকে বুজার্ড যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেদিক লক্ষ রাখা। একজন মাতাল লোক বুজার্ডকে দেখে চিৎকার করে উঠে, “সরি, বার্ডম্যান। তোমার খাওয়ার জন্য এখানে কোনো পোকামাকড় নেই।”

এরপর যখন বুজার্ডের তলোয়ার এর মাথা তার গলায় ঠেকানো হয় তখন সে হাত জোড় করে মাফ চাইতে থাকে।

বুজার্ড বার-এর ওপর দাঁড়িয়ে তার পান করার পাত্রটা হাতে নিয়ে বলতে থাকে, “এটাতে মদ পূর্ণ করে দাও। আর যদি তোমাদের টাকার প্রয়োজন পড়ে তবে প্রিন্স জাহানের কাছে গিয়ে চাও।” যে দাসীটি সবাইকে পরিবেশন করছিল তার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। জাঞ্জিবার-এর সবার মতো সেও জানে যে প্রিন্স জাহানের কাছে একটা জিন আছে যেটা দেখতে অর্ধেক মানব এবং অর্ধেক পাখির মতো। মেয়েটি সেই খুন হওয়া ছোট ছেলেটার কথাও শুনেছে যে কি-না দানবটার মুখে ময়লা ছুঁড়ে দিয়েছিল। এখন সেই দানব যদি মদ চায় তাহলে তর্ক করতে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। সে জানে তার মালিকও এটা নিয়ে কোনো কথা বলবে না।

বুজার্ডের সাথে আসা দাসটা মদের পাত্র পূর্ণ করে তার মনিবের সাথে সাথে গিয়ে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে। পূর্বের শেখানো পদ্ধতিতে সে বুজার্ডের মুখে নল এগিয়ে দেয়। বুজার্ডও মদের পাত্র খালি করতে থাকে।

ভেতরে কোনো এক খাবারের টেবিল থেকে চাপা হাসির আওয়াজ শোনা যায়। বুজার্ড অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। তার নাকটা জাহাজের পালদণ্ডের ন্যায় তার সামনে ঘুরতে থাকে। তার শকুনের ন্যায় দৃষ্টি একজনের পর একজনের ওপর পড়তে থাকে। সবরকম। হাসির আওয়াজ, শব্দ থেমে যায়। তখন বুজার্ড-এর মাথা ঘুরানোও থেমে যায়। সে একটা নির্দিষ্ট টেবিলের দিকে দৃষ্টিপাত করে। বুজার্ড তার শরীর ঘুরিয়ে সেইদিকে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বুজার্ড আস্তে আস্তে সেই টেবিলের দিকে অগ্রসর হয়।

বুজার্ড যে টেবিলের ওপর দৃষ্টি ফেলেছিল সেটার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছল। একজন মানুষ বসে আছে সেই টেবিলে। লোকটির সামনে একটি মদের বোতল আর একটি পানির পাত্র রাখা আছে। বুজার্ডের আগমনেও লোকটিকে ভীত বলে মনে হচ্ছে না। সে চুপচাপ বসে থেকে বুজার্ডের মুখোশের ওপর আঁকা চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর সে বুজার্ডকে বলে, “আমি তোমাকে দেখে পিছিয়ে পড়ব না। যদি তুমি কাউকে ভয় দেখাতে চাও তাহলে অন্য কাউকে খুঁজে বের কর।”

এরপর বুজার্ড যা করে সেটা উপস্থিত কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় এবং একটা চেয়ার টেনে সেটাতে বসে পড়ে। এরপর লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যাপ্টেন হামিশ বেনবুরি, আমি বেঁচে আছি! তোমার কেমন চলছে?”

কামরার ভেতরকার নীরবতা আস্তে আস্তে গম্ভীর হতে থাকে। সবার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকলেও ক্যাপ্টেন বেনবুরি যেমন ছিল তেমনই চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সে কয়েকমুহূর্ত মেঝের দিকে তাকিয়ে পা নড়াচড়া করতে থাকে। এরপর সোজা বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, “গুড ডে টু ইউ কোকরান।” আমার মা বলে, “তুমি অনেক আগেই মারা গেছ। কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে মিথ্যে।” এরপর সে যথেষ্ট পরিমাণ মদ পান করে এবং বলতে থাকে, “আমি ভেবেছিলাম, তুমি আগে দেখতে যেমন ছিলে, তোমাকে তার চেয়ে বেশি কুৎসিৎ বানানো সম্ভব নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আমার ধারণা ভুল।”

বুজার্ড উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। আর ঠিক তখনি, সে সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়; তার হাসি সামাল দিতে ফুসফুস যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস নিতে পারছে না। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই তার তীব্র কাশি শুরু হয়। সেই কাশি সামাল দিতে সে তীব্র হতাশা আর যন্ত্রণায় টেবিলের ওপর হাতের মুঠি দিয়ে চাপড় মারতে থাকে। এরপর সে ঘুরে তার সাথে আসা চাকরদের দিকে তাকায় যারা এখনো টেবিলে বসে আছে। বুজার্ড-এর ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে ওরা বুঝতে পারে বুজার্ড রাম-এর বোতল টেবিলে ফেলে এসেছে। তারা দ্রুত সেটা নিয়ে দৌড়ে আসে এবং বুজার্ডের মুখে নল ঢুকিয়ে দেয়।

সমস্ত ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যায় যে সবার মধ্যে ভয়ের রেশ কাটতে একটু সময় লাগে। সবাই আগের কথাবার্তা, কাজকর্মে ফিরতে শুরু করলেও থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে চারপাশে। আস্তে আস্তে সবাই স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যায়। মোরগ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বুজার্ড এবং ক্যাপ্টেন বেনবুরি শান্তিতে তাদের গল্প শুরু করে।

পরবর্তী কয়েক মিনিট ধরে বুজার্ড তার গত কয়েকমাসের গল্প বলে যায়। কীভাবে সে বেঁচে যায়, কীভাবে উদ্ধার পায়, কীভাবে জাহানের সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত হয়। কীভাবে সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে পূর্বের শক্তি, যুদ্ধ করার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে, এমনকি জাহানের হারেমের গল্পও বলে সে। জাহানের উপপত্নীরা কীভাবে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল সেটাও বলে।

“তাই নাকি?” বেনবুরি বলে উঠল। আমি সবসময় জানতাম অন্য কোনো পুরুষের জাহানের হারেমে প্রবেশের অনুমতি নেই। শুধু সুলতান নিজে এবং কোনো নপুংসক হিজড়া ব্যতীত। আমি হয়ত ভুল জানতাম। তুমি নিশ্চয়ই নপুংসক নও, কোকরান?”

 বুজার্ড ব্যাপারটাকে অস্বীকার করে এবং বলে যে এটা তাকে দেয়া এক বিশেষ সুযোগ। “হ্যাঁ, তা হতে পারে,” বেনবুরি বলে। যদিও সে বুজার্ডের মুখোশ এবং গলায় লাগানো রিং দেখতে থাকে। পেছনে দাঁড়ানো গার্ডরা কীরূপে বুজার্ডের দিকে তাকাচ্ছে সেটাও সে দেখতে পায়।

 অন্য মানুষ কী ধারণা করেছে সেটা বুজার্ড বুঝতে পারছে। সে বেনবুরির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল যে বেনবুরি তার রিং-এর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই সে বলে উঠল, “এটা নিয়তি। এগুলো লাগানো হয়েছে যেন আমাকে কুকুরের মতো টেনে নেয়া যায়।” “আচ্ছা যাই হোক, এখন এই বিষয় বাদ দেয়া যাক। অন্য কথা বল।”

 “তো বেনবুরি তুমি আমার গল্প শুনেছে,” বুজার্ড আবার বলতে শুরু করে। “এখন বল তুমি এবং তোমার পেলিকান-এর কী অবস্থা?” “আমি আশা করব তুমি এখনো সেটার মালিক আছ। তাই না?”

 “হ্যাঁ, আমি এখনো এটা গর্ব করে বলতে পারি যে, আমি পেলিকান-এর ক্যাপ্টেন,” বেনবুরি উত্তর দেয়। এখন আমি ব্যবসার ব্যাপারে চিন্তা করব। সেই ব্যবসায় আমরা দুজনেই কীভাবে লাভবান হতে পারি সেই চিন্তা করব।”

বুজার্ড সামনের দিকে ঝুঁকে বসে এবং মাথাটা এমনভাবে কাত করে যেন তার একমাত্র চোখটির দৃষ্টি সরাসরি সামনের লোকটির চোখে পড়ে। এরপর প্রশ্ন করে, “কীভাবে?”

 “আমি এখানে এক ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হয়েছি। তুমি কী বালথাজার বোবো নামে কোনো পর্তুগীজ ব্যবসায়ীর নাম শুনেছ?”

“ঠিক বলতে পারছি নে।”

“সে হচ্ছে এক অন্যরকম ভদ্রলোক। আমি হয়ত তোমাকে বলেছিলাম যে বহুবছর ধরে সাহিলি উপকূলের বন্দরে পর্তুগীজদের জাহাজ নোঙর করা আছে। ওখানে তাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে। কিন্তু ওখানে সাদা লোকদের প্রবেশ নিষেধ। তারা সেখানে আশেপাশের রাজ্যে সোনা বিক্রি করে।”

“আমি এসব জানি বেনবুরি। আমি পর্তুগীজদের অনেক জাহাজ চালিয়েছি। তাদের জাহাজের ভেতর সোনা বোঝাই করা থাকে। কিন্তু পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে কোনোরকম যুদ্ধ করার অনুমতি না থাকায় আমি সেসব নিতে পারি নি।”

“এরপর বহুবছর যাবত পর্তুগীজরা সেই বন্দরে থেকে দ্বীপের ভেতর বাণিজ্য চালিয়েছে। এখানে সেখানে তাদের ব্যবসার কতগুলো স্থান রয়েছে। কিন্তু মিশনারীরা-যারা তাদের আত্মা শুদ্ধ করতে দ্বীপে যায়-স্থানীয় লোকদের সোনার আসল গ্রহণযোগ্যতা বা মূল্য বুঝিয়েছে। তাই এখন বালথাজার লোবো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সোনা ক্রয় করার জন্য আর উপকূলে অপেক্ষা করবে না। সে দ্বীপের ভেতরে যাবে। কিংডম অব মানিয়াকা নামে একটা জায়গায় সে খনিজ পদার্থের খনি খুঁজে পেয়েছে।”

“আমার মনে হয় না স্থানীয় প্রধান এতে খুশি হবে, তাই না।”

“লোবো স্থানীয় প্রধানের মুখ বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সম্মানী দিয়েছে। সে একটা খনি উত্তোলনের কাজ শুরু করেছে এবং তাতে যথেষ্ট পরিমাণ সোনা পেয়েছে।”

“সে কী তোমাকে কিছু দেয়, বেনবুরি? এটাই কী তোমার ব্যবসা?”

“না, সে আমাকে কিছু দেয় না…এখনো পর্যন্ত। তবে আমি আশা করি যে। সে শীঘ্রই দিবে। দেখ, সেনর লোবোর একটা ছোট সমস্যা আছে। সে এমন কোনো নারী খুঁজে পাচ্ছে না যে তাকে একটা সন্তান দিতে পারে।”

“সম্ভবত সমস্যাটা মহিলাদের নয়।”

“হ্যাঁ, তুমি হয়ত ঠিকই বলেছ কোকরান। কিন্তু দেখ, যদি এমন কোনো রমণী খুঁজে পাওয়া যায় যার পেটে সন্তান আছে, আর তাকে যদি লোবোর হাতে তুলে দেয়া যায় এবং কিছুদিন পরে তাকে বিশ্বাস করানো যায় যে এ সন্তান তার নিজের তাহলে হয়ত এ ক্ষুদ্র সমস্যার সমাধান করা যায়।”

 “তা অবশ্য করা যায়। আমার মনে হয় এতে সে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবে।”

“এখন আমাকে এই ধরনেরই একটা নারী খুঁজে বের করতে হবে লোবোর কাছে বিক্রি করে দেয়ার জন্য। আমি জাঞ্জিবার-এ এসেছি এরকম কাউকে পাওয়ার আশায়। আমি সুলতান-এর হারেমে তোমার যাতায়াতের ব্যাপারে গল্প শুনেছি। আমি ভেবেছি যে সুলতান যখন তার কোনো উপপত্নীকে নিয়ে ক্লান্ত এবং একঘেয়ে হয়ে উঠে তখন কী করে? সে নিশ্চয়ই তাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেয়। এবং এক্ষেত্রে তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পার। সুলতান যদি তার কোনো উপপত্নীকে বিক্রি করে দেয়, তবে সে যেন আমার কাছেই বিক্রি করে। তুমি তাকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত করবে।”

এরপর বুজার্ডের লুকানো চেহারায় এক ধরনের হাসি ফুটে উঠে। মুখোশের ওপর আঁকানো হাসির ন্যায় প্রশস্ত সে হাসি। বেনবুরির কথায় সমস্ত সমস্যার সমাধান সে একটাই দেখতে পায়। একটা নতুন জীবন শুরু, প্রিন্স-এর কাছ থেকে মুক্তি এবং কার্টনির ওপর প্রতিশোধ।

 “আমি তোমার জন্য এর চেয়ে অনেক অনেক ভাল কিছু করতে পারি। আমি তোমাকে এমন মহিলা এনে দিতে পারি যে কিনা লোবোর জন্য সন্তান ধারণ করবে। কিন্তু তার জন্য তোমাকে একটা পেনীও খরচ করতে হবে না…তার চেয়ে বরং লোবো তোমাকে যে টাকাটা দেবে, ওটার অর্ধেকটা আমাকে দিও, তাহলেই হবে।”

“কিন্তু আমি তা কেন করব?”

 “কারণ এই রমণীর মূল্য কোনো রাজার চেয়ে কম নয়। ওকে পেলে যে কেউই নিজেকে রাজা বলে ভাবতে শুরু করে দেবে।”

এরপর বুজার্ড সবকিছু বলতে শুরু করে। গল্প করতে করতে সামনে রাখা মদের বোতল শেষ করার পর বেনবুরির জন্য ওয়াইন-এর বোতল অর্ডার করে। যখন তাদের মদের বোতলগুলো খালি হয় তখন তারা হ্যান্ড শেক করে তাদের কথা পাকাঁপোক্ত করে নেয়। বুজার্ড তার দাসদের নিয়ে ট্রেস মেকাকোস ত্যাগ করে। এখানে আসার সময় যেরকম অনুভূতি নিয়ে এসেছিল সে, এখন তার চেয়ে অনেক ভাল অনুভব হচ্ছে ওর।

*

তিনজন মানুষ প্রেতাত্মার মতো শহরের একছাদ থেকে অন্যছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাল, বিগ ডেনিয়েল আর উইল স্ট্যানলি নীরবে এবং খালিপায়ে অনেকটা ছায়ার মতো করে কনসাল গ্রে’র ছাদের পেছনের একটা সমতল টেরেসে আস্তে করে লাফ দিয়ে চলে আসে। কাজটা যদিও সহজ নয়। কিছুকিছু ছাদের টাইলস এমনভাবে লাগানো যে তাদের পায়ের নিচে কটকট আওয়াজ করছে। আবার কিছু কিছু এমন হালকাভাবে লাগানো যে তাদের মনে হচ্ছিল এখনই পা পিছলে পড়ে যাবে। জাহাজের ঘূর্ণনের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবত চলাফেরার অভিজ্ঞতার ফলে আজকের মতো তারা রক্ষা পেয়ে যায়। যদিও এখনো তাদের আরও একটু সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছতে হবে। জায়গাটা গ্রে’র বাড়ির ছাদ থেকে পাঁচ ফিট উচ্চতায় আছে।

গ্রে’র বাড়ির সামনের দিকটা মেহগনি কাঠ দিয়ে অনেকটা শৈল্পিকভাবে সাজানো ইসলামিক স্তম্ভের ন্যায় বসানো আছে। দেয়ালে জানালা আছে। কিন্তু জানালার নিচে বেলকনি আছে যেগুলোতে আবার রেলিং দেয়া। এগুলো তাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করবে।

“তুমি কী তাকে দেখতে পাচ্ছ?” ডেনিয়েল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে।

হাল-এর চোখ বাজপাখির মতো অন্ধকারে এদিক সেদিক অ্যাবোলিকে খুঁজছে। রাস্তার অদূরেও কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। রাতের আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে আছে। সেই মেঘ ভেদ করে চাঁদের আলোও খুব একটা প্রবেশ করছেনা।

“এখনো নয়,” হাল বলল, যদিও সে পাহারাদারদের দেখতে পাচ্ছে। দুজন আফ্রিকান লোক সাদা আলখাল্লা পড়ে দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত করছে যে শুধু ব্যবসায়ী আর চাকর-বাকর ছাড়া কেউই যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। পাহরাদারদের হাতে একটা করে ব্লান্ডারবাস দেয়া আছে-এই মুহূর্তের জন্য একদম সঠিক অস্ত্র। কারণ এটা থেকে গুলি চালনা করলে তা এমন বিকট আওয়াজ করে যে সবাইকে জানিয়ে দেয় এখানে কোনো বিপদ হয়েছে।

ছাদের পাশ দিয়ে দুজনলোক একপাশ থেকে অন্যপাশে হাঁটাহাঁটি করছে। হাল এবং পেট যখন লাঞ্চ করতে আসে তখন এখানে কোনো লোক ছিল না। গ্রে সবসময় তার নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে। সে নিশ্চিত করতে চেয়েছে রাতে যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে সে যেন নিরাপদে থাকে।

“ওখানে,” হাল ফিসফিস করে বলল। বিগ ডেনিয়েল এবং স্ট্যানলি হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে চলে আসে।

বিগ ডেনিয়েল হিসস জাতীয় আওয়াজ করে উঠে। কারণ ছাদের বিপরীতে অ্যাবোলিকে দেখা যায়। হাতে ছুরি নিয়ে বাঁকা হয়ে পেছন দিক থেকে পাখির মতো দ্রুত এগিয়ে আসছে একটা গার্ডের দিকে।

হাল তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলেছে। কারণ গার্ড যেকোনো মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং তার ব্লান্ডারবাস থেকে গুলি চালাতে পারে। কিন্তু অ্যাবোলি ততক্ষণে চিতাবাঘের ন্যায় আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।

সে তার বাম হাত দিয়ে গার্ডটার নাক মুখ চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে ছুরিটা কানের নিচে দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। হাল ছুরিটার অগ্রভাগ গলার অন্যপাশ দিয়ে বের হতে দেখে। অ্যাবোলি ছুরিটা গলা কেটে বের করে ফেলে এবং লোকটি হাঁটু ভেঙে সামনের দিকে পড়ে যায়। অ্যাবোলি আবার দ্রুত চলতে শুরু করেছে। কিন্তু আরেকটা পাহারাদার ছাদের পূর্বদিক থেকে দৌড়ে আসছে। স্ট্যানলি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছে।

“সে এবার ধরা খেয়ে যাবে…” বিগ ডেনিয়েল বিড় বিড় করে বলে।

 লোকটি ব্লান্ডারবাস চালাতে উদ্যত হয় কিন্তু তার আগেই অ্যাবোলি দৌড়ে গিয়ে লোকটির বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়-পাজরের হাড়ের নিচ দিয়ে একেবারে হার্ট পর্যন্ত। ছুরিটা বের করে লোকটি চিৎকার করার আগেই তার গলায় বসিয়ে দেয় এক কোপ। অ্যাবোলি ব্লান্ডারবাসটা ধরে লোকটিকে কোনোভাবে নিচে ফেলে দেয়। এরপর সে পাহারাদারটার দেহ পাশ কাটিয়ে ছাদের এক কোণে চলে আসে যেখানে রশি টানানো আছে।

ডেনিয়েল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “আমি তাকে ভাইয়ের মতো ভালবাসি। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, সে চিকেন পক্স-এর চেয়েও সাংঘাতিক।”

তারা দাঁড়িয়ে রশিটার এক পাশ ধরে রাখে এবং অন্য পাশটা অ্যাবোলি তার কোমড়ে বেঁধে ফেলে। এরপর আস্তে আস্তে রশিটা ধরে উপরে উঠতে থাকে। যদি জানালা দিয়ে কেউ অ্যাবোলির ছায়া দেখে ফেলে তবে সমস্ত পরিকল্পনা বিফলে যাবে এবং তারা কোনোদিন জানতেও পারবে না জুডিথ কোথায় আছে।

“ঈশ্বর তাকে রক্ষা করুন, বিগ ডেনিয়েল বলল।

“কোনো কিছুর সাথে রশিটা বাঁধতে পারলে বেশি সুবিধা হত,” স্ট্যানলি বলে। হাল বুঝল যে তার বন্ধু ঠিকই বলেছে। সেখানে শুধু একটা জানালা এবং জানালার নিচে একটা ছোট্ট জায়গা রয়েছে। জানালা দিয়ে হলুদ রঙের আলোক রশ্মি বের হয়ে রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ছে।

কিন্তু যখনই কথাটা বলা শেষ হয় তখনই অ্যাবোলি প্রায় দশ ফিট নিচে ব্যালকনির এক কোণায় লাফ দেয়। রশিটা সে তার কোমড় থেকে খুলে ফেলে এবং কাঠের রেলিং-এ বেঁধে নেয়। তার পেছনের জানালা দিয়ে কোনো আলো আসছে না।

এখন আমাদের পালা। বিগ ডেনিয়েল নিজের রশির অংশটা কোমড়ে বাধতে বাঁধতে বলে। রশিটা টান টান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে পেছাতে থাকে। ছাদের ওপর শক্ত কোনো কিছু নেই যেটার সাথে রশিটা আটকে রাখা যায়। তাই বিগ ডেনিয়েল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেই সেই দায়িত্ব নিয়ে নিলো।

“তুমি কী নিশ্চিত যে তুমি পারবে?” স্ট্যানলি জিজ্ঞেস করে।

“তুমি শীঘ্রই সেটা জানতে পারবে।” মাঝি উত্তর দেয়।

“ডেনী তুমি নটটা শক্তভাবে ধরে রেখ। আমি প্রথমে যাব,” হাল বলল। সে তার এক বাহু এবং এক পা দিয়ে রশিটাকে জাপটে ধরে-হরিণ মারার পর যেভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয় অনেকটা সেভাবে। বিগ ডেনিয়েল তার শক্ত বাহু দিয়ে রশিটাকে টান টান রাখার চেষ্টা করছে।

“আপনি নামুন ক্যাপ্টেন,” সে বলল, হাল রাতের অন্ধকারের মধ্যে আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে থাকে। তার নেপচুন তলোয়ারটা পেছন থেকে ঝুলছে, দুটো পিস্তল তার কোমড়ে আটকানো। এখন কোনো কথা নয় শুধু মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে। সে তার পা দুটো দিয়ে আড়াআড়ি করে রশিটাকে ধরে রাখে। তার জীবনের অর্ধেকটা সময় সে মাস্তুলের ওপর রশি বেয়ে উঠানামা করেছে। কিন্তু কোনো গার্ড যদি এখন বাড়ির পেছন থেকে বের হয়ে কিংবা জানালা দিয়ে কেউ দেখে ফেলে তবে তার সেই দক্ষতা তাকে– বাঁচাতে পারবে না।

অন্ধকারের মধ্যে স্কুলে থেকে হাল যদিও তার চারপাশের কিছু দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তার নিজের হার্টবিট সে নিজ কানে শুনতে পাচ্ছে। জাঞ্জিবার এর রাস্তা থেকে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। সাগরের ঢেউ-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে অপেক্ষা করছে কেউ কোনো গানফায়ার-এর শব্দ করে কি-না। কিন্তু কোনো শব্দই এলো না। আস্তে আস্তে রশির শেষ মাথায় পৌঁছে যায় হাল।

হাল এক পা রেলিং-এর ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়ে সমস্ত শরীরটাকে টেনে বেলকনির ভেতরে নিয়ে আসে এবং অ্যাবোলির মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাল আর অ্যাবোলি একে অপরের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নেড়ে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিল পরস্পরের কাছে-এখনো পর্যন্ত সব ঠিক-ঠিক মতোই চলছে। ওরা তাকিয়ে দেখল যে স্ট্যানলিও ততক্ষণে এগিয়ে আসছে। ঠিক তখনই জাঞ্জিবার-এর আকাশ থেকে মেঘ কেটে যায়। চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে যায় শহরটা। স্ট্যানলি যে কি-না এতক্ষণ অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে নড়াচড়া করতে পারছিল না, সেও এগিয়ে আসছে রশি বেয়ে। কিন্তু হঠাৎ ঝাঁকুনিতে বিগ ডেনিয়েল তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। হাল শুনতে পায় ডেনিয়েল চিৎকার দিয়ে উঠেছে। স্ট্যানলি দ্রুত পড়তে থাকে, কিন্তু স্রেফ কপালগুণে শেষ পর্যন্ত ঝুলে থাকতে পারে; বিগ ডেনিয়েল-এর পা পিছলে যাওয়ার পরও পেছন দিকে ঝুঁকে রশি টান টান করে ধরে রেখেছিল সে।

এরইমধ্যে স্ট্যানলি বেলকনিতে পৌঁছে যায়। অ্যাবোলি ছুরি হাতে প্রস্তুত হয়ে যায়-যদি হঠাৎ করেই কোনো গার্ড চলে আসে। এরপর সে জানালার হাতলটা শক্তভাবে ধরে ধাক্কা দেয়। জানালা খুলে যায়। লাফ দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে অ্যাবোলি, সেই সাথে ছুরি হাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

 কিন্তু ঘরে কেউ ছিল না। কিছু আসবাবপত্র চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল। হাল আর স্ট্যানলি অ্যাবোলির সাথে যোগ দিয়ে দরজার দিকে এগুতে থাকে। হাল দরজার খিলটা আস্তে করে খুলে ফাঁকা অংশ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল। সে সেটাই দেখতে পায় যা সে প্রত্যাশা করেছিল।

 বিল্ডিং-এর তিনপাশে একতলাসমান উঁচু যে স্তম্ভ শ্রেণিগুলো রয়েছে সেগুলো একেবারে উঠোন পর্যন্ত চলে গিয়েছে যার মাঝখানটায় যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা রয়েছে। এর বিপরীত দিকে যেদিকে হাল ও তার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কোনো স্তম্ভশ্রেণি নেই। একারণে তারা বিল্ডিংগুলোর পুরো অংশ দেখতে পাচ্ছে। বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর যে বিল্ডিংটা সেটার জানালাগুলো আয়রণ লিয়ন দিয়ে নকশা করা। সম্ভবত গ্রে তার নিজের ব্যবহারের জন্যই এটা সংরক্ষণ করে রেখেছে। হাল দেখতে পায় জানালা দিয়ে মোমবাতির মৃদু আলো বেরিয়ে আসছে যেটা থেকে বোঝা যায় যে গ্রে হয়ত এখনো জেগে আছে। ডেম! হাল চিন্তা করে, “সে যদি জেগে থাকে তাহলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে।”

হাল বাকিদের ইশারা করলে তারা হাল-এর সাথে সাথে স্তম্ভগুলোর ভেতর দিয়ে আসতে থাকে। হাল জানে প্রধান প্রবেশ পথের সামনে আরও দুজন গার্ড থাকতে পারে। কিন্তু এদিক সেদিক তাকিয়ে সে গার্ডদের কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না।

তারা তিনজনে মিলে ঘেরাও করা জায়গাটার চারদিকে ঘুরে-ঘুরে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখতে থাকল। জায়গাটার মাঝখানে একটা নরম পানির ঝরণা পানির ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে। তাই টাইলস করা মেঝেতে পা যেন পিছলে না যায় সেদিকেও তাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছে। পেয়াজের ন্যায় গোল জায়গাটায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারা একটা কাঠের দরজা দেখতে পায়। হাল তার ডানহাতে ছুরিটা নিয়ে দরজার খিল খুলে ধাক্কা দেয়। দরজাটা খুলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে ভেতরে প্রবেশ করে সে। অ্যাবোলি আর স্ট্যানলিও তার সাথে ভেতরে প্রবেশ করে।

এমন সময় হাল চিকন স্বরের চিৎকার শুনতে পায়। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। দেখতে পেল, ঘরের ভেতরে গ্রে প্রায় নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“স্যার হেনরি,” গ্রে অনেকটা তোতলামি করে বলে উঠল। তার পেছনে একটা নগ্ন আফ্রিকান বালক শুয়ে আছে। তেল দেয়ার ফলে ছেলেটার কফি রঙা চামড়া চকচক করছে।

‘কনসাল গ্রে,” হালও তার নেপচুন তলোয়ারটা তাক করে সম্বোধনের জবাব দেয়।

 “কেউ একজন আসছে গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি হালকে বলল। তারা পায়ের শব্দ শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে একটু আগে দেয়া গ্রের চিৎকারে তার লোকেরা এগিয়ে আসছে।

গ্রের দরজায় দু’বার টোকা মেরে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “কনসাল। সব ঠিক আছেতো? কনসাল!”

গ্রে একবার হাল, আরেকবার অ্যাবোলির মুখের দিকে তাকাল। এরপর তার দিকে তাক করা তলোয়ার-এর দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিয়েই দরজার দিকে চোখ দিল। তার চেহারা ভয় আর সিদ্ধান্তহীনতায় প্রায় জমে যাচ্ছে।

“আমাকে সাহায্য কর,” সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। ধড়াম করে দরজা খুলে গিয়ে দুজন লোক ভেতরে প্রবেশ করল।

বিদ্যুৎ বেগে অ্যাবোলি ওদের একজনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাহু দিয়ে গলা প্যাচিয়ে ধরে পেছনে নিয়ে যায়। হাল তার তলোয়ারটা লোকটার মুখে ঢেকিয়ে দিল। কিন্তু তলোয়ার সরিয়ে আরেকজন গার্ড হালকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তার আগেই স্ট্যানলি তাকে পেছন থেকে আঘাত করে বসলো। গার্ডটা মেঝেতে পড়ে যায়। তার গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এরপর স্ট্যানলি বিছানার দিকে এগোয়। যে ছোট ছেলেটা বিছানায় ছিল সে চাদরের নিচে লুকোতে থাকে।

এদিকে দরজার পাশে থাকা অ্যাবোলি অন্য গার্ডটাকেও প্রতিহত করতে সমর্থ হয় এবং বলে উঠে, “অনেক হয়েছে! তোমার গডের কাছে যাও এখন?”

এসব দেখে ভয়ে আর আতংকে প্যান্ট ভিজিয়ে দিল গ্রে। তার মূত্রের ধারা গড়িয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

“জুডিথ কোথায়? তারা জুডিথকে কোথায় নিয়ে গেছে?” হাল তার তলোয়ারটা গ্রে’র পেটের দিকে তাক করে জিজ্ঞেস করে। অ্যাবোলি ততক্ষণে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওটার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছে।

গ্রে বুঝতে পারল যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তার চেহারা থেকে ঘামের ফোঁটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। কিন্তু সে কোনোরকম কথা বলছে না।

হাল তার তলোয়ারের অগ্রভাগ গ্রে’র গালে ছোঁয়াল। পেছাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল কনসাল গ্রে। তার গালে লাল দাগ পড়ে গেল সাথে সাথে।

“ওরা জুডিথকে কোথায় নিয়ে গেছে?” হাল আবারো জিজ্ঞেস করল।

 হাল এবার তার মুষ্টি দিয়ে গ্রে’র কানের ওপরে সজোরে ঘুসি লাগাল।

গ্রে’ প্রথমে মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল। কোনোরকমে ভারসাম্য রক্ষা করে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তীব্র ভয়ে ওর চোখগুলো বড় বড় হয়ে গিয়েছে।

“তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও তাই না হাল?” সে বলে উঠে। “তবে তাই কর।”

“আমি আপনাকে এরপর আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করব না,” হাল বলল। “আমাকে শুধু বলুন যে বুজার্ড এবং তার লোকেরা জুডিথকে কী করেছে?”

“এভাবে অনেক সময় লাগবে”, অ্যাবোলি বলে উঠল।

“তুমি গোল্লায় যাও, কার্টনি,” গ্রে ফোঁস ফোঁস করে বলে উঠে। হয় সে তার হারানো সাহস ফিরে পেয়েছে, নয়ত আজকে রাতে সে বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছে। হাল তার তলোয়ার তুলে লোকটাকে পুনরায় আঘাত করতে যাচ্ছিল।

“থাম, গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি বলে উঠল। হাল তলোয়ার নিচু করে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। “তাকে কীভাবে কথা বলাতে হবে সেটা আমার জানা আছে।”

ইতস্তত করছে হাল। কিন্তু অ্যাবোলি তাকে আবারো বলল, “তুমি যদি ওকে আমার হাত না দাও তাহলে ওর মুখ থেকে কথা শুনতে হলে আমাদেরকে এখানে সারা রাত অপেক্ষা করতে হবে।”

 হাল-এর ইচ্ছে হচ্ছিল তার নেপচুন তলোয়ারটা বদমাশটার হার্টের ভেতর দিয়ে পার করে দিতে। কিন্তু তাতে তো জুডিথকে রক্ষা করা যাবে না। তাই বহু কষ্টে সে তার রাগ দমন করল। “সে এখন শুধুই তোমার, অ্যাবোলি।”

অ্যাবোলি বিছানা পার হয়ে চেয়ারটার দিকে এগিয়ে যায় যেটাতে কনসাল-এর জামা ভাজ করে রাখা আছে। অ্যাবোলি জামাটার একটু অংশ কেটে নিয়ে গ্রে’র মুখে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে কাপড়টা ভেতরে ঢুকাতে থাকে-লোকটার কাশি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত। এরপর চেয়ারটা টেনে ঘরের মাঝখানে নিয়ে আসে এবং গ্রেকে সেটাতে বসায়। তারপর বিছানার চাদর থেকে ফিতার মতো কিছু অংশ কেটে সেটা দিয়ে রশি তৈরি করে। সেগুলো দিয়ে কনসাল-এর পাদুটো চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলল সে। হাল জানে অ্যাবোলির মনে কী খেলা করছে। সে গ্রে’র নিজের বেল্টটা নিয়ে হাতদুটো চেয়ারের পেছনে বেঁধে ফেলল।

 গ্রে তার ফুলে যাওয়া চোখগুলো দিয়ে হাল-এর দিকে তাকায়। তার চেহারার একপাশটা গাঢ় পার্পল রঙ ধারণ করেছে। তার মোটা পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে।

 অ্যাবোলি গ্রে’র চেয়ারের পেছনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে। সে গ্রে’র দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়, এরপর ছুরি হাতে কাজে লেগে যায়। গ্রে ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠে। কিন্তু গড়গড় আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না কারণ তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া আছে। অ্যাবোলি যখন কাজ শেষ করে উঠে আসে তখন দেখা যায় তার বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং তর্জনীর মাঝে গ্রে’র কাটা আঙুল ঝুলে আছে। এরপর সে চেয়ারের সামনে গিয়ে গ্রে-কে তার নিজের কাটা আঙুলটা দেখায়।

“ক্যাপ্টেনকে যা জানতে চাচ্ছে তাকে তা বলে দাও, গ্রে”, অ্যাবোলি ভয়ংকরভাবে বলল। “যদি না তুমি যোবা আর অন্ধ হয়ে যেতে চাও। কারণ তুমি যদি না বললো, তাহলে আমি তোমার জিব কেটে ফেলব, সেই সাথে চোখগুলোও তুলে নেব।”

গ্রে ভয়ে দ্রুত মাথা নাড়ায় এবং বোঝায় যে সে কথা বলবে। অ্যাবোলি কাটা আঙুলটা মেঝের ওপর রাখল। কনসাল-এর মুখে দেয়া কাপড়টা উঠিয়ে নেয়ার পর কনসাল মুখ হা করে শ্বাস নিতে থাকে। হাল এক জগ ওয়াইন গ্রে-র মুখের সামনে ধরে। গ্রে সেটা দ্রুত পান করতে গিয়ে অর্ধেকটা তার পেটের ওপর ফেলে দেয়।

“বুজার্ড জুডিথকে কোথায় নিয়ে গেছে?” হাল আবারো জিজ্ঞেস করে। গ্রে এবার দ্রুত মাথা নাড়ায় যদিও তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে বেশিকিছু হালকে বলতে চাচ্ছে না।

 “ক্যাপ্টেন কার্টনি, সত্যটা হল…” গ্রে ওয়াইন-এর জগ-এর দিকে ইঙ্গিত করল। তাই হাল আবারো সেটা গ্রে-এর মুখের সামনে ধরে ওটা পান করার সুযোগ করে দেয়। “সত্যটা হলো…” গ্রে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “আপনি আর কখনোই সেই বেয়াদব মেয়েটাকে দেখতে পাবেন না। কারণ সে এখন প্রিন্স জাহান-এর কাছে আছে।” “তাকে জাঞ্জিবার-এর দাস বাজারে বিক্রি করে দেয়া হবে।” সে এবার হাল-এর দিকে তাকাল। তার চেহারায় এক ধরনের চাতুর্য খেলা করছে। আর একবার বিক্রি করে দেয়া হলে তুমি আর কখনোই তাকে খুঁজে পাবে না। কারণ ক্রেতারা ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের যেকোনো অংশ থেকে আসে-সেটা উত্তর আফ্রিকা এমনকি ইন্ডিয়াও হতে পারে। অর্থাৎ কলকাতা থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল-এর যে কোনো অংশ থেকে আসতে পারে তারা। পরবর্তী কার্টনি একজন দাস হয়ে জন্ম নেবে এবং দাস হয়েই মৃত্যুবরণ করবে।

হঠাৎ করেই নড়ে উঠে গ্রে। চেয়ারসহ উঠে দাঁড়িয়ে হাল এবং অ্যাবোলিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করল সে। এরপর গলা ফাটিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে।

ঠিক তখনই হাল একজনের চিৎকার শুনতে পায়।

“ওই!”

কাঠের মেঝেতে একজন মানুষের ধপাস করে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল সে। তাকিয়ে দেখে, স্ট্যানলি মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে এবং আফ্রিকান বালকটি তার হাত থেকে ছুটে চলে যাচ্ছে।

“আমি বদমাসটাকে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে এতটাই পিচ্ছিল যে কোনোভাবেই ধরে রাখা যাচ্ছিল না,” স্ট্যানলি বলল।

আশপাশ থেকে আরও আওয়াজ ভেসে আসছিল।

“আরও অনেকেই এদিকে আসছে,” অ্যাবোলি বলল। তার কান দরজার বাইরের দিকে তাক করা ছিল।

“আমাদের এখন চলে যাওয়া উচিত,” হাল বলে উঠল।

দরজার কাছে গিয়ে থামল সে। অ্যাবোলি আর স্ট্যানলি ওকে পাস কাটিয়ে স্তম্ভশ্রেণির দিকে এগিয়ে গেল।

গ্রে এখনো তার চেয়ারে বাঁধা আছে এবং ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁসফাস করছে।

“জুডিথকে বলে বিশ্বাস রাখতে,” হাল তার দিকে তাকিয়ে বলল। যেভাবেই হোক আমি তাকে খুঁজে বের করব এবং মুক্ত করেই ছাড়ব।

হল ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে বাকি দুজনের পথ অনুসরণ করতে থাকে। প্রথমে তারা কিছু কণ্ঠের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায়। ওদের পেছনে কে যেন চিৎকার করে উঠল, এরপর গুলির শব্দ আর কিছু লোকের পদধ্বনি শুনতে পেল ওরা। যেই ঘর দিয়ে তারা এখানে এসেছিল, তার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ওরা।

“তাড়াতাড়ি! আমাকে দরজাটা আটকাতে সাহায্য কর,” হাল চিৎকার করে উঠল।

 তিনজন মানুষ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে রুমে থাকা বড়-সড় ডেস্কটাকে দরজার সামনে নিয়ে এসে দরজাটা আটকে ফেলল। এরপর তারা জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালা দিয়ে বের হয়ে বেলকনিতে আসার পর জানালা বন্ধ করে দিল ওরা। হাল এখন বিল্ডিং-এর মাঝ দিয়ে ডেনিয়েলকে দেখার চেষ্টা করছে। এতক্ষণের হৈ চৈ ও গণ্ডগোল-এ ডেনিয়েলও সতর্ক হয়ে গিয়েছে। ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে শক্তভাবে রশি ধরে আছে ও, সেই সাথে পা টান টান করে ওজনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। “তুমি প্রথমে, স্ট্যানলি,” হাল আদেশ করল।

কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে স্ট্যানলি রশির অর্ধেকটা পর্যন্ত উঠে গেল।

ঘরের দরজার ওপাশ থেকে ধুমধাম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, কারণ গ্রের লোকেরা দরজা খোলার চেষ্টা করছে। হঠাৎ জানালার দিকে কাঠের ছোট্ট একটা টুকরা ছিটকে আসলো; “কেউ একজন হয়ত আঘাত করে দরজাটায় ছোট্ট একটা গর্ত বানিয়ে ফেলেছে।”

“এরপর তুমি, অ্যাবোলি”, হাল বলল।

“কিন্তু, গান্ডওয়েন…”

“যাও। এটা আমার আদেশ। আমার হাতে এখনো এটা আছে…”

হাল-একটু ঝুঁকে তার কোমড়ে গুঁজে রাখা পিস্তলটার দিকে ইঙ্গিত করল। বাধ্য হয়ে অ্যাবোলিও মাথা নাড়ায় এবং রশিটা শক্তভাবে ধরে উপরে উঠতে শুরু করে। হাল জানালার দিকে পেছন ফিরে অ্যাবোলির রশি বেয়ে উঠা দেখতে থাকে, একই সাথে তাদের পেছন থেকে আগত লোকগুলোর শব্দ শুনতে থাকে। পিস্তলটা এখনো তার হাতেই ধরা আছে।

 অ্যাবোলি যখন প্রায় পৌঁছে গিয়েছে ঠিক তখনই কাঠের কিছু একটা ছিটকে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল হাল। সেই সাথে পেছন থেকে কয়েকজনের চিৎকার শোনা গেল। হাল এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনে জানালার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জানালাটায় শক্তভাবে একটা ধাক্কা মারল। তার পিস্তল তাক করাই। ছিল। তার লক্ষ্য বস্তু হচ্ছে ডেস্কের ওপর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করা লোকটা যে কি-না তার থেকে মাত্র দশ-বার ফিট দূরত্বে আছে এখন। হাল প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখার। পিস্তল তাক করে গুলি করে হাল। লোকটা তীব্র চিৎকার দিয়ে ডেস্ক-এর ওপর পড়ে গেল। হাল তার ফাঁকা পিস্তলটা আগের জায়গায় খুঁজে রেখে আরেকটা বের করে আনে। এবার সে দরজার ফাঁকা গর্তটুকু দিয়ে একাধারে গুলি ছুঁড়তে থাকে যেখানে দিয়ে মানুষের শরীরের অংশ দেখা যাচ্ছিল।

এরপর সে রেলিং-এর দিকে ফিরে তাকিয়ে রশিটা শক্তভাবে ধরে ফেলল। ওটাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলো হাল। ততক্ষণে গ্রে’র লোকেরা তাদের দু’জন গার্ড হারানোর ধকলটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। পেছনে আরও কিছু কাঠ ভাঙার শব্দ শুনতে পেল হাল। গ্রে’র লোকেরা দরজা ভেঙে তড়িঘড়ি করে ফাঁকা কক্ষের ভেতর প্রবেশ করল। ততক্ষণে হাল রশি বেয়ে দুই তৃতীয়াংশ উঠে পড়েছে।

“তাড়াতাড়ি করুন, ক্যাপ্টেন!” বিগ ডেনিয়েল বলে উঠল।

“তারা ছাদের উপরেও চলে এসেছে, স্যার!” উইল স্ট্যানলি চিৎকার দিয়ে উঠল।

 গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেল হাল। একটা গুলি বাতাস ভেদ করে তার দিকে এগিয়ে এসে অল্প একটুর জন্য পাশ কাটিয়ে দেয়ালে আঘাত করল।

এরপর বেলকনি থেকে আরেকবার চিৎকার শুনতে পেল হাল। হঠাৎ সে নিজেকে ওজনহীন অনুভব করে; আস্তে আস্তে নিচে পড়তে থাকে হাল।

তারা হাল-এর রশি কেটে দিয়েছে!

এতক্ষণ ডেনিয়েল তার ওজন ধরে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিল কিন্তু এখন তাকে নিজের চেষ্টায় টিকে থাকতে হবে। নিচের দিকে পড়তে পড়তে তীব্র ঝাঁকুনি খায় হাল।

“চিন্তা করবেন না, ক্যাপ্টেন!” ড্যানিয়েল বলে উঠে। আমরা আপনাকে ধরে ফেলেছি। শুধু একটু সময় দিন।

নিচে পড়তে থাকা কাউকে এভাবে ধরে ফেলাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। হাল নিচের রাস্তা থেকে আরও চিৎকার এবং গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায়। ততক্ষণে হাল ছাদের কিনারা ধরে ফেলেছে। “ওয়েল ডান ডেনী, হাল বলে উঠল। খুব দুঃসাহসিক কাজ করেছ।

হাল ছাদের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দ্রুত জাহাজে চল।”

এরপর তারা যত দ্রুত সম্ভব ডেট-এ পৌঁছানোর জন্য যাত্রা শুরু করল যেন তারা ওমানি সৈন্যদল জেগে উঠার আগেই পৌঁছাতে পারে। টাইলস করা ছাদের ওপর দিয়ে সাগরের দিকে দৌড়াচ্ছিল ওরা। পেছন থেকে তেড়ে আসা শত্রুদের চিৎকার ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে এখন। ওরা বুঝতে পারে যে ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছে। উপকূল থেকে দুই রাস্তা পেছনে একটা সিঁড়ির কাছে এসে থামল ওরা। চারজন মানুষ একত্রে হাঁটুভাজ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকল।

এবং এরপর আবার দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে তারা উপকূলের সামনে এসে থামে যেখানে তাদের জন্য লংবোট অপেক্ষা করছিল। তাদের বাঁ দিকে সমুদ্র মৃদু আলোতে চকচক করছে। কিন্তু একইসাথে এর মানে হচ্ছে, ওরা সমদ্র উপকূলকে পাহারা দিয়ে রাখা দুর্গের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে এখন সৈন্য গিজগিজ করছে। যার অর্থ হচ্ছে, এতক্ষণে ওদের খবরটা এদিকে পৌঁছে গিয়েছে।

যখন তারা দুর্গ থেকে মাত্র অল্প কিছু দূরত্বে ছিল, তখনই লোহার দরজাটা ধপাস করে খুলে যায়। সেই সাথে একঝাক ওমানি সৈন্য অস্ত্র হাতে বের হয়ে আসে। ওদের অফিসার হালকে চিহ্নিত করে এবং সবাইকে গুলি করার আদেশ দেয়। ওদের গুলি রাতের আকাশে ফুলকি ফুটাতে থাকে।

“দৌড়াতে থাক”, হাল আদেশ করল, “থেমে যেও না।” ওরা চারজন সাদা আলখাল্লা পরা সৈন্যদের দিকে দৌড়াতে থাকল যারা দুর্গের গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে।

“গড এন্ড দ্য কিং”, হাল গর্জন করে উঠল। ডানহাতে নেপচুন তলোয়ার আর বাম হাতে ফ্লিনটক ধরে আছে সে। “গড় এন্ড দ্য কিং।”

হঠাৎ আরও বহুসংখ্যক লোকের হৈ চৈ শোনা গেল। কারণ গোল্ডেন বাউ এর লং বোটগুলো ততক্ষণে তীরে এসে পড়েছে। জাহাজের নাবিকরা সবাই এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। দুর্গের সৈন্যদের ওপর একাধারে গুলি ছুড়ছে ওরা। এরূপ হঠাৎ আক্রমণে সৈন্যরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে।

“গড এন্ড দ্য কিং এন্ড দ্য গোল্ডেন বাউ” বিগ ডেনিয়েল গর্জে উঠল। সে তার তলোয়ার দিয়ে একজন শত্রুর মস্তক শরীর থেকে ছিন্ন করে ফেলল। এরপর বাউ-এর অন্যান্য নাবিকেরাও তার সাথে যোগ দিল।

তলোয়ার-এর ব্লেড-এর টুংটাং শব্দ এবং মানুষের বেঁচে থাকার আর্তচিৎকারে জাঞ্জিবার-এর আকাশ ভারি হয়ে উঠল। হাল দেখতে পায় তার অতি পরিচিত একজন নাবিক মরে পড়ে আছে। তলোয়ার-এর আঘাতে তার গলার সামনের অংশ ছিন্ন হয়ে আছে। দেখতে পায় উইল স্ট্যানলি একজন আরব সৈন্যের বাহু উড়িয়ে দিয়েছে। আরো দেখতে পায়, একজন স্কুল ছাত্রের তিন পর্যন্ত গুনতে যতটুকু সময় লাগবে, সেই সময়ের ভেতরেই অ্যাবোলি তিনজন আরব সৈন্যকে খুন করে ফেলেছে।

কিন্তু আরও আরব সৈন্য দুর্গ থেকে বের হয়ে আসছে।

“নৌকার দিকে চল”, হাল তার নাবিকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল। এরপর সবাই একযোগে নৌকোর দিকে দৌড়াতে থাকে।

হাল যখন দ্বিতীয় নৌকোটায় উঠছিল তখন সে শুনতে পায় ওমানি অফিসার গুলি ছোঁড়ার আদেশ দিচ্ছে।

“আমাদের নৌকো ডেফট-এর কাছে নিয়ে যাও”, হাল বলল। সে তার শিরদাঁড়া সোজা করে শত্রুদের দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে।

তারা ডেফটে পৌঁছার পূর্বপর্যন্ত শত্রুর গোলাগুলি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

“মি. ট্রোম্প, ডেক্ট-কে উপকূলের বাইরে নিয়ে যাও। চ্যানেল-এর দিকে জাহাজ চালিত কর, যেন আমরা বাতাসের পূর্বে পৌঁছাতে পারি।”

ট্রোম্প ডেফট-এর নাবিকদের আদেশ দিতে থাকে দ্রুত কাজ করার জন্য। পাল তুলে দেয়ার সাথে সাথে ওটা রাতের বাতাসে উড়তে থাকে। ডেটও রেসের ঘোড়ার মতো তর্জন গর্জন করে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

শত্রুদের গুলি এড়িয়ে দুর্গের দেয়াল পাশ কাটিয়ে দ্রুত যেতে থাকে ডেট। অল্প সময়ের মধ্যেই ডেফট আওতার বাইরে চলে যায় এবং দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে।

 “খুব ভালভাবে কাজ সম্পন্ন করেছ মি. ট্রোম্প”, হাল ট্রোম্পকে উদ্দেশ্য করে বলল। জাঞ্জিবার দ্বীপটাকে পেছনে ফেলে এসেছে ওরা। এখন আমাদেরকে বাউ-এর কাছে পৌঁছে দাও।”

*

উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ঝড় এগিয়ে আসছে। ইন্ডিয়া এবং হিমালয়ের পাদদেশে এ ঝড়ের উৎপত্তি বলে মনে হচ্ছে। যেন ঈশ্বরের ক্রোধের কারণে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছে। হাল জাহাজের পশ্চাৎ দিক থেকে আস্তে আস্তে কোয়ার্টার ডেক-এ নেমে এলো, কারণ সেদিকের আকাশের রঙ আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। সেই বদলে যাওয়া রঙ আস্তে আস্তে গাঢ় হতে থাকে। যেন একটা কাল চাদর কেউ আকাশের ওপর বিছিয়ে দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। হাল টেলিস্কোপ ধরার পরপরই সাগর যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে।

 “বাউকে আর সামনে এগুতে দেয়া যাবে না, মি. টেইলর,” হাল চিৎকার দিয়ে বলে উঠল। “খুব দেরিতে পাল গোটানোর চেয়ে খুব তাড়াতাড়ি খুঁটিয়ে ফেলা ভাল, তাই না মি. ট্রাম্প?”

ওলন্দাজটা হাল-এর কথায় হেসে জবাব দেয়, “আপনি যদি দেরিতে পাল গোটানোর চেষ্টা করেন তবে দ্বিতীয়বার আর তা করার সুযোগ পাবেন না, ক্যাপ্টেন।”

‘জাহাজটাকে পাল নিয়ে আর বেশিদূর এগুতে দেয়া যাবে না, মি, টেইলর!” হাল বলে উঠে। “জাহাজের সামনের দিকটাকে ঘুরিয়ে ফেল। এই মুহূর্তে যদিও কাজটা করা অনেক কঠিন, কিন্তু আমাদের পারতেই হবে।”

মি. টেইলর এই আদেশ অন্য নাবিকদের মাঝে পৌঁছে দিল। সেই সাথে পালের কিছু অংশ গুটিয়ে ফেলতে বলল যেন জাহাজটার সম্মুখ অংশ সহজে ঘুরিয়ে ফেলা যায়।

হাল আবার জাহাজের পশ্চাৎ ভাগের রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশ ছেয়ে বিরাট আকারের মেঘটাকে এগিয়ে আসতে দেখে ও~একদম কাছ থেকে। দেখতে পায় জন লোভেল বাউ-এর সাথে তাল মিলিয়ে ডেট এর পালও নামানোর চেষ্টা করছে, যেন দুটো জাহাজ একই তালে টিকে থাকতে পারে।

এরপর হাল নিজের জাহাজের কাজ পরিদর্শনে ফিরে গেল। “মি, স্ট্যানলি জাহাজের পাটাতনের ফাঁকাগুলোতে যেন ঠিকমত ঢাকনা বসানো হয়। মাস্টার ডেনিয়েল, সব গান যেন রশি দিয়ে শক্তভাবে বাধা হয়।”

 “ঝড়টা আমাদের দিকেই তীব্রভাবে এগিয়ে আসছে। তোমরা সবাই প্রস্তুত হও,” হাল আবারো সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে।

হাল তার জাহাজের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। একজোড়া অনভিজ্ঞ দৃষ্টির কাছে এটা চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ। কিন্তু যারা সমুদ্র ভ্রমণে অভ্যস্ত তাদের কাছে এটা অত্যন্ত সুন্দর দৃশ্য। নাবিকেরা সবাই যার যার নিজস্ব জায়গা থেকে কাজে নেমে পড়েছে। প্রত্যেকটা মানুষ, হোক সে অ্যামাডোডা উপজাতির কিংবা দক্ষিণ হল্যান্ড থেকে আসা লিমবারগার অথবা ডেবোনশায়ার এর লোক, প্রত্যেকেই জাহাজের প্রয়োজনে নিজেকে কাজে লাগাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকেরা যে করেই হোক এই ঝড়ের মোকাবেলা করে ছাড়বে।

“ক্যাপ্টেন, আপনি কী মনে করেন যে আমরা আমাদের কর্মফলের কারণে এই ঝড়ের সম্মুখীন হচ্ছি?” রবটি মুন হালকে বলল। এরপর ডেক-এর দিকে ইশারা করল। “আমরা এখানে যা লুকিয়ে রেখেছি সেসবের কারণেই হয়তো বা আমাদেরকে উপরে ডেকে নেয়ার আয়োজন করা হচ্ছে।”

 হাল বুঝতে পারে যে মুন ডেক-এর নিচে লুকিয়ে রাখা ট্রোম্পের সেই কার্গোর কথা বলছে, যেখানে নকল হাড়, ক্রস এর টুকরা, হলি গ্রেইল ইত্যাদি ছিল।

 “মি. মুন, আমরা যদি বিচারের সম্মুখীন হই তবে লুকিয়ে রাখা সেসব জিনিসপত্রের জন্য হব না। আমাদের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা চিন্তা-ভাবনা এবং কাজকর্মের জন্য হব।”

মুন ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনি কী তাই মনে করেন ক্যাপ্টেন?”

“আমরা কী এর আগে একবার খ্রিস্টের সত্যিকার কাপকে অবিশ্বাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করি নি?” হাল জিজ্ঞেস করে।

‘ ডেফট-এর অদ্ভুত কার্গোগুলো গোল্ডেন বাউ-এ নিয়ে আসার পর থেকেই বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল হাল। কারণ সে জানে নাবিকদের মধ্যে অনেকেরই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব আছে। তারা হয়ত অনেকেই মনে করতে পারে যে এসব মিথ্যে রেপ্লিকা বয়ে বেড়ানোর জন্য তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। কথাগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলে হাল তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ঝড়ের দিকে দেয়ার চেষ্টা করল।

“আচ্ছা, ঠিক আছে মি. মুন, আপনার হাতে কী এখন কোনো কাজ নেই?” হাল জিজ্ঞেস করল। লোকটি ক্ষমা প্রার্থনা করে লংবোটগুলোর বাধন ঠিক আছে কি-না সেটা পরীক্ষা করতে চলে যায়।”

“তাড়াতাড়ি করুন মি, টেইলার।” হাল-এর মনে হতে থাকে তার পেটের নাড়ীগুলো শক্ত হয়ে আসছে। কোনো বাজে কাজে নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।

হাল ঘুরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল, এরপর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি তোমার জন্য প্রস্তুত আছি।”

আর ঠিক তখনই তার চোখের দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে প্রধান মাস্তুলের দিকে গেল। সাথে-সাথে চিৎকার দিয়ে উঠল হাল। “নেমে আস অ্যাডি”

 “ছেলেটা এখনো ওই জায়গায় উঠে বসে আছে! যুদ্ধের সময় প্রধান মাস্তুলের উপরের জায়গাটা হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা কিন্তু ঝড়ের সময় সেটা স্রেফ আত্মহত্যার সামিল।”

 “ঝড় তো ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে,” অ্যাবোলি বলে উঠল। নেড টেইলর যখন জাহাজের সম্মুখভাগটাকে ঝড়ের দিকে এগিয়ে নিলো তখন ধমকা বাতাস এসে হাল-এর মুখে আঘাত করল।

“সবাই শক্তভাবে ধরে থাক”, হাল সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে। যদিও ঝড়ের কারণে কথা খুব একটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। ঝড়ো বাতাস গোল্ডেন বাউ-এর চারপাশটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। অসম্ভব তীব্র বাতাস-এর সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে যেন সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। হাল কোমড় বাকা করে শক্ত কিছু একটা ধরে রেখেছে।

 “অ্যাবোলি, নেডকে সাহায্য কর।” হাল নেডের দিকে তাকিয়ে বলল। অ্যাবোলি বাধ্যগতভাবে এগিয়ে গিয়ে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে জাহাজের হাল ধরে রাখতে সাহায্য করল। ঝড়ের বাতাসে জাহাজটা রক এন্ড রোলিং গতিতে এদিক সেদিক ঘুরছে। দুলতে দুলতে জাহাজের এক অংশ প্রায় পানির নিচে তলিয়ে গেল। ভয়াবহ কয়েক মুহূর্তের জন্য পানির নিচে ডুবতে থাকে হাল। এরপর আবারও জাহাজের তলদেশটা আস্তে আস্তে ভেসে উঠল। ঠিক তখনই হাল ওপর থেকে তীব্র চিৎকার শুনতে পেল। অ্যাডি নামের ছেলেটি মাস্তুলের ওপর থেকে এক ঝটকায় নিচে পড়ে সাগরের বুকে আঘাত করেছে। পরমুহূর্তেই সে অদৃশ্য হয়ে যায় যেন অ্যাডি নামে কারো অস্তিত্বই কখনো ছিল না। সাথে সাথে উন্মত্ত সাগর তাকে গ্রাস করে ফেলল।

এরপর আর ডেক-এর ওপর থেকে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল হাল। যার ফলে সে নিশ্চিন্ত হলো যে জাহাজটা এখনো নিরাপদ অবস্থানে আছে। কিন্তু তখনই সে নিচ থেকে ক্রমাগতা পাম্পের শব্দ শুনতে পেল জাহাজের ভেতরে প্রবেশ করা পানি সরানোর চেষ্টা করছে সবাই।

 এরপরই উত্তর দিক থেকে বিশাল বিশাল পানির ঢেউ এগিয়ে এলো। হাল জানে যে সে যতই প্রস্তুতি নিক না কেন, এই ঢেউ-এ যদি তার জাহাজের পাল না ছিঁড়ে যায়, তবে সেটাকে অবিশ্বাস্য রকমের ভাগ্য হিসেবে মেনে নিতে হবে।

“বাবা, আপনি আমাদের সাথে থাকুন!” সে চিৎকার করে বলে উঠল। ঈশ্বর আর তার পিতা, উভয়ের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগল সে। যে ঢেউটা এগিয়ে আসছে সেটা প্রায় প্রধান মাস্তুলের সমান। ওটা লবণাক্ত পানি আর ফেনায় সমস্ত জাহাজকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। অ্যামোড়োডা সৈন্যরা-যারা এর আগে কখনো এরূপ ঝড়ের সম্মুখীন হয়নি-ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের বন্য ঈশ্বরকে ডাকতে থাকল।

 “আমার জাহাজ এটা সামলে উঠতে পারবে। তোমরা ভয় পেয়োনা। সে এরচেয়েও বড় ঝড় দেখেছে জীবনে।” হাল তার নাবিকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল।

 কিন্তু অন্ধকার আরও বাড়ছিল, সেই সাথে আরও বড় বড় ঢেউ এসে জাহাজটাকে ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছিল।

অন্ধকার এবং উত্তাল ঢেউয়ের মাঝ থেকে হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পায় হাল। তার সেই প্রিয় কণ্ঠটা বলছিল, “শক্তভাবে ধরে রাখ, যেন পানিতে হারিয়ে না যাও। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন। আমার এবং আমাদের সন্তান, দুজনেরই তোমাকে প্রয়োজন। প্লিজ আমাদেরকে ছেড়ে যেও না। আমাদের জন্য হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ।”

হাল সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের অনুরোধের উত্তর দেয়। “আমি বেঁচে থাকব। অবশ্যই বেঁচে থাকব জুডিথ। আমার জন্য অপেক্ষা কর, মাই লাভ। আর একটু অপেক্ষা কর।”

প্রায় বারঘণ্টার কাছাকাছি তাণ্ডব চালানোর পর থামল সেই উন্মাতাল ঝড়। যদিও গোল্ডেন বাউকে তছনছ করে দিয়েছে ওটা, কিন্তু তারপরও জাহাজটা টিকে আছে। স্যাম অ্যাডি বাদে অন্য কাউকে তাদের হারাতে হয়নি।

শুধু হাল হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ ঝড়ের কারণে তার জাহাজটা দক্ষিণ দিকে অনেকদূর ভেসে গিয়েছে। জাঞ্জিবার থেকে সে আরও দূরে সরে গিয়েছে। জুডিথ-এর কাছে পৌঁছতে তার অনেক সময় লেগে যাবে।

“বাতাস থেমে গেছে, গান্ডওয়েন, অ্যাবোলি তাকে উৎফুল্ল করার চেষ্টা করল।” “আমরা আবার উত্তর দিকে যাত্রা করতে পারব। জাঞ্জিবার-এ পৌঁছাতে পারব…” এইটুকু বলার পর অ্যাবোলি বলতে চেয়েছিল, “জুডিথ বিক্রি হওয়ার পূর্বেই পৌঁছতে পারব,” কিন্তু সময়মত সে নিজেকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল। “দাস নিলামের আগেই।”

“হয়ত জাঞ্জিবার-এর কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় নোঙ্গর করতে পারব,” হাল জবাব দিল। “কিন্তু আমরা জাঞ্জিবার-এ পৌঁছাতে পারব কী? জাহান এবং তার লোকেরা আমাদের প্রত্যাশায় বসে আছে। নিশ্চয়ই প্রতিটি উপকূলে, প্রতিটি বন্দরে, এমনকি প্রতিটি বাজারের লোকজনকে বলে দেয়া আছে আমাদের ব্যাপারে কিংবা জুডিথকে উদ্ধারের ব্যাপারে সন্দেহভাজন যে কারও ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া আছে।”

“সেক্ষেত্রে, আপনার অবশ্যই জেনারেল জুডিথ নাজেতকে উদ্ধার না করতে চাওয়াই উচিত,” ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় হালকে উদ্দেশ্য করে বলল।

“তুমি কী বোঝাতে চাইছ? আমি কেন জুডিথকে উদ্ধার করতে চাইব না? অবশ্যই আমি তাকে উদ্ধার করতে চাই”, হাল উত্তেজিত হয়ে জবাব দেয়।

 “না স্যার, আপনার সেটা করা উচিত হবে না। আপনার তাকে কিনে নেয়ার চেষ্টা করা উচিত। একমাত্র সেটা করলেই নিজের জীবন না হারিয়েও আপনি জুডিথ নাজেকে পেয়ে যাবেন। সে আপনার সম্পত্তি হয়ে যাবে… যদিও…” সে তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিদ্রুপাত্মক হাসি দিয়ে বলল, “ঐ রমণী কোনদিনও কারও সম্পত্তি হবে না।”

“তাকে কিনব…?” হাল বিড়বিড় করে বলল। “হ্যা…আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কী বলতে চাইছ মি. ট্রোম্প।” প্রস্তাবটা বেশ ভাল। কিন্তু আসল সমস্যাটা থেকেই যাচ্ছে। আমাদেরকে বিশেষ করে আমাকে এবং অ্যাবোলিকে–ধরার জন্য নিশ্চয়ই লোক লাগিয়েছে ওরা? তাই আমরা যখনই জুডিথ-এর দর হাঁকানোর জন্য মুখ খুলব তখনই আমাদেরকে ধরে ফেলা হবে।”

“যদি আপনারা দর হাঁকানোর জন্য না যান? যদি এমন কাউকে পাওয়া যায় যার উপস্থিতি কোনো রকম প্রশ্ন উঠাবে না? এমন কেউ, যাকে জাঞ্জিবারে সবাই চেনে?”

হাল ট্রোম্প-এর দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে তুমি এমন কাউকে চেন যে এই কাজটা করতে পারবে?”

“হ্যাঁ, আমি এমন কাউকে চিনি। আমরা আর বেশি দূরে নই। তার কাছে পৌঁছতে দুই দিন লাগবে। কিন্তু ক্যাপ্টেন, আমি তার ব্যাপারে আপনাকে একটু সতর্ক করে দিতে চাই। আপনি যদি আমাকে শঠ, বদমাশ মনে করেন তবে জেনে রাখবেন সে আমার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। সে একজন জলদস্যু। লাভের আশায় সে তার মাকেও বিক্রি করে দিতে রাজি আছে। যদি তার সাথে কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করা হয় তবে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা ছাড়া সে আপনার গলা কেটে নেবে।”

ট্রোম্প-এর সতর্কবাণীতে চারদিকে নীরবতা দেখা দেয়। তাহলে আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। অবশেষে হাল কথা বলে উঠল, “আমি যদি তোমার এই লোকের সাথে চুক্তিতে আসি তবে সে কী তা রক্ষা করবে?”

“আপনি যদি এক কথার মানুষ হন তবে সেও তার কথা রাখবে। কিন্তু এটুকু বলে রাখি, ওর সাথে কোনোরকম চালাকি করার চেয়ে নিজের মাথাটা হাঙরের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া উত্তম।”

 “তাহলে মি. ট্রাম্প আমি তার সাথে কথা বলতে রাজি আছি। তুমি তাকে খুঁজে বের করার ব্যবস্থা কর।”

*

সতেরোটা গানযুক্ত একিলিস নামের মাঝারি আকারের এক জাহাজের মালিক হচ্ছে ক্যাপ্টেন জেবেদিয়াহ রিভারস। বড় একটা তাল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। তালগাছের বড় বড় পাতা ছায়া দিয়ে তার চারপাশ ঘিরে রেখেছে, সেই সাথে শুকিয়ে যাওয়া পাতার মড়মড় ও খসখসে আওয়াজ শুষ্ক বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আফ্রিকান আকাশে ক্রুদ্ধ সূর্যের নিচে মহাসাগর যেন চকচক ও জ্বলজ্বল করছে। সাগরের বড় বড় ঢেউগুলো ভেসে এসে উপকূলে বেড়াতে আসা মানুষগুলোর পা ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

 কিন্তু এদিকে এত চিৎকার চেঁচামেচি জেব রিভারসকে বিরক্ত করে তুলেছে। চার্চ মিটিং-এ জন মেকলি বেশ্যাদের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করছে। রিভারস অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে লোকটাকে দেখতে লাগল। এখনও লোকটার মধ্যে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সে ক্যাপ্টেন হতে চায়। রিভারস কিছুক্ষণ আগে তা জানতে পেরেছে।

“শেষ কবে আমরা ভাল দাম নিয়েছিলাম, বলতে পারবে?” মেকলি বেশ তর্জন গর্জন করে জেবকে বলল। “আমি শ্রমিকের মতো পাথর টানার জন্য এই নাবিকদলে যোগ দেইনি।” তার এই কথাটা বেশ কিছু লোকের সমর্থন পেল যা দেখে জন মেকলি আরো উৎসাহিত হলো। আমাদের এখন হিসাবটা মিলিয়ে দেখা দরকার। কারণ আমরা এখানে যোগ দেয়ার সময় স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব এই তিনটি জিনিস দেয়া হবে বলে ওয়াদা করা হয়েছিল। আমি এখন সবার কাছে জানতে চাই এই তিনটা ফালতু জিনিস কোথায় লুকায়িত আছে। কারণ আমি এখানে স্বাধীনতা, সাম্য বা ভ্রাতৃত্ব বলে কিছুই পাইনি।

সে সরাসরি রিভারস-এর দিকে তাকাল না। তাকানোর প্রয়োজনও নেই। কারণ সবাই বুঝতে পারল যে সে কোনদিকে চেলেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। “আমরা জানি আমাদের কাজগুলো কীভাবে হয়। শিকার নেই, তো টাকাও নেই। আর বিনা পরিশ্রমে কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় না। সে তার পেছনে অসীম নীল সমুদ্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “আমাদের শিকারে যেতে হবে। নয়ত সাধারণ শ্রমিকদের মতো আমাদের কষ্ট ভোগ করে মরতে হবে।”

 “নির্বোধের মতো পান করে বেশ্যার বাহুডোরে পড়ে থাকাকে কঠোর পরিশ্রম বলা যায় তাহলে, মি মেকলি?” কোয়াটারমাস্টার জর্জ ডাউলিং তার কথার সাথে যোগ করল। ডাউলিং হচ্ছে এখানকার একজন শক্তিশালী যোদ্ধা। সে বুল বাফেলোর মতোই শক্তিশালী।

“আমি অবাক হচ্ছি না, জর্জ ডাউলিং। আমি আমার কাছে থাকা পিতলের শেষ পয়সাটা পর্যন্ত বাজি ধরে বলতে পারি যে আপনি সবসময়ই তার পক্ষ নেবেন।” মেকলি কোয়ার্টারমাস্টার-এর দিকে তুড়ি বাজিয়ে বলে। তবে আপনার মনে রাখা উচিত, আপনি আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন মি. ডাউলিং, তার নয়।

ডাউলিং হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে আক্রমণ ভাগ পরিচালনা করে। এই মুহূর্তে মাথার হ্যাট খুলে টাক মাথায় বাতাস করছিল সে যেন যে করেই হোক এই পরিস্থিতিতে তাকে ঠাণ্ডা থাকতে হবে। এখানে যদি কোনো ভোট হয়, তার ফলাফল যার পক্ষেই আসুক না কেন, আমি সেটা মেনে নেব।”

মেকলি স্বস্তিতে মাথা নাড়ে। কারণ কোয়াটারমাস্টার ডাউলিং অবশেষে তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছে। জাহাজের ভেতর ডাউলিং অনেকটা সিভিল ম্যাজিস্ট্রেট-এর মতো কাজ করে। তাই তাকে পক্ষে পাওয়া কিংবা অন্তত বিপক্ষে যেতে না দেয়াটা মেকলির জন্য অনেক সুবিধার ব্যাপার।

ক্যাপ্টেন রিভারস-এর বাহিনীতে একশ পাঁচজন নাবিক রয়েছে। সাথে আরও ষাটজন যোগ হয়েছে। এর মধ্যে তার লুণ্ঠনকৃত তিনটা জাহাজের নাবিকও যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে একিলিস-এর বাহিনী শক্তিশালী একটা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। যেসব জাহাজ ইলহা মেতাভো দ্বীপ-এর অন্তরীপ এ নোঙর করে সেসব জাহাজ খুব সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। সাগরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জাহাজ থেকে সেগুলোকে দেখা যায় না। দ্বীপের দক্ষিণ দিকের অংশটা অনেকটা লেজের মতো হয়ে আছে যেটা শুধু ভাটার সময় দেখা যায়। এটা থেকে অল্প কিছু দূরে আরেকটা ছোট্ট দ্বীপ রয়েছে ইলহা কুইফুকুই নামে। এই দুটি দ্বীপ সংযুক্ত হয়ে টরকুইস সাগরের ওপর দিয়ে হ্যামক-এর আকারে সংযুক্ত আছে। ক্যাপ্টেন রিভারস মনে করে, তার লাইনের মানুষের জন্য এই জায়গাটার চেয়ে চমৎকার বেইস আর হতেই পারে না।

“যা বলার বলে ফেল, মেকলি। আমার মাথার ভেতর ব্রেইন যেন টগবগ করে ফুটছে।” আর্থার ক্রাওয়েন নামে সাদা চুলের একজন বুড়ো লোক চিত্তার করে বলে উঠল। ভিড়ের মধ্য থেকে ‘আই’ এবং “চালিয়ে যাও”, বলে রব উঠতে থাকে।

 মেকলি ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিল এবং আশ্বস্ত করল যে এরপর সে ঘটনার মাঝখানে প্রবেশ করবে। অনেক নারী ও শিশুরা যারা পুরুষদের সাথে দ্বীপে বাস করে তারাও জড়ো হয়েছে। মেকলির কথা শুনে তাদের মনে হচ্ছে পরদিন সকালে তারা মেকলিকে ক্যাপ্টেন-এর কেবিনে দেখতে পাবে।

“আমরা স্বীকার করছি যে ক্যাপ্টেন-এর বীরত্ব বা যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন-এর সাহসিকতা অনুসরণীয়, এবং অনুকরণীয় হবে। মেকলি বলতে থাকে। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই কিন্তু অন্য সকল ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন-এর উচিত নাবিকদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর চলা।”

“আমরা আমাদেরটুকু করে দেখিয়েছি। ক্রামওয়েল মাথা নাড়ায়। কেউ বলতে পারবে না যে আমরা পারি নি। আমাদের কাছে সেটার প্রমাণও আছে।” সে তার হাত উঁচু করে দেখাল। তার বাহুতে দুটো ক্ষত রয়েছে। একটা পিস্তলের আরেকটা তলোয়ার-এর।

ক্যাপ্টেন রিভারস তার তামাকটা পাইপ-এর মধ্যে রেখে দিয়ে সাগরের দিকে তাকাল। যদিও তাকে নিয়ে এখনো আজেবাজে কথা চলছে। সে ভান করছিল যেন আকাশে ঘুরে বেড়ানো পেট্রেল আর গাল পাখিদের শব্দে সে বিমোহিত হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ম্যানগ্রোভ গাছের ওপর টিয়া এবং লাভবার্ড পাখিদের দ্বারা সৃষ্ট অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তাকে এতটাই মুগ্ধ করে রেখেছে যে সে অন্য কোনো দিকে খেয়াল করার সময়ই পাচ্ছে না।

ক্যাপ্টেন-এর দিকে ঘুরে তাকাল মেকলি। “এখন আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কে আমাদের ক্যাপ্টেন হবে।” একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে কোবরা সাপের মতো ফনা তুলে সে আরো যোগ করল, আমি একটা ভোটের আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সাথে নিজেকে একজন ক্যাপ্টেন প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাচ্ছি।

 “গুড”, রিভারস তামাকের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল। তুমি আসল কথায় আসতে যথেষ্ট সময় নিয়েছ। এরপর সে তার তামাকের পাইপটা মেকলির দিকে তাক করে বলল, “তাহলে তুমি আমার জাহাজটা নিতে চাও?” লোকজনের ভিড়ের মধ্যে আসার পর এই প্রথম রিভারস কথা বলে উঠল।

 “একিলিস আমাদের জাহাজ, মেকলি বাধা দিয়ে বলল। যদিও তার কথায় অতটা দৃঢ়তা ছিল না। তার চোখ এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে।

“একিলিস আমার,” রিভারস এতটা দৃঢ় কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে যে মেকলির একাগ্র সমর্থকরাও মাথা নিচু করে ফেলে। সবাই জানে যে ব্ল্যাক জেব রিভারস যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা দেখানোর মাধ্যমে নিজের নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছে। অনেকে দাবি করে যে পক্স-এর কারণে যে পরিমাণ লোক মারা গিয়েছে তার চেয়ে বেশি লোককে হত্যা করেছে রিভারস।

মেকলি আবারো তার কথা সুপ্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। তার মনে আছে সে কোথায় থেমেছিল। তার চোখ এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে। তার ডান হাতটাকে সে এদিক সেদিক নড়াচড়া করে অবশেষে কোমড়ে গোঁজা তরবারির বাঁটের ওপর হাতটা শক্তভাবে রাখল। রিভারস মনে মনে লোকটার প্রশংসা করতে থাকে। অন্য কারও এতটা দুঃসাহস নেই যে কি-না তার সামনে এভাবে ক্যাপ্টেন হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। সেই সাথে এটাও সত্য যে মেকলি যদি তাদের ক্যাপ্টেন হয় তবে তাদের সবাইকে ডুবে মরতে হবে নয়ত গুলি খেয়ে মরতে হবে।

 “আমরা এখানে ভোটাভোটির আয়োজন করব,” মেকলি বলতে থাকে। কোয়ার্টারমাস্টার ডাউলিং দেখাশোনা করবে যে ভোটিং ঠিকমত হচ্ছে কি-না।

ডাউলিং মাথা নাড়াল। রিভারস তাকিয়ে দেখল যে মেকলির সমর্থনকারীরা আশেপাশের লোকজনের সাথে নিচু স্বরে কথা বলছে। তাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছে তারা যেন ভুল পথে ভোট না দেয়।

“তোমার সময় শেষ, ওল্ডম্যান,” মেকলি রিভারসকে উদ্দেশ্যে করে বলে।

 লোকটা অর্ধেকটা সঠিক বলেছে। ছেচল্লিশ বছর বয়সে তাকে নিশ্চয়ই যুবক বলা যায় না। তার পাতলা হয়ে যাওয়া রুপালি রঙের চুলগুলো সবসময় পেছন দিকে বাঁধা থাকে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে তার হাড়ে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে তার সময় কি শেষ হয়ে গেছে? না, মেকলি এ কথাটা ভুল বলেছে।

রিভারস তার মাথার হ্যাট-এর কিনারা ধরে ঘুরাতে থাকে। এটা হচ্ছে এক ধরনের পূর্ব সংকেত। তার বিশ্বস্ত লোকেরা কাজে নেমে পড়ল। বেন্ডাল তার কোমড়ে গোঁজা তরবারি টান দিয়ে বের করার চেষ্টা করল কিন্তু তার পূর্বেই ড্যাগার-এর আঘাতে তার হার্ট ছিদ্র হয়ে গেল। হাঁটু ভাজ করে নিচে পড়ে গেল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশটা নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে রূপ নিলো। যখন রিভারস ভিড়ের মধ্যদিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল তখন একজন তার পথ আগলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। রিভারস হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তার গলায় ছুরি বসিয়ে দিল।

এরপর রিভারস যখন সামনে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন লোকজন সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিচ্ছিল। মেকলির পাশ থেকেও লোকজন সরে যেতে থাকে। এদিক সেদিক আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। মেকলি দেখতে পায় যে রিভারস এগিয়ে আসছে। সে তার পিস্তল বের করে।

 “তোমাকে এখন নরকে যেতে হবে, ওল্ড ম্যান।” সে চিৎকার করে উঠে গুলি ছুঁড়তে থাকে। রিভারস বুঝতে পারে তার বাম কানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গুলি বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করেছে। এরপরে রিভারস-এর দিকে আরও অনেক গুলি ছুঁড়তে থাকে মেকলি কিন্তু কোনোটাই লাগাতে পারে না। অবশেষে মেকলি পিস্তলটাকে বালিতে ছুরে ফেলে দেয়। কোমরের বেল্ট থেকে বের করে আনে তার তলোয়ার। ব্লেডটা বেশ চওড়া। এটা শত্রুর জাহাজ আক্রমণের সময় খুব একটা কাজের না হলেও ভূমিতে আক্রমণের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত।

মেকলি রিভারস-এর মাথায় আঘাত করতে গেল। রিভারস তাকে প্রতিহত করে নিজের তলোয়ার দিয়ে মেকলির মুখে আঘাত করল। দ্রুত পিছিয়ে গেল লোকটা। কিন্তু রিভারস তাকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে গেল। মেকলি পুনরায় আঘাত করতে আসলে রিভারস তার তলোয়ার-এর অর্ধেকটা মেকলির ডান বগলের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। মেকলির হাত থেকে তলোয়ারটা নিচে পড়ে গেল সাথে-সাথে। রিভারস মেকলির খুব কাছাকাছি গিয়ে বাম হাতদিয়ে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল, এরপর ডান হাতে তলোয়ারটা ধরে এদিক সেদিক নাড়িয়ে ক্ষতটা বড় করতে থাকল যেন হার্টটা দুখণ্ড হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।

 যখন মেকলি হাঁটু ভাজ করে নিচে পড়ে গেল তখন সে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তলোয়ারটা তুলে ফেলল।

“আর কেউ আসবে?” রিভারস দৃঢ় কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে চেলেঞ্জ ছুরে দেয়।

তার সমর্থকেরা তার আশেপাশে জড়ো হতে থাকে। মেকলির সমর্থকদের সে খুব ভালভাবেই চিনে ছিল। এরা পুরো সপ্তাহ জুড়ে সবার কাছ থেকে মেকলির ব্যাপারে সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। এখন কাঁকড়া আর মাছের খাদ্য হওয়া ছাড়া এদের আর কোনো গতি নেই।

“ক্যাপ্টেন,” তার একজন লোক বলে উঠল। এক সেকেন্ড এর জন্য তার মনে হলো আজকের মতো হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়নি-আরো বাকি আছে।

“ক্যাপ্টেন। জাহাজ, লোকটি আবার বলে উঠল। সে সাগরের দিকে ইশারা করল। রিভারস আরও ভালভাবে দেখার জন্য ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল।

“ভেসে আসা রণতরীটা তো বেশ সুন্দর! ডাউলিং বেশ উফুল্ল হয়ে বলে উঠে।” বেশ জাঁকজমকপূর্ণ লাগছে ওটাকে। কী অসাধারণ উজ্জ্বল আলো জ্বলছে ওটার ডেকে।

রণতরীটা যতদ্রুত চলার কথা ঠিক ততটা দ্রুত চলছে না। ওটার অর্ধেকটা পাল তোলা আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটার নাবিক বেশ সতর্কতার সাথেই জাহাজটা চালনা করছে। কিন্তু কেন সে এই দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসছে? রিভারস নিজেকেই প্রশ্ন করে। অধিকাংশ জাহাজই দ্বীপ থেকে অনেক দূরবর্তী চ্যানেল-এর মাঝ দিয়ে চলে যায়।

“কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্যাপ্টেন সম্ভবত যে কি-না ধনসম্পদের আশায় ক্যাপ্টেন রিভারস ও তার নাবিকদের পেছনে এসেছে, ডাউলিং ক্যাপ্টেন-এর চিন্তিত মুখ দেখে সম্ভাবনার কথা বলে দিল।

“সে যদি আমাদের জালে ধরা পড়ে তবে আমরা রাজার মতো ধনী হয়ে যাব,” আরেকজন তার মতামত প্রকাশ করল। রিভারস বুঝতে পারে তার নাবিকদের মধ্যে এগিয়ে আসা জাহাজটা নিয়ে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

“আমাদের থেকে অন্তত দ্বিগুণ বন্দুক রয়েছে তার। কোয়াটারমাস্টার ডাউলিং ক্ষুধার্ত চোখে জাহাজটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে। ওদেরকে আটকানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আমরা লোকবল হারাবো, নৌকো হারাব।”

রিভারস মাথা নাড়ে কারণ সে জানে কথাগুলো সত্যি। কিন্তু তার নাবিকেরা চাচ্ছে জাহাজটাকে আটক করতে। “তারা যদি আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তাহলে কোনোদিন জানতেও পারবে না যে আমরা এখানে আছি,” “সে এই মতামতটা দিয়ে নাবিকদেরকে আরো জাগ্রত করার চেষ্টা করল। অথবা…”

সে তার পরিবর্তিত প্রস্তাবটা শেষ করল না। সে জানে খুব শীঘ্রই ইলহা কুইফুকুই দ্বীপটা রণতরীর ক্যাপ্টেন-এর নজরে আসবে। তখন সে জাহাজের অগ্রভাগটা পশ্চিম দিকে ঘোরাবে দ্বীপের কিনারে নিয়ে আসার জন্য। তখন যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে জাহাজটাকে ফাঁদে ফেলার জন্য। “আমরা দ্বীপের দক্ষিণ দিক থেকে পানসিতে করে নাবিকদের পাঠাব। ওদের বন্দুকধারীদেরকে চিন্তা করার একটু সময় দিব। যখন ওরা একিলিস-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তখন আমাদের নাবিকেরা পেছন থেকে ওদের জাহাজে আক্রমণ চালাবে।”

ডাউলিং মাথা নাড়ায়। পূর্বেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। ঈশ্বরের ইচ্ছে থাকলে আজকেও সেটা কাজে দিবে।

 রিভারস তার নাবিকদেরকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু কিছু একটা তাকে থামিয়ে দেয়।

“জাহাজটা তার দিক পরিবর্তন করছে মি. ডাউলিং। সে জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। সেটা সূর্যের তাপের কারণে নয় বরং কিছু একটা তার কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে। রণতরীটা তার সম্মুখভাগ দ্বীপের পশ্চিম দিকে নয় বরং পূর্ব দিকে নিয়ে যাচ্ছে-তাদের দিকেই আসছে ওটা। কিন্তু কেন?”

“সে আমাদেরকে দেখতে পেয়েছে। ডাউলিং বলে উঠল।”

রিভারস মাথা নাড়াল। সে নিশ্চয়ই জানে যে আমরা এখানে আছি। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে ওর।

“সম্ভবত কিং চার্লিং তার বদমাশ লোকগুলোকে আমাদের পেছনে লাগিয়েছে”, নাবিকদের একজন বলে উঠে।

“কিন্তু তারা কী এতদূরে আসার সাহস দেখাবে?” একজন রমণী চিৎকার দিয়ে বলে উঠল।

কিন্তু এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে জাহাজটি তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। জাঁকজমকপূর্ণ শক্তিশালী জাহাজটা তাদের উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছে। কিন্তু দ্বীপে আসতে হলে তাদেরকে বালির পাড় থেকে বেশ খানিকটা দুরে নোঙর ফেলতে হবে। আর একিলিস দ্বীপের কাছেও নোঙর ফেলতে পারে।

“আমাদেরকে এখনই পালাতে হবে, ক্যাপ্টেন ডাউলিং বলে উঠল। যেদিক দিয়েই সুযোগ পাই সেদিক দিয়েই আমাদেরকে যেতে হবে। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।”

যদিও জাহাজটা তাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে রয়েছে তবুও কোয়ার্টার মাস্টার-এর কণ্ঠে এক ধরনের দ্রুততা এবং ভয়ার্ত ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

কিন্তু রিভারস তার জায়গা থেকে নড়ছে না। কেউ কাউকে পালানোর ব্যাপারে কোনো আদেশও দিচ্ছে না। রিভারস শুধু এক যুবক ছেলেকে বলল দৌড়ে গিয়ে তার টেলিস্কোপটা নিয়ে আসতে। যদিও বালকটা সেটা নিয়ে আসতে আসতে তার আর সেটার প্রয়োজনই পড়ল না। জাহাজটার মধ্যে একটা ব্যতিক্রম কিছু লক্ষ করা যাচ্ছে। জাহাজ এবং বালির পাড়-এর মাঝে যেটুকু ব্যবধান আছে তাতে জাহাজটার থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারপরও জাহাজটা এগিয়ে আসছে। অর্থাৎ এই দ্বীপের পথ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন-এর ভালই ধারণা আছে।

অথবা, সে জাহাজের ক্যাপ্টেন নয়। অন্যকেউ জাহাজটার সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে আছে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাহাজের লোকগুলোকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।

এরপর রিভারস সেই চিহ্ন দেখতে পায়-জাহাজটার মাস্তুলের চূড়ায় দুটি পতাকা উড়ছে। একটি হচ্ছে কমলা, সাদা এবং নীল-এর মিশ্রণে ডাচ রিপাবলিক-এর পতাকা। অন্যটা হচ্ছে ইউনিয়ন-এর পতাকা। কিন্তু ক্যাপ্টেন কেন দুটি পতাকাই উড়িয়েছে। ইংরেজরা হয়ত ডাচদের সাথে শান্তিচুক্তিতে আছে। কিন্তু রিভারস কখনো একসাথে দুই দেশের পতাকা উড়াতে দেখেনি, আর দেখবে বলেও মনে হয় না।

তারপর শোনা যায় সেই শব্দ। পর পর তিনটা কামানের গর্জন। কামানের ধোয়া বাতাসে মিশে যেতে থাকে।

ডাউলিং বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে, তারপর হেসে উঠে আপনমনে। এটা কোনো আক্রমণের ইঙ্গিত নয়। এটা হচ্ছে স্যালুট। যারা একিলিসের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্যে সে চিৎকার করে উঠল। তাদেরকে সে জানাল যে আজকে আর কোনো যুদ্ধ হবে না।

“গুড ডে, মিজনহিয়ার,” রণতরীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল রিভারস। এই তিন কামানের স্যালুট ক্যাপ্টেন মাইকেল ট্রোম্প-এর নিজস্ব অভ্যর্থনা স্টাইল। ক্যাপ্টেন ট্রোম্প অতীতে বিভিন্ন দরকারে যতবারই এসেছিল, এইভাবেই স্যালুট জানিয়ে নিজের আগমনী বার্তা দিয়েছিল।

“এই চিজ-হেড লোকটা এখানে কী করছে?” ডাউলিং নিজের মনে বলতে থাকে। সেই সাথে মনোযোগ দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখতে থাকে।

 রিভারস মাথা নাড়িয়ে বলল, “এটা তার জাহাজ নয়। সে হচ্ছে অত্যন্ত লোভী মানুষ। কিন্তু সে এতটা বোকা নয় যে মহামান্য রাজার এই চিহ্ন সে বহন করবে। সে ভ্রু কুঁচকায় যেন সে নিজের যুক্তি নিজেই মেনে নিতে পারছে না। “কিন্তু কেন সে এটা করেছে”, সে রণতরীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রণতরীর অগ্রভাগটা তাদের দিকেই তাক করা।

 “তাহলে সম্ভবত…” জন ব্লাইটন ভ্রু কুঁচকে বলল, “সম্ভবত ট্রাম্প বেইমানি করে ইংরেজদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়ার জন্য।

“শান্ত হও, বালক”, রিভারস তার মাথা নাড়ায়। ট্রোম্প তা করবে না। যদিও সেরকম বেইমানির কথা মনে করে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। “সে জানে যে সে যদি এই কাজ করে তবে আমি তাকে ফাঁসিতে ঝুলাব। এরপর সে তার কোয়ার্টারমাস্টার-এর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “মি, ডাউলিং তুমি জান এখন কী করতে হবে?”

লোকটি মাথা নাড়িয়ে মার্চ করতে করতে বিচ-এর দিকে এগিয়ে গেল।

*

ব্যাপারটা এমন নয় যে এই প্রথমবারের মতো হাল এমন কারও ওপর তার আস্থা ও বিশ্বাস সমর্পণ করেছে যে কি-না কিছুক্ষণ আগেও তার শত্রু ছিল। পূর্বের মতো এবারও ট্রোম্প তার নৌবিদ্যা এবং জাহাজ পরিচালনার দক্ষতা দিয়ে হালকে মুগ্ধ করল। জায়গাটা বেশ বিপদজনক। ট্রোম্প তার পূর্বের স্মৃতি মনে করে সেইভাবে জাহাজকে চালিয়ে নিয়ে গেল। বর্তমানে টেইলারকে জাহাজের হাল ধরার ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছে সে। হাল এবং জন লোভেল জাহাজের পালের দিকে নজর রাখছে। অ্যামাড়োডাদেরকে মাস্তুলের ওপর উঠিয়ে রাখা হয়েছে যেন তারা বাতাসের গতি পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে।

বাকি সব নাবিক যেন তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে, একইসাথে জিহ্বাও শক্ত করে রেখেছে। শুধু কান দুটোই সজাগ রেখেছে এখনো। কারণ বাউ যদি প্রবাল পাথরের সাথে বিন্দুমাত্র ধাক্কা খায় সেই শব্দটাও তাদের শুনতে হবে। এছাড়াও তারা তাদের পা দুটো ডেক-এর ওপর এমনভাবে স্থির করে রেখেছে যেভাবে কোনো মাকড়সা তার জালের ওপর পা দিয়ে আটকে থাকে। জাহাজে যদি বিন্দুমাত্র কম্পনও হয় সেটাও তারা অনুভব করতে পারবে এখন।

কিন্তু জাহাজের ভেতরে তারা কোনো কম্পন অনুভব করল না। কোনো কম্পন না থাকায় হাল এবং অফিসারগণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। এই জায়গাটা বেশ বিপজ্জনক। জাহাজের বেসটা যে-কোনো সময় পানির নিচের কোনো বড় পাথর খরে সাথে ধাক্কা লাগতে পারে।

“দশ ফ্যাদম, ক্যাপ্টেন,” একজন নাবিক পানির গভীরতা মেপে হালকে জানাল।

 “আমাদের জাহাজের গন্তব্য এই পর্যন্তই।” ক্যাপ্টেন ট্রাম্প হাল-এর দিকে আসতে আসতে বলল। তার কপাল চুঁইয়ে ঘামের ফোঁটা নিচে পড়ছে। “আমাদের এখান থেকে সংবোট-এ করে যেতে হবে।”

“ধন্যবাদ, মি, ট্রাম্প”, হাল ট্রোম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে এরপর অন্যদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। “উপরের পাল গুটিয়ে রাখার ব্যবস্থা কর।” বলার সাথে সাথে অ্যামোডোডারা নিচে নামতে থাকে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন একদল কাঠবিড়ালী ওক গাছ বেয়ে নিচে নামছে।

“মি. টেইলার নোঙর ফেলার ব্যবস্থা কর। যতদূর আসা সম্ভব আমরা চলে এসেছি।” এখান থেকে দুই ক্যাবল সমান পরিষ্কার নীল পানি পার হলেই বী। সেই বী সমুদ্রতল থেকে সাত ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। হাল এই জায়গাটার প্রশংসা না করে পারছে না। কোনো জাহাজ যাওয়ার সময় হয়ত এই জাহাজটাকে দেখতে পারে,” হাল বলতে থাকে। কিন্তু সেটা যদি এখানে এসে নোঙর না ফেলে তবে ইলহা মাতন্ডকে অন্যান্য দ্বীপের মতই মরুভূমি মনে হবে।”

ডেফট-এর পালও নামিয়ে ফেলা হলো। গোল্ডেন বাউ-এর গতি থামিয়ে দেয়া হলো সেই সাথে। ওটা আস্তে আস্তে মৃদু তালে দুলতে শুরু করল। জাহাজের নোঙরটা যখন সাগরের গরম পানিতে ফেলে দেয়া হলো তখন এটা চতুর্দিকে পানি ছিটিয়ে দিল। শেকলে যখন টান পড়ল তখন শেকলটাও পানির ভেতর মৃদু কম্পনে দুলতে শুরু করল।

“ওই দেখ, ওদের ঘোট রণতরী দেখা যাচ্ছে। হাল হাত দিয়ে ইশারা করে একটা জাহাজ দেখায় যেটার পাশে তিনটা পানসি নৌকো রাখা আছে।

“এটা হচ্ছে একিলিস নামক জাহাজটা, ট্রোম্প বলতে শুরু করে। “এটাকে দেখে হয়ত মনে হচ্ছে না যে ক্যাপ্টেন একে নিয়ে নির্বিগ্নে সাগরে চলাচল করতে পারে। কিন্তু খালি চোখে দেখে ওর আসল সৌন্দর্য বোঝা সম্ভব না।”

“আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি,” হাল বলে উঠল। “আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা অনেক দ্রুত চলে।”

একিলিস জাহাজের বন্দুকগুলো গোল্ডেন বাউ-এর বন্দুক-এর মতো আট ফুট লম্বা নয়। কিন্তু সেটার প্রয়োজনও নেই কারণ একিলিস-এর বন্দুকগুলোতে রাউন্ডশট-এর বদলে গ্রেপশট লোড করা আছে।

ট্রোম্প আবারও ক্যাপ্টেন রিভারস-এর ব্যাপারে বলতে শুরু করে। তার নাবিকগুলো হচ্ছে এক একটা শয়তান, ক্যাপ্টেন কার্টনি। অধিকাংশ নাবিক যুদ্ধ করার চেয়ে বরং সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজি আছে।”

হাল মনে মনে এই দস্যু ক্যাপ্টেন-এর কথা ভাবতে থাকে যার সাথে সে আজকে দেখা করতে এসেছে। নামটা তার কাছে বেশ পরিচিত ঠেকছে। তার বাবার বন্ধু অন্য ক্যাপ্টেনদের মুখে সে এই নাম শুনেছে। লোকটা সামরিক যুদ্ধ থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। এখন সে ইন্ডিয়ান সাগরের কেপ অফ গুড হোপ থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে মাদাগাস্কার পর্যন্ত চষে বেড়ায়। সেই সাথে বণিক এবং দাস বিক্রেতাদের জাহাজ-তা সে যেই পতাকাই বহন করুন না কেন-লুণ্ঠন করে।

“সে একজন খুনি, স্যার হেনরী”, ট্রোম্প তাকে সতর্ক করে দেয়।

“সেটা আমি শুনেছি”, হাল বেশ চিন্তাপূর্ণভাবে মাথা নাড়ায়। কিন্তু এই লোকটার সাথে দেখা করার ব্যাপারে হাল-এর মনে কোনো দ্বিধা নেই। যে করেই হোক দেখা করতেই হবে।

 “কিন্তু এই লোকটার সাথে আমার একটা বোঝাঁপড়া আছে, ট্রাম্প তাকে আশ্বস্ত করল।

“কারণ তুমি নিজেও একজন দস্যু,” হাল চোখ বাঁকা করে ট্রোম্প-এর দিকে তাকিয়ে বলল।

সমুদ্রের পানির ওপর জমে থাকা তেলের স্তর যেভাবে সরিয়ে দেয়া হয়, ঠিক সেভাবেই কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে কথাটা সরিয়ে দিল ট্রোম্প। “ব্যবসায়িক স্বার্থে দুজন মানুষ একসাথে চলতে গেলে কিছুটা তাল মিলিয়ে চলতেই হয়।” নয়ত চাকা সমানতালে ঘুরে না। এরপর হাল-এর অস্বস্তি ভাব বুঝতে পেরে বলল, “তথাপি আমি বুঝতে পারছি যে আপনার মতো সম্ভ্রান্ত ইংরেজ-এর এরকম লোকের সাথে ডিল করতে যাওয়া কতটা অরুচিকর ব্যাপার।”

হাল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বীচ-এর ওপর দস্যুদের সমাগম দেখতে থাকে। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে নেড টেইলরকে নোঙর তুলে ফেলার আদেশ দেয়, সেই সাথে পাল উঠাতে বলে। বাতাসে পাল ভাসিয়ে দিয়ে সে আবারও জাহাজ নিয়ে ফেরত যেতে চায়। কিন্তু বহু কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করল সে।

“আমি ভাবছি, আমার পিতা এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতেন।”

 “এসব আমার ওপর ছেড়ে দিন,” স্মিত হাসি দিয়ে বলল ট্রোম্প। “ক্যাপ্টেন রিভারের সাথে সব ব্যাপার আমি মীমাংসা করব। এ ব্যাপারে আপনি আপনার হাত পরিষ্কার রাখবেন।”

হাল তার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। হাত উঠিয়ে আশ্বস্ত করল ট্রোম্প।

“সবকিছু কী আমি পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পেরেছি?” ওলন্দাজ লোকটা বলল।

হাল হ্যাঁ-সূচক দৃষ্টি দিয়ে আবার বীচ-এর দিকে ফিরে তাকায়। সে মনে মনে ভাবতে লাগল যে তারা যখন এখানে এসে পড়েছে তখন কি ঘটে দেখাই যাক।

সাথে-সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে-এই ব্যাপারটা তার নিজস্ব পন্থায় করবে সে।

“মি. লোভেল, পানসি তৈরি কর,” সে হাঁক ছাড়ল। ট্রোম্প হয়ত দস্যু রিভারসকে বিশ্বাস করতে পারে কিন্তু সে তার ওপর একবিন্দুও বিশ্বাস রাখতে পারছে না। সে লংবোট-এ করে তার লোকদের নিয়ে এভাবে দস্যুর কাছে যেতে পারে না। সে অন্তত পানসিতে করে যেতে পারে। পানসিতে নিজেদের বন্দুক এবং অস্ত্রসস্ত্র রাখা থাকবে। অস্ত্র হাতে লোকেরা প্রস্তুত থাকবে।

“এই কী সেই লোক, মি. ট্রোম্প?” হাল জিজ্ঞেস করল। যদিও সে জানে। যে তার এই কথা জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজনই নেই। ধূসর রঙের চুলগুলো পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা লম্বা লোকটাই যে রিভারস এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যান্য সবার মতো সেও সুতি শার্ট এবং পেটিকোট জাতীয় একটা পোশাক পরে আছে।

 “হ্যাঁ, এই সেই ব্যক্তি।”

“সে নিশ্চয়ই এরকম একটা পানসিতে করে আমাকে এখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসাটা পছন্দ করবে না। তুমি যে শুধু আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছ তাই না। আমি চাইলে এই দূরত্ব থেকে স্লিন্টার দিয়ে তার একিলিসও উড়িয়ে দিতে পারি।”

“সে হয়ত আমাকে দেখে খুশি হবেনা,” ট্রোম্প বলতে থাকে। কিন্তু এক শিশি পরিমাণ ভার্জিন টিয়ার সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট, তার চোখ চকচক করে উঠল। এই রকম একটা গুপ্তধন একশ পাউন্ডে বিক্রি করতে পারবেন আপনি। কিংবা এত সোনা আর রুপা পাবেন যে আপনার যেকোনো একটা নৌকো ভরে যাবে।

 হাল একটা বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি দিল। এরপর তার মাঝিমাল্লাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “মাস্টার ড্যানিয়েল, বন্দুক হাতে আমার চল্লিশজন ভাল মানুষ চাই। আর ডেন্ট থেকে আমরা যে ব্যারেলগুলো নিয়েছি সেগুলো এখানে নিয়ে এস।”

 “ক্যাপ্টেন” বিগ ডেনিয়েল একটা সমর্থনপূর্ণ দৃষ্টি দিল। এরপর সে অ্যামাডোডা সৈন্যদের সেই সব ধর্মীয় ধংসাবশেষগুলো নিয়ে আসতে বলল।

 “মি. টেইলর, বন্দুক হাতে নাবিকদের প্রস্তুত থাকতে বলুন এবং আমার টেলিস্কোপটা হাতে নিন। গোলমাল-এর ইঙ্গিত পাওয়ার সাথে সাথে রণতরীটা ডুবিয়ে দিয়ে দস্যুদের জন্য নরকের দরজা খুলে দেবেন।”

নেড টেইলর তার চোয়াল শক্ত করে বলল, “ক্যাপ্টেন আপনার কাছে যদি ওইসব দস্যুদেরকে সুবিধাজনক মনে না হয় তবে শুধু বন্দুকের একটা গুলি ছুড়বেন। এরপর দেখবেন ওদের জাহাজের ছোট ছোট টুকরা ওপর থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে।”

“ভেরি গুড”, হাল তাদের দিকে বেশ আস্থাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এরপর আস্তে আস্তে সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে দেখে নিল যে কে কীভাবে প্রস্তুত আছে। আজকে যদি রিভারস কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করে তবে আজকের দিনটিই হয়ত হবে তার জীবনের শেষ দিন।

.

“তারপর…ট্রোম্প…এখানে কেন এসেছ, সেটা বলল।” রিভারস তার নিজের হ্যাট খুলে অন্য একজন হ্যাট পরা নাবিকের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল-সূর্যের আলো থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য ক্ষুদ্র প্রয়াস আরকি। “সেই সাথে এরকম সুন্দর একটা জাহাজ সাথে করে নিয়ে এসেছ। মাই গড!” বেশিক্ষণ ঝুঁকে থাকতে না পেরে নিজের হ্যাটটা পরে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়াল সে।

বাউ-এর বেশিরভাগ নাবিক সাগরের এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সমুদ্রের ঢেউ এসে তাদের পা ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চারজন নাবিক পানসির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গ্রেপশুট লোড করা কামান থেকে গুলি ছোঁড়ার জন্য তাদেরকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হাল-এর ডান কাঁধের পাশে অ্যাবোলি একটা বড় কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

“এটা কী আমার জন্য নিয়ে এসেছ, ক্যাপ্টেন?” রিভারস জিজ্ঞেস করে।

“হাহ,” ট্রাম্প হাসি দিয়ে বলল। “এমনকি এটা যদি আমারও হত তবুও তুমি এটা পেতে না।” হাল এখনো নিজেকে চুপ রেখেছে। দস্যুটার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ট্রোম্প। “আমি এখন আর ক্যাপ্টেন নই।” সে কোনোরকম ইতস্তত বোধ না করেই বলল। “আমি এখন গোল্ডেন বাউ-এর সেকেন্ডমেট।” এরপর সে হাল-এর দিকে ঘুরে বলল, “আমি কী আমাদের ক্যাপ্টেন-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি? উনি হচ্ছেন, স্যার হেনরি কার্টনি। আমাদের ক্যাপ্টেন।”

রিভারস তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার আগে হাল-এর নীল চোখের দিকে তাকিয়ে তার ওজন বোঝার চেষ্টা করল। হালকে দেখে মনে হচ্ছে সে হ্যান্ডশেক করতে নারাজ। কারণ তাহলে হয়ত তার নিজেকে এবং তার রক্তকে অসম্মান করা হবে। হাল বুঝতে পারছে যে তার পেছনে ট্রাম্প অত্যন্ত দুশ্চিন্তামগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল। হাল সামনে এগিয়ে দস্যু ক্যাপ্টেন-এর সাথে হ্যান্ড শেক করল।

“আপনি খুব কুখ্যাত, ক্যাপ্টেন,” সে বলে ফেলল।

দস্যুটা হাল-এর কথায় খুব একটা বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হল না। “আমার ব্যবসায়িক কাজে কুখ্যাতি হচ্ছে সোনা কিংবা আইভরি পাথরের মতই মূল্যবান। মাঝে-মাঝে কিছু বণিক কিংবা নৌযাত্রী আমার জাহাজ চিনতে না পেরে বোকার মতো যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বসে। আর তাদের পরিণতি খুব একটা ভাল হয় না।”

সে ট্রাম্প-এর দিকে এক নজর তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল। “এরকমটা সচরাচর না হলেও মাঝে-মাঝে ঘটে আরকি। কোনো-কোনো ক্যাপ্টেন মাঝে মাঝে তার লোকদের জীবনের চেয়ে তার সম্মানকেই বেশি মূল্য দিয়ে ফেলে। আর সেটাই তার জীবনের শেষ ভুল হয়ে দাঁড়ায়। সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে ঐ কুঁচকে বলল। কিন্তু আমি আপনার নাম শুনেছি সম্ভবত। আপনি নিশ্চয়ই ফ্রাঙ্কি কার্টনির ছেলে। কিন্তু সে নিজে এই মূল্যবান জাহাজটা চালাচ্ছে না কেন? নাকি সে এরচেয়ে বড় কোনো একটা পেয়েছে?”

“আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, হাল বলতে থাকে। “কেপ অব গুড হোপ-এ মিথ্যে জলদস্যুতার অভিযোগে ওলন্দাজ ঔপনিবেশকরা তাকে অত্যাচার করে এবং…ফাঁসি দেয়।”

রিভারস তার পাইপ-এর অগ্রভাগটা ট্রোম্প-এর দিকে উঠিয়ে বলল, “ওলন্দাজরা আপনার বাবাকে হত্যা করেছে আর আপনি এখানে একজন ওলন্দাজ-এর সাথে মৈত্রী গড়ে তুলেছেন?”

“ট্রোম্প কখনোই আমার পিতার হত্যার ব্যাপারে যুক্ত ছিল না।”

 “বাজি ধরে বলতে পারি যে, সে ঐ সময় এর চেয়েও জঘন্য কোনো কাজে ব্যস্ত ছিল। আমি ঠিক বলেছি না, মিজনহর ট্রোম্প?”।

ওলন্দাজ লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে জবাব দিল, “আপনি আমাকে খুব ভালভাবে চিনেন, ক্যাপ্টেন রিভারস।”

“তা অবশ্য চিনি…। আচ্ছা, এখনো বলছ না কেন যে তোমরা কী কারণে এখানে এসেছ। আমি এখন দুশ্চিন্তায় আছি। তোমাদের যেকোনো ক্ষতি হতে পারে এখন। তোমাদের জাহাজগুলো আর তোমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে কি-না এটা নিয়েও আমি বেশ সংকিত।”

“এরকম কোনো কিছু করার চিন্তা মাথায়ও আনবেন না। আমার জাহাজের বন্দুক এবং কামানগুলো প্রস্তুত রয়েছে, সেই সাথে আমার নাবিকেরাও প্রস্তুত রয়েছে,” হাল বেশ দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল।

“আপনি বেশ তরুণ, ক্যাপ্টেন কার্টনি,” রিভারস তার চেহারায় বিন্দুমাত্র আতঙ্ক বা দুশিন্তা ফুটিয়ে না তুলে বলল। “আপনার মতো একজন বালকের এরকম একটা জাহাজ থাকা আসলেই বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার। এখন আমি বুঝতে পারছি। লাল সাগরে ইথিওপিয়ার যুদ্ধে আরবদের সেই বিভীষিকাময় অবস্থার কাহিনী আমি শুনেছি। যে করুণ পরিণতি আপনি তাদের করেছিলেন আমি তা শুনেছি। তারা আপনার নাম কী যেন দিয়েছে-এল তাজার, যার অর্থ হচ্ছে বারকুড়া নামক সামুদ্রিক মাছ।”

“আমি বুঝতে পারছি না, বর্তমান অবস্থার সাথে সেসব কাহিনীর কী সর্শক?”

“কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু এটুকু বোঝানোটাই উদ্দেশ্য যে বারাকুডার মতো মুখে শক্ত দাঁতযুক্ত মাছও কখনও কখনও জালে আটকা পড়ে যায়। বলতে পারেন ফাঁদে পড়ে যায় ঠিক এখনকার মতো।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?” হাল খুব বিস্ময়াবিভূত হয়ে তাকাল। সাথে-সাথে বাউ-এর কামানের গর্জন পানির ওপর দিয়ে ভেসে আসলো।

 হাল ঘুরে দাঁড়িয়ে তার জাহাজের দিকে তাকাল। একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উপরে উঠছে এখন। নেড টেইলার সতর্কতাস্বরূপ একটা কামান চালিয়েছে। কারণটাও পরিষ্কার হয়ে গেল সাথে-সাথে। একসারি ডাগআউট অন্তরীপ-এর দিকে ছিল সেগুলো এখন বাউ-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাল চারটা পর্যন্ত গুনতে পেরেছে যেগুলোর এক একটাতে পাঁচ থেকে ছয়টা পর্যন্ত মানুষ ছিল। এগুলো অনেক সরু নৌকো। স্প্যানিশ ভাষায় যেগুলোকে পিরাগুয়া বলা হয়।

 “তারা আমাদের বন্দুকের নিচ দিয়ে আসছে,” অ্যাবোলি বিড় বিড় করে বলল। এ কারণেই মি, টেইলার এগুলোকে গুলি করে উড়িয়ে দিতে পারছে না।

  হাল-এর জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। যে ডাগআউট ডিঙ্গিগুলো বাউ-এর দিকে যাচ্ছে সেগুলোতে থাকা প্রত্যেকের হাতে একটা করে লম্বা ব্যারেলযুক্ত বন্দুক আছে। বন্দুকগুলো বাউ-এর রেলিং-এর দিকে তাক করা আছে। ওরা গুলি ছুরে যে কোনো মুহূর্তে বাউ-এর নাবিকদের উড়িয়ে দিতে পারে। হাল আবার রিভারস-এর দিকে তাকিয়ে দেখল যে রিভারস বেশ বড় আকারের একটা বাসকেট হিলটেড তলোয়ার নিচ থেকে উঠিয়ে বালির মধ্যে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রাখছে। সে এমনভাবে হাল-এর সামনে তলোয়ারটা বালিতে গেঁথে রাখল যেন সে বুঝাতে চাইলে যে এরপর সে ঠিক এইভাবেই ওটাকে হাল-এর পেটে ঢুকিয়ে দেবে।

“আমার কোয়ার্টার মাস্টার মি. ডাউলিং এবং তার লোকদের হাতে গ্রেনেড আছে।” তারা যেকোনো মুহূর্তে সেগুলো বাউ-এর ওপর কাজে লাগাবে।

হাল অ্যাবোলির দিকে সতর্কতা মূলক দৃষ্টি দিয়ে তাকাল।

“এরপর তোমার লোকেরা যখন ডেক-এর ওপর এদিক থেকে সেদিক দৌড়াদৌড়ি করবে তখন আমার লোকেরা তোমার রাডার অকেজো করে দেবে।”

এই কথা শুনে রিভারস-এর লোকেরা আনন্দে উল্লাসধ্বনি করে উঠল। তাদের প্রত্যেকের সাগরে নামা ছাড়াই যদি এত সহজে বিজয় তাদের পক্ষে চলে আসে, তাহলে আনন্দে আত্মহারা হওয়াই স্বাভাবিক।

হাল ভাবতে থাকে। কোনোরকম উত্তর দেয়া ছাড়া এভাবে রিভারস-এর হুমকি মেনে নেয়া যায় না।

“আপনি হয়ত মি. ট্রাম্প-এর সাবেক জাহাজ ডেফট-এর কামানগুলোর কথা ভুলে গিয়েছেন। “আর…এটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না যে পানসিতে থাকা আমার লোকগুলোকে বেশ ভালভাবেই মানুষ খুন করার প্রশিক্ষণ দেয়া আছে।” অতএব, “ক্যাপ্টেন রিভারস, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমরা দুজনেই একে অপরের অনেক বড় ক্ষতি করতে পারি। এখন এসব বাদ দিয়ে আসুন, কথা বলি। আপনার অন্তত জানা উচিত যে আমি কেন এখানে এসেছি।”

রিভারস একনজর সাগরের দিকে তাকিয়ে আবারও হাল-এর দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তারপর হা হা করে হাসতে শুরু করে দিল। “বাই গড, তুমি ফ্রাঙ্কির যোগ্য সন্তান। ফ্রাঙ্কিও তোমার মতোই ঠাণ্ডা রক্তের মানুষ ছিল। কিন্তু আমাকে টেক্কা দেয়ার চেষ্টা করো না। তুমি হয়ত নিজেকে “স্যার” ভাবতে পার কিন্তু এখানে সেটা তোমার কোনো কাজেই আসবে না। তোমার পিতাও হয়ত কিং চার্লস-এর সেই কল্পিত আদেশপত্র হাতে নিয়ে ভেবেছিল যে সে যেকোনো পর্তুগীজ জাহাজকে উড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু সত্যিটা হল, তোমার পিতাও আমার মতোই দুস্য ছিল। সেও ধন-সম্পদ লুট করতে চেয়েছিল।”

 “আমার পিতা একজন সম্মানিত মানুষ ছিলেন। নটোনিয়ার নাইট অব দ্য টেম্পল অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য…”

“ব্ল-ব্লা-ব্লা।” রিভারস তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। “তোমার পিতা একজন ভাল নাবিক ছিল এবং কৌশলে অন্যের জাহাজ ছিনিয়ে নিতে পারত। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে তুমিও ঠিক সেভাবেই এই জাহাজটাকে অন্য কারো কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলে।”

 “আমি যার কাছ থেকে এই জাহাজটা কেড়ে নিয়েছিলাম, তার এই পরিণতি প্রাপ্য ছিল।”

“হাহ! সবার ক্ষেত্রেই এটা সত্য, তাই না?” রিভারস হাল এর-দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি হচ্ছ একজন বদমেজাজি, উদ্ধত বালক। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে এই বয়সেই তুমি বহু লোকের সাথে শত্রুতা করেছে যারা তোমাকে হত্যা করতে পারলে খুবই খুশি হবে।”

“কিন্তু, তারপরও আমি বেঁচে আছি।”

“হ্যাঁ, তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছ।” ক্যাপ্টেন রিভারস তার পাইপটা নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “আমি আজকে অনেক কঠিন একটা দিন পার করেছি। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এখন আমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। তুমি তোমার লোকদের জাহাজে ফিরে যেতে বল এবং আমি আমার লোকদের উপকূলে ফিরে যেতে বলব। কোনো রক্তারক্তি হবে না।” “যুবক কার্টনি তোমার ওপর কী এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে যে তুমি কোনো রকম মদপান করতে পারবে না?”

 “আমি একজন নাইট, মুসলমান নই। আমি আপনার সঙ্গে যোগ দিতে রাজি আছি”, হাল কষ্ট করে তার মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল।

“খুব ভাল। তাহলে সূর্য ডোবার পরে এখানে এসো। একা। এরপর আমরা কথা বলবো। এরপর তুমি আমাকে বলবে যে তুমি কেন এখানে এসেছে। কী চাও তুমি? এরপর আমি বলবো যে, তুমি সেটা পাবে, কী পাবে না।”

এরপর রিভারস তার তলোয়ারটা বালি থেকে তুলে কোমড়ের বাঁট-এ গুঁজে রাখল। এরপর আর একটাও কথা না বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিচ ধরে হাঁটতে শুরু করে দিল।

টর্চলাইটগুলো বালির ওপরেই রাখা ছিল। টর্চের আলো রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। হাল-এর ফ্লিন্টক দুটো লোড করা আছে এবং তলোয়ারটা ওর বট-এ রাখা আছে। ক্যাপ্টেন রিভারস-এর মনে যদি বিশ্বাসঘাতকতা করার কোনোরকম ইচ্ছে থাকে তবে তা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত আছে ও।

যেভাবে অনুরোধ করা হয়েছে হাল একদম সেভাবেই এসেছে-একা। এমনকি অ্যাবোলি এবং অন্যান্য অফিসারকেও সাথে নিয়ে আসা হয় নি। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই হাল ধারণা করতে পেরেছে যে রিভারস সবকিছুই নিজের রাস্তায় করে, যা আগে থেকে আঁচ করা যায় না।

হাল আর রিভারস বিচ-এর ওপর পেতে রাখা ছোট্ট একটা টেবিলের ওপর বসে আছে। টেবিলের ওপর মাদেইরা ওয়াইন-এর একটা বোতল এবং দুটো ক্রিস্টাল গ্লাস রাখা আছে। এসবই এক পর্তুগীজ ক্যাপ্টেন-এর সম্পত্তি ছিল যার জাহাজ এখন দ্বীপের দক্ষিণ দিকে পড়ে আছে।

তাদের দুজনের চারপাশে এখন স্বর্গীয় সৌন্দর্য বিরাজ করছে। রাতের আকাশে তারাগুলো মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। হাল তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল জুডিথ কী এই তারাগুলো দেখতে পাচ্ছে, নাকি কোনো অন্ধকার কারাগারে বন্দি আছে যেখানে দিনের আলো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না?

“তাহলে ট্রোম্প তোমার জাহাজ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল?” জলদস্যুটা ক্যাপ্টেন হাল-এর গ্লাসে রাম ঢেলে দিতে দিতে বলে।

“চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়”, হাল জানালো।

“অ্যাবোলি, ট্রাম্প এবং বিগ ডেনিয়েল তাদের লংবোট নিয়ে পানির ধারে অপেক্ষা করছে। পানসিটা পুনরায় বাউ-এর কাছে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেই সাথে হাল এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে রিভারস-এর ডাগআউট ডিঙ্গিগুলো পুনরায় আক্রমণ করার চেষ্টা করবে। রিভারস-এর লোকদের কাউকে হাল আশে পাশে দেখতে পাচ্ছে না। যদিও অন্ধকারে লুকিয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না।

 “এরপর থেকে ট্রোম্প নিজেকে আমার কাছে বেশ বিশ্বস্ত হিসেবে প্রমাণ করেছে,” হাল বলতে থাকল।

 সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। আশে পাশে প্রাণের চিহ্ন বলতে কেবল বালির ওপর দিয়ে দ্রুত চলে যাওয়া কাঁকড়া আর ঝোঁপের ঐ পাশে থাকা লোকজনের হাসি-ঠাট্টার শব্দ।

“আপনি হয়ত শুনেছেন যে, শত্রুরা আমার কাছ থেকে কাউকে কেড়ে নিয়েছে।” কথাগুলো বলতেও হাল-এর বেশ কষ্ট হচ্ছিল। “এমন কাউকে যে আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে প্রিয় মানুষ। যে করেই হোক আমি তাকে ফেরত পেতে চাই। যারা তাকে নিয়ে গিয়েছে আমি তাদেরকে হত্যা করতে চাই। কিন্তু আমি নিজে সেই কাজটা করতে পারছি না।”

 পরবর্তী কয়েক মিনিট হাল রিভারসকে সব গল্প খুলে বলল। সে জানায় যে জাঞ্জিবার-এর পরবর্তী বাজারের দিনে জুডিথকে বিক্রির উদ্দেশ্যে আনা হবে। জুডিথকে পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে তাকে কিনে আনা। কিন্তু হাল নিজে সেই ক্রেতা হতে পারছে না।

রিভারস মনোযোগ দিয়ে শুনল। সে ভাবছে যে তার এখন কি বলা উচিত। এরপর সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে যে, তাকে সেখানে সে সময় বিক্রির জন্য আনা হবে?”

“আমি রাষ্ট্রদূত গ্রে-এর কাছ থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করেছি।”

 “সেই লোক, যে তোমার সাথে প্রথমবার প্রতারণা করেছিল?”

হাল মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ,”

“তাহলে এখন কেন তুমি তাকে বিশ্বাস করছ? এমনও তো হতে পারে সে তোমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য এরকম প্রলোভন দেখাচ্ছে।”

“অবশ্যই সেরকম হতে পারে। কিন্তু তারপরও…এতে কিই বা আসে যায়। আমি যদি সেই বাজারে উপস্থিত থাকি তবে তাকে ফিরে পাওয়ার আশা আছে-তা সে যতই ক্ষীণ, হোক। কিন্তু যদি আমি সেখানে উপস্থিত না থাকি তবে সেই আশা একেবারেই নেই।”

“কিন্তু এখানে আমি কী করতে পারি?”

“আমি চাই, আপনি আমার পক্ষ হয়ে নিলামে সাড়া দিবেন। আমি বা আমার সাথে সম্পৃক্ত কেউই সামনা সামনি দর হাঁকাতে পারবে না। কিন্তু আপনার এবং আমার মাঝে কোনো যোগাযোগ আছে এটা দ্বীপের বাইরে কেউই জানে না। আমি জানতে পেরেছি যে বাজারের দাস বিক্রেতাদের সাথে আপনার পরিচয় আছে।”

“হুম।”

“সেই সাথে জাঞ্জিবার এমন একটা জায়গা যেখানে আপনার কৃতকর্মের জন্য আপনাকে বন্দি করার কোনো আদেশ দেয়া হয়নি।”

“আমি জাঞ্জিবার-এর নিয়ম না ভাঙার ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। সেকারণেই হয়ত আমি মুক্তভাবে সেখানে যেতে পারি। এছাড়া তুমি নিশ্চয়ই এটাও জান যে জাঞ্জিবার চলে তার নিজের নিয়মে। পৃথিবীর নিয়ম সেখানে খাটে না। জায়গাটা অনেকটা গ্র্যান্ড বাজারের মতো। তুমি সেখান থেকে যে-কোনো কিছু এমনকি যে কাউকে কিনতে পার। এই যে দেখ তুমি তোমার প্রিয় নারীকে সেখান থেকে কিনতে যাচ্ছ।”

“অথবা আমার হয়ে আপনি যাচ্ছেন।”

“কিন্তু কী কারণে আমি সেটা করতে যাব, যেখানে তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক বা চুক্তি নেই? আমার যদি কোনো লাভ না থাকে তাহলে আমি নিশ্চয়ই আমার নিজের চামড়ার ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যাব না, তাই না?”

হাল তার সামনে বসা রিভারস-এর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রিভারস নিমগ্নচিত্তে তার পাইপ টানছে। হাল জানে যে খুব অনুনয় করে কিংবা বেপরোয়া হয়ে এর কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। তাকে শান্ত থাকতে হবে-যত নিষ্ঠুর সময়ের মধ্য দিয়েই সে সময় পার করুক না কেন।

“ট্রোম্প কী কখনো আপনাকে ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ-এর ব্যবসা সম্পর্কে কিছু বলেছে?” হাল জিজ্ঞেস করল।

রিভারস মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ কিছুটা বলেছে। বলেছে যে ক্যাথলিকরা জেসাস কিংবা কুমারী ম্যারি সম্পর্কিত যেকোনো পুরনো রেলিক-এর জন্য অনেক মূল্য দেবে। একসময় আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য কমপোস্টেলার আশেপাশে সমস্ত তীর্থস্থান আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। কিছু রেলিক দেখে আমার কাছে শুকিয়ে যাওয়া মুরগির হাড়ের মতো মনে হয়েছে। এরকম ধ্বংসাবশেষ বিক্রি করে টাকা বানাতে হলে লোকজনকে বোকা বানাতে হবে। ট্রোম্প সেটা কখনোই পারবে না। আমাকেই সেটাতে হাত লাগাতে হবে।”

 “আপনি এখনো সেটা পারেন, হাল বলল। “যখন ট্রোম্প আমার জাহাজ আক্রমণ করতে যায় তখন সে এবং তার লোকেরা অভুক্ত ছিল। বাতাভিয়া ছেড়ে আসার পর সঠিকভাবে সে তার জাহাজের লোকদের খাবার যোগাতে পারছিল না। কারণটা পরিষ্কার। সে তার সমস্ত টাকা-পয়সা ও সম্পদ সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ তৈরি করতে নষ্ট করেছে। আমি যখন ডেফট পরিদর্শনে যাই তখন সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষসহ ব্যারেলগুলো খুঁজে পাই। কুমারী মেরীর অশ্রু, সত্যিকার ক্রসের টুকরা এমনকি জেসাস-এর সুন্নতে খানা করার সময় যে ফোরস্কিন বেঁচে গিয়েছিল সেটাও রয়েছে। আমি এইসব প্রতারণাপূর্ণ ব্যবসায় নিজেকে জড়াতে চাই না। কিন্তু আমি জানি ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকদের কাছে এসব জিনিসের অনেক মূল্য আছে। এসব জিনিস আমি আপনার হাতে তুলে দিতে রাজি আছি যদি আপনি আমার হয়ে জাঞ্জিবার-এর বাজারে যান।”

“তার মানে তুমি বলতে চাইছ, আমার কোনো নৈতিকতা নেই?”

“অত্যন্ত সম্মানের সাথেই বলছি, ক্যাপ্টেন রিভারস, আপনার অস্তিত্ব সেটাই প্রমাণ করে।”

 “সম্মানের সাথে! যদিও তুমি তোমার পশ্চাৎদেশ দিয়ে কথাগুলো বলেছ, কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছ। আমি বেশ খুশি হয়েই এসব ধ্বংসাবশেষ খ্রিস্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের কাছে, তীর্থযাত্রীদের কাছে এমনকি সম্ভব হলে পোপ-এর কাছেও বিক্রি করব। আমি ক্যাথলিক-এ বিশ্বাসীদেরকে সম্মান করি একজন এনটিক্রিস্ট হিসেবে। অতএব, আমি আমার মতো করেই কাজটা করব।”

পার্লামেন্টের হয়ে আমি যুদ্ধ করেছি। আমি স্টুয়ার্টদের ঘৃণা করি একজন টাইরান্ট হিসেবে নয় বরং একজন প্যাপিস্ট হিসেবে। তাই আমি এসব ধ্বংসাবশেষ নে এবং বিক্রি করে আমার পুরস্কার আদায় করব। কিন্তু এসব ধ্বংসাবশেষই যথেষ্ট নয়।

“ট্রোম্প আমাকে নিশ্চিত করেছে যে এসবের মূল্য কয়েকশ এমনকি হাজার পাউন্ডও হতে পারে।”

“এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মাথার দাম এর চাইতেও বেশি।”

“তাহলে আপনার মাথার মূল্যায়ন করতে হলে আপনাকে কী পুরস্কার দিতে হবে?”

রিভারস তার পাইপ-এ মগ্ন হয়ে গভীরভাবে প্রশ্নটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। এরপর পেছনে হেলান দিয়ে বসে রাতের আকাশে ধোয়া ছাড়ল কিছুক্ষণ। এরপর সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ধ্বংসাবশেষগুলো আমি নেব। সেই সাথে তারা যে জাহাজে করে এসেছে সেটাও আমার চাই।”

“কিন্তু ডেফট-এর মূল্য অন্তত পাঁচ’শ গিনি হবে?”

“ডেফট-কে চুরি করে আনা হয়েছে তাই না?” তুমি তো আমাকে তা-ই বলেছ। ট্রোম্প তার সমস্ত টাকা-পয়সা এসব ধ্বংসাবশেষ তৈরি করতে খরচ করেছে। সে যদি খাবারই জোগাড় করতে না পারে তাহলে সে নিশ্চয়ই এরকম সুন্দর একটা জাহাজ কিনতে পারেনি, তাই না?”

“ট্রোম্প বোটটা কীভাবে পেয়েছে, সেটা তার ব্যাপার, আমার না।”

“ভাবো একবার। তুমি ডাচ্ নেভীদের জাহাজ দখল করেছ যখন কি-না ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড-এর মধ্যে শান্তি চুক্তি বিরাজ করছে। তোমাকে তো ডাকাতির জন্য ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। বুঝতে পেরেছ?”

 রিভারস-এর যুক্তিগুলো হাল বুঝতে পেরেছে, কিন্তু তার চাহিদা পূরণে হাল খুব একটা অগ্রসর হলো না। রিভারস যেন হাল-এর মনের কথা বুঝতে পেরেছে এমনভাবে বলতে থাকে, “শান্ত হও বালক।” আমি জানি তুমি ব্যাপারটা পছন্দ করছ না। একজন নাইট হয়ে আমার মতো একজন দস্যুর সাথে দর কষাকষি করাটা তোমার জন্য অসম্মানের। কিন্তু ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখ। তুমি সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষগুলো চাও না। আর জাহাজটা তুমি চাইলেও ব্যবহার করতে পারবে। আমি তোমার স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার বদলে এমন দুটো জিনিসই তোমাকে দিতে বলেছি যে দুটো জিনিস তঅমার কোনো কাজেই আসবে না। এখন চিন্তা করে দেখ ব্যাপারটা কী খুব একটা খারাপ হবে?”

“সম্ভবত না”, হাল বলল।

“আমি তোমার কথা বিবেচনা করব শুধু এই কারণে যে একসময় আমিও কাউকে হারিয়েছিলাম।” রিভারস তার গ্লাসের শেষ ওয়াইনটুকুও পান করে নিলো। এরপর কিছুক্ষণ নিজের পেছনের গল্পের মধ্যে হারিয়ে গেল। “কী নাম তার?” অবশেষে সে জিজ্ঞেস করল।

 “জুডিথ,” নামটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে হাল-এর মনে অন্যরকম একধরনের অনুভূতি হচ্ছিল।

“খুব ভাল মেয়ে, তাই না?”

“আমার দেখা সবচেয়ে ভাল মেয়ে।”

“একজন পুরুষের জন্য সবচেয়ে ভাল উপহার হচ্ছে এমন একজন নারী, যে তাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবাসবে।”

বুড়ো শয়তানটার তাহলে হৃদয়ও আছে। মনে মনে চিন্তা করল হাল।

অবশেষে রিভারস রাজি হলো। “আমি তোমার সঙ্গে জাঞ্জিবার-এ যেতে রাজি আছি। সেখানে গিয়ে আমি তোমার স্ত্রীকে কিনে আনার ব্যবস্থা করব।”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *