১. মানুষ বলে গণ্য

গোল্ডেন লায়ন / উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান / ভাষান্তর : লুৎফুন নাহার

লেখকের উৎসর্গ

আমার স্ত্রী, নিসোর উদ্দেশে এ বইটি—

পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই সে আমার কাছে একটা দৃঢ় ও প্রগাঢ় অনুপ্রেরণার উৎস, ব্যর্থতার সময়ে সে আমার পথনির্দেশক আর সফলতার দিনগুলোতে সে এক অপার আনন্দ। আমি সত্যিই জানিনা, কি করতাম যদি সে আমার পাশে থাকতো। আমি আশা করি তেমন দিন কখনোই আসবে না।

আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী, আমি তোমাকে কতখানি ভালবাসি, সম্মান করি, তা ভাষায় প্রকাশে ব্যর্থ।

*****

.

তাদেরকে আর মানুষ বলে গণ্য করা যায় না। তারা এখন কেবল আফ্রিকা মহাদেশের ভেতর অবস্থিত ভারত মহাসাগরের উপকূলে এ পড়ে থাকা একদল মাংসপিণ্ড। অধিকাংশের শরীর শক্রর অবিরাম গুলির আঘাতে কিংবা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। কারো কারো শরীর ডুবে গিয়েছে পানিতে। পেটে গ্যাস জমে তা আবার ভেসেও উঠেছে। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে কোনো ছিপি-আঁটা বোতল পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভেসে যাওয়া মাংসপিণ্ডগুলো মাংসখেকো সামুদ্রিক পাখি আর হাঙ্গরদের জন্য উৎসবের আমেজ বয়ে নিয়ে এসেছে। কোনো কোনোটা ভাসতে ভাসতে আবার সমুদ্রের পাড়ে চলে এসেছে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে অন্য কোনো মানুষখেকো প্রাণী।

দুটি ছোট ছেলে তাদের মা ও নানীর সাথে পানির কিনার ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে তারা চিৎকার করে উঠছে যেন তারা সমুদ্রের মাঝে নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। ওটা কতটা তুচ্ছ এবং অবাঞ্ছিত, সেটা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়।

“ওইতো, আরেকটা দেখা যাচ্ছে,” বড় ছেলেটা সোমালি ভাষায় চিৎকার করে উঠে। জাহাজের মাস্তুলের একটি ভাঙ্গা টুকরোর দিকে ইশারা করল সে যেটার সাথে ছেঁড়া পালটা তখনো ঝুলছিল। পালটার সাথে অদ্ভুতভাবে পাক খেয়ে আটকে আছে একটি মৃতদেহ যেটা দেখে বোঝা যায় যে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে এটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তার মৃতদেহটা পড়ে আছে বালুকাবেলায়, যার সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলেদুটি হাসছে।

 “দেখ, পাখি তার একটি চোখ উঠিয়ে ফেলেছে, বড় ছেলেটি চিৎকার করে উঠল।

 “সেই সাথে মাছেরা তার পুরো একটা হাত খেয়ে ফেলেছে,” ছোট ছেলেটি বলল। ছেঁড়াপালের এক টুকরো তার উপড়ে যাওয়া হাতের অবশিষ্টাংশকে ব্যান্ডেজের মতো করে প্যাচিয়ে রেখেছে, সেই সাথে তার সারা গায়ের কাপড় আগুনে পুড়ে গিয়েছে। তার কংকালসার শরীরের সাথে ঝুলে আছে ছেঁড়া টুকরোগুলো।

“ওইটা দেখ,” বড় ছেলেটি আবারো চিৎকার করে উঠল। “তার তলোয়ার এর বেল্টের বাকলটা দেখ। এটা নিশ্চয়ই সোনা বা রুপার তৈরি হবে। আমরা তো ধনী হয়ে গেলাম!” ছেলেটি হাঁটু গেড়ে লোকটার পাশে বসল, এরপর ধাতব বাকলটা ধরে টানতে লাগল। সাথে সাথেই লোকটা গোঙানির মতো আওয়াজ করে উঠল, তারপর মাথাটা ঘুরিয়ে অক্ষত চোখটা দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেদুটি ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বাকলটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসল তারা। এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল ছেলেদুটো, এরপর ভয়ে মায়ের স্কার্ট ধরে নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল।

ছেলেদুটিকে কাছে টেনে নিল তাদের মা, এরপর দৌড়ে অর্ধমৃত লোকটার কাছে চলে এল। ছেলেদুটির নানীও দৌড়ে ওদের পেছন পেছন আসতে লাগল। ছেলেদুটির মা মৃতদেহটার কাছে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল, সেই সাথে সজোরে মৃতদেহটার গালে একটা থাপ্পড় লাগাল। মৃতদেহটা আবারো গোঙ্গানির মতো আওয়াজ করে উঠল।

“জিংকি ঠিকই বলেছে। ফিরিঙ্গিটা এখনো বেঁচে আছে।”

মহিলা তার পকেটে হাত দিয়ে একটা কাস্তে বের করে আনল যেটা দিয়ে সে তার মুরগিদের খাবার জোগাড় করার জন্য ঘাস কাটে।

“তুমি কী করতে চাচ্ছ?” মহিলাটির মা হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে এসে বলল।

“আমি লোকটার গলা কাটতে যাচ্ছি।”

মহিলাটি মৃতপ্রায় দেহটার চুলের মুঠি ধরে পেছন দিকে টান দিল যেন গলাটা আরো সামনের দিকে এগিয়ে আসে। “বেল্ট এবং বাকলটা কে জিতে নিয়েছে, সেটা নিয়ে এখন কোনো তর্ক করতে চাই না।”

সে তার হাতের বাঁকানো কাস্তেটা লোকটার গলায় ধরল। লোকটা অল্প ককিয়ে উঠল, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পেল না।

“দাঁড়াও?” ছেলেদুটোর নানী খুব জোরালোভাবে তার মেয়েকে আদেশ করল। “আমি এই বাকলটা আগেও দেখেছি…যখন আমি তোমার বাবার সাথে জিবুতিতে থাকতাম আরকি। এই লোকটা অনেক বড় একজন ফিরিঙ্গি লর্ড। তার নিজের জাহাজ আছে। প্রচুর সম্পদের মালিক সে। আমরা যদি তার জীবন রক্ষা করি, তাহলে সে হয়তো তার অঢেল সম্পদ থেকে আমাদেরকে একটা সোনার মোহর দিতে পারে-কিংবা কে জানে, হয়তো দুটোও দিতে পারে।”

মহিলাটিকে দ্বিধান্বিত মনে হল। সে তার মায়ের প্রস্তাবটা ভেবে দেখছে, যদিও সে কাস্তেটা এখনও লোকটার গলায় ধরে রেখেছে। “কিন্তু এই দামি ধাতব বাকলটার কী হবে?”

“স্বাভাবিকভাবেই, এটা আমরা রেখে দেব।” মা তার মেয়ের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখে হতাশ হল। “যদি সে কখনও এটার কথা জিজ্ঞেস করে, তো বলব যে, আমরা কখনও এটা দেখিইনি।”

অবশেষে মহিলাটি লোকটার গলা থেকে কাস্তে সরিয়ে নিল।

মহিলাটি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে…আমরা এখন তাকে নিয়ে কী করব?”

 নানী বলল, “আমরা তাকে গ্রামের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”

মহিলাটি বলল, “কীভাবে?”

“আমরা তাকে ছেঁড়া পালটার ওপর চিৎ করে শুইয়ে দেব-” নানী ভাঙ্গা মাস্তুলের সাথে লাগানো পালের দিকে ইঙ্গিত করল। এবং বলল, “এরপর ওটা দুদিক দিয়ে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাব।” এরপর সে তার নাতীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদুরা, অবশ্যই এ কাজে আমাদের সাহায্য করবে, তাই না?”

যুদ্ধাহত মৃত প্রায় লোকটির মস্তিষ্ক চিৎকার করার বার্তা পাঠাচ্ছে। কিন্তু আগুনের শিখা ও ধোয়ায় তার স্বরযন্ত্র এতটাই ঝলসে গিয়েছে যে, সেখান থেকে বাঁশির মতো চিকন আওয়াজ বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তার গলায় কেউ একজন হারমোনিয়াম-এর ভাঙ্গা বেলোজ (হাপর) বসিয়ে রেখেছে।

অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়-প্রায় এক কী দুই মাস আগেও যখন সে সমুদ্রের ঝড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়াত, তখন তার দৃঢ় ও শক্ত মুখভঙ্গির কাছে সমুদ্রের বাতাস আর গর্জনও বোধহয় ভয়ে কুঁকড়ে যেত। তীব্র বাতাসও তখন তার কাছে কিছুই মনে হত না। আর এখন যখন খোলা জানালা দিয়ে তার ঘরে জেসমিন সুরভিত উষ্ণ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে, তার গায়ে কেউ কাঁটা ফুটিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রোগীর ব্যথা কমানোর চেষ্টা করছে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। তবুও ব্যথা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে বারবার। ডাক্তার যখন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার মুখ থেকে ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছিল তখন তার মনে হচ্ছিল যেন শক্রর ধারালো ছোঁড়ার আঘাতে সে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে। এছাড়াও প্রতিমুহূর্তে তার মনে ভেসে উঠছে যুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতি। আগুনের লেলিহান শিখা। গুলির আওয়াজ, কাঠ পোড়ার শব্দ। আহত মানুষের তীব্র আর্তনাদ।

.

“আমি দুঃখিত! কিন্তু এছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই,” ডাক্তারটা বিড়বিড় করে বলল। যদিও যার সঙ্গে সে কথা বলছে সে আরবি ভাষা খুব একটা ভাল বুঝতে পারে না। ডাক্তারের দাড়িগুলো পাতলা ও রুপালি রঙের এবং চোখের নিচে অনেকটা অগভীর গর্ত হয়ে গিয়েছে। সে তার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনের সাধনা ও সুনিপুণ নৈপুণ্য দিয়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছে তা যে কোনো রোগীকে আশ্বস্ত করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই রোগীটি ব্যতিক্রম। তার আঘাত এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সে বাঁচবে, এই আশা ছেড়েই দেয়া হয়েছিল। তাকে একটা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল পুরোটা সময়। লোকটার একটা বাই পুরোপুরিভাবে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। কেবল পরম করুণাময় আল্লাহই জানেন কিভাবে এটা হয়েছে। একইপাশে বক্ষপিঞ্জরে শক্ত কোনো কুঠার বা অস্ত্র দিয়ে এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে যে, বুকের অনেক হাড় ভেতরের দিকে বসে গিয়েছে। তার শরীরের বেশিরভাগ চামড়া পুড়ে গিয়েছে, সেই সাথে ফোঁসকা পড়ে গিয়েছে পুরো শরীরে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে যে ফুলের সুবাস আসছে তা এই পুড়ে যাওয়া মাংস, পচে যাওয়া চামড়া ও পুঁজের গন্ধের কাছে মিইয়ে যাচ্ছে।

 আগুনে তার হাত-পায়ের চামড়াও পুড়ে গিয়েছে। তার বেঁচে যাওয়া হাতটাতে দুটো আঙুল এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে বিন্দুমাত্র মাংসও হাড়ের সাথে লাগানো ছিল না। ডাক্তারকে পরে সে অংশটুকুও কেটে ফেলতে হয়েছে। সামুদ্রিক শকুন তার বাম চোখটা উপরে ফেলেছে। অন্য চোখের পাপড়িগুলোও এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে, সে এখন শীতল দৃষ্টিতে চোখের পলক ফেলা ছাড়াই তাকিয়ে থাকতে পারছে।

কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হারানোটাই তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়। তার পুরুষাঙ্গ এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে, সেখানকার চামড়ায় ক্ষতচিহ্ন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ, যদি সে কখনও বিছানা থেকে উঠতে পারে, তবে তাকে মহিলাদের মতো বসে মূত্রত্যাগ করতে হবে। স্ত্রীলোকের সঙ্গম উপভোগ করার কোনো রাস্তাই আর তার সামনে খোলা রইল না।

শুধু উপরওয়ালার ইচ্ছাতেই সে এখনো বেঁচে আছে। ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর নিজে নিজে মাথা নাড়াল। ব্যান্ডেজ খোলা অবস্থায় ক্ষতটা দেখেই সে আন্দাজ করতে পেরেছিল-আল্লাহ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না। তিনি সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময়। এটা নিশ্চয়ই কোনো শয়তানের কাজ। তার পেছনে যে দানবটা লেগেছিল সেটা নিশ্চয়ই কোনো মানুষরূপী শয়তান ছিল। সেই শয়তানটাই নিশ্চয়ই একে এত কষ্ট দিচ্ছে। শয়তানের এই কাণ্ডকারখানা বন্ধ করে দেয়া ডাক্তারের জন্য এক মুহূর্তের ব্যাপার।

ডাক্তারের কাছে এক ধরনের মিষ্টি সিরাপ জাতীয় ওষুধ আছে। সেই ওষুধ যদি রোগীকে খাওয়ানো হয়, তবে তা ব্যথা কমিয়ে দেবে, সেই সাথে ধ্বংস করে দিবে নীরব ঘাতক ব্যাধি। এরপর নারীর কোমল স্পর্শের মতো তার হৃদস্পন্দন চিরতরে বন্ধ করে দিবে। কিন্তু ইথিওপিয়া থেকে মহারাজা সাদিক খান জাহান নিজ হাতে আদেশ লিখে পাঠিয়েছেন যেন এই রোগীকে জানজিবার-এ অর্থাৎ মহারাজার ব্যক্তিগত বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সে জন্যই, এই ব্যক্তির বিষেশ যত্ন নেয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে।

মনে হচ্ছে জাহান একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছেন-যে ব্যক্তির পুরো শরীর আগুনে পুড়ে গিয়েছে, যার এক হাত বাহু পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে, সেই সাথে উপড়ে নেয়া হয়েছে একটি চোখ, দীর্ঘসময় ধরে যে মানুষটা পানিতে ডুবেছিল, এবং অবশেষে বালুকাবেলায় দুইজন কিশোর কর্তৃক আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত যে ব্যক্তি দিনের পর দিন তীব্র রোদে পুড়ে দগ্ধ হয়েছিল, তার বেঁচে থাকার পেছনে অবশ্যই স্বর্গীয় হাত রয়েছে।

ডাক্তারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই রোগী বেঁচে গেলে তাকে তার ধারণার চেয়েও বেশি পুরস্কার দেয়া হবে কিন্তু রোগী যদি মারা যায় তবে তার শাস্তিটাও এর চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। সে তার এই দীর্ঘ ডাক্তারি জীবনে বহু রোগীকে তাদের সীমাহীন কষ্ট থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এটা অন্য সব কিছুর চেয়ে আলাদা। রোগীটিকে বেঁচে থাকতে হবে। আর এটা অবশ্যই ডাক্তারকে নিশ্চিত করতে হবে।

লোকটি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যে চারপাশের আলোকিত জগৎ সে অনুধাবন করতে পারছে না। শুধু ডাক্তার যখন ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছে তখন সে কেবল কয়েকটা আলোকরশি দেখতে পাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে আরো বুঝতে পারছে, যে আলোক রশিাগুচ্ছ তার মস্তিষ্কে যাচ্ছে, সেগুলো আসছে ডান চোখ দিয়ে, বাম চোখ দিয়ে নয়। তার বাম চোখ পুরোপুরিই অন্ধ। কিন্তু তার মনে হচ্ছে বাম চোখটি এখনো চোখের জায়গাতেই রয়েছে। ওখানকার স্নায়ুগুলো এখনো চোখের অস্তিত্বকে ভুলতে দিচ্ছে না। সে চোখের পলক ফেলতে চাচ্ছে কিন্তু শুধু ডানচোখের পাতাই কেবল তার সে ইশারায় সাড়া দিচ্ছে। বাম চোখ মোছার জন্য সে তার বাম হাতটি উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাম হাতটিও হাতের জায়গায় নেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে ভুলে গিয়েছিল যে সে তার বাম হাতটিও চিরতরে হারিয়েছে। চোখের স্নায়ুগুলোর মতো হাতের স্নায়ুগুলোও একই রকম চুলকানির মতো অনুভূতি মস্তিষ্কে নিয়ে যাচ্ছে। একারণেই তার মনে হচ্ছে যে বাম হাতটি এখনো হাতের। জায়গায়ই রয়েছে। সে তার ডান হাতটি উঠানোর চেষ্টা করে কিন্তু শুষ্ক ও শক্ত কোনো হাত তার ডান হাতটি ধরে রেখেছে। সে ডাক্তারের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার কি বলছে তার একটি কথাও সে বুঝতে পারছে না।

 সে বুঝতে পারল তার ডান চোখের ওপর কেউ একজন ঠাণ্ডা কিছু একটা চেপে ধরে আছে এবং আস্তে আস্তে তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। যখন এটা উঠিয়ে ফেলা হল, সে তার দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে ফিরে পেতে শুরু করল। সে খোলা জানালা দেখতে পেল। জানালার পেছনে খোলা আকাশ দেখতে পেল। সে আরও দেখতে পেল সাদা রঙের আলখাল্লা ও পাগড়ি পরিহিত একজন বয়স্ক লোক তার পাশে বসে আছে, যে কি-না এক হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছে এবং অন্য হাত দিয়ে তা সরিয়ে নিচ্ছে।

এছাড়াও কামরার মধ্যে অন্য একজন লোক রয়েছে। একজন অল্পবয়স্ক যুবক ডাক্তারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা, গায়ের রঙ সব ইস্ট ইন্ডিস-এর লোকদের মতো। কিন্তু তার পোশাক পরিচ্ছদ, স্টাইল সব ইউরোপিয়ানদের মতো। তার বংশে হয়ত কোনো সাদা রক্তের মিশ্রণ রয়েছে। তার গায়ের রঙে এশিয়ানদের বাদামি বর্ণের সাথে ধূসর গোলাপি রঙের আমেজ মিশে গিয়েছে।

 বিছানায় শোয়া রোগীটি যুবক ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি কী ইংরেজি বলতে পার?”

তার একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছিল না শুধু ফিসফিস আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সে তার ডান হাত দিয়ে ইশারা করে ছেলেটিকে আরও কাছে যেতে বলল। ছেলেটিও খুব সতর্কতার সাথে তা করল।

“তুমি ইংরেজি বলতে পার?” বিছানায় শোয়া রোগীটি আবার বলল।

“হ্যাঁ স্যার, আমি পারি।”

“তাহলে এই ব্যায়াদব আরব লোকটাকে বল…” সে আবারো নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য থামল। মনে হচ্ছে যেন তার বুকের খাঁচা বাতাসের অভাবে চুপসে গিয়েছে। … যাতে সে আমার ব্যান্ডেজ উঠানোর সময় এত আলগা দরদ না দেখায়…” লোকটা আবার থামল নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। মনে হল সে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। “…যত দ্রুত সম্ভব এই জঘন্য জিনিসগুলো সরাতে বলল ওকে…”

কথাগুলো আরবিতে ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলা হল। ফলে ডাক্তারের ব্যান্ডেজ খোলার গতি আরও দ্রুত হল। সে খুব তাড়াতাড়ি শক্ত হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল।

 যদিও ব্যথা বাড়ছে, কিন্তু বিছানায় শোয়া লোকটি তার এই মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে একধরনের পাশবিক আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে নিজেকে বোঝাল যে এটাও একটা বাধা। সমুদ্র বা বাতাস এর সাথে এটার কোনো পার্থক্য নেই। এই বাধাটাকেও দমন করে তার আয়ত্তে আনতে হবে, কোনোভাবেই এটার কাছে হেরে যাওয়া যাবে না। তার শরীর থেকে রক্তমাখানো ব্যান্ডেজ-এর শেষ তন্ত্রটা উঠানোর আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। এরপর বলল, “তাকে বল আমার সামনে একটা আয়না নিয়ে আসতে।”

ডাক্তারের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটি অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। সে ডাক্তারকে কথাটা জানাল। ডাক্তার মাথা ঝাঁকাল, এরপর অস্পষ্ট এবং উচ্চস্বরে খুব দ্রুত কিছু একটা বলতে লাগল। যুবক ছেলেটি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে ডাক্তারকে বোঝনোর চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হল না।

অবশেষে সে বিছানার কাছে এসে লোকটিকে জানিয়ে দিল, “স্যার, সে বলেছে যে সে এটা করতে পারবে না।”

“তোমার নাম কী?” আহত লোকটি জিজ্ঞেস করল।

“এলথুদা, স্যার!”

“আচ্ছা, ঠিক আছে এলথুদা, তুমি এই হারামজাদা শয়তানটাকে বল যে আমি ওমান-এর রাজা আহমেদ এল গ্রেং এবং গ্রেট মোগল-এর ছোট ভাই মহারাজা সাদিক খান জাহান-এর সহযোদ্ধা ছিলাম। আমি তাদের জন্য যা করেছি তারা দুজন অবশ্যই সেটার মূল্য দিবে। তারা যদি জানতে পারে যে সামান্য একজন বৃদ্ধ শল্যচিকিৎসক আমার কথা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তবে সে তার যথার্থ প্রাপ্যটাই পাবে। ওকে তুমি শেষবারের মতো বল, সে যাতে আমাকে একটা আয়না এনে দেয়।”

উত্তেজিত হয়ে এতক্ষণ কথা বলার পর লোকটি আরও ক্লান্ত হয়ে গেল। বালিশের ওপর মাথাটি ছেড়ে দিয়ে সে দেখতে লাগল যে তার কথাগুলো ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলা হচ্ছে কি-না। সে দেখল কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তারের আচরণ হঠাৎ করেই বদলে গেল। সে মাথা নিচু করে বিছানায় শোয়া লোকটিকে কুর্নিশ জানাল, এরপর তৃরিত গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, তারপর উজ্জ্বল ফ্রেম-এ বাধাই করা একটা বড় গোলাকার আয়না নিয়ে ফেরত এল। আয়নাটি বেশ বড়, তাই সে এলথুদাকে সাহায্য করতে বলল, যাতে আয়নাটা আড়াআড়িভাবে বিছানার ওপর শোয়া লোকটির মুখের সামনে ধরা যায়।

আয়নায় নিজের চেহারা দেখার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য লোকটি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। উঠে যাওয়া বাম চোখের আইরিশ মরে একেবারে নীল হয়ে গিয়েছে। এর চারপাশে থকথকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। বাম চোখের নিচের গাল-এর চামড়া ও মাংস এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে দাঁত ও ম্যান্ডিবল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ডান কানের উপরে চুল পুড়ে কুঁকড়ে গিয়েছে। মাথার কিছু অংশের চামড়া পুড়ে গাছের খোলসের মতো উঠে গিয়েছে। তাকে দেখতে অনেকটা পচে যাওয়া মৃতদেহের মতোই লাগছে। কিন্তু এরপরেই লোকটা আপনমনে ভাবতে লাগল-তাকে দেখতে আর কেমনই বা লাগা উচিত যেখানে তার বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না? অথচ এক সময় সে জীবনের ওপর দিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে বেঁচে ছিল। যখন যা মন চাইত তাই করত। আনন্দে ডুবে থাকত সবসময়। মদ খেত, জুয়া খেলত, ফুর্তি করত, যুদ্ধ করত। কিন্তু এখন সবকিছু তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার শরীর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তার হৃদপিণ্ড কবরের মতো নীরব হয়ে গিয়েছে। যদিও এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তার ভেতরে এখনও একটা শক্তি কাজ করছে যেটা তাকে আরো একটিবার উঠে দাঁড়াতে এবং সমস্ত কিছুর প্রতিশোধ নিতে ক্রমাগত প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।

লোকটি এলথুদার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু তুমি কী আমার নাম জান?”

“না, স্যার।”

লোকটির থেতলে যাওয়া মুখে এক ধরনের হাস্যকর মুখভঙ্গি ফুটে উঠল। “তাহলে তো তোমাকে আমার নাম বলতেই হয়। আমি অ্যাংগাস কোকরান। একজন গর্বিত স্কটম্যান। আমার উপাধি ছিল আর্ল অফ কুম্বা।”

 এলথুদার চোখ এত বড় বড় হয়ে গেল যে সে যেন ভয়ঙ্কর কিছু দেখছে। “আপনি… আপনিই সেই ব্যক্তি যাকে বুজার্ড নামে ডাকা হতো।”

“হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি। তুমি যদি সেটা জান তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জান যে, আমার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী। হাল কার্টনি নামে এক ইংরেজ যুবক। আ-হা…! তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি যে তুমি আমাকে ভালভাবেই চিনতে পেরেছ, তাই না?”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“আমি তোমাকে আরও বলে রাখি, যেভাবেই হোক এই হাল কার্টনিকে আমি খুঁজে বের করবই। সে যেখানেই থাকুক আর আমাকে যত দূরেই যেতে হোক। আমি তাকে ধ্বংস করেই ছাড়ব। তার রক্তে আমি আমার ঠোঁট রাঙাব।”

*

উত্তর-পূর্ব ইথিওপিয়ার কেবাসা ভূমির সর্বত্র যুদ্ধের ধামামা ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্য উঠার পর থেকে দিনের শেষ আলোকরশ্মিটি দেখা না যাওয়া পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চলেছে। এখন যুদ্ধের ধামামা থেমে গিয়েছে, কিন্তু তার বদলে বিজয়ীদের হর্ষধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে বাতাসে ভেসে আসছে পরাজিত শত্রুদের ক্ষমা প্রার্থনার আর্তনাদ। আহত যযাদ্ধাদের হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র। ক্রিশ্চিয়ান ইথিওপিয়ান সৈনিকেরা তৃতীয় বারের মতো মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে গ্রেট মোগল-এর নির্দেশেই। প্রথম দু’বারের যুদ্ধে তারা জিতলেও ওগুলোতে তাদের ভিত নড়ে উঠেছিল, সেই সাথে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই শঙ্কা জেগেছিল তাদের মনে। কিন্তু এবারের বিজয় তাদের কাছে পরিপূর্ণতা নিয়ে হাজির হয়েছে। শত্রু ঘটির মূলোৎপাটন করা হয়েছে। অস্ত্র-সরঞ্জামসহ যেসব রণতরী ইরিত্রিয়ান উপকূল দিয়ে রেড সী অতিক্রম করতে চেয়েছিল সেগুলোকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ কাজের নেতৃত্ব দিয়েছে গোল্ডেন বাউ নামক ইংরেজদের জাহাজ। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই গোল্ডেন বাউ সাগরে ভাসানো হয়েছিল। কিন্তু এর ক্যাপ্টেন জাহাজটাকে স্বাধীনতা রক্ষা, ইথিওপিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ বা সম্পদ এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী দেশসমূহকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে টেবারনেও রয়েছে সেখানে যিশু খ্রিস্ট মাউন্ট জিউন থেকে পাথর এনে রেখেছিল এবং ধারণা করা হয় হলি গ্রেইলও সেখানে রাখা আছে।

ইথিওপিয়ান লাইনের পেছনে বিশাল এক তাবু গড়ে উঠেছে। ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ ও বর্ম পরিহিত এক দল সৈনিক এটার প্রবেশপথ পাহারা দিচ্ছে। তাঁবুর ভেতরে ট্যাপেস্ট্রিতে খ্রিস্টের জীবনী সমৃদ্ধ বিভিন্ন দৃশ্য শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন রঙের সিল্কের সুতা দিয়ে এগুলো বোনা হয়েছে। অসংখ্য মোমবাতি ও মশালের আলোতে ওগুলো চকচক করছে।

তাবুর মাঝখানে টেবিলের ওপর যুদ্ধক্ষেত্রের একটা মডেল বা মানচিত্র রাখা আছে। পাহাড়, নদী, হ্রদ সমুদ্র, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী মডেলের নির্দিষ্ট জায়গায় এগুলোকে দেখানো হয়েছে। আইভরি পাথর দিয়ে তৈরি অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত যে সৈন্য, অশ্বারোহী এবং ছোট ছোট কামান-এর মডেল এখানে দেখানো হয়েছে সেগুলো দ্বারা যথাক্রমে পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী এবং আর্টিলারি ইউনিটকে বোঝানো হয়েছে। দিনের শুরুতে মডেলগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে দুই বাহিনীর অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছিল, কিন্তু এখন আরব সৈন্যদের সংখ্যা কমতে কমতে টেবিল থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

তাঁবুর পরিবেশ এখন বেশ শান্ত রয়েছে। লম্বা আলখাল্লা পরিহিত একজন যাজক সিনিয়র এক অফিসারের সাথে ঠাণ্ডা আলোচনায় মশগুল রয়েছেন। তার ধূসর রঙের দাড়ি হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে, গলায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন মণিমুক্তা খচিত পুঁতির মালা ও মেডেল। লোকটির মৃদু মন্থর গলার স্বর টেবিলের আশপাশ থেকে আসা উত্তেজনার মাঝেও আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছে।

 “ব্যাং! ব্যাং! টেইক দ্যাট!” একটা ছোট ছেলে চিৎকার করে উঠল। তার হাতে ইথিওপিয়ান যোদ্ধার একটি ছোট্ট মূর্তি যেটা স্ট্যালিয়ন-এর ওপর বসে ছিল। ছেলেটা মূর্তিটাকে একবার টেবিলের একপাশে, পরমুহূর্তে আবার অন্যপাশে নিয়ে যাচ্ছে। এখনো যে সব আরব সৈন্যের মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোকে ছোট্ট স্ট্যালিয়ন আরোহীর সাহায্যে ফেলে দিচ্ছে সে।

গার্ড তাবুর প্রবেশ পথের পর্দাটা সরিয়ে দিলে একজন সৈন্য সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল যার ইউনিফর্মে বুকের ওপর সাদা রঙের লিলেন কাপড় ও বিভিন্ন ধাতব চেইন লাগানো রয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এগুলো দেখেই বোঝা যায় যে কোনো রকম নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে এগুলো পরানো হয়নি। অন্য কোনোরকম বিশেষত্ব আছে এগুলোর।

“জেনারেল নাজেত!” ছোট্ট ছেলেটি চিৎকার করে উঠল। এরপর ছেলেটি তার খেলনা সৈন্যটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে আগন্তুকের ধাতব পোশাক পরিহিত পা জড়িয়ে ধরল-যে পোশাকে এখনো শত্রুর রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে আছে। সেও ছোট্ট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যে দেখে মনে হচ্ছিল, ছেলেটি তার মায়ের নরম আলিঙ্গনে রয়েছে।

জেনারেল তার মাথা থেকে হেলমেটটি সরিয়ে ফেললে ঘন কালো কোকড়া চলগুলো বের হয়ে এল। জেনারেল যখন তাঁর মাথাটা এদিক ওদিক নাড়া দিল, তার কোকড়া চুলগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে আন্দোলিত হতে লাগল। মোমবাতির আলো যখন তার কোঁকড়া চুলগুলোর ওপর পড়ল, তখন দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্ণালি আভা বিকিরিত হচ্ছিল ওখান থেকে। তার চেহারাই বলে দিচ্ছিল যে যুদ্ধের ক্লান্তি বা বিষণ্ণতা কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

নতস্বরে বলা শুরু করল সে, “ইউর মেজেসটি, আপনাকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে আমাদের বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। শত্রু ভূপাতিত হয়েছে, সেই সাথে তাদের বাকি সৈন্যগুলো পালিয়েছে।”

ক্রিশ্চিয়ান অধিপতি, রাজাদের রাজা, গালা ও অ্যামহারার স্বত্বাধিকারী এবং খ্রিস্টীয় ক্রুসিফাইড-এর প্রতিরক্ষাকারী আইয়াসু, জেনারেল-এর পা ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল, এরপর আনন্দের আতিশয্যে উপরে-নিচে লাফাতে লাগল, সেই সাথে চিৎকার করতে লাগল। মিলিটারির সদস্যরা এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক এবং কাঁধে মৃদু চাপ দেয়ার মাধ্যমে তাদের কমরেডকে ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে অভিবাদন জানাল, একই সাথে সেখানে উপস্থিত যাজক হাত তুলে তাকে আশির্বাদ করল।

জেনারেল নাজেত শান্তভাবে মৃদু হাসি দিয়ে সবার ধন্যবাদ ও অভিনন্দন গ্রহণ করল। “মহারাজ, এখন আমি আপনার কাছে কিছু একটা চাইব। এর পূর্বে আমি কমান্ডার হিসেবে আপনার বাহিনী থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার দেশ এবং আমার রাজ্যের টানে তখন আমি যেতে পারিনি। আমার বিবেক তখন আমাকে যেতে দেয়নি। তাই তখন আমি সৈনিকের পোশাক পরে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু মহারাজ, আমি শুধুই একজন সৈন্যই নই, একজন স্ত্রীলোকও বটে, যে একজন পুরুষের আমানত। সে তখন আমাকে আপনার আদেশ পালন করার অনুমতি দিয়েছিল। আর এখন, আমি আপনার কাছে অনুমতি চাইছি তার কাছে ফিরে যাবার।”

ছেলেটি তার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে চিন্তা করার পর বলল, “সেই লোকটি কী ক্যাপ্টেন কার্টনি?”

“হ্যাঁ, মহারাজ”, জুডিথ নাজেত জবাব দিল।

 “গাছের পাতার মতো সবুজ রঙের চোখওয়ালা সেই ইংলিশ লোকটা?”

“ইয়েস, ইউর মেজেসটি। আপনার কী মনে আছে তার সাহস ও কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আপনি তাকে ‘গোল্ডেন লায়ন অফ ইথিওপিয়া হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, আমার মনে আছে” চেহারায় একটা অপ্রত্যাশিত দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে আইয়াসু জবাব দিল। এরপর সে আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী মাম্মি এবং ড্যাডি হতে যাচ্ছ?” ছোট্ট বালক রাজা ঠোঁটের ওপর ঠোঁট তুলে মুখ বাকা করে বোঝার চেষ্টা করল কেন সে এত কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ কেনই বা তার এত দুঃখ লাগছে। এরপর সে আবার বলল, “আমার যদি একটা মাম্মি এবং ড্যাডি থাকত। যদি তুমি এবং ক্যাপ্টেন কার্টনি চলে এসে প্রাসাদে থাক তাহলে আমি একটা মাম্মি এবং একটা ড্যাডি পেতাম।”

“এখন এসব থাক মহারাজা, আমার মনে হয় না…” যাজক বলতে শুরু করল। কিন্তু ছোট্ট মহারাজার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ জেনারেল নাজেত-এর দিকে। নাজেত ছেলেটির খুব কাছে চলে এল, এরপর হাত দিয়ে টেনে জড়িয়ে ধরল।

 আইয়াসু দ্বিতীয় বারের মতো জেনারেল নাজেত-এর কাছে গেল। কিন্তু এবার আর রাজা হিসেবে নয়, একজন সন্তান যেভাবে মায়ের কাছে যায়, ঠিক সেভাবে গেল।

“আমি আপনার পাশেই আছি,” নাজেত ওকে বোঝাতে শুরু করল “কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার যখন ইচ্ছে হবে আপনি কার্টনির জাহাজ দেখতে চলে আসবেন। কী আসবেন না?”

ছোট্ট বালক জোরে জোরে হা-সূচক মাথা ঝাঁকাল।

“আপনি চাইলে কামানের গোলাও ফোঁটাতে পারেন। আপনার ভালই লাগবে,” নাজেত আবার বলল।

 নাজেত টের পেল যে আইয়াসু তার কাঁধে মুখ গুঁজে রাখা অবস্থায় মাথা নাড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে আইয়াসু তার মাথা সোজা করল, এরপর খুবই ক্ষীণ স্বরে বলল, “তুমি ক্যাপ্টেন কার্টনির সাথে অনেক দূরে ভেসে যাবে তাই না?”

“হ্যাঁ, মহারাজা, আমাকে যেতে হবে।”

“প্লিজ, যেও না।” সে বলল, তারপর সে দৃঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, “আমি তোমাকে আদেশ করছি তুমি যাবে না। তোমাকে আমার আদেশ মানতে হবে। তুমি বলেছিলে মানবে।”

এরপর ছোট্ট মহারাজা আরেকবার কাঁদতে কাঁদতে নাজেত-এর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। পাদরী এক-পা এগিয়ে এল তার ছোট্ট সাহেবটাকে বাধা দিতে। কিন্তু নাজেত তাকে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল। “এক সেকেন্ড বিশপ, আমাকে এর সমাধান করতে দিন।”

 সে আইয়াসুকে খানিকক্ষণ কাঁদতে দিল। কিছুক্ষণ পর সে তার চোখের পানি এবং নাক মুছে দিল। এপর সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “আপনি জানেন আপনাকে আমি অনেক পছন্দ করি। তাই না মহারাজা।”

“এখন আমি যেখানেই যাই, যত দূরেই যাই, আমি সব সময় আপনাকে মনে রাখব। আপনার কথা ভাবব। এখন মনে করুন আমি যদি ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স এরকম দূরের কোনো দেশে যাই তাহলে আমি অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখতে পাব। আর যদি আমি দেখতে পাই তাহলে সেগুলো সম্পর্কে আপনাকে লিখে জানাতে পারব।”

“তুমি আমাকে কথা দাও যে তুমি আমাকে চিঠি লিখবে।”

“একজন সৈনিক হিসেবে আমি আমার মহারাজাকে কথা দিচ্ছি।”

“আর যদি আমি ক্যাপ্টেন কার্টনির জাহাজে যাই তাহলে সে কী আমাকে কামানের গোলা ফোঁটাতে দেবে?”

“আমি তাকে আদেশ করব। আমি জেনারেল আর সে সামান্য ক্যাপ্টেন মাত্র। আমার আদেশ তাকে মানতেই হবে।”

মহারাজা আইয়াসু কিছুক্ষণ চিন্তা করল, এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর সে জুডিথ-এর দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “বিশপ ফেসিলাইডস, আপনি কী দয়া করে জেনারেল জুডিথ নাজেতকে বলে দিবেন যে আমি তাকে যাবার অনুমতি দিয়েছি?”

*

আর্ল অফ কাম্বারল্যান্ড জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর-এর নামানুসারে যারা ইস্ট ইন্ডিস-এর লোকদের সাথে বাণিজ্য করেছিল। জাহাজটি চল্লিশ দিন পূর্বে বোষে (মুম্বাই) থেকে ছেড়ে যায় ১০০ টন খনিজ পদার্থ নিয়ে। লন্ডনের বন্দরে গিয়ে এটি নোঙর ফেলবে। সেখান থেকে খনিজ পদার্থগুলো নিয়ে যাওয়া হবে গ্রীনিচ প্যালেস-এর অস্ত্রাগারে। সেখানে এই মিনারেলগুলো সালফার ও কয়লার সাথে মিশিয়ে গান-পাউডার তৈরি করা হবে। সেই গান পাউডার সরবরাহ করা হবে চার্লস-টু-এর আর্মি এবং নেভীতে।

জাহাজের পেছন দিকে যেখানে ক্যাপ্টেন-এর থাকার ঘর সেখানে আরও কিছু কেবিন রয়েছে সিনিয়র অফিসার এবং গুরুত্বপূর্ণ যাত্রীদের থাকার জন্য। এরকমই একটা কেবিনে এক লোক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে দুই হাত জড়ো করে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে।

তার নাম উইলিয়াম পেট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিনিয়র অফিসার হিসেবে সমস্ত কাগজপত্র সে সাথে করে নিয়ে এসেছে, ফলে কোম্পানির কাজে কোম্পানির যে-কোনো কর্মচারী তাকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে।

বোম্বের (মুম্বাইর) প্রথম গর্ভনর জেরাল্ড আংগিয়ার-এর আমন্ত্রিত এক ডিনারে পেট আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর নাবিক ক্যাপ্টেন রুপার্ট গোডিংস-এর সাথে আলোচনায় মগ্ন রয়েছে। সে এখন তাকে ব্যাখ্যা করছে যে ইন্ডিয়ায় তার কাজকর্ম সমাপ্ত হয়েছে। কাজটা অনেক সূক্ষ্ম এবং কঠিন ছিল, বিশেষ করে প্রসিদ্ধ ইন্ডিয়ান এবং পর্তুগীজ লোকদের সাথে উঠাবসা করা, টাকা-পয়সা আদান-প্রদান করা। যদিও এ ব্যাপারে খুব খোলামেলা আলাপ করার স্বাধীনতা তার নেই।

 “পৃথক হয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন,” পেট অন্য লোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল।

 গোডিংস খুব লম্বা মোটাসোটা, উচ্ছ্বসিত এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ। তার নাকের নিচে কালো ঘন গোঁফ বেঁকে ঠোঁটের কোণ থেকে একটু উপরে উঠে গিয়েছে। এই গোফের কারণে তাকে আরও তরুণ লাগছে এবং প্রকৃত বণিক হিসেবে তার সমাদর বেড়েছে। তাকে একজন দক্ষ নাবিকই বলা যায়। এটার কারণ তার অসীম সাহসিকতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনোভাব। যদিও তার কাছের বন্ধুরা এটা মেনে নিতে নারাজ। লোকটা তার চেহারায় খুব চিন্তিত একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে জবাব দিল, “অবশ্যই, অবশ্যই…আমার মতে পর্তুগীজ এবং ইন্ডিয়ানরা খুব একটা সুবিধার না। এরা হচ্ছে সুস্বাদু খাবারের মতো। কিছু সময়ের জন্য রক্ত গরম করে।”–

“তাদের সাথে আমার যে কথাবার্তা হতো আমি প্রতিনিয়ত তার প্রোগ্রেস রিপোর্ট পেশ করতাম,” পেট বলতে লাগল। কিন্তু এখন যেহেতু তাদের সাথে ব্যাপারটা শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিরেক্টর-এর কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করতে হবে।”

‘বুঝতে পেরেছি। জন কোম্পানির যত দ্রুত সম্ভব সব কিছু জানা দরকার, তাই তো? আমার তো মনে হয়, তোমার জন্য সসেজ-এ একটা শোয়ার মতো বেঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে।”

 অন্যমনস্কতার কারণে কথাটা বুঝতে পারলো না পেট। “আমি দুঃখিত ক্যাপ্টেন। সসেজ কী? আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।”

গোডিংস হাসতে হাসতে বলল, “ওহ্! দুঃখিত। আমি ভেবেছিলাম তুমি জানো। কাম্বারল্যান্ড জাহাজের অপর নাম এটা। তারা এখানে সসেজ বানায়। আমি নিজে একজন ডেভোনশায়ার-এর লোক। যাই হোক এই কারণেই আর্ল অফ কাম্বারল্যান্ড-এর নাম সসেজ। আমি খুব অবাক হলাম যে, কোম্পানির লোক হিসেবে তুমি এটা জান না।”

“আসলে আমি সবসময় অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু আপনার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। আমি খুবই খুশি হব যদি জাহাজে একটা বেঞ্চ পাই। আর যাত্রার খরচ বহন করার মতো টাকা আমার কাছে আছে। ষাট গিনিতে হবে না?”

“অবশ্যই হবে”, গোডিংস বলল এবং নিজে নিজে ভাবতে লাগল যে মি. পেট-এর ব্যাপারে কোম্পানির আরও মনোযোগ দেয়া উচিত। তাকে আরও সুযোগ সুবিধা দেয়া উচিত। “উপরে চল।”

পেট হাসল, সে মনে মনে ভাবছে, গোডিংসকে খুন করার জন্য তাকে যে পাঁচশ গিনি অফার করা হয়েছে সেটা উপার্জন করা এখন কতই না সহজ হয়ে গেল! অনেক নির্বোধ লোককে পেট যেরকম দেখেছে গোডিংসও তার ব্যতিক্রম নয়-সেও নিজেরই নির্বুদ্ধিতার শিকার। এরকম অজ্ঞতা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। গোডিংস মনে করছে যে ডিরেক্টর-এর অল্পবয়সি সুন্দরী বউ-এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে সে ডিরেক্টরকে ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে সে বুঝতে পারবে যে কত বড় ভুল সে করেছিল।

আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর একেবারে উপরে উঠে পেট তার কাজ শুরু করার আগে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে কিভাবে চলতে হয়, কিভাবে নিজের ভারসাম্য রাখতে হয় এটা তাকে আরও ভালভাবে শিখতে হবে। জাহাজটা কিভাবে বানানো হয়েছে, কোথায় কোনটা আছে সেটা আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে হবে। বন্ধুত্ব, বৈবাহিক সম্পর্ক এবং জানা অজানা শত্রুর ব্যাপারে তাকে আরও সচেতন হতে হবে। এই সম্পর্কগুলো যাতে কোনোভাবে তার কাজে ব্যাঘাত না ঘটায়। সর্বোপরি, সে অদৃশ্য এক সংকেত এর জন্য অপেক্ষা করছে, যে সংকেত ছাড়া সে হত্যা করতে পারবে না। স্বর্গীয় এ সংকেত তার মস্তিষ্কে প্রেরিত হলেই সে বুঝতে পারবে যে তার হত্যা করার সময় এসেছে। ওর মাথার ভেতর যে লোকটি কথা বলেছিল, সে তাকে বলেছিল, যেই লোকটিকে তার হত্যা করতে হবে, তার মতো লোকের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। স্বর্গীয় কণ্ঠটা এও বলেছিল যে, সে যদি এই লোকটিকে হত্যা করে তবে সে দুনিয়া থেকে কিছু পাপ মুছে ফেলতে পারবে।

পেট এখন প্রতিরাতে কেবিনের উপরের পাটাতন থেকে ঝুলন্ত এক কাঠের দোলনায় ঘুমায়। জাহাজ নড়াচড়ার সময় সে যাতে পড়ে না যায় এ কারণেই সে এরকম ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন সে তার দোলনার ন্যায় বিছানায় হাঁটুগেড়ে বসে ধ্যানমগ্ন হয়েছে। কারণ সে জানে যে সমস্ত ফেরেশতা এবং স্বর্গীয় দূতেরা সবসময় তার কাজকর্ম দেখাশোনা করছে। ধ্যানরত অবস্থা যতক্ষণ তার মধ্যে এই অলীক দৃষ্টি স্থায়ী হয়, ততক্ষণ সে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে যে আনন্দ সে কোনো নারীর সঙ্গের চেয়েও বেশি উপভোগ করে। যখন সে এই দৃষ্টি থেকে জেগে উঠে, তার মন এক ধরনের স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরে থাকে এই ভেবে যে সে তার সৃষ্টিকর্তার জন্য কাজ করছে।

সে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে সামান্য একটা ছুরি, যেটা সে গোডিংস আর তার সিনিয়র অফিসারদের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার সময় তুলে নিয়েছে। ছুরিটাকে সে আবার শান পাথর দিয়ে ধারালো করে নিয়েছে, তাই এখন এটাকে আর সামান্য ছুরি বলা যায় না। বরং এটাকে এখন ড্যাগার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই শান পাথরটা সে জাহাজের একটা স্টোর রুম থেকে নিয়েছে। যখন পেট গোডিংসকে ছুরি দিয়ে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঠিক তখনই সে একটা ফন্দি এঁটেছিল। গোডিংস-এর সাথে জাহাজের এক কর্মচারীর সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল তার দুর্ব্যবহারের কারণে। সে যদি এরকম একটা ছুরি দিয়ে গোডিংসকে খুন করে তবে খুব সহজেই এর দায়ভার ওই কর্মচারীর ওপর বর্তাবে। কারও মনে সন্দেহ থাকবে না যে ওই কর্মচারী প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই এই কাজ করেছে। তার পক্ষে একটা কথা বলার মতো কোনো বন্ধুও বেচারা খুঁজে পাবে না। পেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে নিজেই ঐ বেচারার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে। তবে সেটা পরের ব্যাপার সে তার ডান পকেটে ছুরিটা রেখে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এল, এরপর হেঁটে গিয়ে ক্যাপ্টেন-এর দরজায় কড়া নাড়ল।

“ভেতরে এসো”, গোডিংস ডাক দেয়। জাহাজের ভেতর ভিন্ন সংস্কৃতির দুজন মানুষের সন্ধ্যাবেলা ব্রান্ডি পান করতে করতে গল্প করাটা তার কাছে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় না। সেই সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্তরোত্তর সাফল্য এবং সম্পদ বৃদ্ধির কথা নিয়ে গল্প করাটাও তার কাছে সঠিক বলেই মনে হয়।

দুজন লোক তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলছিল, সেই সাথে অনবরত মদ্যপান করছিল। যদিও পেট অপেক্ষা করছিল আঘাত হানার সুযোগের জন্য। অপেক্ষা করতে করতে একসময় সেই মোক্ষম সময় চলে এল। এরইমধ্যে গোডিংস মদ্য পান করতে করতে মাতালের একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। পেট সচেতনভাবেই গোডিংস-এর মতো এতটা মদ্যপান করেনি। সে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা কাঠের বক্স থেকে ব্র্যান্ডি বের করতে গেল। ঐ কাঠের বাক্সে ছয়টা আলাদা কম্পার্টমেন্টে বিভিন্ন স্বাদের ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ডি রাখা আছে।

গোডিংসও উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে পেটকে খেয়াল না করে মদ ঢলবার পাত্র খুঁজতে লাগল। ছুরিটা বের করে আস্তে আস্তে তার দিকে এগুতে লাগল পেট। যখনই গোডিংস-এর ডান পাশের কিডনিতে আঘাত করতে যাবে সে, তখনই গোডিংস ফিরে তাকালো।

কিন্তু এতেও পেট-এর কাজে কোনো বাধা পড়ল না। সে তার ভিক্টিম-এর প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা অভিব্যক্তি এবং প্রতিটা নিঃশ্বাস সম্পর্কে সচেতন। গাডিংস চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল। সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে তার কপালে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে। পেট এরই মধ্যে গোডিংস-এর পেটে পরপর তিনবার ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। এরকম আকস্মিক ঘটনায় ক্যাপ্টেন এতই বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়েছে যে সে অ্যালার্ম বাজাতে বা ব্যথায় চিৎকার করতেও ভুলে গিয়েছে। তার বদলে সে পেটে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো নিচে বসে পড়ে হামাগুড়ি দিতে লাগল। তার সাদা ওয়েস্ট কোট রক্তে ভিজে গিয়েছে। তার মূত্রথলি খালি হয়ে গিয়েছে ভয়ে।

গোডিংস তার সর্বশেষ শক্তিবিন্দু দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করল। মদের পাত্রটা শক্ত করে ধরে পেট-এর দিকে নিক্ষেপ করল সে। কিন্তু সচেতন পেট নিজেক সরিয়ে নিল আগেই। গোডিংস-এর নিক্ষেপ করা পাত্র ডেস্ক-এর উপরে ঝুলানো লণ্ঠনে গিয়ে আঘাত করল। সাথে-সাথে লণ্ঠনটা ভেঙে এর সমস্ত তেল পড়ে গিয়ে দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ডেস্ক-এর ওপর কাগজ-পত্র ছড়িয়ে থাকাতে সেগুলোতে আগুন লেগে বার্নিশ করা কাঠে এবং মেঝেতে আগুন ছড়াতে খুব একটা সময় লাগল না।

পেট একটুও নড়ছে না। সে এখনো অবাক হয়ে ভাবছে যে সে কী করেছে। স্থবির হয়ে কেবিন-এর ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল সে। যদিও আগুন তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেই সাথে নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে তার। পালস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, ঠিক যেভাবে গোডিংস তার জীবনের শেষ সময় পার করছে এখন। অবশেষে, গোডিংস যখন তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল তখন যেন পেট-এর হুশ হলো। তার কাছে মনে হলো যেন সে অনেক গভীর একটা ঘুম থেকে উঠেছে। নড়াচড়ার জন্য প্রস্তুত হল সে।

পেট খুব ভাল করেই জানে সমুদ্রের ওপর আগুন কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আর…কোনো জাহাজে যদি খনিজপদার্থ বোঝাই করা থাকে, সেই সাথে কামানের গোলাতে গান-পাউডার ভরা থাকে, তবে সেটাকে বিশাল আকৃতির একটা বোমা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। এতক্ষণে ফিউজ-এর মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছে। এখন যে করেই হোক পেটকে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড ত্যাগ করতে হবে-যত দ্রুত সম্ভব। তার মতো গোডিংস কাঠের ঝুলানো বিছানায় ঘুমাত। সে যত দ্রুত সম্ভব হুক থেকে কাঠের বিছানাটা খুলে ফেলল। এরপর সেটা জানালা দিয়ে বহু কষ্টে সমুদ্রে নিক্ষেপ করল যাতে সে ওটার ওপর ভেসে থাকতে পারে। এরপর সে নিজে জানালায় উঠে লাফ দিল।

গরম বাতাসের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে পড়ার পর তার বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না যে সে এখন কোথায় আছে। তার মনে হল সে ইন্ডিয়া এবং কেপ অফ গুড হোপ-এর বাইরে অন্য কোথাও আছে। সে এখনও বুঝতে পারছে না যে সে ভেসে থাকার জন্য আদৌও কাঠের বিছানাটা খুঁজে পাবে। এমনও হতে পারে যে এটা ঢেউয়ের সাথে অন্য কোথাও ভেসে গিয়েছে। সমুদ্র তার ভাগ্যে কী পরিণতি রেখেছে এটাও সে জানে না। তাকে হত্যা করার জন্য কেউ ওত পেতে আছে, নাকি তাকে খাওয়ার জন্য কোনো কিছু ওত পেতে আছে, সে জানে না। সবচেয়ে বড় কথা, সে নিজে সাঁতার কাটতে জানে না।

যাই ঘটুক না কেন, সেটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। উইলিয়াম পেট সেই অলৌকিক বাণীর জবাব দিয়েছে। সে যা করছে, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই করছে। সে কারণে কোনো কিছুই তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত।

*

দিনের প্রথম আলোকরশ্মি যখন মিতসিওয়ার হারবার পোতাশ্রয় অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে তখন ব্রিটিশ দ্বীপের ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ সময় উড়িয়ে খুব গৌরবান্বিত হয়ে ইথিওপিয়ান যুদ্ধ জাহাজটা নোঙর করল। গোল্ডেন বাউ জাহাজটি তৈরি করা হয়েছে জর্জ ভিসকাউন্ট উইন্টারটন এর আদেশে-দুই হাজার পাউন্ড দামের অবিশ্বাস্য খরচে। উইন্টারটন এরই মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক জাহাজ এবং যুদ্ধ-জাহাজ-এর মালিক হয়েছেন। বাউ তৈরির ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল তার প্রাণপ্রিয় পুত্র ভিনসেন্টকে একটা গ্রহণযোগ্য জাহাজ উপহার দেয়া। সমুদ্র ভ্রমণে তাদের যে পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে সেটা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই এটা তৈরি করা হয়েছে। আর এটা তৈরির মাধ্যমে ইংল্যান্ড-এর ভাগ্যে এক নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে।

 সেই মাননীয় ‘ভিনী” উইন্টারটন এখন কেপ অব গুড হোপ-এর উত্তরে ইন্ডিয়ান সাগরের পাশে এলিফ্যান্ট লেগুন-এর উপকূলে শায়িত রয়েছেন। তাকে ডুয়েল লড়ার সময় নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। যদিও তার বাবা টাকা-পয়সা খরচে কোনো কার্পণ্য করেনি। এমনকি এই গোল্ডেন বাউ যেটা আফ্রিকান নেভীদের প্রধান যুদ্ধ জাহাজ ছিল সেটাও তার পুত্রের মৃত্যুর চেয়ে। বড় না।

গোল্ডেন বাউ দেখতে রেসের ঘোড়ার মতই সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর। সে, যে কোনো গতিতে পানি কেটে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। বাতাসের সাহায্য পেলে পাল ভোলা অবস্থায় ওটা যেকোনো যুদ্ধ জাহাজকে ধোকা দিয়ে পালিয়ে আসতে পারে, সেই সাথে তার চেয়ে বেশ কিছুদূর সামনে এগিয়ে থাকা জাহাজকে তাড়া করে ধরে ফেলত পারে খুব সহজেই। রেসের ঘোড়ার দক্ষ জকির মতো গোল্ডেন বাউও এমন একজন যোগ্য ক্যাপ্টেন পেয়েছে যে কি-না ভয়ংকর দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও গোল্ডেন বাউকে দৃঢ়তার সাথে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যেখানে অন্য যুদ্ধ জাহাজগুলো তাদের ভারসাম্য ধরে রাখতেই রীতিমত হিমশিম খায়।

গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে হাল কার্টনিকে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে; কখনো বা বায়ুহীন পথে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিশাল জলরাশির বুকে, কিংবা কখনো ভয়াবহ মেইলস্টর্ম-এর রাতে একাকী হাতে জাহাজটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে সম্পূর্ণ সাহস আর দৃঢ়তার ওপর ভর করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, জাহাজের পাটাতন থেকে শুরু করে রাডার পর্যন্ত সবকিছুই তার ভালভাবে চেনা আছে। হাল খুব পরিষ্কারভাবেই জানত যে কঠিন বিপদের সময় জাহাজটাকে কিভাবে চালিয়ে নিতে হয়। হাল জানত যে জাহাজ ভাসানোর সময় কিভাবে এর কামানের গান-পাউডারগুলোকে ব্যালেন্স করতে হয়। কেউ কেউ হয়ত দ্রুত চালানোর জন্য অল্প কিছু বন্দুকের ওপর নির্ভর করে আবার কেউ কেউ ফায়ার পাউডার এর ওপর নির্ভর করে। গোল্ডেন বাউ-এর গতি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট কামান এবং গান পাউডার মজুদ রেখেছে হাল কার্টনি। তার জাহাজে যে মাপের কামান থাকা দরকার ঠিক সেই মাপের কামানই সে বেছে নিয়েছে। এক বাক্যে, মারাত্মক সব অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং কামানের সংগ্রহশালা বলা যায় তার জাহাজটাকে। যে-কোনো শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য তার জাহাজ সদা সর্বদা প্রস্তুত। বাউ-এর বাহুগুলো যেমন দ্রুতগামী দাঁতগুলোও তেমনি শক্ত। আর এ কারণেই জাহাজটার ক্যাপ্টেন ওটাকে এতটা সম্মান ও প্রশংসার চোখে দেখে।

 ফলে স্বাভাবিকভাবেই, ক্যাপ্টেন যখন তার এতদিনের ভালবাসার জাহাজটাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল তখন সে চাইছিল ওটা যেন তার সেরা রূপেই থাকে। চারমাস আগে হাল যখন আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সমুদ্রভ্রমণে বের হয় তখন জুডিথ নাজেত তার সাথে গোল্ডেন বাউতেই ছিল। কিন্তু তখন অপ্রত্যাশিতভাবে জুডিথের ডাক আসে রাজার কাছ থেকে-তাকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। জুডিথ যদিও খুব অল্প সময় জাহাজে ছিল, কিন্তু ওইটুকু সময়েই জাহাজের সমস্ত নাবিকের প্রশংসায় ভেসে গিয়েছিল সে। যুদ্ধক্ষেত্রে তার অবদান যেমন নাবিকদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল ঠিক তেমনি আকর্ষণ করেছিল তার অপার সৌন্দর্য। সে যখন তার তলোয়ার এবং বর্ম নামিয়ে রাখতে, কেবল তখনই তাকে পরিপূর্ণ এক মানবী বলে মনে হতো।

জুডিথ চলে যাওয়ার পর হাল তার লোকদেরকে জাহাজ মেরামত করার আদেশ দিয়েছিল। ক্যাপ্টেনের আদেশ পেয়ে তার লোকেরা জাহাজ মেরামতের কাজ শুরু করে দেয়।

পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে কর্মচারীরা জাহাজের পাশে দড়িতে ঝুলে ঝুলে কাজ করেছে। ঘষে ঘষে প্রতিটা কাঠ পরিষ্কার করেছে, রং করেছে, পেরেক ইকেছে। এতদিনের পুড়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া অংশ, রঙের দাগ, ছিঁড়ে যাওয়া পাল, প্রতিটা চিহ্ন বাউ-এর নাবিকেরা নিশ্চিহ্ন করেছে নতুনভাবে মেরামতের মাধ্যমে। জাহাজটার প্রতিটা কাঠের প্রতি নজর দেয়া হয়েছে। যেটা বদলানোর প্রয়োজন সেটা বদলানো হয়েছে। ঘষে ঘষে সবকিছু পরিষ্কার করা হয়েছে। গ্রিজিং করা হয়েছে, আলকাতরা লাগানো হয়েছে, রঙ করা হয়েছে, যেখান দিয়ে পানি ঢুকার মতো সম্ভাব্য ছিদ্র দেখা গিয়েছে সেটা বন্ধ করা হয়েছে খুব ভালভাবে। তারা তাদের সম্মানিত অতিথিদের জন্য যতটুকু করা দরকার তার একটুও বাদ রাখেনি। তারা জাহাজের প্রতিটা বন্দুক, প্রতিটা কুঠার, প্রতিটা বর্শা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করেছে চকচক করার আগ পর্যন্ত।

সব পরিষ্কার করা সম্ভব হলেও এক জায়গায় বিশেষ রক্তের দাগ পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত সেই রক্তের দাগ ছিল এক আরব সৈন্যের যার উরুতে গুলি লেগে রক্তনালী ছিঁড়ে যায়, এরপর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মাস্তুলের কাঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। কাঠ সেই রক্ত এমনভাবে শুষে নেয় যে কাঠের রংটাই বদলে যায়। হাল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের সেই রক্ত মুছতে বলে। কিন্তু রক্ত এমনভাবে কাঠে লেগেছিল যে ঘষতে ঘষতে যখন কাঠের একটা পরদ উঠিয়ে ফেলা হলো তখনও রক্তের দাগ থেকে গিয়েছিল।

 মিতসিবা হারবার পোতাশ্রয়-এর চারপাশটা বালির চর দিয়ে ঘেরাও করা। হাল তার লোকদের নির্দেশ দেয় সেই বালি উঠিয়ে এনে রক্তের দাগের ওপর ফেলতে, তারপর বালি দিয়ে ঘষে সেই রক্ত পরিষ্কার করতে।

 হাল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে নিজেও হাটুগেড়ে বসে রক্ত পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। কারণ সে বিশ্বাস করে, যে কাজ কেউ নিজে করতে পারবে না, সে কাজ তার অধীনস্ত লোকদের করতে আদেশ দেয়া উচিত নয়। অবশেষে পরিষ্কার করতে করতে জাহাজের ডেকটা চাঁদের আলোতে চকচক করতে থাকে। জাহাজের ডেক থেকে যখন চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয়, যেন একটা রঙিন আভা জাহাজটাকে ঘিরে রেখেছে।

হাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ভালবাসার মানুষটির ফিরে আসাটাকে একটা আনন্দপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকেরা খুব শক্ত হাতে জাহাজটাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, প্রাণবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধের ময়দানে তার সহকর্মীদের মরে যেতে দেখেছে, সাগরে ভেসে যেতে দেখেছে। এখন তাদের আনন্দ করার সময়। পেটপুরে খাওয়া দাওয়া করার সময়। হাল তাদের আনন্দের মাত্রাটা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করতে চায়। একারণে আজকের দিনটি সবার কাছেই আনন্দের দিন।

হাল সিদ্বান্ত নিয়েছে যখন সে বিয়ে করবে তখন কোনো ইংলিশ চার্চ-এ খ্রিস্টান পুরোহিতের দ্বারা বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবে। যদিও এখনো জানে না সে কবে বিয়ে করবে। সে এবং জুডিথ সারাজীবন একসাথে কাটানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। হাল এর পূর্বেও ভালবেসেছে। সে ভালবাসার তিক্ততা বা হারানোর ব্যথা জানে। কিন্তু জুডিথ-এর মতো স্থায়িত্ব বা নিশ্চয়তা এর পূর্বে সে কারও জন্য অনুভব করেনি। সে শুধুই তার। এই মেয়েটিই একদিন তার ভবিষ্যৎ সন্তানের মা হবে। এইটুকুই একজন পুরুষের জন্য অনেক কিছু।

উষালগ্নে হালকে দেখা গেল পুপ রেইল-এর ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে যেখান থেকে সে জাহাজের প্রতিটা মাস্তুল এবং প্রতিটা বেঞ্চ দেখতে পাচ্ছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে সে পুরো জাহাজটিকে খুব সহজেই তার নির্দেশ অনুযায়ী চালাতে পারে। যদিও এখন পালগুলো গুটিয়ে রাখা হয়েছে, জাহাজটাও স্থির আছে। হাল একটু দূরে উপকূলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি দেখছে। তারা চামড়া ছাড়ানো মৃত ছাগল, গরুর মাংস আর মুরগি দিয়ে তাদের নৌকো বোঝাই করছে। সাথে আরও নানান ধরনের জিনিসপত্র তারা নৌকোয় তুলছে-ঝুড়ি ভর্তি সবজি, ফলমূল আর বড় বড় পোড়ামাটির পাত্র যেগুলো ভর্তি করা হয়েছে ওয়াট দিয়ে। ওয়াট হচ্ছে ইথিওপিয়ার জাতীয় খাবার। বিভিন্ন সবজি এবং মাংস সেদ্ধ করে এটা তৈরি করা হয়। ইনজেরা দ্বারা তৈরি পাউরুটি দিয়ে এটা পরিবেশন করা হয়। বস্তা ভর্তি কফির বীজ আর বাক্স ভর্তি রেড ওয়াইন-এর বোতলও নৌকোয় তুলছে তারা। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের চমৎকার সব ফুল এবং বাণ্ডিলও ওরা নৌকোয় তুলছে।

হাল বেশ কিছুক্ষণ ধরে দূরের এইসব হৈ হট্টগোল দেখল। যদিও তার বয়স মাত্র বিশ বছর কিন্তু পরিণত পুরুষের মতই ব্যক্তিত্ব বা বিচার বোধ সে এরই মধ্যে অর্জন করেছে। সমুদ্রযাত্রা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের কারণেই সে এসব অর্জন করতে পেরেছে। তাই তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সিরাও বিনা দ্বিধায় তার আদেশ পালন করতে বাধ্য হয়।

তার ধূসর দাগবিহীন ঘন কালো চুলগুলো-যেগুলো সে এখন মাথার পেছন দিকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে-একদম সেই আগের মতই আছে। ঠিক যেমনটা আছে সেই সবুজ রঙের চোখগুলো যেগুলো দেখে মহারাজা আইয়াসু বিস্ময়াবিভূত হয়েছিলেন। যদিও সবকিছু আগের মতো নেই; এই কয়েক বছর আগেও তার মধ্যে যে প্রায়-নারীসুলভ কোমল সৌন্দর্যটুকু ছিল, সেটার কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে তার পিঠে এখনো রয়ে গিয়েছে কালো কালো দাগ, যেগুলো সে উপহার পেয়েছিল ডাচদের বন্দি হয়ে থাকার। ডাচদের কাছে বন্দি থাকাকালে দাসত্বের চেয়েও বেশি কষ্টকর ছিল তার জীবন। তার অভিজ্ঞতাগুলোই তাকে আরো কঠোর, আরো সহিষ্ণু বানিয়েছে যেটা তার ছায়া তার চোয়ালকে করে তুলেছে দৃঢ়, মুখের অভিব্যক্তিকে করেছে কঠোর, দৃষ্টিকে করেছে অন্তরভেদী।

জাহাজের পাশ কেটে যাওয়া জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে আপনমনেই বলে উঠল, “ইস! আজ যদি আমার বাবা-মা এখানে থাকতেন তাহলে তাদেরকে জুডিথকে দেখাতে পারতাম। যদিও আমি মায়ের চেহারা মনে করতে পারি নে। তিনি যখন মারা যান তখন আমি খুবই ছোট। কিন্তু আমার বাবা…” হাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। “আমার মনে হয়…তিনি বুঝতেন যে আমি সঠিক কাজটাই করছি…আশা করি…তিনি অন্তত আমাকে খারাপ ভাবতেন না।”

“অবশ্যই না,” পাশ থেকে একটা নতুন কণ্ঠ বলে উঠল। “সবসময়ই সে তোমাকে নিয়ে গর্বিত ছিল গান্ডওয়েন। শেষ সময়ে সে তোমাকে কী বলেছিলেন সেগুলো মনে করার চেষ্টা কর।”

হাল কথা বলতে পারছিল না। তার মনের চোখে শুধু ভেসে উঠছিল তার বাবার গলিত পচা লাশ কেপ কলোনীতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। স্যার ফ্রান্সিস কার্টনিকে জলপথে মিথ্যে ডাকাতির অভিযোগে ডাচরা এই শাস্তি দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল এইভাবে শাস্তি দিলে তারা গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে, কিন্তু স্যার ফ্রান্সিস ভেঙে পড়েননি। তিনি তার শত্রুদের মনের আশা পূরণ হতে দেননি। একদিকে স্যার ফ্রান্সিস ফাঁসিতে ঝুলছিলেন, আর অন্যদিকে ছোট্ট হাল তা অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।

“মনে আছে তোমার, সে শেষ মুহূর্তে কী বলেছিল?” ভদ্র কিন্তু জোরালো কণ্ঠটা আবারো বলে উঠল।

উত্তরটা দেয়ার আগে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হাল। “তিনি বলেছিলেন যে, আমি তারই রক্ত, তার স্বর্গীয় প্রতিজ্ঞা। এবং… এরপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “গুডবাই, মাই লাইফ।”

“আমার ধারণা, তুমি উত্তর পেয়ে গিয়েছ। তোমার বাবা তোমাকে দেখছেন। আমিই তাকে তার চিরবিদায়ের স্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি দেখেছিলাম যে কিভাবে সে খোলা চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। তুমি যেখানেই থাক সে সবসময়ই তোমাকে দেখছে।”

“ধন্যবাদ, অ্যাবোলি,” হাল বলল।

সে প্রথমবারের মতো তার পিতার খুব কাছের মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তাকে পিতৃস্নেহে আগলে রাখার মতো এখন একমাত্র এই লোকটিই আছে। অ্যাবোলি অ্যামাডোড়া উপজাতির সদস্য, যে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলবর্তী জঙ্গলে অনেক দিন কাটিয়েছে। তার মাথার প্রতিটি চুল আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। যে কারণে তার মাথার চামড়াটা চকচক করছে। তার মুখে অনেক শুকিয়ে যাওয়া কাটা দাগ আছে। শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এসব দাগ কাটা হয়। তার এবং তার ভাইয়ের মুখে একটা ঐতিহ্যবাহী চিহ্নও রয়েছে। চিহ্নের মাধ্যমে তাদেরকে মনোমাপাটাপির পুত্র হিসেবে চেনা যায়, যে হচ্ছে তাদের উপজাতির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। যখন তারা দুই ভাই-ই ছোট তখন একবার তাদের গ্রামে দাস বিক্রেতারা আক্রমণ চালায়। অ্যাবোলি’র ভাইকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু অ্যাবোলির সেই সৌভাগ্য হয়নি। এরপর স্যার ফ্রান্সিস মুক্ত করার আগ পর্যন্ত তার অনেক বছর দাসত্বের জীবন কাটাতে হয়েছে, আর সেকারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়েছে।

‘গান্ডওয়েন’ ডাকনামটা অ্যাবোলির দেয়া, যার অর্থ হচ্ছে- বনের ইঁদুর। হাল-এর বয়স যখন চার বছর তখন এই নামটা দেয়া হয়। অ্যাবোলি তাকে এখনো সেই নামেই ডাকে। গোন্ডেন বাউ-এর আর কেউই তাদের অধিনায়কের এত কাছাকাছি আসতে পারেনি শুধু অ্যাবোলি ছাড়া। পাতলা গড়নের লোকটা বেশ লম্বা, মাংসল পেশিসম্পন্ন। ভয়াবহ চেহারার কারণে তাকে অন্য সবার চেয়ে বেশ আলাদাভাবেই চেনা যায়। তলোয়ার চালানোর যত খুঁটিনাটি আছে সবকিছুই হাল শিখেছে অ্যাবোলির কাছ থেকে। তলোয়ার যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হারাতে হলে শুধু পা চালানো শিখলেই হবে না। প্রথমে প্রতিপক্ষকে জানতে হবে। প্রতিপক্ষকে হারাতে হলে প্রথমে তার যুদ্ধের নীতি জানতে হবে। এসবই সে শিখেছে অ্যাবোলির কাছ থেকে। যদিও শিক্ষাটা কঠিন ছিল। হালকে বেশ কয়েকবার আহত হতে হয়েছে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে। কিন্তু অ্যাবোলি যদি সেই ছোট্ট বালকটির ওপর কঠোর হয়েও থাকে, সেটা হয়েছে কেবল ছেলেটির বাবার ইচ্ছেপূরণের জন্যই।

সেই সব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে মৃদু হেসে হাল বলতে শুরু করল, “আপনি জানেন, আমি এই জাহাজের মাস্টার হতে পারি, কিন্তু যতবারই আমি এই পাটাতনের ওপর দাঁড়াই, আমার মনে হয় যেন আমি লেডী এডউইনাতে ফিরে গিয়েছি, অজানা ভুলের কারণে বাবার শাস্তি ভোগ করছি। আপনার কী মনে আছে সূর্য দেখে জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করতে আমার কতটা সময় লেগেছিল? যখন প্রথমবার আমি চেষ্টা করতে যাই তখন ব্যাকস্টাফটা আমার চেয়ে বড় ছিল। আমি একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঘামছি তো ঘামছি। যতবার জাহাজ নড়ে উঠছিল মনে হচ্ছিল লাঠিটা আমাকে ছিটকে ফেলে দিবে।”

দূরে তাকিয়ে অ্যাবেলিও একটা বড় হাসি দিল যেটা দেখে হাল আবার বলতে শুরু করল, “আমাকে লাটিন শেখানোর কথা আপনার মনে আছে? ল্যাটিন শিখিয়েছিলেন কারণ এটা নাকি ভদ্রলোকদের ভাষা! আপনি ভাবতেও পারবেন না যে আপনি কতটা ভাগ্যবান। আপনাকে কখনো জেরাল্ড শিখতে হয়নি, কখনো অ্যাব্লেটিভ অ্যাবসলিউট শিখতে হয়নি। জাহাজের প্রতিটা পালের নাম মনে না রাখার অপরাধে কেউ আপনার কানের নিচে সজোরে লাগিয়ে দেয়নি। এমনকি আমি যদি কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতামও, তিনি সাথে সাথেই আমার আরো একশটা ভুল ধরিয়ে দিতেন। ঠিক এই জায়গাটাতে…এই পাটাতনের ওপরেই ব্যাপারগুলো হতো…সমস্ত নাবিকদের সামনে।”

হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেল হাল। “আপনি জানেন, সত্যি সত্যিই সে সময় আমি তাকে খুব ঘৃণা করতাম।”

“হ্যাঁ, সে যা করেছে তা জেনে বুঝেই করেছে। সে জানে যে তুমি তাকে ঘৃণা করতে পারো, তবুও সে তোমার সাথে ইচ্ছে করেই ওরকম করেছে। এটাই তার ভালবাসার প্রমাণ।” অ্যাবোলি বলতে লাগল, “তোমার বাবা তোমাকে ভালভাবে প্রস্তুত করতে চেয়েছিল। সে তোমার প্রতি কঠোর হয়েছে যাতে তুমি সময়ের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে হেরে না যাও।” আফ্রিকান লোকটা হেসে আবার বলল, “যদি সৃষ্টিকর্তা চান তাহলে তুমিও হয়তো একটা ছোট্ট কার্টনি পেতে যাচ্ছে, যার ওপর তুমি কঠোর হতে পারবে।”

হাল স্মিত হাসল। একজন স্বামী বা একজন পিতা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য সেও কঠিন সময় পার করছে। “আমি পিতা হওয়ার জন্য প্রস্তুত কি-না আমি বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমি এটা ভেবেও অবাক হই যে, আমি কী ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য আদৌ প্রস্তুত কি-না?”

“হ্যা!” অ্যাবোলি খুব বিস্ময়াবিভূত হল এবং হাল-এর কাঁধে তার লম্বা হাতটা রাখল। “তুমি তোমার শত্রুদের হত্যা করেছ। টাবারনেকল আর হলি গ্রেইলকে রক্ষা করেছ। এমন একটি নারী হৃদয় জয় করেছ, যে তার চেয়েও শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে পারে।” অ্যাবোলি খুব আস্তে করে তার মাথাটা ঝুঁকিয়ে বলল, “অতএব, আমি মনে করি, তুমি তোমার কাঁধের ওপর একটা বাচ্চাকে রেখে ঘুম পাড়ানোর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে।”

অট্টহাসি দিয়ে হাল বলল, “সেক্ষেত্রে, আমাদের যত দ্রুত সম্ভব তার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত।”

.

ক্যাপ্টেন জানে যে তার জাহাজটা এখন এক অর্থে নাবিকদের জীবন্ত কঙ্কাল দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তার কাছে জমানো যা টাকা ছিল তা প্রায় শেষের পথে। যতটা সস্তায় সবকিছু চালানো সম্ভব সেই চেষ্টাই করছে সে।

বিস্কিট ও অন্যান্য শুকনো খাবার যা ছিল উপকূল ত্যাগ করার পূর্বেই তাতে ছত্রাক ধরে ফেলেছে। সবজি যা কিছু ছিল সব পচে গিয়েছে। শুকনো মাংস যা ছিল তা এতটাই শুকিয়ে গিয়েছে যে, তার চেয়ে ববং জুতোর চামড়া ছিঁড়ে খাওয়া ভাল। সে এবং তার নাবিকেরা অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন পার করছে। তারা এমন কোনো সভ্য বন্দরের খোঁজ পাচ্ছে না যেখানে জাহাজ থামিয়ে তারা কিছু কিনতে পারে বা নতুন কোনো যোগানদারের সন্ধান পেতে পারে যার টাকা পরে শোধ করা যাবে। সহজ কথায় ক্যাপ্টেন নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কিন্তু আরো একটা সমস্যা তার মাথার ওপর কড়া নাড়ছে। ক্যাপ্টেন বুঝতে পারে পরিস্থিতি খুব খারাপ হতে যাচ্ছে যখন সে কাকের বাসস্থানের মতো কর্কশ স্বর শুনতে পায়। ক্যাপ্টেন! সমুদ্রে কিছু একটা ভাসতে দেখা যাচ্ছে। জাহাজের দক্ষিণ পাশে, সামনের দিকে। দেখতে কাঠের মতো…অথবা…উল্টানো নৌকোর মতো।”

ক্যাপ্টেন মাথা ঝাঁকাল, এরপর বিড়বিড় করে বলল, “আমাকে কেন এটা বলার প্রয়োজন পড়ল?”

কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকবার চিৎকারের মাধ্যমে সে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। “ওখানে কিছু একটা নড়ছে। আরে…একটা মানুষ! সে আমাদের দেখতে পেয়েছে মনে হচ্ছে…আর…সে আমাদের দিকে হাত ইশারা করছে।”

ক্যাপ্টেন বুঝতে পারছিল যে পঞ্চাশ জোড়া ক্ষুধার্ত চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোনো ইচ্ছেই হচ্ছিল না নতুন করে আরও এক জোড়া চোখ বাড়াতে। লোকটাকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছিল সে। জাহাজের সর্বশেষ যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে খাবার দেয়ার মতো আরেকজোড়া মুখ। এরপরেও, নিজেকে সে খুব সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে দাবি করতে না পারুক, কিন্তু একেবারেই খারাপ লোক সে নয়। সে পাষণ্ড হতে পারে, তবে এতটাও নিষ্ঠুর নয়।

ক্যাপ্টেন তার জাহাজটাকে ঘোরানোর নির্দেশ দিল, এরপর লোকটিকে উঠিয়ে আনার জন্য একটি নৌকো নিক্ষেপ করতে বলল। “দুঃখ পেও না বন্ধুগণ” সে বলল, “যদি আমাদের এই বাস্টার্ডটাকে পছন্দ না হয় তাহলে আমরা তাকে গুলি করে মেরে খেয়ে ফেলব।”

কিছুক্ষণ পরে কাদা-ময়লা কাপড় পরিহিত, রোদে পোড়া মাঝারি উচ্চতার একজন লোককে সাগর থেকে উঠিয়ে আনা হল। সেও তার নাবিকদের মতোই হাল্কা-পাতলা। ক্যাপ্টেন তার জায়গা থেকে নিচে নেমে এল লোকটির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। ক্যাপ্টেন হাল তার মাতৃভাষায় লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, “গুড ডে স্যার। আপনার পরিচয় জানতে পারি?”

 লোকটি অল্প করে মাথা ঝাঁকিয়ে একই ভাষায় জবাব দিল, “গুড ডে টু ইউ ই ক্যাপ্টেন। আমার নাম উইলিয়াম পেট।”

*

 হাল এর সাথে পুনর্মিলনীর দিন কী পোশাক পরা যায় সেটা জুডিথকে ক) বেশ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সে স্টীলের ব্রেস্টপ্লেট পরে যুদ্ধের যে দীক্ষা নিয়েছে সেটাতেই বরং সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেটাতেই বরং তার শারীরিক গঠন ভালভাবে এঁটে যায়, যেটার ওপর লাল, হলুদ, এবং সবুজ রঙের মিশ্রণের সিল্কের এক ধরনের কাপড় পরানো থাকে। সেটার ওপর বিভিন্ন রকমে জুয়েলারি পিন দিয়ে আটকানো থাকে। রাজা তাকে ডামাস্কাস স্টীলের তৈরি বিশেষ এক ধরনের তরবারি দিয়েছে যেটা মহিলাদের গঠন এবং শক্তির সাথে ঠিকভাবে মানিয়ে যায়। অলংকৃত। জিনিসটা যখন সে পেছন দিক থেকে ঝুলিয়ে রেখে গোল্ডেন বাউ-এর ডেকে গিয়ে দাঁড়াবে, তখন বোঝা যাবে যে সে শুধুই কোনো অসহায়, নমনীয় নারী নয়। বরং সে একজন শক্তিশালী যোদ্ধা।

আর একজন নারী যোদ্ধা হিসেবে সে যেমন চায় পুরুষেরা তাকে সম্মান করুক তেমনি চায় কোনো পুরুষ তাকে ভালবাসুক, তাকে প্রত্যাশা করুক। যদিও এটা প্রকাশ করতে সে কুণ্ঠাবোধ করে কিন্তু তার জন্য নিজেকে সে সুন্দর রাখতে চায়। এক মাস আগে যখন তাদের দুজনকে যুদ্ধের কাউন্সিলে ডাকা হয়েছে তখনও তারা দুজন একত্রে একঘণ্টা কাটিয়েছে। এমনকি যদি তারা এক মুহূর্ত সময়ও একত্রে কাটানোর সুযোগ পায় তারা চায় সেই মুহূর্তটাই যেন তাদের জীবনের সেরা মুহূর্ত হয়। এ কারণে আলাদা থাকার সময়টুকু তাদের কাছে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে চায় না যে হাল আর তার। মাঝখানে কোনো কিছু আসুক, তাই দূরে কোথাও যাওয়ার সময় যদিও তার সাথে অস্ত্র, মিলিটারি পোশাক ইত্যাদি থাকে কিন্তু এরপরেও সে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা রঙের ইথিওপিয়ান ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে থাকে যার গলায় আর হাতায় সোনালি রঙের এমব্রয়ডারি করা আছে। সে সোনার ওপর অ্যাম্বার পাথর বসানো নেকলেস পরিধান করে, কানে পাথর বসানো সোনার দুল পরে।

তার চুলগুলো মাথার পেছনে উপরের দিকে খোঁপা করা আছে যার ওপর মণিমুক্তা খচিত অলংকার লাগিয়ে রাখা হয়েছে। মাথার একপাশে ঝুলানো আছে এক ধরনের বড় দুলের মতো গহনা। কপালের ওপর দিয়ে সারা মাথা ঘুরিয়ে এক ধরনের মোটা সোনার চেইন আটকানো আছে যেটা থেকে বিভিন্ন রঙের পাথর ঝুলে আছে। এগুলো ছাড়াও তার মাথার ওপর থেকে কাঁধ পর্যন্ত একটা সাদা রঙের লিলেন কাপড় পরা আছে। শালীনতাস্বরূপ এই কাপড় তার ব্যক্তিত্বকে উজ্জ্বল করেছে। সে তার প্রিয় মানুষটির সামনে যাই করুক না কেন প্রকাশ্যে সে তার জাজ্বল্যমান ব্যক্তিত্বকে বজায় রাখতে চায়।

মিতসিওয়া পোর্ট-এ বহনকারী ক্যারিয়েজে সে উঠে বসেছে। রাজার ব্যক্তিগত সৈন্যদল তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সৈন্যদলের সবাই আনুষ্ঠানিক ইউনিফর্ম পরে আছে। কাঁধের ওপর থেকে লম্বা একটা কাপড় বাঁকা করে ঝুলানো আছে যেটার ওপর ইথিওপিয়ান সিংহের ছবি আঁকা আছে। জুডিথকে বহনকারী যানটা যখন ডকসাইডে গিয়ে থামে তখন সৈন্যদল ক্যারিয়েজের চারপাশে সুবিন্যস্তভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে যাতে জনগণ তাদের জাতীয় বীরের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়। তাদের সবার কাছেই পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো কারণ তাদের পৌরাণিক গল্পের নায়িকা জেনারেল জুডিথ তাদের মাঝে এসেছে! একজন অশ্বারোহী গার্ডম্যান তার অশ্ব থেকে নেমে জুডিথকে বহনকারী গাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সে দরজা খুলে একটা সিঁড়ি নামিয়ে আনল। এরপরে সে সরে দাঁড়াল যাতে জুডিথকে সবাই দেখতে পায়।

শেষমুহূর্তে জুডিথ অনুমান করতে পেরেছিল যে তার উপস্থিতি অনেক লোকের আগমন ঘটাতে পারে। সেই সাথে সে চেয়েছিল তার বিজয়ের আনন্দের কিছু অংশ জনগণকে দিতে। তাই সম্মানসরূপ পাওয়া সব স্মারক এবং মেডেল সে সাথে করে নিয়ে বের হয়েছিল। যখন সে বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায় তখন মধ্যগগনের সূর্যের আলোতে তার গায়ে জড়িয়ে থাকা সমস্ত মণিমুক্তা ও ব্যাজ চকচক করতে থাকে। তাকে এতটাই উজ্জ্বল আর আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল যে ঐ মুহূর্তে তাকে যতটা না সাধারণ মানবী মনে হচ্ছিল, তারচেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় দেবীর মতো। সে গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই চারদিক থেকে উল্লাস ধ্বনির রব উঠল। যদিও সে স্মিত হেসে হাত নাড়িয়ে উপস্থিত জনতার সম্মান গ্রহণ করছিল কিন্তু তার দৃষ্টি এবং হৃদয় তখন অন্য আর একজনের কাছে পড়েছিল।

হাল কার্টনি সিঁড়ির ধাপের নিচে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। যদিও সে যুদ্ধ জাহাজের ক্যাপ্টেন কিন্তু সে কোনো পদমর্যাদার ব্যাজ পরা ছিলনা। যদিও সে গোল্ডেন লায়ন অব ইথিওপিয়ার সম্মানিত সদস্য, সেন্ট জর্জ-এর নউটিনিয়ার নাইট অব টেম্পল উপাধির অধিকারী, সেই সাথে তার বাবার মতো সেও হলি গ্রেইল-এর রক্ষাকারী কিন্তু তবুও সে কোনো পদমর্যাদার ব্যাজ পরেনি। তার পরিবর্তে সে শুধুই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তার প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করছে। তার চুলগুলো পেছনে রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বাঁধা এবং গায়ে একটা সাদামাটা লিলেন-এর জামা পরা, হাল-এর কোমড়ের পেছন থেকে টলেডো ব্লেড-এর তৈরি একটি তলোয়ার বাট-এ আঁটকানো আছে। তরবারির বাঁটটা সোনা ও রূপার মিশ্রণে নকশা করা এবং এর উঁচু অংশে একটা বড় স্যাফায়ার পাথর বসানো আছে। এই তরবারিটা হাল-এর গ্রেট গ্রান্ডফাদারকে এলিজাবেথান নৌ-সেনাধ্যক্ষ স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক দিয়েছিলেন।

 যখন জুডিথ তার মনের মানুষটিকে দেখতে পেল সে এক ধরনের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।

 যুদ্ধের দাবদাহে জুডিথ শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত। দুইগুণ বা তিনগুণ বয়সে বড় কাউন্সিল মেম্বারদের সামনে সে নিজেকে শক্তহাতে ধরে রাখত। যে কাউন্সিল মেম্বাররা শারীরিক গঠনে এবং সম্মানে তার চেয়ে অনেক এগিয়ে। তারা তো বটেই, এমনকি তার শত্রুরাও কখনও তাকে ভয় দেখাতে পারত না। অথচ এখন হাল কার্টনির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব মনে হচ্ছে, পা দুটোর সমস্ত শক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে। সে কোনোভাবেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছিল তার চারপাশের সবকিছু ঘূর্ণায়মান। হাল যদি সময়মত ধরে না ফেলত তাহলে সে হয়ত মাটিতে পড়েই যেত। হাল তাকে ধরে ফেলার পর তাকে স্বাভাবিক হতে একটু সময় দিল। হয়তো বা তার এমন মধুর অসহায়ত্ব তাকে উপভোগ করার একটু সুযোগ দিল হাল! তাকে দেখে মনে হচ্ছিল চারপাশের এত লোকের ভিড়ে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এমন কি হাল যে কি বলছে সেটাও সে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছে না।

হাল তাকে উৎসুক জনতার মাঝখান দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়ায় চড়া গার্ডেরা জনতার মাঝে পথ করে দিয়ে তাদেরকে জেটির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। জুডিথ চারপাশ থেকে এল তাজার” দ্য বারাকুলা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। শত্রুর জাহাজ আক্রমণের বীরত্বের কারণে হাল-এই নামে পরিচিত ছিল। এরপর সে হাল-এর হাত শক্ত করে ধরল। হাল তাকে সাবধানে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। যখন জুডিথ গোল্ডেন বাউ-এর সিঁড়িতে পা রাখল, তখন দেখতে পেল যে এর প্রতিটা দাঁড়-এ একজন করে তোক দাঁড়িয়ে আছে তাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। জাহাজের একমাত্র পালটি গুটিয়ে রাখা আছে। জাহাজের রাডারের ওপর দাঁড়িয়ে বিগ ডেনিয়েল ফিশার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

“ম্যাম, আপনাকে জাহাজে স্বাগতম,” বিগ ডেনিয়েল বলতে লাগল। “আপনি হয়ত আমাকে খেয়াল নাও করতে পারেন কিন্তু আপনি অনেকদিন ধরেই আমাদের সবার কাছে অনেক প্রিয় মানুষ।”

“ধন্যবাদ ডেনিয়েল,” জুডিথ একটু হেসে জবাব দিল। এরপর সে এদিক সেদিক তাকিয়ে হাল-কে জিজ্ঞেস করল, “অ্যাবোলি কোথায়? তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এরকম একটা অনুষ্ঠানের দিন সে অনুপস্থিত।”

 হাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে না জানার ভান করল। এরপর হাতের ইশারা করে কিছু একটা বোঝাল ডেনিয়েলকে। চোখ বড়বড় করে চেহারায় নিষ্পাপ ভাব ফুটিয়ে বলল, “আমি জানি নে সে কোথায় আছে। ডেনিয়েল তুমি কিছু জান?”

“না স্যার, আমি কিছু জানি না।”

 “কেউ কিছু জান?”

নাবিকেরা সবাই মাথা নাড়িয়ে চোখ বাঁকিয়ে জবাব দিল যে তারা কিছুই জানে না। নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছিল যে সবাই কিছু একটা লুকাচ্ছে এবং এই খেলাতে জুডিথ বেশ মজাই পাচ্ছিল।

“সে না আসায় আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি,” জুডিথ বলে উঠে। এরপর আস্তে আস্তে গিয়ে হাল-এর পাশে বসে। “কক্সওয়েল, এবার আমাদেরকে জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে চল।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে ম্যাডাম,” বিগ ডেনিয়েল বলে। এরপর সে সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কাজের তাগিদ দিতে থাকে।

“জাহাজটাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে” হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল জুডিথ। এরপর একদৃষ্টিতে গর্বিত হালকে দেখতে লাগল।

“আমি এবং আমার লোকেরা এটাকে নতুনভাবে সাজিয়েছি,” হাল বেশ আনন্দের সাথে জানাল।

“ম্যাম, আমরা সবাই মিলে গত এক সপ্তাহ জুড়ে দিন রাত পরিশ্রম করেছি, ডেনিয়েল জাহাজটার দিকে তাকিয়ে বলল।

 “বেচারা ডেনিয়েল, আমার জানা ছিল না যে আপনাদের কাপ্টেন এতটা নিষ্ঠুর,” জুডিথও একটু মজা করে বলল।

“না ম্যাম, আপনি জানেন না ক্যাপ্টেন কার্টনি কি ধরনের মানুষ। উনি তার বাবার মতোই হয়েছেন। তার বাবার পরে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যে জাহাজটাকে শক্ত হাতে চালিয়ে নিতে পারেন।

হাল-এর প্রশংসার কথা হয়ত অনেকেই বলতে পারে কিন্তু জুডিথ জানে সে হালকে যতটা জানে অন্য কেউ তার চেয়ে বেশি ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারবে না। জুডিথ হাল-এর হাতে জোরে চাপ দিয়ে তার সেই অনুভূতিটা হাল-এর মাঝে ছড়িয়ে দিল। তারা যখন গোল্ডেন বাউ-এর কাছাকাছি আসল ডেনিয়েল উপস্থিত জনতাকে চিৎকার চেঁচামেচি থামাতে বলল। জাহাজের ব্লেডগুলোকে থামিয়ে দাঁড়গুলোকে সোজা করে রাখতে বলল। এরপর জীবন রক্ষাকারী নৌকোগুলোকে নিরাপদে জাহাজের পাশে থামিয়ে রাখার আদেশ দিল, একইসাথে জাহাজ থেকে কতগুলো মোটা নেট নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিতে বলল যাতে নৌকোয় থাকা লোকগুলো নেট বেয়ে উপরে উঠে যেতে পারে। যখন জুডিথ উঠে দাঁড়িয়ে নেট-এর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল তখন হাল তাকে থামিয়ে দিল। এরপর চিৎকার করে বলল, “আস্তে আস্তে সুইং-টা নিচে নামাও।”

জুডিথ উপরে তাকিয়ে দেখল একটা কাঠের দোলনার মতো জিনিস নিচে নামানো হচ্ছে।

“আমরা এটাকে বড় আর ভারি জিনিসপত্র জাহাজে উঠানোর জন্য ব্যবহার করি। তবে মনে হচ্ছে আজকে এটার সঠিক ব্যবহার হবে,” হাল বলল।

 কাঠের দোলনাটাকে নানানরকম স্থানীয় ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এটার নিচ থেকে নানান রকম সাজানো ফিতা ও কাপড় আর সিগন্যাল ফ্ল্যাগ ঝুলে আছে। স্লিংটা যখন নিচে নামানোর পর হাল ওটার ওপর জুডিথকে বসতে সাহায্য করল।

“দেখো, সে যেন নিরাপদে উঠতে পারে, সে ডেনিয়েলকে আদেশ দিল! তারপর জুডিথ-এর গালে টোকা দিয়ে বলল, “তোমার সাথে ডেক-এ দেখা হবে। মাই ডালিং।”

হাল-এরপর নেট-এর দিকে এগিয়ে গেল এবং এরপর নেট ধরে আস্তে। আস্তে উপরে উঠতে লাগল। হাল-এর উপরে উঠা দেখে সে গাছ বেয়ে উঠা বানরের কথা মনে করে মনে মনে হাসতে লাগল। এরপর সে যখন ব্লিংটা শক্ত করে ধরে বসল তখন ডেনিয়েল আদেশ দিল, “উপরে উঠাও।” জুডিথ-এর চেহারা থেকে জেনারেল নাজেত-এর সমস্ত চিহ্ন অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন তাকে শুধুই একজন সাধারণ নারী মনে হচ্ছে। যেন তার নতুন জীবনের শুরুতে সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে আছে। যখন কাঠের দোলনা উপরে উঠানোর এলার্ম বাজানো হল তখন জুডিথ অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। সে দেখতে পেল হাল উঠতে উঠতে একেবারে ডেক-এর কাছাকাছি চলে গিয়েছে। এরপর লাফ দিয়ে ডেক-এ নেমে পড়ল সে। জাহাজের অন্যান্য লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

“থ্রি চিয়ার্স ফর দ্য ক্যাপ্টেন লেডি” বাউ-এর বৃদ্ধ দাঁড়চালক নেড টেইলার চিৎকার করে উঠল।

ডেক-এর ওপরে যখন জুডিথকে উঠতে দেখা গেল তখন খুশির জোয়ার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। হুররে… বলে একজন তার মাথার ক্যাপটা উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল।

 দ্বিতীয়বারের মতো সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল যখন জুডিথকে বহনকারী কাঠের দোলনাটাকে জাহাজের ডেকের ওপর নামিয়ে আনা হল। নেড টেইলার যখন “হিপ হিপ হুররে…” বলে চিৎকার দিয়ে উঠল তখন জুডিথ দোলনাটা ছেড়ে দিয়ে দক্ষ দড়িবাজের মতো লাফ দিয়ে ডেক-এ নেমে এল এবং হাল এর বাহুতে নিজেকে আবিষ্কার করল। তৃতীয়বারের মতো সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল এবং এবারের চিৎকার বেশ কিছু সময়ের জন্য স্থায়ী হল। কারণ হাল জুডিথকে দুই হাত দিয়ে ধরে তার ঠোঁটে ছোট্ট করে চুমু খেয়েছে। সেটার রোমাঞ্চ জুডিথ-এর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু একই সাথে একটা হতাশা তাকে ঘিরে ধরছে, কারণ তাকে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।

হাল জুডিথ-এর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে বলল, “তুমি অ্যাবোলির কথা জিজ্ঞেস করছিলে। দেখ, এটা তোমার ভাল লাগবে।”

এরপর হাল মুখে কিছু শব্দ উচ্চারণ করল যেগুলো শুনে জুডিথের মনে হলো যে ওগুলো আফ্রিকান শব্দ, কিন্তু সে যে কি বলছে সেটাই বুঝতে পারল না জুডিথ। কিছুক্ষণ পরে পেছন থেকে এর জবাব এল। কেউ একজন তীক্ষ্ণস্বরে স্তবগান গাইতে শুরু করেছে। এই কণ্ঠের উত্তরে আবার একটা গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ ‘হাহ্!’ বলে জবাব দিল। সাথে সাথে ডেক-এ দাঁড়ানো নাবিকেরা পায়ের তালে তালে ডেক-এ আঘাত করতে লাগল। প্রথম কণ্ঠটি তার স্তবগান চালিয়ে যেতে লাগল। জুডিথের সামনে দাঁড়ানো নাবিকেরা সরে গিয়ে সামনের রাস্তা ফাঁকা করে দিল। সামনের দৃশ্য জুডিথকে এত বেশি রোমাঞ্চিত করে তুলল যে সে শক্ত করে হাল-এর হাত ধরে ফেলল।

অ্যাবোলি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় সারস পাখির লম্বা পালক দিয়ে তৈরি এক ধরনের মুকুট পরে আছে সে। তাকে দেখে সাধারণ মানুষ বলে মনেই হচ্ছে না, বরং দেখতে অনেকটা জঙ্গলের দেবতার মতো লাগছে। তার হাতে বড় ব্লেডযুক্ত একটা বল্লম ধরে আছে এবং কোমড় থেকে চিতাবাঘের লেজ দিয়ে তৈরি একধরনের ঘাগরা পরে আছে।

তার পেছনে কয়েকজন অ্যামাডোড়াও রয়েছে। তার গোত্রের এই কয়জন অ্যামাডোডা গোল্ডেন বাউ-এর সেবায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরা সমুদ্রেও ঠিক ততটা শক্তিশালী ও মারাত্মক যতটা শক্তিশালী তারা বনে এবং তাদের নিজভূমিতে ছিল। তারাও মাথায় সারস পাখির পালক পরে এসেছে। যদি ওদেরকে অ্যাবোলির মতো ততটা লম্বা লাগছে না। অ্যাবোলিকে ওদের দলনেতা বলেই মনে হচ্ছে।

তারা সামনে এগিয়ে আসতে আসতে সমস্বরে গান গাইতে লাগল। তাদের গানে বীরত্ব, ভ্রাতৃত্ব এবং দায়িত্বের স্বার্থে ইচ্ছামৃত্যুর কথা ধ্বনিত হচ্ছে। জাহাজের অন্যান্য নাবিক অবাক হয়ে দেখছে, কারণ তারা অ্যামাছোঁড়াদের কখনও এভাবে দেখে নি। হাল এবং জুডিথ-এর কাছাকাছি আসার আগ পর্যন্ত লোকগুলো পায়ের তালে এগিয়ে আসতে লাগল। অনেকটা নাচের তালে এবং অনেকটা প্রকৃত যোদ্ধার মতো পায়ের তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল।

তাদের গান শেষ হওয়ার পর সবাই তাদের প্রশংসা করতে লাগল। জুডিথ এর জন্য ব্যাপারটা সবার চেয়ে বেশি আনন্দের ছিল। কারণ সে আফ্রিকান। যদিও সে গানের কথাগুলো খুব একটা ভাল বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ওরা যে চেতনা দিয়ে গানটা গাইছিল সেটা বুঝতে পারছিল।

অ্যাবোলি সামনে এগিয়ে এল। এরপর মাথায় পরা পালাকের মুকুটটা পাশে রেখে হাঁটু গেড়ে জুডিথ-এর সামনে বসল। জুডিথ-এর হাতটা আলতো করে টেনে নিয়ে চুমু খেল।

এটা অভিজাত বংশীয় কারও তার রানীর প্রতি সম্মান জানানোর রীতি। জুডিথও সম্মানের যথাযথ উত্তর দেয়। সে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে ঝুঁকে অ্যাবোলির হাতটা ধরে রেখে বলে, “ধন্যবাদ অ্যাবোলি। আমার হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে তোমাকে ধন্যবাদ।”

এরপর হালও অ্যাবোলি’র হাত ধরে বলল, “ধন্যবাদ পুরনো বন্ধু, সবকিছু অসাধারণ ছিল।”

অ্যাবোলি হেসে বলে, “আমি অ্যামাডোডাদের প্রিন্স। এর চেয়ে কমে আমার পোয় না।”

এরপর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। খাওয়া-দাওয়া আনন্দ ফুর্তি, গান-বাজনা চলতেই থাকে। জুডিথ হালকে ধরে ফ্লোর-এর বাইরে নিয়ে যায়, এরপর বাজনার তালে তালে নাচতে থাকে। কিছু স্থানীয় রাধুনীরা খাবার পরিবেশন করছে। নাচের জন্য কিছু মেয়েও রয়েছে। কিন্তু হাল কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে যাতে ওদের নিয়ে কোনোরকম বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-তামাশা না করা হয়। যখন সূর্য প্রায় অস্তগামী তখন হাল সিঁড়ির ওপর উঠে দাঁড়ায়, তারপর সবাইকে চুপ হতে বলে।

“সবাই থাম এবার। আমার কিছু কথা বলার আছে,” হাল চিৎকার করে বলতে থাকে। সে খুব উচ্চস্বরে চিৎকার করে নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করে, “আমার নাম…আমার সঠিক নাম স্যার হেনরি কার্টনি।”

“ক্যাপ্টেন, আমরা সবাই এটা জানি,” একজন নাবিক বলে উঠল।

“ভাল। তবে তোমাকে বুঝতে হবে যে আমার এটা বলার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণ আছে। কিন্তু প্রথমে আমি বলতে চাই যে, আগামীকাল আমরা ইংল্যান্ড-এর উদ্দেশ্য রওনা দিব।”

নাবিকদের মাঝ থেকে একটা তীব্র গর্জন শোনা গেল “অবশ্যই।” হাল আবার বলতে শুরু করল, “এই জাহাজের সদস্যদের মধ্যে যাদের বাড়ি এই আফ্রিকায় তারা বাড়ি ফিরে যেতে পার। কিন্তু তার আগে আমাদের একটা কাজ সম্পন্ন করতে হবে।”

“তোমরা অনেকেই জানো, আমার বাবা স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি, এখানে তোমাদের অনেকের সহযোগিতায় ডাচদের পতাকাতলে অনেক জাহাজকে ভূপাতিত করেছেন,..”

 সবাই সম্মতিসূচক চিৎকার দিল।

“…এবং এতে করে তিনি অনেক ধন সম্পদ আহরণ করেন। সেইসব সোনা, রুপা এবং মূল্যবান জিনিস আমরা খুঁজে বের করব। তোমরা সবাই বয়স এবং কাজের বিচারে তার ভাগ পাবে।”

 হাল আনন্দের সাথে তার গলা আরও উপরে তুলে বলল, “তোমাদের প্রত্যেকেরই এই পুরস্কার প্রাপ্য। তোমাদের চেয়ে সাহসী, অনুগত নাবিক আমি আর কোথাও পাব না। তোমরা নাবিক এবং যোদ্ধা হিসেবে তোমাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। তোমরা তোমাদের প্রতিজ্ঞা রেখেছ। এখন আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব। আমি তোমাদেরকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব। এবং সেখানে তোমরা যাতে ভালভাবে বাঁচতে পার সেই ব্যবস্থা করব। কিন্তু তার আগে আমি তোমাদেরকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। তোমরা কী সেই রমণীর জন্য নিজেদের গ্লাস উঁচু করে ধরে উল্লাস জানাবে না যাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি? সেখানে সে হবে আমার মাননীয়া স্ত্রী। প্রিয় নাবিকরা, তোমাদের প্রিয় জেনারেল জুডিথ হবে ভবিষ্যতের লেডি কার্টনি।”

যখন মদ্যপান করতে করতে এক একজন নাবিক প্রায় মাতালের পর্যায়ে চলে গিয়েছে তখন হাল এবং জুডিথ তাদের কোয়ার্টারের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। এখন আর কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নেই যেটার জন্য গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন বাঁকানো ডেস্ক-এর ওপর ক্যাপ্টেনদের লগবুক পূরণ করার জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। পার্সিয়ান কার্পেট-এ অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য যথেষ্ট সুব্যবস্থাও রয়েছে।

“তুমি শেষবার বাউ-এ আসার পর আমি আমাদের ঘুমানোর জায়গাটা নতুনভাবে সাজিয়েছি,” হাল জুডিথকে নিয়ে এসে তার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল। একারণে কাঠুরেদের গত একটা সপ্তাহ অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এখন তুমি তোমার চোখ একটু বন্ধ কর…”

 হাল যেভাবে বলল, জুডিথও তাই করল। হাল দরজা খুলে জুডিথ-এর হাত ধরে তার ব্যক্তিগত কামরায় নিয়ে আসে। চোখ বন্ধ অবস্থায় সে আরও কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেল। হঠাৎ হাল তাকে থামতে বলে। “এখন তুমি তোমার চোখ খুলতে পার।”

তার সামনে একটা স্লিপিং কট ঝুলে আছে। সাধারণ বিছানার চাইতে দ্বিগুণ বড় ওটা। সচ্ছ সাদা রঙের পাতলা কাপড় দিয়ে চারদিকের ঝুলানো রশিগুলো প্যাচিয়ে রাখা হয়েছে, সিল্কের ধূসর রঙের বিছানায় চাদরের ওপর উজ্জ্বল সুতার কাজ করা এবং মিসরীয় সুতীর কাপড়ের বালিশ রাখা আছে।

“খুবই সুন্দর লাগছে, হাল”, জুডিথ একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে কথাটা বলল।

“আমি এই লিলেনগুলো পেয়েছিলাম আমাদের আঁটকে ফেলা একটা জাহাজে।” হাল হেসে ফেলে কথাগুলো বলল। “ক্যাপ্টেন বলেছিল এগুলো শেখের হারেমের জন্য নেয়া হচ্ছে। আমি বলেছিলাম এগুলোর এর চেয়ে ভাল ব্যবহার আমি করব।”

“ওহ, তাই?” জুডিথ একটু টিপ্পনি কেটে বলল। “তা এগুলোর কী ভাল ব্যবহারটা হচ্ছে শুনি…”

কিন্তু বেচারি তার প্রশ্নটা শেষ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই হাল তাকে দু’হাত দিয়ে উঠিয়ে বিছানার ওপর ছেড়ে দিল। সেই সাথে মনে মনে কাঠুরেদের প্রশংসা করতে লাগল। ওরা বেশ মজবুতভাবেই খাটটা বানিয়েছে। মনে হচ্ছে যেকোনো ধরনের ভার এটা বইতে পারবে।

*

নিজের ভাগ্য অন্বেষণে আরবের হয়ে যখন বুজার্ড ইথিওপিয়ার উদ্দেশ্যে উত্তরমুখী যাত্রা শুরু করে তখন তার মনে কোনো য়ৈ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেনি। বরং এটার প্রধান কারণ ছিল অর্থ উপার্জন। অ্যারাবিক সে খুব সামান্যই বলে। সে এটাকে খুব নোংরা ভাষা মনে করত যেটা তার সম্মানের সাথে খাপ খায় না। কিন্তু অচিরেই সে তার ভুল বুঝতে পারে। তার এই অজ্ঞতাই তার জন্য অনেক অসুবিধা বয়ে আনে। কারণ তার আশেপাশের মানুষ তাকে ছাড়াই কথাবার্তা চালিয়ে যায়, যার কিছুই সে বুঝতে পারে না। তাই সে আরবি ভাষা শেখা শুরু করে। তার এই প্রচেষ্টা তার আরোগ্য লাভের সময়ও চলতে থাকে। সে কারণে মহারাজ সাদিক খান জাহান-এর চিঠি পড়া তার জন্য খুব একটা কষ্ট হয় না। চিঠিতে লেখা ছিল, “আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই আরোগ্য লাভের কারণে। স্বীকার করতেই হবে। তুমি যে সুস্থভাবে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে এটা আমার কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু এখন শুধু একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ।”

প্রিন্স জাহানের রাজত্বে বুজার্ড-একসময় বেশ দম্ভসহকারে ঔদ্ধত্য নিয়ে চলাফেরা করত। তাই এমন মধুর বাণী শুনতে বা মেনে নিতে বুজার্ড-এর মন সায় দিচ্ছে না। সেই সাথে মণিমুক্তা হীরা জহরত খচিত পোশাক পরিহিত কারো সামনে একবাহু একচোখ বিশিষ্ট বুজার্ডের নিজেকে গারগেইল ভূত-এর চেয়েও কুৎসিত মনে হচ্ছে। কিন্তু বুজার্ড এখন ভিক্ষুক। নত তাকে হতেই হবে। তাই সে কোনোভাবে মাথাটা নিচু করে বলে, “আপনার অনেক দয়া, মহারাজা।”

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা তার অদম্য ইচ্ছেশক্তিরই একটা প্রমাণ। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় বুজার্ড তার শরীরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। সে শরীরের কী কী অংশ হারিয়েছে সেটার চেয়ে বরং কী কী অংশ অবশিষ্ট আছে সেটার প্রতিই ছিল তার সমস্ত মনোযোগ। তার পাদুটো এখনো ভাঙেনি যদিও বেশিরভাগ চামড়া পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু চামড়া ও ক্ষতের নিচে মাংসপেশিগুলো এখনো তার শরীরের ভার বয়ে বেড়াতে পারবে। যদিও তার বাম হাত উড়ে গিয়েছে কিন্তু ডান হাতটা এখনো অক্ষত আছে। ডান হাত দিয়ে এখনো শক্তভাবে কোনো কিছু ধরার সামর্থ্য আছে তার। অর্থাৎ সে হয়ত কোনোদিন শক্তহাতে তলোয়ার ধরতে পারবে না। তার এক চোখের দৃষ্টিশক্তি এবং এক কানের শ্রবণশক্তি এখনো অক্ষত আছে। সে হয়ত শক্ত কোনো কিছু চিবাতে পারবে না, কারণ তার খাদ্যনালীর অবস্থা এমন হয়েছে যে, শক্ত কোনো খাবার হয়ত সে হজম করতে পারবে না। সব খাবারই হয়ত তাকে তরল জাতীয় মিশ্রণ বানিয়ে খেতে হবে। তার জিহ্বা হয়ত তাকে আলাদা আলাদা খাবারের স্বাদ দিতে পারবে না। কিন্তু এটুকুই তার জন্য যথেষ্ট যে সে খেয়ে বাঁচতে পারবে।

এসব ভেবেই বুজার্ড মানসিকভাবে শান্ত আছে। কিন্তু তার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা এবং সারা শরীরেও তা ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কেটে পড়ে পাওয়া অঙ্গগুলো থেকেও সে ব্যথা অনুভব করছে। তবুও সে চিন্তা করতে পারছিল, পরিকল্পনা করতে পারছিল, হিসাব করতে পারছিল আর…ঘৃণা করতে পারছিল।

এসবের মধ্যে যে জিনিসটা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে তা হলো ঘৃণা। ওটাই তাকে উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। শরীরের হাল ধরতে শিখিয়েছে। তাকে শরীরের অবসন্নতা কাটিয়ে উঠতে শিখিয়েছে। এটাই তাকে খাবার তুলতে সাহস যুগিয়েছে যখন তার মনে হচ্ছিল প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে এসিড তার ফুসফুসে প্রবেশ করছে।

বুজার্ড-এর মনের জ্বলন্ত আগুন জাহানকে বিমোহিত করেছে। “আমি আপনার কষ্ট দূর হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছি,” এইটুকু বলে সে আস্তে আস্তে তার অতিথির খুব কাছে এসে দাঁড়াল। অতিথির এমন পুড়ে যাওয়া আর পচে যাওয়া শরীর দেখে যাতে তার মুখভঙ্গিতে কোনোরকম বিতৃষ্ণা প্রকাশ না পায় সেদিকে খেয়াল রাখল সে।

বুজার্ড বুঝতে পারল মহারাজা জাহান তার দিকে তাকিয়ে আছে-এতে মনে মনে সে আরও কুণ্ঠাবোধ করল। সে তার হাতে ধরে রাখা বস্তাটা বার বার উপরে নিচে করতে লাগল। তার পেশিগুলো অবশ হয়ে আসছিল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তার ক্ষত থেকে পুঁজ এবং রক্তমিশ্রিত পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল কিন্তু তবুও সে থামছিল না। সে সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। জাহানের একজন কর্মচারী ভেতরে প্রবেশ করল সাথে সাথে। বুজার্ডকে দেখে সে তার বিস্ময় এবং হতবাক অবস্থা লুকাতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু অতি দ্রুত সে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বলল, “মহারাজ, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। সে বলছে তার নাম আহমেদ এবং সে চামড়ার কাজ করে। কিন্তু কী কারণে এসেছে তা আমাকে বলেনি। সে বলেছে আপনি তাকে যে কাজ দিয়েছিলেন তা সে পূর্ণ করেছে। বলেছে সে শুধু আপনার কাছেই তা বলবে।”

জাহান হেসে বলল, “ঠিক আছে, তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।” এরপর সে বুজার্ড-এর দিকে তাকায়। বুজার্ড-এখনো তার হাঁটুতে হাত রেখে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রাণপণে চেষ্টা করছে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। জাহান বুজার্ডকে ডেকে বলে, “মহান সৈনিক, আমি আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আনিয়েছি। আশা করি সেটা আপনার ভাল লাগবে। যদিও একটু কষ্টকর।”

.

জাঞ্জিবারের সালতানাত-এর রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম গ্রে মহারাজা সাদিক খান জাহান আলীর প্রাসাদের বাইরে একজন অনুনয়কারী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানাতে এসেছে যে কী দুর্ভাগ্য আর কী অবিচার-এর কারণে আজ তার এই অবস্থা হয়েছে। অথচ জাঞ্জিবার-এ থাকাকালীন সময়ে জাহানের প্রাসাদে সে কত সম্মানিত অতিথি ছিল। জাঞ্জিবার সমাজে সে সবচেয়ে ধনী শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল। শুধু ইউরোপের প্রতিনিধি হিসেবে গুরুতুপূর্ণ সম্রাটই ছিল না সে, বরং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিতও হয়েছিল। সিদ্ধান্তটা ছিল তার ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় নেয়া। সে ভেবেছিল খ্রিস্টিয়ান সমাজের বাইরে গিয়ে বহুদূর যেতে পারবে। তারপর জাঞ্জিবার-এর সেই দুরাত্ম আর্ল অব কামব্রা উপাধিপ্রাপ্ত অ্যাঙ্গাস কোকরান-এর আবির্ভাব ঘটে। এর পরপরই আসে তরুণ কুরশাবক হেনরি কাটনি। যে সহজ এবং সম্মানের জীবন অনেক বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তুলেছিলেন গ্রে, তা নিমিষেই গুঁড়িয়ে যায়।

বুজার্ড আসার পরপরই গ্রেকে নিজের দলে টানার চেষ্টা করে, যেন সে ওমানের সুলতানের পক্ষ নিয়ে ইথিওপিয়ার রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। স্কটল্যান্ডের এই জলদস্যু যুদ্ধের বাজারে ক্রিশ্চিয়ানদের কাজ থেকে ধন সম্পদ লুণ্ঠন করে ধনী হতে থাকে। সেই সাথে গ্রে-কে যথেষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়া শুরু করে। গ্রে-ও এত পারিশ্রমিক পেয়ে বুজার্ড-কে দেয়া কথা রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। যখন শত্রুর জাহাজ আক্রমণ করার চিঠি তার হাতে পৌঁছায় সে হর্ন অব আফ্রিকার উদ্দেশ্যে পাল উড়ায় এবং তাকে দেয়া কাজ পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করে।

এর পাঁচ সপ্তাহ পরে যুবক কার্টনি ওখানে পৌঁছায়। সেও বুজার্ডের মতোই ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। সেও শত্রুর জাহাজ আক্রমণের জন্য চিঠি পায়। কার্টনি যুদ্ধের সবকিছু শোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল। আর্ল অব কামব্রা তারই পথে যুদ্ধ করছে, এটা জেনে সে খুব বিস্মিত হয়। কিন্তু গ্রে, কার্টনির আগ্রহের ব্যাপারে খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না।

কেনই বা হবেন? মুসলিমরা এখানে বড় ধরনের যুদ্ধ করতে চায় যাতে অ্যারাবিয়া এবং আফ্রিকার উপকুলের মাঝে অবস্থিত বিশাল জলরাশির ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তার হয়। আর যে ব্যক্তি এই ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করবে তাকে তারা বন্ধু হিসেবেই আলিঙ্গন করে নেবে।

এর মধ্যে কার্টনি এসে জাঞ্জিবারে নোঙর গাড়ে, এরপর স্কটম্যানকে খুঁজে বেড়ায়। সেই সাথে ইথিওপিয়ার রাজা আর জেনারেল নাজেত-এর হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে অনেকটা অকৃতজ্ঞ, কপট, দ্বিমুখী বিশ্বাসঘাতক-এর মতো। খুব দ্রুতই এই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কার্টনির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বুজার্ডকে ধ্বংস করা, কারণ সে আসলে তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিছু সময় পরে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কার্টনি সেই স্কটম্যানকে খুঁজে পেয়েছে, এরপর তাকে যুদ্ধে আহবান জানিয়েছে। আরও গল্প তৈরি হতে থাকে যে বুজার্ড তার সর্বোচ্চটা দিয়ে যুদ্ধ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি, জীবন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে জাহাজের সাথেই পানিতে তলিয়ে গিয়েছে।

পুরনো দিনে হয়ত গ্রে এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে পারত আর তাতে হয়ত আসল ঘটনা উন্মোচন হতে পারত। কিন্তু সেটা এখন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ কার্টনি আরব জাহাজগুলো আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়া শুরু করেছে। ফলে জাহাজ মালিকরা তাদের কার্গো থেকে কোনোরকম লভ্যাংশ পাচ্ছে না। এই লোকগুলো তাদের এই ক্ষতির জন্য গ্রে-কে দায়ী করছে, সেই সাথে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।

জাঞ্জিবার-এর প্রতিটি দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে কফি শপ-এ বসে গল্প করা ছাড়া তার আর কোনো কাজই নেই। সবচেয়ে বেশি তার যা করার আছে তা হল মহারাজার প্রাসাদে আসা, অপেক্ষা করা, এরপর আশা করা যে মহারাজা সাদিক খান জাহান হয়ত একদিন তার দিকে সদয় দৃষ্টি দিবেন, তার অবস্থার উন্নতি করতে সচেষ্ট হবেন। এভাবেই একদিন মহারাজার জন্য অপেক্ষা করতে করতে গ্রে, নারী ব্যবসায়ী ওসমানকে দেখতে পায় যার সাথে এককালে সে ব্যবসা করেছিল। ওসমান-এর মতো দুপয়সার লোকও কিনা শেষ পর্যন্ত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে যে গ্রে-র মতো লোকের সাথে সে আর ব্যবসা করতে ইচ্ছুক নয়!

ওসমানকে যখন সে গেটের দারোয়ান-এর সাথে কথা বলতে দেখে তখন গ্রে রাগে টগবগ করছিল। লোকজনের ভিড়, তাদের চিৎকার চেঁচামেচি এবং শরীরের গন্ধ সবকিছুই তার কাছে অসহ্য লাগছিল। গ্রে অনেকদিন ধরেই উপকূলে বসবাস করে। ইংরেজদের আঁটসাট মোটা কোটের চেয়ে অ্যারাবিয়ানদের লম্বা আলখাল্লা তার কাছে বেশি আরামদায়ক মনে হয়। ধর্মীয় কারণের চেয়ে ভৌগোলিক পরিবেশগত কারণেই তার এমনটা মনে হয়। চামড়া ব্যবসায়ী আহমেদকে যখন প্রাসাদের ভেতরে যাবার অনুমতি দেয়া হলো তখন গ্রে লজ্জায় আর অপমানে ঘামতে থাকে, তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আহমেদ একটা বড় বক্স বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ওটা অনেকটা মহিলাদের হেডগিয়ার বহন করার বক্সের মতো দেখতে। গ্রে অবশ্য সেটার প্রতি ততটা মনোযোগ দিল না।

কিছু সময় পরে একজন প্রাসাদের কর্মচারী বেরিয়ে এসে গার্ডদের সাথে কথা বলতে থাকে। একসময় তিনজন লোক ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে তাদের হাতে ধরা কাঠের লম্বা লাঠি দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে থাকে। একসময় গ্রে দেখে যে তারা ওরই দিকে এগিয়ে আসছে। সে ভয় পেয়ে দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভিড়ের কারণে সে পালাতে পারে না। ঘর্মাক্ত অবস্থায় প্রচণ্ড ভয়ে সে চিৎকার করে উঠল যখন সে দেখল যে কয়েক জোড়া হাত তাকে টেনে-হিঁচড়ে প্রধান গেইটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। খানিক বাদেই সে নিজেকে প্রাসাদের টাইলস করা মেঝেতে আবিষ্কার করল।

গ্রে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। সেই কর্মচারীটি ওকে এখানে নিয়ে এসেছে যে একটু আগে আহমেদকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। “আমার সাথে আসুন, এফেন্দি, মহারাজা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।”

সে যখন উঠে আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে এগোতে থাকে তখন দেখতে পায় মধ্যদুপুরে ঝরনার পানি চকচক করছে। গ্রে বুঝতে পারে সেই গার্ড তিনটা তার পিছু পিছু আসছে। তাদের হাতে এখন আর সেই লম্বা কাঠের লাঠি নেই। কিন্তু তার বদলে কোমড়ের বেল্টে আটকানো আছে বাকানো তলোয়ার।

ঠিক ঐ মুহূর্তে কনসাল গ্রে বুঝতে পারে যে মহারাজার সাথে দেখা করতে পারাটাকে সে যতটা সৌভাগ্যের বিষয় মনে করেছিল, সেটা হয়তো অতটা সৌভাগ্যের নাও হতে পারে।

*

বুজার্ডের সব ইদ্রিয় সময়মতো এখনো ভালভাবে কাজ করে না। কিন্তু তার নাকের নিচ দিয়ে একটি ইঁদুর হেঁটে গেলে সে সেটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারে। এই নাস্তিক জাহানটা কিছু একটা করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী? এরকম স্বর্গীয় নামধারী একজন লোকের চামড়ার ব্যবসায়ীর সাথে কী কাজ থাকতে পারে?

 প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। জাহান বলে উঠে, “আসুন।” এরপর যে ঘরে প্রবেশ করে ভয়ে তার চেহারা থকথকে জেলির মতো মনে হয়। জাঞ্জিবার-এর মাননীয় কনসাল ঘরে প্রবেশ করে। বুজার্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু জাহান আগন্তুককে স্বাগত জানায়। “গুড মর্নিং মি গ্রে। আপনার সাথে আবার দেখা হবে এটা কখনো ভাবিনি।”

 মানুষ তাকে দেখার পর যে বিস্ময়, ঘৃণা আর বমি করার মতো এক্সপ্রেসান দেয়, তাতে বুজার্ড ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে দেখার পর গ্রে এর মুখের যে অবস্থা হলো, সেটা অন্য সবার এক্সপ্রেসানকেও ছাড়িয়ে গেল। বিস্ময়ে লোকটার মুখ হা হয়ে গেল, বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে যেন সে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু কথা বলার জন্য যথেষ্ট বাতাস সে ফুসফুসে নিতে পারছে না। অবশেষে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয়। “কিন্তু…কিন্তু… আপনি তো মৃত।”

বুজার্ড তার ছেচে যাওয়া ঠোঁটের অংশটক দিয়ে হাসার চেষ্টা করে। “হয়ত সেটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সর্বশক্তিমান বিধাতা আমাকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

 “সত্যিই আল্লাহ তাআলা অনেক দয়ালু ও সবজান্তা,” গ্রে বলে উঠে। এই ফাঁকে সে জাহান-এর দিকেও এক পলক তাকিয়ে নেয় তার অভিব্যক্তি বোঝার জন্য।

জাহান কথা বলা শুরু করে। “এখন আপনারা দুজন পুনরায় একত্রিত হয়েছেন। আমাকে এই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে দিন। হেনরি কার্টনির কারণে আপনাদের দুজনের এবং আমাদের লোকদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা সম্পর্কে আমি জানি। আমি এবং আমার ভাই গ্রান্ড মোগল-এর ইচ্ছে আপনারা দুজন একত্রিত হয়ে এটার প্রতিশোধ নিবেন।”

“আমার ভাই কিছুদিন আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। চুক্তিটা ভূমি সংক্রান্ত বেশ বড় ধরনের চুক্তি। আমার ভাই মনে করে এই চুক্তি বেশ সুফল বয়ে আনবে। তাই এরকম সময়ে সে ইংল্যান্ডের এরকম একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকের পেছনে সরাসরি লাগতে চাচ্ছে না। এতে তার ধনী হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।”

“কার্টনি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে,” বুজার্ড মনে মনে চিন্তা করল। কথাটা তাকে বেশ অবাক করল।

 “একারণে আমাদের হয়ে কাজ করার জন্য মাধ্যম হিসেবে কোনো বিচক্ষণ ও ধূর্ত লোককে আমাদের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আপনাদের দুজনের চেয়ে বিশ্বস্ত আর কে হতে পারে? ক্যাপ্টেন কার্টনিকে ঘৃণা করার পেছনে আপনাদের দুজনেরই যথেষ্ট কারণ আছে। এই লোক সম্পর্কে আপনারা দুজনেই বেশ ভাল করেই জানেন। তার চিন্তাভাবনা গতিবিধি সবই আপনাদের জানা। আপনার উচিত, নিজেদের ব্যর্থতার জন্য অনুশোচনা করা, এবং নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করা, কারণ এই আমার জায়গায় যদি অন্য কোনো রাজা হতো, তাহলে ব্যর্থতার দায়ে আপনাদেরকে সে অনেক আগেই হত্যা করার আদেশ দিত।”

“তার মানে মহামান্য রাজা চাচ্ছেন আমাদেরকে দিয়ে ক্যাপ্টেন কার্টনিকে হত্যা করতে?” গ্রে-এর গলার স্বর শুনেই বোঝা গেল যে সে বিপদ টের পেয়েছে।

“অনেকটা তাই, তবে সেটা আপনাদের নিজেদের তলোয়ার দিয়ে না, জাহান তাদেরকে আশ্বস্ত করে। আমার মনে হয় আপনারা দুজনের কেউই সেটার জন্য উপযুক্ত না। আপনি তার সাথে পাত্তাও পাবেন না, গ্রে। আর আর্ল…উনি দুই হাত দিয়েও কার্টনির কিছু করতে পারেননি, এক হাত দিয়ে আর কিইবা করবেন। কিন্তু আপনারা অন্য কোনো উপায়ে তাকে নিঃশেষ করে দিতে পারেন। আপনারা তাকে খুঁজে বের করে ফাঁদে ফেলুন। তখন অন্তত অন্য কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে। এরপর আপনি সবাইকে বলবেন যে কার্টনিকে আপনিই হত্যা করেছেন। আমার মনে হয়, আপনার বর্তমান অবস্থা দেখার পর সবাই একমত হবে যে কার্টনির উপর প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার আপনার আছে।”

“আর আমরা যদি আপনার হয়ে এই কাজটা করতে রাজি না হই, তবে?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করে।

জাহান উচ্চ হাসি হেসে বলে, “আপনারা অবশ্যই রাজি হবেন। প্রথমত, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যত সরঞ্জাম এবং মানুষজন প্রয়োজন হবে সবই আমি আপনাদের সরবরাহ করব। দ্বিতীয়ত, আপনি এবং কনসাল গ্রে উভয়েই এখানে এই বিল্ডিং-এর নিচে সেদিনই মারা যাবেন যেদিন আপনারা আমার প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানাবেন। আমি অনেক দয়ালু মানুষ। কিন্তু আমার হুকুম অমান্য করার অপরাধ আমি ক্ষমা করি না।”

গ্রে একলাফে মাটিতে শুয়ে পড়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে থাকে। আপনি অতি দয়ালু এবং মহানুভব যে আমার মতো একজনকে দয়া দেখিয়েছেন। আমি খুবই সম্মানিত বোধ করব, সেই সাথে কৃতজ্ঞ থাকব যদি আমি আপনার সেবায় নিয়োজিত হতে পারি।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে কনসাল, দয়া করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ান।” জাহান উত্তর দেয়। এরপর সে বুজার্ড-এর দিকে তাকিয়ে বলে, “আর আপনি?”

“আমিও আপনার প্রস্তাবে রাজি। এমনকি আমি আপনাকে এটাও বলব যে তাকে এই মুহূর্তে কোথায় পাওয়া যাবে। এখন কেবল একটি জায়গাতেই সে যেতে পারে।”

“সময়মত জেনে নেব, এখন অন্য ব্যাপারে কথা বলি,” জাহান বলল। “প্রথমত, গত কয়েকদিন ধরে যে ব্যাপারটা দেখে অবাক হচ্ছি তা হল আপনার গায়ের চামড়া অনেক সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় বাইরের গরম রোদ কিংবা বাতাস কোনোটাই আপনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই আপনার জন্য বিশেষ একধরনের হেডগিয়ার বানানোর আদেশ দিয়েছিলাম যেটা আপনাকে রক্ষা করবে।”

দুই হাত দিয়ে তালি বাজাল জাহান। সাথে সাথে চামড়ার ব্যবসায়ী আহমেদ এসে তার বক্সটা খুলে একটা জিনিস বের করল। সেটা দেখতে অনেকটা চামড়ার ক্যাপ বা হুড-এর মতো মনে হচ্ছে। জিনিসটার ওপর বেশ কিছু নকশাও করা আছে। কিন্তু আহমেদ যেভাবে এটা ধরে আছে তাতে বুজার্ডের পক্ষে বুঝে উঠা সম্ভব হয় না যে এটা আসলে কী কাজে লাগতে পারে।

আহমেদ আস্তে আস্তে বুজার্ডের দিকে এগোতে থাকে। তার চোখ নিচের দিকে ফেরানো। যেন সে কাজের আগে দানবটার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে। যখন চামড়া ব্যবসায়ী বুজার্ড-এর কাছে পৌঁছায় তখন নতুন আরেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। দেখা যায় বুজার্ড চামড়া ব্যবসায়ীটির চেয়ে অনেক লম্বা। আহমেদ অনুগ্রহপূর্বক দৃষ্টিতে জাহান-এর দিকে তাকায়। জাহান তখন অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “যদি আপনি মাথাটা একটু নত করেন তো খুব ভাল হয়।”

 “আমি এই লোকের দিকে মাথা নুইয়ে দাঁড়াব?” বুজার্ড ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠে।

 “তাহলে তুমি এটা হারাবে,” জাহান একটু থামে। এরপর আবার শান্ত স্বরে বলতে শুরু করে, “দয়া করে অস্বীকার করবেন না। আপনি মাথা নত করুন, লোকটিকে তার কাজ করতে দিন। “আমি কথা দিচ্ছি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই আমি আপনাকে দিব। আমাকে বাধা দিলে আপনি মারা পড়বেন।”

 বুজার্ড তার মাথা নোয়ায়। কিছু সময় পরে সে ব্যথায় ছটফট করতে করতে চিৎকার করে উঠে। কারণ একটি চামড়ার হুড তার মুখমণ্ডলের ক্ষতের ওপর দিয়েই পরানো হচ্ছে। বুজার্ড এখন শুধু চামড়ার ওপর দিয়ে কাটা এক চক্ষু দিয়ে পৃথিবীটা দেখছে। চামড়ার হুডটা খুব শক্তভাবে বুজার্ডের মুখমণ্ডলের ওপর লাগানো হয়েছে। চামড়ার ওপর দিয়ে নাকের সামনে করা দুটো ছিদ্রের মধ্যদিয়ে সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মুখের অংশটুকু ছাড়া সারা মুখমণ্ডল চামড়া দিয়ে ঢাকা। কিন্তু কিছু সময় পরে সে অংশটুকুও ঢেকে দেয়া হয় আরেকটা চামড়ার পদা দিয়ে। এই পদটিা অনেকটা কাপের আকৃতিতে তৈরি যেটা বুজার্ডের থুতনিতে আটকে গিয়েছে। এই কাপ আকৃতির ফ্ল্যাপ এবং মাস্কের অন্য অংশের মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। ফলে বুজার্ড মুখটা নাড়াতে পারছে। ফ্ল্যাপটা শক্তভাবে লাগানোর ফলে বুজার্ড মুখের দুইপাশে বেশ টান অনুভব করছে। কিছুক্ষণ পর ক্লিক করে একটা তালা লাগানোর মতো শব্দ শুনতে পায় সে।

ভয়ে আঁতকে উঠে বুজার্ড। সে তীব্রভাবে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করে দিল, এরপর আহমেদকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। আরেকবার আক্রমণ করার আগেই সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলল। তাকে টেনে হেঁচড়ে পেছনে নিয়ে যেতে থাকল তারা। শেষপর্যন্ত শরীর বাঁকিয়ে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া বুজার্ড-এর হাতে আর কোনো উপায় রইলো না।

আরেকবার কারিগর-এর হাত অনুভব করে বুজার্ড। চামড়ার বড় একটা কলার তার গলায় আটকিয়ে পেছনে তালা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। বুজার্ড শুনতে পায় জাহান বলছে, “যি. গ্রে, আপনি কী একটা আয়না এনে আপনার স্বদেশীর সামনের ধরবেন। আমার মনে হয় আর্ল নিজেকে আয়নায় দেখে বেশ খুশি হবেন।”

“উম…ম… আমি?” গ্রে তোতলামি করে জবাব দেয়।

“প্লিজ!” জাহান আবার ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দেয়। “আমাকে কী আবার মনে করিয়ে দিতে হবে যে, আপনি আমার অনুরোধ অস্বীকার করলে কী পরিণতি হবে?”

বুজার্ড শুনতে পায় গ্রে-র পায়ের শব্দ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সৈন্যরা তার হাত ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল বুজার্ড। সে যখন মাথাটা তোলে তখন সরাসরি আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়। সে এখন নিজেকে দেখতে পাচ্ছে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে পৃথিবী তাকে দেখছে। রাগে বিতৃষ্ণায় সে চিৎকার করে কেঁদে উঠে।

তার পুরো মাথাটা চামড়ায় ঢাকা। নানান দিক থেকে সেলাই করে মুখোশটা বানানো হয়েছে। চামড়ার ওপর আঁকা বড় বড় আইতে তাকে দেখতে ভয়াবহ লাগছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখটার ওপর সাদা কালো রঙ দিয়ে চোখ আঁকা রয়েছে, যেটা আরো কিছু ভয়াবহতা যোগ করেছে। মুখোশের নাকটা পাখির ঠোঁটের মতো ছুঁচালো যেটা সম্ভবত তার নামটাকে কটাক্ষ করার জন্যই বানানো হয়েছে। এছাড়াও সেলাই করা মুখোশের ওপর দাঁতাল দানবীয় হাসি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুই পাটি দাঁতের মাঝখানে অল্প একটু ফাঁক রয়েছে। এটুকু দিয়ে সে কথা বলতে আর খেতে পারবে।

বুজার্ড একসসময় পর্তুগীজ এক দাস বিক্রেতার বাড়িতে এরকম একটা মুখোশ ঝুলানো দেখেছিল। ঐ লোক ওটাকে এক উপজাতীয় জাদুকর ডাক্তার এর কাছ থেকে পেয়েছিল। আর এখন একইরকম একটা মুখোশ তাকে পরানো হয়েছে।

অসহ্য ব্যথা আর হতাশায় সে চিৎকার করতে থাকে। বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট আঙুলগুলো দিয়ে তালা ধরে এদিক সেদিক টানতে থাকে যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে এটা ভেঙে ফেলবে। এসময় সে অপমানের সর্বশেষ স্তরটাও দেখতে পায়। তার গলায় থুতনির নিচে একটা ধাতব রিং ঝুলানো আছে। মুহূর্তেই সে বুঝে ফেলে এটা লাগানোর অর্থ কি। সে যদি জাহান-এর কথামত না চলে কিংবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে এটাতে চেইন লাগিয়ে কুকুরের মতো রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।

বুজার্ড ভগ্ন হৃদয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। সে এমন এক মানুষ যে আগুনে পুড়ে এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার পরও এখনো বেঁচে আছে। সূর্য এবং সাগর যখন তাকে সম্মিলিতভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে তখনও সে জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছে। যেকোনো মরণশীল মানুষের চেয়ে বেশি কষ্ট সে সহ্য করেছে, সেই সাথে মানুষের ঘৃণা সহ্য করেছে। তার সর্বশেষ ধাক্কা হয়তো এটাই।

ধীরে ধীরে বুজার্ড-এর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে জাহান। তার হাতে নকশা করা একটা সাদা এনামেল-এর কাপ। সে এতটাই নরম সুরে কথা বলে উঠল যে, শুনে মনে হচ্ছিল সে যুদ্ধে আহত হওয়া রাগান্বিত কোনো ঘোড়াকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। “এই নাও এটা পান কর, ঠাণ্ডা মিষ্টি শরবত।”

 বুজার্ড কাপটা হাতে নেয়, এরপর মুখে দেয়ার চেষ্টা করে। বুজার্ড কাত হয়ে যতবারই শরবত পান করার চেষ্টা করল ততবারই ওটা মুখোশের সাথে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল। সে মাথা ঘুরিয়ে নানান রকম উপায়ে ওটা পান করার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু একফোঁটা শরবতও তার মুখে গেল না। ভিন্ন উপায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে, কিংবা মুখোশ নাড়িয়ে কোনোভাবেই এটা পান করার কোনো উপায় সে বের করতে পারছিল না।

ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অন্য লোকগুলো প্রথমে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। খানিক বাদে পুরো ব্যাপারটায় খুব মজা পেতে থাকে তারা। এক পর্যায়ে সবাই খুব উচ্চস্বরে হেসে উঠল। বুজার্ড এসব কিছু সহ্য করতে না পেরে হাতের কাপটা এত জোরে ছুঁড়ে মারল যে ঘরের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল সাথে সাথে। জাহান আবার কথা বলা শুরু করল বুজার্ডকে উদ্দেশ্য করে। “তুমি শুধু জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে শিখেছ। কর্তৃত্ব করতে শিখেছ। কিন্তু মানুষ হতে শিখনি। উঠে দাঁড়াও, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব কিভাবে পানি পান করতে হয়।”

আবারো দুই হাতে তালি বাজাল জাহান, আর সাথে সাথে কালো আফ্রিকান এক চাকর হাতে পিতলের একটা জগ নিয়ে হাজির হলো। পিতলের জগে এক ধরনের নল লাগানো আছে যেটা দেখতে অনেকটা গাছে পানি দেয়ার নলের মতো। চাকরটা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে বুজার্ডের দিকে তাকাতে তাকাতে এগুতে থাকে। এরপর সাধ্যমত দূরত্ব বজায় রেখে জগটা বুজার্ডের দিকে এগিয়ে দেয় যেন নলটা বুজার্ডের মুখের ভেতর যায়। বুজার্ড ঠোঁট দিয়ে নলটা ধরে তৃষ্ণার্ত পশুর মতো পানি পান করতে থাকে। জাহান পুনরায় যখন তালি বাজাল তখন এক ধাক্কায় নলটা বুজার্ভের মুখ থেকে সরিয়ে নেয়া হলো।

“তোমাকে খাওয়ানো এবং পানি পান করানো হবে দাসদের দ্বারা, যাদেরকে শাস্তিস্বরূপ এই দায়িত্ব দেয়া হবে আরকি। যখন তুমি রাস্তায় বের হবে মহিলারা তোমার দিক থেকে ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিবে। বাচ্চারা যারা দুষ্টামি করবে তাদেরকে রাতে তোমার ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হবে। যুবক ছেলেরা একজন আরেকজনের সাথে বাজি ধরবে যে কে তোমার দিকে সবার আগে পচা সবজি ছুরে মারতে পারবে। যখন তারা কেউ ভুলবশত এটা করে ফেলবে তখন আমার লোকেরা তাদেরকে শাস্তি দিবে। আর এভাবে…তুমি সত্যিকার অর্থে ভয় আর ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হবে।”

“কিন্তু পরবর্তীতে সেই ঘৃণা তোমার কাছে শূন্য মরুভূমিতে এক বিন্দু বালির মতো মনে হবে। একমাত্র আমিই সেই ঘৃণাকে বদলে দিতে পারি, তৃপ্ত করতে পারি যদি তুমি আমার কাজ কর।”

 “এবং তোমার জন্যেও একই কথা মি গ্রে…” এরপর জাহান ঠাণ্ডা এবং কঠোর কণ্ঠে রাষ্ট্রদূত-এর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল। “তুমি এখনি আমার বাড়ি থেকে চলে যাবে। আর কখনো আসবে না-যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি হেনরি কার্টনির ছিন্নমস্তক একটা বড় পাত্রে করে নিয়ে আসতে পারবে অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে পারবে। তুমি যখন এই দুটোর কোনো একটা করতে পারবে কেবল তখনি তুমি আবার এইখানে দাঁড়াতে পারবে। আবার সেই পূর্বের সম্মান ফিরে পাবে। এর আগ পর্যন্ত এখানে তুমি রাস্তার লোক বলেই গণ্য হবে। তুমি এখন যেতে পার।”

গ্রে-কে অবনত মস্তকে বের হয়ে যেতে দেখে বুজার্ড-একটু হাসার চেষ্টা করল। জাহান পুনরায় বুজার্ড-এর দিকে ফিরল। “আমার এই মাত্র মনে পড়ল যে তুমি এখন নপুংসক। আমি তোমাকে একটা সুযোগ দেব যেটা আমি কখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ পুরুষকে দেইনি। যখন আমি আমার প্রিয় উপপত্নীদের সাথে রাতের খাবার খেতে যাব তখন তুমি আমার সাথে থাকবে। তারা এক একজন নিখুঁত সৌন্দর্যের অধিকারী যাদেরকে ইন্ডিয়া, পার্সিয়া কিংবা রাশিয়া এমনকি তোমার নিজের উপকূলের দ্বীপ থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। তারা তোমার সাথে দেখা করতে পারলে আনন্দিত হবে। যদিও তুমি তাদের স্পর্শ করতে পারবে না, খাবার খেতে পারবে না, কোনো কিছু পান করতে পারবে না। কিন্তু তুমি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে এবং তোমার বেঁচে যাওয়া চোখটা দিয়ে সব কিছু দেখতে পারবে। যেদিন হেনরি কার্টনির মৃত্যু হবে সেদিন আমি তোমাকে আমার উপপত্নীদের মাঝ থেকে একজনকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেব। তুমি তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। তুমি ভেবে দেখ কিভাবে তুমি তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করবে। এবার তুমি ভেবে দেখ, ওদের মতো সুন্দর রমণীরাও কী তোমাকে হেনরি কার্টনির মৃত্যু দেখার চেয়ে বেশি আনন্দ দিতে পারবে?”

.

তিনদিন পর বুজার্ডকে প্রথমবারের মতো বাইরের পৃথিবীতে বের হওয়ার আদেশ দেয়া হয়। কালো রঙের এক ধরনের পোশাক পরিয়ে ছয়জন গার্ডসহ বুজার্ডকে বের করা হয়। এদের কাজ যেমন বুজার্ডকে রক্ষা করা, তেমনি যাতে সে পালিয়ে যেতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা। তাদেরকে বলা হয়েছে যেন তারা যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বুজার্ড-এর সাথে হাঁটে যাতে লোকজন বুজার্ডকে ভালভাবে দেখতে পায়।

 জাহান যেমন ধারণা করেছিল তেমনি জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় বুজার্ড-এর উপস্থিতি সাধারণের মাঝে ভয়ের উদ্রেক করল। মহিলারা পালিয়ে যেতে থাকে, সাথে থাকা ছেলেমেয়েদের চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর বুজার্ড যখন পুরুষদের সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিল, তখন তাদের মাঝে কেউ কেউ মাটিতে থুতু দিতে থাকল, কেউবা শয়তানের কুনজর থেকে বাঁচার জন্য পকেট থেকে রক্ষা কবচ বের করে হাতে তুলে নিল। সবশেষে সে যখন একটা জায়গার চারপাশে গড়ে উঠা দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন ওই মুহূর্তে তাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল একটি অল্পবয়সি ছেলে। ছেলেটি পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা নর্দমার কাছে চলে যায়। নর্দমার পাশে। ফেলে রাখা ময়লা আবর্জনা থেকে বাম হাত দিয়ে একটা ময়লার ব্যাগ তুলে বুজার্ডের মুখে ছুঁড়ে মারে। সৌভাগ্যবশত সেই ময়লা বুজার্ডকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তবে খুব দ্রুত দুজন গার্ড ভিড়ের মধ্যে ছেলেটিকে ধরে ফেলে সে পালিয়ে যাওয়ার আগেই। রাগে অপমানে গজরাতে থাকে বুজার্ড, আর তাকিয়ে দেখে যে রাস্তার মাঝখানে জাহানের আদেশ পালনকারী সেনাপতি দাঁড়িয়ে আছে।

যখন বিছু শয়তানটাকে ধরে আনা হয় তখন দেখা যায় যে তার বয়স বড়জোড় চৌদ্দ কি পনের হবে। দেখেই বোঝা যায় সে তার তারুণ্যের ঝোঁকে পড়ে কাজটা করেছে। পরিণতি কি হতে পারে সেটার কিন্দুমাত্র চিন্তাও করে দেখেনি সে। সেনাপতি ইতস্তত করতে লাগল। তার নিজেরও একটি ছেলে আছে। এই বয়সের একটি ছেলেকে যে কোনো পরিবারের বুক থেকে আলাদা করতে তার বিবেকে বাধছে।

বুজার্ড সেনাপতির দোটানা মনোভাব বুঝতে পারে। সে ভিড়ের মধ্য থেকে ক্ষমা প্রার্থনার কান্না শুনতে পায়। বুজার্ডের সহজাত প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়ে উঠল। সে বেশ বুঝতে পারছিল যে এই সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এই মুহূর্তেই নির্ধারণ হবে যে লোকজন কী এখন থেকে তাকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করবে, নাকি ভয়ংকর দানবের মতো ভয় পাবে। আর বুজার্ড জানে যে দুটোর ভেতর সে কোনটা বেশি চায়।

“আমার তলোয়ারটা এদিকে দাও,” তীব্র গর্জন করে সেনাপতিকে আদেশ দিল সে। এরপর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল। সেনাপতি তর্ক করার আগেই তার হাত থেকে তলোয়ারটা নিয়ে নিল বুজার্ড।

তীক্ষ্ণ এবং জলন্ত দৃষ্টি দিয়ে সে সৈন্য দুটির দিকে তাকাল যারা ছেলেটাকে ধরে আছে। “তোমরা দুজন ওর হাতদুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেল,” বুজার্ড আদেশ করল। “নিজেদের দায়িত্ব পালন করো, বুঝলে? নইলে মহারাজাকে গিয়ে বলে দেব।”

লোকদুটি ভয় পেয়ে অতি দ্রুত বুজার্ড-এর আদেশ পালন করে ফেলে। বুজার্ড শুনতে পায় যে ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন ছেলেটির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছে।

 বুজার্ড যখন জলন্ত দৃষ্টি দিয়ে ভিড়ের দিকে তাকাল তখন আর কেউ কোনো কথা বলার সাহস পেল না। তার কথা মতো ছেলেটাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হলো। তার বালকসুলভ দুঃসাহস চেহারা থেকে হারিয়ে গেল। তার বদলে ওখানে ফুটে উঠল ভয়ে কাঁপতে থাকা এক শিশুর চেহারা, যাকে সৈন্যরা জোর করে মাথা নিচু করাচ্ছে যেন তার ঘাড়ের পেছনে জায়গামত তলোয়ার বসাতে পারে বুজার্ড।

 বুজার্ড নিচের দিকে তাকিয়ে তার নিশানা ঠিক করতে থাকে। এরপর সমস্ত শক্তি দিয়ে ডানহাতে ধরে রাখা তলোয়ারটা ঘাড়ে বসিয়ে দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কিন্তু তার নিশানা ব্যর্থ হয়। তার বদলে তলোয়ারটা মেরুদণ্ডের দুটি কশেরুকার মাঝখানে আঘাত হানে। তীব্র আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মেরুদণ্ডে আটকে যাওয়া তলোয়ারটা একটানে উঠিয়ে ফেলে বুজার্ড। এরপর পুনরায় আঘাত করে সে। তারপর আরো একবার।

নিশানামত তলোয়ারটা বসাতে তিনবার আঘাত করতে হয় তার। অবশ্য ততক্ষণে বালকটির দেহ নিথর হয়ে গিয়েছে।

এক পা পিছিয়ে আসে বুজার্ড। তার বুক ধরফর করছে। মাথাটা তিনশত ষাট ডিগ্রি কোণে ঘুরিয়ে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা দেখতে থাকে সে। এরপর সেনাপতিকে আদেশ করে, “আমাকে প্রাসাদে নিয়ে চল।”

সৈন্যরা যখন তার কথামত প্রাসাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন সে মনে মনে একটা কথাই বলছিল, “এতেই হবে। আমার যা দেখানোর, দেখিয়ে দিয়েছি আমি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *