০৫. হোটেলে যাওয়ার পথে

০৫.

হোটেলে যাওয়ার পথে ওদের মাঝে খুব একটা কথা হলো না। রুথ ক্যানিংহাম সানগ্লাস খুলে আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখতে থাকল, এই ফাঁকে কেইন মহিলাটি সম্পর্কে ভাবতে লাগল।

 জেটি পার হয়ে ওয়াটারফ্রন্ট ধরে যখন ওরা হাঁটতে আরম্ভ করল, তখন কেইনের মনে হলো স্কিরোজ ভুল বলেছিল। মহিলা শুধু যে সুন্দরী তাই নয়–তিনি অসাধারণ সুন্দরী। সাধারণ একটা সুতির পোশাকেও হাঁটার ছন্দে তার হালকা পাতলা গড়নের সৌন্দর্য ফুটে উঠছিল। অনেক দিন পর কেইন এমন একজন মহিলার সাথে কথা বলল–অর্থাৎ তার নিজের পছন্দের।

উঁচু হোটেলটির সামনে একটা সরু প্রবেশ পথ রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে। ভেতরে এই শ্বাসরুদ্ধকর গরমে পুরনো একটা ফ্যান আস্তে আস্তে ঘুরছে। কেইন প্রবেশ ঘরটি পার হয়ে বারের দিকে পথ দেখিয়ে চলল।

ভেতরে কেউ নেই, কেবল সাগর থেকে বয়ে আসা মৃদু মন্দ বাতাসে ফ্রেন্চ উইন্ডোগুলো হালকা শব্দ করছে। রুথ কানিংহাম সানগ্লাস খুলে একটু ভ্রু কুঁচকালো।

‘এই জায়গায় কি কোন সার্ভিস পাওয়া যাবে না?

কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিল। এই এলাকায় খুব একটা কাজকর্ম নেই। বেশিরভাগ মানুষ বিকেলে ঘুমিয়ে কাটায়। তাদের ধারণা এই প্রচণ্ড গরমে আর কিছু করার নেই।’

রুথ মৃদু হাসল। হু, তাই বলা হয়, ভ্রমণে অনেক কিছু জানা যায়।

কেইন বারের পিছনে গিয়ে বলল, “আপনি বরং বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসুন, আমি ড্রিংকস নিয়ে আসছি। সাগর থেকে আসা হাওয়ায় ওখানে একটু ঠাণ্ডা পাওয়া যাবে।’

 সে মাথা নেড়ে ফ্রেন্চ উইন্ডো দিয়ে বাইরে গিয়ে একটা রঙ্গিন ছাতার নিচে একটা বড় বেতের চেয়ারে বসল। কেইন বারের নিচে থেকে পুরনো আইসবক্স খুলে বড় দুই বোতল লেজার বিয়ার নিল। বোতলদুটো এত ঠাণ্ডা যে বাইরের দিকে আদ্রতা জমে ফোঁটা ফোঁটা বরফ হয়ে গিয়েছে। সে বারের গায়ে ঠেকিয়ে এক টানে বোতলের ক্যাপ খুলে দুটো লম্বা পাতলা গ্লাসে ঠাণ্ডা বিয়ার ঢেলে নিয়ে বাইরে বারান্দায় গেল।

গ্লাসটা রুথের হাতে তুলে দিতেই সে কৃতজ্ঞ চিত্তে তার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি গ্লাসে একটা চুমুক দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে এত ঠাণ্ডা কোন কিছু আছে। এই জায়গাটা একটা চুল্লির মতো। সত্যি বলতে কি, আমি ভাবতেই পারিনা যে কেউ এখানে ইচ্ছা করে থাকছে।’

‘কেইন একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “ই, আপনার কথায় কিছু যুক্তি আছে অবশ্য।

রুথ একটু মৃদু হাসল, মনে হয় তা আমার নজর এড়িয়ে গেছে। চেয়ারের রঙ চটা কুশনে হেলান দিয়ে সে বলল, “মি. এন্ড্রুজ বলেছেন আপনি নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্বের প্রভাষক ছিলেন।

সে মাথা নাড়ল। সে তো অনেক দিন আগের কথা।’

রুথ বলল, আচ্ছা আপনি কি বিবাহিত?

সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল, ‘ডিভোর্স হয়েছে। আমার স্ত্রী আর আমার মধ্যে কখনো মেলে নি।

রুথ ক্যানিংহাম একটু লজ্জিত হল, আমি দুঃখিত এই বিষয়টা এভাবে টেনে আনার জন্য। আপনি মনে কিছু করেননি তো?

 ‘ঠিক উল্টোটা,’ সে বলল। আমরা সবাই ভুল করি। আমার স্ত্রীর ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ভালই উপার্জন করে।

 আর আপনার মনে কী ছিল?

‘আমার মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে আমি হয়তো একাডেমিক জীবনে সন্তুষ্ট থাকতে পারব। শুধু লিলিয়ানের জন্যই আমি সেখানে লেগে ছিলাম। একদিক দিয়ে বলতে গেলে সে আমাকে মুক্ত করেছে।

তারপর আপনি প্রাচ্যে চলে এলেন?

না প্রথমে তা নয়। বিমান বাহিনী এক বছরের জন্য একটা ফুল টাইম চাইং কোর্স দিয়েছিল, তারপর চার বছর রিজার্ভে। আমি সেটা নিয়ে নিলাম। রেগুলার পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নিলাম। এরপর চলে এলাম এখানে। ছয় বছর আগে একটা আমেরিকান অভিযানে জর্ডানে ছিলাম, তারপর কিছুদিন মিশরীয় সরকারের অধীনে কাজ করলাম, তবে সেটা বেশি দিন টিকলো না। এরপর একজন জার্মান ভূতত্ত্ববিদের সাথে দাহরান চলে এলাম। তিনি আরবি জানা একজন লোক খুঁজছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি এখানেই রয়ে গেলাম।

কখনো দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না?

 সে বলল, “কি করব গিয়ে? একজন সহকারি অধ্যাপকের চাকরি যে প্রাচীন ইতিহাস পড়াবে, যা ছাত্ররা জানতে চায় না?

‘দাহরানে এর চেয়ে ভাল কিছু অফার পাননি?”

সে মাথা নাড়ল। এই জায়গার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আপনার মজ্জার মধ্যে ঢুকে যায়। এককালে এটি ছিল এরাবিয়া ফেলিক্স–সুখী আরব। প্রাচীন জগতে এ জায়গাটি ছিল সম্পদশালী দেশগুলোর মাঝে অন্যতম। তখনকার সময়ে ভারত থেকে মশলার রুটটা এখান দিয়েই ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এখন তা একটা শূন্য মরুভূমি। তবে ঐ পাহাড় আর উত্তরে ইয়েমনে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য বিশাল এক গুপ্ত ধনের ভান্ডার। শহরের পর শহর, কিছু কিছু ধ্বংস্তূপের মাঝে প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়–যেমন মারিব, যেখানে সম্ভবত শেবার রানি রাজত্ব করেছিলেন। অন্যগুলো শত শত বছর ধরে বালুর নিচে চাপা পড়ে আছে।’

‘তাহলে প্রত্নতত্ত্ব হচ্ছে আপনার প্রথম প্রেম, রুথ বলল।

‘অবশ্যই তাই। কিন্তু এখানে আমার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আমরা আসিনি মিসেস কানিংহাম। এখন কি আপনার সময় হয়নি স্বামীর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার?

রুথ তার পার্স থেকে একটা পাতলা সোনার সিগারেট কেস বের করে একটা সিগারেট হাতে নিয়ে বলল, কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। সে একটা দুঃখের হাসি হাসল। আমার ধারণা আমি জীবনের শুরু থেকেই একটু বখে গিয়েছিলাম।’

কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। এটা হতেই পারে। আর আপনার স্বামীর বিষয়টা কি?

রুথ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘জন কানিংহামের সাথে আমার দেশেই কোন এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। লন্ডন স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডি থেকে পাশ করা একজন ইংরেজ। বছরে একবার হার্ভার্ডে লেকচার দিতে যেত। তারপর আমরা বিয়ে করলাম।’

কেইন ভ্রূ উপরের দিকে তুলল, ব্যস এই?’

রুথ মাথা নাড়ল। সে ছিল একজন দীর্ঘদেহী বিশিষ্ট ইংলিশম্যান। তার মতো এমন শান্ত প্রকৃতির মানুষ আমি কখনো দেখিনি।

সমস্যাটা কখন শুরু হল?’

রুথ একটু মৃদু হাসল। আপনার উপলব্ধির ক্ষমতা খুব বেশি, ক্যাপ্টেন কেইন।’ তারপর কয়েক মুহূর্ত সে হাতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকল। সত্যি বলতে কি প্রায় সাথে সাথেই শুরু হল। আমি খুব শিগগিরই আবিষ্কার করলাম, অত্যন্ত নীতিবান একজন মানুষকে আমি বিয়ে করেছি, যে কেবল তার নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকাতেই বিশ্বাস করে।

“সে তো ভালই মনে হচ্ছে।

 রুথ মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু আমার বাবার কাছে নয়। তিনি চাচ্ছিলেন সে তার ফার্মে যোগ দিক, কিন্তু জন সে কথা শুনতেই চাচ্ছিল না।

 কেইন দাঁত বের করে হাসল। ব্যস, জনের খেলা শুরু হয়ে গেল। তারপর কি হল?

রুথ চেয়ারে হেলান দিল, আমরা লন্ডনে থাকতাম। জন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করতো। অবশ্য বেতন খুব বেশি ছিল না। তবে আমার বাবা আমাকে বেশ ভাল অংকের হাত খরচ দিতেন।

মানে যে স্টাইলে আপনি জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন তার খরচ পোষাতে? কেইন বলল। তার কণ্ঠস্বরে খানিকটা সন্দেহপূর্ণ কৌতুকের আভাস পাওয়া গেল।

রুথ মাথা নিচু করে বলল, অনেকটা সে রকমই।

“আর আপনার স্বামী সেটা পছন্দ করতেন না?

বুথ উঠে দাঁড়াল। হেঁটে একটু সামনে এগিয়ে সাগরের দিকে তাকাল। না, সে মোটেও তা পছন্দ করতো না। একঘেয়ে–কণ্ঠস্বরে সে বলল, তারপর ঘুরে যখন কেইনের মুখোমুখি হল, তখন সে টের পেল রুথের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও সে এটা মেনে নিয়েছিল, কেননা সে আমাকে ভালোবাসতো।

তারপর সে ফিরে এসে চেয়ারে বসল। কেইন আলতোভাবে রুথের হাতের উপর হাত রাখল। আরেকটা ড্রিংক দেব?’ সে মাথা নেড়ে মানা করল। কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।

রুথ মুখের সামনে থেকে একগুচ্ছ চুল হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল, দেখুন আমার বাবা নিজের চেষ্টায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একজন মানুষ। জীবনের প্রতিটা ইঞ্চি তাকে যুদ্ধ করে এগোতে হয়েছে। তিনি জনকে সাদামাটাভাবে বলেছিলেন তিনি তার কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করেন না।

‘আর এতে আপনার স্বামীর কী প্রতিক্রিয়া হল?’

রুথ বলল, আমি যেরকম জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলাম সে রকমভাবে চলার জন্য জোর খাটালাম। আর এতে আমার নিজের টাকা থেকে দিতে হতো। কাজেই জন নিজেকে অযোগ্য মনে করতে লাগল। ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিল নিজেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে আরো বেশি সময় কাটাতে লাগল। আমার মনে হয় সে একজন পাগলের মতো ভাবছিল যে এতে তার সুনাম হবে।

কেইন একটা লম্বা শ্বাস নিল। বুঝলাম, তারপর সে আপনাকে ছেড়ে চলে গেল, তাইতো?’

 রুথ মাথা নেড়ে সায় দিল। এক রাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে আর ফিরে এল না। আমার জন্য তার অফিসে একটা চিঠি রেখে গেল। আমাকে বলল কোন চিন্তা না করতে। খুব জরুরি একটা ব্যাপারে তাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য দূরে যেতে হচ্ছে।’

‘এতে কিন্তু এখনও বোঝা যাচ্ছে না কেন আপনি দাহরানে আপনার স্বামীর খোঁজে এসেছেন?’

 ‘সে কথাতেই আসছি এখন,’ সে বলল। চারদিন আগে এডেনের ব্রিটিশ কনসালের কাছ থেকে আমার কাছে একটা প্যাকেট আসে। তাতে কিছু কাগজপত্র আর জনের একটা চিঠি ছিল। তাতে লেখা সে উপকুলীয় স্টিমারে দাহরান যাচ্ছে। সেখান থেকে আরো ভেতরের দিকে শাবওয়া যাবে। প্যাকেটটা কনসালের হাতে দিয়ে কঠোর নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল, যদি দু’সপ্তাহের মধ্যে সে নিজে এসে সেটা দাবী না করে, তাহলে যেন ওটা আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কেইন অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। কিন্তু শাবওয়া তো মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। সে বলল। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় একটা মরুভূমি শাবআল-খালি–শূন্য এলাকার ঠিক কিনারায়। সেখানে তিনি কি করতে গেছেন?

একটা মুহূর্ত রুথ একটু ইতস্তত করল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, আপনি কখনো অ্যাসথারের কথা শুনেছেন, ক্যাপ্টেন কেইন?

 সে একটু ভ্রু কুঁচকে বলল। এক প্রাচীন আরবি দেবী ভেনাসের সমতুল্য। শেবার আমলে তার পুজা হতো।

রুথ মাথা নেড়ে সায় দিল। ঠিক বলেছেন। শেবার রানিও এই গোষ্ঠির একজন উচ্চ পুরোহিত ছিলেন। ওদের মাঝে এক মুহূর্তের নিরবতা নেমে এল। এরপর সে আবার বলতে শুরু করল। আমার স্বামী কোন কারণে বিশ্বাস করতেন ঐ শূন্য এলাকার কোথাও শেবার তৈরি করা অ্যাসথার দেবীর একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে।

আবার কিছুক্ষণের জন্য নিরবতা নেমে এল, তারপর কেইন হতবাক হয়ে তার তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়তে লাগল। না, মিসেস কানিংহাম, আপনার স্বামী যদি সেই জিনিস খুঁজতে গিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে অবাক হওয়ার কোন কারণ নেই–কেন আপনার স্বামী আর যোগাযোগ করেন নি। ঐ জায়গায় কেবল বালু, গরম আর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছু নেই।

 ‘কিন্তু আমার স্বামী অন্য উপায়ে কিছু জেনেছিলেন। দেখুন কয়েকমাস আগে তিনি একটি অত্যাশ্চর্য বিষয় আবিষ্কার করেছিলেন। তার গবেষণার কাজের অংশ হিসেবে তাকে প্রাচীন আরবি পান্ডুলিপি আর ভুর্জপত্র অনুবাদ করতে হয়েছিল। এর বেশিরভাগ সিনাই পর্বত এলাকার সেইন্ট ক্যাথারিন মঠ থেকে এসেছিল। এগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করলেন এর একটি ইতোপূর্বে ব্যবহার করা হয়েছে। ঐ পুরনো হস্তলিপির কিছু অংশ মুছে গেছে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত যন্ত্র ব্যবহার করে মূল লেখাটার একটা অনুলিপি তৈরি করলেন।

এবার কেইনের আগ্রহ বাড়তে লাগল। সেটিও কি আরবিতে ছিল?

 সে মাথা নেড়ে বলল। সেটা ছিল গ্রিক ভাষায়। আলেক্সিয়াস নামে একজন গ্রিক অভিযাত্রির একটি বিশেষ অভিযানের বর্ণনা। তিনি রোমান সেনাবাহিনীর দশম লিজিয়নে একজন সেঞ্চুরিয়ান ছিলেন। রুথ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। আপনি এলিয়াস গ্যালাস নামে একজন রোমান জেনারেলের নাম শুনেছেন?’

কেইন দ্রুত মাথা নাড়ল। খ্রিষ্টপূর্ব ২৪ শতকে তিনি দক্ষিণ আরব বিজয়ের চেষ্টা করেছিলেন। দক্ষিণে শেবা পর্যন্ত গিয়ে মারিব শহর দখল করেন। ফেরার পথে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখিন হন। মরুভূমিতে তার সৈনিকদের বেশির ভাগই হারিয়ে যায়।’

রুথ মাথা নেড়ে সায় দিল। আলেক্সিয়াসের বর্ণনা অনুযায়ী তারা আরো দক্ষিণে এগিয়ে টিমনা পর্যন্ত এগোন। তারপর শাওয়ার দিকে মার্চ করতে থাকেন। সেখানে পৌঁছে এলিয়াস গ্যালাস শেবার মন্দিরের কথা শোনেন। এর অবস্থান হওয়ার কথা শাবওয়া আর মারিবের মাঝে প্রাচীন মশলার রুটের কাছে। পথটা মরুভূমির এক কোন দিয়ে অতিক্রম করেছে। সেই জায়গার সম্পদ সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। আলেক্সিয়াসের প্রতি নির্দেশ ছিল একদল অশ্বারোহী নিয়ে মরুভূমিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পরবর্তীতে মারিবে মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়া।’

রুথ একটু বিরতি দিতেই কেইন বলল, বলে যান। সে কি তা খুঁজে পেয়েছিল না পায়নি?

রুথ মৃদু হাসল। হ্যাঁ, সে অবশ্যই তা খুঁজে পেয়েছিল। মরুভূমির মাঝে সাতটি পাথরের স্তম্ভ দিয়ে পথটি চিহ্নিত ছিল আর মন্দিরটি ছিল শাবওয়া থেকে আশি নব্বই মাইল দূরে। একটি গিরিখাতের মাঝে এক বিশাল পাথরের ভ্রুপের মাঝে এটি অবস্থিত ছিল আর আলেক্সিয়াসের বর্ণনানুযায়ী অপ্রত্যাশিত ভাবে এটি বালিয়াড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছিল। যখন তারা সেখানে পৌঁছাল তখন মন্দিরটি শূন্য ছিল কেবল একজন পুরোহিত–বৃদ্ধা রমণী উঁচু বেদিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসেছিল। প্রথমে যারা ঢুকেছিল তারা কোন ধনরত্ন না দেখতে পেয়ে এত নিরাশ হয়ে গিয়েছিল যে তারা ঐ বৃদ্ধা রমণীটিকে নির্যাতন শুরু করল, কথা বলতে। আলেক্সিয়াস অনেক দেরিতে আসায় ওদের থামাতে পারল না। ততক্ষণে ওদেরকে অভিসম্পাত করতে করতে বৃদ্ধা মারা গেল।

 তারপর নিরবতা নেমে এল। কেইন হঠাৎ এক ধরনের শিহরন অনুভব করল। সে বলল, ওরা কি মন্দিরের গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছিল?

রুথ মাথা নাড়ল। এটা খুব গোপনে সংরক্ষিত ছিল। দুটো দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সফল হলো না। তারপর ওরা শাবওয়ার দিকে ফিরে চলল। ফেরার পথে খোলা প্রান্তরে প্রথম রাতে ওরা ভয়ংকর বালু ঝড়ের কবলে পড়ল। একদিনের বেশি চলল এই ঝড়। কয়েকটা ঘোড়া হারিয়ে ওরা একটা ঘোড়ার পিঠে দুজন করে চলতে লাগল। এরপর পানির প্রথম কুপটির কাছে পৌঁছে দেখল তাতে বিষ মেশানো হয়েছে।’ রুথ কাঁধ খানিকটা উঁচু করে ঝাঁকি দিল। বাদবাকি ঝঞ্ঝাটপূর্ণ বিবরণ বাদ দিলে এটুকু বলতে হয় যে, একমাত্র আলেক্সিয়াস মরুভুমি থেকে পায়ে হেঁটে জীবিত ফিরে এসেছিলেন।

কেইন বলল, তিনি সত্যিকার একজন মানুষ ছিলেন বটে।

সে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমি আপনাকে পান্ডুলিপির অনুবাদটা পড়তে দেব। আপনি নিজেই বিবেচনা করতে পারবেন। তিনি ব্যাখ্যা করেননি কেম করে মূল সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়েছিলেন, তবে যে করেই হোক কি তা পেরেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি প্যালেস্টাইনে বার-শেবা দূর্গের অধিনে ছিলেন।

কেইন উঠে সামনে এগিয়ে প্যারাপেটের কিনারায় এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি চলে গেল এডেন উপসাগরের দিকে।

ক্যাটালিনা বন্দরে পানি ছড়িয়ে শহর পার হয়ে যাচ্ছে। একটা পণ্যবাহী জাহাজ দিগন্ত দিয়ে ধীরে ধীরে ভারত উপমহাসাগরের দিকে যাচ্ছে। আর তিনটা ধাও বড় বড় পাখির মতো বন্দরের দিকে এগিয়ে আসছে।

 সে এসব কিছুই দেখেনি। তার চোখের সামনে তখন শূন্য এলাকা রাব আল-খালি ভেসে রয়েছে, যার মাঝে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে শেবার মন্দির।

যখন সে সিগারেট ধরাল তখন তার হাত কাঁপছিল আর সারা শরীর অজানা উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের অভিজ্ঞতা ইতোপূর্বে তার জীবনে কেবল দুবার ঘটেছিল। দুবারই সে একটি অভিযাত্রী দলের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কোন আবিষ্কারের সন্ধিক্ষণে ছিল।

কিন্তু এটি সম্পূর্ণ আলাদা। এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়–যা সারা জীবনে কেবল একবারই পাওয়া যায়। এমন একটি বিষয় যা নসোস কিংবা ভ্যালি অফ দি কিংএ তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের সাথে তুলনীয় হতে পারে।

 যখন সে ফিরে রুথের মুখোমুখি হল, তখন সে নিজের স্থির কণ্ঠস্বর দেখে অবাক হল। আপনার কি কোন ধারণা আছে আপনি এখন আমাকে যা বলেছেন তা যদি সত্য হয় তবে এর গুরুত্ব কতটুকু?

রুথ ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি কি গুপ্তধনের কথা বলছেন?

রাখুন আপনার গুপ্তধন!’ সে টেবিলে ফিরে এসে চেয়ারে বসল। শেবার সম্পর্কে যা কিছু আমরা জানি তা কেবল বাইবেলে আছে। তার নাম উল্লেখ করে কোথাও কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি, এমনকি মারিবেও নেই। যে জায়গাকে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ তার রাজধানী ছিল মনে করেন। এরকম একটা আবিষ্কার শুধু একাডেমিক জগতেই নয়, সারা দুনিয়ায় আলোড়ন তুলবে।

আচ্ছা! তাই নাকি? রুথ ধীরে ধীরে বলল, ‘এতে বোঝা যায় কেন আমার স্বামী এই আবিষ্কার নিজের কাছে রেখেছিলেন।

কেইন নাক টেনে বলল, তিনি একজন বোকা লোক। এ ধরনের বিষয় সফলভাবে সামলাতে পারে কেবল মাত্র পুরোপুরি সুসজ্জিত একটা অভিযাত্রী দল।

 ‘কিন্তু আপনি বুঝতে পারলেন না? রুথ বলল। সে আমার সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল এটা হবে কেবল তার নিজের একার, কোন সাহায্য ছাড়া একটি আবিষ্কার। যদি সে বিখ্যাত হতো সেটা হতো কোন মানুষের সাহায্য ছাড়া নিজের চেষ্টায় অর্জিত খ্যাতি।

কেইন অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হাসল। যদি তিনি রাব আল-খালিতে একা যাবার চেষ্টা করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি একজন বোকা মানুষ। পানির তৃষ্ণায় মরে না গেলেও সম্ভবত গলা কাটা অবস্থায় বালুতে কোথাও উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।’

রুথের চোখে গভীর বেদনার আভাস দেখা দিল, সে নার্ভাস হয়ে বার বার হাত মুঠো করতে লাগল। আপনি বলেছেন শাবওয়া নিরাপদ জায়গা নয়, ক্যাপ্টেন কেইন। এটা বলতে আপনি ঠিক কি বুঝাতে চেয়েছেন?

সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। এডেন একটি সংরক্ষিত এলাকা আর ওমানের সাথে সউদী আরবের সীমান্ত বিরোধ আছে। বছরকে বছর ধরে সর্বদা গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ লেগেই আছে। এই জায়গার সামরিক নিরাপত্তা দেখার ভার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে। তবে বিশ্বাস করুন এমনিতেই ওরা কর্মব্যস্ত। তাছাড়া সব জায়গায় সাথে সাথে পৌঁছাতে পারে না বলে সেই সব জায়গাকে ওরা ব্যান্ড সিকিউরিটি এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ কেউ যদি বোকার মতো সেসব এলাকায় যায় তবে তাদের কিছু হলে ব্রিটিশরা কোন দায় নেবে না।’

এরপর রুথ অস্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে শাবওয়া সে রকমই একটা এলাকা?

কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। অবশ্যই তাই। তারপরও লোকজন সেখানে যায়। যেমন এই মুহূর্তে জর্ডন নামে একজন আমেরিকান ভুতত্ত্ববিদ সেখানে তেল অনুসন্ধান করছে। সেখানে সে টিকে থাকতে পারছে চারদিকে মুড়ির মতো রুপার মারিয়া থেরেসা ডলার মুদ্রা ছড়িয়ে আর নিজের চারপাশে একদল বাছাই করা গলাকাটা ডাকাত জড়ো করে। এরা নিজেদের স্বার্থে নিশ্চিত করবে যেন সে জীবিত থাকে।

‘আপনি কখনও সেখানে গিয়েছেন?

কেইন মাথা নাড়ল কয়েকবার, তবে সেখানকার স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর মাঝে আমি সুপরিচিত। এরা বেশিরভাগই মুসাবেইন আর একবার আপনাকে পছন্দ করলে ওরা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। তবে মুশকিল হলো শূন্য এলাকার সীমানায় দস্যুদের আবাস। যে সব লোকদেরকে বিভিন্ন অপ্রীতিকর কাজের জন্য তাদের গোত্র থেকে বের করে দেওয়া হয় তারাই সেখানে আড্ডা গেড়ে থাকে। যদি ওরা আপনাকে বাগে পায় তাহলে জ্যান্ত ছাল ছিঁড়ে রোদে টাঙিয়ে রাখে। কেমন লোক ওরা বুঝতেই পারছেন।

রুথের পুরো চেহারায় আতংক ভরে উঠল। আপনি মনে করেন সেরকম কিছু একটা আমার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেছে?

কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিল। কিছুই বলা যায় না, নাও হতে পারে, তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। রুথ প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে কাঁপতে দুহাতে মুখ ঢাকলো কেইন উঠে তার পাশে এসে দাঁড়াল। এক হাত তার কাঁধে রাখল। বিশ্বাস করুন, মিসেস কানিংহাম, আমি কেবল আপনাকে সত্য কথাটাই বলার চেষ্টা করছি। তবে তার যে কোন কিছু হতে পারে।’

রুথ উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে কেইনের বাহু আঁকড়ে ধরে তার দিকে তাকাল। কিন্তু জীবিতও তো থাকতে পারেন? এটা কি সম্ভব নয়?’

একটা মুহূর্ত সে প্রায় বলে ফেলতে যাচ্ছিল যে, এর আশা খুব কম। তারপর মৃদু হেসে তার হাতে আলতো করে চাপড় মেরে বলল, অবশ্যই এটা সম্ভব হতে পারে।

 রুথ কাঁদতে শুরু করল। কেইন এক হাত দিয়ে তার কাধ ধরে তাকে। বারের দিকে নিয়ে চলল। আমার মনে হয় এখন আপনি আপনার কামরায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিন। আমি কয়েক জায়গায় খোঁজ নেবো। হয়তো কিছু একটা জানতে পারব। যদি আপনার স্বামী দুমাস আগে দাহরানে এসেই থাকেন তাহলে কেউ না কেউ তাকে অবশ্যই দেখেছে।

রুথ একথা শুনে ঘাড় কাত করল। তারপর ওরা হল পার হয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। কামরার দরজায় পৌঁছার পর রুথ পার্স থেকে চাবি বের করে তালা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। কেইন ধীরভাবে তার হাত থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে তার পেছন পেছন কামরায় ঢুকল।

খালি কামরাটার এক কোণে কয়েকটা সুটকেস দাঁড় করানো রয়েছে। রুথ এগিয়ে উপরের সুটকেসটা খুলল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটা ভারী এনভেলাপ নিয়ে ফিরে এল। এটি হল পান্ডুলিপিটার অনুবাদ, আমার মনে হয় এটা আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হবে।

সে খামটা পকেটে ভরে মৃদু হাসল। আমি সন্ধ্যা সাতটার দিকে আপনার সাথে দেখা করব। তখন হয়তো আপনার জন্য কিছু খবর নিয়ে আসতে পারি।’

 রুথও মৃদু হাসল–”আমি অপেক্ষায় থাকব, ইতোমধ্যে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করব।

তার হাসির প্রত্যুত্তরে কেইনও মৃদু হেসে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

.

০৬.

করিডোর দিয়ে হেঁটে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছতেই পেছনে একটা দরজা খোলার ক্লিক শব্দ হল। একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এত তাড়াতাড়ি তোমার আর মিসেস কানিংহামের মধ্যে বোঝাঁপড়া হয়ে গেলো?

 স্কিরোজ তার প্রাইভেট কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, দাঁতের ফাঁকে শক্ত করে একটা চুরুট কামড়ে ধরে রেখেছে, মুখে মৃদু হাসির আভা। কেইন ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। ভাবলাম খুঁজে দেখি তিনি আসলে কিসের পেছনে ছুটছেন।

গ্রিক লোকটি মুখ থেকে চুরুট সরিয়ে বলে উঠল, ‘বাপরে বাপ, কি গরম পড়েছে। ভেতরে এসে আমার সাথে একটা ড্রিংকস নেবে?

একটা মুহূর্ত কেইন ভাবছিল তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করবে। তারপর কি ভেবে মত বদলালো। দাহরানে খুব কম ব্যাপারই স্কিরোজের নজর এড়িয়ে ঘটে। সে সায় দিয়ে সামনে এগোল। ঠিক আছে, যদি তুমি বেশ লম্বা আর ঠাণ্ডা একটা ড্রিংকস বানাও তবে আমি রাজি আছি আসতে।’

স্কিরোজ কামরায় ঢুকল রুমালে মুখ মুছতে মুছতে। জানালার পাশে একটা বড় বেতের চেয়ারে ধপাশ করে বসে পড়ল। টেবিলে রাখা কয়েকটা বোতল আর একটা বড় জগে বরফজলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, তুমি বরং ড্রিংকসটা বরফ জল দিয়ে মেশাও, বন্ধু। আমার আর বোতল তোলার শক্তি নেই।’

কেইন দরজা বন্ধ করে টেবিলের কাছে এগোল। সে তাড়াতাড়ি দুটো বড় জিন-স্লিং তৈরি করে একটা গ্লাস স্কিরোজের হাতে তুলে দিল। সে এক ঢোকে। অর্ধেকটা গিলে ঘোঁতঘোঁত করে উঠল। ক্রিস্ট, ওহ, আরাম পেলাম। প্রত্যেক বছরের শুরুতে আমি ভাবি এটাই হবে এই অভিশপ্ত জায়গায় আমার শেষ বছর। আমি আমার মায়ের কবরের নামে শপথ নেই যে আমি গ্রিসে আমার বাড়িতে ফিরে যাবো, কিন্তু…’ তারপর সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার দুকাঁধ ঝুলে পড়ল।

 ‘কেন যাও না? কেইন বলল।

স্কিরোজ এক সারি ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসল।

কারণ আমি লোভী। এখানে আমি খুব সহজেই অনেক টাকা কামাতে পারি।’ গ্লাসে আরেক চুমুক দিয়ে বলে চলল, কিন্তু আমি তোমাকেও একই কথা জিজ্ঞেস করতে পারি। তোমার মত একজন মানুষের জন্য দাহরানে কি আকর্ষণ থাকতে পারে? সে আবার দেতো হাসি দিতেই তার চোখ জোড়া জুল জ্বল করে উঠল। এটা কি সেই চমৎকার মাদমোয়াজেল পেরেট হতে পারে না?’

 কেইন শান্তভাবে কাঁধে ঝাঁকি দিল। নারী আমার কাছে তেমন কিছু নয় স্কিরোজ। আমিও তোমার মত একই কারণে দাহরানে আছি। আমি এখানে টাকা কামাতে পারি–অতি সহজে আর কোন ট্যাক্স না দিয়ে। আজকাল তেমন জায়গা খুব বেশি একটা নেই, যেখানে মানুষ এ কাজ করতে পারে।’

স্কিরোজ মুখ টিপে হাসল। আর ইউরোপকে এড়ানো, যুদ্ধকে এড়ানো।

‘তুমি কি মনে কর এটা ঘটবে? কেইন জিজ্ঞেস করল।

‘অবশ্যই ঘটবে। হিটলার যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। পোলান্ড কি আলাদা কিছু?

‘সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। কেইন বলল।

 ‘আমারও নয়, স্কিরোজ গ্লাসটা শেষ করল। আর এই সুন্দরী মিসেস কানিংহামের বিষয়টা কি? রোজ রোজ দাহরানে এত সুন্দর অতিথি কিন্তু আমরা তেমন পাই না।’

কেইন টেবিলের একটা হাতির দাঁতের বাক্স থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। কেন উনি তোমাকে বলেন নি কেন এসেছেন এখানে?

স্কিরোজ মাথা নেড়ে জানাল, তিনি জাহাজ থেকে সরাসরি হোটেলে চলে আসেন। কামরা বুকিং করার পরপরই তোমার খোঁজ করেন। তবে তার কোন কারণ বলেননি। প্রথমে আমি ভাবলাম তোমরা হয়তো পুরোনো বন্ধু। সত্যি বলতে কি আমি ভেবেছিলাম তোমার অতীত হয়তো ফিরে এসেছে।

কেইন হেঁটে জানালার কাছে গেল। বন্দরের দিকে তাকিয়ে পেছন না ফিরেই সে বলল, তিনি তার স্বামীকে খুঁজতে এসেছেন। আপাত মনে হয় তিনি তাকে ছেড়ে চলে এসেছেন। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী তিনি জানতে পেরেছেন ভদ্রলোক এদিকেই রওয়ানা দিয়েছিলেন।

স্কিরোজ অবাক হয়ে ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠল–”কিন্তু এখানে কেন আসবে?

কেইন এবার ফিরে তার মুখোমুখি হয়ে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। তিনি ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতুবিদ্যার প্রভাষক। সম্ভবত শাবওয়া এলাকায় ধ্বংসাবশেষগুলো দেখতে এসেছেন।

 স্কিরোজ ভ্রু কুঁচকালো। কিন্তু সেখানে তো সেই পাগল আমেরিকান জর্ডন ছাড়া আর কেউ টিকতে পারেনি।’

কেইন ঘাড় কাত করে বলল, ‘সেটা সত্যি। কিন্তু প্রফেসর মুলার? তিনি তো কয়েকমাস ধরে সেই এলাকায় পাথরের উপর খোদাই করা লিপি খুঁজে বেড়াচ্ছন। তিনিওতো সেখানে টিকে রয়েছেন।’

 স্কিরোজ নাক টানল। “ওহ সেই জার্মান কুকুরটা।’ সে মাটিতে এক দলা থুথু ফেলে জুতার ডগা দিয়ে কার্পেটে ঘসলো। তাকে পাহারা দিচ্ছে স্বয়ং শয়তান। তবে একদিন সে খুব বেশি দূর যাবে। তারপর একদিন তাকে পাওয়া যাবে মাথায় একটা বুলেট নিয়ে পড়ে আছে।

কেইন বলল, সে কি এখন শহরে আছে?

স্কিরোজ মাথা নেড়ে বলল। হ্যাঁ, গত রাতে সে বাই-রোড এসেছে। ঠিক রাত এগারোটার সময় হোটেলের পাশ কাটিয়ে গেল যখন আমি এক ব্যাটাকে লাথি মেরে ভাগাচ্ছিলাম।

 কেইন টেবিলের পাশে গিয়ে আরেকটা ড্রিংক নিল। তাহলে তুমি এই কানিংহাম নামে লোকটার সম্পর্কে কিছুই জানো না?’

স্কিরোজ তার বিশাল কাঁধে ঝাঁকি মেরে বলল, না। তার আসার কথা ছিল কবে? যখন কেইন তাকে তারিখটা জানাল তখন সে এক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে তারপর মাথা নেড়ে বলল, না তেমন কিছু মনে পড়ছে না।

 কেইন ড্রিংকস শেষ করে হেঁটে দরজার কাছে গেল। আমার মনে হয় একবার মুলারের সাথে দেখা করি। তার সাথে হয়তো কানিংহামের দেখা হয়ে থাকতে পারে।

সে দরজা খুলতেই স্কিরোজ বলল, কিন্তু বন্ধু, তুমি এত ঝামেলা পোহাতে যাচ্ছো কেন? আমি কিন্তু সত্যি বলছি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

 কেইন ঘুরে দাঁত বের করে হাসল। সে একটা হাত তুলে অপর হাতের তালুতে বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা ঘসা দিল, যেটা বিশ্বের সব জায়গায় একটি বিশ্বজনীন ভাষা হিসেবে সহজেই বোঝা যায়। টাকার জন্য।’ সে বলল, আর কি?

 হোটেল থেকে বের হয়ে দেখল চারদিক নিরব, জনশুন্য। কিন্তু কড়া রোদ তাকে এমনভাবে ঢেকে ফেলল যে শরীরের প্রত্যেকটা ছিদ্র থেকে ঘাম বের হয়ে শার্ট আর প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। সে ধীরে ধীরে রাস্তার ছায়াময় পাশ দিয়ে হেঁটে মুলারের বাসার দিকে চলল। স্কিরোজের সাথে তার আলোচনাটা সে আবার বিবেচনা করে একটু ভ্রু কুঁচকালো।

যদি কানিংহাম দাহরান এসেই থাকে, এটা আশ্চর্য যে স্কিরোজ তা জানে না। এই ছোট্ট শহরে কোন কিছুই তার নজর এড়ায় না। সম্ভবত কানিংহাম আদৌ দাহরান আসেনি। হয়তো সে তার মত বদলেছিল? শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে লেখা চিঠিতেই এ জায়গার কথা লেখা ছিল। আবার অন্যভাবে ভাবলে এটা থোপে টিকে না। সে মেইল বোটে চড়ে এডেন ত্যাগ করেছিল, ব্রিটিশ কনসাল তা নিশ্চিত করেছে। তাহলে সে অবশ্যই দাহরানে পা রেখেছিল। হয়তো সে আগে থেকেই আপ-কান্ট্রির দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিল আর সেজন্যই হোটেলে কামরা বুক করেনি। তার স্ত্রী যতটুকু বলেছেন, তাতে বোঝা যায় তার হাতে তেমন টাকা ছিল না।

মুলারের বাড়ির অবস্থান বন্দরের উত্তরে একটা সরু গলির মাঝে। প্রবেশদ্বারটা একটা উঁচু দেয়ালের মধ্যে লাগানো। কেইন পুরনো বেল চেইনটা কয়েকবার টানল। উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে সে জার্মান লোকটির কথা ভাবলো। মুলার প্রথমবার প্রায় এক বছর আগে দাহরান এসেছিল। সে কঠিন আদব-কায়দা দুরস্ত আপাদমস্তক একজন প্রুশিয়ান। তার আগ্রহ গ্রাফিটির প্রতি-পাহাড়ের গায়ে কঠিন পাথরে আঁকা যেসব প্রাচীন শিলালিপি পাওয়া যেত সে সবের প্রতি। সব সময় ট্রাকে চড়ে সে তার অভিযান চালাতে। সীমান্তের অনেক ভিতরে অনেক বন্য এলাকায় চলে যেত। কখনো দুই কি তিনজনের বেশি আরবীয় লোক সাথে নিত না। কোন অস্ত্রও বহন করতো না। মুসাবেইনরা তাকে একজন পাগল মানুষ মনে করতো। আর সম্ভবত সে কারণেই এতদিন সে টিকে থাকতে পেরেছে।

দরজা খুলে গেল আর কেইন ভেতরে ঢুকতেই পরিষ্কার সাদা আলখাল্লা পরা একজন আরব পরিচারক এক পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল। ওরা একটা চমৎকার উঠানে এসে ঢুকল, যার মাঝখানে একটা ঝর্ণা রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। মাথার উপরে দোতলার জানালা থেকে বেরিয়ে আসা বেলকনি দেখা গেল। মুলার সেখানে উদয় হয়ে তার দিকে তাকাল। তার মুখে খুশির হাসি দেখা গেল, সে হাত তুলে ইশারা করল। আহ কেইন, আমার প্রিয় বন্ধু। ঠিক লোকটি এসেছে। উপরে এসো। এখুনি উপরে চলে এসো!’

কেইন পরিচারকের পিছু পিছু ঘরের ভেতরে ঢুকল। সিঁড়ি বেয়ে একটা সরু করিডোরে পৌঁছে পরিচারক একটা দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে কেইনকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করল।

হাফহাতা শার্ট পরা মুলার একটা বিরাট টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথা নুইয়ে অভিবাদন করার সময় সে প্রায় দুপা ঠুকে মৃদু হেসে বলল। ‘আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যা তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করবে। শাবওয়ার কাছে একটা গিরিখাত থেকে একটা শিলালিপির ল্যাটেক্স ছাপ তুলে এনেছি। এটা দেখে তোমার মতামত দাও।

কেইন লম্বা রাবারের টুকরাটা পরীক্ষা করল। শিলালিপির ছাপ তুলতে প্রফেসার একটা নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। রাবারের একটা দ্রবণ পাথরের উপর ঘসে লাগানো হতো। সূর্যের তাপে এটা খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে শক্ত হলে লম্বা ফালিটা টেনে ভোলা হতো একটা নিখুঁত অনুলিপি সহ।

 কেইন বেশ আগ্রহ নিয়ে পাথরে খোদাই করা শব্দগুলো পরীক্ষা করল। এক মুহূর্ত পর মুখ তুলে বলল, ‘কুতাবানিয়ান, তাই না?

মুলার মাথা নেড়ে সায় দিল–হ্যাঁ। এটা আমি প্রাচীন উটে চলার পথ থেকে সামান্য দূরে একটা পাথরের গায়ে পেয়েছি। সঠিক অনুবাদ করার সময় পাই নি, তবে মনে হচ্ছে খ্রিষ্ট পূর্ব ৭ অব্দে শেবার রাজ্যের সাথে একটা যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে এখানে।

কেইন টেবিলের কিনারায় বসল। তুমি জানো, আমার জানা মতে গত চার মাসের মধ্যে এই নিয়ে তৃতীয়বার তুমি শাবওয়া এলাকায় গিয়েছ। তোমার কি মনে হয় না এতে তুমি নিজের বিপদ ডেকে আনছো?”

 মুলার নাক টেনে বলল, দেশ চালায় কে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, যতক্ষণ না আমাকে একাকী আমার কাজ করতে দেয়। উপজাতীয়রা এটা জানে, তাই তারা আমাকে বিরক্ত করে না।

 কেইন কাঁধ ঝাঁকি দিল, “ঠিক আছে। পরে এটা বলো না যে আমি তোমাকে সাবধান করিনি। আচ্ছা বল তো গত দুই মাসে তুমি শাবওয়া এলাকায় কোন ইউরোপীয় মানুষের দেখা পেয়েছ?

মুলার অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল–’কেবল জর্ডন। তোমার দেশি সেই পাগল লোকটা। একথা জিজ্ঞেস করছো কেন?

 কেইন তাকে জানাল, শহরে একজন মহিলা তার স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কানিংহাম নামে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, তার দুমাস আগে শাবওয়ার দিকে যাওয়ার কথা। তারপর থেকে কেউ তার কোন হদিশ পাচ্ছে না।

মুলার পেছনে মাথা হেলিয়ে কর্কশভাবে হেসে উঠল ‘পাওয়ার কথাও নয়, যদি তিনি এক গিয়ে থাকেন। কিন্তু ঐ ভদ্রলোক শাবওয়ায় কি খুঁজছিলেন?

কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। আমার মনে হয় তিনি তোমার মতো গ্রাফিটি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

ধন্যবাদ,আমার কোন প্রতিযোগিতার প্রয়োজন নেই। মুলার উঠে জানালার কাছে গেল, তার ভ্রু কুচকে রয়েছে। না, আমি এই লোকের দেখা পাই নি। সে মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আরেকজন ইউরোপিয়ান এই পাহাড়ে এলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম।

কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। হ্যাঁ, এই ব্যাপারটাই আমি বুঝতে পারছি না। এমনকি স্কিরোজও তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর এর মানেই কিছু একটা রহস্য আছে।

 মুলার কাঁধ ঝকানি দিয়ে বলল, “দুঃখিত, আমি কোন সাহায্য করতে পারলাম না।’

কেইন বলল, “ঠিক আছে। আমি এখন ভাবতে শুরু করেছি হয়তো এই ভদ্রলোক আদৌ এখানে আসেন নি।’

জার্মান লোকটি বলল, ঠিক সে রকমই মনে হচ্ছে।

কেইন নিচে নেমে এল। সাথে সাথে পেছনের অন্ধকার করিডোর থেকে পরিচারক এগিয়ে এসে তাকে পথ দেখিয়ে দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেল। বাইরে বের হওয়ার পর তার পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর সে প্রচণ্ড গরমে পথে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত ভাবতে লাগল তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। সত্যি বলতে কি এই মুহূর্তে কেবল একটি কাজই করা বাকি আছে। ক্যাপ্টেন গনজালেসের কাছে গিয়ে খোঁজ করতে পারে। তার অবশ্যই মনে থাকার কথা যদি গত দুই মাসের মধ্যে কানিংহাম নামে কোন ইউরোপীয় মেইল বোট থেকে এখানে নেমে থাকে।

সে একই পথ দিয়ে শহরের দিকে ফিরে চলল। হোটেল পার হয়ে ওয়াটার ফ্রন্ট হয়ে উত্তরের জেটির দিকে চলতে লাগল। এই স্পেনিয় লোকটির বাড়ি এই জেটির ঠিক পাশে সাগর সৈকতের দিকে মুখ করে তৈরি। কেইন দরজায় করাঘাত করার সাথে সাথেই লম্বা বোরখা পরিহিত একজন মহিলা দরজা খুলল।

মহিলাটি তাকে পথ দেখিয়ে ভেতরের একটা উঠানের দিকে নিয়ে চলল। সেখানে সে দেখল গনজালেস আরাম করে একটা ডিভানে শুয়ে এক হাতে একটা বিয়ারের ক্যান থেকে লম্বা গ্লাসে বিয়ার ঢালছে।

 সে মুখ তুলে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে উঠল, “দেখলেতো তুমি আমাকে হাতেনাতে ধরে ফেললে। ইতোমধ্যেই আমি আমেরিকান অভ্যাসের দাস হয়ে পড়েছি। চলবে নাকি?”

কেইন মাথা নাড়ল। না এবার না করব না, অবশ্য যদি তুমি কিছু মনে না করো।’

মাথার টুপিটা পেছনে ঠেলে দিয়ে সে ডিভানের শেষ মাথায় বসল। গনজালেস বলল। তুমি কিন্তু অকারণে আমার বাসায় পদধূলি দাও না। সম্ভবত তোমার কোন সাহায্য দরকার।’

কেইন দাঁত বের করে হাসল। সত্যি বলতে কি সে জন্যই এবার এসেছি।’

স্পেনিয় লোকটি আত্মপ্রসাদের ভাব নিয়ে কুশনে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। হুঁ, আগে হোক পরে হোক সবাই আমার কাছে আসে। আমার বিশ্বাস তুমি নিশ্চয়ই আমাকে দোষারোপ করবে না যে, আমি গর্ব করছি এই বলে যে দাহরানে খুব কম ঘটনাই ঘটে যা শীঘ্রই হোক, দেরিতেই হোক আমি জানতে পারি না।’

 কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। সে আমি জানি আর সেজন্যই আমি এখানে এসেছি। মিসেস কানিংহাম নামে একজন মহিলা এই শহরে এসেছেন।’

 গনজালেস সায় দিল। এই তো। তিনি আজকেই এডেন থেকে আসা মেইল বোট থেকে নেমেছেন।’

 ‘তিনি তার স্বামীকে খুঁজছেন। দুইমাস আগে তিনি তার স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, তিনি দাহরান আসছেন। তার উদ্দেশ্যে ছিল শাবওয়ার দিকে যাওয়া। সেই থেকে মহিলা তার স্বামীর খোঁজ পাননি।

গনজালেস ভ্রূ কুঁচকালো। লোকটার নাম কী বললে–কানিংহাম, তাই? সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। আমার মনে হয় তিনি ভূল করছেন। এই নামে কোন লোক দাহরান আসেনি।

‘তুমি কি এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত? কেইন জানতে চাইল।

গনজালেস কাঁধ ঝাঁকাল। কি করে আমার ভূল হবে? আমি কি রোজ প্রত্যেকটা জাহাজ দেখি না?’

একটা মুহূর্ত কেইন ভাবলো বিষয়টা নিয়ে তর্ক করবে কিনা। কিন্তু পরে ভাবলো এতে কোন লাভ নেই। দাহরানের সবাই জানে যত জাহাজ এখানে আসে তার অর্ধেকও এই স্পেনিশ লোকটা চেক করে না। এটা নিয়ে তর্ক করে সত্যি প্রতিষ্ঠা করা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। সে মাথার ক্যাপটা টেনে নিচে নামিয়ে বলল, যাই হোক তোমাকে ধন্যবাদ। সম্ভবত মিসেস কানিংহাম কোন একটা ভুল করেছেন।

গনজালেস বিজ্ঞের মতো বলল, এটা সব মহিলারাই করে থাকে।

পেছনে দরজা বন্ধ হতেই কেইন বাড়ির বাইরে এসে সামনে বন্দরের মাঝে তার লঞ্চের দিকে তাকাল। দেখল পিরু সামনের ডেকে আসন পেতে বসে আছে। সে জানে পিরুও তার দিকে চেয়ে রয়েছে।

হঠাৎ সে খুবই ক্লান্ত বোধ করল। হিপ পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুথ কানিংহাম তাকে যে খামটা দিয়েছিল, সেটা বের করল। কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, তারপর হঠাৎ একটা সিদ্ধান্তে এল। দাহরানে আরেকজন মাত্র মানুষ আছে যে এই জুন কানিংহাম সম্পর্কে কোন কিছু জানতে পারে। সেটি হল মেরি পেরেট। তার সাথেই দেখা করতে হবে। তবে সন্ধ্যায় একটু ঠাণ্ডা পড়লে তারপর যাবে।

সে হেঁটে জেটির শেষ মাথায় গেল। পিরু তাকে দেখেই লঞ্চের পেছন দিক থেকে এক লাফে নিচে ডিঙ্গিতে নেমে পড়ল, তারপর দ্রুত বৈঠা বেয়ে তার দিকে এগোতে শুরু করল। কেইন ধপ করে ডিঙির মাঝখানে বসে পড়তেই পিরু লঞ্চের দিকে ডিঙিটা ফিরিয়ে নিয়ে চলল। আমি যখন বাইরে ছিলাম তখন কি কেউ এসেছিল?

 পিরু মাথা নাড়ল। সব একদম চুপচাপ, সাহেব। এই গরমে কোন বোকা লোক ছাড়া কে আর বাইরে বের হবে।’

কেইন দাঁত বের করে হাসতেই পিরুর মুখ হতাশায় কালো হয়ে গেল। ‘আমি দুঃখিত সাহেব।’ সে বলল। আমি বোকার মতো কথা বলে ফেলেছি।

কেইন মাথা নেড়ে রেইল টপকে লঞ্চে উঠল। না, পিরু তুমি একদম সঠিক কথাটি বলেছে। আমি খুব টায়ার্ড হয়ে গেছি। নিচে যাচ্ছি ঘুমুতে। আটটার দিকে তুলে দিও, ঠিক আছে?

 পিরু মাথা নেড়ে সায় দিতেই কেইন নিচে তার শীতল কেবিনে নেমে গেল। একটা ড্রিংক তৈরি করে পোশাক খুলল। তারপর বাংকে শুয়ে রুথ কানিংহাম তাকে যে খামটা দিয়েছিল সেটা হাতে নিল।

পান্ডুলিপির টাইপ করা অনুবাদটা পড়তে শুরু করল। এক ঘণ্টা ধরে নিবিষ্ট মনে পুরোটা পড়ে শেষ করল। তারপর কিছুক্ষণ কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে আলেক্সিয়াসের কথা ভাবলো। পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো থেকে উঠে এসে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একজন মানুষের সুনির্দিষ্ট অবয়ব। অদম্য দুঃসাহসী, শক্তিশালী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং স্বভাবজাত নেতৃত্বের অধিকারী একজন মানুষ। একজন স্বপ্নদর্শী পুরুষ। পান্ডুলিপির সেই অংশটুকু কেইন আবার পড়ল, যেখানে আলেক্সিয়াস মরুভূমির মাঝে মন্দিরটি খুঁজতে গিয়ে তার অনুভূতি তুলে ধরেছে। তার কথার আলোকে লোকটির চরিত্রের দৃঢ়তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। একজন জন্মগত অভিযাত্রীক, সর্বদা অস্থির, সবসময় পাহাড়ের ওপারে তার দৃষ্টি প্রসারিত। কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে সবসময় কিন্তু কখনো তা পায়নি।

সে কি শুধু শেবার মন্দির অনুসন্ধান করছিল না অন্য কিছুরও অনুসন্ধান করছিল? সে কী নিজ সত্ত্বার অনুসন্ধানে ছিল? যা অধিকাংশ মানুষ সারা জীবন খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কখনও তা পায় না। সে পান্ডুলিপির শেষ পাতায় গিয়ে শেষ বাক্যটুকু আবার পড়ল।

 … আমি, আলেক্সিয়াস, ১০ম লিজিয়নের সিনিয়র সেঞ্চুরিয়ান, বার—-শেবার অধিনায়ক এখানেই এই বিবরণ সমাপ্ত করছি। যদি কেউ শেবার মন্দিরের খোঁজে সাতটি স্তম্ভের পথ ধরে অনুসন্ধান করতে চায়, তাদের জন্য এটি একটি সতর্ক বার্তা। কেননা ঐ সাতটি স্তম্ভ তাদের কেবল মৃতু্যর পথেই এগিয়ে নিয়ে যাবে।

 কেইন উপরে ছাদের দিকে তাকাল। তার মাথার উপরে পোর্টহোল দিয়ে ভেতরে আসা রোদের আলোয় যে ধুলির নৃত্য দেখা যাচ্ছিল সেদিকে সে তাকিয়ে ভাবতে লাগল সেই গ্রিক সৈনিকের কথা। একটি ইথিওপিয় প্রবাদ বাক্যে বলা হয়েছে নরকের পথে সাতটি স্তম্ভ রয়েছে। আর ইথিওপিয়রাই একবার স্বল্প সময়ের জন্য দক্ষিণ আরব জয় করেছিল। একটা মুহূর্ত সে ভাবলো এ দুয়ের মাঝে কোন যোগসুত্র আছে কিনা। তারপর ধারণাটিকে অসম্ভব বলে বাতিল করল। ইথিওপিয়রা অনেক পড়ে এটি বিজয় করেছিল। এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই সে অন্ধকারে চোখ মেলল। অবচেতন মনের অতল থেকে একটি বিশেষ অনুভূতি তাকে একটি বিপদ সংকেত দিতে লাগল। বাংকে শুয়ে হাতের আঙুলগুলো বাঁকা করল, ঠিক যেমনটি কোন শিকারীর উপস্থিতি কাছে টের পেলে কোন বন্য প্রাণী করে থাকে।

 প্রথমে একটা গন্ধ টের পেলবাসি আর হালকা পঁচা গন্ধ। অলিভ অয়েল কিংবা কোন ধরনের গ্রিজের গন্ধ। তারপর কারো নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল আর হঠাৎ টেবিলের গায়ে ধাক্কা লেগে কারো মৃদু শাপান্ত করার শব্দ। সে দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। পোর্টাল দিয়ে ভেতরে আসা উজ্জল চাঁদের আলোয় চোখের পাতা অর্ধেকটা খুলে সে দেখতে লাগল।

তারপর নিঃশ্বাসের শব্দ খুব কাছে আসতেই উঁচু করা একটা ছুরির ফলা চাঁদের আলোয় দীপ্তিমান হলো। সে একটা মোচড় দিয়ে দ্রুত গতিতে তার হাঁটুটা একপাশে উঁচু করল। আততায়ীর পেটে ওর হাঁটু জোরে আঘাত করতেই চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। ডান হাত দিয়ে কেইন লোকটার কব্জি ধরে জোরে একটা মোচড় দিল। একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর ছুরিটা মেঝেতে পড়ে গেল।

কেইন বাংকে উঠে আততায়ীকে ধরার জন্য হাত বাড়াল, কিন্তু লোকটার সারা শরীরে তেল মাখানো ছিল। ফলে সে হাত দিয়ে তাকে শক্তভাবে জাপটে ধরতে পারলো না। বাইন মাছের মতো শরীর মুচড়ে তার হাত থেকে পিছলে দরজার দিকে ছুটে গেল। ডেকে উঠতেই পিরুও লাফ দিয়ে তাকে ধরতে চেষ্টা করল। দুজনের দেহের মাঝে সংঘর্ষ হতেই পিরু যন্ত্রণায় কাতরে উঠল। আততায়ী লোকটা তার হাতের নিচ দিয়ে ছুটে রেইল টপকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কেইন কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল, কিন্তু কোন শব্দ শোনা গেল না। সে ধীরে ধীরে ঘুরে বলল, তুমি ঠিক আছে তো?

 পিরু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, সাহেব, আমাকে মাপ করুন। আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন লোকটা জাহাজে উঠে আপনার উপর আক্রমণ চালিয়ে আপনাকে প্রায় মেরে ফেলছিল।’

 কেইন তার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘দূর বোকা। এতে লজ্জিত হওয়ার কী আছে। লোকটা সম্ভবত পেশাদার খুনি। এরাই কেবল মাত্র কোন কাজে যাবার আগে সারা শরীরে তেল মেখে নেয়। এটা নিয়ে চিন্তা করো না। যাও ডিঙ্গিটা রেডি করো। আমরা এখন সেলিম সাহেবের ওখানে যাবো।

 সে নিচে গিয়ে দ্রুত পোশাক পরে নিল। জ্যাকেটের পকেটে কোল্ট অটোমেটিকটা নিয়ে উপরের ডেকে ফিরে এল। সে ভাবলো এবার সেলিমকে একটু শিক্ষা দেবার সময় এসেছে। মাছ ধরার নৌকাগুলোর মধ্য দিয়ে ওরা ফারাহর দিকে যেতে লাগল। ওদের ডিঙ্গিটা বিশাল ধাউটার গায়ে ঘসা খেতেই সে পিরুকে অপেক্ষা করতে বলল। তারপর একটা দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে রেইল টপকালো। ডেকে কেউ নেই। স্টার্ণ–ডেকের নিচে ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজাটা দেখা গেল। সে সাবধানে এগোতে লাগল। একমুহূর্ত বাইরে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল, তারপর কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে এক লাথিতে দরজা খুলে ডান হাতে কোল্ট অটোমেটিকটা নিয়ে ভেতরে ঢুকল।

 দুজন আরব পা ভাঁজ করে বসে আছে একটু নিচু টেবিলের পাশে। একটা কফি পট আর ছোট ছোট কয়েকটা কাপ সাজানো রয়েছে টেবিলের উপর। লোকদুটো আতংকিত হয়ে কেইনের দিকে তাকাতেই সে রিভলবারটা ওদের দিকে তাক করল।

‘সেলিম কোথায়? সে আরবিতে জিজ্ঞেস করল

একজন কাঁধ ঝাঁকাল, ‘সে দুপুরেই চলে গেছে। আমার মনে হয় সে অনেক দূরে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে।’

কেইন একটা মুহূর্ত ওদের দিকে সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকাল। কোল্ট নিচু করে চলে যেতে উদ্যত হতেই, একটা পরিচিত গন্ধ তার নাকে এল। এটা সেই বাসি, পঁচা অলিভ অয়েলের গন্ধটা।

সে ধীরে ধীরে ঘুরে ওদের মুখোমুখি হল। তোমাদের আলখাল্লা খোলো! ওরা ভীত হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল। আর যে লোকটা এর আগে কথা বলেছিল সে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল। কেইন দ্রুত সামনে এগিয়ে চেহারায় হিংস্রভাবে নিয়ে বলল। যা বলছি তাই কর।

যে লোকটা কথা বলেছিল সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে তার আলখাল্লা খুলতে শুরু করল। কিন্তু অন্য লোকটা হঠাৎ দরজার দিকে ছুটে গেল। কেইন একটা পা বাড়িয়ে ল্যাং মেরে তাকে ফেলে দিল। লোকটা উঠে দাঁড়াতেই কেইন লিভলবারের বাঁট দিয়ে তার মুখে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। রিভলবারের ভারী বাটের আঘাতে তার গাল কেটে গেল, সে ডেকে পড়ে গিয়ে কাতরাতে শুরু করল।

কেইন কোল্টটা পকেটে ভরে দরজার দিকে এগোল। সেখানে একটু থেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য লোকটিকে বলল, ‘সেলিমকে বলো তার জন্য ভাল হবে যদি সে দাহরান ছেড়ে চলে যায়।

দরজা বন্ধ করে ডেক পেরিয়ে সে ডিঙ্গিতে নামল। পিরু জিজ্ঞেস করল, ‘সব ঠিক আছে তো, সাহেব?’

কেইন মাথা নেড়ে বলল, তা সেরকমই বলতে পারো। এখন তুমি আমাকে জেটির দিকে নিয়ে যাও। আমি শহরে যাবো।

জেটিতে দাঁড়িয়ে কেইন অন্ধকারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, পিরুর ডিঙি নিয়ে ফিরে যাওয়ার শব্দ শুনলো, তারপর রুথ কানিংহামের সাথে দেখা করার জন্য ওয়াটারফ্রন্ট ধরে হোটেলের দিকে এগিয়ে চলল।

.

০৭.

আলোয় ঝলমলে হোটেলের প্রবেশ পথে প্রচুর লোকজনের ভিড়। কেইন ভিড় ঠেলে ক্যাসিনোর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। স্কিরোজ জানালার ধারে একটা টেবিলে বসে রয়েছে। তার দুই চোখ এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরছে, আর যখনই ডিলাররা সবুজ টেবিল কভারের উপর দিয়ে চিপসগুলো নিজেদের কাছে টেনে নিচ্ছে তখনই তার চেহারায় সন্তুষ্টির ভাব দেখা যাচ্ছে।

 কেইনকে দেখে সে মৃদু হেসে হাত নেড়ে ইশারা করল। কেইনও একটু মাথা নেড়ে ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল।

বারে জমজমাট ব্যবসা চলছে, ক্যাটলিনার ক্রু-রোমেরো, নোভাল আর কোন্ডে ফ্লাইং জ্যাকেট পরে সেখানে বসে রয়েছে। রোমেরো হাত উঠিয়ে ওর দিকে ইশারা করতেই কেইন তাদের সাথে যোগ দিল।

‘ভাল কোন কার্গো আনানেওয়া করেছে ইদানিং?’ রোমেরো জিজ্ঞেস করল।

‘পাতিল বলছে কেটলি তুমি কালো কেন,’ কেইন বলল। “গুপ্ত জানাল তোমরা আর একটা পর্তুগিজ কার্গো জাহাজ ত্রিশ মাইল ভেতরে মাল খালাস করছে।

রোমেরো মৃদু হাসল। বন্ধু, আমাদের সবাইকে কিছু করে খেতে হয়।

‘সাবধানে থেকো,’ কেইন বলল। যদি সে তোমাকে দেখে থাকে, তাহলে অন্য কেউও দেখতে পারে।

তারপর সে চলে গেল। নোভাল বলল, “সে ঠিক বলছে।’

রোমেরো কাঁধ ঝাঁকাল। নো প্রবলেম। আর কয়েকটা দিন তারপর তো সব শেষ হয়ে যাবে। চল আরেকটা ড্রিংক নেওয়া যাক।

করিডোর একদম নিস্তব্ধ। আর এখান থেকে নিচের কোলাহলের শব্দ আশ্চর্যরকম কেমন চাপা আর অবাস্তব শোনাচ্ছে, যেন অন্য কোন জগত থেকে শব্দটা আসছে।

রুথের কামরার দরজার উপরের স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছিল। সে আস্তে দরজায় টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে গেল আর রুথ মুখ বের করে তাকাল।

তার পরনে ভারী সিল্ক ব্রোকেডের হাইসকোট। কোমরে লাল রঙের স্যাস দিয়ে বাঁধা। খোলা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মুখ একটু ফ্যাকাসে আর একটু ঝুলে রয়েছে, মনে হচ্ছে রাতে ভাল ঘুম হয়নি। একট মৃদু হেসে একপাশে সরে দাঁড়াল।

কেইন ঢুকতেই রুথ দরজা বন্ধ করে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কেইনের মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত পরে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, এখন পর্যন্ত আমার জন্য কোন খবর আনতে পারেন নি, তাই না?

 এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ ইতস্তত করে কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। দুঃখিত পাই নি।’

জানালার ধারে রাখা একটা বেতের চেয়ারের কাছে গিয়ে রুথ বসল। তার চেহারায় একটু অধৈর্য ভাব দেখা গেল। অবশ্যই আপনি কিছু একটা জেনেছেন। এটা একটা ছোট শহর, কেউ না কেউ তাকে দেখেছে।’

কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। পুরো ব্যাপারটায় এটাই একটা আজব বিষয়। মনে হচ্ছে কেউই আপনার স্বামীর সম্পর্কে কিছুই জানে না। সবশেষে আমি কাস্টমস চিফের সাথে কথা বলেছি। সে শপথ নিয়ে বলেছে গত দুই মাসে আপনার স্বামী দাহরানে নামেন নি।

‘কিন্তু তা অসম্ভব, সে বলল। আমরা জানি তিনি এসেছিলেন।’

 কেইন মাথা নাড়ল। আমরা জানি আসতে চেয়েছিলেন। আমরা জানি তিনি এডেন থেকে জাহাজে উঠেছিলেন। তারপর হয়তো তিনি অন্য কোন বন্দরে নেমেছেন–যেমন মুকাল্লা।’

আপনার কি মনে হয়, তা সম্ভব?

 কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। অনেক কিছুই হতে পারে। অবশ্য আমি এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হই নি যে আপনার স্বামী দাহরান নামেন নি। ক্যাপ্টেন গনজালেসের দায়িত্ব অবহেলা করার অভ্যাস আছে। এখানে যত জাহাজ নামে তার অর্ধেকও যদি সে চেক করে থাকে তাহলে খুবই ভাল, কিন্তু সে তা কখনো স্বীকার করবে না।’

রুথ তার দিকে আগ্রহভরে তাকাল। তার মানে আপনি মনে করেন আমার স্বামী এখানে এসেছিলেন?’

কেইন মাথা নাড়ল। যদি তিনি জাহাজ থেকে নেমে একই দিন সরাসরি আপ কান্ট্রিতে চলে গিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে কেন কেউ তাকে দেখেনি।

রুখের চেহারায় স্বস্তির ভাব ফিরে এল। সে কুশনে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। আমি নিশ্চিত তাই হয়তো ঘটেছে। একটু দুর্বলভাবে হাসল। এরপর আমাদের পদক্ষেপ কি হবে?

কেইন জানালার কাছে গিয়ে নিচে রাস্তায় লোকজনের ভিড়ের দিকে তাকাল। আরেকজন মানুষের সাথে দেখা করা বাকি আছে,’ সে বলল। মেরি পেরেট।’

রুথ অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, “একজন মহিলা? কিন্তু সে কীভাবে সাহায্য করবে?

কেইন মৃদু হেসে বলল, তিনি সাধারণ কোন নারী নন। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। মেরি পেরেট আধা ফ্রেঞ্চ আধা আরব। জাঞ্জিবার থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ছড়ানো এক বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান তিনি। অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী একজন নারী। প্রত্যেকদিন তার ট্রাক যায় শাবওয়া এলাকায়। যদি আপনার স্বামীর ঐ এলাকায় যাওয়ার তাড়া থেকে থাকে তাহলে সে উপায়েই তার যাবার কথা।

কেইনের মুখের দিকে তাকিয়ে রুথ এবার একটু অন্যরকম হাসল। তিনি কি আপনার বন্ধু?

 কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। আমি তাকে চিনি। সে বলল। তিনি যা জানেন তা আমি জানতে চাইলে জানাবেন। তারপর সে দরজার দিকে এগোল। রাতে ফিরতে খুব দেরি না হলে আমি আবার আসবো।’

রুথ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল ঘুরে এলো। আমি এডেনে কনসালকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছি যে আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে হেসে উঠল। তিনি আমাকে লিখে জানাতে বলেছিলেন। তবে আমি নিজে এখানে আসাতে খুব একটা খুশি হন নি।

কেইন চিঠিটা নিয়ে পকেটে ভরে দাঁত বের করে হাসল। তার কথায় হয়তো কোন যুক্তি আছে। ঠিক আছে, পরে দেখা হবে।’

সে নিচে গেল, প্যাসেজ পার হয়ে ক্যাসিনোতে ঢুকলো। স্কিরোজ তখনো জানালার ধারে বসে রয়েছে, দাঁতের ফাঁকে একটা চুরুট আর হাতে একটা গ্লাস।

 কেইন তার উল্টোদিকের চেয়ারে বসলো। মনে হচ্ছে ভাল একটা রাত পেয়েছে।

স্কিরোজ মৃদু হাসল। আমার কোন অভিযোগ নেই। সৌভাগ্যবশত এই জগত বোকা মানুষে পরিপূর্ণ, যারা বুঝে না যে হাউস সব সময় জিতে। মিসেস কানিংহামের স্বামীর খবর কি? কোন হদিশ পেলে?

কেইন মাথা নাড়ল। গনজালেস বলেছে তিনি এখানে আসেন নি। তবে তুমিতো জানোই তার কথায় কতটুকু ভরসা করা যায়। আমি এখন যাচ্ছি মেরি পেরেটের সাথে দেখা করতে। সে হয়তো কিছু জানতে পারে।’

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সে পকেট থেকে রুথ কানিংহামের চিঠিটা বের করে টেবিলে রাখল। এটা আমার হয়ে মেইল ব্যাগে দিয়ে দিও। বেশ জরুরি।’

স্কিরোজ মাথা নোয়ালো আর আঙ্গুলে তুড়ি মেরে একজন ওয়েটারকে ডাকল। তুমি ঠিক সময়ে এসেছে। আমি একজন ছেলেকে এখুনি জেটিতে পাঠাচ্ছি। দশটার জোয়ারের সময় মেইল বোট ছেড়ে যাওয়ার কথা।

 সে ওয়েটারের হাতে চিঠিটা দিয়ে সংক্ষেপে নির্দেশ দিল। একটা ড্রিংকের সময় হবে তোমার?

 কেইন মাথা নাড়ল। অন্য সময় স্কিরোজ। পরে আবার হয়তো মিসেস কানিংহামের সাথে দেখা করার জন্য আসতে পারি।’

স্কিরোজ মৃদু হাসল। আমি বিশ্বাস করি তুমি নিশ্চয়ই মনে রাখবে এটা ব্যবসা। তিনি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একজন মহিলা।

কেইন উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। সে ঘুরে ভিড় ঠেলে ফয়ার পার হয়ে বাইরে চলে গেল।

 সরু পথের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে স্কিরোজের সর্বশেষ মন্তব্য নিয়ে ভাবলো। এটা অস্বীকার করা বোকামি হবে যে মিসেস কানিংহাম একজন আকর্ষণীয় মহিলা। তবে সেই প্রথম জেটিতে দেখা হওয়ার সময় যে সাময়িক উত্তেজনা আর অস্বস্তি সে অনুভব করেছিল, তারপর আর সে তার সম্পর্কে দৈহিক কোন ধরনের আকর্ষণ অনুভব করেনি

অনেক বছর পর এই প্রথম সে তার মনমতো একজন নারীর দেখা : পেয়েছে। তারপরও তার কোন অনুভূতি নেই। তবে যে কোন নারীর ব্যাপারে সে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে থাকে। বিয়ের আগে প্রথম কয়েক মাস লিলিয়ানকে চমৎকার মেয়ে মনে হয়েছিল। এরপর যা ঘটেছিল তা মনে করে সে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করল এই ভেবে যে, এখন লিলিয়ান আর তার জীবনের অংশ নয়। এরপর সে পথের এক পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল।

এটিই দিনের সবচেয়ে ভাল সময়। শান্তির সময়–স্থানীয়রা বলে। বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর আলো পানিতে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে। আর কাছের একটা ক্যাফে থেকে কারও বিয়ের উৎসবের গানবাজনা আর হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

বিভিন্ন রঙের আলখাল্লা পরে আরবরা রাস্তার পাশে টেবিলে বসে ছোট ছোট কাপ থেকে কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। রাস্তায় রাতের বাজারে বিভিন্ন পণ্যের সমারোহ। হাতে তৈরি পিতলের জিনিস থেকে শুরু করে রান্না করা নানা খাবার বিক্রি হচ্ছে।

চারপাশের হৈ হুল্লোর আর আনন্দ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ভিড় ঠেলে সে এগিয়ে চলল।

 আরো এগোতেই ক্রমশ রাস্তার লোকজন কমে এল, তারপর সে রাস্তা ছেড়ে একটা গলির মধ্যে চলে এল, যেখান থেকে খোয়া বাধানো পথ চলে গেছে সৈকতের বাঁকা অংশের দিকে।

শৈলান্তরীপের একদম শেষ মাথায় সাগরের দিকে মুখ করে মেরি পেরেটের বাড়িটির অবস্থান। চারপাশে উঁচু দেয়াল ঘেরা, এক একর বাগানের মাঝে সমতল ছাদের একটা দোতালা দালান।

কেইন লোহার মজবুত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেল চেইন ধরে টান দিল। একটু পর অন্যপাশে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেল, তারপর দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল।

দরজায় দাঁড়ানো লোকটির দৈহিক গঠন অত্যন্ত অসাধারণ। সোমালি বংশোদ্ভূত লোকটির আবলুস কাঠের মতো কালো মুখ আর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা ঢেউ খেলানো কালো চুল। ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা আর সেই অনুপাতে চওড়া লোকটির পরনে সাদা আলখাল্লা।

দাঁত বের করে হেসে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে সে কেইকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করল। কেইন মৃদু হেসে আরবিতে বলল, “তোমার মিসট্রেস বাড়িতে আছেন, জামাল?’

 সোমালি লোকটি দরজা থেকে সরে গিয়ে মাথা নোয়ালো। ইয়েমনের বিশেষ কয়েকটি এলাকার রীতি অনুযায়ী তার কপালের মাঝখানে একটা ছাপ মারা রয়েছে। সে তার প্রভুর কাছ থেকে পালাতে চেষ্টা করেছিল তারপর ধরা পড়ার পর উক্ত বাজারে তার জিহ্বা কেটে নেওয়া হয় অন্যদের সাবধান করার জন্য।

এর পরের বার অবশ্য পালাতে গিয়ে সে সফল হয়। মরুভুমিতে পানির তেষ্টায় যখন সে মৃতপ্রায়, তখন মেরি পেরেট তাকে খুঁজে পায়। সেবা শুশ্রূষা করে তাকে বাঁচিয়ে তুলে। সেই থেকে সে ছায়ার মতোই তার সাথে রয়েছে।

সারি সারি ডুমুর গাছের মাঝখান দিয়ে খোয়া ছড়ানো পথ দিয়ে সে কেইনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল একটা ঢাকা বারান্দার দিকে। একটা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে ঘরের ভিতরে অদৃশ্য হলো।

কেইন বাগানের সুঘ্রাণ নিঃশাসে টেনে নিল। চারপাশে বিভিন্ন রঙের সমারোহ, রাতের বাতাস ফুলের সুঘ্রাণে ভারী হয়ে আছে। কয়েকটা পাম গাছ। দেয়াল ছাড়িয়ে উপরে উঠে মৃদু বাতাসে দুলছে। পাতাগুলো রাতের আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে। গাছের মাঝখানে একটা ফোয়ারা থেকে পানি ছড়িয়ে পড়ছে একটা মাছের চৌবাচ্চায়। পেছনে হালকা পায়ের শব্দ পেতেই সে তাড়াতাড়ি ঘুরল আর মেরি পেরেট বারান্দায় আসতেই সে উঠে দাঁড়াল।

 ছোটখাট গড়নের পঁচিশ বছর বয়সি সুন্দর একটি মেয়ে। যোধপুর প্যান্ট আর খাকি বুশ শার্টে তাকে অপূর্ব লাগছিল। আরব মায়ের কাছ থেকে সে উত্তরাধিকার সূত্রে কালো চুল পেয়েছে,আর বড় বড় পটলচেরা চোখ আর পুরুষ্ট ঠোঁট।

বাদবাকি সব বিশুদ্ধ ফরাসি। সে মৃদু হেসে একটা চেয়ারে বসল। কেমন আছো গ্যাভিন? কী সুন্দর রাত। আমি এখুনি কিছুক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে এলাম।

কেইন দাঁত বের করে হেসে তাকে একটা সিগারেট অফার করল। লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে নেবার পর সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। ‘মুকাল্লাতে সব কিছু ঠিকঠাক ছিল তো?

 কেইন পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিল। দুঃখিত, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। গতকালই আমি তোমার এজেন্টের সাথে দেখা করেছি। সে এটা দিল তোমার জন্য।’

চিঠিটা পড়ার সময়ে কেইন তার দিকে লক্ষ করে তার পরিবর্তিত মুখভাব দেখে অবাক হলো–শীতল, ব্যবসায়ী সুলভ আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যখন তার বিশ বছর বয়স, তখন তার বাবা মারা যান, আর সে থেকেই সে লৌহ কঠিন হাতে পেরেট এন্ড কোম্পানির কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে। লোহিত সাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত তার নাম একটি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। অত্যন্ত সৎ তবে যে কোন বাজারের ব্যবসায়ীর চেয়েও সে সুচতুর।

 মেরি একটু ভ্রুকুটি করে ডেকে উঠল, ‘আহমেদ, একটু এদিকে আসবেন এক মিনিট!

 শক্তিশালী গড়নের পাকাঁচলের অধিকারী একজন আরব বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ইউরাপীয় পোশাক পরা লোকটির হাতে একট কলম ধরা, যেন তার কোন জরুরি কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। তিনি এই ফার্মের জেনারেল ম্যানেজার আর, মেরির বাবার একজন পুরোনো ও বিশ্বস্ত বন্ধু।

তিনি কেইনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা নোয়ালেন। মেরি চিঠিটা তার হাতে দিল। এটা একটু পড়ে দেখবেন? গ্যাভিন এটা মুকাল্লা থেকে এনেছে। লাভাল বলছে সে তিল তেল যা পায় তাই নেবে। একটু তাড়াতাড়ি চেষ্টা করলে আমরা সমস্ত স্টক কিনে নিতে পারব।’

আহমেদ মাথা নেড়ে ভেতরে ফিরে যেতে উদ্যত হতেই কেইন বলে উঠল। এক মিনিট আহমেদ। আপনি হয়তো আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন।

আহমেদ ঘুরে একটু মৃদু হাসলেন, তারপর পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, “কি ব্যাপার গ্যাভিন?’

মিসেস কানিংহাম নামে একজন মহিলা এখন দাহরান শহরে আছেন। তিনি তার স্বামীকে খুঁজছেন। তার সম্পর্কে সব শেষের খবর জানা গেছে তিনি দাহরান এসেছেন। কিন্তু কেউ তার সম্পর্ক কিছু বলতে পারছে না।

 আহমেদ ভ্রূকুঁচকে এক মুহূর্ত পর মাথা নাড়লেন। কানিংহাম–জন কানিংহাম। হা মনে পড়েছে। তিনি আপ-কান্ট্রিতে শাবওয়া যেতে চাচ্ছিলেন।

‘কখন সেটা? কেইন জানতে চাইল।

তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন। প্রায় দুই মাস আগে। তারপর মেরির দিকে ফিরে বললেন। এটা ঘটেছে যখন তুমি বোম্বে গিয়েছিলে। ইংরেজ লোকটি বোট থেকে বন্দরে নেমে আমার সাথে অফিসে দেখা করলেন। তিনি শাবওয়া যেতে চাচ্ছিলেন। আমি তাকে সেখানকার বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা বলে সাবধান করলাম, কিন্তু কোন কথা শুনতে রাজি নন তিনি। জর্ডনের কাছে যন্ত্রপাতি পৌঁছাতে আমাদের চারটা ট্রাকের একটা কনভয় যাচ্ছিল সেদিকে। আমি তাকে ওদের সাথে যেতে দিলাম।’

তারপর কখন সে ফিরে আসে?’ মেরি বলল।

আহমেদ কাধ ঝাঁকালেন। সে ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমার যতদুর মনে পড়ে তিনি শাবওয়ার সবচেয়ে কাছের গ্রাম-বার আল মাদানি পর্যন্ত ভাড়া দিয়েছিলেন। তারপর তার কি হয়েছে আমি বলতে পারব না।’

সে কেইনের দিকে ফিরে বলল। দুঃখিত গ্যাভিন, এর চেয়ে আর বেশি কিছু সাহায্য করতে পারলাম না।

কেইন মাথা নাড়ল। আপনি অনেক সাহায্য করেছেন। অন্তত এটুকু জানা গেল যে ভদ্রলোক বার আল-মাদানি পর্যন্ত গিয়েছেন। এর আগে আমি এটা নিশ্চিত হতে পারিনি যে তিনি আদৌ দাহরান এসেছেন।

আহমেদ মৃদু হাসলেন। ঠিক আছে। এখন যদি আপনি কিছু মনে না। করেন, তাহলে আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে।’

তিনি বাড়ির ভেতরে চলে যাওয়ার পর মেরি বলল, এই কানিংহাম লোকটি শাবওয়া এলাকায় কি করছিল?

কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। তিনি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। সম্ভবত পাথরে খোদাই করা লিপি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

‘একা একা?’ সে অবিশ্বাসী স্বরে বলল। হতেই পারে না। শুধু মাত্র একজন বোকা লোক ছাড়া কেউ সেখানে একা যেতে চেষ্টা করবে না।’

‘কিংবা একজন মানুষ, যে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুসন্ধান করছিল।

কথাগুলো তার মুখ থেকে বের হতেই সে অনুতপ্ত হলো, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেরি ভ্রু কুঁচকে একটু সামনে ঝুঁকল। তারপর বলল, তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো, তাই না? পুরো ব্যাপারটা খুলে বললে ভাল হয় না?

কেইন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। মনে হয় আমি তাই করেছি। একটি কারণ হলো তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আর অন্যটি হচ্ছে যেহেতু তুমি একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছো, কাজেই আমার কাছ থেকে আসল কথাটা বের না করা পর্যন্ত তুমি ক্ষান্ত হবে না।’

 মেরি একটু মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। ডিয়ার গ্যাভিন, এতদিনে নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ভাল করে জেনেছো। চল বাগানে হাঁটতে হাঁটতে সব কথা খুলে বলবে।

ওরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গাছের সারির মাঝ দিয়ে হাঁটতে লাগল। মেরি এক হাতে কেইনের বাহু জড়িয়ে ধরল। সে মেরির দেহের সুঘ্রাণ বুক ভরে টেনে নিল। অনেক দিন হল এ রকম অভিজ্ঞতা তার হয়নি।

কেইন বলতে শুরু করল, রুথ কানিংহামের আসা থেকে শুরু করে আলেক্সিয়াস আর তার মরুভূমিতে অভিযানের একটি বর্ণনা দিয়ে শেষ করল।

কেইনের বলা শেষ হলে ওরা দুজনে পানির ফোয়ারার ধারে একটা আসনে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। দূরে কোথাও একটা পাখি ডেকে উঠল আর মেরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এটা সত্যি একটা আশ্চর্য কাহিনী!

‘তুমি বিশ্বাস করো না?’ কেইন বলল।

মেরি কাধ ঝাঁকাল। কানিংহাম যা করেছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন কি করতে চাও তুমি?

কেইন বলল, আমি শাবওয়া পর্যন্ত যাবো। বার আল-মাদানিতে গোত্রপ্রধানকে জিজ্ঞেস করে জানবো কানিংহামের কি হয়েছে।

মেরি উঠে দাঁড়াল, তারপর ওরা পেছনে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।

‘আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তুমি কিংবা আর কেউ কখনো জন কানিংহামকে দেখতে পাবে না।’

 কেইন মাথা নোয়ালো। সম্ভবত তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু তার স্ত্রী নিশ্চিতভাবে না জানা পর্যন্ত হাল ছাড়বেন না।’

 মেরি বারান্দার নিচু রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। আমি তোমার সাথে একমত। যাহোক, ব্যাপারটার দ্রুত নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারবো। কাল সকালে আমি প্লেন নিয়ে জর্ডনের সাথে দেখা করতে বার আল মাদানি যাচ্ছি। তার কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়েছে, সে বিষয়ে আলাপ করতে। সেখান থেকে পনেরো মাইল দূরে সে একটা পরীক্ষামুলক খনন কাজ চালাতে যাচ্ছে। সে তার লোকজনের সাহায্যে আমার জন্য মোটামুটি একটা এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে। আমি শুধু জামালকে সাথে নিচ্ছি। তোমার আর মিসেস কানিংহামের জন্য জায়গা হয়ে যাবে, যদি তোমরা যেতে চাও।

কেইন খুব খুশি হলো। তাহলেতো খুবই ভাল হয়।

‘জর্ডন ট্রাকে করে আমাকে তার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি সকালেই সেখানে পৌঁছাতে চাই। তখন তুমি আমার প্লেনটা নিতে পারো। ঐ এলাকায় দ্রুত একবার সার্ভে করতে তিন ঘণ্টা সময়ই যথেষ্ট।

 ‘এতে ট্রাকে করে যাওয়ার কষ্ট থেকে মিসেস কানিংহাম বেঁচে যাবেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। আমার মনে হয় না এই ধরনের যাত্রার জন্য তার অভ্যাস আছে।’

‘তিনি কি দেখতে সুন্দরী?’ মেরি বলল।

সে কাঁধ ঝাঁকাল। স্কিরোজ অবশ্য তাই মনে করে।

 কিন্তু তোমার বেশি আগ্রহ তার টাকার দিকে, তাই না?

তার স্বামীকে খুঁজে বের করার জন্য তিনি যে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন তা বেশ আকর্ষণীয়। তবে মন্দিরের কাহিনীতে আমার আগ্রহ আরো বেশি।’

মেরি হালকাভাবে হাসল। সেই চিরকালের অনুসন্ধানকারী। তুমি কি কোনদিন পাহাড়ের এই পাশে যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না, গ্যাভিন?’

‘সম্ভবত নয়, সে বলল। আমার মনে হয় সে জন্যই আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই প্রত্নতত্ত্ব আমাকে অনেক আকর্ষণ করতো। সে জন্যই আমি এখানে রয়ে গেছি, অথচ প্রত্যেক বছর প্রতিজ্ঞা করি এবছরই চলে যাবো। এখানে কত কিছু করার আছে–অবশ্য যদি টাকা থাকে। তার মানে মাঝে মধ্যে স্কিরোজের জন্য কাজ করা। তবে ভিক্ষার চাল কাড়া-আকাড়া। সে দাঁত বের করে হাসল।

সে কথা যখন উঠলই, তুমিই বা এখানে থাকছো কেন? তুমি তো অতি সহজেই আরো সুবিধাজনক জায়গায় তোমার হেডকোয়ার্টার করতে পারো। যেমন ধরো বোম্বেতে।

 মেরি কাঁধ ঝাঁকাল। এটি একটি প্রাচীন জায়গা। আর আমার মা একটি প্রাচীন গোষ্ঠী থেকে এসেছেন। আমার ধারণা, এটা আমার রক্তে আছে।

সে মেরির দুই কাঁধে দুই হাত রাখল। তুমি একটি চমৎকার মেয়ে।

 সে হঠাৎ তার পাতলা শার্টের মধ্য দিয়ে মেরির দেহের উষ্ণতা সম্পর্কে সচেতন হল। কয়েক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে একই ভাবে তাকিয়ে রইল। কেইন তাকে নিজের দিকে টানতেই সে কোন ধরনের বাধা দিল না।

কেইনের মনের মধ্যে যে তোলপাড় চলছে তা টের পেয়ে মেরি মৃদু হাসল। ‘বেচারি গ্যাভিন, তোমার এতদিনের ব্রম্মচারি-জীবনের ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমি কি নিয়ম ভঙ্গ করেছি? তবে নারী হল ডেভিল, এটা এতদিনে তোমার জানার কথা।

 ‘আমি সে সত্য ভালভাবে জানি।’ সে বলল।

‘একটা ড্রিংক চলবে?

অনেক কষ্ট করে সেই লোভটি সে সামাল দিতে সফল হল। আমার মনে হয় না তা ঠিক হবে।’

মেরি তার হাত ধরল, তারপর তারা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাগান পেরিয়ে গেটের দিকে হেঁটে চলল। দরজা খুলে তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। ঠিক সাতটায় এয়ার স্ট্রিপে, দেরি করো না। আমি সকালেই যাত্রা করতে চাই।’

কেইন চাঁদের আলোয় দেখল, এক অপূর্ব সুন্দর মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘দ্যাখো, যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।

মেরি এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু আমি নই। তারপর সে তাকে দরজা থেকে বাইরে ঠেলে দিল।

 কেইন, সেখানে অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পিছন ফিরে শহরের দিকে রওয়ানা হলো।

.

হোটেলে পৌঁছার পর সে রুথ কানিংহামের কামরায় গিয়ে দরজায় টোকা দিল। কোন সাড়া নেই। আর একবার চেষ্টা করে দরজা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে দেখল কেউ নেই।

নিচ তলায় নেমে সে বারে গেল। স্কিরোজ জানালার পাশে সামনে এক গ্লাস ড্রিংক নিয়ে বসে আছে। সোজা তাকিয়ে রয়েছে রাতের অন্ধকারের দিকে। কেইন তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

সে উপরের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। কোন কিছু পেলে?

কেইন মাথা নাড়ল। এবার আল মাদানি পর্যন্ত যাওয়ার তথ্য জানতে পেরেছি। সে মেরি পেরেটের একটা কনভয়ের সাথে সেখানে গিয়েছিল

স্কিরোজ অবাক হয়ে বলল, তাহলে আসলেই সে দাহরান নেমেছিল। আমি সত্যি অবাক হচ্ছি। এখন তুমি কি করবে?

‘আমরা কাল সকালেই মেরির সাথে প্লেনে সেখানে যাচ্ছি,’ আমি মিসেস কানিংহামকে খবরটা দেবার জন্য তার কামরায় গিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি সেখানে নেই।

স্কিরোজ অন্ধকারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, কয়েক মিনিট আগে তিনি এখান দিয়ে গেছেন। আমার মনে হয় তুমি তাকে সৈকতে পাবে।’

কেইন তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বারান্দায় এল। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা আর মৃদু হাওয়ার সাথে সাগরের নোনা পানির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে বালুতে নেমে এল। তারপর সামনে সাগরের সাদা ফেনা লক্ষ করে হাঁটতে শুরু করল। চন্দ্রালোকিত সৈকতে সে রুথকে খুঁজতে লাগল।

 একটু হতাশ হয়ে থামল, তখন বাম দিকে পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা গেল। ‘এই যে আমি এদিকে।

রুথ একটা মাছ ধরা নৌকার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেইন এগোতেই সে বলল, কোন খবর আছে আমার জন্য?’

কেইন একটা সিগারেট ধরাল, তারপর মাথা নুইয়ে বলল—

 ‘হ্যাঁ, আমার মনে হয় সব কিছু এখন ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনার স্বামীর খোঁজ পেয়েছি শাবওয়া থেকে দশ মাইল দূরে একটা আরব গ্রামে। আমরা সকালেই মেরি পেরেটের সাথে সেখানে প্লেনে যাচ্ছি। সেখানে আমি গ্রামের গোত্রপ্রধানের কাছ থেকে আরো সঠিক তথ্য যোগাড় করতে পারব।’

রুথ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কেইনের গায়ে হাত রেখে বলল, ‘মাই গড়, এতো খুবই চমৎকার।

রুথ নরম বালুতে বসে পড়ল। কেইন তার পাশে বসে একটা সিগারেট বের করে রুথের হাতে দিল। ম্যাচ জ্বালতেই রুথের চিবুকের একপাশ আলোকিত হয়ে উঠল, তার দু’চোখ পানিতে টলমল করছে।

 কেইন তার হাত ধরে শান্তভাবে বলল, দেখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ঘাড় কাত করল। ‘আপনি এ পর্যন্ত যা করেছেন, জানি না তার ঋণ কীভাবে শোধ করব।

‘তার জন্য আপনার কোন কষ্ট করতে হবে না, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। সে দাঁত বের করে হেসে উঠে দাঁড়াল। আর এখন আমার মনে হয় আপনার একটু ঘুমানো উচিত, মিসেস কানিংহাম। কাল ভোরেই আমাদের রওয়ানা দিতে হবে।’

রুথ আর কোন কথা না বাড়িয়ে কেইনকে হোটেলের বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। পরদিন ভোর ছটায় তাকে হোটেল থেকে তুলে নেবার ব্যাপারে কথা বলে সে জেটির দিকে এগিয়ে চলল।

পিরু একটা পাথরের উপর আসন গেড়ে বসে টুলছিল। কেইনকে দেখেই তাড়াতাড়ি সজাগ হয়ে মৃদু হাসল। অন্ধকারে তার দাঁতগুলো চক চক করে উঠল।

নৌকা বেয়ে লঞ্চের দিকে যেতে যেতে কেইন তাকে পরদিন বার আল মাদানিতে যাওয়ার কথা জানাল। সবকিছু তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’ রেইল টপকে লঞ্চের ডেকে উঠতে উঠতে সে বলল। কোন দিকে থেকে কোন বিপদ আসে কিনা সেদিকে নজর রাখবে। বিশেষত সেলিমের কাছ থেকে।

 পিরুকে ডিঙ্গিটা বেঁধে রাখতে বলে সে নিচে কেবিনে গেল। ভেতরে অন্ধকার নিরবতা। কেবল চাঁদের আলো পোর্নহোলের ফাঁক দিয়ে এসে ভৌতিক আঙুল দিয়ে তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে।

সে বাংকে শুয়ে উপরে কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে মেরির কথা ভাবতে লাগল। একটা মুহূর্ত অন্ধকারে তার উপস্থিতির ছোঁয়া পেল আর মনে হলো সে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। ধীরে ধীরে সে ঘুমে তলিয়ে গেল।

.

০৮.

কেইন জেটি পার হয়ে ওয়াটার ফ্রন্ট ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেল মাছ ধরা নৌকাগুলো বন্দরের প্রবেশ পথ দিয়ে উপসাগরের দিকে চলে যাচ্ছে। দিনের প্রথম সিগারেট ধরাল সে। সিগারেটের ধোঁয়া গলার পেছনে আটকাতেই কাশতে শুরু করল। একটু ক্লান্ত লাগছে আর ডান চোখের পেছনে একটু ব্যথা মনে হচ্ছে। এক মুহূর্ত থেমে সে ভোরের আলোয় মাছ ধরা নৌকাগুলোর সাদা পালগুলোর পত পত করে ওড়া দেখল তারপর ঘুরে হোটেলের পথ ধরল।

তার পরনে খাকি শার্ট প্যান্ট আর বহুল ব্যবহৃত একটা বুশ হ্যাট। কি মনে করে সে লঞ্চ ছাড়ার আগে কোল্ট অটোমেটিকটা হিপ পকেটে ভরে নিয়েছিল। শাবওয়া এলাকার উপজাতিদের মধ্যে তার অনেক বন্ধু থাকলেও বলাতো যায় না কখন কি ঘটে।

হোটেলে পৌঁছেই রুথ কানিংহামকে দেখতে পেল সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো। একটা গলা খোলা সাদা ব্লাউজ আর ক্রিম রঙের হুইপ কর্ডের প্যান্ট পরে রয়েছেন। চুল বাঁধা রয়েছে সেই একই নীল স্কার্ফ দিয়ে যেটা পরেছিলেন প্রথম দিন। কেইনকে দেখে মৃদু হাসতেই অত্যন্ত আকর্ষণীয় দেখাল তাকে।

‘আমার এই পোশাকে চলবে তো?’ দুদিকে হাত ছড়িয়ে সে বলল।

কেইন মাথা নুইয়ে বলল, “বেশ সাজসজ্জা তবে কাজ চলবে। সে হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। আমাদের জলদি পা চালাতে হবে। আমি মেরিকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে চাই না।’

সরু অলিগলির গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে চলার সময় তাদের মাঝে,তেমন কোন কথা হলো না। শেষ পর্যন্ত ওরা শহরের শেষ মাথায় পৌঁছাল। রুথের চোখের নিচে কালো কালির ছাপ, মনে হলো রাতে ভাল ঘুম হয়নি। এছাড়া তার চেহারায় বেশ উদ্বিগ্ন ভাব দেখা যাচ্ছে। এটা কেইনের খুব একটা ভাল মনে হলো না।

 কোয়ার্টার মাইল দীর্ঘ বিমানক্ষেত্রটা দাহরানের বাইরে একটা গিরিপথের মুখের কাছে। গিরিপথটা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। এটা প্রধান প্রধান এয়ারলাইনসের বিমান অবতরনের জন্য অফিসিয়াল বিমানক্ষেত্র নয়। স্পেনিশ বিমান বাহিনী তাদের বিমান জরুরি অবতরণের জন্য এটা তৈরি করেছিল।

শুধু একটা হ্যাঙ্গার রয়েছে, উপরে করোগেটেড ছাদওয়ালা একটা পড়েপড়ো আর জরাজীর্ণ কংক্রিটের বিল্ডিং। ওরা বেশ দূর থেকে দেখতে পেল প্লেনটা রানওয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে–লাল আর রুপালি রং করা একটা ডি হ্যাঁভিল্যান্ড ব্যাপিড। ওরা এগোতেই দেখল এর টুইন ইঞ্জিন ইতোমধ্যেই টিক টিক করতে শুরু করেছে।

জামাল পেছনের একটা সিটে বসা ছিল। মেরি লাফ দিয়ে প্লেন থেকে মাটিতে নামল কেইনের সাথে দেখা করার জন্য। কেইন পরিচয় করিয়ে দেবার পর দুই মহিলা হাত মেলালো।

 ‘আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ রুথ কানিংহাম বলল।

মেরি কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল, “এটা তেমন কিছু নয়, মিসেস কানিংহাম। আমিতো এমনিতেই ব্যবসার কারণে বার আল-মাদানি যাচ্ছিলাম। তারপর সে কেইনের দিকে ফিরে তাকাল, ঠোঁটে মৃদু হাসি আর চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। আশা করি রাতে ভাল ঘুম হয়েছে গ্যাভিন। একটু তাড়াহুড়া করছি বলে দুঃখিত, কিন্তু জর্ডনকে কথা দিয়েছি সাড়ে সাতটার মধ্যে সেখানে পৌঁছাবো।

রুথ কানিংহাম প্লেনে উঠে জামালের পাশের সিটে বসল। সে সরাসরি সামনে তাকিয়ে রইল রুথকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। মেরি পাইলটের আসনে বসল তারপর কেইনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি প্লেনটা চালাবে?

 সে সম্মতি জানাতেই মেরি পাইলটের আসন ছেড়ে পাশের সিটে সরে বসল। কেইন ধীরে ধীরে ট্যাক্সি করে প্লেনটাকে বাতাসের অনুকুলে ফেরালো। এক মুহূর্ত পরেই রানওয়ের শেষ মাথা তাদের দিকে দ্রুত ধেয়ে এল। সে ধীরে ধীরে কলামটা পেছনের দিকে টানতেই র‍্যাপিড প্লেনটা গিরিপথের মধ্য দিয়ে উপরে উঠল। দুপাশের পাথুরে দেয়াল দ্রুত পেছনের দিকে ধেয়ে চলল।

গিরিপথ থেকে বের হতেই প্লেনটা ঝাঁকুনি খেতে শুরু করল। কেননা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বাতাস বইছিল ৪০ নটিকেল মাইল গতিতে। ওরা গরম কুয়াশার মধ্য দিয়ে উঠতে থাকল, কুয়াশা চারপাশ অস্পষ্ট করে তুলেছে। ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে আসার পর লেভেল হল উপসাগর রেঞ্জ অতিক্রম করার জন্য।

পাহাড়ের পরই উজ্জ্বল নীল আকাশ। আধ ঘন্টার মধ্যে দূরে আসল মরুভূমি নজরে এল। মরুভূমির রং সোনালি আর গাঢ় লালের মাঝে খেলা করছিল।

তারপর হঠাৎ একটা উঁচু তেলের খনন-স্তম্ভ আর তার চারপাশ ঘিরে থাকা অনেকগুলো তাঁবু আর মোটর গাড়ির উপর দিয়ে ওরা উড়তে লাগল। রুথ কানিংহাম হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “ঐ যে দেখুন নিচে একটা ট্রাক দেখা যাচ্ছে!

কেইন জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে ওদের দিকেই ছুটে আসছে। একটু পরেই দুরে কাল ছোপ ছোপ নজরে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেগুলো বড় হয়ে একগুচ্ছ সবুজ পাম গাছ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরি করা সমতল ছাদের কতগুলো বাড়ি হয়ে গেল।

বিমান অবতরন ক্ষেত্রটা ছিল দুটো বালিয়াড়ির মাঝখানে একটা সরু পথ। এর এক মাথায় বাতাসের গতি নির্দেশের জন্য একটা লম্বা খুঁটির উপর উইন্ডসক ওড়ানো রয়েছে। কেইন উপরে একটা চক্কর দিয়ে নিখুঁতভাবে দুই সারি ড্রামের মাঝে অবতরণ করার জন্য বাতাসের অনুকুলে পজিশন নিল। টেক্সিং করে রানওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছাতেই ট্রাকটি বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে ওদের দিকে এগিয়ে এল।

কেইন ইঞ্জিনের সুইচ বন্ধ করে দরজা খুলে এক লাফে মাটিতে নামল। তারপর ঘুরে একের পর এক দুইজন মহিলাকেই হাত ধরে নিচে নামাল। ট্রাকটা কয়েকফুট দূরে এসে ব্রেক কষে থামল এবং একজন লোক স্টিয়ারিং হুইল ছেড়ে নিচে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে এল।

তামাটে মুখ বেপরোয়া চেহারার একজন যুবা পুরুষ, সাদা চুল ছোট করে ছাঁটা। পরনে রোদে ঝলসে যাওয়া খাকি পোশাক আর ডানদিকে কোমরে কালো চামড়ার খাপে একটা রিভলবার ঝুলছে। বুদ্ধিদীপ্ত হাসিতে তার দাঁত ঝিক করে উঠল। সে চেঁচিয়ে উঠল। আরে এতো খোদ শয়তান নিজেই হাজির। তুমি এখানে কী করে এলে?

 কেইন দাঁত বের করে হেসে তার কাঁধে একটা ঘুসি মারল। আমি আশা করছিলাম তুমি হয়তো আমাদের সাহায্য করতে পারবে জর্ডন। একটু ঘুরে রুথ কানিংহামকে দেখিয়ে বলল। ইনি মিসেস কানিংহাম, স্বামীকে খুঁজতে এখানে এসেছেন। আমরা জানতে পেরেছি তিনি দুই মাস আগে বার আল মাদানিতে এসেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল কয়েকদিনের জন্য শাবওয়া যাওয়ার। কিন্তু এর পর থেকে ইনি তার স্বামীর কোন খবর পাচ্ছেন না।

 জর্ডন রুথের হাত ধরল, তার মুখ গম্ভীর। আমি দুঃখিত মিসেস কানিংহাম। সে এক মুহূর্ত ভ্রু কুঁচকে রইল। তারপর বলল–না আমি আপনার স্বামীর সম্পর্কে কোন কিছু শুনিনি। হয়তো গ্রামের গোত্র প্রধান কোন কিছু বলতে পারবে।

রুথ কেইনের দিকে ফিরতেই কেইন মাথা নাড়ল। আমি এখানকার গোত্রপ্রধান–ওমর বিন নাসেরকে চিনি। কোন কিছু জানা থাকলে সে আমাদের জানাবে।

জর্ডন ওদেরকে ফোর্ড পিকআপ ট্রাকটির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। সে হাত ধরে রুথকে গাড়িতে উঠিয়ে দিল। তাহলে এ কথাই রইল কেইন, আমি তোমাকে আর মিসেস কানিংহামকে গ্রামে নামিয়ে দেব। বিকালে আমরা আবার দেখা করব। মেরির সাথে আমাকে অনেক বিষয়ে আলাপ করতে হবে।’

 মেরি সামনের সিটে রুথ কানিংহামের পাশে চাপাচাপি করে বসল। কেইন আর জামাল ক্যানভাস ছাউনি দেওয়া পেছনের সিটে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করতেই কেইন এমনি পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল লালচে বাদামি রঙের আলখাল্লা আর মাথায় লাল আবায়া পরা একজন আরব বালিয়াড়ির পেছন থেকে উটে চড়ে রানওয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে। প্লেনের কাছে এসে সে উটের পিঠ থেকে নেমে প্লেনের পাশেই দাঁড়াল।

 কেইন জর্ডনের কাঁধে একটা টোকা দিয়ে বলল। এক মিনিট থামবে জর্ডন?’

 জর্ডন ট্রাক থামাল, তারপর সবাই ঘুরে পেছন দিকে তাকাল। আরব লোকটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্লেনটা দেখছিল, তারপর মুখ তুলে ওদের দিকে তাকাল।

কেইন ট্রাক থেকে নেমে পড়ল। আমি দেখে আসি লোকটা কি চায়। হয়তো এমনিই কৌতূহল, তবুও বেদুঈনদের ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না।

 সে প্লেনের দিকে এগোতেই আরব লোকটিও তার সাথে দেখা করার জন্য এগোল। তার একহাত অলসভাবে বাকা জামবিয়ার রুপালি হাতলে রাখা। কেইন লোকটি থেকে কয়েক ফুট দুরে থেমে আরবিতে জিজ্ঞেস করল। তুমি এখানে কি চাও? কাউকে খুঁজছো?’

আরব লোকটির মুখ রেখাঙ্কিত আর চোয়াল নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। চোখের মনি বিন্দুর মতো আর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লালা ঝরছিল। সে বলল, ‘কেইন নামে একজনের জন্য আমার কাছে একটা চিঠি আছে।

কেইন এক হাত দিয়ে কোল্টের বট ধরে রেখে বলল, “আমিই সে লোক। কোথায় চিঠি, দেখি?

সাথে সাথে আরব লোকটি খাপ থেকে জামবিয়াটা টেনে বের করতেই এর ব্লেড রোদে ঝলকে উঠল। কেইন দ্রুত এক কদম পিছু হটে খাপ থেকে কোল্ট বের করতে চেষ্টা করল। কিন্তু পিস্তলের ডগা তার পকেটের লাইনিংয়ে আটকে গেল। সে ছোরার ব্লেড থেকে বাঁচার জন্য ঝট করে মাথা সরিয়ে আরব লোকটির গলা ধরতে চেষ্টা করল।

 এক মুহূর্ত তারা জাপটাজাপটি করতে লাগল, কেইন লোকটির হাত থেকে অস্ত্রটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করল।

আরব লোকটি ভীষণ জোরে তার হাঁটু উপরের দিকে উঠিয়ে মারল।

কেইন ব্যাথায় কাতড়ে উঠল, দুজনে জাপটাজাপটি করতে করতে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল। কেইনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তারপরও সমস্ত কিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল। নোংরা লোকটার শরীরের তীব্র দুর্গন্ধ আর তার চোখের উন্মাদের মতো চাউনি সম্পর্কে সে সচেতন হলো।

দূরে নারী কণ্ঠের চিৎকার শোনা গেল আর তখনই সে অনুভব করল তীক্ষ্ণ কিছু একটা তার ডান নিতম্বে যন্ত্রণাময় খোঁচা দিচ্ছে। এটি কোল্ট রিভরবারটি, সে টেনেহিঁচড়ে পকেট থেকে সেটা বের করল। তারপরর কোল্টের ব্যারেল আরব লোকটির পেটে জোরে চেপে ধরল। লোকটা আঘাত হানার জন্য জাম্বিয়া উঁচু করতে সে দুবার ট্রিগার চাপলো।

এত কাছ থেকে গুলি করায় বুলেটের প্রচণ্ড শক্তি লোকটিকে পেছনের দিকে তুলে ফেলে দিল। কেইন উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার কানে প্রচণ্ড আওয়াজ হচ্ছে। কেউ তার নাম ধরে চিৎকার করে উঠল। সে এরোপ্লেনের ডানা ধরে কোনোমতে টেনে নিজেকে ওঠালো। তখন তার নজরে পড়ল আরেকজন আরব দৌড়ে তার দিকে এসে মাথার উপর জাম্বিয়া উঁচু করল।

 কেইন কোল্টটা উঁচু করতে চেষ্টা করল, কিন্তু মনে হলো তার হাতে কোন শক্তি নেই। আর তখন জর্ডন সেখানে পৌঁছাল। ভুতত্ত্ববিদ এক হাঁটু গেড়ে তার পাশে মাটিতে বসল, তার ভারী রিভলবারের ব্যারেল বামহাতের বাহুর উপর রেখে অত্যন্ত দ্রুত চারবার গুলি করল, মনে হচ্ছিল,যেন একটি গুলির আওয়াজ অনেকক্ষণ ধরে চলেছে।

আরব লোকটি তখনও গুলির মুখে দৌড়ে আসছিল, বুলেটগুলো একের পর এক তার দেহে বিদ্ধ হতে লাগল। তারপর প্রায় তাদের গায়ের উপর এসে এক পাশে টলতে টলতে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল।

কয়েকটি মুহূর্ত নিঃশব্দে কাটলো, তারপর কেইন তার পেছনেই একটা চিৎকার শুনলো। এরোপ্লেনের ডানা ধরে নিজেকে সামলে সে ঘুরে দেখল মেরি তার দিকে ছুটে আসছে।

তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। সে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। “গ্যাভিন তুমি ঠিক আছে?

 সে মেরির হাতে হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বলল, জর্ডনকে ধন্যবাদ দাও।’

 ভুতত্তবিদ গুলিতে মৃত লোকটির উপর ঝুঁকেছিল, সে ফিরে অবাক হয়ে বলল, কী করে লোকটা গুলি খেতে খেতে ছুটে আসছিল? আমি তো একটা গুলিও মিস করিনি।

 কেইন মৃতদেহটি চিৎ করল। লোকটির মুখ কুঁকড়ে আছে, ঠোঁটে লালা ঝরছে আর ঠোঁট বাইরের দিকে উল্টানো, দাগে ভরা দাঁত দেখা যাচ্ছে। এর আগে এরকম চেহারা হয়েছে সেরকম কাউকে তুমি দ্যাখোনি?

জর্ডন মাথা নাড়ল। তবে মেরি এগিয়ে এসে নিচে তাকাল। এই লোকটাকে কোয়াট খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করা হয়েছে। সে নিশ্চয়ই একজন ভাড়াটে খুনি।

কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। আমারও সেরকম মনে হচ্ছে। যখন আমি প্রথম লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি চায় সে তখন সে আমাকে বলল কেইন নামে একজনের জন্য তার কাছে একটা চিঠি আছে।

 ‘কিন্তু কেউ তোমাকে কেন হত্যা করতে চাইবে?’ জর্ডন বলে উঠল। আর এই কোয়াট জিনিসটা কি?

কেইন একটা সিগারেট ধরাল। এটা হলো এ এলাকার এক ধরনের গুল্মলতার পাতা থেকে বানানো উত্তেজক নেশা দ্রব্য। এই পাতা চিবোলে মানুষটি অতিরিক্ত সচেতন আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে যায়। বার বার এটি চিবোলে ব্যবহারকারীর শারীরিক আকৃতির উপর একটা প্রভাব পড়ে।

জর্ডন ভ্রু কুঁচকালো। আর এই ভাড়াটে খুনির বিষয়টা কি বলো তো?”

কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। আমি মনে করেছিলাম তুমি হয়তো ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে জেনেছ। তুমি যদি এদেশে কাউকে হত্যা করতে চাও তবে সেটা তুমি নিজে করবে না। একজন পেশাদার লোককে ভাড়া করবে।

প্রথম যে লোকটিকে কেইন মেরেছিল জামাল তার দেহ তল্লাশি করে হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে ওদের দিকে আসছিল। সেটা সে তার মিসট্রেসের হাতে দিল।

মেরি ভেতরে তাকিয়ে ব্যাগের মুখটা এমনভাবে খুলে ধরল যাতে বাকি সবাই দেখতে পারে কি আছে ভেতরে। ব্যাগ ভর্তি রূপার মুদ্রা।

জর্ডন শীস দিয়ে উঠল আর মেরি গম্ভীর কণ্ঠে বলল। এখানে কম করেও দুই থেকে তিন হাজার মারিয়া থেরেসা ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা আছে, গ্যাভিন। কেউ তোমাকে মৃত দেখতে চায় নিশ্চিত ভাবে।

কেইন শান্তভাবে মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, আমার মনে হয় আমি জানি কে তা চায়। গতকাল সেলিমের সাথে একটা বোঝাঁপড়া হয়েছিল। গতরাতে আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন তার একটা লোক একবার চেষ্টা চালিয়েছিল আমাকে হত্যা করার।

 মেরি ভ্রু কুঁচকালো। কিন্তু সে কি করে জানল যে তুমি আজ সকালে বার আল মাদানিতে আসবে?

বিষয়টা নিয়ে কেইন একটু ভেবে মাথা নাড়ল। “তোমার কথায় যুক্তি আছে। যাই হোক ছাড়ো এসব। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি আর শুধু শুধু অনেকগুলো টাকা খরচ করল কেউ।’ সে যন্ত্রণায় কাতড়ে উঠে হাত দিয়ে মুখ মুছলো। এখন একটা ড্রিংক পেলে ভাল হতো।

ট্রাকে একটা ফ্লাস্ক আছে,’ জর্ডন তাকে জানাল। আমারও একটু দরকার জিনিসটা। সে দাঁত বের করে হেসে বলল। আমি শুধু শুধু ভাবছিলাম একজন ভূতাত্ত্বিক হলে জীবন হয়তো একঘেয়ে হয়ে যায়।

ওরা যখন ট্রাকের দিকে ফিরছিল তখন একদল উত্তেজিত জনতা ওদের পাশ কাটিয়ে মৃতদেহগুলোর দিকে যাচ্ছিল।

 ‘এরা অবার এল কোত্থেকে? জর্ডন বলল। কেউ দেখলে হয়তো মনে করবে ওরা আগে থেকে জানতো কিছু একটা এখানে ঘটবে।

‘সম্ভবত তারা তা জানতো,’ কেইন তাকে জানাল।

রুথ কানিংহামকে হঠাৎ দেখে অসুস্থ মনে হলো, তার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।

‘আপনি ঠিক আছেন তো? সে কেইনকে জিজ্ঞেস করল।

 কেইন মাথা নাড়ল। দুঃখিত, আপনাকে এসব দেখতে হচ্ছে।

মনে হলো তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। সামনের সিটে গিয়ে কোনরকমে বসে নার্ভাস হয়ে হাতের মুঠো একবার বন্ধ করল আবার খুলতে লাগল।

প্রথম আততায়ীর দেহ তল্লাশি করে জামাল ব্যাগ ভর্তি যে মুদ্রা পেয়েছিল, জর্ডন সেগুলো পরীক্ষা করছিল। সেখান থেকে মুখ তুলে কেইনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এগুলো নিয়ে কী করা হবে?’

 ‘এখন তোমার কাছেই রেখে দাও, কেইন তাকে জানাল। পরে এক সময় নিশ্চয়ই এর ব্যবহার কীভাবে করা যায় তা জানা যাবে।

 জর্ডন দাঁত বের করে হাসল। এই পরিস্থিতিতে বেশ ভাল টাকা পাওয়া গেল। ড্যাশবোর্ডের নিচে একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে সে একটা ব্রান্ডির ফ্লাস্ক বের করে লম্বা এক ঢোক খেয়ে ফ্লাস্কটা কেইনের হাতে দিল। কমপ্লিমেন্ট অফ দি হাউস।

কেইন ফ্লাস্কটা হাতে নিয়ে নিরবে তাকে টোস্ট করল। ব্রান্ডি গলা বেয়ে পেটে পড়তেই তার প্রায় শ্বাসরোধ হয়ে পড়ল। তারপর সে পেছনের সিটে গিয়ে বসল। তোমাকে এখনও ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। তুমি চমৎকার রিভলবার চালিয়েছ।

জর্ডন স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসে গ্রামের দিকে ড্রাইভ করে চলল। ‘আমি ওয়াইমিংয়ে একটা খামারে বড় হয়েছি।’

একটা বড় রাস্তায় ট্রাকটা ঘুরিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বড় বাড়িটার সামনে সে ব্রেক করল। এক পাল ছাগল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল।

 কেইন গাড়ি থেকে নামতেই রুথ কানিংহামও তার পিছু পিছু নামল। “ওমরের সাথে কথা বলার পর আমরা শাবওয়া এলাকায় আকাশে প্লেন নিয়ে একটা চক্কর দেব।’ সে মেরিকে বলল।

 সে মাথা কাত করল। সাবধানে থেকো গ্যাভিন, আর মরুভূমির খুব বেশি ভেতরে যেও না। ওড়ার জন্য জায়গটা ভাল নয়। সে তার হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। হয়তো–ভাগ্য ভাল হলে, আমরা দুপুরের আগেই এখানে ফিরে আসতে পারব।’

কেইন মৃদু হাসল। আমরাও সহজেই তার আগেই চলে আসতে পারব।’

গিয়ার বদলাবার শব্দ করে ধুলার মেঘ উড়িয়ে ট্রাকটা চলে গেল। রুথ কানিংহামের সাথে কথা বলার জন্য ঘুরতেই কেইন দেখল গ্রামের গোত্র প্রধান তার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে অভুর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছে।

 ‘তুমি আমার ঘরকে সম্মানিত করছে ক্যাপ্টেন কেইন, সে আরবিতে বলল।

 কেইন মৃদু হাসল। সবসময় আমি কোন কিছুর দরকার পড়লে আসি, বন্ধু। ভেতরে চল। বাইরে খুব গরম আর গত আধ ঘণ্টার ঘটনার পর আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে একটু বসে আরাম করার।

ওমর ওদেরকে তার জানালাবিহীন কাদামাটির ইটের তৈরি বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। বাড়িটায় দুটো কামরা। একটাতে পরিবারের ছাগল আর মুরগির পাল আর অন্যটায় সবার জন্য থাকার জায়গা। রাতে ওমর তার পরিবার নিয়ে লম্বা গালিচায় ঘুমায়।

দরিদ্র এলাকা হলেও ওমর বিন নাসেরের মধ্যে স্থানীয় আরব রীতি অনুযায়ী শিষ্টাচার ও মর্যাদা বোধ ছিল। সে কেইন এবং রুথ কানিংহামকে দুটো কুশনের কাছে নিয়ে গিয়ে দুহাতে তালি দিল। এক মুহূর্তের মধ্যে একজন মহিলা কামরায় প্রবেশ করল। লম্বা কালো একটা বোরকা জাতীয় আলখাল্লা পরে রয়েছে, যা দিয়ে তার মুখও সম্পূর্ণ ঢাকা। মহিলাটির বাম হাতে একটা তামার পাত্র আর অন্য হাতে তিনটে কাপ।

স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী কেইন প্রথমে প্রত্যাখানের ভান করে একটা কাপ গ্রহণ করল, আর সেই সাথে রুথ কানিংহামকেও ইশারা করল তাকে অনুসরণ করতে। মহিলাটি কয়েকফোঁটা কাপে ঢেলে অপেক্ষা করতে লাগল মতামতের জন্য। এটি ছিল ইয়েমনি মোছা–পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কফি। কেইন মৃদু হেসে কাপটা তুলে ধরল। মহিলাটি সাথে সাথে কাপটা ভরে দিল।

 ওমর হাতের ইশারায় মহিলাটিকে বিদায় করল। কেইন তাকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরতেই গোত্র প্রধান আগ্রহ ভরে সেটা গ্রহণ করল।

সিগারেট টেনে সন্তুষ্ট হওয়ার পর সে আরাম করে বসে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল। বল তোমার জন্য কী খেদমত করতে পারি?

 কেইন রুথ কানিংহামকে দেখিয়ে বলল। আমি এই মহিলার স্বামীর অনুসন্ধান করছি। তিনি প্রায় দুমাস আগে এখানে এসেছেন। তার সম্পর্কে তুমি কিছু বলতে পারবে?

ওমরের চোখের তারা কৌতূহলে নেচে উঠল। সে রুথ কানিংহামের দিকে মাথা হেলিয়ে একটু মৃদু হেসে কেইনকে বলল। এই মহিলা সম্ভবত আরবি জানেন না?’ যখন কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল, তখন সে বলল। প্রায় দুই মাস আগে ঠিকই একজন লোক এখানে এসেছিল। সে একটা ট্রাকের কনভয়ের সাথে এসেছিল। ট্রাকটা আমেরিকান জর্ডনের ক্যাম্পে চলে গেল তবে লোকটি বার আল মাদানিতে রয়ে গেল।’

এখান থেকে তারপর সে কোথায় গেল? কেইন বলল।

ওমর কাঁধ ঝাঁকাল। কে জানে? লোকটা একটা পাগল-বদ্ধ উন্মাদ ছিল। সে শাবওয়া থেকে মারিব উটে চড়ে যেতে চেয়েছিল। সে জন্য গাইড খুঁজছিল।’

‘তুমি তাকে লোক দিয়েছিলে? কেইন বলল।

ওমর মাথা নাড়ল। আমি উট দিতে পেরেছিলাম। তবে পথপ্রদর্শক সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তুমিতো জানোই কেউ রাব আল খালিতে যেতে সাহস করে না, যদি না সে মাথার উপর মূল্য ধার্য করা একজন অপরাধি হয়ে থাকে।’

তারপর সে কী একাই গেল?

গোত্র প্রধান মাথা নাড়ল। সে সময়ে একজন পাগল বেদুঈন–একজন রশিদ এখান দিয়ে যাচ্ছিল। তুমি তো জানোই তারা কী ধরনের হয়ে থাকে। যে কোন এডভেঞ্চারপ্রিয়, গর্বিত, বেপরোয়া মানুষ। সে স্বেচ্ছায় ইংলিশ লোকটার সাথে গেল।

‘তারপর আর তাদের কোন খবর পেয়েছিলে?’ কেইন বলল।

ওমর হালকাভাবে মৃদু হেসে বলল। ক্যাপ্টেন কেইন, এই মুহূর্তে তাদের হাড় রোদে ঝলসাচ্ছে। যে সব বোকা মানুষ রাব আল খালিতে যাবার দুঃসাহস দেখায় তাদের শেষ পরিণতি সেটাই হয়।’

কিছুক্ষণ কেইন ভুরু কুঁচকে বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে রুথ কানিংহামের দিকে এক হাত বাড়াল। কিছু জানতে পারলেন?’ সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

সে ঘাড় কাত করল। অনেক কিছু। আপনার স্বামী এখানে এসেছিলেন। তিনি এখান থেকে উট আর রশিদ গোত্রের একজন বেদুঈনক সাথি হিসেবে পেয়েছিলেন। ওমরকে জানিয়েছিলেন যে তিনি শাবওয়া থেকে রাব আল খালি অতিক্রম করে মারিব যাবেন।

 তার চোখে একটু ভীতি দেখা গেল। কেইন তার বাহুতে চাপড় দিয়ে আশ্বাস দিল। তারপর ওমরের দিকে ফিরে বলল। অশেষ ধন্যবাদ বন্ধু। তবে এখন আমাদের যেতে হবে। আমি এই মহিলাকে সাথে নিয়ে প্লেন নিয়ে উড়ে শাবওয়া যাবো তারপর আরেকটু ভেতরে মরুভূমিতে দেখবো। সম্ভবত কিছু একটা দেখা যেতে পারে।

ওমর সায় দিয়ে ওদের সাথে দরজা পর্যন্ত গেল। বাইরে রাস্তায় বেরুতেই ওরা দেখল গ্রামের কয়েকজন লোক মৃতদেহগুলো একটা ঠেলা জাতীয় কিছুতে করে নিয়ে গেল।

 তাদের আলখাল্লা রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে আর মৃতদেহগুলোর উপর মাছি ভন ভন করছে। রুস্থ কানিংহাম থর থর করে কাঁপতে লাগল। ওমর বলল, তুমি জোর বাঁচা বেঁচে গেছ ক্যাপ্টেন কেইন, সে জন্য আমি আনন্দিত।’

কেইন অবাক বিস্ময়ে দ্রুত তার দিকে ফিরে তাকাল। তুমি জানতে যে ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল?

ওমর ঘাড় কাত করল। অবশ্যই জানতাম।’ সে শান্ত কণ্ঠে বলল।

 ‘আর জানা সত্ত্বেও তুমি তাদের বাধা দিলে না?

ওমরের চেহারায় দুঃখি ভাব দেখা দিল। আরেকজন মানুষের রক্তের দ্বন্দ্বে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না।’

 কেইন হাসতে শুরু করল। ওমর এ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল আর কেইন হাসতে হাসতে রুথ কানিংহামের হাত ধরে সেখান থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

‘কী ব্যাপার বলবেন? সে জিজ্ঞেস করল। আপনাদের আরবিতে কথা বলা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

‘এ আপনি বুঝবেন না, সে তাকে জানাল। এটা এক ধরনের প্রাইভেট রসিকতা।

 এয়ারস্ট্রিপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রুথ বলল, কফিটা খুবই চমৎকার ছিল। ঐ মহিলাটি কে ছিল–তার স্ত্রী?

কেইন মাথা নাড়লো। সে বাড়ির একজন ক্রীতদাসী।

‘আপনি রসিকতা করছেন, সে বললো।

কেইন মৃদু হাসল। আপনি জামালের কপালে গরম লোহার ছাপ দেখেন নি? সে ইয়েমনে একজন ক্রীতদাস ছিল। প্রথমবার পালাবার চেষ্টা করার সময় ওরা তার জিহ্বা কেটে নেয়। এখনও আরবের অনেক জায়গায় প্রচুর ক্রীতদাস রয়েছে।

রুথ কানিংহাম থর থর করে কাঁপতে লাগল। এরপর তারা নিরবে পথ চলতে লাগল। প্লেনের কাছে পৌঁছে ওরা দেখতে পেল সকালের লড়াইয়ের চিহ্ন হিসেবে রানওয়ের কয়েক জায়গায় বালু আর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে। কেইন তাকে ঠেলে কেবিনের ভেতরে ঢুকিয়ে বেশ কসরত করে নিজে ঢুকলো। এরপর আর কোন সময় নষ্ট করল না। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেনটা খাড়া হয়ে নীল আকাশের দিকে উঠতে শুরু করল।

দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যে ওরা শাবওয়া পৌঁছে গেল। রুথ। কানিংহাম নিচের দিকে তাকাল, তার চেহারায় হতাশা। আমি তো এর মধ্যে রোমাঞ্চকর তেমন কিছুই দেখছি না।’

 কেইন মাথা কাত করল, ‘আমি স্বীকার করছি দেখতে তেমন বিস্ময়কর নয়। তবে এখানে বালুর নিচে ষাটটা মন্দির আছে, যার সম্পর্কে রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি লিখেছেন, ভবিষ্যৎ অভিযাত্রিদের জন্য এক বিশাল গুপ্তধনের ভান্ডার।

 সে কম্পাস চেক করে র‍্যাপিডের নাক মরুভূমির দিকে ঘুরিয়ে নিল। ‘আমি মারিবের উদ্দেশ্যে গতিপথ ঠিক করে নিলাম। আলেক্সিয়াসের বর্ণনা অনুযায়ী শাবওয়া থেকে সোজা লাইন বরাবর এ জায়গার কোথাও একটা মন্দির থাকবার কথা। তিনি বলেছেন নব্বই মাইল হবে। আশা করি কিছু একটার দেখা পাওয়া যাবে।

সে বালিয়াড়ির উপরে প্লেনটাকে পাঁচ ছয়শো ফুট উচ্চতায় নামিয়ে আনল এই আশায় যে, কোন মানুষ এখান দিয়ে যাওয়ার কোন চিহ্ন হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। যতদূর চোখ যায় দেখা যাচ্ছে নিষ্ফলা, আদিম এবং অচিন্তনীয় নির্জন মরুভূমি চলে গেছে।

মিনিট পনেরো পর, রুথ কানিংহাম হঠাৎ তাকে একটা খোঁচা মারল। ওদের সামনেই সাত আটশো ফুট উঁচু এক বিশাল বালিয়াড়ি সোজা আকাশে উঠে গেছে। কেইন তাড়াতাড়ি কলামটা সামান্য পেছনের দিকে টানল। ইঞ্জিনটা কয়েকবার ফট ফট শব্দ করল আর দুবার মিস করল।

সে কলামটা ধরে খুব জোরে পেছনের দিকে টান দিতেই প্লেনটা বালিয়াড়ির মাত্র কয়েক ফুট উপর দিয়ে উপরের দিকে উঠল। তারপর ইঞ্জিনটা কয়েকবার খক খক শব্দ করল। তারপর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ সম্পূর্ণ নিরবতা আর মাঝে মাঝে প্লেনের পাখার সাথে বাতাসের সংঘর্ষের শন শন শব্দ। তারপর প্লেনটা নিচের দিকে নামাতে শুরু করতেই রুথ কানিংহাম চেঁচিয়ে উঠল।

কেইন নিয়ন্ত্রণ নেবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল। মরুভূমির পঞ্চাশ কি ষাট ফুট উচ্চতায় এসে সে প্লেনটাকে লেভেলে আনল আর তখনি আরেকটা বিশাল বালিয়ারি ওদের দিকে ছুটে আসতে দেখা গেল। শক্ত করে ধরে থাকুন!’ এই কথা বলে সে সর্বশক্তি দিয়ে কলামটা টেনে ধরল।

 র‍্যাপিডটা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠল। একটা মুহূর্ত মনে হলো এটা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তারপর বামদিকের ডানার ডগা বালুতে গেঁথে গেল। প্লেনটা বৃত্তাকারে ঘুরে গেল আর শোনা গেল ধাতু ছিঁড়ে যাবার চড় চড় শব্দ। কেইন সতর্ক করে চিৎকার দিয়ে উঠল আর নরম বালুতে প্লেনটা থেমে যাবার ধাক্কা সামলাতে নিজেকে প্রস্তুত করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *