০১. বার্লিনে বৃষ্টিঝরা মার্চের শেষ বিকেল

শেবা / মূল : জ্যাক হিগিনস / ভাষান্তর : কাজী আখতারউদ্দিন

অনুবাদকের উৎসর্গ

আমার সহধর্মিণী হাবিবা খান-কে

বাতাসের ঝাপটায় মুখ ঢেকে রাখা কাপড়টা সরে যেতেই খোলা মুখের চামড়ায় জ্বলন্ত সুর্যের তেজ কেটে বসেছে। তারপর আবার সে মুখ থুবড়ে বালুতে পড়ে গেল, আবার জামাল তাকে টেনে তুলল।

এবার সে জামালের চওড়া কাঁধে এলিয়ে পড়ল। সে ভ্রু কুঁচকে মাথা ঝাঁকাল, চেষ্টা করল পরিষ্কারভাবে সবকিছু ভাবতে, কিন্তু কোন কাজ হলো না। এখন আর কোন কিছুই ভাল নেই। সে অন্ধকার একটা তাপের শূন্যতার মাঝে সেঁধিয়ে একটু একটু করে তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলল।

তার মুখে বালু ঢুকেছে। সে আর হাতের আঙুল দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগল। কিন্তু এবার কোন শক্ত হাত থাকে ধরে টেনে তুলল না। এবার সে সম্পূর্ণ একা।

.

খ্রিষ্টপূর্ব ২০ অব্দে রোমান সেনাপতি এলিয়াস গ্যালাস, দক্ষিণ আরব জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। তবে সেই অভিযানে ‘রাভ আল খালি’ নামে এক ভয়ংকর শূন্য এলাকায় তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সেনাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যালেক্সিয়াস নামে এক দুঃসাহসী গ্রিক দলপতি। ১০ম লিজিয়নের একশো সেনার এই দলপতি সেই মরুভূমি থেকে হেঁটে ফিরে আসেন, বয়ে নিয়ে আসেন প্রাচীন জগতের এক লুক্কায়িত বিষয়। বাদশাহ সোলায়মানের গুপ্তধনের মতো এটিও একটি অত্যাশ্চর্য নিদর্শন, যা দুহাজার বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর…

.

বার্লিন, মার্চ ১৯৩৯

০১.

বার্লিনে বৃষ্টিঝরা মার্চের শেষ বিকেল। একটি কালো মার্সেডিস লিমোজিন উইলহেমস্ট্রাস দিয়ে নতুন রাইখ চ্যান্সেলারির দিকে যাচ্ছে। ওই ভবনটি জানুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়েছে। এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করার জন্য হিটলার এক বছর সময় দিয়েছিলেন। তবে সময়সীমা শেষ হওয়ার দুসপ্তাহ আগেই তার নির্দেশ পালিত হয়। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী–এবহোয়ের চিফ, এডমিরাল উইলহেম ক্যানারিস একটু ঝুঁকে গাড়ির জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলেন, যাতে তিনি ভবনটি ভালভাবে দেখতে পারেন।

তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘অবিশ্বাস্য ব্যাপার, বুঝতে পেরেছো হান্স, ভস-স্ট্রাসের দিকে শুধু সামনের দিকটাই সিকি মাইল লম্বা।

পাশে বসা তার সহকারী হান্স রিটার একজন লুফটওয়াফ ক্যাপ্টেন। আয়রন ক্রস সেকেন্ড ও ফার্স্ট ক্লাস প্রাপ্ত সুদর্শন যুবকটি মুখ ফেরাতেই তার ডান গালে একটি বিভৎস ক্ষত চিহ্ন চোখে পড়ল; আর তার পায়ের কাছে দেখা গেল একটি পায়ে ভর দেবার লাঠি পড়ে রয়েছে। স্পেনিশ সিভিল ওয়ারে যখন সে জার্মান কনডর লিজিয়নে উড়ছিল তখন একজন আমেরিকান ভলান্টিয়ার পাইলট গুলি করার ফলে তার এই দুর্দশা হয়েছে।

সে বলল, “ঐ পিলারগুলো আর মার্বেল ইত্যাদিসহ এটাকে প্রাচীন যুগের একটি অত্যাশ্চর্য নিদর্শন মনে হচ্ছে, হের এডমিরাল।

 ‘তার মানে নতুন যুগের একটি নিদর্শনের বদলে?’ ক্যানারিস কাঁধে একটা কঁকি দিয়ে জানালার কাঁচটা উঠিয়ে দিলেন। সবকিছু এক সময়ে চলে যায় হান্স, এমনকি থার্ড রাইখও। যদিও আমাদের প্রিয় ফুয়েরার আমাদেরকে এক হাজার বছরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি কেস থেকে একটা সিগারেট বের করতেই রিটার তার লাইটার দিয়ে সেটা ধরিয়ে দিল। প্রবীন লোকটির কথার সুরে প্রচ্ছন্ন উপহাসের আভাস পেয়ে সব সময়ের মতো সে একটু শঙ্কিত হল।

‘তা আপনি যা বলেন, হের এডমিরাল।

কী এক উদ্ভট ভাবনা তাই না? হয়তো একদিন, টুরিষ্টরা এই চ্যান্সেলারির ভগ্নাবশেষের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখবে, যেরকম তারা মিশরে লুক্সর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে বেড়ায়; আর মন্তব্য করবে, ‘ভাবছি কি ছিল জিনিসটা?

মার্সিডিসটা গিল্টি করা চকচকে গেট পেরিয়ে সোজা সামনের বিশাল প্রবেশ পথের সিঁড়ির দিকে এগোলো৷ রিটার একটু অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। ‘হের এডমিরাল যদি অনুগ্রহ করে আমাকে একটু আভাস দিতেন কেন আমাদের এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে?

 ‘এ সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তাছাড়া উনি কেবল আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, তোমার সাথে নয়, হান্স। আমি তোমাকে সাথে এনেছি যদি অস্বাভাবিক কোন কিছু ঘটে যায়, সে কারণে।

‘আমি কি গাড়িতে অপেক্ষা করব?’ গাড়িটা সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাতেই রিটার জিজ্ঞেস করল।

‘না তুমি রিসিপশনে অপেক্ষা করতে পার। জায়গাটা বেশ আরামপ্রদ আর সেখানে তুমি থার্ড রাইখের নতুন শিল্প কর্মগুলো দেখতে পারবে, সময়টাও বেশ কেটে যাবে।

 তার ড্রাইভার, ক্রেগম্যারিন পেটি অফিসারটি ঘুরে এসে দরজা খুলে ধরল। ক্যানারিস গাড়ি থেকে বের হয়ে রিটারের জন্য অপেক্ষা করলেন। তার যথেষ্ট বেগ পেতে হল গাড়ি থেকে নামতে। সার্জিক্যাল নকল বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবার পর সে হাতের লাঠির সাহায্যে বেশ স্বচ্ছন্দে এগিয়ে গেল। তারপর দুজনে একসাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।

এস এস গার্ডরা ছিল লেইবস্টান্ডার্ট এডলফ হিটলারের বাহিনীর অধীনে। এদের ইউনিফর্ম কালো আর বুকে সাদা চামড়ার বর্ম। ক্যানারিস আর রিটার ভেতরে ঢুকতেই এরা চৌকশ স্যালুউট করল। চমৎকার হলঘরটির মেঝেটা মোজাইকের, দরজাগুলো সতেরো ফুট উঁচু আর দরজার গায়ে নখে স্বস্তিকা আঁকড়ে ধরা ঈগলের বিশাল প্রতিকৃতি। সোনালি রঙের ডেস্কে ড্রেস-ইউনিফর্ম পরা একজন তরুণ হটস্টার্ন-ফুয়েরার বসে রয়েছে। দুজন আর্দালি তার পেছনে দাঁড়ানো রয়েছে। সে এক লাফে উঠে দাঁড়াল।

‘হের এডমিরাল! ফুয়েরার দুবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছেন।’

প্রিয় হফার, আধঘণ্টাও হয়নি, আমি তার সাথে দেখা করার আদেশ পেয়েছি। ইনি আমার সহকারি, ক্যাপ্টেন রিটার। দয়া করে আমার হয়ে এর দেখাশোনা করো।

 ‘অবশ্যই, হের এডমিরাল। তারপর হফার পাশে দাঁড়ানো একজন আর্দালিকে ইশারা করে বলল, ‘হের এডমিরালকে ফুয়েরারের রিসেপশন সোয়টে নিয়ে যাও।

আর্দালি দ্রুত পদক্ষেপে রওয়ানা দিল, ক্যানারিস তার পিছু পিছু চললেন। হফার ডেস্ক ঘুরে এসে রিটারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, স্পেন, তাই না?’

 ‘হ্যাঁ, রিটার নকল পায়ের উপর হাতের লাঠি দিয়ে মৃদু আঘাত করে বলল, “আমি এখনও উড়তে পারি, কিন্তু ওরা আমাকে অনুমতি দেবে না।

 ‘কি দুঃখজনক,’ হফার তাকে বসার আসনগুলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। আপনি বিশাল আয়োজনটা মিস করবেন।’

 রিটার সোফায় আরাম করে বসে সিগারেট কেসটা বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি মনে করেন, এটা আসলেই হবে?

‘কেন, আপনার মনে হয় না? আচ্ছা আরেকটা কথা, এখানে ধুমপান সম্পূর্ণ নিষেধ, ফুয়েরারের সুস্পষ্ট নির্দেশ।’

‘ধুত্তুরি, রিটার বলে উঠল। অনবরত পায়ে ব্যাথার কারণে সিগারেট খেলে সে কিছুটা আরাম পায়।

হফার সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, “দুঃখিত। তবে আমাদের এখানে সবচেয়ে ভাল কফি আছে।

তারপর সে ঘুরে ডেস্কের কাছে গিয়ে টেলিফোন তুলল।

.

গার্ড হিটলারের স্টাডিরুমের বিশাল দরজা খুলে ধরতেই ক্যানারিস ভেতরে এত মানুষ দেখে অবাক হলেন। সেখানে উপস্থিত তিন বাহিনী প্রধান–লুফটওয়াফের গোয়েরিং, সেনাবাহিনীর খিষ্ট এবং ক্রেগম্যারিনের রায়েডার। আরো রয়েছে হিমলার, ভন রিবেট্রপ, জেনারেল জড, কেইটেল আর হালডার। পুরো কামরায় নিরবতা। ক্যানারিস ঢুকতেই সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখল।

‘এই যে এডমিরাল অনুগ্রহ করে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন, তাহলে আমরা এবার শুরু করতে পারি, হিটলার বললেন। আমি খুব সংক্ষেপে বলবো। আপনারা নিশ্চয়ই জেনেছেন ব্রিটিশরা আজ ঘোষণা করেছে, যুদ্ধ বাধলে তারা পোলিশদের নিঃশর্তভাবে সমর্থন করবে।

গোয়েরিং বললেন, কিন্তু ফুয়েরার, ফরাসিরাও কি তাই করবে?

হিটলার তাকে বললেন, “নিঃসন্দেহে করবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার। সময় তারা কিছুই করবে না।

এবার ও কে ডব্লিউর চিফ অফ স্টাফ হালডার জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন পোলান্ডে অভিযান চালানো হবে। আর রাশিয়ানরা কী করবে?

 ‘তারা এখানে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধরে নিন তাদের সাথে একধরনের বুঝাঁপড়া চলছে আর এই বিষয়টি এ পর্যন্তই থাক। অতএব ভদ্রমহোদয়গণ, এ বিষয়ে আমার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত এটিই। আপনারা কেইস হোয়াইটের প্রস্তুতি নিন–পয়লা সেপ্টেম্বর পোলান্ডে অভিযান চালানো হবে। ‘যেন প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে সবার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হলো। কর্ণেল জেনারেল ব্ৰখিস্ট প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, কিন্তু ফুয়েরার, আমাদের হাতে তো মাত্র ছয়মাস সময় আছে।’

হিটলার বললেন, যথেষ্ট সময়। যদি কারো এ বিষয়ে দ্বিমত থাকে তাহলে এখনই বলুন। চারপাশে পিন পতন নিরবতা নেমে এল।

‘ঠিক আছে, তাহলে কাজে লেগে পড়া যাক, ভদ্রমহোদয়গণ। আপনারা সবাই এবার যেতে পারেন, কেবল হের এডমিরাল আপনি যাবেন না।

সবাই সারিবদ্ধ হয়ে চলে গেল। ক্যানারিস সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন আর হিটলার জানালা দিয়ে বাইরে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলেন। তারপর তিনি ঘুরে তাকালেন। ব্রিটিশ আর ফরাসিরা যুদ্ধ ঘোষণা করবে ঠিকই কিন্তু কিছুই করবে না। আপনার কি মনে হয়?

‘একদম সঠিক, ক্যানারিস বললেন।

‘আমরা পোলান্ড আক্রমণ করে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেব। একবার এটা করা হলে ব্রিটিশ আর ফরাসিদের আর এগোবার কোন অর্থ আছে? এরপর তারা শান্তির জন্য আবেদন করবে।’

“আর যদি তা না করে?

হিটলার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন। তাহলে আমি কেইস ইয়েলো কাজে লাগাবো। আমরা বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ফ্রান্সে অভিযান চালিয়ে ব্রিটিশদেরকে সাগর পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাবো। তখন তাদের বোধোদয় হবে। তবে তারা আমাদের স্বাভাবিক শত্রু নয়।’

‘আমি একমত, ক্যানারিস বললেন।

‘এ কথাটা বলার পর আমার মনে হলো, যত শীঘ্র সম্ভব আমার ইংরেজ বন্ধুদের দেখিয়ে দেওয়া দরকার যে, আমি যা বলি তা করি।

ক্যানারিস একটা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন, আপনার মনে ঠিক কি চিন্তা আছে, ফুয়েরার?

দূরের দেয়ালে টাঙানো বিশাল বিশ্ব মানচিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, “এদিকে আসুন হের এডমিরাল! আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।’

.

এক ঘণ্টা পর ক্যানারিস চ্যান্সেলারির রিসেপশন হলে ফিরে দেখলেন হকার তার ডেস্কে বসে রয়েছে, পেছনে দুজন আর্দালিসহ। রিটারের কোন দেখা নেই। এস এস ক্যাপ্টেন তাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে বলল,

‘হের এডমিরাল!

 ‘আমার সহকারি?’ ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন।

‘হপটম্যান রিটারের প্রচণ্ড ধুমপানের প্রয়োজন হওয়ায় তিনি আপনার গাড়িতে ফিরে গেছেন।

‘ধন্যবাদ, ক্যানারিস বললেন। আমি নিজেই যেতে পারব।’

 তিনি বিশাল দরজার বাইরে গিয়ে সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গ্রেটকোটের বোতাম লাগাতে লাগলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ড্রাইভার আসার আগেই লিমোজিনের পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রিটারের পাশে বসলেন।

 ‘সোজা আমার অফিস, ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে মাঝখানের কাঁচের পার্টিশনটা বন্ধ করে দিলেন।

গাড়ি চলতে শুরু করতেই রিটার হাতের সিগারেট নিভিয়ে দিতে উদ্যত হল। কোন দরকার নেই। আমাকেও একটা দাও।

রিটার সিগারেট কেস খুলে একটা সিগারেট দিল এবং লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিল। সব কিছু ঠিক আছে তো হের এডমিরাল? আমি দেখলাম ওরা সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে, আমার চিন্তা হচ্ছিল।

‘হান্স, ফুয়েরার ব্যক্তিগতভাবে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন পয়লা সেপ্টেম্বর পোলান্ডে অভিযান চালাবার।

‘হায় ঈশ্বর!’ রিটার বলল। কেইস হোয়াইট।’

‘ঠিক তাই, তিনি রাশিয়ানদের সাথে এক ধরনের বোঝাঁপড়া করে যাচ্ছেন। তারা একটা চুক্তিতে আসবে। তারা আমাদেরকে এ কাজ করতে দেবে পূর্ব পোলান্ডের একটা অংশের বিনিময়ে।

আর ব্রিটিশরা?

 ‘হু, ব্রিটিশরা যুদ্ধ ঘোষণা করবে আর আমি নিশ্চিত সেই সাথে ফরাসিরাও তাই করবে। তবে ফুয়েরার কোন এক কারণে বিশ্বাস করেন তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে কোন কিছু করবে না এবং এ ব্যাপারে আমিও একমত। আমরা যখন পোলান্ড পুরোপুরি দখলে নেব ওরা চুপ করে বসে থাকবে। তার ধারণা একবার কাজটা শেষ হয়ে যাবার পর, আমরা সবাই আলোচনার টেবিলে বসবো এবং একটা স্থিতাবস্থায় চলে আসবো। তিনি আমাদের জানিয়েছেন ব্রিটেন আমাদের স্বভাবজাত শত্রু নয়।

‘আপনি এ বিষয়ে একমত, হের এডমিরাল?’

‘এ বিষয়ে তিনি অনেকটা সঠিক হান্স, তবে ব্রিটিশরা বড় একরোখা জাতি আর চ্যামবারলেন খুব একটা জনপ্রিয় নন। মিউনিখের ঘটনার পর থেকে তার নিজের দেশের লোকেরাই তাকে পছন্দ করে না।

তিনি সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে নিভিয়ে দিলেন। যদি উপরের দিকে কোন পরিবর্তন হয়, ধরো চার্চিল…’ তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন। কে জানে কি হয়?

 ‘আর আমরা কি করব?

‘আমরা কেইস ইয়েলো কার্যকর করবো। ভাটির দেশগুলো আর ফ্রান্সে অভিযান চালিয়ে, ব্রিটিশরা যেসব সেনাদল চ্যানেল পার করে এনেছিল তাদেরকে সাগরের দিকে ঠেলে দেব।’

একটুখানি থেমে রিটার বলল, এটা কি করা সম্ভব হবে?’

‘আমার মনে হয় এটা সম্ভব হান্স, যতক্ষণ না আমেরিকানরা এদিকে হস্তক্ষেপ করে। ফুয়েরারের প্রেরণাদায়ক নেতৃত্বে আমরা রাইনল্যান্ড পুনর্দখল করতে পেরেছি, অস্ট্রিয়া আর চেকোস্লোভাকিয়া আয়ত্ব করেছি, এছাড়া টুকটাক আরো কিছু পেয়েছি। আমার কোন সন্দেহ নেই পোন্ড আমরা জয় করব।’

“কিন্তু তারপর কি হবে, হের এডমিরাল? ফরাসি আর ব্রিটিশরা?

‘হ্যাঁ, এবার মূল বিষয়ে আসা যাক, কেন সবাই চলে যাবার পর ফুয়েরার আমাকে আটকে রেখেছিলেন।

‘কোন বিশেষ প্রজেক্ট, হের এডমিরাল?

‘সেরকমই কিছু একটা, তুমি বলতে পারো। তিনি চাচ্ছেন পয়লা সেপ্টেম্বর আমরা সুয়েজ খাল উড়িয়ে দেই, ঠিক যেদিন পোলান্ড আক্রমণ করা হবে।’

রিটার সিগারেট কেসটা খুলতে খুলতে বলে উঠল, ‘হায় ঈশ্বর!

 ক্যানারিস তার হাত থেকে কেসটা নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন।

‘তিনি কর্ণেল রোমেলের কাছ থেকে এই আইডিয়াটা পেয়েছেন। সুদেনল্যান্ড দখল করাকালীন রোমেল আমাদের ফুয়েরারের এসকর্ট ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন। উপযুক্ত কারণেই তিনি রোমেল সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। আর বলা যায় এই আইডিয়াতে এক ধরনের পাগলামো যুক্তি আছে। তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি সুয়েজ খাল হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সরাসরি যোগাযোগের পথ। এই সংযোগ পথটি কেটে দিলেই ভারতবর্ষ, দূর প্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়াগামি সব জাহাজকে আফ্রিকা এবং উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ঘুরে যেতে হবে। এর ফলে সামরিক প্রতিক্রিয়া কী হবে বুঝতেই পারছো।

কিন্তু হের এডমিরাল, কি উপায়ে আমরা সেই এলাকায় লোকজন আর যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবো?

ক্যানারিস মাথা নেড়ে বললেন, না, হান্স, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে ভুল করেছে। আমরা সেখানে সরাসরি সামরিক অভিযানের কথা বলছি না, আমরা বলছি স্যাবোটাজের কথা। ফুয়েরার চাচ্ছেন পোলান্ডে অভিযানের দিনে আমরা সুয়েজ খালটা উড়িয়ে দেই, পুরো পথটা অকার্যকর করে ফেলি। এমনভাবে পুরোপুরি বন্ধ করে দেই যেন আবার এটা চালু করতে এক বছরের বেশি সময় লাগে।

 ‘বাপরে! কি বিশাল আঘাত, পুরো পৃথিবী চমকে যাবে। রিটার বলল।

‘সঠিক করে বলতে গেলে ব্রিটিশদের অন্তরাত্মা কেঁপে যাবে আর তখন ওরা বুঝতে পারবে আমরা কি করতে পারি। অর্থাৎ এভাবেই আমাদের ফুয়েরার বিষয়টি বিশ্বাস করেন। ক্যানারিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

‘অবশ্য, কীভাবে কাজটা আমরা করবো সেটা আরেক ব্যাপার। তবে আমাদেরকে কিছু একটা প্ল্যান দেখাতে হবে, অন্তত কাগজে কলমে। আর সেখানেই তোমার ভুমিকা, হান্স।

‘আচ্ছা, এবার বুঝতে পেরেছি হের এডমিরাল।

৭৪/৬ তিরপিজ উফারে এবহোয়ের অফিসের সামনে এসে লিমোজিনটা থামল। পেটি অফিসারটি দ্রুত ঘুরে এসে গাড়ির দরজা খুলে ধরতেই ক্যানারিস আর রিটার গাড়ি থেকে নামলেন। যুবক রিটার প্রু কুঁচকে কিছু ভাবছে মনে হলো।

ক্যানারিস বললেন, তুমি ঠিক আছে তো?”

‘আমি ঠিক আছি হের এডমিরাল। আমার মনের মধ্যে কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে, যা আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক হতে পারে।

‘সত্যি?’ ক্যনারিস একটু মৃদু হেসে সামনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজার কাছে একটু থামলেন–এটা একটা সুখবর বটে, তবে শুভস্য শীঘ্রম, মনে রেখো হান্স। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, যখন ক্যানারিস তার ডেস্কে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে কাজ করছিলেন আর তার প্রিয় ডাকসান্ড কুকুরদুটো কামরার এককোণে একটা বাক্সে ঘুমিয়ে ছিল, তখন দরজায় ঠক ঠক শব্দ হলো। আর সাথে সাথে রিটার এক হাতে একটা ফাইল, বগলে রোল করা একটা ম্যাপ নিয়ে ঢুকল। সে তার লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এগুলো।

‘এই সুয়েজ খাল প্রকল্প নিয়ে আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে, হের এডমিরাল?

ক্যানারিস চেয়ারে পিঠ দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, ‘এত শীঘ্রই হান্স?’

‘আমিতো আগেই আপনাকে বলেছি, আমার মনে একটা বিষয় খচ খচ করছিল, অফিসে ফেরার পরই বিষয়টি মনে পড়ল। গত মাসেই আমি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের একজন অধ্যাপক অটো মুলারের কাছ থেকে একটা রিপোর্ট পাই। কিছুদিন আগে তিনি দক্ষিণ আরব থেকে ফিরে এসেছেন। শীঘ্রই আবার সেখানে যেতে চাচ্ছেন। তবে তার আরো কিছু তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজন পড়েছে।

ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন, এর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক?

আপনিতো জানেন হের এডমিরাল, যেসব জার্মান নাগরিক বিদেশে কাজ করেন, তারা কোন ধরনের অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে এখানে এবহোয়ের সদর দপ্তরে রিপোর্ট করতে বাধ্য।

‘তো?”

‘আমাকে বলতে দিন, হের এডমিরাল, রিটার অন্যপাশের দেয়ালে টাঙানো ম্যাপ-বোর্ডের পাশে গিয়ে তার বগলের নিচ থেকে ম্যাপটা নিয়ে ঐ বোর্ডে পিন দিয়ে জায়গামতো টাঙালো। ম্যাপটিতে মিশর ও সুয়েজ খাল, পুরো দক্ষিণ আরব, লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগর দেখা যাচ্ছে।

‘আপনি এখানে দেখতে পাচ্ছেন হের এডমিরাল, ব্রিটিশ উপস্থিতি–ইয়েমন, এডেন উপসাগর জুড়ে বিভিন্ন আরব রাজ্য, ভারত মহাসাগর, দোফার এবং ওমান।

‘তারপর?’ ম্যাপটি নিরীক্ষণ করতে করতে ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন।

‘আপনি নিশ্চয়ই উপসাগরের উপকূলে দাহরান বন্দরটি লক্ষ্য করেছেন। এখান থেকেই মুলার তার কাজ পরিচালনা করেন। এ জায়গাটি স্পেনের অধীনে। অনেকটা ভারতীয় উপকুল বন্দর গোয়র মতো। সেখানে স্পেনিয়রা কয়েকশো বছর ধরে রয়েছে।

‘আমি বুঝতে পারছি এ জায়গাটা অনেকটা সেরকম, ক্যানারিস বললেন।

উত্তরে সউদী আরবের সীমানা জুড়ে রয়েছে রাব আল খালি, শূন্য এলাকা, পৃথিবীর বুকে ভয়ংকর মরুভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আর এখানেই মুলার কাজ করেন?

 ‘হ্যাঁ, হের এডমিরাল।

 ‘কিন্তু সেখানে তিনি কী কাজ করেন?

‘এ জায়গায় প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। মুলার একজন ভাষাবিদ, বিশেষত প্রাচীন ভাষায়। তিনি ল্যাটেক্স দ্রবণ ব্যবহার করে শিলালিপির ছাপ তুলে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন।

‘এর সাথে সুয়েজ খালের কি সম্পর্ক, হান্স?

‘একটু ধৈর্য্য ধরে আমার কথা শুনুন, হের এডমিরাল। সাবাহ্ নামে সেই এলাকাটির নাম বহুদিন ধরে শেবার রানির সাথে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে।

‘হায় ঈশ্বর!’ বলে কানারিস তার ডেস্কে গিয়ে বসলেন।

‘এতো দেখছি বাইবেল। তিনি একটা রুপার সিগারেট বাক্স থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। আমি তো সবসময় জেনে এসেছি বাইবেলে উল্লেখ ছাড়া আর কোন প্রমাণ নেই যে এর অস্তিত্ব আছে।’

‘হ্যাঁ, তিনি অবশ্যই ছিলেন। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি।’ রিটার বলল। ভেনাসের সমার্থক অ্যাসথার নামে এক আরব দেবীর উপাসক। সম্প্রদায় ছিল। শেবার রানি ছিলেন সেই সম্প্রদায়ের সব্বোর্চ পুরোহিত। আর তিনি সেই রাব আল-খালি এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

‘সেতো কাহিনীতে, ক্যানারিস বললেন।

‘হের এডমিরাল, মুলার এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেছেন, যা সম্ভবত এর ধ্বংসাবশেষ। স্বভাবতই তিনি তার এই আবিষ্কার গোপন রেখেছেন। এ ধরনের একটি ঘটনা ভ্যালি অফ দি কিংস-এ তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সারা দুনিয়া থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ছুটে আসবে সেখানে। আমি আপনাকে বলেছি, তিনি তহবিল সংগ্রহের জন্য বার্লিন ফিরে এসেছেন, তবে তিনি কী জিনিস আবিষ্কার করেছেন তার পূর্ণ বিবরণ এবহোয়েরের কাছে জমা দিয়েছেন।

ক্যানারিস ভ্রু কুঁচকে বললেন, তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে?

‘এ জায়গাটা অচেনা, হের এডমিরাল, মরুভূমির মাঝে লুকোনো রয়েছে। রসদ সরবরাহের জন্য একটা এরোপ্লেন ব্যবহার করে এই জায়গাটিকে সুয়েজ খাল আক্রমণের একটা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ক্যানারিস উঠে ম্যাপটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি সেটা পরীক্ষা করে ঘুরে বললেন, ‘ঐ জায়গা থেকে সুয়েজ খালের দূরত্ব কমপক্ষে এক হাজার মাইল হবে।’

‘খুব বেশি হলে বারোশো মাইল, হের এডমিরাল। কিন্তু আমি নিশ্চিত, উপায় একটা খুঁজে বের করা যাবে।’

ক্যানারিস মৃদু হাসলেন, তুমি সাধারণত তাই পারো, হান্স। ঠিক আছে মুলারকে নিয়ে এসে আমার সাথে দেখা করাও।

‘কখন, হের এডমিরাল?”

‘কেন, অবশ্যই আজ রাতে। আমি আজ রাতে অফিসেই ঘুমাবো।

তারপর তিনি তার টেবিলের দস্তাবেজের দিকে ফিরলেন। রিটার বের হয়ে গেল।

অধ্যাপক অটো মুলার একজন ছোটখাটো, টাক মাথার মানুষ। সারাক্ষণ রোদে থেকে থেকে তার মুখের চামড়া তামাটে হয়ে গেছে। যখন রিটার তাকে ক্যানারিসের সাথে সাক্ষাৎ করাবার জন্য কামরায় ঢুকালো, তখন নার্ভাস হয়ে সে মৃদু হাসতেই তার সোনা বাঁধানো দাঁত দেখা গেল।

ক্যানারিস বললেন, ঠিক আছে, হান্স। রিটার কামরার বাইরে চলে গেল। ক্যানারিস একটা সিগারেট ধরালেন, বেশ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, কি বলেন, প্রফেসর। আমাকে এ সম্পর্কে সব কিছু বলুন।

 মুলার একজন স্কুলছাত্রের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার সৌভাগ্য হের এডমিরাল। আমি বেশ কিছুকাল যাবত শাবওয়া এলাকায় কাজ করছিলাম। এক রাতে এক বুড়ো বেদুঈন পিপাসায় আর জ্বরে মৃতপ্রায় হয়ে আমার ক্যাম্পে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমি তার সেবা শুশ্রূষা করে জীবন বাঁচালাম।

“আচ্ছা!

 ‘এরা অদ্ভুত মানুষ। কোনভাবেই ঋণগ্রস্ত থাকতে রাজি নয়, কাজেই সে আমাকে শেবার মন্দিরের হদিশ বাতলে দিয়ে তার ঋণ শোধ করল।

‘ভাল প্রতিদান বটে। তারপর বলুন এর সম্পর্কে।

 ‘আমি প্রথমে এটাকে সেই বিশাল বিরান ভূমির মাঝে মাটির উপরে বেরিয়ে আসা লালচে পাথরের একটা শিলাস্তরের অংশ হিসেবে দেখলাম। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন হের এডমিরাল! সেখানে অনেক বালিয়াড়ি আছে যেগুলোর উচ্চতা অনেক সময় কয়েক শো ফুট হয়ে থাকে।

‘আশ্চর্য!

‘আরো সামনে এগিয়ে আমরা একটা গিরিখাতের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সাথে বেদুঈন প্রহরী ছিল। আমরা উটে চড়ে সেখানে গিয়েছিলাম। প্রথমে দেখলাম শক্ত মাটির একটা সমতল ভূমি, তারপর একটা গিরিখাত, দুপাশে পিলারসহ একটা চওড়া রাস্তা।

‘আর মন্দির! সে সম্পর্কে বলুন।

মুলার প্রায় আধ-ঘণ্টা ধরে বর্ণনা দিল আর ক্যানারিস মনোযোগ সহকারে সব শুনলেন। শেষে এডমিরাল মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ক্যাপ্টেন রিটার আমাকে বলেছে আপনি আমাদের এবহোয়েরকে একটা চমৎকার রিপোর্ট দিয়েছেন।’

 ‘আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, হের এডমিরাল। আমি পার্টির একজন সদস্য।

‘অবশ্যই, ক্যানারিস শুষ্ক মন্তব্য করলেন।

‘তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আপনার প্রয়োজন মাফিক তহবিল সংগ্রহ করে সে জায়গায় ফিরে গিয়ে আপনাকে যা করতে বলা হবে তা করবেন। এটি এমন একটি প্রজেক্ট যাতে ফুয়েরার নিজে বিশেষভাবে জড়িত আছেন।’

 মুলার উঠে দাঁড়াল, ‘আমি আপনার আদেশের অপেক্ষায় আছি, হের এডমিরাল।

 ‘ঠিক আছে, ক্যানারিস তার ডেস্কে একটা বোম টিপলেন। আমরা আপনাকে যথাসময়ে সব জানাবো।

রিটার প্রবেশ করল–’হের এডমিরাল।

‘আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন প্রফেসার। মুলার বাইরে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন, তারপর বললেন, “তাকে মোটামুটি নিরীহ মনে হচ্ছে, তারপরও আমার সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে, হান্স। তুমি যদি এই জায়গাকে, তোমার বেস হিসেবে ব্যবহার করো, সেক্ষেত্রে তোমাকে সুয়েজ খাল পৌঁছতে বারোশো মাইল উড়ে যেতে হবে। আর একটা মাত্র বোমারু বিমান দিয়ে কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে? এছাড়া এতদুর উড়ে যাওয়ার মতো কোন উড়োজাহাজ কি আমাদের আছে?

 ‘সে ব্যাপারে আমি ইতোমধ্যে ভেবে রেখেছি, রিটার বলল। তবে আপনাকে জানাবার আগে আমি আরেকবার পরীক্ষা করে দেখবো।

 কানারিস একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন, এটা কি খুব সিরিয়াস কোন ব্যাপার, হান্স?

 ‘আমি তাই বিশ্বাস করি, হের এডমিরাল।

 ‘তা হলেই ভাল, ক্যানারিস মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আমার নিশ্চয়ই তোমাকে বলার দরকার নেই, মুলারকে চেপে ধরে এই দাহরান জায়গাটি সম্পর্কে সব কিছু জেনে নেবে–কীভাবে স্পেনিশরা এটা পরিচালনা করছে ইত্যাদি। অবশ্য ওরা আমাদের পক্ষেই আছে। এই বিষয়টি কাজে আসতে পারে।’

‘আমি এটা দেখবো, স্যার।’

যত শীঘ্র পারো, হান্স। একটা প্রকল্প নাও। তিন দিন সময় দিলাম।

 রিটার ঘুরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে গেল আর ক্যানারিস তার কাগজপত্র নিয়ে পড়লেন।

.

০২.

আবার অফিসে তার ছোট্ট সামরিক বেডে ঘুমিয়ে রাত কাটাবার পর বুধবার সকালে যখন ক্যানারিস বাথরুমে দাড়ি কামাচ্ছিলেন, তখন ঠক ঠক শব্দ হল।

‘ভেতরে আসুন, তিনি ডেকে বললেন।

‘আমি, হের এডমিরাল, রিটার উত্তর দিল। আর আপনার প্রাতরাশ।’

ক্যানারিস মুখ মুছে কফির সুঘ্রাণেভরা টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলেন একজন আর্দালি তার ডেস্কে একটা ট্রেতে প্রাতরাশ সাজিয়ে রাখছে আর রিটার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

 আর্দালিকে ‘ডিসমিস’ বলে বিদায় করে ক্যানারিস কফির কাপ তুলে নিয়ে রিটারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, আমার সাথে যোগ দাও, হান্স।

‘আমি ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছি, হের এডমিরাল।

তার মানে তুমি অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। বেশ দায়িত্ব সচেতন বটে।

 ‘ঠিক তা নয়, হের এডমিরাল। আসলে আমার ঘুমাতে কষ্ট হয়।’

ক্যানারিস সাথে সাথে সমবেদনা জানিয়ে বললেন, ‘মাই ডিয়ার হান্স। আমি সত্যিই নির্বোধ। আসলে অনেক সময় আমি ভুলে যাই তুমি কত কষ্ট করে জীবন কাটাও

‘যুদ্ধের অভিশাপ, হের এডমিরাল। সে টেবিলে একটা ফাইল রাখল।

এডমিরাল টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে মুখ তুলে বললেন, কী এটা?”

‘অপারেশন শেবা, হের এডমিরাল।

‘তার মানে তুমি একটা সমাধান খুঁজে বের করেছো?

‘আমার তাই বিশ্বাস।’

 ‘তোমার কি মনে হয় এটা বাস্তবায়ন করা যাবে?’

‘শুধু করা নয় হের এডমিরাল। আমি মনে করি এটা অবশ্যই করা উচিত।’

‘সত্যি। ক্যানারিস অন্য কাপটাতে কফি ঢাললেন। তাহলে আমি বলবো। তুমি বরং একটা সিগারেট ধরাও আর এই কাপটা শেষ করো। ততক্ষণে আমি দেখি তুমি কি এনেছে।

 রিটার তার কথা মতো আদেশ পালন করে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। তিন এপ্রিল। আর কিছুদিন পর ঈস্টার অথচ নভেম্বরের একটি খারাপ দিনের মতো বৃষ্টি হচ্ছে। তার পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছিল, প্রয়োজন হলে যদি তাকে মরফিন পিল খেতে হয় তাহলে মুশকিল হবে। সে কফিটা শেষ করে সিগারেট ধরাল। পেছনে শুনতে পেল ক্যানারিস টেলিফোন তুলে কথা বলছেন।

 ‘রাইখ চ্যান্সেলারি, ফুয়েরার সোয়ীট, এডমিলার বললেন। এক মুহূর্ত পর বললেন, ‘সুপ্রভাত, ক্যানারিস বলছি। আমাকে অবশ্যই ফুয়েরারের সাথে দেখা করতে হবে। হ্যাঁ, অত্যন্ত জরুরি। আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর তিনি বললেন, ‘চমৎকার। এগারোটা।

 রিটার ফিরে বলল, ‘হের এডমিরাল?

‘তোমার এই প্ল্যানটা চমৎকার, হান্স। তুমি নিজে বরং আমার সাথে চল এবং আসল মানুষকে বিষয়টা বল।

.

রিটার কখনও প্রধান অভ্যর্থনা কেন্দ্রের ওপাশে পা রাখেনি, কাজেই ভেতরে গিয়ে যা দেখল তাতে বিস্ময়বিমুঢ় হয়ে গেল। কেবল বিশাল দরজা আর ব্রোঞ্জের ঈগলগুলোই নয়, সেই সাথে চারশো আশি ফুট লম্বা মার্বেল গ্যালারি। এটা ফুয়েরারের গর্বের একটা বস্তু কেননা এটা ভার্সেইলেসের হল মিররের দ্বিগুণ।

ওদেরকে যখন হিটলারের বিশাল স্টাডিতে উপস্থিত করা হল, তখন তারা দেখল হিটলার তার ডেস্কে বসে রয়েছেন। তিনি মুখ তুলে বললেন, “আশা করি জরুরি কোন বিষয়।

 ‘আমার তাই মনে হয়, সম্মানীয় ফুয়েরার, ক্যানারিস বলল। “ইনি আমার সহকারী, ক্যাপ্টেন রিটার।

হিটলার তার পুড়ে যাওয়া মুখ, হাতের লাঠি, বুকের মেডেল দেখে উঠে দাঁড়িয়ে রিটারের হাত ধরলেন। একজন সৈনিক হিসেবে আমি তোমাকে স্যালুট করছি।’

তিনি ফিরে গিয়ে তার চেয়ারে বসতেই রিটার অভিভূত হয়ে বলল, “আমি আর কি বলবো, মহামান্য ফুয়েরার।

ক্যানারিস মাঝখান থেকে বললেন, ‘সুয়েজ খালের বিষয়টা। ক্যাপ্টেন রিটার একটা অসামান্য পরিকল্পনা করেছে। পরিকল্পনাটা অসাধারণ।’ তিনি হিটলারের ডেস্কের উপর ফাইলটা রাখলেন। অপারেশন শেবা।’

হিটলার হেলান দিয়ে বসে দুহাত বুকে ভাঁজ করে বললেন, এটা আমি পরে পড়বো। তুমি বিষয়টি খুলে বলো, ক্যাপ্টেন রিটার।

রিটার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “মহামান্য ফুয়েরার। এই বিষয়টি শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের একজন অধ্যাপক মুলারের থেকে, যিনি দক্ষিণ আরবে এক অভূতপূর্ব মন্দির আবিষ্কার করেন, সেখান থেকে।

.

‘চমৎকার, হিটলার বললেন। তার চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছিল, কেননা প্রত্নতত্ত্বের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। যে কোন মূল্যে আমি ওই মন্দিরটি দেখতে রাজি। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। তাহলে তুমি কাজ শুরু করে দাও ক্যাপ্টেন। ঐ জায়গায় ঘাঁটি করে ফেলো। কিন্তু কীভাবে তুমি কাজটা করবে?

 ‘এই পরিকল্পনার মূল বিষয়টি হচ্ছে এর সহজ প্রক্রিয়াটি। একটি মাত্র বোমারু বিমান দিয়ে সুয়েজ খাল আক্রমণের চেষ্টা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কোনভাবেই কেউ সঠিক লক্ষ্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না।

হিটলার বললেন, তাহলে?

‘ক্যাটালিনা নামে দুই ইঞ্জিনের একটি উভচর আমেরিকান উড়োজাহাজ আছে। এটি চাকা ফেলে মাটিতে যেমন ল্যান্ড করতে পারে, তেমনি পানিতেও পারে। এর ক্রইজিং সীমা অসাধারণ। দেড় হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা নিয়ে এটি ১৬০০ মাইলের বেশি একনাগাড়ে অতিক্রম করতে পারে।

হিটলার বললেন, ‘চমৎকার, এই উড়োজাহাজটি কীভাবে কাজে লাগাবে?’

 ‘আমি যেরকমটি বলেছি, ব্যাপারটি অত্যন্ত সহজ, মহামান্য ফুয়েরার। এই উড়োজাহাজটি মরুভূমিতে আমাদের ঘাঁটিতে ল্যান্ড করে বোমা না নিয়ে মাইন নেবে। তারপর উড়ে যাবে মিশরে আর ল্যান্ড করবে সুয়েজ খালে। সেখানে উড়োজাহাজের ক্রুরা মাইনগুলো অফলোড করবে। সেগুলো সহজেই স্রোতে ভাসতে থাকবে। আমার প্রস্তাব, কান্ট্রার কাছেই একটা ভাল স্পট হবে। ক্রুরা অবশ্যই ক্যাটালিনাটি ডুবিয়ে দেবে। আর উড়োজাহাজের ভেতরটা আমাদের অত্যাধুনিক বিস্ফোরক-হেলিকন দিয়ে ভর্তি করবে। এটাও খালের প্রচুর ক্ষতিসাধন করতে পারবে। এরপর নিশ্চয়ই বিশদ ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই, লেক টিমসাহ্ থেকে উত্তরমুখী চলাচলকারী

জাহাজগুলোর খালের পানির নিচে ভেসে থাকা মাইনগুলোর সাথে সংঘর্ষ হবে। আমরা ধরে নিতে পারি কয়েকটা জাহাজ ডুবে গিয়ে পুরো খালের গতিপথ বন্ধ হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ সবাই নির্বাক বসে রইল আর হিটলার উপরের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলেন। এরপর তিনি এক হাতের তালুতে জোরে একটা ঘুষি মেরে বললেন। চমৎকার! তুমি যেমন বলেছো, খুবই সরল পরিকল্পনা। তারপর একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন, কিন্তু এই ক্যাটালিনা প্লেন। এটা কি যোগাড় করতে পারবে?

‘মহামান্য, ফুয়েরার। লিসবনে এই এরোপ্লেন একটা বিক্রি হবে। আমি মনে করি এটি আমরা কিনে নিয়ে দাহরানে আমাদের নিজস্ব একটা এয়ারলাইন শুরু করতে পারি। অবশ্য কোম্পানিটা স্বভাবতই স্পেনিশ মালিকানাধীন। আমি নিশ্চিত উপকুলে আমরা ভাল ব্যবসা পাবো।’

 হিটলার উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্ক ঘুরে এসে তার কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন। “ঠিক বলেছো। আমি এই ছেলেকে পছন্দ করি, হের এডমিরাল। অবিলম্বে এর পরিকল্পনা কাজে লাগান। আপনাকে আমি পুর্ণ ক্ষমতা দিলাম।

 ‘মহামান্য ফুয়েরার। ক্যানারিস দরজার দিকে এগোলেন, তারপর পেছন ফিরে একটা নাৎসী স্যালুট দিতে চেষ্টা করলেন। চল যাই. ফিসফিস করে রিটারকে বললেন, তারপর দরজা খুলে ফিরে চললেন।

মার্বেল গ্যালারি দিয়ে যেতে যেতে ক্যানারিস বললেন, তুমি সহজভাবে নিজের কথা বলেছো। ক্যাটালিনা কেনার জন্য আমি অবশ্যই প্রয়োজনীয় অর্থের অনুমোদন দিচ্ছি, কিন্তু উপযুক্ত ক্রু পেতে সমস্যা হতে পারে। অবশ্য একটা স্পেনিশ এয়ারলাইনের এরোপ্লেন চালাতে কোন জার্মানের আপত্তি থাকার কথা নয়।’

“তবে খুব ভাল হয় যদি স্পেনিয় ক্রু পাওয়া যায়।

‘কোথায় পাবে এদের?’

 ‘এস, এস, সৈনিকদের মধ্যে অনেক স্পেনিয় ভলান্টিয়ার আছে।’

ক্যানারিস বললেন, তা অবশ্যই আছে, এটা একদম সঠিক হবে।’

‘আমি ইতিমধ্যেই একজন উপযুক্ত বৈমানিক খুঁজে বের করেছি। স্পেনিশ সিভিল ওয়ারে এর প্রচুর লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে। এখন এই লোকটি এস.এস এর অধীনে কুরিয়ার পাইলট হিসেবে কাজ করছে। আমি আজই গ্যাটো বিমান ঘাঁটিতে এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’

‘ভাল। আমিও তোমার সাথে গিয়ে লোকটাকে দেখতে চাই, ক্যানারিস বললেন।

সাতাশ বছর বয়সি সুদর্শন যুবক–গোমরামুখো কার্লোস রোমেরো, মাদ্রিদের একজন ধনী মদ-ব্যবসায়ীর পুত্র। ষোল বছর বয়সে সে প্লেন-চালনা শিখে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই স্পেনিশ বিমান বাহিনীতে একজন ফাইটার পাইলট হিসেবে যোগদান করে। সিভিল ওয়ারের সময় সে জেনারেল ফ্রাংকোর পক্ষে যোগদান করে, তবে এই কারণে নয় যে সে একজন উৎসর্গকৃত ফ্যাসিস্ট। আসলে তাদের শ্রেণীর মানুষেরা তখন তাই করেছিল। সে এগারোটা প্লেন গুলি করে ভূপাতিত করেছিল। এরপর জার্মান কনডর লিজিয়নে প্লেন চালিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করে সেটা বন্ধ হয়ে গেল, যা সে চায় নি। এমন সময় সে কানাঘুষা শুনতে পেল এস, এস, স্পেনিয় ভলান্টিয়ার খুঁজছে। পাইলট হিসেবে তার রেকর্ড দেখে ওরা কোন ধরনের দ্বিধা না করে তাকে নিযুক্ত করল। মূলত কুরিয়ার দায়িত্বে, এদের কাজ ছিল উচ্চ পদস্থ অফিসারদের বিভিন্ন স্থানে আনা নেওয়া করা।

এ মুহূর্তে সে বার্লিনের আকাশে এক হাজার ফুট উচ্চতায় একটা ছোট স্টর্ক স্পটার এরোপ্লেনের নিয়ন্ত্রণে বসে ছিল। গ্যাটো টাওয়ারে কল দিয়ে ল্যান্ড করার অনুমতি পেয়ে বিমান ঘাঁটির দিকে নামতে শুরু করল। এই একঘেয়েমি কাজে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।

স্পেনিশ ভাষায় সে ফিসফিস করে বলে উঠল, “হায় ঈশ্বর! এর চেয়ে ভাল কিছু নিশ্চয়ই আমার জন্য আছে।

.

তা অবশ্যই ছিল এবং তা সে জানতে পারল একটু পরেই। মেসে গিয়ে ফ্লাইং জ্যাকেট খুলতেই তার নিচে কালো রঙের এস এস ইউনিফর্ম বেড়িয়ে পড়ল। ইউনিফর্মের বাম কাঁধে একটা ছোট স্পেনিশ শিল্ড, স্পেনিশ অর্ডার অফ মেরিট ফর গ্যালাষ্ট্রি আর কনডরে তার বীরত্বসূচক কাজের জন্য আয়রন ক্রস ফার্স্ট ক্লাস লাগানো রয়েছে।

প্রথমে তার নজরে পড়ল ক্যানারিসকে তার উচ্চ পদমর্যাদার কারণে, যদিও তাকে সে চিনতে পারল না। তবে রিটারকে চিনতে পেরে খুশি হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।

 ‘হান্স রিটার, কী ব্যাপার!

রিটার তার হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে তার সাথে হাত মেলালো। তোমাকে বেশ ভালই দেখাচ্ছে। স্পেনের ঘটনা অনেক আগে গত হয়েছে মনে হচ্ছে।’

‘আমি তোমার পায়ের কথা শুনেছি। দুঃখিত বন্ধু।

 রিটার বলল, এডমিরাল ক্যানারিস। এবহোয়ের চীফ।

রোমেরো গোড়ালি ঠুকে স্যালুট করল। আমি সম্মানিত বোধ করছি, হের এডমিরাল।

 ‘আমাদের সাথে এসো, হের হল্সটার্মফুয়েরার। ক্যানারিস মেস স্টুয়ার্ডকে ডেকে বললেন। বলিংগার শ্যাম্পেন আর তিনটে গ্লাস। তারপর তিনি রোমেরোর দিকে ফিরে বললেন। আমি জানি তুমি একজন কুরিয়ার পাইলট। কাজটা কি তোমার পছন্দ?

 ‘সত্যি বলতে কি হের এডমিরাল, এই সাধারণ কাজটা আমার জন্য একঘেয়ে হয়ে উঠেছে।

 ‘সেক্ষেত্রে আমরা দেখবো তোমার জন্য এর চেয়ে ভাল কাজ পাওয়া যায় কি না। ওকে খুলে বলল হান্স।

.

রোমেরো ফাইলটা পড়া শেষ করে বন্ধ করল। তার চেহারা বিবর্ণ আর উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। ক্যানারিস বললেন, “তোমার কি এতে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা আছে?

‘ইচ্ছা মানে?’ রোমেরো রিটারের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিল, ওর হাত কাঁপছিল। এতে অংশগ্রহণের জন্য আমি নতজানু হয়ে অনুমতি ভিক্ষা করতে রাজি।

ক্যানারিস হেসে ফেললেন, না, তা করার দরকার নেই।’

 রিটার বলল, ‘ক্যাটালিনা চালাতে তোমার কোন সমস্যা হবে না তো?”

রোমেরো চেয়ারে বসে বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করল। একজন দ্বিতীয় বৈমানিক আর ইঞ্জিনিয়ার হলে আমি এটা সামলাতে পারব।’

‘কোথায় পাবো আমরা এদের?’ ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন।

“ঠিক এখানে এস এস এর স্পেনিশ লিজিয়নে এদের পাওয়া যাবে। আমার মতোই হের এডমিরাল। এই মুহূর্তে আমি দুজন উপযুক্ত পদপ্রার্থীর কথা ভাবছি। জেভিয়ার নোভাল একজন ভাল পাইলট আর জুয়ান কোন্ডে একজন প্রতিভাবান বিমান প্রকৌশলী।

রিটার নাম দুটো নোট করে নিল। চমৎকার। আমি তোমার সাথে। ওদেরকেও এবহোয়ের ডিউটিতে বদলি করে দেব।

‘বিস্ফোরক আর মাইনের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা?’ রোমেরো জিজ্ঞেস করল।

‘আমরা আমাদের সুবিধামতো কোন কার্গো জাহাজে করে ওগুলো ডেলিভারি দেবার ব্যবস্থা করব।’ রিটার ওদের জানাল। দাহরানের মতো জায়গায় আমার মনে হয় কোন সমস্যা হবে না। সেপ্টেম্বর থেকেই যাতায়াত করে তোমরা তোমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তুলবে। উপসাগরীয় এলাকায় ব্যবসা, পণ্য পরিবহন এই ধরনের ব্যবসা।

রোমেরো ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে। সময় হলে আমরা মাইনগুলো সাগরে নিয়ে যেতে পারব। আমি সহজেই কোন জাহাজের পাশে ল্যান্ড করতে পারব। সেখান থেকে সরাসরি ঘাঁটিতে উড়ে গেলে পুরো ব্যপারটা আরো সহজ হবে।

‘চমৎকার, ক্যানারিস উঠে দাঁড়ালেন। আমার মনে হয় তোমার উচিত হবে আমাদের বন্ধু প্রফেসার মুলারের সাথে সাক্ষাত করা। তুমি বরং আমাদের সাথে শহরে চল। পথে আমাকে নামিয়ে দিয়ে তোমরা সোজা বিশ্ববিদ্যালয় চলে যাও। এখন থেকে সব বিষয়ে ক্যাপ্টেন রিটারের সাথে তুমি পরামর্শ করবে।

‘আপনি যা আদেশ করেন, হের এডমিরাল।

“ঠিক আছে,’ বললেন ক্যানারিস। তারপর ঘুরে ওদেরকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলেন।

.

বিশ্ববিদ্যালয়ে মুলারের বিভাগটি সব ধরনের নৃতাত্ত্বিক আগ্রহের বস্তু দিয়ে পরিপূর্ণ একটি বিশাল হলে অবস্থিত। মিশরীয় মমি, রোম ও গ্রীস থেকে আনা স্ট্যাচু, ভূমধ্যসাগরের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত এমফোরা–সব কিছু রয়েছে সেখানে। রিটার আর রোমেরো ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখতে লাগল আর ততক্ষণ মুলার তার কাঁচ ঘেরা অফিস ডেস্কে বসে অপারেশন শেবা ফাইলটা পড়ল। পড়া শেষ হওয়ার পর সে ওদের সাথে যোগদান করল।

রিটার ঘুরে জিজ্ঞেস করল, তো আপনার কি মনে হয়?

মুলার অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। সে মুখে হাসি ফুটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘এটি একটি চমৎকার আইডিয়া, হের হপ্টম্যান। তবে আমি ভাবছিলাম এ কাজের জন্য আমি উপযুক্ত কি না, অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আমি তো একজন প্রশিক্ষিত স্পাই নই। আমি কেবল একজন প্রত্নতত্তবিদ।

 ‘এ কাজটা করতেই হবে প্রফেসার, ফুয়েরারের সরাসরি নির্দেশ অনুযায়ী। এতে কি আপনার কোনো সমস্যা আছে?

‘হায় ঈশ্বর! না নেই।’ মুলারের মুখমন্ডল ছাইবর্ণ ধারণ করল।

রোমেরো তার কাঁধে একটা চাপড় দিয়ে বলল, কোন চিন্তা করবেন না প্রফেসর। আমি আপনার খেয়াল করব।’

রিটার বলল, তাহলে সব ঠিক আছে। যখন হস্পটার্মফুয়েরার রোমেরো ক্যাটালিনা নিয়ে লিসবন রওয়ানা দেবেন, আপনি তার সাথে গিয়ে সব কিছুর প্রস্তুতি নেবেন। আমি সব সময় যোগাযোগ রাখবো।’

রিটার তার লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলল। হলের মাঝ দিয়ে যখন ওরা প্রবেশ পথের দিকে যাচ্ছিল তখর রোমেরো বলল, বেচারা খুব বেশি নার্ভাস হয়ে গেছে রিটার।’

 ‘সে ঠিকই পথে চলে আসবে আর সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

মূল প্রবেশ পথের বাইরে এসে সিঁড়ির প্রথম ধাপের উপর ওরা দাঁড়াল। ‘আমি আজই তোমার, নোভাল আর কোন্ডের বদলির ব্যবস্থা করব। তোমরা কালই সাদা পোশাকে লিসবন রওয়ানা দাও। আমি লুফথানসা ফ্লাইটে তোমাদের জন্য প্রায়োরিটি সিটের ব্যবস্থা করে রাখবো। ক্যাটালিনা কেনার ব্যাপারে সেখানকার জার্মান দূতাবাসে আমাদের লোক তোমার ব্যাংকার হিসেবে কাজ করবে। প্লেনটা পরীক্ষা করার পর তুমি দূতাবাসের নিরাপদ টেলিফোনে আমাকে জানাবে। আশা করি বৃহস্পতিবারের মধ্যে তুমি কিছু একটা জানাতে পারবে।

‘হায় ঈশ্বর! তুমি কোন কিছুতেই দেরি করতে চাওনা, তাই না হান্স?

‘এটা না করার কোন কারণ তো আমি দেখি না এ কথা বলে রিটার সিঁড়ি বেয়ে অপেক্ষামান মার্সেডিসের দিকে এগিয়ে চলল।

.

কেউ কেউ বলে চওড়া উপসাগর আর অনেকগুলো নোঙ্গর-স্থান নিয়ে টাগুস নদীই লিসবনের অস্তিত্বের সত্যিকার কারণ। এখান থেকেই বিশাল আকৃতির ফ্লাইং বোট-বিশাল ক্লিপারগুলো আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এখানেই তীর থেকে প্রায় তিনশো গজ সাগরে দুটো বয়ার সাথে বাঁধা ক্যাটালিনাটিকে দেখতে পেল কার্লোস রোমেরো। উড়োজাহাজটির মালিকের প্রতিনিধি দ্যা গামা নামে লোকটির সাথে সাক্ষাতের জন্য জেভিয়ার নোভাল আর জুয়ান কোন্ডেকে নিয়ে দশমিনিট আগেই সে আভেনিদা দ্য ইন্ডিয়ার কাছে ডকে পৌঁছেছিল। ডকের কিনারায় দাঁড়িয়ে ওরা উভচর উড়োজাহাজটির দিকে তাকাল।

 ‘এটা দেখতো ভালই মনে হচ্ছে,’ বলল রোমেরোর প্রায় সমবয়সী শক্ত সমর্থ গড়নের নোভাল। তার পরনে একটা পুরনো ফ্লাইং জ্যাকেট।

 পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী মোটাসোটা কোন্ডে ওদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড়। সেও একটা ফ্লাইং জ্যাকেট পরেছিল। সে চোখের উপর হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে ক্যাটালিনার দিকে তাকিয়ে ছিল।

‘তোমার কি মনে হয় জুয়ান? সামলাতে পারবে এটাকে?

‘দেখি একবার চেষ্টা করে।

একটা মোটর বোট ডকে এসে নাক ঠেকালো। বাদামি স্যুট আর পানামা হ্যাট পরা একজন লোক বোট থেকে হাত নাড়তে লাগল। লোকটি স্পেনিশে বলল, ‘সিনর রোমেরো? আমি ফার্ডিনান্ড দা গামা, বোটে উঠে আসুন।

তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে মোটরবোটে চড়তেই লোকটি বোটম্যানকে ইশারা করতেই সে বোট ছেড়ে দিল।

দা গামা বলল, দেখতে ভাল মনে হচ্ছে না?

‘অবশ্যই এটি দেখতে চমৎকার, রোমেরো বলল। এখন এর বিষয়ে বলুন।

 ‘স্থানীয় একটা শিপিং কোম্পানি ম্যাদেইরা দ্বীপে প্রতিদিন ফ্লাইট চালাতে চেয়েছিল। গত বছর ওরা যুক্তরাষ্ট থেকে একটা ক্যাটালিনা কেনে। চমৎকার সার্ভিস দিয়েছিল ওটা, কিন্তু ওদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী পরিবহন। তবে যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা এত সীমিত ছিল যে তাতে কোন লাভের উপায় ছিল না। আচ্ছা কী উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করতে চান জানতে পারি কী?

 রোমেরো প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি কথাটা বলল–লোহিত সাগর আর এডেন উপসাগরে সাধারণ পণ্য আনা নেওয়া করা। এমনকি গোয়া পর্যন্ত যেতে পারি। এটা একটা নতুন ব্যবসা।

 দ্যা গামা বলল, এই এলাকা আমি চিনি। এ কাজের জন্য ক্যাটালিনা খুবই উপযোগী হবে।

ওদের মটরবোটটি ভাসমান একটা ডকের সাথে ঠেকতেই বোটম্যান ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। নোভাল আর কোন্ডে একটা রশি ধরে তার সাথে বাধল। দা গামা কেবিনের দরজা খুলে পথ দেখিয়ে চলল। রোমেরো ককপিটের চারপাশে প্রীত হয়ে তাকাল এবং ককপিটের একটা আসনে বসে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে হাত বাড়াল। নোভাল অন্য আসনটিতে বসে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করল।

কী সুন্দর।

দা গামা একটা ফাইল মেলে ধরল। তার কাঁধের ঠিক পেছনে কোন্ডে দাঁড়াল। ফাইল খুলে সে বলল, আমি আপনাদের এর আয়তন বলছি। দৈর্ঘ্য তেষট্টি ফিট, উচ্চতা বিশ, উইংস্প্যান একশো চার। দুটো প্র্যাট এত হুইটনি ইঞ্জিন, প্রত্যেকটা বারোশো অশ্বশক্তি সম্পন্ন। কুইজিং গতি ঘণ্টায় একশো আশি মাইল। বেশ চমৎকার রেঞ্জ। একবার জ্বালানী নিয়ে পণ্য বোঝাই ছাড়া এটি চারহাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। আমি আর কোন উড়োজাহাজের কথা জানি না–যা এরকম করতে পারে।

 ‘আমিও তাই মনে করি, রোমেরো বলে উঠলো। আপনি এখন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।’

 মটরবোটটিতে গাদাগাদি করে সবাই বসতেই দা গামা সেই পুরনো গাধা বুলি আওড়ালো’–অবশ্য আরো কিছু লোক প্লেনটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।’

 মোটরবোটটি চলতে শুরু করতেই রোমেরো বলল, “ঐসব বিক্রেতা মার্কা বুলি ছেড়ে আপনি বরং একটা চুক্তিপত্র তৈরি করুন। আমি আপনাকে আমার উকিলের নাম দিচ্ছি। আমরা কালকেই চুক্তিপত্র সই করব আর আপনি যে দাম চেয়েছেন সে অংকেরই একটা চেক পাবেন। খুশি তো?’

দা গামাকে একটু অবাক দেখাল। অবশ্যই সিনোর।

রোমেরো একটা সিগারেট বের করল, নোভাল লাইটার দিয়ে সেটা জ্বেলে দিলে সে ক্যাটালিনাটার দিকে চেয়ে লম্বা একটা ধুয়া ছাড়লো।

‘মনে হচ্ছে আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেছে,’ সে বলল।

.

ব্যারন অসওয়াল্ড ভন হেইনিনজেন-হিউন ছিলেন লিসবনের জার্মান মিশনের মিনিষ্টার। তিনি একজন অভিজাত পরিবারের সন্তান, পুরোনো আমলের পেশাদার কূটনীতিক এবং নাৎসি নন। আর অধিকাংশ কর্মচারীর মতো বার্লিন থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকতে পেরে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।

প্রথমদিকে এই অচেনা স্পেনিয় এসএস হল্সটার্মফুয়েরারটিকে দেখে একটু সতর্ক হলেও তিনি বার্লিনের নির্দেশ পালনে বাধ্য হলেন। একটু অবাক হলেও রোমেরোর প্রতি আকৃষ্ট হলেন।

স্পেনিয় লোকটি তার অফিসে প্রবেশ করতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘মাই ডিয়ার রোমেরো! সব কিছু ঠিকঠাক মতো হয়েছে তো?

‘এর চেয়ে আর ভাল হতে পারে না। আপনি যে আইনজীবীর কথা বলেছেন দা গামা তার সাথে যোগাযোগ করবে। আপনি টাকার ব্যবস্থা করলেই আমরা আগামীকালের মধ্যে সবকিছু সেরে ফেলব। ও হ্যাঁ,আমার এখুনি এবহোয়ের হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন রিটারের সাথে কথা বলতে হবে।’

 ‘অবশ্যই।’ ব্যারন তার ডেস্কের লাল নিরাপদ ফোনটি টেনে নিয়ে একটা কল বুক করলেন। বেশি সময় লাগবে না।’ তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কনিয়াক চলবে?

‘চলবে না কেন?

রোমেরো একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা সোফায় বসল। ব্যারন তার হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে উল্টো দিকে বসলেন। সব কিছু খুব গোপনীয় বিষয় তাই না?

‘হ্যাঁ, খুবই গোপনীয়।

না আমি কোন নাক গলাতে যাচ্ছিনা। সত্যি বলতে কি, আমি বরং কিছুই জানতে চাই না।’ তিনি গ্লাস তুলে বললেন। তবে যাইহোক আমি আপনার সাফল্য কামনা করি।

সেই মুহূর্তে ফোনটি বেজে উঠল। রোমেরো বলল, ‘অনুগ্রহ করে আপনার অনুমতি পেলে?

‘অবশ্যই। আমি বরং বাইরে যাচ্ছি।’

ব্যারন অফিসের বাইরে যেতেই রোমেরো ফোন তুলল-কে হান্স বলছো?

‘আর কে?’ রিটার বলল। তোমার কতদূর এগুলো?’

‘চমৎকার, রোমেরো তাকে সব খুলে বলল। অপূর্ব একটা উড়োজাহাজ। এর চেয়ে বেশি খুশি আমি আর হতে পারি না। এডমিরালকে বলল আমরা আমাদের পথে বেড়িয়ে পড়েছি।

.

রিটার দরজায় টোকা মেরে ভেতরে ঢুকল। ক্যানারিস কোলে একটা কুকুরছানা নিয়ে চা পান করছিলেন। তিনি তাকিয়ে বললেন, কী খবর, হান্স?

 ‘রোমোরা এখুনি লিসবন থেকে আমার সাথে কথা বলেছে, হের এডমিরাল। ক্যাটালিনা সম্পূর্ণ ঠিক আছে আর কালকেই তারা সেটা কেনার কাজ সেরে ফেলবে।

‘চমৎকার, ক্যনারিস ঘাড় নেড়ে বললেন। “তুমি সবশেষ ঘটনাবলির সমস্ত বিবরণ দিয়ে আরেকটা প্রতিবেদন তৈরি কর। আমরা আগামীকালই ফুয়েরারের সাথে দেখা করার এপয়েন্টমেন্ট করে ফেলব।’

 ‘এক্ষুণি সব করছি, হের এডমিরাল।

তারপর রিটার খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে যেতে উদ্যত হতেই ক্যানারিস তাকে ডেকে বললেন, “ওহো, আরেকটা কথা, আমরা মুলারকে আমাদের সাথে নেবো।’

 কিন্তু তাদের প্রত্যাশার আগেই ওদের ডাক পড়ল। সে রাতেই দশটায় চ্যান্সেলারিতে তাদের সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট করা হলো। পথেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা মুলারকে তুলে নিল। ফুয়েরারের সাথে দেখা করার কথা শুনে মুলার হতভম্ব হয়ে পড়ল।

হিটলারের সোয়ট-এর অভ্যর্থনা কাউন্টারে পৌঁছতেই সেখানকার দায়িত্বরত সহকারী উঠে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। আশা করি আপনি ফুয়েরারের জন্য একটি প্রতিবেদন নিয়ে এসেছেন, হের এডমিরাল।’

হ্যাঁ তাই। ক্যনারিস বললেন।

সহকারী হাত বাড়িয়ে বলল, আপনাদের সাথে দেখা করার আগে তিনি এটা পড়তে চাচ্ছেন।

‘অবশ্যই।

ক্যানারিস তার হাতে ফাইলটা দিলেন; সেটা নিয়ে সে দরজা খুলে ভেতরে চলে গেল। ক্যানারিস বাকী দুজনের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে সবাইকে নিয়ে বসে পড়লেন।

 মুলার একটু কাঁপছে দেখে ক্যানারিস বললেন, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?

‘হায় ঈশ্বর, আমি কীরকম বোধ করব বলে আপনি আশা করেন, হের এডমিরাল! এটাতো ফুয়েরার, আমাকে কি বলতে হবে?

যতো কম বলা যায় ততই মঙ্গল, ক্যানারিস তাকে বললেন। তারপর একটু শ্ৰেষমাখা কণ্ঠে বললেন, মনে রাখবেন, তিনি একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব, অতএব ঠিকমতো আচরণ করবেন।

দরজা খুলে গেল, সহকারী বলল, “ভদ্রমহোদয়গণ, ফুয়েরার এখন আপনাদের সাথে সাক্ষাত করবেন।

.

পুরো কামরাটি ছায়া ছায়া অন্ধকারে রয়েছে আর হিটলার একটা বিশাল ডেস্কে বসে রয়েছেন। একটি মাত্র পিতলের ল্যাম্প আলো দিচ্ছে। তিনি ফাইলটি পড়ছিলেন, এবার সেটা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালেন।

‘অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, হের এডমিরাল! একটি প্রথম শ্রেণীর কাজ।’

 ‘এর সমস্ত কৃতিত্ব ক্যাপ্টেন রিটারের।

না হের এডমিরাল, আমার মনে হয় এসবের পর মেজর রিটার বললে আরো উপযুক্ত হবে। সত্যি বলতে কি, আমি আপনাকে আগাম সতর্ক করে দিচ্ছি তাকে আমি আপনার কাছ থেকে চুরি করে আমার নিজস্ব স্টাফ করতে পারি।

তিনি উঠে দাঁড়াতেই রিটার যা বলা স্বাভাবিক তাই বলল–আপনি আমাকে খুব বেশি সম্মান করেছেন, মাননীয় ফুয়েরার।

হিটলার ডেস্ক ঘুরে মুলারের কাছে এলেন। প্রফেসার মুলার, তাই না? একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার আর আপনি এটি রাইখের জন্য উৎসর্গ করছেন।’

 আর মুলার কাঁপতে কাঁপতে সঠিক কথাটিই বলল–’শুধু আপনার জন্য, মাননীয় ফুয়েরার, কেবল আপনার জন্যই।

হিটলার তার কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, একটি বড় দিন আসছে, জার্মানির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিন।

তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন আর ডেস্ক ল্যাম্পটি তার দেহের ছায়া ফেলল বিশাল পৃথিবীর মানচিত্রটির গায়ে। সেখানে তিনি হাত বেঁধে দাঁড়ালেন। আপনারা এবার যেতে পারেন।’

 ক্যানারিস বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইশারা করে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন।

.

মুলারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দেবার পর ক্যানারিস ড্রাইভারকে বললেন তাদেরকে টিরপিজ উফারে নিয়ে যেতে। পাশের রাস্তাটিতে ঢুকতেই এক কোনে একটা রেস্তোরাঁর সামনে এলেন। জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।

ক্যানারিস একটু ঝুঁকে বললেন, এখানেই থামো। তারপর রিটারের দিকে ফিরে বললেন, ‘একটু কফি আর শ্যাপস। আমরা তোমার পদোন্নতি উদযাপন করব মেজর।

‘আমি অবশ্যই আনন্দিত হের এডমিরাল।

ক্যাফেটা প্রায় খদ্দের শূন্য ছিল আর এর মালিক ওদের দেখে অভিভূত হয়ে পড়ল। সে তাদেরকে জানালার পাশে একটা বুথে নিয়ে বসিয়ে খুব দ্রুত অর্ডার নিল। ক্যানারিস তার সিগারেট কেস বের করে রিটারকে এগিয়ে দিলেন। রিটার একটা সিগারেট নিয়ে তার লাইটার দিয়ে জ্বেলে দিল।

এডমিরাল ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তিনি খুব খুশি হয়েছেন। অবশ্য মুলার একদম তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। লোকটা মোটেও শক্ত নয়।’

 ‘আমি একমত,’ রিটার বলল। তাকে ঠিকমতো চালাবার জন্য আমাদের একজন পেশাদার লোক দরকার।

ক্যাফের মালিক তাদের জন্য একটা ট্রেতে করে কফি আর পানীয় নিয়ে এল। ক্যানারিস তাকে হাত নেড়ে বিদায় করে দিলেন। তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে সেরকম কাউকে, একজন পুরোনো এবহোয়ের কর্মী, যার উপর আস্থা রাখা যায়।

‘কোন সমস্যা নেই, হের এডমিরাল।

‘তুমি তো বুঝতেই পারছো এই বিষয়টি এতো সরল যে এটা অবশ্যই কার্যকর করা যাবে।’ কথাটি বলে ক্যানারিস বোতল থেকে শ্যানপস দুটো গ্লাসে ঢাললেন।

‘আমি একমত, রিটার বলল।

ক্যানারিস মাথা নাড়লেন, তবে একটি সমস্যা আছে।

 ‘সেটা কি, হের এডমিরাল?

‘এটি আমাদের যুদ্ধে জয় এনে দেবে না, বন্ধু। কোন কিছুই তা করবে না। তুমি দ্যাখো হান্স, আমরা সবাই নরকে যাবে। তবে যাই হোক এটা তোমার পদোন্নতির জন্য।’

তিনি গ্লাসটি তুলে এক ঢোকে পুরোটা শেষ করে ফেললেন।

.

দাহরান, আগস্ট ১৯৩৯

০৩.

আফ্রিকা থেকে উপসাগরের উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস তখনো দিনের উষ্ণতা নিয়ে আসছে কেইনের দেহে। সে লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে কান পেতে কিছু শুনছিল।

চাঁদ না থাকলেও কোটি কোটি তারার আলোয় ভাস্বর আকাশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সে তাজা বাতাসের আস্বাদন নিল। তার চোখ অনুসরণ করছে একঝাক উড়ঙ্কু মাছকে যেগুলো সাগর থেকে বাঁকা হয়ে মৃদু আলোকিত পানির ঝর্নাধারা ছড়িয়ে বের হয়ে আসছে।

একটা দরজা খুলতেই সেলুন থেকে এক মুহূর্তের জন্য একঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ল। হিন্দু খালাসি পিরু ধূমায়িত এক মগ কফি নিয়ে কোম্পেনিয়ানওয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে এল।

কেইন একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাহ্ চমৎকার!’

‘সাহিব, আজ রাতে কানতারা আসতে বেশ দেরি করছে, পিরু বলল।

কেইন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘড়ি দেখল। প্রায় দু’টা বেজেছে। আমি ভাবছি ঐ বুড়ো শয়তান ও’হারা আজ কী খেলা খেলছে।’

‘আমার মনে হয় আবার হুইস্কিতে ডুবেছে।’

 কেইন হেসে বলল, “হতে পারে।

সে কফি শেষ করতেই পিরু তার বাহু ছুঁলো। আমার মনে হয়ে সে আসছে।’

কেইন কান খাড়া করল। প্রথমে শুধু লঞ্চের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর বাতাসের শিস শোনা গেল। তারপর সে পানির উপর হালকা একটা কম্পন অনুভব করল। দূরে দেখা গেল সবুজ এক বিন্দু আলো-কানোরার স্টারবোর্ড নেভিগেশন বাতি।

“ঠিক সময়ের আগে নয়, সে মুদু স্বরে বলল।

 কেইন হুইলহাউসে গিয়ে নেভিগেশন বাতি জ্বেলে স্টার্ট বোতাম টিপতেই ইঞ্জিন শব্দ করে চালু হলো। ধীরে থ্রটল খুলে অপেক্ষা করল যতক্ষণ না স্টিামারটা প্রায় তাদের উপরে এসে পড়ল, তারপর লঞ্চটা এগিয়ে নিয়ে দুটো জলযান সমান্তরাল করল।

পুরনো পণ্যবাহী জাহাজটা দুই কি তিন নট গতিতে চলছিল। কেইন লঞ্চটা কাছাকাছি আনতেই সংঘর্ষ এড়াতে পিরু দড়িদড়ার গুচ্ছটা বের করল। একজন লস্কর রেইলে হাজির হয়ে একটা দড়ির প্রান্ত ছুঁড়ে মারতেই পিরু সেটা ধরে বাধল। এক মুহূর্ত পর একটা দড়ির সিঁড়ি বের হতেই কেইন ইঞ্জিন বন্ধ করে ডেকে বের হয়ে এলো।

উঁচু মরচে ধরা কানতারার পেছনটা রাতের অন্ধকারে চোখে পড়ল। কালো লম্বা একটা ছায়ার মতো উপরে দেখা যাচ্ছে। দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কেইন আবার ভাবলো কি উপায়ে এই বাতিল লোহার টুকরাটা পানিতে ভাসছে।

সে রেইল আঁকড়ে ধরে টপকালো, তারপর হিন্দিতে বলল, ক্যাপ্টেন কিধার?’

লস্কর কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘কেবিনে।

সে দ্রুত কোম্পেনিয়ানওয়ে দিয়ে উপরের ডেকে পৌঁছে ক্যাপ্টেনের দরজায় টোকা দিল। কোন উত্তর নেই। এক মুহূর্ত পর সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। কেবিন অন্ধকার–তীব্র দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে হাতড়ে হাতড়ে আলোর সুইচটা অন করল।

ও’হারা বাংকে শুয়ে আছে।

পরনে হাতাকাটা গেঞ্জি আর প্যান্ট। হা করা মুখে হলুদ ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত দেখা যাচ্ছে। জাহাজের দুলুনির সাথে তাল মিলিয়ে একটা খালি হুইস্কির বোতল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেইন ঘেন্নায় নাক কুঁচকে বাইরে ডেকে চলে এল।

 আরেকজন লস্কর তার জন্য অপেক্ষা করছিল। লোকটি বলল, “মেট বলেছে আপনাকে উপরে ব্রিজে যেতে।

কেইন দ্রুত ডেক পার হয়ে একটা লোহার সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজে পৌঁছাল। পাগড়ি মাথায় মেট গুপ্ত হুইল ধরে আছে।

কেইন দরজায় ঠেস দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কতক্ষণ হল সে এরকম আছে?’

গুপ্ত দাঁত বের করে হাসল। সেই যখন আমরা এডেন ছেড়েছি তখন থেকেই। অন্তত দুদিন ঘুমালে এই অবস্থা কাটবে।

‘জাহাজ চালাবার কি সুন্দর উপায়!’ কেইন বলল, “আচ্ছা এবার তোমাদের কি হয়েছে বলতো? নিয়মমাফিক বোম্বে থেকে আসার পর দাহরানে যোগাযোগ করনি কেন?

গুপ্ত জানাল, আমাদের কাছে মোম্বাসার কার্গো ছিল, তারপর এডেন।

কেইন বলল, ‘স্কিরোজ খুব একটা খুশি হবে না। মাল ঠিকঠাক আছে আশা করি।’

গুপ্ত মাথা নেড়ে সায় দিল। ওরা এখনই মাল উপরে নিয়ে আসবে। ওহ! আরেকটা কথা এবারের ট্রিপে আমরা একজন যাত্রী নিয়ে এসেছি।’

‘যাত্রী?’ কেইন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।এই গামলাতে?’

‘একজন আমেরিকান ভদ্রমহিলা। গুপ্ত বলল। তার খুব তাড়া ছিল এডেন ছেড়ে যাবার আর আমাদেরটাই ছিল একমাত্র জাহাজ। ক্যাটালিনাও এক সপ্তাহের আগে আসবে না।’

কেইন সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে বলল। তাহলে আমি আর এখানে বেশিক্ষণ থাকব না। ভদ্রমহিলাকে জাগাবার দরকার নেই। অহেতুক কৌতূহল সৃষ্টি করবে।

গুপ্ত মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার মনে হয় সেটাই ভাল হবে। গতকাল ভোরের একটু আগে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে।

কী সেটা?

 ‘রোমেরোর ক্যাটালিনাটাকে দেখলাম প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে। একটা পর্তুগিজ পণ্যবাহি জাহাজের পাশে ল্যান্ড করল আর কিছু ক্রেট অফলোড় করল।’

‘সেটা আর আমরা এখানে যা করছি তার মাঝে কি পার্থক্য? তার মানে। রোমেরোও কিছু একটা স্মাগলিং করছে।’

কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল। আমরা সবাই কিছু টা করছি। আচ্ছা আসি, আবার আগামী মাসে দেখা হবে।

তারপর সে লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচে ডেকে নেমে গেল। রেইলে ঝুঁকে দেখল দুজন লস্কর একটা তেলের ড্রাম লঞ্চের ডেকে পিরুর কাছে নামাচ্ছে। পেছন থেকে হঠাৎ একটা মৃদু নারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আপনার কাছে কি লাইটার আছে?

সে দ্রুত ঘুরল। গোলাকার নিটোল মুখের একজন দীর্ঘাঙ্গী। মাথায় একটা স্কার্ফ জড়ানো আর পরনে ডাস্টার কোট। কেইন লাইটার জ্বেলে দুহাত দিয়ে আড়াল করে ধরল। বেড়াবার জন্য সময়টা একটু বেশি রাত হয়ে গেল না?’

ভদ্রমহিলা এক মুখ ধোয়া ছেড়ে রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আসলে আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। এই জাহাজে যাত্রী সেবার ব্যবস্থা খুবই সীমিত।

‘সেটা আমি বিশ্বাস করি।’

‘আরেকজন আমেরিকানের সাথে দেখা হওয়ার আজব জায়গা এটা, তাই না?

কেইন দাঁত বের করে হাসল। আজকাল আমরা যেখানে সেখানে ভেসে উঠছি।

 মহিলাটি রেইলের উপর ঝুঁকে তার লঞ্চের দিকে তাকিয়ে বলল। ওটা নিশ্চয়ই আপনার লঞ্চ?’

কেইন সায় দিয়ে বলল। আমি গভীর সমুদ্রের একজন মৎস্যশিকারী। দাহরান থেকে অপারেট করি। ঝড়ের কবলে পড়ে গিয়েছিলাম আর জ্বালানিও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস কানতারা এগিয়ে এল।

‘ও আচ্ছা।’ মহিলা বলল।

তার পারফিউমের সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর কোন এক কারণে কেইন বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না। এমন সময় লঞ্চ থেকে পিরুর হাঁক শোনা গেল। সে মৃদু হেসে বলল। এবার আমাকে যেতে হবে।’

সে তাড়াতাড়ি মই বেয়ে নিচে নেমে আসতেই পিরু দড়ির বাঁধনটা খুলে ফেলল। সাথে সাথে কানতারা সরে গেল। আর যখন সে উপরের দিকে তাকাল, ডেকের হলুদ আলোয় দেখা গেল মহিলাটি রেইলে হেলান দিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখছে। এক সময় রাতের অন্ধকারে ওরা মিলিয়ে গেল।

এই মুহূর্তের জন্য সে মন থেকে মহিলার কথা ঝেড়ে ফেলল। কেননা এখন অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। দুই গ্যালনের তেলের টিনটা পিরু ডেকের যেখানে রেখেছিল সেখানেই আছে। কেইন সেটা দ্রুত একবার পরীক্ষা করে নিচে সেলুনে গেল।

পিরু এয়ার ট্যাংক রেডি করে রেখেছিল। কেইন সব পোশাক খুলে ফেলল, পরনে কেবল একটা শর্ট। পিরুর সাহায্য নিয়ে এয়ার ট্যাংকটা পিঠে বেঁধে নিল। পিরু হইল হাউস থেকে একটা শক্তিশালী স্পট ল্যাম্প নিয়ে এল। লম্বা একটা তার লাগানো আছে এর সাথে। পানির নিচে ব্যবহারের জন্য ল্যাম্পটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। তারের আরেক মাথার প্লাগ বোটের লাইটিং সিস্টেমের সাথে লাগানো আছে। তেলের টিনটার দুই মাথায় একটা আংটা ঝালাই করা আছে। পিরু একটা মোটা শনের দড়ি আংটার মধ্য দিয়ে ঢোকালো। কেইন ডাইভিং মাস্ক পরে শ্বাস নেবার নলের মাউথ পিসটা দাঁতের মাঝে শক্ত করে কামড়ে ধরল। তারপর এক হাতে ল্যাম্প নিয়ে লঞ্চের এক পাশ দিয়ে সাগরের পানিতে ঝাঁপ দিল।

এক মুহূর্ত অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক করার পর সাঁতার কেটে নিচে নেমে লঞ্চের তলায় গিয়ে পৌঁছাল।

নিস্তব্ধ এক জগতে একাকী ভেসে বেড়াবার অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করল। চারপাশে সাগরের পানি ফসফরাসের মতো জ্বলে উঠছে আর ল্যাম্পের আলোয় আকৃষ্ট হয়ে আসা স্বচ্ছ মাছের দল উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

একটু পর তেলের টিনটা পানির মধ্য দিয়ে নিচে নেমে এল। কেইন এক হাতে রশিটা ধরে জাহাজের খোলের নিচে লাগানো দুটি আংটার মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দিল।

রশিটা আংটার মাঝে শক্ত করে বাঁধার সময় সে চারপাশের অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। সাগরের তলদেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে ভাস্বর মাছগুলোর কারণে, যেন অনেক মোমবাতি জ্বলছে। এক ঝাঁক ব্যারাকুড়া একটা রূপালি রেখার মতো বিদ্যুত গতিতে ছুটে গেল। তারপর আট ফুট দৈর্ঘ্যের একটা শার্ক ল্যাম্পের আলোর আভার মাঝে এসে থমকে দাঁড়িয়ে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল।

শাকটা সামনে এগোতেই সে মুখ থেকে শ্বাস নেবার নলটা খুলে ফেলল। সাথে সাথে রূপালি রঙের বুদবুদ মুখ থেকে বেরিয়ে এল। শাকটি তার লেজ দিয়ে পানিতে একটা ঝাপটা মেরে গতিপথ বদলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কেইন দ্রুত সাঁতার কেটে উপরে চলে এল, পিরু তাকে টেনে নিচু রেইলের উপর দিয়ে তুলল। সব ঠিক আছে তো সাহিব?’

কেইন মাথা নেড়ে ট্যাংকটার স্ট্র্যাপ খুলল। কোন সমস্যা নেই, শুধু একটা শার্ক ছাড়া। সে ব্যাটা একটু খেলা করতে চেয়েছিল।

পিরু অন্ধকারে সাদা দাঁতগুলো বের করে হেসে তার হাতে একটা তোয়ালে দিল। কেইন নিচে নেমে এল। পানি অসম্ভব ঠাণ্ডা ছিল। সে গা রগড়ে মুছলো, তারপর পোশাক পরলো।

ডেকে বের হবার পর পিরু তাকে আরো এক মগ কফি দিল। কফি পান করতে করতে কেইন দূর দিগন্ত রেখায় কানতারার নেভিগেশন আলো দেখতে পেল। তখন আবার সেই মহিলার কথা মনে পড়ল।

 দেখতে তিনি অবশ্যই সুন্দরী, কিন্তু কানতারার মতো একটা গামলায় কি করছিলেন! অবশ্য এর কোন সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 মৃদু হেসে হুইলহাউসে ঢুকে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে সে লঞ্চটা সামনের অন্ধকারে চালিয়ে নিয়ে চলল।

.

০৪.

পরদিন বিকালে তারা দাহরানে পৌঁছাল। লঞ্চটি বাঁকা শৈলান্তরীপ পার হতেই দুই মাস্তুলওয়ালা একটা ধাও–(আরবি স্টাইলের জাহাজ) বন্দর থেকে বের হয়ে এল। উপসাগরের বাতাসে এর পাল ফুলে উঠেছে। আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ধাওটি ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে।

কানতারা জেটিতে মাল নামাচ্ছিল। সমুদ্র সৈকতের বাঁকা অংশে জেলেরা ধৈর্য ধরে বসে তাদের জাল মেরামত করছে। আর নেংটা কয়েকটা শিশু অগভীর পানিতে খেলা করছে।

 কেইন ইঞ্জিন বন্ধ করে পিরুকে ইশারা করল। সে লঞ্চের পেছনের ডেকে নোঙর নিয়ে তৈরি ছিল। নোঙরটা বন্দরের সবুজ পানিতে সশব্দে পড়ে নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। লঞ্চটা একটু সামনে এগিয়ে নোঙরের টানে পূব দিকের পাথুরে জেটির পঞ্চাশ কি ষাট গজ দূরে থেমে পড়ল।

পিরু কেবিনে অদৃশ্য হল। আর কেইন হুইলহাউস থেকে বের হয়ে এল। একটা সিগারেট ধরিয়ে লঞ্চের পেছন দিকে ধীরে ধীরে এগোল। সেখানে দাঁড়িয়ে এক পা পিতলের রেইলের সাথে ঠেকালো। রোদের প্রচণ্ড তেজ থেকে চোখ জোড়া বাঁচাতে তোবড়ানো নোনা দাগে ভরা পিক ক্যাপের সামনের অংশটা একটু বেশি নামিয়ে নিল।

 বলিষ্ঠ গড়নের দীর্ঘদেহের অধিকারী একজন মানুষ, পরনে নিল ফেডেড ডেনিম আর সোয়েট শার্ট। বাদামি চুলগুলো রোদে ঝলসে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। গালে তিন দিনের না কামানো দাড়ি। রোদে পোড়া মুখের চামড়া গালের হাড়ের উপর টান টান হয়ে আছে। গর্তে ঢোকা চোখ জোড়া শান্ত, ভাবলেশহীন। চোখের দৃষ্টি সবসময় দূরে তাকিয়ে রয়েছে, যেন কিছু একটা খুঁজছে।

বন্দরের দিকে তাকিয়ে সে দেখল নোঙর করা দুটো ধাওয়ের মাঝ খান দিয়ে একটা ছোট দাঁড়টানা নৌকা এগিয়ে আসছে। পেশিবহুল দেহের অধিকারী একজন আরব বৈঠা বাইছে। আর কুঁচকানো খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন দাড়িওয়ালা মোটা সোটা অফিসার তাকে দ্রুত যাওয়ার জন্য বলছে। অফিসারের মাথায় একটা সাদা। জড়ানো।

পেছন থেকে একটা মৃদু কাশির শব্দ শোনা যেতেই কেইন না ঘুরে পেছনে এক হাত বাড়াল। পিরু তার হাতে বড় এক গ্লাস বরফ দেওয়া জিন-স্লিং দিল। সে শান্ত স্বরে বলল, সম্ভবত ক্যাপ্টেন গনজালেস বোটে তল্লাসি চালাবেন, সাহেব।

কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল। সেজন্যই তাকে বেতন দেওয়া হয়।

সে আস্তে আস্তে গ্লাসের ড্রিংকস চুমুক দিয়ে শীতল আমেজটুকু উপভোগ করতে করতে তাকিয়ে দেখতে লাগল নৌকাটাকে এগিয়ে আসতে। নৌকা লঞ্চের গায়ে মৃদু ধাক্কা লাগতেই গনজালেস তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ঘামে তার সারা মুখ চক চক করছে। ডান হাতে একটা কাগজের জাপানি পাখা অনবরত নেড়ে মাছি তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

কেইন তার দিকে তাকিয়ে একটা সেঁতো হাসি দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে গরম তোমাকে পেয়ে বসেছে, জুয়ান।

 গনজালেস কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে উত্তর দিল, “শুধু মাত্র ডিউটি করার কারণেই একজন কর্তব্যরত অফিসার হিসেবে আমাকে বাধ্য হয়ে জেটিতে আসতে হয় যখন কোন মেইল বোট এডেন থেকে আসে। মাথা-ঢাকা কাপড়ের এক প্রান্ত দিয়ে সে মুখ মুছলো–”এবার কোত্থেকে এলে?

কেইন ড্রিংকসটা শেষ করে গ্লাসটা পিরুর হাতে দিল। সে তখনও ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, “মুকাল্লা, মেরি পেরেটকে ডেলিভারী দেবার জন্য আমার কাছে কয়েকটা চিঠি রয়েছে।’

গনজালেস তার আঙ্গুলে চুমু খেয়ে বলল, “আহ, সেই আনন্দময়ী মাদমোয়াজেল পেরেট। আমরা হচ্ছি সুবিধাপ্রাপ্ত লোক। এইখানে এই পৃথিবীতে এক ঝলক স্বর্গ। তুমি কি কোন কার্গো এনেছো?

কেইন মাথা নেড়ে বলল, ‘ফেরার সময় আমরা একটা শার্ক আনতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বরশি শুদ্ধ অর্ধেকটা রশি সে নিয়ে গেছে।’

গনজালেস একটা হাত তুলে চোখ ঘুড়িয়ে বলল, ‘তোমরা, আমেরিকানরা এতে উৎসাহী—আর সেটা কিসের জন্য?

কেইন বলল, তুমি কি উপরে আসবে তল্লাশি চালাতে?’।

গনজালেস মাথা নেড়ে বলল, আমি কি একজন বন্ধুকে অপমান করব? সে হাতে ইশারা করে বৈঠাধরা লোকটাকে ফিরে যেতে বলল। আমি এখন বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ড্রিংকস আর আমার স্ত্রীর শীতল হাতের পরশ নেবো।’

কেইন লক্ষ্য করল অনেকগুলো ধাওয়ের মাঝে নৌকাটা অদৃশ্য হয়ে। গেল। কিছুক্ষণ পর সিগারেটটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলে রেইল থেকে ঘুরে পেছন ফিরল। ভাবছি একটু সাঁতার কাটবো,’ সে বলল। ডেকটা মুছে ফেলে, পিরু। তারপর তুমি তীরে গিয়ে তোমার ভালোবাসার মেয়েটির সাথে দেখা করতে যেতে পারো।

সে নিচে কেবিনে গিয়ে দ্রুত পোশাক বদল করল। ডেকে যখন ফিরে এল, তখন তার পরনে একটা পুরনো খাকি শর্টস আর কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলানো চামড়ার খাপে একটা কর্ক হ্যান্ডলওয়ালা ছুরি।

 পিরু রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে একটা রশি টানছে। কয়েকমুহূর্ত পর একটা বড় ক্যানভাসের বালতি উঠে এল। সে এর ভেতরের বস্তুগুলো ডেকে খালি করে বালতিটা আবার পানিতে ছুঁড়ে ফেলল।

 কেইন ডাইভিং মাস্ক পরার প্রয়োজন বোধ করল না। সে দৌড়ে এসে পিরুকে পাশ কাটিয়ে রেইল টপকে সোজা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ জায়গায় বন্দরের গভীরতা প্রায় বিশ ফুট। সে পরিষ্কার সবুজ পানিতে সাঁতার কাটতে লাগল। কয়েকবার সাগরের তলদেশে গিয়ে সাদা বালুতে লাথি দিয়ে আবার উপরে উঠে এল।

 প্রায় উপরে পৌঁছার পর দিক পরিবর্তন করে লঞ্চের নিচে পৌঁছাল। দুই গ্যালনের তেলের ক্যানটা তখনো একইভাবে আংটা থেকে ঝুলছে, যেভাবে সে রেখে গিয়েছিল।

দ্রুত সেটা পরীক্ষা করে উপরে ভেসে এল। পিরু রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতে ক্যানভাস বালতিটা নিয়ে। কেইন একবার মাথা নেড়ে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবার ডুব দিল।

 তেলের ক্যানটার কাছে পৌঁছে ছুরিটা বের করে রশির বাধনটা কাটলো। একমুহূর্ত পরেই ক্যানভাসের বালতিটা তার পিঠে এসে ধাক্কা মারল। মুক্ত হাত দিয়ে সেটা টেনে নিয়ে এর ভেতরে তেলের ক্যানটা ঠেলে ভরলো। দুবার রশি ধরে টান দিতেই বালতিটা হালকাভাবে উপরের দিকে উঠে গেল।

 কোন তাড়া নেই তার। সে আবার সাঁতার কেটে সাগরের তলদেশের সাদা বালুতে পৌঁছে অলসভাবে বুদবুদের ধারার মাঝে উপরে ভেসে উঠল। একটু পর ভেসে উঠে রেইল পেরিয়ে ডেকে উঠে দেখল কেউ নেই। শুধু একটা তোয়ালে পরিষ্কার ভাঁজ করে হ্যাঁচের উপরে রাখা রয়েছে। সে তাড়াতাড়ি গা মুছে নিচে গেল ভেজা চুল মুছতে মুছতে।

 পিরু কেবিনের মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে। দুই হাঁটুর মাঝে তেলের টিনটা ধরে বেশ নিপুণতার সাথে বাটালির চাপে ঢাকনিটা খুলে ফেলল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা পেট মোটা পানি নিরোধক কাপড়ের পুটলি বের করল। মুখ তুলে বলল, আমি কি এটা খুলবো, সাহিব?’

কেইন মাথা নেড়ে বলল, “আমরা বরং স্কিরোজকে এই আনন্দটুকু উপভোগ করতে দেব। কারণ টাকা তো সেই দিচ্ছে। তুমি বরং তেলের টিনটা এখান থেকে সরিয়ে ফেল।

পিরু টিনটা নিয়ে উপরে ডেকে চলে গেল। কেইন কাপড়ের পুটলিটা হাতে নিয়ে এর ওজন আন্দাজ করল এক সেকেন্ড। তার ভ্রু কুঁচকে উঠল। তারপর সেটা টেবিলে রেখে বাংকে শুয়ে পড়ল।

ক্লান্তিতে তার সারা শরীর ভেঙে এল। হঠাৎ মনে পড়ল গত চব্বিশ ঘণ্টা সে ঘুমায়নি। চোখ বুজে সারা শরীর একটু শিথিল করল। এমন সময় লঞ্চের গায়ে একটা নৌকার ঘসা লেগে মৃদু শব্দ শোনা গেল আর পিরু হাজির হল দরজায়। সাহিব! সেলিম এসেছে।’

একটা মুহূর্ত বাংকের উপর বসে সে ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগল। তারপর বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা ‘৪৫ ক্যালিবার কোল্ট অটোমেটিক বের করে আনল। প্যান্টের কোমর বন্ধনিতে ওটা গুঁজে পিরুকে পাশ কাটিয়ে উপরে ডেকে চড়লো। •

একজন দীর্ঘদেহী আরব রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা ঢাকা কাপড়টা কালো সিল্কের কর্ড দিয়ে আটকানো। কালো মুখে ঠাণ্ডা চোখ জোড়া চক চক করছে। একটা পুরোনো ক্ষত মুখটাকে বাঁকা করে দাড়ির মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

কী চাও তুমি? কেইন প্রশ্ন করল।

সেলিম তার বেল্টে আটকানো বাঁকা জামবিয়া ছুরিটার রূপালি বাঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল, “স্কিরোজ আমাকে পাঠিয়েছে, সে বলল। আমি পুটলিটা নিতে এসেছি।’

‘তাহলে তুমি বরং স্কিরোজের কাছে ফিরে গিয়ে তাকে নিজে আসতে বলো।’ কেইন বলল। কে আমার লঞ্চে উঠতে পারবে না পারবে সে ব্যাপারে আমার নিজের পছন্দ অপছন্দ আছে।

সেলিম নরম স্বরে বলল, ‘একদিন তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলবে, সেদিন তোমাকে আমার মেরে ফেলতে হবে।’

‘আমি প্রাণ ভয়ে এখনই কাঁপছি।’

আরব লোকটি অতিকষ্টে তার রাগ সামলে বলল, ‘পুটলিটা।

কেইন কোমরবন্ধ থেকে কোল্টটা বের করে গুলি ছোঁড়ার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বলল। “আমার লঞ্চ থেকে নামো।’

 হঠাৎ একটা বিপজ্জনক নিরবতা নেমে এল। সেলিম হাতের মুঠোয় জামবিয়ার হাতল শক্ত করে ধরল। কেইন দ্রুত কয়েক পা সামনে এগিয়ে এক পা তুলে নিচু রেইলের উপর দিয়ে তাকে একটা ধাক্কা মারল।

বৈঠার কাছে বসে থাকা দুজন আরব মাঝি তাড়াহুড়ো করে তাদের মালিককে পানি থেকে তুলল। সে পানিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়েছিল, কাশতে কাশতে মুখ থেকে সে পানি বের করল। তার আলখাল্লা পানিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে।

কেইন এক পা রেইলে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। কোল্টটা অলসভাবে এক হাতে ধরে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য সেলিম তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর আঙ্গুলে তুড়ি মারতেই দুই দাড়ি নৌকা নিয়ে লঞ্চের পাশ থেকে সরে গেল।

জেটিতে মরচে ধরা কার্গো জাহাজটার পাশে একটা বড় তিন মাস্তুলওয়ালা ধাও নোঙর করা রয়েছে। সেলিম চিনতে পারল ওটা সেলিমের ধাও ফারাহ। দাঁড়টানা নৌকাটা ধীরে ধীরে ওটার দিকে যাচ্ছিল। কয়েক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে সে রেইল থেকে ফিরল।

পিরু ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বেশ চিন্তিত। কাজটা ভাল হলো না সাহিব। সেলিম এটা ভুলবে না।’

 কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “সে আমি ভাববো। ক্লান্তি আবার ভর করতেই সে অলসভাবে হাই তুলল। এখন একটু ঘুমানো দরকার। স্কিরোজ এলে আমাকে জানাবে।

পিরু মাথা নেড়ে রেইলে হেলান দিয়ে ডেকের উপর আসন পেতে বসল। কেইন নিচে চলে গেল।

কোল্টটা বালিশের নিচে ঠেলে দিয়ে একটা ড্রিংকস নিয়ে সিগারেট ধরাল, তারপর বাংকে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রেখে কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এয়ারকন্ডিশনারের হাওয়ায় নীল ধোয়ার মোচড় খাওয়া দেখতে দেখতে সেলিমের কথা ভাবলো।

 লোহিত সাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত সমস্ত বন্দরে সে পরিচিত। যে কোন জিনিস–সোনা, অস্ত্র, এমনকি মানুষ, যাতেই লাভ পাওয়া যায় সে তা নিয়েই ব্যবসা করে। তবে তার কাজের এই অংশটুকু কেইন সহ্য করতে পারে না। এখনো আরব দেশগুলোতে ক্রীতদাস বিশেষত ক্রীতদাসীর বেশ চাহিদা আছে। সেলিম এই চাহিদা মেটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সে বিশেষ করে অল্পবয়সি মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করে।

কেইন মনে মনে চিন্তা করল, কোন এক অন্ধকার রাতে যদি ফারাহ কোন দুর্ঘটনায় পড়ে তখন সেলিম কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এটা অবশ্য সহজেই ঘটানো যায়। মুকাল্লাতে উদ্ধারকাজ করার সময় সে যে পানি নিরোধক বিস্ফোরক ব্যবহার করেছিল তার একটা দিয়ে কাজটা সারা যেতে পারে। এই ভাবনাটা তাকে বেশ স্বস্তি দিল।

চোখ বন্ধ করতেই অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরল।

.

ঘণ্টাখানেক ঘুমাতেই কাঁধে হালকা ঠেলা খেয়ে সে জেগে উঠল। পিরু বাংকের পাশে দাঁড়ানো।

কেইন কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হল। কী ব্যাপার, স্কিরোজ এসেছে?

 পিরু মুখ গম্ভীর করে ঘাড় কাত করল। সে জেটিতে অপেক্ষা করছে, সাহিব।

 কেইন মাটিতে দুপা নামিয়ে দাঁড়াল, তারপর দুহাত টান টান করল। ঠিক আছে তুমি বরং তাকে ডিঙ্গিতে করে এদিকে নিয়ে এস।’

 পিরুকে পেছন পেছন নিয়ে সে উপরে ডেকে গেল। স্কিরোজ বড় একটা পানামা হ্যাট দিয়ে মুখ আড়াল করে জেটির কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ময়লা দাগলাগা সাদা লিনেন স্যুট।

পিরু পানিতে ডিঙ্গি নামিয়ে দ্রুত দাঁড় বেয়ে ওর দিকে এগোতেই গ্রিক লোকটি তার মালাক্কা বেতের লাঠিটা উঁচু করে উৎফুল্ল স্বরে বলল, আমার কি এখন আসাটা নিরাপদ হবে। সকালেই কিন্তু একবার গোসল করেছি।’

কেইন এক হাত উঠিয়ে বলল, “আমি তোমার জন্য একটা ড্রিংকস রেডি করে রাখবো।”

 অনেক কসরত করে জেটির গায়ে লাগানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে অবশেষে সে ডিঙ্গিতে নামল। এ দৃশ্য দেখার পর কেইন কেবিনে গেল। দুই গ্লাস জিন স্লিং তৈরি করা শেষ করতেই ডিঙ্গিটা এসে লঞ্চের গায়ে ঠেকলো। একটু পরই স্কিরোজ ভারী পায়ে মচ মচ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে কেবিনে প্রবেশ করল।

 ধপাস করে একটা চেয়ারে বসেই আর্তনাদ করে উঠল সে। আচ্ছা তুমি কেন বন্দরের মাঝখানে তোমার লঞ্চের নোঙ্গর ফেল? অন্য সবার মত কেন জেটির গায়ে বেঁধে রাখো না?

ঘামে তার কোটের বিভিন্ন জায়গা ভিজে বড় বড় ছাপ ফেলেছে। স্কিত মুখের ভাজ দিয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে। একটা লাল সিল্কের রুমাল বের করে সে ঘাম মুছলো। তারপর পানামা হ্যাটটা খুলে সেটা দিয়ে হাওয়া খেতে লাগল। সযত্নে আচোনো পমেড মাখা চুল চপ চপ করছে। তার কালো কুতকুতে চোখ জোড় ধূর্ততায় ভরে আছে।

কেইন তার হাতে একটা ড্রিংকস দিল। ইতোমধ্যে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চিনেছো। আমি এই হতচ্ছাড়া শহরের কাউকে বিশ্বাস করি না। বলতে পারো আমি আমার চারপাশে একটা পরীখা রাখাটাই শ্রেয় মনে করি।’

 স্কিরোজ মাথা নাড়তে লাগল। পাগল আমেরিকান। তোমাকে আমি কখনো বুঝতে পারব না। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে সাবধানে টেবিলে নামিয়ে রাখল। আমার বিশ্বাস সেলিমের সাথে তোমার সামান্য ঝামেলা হয়েছে।’

কেইন একটা সিগারেট ধরাল। আমি একে সামান্য বলবো না। আমি কেবল আমার বোট থেকে তাকে পানিতে ফেলে দিয়েছি। আচ্ছা কবে থেকে সে তোমার হয়ে কাজ করছে বলতো?’

স্কিরোজ কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বেশ সময় নিয়ে কালো তেলতেলে একটা চুরুট ধরাল। মাঝে মাঝে আমি তাকে কাজে লাগাই। আবার প্রয়োজন পড়লে সে আমার হয়ে ভারতে জাহাজ নিয়ে যায়। আজ বিকেলে তাকে আমি এজন্য পাঠিয়েছিলাম, কারণ অন্য একটা ব্যাপারে আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।

 কেইন ভ্রূ কুঁচকালো। “ঠিক আছে। ওকে আর কখনো পাঠিও না। আমি ওকে সহ্য করতে পারি না। এর আগে একবার ব্রিটিশ গান বোট ওর পিছু নিলে সে চারজন ক্রীতদাসকে উপসাগরে তিন মাইল গভীরে পানিতে ফেলে দেয়। তাদেরকে আমি উদ্ধার করি।’

স্কিরোজ কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে এক হাত তুলে বলল। “আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝলাম সে যেভাবে টাকা উপার্জন করে তা তোমার পছন্দ নয়। তবে একটা কথা মনে রেখো। আজ বিকেলে তুমি তার সাথে যে আচরণ করেছো, তোমার জায়গায় আমি হলে এখন থেকে সাবধান হতাম।

কেইন পানি নিরোধক পুটলিটা টেবিলে ঠেলে বলল, আচ্ছা এখন কাজের কথায় আসা যাক।

 স্কিরোজ একটা ছুরি বের করে সতর্কতার সাথে পুটলিটা কাটতে শুরু করল। তোমার কোন সমস্যা হয়নিতো?’

কেইন মাথা নেড়ে বলল, মাঝরাতের পরপরই আমরা জায়গামতো পৌঁছে গিয়েছিলাম। তবে জাহাজটা দেরি করে আসে আর ও’হারা রোজকার মতো মাতাল হয়ে পড়েছিল। নিয়ন্ত্রণ গুপ্তর হাতে ছিল। সে আমাকে একটা নতুন খবর শোনালো।

কী সেটা?

 ‘ওরা ক্যাটালিনাকে সাগরের ত্রিশ মাইল গভীরে একটা পর্তুগিজ কার্গো জাহাজ থেকে মাল খালাস করতে দেখেছে।’

স্কিরোজ হেসে উঠল। “আচ্ছা তাহলে রোমেরোও হাত ময়লা করছে। বেশ ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা আসার পর কাস্টমসে কোন সমস্যা হয়েছে?”।

কেইন বলল, সেখানে কোন সমস্যা হয়নি। গনজালেস লঞ্চে উঠেনি। শুধু শুধু তেলের টিনটা জাহাজের নিচে বেঁধে নিয়ে আসাটা কেবল সময়ের অপচয় হয়েছে।

 স্কিরোজ মাথা নেড়ে বলল। এই কাজে কোন কিছুই সময়ের অপচয় নয়। হয়তো একদিন যখন তুমি মোটেই আশা করবে না তখন সে হয়তো নিয়ম মাফিক দায়িত্ব পালন করতে শুরু করবে।

কথা বলতে বলতে সে পুটলিটার উপরের আবরণ সরিয়ে এক বান্ডিল ভারতীয় রুপি বের করল।

 স্কিরোজ টাকা গণনা শুরু করতেই কেইন মাথা নাড়তে লাগল। আমি কোনদিন তোমার এই ধান্দা বুঝতে পারবো না। ভারতে সোনা পাচার করে সেখান থেকে ভারতীয় রুপি স্মাগলিং করে আনা।

স্কিরোজ মৃদু হাসল। এটা হল বিনিময়ের বিষয়। আজকের এই আধুনিক জগতে টাকা কামানো আসলে খুবই সহজ। চুরি করার দরকার পড়ে না।

আবার তার সারা মুখ ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে উঠেছে। সে ব্যাংক নোটগুলোর উপর আলতো হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আহা আমার বন্ধু, তুমি যদি জানতে টাকা আমার উপর কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ছয় মাস আগে যখন গোয়া থেকে এখানে চলে আসি তখন আমার ধারণা ছিল না এই জায়গাটা একটা সোনার খনির মত।

 কেইন নিজের গ্লাসে আরেকটা ড্রিংকস ঢাললো। এই টাকার কিছুটা মাঝে মধ্যে খরচ করো না কেন?

স্কিরোজ কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। আমার জীবন শুরু হয়েছে উত্তর গ্রিসে একটা পাহাড়ি খামারে। সেখানে জমিতে মাটির চেয়ে পাথর বেশি। আমার মা পঁচিশ বছর বয়সেই বুড়ি হয়ে যান। আর এক বছর অনাবৃষ্টির কারণে ক্ষেতে ফসল ফলেনি। আমার দুই বোন অনাহারে মারা গেল। এই ঘটনা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না। সেজন্য আমি বেঁচে আছি শুধু টাকা কামাবার জন্য। আমার ব্যাংক ব্যালেন্স স্ফিত হলেই আমি খুশি হই। একটা পেনি হাতছাড়া করতেও আমার মায়া লাগে।

কেইন এবার দাঁত বের করে হাসল। টাকার কথা যখন উঠলই তখন আমার পাওনাটা মিটিয়ে দাও। যদি কিছু মনে না করো সবসময়ের মতো ডলারেই দিও।

 ফিরোজ আবার হেসে উঠতেই তার বিশাল দেহের মাংসপেশিগুলো কেঁপে উঠল। তবে আমি কিন্তু কখনো ভুলিনা তুমি হচ্ছো আমার এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যাকে তোমরা বলে থাকো কিং পিন, তাই না?’

‘গ্যাস দেওয়া ছেড়ে এবার ক্যাশ বের করো।’ কেইন বলল।

স্কিরোজ একটা পেটমোটা ওয়ালেট বের করে একশো ডলারের নোটগুলো গুনতে শুরু করল। তার হাত ঘেমে উঠল আর বেশ অনিচ্ছা নিয়ে—- সে একটা একটা নোট টেবিলে রাখতে লাগল। বিশটা নোট রাখার পর একটু থেমে আরো পাঁচটা নোট তার সাথে যুক্ত করে বলল, এই নাও বন্ধু, আমাদের মাঝে চুক্তি হয়েছিল দুই হাজার। তবে আমি তোমাকে আরো পাঁচশো ডলার বোনাস হিসেবে দিলাম। কেউ যেন বলতে না পারে স্কিরোজ ভাল কাজের পুরস্কার দেয় না।’

কেইন নোটগুলো টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল। তুমি একটা বুড়ো মাকড়সা। খুব ভাল করেই জানো এ টাকার বেশির ভাগ তোমার কাছেই ফিরে আসবে, হয় তোমার হোটেলের বারে কিংবা জুয়ার টেবিল থেকে।’

 স্কিরোজ আবার হেসে উঠল, তার সারা মুখ এমনভাবে কেঁপে উঠল যে দুই চোখ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর সে দুপায়ে খাড়া হলো।

 ‘এবার যেতে হবে। দরজার দিকে এগিয়েই তারপর একটু থামল। ‘একটা জরুরি খবর প্রায় ভুলেই বসেছিলাম। সে ধীরে ধীরে ঘুরল, “আজ বিকেলের জাহাজে এডেন থেকে একজন মহিলা এসেছেন। একজন আমেরিকানমিসেস কানিংহাম, বেশ সুন্দরী। তিনি তোমাকে খুঁজছিলেন।

কেইনের দেহ শক্ত হল। হঠাৎ অবাক হয়ে তার ভ্রু কুঁচকে উঠল। কানিংহাম নামেতো কাউকে আমি চিনি না।’

স্কিরোজ কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল, তিনি তোমাকে চেনেন অথবা তোমার সম্পর্কে জানেন সম্ভবত। আমার হোটেলে উঠেছেন। আমি তাকে বলেছিলাম তোমার সাথে আজ আমার দেখা হবে। তখন তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন তোমাকে একটা খবর দিতে। তুমি যেন আজ তার সাথে হোটেলে গিয়ে দেখা করো। জরুরি একটা ব্যাপারে।

 কেইন টেবিলে দুহাত রেখে একটু সামনে ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ থেমে স্কিরোজ বলল, “আসছো তাহলে?

কেইন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে বলল, “অবশ্যই যাবো। আজ সন্ধায় যে কোন একসময় যাবো।’

স্কিরোজ মাথা নাড়ল। আমি তাই জানাবো তাকে। সে মৃদু হাসল। এত দুশ্চিন্তা করছো কেন। তিনি হয়তো একজন টুরিস্ট। সম্ভবত তোমার লঞ্চ ভাড়া নিতে চান, সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য।

কেইন ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্ত তার মনে হল, এটা কারণ হতে পারে না–অন্তত এই মুহূর্তের জন্য। স্কিরোজ চলে যাবার পর সে বাংকে শুয়ে উপরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অতীতের দিকে পেছনে ফিরে খুঁজতে চেষ্টা করল রুথ কানিংহামকে, কিন্তু কোন ফলোদয় হলো না। এই নামে কাউকে মনে পড়ল না।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল তিনটা বেজেছে। আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে মেঝেতে পা নামাল। তারপর পোশাক পরতে শুরু করল।

ফেডেড জিন্স আর সোয়েট শার্ট পরে উপরে ডেকে গেল। পিরু রেইলে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ঢুলছিল। কেইন তাকে আস্তে ঠেলা দিতেই সে সাথে সাথে জেগে উঠে দাঁড়াল। আমি তীরে যাচ্ছি, তুমি কী করবে? কেইন বলল।

পিরু বলল, না এখন নয় পরে যাবো। আমি ডিঙিতে করে আপনাকে জেটিতে পৌঁছে দিয়েই আবার ফিরে আসবো। এটাই ভাল হবে। সেলিম আবার হয়তো আসবে।’

 কেইন সায় দিয়ে বলল, তোমার কথায় যুক্তি আছে। যদি সে আসে তবে তুমি বালিশের নিচে আমার কোল্ট রিভলবারটা পাবে। প্রয়োজনে ব্যবহার করতে মোটেই ইতস্তত করো না। এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে, ওর চেয়েও বেশি।

সে ডিঙ্গিতে চড়ে বসতেই পিরু দ্রুত দাঁড় বেয়ে পাথরের জেটির দিকে চলল। জেটিতে পৌঁছার সাথে সাথে কেইন লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। উপরে উঠতেই তার নজরে পড়ল কয়েক ফুট দূরে একটা বড় পাথরের উপর বসে একজন মহিলা তার দিকে চেয়ে রয়েছে।

সে সামনে এগোতেই মহিলাটিও উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগোলো। পরনে সাদা সিল্কের দামী পোশাক, কষানি স্টাইলে মাথায় একটা নীল স্কার্ফ জড়ানো, চোখে সানগ্লাস। চশমা খুলতেই সে সাথে সাথে চিনতে পারল ইনিই সেই মহিলা যার সাথে গতরাতে কানতারা জাহাজে দেখা হয়েছিল।

একটু অনিশ্চয়তার হাসি, সেই সাথে একটু বিহ্বলতা তার কণ্ঠে, আবার আপনি? কিন্তু আমিতো ক্যাপ্টেন গ্যাভিন কেইনকে খুঁজছি।’

 ‘আমিই সেই লোক।’ কেইন বলল। আপনি নিশ্চয়ই মিসেস কানিংহাম, তা আপনার জন্য কী করতে পারি আমি?

মহিলাটি বেশ অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়ল। এডেনের আমেরিকান কনসাল মি. এন্ড্রুজ আমাকে বলেছেন আপনাকে খুঁজে বের করতে। তিনি বলেছেন আপনি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, দক্ষিণ আরব সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ।

 সে একটু মৃদু হাসল। আমার ধারণা আমার চেহারা দেখে আপনার সে রকম মনে হচ্ছে না। এভুজ দুটোই সঠিক বলেছেন। আমি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ আর দক্ষিণ আরব সম্পর্কে আমি কিছুটা জানি। তা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

মহিলা বন্দরের দিকে তাকাল, ভুরু সামান্য কুঁচকে রয়েছে। তারপর ফিরে কেইনের দিকে ঠাণ্ডা ধুসর চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার স্বামীকে খুঁজে বের করুন। এ কাজের জন্য যত টাকা লাগে আমি দিতে রাজি আছি।’

কেইন একটা সিগারেট বের করে ধীরে ধীরে ধরাল। কত টাকা দেবেন?

 মহিলা কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “এখন পাঁচ হাজার ডলার আর যদি তাকে খুঁজে পান, তখন আরো পাঁচ হাজার।

কয়েক মুহূর্ত ওরা দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর কেইন একটা লম্বা শ্বাস নিল। চলুন একটা কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমি একটা ভাল জায়গা চিনি। তারপর সে মহিলার বাহু ধরে দুজনে জেটি থেকে সামনে এগোলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *