৫. দ্য রিটার্ন টু ইথিকা

দ্য রিটার্ন টু ইথিকা

আমরা আজ রাত এবং আগামীকাল এখানে ঘুমাতে পারব। তারপর আমরা ঘোড়ার পিঠে চড়তে থাকব। স্টেপসের বালির শব্দ আমার কান সহ্য করতে পারে না।’

আমরা এক ধরনের ব্যাংকারে আছি, দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো মনে হচ্ছে। একজন মানুষ, তার স্ত্রী আর নাতনি নিয়ে আমাদের স্বাগতম জানাল।

ডজ বলে চলল : ‘একটা নাম বেছে নিতে ভুলবেন না।’

‘আমি মনে করি না তার প্রয়োজন আছে।’ মিখাইল বলল।

 ‘অবশ্যই আছে।’ ডুজ জোর দিয়ে বলল, আমি সম্প্রতি তার স্ত্রীর সাথে ছিলাম। আমি জানি ও কীভাবে চিন্তা করে। এবং সে কী শিখেছে। জানি সে কী আশা করছে।

ডজ একইসাথে দৃঢ় এবং ন্দ্র। হ্যাঁ, আমি একটা নাম বেছে নেব, ও যেভাবে করতে বলছে ঠিক তাই তাই করব, আমি ব্যক্তিগত ইতিহাস চেপে যাওয়ার চেষ্টা করব, তার বদলে আমার ব্যক্তিগত খ্যাতিকে বদলে দেব।

 আমি ক্লান্ত। গত রাতে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ঘুমিয়েছিলাম। আমার শরীর এখনো এই সময়ের ব্যবধানের সাথে সামঞ্জস্য করতে পারেনি। আমি রাতের লোকাল টাইমে প্রায় রাত এগারোটার দিকে আলমাটিতে পৌঁছেছি। ফ্রান্সে তখন মাত্র সন্ধ্যে ছয়টা। মিখাইল আমাকে হোটেলে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আমি কিছু সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। তারপর কিছুক্ষণ পরেই জেগে উঠেছি। নিচের আলোর দিকে তাকালাম। প্যারিসে থাকলে এই সময়ে সাপারের জন্য কীভাবে বাইরে থাকতাম তাই ভাবলাম। আমি ক্ষুধার্ত। রুম সার্ভিসকে বললাম খাওয়ার মতো কিছু থাকলে দিতে।

 ‘অবশ্যই পারি স্যার, কিন্তু আপনার সত্যিই ঘুমানোর চেষ্টা করা উচিত। যদি তা না করেন, আপনার শরীর ইউরোপিয়ান টাইম টেবলের সাথে ধাক্কা খাবে।

আমার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো ঘুমানোর চেষ্টা করে ঘুম পড়তে না পারা। আমি একটা স্যান্ডউইচ খেলাম। বাইরে হেঁটে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। রিসিপশনিস্টকে স্বাভাবিক প্রশ্নটাই করলাম : এই সময়ে বাইরে যাওয়াটা কি বিপজ্জনক?’ রিসিপশনিস্ট জানাল, সমস্যা নেই। তো আমি এই খালি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। সরু গলি, প্রশস্ত এভিনিউ, যেকোনো শহরের মতোই শহর। চারদিকে নিয়ন সাইন, মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, একজন ভিখারির দেখা মিলল। বেশ্যাও দাঁড়িয়ে আছে। জোরে জোরে বললাম, আমি এখন কাজাখস্তানে!’ যদি এমনটি না করতাম, তাহলে হয়তো আমার কাছে মনে হতে প্যারিসের কোনো অপরিচিত রাস্তায় আছি।

‘আমি কাজাখস্তানে!’ জোরে জোরে বললাম।

একটা কণ্ঠস্বর উত্তর দিল, অবশ্যই আপনি কাজাখস্তানে।

আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমার খুব কাছে একজন মানুষ বসে আছে। রাস্তার পাশের বেঞ্চে বসা। ব্যাকপাক একপাশে রেখেছে। লোকটা উঠে দাঁড়াল। নিজের পরিচয় দিল জন বলে। হল্যান্ড থেকে এসেছে। সেই সাথে যোগ করল, “আর আমি জানি আপনি এখানে এসেছেন কেন।

লোকটা কি মিখাইলের কোনো বন্ধু? অথবা আমি কোনো গোপন পুলিশের দ্বারা। অনুসরিত হয়েছি?

 ‘আমি এখানে কেন?”

‘আমার মতোই, আপনি ইস্তাম্বুল থেকে ভ্রমণ করতে এসেছেন। সিল্ক রোড ধরে।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। লোকটার সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

‘পায়ে হেঁটে? আমি বুঝতে পারছি, তার মানে গোটা এশিয়া ক্রস করে আসতে হয়েছে।

‘আমার এমনটি করার দরকার ছিল। আমি নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ। আমার অর্থকড়ি আছে, স্ত্রী আছে, বাচ্চা আছে। রটরডমে আমার নিজস্ব হোসিয়ারি ফ্যাক্টরি আছে। এক সময় আমি জানতাম, কীসের জন্য লড়াই করে যাচ্ছি। আমার পরিবারের স্টাবিলিটির জন্য। এখন আমি আর নিশ্চিত নই। এক সময় যা কিছু আমাকে সুখী করত এখন তা বিরক্ত করে, আমাকে শীতল করে দেয়। আমার বিয়ের দোহাই দিয়ে, বাচ্চাদের ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আর কাজের থেকে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের জন্য দুটো মাস সময় নেব। জীবনের দিকে দৃষ্টি দেব। আর তাতে কাজ হচ্ছে।

 ‘আমিও শেষ কয়েক মাস একই কাজ করেছি। আপনার মতো এ রকম তীর্থযাত্রী অনেক আছে?

‘অনেক আছে। পরিপূর্ণ। ব্যাপারটা বিপজ্জনক। কারণ এই দেশের রাজনীতিক অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা পশ্চিমাদের ঘৃণা করে। কিন্তু আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই। আমি মনে করি, একজন তীর্থযাত্রী হিসেবে আপনার সব সময় সম্মান পাওয়া উচিত, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রমাণ হচ্ছে আপনি একজন গুপ্তচর। কিন্তু আপনি যা বলেছেন তাতে মনে এখানে আসার আপনার অন্য কোনো কারণ আছে। কী আপনাকে আলমাটিতে টেনে এনেছে?

 ‘আপনাকে যা নিয়ে এসেছে তাই। আমি একটা নির্দিষ্ট রাস্তার শেষটা দেখতে চেয়েছিলাম। আপনি কি ঘুমাতে পারছেন না?

‘আমি কেবল জেগে উঠেছি। যত তাড়াতাড়ি আমি গুছিয়ে নিতে পারব, তত তাড়াতাড়ি আমি পরবর্তী শহরের কাছাকাছি পৌঁছে যাব। এই ঠাণ্ডা শীতের বাতাসে, স্টেপের ঠাণ্ডায় আমাকে গোটা রাত কাটাতে হবে।’

‘খুব ভালো ভ্রমণ হবে তাহলে।

 ‘না, একটু অপেক্ষা করুন। আমার কথা বলা দরকার। অভিজ্ঞতা কারো সাথে শেয়ার করা দরকার। বেশির ভাগ তীর্থযাত্রীই ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না।

 জন তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করল। সেই ফাঁকে আমি সিল্ক রোড সমন্ধে কী জানি তা মনে করার চেষ্টা করলাম। পুরাতন বাণিজ্যিক রুট, যেটা ইউরোপের সাথে পূর্ব অংশকে সংযুক্ত করেছে। ট্রাডিশনাল রুটটা বৈরুত থেকে শুরু হয়ে এন্টিকের পাশ দিয়ে চায়নার দিকে চলে গেছে। কিন্তু মধ্য এশিয়ায় এটা এক ধরনের জালের মতো ছড়িয়ে আছে।

 ‘আমি এন্টিওক থেকে দুইশ ডলারের মতো পকেটে নিয়ে চলে এসেছি। ডাচ লোকটা বলল। পাহাড়, পর্বত, ল্যান্ডস্কেপ, গোত্র এবং বিভিন্ন দেশের পুলিশ পেট্রোলের সাথে নানা সমস্যার কথা বলল, আমার এটা বের করার দরকার ছিল যে আমি আবার নিজেকে খুঁজে পাই কিনা। আমি কী বলতে চেয়েছি তা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন?’

‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি।’

 ‘টাকা-পয়সার জন্য আমি ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছি। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে লোকজন আমি যে রকমটি কল্পনা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি দয়ালু।

ভিক্ষা? আমি ওর ব্যাকপ্যাক এবং কাপড়চোপড়ের দিকে লক্ষ করতে লাগলাম, মিখাইলের গোত্রের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে কিনা। কিন্তু আমি তা খুঁজে পেলাম না।

 ‘আপনি কি প্যারিসে কখনো আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁয় গিয়েছেন?

 ‘আমি অনেক আর্মেনিয়ান রেস্টুরেন্টে গিয়েছি কিন্তু কখনো প্যারিসে যাইনি।’

 ‘আপনি কি মিখাইল নামে কাউকে চেনেন?

 ‘এই অঞ্চলে এই নামটা খুবই কমন নাম। আমি যদি কোনো মিখাইলকে চিনেও থাকি, মনে করতে পারছি না। তো আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারছি না।

না, আপনার সাহায্যের আমার দরকার নেই। আমি একধরনের কাকতালীয় ব্যাপারে বিস্মিত। মনে হচ্ছে গোটা দুনিয়ায় অনেক লোকজনই একই জিনিস সমন্ধে সচেতন এবং একইভাবে আচরণ করে।

 ‘প্রথম ব্যাপারটা হলো অনুভব। যখন আপনি এই জাতীয় ভ্রমণে নিজেকে সঁপে দেবেন, যে জার্নির কোনো শেষ নেই, তাহলে আপনি ইনসিকিওর বোধ করবেন। সব সময় মনে হবে আর গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু আপনি যদি অন্তত সপ্তাহখানেকও টিকে থাকতে পারেন, তাহলে আপনি এর শেষটা দেখতে পারবেন।’

একটা শহরের রাস্তায় তীর্থযাত্রীর মতো পরিব্রাজক হয়ে আছি। গতকাল আমি আরেকটা শহরে ছিলাম। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন, আমি কি এখন যেতে পারি?

 লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল।

 ‘আমি কোনো ধর্মীয় কারণে ভ্রমণে বের হইনি। আপনি কি একজন ধর্মযাজক?

না। আমি কোনো ধর্মযাজক নই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনাকে আশীর্বাদ করা উচিত। কোন কোন ব্যাপার যুক্তি মানে না, আপনি তা জানেন।

জন নামের সেই ডাচমান, যাকে আমি আর কখনো দেখিনি, মাথা নুইয়ে দু চোখ বন্ধ করল। আমি তার কাঁধের ওপর হাত রাখলাম। আঞ্চলিক ভাষায়, যা ও বুঝতে পারবে না। আমি প্রার্থনা করলাম, যাতে ও ওর গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছে যেতে পারে এবং তার দুঃখ-দুর্দশা সিল্ক রোডে ছেড়ে আসতে পারে এবং জীবন অর্থহীন নয় এই বুঝতে পারে। আমিও প্রার্থনা করলাম। সে যাতে তার পরিবারের কাছে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এবং বিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হয়ে পৌঁছাতে পারে।

 ও আমাকে ধন্যবাদ দিল। ব্যাকপ্যাক তুলে নিল। চায়নার দিকে হাঁটতে লাগল। আমি হোটেলে ফিরে গেলাম। ভাবতে লাগলাম আমার সারা জীবনে এর আগে কখনো কাউকে আশীর্বাদ করিনি। কিন্তু আমি ভেতর থেকে সাড়া পেলাম। আমার ইমপালস ঠিক। প্রার্থনার উত্তর পাওয়া যাবে।

.

পরের দিন, মিখাইল ওর বন্ধু ডজকে নিয়ে এল। ডজ আমাদের সঙ্গ দেবে। ডজের একটা গাড়ি আছে, আমার স্ত্রীকে জানে এবং স্টেপসের পথ চেনে। আমি এসখারের গ্রামে পৌঁছালে সেখানে থাকতে চায়।

আমি ওদের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। প্রথমে মিখাইল, এখন মিখাইলের বন্ধু আর আমরা যখন এসথারের গ্রামে পৌঁছাব, তখন হয়তো আমাদের পেছনে বিশাল জনতা থাকবে, হাততালি দেবে, কাঁদবে, কী ঘটে তাই দেখতে অপেক্ষা করবে। কিন্তু আমি এত ক্লান্ত যে, কিছু বলতে ইচ্ছা করল না। পরের দিন, আমি মিখাইলকে প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেব, সেই মুহূর্তে আমি কোনো সাক্ষী রাখতে চাই না।

 আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। মাঝে মাঝে সিল্ক রুট ধরে চলতে হচ্ছিল। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি এই ব্যাপারে জানি কিনা, ওদের বললাম আমার সাথে একজন সিল্ক রুটের তীর্থযাত্রীর সাথে গত রাতে দেখা হয়েছিল। তারা বলেছিল, এ জাতীয় ভ্রমণ সব সময় দেশের ভ্রমণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেনিফিট নিয়ে আসবে।

ঘণ্টা দুই পরে, আমরা মেইন রোড ছেড়ে ছোট্ট রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। ‘এসথার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ডজ ব্যাখ্যা করল। ডজের পেইন্টিংয়ের একটা ছবি দেখাল, যেটাতে রক্তমাখা কাপড়ের টুকরোর ব্যাপারটা আছে। আমি ওখানে বাস করার স্বপ্ন দেখি, ওলেগের মতো…’

 ‘ওর চেয়ে ভালো তুমি আমাকে মিখাইল বলেই ডাকো, না হলে উনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন।

 ‘আমি এখানে বাস করার স্বপ্ন দেখি, যেমনটি আমার বয়সের অনেক মানুষই দেখে। তারপর একদিন, ওলেগ বা মিখাইল- আমাকে ফোন করে। ও জানায় তার শুভাকাঙ্ক্ষী সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে এসে কিছুদিনের জন্য স্টেপসে বাস করবে এবং ও চায় যাতে আমি মেয়েটাকে সাহায্য করি। আমি রাজি হলাম। ভাবলাম আমার সুযোগ এসেছে। সম্ভবত আমি মেয়েটার কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করতে পারব, অন্ততপক্ষে একটা ভিসা, একটা প্লেনের টিকিট এবং ফ্রান্সে কোনো একটা চাকরি? মেয়েটা এসে আমাকে একটা প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়ার জন্য বলল। আগেও সে ওই গ্রামে গিয়েছে।

‘আমি জিজ্ঞেস করিনি কেন। ওর অনুরোধ রাখলাম। পথে, ও এর আগে আসা যাযাবরের বাড়িতে দেখা করে যাওয়ার জন্য জোর দিল। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে, সে আমার দাদুর বাড়িতেই দেখা করতে যেতে চাইল! ওকে সেভাবেই অভ্যর্থনা জানানো হলো, যে রকমটি সাধারণত গ্রামের লোকেরা করে থাকে। আমার দাদু ওকে বললেন, যদিও সে ভাবছিল ও দুঃখী, দাদু বললেন, ওর আত্ম সুখী, মুক্ত এবং ভালোবাসার শক্তিতে ভরপুর। তিনি ওকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, এই ভালোবাসার শক্তির প্রভাব গোটা পৃথিবীর ওপর পড়বে, এমনকি তার স্বামীর ওপরও। আমার দাদু ওকে স্টেপসের সংস্কৃতিসহ বহু জিনিস শিখিয়েছিলেন। আমাকে বাকি ব্যাপারগুলো শিখিয়ে দিতে বললেন। শেষ পর্যন্ত, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ও তার নাম রাখতে পারবে, যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি বিপরীত।

“আর যে সময়ে ও আমার দাদুর কাছে শিখত, আমি ওর কাছ থেকে শিখতাম। বুঝতে পারছিলাম আমার খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, যেমনটি মিখাইল করেছে, আমার মিশন হলো ফাঁকা জায়গায়- এই স্টেপসে- এর রং এবং পেইন্টিংয়ের রূপান্তর বুঝতে পারা।

 ‘আমি মোটেও বুঝতে পারছি না আপনি আমার স্ত্রীকে শেখানো বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম আপনার দাদু বলেছিলেন আমাদের সব কিছু ভুলে যাওয়া উচিত।’

‘আগামীকাল আপনাকে তা দেখাব। ডজ বলল।

*

পরের দিন, উজ আমাকে যা দেখাল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি সীমাহীন স্টেপস দেখতে পেলাম, যা দেখে মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না অথচ জীবনীশক্তিতে ভরপুর। আমি বিস্তৃত দিগন্ত দেখতে পেলাম, বিস্তৃত শূন্যতা, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পেলাম, শান্ত বাতাস এবং তারপর আমাদের চারদিকে আর কিছুই নেই। দেখে যেন মনে হয় জগৎ এই জায়গাটাকে ডিসপ্লের জন্য রেখেছে। এর শূন্যতা, সরলতা এবং জটিলতা মিলিয়ে। মনে হয় যেন আমরা এখানকার স্টেপসের মতো- শূন্য, অসীম এবং একইসাথে প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

 নীল আকাশের দিকে তাকালাম। কালো চশমা খুলে ফেললাম। আশপাশের প্রকৃতির সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিলাম। আমরা নিঃশব্দে এগোতে লাগলাম। মাঝে মাঝে শুধু ঘোড়াগুলোকে ঝরনা থেকে পানি খাইয়ে নিচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে দূরে অন্য ঘোড়সওয়ার বা মেষপালককে দেখতে পাচ্ছিলাম।

আমি কোথায় যাচ্ছি। আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কিন্তু তার পরোয়া করি না। যে মহিলাটির খোঁজ করছি সে এ রকম ফাঁকা জায়গায় থাকতে পারে। আমি ওর আত্মা ছুঁতে পারি, ওর গাওয়া গান শুনতে পারি, যা ও কার্পেট বোনার সময় গেয়ে থাকে। এখন বুঝতে পারছি কেন ও এই জায়গাটা পছন্দ করেছিল। কোনো কিছুই নেই। ওর মনোযোগ বিঘ্নের মতো কোনো কিছুই এখানে নেই। এ রকম নির্জনতাই ও খুঁজে বেড়িয়েছে। বাতাসে ধীরে ধীরে ওর কষ্ট দূরে চলে যেতে পারে। ও কি কখনো কল্পনা করেছিল একদিন আমি এখানে আসতে পারি? ঘোড়ার পিঠে চড়ে ওর সাথে দেখা করতে পারি? আকাশ থেকে যেন স্বর্গ ভেসে আসছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ মুহূর্ত সমন্ধে আমি সচেতন। এটা সেই জাতীয় সচেতনতা আমরা বেশির ভাগ সময়ে ম্যাজিক মুহূর্তগুলোতে এড়িয়ে যাই। আমি পুরোপুরি এখানে, কোনো অতীত নেই, কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

আকাশকে কিছু প্রশ্ন করলাম। একই প্রশ্ন ছোটবেলায় মাকে করতামঃ

কেন আমরা নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে ভালোবাসি এবং অন্যদের ঘৃণা করি?

 আমরা মৃত্যুর পরে কোথায় যাই?

কেন আমরা জন্মেছি, যদি শেষ পর্যন্ত মরে যেতে হয়?

ঈশ্বর অর্থ কী?

স্টেপস বাতাসের প্রবাহে সাড়া দিল। সেটাই যথেষ্ট, জীবনের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর কখনোই পাওয়া যাবে না, আর সে কারণেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।

.

দিগন্তের গায়ে হেলান দিয়ে পর্বতমালা। ডজ আমাদের থামতে বলল। আমি দেখতে পেলাম ওখানে কাছে পিঠে একটা ঝরনা আছে।

‘আমরা এখানে ক্যাম্প করব।’

আমরা ঘোড়ার পিঠ থেকে স্যাডলব্যাগ নামিয়ে নিলাম। তাঁবু খাটালাম। মিখাইল মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়তে লাগল।

যাযাবররা এভাবেই এ কাজটি করে। আমরা একটা গর্ত খুঁড়ি, গর্তের তলাটা পাথর দিয়ে ভরে ফেলি, কিনারার চারদিকে আরো বেশি পাথর দিয়ে রাখি, এখানে বাতাস এড়িয়ে আমরা আগুন জ্বেলে রাখি।’

দক্ষিণে, পর্বত এবং আমাদের মাঝখানে এক খণ্ড ধুলোর মেঘ দেখা গেল। আমি বুঝতে পারলাম ঘোড়ার খুরের কারণে এমনটি দেখাচ্ছে। আমি ওদের দুজনকে ডেকে দেখলাম। ওরা তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। আমি দেখতে পেলাম ওরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তারপর তারা নিজেদের মধ্যে রাশিয়ান ভাষায় কী যেন বলে রিলাক্সড হয়ে দাঁড়াল। ডজ আবার তাঁবু খাটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিখাইল আগুন জ্বালতে শুরু করল।

 ‘ওখানে কী হচ্ছে তা কি আমাকে বলা যাবে?’ আমি বললাম।

‘দেখে মনে হয় আমরা যেন ফাঁকা জায়গায় আছি। কিন্তু আপনার এর মধ্যে যেসব জিনিস দেখেছি তা চলে যেতে পারে না; মেষপালক, নদী, কচ্ছপ, শেয়াল এবং ঘোড়ামানব। দেখে মনে হয় যেন আমাদের দৃষ্টিসীমা পরিষ্কার, তো এইসব লোক কোথা থেকে এসেছে? তাদের ঘোড়াগুলো কোথায়? তাদের লোকজনদের কোথায় রেখেছে?

‘শূন্যতার অনুভূতি এক ধরনের ইলিউশন। আমরা অনবরত দেখছি এবং অন্যরা আমাদের দেখছে। একজন অপরিচিত আগন্তুকের কাছে যে স্টেপসের সাইনগুলো পড়তে পারে না, সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে এবং একমাত্র যে জিনিস সে দেখতে পায় ঘোড়া এবং ঘোড়সওয়ার।…

আর এখন খারাপ খবর হলো, ওরা আমাদের খুঁজে পেয়েছে যে আমরা গ্রাম থেকে ঘোড়ায় চড়ে পর্বতের পাদদেশে আছি। আর লোক পাঠিয়েছে শ্যামনকে হত্যা করার জন্য যে বাচ্চাদের দৃষ্টি দেখতে পায় এবং একজন বিদেশি মহিলার শান্তি নষ্ট করতে যে মানুষটি এসেছে।

ও জোরে জোরে হেসে উঠল।

 একটু অপেক্ষা করুন। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।

ঘোড়সওয়ারদের দেখা যাচ্ছে। আমি খুব শিগগিরই কী হচ্ছে তা দেখতে পেলাম।

 ‘আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে একজন মহিলার খোঁজে একজন পুরুষ।

 ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত। কিন্তু এটাও আমাদের জীবনযাত্রার একটা অংশ।

মহিলা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। হাতে লম্বা একটা চাবুক। যাওয়ার পথে আমাদের অভিবাদন জানিয়ে চিৎকার করল এবং সরাসরি ডজের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর জায়গাটার চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগল। হাসি, ঘর্মাক্ত মানুষ তার পিছু নিয়েছে ব্যাপারটা অন্য রকম লাগল।

নীনার এতটা নিষ্ঠুর হওয়া উচিত নয়। মিখাইল বলল, ‘এসবের কোনো দরকার নেই।’

ব্যাপারটা অমূল্য কারণ এটার কোনো প্রয়োজন নেই যে সে নিষ্ঠুর হতে পারে। ডজ উত্তর দিল, ও সব সময় সুন্দরী এবং খুব ভালো একটা ঘোড়া আছে।

কিন্তু ও সবার সাথেই এমনটি করে।

‘আমি একবার ওকে উঠিয়েছিলাম। ডজ গর্বিত স্বরে বলল।

ঘটনা হলো আপনি ইংরেজিতে কথা বলছেন মানে আপনি আমাকে বুঝতে চান।

 মেয়েটি হেসে উঠে আরো জোরে ঘোড়া ছোটাল। ওর হাসি স্টেপস যেন আনন্দে ভরে গেল।

‘এটাও একরকমের তোষামদের রূপ। একে বলা হয় কিজ কু, মানে ‘মেয়েটাকে লাইনে নিয়ে আসো। আমরা সব সময় এতে অংশ নিয়েছি, সে শৈশবে হোক আর যৌবনে।

যে মানুষটি ওকে খুঁজছিল সে ওর কাছাকাছি হয়ে গেল কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম মানুষটির ঘোড়া খুব বেশি এগোতে পারল না।

 ‘পরে আমরা টেংরিদের নিয়ে, স্টেপসের সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলব।’ ডজ বলে চলল, কিন্তু এখন আপনি যখন এটা দেখেছেন, তখন আমাকে গুরুতপূর্ণ কিছু ব্যাখ্যা করতে দিন। এখানে, এই ভূমিতে, মেয়েরাই দায়িত্বে থাকে। মেয়েরাই আগে আসে। ডিভোর্সের ক্ষেত্রে মেয়েরা যৌতুকের অর্ধেকটা ফেরত নিয়ে নেয়, তাতে যদি মেয়েটাই এ ক্ষেত্রে ডির্ভোস চায় তবু। যখন একজন পুরুষ কোনো মহিলাকে সাদা টারবান পোশাক পরতে দেখে, তার মানে সেই মহিলাটি একজন মা এবং আমরা, পুরুষেরা, অবশ্যই আমাদের হাত হৃৎপিণ্ডের ওপর রেখে মাথা নুইয়ে তার দিকে সম্মান জানাব।’

 “কিন্তু, মেয়েটাকে লাইনে আনো’ এটা বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?’

‘পর্বতের পাদদেশের গ্রামটাতে, ঘোড়সওয়ার একদল পুরুষ এই মেয়েটার চারদিকে একত্র হতে পারে, মেয়েটির নাম নীনা আর ও এই এলাকার সবচেয়ে আকাক্ষিত মেয়ে। তারা মেয়েটার সাথে একটা খেলা খেলে, খেলাটার নাম কুজ কু, প্রাচীন খেলা, যখনকার সময় এখানকার মহিলারা আমাজন চিনত তখন থেকেই তারা যোদ্ধা।

এক সময়, কেউ বিয়ে করতে চাইলে পরিবারের কারো সাথে আলাপ করত না, যারা বিয়ে করতে চাইত এবং মেয়েটি খুব সাধারণভাবে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রে যেত, সবাই ঘোড়ায় সওয়ার হতো। মেয়েটা ঘোড়ায় চড়ে পুরুষের চারপাশে ঘুরত, হাসত, খোঁচাত, উত্তেজিত করত, পুরুষের চাবুকের আঘাত করত। তারপর পুরুষদের মধ্যের সবচেয়ে সাহসী পুরুষ মেয়েটাকে তাড়া করতে শুরু করত। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যদি মেয়েটি পুরুষটির নাগাল থেকে বাইরে যেতে পারে, তাহলে পুরুষটি নিজেকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলত, কারণ সে খুব খারাপ একজন ঘোড়সওয়ার হিসেবে বিবেচিত হতো, যা যোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় লজ্জার ব্যাপার।

 ‘চাবুকের আঘাত সত্ত্বেও যদি পুরুষটি মেয়েটির কাছাকাছি যেতে পারে, মেয়েটিকে মাটিতে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে সে একজন সত্যিকারের পুরুষ এবং এখন সে মেয়েটিকে চুম্বনের অনুমতি পাবে এবং বিয়ে করতে পারবে। সুস্পষ্টত, তারপর এখনকার মতোই, মেয়েটি জানত কাদের কাছ থেকে তাকে পালিয়ে যেতে হবে এবং কাদের কাছে তারা ধরা পড়বে।

 নীনা পরিষ্কারভাবেই বেশ মজা পেয়েছে। সে পুরুষটির সামনে থেকে আবার এগিয়ে গেল এবং এবার গ্রামের দিকে ফিরে গেল।

নীনা শুধু আমাদের দেখাতে এসেছিল। নীনা জানে আমরা এই পথে আছি এবং খবরটা গ্রামে নিয়ে পৌঁছে দেবে।’

 ‘আমার দুটো প্রশ্ন আছে। প্রথম হয়তো বোকার মতো শোনাবে : আপনি কি এরই মধ্যে এভাবে আপনার কনেকে খুঁজে নিয়েছেন?

ডজ বলল, এখনকার দিনে, এটা শুধু একটা খেলা মাত্র। পশ্চিমে, লোকজন সুন্দর পোশাক পরে বার অথবা ফ্যাশনেবল ক্লাবে যায়, এখানকার স্টেপে সে রকম কুজ কু সে রকম মন ভোলানোর একটা জনপ্রিয় খেলা। নীনা এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন তরুণকে অপমানিত করেছে এবং নিজেকে দুর্লভ প্রমাণিত করেছে।

“দ্বিতীয় প্রশ্নটি হয়তো সেই তুলনায় আরো বেশি গাধার মতো করা হয়ে যাবে : পর্বতের পাদদেশের গ্রামেই কি আমার স্ত্রী বাস করে? ডজ মাথা নোয়াল।

‘যদি শুধু ঘণ্টা দুইয়ের পথ বাকি, তাহলে আমরা এখানে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি কেন? অন্ধকার নেমে যাওয়ার আগে আমরা ওখানে যেতে পারি।

‘আপনার কথাই ঠিক, আমরা কেবল দুই ঘণ্টা দূরে আছি। দুটো কারণে আমরা আজ রাতে এখানে কাটাতে চাইছি। প্রথমত, নীনা যদি এখানে নাও আসত, তাও কেউ না কেউ আমাদের এরই মধ্যে দেখে থাকবে এবং আর গিয়ে এসথারকে বলে দেবে আমরা এদিকে আসছি। আর এভাবে, এসথার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সে আমাদের সাথে দেখা করতে চাইবে কি না অথবা যদি সে আরেকটা গ্রামে কয়েক দিনের জন্য চলে যেতে চায় যেতে পারবে। যদি ও এমনটি করে, আমরা তাকে অনুসরণ করতে পারব না।

 আমার হৃদয় কেঁপে উঠল।

‘এত কিছুর পরে আমি ওকে আর পাব না?”

যদি আপনার ও রকমটি মনে হয়, তাহলে আপনি কিছুই বুঝতে পারেননি। আপনার কীসে মনে হয় আপনার শক্তিই আপনার ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে নিয়ে আসবে? আপনি এখানে এসেছেন কারণ এ রাস্তাটাই আপনাকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হতো। আপনার বউয়ের ভালোবাসা কেনার জন্য নয়।’

 ওর কথাগুলো যতই অনুচিত মনে হোক কেন, ঠিক কথাই বলছিল। আমি ওকে দ্বিতীয় কারণটি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘আপনি এখনো আপনার নাম বেছে নেননি।

‘সেটা কোনো ব্যাপার নয়।’ মিখাইল আবার বলল, “উনি আমাদের সংস্কৃতি বুঝে উঠতে পারেননি। আর উনি এর অংশও নন।

 ‘আমার কাছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। ডজ বলল, আমার দাদু বলেছিলেন আমার অবশ্যই বিদেশি মহিলাকে রক্ষা এবং সাহায্য করা উচিত। যে রকমভাবে আমি নিজেকে রক্ষা করি। আমি এসখারের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর আমি চাই ও শান্তিতে দিনযাপন করুক।

উনাকে একটা নাম বেছে নিতে হবে। ওকে ওর যন্ত্রণা এবং দুঃখ-দুর্দশার কথা ভুলে যেতে হবে এবং এটা মেনে নিতে হবে, তার মধ্যে একজন নতুন মানুষ জন্ম নিয়েছে এবং এখন থেকে উনি প্রতিদিনই একবার করে নতুন জন্ম নেবেন। তিনি অমনটি না করলে এবং তারা যদি আবার একত্রে বাস করতে থাকে, তাহলে তিনি আবার এসথারকে একই রকম যন্ত্রণা দেবেন, যেমনটি আগে দিয়েছেন।’

‘আমি গত রাতে একটা নাম পছন্দ করে রেখেছি। আমি বললাম।

 ‘আমাকে বলার জন্য আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

.

যত তাড়াতাড়ি সূর্য দিগন্তে ঢলে পড়তে লাগল, আমরা স্টেপসের এমন একটা এলাকায় গেলাম, যেখানে বালির সমুদ্র। আমি ভিন্ন ধরনের শব্দের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম, এক ধরনের মূৰ্ছনা, কম্পন। মিখাইল বলল, পৃথিবীর খুব অল্প জায়গার একটা এটি, যেখানে বালি গান করে।

‘প্যারিসে থাকাকালীন আমি যখন লোকজনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতাম, তারা আমাকে বিশ্বাস করত, কারণ একজন আমেরিকান উত্তর আফ্রিকায় এই জাতীয় অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। জগতে মাত্র ত্রিশটি এ রকম জায়গা আছে। এখানকার দিনে, অবশ্যই, বিজ্ঞানীরা সব কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারেন। তাদের মতে, জায়গাটার অদ্ভুত গড়নের জন্য, বাতাস বালির ভেতরে ঢুকে এই জাতীয় শব্দ তৈরি করে। যদিও প্রাচীনকাল থেকে এ জায়গাটা স্টেপসের জাদুকরী জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়। আর আপনার নাম বদলের জন্য ডজ এই জায়গা বেছে নিয়েছে, এটা আপনার জন্য খুব সম্মানের ব্যাপার।

আমরা জায়গা বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। এগিয়ে যেতেই শব্দটা আরো বেশি তীক্ষ্ণ এবং বাতাসের প্রবাহ শক্তিশালী মনে হলো। আমরা একেবারে ওপরে উঠে গেলে, দেখতে পেলাম দক্ষিণের দিকে পর্বত দাঁড়িয়ে আছে আর নিচে বিশাল সমতল ভূমি।

 ‘পূর্ব দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আপনার কাপড়চোপড় খুলে ফেলুন। ডজ বলল।

কোনো রকম প্রশ্ন না করেই ডজের কথামতো কাজ করলাম। আমার শীত লাগছিল, কিন্তু মনে হলো ওরা আমার ভালোমন্দের ব্যাপারটা দেখছে না। মিখাইল হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করতে লাগল। ডজ আকাশের দিকে, মাটির দিকে, আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার দুই হাত আমার কাঁধে রেখে আমি যেমনটি সেই ডাচমানের সাথে করেছিলাম সে রকম করতে লাগল।

 ‘দেবীর নামে আমি আপনাকে উৎসর্গ করছি। আমি মাটির নামে আপনাকে উৎসর্গ করছি, যা দেবীর আয়ত্তাধীন। ঘোড়ার নামে আপনাকে উৎসর্গ করছি। আমি পৃথিবীর বুকে আপনাকে উৎসর্গ করছি এবং প্রার্থনা করছি আপনার ভ্রমণের ব্যাপারে জগতের সাহায্য পাবেন। আমি আপনাকে অপূরণীয় প্রজ্ঞায় উৎসর্গ করছি। প্রার্থনা করছি যাতে আপনার দিগন্ত সব সময় এত প্রশস্ত হয়, যাতে আপনি দেখতে পারেন। আপনি আপনার নাম বেছে নিয়েছেন এবং প্রথমবারের মতো তা নিয়ে কথা বলবেন।

 ‘এই অসীম স্টেপসের নামে, আমি একটা নাম বেছে নিয়েছি। আমি উত্তর দিলাম। ওদের জিজ্ঞেস করলাম না আমি প্রার্থনার রীতি ঠিকঠাক করছি কিনা।

 ‘অনেক বছর আগে, একজন কবি একজন মানুষের আশ্চর্য বর্ণনা দিয়েছিলেন, যাকে বলা হতো ইউলিসিস। সে ইথিকা নামে একটা দ্বীপে যেতে চায়, যেখানে তার ভালোবাসার মানুষটা তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, ঝড়-জল থেকে শুরু করে নানা প্রলোভন। এক পর্যায়ে, একটা গুহায়, এক চোখা দৈত্যের সাথে লড়াই করে।

 দৈত্যটা ওর নাম জিজ্ঞেস করল। নোবডি’ ইউলিসিস উত্তর দিল। তারা লড়াই করতে শুরু করল। ইউলিসিস তরবারি দিয়ে দৈত্যের চোখ গেলে দিতে পারল। তারপর গুহার মুখ একটা বড় পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিল। দৈত্যের চিৎকার শুনে তার সঙ্গীরা সাহায্য করতে ছুটে এল। দেখতে পেল গুহার মুখে একটা বড় পাথর দিয়ে আটকে দেয়া আছে। তারা দৈত্যের কাছে জিজ্ঞেস করল, কে এমনটি করেছে। নোবডি! কেউ না!’ দৈত্য উত্তর দিল। দৈত্যের সঙ্গীরা চলে গেল। তারপর থেকে তার ওপর আর কোনো আক্রমণ এল না। ইউলিসিস অপেক্ষারত মহিলার জন্য তার প্রমণ বহাল রাখল।

 ‘তো আপনার নাম ইউলিসিস?

 ‘আমার নাম কেউ না।

আমি কাঁপতে লাগলাম। মনে হলো যেন আমার চামড়ায় সঁচ দিয়ে শত শত ছিদ্র করা হয়েছে।

 ‘ঠাণ্ডার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, নাহলে কাঁপুনি থামবে না। ঠাণ্ডা দিয়ে আপনার প্রতিটি চিন্তাভাবনা ভরে নিন, যতক্ষণ না অন্য কিছুর জন্য কোনো জায়গা থাকে, ঠাণ্ডা আপনার সঙ্গী আপনার বন্ধু হয়ে উঠবে। শীতকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন না। সূর্যের ব্যাপারে ভাববেন না, তাতে আরো খারাপ হবে কারণ আপনি অন্য কিছুর কথা জানেন, উত্তাপ- উত্তাপের অস্তিত্ব আছে তাহলে ঠাণ্ডা আরো বেশি করে জাকিয়ে বসবে।

আমার মাংসপেশি টানটান হয়ে গেছে। আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেগুলো শক্তি উৎপাদন করছে। যাই হোক, ডজ যে রকম আদেশ দিল আমি তেমনটিই করলাম, কারণ আমি ওকে বিশ্বাস করি, তার শান্তভাবটাকে বিশ্বাস করি, ওর তারুণ্য, ওর কর্তৃত্বপরায়ণতা। আমি ঠাণ্ডার তীব্রতা আমার শরীরে মেনে নিলাম, দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেতে লাগল, আমি মনে মনে বারবার বলতে লাগলাম, লড়াই করো না, ঠাণ্ডা তোমার বন্ধু। আমার মাংসপেশি তা মেনে নিতে চাইল না। আমি ও রকমভাবে প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মাংসপেশি কাঁপুনি না থামানো পর্যন্ত ও রকমভাবে চলতে লাগল। আমি বসার চেষ্টা করলাম; কিন্তু মিখাইল আমাকে ধরে ফেলল। আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখল। ডজ আমার সাথে কথা বলছিল। তার কথাগুলো যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল।

‘স্বাগতম, স্টেপস অতিক্রমকারী যাযাবরকে স্বাগতম। স্বাগতম সেই রাজ্যে যেখানে আমরা সব সময় বলি আকাশ নীল তাই যখন তা ধূসর থাকে তখনো, কারণ আমরা জানি সেই ধূসরতার ওপরে নীল রয়েছে। টেংগ্রিদের মাটিতে স্বাগতম। আমার পক্ষ থেকে স্বাগত জানাচ্ছি, আমি এখানে আপনাকে নিতে এসেছি। আপনার খোঁজকে সম্মান জানাচ্ছি।’

মিখাইল মাটিতে বসে পড়ল। শরীর গরম করার জন্য এই মুহূর্তে কোনো পানীয় পান করতে চাই কিনা জিজ্ঞেস করল। ডজ আমাকে কাপড় পরতে সাহায্য করল। আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে লাগলাম। উজ আর মিখাইল রান্না শুরু করার আগে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

*

কী ঘটেছে? এখনো আলো আসেনি?”

 ‘এটা বয়সের আলো। এটা বালুঝড়, চিন্তা করবেন না। চোখকে রক্ষা করার জন্য আপনার কালো গগলস পরেন।

 ‘ডজ কোথায়?

ও আলমাটিতে ফিরে গেছে। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের কারণে তাকে যেতে হয়েছে। তার এমনটি করার দরকার ছিল না। আপনার জন্য সত্যিই সময়ের অপচয় এবং নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার বড় সুযোগ। আশা করছি আপনি বুঝতে পেরেছেন এখানে আপনাকে স্বাগতম জানানোর এটা একটা পদ্ধতি মাত্র। এই তেলটা নিন।

 ‘আমি অনেক বেশি ঘুমিয়েছি।’

গ্রামে যেতে মাত্র ঘণ্টা দুই ঘোড়ায় চড়লে হয়। সূর্য মাথার ওপরে ওঠার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।’

‘আমার গোসল করার দরকার। কাপড়চোপড় বদলানো দরকার।’

‘সেটা অসম্ভব। আপনি এখন স্টেপসের মাঝখানে রয়েছেন। পাত্র থেকে তেল নিন কিন্তু তার আগে দেবীকে অফার করুন। লবণ থেকে দূরে থেকে এটাই আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস।

 ‘টেংগ্রি কী?

 ‘টেংগ্রি শব্দের অর্থ ‘আকাশ পূজা। এটা একধরনের ধর্ম, যা ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন। সবাই এখান দিয়ে গিয়েছে। বৌদ্ধ, হিন্দু, ক্যাথলিক, মুসলিম, বিভিন্ন ধর্মের লোক তাদের বিশ্বাস আর কুসংস্কার নিয়ে গেছে। যাযাবররা…

‘ডজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। গতকাল, সেই উৎসর্গের অনুষ্ঠানের সময়, আমি বুঝতে পেরেছি ওর মধ্যে বিশেষ কিছু আছে।’

“ও ওর দাদুর কাছ থেকে শিখেছে, যিনি তার বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন, যিনি আবার তার বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন এবং এভাবেই চলে এসেছে। যাযাবরদের জীবনযাপন এবং লিখিত ভাষার অনুমতির ব্যাপারে উনিশ শতকের শেষ দিকে, যেখান থেকে একিনের ঐতিহ্য, যে মানুষটি সব কিছু মনে রাখে এবং গল্পগুলো বলে। ডজ একজন একিন। আমি বলেছি শিখেছি’ যদিও, আমি আশা করি আপনি তার অর্থ এই করেননি যে, জ্ঞান সংগ্রহ করা।’ গল্পগুলোতে শুধু কিছু তারিখ, নাম আর ঘটনার ঘনঘটা। সেগুলো নায়ক নায়িকা, পশু আর যুদ্ধ এসবের কিংবদন্তীতেই আছে। …

‘আমি আশীর্বাদিত হয়েছি।’

 ‘আমারও একই রকম অনুভূতি হয়েছে। গতকাল আমি আলমাটিতে মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি জানতে চাইলেন আমি ভালো আছি কিনা এবং যথেষ্ট উপার্জন করছি কিনা। আমি মিথ্যা বললাম। বললাম আমি ভালো আছি, প্যারিসে খুব সফলভাবে একটা নাটকের প্রযোজনা করছি। আমি আজ আমার নিজের লোকজনের কাছে ফেরত যাচ্ছি, মনে হচ্ছে যেন আমি গতকালই এখান থেকে চলে গিয়েছিলাম, যে সময়টা আমি বাইরে কাটিয়েছি তার কোনো গুরুত্ব নেই, এ রকমটি মনে হচ্ছে। আমি ভিখারিদের সাথে কথা বলেছি, গোত্রের সাথে পথে পথে ঘুরেছি, রেস্তোরাঁয় মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে, আমি কী অর্জন করেছি কিছুই না। আমি ডজের মতো নই, ডজ ওর দাদুর কাছ থেকে শিখেছি। আমি শুধু নিজেকে পরিচালিত করেছি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে, এক ধরনের হ্যালুসিনেশনের মধ্যে আছি। সম্ভবত আমার দৃষ্টিপ্রদীপ সত্যিকার অর্থেই এক ধরনের এপিলেপটিক ফিট, এর বেশি কিছু নয়।’

 ‘এক মিনিট আগে আপনি আপনাকে আমার সাথে আনার জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন। আর এখন মনে হচ্ছে আপনাকে এনে শুধু দুঃখ ছাড়া আর কিছু আনতে পারিনি। আপনার এখন কী অনুভূতি হচ্ছে, তা আগে ঠিক করুন।’

 ‘আমার একই সাথে দুরকম অনুভূতি হচ্ছে। আমার কোনো পছন্দ নেই। আমি আবার ভ্রমণে ফিরতে পারি এবং আমার মধ্যের বিপরীতধর্মী সত্তার কথা শুনতে পারি।

 ‘আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই, মিখাইল। আমাকে অনেক বাধা-বিপত্তের মধ্যে ভ্রমণ করতে হয়েছে যখন প্রথম আপনার সাথে দেখা হয়েছে। শুরুতে আমি আপনাকে ঘৃণা করি, তারপর আমি আপনাকে গ্রহণ করি। আমি আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করি, সেই গ্রহণযোগ্যতা সম্মানে পরিণত হয়। আপনি এখনো তরুণ। আপনার মধ্যে যে শূন্যতা, খুবই স্বাভাবিক। আমি জানি না কতজন মানুষকে আপনি এ রকমভাবে আপনার সংস্পর্শে এসেছে, কিন্তু আমি আপনাকে একটা জিনিস বলতে পারি, আপনি আমার জীবন বদলে দিয়েছেন।’

 ‘আপনি শুধু আপনার স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী।

 ‘আমি এখনো তাই করছি, কিন্তু শুধু সেই জন্য আমি কাজাখস্তানের স্টেপসে ভ্রমণ করছি না। আমি আমার গোটা জীবনের অতীতের সাথে ভ্রমণ করছি। আমি দেখতে পেয়েছিলাম আমি কী ভুল করেছি, আমি দেখতে পেয়েছিলাম কোথায় আমাকে থামতে হবে। আমি এসথারকে হারানোর মুহূর্ত দেখতে পেয়েছিলাম, যে সময়টা মেক্সিকান ইন্ডিয়ান একোমোডাডরের কথা বলল। আমি এ রকম কিছু বিষয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, যা আমার জীবনে কোনো দিন করব তা কল্পনাও করিনি। আর এর সব কিছুই হয়েছে আপনি পাশে ছিলেন বলে। আমাকে গাইড করেছেন, যদিও সে সমন্ধে আপনি সচেতন ছিলেন না। আপনি কি আরো বেশি কিছু জানতে চান? আমি বিশ্বাস করি, আপনি কণ্ঠস্বর শুনতে পান এবং শৈশব থেকেই আমার ভেতরে দৃষ্টিপ্রদীপ ছিল। আমি সব সময় অনেক কিছুতে বিশ্বাস করে এসেছি। আর এখন তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি।

 ‘প্রথমে আপনার সাথে যখন দেখা হয়েছিল আর এখন আপনি একই মানুষ নন।’

না, তা নই। আমি আশা করি এসথার সন্তুষ্ট হবে।

তাই কি?

 ‘অবশ্যই।

‘তাহলে এই ব্যাপার। চলুন কিছু খাওয়া যাক। ঝড় থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। তারপর সব ঠিক করা যাবে।’

‘চলুন ঝড়ের মুখোমুখি হওয়া যাক।

না। সব ঠিক আছে। বেশ, আমরা পারি যদি আপনি চান, কিন্তু ঝড় কোনো সাইন নয়। এটা শুধু বালুর সাগরের ওপর একটা ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

*

 ঝড় উঠেছে।

 “এই তো এখানে আপনি যা দেখতে পেয়েছিলেন এখানে…

না, আমার গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে।’

 ‘তো তাহলে এটা কী?’

 ‘একটা জায়গা, যেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবশ্যই ঘটে থাকবে।’

মিখাইল স্যাডল ব্যাগ খুলে একটা ছুরি বের করল। তার শার্টের একটা অংশ কেটে নিল, তারপর গাছের একটা ডালে বেঁধে দিল। ওর চোখের দৃষ্টি বদলে গেছে। ও হয়তো ওর পাশে আমার উপস্থিতি বুঝতে পারছে, কিন্তু আমি কিছু জিজ্ঞেস না করাটাই ভালো মনে করলাম।

আমি ওর উদাহরণ অনুসরণ করলাম। আমি গাছের কাছে রক্ষা এবং সাহায্যের জন্য বললাম। আমিও আমার পাশে ওর উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। আমার স্বপ্ন, ভালোবাসার মানুষটির কাছে ফিরে আসার দীর্ঘ ভ্রমণ।

আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ও আমার কাছে জিজ্ঞেস করেনি আমি কী চেয়েছি, আমিও ওর কাছে জিজ্ঞেস করিনি। পাঁচ মিনিট পরে, আমরা সাদা সাদা বাড়ির একটা ছোট্ট গ্রাম দেখতে পেলাম। একজন মানুষ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। লোকটা মিখাইলের কাছে এল। রাশিয়ান ভাষায় মিখাইলের সাথে কথা বলল। তারা কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর লোকটা চলে গেল।

‘লোকটা কী চায়?’

‘ও চায় আমি ওর বাড়িতে গিয়ে ওর মেয়েকে সুস্থ করে তুলি। নীনা অবশ্যই ওকে বলে থাকবে আমি আজকে এখানে পৌঁছাব। বৃদ্ধ লোকটা এখনো আমার দৃষ্টিশক্তির কথা মনে রেখেছে।’

 মিখাইলকে অনিশ্চিত মনে হলো। চারদিকে আর কেউ নেই। সম্ভবত এটা সবার কাজের সময় অথবা খাওয়াদাওয়ার সময়। আমরা মেইন রোড ক্রস করছিলাম। দেখে মনে হচ্ছিল একটা সাদা বাড়ির চারদিকে বাগান।

মনে আছে আজ সকালে আমি আপনাকে কী বলেছিলাম, মিখাইল। আপনি হয়তো সেই একজন যে এপিলেপটিক হওয়া সত্ত্বেও ডায়াগনসিস করতে অস্বীকার করেছে এবং যে তার অচেতনতাকে নিয়ে একটা গল্প তৈরি করেছে, কিন্তু এটার অর্থ এ রকমটি হতে পারে, এই জগতে আপনার একটা মিশন আছে, লোকজনকে তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে, সত্যিকারের নিষ্পাপ পবিত্র ভালোবাসার মাধ্যমে স্বর্গীয় শক্তিকে উন্মুক্ত করা।

 ‘আমি আপনাকে বুঝতে পারছি না। এত দিন ধরে আমরা একে অপরকে জেনে এসেছি, আপনি কিছুই বলেননি কিন্তু এই মুহূর্তে-এসথারকে খুঁজতে এসে বলছেন। হঠাৎ করে, আজ সকাল থেকে, অন্য কিছুর চেয়ে আপনি আমার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। সম্ভবত, গত রাতে ডজের উপসানা আপনার ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।

 “ওহ, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।

আমি বোঝাতে চাইছি, আমি ভয় পাচ্ছি। পরের কয়েক মিনিটে যা ঘটবে তা বাদে আমি আর সব কিছু নিয়ে চিন্তা করতে চাই। আজ, আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে দ্র মানুষ, কারণ আমি আমার লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে সে ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি। আমার প্রতিক্রিয়া অন্যকে সাহায্যের চেষ্টা করা, ঈশ্বরকে দেখানো আমি একজন ভালো মানুষ, যাতে ঈশ্বরের করুণা আমার ওপর বর্ষিত হয়।

.

মিখাইল উঠে দাঁড়াল এবং আমাকে একই রকম করতে বলল।

অসুস্থ মেয়েটার বাড়িতে যাচ্ছি। আপনি এসথারের সাথে কথা বলার সময় আমি আপনার ঘোড়ার দেখাশোনা করব।’

 গাছপালার মধ্যে ছোট্ট সাদা বাড়িটার দিকে মিখাইল আঙুল তুলে দেখাল।

‘ওখানে।

 নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলাম।

 ‘ওখানে ও কী করছে?

‘আমি আগে যেমনটি বলেছিলাম, এসথার কার্পেট বানানো শিখছে, তার বদলে ও ওদের ফ্রেন্স শেখায়। যাই হোক, কার্পেট বানানো দেখে সহজ মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, অনেক জটিল- ঠিক যেন স্টেপসের মতো। রংগুলো এ রকম গাছ থেকে আসে, যেগুলো সঠিক সময়ে তুলতে হয়, না হলে রং ঠিকঠাক মতো হয় না। তারপর মাটিতে উলগুলো ছড়িয়ে রাখতে হয়, গরম পানিতে মেশাতে হয়, উল ভেজা থাকা অবস্থায় সুতো তৈরি করতে হয়। তারপর, কয়েক দিন পরে, সূর্যের তাপে ওগুলো শুকিয়ে গেলে, সেগুলো গুটি পাকানো শুরু হয়। শেষ সূক্ষ্ম কাজ বাচ্চাদের দ্বারা করা হয়। বয়স্ক হাত এত বড় যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, সবচেয়ে সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি বাচ্চাদের হাতেই ভালো হয়।

 মিখাইল থামল।

‘আর বাচ্চাদের খেলা নিয়ে কোনো কৌতুক করবেন না। এখানকার ঐতিহ্য, তারা সম্মান পেতে পারে।

‘ও কেমন আছে?

 ‘আমি জানি না। ওর সাথে গত ছয় মাসের মধ্যে আমার কোনো কথা হয়নি।

 ‘মিখাইল, এই কার্পেটগুলো আরেকটা সাইন।

 ‘কাপের্টগুলো?”

‘গতকালের কথা আপনার মনে আছে, যখন ডজ আমাকে একটা নাম পছন্দ করতে বলল, আমি আপনাদের একজন যোদ্ধার গল্প শুনিয়েছিলাম, যার ভালোবাসার মানুষের খোঁজে দ্বীপে এসেছিল? দ্বীপটির নাম ইথিকা। মেয়েটির নাম পেনিলোপি। ইউলিসিস চলে যাওয়ার পর থেকে পেনেলোপি কী করেছে বলে আপনি মনে করেন? সুতোর কাজ! সে তার শ্বশুরের ওখানে সুতোর কাজ করেছে, সে একটা সোয়েটার বানিয়েছে। শুধু যখনই তার সোয়েটার বোনার কাজ শেষ হবে সে আবার বিয়ে করতে পারবে। পেনিলোপি যখন ইউলিসিসের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করত, সে প্রতি রাতে তার কাজগুলো খুলে ফেলত এবং পরদিন আবার তা শুরু করত।

 তার ভক্তরা চাইত সে তাদের মধ্যে কাউকে বেছে নিক, কিন্তু সে ভালোবাসার মানুষটার ফিরে আসার স্বপ্ন দেখত। শেষ পর্যন্ত, সে যখন অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত, তখনই ইউলিসিস ফিরে এল।

 ‘শুধু ব্যতিক্রম গ্রামটার নাম ইথিকা নয় এবং এসথারের নাম পেনিলোপি নয়। মিখাইল পুরোপুরি গল্পটা বুঝতে পারেনি। আমি আর ব্যাখ্যা করার মতো ঝামেলায় গেলাম না।

আমি মিখাইলের হাতে আমার ঘোড়াটা বুঝিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি, মাত্র একশ মিটার দূরে সেই মেয়েটি আছে যে আমার স্ত্রী, যে জাহির হতে পারে এবং এক সময় যে সমস্ত মানুষের স্বপ্ন হতে পারে, যারা যুদ্ধ অথবা কাজ থেকে ফিরে এসেছে।

*

আমি অপরিছন্ন। আমার কাপড়চোপড়, মুখমণ্ডল বালিতে ভরা। আমার শরীর ঘামে ভেজা, যদিও এখানে খুব ঠাণ্ডা।

আমার বাহ্যিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত, যদিও পৃথিবীর সবচেয়ে সুপারফিশিয়াল ব্যাপার এই কাপড়চোপড়, যেন মনে হচ্ছে আমি এতটা পথ জার্নি করে শুধু ওকে আমার নতুন পোশাক দেখাতে এসেছি। আমাকে এই একশ মিটার পথ যাওয়ার পথে, এ রকম কিছু ভাবতে হবে, যা ওর ক্ষেত্রে ঘটে যেতে পারে অথবা আমার ক্ষেত্রে? আমার অনুপস্থিতিতে।

আমাদের দেখা হলে আমি কী বলব? আমি প্রায়ই এ জিনিসটা ভাবতাম এবং আমার মধ্য থেকে এ বাক্যমালাই বেরিয়ে আসত : এই মুহূর্তের জন্য আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি।’ অথবা আমি এখন জানি আমার ভুল।’ অথবা “আমি এখানে এসেছি তোমাকে এটা বলার জন্য, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অথবা এমনকি তুমি আগের চেয়ে আরো সুন্দরী হয়েছ।

 আমি শুধু হ্যালো বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেন আমাদের কখনো ছাড়াছাড়ি হয়নি। যেন মাত্র কয়েকটা দিন অতিবাহিত হয়েছে, দুই বছর, নয় মাস, এগারো দিন, এগারো ঘণ্টা নয়।

ওকে বুঝতে হবে আমি বদলে গেছি। ও যেসব জায়গায় ভ্রমণ করেছে আমিও সেসব জায়গায় ভ্রমণ করেছি। সেসব জায়গা সমন্ধে হয়তো আমি কিছুই জানতাম না অথবা আমি হয়তো কখনো আগ্রহী ছিলাম না। আমি একজন ভিখারির হাতে রক্তমাখা কাপড় দেখেছি, দেখেছি তরুণের হাতে, প্যারিসের রেস্তোরাঁয় প্রাপ্তবয়স্কদের হাতে, একজন চিত্রশিল্পীর হাতে, একজন ডাক্তারের হাতে এবং এ রকম একজন তরুণের হাতে, যে ভবিষ্যৎ দেখতে পায় এবং কণ্ঠসস্বর শুনতে পায় বলে দাবি করে। আমি যখন ওর পদচিহ্ন অনুসরণ করছিলাম, আমি জানতাম যে মহিলাকে আমি বিয়ে করেছিলাম তাকে পুনরাবিষ্কার করতে হবে। আমার নিজের জীবনের অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই বদলে গেছে। আমি আবার বদলে দিতে চাই।

আমাদের এত দিন বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও, আমি কখনো আমার স্ত্রীকে সত্যিকারের চিনতে পারিনি। আমি অন্যদের মতো ভালোবাসার গল্প সৃষ্টি করেছি, যেমনটি দেখেছি সিনেমায়, বই আর ম্যাগাজিনে পড়েছি, টিভিতে দেখেছি। আমার গল্পে, গল্প এ রকম জিনিস, যা একটা নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত বেড়ে ওঠে। তারপর থেকে এটাকে বাঁচিয়ে রাখাই ব্যাপার, যেন একটি গাছের চারা, বারবার ওটাকে পানিতে দিতে হয়, মরা পাতা তুলে ফেলতে হয়। ভালোবাসা সব সময় তারুণ্যের প্রতীক। ভালোবাসা হাসি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ অথবা তুমি ঘরে ফিরে এলে আমি খুব খুশি হই’ এই বাক্যে প্রকাশ করা যায়।

কিন্তু আমি যে রকমটি ভাবছি ব্যাপারটা তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। আমি এসথারকে পাগলের মতো ভালোবাসতে পারি। রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার সময়, আমি অন্য পাশে পৌঁছালে, আমার মনে হলো এক ধরনের ফাঁদের মধ্যে থাকার মতো। তারপর আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমি এখন আর ওকে মোটেও ভালোবাসি না। আর যখন ভালোবাসা আগের মতোই আবেগ নিয়ে ফিরে এল, আমার সন্দেহ হতে থাকে। নিজেকে বললাম, আমাকে এই ব্যাপারে অভ্যস্ত হতে হবে।

 সম্ভবত এসথারও একই ভাবনা ভেবে থাকতে পারে। নিজেকে বলতে পারে, ‘বোকার মতো হয়ো না, আমরা সুখী, আমরা বাকি জীবনটা এভাবে কাটিয়ে দিতে পারব। সর্বোপারি, এসথারও একই গল্প পড়েছে, একই সিনেমা দেখেছে, একই টিভি সিরিজ উপভোগ করেছে এবং আর আমাদের মধ্যে কেউ বলেনি ভালোবাসা সুখী সমাপ্তের চেয়ে বেশি কিছু, তাহলে তাকে কেন এখন এ রকম কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে? যদি এসথার প্রতিদিন সকালে বারবার বলে, ও নিজের জীবন নিয়ে সুখী, তাহলে সে এই সন্দেহ নিয়ে শেষ করবে এবং আমাদের চারপাশের সবাইকে তা বিশ্বাস করাবে।

 যাই হোক, এসথার অন্যভাবে ভেবেছিল এবং ভিন্ন রকম কাজ করেছে। ও আমাকে দেখানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি দেখতে পাইনি। আমি ওকে হারিয়ে এটা বুঝতে পেরেছি, কোনো কিছু নতুন করে আবিষ্কার করা সবচেয়ে মধুর জিনিস। এখন আমি এখানে, রাস্তার নিচ দিয়ে একটা ছোট্ট, ঠাণ্ডা, ঘুমন্ত গ্রামে, আবার অনুসরণ করছি শুধু এসথারের কারণে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে হুমকিটা আমার সামনে আছে সব ভালোবাসার গল্পই একই রকম’ এই ধারণা ভেঙে গেছে আমি মোটরবাইকের সাথে দুর্ঘটনা ঘটার পর।

হাসপাতালে ভালোবাসা আমার সাথে কথা বলেছে, “আমিই সব কিছু এবং আমি কিছুই না। আমি বাতাস এবং বন্ধ দরজা জানালা দিয়ে ঢুকতে পারি না। আমিও ভালোবাসাকে বলেছিলাম, কিন্তু আমি তোমার জন্য উন্মুক্ত।

আর ভালোবাসা আমাকে বলেছিল, বাতাস বায়ু দিয়ে তৈরি। তোমার ঘরের ভেতরে যে বাতাস কিন্তু সব কিছু বন্ধ করা। ফার্নিচারগুলো ধুলোর আবরণে ঢাকা, স্যাঁতসেঁতে ভাব পেইন্টিংকে ড্যাম্প করে ফেলছে, দেয়ালের গায়ে নোনা ধরছে। তুমি শ্বাস নিতে পারবে, তুমি আমার খুব ছোট্ট একটা অংশকে জানো, কিন্তু আমি একটা ছোট্ট অংশ মাত্র নই। আমিই সব কিছু। আর তুমি তা কখনো জানবে না।

ফার্নিচারগুলো ধুলোয় ঢাকা দেখতে পেলাম। পেইন্টিংগুলোতে ডাম্প উঠে গেছে। জানালা-দরজা খুলে দেয়া ছাড়া আমার কোনো বিকল্প নেই। আমি তা করতেই বাতাসের প্রবাহ সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি আমার স্মৃতি আঁকড়ে ধরতে চাইলাম, আমি যা অর্জন করেছি তা রক্ষা করতে চাইলাম, কিন্তু সব কিছুই অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি স্টেপসের মতোই শূন্য। স্টেপসের মতোই শূন্য।

আমি এখন বুঝতে পারছি এসথার কেন এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ব্যাপারটা মূল্যবান, কারণ এখানে এই বাতাসের নিচে সব কিছুই শূন্য, যা নতুন জিনিস নিয়ে আসে, আমি এখানে যে শব্দ শুনেছি, যেসব মানুষের সাথে আমি কখনো কথা বলিনি। আমার পুরনো প্রাণশক্তি পুনরুদ্ধার হচ্ছে, কারণ আমি আমার ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। আমার একোমোডাডরকে ধ্বংস করেছি আর আবিষ্কার করেছি একজন মানুষ অন্যর আশীর্বাদের যোগ্য হতে পারে। যেভাবে যাযাবর আর শ্যামনরা তাদের অনুসারীদের আশীর্বাদ করে। আমি আবিষ্কার করেছি, আমি আগের চেয়ে অনেক ভালো আর সামর্থ্যবান হয়েছি। যারা তাদের নিজেদের পথে চলে না, বয়সই কেবল তাদের অগ্রযাত্রাকে ধীর করে দেয়।

 একদিন, একজন মহিলাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য দীর্ঘ তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়লাম। অনেক বছর পরে, সেই একই মহিলা আমাকে আবার বেরিয়ে পড়তে সাহায্য করেছে, এইবার সেই মানুষটাকে খুঁজতে, যে নিজের পথ হারিয়ে ফেলেছে।

এখন আমি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাদে আর সব কিছু নিয়েই ভাবছি। আমি মনে মনে একটা সুর ভেজে চলেছি। আমি বিস্মিত এখানে কোনো গাড়ি পাকিং না থাকায়, আমি লক্ষ করলাম, আমার জুতো ঘষা খাচ্ছে আর আমার হাতঘড়ি এখনো ইউরোপিয়ান সময় অনুযায়ী চলছে।

আর সব কিছুই শুধু একজন মহিলার কারণে, আমার স্ত্রী, আমার গাইড এবং আমার জীবনের ভালোবাস এখন মাত্র কয়েক পা দূরে। বাস্তবতাটা আমি এত দিন পরে মুখোমুখি হওয়ার ভয় পাচ্ছি।

আমি বাড়িটার সামনের দরজায় গিয়ে বসে পড়ল একটা সিগারেট ধরালাম। আমি ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করতে লাগলাম। আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি, কেন এগিয়ে যাব?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। পা কাঁপছিল। ফিরে যাওয়ার কথা বাদ দিয়ে, আমি কাপড়চোপড় হাত-পা-মুখ থেকে যত দূর সম্ভব বালি মুছে ফেললাম। দরজায় হাতল ধরে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

যদিও আমি জানি যে মহিলাকে আমি ভালোবাসি তাকে চিরদিনের জন্য হারাতে পারি, আমার অবশ্যই ঈশ্বর আজকের জন্য যে আশীর্বাদ আর উপহার রেখেছে, তা উপভোগ করা উচিত। গ্রেস ধরে রাখা যায় না। এ রকম কোনো ব্যাংক নেই যেখানে এটাকে ডিপোজিট রেখ পরে শান্তির সময়ে ব্যবহার করা যাবে। আমি যদি পুরোপুরি আশীর্বাদের সদ্ব্যবহার না করতাম, আমি ওদের চিরদিনের জন্য হারাতাম।

ঈশ্বর জানেন আমরা সবাই জীবনের শিল্পী। একদিন, তিনি আমাদের একটা হাতুড়ি দিয়েছিলেন, যা দিয়ে ভাস্কর্য বানানো যায়। আরেক দিন আমাদের হাতে একটা ব্রাশ দিয়ে দিয়ে অঙ্কন করতে বলেছেন, যা দিয়ে ছবি আঁকা যায় অথবা কাগজ-কলম দিয়েছেন, যা দিয়ে আমরা লিখতে পারি। কিন্তু আপনি একটা হাতুড়ি দিয়ে ছবি আঁকতে পারবেন না অথবা ব্রাশ দিয়ে একটা ভাস্কর্য তৈরি করতে। যাই হোক, যতই ব্যাপারটা কঠিন হোক না কেন, আমাকে আজকের আশীর্বাদ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, এমনকি যদিও সেগুলো অভিশাপের মতো মনে হয়, কারণ আমি যন্ত্রণা ভোগ করছি এবং আজ খুব সুন্দর একটা দিন, সূর্য উজ্জ্বল কিরণ ছড়াচ্ছে। বাচ্চারা রাস্তায় গান করছে। আর একমাত্র এই উপায়ে আমি যন্ত্রণাকে পেছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারব।

.

কক্ষটা আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। আমি ভেতরে ঢুকতেই এসথার মুখ তুলে তাকিয়ে হাসল। তারপর মহিলা ও বাচ্চাদের কাছে এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ পড়ে শোনানোটা অব্যহত রাখল। ওরা মেঝেতে বসে আছে, চারদিকে রংবেরঙের ফেব্রিক ছড়ানো। যখনই এসথার থামছিল, তারা শব্দগুলোকে পুনরাবৃত্তি করছিল, তখনো কাজের দিকে নজর ছিল।

 আমার বাকরুদ্ধ হয়ে আসছিল, গলার মধ্যে যেন ব্যাঙ ঢুকে গেছে। আমি কান্না চাপার চেষ্টা করছিলাম। কোনো কিছুই অনুভূত হলো না। আমি দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা অবলোকন করছিলাম। ওর কণ্ঠে আমার শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম, চারদিকে রঙের ছড়াছড়ি। সবাই তারা কী করছে তার দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ।

পারসিয়ান প্রবাদে বলে, ভালোবাসা এ রকম রোগ, কেউ এর থেকে আরোগ্য পেতে চায় না। যাদের এই রোগে ধরে তারা কখনো ভালো হওয়ার চেষ্টা করে না। আর যারা রোগে ভোগে তার ভালো হতে চায় না।

.

এসথার বইটা বন্ধ করল। ভদ্রমহিলাটি এবং বাচ্চারা আমার দিকে তাকাল। আমি আমার এক বন্ধুর সাথে ঘুরতে যাচ্ছি, ও এইমাত্র এসে পৌঁছেছে। ও ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকের মতো ক্লাস শেষ।

 ওরা সবাই হেসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল। এসথার আমার কাছে এসে আমার গালে চুম্বন করল। দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম।

.

হ্যালো আমি বললাম।

আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। এসথার বলল।

আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর কাঁধের ওপর আমার মাথা। আমি কাঁদতে থাকি। ও আমার চুলে আলতো করে আদর করে দিতে থাকে। যেভাবে ও আমাকে ছুঁয়ে আছে তাতে আমি বুঝতে শুরু করি যে আমি কিছুই বুঝতে চাই না। আমি যা মেনে নিতে চাইনি তাই মেনে নিতে শুরু করলাম।

আমি অনেকভাবেই তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। এসথার আমার বাঁধভাঙা কান্না দেখে বলল, একজন বেপরোয়া স্ত্রীর মতো যে জানে তার স্বামী কখনো তার জীবনটা বুঝতে পারেনি। সে কখনো তার কাছে আসবে না। সে কারণে প্লেনে উঠে ফিরে যাওয়া ছাড়া তার কাছে কোনো অপশন নেই। পরের সমস্যার মধ্যে বেঁচে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বারবার ফিরে যাও আর বাঁচো আর ফিরে যাও… বাতাস পড়ে গেছে। ও কী বলছে গাছপালা চুপটি করে শুনছে।

আমি অপেক্ষা করে ছিলাম, যেমনটি পেনিলোপি ইউলিসিসের জন্য অপেক্ষা করে ছিল, রোমিও অপেক্ষা করে ছিল জুলিয়েটের জন্য, বিয়াত্রিস দান্তের জন্য। শূন্য মনে তোমার স্মৃতির জোয়ারে পরিপূর্ণ ছিল, আমরা যে সময়টুকু একত্রে কাটিয়েছি, আমরা একসাথে যেসব দেশ দেখেছি, আমাদের আনন্দ, আমাদের ঝগড়া। তারপর আমি পেছন ফিরে আমার পদচিহ্নের দিকে তাকালাম; কিন্তু তোমাকে দেখতে পেলাম না।

আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম এ রকম পথে এসেছি যেখান থেকে ফেরার পথ নেই। আর সে রকমটি যখন একজনের জীবনে ঘটে, সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। আমি সেই যাযাবরদের কাছে ফিরে গেলাম, যাদের সাথে আমার আগে দেখা হয়েছিল। যাযাবরকে বললাম, অতীত ভুলিয়ে দেয়ার শিক্ষা দিতে। ভালোবাসার সেই জগৎ আমার সামনে উন্মুক্ত করে দিতে, যা সর্বত্র। তার কাছ থেকে আমি টেংগ্রি ঐতিহ্যের ব্যাপারে শিখলাম। একদিন, আমি একদিকের এক ঝলক দেখতে পেলাম। দেখলাম একই রকম ভালোবাসা আরেকজনের চোখের ভেতর প্রতিফলিত হচ্ছে। এ রকম দৃষ্টিকে চিত্রশিল্পীর ভাষায় মুগ্ধ দৃষ্টি বলে। আমি কিছুই বললাম না।

আমি তখনো বেশ ক্ষতবিক্ষত ছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আবার ভালোবাসা সম্ভব। ও আমাকে খুব বেশি কিছু বলেনি। ও আমাকে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলতে শিখিয়েছিল। আমাকে বলেছিল তাদের ভাষায় আকাশকে নীল বলে যখন তা ধূসর থাকে। কারণ তারা জানে, মেঘের ওপারে আকাশ সব সময় নীল। ও আমার হাত ধরে মেঘের ওপারের জগতে নিয়ে গিয়েছিল। ও আমাকে ওকে ভালোবাসার চেয়ে নিজেকে ভালোবাসার ব্যাপারে শিখিয়েছিল। ও দেখিয়েছিল আমার হৃদয় আমার নিজের এবং ঈশ্বরের কাজের জন্য, অন্যর সার্ভিস দেয়ার জন্য নয়।

 ও আমাকে বলেছিল আমার অতীত সব সময় আমার সাথেই থাকে, কিন্তু যতই আমি নিজেকে ঘটনাগুলো থেকে মুক্ত করে আমার আবেগের দিকে মনোযোগ দিতে পারব, ততই আমি বুঝতে পারব যে বর্তমানে সব সময় নতুন করে ভালোবাসা শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য অপেক্ষা করছে আর ততই জীবন আনন্দে ভরে উঠবে।

শেষ পর্যন্ত, ও আমাকে ব্যাখ্যা করল আমাদের জীবনে দুর্দশা নেমে আসে যখন আমরা চাই অন্যরা আমাদের এমনভাবে ভালোবাসবে যেভাবে আমরা তারা ভালোবাসবে বলে কল্পনা করি। যেভাবে ভালোবাসা পরিচালিত হতে চায় সেভাবে আমরা চাই না।

আমি ওর দিকে তাকালাম।

 আর তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?

আমি ভালোবাসতাম।

 তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাসো?

 তুমি কী মনে করো? যদি আমি অন্য কাউকে ভালোবাসতাম আর বলতাম যে তুমি আসছ, তুমি কি মনে করো আমি এখন এখানে থাকতাম?

 না, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি তুমি সারা সকাল ধরে দরজা খুলে আমার জন্য অপেক্ষা করেছ।

তাহলে এ রকম হাস্যকর প্রশ্ন করছ কেন?

 অনিরাপত্তার জন্য, আমি ভাবলাম। কিন্তু ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যজনক যে, ও আবার ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছে।

আমি প্রেগন্যান্ট।

 মুহূর্তের মধ্যে আমার গোটা জগৎ ভেঙে খানখান হয়ে পড়ল।

ডজের দ্বারা?

না, এ রকম কারো দ্বারা, যে এক মুহূর্তের জন্য ছিল, তারপর আবার ছেড়ে গিয়েছিল।

আমি হেসে উঠলাম। যদিও আমার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল।

বেশ, আমার মনে হয় এই এক-ঘোড়া শহরে খুব বেশি কিছু করার নেই। আমি বললাম।

এক-ঘোড়া শহরে খুব কমই কিছু করা যায়। এসথারও হাসতে হাসতে বলল।

 কিন্তু সম্ভবত এখন তোমার প্যারিসে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। পত্রিকা থেকে আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিল আমি জানি কিনা কোথায় তোমাকে পাওয়া যাবে। তারা চায় তুমি আফগানিস্তানের ন্যাটো পেট্রলের ব্যাপারে রিপোর্ট করো; কিন্তু তোমাকে তা না করে দিতে হবে।

কেন?

কারণ তুমি গর্ভবতী! তুমি একজন শিশুকে যুদ্ধের অন্ধকার দিকগুলোর মধ্যে নিতে পারো না নিশ্চয়।

শিশু? তুমি কি মনে করো একজন শিশু আমার কাজ আটকে দিতে পারে? তুমি কি তাই মনে করো? পাশাপাশি, তুমি চিন্তিত হবে কেন? তোমার কোনো কিছুতে সহযোগিতার কিছু নেই।

কনট্রিবিউট করব না? ধন্যবাদ দাও যে তুমি এখানে এসেছিলে। না হলে তা কি গুনতির মধ্যে পড়ত না?

 এসথার তার সাদা পোশাকের পকেট থেকে রক্তমাখা এক টুকরো কাপড় বের করল। আমার হাতে কাপড়ের টুকরোটি দিল। ওর চোখ জলে ভরে গেছে।

 এটা তোমার জন্য। আমি আমাদের তর্কবিতর্ক মিস করি।

আর তারপর, কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ও যোগ করলঃ

মিখাইলকে আরেকটা ঘোড়া আনতে বলো।

আমি ওর কাঁধের ওপর হাত রেখে আশীর্বাদ করলাম, যেভাবে এইমাত্র আমি আশীর্বাদিত হয়েছি।

.

লেখকের সূত্র

আমি জানুয়ারি এবং জুন ২০০৪ এর মধ্যে জাহির লিখেছিলাম। আমি এই সময় আমার নিজের তীর্থ তৈরি করছিলাম। বইয়ের কিছু অংশ কাজাখস্তানে, আলমাটিতে, প্যারিসের রাস্তায়, আমস্টাডার্ম, স্পেন ও মাদ্রিদে বসে লিখেছি। আমার ফরাসী প্রকাশক, অ্যানকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, ও বইতে ফরাসী আইনের সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য পরীক্ষা করে দিয়েছে।

 আমি টম উলফের দ্য বনফায়ার অব ভ্যানিটিজ বইতে প্রথম ফেভার ব্যাংক সমন্ধে পড়েছিলাম। হ্যাঁন্স ও ফ্রিটজ এর সম্বন্ধে ড্যানিয়েল কুইনের ইসমেল বইয়ের একটি গল্পের ভিত্তিতে লেখা। প্যারিসের বেশীরভাগ উপজাতি অল্পবয়স্ক জনগণের মধ্যে যেমন দলে অন্তর্ভুক্ত, সে সমন্ধে ইন্টারনেটে তাদের আর্টিকেল পড়ে জেনেছি।

 গল্পের প্রধান চরিত্র যে লাইনগুলো শৈশবকালে শিখেছিল, তা হাসপাতালে থাকাকালীন মনে আসে (অবাঞ্ছিত অতিথী হিসেবে… ব্রাজিলীয় কবি ম্যানুয়েল ব্যানার এর কবিতা কনসুয়াডা থেকে নেয়া হয়েছে। মেরীর কিছু কিছু মন্তব্য সুইডিশ অভিনেত্রীর কথোপকথন থেকে ধার করা।

 আমার দুবন্ধু, দিমিত্রি ভস্কয়বয়নিকভ এবং ইভজেনিয়া ডটসকের কারণে কাজাখস্তানে ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল।

 আলমাটিতে, আমার সাথে ইমাঙ্গালি তাসমাগাবেটভের সাথে দেখা হয়েছিল, যার দ্য সেঞ্চুরী অব দ্য গ্রেট স্টেপস ও কাজাখস্তান সমন্ধে অন্যান্য লেখা আমার খুব উপকারে এসেছে। আমি সেই সাথে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নাজারবায়েভকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, আমাকে এর সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে নিউক্লিয়ার টেস্ট বন্ধ রাখার জন্য।

অবশেষে, আমি আমার তিনজন শুভাকাঙ্খী কায়সার আলিমকুলভ, ডস এবং মেরী নিমিরভস্কয়ার কাছে স্টেপসে এরকম জাদুকরী ভ্রমণের জন্য চিরঋণী। মেরী প্রথমে আমার দোভাষী থাকলেও পরে খুব ভাল বন্ধুতে পরিণত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *