৩. আরিয়াডেনস থ্রেড

আরিয়াডেনস থ্রেড

আমি ছোট্ট একটা গ্রামে জন্মেছিলাম। বড় গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। বড়গ্রামে একটা স্কুল ও মিউজিয়াম ছিল। স্কুল আর মিউজিয়াম একজন কবির নামে উৎসর্গ করা, যিনি অনেক আগে ওই গ্রামে বাস করতেন। আমার বাবার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর। মায়ের পঁচিশ। বাবা কার্পেট বিক্রির সময় মায়ের সাথে দেখা হয়। বাবা রাশিয়া থেকে এতটা পথ এসেছিলেন। কিন্তু মায়ের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি মায়ের জন্য সব কিছু ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মা বাবার মেয়ের ভূমিকা নিতে পারত কিন্তু মা অনেক বেশি বাবার মায়ের মতো আচরণ করতে লাগলেন। এমনকি বাবাকে ঘুম পাড়াতে সাহায্য করতেন। বাবা সতেরো বছর বয়স থেকে এই জাতীয় সমস্যায় ভুগছিলেন। তাকে স্টালিনগ্রাদে জার্মানদের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম দীর্ঘ সময়ের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তিন হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র তিনজন বেঁচে ছিল।

.

অদ্ভুতভাবে, মিখাইল এই গল্প বলার সময় বর্তমানকাল ব্যবহার করছিল। ও বলছিল না আমি জন্মেছিলাম, তার বদলে আমি জন্মেছি যেন সব কিছুই এখন এই মুহূর্তে ঘটছে।

.

স্টালিনগ্রাদে, আমার বাবা আর বাবার প্রিয় বন্ধু ধরা পড়ে যান। তারা। নিজেদের রক্ষা করতে বোম শেলের গর্তের মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। দুদিন কাদামাটির মধ্যে লুকিয়ে থাকেন। সেখান না ছিল কোনো খাবার, না উষ্ণ রাখার মতো কোনো কিছু। অন্য রাশিয়ানরা কাছাকাছি কোনো ভবনে কথা বলছে তারা শুনতে পেত, বুঝতে পারত তাদের অবশ্যই ওদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা উচিত, কিন্তু গোলাগুলি কখনো বন্ধ হতো না, রক্তের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ছিল, আহতরা রাত-দিন সাহায্যের জন্য চিৎকার করে কাতরাত। হঠাৎ করে, সব কিছু নিস্তব্দ হয়ে গেল। বাবার বন্ধু ভাবছিলেন জার্মানরা বোধ হয় চলে গেছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বাবা তার পা ধরে টেনে বসানোর চেষ্টা করলেন। চিৎকার করে উঠলেন, বসে পড়ো! কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটা গুলি বাবার বন্ধুর খুলি বিদ্ধ করেছে।

আরো দুটো দিন কেটে গেল। বাবা একা। পাশে বন্ধুর মৃতদেহ। তিনি তখনো চিৎকার থামাতে পারছিলেন না, বসে পড়ো অবশেষে, কেউ একজন বাবাকে উদ্ধার করে কাছের ভবনে নিয়ে যায়। ওখানে কোনো খাবার ছিল না। শুধু গোলাগুলি আর সিগারেট। ওরা তামাক খেত। এক সপ্তাহ পরে, ওরা মৃতদেহের মাংস খেতে শুরু করল, বরফ হয়ে যাওয়া সাথীদের মাংস। তৃতীয় ব্যাটালিয়ান সৈন্য এসে গেল। তাদের খুঁজে পেল। বেঁচে যাওয়ার উদ্ধার পেল। আহতদের চিকিৎসা দিয়ে আবার তৎক্ষণাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হলো। স্টালিনগ্রাদকে কোনোমতে দখল হতে দেয়া যাবে না। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ এর ওপর নির্ভর করছে। চার মাস একটানা যুদ্ধের পর, নরমাংসভোজন, হাত-পা হারানোর পর, জার্মানরা শেষ পর্যন্ত আত্মসর্মপণ করল। হিটলার আর তার থার্ড রাইখের পতন হলো। আমার বাবা হেঁটে গ্রামে ফিরে এলেন। স্টালিনগ্রাদ থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটারের পথ। তিনি এখন ঘুমাতে পারেন না। একটুখানি ঘুমে চোখ বুজে এলে, সেই বন্ধুর স্বপ্ন দেখেন, যাকে তিনি বাঁচাতে পারতেন।

দুই বছর পরে, যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। বাবা একটা মেডেল পান, কিন্তু কোনো চাকরি পান না। তিনি কমেমোরাশনের সার্ভিসে অংশ নেন, কিন্তু এর পরও তাকে প্রায় না খেয়েই থাকতে হয়। তাকে স্টালিনগ্রাদের একজন বীরের মর্যাদা দেয়া হয়, কিন্তু উটকো কাজ করেই তাকে জীবন কাটাতে হয়। শেষ পর্যন্ত, কেউ একজন তাকে কার্পেট বিক্রি করার কাজ দেন। ইনসমনিয়ায় ভোগার কারণে, বাবা সারা রাত ভ্রমণ করাটা পছন্দ করতেন, তিনি স্মাগলরাদের জানতে পারলেন, তাদের আত্মবিশ্বাস অর্জন করলেন, টাকা-পয়সা রোজগার করা শুরু করলেন। তিনি কমিউনিস্ট সরকারের হাতে ধরা পড়লেন। তারা তাকে ক্রিমিনাল হিসেবে সাব্যস্ত করল। একজন যুদ্ধের নায়ক হওয়া সত্ত্বেও তাকে পরবর্তী দশ বছর সাইবেরিয়ায় জনগণের বিশ্বাসঘাতক পদবি দিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হলো। শেষ পর্যন্ত যখন ছাড়া পেলেন তত দিনে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, আর একমাত্র কার্পেটের ব্যাপারেই কিছুটা জানেন। তিনি কোনোমতে তার পুরনো যোগাযোগগুলো জোগাড় করলেন। একজন তাকে কিছু কার্পেট বিক্রি করতে দিল। কিন্তু কেউ কিনতে আগ্রহী নয়। সময় বদলে গেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বহুদূর চলে যাবেন, তিনি যাত্রা শুরু করলেন, কাজাখস্তানে গিয়ে যাত্রা শেষ হলো।

তিনি বৃদ্ধ এবং একাকী, কিন্তু খাওয়ার জন্য কাজের দরকার। দিনের বেলায় উটকো কাজ করে কাটান, আর রাতের বেলায় দুঃস্বপ্ন দেখে বসে পড়ো! বলে জেগে ওঠেন। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও, ইনসমনিয়া, খাবারের আকাল, হতাশা, শারীরিক চুতি বিচ্যুতি, ধূমপান, এসব সত্ত্বেও তার শরীরটা ছিল লোহার মতো।

 ছোট্ট গ্রামে, একজন তরুণীর সাথে বাবার দেখা হয়। মেয়েটি বাবা-মায়ের সাথে থাকে। তরুণী বাবাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। সেই অঞ্চলে আতিথেয়তার উচ্চমূল্য ছিল। তারা বাবাকে লিভিংরুমে ঘুমাতে দিল। কিন্তু তিনি চিৎকার দিয়ে জেগে উঠলেন। মেয়েটি বাবার কাছে গেল, প্রার্থনা করল, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, আর কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম তিনি শান্তিতে ঘুমালেন।

পরের দিন, তরুণীটি বলল, যখন সে বালিকা ছিল, স্বপ্ন দেখত একজন বৃদ্ধ মানুষ তার সন্তানের পিতা। সে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে, অনেক বৃদ্ধই তার জীবনে এসেছে; কিন্তু সে হতাশ হয়েছে। বাবা-মা বিয়ে না হওয়া নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। তারা চায় না তাদের একমাত্র মেয়ে সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে যাজিকার জীবনযাপন করুক।

সে বাবাকে জিজ্ঞেস করল তাকে বিয়ে করবে কিনা। বাবা নিজের দিকে তাকালেন, মেয়েটা বয়সে এত ছোট যে তার নাতনি হতে পারত। তো তিনি কিছুই বললেন না। সূর্যাস্তের সময়, ছোট্ট লিভিংরুমে, মেয়েটি জিজ্ঞেস করল ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে কিনা। বাবা আরেক রাত শান্তিতে ঘুমালেন।

 পরের দিন, বিয়ের ব্যাপারটা আবার চলে এল। এবার বাবা-মায়ের সামনে। তারা বেশ খুশি হলো, তারা শুধু চায় মেয়ে একজন স্বামী খুঁজে নিক এবং পরিবারকে লজ্জার হাত থেকে মুক্তি দিক। তারা বৃদ্ধের ব্যাপারে একটা গল্প তৈরি করল। বৃদ্ধ বহুদূর থেকে এসেছে, খুব ধনী কার্পেট ব্যবসায়ী, কিন্তু জীবনটাকে বিলাসিতা আর ভোগবাদের মধ্যে কাটাতে চায় না। তার বদলে অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বেড়ায়। লোকজন খুব প্রভাবিত হলো। তারা খুব ভালো যৌতুকের ব্যাপারে কল্পনা করল। বিশাল ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কথা ভাবল। আমার মা কত ভাগ্যবতী যে এ রকম একজন লোককে খুঁজে পেয়েছে, যে এই ধাধধেড়ে গ্রাম থেকে নিয়ে যাবে। আমার বাবা এই গল্প বেশ মজা আর বিস্ময় নিয়ে শুনতে লাগলেন। তিনি বিগত দিনের কথা ভাবছিলেন। সারা জীবন একা কাটিয়েছেন, ভ্রমণ করেছেন, দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন, কখনো নিজের পরিবার বলে কিছু ছিল না। তিনি প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেন। অতীতের জীবনকে মিথ্যে ভেবে মুসলিম রীতিনীতি অনুযায়ী বিয়ে করলেন। দুই মাস পরে, মা গর্ভবতী হলেন। আমি মায়ের পেটে।

সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমি বাবার সাথে কাটালাম। তিনি খুব ভালো ঘুমাতেন, মাঠে কাজ করতেন, শিকারে যেতেন। অন্য গ্রামবাসীর সাথে তার কল্পিত টাকা-পয়সা আর জমাজমির গল্প করতেন। তিনি এ রকমভাবে আমার মায়ের দেখাশোনা করতেন, যেন জগতের একমাত্র ভালো জিনিস তার জীবনে ঘটেছে। আমি এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগলাম যে আমি একজন ধনীর পুত্র। কিন্তু এক রাতে, আগুনের পাশে, তিনি তার অতীতের কথা আমাকে বললেন এবং কেন তিনি বিয়ে করেছেন, কিন্তু তিনি কাউকে এই গল্প যাতে না বলি তা করুণা ভিক্ষা চাইলেন। খুব শিগগিরই, তিনি বলতেন, তিনি মারা যাবেন। চার মাস পরে তিনি আমার মায়ের কোলের মধ্যে হাসতে হাসতে মারা গেলেন, যেন কখনো কোনো দুঃখ তাকে স্পর্শ করেনি। তিনি একজন সুখী মানুষ হিসেবে মারা গেলেন।

.

বসন্তের হিম হিম রাতে বসে মিখাইল এই গল্প করছিল। যদিও স্টালিনগ্রাদের মতো ও রকম ঠাণ্ডা নয়, ওখানে তাপমাত্রা মাইনাস পঁয়ত্রিশ ডিগ্রিতে নেমে আসে। আমরা কয়েকজন ভিখারির পাশে বসে। ভিখারিরা আগুন জ্বেলে নিজেদের গরম করছে। মিখাইলের দ্বিতীয় ফোন কল পেয়ে আমি ওখানে গিয়েছি। আমাকে প্রতিজ্ঞা রাখতে বলেছে। আমাদের কথোপকথনের সময়, ও একবারও আমার অ্যাপার্টমেন্টে রেখে আসা ওর এনভেলাপের কথা উল্লেখ করেনি। যেন ও ওই কণ্ঠস্বরের মধ্যে তা জেনেছে, আমি সাইন অনুসরণ করে সময়মতো সব কিছু ঘটতে দেব আর জাহিরের শক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আসব।

 মিখাইল আমাকে ফোন করে প্যারিসের সবচেয়ে বিপজ্জনক অঞ্চলে আসতে বললে, আমার প্রথম অভিব্যক্তি সতর্ক সংকেতের মতো ছিল। সাধারণভাবে, আমি ওকে বলতে পারতাম আমি খুবই ব্যস্ত আর ওকে কোনো একটা আরামদায়ক বারে দেখা করার জন্য প্রভাবিত করতে পারতাম, যেখানে আমরা নিরাপদে বসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আলোচনা করতে পারি। আমি এখনো ভয়ে ছিলাম হয়তো পাবলিক প্লেসে আবার ওর এপেলেপটিক ফিট হতে পারে। যদিও আমি জানি কী করতে হবে; কিন্তু অর্থোপেডিক কলার পরে ও রকম অবস্থায় কোনো কিছু করা খুব জটিল ব্যাপার।

মিখাইল জোর দিল, ভিখারিদের ওখানেই দেখা করতে হবে, ওরা তার জীবনের অংশ, যেমনটি এসথারেরও। আমি বুঝতে পারলাম, আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম তখন কিছু একটা ভুল আমার জীবনে ঘটে গেছে। গুরুতরভাবে বদল ঘটেছে। কীভাবে এই পরিবর্তন এসেছে? সম্পূর্ণ ভিন্নতর কিছু, উদাহরণস্বরূপ, বিপদজনক জায়গায় গিয়ে সমাজ বিতাড়িতদের সাথে দেখা করেছি।

 গ্রিক দেবতার একটা গল্প আছে। থেসাস। একটা দৈত্যকে হত্যা করতে যে গোলকধাঁধায় ঢুকেছিল। তার প্রিয়তমা, আরিয়াডন, তাকে একটা সুতোর একপ্রান্ত ধরিয়ে দিয়েছিল, যাতে এই সুতো ধরে সে এগিয়ে গিয়ে আবার সুতো ধরেই ফিরে আসতে পারে। এই লোকগুলোর সাথে বসে, মিখাইলের গল্প শুনে, আমার কাছে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে এই জাতীয় কোনোকিছুর কোন অভিজ্ঞতা আমার হয়নি- স্বাদটা অনাস্বাদিত অ্যাডভেঞ্চার। কে জানে, সম্ভবত আরিয়াডনের সুতো আমার জন্য অপেক্ষা করছে, এই জাতীয় জায়গায় আমি কখনো স্বাভাবিকভাবে আসতাম না অথবা আমার গল্প আর জীবন বদলে গেছে বলেই এমনটি হয়েছে।

মিখাইল গল্প বলে চলল। আমি দেখতে পেলাম গোটা দল খুব মনোযোগ দিয়ে ওর গল্প শুনছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস অভিজাত টেবিলে উষ্ণ রেস্তোরাঁয় ঘটে না।

.

প্রতিদিন, আমি ঘণ্টাখানেক হেঁটে পাশের গ্রামে স্কুলে যেতাম। আমি দেখতে পেতাম মহিলারা পানি আনতে যাচ্ছে, অসংখ্য সিঁড়ি, রাশিয়ান সৈন্যরা বরফ আবৃত পাহাড়ে চড়ার জন্য এই সিঁড়ির ধাপগুলো বানিয়েছিল। যে গ্রামে আমি প্রতিদিন যেতাম ওখানে একজন কবিকে উৎসর্গ করে একটা মিউজিয়াম ছিল। একটা মসজিদ, একটা স্কুল এবং তিনটি কি চারটি রাস্তা ছিল। আমরা স্বপ্নের অস্তিত্ব সমন্ধে শিখেছিলাম। আমাদের একটা আর্দশ ছিল। আমাদের অবশ্যই কমিউনিজমের জয়ের জন্য লড়াই করা উচিত। উচিত সমস্ত মানুষের মধ্যে সাম্যের সমতা আনা। আমি এই স্বপ্নে বিশ্বাস করতাম না। কারণ এমন কি হতদরিদ্র গ্রামেও ভিন্নতা ছিল। পার্টির প্রতিনিধিরা সবার উপরে ছিল। তারা বড় শহরগুলো ঘুরতে যেত। সুস্বাদু খাবার, বাচ্চাদের জন্য উপহার, দামি কাপড়চোপড়, প্যাকেট এসব নিয়ে ফিরে আসত।

একদিন বিকালে, আমার বাড়ির পথে, বুঝতে পারলাম ঝড়ো হাওয়া বইছে। চারদিকে বাজের আলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আবার জেগে উঠে দেখলাম আমি মাটিতে বসে আছি। আর খুব ছোট্ট সাদা বালিকা, সাদা ড্রেস আর নীল বেল্ট পরা, আমার সামনে বাতাসে ভাসছে। মেয়েটি হাসল কিন্তু কিছুই বলছিল না। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম। মায়ের কাজে বাধা দিলাম। আমি যা দেখেছি। তা বললাম। মা ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন আমি যা বলেছি তা যেন আর কখনো না বলি। তিনি আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন একজন আট বছর বয়সী বালকের কাছে যতটুকু ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাপারটা শুধু এক ধরনের হ্যালুসিনেশন। মাকে বললাম, আমি সত্যিই মেয়েটাকে দেখেছি, আমি ওর প্রতিটি ব্যাপারে বর্ণনা দিতে পারি। আমি এও যোগ করলাম, আমি ভয় পাইনি। আমি ছুটে চলে এসেছি, কারণ কী ঘটেছে মাকে তা জানাতে চেয়েছি। পরদিন, আমি স্কুল থেকে ফিরে, মেয়েটির খোঁজ করলাম। কিন্তু মেয়েটি ওখানে ছিল না। গোটা সপ্তাহ জুড়ে কিছু ঘটেনি। আমি ভাবতে শুরু করলাম, সম্ভবত মায়ের কথাই ঠিক : আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম।

তারপর, এইবার খুব সকালে, আমার স্কুলে যাওয়ার পথে, আবার মেয়েটিকে বাতাসে ভাসতে দেখলাম। এবার ওর চারদিকে সাদা আলো ছিল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম না বা কোনো রকম ফ্লাশলাইট দেখতে পেলাম না। আমরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলাম, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, আমিও ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না। স্কুলে এসে ক্লাসমেটদের জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কোনো ভাসমান মেয়েকে দেখেছে কিনা। ওরা সবাই হেসে উঠল।

 ক্লাসের সময়ে, হেডমাস্টারের অফিস থেকে আমার ডাক পড়ল। তিনি আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন, আমার অবশ্যই কোনো মানসিক সমস্যা আছে- এ রকম কোনো দৃশমান জিনিস নয়। আমরা চারদিকে যা দেখি, তাই আমাদের বাস্তবতা। ধর্ম মানুষকে বোকা বানানোর জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে। আমি শহরের মসজিদ সমন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, শুধু বৃদ্ধ এবং কুসংস্কারাচ্ছন্নরাই ওখানে যায়। অজ্ঞ, বোকা, অলস, যেসব মানুষ শক্তিকে পুনরুদ্ধার করতে চায়, তারাই ধর্ম বিশ্বাস করে। তারপর তিনি আমাকে হুমকি দিলেন : আমি যদি ছোট্ট মেয়েটার গল্প আবার বলি, আমাকে বহিষ্কার করা হবে। আমি হেডস্যারকে বললাম, আমার মাকে কোনো কিছু না জানাতে, তিনি একমত হলেন। আমি ক্লাসমেটদের বললাম, গোটা গল্পটা বানিয়েছি।

হেডস্যার প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রাখলাম। আমার বন্ধুরা আর এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাল না। এমনকি আমাকে বললও না যেখানে আমি মেয়েটাকে দেখেছিলাম সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিতে। যাই হোক, সারা মাসে মেয়েটা কয়েকবার আমাকে দেখা দিল। মাঝে মাঝে আমি অজ্ঞান হতে পড়তাম, মাঝে মাঝে ঠিক থাকতাম। আমরা কখনো কথা বলতাম না। ও যতক্ষণ থাকতে চাইত আমরা একসাথে থাকতাম। মা চিন্তিত হতে শুরু করলেন, কারণ আমি বিভিন্ন সময়ে বাড়িতে আসতাম।

 এক রাতে, মা জোর করতে লাগলেন, আমি স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে ফেরার পথের সময়টুকুতে কী করি। আমি আবার মাকে সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা বললাম।

আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে, আমাকে বকা দেয়ার বদলে, তিনি বললেন, আমার সাথে ওই জায়গায় যাবেন। পরের দিন, আমরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম, আমরা যখন ওখানে গেলাম, মেয়েটা এসে গেছে। কিন্তু মা ওকে দেখতে পেলেন না। আমার বাবা সমন্ধে মেয়েটার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করতে বললেন। আমি প্রশ্নটা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তার অনুরোধ মতো আমি প্রশ্নটা করলাম। সেই প্রথমবার আমি মেয়েটার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মেয়েটার ঠোঁট নাড়েনি, কিন্তু আমি জানি ও আমার সাথে কথা বলেছে। ও বলল, আমার বাবা ভালো আছে এবং আমাদের সবাইকে দেখছে। দুনিয়ার তার সব দুঃখ-কষ্টের পুরস্কার ভোগ করছে। ও উপদেশ দিল, আমি যেন মাকে হিটারের ব্যাপারে মনে করিয়ে দেই। আমি তেমনটি করলাম। মা কাঁদতে শুরু করলেন। ব্যাখ্যা করে জানালেন, যুদ্ধের সময় অনেক কষ্টের মধ্যে বাবা একটা হিটারের পাশে বসে থাকাটা উপভোগ করতেন। মেয়েটি বলল, পরেরবার মা যখন এই পথ দিয়ে যাবেন তখন যেন একটা ফেব্রিকের টুকরো ছোট্ট গাছটাতে বেঁধে দিয়ে প্রার্থনা করেন।

মেয়েটা সারা বছর ধরে আমার সাথে দেখা দিতে লাগল। মা তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে ব্যাপারটা জানালেন। তারা অন্য বন্ধুদের জানাল। শিগগিরই গাছটা কাপড়ের টুকরোয় ভরে উঠল। সব কিছুই খুবই পবিত্রতার সাথে করা হতো। মহিলাটি ভালোবাসার মানুষটির কথা জিজ্ঞেস করল, যে মারা গেছে। আমি কণ্ঠস্বরের উত্তর শুনতে পেলাম। মেসেজটা মহিলাটিকে বললাম। সাধারণভাবেই, তাদের ভালোবাসার মানুষটি ভালো আছে। মাঝে মাঝে দু একবার, মেয়েটি দলবদ্ধভাবে নিকটস্থ পাহাড়ে গিয়ে সূর্যোদয়ের সময়ে নীরবতার মাধ্যমে আত্মাদের জন্য প্রার্থনা করতে বলে। আপাতদৃষ্টিতে, আমি মাঝে মাঝে মোহাবস্থায় চলে যাই। মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, মুখ দিয়ে অনর্থক কথা বের হয়, কিন্তু আমি কখনো এ ব্যাপারে কিছু মনে করতে পারি না। শুধু জানি, যখন মোহাবস্থায় চলে যাই, আমি একটা গরম হাওয়ার পরশ বুঝতে পারি। আমার চারদিকের বুদবুদের মধ্যে আলোর ঝলকানি।

 একদিন, আমি যখন ওই ছোট্ট মেয়েটার কথা একটা দলের কাছে বলছিলাম, আমরা পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত হলাম। মহিলাটি প্রতিবাদ করল, চিৎকার দিয়ে উঠল। আমরা পালিয়ে যেতে পারলাম না। আমাকে এসকর্ট করে স্কুলে আনা হলো। হেডমাস্টার জানালেন, আমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কারণ আমি বিদ্রোহ উসকে দিয়েছি এবং কুসংস্কার বাড়িয়ে দিয়েছি। ফেরার পথে, আমি দেখতে পেলাম গাছটাকে কেটে ফেলা হয়েছে, ফিতাগুলো এলোমেলো হয়ে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে। আমি একাকী বসে কাঁদতে থাকলাম। কারণ ওইদিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন ছিল। সেই মুহূর্তে মেয়েটা উদয় হলো। ও আমাকে চিন্তা করতে নিষেধ করল। সব কিছুই পরিকল্পনার অংশ। এমনকি গাছটা কেটে ফেলাও তার অংশ। এখন ও বাকি দিনগুলোতে আমার সঙ্গী হয়ে আমাকে অবশ্যই কী করতে হবে তা বলে দেবে।

.

ও কি কখনো তোমাকে ওর নাম বলেনি? একজন ভিখারি জিজ্ঞেস করল।

কখনোই না। কিন্তু ওটা কোনো ব্যাপার নয়, কারণ আমি সব সময় জানি ও কখন আমার সাথে কথা বলে।

আমরা কি আমাদের মরণের ব্যাপারে কোনো কিছু জানতে পারি?

না। ব্যাপারটা ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে। এখন আমার মিশন ভিন্ন। আমি কি আমার গল্প চালিয়ে যেতে পারি?

অবশ্যই। আমি বললাম, কিন্তু আমি কি শুধু একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারি? দক্ষিণ ফ্রান্সে লোড্রেস নামে একটা শহর আছে। অনেক দিন আগে, একজন মেষপালিকা একজন ছোট্ট মেয়েকে দেখেছিল, যাকে তোমার দৃশ্যমান মনে হয়।

 না, আপনি ভুল বলছেন। একজন বৃদ্ধ ভিখারি বলল। ভিখারির এক পা কৃত্রিম। সেই মেষপালিকা, যার নাম বার্নাডেট, কুমারী মেরিকে দেখেছিল।

আমি ওর ভিশন নিয়ে একটা বই লিখেছি। আমি ওই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি। আমি বললাম, এ ব্যাপারে যা কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সব পড়েছি আমি। উনিশ শতকের শেষ দিকের ঘটনা। বার্নাডেটের পুলিশ এবং বিজ্ঞজনের কাছে দেয়া অনেক স্বীকারোক্তি পড়েছি। কোথাও সে বলেনি সে একজন মহিলাকে দেখেছে। সে জোর দিয়েই একজন বালিকার কথা বলেছে। ও সারা জীবন এই গল্পের পুনরাবৃত্তি করে গেছে। বেশ রেগেই গিয়েছিল তার ভিশন নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য। বলেছে তার ভিশনের সাথে তা মেলে না। কারণ সে একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখেছিল, একজন মহিলাকে নয়। শুধু তা-ই নয়, গির্জা গল্পটাকে প্রশংসা করেছে, তার ভিশনের ছোট্ট বালিকার জায়গায় যিশুর মায়ের ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। সত্যটা সবাই ভুলে গেছে। একটা মিথ্যাকে যদি বারবার বলা হয়, শেষ পর্যন্ত সবাই তা বিশ্বাস করতে শুরু করে। শুধু পার্থক্যাটা হলো, ছোট্ট মেয়েটি বার্নাডেট সব সময় তার নাম বলেছে।

 নামটা কী? মিখাইল জিজ্ঞেস করল।

 আমি একজন ইম্মাকুলেট কনসেপশন। অবশ্যই এ নামটা বিয়াট্রিজ বা মারিয়া অথবা ইসাবেলার মতো নাম নয়। মেয়েটি নিজেকে একটা ঘটনা, একটা অনুষ্ঠান, একটা ভবিতব্য, যাকে মাঝে মাঝে বলা হয়েছে, আমার জন্ম লিঙ্গ ছাড়াই। এখন, দয়া করে আপনি আপনার গল্পটা বলুন।

ও, গল্প বলার আগে, আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি? আরেকজন ভিখারি বলল। লোকটা প্রায় আমারই সমবয়সী।

 আপনি এইমাত্র বললেন আপনি একটা বই লিখেছেন। বইয়ের নাম কী?

আমি অনেক বই লিখেছি।

 তারপর আমি ভিখারিটাকে আমার বইয়ের নাম বললাম, যাতে আমি বার্নাডেটের গল্প লিখেছি।

তো আপনি সেই সাংবাদিকের স্বামী?

আপনি কি এসখারের স্বামী? একজন ভিখারিনী জিজ্ঞেস করল। এক চোখ কানা। অদ্ভুত একটা পোশাক পরেছে। সবুজ হ্যাট এবং বেগুনি কোট।

 কী বলতে হবে আমি বুঝতে পারছিলাম না।

ও এখানে ফিরে আসছে না কেন? কেউ একজন জিজ্ঞেস করল। আমি আশা করছি ও মারা যায়নি। ও সব সময় খুব বিপজ্জনক জায়গায় যায়। আমি সব সময় ওকে বলেছিলাম ও রকম জায়গায় না যেতে। দেখুন ও আমাকে কি দিয়েছে!

আর তারপর ভিখারিনী আমাকে রক্তমাখা কাপড়ের টুকরো দেখাল। মৃত সৈনিকের জামার অংশ।

না, ও মারা যায়নি। আমি বললাম, কিন্তু আমি শুনে বিস্মিত হয়েছি ও এখানে প্রায়ই আসত।

 কেন? আমরা অন্য রকম বলে?

না। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনাদের বিচার করছি না। আমি বিস্মিত হয়েছি। ও এ রকম করত জেনে খুশি হয়েছি।

যাই হোক, ঠাণ্ডা কাটানোর জন্য পান করা ভদকা আমাদের সবার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে লাগল।

এখন আপনি আইরনিক হয়ে যাচ্ছেন। একজন লম্বা চুলের দাড়িওয়ালা ভিখারি বলল। দেখে মনে হচ্ছে কয়েক দিন শেভ করেনি। আপনি যদি মনে করেন এখানে খারাপ সঙ্গে আছেন, তাহলে আপনি চলে যাচ্ছেন না কেন।

আমিও পান করেছিলাম। আমারও সাহসের অভাব ছিল না।

তুমি কে? এইটা কোন ধরনের জীবন? তুমি স্বাস্থ্যবান। তুমি কাজ করতে পারো। কিন্তু তার বদলে তুমি কিছুই করছ না!

আপনি বাইরের জগৎটা বেছে নিয়েছেন। বাইরের জগৎটা চাকচিক্যময়। বাইরের লোকেরা প্রতিনিয়ত কিছু হারানোর ভয় নিয়ে বেঁচে থাকে। যারা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এ রকম ভান করে যেন সব কিছুই খুব ভালো চলছে। প্রকৃতপক্ষে, সব কিছুই খারাপ। খুবই খারাপ! আপনিও কি ভিক্ষা করেন না? আপনি কি আপনার বসের কাছে হাত পাতেন না? অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দেয়ার জন্য বসের কাছ থেকে টাকা নেন না?

জীবনটাকে নষ্ট করার জন্য কি আপনার লজ্জা হয় না? বেগুনি কোট পরিহিত ভিখারিনী জিজ্ঞেস করল।

কে বলেছে আমি জীবনটাকে নষ্ট করছি? আমি যা করতে চাই তা মূল্যয়ানের সাথেই করছি।

দাড়িওয়ালা মানুষটা বাধা দিল।

 আপনি কী চান? জগতের একেবারে প্রথম সারিতে বাস করতে চান? আপনাকে কে বলেছে পর্বত সমতল ভূমির চেয়ে ভাল? আপনি মনে করেন। কীভাবে জীবনযাপন করতে হয় তা আমরা জানি না, তাই না? বেশ, আপনার স্ত্রী ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমরা জীবন থেকে প্রকৃতপক্ষে কী চাই তা আমরা জানি। আপনি কি জানেন আমরা কী চাই? শান্তি! স্বাধীনতা! আর হাল ফ্যাশনের মোহগ্রস্ত হতে চাই না। আমরা এখানে আমাদের নিজেদের ফ্যাশন গড়ে নিয়েছি। আমাদের যখন ইচ্ছা হয় পান করি। যেখানে ইচ্ছা সেখানেই শুয়ে পড়ি! এখানকার একজনও দাসত্বকে বেছে নেয়নি। আমরা সে জন্য গর্বিত। এমনকি আপনি আর আপনার মতো লোকজন ভাবতে পারে আমরা শুধু হতভাগ্য ভিখারি!

কণ্ঠস্বরটা বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে লাগল।

 মিখাইল এগিয়ে এল :

 তোমরা কি আমার বাকি গল্পটুকু শুনতে চাও, না আমরা চলে যাব?

ও আমাদের সমালোচনা করেছে! কৃত্রিম পায়ের মানুষটা বলল, উনি এখানে আমাদের বিচার করতে এসেছেন, যেন উনি একজন ঈশ্বর!

আরো কয়েকজন অভিযোগ করল। কেউ একজন আমার পিঠে চাপড় মারল। আমি আমার সিগারেট ওদের অফার করলাম। একজন এক বোতল ভদকা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। লোকজন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসতে লাগল। আমি তখনো বিস্ময়ের সাথে দেখছিলাম এই লোকগুলো এসথারকে জানত, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমার চেয়ে বেশিই জানত, এসথার আমাকে নয়, ওদের রক্তমাখা জামার টুকরো দিয়েছিল।

মাইকেল ওর গল্প বলে চলল।

 আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। পড়াশোনাও করার ছিল না। ঘোড়া দেখাশোনা করার মতো যথেষ্ট বয়স তখনো আমার হয়নি, যা আমাদের গোত্র এবং দেশের গর্বের বিষয় ছিল। আমি একজন মেষপালক হয়ে গেলাম। প্রথম সপ্তাহে, একটা ভেড়া মারা গেল। গুজব ছড়িয়ে পড়ল, আমি অভিশপ্ত। আমি এ রকম একজনের সন্তান, যে বহুদূর থেকে এসেছিল এবং আমার মাকে প্রতিজ্ঞা করেছিল অনেক ধনসম্পদ, তারপর আমাদের জন্য কিছুই না রেখে মারা গেছে। কমিউনিস্টরা ওদের বলেছিল, ধর্ম শুধু মিথ্যে আশা দেয়ার ব্যাপার, তারা সবাই এই বিশ্বাস লালন করতে শুরু করল যে, শুধু বাস্তবতারই অস্তিত্ব রয়েছে আর আমাদের চোখ যা দেখতে পায় না তা শুধু মানুষের কল্পনার প্রতিফলন। কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্যের সিঁড়িগুলো সে রকমই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেল। বংশপরম্পরায় এড়িয়ে যেতে লাগল।

 এখন গাছ কেটে ফেলার কারণে, আমি আর ছোট্ট মেয়েটাকে দেখতে পাই না। যদিও আমি ওর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। আমি ওকে সাহায্যের জন্য বললাম। ও আমাকে ধৈর্য ধরতে বলল। সামনে কঠিন সময় আসছে। আমি বাইশ বছর পেরনোর আগে অনেক দূর থেকে একজন মহিলা আসবে এবং আমাকে জগৎ দেখাতে নিয়ে যাবে। ও আমাকে এও বলেছিল, আমাকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে ভোলার জন্য একটা মিশন রয়েছে। সেই মিশন হচ্ছে ভালোবাসার সত্যিকারের শক্তি গোটা জগৎ জুড়ে ছড়িয়ে দেয়া।

 গুজবের কারণে ভেড়ার মালিক চিন্তিত হয়ে পড়ল। অদ্ভুতভাবে, লোকজন গুজবটা বিস্তৃত করে আমার জীবনটা ধ্বংসের মুখে ফেলে দিল। বিগত বছরগুলোতে ছোট্ট মেয়েটা যাদের সাহায্য করেছে তারাই আমার ক্ষতি করতে শুরু করল। একদিন, মালিক গ্রামের পাশের কমিউনিস্ট অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ওখানে গিয়ে মালিক আমি ও আমার মা যে জনগণের শত্রু তা বিবেচনায় আনতে বলল। তারপর আমাকে ছাঁটাই করা হয়। ব্যাপারটা আমার জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি, কারণ মা বড় শহরের একটা কম্পানির জন্য এমব্রয়ডারি করা শিখেছিলেন। তারা কেউ জানত না আমরা জনগণের শত্রু। সব ফ্যাক্টরি মালিকই মায়ের এমব্রয়ডারি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত করিয়ে নিতে চাইত।

আমার এখন অফুরন্ত সময়। তো আমি শিকারিদের সাথে ঘুরে বেড়াই। ওরা আমার গল্প জানে। আমার ভেতরে যে জাদুকরী শক্তি আছে, তা বিশ্বাস করে, কারণ আমি আশপাশে থাকলেই তারা সব সময় শিয়াল খুঁজে পায়। আমি সারা দিন কবির মিউজিয়ামে কাটাই, তার সব কিছুই পড়াশোনা করি, তার লেখা বই পড়ি। ওখানে এসে যারা কবিতা আবৃত্তি করে, তা শুনি। প্রায়ই, উষ্ণ বাতাসের প্রবাহ টের পাই, আলো দেখতে পাই আর মাটিতে পড়ে যাই। তারপর কণ্ঠস্বরটা আমাকে অনেক কিছু জানায়- কখন পরবর্তী খরা আসবে, কখন জীবজন্তু অসুস্থ হয়ে পড়বে, কখন ব্যবসায়ীরা হাজির হবে। আমি মাকে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলি না। মা এসব শুনে আমার জন্য আরো বেশি উদ্বিগ্ন আর সতর্ক হয়ে পড়েন।

একদিন, মা আমাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন, যিনি আমাদের এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন। আমার গল্পগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে ডাক্তার নোট নিয়ে নিলেন। অদ্ভুত যন্ত্র দিয়ে আমার চোখের ভেতরে দেখলেন, আমার হৃদস্পন্দন শুনলেন, আমার হাঁটুতে ট্যাপিং করলেন, তারপর তিনি এপেলিপসির একটা ধরন শনাক্ত করলেন। তিনি জানালেন, রোগটা সংক্রামক নয় এবং বয়সের সাথে সাথে চলে যাবে।

আমি জানি এটা কোনো রোগ নয়, কিন্তু মাকে আশ্বস্ত করার জন্য আমি ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করার ভান করলাম। মিউজিয়ামের ডিরেক্টর কষ্ট করে পড়াশোনা করার চেষ্টা দেখে আমার প্রতি সদয় হয়ে আমার শিক্ষক হলেন। তিনি আমাকে ভূগোল ও সাহিত্য শেখালেন এবং এ রকম একটা জিনিস শেখালেন, যা আমার জন্য ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হয়ে দেখা দিল। ইংরেজি। একদিন বিকালে, কণ্ঠস্বরটা আমাকে বলল ডিরেক্টরকে বলতে তিনি যাতে খুব শিগগিরই আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেন। আমি তাকে যখন এ ব্যাপারটা বললাম, তিনি একটু ভীতু হাসি দিয়ে দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখালেন, এ রকমটি হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই, কারণ তিনি শুধু একজন পার্টি মেম্বারই নন, খুব ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

 আমি তখন পনেরো বছরের কিশোর। এই কথোপকথনের দুই মাস পরে, আমি বুঝতে পারলাম এই অঞ্চলে কিছু একটা বদলে যাচ্ছে। খুব রাগী সিভিল অফিসার এসে হঠাৎ করে আমার ওপর সদয় হয়ে জানতে চাইল আমি স্কুলে ফিরে যেতে চাই কিনা। রাশিয়ান সৈন্যদের বিশাল কনভয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে এসেছে। একদিন সন্ধ্যায়, আমি ছোট্ট অফিসে পড়াশোনা করছিলাম, তখন ডিরেক্টর দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন তিনি সতর্ক এবং বিব্রত। তিনি আমাকে বললেন, এ রকম ঘটনা ঘটেছে, যা কোনো দিন ঘটবে তিনি কল্পনা করেননি। কমিউনিস্ট শাসনের পতন হয়েছে। এই মুহূর্তে হয়েছে এবং খুব দ্রুতই এগিয়ে আসছে। আগের সোভিয়েত রাশিয়া স্বাধীন দেশ হতে চলেছে। নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং এই প্রদেশের জন্য সরকার নিয়োগ দেয়া হবে!

 আনন্দের সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরার বদলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি আগে থেকেই তা কীভাবে জানতে পেরেছিলাম। কেউ কি আমার মাথার মধ্যে তা বলে গিয়েছিল? আমি কোনো গোপন গোয়েন্দা সংস্থার সাথে জড়িত। কারণ তিনি পার্টিতে ছিলেন না? অথবা, সবচেয়ে খারাপ যেটা আমার জীবনের কোনো কিছু কি শয়তানের সাথে যুক্ত?

আমি উনাকে মনে করিয়ে দিলাম, উনি আমার গল্পটা জানেন, সেই ছোট্ট মেয়েটি, সেই কণ্ঠস্বর, যা অন্য কেউ শুনতে পায় না। তিনি বললেন, ওটা আমার অসুস্থতার একটা অংশ। একজন মাত্র নবী আছেন, মোহাম্মদ (সা.), আর যা কিছু বলার দরকার তা বলা হয়ে গেছে। তারপর তিনি বলে চললেন শয়তানের শয়তানি সারা দুনিয়াব্যাপী প্রসারিত। সব রকম কৌশলই শয়তান ব্যবহার করে, এমনকি কাউকে ভবিষ্যৎ দেখতে দিয়ে দুর্বলদের প্রতারিত করে। সাধারণ মানুষ সত্যিকারের বিশ্বাস থেকে দূরে সরে যায়। তিনি আমাকে একটা চাকরি দিয়েছিলেন, কারণ ইসলাম দাঁতব্য কাজের জন্য উৎসাহিত করে। কিন্তু তিনি এখন তার জন্য গভীরভাবে দুঃখিত, পরিষ্কারভাবেই আমি হয় গোপন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য অথবা শয়তানের বার্তাবাহক।

 তৎক্ষণাৎ তিনি আমাকে চাকরিচ্যুত করেন।

 জীবন আগে খুব একটা সহজ ছিল না। কিন্তু এখন আরো কঠিন হয়ে গেল। আমার মা যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন, যা আগে সরকারের ছিল তা ব্যক্তি মালিকানায় চলে এল। আর নতুন মালিকের ভিন্নতর ধারণা ছিল। তিনি গোটা ব্যবসাটাকে নতুন করে সাজালেন। মারও চাকরি চলে গেল। দুই মাস পরে, আমাদের জীবনধারণ করার মতো কিছুই ছিল না। আমাদের সামনে শুধু গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়ে কাজ খোঁজার পথ খোলা ছিল।

 আমার নানা-নানি গ্রাম ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। তারা তার চেয়ে নিজ বাসভূমে না খেয়ে মারা যাবেন, তবু গ্রাম ছাড়বেন না। মা আর আমি আলমাটি শহরে গেলাম। এই প্রথম আমি বড় শহর দেখলাম। গাড়ি, বিশাল বিশাল ভবন, নিওন সাইন, এস্কলেটার বিশেষত এলিভেটর দেখে বিস্মিত হলাম। মা একটা দোকানে চাকরি পেলেন। আমি শিক্ষানবিশ মেকানিক হিসেবে একটা গ্যারেজে কাজ পেলাম। কিন্তু এসব করার পরে আমাদের হাতে থাকা-খাওয়া বাদেও অনেক টাকা থেকে যেত। এর আগে আমি কখনো সিনেমা, মেলা অথবা ফুটবল খেলা দেখিনি।

 আমরা শহরে গেলে আমার ওপর ওই অ্যাটাক দূর হয়ে গেল। কিন্তু সেই সাথে সাথেই কণ্ঠস্বর এবং ছোট্ট মেয়েটির উপস্থিতিও হারিয়ে ফেললাম। যেভাবেই হোক ব্যাপারটা ভালো, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। আলমাটি শহরের প্রতি এত মোহ জন্মে গেল এবং জীবনধারণে অর্থ উপার্জনে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে, আট বছর বয়স থেকে যে অদৃশ্য বন্ধু আমার সঙ্গ দিয়েছে তার কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম, হঠাৎ করে আমি অন্য জগতে এসে পড়েছি। তারপর, একদিন রবিবার রাতে, আমি অ্যাপার্টমেন্টের একমাত্র জানালার পাশে বসে আছি, যেটা দিয়ে বাইরে নোংরা গলিপথ দেখা যায়। আমি খুব চিন্তিত ছিলাম, কারণ এর আগের দিন, আমি একটা গাড়ির কাজ করেছি আর তা নিয়ে এত ভীত ছিলাম যে, সারা দিন ঠিকমতো খেতে পারিনি।

 হঠাৎ করে, আমি উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ অনুভব করলাম এবং আলো দেখতে পেলাম। মায়ের বর্ণনা অনুসারে, আমি মেঝের ওপর পড়ে গিয়েছিলাম এবং অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছিলাম। মোহাবিষ্ট অবস্থা অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী ছিল। মনে পড়ে গেল কণ্ঠস্বরটা আমাকে আমার মিশনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সুস্থ হয়ে উঠলেও আবার ছোট্ট মেয়েটির উপস্থিতি অনুভব করতে পারলাম। আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমি ওর সাথে কথা বলতে পারছি।

 বাসা বদলে ফেলা মানে জগৎটাকেও বদলে ফেলা। এ ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। অন্যথায়, আমার মিশনটা কী, তা ওকে জিজ্ঞেস করতাম। কণ্ঠস্বর আমাকে জানিয়েছে, মিশনটা গোটা মানুষ জাতির সাথে ভাগ করে নিতে হবে- জগৎটাকে ভালোবাসার শক্তিতে পরিপূর্ণ করতে হবে। আমি একটা জিনিস ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, আঘাত পাওয়া গাড়ি এবং গাড়ির মালিকের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে। ও আমাকে চিন্তিত হতে বারণ করল। শুধু সত্যিটা বললে মালিক তা বুঝতে পারবে।

 আমি গ্যারেজে আরো পাঁচ বছর কাজ করলাম। আমার বন্ধুবান্ধব তৈরি হলো। প্রথম গার্লফ্রেন্ড্রের সাথে দেখা হলো, যৌনতার ব্যাপারটা আবিষ্কার করলাম, স্ট্রিট ফাইটে জড়িয়ে পড়লাম। সংক্ষেপে, আমি পুরোপুরি একজন উঠতি কিশোরে পরিণত হলাম। এর মধ্যে কয়েকবার মূৰ্ছা গেলাম। প্রথমে আমার বন্ধুরা বিস্মিত হতো, কিন্তু তারপর আমি উচ্চতর শক্তির ব্যাপারে গল্প গড়ে তুললাম। ওরা আমাকে সম্মান দিতে লাগল। ওরা আমার সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগল। ওদের বান্ধবী অথবা পরিবার নিয়ে সমস্যায় পড়লে আমার পরামর্শ নিত। কিন্তু আমি কখনো ওই কণ্ঠস্বরের কাছে উপদেশের জন্য বলিনি- গাছটা কেটে ফেলার ক্ষত এত বছর ধরে আমার মনের মধ্যে এই উপলব্ধি সৃষ্টি করেছে, কাউকে সাহায্য করলে তার প্রতিদানে তুমি শুধু অকৃতজ্ঞতাই পাবে।

আমার বন্ধুরা যদি আরো বেশি চেপে ধরত, আমি ওদের বলতাম, আমি একটা গোপন সোসাইটির সদস্য। কয়েক দশক ধরে কাজাখস্তানে ধর্মীয় চাপ থাকার পরে, রহস্যময়তা এবং এসোটেরিক এখন আলমেটিতে বেশ ফ্যাশনেবল। উচ্চ শক্তির ব্যাপারস্যাপার নিয়ে বই প্রকাশিত হয়। ভারত আর চায়নার গুরু ও শিক্ষকরা আসতে শুরু করে। আত্ম-উন্নয়নের কোর্স চারদিকে প্রচারিত। আমি কয়েকজনের কাছে গিয়েছি, কিন্তু বুঝতে পারলাম আমি কিছুই শিখিনি। একমাত্র ভালোবাসাকেই আমি সত্যিই বিশ্বাস করি। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শোনার মতো সময় আমার নেই।

একদিন, চার চাকার গাড়ি চালিয়ে একজন ভদ্রমহিলা আমার গ্যারেজে এসে থামল। আমাকে টাংক ভরে দিতে বলল। তিনি আমার সাথে ভারী উচ্চারণের রাশিয়ান ভাষায় কথা বলছিল। আমি ইংরেজিতে উত্তর দিলাম। তাকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করল এ রকম কোনো দোভাষীর সন্ধান আমি দিতে পারি কিনা, যে তার সাথে কাজাখস্তানের একেবারে ভেতরে যেতে পারে।

যে মুহূর্তে ভদ্রমহিলা ওই কথা বলছিল, তখনই ছোট্ট মেয়েটির উপস্থিতি গোটা জায়গা ভরে গেল। বুঝতে পারলাম, আমি সারা জীবন ধরে এই মানুষটির জন্য অপেক্ষা করছি। ও আমার বাইরে যাওয়ার পথ। আমার এই সুযোগ হারানো উচিত নয়। আমি মহিলাকে তা বললাম, সে চাইলে, আমি দোভাষী হতে পারি। ও বলল, দেখাই যাচ্ছে আমি এরই মধ্যে একটা চাকরি করছি। পাশাপাশি, তার একজন বয়স্ক, আরো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, তার সাথে ভ্রমণে কোনো বাধা নেই, এ রকম একজন লোকের দরকার। আমি বললাম পাহাড় পর্বত জঙ্গলের প্রতিটি পথই আমার চেনা। আমি মিথ্যা বললাম, জানালাম, আমার এই চাকরিটা টেম্পরারি। আমাকে অন্তত একটিবার সুযোগ দেয়ার জন্য অনুনয় করলাম। শহরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হোটেলে আমার সাথে ও পরে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো।

আমরা লাউঞ্জে দেখা করলাম। আমার ইংরেজির জ্ঞান পরীক্ষা করল। মধ্য এশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে পরপর কয়েকটা প্রশ্ন করল। আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, এসব জানতে চাইল। ও অনেকটা সন্দেহবাতিক। ঠিক কী করে অথবা কোথায় যেতে চায় কিছুই বলল না। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখলাম ও খুব একটা প্রভাবিত হলো না।

আর বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করলাম, কোনো কারণ ছাড়াই আমি ওই মহিলার প্রেমে পড়ে গেছি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে এই অঘটন ঘটে গেল। আমি উদ্বিগ্নতাকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। আমি আবার কণ্ঠস্বরের ওপর বিশ্বাস রাখলাম। ওই অদৃশ্য মেয়ের কাছে সাহায্যের জন্য অনুনয় ভিক্ষা করলাম। আলোকিত করার জন্য বললাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি যদি চাকরিটা পাই, আমার ওপর যে মিশন দেয়া হয়েছে তা চালিয়ে যাব। সে আমাকে বলেছিল একদিন একজন মহিলা আসবে এবং আমাকে বহুদূরে নিয়ে যাবে। মহিলাটি টাংক ভরার সময় মেয়েটি আমার সাথে ছিল, আমি একটা পজেটিভ সাড়া পাচ্ছিলাম।

এসথারের প্রশ্ন পর্বের পর, বুঝতে পারলাম আমি ওর আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে শুরু করেছি। ও আমাকে সতর্ক করল, যা ও করতে চায় তা পুরোপুরি অনৈতিক। ও আমাকে ব্যাখ্যা করল ও একজন সাংবাদিক। আর ও আমেরিকান যুদ্ধ ঘাঁটি তৈরি করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতির ব্যাপার নিয়ে লিখতে চাই। ওর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তো আমাদের হেঁটে পথ চলতে হবে। যেসব জায়গায় গার্ড নেই, সেসব জায়গা দিয়ে বর্ডার পেরোতে হবে। ওর উপরোক্তরা ওকে একটা ম্যাপ দিয়েছে। ওখানে কোথা থেকে বর্ডার পার হওয়া নিরাপদ দেখানো আছে। কিন্তু বলল, আমরা আলমাটি থেকে দূরে সরে না যাওয়া পর্যন্ত ও এর একটিও ব্যবহার করবে না। আমি যদি ওর সাথে যেতে চায়, আমাকে দুই দিনের মধ্যে সকাল এগারোটায় হোটেলে আসতে হবে। আমাকে একটা স্থায়ী চাকরি দেয়ার বদলে ও মাত্র এক সপ্তাহের বেতনের কথা বলল। মা এবং নানা-নানির জন্য উপার্জনের মতো যথেষ্ট উপার্জন ছেড়ে, আমার বস কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটানোর পরও আমাকে বিশ্বাস করে- বস ওটাকে মৃগী রোগ বলেই ডাকে

বিদায় জানানোর আগে মহিলা আমাকে তার নাম বলল- এসথার। আমাকে সতর্ক করে দিল, যদি আমি পুলিশকে গিয়ে তার ব্যাপারে রিপোর্ট করি, ওকে অ্যারেস্ট করা হবে এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হবে। ও অবশ্য এও বলল, জীবনে এ রকম মুহূর্ত আসে যখন ইনটুইশনের ওপর অন্ধবিশ্বাস রাখতে হয়। এখন ও যেমনটি আমার ওপর করছে। আমি ওকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করলাম। কণ্ঠস্বর এবং মেয়েটির উপস্থিতির ব্যাপারে বলতে লোভ সামলাতে পারছিলাম না, কিন্তু চেপে গেলাম। আমি বাড়িতে ফিরে এলাম, মায়ের সাথে কথা বললাম। দোভাষী হিসেবে নতুন চাকরি পাওয়ার কথা বললাম। ভালো বেতন পাব, কিন্তু আমাকে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে হবে। মাকে খুব বেশি চিন্তিত মনে হলো না। আমার চারপাশে যা কিছু ঘটে সব কিছুই পরিকল্পনামাফিক। আমরা শুধু ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করি।

 রাতে ঘুমাতে পারলাম না। পরের দিন অনেক সকালে গ্যারেজে গেলাম। বসকে বিনয়ের সাথে আমার নতুন চাকরির কথা বললাম। বস বলল, আজ হোক কাল হোক, তারা আমার অসুস্থতার কথা জেনে যাবে, সে ক্ষেত্রে এ রকম একটা চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমার মায়ের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল, বসও আমার যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা দিল না। কণ্ঠস্বরটা যেন এই দিনগুলোতে সব মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। আমার প্রথম পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সাহায্য করছে।

এসথার আর আমি হোটেলে দেখা হলে বললাম, আপনি যদি ধরা পড়েন আপনাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হবে কিন্তু আমি ধরা পড়লে আমাকে জেলে যেতে হবে, সম্ভবত কয়েক বছরের জন্য। যেহেতু আমি অনেক বেশি ঝুঁকি নিচ্ছি, আপনি নিশ্চিতভাবে আমার ওপর বিশ্বাস করতে পারেন। আমি কী বলতে চাইছি ও বুঝতে পারল। আমরা দুদিন একনাগাড়ে হাঁটলাম। যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য পাশে একদল পুরুষ ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। ও ওদের সাথে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর হতাশ এবং রাগী ভঙ্গিতে ফিরে এল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পথে। সব রাস্তায় প্রহরা বসানো হয়েছে। স্পাই হিসেবে অ্যারেস্ট হওয়া ছাড়া আর বেশি দূর যাওয়া অসম্ভব।

আমরা ফিরে আসতে শুরু করলাম। আত্মবিশ্বাসী এসথারকে হঠাৎ করে বেশ দুঃখী আর বিভ্রান্ত মনে হলো। ওকে অন্যমনস্ক করতে, আমাদের গ্রামের এক কবির কবিতার লাইন আবৃত্তি করলাম। একই সাথে ভাবতে লাগলাম আটচল্লিশ ঘণ্টার এই অভিজ্ঞতা শেষ হয়ে যাবে। যাই হোক, আমি কণ্ঠস্বরকে বিশ্বাস করতে গুরুত্ব দিলাম। এসথার যত তাড়াতাড়ি এসেছে তত তাড়াতাড়ি যাতে চলে না যায় তার জন্য আমার যা কিছু করার করতে হবে। সম্ভবত আমাকে বোঝাতে হবে আমি সব সময় ওর জন্য অপেক্ষা করব। ও আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সেই রাতে, আমাদের স্লিপিং ব্যাগ পাথরের কাছে গুটিয়ে রাখলাম। আমি বেরিয়ে এসে ওর হাত ধরলাম। ও খুব আলতো করে হাত সরিয়ে নিল। বলল, বিবাহিত। আমি বুঝতে পারলাম, বোকার মতো কাজ করেছি। কিন্তু আমার হারানোর কিছু নেই। আমি শৈশব থেকে দেখা সেই দৃষ্টিপাতের কথা বললাম। গোটা জগতে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ার মিশনের কথা বললাম। ডাক্তারের ইপেলপসি ডায়াগনসিসের কথা বললাম।

আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে, আমি কী বলতে চাইছি তা ও বুঝতে পারল। নিজের জীবনের কথা আমাকে কিছুটা বলল। ও আমাকে বলল ও ওর স্বামীকে ভালোবাসে। ওর স্বামীও ওকে ভালোবাসে। কিন্তু, বিগত দিনগুলোতে সে কিছু হারিয়ে ফেলেছে। এখন স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে চায়। ওর জীবনে সব কিছুই আছে কিন্তু এর পরও ও অসুখী। যদিও ও বাকি জীবন এ রকম ভান করে কাটিয়ে দিতে পারে যে ওর জীবনে সুখের কোনো কমতি নেই। ও এ রকম হতাশায় পড়েছে যেমনটি কখনো বুঝতে পারেনি।

 সে কারণেই ও সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে বেরিয়েছে। এ রকম জিনিসের খোঁজে বেরিয়ে, যা ভালোবাসার ব্যাপারে ভাবার কোনো সময় দেবে না। যাই হোক, যতই সে দেখছে ততই বিভ্রান্ত হচ্ছে। ততই নিজেকে ওর একাকী মনে হয়। ওর মনে হয় পুরোপুরি পথ থেকে হারিয়ে গেছে। একটু আগে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এসেছি তার পর থেকে তার মনে হচ্ছে সে ভুল পথে আছে এবং নিয়মিত রুটিনে ফিরে যেতে চায়।

 আমি উপদেশ দিলাম খুব কাছ থেকে পাহারা না দেয়া পথে চেষ্টা করতে। আমি আলমাটিতে এ রকম স্মাগলারদের চিনি যারা আমাদের সাহায্য করতে পারে। কিন্তু ওকে দেখে মনে হলো আর কোনো উৎসাহ পাচ্ছে না, কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।

সেই মুহূর্তে, কণ্ঠস্বরটা আমাকে বলল, এসথারকে আশীর্বাদ করে পৃথিবীর জন্য উৎসর্গ করতে। কী করছি তা না জেনেই, উঠে দাঁড়ালাম, ওর মাথায় হাত রাখলাম, নিঃশব্দে প্রার্থনা করলাম, শেষে জিজ্ঞেস করলাম, কারণ আমাদের দুজনের জন্যই তা গুরুত্বপূর্ণ। কণ্ঠস্বরটা আমাকে বলল, আমি কথাগুলো উচ্চ স্বরে ওকে শুনিয়ে দিলাম- শুধু একজন মানুষ যদি বদলে যায়, গোটা মানবজীবন বদলে যায়। ও আমাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। আমি বুঝতে পারলাম সারা পৃথিবী ওকে আশীর্বাদ করছে। আমরা কয়েক ঘণ্টা ধরে ওই অবস্থায় থাকলাম।

তারপরে, আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও আমার ওই কণ্ঠস্বরের কথা বিশ্বাস করেছে কিনা? ও জানাল, বিশ্বাস করেছে, আবার করেনি। ও বিশ্বাস করে আমাদের সবারই এ রকম শক্তি আছে, যা আমরা কখনো ব্যবহার করি না। আমি এপেলেপটিক মূৰ্ছার মাধ্যমে সেই শক্তির খুব কাছাকাছি আসতে পারি। কিন্তু এ রকম কিছু আছে, যা আমরা দুজন একসাথে খুঁজে বের করতে পারি। ও আলমাটির উত্তরে বাস করা যাযাবরদের সাক্ষাৎকার নেয়ার চিন্তাভাবনা করছিল। যাযাবররা বলে প্রত্যেকের মধ্যেই জাদুকরী শক্তি আছে। আমি সানন্দে ওকে সঙ্গ দিতে রাজি হলাম। যখন ও আমাকে মানুষটার নাম বলল, বুঝতে পারলাম আমি তার নাতিকে চিনি। খুব সহজেই কাজ হয়ে যাবে।

আমরা আলমাটির দিকে চললাম। ফুয়েল স্টেশনে থেকে টাংকে গ্যাস ভরলাম। খাবার কিনে নিলাম। তারপর সেই ছোট্ট গ্রামের দিকে চালিয়ে গেলাম। সোভিয়েত অঞ্চলের নির্মাণ শৈলীর দ্বারা কৃত্রিম লেকের কাজ চলছে। সেই যাযাবর কোথায় বাস করে আমি খুঁজে বের করলাম। কিন্তু যাযাবরের একজন সহকারীকে আমি তার নাতিকে চিনি তা বলা সত্ত্বেও আমাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হলো। যাযাবরকে সন্তুদের মতো অনেক লোককে উপদেশ দেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।

 শেষ পর্যন্ত, আমরা দেখা করতে পারলাম। এসথারের দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়ে এবং বারবার এসথারের প্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ে, আমি কয়েকটা জিনিস শিখলাম, যা আমার জানা দরকার ছিল।

 এসথার জিজ্ঞেস করল, নোকজন কেন দুঃখী হয়।

 খুব সাধারণ ব্যাপার, বৃদ্ধ বললেন। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত ইতিহাসে বন্দি। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে জীবনের প্রধান লক্ষ্যই একটা পরিকল্পনা অনুসরণ করা। তারা কখনো প্রশ্ন করে না সেই পরিকল্পনা আসলে আরেকজন মানুষের সৃষ্ট। তারা অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, জিনিসপত্র, অন্য লোকের আইডিয়া একত্র করে। সম্ভব হলে সেগুলো ছিনিয়ে নেয়। সে কারণেই তারা তাদের স্বপ্নের ব্যাপারে ভুলে যায়।

এসথার উল্লেখ করল, অনেক মানুষ তাকে বলে, তুমি ভাগ্যবতী, তুমি জানো জীবন থেকে তুমি কী চাও, যেখানে এমনকি আমি জানিও না আমি জীবনের কাছ থেকে কী চাই।

অবশ্যই তারা জানে, যাযাবর উত্তর দিলেন। কত মানুষকে তুমি জানো যারা বলেছে, আমি যা চাই তা কখনো করিনি কিন্তু তারপর, সেটাই জীবন? যদি তারা বলে তারা যা চায় তা করতে পারেনি, তারপর, একই ব্যাপার, তারা অবশ্যই জেনে থাকবে তারা কী চায়। জীবনের ক্ষেত্রে, ব্যাপারটা শুধু একটা গল্প, যাতে অন্য লোকেরা জগৎ সমন্ধে বলে এবং জগতে কীভাবে আচরণ করতে হবে তা বলে দেয়।

এমনকি যেসব লোকেরা এ কথা বলে, তারা আরো খারাপ। আমি সুখী, কারণ আমি যাকে ভালোবাসি তার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারি।

তুমি কি মনে করো যেসব লোকজন আমাদের ভালোবাসে তারা আমাদের নিজেদের জন্য কষ্টভোগ করা দেখতে পারে? তুমি কি মনে করো ভালোবাসা কষ্টভোগের উৎস?

সত্যি বললে, হ্যাঁ।

 বেশ, তা হতে পারে না।

অন্য লোকে আমাকে যে গল্প বলেছে আমি যদি তা ভুলে যাই, তাহলে জীবন যা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখিয়েছে, তা ভুলে যাব। তাহলে এত পরিশ্রম করে এত কিছু শেখার অর্থ কী হতে পারে? অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এ রকম পরিশ্রম করার অর্থ কী হতে পারে, আমার ক্যারিয়ার, স্বামী আর আমার বিভিন্ন রকমের কান্না?

জ্ঞান অর্জন তখনই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে যখন রান্নার ব্যাপার অথবা নিজের সামর্থ্যের মধ্যে বাস করা অথবা শীতের গরম কাপড় অথবা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সম্মান দেখানো অথবা নির্দিষ্ট বাস বা ট্রেন কোনো দিকে যায় সে সমন্ধে শেখা হয়। তুমি কি বিশ্বাস করো তোমার অতীতের ভালোবাসা তোমাকে আরো ভালোবাসা শিখিয়েছে?

 আমি কি চাই তা জানতে শিখিয়েছে।

আমি তা জিজ্ঞেস করিনি। তোমার অতীতের ভালোবাসা কি তোমার স্বামীকে আরো অধিক ভালোবাসতে শিখিয়েছে?

না। নিজেকে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে দেয়া, আমি ভুলে গেছি অন্য মানুষ আমার জীবনে কী ক্ষতি নিয়ে এসেছে। আপনি কি তাই বোঝাতে চেয়েছেন?

 ভালোবাসার সত্যিকারের শক্তির ক্ষেত্রে তা তোমার আত্মাকে বিদ্ধ করে, তোমার আত্মা এ রকম অবস্থায় চলে আসে যেন কেবল জন্ম হয়েছে। লোকজন অসুখী কেন? কারণ তারা নিজেদের শক্তিকে বন্দি করে রাখে, ব্যাপারটা অসম্ভব। তোমার ব্যক্তিগত ইতিহাস ভুলে যাওয়া মানে পথটাকে পরিষ্কার রাখা যাতে প্রতিটি দিন সেই শক্তি তার পছন্দের পথ বেছে নিতে পারে।

ব্যাপারটা খুব রোমান্টিক কিন্তু বেশ কঠিনও। কারণ সেই শক্তি সর্ব প্রকারের জিনিসের পথকে রুদ্ধ করে দেয়, কমিটমেন্ট, বাচ্চাকাচ্চা, সামাজিক অবস্থান…

 কিছু সময় পরে অন্তর্ধান, ভয়, একাকীত্ব এবং অনিয়ন্ত্রণকে নিয়ন্ত্রণে আনা। টেংগ্রি ঐতিহ্য অনুসারে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করার জন্য, নিয়মিত ঘোরাফেরা করা দরকার। তাহলেই শুধু প্রতিটি দিন বিগত দিনের চেয়ে অন্য রকম হয়ে ওঠে। যাযাবরেরা যখন শহর অতিক্রম করে তারা ভাবতে থাকে, এখানে যেসব গরিব বেচারারা বাস করে তাদের কাছে সব কিছুই একই রকম। শহরের লোকেরা যাযাবরদের দেখে সম্ভবত একই রকম ভাবে, গরিব বেচারারা, ওদের বাস করার কোনো জায়গা নেই। যাযাবরদের কোনো অতীত নেই, শুধু বর্তমান। সে কারণেই তারা সব সময় সুখী থাকে। যত দিন পর্যন্ত না কমিউনিস্ট সরকার ওদের ভ্রমণ করা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং ওদের একটা নির্দিষ্ট ফার্মে একত্রে বাস করতে বলেছিল। তারপর থেকে একটু একটু করে, তারা তাদের সমন্ধে সমাজের কথাগুলো বিশ্বাস করতে লাগল। ফলাফলে, ওরা ওদের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলল।

 এখানকার দিনে কেউ তাদের সারা জীবন ভ্রমণ করে কাটিয়ে দিতে পারে না। শারীরিকভাবে পারে না। কিন্তু তারা আধ্যাত্মিকতার প্লেনে উঠতে পারে। দূরে বহুদূরে গিয়ে নিজেদের অতীত ভুলে যেতে পারে।

একজনের বলা গল্পে কীভাবে আরেকজন অত দূরে যেতে পারে?

পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জোরে জোরে বারবার পুনরাবৃত্তি করে। আর আমরা যখন আমাদের গল্প বলি, আমরা নিজেরা যা ছিলাম তাকে বিদায় জানাই, তুমি যদি চেষ্টা করে দেখ তাহলে বুঝতে পারবে, আমরা নতুন অজানা জগতের জায়গা তৈরি করি। আমরা গল্পগুলোকে বারবার পুনরাবৃত্তি করি যত দিন না তা আমাদের কাছ থেকে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

 সেটাই সব?

শুধু আরেকটা জিনিস আছে, যতই গল্পের ক্ষেত্র বড় হতে থাকে, ফাঁকা জায়গাটা তাড়াতাড়ি পরিপূর্ণ করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে সেই শূন্যতা অনুভব করা যায়।

 কীভাবে?

 অন্য গল্প বলে। যেসব অভিজ্ঞতা আমাদের কখনো হয়নি অথবা হওয়ার সাহস করিনি অথবা করতে চাইনি তা বলে। এভাবে আমরা পরিবর্তন আনতে পারি। এভাবেই ভালোবাসা জন্মায়। আর ভালোবাসা জন্মালে আমরা এর সাথেই বেড়ে উঠি।

তার মানে আমরা কোনো কিছু হারিয়ে ফেললে তা গুরুত্বপূর্ণ?

কখনোই না। গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সব সময় স্থায়ী হয়। আমরা যে জিনিস হারিয়ে ফেলি আমরা তা গুরুত্বপূর্ণ ভাবি কিন্তু ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে, মিথ্যা শক্তি ভালোবাসার নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো।

বৃদ্ধ লোকটি এসথারকে বললেন তার সময় শেষ হয়ে গেছে। তাকে অন্য লোকের সাথে দেখা করতে হবে। আমার অনুনয় সত্ত্বেও তাকে সময়ের ব্যাপারে বেশ কঠোর মনে হলো। কিন্তু এসথারকে বললেন, এসথার যদি ফিরে আসে তাহলে তাকে আরো বেশি কিছু শেখাবেন।

এসখার আলমাটিতে মাত্র আরেক সপ্তাহ ছিল। কিন্তু ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করল। সেই সময়ে আমি আমার গল্প ওকে বারবার বললাম। এসথারও তার গল্প আমাকে বলল। আমরা বুঝতে পারলাম বৃদ্ধ যাযাবরের কথাই ঠিক। কিছু একটা আমাদের থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমরা হালকা হচ্ছি। যদিও আমরা সত্যিই বলতে পারছি না সুখী হয়েছিলাম কিনা।

বৃদ্ধ যাযাবর আমাদের আরেকটি উপদেশ দিয়েছিলেন, ফাঁকা জায়গাটা তাড়াতাড়ি পূরণ করতে হবে। এসথার চলে আসার আগে, আমার কাছে জানতে চাইল আমি ওর সাথে ফ্রান্সে যেতে চাই কিনা, যাতে আমরা ভুলে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াটা বজায় রাখতে পারি। এসব জিনিস শেয়ার করার মতো তার কেউ নেই। ও তার স্বামীর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারে না। যাদের সাথে কাজ করে তাদের বিশ্বাস করে না। বাইরের থেকে কাউকে তার দরকার। অনেক দূরের কেউ, যার সাথে তার ব্যক্তিগত গল্পের কোনো ক্ষতি হবে না।

 আমি বললাম, আমি ওর সাথে যেতে পারি। তারপর কণ্ঠস্বর কি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তা উল্লেখ করলাম। ওকে আরো বললাম, আমি ফরাসি ভাষা জানি না। আমার কাজের অভিজ্ঞতা শুধু ভেড়া চরানো আর গ্যারেজে কাজ করা।

এয়ারপোর্টে, এসথার আমাকে ফরাসি শিক্ষার কোর্স করতে বলল। জানতে চাইলাম কেন আমাকে ফ্রান্সে নিতে চায়। আগে যা বলেছিল তাই আবার বলল। স্বীকার করল তার ব্যক্তিগত গল্প বলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে সব কিছু আগের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণা নিয়ে তার কাছে হাজির হতে পারে। তখন অতীতকে মুক্ত করে দেয়ার কোনো পথ খোলা থাকবে না। এসথার আমাকে বলল, টিকিট কেনা বা ভিসা পাওয়া নিয়ে চিন্তা না করতে, ও সব কিছুই ম্যানেজ করবে। পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ রুমে ঢোকার আগে এসথার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, যদিও সে জানে না এর পরও আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা যে দিনগুলো একসাথে কাটিয়েছিলাম বিগত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে সুখের সময়।

আমি রাতে কাজ করা শুরু করলাম। দিনের বেলা নিজে নিজে ফরাসি শিক্ষায় মগ্ন হলাম। অদ্ভুত ব্যাপার, এপিলেপটিক আক্রমণ কমে গেল কিন্তু সেই সাথে মেয়েটির উপস্থিতিও চলে গেল। মাকে বললাম বিদেশ যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ এসেছে। মা বললেন, ও রকম নেইভ না হতে, আমি কখনো যেন আবার ওই মহিলার কথা না শুনি।

এক বছর পরে, এসথার আলমাটিতে ফিরে এল। কাক্ষিত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কেউ একজন আমেরিকান গোপন ঘাঁটি নিয়ে আর্টিকেল লিখেছে। কিন্তু বৃদ্ধ যাযাবরের সাথে এসথারের ইন্টারভিউ বিশাল সাফল্য নিয়ে এসেছে। যাযাবরদের অন্তর্ধানের ব্যাপারে তাকে বিস্তারিত লেখার জন্য বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এসথার বলল, অনেক বছর পরে আমি আমার গল্প কাউকে বলেছি। আমি আবার হতাশ হতে শুরু করেছিলাম।

 আরো কয়েকটা যাযাবর গোষ্ঠী, যারা এখনো ভ্রমণ করে বেড়ায় তাদের কাছে এসখারকে নিয়ে গেলাম। টেংগ্রি ঐতিহ্য এবং স্থানীয় শ্যামনদের কাছে নিলাম। আমি এখন একনাগাড়ে ফরাসি বলতে পারি। রাতের খাবারের পরে এসথার আমাকে অনেকগুলো ফরম পূরণ করতে দিল। আমার ভিসা এনে দিল, আমার জন্য টিকিট কাটল। আমি প্যারিসে চলে এলাম। আমরা দুজনই লক্ষ্য করলাম, যখনই গল্প বলে আমরা আমাদের মনকে শূন্য করে ফেলি, নতুন খালি জায়গা তৈরি হয়ে যায়, রহস্যময় আনন্দে মন ভরে যায়। আমাদের মধ্যের সম্পর্কটা আরো জোরাল হলো। আমরা সাহসী হয়ে উঠলাম। বেশি ঝুঁকি নিতে শুরু করলাম। ভুল কি ঠিক না বুঝেই কাজ করতে লাগলাম। দিনগুলো বড় আর কার্যকরী মনে হলো।

প্যারিসে পৌঁছে জানতে চাইলাম, আমাকে কোথায় কাজ করতে হবে। কিন্তু এসথার এর মধ্যেই পরিকল্পনা করে ফেলেছে। একটা বারে খোঁজ লাগিয়ে সপ্তাহে এক দিন আমার জন্য কাজ বাগিয়েছে। বার মালিককে বলেছে আমি কাজাখস্তানে বিশেষ প্রকার পারফরম্যান্সে ওস্তাদ, যা তোকজনের জীবনযাত্রার মান এবং শূন্য মনকে পূর্ণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

প্রথমে, ব্যাপারটা খুব কঠিন ছিল। এ রকম অচেনা দর্শক-শ্রোতাকে গল্প শোনানো। কিন্তু মাতালরা ব্যাপারটা খুব উপভোগ করত। এসো, তোমার পুরনো গল্প বলো আর নতুন আরেকটা খুঁজে নাও। জানালার গায়ে হাতে লেখা নোটিশ ছিল। লোকজন আসতে শুরু করল।

একরাতে, আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। বারের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমি একাই কথা বলছিলাম না। ওর উপস্থিতি ছিল। আমার নিজের দেশের কথা বলার বদলে এবং তাদের নিজের গল্প বলতে উৎসাহ দিলাম। কণ্ঠস্বর কী বলেছিল তা বললাম না। কিছুক্ষণ পরে, একজন শ্রোতা কাঁদতে আরম্ভ করল। তারপর অপরিচিত লোকজনের সামনে তার বিয়ের অন্তরঙ্গ বিষয়গুলো বলতে লাগল।

পরের সপ্তাহেও একই ব্যাপার ঘটল। কণ্ঠস্বরটা আমাকে বলল, লোকজনকে শুধু তাদের ভালোবাসার গল্প নয়, ভালোবাসাহীনতার গল্প বলতে। পুরো পরিবেশটাই এমনভাবে বদলে গেল যে, সাধারণ ফরাসি লোকজন তাদের ব্যক্তিগত জীবন জনসম্মুখে বলতে শুরু করল। আমি আগের চেয়ে নিজের এপিলেপটিক আক্রমণটা ভালোভাবে সামলাতে শুরু করলাম। স্টেজে থাকার সময় আমি আলো আর গরম হাওয়া অনুভব করি, আমি তাড়াতাড়ি মোহাবিষ্ট অবস্থায় চলে যাই, জ্ঞান হারাই, কেউ লক্ষ করে না। খুব বেশি স্নায়বিক চাপে থাকলে আমি এপিলেপটিক মূৰ্ছা অবস্থার সম্মুখীন হই।

অন্য লোকজন দলে যোগ দিতে লাগল। আমার বয়সের তরুণেরাও তার মধ্যে আছে। তারা দেশ ভ্রমণ ছাড়া আর কিছুই করেনি। পশ্চিমা যাযাবরেরা, কাজাখস্তানের কয়েকজন মিউজিশিয়ান, যারা আমার সাফল্যের কথা শুনেছিল, তারা জানতে চাইল এই শোতে অংশ নিতে পারবে কিনা, কারণ তারা অন্য কোথাও কোনো কাজ খুঁজে পাইনি। আমরা পারফরম্যান্সের মধ্যে যন্ত্রসংগীত যোগ করলাম। বারটা আমাদের জন্য খুব ছোট। আমরা এখন যেখানে আছি রেস্তোরাঁয় ওই রুমটা নিয়ে নিলাম। কিন্তু এখন আমাদের কাছে ওই জায়গাও কম মনে হচ্ছে। কারণ লোকজন গল্প বলতে থাকলে সাহসী হয়ে ওঠে, যখন নাচতে থাকে, তারা শক্তির স্পর্শ পায় এবং বদলে যেতে থাকে। ভালোবাসার কারণে তারা এসব পরিবর্তনকে মেনে নেয়- মনের জোর বেড়ে ওঠে। বন্ধুবান্ধবদের এইখানকার কথা জানায়।

এসথার ওর আর্টিকেল লেখার জন্য ভ্রমণ করতে থাকে। কিন্তু প্যারিসে এলে ও সব সময় এখানে আসে। একরাতে, ও আমাকে বলল, রেস্তোরাঁয় আমাদের কাজ যথেষ্ট নয়, এতে শুধু পয়সাওয়ালা লোকদের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। আমাদের তরুণদের সাথে কাজ করতে হবে। তাদের কোথায় খুঁজে পাব, আমি জিজ্ঞেস করলাম। তারা এলোমেলো থাকে, ভ্রমণ করে, সবখানেই থাকে, ভিখারির বেশে থাকে অথবা সাই-ফাই মুভির চরিত্রের মতো ঘোরাফেরা করছে।

 এসথার জানাল ভিখারিদের কোনো ব্যক্তিগত ইতিহাস থাকে না, তাহলে আমরা কেন ওদের কাছে যাই না আর দেখি না ওদের কাছ থেকে কী শিখতে পারি? আর এভাবেই আমি আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছি।

এই অভিজ্ঞতাই আমি অর্জন করেছি। আপনারা কখনো জিজ্ঞেস করেননি আমি কে অথবা আমি কী করি, কারণ আপনারা আগ্রহী হননি। কিন্তু আজকে, আমাদের মাঝে একজন বিখ্যাত লেখক আছে, আমি বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 কিন্তু তুমি তোমার অতীত নিয়ে কথা বললে, হ্যাট কোট পরা ভিখারিনী বলল, এমনকি যদিও সেই বৃদ্ধ যাযাবর…

 যাযাবর কী? কেউ একজন জিজ্ঞেস করল।

 আমাদের মতো মানুষজন ভিখারিনী উত্তর দিল। এই শব্দের অর্থ জানে বলে গর্ববোধ করল। যেসব লোকজন মুক্ত আর বাঁচার জন্য যা দরকার তা নিজেরাই বহন করতে পারে।

আমি ওকে শুধরে দিলাম : ব্যাপারটা পুরোপুরি ঠিক নয়। ওরা গরিব নয়।

দারিদ্র্যের ব্যাপারে তুমি কী জানো? দীর্ঘাকায় আক্রমণাত্মক লোকটা সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে বলল। তুমি কি সত্যিই মনে করো, অর্থ না থাকার সাথে দারিদ্র্যের সম্পর্ক? তুমি কি মনে করো আমরা জঘন্য মানুষ কারণ আমরা চারদিকে ঘুরে ঘুরে ধনী লেখকদের কাছ থেকে ভিক্ষা মাগি, ভিক্ষা নিই দোষী দম্পত্তিদের কাছ থেকে, প্যারিসে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কাছ অথবা আইডিয়াবাদী তরুণদের কাছ থেকে, যারা মনে করে দুনিয়া বদলে দিতে পারবে? তুমিই সেই দরিদ্রদের একজন তোমার সময়ের ওপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা মন চায় তা তুমি করতে পারো না, যেসব আইনকানুন তুমি তৈরি করোনি তা তোমাকে জোর করে মেনে চলতে হয়, যা তুমি বুঝতে পারো না…

মিখাইল আমাদের কথোপকথনে বাধা দিয়ে ভিখারিনীকে জিজ্ঞেস করল : তুমি আসলে কী জানতে চাও?

আমি জানতে চাই তুমি কেন আমাদের তোমার গল্প বলছ, যেখানে বৃদ্ধ যাযাবর ভুলে যেতে বলেছে।

 এটা এখন আর আমার গল্প নেই। যেখানে আমি আমার অতীতের গল্প বলেছি, আমার মনে হয়েছে যেন আমার জীবনে এ রকম কোনো কিছু ঘটেনি। বর্তমানে শুধু কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। আমার মিশনকে পরিপূর্ণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেসব কঠোর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি তার জন্য অনুশোচনা করি না। আজকের এই আমাকে গড়ে তোলার পেছনে সেগুলোর অবদান আছে বলেই মনে করি। যোদ্ধারা বছরের পর বছর প্রশিক্ষণের পরে যেমনটি অনুভব করে আমিও তেমন বোধ করি। যোদ্ধা যা শিখেছে তার সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মনে করার দরকার নেই, কিন্তু ঠিক সময়ে কোন আঘাতটা করতে হবে, তা তার ঠিক জানা আছে।

 তাহলে আপনি আর ওই সাংবাদিক আমাদের কাছে কেন আসেন?

মনের খোরাক জোগাতে। বৃদ্ধ যাযাবর যেমনটি বলেছিলেন, আজকের জগৎটা আমরা যে রকমটি জানি তা হয়তো কারোর বলা গল্প, কিন্তু গল্পটা সত্যি নয়। অন্য গল্পগুলোতেও উপহার এবং শক্তি সামর্থ্যের কথা চাপা থাকে, যা আমরা জানি। ছোট্টবেলা থেকেই আমি বর্তমানে বাস করি। ওকে দেখার মতো সামর্থ্য হওয়ার পর থেকে। কিন্তু এসথার আমাকে দেখিয়েছিল আমি একা নই। ও বিশেষ শক্তির অন্য মানুষের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যারা ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে কাঁটা চামচ বাঁকিয়ে ফেলতে পারত। অথবা কোনো রকম এ্যানেসথেশিয়া ছাড়াই সামান্য ছুরির সাহায্যে বড় বড় সার্জারি করতে পারত। অপারেশনের পরে রোগী উঠে হেঁটে চলে যেতে পারত।

আমি এখনো আমার অজানা শক্তিকে বাড়িয়ে নেয়ার পদ্ধতি শিখে চলেছি। কিন্তু আমার সাহায্যের দরকার। আপনাদের মতো লোকের দরকার যাদের কোনো ব্যক্তিগত ইতিহাস নেই। আমার নিজেরও মনে হতে থাকে এই অপরিচিত লোকজনের কাছে আমার গল্পও বলি, আমার অতীতকে এদের কাছে মুক্ত করে দিই। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডাক্তারের সাথে দেখা করার জন্য আমার পরের দিন সকাল সকাল উঠতে হবে। অর্থোপেডিক কলারটা ডাক্তার সরিয়ে ফেলবে।

.

মিখাইলের কাছে জানতে চাইলাম আমার সাথে যেতে চায় কিনা, কিন্তু ও না করল। ওর এখনো এদের সাথে কথা বলার কাছে। কারণ ওর মনে হয় এসথারের অনুপস্থিতি এই রাতে বেশি অনুভব করছে। আমরা ওদের থেকে চলে এলাম। ট্যাক্সি খোঁজার জন্য রাস্তার দিকে এগোতে থাকলাম।

আমার মনে হয় ওই মহিলার কথা ঠিক। আমি বললাম, আপনি যদি কোনো গল্প বলেন, তার মানে এই দাঁড়ায় না যে আপনি তখনই গল্পটাকে মুক্ত করে দিলেন।

আমি মুক্ত, কারণ আমি নিশ্চিত আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। গোপনীয়তার মধ্যে মিথ্যা আছে, সব সময় কোনো না কোনো গল্প থাকে যা বাধাগ্রস্ত হয়। কিছু কিছু গল্প আছে যেগুলো ওপরে ওপরে ঘোরাঘুরি করে, আর তখনো বর্তমানকে দখল করে রাখে, যখনই আমরা ওই গল্পটাকে বন্ধ করে দিই তখনই আরেকটা গল্পের দ্বার খুলে যায়।

ইন্টারনেটে এ রকম কিছু একটা পড়েছিলাম বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা আমার মনে আছে, যদিও আমি তা লিখিনিঃ

এ কারণেই কোনো কোনো জিনিসকে চলে যেতে দেওয়া এতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওগুলোকে মুক্ত করে দেওয়া। বন্ধন মুক্ত করা। লোকজনের বোঝা দরকার কেউ চিহ্নিত তাস নিয়ে খেলে না; মাঝে মাঝে আমরা জিতি, মাঝে মাঝে আমরা হারি। কোনো কিছু ফিরে পাওয়ার আশা করো না। তোমার শক্তির পরিচয়ের ব্যাপারে আশা করো না। আশা করো না তোমার প্রতিভা আবিষ্কৃত হবে অথবা তোমার ভালোবাসা কেউ বুঝতে পারবে। বৃত্তটি পূরণ করো। কোনো রকম গর্ব, অসামর্থ্য অথবা ঔদ্ধত্য নয়, শুধু তোমার জীবনে যা মেনে নেয়। দরজা বন্ধ করে রেকর্ড বলে দাও, ঘরটাকে পরিষ্কার করো, ধুলোময়লা থেকে মুক্ত হও। তুমি কে অথবা তুমি কী হয়েছ তা বন্ধ করো।

.

কিন্তু মিখাইল কী বলছে তা বোঝা দরকার।

বাধাগ্রস্ত গল্প বলতে আপনি কী বোঝাতে চান?

 এসথার এখানে নেই। ও এ রকম একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেখানে ওর গল্প শেষ হয়ে গেছে। ও নিজের অসুখী সত্তাকে পুরোপুরি উজাড় করে দিয়ে আনন্দে আবাহন করছে। কেন? কারণ ওর গল্প লক্ষ লক্ষ লোকের গল্পের মতো ভালোবাসার শক্তি দিয়ে পরিপূর্ণ। ব্যাপারটা শুধু ওর নিজের মধ্যে নেই। তাকে অবশ্যই ভালোবাসা বন্ধ করতে হবে অথবা যত দিন তার ভালোবাসার মানে ওর কাছে না আসে তত দিন অপেক্ষা করতে হবে।

ব্যর্থ বিয়েতে, যখন একজন মানুষ হাঁটা বন্ধ করে দেয়, অন্যজনও জোর করে তাই করতে চেষ্টা করে। আর যখন কেউ একজন অপেক্ষা করে, অন্যজনের জীবনে ভালোবাসা এসে পড়ে, অথবা তারা নিজেরাই দাঁতব্য কাজে জড়িয়ে পড়ে, বাচ্চাদের জন্য দুশ্চিন্তা করে, অফিসের পরে দীর্ঘ সময়। তার চেয়ে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথাবার্তা বলা অনেক সহজ। চলো এভাবে দুশ্চিন্তা, হতাশা আর ভয়ে মরে না গিয়ে কথা বলি।

আপনি কি আমাকে বলতে চাইছেন, এসথার এই প্রক্রিয়ায় দুঃখ এড়াতে পারেনি শুধু আমার জন্য?

না। আমি তা বোঝাতে চাইছি না। আমি বিশ্বাস করি না একজন মানুষ আরেকজনকে দোষারোপ করতে পারে, তা যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন। আমি বলতে চাইছি, এসখারের কাছে এই অপশন ছিল, আপনাকে ভালো না বাসা অথবা আপনাকে তার কাছে নিয়ে আসা।

তাই তো সে করছে।

আমি জানি, কিন্তু ব্যাপারটা যদি আমার ওপর থাকত, আমরা শুধু তখনই ওর কাছে যেতাম, যখন কণ্ঠস্বর আমাদের সেখানে যেতে বলত।

.

ঠিক, আপনি অর্থোপেডিক কলার ঠিক সময়ে খুলতে পারবেন। আমি সে রকমই আশা করি। কিন্তু কোনো রকম হঠাৎ মুভমেন্টে এড়ানোর চেষ্টা করবেন। আপনার মাংসপেশিগুলো তাদের মতো আবার কাজ করতে অভ্যস্ত হতে দিন। যাই হোক, আপনাকে যে পূর্বধারণা দিয়েছিল, সেই মেয়েটার কী হয়েছে?

কোন মেয়ে? কী প্রিডিকশন?

আপনি কি হাসপাতালে থাকতে আমাকে বলেননি কেউ এজন আপনাকে বলেছিল একটা কণ্ঠস্বর আপনার কিছু একটা ঘটতে পারে, এ রকম সতর্ক করে দিয়েছিল?

ওহ, ও কোনো মেয়ে নয়। আর আপনি বলেছিলেন আমার জন্য এপিলেপসির ব্যাপারটা খুঁজে দেখবেন।

 হ্যাঁ। আমি একজন স্পেশালিস্টের সাথে দেখা করেছিলাম। তাকে এ ব্যাপারে কোনো কেস হ্যাঁন্ডেল করে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। ওর উত্তর আমাকে কিছুটা বিস্মিত করেছিল। কিন্তু আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ওষুধের রহস্যময় ক্ষমতা আছে। আপনার কি মনে আছে, আমি আপনাকে একটা গল্প বলেছিলাম, এক বালক, যে পাঁচটা আপেল কিনে দুটো নিয়ে চলে আসে?

হ্যাঁ, ছেলেটা হয়তো সেগুলো হারিয়ে ফেলতে পারে বা কাউকে দিয়ে দিতে পারে অথবা ওর কাছের টাকার চেয়ে দাম বেশি হতে পারে। চিন্তা করবেন না, আমি জানি কোনো প্রকৃত উত্তর নেই। কিন্তু, প্রথম কথা, জোয়ান অব আর্ক কি ইপিলেপসিতে ভুগত?

অদ্ভুত হলেও তাই। আমার বন্ধু আমাদের কথোপকথনের সময় জোয়ান অব আর্কের নাম উল্লেখ করেছিল। জোয়ান অব আর্ক তেরো বছর বয়সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেতে শুরু করে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সে আলো দেখতে পেত, যা ওর আক্রমণের একটা উপসর্গ ছিল। নিউরোলজিস্ট ডাক্তার লিডিয়া বায়ানের মত অনুসারে, যোদ্ধা-সন্তদের অতুরীয় অভিজ্ঞতার ব্যাপারটাকে এখন মিউজিকোজেনিক এপিলেপসি বলে, যা নির্দিষ্ট ধরনের সংগীত বা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। জোয়ান অব আর্কের ক্ষেত্রে যা ঘন্টাধ্বনির শব্দ হিসেবে ধরা দেয়। ছেলেটি যখন মূর্ছা যায় তখন কি আপনি সেখানে ছিলেন?

হ্যাঁ

ওখানে কি কোনো মিউজিক বাজছিল?

আমার মনে নেই। কিন্তু যদি তা থেকে থাকে, মৃদঙ্গের শব্দ আর লোকজনের কথোপকথনের শব্দে তা চাপা পড়ে গিয়েছিল।

ওকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল?

হ্যাঁ, বেশ।

ওটাও আরেকটা ব্যাপার, যা এপিলেপটিক আক্রমণের সূচনা করে। এপিলেপসি আপনি যা ভাবছেন তার চেয়ে অনেক সময় ধরে স্থায়ী হয়। মেসোপটেমিয়ায়, অসুস্থ হওয়ার ওদের কাছে সঠিক বর্ণনা আছে, যা আসলে খিচুনিতে রূপ নেয়। প্রাচীন লোকেরা বিশ্বাস করত, শয়তান মানুষের শরীরে ঢুকে অমনটি করে। তার অনেক পরে গ্রিক হিপোক্রেটাস মস্তিষ্কের অকার্যকারিতার সাথে এই খিচুনির সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন। এমনকি এখনো, ইপিলেপসি কুসংস্কারের শিকার হয়।

আমি নিশ্চিত। ব্যাপারটা ঘটলে আমি সত্যিই ভয় পাই।

 আপনি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করেছেন। তো আমি আমার বন্ধুকে এইদিকটাতে মনোযোগ দেয়ার জন্য বলেছিলাম। ওর কথা অনুযায়ী, অধিকাংশ বিজ্ঞানীই একমত, যদিও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিই এপিলেপসিতে ভুগেছে, অসুখটা কাউকে বৃহত্তর অথবা ক্ষুদ্রতর শক্তির ব্যাপারে কিছুই জানায় না। শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশই বিখ্যাত এপিলেপটিক ব্যক্তি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি রহস্যময় জ্যোতি দেখতে পায়।

আমাকে এ ধরনের কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির উদাহরণ দিন।

নেপোলিয়ন, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, দান্তে আলেঘেরি… আমি পুরো তালিকা বলতে পারছি না। ওই ছেলেটির ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে আপনি আগ্রহী ছিলেন বলেই জেনেছি। আচ্ছা, ওই ছেলেটার নাম কী?

 আপনি ওকে চিনবেন না। যত দিন না আপনি ওর সাথে কোনো কাজ করছেন। তার চেয়ে আপনি আপনার ব্যাখ্যা শেষ করে ফেলুন।

ঠিক আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যারা বাইবেল নিয়ে পড়াশোনা করেছে তারা নিশ্চিত পলের এপেলেপসি ছিল। ঘটনাটা এভাবে বিবৃত হয়, দামেস্কাসের পথে, তিনি খুব উজ্জ্বল আলো দেখেছিলেন, যার কারণে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন, সাময়িক অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক দিন কিছু খেতে বা পান করতে পারেননি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে টেমপোরাল লোব এপিলেপসি বলে।

আমি মনে করি না গির্জা এর সাথে একমত হবে।

আমিও একমত কিনা নিশ্চিত নই। কিন্তু মেডিকেল লিটারেচার এ রকমটিই বলছে। অন্য এপিলেপটিক কন্ডিশনে আত্ম-ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখায়, যেমনটি ভ্যানগগ দেখিয়েছিলেন। তিনি তার কনভালশনকে ঝড়ের বেগে বলে বর্ণনা করেছিলেন। সন্ত রেমি রোগী থাকা অবস্থায় তার একজন নার্স খিচুনি দিয়ে মূৰ্ছা যেতে দেখেছিল।

অন্ততপক্ষে ভ্যানগগ তার পেইন্টিংগুলোকে আত্মবিধ্বংসী অবস্থা থেকে পুর্নির্মাণের অবস্থায় জগৎকে উপহার দিয়েছিলেন।

কেউ কেউ সন্দেহ করে, লুই ক্যারল এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড বইয়ে তার নিজের এপিলেপটিক অবস্থার কথা বর্ণনা করেছিলেন। বইয়ে গল্পটা এভাবে শুরু করে, যখন এলিস ব্লাক হোলের মধ্যে পতিত, অধিকাংশ এপিলেপটিক রোগী এই অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত। ওয়ান্ডারল্যান্ডে এলিসের ভ্রমণের সময়, এলিস অধিকাংশ সময়ই নিজেকে উড়তে এবং নিজের ওজন খুব হালকা হতে দেখে, যা অধিকাংশ এপিলেপটিক আক্রমণের সময়ে দেখে থাকে।

 তো দেখেশুনে মনে হয় এপিলেপটিকের কারণে আর্টের ব্যাপারে প্রভূত উন্নতি হয়।

 ঠিক তা নয়, শুধু শিল্পীরা বিখ্যাত হওয়ার কারণে লোকজন শিল্পী আর এপিলেপসির মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পায়। সাহিত্য জগতেও এ রকম অনেক লেখকের উদাহরণ আছে, যাদের মধ্যে এপিলেপসির উপসর্গ খুঁজে পাওয়া গেছে। মলিয়ের, এডগার এলান পো, ফ্লয়েবার… দস্তয়েভস্কির নয় বছর বয়সে এপিলেপটিক আক্রমণ শুরু হয়। তিনি ব্যাপারটাকে এভাবে বর্ণনা করেন যে, সেই মুহূর্তে জগতের সকল হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির জগতে প্রবেশ করেন। এসব ব্যাপার খুব সিরিয়াসলি নেয়ার দরকার নেই। এসব ভাববেন যে, আপনার দুর্ঘটনা ঘটেছিল, কারণ আপনার মধ্যে এপিলেপসির লক্ষণ ডেভেলপ করেছে। মোটরবাইক দুর্ঘটনার কারণে কারো এপিলেপটিক হয়েছে, এ রকম কোনো কেস এখনো পায়নি।

আমি যেমনটি বলছেন, প্রকৃতপক্ষে, একজনকে আমি চিনি।

সত্যিই কি ওই ছেলেটার ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো অস্তিত্ব আছে অথবা নাকি আপনি নিজেই এসব আবিষ্কার করেছেন, কারণ আপনি হয়তো পেভমেন্টের বাইরে পা বাড়িয়েছিলেন?

উল্টো দিকে, রোগের ব্যাপারে জানতে আমি খুবই অপছন্দ করি। যখনই আমি কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই পড়ি, সাথে সাথে আমার মধ্যে সেই রোগের সব লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে বলে মনে হয়।

আপনাকে কিছু কথা বলা দরকার, কিন্তু দয়া করে ব্যাপারটাকে ভুল ভাববেন না। আমার মনে হয় এই দুর্ঘটনায় আপনার অনেক ভালো হয়েছে। আপনাকে বেশ শান্ত, অনেক কম অবসেসড দেখাচ্ছে। মৃত্যুর একটুখানি ছোঁয়া সব সময় আমাদের জীবনকে আরো সুন্দরভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। আপনার স্ত্রী আমাকে রক্তমাখা কাপড়ের টুকরো দিয়ে এ রকমটিই বলেছিল। সেই টুকরোটি আমি সব সময় সাথে রাখি। ডাক্তার হিসেবে, আমি খুব কাছ থেকেই মৃত্যুকে দেখি, প্রতিদিন।

ও কি আপনাকে বলেছিল কেন ওই কাপড়ের টুকরোটি দিচ্ছে?

আমার কাজের ব্যাপারে বর্ণনা করতে ও খুবই বিনয়ী। ও আমাকে বলেছিল আমি ইনটিউশন আর নিয়মানুবর্তী ভালোবাসার ধারণে সক্ষম। ও জানিয়েছিল একজন সৈনিক মারা যাওয়ার আগে ওই রক্তমাখা শার্ট দিয়েছিল, ওটাকে টুকরা টুকরো করে সেগুলোকে ও সেইসব মানুষের মাঝে বিতরণ করছে, যারা এই জগৎটাকে জানতে চায়। আমি কল্পনা করতে পারি, আপনি, আপনার সব বইয়ের মধ্যে এই কাপড়ের টুকরো পেয়েছেন।

না, আমি পাইনি।

আমি কি জানতে পারি কেন?

আমি তা জানতে চাই অথবা আমি তা খুঁজে বের করার জন্য উন্মুখ।

 শুনুন, আমি শুধু আপনার ডাক্তারই নই, বন্ধুও বটে। আমি কি আপনাকে কোনো উপদেশ দিতে পারি? যদি ওই এপিলেপটিক ছেলেটা আপনাকে বলে থাকে সে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, তাহলে ও মেডিসিনের ব্যাপারে কিছুই জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *