২. হ্যান্সের প্রশ্ন

হ্যান্সের প্রশ্ন

বুয়েন্স আয়েৰ্পে, দ্য জাহির একটা বিশ সেন্টের কয়েনের গায়ে খোদাই করা। অক্ষরগুলো এবং ছুরি অথবা একটা চিঠির খাম খোলা ছুরির মতে, ১৯২৯ অক্ষরগুলো দুইভাবে মুদ্রিত। (গুজরাটে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, দ্য জাহির একটা বাঘকে বলা হতো। জাভা দ্বীপে, এটা একজন অন্ধ মানুষ, সুরাকাটা মসজিদ থেকে এসেছে। প্যারিসে, একটা অ্যাস্ট্রোল্যাব, যা নাদির শাহ সাগরে পতিত করতে আদেশ দেয়…)

এক বছর পরে, হোর্সে লুই বোর্গেসের একটা গল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। গল্পটা হলো, এ রকম কিছু যা একবার দেখা বা স্পর্শ করা হয়েছে, কখনো ভোলা যায় না, যা আমাদের ভাবনাচিন্তাকে ধীরে ধীরে উন্মত্তের মতো করে দেয়। আমার জাহির কোনো রোমান্টিক মেটাফর নয়- একজন অন্ধ মানুষ, একটা কম্পাস, একটা বাঘ অথবা একটা কয়েন নয়।

 তা একটা নাম। তার নাম এসথার।

জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পরই, আমি কয়েকটা স্ক্যান্ডাল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে পরিণত হলাম। তারা একটা সম্ভাব্য ক্রাইমের গন্ধ খুঁজে পেল। কিন্তু কোর্টের ঝামেলা এড়ানোর জন্য তারা সব সময় উপসংহার টেনেছে আমাকে নিষ্কলুষ দেখিয়ে। (আমি দোষী সাব্যস্ত হয়নি!) তারা এক সপ্তাহ সময় অনুমোদন করেছে, দেখতে চেয়েছে তাদের বিক্রি ভালো অবস্থানে আছে কিনা (বিক্রি ভালই, কারণ আমি এ রকম একজন লেখক, যে সাধারণ সন্দেহের ঊর্ধ্বে, আর প্রত্যেকেই জানতে চেয়েছে, যে মানুষটা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে লেখে তার মধ্যে এ রকম অন্ধকার দিক থাকা কীভাবে সম্ভব!) তারপর তারা আবার আক্রমণে ফিরে গেছে, আমাকে দোষ দিয়েছে, আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে কারণ আমার বিবাহবহির্ভুত অনেক সম্পর্ক ছিল। একটা জার্মান ম্যাগাজিন এমনকি একজন সাম্ভাব্য গায়িকার ব্যাপারে হিন্টস দিয়েছে, মেয়েটি আমার চেয়ে বিশ বছরের ছোট, ম্যাগাজিনে বলেছে মেয়েটি আমার সাথে নরওয়ের অসলোতে দেখা করেছে। (ব্যাপারটা সত্যি, কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল শুধু ফেভার ব্যাংকের ব্যাপারে আমার একজন বন্ধু ওর সাথে একত্রে সাপার করতে বুদ্ধি দিয়েছিল।) গায়িকা জানিয়েছে, আমাদের মধ্যে কিছুই ঘটেনি (তো তাহলে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আমাদের দুজনের ছবি ছাপার কী দরকার?) আর এই সুযোগে মেয়েটি জানিয়ে দিয়েছে তার একটা নতুন অ্যালবাম রিলিজ হতে চলেছে, মেয়েটি ম্যাগাজিন আর আমাকে দুজনকেই ব্যবহার করেছে। আমি এখনো জানি না এই অ্যালবামের ব্যর্থতা এ রকম সস্তা পাবলিসিটির ফল কিনা ( অ্যালবামটা খুব একটা খারাপ ছিল না, প্রেস রিলিজই সব কিছু নষ্ট করে দিয়েছে।)

 ইউরোপে একজন বিখ্যাত লেখকের স্ক্যান্ডাল খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিশেষত ফ্রান্সে, অবিশ্বাসী কোনো কিছু গ্রহণ করা হয় না, বরং গোপনে গোপনে প্রশংসিত হয়। কেউ এই জাতীয় জিনিস পড়তে পছন্দ করে না, যা খুব সহজেই ঘটে যায়।

 প্রসঙ্গটা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ থেকে অন্তর্হিত হয়। কিন্তু হাইপোথিসিস চলতে থাকে। এসথার অপহৃত হতে পারে। এসথার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কারণ আমি তাকে শারীরিক নির্যাতন করেছি (একজন ওয়েটারের ছবি ছাপিয়েছে, সে জানিয়েছে, আমরা প্রায়ই ঝগড়া করতাম। আমার মনে পড়ে তা তর্কবির্তক হতো। প্রকৃতপক্ষে, রেস্টুরেন্টে ওর সাথে আমার তর্ক হয়েছিল একজন সাউথ আমেরিকান লেখককে নিয়ে, যে সম্পূর্ণ আমার বিপরীতধর্মী।) একটা ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ঘোষণা করেছে আমার স্ত্রী একটা ইসলামিক টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের সাথে লুকিয়ে আছে- সৌভাগ্যবশত এর তেমন কোনো সিরিয়াস প্রতিক্রিয়া হয়নি।

জগৎটা এত বেশি প্রতারণা, বিবাহ বিচ্ছেদ, খুন, জখম, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে পরিপূর্ণ যে মাসখানেক পরে সাধারণ লোকজন আমার বিষয়টা ভুলে গেল। বছর পর বছরের অভিজ্ঞতায় এই শিখেছি, এই জাতীয় জিনিস কখনো আমার বিশ্বস্ত পাঠকের ওপর প্রভাব ফেলে না। (এ রকমটি আগে ঘটেছিল, যখন একজন সাংবাদিক আর্জেন্টাইন টেলিভিশন প্রোগ্রামে অভিযুক্ত করে তার কাছে প্রমাণ আছে যে, আমি চিলির ভবিষ্যৎ ফার্স্ট লেডির সাথে গোপনে মিটিং করেছি, কিন্তু আমার বই তখন বেস্ট সেলারের তালিকায় ছিল।) একজন আমেরিকান শিল্পী প্রায়ই বলেন, সেনসেশনাইলিজম কেবল পনেরো মিনিট স্থায়ী হয়। আমার মূল দৃষ্টিভঙ্গি তার থেকে ভিন্নতর। জীবনকে চিনতে শেখা, নতুন ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া, আবার বই লিখতে শুরু করা। আমার স্ত্রীর স্মৃতি ছোট্ট ড্রয়ারটাকে তুলে রাখা, যা ভালোবাসা এবং ঘৃণার মাঝামাঝি থাকে।

অথবা আমি আমার এক্স-ওয়াইয়ের স্মৃতি বলতে পারি (আমার এই টার্মটা ব্যবহার করা দরকার।)

হোটেলরুম থেকেই বাইরের দৃশ্যাবলি দেখছি। খুব কম সময়ের জন্য, আমি অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বাইরে যাই। জানি না কীভাবে বন্ধুদের মুখোমুখি হবো। কীভাবে ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে খুব সাধারণভাবেই বলব, আমার স্ত্রী এক তরুণের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি বাইরে গেলে কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু কয়েক গ্লাস ওয়াইন পানের পর আমি নিজেই ওই বিষয়টা টেনে তুলি, যেন আমি সবার মনের ভেতরটা পড়তে পারছি। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি আমার জীবনে কী ঘটে গেছে ইহা ছাড়া ওরা আর কিছু ভাবছে না। কিন্তু ওরা এত বেশি ভদ্র যে, কোনো কিছুই বলে না। আমার মুডের ওপর নির্ভর করে, এসথার হয় একজন সন্তুর মতো যে খুব ভালো কিছু প্রত্যাশা করে অথবা ঐশ্বর্যশালী মহিলা, যে আমাকে এ রকম জটিল একটা পরিস্থিতিতে ফেলে গেছে। যে আমাকে, এমনকি একজন ক্রিমিনাল হিসেবে ভাবা হচ্ছে।

বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন, প্রকাশক, লোকজন যাদের পাশেই আমি বসি, অনেক গালা ডিনারে আমাকে বাধ্য হয়েই যোগ দিতে হয়, প্রথমে কিছুটা কৌতূহলে আমার কথা শোনে। আমি লক্ষ করি, ধীরে ধীরে, তারা প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। তারা কোনো এক মুহূর্তে ওসব ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়, কিন্তু তা তাদের বর্তমান কৌতুলের বিষয় নয়। একজন অভিনেত্রী, যে একজন গায়কের দ্বারা খুন হয়েছে, তার ব্যাপারেই বেশি কৌতূহল দেখায়। অথবা সেই কৈশোর উত্তীর্ণ বালিকা, যে একজন : রাজনীতিবিদের সাথে তার সম্পর্কের বিষয় নিয়ে বই লিখেছে। একদিন মাদ্রিদে, আমি লক্ষ করলাম, অতিথিরা সাপারের সময় কেটে পড়তে শুরু করেছে। যদিও ব্যাপারটা আমার জন্য ভালোই হওয়ার কথা, কিন্তু আমি বুঝতে শুরু করলাম, একজন অবিশ্বস্ত স্বামীর চেয়ে খারাপ কিছুতে পরিণত হয়েছি। এ রকম একজন বোরিং ব্যক্তি হয়ে গেছি, কেউ আমার আশপাশে থাকতে চায় না।

তারপর থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, নিঃশব্দে যন্ত্রণা ভোগ করব। আমার মেইলবক্সে আমন্ত্রণের চিঠি উপচে পড়তে লাগল।

কিন্তু দ্য জাহির, আমার আত্মার ভেতরে সেই আকাক্ষা বাড়তে লাগল। আমি প্রতিটি মেয়েমানুষের মধ্যে এসথারকে খুঁজে ফিরতে লাগলাম। ওকে প্রতিটি বার, প্রতিটি সিনেমাহলে, বাস স্টপেজে দেখতে পেতে লাগলাম। তার চেয়ে বেশি একবার আমি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে পথের মধ্যে থেমে পড়তে বলেছিলাম, আরেকবার একজনকে অনুসরণ করতে বলেছিলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝতে পেরেছি আমি যাকে খুঁজছি সে ওই মেয়েটা নয়।

জাহির আমার প্রতিটি চিন্তাভাবনাকে দখল করে রাখতে লাগল। আমার অ্যান্টিডোটের দরকার। এ রকম কিছু যা আমাকে ওর চিন্তা থেকে দূরে রাখে। একটিমাত্র সাম্ভাব্য উপায় আছে।

একজন গার্লফ্রেন্ড।

 তিন থেকে চারজন মহিলার সাথে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারপর আমার মেরির সাথে দেখা হয়। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্কা ফরাসি অভিনেত্রী। ওই একমাত্র মহিলা, যে অন্যদের মতো উল্টাপাল্টা বকেনি, আমি তোমাকে একজন পুরুষমানুষ হিসেবে পছন্দ করি, অন্যরা যে রকম সেলিব্রেটির সাথে দেখা করতে চায় সে রকম নয়। অথবা আমি আশা করছি তুমি ততটা বিখ্যাত নও। অথবা তার চেয়ে খারাপ, আমার টাকা-পয়সার প্রতি কোনো মোহ নেই। মেরিই একমাত্র মহিলা, যে প্রকৃতপক্ষেই আমার সাফল্যে খুশি ছিল, কারণ সেও অনেক বেশি বিখ্যাত ছিল। আর জানত সেলিব্রেটিদের মর্যাদা আছে। সেলিব্রেটিরা আফ্রোডিয়াজ। একজন মহিলার জন্য এ রকম একজন মানুষের সাহায্য বেছে নেয়া ভালো যে, আরো অনেককে বেছে নেয়ার সুযোগ ছিল।

 আমরা প্রায়ই একসাথে পার্টি আর রিসিপশনগুলোতে যেতে লাগলাম। আমাদের সম্পর্কের অনেক দৃশ্যমান দর্শক ছিল। কিন্তু মেরি অথবা আমি কোনো কিছু নিশ্চিতও করিনি, আবার অস্বীকারও করিনি। ব্যাপারটা ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছি। ম্যাগাজিনগুলো আমাদের বিখ্যাত চুম্বনের ছবির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল, যা কখনো আসেনি। কারণ মেরি আর আমি দুজনেই এ রকম পাবলিক প্রদর্শনরত অশ্লীলতা অপছন্দ করতাম। মেরি ওর শুটিংয়ের কাজে ব্যস্ত থাকে। আমি লেখালেখির কাজ করি। যখনই সময় পাই, মিলানে ভ্রমণ করি। মেরিও যখন সময় পায়, আমার সাথে দেখা করতে প্যারিসে আসতে পারে। আমরা খুব কাছাকাছি আসি, কিন্তু কখনো একে অন্যের ওপর নির্ভর করি না।

মেরি এ রকম ভান করে, আমার মনের মধ্যে কী চলছে তা সে জানে না। আমিও এ রকম ভান করি, ওর মনের মধ্যে কী ঘটছে তা জানি না (এক অদ্ভুত অসম্ভব সম্পর্ক, যা বিবাহিত মানুষের ভালোবাসার ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এমনকি ও যাকে চায়, সেই পুরুষটিকে দখল করতে পারে। আমরা বন্ধুর মতো, একে অন্যের সাথী, আমরা একই জিনিস উপভোগ করি। এমনকি আমি আরেকটু এগিয়ে থেকে বলতে চাই, আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসা গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসথারের প্রতি আমি যে রকম ভালোবাসা অনুভব করি অথবা মেরি তার প্রতিবেশীর প্রতি, তার থেকে ভিন্নতর।

আমি আবার বইয়ে স্বাক্ষর দেয়া শুরু করলাম। লেকচার দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে লাগলাম। আর্টিকেল লিখতে শুরু করলাম, চ্যারিটি ডিনারে যোগ দিতে লাগলাম, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। উঠতি তরুণদের প্রজেক্টে সাহায্য করতে লাগলাম। আমি সব কিছু করতে লাগলাম, শুধু আমার যা করার কথা তা করা হয়ে উঠছে না, বই লেখা।

এটা আমার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে আমি বিশ্বাস করি, বইয়ের লেখক হিসেবে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। কারণ যে মানুষটা এসব শুরু করিয়ে দিয়েছিল সে আর এখন এখানে নেই। আমি আমার স্বপ্নের মধ্যে বাস করতে পারি, বাকি জীবনটা মজা করে কাটিয়ে দিতে পারি। প্রতিটি সকালে এসব ভাবি। সন্ধ্যার আঁধারে, বুঝতে পারি, একমাত্র বিষয়, যা আমি পছন্দ করি, তা বই লেখা। রাত নেমে এলে, নিজেকে আরেকটু খুঁজতে চেষ্টা করি, আমি আমার স্বপ্ন পূর্ণ করেছি। আমার নুতন কিছু চেষ্টা করা উচিত।

.

এ বছরটা ছিল স্পেনের পবিত্র বছর, দ্য এনো সান্টা কমপোস্টেলানো। সেইন্ট জেমস অব কমপোস্টেলার দিনটি, ২৫ জুলাই, রবিবারের দিনে পড়েছে। সান্টিয়াগোর ক্যাথেড্রালের একটা বিশেষ দরজা ৩৬৫ দিনের জন্য খোলা থাকে। ঐতিহ্য অনুসারে, যে ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সে এক গুচ্ছ বিশেষ আশীর্বাদ গ্রহণ করে।

স্পেনে বিভিন্ন রকম স্মরণীয় ইভেন্ট হয়ে থাকে। তীর্থযাত্রার সেই ঘটনার জন্য আমি এই শহরের ওপর কৃতজ্ঞ। আমি অন্তত একটা ইভেন্টে অংশ নেব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। জানুয়ারিতে বাস্ক প্রদেশে একটা সভায় বক্তৃতায় অংশ নেব। আমার রুটিনের নিয়ম থেকে বের হওয়ার জন্য, একটা বই লেখার চেষ্টা একটা পার্টিতে অংশ নেয়া বিমানবন্দরে যাওয়া/ মেরিকে দেখতে মিলানে যাওয়া/ নৈশ ভোজে যাওয়া/ হোটেলে যাওয়া বিমানবন্দরে যাওয়া/ ইন্টারনেট সার্ফিং করা বিমানবন্দরে যাওয়া সাক্ষাৎকার দেয়া/ আরেকটা বিমানবন্দরে যাওয়া- আমি অন্তত ১৪০০ কিলোমিটার একাকী ড্রাইভ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

সব জায়গায়, এমনকি যেসব জায়গায় আমি আগে কখনো যাইনি, আমাকে আমার ব্যক্তিগত জাহিরের কথা মনে করিয়ে দিল। ইসথার এসব ব্যাপার কেমন পছন্দ করত তা ভাবলাম। এসব রেস্টুরেন্টে ও কতটা আনন্দ পেত অথবা নদীর ধার ঘেঁষে এভাবে হেঁটে যেতে পছন্দ করত। আমি রাতটা বায়োনে কাটালাম। ঘুমাতে যাওয়ার আগে টেলিভিশন অন করলাম। জানতে পারলাম, অন্তত পাঁচশ ট্রাক ফ্রান্স আর স্পেনের ফ্রন্টিয়ারের মাঝখানে অপ্রত্যাশিত ভয়াবহ তুষার ঝড়ে আটকে আছে।

প্যারিসে ড্রাইভ করে ফিরে যাব এই চিন্তা করে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। এনগেজমেন্ট বাতিল করার জন্য আমার কাছে অদ্ভুত এক অজুহাত আছে। অর্গানাইজাররা খুব ভালোভাবেই তা বুঝতে পারবে। রাস্তায় ট্রাফিক জটিল অবস্থায় আছে। রাস্তাজুড়ে বরফ। স্পেন আর ফ্রান্সের উভয় সরকারই জনগণকে এ অবস্থায় রাস্তায় বের হতে নিষেধ করছে। এই উইকান্ডে বাড়িতেই থাকতে বলছে, কারণ দুর্ঘটনার ঝুঁকি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। গত রাতে অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। সকালের খবরের কাগজ জানাচ্ছে, প্রায় সতেরো হাজার লোক রাস্তায় আটকা পড়ে আছে। নগরের প্রতিরক্ষা দল ওদের খাদ্য পানীয় ও সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। এর মধ্যে অনেকেরই জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে, তারা গাড়ির হিটারও ব্যবহার করতে পারছে না।

হোটেলের স্টাফরা বলল, যদি আমাকে সত্যিই ট্রাভেল করতে হয়, যদি এটা জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, তাহলে একটা ছোট্ট রাস্তায় আমি যেতে পারি, এটা হয়তো গাড়ির জট নেই, তবে আমার জার্নির আরো ঘণ্টা দুই বেশি সময় লাগবে। কেউ গ্যারান্টি দিতে পারল না ওই রাস্তার অবস্থা কেমন হতে পারে। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে, আমি এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভেতরে কেউ যেন আমাকে ঠেলছিল।

 সম্ভবত এটা শহরের নাম হতে পারে : ভিটোরিয়া- ভিক্টোরি। সম্ভবত আমার মধ্যে এ রকম একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে, আমি আরামে অভ্যস্ত। আর সেই কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছি। সম্ভবত মানুষের প্রাণশক্তির ব্যাপার এটা। এই মুহূর্তে অনেক শতাব্দী আগের ক্যাথেড্রালকে পুনর্নির্মাণ করছে। তাদের সেই শক্তিতে বাড়িয়ে দেয়ার জন্য মাত্র কয়েকজন লেখক বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অথবা এটা আমেরিকার বিজয়ীদের সেই পুরনো প্রবাদ : এটা জীবনের কোনো ব্যাপার নয়, এটা ভ্রমণের ব্যাপার।

 সে জন্য আমি ভ্রমণের ওপরই আছি। অনেক অনেক সময় পরে, উৎকণ্ঠিত ঘণ্টা পেরিয়ে, ভিটোরিয়াতে পৌঁছালাম। ওখানে আরো কিছু উৎকণ্ঠিত লোকজন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা বলল, বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে এ রকম তুষারপাত তারা কখনো দেখেনি। আমি এ রকম কষ্ট সহ্য করে এসেছি বলে আমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল। তারপর অফিশিয়াল প্রোগামে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করল। সান্তা মারিয়ার ক্যাথেড্রাল দর্শন দিয়ে আমার ভিজিট শুরু হলো।

একজন উজ্জ্বল চোখের তরুণী আমাকে গল্পটা বলতে শুরু করল। একেবারে শুরুতে এটা শুধু একটা নগর দেয়াল ছিল। দেয়ালটা থেকে গেলেও এর একটা অংশ চ্যাপেল হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল। অনেক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল, চ্যাপেলটাই চার্চ হয়ে গেল। আরেক শতাব্দী পেরিয়ে গেলে, চার্চটা একটা গথিক ক্যাথেড্রাল হয়ে গেল। ক্যাথেড্রালের অসংখ্য অবিস্মরণীয় মুহূর্ত আছে। স্ট্রাকচারাল সমস্যা শুরু হয়ে গেল, দিনে দিনে তা আরো বাড়তে থাকে। তারপর গোটা ভবনের আকৃতি পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু প্রতি জেনারেশন ভাবে, তারাই সমস্যাটা সমাধান করেছে এবং আদি পরিকল্পনা অনুযায়ী পুনরায় কাজ করতে শুরু করে। সেই অনুযায়ী, এই শতাব্দীতে, তারা একটা দেয়াল তুলে দিয়েছে, সেখানে একটা নতুন বিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়েছে, স্টেইন-গ্লাস জানালা তৈরি করেছে।

ক্যাথেড্রাল এখন সেই অবস্থায় আছে।

 আমি ক্যাথেড্রালের কাঠামোর মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলাম। পুনর্নির্মাণের কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। এইবার আর্কিটেক্ট গ্যারান্টি দিচ্ছে, তারা একেবারে খাঁটি সমাধান পেয়ে গেছে। সর্বত্র ধাতব খুঁটি, তার এসব ছড়ানো ছিটানো। কেউ কেউ এর আগে অতীতে কী করা হয়েছে, তা নিয়ে সমালোচনা করতেও ছাড়ল না।

হঠাৎ করে, ক্যাথেড্রালের একেবারে মাঝখানে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বুঝতে পারলাম আমি, কাথেড্রালটাই যেন আমি, এটাই যেন আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমরা সবাই বেড়ে উঠছি, আকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। আমরা কোনো কোনো দুর্বলতা লক্ষ করি, যা শুধরে নেয়া দরকার। আমরা সব সময় সর্বোত্তম সমাধানটা বেছে নিতে পারি না। কিন্তু আমরা বিরতিহীনভাবে তা করে যাই, সব সময় নিজেকে নির্মল আর ঊর্ধ্বে তোলার চেষ্টা করি। দেয়াল বা দরজা অথবা জানালার সম্মান রক্ষার্থে তা করি না; কিন্তু ভেতরের খালি জায়গাটার জন্য করতে হয়, ওই ফাঁকা জায়গাটাতে দেবতা পূজিত হয়, আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা।

হ্যাঁ, আমরা সবাই ক্যাথেড্রাল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার ভেতরের ক্যাথেড্রালের ফাঁকা জায়গাটায় কি আছে?

 এসথার, দ্য জাহির।

এসথার সব কিছু অনুভব করে। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ ও। আমি চারদিকে তাকালাম। আমি যে বক্তৃতা দেব, তার প্রস্তুতি নিলাম। আমি বুঝতে পারলাম, কেন তুষারপাতের মধ্যে, ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে, রাস্তার বরফের মধ্যে সাহস করে চলে এসেছি। এটা বুঝাতে এসেছি প্রতিটি দিন আমরা নিজেদের পুনর্নির্মাণ করি। এই প্রথমবারের মতো আমার গোটা অস্তিত্বের মধ্যে মনে হলো- নিজের চেয়ে আরেকজন মানুষকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। প্যারিসে ফেরার পথে আবহাওয়ার অবস্থা অনেক বেশি ভালো থাকা সত্ত্বেও এক ধরনের মোহাবেশের মধ্যে আছি। ভাবতে পারছি না, খুব কমই রাস্তার যানবাহনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। বাড়িতে পৌঁছে, আয়াকে বললাম, কাউকে যেন ভেতরে ঢুকতে না দেয়। জিজ্ঞেস করলাম, যদি সে পরের কয়েক রাত ঘুমিয়ে কাটাতে চায় তাহলে আমার জন্য ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং সাপার তৈরি করে রাখতে পারে। আমি ইন্টারনেটের লাইন পুরোপুরি নষ্ট করে দিলাম। টেলিফোনের প্লাগ খুলে রাখলাম। সেলফোন একটা বক্সের মধ্যে পুরে প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বললাম, আমি ব্যক্তিগতভাবে এসে ওটা নিয়ে নেব।

সপ্তাহ ধরে, সেইন নদীর ধারে প্রতিটি ভোরবেলা হাঁটতে বের হলাম। ফিরে এসে, নিজেকে স্টাডিরুমের মধ্যে বন্দি করে ফেললাম। এ রকমভাবে বন্দি করলাম, যেন আমি কোনো দেবদূতের ঐশীবাণী শুনতে পাচ্ছি, আমি একটা বই লিখতে পারি অথবা অন্তত পক্ষে একটা চিঠি, আমার স্বপ্নের নারীকে দীর্ঘ চিঠি, যাকে আমি ভালোবাসি এবং সব সময় ভালোবাসব। বই হয়তো একদিন ওর হাতে গিয়ে পৌঁছাবে এবং এমনকি যদি তা নাও পৌঁছায়, নিজের আত্মার কাছে শান্তি পাব। আমি আর আমার ক্ষতবিক্ষত গর্বের সাথে যুঝব না। আমি আর এখন প্রতিটি জায়গায়, প্রতি কোণে, প্রতিটি বারে, সিনেমা হলে, নৈশ ভোজে এসথারকে খুঁজে ফিরব না।

 আমি আর মেরির মধ্যে বা খবরের কাগজে ওকে খুঁজে ফিরব না। তার বদলে, এসথার আছে বলেই আমি খুশি। ও আমাকে দেখিয়েছে, আমি এ রকমভাবে ভালোবাসতে পারি, যে সমন্ধে আমি নিজেই জানি না। আর তা আমাকে এ রকম একটি অবস্থায় এনে দিয়েছে।

আমি জাহির বা প্রকাশ্য ব্যাপারটাকে গ্রহণ করলাম। এটা আমাকে হয় পবিত্রতায় অথবা পাগলামিতে পৌঁছে দিতে পারে।

.

এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ- আমার বইয়ের এ টাইটেলটা ধর্মযাজকদের একটা লাইন থেকে নেয়া। বইটা এপ্রিলের শেষে প্রকাশিত হলো। মের দ্বিতীয় এরই মধ্যে বেস্ট সেলার লিস্টের প্রথমে চলে এল সপ্তাহে। পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো, যারা কখনো আমার প্রতি সদয় ছিল না, তাদের আক্রমণ দ্বিগুণ করে দিল। আমি বিগত বছরের ওদের উদ্ধৃতি থেকে মূল ফ্রেজগুলো কেটে কেটে আমার নোটবুকে সেঁটে রেখেছিলাম। দেখলাম, এবারও তারা মূলত সেই একই কথাই বলেছে, শুধু বইয়ের নামটা বদলে ফেলেছে।

… আরো একবার, আমরা যে সমস্যাপূর্ণ সময়ে বাস করি তা পাশ কাটিয়ে, লেখক আমাদের বাস্তব থেকে পালিয়ে ভালোবাসার গল্প শুনিয়েছেন… (ভাবটা এ রকম, যেন লোকজন ভালোবাসা ছাড়াই বেচে থাকে।)

 .. ছোট ছোট বাক্য, ভাসা ভাসা বর্ণনা.. (ভাবখানা এমন, যেন লম্বা বাক্যে জোরটা বেশি।)।

… লেখক সাফল্যের গোপন রহস্য ভেদ করে ফেলেছেন- মার্কেটিং… বাণিজ্যিকরণ… (যেন আমি এ রকম একটা দেশে জন্মেছিলাম, যে দেশের দীর্ঘদিনের সাহিত্যিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং আমি আমার প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রে মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করেছিলাম।)।

.. তার (লেখকের) অন্যান্য বইয়ের মতোই এ বইয়ের কাটতি, যা প্রমাণ করে মনুষ্যজাতি একই রকম ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হতে কতই না প্রস্তুত থাকে… (যেন তারা জানত কী বিষয়ে লেখা হবে।)

কোনো কোনো সমালোচনা একটু ভিন্নধর্মী। তারা সেই সাথে যোগ করেছে গত বছরের স্কাল থেকে আমি প্রচুর লাভ করেছি, এমনকি আরো অর্থ উপার্জনের জন্যই মি ওই জাতীয় স্ক্যান্ডালের সৃষ্টি করেছি। আর সব সময়ের মতো, এই রকম ঋণাত্মক সমালোচনায় আমার বই আরো বেশি বিক্রি হতে থাকে। আমার বিশ্বস্ত পাঠকেরা যেভাবেই হোক বইটা জোগাড় করে। আর যারা আমার ওই স্কাল্ডালের ব্যাপারে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল তাদের আবার তা মনে পড়ে যায়। তখন তারাও বইটার কপি কিনে আনে, কারণ এসথারের অন্তর্হিত হওয়ার রহস্য আমার জবানিতেই শুনতে চায় (যদিও এ বইটা পুরোপুরি সে সমন্ধে নয়, কিন্তু এ বইটা ভালোবাসার ক্ৰোন্তর মতো, তারা অবশ্যই বই পড়ে বেশ হতাশ হবে। তাদের কোনো সন্দেহ থাকবে না যে, সমালোচকরা বই না পড়েই সমালোচনা করেন। বইয়ের স্বত্ব খুব তাড়াতাড়িই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়ে গেল, যেসব জায়গায় সাধারণত আমার বই প্রকাশিত হয়।

 টাইপরত অবস্থায় প্রকাশকের কাছে পাঠানোর আগে মেরি গোটা পাণ্ডুলিপিটা পড়েছিল, আশা করেছিল ওর কথা লেখা থাকবে, কিন্তু সে ঈর্ষান্বিত হওয়ার পরিবর্তে আমাকে এ ব্যাপারে আরো উৎসাহ দিতে লাগল। আর এ বইয়ের সাফল্যে বেশ থ্রিল অনুভব করল। এই সময়ে, সে রহস্যময় জিনিসের ব্যাপারে পড়ছিল, আমাদের কথোপকথনের মধ্যে তা পুনরাবৃত্তি করতে থাকে।

.

যখন লোকজন আমাদের প্রশংসা করে, আমাদের সব সময় সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা উচিত, আমরা কীভাবে আচরণ করি।

 সমালোচকরা কখনো আমার প্রশংসা করে না।

আমি তোমার পাঠকদের কথা বলতে চেয়েছি। তুমি আগের চেয়ে এবার অনেক বেশি চিঠি পেয়েছ। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, তুমি আগের চেয়ে অনেক ভালো লিখেছ। নিজেকে মিথ্যা খোলসের মধ্যে রেখ না, তা খুব বিপজ্জনক হতে পারে।

ভিটোরিয়ার ক্যাথেড্রাল পরিদর্শন করার পর থেকে, আমি নিজেকে যতটা ভাবি তার চেয়ে অনেক বেশি বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু তাতে এসব পাঠকের চিঠির ব্যাপার কিছু বোঝায় না। ব্যাপারটাকে তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে, আমি ভালোবাসার রহস্য আবিষ্কার করেছি।

খুব ভালো। এ বইয়ের ব্যাপারে যে জিনিসটা আমি পছন্দ করি, তা হলো, কোনো ক্ষেত্রেই তুমি তোমার আগের বউকে দোষ দাওনি। আর তুমি নিজেকেও দোষী করোনি।

ওসব করে সময় নষ্ট না করতে শিখেছি।

 তাহলে কি তুমি মনে করো এসথারের অন্তর্ধান এক ধরনের শুদ্ধি প্রক্রিয়া?

দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যে উপশমের শক্তি আছে, আমি তাকে বিশ্বাস করি না। ওসব ঘটে, কারণ ওসব আমাদের জীবনেরই অংশ। ওগুলো শাস্তি হিসেবে দেখা উচিত নয়। সাধারণভাবেই বলছি, জগটা আমাদের শিখিয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, আমাদের বন্ধুদের আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বুঝিয়েছে কখন আমরা ভুল করি। মনে হয় আমি ঠিক বলেছি, ব্যাপারটা তোমার সাথে ঘটেছে।

আমি সম্প্রতি কিছু বিষয় শিখেছি, আমাদের প্রকৃত বন্ধু তারাই, যখন ভালো জিনিস ঘটে তখন আমাদের সাথে থাকে যারা। তারা আমাদের সাথে আনন্দ করে। আমাদের উৎসাহিত করে। আমাদের বিজয়ে খুশি হয়। ভণ্ড বন্ধুরাই শুধু কঠিন সময়ে আবির্ভূত হয়, তারা তাদের দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে সাহায্যের ভাব করে, তখন প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দুঃখ-কষ্ট তাদের নিজের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনে সান্ত্বনা হয়ে দেখা দেয়। যখন গত বছরে আমাদের জীবনে খুব খারাপ ব্যাপার ঘটে গেল, তখন অনেক লোক যাদের আমি আগে কখনো দেখিনি তারা আমাকে সান্ত্বনা দিতে এল। আমি এ ব্যাপারটা ঘৃণা করি।

 একই রকম ব্যাপারটা আমার বেলায়ও ঘটে।

 কিন্তু আমি খুব কৃতজ্ঞ যে আমার জীবনে এসেছ তুমি, মেরি।

এত তাড়াতাড়ি এত বেশি কৃতজ্ঞ হয় না। আমাদের সম্পর্কটা এখনো ততটা মজবুত হয়নি। ঘটনাক্রমে, আমি প্যারিসে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছি, অথবা তোমাকে মিলানে বাস করার জন্য আসতে বলতে চাইছি। এতে আমাদের কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। তুমি সব সময় ঘরেই কাজ করো। আমি সব সময় বাইরে বাইরে থাকি। তুমি কি চাও এই প্রসঙ্গে কথা না বলে অন্য কিছু বলি অথবা আমরা কি সম্ভবনা আছে ধরে আলোচনা চালিয়ে যাব?

প্রসঙ্গ বদলালেই বোধ হয় ভালো হয়।

তাহলে আমরা অন্য বিষয়ে কথা বলি। এ বই লিখতে তোমার অনেক সাহস দেখাতে হয়েছে। যে বিষয়টা আমাকে বেশি বিস্মিত করেছে, তুমি একবারও সেই তরুণের কথা উল্লেখ করোনি।

আমি ওর প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করিনি।

তোমার তা করা উচিত। প্রতি মুহূর্তে তোমার নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত: এসথার কেন ওকে বেছে নিল?

আমি নিজেকে কখনো ও প্রশ্ন করিনি।

তুমি মিথ্যা বলছ। আমার মাঝেমধ্যে জানতে ইচ্ছা করে, কেন আমার প্রতিবেশী তার একঘেয়ে হাস্যমুখ বউটাকে তালাক দেয় না। বউটা সব সময় ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে, রান্নাবান্না করা, বাচ্চাদের সামলানো, বিল মেটানো। আমি যদি নিজেকে এ প্রশ্ন করতে পারি, তোমারও তা করা উচিত।

তুমি কি বলতে চাইছ আমি ওই তরুণকে ঘৃণা করি? কারণ সে আমার বউ চুরি করে নিয়ে গেছে?

না, আমি শুনতে চাই তুমি বলছ তুমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছ।

আমি তা করতে পারি না।

ব্যাপারটা কঠিন, আমি জানি। কিন্তু তোমার অন্য কোনো পথ খোলা নেই। যদি তা না করো, তাহলে যে যন্ত্রণা সে তোমাকে দিয়েছে সব সময় তার ব্যাপারে ভাববে তুমি। আর কখনো যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। আমি বলতে চাইছি না, তোমার ওকে পছন্দ করা উচিত। বলতে চাইছি না, তোমার ওকে খুঁজে বের করা উচিত। তোমাকে এই পরামর্শ দেব না যে, তুমি ওই তরুণকে একজন দেবদূত হিসেবে ভাবতে শুরু করো। ওর বর্তমান নাম কী? রাশিয়ান কিছু একটা, তাই না?

ওর নাম কি তাতে কিছু আসে-যায় না।

দেখেছ? এমনকি তার নামও মুখে আনতে চাও না তুমি। তুমি কি কুসংস্কারাচ্ছন্ন?

মিখাইল। এই তো জেনে গেছ। এটাই ওর নাম।

ঘৃণার শক্তি তোমাকে কোনো কিছু থেকে মুক্তি দেবে না। কিন্তু ক্ষমার শক্তি, যা ভালোবাসার মধ্যে নিজেকে উন্মোচিত করে, তোমার জীবনকে একটা ভালো দিকে ঘুরিয়ে দেবে।

এখন তোমার কথা শুনে তিব্বতের জ্ঞানীদের কথার মতো মনে হচ্ছে, ছুটন্ত বস্তু থিওরির জন্য খুব ভালো কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করা অসম্ভব। ভুলে যেও না, এর আগে আমি আঘাত পেয়েছিলাম।

 ঠিক তাই। তুমি এখনো সেই ছোট্ট বালকটাকে তোমার ভেতরে বহন করে চলেছ। স্কুলের সেই দুর্বল ছেলেটি, যে বাবা-মায়ের কাছ থেকে তার কান্না লুকিয়ে রাখে। তুমি এখনো সেই দুবলা পাতলা ছেলেটিকে বয়ে বেড়াচ্ছ, যে কোনো বান্ধবী জোটাতে পারেনি, আর কখনো খেলাধুলায় ভালো ছিল না। তুমি এখনো তোমার জীবনে যেসব অবিচার ঘটে গেছে তা সামলে উঠে উত্তরণ ঘটাতে পারোনি। কিন্তু এসব মনে রেখে লাভটা কী?

তোমাকে এসব কে বলেছে?

যেভাবেই হোক, আমি জানি। তোমার চোখের ভেতরে তা দেখতে পাই। সব কিছু সেভাবেই হয়ে থাকে যেভাবে তুমি চাও। তুমি নিজের জন্য দুঃখ পাও। কারণ তুমি সেই সব মানুষের দ্বারা আক্রান্ত, যারা তোমার চেয়ে শক্তিশালী। অথবা তোমাকে তা তাড়া করে ফেরে, তুমি আরো বেশি বেশি নিজেকে ছদ্মাবরণে মুড়ে রাখো, যাতে যেসব মানুষ তোমাকে আঘাত করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারো। ব্যাপারটা কি অহেতুক সময় নষ্ট নয়?

এটাই মানুষের ধর্ম।

ওহ, হ্যাঁ তাই। কিন্তু ব্যাপারটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যুক্তিসংগতও নয়। পৃথিবীতে কাটানো সময়ে তোমার সময়ের ওপর কিছুটা শ্রদ্ধা অন্তত দেখাও। জেনে রেখো, ঈশ্বর সব সময় তোমাকে ক্ষমা করে আসছেন, ভবিষ্যতেও করবেন।

.

আমার বইয়ের জন্য চ্যাম্প-এলিসির একটা মেগাস্টোরে ভিড় জমে গেছে। আমি জনতার মধ্যে বইয়ের অটোগ্রাফ দিতে দিতে ভাবলাম : আমার স্ত্রীর সাথে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, এর মধ্যে কতজনের ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতা আছে?

খুব কম মানুষেরই। সম্ভবত একজন বা দুজনের। যদি তা হয়ে থাকে, তাদের বেশির ভাগই আমার নতুন বইয়ে কী আছে, তা শনাক্ত করতে পারবে।

 জগতের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ কাজগুলোর মধ্যে লেখালেখি অন্যতম। প্রতি দুই বছর আমি কম্পিউটারের সামনে বসে থাকি। আমার হৃদয়ের মধ্যে আত্মার মধ্যের অজানা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি, কতকগুলো দ্বীপ দেখতে পাই আমার আইডিয়া বেড়ে ওঠার অপেক্ষায় এবং এক সময় সেগুলো পরিপক্ক হয়ে ফেটে পড়বে। তারপর আমি আমার নৌকায় উঠে পড়ি- জাগতিক ভাষায় যেগুলোকে শব্দ বলা হয়- সবচেয়ে কাছের দ্বীপটার দিকে এগোতে থাকি। পথিমধ্যে সাগরের শক্তিশালী স্রোতের মুখোমুখি হই, মুখোমুখি হই ঝড়ের কিন্তু দাঁড় বাইতে থাকি। ক্লান্ত, জানি আমি আমার পছন্দসই পথ থেকে ছিটকে যেতে পারি আর যে দ্বীপে পৌঁছাতে চাই, তা হয়তো দিগন্তের কোথাও নেই।

আমি ফিরে আসতে পারি না। যেভাবেই হোক আমাকে দাঁড় বেয়ে যেতে হয়। তা না হলে আমি সাগরের মাঝে হারিয়ে যাব। এ ক্ষেত্রে, দৃশ্যের পর দৃশ্যাবলি আমার মনের আকাশে ভিড় করে। যেমন আমার বাকি জীবন হয়তো বিগত দিনের সাফল্যের কথা বলে কেটে যাবে। অথবা নতুন লেখকদের বিরুদ্ধে তিক্ত সমালোচনা করে কাটবে। কারণ আমার আর নতুন কোনো বই প্রকাশ করার সাহস নেই। এটাই কি আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন নয়? তারপর আমি অবশ্যই আমার নতুন বাক্য লেখার কাজ চালিয়ে যাব। অনুচ্ছেদ, পরিচ্ছেদ এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে যাব। সাফল্য বা ব্যর্থতার এই ফাঁদে ধরা দেব না। অন্যথায়, আমার জীবনের আর কী অর্থ থাকতে পারে? ফ্রান্সের দক্ষিণে একটা পুরনো মিল কিনতে পারি আর বাগান করতে পারি? তার বদলে বক্তৃতা দিতে পারি, কারণ লেখার চেয়ে কি বক্তৃতা দেয়া সহজ নয়? শব্দগুলো ঠিকঠাক হিসাব করে লিখে, রহস্যময় পথে, একটা কিংবদন্তি সৃষ্টি করার জন্য আমি কি নিজেকে অনেক আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছি না?

এসব ভয়ংকর চিন্তাভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে, আমি শক্তি সাহস খুঁজে পাই। এ রকম সাহস আমার মধ্যে আছে জানতাম না। তারা আমাকে আত্মার অজানা অংশের অভিযানে সাহায্য করে। আমি নিজেকে স্রোতের দিকে ভাসিয়ে দিই। শেষ পর্যন্ত পছন্দসই দ্বীপে নোঙর করতে পারি। দিন-রাত ধরে কী দেখেছি তার বর্ণনা করে যাই। আশ্চর্য লাগে, কেন আমি এসব করছি? নিজেকে বলি, সত্যিই যন্ত্রণা আর শক্তির অপচয় ঠিক নয়। আমার কারোর কাছে কোনো কিছু প্রমাণ করার দরকার নেই। আমি যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি। আমি যা স্বপ্ন দেখেছি, তাও পেয়েছি।

আমি লক্ষ করেছি, আমার প্রথম বই লেখার সময় যে রকম অবস্থা হয়েছিল, এখনো সেই অবস্থা হচ্ছে। সকাল নয়টায় ঘুম থেকে জেগে উঠতাম আমি। সকালের প্রাতঃরাশ সেরে খুব তাড়াতাড়িই কম্পিউটারের সামনে বসার জন্য প্রস্তুতি নিতাম। তারপর পেপারপত্রিকা পড়া শুরু করতাম। একটু হাঁটতে বের হতাম, কথা বলার জন্য নিকটস্থ বারে যেতাম, বাড়িতে ফিরে এসে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তখনই আবিষ্কার করতাম কয়েকটা ফোন কল করার দরকার আছে আমার। আবার কম্পিউটারের দিকে তাকাতাম, ততক্ষণে দুপুরের খাবার রেডি। খেতে বসে ভাবতাম রাত এগারোটা থেকে লেখা শুরু করা উচিত। কিন্তু এখন আমার ভাতঘুম দরকার। আমি বিকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে জেগে উঠতাম। শেষ পর্যন্ত কম্পিউটার চালু করতাম। আমার ইমেইলগুলো চেক করতে যেতাম, তখনই মনে পড়ত আমি আমার ইন্টারনেট কানেকশন নষ্ট করে দিয়েছি। এখন থেকে দশ মিনিটের পথ গেলেই আমি অনলাইন কানেকশনের দোকানে পৌঁছাতে পারি; কিন্তু আমি তা করব না। নিজেকে এসব দোষ থেকে মুক্ত রেখে, অন্তত আধঘণ্টার জন্য কি লিখতে পারি না?

আমি কর্তব্য সচেতন হয়ে উঠলাম। কিন্তু হঠাৎ করে সেই জিনিসটা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। থামতে পারলাম না। আমার চাকরানি রাতের খাবারের জন্য ডাকতে এল। আমি ওকে বাধা না দিতে বললাম। এক ঘণ্টা পর চাকরানি আবার ডাকতে এল। আমি ক্ষুধার্ত। কিন্তু আমাকে অন্তত আরেকটা লাইন বেশি হলেও লিখতে হবে, অন্তত আরেকটা বাক্য, আরো এক পাতা। সেই সময়ে আমি টেবিলের সামনে বসে পড়লাম। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোনোমতে সেগুলো গলাধঃকরণ করে আবার কম্পিউটারের সামনে বসলাম। আমার পায়ের নিচে কী আছে, সে ব্যাপারে আমার আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দ্বীপটা নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেছে আমার কাছে। আবার সেই পথে এগিয়ে যেতে লাগলাম আমি। এ রকম সব জিনিস পেতে লাগলাম, যা আমি কখনো ভাবিনি বা স্বপ্নেও দেখিনি। এক কাপ কফি পান করলাম। তারপর আরেক কাপ নিলাম। রাত দুটো পর্যন্ত একটানা লিখে গেলাম। সুবহে সাদিকের সময় লেখা থামালাম। কারণ আমার চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

 বিছানায় গেলাম। আরো এক ঘণ্টা পরবর্তী অনুচ্ছেদে কী লিখব, সে ব্যাপারে চিন্তা করে আরেক ঘণ্টা কাটালাম। এসব নোট পরে কোনো কাজে লাগে না। ওগুলো শুধু আমার মন থেকে বেরিয়ে গেলেই আমি ঘুমাতে পারি। প্রতিজ্ঞা করলাম, পরের দিন সকালে এগারোটায় প্রম্পট করা শুরু করব। পরের দিন সেই একই ঘটনাগুলো ঘটতে লাগল- হাঁটতে বের হলাম, কথোপকথন চলতে লাগল, লাঞ্চ করলাম, ভাতঘুম দিলাম, নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল, ইন্টারনেট কানেকশন নষ্ট করার জন্য নিজের ওপর খেপে উঠলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি আবার বসে পড়ে প্রথম পৃষ্ঠা লেখা শুরু করলাম…

হঠাৎ করে, দুই, তিন, চার, এগারো সপ্তাহ কেটে গেল। আমি জানি বইয়ের প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি। আমার মধ্যে এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতি এল। মনে এল কেউ একজন আমার ভেতরে শব্দের ভাণ্ডার গচ্ছিত রেখেছিল আবার তা বের করে নিয়ে গেছে। এখন, একেবারে শেষ বাক্যটা লিখতে শুরু করেছি। আমি লিখেছি।

 আমি যখন লেখকদের আত্মজীবনী পড়তাম, সব সময় ভাবতাম, লেখকরা মনে হয় তাদের পেশাকে আরো বেশি ইন্টারেস্টিং বোঝানোর জন্য বলত, এই বইটা নিজেই লেখা হয়েছে, লেখক তো শুধু টাইপিস্টের ভূমিকা পালন করেছে। এখন আমি জানি, ব্যাপারটা পুরোপুরি নির্জলা সত্য। কেউ জানে না, স্রোত কেন তাকে একটা নির্দিষ্ট দ্বীপে নিয়ে যায়। তারা যেখানে পৌঁছাতে চায় সেখানে নেয় না। এরপরপরই আমার পুনরায় পড়া এবং এডিটিংয়ের কাজ শুরু হয়। আর শেষ পর্যন্ত যখন আর একই শব্দ আরো একবারও পড়ার মতো ধৈর্য রাখতে পারি না, আমি এটা আমার প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিই। ওখানে আবার সম্পাদিত হয়। তারপর প্রকাশিত হয়।

আমার কাছে ব্যাপারটা বিস্ময়ের যখন আবিষ্কার করলাম, অন্য লোকেরাও আমার মতো দ্বীপ খুঁজে ফেরে এবং তারা সেই দ্বীপটাকে আমার বইয়ের মধ্যে খুঁজে পায়। একজন আরেকজনকে তা বলে, রহস্যময় চেইন বাড়তে থাকে। লেখক যা তার নিঃসঙ্গতার ক্রিয়াকাণ্ড ভেবেছিল তাই একটা সেতুবন্ধ, একটা নৌকা হয়ে যায়, যাতে অন্যরাও ভ্রমণ করতে পারে, যোগাযোগ করতে পারে। তারপর থেকে, আমি ঝড়ের বুকে হারিয়ে যাওয়া মানুষ নই। আমার পাঠকের মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে পাই আমি। কী লিখেছি তা নিজে যখন বুঝতে পারি, দেখি অন্যরাও তা বুঝতে পারছে, কিন্তু তা কখনো আগে ঘটে না। খুব কম ক্ষেত্রেই, অন্যদের কী ঘটেছে তা দেখি আমি। আমি সেসব মানুষের চোখের দিকে তাকাই। বুঝতে পারি আমার আত্মা একা নয়।

.

অ্যাপয়নমেন্ট অনুযায়ী, বইয়ে স্বাক্ষর দিতে শুরু করলাম। চোখে চোখ রেখে আনন্দ প্রকাশ, সামাজিক বন্ধন, আর পারস্পরিক সম্মানের প্রকাশ ঘটাতে লাগলাম। হ্যান্ডশেক, কিছু চিঠিপত্র, উপহার, মন্তব্য এসবও চলতে লাগল। ঘণ্টা দেড়েক পরে, অন্তত দশ মিনিটের জন্য বিশ্রাম চাইলাম আমি। কেউ অভিযোগ করল না। আমার প্রকাশক ( ফ্রান্সে বই স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে যে রীতি প্রচলিত) লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে শ্যাম্পেন সার্ভ করতে বলল। (আমি অন্য দেশগুলোতেও এই রীতি প্রচলনের চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা সব সময় বলে এসেছে ফরাসি শ্যাম্পেন খুবই দামি জিনিস আর শেষ পর্যন্ত মিনারেল ওয়াটারে তা শেষ হয়। কিন্তু তাতেও যারা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য সম্মান দেখানো হয় না।)

আমি আবার টেবিলে ফিরে এলাম। দুই ঘণ্টা পরে, সবাই লক্ষ করে বুঝতে পারল, আমি ক্লান্ত নই, বরং প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সারা রাত এ রকমটি চালাতে পারি আমি। যাই হোক, দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। লাইনের লোকজন কমে গেছে। বাম দিকে অন্তত চল্লিশজনের মতো আছে। ওরা ধীরে ধীরে ত্রিশ, বিশ, এগারো, পাঁচ, চার, তিন, দুই… এবং হঠাৎ করে আমাদের চার চোখের মিলন হলো।

শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। আমি শেষেই আসতে চেয়েছি, কারণ আপনার জন্য আমার কাছে একটা মেসেজ আছে।

আমি জানি না কী বলতে হয়। একপাশে তাকালাম। প্রকাশক, বিক্রেতারা, বই বিক্রেতা, ওরা সবাই বেশ প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। আমরা খুব তাড়াতাড়িই ডিনারে যাব। দিনের উত্তেজনাময় ব্যাপারগুলো শেয়ার করব। বইয়ে স্বাক্ষর করার সময় যেসব অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে, সেগুলো বর্ণনা করব।

ওকে আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু জানি লোকটা কে। আমি ওর কাছ থেকে বইটা নিয়ে লিখলাম :

মিখাইলের জন্য, আমার শুভেচ্ছাসহ।

 কিছুই বললাম না আমি। ওকে হারালে চলবে না। একটা শব্দ, একটা বাক্য, একটু নড়াচড়ার ফাঁকে ও চলে যেতে পারে। আর হয়তো কখনো ফিরে আসবে না। সময়ের ভগ্নাংশে, বুঝতে পারলাম, শুধু ও এবং একমাত্র ওই আমাকে আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ থেকে বাঁচাতে পারে- দ্য জাহির, কারণ একমাত্র ওই জানে কোথায় এসথারকে খুঁজে পাওয়া যাবে। শেষ পর্যন্ত আমি সেই প্রশ্নটা করতে পারলাম, যা দীর্ঘদিন ধরে আওড়ে গেছি।

 আপনাকে জানাতে চাই ও ভালো আছে, এমনকি আপনার বইও পড়েছে।

প্রকাশক, বই বিক্রেতারা আমার কাছে এল। ওরা সবাই আমাকে আলিঙ্গন করল। জানাল, খুব ভালো একটা অপরাই কেটেছে। এখন পানীয় নিয়ে রিলাক্স করে এ ব্যাপারে আলাপ করা যায়।

 আমি এই তরুণকেও আমাদের সাথে সাপারে নিমন্ত্রণ করতে চাই। আমি বললাম, ইনি কিউয়ের সবার শেষে ছিলেন। আজকের সমস্ত পাঠকের পক্ষ থেকে ইনি প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন।

পারছি না, আমার ভয় হচ্ছে, আরেকটা জায়গায় যাওয়ার কথা আছে আমার। তারপর আমার দিকে ঘুরে, চমকে ওঠার বদলে, সে যোগ করল, আমি শুধু আপনাকে ওই মেসেজটা দিতে এসেছিলাম।

 কোন মেসেজ? একজন বই বিক্রেতা জিজ্ঞেস করল।

উনি সাধারণত কখনো কাউকে আমন্ত্রণ করেন না! প্রকাশক বললেন, চলে আসুন, আমরা সবাই মিলে সাপারে যোগ দিই!

 আপনার অনেক দয়া। কিন্তু প্রতি বৃহস্পতিবারে আমাকে একটা মিটিংয়ে যোগ দিতে হয়।

মিটিং কখন শুরু হবে?

ঘণ্টা দুই পরে।

 মিটিংটা কোথায়?

একটা আর্মেনিয়ান রেস্টুরেন্টে।

আমার ড্রাইভার নিজে একজন আর্মেনিয়াম। তাকে জিজ্ঞেস করতেই জানাল, আমরা যেখানে খেতে যাচ্ছি তার থেকে মাত্র পনেরো মিনিটের পথ। সবাই সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছিল আমাকে। তারা ভাবছিল, যে মানুষটাকে আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি সে হয়তো খুব খুশি হবে। নিজেকে সম্মানিত ভাববে। আর অন্য যা কিছু আছে, তা অপেক্ষা করতে পারে।

আপনার নাম কী? মেরি জিজ্ঞেস করল।

 মিখাইল।

 বেশ, মিখাইল, আর বুঝতে পারলাম মেরি সব কিছু বুঝতে পেরেছে। আপনি কেন অন্তত ঘণ্টাখানেকের জন্য আমাদের সাথে আসছেন না? আমরা যে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি, তা এই কোনার দিকে। তারপর যেখানে যেতে চান, ড্রাইভার আপনাকে দিয়ে আসবে। আর যদি আপনার জন্য ভালো হয়, তাহলে আমরা আমাদের রিজারভেশন ক্যানসেল করে দিয়ে সবাই মিলে তার বদলে আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁয় যেতে পারি। তাতে আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু থাকবে না।

 আমি ওর দিকে না তাকিয়ে পারছিলাম না। ওকে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে খুব একটা হ্যান্ডসাম অথবা কুৎসিৎ বলা যায় না। খুব একটা খাটো বা অনেক বেশি লম্বা নয়। কালো একটা পোশাক পরেছে, সাধারণ হলেও অভিজাত।

 মেরি মিখাইলকে পথ দেখিয়ে বাইরের দিকে এগিয়ে গেল। বই বিক্রেতাদের কাছে এরই মধ্যে স্থূপাকৃতির বই রয়েছে যেগুলোতে এখনো স্বাক্ষর দেয়া হয়নি, যার পাঠকরা এখনো স্বাক্ষরের জন্য আসেনি। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, ওগুলো আগামী দিনে শেষ করব। আমার পা কাঁপছিল, হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুতগতির হয়ে গেছে। যদিও এখনো ভান করে চলেছি সব কিছু ঠিকঠাক আছে। আমি খুশি বইয়ের স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সাফল্যের সাথে শেষ হয়েছে। অন্যরাই কি বলেছে সে ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী। আমরা চ্যাম্প এলিসি পার হলাম। আর্ক ডি ট্রিয়োম্পির আড়ালে সূর্য অস্ত গিয়েছে। বিশেষ কিছু কারণে, আমি জানি এটা একটা লক্ষণ। খুব ভালো লক্ষণ।

 যতক্ষণ পারি এ পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

আমি কেন ওর সাথে কথা বলতে চাই? পাবলিশিং হাউসের লোকজন আমার সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে, অটোমেটিক্যালি সাড়া দিচ্ছি আমি। কেউ লক্ষ করছে না আমার মন অনেক দূরে হারিয়ে গেছে, বুঝতে চেষ্টা করছি আমি কেন ওকে সাপারের নিমন্ত্রণ করলাম। তার বদলে ওকে ঘৃণা করা উচিত ছিল। তাহলে কি আমি এসথার কোথায় আছে, তা খুঁজে পেতে চাই? আমি কি এই তরুণের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই? আমি যাকে ভালোবাসি তাকে নিজের যোগ্যতা বলে আপন করে নিয়েছে বলে? আমি কি নিজের কাছে প্রমাণ করতে চাই, আমি ওর চেয়ে অনেক উচ্চস্তরের মানুষ? আমি কি ওকে ঘুষ দিতে চাই, ওকে প্রভাবিত করতে চাই, যাতে আমার স্ত্রীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়?

আমি এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। সেটা কোনো ব্যাপার না। একমাত্র যে জিনিসটা এখনো বলে চলেছি তা হলো : আমি এই তরুণকে সাপারে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। আমি এ রকম দৃশ্য প্রায়ই কল্পনা করতাম। আমাদের দেখা হয়েছে, আমি ওর গলা টিপে ধরেছি, মুখে ঘুষি দিয়েছি, এসথারের জন্য লড়াই করছি। এসথারের জন্য কষ্ট পাচ্ছি। আমি এ রকম কত কিছু কল্পনা করেছি, এমনকি স্ক্যান্ডালের কথাও চিন্তা করেছি। কিন্তু কখনো ওকে সাপারে আমন্ত্রণ জানানোর কথা আমার মাথায় আসেনি।

এরপর আমি কী করব, তা জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। শুধু মেরির দিকে নজর রাখছি। মেরি আমার থেকে একটু এগিয়ে হাঁটছে। মিখাইলের হাত ধরে  রেখেছে, যেন সে মিখাইলের গার্লফ্রেন্ড। মেরি ওকে যেতে দিচ্ছে না এবং একই সাথে আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে, কেন মেরি আমাকে সাহায্য করছে, যেখানে মেরি জানে এই তরুণের সাথে আমার সাক্ষাৎ হওয়া মানে আমি যেকোনোভাবে আমার স্ত্রী কোথায় আছে তা জেনে নিতে পারি।

আমরা রেস্তোরাঁয় পৌঁছালাম। মিখাইল আমার থেকে দূরে বসেছে। সম্ভবত আমার সাথে কথোপকথন এড়িয়ে যেতে চায়। হাসাহাসি, শ্যাম্পেন, ভদকা আর ক্যাভিয়ার- আমি একনজর মেনুর ওপর চোখ বুলিয়ে গেলাম। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম, বই বিক্রেতা প্রায় হাজার ডলারের কাছাকাছি আমাদের জন্য ব্যয় করছে। সাধারণ কথাবার্তা হতে লাগল, মিখাইলকে জিজ্ঞেস করা হলো সন্ধ্যায় এই মিটিংয়ের ব্যাপারে সে কী ভাবছে। সে জানাল, বেশ উপভোগ করছে। তাকে বইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলো। জানাল, বইটা বেশ উপভোগ করেছে। তারপর সে ভুলে গেল, আমার দিকে মনোযোগ দিল। আজকের ব্যাপারটাতে আমি খুশি কিনা, যে কিউয়ে স্বাক্ষর দিতে হয়েছে তার অর্গানাইজ পছন্দ করেছি কিনা, নিরাপত্তার ব্যাপার কেমন ছিল? আমার হৃদয় তখনো ধড়ফড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওপরে ওপরে আমি শান্ত। আমি সব কিছুর জন্য ওদের ধন্যবাদ জানালাম।

আধাঘণ্টা মতো কথাবার্তার পরে, অনেকখানি ভদকার সদ্ব্যবহারে, আমি দেখতে পেলাম মিখাইল রিলাক্স হতে শুরু করেছে। ও আর এখন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে নেই। ওর বেশি কিছু বলার নেই। আরো কিছুক্ষণ আমাদের সাথে থেকে চলে যেতে পারে। আমি জানি আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁয় যাওয়ার ব্যাপারে ও মিথ্যা বলেছে। তো অন্তত এখন আমি একটা কু পেয়েছি। আমার স্ত্রী এই মুহূর্তে প্যারিসে আছে! আমাকে অবশ্যই বন্ধুত্বের ভান করে যেতে হবে। ওর আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে। প্রাথমিক টেনশনটা চলে গেছে।

 এক ঘণ্টা পরে, মিখাইল ওর ঘড়ির দিকে তাকাল। আমি দেখতে পেলাম ও চলে যেতে চাইছে। আমার এখনি কিছু করা উচিত। যতবার ওর দিকে তাকাই, ওকে ততই তুচ্ছ মনে হয়। ততই বুঝতে পারি না এসথার কীভাবে ওই লোকটার সাথে চলে যেতে পারে। (এসথার উল্লেখ করেছিল, ওর ম্যাজিক্যাল পাওয়ার আছে।) নিজের শত্রুর সাথে কতক্ষণ পুরোপুরি সহজ থাকার ভান করা যায়, আমার অন্য কিছু করা দরকার!

আমাদের পাঠকের ব্যাপারে আরো কিছু খুঁজে দেখি, চলো। আমি বললাম। সবাই চুপ করে গেল। ও এখানে আছে, যেকোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারে। আর ও নিজের সমন্ধে তেমন কিছুই বলেনি। আপনি কী করেন?

কয়েক পেগ ভদকার প্রভাবে ওকে যে রকম মাতাল মনে হচ্ছিল, মিখাইলকে দেখে মনে হলো হঠাৎ করে ও সামলে নিয়েছে।

আমি আর্মেনিয়ান রেস্টুরেন্টে মিটিং অর্গানাইজ করি।

সেখানে কোনো ব্যাপারে জড়িত?

আমি স্টেজে দাঁড়িয়ে গল্প বলি। আর ওখানে দর্শকের আসনে থাকা লোকেরাও তাদের গল্প বলে।

আমিও আমার বইতে একই ব্যাপার করি।

আমি জানি, আর সে কারণেই আমি প্রথমে সাক্ষাৎ…

 মিখাইল কে তা বলতে চাইছিল!

আপনি কি এখানে জুনন্মছেন? মেরি জিজ্ঞেস করল। সে কারণে মিখাইল ওর বাক্য শেষ করতে পারল না।

 আমি কাজাখস্তানে জন্মেছি।

কাজাখস্তান। কাজাখস্তান কোথায় তা জিজ্ঞেস করার মতো হিম্মত কার আছে?

কাজাখস্তান কোথায়? সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ জিজ্ঞেস করল।

যারা নিজেরা জানে না এবং তা স্বীকার করতে ভয় পায় না তাদের আশীর্বাদ করি।

কেউ আমাকে তা জিজ্ঞেস করুক, সে জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। মিখাইল বেশ আনন্দিত স্বরে বলল, যখনই বলি আমি কোথায় জন্মেছিলাম, প্রায় দশ মিনিট পরে লোকজন বলে আমি পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তান থেকে এসেছি… আমার দেশ মধ্য এশিয়ায়। এ দেশে মাত্র চৌদ্দ মিলিয়ন জনসংখ্যা, ফ্রান্সের চেয়ে বড় যার জনসংখ্যা ষাট মিলিয়নের বেশি।

 তো, তাহলে ওখানে কেউ জায়গার স্বল্পতা নিয়ে কোনো অভিযোগ করে না। প্রকাশক হাসতে হাসতে বললেন।

 এটা এ রকম জায়গা, গত শতাব্দীতে, কেউ কোনো বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেনি, এমনকি যদিও তা তারা করতেও চাইত। কমিউনিস্ট শাসন নির্মূল হয়ে ব্যক্তিগত মালিকানায় সম্পত্তি চলে গেল তখন গবাদিপশুর সংখ্যা বেড়ে গেল এবং প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ মারা পড়ল। আপনারা কি জানেন তার মানে কী? প্রায় আমার দেশের অর্ধেক লোক ১৯৩২ থেকে ১৯৩৩, এই এক বছরে না খেতে পেয়ে মারা যায়।

নীরবতায় ডুবে গেল সবাই। সর্বোপরি, ট্র্যাজেডি উৎসবের পথ দেখিয়ে দেয়। কেউ একজন এ প্রসঙ্গটা বদলে দিক। যাই হোক, আমি আমার পাঠকদের সব সময় তার দেশ সমন্ধে বলতে বলি।

ওখানকার স্টেপসগুলো কেমন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

বিস্তৃত সমতল ভূমি, কোনো রকম গাছপালা সবুজ নেই, আমি নিশ্চিত আপনি তা জানেন।

আমি জানি, কিন্তু প্রশ্নটা করার উদ্দেশ্য হলো কথোপকথন চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আমি।

কাজাখস্তানের ব্যাপারে আমার এই মুহূর্তে কিছু কথা মনে পড়ল। প্রকাশক বললেন, কিছুদিন আগে, আমি একটা টাইপ করা পাণ্ডুলিপি ওখানে থাকা একজন লেখককে পাঠিয়েছিলাম, একটা পারমাণবিক পরীক্ষা ওই স্টেপে সংঘটিত হয়েছিল।

আমাদের দেশের মাটিতে রক্ত, এর আত্মা রক্তস্নাত। এই পরীক্ষা এ রকম পরিবর্তন এনে দিয়েছে, যা বদলানোর দরকার ছিল না। অনেক প্রজন্ম ধরে আমাদের সেই দায় মেটাতে হবে। আমরা এমন কি একটা গোটা সাগর অদৃশ্য হতে দেখেছি।

 এবার মেরির কথা বলার পালা।

কেউ একটা সাগরকে অদৃশ্য করে দিতে পারে না।

আমার বয়স পঁচিশ বছর। আর এই সময়টুকুতেই তা হয়েছে। শুধু একটা প্রজনেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী যা পানিরূপে ছিল তা ধুলায় পরিণত হয়েছে। কমিউনিস্ট শাসকরা তাকে দুটো নদীতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। আমুর দরিয়া আর সির দরিয়া। তো তারা সেচ করে সেখানে তুলোর প্লানটেশন গড়ে তুলতে গেল। তারা ব্যর্থ হলো কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সাগর অস্তিত্বের সংকটে পড়ল। চাষ করা জমি মরুভূমিতে পরিণত হলো।

পানির সংকট গোটা জলবায়ুতে প্রভাব ফেলল। এখনকার দিনে, মরুঝড়ে প্রতিবছর পনেরো লক্ষ টন লবণ আর ধুলা উৎপন্ন হয়। পঞ্চাশ মিলিয়ন লোক পাঁচটা দেশে সোভিয়েট বুরোক্রেসির দায়িত্বহীনতার শিকার হয়েছে। যে সামান্য পানি পাওয়া যায় তাও দূষিত এবং নানাবিধ রোগব্যাধির শিকার।

 মিখাইলের কথাগুলো আমি মনে মনে নোট করে নিলাম। আমার কোনো একটা বক্তৃতায় তা কাজে লাগতে পারে। মিখাইল বলে চলেছে। তার গলার স্বর এখন আর যান্ত্রিকতার ছাপ নেই, বেশ দুঃখ ভারাক্রান্ত গলা।

আমার দাদা বলেছেন, ওটা ছিল আরাল সাগর, যা একসময় নীল নদ নামে পরিচিত ছিল। কারণ এর পানির রং ছিল নীল। এর আর কোনো অস্তিত্ব নেই। লোকজন ওখানে বাস করতে চায় না। তারা বাড়িঘর ছেড়ে অন্য কোথায় চলে গেছে। তারা এখনো সাগরের ঢেউ আর মাছের স্বপ্ন দেখে। এখনো তাদের কাছে ছিপ-বঁড়শি আছে। তারা এখন নৌকা আর সমুদ্রযাত্রার গল্প করে।

 পরামাণবিক পরীক্ষার ব্যাপারটা কি সত্যি? প্রকাশক জিজ্ঞেস করলেন।

আমার মনে হয় আমার দেশে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষই মাতৃভূমির মতো একই বেদনা অনুভব করে। কারণ প্রত্যেক কাজাখই রক্তের মধ্যে তাদের মাতৃভূমিকে বহন করে। চল্লিশ বছর ধরে, এই ভূমি নিউক্লিয়ার অথবা থার্মোনিউক্লিয়ার বোমায় কেঁপে ওঠে। ১৯৮৯ পর্যন্ত ৪৫৬ বার এ ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১১৬টি পরীক্ষা প্রকাশ্যে করা হয়েছে। যা যোগ করলে হিরোশিমায় পতিত বোমার চেয়ে পঁচিশ গুণ শক্তিশালী। ফলস্বরূপ, হাজার হাজার লোক তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তার ফলে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, যে কারণে হাজার হাজার শিশু শারীরিক প্রতিবন্ধী, অঙ্গহানি অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্ম নিচ্ছে।

 মিখাইল হাতঘড়ির দিকে তাকাল।

এখন, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে যেতে হবে।

টেবিলের অর্ধেক মানুষই দুঃখিত হলো। কথোপকথনটা কেবল জমে উঠেছিল। বাকি অর্ধেক মানুষ বেশ খুশি হলো। এ রকম আনন্দময় সময়ে দুঃখময় ঘটনার কথায় অস্বস্তি হচ্ছিল।

মিখাইল মাথা ঝুঁকিয়ে সবাইকে বিদায় জানাল। আমাকে আলিঙ্গন করল। এ কারণে আলিঙ্গন করল না যে, আমার ওপর আবেগ দেখাচ্ছে, কারণ আমার কানে কানে কথা বলতে পারে :

আমি আগে যেমনটি বলেছিলাম, ও ভালো আছে। চিন্তিত হবেন না।

.

দুশ্চিন্তা করবেন না, মিখাইল বলেছিল। যে মহিলা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তার জন্য আমি কেন দুশ্চিন্তা করব? ওই মহিলার কারণে আমাকে পুলিশের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। স্ক্যান্ডাল পত্রিকার সবগুলো প্রাচ্ছদে আমার ছবি ছেপে কভার স্টোরি করেছে। ওই মহিলার কারণেই আমি এত দিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছি। আমার বন্ধু, শুভাঙ্কাজমীদের প্রায় হারাতে বসেছিলাম এবং…

….এবং এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ বই লিখেছি। কাজের কথায় এসো, আমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। জীবনের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। নিজেদের প্রতারণা করা যায় না। অবশ্যই, সে কেমন আছে তা তুমি জানতে চাইবে। আরো বাড়িয়ে বললে বলতে হয়, তুমি ওকে দেখতে চাও।

যদি তুমি সে ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত হয়ে থাকো, তাহলে তুমি ওকে খুঁজে এনে আমাদের সাথে নৈশ ভোজে নিয়ে আসোনি কেন? এখন আমি একটা ক্ল পেয়েছি : মিখাইলকে প্রতি বৃহস্পতিবার আর্মেনিয়ান রেস্টুরেন্টে দেখা যায়। আমি জানি। তার চেয়ে ভালো হয় তুমি ওকে অনুসরণ করলে।

তুমি কি আমাকে ভালোবাস না?

গত পরশুর চেয়ে বেশি এবং আগামীকালের চেয়ে কম। স্টেশনারি দোকানের পোস্টকার্ডে এমনটিই লেখা আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি আশাহীন, তুমি অবশ্যই তা জেনে থাকবে। আমি নিজের ঠিকানা বদলে তোমার এই বিশাল ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে এসেছি। কিন্তু যখনই আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ দিতে চেয়েছি, তুমি সব সময় প্রসঙ্গ বদলে গেছ। শুধু তা-ই নয়, আমি নিজের গৌরব ভুলে আমাদের একসাথে থাকার জন্য কত বড় পদক্ষেপ নিয়েছি। তুমি বলেছিলে ব্যাপারটা বড় তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। সম্ভবত এসথারের মতো আমাকেও হারানোর ভয় পাচ্ছিলে, সম্ভবত তুমি তখনো এসথারের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলে। অথবা তুমি তোমার স্বাধীনতা হারাতে চাচ্ছিলে না, আবার সেই সাথে একাকী থাকতে ভয় পাচ্ছিলে। ভয় পাচ্ছিলে কারো সাথে বাস করতে সংক্ষেপে বললে, আমাদের সম্পর্কটা পুরোপুরি দুর্ঘটনাই বলা যায়। কিন্তু, এখন যখন আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলে, আমার উত্তরটা হলো : আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি।

তো, তাহলে তুমি আমাকে সাহায্য করছ কেন?

কারণ আমি সারা জীবন ওই মহিলার ভূত বয়ে বেড়াতে পারি না, যে কোনো রকম ব্যাখ্যা না দিয়ে ছেড়ে চলে গেছে। আমি তোমার বই পড়েছি। আমি বিশ্বাস করি, শুধু ওকে খুঁজে পেলে, এ সমস্যার সমাধান করলে, তোমার হৃদয় পুরোপুরি আমার প্রতি ঝুঁকে পড়বে। আমার সেই প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে এ রকমটি ঘটেছিল। যখন তা আমাদের সম্পর্কের মধ্যে পড়ে, আমি ওর সাথে এ রকম কাছাকাছি হয়েছিলাম দেখতে, সেই কাপুরুষটা কী করে। সে কখনো তার হৃদয়ের কথা সেভাবে খুলে বলেনি। কিন্তু সব সময় যা অনুভব করত, তা বেশ বিপজ্জনক। তুমি সব সময় বলেছ, প্রকৃত স্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই। যে স্বাধীনতার অস্তিত্ব আছে, তা তোমার পছন্দের এবং তারপর তা তোমার সিদ্ধান্তের ওপর বর্তায়। আমি আমার প্রতিবেশীর যতই নিকটবর্তী ছিলাম, ততই আমি তোমার ভক্ত হয়ে পড়ি। একজন মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং যে আর তার সাথে কিছু করতে চায় না। তুমি একাই শুধু তোমার সিদ্ধান্তের উপযোগী নও। তোমার সিদ্ধান্ত জনগণের। তোমার বইয়ে এসব কথাই বলেছ। হৃদয়ের ওপরই একটা প্যারাগ্রাফ আছে :

যখন আমার কোনো কিছু হারানোর থাকে না, তখন আমি সব কিছু দিতে পারি। যখন আমি নিজেকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে নিই, আমি নিজেকে খুঁজে পাই। যখন আমি অপমানের মধ্য দিয়ে যাই, আমি হাঁটতে থাকি। আমি বুঝতে পারি, নিজের ভাগ্য বেছে নেয়ার সুযোগ আমার আছে। সম্ভবত আমার নিজের মধ্যেই কোনো সমস্যা আছে, আমি তা জানি না, সম্ভবত আমার বিয়ে একটা স্বপ্নের মতো ছিল, আমি বুঝতে পারি না যখন তা শেষ হয়ে গেছে। যেটুকু জেনেছি, আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারি, ওকে আবার দেখতে চাইব ওকে শুধু এটুকু বলার জন্য দেখতে চাইব, যাতে একসাথে হলে ওকে বলতে পারি, আমি নিজের চেয়ে তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। যদি ওকে এটুকু বলতে পারি তারপর আমি শান্তিতে বাস করতে পারব, কারণ সেই ভালোবাসা আমি পুনরুদ্ধার করেছি।

মিখাইল আমাকে বলেছে, সম্ভবত এসথার আমার বই পড়েছে। তাই-ই যথেষ্ট।

হতে পারে, কিন্তু তোমার জন্য পুরোপুরি ভালোবাসার ব্যাপার জড়িত। ওকে তোমার খুঁজে বের করতে হবে এবং মুখোমুখি তা বলতে হবে। তা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। সে হয়তো তোমার সাথে দেখা করতে নাও চাইতে পারে, কিন্তু তুমি তা চাও। অন্ততপক্ষে, চেষ্টা করে দেখা উচিত। আমি সেই আদর্শ মহিলার থেকে মুক্ত হতে পারব এবং তুমিও বর্তমান থেকে মুক্ত হতে পারবে, যাকে তুমি জাহির বলে আখ্যা দাও।

 তুমি খুব সাহসী।

না, তা নয়। আমি ভীত। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই।

.

পরদিন সকালে, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম, এসথার কোথায় বাস করে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব না। দুই বছর ধরে, অবচেতন মনে বিশ্বাস করে আসছিলাম এসথারকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ওকে অপহরণ করা হয়েছে অথবা কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ওকে ব্ল্যাকমেইল করছে। এখন আমি জেনে গেছি, ও বেঁচে আছে। ভালো আছে (মিখাইল আমাকে তাই বলতে চেয়েছে)। তাহলে ওকে আবার দেখার চেষ্টা করব কেন? আমার প্রাক্তন স্ত্রীর সুখ খোঁজার অধিকার আছে। ওর সিদ্ধান্তকে আমার সম্মান জানানো উচিত।

 চিন্তাটা ঘণ্টা চারেকের বেশি স্থায়ী হলো না। সেদিন সন্ধ্যায়, গির্জায় গিয়ে একটা মোমবাতি জ্বেলে দিলাম। আরেকটা প্রতিজ্ঞা করলাম। এইবার আনুষ্ঠানিক পবিত্র প্রতিজ্ঞা করলামঃ আমি ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। মেরির কথাই ঠিক। নিজের সাথে ভান করে প্রতারণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমার বয়স বেড়ে গেছে। এসথারের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি, কিন্তু যে মানুষটি আমার জীবনটাকে গড়ে দিয়েছিল, খুব সম্প্রতি তা ধ্বংস হতে চলেছে। ও সব সময় খুব সাহসিনীর ভূমিকায় থাকত। তাহলে এবার কেন সে রাতের আঁধারে চোরের মতো পালিয়ে গেল? স্বামীর চোখে চোখ রেখে কারণটা জানিয়ে গেল না? যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো আমাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ওর এ রকম আচরণ সম্পূর্ণ ওর চরিত্রের পরিপন্থি। আর সে কারণটা আমার জানা দরকার।

.

রেস্তোরাঁয় সেই ঘটনার পুরোপুরি এক সপ্তাহ পরের কথা। রেস্তোরাঁ থেকে এসে পরের কয়েকটা দিন, আমি এ রকম কিছু সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলাম, যা আগে কখনো সম্মত হয়নি। কয়েকটা পত্রিকায় আর্টিকেল লিখলাম। যোগ ব্যায়াম আর মেডিটেশন করলাম। একজন রাশিয়ান চিত্রকরকে নিয়ে লেখা বই পড়লাম। নেপালে সংঘটিত ক্রাইমের ওপর বই পড়লাম। দুটো বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিলাম। আরো চারটি বইয়ের মুখবন্ধের কথা জানালাম, বেশির ভাগ সময়ে প্রকাশকরা আমার কাছ থেকে করিয়ে নিতে চাইত, আর আমি সাধারণত অস্বীকার করতাম।

তার পরও আমার হাতে অনেক সময় রয়ে গিয়েছিল। আমি ফেভার ব্যাংকের ঋণ শোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। নৈশ ভোজের আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করলাম। বন্ধুদের বাচ্চারা যেসব স্কুলে পড়ে সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলাম। গলফ ক্লাবে গেলাম। এভিনিউ ডি সাফ্রেনের বুক শপে বইয়ে স্বাক্ষর দিতে গেলাম। বুক শপটার মালিক আমার একজন বন্ধু (ও গত তিন দিন ধরে জানালার গায়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছিল। গোটা কুড়ি লোক এসেছিল। আমার সেক্রেটারি ধারণা করেছিল, আমি বেশ সুখী, কারণ ও আমাকে সারা জীবনে এত কাজ করতে দেখেনি। আমি জানালাম, বেস্ট সেলারের লিস্টে আমার বইয়ের নাম আসার কারণে সাধারণ সময়ের চেয়ে আমি একটু বেশি পরিশ্রম করছি।

ওই সপ্তাহে আমি দুটো কাজ করিনি। প্রথমত, আমি কারো পাঠানো কোনো টাইপস্ক্রিপ্ট পড়িনি। আমার লইয়ারের মত অনুসারে, সেগুলো সাথে সাথেই প্রেরকের কাছে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। অন্যথায়, আগে হোক পরে হোক, তাদের গল্প চুরি করে নিয়েছি, এই অপবাদ আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে (আমি কখনো বুঝতে পারি না লোজন কেন আমার কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠায়- আমি তো কোনো প্রকাশক নই)। দ্বিতীয়ত, আমি বিশ্ব মানচিত্র টেনে নিয়ে কাজাখস্তান কোথায় তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি। যদিও আমি জানতাম, মিখাইলের বিশ্বস্ততা অর্জন করার জন্য সে কোথা থেকে এসেছে সে সমন্ধে আমার আরেকটু জানার চেষ্টা করা উচিত।

.

লোকজন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। কেউ একজন দরজা খুলে দেবে, যাতে রেস্তোরাঁয় পেছনের দিকে যাওয়া যায়। এই জায়গাটা সেন্ট-জার্মান-ডেস-প্রেজ অনুল্লিখিত একটা বার। এক কাপ কফিও ছোট্ট এক গ্লাস পানি ছাড়া সার্ভ করা হয় না। কোনো ভালো পোশাক পরিহিত, সুন্দরভাবে কথা বলা লোকজন এখানে আসে না। এটার কোনো আভিজাত্যপূর্ণ থিয়েটার ফয়ার নেই। ম্যাজিক শোয়ের লোকেরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টায় ব্যস্ত নেই, যাতে বিখ্যাত কারো নজরে ধরা পড়ে আর শোয়ের শেষে নিজেকে পরিচিত করিয়ে দেয়।

সত্যি কথা বলতে কি, এ জায়গাটা এ রকম পরিপূর্ণ কেন আমি তা বুঝতে পারছি না। কখনো প্যারিসের বিনোদন আর বিখ্যাত ম্যাগাজিনগুলোকে এর ব্যাপারে কোনো কিছু লেখা দেখিনি।

অপেক্ষা করার সময়, আমি মালিকের সাথে কথা বললাম। জানতে পারলাম, তিনি রেস্টুরেন্টের গোটা এরিয়াটা থিয়েটারে রূপ দিতে চান।

প্রতি সপ্তাহে লোকের সংখ্যা বাড়ছে, তিনি বললেন, আমি প্রথম দিকে সম্মত হয়েছিলাম কারণ একজন সাংবাদিক আমাকে একটা কাজ করে দিতে বলেছিল। বিনিময়ে, সে তার ম্যাগাজিনে এই রেস্টুরেন্ট নিয়ে একটা রিভিউ ছাপবে। পাশাপাশি, বৃহস্পতিবারে এখানকার কক্ষগুলো তেমন ব্যবহার হয় না বললেই চলে। তারা অপেক্ষা করার সময় খাবার খায়। প্রকৃতপক্ষে, সপ্তাহের অন্য যেকোনো রাতের চেয়ে আমি বৃহস্পতিবার রাতে বেশি কামাই। একমাত্র যে জিনিসটা আমার গোচরে রাখতে হয়, অভিনেতারা আইনের মধ্যে চলবে। আপনি সম্ভবত জানেন, এখানে আইনকানুন খুবই কড়া।

হ্যাঁ। আমি জানি। এই জাতীয় লোকজন আমাকে উপদেশ দিয়েছে আমার বই এক ধরনের বিপজ্জনক ভয়াবহ দার্শনিক ট্রেন্ড চালু করতে চাইছে, ধর্মীয় কিছু স্পর্শকাতর ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাধারণত ফ্রান্স খুব উদার একটা দেশ, কিন্তু কিছু কিছু বিষয় নিয়ে প্যারানয়েডে ভোগে। মগজধোলাইয়ের ব্যাপারে বিশদ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো মানুষ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, টুথপেস্ট, গাড়ি, সিনেমা, স্বামী, স্ত্রী, প্রেমিক সব কিছুর ব্যাপারে ভিন্নমত আছে কিন্তু যখন বিশ্বাসের প্রশ্ন আসে, তখন সহজেই তা অন্য খাতে পরিচালিত হতে পারে।

 ওরা এসব অনুষ্ঠানগুলোতে কীভাবে এডভাটাইজ দেয়? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমার কোনো ধারণা নেই। যদি তা করতে চাইতাম, আমিও আমার রেস্টুরেন্ট প্রমোট করার জন্য একই ব্যক্তিকে ধরতাম।

এবার আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, আমি কে তা উনি জানেন না।

 তিনি যোগ করলেন, যে কথা বলছিলাম, এটা কোনো আইন লঙ্ঘন নয়। ওরা সত্যিই শুধুই অভিনেতা।

.

থিয়েটারের দরজা খুলে গেল। লোকজন একটা ছোট্ট বাস্কেটে পাঁচ ইউরো দিয়ে ঢুকে পড়ল। ভেতরে একটা মঞ্চ রয়েছে। দুজন তরুণ আর দুজন তরুণী সাদা স্কার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। এই চারজন বাদে একজন বয়স্ক মানুষ একটা কঙ্গো ড্রাম বয়ে এনেছে। একজন মহিলা একটা যন্ত্রের ওপর ব্রাশ দিয়ে ঘষছে, তাতে ধাতব বর্ষণের মতো এক ধরনের শব্দ হচ্ছে।

ওই দুজন তরুণের মধ্যে মিখাইল একজন, যদিও বই স্বাক্ষরের দিনে যে রকম দেখেছিলাম তার থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাচ্ছে। মিখাইলের চোখ একটা নির্দিষ্ট দিকে নিবদ্ধ। বিশেষ আলোয় আলোকিত।

দর্শকরা রুমের মধ্যে চেয়ারে এখানে-ওখানে বসে আছে। তরুণ-তরুণীরা এ রকম সাজ-পোশাকে আছে, যেন তাদের সাথে আপনার রাস্তায় দেখা হয়েছে, আপনি তাদের ড্রাগ অ্যাডিক্ট ভাবতে পারেন। মধ্য বয়সী এক্সিকিউট অথবা সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে এসেছেন। হাতে গোনা নয়-দশ বছরের কয়েকজন ছেলেমেয়ে সম্ভবত তাদের বাবা-মার সাথে এসেছে। কয়েকজন বয়স্ক লোকও এখানে এসেছে।

 তারা পান করছে, ধূমপান করছে, জোরে জোরে কথা বলছে, যেন স্টেজের ওপরের লোকজনের কোনো অস্তিত্বই নেই। কথাবার্তার আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছে। কেউ কেউ জোরে হাসছে। সত্যিকারের পার্টির পরিবেশ এখানে। একটা সম্প্রদায়? ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকায়, স্পষ্ট কিছু বোঝা যায় না। আমি উদ্বিগ্নতার সাথে তাকালাম, ভাবছিলাম এসব মহিলার মধ্যে কোথায় এসথার থাকবে, তাদের কারো মধ্যে আমার স্ত্রীর মতো শারীরিক অবয়বের মনে হলো না ( আমি কেন এখনো ওকে আমার প্রাক্তন স্ত্রী বলতে অভ্যস্ত হলাম না?)

আমি একজন সুসজ্জিত মহিলাকে এটাই সব কিনা জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর দেয়ার মতো ধৈর্য তার আছে বলে মনে হলো না। আমার দিকে এ রকমভাবে তাকাল, যেন আমি একজন নতুন মানুষ, যার এ রকম রহস্যময় জীবনের ব্যাপারে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন আছে।

প্রেমের গল্প ভদ্রমহিলা বললেন, গল্প আর শক্তি। গল্প আর শক্তি।

সম্ভবত আমি এর ভেতরে বিষয়টা খুঁজে পাচ্ছি না, যদিও ভদ্রমহিলাকে পুরোপুরি স্বাভাবিকই মনে হলো। আমি আর কাউকে জিজ্ঞেস করার কথা বিবেচনা করলাম, কিন্তু কোনো কিছু না বলাই ভালো হবে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি নিজেই খুব তাড়াতাড়ি অনেক কিছু বুঝতে পারব। একজন ভদ্রলোক আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

আপনার বই পড়েছি। আর সে কারণেই আমি জানি আপনি এখানে কেন এসেছেন।

আমি বিস্মিত হলাম। ভদ্রলোক কি মিখাইল আর আমার স্ত্রীর মধ্যের সম্পর্কের ব্যাপারটা জানেন। আমার অবশ্যই নিজেকে শুধরে নিতে হবে- স্টেজের ওপরের মানুষটি এবং আমার প্রাক্তন স্ত্রী।

আপনার মতো একজন লেখকের অবশ্যই টেংগ্রি সমন্ধে জানা উচিত। তা একে অন্যের সাথে যুক্ত, যাকে আপনি, ওয়ারিওর অব লাইট বলেন।

অবশ্যই। আমি স্বস্তির সাথে বললাম।

 টেংগ্রি সমন্ধে আমি কখনো শুনিনি।

.

মিনিট বিশেক পরে, সিগারেটের ধোঁয়ায় রুমের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, আমরা বড় করতালের শব্দ শুনতে পেলাম। অলৌকিকভাবে, কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেল। অনৈরাজ্যকর পরিবেশ সাথে সাথে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে রূপ নিল। দর্শক এবং মঞ্চের অভিনেতারাও চুপ হয়ে গেল। শুধু রেস্টুরেন্টের পেছন দরজা দিয়ে আসার শব্দ ভেসে আসতে লাগল।

মিখাইলকে দেখে মনে হলো একটা মোহাবেশের মধ্যে আছে, দূরে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, মঙ্গোলিয়ান সৃষ্টি রহস্যের মিথে বলা আছে, একটা বুনো কুকুর আছে যার চোখ নীল আর ধূসর, যার ভাগ্য তাকে স্বর্গে টেনে আনবে। সেই কুকুরের সঙ্গী হবে রক হরিণী।

মিখাইলের কণ্ঠস্বর অন্য রকম শোনাতে লাগল। কিছুটা মেয়েলি তবে আগের চেয়ে বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

সেখান থেকে আরেকটা প্রেমের গল্প শুরু। বুনো কুকুরের সাহস আর শক্তি আছে, হরিণীর আছে নম্রতা, আভিজাত্য আর অনুভূতি। শিকার আর শিকারি একে অন্যের সাথে দেখা হলো। তারা একে অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে, একজন আরেকজনকে ধ্বংস করে ফেলা উচিত, কিন্তু ভালোবাসার কারণে সেখানে ভালোমন্দের কোনো ব্যাপার নেই। সেখানে কোনো ধ্বংস নেই, কোনো সৃষ্টি নেই, খুব কমই নড়াচড়া আছে। ভালোবাসা প্রকৃতির ধরন বদলে দিয়েছে।

মিখাইল হাত নাড়ানোর সাথে সাথে চারজন লোক স্পটে চলে এল।

আমি যে জায়গা থেকে এসেছি, বুনো কুকুর সেখানে স্ত্রী জাতীয় প্রাণী হিসেবেই দেখা যায়। ইন্দ্রিয়পরায়ণ, শিকার ধরতে সক্ষম। কারণ সে সহজাত প্রবৃত্তিতে চলে, তবে সে বেশ ভীতুও। সে নিজের হিংস্র শক্তির চেয়ে কৌশল ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। সাহসী, সাবধানী, ক্ষিপ্রগতির। মুহূর্তের মধ্যে নিজের বিশ্রাম অবস্থা বদলে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

গল্প লেখার কারণে আমি ভাবছি, হরিণীর ব্যাপারটা কী?

 মিখাইল গল্প বলায় সিদ্ধহস্ত। প্রশ্নটা বাতাসে ছুঁড়ে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে পছন্দ করে।

হরিণীটা গতি এবং পৃথিবীর সাথে তাল রেখে চলে। দুটি প্রাণী তাদের জগতে একসাথে চলে। দুটো অসম্ভবতার মধ্যে একে অন্যকে খুঁজে পায়। কারণ তারা নিজেদের প্রবৃত্তি আর বাধ্যবাধকতা উতরে একটা সম্ভাব্য জগৎ তৈরি করে। মঙ্গোলিয়ান সৃষ্টিতত্ত্বের মিথ এটাই। দুটো ভিন্ন প্রকৃতির ভালোবাসার জন্ম হয়। এর বিপরীত দিকে, ভালোবাসা শক্তির মধ্যেই বেড়ে ওঠে। রূপান্তর আর সংঘাতে ভালোবাসা টিকে থাকে।

আমাদের নিজেদের জীবন আছে। জগৎটাকে দীর্ঘ সময় নিয়েছে। আমরা নিজেদের যথাসম্ভব সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি। কোনো চুক্তি ছিল না। কিন্তু আমরা তা করতে পেরেছি। যদিও ওখানে কিছু না কিছু ত্রুটি ছিল। সব সময় কোনো না কোনো খুঁত থেকে যায়। আর সে কারণেই আমরা আজ রাতে এখানে একত্র হয়েছি। যাতে আমরা একটু হলেও একে অন্যকে সাহায্য করতে পারি। আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই তা দরকার। এভাবে গল্প বলার কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। আমরা সাধারণভাবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারি না। সম্ভবত এক বা দুই জেনারেশনে বাঁচার অন্য অর্থ খুঁজে বের করতে পারব। যেমনটি মহান দান্তে তার দ্য ডিভাইন কমেডিতে লিখেছিলেন, যেদিন থেকে সত্যিকারের ভালোবাসা আবির্ভূত হয়েছে…। জগৎটা সত্যিকারের বাস্তবতায় আসবে যখন মানুষ ভালোবাসতে শিখতে…।

ভালোবাসা পোষ না মানা শক্তি। আমরা যখন একে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি, তা আমাদের ধ্বংস করে দেয়। যখন আমরা একে বন্দি করার চেষ্টা করি, তা আমাদের দাস বানিয়ে ফেলে। যখন আমরা একে বোঝার চেষ্টা করি, তা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। শুধু হারানোর বেদনা আর সংশয়ের অনুভূতি রেখে যায়।

 ভালোবাসার শক্তি এই পৃথিবীতে আমাদের সুখী রাখে। আমাদের ঈশ্বর আর প্রতিবেশীর কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমরা এখন যেভাবে ভালোবাসার আদান-প্রদান করি, আমরা প্রতি মিনিটের শান্তির জন্য এক ঘণ্টার উদ্বিগ্নতা উপভোগ করি। মিখাইল থেমে গেল। অদ্ভুত করতালের শব্দ আবারও হতে লাগল।

প্রত্যেক বৃহস্পতিবার, আমরা ভালোবাসার গল্প বলতে চাই না। আমরা ভালোবাসার কমতির সমন্ধে গল্প বলতে চাই। উপরিভাগে কী আছে তা আমরা দেখব- যেভাবে আমরা আমাদের রীতিনীতি আর মূল্যায়ন খুঁজে পাই তার নিচে কী আছে তা বুঝতে সক্ষম হই। সেই আচ্ছাদন ভেদ করে নিচে যেতে পারলে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই। কে শুরু করতে চায়?

কয়েকজন হাত তুলল। মিখাইল আরবীয় ধাচের এক তরুণীকে আঙুল তুলে নির্দেশ দিল। সে রুমের অন্যদিকে দাঁড়ানো এক পুরুষের দিকে গেল।

আপনি যখন বিছানায় কোনো মহিলার সাথে থাকেন, তখন কখনো কি আপনার যন্ত্র উত্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন?

সবাই হেসে উঠল। পুরুষ মানুষটি সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গেল।

আপনি আমাকে এ রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন, কারণ আপনার বয়ফ্রেন্ড নপুংসক?

 সবাই আবার হেসে উঠল। মিখাইল আবার বলতে শুরু করল। আমার আবার সন্দেহ হলো, এরা কোনো নির্দিষ্ট সমগোত্রীয়। কিন্তু যখন এই নির্দিষ্ট গোত্র একত্র হয়, আমি কল্পনা করতে পারছি না তারা ধূমপান করে, মদপান করে এবং একে অন্যকে নিজেদের যৌনজীবন সমন্ধে বিব্রতকর প্রশ্ন করে।

 না, ও নপুংসক নয়। তরুণীটি দৃঢ়স্বরে বলল। কিন্তু মাঝে মাঝে ওর ক্ষেত্রে অমনটি হয়ে থাকে। আর আমি জানি আপনি যদি আমার প্রশ্নটা সিরিয়াসলি নেন তাহলে আমার উত্তাও হবে, হ্যাঁ, আমারও হয়।

হ্যাঁ, ব্যাপারটা স্বাভাবিকই। আর যে মানুষটি আমাকে তা বলেছিলেন তিনি। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। কোনো সমস্যায় পড়লেই আমি তার কাছে যাই।

মেয়েটি বলে চলল :

কিন্তু যে গল্পটি আমরা বলতে চাইছি, সব পুরুষই সব সময় যন্ত্র উত্থিত করতে পারে। যখন সে পারে না, নিজেকে হতভাগ্য মনে করে। আর মেয়েটি মনে করে পুরুষটির যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগানোর মতো যথেষ্ট আকর্ষণীয়া সে নয়। যখন থেকেই তা নিষেধাজ্ঞার বিষয়, পুরুষটি তার বন্ধুর সাথে এ ব্যাপারে বলতে পারে না। সে মেয়েটিকে বলে, আমার এর আগে কখনো এমনটি হয়নি। সে নিজের ওপরই লজ্জিত হয়। আর প্রায় সময়ই মেয়েটির কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়, যার সাথে তার খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। যদিও তা হয়তো তার দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা চতুর্থবার হতে পারে। যদি সে তার সঙ্গীর ভালোবাসার ওপর বেশি বিশ্বাস করে, সে সত্যটা বলে দেয়, তাহলে সে বুঝতে পারবে সে একাই এ রকম নয়। যদি সে মেয়েদের ভালোবাসার ওপর বেশি বিশ্বাস করে, তাহলে তার অপমানিত বোধ করা উচিত নয়।

সবাই হাততালি দিল।

লোকজন সিগারেট ধরাল। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

 মিখাইল এ রকম একজন লোকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল, যাকে দেখে বিশাল মাল্টিন্যাশন্যাল কম্পানির এক্সিকিউটিভ বলে মনে হয়।

 আমি একজন আইনজীবী। বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারে আমি একজন বিশেষজ্ঞ।

তার মানে কী? শ্রোতাদের একজন জিজ্ঞেস করল।

 ব্যাপারটা তখন ঘটে, যখন দম্পতি দুজনের মধ্যে একজন আলাদা হতে সম্মত হয় না। আইনজীবী উত্তর দিলেন। কথার মাঝখানে কথা বলায় কিছুটা বিরক্ত।

বলে যান, মিখাইল বলল। বই স্বাক্ষরের সময় যে মানুষটাকে দেখেছিলাম আমি কল্পনাও করতে পারিনি সে এ রকম কর্তৃত্বসুলভ গলায় কথা বলতে পারে।

আইনজীবী বলতে লাগলেন,

আজ আমি লন্ডনভিত্তিক সংস্থা হিউম্যান অ্যান্ড লিগ্যাল রিসোর্স থেকে একটা রিপোর্ট পেয়েছি। তাতে বলা হয়েছে– একটা কম্পানির দুই-তৃতীয়াংশ কর্মচারীর মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ও কল্পনা করতে পারেন! তার মানে হলো, যেকোনো অফিসে তিনজন মানুষের মধ্যে দুজন সম্পর্কের ইতি টানে ঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে।

 দশ শতাংশ মানুষ এ কারণে চাকরি ছেড়ে দেয়। চল্লিশ শতাংশ মানুষের মধ্যে এই সম্পর্কের ব্যাপারটা তিন মাসের বেশি থাকে না। আর এ রকম কোনো পেশায় যেখানে মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

 ব্যাপারটা কি অবিশ্বাস্য নয়?

অবশ্যই। তবে আমাদের পরিসংখ্যানের কাছে মাথা নত করতে হয়। একজন তরুণ বলল। তার পোশাক দেখে মনে হচ্ছে কোনো ডাকাত দলের সদস্য। আমরা সবাই পরিসংখ্যানে বিশ্বাস করি! তার মানে হচ্ছে আমার মা আমার বাবার প্রতি অবিশ্বস্ত। কিন্তু সেটা আমার মায়ের দোষ নয়, পরিসংখ্যানের দোষ!

 হাসির হল্লা বয়ে গেল। আরো সিগারেটের ধোঁয়া উড়তে লাগল। লোকজন আরো বেশি স্বস্তি পেল। দেখে মনে হচ্ছে এখানকার দর্শকরা এক ধরনের উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। আমি এসথারের কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম মিখাইলের পেশার কথা…

আমি নিজের কথা ভাবছিলাম। আমার নিজের বেলায় এমনটি অনেকবার ঘটেছে। সর্বোপরি, পরিসংখ্যান সেই কথা বলছে। আমরা একা নই।

ঈর্ষাপরায়ণতা, প্রাচুর্য, হতাশা- এসব নিয়ে আরো অন্যান্য গল্প বলা হচ্ছিল। কিন্তু আমি আর কিছুই শুনছিলাম না। আমার জাহির তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। এমনকি যদিও কয়েক মুহূর্তের জন্য, আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম একটা ছোট্ট দলগত থেরাপির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছি আমি। প্রকৃতপক্ষে যে মানুষটা আমার স্ত্রীকে চুরি করে নিয়ে গেছে, সেই মানুষটার সাথে একই রুমে আছি। আমার প্রতিবেশী, যে আমাকে চিনতে পেরেছে, আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি উপভোগ করছি কিনা। সে আমাকে মুহূর্তের। জন্য জাহির থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমি খুশি যে, সাড়া দিয়েছিলাম।

আমি এখনো এদের ব্যাপারটা ধরতে পারছি না। দেখে মনে হচ্ছে, আত্ম-উন্নয়নমূলক গ্রুপ, যেমন এলকোহলিক অথবা বিবাহসংক্রান্ত পরামর্শকেন্দ্র।

কিন্তু আপনি এখানে যা শুনেছেন তা কি খাঁটি কথা বলে মনে হচ্ছে না?

 সম্ভবত। কিন্তু আবারও বলছি, আমি পয়েন্টটা কী বুঝতে পারিনি।

আজ সন্ধ্যেয় এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়। নিজেকে একাকী না মনে করার জন্য এটা একটা পথ মাত্র। আমাদের নিজেদের জীবনের সমন্ধে কথা বলে, আমরা বুঝতে পেরেছি বেশির ভাগ মানুষই একই রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

আর বাস্তব ফলাফল কী?

আপনি যদি একাকী না হন, তাহলে আমরা ভুল পথে চলেছি, নাকি পথ বদলে নিতে হবে, এসব ব্যাপার খুঁজে পেতে অনেক শক্তি পাব। কিন্তু, আমি যেমনটি বলেছিলাম, এটা শুধু একটা বিরতি, যাতে শক্তির সাথে যুক্ত হতে পারি আমরা।

 ওই তরুণটি কে?

 করতালের শব্দে আমাদের কথোপকথন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। এইবার, কংগো ড্রাম বাজানো বয়স্ক মানুষটাই কথা বলতে শুরু করল।

যুক্তিতর্কের সময় শেষ। এখন আমাদের আচার-আচরণের দিকে ধাবিত হতে হবে। আবে মুকুটের মতো- সব কিছুকেই রূপান্তরিত করে। আজ রাতে প্রথমবারের মতো যারা এখানে এসেছে, এই নাচ ভালোবাসাকে গ্রহণ করার জন্য আমাদের গ্রহণযোগ্যতাকে উন্নত করবে। ভালোবাসাই একমাত্র জিনিস, যা আমাদের বুদ্ধিমত্তা এবং সৃষ্টিশীলতাকে সচল রাখে। ভালোবাসা আমাদের পরিশুদ্ধ করে মুক্ত করে দেয়।

সিগারেটের ফুলকি নিভে গেছে। গ্লাসের ঝনঝন শব্দ থেমে গেছে। রুমের ভেতরে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে। একজন তরুণী প্রার্থনা করছে।

 আমরা নাচব, দেবী, তোমার উদ্দেশে নাচব। আমাদের নৃত্য যেন আমাদের স্বর্গে পৌঁছে দেয়।

আমি কি ঠিক শুনেছি? মেয়েটি কি দেবী বলল?

মেয়েটি তাই বলেছে।

অন্য তরুণীটি চারটি মোমবাতিদানে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। ঘরের অন্য সব আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। চারটি সাদা মূর্তি দেখা গেল। তাদের সাদা স্কার্ট, স্টেজের দিক থেকে এসে দর্শকের দিকে মুখ করল। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে, দ্বিতীয় তরুণটি, যার কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছিল পেটের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে, একঘেয়ে স্বরে, বারবার একই গান গেয়ে চলেছে। আমাকে জাহিরের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে।

 এমনকি একটা বাচ্চা ছেলে, যে ভালোবাসার কথাবার্তা সেশনে গোটা ঘর জুড়ে দৌড়াদৌড়ি করছিল, সেও এখন শান্ত হয়ে গেছে।

ও গান গাওয়া বন্ধ করলে, যন্ত্রসংগীত, করতাল আর ড্রাম একই ছন্দে এমনভাবে বাজতে লাগল, যেন আফ্রিকার কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সংগীত।

 সাদা পোশাকের মানুষগুলো ঘুরতে শুরু করল। দর্শকরা জায়গা করে দিল, যাতে বিস্তৃত স্কার্ট চারদিকে বেশ জায়গা নিয়ে ঘুরে আসতে পারে। যন্ত্রসংগীত আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাজতে লাগল। ওরা চারজন আরো জোরে ঘুরতে লাগল। ওদের আচরণ দেখে মনে হলো ওরা সরাসরি নাচের মাধ্যমে ওদের দেবীর সাথে কথা বলছে।

 আমার পাশের জন উঠে দাঁড়িয়ে ওদের মতো করে নাচতে শুরু করল। মুখে বিড়বিড় করে কী যেন আওড়ে যাচ্ছে। দর্শকদের মধ্যে আরো দশ থেকে বারোজনও একই রকম করতে শুরু করেছে। বাকিরা অন্য রকম আনন্দে তা দেখছে।

.

আমি জানি না এই নৃত্যগীতি কতক্ষণ চলবে, কিন্তু যন্ত্রসংগীত শুনে মনে হচ্ছে যেন আমার হৃদয়ের তন্ত্রীতে আঘাত করছে। নিজেকে আত্মসমর্পণ করার আকাক্ষা জেগেছে। অদ্ভুত কিছু বলতে ইচ্ছা করছে, শরীর দোলাতে মন চাইছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হচ্ছে।

এ রকম অপরিচিত রীতিনীতির মধ্যে নিজেকে না জড়াতে যুঝছিলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম। আজ রাতে এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছি। মিখাইলের সাথে কথা বলা দরকার। আমার কাছ থেকে আমার জাহিরকে নিয়ে গেছে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কিছুটা সতর্কতার সাথে লজ্জিতভাবে সুরের তালে তালে প্রথম পাক দিতেই গান বন্ধ হয়ে গেল।

 রুমের মধ্যে শুধু মোমবাতির নরম আলো। নৃত্যরতদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ধীরে ধীরে, শব্দটা মিলিয়ে গেল। রুমের আলো জ্বলে উঠল। সবাইকে দেখে মনে হলো তারা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। গ্লাসগুলো আবার বিয়ার, ওয়াইন, ওয়াটার, কোমল পানীয় ভরে উঠছে। ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি শুরু করেছে। জোরে জোরে কথা বলছে। সবাই এমন ভাবে কথা বলছে, যেন কিছুই ঘটেনি।

আজকের অনুষ্ঠান শেষ করার সময় এসে গেছো মোমবাতি জ্বালানো সেই তরুণী বলল, আলমা শেষ গল্প বলবে।

আলমা হলো সেই করতাল বাজানো মহিলা। সে বলতে শুরু করল :

জমিদারের একটা মহিষ ছিল। মহিষটার দুই দিকে বিস্তৃত বিশাল শিং দেখে মহিষের মালিক ভাবল, সে যদি কোনোভাবে দুই শিংয়ের মাঝখানে বসতে পারত, তাহলে তা শিংয়ের ওপর বসার মতো হতো। একদিন, মহিষটা যখন অন্যমনস্ক ছিল, মালিক মহিষটার ওপর চড়ে শিংয়ের মাঝখানে বসে পড়ল। যাই হোক, মহিষটা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে মালিককে শিংয়ের ওপর থেকে ফেলে দিল। মালিকের স্ত্রী তাই দেখে কাঁদতে শুরু করল।

কেঁদো না মালিক বলল। সে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, আমি হয়তো কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু আমি সেই সাথে আমার স্বপ্নটা বুঝতে পেরেছি।

 লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। আমার পাশেরজনকে জিজ্ঞেস করলাম তার কেমন লাগছে।

আপনার জানা উচিত। আপনার বইয়ে এ ব্যাপারে লিখেছেন।

আমি জানি না। কিন্তুএ রকম ভান করলাম আমি জানি।

 হতে পারে আমি জানি, কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে চাই।

 লোকটা আমার দিকে তাকাল। প্রভাবিত হয়নি। এখন পুরোপুরি সন্দেহ করতে শুরু করেছে, যে লেখক বলে আমাকে ভাবছে, সে আমি কিনা।

 জগতের শক্তির সংস্পর্শে এক সময় আমি ছিলাম। লোকটা উত্তর দিল, ঈশ্বর আমার আত্মার পাশ কাটিয়ে গেছেন।

 লোকটা চলে গেল। লোকটা কী বলতে চেয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে গেল না।

ফাঁকা রুমে শুধু চারজন অভিনেতা, দুজন মিউজিশিয়ান আর আমি বসে আছি। মহিলারা লেডিস রুমে গেছে। সম্ভবত কাপড়চোপড় বদলাতে গেছে। পুরুষেরা তাদের সাদা পোশাকগুলো বদলে সাধারণ পোশাক পরল। তারা সাথে সাথে তাদের করতাল, সংগীত যন্ত্রগুলো বিশাল দুটো বাক্সের মধ্যে ভরে ফেলল।

 ড্রাম বাজানো বয়স্ক মানুষটা টাকা গুনতে শুরু করল। সেগুলোকে ছয়টা ভাগে ভাগ করল। ঠিক সেই সময় মিখাইল আমার উপস্থিতি খেয়াল করল।

আমি ভেবেছিলাম আপনাকে এখানে দেখব।

আর আমি জানি আপনি কারণটা জানেন।

আমার শরীরের মধ্যে দিয়ে স্বর্গীয় শক্তিকে যেহেতু প্রবাহিত হতে দিয়েছি, সেহেতু আমি সব কিছুর কারণ জানি। আমি ভালোবাসার কারণ জানি। জানি যুদ্ধের কারণ। আমি জানি কেন একজন পুরুষ একজন মহিলাকে ভালোবাসার কারণে খোঁজ করে।

আমার আবারও মনে হলো যেন ছুরির ফলার ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। যদি জানতাম আমি আমার জাহিরের কারণে এখানে এসেছি। তারপর সে এও জানে এসথারের ব্যাপারটা তার জন্য হুমকির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

আমরা হয়তো কথা বলতে পারি, যেমনটি দুজন মানুষ সম্মানের জন্য লড়াই করে?

 মিখাইলকে দেখে মনে হলো একটু ইতস্তত করছে।

আমি বলে চললাম,

জানতাম যে আমি ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় আছি। সেই মালিকের মতো, যে মহিষের শিঙের ওপর বসতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার তাই-ই প্রাপ্য। কারণ অগোচরে হলেও এই যন্ত্রণা আমি চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করতে পারিনি আমি যদি ওর ভালোবাসাকে সম্মান জানাই তাহলে ও কোনো দিন আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে।

আপনি কিছুই বুঝতে পারেননি। মিখাইল বলল।

এ কথাগুলো আমাকে বিরক্ত, উত্তেজিত করল। একজন পঁচিশ বছরের ছেলে কীভাবে একজন অভিজ্ঞ মানুষকে, যে যন্ত্রণা আর জীবনের পরীক্ষার ওপরে আছে তাকে বলতে পারে সে কিছুই বুঝতে পারেনি? নিজেকে সংযত করলাম আমি। এই মুহূর্তে বিনয়ী থাকাই আমার জন্য প্রয়োজন। আমি ভূতের সাথে বাস করতে পারি না। গোটা জুগটা আমার জাহিরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না।

হতে পারে সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেই কারণেই আমি এখানে সব কিছু বুঝতে এসেছি। কী ঘটেছে তা জেনে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছি।

 আপনি সব কিছুই খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলেন। তারপর হঠাৎ করে বুঝতে পারাটা থামিয়ে দিলেন। অন্ততপক্ষে এসথার আমাকে এমনটিই বলেছে। যেমনটি সব স্বামীর ক্ষেত্রেই হয়, আর এ রকম একটা সময় এল যখন আপনি আপনার স্ত্রীকে সংসারের আসবাবপত্রের মতো ব্যবহার করতে শুরু করলেন।

আমি কোনোমতে নিজেকে সামলালাম। আরেকটু হলে বলেই ফেলতাম, ও নিজেই কেন তা আমাকে বলেনি? কেন আমার দোষগুলো শুধরে নেয়ার সুযোগ দেয়নি? আর পঁচিশ বছরের এ রকম এক যুবকের সাথে গেছে, যে নিজেই শেষ পর্যন্ত ওর সাথে আমার মতো একই আচরণ করবে। কিন্তু আমি খুব সাবধানের সাথে শব্দ চয়ন করলাম।

আমি মনে করি না ব্যাপারটা ঠিক। আপনি আমার বই পড়েছেন। আমার বইয়ে স্বাক্ষর নিতে এসেছিলেন, কারণ আপনি জানতেন আমি কেমন অনুভব করছি। আমার হৃদয় এখন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে আছে। আপনি কি কখনো জাহির নামে কোনো শব্দ শুনেছেন?

আমি ইসলাম ধর্মীয় পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছি। হ্যাঁ, আমি ওই ধারণার সাথে পরিচিত।

বেশ, এসথার আমার জীবনের প্রতিটি শূন্যতা পূর্ণ করে রেখেছিল। আমার অনুভূতির ব্যাপারে বইয়ে লিখে ফেলেছি ভেবেছিলাম। ওর উপস্থিতিতে নিজেকে অনেক বেশি মুক্ত স্বাধীন মনে করতাম। এখন ওকে নীরবতার মাঝেই অনেক বেশি ভালোবাসি। কিন্তু আমি অন্য কিছু ভাবতে পারছি না। আপনার কাছে ভিক্ষা চাইছি, আমার প্রতি দয়া করুন। আপনি যা চান আমি তাই করব। কিন্তু ও এভাবে আমার কাছ থেকে কেন চলে গেল, তা ব্যাখ্যা করার জন্য আমার আপনাকে দরকার। আপনি যেমনটি বলেছিলেন, আমি কোনো কিছুই বুঝতে পারি না।

 স্ত্রীর প্রেমিকার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব কঠিন ব্যাপার। মিখাইল বই স্বাক্ষর করতে না এলে সম্ভবত সেই মুহূর্তে ভিটোরিয়ার ক্যাথেড্রালে থাকতাম। ওখানে আমি আমার ভালোবাসার কথা জানিস টাইম টু রেস্ট অ্যান্ড টাই টু সিউ বইটা লিখেছিলাম, সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার অন্য পরিকল্পনা ছিল। সম্ভাবনা ছিল আবার কোনো এক সময় আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হবে, সব কিছুই ওলটপালট হয়ে যাবে।

চলুন, আগে আমরা একসাথে লাঞ্চ সারি। মিখাইল বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনি সত্যিই কোনো কিছুই বুঝতে পারেননি। কিন্তু যে স্বর্গীয় শক্তি আজ আমার মধ্য দিয়ে চলে গেছে, তা আপনার প্রতি নমনীয় হতে শিখিয়েছে।

আমরা পরের দিন সাক্ষাতের আয়োজন করলাম। বাড়ি ফেরার পথে পুরোটা সময়, এসথারের চলে যাওয়ার তিন মাস আগে ওর সাথে কথোপকথনের কথা স্মরণ করলাম।

তুমি যোদ্ধাদের কথা বলছ, তাই না?

হ্যাঁ। আমি এ রকম কিছু দেখেছি, যা আমার কাছে গ্রহণ করা খুবই কঠিন, কিন্তু আমি যা দেখেনি তা ভান করতে পারি না। যুদ্ধ একটা উপাসনা। রক্তের উপাসনা। কিন্তু সেই সাথে তা ভালোবাসার উপাসনা।

তুমি উন্মাদ।

হতে পারে আমি তাই। কিন্তু আরেকজন যুদ্ধক্ষেত্রের সাংবাদিকের সাথেও আমার দেখা হয়েছে। যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যায়। যেন মৃত্যু ওদের জীবনের একটা অংশ। ওরা কোনো কিছু নিয়ে ভীত নয়। যোদ্ধারা যে রকম বিপদের মুখোমুখি হয়, ওরাও হয়। শুধু সংবাদ সংগ্রহের জন্য? আমি তা মনে করি না। তারা খুব বেশি দিন বিপদ ছাড়া থাকতে পারে না। তাদের ওই অ্যাডভেঞ্চার, রক্তের এড্রেনালিন প্রবাহ ছাড়া বাঁচতে পারে না। ওদের মধ্যে একজন, বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক, আমাকে বলেছিল যুদ্ধের মধ্যেই সে সবচেয়ে সহজ বোধ করে, যদিও সে তার পরিবারকে খুবই ভালোবাসে এবং সব সময় স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের গল্প করে।

আমি ব্যাপারটা মোটেই বুঝতে পারছি না, এসথার। আমি তোমার জীবনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। কিন্তু আমার মনে হয় এসব অভিজ্ঞতা তোমার একটা বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার পরে শেষ হবে।

 কোনো অর্থ ছাড়া জীবনযাপন করাটাই আমার জন্য বেশি ক্ষতির ব্যাপার হবে। যুদ্ধের মধ্যে, সবাই জানে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাচ্ছে।

 তার মানে বোঝাতে চাচ্ছ, একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত?

না। জীবনের ওপর ঝুঁকি নেয়ার জন্য সেটাই যথেষ্ট নয়। না, আমি বোঝাতে চাইছি মানুষের সত্যিকারের জীবনের স্বাদ গ্রহণ করেছে।

 যুদ্ধ?

না, ভালোবাসা।

তুমি তাদের পছন্দ করতে শুরু করেছ।

 মনে করি আমি তাই।

তোমার নিউজ এজেন্সিকে বলো যথেষ্ট হয়েছে।

আমি তা বলতে পারি না। ব্যাপাটি ড্রাগের মতো। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকি, আমার জীবনটা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমি কয়েক দিন গোসল ছাড়া কাটিয়ে দিই। সৈনিকরা যা খায়, আমি তাই খেয়ে থাকি। রাতে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমাই। গোলাগুলির শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। আমি জানি যেকোনো মুহূর্তে আমরা যেখানে বসে আছি, সে জায়গায় গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আমার কাছে বেঁচে থাকা তাই-ই বোঝায়, তুমি কি দেখেছ? সত্যিকারের জীবন। আমি বোঝাতে চেয়েছি, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসা। দুঃখ, সন্দেহ, এসবের কোনো সময়ই নেই। কিছুই না। শুধু জীবনের প্রতি মহৎ ভালোবাসা আছে। তুমি কি শুনছ?

 নিঃসন্দেহে।

ব্যাপারটা যেন এমন মনে হয়, প্রতিটি যুদ্ধেই এক ধরনের স্বর্গীয় আলো বিকিরণ করে। যুদ্ধক্ষেত্রের সকল জঘন্য পরিস্থিতির মধ্যেও তা উপলব্ধি করা যায়। ভয়ের অস্তিত্ব আগে আর পরে, কিন্তু যখন গুলিবর্ষণ করা হয় তখন নয়। কারণ সেই মুহূর্তে, তুমি দেখতে পাবে তাদের সীমাবদ্ধতা। সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ ভঙ্গিমায় আবার একই সাথে সবচেয়ে অমানবিক কাজ। তারা তাদের একজন সাথীকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসে। একই সাথে যা কিছু নড়াচড়া করছে তাতেই তারা গুলি করে শিশু, মহিলা- যে কেউ যে তাদের লাইন অব ফায়ারে এসে পড়ে। ছোটখাটো শহরগুলোর লোকের কখনো এ রকম কিছু ঘটবে ভাবতে পারেনি। সেখানকার ভদ্রলোকেরা দেখতে পায় তাদের জাদুঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, শতাব্দী প্রাচীন শিল্পকর্ম ধ্বংস হয়ে গেছে। লোকেরা এসব ছবি সংগ্রহ করে, নিজেদের সান্ত্বনা দেয়ার চেয়ে গর্ববোধ করে। অসৎ এবং ভণ্ডরা তখন দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এ যেন এক পাগলের জগৎ। পুরোপুরি এলোমেলো জগৎ।

ব্যাপারটা কি তোমাকে টোকিওতে হ্যান্স ফ্রিটজুকে যা জিজ্ঞেস করেছিল তার উত্তর মিলতে সাহায্য করেছে?

 হ্যাঁ। উত্তরটা জেসুট টেলহার্ড দ্য চাডিনের লেখার মধ্যে আছে। যিনি বলেছিলেন, আমাদের পৃথিবীটা ভালোবাসার স্তর দ্বারা পরিবেষ্টিত। তিনি বলেছিলেন, আমরা বাতাসের শক্তি, সাগরের সৌন্দর্য, সূর্যের উত্তাপ উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু যেদিন থেকে আমরা ভালোবাসার শক্তি উপলব্ধি করতে শিখেছি, সেটাই আগুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।

আর তুমি শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে যেয়েই তা শিখতে পারো?

আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাকে অনেক কিছু বুঝতে শিখিয়েছে। লোকজন যুদ্ধক্ষেত্রেই সুখী থাকে। তাদের জন্য, জগৎটার একটা অর্থ থাকে। আমি আগে যেমনটি বলেছিলাম, পুরোপুরি শক্তি অথবা নিজেদের উৎসর্গ করার অর্থই তাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। তারা ভালোবাসার সীমাবদ্ধতাকে বুঝতে পারে। কারণ তাদের হারানোর কোনো কিছু থাকে না। বিপজ্জনক ক্ষতবিক্ষত হওয়া সৈনিক কখনো মেডিকেল টিমকে বলে না দয়া করে আমাকে বাঁচান! তার শেষ কথাটাই সাধারণত এমন হয় আমার স্ত্রী পুত্রকে বলবেন আমি তাদের ভালোবাসি। একেবারে শেষ মুহূর্তে তারা ভালোবাসার কথা বলে!

তো, তোমার মত অনুসারে, মানব জীবন শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়।

কিন্তু আমরা সব সময় যুদ্ধের মধ্যে থাকি। আমরা মৃত্যুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকি। আমরা জানি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই জয়ী হয়। সরাসরি লড়াইয়ে ব্যাপারটা খুব সুস্পষ্ট কিন্তু একই জিনিস দৈনন্দিন জীবনেও ঘটে। আমরা নিজেদের সব সময় অসুখী রাখতে পারি না।

তুমি আমাকে কী করতে বলো?

আমার সাহায্যের দরকার। আর তার মানে এই নয় যে আমাকে বলল যাও তোমার কাজ করো। কারণ তাতে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিজেকে কনফিউজ মনে হবে। আমাদের এ ব্যাপারে একটা পথ খুঁজে বের করা দরকার।

তুমি কি ঈশ্বরের ভালোবাসার কথা বলছ?

কেউ যদি তার সঙ্গীকে কোনো রকম শর্ত ছাড়াই, কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই ভালোবাসে, তাহলে সে ঈশ্বরের ভালোবাসার বার্তা বহন করে। যদি ঈশ্বরের ভালোবাসার ইশতেহার হয়, তাহলে সে তার প্রতিবেশীকে ভালোবাসবে। যদি সে তার প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে পারে, সে নিজেকেও ভালোবাসতে পারবে। যদি সে নিজেকে ভালোবাসতে পারে, তাহলে সব কিছুই তার কাছে ঠিকঠিক জায়গায় চলে আসবে। ইতিহাস বদলে যায়।

 ইতিহাস কখনো বদলাবে না, কারণ রাজনীতি, যুদ্ধ সব কিছুরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। সময়ের শুরুতেই তা ওরকমভাবে ছিল। ইতিহাস শুধু তখনই বদলে যাবে যখন ভালোবাসার শক্তিকে ব্যবহার করতে পারব। যেভাবে আমরা বাতাসের শক্তি, সাগরের শক্তি, পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে থাকি।

তুমি কি মনে করো আমরা দুজনে মিলে জগৎটাকে রক্ষা করতে পারব?

আমার মনে হয় আরো অনেক মানুষ আছে, যারা একইভাবে চিন্তা করছে। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?

 হা। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমাকে বলবে আমাকে কী করতে হবে।

কিন্তু আমি সেই ব্যাপারটাই জানি না!

.

প্রথমবার প্যারিসে আসার পর থেকেই আমি এই সুস্বাদু পিজ্জারিয়ার নিয়মিত খদ্দের। ব্যাপারটা যেন আমার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে শিল্প ও সাহিত্যের ওপর আমাকে দেয়া পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এখানেই আয়োজন করেছি আমি। এমনকি যদিও অনেকে মনে করে, এ রকম জমকালো একটা অনুষ্ঠান আরো বিলাসবহুল আভিজাত্যপূর্ণ জায়গায় হওয়া উচিত। কিন্তু পিজ্জারিয়ার মালিক রবার্টো আমার জন্য এক রকম সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখনই আমি এই রেস্টুরেন্টে গেছি তখনই আমার জীবনে ভালো কিছু ঘটেছে।

এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ-এর সাফল্য নিয়ে আমরা কথা শুরু করতে পারি। অথবা গত রাতে আপনার পারফরম্যান্স দেখে আমার অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে কিছু বলতে পারি।

এটা কোনো পারফরম্যান্স ছিল না, একটা মিটিং। মিখাইল বলল, আমরা গল্প বলি আর ভালোবাসার শক্তি অনুভব করার জন্য নাচি।

আপনি যাতে সহজ বোধ করেন সে জন্য আমি যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি। কিন্তু আমরা দুজনই জানি এখানে কেন এসেছি।

 আপনার স্ত্রীর কারণে আমরা এখানে। মিখাইল বলল। ওকে এখন পরিপূর্ণ যুবকের মতো আত্মবিশ্বাসী লাগছে। বইয়ে অটোগ্রাফ নেয়ার দিনের সেই লজ্জিত বালকসুলভ ভাবটা আর নেই।

আপনি তার মানে আমার প্রাক্তন স্ত্রীর কথা বলতে চাইছেন। আমার হয়ে আপনি অন্তত একটা কাজ করে দেন। আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলেন। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাই কেন ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু এরপরই আমি জাহির থেকে মুক্ত হতে পারব। তা না হলে আমি দিন-রাত ওর কথা ভাবতেই থাকব। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাদের গল্পগুলো, আমাদের ইতিহাস বারবার ভাবতে থাকব। চেষ্টা করতে থাকব সেই মুহূর্তগুলোর কথা, যে সময় আমি ভুল করেছিলাম আর আমাদের পথ দুদিকে চলে গেল।

মিখাইল হেসে উঠল।

 ইতিহাসের পরীক্ষণ খুব ভালো ব্যাপার। একমাত্র ওভাবেই আপনি কোনো কিছুকে বদলে দিতে পারেন।

ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যাপারটা দার্শনিক আলোচনা মুক্ত রাখতেই পছন্দ করব। আমি নিশ্চিত, সব তরুণের মতোই, আপনিও মনে করেন জগৎটাকে ঠিক রাখার জন্য আপনার হাতেই মূল্যবান ফর্মুলা রয়েছে। যাই হোক, সব তরুণের মতোই, আপনিও একদিন আমার মতো বয়স্ক হয়ে উঠবেন। তখন দেখতে পাবেন যেকোনো জিনিস বদলে দেয়াটা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে এখন কথা বলার কোনো যুক্তি নেই। আপনি কি আমার হয়ে ওই কাজটুকু করবেন?

আমার অবশ্যই প্রথমে একটা কথা জিজ্ঞেস করা দরকার, ও কি আপনাকে বিদায় বলেছিল?

না।

ও কি জানিয়েছিল ও চলে যাচ্ছে?

না, ও তা জানায়নি। আপনি সেটা জানেন।

আপনি কি মনে করেন, এসথার ওই ধরনের মানুষ, যে মানুষটার সাথে সে দশ বছরের বেশি সময় ধরে সংসার করছে তাকেই প্রথমে না জানিয়ে, চলে যাওয়ার ব্যাখ্যা না দিয়ে চলে যেতে পারে?

সেই ব্যাপারটাই আমাকে সবচেয়ে সমস্যার মধ্যে ফেলেছে। কিন্তু আপনি তাতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?

 রবার্টোর কারণে কথোপকথন বাধাগ্রস্ত হলো। রবার্টো জানতে চায় আমরা এখন কোনো কিছু খেতে চাই কিনা। মিখাইল নাপোলিটানা দিতে বলল। আমি রবার্টোকে ওর ইচ্ছামতো কিছু আমাকে দিতে বললাম। এই মুহূর্তে কী খেতে চাই তা নিয়ে চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই। আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা দরকার, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এক বোতল রেড ওয়াইন। রবার্টো জানতে চাইল কোন ধরনের ওয়াইন চাই। তার উত্তরে আমি বিড়বিড় করে কী বললাম তা রবার্টো শুনতে পেল না, কিন্তু বুঝতে পারল আমাদের একা থাকতে দিয়ে তাকে কেটে পড়তে বলছি। সে কারণে আর লাঞ্চের খাবারের কথা কিছুই জিজ্ঞেস করল না। কিন্তু নিজেই দরকারি সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। আমরা নিজেদের মতো করে কথোপকথনে মনোযোগী হতে পারলাম।

ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ওয়াইন চলে এল। আমরা গ্লাস পরিপূর্ণ করে নিলাম।

ও কী করছে?

আপনি কি সত্যিই তা জানতে চান?

 আমি একটু বিরক্ত হলাম।

 হ্যাঁ, চাই।

 ও কার্পেট বানায় আর ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষা দেয়।

 কার্পেট! আমার স্ত্রী (প্রাক্তন স্ত্রী, দয়া করে চেষ্টা করো এতে অভ্যস্ত হতে), দরকার মতো অর্থ ওর কাছে আছে, সাংবাদিকতার ওপর ডিগ্রি আছে, চার চারটে ভাষায় কথা বলতে পারে, সে কিনা এখন কার্পেট তৈরি করে আর বিদেশিদের ফরাসি ভাষা শিখিয়ে জীবিকা উপার্জন করছে? পুরো ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এই তরুণের পুরুষকারে আঘাত করার মতো ঝুঁকি আমি নিতে পারি না, এমনকি যদিও ব্যাপারটা ভাবতে লজ্জা করছে, মিখাইল এসখারের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।

দয়া করে, আমার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন। গত বছরটা আমার কীভাবে গেছে বুঝুন। আপনার সাথে এসথারের সম্পর্কের ব্যাপারে আমি কোনো হুমকির কারণ হয়ে থাকব না। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আমি ওর সাথে থাকতে চাই তা না হলে অন্ততপক্ষে ঘণ্টাখানেক।

মিখাইলকে দেখে মনে হলো কথাগুলো বিবেচনা করে দেখছে।

আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি। মিখাইল হেসে বলল, আপনি কি মনে করেন, এসথার ওই জাতীয় মানুষ যে অন্ততপক্ষে বিদায় না বলে এবং কারণ না জানিয়ে আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে?

না, আমি তা মনে করি না।

তাহলে কেন বারবার বলছেন, ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে? তাহলে কেন আপনি বলছেন, আপনাদের সম্পর্কের ব্যাপারে আমি কোনো নাক গলাতে আসব না?

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মনে হচ্ছে আশার কথা শুনতে পাচ্ছি জানি না কেন এ রকমটি আশা করছি বা আশার উৎস কী!

আপনি কি আমাকে বলতে চাইছেন…

ঠিক তাই। আমি আপনাকে বলছি ও আপনাকে অথবা আমাকে কাউকে ছেড়ে যায়নি। ও শুধু কিছু সময়ের জন্য অন্তর্ধান হয়ে গেছে, সম্ভবত চির জীবনের জন্য, কিন্তু আমাদের দুজনেরই সে জন্য ওকে সম্মান দেখানো উচিত।

এই রেস্টুরেন্টের স্বল্প আলোকিত আলোর মধ্যে যেন উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখতে পেলাম। এই জায়গা আমার জন্য সব সময় সুখস্মৃতির আর ভালো গল্পের। আমি বেপরোয়াভাবে বিশ্বাস করতে চাইলাম এই তরুণটি বলছে, জাহির এখন আমার চারদিকে প্রবাহিত হচ্ছে।

আপনি কি জানেন, ও কোথায় আছে?

হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু এমনকি আমিও আপনার মতো একই রকম ভাবে ওকে মিস করি। ওর নীরবতাকে আমাদের অবশ্যই সম্মান জানানো উচিত। গোটা ব্যাপারটাই আপনার মতো আমার কাছেও খুব ঘোলাটে। এসথার হয়তো সর্বগ্রাসী ভালোবাসার মধ্যে শান্তি খুঁজে পায়। হয়তো আমাদের কোনো একজনের জন্য অপেক্ষা করছে, আমরা কেউ গিয়ে তাকে খুঁজে নিয়ে আসব। হয়তো কোনো নতুন পুরুষের সাথে ওর দেখা হয়েছে। অথবা হয়তো ও গোটা জগতের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সত্যটা যাই হোক, আপনি যদি ওকে খুঁজে পাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, আমি আপনাকে বাধা দিতে পারি না। কিন্তু আপনি যদি সে রকম করেন, আপনার অবশ্যই একটা ব্যাপার জানা উচিত, আপনি অবশ্যই শুধু তার দেহটাই খুঁজে পাবেন না, তার আত্মাও পাবেন।

আমার হাসতে ইচ্ছা করছে। ওকে জড়িতে ধরতে ইচ্ছা করছে অথবা সম্ভব হলে খুন করতে আমার আবেগ ঝড়ের বেগে বদলে যাচ্ছে।

আপনি কি ওর সাথে…

আমরা একসাথে শুয়েছি কিনা? সেটা আপনার মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। আমি যে জীবনসঙ্গী খুঁজছিলাম, এসথারকে সে রকমটি পেয়েছিলাম। আমি যে মিশনকে বিশ্বাস করতাম, ও আমাকে সে ব্যাপারে গুছিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। ও দেবীর মতো আমার জন্য দরজা খুলে ধরেছিল, পথ দেখিয়েছিল, সে পথে আমাদের অনুমোদন দেবে- যদি আমাদের দেবী ইচ্ছা করেন- জগতের ভালোবাসার শক্তিকে গচ্ছিত রেখেছিল। আমরা একই মিশনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আর আপনার মনকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য জানাচ্ছি, আমার একজন গার্লফ্রেন্ড আছে, গত রাতে যে স্বর্ণকেশী মেয়েটিকে আমার সাথে স্টেজে দেখেছিলেন। মেয়েটির নাম লুসেরিয়া। ইতালিয়ান।

আপনি কি আমাকে সত্যি কথা বলছেন?

হ্যাঁ, স্বর্গীয় শক্তির দোহাই, আমি সত্যিই বলছি। মি

খাইল পকেট থেকে এক টুকরো ফাব্রিকের কালো কাপড় বের করল।

আপনি কি এটা দেখতে পাচ্ছেন? কাপড়ের টুকরোটি আসলে সবুজ রঙের ছিল। এটা কালো দেখাচ্ছে কারণ এটা শুকনো রক্তে এ রকমটি হয়েছে। একজন সৈনিক, জগতের যেকোনো জায়গার হতে পারে, মরার আগে গায়ের জামা খুলে সেটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে এই টুকরোগুলোকে এমন কাউকে দিয়েছে, যে সৈনিকের পাঠানো মেসেজটা বুঝতে পারে। আপনার কাছে কি কোনো টুকরো আছে?

না, আমার কাছে নেই। এসথার এমনকি আমার কাছে কখনো এর কথা উল্লেখ করেনি।

যখন এসথারের সাথে কারো দেখা হয় ও বুঝতে পারে সে মেসেজটা গ্রহণ করতে পারে, ও তখন সৈনিকের রক্তের এক টুকরো দেয়।

 সেই মেসেজটা কী?

ও যদি আপনাকে সেই শার্টের টুকরো না দিয়ে থাকে, তাহলে আমার মনে হয় না আমার তা আপনাকে বলা উচিত, ও আমাকে সেই গোপনীয়তা রাখতে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে।

আপনি কি এ রকম কাউকে চেনেন, যার কাছে সেই কাপড়ের টুকরো আছে? ও রেস্টুরেন্টে আমরা যারা পারফর্ম করি তাদের সবার কাছে আছে। আমরা সেখানে ছিলাম, কারণ এসথার আমাদের সবাইকে একত্র করেছিল।

খুব সাবধানে ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। মিখাইলের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করে, ফেভার ব্যাংকে একটা ডিপোজিট করা দরকার। ওকে ভয় পাইয়ে দেয়া উচিত নয়। ওর সম্পর্কে, ওর কাজের ব্যাপারে, ওর দেশের কথা, ও যা বলতে গর্ববোধ করে সেগুলো সমন্ধে জিজ্ঞেস করা উচিত। খুঁজে বের করা দরকার ও আমাকে যা বলছে তা সত্যি কিনা, নাকি ওর নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমার পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া দরকার ও সত্যিই এসথারের সংস্পর্শে এসেছিল কিনা অথবা সেও আমার মতো এসথারকে হারিয়ে ফেলেছে। হতে পারে সে একটা বিছিন্ন দেশ থেকে এসেছে, ওখানে মূল্যবোধের সঙ্গা ভিন্ন কিন্তু আমি জানি ফেভার ব্যাংকে সবত্রই পরিচালিত হয়। এই সংস্থার কোনো কিছুর বাধা মানে না। অন্যদিকে, মিখাইল যা বলেছে সবই বিশ্বাস করতে চাই। আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। হাজার এক রজনী ধরে তা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। আমি কখনো ভালোভাবে ঘুমাতে পারি না। দরজায় শব্দের জন্য অপেক্ষা করি। এসথার আসতে পারে। কোনো কথা না বলে আমার পাশে শুয়ে পড়তে পারে। আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, এমনটি ঘটলে আমি এসখারকে কোনো প্রশ্ন করব না। আমি শুধু ওকে চুমু খেয়ে বলতাম, ভালোভাবে ঘুমাও, প্রিয়তমা। আমরা একসাথে পরের দিন ঘুম থেকে উঠব। হাতে হাত ধরে থাকব, যেন গোটা দুঃস্বপ্নটা কখনো ঘটেনি।

রবার্টো পিজ্জা নিয়ে হাজির। ওকে দেখে মনে হয় আমার চিন্তা করার জন্য কখন একান্ত সময় দরকার তা ও জানে।

আমি আবার মিখাইলের দিকে তাকালাম। শান্ত থাকলাম। নিজের নাড়ির স্পন্দনের নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত। পুরো এক গ্লাস ওয়াইন পান করলাম। লক্ষ করলাম, মিখাইলও এক গ্লাস সাবাড় করল।

মিখাইল কেন এতটা নার্ভাস?

ওহ, আপনি যা বলেছেন আমি তা বিশ্বাস করি। কিন্তু আমাদের সামনে এ ব্যাপারে কথা বলার অনেক সময় পড়ে আছে।

আপনি ওর কাছে আপনাকে নিয়ে যেতে বলছেন।

ও আমার খেলাটা নষ্ট করে দিয়েছে। আমাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।

হা, তাই চাই। আমি আপনাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করছি। আমার শক্তি খরচ করে আমি তা করতে সব কিছু করব। যদিও আমার তেমন কোনো তাড়া নেই। আমাদের আগে একটা পিজ্জা শেষ করতে হবে। পাশাপাশি, আমি আপনার সমন্ধে আরো বেশি জানতে চাই।

আমি লক্ষ করলাম, ও নিজের হাতের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।

আমি একটা মিশন নিয়ে এসেছি। আমার মিশন এখনো পুরা হয়নি। কিন্তু মনে হয় এরপরও আমি কিছুটা সময় পাব।

সম্ভবত আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

হ্যাঁ, আপনি তা পারেন। যে কেউ তা পারে। গোটা জগৎ জুড়ে ভালোবাসার শক্তি ছড়িয়ে রাখতে পারে।

 আমি তার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারি।

আমি আর বেশি কিছু বলতে চাইনি। ওর নৈতিকতা কিনে নেয়ার চেষ্টা করছি এ রকম কিছু দেখাতে চাইনি। সতর্কতার সাথে কথা বলতে হবে। আমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। মিখাইল হয়তো সত্যটা বলতে পারে কিন্তু সেই সাথে সে মিথ্যাও বলতে পারে, আমার যন্ত্রণার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে।

আমি শুধু এক প্রকার ভালোবাসার শক্তির কথা জানি, আমি বলে চললাম, আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া মহিলার প্রতি আমি সেই ধরনের ভালোবাসা অনুভব করি। অথবা যে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যদি ওকে আবার দেখতে পেতাম, আমি একজন সুখী মানুষ হতাম। জগৎটা আমার জন্য আরো ভালো জায়গা মনে হতো কারণ একজনের আত্মা তা ধারণ করে আছে।

মিখাইল একবার ছাদের দিকে তাকাল। আবার তার দৃষ্টি টেবিলে ফিরে এল। আমি নীরবতা বজায় রাখার চেষ্টা করলাম।

আমি একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পারি। আমার দিকে না তাকিয়ে ও শেষ পর্যন্ত বলল।

আধ্যাত্মিকতা নিয়ে লেখার সবচেয়ে বড় সুবিধা, জানি লোকজনের ভেতরের এক ধরনের শক্তির ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি। এর ভেতরে কিছু উপহার বাস্তব, অন্যগুলো ভণ্ডামি। কিছু লোক আমাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, অন্যরা আমাকে উপহাস করে। আমি অনেক বেশি অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, মিরাকল ঘটে। সব কিছুই সম্ভব। অনেক আগে ভুলে যাওয়া অন্তরের শক্তির ব্যাপারে তারা শিখতে পারে।

 যাই হোক, এই জাতীয় বিষয় নিয়ে কথা বলার এখনই উপযুক্ত সময় নয়। আমি শুধু জাহিরের ব্যাপারে আগ্রহী। এসথার আবার জাহির হিসেবে আসুক। আমার তাই দরকার।

মিখাইল…।

আমার আসল নাম মিখাইল নয়। আমার নাম ওলেগ।

 ওলেগ, তাহলে…

আমি যখন নতুন জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তখনই মিখাইল নামটা বেছে নিলাম। যোদ্ধাদের মতো, তাদের উন্মুক্ত তরবারি, একটা পথের মুখ খুলে দেয়- আপনি একে কী বলবেন? ওয়ারিয়র অব লাইট, যা একে অন্যকে খুঁজে পায়। আমার মিশন সেটাই।

আমারও মিশন তাই।

আপনি কি আর এসথারের কথা বলতে চান না?

কী? ও কি আবারও আমার অজান্তে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে চলে গেছে?

আমি খুব একটা সুস্থ বোধ করছি না। মিখাইল অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। সে রেস্তোরাঁর চারদিকে এমনভাবে দেখতে লাগল, যেন সেখানে আমি উপস্থিত নেই আমি ও ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। কণ্ঠস্বরটা…

অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত কিছু ঘটছে। ও আমাকে প্রভাবিত করার জন্য আর কতদূর যেতে চায়? ও কি ওর জীবনের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে আমাকে বই লিখতে বলবে? যেমনটি এর আগে অনেকেই বলেছে?

যখন আমার কাছে বিষয়বস্তু পরিষ্কার থাকে, তা অর্জন করতে আমি যা দরকার তাই করি। যাই হোক, এসব কথা আমি আমার বইয়ে লিখেছি। আমি নিজের কথার কখনো বিট্রে করি না। আমার এখন একটা লক্ষ্য আছে। জাহিরের চোখের দিকে অন্তত একবারের জন্য হলেও তাকিয়ে থাকব। মিখাইল আমাকে অনেকগুলো নতুন তথ্য জানিয়েছে। মিখাইল তার প্রেমিক নয়। এসথার আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। এসথারকে ফিরিয়ে আনা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। আবার এমনও হতে পারে, পিজ্জারেজ্জা আমাদের এই সাক্ষাৎকারটা একটা উপহাসের বিষয় মাত্র। মিখাইলও অন্য অনেকের মতো মানুষের দুঃখকষ্ট-যন্ত্রণাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকে

আমি আরেক গ্লাস ওয়াইন পান করলাম। মিখাইলও পান করল।

সাবধান হও।

হ্যাঁ, আমি এসথারের ব্যাপারে কথা বলতে চাই। কিন্তু আমি আপনার ব্যাপারেও জানতে চাই।

কথাটা সত্যি নয়। আপনি শুধু আমাকে প্রভাবিত করতে চাইছেন। আমি যা করতে চাইছি তাতে প্রলুব্ধ করে এগিয়ে নিতে চাইছেন। আপনার যন্ত্রণা এই ব্যাপারটাকে স্পষ্ট করে দেখতে চাচ্ছে। আপনি ভাবছেন আমি মিথ্যা বলতে পারি। আমি আপনার পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারি।

মিখাইল হয়তো আমি কী ভাবছি তা ঠিকঠাক জানতে পারে, কিন্তু সে ভদ্রতার সূচক ছাড়িয়ে বেশ জোরে জোরে কথা বলছিল। লোকজন মাথা ঘুরিয়ে ব্যাপার কী ঘটছে দেখতে আমাদের দিকে তাকাল।

আপনি আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না আপনার বই আমার জীবনে কেমন প্রভাব বিস্তার করে অথবা আমি তা থেকে কতটা শিখেছি। আপনার যন্ত্রণা আপনাকে অন্ধ করে দিয়েছে। জাহিরের ব্যাপারে আপনি অনেক অবসেসড। ওর প্রতি আপনার ভালোবাসাই কি আমাকে এই লাঞ্চের দাওয়াত দিতে বলেনি? আমি নিশ্চিত নই, আমি পুরোপুরি আপনার ভালোবাসাকে প্রভাবিত করতে পেরেছি কিনা, সম্ভবত গর্ব আহত হয়েছে। যে কারণেই আমি এখানে…

মিখাইলের কণ্ঠস্বর চড়া হয়ে উঠছিল। সে তখনো বুনো দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছিল। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল।

 এই আলোগুলো…

 তাতে সমস্যা কী?

আপনার প্রতি ওর ভালোবাসার কারণেই আমি এখানে!

আপনি ঠিক আছেন?

রবার্টো খেয়াল করেছিল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। সে টেবিলের কাছে চলে এল। হেসে খুব স্বাভাবিকভাবে মিখাইলের কাঁধে হাত রাখল।

বেশ, পিজ্জা সত্যিই খুব অপূর্ব ছিল। কোনো দাম দেয়ার দরকার নেই। আপনার যখন ইচ্ছা হয় চলে যেতে পারেন।

আমাদের এখন বেরিয়ে যাওয়া দরকার। আমাদের খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে অন্যদের চোখের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়া উচিত।

আপনি কি বাতাসের প্রবাহ টের পাচ্ছেন?

সেই মুহূর্তে, আমি নিশ্চিত মিখাইল কোনো ধরনের অভিনয় করছে না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।

 এই আলোগুলো, এই আলোগুলো বড় চোখে লাগছে! দয়া করে, আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান!

ওর শরীরে অদ্ভুত কাঁপুনি শুরু হয়েছে। কী ঘটছে তা আর এখন লুকানোর কিছু নেই। অন্য টেবিলের লোকজন উঠে দাঁড়িয়েছে।

কাজাখে…

মিখাইল বাক্যটা শেষ করতে পারল না। সে নিজের দিক থেকে টেবিলটাকে ধাক্কা দিল। পিজ্জা, গ্লাস, কাঁটাচামচ সব উড়ে গিয়ে পাশের টেবিলের খাবারে আঘাত করল। ওর ভাবভঙ্গি পুরোপুরি বদলে গেছে। ওর গোটা শরীর কাঁপছে। এখন শুধু ওর চোখের সাদা অংশটাই দেখা যাচ্ছে। ওর মাথা ভয়ানকভাবে পেছনের দিকে হেলে আছে। আমি ঘাড়ের হাড় ফোঁটার শব্দ শুনতে পেলাম। অন্য টেবিল থেকে উঠে আসা এক ভদ্রলোক ওর পায়ের কাছে দাঁড়াল। মিখাইল পড়ে যাওয়ার আগে রবার্টো ওকে ধরে ফেলল। আরেকজন মেঝে থেকে একটা চামচ কুড়িয়ে নিয়ে মিখাইলের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল। কিন্তু আমার কাছে যেন অনন্ত সময়। আমি কল্পনা করতে পারি ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিন ব্যাপারটাকে কীভাবে বর্ণনা করছে- একজন বিখ্যাত লেখক, সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে যিনি সবচেয়ে বড় সাহিত্য পুরস্কারের একজন ক্যান্ডিটেট- পিজ্জারেজ্জায় নতুন বইয়ের পাবলিসিটির সময় একটা দৃশ্যের অবতারণা হয়। আমার ভয়টা সীমাহারা হয়ে যাচ্ছে। তারা হয়তো খুঁজে বের করতে পারে আমি যার সাথে ছিলাম সে আমার স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া একই মানুষ। ব্যাপারটা আবার শুরু হবে। আর এইবার তা সামাল দেয়ার মতো শক্তি সাহস আমার নেই।

রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে আসা লোকজনের মধ্যে কয়েজনকে চিনি, কিন্তু তাদের মধ্যে আমার সত্যিকারের বন্ধু কে? যা দেখেছে তা মুখ বন্ধ করে থাকার মতো কে আছে?

মিখাইলের শরীরের কাঁপুনি বন্ধ হলো। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। রবার্টো ওকে চেয়ারের ওপর ধরে রাখল। আরেকজন মিখাইলের নাড়ি দেখল। চোখের দৃষ্টি পরীক্ষা করল। তারপর আমার দিকে ঘুরল :

এই প্রথমবার ওর এমনটি হয়েছে তা নয়। আপনি ওনাকে কত দিন ধরে চেনেন?

ওহ, এরা আমার নিয়মিত খরিদ্দার। রবার্টো উত্তর দিল। বুঝতে পারছেন কথা বলার মতো অবস্থা আমার নেই। কিন্তু জনসমক্ষে এই প্রথমবার এমনটি ঘটেছে। অবশ্যই, আমার রেস্তোরাঁয় এর আগে আরো এ ধরনের ঘটনা সামলেছি।

 হ্যাঁ। লোকটা বলল, আমি লক্ষ করেছি আপনি আতঙ্কিত হননি।

মন্তব্যটা আমাকে স্বস্তিতে ফিরিয়ে আনল। আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

লোকটা নিজের টেবিলে ফিরে গেল।

রবার্টো আমাকে আশ্বস্ত করল, একজন খুব বিখ্যাত অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক উনি। রবার্টো বলল, যদিও আমার মনে হয়েছে আপনার অতিথির চেয়ে আপনারই বেশি মেডিকেল ট্রিটমেন্ট দরকার।

মিখাইল, অথবা ওলেগ, অথবা আমার বিপরীতে বসা এই তরুণটির যে নামই হোক না কেন, আমার দিকে আসতে থাকে। সে নিজের দিকে তাকায়। তাকে বেশ বিব্রত মনে হয়। তার হাসিটাও লজ্জায় ভরা।

আমি দুঃখিত। মিখাইল বলল, আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি।

আমি শান্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। রবার্টো আবারও আমাকে উদ্ধার করতে এল।

চিন্তা করো না। ভাঙা প্লেটগুলোর দাম দেয়ার মতো যথেষ্ট টাকা আমাদের লেখকের আছে।

 তারপর রবার্টো আমার দিকে ফিরল, এপিলেপসি। ব্যাপারটা শুধু মৃগীজনিত মূৰ্ছা। আর কিছু নয়।

 আমি মিখাইলকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট ত্যাগ করলাম। মিখাইল হাঁক দিয়ে ট্যাক্সি ডাকল।

কিন্তু আমাদের কথা এখনো শেষ হয়নি! আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

কথা বলার মতো অবস্থা এখন আর আমার নেই। আর আপনি জানেন আমাকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

.

দুই ধরনের জগৎ আছে : যে জগণ্ডাকে আমরা স্বপ্নে দেখি। আর বাস্তব জগৎ।

আমার স্বপ্নের জগতে, মিখাইল সত্য কথা বলেছে। আমি শুধু একটা কঠিন। সময় পার করছি। যেকোনো ভালোবাসার সম্পর্কের অভিজ্ঞতার ভুল বোঝাবুঝি আছে। এসথার কোথাও না কোথাও আছে, আমাদের বিয়েতে ভুল কি ছিল তা খুঁজে পেয়ে আমার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। তারপর ওর কাছে গিয়ে ওর ক্ষমা প্রার্থনা করে আমাদের জীবনটা সুন্দর হয়ে উঠবে।

স্বপ্নের জগতে, মিখাইল আর আমি শান্ত স্বরে কথা বলেছি, পিজ্জারেজ্জা ছেড়ে চলে এসেছি, একটা ট্যাক্সি ডেকেছি, এ রকম একটা ঘরের দরজায় ঘণ্টি বাজিয়েছি যেখানে আমার প্রাক্তন স্ত্রী (অথবা আমার স্ত্রী?), সকালে কার্পেট ঝাড় দিয়েছে, ফরাসি ভাষা শিখিয়েছে, সারা রাত ঘুমিয়েছে, সেখানে এসেছি।

বাস্তব জগতে, মিখাইলের সাথে যেকোনো সাক্ষাৎই সব সময় বেশ টেনশনের ব্যাপার। কারণ পিজ্জারেজ্জায় যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। মিখাইল যা কিছু বলেছে তা শুধু ওর উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। আমার মতো তারও এসথার কোথায় আছে সে সমন্ধে কোনো ধারণাই নেই।

 বাস্তব জগতে, সকাল পৌনে বারোটায় আমি গার্ড দ্য এস্ট স্ট্রেসবার্গের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। একজন গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা পরিচালক, আমার বই অবলম্বনে একটা সিনেমা তৈরি করতে ইচ্ছুক, তাকে আনতে যেতে হবে।

এর আগ পর্যন্ত, যখনই কেউ আমার বইয়ের এডাপটেশন নিয়ে সিনেমা তৈরি করতে চেয়েছে, আমার সব সময়ের উত্তর ছিল, না, আমি আগ্রহী নই। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি পাঠকই নিজের ভেতরে নিজের মতো করে সিনেমা তৈরি করে নেয়। চরিত্রগুলোর মুখাবয়ব দেয়, প্রতিটি দৃশ্য তৈরি করে, কণ্ঠস্বরগুলোকে শোনে, গন্ধগুলোর গন্ধ নেয়। আর সে কারণে, যখনই কোনো পাঠক বইয়ের কাহিনী নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখতে যায়, তাকে বেশ হতাশ হতে হয়, বলে, বইটা ছবির চেয়ে অনেক ভালো ছিল।

 এইবার, আমার এজেন্ট অনেক বেশি জোর দিয়েছে। মেয়েটা আমাকে বলেছে, এই অভিনেতা-পরিচালক অনেক বেশি আমাদের দিকে। এর আগে অন্যরা যে রকম প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের কিছু হবে। দুই মাসে আগে এই সাক্ষাতের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমাদের রাতের খাবার একত্রে খাওয়ার কথা। দেখার ইচ্ছা সত্যিই আমরা একই চিন্তাভাবনার মানুষ কিনা।

গত দুই সপ্তাহে, যাই হোক, আমার দিনপঞ্জি পুরোপুরি বদলে গেছে। আজ বৃহস্পতিবার। আমার আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁয় যাওয়ার দরকার। ওই তরুণ মৃগী মিখাইলের সাথে আমার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা দরকার। ওই তরুণই শুধু জানে কোথায় আমার জাহিরকে পাওয়া যাবে। আমি এই ব্যাপারটাকে আমার বই সিনেমার জন্য না বিক্রির একটা চিহ্নস্বরূপ দেখলাম। তো আমি অভিনেতা- পরিচালকের সাক্ষাৎকারটাকে বাতিল করে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। তিনি জোর দিয়ে বলতে লাগলেন, এটা অন্ততপক্ষে কোনো ব্যাপার নয়, আমরা আগামী দিন লাঞ্চে বসতে পারি। কেউ সম্ভবত রাতে প্যারিসে একা কাটাতে চায় না। তিনি বললেন।

কল্পনার জগতে, এসথার আমার সব সময়ের সঙ্গী। তার ভালোবাসা আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়। আমার সম্মুখ সমরের দ্বার খুলে দেয়।

 বাস্তব জগতে, এসথার পুরোপুরি আমার মোহাবিষ্টতা অধিকার করে আছে। আমার শক্তিকে ছিনিয়ে নিয়েছে। আমার জীবনযাত্রাকে বাধ্যবাধকতায় রূপ দিয়েছে। আমার কাজ, ছবির লোকজনের সাথে আমার সাক্ষাৎকার, আমার ইন্টারভিউ সব দখল করে নিয়েছে।

দুই বছর পরেও কীভাবে তা সম্ভব ভেবে পাই না। আমি এখনো ওকে ভুলে যেতে পারিনি? আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবতে পারছি না। সবগুলো সম্ভবনা বিশ্লেষণ করেছি এবং অনেকগুলো পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। পরিস্থিতিটাকে খুব সাধারণভাবে গ্রহণ করতে চেয়েছি। যোগ ব্যায়াম করেছি, কয়েকটা দাঁতব্য সংস্থার কাজ করেছি, বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা করেছি, মেয়েদের প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছি, নৈশ ভোজে অংশ নিয়েছি, সিনেমায় গিয়েছি (সব সময় বইয়ের প্রভাবে সিনেমা ব্যাপারটা এড়িয়ে চলেছি), থিয়েটারে গেছি, ব্যালে দেখেছি, ফুটবল খেলেছি। সব সময় জাহির জিতে গেছে। যদিও, সব সময় আমার সাথে ছিল, ও সব সময় আমার সাথে ছিল।

স্টেশনের ঘড়ির দিকে তাকালাম- পনেরো মিনিট চলে গেছে। আমার কল্পনার জগতে মিখাইল আমার সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করেছে। বাস্তব জগতে, এ ব্যাপারে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। মিখাইল কী বলছে সে ব্যাপারে আমার আকাঙ্ক্ষা থাকার পরও, ও ছদ্মবেশধারী একজন শত্রু হতে পারে।

আমি সাধারণ প্রশ্নে ফিরে এলাম, এসথার কেন কখনো আমাকে কোনো কিছু বলেনি? অথবা যখন এসথার আমাকে হ্যাঁন্সের প্রশ্নের কথা বলেছিল তখন কী বোঝানোর চেষ্টা করেছিল? এসখার জগক্টাকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমাদের কথাবার্তার মধ্যে ভালোবাসা এবং যুদ্ধের ব্যাপারে ধারণা দিয়েছি, ও কি আমাকে ওর মিশনে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করতে চেয়েছিল?

আমার চোখ রেলওয়ে ট্র্যাকের ওপর নিবদ্ধ হয়ে আছে। এসথার আর আমি এর ওপর দিয়ে সমান্তরালে হেঁটে গেছি। কেউ কাউকে স্পর্শ করিনি।

 দুজনের গন্তব্য…

রেলওয়ে ট্র্যাক।

 দুই লাইনের মধ্যে ফারাক কতটুকু?

 জাহিরের কথা ভুলে গিয়ে, আমি প্লাটফর্মের স্টাফকে কথাটা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম।

ওগুলো ১৪৩.৫ সেন্টিমিটার অথবা ৪ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি দূরত্বে আছে। কর্মচারী উত্তর দিল।

লোকটাকে দেখে মনে হয় নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। চাকরি নিয়ে গর্বিত। সে কখনো এসথারের স্টেরিওটাইপের সাথে মিলবে না। আমাদের সবার অন্তরে বিষাদের ছোঁয়া আছে।

কিন্তু তার উত্তর আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। ১৪৩.৫ সেন্টিমিটার অথবা ৪ ফিট সাড়ে আট ইঞ্চি?

অদ্ভুত। যুক্তিগ্রাহ্যভাবে, এটার ১৫০ সেন্টিমিটার বা ৫ ফিট হওয়া উচিত। একটা রাউন্ড নাম্বার। নির্মাণকারী অথবা রেলওয়ে কর্মচারীদের সহজে মনে রাখার জন্য। কিন্তু কেন? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

কারণ গাড়ির দুই চাকার মাঝখানের প্রশস্ততা ও রকমই।

কিন্তু নিশ্চয় চাকার ব্যবধান ও রকম কারণ রেলওয়ে ট্রাকের ব্যবধান তাই।

দেখুন, আমি রেলওয়ে স্টেশনে কাজ করি, তার মানে এই নয় যে আমি ট্রেনের সমন্ধে সব কিছুর উত্তর জানি। জিনিসগুলো এ রকমই।

 লোকটা এখন আর কোনো সুখী মানুষ নয়। শান্তির সাথে কাজ করতে পারবে না। সে হয়তো একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কিন্তু তার বেশি পারে না। আমি লোকটার কাছে ক্ষমা চেয়ে অন্তত মিনিট পনেরোর মতো রেলওয়ে ট্রাকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো রেলওয়ে ট্রাক আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে।

ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হলেও, ট্র্যাক যেন আমার বিয়ে নিয়ে কিছু বলতে চাইছে। সবার বিয়ে নিয়েই।

অভিনেতা এলেন। আমি যে রকমটি আশা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো মানুষ। এতটা বিখ্যাত হওয়ার পরেও অনেক বিনয়ী। আমি তাকে আমার প্রিয় হোটেলে রেখে বাসায় এলাম। বিস্ময়ের ব্যাপার, মেরি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। জানাল, আবহাওয়ার অবস্থা অনুকূল না হওয়ায়, আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত সিনেমার শুটিং বন্ধ রাখা হয়েছে।

.

আমার ধারণা, আজ যেহেতু বৃহস্পতিবার, তুমি রেস্তোরাঁয় যাবে।

তুমিও কি আমার সাথে আসতে চাও?

হ্যাঁ, আসতে চাই, কেন? তুমি কি একাই যেতে চাও?

হ্যাঁ, একাই যেতে চাই।

 বেশ, আমি যেভাবেই হোক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই পুরুষ এখনো জন্মায়নি, যে আমাকে বলতে পারে আমি কোথায় যাব আর না যাব।

তুমি কি জানো রেলওয়ে ট্র্যাক ১৪৩.৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে বসানো?

আমি ইন্টারনেটে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। ব্যাপারটা কি গুরুত্বপূর্ণ?

খুব।

এক মুহূর্তের জন্য রেলওয়ে ট্র্যাকের ব্যাপারটা সরিয়ে রাখো। আমি আমার কয়েকজন বন্ধুর ব্যাপারে কথা বলতে চাই, যারা তোমার বইয়ের ভক্ত। তারা মনে করে যে লেখক এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ অথবা মেষপালকের সমন্ধে অথবা সান্তিয়াগোর তীর্থযাত্রীদের নিয়ে বই লিখতে পারে, অবশ্যই এ রকম জ্ঞানী লোক যিনি সব কিছুর উত্তর দিতে পারেন।

সেটা পুরোপুরি সত্য নয়, তুমি জানো।

তাহলে সত্যিটা কী? তোমার নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা যে জিনিসে আছে তা কীভাবে পাঠকের মনে প্রভাব ফেলবে?

ওগুলো আমার জ্ঞানের ঊর্ধ্বে নয়। আমার বইয়ে যা কিছু লেখা তা আমার আত্মারই অংশ। আমি নিজের জীবন দিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তারই শিক্ষা, তা আমার নিজের জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি। আমি আমার নিজের বইয়ের পাঠক। আমি এরই মধ্যে যে জিনিস জানি তা জানি, এমনকি শুধু অসচেতনভাবে।

 পাঠকের ব্যাপারটা কী?

আমি মনে করি পাঠকেরও একই ব্যাপার। একটা বইয়ের ক্ষেত্রে, অথবা আমরা যেকোনো কিছু নিয়েই বলতে পারি। একটা সিনেমা, সংগীতের সুরমূর্ঘনা, বাগান, পাহাড়ের দৃশ্য কিছু না কিছু উন্মোচিত করে। এখানে উনোচন বোঝাতে দুরকমই বোঝায়। কোনো কিছুর ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলা, যা এর আগে থেকেই ছিল। আর নতুন কিছু আবিষ্কার করা।

এই মুহূর্তে ভালোবাসার ব্যাপারটা আমাকে কঠিন সময়ের মুখে পতিত করেছে, তুমি তা জানো। এখন ব্যাপারটাকে জঘন্য কিছু হিসেবেও দেখতে পারো অথবা উন্মোচনের মতো করেও দেখা যায়। এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ লেখার সময়ই আমি ভালোবাসার নিজস্ব ধারণক্ষমতাটা বুঝতে পেরেছিলাম। যখন ওই বইয়ের জন্য প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য লিখেছি তখনই প্রকৃতপক্ষে বুঝতে পেরেছি।

 কিন্তু আধ্যাত্মিকতার দিকটা কী? তোমার বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় যে আধ্যাত্মিকতার ব্যাপার আছে সেগুলোর সমন্ধে কী বলবে?

তুমি আমার সাথে আর্মেনিয়ান রেস্টুরেন্টে আসবে এই আইভিরাটা আমি পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম, কারণ তুমি শিখতে পারবে অথবা অন্ততপক্ষে, তিনটি জিনিস সমন্ধে সচেতন হবে। প্রথমত, যত তাড়াতাড়ি লোজন একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়, তারা বুঝতে পারে তারা যে রকমটি ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সামর্থ্য থেকে দূরে সরে আছে। দ্বিতীয়ত, সমস্ত শক্তি আর জ্ঞান একই অজানা উৎস থেকে আসে, যাকে আমরা ঈশ্বর বলে ডাকি। যা আমি আমার জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি, এমনকি আমি প্রথম থেকেই আমার নিজের পথে তা বিশ্বাস করে সম্মান জানিয়েছি। প্রতিটি দিন আমি সেই শক্তির মুখোমুখি হয়ে চিন্তাভাবনা করেছি।

তৃতীয়ত, কেউ একাই তার নিজের সমস্যায় পতিত নয়। সব সময় কোথাও না কোথাও কেউ একইভাবে ভাবছে, আনন্দ করছে অথবা দুঃখ কষ্ট ভোগ করছে। আর সেগুলোই আমাদের সামনের বাধাগুলোকে মোকাবিলা করার শক্তি জোগায়।

তার মধ্যে কি ভালোবাসার জন্য কষ্টভোগও জড়িত?

এর মধ্যে সব কিছুই পড়ে। যদি কষ্টের মধ্যে পড়ে যাও, তাহলে সবচেয়ে ভালো হয় তাকে গ্রহণ করে নেয়া। কারণ তুমি কষ্ট নেই বলে ভান করলেই কষ্ট চলে যায় না। আনন্দের কোনো ব্যাপার ঘটলে তাও একইভাবে গ্রহণ করে নেয়া উচিত, যদিও তুমি ভয় পেতে থাকো এই আনন্দও একদিন শেষ হয়ে যাবে। কোনো কোনো মানুষ জীবনটাকে শুধু নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়া আর আত্মত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। কোনো কোনো মানুষ নিজেরা সুখী থাকলেই মানবিকতার দিকটা অনুভব করতে পারে। কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?

কারণ আমি প্রেমে পড়েছি এবং আমি কষ্টভভাগের ভয় পাচ্ছি।

ভয় পেয়ো না। কষ্টভোগকে এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করা।

আমি এসথারের উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। ওই তরুণের এপিলেপটিক মূৰ্ছা যাওয়া ছাড়া তুমি আমাকে পিজ্জারেজ্জায় আর কী ঘটেছে, সে সমন্ধে আর কিছুই বলোনি। ব্যাপারটা আমার জন্য খারাপ সংকেত, যদিও তোমার জন্য তা খুব ভালো সংকেতই হতে পারে।

 এটা আমার জন্যও খারাপ সংকেত হতে পারে।

তুমি কি জানো আমি কোনো ব্যাপারে জানতে পছন্দ করি? আমি জানতে চাই আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি তুমিও আমাকে ততটা ভালোবাসো কিনা? কিন্তু তা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আমার নেই। পুরুষের সাথে আমার কেন এ রকম হতাশাজনক সম্পর্ক? আমি সব সময় অনুভব করি আমাকে সম্পর্কের মধ্যে থাকতে হবে। তার অর্থ এই অপূর্ব, বুদ্ধিমান, সেনসেটিভ, ব্যতিক্রমী মানুষটাকে আমার চাই। পাশাপাশি, তোমার নিজেরও একাকী বাস করাটা বেশ কঠিন। আমি জানি না, সবচেয়ে ভালো ব্যাপারটা কী।

 তো তুমি আমাকে জানাতে চাও, একজন মেয়েমানুষকে ভালোবাসার সামর্থ্য এখনো আমার আছে, যদিও ও আমাকে কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়াই ছেড়ে চলে গেছে।

আমি তোমার বই পড়েছি। আমি জানি তুমি তাই।

তুমি আমাকে জানাতে চাও, এসথারকে ভালোবাসা সত্ত্বেও, আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারি?

সে প্রশ্ন করার সাহস আমার নেই। কারণ উত্তরটা আমার জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

তুমি জানতে চাও, পুরুষ বা মহিলার হৃদয়ে একজনের চেয়ে বেশি মানুষের ভালোবাসা ধারণের ক্ষমতা আছে কিনা?

 তাহলে আগেরটার তুলনায় এটা মোটেই সরাসরি প্রশ্ন নয়, হ্যাঁ, উত্তর দিলেই আমি খুশি হব।

আমি মনে করি ব্যাপারটা পুরোপুরি সম্ভব যতক্ষণ পর্যন্ত এসব লোকজন নিজেদের অন্যদিকে…।

..একজন জাহির। বেশ, আমি তোমার জন্য যেভাবেই হোক লড়ে যেতে চাচ্ছি। কারণ আমি মনে করি তুমি তার যোগ্য। যেকোনো মানুষ একজন মহিলার জন্য ভালোবেসে যেতে পারে যেমনটি তুমি ভালোবেসেছিলে অথবা ভালোবাস- এসথার আমার সমস্ত শ্রদ্ধা আর সম্মান পেতে পারে। আর দেখিয়ে দিয়েছে, আমি তোমাকে আমার পাশে রাখতে চাই, দেখিয়ে দিয়েছে তুমি আমার জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তুমি যেমনটি বলেছ আমি তাই করতে যাচ্ছি। আমি খুঁজে বের করতে যাচ্ছি কেন রেলওয়ে ট্র্যাকগুলো সব সময় চার ফিট সাড়ে আট ইঞ্চি ফাঁক থাকে।

.

আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁর মালিক আমাকে যে পরিকল্পনার কথা বলেছিল ঠিক তাই করেছে। গোটা রেস্তোরাঁ, শুধু পেছনের রুমই নয়, এখন সাক্ষাৎ করতে আসা মানুষে পরিপূর্ণ। মেরি কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাচ্ছিল। মাঝে মাঝে মন্তব্যও করছিল।

এ রকম জায়গায় বাচ্চাদের কেন নিয়ে আসে? ব্যাপারটা অদ্ভুত।

সম্ভবত এরা ছেড়ে আসার মতো কাউকে পায়নি।

 ঠিক নয়টায়, ছয়জন পারফর্মার- গ্রাম্য পোশাকে দুজন মিউজিশিয়ান এবং চারজন তরুণ সাদা শার্ট আর লম্বা স্কার্ট পরা স্টেজে এল। টেবিলে টেবিলে আপ্যায়ন তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। দর্শকরা নীরব হয়ে গেল।

মঙ্গোলিয়ান সৃষ্টি উপকথায়, হরিণ আর বুনো কুকুর একত্রে এসেছে। মিখাইল সেই স্বরে কথা বলতে লাগল, যা তার নিজের মনে হয় না। দুটি প্রাণীরই প্রকৃতি ভিন্ন। একটির বুনো। কুকুর সাধারণত খাবারের জন্য হরিণকে মেরে ফেলে। মঙ্গোলিয়ান মিথে, তারা দুজনই বুঝতে পারে একে অন্যের জন্য তাদের নিজেদের প্রয়োজন, এই শত্রুতাপূর্ণ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে একে অন্যের সাহায্য দরকার। তারা তাই করে। শক্তির সাথে অংশ নেয়।

তাই করতে গিয়ে তাদের অবশ্যই ভালোবাসার ব্যাপারটা শিখতে হয়। ভালোবাসার ক্ষেত্রে, তাদের নিজেদের আবিষ্কার করতে হয়, অন্যথায় তারা কখনো একত্রে বাস করতে পারবে না। সময়ের সাথে সাথে, বুনো কুকুর ব্যাপারটা বুঝে নেয়, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে থাকে। এখন মহৎ উদ্দেশ্যে কাজ করে যায়, এ রকম কাউকে খুঁজে ফেরে যার দ্বারা জগৎটাকে আবার পুনর্নির্মাণ করতে পারে।

 মিখাইল বিরতি দিল।

আমরা যখন নাচি, আমাদের চারদিকে একই রকম শক্তি পাক খায়। যা আমাদের দেবীর সম্মুখে উপনীত করে, তার সকল শক্তির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যেভাবে নদীর পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়, মেঘে রূপান্তরিত হয়। আর বৃষ্টিরূপে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। আমার আজকের গল্প ভালোবাসার বৃত্তায়ন নিয়ে।

একদিন সকালে একজন কৃষক একটা মনেস্টারির দরজায় নক করল। ব্রাদার পোর্টার দরজা খুললে, কৃষক ব্রাদারের সামনে একগুচ্ছ টাটকা আঙুর বাড়িয়ে ধরল।

 প্রিয় ব্রাদার পোর্টার, আমার আঙুর বাগানের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আঙুর এটি। আমার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে এগুলো গ্রহণ করুন।

অনেক ধন্যবাদ! আমি এগুলো সরাসরি অ্যাবের কাছে নিয়ে যাব, তিনি এ রকম উপহার দেখলে অভিভূত হয়ে যাবেন।

না, না। আমি এগুলো আপনার জন্য এনেছি।

 আমার জন্য? কিন্তু প্রকৃতির এত অপূর্ব উপহার গ্রহণ করার মতো সাধ্য আমার নেই।

যখনই আমি দরজায় নক করেছি, আপনি দরজা খুলে দিয়েছেন। যখন অনাবৃষ্টিতে ক্ষেতের ফসল ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, আপনি প্রতিদিন আমাকে একটুকরো রুটি আর ওয়াইন দিয়েছিলেন। আমি এই একগুচ্ছ উৎকৃষ্ট আঙুর আপনার জন্য এনেছি, সূর্যের ভালোবাসা, বৃষ্টির সৌন্দর্য আর ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতার উদাহরণ হিসেবে।

ব্রাদার পোটার আঙুরগুলো এ রকম জায়গায় রেখে দিলেন, যেখান থেকে ওগুলোকে দেখতে পান। গোটা সকাল ওগুলোর প্রশংসা করে কাটিয়ে দিলেন। আঙুরগুলো সত্যিই অপূর্ব। সে কারণেই, তিনি ওগুলোকে অ্যাবেকে উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অ্যাবের প্রজ্ঞার কথা তার জীবনে আশীর্বাদের মতো।

আঙুর পেয়ে অ্যাবে খুব খুশি। কিন্তু তারপর অ্যাবের মনে পড়ে গেল একজন মঙ্ক বেশ অসুস্থ। তিনি ভাবলেন, আমি আঙুরগুলো ওকে দেব। কে জানে, এগুলোই হয়তো ওর জীবনে কিছুটা আনন্দের সঞ্চার করবে।

কিন্তু আঙুরগুলো সেই মঙ্কের কাছে খুব বেশি সময় রইল না। তার বদলে তিনি ভাবতে লাগলেন, ব্রাদার কুক আমার জন্য এতটা করে। সব সময় ভালো খাবারটা আমাকে খেতে দেয়। আমি নিশ্চিত এই আঙুরগুলোতে ও খুব খুশি হবে। আর ব্রাদার কুক যখন তার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে এল, মঙ্ক আঙুরগুলো তাকে দিয়ে দিলেন।

এইগুলো তোমার জন্য। তুমি প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকো আর তুমি জানবে এগুলো দিয়ে কী করতে হবে। ঈশ্বরের সৃষ্টি এগুলো।

ব্রাদার কুক আঙুরের সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়ে গেল। তার সহকারীকে আঙুরের সৌন্দর্য দেখাল। এগুলো এত বেশি সুন্দর যে, ব্রাদার সাক্রাস্টান ছাড়া কেউ এর প্রশংসার উপযোগী নয়। ব্রাদার সাক্ৰাস্টান পবিত্র সাক্ৰামেন্টের চার্জে আছেন।

ব্রাদার সাক্রাস্টানও সেগুলো তার তরুণ শিক্ষানবিশকে দিয়ে দিলেন। ছেলেটা এগুলোর মাধ্যমে ঈশ্বরের সৃষ্টির ক্ষুদ্র নমুনা দেখতে পাবে। শিক্ষানবিশ এগুলো গ্রহণ করার পর, তার হৃদয় ঈশ্বরের মহিমায় পূর্ণ হয়ে গেল। কারণ সে এর আগে কখনো এত অপূর্ব একগুচ্ছ আঙুর দেখেনি। একই সাথে, মনস্টেরিতে আসার দিনটির কথা তার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল সেই লোকটার কথা, যে তার জন্য দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। ঈশ্বরের অলৌকিকতার জগতে যে লোকটা তাকে স্বাগত জানিয়েছিল।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, সে আঙুরের গুচ্ছ ব্রাদার পোর্টারের কাছে নিয়ে গেল। খাও এবং উপভোগ করো। তুমি বেশির ভাগ সময় এখানে একাকী কাটাও। এই আঙুরগুলো তোমার ভালো লাগবে।

 ব্রাদার পোর্টার তখন বুঝতে পারলেন এই উপহার সত্যিই তার জন্য ছিল। তিনি প্রতিটি আঙুরের স্বাদ উপভোগ করে সুখী মানুষের মতো ঘুমাতে গেলেন। এভাবেই, বৃত্তায়নটা পূর্ণ হলো। আনন্দ আর সুখের বৃত্তটা সব সময় এভাবে ভালোবাসার শক্তিতে আচ্ছাদিত থাকে।

মহিলাটি বাদ্যযন্ত্রের জন্য আলমাকে ডাকলেন।

প্রতি বৃহস্পতিবার আমরা যেমনটি করে থাকি, আমরা একটা ভালোবাসার গল্প শুনে থাকি আর ভালোবাসাহীনতার একটা গল্প বলি। এখন আমরা দেখি, উপরিভাগে কী আছে, তারপর একটু একটু করে আমরা গভীরের ব্যাপারটা বুঝতে পারব। আমাদের অভ্যাস, মূল্যবোধ। আমরা যখন সেই স্তর অতিক্রম করতে পারব, আমরা নিজেদের খুঁজে পাব। কে শুরু করতে চান?

কয়েকজন হাত তুলল। মেরিকে বিস্মিত করে দিয়ে আমার হাতও উঁচু হলো। গুঞ্জনটা আবার শুরু হয়েছে। লোকজন তাদের সিটে গিয়ে বসছে। মিখাইল একজন দীর্ঘাঙ্গি, নীলনয়না সুন্দরীর দিকে দেখিয়ে দিল।

গত সপ্তাহে, আমার একজন ছেলে বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলাম। ও স্পেন সীমান্তের কাছের পাহাড়ে একাকী বাস করত। ও জীবনের সব ভালো দিকগুলোকে ভীষণ ভালোবাসে। আর প্রায়ই বলে, যেটুকু প্রজ্ঞা তার মধ্যে জন্ম নিয়েছে তা সবই সে পেয়েছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগের সাথে বাস করার মধ্য দিয়ে। এখন, শুরু থেকেই, আমার স্বামী ওই বন্ধুকে দেখতে যাওয়ার বিরোধী। আমার স্বামী জানে সে কী পছন্দ করে। তার প্রিয় অবসর যাপনের মাধ্যম হলো পাখি শিকার আর মহিলাদের প্রলুব্ধ করা। কিন্তু আমার বন্ধুর সাথে কথা বলা দরকার। আমি কঠিন সময় পার করছি। আর শুধু ও ই আমাকে সাহায্য করতে পারে। আমার স্বামী একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর জন্য উপদেশ দিল। অথবা কোথাও ঘুরে আসতে পারি। আমরা ঘুরে এলাম। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমি মুষড়ে পড়লাম। আমার বন্ধুটি বিমানবন্দরে আমার সাথে দেখা করতে এল। আমরা গোটা অপরাহু কথা বলে কাটালাম। আমরা একসাথে রাতের খাবার খেলাম। ওয়াইন পান করলাম। আরো কথা বলতে বলতে বিছানায় গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে, ও যেখানে বাস করত সেদিকে হাঁটতে গেলাম। ও আমাকে বিমানবন্দরে দিয়ে এল।

বাড়িতে পৌঁছে আমি নিজের কাছে প্রশ্ন করলাম, ও কি একা? হ্যাঁ। তার মানে ওর সাথে কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই? না, তা নয়। পান করার মতো কিছু কি আছে? হ্যাঁ, আমার এখানে আছে। তুমি কেন এ ব্যাপারে কথা বলতে চাও না? কিন্তু আমি ওই ব্যাপারেই বলছি! পাহাড়ের ওপরে বাড়িতে তোমরা দুজন একাকী। হাঃ হাঃ? খুবই রোমান্টিক ব্যাপার। তো? আর তুমি বলতে চাও তোমরা শুধু কথা বলেই সময় কাটিয়েছ? হ্যাঁ, তাই তো। আর তুমি চাও আমি তাই বিশ্বাস করি? তুমি কেন তা বিশ্বাস করবে না? কারণ মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছু চলতে পারে না- যদি একজন পুরুষ ও মহিলা একসাথে নির্জন স্থানে থাকে, একত্রে পান করে, নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপারস্যাপার নিয়ে কথা বলে, তারা তাদের সম্পর্ক বিছানায় শেষ করতে বাধ্য!

আমি আমার স্বামীর সাথে একমত। আমরা যা শিখেছি তার বিরুদ্ধে যায়। আমি এই মুহূর্তে যে গল্প বললাম আমার স্বামী তা কখনোই বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই সত্যি। তারপর থেকে, আমাদের জীবনটা একটা ছোটখাটো নরকে বদলে গেছে। সময়ে হয়তো সয়ে যাবে কিন্তু যে যন্ত্রণা ভোগ করছি তা সীমাহীন। আর তার কারণ আমরা বলতে চেয়েছি যদি একজন পুরুষ আর মহিলা একে অন্যকে পছন্দ করে, পরিস্থিতি তা মেনে নেয়, তাহলে তারা সম্পর্কটা বিছানায় নিয়ে যেতে বাধ্য।

 সবাই হাততালি দিল। সিগারেট জ্বালাল। গ্লাস আর বোতলের ঝংকার শোনা গেল।

এখানে কী ঘটছে? মেরি ফিসফিস করল, দম্পতিদের জন্য গ্রুপ থেরাপি?

সবটাই মিটিংয়ের অংশ। কেউ বলতে পারে না কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। তারা শুধু গল্প বলে যায়।

 কিন্তু এ রকম লোক সম্মুখে কেন, কেন এ রকম অস্বস্তিকর পদ্ধতিতে, ধূমপান আর মদপান করতে করতে এসব বলে?

সম্ভবত তাতে ব্যাপারটা আর মনোকষ্টের কারণ হয়ে ওঠে না। এভাবেই সহজে মেনে নেয়। আর এভাবে যদি সহজে মেনে নেয়া যায়, তাহলে তাতে সমস্যাটা কী?

সহজে? এসব অপরিচিত লোকজনের সামনে নিজের স্বামীর গল্প বলা, যাতে তারা নিজেদের বাড়িতে গিয়ে বলতে পারে?

 কেউ একজন গল্প বলা শুরু করেছে। আমি মেরিকে বলতে পারলাম না, এটা কোনো ব্যাপার নয়, প্রত্যেকেরই ভালোবাসার ব্যাপারে খামতি রয়েছে।

আমি ওই মেয়েটির স্বামী, যে একটু আগে ওই গল্পটা বলেছে। একজন পুরুষ বলল। লোকটা অন্ততপক্ষে ওই সুন্দরী তরুণীর চেয়ে কম করে হলেও বিশ বছরের বড়। ও যা বলেছে তার প্রতিটি কথাই সত্য। কিন্তু এ রকম কিছু আছে, যা ও জানে না। যা বলার মতো সৎসাহস আমার হয়নি। এখন আমিও তাই করব।

 ও যখন পাহাড়ে গেল, আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। আমি বিস্তারিত কল্পনা করতে শুরু করলাম, ব্যাপারটা কী ঘটতে পারে। ও যখন ওখানে পৌঁছাল, এরই মধ্যে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে, ও কোট খুলে ফেলেছে, সোয়েটার খুলেছে, ও ওর পাতলা টি-শাটের মধ্যে ব্রা পরেনি। ওর প্রেমিক পরিষ্কারভাবে ওর স্তনের আকৃতি দেখতে পাচ্ছে।

ও এ রকম ভাব করছে, যেন প্রেমিক ওর দিকে দেখছে তা লক্ষ করেনি। ও বলছে, কিচেনে গিয়ে আরেক বোতল শ্যাম্পেন নিয়ে আসবে। ও খুব টাইট জিন্স পরেছে, ধীরে ধীরে হাঁটছে, আর ওর ঘুরে দেখার কোনো দরকারই নেই, যখন ওর প্রেমিক ওর প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে। ও ফিরে এসেছে, তারা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপারস্যাপার নিয়ে আলাপ শুরু করেছে, যার কারণে তারা আরো কাছে আসতে পারছে।

তারা ওই বিষয়ে কথা বলে শেষ করেছে, যে কারণে ও প্রেমিকের কাছে গিয়েছে। ওর সেল ফোন বাজতে শুরু করেছে। আমার ফোন। জানতে চাইছি ও ঠিক আছে কিনা। ও ছেলেটার কাছে গেল। ফোনটা ছেলেটার কানের কাছে ধরল। ওরা দুজনই শুনছে আমি কী বলছি। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত কথোপকথন। কারণ আমি জানি, যেকোনো রকম চাপ সৃষ্টি করার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার চেয়ে সব কিছু ঠিকঠাক আছে, এ রকম ভান করাই শ্রেয়। ওকে বলা উচিত পাহাড়ের সময়টুকু উপভোগ করুক। কারণ পরের দিন ও প্যারিসে ফিরে আসবে। বাচ্চাদের যত্ন নেবে। শপিং করবে।

আমি ফোন ধরে থাকলাম, জানি ছেলেটা আমাদের সমস্ত কথোপকথন শুনেছে। আগে ওরা আলাদা সোফাতে বসলেও এখন খুব কাছাকাছি বসেছে।

এ রকম সময়ে, পাহাড়ে আর কী ঘটতে পারে, আমি কল্পনা করা বন্ধ করে দিলাম। আমি উঠে পড়লাম। বাচ্চাদের বেডরুমে গেলাম। জানালার কাছে চলে এলাম। প্যারিসের দিকে তাকালাম। তুমি কি জানো তখন আমার কেমন মনে হচ্ছিল? আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। খুব, খুব উত্তেজিত। ওরা দুজন এখন একসাথে আছে, জানি আমার স্ত্রী ঠিক এই মুহূর্তে, আরেকজন আমার স্ত্রীকে চুম্বন করছে, আমার স্ত্রীর সাথে প্রেম করছে। তারা যৌনানন্দ উপভোগ করছে।

ভয়ানক খারাপ লাগছিল। আমি এ রকম ব্যাপার ভেবে কীভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছি? পরের দিন, আমার দুজন বন্ধুর সাথে আলাপ করলাম। সুস্পষ্টভাবে, আমি নিজেকে কোনো উদাহরণ হিসেবে দেখালাম না। কিন্তু আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, যদি তারা বুঝতে পারে কেউ তাদের স্ত্রীদের বুকের ভাঁজের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন তাদের কেমন লাগে? তারা সত্যিই আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না, কারণ ব্যাপারটা এ রকম নিষিদ্ধ। কিন্তু তারা দুজনই একমত হলো, ব্যাপারটা সব সময় সুন্দর, অন্য লোকে তোমার স্ত্রীকে কামনা করে, যদিও তারা এর বেশি এগোল না। সমস্ত মানুষের অন্তরের গোপন বাসনা এটি? আমি জানি না। সাধারণভাবে বলতে গেলে গত সপ্তাহ আমাদের দুজনের জন্য নরক যন্ত্রণার মতো গেছে, কারণ আমি আমার নিজের অনুভূতিকে বুঝতে পারছিলাম না। ওদের দুজনকে বুঝতে পারছিলাম না। আমি ওকে দোষ দিচ্ছিলাম, হঠাৎ করে আমার জগৎটা কেমন যেন ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল।

এবার অনেকেই সিগারেট ধরাল। কেউ কোনো তালি দিল। ওখানে সবার মধ্যে এ রকম ভাব, যেন ব্যাপারটা নিষিদ্ধ।

 আমি আবার হাত তুললাম। ইত্যবসরে, নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম ওই মানুষটা যা বলল তাতে আমিও কি একমত? হ্যাঁ। আমি একমত। এসথারকে জড়িয়ে আমিও একই রকম দৃশ্য কল্পনা করেছি। যে যোদ্ধার সাথে তার যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা হয়েছে তাকে নিয়ে কল্পনা করেছি, কিন্তু আমি কখনো তা বলতে সাহস করিনি, এমনকি নিজেকেও বলিনি।

 মিখাইল আমার দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নোয়াল।

কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ালাম তা জানি না। শ্রোতাদের দিকে তাকালাম। মানুষগুলো এখনো আগের গল্পের কারণে শকিং অবস্থায় আছে, ভাবছে নিজেদের স্ত্রীরাও আরেকজন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলছে। কাউকে দেখে মনে হলো না কোনো কিছু শুনছে, আর সে কারণেই আমার জন্য শুরু করা সহজ হলো।

আগের দুজন বক্তার মতো আমি সরাসরি শুরু করতে পারছি না বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আমারও একই ধরনের বক্তব্য আছে। আমি আজ রেলস্টেশনে গিয়েছিলাম। জানতে পারলাম রেলওয়ে ট্রাকের মধ্যে ১৪৩,৫ সেন্টিমিটার বা চার ফিট সাড়ে আট ইঞ্চির ব্যবধান আছে। কেন এই অদ্ভুত মাপ? আমি আমার বান্ধবীকে এটা খুঁজে বের করার জন্য বলেছিলাম, সে এটা খুঁজে বের করেছে। যখন ওরা প্রথম ট্রেন ক্যারিজ বানিয়েছিল, তখন তারা ঘোড়ায় টানা ক্যারিজের যন্ত্রপাতি দিয়েই তৈরি করেছিল। আর সে কারণেই দুটো ক্যারিজের মধ্যে এ রকম পার্থক্য? কারণ ক্যারিজ চলাচল করার জন্য পুরনো রাস্তার মাপ ছিল এটাই। কে এ রকম মাপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? হ্যাঁ, আমাদের আবার পুরনো ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। রোমানরা। সেই মহান রোমান স্থপতিরা, যারা প্রথম রাস্তা তৈরি করেছিল, তারা তাদের রাস্তার মাপটা এ রকমই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? কিন্তু কেন? কারণ তাদের যুদ্ধযানগুলো দুটো ঘোড়ায় চালিত ছিল। আর তারা যখন ঘোড়াগুলোকে পাশাপাশি রাখত তখন ১৪৩.৫ সেন্টিমিটার ফাঁক থাকত।

তো যে পাথর্ক আজ আমি রেলওয়ে ট্র্যাকের মধ্যে দেখলাম, যা আমাদের দেশের হাই-স্পিডি ট্রেনের জন্য রয়েছে, তা রোমানদের সৃষ্ট। যখন লোকজন আমেরিকায় গিয়ে তাদের রেলওয়ে তৈরি করেছে, তাদের কাছে মনে হয়নি এই ফারাকটা বদলে দেয়া দরকার, সে কারণেই একই রকম রয়ে গেছে। এমনকি এগুলো এখন স্পেশ শাটল তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারেরা ভেবেছিল ফুয়েল ট্যাংক কিছুটা চওড়া করবে কিন্তু উটাহে যে ট্যাংক তৈরি করা হয়েছিল তা ফ্লোরিডার স্পেস সেন্টারের দিকে গেছে আর টানেলটাও চওড়া হয়নি। সে কারণেই তারা রোমানদের মাপটাই আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে সব কিছুই এভাবে হবে কীভাবে?

আমি থামলাম। কোনো কোনো মানুষকে রেলওয়ে ট্রাকের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহিত মনে হলো না। অন্যরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তাদের মধ্যে মেরি আর মিখাইলও ছিল।

বিয়ের ক্ষেত্রে সব কিছুই করার আছে। আমরা একটু আগে যে দুটো গল্প শুনলাম। ইতিহাসের কোনো কোনো ক্ষেত্রে, কেউ কেউ বলে গেছে, যখন দুজন মানুষ বিয়ে করে, তারা অবশ্যই তাদের বাকি জীবন শীতল অবস্থায় থাকে। তুমি দুটো ট্র্যাকের মতো একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতে পারো না, সব সময় একই রকম দূরত্ব বজায় থাকবে। এমনকি তোমাদের মধ্যে যদি কারো কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার দরকার হয় বা দরকার হয় কাছে আসার, তা নিয়মের বাইরে চলে যাবে। নিয়মটা জানো, সহানুভূতিশীল হও, ভবিষ্যতের চিন্তা করো, ভাবো তোমার ছেলেমেয়েদের কথা। তুমি বদলে দিতে পারো না, তোমরা দুজনে অবশ্যই রেলওয়ে ট্রাকের মতো, যারা সব সময় একই রকম ফারাক রেখে চলে, আর ওভাবেই তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যায়। ভালোবাসার কারণে নিয়মের পরিবর্তন হয় না। তা অর্ধেক পথে গিয়েই থমকে যায় না, একই পার্থক্য বজায় রাখে। একই রকম আনুগত্য, একই রকম কার্যকরী প্রকৃতি। তোমার উদ্দেশ্য হলো ট্রেনটাকে ঠিকঠাকমতো ভবিষ্যতের দিকে পৌঁছে দেয়া। তোমার বাচ্চারা তখনই সুখী হবে যদি তুমি তোমার কাজটা ঠিকভাবে করে যেখানে আছে সেখানেই থাকো– ১৪৩.৫ সেন্টিমিটার দূরে থাকো। এ রকম কোনো কিছু নিয়ে তুমি অসুখী থাকো, যা কখনো বদলে দিতে পারবে না, ওদের কথা ভাবো, তোমার ছেলেমেয়েদের কথা ভাবো।

তোমার প্রতিবেশীদের কথা ভাবো। তাদের দেখাও তুমি সুখী, রবিবারের দিন গরুর রোস্ট খাও, টেলিভিশন দেখো, কমিউনিটিকে সাহায্য করে। সমাজের কথা ভাবো। এ রকমভাবে পোশাক পরিধান করো, যাতে সবাই বুঝতে পারে সব কিছু ঠিকঠাক আছে। কখনো পাশের দিকে তাকিয়ো না, কেউ না কেউ তোমাকে দেখছে। তাতে তোমার লালসা বাড়বে। তার মানেই বিবাহ বিচ্ছেদ, সংকট, হতাশা।

সমস্ত ছবিতে হাসো। ছবিগুলো তোমার লিভিংরুমে সাজিয়ে রাখা, যাতে সবাই তা দেখতে পায়। ঘাষ কাটো, খেলাধুলা করো- ওহ, হ্যাঁ, তোমাকে অবশ্যই কোনো না কোনো খেলায় মনোযোগী হতে হবে। যখন খেলাও তোমার জন্য যথেষ্ট হবে না, প্লাস্টিক সার্জারি করে নাও। কিন্তু কখনো ভুলে না, অনেক আগে থেকেই এ নিয়মগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে, এগুলোকে অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। কে এই নিয়মগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছে? সেটা কোনো ব্যাপারই নয়। তাদের কোনো প্রশ্ন করো না। কারণ তারা সব সময় প্রয়োগ করবে, এমনকি যদি তাদের সাথে তোমার মতের নাও মিল হয়।

 আমি বসে পড়লাম। সবার মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। হাততালিও পড়ল সেভাবে। আমি বুঝতে পারলাম অনেক দূর এগিয়ে গেছি। মেরি আমার দিকে বিস্ময় আর প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

স্টেজের ওপরের মহিলাটা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করল।

মেরি যেখানে আছে ওখানেই বসে থাকতে বললাম। আমি একটা সিগারেট ধরানোর জন্য বাইরে যাচ্ছি।

ওরা এখন ভালোবাসার নামে একটা নৃত্য পরিবেশন করবে। ভালোবাসার দেবীর নামে।

তুমি এখানেই ধূমপান করতে পারো, পারো না?

 হ্যাঁ, কিন্তু আমার একটু একা হওয়া দরকার।

.

বসন্তের শুরুর দিকে হতে পারে, কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। আমার মুক্ত বাতাসের দরকার। কেন আমি এ রকম গল্প বললাম? আমি যেভাবে বর্ণনা করেছি, এসথারের সাথে আমার বিয়ে কখনোই ও রকমটি ছিল না। দুটো রেলওয়ে ট্র্যাক, সব সময় পাশাপাশি, সব সময় দুটো ঠিক সমান্তরাল লাইন বজায় রেখে চলছে। আমাদের সবার জীবনে উত্থান-পতন রয়েছে। আমাদের মধ্যে যে কেউ একজন চিরতরে ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিতে পারে, এর পরও একসাথে থাকতে পারি আমরা।

দুই বছর আগ থেকেই এ ব্যাপারটি ঘটে এসেছে।

অথবা যে মুহূর্তে এসথার বুঝতে শুরু করেছিল সে কেন অসুখী তখন থেকে। কেউ নিজেদের কখনো প্রশ্ন করেছে কি, আমি কেন অসুখী? এ প্রশ্নটা ভাইরাসের মতো এ রকমভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা সব কিছুকে ধ্বংস করে দেবে। আমরা যদি এ প্রশ্ন করি, তার মানে খুঁজে বের করতে চাই কীসে আমাদের সুখী করে? আমরা এখন যা আছি তা থেকে অন্য কিছু যদি আমাদের সুখী করে, তাহলে আমরা নিজেদের আমূল বদলে ফেলতাম অথবা আরো বেশি অসুখী হয়েছি, তাই-ই থেকে যেতাম।

নিজেকে এখন সেই অবস্থার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একজন বান্ধবী রয়েছে আমার। নিজের কাজ বেশ ভালোই এগিয়ে যাচ্ছে। সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই নিজের গতিতে এগিয়ে চলছে। আমি এ অবস্থা থেকে নিজেকে অবমুক্ত করে নিতে পারি। জীবন আমার কাছে যে প্রাচুর্য নিয়ে এসেছে তা গ্রহণ করতে পারি, এসথারের উদাহরণ অনুসরণ করে, আর কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে মেরির কথা মনে রেখে, তার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে পারি।

না, ও রকমটি ভাবতে পারি না। মানুষজন যে রকমটি আমার কাছ থেকে আশা করে, আমি যদি সে রকম আচরণ করি তাহলে ওদের দাসে পরিণত হব। আমার নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা উচিত। কারণ আমার স্বাভাবিক হতে চাওয়া, এমনকি যদি সেই ব্যক্তি আমাদের খুশি করে। অমনটি করলে, শুধু এসথারকেই নয়, মেরিকেও হারাব। আমার কাজ, আমার ভবিষ্যৎ, আমার সম্মান, যা কিছু এত দিন বলেছি ও লিখে গেছি সবই হারাব।

ভেতরে ফিরে দেখতে পেলাম লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। মিখাইলকে দেখতে পেলাম। এরই মধ্যে ও ওর স্টেজের পোশাকাদি বদলে ফেলেছে।

শুনুন, পিজ্জারিয়ায় যা ঘটেছে…

ওহ, ও ব্যাপারে চিন্তিত হবেন না, আমি বললাম চলুন, সেই নদীর তীর ঘেঁষে একটু হেঁটে আসা যাক।

 মেরি আমার কথার অর্থ বুঝতে পারল। সে বলল, তার আজ রাতে একটু আগে যেতে হবে। আমাদের ব্রিজ পর্যন্ত ওর ট্যাক্সিতে লিফট দিতে বললাম।

 ব্রিজটা আইফেল টাওয়ারের ঠিক বিপরীতে। ওই পথে হেঁটে বাসায় যেতে পারব। একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করি মিখাইল কোথায় থাকে, কিন্তু বুঝতে পারলাম প্রশ্নটা করলে ওকে তদন্ত করে দেখা হবে। আমার নিজের মন বলছে এসথার মিখাইলের সাথে থাকে না।

 যাওয়ার পথে, মেরি মিখাইলকে একই প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত রাখল, এই মিটিংটা কীসের ছিল। মিখাইল সব সময় একই উত্তর দিয়েছে, ভালোবাসা পুনুরুদ্ধারের পথের হদিস।

মিখাইল জানাল, ও আমার রেলওয়ে ট্রাকের গল্পটা পছন্দ করেছে।

ওভাবেই ভালোবাসা হারিয়ে যায়, মিখাইল বলল, যখন আমরা ভালোবাসা থাকবে কী থাকবে না, তার ওপর নিয়মকানুন বর্তাতে শুরু করি।

সেই সময়টা কখন? মেরি জিজ্ঞেস করল।

 আমি জানি না। কিন্তু শুধু জানি সেই শক্তিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমি জানি, কারণ যখন নাচি অথবা যখন আমি কণ্ঠস্বর শুনি, ভালোবাসা আমার সাথে কথা বলে।

মেরি জানে না কণ্ঠস্বর শুনি এর মানে কী? তারপর আমরা ব্রিজের কাছে পৌঁছে গেলাম। মিখাইল আর আমি ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লাম। প্যারিসের ঠাণ্ডা রাতে হাঁটতে শুরু করলাম।

.

আমি জানি যা দেখেছেন তাতে ভয় পেয়েছেন আপনি। সবচেয়ে বড় ভয় তখন যখন কারো মূর্ছা যায় আর তাদের জিহ্বা ভেতরে পেঁচিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। রেস্তোরাঁর মালিক জানত কী করতে হবে, তার মানে এর আগে অবশ্যই ওখানে ও রকমটি ঘটেছে। ব্যাপারটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আপনার ডায়াগনসিস ভুল। আমি কোনো মৃগী রোগী নই। ব্যাপারটা তখনই ঘটে, যখন আমি সেই শক্তির সংস্পর্শে থাকি।

 অবশ্যই মিখাইল মৃগী রোগী। কিন্তু ওর সাথে এখন তর্কে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। আমি স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছি। এ পরিস্থিতিটা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা আমার জন্য খুব জরুরি। ও এই সাক্ষাৎকারের জন্য খুব সহজে রাজি হওয়ায় আমি বিস্মিত।

আপনাকে আমার দরকার। আপনাকে এই জন্য দরকার, যাতে আপনি ভালোবাসার গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু লিখতে পারেন। মিখাইল বলল।

সবাই জানে ভালোবাসা গুরুতুপূর্ণ। বেশির ভাগ বইই এ নিয়ে।

 ঠিক আছে। এখন আমার অনুরোধটা অন্যভাবে করতে দিন। নতুন রেনেসাঁ সমন্ধে কিছু লেখার জন্য আপনাকে দরকার।

 নতুন রেনেসাঁর ব্যাপারটা কী?

 পনেরো-ষোলো শতকের ইতালিয়ান রেনেসাঁর অনুরূপ। সেই সময়ে ইরাসমাস, লিওনার্দো আর মাইকেল এঞ্জেলোর মতো প্রতিভাবানরা তাদের সেই সময়ের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। আমরা আলকেমির মাধ্যমে একটা জাদুকরী ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছি। মাদার গডেসের ধারণা, লোকজনের স্বাধীনতার ওপরে চার্চ অথবা সরকার বাধা নিষেধ চাপিয়ে দিয়েছিল, তাই কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক। পনেরো আর ষোলো শতকে ফ্লোরেন্সে, আমরা আবিষ্কার করলাম, অতীত ভবিষ্যতের উত্তর ধারণ করে।

 রেলওয়ে ট্র্যাক সমন্ধে আপনার গল্পটা উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। আমাদের জীবনের কতগুলো ক্ষেত্রে আমরা ভালোবাসার নিয়মকানুন না বুঝেই পালন করি? আপনি যা লেখেন লোকে তাই পড়ে- আপনি কি এ বিষয়ে কোথাও কিছু লিখতে পারেন না?

 আমি যা লিখি তা নিয়ে কখনো কোনো চুক্তি করি না। আমি উত্তর দিলাম। বুঝতে পারলাম নিজের আত্মসম্মানটা বজায় রাখতে হবে। যদি তা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় হতো, যদি আমার আত্মা তা ধারণ করত, যদি সেই নৌকা আমাকে শব্দের নির্দিষ্ট দ্বীপে বয়ে নিয়ে যেত, আমি হয়তো এ বিষয়ে লিখতাম। কিন্তু এসথারের খোঁজার ব্যাপারে কোনো কিছুই কিছু করতে পারে না।

 আমি জানি। আপনার ওপর কোনো শর্ত আরোপ করতে চেষ্টা করছি না। আমি। শুধু আমার কাছে গুরুত্ব বহন করে এ রকম কোনো ব্যাপারে আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছিলাম।

এসথার কি আপনাকে ফেভার ব্যাংক সমন্ধে বলেছে?

হ্যাঁ, বলেছিল। কিন্তু এটা ফেভার ব্যাংকের কোনো ব্যাপার নয়। এটা এ রকম একটা মিশন, যা আমি নিজেকে পরিপূর্ণ করতে পারছি না।

আপনি আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁয় যা করেন, তাই কি আপনার মিশন?

এটা আমার মিশনের ছোট্ট একটা অংশমাত্র। আমরা শুক্রবারে এক দল ভিখারির সাথে একই জিনিস করি। বুধবারে আমরা নতুন যাযাবরদের একটা দলের সাথে কাজ করি।

নতুন যাযাবর? এখনই বাধা দেয়া ভালো কাজ হবে না। মিখাইল এখন আমার সাথে কথা বলছে, পিজ্জারিয়ার সেই উদ্ধত্য ভাবটা আর ওর মধ্যে নেই। মঞ্চের ওপর ও যে ক্যারিশমা দেখায় অথবা সেই সন্ধ্যায় বইয়ের স্বাক্ষর নেয়ার সময়ে, সেই ভাবটা আর নেই। এখন ও একজন সাধারণ মানুষ, এ রকম একজন কলিগ, যে জগতের সমস্যা নিয়ে কথা বলে।

আমি শুধু সেই ব্যাপারে লিখি, যা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমি জোর দিয়ে বললাম।

আপনি কি আমাদের সাথে এসে ভিখারিদের সাথে কথা বলবেন?

 এসথারের কথা মনে পড়ে গেল। ও প্রায়ই আমাকে এ জাতীয় কথা বলত। আগে আমাকে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে দিন।

আমরা লুভরের দিকে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু ও হঠাৎ করে রাস্তার এক পাশে থেমে গেল। নদীতে বয়ে যাওয়া নৌকাগুলোর পাশে দাঁড়াল। নৌকাগুলো স্পট লাইটের আলোয় কাঁপছিল।

ওগুলোর দিকে দেখুন। আমি বললাম। কারণ আমার কোনো কিছু নিয়ে কথা বলা দরকার। ভয় পাচ্ছি ও হয়তো বিরক্ত হয়ে বাড়িতে চলে যেতে পারে। ওরা শুধু তাই-ই দেখতে পায়, যা স্পটলাইট ওদের দেখায়। ওরা বাড়িতে গিয়ে বলতে পারবে ওরা প্যারিস সমন্ধে জানে। আগামীকাল, ওরা মোনালিসা দেখতে যাবে এবং দাবি করবে ওরা লুভর মিউজিয়াম দেখে এসেছে। কিন্তু ওরা প্যারিসকে জানে না। আর কখনো লুভরেতে যেতে পারবে না। তারা যা করে নৌকায় চাপে, ছবির দিকে তাকায়, গোটা শহর ঘুরে দেখার চেয়ে একটামাত্র ছবি দেখে, চেষ্টা করে এটাতে কী ঘটেছে তা বের করার, বারগুলো ঘুরে দেখে, ডাউন স্ট্রিটগুলোতে যায়, টুরিস্ট গাইড ভাড়া নেয় তারপর এক পর্যায়ে ওদের হারিয়ে ফেলে। একটা পর্ন মুভি দেখতে দেখতে সেক্স করার মধ্যে এটাই পার্থক্য।

আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেখে প্রশংসা করতে হয়। আপনি সেইনের ওপর দিয়ে চলা নৌকার কথা বলছেন, আমি সেই প্রশ্নটার জন্য অপেক্ষা করছি, যা বলার জন্য আপনি এখানে এনেছেন, বলার সঠিক মুহূর্ত খুজছেন। আপনার যা ইচ্ছা তা আপনি ভোলা মনে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

ওর কণ্ঠস্বরের মধ্যে কোনো আধিপত্য নেই। তো আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সরাসরি জিজ্ঞেস করাটাই ভালো হবে।

এসথার কোথায়?

শারীরিকভাবে, এসথার এখন অনেক দূরে, মধ্য এশিয়ায়। আর আধ্যাত্মিকভাবে, ও এখন খুব কাছাকাছি আছে। ওর হাসি, ওর উদ্দীপনাময় কথাবার্তা প্রতিদিন আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। ওই আমাকে এখানে টেনে এনেছে। একুশ বছরের তরুণ, যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, একজন বিপথগামী তরুণ যাকে গ্রামের লোকে অন্য চোখে দেখে, অথবা একজন উন্মাদ অথবা এ রকম কোনো যাজক, যাকে শয়তান উপাধি দেয়া হয়েছে, অথবা সেই কৃষক যারা এখানে শহরের রাস্তায় কাজ খুঁজে বেড়ায়, তাদের কাছাকাছি আছে।

আরেক দিন আপনাকে আমার গল্প বলব। কিন্তু খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, আমি ইংরেজি জানি। আমি এসথারের ইন্টারপ্রেন্টার হিসেবে কাজ করতে শুরু করি। আমরা একটা দেশের সীমান্তে কাজ করছিলাম। ওখানে আমেরিকানরা একটা মিলিটারি বেস ভবন তৈরি করছিল, আফগানিস্তানে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওখানে ভিসা পাওয়া অসম্ভব। আমি এসথারকে ইলিগ্যালি পাহাড় অতিক্রমের ব্যাপারে সাহায্য করছিলাম। আমরা যে এক সপ্তাহ এক সাথে কাটিয়েছিলাম, সেই সময় ও আমাকে বুঝিয়েছিল আমি একা নই, ও আমাকে বুঝতে পারত।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাড়ি থেকে এত দূরে এসে ও কী করছে। কতকগুলো এলোমেলো উত্তর দিয়ে, ও শেষ পর্যন্ত যা বলল তা অবশ্যই তোমাকে বলে থাকবে, ও এ রকম একটা জায়গা খুঁজছে যেখানে ভালোবাসা নিজেই লুকিয়ে আছে। আমি ওকে বলেছিলাম আমার মিশন হলো ভালোবাসার শক্তিকে আবার জগতের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। মূলত আমরা দুজনও একই জিনিস খুঁজে ফিরছিলাম।

 এসথার ফরাসি এমবাসিতে গিয়েছিল। আমার জন্য একটা ভিসার জোগাড় করেছিল। কাজাখ ভাষার জন্য একজন দোভাষী হিসেবে আমাকে নিয়োগ দিয়েছিল, যদিও আমাদের দেশে রাশিয়ান ভাষা ছাড়া কেউ অন্য কোন ভাষায় কথা বলে না। আমি এখানে বাস করতে এলাম। ও যখন বাইরের দেশ থেকে ওর মিশন শেষ করে আসত, তখনই আমরা একত্র হতাম। আমরা দুজন কাজাখস্থানে দুবারের বেশি ট্রিপ দিয়েছি। ও টেংগ্রি সংস্কৃতিতে বেশ মুগ্ধ হয়েছিল। যাযাবরদের সাথে দেখা হওয়ায় ও যা কিছু বিশ্বাস করত তার চাবিকাটি খুঁজে পেয়েছিল।

টেংগ্রি সংস্কৃতির ব্যাপারটা আমারও একটু জানা দরকার, কিন্তু প্রশ্নটা আরো পরে করলেও হবে। মিখাইল বলে চলল। ওর চোখে অনেক দিন পরে আমি এসথারের অনুভূতি খুঁজে পেলাম।

আমরা প্যারিসে একসাথে কাজ শুরু করলাম। লোকজনকে সপ্তাহে একবার একত্র করা এসথারেরই আইডিয়া। ও বলত, মানুষের সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসই হচ্ছে কথোপকথন। কিন্তু লোকজন এখন আর কথা বলতে চায় না। তারা এক দণ্ড বসে কথা বলেও না, শোনেও না। তারা থিয়েটারে যায়, সিনেমা দেখে, টেলিভিশন দেখে, রেডিও শোনে, বই পড়ে কিন্তু তারা ধরতে গেলে কথাই বলে না। আমরা যদি জগৎটাকে বদলে দিতে চাই, আমাদের সেই সময়ে ফিরে যেতে হবে যখন যোদ্ধারা অগ্নিকুণ্ডের পাশে একত্র হয়ে গল্প বলত।

আমার মনে পড়ে এসথার বলেছিল সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো আমাদের মধ্যে দীর্ঘ কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া। আমরা একটা বারের টেবিলের সামনে বসতে পারি অথবা লম্বা রাস্তা ধরে হাঁটতে পারি, পার্কে যেতে পারি।

 বৃহস্পতিবারের এই মিটিংয়ের আইডিয়াটা ছিল আমার, কারণ আমি যেখানে বেড়ে উঠেছি ওখানকার ঐতিহ্যই এটি। কিন্তু ওর আইডিয়া ছিল মাঝে মাঝে প্যারিসের রাস্তার ধারে রাতে জড়ো হওয়া। ও বলেছিল, ভিখারিরাই কখনো সুখী হওয়ার ভান করে না। তার বদলে, ওরা দুঃখী হওয়ার ভান করে।

এসথার আমাকে আপনার বই পড়তে দিয়েছিল। আমি বইয়ের প্রতিও সংবেদনশীল- আমরা যে জগতের কল্পনা করি সে রকমটি। আমি বুঝতে পারলাম আমি একা নই, যদিও আমি একাই সেই কণ্ঠস্বর ধারণ করে আছি। ধীরে ধীরে, যত বেশি লোক মিটিংয়ে আসতে শুরু করল, বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আমার মিশন পূর্ণ করতে পারব আর ভালোবাসার শক্তি ফেরত আসবে। এমনকি তাতে যদি আমাদের অতীতে ফিরে যেতে হয়, সেই মুহূর্তে ফিরে আসতে হয় যখন আমরা লুকিয়ে ছিলাম।

এসথার আমাকে ছেড়ে গেল কেন?

আমি কি ওর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম? এবারের প্রশ্নটা মিখাইলকে কিছুটা বিরক্ত করল।

ভালোবাসার বাইরে আজ, আপনি রেলওয়ে ট্রাকের উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। বেশ, ও আপনার পাশাপাশি ছুটে চলা শুধু আরেকটি লাইন নয়। ও নিয়মকানুন অনুসরণ করে না, নতুবা, আমি কল্পনা করতে পারছি, আপনিও ওকে সে কারণে মিস করছেন, আপনিও তা জানেন।

তো…

 তো আপনি যদি ওকে খুঁজে পেতে চান, ও কোথায় আছে তা আপনাকে বলতে পারি। আমিও এর মধ্যে একই রকম অনুভূতিতে ভুগছি। কিন্তু আমার ভেতরের কণ্ঠস্বর বলছে এখনই সেই মুহূর্ত নয়, ভালোবাসার শক্তির ক্ষেত্রে কোনো কিছুই বাধা দেয়া ঠিক নয়। আমি সেই কণ্ঠস্বরকে সম্মান করি, ওই কণ্ঠস্বর আমাদের রক্ষা করে, আমাকে রক্ষা করে, আপনাকে, এসথারকে।

 সঠিক মুহূর্তটি কখন হবে?

 সম্ভবত আগামীকাল, বছরের যেকোনো সময়ে অথবা কখনোই নয়। আর ব্যাপারটা যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের সেই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত। কণ্ঠস্বরটাই শক্তি, আর সে কারণেই ও লোকজনকে একত্র করে যখন তারা সত্যিকারের প্রস্তুত থাকে। আমরা সবাই সেই পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করে থাকি। আমরা যা শুনতে চাই না তাই শুনতে পাই, দূরে চলে যাও। সেই কণ্ঠস্বরকে মান্য করতে যে ব্যর্থ হয়, আগে অথবা দেরিতে পৌঁছায়, তাহলে সে কখনো যে জিনিসটা চায় তা পায় না।

এ রকমভাবে জাহিরের সাথে দিন-রাত লেগে থাকার চেয়ে আমি তাকে বলতে শুনেছি দূরে চলে যাও সেটাই ভালো। যদি ও তা বলে থাকে, তাহলে অন্তত ও তা মনে মনে বলেছে। আর এখন ও এ রকম একজন মহিলা যার ভিন্নতর জীবন ভিন্নতর চিন্তাভাবনা রয়েছে।

ও আর কোনো জাহিরের অংশ নয়। কিন্তু খুব বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। একজন পুরুষ আর মহিলা যদি সেই শক্তি তৈরি করে, তাহলে তারা জগতের সমস্ত নারী পুরুষকে সাহায্য করতে পারে।

আপনি আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছেন। আমি ওকে ভালোবাসি। আমি জানি কী করতে হবে। আর আপনি বলছেন এসথার এখনো আমাকে ভালোবাসে। আমি জানি না আপনি প্রস্তুতির ব্যাপার বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন। আমি অন্য লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বাস করতে পারি না, এমনকি এসথারেরও না।

 আমি যখন ওর সাথে ছিলাম ওর সাথে কথাবার্তা বলে বুঝতে পেরেছি, আপনি ওর কিছু কিছু কথা বুঝতে পারেননি। আপনার চারদিকের জগত্তা বেপরোয়াভাবে ঘুরছে।

ব্যাপারটা সত্যি নয়। এসথার ওর নিজের পথ বেছে নেয়ার জন্য স্বাধীন ছিল। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যুদ্ধের সংবাদদাতা হবে, যদিও আমি ওকে যেতে দিতে চাইনি। লোকজন কেন অসুখী তা খুঁজে বের করতে চেয়েছে, যদিও আমি বলেছি ব্যাপারটা অসম্ভব। তাহলে কি ও চায় ফিরে এসে একটা রেলওয়ে লাইনের মতো পাশাপাশি চলবে, সব সময় বোকার মতো একই দূরত্ব বজায় রাখবে, কারণ রোমানরা সেই সিদ্ধান্ত ঠিক করে দিয়েছিল?

উল্টো দিকে হাঁটি।

মিখাইল হাঁটতে শুরু করল। আমি ওকে অনুসরণ করলাম।

আপনি কি বিশ্বাস করেন আমি একটা কণ্ঠস্বর শুনি।

সত্যি বলতে কি, আমি জানি না। কিন্তু এখন যেহেতু আমরা এখানে, আমাকে কিছু দেখাতে দিন।

সবাই মনে করে আমার মৃগী ব্যারাম রয়েছে। সে জন্য ফিট হয়ে পড়ি। আমি লোকজনকে তাই বিশ্বাস করতে দিই। কারণ ব্যাপারটা সহজ। কিন্তু আমার ভেতরে কণ্ঠস্বরটা আমার সাথে শৈশব থেকেই কথা বলে। আমি শিশুকালেই সেই দেবীকে দেখতে পাই।

কোন দেৰী?

আমি আপনাকে পরে বলব।

যখনই আমি আপনাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করি, আপনি বলেন, পরে বলব।

 কণ্ঠস্বরটা এখন আমাকে কিছু একটা বলছে। আমি জানি আপনি উদ্বিগ্ন, সেই সাথে ভয়ও পাচ্ছেন। পিজ্জারিয়ায়, যখন আমি গরম বাতাস আর আলো দেখতে পেলাম, আমি জানতাম এগুলো ঐশ্বরিক শক্তির সাথে আমার সংযোগের লক্ষণ। আমি জানতাম, শক্তিটা আমাদের দুজনকেই সাহায্য করতে এসেছে। আপনি যদি মনে করেন আমি যা কিছু বলছি সবই একজন মৃগী রোগীর প্রলাপ, যে একজন বিখ্যাত লেখককে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, আমি আপনার জন্য আগামীকাল একটা ম্যাপ নিয়ে আসব, এসথার কোথায় বাস করে তা দেখিয়ে দেব। আপনি সেখানে গিয়ে এসথারকে খুঁজে বের করতে পারেন। কিন্তু কণ্ঠস্বরটা আমাদের কিছু একটা বলছে।

আপনি কি ঠিক কথাটা বলতে চাচ্ছেন, নাকি আপনি আমাকে পরে বলবেন?

আমি আপনাকে যেকোনো মুহূর্তে বলব। আমি নিজেই এখনো পুরোপুরি মেসেজটা বুঝতে পারিনি।

কিন্তু আপনি প্রতিজ্ঞা করেছেন আমাকে ঠিকানা আর ম্যাপটা দেবেন।

আমি প্রতিজ্ঞা করেছি। ভালোবাসার ঐশ্বরিক শক্তির নামে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি। এখন আপনি আমাকে কী দেখাতে চেয়েছিলেন বলুন?

একজন তরুণী ঘোড়ার আরোহণরতা স্বর্ণালি স্ট্যাচুর দিকে নির্দেশ করলাম। ওই দেখুন। ওই মেয়েটা সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত সে যা বলেছে লোকজন সম্মান দেখিয়েছে সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যখন লোকজন মেয়েটার ওপর সন্দেহ করতে শুরু করে, বিজয়ের বাতাস দিক বদলে ফেলে।

জোয়ান অব আর্ক। অরলিন্সের কুমারী। শত বছরের যুদ্ধের নায়িকা। সতেরো বছর বয়সে মেয়েটি ফরাসি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিল। কারণ সে ওই কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল। কণ্ঠস্বর তাকে ইংরেজদের পরাজিত করার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছিল। দুই বছর পরে, তাকে ডাইনিবিদ্যা চর্চার অপরাধে পুড়িয়ে মারা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারির সেই ইন্টারোগেশনের একটা অংশ আমার একটা বইয়ে তুলে দিয়েছি।

জোয়ান অব আর্ককে মেরি জ বোপরে প্রশ্ন করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল কত দিন ধরে সে এই কণ্ঠস্বর শুনতে পায়?

আমি এই কণ্ঠস্বর তিনবার শুনতে পেয়েছিলাম। গতকাল আর আজকে। আজ সকালে, ভেসপারে। সন্ধ্যায় যখন এভ মারিয়া ঘন্টা বাজিয়েছিল…

তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কণ্ঠস্বরটা কক্ষের ভেতর ছিল কিনা, জোয়ান উত্তর দিয়েছিল সে জানে না কিন্তু সে কণ্ঠস্বর শুনে জেগে উঠেছিল। কণ্ঠস্বর কক্ষের ভেতর ছিল না, ছিল দুর্গের ভেতর।

সে কণ্ঠস্বরকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কী করা উচিত। কণ্ঠস্বরটা তাকে বলেছিল বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের হাতের তালু একসাথে করতে।

তারপর জোয়ান প্রশ্নকারী বিশপকে বলল :

আপনি বলেছেন আপনি আমার বিচারক। আপনি যা করছেন তার প্রতি যত্নবান হোন। সত্যটা হলো আমি ঈশ্বর প্রেরিত। আর আপনি নিজেকে ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলছেন। আমার কণ্ঠস্বর এই বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে যে, কিছু নির্দিষ্ট জিনিস রাজাকে বলতে, আপনাকে নয়। কণ্ঠস্বরটা ঈশ্বরের কাছ থেকেই এসেছে। আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিলে আমাকে আরো ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভবনা আছে।

মিখাইল আমার দিকে তাকাল।

আপনি কী পরামর্শ দিচ্ছেন…

আপনি কি জোয়ান অব আর্কের পুনর্জাগরণের কথা বলছেন? না, আমি তেমনটি মনে করি না। জোয়ান প্রায় উনিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিল, আর আপনার এখন পঁচিশ চলছে। জোয়ান ফরাসি সৈন্যবাহিনীর কমান্ডার হয়েছিল, আর আপনি আমাকে যা বলেছেন তাতে মনে হয় আপনি এমনকি আপনার নিজের জীবনের দায়িত্বও নিতে পারেননি।

আমরা সেইনের তীরে একটা দেয়াল ঘেঁষে বসলাম।

আমি চিহ্ন বা সাইনে বিশ্বাস করি। আমি বললাম, আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি যে প্রতিটি দিনে লোকজন, যা কিছু করছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো সুযোগটা চলে আসে। আমি বিশ্বাস করি মানুষ ব্যর্থ হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাকে ভালোবাসে তার সাথে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। আর এখন, এই সব কিছু একটা নির্দিষ্ট চক্রে শেষ করা দরকার। সে কারণেই আমি ম্যাপটা চাই। যাতে আমি এসথারের কাছে যেতে পারি।

মিখাইল আমার দিকে তাকাল। ওর চাহনি অন্য রকম। মঞ্চে কাজ করার সময় যে অদ্ভুত মোহাবিষ্ট অবস্থায় থাকে তেমন অবস্থায় চলে এসেছে। আরেকবার ইপিলেপটিক মূর্ছা যেতে পারে এই ভয় পেতে লাগলাম। এই মাঝরাতে এ রকম জনশূন্য জায়গায় কীভাবে সামাল দেব তাই নিয়ে চিন্তা করলাম।

 সেই দৃষ্টি আমাকে শক্তি দিয়েছে। শক্তিটা প্রায় দৃশ্যমান, অনুভবযোগ্য। আমি তা সামলে নিতে পারি। কিন্তু আমি এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারি না।

এই জাতীয় কথোপকথনের জন্য কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। আমি ক্লান্ত। আপনাকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি কি আমাকে সেই ম্যাপ আর ঠিকানাটা দেবেন?

সেই কণ্ঠস্বর… হ্যাঁ। আমি আগামীকাল অপরাহে আপনাকে ম্যাপটা দেব। আপনার ঠিকানা কী?

 আমি ওকে আমার ঠিকানা দিলাম। বিস্মিত হলাম এটা বুঝতে পেরে, এসথার আর আমি কোথায় বাস করতাম তা ও জানে না।

আপনি কি মনে করেন, আমি আপনার স্ত্রীর সাথে ঘুমিয়েছি?

আমি এমনকি কখনো তা জিজ্ঞেস করিনি। এটা আমার ব্যাপার নয়।

 কিন্তু আমরা পিজ্জারিয়া থাকা অবস্থায় আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন।

আমি ভুলে গিয়েছিলাম। অবশ্যই এটা আমার ব্যাপার। কিন্তু আমি এখন আর এর উত্তরে আগ্রহী নই।

মিখাইলের চোখের দৃষ্টি বদলে যেতে থাকে। ওর মুখের ভেতরে দেয়ার জন্য আমি পকেটে কিছু হাতড়াতে লাগলাম। কিন্তু ওকে বেশ শান্ত আর নিয়ন্ত্রিত মনে হলো।

 আমি এখন সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। আগামীকাল আমি আপনার জন্য ম্যাপটা নিয়ে আসব, বিস্তারিত ডিরেকশন আর ফ্লাইটের সময়সূচিও নিয়ে আসব। আমি বিশ্বাস করি এসথার আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি বিশ্বাস করি, জগন্টা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, যদি শুধু দুজন মানুষও সুখী থাকে। এমনকি কণ্ঠস্বরটা আমাকে বলছে আমরা আগামীকাল একে অন্যকে দেখতে পাব না।

আগামীকাল বিদেশ থেকে আসা একজন অভিনেতার সাথে আমার লাঞ্চ করার কথা রয়েছে। আমার পক্ষে তা বাতিল করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি সারাটা বিকাল বাসায় থাকব।

কণ্ঠস্বরটা আমাকে ও কথা বলেনি।

 কণ্ঠস্বরটা কি এসখারকে খুঁজে পেতে আমাকে সাহায্য করতে নিষেধ করছে?

না। আমি তা মনে করি না। এই কণ্ঠস্বরটাই আমাকে বই স্বাক্ষর করে নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারপর থেকে, আমি কম বেশি এটুকু জানি, যেকোনো ঘটনা মোড় নিতে পারে, কারণ আমি এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ পড়েছি।

ঠিক আছে। আমি ভয় পেলাম ও হয়তো মত বদলাতে পারে। আমরা আমাদের কথাতে ঠিক থাকি। আমি দুপুর দুইটার পর থেকে বাসায় থাকব।

কিন্তু কণ্ঠস্বরটা বলছে, এখনই ঠিক সময় নয়।

আপনি প্রতিজ্ঞা করেছেন।

 ঠিক আছে।

মিখাইল হাত বাড়িতে হ্যান্ডশেক করে জানাল, আগামীকাল বিকালে ও আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসবে। ওই রাতে ওর শেষ কথাটি ছিল :

কণ্ঠস্বরটা বলেছে এসব জিনিস তখনই অনুমোদন করা উচিত যখন সঠিক সময় আসবে।

বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময়, শুধু ভালোবাসার ব্যাপারে এসথারের কথাবার্তা শুনতে পেলাম। সেই কথোপকথন মনে করে বুঝতে পারলাম, ও আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছে।

.

আমার বয়স যখন পনেরো, আমি যৌনতার ব্যাপারটা বুঝতে বেপরোয়া হয়ে উঠলাম। কিন্তু ব্যাপারটা ছিল পাপ। নিষিদ্ধ। আমি বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা পাপ হবে কেন, তুমি কি বুঝতে পারো? তুমি কি আমাকে বলতে পারো কেন সমস্ত ধর্মে, সারা পৃথিবীতে, এমনকি আদিম যুগের ধর্ম সংস্কৃতিতে, যৌনতাকে এ রকম একটা বিষয়ে বিবেচনা করা হয়েছে যা নিষিদ্ধ।

আমরা কীভাবে এ বিষয়ে বলতে পারি? ঠিক আছে, কেন যৌনতা নিষিদ্ধ বস্তু হতে পারে?

খাদ্যের কারণে।

খাদ্য?

হাজার বছর আগে, উপগোষ্ঠীগুলো সব সময় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। পুরুষের তাদের ইচ্ছামতো যত খুশি মহিলাদের সাথে সম্ভোগে মেতে উঠত। আর অবশ্যম্ভাবীভাবে তার ফলাফলে বাচ্চাকাচ্চা পয়দা হতো। যাই হোক, উপগোষ্ঠী যত বড় হয়ে উঠতে লাগল ততই তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি হয়ে গেল। উপগোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে খাদ্যের জন্য লড়াই করত। প্রথমে বাচ্চাদের হত্যা করত। তারপর মহিলাদের। কারণ ওরাই দুর্বল। শুধু সবলেরা টিকে থাকত। কিন্তু তারা সবাই পুরুষ। আর মহিলাদের ছাড়া, পুরুষেরা প্রজাতি বাড়াতে পারত না।

 তারপর কেউ একজন পাশের উপগোষ্ঠীতে কী ঘটছে তা দেখতে থাকে। নিজেদের মধ্যে সে রকমটা যাতে না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। সে তখন একটা গল্প বানায়। ঈশ্বর পুরুষকে উপগোষ্ঠীর যেকোনো মহিলার সাথে যত্রতত্র যৌনকার্য করতে নিষেধ করেছেন। পুরুষেরা শুধু একজন মহিলার সাথে অথবা বড়জোর দুজনের সাথে যৌনতার সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারে। কোনো কোনো পুরুষ পুরুষত্বহীন, কোনো কোনো মহিলা বন্ধ্যা, গোষ্ঠীর কোনো কোনো সদস্য প্রাকৃতিক কারণে কোনো বাচ্চার জন্ম দিতে পারে না, কিন্তু কেউ যৌনসঙ্গীকে বদলাতে পারবে না।

 তারা গল্পটা বিশ্বাস করে, কারণ যে মানুষটি তাদের এই গল্পটা বলছিল সে ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলেছিল। যেকোনোভাবেই হোক লোক একটু আলাদা রকমের ছিল। হয়তো কোনো প্রতিবন্ধিতা, কোনো অসুখ, খিচুনি এ রকম কিছু থাকতে পারে, অথবা কোনো বিশেষ গিফট, যেকোনোভাবেই হোক, সে অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে উঠল। কারণ সেভাবেই প্রথম দলনেতার আবির্ভাব। কয়েক বছরের মধ্যে গোষ্ঠীগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল। পরিকল্পিতভাবে যৌনজীবনের কারণে নির্দিষ্ট সংখ্যক বাচ্চাকাচ্চা সুষ্ঠভাবে বড় হয়ে উঠল, তারা শক্তিশালী শিকারি আর সুস্থ সন্তান উৎপাদনকারী হয়ে বড় হতে লাগল। তুমি কি জানো বিয়ের মাধ্যমে একজন মহিলাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয় কীসে?

 সেক্স।

না। খাবার তৈরি করা। প্রিয় পুরুষ খাচ্ছে তা অবলোকন করা। মহিলাদের সেই মুহূর্তটাই গর্বের। কারণ সে সারাটা দিন রাতের খাবারের জন্য ব্যয় করে। সে কারণেই এই গল্পের মধ্যে আসল কারণটা লুক্কায়িত আছে- ক্ষুধার মধ্যেই অস্তিত্বের সংকট আর বেঁচে থাকার পথ নিহিত।

 সন্তান না থাকার কারণে তোমার মধ্যে কি কোনো দুঃখ আছে?

 এ রকমটি তো ঘটেনি, ঘটেছে কি? তাহলে যা ঘটেনি তা নিয়ে আমি দুঃখ করতে যাব কেন?

তুমি কি মনে করে তাতে আমার বিয়ের সম্পর্কটা বদলে যেতে পারত?

আমি তা কীভাবে জানব? আমি আমার বন্ধুবান্ধবদের দেখছি, নারী পুরুষ উভয়ই। সন্তান থাকার কারণে কি তাদের সুখী দেখি? কাউকে মনে হয়, কাউকে মনে হয় না। ওরা যদি ওদের সন্তানদের কারণে সুখী হয় তাহলে তা তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে ভালো-মন্দর কিছু পার্থক্য করে না। তারা এখনো মনে করে তাদের একে অন্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার অধিকার আছে। তারা এখনো মনে করে, যেভাবেই হোক নিজেদের সুখী রাখার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, এমনকি প্রতিদিনের অসুখী অবস্থার মধ্যেও।

যুদ্ধটা তোমার জন্য ভালো কিছু নয়, এসথার। আমরা এখানে বসে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তোমার প্রতিটি মুহূর্ত তা অন্য রকম করে ভিন্ন বাস্তবতায় নিয়ে যাবে। আমি জানি একদিন মারা যাব, কিন্তু তা শুধু প্রতিটি দিন আমার জীবনে এ রকমভাবে বাঁচতে সাহায্য করে যে, অলৌকিক কোনো ঘটনা। এ ব্যাপারটা আমাকে ভালোবাসা, যৌনতা, সুখ, খাদ্য আর বিবাহের ব্যাপারে বেপরোয়াভাবে ভাবতে দেয় না।

 যুদ্ধের কারণে আমার এসব ভাবার সময় নেই। আমি সাধারণভাবেই ভাবি। যেকোনো মুহূর্তে সরাসরি একটা বুলেট আমার বুকে এসে লাগতে পারে। আমি শুধু ভাবি, ভালো, অন্ততপক্ষে আমার বাচ্চাদের কী হবে তা নিয়ে আমাকে চিন্তিত হতে হবে না। কিন্তু আমি এও ভাবি, কী লজ্জার কথা, আমি মারা যাচ্ছি আর আমি কিছুই রেখে যাচ্ছি না। আমি শুধু একটা জীবনকে হারাতে পারি, একটা জীবনকে এই পৃথিবীতে আনতে পারি না।

তুমি কি মনে করো আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে? আমি এই ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করছি কারণ মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছো। কিন্তু তুমি নিজেই বলছ না।

হ্যাঁ। কিছু একটা সমস্যা আছে। আমাদের একসাথে সুখী হতে বাধ্য মনে হয়। তুমি মনে করো তুমি আমার জন্য সব কিছু করেছ। আমার মনে হয় তোমার মতো একজন মানুষ আমার পাশে আছে তার সুবিধাটা আমি ভোগ করছি।

 আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসি, কিন্তু আমি সব সময় মনে রাখি না এবং নিজেকে প্রশ্ন করি না, আমার সমস্যাটা কি?

খুব ভালো যে তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার মধ্যে কোনো সমস্যা আছে অথবা আমার কোনো সমস্যার কারণে এ রকমটি হচ্ছে। কারণ আমি নিজেকেও একই প্রশ্ন করেছি। আমরা এখন যেভাবে আমাদের ভালোবাসাবাসি করি তার মধ্যে কী সমস্যা। আমরা যদি মনে করি এটাতে আমাদের সমস্যা সৃষ্টি করছে, আমরা সেই সমস্যার মধ্যে বাস করে সুখী হতে পারি। হয়তো ব্যাপারটা চিরায়িত লড়াইয়ের মতো হতে পারে, কিন্তু অন্ততপক্ষে আমাদের সচল, সজীব আর আনন্দিত রাখতে পারে, অনেকগুলো জগৎ আমরা জয় করতে পারি। সমস্যাটা হলো আমরা এ রকম একটা দিকে এগোচ্ছি সেখানে খুব সহজভাবে স্বস্তিদায়ক হতে পারে, যেখানে ভালোবাসা সমস্যা সৃষ্টি থেকে বন্ধ করতে পারে।

 তাহলে সমস্যাটা কী?

 সব কিছুতেই। আমি আর ভালোবাসার শক্তির ওপর থাকতে পারছি না। লোকজনের কাছে যা আবেগ তাই আমার রক্তমাংস আর আত্মা ভেদ করে যায়।

 কিন্তু কিছু একটা রয়ে যায়।

রয়ে যায়? প্রত্যেকটি বিয়েই এ রকমভাবে শেষ হয়ে যায়, আবেগের কারণে লোকজন যাকে একটা পরিপকু সম্পর্ক বলতে পারে? তোমাকে আমার দরকার, আমি তোমাকে মিস করি। মাঝে মাঝে আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ি। তুমি রাতে কি খাবে তা নিয়ে আমি ভাবতে পছন্দ করি। এমনকি মাঝে মাঝে তুমি কখনো কী খাচ্ছ তা লক্ষ করো না। কিন্তু সেখানে আনন্দের ঘাটতি আছে।

না। ব্যাপারটা তা নয়। যখনই তুমি দূরে থাকো, আমি আশা করি তুমি আমার কাছে আছে। তুমি যখন সাথে থাক বা কোনো ট্রিপ থেকে ফিরে আসো তখন যে রকম কথাবার্তা হয় তা কল্পনা করি। সব কিছু ঠিকঠাক আছে তা জানতেই তোমাকে ফোন করি। তোমার কণ্ঠস্বর প্রতিদিন শুনতে ইচ্ছা করে। এখনো তোমার প্রতি আবেগাপ্লুত হয়ে আছি, তা গ্যারান্টি দিতে পারি।

আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একই। কিন্তু আমরা একসাথে থাকলে কী ঘটে? আমরা তর্ক করি, সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করি, একজন আরেকজনকে বদলে দিতে চাই, তার বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করি। তুমি আমার কাছে এ রকম জিনিস চাও, যার কোনো অর্থ হয় না। আমিও একই রকম করি। মাঝে মাঝে, আমাদের হৃদয়ের নীরবতা আমাদের বলে, এর চেয়ে মুক্ত হয়ে যাওয়াও অনেক ভালো।

 তোমার কথাই ঠিক। এ রকম মুহূর্তে, আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কারণ আমি জানি এ রকম একজন মহিলার সাথে আছি যাকে আমি চাই।

আর একইভাবে সব সময় আমার মনে হয় আমার পাশে আমার চাওয়ার মানুষটি আছে।

 তুমি কি মনে করো তা বদলানো দরকার?

আমি যত বেড়ে উঠছি, কয়েকজন পুরুষ আমাকে দেখছে, আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি, ওরা যে রকম আছে সে রকম থাকুক। আমি নিশ্চিত আমি খুব ভালোভাবে বাকি জীবন নিজেকে ধোঁকা দিতে পারি। আর এখন, যখনই যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাই, আমি আরো মহত্তর ভালোবাসার অস্তিত্ব দেখতে পাই, যেটা একজন মানুষ আরেকজনকে হত্যা করার চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা দেখতে পাই। তারপর, শুধু তারপর, আমি মনে করলাম আমি জিনিসটা বদলে দিতে পারি।

কিন্তু তুমি একটানা যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে পারো না।

আবার আমি একটানা এই জাতীয় শান্তির ওপর থাকতে পারি না, যা তোমার সাথে পাচ্ছি। আমার মধ্য থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ধ্বংস করে দিচ্ছে, তোমার সাথে আমার সম্পর্কের ধরনটা, এমনকি যদিও আমার ভালোবাসার প্রতি …

এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে একই রকম ভাবনা লাখ লাখ লোক ভাবছে। তারা ব্যাপারটা হতাশায় চাপিয়ে রেখে মুহূর্তগুলোকে দাবিয়ে রাখছে। তারা এক, দুই, তিন করে সংকট মোকাবিলা করে শেষ পর্যন্ত শান্তি খুঁজে পায়।

তুমি জানো ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে। অন্যথায় তুমি যে বই লিখছ তা লিখতে না।

.

রবার্টোর পিজ্জারিয়ায় আমেরিকান অভিনেতা-পরিচালকের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলাম। আমার ওখানে খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার যাতে আমার দ্বারা ওদের মনে কোনো খারাপ প্রভাব না পড়ে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে, আমার ভৃত্য আর অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকারকে জানিয়ে গেলাম, যদি আমি সময়মতো ফিরে না আসি আর মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের একজন তরুণ আমার জন্য কোনো প্যাকেজ দিতে আসে, তারা যেন অবশ্যই তাকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। ওকে লিভিংরুমে অপেক্ষা করতে বলে, ওর যা দরকার হয় তাই দেয়া হয়। যদি কোনো কারণে তরুণটি অপেক্ষা করতে না চায়, তাহলে যেন ওদের কেউ একজন ওর কাছ থেকে প্যাকেটটি নিয়ে নেয়।

সর্বোপরি, ওরা যেন কোনোমতেই ওই তরুণটি প্যাকেট না রেখে যেতে না দেয়!

আমি ট্যাক্সি নিলাম। বুলভার্দের সেন্ট-জামিয়ান আর রু দ্য স-পেরেসের কোনায় এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। কিন্তু জায়গাটা রেস্তোরাঁ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড, রবার্টোর হাসিমাখা মুখ দেখতে পাচ্ছি। ও বাইরে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছে। বেবি ট্রলি নিয়ে একজন ভদ্রমহিলা আমার দিকের সরু জায়গার মধ্যে এল, কারণ ওখানে আমাদের দুজনের দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট জায়গা নেই। আমি মহিলাটিকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এলাম।

আর তার পর পরই স্লো মোশনের মতে, জগত্তা আমার কাছে বিস্তৃত হয়ে ধরা দিল। ভূমিটাই যেন আকাশ আর আকাশটাই মাটি হয়ে গেল। আমি মাঝে মাঝে কিছু ভবনের স্থাপত্য শিল্পের ছোঁয়ায় খচিত ভবনের ওপরেরটা খেয়াল করেছি। আমি প্রায়ই এগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি, কিন্তু কখনো ওভাবে ওপরের দিকে তাকাইনি। কিন্তু এখন সেগুলো সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বিস্ময়ের সাথে এই অনুভূতির কথা মনে করতে পারছি। আমার কানের মধ্য দিয়ে বাতাসের প্রবাহ, দুর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ঘেউ ঘেউ, তারপর সব কিছু আমার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল।

আমি যেন বলের মতো একটা ব্লাকহোলের মধ্যে গিয়ে পড়লাম, যার শেষ মাথায় আলোর রেখা। সেখানে পৌঁছানোর আগে, যেভাবেই হোক, কয়েকটা অদৃশ্য হাত আমাকে বেপরোয়াভাবে টেনে তুলল। চারদিকে কণ্ঠস্বর আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে জেগে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। আমি মুখের মধ্যে রক্তের নোনা স্বাদ পেলাম। ভেজা অ্যাসফল্টের গন্ধ নাকে এল। তখনই বুঝতে পারলাম দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছি। আমি একই সাথে সচেতন এবং অচেতন। নড়তে চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম আমার পাশে আরেকজনকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমি সেই মানুষটার গন্ধ পেলাম। তার সুগন্ধি গন্ধ! আমি কল্পনা করতে পারছি অবশ্যই সেই ভদ্রমহিলা হবে, যে তার বাচ্চাটাকে পেভমেন্টের দিকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিল। হায় খোদা!

 কেউ একজন আমার কাছে এসে আমাকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে সাহায্য করল। চেঁচিয়ে উঠলাম। আমাকে ছোঁয়া যাবে না। কোনো রকম নড়াচড়াই বিপজ্জনক হতে পারে। আমি ওদের কথোপকথন শুনে বুঝতে পারলাম কাঁধে ঘাড়ে ভালোমতোই আঘাত পেয়েছি এবং এ রকম আঘাত থেকে আমার এক পাশ চিরদিনের জন্য প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।

আমি সচেতন থাকার জন্য লড়ে যেতে লাগলাম। আমি তীব্র ব্যথার জন্য অপেক্ষা করছি। এর চেয়ে একটু নড়াচড়া করার চেষ্টা করে দেখাই ভালো। আমার মনে হলো কিছু ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আবারো নড়াচড়া না করানোর জন্য বললাম। দূর থেকে সাইরেন শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম আমার ঘুমিয়ে পড়া উচিত। আমার নিজের আর জীবন বাঁচানোর জন্য লড়াই করার দরকার নেই। বেঁচে থাকি আর মরে যাই কোনোটাই এখন আর আমার ওপর নেই। ডাক্তার, নার্স, ভাগ্য আর ঈশ্বরের ওপরের সব।

একজন শিশুর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি মেয়েটা আমাকে তার নাম বলছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। মেয়েটা আমাকে শান্ত হয়ে থাকতে বলছে। আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে বলছে মরে না যাওয়ার জন্য। ও যা বলছে তা আমি বিশ্বাস করতে চাই। ও যাতে আমার পাশে থাকে সে জন্য করুণা ভিক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম কেউ একজন প্লাস্টিকের কিছু আমার গলায় চারপাশে জড়িয়ে দিল। আমার মুখে একটা মাস্ক পরিয়ে দিল। তারপর আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম। এবারে আর কোনো স্বপ্ন নেই।

.

জ্ঞান ফিরে এলে, চারদিকে ভয়ানক গুঞ্জনের শব্দ শুনতে পেলাম। তার পরই সব নীরব এবং অন্ধকারে ডুবে গেল। হঠাৎ করে, আমি বুঝতে পারলাম সব কিছুই নড়ছে। আমি নিশ্চিত আমাকে কফিনে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে জীবন্ত কবর দেয়া হবে!

আমি দেয়ালের গায়ে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো রকম মাংসপেশি নাড়াতে পারলাম না। যেটা মনে হলো যেন আমাকে অসহায়ের মতো সামনের দিকে এগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমার সমস্ত শক্তিকে শুষে নেয়া হয়েছে। চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু তা শূন্য জায়গায় প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কানেই ফিরে এল। আমাকে পরিহাস করল। কিন্তু জানতাম, একবার যদি চিৎকার করতে পারি, নিরাপদে থাকব। একটা আলো আমার পায়ের ওপর তৎক্ষণাৎ এসে পড়বে, ওরা বুঝতে পারবে আমি মৃত নই!

আলো এই মুহূর্তে আমার জীবন বাঁচিয়ে তুলতে পারে, এই যন্ত্রণা, দমবন্ধ ভাব আমার সমস্ত শরীরের ওপর আলোর প্রবাহ, ওরা শেষ পর্যন্ত আমার ওপর থেকে কফিনের ডালাটা তুলে ফেলেছে। আমার শরীর দিয়ে ঠাণ্ডা ঘাম ছেড়ে গেল। বেশ যন্ত্রণা বুঝতে পারলাম কিন্তু সেই সাথে বেশ খুশি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ওরা ওদের ভুল বুঝতে পেরেছে। আমি আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছি!

 আলোটা শেষ পর্যন্ত আমার চোখে গিয়ে লাগল। নরম হাত আমাকে স্পর্শ করল। দেবদূতের মতো চেহারার একজন আমার মুখের ওপর থেকে ঘাম মুছে নিল।

চিন্তা করবেন না। দেবীর মতো চেহারার, সোনালি চুল সাদা আলখাল্লা পরা মেয়েটি বলল, আমি কোনো অ্যাঞ্জেল নই, আপনি মারা যাচ্ছেন না। এটা কোনো কফিন নয়। শুধু একটা বডি স্ক্যানার। আপনার শরীরে আর কোনো ক্ষত আছে কিনা তা খুঁজে বের করছিলাম। দেখে মনে হচ্ছে খুব ভয়ানক কিছু ঘটেনি। কিন্তু আপনাকে এখানে পর্যবেক্ষণের জন্য থাকতে হবে।

 কোনো হাড় ভাঙেনি?

শুধু কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে। আমি যদি আপনার সামনে আয়না ধরি, আপনি ভয় পেয়ে যাবেন কিন্তু ওই ফোলাগুলো কয়েক দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।

আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মেয়েটি খুব আলতো করে আমাকে থামিয়ে দিল। তখনই আমি মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে গুঙিয়ে উঠলাম।

আপনি দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে একটু যন্ত্রণা হওয়া তো স্বাভাবিক।

আমার মনে হয় আপনি আমার সাথে মিথ্যা বলছেন, আমি কোনোমতে বলতে পারলাম, আমি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ। আমার বেশ সুন্দর একটা জীবন রয়েছে। কোনো রকম আতঙ্ক ছাড়াই আমি যেকোনো প্রকার খারাপ সংবাদ সহ্য করতে পারব। আমার মাথার মধ্যের কয়েকটা শিরা মনে হয় ফেটে গেছে, তাই না?

 দুজন নার্স এসে আমাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিল। আমি বুঝতে পারলাম আমার গলার চারদিকে একটা অর্থোপেডিক কলার পরানো হয়েছে।

কেউ একজন আমাকে বলেছে আপনি নড়াচড়া করতে পারছেন না। অ্যাঞ্জেল বলল, সে কারণেই ওভাবে রাখা হয়েছে। আপনাকে এই কলার কিছু সময়ের জন্য পরে থাকতে হবে। যাতে কোনো রকম আঁকিঝুঁকি না লাগে। কারণ কেউ বলতে পারে না কখন কী ঘটতে পারে। আপনি এখন খারাপ ধরনের শকের মধ্যে আছেন। আপনি খুব ভাগ্যবান।

কত সময়? আমি এখানে থাকতে পারি না।

 কেউ কিছু বলল না। রেডিওলজি ইউনিটের বাইরে মেরি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। হাসল। ডাক্তার নিশ্চয় এরই মধ্যে বলেছে যে আমার দুর্ঘটনা খুব একটা ভয়াবহ কিছু নয়। মেরি খুব সাবধানে আমার চুলে চাপড় দিতে লাগল। খুব সাবধানের সাথে আমার ভাবভঙ্গিতে কোনো শকিং কিছু আছে কিনা দেখতে লাগল।

 দুজন নার্সের সাথে মেরিও করিডোর দিয়ে আমার স্ট্রেচারের সাথে সাথে আসতে লাগল। আমার মাথার যন্ত্রণাটা সব সময় খারাপভাবে ব্যথা দিতে লাগল।

 নার্স, আমার মাথায়…।

আমি নার্স নই। আমি এই মুহূর্তে আপনার ডাক্তার। আমরা আপনার নিজস্ব ডাক্তার আসার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনার মাথার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি দুর্ঘটনায় পড়লে আপনার শরীরের সমস্ত রক্তনালিকা ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করার জন্য একত্র হয়। বিপদ কেটে গেলে নালিকাগুলো আবার খুলে যায়, রক্ত প্রবাহ হতে শুরু করে, যা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু সেটাই সব। যাই হোক, আপনি চাইলে আমি আপনাকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য কিছু দিতে পারি।

আমি অস্বীকার করলাম। আমার আত্মার অন্ধকার দিকগুলো ঘুরে, আজ দিনের আগে যে কথাগুলো শুনেছিলাম তা মনে করতে পারলাম : কণ্ঠস্বরটি বলেছিল ঠিক সময় এলেই কেবল এ ব্যাপারগুলো অনুমতি দেয়া উচিত।

ও সম্ভবত তা জানে না। বুলভার্ন সেন্ট-জামাইন আর রু দ্য স-পেরেসের কোনায় যে ঘটনাটা ঘটেছে তা জাগতিক ষড়যন্ত্র বলা যায়, ঈশ্বরের পূর্বনির্ধারিত ব্যাপারস্যাপার। আমার জাহিরের খোঁজের ব্যাপারে হয়তো তা সতর্কতার মতো। মিখাইল সম্ভবত এই ভবিষ্যতের ব্যাপারে দেখতে পাইনি, নয়তো সে সত্যিই একটা কণ্ঠস্বর শুনেছে। আমি যা কল্পনা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আমার জন্য সব কিছুই বেশি বেশি শুরু হয়েছিল। মেরির হাসি, কারো কণ্ঠস্বর আর আমার মাথার মধ্যের যন্ত্রণা।

 ডাক্তার, আমি সিদ্ধান্ত বদলেছি। আমি ঘুমাতে চাই। আমি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।

ডাক্তার একজন নার্সকে কিছু একটা বলল। নার্সটা বেরিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর আমার রুমে ফিরে এল। আমার বাহুতে সূক্ষ্ম খোঁচার স্পর্শ পেলাম। ততক্ষণাৎই ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

জেগে উঠে জানতে চাইলাম ওই সময়ে ঠিক কী ঘটেছিল। আমার পাশ দিয়ে যে ভদ্রমহিলা যাচ্ছিল সে কি আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, তার বাচ্চাটার কী হয়েছে। মেরি বলল, আমার বিশ্রামের দরকার। কিন্তু আমার পরিচিত ডাক্তার এবং বন্ধু, ডাক্তার সুইট চলে এল। জানাল আমাকে না জানানোর মতো কোনো কারণ ঘটেনি। আমি একটা মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমার পাশে মাটিতে শোয়ানো যে শরীরটা দেখেছিলাম তা সেই মোটরসাইকেল আরোহী যুবকের। ওকে আমার মতো একই হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আমার মতোই তারও আঘাত তত গুরুতর নয়। দুর্ঘটনার পর পরই পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার, আমি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যে কারণে মোটরসাইকেল আরোহীর জীবনটা আমি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি।

আমারই দোষ, কিন্তু মোটরসাইকিলিস্ট আমার ব্যাপারে কোনো চার্জ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেরি তার সাথে দেখা করে কথা বলেছে। মেরি জেনেছে সেই তরুণ একজন অভিবাসী, বেআইনিভাবে এখানে কাজ করছে আর পুলিশের সাথে কোনো রকম সংস্পর্শে জড়িয়ে পড়লে সমস্যা হতে পারে। ওকে চব্বিশ ঘণ্টা পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কারণ ও একটা হেলমেট পরে ছিল। ওর মস্তিষ্কের আঘাতটা খুবই কম।

 তুমি বলছ চব্বিশ ঘণ্টা পরে ছেলেটাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে? তার মানে আমি এখানে এক দিনের বেশি আছি?

তুমি এখানে তিন দিন ধরে আছে। তোমাকে বডি স্ক্যানারের বাইরে আনার পর এখানকার ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করল তোমাকে সিডেটিভের ওপর রাখবে কিনা। আমার কাছে মনে হয়েছে তুমি অনেক বেশি চিন্তিত আর উত্তেজিত ছিলে। শেষের দিকে এসে কিছুটা হতাশও। সে কারণে আমি ডাক্তারকে সিডেটিভ দিতে বলেছিলাম।

 তো এর পরে কী?

 তোমাকে আরো দুদিন বেশি হাসপাতালে আর তিন সপ্তাহ গলায় অর্থোপেডিক কলার পরে থাকতে হবে। তুমি আটচল্লিশ ঘণ্টার সংকটজনক অবস্থা কাটিয়ে উঠেছ। অবশ্য, তোমার শরীরের কোনো কোনো অংশ এখনো ঝামেলা করতে পারে। সেই সাথে তোমার হাতেও সমস্যা হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটলে তখন দেখা যাবে। এখনো ও নিয়ে অযথা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

তা আমি এখনো মারা যেতে পারি।

 তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমরা সবাই শুধু মারা যেতে পারি না, যাবই।

হ্যাঁ। কিন্তু এই দুর্ঘটনার কারণে আমার মারা যাওয়ার সম্ভবনা আছে?

ডাক্তার লুইট থামলেন।

 হ্যাঁ। সব সময় একটা চান্স থেকে যায় যে রক্ত জমাট বদ্ধ হয়ে থাকতে পারে, যা মেশিন ধরতে পারিনি। এটা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে গিয়ে এমবোলিজম ঘটাতে পারে। এ সম্ভবনাও আছে যে, একটা কোষ অন্য রকম হয়ে ক্যান্সার শুরু করে দিতে পারে।

আপনার ও রকম কিছু বলা উচিত নয়। মেরি বলল।

আমরা পাঁচ বছর ধরে বন্ধু। ও আমাকে একটা প্রশ্ন করেছে আর আমি তার উত্তর দিয়েছি। আর এখন, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে অফিসে ফিরে যেতে হবে। আপনি যে রকম মনে করছেন ওষুধ ও রকম নয়। আমরা যে জগতে বাস করি সেখানে, একটা ছেলে যদি পাঁচটা আপেল কিনতে যায়, কিন্তু বাড়িতে মাত্র দুটো নিয়ে ফিরে আসে, লোকজন উপসংহারে যাবে সে তিনটি আপেল খেয়ে ফেলেছে। আমার জগতে, সেখানে অন্য সম্ভবনাও আছে। ও সেগুলোকে খেয়ে ফেলতে পারে। কিংবা আপেলগুলো ওর কাছ থেকে ডাকাতি হয়ে যেতে পারে, ওকে যে অর্থ দেয়া হয়েছিল তা হয়তো পাঁচটা আপেল কেনার মতো যথেষ্ট ছিল না। বাড়িতে ফেরার পথে হারিয়ে ফেলতে পারে। এ রকম কারোর সাথে ওর দেখা হতে পারে যে খুব ক্ষুধার্ত যাকে ও আপেলগুলো দিয়েছে। আমার জগতে, সব কিছুই সম্ভব এবং সব কিছুই সম্পর্কিত।

আপনি এপলেন্সির ব্যাপারে কী জানেন?

মেরি তখনই বুঝতে পারল আমি মিখাইলের ব্যাপারে কথা বলছি। মেরি জানাল তাকে এখন যেতে হবে। সিনেমার একজন ক্রু তার জন্য অপেক্ষা করছে।

ডাক্তার লুইট, জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য থামল।

মস্তিষ্কের একটা বিশেষ এরিয়ায় অতিরিক্ত ইলেকট্রিক ইমপালসের কারণে এমনটি হতে পারে। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো গবেষণা নেই। কিন্তু ওরা মনে করে আক্রমণটা তখনই আসে যখন মানুষটা খুব সমস্যার মধ্যে থাকে। কিন্তু চিন্তা করো না, মৃগী রোগীর উপসর্গ যেকোনো বয়সে দেখা দিতে পারে। ইপিলেপসি নিজেই একটা মোটরসাইকেলের সাথে সংঘর্ষের স্থানে নিয়ে যেতে পারে।

 তো কারণটা কী?

 আমি বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু তুমি চাইলে আমি খুঁজে বের করতে পারি।

হ্যাঁ, তুমি যদি পারো। আর আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে। কিন্তু তার জন্য দয়া করে তুমি মনে করো না আমার মস্তিষ্ক দুর্ঘটনার কারণে আক্রান্ত হয়েছে। ইপলেপটিক অবস্থায় মানুষ কণ্ঠস্বর শুনতে পায় এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে তা কি সম্ভব?

 তোমাকে কি কেউ বলেছিল এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে?

ঠিক তা নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এ রকম মনে হতে পারে।

 দেখ, আমি আর থাকতে পারছি না। মেরিকে নামিয়ে দিয়ে যাব। কিন্তু তোমার জন্য এপিলেপসির ব্যাপারে কী করতে পারি তা দেখব।

.

দুদিন হয়ে গেছে মেরি বাইরে, দুর্ঘটনার শক সত্ত্বেও আমার মনের ভেতর জাহিরের চিন্তা দখল করে আছে। জানি মিখাইল যদি ওর কথা রেখে থাকে, তাহলে বাড়িতে আমার জন্য একটা এনভেলাপ অপেক্ষা করে আছে, ওর মধ্যে এসখারের ঠিকানা। এখন এ ব্যাপারটাই আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।

 মিখাইল যদি কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে ঠিক বলে থাকে তাহলে কী হবে?

 আমি দুর্ঘটনার ব্যাপারটা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মনে করার চেষ্টা করলাম। আমি মোড় ঘুরে সামনের দিকে এগোলাম, অটোমেটিক্যালি দেখার চেষ্টা করলাম কোনো কিছু আসছে কিনা। আমি একটা গাড়ি এগোতে দেখলাম। কিন্তু তা বেশ নিরাপদ দূরত্বে ছিল। তারপর আমি দুর্ঘটনায় পড়েছি, সম্ভবত ওই মোটরসাইকেল গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে ওভারটেক করার চেষ্টা করছিল।

আমি সাইনে বিশ্বাস করি। সান্তিয়াগোর রাস্তা হেঁটে দেখেছি, সব কিছু বদলে গেছে। আমাদের যা শেখার দরকার সব সময় তা আমাদের সামনেই থাকে, আমাদের শুধু সম্মানের সাথে সেগুলো খুঁজে নেয়া এবং ঈশ্বর আমাদের যেদিকে চালিত করে সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। আমরা পরের পদক্ষেপ কোন দিকে নেব। আমি এও শিখেছি রহস্যকে সম্মান জানানো উচিত। যেমনটি আইনস্টাইন বলেছেন, ঈশ্বর পৃথিবী নিয়ে পাশা খেলেন না। সব কিছুই একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং অর্থপূর্ণ। সেই অর্থ হয়তো সব সময় লুকায়িত থাকে। কিন্তু আমরা সব সময় জানি আমাদের সত্যিকারের মিশনের খুব কাছাকাছি, আমরা প্রাণশক্তির সংস্পর্শে থাকি।

 যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সব কিছুই ভালো। যদি না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের দিক বদলে ফেলা দরকার।

আমরা ঠিক পথে থাকলে, সাইনটাকে অনুসরণ করতে পারি। মাঝে মাঝে যদি হোঁচট খাই, স্বর্গীয় শক্তি আমাদের সাহায্যে এসে ভুল থেকে রক্ষা করে। এই দুর্ঘটনাও কি সে রকম কোনো সাইন? মিখাইল কি এ রকম কোনো চিহ্নের ব্যবস্থা করছে, যা আমাকেও প্রভাবিত করে?

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রশ্নের উত্তর হবে হ্যাঁ।

 সম্ভবত আমি আমার নিয়তিকে গ্রহণ করে নিয়েছি। আমার চেয়ে মহোত্তর কিছুর দ্বারা নিজেকে প্রদর্শিত হতে অনুমতি দিয়েছি। আমি তা লক্ষ্য করেছি, সেই দিন থেকে, জাহির স্থিমিত হয়ে যেতে লাগল। আমি জানতাম যে সেই খামটা খুলে যখনই এসথারের ঠিকানাটা পড়ব, ওর কাছে যাব, দরজায় নক করব কিন্তু সাইন আমাকে জানাচ্ছে এখনই সেই মুহূর্ত নয়। যদি এসথার আমার জীবনে অতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে যেমনটি আমি ভাবছিলাম, যদি ও এখনো আমাকে ভালোবাসে (যেমনটি মিখাইল বলছিল) তাহলে কেন এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, যাতে আমি অতীতের মতো একই ভুল করতে পারি?

 আমি কীভাবে তার পুনরাবৃত্তি এড়াতে পারি?

নিজেকে আরো বেশি জানা দরকার। ব্যাপারটা খুঁজে বের করা উচিত। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ করে এ রকম দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার কারণ খুঁজে বের করা।

তাই কি যথেষ্ট?

না। এসথার কোথায় আছে আমার জানা দরকার। আমরা একত্রে থাকার সময় থেকে এখন ওর মধ্যে কী পরিবর্তন এসেছে জানা দরকার।

 এই দুটো প্রশ্নের উত্তর জানাই কি যথেষ্ট?

তৃতীয়ত আরেকটা প্রশ্ন আছে : কেন ভাগ্য আমাদের দুজনকে একত্র করেছিল? হাসপাতাল রুমে আমার অফুরন্ত সময়। আমার জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলো বিবেচনা করতে লাগলাম। আমি সব সময় অ্যাডভেঞ্চার আর নিরাপত্তাকে বেছে নিয়েছি। যদিও জানতাম এ দুই জিনিস সত্যি কখনো মেশে না। আমি এসথারের প্রতি আমার ভালোবাসার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। যদিও খুব সহজেই অন্য মহিলার প্রেমে পড়ে যেতাম। কারণ প্রেমে আবদ্ধ করার খেলা জগতের সবচেয়ে মজাদার খেলা।

আমি আমার স্ত্রীকে কি কখনো দেখিয়েছি আমি ওকে ভালোবাসি? সম্ভবত কখনো কখনো, কিন্তু সব সময় নয়। কেন? কারণ আমি মনে করতাম এর কোনো প্রয়োজন নেই। ও অবশ্যই জানে আমি ওকে ভালোবাসি। ও সম্ভবত আমার ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করবে না।

 মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে, কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার যত গার্লফ্রেন্ড আছে তার মধ্যে কমন ডেনোমিনেটর কী? আমার উত্তরটা বেশ সহজ : আমি নিজেই। আর যখন আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম, কতটা সময় আমি সঠিক মানুষটিকে খুঁজে পেতে অপব্যয় করেছি-মেয়েমানুষ বদলে গেল। কিন্তু আমি একই রকম রয়ে গেলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছুই শিখলাম না। আমার অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিল। কিন্তু আমি সব সময় ঠিক মানুষটির জন্য অপেক্ষা করতাম। আমি সব সময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিলাম, যে কারণে আমার সম্পর্ক কখনো খুব বেশি দূর গড়ায়নি। তারপর আমার জীবনে এসথার এল। সব কিছু বদলে গেল।

আমার প্রাক্তন স্ত্রীর কথা ভাবছিলাম। ওকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আমি আর মোটও অবশেসনের মধ্যে নেই। কোনো রকম ব্যাখ্যা না দিয়েই ও আমাকে কেন ছেড়ে চলে গেল? এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ আমার বিয়ের প্রকৃত উপাখ্যান। কিন্তু সর্বোপরি তা ছিল আমার নিজের জীবনগাথা, আমি একজন মহিলাকে ভালোবাসতে পারি। এসথার কথার চেয়ে বেশি কিছু আশা করেছিল। বিশেষত আমরা একসাথে থাকাকালীন সময়ে তেমন কথাবার্তা বলিনি।

কেউ যখন শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় তখন তা জানা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। বৃত্তায়ান বন্ধ করে, দরজা বন্ধ করে, চ্যাপ্টারগুলো শেষ করে, আমরা কী বলি তা কোনো ব্যাপার নয়, এই মুহূর্তে জীবন যেভাবে শেষ করছি সেটাই ব্যাপার। ধীরে ধীরে, বুঝতে শুরু করলাম আমি ফিরে যেতে পারি না।

.

আমার বিয়ের ব্যাপারটা তুলনা করলে, সব পুরুষ আর মহিলাই বিয়ের মাধ্যমে এ রকম একটা শক্তির সাথে যুক্ত হয়, যাকে বহু মানুষ ভালোবাসা বলে ডাকে। কিন্তু পৃথিবী সৃষ্টির কাঁচামাল হিসেবেই তা প্রকৃতপক্ষে গঠন করা যায়। এই শক্তি কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমাদের সমুখপানে এগিয়ে নিয়ে চলে, আমরা সারা জীবন যা শিখেছি তা ধারণ করে। আমরা যে পথে যেতে চাই তা শেষ পর্যন্ত বেপরোয়া, হতাশাজনক হয়ে ওঠে, কারণ সেই শক্তি বুনো আর উন্মুক্ত।

 আমরা আমাদের বাকি জীবন এই বলে কাটিয়ে দিই, আমরা এই ব্যক্তি বা জিনিসকে ভালোবাসি, যখন মূল সত্যটা সামনে এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসার শক্তির গ্রহণযোগ্যতা বাদ দিয়ে নিজেদের মানিয়ে নিই।

আমি যতই এসব ব্যাপারে ভাবতে লাগলাম, জাহিরের ব্যাপারটা ততই দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। মনে মনে নিজেকে বৃহৎ কাজের জন্য প্রস্তুত করতে লাগলাম। যে কাজের জন্য আমার অনেক বেশি নীরবতা, মেডিটেশন আর অধ্যবসায় দরকার।দুর্ঘটনাটা আমার নিজেকে বুঝতে সাহায্য করেছে।

ডাক্তার লুইটের কথাগুলো মনে পড়ে গেল : এ রকম শারীরিক দুর্ঘটনার পর, মৃত্যু যেকোনো মুহূর্তে হাজির হতে পারে। ব্যাপারটা সত্য হলে কী হবে? কী হবে যদি দশ মিনিটের মধ্যে আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়?

একজন নার্স আমার কামরায় রাতের খাবার দিতে এল।

 আমি নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম : আপনি কি আপনার শেষকৃত্য সমন্ধে ভেবেছেন?

চিন্তিত হবেন না। নার্স উত্তর দিল, আপনি বেঁচে যাবেন। এরই মধ্যে আপনাকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে।

 আমি চিন্তিত নই। আমি জানি আমি বেঁচে যাব। একটা কণ্ঠস্বর আমাকে তা বলেছে।

আমি আলাদা করে কণ্ঠস্বর-এর কথা উল্লেখ করলাম। ও আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। হয়তো ভাবছিল আবার আমার আরেকটা পরীক্ষা করে দেখে আমার মস্তিষ্কে কোনো রকম আক্রান্ত হয়েছে কিনা দেখতে হবে।

জানি আমি বেঁচে যাচ্ছি। আমি বলে চললাম, সম্ভবত একদিনের জন্য, একবছরের জন্য, ত্রিশ অথবা চল্লিশ বছরের জন্য, কিন্তু একদিন, সমস্ত বৈজ্ঞানিক সুযোগসুবিধা সত্ত্বেও, আমি এই জগৎ ছেড়ে চলে যাব। আমার শেষকৃত্য হবে। এই মুহূর্তে তাই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম আপনি কখনো এ ব্যাপারে ভেবেছেন কিনা।

কখনোই না। আর আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। ব্যাপারটা সত্যিই আমাকে ভীষণ ভীত করে। আমি জানি সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে।

আপনি পছন্দ করেন আর নাই করেন, আপনি একমত হন আর নাই হোন, এই বাস্তবতাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না। এই ব্যাপারে আলাপ করার মতো সময় কী আপনার হাতে আছে?

আমাকে আরেকজন রোগী দেখতে যেতে হবে। আমি থাকতে পারছি না। নার্স বলল। খাবারটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে এ রকমভাবে চলে গেল, যেন দৌড়ে পালিয়ে বাঁচল। যেন আমার কাছ থেকে নয়, আমার কথার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচল।

নার্স হয়তো আমার কথা শুনতে চাইতে না পারে, কিন্তু এ ব্যাপারে একা একা ভাবনা চিন্তার ব্যাপারটা কেমন হবে? ছোটবেলায় শেখা একটা কবিতার কিছু লাইনের কথা মনে পড়ে গেল।

যখন অযাচিত অতিথি দুয়ারে…
আমি পেতে পারি ভয়।
আমি হয়তো হেসে বলতে পারি
আমার দিনটা ভালো গেছে, আসতে দাও রাত্রি
তুমি দেখতে পাবে চষা ক্ষেত, পরিচ্ছন্ন ঘর
 টেবিল প্রস্তুত হয়ে আছে।
আর সব কিছুই জায়গামতো।

ব্যাপারটা সত্যি হলে খুব ভালো হবে- সব কিছুই জায়গামতো। আর আমার এপিটাফ কী হতে পারে? এসথার আর আমার দুজনেরই ইচ্ছা, আরো অন্যান্য বিষয়ের মতো, আমরা আমাদের শেষকৃত্য পছন্দ করেছিলাম, আমার দেহভস্ম সান্তিয়াগোর রাস্তায় সেব্রেরো নামের একটা জায়গায় উড়িয়ে দিতে চেয়েছি। এসথার চেয়েছে ওর দেহভস্ম সমুদ্রের জলে ছড়িয়ে দিতে। তো সে কারণেই আমাদের কোনো এপিটাফ হেডস্টোন থাকবে না।

কিন্তু আমি যদি এপিটাফ লিখি, তবে কী লিখব?

আমি এ কথাগুলোই লিখতে চেয়েছি : তিনি মারা গেছেন যখন তিনি বেঁচে ছিলেন।

 কথাটা শুনতে বিপরীতমুখী মনে হতে পারে। কিন্তু আমি জানি অনেক মানুষ যারা বাঁচতে চায় না, যদিও তারা নিয়মমাফিক কাজ করে যাচ্ছে, সময়মতো খাচ্ছে, নিজেদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে। তারা সব কিছুই স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে যায়। প্রতিটি দিন অবশ্যই জাদুকরী মুহূর্ত আসে, তারা জীবনের অলৌকিকতা নিয়ে ভাবনা থামাতে পারে না। কখনো বুঝতে পারে না, পরবর্তী মিনিট তাদের জীবনের শেষ মুহূর্ত হতে পারে।

 এসব ব্যাপার নার্সকে বোঝানো অর্থহীন। তা ছাড়া রাতের খাবারের প্লেট নিতে আরেকজন নার্স এল। নার্স আমাকে প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। সম্ভবত কোনো ডাক্তার প্রশ্নগুলো করার আদেশ দিয়েছে। নার্স জানতে চাইল আমার নাম মনে করতে পারছি কিনা, এখন কোন বছর, আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নাম কী? যে জাতীয় প্রশ্ন সে করছে তাতে আমার মানসিক অবস্থা নিয়ে সন্দিহান হতে হয়।

আর তা এই কারণে যে, আমি এমন একটি প্রশ্ন করেছিলাম, যা প্রতিটি মানুষকে করা উচিত : তুমি কি তোমার শেষকৃত্যের কথা ভেবেছ? তুমি কি বুঝতে পেরেছ আজ হোক কাল হোক তুমি মারা যাবে?

সে রাতে হাসিমুখে ঘুমাতে গেলাম। জাহির আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। এসথার ফিরে আসছে। আমি যদি মারা যাই, আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, সমস্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও, যাকে ভালোবাসি সে চলে যাওয়ার পরও, যে অবিচারের মুখোমুখি হয়েছি অথবা অন্যরা হয়েছে, তারপর আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই। আমার দিনগুলো সুন্দর, রাতটাকে আসতে দাও।

.

দুই দিন পর, বাড়ি ফিরে গেলাম। মেরি লাঞ্চ তৈরিতে ব্যস্ত, আমি প্রতিনিধির সাথে যাওয়ার ব্যাপার ঝালিয়ে নিলাম। ফোন বাজছে। কেয়ারটেকার আমাকে জানাল, যে এনভেলাপের জন্য আশা করেছিলাম তা ডেলিভারি হয়েছে। আমার ডেস্কের ওপর আছে।

আমি ওকে ধন্যবাদ দিলাম। কিন্তু এত আশা করেও তার বিপরীত কাজ করলাম। ওটা খোলার জন্য কোনো ব্যস্ততা দেখালাম না। মেরির সাথে লাঞ্চে বসলাম। ওকে ওর শুটিংয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। ও আমার সম্প্রতি পরিকল্পনার কথা জানাল। গলায় এ রকম অর্থোপেডিক কলার পরে খুব বেশি বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। ও বলল, যদি দরকার হয় ও এসে আমার সাথে থাকতে পারে।

আমি কোনো কোনো কোরিয়ান টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রামে অংশ নিই। কিন্তু বেশির ভাগ সময় বন্ধ করে রাখি অথবা আমরা দুজনই একসাথে বাতিল করে দিতে পারি। সেটা অবশ্যই তুমি যদি আমার সঙ্গ চাও।

ওহ, আমি চাই। তুমি আমার আশপাশে থাকলে ব্যাপারটা ভালো হবে।

মেরি চওড়া করে হাসল। ওর ম্যানেজারকে ফোন করার জন্য ফোন তুলল। ওর কাজের ব্যাপারটার সময় পরিবর্তন করে দিতে লাগল। আমি ওকে বলতে শুনলাম, ওদের বলো না আমি অসুস্থ। আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আমি যতবারই অতীতে যখনই কোনো অজুহাত ব্যবহার করেছি, সব সময় আমার জীবনে ভয়ানক কিছু ঘটেছে। শুধু ওদের বলল যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি তার দেখভাল করছি।

বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আছে। সাক্ষাৎকারকে স্থগিত করতে হবে। যেসব আমন্ত্রণের উত্তর দেয়া দরকার দিতে হবে, বিভিন্ন মানুষের ফোন কল আর ফুলের তোড়া উপহার পাঠানোর কারণে তাদের চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানাতে হবে। মেরি সারাটা দিন আমার ফোনের কাছে আমার এজেন্ট হিসেবে কাটাল। আমার দিনপঞ্জি নতুনভাবে এমন করে সাজাল, যাতে কেউ বাদ না পড়ে। আমরা প্রতিটি রাতে একসাথে খাবার খেতাম। অন্যান্য দম্পতির মত মজাদার, বাতিল জিনিস নিয়ে কথা বলে সময় কাটাতাম। এ রকম একদিন রাতের খাবারের পর, কয়েক গ্লাস ওয়াইন পানের পর, ও লক্ষ করেছিল আমি বদলে গেছি।

দেখে মনে হচ্ছে মৃত্যুর ছোঁয়া তোমার জীবন ফিরিয়ে এনেছে। ও বলল।

প্রত্যেকের জীবনে তা ঘটে।

কিন্তু আমি অবশ্যই বলতে চাই- চিন্তা করো না, আমি কোনো রকম তর্ক শুরু করছি না। ঈর্ষান্বিত হয়ে কোনো রকম আক্রমণ করার চিন্তা করছি না- তুমি বাড়ি ফিরে এসে একবারও এসথারের নাম বলোনি। একই ব্যাপার ঘটেছিল তোমার বই এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ শেষ করার পর। বইটা তোমার জন্য একধরনের থেরাপির কাজ করেছিল। কিন্তু প্রতিক্রিয়াটা খুব বেশি দিন ক্রিয়া করেনি।

তুমি কি বলতে চাইছ দুর্ঘটনায় আমার মস্তিষ্কের ওপর আক্রান্ত হয়েছে?

আমার কণ্ঠস্বর আক্রমণাত্মক ছিল না। কিন্তু ও প্রসঙ্গ বদলাতে চাইল। তার বদলে মোনাকো থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ভয়াবহ হেলিকপ্টার ট্রিপের গল্প বলল। পরে, বিছানায়, আমরা ভালোবাসাবাসি করলাম, যদিও অর্থোপেডিক কলারের কারণে সমস্যা হচ্ছিল; কিন্তু এর পরও আমাদের ভালোবাসাবাসির কমতি ছিল না।

 চার দিন পরে, আমার ডেস্ক থেকে এক গাদা চিঠিপত্র সব কমে এল। শুধু বড় একটা খাম, যার ওপরে আমার নাম আর অ্যাপার্টমেন্ট নাম্বার লেখা তাই পড়ে রইল। মেরি ওটা খুলতে চাইছিল, কিন্তু আমি অপেক্ষা করতে বললাম।

মেরি ওই এনভেলাপের ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। সম্ভবত ভেবে নিয়েছে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা আরো গোপনীয় কোনো সংবাদদাতার, সম্ভবত কোনো মহিলার কাছ থেকে পাঠানো কিছু। আমিও ওকে কিছু ব্যাখ্যা করলাম না। খুব সাধারণভাবে প্যাকেটটা ডেস্ক থেকে সরিয়ে শেলফে অন্যান্য বইয়ের মাঝে রাখলাম। আমি ওই প্যাকেটের দিকে তাকালে, জাহির ফিরে আসবে।

কোনোভাবেই আমার মনের মধ্য থেকে এসথারের প্রতি ভালোবাসা কমেনি, কিন্তু হাসপাতালে কাটানো প্রতিটি দিন আমার স্মৃতিকে উসকে দিত, আমাদের মধ্যের কথোপকথনই শুধু নয়, আমরা যেসব মুহূর্ত নীরবে কাটিয়েছি সেগুলোও। আমি ওর চোখের ভাষা স্মরণ করতে পারি, যা ওর অন্তরাত্মার প্রতিচ্ছবি। যখনই ও কোনো নতুন অ্যাডভেঞ্চারে মত্ত হয়ে উঠত, ওকে তখন প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরুণীর মতো মনে হতো, অথবা স্বামীর সাফল্যে গরবিনী স্ত্রী, অথবা এ রকম একজন সাংবাদিক, যে তার প্রতিটি লেখার সাথে পরিচিত। পরে, ও এ রকম একজন স্ত্রী, আমার জীবনে যার কোনো স্থান নেই। যুদ্ধের সাংবাদিক হওয়ার আগে ওর চোখে আমি ও রকম বিষাদ দেখেছি। প্রতিবারই ও যখন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট থেকে ফিরে আসত, খুব আনন্দের ব্যাপার হতো। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু কয়েকটা দিনের, তারপর বিষাদ ফিরে আসত।

একদিন সন্ধ্যেয়, ফোন বেজে উঠল।

 সেই তরুণটি, মেরি ফোন আমার হাতে দিল।

অন্য প্রান্তে মিখাইলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমার দুর্ঘটনার খবর শুনে কতটা দুঃখিত হয়েছে জানাল। তারপর জিজ্ঞেস করল আমি এনভেলাপ গ্রহণ করেছি কিনা।

হ্যাঁ, আমার কাছেই আছে।

আপনি কি ওকে খুঁজতে যাবেন?

 মেরি আমাদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিল। আমার মনে হলো প্রসঙ্গ বদলে ফেলাই ভালো।

আপনার সাথে দেখা হলে আমরা কথা বলতে পারি।

আমি আপনাকে কোনো রকম বিরক্ত বা কোনো কিছু করছি না। কিন্তু আপনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আমাকে সাহায্য করবেন।

 মিখাইল ওর সেলফোন নাম্বার দিল। আমি মেরির দিকে তাকিয়ে ওকে অন্যরূপে দেখলাম।

তো কোনো কিছুই বদলে যায়নি। মেরি বলল।

 বিপরীতভাবে, সব কিছু বদলে গেছে।

আমার নিজেকে আরো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার যে আমি এখনো এসথারকে দেখতে চাই। আমি এখন জানি, ও কোথায় আছে। যখন ঠিক সময় আসবে, আমি ট্রেন, ট্যাক্সি, প্লেন অথবা যা ওর কাছে নিয়ে যায় তাতেই উঠে পড়ব। তার মানে এই মুহূর্তে আমার পাশে যে মহিলাটি আছে তাকে হারাব, যদিও ও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে ওর জীবনে আমি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

আমি অবশ্যই একজন কাপুরুষ। নিজের ওপরই লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু জীবনটা এ রকমই। আমি সত্যিই ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আমি মেরিকেও ভালোবাসি।

আরেকটা কারণ সমন্ধে আমি খুব বেশি কিছু বলতে পারছি না। আমি সব সময় সাইনে বা চিহ্নে বিশ্বাস করি। যেসব মুহূর্ত আমি আমার স্ত্রীর সাথে নীরবে কাটিয়েছি তার কথা স্মরণে এল। কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়াই বুঝতে পারলাম- এসথারকে খোঁজ করার মুহূর্তটা এখনো আসেনি। আমার আরো বেশি নীরবতার ওপর মনোযোগ দেয়া উচিত। কারণ তাহলে আমি বুঝতে পারব কখন আমাদের মধ্যে ঠিক সময় উপস্থিত হবে।

মেরি ওখানে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। যে আমার জন্য এতটা করেছে তার প্রতি কি আমি অবিচার করতে পারি? আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আমি ওকে সব কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার অনুভূতি অন্য কোনোভাবে ওকে বোঝাতে হবে।

মেরি, মনে করো দুজন ফায়ারম্যান জঙ্গলে ছোট্ট একটু আগুন জ্বালাতে গেল। তারপর, তারা যখন একটা ঝর্ণার কাছে গেল, একজনের মুখ পুরোপুরি কালো কালিতে ঢেকে গেল, আরেকজনের মুখ পরিষ্কার রয়ে গেল। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, ওই দুজনের মধ্যে কে মুখ পরিষ্কার করবে?

 খুব সিলি প্রশ্ন। যার মুখ ময়লা কালো হয়েছে, অবশ্যই সে করবে।

না, যার মুখ ময়লায় ঢেকে গেছে সে অন্যের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হবে তার মুখও বন্ধুর মুখের মতো পরিষ্কার আছে। অন্যদিকে, পরিষ্কার মুখের অধিকারী তার কলিগের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাববে আমার মুখটাও নিশ্চয় ও রকম ময়লা হয়েছে, আমার মুখটা পরিষ্কার করা উচিত।

 তুমি কী বোঝানোর চেষ্টা করছ?

আমি বলতে চাইছি, যে সময়টা হাসপাতালে কাটিয়েছি, আমি বুঝতে পেরেছি আমি সব সময় যে মহিলাকে ভালোবাসি তাকেই খোঁজ করেছি। আমি ওদের সুন্দর, পরিষ্কার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মুখটার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি। ওরা, অন্যদিকে, আমার দিকে তাকিয়ে আমার ময়লা মুখটা দেখেছে, যতটা বুদ্ধিমতী অথবা আত্মবিশ্বাসী ওরা হোক না কেন, ওরা শেষ পর্যন্ত মনে করে আমার মুখের মতো ওদের মুখেও ময়লা লেগে আছে, আর নিজেদের আরো খারাপ ভেবেছে। দয়া করে, তোমার ক্ষেত্রেও অমনটি হতে দিও না।

আমি আরো যোগ করতে চাইলাম : এসথারের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল? আমি তখনই শুধু বুঝতে পেরেছিলাম। মনে পড়ছে ওর চোখের দৃষ্টি কেমনভাবে বদলে গিয়েছিল। আমি সব সময় ওর জীবন, ওর প্রাণশক্তিকে শুষে নিয়েছি। আমাকে তা সুখী আর আত্মবিশ্বাসী করেছে, সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে, ও আমার দিকে তাকিয়ে নিজেকে কুৎসিত ভেবেছে কারণ, এতগুলো বছর ধরে ও আমার ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছে। আমাদের সম্পর্কটাকে দ্বিতীয় স্তরে নামিয়ে দিয়েছে।

আমি যদি আবার ওকে দেখতে পাই, আমার মুখটাও ওর মুখের মতো পরিষ্কার হওয়া দরকার। ওকে খুঁজে পাওয়ার আগে, আমার অবশ্যই নিজেকে খুঁজে পেতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *