১. আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান

দ্য জাহির / মূল : পাওলো কোয়েলহো / অনুবাদ : প্রিন্স আশরাফ

অনুবাদকের উৎসর্গ

শতাব্দী জাহিদ
 প্রিয় বন্ধু,
 প্রিয় সুজন

.

ইথাকা (রূপকথার রাজ্য)

যখন তুমি ইথাকা ভ্রমণের কথা চিন্তা করবে,
প্রার্থনা করবে কারণ তোমার পথ অনেক দীর্ঘ,
 দুঃসাহসিকতায় পূর্ণ, জ্ঞানময়।
লেস্ট্রাইগনিয়ান্স ও সাইক্লোপস রূপী দৈত্য,
ভয়াল ক্রোধান্বিত, এগুলোকে ভয় পেও না,
তোমার পথে কখনও এরূপ খুঁজবে না,
যদি তোমার চিন্তা উদার হয়, যদি তোমার আবেগ
 ছুঁয়ে যায় তোমার হৃদয় ও দেহকে।
 লেস্ট্রাইগনিয়ান্স ও সাইক্লোপস্ রূপী দৈত্য
এরা কখনই তোমার প্রতিপক্ষ হবে না,
যদি তুমি কখনই তোমার আত্মায় এদেরকে ধারণ না কর,
যদি তোমার হৃদয়ে এদের স্থান না হয়,
তবে তুমি আগের মত নিরাপদ!

প্রার্থনা কর কারণ তোমার পথ অনেক দীর্ঘ।
গ্রীষ্মের অনেক সকাল আছে এরূপ, যখন
তোমাকে আনন্দ ও বিনোদনের জগতে নিয়ে যায়
যা তুমি অনুভব কর জীবনে প্রথম;
আমি তোমাকে এরূপ সুসংবাদ দেব।
ফোয়নিসিয়ান মার্কেটে দাঁড়াও,
 এবং ক্রয় কর মুক্তাখচিত সামুদ্রিক সৌন্দর্যময় জিনিসপত্র
এবং শারীরিক প্রেষণাদায়ী সুগন্ধিসহ নানা সামগ্রী
তুমি যত পার এই রূপ প্রেষণাদায়ী সুগন্ধিসহ নানা সামগ্রী নিতে পার,
প্রয়োজনে তুমি বিজ্ঞজনের থেকে শিক্ষাগ্রহণের জন্য অনেক মিশরীয় শহর
 ভ্রমণ কর,
সর্বদা তোমার মনে ইথাকাকে ধারণ কর,
সেখানে পৌঁছার জন্য এটাই তোমার একমাত্র লক্ষ্য।
 কিন্তু এই ভ্রমণে তুমি কোন তাড়াহুড়া কর না।
 বিলম্ব করাই তোমার জন্য উত্তম হবে, কারণ পরবর্তী সময়ে
দীর্ঘদিন তোমার স্মৃতিতে তা বহাল থাকবে।
 এবং অর্জন ও প্রাপ্তিই তোমার সঙ্গী যখন তুমি বৃদ্ধ।
 তোমার চলার পথের সমস্ত অর্জনকে মহৎ করে দাও,
 তুমি এটা প্রত্যাশা কর না যে, ইথাকা তোমাকে পরিপূর্ণ করে দেবে।
ইথাকা তোমাকে এক চমকপ্রদ ভ্রমণ উপহার দিয়েছে।
 ইথাকা ছাড়া তুমি কখনও এ পথে তোমাকে পরিচালিত করতে পারবে না।
 যদিও বাস্তব অর্থে সে তোমাকে কিছুই দেয়নি।
 এবং যদি তুমি তাকে দরিদ্র দেখ, ইথাকা তোমাকে বঞ্চিত করবে না,
 যদি তুমি জ্ঞানী হও, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন কর,
 তাহলে ইতোমধ্যেই তুমি বুঝতে পেরেছ ইথাকা কী?

–কনস্টানটাইন ক্যাভাফি
 (১৮৬৩-১৯৩৩)
 Translated by Reo-Dalven

.

লেখকের উৎসর্গ

গাড়িতে বসে আমার বইয়ের প্রথম খসড়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম। পরে পাইরিনিস পর্বতমালায় একত্রে আহরণের সময়ে আমরা দুজনেই কিছু অসাধারণ মুহূর্তের কথা শেয়ার করেছিলাম। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ও আমার বইয়ের থিম অথবা নাম জানতে চায় কিনা। ও ব্যাপারটা পছন্দ করে, কিন্তু আমার লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলল না।

তো আমি ওকে নাম ও ঘটনা বললাম। আমরা নিরবে হাঁটতে লাগলাম। ফেরার পথে বাতাসের শব্দ শুনতে পেলাম। পত্রহীন বৃক্ষগুলো আমাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। পর্বতমালা আরো একবার জাদুকরী শক্তি উন্মোচিত করল। হঠাৎ করে তুষারপাত হতে শুরু করল। আমি থমকে দাঁড়ালাম। তুষারপাতের অপূর্ব দৃশ্যের সময় ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে। যাকে আমি ভালবাসি সবসময় আমার পাশে।

আমার মনে হলো ব্যাপারটা ওকে বলি। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম বইটা প্রথমবার ও পড়েই আবিষ্কার করুক।

এই বইটি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ক্রিস্টিনাকে উৎসর্গীকৃত।

.

লেখক জর্জ লুইস বোর্জ (Jorge Luis Borges)-এর মতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে জাহিরের ফিরে আসার ইসলামিক ঐতিহ্য, চিন্তাধারা ও সমৃদ্ধির কিছু বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। জাহির আরবী শব্দ, যার অর্থ : দৃশ্যত, উপস্থিত, প্রত্যক্ষ করা যায় এমন কিছু।

এটা কোন ব্যক্তি বা বস্তুবিশেষ, আমরা যার সংস্পর্শে আসি; যা প্রতিনিয়ত আমাদের সকল চিন্তাকে সমৃদ্ধ করে। যতক্ষণ না আমরা কিছু চিন্তা করছি-আমাদের সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয় না।

এটা ভাবা যেতে পারে যে, এটা একটা পবিত্র জায়গা অথবা পাগলামীর স্থান।

–ফাওবোর্জ সেইন্ট পেরিস
 চমকপ্রদ বিশ্বকোষ-(১৯৫৩)

.

.

আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান

ওর নাম এসথার। এসথার যুদ্ধের সংবাদদাতা। সম্প্রতি ও ইরাক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে। কারণ ওই দেশ আসন্ন আক্রমণের শিকার হতে চলেছে। এসথারের বয়স ত্রিশ। বিবাহিত। কোনো সন্তানাদি হয়নি। ওর সাথের ব্যক্তিটি একজন সাধারণ মাপের অপরিচিত পুরুষ। বয়স তেইশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হতে পারে। বেশ গাঢ় মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের। ওদের দুজনকে সর্বশেষ রু ড্য ফিওবার্গ সেইন্ট-হনরির ক্যাফেতে দেখা গিয়েছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, ওরা দুজন এর আগেও দেখা করেছে। যদিও কেউ জানে না কতবার। এসথার সব সময় বলে এসেছে- মানুষটা সত্যিকারের পরিচয় মিখাইল নামের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে-ব্যাপারটা ওর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এসথার কখনো বুঝিয়ে বলেনি ওই মানুষটা ওর কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ, জার্নালিস্ট হিসেবে এসথারের ক্যারিয়ারের জন্য, নাকি একজন নারীর কাছে পুরুষের গুরুত্বের জন্য।

পুলিশ রুটিনমাফিক ইনভেস্টিগেশন শুরু করল। কয়েকটা থিওরি সামনে দাঁড় করাল-অপহরণ, ব্ল্যাকমেইল। এ রকম অপহরণ, যার পরিণতি শেষ হয়েছে মৃত্যুতে কোনো কিছুর সম্ভবনাকে তারা উড়িয়ে দিচ্ছে না। এসখারের কাজের ধরনের কারণে অনেক রকম লোকজনের সাথে তাকে ওঠাবসা করতে হয়। তার মধ্যে অনেকের আবার টেররিস্ট গ্রুপের সাথে যোগাযোগ ছিল। ওরা খুঁজে পেয়েছে, এসথারের অন্তর্ধানের আগের সপ্তাহে, নিয়মিতভাবেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা এসথারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। তদন্তের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের ধারণা, এসব টাকা তথ্য সংগ্রহের পেমেন্ট হিসেবে ব্যয় করা হয়েছে। এসখারের কাপড়চোপড় যে রকম ছিল সে রকমই আছে। কিন্তু ব্যাপারটা যথেষ্ট অদ্ভুত, এসথারের পাসপোর্ট কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 পুরুষটি অপরিচিত অধিবাসী। বয়সে অনেক তরুণ। কোনো রকম পুলিশি রেকর্ড নেই। পরিচয় শনাক্তকরণের কোনো সূত্রও নেই।

মেয়েটি এসথার। বছর তিরিশেক বয়স। সাংবাদিকতার জন্য দুবার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। বিবাহিত।

আমার স্ত্রী।

.

প্রথমেই সন্দেহের তালিকায় আমি পড়ে গেছি। ওরা আমাকে আটকে রেখেছে। কারণ এসথারের অন্তর্ধানের রাতে কোথায় ছিলাম তা জানাতে অস্বীকার করেছি। যাই হোক, একজন প্রিজন অফিসার এইমাত্র আমার জেলকুঠুরির দরজা খুলে দিয়ে জানিয়ে দিল, আমি একজন মুক্ত মানুষ।

কেন আমি একজন মুক্ত মানুষ? কারণ এখানকার দিনে, একে অন্যের ব্যাপারে সব কিছুই জানে। তুমি শুধু প্রশ্ন করতেই তথ্য পেয়ে যাবে। তুমি কোথায় তোমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছ, কোথায় সময় ব্যয় করেছ, তুমি কার সাথে রাত কাটিয়েছ, সব তথ্যই জমা হয়ে আছে। আমার কেসে, ব্যাপারটা আরো সহজ। আরেকজন জার্নালিস্ট মহিলা, আমার স্ত্রীর ডির্ভোসী বান্ধবী যার সাথে আমার রাত কাটানোর ব্যাপারটা প্রকাশ পায়। মহিলা কিছু মনে করেনি। ও আমার আটকের ব্যাপারে জানতে পেরে তখনই এগিয়ে এসে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। এসথারের অন্তর্ধানের সময় তার সাথে আমার গোটা রাত কাটানোর ব্যাপারে বাস্তবধর্মী প্রমাণ হাজির করেছিল।

আমি চিফ ইনস্পেক্টরের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি আমার জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে ক্ষমা চাইলেন। সেই সাথে যোগ করলেন, এ রকম তড়িৎ আটকে রাখার গোটা ব্যাপারটা আইনের খাতিরেই। তা ছাড়া আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার আর কোনো যুক্তি নেই। তাকে জানালাম, এই ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই। আমি জানি, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য তত্ত্বাবধায়নে রাখাটা জায়েজ আছে। এমনকি আমরা যদি কোনো রকম অপরাধ নাও করে থাকি।

‘আপনি এখন পুরোপুরি মুক্ত।’ চিফ ইনস্পেক্টর বললেন। প্রিজন অফিসারের একই কথা প্রতিধ্বনিত করলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম : ব্যাপারটা কি এ রকম হতে পারে না, আমার স্ত্রীর ভাগ্যে সত্যিই কিছু ঘটেছে? এসথার একবার আমাকে বলেছিল- টেররিস্ট আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে তার ব্যাপক যোগাযোগ থাকার কারণে, ওর প্রায়ই মনে হয় ওকে অনুসরণ করা হচ্ছে।

ইনস্পেক্টর অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইলেন। আমি জোর দিয়ে বললাম। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এসথার ওর পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করতে যেতে পারে কিনা। তিনি বললেন, অবশ্যই পারে, যত দিন পর্যন্ত না উনি কোনো অপরাধ করছেন। ও কেন আমাকে ছেড়ে দেশে স্বাধীনভাবে প্রবেশ করল না?

 ‘তো ও এখন আর ফ্রান্সে নাও থাকতে পারে?’

‘আপনার কি মনে হয়, উনি আপনাকে ছেড়ে চলে গেছেন, কারণ আপনি আরেকজন মহিলার সাথে রাত কাটিয়েছিলেন?’

সেটা আপনার দেখার বিষয় নয়, আমি উত্তর দিলাম। ইনস্পেক্টর মুহূর্তের জন্য থামলেন। এবার বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, নিয়মমাফিক প্রক্রিয়া হিসেবে আপনাকে অ্যারেষ্ট করেছিলাম। কিন্তু তাকে আমার স্ত্রীর অন্তর্ধানের ব্যাপারে খুব একটা দুঃখিত মনে হলো না। ইনস্পেক্টর নিজেই বিবাহিত জীবনযাপন করেন। যদিও তিনি আমার বই পছন্দ করেন না (তো ইনস্পেক্টরকে যতটা অশিক্ষিত দেখায় ততটা নয়! আমি কে তা সে জানে!) তিনি নিজে আমার জুতা পরিয়ে দিতে পারেন। কল্পনা করতে পারেন আমি অবশ্যই চলে যাব।

এরপর আমি কী করব সে ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি তার কার্ড আমাকে দিলেন। তার সাথে যোগাযোগ রাখতে বললেন। স্ত্রীর ব্যাপারে কিছু জানতে পারলে সাথে সাথে জানাতে বললেন। আমি ডজনখানেক মুভিতে এ রকম দৃশ্য দেখেছি। আমি প্রভাবিত হলাম না। ইনস্পেক্টররা সব সময় তারা যা করে তার চেয়ে অনেক বেশি জানে।

 ইনস্পেক্টর জিজ্ঞেস করলেন, এসথারের সাথে সর্বশেষ যখন আমার দেখা হয়েছিল, তখন ওই ছেলেটি তার সাথে ছিল কিনা অথবা আমি কখনো ওকে দেখেছি কিনা। আমি বললাম, ওই ছেলেটার কোড নেম জানি কিন্তু ওকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না।

 তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের মধ্যে কোনো পারিবারিক সমস্যা ছিল কিনা। আমি তাকে বললাম, আমরা দশ বছর ধরে একসাথে ঘরসংসার করছি। আর অধিকাংশ বিবাহিত দম্পত্তিদের মধ্যে যে রকম টুকিটাকি সমস্যা হয়। সে রকম সমস্যা- এর বেশি কিছু নয়।

 তিনি খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের মধ্যে ডিভোর্সের ব্যাপারে সম্প্রতি কোনো আলোচনা হয়েছিল কিনা, অথবা আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এ রকম কিছু বলেছিল কিনা। আমি তাকে বললাম, আমরা কখনো এ রকম সম্ভবনা নিয়ে আলাপও করিনি। আবারও বললাম, সব দম্পত্তির মতো আমাদের মাঝে মাঝে মতোনৈক্য হতো।

প্রায়ই, নাকি শুধুই মাঝে মাঝে?

মাঝে মাঝে, আমি বললাম।

তিনি এখন আরো ভদ্রভাবেই জানতে চাইলেন, এসখারের বান্ধবীর সাথে আমার যে অ্যাফেয়ার চলছে তা আমার স্ত্রী সন্দেহ করেছিল কিনা। আমি তাকে বললাম, সেটাই প্রথম এবং শেষবার। আমি ওর বান্ধবীর সাথে একত্রে রাত কাটিয়েছিলাম। ব্যাপারটা কোনো অ্যাফেয়ার নয়। খুব সাধারণভাবেই তা ঘটে গিয়েছিল, কারণ আমাদের আর কিছু করার ছিল না। খুব খারাপ একটা দিন ছিল। আমাদের দুজনেরই লাঞ্চের পরে সময় কাটানোর মতো উপভোগ্য কিছু ছিল না। আর এ রকম শারীরিক প্রলোভন সব সময় জীবনের আনন্দে একটুখানি নতুনত্ব যোগ করে, যা আমরা বিছানায় উদ্দাম সঙ্গমের মাধ্যমে শেষ করেছিলাম?

আপনি যে কারো সাথে বিছানায় যেতে পারেন, কারণ দিনটা খুব খারাপ ছিল।

আমি তাকে বলতে পারতাম, এ জাতীয় বিষয় ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে খুব কমই কাজে আসবে। কিন্তু ইনস্পেক্টরের সাহায্য আমার দরকার। হয়তো পরেও সাহায্য লাগতে পারে। যাই হোক, সর্বোপরি, সেই অদৃশ্য সংস্থা যাকে ফেভার ব্যাংক বলা হয়, আমি সব সময় খুব উপকারী হিসেবে পেয়েছি।

হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এ রকমই মনে হয়। আর কোনো কিছুই মজাদার উপভোগ্য ছিল না। মেয়েটা উত্তেজনার বিষয় খুঁজছিল। আমি অ্যাডেভেঞ্চারের স্বাদ নিতে চাইছিলাম। আর ওভাবেই ঘটে গেল। পরের দিন, আমরা দুজনই এ রকম ভান করতে লাগলাম যেন কিছুই হয়নি। জীবন আগের মতোই চলতে লাগল। তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। হাত বাড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তার জগতে সব কিছু এত সহজভাবে ঘটে না। স্বাভাবিকভাবেই, বিরক্তি আর ক্লান্তির মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। তারও যে কারো সাথে রাত কাটানোর আকাঙ্ক্ষা হয়। কিন্তু সব কিছুই অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। কেউ তাদের ভাবনাচিন্তা বা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে পারে না।

 সম্ভবত শিল্পীদের অনেক বেশি স্বাধীনতা আছে। তিনি মন্তব্য করলেন।

আমি বলতে চাইলাম, আমি তার জগতের সাথে পরিচিত। কিন্তু সমাজ আর জনতা নিয়ে তার আর আমার মধ্যে যে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি সে ব্যাপারে তুলনা করার ইচ্ছা নেই। আমি চুপ করে গেলাম। পরের প্রসঙ্গের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

 স্বীধানতার কথা বলছিলাম, তিনি বললেন। একজন পুলিশ অফিসারের সাথে একজন লেখকের ডিবেট রিফিউজ করার জন্য উনি হতাশ হয়ে পড়লেন। আপনি এখন মুক্ত। এখন যেহেতু আমাদের দেখা হয়েছে, আমি আপনার বই পড়ব। আমি জানি, বলেছিলাম আমি ওগুলো পছন্দ করি না। কিন্তু ঘটনা হলো, আমি প্রকৃতপক্ষে ওর একটাও পড়ে দেখিনি।

এই জাতীয় কথা যে আমি এই প্রথম শুনলাম বা এই শেষ তা নয়। অন্ততপক্ষে এই ঘটনায় আমি আরেকজন পাঠক লাভ করেছি। হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এলাম।

.

আমি মুক্ত। আমি জেলখানার বাইরে। আমার স্ত্রী রহস্যময় পরিস্থিতিতে হারিয়ে গেছে। আমার কাজের নির্দিষ্ট কোনো টাইমটেবল নেই। নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। আমি ধনী। বিখ্যাত। যদি সত্যিই এসথার আমাকে ছেড়ে চলে যেত, আমি খুব তাড়াতাড়িই তার জায়গায় অন্য আরেকজনকে নিয়ে আসতাম। আমি মুক্ত। স্বাধীন।

কিন্তু স্বাধীনতা কী?

আমি আমার জীবনের একটা বড় অংশ এক জিনিস থেকে অন্য জিনিসের দাসত্ব করে কাটিয়েছি। তো আমার এই শব্দটার মানে জানা উচিত। এমনকি সেই ছোটবেলা থেকে, সেই শৈশবকাল থেকে, স্বাধীনতাটাকে আমার সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হিসেবে দেখেছি। আমি আমার বাবা মায়ের সাথে বুঝেছি, ওরা আমাকে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চেয়েছিল, কোনো লেখক হিসেবে নয়। আমি স্কুলে অন্য বালকদের সাথে লড়াই করেছি, যারা খুব তাড়াতাড়িই তাদের নিষ্ঠুর রসিকতায় আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। নাক থেকে অনেক রক্তপাতের পর, অনেক সন্ধেয় মায়ের কাছ থেকে আমার ক্ষতচিহ্নগুলো লুকিয়ে গেছি। কারণ আমার সমস্যা আমাকেই সমাধান করতে হবে, মাকে নয়। আমি অনেক কষ্টে তাদের বোঝাতে চেয়েছি, কোনো রকম কান্নায় ভেঙে পড়া ছাড়াও আমি সব কিছু ম্যানেজ করতে পারি। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে একটা চাকরির জন্য লড়াই করে গেছি। একটা হার্ডওয়্যার স্টোরে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করে গেছি। যাতে আমার পরিবারের ব্ল্যাকমেইল করার সেই প্রচলিত লাইনটা থেকে মুক্ত হতে পারি, আমরা তোমাকে টাকা পয়সা দেব কিন্তু তোমাকে এই এই করতে হবে।

 আমি লড়াই করে গেছি- যদিও তেমন কোনো সাফল্য আসেনি। সেই মেয়েটির জন্য লড়াই করে গেছি, কৈশোর পেরোতেই ওর প্রেমে পড়েছিলাম আর ও আমাকে ভালোবেসেছিল। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। কারণ তার বাবা–মা তাকে বুঝিয়েছিল, আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি সাংবাদিকতার শত্রুতাপূর্ণ জগতের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছি। জার্নালিজম আমার পরের চাকরি। ওখানে আমার প্রথম বস পুরো তিন ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার পরও যখন আমার দিকে কোনো লক্ষ করে না, তখন আমি আরেকটু হলেও বস যে বইটা পড়ছিল তা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে শুরু করেছিলাম। তিনি আমার দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকালেন। দেখলেন একজন ভালো রিপোর্টার হওয়ার জন্য অধ্যবসায় এবং রাগ দমন করতে আমি কতটুকু সমর্থ হয়েছি। আমি সামাজিক আদর্শের জন্য লড়াই চালিয়ে গেলাম। আমাকে সে জন্য জেলে যেতে হলো। বেরিয়ে এসে আবার লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলাম। নিজেকে একজন ওয়ার্কিংক্লাস হিরোর মতো লাগছিল। যত দিন পর্যন্ত না বিটলসের কথা জানতে পেরেছি। বুঝতে পারলাম, রক মিউজিক কার্ল মার্কসের চেয়ে অনেক বেশি মজার জিনিস। আমি আমার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্ত্রীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে গেলাম। আমার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্ত্রী যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেল তখন তা মেনে নেয়ার সাহসটুকু সঞ্চয় করার জন্য লড়াই করে গেলাম। কারণ ওদের প্রতি আমার যে ভালোবাসা ছিল তা কখনো পরিপূর্ণ ছিল না। আমার এগিয়ে যাওয়া দরকার। অন্তত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দরকার যে আমাকে চাইছে আমার আগের তিনজন স্ত্রীর মধ্যে কেউ না।

সংবাদপত্রের চাকরি ছেড়ে দেয়ার মতো সাহস অর্জন করার জন্য লড়াই করতে লাগলাম। বই লেখার মতো অ্যাডভেঞ্চারের সাথে নিজেকে নিয়োজিত করতে চাইলাম। আমাদের দেশে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়ে এখনো কেউ বাস করেনি। বছরখানেক পরে আমি লেখালেখি থেকে বিরত থাকলাম। তত দিনে আমি হাজারখানক পাতা লিখে ফেলেছি। সেই পাতায় এত পাণ্ডিত্য ফলিয়ে ফেলেছি, যা এমনকি আমি নিজেও বুঝতে পারতাম না।

আমি যখন এ রকমভাবে নিজের সাথে যুঝে চলেছি, তখনই শুনতে পেলাম লোজন স্বাধীনতার কথা বলছে। তারা যতই এই অসাধারণ সত্যটাই উপনীত হয়, ততই তারা তাদের বাবা-মায়ের ইচ্ছার কাছে নিজেদের জলাঞ্জলি দেয়। বিবাহিত জীবনে এসে তারা প্রতিজ্ঞা করে বাকি জীবন একে অন্যের সাথে থাকবে। তারা নানান বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করে। তাদের ডায়েট, অর্ধ-সমাপ্ত প্রজেক্ট, সেই সব প্রেমিকা, যাদের তারা কখনো না বলতে পারে না, বলতে পারে না সব শেষ হয়ে গেছে। সপ্তান্তে তারা যেসব মানুষকে পছন্দ করে না তাদের সাথে লাঞ্চ করতে বাধ্য হয়। জীবনের দাসত্ব করা তারা বেছে নেয়নি, কিন্তু তারা এই জীবন যাপন করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ কেউ একজন তাদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছে, এটাই সবচেয়ে ভালো। তো তাদের আদর্শগত দিন-রাতগুলো অতিবাহিত হয়। তারা সেই সব অ্যাডভেঞ্চারের কথা বইয়ের পাতা অথবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে, তা দেখেই চলে। যখন একটা দরজা খুলে যায়, তাদের বলতে শোনা যায়,

আমি আগ্রহী নই। আমার এখন মুড নেই।

তারা চেষ্টা না করলে জানতে পারবে কী করে যে তাদের মুড আছে কি না? কিন্তু সেই সব কথা জিজ্ঞেস করা যাবে না। সত্যটা হলো, তারা যে জগতে বেড়ে উঠেছে, তার একটু এদিক-ওদিক হলেই তারা ভয় পায়।

ইনস্পেক্টর বলেছেন, আমি মুক্ত। আমি এখন মুক্ত। আমি জেলখানা থেকেও মুক্ত, কারণ স্বাধীনতা জগতের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। অবশ্যই, আমাকে এ রকম ওয়াইন পান করাতে পারে, যা আমার পছন্দ নয়। এ রকম জিনিস করতে হবে, যা আমি করতে চাই না। আমার দেহ-মনের ওপর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। আমি সেই যন্ত্রণাকাতর সময়ের জন্য দুঃখ করি না। আমি এই ক্ষতচিহ্নকে মেডেলের মতোই বহন করে চলি। আমি জানি, স্বাধীনতার মূল্য অনেক। এত উচ্চমূল্যে তা কিনতে হয়, যেন তা দাসত্বের পর্যায়ে পড়ে। শুধু পার্থক্যটা হলো, তুমি আনন্দ আর হাসির সাথে তার মূল্য পরিশোধ করো, তা সেই হাসিতে কান্না ঝরে পড়লেও।

.

পুলিশ স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে সুন্দর ঝলমলে দিন। রৌদ্রকরোজ্জ্বল রবিবার। তাতে আমার মনের ভাবগতিক দূর হলো না। আমার আইনজীবী বাইরে আমার জন্য সান্ত্বনাসূচক শব্দ আর একগুচ্ছ ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বললেন, তিনি আশপাশের সমস্ত হাসপাতাল আর মর্গে ফোন করেছিলেন (কেউ বাড়িতে না ফিরলে আপনিও ঠিক এমনটি করেন) কিন্তু এখনো এসখারকে পাওয়া যায়নি। তিনি জানালেন, তিনি সাংবাদিকদের ম্যানেজ করে ফেলেছেন, আমি কোথায় ছিলাম এই জিনিসটা জানতে দেননি। তিনি বললেন, তার আমার সাথে কথা বলা দরকার। কয়েকটা লিগ্যাল স্ট্রাটেজি ঠিক করে রাখতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আমার বিরুদ্ধে আর কোনো দোষ আরোপ না করা হয়। এই সমস্ত ঝামেলা মেটানোর জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম। আমি জানি, তিনি একটা লিগ্যাল স্ট্রাটেজি ঠিক করার জন্য ততটা আগ্রহী নন। তিনি শুধু আমাকে একা ছাড়তে চাইছিলেন না। কারণ তিনি নিশ্চিত নন, আমি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই। (আমি মাতাল হয়ে আবার অ্যারেস্ট হতে পারি? আমি কি কোনো স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়তে পারি? আমি কি আত্মহত্যার চেষ্টা করব?) আমি তাকে জানালাম, আমার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। আমরা দুজনই জানি, আইনের ব্যাপারে আমি কতটা দ্বিধাহীন। তিনি জোর দিয়ে কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু আমি তাকে কোনো সুযোগ দিলাম না। যাই হোক, আমি একজন মুক্ত মানুষ।

 স্বাধীনতা। স্বাধীনতা চরম হতাশাজনকভাবেই একা।

আমি প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আর্ক ডি ট্রিয়োম্পিতে যেতে বললাম। আমি চ্যাম্পস-ইলিসিসের থেকে হোটেল ব্রিস্টলে গেলাম, এখানে এসথার আর আমি সব সময় বাইরের কোনো ট্রিপ থেকে ফিরে এলে হট চকোলেট খেয়ে থাকি। এটাই আমাদের হোম-কামিং রীতি। আমাদের ভালোবাসাকে আরো দৃঢ়বন্ধনে আবদ্ধ করে।

আমি হাঁটতে থাকলাম। লোকজন হাসছে। বাচ্চারা বেশ হাসিখুশি। শীতের মাঝামাঝি এই কয়েক ঘণ্টা যেন বসন্ত উৎসব পালন করছে। যানবাহন ইচ্ছামতো চলাচল করছে। সব কিছুই বেশ নিয়মমাফিক মনে হয় শুধু কেউ জানে না আমি আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি। তারা এমনকি জানার ভানও করছে না। তারা এর পরোয়া করে না। আমার বুকের মধ্যে যে কষ্ট তা কি তারা বুঝতে পারছে না? তাদের সবারই দুঃখিত হওয়ার কথা। সহানুভূতি দেখানো উচিত। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে তাকে সান্ত্বনা দেয়া উচিত। কিন্তু তারা হাসিতে ফেটে পড়ছে। তাদের দুঃখপূর্ণ ছোট্ট জীবনটাকে উইকএন্ডের আনন্দে ভুলে থাকতে চায়।

কি হাস্যকর চিন্তাভাবনা! আমাদের পাশ দিয়ে যেসব মানুষ চলেছে তাদের অনেকের আত্মাই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে আছে। তারা কেমন কষ্ট ভোগ করছে সে সমন্ধে আমার কোনো ধারণাই নেই।

আমি একটা বারে ঢুকে কয়েকটা সিগারেট কিনলাম। লোকটা আমাকে ইংরেজিতে উত্তর দিল। আমি একটা ক্যামিস্টের দোকানে ঢুকে আমার পছন্দের নির্দিষ্ট মিন্ট কিনলাম। কেমিস্টের সহকারী আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলল। (দুবারই আমি ফ্রান্সের প্রোডাক্টের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।) হোটেলে পৌঁছানোর আগে, দুটো ছেলে আমাকে দাঁড় করাল। তারা এইমাত্র টেীলুজি থেকে এসেছে, একটা নির্দিষ্ট দোকান খুঁজছে। তারা আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু তারা কী বলতে চাইছে কেউ বুঝতে পারেনি। এসব কী হচ্ছে? আমার অ্যারেস্ট হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কি চ্যাম্প-ইলিসিসের ভাষা বদলে গেছে?

ট্যুরিজম আর অর্থকড়ি মিরাকল ঘটাতে পারে। আগে কেন এসব লক্ষ করিনি? বোঝাই যাচ্ছে, হট চকোলেটের জন্য এসথার আর আমি অনেক দিন এখানে আসিনি। এমনকি এই সময়টাতে আমরা দুজনই অনেকবারই বাইরে বেরিয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ আরো কোনো ব্যাপার সব সময় থাকে। সব সময় কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েনমেন্ট থাকে। হ্যাঁ, প্রিয়তম, আমরা পরেরবার আবার হট চকোলেট খাব, শিগগিরই ফিরে এসো। আমার আজকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইন্টারভিউ আছে। তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে পারছি না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে যাও। আমার সেলফোন খোলাই থাকবে। আর্জেন্ট কোনো কিছু হলে ফোন দিও। অন্যথায়, রাতে আমাদের দেখা হবে। আমার সেলফোন! আমি পকেট থেকে সেলফোনটা বের করলাম। তাড়াতাড়ি চালু করলাম। কয়েকবার বেজে উঠল। প্রত্যেকবার আমার হৃদয় নেচে উঠল। ছোট্ট স্ক্রিনে পরপর কয়েকটা নাম দেখতে পেলাম, যারা আমার সাথে কথার বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের কাউকে উত্তর দিলাম না। আশা করছিলাম, অপরিচিত কোনো নাম্বার স্ক্রিনে ভেসে উঠবে। কারণ তাহলে হয়তো এসথার হতে পারে। মাত্র কুড়িজন মানুষ আমার নাম্বার জানে, আর তারা অন্য কাউকে দেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। অপরিচিত নাম্বার এল না। শুধু কয়েকজন বন্ধু আর বিশ্বস্ত কলিগরা ফোন করল। তারা অবশ্যই কী ঘটেছে সে ব্যাপারে উৎসুক হয়ে আছে। তারা সাহায্য করতে চায় (কিন্তু কীভাবে?), আমার কোনো কিছুর দরকার কিনা জিজ্ঞেস করতে চায়।

টেলিফোন বাজতেই থাকল। আমার কি উত্তর দেয়া উচিত? এদের মধ্যে কারো সাথে কি দেখা করা উচিত?

কী ঘটেছে তা না বোঝা পর্যন্ত চুপচাপ একাকী থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমি ব্রিস্টোল হোটেলে পৌঁছালাম। এসথার সব সময় এই হোটেলটাকে বর্ণনা করত প্যারিসের মধ্যে গুটিকয় হোটেলের মধ্যে একটা, যেখানে কাস্টমাররা খরিদ্দারদের চেয়ে অনেক বেশি অতিথি হিসেবে আপ্যায়িত হয়। আমাকে এ রকমভাবে অভ্যর্থনা জানানো হলো, যেন আমি তাদের পরিবারের একজন বন্ধু। এন্টিক ঘড়ির পাশের একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। পিয়ানোর বাজনা শুনতে শুনতে বাগানের দিকে তাকালাম।

আমার বাস্তববাদী হওয়া দরকার। অপশনগুলো খতিয়ে দেখা উচিত। সর্বোপরি, জীবন বয়ে চলে। আমিই প্রথম ব্যক্তি নই বা শেষ ব্যক্তি হব না, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু ব্যাপারটা এ রকম রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে ঘটবে। রাস্তার সবাই হাসিখুশিতে ফেটে পড়বে, বাচ্চারা গান গাইবে, বসন্তের প্রথম আগমনী বার্তা এসে যাবে। সূর্য আলো ছড়াবে। ড্রাইভাররা পথচারীর জন্য গাড়ি থামাবে? আমি ন্যাপকিন তুলে নিলাম। আমি আইডিয়াগুলো মাথা থেকে বের করে লিখে রাখতে চাইলাম। আবেগকে এক পাশে সরিয়ে রেখে কী করতে পারি তাই দেখা উচিত :

এই সম্ভাব্য দিকটা বিবেচনা করে দেখা যায়। এসথারকে অপহরণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে তার জীবন হুমকির সম্মুখীন। তার স্বামী হিসেবে ওকে খুঁজে পেতে গোটা জগৎ তোলপাড় করে ফেলা দরকার। এসথার ওর পাসপোর্ট সাথে করে নিয়ে গেছে। পুলিশ তা জানে না, কিন্তু ও ওর সাথে করে আরো কয়েকটা ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে গেছে। তার মধ্যে এ রকম একটা ওয়ালেট নিয়ে গেছে, যার ভেতরে কয়েকজন অভিভাবকসুলভ সেইন্টের ছবি আছে, যখন ও বাইরে যেত এই ছবিগুলোকে সব সময় সাথে নিত। এসথার অবশ্য ব্যাংক থেকে তার টাকা-পয়সাও তুলে নিয়েছে।

উপসংহার : এসথার সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়েই চলে গেছে।

.

সম্ভাব্য দিক বিবেচনা করে দেখা যায়, কেউ একজন তার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে কারণেই বেরিয়ে গেছে পরে তা ফাঁদে পরিণত হয়েছে।

 রেসপন্স : এসথার এর আগে প্রায়ই নিজেকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিয়ে ফেলেছে। তার চাকরির ধরনই এ রকম। কিন্তু এ রকম কিছু করার আগে ও সব সময় আমাকে সতর্ক করে গেছে। কারণ একমাত্র আমাকেই ও পুরোপুরি বিশ্বাস করত। ও কোথায় যেতে পারে সে ব্যাপারে আমাকে বলত। কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে তা জানাত। (যদিও, বেশির ভাগ সময় আমাকে বিপদে না ফেলার জন্য সেই ব্যক্তির নাম বলত না) আর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ও ফিরে না এলে আমি কী করতে পারি জানিয়ে দিত।

উপসংহার : এসথার ওর কোনো ইনফরমারের সাথে দেখা করতে যায়নি।

.

এসথারের অন্য আরেকজন পুরুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে, এ বিষয়টি বিবেচনা করা যায়।

রেসপন্স : কোনো রকম রেসপন্সের দরকার নেই। সব রকম হাইপোথিসিস খাড়া করে, একমাত্র এ বিষয়ে কোনো কিছুই বলা যায় না। আর এখনো আমি তা মেনে নিতে পারছি না। ও আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারে তা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমাকে কোনো কারণ না দেখিয়েই চলে যাবে। আমরা দুজনই জীবনের সব রকম জটিলতা একসাথে সামলেছি। আমরা কষ্ট ভোগ করেছি, কিন্তু কখনো পরস্পরের কাছে মিথ্যা বলিনি। যদিও এই খেলার নিয়মই হলো, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা কেউ কাউকে উল্লেখ করে না। মিখাইল নামের ওই ছেলেটার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে ও অনেক বদলে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমি সচেতন ছিলাম। কিন্তু তাই বলে দশ বছরের সুখী দাম্পত্য জীবনের ইতি টানবে?

এমনকি এসথার যদি মিখাইলের সাথে রাত কাটিয়েও থাকে, ওর প্রেমে পড়ে যায়, ও কি তাহলে সব সময় ভারসাম্য বজায় রেখেছে? আমরা একসাথে সময় কাটিয়েছে। আমরা দুজন মিলে যেসব অ্যাডভেঞ্চার করে তা কি ফিরে আসবে না? ও যেখানে যেতে চাইত, ইচ্ছা খুশিমতো ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারত। পুরুষ মানুষের দ্বারা আবর্তিত হয়েই ও বাস করত। এ রকম সৈনিকের আশপাশে থাকত, যারা বড় হওয়া অবদি মেয়েমানুষ দেখেনি। কিন্তু কখনো কোনো প্রশ্ন করত না। ও আমাকে কখনো কোনো কিছু বলত না। আমরা দুজনই মুক্ত মানুষ ছিলাম। আমরা তা নিয়ে গর্ববোধ করতাম।

কিন্তু এসথার অন্তর্হিত হয়েছে। আর এ রকম কিছু সূত্র দিয়ে গেছে, যা শুধু আমার চোখেই ধরা পড়ে। যেন ও আমাকে একটা গোপন মেসেজ দিয়ে গেছে : আমি চলে যাচ্ছি।

 কেন?

প্রশ্নটার উত্তর কি খুব খারাপ কিছু?

 না। কারণ লুকানো উত্তরটা যেসব মেয়েকে আমি ভালোবাসি তাদের ধরে রাখার সামর্থ্যের মধ্যেই লুকায়িত। ওকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনাটা কি খুব খারাপ হবে? ক্ষমা ভিক্ষা করে অনুনয় প্রার্থনা করব, যাতে আমাদের বিবাহিত জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হয়?

ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর মনে হয়। অতীতের মতো এর চেয়ে দুঃখ ভোগ করাই আমার জন্য ভালো হবে। কাউকে আমি ভালোবাসলেই সে আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। তার চেয়ে নিজের ক্ষত নিজেই পরিষ্কার করা ভালো। অতীতে অনেকবার এমনটি করেছি। আমি অবচেতনে এসথারকে ভেবে যাব। আমার মনটা তিক্ততায় ভরে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গ বিরক্ত বোধ করব। কারণ ওরা সবাই আমার স্ত্রীর চলে যাওয়া নিয়ে আলাপ করবে। কী ঘটেছে তা জাস্টিফাই করতে চেষ্টা করব। ওর সাথে থাকার সময়টুকুর কথা দিন-রাত প্রতিটি মুহূর্ত ভাবব। আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হব, ও আমার সাথে খুব কঠোর আচরণ করেছে, যদিও আমি আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমি অন্য মেয়েমানুষ খুঁজে নেব। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব, আমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখব ও হতে পারে কিনা। আমি দিবা-রাত্রি কষ্ট ভোগ করে যাব। সপ্তাহ, মাস, বছর বা সম্ভবতও তারও বেশি হবে আমি কষ্ট ভোগ করে যাব।

একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখব আমি অন্য কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। তখন আমি জানব সবচেয়ে খারাপ সময়টা পার করে এসেছি। আমার হৃদয় হয়তো যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। কিন্তু তা সামলে নিয়ে আবার জগতের অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে উপভোগ করব আমি। এর আগেও এমনটি ঘটেছে। আবার তা ঘটবে। আমি নিশ্চিত। যখন কেউ চলে যায়, তা এ কারণে যায় যে কেউ আসবে। আমি আবার ভালোবাসা খুঁজে পাব। মুহূর্তের জন্য, আমার নিজের জীবনের নতুন অবস্থার কথা বিবেচনা করলাম। একাকী এবং কোটিপতি। যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়েই আমি প্রকাশ্য দিবালোকে বাইরে যেতে পারি। পার্টিতে এ রকম আচরণ করতে পারি, যা বিগত বছরের মধ্যে কোনো দিন করিনি। এই খবর খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়বে। শিগগিরই সব রকমের মেয়েমানুষ, তরুণী, মাঝবয়সী, সুন্দরী, ধনী- তারা যে রকম ভাব দেখায় সে রকম ধনী নয়, বুদ্ধিমতী আর যারা আমার দরজায় এসে শুধু বলতে চাইবে এ ঘটনাটা তারা শুনেছে।

 আমি বিশ্বাস করতে চাই, মুক্ত মানুষ হওয়া কতই না অপূর্ব ব্যাপার! আমি স্বাধীন। সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে নেয়ার জন্য প্রস্তুত। আমার জন্য যে অপেক্ষা করে আছে, যে আবার আমাকে এই জাতীয় অপমানের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে না।

.

আমি হট চকোলেট শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। আমি জানি এখনই এই মুহূর্তে যে চিন্তাভাবনা করলাম সেই জাতীয় আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব নয়। এক মুহূর্তের জন্য, আমার মনে হলো এসথার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে, সুন্দর পারসিয়ান কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে আমার কাছে এসেছে। কোনো কথা না বলে আমার পাশে বসেছে। বসে বসে ধূমপান করছে। বাইরের বাগানের দিকে তাকিয়ে আমার হাত ধরেছে। আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেল। আরো আধা ঘণ্টা পরে বুঝতে পারলাম, এতক্ষণ আমি নিজের সৃষ্ট গল্প বিশ্বাস করে বসেছিলাম, যা পুরোপুরি ফ্যান্টাসি ছাড়া আর কিছু নয়।

 বাড়িতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। রিসিপশনে গিয়ে রুমের কথা বললাম। সেই সাথে একটা টুথব্রাশ, আর কিছু ডিওডেরান্ট দিতে বললাম। হোটেল বোর্ডারে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু ম্যানেজার আমার জন্য একটা সুট ম্যানেজ করে দিল। আমি খুব সুন্দর একটা সুটে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে আইফেল টাওয়ার, টেরেস ও প্যারিসের বাড়িগুলোর ছাদ দেখা যায়। একের পর এক আলো জ্বলে উঠতে লাগল। পরিবারগুলো রবিবার রাতের খাবারের জন্য একত্র হতে থাকে। চ্যাম্প-ইলিসিসে ফিরে যাওয়ার পরে যে অনুভূতি ফুটে উঠেছিল, আমার চারদিকের সব কিছুই সুন্দর, সেই অনুভূতি ফিরে এল, শুধু নিজের জন্য খারাপ লাগল।

কোনো টেলিভিশন নেই। কোনো রাতের খাবার নয়। টেরেসে বসে নিজের অতীত জীবনের দিকে ফিরে তাকালাম। এক তরুণ, যে নিজে বিখ্যাত একজন লেখক হিসেবে স্বপ্ন দেখত। হঠাৎ করে বুঝতে পারল বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে এ রকম এক ভাষায় লেখে, যা প্রায় বলতে গেলে কেউই পড়ে না। এ রকম দেশে থাকে যেখানে বলতে গেলে কোনো পড়ুয়া ধাচের লোক নেই। তার পরিবার তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য জোর দিতে থাকে। (যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় হলেই হবে, খোকা, তোমাকে যেকোনো একটা ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। অন্যথায় তুমি কখনোই একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারবে না।) তরুণ বিদ্রোহ করল। হিপ্লিদের যুগে জগৎ ভ্রমণে বের হলো। একজন গায়কের সাথে পরিচয় হলো। কয়েক ছত্র গান লিখল। হঠাৎ করে বোনের চেয়ে বেশি উপার্জন করতে লাগল। বোন বাবা-মায়ের কথা শুনে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল…

আমি আরো গান লিখতে লাগলাম। গায়কেরও নাম হতে লাগল। আমি একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ফেললাম। গায়কের সাথে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু তখনো পরবর্তী কয়েক বছর কাজ করার জন্য যথেষ্ট অর্থ আমার কাছে ছিল না। প্রথমবারের মতো বিয়ে করলাম। একজন বয়স্কা মহিলা। বয়স্কা মহিলার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। কীভাবে সঙ্গম করতে হয়, কীভাবে গাড়ি চালাতে হয়, কীভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, দেরি না হওয়া পর্যন্ত কীভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। কারণ প্রথমা স্ত্রী আমাকে বিবেচনা করল, আবেগী অপরিপকু আর বিশাল বক্ষা কোনো তরুণী দেখলেই তার পেছনে ছুটতে রাজি হিসেবে। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করলাম। তৃতীয়বারে মনে হলো এবারের মহিলা আমাকে আবেগাপ্লুত স্থিরতা দেবে। আমি যা চাই তা পাচ্ছিলাম। কিন্তু এক সময় আবিষ্কার করলাম, যে স্থিরতা আমি চেয়েছি, তা এক ধরনের গভীর ক্লান্তি ছাড়া আর কিছু নয়।

আরো দুইবার ডিভোর্স হওয়ার পরে আমি আবার মুক্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু অনুভূতিটা এ রকম হলো, স্বাধীনতা মানে অঙ্গীকারের অনুপস্থিতি নয়। পছন্দ করার সামর্থ্য থাকা এবং নিজের সবচেয়ে ভালো জিনিসটার প্রতি অঙ্গীকার রাখা।

ভালোবাসার খোঁজ অব্যাহত রাখলাম। গান লেখা চালিয়ে গেলাম। আমি কী করি তা লোকজন জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আমি একজন লেখক। যখন তারা জানত, তারা শুধু আমার গানের লিরিকের কথা জানে, আমি বলতাম, ওটা আমার কাজের একটা অংশমাত্র। তারা যখন ক্ষমা চেয়ে জানাত তারা কখনো আমার কোনো বই পড়েনি, আমি ব্যাখ্যা করে বলতাম, আমি একটা প্রজেক্টে কাজ করছি, যা ছিল ডাহা মিথ্যে কথা। সত্যটা হলো আমার হাতে অর্থ ছিল। লোকজনের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল, কিন্তু বই লেখার মতো কোনো সৎসাহস আমার ছিল না। আমার স্বপ্নটা এখন বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি যদি চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, জানি না আমার বাকি জীবনে আমি কী করব। সে কারণেই একটা স্বপ্নের ওপর নিজেকে আছন্ন কর রাখাটাই অনেক সহজ।

একদিন, একজন সাংবাদিক আমার ইন্টারভিউ নিতে এল। সাংবাদিক মেয়েটা জানতে চায়, দেশের লোক সবাই আমার যে কাজের কথা জানে সেটা কী। কিন্তু আমার কাছেই তা পুরোপুরি অজ্ঞাত। একজন গায়কই শুধু মিডিয়ার সামনে নিজেকে উন্মোচিত করে। মেয়েটা বেশ সুন্দরী, যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, ঠাণ্ডা ধাচের। একটা পার্টিতে আমাদের আবার দেখা হয়ে গেল। ওখানে কাজের কোনো চাপ ছিল না। ওই রাতেই আমি মেয়েটাকে বিছানায় নিয়ে যেতে পারি। আমি প্রেমে পড়ি। কিন্তু মেয়েটাকে মোটেই আগ্রহী মনে হয় না। আমি ফোন করলেই ও জানাত, ব্যস্ত আছে। যতই ও আমাকে এড়িয়ে চলত, প্রত্যাখ্যান করত, ততই মেয়েটার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আমি ওকে আমার দেশের বাড়িতে এক সপ্তাহ কাটানোর জন্য নিয়ে যেতে পারি। (আমি হয়তো আমার পরিবারের কুলাঙ্গার হতে পারি কিন্তু মাঝে মাঝে বিদ্রোহ তার মূল্য দেয়। আমার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র দেশের বাড়িতে আমি একটা বাড়ি কিনতে পেরেছি।)

আমরা একসাথে তিন দিন কাটালাম। সাগর দেখে মুগ্ধ হলাম। ওর জন্য আমি রান্না করলাম। ও আমাকে ওর কাজের কথা বলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ও আমার প্রেমে পড়ে গেল। আমরা শহরে ফিরে এলাম। ও তখন থেকেই নিয়মিত আমার অ্যাপার্টমেন্টে আমার সাথে শুতে লাগল। একদিন সকালে, ও অন্যদিনের চেয়ে খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল একটা টাইপরাইটার নিয়ে। তারপর থেকে, কোনো কিছু না বললেও, আমার বাড়িটা ওরও বাড়ি হয়ে গেল।

আগের স্ত্রীদের মতো একই রকম জটিলতায় জড়িয়ে পড়লাম। মেয়েরা সব সময় স্থিরতা এবং প্রভুত্ব চায়। তখন আমার অ্যাডভেঞ্চার আর অজানা জিনিসেই আগ্রহ বেশি। এইবার আমাদের সম্পর্কটা অনেক দিন টিকে রইল। নেই নেই করে, দুই বছর হয়ে গেল, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার এসথার তার টাইপরাইটার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে নিয়ে যাক, সেই সাথে আর যেসব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে সেগুলোও।

এতে কোনো কাজ হচ্ছে না।

 কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবাস। আমিও তোমাকে ভালোবাসি, তাই না?

আমি জানি না। যদি তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো তোমার সঙ্গ আমার পছন্দ কিনা, উত্তরে হ্যাঁ বলব। আবার অন্যদিকে, তুমি যদি জিজ্ঞেস করো, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব কিনা, তার উত্তরেও বলব হ্যাঁ।

আমি খুশি যে পুরুষ মানুষ হয়ে জন্মাইনি। আমার নারীসুলভ আচরণ নিয়ে আমি অনেক বেশি সচেতন। তোমরা সবাই মেয়েদের কাছ থেকে আশা করো তারা খুব ভালো রান্না করতে পারবে। অন্যদিকে পুরুষেরা, আশা করে তারা সব কিছু করতে পারবে। তারা একটা বাড়ির মালিক হতে পারবে। ভালোবাসতে পারবে, বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারবে, অর্থ উপার্জন করে আনবে এবং জীবনে সফল হবে।

ব্যাপারটা তা নয়। আমি নিজেকে নিয়ে অনেক সুখী। তোমার সঙ্গ আমি উপভোগ করি। কিন্তু আমার মনে হয় না, তাতে কোনো কাজ হবে।

 তুমি আমার সঙ্গ পছন্দ করো। কিন্তু নিজের দিকটা দেখো না। তুমি সব সময় অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বেড়াও। অথচ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বুঝতে ভুলে যাও। তুমি সব সময় চাও তোমার শিরা-উপশিরায় অ্যাড্রেনালিন প্রবাহিত হোক। আর ভুলে যাও ওগুলোর ভেতর দিয়ে শুধু রক্তই প্রবাহিত হয়।

আমি কখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে দূরে সরে থাকি না। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ কিছুর অন্তত একটা উদাহরণ দেখাও দেখি।

একটা বই লেখা।

 তা আমি যেকোনো সময় করতে পারি।

 তাহলে তাই করো। তারপর, তুমি চাও, আমরা আমাদের ভিন্ন পথে যেতে পারি।

.

এসথারের মন্তব্য আমার কাছে বেশ অদ্ভুত মনে হলো। আমি যখনই চাই তখনই বই লিখে ফেলতে পারি। আমি পাবলিশারদের চিনি। সাংবাদিকদের সাথেও পরিচয় আছে। ওরা সবাই আমার পক্ষেই আছে। এসথার খুব সাধারণ মেয়ে, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পায়। ও অনেক কিছু আবিষ্কার করে। আমি ওকে বলেছি সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের সম্পর্ক এখন শেষ সীমায় এসেছে। আমাকে কীসে খুশি করে তা এসথারের ভাববার বিষয় নয়। এটা ভালোবাসার ব্যাপার।

ভালোবাসা কী? এসথার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। আমি আধা ঘণ্টা ধরে ব্যাখ্যা করে বুঝতে পারলাম আমি কোনো সুন্দর সংজ্ঞা দিতে পারিনি।

ও আমাকে বলল, যেহেতু আমি ভালোবাসার সংজ্ঞায়ন জানি না, আমার অন্তত একটা বই লেখার চেষ্টা করা উচিত।

 আমি বললাম, দুটো জিনিসের মধ্যে কোনো রকম সম্পর্ক নেই। আমি এই অ্যাপার্টমেন্ট ভালো একটা দিনে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ও এখানে যত দিন ইচ্ছা থাকতে পারে। ও যত দিন থাকার জন্য ভালো একটা জায়গা না পায় তত দিন আমি হোটেলে গিয়ে থাকব। এসথার জানাল, তার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই, আমি এখনই চলে যেতে পারি। মাসখানেকের মধ্যে ও অ্যাপার্টমেন্ট খালি করে দেবে। নতুন একটা থাকার জায়গা আগামীকাল থেকেই খুঁজতে শুরু করবে। আমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। ও ওর রুমে গিয়ে বই পড়তে লাগল। আমি বললাম, আজ দেরি হয়ে গেছে। আমি আগামীকাল চলে যাব। এসথার বলল, আমার এখনই চলে যাওয়া উচিত। কারণ আগামীকাল আমি আজকের মতো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে পারব না। আমি জানতে চাইলাম, ও আমার থেকে মুক্তি পেতে চাইছে কিনা? ও হেসে উঠল। বলল, আমিই এই সম্পর্কের ইতি টানতে চেয়েছি। আমরা বিছানায় গেলাম। পরের দিন, চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা অতটা জরুরি মনে হলো না। আমি ব্যাপারটা আবার ভেবে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাই হোক, এসথার বলল, ব্যাপারটা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এই দৃশ্য বারবার ফিরে আসবে, যত দিন না আমি সব কিছুর ওপর ঝুঁকি নিতে শুরু করব, বেঁচে থাকার প্রকৃত কারণ আমি যা মনে করি না কেন। শেষ পর্যন্ত, ও অসুখী হয়ে পড়বে। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তা ছাড়া, যদি ও তাই করে, ও খুব তাড়াতাড়িই তাই করবে। ফিরে আসার সব পথ শেষ করে দিয়েই যাবে। ও কী বোঝাতে চাইছে তা জানতে চাইলাম। ও আরেকজন বয়ফ্রেন্ড খুঁজে নেবে। ও বলল, প্রেমে পড়বে।

এসথার সংবাদপত্রের কাজে বেরিয়ে গেল। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম এক দিনের ছুটি নেব (গানের লিরিক লেখা ছাড়াও আমি একটা রেকর্ডিং কম্পানিতে কাজ করি)। আমি টাইপরাইটারের সামনে বসে পড়লাম। আবার উঠে পড়লাম। পত্রিকাগুলো পড়লাম। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠির উত্তর দিলাম। সেগুলো শেষ হলে অগুরুতুপর্ণ চিঠিগুলোরও উত্তর দিতে শুরু করলাম। আমার কী কী জিনিসের দরকার তার একটা লিস্ট করলাম। গান শুনলাম। সামনের ব্লক থেকে হেঁটে আসতে বেরিয়ে পড়লাম। বেকারির লোকজনের সাথে কথা বললাম। ঘরে ফিরে এলাম। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, আমার গোটা দিন কেটে গেছে। আমি এখনো একটা লাইনও লিখতে পারিনি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এসথারকে ঘৃণা করব। কারণ আমি যা করতে চাই না ও আমার কাছ থেকে জোর করে তাই করিয়ে নিতে চায়।

এসথার ঘরে ফিরে এসে আমাকে কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করল না। কিন্তু আমি স্বীকার করলাম কোনো কিছুই লিখতে পারিনি। পড়াশোনা করেছি, টেলিভিশন দেখেছি, গান শুনেছি, তারপর টাইপরাইটারের কাছে ফিরে গেছি। তো দুই মাস কেটে গেছে, পাতার পর পাতা গুছিয়ে রেখেছি। প্রতিটি পাতায় প্রথম বাক্যটা লিখে রেখেছি। কিন্তু কখনো একটা প্যারাগ্রাফ শেষ করতে পারিনি।

আমি সব রকম সম্ভাব্য অজুহাত খাড়া করলাম- এ দেশে কেউ বই পড়ে না। কোনো প্লটের ব্যাপারে কাজ করিনি। আমি খুব ফ্যান্টাস্টিক একটা প্লট পেয়েছি। কিন্তু আমি এখনো ওই প্লটের উন্নয়নের জন্য ঠিক ঠিক বিষয়গুলো খুঁজে বেড়াচ্ছি। পাশাপাশি, গানের লিরিকের ব্যাপারে একটা আর্টিকেল লেখার কাজেও খুব ব্যস্ত আছি। আরো দুই মাস কেটে গেল। একদিন, ও একটা বেয়ারিং প্লেনের টিকিট নিয়ে বাসায় এল।

 যথেষ্ট হয়েছে। এসথার বলল, ব্যস্ত হওয়ার ভান বন্ধ করো। তুমি তোমার দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলছ। তুমি যা করছ তা করার দরকার আছে। এক মুহূর্তের জন্য কোথা থেকে বেড়িয়ে এসো। আমি সব সময় একজন সম্পাদক হতে চাইতাম, যেখানে আমার কয়েকটা আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। আমি সব সময় রেকর্ডিং কম্পানির প্রেসিডেন্ট হতে চাইতাম, যেখানে আমি কিছু লিরিক লিখেছি। ওখানে ওরা আমাকে কাজ দিয়েছে, যাতে আমি ওদের প্রতিদ্বন্দ্বী কম্পানিগুলোর জন্য কোনো গান না লিখি। আমি এখন যা করছি তা করার জন্য সব সময় ফিরে আসতে পারি। কিন্তু আমার স্বপ্ন অপেক্ষা করতে পারে না। হয় আমাকে তা মেনে নিতে হবে, নয়তো ভুলে যেতে হবে।

এই টিকিট কোথাকার?

 স্পেন।

আমি বেশ চমকে গেলাম। প্লেনের টিকিট অনেক ব্যয়বহুল। পাশাপাশি, এখন আমি বাইরে যেতে পারি না। আমার সামনে ক্যারিয়ার পড়ে আছে। আমার সে ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া উচিত। অনেকগুলো নামী কম্পানির পার্টনারশিপ হারাতে হবে। সমস্যাটা আমি নই। আমাদের বিবাহই সমস্যা। যদি সত্যিই আমি একটা বই লিখতে চাই, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।

 তুমি পারো, তুমি করতে চাও কিন্তু তুমি তা করো না। ও বলল, তোমার সমস্যা আমি নই। তুমি নিজেই তোমার সমস্যা। তো এটাই তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে যদি তুমি কিছুটা সময় একাকী কাটাও।

এসথার আমাকে একটা ম্যাপ দেখাল। আমি অবশ্যই মাদ্রিদ যাব, ওখান থেকে আমি পাইরিনিসের বাস ধরতে পারব। পাইরিনিস ফ্রান্সের বর্ডারের কাছে। ওখান থেকে মধ্যযুগীয় তীর্থযাত্রীদের রুট শুরু হয়েছে। ওই রাস্তাটা সান্তিয়াগো গেছে। সমস্ত পথ আমাকে একা হেঁটে যেতে হবে। ও অন্য প্রান্তে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর আমি যা বলব ও তাই মেনে নেবে। আমি যদি বলি ওকে আর ভালোবাসি না। আমি যদি বলি সাহিত্যের রচনা করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করিনি, আমি লেখক হওয়ার মত চিন্তাভাবনা করিনি। এটা কৈশোরের স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।

এটা পাগলামি! দুই বছর ধরে যে মহিলার সাথে ঘরসংসার করছি- সম্পর্কের স্বর্গীয় অবস্থায় পৌঁছে গেছি সেই মহিলা আমার জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার কাজ থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য জোর করছে। আশা করছে গোটা দেশ হেঁটে পার হব! ব্যাপারটা উন্মত্তের পর্যায়ে চলে গেল। কারণ আমি তা খুব সিরিয়াসলি নিলাম। কয়েক রাত মদ খেয়ে মাতাল হলাম। সেও আমার সাথে সমানভাবে মাতাল হয়ে গেল। এমনকি ও মদ পান করাটাকে ঘৃণা করে। আমি বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলাম। আমি বলব, ও আমার স্বাধীনতায় ঈর্ষা বোধ করছে। এই গোটা পাগলামির ধারণাটা তার মাথায় ঢুকেছে, কারণ আমি বলেছিলাম ওকে ছেড়ে দিতে চাই। ও বলেছিল, এসব কিছু আমার স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছে, যখন থেকে আমি লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। আমি যদি এখন এই বাস্তবতার সম্মুখীন না হই, আমার বাকি জীবন বিয়ে করে আর ডিভোর্স দিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে।

স্পষ্টত, ও যে ঠিক বলছে তা আমি স্বীকার করতে পারি না। কিন্তু আমি জানি ও সত্য কথাই বলছে। আর এ ব্যাপারে আমি যতই সচেতন হয়ে উঠেছি, ততই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে লাগলাম। কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই ও আমার এই আক্রমণাত্মক ভাবটাকে মেনে নিল। মাঝে মাঝে ও আমাকে মনে করিয়ে দিতে লাগল, দেশের বাইরে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে।

বিদেশ যাওয়ার কয়েক দিন আগে, এক রাতে ও আমার সাথে সঙ্গম করতে

জানাল। আমি মারিজুয়ানার একটা গোটা প্যাকেট শেষ করলাম, দুই বোতল ওয়াইন পান করলাম। লিভিংরুমের মাঝামাঝি দিয়ে পার হচ্ছিলাম, আমি ওখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম, আমি খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছি। গর্তের নিচে পড়ে গেছি। এখন আমাকে যেভাবেই হোক ওপরে উঠতে হবে। আমার নিজের সাহস নিয়ে যে গর্ব ছিল তা কাপুরুষতায় নিমজ্জিত দেখলাম। আমার গোটা জীবন কোনো রকম অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া কেটে গেছে। সেই সকালে, আমি ঘুম থেকে জেগে ওকে চুমু খেলাম। বললাম, ওর সাজেশন। মতোই আমি সব কিছু করব।

সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। আটচল্লিশ দিনে আমি সান্তিয়াগোর পথে রওনা দিলাম। ওখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম আমার সত্যিকারের ভ্রমণ কেবল শুরু হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, মাদ্রিদে সেটেল করে রয়ালটির টাকায় জীবনযাত্রা নির্বাহ করব। এসথারের শরীর আমার থেকে এখন অনেক দূরে। যদিও এখনো আমরা অফিসিয়ালি একসাথেই আছি। আর প্রায় সময়ই টেলিফোনে কথা বলি। বিবাহিত জীবনের স্বস্তিদায়ক অংশই এটি, আমি যখন ইচ্ছা তখন ওর কাছে ফিরে যেতে পারি। যদিও এই মুহূর্তে জগতের স্বাধীনতা উপভোগ করছি।

আমি একজন কাটালান বিজ্ঞানীর প্রেমে পড়লাম। আর্জেন্টাইন ওই ভদ্রমহিলা জুয়েলারি তৈরি করে। সেই সাথে মেট্রোতে গান গায়- এমন এক তরুণীর প্রেমে পড়লাম। গানের লিরিক থেকে পাওয়া রয়ালটি থেকে স্বচ্ছন্দে বাস করার মতো যথেষ্ট অর্থ জোগাড় হয়ে গেল। কোনো কাজ না করেই যথেষ্ট সময় হাতে পেলাম। সেই সময় আমি যেকোনো কিছু করতে পারি- এমনকি একটা বইও লিখতে পারি।

বই লেখা সব সময় আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারে। কারণ মাদ্রিদের মেয়র ঘোষণা করেছেন, শহরে দীর্ঘ পার্টির আয়োজন করা হবে। অদ্ভুত মজাদার শ্লোগান তৈরি করেছে, মাদ্রিদ ইজ কিলিং মি। আমাদের অনুরোধ করেছে প্রতি রাতে কয়েকটা বার ঘুরে মাদ্রিদের দৃশ্য দেখে আসার জন্য। এ কাজ আমার পক্ষে আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা সম্ভব নয়। সব কিছুই এতই মজার, দিনগুলো ছোট আর রাতগুলো বেশ বড় লাগতে থাকে।

একদিন এসথার ফোন করে জানাল, ও আমাকে দেখতে আসছে। ওর কথামতো, আমাদের অবস্থাটা যাচাই করে একেবারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। পরের সপ্তাহে এসথার ওর টিকিট বুক করেছে। আর সে কারণে, একগাদা অজুহাত খাড়া করার মতো যথেষ্ট সময় আমার হাতে আছে। (আমি পর্তুগাল যাচ্ছি, এক মাসের মধ্যে ফিরে আসব। মেট্রোয় গান গাওয়া স্বর্ণকেশী মেয়েটাকে বললাম। ওই মেয়েটা এখন আমার ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে বাস করে, আমার সাথেই ঘুমায়। ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আমি প্রতি রাতে বাইরে বেরিয়ে মাদ্রিদের দৃশ্য উপভোগ করতে পারি।) আমি অ্যাপার্টমেন্টটা গুছিয়ে রাখব। কোনো মহিলার উপস্থিতি রাখব না। বন্ধুদের মুখ বন্ধ রাখতে বলব। কারণ আমার স্ত্রী মাসখানেক আমার সাথে থাকার জন্য আসছে।

এসথার প্লেন থেকে নামল। বেশ খেলোয়াড়সুলভ, কুৎসিৎ, অপরিচিত হেয়ার কাট দিয়েছে চুলে। আমরা স্পেনের ভেতরের দিকে ভ্রমণ করতে গেলাম। ছোট্ট একটা শহরে এক রাত খুব মজায় কাটালাম। কিন্তু আজ সেখানে গেলে আমি হয়তো শহরটাই খুঁজে পাব না।

আমরা বুল ফাইট দেখতে গেলাম। ফ্লামিংকো শো দেখলাম। আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী বিবেচিত হলাম। কারণ আমি চাইছিলাম বাসায় ফিরে ওর মনে হোক আমি এখনো ওকে ভালোবাসি। আমি জানি না কেন এ রকম অনুভূতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলাম। কারণ সম্ভবত, আমি জানি মাদ্রিদের স্বপ্ন শেষ হতে চলেছে।

 এসখারের হেয়ার কাটের ব্যাপারে অভিযোগ করলাম। ও তা বদলে ফেলল। ওকে আবার সুন্দরী দেখাতে লাগল। ওর ছুটির আর মাত্র দশ দিন বাকি আছে। আমি চাইলাম ও সুখী অনুভূতি নিয়ে ফিরুক। আর আমাকে এখানে একাকী রেখে যাক, যাতে আমি মাদ্রিদকে উপভোগ করতে পারি। মাদ্রিদের দিনগুলো অন্য রকম, বুল ফাইট, একই পুরনো বিষয় নিয়ে অন্তহীন আলোচনা, মদপান, নারী, আরো বেশি বুল ফাইট, আরো বেশি অ্যালকোহল, আরো বেশি নারী আর পুরোপুরি কোনো টাইমটেবল মেনে না চলা।

এক রবিবারের দিন, আমরা সারা রাত খাবার পাওয়া যায় এ রকম একটা বারের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ও আবারো সেই পুরনো নিষিদ্ধ বিষয়ে আলোচনা শুরু করল। যে বই আমি লেখার কথা বলেছি। আমি এক বোতল শেরি পান করলাম। বেরোনোর পথে ধাতব দরজায় লাথি কষলাম। রাস্তায় মুখ খিস্তি দিয়ে অন্য লোকজনকে অপদস্থ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম কেন ও এতটা পথ কষ্ট করে শুধু আমাকে ওই একটা বিষয়ে বিরক্ত করতে এসেছে, কেন ওর একমাত্র উদ্দেশ্য আমার জীবনটাকে জাহান্নাম বানিয়ে আনন্দটাকে মাটি করা। ও কিছুই বলল না। কিন্তু আমরা দুজনই বুঝতে পারলাম আমাদের সম্পর্ক শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে।

একটা স্বপ্নহীন রাত কেটে গেল। পরের দিন সকালে, বিল্ডিং ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ করলাম ফোন কাজ করেনি। ক্লিনিং মহিলার ব্যাপারে অভিযোগ করলাম, সে গত এক সপ্তাহ যাবৎ বিছানার চাদর বদলে দেয়নি। আমি টাইপরাইটারের সামনে বসে পড়লাম। শুধু এসথারকে দেখাতে চাইলাম আমি চেষ্টা করছি, সত্যিই কাজ করার চেষ্টা করছি।

এবং হঠাৎ করে মিরাকল ঘটে গেল। আমি সামনের মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলাম, যে এইমাত্র কফি বানিয়ে নিয়ে এখন নিউজপেপার পড়তে শুরু করেছে। ওর চোখ বেপরোয়া আর ক্লান্ত। ও স্বাভাবিক নীরবতায় ডুবে আছে। ওর আবেগকে অভিব্যক্তি দিয়ে প্রকাশ করছে না। ওই মহিলাটি আমি যখন না বলতে চেয়েছি তখন আমাকে দিয়ে হা বলিয়ে নিয়েছে, তার নিজের সঠিক ধ্যান-ধারণার ব্যাপারে আমাকে লড়াই করতে জোর করেছে, আমার বেঁচে থাকার কারণটাকে বিশ্বাস করেছে, ও আমাকে একাকী ছেড়ে দিয়েছে, কারণ ওর ভালোবাসা ওর নিজেকে ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি মহত্ত্বর। ও আমার স্বপ্নের খোঁজে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এবং হঠাৎ করে ওই ছোটখাট শান্ত শিষ্ট মহিলাটি কোনো কথা না বলে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কিন্তু সব সময় ওর কাজের মধ্যে সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছিল। ও যাকে ভালোবাসে তার জন্য লড়াই করতে একটুও ভয় পায় না। আমার আঙুল কিয়ের ওপর চাপ দিতে লাগল।

প্রথম বাক্যটা লেখা হয়ে গেল। তারপর পরের বাক্যটা।

আমি দুটো দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছিলাম। খুব কম সময়ই ঘুমিয়েছি। শব্দগুলো যেন কোনো অপরিচিত জগৎ থেকে ভেসে আসে। গানের লিরিক লেখার সময়ও অমনটি হতো। সেসব দিনগুলোতে অনেক তর্কবিতর্ক, কথোপকথনের পরে আমার মিউজিক্যাল পার্টনার জানত শব্দগুলো অন্য কোথা থেকে আসে। আর তখনই তা শব্দে ধারণ করে লেখা সম্ভব হয়। এইবার আমি বুঝতে পারলাম শব্দগুলো এসথারের হৃদয় থেকে উৎসরিত হচ্ছে। আমার ভালোবাসার পুনর্জন্ম হয়েছে। আমি এ বইটা লিখছি কারণ ওর অস্তিত্ব আছে। সমস্ত দুঃসময় কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই ও টিকে থেকেছে। নিজেকে ও কখনো দোষী ভাবেনি। গত কয়েক বছরে সান্তিয়াগোর পথে আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সে কথাই বর্ণনা করতে লাগলাম।

লেখার সময় বুঝতে পারলাম, যে দৃষ্টিতে আমি জগৎটাকে দেখি তার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক বছর যাবত, আমি জাদুবিদ্যা, অ্যালকেমি, অকাল্ট এসব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা করেছি। আমার ধারণা ছিল, কিছু লাকজন এ রকম শক্তির অধিকারী, যা বাকি মানুষের সাথে কখনো ভাগ করে নেয় না। কারণ অনভিজ্ঞ হাতে পড়লে এর শক্তিমত্তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমি সিক্রেট সোসাইটির একজন সদস্য ছিলাম। আমি নিজেকে বাইরের সেক্টরের সাথে জড়িত রেখেছিলাম। অনেক দামি বই কিনেছিলাম। অনেকটা সময় ধরে রীতিনীতি আর উপাসনায় ব্যয় করতাম। আমি সব সময় বিভিন্ন দল এবং ভ্রাতৃসংঘের সাথে যোগ দিতাম আবার চলেও আসতাম। সব সময় ভাবতাম শেষ পর্যন্ত এ রকম কোনো লোকের সাথে আমার দেখা হবে, যে আমার কাছে অদৃশ্য জগতের রহস্য উন্মোচিত করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি সব সময় হতাশ হতাম এই আবিষ্কার করে, বেশির ভাগ মানুষই একটা নির্দিষ্ট মতবাদ অনুসরণ করে চলে। কারণ ধর্মীয় উন্মত্ততাই একমাত্র পথ, যেখানে সন্দেহকে মানুষের আত্মার ওপর চাপিয়ে দেয়া যায়।

আমি আবিষ্কার করলাম, অনেক রীতিনীতি আসলে কোনো কাজ করে না। কিন্তু এও আবিষ্কার করলাম, যারা নিজেদের সিক্রেট লাইফের প্রতিভূ দাবি করে, যারা নিজেদের দাবি করে প্রতিটি আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর কৌশল তাদের জানা আছে, তারা প্রাচীন রীতিনীতির শিক্ষার কোনো ছোঁয়াই পায়নি। সান্তিয়াগোর রাস্তা অনুসরণ করে, সাধারণ লোকজনের সংস্পর্শে এসে এই জগৎ নিজস্ব ভাষায় নিজস্ব প্রতাঁকে কথা বলে। আমাদের শুধু ভোলা মনে চারদিকের দৃশ্যপট দেখা যাওয়া দরকার। এই সব কিছু আমাকে বেশ বিস্মিত করল। যদি অকাল্ট বিদ্যা এই রহস্যের একটা পথ হতো! আমার বইয়ে, রোড টু সান্তিয়াগোর ব্যাপারে, আমি অন্যান্য সম্ভাব্য পথে এসব চিন্তাভাবনা করতে লাগলাম। তোমাকে যেটা করতে হবে, সব সময় মনোযোগ দিয়ে রাখতে হবে, তাহলে যদি তুমি চিহ্নগুলো পড়তে পারো, তোমার যা কিছু জানার সব শিখে যাবে।

.

মানুষের দুটো বড় সমস্যা আছে : প্রথমটা হলো কখন শুরু করতে হবে তা জানা আর দ্বিতীয়টা হলো কখন থামতে হবে তা জানা।

 এক সপ্তাহ পরে, আমি প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ড্রাফট শেষ করলাম। মাদ্রিদ আর এখন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় না। এখন ঘরে ফেরার সময় হয়েছে। আমি অনুভব করলাম, একটা সাইকেল শেষ হয়েছে, শিগগিরই আরেকটা শুরু করা দরকার। আমি এই শহরকে বিদায় জানালাম, যেভাবে সব সময় জীবনকে বিদায় জানাই। ভাবলাম, এক সময় হয়তো মত পরিবর্তন করে এখানে একদিন ফিরে আসতে পারি।

এসথারকে সাথে নিয়ে নিজের দেশে ফিরে এলাম। নিজেকে প্রবোধ দিলাম, হয়তো আরেকটা চাকরি পেয়ে যাব। কিন্তু যত দিন না পাই, আমি বইটা রিভাইস দিতে থাকলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না যে, কেউ একজন মানুষের রোমান্টিক অথচ স্পেনের পথের কঠিন অভিজ্ঞতা কেন আগ্রহ নিয়ে পড়বে।

 চার মাস পরে, যখন আমি দশমতম ড্রাফট নিয়ে ব্যস্ত, আবিষ্কার করলাম টাইপস্ক্রিপ্ট আর এসথার দুজনই চলে গেছে। দুশ্চিন্তায় যখন পাগল হওয়ার জোগাড়, এসথার পোস্ট অফিসের একটা ফেরত রিসিপ্ট নিয়ে এল- ও আমার স্ক্রিপ্টটা তার একজন পুরনো বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই বয়ফ্রেন্ড্র এখন একটা ছোটখাটো পাবলিশিং হাউজের মালিক।

পুরনো বয়ফ্রেন্ড বইটা প্রকাশ করল। পত্রপত্রিকায় এ ব্যাপারে একটা লাইনও লেখা হলো না। কিন্তু কয়েকজন বইটা কিনল। তারা অন্যদের বইটার ব্যাপারে বলল। তারাও কিনল এবং অন্যদের বলল। ছয় মাস পরে, বইয়ের প্রথম সংস্করণ বিক্রি হয়ে গেল। এক বছর পরে আরো তিনটি সংস্করণ বেরিয়ে গেল। আর এ রকম একটা প্রফেশন থেকে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করলাম, যা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি সাহিত্যের কাছ থেকে।

আমি জানি না স্বপ্নটা কত দিন জাগরূক থাকবে; কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রতিটি মুহূর্ত এমনভাবে বাঁচব, যেন এটাই জীবনের শেষ মুহূর্ত। আমি দেখতে পেলাম, সাফল্য তার দ্বার উন্মোচিত করেছে, যা আমি অনেক দিন যাবত খুলতে চেয়েছিলাম। অন্য প্রকাশকরা আমার পরবর্তি বই প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখাল।

সুস্পষ্টত, আমি প্রতিবছর সান্তিয়াগোর পথে যেতে পারি না। তাহলে আমি পরের বই কী লিখব? আমি কি তাহলে টাইপরাইটারের সামনে বসে থাকব আর লেখা বাদে আর সব কিছু করতে থাকব? ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ যে, জগতের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আর নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। আমি কয়েকটা দিন তা চেষ্টা করে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা অসম্ভব। তারপর এক সন্ধ্যায়, আমি অদ্ভুত গল্পের বই পেলাম হাজার এক আরব্য রজনী। এর মধ্যে আমি নিজের পথের চিহ্ন খুঁজে পেলাম। আমি কে তা বুঝতে সাহায্য করল। আমার জন্য যা অপেক্ষা করছে তা পেতে আমি কেন এতটা সময় ব্যয় করি। আমি এই গল্পটা আরেকটা গল্পের ভিত্তিতে প্রোথিত করি। এক রাখাল বালক তার স্বপ্নের খোঁজে মিশরের পিরামিডের গোপন সম্পদ অনুসন্ধানে বের হয়। আমি ভালোবাসার কথা বলি। এসথার আমার কাছ থেকে এ রকমটিই আশা করে।

আমি আর এখন এমন কেউ নই, যে কিছু হওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখে। আমি সেই রাখালবালক যে মরুভূমি পার হয়ে যায় কিন্তু তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সেই অ্যালকেমিস্ট কোথায়? আমি এই উপন্যাস শেষ করে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না কী লিখেছি। বেড়ে ওঠা শিশুদের জন্য রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। বয়স্করা যুদ্ধ, যৌনতা আর শক্তিমত্তার গল্পের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। শুধু তা-ই নয়, প্রকাশক বইটা গ্রহণ করে। বইটা প্রকাশিত হয়। পাঠকরা আবারও বইটাকে বেস্ট সেলার তালিকায় তুলে ফেলে।

 তিন বছর পরে, আমার বৈবাহিক জীবন অপূর্ব রূপ নেয়। আমি সব সময় যা করতে চেয়েছি তাই করছি। আমার বইয়ের প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তারপর দ্বিতীয়। এরপর সাফল্যের শুরু- ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত- আমার লেখা পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

 আমি প্যারিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ প্যারিসের ক্যাফে, লেখকরা আর সাংস্কৃতিক জীবন অর্থবহ। আমি আবিষ্কার করলাম, আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্যাফেগুলো টুরিস্ট আর ফটোগ্রাফেরা ভর্তি, ওরা এই জায়গটাগাকে বিখ্যাত করে রেখেছে। বেশির ভাগ লেখকই বিষয়ের চেয়ে স্টাইল নিয়েই আগ্রহী। তারা মৌলিক কিছু করতে চায়, কিন্তু সাফল্যের হার খুব নগণ্য। তাদের নিজেদের ছোট্ট জগতে আটকা পড়ে আছে তারা। আমি খুব মজাদার ফরাসি অভিব্যক্তি শিখে ফেললাম, রিনোভয়র লএনেসসেসর, আক্ষরিক অর্থ এলেভটারকে ফেরত পাঠাও। কিন্তু এর রূপক অর্থ হচ্ছে টু রেটার্ন এ ফেভর। প্রায়োগিক দিক দিয়ে এর অর্থ হলো, আমি তোমার বইয়ের সমন্ধে খুব ভালো ভালো কথা বলেছি, তুমি আমার বই সমন্ধে ভালো ভালো কথা বলবে, আর এর থেকেই আমরা একটা নতুন কালচারাল লাইফ গড়ে তুলব। এক ধরনের বিপ্লব, আপাতদৃষ্টিতে নতুন দর্শন, আমরা কষ্ট ভোগ করি কারণ কেউ আমাদের বুঝতে চায় না। কিন্তু তারপর অতীতে সব প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল, সমসাময়িক লোকেরা মহৎ শিল্পীদের ভুল বুঝেছিল।

 তারা এলেভেটারকে ফেরত পাঠিয়েছে। প্রথম দিকে এসব লেখক কিছু কিছু সাফল্য পেয়েছিল। লোকজন খোলাখুলিভাবে তারা যা বুঝতে পারছে না এসব কিছুর সমালোচনা করার ঝুঁকি নেয়নি। কিন্তু খুব শিগগিরই তারা বুঝতে পারল, তারা সমালোচকদের কথার মারপ্যাঁচে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

ইন্টারনেটের সাধাসিধে ভাষা জগৎটাকে বদলে দিল। প্যারিস একটা সমান্তরাল জগৎ আবির্ভূত হলো। নতুন লেখকরা তাদের কথামালা এবং আত্মাকে বোঝনোর জন্য লড়াই করতে লাগল। আমি ক্যাফেতে এই নতুন লেখকদের সাথে যোগ দিলাম, কেউ তাদের কথা শুনতে চাইত না, কারণ ওই লেখক এবং ক্যাফে কোনোটাই বিখ্যাত ছিল না। আমি একাকী নিজের স্টাইল উন্নত করে চললাম। একজন প্রকাশকের কাছ থেকে শিখলাম, মিউঁচুয়াল সাপোর্টিংয়ের ব্যাপারে আমার জানা দরকার।

.

ফেভার ব্যাংক কী?

আপনি জানেন। সবাই জানে।

সম্ভবত। কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন।

 একজন আমেরিকান লেখক প্রথম এই ব্যাপারটার উল্লেখ করেন। জগতের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক। আপনি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা খুঁজে পাবেন।

হ্যাঁ। কিন্তু আমি এ রকম একটা দেশ থেকে এসেছি, যেখানে কোনো সাহিত্যিক ঐতিহ্য নেই। আমি যে কারো জন্য কী ফেভার করতে পারি?

 অন্ততপক্ষে তা কোনো ব্যাপার নয়। আপনাকে আমি একটা উদাহরণ দিই : আমি জানি আপনি একজন উঠতি লেখক। একদিন আপনি অনেক বেশি প্রভাম্বিত হবেন। আমি তা জানি কারণ আপনার মতো আমিও একদিন উচ্চাকাতক্ষী ছিলাম। ছিলাম স্বাধীন, সৎ। একসময় আমার যে রকম শক্তি ছিল তা আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই, কারণ আমি পারি অথবা চাই না, আমি অবসরের ব্যাপারে কোনো স্বপ্ন দেখছি না। আমি এখনো অপূর্ব জীবনের শক্তি আর মর্যাদার ব্যাপারে স্বপ্ন দেখা থেকে অবসর নিইনি।

 আমি আপনার অ্যাকাউন্টে ডিপোজিট রাখতে শুরু করেছি- ক্যাশ ডিপোজিট নয়, শুধু যোগাযোগ। আপনি বুঝতে পেরেছেন? আমি আপনার সাথে এ রকম কিছু লোকের পরিচয় করিয়ে দেব। কয়েকটা ডিলের জোগাড় করে দেব, অন্তত যত দিন সেগুলো লিগ্যাল থাকবে। আপনি জানেন কিছু ব্যাপারে আমার কাছে ঋণী আপনি। কিন্তু আমি কখনো আপনার কাছে কোনো কিছু চাইনি।

 আর তারপর একদিন…

 ঠিক তাই, একদিন, আমি আপনাকে আমার পক্ষে কিছু করতে বলব। আপনি অবশ্যই করবেন। মুখে হয়তো না বলবেন কিন্তু আপনি আমার ঋণ সমন্ধে সচেতন। আমি যা বলব আপনি তাই করবেন। আমি আপনাকে সাহায্য চালিয়ে যাব। আর অন্যরাও দেখবে আপনি একজন নম্র, ভদ্র, খাঁটি মানুষ। তো তারাও আপনার অ্যাকাউন্টে ডিপোজিট করতে শুরু করবে- সব সময় সেই ডিপোজিট যোগাযোগের রূপে আসে। কারণ এই জগত শুধু যোগাযোগের ভিত্তিতে তৈরি। তার বেশি কিছু নয়। তারাও একদিন আপনাকে তাদের পক্ষে কাজ করতে বলবে। আর আপনিও একদিন যারা আপনাকে সাহায্য করেছিল তাদের সাহায্য করবেন। আর এই সময়ে জগব্যাপী আপনার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হবে। যাদের আপনার দরকার তাদের সবাইকে চিনবেন। আপনার প্রভাব বাড়তেই থাকবে।

আপনি আমাকে যা করতে বলবেন তা আমি অস্বীকার করতে পারি।

আপনি করবেন। ফেভার ব্যাংক অন্য যেকোনো ব্যাংকের মতো খুব ব্যকিপূর্ণ ইনভেস্টমেন্ট। আমি যে সুযোগ-সুবিধা আপনাকে অফার করছি, তা গ্রহণ করতে বা রিফিউজ করতে পারেন। এই বিশ্বাসে আমি আপনাকে সাহায্য করেছি কারণ আপনার সাহায্যের দরকার। কারণ আপনি অনেকের মধ্যে অন্যতম। আর সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনার প্রতিভাকে খুঁজে বের করবে। বেশ, আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আর অন্য যাদের অ্যাকাউন্টে আমি বিভিন্ন রকম ডিপোজিট করে দিয়েছি, তা দেখাতে চাই। কিন্তু তারপর থেকে, সবাই জানে, আমাকে ছাড়া কোনো কথা বলার থাকবে না। আপনি বিশ্বস্ততা হারাবেন।

 আপনি শুধু অর্ধেকটার মতো এগিয়ে যেতে পারবেন, আপনি যতটা চান ততটা পারবেন না। আর একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, আপনার জীবন নিম্মমুখী হতে শুরু করবে। আপনি অর্ধেকটা পথ যেতে পারবেন, পুরো পথটুকু নয়। আপনি কিছুটা সুখী হবেন, কিছুটা দুঃখিত হবেন। হতাশও হবেন না আবার সব আশা পূর্ণও হবে না। আপনি শীতলও নন, উত্তপ্তও নন। আপনি কতটা লুকওয়ার্মের মতো। পবিত্র গ্রন্থে আছে, লুকওয়ার্ম জাতীয় জিনিস কখনো সুস্বাদু হয় না…

.

প্রকাশক ফেভার ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্টে অনেক বেশি ডিপোজিট বা যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। আমি শিখছি, কষ্ট ভোগ করছি। আমার বই ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই দেশের রীতি অনুযায়ী, অপরিচিতরা সব সময় স্বাগতম। শুধু তা-ই নয়, আগন্তুকরা ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়ে থাকে! দশ বছর ধরে, একটা বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে অপূর্ব দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে বাস করছি। আমি আমার পাঠকদের ভালোবাসি। সমালোকচকদের প্রতি বিমুখ (এক লক্ষ কপি বিক্রি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওরা আমাকে প্রশংসা করেছে, তারপর থেকে ওরা আমাকে ভুল বোঝাবুঝির প্রতিভা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আমি সব সময় সঠিকভাবে আমার ডিপোজিট বাড়িয়ে চলেছি। খুব শিগগিরই আমিও একজন ধারদাতা হতে যাচ্ছি। আমার প্রভাব বেড়ে গেছে। আমি অন্যদের দিয়ে নিজের পক্ষে কাজ করানো শিখেছি। অন্যরাও যখন তাদের পক্ষে কাজ করতে বলে, করি।

এসথার ফ্রান্সে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অনুমতি পেয়েছে। যেকোনো সাধারণ বিয়ের মতো ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি ছাড়া, আমি সুখেই আছি। এই প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পেরেছি, পূর্ববতী ভালোবাসার অ্যাফেয়ার এবং বিবাহগুলোর হতাশা ওসব মহিলার কাছ থেকে আসেনি। এসেছে আমার নিজস্ব তিক্ততা থেকে। যাই হোক, এসথার একমাত্র নারী, যে আমার সব কিছুই বুঝতে পারে। ওকে খুঁজে পাওয়ার আগে আমি নিজেকে খুঁজে পাইনি। আমরা আট বছর ধরে একসাথে আছি। আমি বিশ্বাস করি, ও আমার জীবনের সর্বোত্তম ভালোবাসা। যদিও আমি প্রায়ই আমার আশপাশের অন্য নারীর প্রেমে পড়ে যাই। আমি কখনো বিবাহ বিচ্ছেদের সম্ভাবনাকে বিবেচনা করি না। আমি কখনো ওকে জিজ্ঞেস করিনি, ও আমার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা জানে কিনা। ও কখনো এ বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

আর সে কারণেই একটা সিনেমা দেখে ফেরার পথে ওর কথা শুনে আমি বিস্মিত হই। ও আমাকে বলে, ও ওর ম্যাগাজিনকে জিজ্ঞেস করেছে আফ্রিকায় সিভিল ওয়ার নিয়ে কোনো ফাইল রিপোর্ট করতে পারে কিনা।

.

তুমি কী বলেছ?

 আমি যুদ্ধের সাংবাদিক হতে চাই।

 তুমি পাগল হয়ে গেছ। তোমার তা করার দরকার নেই। তুমি যা করতে চাও তা এরই মধ্যে করে ফেলেছ। তুমি যথেষ্ট ভালো আয় করো। আর বাস করার জন্য ওই অর্থ যে তোমার দরকার, তাও নয়। ফেভার ব্যাংকের জন্য যত যোগাযোগ, তা তোমার আছে। তোমার প্রতিভা আছে। তুমি তোমার কলিগদের কাছ থেকে সম্মান অর্জন করেছ।

 সেসব ঠিক আছে। শুধু আমাকে বলতে দাও, আমার একটু একা হওয়া দরকার।

আমার কারণে?

আমরা দুজন একসাথে বাস করেছি। সেভাবেই সব গড়ে তুলেছি। আমি আমার মানুষটাকে ভালোবাসি। আর সেও আমাকে ভালোবাসে। এমনকি যদিও সে সব সময় বিশ্বস্ত স্বামী হিসেবে থাকতে পারে না।

তুমি এ ব্যাপারে এর আগে কখনো কিছু বলেনি…

কারণ আমার কাছে এগুলো কোনো ব্যাপারই না। আমি বোঝাতে চাইছি, বিশ্বস্ততা কী? শরীর ও মনের অধিকার, যা আমার নয়? তুমি কি কল্পনা করতে পারো, আমরা এই যে এত বছর একসাথে ছিলাম, এর মধ্যে আমি কখনো কোনো পরপুরুষের সাথে ঘুমাইনি?

আমি তা পরোয়া করি না। আমি তা জানতেও চাই না।

বেশ, আমিও তা চাই না।

তা, ও রকম ঈশ্বর বিবর্জিত এলাকায় গিয়ে যুদ্ধের ব্যাপারে লেখার দরকারটা কী পড়ল?

আমি যে রকমটি বলেছি, আমার যাওয়া দরকার।

তোমার যা কিছু প্রয়োজন তা কি তুমি পাচ্ছ না?

 একজন মহিলা যা কিছু চায় আমার সব আছে।

তাহলে তোমার সমস্যাটা কোথায়?

এ কথা সত্যি যে, আমার সব কিছু আছে। কিন্তু আমি সুখী নই। আর এ রকম যে শুধু আমি একাই তা নয়। বছরের পর বছর, আমি বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশে সাক্ষাৎকার নিয়েছি, ধনী, গরিব, ক্ষমতাবান, যাদেরকেই সামনে পেয়েছি। আমি দেখতে পেয়েছি সবার চোখেই একধরনের অসীম তিক্ততা। একধরনের দুঃখবোধ, যে সমন্ধে বেশির ভাগ লোকেরই ধারণা নেই। কিন্তু তারা আমাকে যা বলেছে, তা কখনোই করতে পারেনি। তুমি কি আমার কথা শুনছ?

 হ্যাঁ। আমি শুনছি। শুধু ভাবছি। তো, তোমার মত অনুসারে, কেউ সুখী নয়?

কোনো কোনো মানুষকে আপাতদৃষ্টিতে সুখী মনে হয়। কিন্তু তারা সাধারণভাবে ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি ভাবনাচিন্তা করে না। অন্যরা পরিকল্পনা করে, আমার একজন স্বামী থাকবে, একটি বাড়ি, দুটো শিশু, গ্রামে একটি বাড়ি। তারা যখন এসব অর্জন করায় ব্যস্ত থাকে, তখন তাদের বুল ফাইটের ষাড়ের মতো মনে হয়। তারা তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা ভুল পথে থাকে, তাদের লক্ষ্য কী সে সমন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তারা তাদের গাড়ি পেয়ে যায়, মাঝে মাঝে এমনকি ফেরারি গাড়িও কিনে ফেলে। তারা মনে করে, এটাই জীবনের অর্থ। তারা আর কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন করে না। তাদের চোখের ভেতরের দুঃখবোধ, যা তাদের আত্মা বহন করে, তা থেকে ধোকা দেয়। তুমি কি সুখী?

আমি জানি না।

আমি জানি না সবাই অসুখী কিনা। আমি জানি তারা সবাই খুব ব্যস্ত। ওভারটাইম কাজ করা নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করা, স্বামী, ক্যারিয়ার, ডিগ্রি, আগামী দিনে কী করবে তাই নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কী কেনা দরকার তাই নিয়ে ব্যস্ত। খুব কম মানুষই আমাকে বলেছে, আমি অসুখী। বেশির ভাগই বলেছে, আমি খুব ভালো আছি। আমি যা কিছু চেয়েছি তার সব কিছুই পেয়েছি। তারপর আমি জিজ্ঞেস করেছি, কী আপনাকে সুখী করেছে? উত্তরটা হলো, একজন মানুষ যা চায় তার সব কিছু আমি পেয়েছি- পরিবার, একটা বাড়ি, কাজ, সুস্বাস্থ্য। আমি আবার জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এ সবই জীবনের অর্থ কিনা? উত্তর : হ্যাঁ, সব কিছুই ওর মধ্যে নিহিত। আমি জোর দিয়ে বলেছি, তো জীবনের অর্থ হচ্ছে কাজ, পরিবার, বাচ্চাকাচ্চা- যারা বড় হয়ে আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে, স্বামী অথবা স্ত্রী- যে প্রকৃত ভালোবাসার মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বন্ধুর মতো। আর অবশ্যই, একদিন আপনার কাজও শেষ হয়ে যাবে। আর এসব কিছু ঘটার পরে আপনি কী করবেন?

 কোনো উত্তর নেই। তারা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে।

 না। তারা যা বলে, যখন বাচ্চারা বড় হয়ে উঠবে, যখন আমার স্বামী অথবা আমার স্ত্রী আমার ভালোবাসার মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু হয়ে উঠবে, যখন আমি অবসর নেব, তখন আমি সব সময় যা করতে চেয়েছি তা করতে পারব- ভ্রমণ।

প্রশ্ন : কিন্তু আপনি কি বলেননি আপনি এখন সুখী? আপনি সব সময় যা করতে চেয়েছেন তা কি এখনই করেননি? তখন তারা বলে তারা খুব ব্যস্ত। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে।

যদি আমি জোর দিই, তারা সব সময় তাদের যে ঘাটতিটুকু আছে তাই নিয়ে কথা বলে। ব্যবসায়ীরা বলে তারা যে ডিলটা করতে চেয়েছে তা এখন পূরণ হয়নি, গৃহবধূরা আরো অনেক বেশি স্বাধীনতা এবং অর্থকড়ি চায়। প্রেমে পড়া ছেলেরা গার্লফ্রেন্ডকে হারানোর ভয় পায়। নতুন ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্ররা ভাবে তারা নিজেরা তাদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলবে, নাকি তাদের জন্য জোর করে চাপিয়ে দেয়া হবে। ডেন্টিস্ট একজন গায়ক হতে চায়। গায়ক চায় রাজনীতিবিদ হতে। রাজনীতিবিদ চায় লেখক হতে। লেখক চায় কৃষক হতে। আর এমনকি আমি যখন এমন কারো সাথে সাক্ষাৎ করি যে যা হতে চেয়েছিল তাই করছে, সেই মানুষটার আত্মাও নিদারুণ ক্লেশের মধ্যে থাকে। সেও এখনো শান্তির শ্বেত কপোত খুঁজে পায়নি। তো আমি তোমাকে আবারও জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি সুখী?

না। যে মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি সে আমার সাথে আছে। যে ক্যারিয়ারের স্বপ্ন দেখেছি তা হতে পেরেছি। যে ধরনের স্বাধীনতা আমার বন্ধুরা ঈর্ষা করে তা আমি পেয়েছি। ভ্রমণ, সম্মান, প্রশংসা সবই কুড়িয়েছি। কিন্তু আরো কিছু আছে…

কী?

আমার সেই ধারণাটা আছে, যদি আমি থেমে যাই, জীবন পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে পড়বে।

তুমি শুধু রিলাক্স থাকতে পারো না। প্যারিসের দিকে তাকাও, আমার হাত ধরে বলো, আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি, এখন চলো জীবন আমাদের জন্য কী রেখেছে তা উপভোগ করি।

আমি প্যারিসের দিকে তাকাতে পারি। তোমার হাত ধরতে পারি কিন্তু আমি এই কথাগুলো বলতে পারি না।

আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই রাস্তা দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকের অনুভূতিই তোমার মতোই। ওই অভিজাত ভদ্রমহিলা যে একটু আগে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল তিনি সব সময় তার এই দিনক্ষণ ধরে রাখতে চান। সব সময় সব কিছু মেপে দেখেন, কারণ তিনি ভাবেন এসবের ওপরে ভালোবাসা নির্ভর করে। রাস্তার উল্টোদিকে তাকাও, দুটো বাচ্চা নিয়ে এক দম্পতি। তারা বাচ্চাদের সাথে বাইরে বেরোনোর কারণে এই মুহূর্তে নিজেদের সুখী ভাবছে কিন্তু একই সাথে তাদের অবচেতন মন একধরনের আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে, তারা ভাবছে তাদের চাকরিটা যেকোনো সময় চলে যেতে পারে, যেকোনো সময় অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হতে পারে, হেলথ ইনস্যুরেন্স হয়তো সময়মতো কাজ নাও করতে পারে, একটা বাচ্চা দৌড়ে যেতে পারে। তারা এসব দুর্ভাবনা থেকে মুক্তি চায়, বাচ্চাদের এই জগৎ থেকে রক্ষা করতে চায়।

আর কোণের ওই ভিখারি?

 আমি ওর সমন্ধে জানি না। আমি কখনো কোনো ভিক্ষুকের সাথে কথা বলিনি। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক। কিন্তু ওর চোখ, যেকোনো ভিখারির মতো কোনো কিছু লুকাচ্ছে। ওর দুঃখ এতই সুস্পষ্ট, আমি তা বিশ্বাস করতে পারছি না।

কীসের ঘাটতি আছে?

আমার কোনো ধারণা নেই। সেলিব্রেটি ম্যাগাজিনে দেখেছি সবাই হাসছে। কিন্তু যখন থেকেই আমি একজন সেলিব্রেটিকে বিয়ে করেছি, আমি জানি ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। সবাই এই মুহূর্তে ছবির ভেতরে হাসে, কিন্তু পরে সেই রাতে অথবা পরদিন সকালে, গল্পটা সব সময় ভিন্ন ধরনের। ম্যাগাজিনে আমি কীভাবে থাকতে পারি? আমি কীভাবে জানাতে পারি বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য আমার নেই? ছবিতে আমার সাথে যে অভিনেত্রী রয়েছে, যার সাথে আমি হেসে গড়িয়ে পড়ছি, সে এখনো আমার আগামী দিনের অংশ! ওর চেয়ে কি আমি ভালো পোশাক পরেছিলাম? আমরা একে অপরকে অপছন্দ করলেও কীভাবে একসাথে হেসেছি? ম্যাগাজিনের পাঠকদের কাছে আমরা কীভাবে সুখ বিক্রি করি, যখন আমরা নিজেরাই অসুখী, খ্যাতির দাস।

আমরা খ্যাতির দাস নই।

 প্যারানয়েড হয়ো না। আমরা আমাদের কথা বলছি না।

তাহলে কী হচ্ছে বলে তুমি ভাবছ?

 বছরখানেক আগে, আমি একটা বইয়ে মজাদার একটা গল্প পড়েছিলাম। শুধু ধরে নাও, হিটলার যুদ্ধে জিতে গেছেন। সমস্ত ইহুদিদের নির্মূল করে দিয়েছেন। লোকজনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, তারা সমস্ত জাতির সেরা। ইতিহাস বই বদলে যেতে শুরু করেছে। একশ বছর পরে, হিটলারের সাফল্যের কারণে সমস্ত ইন্ডিয়ানরা নির্মূল হয়ে গেল। তিনশ বছর পরে নিগ্রোরাও নির্মূল হয়ে গেল। হয়তো পাঁচশ বছর লাগতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব শক্তিশালী যুদ্ধ যন্ত্র সাফল্যের সাথে সমস্ত এশিয়ানদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হলো। ইতিহাস বই দূর অতীতের বর্বরতার কথা বলে। কিন্তু কেউ তা মনোযোগ দিয়ে পড়ে না। কারণ এর কোনো মূল্য নেই।

নাৎসিদের জন্মের দুই হাজার বছর পরে, টোকিওর একটা বারে, (এই শহরে পাঁচ শতাব্দী পরে দীর্ঘদেহী, নীল চোখের লোকজনের বাস), হ্যাঁন্স আর ফ্রিটজ বিয়ার উপভোগ করছে। এক পর্যায়ে, হ্যাঁন্স ফ্রিটজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ফ্রিটজ, তুমি কি মনে করো ব্যাপারটা সব সময় ঠিক এ রকম?

কী? ফ্রিটজ জিজ্ঞেস করল।

 পৃথিবী।

অবশ্যই পৃথিবী সব সময় এ রকম। আমাদের কি তাই শেখানো হয়নি?

অবশ্যই। আমি জানি না কেন আমি এ রকম বোকার মতো প্রশ্ন করছি। হ্যাঁন্স বলল। তারা বিয়ার শেষ করল। অন্য জিনিস নিয়ে কথা বলতে লাগল। এই প্রশ্নের কথা পুরোপুরি ভুলে গেল।

তোমার অতটা দূর ভবিষ্যতে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি শুধু দুইশ বছর পেছনে যাও। তুমি কি নিজেকে গিলোটিন, ফাঁসির মঞ্চ অথবা একটা ইলেকট্রিক চেয়ারের ভক্তিশ্রদ্ধা করতে দেখতে পাচ্ছ?

আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছ। সমস্ত অমানবিক অত্যাচারের মূলে ক্রস। আমি মনে করতে পারি সিসেররা এটাকে উল্লেখ করেছিলেন বীভৎস শাস্তি হিসেবে। একজন মানুষ মারা যাওয়ার আগে তাকে ক্রসিফাই করাটা ভয়ানক। আর এখনকার দিনে লোকজন ক্রসটাকে তাদের গলায় পরে, বেডরুমের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে। এটাকে ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে। তারা ভুলে যায় এটাকে একসময় শাস্তির যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

আড়াইশ বছর আগে কেউ একজন সিদ্ধান্ত নেয়, শীতের সময়ের প্যাগান উৎসবকে নির্মূল করে দেবে, ওই সময়ে সূর্য পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করে। ধর্মীয় দূতগণ এবং তাদের অনুসারীরা যীশুর ওহি জগতে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, মিথরিক উৎসব সূর্যের জন্মতিথিতে হয়, যা ২৫ ডিসেম্বর তারিখে পড়ে। তারপর একজন বিশপ সিদ্ধান্ত নেন, এই সলস্টিক উৎসব ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর অন্য রূপ! এখন আমাদের কত কিছু আছে, উপহার, উপদেশ, প্লাস্টিক পুতুল, কাঠের জিনিস, কাস্ট-রট আয়রন, যাতে প্রতিপন্ন হয় যিশুখ্রিস্ট এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন!

আর সেই সাথে ক্রিসমাস ট্রিরও প্রচলন ঘটে। তুমি কি জানো এটা কোথা থেকে এসেছে।

কোনো ধারণা নেই।

সেইন্ট বোনিফেস সিদ্ধান্ত নেন ক্রিস্টিনাইজ উৎসবের দেবতা ওডিনকে সম্মান জানাবেন। বছরে একবার, জার্মানির উপগোষ্ঠীরা শিশুকে খোঁজার জন্য একটা ওক গাছের চারধারে উপহার দিয়ে থাকে। তারা ভাবে, এই করলে প্যাগান দেবতাকে খুশি করা যাবে।

হ্যান্স আর ফ্রিটজের গল্পে ফিরে যাই : তুমি কি মনে করো সেই সেই সভ্য মানবীয় সম্পর্ক, আমাদের আশা, আমাদের অর্জন, সব কিছুই অন্য কারো বিকৃত গল্প?

যখন তুমি রোড টু সান্তিয়াগো সমন্ধে লিখেছিলে, তুমি একই রকম উপসংহারে এসেছিলে, তাই নয় কি? তুমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলে কতিপয় নির্দিষ্ট ব্যক্তিই শুধু ম্যাজিকের প্রতাঁকের অর্থ জানে, কিন্তু এখন তুমি বুঝতে পারছ আমরা সবাই এর অর্থ জানি, আমরা শুধু তা ভুলে গিয়েছিলাম। জানাটা কোনো পার্থক্য বয়ে আনে না। লোকজন তাদের মধ্যে যে জাদুকরী শক্তি ধারণ করে থাকে, তা মনে করতে চায় না, চায় না নিজেদের জীবনে তা গ্রহণ করতে। কারণ তাদের ছোটখাটো নিজস্ব জগটা তাতে আপসেট হয়ে পড়বে।

কিন্তু আমাদের সবার সেই সামর্থ্য আছে, তাই না?

পুরোপুরি। আমাদের সবার নিজের স্বপ্ন অনুসরণ করার সাহস নেই। ম্যাজিকের প্রতীক অনুসরণ করতে পারি না। সম্ভবত সে কারণেই দুঃখবোধ ফিরে ফিরে আসে।

আমি জানি না। আর বলছি না আমি সব সময় অসুখী থাকি। বেশ মজা করি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার কাজকে ভালোবাসি। এমনকি আগে-পরে দুঃখবোধ অনুভব করতে পারি আমি। মাঝে মাঝে ভয় অথবা দোষের কারণে কেঁপে কেঁপে উঠি। কিন্তু সব সময় তা সামলে নিতে পারি। হ্যাঁন্সের মতো, আমারও কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আছে, এমনকি কোনো উত্তর না পেলেও। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে তা ভুলে যাই। আমি ক্ষুধার্ত শিশুদের সাহায্য করতে পারি, রাস্তার শিশুদের জন্য একটা ফাউন্ডেশন গড়ে তুলতে পারি, যিশুর নামে মানুষজনকে বাঁচিয়ে তুলতে পারি, এ রকম কোনো কিছু করতে পারি যাতে মনে হয় বেঁচে থাকাটা কাজে লেগেছে। কিন্তু আমি তা করতে চাই না।

 তাহলে কেন তুমি যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে যেতে চাও?

কারণ মনে করি, যুদ্ধের সময়, মানুষ খুব সীমিত সময়ের জন্য বাঁচে, তারা পরের দিন মারা যেতে পারে। এ রকমভাবে যারা বেঁচে থাকে তারা অবশ্যই ভিন্ন রকম আচরণ করবে।

তো তুমি হ্যাঁন্সের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেতে চাও?

হ্যাঁ, তাই চাই।

.

হোটেল ব্রিস্টলের অপূর্ব সুটে বসে আজ আইফেল টাওয়ারের চকমকানি দেখছি। প্রতি ঘণ্টায় ঘড়ির শব্দ ওদিকে মন কেড়ে নিচ্ছে। ওয়াইনের বোতল খালি হয়ে এসেছে। সিগারেটও দ্রুত শেষ হওয়ার পথে। লোজন আমাকে এভাবে অভিবাদন জানাচ্ছে, যেন তেমন কিছুই হয়নি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসেই কি তা শুরু হয়েছিল? আমি ওকে খোঁজা বন্ধ করে দেব অথবা আমি কি আবার পূর্ণ উদ্যমী হব আর গোটা ব্যাপারটা ভুলে যেতে বলব? কারণ ও ছিল আমার স্ত্রী আর আমার দরকার ওকে। ওর সহযোগিতা দরকার?

 ননসেন্স। এই মুহূর্তে, আমি জানতাম, যা এখন জানি। ও যা চেয়েছে তা মেনে নেয়া ছাড়া আমার আর কোনো অপশন ছিল না। আমি যদি বলতাম, একজন যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রাহক হও অথবা আমাকে বেছে নাও। এসথার আমার জন্য যা কিছু করেছে সবই আমি অস্বীকার করতে পারতাম। তাতে ওর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারতাম না। কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, ওর কিছুটা স্বাধীনতার দরকার ছিল। বাইরের দুনিয়ায় বেরিয়ে গভীর আবেগের অভিজ্ঞতা হওয়া দরকার। আর তাতে ভুলটা কী ছিল?

আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, ফেভার ব্যাংক থেকে প্রথম দিকে আমি খুব বেশি কিছু উত্তোলন করতে পারিনি। (এখন আমি যখন এই জিনিসটা নিয়ে ভাবি তখন ব্যাপারটাকে হাস্যকর মনে হয়)। দুই বছর যাবৎ, এসথার বিভিন্ন রকমের সংঘর্ষ খুব কাছ থেকে দেখেছে। এক উপমহাদেশ থেকে আরেক উপমহাদেশে এ রকমভাবে গেছে যেন জুতো বদলাচ্ছে। ও যখনই ফিরে আসত, আমি ভাবতাম এবার বোধ হয় সব ছেড়েছুঁড়ে দেবে। এমন এক জায়গায় দীর্ঘদিন বাস করা সম্ভব নয়, যেখানে অভিজাত খাবার নেই, প্রতিদিন গোসলের ব্যবস্থা নেই, নেই সিনেমা অথবা থিয়েটার। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ত্যান্সের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে কিনা। ও সব সময় আমাকে বলেছে, ও ঠিক পথেই আছে। আর আমাকে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। মাঝে মাঝে, ও মাসের পর মাস বাড়ি থেকে দূরে থাকত। বিপরীত দিকে বলা যায়, বিয়ের অফিসিয়াল ইতিহাস (আমি ওর টার্মগুলো ব্যবহার করতে শুরু করেছি), এ রকম দূরত্ব আমাদের মধ্যে ভালোবাসাকে আরো মজবুত করত। বুঝিয়ে দিত, একে অন্যের কাছে আমরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সম্পর্ক, যা আমি ভেবেছিলাম প্যারিসে যাওয়ার পরে একটা আর্দশ সম্পর্কে রূপ নিয়েছে, দিন দিন আরো ভালোর দিকে যাচ্ছে।

আমি বেশ বুঝতে পারছি, মিখাইলের সাথে ওর দেখা হয় যখন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ওর একজন অনুবাদকের দরকার হয়ে পড়ে। প্রথমে, এসথার মিখাইলের সমন্ধে বেশ প্রাণশক্তি নিয়ে কথা বলত- মিখাইল খুব সেনসেটিভ ব্যক্তি, যে এই পৃথিবীটাকে বাস্তব ভঙ্গিতেই দেখে। মিখাইল এসথারের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। কিন্তু এ রকম গুণ ছিল এসথার যাকে ম্যাজিক্যাল বা জাদুকরী বলে আখ্যা দিয়েছে। আমি খুব ধৈর্য ধরে দ্রভাবে ওর কথা শুনে গেছি, যেন আমরা দুজনই ওই ছেলেটার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। কিন্তু সত্যটা হলো, আমার মন তখন অনেক দূরে, আমি কী কী জিনিস করব তাই নিয়ে ভাবছিলাম, আর্টিকেলের জন্য আইডিয়া, সাংবাদিক আর প্রকাশকদের প্রশ্নের উত্তর, যে মেয়েটি আমার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে তাকে কীভাবে প্রভাবিত করব, ভবিষ্যতের বই প্রমোশনের ব্যাপারে পরিকল্পনা করছি।

আমি জানি না এসথার এসব লক্ষ্য করেছিল কিনা। আমিও লক্ষ্য করতে পারিনি, ধীরে ধীরে আমাদের কথোপকথন থেকে মিখাইল দূরে সরে যাচ্ছে। তারপর এক সময় পুরোপুরি অন্তর্হিত হয়ে গেল। এসথারের আচরণ ধীরে ধীরে বহিঃমুখী হয়ে উঠল। এমনকি ও যখন প্যারিসে থাকত, তখনো সপ্তাহের অনেক রাত বাইরে কাটাত, আমাকে বলত ভিখারিদের ওপর একটা আর্টিকেল লেখার জন্য রিসার্চ করছে।

 আমি ভেবেছিলাম ওর অবশ্যই কারো সাথে চক্র চলছে। গোটা একটা সপ্তাহ আমি যন্ত্রণায় দগ্ধ হলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমার সন্দেহের ব্যাপারে আমি কি ওকে বলব, নাকি এ রকম ভাব করব, কিছুই হয়নি? আমি এসব এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই নীতিতে বিশ্বাসী থাকলাম, চোখ যা দেখতে পায় না, হৃদয় তার জন্য নালিশ করতে পারে না। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম আমাকে ছেড়ে যাওয়ার মতো সামান্যতম সম্ভবনাও নেই। আমাকে সাহায্য করার জন্য ও এত পরিশ্রম করত, ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কের জন্য তা ছেড়ে যাবে, তা কোনো যুক্তিতে আসে না।

 যদি এসথারের কাজ, ওর নিজস্ব জগতের ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকত, তাহলে অন্তত ওকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, ওর সেই অনুবাদকের জাদুকরী আবেগের কী খবর। ও রকম নীরবতায় সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠতে পারতাম। কোনো তথ্য না দেয়ায় সন্দেহ করতে পারতাম। একদিন ওর সাথে ভিখারিদের নিয়ে ওর রিসার্চ ট্রিপ-এর সঙ্গী হতে পারতাম।

ও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত, আমি ওর কাজে আগ্রহী কিনা। আমার উত্তর সব সময় একই রকম, হ্যাঁ, আমি ইন্টারেস্টেটেড। কিন্তু এতে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমি চাই তুমি তোমার স্বপ্নকে স্বাধীনভাবে অনুসরণ করো, তোমার মতো করে, যেভাবে তুমি আমাকে সাহায্য করেছ।

আমার কথার অর্থ ছিল, অবশ্যই আমি ওর কাজের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাতাম না। কিন্তু লোকজন নিজেরা যা বিশ্বাস করে তাই সব সময় বিশ্বাস করতে চায়, এসথার আমার উত্তরে বেশ খুশি মনে হতো।

পুলিশ সেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে পুলিশ ইনস্পেক্টর আমাকে যে কথাটি বলেছিল তা মনে পড়ে গেল, আপনি একজন মুক্ত মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ কী? তুমি যা করছ তাতে তোমার স্বামীর কোনো আগ্রহ নেই? একা থাকার অনুভূতি, কেউ তোমার ভেতরের আবেগের অংশীদার হচ্ছে না, কারণ যে মানুষটাকে তুমি বিয়ে করেছ সে পুরোপুরি তার নিজের কাজে মনোযোগী, তার নিজের কাজের গুরুত্ব, কঠিন ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত?

আমি আইফেল টাওয়ারের দিকে তাকালাম। আরেকটা ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। টাওয়ার এ রকমভাবে চকমকাচ্ছে যেন হীরকের তৈরি। আমার কোনো ধারণা নেই জানালার পাশে থাকলে এ রকমটা কতবার দেখা যায়।

আমি জানি, আমাদের বিয়ের স্বাধীনতার নাম, আমি লক্ষ করিনি মিখাইল আমার স্ত্রীর কথোপকথন থেকে অন্তর্হিত হয়েছে, শুধু বারে একবার আবির্ভূত হয়েছিল, তারপর আবার অন্তর্হিত হয়েছে। এইবার ওকে তার সাথে করে নিয়ে গেছে। পেছনে ফেলে রেখে গেছে ওর বিখ্যাত, সফল লেখক স্বামীকে প্রথম সন্দেহভাজন হিসেবে।

অথবা, তার চেয়ে খারাপ, মানুষটাকে পরিত্যাগ করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *