৩. সিভিউ হোটেলের সামনে

০৩.

মাইক ব্যানিয়েন সিভিউ হোটেলের সামনে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল। তারপর রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেল।রিসেপশনের ছিমছাম পোশাক পরা বয়স্ক ভদ্রলোকটি অভ্যর্থনার হাসি হাসল।

মিঃ ভাল আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

–আপনি কি মিঃ লুকাস?

—হ্যাঁ।

আর্ট তাকে বলে দিয়েছিল তার নাম টেড লুকাস। ঐ নামেই হোটেলে রিজার্ভেশন করা আছে।

 রিসেপশনিস্ট ফোন তুলে কার সঙ্গে কথা বলল।

মিঃ ভান্স আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

 দোতলা, দুনম্বর ঘর। আপনার ঘর চার তলার বার নম্বর। ব্যাগটা যদি রেখে যান আপনার ঘরে পৌঁছে দেব।

মাইক এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেল। প্লেন চড়া আর ব্যাগ বওয়ার জন্য তার ভেতরের যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সে সত্যিই মরবে না। কিন্তু আজ এত যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে, সে নিজেকে মিথ্যে স্তোক দিচ্ছে।

সে দুনম্বর ঘরের দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে একটা কড়া গলা তাকে ভেতরে আসতে বলল।

.

লু ব্ৰাডে একটা হুইল চেয়ারে বসেছিল। মাইক দেখল একটা রোগা পাতলা বৃদ্ধ তার সামনে বসে আছে।

ম্যাগী পর্যন্ত তার ছদ্মবেশ ধরতে পারেনি। গতকাল রাতে ঘরে ঢুকে ব্রাডেকে দেখে ম্যাগী লজ্জিত হয়ে মাফ করবেন বলে ফিরে যাচ্ছিল। তাকে স্টেলা জ্যাকি নাম নিতে বলা হয়েছিল।

ব্রাডে তার পরিচিত গলায় বলল–আরে এসো এসো সুন্দরী।

ম্যাগী চোখ বড় বড় করে ব্রাডের দিকে তাকিয়েছিল।

ব্রাডে ম্যাগীকে বলেছিল নতুন লোকটির ওপর লক্ষ্য রাখতে। ম্যাগী তাই শোবার ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করে ওদের কথাবার্তা শুনছিল।

মাইককে লু ব্ৰাডে ঠাণ্ডা চোখে জরিপ করছিল। একটু পরেই সে সহজ হয়ে গেল। না, বেশ শক্তপোক্ত লোক। শৃঙ্খলা বোধের একটা আভা বেরোচ্ছে লোকটার মধ্যে থেকে। কিন্তু গর্তে বসা। চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তায় পড়ল ব্রাডে। অবশ্য দৃঢ় মুখ আরশক্তিশালী চোয়াল রেখা দেখে সে নিশ্চিন্ত হল।

মাইককে বৃদ্ধের গলায় ব্রাডে বলল তুমিই মাইক ব্যানিয়েন-তোমার নিজের সম্বন্ধে আমাকে বল। মাইক সরাসরি তাকাল ব্রাডের দিকে। এই বৃদ্ধের মধ্যে কি একটা ছলনা রয়েছে।

আমি এখানে একটা কাজ করতে এসেছি। আপনি আমার সম্বন্ধে জানতে চাইবেন না–আমিও চাইব না আপনার সম্বন্ধে কিছু জানতে।

কথাগুলো ব্রাডের পছন্দ হল। তবে আরেকটু ওকে বাজিয়ে নেওয়া দরকার, সে ভাবল।

–শুনেছি তোমার লক্ষ্য অব্যর্থ। একটু দেখতে চাই।

এই সময় ম্যাগী শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে হাততালি দিয়ে বলল–চমৎকার লোক।

–এস আমরা একটু ড্রিংক করে নিই। ব্রাডে মাইকের সাথে ম্যাগীর পরিচয় করিয়ে দিল। তার এলাকার নামও বলে দিল।

ব্রাডে বলল, তোমাকে ঠকাবার জন্য দুঃখিত। তবে তোমাকে পরীক্ষা করে নেওয়ার দরকার ছিল। আমি সন্তুষ্ট, ম্যাগী তুমি?

ম্যাগী বলল লোকটার পেশীগুলো কি সতেজ।

ব্রাডে হাসল–ম্যাগীর সঙ্গে তোমার মানিয়ে নিতে সময় লাগবে, মাইক। আমারও লেগেছিল।

মাইক এবার নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। পেশাদারী গলায় সে বলল, আমাকে কি করতে হবে মিঃ ভান্স?,

–আমি একজন অথর্ব বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করছি। ম্যাগী আমার নার্স। তুমি আমার সোফার। তোমার ইউনিফর্ম নিয়ে এসেছ?

–এনেছি।

–বেশ, এবার আমাদের প্ল্যান শোন।

 ব্রাডে কুড়ি মিনিট ধরে মাইককে ব্যাপারটা বোঝাল। বলল, তোমাকে এক বিশেষ ধরনের পিস্তল চালাতে হবে। তাতে কেউ মারা পড়বেনা। পিস্তল থেকে একটা বর্শা প্রহরীদের ঘাড় লক্ষ্য করে ছুঁড়বে। এছাড়া সিন্দুক থেকে বাক্সগুলো সরাবার কাজে আমাকে সাহায্য করতে হবে। এর জন্যে তুমি পাবে পঞ্চাশ হাজার ডলার। ম্যাগী ঘর থেকে পিস্তলটা নিয়ে এস।

মাইক বলল, আপনি জানতে চাইছিলেন আমার লক্ষ্য অব্যর্থ কিনা বলে মাইক ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কুড়ি ফুট দূরে একটা ছবি ঝুলছে। সে ম্যাগীর আনা পিস্তলটা নিয়ে বলল, বাঁ দিকের ছেলেটির ডান চোখ দেখতে পাচ্ছেন?

মাইক বসা অবস্থায় পিস্তলটা তুলল, তুলে ট্রিগার টিপল। বব করে একটা আওয়াজ হল।

-দেখুন।

ব্রাডে হুইল চেয়ার ছেড়ে ছবিটার কাছে গিয়ে দেখল বাঁ দিকের ছেলেটির ডান চোখে ওষুধ মাখানো বর্শাটা বিঁধে রয়েছে।

.

সময় এখন বেলা এগারোটা চল্লিশ মিনিট। স্প্যানিস হোটেলের চারপাশে বেয়ারারা ককটেল ভর্তি ট্রে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ডেক চেয়ারে বসে ধনীরা আঙ্গুলের ইশারায় তাদের ডেকে মাঝে মাঝে পান করছিল।

উইলবার ওয়ারেনটনের সকালের সাঁতার কাটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তার পাশের্তার স্ত্রী মারিয়া একটা বিকিনি পরে বসে বসে নভেল পড়ছিল। মারিয়া সন্ধ্যাবেলায় সাঁতার কাটে। সকালে নয়। তারপর একঘণ্টা ধরে মেক-আপ করে রাতে দেরী করে খেতে যায়।

উইলবার দুবার মার্টিনি পান শেষ করেছে। এখন তার নিজেকে ফুরফুরে লাগছে। তার মধুচন্দ্রিমা খুবই সফল হয়েছে। এই হোটেলের ব্যবস্থা অতি চমৎকার। কিন্তু মারিয়া হচ্ছে সেই ধরণের মহিলা যারা সবসময়েই সার্ভিস নিয়ে অনুযোগ করে। বর্তমানে তার অনুযোগ রয়েছে এই হোটেলে বড্ড বেশী সংখ্যায় বুড়ো মানুষ রয়েছে।

উইলবার তাকে বলেছে বে হোটেল জগতের মধ্যে সবচাইতে দামী আর ভাল হোটেল। এই বৃদ্ধেরা খুবই ধনী। তাই তো এখানে থাকবার টাকা জোগাড় করতে পেরেছে। আমাদের ভাগ্য ভাল যে বাবা টাকাটা জুগিয়েছেন।

নাক কুঁচকিয়ে মারিয়া বলল, যেন মনে হচ্ছে কবরখানায় রয়েছি।

–আমরা অন্য জায়গায় চলে যেতে পারি। কিন্তু সে সব জায়গা কি তোমার পছন্দ হবে? রিভেজে যেতে পারি।

–রিভেজ! ওটা তো একটা বস্তী উইলবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাবাকে ফোন করতে যাচ্ছি।

–হে ভগবান! রোজ কি তোমার বাবাকে ফোন না করলে চলে না?

–তিনি আমার ফোনের অপেক্ষা করেন। আমার বেশী দেরী লাগবে না।

 উইলবার রোজই বাবার সঙ্গে কথা বলে। সে জানে বাবা তার ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকেন। আর তার বাবা নিঃসঙ্গ। তিনি চান সে তাড়াতাড়ি ডালাসে ফিরে যাক আর তাকে একটি নাতি উপহার দেয়। কথাপ্রসঙ্গে সে মারিয়াকে বলেছিল যে বাবা তাদের জন্য ডালাসে একটা ডিলুক্স বাড়ি কিনেছেন। বাড়িটা পুরো সাজান, পরিচারক-পরিচারিকারয়েছে, দুটো গাড়ি, সুইমিং পুল এবং একটা ছোট পার্কও আছে।

–কে ডালাসের মত গর্তে বাস করতে চায়? আমি প্যারিস বা ভেনিসে যেতে চাই,মারিয়া বলেছিল।

উইলবার শান্তভাবে বলেছিল, কিন্তু আমার কাজের জায়গা যে ডালাস, মারিয়া। আমরা পরে প্যারিসে যাব।

মারিয়া রেগেমেগে কোন উত্তর দেয়নি। পেন্ট হাউসে ঢুকে বসবার ঘরে গেল উইলবার। সেখান থেকে বাবাকে ফোন করল।

বল, গিলাস ওয়ারেনটন বললেন, কেমন চলছে?

–চমৎকার, বাবা। তুমি কেমন আছ?

–প্রচুর কাজ। আমি কিছুস্টক বিক্রি করেছি, ভাল লাভ হয়েছে। আরবদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা চলছে।

–ভালই চলছে তাহলে।

–তোমার বউ কেমন আছে? সন্তানসম্ভবা হল কি?

উইলবার জোরে হাসল। আমাদের একটু সময় দাও, বাবা। পুরোদস্তুর সংসারী হওয়ার আগে পৃথিবীটা একটু দেখে নিতে দাও।

গিলাস ওয়ারেনটন হতাশ হয়ে বলল, ঠিক আছে, তোমরা কবে আসছ?

–দুসপ্তাহের মধ্যে।

–আমি আমার কাজের কিছু বোঝা হালকা করতে চাই। বাড়িটার কথা মারিয়াকে বলেছ। আশা করি, ওর পছন্দ হবে।

-বলেছি, শুনে খুব খুশি হয়েছে।

–তা তো হবেই। খরচ পড়েছে তিরিশ লক্ষ ডলার। একটু অসন্তোষের গলায় বললেন গিলাস ওয়ারেনটন। যা হোক, তোমাদের আনন্দেই আমার আনন্দ। আমার বোর্ড মিটিং আছে। এখন রাখছি। ভাল থেক।

উইলবার যখন ফোনে কথা বলছিল, অনিতা বাথরুম পরিস্কার করতে করতে সব শুনছিল। বাবাঃ কি বড়লোক এরা। এই ছেলেটিই তেল রাজ্যের রাজা হবে একদিন। অনিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

অনিতা আগের দিন সারা রাত ঘুমায়নি। ম্যানুয়েলের বোটের সামনে ঘিঞ্জি কেবিনের মধ্যে ম্যানুয়েল আর ফুয়েনটেসের সঙ্গে সে কয়েকঘণ্টা কথা বলেছে। প্রথমে সে পেড্রোকে সাহায্য করার জন্য ফুয়েনটেসকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ফুয়েনটেসকাধাকিয়ে বলল, আমি কি করতে পারি। আমাকেই পুলিশ খুঁজছে। আমিই বরং কিছু টাকা জোগাড় করে পালাবার ধান্দা করছি।

-তুমি এখানেই নিরাপদ ফুয়েনটেস, ম্যানুয়েল বলল, আমি আমার বন্ধুদের বিপদে ফেলিনা।

-পেড্রোও তত তোমার বন্ধু ছিল, অনীতা বলল।

আমার নয় ফুয়েনটেমের।

ফুয়েনটেস বিরক্তভাবে হাত নেড়ে বলল–আমি কিছুই করতে পারব না। সে পুলিশের হেফাজতে এবং আহত। আমি কি করতে পারি?

অনিতা এবার তার প্রস্তাবটা রাখল। দুজনে মনোযোগ দিয়ে শুনল। ফুয়েনটেস হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল–তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি চলে যাও, আর এখানে এস না।

ম্যানুয়েল হাত দিয়ে ফুয়েনটেসকে থামতে বলল–না, এর মধ্যে সম্ভাবনা আছে। তুমি ঠাণ্ডা হয়ে বস।

-পাগলামো, স্রেফ পাগলামো। ফুয়েনটেস গজগজ করতে লাগল।

ফুয়েনটেস পঞ্চাশ লক্ষ ডলারের কাজ আমার কাছে পাগলামো মনে হয় না।

অনিতা ঝাঁকড়া চুলওলা নিষ্ঠুর চোখের লোকটার দিকে তাকাল। হয়তো এর ওপর নির্ভরকরা চলে।

ম্যানুয়েল অনিতার দিকে তাকাল। আমাকে ভালভাবে ব্যাপারটা বুঝতে দাও। তোমার পরিকল্পনা হল আমরা হোটেলের পেষ্ট হাউসটা দখল করে উইলবার ও তার বউকে মুক্তিপণের জন্যে আটকিয়ে রাখি।

হা উইলবারের বাবা কোটিপতি। আর সেতার ছেলেকে ভীষণ ভালবাসে। পঞ্চাশ লক্ষ ডলার ছেলের বিনিময়ে কিছুই নয় তার কাছে।

–কিন্তু পেন্টহাউস দখল করব কি করে?

ফুয়েনটেস উত্তেজিত হয়ে বললো–একদম পাগলী। ওখানে সশস্ত্র প্রহরীরা আছে।

–আঃ তুমি থাম। বল, পেন্টহাউস দখল কি করে করব?

আমার সাহায্যে। অনিতা বলল, আমি ঐ হোটেলে কাজ করি। ওখানে সুরক্ষার কি ব্যবস্থা কি ভাবে প্রহরীদের চোখ এড়াতে হবে, সব আমি বলে দেব। অনিতা ফুয়েনটেসের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাকে পুলিশ খুঁজছে। তুমি কি এখানে মাসের পর মাস থাকতে পারবে? ভাব একবার, পেন্টহাউস দখল করলে তুমি হোটেলের কাছ থেকে খাবার, মদ, সিগারেট সবকিছু চাইতে পার। কারণ, তোমাদের হেফাজতে ওয়ারেনটনরা আছে।

ফুয়েনটেস আস্তে আস্তে বলল–তুমি নিশ্চিত আমাদের পেন্টহাউসে ঢোকাতে পারবে?

অনিতা বুঝল এরা টোপ গিলেছে। সে সহজ স্বরে বলল–আমার কাছে দরজা এবং পেন্টহাউসের ডুপ্লিকেট চাবি আছে।

ম্যানুয়েল বলল ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমাদের একজন তৃতীয় লোক চাই। আমরা জানিনা কতদিন ওখানে থাকতে হবে। একজন জাগবে একজন ঘুমোবে তা হয় না।

আমি-ই হব সেই তৃতীয়জন অনিতা বলল।

 ম্যানুয়েলের পছন্দ হল না তোমার বাইরে থাকাটাই ভাল।

কিন্তু অনিতা দৃঢ়স্বরে বলল–আমিই সেই তৃতীয় জন হব। খুব শিঘ্রী পুলিশ আমার খোঁন্সে আসবে। তখন পেন্টহাউসের চাকরীও আমার থাকবে না। যা করবার তাড়াতাড়ি কর।

ম্যানুয়েল মাথা নেড়ে বলল–ঠিক আছে, আমাদের একটু ভাবতে দাও। কাল রাতে এখানে এস।

কাল রাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেবে।

–ঠিক আছে। অনিতা ম্যানুয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার একটা শর্ত আছে। তা হলেই পেন্ট হাউসে তোমাদের ঢোকাব।

মুক্তিপণের শর্তের সাথে পেড্রোর মুক্তির কথাও থাকবে। টাকা পয়সা তোমরা ভাগ করে নিও। কিন্তু পেড্রো যেন আমাদের সাথে হাভানায় যেতে পারে।

ফুয়েনটেস আবার উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল–তোমার মাথা খারাপ। পেড্রো আহত। আর দুদুটো সে খুন করেছে। পুলিশ ওকে কিছুতেই ছাড়বে না।

-চুপ কর। ম্যানুয়েল গর্জে উঠল।

মিসেস সারটেসশর্তটা খুব কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। একবার যদি আমরা পেন্টহাউসের দখল নিতে পারি,আমরাসবরকমশর্তরাখতে পারব।আমি তোমাকেকথাদিচ্ছি, আমরা আপ্রাণ চেষ্টাকরব যাতে পেড্রোও আমাদের সাথে হাভানায় যেতে পারে। আমার কথার দাম সবাই জানে।

অনিতা ঠাণ্ডা চোখে বলল–ম্যানুয়েল আমি বোকা মেয়ে নই। আমার একমাত্র লক্ষ্য আমার স্বামীকে ফিরে পাওয়া। সময় যখন আসবে–তখন যদি দেখি পুলিশ পেড্রোকে ছাড়ছেনা, আমি ঐ ওয়ারেনটন আর ওর পাজী বউটাকে খুন করব। একথাগুলো ওদের জানিয়ে দিও। না পারলে আমিই বলব।

ম্যানুয়েল সপ্রশংসদৃষ্টিতে হতবাকের মতন অনিতার দিকে তাকিয়ে থাকল। একজনশক্তিশালী মেয়ে বটে। এ যা মুখে বলছে, কাজেও তা করবে।

-হ্যাঁ। ওতে কাজ হতে পারে। কাল এস। প্রথমেই তোমার স্বামীর খবরটা নিতে হবে। তারপর আমাদের পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।

অনিতা উঠে দাঁড়াল।

স্প্যানিশ বে হোটেলের দিনের ডিউটিরিসেপশনক্লার্কক্লভেরবয়সপঁয়ত্রিশ বছর। লম্বা, দোহারা শ্যামলা রঙের সুপুরুষ। সকাল থেকে ডেস্কে বসে লাউঞ্জে ধনীবুড়ো লোকগুলিকে দেখে দেখে সে ক্লান্ত হচ্ছিল। হঠাৎ তার সামনে আবির্ভাব হল সাদা পোশাক পরিহিত চমৎকার এক রমনী।

ম্যাগী নার্সের পোশাক পরে ক্লভের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বুঝল ক্লভ প্রথম দেখাতেই কাত হয়েছে।

মিঃ কর্নেলিয়াস ভ্যান্সের একটা রিজার্ভেশন আছে–মোহিনী স্বরে সে বলল।

ক্লভ এতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়েছিল। তারপর নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে অভিবাদন করল। বিগলিত স্বরে বলল– মিঃ ভান্স? নিশ্চয়। তিন নম্বর ব্যালেতে।

ধন্যবাদ। কিন্তু অথর্ব বৃদ্ধটি বাইরেই রয়ে গেছেন। আমি তাঁর হয়ে সই করতে পারি কি? বলে মোহময়ী হাসি হাসল ম্যাগী।

পারভিন ক্লভ টুসকি দিয়ে দুজন লোককে ডাকল। বলল–আপনি সই করতে পারেন। আর এরা দুজন আপনাকে ঘরে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

ম্যাগী সই করে মাতাল করা একটা হাসি উপহার দিয়ে দুজন বেলবয়ের সঙ্গে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রোলস রয়েসের দিকে এগোল।

পারভিন তখনও সম্মোহিতের মতন ম্যাগীর যাওয়া দেখছিল। হঠাৎ হোটেলের মালিক মিঃ ডুলাক এসে প্রশ্ন করলেন।

–মেয়েটি কে, পারভিন।

–গুড মর্নিং, মিঃ ডুলাক। মিঃ কর্নেলিয়াস ভান্স এই হোটেলে থাকতে এসেছেন। ঐ মেয়েটি ওর নার্স।

–ও, হ্যাঁ। মিঃ ভ্যান্স তো পঙ্গু। তবে কেমন নার্স রাখতে হয় তিনি তা জানেন।

জোরে হাসল পারভিন। যা বলেছেন স্যার।

ডুলাক চলে গেলনা। লাউঞ্জে বসে থাকা বোর্ডারদের সঙ্গে কথা বিনিময় করতে করতে সুইমিং পুলের দিকে এগিয়ে গেল।

ডিলুক্স ব্যালেটে পৌঁছেই লু ব্রাডে, ম্যাগী আর মাইক শ্যাম্পেন বার করে বসল।

.

অনিতা, আবার ম্যানুয়েলের ঘিঞ্জি বোটটার কেবিনে উঠে এল। ম্যানুয়েল বলল–কাজটা আমরা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার স্বামীর খবর পেয়েছি। তার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তবে বেঁচে যাবে। ডাক্তাররা খুবই চেষ্টা করছে। চিন্তা কোরনা, অনিতা।

অনিতাকে হাত মুঠো আর চোখ বন্ধ করতে দেখে ম্যানুয়েল ভাবল, লোকটার কি ভাগ্য। এমন বউ পেয়েছে।

ম্যানুয়েল জানাল পুলিশরা পেড্রোর পরিচয় বার করবার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি এখনও। আমাদের লোকজন মুখে কুলুপ এঁটে আছে। অতএব আমাদের পরিকল্পনা কার্যকরীকরার যথেষ্ট সময় রয়েছে?

অনিতা উদ্বিগ্ন ভাবে ম্যানুয়েলের দিকে তাকাল। তারপর সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করল–আমার স্বামী বাঁচবে তো?

–হ্যাঁ, বেঁচে যাবে। ঐহসপিটালে আমার এক বন্ধু রয়েছে। সে বলছে, পেড্রো মারাত্মক আহত তবে বেঁচে যাবে।

অনিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে তা মুছে ফেলল।

ম্যানুয়েল বলল, পেড্রো ভ্রমণ করার মন সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষাকরতে হবে। তাহলে দেখছ, আমি শুধু টাকার চিন্তা করছি না তোমার স্বামীর জন্যও ভাবছি। আমাদের এমন চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে পুলিশ পেড্রোকে ছেড়ে দেয়।

কেমন চাপ? অনিতা প্রশ্ন করল।

–স্প্যানিশ বে জগতের সেরা হোটেল। ঐ হোটেলটা না থাকলে শহরের অর্ধেক আয় কমে যাবে। সুতরাং ডুলাক নিজেই পেড্রোকে ছাড়াবার প্রাণপন চেষ্টা করবে।

ধর, পুলিশ যদি তোমার ধাপ্পায় না বিশ্বাস করে?

 ম্যানুয়েল একটু হাসল, আমি কখনও ধাপ্পা দিই না। আমি একটা শক্তিশালী বোমা হোটেলের মধ্যে রাখব। তোমাকে তার উপযুক্ত জায়গা খুঁজে দিতে হবে।

অনিতা বলল সত্যিই তোমার কাছে বোমা আছে?

 কয়েকদিনের মধ্যেই আমি দুটো বোমা পাব। এ বিষয়ে আমি কথাবার্তা বলে রেখেছি। প্রথম বোমাটা সাধারণ, সামান্যই ক্ষতি হবে। দ্বিতীয় বোমাটা শক্তিশালী। পেন্টহাউস দখল করে একটা বেতারের সাহায্যে হোট বোমাটা ফাটিয়ে ডুলাককে জানিয়ে দেওয়া হবেআমরা মিথ্যে কথা বলছি না।

অনিতা উৎসাহিত হয়ে বলল, চমৎকার প্ল্যান। তুমি সত্যিই সত্যনিষ্ঠ লোক। আমি বোমা দুটো কোথায় লুকোব?

রান্নাঘরে।রান্নাঘর উড়ে যাওয়ার মানে হোটেলও বন্ধ। ডুলাককে একথাবললে সেনিশ্চয়ই ঘাবড়ে যাবে। তবে কাজটা সহজ নয়। কিন্তু তোমার স্বামীকে তো বাঁচাতেই হবে।

অনিতা কিছুক্ষণ বসে ভাবল। তারপর উঠে পড়ে বলল- ঠিক আছে, আমি বোমা দুটো লুকোবার জায়গা খুঁজে বার করব। ধন্যবাদ।

অনিতা চলে যাওয়ার পর ফুয়েনটেস বলল, পেড্রোর জন্য ভাবনা করার কি দরকার। পঞ্চাশ লক্ষ ডলার আমাদের পেলেই হল। ঐসব বোমাটোমা রাখার প্ল্যান বাতিল কর।

ম্যানুয়েল ব্যস্ত স্বরে বলল, আরে আমি ওকে কথা দিয়েছি। পেড্রোকে আমাদের সাথে নিতে। হবে।

ফুয়েনটেস বলল, দাঁড়াও বোমার ব্যাপারে কে তোমার সঙ্গে থাকবে?

ম্যানুয়েল বলল, তাহলে বন্ধু বন্দরে বেরিয়ে পড়া পুলিশ তোমাকে ধরে নিক। হয় আমি যা বলব তাই তোমাকে করতে হবে, নয়তো নিজের পথ দেখ।

ফুয়েনটেস বুঝল ম্যানুয়েলের কথা শোনা ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই, ব্যাজার মুখে বলল, বেশ, আমি রাজি।

ম্যানুয়েল ফুয়েনট্রেসের কঁধ চাপড়ে বলল তা হলে এস আমরা এই উপলক্ষে পান করি। তবে মনে রেখ আমার সঙ্গে কাজ করব বলে যে আমার পান করার সঙ্গ দেয়–সেটা তখন তার কাছে এক অলঙ্ঘনীয় চুক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

ফুয়েনটেস নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি বুঝতে পারছি।

.

মিয়ামি থেকে আসা দুজন ডিটেকটিভ আর প্যারাডাইস সিটির আটজন ডিটেকটিভ মোট দশ জন ডিটেকটিভ উপকূল অঞ্চল তন্ন তন্ন করে খুঁজছিল ফুয়েনটেসকে ধরবার জন্য। সঙ্গে পেড্রোর ছবিও ছিল যদি কেউ তাকে শনাক্ত করতে পারে।

কিন্তু ম্যানুয়েলের নির্দেশ অনুযায়ী সবাই মুখে কুলুপ এঁটে রইল।

 লেপল্কি অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল ম্যানুয়েলের সঙ্গে সে দেখা করবে।

দুটো নৌকোর মাঝে ম্যানুয়েলের নৌকোটা নোঙরকরা ছিল। একটা কাঠের পাটাতনও পাতা ছিল। ম্যানুয়েলের বোটে স্বল্প আলো দেখে পাটাতনের ওপর থেকে লেপস্কি চেঁচাল–এই ম্যানুয়েল, আমি পুলিশের লোক কথা বলছি।

কেবিনে তখন ম্যানুয়েল আর ফুয়েনটেস তাদের নতুন চুক্তির উপলক্ষ্যে পান করছে।

ফুয়েনটেসের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। পুলিশ, ম্যানুয়েল, পুলিশ

ম্যানুয়েল তাকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে এল।

-তুমিই টেরেস ম্যানুয়েল? লেপস্কি কর্কশ স্বরে বলল।

–আজ্ঞে হ্যাঁ। ওটাই আমার নাম। কিন্তু কি ব্যাপার যদি বলেন।

–রবার্টেন ফুয়েনটেল কোথায়?

–মানে, আমার বন্ধু রবার্টেন?

–হ্যাঁ, সে কোথায় বল। নয়তো হত্যার সহযোগী হিসেবে তোমাকেও চালান করে দেব।

অবাক হবার ভান করে ম্যানুয়েল বলল–হত্যার সহযোগী? মানে কি বলছেন স্যার, আমি বুঝতে পারছি না। আমার বন্ধু গতরাতে আমার কাছে এসেছিল। খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে। আমার কাছে হাভানা যাবার জন্য একশো ডলার চাইল। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলাম আর সে নৌকা করে হাভানায় পাড়ি দিল।

–কোন বোটে?

–আমি জানিনা। আমাদের অনেক বন্ধুই নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে বা অন্য ব্যবসার খাতিরে হাভানায় যায়। আমরা কিউবানরা এইসব ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করি।

লেপস্কি গম্ভীর স্বরে বলল, আমার মনে হচ্ছে সে এখন তোমার নৌকার মধ্যে রয়েছে।

–মিঃ অফিসার। এখানে লোকে আমাকে সত্যবাদী মানুষ বলে জানে। তবে আপনি আমার নৌকা তল্লাশি করে দেখতে পারেন। আশা করি আপনার কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।

লেপস্কি মুশকিলে পড়ল। যদি সেফুয়েনটেসকে নৌকায়না পায় তাহলেশয়তানটাকর্তৃপক্ষের কাছেনালিশকরবে।অনাধিকারপ্রবেশ।ওসবঝঞ্জাটেনাপড়ে বরঞ্চ চীফেরকাছেরিপোর্টকরাভাল।

–আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট অফিসার। ম্যানুয়েল পাটান তুলে নিল।