৫. অন্ধকার একটা বাড়ি

অন্ধকার একটা বাড়ির দোরগোড়া থেকে বুচ রোলোকে গাড়ি থেকে নেমে ডাক্তার মার্টিনের বাড়িতে ঢুকতে দেখল।

ডাক্তার মার্টিনের ডায়েরির কথা বুচও শুনেছিল। সেও যে মুহূর্তে ডায়েরিটার গুরুত্ব অনুভব করেছিল সেই মুহূর্তে ডাক্তারের বাড়ি গিয়ে দেখল রোলো মিনিটখানেক আগেই সেখানে পৌঁছেছে। এখন বন্দুক হাতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মনস্থির করছে।

ডায়েরিতে যদি শেলির কথা লেখা না থাকে, রোলোর থেকে যদি ডায়েরীটা কেড়ে নিয়ে নেয় তাহলে তার সঙ্গে রোলোর সম্পর্ক চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যাবে।

অথচ বিন যুদ্ধে ডায়েরিটা সে হাতছাড়াও করবেনা। ডায়েরিটা সম্পূর্ণভাবে পেতে হলে রোলোকে খুন করা ছাড়া কোন রাস্তা নেই। কিন্তু ভোলোকে খুন করতে হলে আগে লংটমকেও খুন করতে হবে। আবার রোলোকে যে মুহূর্তে সে খুন করবে লংটমও তার নিজস্ব বন্দুক দিয়ে তাকে খুন করবে।

সে যখন এইসব চিন্তা করছে তখন রোলো ডায়েরি নিয়ে গাড়িতে উঠল। বুচ এগিয়ে যেতেই গাড়ি এগিয়ে চলল নিউবন্ড স্ট্রিট ধরে গিলোরীর বাড়ির দিকে। কিন্তু গিলোরীর বাড়িতে রোলোর এখন কি প্রয়োজন থাকতে পারে!বুচও তার নিজের গাড়ি নিয়ে রোলোকে অনুসরণ করতে লাগল। সময় মত এথেন্স কোর্টে এসে রোলো তার বিশাল শরীর নিয়ে গিলোরীর বাড়ি ঢুকল। সে অন্ধকারে অপেক্ষা করতে লাগল।

রোলোকে কিছুতেই চোখের আড়াল করা চলবেনা। সে জানে রোলো ওয়েডম্যানের তিন মিলিয়ন পাউন্ড এই অস্বাভাবিক টাকার অঙ্কের লোভটা কিছুতেই হাতছাড়া করবেনা। এই বিশাল টাকা দিয়ে রোলো কি কি করবে ভাবতেই বুচের মুখ কুঞ্চিত হয়ে উঠল। রোলোর কার্যকলাপের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। যদি কেউ টাকাটা পকেটস্থ করতে পারে তো রোলোই। তারপর তার থেকে টাকাটা কেড়ে নিতে হবে এবং রোলোকে খুন করতে হবে। কিন্তু মুহূর্তের এক চুল এদিক ওদিক হলেই রোলোকে সুযোগ করে দেওয়া হবে আর তার জন্যে তাকে আপশোস করতে হবে। তাই যে মুহূর্তে রোলো তিন মিলিয়ন পাউন্ড পকেটস্থ করবে সেই মুহূর্তেই রোলোকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে এবং তা বুচের হাতেই। আর এ কাজটার পুরস্কার এমন অবিশ্বাসরকমের যে এছাড়া অন্য কোন পথ নেই।

রোলো গিলোরীর সঙ্গে কি করছে?

বুচ দেখল প্রায় অধঘণ্টা পরে রোলো গলি থেকে বেরিয়ে লংটমের সঙ্গে কি কথা বলে গাড়িতে চড়ে বসল।

আর বুচ রোলোর গাড়ির লাল টেল ল্যাম্প লক্ষ্য করে বাফটেন্স ব্যারী এভিন তারপর পিকাডিলী ধরে অনুসরণ করে চলল। রোলো কি তবে শেলির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে! নাকি করনেলিয়াসের সন্ধানে যাচ্ছে। বুচের নিজের কোন ধারণাই নেই যে করনেলিয়াসের লাশটা কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু তার স্থির বিশ্বাস রোলো নিশ্চয় জানে করনেলিয়াসের মৃতদেহটা কোথায় আছে। রোলোর চতুর মস্তিষ্কের কাছে বুচের বুদ্ধি কখনও সমকক্ষ নয় সে জানে। তাই ওয়েডম্যানের টাকাটা হাতাবার একটাই রাস্তা যে রোলোর পেছনে লেগে থাকা।

ভাল। রোলো শেলির কাছে যাচ্ছে না। গাড়িটা এখন বার্কলে হোটেল পেরিয়ে পার্ক লেন দিয়ে হাইড পার্কে ঢুকে থেমে গেল। বুচ দ্রুত চিন্তা করে পার্কের গেট পেরিয়ে কয়েকশ গজ দূরে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এমন একটা জায়গায় এল সেখান থেকে লংটম আর রোলোকে দেখা যায়। লংটম ও রোলো কেউই গাড়ি থেকে নামল না। রোলো সিগার খাচ্ছে।

বুচ বেশ কয়েক মিনিট ধরে লক্ষ্য করার পর অধৈর্য হয়ে আরও এগিয়ে এল। ওদের ব্যাপারটা কি? কার জন্যে অপেক্ষা করছে? রাগে মুঠি পাকাল। সে যদি এভাবে পার্কের গেটের কাছে ঘোরাফেরা করে যে কোন মুহূর্তে তাকে পুলিশ ধরে নানা প্রশ্ন শুরু করবে। তাহলে তাকে পার্কের এমন জায়গায় লুকিয়ে থাকতে হবে যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়।

রোলো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকার সময় বুচ মাঠে ঢুকে একটা গাছের ছায়ার কাছে গিয়ে আড়াল করে ঘাসের ওপর বসল।

আকাশ পরিষ্কার। মনোরম উষ্ণ রাত। চাঁদ প্লেটের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। বুচ ভাবল আর কতকাল এভাবে বসে থাকতে হবে। রোলো তো বেশ গাড়ির ভেতর আরামে বসে আছে। বুচের হাই উঠল।

রোলোর গাড়ির জানলাটা খোলা। সিগার খাওয়া এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। সিগারের তামাকের গন্ধ বুচের নাকে ভেসে আসতে তারও ধূমপান করার ইচ্ছে হতে লাগল। বুচ দেখল, হাওয়ায় সিগারের ধোঁয়াগুলো কেমন পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে।

এমনি করে সময় বয়ে চলল। হঠাৎ রোলো গাড়ির দরজা খুলে নেমে এসে রাস্তার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত কি যেন লক্ষ্য করতে লাগল। রোলোর ঘড়িতে তখন একটা বেজে দশ মিনিট।

কতক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হবে এ সম্বন্ধে রোলোর কোন ধারণাই নেই। কিন্তু তবু গিলোরীর ওপর তার অগাধ বিশ্বাস, সে যে করেই হোক মেয়েটাকে এখানে পাঠাবে। সেই বিশ্বাস নিয়েই সে এতক্ষণ অপেক্ষায় আছে। মেয়েটা যদি না আসেকরনেলিয়াসের মৃতদেহ কোথায় পাওয়া যাবে সে সম্বন্ধে সে কোন চিন্তাই করতে পারছে না।

পাদানীর ওপর বসে রোলো আবার ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল আর ডায়েরিটা অধৈর্যের মত পকেটে পুরে চিন্তা করতে লাগল বুচ আর শেলির মৃত্যুৎসবের আয়োজনটা বেশ মনোরম করেই করবে। তার হাত নিস পিশ করতে লাগল শেলিকে শাস্তি দেবার জন্যে। কাঁধটা তুলে এখনকার মত চিন্তা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। দুই বা তিন সপ্তাহ যাই লাগুক, তাড়াহুড়োর কোন দরকার নেই। দুজনের কারোর জন্যেই সে এখনফাঁসিতে যেতে রাজীনয়। তার মত বিশাল চেহারার মানুষ ফাঁসিতে ঝুললে হয় দড়ি ছিঁড়বে নয়তো তার মুণ্ড।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ যেন রোলো অনুভব করল কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। চারিদিকটা তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভাবল এসবই তার মনের ভুল।

লংটম জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, আর কতক্ষণ বস্? বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমলে হয়না?

–চুপ কর। গর্জে উঠল রোলো। ভোর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে

।–হে ভগবান। সীটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল লংটম।

রোলো সিগার শেষ করে আবার গাড়িতে এসে বসল। তারও খুব ক্লান্তি লাগছিল কিন্তু গিলোরী যখন বলেছে আসবে, তাকে প্রতি মুহূর্তেই চোখ রাখতে হবে সেই মেয়েটির অপেক্ষায়। ঝিমোন চলবে না।

রাত প্রায় দুটো পনের মিনিটের সময় সুশান মাঠে ঢুকল।

বুচই প্রথম তাকে দেখে লাফিয়ে উঠেছিল আর কি। কিন্তু ঠিক সময় নিজেকে সংযত করে নিল সে। রোলোর গাড়ির দিকে তাকাতে দেখল রোলো ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। উত্তেজিত হয়ে সে এত জোরে লংটমকে পিঠ চাবড়িয়ে দিয়েছে যে তার দমবন্ধ হবার জোগাড়।

তিনটে নোক তিনদিক দিয়ে তাদের বিভিন্ন অবস্থায় গভীর মনোযোগ দিয়ে সুশান হেডারকে লক্ষ্য করতে লাগল।

সুশান শক্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পার্কে ঢুকল। তারপর রোলোর গাড়ির কাছাকাছি এসে থেমে গেল।

রোলো তার দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় তার সাদামুখ আর শূন্যদৃষ্টি দেখল। সে সোজাসুজি তার দিকে তাকাল এবং মুহূর্তের অস্বস্তির পর রোলোলাবুঝল যে মেয়েটা তার উপস্থিতির কথা জানেই না।

–মেয়েটাকে লক্ষ্য কর লংটম। ঘুমের মধ্যে হাঁটছে সে।

–তাই তো! গাড়ি থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে এল। কিন্তু কেন?

রোলোর কানে কোন কথাই ঢুকছিল না। উত্তেজনায় সে বধির প্রায়। ভুডু। তাহলে ব্যাপারটার মধ্যে সত্যি কিছু আছে। রোলোর মনে পড়ল সুদূর এথেন্স কোর্ট থেকে গিলোরী মেয়েটাকে তার কাছে আসতে বাধ্য করেছে।

চুপ। একটা হাত তুলে সুশানের দিকে দৃষ্টি অব্যাহত রেখে সে বলল।

সুশান ঘুরে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে শক্তভাবে দ্রুত পার্কের গেটের দিকে হেঁটে চলল।

চলে এস। গাড়িটা ওখানে থাকুক। ওকে চোখের আড়াল করা চলবেনা। লংটমকে বলল।

লংটমের অপেক্ষা না করেই সে মেয়েটার দিকে হাঁটা শুরু করল। গিলোরীর কথা তার মনে পড়ল যে মেয়েটা তাকে করনেলিয়াসের মৃতদেহের কাছে নিয়ে যাবে। এখন আর কোন চিন্তা নয়। ব্যাপারটা এতই উত্তেজিত করে তুলল রোলোকে যে নিয়মমাফিক সতর্কতার কথা সে ভুলে গেল। তিন মিলিয়ন পাউন্ডের ওপর হাত রাখা ছাড়া আর কোন ব্যাপারেই সে আগ্রহী নয়।

গোপন জায়গা থেকে বুচ রোলোকে সুশানের পেছন পেছন যেতে দেখে ভাবল যে কোন কারণেই হোক মেয়েটা বিভীষিকাময় রোলোর সামনে হাজির হয়েছে। সে বুঝলনা সুশান তাদের করনেলিয়াসের মৃতদেহের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় টাকাটার ব্যাপারেও হতে পারে। গোপন জায়গা থেকে বেরোবার আগে সে নিশ্চিত হয়ে নিল যে, কেউ তাকে দেখেনি।

বুচ দেখল মেয়েটা কন্সটিচ্যুয়াল হিলের দিকে যাচ্ছে, তার পেছনে রোলো তার পেছনে লংটম, তাদের পেছনেহঠাৎ আবিষ্কার করল এক ছায়ামূর্তি,যাকে সে চিনত, ডিটেকটিভ অ্যাডমস।

সঙ্গে সঙ্গে তার হাত বন্দুকে পৌঁছল। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল যে কাজটা করা বোকামী হবে। সে ভাবল রোলোকে সাবধান করা উচিত পুলিশটা পিছন নিয়েছে। তারপর ঠিক করল,না, পুলিশটা যদি রোলোকে ধরে তবে টাকাটা নিয়ে পালাতে তারই সুবিধা হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভাবল না, টাকাটা কোথায় আছে সে নিজে জানেনা। আর যে মুহূর্তে রোলো সেটা জানতে পারবে, পুলিশও জানবে। সেক্ষেত্রে রোলো, লংটম, অ্যাডমসকে খুন করে টাকা হাতানো প্রায় অসম্ভব এবং বিপদজ্জনক।

ইতিমধ্যে রোলো সুশানের পিছন পিছন বাকিংহাম প্যালেস ছাড়িয়ে এখন স্লোয়ান স্কোয়ারের দিকে এগিয়ে চলেছে। রাস্তাজনশূন্য।

অ্যাডমস অন্ধকারে মিশে চলছে যাতে রোলো, লংটম তাকে দেখতে না পায়। কিন্তু অ্যাডমস খুব অবাকই হল যে রোলো একবারও পেছন ঘুরে তাকালই না।

অ্যাডমস রোলোকে চিনে ফেলেছে। রোলো যখন এই ব্যাপারটার মধ্যে আছে তাহলে ব্যাপারটা নিশ্চয় জটিল। এতদিন সে যে ধরণের কেসের অপেক্ষায় ছিল, আজ তা তার সামনে।

অ্যাডমস থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা দেখার জন্যে। বুচও এজন্য প্রস্তুত ছিল। সে তার কালো পোশাক, কালো টুপীতে অন্ধকারে মিশে এগিয়ে চলল। রোলোর বিশাল লাশটা জীবনে এই প্রথম এতটা পথহাঁটছে। আর তার ঘামে ভেজা শরীরটা দেখে লংটম মজা পাচ্ছিল।

–মেয়েটা যে ভাবে হাঁটছে মনে হচ্ছে ব্রিটেন পৌঁছে যাবে। লংটম বলে উঠল।

রোলো গর্জন করে উঠল, ব্রিটেন গেলেও হামাগুড়ি দিয়ে সে যেতে তৈরী আছে।

 মেয়েটা আবার থেমেছে।

রোলো লংটমকে টেনে নিয়ে অন্ধকারে সরে গেল। কুড়ি গজ দূরে অ্যাডমসও সতর্ক হল। বুট এক দেওয়ালে মিশে দাঁড়াল।

সুশান দু-এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে গলিপথ বেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

–এখানে। রোলো চট করে এগিয়ে গেল। প্রায় গলির মুখ পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে ঢুকল। এটা একটা মুখবন্ধ গলি।

লংটমকে রোলো বলল, যাও মেয়েটাকে আমি সামলাচ্ছি, তুমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গাড়িটা নিয়ে এস।

লংটম এতটা রাস্তা হেঁটে ফিরতে হবে বলে গজরালে রোলো তাকে চোখ পাকিয়ে গর্জে উঠল–যাও। যা বলছি চট্‌পট্ কর।

-ঠিক আছে। লংটম দ্রুত আগের পথ ধরে ফিরতে লাগল।

অ্যাডমস আড়াল হবার কোন সুযোগ না দেখে মাথা নীচু করে চলতে লাগল। লংটমের পুলিশের প্রতি কোন আগ্রহ না থাকায় সে অ্যাডমসকে লক্ষ্যই করল না।

লংটমকে আসতে দেখে বুচ একটা অন্ধকার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাবল, সে কি লংটমকে পুলিশের কথা বলে সতর্ক করবে। না লংটমকে কোন বিশ্বাস নেই। সে যদি ভোলো শেলির সম্পর্কে জেনে থাকে তাহলে বুচকেও ফাঁকি দেবে। তার চেয়ে লংটম চলে যাক। তারপর সে প্রথমে অ্যাডমস পরে রোলোকে নিকেশ করবে।

ইতিমধ্যে লংটমের জন্যে বুচের অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেল। লংটম অতিক্রম করল তাকে। রাস্তায় নেমে রোলো আর অ্যাডমসকে দেখতে পেল না। সাবধানে অন্ধকার গলি হেঁটে চলল। সামনে একটা দরজা দেখে কিছু শোনার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলনা। দরজায় আস্তে চাপ দিতে দরজাটা খুলে গেল। পকেট থেকে বন্দুক বের করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। মাথার ওপর ভারী পদশব্দ শুনে ভাবল রোলো ওপরে গেছে কিন্তু আর কোন শব্দ শুনতে না পেয়ে সদর দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলল।

.

জ্যাক ফ্রেসবী তার সদর দরজা খুলে শোলার টুপীটা খুলে স্ট্যান্ডে রাখল। ভারী ট্রাঙ্কটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তার পিঠ ব্যাথা করছিল। সুশান পালিয়ে যাওয়ার পর সে ফিরে গিয়ে করনেলিয়াসের মৃতদেহের একটা সুন্দর ব্যবস্থা করেছিল।কাজটানক্কারজনক কিন্তু এর থেকে টাকা কামাতে হলে মৃতদেহটা লুকিয়ে রাখতেই হবে।

সে রান্না ঘরে গিয়ে কেটলীটা চাপিয়ে দিল। ফ্রেসবী নিজের পরিচর্যায় অভ্যস্ত ছিল। পাঁচ বছর একাবাস করতে করতে। এখন তার একমাত্র সঙ্গী বেড়ালটা। বেড়ালটাকে খেতে দিতে দিতে ভাবল এখন কি সে রোলোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে?বলবে সে জানে মৃতদেহটা কোথায়!বদলে একশ কিংবা এক হাজার চাইবে সে। ক্লান্তির দরুণ শেফার্ড মারকেট অবধি যেতে ইচ্ছে করছিল না তার। তাই টেলিফোন করতে রাস্তার বুথটায় গেলেই চলবে।

চা তৈরী করে ফ্রেসবী বসবার ঘরে বসল। পাঁচশো পাউন্ড হাতিয়ে সে দেশ ছেড়ে পালাতে– পারে। যে রাতে ভেরা স্মলকে মেরে নীচে দেহটা কবর দিয়েছে সে রাত থেকেই সে দেশ ছাড়ার কথা ভাবছে। সুশানের কথা ভাবতেই তার শরীর ঘেমে উঠল। এই ফাঁকা বাড়িতে তাকে যদি একলা পাওয়া যেত চীৎকার করলেও কেউ শুনতে পেতনা।এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া করে কি বোকামীটাই না করেছে সে। যা কিছুই ঘটত না কেন অভিযোগ করার সাহস পেত না সুশান। কারণ করনেলিয়াসের খবর সে জানে। কিন্তু তার নিজের কি হয়? এক বছর আগে হলে সে ইতস্ততঃ করত না। ভেরা স্মল তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। তা না হলে তাকে হত্যা করার ইচ্ছে ছিল না তার। মেয়েটা তার জীবন বরবাদ করে দিয়েছে। সে যদি ওরকম ধস্তাধস্তি না করত, আঘাত করার প্রয়োজন হত না। এখনও ফ্রেসবী মনে করতে পারে ভেরার ভয়ার্ত চোখ। মানুষের চোখে অমন আতঙ্ক ফুটে উঠতে পারে তা ভেরাকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারত না। তার মনে পড়ল কেমনভাবে তার সাদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল।

হঠাৎ ফ্রেসবী শুনল দরজায় টোকা পড়ছে। ঘড়িটায় দেখল রাত বারোটা। হয়তো কেউ ভুল করে টোকা মেরেছে। এখুনি ভুল বুঝতে পেরে চলে যাবে। কিন্তু আবার জোরে টোকার শব্দ শোনা গেল।

বিড়বিড় করতে করতে ফ্রেসবী সদর দরজা খুলল।

— আলোয় পা রেখে ফ্রেসবীকে দেখে শেলি প্রশ্ন করল, ঘরে তুমি একা আছ?

ফ্রেসবী তার দিকে তাকিয়ে দেখল কি চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে। থ্র কোয়ার্টার কোর্ট উঁচু স্কার্ট।

হেসে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?

 চোখ বড় বড় করে শেলি বলল, হ্যাঁ, তুমি কি আমায় চেনো?

মাথা নেড়ে ফ্রেসবী বলল, হ্যাঁ মাদমোয়াজেল শেলি তাই নয় কি?

–আমি কি ভেতরে আসতে পারি?

ফ্রেসবী সরে দাঁড়াতে শেলি ঢুকে গেল ঘরে।

–এখানে এস। ভাবল, এখানে কি ওকে রোলো পাঠিয়েছে? নাকি নিজের থেকে এসেছে। কি চায় ও?

ফায়ার প্লেসের দিকে ভাঙ্গা আর্মচেয়ারটা দেখিয়ে বলল, চেয়ারটার জন্যে ক্ষমা চাইছি। বসবে না? জানি তুমি ওতে বসতে অভ্যস্ত নও।

হেডার বলে মেয়েটার সম্বন্ধে কি জান? শেলি প্রশ্ন করল।

ফ্রেসবী এরকম সোজাসুজি প্রশ্ন আশা করেনি। বুচও ওর কথা জিজ্ঞেস করছিল। সময় নেবার জন্যে বলল, চা খাবে?

শেলি গম্ভীর গলায় বলল, না আমি আমার প্রশ্নটার উত্তর এখনও পাইনি।

ফ্রেসবী নিজেকে খানিকটা সামলিয়ে নিল।হঠাৎ সে ভাবল, মেয়েটা আসার পর ঘরটা কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে। মেয়েটা কালো বটে কিন্তু ওর সুন্দর পোশাক, দস্তানা সব কিছুই উত্তেজক। চা ফেলে ফ্রেসবী শেলির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, আমি খুবই ক্লান্ত যদি কিছু মনে না করেন আমি বসছি। শেলির কয়েক ইঞ্চি দূরে সে বসে শেলির মুখের দিকে চেয়ে রইল।

ফ্রেসবীর কামনা জাগছে বুঝতে পেরে শেলি বলল, আমার সময় বেশী নেই। উত্তরটা দিলে ভাল করতে।

বুচ তোমায় কিছু বলেনি? আমি যা জানি তা বুচকে বলেছি।

না বলনি। আমাকে সত্যি কথাটা বললে ভালই করবে। কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, তোমার সময়ের দাম আমি ধরে দেব।

ফ্রেসবী শেলির সুন্দর চেহারা দেখতে থাকল। মনোসংযোগ করা তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠল। আমার সময়ের মূল্য দেবেমানে টাকা দিতেও রাজী আছেখবরের জন্যে?–তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না।

–মেয়েটির সম্বন্ধে কি জান? তাড়াতাড়ি বল, দেরী কোর না। একশো পাউন্ড দোব।

 ফ্রেসবী ভাবল একশো পাউন্ড! সে তো বুচও দেবে বলেছিল। অঙ্কের দরটা বাড়াতে হবে।

–পাঁচশো পাউন্ড মোটামুটি ঠিক হতে পারে, বলে সে পকেটে হাত ঢোকাল। এই মুহূর্তে শেলিকে ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করছে।

শেলি হেসে বলল, বোকার মত কথা বোল না। শক্ত হয়ে বলল, একশো পাউন্ডের বেশী পাবে না। চটপট বল।

পাঁচশো। ওর সঙ্গে সারারাত বসে তর্ক করতে ইচ্ছে করছে তার। শেলি ছাড়া ঘরটাকে ভাবতেই ইচ্ছে করছে না।

অধৈর্য হয়ে শেলি নড়াচড়া করায় তার স্কার্টের প্রান্তভাগ ফ্রেসবীর হাঁটু ছুঁয়ে গেল।

–তুমি জান কি মড়াটা কোথায়?

 ফ্রেসবী শক্ত হয়ে বসে রইল। সে নিজেকে সংযত করার জন্যে কোন কথা বলল না।

তার মানে তুমি জান, বোকা কোথাকার! শিগগীর বল কোথায় আছে। আমার সময় নষ্ট কোর না। এই নাও একশো পাউন্ড। করকরে সাদা নোট বার করল শেলি।

 ফ্রেসবী পায়ের ওপর পা তুলে বলল-যথেষ্ট নয়। রোলো আমায় হাজার দেবে বলেছে।

শেলি হতাশাজনিত রাগে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

ফ্রেসবীর সঙ্গে দর কষাকষির সময় নেই এখন। যদি ফ্রেসবীকে ওই অবিশ্বাস্য রকমের টাকার অর্ধেকও দিতে হয় ভাল, তবু রোলোকে নিতে দেওয়া যায়না। ফ্রেসবীর থেকে মড়াটার খোঁজ নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে তাকে দুর্ঘটনায় ফেলা যায়। আঃ, এসময় বুচ কাছে থাকলে ঘুষের লোভ ছাড়াও অন্য ওষুধ দিয়ে ওর মুখ থেকে কথা বের করে নিত।

–মড়ার ভেতর টাকা লুকোনো আছে। এখন আমরা তর্কাতর্কি করে সময় নষ্ট করলে পরে ওটা যদি কেউ হাতিয়ে নেয়, তখন তোমার দুঃখ করতে হবে।

ফ্রেসবীর চোখ কুঁচকে এলো। ও যদি জানত মড়ার ভেতর টাকা আছে, তাহলে মোম মাখাবার আগে তা বের করে নিত।

টাকা? কত টাকা?

–শেলি ভাবল বলবে কিনা। তারপর ভাবল ভবিষ্যতে তো জানতেই পারবে। বলল–তিন মিলিয়ন পাউন্ড।

চমকে বসে পড়ল ফ্রেসবী–তুমি ঠিক জানো?

–হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এখন সময় নষ্ট কোর না। তাড়াতাড়ি বল মড়াটা কোথায়? রোলো যে কোন মুহূর্তে ওটা খুঁজে বের করে নেবে।

ফ্রেসবী ভাবল মড়া খুঁজে বের করা অসম্ভব।

–যদি মড়াটা কোথায় আছে আমাকে নিয়ে যাও, তাহলে টাকাটা আমরা ভাগাভাগি করে নেব।

ফ্রেসবী ভাবল সে ছাড়া যখন কেউ জানে না মড়াটা কোথায়, তবে অমন দাঁতভাঙ্গা অঙ্কের টাকাটা বখরা করতে যাবে কেন? শুধু হুইটবীর ওখানে গিয়ে টাকাটা বের করে দেশছাড়া হতে হবে।

শেলি অস্বস্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে টাকার কথাটা বলা বিপজ্জনক হয়েছে। কিন্তু সে আর কি করতে পারত?

ফ্রেসবী শেলির দিকে তাকাল। ভেরার বেরিয়ে আসা জিভের কথা মনে পড়ল তার। পকেট থেকে মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটো বের করল। আমায় খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি খুব ক্লান্ত।

–তুমি সময় নষ্ট করছ। চল আমরা যাই। শেলি বলল।

ফ্রেসবী মাথা নাড়ল। ভেরার মত এত সহজে এই পাতলা চেহারার মেয়েটাকে কাবু করা যাবে না। দেহে যথেষ্ট শক্তির আভাস আছে।

উঠে দাঁড়ায় ফ্রেসবী। চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে বলে–হ্যাঁ জায়গাটা দুরে নয়। কি করবে সে এখানেই না হুইটেবীর ওখানে। ওখানে মূর্তিদের ভীড়ে জায়গাটা নাও পাওয়া যেতে পারে।

চারিদিকে তাকাল সে। টেবিলটা সরাতে হবে তারপর হাতদুটো দিয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরতে পারলেই ব্যাস! একবার ধরতে পারলেই হল।

–আমি বুটটা পালটাই, যদি কিছু মনে না করো। ভয় নেই, বেশী দেরী করবো না।

শেলি কিছু বলার আগেই সে পা বাড়াল দরজার দিকে।ইচ্ছে করে টেবিলের গায়ে ধাক্কা খেল। বিড়বিড় করে বলল, ঝিটা ঠিক জায়গায় রাখে না যে কেন? তারপর টেবিলটা ঠেলে দরজাটা, যাবার সময়, বন্ধ করে দিয়ে গেল।

শেলি ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে বুঝল, হতভাগাটার কোন মতলব আছে। সতর্ক হয়ে উঠল যেন। ব্যাগ থেকে খেলনার মত ছোট পিস্তলটা বার করে আওয়াজ হতেই লুকিয়ে ফেলল সে। ফ্রেসবী ফিরে আসার আগে ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

তারপর ফ্রেসবী চোখ লাল করে ঘরে ঢুকল।

শেলির ভীতির ভাব আরও বেড়ে গেল। বুঝতে পারল কোন মতলব আছে ফ্রেসবীর। হয়তো তাকে ভাগিয়ে একাই যাবে করনেলিয়াসের মড়ার কাছে।

বেশ আমি প্রস্তুত। যাবে কি? ফ্রেসবীর স্বর এত মোটা শোনাল যেন মুখের ভেতর কিছু রেখেছে।

–বেশ। চল। কিন্তু জায়গাটা কোথায়? ঘরটা পার হবার সময়েই শেলি বুঝতে পারল কি ঘটতে যাচ্ছে। ফ্রেসবীর দুটো হাত তার গলা টিপে ধরল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শেলি বুঝল তার বাঁচার কোন আশাই নেই। তবু চেতনা হারাবার আগে পাঁচ সেকেন্ড সময় পেল। ভাবল ঝটাপটি করার কোন মানেই হয়না, ফ্রেসবীরঐ ইস্পাত সমান হাতের সুঙ্গে। শরীরের ভার ছেড়ে দিল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুজনে। শেলি অনুভব করল তার মুখ হাঁ হয়ে জিভ বেরিয়ে আসছে।

ফ্রেসবীর আঙুলগুলো ব্যথা করলেও চাপ দিতেই থাকল। কিন্তু শেলি ধস্তাধস্তি করছে না। দেখে মুঠি ঢিলে করল আর সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল হঠাৎ একটা শব্দ তাকে চমকিয়ে দিল। শেলির দেহটা নড়ে উঠল। আবার একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনল। নীচের দিকে তাকিয়ে বন্দুকটা দেখতে পেয়ে কেড়ে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে শেলির মাথায় আঘাত করল। শেলি অনুভব করল সে জ্ঞান হারাচ্ছে। ফ্রেসবী তাকে খুন করতে চায় এটা সে বুঝতে পারল। গিলোরীর কথা মনে পড়ল আর গিলোরীর কাঁধের ওপর থেকে ডাঃ মার্টিন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ব্যঙ্গের হাসিতে তার মুখ উদ্ভাসিত। ফ্রেসবী বুঝতে পারল তার পেটে গরম জ্বালাদায়ক কিছু প্রবেশ করেছে। মোটা উলের অন্তর্বাসটা ভিজে উঠেছে। শেলির নাকে আঘাত করে নাকের হাড় ভেঙ্গে দিল সে।

শেলির ছটফটানি থেমে গেল। কিন্তু তখনও আঘাত করে চলতে থাকলে ঠিক সেই সময় কেউ যেন চীৎকার করে তার হাত ধরে টান মারল।

চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। শেলির নখে তার মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত জমে গেছে। উপুড় হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল সে। পেটের যন্ত্রণায় কুঁকড়িয়ে গেছে। কোন হাত যেন তাকে টেনে বসিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিল। পুলিশের হেলমেট পরা একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে।

ফ্রেসবী তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ওকে খুন করার চেষ্টা করেছিলাম। তার কাছেও একটা পিস্তল ছিল।

ও মারা গেছে। কথাটা বলে কন্সটেবলটি ফ্রেবীর ওয়েস্টকোট খুলে রক্তে লাল ছোপটার দিকে বিতৃষ্ণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

ফ্রেসবী বলল-ওর কাজ এটা। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এস। আমি মরব না। মরব কি?

কন্সটেবলটি ভাবল–সম্ভবতঃ মারাই যাবে। সে বুঝল ফ্রেসবী আর বেশীক্ষণ নেই। দেরী করার সময় নেই। ফোন আছে ফোন?

রাস্তার মোড়ে আছে। আমায় ছেড়ে যেও না এখন। আমি একটা জবানবন্দী দোব।

না আমার যাওয়াই উচিত। তার বয়স কম, এরকম ব্যাপার তার জীবনে কখনও ঘটেনি।

ফ্রেসবীর স্বর চড়ছিল–এটা লিখে ফেল। ওয়েডম্যানের ভাইয়ের মৃতদেহ ২৪ লেনস্ক স্ট্রিটে ইটেবীর কারখানায় আছে। ওর ভেতরের তিন মিলিয়ন পাউন্ড রোলো হাতাবার চেষ্টা করছে।

কন্সটেবলটি কথাগুলো নোটবইয়ে লিখে নিল। সে রোলোর নাম শুনেছে।

সেবী জোর দিয়ে বলল–হুঁইটেবীর ওখানে আছে। রোলো অতগুলো টাকা হাতিয়ে নিক এটা তার সহ্য হচ্ছিল না। তিন মিলিয়ন পাউন্ড ছেলেখেলা নয়।

ফেসবী চোখ বুজল। তার ঠাণ্ডা লাগতে লাগল–তাড়াতাড়ি কর।

পুলিশটিকে ঘর ছেড়ে যেতে সে শুনল। পর মুহূর্তেই শুনতে পেল দৌড়ে সে রাস্তায় নামছে। ফ্রেসবী অনুভব করল তার ট্রাউজার বেয়ে রক্ত নামছে। শেলি মারা গেছে।

কিন্তু সে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তিই পেতে চায়। পুলিশটি যখন ফোন বুথে পৌঁছল ফ্রেসবীর চোয়াল স্কুলে পড়ল।

কয়েক মিনিট পরে বেড়ালটা ঘরে এসে আরাম করে শেলির মাথার গন্ধ শুকল আর পরমুহূর্তেই ফ্রেসবীর বুকের ওপর বসে পড়ে গররর করতে লাগল।

.

ডিটেকটিভ সার্জেন্ট অ্যাডমস লক্ষ্য করল রোলো খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।

রোলোকে অনুসরণ করার জন্যে সেব্যস্ত ছিলনা। কেননা সে জানত যে রোলো ক্ষেপে উঠলে তার পাশবিক শক্তির কাছেতাকে নতি স্বীকার করতেই হবে। তবে তো সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। নিজের কাছে পিস্তল, নিদেনপক্ষে লাঠিটাও নেই।

সিঁড়ির গোড়ায় পা রাখতেই সে একটা মেয়ের কাশির শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠল। শুনে বুঝল সিঁড়ির ওধার থেকে আসছে।

নিশ্চয়ই মিস্ হেডার। সে কোন মতেই ওপরে উঠে যেতে পারে না। তাই সে সিঁড়ির কাছ থেকে সরে প্যাসেজ থেকে এগিয়ে গুদামঘরের দরজার কাছে পৌঁছল। তার মনে হল ঘরভর্তি বদমাইশ লোক। ভাল করে দেখল, ওগুলো মোমের মূর্তি।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সুশান। অ্যাডমস বুঝতে পারল সে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, আর ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে ঘরের চারিদিকে তাকাচ্ছে।

ভারী একটা শব্দে তাকে বুঝিয়ে দিল রোলো ওপরে কোন খোঁজ না পেয়েনীচে নেমে আসছে। অ্যাডমস ঘরের দিকে চোখ বুলিয়ে তিনটে মোমের মূর্তির পেছনে দাঁড়াল। সে নিশ্চিত ছিল রোলো যদি টর্চের আলো না ফেলে তবে তাকে মূর্তি বলেই ভাববে।

সুশান নড়া শুরু করল। অ্যাডমসের বিপরীত দিকের মূর্তিগুলোর দিকে সে এগিয়ে চলল।

রোলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করতে থাকল।

রোলোকে ঘরটা ঘাবড়িয়ে দিয়েছে। বিকট দৃষ্টিতে রোলো মূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।

সুশান চেয়ারে ঝুঁকে পড়া একটা ছোট্ট মানুষের মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঢাকা দেওয়া মূর্তিটার মুখে গোলাপী রঙের মত জ্বল জ্বল করছিল।

সুশান হাত তুলে মূর্তিটা ছুঁয়ে ভয়ঙ্কর চীৎকার করে সরে দাঁড়াল। রোলো ও অ্যাডমস প্রচণ্ড রকমের চমকিয়ে গেল। সুশানের চোখ এখন জীবন্ত। সে তার সামনে রোলোকে দেখতে পেল।

-ও না। তীক্ষ্ণ চীৎকার করে সে পিছিয়ে গেল। চলে যাও। আমাকে এখান থেকে যেতে দাও।

–ভয় পেও না। ঠিক আছে, রোলো দ্রুত এগিয়ে গেল।

 সুশান মুখে হাত চাপা দিয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

ছুটে যাওয়ার প্রবণতাকে অনেককষ্টেদমিয়ে অ্যাডমস দেখতে থাকল, রোলোর উদ্দেশ্যটা কি?

রোলা হাঁপাতে হাঁপাতে সুশানকে শুইয়ে দিল। সে বুঝল, মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর বিরক্ত স্বরে কিছু বলে ছোট বসা মূর্তিটাকে দেখতে থাকল।

সুশান তাকে নিশ্চিতভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। এটাই কি করনেলিয়াস? অন্য মূর্তিগুলোর চেয়ে এর মোমটা নতুন মনে হচ্ছে। রোলো এগিয়ে টর্চের আলো ফেলে নিশ্চিত হতে লাগল। মনে হল ভীতিপ্রদ এমন কিছু ছিল যা তার হিম শীতল স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।

ঘরের চারদিকে তাকাল সে। অনুভব করল নিশ্চল মূর্তিগুলো ছাড়া কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না। হিংস্র মূর্তিগুলো যতই ভীতিপ্রদ হোক না কেন এতদূর এগিয়ে ভয় পাওয়াটা সমীচিন নয়।

নিজেকে সামলিয়ে করনেলিয়াসের কাছে গেল। তারপর বিরক্তি ভরে করনেলিয়াসের কোটটা খুলল।

রোলোর খুব কাছে একদঙ্গল মূর্তির আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল বুচ। অ্যাডমস কোথায় আছে তাও বুচের জানা। সে নিশ্চিত অ্যাডমস তাকে দেখতে পায়নি। সে ভাবল রোলোকে মারতে গেলেই অ্যাডমসের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। অ্যাডমস সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আর রোলোকে মেরে তাকে পুরো ঘরটা পেরিয়ে আসতে হবে। তার চেয়ে রোলোকে গুলি করে আলোটা নিভিয়ে পালিয়ে যাওয়াই ভাল হবে। অ্যাডমস বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকেও শেষ করবে সে।

সে আবার রোলোর দিকে তাকাল। রোলো ঘামছে। করনেলিয়াসের মড়াটা ছুঁতে তার ঘেন্না করছে। কোট খুলে ফেলল। এই তত বেল্টটা। দুটো পকেটওলা আর পকেট দুটো ফুলে আছে।

কাঁপা হাতে বেল্টটা খুলে নেওয়ার চেষ্টা করল। সজোরে টান মারল বেল্টটায়, মড়াটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝেয়।

রোলো চট করে দম নিয়ে একটু পিছিয়ে এল।

 বুচ আতঙ্কে খিস্তি করতে করতে বন্দুকটা বাগিয়ে নিল।

রোলো বেল্টটা ধরেছিল। জয়ের আনন্দে তার মুখ উদ্ভাসিত। পাগলের মত সে এটা পকেটে পুরল। পকেটটা ভাজ করা থাক থাক বন্ডে ভর্তি। রোলোর জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত।

বুচ বন্দুক তুলল।

অ্যাডমস নড়াচড়া দেখতে পেল। তার মনে হল একটা মোমের মুর্তি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার অন্য কোন উপায় ছিল না। বুকে ধুকপুকানি।

এক মুহূর্তের ভগ্নাংশের সময় ধরে বুচ আর রোলো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। বুচ মুখ বিকৃত করে রোলোর ঠিক কপালের মাঝখানটা লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল। নির্জন ঘরটায় গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।

রোলোর চোখ বন্ধ হল। এলোমেলো দু-একটা পা ফেলে বুচের দিকে এগিয়ে এক বিশাল হাতির মত ধরাশায়ী হয়ে পড়ল।

বুচ বেল্টটা কুড়িয়ে নিয়ে বাল্বটাকে গুলি করল। গুদামঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেল।

সমস্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাডমস প্রচণ্ড ভীত হয়ে পড়ল। যদিও সে নিরস্ত্র তবু ইতস্ততঃ করল না। কোন কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল বুচকে কষ্ট দেবার জন্যে। ছুটতে গিয়ে একটা মূর্তির সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল।

বুচ তার ঘর পেরোবার শব্দ পেয়েছিল।

-ওহে খচ্চর, সরে পড়। তুমি আমাকে ধরতে পারবে না।

 অনেক আত্মনির্ভর হয়ে অ্যাডমস বলল, চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি, বন্দুক তো তোমার একলার নেই।

বুচ গর্জন করে উঠল, আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা কোরনা। আমি জানি তোমাদের মত হোদল কুতকুতেরা বন্দুক কেন একটা রড নিয়েও বেরায়ও না। কেটে পড় নয়তো খুলি উড়িয়ে দেব।

বুচের কথা আন্দাজ করে নিজের শরীরকে একটা মোমের মূর্তি দিয়ে আড়াল করল। ভাবল এটা গুলি প্রতিহত করার মত যথেষ্ট নিরেট।

বুচ ভাল চাওতো ধরা দাও। তোমায় আমি চিনি, পালাবার চেষ্টা কোর না।

বুচ বন্দুক তুলে গুলি ছুড়ল।

অ্যাডমস শব্দ শুনে বুঝল গুলিটা মোমের মূর্তির গায়ে লেগে মূর্তিটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। বুচ গুলিটা বেশ ভালই ছোঁড়ে। অ্যাডমস মেঝের সমান্তরাল হয়ে গেল।

অ্যাডমস শুনতে পেল বুচ তার দিকে এগিয়ে আসছে, সে মূর্তিটা সজোরে তার দিকে ছুঁড়ে দিল। সেটা বুচের শরীরের ওপর আছড়িয়ে পড়ল। অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে লাফিয়ে উঠে অন্ধের মত গুলি ছুঁড়ল। সিলিং থেকে এক চাবড়া পলেস্তারা খসে পড়ল।

বন্দুকের আলোয় অ্যাডমস একঝলক দেখলবুচ কোথায় রয়েছে সেঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।

— যে মুহূর্তে বুচ বুঝল শয়তান ডিটেকটিভটা তাকে ধরে ফেলেছে সে পাগল হয়ে গেল। টাকাটা নিয়ে পালাবার জন্যে কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না।

পুলিশী জীবনে অ্যাডমস এরকম হাতাহাতি অনেক করেছে। তাই যেমুহূর্তে সে বুচের নখ মুখের ওপর অনুভব করল, সঙ্গেসঙ্গেই সে বুচের বুকে মারল এক ধাক্কা। সংঘাতের ভীষণতা কয়েকমুহূর্তের জন্য পরস্পরকে নিশ্চল করে দিল। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমস নিজেকে ছাড়িয়ে বুচের চোয়ালে মারল এক ঘুষি। ঘুষি খেয়ে বুচ ক্ষেপে গিয়ে অ্যাডমসকে মারল দুটো ঘুষি।

কয়েক মিনিট ধরে তারা পরস্পরকে আঘাত পাল্টা আঘাত হানল। অ্যাডমস বুঝল বুচ তার গলা টিপে ধরার ধান্দায় আছে। যত বার বুচ গলার দিকে হাত বাড়াচ্ছে অ্যাডমস ঘুষি না হয় হাত মুচড়িয়ে সরে যাচ্ছে।

এক মুহূর্তের জন্যে অ্যাডমস বুচের কব্জিটা ধরে বলল, আমার হাত থেকে তুমি পালাতে পারবে না, শুধু শুধু ঝামেলা কোর না।

বুচ ঝটকা মেরে অ্যাডমসের পিঠটা বেঁকিয়ে ফেলার জন্যে চাপ দিতে থাকল। অ্যাডমসের গলা চেপে ধরে হাঁটু দিয়ে তার বুকে আঘাত করতে লাগল।

অ্যাডমস দম নিতে পারছিল না। সে লাথি ছুঁড়ে ছটফট করতে থাকল। চোখে অন্ধকার দেখল। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে সেবুচের হাতেরবাঁধন ছাড়াবার জন্যে অসহায় ভাবে চেষ্টা করতে লাগল।

বুচ যখন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ দিতে থাকল তখন হঠাৎই তার মুঠি ঢিলে হয়ে গেল। নিচে কিছু একটা শব্দ হল। সিঁড়ির মাথা থেকে কেউ যেন বলল, একটা আলো আন জিম।

বুচ এ্যাডমসের গলা ছেড়ে লাফ মেরে দাঁড়িয়ে দেখল একটা শক্তিশালী টর্চের আলো পড়েছে। পড়ে থাকা পিস্তলটা দেখতে পেয়ে চট্ করে তুলে নিয়ে দেওয়ালের দিকে সরে যেতেই আলোর বৃত্তটা সম্পূর্ণ তার ওপর এসে পড়ল।

-ওখানে কি হচ্ছে?

 পুলিশের একটা হেলমেটের আভাস পেয়ে কোন কিছু চিন্তা না করে গুলি চালাল।

সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো নিভে গেল। হুড়োহুড়ির আওয়াজে সে বুঝতে পারল পুলিশগুলো পিছিয়ে গেছে।

বুচ পাগলের মত মরিয়া হয়ে ভাবল সে যদি এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে না যেতে পারে তাহলে ফাঁদে পড়ে যাবে। বেল্টটা কোথায় খোঁজবার জন্যে মেঝেতে হাত দিয়ে হাতড়াতে লাগল।

এই যে! বন্দুকটা ফেলে দিয়ে মাথার ওপর হাত তুলে এগিয়ে এস। কেউ চেঁচিয়ে আদেশ করল।

বুচ নীরবে হাতড়াতে লাগল, বেল্টটা তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। আঃ আলোটা নিভিয়ে কি ভুলই না করেছে।

উন্মত্তের মত লম্বা লম্বা বৃত্তে হাতড়াতে হাতড়াতে এ্যাডমসের মুখে ছোঁয়া লাগতেই চকিয়ে গালাগাল করতে লাগল।

এভাবে কোন কাজ হবে না, তাকে একটা আলো জোগাড় করতেই হবে। এখুনি ঐ ফ্লাইং স্কোয়াড্রনগুলো হাতে বন্দুক নিয়ে হাজির হবে।

–আগে একটা আলো দেখাও। যাচ্ছি। সিঁড়িটা কোনদিকে বুঝতে পারছি না।বুচ চীৎকার করে বলল।

— তোমার বন্দুকটা আগে ছুঁড়ে ঘরের অপরদিকে ফেল। শব্দটা যাতে আমি শুনতে পাই। অন্ধকারের মধ্যে একটা পুলিশ চেঁচিয়ে উঠল।

বুচ তার ভারী সিগারেট কেসটা বার করে অন্ধকারে ছুঁড়ে দিল। শব্দ করে ওটা পড়ল। এক মিনিট পরে টর্চের আলোয় আবার গুদোমঘর আলোকিত হয়ে উঠল।

উন্মত্তের মত বুচ তার দিকে তাকাল। সুশান একা অনেক দূরে কুঁকড়িয়ে শুয়ে আছে। তারই কাছে বেল্টটা পড়ে আছে।

বুচ এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে লাফ দিয়ে পড়ে বেল্টটা তুলে নিয়েই ঘুরে ছুটল সিঁড়ির দিকে। তীব্র টর্চের আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

বন্দুকটা ফেলে দাও। উৎকণ্ঠিত গলায় পুলিশটা বলল।

 বুচ সামনাসামনি গুলি চালাল। পুলিশটা মেঝের ওপর আছড়িয়ে পড়ল। বুচ পা দিয়ে তাকে সরিয়ে রাস্তা করে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছল। জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে সদর দরজার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল চ্যাপ্টা টুপী মাথায় দুটো পুলিশ দরজা ঠেলে ঢুকছে। হাতে ঝকঝকে পিস্তল।

–দেখ হ্যারি। একজন চীৎকার করে বলল, ব্যাটা মাইক ইগান।

 তিক্ত গলায় হ্যারি জবাব দিল, হ্যাঁ, আমি দেখেছি। এই ব্যাটাই জ্যাককে মেরে ফেলেছে।

–বেশ,ব্যাটা পালাতে পারবেনা। তুমি সিঁড়ির দিকে নজর রাখ। আমি জ্যাককে সরিয়ে নিই।

বুচ বেশ ভয় পেয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে হঠাৎ সিঁড়ির মাথায় শব্দ পেয়ে সে গুলি চালাল। পাল্টা দুটো গুলি ছুটে এসে দেওয়ালে গেঁথে গেল। মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে সে ঘামতে লাগল।

রাগে আর ভয়ে কান খাড়া করে সে শোনবার চেষ্টা করতে লাগল। বন্দুকটা সামনে বাগিয়ে ধরা। ভাল ফাঁদেই পড়েছে সে। বেল্টটা মুঠোর মধ্যে। এর ভেতর তিন মিলিয়ন পাউন্ড রয়েছে–আর কিনা একটা পাউন্ডও কপালে জুটবে না। এর থেকে ছুটে পালিয়ে যাওয়া ভাল। জীবন্ত তাকে আর ধরতে হচ্ছে না।

কোটটা খুলে বেল্টটা কোমরে বাঁধল। প্রস্তুত সে। যদিও পুলিশ সারা বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে হয়ত আর একটা বুলেট তার পালবার রাস্তা সাফ করে দিতে পারে। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সে সিঁড়ির দিকে উঠে যাবে। তাতে তাকে যদি মরতে হয়, সেও ভাল।

হঠাৎ একটা আলো দপ করে জ্বলে উঠল-পরমুহূর্তে একটা জ্বলন্ত খবরের কাগজের বল নীচের গুদোমে এসে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির দিক থেকে গুলি ছুটে এল।

কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে তার হাত থেকে বন্দুক খসে পড়ল। গালাগাল করতে করতে সে হাত আর হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে পড়ে গেল।

–ইগান নড়াচড়া করলে তোমায় ঝাঁঝরা করে দেব। কঠিন স্বরে কে বলে উঠল।বন্দুকটা কোথায়?

বুচ অন্ধকারে লাফ দিয়ে সরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হল। কিন্তু পিছিয়ে আসতে হল।

তারই বন্দুক হাতে নিয়ে ভয়ার্ত সাদা মুখে সুশান হেডার তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

-খবরদার, নড়বে না। নইলে আমি গুলি করব। সুশান চীৎকার করে উঠল।

 বুচ মাথার ওপর হাত তুলে পেছোতে পেছোতে বলল, ওভাবে তাক কোরনাগুলি বেরিয়ে আসবে। গলা কাঁপছে বুচের।

ঐ ভাবেই থাক। ওপর থেকে কে একজন বলল এবং এক মুহূর্তেই গোটা গুদোমঘরটা মনে হল পুলিশে ভরে গেছে।

.

ডিটেকটিভ সার্জেন্ট অ্যাডমসের অফিসটা খুব ছোট্ট–অল্প আসবাবপত্র। সুশান হেডার সেখানে একটা শক্ত চেয়ারে বসেছিল।

দরজা খুলে অ্যাডমস ঘরে ঢুকে বন্ধুত্বের হাসি হেসে বলল–আপনাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্যে দুঃখিত মিস্ হেডার। এ ঘরটা কোন মহিলা অতিথিকে অভ্যর্থনা জানবার পক্ষে মোটেই আদর্শ নয়। অ্যাডমস একটা সিগারেট অফার করল।

সুশান ভয়ে ভয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করল।

— অ্যাডমস হেসে বলল, ঠিক আছে, মিস্ হেডার। আপনি কিছুটা বোকামী করে ফেলেছিলেন, তবুও আপনি না থাকলে এই ব্যাপারটার জন্যে আমাদের আরও জটিল এবং দীর্ঘ অনুসন্ধান চালাতে হতো। ভাগ্যক্রমে বুচ সোজাসুজি কাউকে খুন করার কথা স্বীকার করছে না তাই আমিও আমার বস-কে আপনার একটা হত্যার ঘটনা চেপে যাওয়ার ব্যাপারটা জানাইনি। ব্যাপারটা গোপন থাকাই ভাল, বুঝতেই পারছেন।

সুশান কোন জবাব না দিয়ে কোলের ওপর হাত দুটোকে মোচড়াতে লাগল।

–কি এমন ঘটেছিল যে আপনার মতো মেয়ে এইরকম একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলেন?

সুশান বলল-জানি না, জো ওয়েডম্যানকে সাহায্য করতে চেয়েছিল আর আমি তার জন্যে করুণা অনুভব করেছিলাম। আর আমি আমি সত্যিওকে সাহায্য না করে পারিনি।

-ভাল। ধূর্ত আর বদমাইশ রোলোটাকে ধরবার চেষ্টা আমরা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলাম। আপনার সাহায্য ছাড়া সেটা সম্ভব হত কিনা জানিনা।

সুশান প্রতিবাদ জানাল–আমার আর কি করার ছিল?

অ্যাডমস জানাল-পরোক্ষভাবে ছিল। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনাকে অনুসরণ না করলে ঐ অবিশ্বাস্য অঙ্কের অর্থ হাতবদল হয়ে যেত।

–আমি এখন বুঝতে পারছি না, আমি কেন ওখানে গেলাম।

-হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমাকে অবাক করেছে। আপনি যেন ঘুমের ঘোরে হাঁটছিলেন। বুচ বলছিল-গিলোরী ভুডু জানে। আমি ওসব বিশ্বাস করিনা। যাইহোক গিলোরীর খোঁজ করতে গিয়ে দেখি সে ফ্রান্স থেকে এখন জাহাজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাড়ি দিচ্ছে।

সুশান অবশেষে প্রশ্ন করল, মিঃ ওয়েডম্যানের কি হল?

মিঃ ওয়েডম্যান আপনাকে দেখতে চান। আর এজন্যই আমার আপনাকে ডেকে পাঠানো।

–আমাকে উনি দেখতে চান? কেন?

অ্যাডমস মাথা নাড়ল, জানি না। যদি দেখা করতে চান তো চলুন, গাড়ি আছে।

সুশান ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করল–তিনি এখন কোথায়?

তিনি একটা নার্সিংহোমে। তিনি খুব ভাল নেই। আমাদের এখন তাকে দেখাশোনা করতে হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন।

–জো বলেছিল এরকমই ঘটবে।

-হ্যাঁ। রোলোর সঙ্গে দুর্ব্যবহারে তিনি তেমন বিক্ষুব্ধ হননি। তার ওপর নজর রাখার জন্যে এখনও লোক আছে। তাকে একা ঘুরে বেড়াবার জন্যে ছেড়ে দিতে পারিনি আমরা। ব্যাঙ্ক তার কাজ দেখাশোনা করছে। তিনি এখন স্বস্তিতে রয়েছেন। অ্যাডমস দাঁড়িয়ে পড়ল–যাবেন?

সুশান দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি বুঝতেই পারছি না তিনি আমার কাছে কি চান? তবে মনে হয় ওনার সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়াটা অভদ্রতা হবে। তাই নয় কি?

অ্যাডমস তার দিকে তাকিয়ে হাসল।ভয় পাবার কিছু নেই। চান তো আমিও আপনার সঙ্গে থাকব। সুশানকে এ্যাডমসের ভাল লাগে। ভাল লাগে তার ভীত চোখ দুটো আর চুল।

সুশান হেসে বলল, ভয়ঙ্কর সব ঘটনা পার করে এখন একটা বৃদ্ধ লোককে ভয় পাওয়াটা ন্যাকামী করা হবে না কি? চলুন, আমি প্রস্তুত।

তারা গাঢ় নীল রঙের পুলিশের গাড়িতে দ্রুত লন্ডনের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। অ্যাডমস সুশানকে সহজ করার চেষ্টা করল।

–এখন তো সব উত্তেজনার শেষ। এখন কি করবেন বলে ভাবছেন?

সুশান মাথা নাড়ল-হয়ত একটা চাকরি করব। কিন্তু চাকরি এখন খুব নীরস, নিরুত্তেজ মনে। হবে বলে মনে হয়।

অ্যাডমস হাসল। পাঁচ বছর পুলিশে আছি এরকম ঘটনা এই প্রথম।

সুশান বিস্মিত হয়ে বলল–মনে হয় আপনি উত্তেজনা ভালবাসেন না। যদিও আমি প্রথমে একটু ভয় পাই, তবুও আমার যদি অনেক টাকা থাকত তবে আমি উত্তেজনার দিকে ছুটতাম। উত্তেজনা আমার ভাল লাগে।

–হতভাগা সেডরিক আপনার জন্যে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। আপনি আবার কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন তা আমি চাই না।

–জোর দেওয়া টাকার এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। টাকাটা ফুরিয়ে গেলে কিছু একটা ধান্দা করতেই হবে।

আপনার কেউ নেই?

–সুশান মাথা নেড়ে বলল–এক কাকীমা আছেন, কিন্তু তিনি আমাকে ঠিক পছন্দ করেন না।

অ্যাডমস সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে দেখে বলল–তাহলে এবার নিশ্চয় আপনি বিয়ে করবেন? আবার আপনার কোন পুরুষ বন্ধু নেই–এটা বিশ্বাস করতে বলবেন না।

সুশান জোর দিয়ে বলল–সত্যিই নেই। পুরুষরা এত অধিকারপ্রবণ যে ওরা আমার চক্ষুশূল।

–কিন্তু আপনার ভবিষ্যতের দেখাশোনার জন্যে তো কাউকে চাই।

না, ধন্যবাদ। আমার দেখাশোনা আপাততঃ আমি নিজেই করতে পারবো। পরে দরকার হলে ভেবে দেখব।

অ্যাডমস কিছু জবাব দেবার আগেই গাড়িটা ধীর গতিতে এসে একটা বিশাল নার্সিংহোমের ড্রাইভওয়েতে দাঁড়ালো।

সুশান কম্বল গায়ে আগুনের পাশে বসে থাকা ক্রেস্টার ওয়েডম্যানের কাছে এগিয়ে গেল।

-বোস। চেয়ার এগিয়ে দিলেন ওয়েডম্যান। আমি যা শুনেছি তুমি একজন উল্লেখযোগ্য মহিলা। তোমার নামই সুশান হেডার?

-না-না, আমি সেরকম কেউ নই।

–তোমার বয়স অনেক কম। কত বয়স তোমার?

অক্টোবরে বাইশ হবে।

তাই বুঝি। গভীর ভাবে তাকিয়ে থেকে ওয়েডম্যান বললেন, ওরা বলছে আমি নাকি পাগল। যত বাজে কথা। আসলে আমার বয়স হয়ে গেছে বলে ব্যবসা-ট্যবসা চালাবার মত ক্ষমতা আমার নেই। কেন জান, কারণ আমার ভাই আমার সঙ্গে আর নেই। যাইহোক হারানো টাকাপয়সা আবার পেয়ে গেছি আর এ জায়গাটাও ভাল। নিজের দেখাশুনা করতে করতে আমি ক্লান্ত। এরা যদি এ জায়গাটায় রেখে আমার দেখাশোনা করতে চায় করুক।

সুশানের মনে হল সে আর ভয় পাচ্ছে না লোকটাকে। কথাবার্তা শুনেও এতটুকু পাগল বলে মনে হলনা তার, বরং বুড়ো বাপের মতই।

–জো-এর কথা আমায় বল, ওর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা শুনব বলেই তোমায় ডেকে পাঠিয়েছি।

সুশান জো-এর কথা, বুচকে অনুসরণ করার কথা, করনেলিয়াসের মৃতদেহ সরিয়ে ফেলার কথা, আধঘণ্টা ধরে বলে গেল।

বাঃ চমৎকার। অ্যাডমসের কাছ থেকে কিছু কিছু শুনেছি। এখন মনে হচ্ছে তুমি না থাকলে আমি আমার ঐ দীর্ঘসময়ের রোজগারের টাকাগুলো হারাতাম। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আর হতভাগ্য জো-এর কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না।

না না। আসলে এটা করতে আমার ভালই লেগেছিল। আমি উত্তেজনা ভালবাসি আর এখন উত্তেজনাহীন জীবন আমার ভাল লাগছে না।

দরকারও নেই। তোমার বয়সী সাহসী মেয়ে একলাই জীবনে অনেকদূর যেতে পারে। তুমি আমার বিপদে সাহায্য করেছ। এখন আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই।

ওয়েডম্যান পকেট থেকে একটা খাম বার করে কোলের ওপর রেখে বললেন, আমি পাগল বটে, তবু আমি আমার ট্রাস্টিদের সঙ্গে কথা বলে এ টাকাটা তোমাকে দিতে চাই। তারপর খামটা সুশানের কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, এখন খুলো না। এমন কিছু বিরাট অঙ্কের টাকা নয়। তবে বছর পাঁচেক তুমি স্বাধীনভাবে ইচ্ছেমত বাঁচতে পারবে আশা করি।

জোর টাকাটা এখনও আছে।

-ওটা তোমার ফী। তর্ক করো না। বুড়ো ডাক্তারটা এসে পড়ল। সুযোগের সদব্যবহার কর। সুযোগ নষ্ট করতে নেই।

ডাক্তার এজলী ঘরে ঢুকে পড়ে বললেন, আশা করি এবার আপনি একটু ঘুমিয়ে নেবেন।

সুশান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ধন্যবাদ মিঃ ওয়েডম্যান।

ওয়েডম্যান হাত তুলে বললেন, সুখে থাক বাছা! সাহায্যের দরকার পড়লে আমার কাছে এসো। না হলে, দূরে থেকো। তোমার মত বাচ্চা মেয়ের জায়গা এটা নয়। তারপর হঠাৎই ওয়েমানের চোখমুখের চেহারা পাল্টে গেল। মেয়েটাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। ও কে? এখানে ওর কি দরকার? তারপর ঝগড়াটে গলায় বললেন–আমার করনেলিয়াস কোথায়? ওকে এখুনি এখানে আসতে বল। হেভওয়ে স্টিল মারজার সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোচনা আছে।

সুশান খুব আঘাত আর দুঃখ পেল। ডাঃ এজলীকে জিজ্ঞেস করল, উনি কি সুখী?

সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে এজলী বললেন, নিশ্চয়। দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আপনি এখান থেকে যেতে পারবেন তো। আমাকে এখনই গিয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলতে হবে, ওনাকে বোঝাতে হবে।

হলে পৌঁছে খামটা খুলে সুশান দেখল তার নামে পাঁচ হাজার পাউন্ড-এর একটা চেক। সই রয়েছে ওয়েডম্যান, ব্যাংক ডাইরেক্টর।

হঠাৎ পুলিশের গাড়ির তীব্র হনের আওয়াজে তার চমক ভাঙ্গল। সে তাড়াতাড়ি সযত্নে চেকটা ব্যাগে রাখল। এতগুলো টাকা একসঙ্গে পাবার আশা সে কল্পনাও করতে পারেনি কোনদিনও। ভাবল–এখন সে স্বাধীন। সে এখন স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারে কিংবা একটা অফিস বা দোকান। এমনকি একটা ডিটেটিভ এজেন্সীও খুলে বসতে পারে। এখন তাকে কারোর ওপর নির্ভর করতে হবে না।

আবার হর্ন বাজল। সুশান এগিয়ে গেল গাড়িটার দিকে। গাড়ির ভেতর বসে আছে অ্যাডমস। সামনের দরজাটা খুলে দিল অ্যাডমস। সুশান গাড়িতে উঠে বসল। সে অ্যাডমসকে ওয়েডম্যানের সমস্ত কথা জানাল। গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে চলল।