১-৩. চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার

ভালচার ইজ এ পেসেন্ট বার্ড

০১.

চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ফেনেলের।বালিশ থেকে মাথা তুলে কান পেতে রইলো। কোথায় যেন বিপদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নোঙর পড়ার একটানা শব্দ, কিন্তু এটা তো বিপদ সূচক নয়–তবু কিসের আশঙ্কায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।

প্রায় একমাস যাবৎ ফেনেল মৃত্যুর আতঙ্কে বাস করছে। নিঃশব্দে বিছানার নীচে হাত ঢুকিয়ে পুলিশী ব্যাটনটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরলো সে।

পাশের মেয়েটার ঘুম যাতে ভেঙে না যায় এমন ভাবে ধীরে ধীরে গায়ের চাদর সরিয়ে খাট থেকে নামলো। নিঃশব্দে প্যান্ট এবং রাবার সোলের জুতো জোড়া পরে মারাত্মক অস্ত্রটা হাতে নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। একটানা বৃষ্টি পড়ে চলেছে। স্ট্রীট ল্যাম্পের আলোয় ডেকে আলো-আঁধারের লুকোচুরি চলেছে। সে লক্ষ্য করলোবজরা থেকে মিটার পঞ্চাশেক দূরে একটা সাম্পান, দাঁড় বেয়ে এগিয়ে আসছে বজরার দিকে। সাম্পানের ওপর চারটে ঘণ্ডামার্কা চেহারার লোক হাঁটু মুড়ে বসে, একজন ধীরে ধীরে দাঁড় বাইছে। বিপদ যে আসছে এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। ডেকের ওপর শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে এগোতে লাগলো ধীরে ধীরে। কাউকেই সে পরোয়া করে না। যে কোনো মূল্যে আত্মরক্ষার জন্যে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। আজ নয়তো কাল ওরা যে তাকে খুঁজে পাবে একথা সে ভালো করেই জানে। মৃত্যুর সে করে না।

সাম্পান ধীরে ধীরে জল কেটে এগিয়ে আসে। জলেদড় ছেড়ে দিয়ে জলযানটির গতি নিয়ন্ত্রণ করলো দাড়ি, ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সাম্পান লাগলো বজরার গায়ে।

হঠাৎ ফেনেল উঠে দাঁড়িয়ে এক পা এগিয়ে এলো। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হাতের ব্যাটনটা ঘোরালো প্রথম লোকটাকে লক্ষ্য করে। বাতাস কেটে বিদ্যুৎগতিতে চেনটা গিয়ে আছড়ে পড়লো লোকটার মুখে। একটা আর্তনাদ শোনা গেলো।

দ্বিতীয় আরোহীকেও ফেনেল একই ভাবে ঘায়েল করলো। আরও দুজন আরোহী গন্ডগোল বুঝতে পেরে দাঁড় তুলে বাইতে শুরু করে দিল।সাম্পান ধীরে ধীরে বজরা থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। ফেনেল চুপচাপ তাদের চলে যাওয়া দেখতে লাগলো।

আর দেরী না করে সে চলে এলো। দরজা ঠেলে শাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সুইচ টিপে আলো জ্বাললো। মিমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো বিছানায়, কি হয়েছে লিউ? কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

ফেনেল কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ভিজে প্যান্ট ছেড়ে উলঙ্গ অবস্থায় বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। গরম জলের শাওয়ারটা খুলে দিয়ে চুপচাপ চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলো।

মিমি বিস্রস্ত বেশবাসে বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। ফিনফিনেনাইটির আড়াল থেকে ভারী স্তন দুটি ঝুলে রয়েছে। তার সবুজ চোখের দৃষ্টিতে একই সঙ্গে হতাশা আর আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠেছে।

মিমিকে দেখে হাত নেড়ে চলে যেতে বললো ফেনেল, শাওয়ার বন্ধ করলো। ঘরে ঢুকে চটপট জামা প্যান্ট পরে নিল। টেবিলের ওপরের বাক্স থেকে একটা সিগারেট তুলে নিলো ফেনেল, ঠোঁটে ঠেকিয়ে দেশলাই জ্বাললো। মিমিকে বললো, তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।

মনে মনে ভাবলো, মেয়েটি দেখতে যেমনই হোক না কেন, এতদিন মেয়েটি তার উপকারেই এসেছে, গত চারসপ্তাহ ধরে তাকে বজরায় লুকিয়ে রেখেছে সে। যাই হোক এখন সে পালাতে চায়। একবার বেরিয়ে পড়লে আর কতক্ষণ লাগবে মিমিকে ভুলতে।

মেয়েটি কিন্তু তাকে একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে। হঠাৎ সে ফেনেলের হাত দুটি ধরে বললো, না, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না, কিছুতেই না। ফেনেল একরকম ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো রিসিভারের দিকে। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে তিনটে। জেসি? আমি লিউ বলছি, লিউ ফেনেল। কুড়ি পাউন্ডের একটা কাজ আছে। গাড়িটা নিয়ে কুড়ি মিনিটের মধ্যে কিংস রোডের ক্রাউন পাব-এ চলে এসো, যেন এদিক ওদিক না হয়।

মিমি সামনে এসে দাঁড়ালো, ফেনেল তাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেলে অগ্নিকুণ্ডের দিকে। ওপরের তাক থেকে একটা চায়ের কেটলি নামিয়ে নিল, মিমি উদ্ভ্রান্তের মতো এসে ফেনেলের হাত চেপে ধরল।

ফেনেলের চোখ দুটি জ্বলে উঠলো। সে প্রাণপণ চেষ্টা করলো ক্রোধ সম্বরণ করতে। বললো, কেন অনর্থক ঝামেলা বাড়াচ্ছো, টাকাপয়সার আমার এখন খুব দরকার। পরে তোমাকে সব শোধ করে দেবো।

না, পারবে না তুমি। মিমি ডান হাত মুঠো করে ফেনেলের গাল লক্ষ্য করে চালালো এক ঘুষি। ফেনেল কোন প্রকারে ঘুষিটা এড়িয়ে মিমির চোয়াল লক্ষ্য করে প্রচণ্ড শক্তিতে একটি বিশ পাউন্ড ঘুষি চালালো। নোটের বান্ডিল, একগাদা খুচরো পয়সা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মিমি চিৎ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। জ্ঞান হারালো, ফেনেল আর দেরী না করে নীচু হয়ে সমস্ত টাকা পয়সা, নোটের বান্ডিল পকেটে পুরে পুলিশ ব্যাট হাতে দরজা খুলে এলো বাইরের ডেকে।মিমির দিকে একবারও ফিরে তাকালো না।

বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। কনকনে বাতাস বইছে। এক ছুটে কাঠের পাটাতন বেয়ে সে এসে উঠলো পাড়ে। অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দৃঢ় মুষ্টিতে ব্যাটনটা চেপে ধরে হাঁটতে লাগলো বড় রাস্তার দিকে।

দূর থেকে জেসির মরিস গাড়িটা দেখা গেল। নিশ্চিন্ত হয়ে এক ছুটে গিয়ে পেছনের দরজা, খুলে গাড়িতে উঠে বসলো সে। জেসি লক্ষ্য করলো ফেনেলের চোখের হিংস্র দৃষ্টি।

দশ মিনিটের মধ্যে জেসির ডেরায় গিয়ে দুজনে ঢুকলো। আলো জ্বাললো, কাবার্ড খুলে এক বোতল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট আর দুটো গ্লাস এনে রাখলো জেসি টেবিলের ওপর। বোতল খুলে গেলাস ভর্তি করে পানীয় ঢাললো।

ব্যক্তিগত জীবনে জেসি এক রেসের কেরানী। বিশেষ করে নীচের মহলের লোকজনদের নিয়েই এই সব কাজ। ফেনেলের সঙ্গে তার পরিচয় পারমা জেলে। এক সাঙাতের কাছে সে শুনেছে, ফেনেল চুকলি খেয়েছে পুলিশের কাছে। তার কাছে খবর পেয়ে পুলিশ মোয়রানির পাঁচ পাঁচজন সাগরেদকে গ্রেপ্তার করেছে। মোয়রানি ক্রোধে ফেনেলের মৃত্যু পরোয়ানা জারীকরেছে, এই অবস্থায় তাকে সাহায্য করার অর্থ বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া।কিন্তু কুড়ি পাউন্ডের লোভটাও তো কম নয়।

ফেনেল মিমির নোটের বান্ডিল পকেট থেকে বের করে দুখানা দশ পাউন্ডের নোট জেসির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো যে, সে জেসির ডেরায় দুদিন থাকতে চায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জেসী রাজী হলো।

.

এক সপ্তাহ আগে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপন চোখ এড়ায়নি গ্যারী এডওয়ার্ডস্-এর। একজন অভিজ্ঞ হেলিকপ্টার পাইলট প্রয়োজন, বেতন আশাতীত।

গ্যারী অভিনব কিছু করতে চায় সুতরাং চাকরির লোভে টনিকে কিছু না জানিয়েই সে একখানা দরখাস্ত পাঠিয়ে দিল।

গ্যারী এডওয়ার্ডস, লম্বা, শক্ত-সমর্থ চেহারার যুবক।বয়স ঊনত্রিশ। গ্যারীর চেহারার মধ্যে এমন এক আকর্ষণী শক্তি আছে যে মেয়েরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে তার ওপর। টনি হোয়াইট এর সঙ্গে তার পরিচয় কালো ডোভার ফেরী জাহাজে। দুজন ফরাসী ডিটেকটিভ এসেছিলো তার সঙ্গে জাহাজ ঘাটা পর্যন্ত। অবশেষে জাহাজ ছাড়লো। গ্যারী ডেক থেকে সোজা গিয়ে ঢুকলো জাহাজের প্রথম শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট পানশালায় দীর্ঘ তিন বছর পর এই প্রথম প্রাণভরে মদ খেল। টনি পানশালার উঁচু টুলে বসে ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছিলো সিঞ্জানোর গেলাসে। তার বয়স বাইশ। চোখে পড়ার মতোই তার চেহারা। গ্যারী যে অভিবাদন করবে এ আর বিচিত্র কি!

এদিকে গ্যারীকে দেখে রক্তে ঝড় বয়ে গেলো টনির। শরীরের প্রতিটি কোষে যেন যৌবন টগবগ করছে। গ্যারীকে পাওয়ার জন্যে তার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। একেবারে প্রথম দর্শনেই প্রেম।

হঠাৎ গ্যারীর দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। মেয়েদের এসব কায়দা-কানুন তাঁর নখদর্পণে। গ্যারী গেলাসে চুমুক দিয়ে টনির দিকে এগিয়ে গেলো। মৃদু হেসে বললো, আপনাকে জানতে ভারী ইচ্ছা করছে। জাহাজ বন্দরে ভিড়তে এখনও এক ঘন্টা দেরী, ততক্ষণের জন্য বরং একটা কেবিন ভাড়া করা যাক।

প্রস্তাবটা টনির ভারী মনোমতো হলো। তারপর বন্ধ কেবিনের মধ্যে দুজনে দুজনকে অন্তরঙ্গ ভাবে চিনলো, পরিতৃপ্তির আনন্দে দুজনের মনই পরিপূর্ণ। জাহাজ থেকে নেমে ট্রেনের এক ফাঁকা প্রথম শ্রেণীর কামরায় দুজনে পাশাপাশি বসলো। টনি জানালো অন্য কোথাও না থেকে গ্যারী যেন তার ফ্ল্যাটেই থাকে। গ্যারী ভাবলো সেটা মন্দ নয়। সেই থেকে সে টনির কাছেই রয়ে গেছে। শুধু একটা চাকরী এখনও তার জুটলো না। চাকরীর জন্য তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

কফি শেষ করে গ্যারী উঠে দাঁড়ালো দরজা খুলে বাইরে এসে চিঠির বাক্সে একটা চিঠি তার চোখে পড়লো।

ডেইলি টেলিগ্রাফ প্রকাশিত এস, ১০১২ বক্স নম্বরের বিজ্ঞাপনের উত্তরে তার দরখাস্তের ভিত্তিতেই তাকে ডাকা হচ্ছে।

চিঠি হাতে সে ঘরে ঢুকলো। টনি উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে। পাতলা নাইটিটা কোমর পর্যন্ত উঠে বে-আবু হয়ে পড়েছে, ঘুমোচ্ছে।

গ্যারীর ধাক্কায় ত্ৰস্তে উঠে বসলো টনি। গ্যারী তাকে আলিঙ্গন করে বললো একটা চিঠি। এসেছে তার নামে। গ্যারী ডেইলি টেলিগ্রাফের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে তার দরখাস্ত করা, এই চিঠি আসা সব ব্যাপারটাই বললো। ঠিকানাটা শুনে লাফিয়ে উঠলো টনি। রয়্যাল টাওয়ার্স। সে তো হাল আমলের সবচেয়ে নামী এবং দামী হোটেল। যেন বস্তা বস্তা সোনা, দানা, হীরে জহরতের গন্ধ ভেসে আসছে।

বেলা এগারোটা নাগাদ গ্যারী পৌঁছে গেল রয়্যাল টাওয়ার্সে। দরওয়ানের কথা মত লিফটে চড়ে এগারো তলায় পৌঁছে সাতাশ নম্বর সুইচ খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না। বন্ধ দরজায় ধীরে ধীরে টোকা মারলো সে। দরজা খোলাই ছিল। ছিমছাম সাজানো ঘর, ডিস্কের পেছনে বসে একটা মেয়ে। তার সামনে তিনটে টেলিফোন, একটি টাইপ মেশিন, একটি টেপ রেকর্ডার। মেয়েটিকে দেখে অবাক হলো গ্যারী। মনে হলো যেন রক্তমাংসের মেয়ে নয় একটা যন্ত্র।

চোখ তুলে তাকালো মেয়েটি মিঃ এড়ওয়ার্ডস? যন্ত্রটায় একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠলো। মেয়েটি উঠে এগিয়ে গেল একটা দরজার দিকে। পেছনে পেছনে এলো গ্যারী। ঘরের ভিতরে গ্যারী প্রবেশ করলো।

দরজার সোজাসুজি বিরাট একটা ডেস্কের পেছনে বসে আছেন এক মোটাসোটা, ছোটখাটো চেহারার ভদ্রলোক। মুখে তার জ্বলন্ত চুরুট, হাত দুটি টেবিলের ওপর স্থির করা। চোখের দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী। পায়ে পায়ে ডেস্কের কাছে এগিয়ে গেল গ্যারী। স্যালিক হাত তুলে একটা চেয়ার দেখালেন বসার জন্য। তারপর গ্যারীর দরখাস্তটা হাতে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন আর বললেন, নিজের সম্বন্ধে মিথ্যে বাজে কথা একগাদা লিখেছেন। কল্পনা শক্তি দেখছি বেশ প্রখর।

গ্যারীর চোয়াল শক্ত হলো, ঠিক বুঝতে পারলো না উনি কি বলতে চাইছেন।

একটা সোনার অ্যাসট্রেতে চুরুটের ছাই ঝাড়লেন স্যালিক, পড়ে আমার বেশ মজা লাগছিল বানানো মিথ্যা গল্প। লোক লাগালাম সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য। আপনি গ্যারী এডওয়ার্ডস বয়েস উনত্রিশ। জন্ম আমেরিকার ওহিওতে। আপনার বাবার পেট্রোল পাম্পের ব্যবসা ছিল। লেখাপড়া শিখে আপনি বাবার ব্যবসাতে লেগে পড়লেন, মোটর গাড়ি সম্বন্ধে বেশ ভালো জ্ঞান আহরণ করলেন। বিমান চালানো শেখার একটা সুযোগ আপনার হলো। পাইলট হতে বেশী দেরী হলোনা। টেক্সাসের এক তৈল ব্যবসায়ীর বিমান চালকের কাজ পেলেন আপনি। ধীরে ধীরে টাকা বাড়ালেন আপনি এবং স্মাগলারদের দলে ভিড়ে গেলেন।

মেক্সিকোর লোকেদের হয়ে আমেরিকায় স্মাগল করার কাজ।কদিন পরে চোরাই চালানকারী বনে গেলেন। শুরু করলেন নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা। লোভের বশবর্তী হয়ে একটি মারাত্মক ভুল করে বসলেন। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়লেন। পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা চলাকালীন আপনারই একজন সাকরেদ হেলিকপ্টারটি নিয়ে পালালো। সেটা সে বিক্রি করে সেই টাকা জমা রেখে দিল আপনার অ্যাকাউন্টে। তিন বছর জেলের ঘানি টানার পর বেরিয়ে এসে সেই টাকাটা তুলে নিলেন। ফ্রান্সের পুলিশ এসে তুলে দিয়ে গেল আপনাকে জাহাজে। আপনি সোজা চলে এলেন ইংল্যান্ডে।

স্যালিক চুরুটটা অ্যাসট্রেতে ঠেসে নিভিয়ে দিয়ে গ্যারীর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, আপনার অতীত জীবন সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আগ্রহ শুধু দুটো ব্যাপারে–এক, আপনার পাইলটের লাইসেন্স আছে এবং দুই আপনি হেলিকপ্টার চালাতে জানেন। আমার কাছে এইটুকুই যথেষ্ট। আপনার মতো লোককেই তো আমি খুঁজছিলাম। গ্যারী চেম্বারে বসেতার পকেট থেকে পাইলট লাইসেন্স, প্রশংসা পত্র ইত্যাদি বার করে স্যালিকের দিকে এগিয়ে দিল।

স্যালিক একনজরে দেখে বললেন, এতেই হবে। চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে একটা চুরুট তুলে নিলেন, তারপর গ্যারীর দিকে চেয়ে বললেন–এমন কোন কাজ যদি আপনাকে করতে বলা হয় সেই কাজ কি মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আপনি করতে রাজী হবেন? পারিশ্রমিকটা কিন্তু খুব আকর্ষণীয়। কাজটি তিন সপ্তাহের। সপ্তাহে তিন হাজার ডলার ফী। তিন সপ্তাহ পর মোট নহাজার ডলার হাতে আসবে আপনার। কাজের ঝুঁকি কিছুটা থাকলেও পুলিশের ঝামেলা হবার– সম্ভাবনা নেই। গ্যারী জানতে চাইলো ঝুঁকিটা কিসের?

এই ধরুন বিপক্ষের লোকেদের নিয়ে। তা সব কাজেই একটু ঝুঁকি থাকে। মানুষের জীবনটাই হাজার ঝুঁকি, হাজার ঘাত-প্রতিঘাতের সমন্বয়।

গ্যারী জানতে চাইলে তাকে এখন কি করতে হবে। স্যালিক জানালো আজ রাতে সব কিছু জানানো হবে, তবে কাজটা একান্তই গোপনীয়, পাঁচ কান হলে অসুবিধে আছে।

গ্যারী উঠে দাঁড়ালো। ডেস্কের মেয়েটি উঠে এসে তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।

ঠিক রাত নটায় গ্যারীকে মিঃ স্যালিকের ঘরে ঢুকিয়ে দিল সেই মেয়েটি। ঘরে আরো দুজন লোক বসে সিগারেট টানছে। চেয়ার টেনে বসলো সে। ভিতরের দিকে একটা দরজা খুলে স্যালিক প্রবেশ করলো। ডেস্কের ওধারের চেয়ারে বসে তিনজনের দিকে তাকালেন। তারপর পরিচয় পর্ব শুরু করলেন।

ইনি মিঃ গ্যারী এওয়ার্ডস, হাতের জ্বলন্ত চুরুটটা দিয়ে দেখালেন তিনি গ্যারীকে। পেশায় পাইলট, মোটর গাড়ী বিশারদ। চোরাই চালান করতে গিয়ে ধরা পড়ে তিন বছর কাটিয়ে এসেছেন ফরাসী জেলে। স্যালিক এবার দেখালেন গ্যারীর বয়েসী লোকটিকে, ইনি মিঃ কেনেডি জোন্স। শিকারের দল নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে জঙ্গলে শিকার করা এই ছিল ওঁর কাজ। দুর্ভাগ্যবশত মিঃ জোন্সকেও একবার ঘানি টানতে হয়েছে প্রিটোরিয়া জেলে। স্যালিক এবার দেখালেন তৃতীয় ব্যক্তিটিকে। ইনি হলেন মিঃ লিউ ফেনেল। সিন্দুক ভাঙতে পাকা ওস্তাদ। ইনিও যথারীতি বিভিন্ন সময়ে কয়েক বছর জেল খেটেছেন। তিনজনের মধ্যে একটা ব্যাপারে বেশ মিল আছে তিন জনেই একবার না একবার জেলের ঘানি টেনেছেন। কেউ কোনো কথা বলল না। স্যালিক এবার নীচু হয়ে ড্রয়ার খুলে একট খাম বের করে তার ভিতর থেকে একটা ছবি নিয়ে ফেনেলের হাতে দিলেন। ছবিটা মধ্যযুগের একটা আংটির–ছোট নেগেটিভ থেকে বড় করা হয়েছে। প্রত্যেকেই একবার করে ছবিটা দেখে নিলেন।

স্যালিক বলতে শুরু করলেন যে এবারে আমরা কাজের কথায় আসবো। এই ছবিটা হলো একটা আংটির যেটি সিজার বার্জিয়া তৈরী করেছিলেন। ইনি হলেন সেই লোক যিনি সকলকে বিষ দিয়ে মারতেন। বিষ প্রয়োগের পদ্ধতিটা ছিল রীতিমতো অভিনব। পনেরশ এক সালে বার্জিয়ার আঁকা নক্সা দেখে এক অজ্ঞাত স্বর্ণকার এই আংটিটি তৈরী করে। এই আংটির গঠন প্রণালী এমনই অদ্ভুত যে ছোট এক হীরের আড়ালে এক সংকীর্ণ স্থানে ভরা থাকতো বিষ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম একটা ছুঁচের মধ্যে দিয়ে সেই বিষ চলাচলের পথ ছিল। বার্জিয়া যখন কোন শত্রুকে শেষ করার কথা ভাবতেন আংটিটা আঙুলে পরে হীরেগুলোকে ঘুরিয়ে হাতের তালুর দিকে এনে উল্টে দিতেন হীরের মুখটাউঁচটা চলে আসতো ওপরে। তারপর সেই আংটি পরা হাতে করমর্দন করতেন শত্রুর সঙ্গে করমর্দনের সময় শত্রুর হাতে সঁচটা বিধে যেত। রক্তের সঙ্গে বিষ মিশে যেত। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শত্রুর মৃত্যু হতো।

গত চারশো বছর আংটির ইতিহাস অবলুপ্ত। অবশেষে, কিভাবে যেন আংটি ফ্লোরেন্টাইন এর এক ব্যাঙ্ক মালিকের হাতে এসে পড়ে। ভদ্রলোক মারা যাওয়ার পর আংটিটা নিলাম হয়ে গেল। আমি আংটিটা কিনলাম। পরে শুনলাম আমার এক মক্কেল বার্জিয়া সম্পর্কিত প্রাচীন ঐতিহাসিক বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করছেন। আমি আংটিটা তাকে বিক্রি করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আংটিটা চুরি হয়ে গেল। আমি খবর পেয়ে লোক লাগিয়ে অনুসন্ধান চালালাম। আমার মক্কেলের ইচ্ছা যেভাবে তোক আংটিটা তার চাই। আমি কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি এক শিল্প সংগ্রাহকের কাছে আংটিটা আছে। আপনাদের তিনজনকে আমার সেই কারণেই প্রয়োজন। আংটিটা আপনাদের উদ্ধার করে আনতে হবে। স্যালিক আরো বললেন যে, আংটিটা এখন যার কাছে আছেতিনি একজন ধনকুবের। পৃথিবীর তাবৎমূল্যবান শিল্প-সম্মত জিনিসপত্র সংগ্রহের এক অদ্ভুত বাতিক তার ন্যায় অন্যায় বোধ তার বিন্দু মাত্র নেই। একদল ভাড়া করা শিল্পী চোর আছে তাঁর। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সংগ্রহশালা থেকে তাঁরা কিছু না কিছু হাতিয়ে দিয়েছে তাকে।

গ্যারী জানতে চাইলো-মিউজিয়ামটা কোথায়? ঠিক বাসুতোল্যান্ড এবং নাটালের সীমান্ত বরাবর একটা জায়গায়–ড্রাকেন্সবার্গ পাহাড়ের কাছাকাছি।

জোন্স হঠাৎ বলে বসলো-আপনি কি কালেন বার্গ-এর কথা বলছেন?

–চেনেন আপনি তাকে?

 –শুধু আমি কেন সাউথ আফ্রিকার সকলেই তাকে চেনে।

–বেশ, তাহলে আপনি তার সম্বন্ধে যা জানেন বলুন।

 জোন্স একমুহূর্ত ভেবে বলতে শুরু করলো যা বলছি সবই আমার শোনা কথা। কালেনবার্গকে আমি চোখে দেখিনিতার বাবাকে আমি চিনতাম। ভদ্রলোক ছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মান প্রত্যাগত এক রিফিউজী। জোহান্সবার্গে এসে তার ভাগ্য ফিরে গেল। এক স্বর্ণখনির সন্ধান পেয়ে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে উঠলেন। ষাট বছর বয়সে স্থানীয় এক মেয়েকে বিয়ে করেন। কালেনবার্গ-এর জন্ম হয়। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর সে বাবার মতোই চতুর বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন হলো। সুবিশাল তার জমিদারীতে ঢুকতে চেষ্টা করা আর দুআঙুলের চাপে ঝিনুক খুলতে চেষ্টা করা একই রকম অসম্ভব কাজ।

স্যালিক জানালেন, একটি কথা মিঃ জোন্স আপনাদের বলেননি সেটি হলো কালেনবার্গ পঙ্গু চলাফেরা করতে পারেনা। তবু সুন্দরী মেয়েদের ওপর ভারী লোভ তাঁর। দুর্গ যতই সুরক্ষিত হোক, উপায় আমি একটা বের করেছি।

–ট্রয়ের ঘোড়ার মতো কাজ করার জন্য একটি মেয়েকে সংগ্রহ করেছি। সেও আপনাদের সঙ্গে যাবে।

স্যালিক কথা বন্ধ করে টেবিলের ওপরের একটা বোতামে চাপ দিলেন। একটু পরে পেছন দিকের দরজা খুলে একটি মেয়ে প্রবেশ করলো। তার চেহারা মাদকতাময়, তিলোত্তমার মতো অপরূপা, মৃদু পদসঞ্চারে স্যালিকের পাশে এসে দাঁড়ালো।

.

০২.

 আর্মো স্যালিক দশ বছর আগে নিতান্তই এক স্বল্পবিত্ত, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ ছিলেন। অবশেষে কি ভেবে এক দিন ইজিপ্টের খবরের কাগজে এক বিজ্ঞাপন দিয়ে বসলেন–যে কোন ধরনের গোলমেলে কাজ উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি করতে রাজি আছেন।

দিন কয়েক পর একটা জবাব এলো। কাজটা গোলমেলে হলেও অসম্ভব নয়। আরবের এক রাজার প্রতিদ্বন্দ্বী কোন তেল কোম্পানীর সঙ্গে আমেরিকান এক তেল কোম্পানীর ভবিষ্যৎ চুক্তি সম্পর্কিত একান্ত গোপনীয় একটি খবর সংগ্রহ করতে হবে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজে নেমে পড়ে স্যালিক দশ হাজার ডলার আয় করলেন। বরাত খুলে গেল স্যালিকের। সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে লন্ডনে অফিস খুলে বসলেন। একে একে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠলো। স্থায়ী চাকুরে তার কাছে মাত্র দুজন। এক নাটালিনরম্যান, রিসেপশনিস্টএবং তার ব্যক্তিগত সহকারী,দুইজর্জ শেরবর্ণ, তার একান্ত সচিব ও ভৃত্য।

কিন্তু অসুবিধা হলো অন্যদিকে। এমন এমন কাজ আসতে লাগলো যেগুলো ঝামেলার কাজ। তিনি ঠিক করলেন একটি মেয়েকে স্থায়ীভাবে রাখা যত জটিল হোক না কেন, কাজ হাসিল করতে মেয়েদের জুড়ে নেই। সুতরাং স্যালিক খুঁজতে বের হলেন তেমন একটি মেয়েকে, যাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে কাজে আসবে।পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত শহরে ঘোরাঘুরি করলেন তিনি। প্রায় ছমাস পরে এক সুচতুর, বুদ্ধিমতী-সুন্দরী মেয়েকে তিনি পেয়ে গেলেন, নাম গেই। মেয়েটির সঙ্গে একটি চুক্তি হলো, বছরে মাইনে তিরিশ হাজার ডলার। মাইনে এবং কমিশনের টাকা গেঈয়ের অ্যাকাউন্টে সুইস ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে। স্যালিক ভাবলেন তার সারা বছরের আয়ের শতকরা সাতভাগ মেয়েটাকে দিতেই যাবে।

স্যালিক গেইকে নিয়ে লন্ডনে এলেন, আত্মরক্ষার নানারকম কায়দা শেখাতে ভর্তি করে দিলেন নামকরা এক ক্লাবে। একমাস পরে প্রশংসাপত্র নিয়ে ফিরে এলো গেই। স্যালিক ভারী খুশী হলেন, রয়্যাল টাওয়ার্স হোটেলে এনে তুললেন তাকে। নিজের স্যুইটের পাশে ছোট্ট একটা স্যুইটে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করলেন। তবে বেশীদিন অপেক্ষা করতে হলোনা গেষ্ট্রর প্রতিভা যাচাই করার জন্য। দুমাসের মধ্যেই দুটি কাজ নিপুণভাবে করে ফেললো। প্রথম কাজ এক মক্কেলের বিরুদ্ধ পক্ষের কাছ থেকে একটি রাসায়নিক ফর্মুলা সংগ্রহ করা। দ্বিতীয় কাজ জাহাজ কোম্পানীর এক গোপন খবর এনে শেয়ার বাজারে আর এক মক্কেলের অনেক টাকা লাভ করিয়ে দেওয়া। দুটো কাজই নিপুণভাবে করলো গেই। স্যালিক মনের খুশীতে গেইকে গরমের ছুটি দিলেন। এর পরই এসে হাজির হলো আংটির ব্যাপারটা। সঙ্গে সঙ্গে গেঈর কাছে টেলিগ্রাম পাঠালেন তিনি।

টেলিগ্রাম পেয়ে পরের প্লেনেই উড়ে এলো গেই। স্যালিক বার্জিয়া আংটি সম্বন্ধে আগাগোড়া সমস্তই বুঝিয়ে দিলেন গেইকে। আরও বললেন যে তিনজন পুরুষ তোমার সঙ্গে থাকবে তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের পেশায় অভিজ্ঞ। তবে কালেন বার্গ লোকটি বড় সাংঘাতিক, একটু সাবধানে থাকবে।

গেঈ স্যালিকের পাশে এসে দাঁড়াতে তিনজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। স্যালিক তার সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রসিকতা করে বললেন, আপনাদের যে ট্রয়ের ঘোড়ার কথা বলেছিলাম, গেঈ ডেসমন্ডই আমাদের সেই ঘোড়া। এবারে কাজের কথায় আসা যাক। আগামী মঙ্গলবার প্লেনে আপনাদের জোহান্সবার্গে যেতে হবে। সেখানে র‍্যান্ডি ইন্টারন্যাশানাল হোটলে আপনাদের থাকার বন্দোবস্ত ইতিমধ্যেই করে রেখেছি।মিঃ জোন্স এই অভিযানের যাবতীয় ব্যবস্থা করে না ওঠা পর্যন্ত আপনারা হোটেলেই থাকছেন। কালেনবার্গ-এর বাড়ি এবং জমিদারী সম্পর্কে বিশ্বস্ত সূত্রে কিছু খবর সংগ্রহ করেছি আমি। আংটি উদ্ধারের জন্য মিস ডেসমন্ডকে আগে ঢুকতে হবে তাঁর বাড়িতে এবং ঢুকে জানতে হবে বাড়ির রক্ষণভাগ কত শক্তিশালী, মিউজিয়ামটা কোথায়। মিস গেঈ ডেসমন্ড বাড়িতে ঢোকার সময় সাজবে একজন জন্তু জানোয়ারের ছবি তুলতে ওস্তাদ পেশাদার ফটোগ্রাফার। অ্যানিম্যাল ওয়ার্লড পত্রিকার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমি গেঈ ডেসমন্ড এর নামে একখানা পরিচয়পত্র বের করার ব্যবস্থা করেছি। মিঃ এড়ওয়ার্ডস সাজবেন হেলিকপ্টারের পেশাদার পাইলট। কালেনবার্গ-এর বাড়ির লাগোয়া প্লেন নামার বিস্তৃত রানওয়ে আছে। গেঈ এবং মিঃ এডওয়ার্ডস হেলিকপ্টার নামাবেন সেই রানওয়েতে; জানতে চাইলে বলবেন ওপর থেকে দেখে ভালো লাগলো খুব, তাই নেমে পড়লেন, বাড়ির একটা ছবি ভোলার ইচ্ছা আপনাদের। ফিরে এসে ছবি সমেত একটা ফীচার কাগজে ছাপাবেন। কালেনবার্গ-এর মিউজিয়ামটি মনে হয় সুরক্ষিত এবং অত্যন্ত গোপন স্থানে আছে, যেহেতু মিউজিয়ামে অনেক দুষ্প্রাপ্য বহুমূল্য সামগ্রী আছে। ডারবানে আমার একজন লোক বছর আষ্টেক আগে দেখেছিলো কালেনবার্গ-এর নাম লেখা বড় বড় অনেকগুলো কাঠের পেটি জাহাজ থেকে নামলো। সে জানতো কালেনবার্গ সম্পর্কে আমি বহুদিন থেকেই আগ্রহী। গোপনে অনুসন্ধান চালালো সে। জানা গেল, সুইডেনের বলস্ট্রদের কাছ থেকে চালান এসেছে পেটিগুলো। আমার সেই লোকটি বুদ্ধি করে জাহাজ কোম্পানীর কাছ থেকে চালানের নকলটাও কিছু টাকাপয়সার বিনিময়ে সংগ্রহ করেছে। মিঃ ফেনেল, সেই চালানের নকল এবং তার সঙ্গে বাড়ির একটা ম্যাপ আপনাকে দিচ্ছি। চালানের নকল এবং আপনার বলস্ট্রদের সম্পর্কে জ্ঞান–খুব একটা অসুবিধে বোধ হয় হবে না আপনার। একটা খাম তিনি ফেনেলের দিকে এগিয়ে দিলেন।

আর মিঃ এডওয়ার্ডস, ড্রাকেন্সবার্গ পর্বতমালার ওপর দিয়ে যাবার বিমান পথের একটা ম্যাপ আপনাকে দিচ্ছি। ম্যাপটা দেখে আপনি আমাকে জানাবেন যাতায়াতের কিছুমাত্র অসুবিধা হবে কিনা, আর একটা খাম তিনি এগিয়ে দিলেন গ্যারীর দিকে।

এবং মিঃ জোন্স, আপনি তো কিছু কিছু কাজ আগেই করে এসেছেন, তবু আপনাকে বলি এই অভিযানের সাফল্য কিন্তু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আপনার হাতে। আপনি এবং মিঃ ফেনেল গাড়িতে এগোবেন, মিস ডেসমন্ড আর গ্যারী যাবেন হেলিকপ্টারে।

স্যালিক ড্রয়ার খুলে চারটে খাম বের করে চারজনের দিকে এগিয়ে দিল। প্রত্যেকটি খামে অগ্রিম তিন হাজার ডলারের ট্রাভেলার্স চেক আছে। কাজ শেষ হলে বাকি ছয় হাজার।

স্যালিক আর একটা চুরুট ধরিয়ে তাকালেন ফেনেলের দিকে। আপনাকে দুটো ব্যাপারে একটু সাবধান করে দেওয়ার আছে। প্রথমত, মিস ডেসমন্ড সম্পর্কে কোন অতিরিক্ত আগ্রহ কখনো দেখাতে যাবেন না। যে মুহূর্তে আমি শুনবো গেঈর দিকে হাত বাড়িয়েছেন আপনি, অমনি আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা বাহিনীকে সব খবর তুলে দেবো। আর দ্বিতীয় যে বিষয়টা সম্পর্কে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে তা হলো কাজটা যে কোন প্রকারে আপনাকে করতেই হবে। খালি হাতে ফিরলেই আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা দপ্তরে আপনার সব গোপন খবর পৌঁছে যাবে। আমি জানি মোয়রানির দলের পাঁচ জনকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য মোয়রানি আপনার পেছনে লেগেছে—খুন না করে আপনাকে ছাড়বে না, খুব সাবধান!

ফেনেল দরজা খুলে বাইরে এলো। ফেনেল চলে যেতে ন্যাটালি টাইপ করা বন্ধ করলো। কান পেতে শুনলো একটু তারপরনীচু হয়ে টেপ রেকর্ডারটা বন্ধ করলো। টেপটা খুলে সরিয়ে রাখলো আলগোছে।

গ্যারী নীচে নেমে হোটেলের টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করল টনিকে। টনি যেন বসেই ছিল টেলিফোনের পাশে, রিং হতেই রিসিভার তুললো।

শোনো টনি, গ্যারী বললো, খুব ক্ষিদে পেয়েছে আমার। ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে চলে এসো কার্লটন টাওয়ার্স-এর কাছে রিব রুম রেস্তোরাঁয়। ওখানেই সব কথা হবে। রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলল, ড্রাইভারকে রিব-রুম-এর ঠিকানা বলে সীটে শরীর এলিয়ে দিলো। নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট পরে টনি এলো। দুজনে গিয়ে বসলো একটা নিরিবিলি জায়গায়।

ওয়েটারকে ডেকে দামীদামী একগাদা ভালো খাবারের অর্ডার দিলো গ্যারী। পানীয়রও অর্ডার দিলো।

টনি তাকালো গ্যারীর চোখে, তাহলে চাকরিটা তোমার সত্যি সত্যিই হলো!

 না হলে কি! আর এখানে ডিনার খেতে আসতাম?

খাবার এলো টেবিলে। দুজনে খেতে শুরু করলো। খেতে খেতে গ্যারী টনিকে সমস্ত ব্যাপারটা বললো। ফী বললো তিন হাজার ডলার। মিথ্যে করে বললো গ্যারী।

টনি মুখ নীচু করে সরবতের গেলাসে চুমুক দিল। তার মুখের সেই চপল ভাবটি অন্তর্হিত হয়েছে। দৃষ্টিতে কেমন যেন এক শূন্যতা।

গ্যারী আরও জানালো যে তার সঙ্গে থাকবে এক আমেরিকাবাসিনী ফটোগ্রাফার। একথা শুনে টনির আয়ত দুই চোখের কোণে মুক্তোর মতো জলবিন্দু চিক্ চিক্ করে উঠলো। সে জানতে চাইলো যে, আমেরিকাবাসিনী ফেটোগ্রাফার সুন্দরী কি না। গ্যারী জানালো, সুন্দরী, হ্যাঁ তা বলতে পারো।

টনির চোখে দুঃখের ছায়া নামলো। –গ্যারী, তুমি কি আর ফিরে আসবে আমার কাছে?

একটু ইতস্ততঃ করলো গ্যারী তারপর মাথা নীচু করে বললো, কি জানি বলতে পারি না।

গ্যারীর একখানি হাত দুহাতের মধ্যে তুলে নিলোটনি,বুকের কাছটিতে,দুচোখ অশ্রুতে ভরে গেল। মাথা নীচু করে গ্যারীর হাতে চুমু খেতে খেতে সে বললো, আমি ভালোবাসি তোমাকে গ্যারী বিশ্বাস করো খুব ভালোবাসি।

.

 জেসির আস্তানা হর্নসি রোডে, ট্যাক্সি চালককে সেদিকে যেতে বলে ফেনেল এলিয়ে রইলো সীটে।

জেসির ফ্ল্যাট বাড়িটা ছাড়িয়ে একটু দূরে গাড়ি থামিয়ে নামলো সে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো–যেন বিপদের গন্ধ ভেসে আসছে। কি মনে করে সিঁড়িতে না উঠে বারান্দার এক প্রান্তে টেলিফোন বুথে ঢুকে ডায়াল করল জেসির ঘরের নম্বর। ফোনটা বেজেই চললল কেউ ধরলো না। এবার সে পুলিসের নম্বর ডায়াল করে বললো শীগগিরই চলে আসুন ভীষণ বিপদ। খুনও হতে পারে। ফোন নামিয়ে রাখলো সে।

বুথ থেকে বেরিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো, তারপর গুটিগুটি পায়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো।

চারিদিকে জমাট অন্ধকার। সে সন্তর্পণে রাস্তা পার হলো, অন্ধকারে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অসাড় হয়ে একটা গলির মুখে। একটু পরে পুলিশের দুটো গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে।কয়েক মিনিট পর জেসির ঘরে আলো জ্বললো। আরো মিনিট কুড়ি পর দুটো জোয়ানকে হাত কড়া লাগানো অবস্থায় ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে এলো তিনজন পুলিশ, লাথি মেরে তুললো ওদের গাড়িতে। একজন পুলিশ রইলো জেসির ঘরে।

নিঃশব্দে গুঁড়ি মেরে দরজার কাছে গিয়ে ভিতরে তাকালো ফেনেল, ওদিকের দেয়ালটা চোখে পড়লো। রক্ত দিয়ে দেয়ালে কেউ যেন পিচকারী খেলেছে। রক্তের বন্যা বইছে। পুলিশটা জেসির মৃতদেহের পাশে বসে কি যেন পরীক্ষা করছে।

ফেনেল কি ভাবলো, তারপর একছুটে গিয়ে পড়লো একেবারে পুলিশটার ওপর। কিছু বোঝার আগেই ধরাশায়ী।

শোবার ঘরে ঢুকে ফেনেল তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চিলে কোঠায় উঠে গেল। টান মেরে যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নিয়ে নামলো সমান ক্ষিপ্রতায়। এক লাফে তিন-তিনটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নেমে এলো নীচে।

দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। বৃষ্টি পড়ছে। এখন ভালোয় ভালোয় কেটে পড়াই ভালো।

 দুটো পুলিশের গাড়ি আর একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে থামলো বাড়ির দরজায়। ফেনেল গলিপথ ধরে এগিয়ে বড় রাস্তায় উঠলো। ট্যাক্সি দেখে হাত তুলে থামালো। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে বললো, রয়্যাল টাওয়ার্স হোটেল। একটু তাড়াতাড়ি।

হোটেলে স্যালিকের স্যুইটের দরজায় কড়া নাড়লো ফেনেল। একটু পরে দরজা খুলে দিল এক বয়স্ক লোক। ফেনেল দেখেই চিনলো লোকটা জর্জ শেরবর্ণ, একাধারে স্যালিকের একান্ত সচিব ও প্রধান ভৃত্য।

দরজা বন্ধ করে ফেনেলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, মিঃ স্যালিক দিন দুয়েকের জন্য বাইরে গেছেন। কি দরকার আমাকে বলুন।

কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ফেনেল বললো, আমাকে এক্ষুনি এ দেশ ছাড়তে হবে। মহা ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়েছি। শয়তানগুলো আমাকে না পেয়ে আমার বন্ধুকে খতম করেছে। পুলিশ এখন সে বাড়িতে। হাতের ছাপ আমার ঘরের সর্বত্র। ব্যাটারা ঠিক ধরে ফেলবে।

শেরবর্ন-এর প্রধান গুণ হলো জরুরী অবস্থায় ধর্মযাজকের মতো মাথা ঠাণ্ডা রাখা। ফেনেল ছাড়া যে বার্জিয়া আংটি উদ্ধার করা অসম্ভব একথা সে ভালোভাবেই জানতো। ফেনেলকে সে ভেতরের ঘরে চুপচাপ বসতে বলে দরজা বন্ধ করে বাইরে বের হলো।

প্রায় আধঘণ্টা পরে ফিরে এসে জানালো যে, ফেনেলকে লিড অবধি নিয়ে যাবার জন্য বাইরে। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। হেলিকপ্টারে লিড থেকে তাকে যেতে হবে নো-তুকেতে। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে প্যারিসের নরম্যান্ডি হোটেলে, প্যারিস থেকে জোহান্সবার্গে প্লেনে সে যাবে ওরলি পর্যন্ত। সেই ভাবেই তার টিকিট কাটা।

শেরকর্ন আরো বললো যে, এই ব্যবস্থায় আপনার জন্য যা যা খরচ সব বাদ যাবে আপনার ফি থেকে। ফেনেলের হাতে একখন্ড কাগজ খুঁজে দিল সে, সব খুঁটিনাটি এতে লেখা আছে, দেখে নেবেন।

ফেনেল কাগজখানা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে লিফটের দিকে ছুটলো। পাঁচ মিনিট পর ভাড়া করা,একখানা ট্যাক্সি তাকে উড়িয়ে নিয়ে চললো লিডের দিকে।

.

০৩.

 গেঈ, গ্যারী, জোন্স এবং ফেনেল ওরা সব যে যার চলে গেছে। স্যালিক তার ওভারকোট এবং বাইরে বেড়াতে যাবার ছোট ব্যাগটি নিয়ে ন্যাটালির অফিস ঘরে ঢুকলেন। ন্যাটালি মাথা নীচু করে কি যেন করছিলো। পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকালো।

গত প্রায় তিন বছর ন্যাটালী আছে স্যালিকের সঙ্গে। এক এজেন্সির কাছে লোক চেয়ে পাঠিয়েছিলেন স্যালিক তার ব্যক্তিগত সহকারী হতে পারে এমন একজন। এজেন্সি যাদের পাঠিয়েছিল, তাদের ভেতর থেকে ন্যাটালিকেই বেছে নিলেন তিনি। স্বভাবতই ন্যাটালির যোগ্যতা অন্যান্যদের থেকে বেশীই ছিল।

ন্যাটালির বয়স আটত্রিশ, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান সে অনর্গল বলতে পারে। অফিস আর বাড়ি ছাড়া তার বাইরের জগতে কোন টান নেই। স্যালিকের মাঝে মাঝে মনে হয় ন্যাটালি মানুষ নয়, একটা যন্ত্র। ন্যাটালির চোখের দৃষ্টি ভেজা ভেজা, গায়ের রঙ ফ্যাকাশে, চেহারায় মাদকতার চিহ্ন মাত্র নেই। কথা বলার সময় স্যালিক ন্যাটালির চোখের দিকে তাকান না।

–দিন দুয়েকের জন্য বাইরে চললাম মিস নরম্যান, অন্য দিকে তাকিয়ে স্যালিক বললেন, আগামীকাল যখন তোক ঘণ্টা খানেকের জন্য এসে চিঠিপত্র কি আসে না আসে একবার দেখে যাবেন। তারপর আপনার ছুটি। স্যালিক আর না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন।

পরদিন সকালে যথারীতি এসে ন্যাটালি চিঠির গোছা খুলে বসেছে এমন সময় জর্জ শেরবর্ন এসে তার ঘরে ঢুকলো।

ন্যাটালি এবং শেরবর্ন কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেনা।দুজনেই দুজনকে ঘৃণা করে, অবশ্য কাজের সময় আলাদা কাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কোন ব্যাপার নেই।

ন্যাটালিকান পেতে শুনলো ডায়ালের শব্দ। শেরবর্ন কাকে যেন টেলিফোন করছে। সেড্রয়ার টেনে প্লাস্টিকের বড় ব্যাগ খুলে ছোট টেপরেকর্ডারটা এবং তিন রিল টেপ দ্রুত ব্যাগে পুরলো। শেরন তখন টেলিফোনে কথা বলছিল।ন্যাটালি শুনলো, আজ একেবারে একা কেউ নেই এখানে –ইস। একেবারে ন্যাকা খুকীটি আমার–তিনি সোমবার ফিরবেন-হা-হা-আসছ তো তাহলে? ঘৃণায়, বিরক্তিতে ন্যাটালির মন ভরে গেল।

ন্যাটালি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, লিফটের দরজা খুলতে ন্যাটালি লিফটে উঠেনীচে নামার বোতাম টিপলো। দরজা বন্ধ হলো। রাস্তায় একটা ট্যাক্সি ধরে সে কেনসিংটনে তার চার্চ স্ট্রীটের বাড়িতে পৌঁছলো। চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলো এখন এগারোটা দশ, শনিবার। ব্রানেটকে এখন। ব্যাঙ্কে পাওয়া যাবে তো?

নম্বর ঘুরিয়ে ডায়াল করলো ন্যাটালি। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে ভরাট, সুমিষ্ট পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো, মিস নরম্যন? কি মনে করে? কেমন আছেন?

ন্যাটালির গলা একটু কেঁপে উঠলো, একটু ইতস্ততঃ করলো তারপর খানিকটা জোর দিয়েই বলে ফেললো, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই মিঃ ব্রানেটজরুরী দরকার।

বেশ বেশ, আতিথেয়তার সুর মিঃ ব্রানেটের কণ্ঠে, চলে আসুন তাহলে, এখনই আসুন। ঘন্টাখানেক পরেই আমি বের হবো।

না, আপনি এখানে আসবেন আমার ফ্ল্যাটে, ৩৫-এ চার্চ স্ট্রীটের পাঁচ তলায়, আধ ঘণ্টার মধ্যে আসা চাই। সে রিসিভার নামিয়ে রাখলো।

ঠিক পঁয়ত্রিশ মিনিট পর দরজায় করাঘাতের শব্দ হলো। ক্ষণিকের জন্য সমস্ত রক্ত যেন উঠে এলো তার মুখে। এক অজ্ঞাত ভয় যেন পঙ্গু করে দিল তাকে। ধীরে ধীরে উঠে দরজা খুলে দিল।

চার্লস ব্রানেট, ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক অফ নাটালের চেয়ার ম্যান, ঘরে ঢুকলেন, দীর্ঘাকায় শক্ত সবল চেহারার মানুষ। পরনে ধূসর রঙের স্যুট।

–এত জরুরী তলব কিসের মিস নরম্যান? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ন্যাটালির দিকে।

ন্যাটালি শান্ত গলায় বললো, বসুন মিঃ ব্রানেট। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য এখানে আপনাকে ডাকিনি। মিঃ কালেনবার্গ সম্বন্ধে কিছু খবর দিতে পারি।

ব্রানেট বললেন, ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক অফ নাটালের চেয়ারম্যান তিনি। ম্যাক্স কালেনবার্গ তার মালিক। ব্রানেটের কাছে কালেনবার্গের বরাবর নির্দেশ আছে লন্ডনের এমন সব খবর যা কালেনবার্গের ক্ষতি করতে পারে, তাকে জানাতেই হবে।

এই তত দিন বারো হলো, এক টেলিগ্রাম এসে হাজির নাটাল থেকে

আর্মো স্যালিকের কাজকর্মের বিবরণী চাই, কালেনবার্গ। টেলিগ্রামটা পেয়ে তার টনক নড়লো। কালেনবার্গের ক্ষতি করতে পারে–কি সেই খবর? ভেবে কূল পেলেন না তিনি। কিন্তু এতো সব ভেবে লাভ নেইকালেনবার্গ জানতে চেয়েছেন এটাই বড় কথা। ব্রানেটের কপাল ভালো।দু-এক দিন পরেই এক নিমন্ত্রণ পেলেন–স্যালিকের স্যুইটে ককটেল পার্টিতে যোগদানের সাদর নিমন্ত্রণ। সেই পার্টিতেই তাঁর পরিচয় ন্যাটালি নরম্যানের সঙ্গে। ন্যাটালির সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি বুঝলেন, স্যালিকের এই একান্ত সচিবটির এই ভাবলেশহীন সরল মুখের অধিকারিণী মেয়েটির অবিলম্বে যৌনক্ষুধা নিবারণ একান্ত প্রয়োজন।

ন্যাটালি তার দরকারে আসতে পারে–ওকে দিয়েই তার কাজ হতে পারে। ব্রানেট ন্যাটালিকে বলেছিলেন যে, যখন কোন প্রয়োজন হবে নিঃসঙ্কোচে আমাকে জানাবেন। ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক অফ নাটালের চেয়ারম্যান আমি। এখানে কাজ করতে এক ঘেয়ে লাগলে বা টাকা পয়সা আরো রোজগারের ইচ্ছে থাকলে আমার সঙ্গে যোগযোগ করতে কোন সঙ্কোচ করবেন না।

বাড়িতে ফিরে ব্রানেট ভাবতে লাগলেন ভালোই হয়েছে, গোপন খবরাখবর যা কিছু একমাত্র ন্যাটালির মাধ্যমেই পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আগে চাই একজন পুরুষ–সর্বগুণ সমন্বিত, একজন শয্যাসঙ্গী–লোলুপ কামোন্মত্ত একজন পুরুষ। এখন প্রয়োজন সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর টম পার্কিস-এর সাহায্য। পার্কি-কে ফোন করে ব্যাপারটা বলে দিলো ব্রানেট। বেলা তিনটে নাগাদ পার্কি-এর ফোন এলো আপনার লোক পাওয়া গেছে। ড্যাজ জ্যাকসন তার নাম। চব্বিশ বছর বয়েস। একটা বাজে হোটেলে গীটার বাজিয়ে পেট চালায়, জ্যাকসনকে দেখে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।

পাঁচটা বাজার দশ মিনিট পরে ড্যাজ এসে হাজির হলো। ব্রানেটের মহিলা সেক্রেটারী তাকে নিয়ে গেলেন ব্রানেটের ঘরে।

ড্যাজ ঘরে ঢুকতেই ব্রানেট তাকে খুঁটিয়ে দেখলেন। ড্যাজের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। জ্যাকসন নিজেই একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। তারপর জানতে চাইলে কাজটা কি ধরনের? মালকড়িই বা কত?

ব্রানেট আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিলো ড্যাজকে। সব শুনে ড্যাজ বললো আসল কথা ছুকরীটাকে শোয়াতে হবে–এই তো? একশ ডলার চাই আমার। এ ছাড়া ওর যা মাল খসাতে পারবো–সব আমার। ব্রানেট রাজী হলেন এবং ন্যাটালির বাড়ির ও অফিসের ঠিকানা টাইপ করা একখন্ড কাগজ এগিয়ে দিলেন ড্যাজ-এর দিকে।

ব্রানেট ড্যাজকে জানিয়ে দিলেন যে কাজটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে।

.

জানুয়ারীর এক সূচীতীক্ষ শীতের রাতে অফিসের কাজ সেরে বেরিয়ে ন্যাটালি দেখলো, তার গাড়ির পেছনের একটা চাকা একেবারেই গেছে। শীতও পড়েছে ভীষণ। সেই হাড় কাঁপানো শীতে গাড়ির ঐ অবস্থা দেখে তার কান্না এলো। এই অবস্থায় সে কি করবে ভেবে পেলো না।

অন্ধকারের গা ছুঁড়ে এমন সময় বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘাকায় যুবক।ন্যাটালির গাড়ির চাকার হাওয়া সেই খুলে দিয়ে অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে সে ন্যাটালির দেখা পেলো।

রাস্তার আলোয় ন্যাটালির লম্বা সুঠাম পা দুটি দেখে তার মন্দ লাগলো না। চেহারার গঠনটাও মন্দ নয়। এবারে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ড্যাজ। ন্যাটালির কাছে গিয়ে বললো, দেখে মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছেন। সাহায্যের দরকার নাকি?

হঠাৎ তাকে দেখে ন্যাটালি চমকে উঠলো, ডাইনে বাঁয়ে সেই কানাগলিতে তারা দুজন ছাড়া আর কেডই নেই।

অসহায়ের মত ন্যাটালি বললো, গাড়ির চাকাটা গেছে দেখছি। এমন কিছু নয় অবশ্য, একটা ট্যাক্সি খুঁজছি। সাহায্যের দরকার নেই, ধন্যবাদ!

ড্যাজ এবার আলোর সামনে এসে দাঁড়ালো, দুজনে এবার দুজনকে দেখলো। ন্যাটালির ফুসফুসের স্পন্দন বাড়লো, কি সুন্দর সুঠাম চেহারা। উত্তেজিত হলো ন্যাটালি, শিরায় শিরায় রক্তের শিহরণে চমকিত হলো তার শরীর।

ড্যাজ বললো, আমি ঠিক করে দিচ্ছি সব, আপনি গাড়িতে উঠে বসুন, এই শীতে কি বাইরে থাকা যায়

দরজা খুলে ন্যাটালি গাড়িতে বসলো। যুবকটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে গেল। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে নতুন চাকা লাগিয়ে গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে প্যান্টের পেছনে হাত মুছতে মুছতে ড্যাজ বললো, সব হয়ে গেছে–আপনি এবার গাড়ি ছাড়তে পারেন।

ন্যাটালি তার দিকে তাকালো। যুবকটি ঝুঁকে পড়েছে জানলার ওপর, তাকিয়ে আছেতার দিকে স্থির দৃষ্টিতে। ঐ দৃষ্ঠিতে যেন মনে হয় কোন প্রতিশ্রুতির চিহ্ন আছে।

চোখের থেকে চোখ নামিয়ে হাসলো ন্যাটালি, চলুন না, আপনাকে একটা লিফট দিই গাড়িতে।

ড্যাজ রাজী হয়ে গেল। বিপরীত দিকের দরজা খুলে ন্যাটালির পাশে গিয়ে বসে পড়লো। ড্যাজের কাঁধে কাঁধ লাগলো ন্যাটালির, শরীরে শিহরণ খেলে গেলো তার। উত্তেজনায় উল্লাসে ন্যাটালির হাত কাঁপছিল। ড্যাজ মুচকি হেসে বললো, আপনি তো শীতে কাঁপছেন দেখছি, দিন না, আমি চালাই।

নিঃশব্দে ড্যাজের হাতে চাবি তুলে দিলোন্যাটালি। জায়গা বদল হলোদুজনের, গিয়ারে লেগে স্কার্টটা একটু ওপরে উঠে গেলো।

ন্যটালি ভাবলো, সারা শরীরের মধ্যে দেখবার মতো তো আমার পা আর উরু দুটো। দেখুক না একটু।

ন্যাটালির মনে সন্দেহ ছিলো, ঠিকমতো গাড়ি হয়তো চালাতে পারবে না ও–হয়তো ঝড়ের বেগে বিপজ্জনকভাবে উড়িয়ে নিয়ে যাবে গাড়ি। কিন্তু না, গাড়ি ভালোই চালায় ও–তিরিশ মাইলের বেশী গতিবেগ কখনই বাড়ালো না। অভ্যস্ত নিপুণ হাতে, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে গাড়ি চালাতে লাগলো। আবার তার সুন্দর মুখের দিকে তাকাতে লাগলো সে, আবার তার কামনা সজীব হয়ে উঠলো।

ঘাড় ফিরিয়ে ন্যাটালির দিকে ড্যাজ হাসলো–সেই মাদকতাময় হাসি। ন্যাটালির কামনা তীব্রতর হলো, মন তার দুর্বল হলো।

গাড়ি ততক্ষণে নাই ব্রীজের ভূগর্ভ রেলস্টেশন পার হচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে চার্চ স্ট্রীটে ঢুকে পড়লো। ন্যাটালি আঙুল তুলে দেখালো ঐ যে আমার বাড়ি।

–এই বাড়িটায় থাকেন আপনি? এই বড় বাড়িটায়?

–হ্যাঁ, এই ঢালু রাস্তা ধরে নেমে সোজা গ্যারেজ। একটু ইতস্ততঃ করলো ন্যাটালি, হাত মুখ ধোবেন নিশ্চয়? ড্রিঙ্কস্ একটু–চলুন না ওপরে।

ড্যাজ মুচকি হাসলো, কাজটা সোজা হবে, সে জানতো তাই বলে এত সোজা। হ্যাঁ, হাতমুখ ধুলে তত ভালোই হতো। আলোকিত প্রশস্ত গ্যারেজে গাড়ি ঢোকালো ড্যাজ।

 লিফটে পাঁচতলায় উঠলো দুজনে, কেউ কোনো কথা বললো না, কেউ কারোর দিকে তাকালো না। ঘরের দরজা খুললোনাটালি। ছোট্ট, ঝকমকে বসবার ঘরে এসে বললো ড্যাজকে, নিন, কোটটা খুলে ফেলুন। বাথরুমটা ওদিকে।

চারিদিকে তাকিয়ে বলল ড্যাজ, বাঃ ভারী সুন্দর তো! এতক্ষণে ন্যাটালি বুঝে গেছে সুন্দর কথাটার ওপর ভ্যাজের বড় ঝোঁক।

বাথরুমে পৌঁছে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো ন্যাটালি। ধীরে ধীরে কোট খুললো, স্কাট খুললো, কামনা তার হৃদয়ে টগবগ করে ফুটছে, সে কাঁপছে থর থর করে।

 বাথরুম থেকে বেরিয়ে তাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্যাজ বুঝলল, জল অনেকদূর গড়িয়েছে। দুজনে দুজনের চোখে চোখ রাখলো।কয়েক মুহূর্ত নীরবে কাটলো। ড্যাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ন্যাটালির দিকে–শক্ত আলিঙ্গনে বেঁধে ফেললো তাকে। আনন্দে, উত্তেজনায় ন্যাটালি কেঁপে কেঁপে উঠলো। আচ্ছন্নের মতো সে অনুভব করলো, ড্যাজ তাকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকছে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে শান্তি পেলো। একে একে তার পোশাক খুলে ফেললো ড্যাজ-তপ্তচুম্বনে ভরিয়ে দিলোর্তার নিরাবরণ অঙ্গ। বাধা দিলনান্যাটালি। ড্যাজের হাতে নির্ভয়ে নিজেকে সমর্পণ করে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলো সে।

আচমকা ঘুম ভেঙে গেলড্যাজের চারিদিকে তাকিয়ে দেখলোসুন্দর সাজানোঘর পাশেন্যাটালি উপুড়হয়ে শুয়ে,হাতদুটিতারবুকেরনীচেভাঁজ করা ন্যাটালিকেআর একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো ড্যাজ। ন্যাটালিকে ডেকে তুললল,বললো। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। খাবার কিছু আছে কি?

একটু নড়ে চড়ে চোখ মেলে তাকালো ন্যাটালি, চোখ তাঁর পরিতৃপ্তির আনন্দে উজ্জ্বল। এমন তৃপ্তি আগে কোনদিন পায়নি সে। এত দিনে অনাবিষ্কৃত এক দরজা যেন খুলে গেছে তার সামনে। তাড়াতাড়ি উঠে সে রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকলো। নিঃশব্দে আলমারীর ড্রয়ার খুলে ফেললো ড্যাজ। ড্রয়ারে একটা সোনার সিগারেট কেস, সোনার লাইটার। গয়নার বাক্সে একটা মুক্তোর হার আর দুটো আংটি। একে একে সব কটাই পকেটস্থ করলো ড্যাজ। তারপর ড্রয়ার বন্ধ করে বসবার ঘর পেরিয়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো।

ন্যাটালি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেললো। গোগ্রাসে খেলো ড্যাজ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আগাগোড়া ঘটনাটা ভাবলো ড্যাজ। বেশ ছবির মতো ঘটে গেলো সব। চেয়ারে বসে ন্যাটালি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে তার চোখে সেই ভেজা ভেজা দৃষ্টি। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মুখ মুছলো ড্যাজ, বাঃ ভারী ভালো লাগলো, সুন্দর!

তোমার খুব ক্ষিদে পেয়েছিলো, তাই না?

ন্যাটালির চোখে চোখ রেখে বললো ড্যাজ, তোমারও তো পেয়েছিলো ক্ষিদে?

ন্যাটালির গাল গোলাপি হলো। সে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। ড্যাজ উঠে দাঁড়ালো, আজ চলি।ন্যাটালির চোখে জল এলো, তুমি চলে যাবে? থাকবেনা? একটা যন্ত্রণাদলা পাকিয়ে উঠলো তার গলায়, এমন শীত বাইরে–থাকো না আজ।

মাথা নাড়লো ড্যাজ, না থাকা চলবে না, ফিরতেই হবে আমাকে। দরজার দিকে এগোতে লাগলো সে। আবার আবার কবে দেখা হবে আমাদের? কথাগুলো আর্তনাদের মতো ন্যাটালির গলা থেকে বেরিয়ে এলো।

ন্যাটালি কিছু বলার আগেই সে চলে গেলো। দরজাটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলো। শব্দটা মেঘের গর্জন হয়ে ন্যাটালির মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়লো।

পরদিন সন্ধ্যায় ন্যাটালি আবিষ্কার করলো, তার সিগারেট কেস, লাইটার এবং গয়নাগুলো অপহৃত হয়েছে। সিগারেট কেস আর লাইটারটা তাকে স্যালিক দিয়েছিলো তাঁর জন্মদিনে উপহার। মনে বড়ো ব্যথা পেলো সে, বুঝতে বাকি রইলো না ওগুলো কে হাতিয়েছে, পুলিশকে • টেলিফোন করে সব জানানোর কথা মনে হলো তাঁর। কিন্তু না, থাক।

দিন পাঁচেক পরে রাত্রিবেলা ন্যাটালি একা ঘরে বসে আছে। দুঃখে, শোকে, বেদনায় সে মুহ্যমান। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো। ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলে ধরলো।

ড্যাজ বলছি। সেদিন তোমার জিনিসগুলো নিয়ে এসে মোটেই ভালো করিনি, কি করব। টাকার যে বড় দরকার হয়েছিল। ওগুলো বাঁধা দিয়ে টাকা এনেছি। রসিদগুলো তোমাকে দেবো খন–নিয়ে আসবো এখনই?

এসো।

রাত দশটার সময় ড্যাজ এসে পৗঁছলো, একটু রোগা হয়েছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে।

ড্যাজ রসিদগুলো ন্যাটালির টেবিলে রাখলো, আবার বললো, কাজটা আমার উচিত হয়নি, কি করি-বড় বিপদে পড়েছিলাম–টাকার দরকার তাই।

ড্যাজ যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালো।

–যেয়ো না লক্ষিটি, কাতর মিনতি ফুটে উঠলো ন্যাটালির গলায়।

ঘুরে দাঁড়ালো ড্যাজ, তার চোখে অস্থির দৃষ্টি। আরো টাকা চাই। আমায় যোগাড় করতে হবে। এখানে বসে কাটালে আমার চলবে না। তোমাকে তো কিছু বলতে পারবো না, তোমার অনেক নিয়েছি আমি।

ড্যাজ তাকে এক বানানো গল্প শোনালো। আগামীকালের মধ্যেই তাকে পঞ্চাশ পাউন্ড যোগাড় করতে হবে।

ন্যাটালি অধীর হলো। সে বলে বসলো, আমি তোমাকে পঞ্চাশ পাউন্ড দেবো ড্যাজ, আমি তোমাকে এখনই চেক দিচ্ছি।

এক ঘন্টা পর। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে দুজন। ড্যাজের সঙ্গে সেই দেখার পর ন্যাটালি আবার নিশ্চিন্ত, সুখী। গতবারের চেয়ে এবার আরো ভালো।

মুখ ফিরিয়ে ড্যাজের দিকে তাকালো সে। ড্যাজের চোখে আবার সেই বিষাদ দৃষ্টি।

 সে ধীরে ধীরে বলল, কি হলো ড্যাজ?

ড্যাজ বললো, আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে, ডাবলিন-এ যাবো। ড্যানি আমাকে একটা না একটা কাজ ঠিকই জুটিয়ে দেবে। তোমার পঞ্চাশ পাউন্ড-এ হয়তো দুদিন চলবে, তারপর কি হবে? আমার বাবোশোর প্রয়োজন। বারোশ পাউন্ড না হলে আমায় ইংল্যান্ড ছেড়ে আয়ারল্যান্ডে যেতেই হবে।

ন্যাটালির সম্বিৎ লোপ পাবার উপক্রম হলো। বিছানা থেকে নেমে নাইটিটা পরে নিলো সে। ড্যাজ আড়চোখে তাকালো তার দিকে–তুরুপের তাশখানা ঠিকই চেলেছে সে। চোখে তার চিন্তার ছায়া। ঘরময় পায়চারি করতে করতে কি যেন ভাবলো ন্যাটালি তারপর বিছানায় বসে ড্যাজের চোখে চোখ রাখলো, ড্যাজ, যদি আমি তোমাকে বারোশো পাউন্ড দিই, থাকবে তুমি লন্ডনে?

–নিশ্চয়ই থাকবো। দশদিনের মধ্যেই আমার চাই।

যদি তোমাকে টাকাটা দিই, এখানে এসে থাকবে?

–মনে হয় পিরবোতোমার সঙ্গে থাকতে পারবো।

 ন্যাটালি একটানে খুলে ফেললো নাইটি। বিছানায় শুয়ে ড্যাজের গলা জড়িয়ে ধরলো। ড্যাজ অনিচ্ছায় ন্যাটালিকে জড়িয়ে ধরলো।

ন্যাটালির চোখে ঘুম নেই।মন তার চিন্তায় মগ্ন। বারোশো পাউন্ড!তারসঞ্চয় দুশো বাদ দিলেও আরো হাজার পাউন্ড। স্যালিকের কাছে চাওয়া বৃথা। একটা উপায় অবশ্য আছে, ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক অফ নাটালের চার্লস ব্রানেটের কথাই বারবার মনে হয়েছে তার। এখানকার বড় বড় ব্যবসায়ে এ পক্ষ ও পক্ষ দুপক্ষেরই গোয়েন্দাগিরির কথা ন্যাটালির অজানা নেই।

পরদিন সকালে আর দেরী না করে ন্যাটালি ফোন করলো ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে।

ব্রানেটকে ড্যাজ আগেই ফোনে সব জানিয়ে রেখেছে। ন্যাটালির ফোন পেয়ে তাই মোটেই অবাক হলেন না ব্রানেট।বললেন, আপনার সঙ্গে আবার দেখা হলে বড়ো খুশী হবো মিস নরম্যান।

তিনটে নাগাদ নাটালি ব্রানেট-এর অফিসে এসে জানালো য়ে এক হাজার পাউন্ডের তাঁর ভীষণ দরকার।

ব্রানেট বললো, মিসনরম্যান, আপনাকে ভেঙে বলার কিছু নেই। আপনার টাকার দরকার আর আমার দরকার খবরের, মিঃ স্যালিকের কাজকর্মের খবর,নাটালের মিঃ ম্যাক্স কালেনবার্গ যে খবরের মূল বিষয়!

ন্যাটালির চোয়ালের হাড় শক্ত হলো। গত কয়েকদিন যাবৎ স্যালিকের টেবিলের টুকরো টুকরো কাগজ থেকে বা শেরবর্ন এর সঙ্গে তার কথাবার্তা থেকে সে বুঝেছে ম্যাক্স কালেনবার্গের বিষয়ে একটা কিছু জরুরী পরিকল্পনা হতে চলেছে।

ন্যাটালি আতঙ্কিত স্বরে বললো, ও ব্যাপারে আপনাকে আমি কোনরকম সাহায্য করতে পারবো না। মিঃ স্যালিকের কাজকর্মের ব্যাপারে আমি নেই, তবে একটা কথা বলতে পারি যে কালেনবার্গ নামে একজনের ব্যাপারে কিছু একটা হতে চলেছে।

ব্রানেট হাসলেন, আমি তাহলে আপনাকে একটু সাহায্য করি। দেখবেন আপনার কাজ অনেক সহজ হয়ে আসবে।

কুড়ি মিনিট পর নাটালি ব্রানেটের কাছ থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ছোট একটি টেপরেকর্ডার, ছরীল টেপ এবং অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ছোট মাইক্রোফোন পেলো, মনে রাখবেন, খবরের ওপর টাকা। খবর ভালো হওয়া চাই। হাজার পাউন্ডের দরকার আপনার তাই না? খবর জোগার করুন টাকা পেতে অসুবিধা হবে না।

সেই সাক্ষাৎকারের আটদিন পরে তিনি আজ এসেছেন ন্যাটালির ফ্ল্যাটে। এই তিন দিনব্রানেটের মাইক্রোফোন অনেক কাজ দিয়েছে। ড্যাজ আটদিন হলো ন্যাটালির সঙ্গে আছে–নিত্য নতুন ভাবে-ভঙ্গীতে ন্যাটালিকে সে নিয়ে গেছে চরম পুলকে সাতরঙা এক জগতে।

ন্যাটালি এবার ব্রানেটকে মিঃ কালেনবার্গের খবর শোনাতে আরম্ভ করলো।

মিঃ কালেনবার্গের কাছ থেকে সিজার বার্জিয়া আংটি চুরির পরিকল্পনা করছেন মিঃ স্যালিক, ন্যাটালি বললো, তিনটে টেপ-এ আমি সব ধরে রেখেছি। কাজটা কিভাবে হবে তার খুটিনাটি বিবরণ এবং কে কে সেই কাজ করবে–সব ধরা আছে আমার টেপ-এ।

বার্জিয়া আংটি। ব্রানেট অবাক হলেন, তাহলে এই হলো ব্যাপার! অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, মিস নরম্যান টেপগুলো বাজান দেখি, শুনি।

টেপরেকর্ডার আগেই ঠিক করে রেখে দিয়েছিলো ন্যাটালি, চালিয়ে দিলো এবার। তিন মিনিট রীলের পর সে টেপ বন্ধ করলো, ব্রানেট টেপ শুনতে শুনতে অবাক হয়ে গেলেন সাবাস মিস নরম্যান, আপনাকে বলিহারি! শেষ পর্যন্ত শুনে তিনি বললেন,পারিশ্রমিকের যোগ্য কাজই আপনি করেছেন, এই ধরনের আরো খবর দিলে আরো ভালো পারিশ্রমিক আপনি পাবেন, বিপদের আশঙ্কায় মেসিনটা এবং তিনটে রীল নিয়ে ব্রানেট দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হলেন।

ঘণ্টা তিনেক পর ড্যাজ ফ্ল্যাটে ফিরে এলো। ব্রানেটের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। সে জানে তার টাকা পৌঁছে গেছে ফ্ল্যাটে।

এত টাকার মালিক হবার আনন্দে সে এক ঘুড়ির সঙ্গে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে–বিলী ওয়াকারের খুঁড়িখানায় জমাটি মাহিফিল হবে আজ রাতে। মহিফিল সেরে সেই ছুঁড়িটাকে নিয়ে যাবে কিংস রোডের এক নামকরা ক্লাবে, সেখান থেকে একেবারে ওর বাড়িতে বিছানায়। ফ্ল্যাটে ঢুকে ন্যাটালিকে দেখে সে একটু অবাক হলো, বিবর্ণ-বিরস মুখে চেয়ারে বসে কাঁদছে ন্যাটালি।

-কি হলো তোমার? জানতে চাইলো সে।

চোখ মুছে ন্যাটালি সোজা হয়ে বসলো, টাকা পেয়েছি, ড্যাজ।

এতো আনন্দের কথা। মন খারাপের কি আছে? টাকা কোথায়? নিয়ে এসো।

ন্যাটালি তার মুখখানিতে লোভের হীন ছায়া দেখতে পেলোকাবার্ড খুলে নিয়ে এলো নোটের বান্ডিল।

টাকা দেখে চক্ করে উঠলো ড্যাজের চোখ। টাকাগুলোকে লোভীর মতো জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো, আদর করলো। ন্যাটালির মন বেদনায় ভরে গেলো। একেই কি সে ভালোবেসেছে? এই কি তার চোখের সামনে খুলে দিয়েছে তার গোপন পথের দরজা। এতো সে নয়, এ যেন একটা লোভী জন্তু। শেষ নোট কখানা পকেটে পুরতে পুরতে ড্যাজ তার দিকে তাকালো, এখান থেকে ভাগব এবার, কেটে পড়ব।

–তার মানে, টাকা নিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

–হ্যাঁ, তাই যাবো। ড্যাজ তীক্ষ্ণ, ঘৃণামিশ্রিত চোখে তাকালো তার দিকে, তোমাকে ভালবাসতে যাব আমি? শোনো যাবার আগে তোমাকে কয়েকটা কথা বলে যাই, আর যাকে তাকে বিছানায় ডেকো না যখন-তখন বিপদে পড়বে। মরবে!

আর না দাঁড়িয়ে ড্যাজ চলে গেল। ন্যাটালি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে পায়ে হেঁটে সে চেয়ারে গিয়ে বসলো। দিনের আলো নিষ্প্রভ হয়ে এলো একে একে। সে ভাবতে লাগলো, এমন যে হতে পারে আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। আগাগোড়া আমি তো মরীচিৎকার পেছনে ছুটেছি।

আবার একা–নিঃসঙ্গ রাত্রি যাপনের সেই নিঃসীম বেদনা। আমি শুধু নিজেকেই ঠকাইনি, ঠকিয়েছি আমার অন্নদাতা স্যালিককেও। কেন ঠকালাম-ড্যাজের জন্য, তাকেই যখন পেলাম না, বেঁচে থাকার আর কি অর্থ তাহলে? সে রান্নাঘর থেকে তরকারী কাটার ছুরিটা হাতে নিলো তারপর বাথরুমে ঢুকে বাথটবের কল খুলে দিলো। জলে তার গলা পর্যন্ত ডুবে গেলো। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বাঁ হাতের কব্জির শিরায় ছুরি টানলো সে। যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠলো একবার। রক্ত বের হতে লাগলো গল গল করে। জলের রঙ প্রথমে ফিকে, তারপর লাল, তারপর ঘন লাল হলো, চোখ বুজলো ন্যাটালি।

কল্পনায় ভেসে উঠলো ড্যাজের সুন্দর মুখ, তার কোঁকড়া একমাথা চুল, তার সুঠাম–দীর্ঘ অবয়ব।

ন্যাটালির প্রাণবায়ু সেই মধুর স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় তার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।