০৭. বৈদ্যুতিক সাজ সরঞ্জাম

০৭.

অ্যানসন বৃহস্পতিবার সকালে ল্যামবসভিলের এক বৈদ্যুতিক সাজ সরঞ্জাম বিক্রীর দোকানে গেল। অনেক দেখেশুনে একটা ছোট্ট বৈদ্যুতিক ঘড়ি সে কিনল।

কাউন্টারের বিক্রেতাটি এরকার্যকারিতা সম্বন্ধে এক ছোটখাটো বক্তৃতাই দিয়ে বসল। ঘড়িটা এক অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন ঘড়ি। যে কোনো বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র আপনার প্রয়োজনীয় সময়ে চালু করা বা বন্ধ করা এর কাজ। ধরুনরাত দশটায় আপনি রেডিওর কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান শুনতে চান। ঘড়ির কাটা দশটার ঘরে রেখে ঘড়িটা রেডিওর প্লাগে আটকে দিন।ব্যস, আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। দশটা বাজলে রেডিও আপনা-আপনি চালু হবে। আপনি অনুষ্ঠান শুনতে পাবেন।

সকালে যদি কফির জল গরম করতে হিটার চালাতে চাই।

হ্যাঁ হ্যাঁ স্বচ্ছন্দে। ঘাড় নাড়লো বিক্রেতাটি, আমি নিজেও ঐ কাজের জন্যই একটা ঘড়ি বাড়িতে নিয়ে গেছি।

দুপুরে মার্লবোরো হোটেলে লাঞ্চ সারতে গিয়ে দেখা জেফ ফ্রিসবির সঙ্গে। ফ্রিসবি টাউন গেজেট-এর একজন সাংবাদিক।

দু-গ্লাস হুইস্কির অর্ডার দিয়ে অ্যানসন তার মুখোমুখি বসল।বলল, তারপর কেমন আছো বলো। কাজকর্ম কেমন চলছে?

আর বোলোনা। ফ্রিসবি ঘাড় নাড়লল,দু-দুটো খুন নিয়ে চারদিক তোলপাড়।সম্পাদক জোর তাগাদা মারছে, রোজই-এ সম্বন্ধে দুকলম লেখা চাই। দেখো কাণ্ড! একদিন দুদিন না হয় একটা বিষয় নিয়ে দু-চার কলম লেখা যায়। রোজ রোজ লেখার মতো এত মাল-মসলা কোথায় পাবো বলতো?

ওয়েটার পানীয় দিয়ে যেতে গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে অ্যানসন চুমুক দিলো। পুলিস তো এখনও কিছুই করে উঠতে পারলো না। উন্মাদটা বেশ খোশমেজাজেই ঘুরে বেড়াচ্ছে বলো?

কি জানি পুলিসের খবর পুলিসই জানে। বড়কর্তা জেনসন একটা আস্ত পাকা মাল। ভেতরে– ভেতরে কি করছে কাউকে তা আগে থাকতে জানতে দেবে না। আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একদিন তার কথা হচ্ছিলো। আমাকে বললো, পেট্রোল পাম্পের ডাকাত নির্ঘাত বাইরের কোনো লোক, কিন্তু এই উন্মাদটা এখানকারই কেউ। তার ধারণা সেরকমই।

এরকম অদ্ভুত ধারণার কারণ?

কারণ এই যে, বাইরের কোনো লোকের পক্ষেই গ্লিন হিল সম্বন্ধে খবরাখবর জানা অসম্ভব।

তা বেশ তো, খুঁজে খুঁজে শহরের টাকমাথা লোকগুলোকে একদিন ধরে আনলেই হয়।

তা অবশ্য হয়, তবে জেনসন-এর ধারণা মেয়েটা আততায়ী সম্বন্ধে যে বর্ণনা দিয়েছে, সেটা পুরোপুরি ঠিক নেই। ভয়ে-আতঙ্কে কি দেখেছে। এমনও হতে পারে, আততায়ীর মাথায় হয়তো লালচে কিংবা সাদা ধবধবে চুল ছিলো এবং জ্যোৎস্নার আলোয় তা দেখেই টাক বলে মনে হয়েছে।

তা বেশ তো, তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। লালচে আর ধবধবে সাদা চুলের লোকগুলোকে ধরে এনে জিজ্ঞাসা করলেই হয়। ঐদিন ঐসময় তাদের মধ্যে কে কি করছিলো। তার কি প্রমাণ আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যস, ঝামেলা মিটে গেলো।

তা তোমার মাথার চুলও তো লালচে, ফ্রিসবি চোখ টিপে হাসল, তুমি ঐদিন ঐসময় কোথায় ছিলে?

অ্যানসন হো হো করে হেসে উঠল বলল আমার ওসব করার সময় কোথায়? যা কাজের চাপ আজকাল, দশটা কোন কোন দিন রাত এগারোটা বেজে যায়।

 তাছাড়া তোমার বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছিনয় মুচকি হেসে বলল ফ্রিসবি, অতএব তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম।

অ্যানসন তার বলার ধরন দেখে আবার হেসে উঠলো।

ফ্রিসবি শেষ চুমুক দিয়ে গ্লাসসরিয়ে রেখে বললো মেয়েটা বেঁচে ফিরেছে এই যা রক্ষে। আচ্ছা আজ উঠি। আমার আবার দুকলমের মসলা জোগাড় করতে হবে। চলি আজ।

অ্যানসন-ফ্রিসবি চলে যেতে রেস্তোরাঁয় গেল। খাবারের টেবিলে বসে খাবার খেতে খেতে সে ভাবলো যাক বাবা, উন্মাদটা এখনো তাহলে ধরা পড়েনি। তবে হ্যাঁ শুক্রবার রাত আসতে এখনও অনেক বাকি। তার মধ্যে যদি ধরা পড়ে। যাক গে যা হবার হবে, যদির কথা ভেবে এখনই মন খারাপ করার কিছু নেই।

অ্যানসন রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে হোটলের টেলিফোন বুথে ঢুকলো। কয়েকটা জরুরী টেলিফোন সারল। তারপর বেরিয়ে ধীরে-সুস্থে এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে সময় কাটিয়ে সে গাড়ি ঘোরালো বারলোর বাড়ির দিকে।

নুড়ি বিছানো পথ বেয়ে গাড়ি এনে সোজা গ্যারেজে তুলল আনন। কড়া নাড়তে না নাড়তেই দরজা খুলে গেলো। মেগ ম্লান হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানালো।

বসবার ঘরে এসে দুজনে সোফায় বসল।

অ্যানসন ঘরের মৃদু আলোয় লক্ষ্য করলে মেগ-এর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে, বিবর্ণ। চোখের কোলে কালির ছাপ। কি ব্যপার!

মেগ-এর একটা হাত অ্যানসন তার হাতে তুলে নিল বলল মেগ কি হয়েছে। তোমার কি শরীর খারাপ, নাকি কিছু গণ্ডগোল হয়েছে।

মেগ এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো বলল গণ্ডগোল, তার চোখের দৃষ্টিতে আগুন ঝরে পড়লো। এখন আবার আমাকে ভালো মানুষের মতো জিজ্ঞেস করছে গণ্ডগোল হয়েছে নাকি। ন্যাকা, সারাদিন কি দুশ্চিন্তা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তা তুমি কেন বোঝ না। ঘুমুতে পারি না, শান্তি মতো খেতে পারি না একমিনিট একজায়গায় বসতে পৰ্য্যন্ত পারি না। আজ বাদে কাল যাকে খুন করবে তার সঙ্গে এক বাড়িতে এক ছাদের নীচে আছি. ওঃ, এ যে কি যন্ত্রণা এ তুমি বুঝবে না, কোনোদিন বুঝবে না।

মেগ, সবই আমি বুঝলাম। কিন্তু এখন তো আর ফেরার পথ নেই। সে মেগ-এর পিঠে হাত বোলাল, এখন তোমাকে মন থেকে ওসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। মন শক্ত করতে হবে।

আমি এখনও ভাবতে পারছি না যে কাল রাতে ফিল মরবে।

ভাবতে না পারার কি আছে মেগ! জেসন গ্লেন অবধি ওকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তোমার। একবার যদি ওখানে ওকে নিয়ে যেতে পারো, তাহলে ব্যস, আর দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। তারপর যা করার আমিই করবো।

আমি পারবো নিয়ে যেতে পারবো। মেগ টলতে টলতে উঠে জানালার কাছে গেল, ডিনারের পর ওকে নিয়ে জেসন গ্লেনে যাবোই।

আচ্ছা এবার একটা দরকারী কথা বলি মন দিয়ে শোনো। কাল আমি জেসন গ্লেনে গিয়েছিলাম। ঢোকার মুখে আধ মাইলটাক আগে রাস্তার পাশে এক টেলিফোন বুথ আছে। ঐ বুথে আমি অপেক্ষা করবো। তুমি আমাকে ফোন করে আগেই জানিয়ে দেবে যে তোমরা যাচ্ছো কিনা। যদি কোনো গণ্ডগোল হয়, যদি বারলো ডিনার খেয়ে সোজা বাড়ি চলে আসতে চায়, তাও আমাকে জানিয়ে দেবে। মানিব্যাগ খুলে এক টুকরো কাগজ বের করে সে মেগ-এর দিকে এগিয়ে ধরলো। এটা সেই বুথের টেলিফোন নম্বর। নাও এটা কাছে রেখে দাও।

কাগজটা ভাজ করে মেগ তার হাত ব্যাগে রাখলো।

আর হ্যাঁ অ্যানসন বললো, ওখানে গিয়ে গাড়ি থেকে বেরিও না কিন্তু। শুধু দরজার কাঁচ নামিয়ে রেখো। সে একটা সিগারেট ধরালো তারপর বলল ওকে কায়দা করার পরে পড়তে হবে তোমাকে নিয়ে। উপায় নেই। মেগ একটু কষ্ট সহ্য করতে হবে, কাজে কোনরকম ত্রুটি আমি রাখতে চাইনা। দাঁতে দাঁত চেপে সবকিছু মানিয়ে নিতে হবে। আমাকে দোষ দিও না ম্যাডক্সকে স্থির নিশ্চিত করার জন্যই এ কাজ করতে হবে। এটা যে কোনোরকম ভান-ভনিতা নয়, ডাক্তারের রিপোর্টে সেটা পরিস্কার লেখা থাকা দরকার।

মেগের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে কোনোক্ৰমে ঘাড় নেড়ে বললো হ্যাঁ বুঝেছি, তারপর?

তারপর কষ্টেসৃষ্টে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তোমাকে আসতে হবে আধমাইল, বড় রাস্তা অবধি। সেখানে অজ্ঞানের মতো চুপচাপ পড়ে থাকবে। কারুর না কারুর নজরে ঠিক পড়ে যাবেই। গাড়ি থামিয়ে তারাই তোমাকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেবে। অজ্ঞানের মতো পড়ে থেকো। আমি ফুল পাঠাবো তারপর মুখ খুলবে। যদি দেখো লাল ফুল তাহলে বুঝবেউম্মাদটা ধরা পড়েছে, আর যদি দেখো গোলাপ তাহলে নিশ্চিন্তে কাগজের সেই লোকটার বর্ণনা গড়গড় করে মুখস্থ বলে যাবে। মেগ-এর হাতে একটুকরো কাগজ বের করে সে দিল বলল এতে আমাদের কল্পিত উন্মাদের বর্ণনা আছে। পড়ে আগাগোড়া মুখস্থ করে ফেলল।কাগজের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে এটাকে যেন গুলিয়ে ফেল না।

তারপর?

তারপর আর কি? আপাততঃ তোমাকে এটুকুই করতে হবে। খবরদার, ফুল না দেখে কিন্তু ভুলেও মুখ খুলোনা। ডাক্তার অবশ্য তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পুলিসকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দেবে না। সুতরাং সেদিক থেকে খানিকটা নিশ্চিন্ত।

মেগ অ্যানসনের দিকে তাকিয়ে বলল তুমি বলছ যে কোন ভয় নেই। সব ঠিকঠাক হবে আমরা টাকা পাবো।

অ্যানসন সোফায় চাপড় মেরে বললো আলবাত পাবো। একেবারে ছবির মতো নিখুঁত পরিকল্পনা। কোথাও এতটুকু ভুল নেই।

কাগজে তোমাদের খবর ছাপা হবে। দেশের সমস্ত লোক তোমার দুঃখে সমবেদনা জানাবে। ম্যাডক্স এরকম অবস্থায় আর বেগড়বাই করতে পারবেনা। করলে ওরই ক্ষতি। ওরই কোম্পানির দুর্নাম রটবে। সংবাদ প্রকাশের দিকটা আমি দেখবো।ও ব্যাপারে আর তোমাকে ভাবতে হবেনা।

কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।

আর বিশ্বাস করার দরকার নেই। দিন পনেরো পরে যখন তুমি পঞ্চাশ হাজার ডলারের মালিক হবে, তখন একেবারে বিশ্বাস করে ফেলবে। আঃ ভাবতেও ভাল লাগছে, পনেরো দিন পরে পঞ্চাশ হাজার তুমি আর আমি, আমি আর তুমি, মেগ আকাশের চাঁদ আমি তোমার পায়ে এনে দেবো, নাটকীয় ভঙ্গিতে অ্যানসন বলে উঠল।

সে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কাটলো। মেগ ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করে অগ্নিকুণ্ডের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অ্যানসন এগিয়ে গেলে আলমারীর কাছে বলল দেখো কাণ্ড, এক্ষুণি ভুলতে বসেছিলাম আর কি। রিভলভারটা নেবার কথা একেবারে ভুলে গেছিলাম। ওটা না নিলে তো কাজই হবেনা। ড্রয়ার খুলে কাঠের বাক্সটা থেকে সে রিভলভার এবং কার্তুজ বের করলো। পকেটে পুরলো। তারপর মেগ-এর দিকে ফিরলো।

মেগ স্থির দৃষ্টিতে অ্যানসনের-চোখে তাকাল। এবার তুমি যাও, জন। ফিল আজ বাড়িতে থাকবে। বলে গেছে, নটা নাগাদ ফিরবে।

অ্যানসনের দু-চোখে আগুন ঝরে পড়ল। সে বলল ফিরবে কেন আজ তো বৃহস্পতিবার।

ফ্লোরিডায় যাবে বলে স্কুল ও ছেড়ে দিয়েছে। দোকান থেকে বেরিয়ে ও যাবে সেই ব্যবসায়ীর কাছে। তারপর বাড়িতে আসবে। তুমি আর দেরী কোরো না জন যাও প্লিজ। আর দেরী করলে হয়তো পথেই তোমাদের দেখা হয়ে যেতে পারে।

অ্যানসন ছোট ছোট চোখে মেগ-এর দিকে তাকাল বলল টাকা পাওয়ার আগে থেকেই গড়বড় শুরু করলে মেগ। আমাকে বোকা বানাচ্ছে।

ছিঃ ছিঃ জন এ তুমি কি বলছো। তোমাকে বোকা বানিয়ে আমার কি লাভ? সত্যি বলছি বিশ্বাস করো, ফিল একটু পরেই ফিরে আসবে।

ফিল…ফিল…ফিল…! এ ছাড়া কি তোমার অন্য কোনও কথা নেই। যে লোকটা আজ বাদে কাল আর…

প্লিজ জন, তুমি এখন যাও।

আচ্ছা বেশ, চললাম। ফোনের কথাটা যেন মনে থাকে। আমি বুথে বসে থাকবো। কোন ভয় নেই, মাথা ঠাণ্ডা রেখে যা করার করবে।

মেগ তাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো। কঠিন গলায় বললো জন আর দেরী করো না।

অ্যানসন স্থির দৃষ্টিতে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। একটু পরে তার গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল।

শব্দ মিলিয়ে যেতে গেলার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এতক্ষণ যেসব কথাবার্তা হলো, তার একটিও তার কান এড়ায়নি।

মেগ গেলারকে দেখে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। গাল বেয়ে তার জলের ধারা নামলো।

 গেলার থুতনি ধরে নাড়া দিয়ে বলল, মেগ আবার কি রঙ্গ শুরু করলে বলোত, কোথায় অ্যানসনকে একটু ভালোবাসবে, গরম করবে তা না, এখন ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে। কত ভালো ছেলে, এতো ভালোবাসা, আর তাকে তুমি ওভাবে তাড়িয়ে দিলে।

উত্তরে মেগ আরও শক্ত হাতে তার শরীর জড়িয়ে ধরলো।

.

শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অ্যানা গারভিল টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে ড্রয়ার তুলে টাইপ মেশিনে ঢাকনা পরালো। তারপর চেয়ার ঠেলে উঠে অ্যানসনের দিকে তাকাল। চলি মিঃ অ্যানসন গুডনাইট।

নাইট। আমার আজ আরো কিছুক্ষণ থাকতে হবে। কটা জরুরী চিঠি লেখার আছে।

তাহলে তো আমাকেও থাকতে হয় আপনার কখন কি দরকার হয়।

না না, সেজন্য তোমার থাকার দরকার নেই, আমি নিজেই করে নেবো সব। তেমন কিছু একটা জরুরী কাজ নয়।

অ্যানসন চোখ টিপে মুচকি হাসল, আসলে বাড়িতে ভাববার তেমন কেউ তো নেই, বাড়ির টানও তাই কম।

অ্যানা মৃদু হেসে বেরিয়ে গেলো। তার জুতোর শব্দ টানা বারান্দার প্রান্তে মিলিয়ে যেতেই অ্যানসন টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে ড্রয়ারে তুললো। পকেট থেকে স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক ঘড়ি বের করে চোখ বুজে ঘড়ি চালু করার নিয়মটা একবার মনে মনে পর্যালোচনা করলো তারপর উঠে গিয়ে সে দেয়ালের প্লাগে ঘড়িটা লাগিয়ে দিল।

ঘড়ির দু-পাশে দুটো লম্বা তার। তারের জন্য একটা করে প্লাগ। একটা প্লাগ টেপ রেকর্ডারে আটকে আর একটা প্লাগ সে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ বোর্ডে আটকে দিলো। তারপর ঘড়ির কাঁটা দুটো ঘুরিয়ে পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটে এনে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো।

হাত ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা পঞ্চাশ বাজতেই টেবিল ল্যাম্প দপ করে জ্বলে উঠলো। টেবিল ল্যাম্প, টেপ রেকর্ডারটা আপনা আপনি ঘুরতে শুরু করলো। টাইপে খটখট শব্দ শোনা গেল। কালকের সেই শব্দ।

হঠাৎ শুনলে মনে হয় কেউ যেন খুব মন দিয়ে পাতার পর পাতা টাইপ করে চলেছে। বিরাম বিহীন অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ তার গতি। বাঃ চমৎকার! আসল নকলের ফারাক বোঝার জো নেই। একেবারে নিখুঁত, নিপুণ কাজ। সুইচ টিপে অ্যানসন টেপ বন্ধ করলো।

এবার কাঁটা ঘুরিয়ে সে ঘড়িতে সাড়ে নটা করলো। টেপের রীল উলটো দিকে ঘুরিয়ে আবার শুরুর মুখে আনলো। তারপর উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে একতলায় এলো।

বেরোবার মুখে জাড় জোন্স-এর সঙ্গে দেখা। জোল কাগজ পড়ছিল। অ্যানসনকে দেখে কাগজ ভাঁজ করে জিজ্ঞাসু নেত্রে সে মুখ তুলে তাকাল।

অ্যানসন বললো, আজ আবার আমার একটু বেশি রাত অবধি কাজ করতে হবে জোন্স। তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম।

ঠিক আছে মিঃ অ্যানসন। মুচকি হাসলো জোন্স, জানিয়ে ভালোই করলেন। নয়তো দরজায় ধাক্কা দিয়ে আপনাকে শুধু শুধু অনর্থক বিরক্ত করতাম।

তুমি যা ভাবছে তা নয় হে জোন্স। অ্যানসন হাসলো। আজকাল একেবারে পাকা সন্ন্যাসী হয়ে গেছি। ওসব পাট আজকাল প্রায় তুলেই দিয়েছি। মাইরি বলছি, আজ কাজই করব। যাই চটপট ডিনারটা সেরে আসি।

ঘরের চাবিটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন তো। না ভুল করে দরজাতেই আটকে রেখে যাচ্ছেন?

না, না, ভুল করিনি, চাবি সঙ্গেই আছে।

অ্যানসন নামমাত্র খাবার খেলো। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সে সোজা নিজের ফ্ল্যাটে এলো। বারলোর রিভলভাবে ছটা কার্তুজ ভরলো। তারপর প্যান্টের পকেটে রিভলভার নিয়ে সে ফিরে এলো অফিসে।

অ্যানসন গাড়ি ভেতরে ঢোকাল না। রাস্তার পাশে এক গাছের নীচে দাঁড় করিয়ে রাখল। ঢোকার মুখে জোন্স-এর সঙ্গে দেখা। তার ঘরের বড় দেয়াল ঘড়িটায় তখন আটটা বেজে কুড়ি।

জোন্সকে সে বললো, এলাম। বড়জোর এগারটা অবধি থাকবে। তারপরই সোজা বাড়ি চলে যাবো।

জোন্স-এর স্বরে উদ্বেগ ঝরে পড়লো, এই কদিনেই যা শরীরের হাল করেছেন, এতো খাটকেন না মিঃ অ্যানসন, শেষে বড় অসুখ-বিসুখ একটা আবার না হয়ে বসে।

আরে না না, অসুখ হওয়া অতো সোজা নয়। চলি, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এগিয়ে গিয়ে অ্যানসন লিফটে উঠলো।

যথারীতি সে চারতলায় নামলো। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে পা ফেলে চোরের মতো চুপিচুপি নেমে এল সিঁড়ি পথে একতলায়। জোল-এর অফিস ঘরটা ওদিকে লিফটের মুখোমুখি। সিঁড়িটা বাড়ির একবারে ডানদিক ঘেঁষে। খিড়কি দরজার মতো একটা দরজা আছে সিঁড়ির সোজাসুজি। সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আনসন রাস্তায় উঠে এল।

গাড়িতে বসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইঞ্জিন চালু করলো।

গাড়ি ছুটে চললো ঝড়ের বেগে।

অ্যানসন জেসন গ্লেন-এর আধ মাইল আগে টেলিফোন বুথের পাশে গাড়ি থামাল।

ইঞ্জিন বন্ধ করে হেডলাইট নেভালো। তারপর সীটে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরালো। হাতে এখনও অনেক সময়।

পকেটের কাপড় ভেদ করে রিভলভারের স্টীলের চোঙটা শরীরে এক শীতল অনুভূতি জাগাচ্ছে। একটু পরেই এই রিভলভার উষ্ণ ক্রোধে ফেটে পড়বে। আঃ তারপরেই শান্তি। সেই দিনের প্রতীক্ষা টাকা, মেগ, সুখ।

দশটা বাজতে এখনও কুড়ি মিনিট বাকি। আর একটা সিগারেট ধরালো অ্যানসন। গাড়ি থেকে নামলো। বুথে ঢুকে ছোট্ট পাথরের চেয়ারটিতে বসলো।

সময় সেকেন্ড মিনিট ধরে এগিয়ে চললো। বসে বসে একের পর এক সিগারেট শেষ করলো। তাইতো এখনো ফোন আসছে না কেন। তাহলে কি বারলোকে এখানে আনা সম্ভব হল না। দশটা প্রায় বাজে।

ক্রি-রি রিং-ক্রি রি-রিং

অ্যানসন এক লাফে উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল। সজোরে কানের সঙ্গে চেপে বলল হ্যালো।

.

বারলো এরকম অনুরোধের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। মেগ একেবারেনাছোড়বান্দা, তাকে নিয়ে আজ বেরোতেই হবে। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর এই দিনটা নাকি মেগ চিরস্মরণীয় করে রাখতে চায়।

বারলো সকালে একা একা বসে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন এমন সময় মেগ এসে উপস্থিত। তার হাতে ধূমায়িত কফির ট্রে। মুখে মৃদু হাসির ঝিলিক।

বারলো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন হলো তিনি একা একাই ব্রেকফাস্ট সারেন। মেগ ভুলেও তাকে সঙ্গ দিতে আসে না। আজ শুধু সঙ্গ নয়। একেবারে দু কাপ ধূমায়িত কফির সঙ্গে মিষ্টি-মধুর হাসি, কি ব্যাপার!

একটা কাপ বারলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের কাপে ছোট করে চুমুক দিল মেগ। এগিয়ে এসে গা ঘেষে দাঁড়ালো, আদুরে গলায় বললো, কতদিন আমরা একসঙ্গে বেরোইনি। বাড়িতে সারাদিন একা একা থাকি। তুমি একদিনও জানতে চাও না, যে মরে গেছি না বেঁচে আছি। আজ আমি কোনো ওজর শুনবো না আমাকে নিয়ে বেরোতেই হবে।

আজ হঠাৎ! বারলো একটু সরে বসলেন। মাথা নীচু করে কফির কাপে চুমুক দিলেন।

বাঃ এর মধ্যেই ভুলে গেলে। আজ যে আমাদের বিয়ের তারিখ। মেগ সোফায় বসে পড়লো, ঘনিষ্ট হয়ে বারলোর পায়ে নিজের পা ঘষলো।

বেরোলেই তো গাদা গুচ্ছের পয়সা নষ্ট। মুখ না তুলে মাথা নীচু করে বললেন, টাকাকড়ি টানাটানি, মাসের শেষ।

হোক গে মাসের শেষ। আজ কোন অজুহাতই আমি শুনব না। আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে বেরোবো, ঘুরব। ডিনার খাবো, মদ খেয়ে মাতাল হবে, তারপর শেষ রাতে বাড়িতে ফিরবো। এই আমার আজ রাতের রুটিন। বিকেলে একেবারে সেজেগুজে নামবো। তুমি তৈরী থেকো। মেগ উঠে দাঁড়াল। এখন যাই। অনেক কাজকর্ম পড়ে আছে।

বারলোর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে হিল্লোল তুলে সিঁড়ির দিকে এগোল মেগ, বারলো একই ভাবে বসে রইলেন।

অনেকক্ষণ পরে তার স্তম্বিৎ ফিরে এলো।

চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটের ধোঁয়াতে একের পর এক চিন্তার জাল রচনা করে চললেন।

না মেগ-এর সম্বন্ধে আমার আর কোন মোহই নেই। আমার কাছে ও এখন মৃত একটা অচল মাংসের তাল। ও আর আমাকে কি সুখই বা দেবে। বরং সেই মেয়েটা, তার ভয় চকিত, করুন আর্তনাদ অতুলনীয়, অমন সুখ আমি কোনোদিনও পাইনি।

তবে হ্যাঁ বেরোতে যখন চাইছে, মুখ ফুটে যখন একবার বলেইছে কথাটা, তখন আপত্তি করা আর ঠিক হবে না। কে জানে বাবা, কি ভাবতে শেষে কি ভেবে বসবে। আচ্ছা খুনটা যে আমিই করেছি সেকথা আবার মেগ জানতে পারেনি তো।

অবশ্য জানার কোনও উপায়ও নেই। ছদ্মবেশটা দারুণ, কাগজের বর্ণনার সঙ্গে আমার কোন জায়গায় এতটুকু মিল নেই। তাছাড়া, রিভলভার টুপি এবং সেই রবারের পিণ্ড দুটো, বই মোক্ষম জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি খাটের নীচে মেঝের কাঠ সরিয়ে সেই গোপন কুঠুরিতে। কারোর বাবার সাধ্য নেই সে জায়গা থেকে পায়। ইচ্ছে করেই ওগুলো নষ্ট করিনি কারণ আবার দরকার হবে, হয়তো কোনোদিন ঐ টুপি, ঐ পোষাক, ঐ রিভলভারের সাহায্য আমাকে নিতে হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে যে ভীরু কাপুরুষরা প্রেম প্রেম খেলে তাদের আমি বারোটা বাজাবো।

নাঃ মেগই আজ সবকিছু গোলমাল করে দিল। কোথায় ভেবে রেখেছিলাম আজ একটু জেসন গ্লেনটা টহল মেরে আসবো, তা না ওকে নিয়ে বেরোতে হবে। বিবাহ বার্ষিকী স্মরণীয় করতে হবে। নিকুচি করেছে বিবাহ বার্ষিকীর।

বারলো উঠে দাঁড়ালেন। ঘৃণায়-বিরক্তিতে তার মুখের রেখা পাল্টালো। নিঃশব্দে তিনি নিজের ঘরের দিকে এগোলেন।

প্রায় একরকম জোর করেই মেগ তাকে কোর্ট রোডহাউস রেস্তোরাঁয় নিয়ে এসেছে। এখানে খাবারের দাম এমনিতেই বেশি।

খাবারও এমন কিছু ভাল নয়। তবু কেন যে মেগ এখানে এল, শুধু শুধু কতগুলো টাকা দণ্ড যাবে, আর কিছুই না।

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলো। দুজনে এসে বসল রেস্তোরাঁর গায়ে লাগানো ছোট্ট পানশালায়। মেগ একাই প্রায় এক বোতল হুইস্কি খেল।

সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার পা টলছে। চোখ আরক্ত, শরীরে একটা আলগা ভাব। এক পা এগিয়ে এসে সে বারলোর হাত ধরল। চলো, এখানে আর না এখন জেসনস্ গ্লেনে যাবো, ওঠো, না বলো না।

বারলোর মন ঘৃণায় ভরে গেলো। রস একেবারে উথলে উঠেছে। রাগ সামলে বারলো তাকে বলল না এখন আর কোথাও না, বাড়ি চলে আমার ঘুম পাচ্ছে।

মেগ মায়া-মদির চোখে বারলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যেন একটা কি, আজকের দিনে কোথায় একটু রোমান্টিক হবে, আমাকে আদর করবে তা না কেবল বাড়ি যাবো আর বাড়ি যাবো, না এখন আমি বাড়ি যাবো না।

বারলো দৃঢ়স্বরে বললো আমি যাবো, তোমার সঙ্গে রোমান্টিক হবার চেয়ে। যাকগে বাড়ি চলো। মদ খেয়ে মাতলামি করার জায়গা এটা নয়।

মেগ জড়ানো স্বরে বললো মাতলামি করছি নাকি? বেশ তাহলে তাই,আমি মাতাল তোমার মতো সাধু নই, হল তো, এখন চলল আর দেরী কোরো না, আমার আর এখানে ভাল লাগছে না।

না, বাড়ি ছাড়া আমি আর কোথাও যাবে না। তিনি ইতস্ততঃ করে বললেন যে, এছাড়া ওখানে তো সবাই লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম করতে যায়। ওখানে আমরা গিয়ে কি করবো?

আমরাও প্রেম করবো, মজা লুটবো প্লিজ চলো, বেশ তুমি না যাও আমি একলাই যাবো। রাস্তা থেকে যাকে লোক একজনকে গাড়িতে তুলে নেবো, তার সঙ্গে মজা লুটবো। বলতে বলতে মেগ খিলখিল করে হেসে উঠল।

বারলোর শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠল।

তার চোয়াল শক্ত হল, বেশ তোমার যা করার করো, আমি চললাম।

মেগ উঠে দাঁড়ালো, আমিও চললাম। তবে তুমি যাবে হেঁটে, আমি যাবো গাড়িতে।

বারলো অনিচ্ছায় বসে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন যখন নাছোড়বান্দা, তখন আর আপত্তি করে লাভ নেই। যাওয়া যাক ওর সঙ্গে। বরং জায়গাটা এই তালে দেখে আসা যাবে যে ক-খানা গাড়ি আসে, লোকজন কেমন হয়, মন্দ কি?

তিনি মেগ-এর চোখ এড়িয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন বেশ চলো তবে বেশিক্ষণ কিন্তু ওখানে থাকা যাবেনা।

মেগ খুশীতে ঝলমল করে উঠল, বলল একটু বোসো, আমি চট করে বাথরুম থেকে একটু ঘুরে আসি। সে আর দাঁড়ালো না বাথরুমের দিকে ছুটে গেল।

বাথরুমটা ভেতরে। রেস্তোরাঁ এবং পানশালা দুটোর জন্য এই একটাই বাথরুম। দুদিক থেকেই ঢোকার দরজা আছে।

পানশালার দিকের দরজা দিয়ে ঢুকে মেগ রেস্তোরাঁর দিকের দরজা খুলে বেরলো। দু-পা এগিয়ে গিয়ে টেলিফোন বুথে ঢুকলো।

হ্যালো, অ্যানসন-এর স্বরে একরাশ উকণ্ঠা ঝরে পড়লো কে, মেগ?

 হ্যাঁ, শোন, আমরা যাচ্ছি, এক্ষুনি রওনা দিচ্ছি।

ঠিক আছে। এসো আমি আছি। ফোন নামিয়ে রাখলো অ্যানসন।

সে বুথ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল। ইঞ্জিন চালু করে পাকা রাস্তা ছেড়ে গ্লেন-এর কঁচা রাস্তায় উঠতে লাগল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।মনে নিদারুণ উৎকণ্ঠা। আরো খানিকটা উঠে বিস্তৃত উপত্যকাটিতে পৌঁছল সে। দুটো উঁচু ঝোঁপের আড়ালে গাড়ি থামালো। ইঞ্জিন বন্ধ করে আলো নিভিয়ে গাড়ি থেকে নামলো, তারপর বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপে এগোল উপত্যকটা ঘুরে ফিরে জরীপ করতে।

নীচে, অনেক দূরে শহর। আলোর মালায় যেন তার অন্ধকারের ঘোমটা খসে পড়েছে। সলজ্জ বিনম্র মুখে সে যেন তাকিয়ে আছে চোখ মেলে। গাড়ির হেডলাইটের তীব্র-আলোয় মাঝে মাঝে সেই লাজরক্ত রূপটি চঞ্চল হয়ে উঠছে। পরমুহূর্তেই অন্ধকার এসে তার চোখ ঢাকছে।

একদিকে যখন এই চাঞ্চল্য, আর একদিকে তখন স্থির নির্জনতা। জেসন গ্লেন আজ অন্ধকার। একটা গাড়ি নেই, একটা মানুষ নেই, নেই এতোটুকু ফিসফিসানি। সব যেন কেমন শান্ত, স্তব্ধ। সাধারণতঃ কোনদিনই এরকম হয় না অন্ততঃ পনের কুড়িখানা গাড়ি প্রত্যেকদিনই আসে। কিন্তু আজ অন্য রকম, পুলিসের ফরমান শোনার পর কেউই আর সাহস করে এদিকে আসেনি। তা, না এসে একপক্ষে ভালই করেছে, অ্যানসন বেঁচে গেছে। যোগাযযাগটা যাকে বলে একেবারে মনিকাঞ্চন যোগ।

অ্যানসন একচক্কর ঘুরে এসে এক ঝোঁপের আড়ালে উবু হয়ে বসলো। পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে প্রস্তুত হয়ে রইল।

সে হঠাৎ আপন মনেই হেসে উঠলো। আঃ জব্বর একখানা অ্যালিবাই তৈরী করে অফিসে রেখে এসেছি। আমার অনুপস্থিতিতেই সেখানে আমার কাজের শব্দ হচ্ছে। ব্যস্ত অ্যানসন সেখানে পাতার পর পাতা টাইপ করেই চলেছে। দরজার ফাঁকে টেবিল ল্যাম্পের আলো পড়ায় জাড় জোন্সও ধোকা খাবে। ভুলেও ভেবে উঠতে পারবে না, শব্দটা টাইপের না টেপ রেকর্ডারের।

কোর্ট রোডহাউস রেস্তোরাঁ থেকে এখানে আসতে মিনিট তিরিশেক তো লাগবেই। সাড়ে আটটার আগে কিছুতেই ওদের পক্ষে এখানে আসা সম্ভব নয়। তা ঠিক আছে, আসুক ওরা ধীরে সুস্থে, আমি এখানে একই ভাবে বসে থাকবো। ওরা না এসে পৌঁছান অবধি এক পাও নড়ছি না।

আঃ, সেই দৃশ্যটা কি দারুণই না হবে। ট্রিগারে একটু চাপ,বুম, একটা আগুনের হলকা, বারলো লুটিয়ে পড়বে গাড়ির মেঝেয়। ওঃ অতুলনীয়, জীন এবং মৃত্যু জীবিত এবং মৃত, এক মুহূর্ত আগেকার জীবিত বারলো এক মুহূর্ত পরে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়বে, পৃথিবীর সমস্ত পাখি একসঙ্গে তাদের স্বরে কিচির-মিচির করেও তার ঘুম ভাঙ্গাতে পারবে না। বারলো আর জাগবে না।

কি অদ্ভুত! এত কথা ভাবছি, বারলোকে খুন করার কথা ভাবছি, তবু আমার এতটুকু ভাববৈষম্য হচ্ছে না। ঠিক সেই পুলিসটার মতো, ওকে মারতেও আমার এতটুকু হাত কাঁপেনি। রিভলভার তুলেছি, ট্রিগার টিপেছি, ব্যস্ অতবড় জোয়ানটা মুখ থুবড়ে পড়লো। অত তেজ, অত হম্বিতম্বি, সব একেবারে গলে জল হয়ে গেল।

অ্যানসন হঠাৎ চমকে উঠল। কান খাড়া করল। দূরে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে, গাড়িটা এদিকেই আসছে…ওরা আসছে…।

অ্যানসন শক্ত হাতে রিভলভার চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত ঘষলো। কপালে তার জমে উঠল বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটা বাঁক পেরোতেই গাড়ির আলোটা অন্ধকার কেটে এগোল।

ভাগ্য, একেই বলে ভাগ্য। তার থেকে মাত্র কুড়ি হাত দূরেই গাড়িটা এসে থামলো। পুরনো আমলের রংচটা একখানা বুইক। তার আরোহী মাত্র দুজন, ফিলিপ বারলো এবং মেগ।

বারলো বলল দ্যাখ চারিদিকে একবার তাকিয়ে দ্যাখ, আমরা ছাড়া এখানে আর জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।

গাড়ির কাঁচ নামানো। মৃদু বাতাসে ভর করে বারলোর প্রতিটি কথা অ্যানসনের কানে ভেসে এলো।

 চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বারলো মেগ-এর চোখে তাকাল। দেখো চারদিক কেমন নিরব শুনসান, তার কথা শেষ না করেই তিনি একদৃষ্টে মেগ-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভাবলেন কি আশ্চর্য, এতক্ষণে এই সহজ-সরল কথাটাই আমার মাথায় ঢোকেনি। মেগকে তো আমি এখন নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারি। কেউ জানবে না, কাকপক্ষীটিও টের পাবে না। এমন সুবর্ণ সুযোগ কি আর কোনোদিন আসবে।

কিন্তু আমি ওর সঙ্গে আছি। সেক্ষেত্রে আমার কিছু হবে না অথচ ও মরবে, এটাই বা কেমন দেখায়। সবাই ভাববেন বা কি? মেগের মৃত্যুতেই তারা বুঝে নেবে যে আরেকটা খুন কে করেছে? না, বরং এখন থাক।

অ্যানসন মাটির সঙ্গে মিশে বুকে হেঁটে এগিয়ে গেলো। গাড়ির কাছে এসে থামল। ঘাড় তুলে উঁকি মেরে দেখলো। হ্যাঁ এখান থেকে বারলোর মাথাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

মেগ-এর গলা শোনা গেল কই আমাকে আদর করো। বারলোর কাঁধে মাথা রেখে সে তাকালো জানালার দিকে, হঠাৎ গলা চিরে এক তীক্ষ্ণ চীৎকার বেরিয়ে এল তার, না মেরো না প্লিজ মেরো না।

বারলো চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো, অ্যানসন ট্রিগারে চাপ দিল।

বারলো হুমড়ি খেয়ে পড়লো, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। দু-হাতে মুখ ঢেকে মেগ চীৎকার করে উঠল না-না-না–

অ্যানসন রিভলভার পকেটে রেখে এক পা এগোল, এক টানে গাড়ির দরজা খুলে ফেললো। মেগ দু হাতে বাধা দেবার চেষ্টা করলো।

অ্যানসন তার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে গাড়ি থেকে নামালো। তারপর…

রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো মেগ-এর আর্তনাদে। কটা নিশাচর প্রাণী ডানা ঝাঁপটালো। একটা শকুন কাঁদতে লাগল।