০৯. দপ্তরের থমথমে পরিবেশ

০৯.

ফ্যান’শর দপ্তরে পা রাখতেই চোখে পড়ে দপ্তরের থমথমে পরিবেশ। ম্যাক্স টেবিলের ওপর বসেছিল, তবে তফাৎ এটুকুই যে তার গর্জন তখন বহিঃপ্রকাশ করেনি, কিন্তু তার চোখের দিকে চোখ পড়লেই বোঝা যাচ্ছে, এবার কারুর কপালে দুর্ভোগ ঘনিয়ে আসছে।

ফ্যান’শ দাঁড়িয়েছিল জানলার পাশেই, তার কাঁপা কাঁপা হস্তের সিগারেট থেকে কার্পেটের ওপর ছাই পড়েছিল। আমাকে দেখামাত্র হালে পানি পেল সে।

দেখছে এটা? টেবিলে রাখা খবরের কাগজটার ওপর টোকা মারল ম্যাডক্স।

হা। একটা চেয়ার পায়ে করে পেঁচিয়ে টেনে তার ওপর বসে পড়লাম। ওতে বিশেষ কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ইদানীং আমাদের পলিসিগুলো লাভের পরিবর্তে বড় ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।

তোমার কী মনে হয়, বীমার টাকা কেউ দাবি করবে?

তা জানি না, তবে রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কথাটা পলিসিতে বিন্দুমাত্র উল্লেখ ছিল না, বিস্তারিত সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত দাবি করার সম্ভাবনাটাই আমি ধরে নেব।

বিস্তারিত খবর আমার জানা আছে,ম্যাডক্স বলে উঠল, প্রেস অ্যাসোসিয়েশান থেকে একটু আগেই জেনেছি। মেয়েটা মরেছে গতকাল বিকেলে। নিউইয়র্ক যাবার আগে সে দ্বীপে জ্যাক কনির নিকট কিছুদিন থাকার জন্যই গিয়েছিল।কনি বলেছে, সেসকাল দশটায় দ্বীপ ছেড়ে ওপারে চলে আসে। সুসান নাকি তাকে বলেছিল, ঐ সময়ে সে কেবিনটা পরিষ্কার করে রাখবে।

জানালার ধুলো ঝাড়ার জন্য সে কনির কাছে একটা মই চেয়ে নেয়।কনি তাকে মইটা দেখিয়ে জানায়, ওটা সে ব্যবহার করতে পারে তবে জিনিসটা মোটেই মজবুত নয়। কোন জানলাই যখন সাত ফুটের বেশী উঁচুতে ছিল না, তাই সুসান তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে উঠল, পড়ে গেলেও ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।

চুরুট ধরানোর জন্য ম্যাডক্স একটু থামল, তারপর ধোয়াটা হাত নেড়ে মুখের পাশ থেকে সরিয়ে আবার তার বলা শুরু করে দিল, দুপুরের আহারপর্ব মিটে গেলে সুসান জানলা পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মইয়ের পাশটা হঠাৎ ভেঙে পড়লে সোজা জানলার ওপর সে আছড়ে পড়ে। আত্মরক্ষার তাগিদে তার বাড়ানো দুই হাত গিয়ে পড়ে জানালার সার্সির ওপর। কাঁচটা চুরমার হয়ে ভেঙে ওর হাতের কব্জি দুটোর ভেতর ঢুকে শিরা কেটে দেয়।

এরপর বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, দুহাতের শিরা কেটে যেতে গলগল করে রক্তক্ষরণ হতে থাকে ওর শরীর থেকে। জায়গা জুড়ে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে বোঝা যায়, সুসান ঐ অবস্থাতে সারা ঘরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল–হয় রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য ব্যান্ডেজের খোঁজে আর নয়তো সে রক্ত দেখে ভীষণ ভাবে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সপসপে রক্তে ভেজা দুটো ভোয়ালেও পাওয়া গেছে। একটা কম্বল ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধার প্রচেষ্টাও সে করেছিল। অবশ্য বাঁধনটা তেমন শক্ত হয়নি, তবে সেটা অস্বাভাবিক কিছুনয়। রক্তমাখা পিচ্ছিল হাত দিয়ে নিজের ব্যান্ডেজ বাঁধা একেবারেই অসম্ভব।

ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখছি,আমি মব্য করে উঠলাম। ম্যাডক্স দুকাঁধে ঝাঁকুনি তুলল। কাল সরেজমিন তদন্ত হবে। রায় যা বেরোবে তা অনেক আগে থাকতেই জানা। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুচক্রান্তের কোন প্রমাণ নেই। রক্তপাতের সময় জ্যাক কনি ম্প্রিংভিলেতে গিয়েছিল হোটেলে চিঠি আনতে। বহুলোক তার হয়ে সাক্ষী দেবে। তার স্ত্রী বর্তমানে বুয়েনস এয়ারস এর পথে। ডেনি নিউইয়র্কে, আর রাইসের গতিবিধির যাবতীয় খবর পুলিসই দিয়ে দেবে। সবার কাছেই অজুহাত যথেষ্টই মজবুত। তাছাড়া এমন কোন শক্তিশালী সূত্রই নেই যেটার মাধ্যমে শেরিফের মনে সন্দেহ জাগাতে পারে।

কেবলমাত্র ওর দশলক্ষ ডলারের ইসিওরটা ছাড়া, আমি বলে উঠলাম।

ওটা বোধহয় কনির কাছে অজানা। ছাদ লক্ষ করে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়ল ম্যাডক্স। ভুরু কুঁচকে ভাবল কয়েক মুহূর্ত, তারপর আবার তার প্রসঙ্গ শুরু করল, একাজটা অত্যন্ত চালাকির সঙ্গে করা হয়েছে, হারমাস। এরকম সে কিছু একটা ঘটতে পারে অনেক আগে থাকতেই অনুমান করেছিলাম আমি। প্রমাণ যা আছে, তাতে কোন জুরি-ই এই ঘটনাকে চক্রান্ত বলে কখনই রায় দেবে না। তাদের নিকট এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আসল ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।

হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে দড়াম করে টেবিলে ঘুষি মেরে বসল ম্যাডক্স, এটা খুন! কোন ভুল নেই এতে। যে মুহূর্তে ডেনি ঐ গর্দভ গুডইয়ারকে দিয়ে হতচ্ছাড়াটা পলিসি করিয়েছে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই খুনের মঞ্চ তৈরী হতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন আমাদের এটাই দেখতে হবে, টাকা দাবি করার মতো ক্ষমতা ওদের আছে কিনা।

সে তো করবেই, আমি বলে উঠলাম। দাবি না করার কোন কারণ আছে কি?

ভালো ভাবে নিজের মগজটা একবার খেলাও, হারমাস।রক্তপাত ঘটিয়ে হত্যা করার অনেক সুবিধে। এতে হৈ-চৈ হয় না, সেইসঙ্গে মৃত্যুও হয় খুব তাড়াতাড়ি–তবে হত্যাকারী সরে পড়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, জিনিসটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, দেখে মনে হবে নিছক দুর্ঘটনা।

কাধ-টাধ বেঁকিয়ে এক বিচিত্র ভঙ্গী করে উঠল ম্যাডক্স। এতে অবশ্য আমার কিছু আসে যায় না কারণ আমি পুলিশের লোক নই। হত্যারহস্যের কিনারা করা আমার কাজের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু জাল-জোচ্চুরির সন্ধান করা আমার কাজের মধ্যে এসে পড়ে। আর এটা হল সরাসরি এক জোচ্চুরি! তা না হলে দশলক্ষ ডলারের অ্যাক্সিডেন্ট পলিসি করিয়ে কেউ এক মাসের মধ্যেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বে না। অসম্ভব! এটা খুন ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না, খুন হতে বাধ্য।

তাহলে আমাদের পরবর্তী কাজটা কী?

করণীয় কিছুই নেই। চুপচাপ বসে তামাসা দেখা। দান দেবার পালা ওদের, ওরাই চাল চালুক।

আর এ ব্যাপারে দেরী করবে বলে মনে হয় না।

ওদের যা মন চায় প্রাণ চায় ওরা করুক। এখবরটার পেছনে এমন কিছু নেই যার জন্য আমাদের এতো গুরুত্ব দিতে হবে। কাগজটার ওপর টোকা মেরে বলল ম্যাডক্স। আমরা কেউ এটা দেখিনি। আমরা ওদের এই বলবো যে, পলিসিগুলো শুধুমাত্র নাম প্রচারের উদ্দেশ্যে করানো হয়েছিল, সেই কারণে প্রিমিয়াম এত কম। মেয়েটা আর ডেনি দুজনেই তোমায় বলেছিল, এ বীমায় টাকা দাবি করার কেউ নেই, এ বিষয়টাও এই সুযোগে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। এর জবাবে ওরা যা যা স্বীকার করবে সব সাক্ষীদের সামনে টুকে নেওয়া হবে। আমরা ওদের ভয় দেখাবো, টাকা দাবি করলেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দেওয়া হবে। জুরিদের কাছে সব ফাস করে দিয়ে ব্যাপারটায় জোচ্চুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কিনা বিবেচনা করার জন্য আমরা তাদের অনুরোধ করব।

ঝুকে বসে আমার দিকে কটমট করে তাকাল ম্যাডক্স। ওদের মনে ভীতির সঞ্চার করতে হবে, যে টাকা দাবির চেষ্টা করলে শুধু জালিয়াতি নয়, খুনের দায়েও তাদের জড়িয়ে ফেলা হবে।

সরেজমিন তদন্তের সময় আমায় কী যেতে বলছেন?

তদন্ত, লাফিয়ে ওঠে ম্যাডল। এতক্ষণ ধরে কী বকবক করলাম তোমার সঙ্গে?…আমরা গোটা ব্যাপারটাই উড়িয়ে দেব। ওখানে যাওয়া মানেই জুরিদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, ক্ষতিপূরণের টাকা সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট সচেতন। খবরটা আমরা দেখিইনি! মেয়েটা যে মারা গেছে এ বিষয়েও আমরা কিছুই জানি না। কি, মগজে ঢুকেছে তোমার? আমরা কোন কিছুই করবো না।

কোন কিছুই না করলে আমাদের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হারাতে হবে, আমি বলে উঠলাম।

কেবিনটা একবার পরীক্ষা করার ইচ্ছে ছিল। তাছাড়া দেহটা সনাক্ত করলে আঙুলের ছাপও সঙ্গে নিয়ে নিতে পারতাম।

ওসব কিছুই আমরা করবো না,বলার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডক্সের মুখ লাল হয়ে ওঠে। এটা আমার আদেশ। দুএকটা সুযোগ হারাতে হবে বলে আমরা কোর্টে নিজেদের মামলাটাকে দুর্বল করে ফেলতে পারি না।

ওর অভিপ্রায় বুঝেও আমি তাও বললাম, একটা কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই। এই দুটো মেয়েকে দেখতে কিন্তু অবিকল এক। ধরুন, সুসান যদি জালিয়াতির মধ্যে থাকে, তাহলে মৃতদেহটা নিশ্চিত কোরিনের। কিন্তু দেহটা সনাক্ত না করা পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারব না।

ম্যাডক্স ঘোঁত ঘোঁত করে উঠল। তুমি আমাদের জানিয়েছ, কোরিন এখন বুয়েনস এয়ারস এ।

সেটা ওর কথা, কিন্তু ও সেখানে গেছে কিনা আমরা জানি না। তাছাড়া কালো পরচুলা পরে ওটা সুসানও হতে পারে! অবশ্য ও জাহাজে উঠেছে কিনা সেটা এক্ষুণি আমি জেনে নিতে পারি।

কাধ ঝাঁকিয়ে উঠল ম্যাডক্স। ইচ্ছে হলে জেনে নাও, তবে ওটা শুধু সময়ের অপচয়। দশলক্ষ ডলারের প্রশ্ন যেখানে জড়িয়ে আছে, সেখানে অত সাধারণ ভুল কেউ করবে না।

আপনার কথাই হয়তো ঠিক। তাও আমি দেখবো। কোথাও না কোথাও ভুল ওরা করবেই কিন্তু দেহ সনাক্ত করার ব্যাপারে আপনি কি উৎসাহী নন?

উপায়ও নেই! প্রচণ্ড জোরে টেবিলে এক খুঁষি কষাল ম্যাডক্স। কোর্টে যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি, দেহটা আমাদের দেখানো হয়নি–সনাক্ত করার সুযোগ আমরা পাইনি, আমরা ঠিক সেই সময়েই সন্দেহ করার অজুহাতে কেস লড়তে পারব।

আমি কিন্তু মনে করি দেহটা সনাক্ত করা প্রয়োজন, জোরের সঙ্গে আমি বলে উঠলাম।

প্রায় ফেটে পড়ার দশা হয়েছিল ম্যাডক্সের। আর এই মুহূর্তে দরজায় টোকা দিয়ে মুখ বাড়ালো ফ্যান’শর সেক্রেটারি মিস ফেভারশ্যাম। মিঃ ব্র্যাড ডেনি নামে এক ভদ্রলোক মিঃ হারমাসের খোঁজ করছেন।

ম্যাডক্স হাসল। শেয়াল আর বাঘের মাঝামাঝি ঠিক এক জন্তুর মতো তার বর্তমান দশা।

ঐ এসে গেছে,বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যান’শর দিকে তাকাল। তুমি বরং থাকে। কিছুক্ষণের জন্য আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমিও থাকো ফেভারশ্যাম। লোকটা যা বলবে প্রত্যেকটা কথা লিখে নিও। তবে হ্যাঁ হারমাস, খুব সাবধান। আমরা কিছুতেই স্বীকার করবো না, বুঝেছো? দরখাস্ত করে টাকা দাবি করতে বলবে,কাকুতি-মিনতি করলে সোজাসুজি বকিছু অস্বীকার করবে। আর এই বলবে, প্রয়োজন বোধ করলে যে কোন কোর্টে গিয়ে টাকা আদায় করতে। বুঝেছো?

বুঝেছি।

ম্যাডক্স বেরিয়ে যাবার পর ফ্যান’শ ওর সেক্রেটারীর উদ্দেশ্যে বলল, যাও, মিঃ ডেনিকে ভেতরে নিয়ে এসো।

নিজের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে ফ্যান’শ তাড়াতাড়ি করে জানালার ধারে সরে গেল। তারপর ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠল, কথাবার্তা তুমি না হয় চালিয়ে যাও। মাঝে মধ্যে দরকার পড়লে আমি যোগ দেবো।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ডেনি। ঝোড়ো কাকের মতো পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। হাত বাড়িয়ে সে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই মিস ফেলারশ্যাম শান্ত পায়ে অন্য একটা টেবিলে গিয়ে নোটবই খুলে বসল। শুনেছেন তো? আমার হাতে হাত মিলিয়ে বলল ডেনি।

আপনার সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হয়ে সত্যি খুশি হলাম, শান্তকণ্ঠে বলে উঠলাম।

বসুন, তারপর নিউইয়র্কের সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল?

বাদ দিন ওসব। সুসানের কথা শোনেননি আপনারা? ও মারা গেছে।

মারা গেছে! আকাশ থেকে পড়লাম আমি। কি হয়েছিল?

ফ্যান’শ ধীর পদব্রজে এগিয়ে এসে কাগজটা টেবিল থেকে তুলে নিল।

এটার কথা আমাদের কারুরই খেয়াল ছিল না। সেটা মুড়ে আজেবাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিল সে।

সে তো ভয়ঙ্কর কাণ্ড! চেয়ারে বসে পড়ল ডেনি। তার মুখে ফুটে ওঠা বেদনা আর হতাশা দেখে মনে হচ্ছিল এটা অভিনয় নয়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে মনে। ও নিজের হাতের শিরা কেটে ফেলেছিল, আর সেই সময় ও ছিল ঐ হতচ্ছাড়া দ্বীপটায়। আশে পাশে কেউ কোথাও ছিল না ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। অনর্গল এক নাগাড়ে রক্তপাতে বেচারির মৃত্যু ডেকে আনে।

কী সর্বনাশ! চেয়ার টেনে বসে পড়ি আমি। এ ঘটনা ঘটল কবে?

গতকাল একটু আগে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে কাগজে এই খবরটা চোখে পড়ে। তারপর ম্প্রিংভিলে হোটেলে পেটে ইগানকে ফোন করে ব্যাপারটা শুনলাম। কনি তো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন প্রয়োজনই মনে করল না। আর কোরিন বর্তমানে বুয়েনস এয়ারস এ। তাই আমি এখন স্প্রিংভিলেতে-ই যাচ্ছি।

আমি কি এ ব্যাপারে আপনার কোন কাজে আসতে পারি?

না, ধন্যবাদ আপনি আর কী করবেন! আমি আপনার সঙ্গে ইসিওর পলিসিটার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।

হু, এবার তাহলে পথে এসেছে! ফ্যান’শর দিকে তাকালাম আমি। আসুন আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হলেন আমাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, টিম-ফ্যান’শ।

ফ্যান’শ এগিয়ে এসে করমর্দন করল।

পলিসির কথা কী বলছিলেনঃ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

মানে, সুসি যখন আর বেঁচে নেই, তখন ওটা তো আর কোন কাজে আসছে না। তাই প্রিমিয়াম দেবার কথাটা চিন্তা করছিলাম। ওটা কি আমায় দিয়ে যেতে হবে?

মুহূর্তের জন্য মনে হল, কথাটা ঠিক শুনেছি তো! ফ্যান’শ যেভাবে হঠাৎ করে কুঁকড়ে গেল, তাতে বুঝতে কষ্ট হল না, আমার মতো সেও অবাক হয়েছে।

মুখের ভাব যতদূর সম্ভব ভাবলেশহীন রাখার চেষ্টা করে আমি জবাব দিলাম, না না, তা কেন! ওর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রিমিয়াম নেওয়া আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে।

ডেনি এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। ওঃ, আপনি আমার মনের বিরাট এক বোঝা হালকা করলেন। ইদানীং আমার সময় ভালো যাচ্ছে না, টাকা-পয়সার খুবই টানাটানি চলছে, এর ওপর টাকাটা দিতে হবে ভেবেই আমি আরো চিন্তান্বিত হয়ে পড়ি।

একজোড়া মাটির পুতুলের মতো চোখ বড়ো বড়ো করে প্রতীক্ষা করছিলাম কখন না ইনসিওরের টাকাটা দাবি করে বসে, কিন্তু তার ধারে কাছেও সে গেল না।

শুধু বলল, জানেন মিঃ হারমাস, আমার কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে, এই ইনসিওরেন্স করে চমক দেখানোর বুদ্ধিটা সুসির মাথায় দানা না বাঁধলে ওকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না।

একথা বলছেন কেন?

কারণ পলিসিগুলো না করালেও আমার সঙ্গে ঝগড়াও করত না, আর ডেড লেকে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্তও নিয়ে বসত না।

আপনার সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল নাকি?

হা। আপনার নিশ্চয়ই মনে থাকবে, প্রচারের জন্য পলিসিগুলো ব্যবহার করতে ও কতখানি উৎসাহী ছিল? মতলবটা ছিল আগাম কিছু প্রচার করে নিউইয়র্কের ম্যানেজারদের কানে ওর নামটা তুলে ধরা। যখন বুঝলাম শোর যথেষ্ট বাজার ভালো চলছে, আমি পলিসির কথা নিজে উপযাচক হয়েই কাগজের রিপোর্টারদের জানানোর ব্যাপারে বললাম। কিন্তু তাতে ও কি জানাল জানেন?

শুনলে আমার মতো আপনিও কম আশ্চর্য হবেন না। প্রত্যুত্তরে বলল, ও ভেবে দেখছে, ওর শোনাকি এতোই ভালো চলছে যে,এরকম একটা সস্তা ধরনের প্রচারে নেমে নিজেকে খেলো, প্রতিপন্ন করার কোন বাসনা ওর নেই। আমি যা বললাম তার বক্তব্যের সঙ্গে আমার বক্তব্য হুবহু এক। ভাবুন দেখি একবার! এক-দুই ডলার নয়, দশলক্ষ ডলারের ইনসিওরেন্স করানোর পরে ও বলছে, নিজেকে খেলো করার কোন বাসনা নেই ওর।

মেয়েদের মাথায় এরকম উদ্ভট চিন্তা এসেই থাকে, সতর্ক হয়েই আমি জবাব দিই। তবে আমি যেদিন হলে খেলাটা দেখেছিলাম, উনি দর্শকদের কাছ থেকে ভালোই সাড়া পেয়েছিলেন। হয়তো ওসবস্বচক্ষে দেখার পরই নিজের অভিনয় ক্ষমতার প্রতি ওর ভুল ধারণা জন্মে গিয়েছিল।

ঠিক তাই। আর এই কথাটা বোঝাঁতে যেতেই ও অদ্ভুতভাবে কী রেগেই উঠল। বললো, শুধু ওর অভিনয় ক্ষমতার জোরেই আমি যদি নিউইয়র্কে ওর জন্য শোয়ের বন্দোবস্ত না করে দিতে পারি, তাহলে এজেন্ট হবার কোন মোগ্যতা আমার নেই। আমিও তার এই কথায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি, মাথাও একটু গরম করে ফেলেছিলাম। যতই হোক, অতগুলো টাকা দিয়ে করানো পলিসিগুলো কাজে না এলে, টাকাগুলো শুধু শুধুই জলে যাবে। সুসিকে একথা বলতেই ও বলে উঠল, নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত হবার পর ও সেগুলো ব্যবহার করবে।করুণ দৃষ্টিতে তাকাল ডেনি।

আমিও বোকার মতোই তর্ক করে গেলাম। এতদিন ধরে ওর সঙ্গে কাজ করেছি কিন্তু এরকম মেজাজ এর আগে কোনদিন আমার চোখে পড়েনি। সুসি সেদিনই আমায় জানিয়ে দিল, জ্যাক কনির নিকট ও থাকতে যাচ্ছে, আর নিউইয়র্ক ওর শোয়ের বন্দোবস্ত করতে না পারলে আমার আর দেখা করার কোন প্রয়োজন নেই।

পলিসিগুলো তাহলে আপনারা কাজেই লাগান নি?

ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়লো ডেনি। নাঃ, টাকাটাই শুধু নষ্ট হল। এই জন্যই আপনার কাছে আমার আসা। ওর পেছনে আর টাকা ঢালা আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়।

তার আর কোন প্রয়োজন হবে না, মিঃ ডেনি।

 সিগারেটের প্যাকেটটা ঠেলে দিলাম। নিন, সিগারেট খান।

ডেনি সিগারেট ধরানোর পর বললাম, একটু আগে আপনি বলছিলেন, ইনসিওরেন্স করানোর মতলবটা বেরিয়েছিল কিন্তু মিস গেলার্টের মাথা থেকে। আমি এতোদিন ধরে কিন্তু ঠিক তার উল্টোটাই জানতাম। আমার ধারণা ছিল ওটা বোধহয় আপনি করিয়েছিলেন।

 পিটপিট চোখে তাকাল ডেনি। নানা, ওটা সুসিরই প্ল্যান। প্রথম প্রথম এব্যাপারে আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি, কিন্তু যখন দিলাম, ওর আগ্রহ তখন চলে গেছে।

কিন্তু আপনি তো গুডইয়ারকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন?

নিশ্চয়ই। কারণ আমি ছিলাম সুসির এজেন্ট। ওর ব্যবসা সংক্রান্ত সব কিছুই আমাকেই। দেখতে হতো। তবে ব্যবস্থা সবটাই ওর হাতে ছিল।

ব্যবস্থা বলতে?

সুসিই যোগাযোগ করে মিঃ গুডইয়ারের সঙ্গে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করে দেয়। আপনার কোম্পানির নামটাও ওই কিন্তু বেছেছিল।

তাহলে আপনার বলার অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে আমি যা জানতাম সবই ছিল ভুল! আমি তো জানতাম, গুডইয়ারের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হঠাৎ-ই হয়েছিল।

ডেনির চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব। না না, কে বলবে? সুসিই উদ্যোগ নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল।

গুডইয়ারের সঙ্গে তার কী ভাবে আলাপ হয় আপনি জানেন?

না, ঠিক বলতে পারব না।

যাক গে, বাদ দিন ওসব। হেলান দিয়ে বসে পড়লাম আমি। ঘটনাটা ভাবতেও খারাপ লাগছে।

আচ্ছা, আপনার আর সময় নষ্ট করব না। আমি শুধু প্রিমিয়ামের ব্যাপারটা জানতে এসেছিলাম। তাহলে ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামাতে হবে না বলছেন?

না। আমাদের কেবল ডেথ-সার্টিফিকেটের একটা কপি দরকার। ওটা পেলেই প্রিমিয়াম আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি যদি চান, অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও আমি কথা বলতে পারি।

তাহলে তো ভালোই হয়, কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে উঠল ডেনি। একটা ছেঁড়া-ফাটা ব্রীফ কেস্ তার হাতে ধরা, সেটা খুলে লাল ফিতে বাঁধা কয়েকটা পলিসি বের করে টেবিলের ওপর রেখে বলল, আপনার হয়তো এগুলো প্রয়োজনে আসতে পারে।

আমি আর একটু হলেই চেয়ার থেকে উল্টে পড়ার দাখিল। পলিসিগুলো ছাড়া সে বা অন্য কেউ টাকা দাবি করে তার সমর্থনে প্রমাণ দাখিল করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমি এত চমকে উঠলাম যে, সেটা নিশ্চয়ই নিজের অজান্তে আমার মুখেও প্রস্ফুটিত হয়েছিল।

ডেনির প্রশ্ন শুনে বুঝলাম আমার অনুমান সত্যি। ডেনি প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার হারমাস, আরে না,আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, পলিসিগুলোর দিকে তাকিয়ে ফ্যান’শর চোখ দুটো প্রায় ঠেলে বেরিয়ে আসছে। আসলে পলিসিগুলোর কথা আমার একবারও খেয়ালই হয়নি।

ও। ডেনি ওগুলো আমার দিকে ঠেলে দিল।

এগুলো বাতিল হবার পর আমায় লিখে জানাবেন তো?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। অনুভব করলাম বিন্দু বিন্দু ঘামে সিক্ত আমার কপাল।

পলিসিগুলো নষ্ট করে ফেললেই প্রতারণার সব রকম সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। ওগুলো ছাড়া টাকা দাবি করার ক্ষমতা কারো নেই। অন্যদিকে পলিসিগুলো বর্তমানে সুসান গেলার্টের সম্পত্তি। আর আমি, ন্যাশানাল ফিডালিটির প্রতিনিধি হিসেবে, কোন অধিকারেই ওগুলো নিতে পারি না। পলিসিগুলো স্পর্শ করেও ধীরে ধীরে হাতটা সরিয়ে আনলাম। এগুলো হাতিয়ে নেওয়া চরম অসাধুতা আর ডেনির আপাত-অজ্ঞতার সুযোগ নেওয়া। তাছাড়া দাবি উঠতে পারে জেনেও আমরা পলিসিগুলো নষ্ট করে ফেলেছি, একথাটা একবার চাউর হয়ে গেলে আমাদের কোম্পানির সুনাম চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যাবে। নাঃ, ও ধান্দায় আর যেই যাক, আমি নেই।

ফ্যান’শর সমর্থনের আশায় না তাকিয়েই আমি আবার পলিসিগুলো ডেনির দিকে ঠেলে দিয়ে বললাম, তদন্তের শেষ না হওয়া পর্যন্ত এগুলো আপনার কাছেই রাখা বাঞ্ছনীয়। মিস গেলার্টের কাগজপত্রের সঙ্গে এগুলো মনে করে অবশ্যই তার উকিলের কাছে পাঠাবেন।

এবার বিভ্রান্ত দেখাল ডেনিকে। কিন্তু এগুলোর তো কোন মূল্যই নেই। পাঠানোর কী খুব প্রয়োজন আছে?

প্রথমটায় মনে হল, সে হয়তো ভাওতা দিয়েই আমাকে বলিয়ে নিতে চাইছে যে এগুলোর মূল্য আছে, কিন্তু ওর সরল হতচকিত মুখ দেখে বুঝতে পারলাম আমার অনুমান কতখানি ভুল ছিল। সতর্কতার সঙ্গে এবার বলে উঠি, উকিলের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোন ব্যক্তির কোন ব্যক্তিগত কাগজপত্র বিনষ্ট করার কোন অধিকার আপনার নেই। ওঁর কোন উকিল ঠিক আছে কি?

ঠিক জানি না, তবে এ ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। কনির সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি।

তাই করুন।

পলিসিগুলো আবার ব্রীফ কেসে পুরে ডেনি উঠে দাঁড়াল। আজই স্প্রিংভিলেতে পৌঁছতে গেলে আমার আর দেরী করা উচিত হবে না। আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ, মিঃ হারমাস।

ডেনি চলে যাবার পর সিগারেটটা ছাইদানিতে গুঁজে, চেয়ারটা পেছনে ঠেলে, আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্যান’শর দিকে তাকালাম। নাও, এবার শুরু করো। তোমার যা মন চায় বলতে পারো আমায় স্বচ্ছন্দে।

না, তোমার জায়গায় আমি উপস্থিত থাকলে, আমি বোধহয় ঐ একই কাজ করতাম,বিষয় কণ্ঠে উত্তর দিল ফ্যান’শ।

তুমি আমাকে এর মধ্যে টেনে আনোনি দেখে আমি খুশি। এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। তোমার কী মনে হয়, লোকটা সৎ?

সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, বলতে বলতে ম্যাডক্স ঢুকে পড়ল হঠাৎ।

আমি বাইরে থেকে সব শুনতে পাচ্ছি। আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল।

ওগুলো ফেরৎ দেবার পূর্বে তুমি কি একবারের জন্যেও আমার সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার অনুভব করলে না?

অনর্থক সময় নষ্ট করে লাভ কি? আপনি কী মনে করেন, কাজটা আরও সুষ্ঠুভাবে করতে পারতেন? আত্মসম্বরণ করতে গিয়ে শেষে হয়তো রক্ত আপনার মাথায় চড়ে যেত।

কি একটা বলার জন্য উদ্যত হয়েও দন্ত বিকশিত করে হেসে উঠল ম্যাডক্স। তা হয়তো সত্যি হলেও হতে পারত।…

আমি স্থির নিশ্চিন্ত, ডেনি পলিসিগুলো কনির হাতে তুলে দিলেই, সে এখানে এসে হাজির হবে, উদ্দেশ্য টাকা দাবি করার জন্য। আর আমি এও নিশ্চিত, যে দেহটা সুসান গেলার্টের বলে প্রচার করা হচ্ছে, ওটা আসলে কোরিন কনির। ম্যাডক্স আমাকে সনাক্ত করণের জন্যে না পাঠিয়ে এক মস্ত ভুল করে বসল। কোরিনই যে খুন হয়েছে তার প্রমাণ হাতে আছে আমার, আর তাতে এতবড় একটা চক্রান্ত নিমেষে বসে পড়বে। মনে মনে স্থির করলাম, ম্যাডক্সের বারণ করা সত্ত্বেও ম্প্রিংভিলের মর্গে গোপনে ঢুকে পড়ে নিজের আত্মতুষ্টি করেই চলে আসব। একটু রাত করে গেলে ওখানে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।

কোরিন বুয়েনস এয়ারস-এ গেছে কিনা খোঁজ নিতে যাচ্ছি বলে ম্যাডক্সের কাছে বিদায় নিয়ে আমি হোটেলের দিকে রওনা হলাম।…

হোটেলে নিজের ঘরে ঢুকে প্রথমেই দক্ষিণ আমেরিকান জাহাজ কোম্পানিতে ফোন করলাম। কেরানীটার সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা বলে জানতে পারলাম, কোরিন কনি নামে একটি মেয়ে সমুদ্রপথে বুয়েনস এয়ারস-এর পথে রওনা হয়েছে। ঐ মেয়েটা আসলে কোরিন কনি কিনা জানি, কেরানীটিও বলতে পারবে না, তবে কোর্টে কেস উঠলে এ ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ ওর পক্ষে সহায়ক হবে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

আর দেরী না করে স্যান বারনাডিনোতে আমি ফোন করলাম, হেলেনের হোটেলে। হেলেনকে পাওয়া গেল না, তবে শুনলাম ও আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। ওর জন্যে বিস্তারিত সংবাদ রেখে দিলাম, আর এও বললাম ও এলে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়।

টেলিফোন রেখে, আমার দীর্ঘপথের মোটর যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে স্যুটকেসটা গোছগাছ করতে রাখলাম। একটু পরেই টেলিফোনের ঘন্টি। ওটা হেলেনের ফোন ভেবে তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলাম, হ্যালো! মিঃ স্টিভ হারমাস বলছি।

হেলেন নয়, ফোন করেছে গুডইয়ার। খনখনে গলায় চিৎকার করে উঠল সে, কাগজ দেখেছিস? হতচ্ছাড়ি মেয়েটা শেষ পর্যন্ত নিজেকেই শূলে চড়িয়েছে।

জানি। তুই না করলে আমি এই মাত্র তোকেই ফোন করছিলাম। নির্ভেজাল ডাহা মিথ্যে, ওর কথা আমায় স্মরণেই ছিল না। আমি এক্ষুনি ফ্যান’শর অফিস থেকে ফিরছি। ম্যাডক্স এখন চৌকো গোছের ডিম পাড়ছে।

ব্যাপারটা ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দিস না, স্টিভ,ওর কথাগুলো কেমন যেন জড়ানো জড়ানো।

 আমাদের তাহলে এখন কী করণীয়? কি বলছে ম্যাডক্স?

আরে অত উত্তেজিত হোস না। তোর চিৎকারে কানে তালা লাগার জোগাড় আমার।

কি আর করবো কিছু না!

ছোট একটু নীরবতা।

 ম্যাডক্সও কী তাই বলছে? ওর কণ্ঠ এখন অনেক সংযত।

হ্যাঁ। তা

র মানে টাকা আমরা মেটাবো না?

আরে টাকা যে ওরা:চাইবে একথা তুই বা ভাবছিস কী করে?

 নিশ্চয়ই চাইবে। দেহের রক্ত ঝরিয়ে ওর মৃত্যু হয়েছে। আমার পলিসিতে ওটা লেখা ছিল না। কোন ঝানু ধুরন্ধর উকিলের হাতে পলিসিটা পড়লে আমাদের রেহাই মিলবে ভেবেছিস?

সেসব আমি জানি না। ডেনি জানে পলিসিগুলো শুধুমাত্র প্রচারের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। এখন কনি যদি টাকা দেবার জন্য আমাদের কাছে খোসামোদ করে তাহলে সেটা চিটিং বাজি করা হবে।

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। দূরভাসে ওর গভীর নিশ্বাস ফেলার শব্দ কানে আসছিল।

তুই কী আমাকে বুদ্ধ বানানোর চেষ্টায় আছিস?

নিরুপায় হয়ে বলল সে, তুই আর ম্যাডক্স ঠিকই ধরেছিলি। ভুল করেছিলাম আমি। ব্যাপারটায় কোথাও কোন গণ্ডগোল আছে। কোন ফন্দি বাজি না থাকলে মেয়েটা কখনোই ওভাবে মরতে পারে না।

 তুই কী মনে করিস, ওকে খুন করা হয়েছে?

নিশ্চয়ই তাই! ম্যাডক্স আমার সম্পর্কে কী বলছে বল? নিশ্চয়ই আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে?

দূর, তোর নামটা উচ্চারণ পর্যন্ত সে করেনি।

সে-তো আরো খারাপ, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল গুডইয়ার। কদিন আগেই আমি কোম্পানির পঞ্চাশ হাজার ডলার নষ্ট করে ফেললাম। তার ওপর আবার এটা আছে। সম্পূর্ণ দোষ আমার। ভাবছি, ম্যাডক্স তাড়িয়ে দেবার আগে আমি নিজেই কাজ ছেড়ে দেবো। এ জীবনে আর কাউকে দিয়েই ইনসিওর করাচ্ছি না।

মিথ্যে মিথ্যে অযথা কেন মাথা গরম করছিস অ্যালান? তুই আমাদের সেরা সেলসম্যান। ম্যাডক্স ততকৈ তাড়াতে কখনোই সাহস পাবে না। এ ধরনের অবস্থায় অন্য এজেন্টরা বহুবার পড়েছে। তাছাড়া এখনও পর্যন্ত টাকা কেউ চাইতে আসেনি। তুই এতে ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? এক পেয়ালা মাল সাঁটিয়ে নে দেখি। ওটাই এখন তার দরকার।

কোন প্রয়োজন নেই ওসবের। গুডইয়ারের কণ্ঠ উত্তেজনার শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল। আমার মান ইজ্জত একে একে সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আমি একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। খেদিয়ে দেবার আগে আমি নিজে থাকতেই কাজ ছেড়ে দিচ্ছি।

তোর যা অবস্থা, মাথা তোর কাজ করছে না, অ্যালান–সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করতে থাকি আমি। সে রকম কোন ইচ্ছে থাকলে বরং ম্যাডক্সের কাছে গিয়ে খুলে বল। তুই যে কী নির্বোধের মতো কাজ করতে যাচ্ছিস, ও তোকে খুব ভালো বুঝিয়ে দেবে। যা না একবার তার কাছে।

আমি আমার পদত্যাগ পত্র নিয়ে এক্ষুণি যাচ্ছি। তোর সঙ্গে কোথায় দেখা হবে?

এখন হবে না–আমি বেরোচ্ছি। কাল সকালে না হয় দেখা করিস।

রাত্তিরের দিকে দেখা করতে পারবি?

না রে, আমি একটু শহরের বাইরে যাচ্ছি। সকালের আগে ফিরতে পারব বলে তো মনে হয় না। বলবো তোকে সব। কাল এগারোটার পর আমার এখানে চলে আয় না?

ঠিক আছে। আমি এখন ম্যাডক্সের কাছে যাচ্ছি।

তাই যা। মাথা ঠাণ্ডা রাখিস, ছাড়ছি।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে এক গেলাস পানীয় হাতে ভাবতে বসলাম, গুডইয়ারের কথাগুলো ম্যাডক্সকে জানিয়ে তাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত হবে কিনা। পরক্ষণেই চিন্তা করলামনা, এসবের কোন দরকার নেই, ব্যাপারটা ওর ওপরেই ছেড়ে দেওয়াই ভালো। স্প্রিংভিলেতে আমায় যেতেই হবে। ম্যাডক্সকে ডাকতে গিয়ে সে যদি আবার নতুন করে কোন কাজ চাপিয়ে দেয় তাহলে যাওয়া বোধহয় আর সম্ভব হবে না।

কোর্টের ভেতরের পকেটে রিভালবারটা খুঁজে নিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে আমি বুইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্প্রিংভিলের উদ্দেশ্যে।…

ম্প্রিংভিলে যাবার ধূলিকণায় ভরপুর রাস্তা চাঁদের আলোয় সাদা হয়ে গেছে।

শহর ছেড়ে সিকি মাইল ভেতরে যাবার পর আমি একটা ঝোঁপের পাশে গাড়ি দাঁড় করালাম। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলতে হবে আমায়। কেউ যদি দেখে ফেলে, বা ম্যাডক্স যদি কোনরকমে শুনে ফেলে আমি তার আদেশ অমান্য করেছি, তাহলে এই মুহূর্তেই আমার চাকরির দফারফা। গাড়ির দরজায় চাবি এঁটে অন্ধকার ঘেঁষে শহরের দিকে এগিয়ে চললাম।

বেশীরভাগ বাড়িগুলোই এখন অন্ধকার। তবে এদের মধ্যে পৃথক ছিল হোটেল, শুড়িখানা আর গোটা দুই কাঠের বাড়ি।

শেরিফের দপ্তর আর মর্গটা বড় রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে। হেলেনের সঙ্গে ডেড লেকে যাবার পথে আমি বাড়িটার ওপর নজর রাখছিলাম।

জঙ্গলটা ধীরে ধীরে অনেক পাতলা হয়ে এল। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি রাস্তাটা একবার ভালো ভাবে চোখ বুলিয়ে নিলাম। জনা ছয়েক লোক একটা সেলুনের সিঁড়িতে বসে গান করছিল। ওদের নজর এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। অগত্যা নিজেকে গোপন রেখে আমি বসে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। এগারোটার সময় সবার শেষে থাকা লোকটা চলে যাবার পর সেলুনের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে আলো না নেভা পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকলাম। লম্বা রাস্তাটা এখন জনমানবশূন্য। এবার এগোন যাক।

কান দুটো খোলা রেখে, চতুর্দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে অতিসন্তর্পণে বাড়িগুলোর গা ঘেঁষে ঘেঁষে এগোতে লাগলাম।

মাঝামাঝি আসার পর হঠাৎ একটু দূরে কুকুর চিৎকার করে উঠল। তাড়াতাড়ি করে সেলুনের পাশের অন্ধকারে গা ঢাকা দিলাম। কুকুরটা ডেকেই চলেছে, শেকলের ঝাঁপটা ঝাঁপটি আমার কানে এসেছিল।

কুকুরটাকে এড়াতে সেলুনের পেছন দিকটা চলে গেলাম। ভাগ্য ভালো, সেখানে একটা সরু গলি ছিল। গলিটা বড় রাস্তার সমান্তরাল। ওটা ধরে দু-তিন মিনিট জোর কদমে হাঁটতেই শেরিফের দপ্তরের একেবারে সামনা-সামনি পৌঁছে গেলাম।

জানলার ওপর একটা আলো আসছিল। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম।

দীর্ঘকায় চেহারার এক লোক একরাশ ছাপা ফর্ম টেবিলে ছড়িয়ে বসেছিল। পাইপের নীল ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে আসছিল আমার মাথার ওপর।

সরে এলাম ওখান থেকে। বাড়িটার ঠিক শেষ প্রান্তে জেলখানা, তার নীচে একটা কাঠের নীচু কেবিন। আরো কিছু দূর এগিয়ে যাবার পর দরজার ওপরে সাদা অক্ষরে লেখা মর্গ চোখে পড়লো।

বাড়িটা ঘুরে পেছন দিকটায় চলে এলাম। একমাত্র জানালাটায় শার্টার লাগানো। ভেতরে কোন আলো জ্বলছিল না। শার্টারের ওপর কিছুক্ষণ কান পেতে বুঝতে পারলাম, ভেতরে কেউ নেই। এগিয়ে গিয়ে দরজার তালাটা পরীক্ষা করলাম, ওটা খোলা আমার কাছে কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। সঙ্গে করে আনা লোহার চালো টুকরোটা দিয়ে নিমেষের মধ্যে খুলে ফেললাম ওটা। তারপর পকেট থেকে টর্চ বার করে আস্তে আস্তে দরজাটা ঠেলা দিলাম। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে উঠল পাল্লা দুটো। চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে শেরিফের ঘরের জানলাটা একবার দেখে নিলাম।

নাঃ, এদিকে কারো চোখ নেই। সন্তর্পণে আলো জ্বেলে ভেতরে পা বাড়ালাম।

একটা চাকা লাগানো স্ট্রেচার দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো। আসবাব বলতে একটা টেবিল, একটা চেয়ার আর টেলিফোন। আমার ঠিক বিপরীতে অন্য একটা ঘরের দরজায় সাদা এনামেল রঙ করা একটা ফলকের ওপর লেখা : শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষ। কাছে গিয়ে হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম। অন্ধকার ঘরটার ভেতর থেকে বীজাণুনাশক ওষুধের গন্ধ ভক্ করে এসে লাগল আমার নাকে। টর্চের আলো ফেলতে চোখে পড়ল, সাদা কল লাগানো একটা গভীর জলাধার, আলো বসানো একটা অপারেশন টেবিল আর তার পাশে অন্য দুটো টেবিলের একটার ওপর চাদর ঢাকা একটা মৃতদেহ। আমি সেদিকেই এগিয়ে গেলাম। উত্তেজনায় ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছিল আমার। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনরকমে চাদরের একটা কোণ উঠিয়ে টর্চের আলো ফেললাম।

শুয়ে আছে সুসান গেলার্ট। নিথর বিষণ্ণ মুখটা এখন ফ্যাকাশে, বরফের মতো সাদা হয়ে আছে।

হ্যাঁ, এ যে সুসান এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। চেহারাটা ওরই মতো, কোঁচকানো সোনালী চুলের বাহারও একই রকমের। চাদরটা একটু নীচে টানলাম। ডান দিকের স্তনের ওপর গাঢ় লাল রঙের ছোট্ট একটা জন্ম চিহ্ন। কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে মনে করতে চেষ্টা করলাম, এর আগে ওটা কোথাও দেখেছি কিনা। প্রথমবার কোরিনের সঙ্গে দেখা হবার সময় ওটা কী আমার নজরে এসেছিল? যে জামা ওর পরনে ছিল তাতে ওটা কখনও আড়াল করা যাবে না। স্টেজে সুসানের নাচ দেখার সময়েও এটা আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেনি। অবশ্য ছোট্ট এইটুকু চামড়ার দোষ খুব সহজেই প্রসাধনের সাহায্যে লুকিয়ে ফেলা যায়।

প্রমাণের দিক দিয়ে চিন্তা করলে এই জন্মচিহ্নটাই সামনে শায়িত এই মেয়েটাকে সুসান বলে সনাক্ত করার পক্ষে যথেষ্ট।

আঙুলের ছাপ নেওয়ার সমস্ত সরঞ্জামই সঙ্গে মজুত ছিল। মেয়েটার শীতল হাত থেকে চটপট ছাপ তুলে নিলাম। এক নজরে পরীক্ষা করে মনে হল, পলিসির ছাপটার সঙ্গে এর কোন তফাৎ হবার কথা নয়।

সরঞ্জামগুলো একে একে পকেটে রাখতে গিয়ে মন কেমন বেদনায় ভরে উঠল। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটা সুসান গেলার্ট নয়, কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

চাদরটা টেনে দিয়ে নিঃশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। হাতলটা ঘোরাতে গিয়ে সহসা একটা ক্ষীণ শব্দ ওপাশ থেকে কানে এল। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। কানদুটো সজাগ আর হৃৎপিণ্ড ডাঙায় তোলা জ্যান্ত মাছের মতো ছটফট করতে লাগল।

কিন্তু না, আর কোন শব্দ নেই। তবু আমার স্থির বিশ্বাস, এবাড়িতে আমি আর একা নই।

টর্চ নিভিয়ে, সন্তর্পণে দরজা খুলে, কান দুটো সজাগ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বেশ কয়েক মুহূর্ত। এবারও কিছু হলো না। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের একটা দেয়াল শুধু আমার সমুখে। সবটাই আমার কল্পনারই একটা অঙ্গ বলে মনকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বিপদের অনুভূতিটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। আমার ঠিক পেছনে সুসান-গেলার্টের কথা মনে হতেই একটা কনকনে শীতল হোত নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। অতি সন্তর্পণে বাইরের ঘরটায় দু পা এগোলাম। আর সেই সময়েই ঘটে গেল অঘটন। আমার ডানদিকে কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখে আমি এক ঝটকায় ছিটকে একপাশে সরে দাঁড়ালাম।

সহসা একটা ঠাণ্ডা ধাতব বস্তু চড়চড় করে কোটটা ছিঁড়ে আমার হাতটা চেঁচে দিয়ে গেল। তার পরই সামনে থেকে কারুর চাপা গর্জন শুনে ঘামতে শুরু করে দিলাম আমি। মুখের ওপর কয়েকটা হাতের স্পর্শও অনুভবে এল। কাল বিলম্ব না করে মাথা নুইয়ে, দু-হাত বাড়িয়ে,ঝাঁপিয়ে পড়লাম সামনে।

একটা শক্তিধর পেশীবহুল দেহের ওপর আছড়ে পড়লাম। ইস্পাতের কঠিন ফলা কোটে বিধে পাঁজরে খোঁচা মেরে বসল। আমি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ঘুষি চালালাম, ধপ করে গিয়ে লাগল একটা মুখের ওপর। অশ্রাব্য খিস্তি বেরিয়ে এল লোকটার মুখ দিয়ে। একটা ছুরি সশব্দে মাটি স্পর্শ করল। এরপরই সবল দুটো হাত আমার বুক হাতড়ে গলার কাছে এগিয়ে এল। মরিয়া হয়ে ঘুরে গিয়ে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ওপর চেপে বসল কোন একজনের হাঁটু।

দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগার আমার। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মোটা-লোমশ দুটো হাত গলা থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম… কিন্তু কিছুতেই সফল হলাম না। সাঁড়াশির মতো আঙুলগুলো গলাটাকে আটকে রেখেছে। কানের ভেতর কেউ যেন দামামা বাজাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম অবশ হয়ে আসছে সারা শরীর, ক্ৰমে চেতনাও হারাতে বসেছি আমি। গলার চাপটা সহ্য করা সত্যিই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। সরল হাতের অধিকারী লোকটি নিঃসন্দেহে ষাঁড়ের মতো শক্তি তার।

আমি আবার ঘুষি চালালাম। কাঁচের জানালায় তুষারের আঘাতের মতো মুখে গিয়ে আঘাত করল ওটা।

অন্ধকারটা আমার চোখে জ্বলন্ত লাল গোলার মতো লাগছিল। হাত উঠিয়ে আমি আবার অন্ধকারে আঘাত হানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওটা যেন সীসের মতো ভারী হয়ে উঠেছে এখন। চিৎকার করতে চাইলাম। জ্বলন্ত গোলাটা যেন সশব্দে মাথার মধ্যে ফেটে আমার এই পৃথিবীটাকে স্তব্ধ করে দিল, সেইসঙ্গে অন্ধকারেও ঢেকে দিল।…

.

হুইস্কির বোতলটা আমার দিকে ঠেলে দিল শেরিফ। তার হালকা রঙের নীল চোখ দুটো একবারের জন্যও আমার মুখ থেকে সরছিল না।

এক চুমুক দাও। এখন নিজেই নিতে পারবে।

বোতলটা তুলে ঢেলে দিলাম গলায়, বেশ খানিকটা। স্বাদ ঠিক দুধের মতো।

তোমার ভাগ্য ভালো যে আমি সময়মতো ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। টেবিলে পড়ে থাকা একটা পাতলা ফলাওয়ালা ছোরার দিকে মাথা নেড়ে দেখালো শেরিফ। লোকটা যে ঘুঘু আসামী তাতে কোন ভুল নেই।

তাই হবে।স্ব র ভেঙে গেল আমার, বিধ্বস্ত কণ্ঠের যন্ত্রণা চাড় দিয়ে উঠল। আপনি দেখেছেন তাকে?

নাঃ, আমার পায়ের শব্দ পেয়েই সেখান থেকে হাওয়া হয়ে যায় সে। এত তাড়াহুড়ো করে আসতে হয়েছিল যে বন্দুকটা পর্যন্ত আনতে ভুলে গেছি।

আর এক ঢোক গলায় ঢালোম। আমি জানি প্রশ্নবাণ শুরুর মুহূর্ত এখন আগত, অথচ শরীরের এই রকম অবস্থায় বিশ্বাসযোগ্য একটা কাহিনী ফেঁদে বসব তাও এখন মাথায় আসছে না। তবে বুঝতে পারছিলাম, আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়ল মারলাম অর্থাৎ নিজের বারোটা নিজের হাতেই বাজালাম।

এর ওপর ম্যাডক্সও ফেঁসে গেল। সম্পূর্ণ রূপে আশ্বস্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাকে রেহাই দেবার পাত্র এ লোক নয়। জ্ঞান ফেরার আগেই সে আমার পকেটে তল্লাশী চালিয়েছিল। আমার মানিব্যাগ, লাইসেন্স, পরিচয়পত্র…সবই টেবিলের ওপর ছড়ানো। অর্থাৎ আমার পরিচয়পত্র তার কাছে ফাঁস হয়ে গেছে।

শোনো হে ছোকরা, হালকা কণ্ঠে বলে উঠল শেরিফ। তোমাকে আমি এখুনি জেলে ভরে দিতে পারি আমি জানি তুমি ওখানে কোন উদ্দেশ্য নিয়েই হাজির হয়েছিলে বলল এবার সেটা কী জন্যে? মেয়েটাকে সনাক্ত করতে?

হ্যা!

 ওকি তোমাদের কোম্পানিতে ইনসিওর করিয়েছিল?

শুনুন শেরিফ, জোর করে সাহসে ভর করে আমার বলা শুরু করি। আমি বিরাট এক ঝামেলায় পড়ে গেছি। ঐ মেয়েটা আমাদের নিকট ইনসিওর করিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাছে ওটা জালিয়াতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের অনুমান ওকে হত্যা করা হয়েছে। তাই এখানে এসে আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম যে, মেয়েটা সুসান গেলার্টই–তার যমজ বোন কোরিন কনি নয়। এখন সমস্যা একটাই–তা হল আমার এখানে আমার খবর যদি কোনভাবে বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাহলে শুধু আমাদের কোম্পানীনয় সেইসঙ্গে আরও নটা কোম্পানীর সবশুদ্ধ দশলক্ষ ডলার একেবারে চলে যাবে।

ঠোঁট চেটে হালকা ভাবে শি দিয়ে উঠল শেরিফ। তারপর নড়ে চড়ে বসল, ব্যাপারটা একটু খুলে বলল দেখি! আমি এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারি কিনা।

লোকটার নম্র আচরণ দেখেও বিচলিত হলাম না। আমি জানি বলতে আমাকে হবেই, না হলে এর থেকেও আরও ভয়ঙ্কর ঝামেলার মধ্যে জড়িয়ে পড়ব। অগত্যা তার কাছে সব খুলে বললাম, এর মধ্যে জোইস শ্যারম্যানের অন্তর্ধাণের কথাটাও বাদ পড়ল না।

এক নাগাড়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বিনা মন্তব্যে সবটা শুনে গেল শেরিফ, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমিও তোমার সঙ্গে একমত যে ব্যাপারটা সুবিধের নয়, কিন্তু তুমিও ভুল পথে পা বাড়িয়েছ। মেয়েটার নিছক দুর্ঘটনাতেই যে মৃত্যু হয়েছে, তার মৃত্যুতে যে কারো হাত নেই, এ সন্দেহ মেটাতে আমাকে বহু পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কনি যখন জানাল, ওকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, আমার প্রথমে সন্দেহটা তার ওপরে গিয়েই পড়েছিল এই ভেবে সেই ওকে খুন করেছে কিনা। ও লোকটাকে আমার দুক্ষের বিষ। ভয়ঙ্কর বদ-চরিত্রের লোক। তাড়াহুড়ো করে তক্ষুণি দ্বীপে ছুটে গিয়েছিলাম। ওখানে যা যা ছিল সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে। মইটাসে যা বলেছিল, তার কথাটা ঠিক। একদম ভাঙাচোরা। এই মইয়ের একটা পায়া ভেঙে যেতে যত বিপত্তি। জানালার ভাঙা কাঁচগুলো দেখেছিরক্তে সব একেবারে মাখামাখি আর কেবিনের বাইরে যে পায়ের ছাপগুলো ছিল সেগুলো হয় কনির নয়তো এই মেয়েটার।

আর এখানে সবাই এটাই দুর্ঘটনা বলে প্রমাণও করে দিচ্ছে। মারা যাবার সময় মেয়েটা এই দ্বীপে একাই ছিল। ডাক্তারের কথামতো তার মৃত্যু হয় বেলা তিনটে নাগাদ। এদিকে কনি দ্বীপ থেকে হোটেলে এসে পৌঁছেছিল বেলা দশটায়। জ্যাক ওকলে নামে একটা লোক তখন থেকে সেই বিকেল পর্যন্ত ডেড লেকে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ ধরেছে। জ্যাক কনিকে সে দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিল।

আর কনি নাকি দ্বীপে ফিরে দু-মিনিটের মধ্যে আবার মোটরবোট নিয়ে এপারে চলে আসে। তখন সে মেয়েটার মৃতদেহ দেখতে পেয়েই সরাসরি আমার কাছে এই খবর দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছিল। আমি যখন লোকজন নিয়ে সেখানে পৌঁছই, ওকলে তখনও স্থির চোখে তাকিয়ে আছে দ্বীপের দিকে। এরমধ্যে কাউকেই সে ওখান থেকে ফিরে আসতে দেখেনি। আর আমরাও দ্বীপটা তন্ন তন্ন করে খোঁজ করেও কারুর দেখা পাইনি। তাই খুন করার যে চিন্তা তোমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, সেটাকে তুমি অনায়াসেই ঝেড়ে ফেলতে পার।

আমি দুঃখিত–আপনার কথাটা মানতে আমার একটু আপত্তি আছে,গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠি। খুনটা সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু কীভাবে এটা সংঘটিত হল এটা ঠিক আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

বিচিত্র এক অঙ্গভঙ্গিমা করে উঠল শেরিফ। দেখো–প্রমাণ করাতে পারে কিনা। কিন্তু এও বলে রাখি, ওকলের কথা শোনার পর কোন জুরিকে তুমি ও-কথা বিশ্বাস করাতে কখনোই পারবে না।

ধরে নিন, কনিই যদি তাকে ঠিক করে থাকে আপনাকে ওসব বলার জন্যে?

সে দুচক্ষে দেখতে পারে না, আর ও প্রকৃতই সাদা লোক। তাকে দিয়ে ও কাজ করানো সম্ভব নয়।

একটু ইতস্ততঃ করে বলে উঠলাম, আচ্ছা, আমি যে এখানে এসেছিলাম, আপনি কী তা জানিয়ে দেবেন? বুঝতেই পারছেন, আমি কী রকম ঝামেলার মধ্যে জড়িয়ে গেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কনিকে ফাঁসানো, এখন সে যদি কোনভাবে প্রমাণ করে দিতে পারে, আমি এখানে মেয়েটাকে সনাক্ত করণের জন্য এসেছিলাম, তাহলে পরিবর্তে সেই আমাদের ফাঁসিয়ে দেবে।

সহানুভূতির হাসি হাসল শেরিফ। সাধারণতঃ আমি নিজের চরকাতেই তেল দিয়ে থাকি, তবে আমায় যদি সমন দিয়ে কোর্টে নিয়ে গিয়ে শপথ করানো হয়, আমি কিন্তু আসল ঘটনাই বলতে বাধ্য হবো।

আমি জানি, মর্গে কনিই আমার ওপর চড়াও হয়ে ছিল। সম্ভবতঃ চিনেও ফেলেছে আমাকে। তাই শেরিফকে সে কোর্টে টেনে নিয়ে যাবেই। অর্থাৎ নিস্তার আমার ভাগ্যে নেই, আবার করণীয়ও কিছু নেই। বললাম, ভগবানকে ডাকা ছাড়া এখান থেকে বেরোনোর কোন রাস্তা আমার জানা নেই, তিনি যদি কোন উপায় দেখাতে পারেন। আপাততঃ আর কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আগে আমি লস-এঞ্জেলেস-এ ফিরে যেতে চাই। যা করেছি তারজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

বেশ, এবারের মতো আমি তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু এরপরে আর কখনও এমন কোন কাজ করতে যেও না যেন, মৃদু ধমক দেবার মতো সুরে বলে উঠল শেরিফ।

যাবার আগে আর একবার মেয়েটার দেহ দেখে যাবার ইচ্ছে আছে?

না, আর প্রয়োজন নেই। ওর কোন ছবি আপনার কাছে আছে? এই মুহূর্তে নেই, তবে কাল সকাল দশটা নাগাদ এসে যাওয়ার কথা। তোমাকে এক কপি পাঠিয়ে দেবো।

ওর বুকে যে জন্মচিহ্নটা আছে ওটা আমি ছবিতে একবার দেখতে চাই। একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?

কেন পারব না?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। আচ্ছা, চলি তাহলে।

হাত তুলল শেরিফ। এসো।

শেরিফের দপ্তর থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম আমি। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা একটাই, এই বুঝি কনি চড়াও হল। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না।…

পরের দিন বেলা এগারোটায় ফ্যান’শর দপ্তরে প্রবেশ করলাম আমি। ম্যাডক্স আর ফ্যান’শ নিজেদের মধ্যে কথোপথনে ব্যস্ত ছিল। আমি ঘরে পা রাখতেই ম্যাডক্স কটমট চোখে তাকাল।

কোন চুলোয় ছিলে এতক্ষণ? কাল থেকে গরু খোঁজা খুঁজছি তোমাকে!

মাপ করবেন। আমি এখানে ছিলাম না, স্প্রিংভিলেতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এমন কিছু একটা হাতে আসবে যাতে এই কেসটায় একটু আলো দেখতে পাই, কিন্তু পেলাম না। তার পরিবর্তে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে গেল।

আমি ভাবলাম, ম্যাডক্স বোধহয় ক্রোধে ফেটে পড়বে, কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না। নিশ্চল হয়ে বসে রইল, তার চোখ দুটো গ্রানাইট পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠল। সামান্য হলেও রক্তাভা বহিঃপ্রকাশ করল তার মুখে, তবু নিজেকে সংযত রাখল।

তাতে করে ক্ষতির পরিমাণ কতটা? ঝাঁকালো কণ্ঠে বলল সে।

ক্ষতি হওয়া যতটা সম্ভব, ততখানি।

স্থির হয়ে বসে আমায় সব খুলে বল।

একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে আমি আদ্যপান্ত খুলে বললাম। আমার কথা শেষ হবার পর ম্যাডক্স বলে উঠল, হু, আশাকরি তোমার সন্দেহ এখন মিটেছে। তবে আমার যা মনে হচ্ছে, ওরা তোমার জন্যই ফাঁদটা পেতে রেখেছিল, আর তুমি উজবুকের মতো সোজা করে তাতে ধরা দিয়েছে।

তাই হবে বোধহয়। আমি ঘামতে শুরু করেছিলাম। আমি জানি ম্যাডক্সের কাছে ক্ষমা চেয়ে আজ আর কোন লাভ নেই, ওসবের সে ধার ধারে না।

চুরুটটা তুলে নিয়ে একটা প্রান্ত কামড়ে বসল ম্যাডক্স।গুডইয়ার রিজাইন দিয়েছে, শুনেছো?

বলেছিল দেবে।

 সত্যি বলতে কি, সে চলে যেতে আমি সুখী-ই হয়েছি। ভালো সেলসম্যান সে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার বিচারবুদ্ধির কোন ক্ষমতা নেই। তুমিও ঠিক তাই।

তাহলে আমিও না হয় কাজ ছেড়ে দিচ্ছি।

আমার অনুমান ছিল একথা শোনার পর ম্যাডক্স প্রতিবাদী কণ্ঠে গর্জে উঠবে, কিন্তু তাহলো না। চুরুট জ্বালিয়ে প্রায় মিনিট দুই সে ছাদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ নত করে ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করল, তোমার কাজের দরুণ আমাদের হয়তো একলক্ষ ডলার জলাঞ্জলি যেতে বসেছে। অন্য নটা কোম্পানিও হয়তো একই অবস্থার মুখোমুখি হবে। ভুলটা তোমার অসাবধানতার জন্য হয়নি এটা তোমার নিরেট মস্তিষ্কের দায়িত্বজ্ঞানহীন মূর্খতার, ফল। তোমাকে আমি অনেক আগেই সাবধান করেছিলাম এ ব্যাপারে নাক না গলাতে, কারণটাও বলেছিলাম–একবার নয়, কমপক্ষে বারংবার। তা সত্ত্বেও তুমি নিজের অপদার্থতা প্রমাণ করার জন্য সেখানে হাজির না হয়ে পারলে না। তাই তোমাকে যদি এই মুহূর্তে আমি বরখাস্ত করি, সেটা নিশ্চয়ই আমার দিক থেকে কোন অন্যায় হবে না। যাইহোক, সমস্ত ব্যাপারটা আমি ঐ নটা কোম্পানিকেই জানিয়ে দিতে চাই–কারণ তদন্তের সম্পূর্ণ দায়িত্বটা সবার হয়ে আমি আমার কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। সম্ভবতঃ তারাও আমাকে এই প্রস্তাব করবে, তোমাকে এখান থেকে বিতাড়িত করার অভিপ্রায়ে। এবার তোমার যদি কিছু বলার থাকে বলো।

কাজ ছেড়ে চলে যাবো আর কী করতে পারি?

আমাকে শ্যেনভরা দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে নেয় ম্যাডক্স। তুমি ঠিক জানো, তোমার করণীয় আর কিছুই নেই।..ঝামেলাটা যখন তুমিই সৃষ্টিকরেছ, তখন পারো না সেটার জাল থেকে আমাদের ছাড়িয়ে আনতে?

সেরকম কোন সম্ভাবনা থেকে থাকলে আমি নিজেই সে কথা বলতাম। মনে হয় এ রহস্যের মীমাংসা করতে গেলে আমার থেকেও উন্নত মস্তিষ্কের চতুর কাউকে আপনার প্রয়োজন।

সাত বছর তুমি আমার হয়ে কাজ করছে, হারমাস, ম্যাডক্সের কণ্ঠস্বর এখন অনেক নরম। এখন পর্যন্ত তোমার কাজে কোন ত্রুটি আমার চোখে পড়েনি। যাইহোক, আমি কী করতে চাই একবার শোনো। আমি তোমার একমাসের সবেতন ছুটি দিচ্ছি। এরমধ্যে তুমি কোথায় যাবে বা কী করবে, সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তবে এই কেসটার যদি কিনারা করতে পার, তাহলে তোমার চাকরি যথারীতি আগের মতো বহাল থাকবে, এ প্রতিশ্রুতি আমি তোমায় দিচ্ছি। কিন্তু তা যদি সম্ভব না হয়, তোমার ফিরে আসার আর কোন প্রয়োজন নেই।

ওলে জ্যাকসন আমাদের আর এক গোয়েন্দা। সে নিজেকে অতি মাত্রায় চালাক মনে করলেও, আমি জানি সে আসলে একটা আস্ত গবেট।

কঠিন কণ্ঠে বলে উঠি, তার মানে জ্যাকসনকে আমার জায়গায় বহাল করছেন?

জ্যাকসন আদেশ মেনে কাজ করে, হারমাস। হ্যাঁ, তাকেই আমি কাজটা দিচ্ছি। কেসটা তুমি যদি নিজে থেকে সমাধান করতে পারো, তাহলে জানবে ভাগ্য তোমার প্রতি সদয়। কিন্তু আমাদের একজন বিশ্বস্ত গোয়েন্দাকে এ কাজে লেগে থাকতে হবে। আর জ্যাকসনের মধ্যে সেই সুপ্ত প্রতিভা আছে, সে নিঃসন্দেহে একজন বিশ্বস্ত লোক।

কাগজটা আমি সজোরে টেবিলে ছুঁড়ে মারলাম। এটা রেখে দিন, নাক মোছর কাজে এটা কাজে আসবে। এই চাকরির আমার প্রয়োজন নেই। আমি চললাম।

গটমট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দড়াম করে দরজাটা মুখের ওপর বন্ধ করে দিলাম।