০৬. এক নাটকীয় ঘটনা

০৬.

চিত্রজগতে জোইস শারম্যানের উত্থান এক নাটকীয় ঘটনা। শোনা যায়, তিনবছর আগে সে ছিল ম্যান করনাডিনের এক ছোট্ট হোটেলের অ্যাপ্যায়িকা। এসময় পেরি রাইস নামে প্যাসিফিক পিকচার্সের সুদক্ষ এক পরিচালকের নজরে সে পড়ে যায়। রাইসের তখন বাজার মন্দা। অযোগ্যতার অজুহাতে ফিল্ম জগৎ থেকে বিতাড়নের মুখে এসে মুখ থুবড়ে সে পড়েছিল। জোইস শারম্যানের সঙ্গে দেখা হবার আগে পর্যন্ত তার ভবিষ্যত ছিল অন্ধকারের মোড়কে মোড়া।

যোগ্যতা থাক বা না থাক জোইসকে এক দেখাতেই বিচক্ষণ রাইসের বুঝতে অসুবিধে হয়নি, মেয়েটার মধ্যে নায়িকা হবার প্রতিভা আছে। তাই অভিনেত্রীহিসেবেওর যাবতীয় অধিকার নিজের হাতে তুলে নিতে দেরি করেনি। এরপর প্যাসিফিক পিকচার্সকে দিয়ে জোইসের একটা স্ক্রিন টেস্ট করাতেও তাকে কোনরকম বেগ পেতে হয়নি। এই পরীক্ষায় জোইস সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছিল।

এক রোমাঞ্চকর কাহিনীর উপনায়িকা হিসেবে জোইসকে প্রথম সুযোগ দেওয়া হয়, এতেও সে এমন দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে যে নায়িকার ভূমিকাও সেখানে ম্লান হয়ে যায়। প্যাসিফিক পিকচার্সের প্রধান, হাওয়ার্ড লয়েড প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাকে দিয়ে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে একটা ছবির নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব করে।

প্রস্তাব যেদিন আসে, সেইদিনসকালে পেরি-রাইস প্যাসিফিক পিকচার্সের কাজ ছেড়ে জোইস শারম্যানের এজেন্ট এবং ম্যানেজার হিসেবে লয়েডের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে। লয়েড অবশ্য তার এই আচরণে ক্রোধে-উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল।

তারপর বন্ধ দরজার ভেতর বেশ কয়েকঘন্টা ধরে চলতে থাকে রাইস আর লয়েডের দর কষাকষি। অবশেষে যে চুক্তিপত্র সই হয় তা আজও হলিউডের আলোচনার অন্যতম বিষয়।

রাতারাতি হলিউডের সব চাইতে নামী অভিনেতা হয়ে ওঠে জোইস শারম্যান।

এক সপ্তাহ পরেই রাইস নিজের এই দুর্লভ সম্পত্তিকে সুরক্ষার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়, তাকে বিবাহ করে স্ত্রীর যোগ্য সম্মান দেয়।

শুধু অভিনয় ক্ষমতা নয়, জোইস শারম্যানের দৈহিক সম্পত্তিও ছিল চিত্রতারকা হবার উপযুক্ত। তার আগুনরঙা কেশ (ড্রাই করা) আর আয়ত চোখ দুটো (নকল বলে অনেকের সন্দেহের বিষয়বস্তু) ছিল নারী-পুরুষ উভয়ের কাছেই আকর্ষণীয় বস্তু। শরীরের গড়ন ছিল যেমনি নিখুঁত, তেমনি যৌন আবেদনেও শরীর ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

.

 ফ্যান’শর দপ্তরে ম্যাডক্সকে দেখতে পেয়ে আমি অবাক। তার পাশেই ছিল গুডইয়ার। তাকে দেখে খুশীর পরিবর্তে কেমন মনমরা লাগছিল।

ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করতে করতে ঘরময় পায়চারি করে ফিরছিল ম্যাডল। আমাকে দেখেই সে আমার ওপর রাগে ফেটে পড়ল,কোন চুলোয় ছিলে তুমি, আঁঃ, একঘণ্টা ধরে আমি তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।

প্রতীক্ষার অবসান,এই তো এসে গেছিএকটা চেয়ার টেনেবসতে বসতে বললাম। গুডইয়ারের দিকে একবার মাথা নেড়ে সহজ করে প্রশ্ন করে বসি ম্যাডক্সকে, কি ব্যাপার বলুন, শুনি?

ব্যাপার? ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমার দিকে মুখ করে দড়াম করে টেবিলে ঘুষি মেরে বসল ম্যাডক্স।

ব্যাপার কিছুনা। আমরা এক হতচ্ছাড়ি ফিল্ম অ্যাকট্রেসকে দিয়ে পলিসিকরিয়েছিলাম, যাকে কিডন্যাপ করা হলে মুক্তিপণ দিয়ে আমরা তাকে ছাড়িয়ে নেবো। আর তিন হপ্তা পার হতে না হতেই সেই মাগীকে কারা যেন তুলে নিয়ে গেল। কিছু বুঝলে? এই ব্যাপার।

পলিসিটা করার সময় আপনি তো এসব কিছুই বলেননি,গোবেচারার মতো মুখের ভাবফুটিয়ে গুডইয়ার বলে উঠল। আমিই বা কেমন করে জানবো…

আর এসবের মধ্যে একদম নাক গলিওনা,হুঙ্কার দিয়ে বসে ম্যাডক্স। পলিসিটা করিয়ে তুমি আমাদের ক্ষতি যা করার ছিল তা করেই দিয়েছ।

এক মিনিট, উত্তেজিত কণ্ঠে বাধা দেয় ফ্যান’শ। আমি কিন্তু এসব শুনতে ইচ্ছুক নই। অ্যালনের কাজই হলো পলিসি করানো। ওটুকু না করলে আমরা ওকে চাকরিতে কখনোই রাখব না। ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলার কোন অধিকার আপনার নেই।

 কি একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল ম্যাডক্স, ফ্যানশুর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অপেক্ষাকৃত কোমল স্বরে গুডইয়ারকে বলে উঠল, ঠিক আছে, ওসব স্মরণে না রাখাই ভালো। আমার মাথার ঠিক ছিল না, আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।

যাক বাদ দিন ওসব,গুডইয়ার বলল, মুখে বলল বটে দেখে কিন্তু তাকে খুশী লাগছিল না।

এবার আমি মুখ খুললাম, আপনি বরং পুরো ঘটনাটা আমাদের খুলে বলুন। কিডন্যাপ হয় ঠিক কখন?

আজ থেকে তিনদিন আগে,ফ্যান’শবলল। কিন্তু পলিসির কথা ওরা সবেমাত্র জেনে থাকবে। আর এখনও কিডন্যাপের খবরটা স্টুডিওর লোকজনের কানে তোলা হয়নি। সেদিন ডিনারেরপর কাউকে কিছু না বলে মেয়েটা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যায়। রাত দুটোর পরে ও ফিরছে না দেখে রাইস চিন্তিত হয়ে পড়ে। অবশ্য রাইসের মতো মাথা মোটা এক গাড়োল কারুর জন্য চিন্তা করবে একথা আর কেউ বিশ্বাস করলেও আমি করব না।

যাইহোক, ওর বক্তব্য অনুযায়ী জোইসের ফিল্ম লাইনের বহু বন্ধুর সঙ্গে সে ফোনে যোগাযোগ করেছিল, তাঁরা কেউই ওর সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেনি। এরপর পুলিস হেড কোয়ার্টারে খবর আসে, যে, ফুটহিল বলে ভার্দের কাছাকাছি একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। গাড়িটা জোইস শারম্যানের আর তার উইন্ডস্ক্রিনের ওপর রাইসের নাম লেখা একটা খাম আটকানন, তাতে লেখা ছিল-মিস শারম্যানকে কিডন্যাপ করা হয়েছে আর মুক্তিপণ আজই দাবি করা হবে।

দাবি করা হয়েছিল কি?

 না। এর অর্থ দাঁড়ায় এইমুহূর্তে আমাদের গাঁট থেকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড খুলতে হবে। মিস শারম্যানের কোন সন্ধান করতে না পারলে এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

ম্যাডক্স নাক টেনে বিশ্রী এক শব্দ করল, তার এই শব্দে কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাল না।

কোন সূত্র-টুত্র পাওয়া গেছে কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম। না–পুলিশ এ ব্যাপারে বেসরকারী তদন্ত শুরু করেছে। রাইসের মনোগত ইচ্ছা নয় যে তারা এব্যাপারে নাক গলাক। সে বলেছে, স্ত্রীকে ও জীবন্ত ফিরে পেতে চায়, আর যতক্ষণ না সে ফিরে আসছে, হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। তার মানসিক অবস্থা আমি অনুমান করতে পারি। চিঠিতে স্পষ্ট লেখা ছিল, পুলিসকে যেন খবর না দেওয়া হয়, ক্ষতিটা তাহলে মিস শারম্যানকেই ভুগতে হবে।

ম্যাডক্স অনেকক্ষণ ধরেই কিছু বলার জন্য উসখুস করছিল, এবার সুযোগ বুঝে ফ্যান’শর কথার মাঝে ঢুকে পড়ে, আমি চাই তুমি এখুনি শারম্যানের বাড়িতে চলে যাও। যদিও এই আমরাই তোমায় লাগাচ্ছি, তবু পুলিশের দিক থেকে সব রকমের সাহায্যই তুমি পাবে। তাদের সঙ্গে কথা আমার হয়ে গেছে, সেইসঙ্গে তোমার সুযোগ-সুবিধার সব রকমের ব্যবস্থাও সেরে রেখেছি।

বেশ। ফ্যান’শর দিকে ঘুরলাম। একটা কথা ছিল আমার। রাইসকে তুমি গাড়োল বললে কেন?

আমার বলাতে একটু ভুল হয়ে গেছে। দুশ্চরিত্র কথাটার ওর আচরণের সঙ্গে বেশি মানায়। আজ পর্যন্ত তিনমাসের বেশী একটা দিনও কাউকে নিয়ে ঘর করেনি। মেয়েদের নিয়ে বহু কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে তার নামে শোনা যায়–সব ব্যাপারগুলোই সে দক্ষতার সঙ্গে যে ভাবেই হোক ধামাচাপা দিতে পেরেছে।

বর্তমানে সে লজ্জার মাথা খেয়ে স্ত্রীর রোজগারের টাকায় বসে বসে খাচ্ছে। আর বিয়ের আগেই সে যখন একটা চুক্তি তাতে সই করে নিয়েছিল, জোইস এখন তাকে ছেড়েও যেতে পারছে না।

গুডইয়ারকে প্রশ্ন করলাম, রাইসের সঙ্গে পলিসিটার কোন সম্পর্ক আছে কী?

গুডইয়ার মাথা নাড়ল, না, কিছুই নেই। বরং মিস শারম্যানই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল কথাটা যাতে তার কানে না পৌঁছয়।

রাইস ওটা পরেও শুনে থাকতে পারে নাকি?

তা কী করে সম্ভব? ওটা মিস শারম্যানের উকিলের অফিসে সই করানোর পরে তারই দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। মিস শারম্যান কিডন্যাপ হবার পর সেই ভদ্রলোকই আমাদের নিকট টাকা দাবি করেছেন।

উকিলের নাম?

লিও সিমান,ফ্যান’শবলে উঠল। উনি এখানকার এক নামজাদা আইনজীবী। রাইস পলিসি সম্বন্ধে আগে বিন্দুবিসর্গ জানত না, সব শুনে এখন আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

ঠিক আছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি ওখানেই যাই তাহলে।

আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো, ম্যাডক্স বলল। আমি সানফ্রান্সিসকো ফিরে যাচ্ছি। খবর থাকলে আবার আসব।

গেলার্টের কেসটা শুনে যাবেন নাকি একবার?

ঘড়ি দেখল ম্যাডক্স। গণ্ডগোলের কিছু না থাকলে এখন তাহলে থাক। আমাকে এক্ষুণি প্লেন ধরতে হবে। আমাদের বর্তমানে আলোচনার বিষয়বস্তু শারম্যান, তার কেসটা নিয়েই মাথা ঘামাবো। গেলার্টের ব্যাপারে কোন দাবি এলে তখন না হয় দেখা যাবে।

গুডইয়ার আর আমি দপ্তর থেকে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে গুডইয়ার বলে উঠল, শালা কী কপাল করেই না জন্মেছি আমি!

তোর এত চিন্তার কি আছে? আমি ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি। এতে তোর দোষটা কোথায়?বলতে হয় তাই ম্যাডবলেছে।তাছাড়া তোর তোঅজানানয়, এরকম আমাদের লাইনে হয়েই থাকে।

তা জানি, কিন্তু আমার দু-দুটো এরকম শোচনীয় ফল হলো, তাই ভাবছিলাম। যাকগে, মিস গেলার্টের সঙ্গে দেখা করে কিছু পেলি?

ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ি। নাঃ, কাজে আসে এমন কিছু নয়। আচ্ছা, তুই জানতিস, মেয়েটার একটা যমজ বোন আছে?

কই, নাতো! কেন, তার সঙ্গে কী সম্পর্ক?

সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। ওর বোন জ্যাক কনি নামে একটা লোককে বিয়ে করেছে। তার মাথায় বদমতলবের চাষ থাকলেও থাকতে পারে।

উত্তেজনায় হাত দুটো কাঁপিয়ে ওঠে গুডইয়ার, এ দোষটাও কী আমার?

আমি না হেসে পারিনা, আরে অত চটছিস কেন? সুসান গেলার্ট আর ডেনি দুজনকেই আমি দেখেছি। তোর জায়গায় আমি থাকলে, অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে পলিসিটা করিয়ে নিতাম। দুটো বোনকেই আমার খুব ভালো লেগেছে।

আমি জানতাম, তুই একথাই বলবি, জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে শুডইয়ারের সারা মুখ।

সত্যিই ওদের মতো সন্দেহ করার মতো কিছু নেই।

তুই মেয়েটার অভিনয় দেখেছিস?

নারে, একটুর জন্য দেখা হয়নি। কেমন? ভালো?

যে জায়গায় ও এখন শো করছে সেখানে সাড়া ফেলেছে, তবে নিউইয়র্কে ও জিনিস কখনোই চলবে না।

মেয়েটা প্রায় উলঙ্গ হয়েই একটা সাপ নিয়ে খেলা দেখায়।

হেলেনও তোর সঙ্গে কাজ করছে শুনলাম?

হ্যাঁ, অ্যানড্রুজ ওকে কাজে লাগিয়েছে। স্প্রিংভিলেতে কনিদের ডেরার দিকে ও সজাগ দৃষ্টি রেখে বসে আছে।

কনিরা আবার এর মধ্যে এল কী করে? গুডইয়ার অবাক।

সে আমারও জানা নেই। হেলেন লোকটাকে সন্দেহের চোখে কেন দেখছে একমাত্র ওর পক্ষেই বলা সম্ভব। সহসা একটা কথা মনে আসতেই প্রশ্ন করি, আচ্ছা, বার্নাড হফম্যান নামে তুই কোন লোককে চিনিস?

ভুরু কুঁচকে ওঠে গুডইয়ারের। নাম শুনেছি, কিন্তু চোখে দেখিনি কখনো। কেন?

গেলার্টের কেসে সেও কাজ করছে। লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, কিন্তু কিছুতেই জানতে পারলাম না কে ওকে এই কাজে লাগিয়েছে। তার সম্বন্ধে তুই কিছু জানিস?

চমকে উঠল, গুডইয়ার। তার চমকে ওঠা ক্ষণিকের এই দৃশ্যটা আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।

ও অতি সাধারণ এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ। লোক তেমন সুবিধের নয়।তুই ঠিক জানিস গেলার্টের ব্যাপারে সে তদন্তে নেমেছে?

শুধু এইটুকুই জানার পরিধির মধ্যে ছিল আমার, লোকটা পলিসিগুলো সম্বন্ধে আগ্রহী। দিন তিনেক আগে ডেনির অফিসে ঢুকে ওর সেগুলো দেখে আসাও হয়ে গেছে।

কেন? বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে গুডইয়ার।

মুখ খুলল না। তবে সুযোগ এলে তাকে একটু চাপ দিয়ে দেখব। আশা করি কথাটা আদায় করা আমার পক্ষে খুব সহজ না হলেও শক্ত হবে না।

গুডইয়ার ঘড়ি দেখাল, এবার চলি। অনেক দেরী হয়ে গেল। হফম্যানের সম্বন্ধে কিছু পেলে আমাকে জানাতে ভুলিস না, কেমন?

ওর কাছে বিদায় নিয়ে নিজের গাড়িতে চেপে আমি বেভারলি প্লেন বুল ভার্দের দিকে এগিয়ে চললাম।

জোইস শারম্যানের বাড়ি পৌঁছতে বহুক্ষণ স্টিয়ারিংহাতে বসে থাকতে হলে আমাকে। বাড়িটা সম্বন্ধে আমার প্রত্যাশার হুবহু মিল খুঁজে পেলাম। চলচ্চিত্র শিল্পীরা নিজেদের সাফল্য আর বিত্তশালীতার প্রমাণ স্বরূপ যে সকল জাকজমক প্রদর্শন করে থাকে তার সব উপকরণই অক্ষুণ্ণ ছিল বাড়িটায়।

ফ্লাডলাইটে আলোকিত সাঁতার দীঘি, চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ সাজানো বাগান,চওড়াচওড়া বারান্দা, লাউঞ্জে রাখা সারি সারি চেয়ার, ঝুলন্ত শয্যা, বিরাট বিরাট ছত্রছায়ায় নীচে আরামের সুব্যবস্থা–কোনটারই অভাব সেখানে পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। এর ওপর কমপক্ষে কুড়িটা ঘরওলা বিশাল অট্টালিকার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।

বাড়ির বাইরে পুলিশ পাহারা ছিল, কিন্তু পরিচয়পত্র দেখার পর ওরা আমায় বাড়ীর অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি দিল। বাড়ির সদর দরজাতেও বেশ কয়েকজন প্রহরী। ওখান থেকে একজন পরিচারক সঙ্গে করে আমায় লাউঞ্জে নিয়ে গেল। সেখানে পা দিতেই চোখে পড়ল, তিনজন পুরুষ আর এক তরুণী চাপা-স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল।

একজন পুরুষ আমাকে দেখে এগিয়ে এল। লোকটা ঢ্যাঙা, রোদে পোড়া লম্বাটে মুখ, টিকোলো চিবুক, পেনসিলের মতো সরু গোঁফ আর দাম্ভিক চোখ–সেই দৃষ্টিতে অবজ্ঞা ভরপুর। লোমশ হাতে ছিল সোনার একটা ব্রেসলেট।

ইনি যে পেরি রাইস তা বুঝতে আমার এতটুকু অসুবিধে হল না। জোইস শারম্যানের সঙ্গে এই ব্যক্তির অজস্র ছবি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চোখে পড়েছে। তবে আমার মনে হয়, তাকে ছবিতে দেখার চাইতে শরীরে দেখা বড় বেশী বিরক্তিকর।

আমি সর্বপ্রথম এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম আমি হারমাস-ন্যাশানাল ফিডালিটি কোম্পানি থেকে আসছি। ক্লেম ডিপার্টমেন্ট থেকে মিঃ ম্যাডক্স আমায় পাঠিয়েছেন।

আপনাদের অনেক সময় লেগে গেল, টেনে টেনে কথা বলে এই ব্যক্তি, আমরা তো আপনাদের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। যাই হোক; এসে যখন পড়েছেন। এদের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিই।..ইনি মিস মীরা ল্যাসটিস-আমার স্ত্রীর সেক্রেটারি।

মেয়েটা ঘুরে আমার দিকে তাকাল বটে তবে সে দৃষ্টিতে কৌতূহলের কোন চিহ্নই নেই। ছোটখাটো ঘনবর্ণের মেয়ে। দেখে মনে হয়, ওরশরীরে মেক্সিকান রক্ত থাকা কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। এরকম পরিস্থিতিতে ভদ্রতার খাতিরে লোকে যা বলে আমিও তাই বললাম, কিন্তু মীরা ল্যাসটিস তাতে উত্তর দেবার প্রয়োজনটুকুও অনুভব করল না।

ইনি মিঃ হাওয়ার্ড লয়েড।লম্বা,সাদা চুলওয়ালা লোকটা এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে করমর্দন করল। কৌতূহল চোখে তার দিকে তাকালাম। এনাম আমার খুব চেনা, কোথায় শুনেছি যেন।

প্যাসিফিক পিকচার্সের প্রধান, হাওয়ার্ড লয়েড পৃথিবীর অন্যতম ধনী হিসেবে জগৎ বিখ্যাত। লোকটার কোটরাগত দু-চোখের সন্ধানী দৃষ্টি আমাকে রীতিমতো বিব্রত করে তুলল।

আপনি আসায় খুশী হলাম, মিঃ হারমাস। গুরুগম্ভীর গলার স্বর লয়েডের, নীচু সুর বাঁধা। মনে হচ্ছে ভাগ্যদেবী আপনাদের ওপর সুপ্রসন্ন নন!

মৃদু হাসি হাসলাম আমি। আমাদের এই ব্যবসায় এরকম ঘটনা নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা লেগেই থাকে, এটা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়, মিঃ লয়েড।

আর ইনি মিকলিন–পুলিশ থেকে এসেছেন। ছোট আকৃতির বলিষ্ঠ লোকটার দিকে সামান্য মাথা ঝোকালাম আমি। জবাবে হাত মেলানোর কোন প্রচেষ্টাই তার দিক থেকে এলোনা।

এখনও পর্যন্ত কোন সংবাদ পাওয়া গেছে? আমি জানতে চাইলাম তার কাছে।

না। মুক্তিপণের অঙ্কটা শোনার প্রত্যাশায় আছি আমরা। ওটা না জানা পর্যন্ত আমাদের বিশেষ কিছু করণীয় নেই।

টাকা দেওয়ার দায়িত্ব যখন আপনাদের,রাইস নিজের সোনার সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট তুলে নিল, তাই আপনাদের পক্ষেই বলা সম্ভব। টাকা যোগাড় করতে কত সময় লাগবে?

সেটা নির্ভর করছে টাকার অঙ্কের ওপর,আমি যথা সম্ভবসংযত থেকে জবাব দিই। কিডন্যাপ যারা করে তারা কম মূল্যের নোটে টাকা দাবি করে থাকে, সাধারণতঃ এর জন্য অপেক্ষা করতেও ওরা প্রস্তুত থাকে।

ও আচ্ছা। সিগারেট ধরালো রাইস। তার ফ্যাকাশে চোখে দুটো আমার সর্বাঙ্গে যেন বিচরণ করতে লাগল।

বেচারি জোইসকে তাহলে ততক্ষণ ওদের কবলে আটক থাকতে হবে। টাকাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করে রাখলে আপনাদেরই ভালো।

ওরা কত টাকা দাবি করতে পারে আপনার এ সম্বন্ধে কোন ধারণা আছে?

 কটমট করে আমার দিকে তাকাল রাইস। সে আমি কেমন করে জানব?

এভাবে আমরা অনর্থক সময় নষ্ট করছি না তো? লয়েড অধৈর্য হয়েই বলে ওঠে।

মিঃ হারমাস, আমরা সকলেই এই কথা ভেবে দেখলাম যে, নির্দেশ আসার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকাটা মিটিয়ে দিলে আপনাদের বলার কিছু থাকবে না।

তাই নাকি? সত্যি আপনাদের চিন্তা-ভাবনা তারিফের যোগ্য…।

নিশ্চয়ই, উত্তেজিত শোনালো রাইসের কণ্ঠস্বর।যেকোন মূল্যে আমি আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে চাই।

মিকলিনের দিকে ফিরে তাকালাম। এবিষয়ে আপনি কী বলেন? আপনারাও মুক্তিপণ মিটিয়ে দেবার পক্ষপাতিত্বের দলে?দুকাঁধে ঝাঁকুনি তুলল মিকলিন। টাকা হাতছাড়া হবার আগেই তাকে উদ্ধার করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কিন্তু আমি এখানে এসেছি বেসরকারি ভাবে, তাই এক্ষেত্রে বিশেষ কিছুই করণীয় নেই আমার।

পুলিশকে যাতে এ ব্যাপারে জড়ানোনা হয় তার জন্য আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, লয়েড জবাব দিল, মিঃ মিকলিন শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণের দায়িত্বেই থাকবেন। টাকা মিটিয়ে দেবার পর মিস শারম্যান ফিরে এলে আবার উনি তদন্তের কাজ শুরু করবেন।

আমি মিকলিনকে বলে উঠি, আপনারা কী করে ভাবছে টাকা দিলেই মিস শারম্যানকে ফিরিয়ে দেবে?

এই কথাটাই এতক্ষণ ধরে বোঝাবার চেষ্টা করছি আমি। কিন্তু ওঁরা কিছুতেই এই সহজ কথাটা বোঝার চেষ্টাও করছেন না।

এর মধ্যে না বোঝার কী কারণ থাকতে পারে? রাইস সিগারেটটা ছাইদানিতে গুঁজে দিয়ে আর একটা ধরিয়ে নিল।

টাকা পাবার পর জোইসকে শুধু শুধু আটকে রেখে ওদের কী লাভ?

মিকলিন আমার দিকে তাকিয়ে বিচক্ষণের মতো সামান্য ঘাড় নাড়ল। আমি এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে এটুকু বুঝলাম যে ওদের বুঝিয়ে কোন লাভ নেই যে, অপহরণকারীরা বন্দীদের মেরে ফেলে নিজেদের সুরক্ষিত মনে করে। আমার আর মিকলিনের কথা যদি ওদের মাথায় না। ঢুকে থাকে, তাহলে অবুঝ মন খুব শীঘ্রই বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করবে সমগ্র ব্যাপারটা।

মুক্তিপণের টাকা মেটানোর দায়িত্ব যখন আমাদের ঘাড়েই পড়বে,আমি বলতে থাকি, তখন কতকগুলো ছোটখাটো তথ্য জানার অধিকারও আমাদের থাকা স্বাভাবিক। আচ্ছা, আপনারা বা মিস ল্যাসটিস কি স্থির নিশ্চিত যে, মিস শারম্যান গাড়ী নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন আপনারা তা একেবারেই জানেন না?

এ বিষয়ে উত্তর যা দেবার ছিল তা আমি বহুপূর্বেই দিয়ে দিয়েছি,রাইস উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে দাঁড়াল। পুলিস তার প্রশ্নবানে আমাকে নাজেহাল করে তুলেছে। এরপর আপনিও যদি তাদের পন্থাই অনুসরণ করে তুলতে চান তুলতে পারেন, তবে আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমি নিজের শরীরটাকে আরও ক্লান্ত করতে চাই না।

সঠিক অনুমান আমাদের মধ্যে কারুর-ই নেই,লয়েড বলল। তবেস্টুডিওর কাজ মিটে যাবার পর জোইসএরকম প্রায় দিনই বেড়িয়ে যেতো। রাত্রে গাড়ি চালালে নাকি ওর নার্ভ ভাল থাকে।

উনি সঙ্গে করে কোন মালপত্র নিয়ে গেছিলেন কি?

রাইস অগ্নিশর্মা হয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আমার উদ্দেশ্যে। আপনি যা বলছে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে স্ত্রী আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে?

পঞ্চাশ হাজার ডলারের অঙ্কটা খুব ছোট নয়, মিঃ রাইস,কঠিন সুরে জবাব দিই। ওকে যে কিডন্যাপ করা হয়েছে সে সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত হতে চাই।

এই কথা শোনার জন্য রাইস আর মীরা ল্যাসটিস প্রস্তুত ছিলনা, এরকম যে শুনতে হবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। তাই একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। অধৈর্য হয়ে অঙ্গভঙ্গী করে উঠল লয়েড। একমাত্র মিকলিনকে এদের দলে ফেলা যায় না। তিনি সবার থেকে আলাদা। অবিচল মিকলিন।

এক পা আমার দিকে এগিয়ে এল রাইস। তার মরা মাছের মতো চোখ দুটো ধিকিধিকি করে জ্বলছে, নিভছে। কি বলতে চান আপনি?

তার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দিলাম, আপনার স্ত্রী কোথাও পালিয়ে গিয়ে আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য চিঠিটা লিখে গেছেন কিনা সে সম্বন্ধে আমার নিশ্চিত হবার প্রয়োজন আছে বৈকি। আমার জানা প্রয়োজন, ইনসিওরেন্সের কথাটা কেউ জেনে, পরে কিডন্যাপিংয়ের অজুহাত দেখিয়েছে কিনা। আপনার স্ত্রী আমাদের কাছ থেকে যে ইনসিওরটা করিয়েছেন, তাতে খুনের উল্লেখ নেই কোথাওঁ, তার পরিবর্তে আছে কিডন্যাপিংয়ের কথা। তাই এবিষয়েও সঠিক ভাবে জানা প্রয়োজন যে আপনি এবং আপনার স্ত্রী দুজনে মিলে মাথা খাটিয়ে কৌশলে আমাদের কাছ থেকে টাকাটা আদায় করার চেষ্টা করছেন না।

আপনি…আপনি…. রাইস বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করল। অগ্নিদৃষ্টির ভয়াবহ রেশও প্রশমিত হলে কিছুটা। হয়তো উপলব্ধি করল, এই পরিস্থিতিতে মাথা গরমের পরিবর্তে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করা উচিত। বললো, সোজা কথায়, আপনারা এই চেষ্টায় আছেন মুক্তিপণ যাতে না দিতে হয়–তাইতো?

একরকম তাই,হাসি মুখে জবাব দিলাম আমি। একেবারে নিরূপায় না হলে আমরা কাউকে টাকা দিই না।… যাক, আমি মিস শারম্যানের ঘরটা একবার দেখতে চাই।

এক মিনিট, লয়েড বলে উঠল। আপনি যে সব প্রশ্নের পাহাড় খাড়া করছেন তার একটার সম্বন্ধে আপনার সন্দেহ আমি দূর করতে পারি।

জোইসের পালানোর সম্ভাবনা এক কথায় ভিত্তিহীন, কেননা তার যে ছবিটার স্যুটিং বর্তমানে চলছে, সেটা ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ চরিত্র বলা চলে। এই অবস্থায় ছবিটা অর্ধেক পথে শেষ করে ও কখনোই পালাতে পারে না। আমি এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত।

ছবিটা বন্ধ হয়ে গেলে আপনার নিশ্চয়ই বেশ কিছু লোকসানের মুখ দেখতে হবে? আমি জানতে চাইলাম।

হ্যাঁ, বেশ কয়েক হাজার ডলার। আপনারা যা অনুমান করছেন তার থেকেও অনেক বেশি। এর মধ্যেই আমরা পঁচাত্তর হাজার ডলার খরচ করে ফেলেছি। জোইসকে না পাওয়া গেলে আমাদের পুরোটাই জলে যাবে। তাই, ওকে যে করেই হোক খুঁজে বার করতেই হবে।

 আমি মিস শারম্যানের ঘরটা দেখতে চাই। মীরা ল্যাসটিস নীরবে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। ওকে অনুসরণ করেই বিশাল একটা ঘরে আমি পা রাখলাম। ঘরটার দেয়াল সবুজ রঙের আর বাদামী রঙের পর্দা। বিরাট পালঙ্কটাতেও দেয়াল আর পর্দার সঙ্গে মানানসই বাদামী আর সবুজ রঙের সুন্দর কাজ। চিত্র জগতের নায়িকার উপযুক্ত ঘরেরই মতো ঘর। স্বাভাবিক কারণেই একটু হকচকিয়ে গেলাম।

ঘরটার চারপাশে একবার তাকিয়ে আমি মীরাকে প্রশ্ন করলাম, উনি ওনার সঙ্গে কোন মালপত্র নিয়ে গেছেন কিনা আপনি বলতে পারেন?

না।

কথাটা শেষ করেই ও চলে যাবার জন্য পা বাড়ায়, কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি তার সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালাম।

আর আপনি এও জানেন না, কেন উনি রাত্রে কাউকে কিছুনা বলে একা বেড়িয়ে পড়েছিলেন?

চকচকে গভীর চোখে আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল ও। নিকটে এসে দাঁড়াল।

ও মদে ডুবে থাকতো,মিষ্টি চাপা গলার স্বর মেয়েটার। বেশির ভাগ সময়েই ওর হুঁশ থাকে না নিজে কি করছে। সে রাত্রেও ঐ একই ঘটনা ঘটেছিল। দেখছেন না, ব্যাপারটা ওরা কীভাবে ধামাচাপা দিতে চাইছে? ছবি ছাড়া ওঁদের অন্য কোন চিন্তাই নেই। জোইসের উপযুক্ত স্থান মনস্তাত্বিক বিশেষজ্ঞ, সেখানেই পাঠানো দরকার তাকে।

কানে হাত বোলাতে বোলাতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা রাইসের বিপক্ষে গিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করছে। আমার যেন মন বলছে ওকে চুমু খাবার চেষ্টা করলে ওর দিক থেকে বিশেষ বাধা আসবে না।

গম্ভীর কণ্ঠেই বলে উঠলাম,, তাহলে এই ব্যাপার! কদ্দিন, এসব কদ্দিন ধরে চলছে?

বহুমাসের ব্যাপার এইসব। এটাই হয়তো ওর শেষ ছবি। এমন অনেক সময়েই হয়েছে যখন ওকে ধরাধরি করে সেট থেকে নিয়ে আসতে হয়।

কিডন্যাপটা তাহলে সময় বুঝেই হয়েছে?

এর কোন উত্তরই বেরাল না মীরার মুখ থেকে।

 আপনার ধারণাও কি তাই বলে, সত্যি সত্যি ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?

না করার কোন কারণ তো চোখে পড়ছেনা?চিঠি চিঠি লিখে যাবার মতো ওর বুদ্ধি ছিলনা।

যদি না আপনাকে দেখে আমার খুব ভুল হয়ে থাকে, আপনি ওকে ঠিক পছন্দ করেন না–তাইনা?

মোটও না। ওকে আমার ভালোই লাগে। সবাই ওকে ভালোবাসে।

মিঃ রাইসও?

ওঁর ওকে ভাল না বাসলেও চলে যায়। কারণ উনি তো ওকে দিয়ে চুক্তিই করিয়ে নিয়েছেন।

ও আচ্ছা। তাহলে ব্যাপারটা কিন্তু অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। এগিয়ে এসে ও আমার টাইটা টেনে টেনেঠিক করতে লাগল। এতে আমাদের মুখ খুব কাছে এগিয়ে আসতে ইঞ্চি ছয়েক ব্যবধানে নিজেকে পিছিয়ে এনে এই দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলাম।

আমি জানতাম দৃঢ়চেতা গোয়েন্দাদের কথা একমাত্র পুস্তকেই শোভা পায়, বলেই আমাকে মৃদু ঠেলা দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে দিল ও।

নিজের মনেই কিছুক্ষণ হেসে একটা সিগারেট ধরালাম আমি। তারপর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধানের কাজে নেমে গেলাম ঘরটার মধ্যে। আমি নিজেও জানি না কি খুঁজে চলেছে আমার এই দুরন্ত মন। কিন্তু আমি স্থির নিশ্চিত, জোইস শারম্যানের সেই রাত গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়াই ওর জীবনের অন্তিম গাড়ি চালানো। মেয়েটার পোষাকের কোন অন্ত নেই। অবশ্য একজন ফিল্ম অভিনেত্রীর পক্ষে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাশিকৃত ব্রান্ডির বোতলও হাতে ঠেকল। পোষাকের আড়ালে,জুতোর আলমারির মধ্যে আর অন্তর্বাসগুলোর নীচে সেগুলো লুকোনো ছিল।

দেরাজের ভেতর একটা ২২ রিভলভার পেয়ে গেলাম। গুলিভরা অথচ বোঝা যায় খুব বেশী দিন চালানো হয়নি। ঐ দেরাজেই ছিল তিনটে জয় সেন্টের শিশি কোনোটারই ছিপি খোলা হয়নি। এই আবিষ্কারটার জন্য আমার মন মানসিক দিক থেকে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তাই ক্ষণিকের জন্য নিশ্চল-নিথর হয়ে পড়েছিলাম। কি মনে হল একটা শিশির ছিপি খুলে ঘ্রাণ নিলাম। ই, অন্ধকার গলিপথে হন্তদন্ত হয়ে বিরাট বড় গাড়িটায় উঠতে দেখা মেয়েটার গায়ের সেন্টের সঙ্গে এই গন্ধটার আশ্চর্য এক মিল আছে। এ চিন্তা যদিও অর্থহীন, কেননা হলিউডের অর্ধেকের বেশি অভিনেত্রীই হয়তো জয় সেন্ট ব্যবহার করে থাকে।

 শিশিটার ছিপি আটকে আমি আবার অনুসন্ধানের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এবার যেটা সামনে এল সেটা হল টুপির বাক্সতে লুকাতে কুৎসিত আকৃতির এক ছোরা। সঁচের মতো তীক্ষ্ণমুখ, দেখতে অনেকটা বরফ কাটা ছুরির মতো।

আকস্মিকভাবে সেন্ট আর ছুরির যুগল আবির্ভাব আমার অনুসন্ধানে আরো চাঞ্চল্য এনে দিল। মনের জোর বেড়ে গেল। জানালার পাশে রাখা টেবিলটার দিকে তাকালাম। এর একটা দেরাজ ছিল কাগজপত্রে আর চিঠিপত্রে ঠাসা, পুরনো চুক্তিপত্র, ছবি, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে কাটা টুকরো সংবাদ। চিঠির বান্ডিলের তলা থেকে হাতে ঠেকল একটা ব্যবসায়িক কার্ড। সামান্য অপরিষ্কার, তবে কোণাগুলো ভাঙা। তুলে নিয়ে চক্ষুস্থির, ওটা বার্নাড হফম্যানের।

কার্ডটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে উত্তেজনার এক ঠাণ্ডা শিহরণ নেমে এল আমার মেরুদণ্ড দিয়ে। নীচে কোথাও একটা টেলিফোন বেজে চলেছে।

ফ্যান’শর দপ্তরে আলো জ্বলতে দেখে আমি একটু অবাকই হলাম। এখন সাতটা পঁয়তাল্লিশ। এতক্ষণ ধরে তার কাজ করার কথাও নয়। ভেতরে ঢুকে দেখলাম সে কোন কাজও করছে না। টেবিলের ওপর ঠ্যাং তুলে একটা পেপার ব্যাক নভেল, পড়তেই সে ব্যস্ত। পাশেই হাতের নাগালের মধ্যে ছিল এক বোতল স্কচ আর সিগারেটের টুকরোয় ভরা ছাইদানি।

এই তো এসে গেছে, সন্তর্পণে পা দুটো মেঝেতে নামিয়ে আনল ফ্যান’শ। তোমার যদি হুট করে প্রয়োজন হয়ে পড়তে পারে ভেবে এতক্ষণ আমি অপেক্ষা করছিলাম। টাকার অঙ্কটা ওরা জানিয়েছে?

হ্যাঁ, ঘণ্টাখানেক আগে তাদের দাবির অঙ্ক চেয়ে বসেছে। চেয়ার টেনে অগত্যা বসে পড়ি।

জানানোর স্বাদ জাগলেও জিজ্ঞাসা করতেই কেমন যেন ভয় ভয় করছে। কত টাকা?

ম্যাডক্সের হয়তো কানে যাওয়া মাত্রই স্ট্রোক হবার উপক্রম হবে। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, ইনসিওরেন্সের শর্তগুলো সবই ওদের নখদর্পণে। ওরা পুরোটাই পেতে যায়–পঞ্চাশ হাজার।

আঁ! আঁতকে ওঠে ফ্যান’শ। বলল কি? কবে দিতে হবে?

আজ থেকে চারদিনের মধ্যে। পাঁচ, দশ আর কুড়ি ডলারের নোটে–এর থেকে বড় নোট চলবেনা। লোকটার সঙ্গে আমি নিজেও কথা বলে দেখেছি। ভয়ঙ্কর সেয়ানা। চারদিন পরে আবার যোগাযোগ করে সে আমাদের জানিয়ে দেবে টাকা পৌঁছনোর স্থান। ফাঁদ পাতার কোন সুযোগই সে দেবার পক্ষপাতী নয়।

আর ম্যাডক্স যদি টাকা দিতে না চায়?

না দিয়ে সে যাবেই বা কোথায়? রাইস নিজেই উপযাচক হয়ে ইনসিওরেন্সের কথাটা ফোন করে খবরের কাগজওয়ালাদের বলে এ কাজটা সেরে রেখেছে। টাকা দিতে আমরা বাধ্য।

তাহলে সংবাদটা না হয় তাকেই জানিয়ে দিই। নোটগুলো এক কথায় যোগাড় করাও সহজ ব্যাপার নয়।

কুড়ি ডলারের থেকে বড় নোটও চলবে না বললে?

না। আচ্ছা, মিস শারম্যান বদ্ধ মাতাল ছিল, একথা তোমরা জানতে?

ফ্যানশের মুখে চিন্তার ছাপ। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু কিছু গুজব আমার কানেও যে আসেনি তা নয়, তবে পাড় মাতাল হবার কথাটা এই প্রথম শুনছি। রাইসকে তোমার লাগল কেমন?

যেমনটা ভেবেছিলাম। একজন নামীপ্রখ্যাত অভিনেত্রীমদ খেয়ে নিজের কাজ হারাতে বসেছিল, তার এই দুর্দিন দেখে তার স্বামী সুযোগ বুঝে স্ত্রীকে ভাঙিয়ে বেশ কিছু টাকা আত্মসাৎ করার মতলব আঁজলো। স্ত্রীকে কিডন্যাপ করিয়ে মুক্তিপণটা সে নিজের পকেটস্থ করার অভিপ্রায় রাখে।

মাথা নাড়ল ফ্যান’শ। হতে পারে। তবে সব ঠিক থাকলেও একটা প্রশ্নে কিছু গলদ থেকেই যাচ্ছে।…পলিসিটার কথা সে আগে থাকতে জানতো না।

সে প্রমাণ এখনও আমাদের হাতে আসেনি। কে বলতে পারে স্ত্রীর মুখে থেকেই সে প্রথম কথাটা শুনেছিল কিনা!..নাঃ, আমার কাছে এই অনুমান খুব ভিত্তিহীন লাগছে না।

আমরা তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না, এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কি?

 টাকা মিটিয়ে দেবার আগে পর্যন্ত কিছুই করা যাবে না। তারপর আছে রাইসের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা। কিছুদিন দেখলেই বোঝা যাবে টাকা তার গবরে গেছে কিনা।

আর জোইস শারম্যান?

আমার ধারণা যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে ও আর এপথ মাড়াচ্ছে না।

আমারও তাই অনুমান, চিন্তিত গলায় বলল ফ্যান’শ। যাক, আমি না হয় ম্যাডক্সকে একটা খবর পাঠাচ্ছি।

তোমার বক্তব্য আমি তাকে জানিয়ে দেব।

ওতো মনেপ্রাণে এটাই চায়। এরকম একটা অবস্থা তার মন অনেক আগে থাকতেই কল্পনা। করে নিয়েছে।উঠে দাঁড়ালাম। চলি, একটা কাজ আছে। ম্যাডক্সয়দি আমার খোঁজ করে, বোলো, এক ঘন্টার মধ্যে কালভার হোটেলে ফিরে আসব আমি।

আচ্ছা। হাত তুলল ফ্যান’শ। সকালে আবার দেখা হবে।

বাইরে বেড়িয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে এলাম ৫৫ নম্বর উইল্টশায়ার রোডে। ট্যাক্সি ওলাকে দাঁড় করিয়ে বাড়িটার দরজায় টোকা দিলাম।

দ্বিতীয়বার টোকা মারার পর একজন স্ত্রীলোক এসে দরজা খুলে দিল।

কে?

মিঃ হফম্যান আছেন?

না।

বলেই কথা আর না বাড়িয়ে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হলো স্ত্রীলোকটি। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি, আপনি কী মিসেস হফম্যান?

আমার পরিচয় যাই হোক না কেন তাতে আপনার কি আসে যায়? ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব এল।

মিঃ হফম্যানের সঙ্গে আমার একটু প্রয়োজন ছিল। কোথায় গেলে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে বলতে পারেন?

একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করল, তারপর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। আপনি ভেতরে আসতে পারেন।

ওকে অনুসরণ করে যে ঘরে এসে ঢুকলাম, ঘরটা তেমন সাজানো-গোছানো নয়। সব কিছুই আছে তবে সবই অগোছালো। আসবাবপত্রগুলোর ওপর জমা পুরু ধূলোর আস্তরণ। বৈদ্যুতিক আলোয় স্ত্রীলোকটিকে ভালভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। বয়েস প্রায় পঁয়ত্রিশের মধ্যে, ঘন গায়ের রঙ, তবে মুখটা জুড়ে বিষণ্ণতার ভাব। নিজেকে এভাবে শেষ না করে দিলেও হয়তো তার মধ্যে একটা সস্তা মাপের চটুলতা খুজলে এখনও বোধহয় পাওয়া যেত। গায়ে মোটা একটা সোয়েটার। ধূসর রঙের কোঁচকানো স্কার্টটার ঠিক মাঝে বিরাট একটা তেল কালির ছাপ।

আপনি কি মিসেস হফম্যান?

ধরুন তাই, রুক্ষ মেজাজে জবাব দিল। অবশ্য গর্ব করার মতো এটা কিছু নয়। কি চান আপনি?

আমি একটা সিগারেট এগিয়ে দিলাম। সিগারেটটা ধরিয়ে একটা প্রায় ভাঙ্গা চেয়ারে বসে ও আমার মুখের দিকে তাকাল। আপনি যা বলতে এসেছেন চটপট বলে ফেলুন তো। এক্ষুণি আমায় বেরোতে হবে।

আপনার স্বামী কোথায় গেছেন আপনি জানেন না?

এ কথার জবাব তো আমি অনেক আগেই দিয়েছি। তাকে আপনার কি দরকারে লাগবেবলুন।

গতরাত্রে স্প্রিংভিলেতে ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ। দেখা হলে ওঁর কিছু রোজগারের বন্দোবস্ত করে দিতাম আর কি।

কৌতূহলী চোখে জরিপকরল আমায়, মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো জ্বলজ্বলে ভাবে আমার চোখে ও ধরা পড়ল।

আপনি কি সেই ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোক?

হ্যাঁ। উনি তাহলে আমার সম্পর্কে আপনাকে বলেছেন?

ও বলবে! বিষঃ হাসি হাসল ও। ও আমাকে একটা কথাও বলে না। ও ফোনে বলেছিল আড়ি পেতে শুনে নিয়েছি। আপনার নাম হারমাস, তাই না?

মাথা নেড়ে আমি একটা আরাম কেদারায় আস্তে করে নিজের দেহটা এলিয়ে দিলাম। ফোনটা উনি কবে নাগাদ করেছিলেন?

ঠিক দিন তিনেক আগে রাত্রে।

কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, কিছু জানেন?

না। তবে একটা আন্দাজে ঢিল মারতে পারি।

বলুন?

অর্থপূর্ণ হাসি ফুটে উঠল ওর মুখ জুড়ে। স্বামীর কাজের বিষয় নিয়ে আমি কারুর সঙ্গে আলোচনা করি না। ও এ ব্যাপারটা পছন্দ করে না।

মৃদু হাসি হাসলাম। সেটা আমার কাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু তার দরুণ কুড়ি ডলারের একটা পাত্তি খরচা করতে রাজি আছি।

ফ্যাকাশে ঠোঁটে একবার জিভ বুলিয়ে নড়েচড়ে বসল ও। তাহলে অবশ্য আলাদা কথা।

নোটটা মানিব্যাগ থেকে বার করলাম। এবার বলুন, কে সে?

 লালচুলো ঐ মেয়েটা, আজকাল ও যার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।

শুনুন, ব্যাপারটা কিন্তু অত্যন্ত জরুরী। একটু পরিষ্কার করে খুলে বলুন, কেমন? এর দরুণ টাকার অঙ্কটা বাড়িয়ে চল্লিশ করে দিচ্ছি। বর্তমানে কুড়ি, বাকিটা ভোলা থাক আপনার বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। নোটটা চেয়ারের হাতলের ওপর দিকে ঠেলে দিলাম।

সেটা তুলে নিয়ে সোয়েটারের ভেতর চালান করে দিল। আপনি যেন তার কাছে আবার ফাঁস করে দেবেন না, আমি এসব বলেছি। তবে আমি ভালো করেই জানি। ও আর ফিরে আসছে না।

সঙ্গে করেও জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। কেউ বোধহয় ওকে ভয় দেখিয়েছে। রান্নাঘরে আমায় ব্যস্ত দেখে চুপিসাড়ে ও পালিয়েছে। আমি এবিষয়ে স্থির নিশ্চিত যে এপথ ও আর মাড়াচ্ছে না।

একটু আগে লালচুলো যে মেয়েটির কথা বললেন, সে কে?

জানি না। হপ্তাখানেক আগে এখানে একবার এসেছিল। আমি তাকে সঙ্গে করে ভেতরে এনেছিলাম, কিন্তু মুখটা ভালো করে দেখতে পারিনি। তার চোখে লাগানো ছিল গগলস্ আর মাথা জুড়ে বিরাট এক টুপি। এখন সামনে এলেও তাকে চিনতে পারব না।

মেয়েটা এর আগে কোনদিন আসেনি?

এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াল ও। নাঃ। তবে আমি জানি টাকা নেবার জন্য বানি তার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই গভীর রাত্রে দেখা করতো।

মেয়েটা আপনার স্বামীকে কোন কাজে লাগিয়েছিল জানেন?

ঠোঁট উল্টিয়ে আবার মাথা নাড়ল ও, অর্থাৎ এবিষয়ে ওর কিছুই জানা নেই।

দিন তিনেক আগে মেয়েটিকে উনি ফোন করেছিলেন বললেন?

হ্যাঁ। আমি তখন রান্নাঘরে। কোন কাজের সঙ্গে ও যুক্ত সে বিষয়ে জানার ইচ্ছা ছিল আমার। তাই ফোনের শব্দ কানে যেতেই তাড়াতাড়ি দরজার কাছে কান পেতে দাঁড়িয়ে পড়ি। ওরা…ওরা একটা খুন নিয়ে আলোচনা করছিল। আর আমি খুব ভালো ভাবেই জানি, রিসিভারের অপর প্রান্তে কথা বলছিল ঐ লালচুলো মেয়েটা।

আপনার স্বামীর কথাগুলো একবার বলতে পারেন?দু-এক মুহূর্তের জন্য বিরতি। মনে মনে গুছিয়ে নেয়। সবটা আমার মনে পড়ছে না, তবে অনেকটা এইরকম ছিল, সে বলছিল : হারমাস নামের ইনসিওরেন্সে কোম্পানীর এক গোয়েন্দা আমার পিছু নিয়েছে। সে জানে আমি তখন ঐ বাড়িতেই উপস্থিত ছিলাম। তার কাছে কোন প্রমাণ নেই, সে নিজেও এই কথাটা স্বীকার করে। খুনটা সে আমার ঘাড়েই চাপানোর চেষ্টা করবে। শুনুন, অনর্থক এতবড় ঝুঁকি নেবার মনোগত বাসনা আমার নেই। আমি আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। হ্যাঁ, এক্ষুণি। সঙ্গে করে কিছু টাকাও আনকেন। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।…বলেই ও ফোন রেখে দিয়েছিল।

তারপর কি হল?

বেড়িয়ে যায়। তখন সোয়া বারোটা। সাড়ে বারোটা নাগাদ ফিরে এসে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। ও ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে আছি।… আমরা এখন একঘরে থাকি না। দুজনেরই আলাদা ঘর। মিনিট কুড়ি বাদে ব্যাগ হাতে ও আবার গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিল।

আপনি তখন বলছিলেন, কেউ ওঁকে ভয় দেখিয়েছে। হঠাৎ করে এই চিন্তা আপনার মাথায় এল কেন?

কারণ আমি নিজের চোখে দেখেছি, ওর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। আপন মনেই বিড়বিড় করতে করতে দর দর করে ঘামছিল। এর আগে এই হাল তার কখনো হয়নি। ও কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে নিঃসন্দেহে বলা যায়।ও যাওয়াতে কষ্টের পরিবর্তে আমি খুশি হয়েছি। অনাবশ্যক ঝুট-ঝামেলায় নিজেকে জড়ানোর কোন মানসিকতা আমার নেই। তাকে রাখা ঘড়িটার দিকে ফিরে তাকাল ও। রাত্রের শোতে সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা, এখন না বেরোলে আবার দেরী হয়ে যাবে।

আর একটা প্রশ্নই আমার আছে, বলতে পারেন ঐ লালচুলো মেয়েটা বাদে আর কারুর সঙ্গে তিনি কাজ করছিলেন কিনা?

ঠিকঠিক বলতে পারবো না। দুএকটা ছুটকো-ছাটকা কাজ বোধহয় করত। লোকে তো সব সময়েই ওর খোঁজ করে থাকে। কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালও। কোন্ খুনটার কথা ও বলছিল বলুন তো?

জানিনা, বলেই চেপে গেল ব্যাপারটা। আপনার জায়গায় যদি আমি থাকতাম তাহলে কখনোই এর মধ্যে নিজেকে জড়াতাম না। কোথায় গেছেন উনি জানেন না, না?

না। কাল রাত্তিরে ও স্প্রিংভিলেতে গিয়েছিল তাও জানতাম না আমি। কাল ওর সঙ্গে কথা বলেন নি কেন?

সুযোগ পাইনি।

সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল ও। ওকি সত্যি সত্যি কাউকে খুন করেছে?

এ, ব্যাপারে সঠিক ভাবে আমার কিছু জানা নেই।কুড়ি ডলারের আর একটা নোট ওর দিকে এগিয়ে ধরলাম।

কয়েকদিন এখানেই থাকবেন। পুলিশ হয়তো আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য আসতে পারে।

ধ্যাৎ, ওসবে আমি মাথা ঘামাই না,অবজ্ঞার সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকালো। ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না। এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলে ধরলো।

আপনার স্বামী বর্তমানে কোথায় এই খবরটা, জানতে পারলে আমি একশো ডলার খরচ করতেও প্রস্তুত। ওকে অতিক্রম করে দুটো সিঁড়ি টপকে বললাম, কালভার হোটেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

কথা বলতে বলতে ট্যাক্সিটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে কিনা দেখছিলাম। ওটা তখনও অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু রাস্তার উল্টোদিকে যে বিরাট কালো গাড়ি দাঁড়িয়েছিল আসার সময় খেয়াল করিনি। অন্ধকার থাকার দরুণ গাড়ির মধ্যে কেউ উপস্থিত আছে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। সহসা কাঁচের ভেতর দিয়ে চালক আসনের ওপর কিছু একটা সরে যাচ্ছে মনে হল। এমন কিছু যা রাস্তার মৃদু আলোর আভায় চকচক করছিল।

ট্যাক্সির চালক বাজখাঁই কণ্ঠে আমায় সতর্ক করে চিৎকার করে উঠল। ট্যাক্সিটা ছিল গাড়িটার নাগালের মধ্যেই, তাই চলমান বস্তুটা অনেক আগে থাকতেই তার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল।

সরে যান! বলেই রাস্তার পাশে লাগানো আগাছার ঝোঁপ বরাবর লাফ দিলাম।

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্তিরেও একটা হলুদ আলো ঝলকে উঠল, তার পর পরই বাতাস চিরে বেরিয়ে গেল একটা গুলির শব্দ। কিছু একটা প্রচণ্ড গতিতে ছুটে এসে আঘাত করল আমার বাঁহাতে। মনে হল গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে।

আমার দৃষ্টি তখন স্থির মিসেস হাফম্যানের দিকে। উপর্যুপরি বেশ কয়েকটা গুলির আঘাত ওকে ছিটকে ফেলেছিল ঘরের ভেতরে।ওর নিস্তেজ হাত দুটো ক্ষতবিক্ষত বুকটাকে আগলে ছিল। পরমুহূর্তেই হাঁটু ভেঙে হলের নোংরা কার্পেটের ওপর আছড়ে পড়ল ও। আগাছার ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আমি যখন তার পাশে এসে দাঁড়ালাম, তখন সে মৃত।