০৫. একটানা গাড়ি চালিয়ে

০৫.

একটানা গাড়ি চালিয়ে সন্ধ্যা ছটা চল্লিশে স্প্রিংভিলেতে পৌঁছনোর পর আমি স্প্রিংভিলে হোটেল লেখা কাঠের একটা বাড়ির সামনে বুইকটা দাঁড় করালাম।

আমাদের দেখা মাত্রই টাকমাথা গোলগাল চেহারার এক বৃদ্ধ এগিয়ে এল।

আসুন, আসুন। আমি পেটে ইগান। হোটেলটা আমারই। এখানে থাকতে আপনাদের কোনরকম অসুবিধা হবে না।

বেশ, আমি বললাম, আজ রাতটা আমরা এখানেই থাকতে চাই।

হোটেলের খাতায় নাম সই করা হলেইগান আমাদের বলল, মিনিট কুড়ির মধ্যে খাবার তৈরী হয়ে যাবে। ততক্ষণ কিছু ড্রিঙ্ক চলবে নাকি?

এই কথাটা আমার জিভের ডগায় এসেও গিয়েছিল। চলুন যাওয়া যাক।

ওকে অনুসরণ করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম। সুসজ্জিত একটা বারে এসে ঢুকলাম। পানীয় ঢালতে ঢালতে ইগান বলে উঠল, এই সময়টা আমাদের এখানে খুব কম ভিড় থাকে। আপনারা যদি দু-এক মাস আগে বা পরে আসতেন তাহলে এতটা ফাঁকা বোধহয় পেতেন না।

পানীয় নিয়ে টুলে বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে করতে এক সময় সুযোগ বুঝে ঝুপ করে আসল কথাটা পেড়েই ফেললাম : আচ্ছা, কনি পরিবারের বাস আশেপাশেই কোথাও শুনেছি। ওদের সঙ্গে কী ভাবে যোগাযোগ করা যায় বলতে পারেন?

ইগান মাথা নাড়ল, ওরা থাকে ডেড লেকে–ওখানে সব চাইতে নির্জন জায়গা বলে সুনাম আছে। ওখানে যেতে হলে আপনাদের অনেকখানি পথ যেতে হবে। তার থেকে আপনাদের হাতে যদি সময় থাকে, এখানে দিন-তিনেক থেকে যান না? প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে ওদের এখানে আগমন ঘটে। এখানে ওরা চিঠিপত্রও নিয়ে আসে, সেইসঙ্গে মাসকাবারি জিনিসপত্রও কিনে নিয়ে যায়।

আমি মাথা ঝাঁকাই, নাঃ, অতদিন থাকার কোন উপায় নেই। কাল রাতের মধ্যে আমাদের যে ভাবেই হোক লস-এঞ্জেলসে পৌঁছতে হবে। আপনি বরং যাবার রাস্তাটা যদি বলে দেন অনেক উপকার হয়।

ঠিক আছে, আপনার যা মনে হয় তাই করুন। এই হোটেল ছাড়িয়ে আরও মাইল পাঁচেক এগিয়ে গেলে একটা সাইনপোস্ট চোখে পড়বে। তারপর বাঁদিকে ঘুরে আরও তিনমাইল মতো রাস্তা যেতে হবে। সেখানে গেলেই দেখতে পাবেন, রাস্তাটা আঁকশির মতো দু-ভাগ হয়ে বেরিয়ে গেছে। আপনারা ডানদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবেন। রাস্তায় প্রবেশের ঠিক মুখে ঘন্টি বাজাবার– এক অদ্ভুত কল আছে দেখবেন। ওটা বাজাতে ভুলে যাবেননা। ওটা হলো, আপনারা যে আসছেন তার সঙ্কেত। গলিটায় একটার বেশী গাড়ি যাবার অন্য কোন রাস্তা নেই। আপনারা যদি ঘন্টি না বাজিয়ে গাড়ি ঢোকান আর কনিরা যদি ওপাশে থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়, তাহলে আপনাদের দুজনের একজনকে গাড়ি নিয়ে মাইল দুই পিছু হটতে হবে। আর সে কাজটা কনিরা করতে কখনোই রাজি হবে না পরিবর্তে আপনাকেই সর্বপ্রথম এই কাজটা করতে হবে।

দন্ত-বিকশিত করে হাসল ইগান, তারপর আবার বলা শুরু করল, লেকের ধার দিয়েও একটা রাস্তা গেছে, তবে লম্বায় সেটা পঁচিশ মাইল। কনিদের বাড়িটা একটা দ্বীপের মধ্যে। রাস্তার শেষ পর্যন্ত গেলেই দ্বীপটা দেখতে পাবেন।

সাধারণতঃ এপারে একটা ডিঙি বাঁধা,থাকে। ওটা পেলে আপনি নিজেই চালিয়ে চলে যেতে পারবেন। আর যদি ওটার দেখা না পান, তাহলে ঘণ্টির ব্যবস্থাও আছে। ঘণ্টি টিপলেই কনিরা হাজির হবে।

কনিরা করে কী? স্বাভাবিক কণ্ঠে হেলেনের প্রশ্ন।

ঠিক বলতে পারব না। দ্বীপে ওরা মিঙ্ক চাষ করে। কানে যতদূর এসেছে, ওদের ব্যবসায় ভাটা চলছে। স্বামী-স্ত্রী এখন কষ্ট করে তাদের সংসার চালাচ্ছে।

বিয়ের আগে মিসেস কনি তো শো দেখিয়ে জীবিকা উপার্জন করত, শুনেছি। গেলাসে চুমুক দিয়ে আমি বললাম, তা, ও লাইন ছেড়ে হঠাৎ এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় দিন কাটাচ্ছেন কী করে?

মাঝে মধ্যে আমিও তাই ভাবি, চিন্তান্বিত কণ্ঠে জবাব দেয় ইগান। তরে ওনাকে দেখে সুখীই মনে হয়। আমি ওর জায়গায় হলে ওরকম বদমেজাজী লোককে নিয়ে বছরের পর বছর কাটাতে পারতাম না।

দ্বীপে বসবাস করার আগে কি করতেন ভদ্রলোক?

বিমর্ষ হয়েই মাথা নাড়ে ইগান, বলতে পারি না। তার সম্বন্ধে কেউই কিছু জানে না। আমার এখানে এসেও সে বিশেষ মুখ খোলে না। লোকটা দ্বীপে বাস করছে প্রায় ছমাস হয়ে গেল। তবে এই সংবাদ আমার কানে এসে পৌঁছতে আরও একমাস লেগে গেছে। মাস দেড়েক পরে সে তার স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। ভদ্রমহিলা বেশ ভাল। আমার সঙ্গে আলাপও আছে, কিন্তু তার স্বামী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু তার কাছ থেকে জানা যায়নি।

ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক কেমন? হেলেন প্রশ্ন করল এবার।

দুকাঁধে ঝাঁকুনি তুলল ইগান, বলতে পারব না। ওদের জোড়ে দেখার সৌভাগ্য কোনদিন হয়নি। ওরা এখানে আসে ঠিকই, তবে পৃথক।

সেদিন ওর বোন সুসান গেলার্টকে দেখলাম আমি, আমি মুখ খুললাম। উইলিংটনে ওর শো দেখতে গিয়েছিলাম। সে এখানে কখনও আসে না?

একবার এসেছিল, মিসেস কনে আসার মাসখানেক পরে। আশ্চর্য মিল না ওদের মধ্যে? আমি তো প্রথম দেখে ঘাবড়েই গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম মিসেস কনেই বোধহয় চুলের রঙ। করিয়েছেন। বহু পরে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম।

সেও নাচে, তাই না?

একটা গোখরো সাপ নিয়ে খেলার আসরে নামে, আমি বললাম।

কনি লোকটারও সাপ পোর বাতিক আছে। এ যেন তার কাছে একেবারে ছেলেখেলা। তাকে খালি হাতে সাপ ধরতে দেখার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে, বিশ্বাস করতে পারেন?

সাপ নিয়ে কী করে সে? হেলেন প্রশ্ন করল।

বিক্রি করে। গোখরো সাপের মাংসও কিছু লোক এখনও খায় শুনেছি। লোকটা কিছু না হলেও কমকরে প্রতিদিন এক ডজন করে গোখরো সাপ ধরে। কোথায় গেলে ওদের দর্শন মিলবে তা ওর নখদর্পণে।

এধারের বড় ঘড়িটার দিকে তাকাল ইগান।

চলি, খাবারের ব্যবস্থা হলো কিনা একবার দেখে আসি। রান্নার লোকটা ভালো বটে কিন্তু এত কুঁড়ে যে চোখের সামনে না থাকলে তাকে দিয়ে কাজ করানো সম্ভব হয় না। কারণ সে দায়সারা হয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করে যাবে।

ইগান চলে যাবার পর আমি হেলেনকে বললাম, তারপর, কী বুঝছো? সন্দেহ আছে আর?

আমার এখনও পর্যন্ত ওদের সঙ্গে কোন সাক্ষাৎ হয়নি, গম্ভীর কণ্ঠে হেলেন জবাব দেয়।

আচ্ছা, পাণ্ডববর্জিত জায়গায় থাকার পেছনে ওদের কোন অভিসন্ধি নেই তো?

হেলেন একদৃষ্টে আমার পিছনে তাকিয়েছিল। ওর চোখে মুখে চাপা উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। ঘুরে তাকাতেই চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল, নীল সাদা ডোরাকাটা কোট পরনে লোকটা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করছে।

চারপাশে সজাগ চোখ বুলিয়ে আমাদের দিকে সে অচেনার দৃষ্টি নিয়ে তাকাল, তারপর বারের দিকে ধীর পদব্রজে এগিয়ে গেল। একজোড়া মোমের পুতুলের মতো নিষ্পলক নেত্রে আমরা তার গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলাম। কাউন্টারের ওপর অধৈর্য হয়েই বার কয়েক টোকা মেরে বসল সে। ইগান আসতে ভরাট গমগমে কণ্ঠে বলে উঠল, দু প্যাকেট লাকি।

সিগারেটের বিনিময়ে টাকা নিয়ে ইগান পানীয় দ্রব্যের প্রস্তাব রাখল তার কাছে।

 দরকার নেই। খাবারটা আমার ঘরে পাঠিয়ে দেবেন। আমার কাজ আছে। প্যাকেট ছিঁড়ে তার থেকে একটা সিগারেট বের করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে।

ইগান রান্নাঘরের দিকেই পা বাড়িয়েছিল, আমি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। মিঃ ইগান?

ঘুরে দাঁড়াল সে, আর এক গ্লাস খাবেন?

না, এখন থাক। আচ্ছা এই লোকটাকে এর আগে কোথায় যেন দেখেছি। কে বলুন তো, খুব চেনা মুখ?

মিঃ হফম্যানের কথা বলছেন। উনি এর আগে আরও দু-থেকে তিনবার এখানে এসেছেন। ভদ্রলোক ফিল্ম লাইনের সঙ্গে যুক্ত।

ও, তাহলে বোধহয় হলিউডে দেখেছি। এখানে কী উনি ছুটি কাটাবার উদ্দেশ্যে এসেছেন?

না না,কাজেই এসেছে। এখানে একটা ফিল্ম তুলতে চান। এখন লোকেশান খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সারাদিন কেবল গাড়ি নিয়ে চক্কর মারাই ওঁনার অন্যতম কাজ।

কনিদের ওখানে গিয়েছিলেন নাকি?

নিশ্চয়ই। প্রথমবার এসেই ওই জায়গাটা সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ছিল তার।

দ্বীপটা ওনার মনে ধরলে কনিদের ভাগ্য খুলে যাবে। ফিল্ম লাইনের লোকেরা ভালোই পয়সাকড়ি দেয় শুনেছি।

আপনার রান্না এগলো কদুর? আমার যে পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।

ব্যস, হয়ে গেছে, তিন মিনিট। রেস্তোরাঁতে বসতে বসতে খাবার আপনাদের সামনে পৌঁছে যাবে, বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ইগান।

রেস্তোরাঁর দিকে যেতে যেতে হেলেন বলল, তোমার কী মনে হয়, লোকটা আমাদের অনুসরণ করেই এতোটা পথ এসেছে? না এমনি এখানে এসে ঢুকেছে?

আমাদের অনুসরণ করছে বলে তো মনে হয় না। একটা টেবিল বেছে বসে পড়ি। ওর এই দুরভিসন্ধি মাথায় চাপলে এত সহজে আমাদের সামনে নিজেকে ধরা দিত না। তাও এটাকে নিছক দৈব্যক্ৰম বলেও মানতে মনের দিক থেকে সাড়া পাচ্ছি না।

সে তোনয়ই। হয় ও আমাদের অনুসরণ করছে, না হয় কনিদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ আছে। আচ্ছা কনিদের নির্দেশে ডেনির ওপর ও গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে না তো?

ঠিক ধরেছ তো! হ্যাঁ, কনিদের লোক হওয়া কোন অস্বাভাবিক নয়।

সাদা কোট পরা একজন নিগ্রো আমাদের টেবিলে খাবার সাজিয়ে চলে যাবার পর হেলেন বলে উঠল, নিশ্চয়ই গাড়িও ওর সঙ্গে আছে। গাড়ির লাইসেন্স নম্বরটা রেজিস্ট্রেশান কার্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে কেমন হয়?

সেটা করলেই ভালো হয়।

আহার পর্ব মিটিয়ে বুইকটা কোথায় রাখব ইগানকে জিজ্ঞাসা করায় সে জানাল, পেছনে অনেকগুলো গ্যারেজ আছে। আমার কাছ থেকে চাবি পেলে সে গাড়িটা ওখানে রাখার ব্যবস্থা করবে। আমি নিজেই ও বন্দোবস্তুটা করব বলে হেলেনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলাম।

পাশাপাশি গ্যারেজের শুধু একটারই দরজা বন্ধ ছিল। বুইকটা একটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর হেলেনকে মাঝের দরজার সামনে পাহারায় দাঁড় করিয়ে আমি বন্ধ গ্যারেজটার দরজা খুলে ভেতরে পা দিলাম।

দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল কাদায় সিক্ত একটা প্লাইমাউথ। দেখেই বোঝা যায়, গাড়িটা যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করা হলেও যত্ন-আত্তির তেমন নেওয়া হয় না। গাড়ির নাম্বারটা টুকে নিয়ে দরজা খুলে রেজিস্ট্রেশন কার্ডটা একবার পরীক্ষা করে দেখলাম:

বার্নাড হফম্যান
৫৫, উইল্টশায়ার রোড
লসএঞ্জেলস ১

ঠিকানাটা টুকে নিয়ে গ্লোভ কম্পার্টমেন্টের ডালা খুললাম। ভেতরে রাখা আছে শক্তিশালী একটা দূরবীন আর একটা ৩৮ বোরের পুলিস স্পেশাল।

নলের মধ্যে পড়া ধূলির আস্তরণটা দেখে মনে হয় ওটা দিয়ে বহুকাল গুলি ছোঁড়া হয়নি। রিভলবারটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে গাড়ির অন্য ফোকরগুলো পরীক্ষা করে নিলাম। উল্লেখযোগ্য কোন কিছুই তেমন চোখে পড়ল না। অগত্যা আলো নিভিয়ে, গ্যারেজের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম।

হোটেলে ফেরার পথে পথ চলতে চলতে হেলেনের কাছে সব খুলে বললাম, কিছুক্ষণ আগে গাড়ির মধ্যে যেগুলো সচক্ষে দেখেছি। শেষে শুধু বললাম, দূরবীনটা দেখে মনে হল ও কনিদের ওপর নজর রাখছে। তার মানে কথার অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, লোকটা কনি আর ডেনি দুজনেরই বিরুদ্ধে। ওকে গিয়ে ধরবো নাকি?

ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ে হেলেন। তাতে আমাদের কোন লাভ হবে বলে মনে হয়না। ও যদি সত্যিই দারোয়ানটার হত্যাকারী হয়ে থাকে আমাদের কাছে ও কখনোই এ ব্যাপারে মুখ খুলবে না।

লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে চিনে ফেলেছিল, নিজে সামনে আসতে চায় না, তাই ঘরে খাবার পাঠিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করল।

আমি এখন শুতে যাব, ঘুম দরকার,হাই তুলল হেলেন।এতখানি রাস্তা গাড়িতে এসে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ওকে হোটেলের সিঁড়িতে তুলে দিয়ে আবার আমি বারে ঢুকে পড়লাম।

ওখানে আমার জন্য আশ্চর্য এক চমক প্রতীক্ষায় ছিল। দেখি, এককোণে বসে হুইস্কি খাচ্ছে। স্বয়ং হফম্যান। আমায় ভেতরে ঢুকতে সম্ভবতঃ সে খেয়াল করেনি।

বার কাউন্টারের পেছনে গ্লাস মুছতে মুছতে ইগান আমাকে লক্ষ্য করেই বলল, বাইরে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে নিশ্চয়ই?

ঠাণ্ডা বলে ঠাণ্ডা, ভীষণ ঠাণ্ডা। আমাকে একগ্লাস স্কচ দিন।

স্কচ ঢালতে ঢালতে গান বলে উঠল, আপনার স্ত্রী কি শুতে গেলেন?

হ্যাঁ, বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হফম্যানের সঙ্গে শুভ দৃষ্টি হতেই বললাম, গুড ইভিনিং। আপনার সঙ্গে এর আগেও কোথাও যেন দেখা হয়েছে, তাই না?

দুচোখের শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, দেখতে পারেন।

 ইগানের থেকে গ্লাসটা নিয়ে তার টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলাম, এখানে বসতে পারি?

লোকটা তার কুচকুচে কালো যুগল চোখ আমার সারা দেহে বুলিয়ে নিল, বসুন।

চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসে পড়লাম, তারপর গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে আমার চোয়ালের ক্ষতচিহ্নটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠলাম, ওঃ, আপনার ঘুষি বটে, একটাই যথেষ্ট!

চোখ ঘুরিয়ে একপলক আমার ক্ষতটা দেখে নেয় হফম্যান। প্রয়োজনে ঘুষিতে শক্তির জোরটা সময়ে সময়ে বেড়ে যায় বৈকি।

প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিলাম, আপনি তো ফিল্ম লাইনে আছেন শুনেছি। ইনসিওরেন্সে কাজ করি। এটা জানা আছে নিশ্চয়ই?

প্রশ্নের উত্তর পেলাম না।

 কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বলি, তারপর, শেষ পর্যন্ত ডেনির নাগাল পেয়েছিলেন?

ডেনিকে নিয়ে আমার কোন কৌতূহল নেই, ঝাঝালো কণ্ঠে উত্তরের জবাব এল।

তাহলে কী আপনি তালা ভেঙে তার অফিস ঘরে ঢুকেছিলেন? কথাটা এই কারণেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সেই সময় আমরা আপনাকে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে চীনে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে দেখেছিলাম।

কম করেও পাঁচ সেকেন্ড মতো লোকটা আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল, সহসা মন স্থির করে এক চিলতে ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে তুলল তার ঐ কুটিল মুখে।

আপনি অসম্ভব চালাক, তাই না? …বেশ, আপনার সঙ্গে কাজ করতে আমার কোন আপত্তি নেই। চলুন না আমার ঘরে গিয়ে আলোচনায় বসা যাক।

কি সংক্রান্ত?

এটা-সেটা নিয়ে আর কি। উঠে দাঁড়াল, আসছেন?

 মাথা নেড়ে এক চুমুকে গ্লাস ফাঁকা করে আমিও উঠে পড়ি। চলুন, না হয় যাওয়াই যাক।

হফম্যানকে অনুসরণ করতে করতে ওর পিছু পিছু এগিয়ে যেতে দেখে, ইগানও কম অবাক হয়নি। সেও আমাকে লক্ষ্য করছিল।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল হফম্যান। মাথা ঝাঁকিয়ে ঘরে থাকা একটিমাত্র চেয়ারে আমাকে বসতে বলে নিজে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল।

আমি বসতেই কথা শুরু করে দিল, ঘুষিটার জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত। মুখে বলছে বটে তবে দুঃখের লেশমাত্র নেই। কেউ আমাকে অনুসরণ করলে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না, তার ওপর অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়ি।

একটা সিগারেট বার করে প্যাকেটটা ওর দিকে এগিয়ে ধরলাম। এ ব্যাপারে আপনি কোন ভূমিকা নিচ্ছেন?

একটা কাজের ব্যাপারেই আমার এখানে আগমন। মানিব্যাগ খুলে একটা কার্ড দেখাল হফম্যান। তাতে লেখা?

বার্নাড হফম্যান
 লাইসেন্স প্রাপ্ত গোয়েন্দা
৫৫, উইল্টশায়ার রোড
লস এঞ্জেলস ১

 আমি একাই একশো, বিদ্রূপমাখা হাসি ফুটে উঠল হফম্যানের মুখে, আপনাদের তুলনায় আমার ভূমিকা নূন্যতম, তবে মাঝেমধ্যে দু-পয়সা কামিয়ে থাকি।

কার হয়ে একাজে নেমেছেন?

হরিদাস পালের হয়ে। আবার হাসল হফম্যান।

যাক, ওসব কথা এখন থাক। যতদূর আমি জানি, আপনার আমার তদন্তের বিষয় কিন্তু একই ব্যাপার।

ডেনির অফিসে যে পলিসিগুলো আছে তার মধ্যে আপনার কোম্পানিটাও পড়ছে নাকি?

হু, তাহলে ডেনির অফিসে ওই-ই ঢুকেছিল। আমাকে এখন খুব বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই, হ্যাঁ।

আপনাদের মনেও ওটার ব্যাপারে অসন্তোষ আছে?

পুরোপুরি বললে ভুল বলা হবে। তবে এখনও পর্যন্ত সন্দেহজনক কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু পলিসি নিয়ে আপনার দরকারটা কোথায়?

এর উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। তবে আজ যদি আপনি আমায় কিছু সংবাদ দেন পরে আমার ভাগ্যে কিছু জুটলে আপনাকে জানাতে ভুলব না। বলুন, রাজী আছেন?

লোকটাকে গম্ভীরভাবে লক্ষ্য করছিলাম। আমার তাকে দেখে মোটেই সুবিধের ঠেকছে না। লস এঞ্জেলসের বেসরকারী গোয়েন্দাদের মধ্যে এমনও বহুলোক সন্ধান করলে পাওয়া যাবে যারা বিভিন্ন সূত্রে খবর সংগ্রহ করে নিজেদের মক্কেলদের ব্ল্যাকমেল করে তাদের পসার জমায়। একে দেখেও আমার তাদেরই একজন মনে হচ্ছে। অবশ্য আমার সিদ্ধান্ত যে নির্ভুল তা বলা যায় না, ভুল হলেও হতে পারে। কিন্তু তাচ্ছিল্যভরা ওর চাউনি আর চাপা ঠোঁটের ধূর্ততা আমার প্রথম থেকেই ভালো লাগছে না।

কি জানার ইচ্ছা আছে আপনার?

সুসান গেলার্ট দশলক্ষ ডলারের একটা ইনসিওর করিয়েছে-কথাটা কী সত্যি?

 মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে কথাটার সমর্থন জানালাম।

পলিসিটা যে এজেন্টদের দ্বারা হয়েছিল তার নাম কি?

তাকে নিয়ে কী হবে?

হফম্যান নড়েচড়ে বসল, নিজের হাতে ধরা সিগারেটটার দিকে একবার তাকাল, তারপর মুখ তুলল।

আপনি যদি প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করে তোলেন তাহলে আমাদের কাজ মোটেই এগোবে না। লোকটা কে বলুন?

লোক আছে সবশুদ্ধ দশজন। মেয়েটা দশজনের কাছে পৃথক পৃথক ভাবে পলিসি করিয়েছে। সবার নাম জানা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।

আপনি কার হয়ে কাজ করছেন?

ন্যাশানাল ফিডেলিটি।

আর আপনার সঙ্গের ঐ মহিলা?

জেনারেল লায়বিলিটি।

বেশ, আপনাদের এজেন্ট ছিল কারা?

অ্যালান গুডইয়ার আর জ্যাক ম্যাকফেডেন।

সিগারেটে লম্বা টান দিল হফম্যান, তারপর ছাতের দিকে তাকিয়ে ধীরেসুস্থে ধোঁয়া ছাড়ল। প্রথম কে করিয়েছিল? গুডইয়ার?

হ্যাঁ।

মাথা নেড়ে বুড়ো আঙুলের নখ কামড়ালো কিছুক্ষণ। তারপর বলল, পলিসিগুলো আমি দেখেছিলাম। সব কটাই হুবহু একই ধরণের। মনে হয় আপনাদের থেকে পলিসিটা করানোর পর অন্যগুলো করতে মেয়েটার আরও সুবিধা হয়েছিল, তাই না?

অনেকটাই তাই।

এই ধরণের পলিসি এর আগে কেউ করিয়েছে বলে শুনেছেন?

না, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না।

কনিরা যে এতে জড়িত হঠাৎ এই ভাবনা আপনাদের মনে এল কী করে?

জড়িত আছে নাকি?

জবাব দেবার আগে হফম্যান তার মোটা নাকটা ঘস ঘস করে রগড়ে নিল। হয়তো আছে, বিশেষ করে কনি লোকটার ওপর নজর রাখারও প্রয়োজন আছে, তাকে দেখেছেন নিশ্চয়ই?

না দেখিনি, কাল তার সঙ্গে দেখা করতে যাবার ইচ্ছা আছে।

দেখা করে আসুন তাহলে। আমি তো জোর গলায় বলতে পারি লোকটার পুলিশের খাতায় নাম আছে। তবে সে সম্ভবের চাইতে একটু বেশী ধুরন্ধর। আমি তো তার সম্বন্ধে এখনও পর্যন্ত কিছুই জেনে উঠতে পারিনি।

কোরিন মেয়েটাকে দেখে কেমন মনে হয়?

ঠোঁট বেঁকিয়ে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল হফম্যান, ও কিছু না। এই লোকটাই পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে।

সব কিছুর পেছনে বলার অর্থ?

হফম্যানের মুখে সবজান্তার মতো বিখ্যাত সেই হাসি, ধৈর্য ধরে কিছুদিন তার ওপর নজর রাখলেই সব ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার ওপর মুখে কুলুপ এঁটে থাকার নির্দেশ মাথায় ঝুলছে। হ্যাঁ, ভালো কথা, পলিসির ওপর আঙুলের ছাপ দেওয়ার বুদ্ধিটা কার মগজের? গুডইয়ারের না মেয়েটার?

মেয়েটারই হবে।

হফম্যান আবার মাথা নাড়ল, আমি আগে থাকতেই জানতাম, কনি লোকটা এতো বোকা নয়।

আমি ধৈর্যের বাঁধ ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা রুক্ষ স্বরেই বলে উঠলাম, আপনি ঝেড়ে কাশলে আমাদের সময়ও বাঁচত আর ঝক্কি ঝামেলাও অনেক কম হতো। আপনার মক্কেলটি কে জানতে পারি কি?

উঁহু, উপায় নেই বলার। এর পেছনে বহুরথী মহারথীও জড়িত, আমার এক পা ভুল পদক্ষেপে সব কেঁচে গণ্ডুষ হয়ে যাবে। যাক, খবরগুলোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আপনার কাজে লাগতে পারে এমন কিছু তথ্য আমার হাতে এলেই আমি আপনাকে জানিয়ে দেব।

আমি ওঠার বিন্দুমাত্র কোন লক্ষণ না দেখিয়েই বললাম, আমি কিন্তু এই মুহূর্তে আপনাকে এমন একটা খবর শোনাতে পারি, যা শুনলে রাতের ঘুম আপনার পালিয়ে যাবে। ম্যাসনকে মনে আছে আপনার?

ডেনির অফিসের দারোয়ান?

হ্যাঁ, ভুরু কুঁচকে উঠল হফম্যানের। কি হয়েছে তার?

গতকাল রাতে সে খুন হয়েছে।

চমকে উঠল সে, খুন হয়েছে?

হ্যাঁ, ছুরির সাহায্যে নির্মম হত্যা। কেন, কাগজ পড়েননি?

তাতে আমার কী আসে যায়? উত্তেজনায় দুহাতের মুঠো শক্ত করে রেখেছিল হফম্যান। এসব আমাকে শোনানোর অর্থ কী?

কারণ, যেসময় খুন হয় ঐ সময় আপনি ও বাড়িতে ছিলেন। আপনার কর্মকাণ্ড দেখতে গিয়েই বেচারীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

মিথ্যে কথা! ঝুঁকে বসে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে ও তাকাল। আপনিও তখন ওই বাড়িতে উপস্থিত। আমি যদি বলি আপনি তাকে ছুরি মেরেছেন?

মুখ দিয়ে অবিরাম ধারায় ঘাম চুঁইয়ে ঝরে যাচ্ছিল ওর, জ্বলন্ত দৃষ্টির পরিবর্তে দুচোখে এখন চাপা-আতঙ্ক। চকিতে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলবার উঁচিয়ে ধরল আমার সম্মুখে। একপলক সেটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে সেদিন যে মহিলা ছিল তিনি কে? আপনার কোন ধনী মক্কেল?

উঠে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে রিভলবার ঝাঁকালে আমার সামনে, বেরিয়ে যান।

হাবভাব দেখেই বুঝলাম ওষুধে কাজ হয়েছে, এখন আর গুলি চালাবার জন্য ওকে বিশেষ প্ররোচনার আর দরকার হবে না।

অযথা ঝুঁকি মাথায় না নিয়ে দালানে বেরিয়ে এসে বলি, খুব বেশীদিন তাকে গোপনে লুকিয়ে রাখা আপনার ক্ষমতায় কুলোবেনা। আপনি নিজেও ঐ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন। তার থেকে আমার কাছে সব কথা খুলে বললে আপনারই সুবিধা হতো। আমাদের কোম্পানির পক্ষে কেউ থাকলে পুলিশকেও তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট সমঝোতা করেই চলতে হয়। একটু ভেবে দেখবেন।

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে যদিও সে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু চোখের দিকে তাকাতেই বুঝলাম, সেখানে লোভ আর শঙ্কার দ্বন্দ্ব চলছে। পরিশেষে যা হয়ে থাকে সব সময়-লোভেরই জয় হলো।

জাহান্নামে যান! খিঁচিয়ে উঠে আমার মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল সে।

পরের দিন সকাল সকাল পোক গায়ে পরার সময়ে হেলেনকে হফম্যানের সঙ্গে কথাবার্তার বিশদ বিবরণ দিয়ে দিলাম। গতরাতে যখন ফিরে আসি ও তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, ইচ্ছে করেই আমি তার কাঁচা ঘুম আর ভাঙাইনি।

বিছানায় উঠে বসে চোখ দুটো বড় বড় করে ও একমনে আমার কথা শুনছিল। সবশেষে আমি শুধু বললাম, আমার দৃঢ় ধারণা, ম্যাসন ওর হাতে খুন হয়নি। আর ও যদি নাও করে থাকে তাহলে একটাই উজ্জ্বল সম্ভাবনা কাজটা সেই রহস্যময়ী মেয়ের কাজ। আমার মনে হয় ঐ মেয়েটা হফম্যানকে কাজে লাগিয়েছে। ওরা দুজনেই একসঙ্গে ডেনির অফিসে ঢুকেছিল। আর খুব সম্ভব, মেয়েটা যখন পলিসিগুলো পরীক্ষা করেছিল, হফম্যান তখন তাদের আসল উদ্দেশ্যটা চাপা দিতে ঘটনাটা এমনভাবে সাজিয়ে ফেলে, যাতে দেখে মনে হয় ওটা ডাকাতির চেষ্টা।

ম্যাসনের কান হয়তো কিছু আওয়াজ শুনেই কৌতূহলেই সে এগিয়ে দেখতে গিয়েছিল, সেই সময় মেয়েটা তাকে ছুরি মেরে কোনরকমে ওখান থেকে পালায়। এই কারণেই আমার মুখ থেকে শোনা দারোয়ানের ছুরি খেয়ে মৃত্যুর ঘটনাটা শুনে হফম্যান চমকে উঠেছিল।…বলল, আমার থিওরিটা শুনে তোমার কী মনে হচ্ছে?

হেলেন সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর বিছানা থেকে নেমে স্নান ঘরের দিকে এগোতে এগোতে মুখে শুধু বলল, আমাদের হফম্যানের পেট থেকে আরো কথা আদায়ের চেষ্টা করা উচিত নয় কি?

আমি তা ভেবে দেখেছি। দেখি খাওয়া-দাওয়া সেরে আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব।

প্রাতঃরাশ সারতে সারতে ইগানের মুখ থেকে শুনলাম, হফম্যান চলে গেছে। সে বলেছে, রাত্রেই গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ আমার কানে গিয়েছিল। উনি এত তাড়াতাড়ি হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন যে হোটেলের পাওনাগণ্ডাও অসম্পূর্ণ রেখেই চলে গেছে।

আপনি তাহলে এখন কী করতে চান? হেলেন প্রশ্ন করল, শেরিফকে জানাতে চান ব্যাপারটা?

মাথা নাড়ল ইগান, নাঃ, হফম্যান এর আগেও এখানে এসেছে। কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেখি।

ইগান চলে যাবার পর পরই হেলেনের গলার স্বর একেবারে পালটে গেল। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সে বলে উঠল, ইস্! সুবর্ণ সুযোগ হাতে এলেও আমরা তা হারালাম। আমাদের উচিত ছিল ওর ওপর, নজর রাখা।

ও চিন্তা কোর না, ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি। ওকে এসময় কোথায় পাওয়া যাবে তা একমাত্র আমি জানি। লস এঞ্জেলসে পা দেওয়ার আগে ভাগেই আমি ঠিক ওকে ধরে ফেলব।

প্রাতঃরাশের পর ডেড লেকের উদ্দেশ্যে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। মাইল তিনেক পরে ইগানের শোনা আঁকশির মতো রাস্তাটা চোখে পড়ল। সামনে একটা ঝরঝরে নোটিশ বোর্ড। তাতে মুক্তোর মতো হরফে লেখা?

ব্যক্তিগত পথ
শুধু একদিকে গাড়ি যাবে
ঘন্টি বাজান

 তুমি কী ঘণ্টা বাজাবে নাকি? হেলেন জিজ্ঞাসা করল।

পাগল নাকি! আমরা যে আসছি ওদের আগে থাকতে আমাদের উপস্থিত সম্বন্ধে সতর্ক করব কোন দুঃখে! এটুকু ঝুঁকি তো আমাদের নিতেই হবে।

 আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। রাস্তাটা এত সরু যে দু-পাশের জংলী গাছগুলো গাড়িতে লেগে ছিটকে যাচ্ছিল। প্রায় মাইল খানেক পরে রাস্তা কিছুটা চওড়া হয়ে গেল, আরও দু-মাইল যাবার পর হ্রদের জল আমাদের গোচরে এল।

গাড়ির গতি কমিয়ে এনে বললাম, যাক আর বেশী দূর নয়, এসে গেছি। এবার গা ঢাকা দিয়ে জায়গাটা একবার দেখে আসতে হবে।

গাড়িটা একটা গাছের নীচে দাঁড় করিয়ে রাস্তার শেষপ্রান্তের দিকে আমরা এগিয়ে চললাম। সামনেই বিরাট হ্রদ। সকালের মিঠেসূর্যের আলো জলের ওপর পড়েছেআর চিকচিক করছে হ্রদের এই জল। অন্ততঃ মাইল দুই চওড়া হবে হ্রদটা। পাড় থেকে সিকি মাইল দূরে আমাদের বিপরীত দিকে একটা ছোট দ্বীপবড় বড় ফার গাছে ওটাকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিল।

কি সুন্দর জায়গা, চোখ জুড়িয়ে যায় না গো?

হেলেনের কণ্ঠ জুড়ে আজ উচ্ছ্বাস ফেটে পড়ছে।

সে আর বলতে! ঠিক যেন এক দুর্গ।

প্রায় দশমিনিট দ্বীপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জনপ্রাণীর কোন চিহ্ন আমাদের নজরে এল না। ছোট্ট ঘরটার কাছে একটা মোটরবোট তখনও বাঁধা রয়েছে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি বলে উঠি, চলো, ওদিক বরাবর কোন নৌকা-টৌকা আছে কিনা একবার দেখে নেওয়া ভাল।

এদিকের ঘাটেও একটা নৌকা, তাতে মোটর ছিল না। দাঁড় টানতে হবে দেখে কোট খুলে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিলাম। হেলেন বসার পর দ্বীপের দিকে নৌকা নিয়ে এগিয়ে চললাম।

ঘর্মাক্ত মুখটা রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে বলে উঠি, লোকটার কাছে যদি রাইফেল থাকে আর গুলি চালানোর অনুশীলনে সে যদি আমাদের বেছে নেয়?

খুব খারাপ হবে না তাহলে। হেলেন খরখরে কণ্ঠে এই কথার জবাব দিয়ে বসে। দয়া করে এখন চুপ করো তো! এই দৃশ্যটা আমি খুশী মনেই উপভোগ করছি।

দ্বীপে পৌঁছতে প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল। নৌকার মুখ যখন ঘাট স্পর্শ করল আমি তখন একেবারে ঘর্মাক্ত কলেবর। হেলেন তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে এগিয়ে গিয়ে নৌকাটা বাঁধতে শুরু করে দিল। আমি ওর পাশে গিয়ে বললাম, ওঃ, এটা নিয়ে ফেরার কথা ভাবতেই আমার এখনই গায়ে জ্বর এসে যাচ্ছে। রৌদ্রের তেজ তখন তিনগুণ বেড়ে যাবে।

তোমার ওজনও যে কিছুটা কম হয়ে যাবে সেটাও একবার ভেবে দেখছো,নির্মম কণ্ঠে জবাব দিল হেলেন।

হ্রদ থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে। পঞ্চাশ গজের মতো সেই রাস্তা ধরে হেঁটে আমরা একটা নির্জন জায়গায় এসে পড়লাম। সামনেই ছোট একটা কুটির আর জরাজীর্ণ কতগুলো পুরনো আমলের বাড়ি। কুটিরের চওড়া বারান্দার ওপর কতকগুলো চেয়ার আর কাঠের একটা টেবিল পাতা আছে।

পরিবেশটার মধ্যে অদ্ভুত এক শ্রীহীন বিভীষিকা অনুভব করলাম।

যাক বাবা, কুকুর-টুকুরও কোথাও নেই, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল হেলেন। সারা রাস্তা আমি কুকুরের ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম।

ওদের কুকুরের কোন প্রয়োজন নেই। গোখরো সাপ নিয়ে ওদের সংসার, তাকে ওরা দুধকলা দিয়ে পোষে। মনে আছে নিশ্চয়ই?

কুটিরটা একদৃষ্টে লক্ষ্য করছিলাম। জানালাগুলো আর সামনের দরজাটা খোলা। ভেতর থেকে কোন একটা ঘর থেকে রেডিওর আওয়াজ ভেসে আসছিল।

হেলেনের উদ্দেশ্যে আমি বললাম, মিঙ্ক পোষার খামার অথচ মিঙ্কের দিক থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই–আশ্চর্য! দেখা যাক, বাড়িতে কেউ আছে কিনা।

বারান্দার সিঁড়িতে তিন ধাপ সবে উঠেছি এমন সময় দোর গোড়ায় এসে দাঁড়ায় একটি মেয়ে। ইগান আর মসি-ফিলিপসের মুখ থেকে শোনা সুসান আর তার বোনের মধ্যে আশ্চর্য এক মিল আছে।কিন্তু দুজনের মধ্যে সামান্যতফাৎ আমার দৃষ্টিতে ফাঁকি দিতে পারলনা। এই মেয়েটির মুখও ভরাট তবেদাঁতগুলো সামনের দিকে যৎসামান্য ঠেলে উঠেছে। তাছাড়া মাথার কেশও কালো আর যতদূর মনে হয়, স্বাস্থ্যও সুসানের চাইতে ভালো। গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। হেলেনকে প্রথম দর্শনে দেখে নিয়ে তারপর হাসি হাসি মুখে আমার দিকে মুখ ফেরাল। আপনারা যুগলবৃন্দ কোত্থেকে উদয় হলেন? এত গরমে এতটা পথ নিশ্চয়ই দাঁড়ের সাহায্যে আসেননি?

আপনার ধারণাই ঠিক, আসলে আমরা এভাবেই এসেছি।রুমালে মুখ মুছলাম আমি। আমরা উঠেছিম্প্রিংভিল হোটেলে। ওখানকার পেট ইগানের কাছ থেকে আপনাদের মিচাষ সম্বন্ধে সেই প্রথম শুনলাম। আমার স্ত্রীর বহুদিনের শখ একটা মিঙ্ক কোট করানো। তাই ভাবলাম, আপনাদের এখানে জ্যান্ত মিঙ্কগুলো দেখিয়ে যদি ওর সখের কিছুটা পূরণ করা যায়…ওগুলো দেখাতে আপনাদের যদি খুব অসুবিধে না হয়।

বারান্দায় চলে এল কোরিন কনি। আমাদের দেখে ওকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখে আমার প্রথমে অবাক-ই লেগেছিল।

সত্যিই কি আপনারা মিঙ্কগুলো দেখার অভিপ্রায়ে নৌকা চালিয়ে এতটা পথ এসেছেন? ইস, বেচারী! শুধু শুধু এতো কষ্ট ভোগ করতে হল আপনাদের। ঐ হতচ্ছাড়াগুলো তো কবে ইহ জগত ত্যাগ করেছে!

সে কি? ইগান যে বলল…

জ্যাক ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল, খিল খিল করে হাসতে থাকে কোরিন, তাই ও কথাটা কারুর কাছে প্রকাশ করেনি। আসলে ওগুলো ওর দোষেই মারা যায়। নিন, বসুন আপনারা, ঠাণ্ডা কফি খাবেন?

চমৎকার প্রস্তাব, এই প্রথমবার হেলেন মুখ খুলল।

কিন্তু আপনার কোন কষ্ট হবে না তো?

ছিঃ ছিঃ, এসব কী বলছেন? এই ছন্নছাড়া জায়গায় মাসের পর মাস মানুষের মুখ দর্শন না করলে আপনারা এটাকেও কষ্ট বলে মেনে নিতে পারতেন না। বসুন, আমি এখুনি আসছি।

কোরিন ভেতরে ঢুকে যাবার পর আমি হেলেনকে বললাম, কী বুঝছো?

হেলেন দুকাঁধে সামান্য ঝাঁকুনি তুলল, মেয়েটাকে দেখে তো ভালোই মনে হয়। তবে ও আমাদের পেয়ে খুশি হয়েছে এটা সত্যিই আশ্চর্যের।

ওর কত্তাটি অসময়ে গেলেন কোথায়? এখন সেও যদি আমাদের দেখে খুশি হয় তাহলে আমাদের সব থিওরি ভেস্তে যাবে।

কোরিন ফিরে এল হাতের ট্রেতে তিন গ্লাস কফি। ও ট্রেটা নামিয়ে রাখতেই আমি বলে উঠলাম, আমাদের পরিচয় পর্বটা আগে না হয় সেরে ফেলা যাক। এ হলো আমার স্ত্রী, হেলেন। আর আমি, স্টিভ হারমাস। আমরা এই প্রথমবার স্প্রিংভিলেতে ছুটি কাটাতে এসেছি।

আমি কোরিন কনি। আমার স্বামী আশেপাশেই কোথাও আছেন। সম্ভবতঃ সাপ ধরার কাজে ব্যস্ত।

সাপ? হেলেন বলে উঠল, তাহলে নিশ্চয়ই সুসান গেলার্ট আপনার সহদরা বোন হবেন। গতকাল রাত্রে উইলিংটনে তার শো দেখতে গিয়েছিলাম। কী আশ্চর্য যোগাযোগ বলুন তো!

কথাটার কী প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার জন্যে আমি কোরিনের দিকে তাকালাম, কিন্তু একটা মনোরম বিস্ময় ছাড়া এর বেশী কিছু প্রস্ফুটিত হলো না ওর মুখে। খুশি খুশি গলায় ও বললো, সত্যি সত্যি আপনারা সুসিকে দেখেছেন? তাহলে তো এটাকে অদ্ভুত যোগাযোগ বলে মানতেই হয়। বিয়ের আগে আমিও শো দেখিয়ে বেড়াতাম। এগিয়ে এসে আমার পাশে বসে পড়ল।

মাঝে মধ্যে ভাবি, আমার মাথায় বোধহয় কোন গণ্ডগোল হয়েছিল। না হলে এই ভয়ঙ্কর জীবনের জন্য কেউ ওটা ছাড়ে! যাক, কীরকম লাগল বলুন সুসির অভিনয়?

মনে হল, বড় ভোলামেলা, আমি বলে উঠলাম।

 সাপটাকে দেখে আমার তো ভিরমি খাবার উপক্রম দেখা দিয়েছিল।

বাঁধ ভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ল কোরিন।বেলরিয়াস, কে দেখে? ওর তো একটা মাছি মারারও ক্ষমতা নেই। সাপটা সুসিকে দেবার সময় জ্যাক ওর বিষ থলিটা আগেই খুলে নিয়েছিল। কিন্তু মজার কথা এই যে, সুসি আজও জানে ওটা বিষধর সাপ।

সে কী! আমি হতবাক। ম্যানেজারও সুসির মতোই ঐ একই ধারণা পোষণ করে।

সে তো সাপটাকে দেখাশুনো করার ব্যাপারে একটা ওঝাও রেখে দিয়েছে।

জানি সব, কোরিন হাসতে লাগল। জ্যাকই ঐ লোকটাকে ঠিক করে দিয়েছে। সুসি খেলাটাকে বেশী গুরুত্ব দেয়। ওর ধারণা, সাপটার বিষ না থাকলে লোকের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। তাই ওকে না জানিয়ে আমরা এই ব্যবস্থা করেছিলাম। এমা, আমি আবার সব ফাস করে দিলাম! দোহাই আপনাদের, সুসির সঙ্গে দেখা হলে এই সত্যি কথাটা ওর কানে তুলবেন না যেন।

না না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, হাসতে হাসতেই জবাব দিই আমি, আমার আর আপনার মধ্যে এই কথা আমাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, উনি এর বিন্দু বিসর্গও জানতে পারবেন না।

হেলেন একদৃষ্ট কোরিনকে লক্ষ্য করছিল। এতক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎ করে সেবলল, সত্যিই আপনাদের অদ্ভুত মিল।

আমাদের দেখলে সবাই এই একই কথা বলে। বিয়ের আগে আমরা দুজনে একসঙ্গে খেলা দেখাতাম। আমি তো জ্যাককে কতবার বোঝাবার চেষ্টা করেছি, এই দ্বীপ ছেড়ে চল লোকালয়ে ফিরে যাই। সুসি আর আমি আবার একসঙ্গে খেলার আসরে নামতে পারব। বেচারী সুসি! সাপটাকে নিয়ে ও নিউইয়র্কে শো করার স্বপ্ন দেখে। আমার কোন কথাই ও কানে তোলে না। বাইরের দিকে চোখ পড়তেই কোরিন বলে ওঠে, এই তো, জ্যাক এসে গেছে।

আমরা দুজনে ঘুরে তাকালাম। বেঁটে-মোটাসোটা গড়নের একজন লোক রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছিল। পরনে মলীন সাদা ফতুয়া, মোটা কাপড়ের প্যান্ট আর পায়ে উঁচু বুটজুতো। কাঁধে ঝোলানো এক চটের বস্তা।

লোকটার বয়স তেত্রিশ থেকে বড় জোর চৌত্রিশ, তার বেশী হতে পারে না। অথচ এর মধ্যেই টাক পড়তে শুরু করেছে। থলথলে গোলাকার মুখটা রোদের তাপে বিবর্ণ, গর্তে ঢোকা চোখজোড়া নুড়ি পাথরের মতো নিষ্প্রাণ আর ভাবলেশহীন। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই আমাদের দুই মূর্তিমানকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

কোরিন বলল, জ্যাক, এরা হলেন মিঃ অ্যান্ড মিসেস হারমাস। পেটে ইগানের কাছ থেকে খবর পেয়েই আমাদের মিঙ্কের চাষ দেখতে এখানে হাজির হয়েছেন।

আপনারা সেই এলেনই তবে বড় বেশী দেরী করে ফেলেছেন, অস্বাভাবিক মৃদু গলার স্বর লোকটার। বহুদিন আগেই ওগুলো মরে গেছে। আপনারা কি নৌকো করে এসেছেন?

হা, আমি বললাম। বেলটা বাজাবো একবার ভেবেছিলাম, তারপর কী মনে হল, আপনাদের আর বিরক্ত করার ইচ্ছে হলো না।

জ্যাক কনি মাথা নাড়ল। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার মনের মধ্যে কী চলছিল, তবু দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা আর মাথা নাড়ার কায়দার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা দেখলে সহজেই টের পাওয়া যায়, মোটেই সুবিধের নয় এই লোকটা। কাঁধ থেকে বস্তাটা নামিয়ে রেখে জ্যাক কনি বলল, কোরিন আপনাদের দেখিয়ে দেবে জায়গাটা। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমাকে বেরোতে হবে। আপনারা চাইলেও আমার সঙ্গে আসতে পারেন।

কুটিরের দরজা বরাবর এগোতেই কোরিন বলে উঠল, কিন্তু জ্যাক, আমি যে ভেবেছিলাম, ওঁদের খেয়ে যেতে বলবো।

জ্যাক কনি থমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কোরিনের দিকে। মুহূর্তের জন্য নিষ্প্রভ চোখের জ্যোতি জীবন্ত হয়ে এক হলুদ দীপ্তিতে ঝলসে উঠল।

আমি যাবার সময় ওদের নিয়ে যাব, বলেই ঢুকে গেল কুটিরের ভেতর।

অস্বস্তিকর এক নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল আমাদের মধ্যে।

অবশেষে কোরিন মুখে আড়ষ্ট হাসি হেসে বলে উঠল, আপনারা কিন্তু জ্যাককে ক্ষমা করে দেবেন। লোকজন ও একদম সহ্য করতে পারে না। আসলে এত বছর ধরে একা থাকতে থাকতে বিনয় জিনিসটা সে একেবারেই ভুলে গেছে।

না না ঠিক আছে, হেলেন সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। মোটরবোট করে ফিরতে স্টিভের ভালোই লাগবে। ওত এই গরমে নৌকা চালাতে একেবারে অরাজী ছিল।

তাহলে আসুন আপনাদের দ্বীপটা ঘুরে দেখিয়ে দিই। কোরিন উঠে পড়ল। দেখার বিশেষ কিছুই নেই, তবে আপনাদের হয়তো ভালো লাগতে পারে।

দেখার মতো কিছুই ছিল না। আমি যা অনুমান করেছিলাম দ্বীপটা তার থেকে অনেক ছোট। কুটিরের ঠিক পেছনে পনেরো-ষোলটা খাঁচা দেখলাম। সব কটাই শূন্য। দেখে বোঝা যায়, কোন এক কালে মিঙ্কের রাজত্ব ছিল ওখানে। খাঁচাগুলো দেখিয়ে কোরিন বলল, জ্যাকের আজকাল সাপ ধরেই চলে যায়, তাই মিঙ্ক নিয়ে আজকাল ওর কোন মাথা ব্যথা নেই।

ঘুরতে ঘুরতে আমরা ঘাটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি এমন সময় জ্যাক কনি এসে হাজির। মুখে কিছু না বলে সোজাসুজি মোটরবোটে উঠে বসল সে।

আচ্ছা, বিদায় তাহলে, কোরিন বলে উঠল। কথা এতো কম হল বলে আমার সত্যিই বড় বিশ্রী লাগছে। এদিকে এলে মনে করে একবার আসবেন কিন্তু।

হেলেনকে ওর সঙ্গে করমর্দন করতে দেখে আমি নিজের সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেট নিয়ে কেসটা কোরিনের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।

ও, ধন্যবাদ বলে সিগারেট নিতে তার হাত বাড়িয়ে দিল।

কিন্তু আমি অনেকটা ইচ্ছে করেই কেসশুদ্ধ ওর হাতে ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলাম, এহ হে, কি হল বলুন তো!

না না, এটা আমারই দোষ। হাসতে হাসতে একটা সিগারেট ধরিয়ে কেসটা বন্ধ করে আমায় ফিরিয়ে দিল ও।

যাক, এখানে আসাটা তাহলে একেবারেই বৃথা হয়নি। ওর আঙুলের ছাপ এখন আমার হাতে।

মোটরবোটে উঠতে যাব ঠিক এই সময় হঠাৎ এক বিশ্রী শব্দ কানে আসতেই চমকে পেছনে তাকালাম। কুটিরের দিক থেকে কারুর অস্পষ্ট এক আর্ত চিৎকার ভেসে আসছিল।

কে চেঁচাচ্ছে? আমি জানতে চাইলাম।

আমার দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না যে জ্যাককনি শব্দটা শোনামাত্র আড়ষ্ট হয়ে গেছে, আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার ব্যর্থ প্রয়াস। তাড়াতাড়ি করে আমি কোরিনের মুখের দিকে তাকালাম।

চমকে গিয়েছিলেন নাকি? হাসতে হাসতে বলল ও। ওটা আমার পোষা কাকাতুয়া। আপনাকে দেখাতে ভুলে গেছি। রাত্রে ওর চিৎকার শুনলে সবাই চমকে যায়। কাউকে প্রাণে মারা হচ্ছে যেন, অনেকটা তাই না?

হ্যাঁ, কোনরকমে আমি বলে উঠলাম। জানি না কেন আমার মেরুদণ্ড দিয়ে তখন একটা হিম স্রোত নেমে যাচ্ছিল।

আসুন, উঠে পড়ুন, জ্যাক কনি তার নরম গলায় যতটা সম্ভব কাঠিন্য এনে বলে উঠল। ইতিমধ্যে সে ইঞ্জিনও চালু করে ফেলেছে। আমি আর হেলেন বসার পর মোটরবোটটা চলতে শুরু করে দিল।

ঘাটে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে লাগল, কোরিন।

 বড় চমৎকার জায়গায় থাকেন আপনারা,কনিকে বললাম আমি।

জবাব দেওয়া দূরে থাক মুখ তুলে তাকাল না একবারও।চুপনা থেকে আবার বলি, আপনার স্ত্রীর পক্ষে জায়গাটা একটু বেশী নির্জন হয়ে গেছে।

উত্তরে সে মোটরবোটের ইঞ্জিনগুলো সম্পূর্ণ গতিতে চালিয়ে দিল, যার প্রচণ্ড গর্জনে কথা বলা অসম্ভব।

 বিপরীত ঘাটে পৌঁছতে দশ মিনিটও বোধহয় লাগল না। জ্যাক কনি সারাক্ষণ ধরে আমাদের উপেক্ষা করে তার চোখের দৃষ্টি সামনের দিকেই স্থির ছিল। ঘাটের কাছে এসে ইঞ্জিন বন্ধ করে এই প্রথম তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল, আমাকে আরও ওপাশে যেতে হবে। আপনারা নেমে যান।আমরানামার পর বলে উঠল, এখানে যদি আসতেই হয় বেল বাজিয়ে আসবেন। সেইজন্যই ওটা লাগানো হয়েছে। আমাদের এখানে চোর-হিচড়ের কোন অভাব নেই, সেইজন্য আগে গুলি চালিয়ে পরে আমি ক্ষমা চেয়ে থাকি।

কথা শেষ হতে মুখ ঘুরিয়ে সে মোটরবোট করে চলে গেল। একবারও আর পেছনে তাকাল না।

এই লোককে খুব মিশুকে বলা যায় না, কী বলো? আমি হাসতে হাসতে বললাম।

উঃ, কী ভয়ঙ্কর! মোটরবোটটা একদৃষ্টে লক্ষ্য করতে করতে হেলেন বলল,লোকটা আমার হৃন্ত্রে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল।

গাড়িতে উঠতে উঠতে শুধু বললাম, মেয়েটার আঙুলের ছাপ সিগারেট কেসের ওপর নিয়ে নিয়েছি। তোমার পাউডার একটু পেলেই এক্ষুনি আমি ওটা পরীক্ষা করে নেব।

সিগারেট কেসের ওপর পাউডার ছড়াতে যে ছাপটা স্পষ্ট হল, সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে এটুকু বুঝতে পারলাম, পলিসির ওপর যে ছাপ পড়েছে তা কোরিনের আঙুলের ছাপ নয়।

কেসটা হেলেনকে দেখিয়ে বললাম, চেয়ে দেখো, এই সম্ভাবনাটাও বাতিল। অর্থাৎ আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। আচ্ছা, তখন ওর আওয়াজটা তোমার কাকাতুয়ার মতো শুনিয়েছিল?

বলতে পারলাম না. হেলেনকে বিভ্রান্তর মতো দেখাল। আমি তো ভীষণভাবে চমকে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে মজার কথা, দ্বীপটা ঘুরিয়ে দেখালেও কোরিন আমাদের দ্বীপের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়নি।

তার অন্য কোন কারণও থাকা স্বাভাবিক। সবারই নিজেদের ঘরদোর দেখানোর ব্যাপারে কখনোই আগ্রহ থাকে না। আমার কান যদি ধোঁকা না খেয়ে থাকে তবে ওটা কোন মেয়েছেলের চিৎকার ছিল ইঞ্জিন চালু করলাম।

জ্যাক কনির আঙুলের ছাপটা নিতে পারলে ভালোই হতো। হফম্যানের ধারণাই ঠিক ছিল। লোকটার চেহারা জেল ফেরত আসামীর মতো। তবে তাকে হয়তো এত সহজে ফাঁদে ফেলা সম্ভব হতো না। কোরিনই বা নিজে থাকতে এত ধরা দিল কেন বুঝলাম না!

হ্যাঁ, এটাও একটা প্রশ্ন–যদি না ইচ্ছে করেই ছাপ দিয়ে থাকে,গলায় চিন্তার ছাপ হেলেনের।

কতকগুলো জিনিস ভালো করে একবার চিন্তা করো তো স্টিভ। আমাদের দ্বীপে যেতে কোনরকম বেগ পেতে হলো না…কেন? নৌকা রাখার যুক্তি কি?

ওর নিজেরই যখন একটা মোটর বোট আছে তখন কোন দুঃখে একটা নৌকা বেঁধে রাখে বলতে পারো?

তুমি এবার ব্যাপারটাকে অযথা ঘোলা করে তুলছো? কিন্তু মেয়েটাই বা তার আঙুলের ছাপ আমাদের হাতে আসার সুযোগ করে দেবে কেন?

আর ওটা পেয়ে আমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম? আমরা কী মনে মনে ভাবছিনা, অযথাই ওদের সন্দেহের তালিকায় ফেলা হচ্ছে? আর দোষী হলে আমাদের মনে এই চিন্তাটা জাগিয়ে ভোলা কী ওদের কাম্য নয়?

আমি মাথা নাড়ি, হা, তোমার কথায় যুক্তি আছে বটে।

আমার এখনও বদ্ধমূল ধারণা যে এর মধ্যে হাত সাফাইয়ের কোন ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, ওরা আমাদের যা দেখাতে চাইছে শুধু এইটুকুই আমাদের চোখে পড়ছে। স্টিভ, আমরা যদি এখনও সতর্ক না হই তাহলে মেয়েটাকে বাঁচানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

চট করে আমি একবার ওর মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিই। তোমার তাহলে মন বলছে, মেয়েটাকে ওরা খুন করার মতলবে আছে?

ঐ লোকটার পক্ষে কোন কাজই অসম্ভব নয়। আমার অনুমান মেয়েটার অবস্থা সত্যিই বিপজ্জনক। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে কিনা জানিনা, কিন্তু আমার চোখে পড়েছে সবাই আমাদের ওপর একটু বেশি সদয় হয়ে উঠেছে। সকলে এক কথায় স্বীকার করেছে, মেয়েটার মৃত্যুর পর টাকা দাবি করার কোন সম্ভাবনাই নেই। এই ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো ঠেকছে না, স্টিভ। আমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে, এই দশলক্ষ ডলারের জন্য কোন একজন মেয়েটাকে এমন এক উপায়ে খুন করার মতলব এটেছে, যেটা এখনও পর্যন্ত আমাদের মাথাতেই আসেনি। স্টিভ বিশ্বাস করো, আমি জ্যাক কনির ভয়ঙ্কর ঐ চোখ দুটোর কথা মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছি না। লোকটাকে দেখে ভালোর পরিবর্তে খুনীর মতোই ঠিক দেখতে লাগে।

লোকটা যে সুবিধের নয় তা আমিও মানছি, কিন্তু আমরা যে এগোব তার তো কোন রাস্তা জানা চাই! আমি বলছিনা তোমার কথায় কোন ভূল আছে…তর্ক করতে করতে আমরা হোটেলের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলাম। কিন্তু তবু কোন মীমাংসায় আসা গেল না।

গাড়ি থেকে নামতে নামতেই বলে উঠলাম, ভাবছি তল্পিতল্পা গুটিয়ে লস-এঞ্জেলস ফিরে যাব এখনই। হফম্যানকে যদি ধরতে নাও পারি তাহলে আমার পরবর্তী কাজ হবে, সম্পূর্ণ বিষয়টা ম্যাডন্সের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া।

তাহলে তুমি ফিরে যাও, এখান থেকে এক পাও নড়ছি না আমি, হেলেন উষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে। তুমি এতো ছটফট কোর নাতো! আমাদের একজনকে এখান থেকে দ্বীপটার ওপর নজর রাখতে হবে। খুব শীঘ্রই এখানে কিছু একটা ঘটবে, আমার কথা মিলিয়ে নিও তুমি।

হেলেন, আমি এত আহাম্মক নই তোমাকে এই পরিবেশে অচেনা জায়গায় একা ছেড়ে চলে যেতে পারি না, দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠি।

জ্যাক কনি লোকটা বড় সাংঘাতিক। তার থেকে লস-এঞ্জেলস-এ ফিরে যেতে যদি হয়ই তুমি চলে যাও। আমি এখানে থেকে সব দিকে সামলে নেব।

অযৌক্তিক কথা বন্ধ কর, স্টিভ। হফম্যানকে সামলানো আমার একার কম্ম নয় তা তোমার থেকে ভালো কে বোঝে? নিশ্চিন্তে থাকো তুমি, কনি আমায় দেখতে পাবেনা। দ্বীপের উল্টো দিক থেকে দূরবীণ দিয়ে দিকটা আমি লক্ষ্য রাখব।

.

পেটে ইগান হোটেলের ভেতর থেকে হনহন করে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। জনৈক মিঃ ফ্যান’শ আপনাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন। উনি বললেন, ফিরেই আপনি যেন তাকে ফোন করেন, জরুরী দরকার।

ইগানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করার পর হেলেনকে বলে উঠলাম, ওকে আবার কোন্ পোকায় দংশন করল কে জানে! তুমি বরং এখানে থাকো, আমি ওর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসি।…

হেলেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম। ফ্যান’শর দপ্তর পৌঁছতে কয়েক মিনিটও লাগল না। আমাকে দেখা মাত্রই হই হই করে দ্রুত পদক্ষেপে ছুটে এল সে।

আরে হারমাস নাকি? এসো এসো–ভেতরে এসো। ম্যাডক্সের কড়া হুকুম, গেলার্টের কাজ ছেড়ে এখন থেকে তুমি আমার হয়ে কাজ করবে।

কী ব্যাপার কী–এত হাঁক-ডাক কিসের? আমি তো তোমার কাছে এমনিতেই আসছিলাম।

ব্যাপার খুব গোলমেলে। ফিল্মস্টার জোইস শারম্যানকে কেউ কিন্তু ন্যাপ করে নিয়ে গেছে। ম্যাডক্স আমাদের হয়ে ব্যাপারটা তদন্ত করার দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছে, এই তার নির্দেশ।

তা, এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি? বলেই মনে পড়ে গেল, সম্প্রতি অ্যালান গুডইয়ার জোইস শারম্যানকে দিয়ে একটা পলিসি করিয়েছে।

মুক্তিপণের দায়িত্ব কি শুধুই আমাদের?

আমার এই নির্বুদ্ধিতায় নাক সিটকে এক বিশ্রী শব্দ করল স্বয়ং ফ্যান’শ।

দায়িত্ব আমাদের ঘাড়েই পড়বে বৈকি। কিডন্যাপিং-এর জন্যই নসিওর করিয়েছিল। তাকে। যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের সন্ধান করতে হবে, আর তার খোঁজে ব্যর্থ হলে পুরো পঞ্চাশ হাজার ডলার আমাদের গুণেগুণে দিতে হবে। নাও, চটপট এবার কাজে লেগে পড়ো তো।