০৩. চাপা উত্তেজনা

০৩.

কে ও? চাপা উত্তেজনায় হেলেনের গলা থরথর করে কাঁপছে। ঐ অবস্থায় সে আমার পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

নাও, টর্চটা ধরো।

টর্চটা ওর হাতে দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বার করে হাতে জড়িয়ে নিলাম। তারপর জাফরি লাগানো দরজাটা আলতো করে খুলে ঝুঁকে পড়ে দারোয়ানের অসাড় দেহটা চিৎ করে উল্টে দিলাম।কঁধ আর গলা ভেদ করে ঢুকে গেছেছুরির ফলা। কোন দরকার ছিল না, অকারণেই চোখের পাতা টেনে একবার দেখে নিলাম। লোকটা মৃত।

পুলিশের সেই অতি বিখ্যাত সাইরেনের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। হেলেন আমার হাত খামচে ধরে বলল, ওপরে চল। গলি দিয়ে বেরোতে গেলে ওদের সামনাসামনি পড়ে যাব।

নীচে সদর দরজার ওপর দুমদাম করে আওয়াজ হচ্ছিল। আমরা দুজন পড়িমরি করে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে ওপরে উঠতে লাগলাম।

আমরা ওপরে পা রাখার অগেই পুলিশ অন্দর মহলে ঢুকে পড়ল। হেলেন ক্ষিপ্রহস্তে অবতরণ পথের দরজায় লাগানো খিলটা খুলে বলে উঠল, রাস্তাটা ঠিক কোথায় গেছে জানা আছে তোমার?

সেটা এক্ষুণি না হয় জানা যাবে। কিন্তু খিলটা আমরা পেছন থেকে লাগাতে পারবনা। ওরা তখন সহজেই বুঝে যাবে আমরা কোন পথে পালিয়েছি।

ওর পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকতেই নীচ থেকে একজনের কণ্ঠস্বর কানে এল–ওপরে কেউ আছে?

দরজাটা তাড়াতাড়ি করে আটকে দিলাম। অবতরণ পথটা একবার চোখ বুলিয়ে বুঝে গেলাম, ওটা গলি পথে গিয়ে মিশেছে। বাড়ির সামনে দাঁড়ান একজন পুলিশও নজরে এল। রাস্তায় পাহারা বসে গেছে। বললাম; এখান দিয়ে নামা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। হেলেন একটা জায়গার দিকে আঙুল তুলে আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করল। ওখান দিয়ে আমরা যেতে পারি। কষ্ট করে একটু লাফাতে হবে, কিন্তু অসম্ভব হবে না। কুড়ি ফুট নীচে রয়েছে আর একটা ছাত। সম্ভবতঃ ওটাই সেই চীনে রেস্তোরাঁ, যেটা আমি সন্ধ্যার সময় দেখেছিলাম।

পা যদি ভেঙে যায়!

ঠিক মতো লাফাতে পারলে ভেঙে যাবার ক্ষীণ আশাও নেই, বলেই ছাতের ওপর বসে পড়ে, পয়োনালীর খাজে হাত রেখে, নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রেখে সুন্দর ভঙ্গিমায় নিজের দেহটাকে নীচের দিকে ছেড়ে দেয় হেলেন। ছাতে পড়ে পলকের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাতছানি দিয়ে ফিসফিস করে ওঠে, খুব সোজা, নেমে এসো!

নিজের মনে অশ্লিল বুলি আওড়াতে আওড়াতে আমি ছাতের ধারে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। ওর থেকে আমার দেহের ভার যথেষ্ট বেশী।বুঝতে আমার এতটুকু অসুবিধা হচ্ছিল না যে আমার গোড়ালির হাড়টা ভাঙনের পথে। যথাসম্ভব আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভবপর ছিল ঠিক সেই ভাবে ওর মতো করে দেহটা নীচে নামিয়ে হাত ছেড়ে দিলাম। নীচে পড়ার পর মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হল, আমার চলমান নিঃশ্বাস বোধহয় থেমে গেল। হতভম্ব হয়ে নীরবে বসে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর হেলেন হাত ধরে টানতে সম্বিত ফিরে এল, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম।

এভাবে কেউ লাফায়? কপট ধমক দিল হেলেন। লেগেছে?

শিরদাঁড়া আর দুটো ঠ্যাঙ বোধহয় আর আস্ত নেই, গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে,দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলে ফেলি। তবে তোমার চিন্তার কিছু নেই।

অবশ্য একথা বলার কোন প্রয়োজন ছিল না। হেলেনের মনে আমাকে নিয়ে আদৌ চিন্তা ছিল না। ছাদের রোদ শার্শিটা ও ততক্ষণে নিজের ক্ষমতা বলে খুলে ফেলেছে।

দারুণ গন্ধ বেরোচ্ছে!সজোরে নাক টেনে মুচকি হাসি হাসল ও। তারপরেই চোখের নিমেষে রোদ শার্শিতে পা গলিয়ে ঝুপ করে ভেতরে নেমে গেল।

আমি ওকে অনুসরণ করলাম।

অন্ধকারাচ্ছন্ন এক দালানে এসে পড়লাম আমরা দুজনে। সামনে একসারি সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। রেলিঙে ঝুঁকে দেখি বাড়িটা দুতলা, নীচে ওয়েটাররা ট্রে হাতে ঘোরাফেরা করছে।

এখান দিয়ে নামা যাবে না, ওরা ঠিক বুঝে যাবে আমরা ওপর থেকে এসেছি,আমি বলে উঠলাম।

ওরা বুঝতেই পারবেনা। সিঁড়ির মুখে এগিয়ে যায় হেলেন। ওরা এখন ওদের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। চলে এসো।

দ্রুত পদক্ষেপে নেমে পৌঁছে গেলাম চাতালে। মহিলা লেখা এক দরজা ইঙ্গিতে দেখিয়ে হেলেন বলল, বাথরুম থেকে টুপিটার একটা গতি করে আমি আসছি। তুমি ততক্ষণেনীচের একটা টেবিলে গিয়ে বসে পড়।

আমাকে কিছু বলার অবকাশ পর্যন্ত না দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল ও।

গরাদস্তম্ভ ধরে নীচের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে চাতালটা জনশূন্য হতেই তরতর করে নীচে নেমে গেলাম। রেস্তোরাঁর চাতাল ছাড়িয়ে আরও খান দশেক সিঁড়ি অতিক্রম করে যাবার পর সেখান থেকে ধীরে সুস্থে আবার ওপরেই উঠে এলাম, দেখে সকলেই এই ভাববে যে সবেমাত্র রেস্তোরাঁয় ঢুকছি।

চাতালে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে রেস্তোরাঁর দরজার পর্দার আড়াল থেকে উর্দি পরা একজন সজ্জন ব্যক্তি বেরিয়ে এসে আমায় ঝুঁকে পড়ে অভিবাদন জানিয়ে বলল, আপনার টেবিল কী রিজার্ভ করা আছে স্যার?

না। কেন, তার কোন প্রয়োজন আছে নাকি?

না না, ঠিক আছে। আজ বহু টেবিল ফাঁকা।ভুরু কুঁচকে তাকাল সে। পাশের বাড়িতে কোন গণ্ডগোল হয়েছে নাকি? সাইরেনের শব্দ শুনলাম!

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাই, তারপর গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে এনে জবাব দিই, গোটা দুই পুলিসেরও দর্শন পেয়েছি। কিসের ঝামেলা বলা সম্ভব নয়। যতদূর মনেহয় চুরির ব্যাপার, কোথাও চুরি করতে গিয়ে কেউ ধরা পড়েছে বোধ হয়।

হেলেন এসে দাঁড়াল। দুহাত পকেটে গোঁজা, মুখ জুড়ে বিরক্তির চিহ্ন। টুপি না থাকায় ওর চুলগুলো মাথার দুপাশ থেকে নেমে এসে মুখের সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

দুজন স্যার? হেলেনের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল আগন্তুক।

হ্যাঁ। আমাদের ছছেলেমেয়ে আর কুকুরটাকে বাইরে রেখে এসেছি।

অজ্ঞাত নামা ব্যক্তি বার দুই চোখ পিটপিট করল, তারপর হেলেনের দিকে আর একবার তাকিয়ে আমাদের রেস্তোরাঁর মধ্যে নিয়ে চলল।

কীসব আবোল-তাবোল বকছো? হাঁটতে হাঁটতে চাপা গলায় হেলেনের ধমক আমাকে শুনতে হল।

সন্দেহ এড়াতে গেলে এরকম ঘরোয়া প্রসঙ্গ অনেক সময় কার্যকরী হয়ে ওঠে। হাসতে হাসতেই নীচু গলায় জবাব দিলাম।

রেস্তোরাঁটা যেমন বিরাট তেমনই জাঁকজমকপূর্ণ। এক চিকের দেওয়ালে অতিকায় এক ড্রাগনের চিত্র।আমরাঢুকতেই ভেতরে বসেথাকাকিছুঅচেনামুখমুখ তুলে তাকাল।সবার লক্ষ্যের সীমা অবশ্যই হেলেন, আমাকে কেউ ভুল করেও পাত্তা দিচ্ছিল না। কোনের দিকের একটা টেবিল বেছে নিয়ে আমরা বসে পড়লাম। খাবারের অর্ডার দিয়ে হেলেনকে শুধু চাপা গলায় বলি, এভাবে পালানো বোধহয় উচিত হলো না। যে কোন মুহূর্তে আমরা ঝামেলায় ফেঁসে যেতে পারি।

ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়াল হেলেন। মোটেও নয়। বরং ওখানে থাকলেই আমরা আরও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তাম।

পুলিশকে নিশ্চয়ই কেউ সংবাদ দিয়েছিল। কী মনে হয়, আমাদের পেছনে কোন টিকটিকি লক্ষ্য রাখছে?

ঠোঁট উল্টিয়ে কাধ বেঁকালো ও, দেখতেও পারে। আমরা না হয় এখানে কিছুক্ষণ থাকার পর বেরোব। কেউ যদি আমাদের বর্ণনা ওদের কাছে দিয়ে থাকে…।

ঠিকই বলেছে।

ওয়েটারের আগমন ঘটল,তার হাতে ধরা আমাদের ভোজন সামগ্রী। সে চলে যেতে হেলেন বলল, তুমি কি জানো, লোকটা আর বেঁচে নেই?

তাতে সন্দেহের কোন ব্যাপার নেই। ওর গলার শিরা দু-ফালা করা। কিন্তু ও লিফটের ভেতর ঢুকলো কী করে?

বোধহয় অন্তিম প্রচেষ্টায় একটা ফোন করতে অগ্রসর হচ্ছিল। ওর ঘরে ফোন নেই।

তুমি কী মনে কর, ওর মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের ডেনির কোন সম্পর্ক আছে?

হেলেন নিজের মনে বকে যাচ্ছিল, তার কথায় কর্ণপাত করার মতো মানসিকতা তখন ছিল না। কারণ তখন আমার দৃষ্টি আটকে গেছে ঘরের অপর প্রান্তে দাঁড়ান একজন ব্যক্তির ওপর। মুজিমোক্কার মতো লম্বা পেশীবহুল চেহারা। ফোলা ফোলা লোমশ ভুরু জোড়া-নাকের ওপরে একসঙ্গে মিলে গেছে। রোদে-তপ্ত মুখ গম্ভীর,থমথমে, ভাবলেশহীন।পরনেনীল সাদা ডোরাকাটা কোট আর হালকা বাদামী রঙের পালুন। হাতে ধরা টুপি, পিঙ্গল বর্ণের।

সহসা রেস্তোরাঁর জানালা দিয়ে সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভেসে এল। আমাদের আশে পাশের কয়েকজন আসন ছেড়ে এক ছুটে জানলার কাছে চলে গেল ব্যাপারটা দেখতে, কৌতূহল চরিতার্থের জন্য। এক্ষুণি দেখার চেষ্টা করোনা,আমি হেলেনকে বললাম। আমাদের ডোরাকাটা কোর্ট পরা ব্যক্তিটিও এখানে উপস্থিত। মূর্তিমান বেরোবার জন্য উদগ্রীব। আমি ওকে অনুসরণ করছি। তোমার সঙ্গে হোটেলে দেখা হবে।

হেলেন গাড়ির চাবিটা লুকিয়ে আমার হাতে তুলে দিল।তোমার গাড়ি কাজে লাগতে পারে। আমি না হয় ট্যাক্সিতে ফিরব।

ডোরাকাটা কোটকে দরজার দিকে এগোতে দেখে আমি দ্রুত বেগে এগিয়ে গেলাম কাউন্টারের দিকে। পাঁচ ডলারের একটা নোট রেখে বললাম, আমি বাইরের ঝামেলার আবহাওয়াটা একবার দেখতে যাচ্ছি। যা ফিরবে ঐ মহিলাকে দিয়ে দেবেন।

ঠিক আছে, স্যার।

 বারান্দায় এসে দেখি, ডোরাকাটা কোর্ট বাইরে বেরিয়ে পুলিস পরিবেষ্টিত ঘেরা বাড়িটার উল্টো দিক বরাবর হাঁটতে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় এসেদাঁড়ালাম। লোকটা চলার গতিবেগ এতোই বাড়িয়ে দিয়েছিল যে চক্ষের নিমেষে মিশমিশে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

পাশের বাড়িটার সামনে তিনটে পুলিশের গাড়ি আর একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। প্রবেশের পথে বেশ কিছু স্থানীয় লোকের ভিড়। পুলিস হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ভিড় সামলাতে। আমাদের প্রতি নজর দেবার অবকাশ পর্যন্ত তাদের ছিলনা।

আমার গাড়ি বরাবর সেই ব্যক্তিটি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে আমি তার নাগাল পাবার জন্য তাকে অনুসরণ করলাম।

পথ চলতে চলতে বেশ কিছু প্রশ্ন আমার মনে জট পাকাতে লাগল। রেস্তোরাঁতে ঐ ব্যক্তির হঠাৎ করে আগমন ঘটল কেন?

ডেনির দপ্তরের দরজা ভেঙে ঢোকা আর দরোয়ানকে হত্যা করার পিছনেও কী ওর কীর্তি? আবার এমন হওয়ায় অস্বাভাবিক নয় যে বাড়িতে আমাদের দেখামাত্রই রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে সে পুলিশকে ফোন করে এই সংবাদ জানিয়ে দিয়েছে। যদিও সবটাই আমার অনুমান, তবুও..

কিন্তু গলির মধ্যে উদয় হওয়া সেই মেয়েটাই বা কে? খুনের সঙ্গে ওরও কী যোগসাযোগ আছে?

ডোরাকাটা কোট গাড়ি রাখার ঘেরা টোপে প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। চকিতে আমি পাশের একটা দেওয়ালের সঙ্গে গা সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত যে সে আমায় দেখতে পায়নি। বিরাট মাপের ফটকটা পেরিয়ে সে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি নিঃশব্দে লম্বা লম্বা পা ফেলে ফটকের মুখে পৌঁছে গেলাম।

লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না বটে তবে আমি জানি সে ভেতরেই আছে। বিরাট উঁচু দেওয়ালের পাঁচিল। সহজে টপকানো সম্ভব নয়। চেষ্টা করলে আমার কান সেই শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে ভুল করত না। হয় সে নিজের গাড়ির অনুসন্ধানে ব্যস্ত আর নয়তো আমি অনুসরণ করছি বুঝতে পেরে নিজেকে আড়াল করে ঘাপটি মেরে কোথাও অপেক্ষা করছে আমার পরবর্তী কার্যকলাপ দেখার প্রত্যাশাকে বুকে নিয়ে।

লোকটা যদি এই মাত্র একটা খুন করে নিজের হাত রাঙিয়ে থাকে তাহলে আর একটা প্রাণ নিতেও তার হাত কাঁপবেনা। মনের মধ্যে অজানা এক অস্বস্তি দেখা দিল রিভালভারটা খাপ থেকে বার করে, পকেটে ঢুকিয়ে আরো কয়েক মিনিট অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সজাগ দৃষ্টি ভেতরে রেখে দেওয়াল ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। মাঝখানে কম করেও ছটা গাড়ি পরপর সার সার করে দাঁড় করানো। কিন্তু কোনটাতেই জন মানবের নড়াচড়ার চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না। পায়ে পায়ে এক একটা গাড়ির সামনে এগিয়ে ভেতরগুলো ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিলাম।

প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে চললো এই বিচিত্র খেলা।আমিতখন দস্তুর মত ঘামঝরিয়ে চলেছি। সহসা একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকল। চকিতে ডাইনে বাঁয়ে একবার দেখে নিয়ে সটান খালি মাটিতে নিজেকে গড়িয়ে দিলাম। কোথাও ভোরাকাটা-কোটের পাত্তা পর্যন্ত নেই।

গাড়িটা থেমে যাবার পর হেডলাইটটা আপনা থেকেই নিভে গেল। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

মেয়েটার উত্তেজনা পূর্ণ গলা কানে আসছিল?

শেষ পর্যন্ত ফোর্থ স্ট্রীটে খুন হলো! তুমি কি বলল, মৃতদেহটা আমরা দেখতে পাব?

চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি তো নেই। মেয়েটার হাত ধরে দৌড় লাগাল লোকটা।

ওরা বাইরে চলে যেতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। ডোরাকাটা-কোট আমার মতো লোককেও বোকা বানিয়েছে। আমার কানকে ফাঁকি দিয়ে দেওয়াল টপকে পালিয়েছে।

ইস, হেলেন যখন একথা শুনবে সে আমার সম্বন্ধে কী ভাববে? আমার মতো ধুরন্ধর বিচক্ষণ এক গোয়েন্দার হাত থেকে লোকটা পালাল, একথা ওকে বলবই বা কোন মুখে।

নিজের উদ্দেশ্যে খিস্তি আওড়াতে আওড়াতে মাঝে দাঁড় করানো গাড়ি গুলোর পাশ দিয়ে প্রবেশদ্বারের দিকে আমি হেঁটে চললাম।

তৃতীয় গাড়িটা অতিক্রম করতেই একটা হালকা শিসের শব্দে আমার কান সজাগ হয়ে উঠল। থমকে গেলাম, দেওয়ালে যেন মুখ ঠুকে যাচ্ছিল। তারপর রুদ্ধশ্বাসে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে দেখার বৃথা চেষ্টায় লেগে গেলাম। যে কোন তীক্ষ্ণ-দৃষ্টি সম্পন্ন বন্দুকধারীর কাছে আমি এখন চমৎকার এক নিশানা।

মাটিতে বসে পড়ব পড়ব ভাবছি, এমন সময় পেছন থেকে মৃদু খখস্ আওয়াজ হল। রিভলভার রাখা পকেটে হাত ঢুকিয়ে চকিতে আমি সেদিকেই ঘুরে দাঁড়ালাম।

চওড়া কাঁধওয়ালা এক ব্যক্তি আমার সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে। আচমকা এক প্রচণ্ড ঘুষি বুকের ওপর আছড়ে পড়তে আমি বেসামাল হয়ে গেলাম। আগ্নেয় অস্ত্র হিসেবে রিভালভারটা বার করতে উদ্যত হতেই আরো একটা শক্তিশালী ঘুষি চোয়ালে আঘাত হানতেই আমার এই দেহ ধরাশায়ী হয়ে মাটির বুকে আশ্রয় নিল।

চোখের সামনে একঝাক তারা আর রঙ-বেরঙের আলোর রশনাই দেখতে দেখতে জ্ঞান হারালাম আমি।

হোটেলে ফিরে দেখি, হেলেন শোবার ঘরে পায়চারি করছে। আমার বিধ্বস্ত মুখের দশা আর ধূলো মাখা মলিন পোষাকের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে দৌড়ে এল ও।

কী হয়েছে, স্টিভ? খুব লেগেছে তোমার?

 কোনরকমে বাঁকা ঠোঁটে হাসলাম। এই অবস্থায় এর থেকে বেশি হাসির ক্ষমতা আমার আসছিল না। না, তেমন কিছু নয়, বিছানায় বসতে, বসতে জবাব দিলাম।

স্কচের বোতলটা দাও দেখি।

ক্ষিপ্র হাতে একটা গেলাসে স্কচ ঢেলে আমার পাশে এসে ও বসল।

বুঝতে পারছি লোকটাকে ধরতে তোমার ক্ষমতায় কুলোয়নি। গেলাস হাতে একটা লম্বা চুমুক দেবার পর সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বললাম ওকে।–এই হল ব্যাপার। লোকটা আমার পকেট ভাণ্ডারে থাকা জিনিসগুলো লণ্ডভণ্ড করে কেটে পড়েছে।

কি কি ছিল তোমার ঐ ব্যাগে?

কি ছিল না তাই বলো? আমার পরিচয়পত্র, ফ্যান’শর ঠিকানা, আমার গোয়ন্দা লাইসেন্স আর যে সমস্ত উপায়ে মৃত্যু হলে গেলার্টের পলিসি থেকে টাকা দাবি করা যাবে না তার একটা লিস্ট। অর্থাৎ এক কথায় ধরতে গেলে সব কিছু। ঐ অজ্ঞাত নামা লোকটি যদি ডেনির চেনা হয়, তাহলে আমি এখানেই শেষ।

কী আর করবে বলল, হেলেন ছোট্ট করে গালে একটা চুমু খেল আমার। এরকম ঘটলে তুমি কেন, যে কোন লোকই ফেঁসে যেত। অনর্থক নিজের ঘাড়ে দোষের বোঝা চাপিও না।

তুমি তো বলেই খালাস। আর এ কথাটা যদি একবার ম্যাডক্সের কানে কোন ভাবে পৌঁছে যায়? তক্ষুণি সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। যাক, অনেক হয়েছে, এবার শুধু ঘুম। গেলার্ট কেসটা নিয়ে আজ যথেষ্ট মাতামাতি হয়েছে।

পোষাক আলমারি থেকে আমার পায়জামা বের করে হেলেনবলল, তুমি চলে যেতেই ভিড়ের মধ্যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। বোকার মতন এদিক-ওদিক উদভ্রান্তের মতো ঘুরে শেষে ক্যাবলা সেজে একটা পুলিশের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিলাম। তার কাছ থেকেই শুনলাম, চারতলায় এক হীরের দালালের অফিসের সেফ খোলার প্রচেষ্টা হয়েছিল। সফল হয়নি। কারণ চোরটা একেবারেই আনাড়ি। সবে হাতখড়ি হয়েছে বোধহয়। কয়েকটা আঁচড় কাটা ছাড়া সেটার কোন ক্ষতি করতে পারেনি।পুলিশটার মতে, থ্যাসন–মানেদারোয়ানটা,শব্দ শুনে দেখতে গিয়ে চোরের হাতে ছুরির আঘাতে বেঘোরে প্রাণ হারায়।

ডেনি সম্বন্ধে কিছু শুনলে। মাথা নাড়ে হেলেন। নাঃ! তবে পুলিশ এই সিদ্ধান্তে অনড় যে, হীরেগুলো চুরির মতলবেই লোকটার এখানে আগমন।

তাই যদি হয়ে থাকে, তবে দারোয়ানটার খুন হবার সঙ্গে ডেনির কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু এখনও জোর দিয়ে একথা বলা সম্ভব হচ্ছেনা যে, ঘটনাটা যখন ঘটে ঐ সময় ডোরাকাটা কোট বাড়িতে ছিল কিনা বা এই খুনটা তার দ্বারাই হয়েছে কিনা। তবে তিনদিন ধরে ডেনির খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিল, তার ওপর ঐ অঘটনের সময়েও আমরা স্বচক্ষে তাকে রেস্তোরাঁতে খেতে দেখেছি, তাই সব দেখে-শুনে সমগ্র পরিস্থিতি তাকেই খুনি বলে ইঙ্গিত করছে–অবশ্য তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ আমাদের হাতে বর্তমানে নেই। আর আছে সন্দেহের এক মুখ জয় সেন্ট মাখা সেই মেয়েটা। তারই বা এখানে কোন ভূমিকা ছিল কি?

আমার কথা বলার ফাঁকেই কোন এক সময় হেলেন পোষাক খুলে নাইটিটা পরে নিয়েছিল। ওর পরনের পোষাক খোলার অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা আমাকে সব সময়েই বিবশ করে দেয়।

ও স্নানঘর থেকে বেরোবার পর বললাম, বুঝলে হেলেন, এই গেলার্ট মেয়েটাকে আমাদের যে কোন উপায়েই হোক সন্ধান করে বার করতে হবে। থিয়েটারের ছোটখাটো এজেন্টদের কাছে গেলে হয়তোওর খোঁজ মিললেও মিলতে পারে। এর চাইতে আর কোন উন্নত মানেরমতলব দিতে পার?

হ্যাঁ। এক লাফে তড়াক করে বিছানার ওপর উঠে বসল ও।

আসুন মিঃ হারমাস, আপাততঃ গোয়েন্দাগিরি ভুলে একটু ঘুমিয়ে নিই আমরা। দুটো যে কখন বেজে গেছে সে খেয়াল আপনার আছে?

তাহলে শুনুন মিসেস হারমাস, বুক ফুলিয়ে বলে উঠি, একজন গোয়েন্দার ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করার প্রবণতা নেই বা থাকা উচিত নয়। দিনে রাতে প্রত্যেকটি ঘন্টাই তার নিকট যথেষ্ট মূল্যবান।

থাক থাক, ওসব এখন ভোলা থাক। এখন বিছানায় এসে তো একটু গড়িয়ে নিই..

পরের দিন প্রাতঃরাশের পর টেলিফোন-পঞ্জী দেখে দেখে আমি আর হেলেন শহরের বিভিন্ন থিয়েটারের এজেন্টদের নামের তালিকা বানিয়ে ফেললাম।

কাজটা যখন শেষ হল, তাকিয়ে দেখি তালিকাটি লম্বায় আমার হাতকেও ছাড়িয়ে গেছে।

তালিকায় লেখা এত জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে করতে তো আমাদের নাতি-নাতনি হয়ে যাবে, বিরক্ত কণ্ঠেই আমি বলে উঠলাম।

কে বলতে পারে আমাদের ভাগ্যে প্রথম বারেই শিকে ছিঁড়ে যাবে না? হেলেন আশ্বাসের সুরে বৃথা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল আমায়। লিস্টটা মাঝখান থেকে অর্ধেক করে ছিঁড়ে নাও। অর্ধেকটা নিয়ে তুমি কাজ করো, বাকিটার বোঝা আমি আমার কাঁধে তুলে নিচ্ছি।

সত্যি খুব ভালো বুদ্ধি দিয়েছে তো

আচ্ছা, আমারটা দাও দেখি। কাজে নেমে পড়া যাক। একটার সময় খাবার টেবিলে আবার দেখা হচ্ছে। খেতে আসবে তো এখানে?

হ্যাঁ, যেখানে যেখানে এজেন্টের দর্শন পাবে, সেইসব জায়গায় বেশি করে মনোযোগ দিও।বড় কোন জায়গায় এ মেয়েটার সন্ধান পাওয়া যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না। সাবধানে থেকো কিন্তু।

তালিকাটা পকেটে পুরে আমি নিজের উদ্দেশ্যে পথে নামলাম।

এ কাজটায় যদিও আমার মনের দিক থেকে কোন সাড়া পাচ্ছিলাম না, কিন্তু আমি জানি ধৈর্য ধরে কাজ করতে পারলে কাজে সফলতা আসবে।

প্রায় দু-ঘণ্টা ক্রমাগত সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা আর এ-অফিস ও-অফিসে দৌড়াদৌড়ি করার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আজ বিধাতা আমার ওপর একেবারেই প্রসন্ন নন। ইতিমধ্যে দশটা এজেন্সী অফিসে আমার খোঁজ করা হয়ে গেছে। সুসান গেলার্টের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সবজায়গা থেকে বার বার একটা উত্তর-ই পেয়েছিলামই কোনদিন শুনিনি মশাই। আর ব্র্যাড ডেনির কথা তো না হয় ছেড়েই দিলাম। তাকে কেউ চেনেও না আর চেনবার কোন ইচ্ছাও তাদের নেই।

একেই এতো গরম, তার ওপর অনবরত হাঁটাহাঁটি করতে করতে আমি কাহিল হয়ে পড়েছি। তাই বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ স্থির করলাম, পা দুটোকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম দিতে কফি হলে মন্দ হয় না।

এ রাস্তায় এজেন্ট ছিল কমপক্ষে বাইশ, আর সকলেরই দপ্তর বাড়ির একেবারে ওপর তলায়, লিফটের কোথাও কোন বন্দোবস্তও নেই। ভেবে দেখলাম, যে বৃদ্ধ ওয়েটারটি আমায় কফি দিয়ে গেল তার কাছে খোঁজ নিলে সে কিছু জানলেও জানতে পারে।

রুমালে মুখ আর ঘাড়েরঝড়ে পড়া ঘাম মুছতে মুছতে ধীরসুস্থেকথাটা পাড়লাম, বুঝলে, আমি একটা মেয়ের খোঁজ করছি। স্টেজে শোকরা তার পেশা।নাম সুসান গেলার্ট। চেনোনাকি তাকে?

সুসান গেলার্ট? ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। না, কোরিন গেলার্টের নাম শুনেছি, সুসান নয়। ওর আপন বোন নয়তো? কোরিন গেলার্টের একজন বোন আছে, শুনেছিলাম?

কোরিন গেলার্ট আবার কে?

তিনখানা দাঁত আর অনেকটা মাড়ি বের করে বৃদ্ধ হাসল।

বয়েস কালে ও একটা জিনিস ছিল বটে, স্যার। নিত্যই তার পদধূলি এখানে পড়ত। ভীষণ বেপরোয়া স্বভাবের মেয়ে এই কোরিন।

বেপরোয়া! মানে?

দুনিয়ায় কাউকে সে মানতো না। ছ-সাত বছর আগে এখানকার কী হোল ক্লাবে নিজেকে উন্মুক্ত করে সকলের সামনে নৃত্য পরিবেশন করত। একদিন হল কি একরাতে সে নেশায় বুঁদ হয়ে ঐ অবস্থাতেই রাস্তায় চলে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে, ওরই জানাশুনো এক পুলিশ তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে আসে। ওঃ, মেয়ে ছিল বটে একখানা!

এখন সে কোথায় আছে জানো?

না স্যার। তিন বছরের বেশি হয়ে গেল তাকে আমি আর দেখিনি। শুনেছি বিয়ে-সাদি করেছে। তবে এটুকু বলতে পারি, ঐ ব্যবসার সঙ্গে সে আর জড়িত নেই, ওখানে থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছে।

আচ্ছা ব্র্যাড ডেনি বলে কারুর নাম শুনেছো? সে যতদূর সম্ভব থিয়েটারের একজন এজেন্ট।

নাঃ! বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়ে শুধু মাথা নাড়ে বৃদ্ধ। রাস্তার ওপারে মমি-ফিলিপসের দোকানে বরং চলে যান। তার নিকট এ লাইনের সকলের ছবি পেয়ে যাবেন। ও হয়তো আপনাকে কিছু খবর দিতে পারবে বা আপনার কাজে আসবে।

বাঃ, চমৎকার মতলবটা আপনা থেকেই ধরা দিল! কফির দাম মিটিয়ে আর বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আবার রোদ ঝরা দুপুরে নেমে পড়লাম।

রাস্তাটা পার হতেই ছোট্ট স্টুডিওটা চোখে পড়ল। কাঁচের জানালার ওপর সব থেকে বেশি ছবি আটকান। ছোট্ট সাইন বোর্ডটায় আবছা অক্ষরে লেখা?

এম ফিলিপিস, ফটোগ্রাফার, স্থাপিত ১৮৯৭।

 দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখলাম। সামনেই কাউন্টার।

চারটে বড় বড় বোর্ডের ওপর বেশ কিছু ছবি পিন দিয়ে আটকানো। দরজা ঠেলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈদ্যুতিক ঘন্টি তীক্ষ্ণভাবে বেজে উঠছিল, কিন্তু কারও দর্শন পেলাম না।

ছবিগুলো দেখতে দেখতে পেছনে হঠাৎ কাশির শব্দ কানে যেতেই ঘুরে দাঁড়ালাম।

দীর্ঘকায়, বিষণ্ণ রূপের শ্বেত শুভ্র কেশের এক নিগ্রো কাউন্টারের পেছন থেকে আমার দিকে তাকিয়েছিল।

গুডমর্নিং স্যার। বলুন?

আমি আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হাসলাম।পোষা একটা কুকুরের সামনে তুড়ি মারলে যা হয়,এখানের প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি হল ঠিক সেরকম। বৃদ্ধ তার সাদা ঝকঝকে বড় বড় দাঁতের পাটি এই সুযোগে বার করে দেখিয়ে নিল। নিজের পরিচয়পত্রটা কাউন্টারের ওপর রেখে বললাম, আমি আপনার কাছ থেকে কিছু সংবাদ সংগ্রহের জন্য এসেছিলাম।

কার্ডটা নেড়ে চেড়ে দেখে নিয়ে বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো মাথা নাড়ল সে। ই, বুঝেছি। আপনার কোম্পানির নাম আমি জানি, মিঃ হারমাস। আমার ছেলে ওখানেই ইনসিওর করিয়েছে।

ও, তাই নাকি!হাসি অক্ষত রেখেই জবাব দিলাম, তাহলে একদিকে তো ভালোই হল। আমি এক মহিলার বিষয়ে খোঁজ নিতে এসেছি, মিঃ ফিলিপস। প্রয়োজনটা আমার ইনসিওর সংক্রান্ত।

কী নাম বলুন তো?

 সুসান-গেলার্ট, তার এজেন্টের নাম ব্র্যাড ডেনি। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।

সুসান গেলার্ট? ফিলিপস ভুরু কুঁচকে তাকাল। কোরিন গেলার্টের বোন নাকি?

আমি সঠিক জানি না, মিঃ ফিলিপস, যথাসম্ভব নিরীহভাবে জবাব দিলাম আমি।

ওই-ই হবে। দুজনের মধ্যে কোরিন মেয়েটাই চালাক-চতুর ছিল।

হাড্ডিসার কপালে টোকা মারতে মারতে মাথা নাড়তে থাকে ফিলিপস। ওরা যমজ। একমাত্র চুলের রঙ ছাড়া আপনি কোনমতেই ওদের আলাদা ভাবে চিনে নিতে পারবেন না।

যমজ? সজাগ হয়ে উঠি।

হ্যাঁ, এরকম মিল সচরাচর চোখে পড়ে না। প্রভেদের মধ্যে সুসানের কেশ সোনালী আর কোরিনের কালো। একবার ওরা একসঙ্গে অভিনয় করেছিল, সুসান কালো পরচুলা পরে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ওদের একটা ছবি আমার কাছে হয়তো আছে। দাঁড়ান দেখাচ্ছি।

বিরাট একটা ফাইল থেকে গাদা খানেক ছবি বের করে দেখতে লাগল ফিলিপস। এক একটা ছবি দেখছে আর নিজের অজান্তে নাকে হাত চলে যাচ্ছে আর গায়ের জোরে নাক রগড়ে যাচ্ছে। বুঝলাম, চোখের দৃষ্টি তেমন ভালো নয়। অধৈর্য হয়েই এদিক-ওদিক দৃষ্টি দিলাম আমি।

একসময় তার উল্লাসধ্বনি কানে এল।

অ্যাই হলো সেই ছবি। খুশিতে গদগদ হয়ে আটবারো মাপের একটা ছবি আমার দিকে এগিয়ে দিল সে, দেখেই বুঝবেন কী ধরণের অভিনয় করত ওরা।

ছবিতে এক মহিলা বিরাট মাপের এক দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল। একটু খুঁটিয়ে দেখতেই বুঝে গেলাম, ফ্রেমটা ফাঁকা–ভেতরে কোন আয়না নেই। প্রতিবিম্বটা আসলে ঐ যমজ বোনের, একই ভঙ্গিমায় উল্টো দিকে সে দাঁড়িয়ে। হুবহু একরকম রূপের বাহার দুজনের। পরনে ঝালর দেওয়া খাটো ঘাগরা আর টাইট কাঁচুলি, তাতে চুমকি বসানো।

পরচুলা ছাড়া সুসানের আর একটা ফটো আমার কাছে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, ফিলিপস সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, তবে দেখি, পাই কিনা।

এই সুসান মহিলাকে কোথায় গেলে দেখা মিলবে বলতে পারেন?

নাঃ, বহুকাল তাকে চোখের দেখা দেখিনি। কোরিনও বিয়ে থা করে বছর তিনেক হল কাজ ছেড়ে দিয়েছে। যতদূর জানি সে এখন বুয়েনস এয়ারস-এ আছে।

আচ্ছা, ব্র্যাড ডেনি নামে কারুর নাম আপনি এর আগে শুনেছেন?

হা হা, শুনেছি বৈকি। সেও তো এখানে বার দুই এসেছিল।

সে কোন ফটো-টটো তোলেনি এখান থেকে?

 নাঃ, বিষণ্ণ-বিষাদে মাথা নাড়ে ফিলিপস।

আমার কাজকর্মের ধারা তার বোধহয় সেকেলে মনে হতো। সে কিছু ছবি কিনতেই এখানে উপস্থিত হয়েছিল।

কী রকম বলুন তো লোকটা?

 বেশ ভদ্রগোছের লোক। একদৃষ্টে অ্যালবামের দিকে চোখ রেখে পাতা ওল্টাতে থাকে ফিলিপস। নাচেও চমৎকার।

সে সুসানের এজেন্ট নাকি?

হলেও হতে পারে, আমার ঠিক জানা নেই। মাস ছয়েক আগে তার সঙ্গে যখন দেখা হল তখন সে একটানৃত্যনাট্যকরছে।বয়স খুব বেশী হবেনা ছোকরার।বড়জোর মেরে কেটে তেইশ চব্বিশ।

এবার সামান্য ঝুঁকি নিয়েই প্রশ্ন করলাম, লোকটাকে আপনি বিশ্বাস করেন, মিঃ ফিলিপস?

চট করে মাথা তুলে পিটপিট চোখে আমার দিকে তাকাল ফিলিপস, বিশ্বাস মানে,…ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনার কথাটা।

মানে, লোকটাকে দেখে আপনার সৎ বলে মনে হয়?

হ্যাঁ, বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে যায় সে। যদিও আমি তার সঙ্গে কোন কাজ করিনি, কিন্তু মিঃ ডেনিকে আমার মানুষ হিসেবে সৎ-ই মনে হয়।

মাথা নাড়া ছাড়া আমার আর কোন কৌশলও জানা ছিল না। গুডইয়ারের কথাগুলো একে একে সব মিলে যাচ্ছে। আর এই গেলার্ট বোনেরা?

ফিলিপস কিঞ্চিৎ অস্বস্তির মুখে পড়ল। সমালোচনা করা…হয়তো আমার উচিত হবে না। আর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো অনেক পরিবর্তনও ওদের হয়েছে। আসলে তারা চরিত্রের দিক থেকে একটু উজ্জ্বল প্রকৃতির ছিল বটে, তবে এ ব্যবসায় লোকেরা সাধারণতঃ এরকমই হয়ে থাকে। তাছাড়া বহুদিন তাদের আর দেখি না, তাই এর চেয়ে বাড়তি কিছু বলাও আমার উচিত নয়।

বৃদ্ধ অনেক কিছু জেনেও নিজেকে গুটিয়ে রাখল। কথাগুলো আদায়ে সহজ হবে না বলে আমি আর পীড়াপীড়ি করলাম না অহেতুক।

অবশেষে ছবিটা পাওয়া গেল। ফিলিপসের হাত থেকে ওটা নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমি ছবিটা দেখতে লাগলাম। সুসান প্রকৃত সুন্দরী। কৌতুকে ঝলমল করছে চোখের মনি, তবে ও দুটো সময়ে সময়ে চরম দুঃসাহসিক হয়ে উঠতে পারে তা একবার দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু মুখ দেখে ঘুণাক্ষরেও বোঝার উপায় নেই ও নষ্ট চরিত্রের মেয়ে।

মুখটা খুব চেনা চেনা, কোথায় যেন দেখেছি ওকে…!

দেখা শেষ হলে পর বললাম, ছবি দুটো আমাকে বিক্রি করবেন? ফিলিপস একটু অপ্রস্তুত, ইতস্ততঃ করছে দেখে পাঁচ ডলারের একটা নোট সামনে রাখলাম।

আপনি যদি এগুলো দেন, আমার কোম্পানী বড় উপকৃত হবে।

হা-হা, নিশ্চয়ই!কিন্তু, এগুলোর পরিবর্তে পাঁচ ডলার বড্ড বেশী হয়ে যাচ্ছেনা? এক ডলারই যথেষ্ট।

না না, ঠিক আছে, বিনয়ের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠি আমি। আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর কোনো ভাষা আমার নেই, তবু বলছি ধন্যবাদ, অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে, মিঃ ফিলিপস। আপনি যে খবর আমাকে শোনালেন তাতে আমার অনেক উপকার হল। আচ্ছা, কোথায় গেলে সুসান গেলার্ট বা ডেনির সঙ্গে দেখা হতে পারে বলতে পারবেন না, না?

আপনি ভদেভিল ক্লাবে একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। ফায়ার স্টোন বুলেভার্দের কাছেই ক্লাবটা। ওরা ওখানকার মেম্বার হতে পারে।

আচ্ছা..বলছে যখন, দেখি চেষ্টা করে। ধন্যবাদ। ফিলিপসের সঙ্গে করমর্দন করে, ছবিদুটো সঙ্গে নিয়ে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম…।

হোটেলের লাউঞ্জে বসে খোস মেজাজে কাগজ পড়ছিল হেলেন। ওর চোখে-মুখে ক্লান্তির কোন ছাপই নেই বরং অসম্ভব তাজা আর প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল ওকে। কেন জানি না ওকে দেখেই আমার মনে খটকা লাগল।

এই তো, আমাকে দেখামাত্রই মুখ থেকে কাগজটা নামিয়ে মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসল ও। ক্লান্তিতে তোমার চোখ মুখ বসে গেছে। খুব ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে বোধহয়? গরমও পড়েছে বেশ, তাই রোদে আর বেরোতে মন চাইল না, থেকে গেলাম।

তার মানে তোমার কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে সকাল থেকে তুমি এভাবেই বসে? শুধু অবাকই নই সেইসঙ্গে ততধিক স্তম্ভিত। আর এদিকে আমার শালা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে জান কয়লা হবার জোগাড়! তুমি না বলেছিলে লিস্ট দেখে দেখে অনুসন্ধানে নামবে?

নিয়েছি গো নিয়েছি, হাসতে হাসতে হেলেন আমার হাতে মৃদু চাপ দিল।

তুমি চলে যাবার পর মাথায় হঠাৎ এক উদ্ভট খেয়াল এল, ভেবে দেখলাম পা দুটোকে অনর্থক কষ্ট না দিয়ে মগজটাকে কাজে লাগানো যাক। তুমিই একবার আমায় বলেছিলে, শুধুমাত্র মাথা খাটানোর জন্যই আমাকে একাজে বহাল করা হয়েছে। কি, বলোনি?

সিক্ত রুমালটা দিয়ে মুখ মুছলাম। তুমি জানো কোথায় গেলে ওদের পাওয়া যাবে?

জানি বৈকি। ওরা এখন উইলিংটনে প্যালেস থিয়েটারে কাজ করছে।

কী করে জানলে?

খুব সহজ। আমি ভ্যারাইটিটা উল্টেপাল্টে দেখেছি। আমার মনে পড়ল, আর্টিস্টরা সাধারণতঃ তাদের পরবর্তী শোয়ের বিজ্ঞাপন ঐ পত্রিকাতেই দিয়ে থাকে। যেমনি না ভাবা অমনি কাজ। ভাগ্য জোরে পেয়েও গেলাম। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করা বাসনা ছিল, কিন্তু সম্ভব হবে না জেনে আর বৃথা চেষ্টা করিনি।

নির্বাক শ্রোতা হয়ে সব শোনার পর উঠে দাঁড়িয়ে আমি বার অভিমুখে হেঁটে চললাম।