০২. লস এঞ্জেলসে পৌঁছালাম

০২.

বিকেল তিনটে নাগাদ আমরা লস এঞ্জেলসে পৌঁছালাম। মাল-পত্তর সমেত হেলেনকে কাল ভোর হোটলের দিকে রওনা করিয়ে আমি চললাম আমাদের শাখা-দপ্তরের বড়বাবু ফ্যানর সঙ্গে দেখা করার অভিপ্রায়ে।….

ম্যাডক্স আমায় ঘন্টা খানেক আগে ফোন করেছিল গেলার্টের পলিসি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পর ফ্যান’শ বলল, আঙুলের ছাপটা সম্বন্ধে সে খোঁজ নিয়েছিল কিন্তু কিছু পাইনি। সে বোধহয় এই ভেবেছিল, মেয়েটার পুলিশের খাতায় নাম থাকবে।

পুলিশের খাতায় নাম থাকলে কেউ ওভাবে ছাপ দেওয়ার সাহস দেখায় নাকি!আমি জবাব দিলাম। কিন্তু ওটা অসাবধানতা বশতঃ লেগেছে বলেও আমার মন বিশ্বাস করতে একেবারেই প্রস্তুত নয়।

আমি ব্যাপারটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি না, মৃদু হাসি হাসল ফ্যান’শ।

কিন্তু মুশকিল হয়েছে ঐ ম্যাডক্সকে নিয়ে। তার সন্দেহবাতিক স্বভাবটা বেড়েই চলেছে। আরে বাপু, গুডইয়ারকে একটু বিশ্বাস করলে ক্ষতিটাই বা কোথায়?

ওর মতো দক্ষ সেলসম্যান কটা আছে শুনি?

আমি ভাগ্যবান যে সে আমার অফিসে বদলি হয়ে এসেছে। তুমি শুনেছ কিনা জানি না, ও তো এখানে জোইস শারম্যানকে পর্যন্ত মক্কেল বানিয়ে নিয়েছে। অত আটঘাট বাঁধা পলিসি আজ পর্যন্ত আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। প্রিমিয়ামের অঙ্কটা শুনলেই তো মুণ্ড ঘুরে যায়। শুধু তাই নয়, সে এখানে নিজে উপস্থিত থেকে শারম্যানকে দ্বিতীয় কিস্তির প্রিমিয়াম দেবার কথা স্মরণ করিয়ে। দিয়েছে। এ জায়গায় আমাদের অন্য এজেন্টরা থাকলে কী করতো? বড় জোর টেলিফোন করে না হয় চিঠি লিখে দায় মিটিয়ে কর্তব্য শেষ করত। কিন্তু গুডইয়ার এদের সকলের থেকে পৃথক। নিজে এসে সে দেখা করেছে। আমি কখনোই তাকে বিতাড়িত করার পক্ষপাতী নই।

সে আমার অজানানয়, গুডইয়ার এখন আমাদের সেরা এজেন্ট। কিন্তু ম্যাডক্স কাউকে বিশ্বাস করবে, এ ভাবাই তো দুরাশা।যাইহোক, আমার ও নিয়ে বিশেষ চিন্তা ভাবনা নেই, কাজটা সহজেই মিটে যাবে এ আশা রাখি। ম্যাডক্সের ধরাছোঁয়ার বাইরে কটা দিন কাটাতে পারব, তার থেকে আর সুখের কী হতে পারে।

ফ্যান’শ মুচকি মুচকি হেসে উঠল। অবসর সময়ে যদি দেহকসরত করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাহলে আমাকে জানাতে ভুলো না। আমার নিজস্ব নোটবইতে যেসবনরম গরম যত্তরবৃন্দের টেলিফোন নম্বর সযত্নে রাখা আছে, ওদের মধ্যে যে কেউ খুশি হয়ে তোমায় সঙ্গ দিতে চাইবে।

না ভাই, ঐ উপায়টা এখন আর কাজ দেবে না। গিন্নীকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াই। ও অবশ্য গরম কিছু কমতি নয়। যাক চলি। সময় যখন হাতে আছে, ডেনির অফিস একবার ঘুরে যাব।

রাতে কাজ না থাকলে তোমরা দুজন একবার কষ্ট করে অ্যাথলেটিক ক্লাবে এসোনা!

আচ্ছা, দেখা যাবে।

 ফ্যান’শর সঙ্গে করমর্দন করে রাস্তায় পা রাখলাম আমি।

যে বাড়িতে ডেনির দপ্তর সেটাকে দু-পাশ থেকে স্যান্ডউইচের মতো চেপে রেখেছে, একটা ওষুধের দোকান আর একখানা চীনে রেস্তোরাঁ।

সুইং দরজা ঠেলে ভেতরে কদম রাখতেই ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগল। ডেনির নাম একপাশে চোখ পড়ল। আগের কোন ভাড়াটের নামের ফলকের ওপর কাগজ সেঁটে গোটা গোটা কালির হরফে লেখা?

ব্র্যাড ডেনি
এজেন্ট নং দশ, ছতলা।

ছতলায় উঠেও দেখি একই অবস্থা। ডেনির দপ্তরের পাশেই পুরুষের প্রস্রাবাগার আর দরজার সম্মুখে অবতরণ পথ। দপ্তরের দরজাটা বোধহয় লাগানোর পর থেকে আর রঙের প্রলেপ লাগেনি। দরজায় গায়ে ডেনির একটা পরিচয়কার্ড আঠা দিয়ে মারা।

দরজাটা বন্ধ দেখে খটখট করে টোকা মেরে বসলাম বেশ কয়েকবার। কিছুক্ষণ জবাবের প্রতীক্ষা করে হাতলটা ঘোরানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হতে হল। ঘুরলো না। অর্থাৎ তালা দেওয়া।

কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দরজাটা ভালো ভাবে দেখে নিলাম। এ তালা খুলতে আমার কয়েক সেকেন্ডও লাগবে না। আপাততঃ এ প্রচেষ্টা থাক।

 ফাঁকা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে বারান্দায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। লিফটের পাশেই আছে আরও একটা দরজা। ওখানেও টোকা মারলাম।এবারও প্রত্যুত্তরে কোন সাড়া মিললো না।

দ্বিতীয়বার টোকা মারতেও সাড়াশব্দ এলো না দেখে দরজার হাতলটা ঘুরিয়ে ঠেলা দিলাম। দরজাটা খুলে গেল আর সেই সঙ্গে বীয়ার আর নর্দমার ভ্যাপসা গন্ধ ভক্ করে বেরিয়ে এসে নাকে লাগল আমার।

সামনে কতকগুলো পাথরের সিঁড়ি। কোনদিকে দৃষ্টি না দিয়ে আমি ওদিকে এগিয়ে গেলাম, তারপর সিঁড়ির ওপর থেকে রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে নীচে তাকালাম। বিরাট মাপের একখানা ঘর, তাতে গাদা গুচ্ছের বালতি, ঝাড়ু, খালি টিন আর আছে কাঠের বাক্স। পচা খাবার আর ইঁদুরের দুর্গন্ধে চারিদিক ভরপুর।কাঠের বাক্সের ওপর বসেছিল এক বৃদ্ধ। চোখে মান্ধাতার আমলের টিনের ফ্রেমের সাধারণ এক চশমা, মাথায় টুপি, শতছিন্ন প্যান্ট। এক হাতে ঘোড় দৌড়ের বই, অন্য হাতে বীয়ারের পাত্র নিয়ে আপন মনে গুন গুন করে যাচ্ছিল সে। দুনিয়ার কোন কিছুতেই যেন পরোয়া নেই তার।

তার বীয়ারটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরই আমিনীচে নামতে শুরু করলাম। আমাকে দেখা মাত্রই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বৃদ্ধ, চশমাটা টেনেটুনে ঠিক করে নিল, তারপর বীয়ারের খালি পাত্রটা নামিয়ে রেখে চোখ পিটপিট করল বেশ কয়েকবার। লোকটাকে দেখে মনে হয়না যে অযথা ঝামেলা সৃষ্টি করার কোন সুপ্ত বাসনা আছে বলে। তবু কাছে যাবার আগে আরও সতর্ক হতে লম্বা-চওড়া এক হাসি বর্ষণ করলাম আমি।

আমি এ বাড়ির ম্যানেজারের খোঁজ করছিলাম। আপনি নাকি?

ঘোলাটে চোখ দুটো আগের মতো বারকতক পিটপিট করল সে। আঁ?

 বলছিলাম, এবাড়িটার তত্ত্বাবধায়ক কী স্বয়ং আপনি? মানে দেখাশুনো করেন?

এবার কথার মানে কী বুঝল কে জানে, তবে কিছুক্ষণ চিন্তা করেই ঘাড় নাড়লো।

অর্থাৎ ও-ই।

ততক্ষণে গরমে দগ্ধ হয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার জোগাড়। তা সত্ত্বেও একটা খালি টিন নিয়ে ফুঁ দিয়ে ওপরের ধুলো ঝেড়ে তার ওপর বসে পড়ি।

আপনি যদি এক পাত্র বীয়ার বেচেন, তাহলে আমি নিতে পারি।

বেচার মতো আমার কাছে কিছুই নেই। উত্তর এসেও গেল তৎক্ষণাৎ।

অগত্যা সিগারেটের প্যাকেট বের করে দুটো সিগারেট নিয়ে একটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। বৃদ্ধ ওটা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে তুলে নিল।

দুজনেই এক সঙ্গে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলাম। তারপর কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ার পর ও-ই সর্বপ্রথম কথা শুরু করল? আমায় খুঁজছিলেন?

হ্যাঁ। মানিব্যাগ থেকে নিজের কার্ড বার করে বাড়িয়ে ধরি। ওটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে চোখ বুলিয়ে নেয় কিছুক্ষণ, তারপর আবার ফিরিয়ে দেয় আমাকে।

ওসবের কোন প্রয়োজন নেই। ইনসিওর-টিনসিওরে আমার তেমন বিশ্বাস নেই।

আরে না, না, ওর জন্যে আপনার দ্বারস্থ আমি হইনি। আমি ব্র্যাড ডেনির সন্ধান করছি।

ছতলায় চলে যান, দশ নম্বর ঘর।

সে, জানি। আমি গিয়েও ছিলাম। উনি বোধহয় বেরিয়েছেন।

তাহলে আমার করণীয়ই বা কী থাকতে পারে? জবাব শেষ করেই ঘোড়দৌড়ের বইটা আবার নাকের ওপর তুলে ধরল সে। অর্থাৎ সোজা কথায়, এখন কেটে পড়ো তো বাপু! কিন্তু অত সহজে ছাড়ার পাত্র আমি নই।

উনি কখন ফিরবেন বলতে পারেন? অগত্যা জানতে চাইলাম আমি।

জানিনা।

কোথায় গেছেন জানার উপায় আছে?

নাঃ।

কিন্তু যে করেই হোক ওঁর সঙ্গে দেখা আমায় করতেই হবে, গাম্ভীর্যের আবরণে নিজেকে ঢেকে নিই। কাজটা সত্যিই জরুরী।

বইটা চোখ থেকে সামান্য সরায় বৃদ্ধ। আমাকে দিয়ে কিছু সুবিধা হবে না।

হওয়াতো উচিত ছিল, বলেই দুডলারের একটা নোট বার করে তার সামনে তুলে ধরি।

 বৃদ্ধ এবার নিজের আসন ছেড়ে তড়াৎ করে লাফিয়ে ওঠে। তারপর কয়েক পা হেঁটে গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখা একটা বীয়ার নিয়ে আসে।

টিনটা হাতে নিয়ে মুঠোয় ধরা নোটটা বাড়িয়ে দিই তার দিকে। তাহলে আবার শুরু করা যাক, কেমন? বলুন ডেনি কোথায়?

আরে ওসব গুলি মারুন।

আমি টিনে চুমুক দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সারা গা কেমন গুলিয়ে উঠল। বীয়ারটার স্বাদ ঠিক চায়ের কাপ ধোয়া জলের মতো।

আপনার সঙ্গে তার শেষ কখন দেখা হয়েছে?

গতমাসে, ভাড়া দেবার সময়।

এখন কোথায় গেলে তার দর্শন মিলবে, জানেন?

 মুখটাকে কাচুমাচু করে ঠোঁট ওলটায় বৃদ্ধ। নাঃ, ওনার বহু পরিভ্রমণ করার শখ আছে শুনেছি।

কী করে যোগাযোগ করা সম্ভব হতে পারে তাও বলতে পারবেন না?

উঁহু, এই কথাই সেদিন ঐ লোকটাকে বলছিলাম…

মাঝপথে থেমে গিয়ে চোখ কোঁচকায়, নড়ে চড়ে বসে নিজের জায়গায়।

কে লোক?

তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ধরি। বেশ, তাহলে আমার মালটি ভালোয় ভালোয় ফেরত দিন তো দাদু। আমার পয়সা অত সস্তা নয়।

যেই না বলা সঙ্গে সঙ্গে কাজ। নোংরা হাতে নোটটা শক্ত করে চেপে ধরে তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে বসল,

দুদিন ধরে একটা লোক বারবার মিঃ ডেনির সন্ধানে চক্কর দিচ্ছে। আজ সকালেও এসেছিল।

নাম কিছু বলেছে সে?

না আমি জিজ্ঞাসা করিনি। দেখেই বোঝা যায় অত্যন্ত বদ স্বভাবের লোক, তার সঙ্গে একাকী কথা বলতেও ভয় লাগে।

ব্যাপারটা মনে কিঞ্চিৎ সাড়া দিল, জিজ্ঞেস করলাম, কোন অভিনেতা-টভিনেতা নয় তো? ডেনির কিন্তু এদের নিয়েই কাজ কারবার।

না, অভিনেতা সে নয়, বৃদ্ধর গলার স্বর গুরু-গম্ভীর। তার চোখ দেখলেই আমার শির দাঁড়া হিম হয়ে যায়।

আজও সে এসেছিল?

হ্যাঁ, সকালে। আমাকে দেখতে পায়নি কিন্তু আমি তাকে দেখতে পেয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে গুঁড়ি মেরে উঠেছিল। ভেবেছে ধারে কাছে কেউ নেই।-বাবা, এবাড়িতে আমার চোখে ধূলো দেবার উপায় আছে।

ডেনি তো নেই, তাহলে সে উপরে উঠেছিল কোন উদ্দেশ্যে!

বৃদ্ধর শীর্ণ মুখটা মুহূর্তের মধ্যে ভাবলেশহীন হয়ে ওঠে। সে আমি কী করে জানব! ওরকম একটা সাংঘাতিক লোককে তো আর প্রশ্ন করে উত্যক্ত করতে পারি না!

তাকে দেখতে কেমন, তার একটা বর্ণনা তো দিতে পারেন? বৃদ্ধ চোখ-টোখ কুঁচকে ভেবে নেয় বেশ কিছুক্ষণ, তারপর মাঝপথে থেমে থাকা তার বক্তব্য আবার শুরু করে, আপনার মতোই চেহারা, ঘন গায়ের রঙ। ভুরু দুটো নাকের ওপর জোড়া। যতদূর মনে পড়ছে… নীল আর সাদা ডোরাকাটা একটা কোট পরে এসেছিল। প্যান্টটা…হালকা বাদামী। টুপিটাও প্যান্টের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে, তবে গাঢ়।

বর্ণনা শুনে তো অভিনেতাই বলেই মনে হচ্ছে।

যাকগে, ওসব প্রসঙ্গ এখন থাক। আমি আর একটা সিগারেট ধরালাম। আমি শুধু তাই জানতে আগ্রহী, যার বিষয় একমাত্র ডেনি। আচ্ছা, সে টুর যাবার সময় নিজের মালপত্র কোথাও রেখে যায়না?

রাখতে পারে, আমার জানা নেই।

চিঠিপত্রগুলোর কী দশা হয়?

ওনার জন্যে রেখে দেওয়া হয়। তবে চিঠি-টিঠি বিশেষ আসে না।

না, কোন দিক থেকেই সুবিধের ক্ষীণ আশাও চোখে পড়ছেনা। তবু শেষ চেষ্টা করে দেখতে কোন লোকসান তো নেই।

আচ্ছা, মিস গেলার্ট নামে কোন মেয়ে তার কাছে আসে?

আমি কোন মেয়ে-ফেয়ে সম্বন্ধে জানিনা।

এতে আমি কম অবাক হলাম না।

তার কোন বন্ধুও তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আসত না?

ভাড়াটেদের নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই আমার।

ও যে কীসে মাথা ঘামায় সেটাই একমাত্র চিন্তার বিষয়।

লোকটাকে পাওয়া মুশকিল হবে দেখছি, কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াই।

আরে, বীয়ারটা আপনি কী অসমাপ্তই রেখে দেবেন? বৃদ্ধ হাঁ হাঁ করে ওঠে।

ওটাইতো আমাকে প্রায় শেষ করার উপক্রম করেছিল, বলেই গটগট করে দ্রুত পদব্রজে দরজার অভিমুখে হাঁটতে শুরু করে দিই।

কালভার হোটেলের কোম্পানীর কাছে হেলেনের খোঁজ-খবর নিয়ে আমি ককটেল বারে প্রবেশ করলাম। ওর চিহ্ন মাত্র নেই সেখানে।

হোটেলের এককোণে নিরিবিলি একটা টেবিল বেছে সবে মাত্র বসবার আয়োজন করছি, আচমকা, ধূমকেতুর মতো উদয় হল হেলেন।

এক মুখ হাসি নিয়ে আমার পাশের আসনটা গ্রহণ করল। ভীষণ ভালো লাগছে গো এখানে এসে। কি সুন্দর এখানের ঘরগুলো। তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণ ধরে ফ্যান’শর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলে না?

দিইনি একথা ঠিক, তবে দেওয়ার সুযোগ ছিল। তার কাছে মহিলা জগতের টেলিফোন নাম্বারের একটা বড় লিস্ট আছে। ওদের সঙ্গে সে আমায় একটু যোগাযোগ করিয়ে দিতে চেয়েছিল।

আর তুমি নিশ্চয়ই…? ব্যাগ থেকে ছোট আয়নাটা বের করে নিজের মুখটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয় হেলেন।

আরে না, আমি গিয়েছিলাম ডেনির অফিসে।

তারপর?

মনে হয় লোকটার সন্ধান পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। দারোয়ানের কাছ থেকে কিছু জানা গেল না। ভাবছি রাত্রে ডিনার সেরে ওর অফিসে হানা দেব। ওখানকার সব কাগজপত্র ঘেঁটে কেঁটে হয়তো কোনসূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তুমি কী বল?

তার মানে শেষ পর্যন্ত তালা ভেঙে ঢুকবে? হেলেনের চোখ দুটো অপার বিস্ময়ে একবারে ছানা বড়া।

তাছাড়া উপায় তো কিছু নেই। তালাটা দেখে তেমন মজবুত মনে হলনা।

আমিও তাহলে তোমার সঙ্গে যাব।

পাগল হলে নাকি! এটা মহিলা মহলের কোন কাজ নয়। তুমি এখানেই থাকবে, আমি ফিরে এসে তোমায় সব বলে দেব।

না, আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি,ওর কণ্ঠে জেদের আভাস। তার থেকেও ভালো হয়, যদি তুমি এখানে থাক আর আমি কাজটা সেরে আসি। মেয়েরা এসব কাজ পুরুষ মানুষের চাইতে ভালোভাবে করতে যথেষ্ট পটু, হৈ-চৈ হবারও কোন প্রশ্নই ওঠে না।

পাগলামি করা না হেলেন। এতে ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন হয়। তোমার মতো আনাড়ি লোকদের একাজ সাজে না। ভেতরে প্রবেশ করতে হবে, তালা ভাঙতে হবে, এরকম বহু ঝামেলার ব্যাপার তো আছেই। অবশ্য একটা মেয়েকে তালা ভাঙতে অবস্থায় দেখার শখ আমার বহুদিনের।

তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে আমার সঙ্গে এসে দেখে যাও। হেলেন উঠে দাঁড়াল।

রাত এগারোটা নাগাদ আমরা হোটেল থেকে রওনা হলাম। রাতের আহার সারতে সারতে আমরা গেলার্টের পলিসিটা নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনায় বসেছিলাম।

হেলেনের বক্তব্য, ব্যাপারটা সন্দেহজনক রূপে দৃষ্ট হলেও এর মধ্যে যে কোন গ্যাড়াকল কারবার আছে তা বলা যায় না। হয়তো এটা সতিসত্যি প্রচারের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। টিম অ্যানড্রুজ তো আমায় বলল, পলিসিটা দেখে সে সন্তুষ্ট। অ্যালান গুডইয়ার সম্বন্ধে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে। সে পলিসিটা করেছে বলেই তার ওটা গ্রহণে কোন আপত্তি নেই। অবশ্য ম্যাডক্স অ্যালানকে একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, পলিসির গণ্ডগোল আগে থেকে আঁচ করতে ম্যাডক্সের আজ পর্যন্ত ভুল হয়নি। তাই ভুল অ্যালানের হয়ে থাকতে পারে।

সে আমি বুঝেছি, কিন্তু এটা যদি সত্যিই কোন গ্যাড়াকলের ব্যাপার হয়, মেয়েটা খুন হবে কীভাবে?

এখন পর্যন্ত একটা সম্ভাবনাই আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছে।

পলিসিতে উল্লেখিত বৈদ্যুতিক লাইনের ত্রুটি আর প্রাণদণ্ড হিসেবে বৈদ্যুতিক চেয়ারে মৃত্যু, দুটোর মধ্যে তফাত ঠিক কোন জায়গায় তা ওকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম।

সব শুনে হেলেন বলল, কিন্তু প্রাণদণ্ডের আদেশ আর কটা মেয়ের ভাগ্যেই বা জোটে? এটা যদি জোচ্চুরি হয়, তাহলে তার পেছনে যার হাতই থাক, এমন এক অনিশ্চিত ব্যবস্থার ঝুঁকি সে কখনোই নেবে না।

কিন্তু আমার মন বলছে, মেয়েটা ইতিমধ্যেই হয়তো একটা খুন করেছে। আর ধরা পড়লে যাতে আত্মপক্ষের দৃঢ় সমর্থন পাওয়া যায়, সেই আশায় ও পলিসিগুলো করিয়েছে। আমি জানি, তার ইলেকট্রিক চেয়ারে সাজা পাবার পর সম্ভাবনার আভাস যদিও খুব কম, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সে সম্ভাবনা একটুও থেকে থাকবে,ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলোকে ওর হয়ে লড়তে হবে তো?

না, হেলেন গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে। আমার তো মনে হয় না। জোচ্চুরি যদি হয়েই থাকে তাহলে সেই টাকা আদায়ের জন্যেই, এ বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চিত। ব্যাপারটা আমার কাছে যাদুকরের খেলা দেখানোর মতো লাগছে–যে এক হাতের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে অন্য হাতে কাজ সেরে ফেলে। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে, তুবে ওদের দুজনকে চোখে না দেখা পর্যন্ত কোন ভবিষ্যৎবাণীকরাআমার বোধহয় এই মুহূর্তে উচিত হবেনা, কিন্তু আমার কথাটা স্মরণে রেখ। যে তাসটা ওরা এখন আমাদের দেখাচ্ছে, সেটা যাতে ওরা অন্যনা তাসের সঙ্গে বদল করে নেয় বা করার সাহস পর্যন্ত না পায়, তার জন্য আমাদের যথেষ্ট সতর্ক হয়ে থাকতে হবে।

বাবা! তুমি কী দিব্যদৃষ্টির অধিকারী হয়ে গেলে নাকি? মিটিমিটি হাসলাম আমি। একেই বলে নাকি সহজাত প্রবৃত্তি?

হেলেন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। না গো না, আমার মনে যা ছিল সব কথাই তো তোমার কাছে উজাড় করে দিলাম। আবার যা বললাম তার হয়তো পুরোটাই আমার ভুল।

তখনকার মতো এই বিচিত্র আলোচনা মুলতুবি রেখে প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিলাম আমরা। সিঁদকাঠি আর ৩৮ পুলিশ স্পেশালটা সঙ্গে নিয়েই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।

ফোর্থ স্ট্রীটের কাছাকাছি এসে রয়েল অ্যাভিনিউতে বুইকটা পার্ক করে হেলেনকে বললাম, গাড়িটানা হয় এখানেই থাক।অনর্থক পুলিশের মনে সন্দেহ জাগাবার কোন প্রয়োজন নেই। কোন গণ্ডগোল হলেই তুমি একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে কেটে পড়ো। ঝামেলা যদি হয়ও আমি একাই সামলে নেবার ক্ষমতা রাখি।

কী রকম ঝামেলা তুমি আশা করছ?

তা বলতে পারবনা, কিন্তু সাবধানের কোন মার নেই। পুলিশই আসুক বা অন্য কোন ঝামেলাই হোক, তুমি গাড়ি নিয়ে হোটেলে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

আর তুমি যদি না ফেরো?

তাহলে ফ্যান’শকে ফোন করে আমাকে ছাড়িয়ে আনতে বলবে।

 গাড়ি থেকে নেমে ফোর্থ স্ট্রীটে ফিরে এলাম আমরা। রাস্তায় কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে না দেখে একটা অন্ধকার দুর্গন্ধময় গলিতে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু গলির মাঝবরাবর এসে একটা পায়ের শব্দ কানে আসতেই দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।

কয়েক সেকেন্ড পরে একটি মেয়ে হনহন করে দ্রুতগতিতে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গলির শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল। অন্ধকার ছিল বলে ওর মুখ তেমন ভাল বোঝা গেলনা, শুধু দেখলাম, মাথায় জড়ানো একটা স্কার্ফ আর পরনে গাঢ় রঙের লম্বা কোট।

আচমকা ওকে ভূতের মতো উদয় হতে দেখে আমরা দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। হেলেন ভয়ে-শঙ্কিত হয়ে আমার হাত খামচে ধরেছিল। তার হাত ছাড়িয়ে আমি ঘুরে মেয়েটাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছি, এমন সময় গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ কানে এল। দৌড়ে গলির মুখে গিয়ে দেখি, একটা বিশাল গাড়ি আলো নিভিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে হেলেনও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়িটাকে লক্ষ্য করতে করতে ও বলে উঠল, সেন্টের গন্ধ তুমি পেয়েছিলে?–ওটার নাম জয়

বাজারের সবচেয়ে মূল্যবান সেন্ট।

চলল, গলিটা একবার দেখা যাক, আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।

 কুড়ি গজ মতো এগোতেই একটা দরজা নজরে পড়ল। ওপরে সাদা রঙ দিয়ে লেখা?

জেন ম্যাসন
দ্বাররক্ষী
শুধুমাত্র মালপত্র রাখিবার জন্য।

পকেট থেকে টর্চ বার করে দরজার ওপর টর্চের আলো ফেললাম। তারপর দু-পা এগিয়ে একটু ঠেলা দিতেই দরজাটা খুলে গেল।

হু! মেয়েটা যতদূর সম্ভব এখানেই এসেছিল।

ওর এখানেই অফিস হয়তো! চাপা গলায় বলল হেলেন, যাবে নাকি ভেতরে?

হ্যাঁ। আমি বারান্দায় পা রাখলাম। দরজাটা বরং টেনে দাও।

হেলেন দরজা বন্ধ করে ছোট একটা কাঠের গেজ তলায় ঢুকিয়ে দিল। পুলিশ এসে পড়লেও সহজে খুলতে পারবেনা। একটা বই দেখে এই নিদর্শন পেয়েছি।

ভালোই করেছ। কোন কথা না বলে চুপচাপ আমার সঙ্গে এসো। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠব, লিফটে আমার ঠিক আস্থা নেই।

নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগলাম। হেলেন আমার থেকে দু-ধাপ পেছনে। মাঝে মধ্যে টর্চ জ্বালাচ্ছে।

পাঁচতলায় উঠে হেলেন আচমকা আমার কোট আগের মতোই খামচে ধরল। অগত্যা থেমে যেতে হয় আমাকে। কী হল আবার?

আমি যেন একটা শব্দ শুনলাম, আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস কণ্ঠে বলে ও। মনে হচ্ছে বাড়িতে জন-মানব আছে।

কিছুক্ষণ আমরা কান পেতে শুনলাম, কিন্তু কোন শব্দই হল না। যাকগে, আমি বললাম। তোমার শুনতে ভুল হয়েছে? চলল, আমরা একদম ওপর তলায় যাব।

হাঁফাতে হাঁফাতে ছতলায় পৌঁছে হেলেনের কাছ থেকে টর্চ চাইলাম। এবার আলোটা দাও দেখি। বন্ধ তালা কী করে খুলতে হয় আজ আমি তোমায় হাতে নাতে দেখাব। এই দৃশ্য দেখার জন্য অনেকে বহু পয়সা খরচ করতেও রাজি থাকে। টর্চ হাতে দরজার কাছে এগিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এল ও। টর্চ তুমি নিতে পার কিন্তু একে বোধহয় আর কাজে লাগবেনা।

এক দর্শনেই বুঝে গেলাম আসল ব্যাপার। দরজাটা অর্ধেক খোলা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, দেখেই আমার ঘাড়ের লোমকূপ খাড়া হয়ে উঠল। কে ঢুকেছিল ওখানে? আমি তো সন্ধ্যার সময়েও তালা বন্ধ দেখে গেছি।

সে যে এখনও ভেতরে নেই তুমি জানছই বা কী করে? কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রিভালভারটা টেনে আনি। চলো দেখা যাক। পা দিয়ে দরজাটা খুলে টর্চের আলো ফেলি ঘরের মধ্যে। চারদিকে ধূলোয় ধূলো। আসবাব বলতে একখানা টেবিল,দুটো চেয়ার, দড়ি বেড়িয়ে থাকা কাপেট আর ফাইল রাখা একটা ক্যাবিনেট। জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। আশ্চর্য তো!পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকলাম। তবে কি ডেনি সন্ধ্যার পর কোন এক সময় এসেছিল? ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল হেলেন, তারপর জানালার খড়খড়ি নামিয়ে আলো জ্বালাল। ডেনি বলে আমার অন্ততঃ মনে হয়না। যে মেয়েটাকে আমরা গলির মধ্যে এই কিছুক্ষণ আগে দেখেছি, ও-ই এসেছিল। তুমি সেন্টের গন্ধ পাচ্ছনা?

বারকয়েক নাক টেনেও সেন্টের কোন গন্ধ আমি পেলাম না। তবে আমার ঘ্রাণশক্তি যে হেলেনের মতো অতো তীব্র নয় তা বহু অনেক আগেই আমার জানা ছিল। ঠিক বলছ? আমি কিন্তু এখনও কোন গন্ধ পাচ্ছিনা।

আমি কিন্তু স্থির নিশ্চিত, স্টিভ।

দপ্তরের চারপাশটা একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম, কোথাও কিন্তু কোন বিসদৃশ কিছু চোখে পড়ল না।

যে মেয়ে অত দামী সেন্ট মাখে সে ডেনির মক্কেল হতে পারেনা। হেলেন বলে উঠল।

তাহলে কে ও? কি করতেই বা এখানে পদধূলি দিয়েছিল? এগিয়ে গিয়ে একটানে খুলে ফেললাম টেবিলের দেরাজটা। পুঞ্জীভূত জঞ্জালে ভর্তি কাগজ আটকানোর ক্লিপ,টুকরো কাগজ, পাইপ পরিষ্কার করার কাঠি, খালি তামাকের টিন-কিন্তু কাজে লাগার মতো কিছু নেই। অন্য দরজাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। একটায় ছিল নোংরা একখানা শার্ট। আর অন্যটায় তোয়ালে, ক্ষুর, দাড়ি কামানোর সাবান আর আয়না।

হেলেন ক্যাবিনেটটা খুলে একটা ফাইল নিয়ে ভেতরের মধ্যে রাখা সমস্ত কাগজপত্রগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল। কিছুক্ষণ পরে ফাইলটা যথাস্থানে ঢুকিয়ে রেখে মাথা নেড়ে উঠল, নাঃ, এর থেকে বোঝার উপায় নেই তার বর্তমান পরিস্থিতি।

তলারটা না হয় একবার খুলে দেখো তো।

তলার দেরাজটা খুলতেই তার থেকে বেড়িয়ে পড়ল লালটেপে জড়ানো এক বাণ্ডিল বীমা পলিসি।

এগুলোই হলো যত গণ্ডগোলের মূল কেন্দ্রবিন্দু। দেখি ওগুলো। টেপ খুলে দশটা পলিসি টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিলাম। একবার চোখ বোলাতেই বোঝা গেল, গুডইয়ার যেসব শর্তে পলিসিটা করিয়েছিল এগুলো প্রত্যেকটাই তার হুবহু নকল। সইটা দেখতে গিয়ে একটা পলিসি ওলটাতেই আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! দেখেছো? এখানেও সেই ধ্যাবড়া কালি আর আঙুলের ছাপ!

হেলেন দ্রুততার সঙ্গে অন্য পলিসিগুলোও উল্টে ফেলে। আরি ব্বাস! সবই দেখছি এক ব্যাপার! আমরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম।

অ্যালান বলছিল কালিটার এই দুর্গতি ঘটনাচক্রে। এখন দেখা যাচ্ছে তা সত্যি নয়। তার মানে গণ্ডগোল একটা আছেই।

হেলেন পলিসিগুলোর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। প্রথম ছাপটা ঘটনাচক্রে হলেও হতে পারে। হয়তো ওটা থেকেই বাকিগুলোতে ছাপ দেবার চিন্তা তার মাথায় দানা বাঁধে।

তোমার সহজাত প্রবৃত্তি কী একই মত পোষণ করে?

না, মাথা নাড়ে হেলেন। বর্তমানে আমাদের কাজ হল অন্য নজন এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে হবে, তারাও ছাপটাকে দুর্ঘটনা বলে মনে করে কিনা। এই কাজটা তুমি কর, স্টিভ।

আমিও তোমার সঙ্গে একমত, এখানে নিশ্চই গণ্ডগোল আছে।

পলিসিগুলো গুছিয়ে আবার সযত্নে দেরাজে ঢুকিয়ে দিলাম। চলল, এখানে দেখার আর কিছু নেই। এক মিনিট সময় যদিও অপব্যয় হয়নি, কিন্তু কোথায় গেলে যে তার দর্শন মিলবে এখনও পর্যন্ত তা জানা গেলনা।

ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে দ্রুত পদব্রজে সিঁড়ি ভেঙে আবার আমরা নীচে নামতে লাগলাম।

চার তলার চাতালে নেমে হেলেন হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরল।

দাঁড়াও! ফিসফিস কণ্ঠে ও বলে উঠল। শুনতে পাচ্ছ? টর্চ নিভিয়ে অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ালাম এবার আওয়াজটা আমার কানও পরিষ্কার শুনতে পেল। খুব মৃদু খসখস শব্দনীচের থেকে ভেসে আসছিল।

ঠিক যেন একটা বস্তাকে পাথরের মেঝের ওপর কোন এক জন টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

আমার হাত আরো শক্ত করে বলে আঁকড়ে ধরল হেলেন। কি ওটা?

বারান্দার রেলিঙে বুকে আমি নীচে দেখার চেষ্টা করলাম। ঘুটঘুটে গুমোট অন্ধকার ছাড়া দৃষ্টিতে আর কিছুই এলনা, অথচ শব্দ ধারাবাহিক ভাবে হয়েই চলেছে।

কেউ কিছু টানা হিচড়া করছে বলে মনে হয় হেলেনের কানের কাছে মুখ এনে আমি জবাব দিলাম।

কান খাড়া করে রেলিং-এ বুকে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। সহসা খস খসানি থেমে ধাতু ঠোকাঠুকির এক তীব্র শব্দ আমাদের উভয়কেই চমকে দিল।

লিফটে করে কেউ ওপরে আসছে। হেলেনকে রেলিঙের ধার থেকে টেনে নিয়ে এসে বলি এসো, গা ঢাকা দিই।

ক্যাচ ক্যাচ শব্দে লিফটা ওপরে উঠে আসছিল। সামনে একটা দরজা দেখে আমি ভেতরে ঢোকবার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতিও নিলাম। কিন্তু সেটা ছিল তালা বন্ধ।

সিঁড়িতে চলো, হেলেন ফিসফিস করে বলে ওঠে। ও যতক্ষণ উঠতে থাকবে, আমরা ততক্ষণে ধাপে ধাপে নেমে যাব।

ওর হাত ধরে সিঁড়ির কাছে একছুটে চলে গেলাম। সবেমাত্র আমরা প্রথম ধাপে পা ফেলেছি, এমন সময় আর একটা শব্দ শুনে থমকে গেলাম আমরা মর্মভেদী এক গোঙানির আওয়াজ লিফটের পাশ থেকে উঠে যেন ভরিয়ে দিচ্ছিল সারা বাড়িময়। কেউ জখম হয়েছে। আমার বড় ভয় করছে স্টিভ, কাঁপা কাঁপা গলায় হেলেন বলে ওঠে।

ওকে আমার কাছে টেনে নিল চাতাল থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখি, লিফটটা ধীর গতিতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অবশেষে আমাদের থেকে মাত্র দুগজ দূরে ওটা আপনা থেকে থেমে গেল।

কয়েকটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে এল। একটা দীর্ঘশ্বাস। তারপরেই ভারি কিছু একটা গড়িয়ে পড়ার স্পষ্ট আওয়াজ।

হেলেন আগের থেকে আরো সবলে আঁকড়ে ধরল দুহাতে আমাকে।

ওকে আমার পেছনে ঠেলে দিয়ে, এক হতে রিভলভার ধরে অন্য হাতে টর্চের আলো ফেললাম লিফটের জাফরির ঠিক ওপরে। হেলেন অস্ফুট আর্তনাদেঝাঁকিয়ে উঠল।

লিফটের সিঁড়ির কাছটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কম্পমান হাতে টর্চ ধরে আমি এক পা এগিয়ে লিফটের ভেতরে উঁকি দিলাম।

দারোয়ানটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দণ্ডায়মান। চশমাটা ঝুলে পড়েছে তার স্থান অর্থাৎ কান থেকে। সারা মুখে রক্তে মাখামাখি। নিষ্প্রাণ দুটো চোখ। আমি আর এক পা এগোতেই সেজাফরির ওপর মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়ল।

বহুদূর থেকে হঠাৎ নিস্তব্ধ রাত্রির বুক ভেদ করে পুলিশ সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভেসে এল আমাদেরও এই কানে।